পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১.
এরপর দিন চালানো খুবই কঠিন হয়ে উঠল মেরিয়াসের পক্ষে। পোশাক গেছে, ঘড়ি গেছে। আর কোনও সংস্থান নেই। সারাদিন খাওয়া নেই। রাতে ঘুম নেই, আশ্রয় নেই। অন্ধকারে আলো নেই, ভবিষ্যতের আশা নেই। সে ভাড়া দিতে পারে না বলে আর কোনও ঘরভাড়া পায় না। যে বয়সে মানুষের সবচেয়ে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার দরকার হয় সেই বয়সে শুধু উপহাস আর বিদ্রূপ পাচ্ছে সবার কাছ থেকে। যুবকদের মন যে বয়সে আত্মবিশ্বাসে ভরে থাকে, তখন সে বয়সে ঘেঁড়া জুতো ও ছেঁড়া পোশাক পরে নিঃসীম দারিদ্রের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাকে। ভাগ্যের নিষ্ঠুর বিধান কোথায় নিয়ে চলেছে, তা কে জানে। হয়তো সে একটা অপদার্থ হয়ে উঠবে অথবা দেবতার কাছাকাছি চলে যাবে।
মানুষের এই দুরবস্থার মধ্যে ব্যাপক অবজ্ঞা ও অবহেলার মধ্যেও অনেক বড় কাজ হয়। এই সময় মানুষের মধ্যে এমন এক দুর্বার একগুয়ে সাহস থাকে, যা বাইরের যে কোনও বাধা-বিপত্তি অশুভ প্রভাবের প্রতিরোধ করে। অভাব, দারিদ্র্য আর নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে অনেক সময় অনেক বলিষ্ঠ বিরল চরিত্রের মানুষ গড়ে ওঠে।
এই সময় ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড়ের জন্য দিনের বেলায় বেরোত না মেরিয়াস। সন্ধের পর বেরোত। তার মাসি ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ আবার সেই একই পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছিল। কিন্তু এবারও সে ফেরত পাঠায় সে টাকা। এবারও চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় তার টাকার প্রয়োজন নেই।
এত কষ্ট করেও সে আইন পড়া ছাড়ল না। সে নিয়মিত কলেজে যেত। কুরফেরাকের ঘরে অনেক আইনের বই ছিল। সেইসব বই সে পড়তে পেত। কুরফেরাকের ঠিকানাতেই তার চিঠিপত্র আসত।
আইন পাস করার সঙ্গে সঙ্গে কথাটা মঁসিয়ে গিলেনর্মাদকে একটা চিঠি দিয়ে জানায় মেরিয়াস। কর্তব্যগত শ্রদ্ধার সঙ্গেই লেখে চিঠিটা। মেরিয়াসের এই চিঠি পড়তে গিয়ে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের হাত দুটো কাঁপতে থাকে। কিন্তু পড়া হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দেন বাজে কাগজের ঝুড়ির মধ্যে। চিঠিটার কথা তার মেয়েকে বলেননি কিছু। কিছু না বললেও তিনি যখন নিজের ঘরে বসে আপন মনে বিড় বিড় করে কী বলছিলেন তখন তাঁর মেয়ে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ শুনতে পায় তার কথা। তিনি বলছিলেন, তুমি যদি একটা অপদার্থ ক্লীব না হতে তা হলে বুঝতে পারতে একই সঙ্গে কেউ কখনও ব্যারন আর অ্যাডভোকেট হতে পারে না।
.
২.
অন্য সব কিছুর মতো দারিদ্রও সহনীয় হয়ে ওঠে কালক্রমে। নিদারুণ অভাবের মধ্যে হীনভাবে যাপন করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল মেরিয়াস।
সবচেয়ে দুঃসময়টা সে পার হয়ে এসেছে। তার সামনে যে পথটা রয়েছে সে পথ অনেক মসৃণ ও মোলায়েম মনে হচ্ছে আগের তুলঁনায়। সাহস, সংকল্প আর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়সহকারে কাজ করে সে এখন বছরে সাতশো ফ্রাঁ রোজগার করতে পারে। সে এখন ইংরেজি ও জার্মান শিখেছে। কুরফেরাকের দৌলতে বিশ্বকোষের সেই কাজটা পেয়েছে। তাছাড়াও খবরের কাগজের জন্য কিছু লেখা লেখে। আরও কিছু নোটের কাজ ও জীবনীগ্রন্থ লেখার কাজ করে।
গর্বোর সেই ব্যারাক বাড়িটার মধ্যে বছরে তিরিশ ফ্রাঁ দিয়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে সে। রাত্রিতে কুরফেরাদের সেই হোটেলটায় গিয়ে মোলো স্যু দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে আসে। আসার সময় কাউন্টারে পয়সা দিতে গেলে মাদাম রুশো একমুখ হেসে তাকে বিদায় দেয়। তার সব খরচ ধরে বছরে ৬৫০ ফ্রা’র মধ্যেই হয়ে যায়। পঞ্চাশ ট্র্যা করে তার জমে এই জমানো টাকা থেকে সে কুরফেরাককে একবার ষাট ফ্ৰাঁ ধার দেয়।
কয়েক বছর ধরে সংগ্রামের পর এই সচ্ছল অবস্থায় মধ্যে আসতে পেরেছে সে। অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে কাটলেও সে কারও কাছ থেকে একটা পয়সা ধার করেনি। তার মতে ধার থেকেই দাসত্বের শুরু। কারও অধীনে কাজ করা ভালো। উত্তমর্ণ বা ঋণদানকারী লোকের থেকে মালিক ভালো। মালিক শুধু শ্রমিকের উপস্থিতি চায়। কিন্তু ঋণদানকারী আমাদের মানসম্মান গ্রাস করতে চায়। সে কতদিন না খেয়ে থেকেছে, তবু কারও কাছে ধার করেনি।
দুঃখের দিনে এক গোপন আত্মশক্তিই তাকে সাহস জুগিয়ে এসেছে। আত্মাই দেহকে অনেক সময় সাহায্য করে এবং তাকে উপরে তোলে। পাখিই একমাত্র খাঁচাকে সহ্য করতে পারে।
