৩.৫ কিজিল-বাশ, টুপিতে লাল সালু

১৯. কিজিল-বাশ, টুপিতে লাল সালু

১৫১১ সালের শরৎকালের সেই উজ্জ্বল সূর্যালোকিত দিনটার কথা বাবর নামায় বিশেষ করে লিখতে হবে। বাবর ভাবে, যখন সে কালো উজবেক নিশানের বদলে ঝিরঝির বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা উজ্জ্বল সবুজ নিশানা সজ্জিত ফিরোজা দরোজার নীচ দিয়ে তার সেনাবাহিনী নিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিলো। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণ হিসাবে দশ বছর আগে সে শেষবারেরমতো সমরকন্দে একজন সুলতান হিসাবে প্রবেশ করেছিলো। আজ তার বয়স উনত্রিশ বছর, সেদিনের পর থেকে তার জীবনে যা কিছু ঘটেছে সবকিছুই তাকে অভিজ্ঞ আর পোড়খাওয়া এক যোদ্ধায় পরিণত করেছে।

কোনো সংঘর্ষ ছাড়াই শহরটার পতন হয়েছে। পারস্যের শাহের অশ্বারোহী বাহিনী এসে যোগ দেবার পরে বাবরের ঘোড়সওয়ারের সংখ্যা বিশ হাজারে উন্নীত হতে দখলদার উজবেকদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা বেমালুম উবে গিয়েছিলো। বাবরের শক্তিশালী বাহিনীর মোকাবেলা করার বদলে তারা শহর ছেড়ে উত্তরের পাহাড়ে তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি কারসিতে পালিয়ে যাওয়াকেই বাঞ্ছনীয় মনে করে। তাদের পলায়নের সংবাদ শুনে বাবর সাইবানি খানের করোটি রক্ত লাল সুরায় পূর্ণ করে তাতে একটা গভীর চুমুক দিয়ে তার সেনাপতিদের পর্যায়ক্রমে করোটিপাত্র থেকে পান করতে দেয়।

কাড়া-নাকাড়ার গমগমে আওয়াজের মাঝে, ঝকঝক করতে থাকা তোরণদ্বারের নিচে দিয়ে অতিক্রম করার সময়ে সে উৎফুল্ল চিত্তে ভাবে, অবশেষে আমার দিন বদলালো। আজ রাতে সে আর মাহাম- শাহী হারেমের অন্য মেয়েদের সাথে, সোনালী আর সবুজ টোপর দেয়া খচ্চরটানা গাড়িতে ভ্রমণ করছে। অনেক দিন পরে মিলিত হবে। শাহী জ্যোতিষবিদের গণনা অনুসারে, পুত্র সন্তান গর্ভধারণের জন্য গ্রহ-নক্ষত্র আজ তাদের সঠিক অবস্থানে রয়েছে। সে আরো একজন উত্তরাধিকারী লাভ করবে আর মাহামও হুমায়ুনের পরে আর কোনো সন্তান জন্ম। দিতে না পারার দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে।

তোরণদ্বারের নিচের আবছা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসে সে শহরে প্রবেশ করতে, তার প্রজাদের উৎফুল্ল সমর্থন চিৎকারের মহিমায় গর্জে উঠে- উজ্জ্বল আলখাল্লার একটা জীবন্ত রংধনু- তার নাম আর তৈমূরের নাম এমন উদ্দীপনায় ধ্বনিত হয়, যেনো তার মহান পূর্বপুরুষ তার পাশেই রয়েছেন। দূর্গপ্রাসাদ এবং কোক সরাই অভিমুখী প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে সে দেখে পথের দুধারে দোকানদারেরা তাদের দোকান সমরকন্দের বিখ্যাত রক্তলাল মখমল আর ভারী জরির কাজ করা পর্দা দিয়ে সাজিয়েছে। বাড়ির ছাদ আর জানালা থেকে অন্তপুরের মেয়েদের ছুঁড়ে দেয়া গোলাপের শুকনো পাপড়ি গোলাপী তুষারকণার মতো বাতাসে ভাসতে থাকে।