তার বাবার সঙ্গে সঙ্গে আরও একজনের নাম মুদ্রিত হয়ে গেল মেরিয়াসের মনে। সে নাম হল থেনার্দিয়েরের। যে থেনার্দিয়ের তার বাবাকে ওয়াটারলু যুদ্ধের মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে তার সম্বন্ধে স্বভাবতই একটা উচ্চ ধারণা গড়ে ওঠে তার মনে। তার মনের মধ্যে দুটো বেদি করে তার বাবা আর থেনার্দিয়েরকে বসিয়ে এক ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে তাদের স্মৃতিকে লালন করতে থাকে। যেনার্দিয়েরকে মঁতফারমেলে না পেয়ে হতাশ হলেও সে আবার তার খোঁজ করতে থাকে। দুর্ভাগ্যের কবলে পড়ে স্থান ত্যাগ করতে সে বাধ্য হয় একথা ভেবে তার প্রতি তার কৌতূহল বেড়ে যায়। তিন বছর ধরে আশপাশের অঞ্চলের অনেক শহর ও গ্রামে খোঁজ করে সে এবং এর জন্য যথাসাধ্য সে অর্থব্যয় করে। সবাই বলছে থেনার্দিয়েররা পাওনাদারদের টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে গেছে। মেরিয়াসের মতো পাওনাদারেরাও খুঁজছে থোর্দিয়েরকে। এই একটামাত্র ঋণ তার বাবা তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে। মেরিয়াস ভাবল, আমার বাবা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়েছিল তখন এই থেনার্দিয়েরই পিঠে করে নিরাপদ স্থানে বয়ে নিয়ে যায়। সে আমার বাবার জন্য এত কিছু করেছে তাকে খুঁজে বার করে তার বিপদে না দেখে কী করে থাকি। তাকে জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা আমার একান্ত কর্তব্য। তাকে অবশ্যই খুঁজে বার করতে হবে।
থেনার্দিয়েরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য মেরিয়াস তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারত। সে তার শেষ রক্তবিন্দু দান করতে পারত। তাকে খুঁজে বার করে তাকে সেবা দান করার জন্য বলতে ইচ্ছা করছিল। তুমি আমাকে চেন না। আমিও তোমাকে চিনি না। তবু আমি এসেছি। তুমি আমার কাছ থেকে কী চাও তা বল।
এটাই এখন মেরিয়াসের একমাত্র স্বপ্ন।
.
৩.
মেরিয়াসের বয়স এখন কুড়ি। আজ তিন বছর হল সে তার মাতামহকে ছেড়ে চলে এসেছে। তার সঙ্গে সম্পর্কের কোনও উন্নতি হয়নি।
তাদের মধ্যে আর দেখা হয়নি। তাদের পুনর্মিলনের জন্য কেউ কোনও চেষ্টা করেনি। অবশ্য দেখা হলেও কোনও ফল হত না। তবে ঝগড়াটা নতুন করে জোরালো হয়ে উঠত। কেউ মাথা নত করল না। মেরিয়াস এক দুর্বার চলমান শক্তি, আর বৃদ্ধ গিলেনৰ্মাদ অটল।
তবে একটা কথা ঠিক যে মেরিয়াস তার মাতামহকে ভুল বোঝে। কারণ তার ধারণা ছিল তার মাতামহ তাকে মোটেই ভালোবাসে না, কখনও ভালোবাসেনি। শুধু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছে আর তিরস্কার করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সে ভুল করেছে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তাকে ভালো ঠিকই বাসতেন, এ ব্যাপারে তার একটা নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। তাকে যখন-তখন ভর্ৎসনাটা ছিল তাঁর ভালোবাসারই এক বিশেষ ভঙ্গিমা। মেরিয়াস বাড়ি থেকে চলে গেলে এক অন্ধকার শূন্যতা আচ্ছন্ন করে ফেলে তারা সারা অন্তরটাকে। তিনিই নিজে হুকুম দিয়েছিলেন, তার নাম যেন কেউ কখনও না করে তাঁর কাছে। কিন্তু তার এ আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্যও তিনি খুবই দুঃখিত হন। প্রথম প্রথম তিনি ভেবেছিলেন বোনাপার্টপন্থী জ্যাকোবিন বিদ্রোহী যুবক নিজে থেকেই ফিরে আসবে। কিন্তু সপ্তার পর সপ্তা, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে গেলেও সে ফিরে এল না দেখে দুঃখ বেড়ে গেল তার। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলেন তিনি, সে ফিরে এসে ওকথা আবার যদি বলে তা হলে আবার কি তাকে তাড়িয়ে দেবেন তিনি? তাঁর অহঙ্কার বলল, হ্যাঁ, তাই করবেন তিনি। কিন্তু তার মস্তিষ্ক ভেবে বলল, না। মেরিয়াসের অভাব ক্রমশ বিষণ্ণ করে তুলঁতে থাকে তাঁকে। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তপ্ত সূর্যালোকের মতোই ভালোবাসার বস্তু এবং তার তপ্ত সাহচর্য চায়। তার চরিত্রের ধাতুটা শক্ত হলেও মেরিয়াসের অনুপস্থিতিতে সে ধাতু অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আগের মতো বাইরে হাসিখুশির উচ্ছলতা দেখালেও সে উচ্ছলতার মধ্যে একটা চাপা যন্ত্রণার আবেগ ফুটে উঠত। কোনও কারণে হঠাৎ রাগে ফেটে পড়লে তার পর অনেকক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে নিজের মনে বলতেন, ছোকরাটা একবার যদি ফিরে আসে তা হলে আমি তার কান মলে দেব।
তাঁর মেয়ে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদের অন্তরটা এমনই অগভীর ছিল যে তাতে কোনও গভীর স্নেহ-ভালোবাসা স্থান পেত না। মেরিয়াসের স্মৃতিটা ক্রমশই অস্পষ্ট ও ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার মনে। যেন একটা পোষা বিড়াল পালিয়ে গেছে।
বৃদ্ধ মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের দুঃখ আরও বেড়ে যাবার কারণ এই যে তিনি সে দুঃখের কথা বাইরে প্রকাশ করতেন না কারও কাছে। যে চুল্লি থেকে ধোঁয়া বার হয় না সেই চুল্লির মতো সব দুঃখের বাম্প নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করে নিতে হত তাকে। মাঝে মাঝে কখনও তার কোনও পরিচিত ব্যক্তি তাকে যদি জিজ্ঞাসা করত, তোমার নাতি আজকাল কী করছে?’ তখন তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষাদময়তার সঙ্গে উত্তর দিতেন, ব্যারন পঁতমার্সি আজকাল নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে তুলঁছে।
এদিকে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বুকটা যখন দুঃখে জ্বলে যাচ্ছিল, মেরিয়াস তখন নিজে সব বিপদ থেকে একে একে মুক্ত করে তুলঁতে পারার জন্য একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করে অভিনন্দন জানাচ্ছিল নিজেকে। আজ আর তার মনে কোনও তিক্ততা নেই তার মাতামহের প্রতি। তবে একটা বিষয়ে মনস্থির করে ফেলেছে সে, তার যে মাতামহ তার বাবার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করে, তার কোনও সাহায্য বা দান আর সে নেবে না। বর্তমানে জীবনে সে যত দুঃখ-কষ্ট পায় তখনই সে একদিক দিয়ে একটা আত্মতৃপ্তি লাভ করে, তার কেবলি মনে হয় এই শাস্তি এই অভিশাপের যোগ্য সে এবং এর একটা প্রয়োজন ছিল তার। আজ এই শাস্তি ভোগ না করলে তার পরবর্তী জীবনে কখনও না কখনও এই শাস্তি ভোগ করতেই হত। তা না হলে তার বাবার প্রতি এক নিষ্ঠুর ঔদাসীন্য দেখিয়ে সে যে অপরাধ করেছে, সে অপরাধ স্খলন হত না। তার বাবা জীবনে একা যে দুঃখের বোঝা বহন করেছে, তার কিছুটা দুঃখ ভোগ তার করা উচিত। তাছাড়া তার বাবার দুঃখের তুলঁনায় কতটুকু দুঃখই-বা সে ভোগ করছে। তার বাবা যেমন শত্রুপক্ষের কামান ও গোলাগুলির সামনে সাহসের সঙ্গে বুক পেতে দিয়েছিল তেমনি আজ সে যদি অনুরূপ সাহসের সঙ্গে সমস্ত দুঃখ-দারিদ্র্য বুক পেতে সহ্য করতে পারত, একমাত্র তা হলে সে তার বাবার আদর্শের সার্থক উত্তরাধিকারী হয়ে উঠতে পারবে। তার বাবা তার শেষ চিঠিতে এই জন্যই লিখে গেছে, সে এই উপাধির যোগ্য হয়ে উঠবে। চিঠিখানি নষ্ট হয়ে গেলেও চিঠির এই কথাটা চিরদিন মনে রেখে দেবে সে।
তার মাতামহ যখন তাকে তাড়িয়ে দেয় বাড়ি থেকে তখন বয়সে সে ছিল তরুণ যুবক। এখন সে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হয়ে উঠেছে। দারিদ্র অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে তার জীবনে। যৌবনে দারিদ্র্যকে যদি সংযত রাখা যায় তা হলে সে দারিদ্র্য মানুষের ইচ্ছাশক্তিতে সগ্রাম আর তার আত্মাকে আশার মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে রাখে। বাস্তব জীবনের স্বরূপকে উদ্ঘাটিত করে এই দারিদ্র্য আদর্শ জীবনের প্রতি এক অনির্বচনীয় আকাক্ষা জাগায় মানুষের মধ্যে। ধনী যুবকরা হাতের কাছে ভোগের অনেক উপকরণ পায়–ঘোড়া, শিকার, জুয়া, ভালো খাবার, তামাক প্রভৃতি মাদকদ্রব্য। এইসব ভোগ উপভোগের ফলে তাদের মনটা নিচের দিকে যায়, উদার মানসিকতা ও সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতা তাদের স্বভাবের মধ্যে পাওয়া যাবে না। গরিব যুবকরা বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে, খাওয়া-থাকার জন্য লড়াই করে এবং স্বপ্নই তার একমাত্র সান্তনা। তার আমোদ-প্রমোদের উপকরণ কেবল কোনও কৃত্রিম রঙ্গমঞ্চে থাকে না, তা থাকে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে। আকাশ, নক্ষত্র, ফুল, শিশু প্রভৃতির মধ্যে ঈশ্বরপ্রদত্ত আমোদর উপাদান থরে থরে সাজানো থাকে তার জন্য। এমনকি তার জীবনসংগ্রামের মধ্যেও সে আনন্দ পায় এক ধরনের। সে সাধারণ মানুষের এত কাছে থাকে যে মানবতার আত্মাকে সে দেখতে পায়, ঈশ্বরের সৃষ্টির এত কাছে থাকে যে সেই সৃষ্টির মধ্যেই ঈশ্বরকে দেখে। সে তার আপন মহত্ত্বকে আপনি অনুভব করে। অপরের করুণার ওপর তাকে নির্ভর করতে হয় বলে সব রকম আত্মম্ভরিতা হতে মুক্ত হয় সে। ফলে এক নিরহঙ্কার আত্মবিস্মৃতি আর পরদুঃখকাতরতা–এই প্রশংসনীয় গুণ দুটির জন্ম হয় তার মধ্যে। প্রকৃতির মধ্যে যেসব অজস্র আনন্দের বস্তু ছড়িয়ে আছে, মুক্ত মন নিয়ে সেই বস্তু উপভোগ করে আত্মার দিক থেকে নিজেকে সম্পদশালী মনে করে, এবং অর্থের দিক থেকে যারা সম্পদশালী তাদের জন্য দুঃখবোধ করে। সব ঘৃণা দূরীভূত হয়ে যায় তার মন থেকে। সত্যি সত্যিই কি সে সুখী? একজন বলিষ্ঠ যুবক যে কালো চুল, সাদা ঝকঝকে দাঁত, সজীব উজ্জ্বল গাল আর দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত উত্তপ্ত রক্তস্রোত নিয়ে আনন্দোচ্ছল ভঙ্গিতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যায়, সে এক বৃদ্ধ সম্রাটের ঈর্ষার বস্তু। তার পর সে যুবক যখন রোজ সকালে উঠে জীবিকার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে যায় তখন তার হাত দুটো কাজে ব্যস্ত থাকলেও তার মেরুদণ্ডটা গর্বে খাড়া হয়ে ওঠে এবং তার মনটা এক নতুন ভাবধারায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। সারাদিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে এসে আনন্দের সঙ্গে চিন্তা করে। দুঃখ-কষ্টে ও হতাশার কাটাবন ও কাদাজলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে পারে, কিন্তু তার মনটা থাকে আকাশের নক্ষত্রের দিকে। তার মন থাকে শান্তস্থির, সদাসচেতন, অল্পে-সতুষ্ট, পরোপকারী। সে তাদের এই স্বাধীনতা, এই দানের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়।
মেরিয়াস তখন এই পথেই যেতে লাগল। সে এখন চিন্তার দিকে বেশি ঝুঁকল। যখন দেখল তার একট জীবিকার সংস্থান হয়ে গেছে তখন বুঝল চিন্তায় বেশি সময় সে দিতে পারবে। এক একবার সারাদিন ধরে সে দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত। জীবনের সব সমস্যা সে এইভাবে সমাধান করল। পার্থিব বিষয়ে সে কম কাজ করে অপার্থিব বিষয়ে সে বেশি সময় কাটাবেই। তার মানে কয়েক ঘণ্টা বাস্তব কাজকর্ম করে বাকি সময়টা অনন্তের কথা চিন্তা করবে। দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস আয়ত্ত করতে পারায় সে যেন অলস হয়ে পড়ছিল। মেরিয়াসের মতো উদ্যমশীল যুবকদের ক্ষেত্রে এমনিই হয়। কিন্তু জীবনের কোনও অপরিহার্য জটিলতার আঘাতে তাদের সাময়িক অলস কর্মহীন অবস্থাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
তার মাতামহ ভেবেছিল সে উকিল হওয়ার পর কোর্টে ওকালতি করবে। কিন্তু তা সে করল না। দিবাস্বপ্ন ওকালতির প্রতি একটা অনীহা ও বিতৃষ্ণা এনে দিয়েছিল তার মধ্যে। অ্যাটর্নিদের সঙ্গে মেলামেশা, মামলার পেছনে ছুটে চলা অসম্ভব এবং একটা ঘৃণার ব্যাপার হয়ে উঠল তার কাছে। সে তার বর্তমান জীবনের কাঠামোকে বদলাবার কোনও কারণ খুঁজে পেল না। সে আগের মতোই প্রকাশকদের লেখালেখির কাজ করে যেতে লাগল এবং তাতেই তার খাওয়া-পরার প্রয়োজন মিটে যেতে লাগল।
মঁসিয়ে ম্যাগিমেল নামে এক পুস্তকবিক্রেতা ও প্রকাশক তাকে একটা স্থায়ী কাজ দিতে রাজি হল। এই কাজের জন্য সে মেরিয়াসকে একটা থাকার জায়গা, আর বছরে পনেরোশো ফ্রাঁ মাইনে দিতে চাইল। চাকরিটা আকর্ষণীয় হলেও তাতে তার স্বাধীনতা থাকবে না। সে বেতনভোগী দাসে পরিণত হবে। মেরিয়াস চায় একই সঙ্গে ভালো এবং খারাপ হতে। সে চায় ছোটখাটো কিছু স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম। কিন্তু মান-মর্যাদার দিকে তার কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। সে একটা চোখ হারিয়ে মাত্র একটা চোখ নিয়ে থাকতে চাইল। সে নতুন পাওয়া চাকরিটাকে প্রত্যাখ্যান করল।
তার জীবনটা রয়ে গেল নিঃসঙ্গ। সে যেমন কোনও বিষয়ে নিজেকে জড়াতে চাইল না, তেমনি এঁজোলরাসের দলেও যোগদান করতে চাইল না। অবশ্য তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা রয়ে গেল। দরকার পড়লে একে অন্যকে সাহায্য করত, এই পর্যন্ত। মেরিয়াসের মাত্র দু জন বন্ধু ছিল। একজন যুবক আর একজন বৃদ্ধ। একজন হল যুবক কুরফেরাক আর একজন হল মঁসিয়ে মেবুফ, চার্চের কর্মচারী। তবে মঁসিয়ে মেবুফে’র প্রতি তার আসক্তিই ছিল বেশি। মেবুফে’র জন্যই তার জীবনে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। মেবুফ তার চোখ খুলে দিয়েছে।
কিন্তু মঁসিয়ে মেবুফ যা কিছু করেছে সচেতনভাবে করেনি। ভাগ্যের বিধানের এক যন্ত্র হিসেবে করেছে। মেরিয়াসের অন্তরের মধ্যে যে আলোড়ন চলছিল, যে রূপান্তর এসেছিল সে বিষয়ে সে কিছুই জানত না। সে এ বিষয়ে কিছুই বুঝত না।
.
৪.
মেবুফ মেরিয়াসকে বলত, সব মানুষেরই একটা করে রাজনৈতিক মতামত থাকে। এটাতে ক্ষতি নেই। মেবুফের কাছে সব রাজনৈতিক মতামত সমান লাগত। অবসর সময়ে সে গাছপালা আর বই নিয়ে থাকত। তার কোনও রাজনৈতিক মতবাদ ছিল না। সে রাজতন্ত্রী বা বোনাপার্টপন্থী কোনও পন্থীই ছিল না।
সে বুঝতে পারত না পৃথিবীতে এত ঘাস, শ্যাওলা, কাঁটাগাছ ও গাছপালা থাকতে মানুষ কেন সনদ, গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র প্রভৃতি এত সব নিয়ে মাথা ঘামায়। অবসর সময়ে বইও সংগ্রহ করে বেড়ায়। কর্নেল পঁতমার্সি বাগানে ফুলের চাষ করত বলে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মেবুফে’র। সে চার্চে উপাসনাসভায় যোগ দিত তার কর্তব্যের খাতিরে, ভক্তির নিবিড়তার সঙ্গে নয়। চার্চে সমবেত মানুষের মুখগুলো দেখতে ভালো লাগত তার। কিন্তু তাদের গোলমাল ভালো লাগত না। সমাজের মানুষ হিসেবে, দেশের নাগরিক হিসেবে কিছু একটা তাকে করতে হবে এইজন্যই সে চার্চের কাজে যোগদান করে। কোনও নারীর প্রতি কোনও আসক্তি ছিল না তার। তার বয়স ষাট পেরিয়ে গেলে একজন জিজ্ঞাসা করে তাকে, আপনি কি কখনও বিয়ে করেননি?
মেবুফ তাকে উত্তর করে, না, বিয়ে করতে ভুলে গিয়েছি।
তবে কেন সে বিয়ে করেনি, একথা বুঝিয়ে বলতে গিয়ে সে বলত, আমি যদি ধনী হতাম তা হলে হয়তো বিয়ে করার কথাটা ভেবে দেখতাম। কিন্তু ধনী হবার কথাটা মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের মতো কোনও ধনীকে দেখে অথবা কোনও সুন্দরী মেয়েকে দেখে জাগেনি তার মনে। একথা জেগেছে কোনও আকাক্ষিত দামি বই কিনতে না পেরে।
সে এমন একটা বাড়িতে বাস করত যে বাড়িতে লোক বলতে বাড়ি দেখাশোনার জন্য এক বৃদ্ধা ছাড়া আর কেউ থাকত না। সে একটা বই প্রকাশ করেছিল। বইটা সুচিন্তিতভাবে লেখা। সে নিজেই বিক্রি করত। দিনে দু-তিনখানা করে সে বই বিক্রি হত এবং তাতে বছরে দু হাজার ফ্রাঁ পেত। এটা তার মোট আয়ের বড় একটা অংশ ছিল। কয়েক বছরের চেষ্টা আর আত্মনিগ্রহের ফলে বিভিন্ন রকমের বেশ কিছু বই সে সংগ্রহ করেছিল। সে বাড়ি থেকে বড় একটা বার হত না। কিন্তু যখনি বার হত একটা বই থাকত তার বগলে। যে বাড়িটাতে সে থাকত তার সংলগ্ন একটা ছোট বাগান ছিল এবং তাতে চারখানা কামরা ছিল। তাতে শুধু বই আর ভালো শিল্পীদের আঁকা কিছু ছবি ছিল। তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে শুধু এক ভাই ছিল। সে ছিল একটা ছোট গির্জার যাজক। মাথায় পাকা চুল, মুখে দাঁত ছিল না। সে খুব শান্ত মেজাজের লোক ছিল। তার মুখে কোনও শক্ত বা তিক্ত কথা উচ্চারিত হত না। তাকে এক বৃদ্ধ ভেড়ার মতো শান্ত দেখাত সব সময়। এ ছাড়া কোনও বন্ধু বা আত্মীয় ছিল না তার। কারও বাড়ি যাবার ছিল না। শুধু পোর্তে সেন্ট জ্যাক অঞ্চলে রয়ল নামে এক পুস্তকবিক্রেতার কাছে মাঝে মাঝে যেত সে। পায়ে তার বাত ছিল। ঘুমোবার সময় কম্বলের তলায় শক্ত হয়ে উঠত পাগুলো। কোনও তরবারি বা বন্দুক দেখার সঙ্গে সঙ্গে হিম হয়ে উঠত তার গায়ের রক্ত।
মঁসিয়ে মেবুফে’র বাড়ি দেখাশোনার কাজ করত যে বৃদ্ধা মহিলা সে-ও খুবই নিরীহ প্রকৃতির ছিল। সে ছিল চিরকুমারী এবং নিষ্ঠা ও শুচিতার সঙ্গে তার কৌমার্যব্রত পালন করে। একটা বিড়াল ছাড়া তার জীবনের সঙ্গী বলতে কেউ ছিল না। বাড়ি থেকে কোথাও যেত না সে। তার একমাত্র শখ ছিল লিনেনের কিছু পোশাক কেনা এবং সন্ধের দিকে একবার করে পোশাকগুলো বাক্স থেকে বার করে বিছানার উপর ছড়িয়ে রাখা। সে পোশাকগুলো সে কখনও ব্যবহার করত না। সে-ও কিছু পড়াশুনো করত। মঁসিয়ে মেবুফ তাকে ঠাট্টা করে বলত, মেরে প্লুতার্ক।
মেরিয়াসের প্রতি একটা আসক্তি গড়ে উঠেছিল মঁসিয়ে মেবুফে’র, কারণ মেরিয়াস বয়সে যুবক হলেও শান্ত প্রকৃতির ছিল এবং তার সাহচর্যের উত্তাপ তার ব্যক্তিগত পাণ্ডিত্যানুরাগের ওপর হস্তক্ষেপ করত না বা আঘাত হানত না কোনওভাবে। কোনও বৃদ্ধের কাছে কোনও শান্ত প্রকৃতির যুবকের সাহচর্য বায়ুতরঙ্গহীন শান্ত অচঞ্চল সূর্যালোকের মতোই উপভোগ্য। মেরিয়াস যখন দেশের সামরিক ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে যে সব বড় বড় যুদ্ধে তার বাবা অংশ গ্রহণ করেছে এবং আহত হয়েছে সেইসব যুদ্ধের কথা পড়ত তখন সে মাঝে মাঝে মঁসিয়ে মেবুফে’র কাছে যেত। মেবুফ তখন শান্ত কণ্ঠে বড় বড় বীরপুরুষদের কথা এমনভাবে বলত যাতে মনে হত সেই বীরেরা যেন একগুচ্ছ ফুল।
কিন্তু ১৮২০ সালে মঁসিয়ে মেবুফে’র ভাই কুরে হঠাৎ মারা গেলে অন্ধকারে ডুবে গেল মেবুফ। যে অ্যাটর্নির কাছে তাদের মূলধন ছিল এবং যে মূলধন থেকে তারা দুই ভাইয়ে বছরে দশ হাজার ফ্রাঁ করে পেত সেই অ্যাটর্নি দেউলিয়া হয়ে পড়লে তাদের সে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায় একেবারে। তার ওপর জুলাই বিপ্লবের ফলে বইয়ের ব্যবসা বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মঁসিয়ে তার যে বই বিক্রি করে বছরে দু হাজার ফ্রাঁ করে পেত সে বই বিক্রিও বন্ধ হয়ে যায়। দরজায় ঘন্টা বাজার শব্দ শুনেই ভয়ে চমকে উঠত মেবুফ। মেরে পুর্ক তখন তাকে বলত, জলবাহক মঁসিয়ে।
খরচ কমাবার জন্য মঁসিয়ে চার-কামরার বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে বুলভার্দ মঁতপার্নেসি অঞ্চলে একটা ছোট বাড়িতে উঠে যায়। কিন্তু মাস তিনেকের মধ্যেই সে আবার সে বাড়ি থেকে উঠে যায়। কারণ সে বাড়ির ভাড়া বছরে তিনশো ফ্রাঁ করে। কিন্তু মঁসিয়ে মেবুফে’র ক্ষমতা ছিল মাত্র দুশো ফ্রাঁ দেবার। তাছাড়া বাড়িটার কাছে বন্দুক শেখার একটা গ্যালারি ছিল, যেখান থেকে প্রায়ই বন্দুকের গুলির আওয়াজ আসত।
এপর অস্টারলিস গ্রামে সানপেত্রিয়ের অঞ্চলে একটা ছোট বাড়িতে উঠে গেল। সে বাড়িতেও তিনখানা কামরা ছিল এবং একটা ছোট বাগান ছিল। যেদিন সেই বাড়িতে উঠে যায় মেবুফ সেদিন সে নিজের হাতে তার ঘরে ছবিগুলো টাঙায় এবং বাগানে কাজ করতে থাকে। সে তার বেশির ভাগ আসবাবপত্র বিক্রি করে দেয়।
এই নতুন বাসায় মাত্র দু জন লোক দেখা করতে আসে তার সঙ্গে। তার মধ্যে একজন। হল সেই সেন্ট জ্যাক অঞ্চলের পুস্তকবিক্রেতা আর একজন হল মেরিয়াস। মেরিয়াসের নামটার মধ্যে একটা সামরিক গন্ধ থাকায় নামটা মোটেই ভালো লাগত না মেবুফে’র।
সাধারণত যারা জ্ঞানী অথবা নির্বোধ তারা কেউ দৈনন্দিন জীবনের কোনও ঘাত-প্রতিঘাত কখনও মানে না, ভাগ্যের খেলায় অর্থাৎ সৌভাগ্যে বা দুর্ভাগ্যে বিচলিত হয় না। তারা দেহগত অবক্ষয় বা অসুস্থতার মতোই লাভ-ক্ষতিতে উদাসীন থাকে।
এইভাবে দিনের পর দিন মেবুফে’র চারদিকে যতই ছায়া ঘনিয়ে উঠতে লাগল ততই সব আশা বিলীন হয়ে যেতে লাগল একে একে। কিন্তু সমস্ত বিপর্যয়ের মধ্যেও শিশুসুলভ অথচ এক গভীর ঔদাসীন্যসহকারে প্রশান্ত রয়ে গেল সে। তার আত্মার গতি অব্যাহত রয়ে গেল।
মাঝে মাঝে খুবই সহজ সরল ঘটনা থেকে বিনা খরচে আনন্দ পেত। একদিন মেরে প্লুতার্ক যখন একটা বই পড়ছিল তখন মঁসিয়ে তা শুনছিল। শুনতে শুনতে প্লুতার্ক দুটো শব্দ ভুল বলায় মেবুফ তার ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলল, শব্দ দুটো হল বৃদ্ধ আর ড্রাগন।
তার পর সে বলতে লাগল, এই গল্পে এক ড্রাগনের কথা আছে যে ড্রাগন একটা গুহাতে বাস করত। সেই গুহা থেকে সে এমন আগুন ছড়াত যে সেই আগুনের আঁচে আকাশটা পর্যন্ত জ্বলে যায়, কতকগুলি নক্ষত্রও জ্বলে ওঠে। সেই ড্রাগনের আবার বাঘের মতো থাবা ছিল। বৃদ্ধ সাহসের সঙ্গে সেই গুহায় গিয়ে ড্রাগনের স্বভাবটাকে পাল্টে দেয়। তুমি ভালো বই-ই পড়ছ। এর থেকে ভালো রূপকথা আর হতে পারে না।
এক মধুর আত্মচিন্তার মধ্যে ডুবে গেল মঁসিয়ে মেবুফ।
.
৫.
এই সরল প্রকৃতির মানুষটিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত মেরিয়াস। সে দেখল এই ভালো লোকটি নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে ক্রমশই তলিয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে অবস্থার জটিলতা বেড়ে গেলেও কোনও ভয় নেই মেবুফে’র। মেরিয়াস শুধু মাঝে মাঝে কুরফেরাক আর মেবুফে’র কাছে যেত। তবে মাসে দু-তিনবারের বেশি নয়। অপেক্ষাকৃত নির্জন পথ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ একটানা হেঁটে যেতে ভালো লাগত তার।
এমনি করে বড় রাস্তা দিয়ে বেড়াতে বেড়াতেই একদিন গর্বে অঞ্চলের সেই ব্যারাকবাড়িটাকে দেখতে পায় মেরিয়াস। বাড়িটার কম ভাড়া আর নির্জনতা দেখে পছন্দ হয়ে যায় তার। সেই বাড়িটার মধ্যেই একটা ঘর ভাড়া নেয় সে। সেখানকার লোকেরা তাকে মঁসিয়ে মেরিয়াস বলত।
কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার যারা অতীতে একদিন তার বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে তারা তার পরিচয় পেয়ে তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। তাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানায় তাকে। তাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেনি মেরিয়াস। কারণ তাদের বাড়িতে গেলে তার বাবার কথা আরও অনেক জানতে পারবে সে। সেসব বাড়িতে নাচগানও হত। এইসব ক্ষেত্রে সে ভালো পোশাক পরে যেত এবং সে যেত রাত্রিকালে। তার পায়ের জুতোজোড়া চকচকে পালিশ করা থাকত।
১৮৩০ সালের বিপ্লবের ফলে মেরিয়াসের রাজনৈতিক মতবাদ এবং উত্তপ্ত আবেগ উদ্যম সব উবে যায়। সে শান্ত হয়ে ওঠে অনেকখানি। সেই একই যুবক, কিন্তু তার মধ্যে আর কোনও উত্তাপ নেই। তার রাজনৈতিক মত একটা আছে, কিন্তু সেটাতে আর সে জোর দেয় না। আসলে সে কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নয়, শুধু কিছু কিছু সহানুভূতি আছে মাত্র। আসলে সে মানবতাবাদী। আবার সমস্ত মানবজাতির মধ্যে ফরাসি জাতিকে শ্রদ্ধা করে। আবার ফরাসি জাতির মধ্যে জনসাধারণকে সে ভালোবাসে বেশি। আর সাধারণ জনগণের মধ্যে নারীদের প্রতি তার মমতা ও সহানুভূতি বেশি। সে ঘটনার থেকে বই পছন্দ করে বেশি এবং বীর যোদ্ধাদের থেকে কবিদের শ্রদ্ধা করে বেশি। এই কারণে ম্যারেঙ্গোর যুদ্ধজয়ের ঘটনার থেকে ‘জন’ গ্রন্থখানি সে বেশি ভালোবাসে। কোনওদিন চিন্তামগ্ন হয়ে কাটাবার পর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সে যখন গাছের ফাঁক দিয়ে অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে অজানা নক্ষত্রের আলো আর এক রহস্যময় অন্ধকারের খেলা দেখেছে তখন তার মনে হয়েছে সেসব বস্তুর সঙ্গে মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই, সেইসব বস্তুর কোনও গুরুত্ব নেই। তার মনে হত সে মানবজীবন এবং জীবনদর্শনের গভীরে প্রবেশ করেছে, অথচ আকাশ ছাড়া আর কোনও কিছুর দিকে তাকাচ্ছে না।
তবু তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনেক রকম পরিকল্পনা করত মেরিয়াস। সে কাজের থেকে স্বপ্ন দেখত বেশি। এই সময় কেউ তার অন্তরের দিকে তাকালে তার শুচিতায় মুগ্ধ হয়ে যেত। আমরা যদি কোনও মানুষের অন্তর বিচার করতে চাই তা হলে তার চিন্তা-ভাবনার থেকে তার স্বপ্নকে অবলম্বন করেই সে বিচার করা ভালো। স্বপ্নের মধ্যেই মানুষের স্বরূপটা খুব ভালো করে ধরা পড়ে। সব চিন্তার মধ্যেই ইচ্ছার একটা উপাদান থাকে, কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে সে উপাদান থাকে না। স্বপ্নের মধ্যে আমাদের কল্পনা যখন ইচ্ছামতো অবাধে উড়ে চলে তখন আমাদের অচিন্তিত অসংযত উদ্দাম উচ্চাভিলাষগুলো আত্মার গম্ভীর হতে উঠে আসে। নিয়মিত সব পরিহাসকে ব্যর্থ করে দিয়ে তারা এক স্বকীয় ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। স্বপ্নের মধ্যে আমরা আমাদের এক অজানিত অসম্ভব পরিণতির কল্পনা করে থাকি আর এই কল্পনার মধ্যেই আমাদের স্বরূপটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে এক আশ্চর্য সাদৃশ্যময়তায়।
১৮৩১ সালের মাঝামাঝি যে বৃদ্ধা মেরিয়াসের ফাইফরমাস খাটত তার বাসায় সে একদিন তাকে বলল, তার পাশের ঘরের এক ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
মেরিয়াস বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের কোনও খোঁজখবর রাখত না। সে তবু জিজ্ঞাসা করল, কেন তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে?
বৃদ্ধা বলল, কারণ তাদের বাড়িভাড়া অনেক বাকি পড়েছে। দুই কোয়ার্টারের ভাড়া বাকি পড়েছে।
মেরিয়াস বলল, মোট কত টাকা বাকি আছে?
কুড়ি ফ্রাঁ।
একটা ড্রয়ারের মধ্যে মেরিয়াসের তিরিশ ফ্র জমানো ছিল। সে তার থেকে পঁচিশ ফ্ৰাঁ বার করে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বলল, এর থেকে কুড়ি ফ্ৰাঁ ভাড়া দেবে আর পাঁচ ফ্রাঁ ওদের দেবে। ওরা বড় গরিব। কিন্তু আমি টাকাটা দিয়েছি সে কথা বলবে না।
.
৬.
ঘটনাক্রমে থিওদুল যে সেনাবাহিনীতে কাজ করত সে বাহিনী প্যারিসে স্থানান্তরিত হল। এর ফলে এক নতুন মতলব খেলে গেল ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদের মাথায়। তার প্রথমদিকটা হল থিওদুলকে দিয়ে সে মেরিয়াসের খোঁজ করাবে। মেরিয়াস এখন কোথায় আছে, কী করছে সে বিষয়ে খোঁজখবর নেয়াবে থিওদুলকে দিয়ে। তার দ্বিতীয় মতলব হল মেরিয়াসের পরিবর্তে থিওদুলকে তাদের বিষয়সম্পত্তির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হিসেবে তাদের বাড়িতে রাখবে।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ যদি একজন যুবকের মুখ দেখতে পেলেই ক্লান্ত হন তা হলে মেরিয়াস আর থিওদুলের মধ্যে তফাত কী? তাছাড়া তার ভাইপো’র ছেলে মেয়ের ছেলের থেকে রক্তের দিক থেকে নিকটতম সম্পর্ক। এক উকিলের মতোই একজন সামরিক অফিসার গ্রহণীয়।
একদিন সকালবেলায় মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ যখন তাঁর ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন তখন তার মেয়ে ঘরে ঢুকে নরম সুরে বলল, বাবা, আজ সকালে থিওদুল তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসছে।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ অন্যমনস্কভাবে বললেন, কে থিওদুল?
তোমার ভাইপো’র ছেলে।
আহা!
বৃদ্ধ গিলেনৰ্মাদ আবার কাগজ পড়ায় মন দিলেন। কাগজটা রাজতন্ত্রবাদী হলেও তাতে এমন একটা খবর ছিল যেটা পড়ে রাগে জ্বলে যাচ্ছিলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। সে খবরে প্রকাশ হয় সেদিন বেলা দুটোর সময় প্লেস দ্য প্যান্থিয়নে আইন ও ডাক্তারি ছাত্ররা সমবেত হয়ে প্রকাশ্যে একটা বিষয় আলোচনা করবে। বিষয়টা ছিল এই যে, লুভারের মিউজিয়াম প্রাঙ্গণে যেসব কামান ও অস্ত্রশস্ত্র রাখা হয়েছে তার বৈধতা নিয়ে সরকারের যুদ্ধদপ্তর আর অসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে যে বিরোধের উদ্ভব হয়েছে, সে বিরোধের ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ভাবলেন, যেহেতু মেরিয়াস একজন আইনের ছাত্র, সে-ও নিশ্চয় এ বিতর্কে যোগদান করবে। তার মতে এই ধরনের ব্যাপার নিয়ে ছাত্রদের আলোচনা ও বিতর্ক করার কোনও অধিকারই নেই।
এমন সময় ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ থিওদুলকে সঙ্গে করে এনে ঘরের দরজার কাছে দিয়ে গেল। তার বাবাকে বলে গেল, থিওদুল এসে গেছে।
যাবার সময় থিওদুলকে চাপা গলায় বলে গেল, উনি যা বলবেন তা যেন সমর্থন কর।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ থিওদুলকে বললেন, তা হলে তুমি এসে গেছ। বসো। কথাটা বলেই তিনি চেয়ার থেকে উঠে ঘরের মধ্যে অশান্তভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। আর মাঝে মাঝে ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে হাতঘড়ি বার করে দেখতে লাগলেন। পায়চারি করতে করতে আপন মনে বলে যেতে লাগলেন, গাল টিপলে নাক টিপলে দুধ বেরোয় এই ধরনের একজন যুবক প্লেস দ্য প্যান্থিয়নে আবার সভা করবে। দেশের অবস্থাটা হল কী? অসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী মানে কী? মানে যত সব আজেবাজে লোকের হাতে বন্দুক দেওয়া হয়েছে। তার মানে আমি জোর গলায় শপথ করে বলতে পারি যত সব জ্যাকোবিনপন্থী আর প্রজাতন্ত্রী –যত সব পলাতক আসামি আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কয়েদি।
থিওদুল বলল, আপনি ঠিক বলেছেন।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার দিকে একবার তাকালেন। তার পর আবার বলে যেতে লাগলেন। সেই হতভাগা পাজি ছোকরাটার এতদূর স্পর্ধা যে সে বিপ্লবীদের দলে যোগ দিয়েছে। সে আমার বাড়ি কেন ছেড়ে গেছে? তার কারণ সে প্রজাতন্ত্রী হতে চায়। কিন্তু
জনগণ তাদের প্রজাতন্ত্র চায় না। তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে রাজা ছিল, রাজতন্ত্র। ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে আর জনগণ জনগণই থাকবে। তারা এইসব নির্বোধ যুবকদের প্রজাতন্ত্রকে হেসে উড়িয়ে দেবে। এই যুবকদের মুখে থুতু দেবে আজকের জনসাধারণ। এই উনিশ শতক হচ্ছে বিষাক্ত যুগ। এ যুগের যুবকরা তাদের বাবা-মা ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে এসে মুখে ছাগলের দাড়ি গজিয়ে ভাবে তারাই দেশের সব। এটা যদি প্রজাতন্ত্র হয় তা হলে এটা রোমান্টিসিজম্। আর রোমান্টিসিজম্ মানেই পাগলামি।
থিওদুল আবার বলল, আপনি ঠিক বলেছেন।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বলতে লাগলেন আবার, মিউজিয়ামের উঠোনে কামানই-বা রাখে কেন? তার কারণ কী বলতে পার? তারা কি অ্যাপোলো বা ভেনাসের মূর্তিগুলোকে কামান দিয়ে উড়িয়ে দিতে চায়? আজকের সব যুবক বেনজামিন কনস্ট্যান্টের মতোই অপদার্থ। তাদের বেশভূষা ও পোশাক-আশাকের মধ্যে কোনও পারিপাট্য নেই। তারা নারীবিমুখ, লাজুক, তারা যেভাবে মেয়েদের কাছ থেকে পালিয়ে যায় তা দেখে মেয়েরা হাসিতে ফেটে পড়ে। তারা ভালোবাসাকে ভয় পায়। তারা মূর্খ। তাদের পোশাকের মতোই তাদের কথাগুলোও অমার্জিত। তারা বলে তাদের আবার রাজনৈতিক মতবাদ। আছে। তারা আবার নতুন তত্ত্ব ও পদ্ধতি আবিষ্কার করে সমাজকে নতুন করে গড়ে তুলঁতে চায়। রাজতন্ত্র আর আইনের অনুশাসনের উচ্ছেদ চায়। বাইরের সব জিনিসকে। ভেতরে আর ভেতরের সব জিনিসকে বাইরে এনে পৃথিবীর সব কিছু ওলটপালট করে দিতে চায়। হায় মেরিয়াস, মেরিয়াস, সেই হতভাগ্য যুবক আবার প্রকাশ্য সভায় আলোচনা করবে! চরম বিশৃঙ্খলা আজ ছেলেমানুষিতে পরিণত হয়েছে। স্কুলের কতকগুলি ছেলে কিনা জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবে। আবার ফ্রান্সেই এইসব যুবকের জন্ম হয়েছে। ঠিক আছে হে যুবকবৃন্দ, তোমরা তর্ক করে যাও। এইসব খবরের কাগজগুলো যতদিন থাকবে ততদিন এইসব ব্যাপার চলতে থাকবে। এর দাম মাত্র এক স্য, কিন্তু এই কাগজ মানুষের সব বুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়। বাঃ, বেশ ছোকরা, মাতামহকে হতাশায় ডুবিয়ে দিয়ে বেশ গর্ব অনুভব করছ।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ একটু চুপ করতেই থিওদুল বলে উঠল, একমাত্র মন্ত্রিউল ছাড়া সব খবরের কাগজ নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। সৈন্যদের তালিকাগ্রন্থ ছাড়া সব বই নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আবার বলে যেতে লাগলেন, যে সায়েস তার বাচ্চাকে হত্যা করে সে আবার পরে সিনেটর হয়। এদের নীতিই হল এই। ওরা প্রথমে সবাইকে নাগরিক বলে, পরে বলে মঁসিয়ে। একদিন যারা খুনি ছিল তারা আজ পেটমোটা কাউন্ট হয়েছে। সায়েস আবার দার্শনিক! আমি এই দার্শনিকদের ভাঁড়ের মতো জ্ঞান করি। আমি কয়েকজন সিনেটরকে দেখেছি। তাদের দেখে আমার মনে হয়েছে বাঘের চামড়াপরা বাঁদর। তারা কোয়ে মালাকোয়ের পথ দিয়ে যাচ্ছিল। নীল মখমলের পোশাক পরা সেইসব সিনেটর! সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। হে নাগরিকবৃন্দ, আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি, তোমরা যাকে প্রগতি বলছ তা হল উন্মত্ততা, তোমাদের মানবতা হচ্ছে স্বপ্ন, তোমাদের বিপ্লব হচ্ছে অপরাধ, তোমাদের প্রজাতন্ত্র হল একটা রাক্ষস, তোমাদের যুবতী কুমারী ফ্রান্স এক বেশ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। তোমরা জননেতা, অর্থনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা, সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার উদ্গাতা, যা-ই হও না কেন, গিলোটিনের ক্ষুর ছাড়া আর কিছুই নও। এই হল আমার বক্তব্য।
লেফটন্যান্ট থিওদুল বলল, চমৎকার! আপনার প্রতিটি কথাই সত্যি।
মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ঘুরে দাঁড়িয়ে থিওদুলের মুখপানে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি একটা আস্ত বোকা।