কিন্তু সহসা এই হাস্যোস্ফুল্ল আবহাওয়ায় ছেদ পড়ে। জনগণের ভেতর থেকে কর্কশ, ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে: “কিজিল-বাশ! কিজিল-বাশ!” লালসালু! লালসালু! বাবর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে ফিরোজা দরোজা দিয়ে প্রবেশ করা পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনীর দিকে লোকেরা তাকিয়ে রয়েছে। একটা কণ্ঠস্বরের আওয়াজ এখন অসংখ্য কণ্ঠস্বর আপন করে নিয়েছে। সমবেত জনতা উত্তেজিত ভঙ্গিতে পার্সীদের মাথার চূড়াকৃতি পাগড়ি আর তার পেছনে ঝুলতে থাকা লাল কাপড়ের ফালির দিকে ইঙ্গিত করছে, যার মানে বাবর আর সমরকন্দের লোকদের মতো তারা সুন্নী মুসলমান না, বরং তাদের সম্রাট শাহের মতো তারাও শিয়া।

কোনো ব্যাপার না, বাবর নিজেকে প্রবোধ দিয়ে, গর্বিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকায়। সে শীঘই পারসিকদের দেশে ফেরত পাঠাবে আর তার প্রজারা তাহলে বুঝতে পারবে কেবল শিয়া হবার কারণে তাদের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তারপরেও সে তাদের বিক্ষুব্ধ চিৎকার আর বিড়ালের মাও ডাক ভুলতে পারে না।

তিন ঘণ্টা পরে, কোক সরাইয়ের আম দরবারে চিন্তিত মনে একাকী দাঁড়িয়ে ছাদের আর দেয়ালের চকচকে নীল, ফিরোজা, হলুদ আর সাদা টালির জ্যামিতিক নকশার দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে, যা প্রথমবার তাকে ভীষণ বিমোহিত করেছিলো, এই নতুন আশঙ্কা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই মুহূর্তটার জন্য সে অনেকদিন প্রতীক্ষা করেছে, কিন্তু তারপরেও তার মনে হয় ফিরে আসবার গৌরব যেনো অনেকটাই ফিকে হয়েছে, ব্যর্থতার দাগ লেগেছে।

তার চারপাশের এই চমৎকারিত্ব ফিকে হয়ে সেখানে বাবুরীর মুখ ভেসে উঠে। বাবুরীর এখানে এখন নীল চোখে নিরব বিদ্রূপ নিয়ে তাকিয়ে থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু সে উপস্থিত থাকলে এই মুহূর্তে কি মন্তব্য করতো? যে সেই আগাগোড়া ঠিক বলেছে, যে বাবর নিজেই এখন আর নিজের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক না, অন্য কারো হাতের খেলার পুতুল? সে ভবিষ্যতের কথা ভাবলে যা কতোটাই না মহিমাময় হবে বলে সে ভেবেছিলো, বাবরের এবার সত্যিই নিজেকে একা মনে হয়…

***

“সুলতান তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।” বাইসানগারের কঠোর মুখের বলিরেখাগুলো আরো গভীর দেখায়। তৈমূরের আংটি নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে ফারগানা আসা সেই যোদ্ধার বলিষ্ঠতা তার আর নেই। বাবর ভাবে, তাকে গ্রান্ড উজিরের দায়িত্ব দিয়ে সে ভালোই করেছে। যোদ্ধা হিসাবে তার লড়াকু মনোভাব আর বিশ্বস্ত তা এমনই উপযুক্ত প্রতিদান আশা করে এবং মাহামও নিজের পিতাকে এভাবে সম্মানিত হতে দেখে খুশিই হয়েছে।

বাইসানগার কি আজকাল নিজের ভেতরে উঁকি দেয়া হতাশা টের পায়? মুখের উপরে শীতল বাতাসের ঝাপটা অনুভব করতে করতে চন্দ্রালোকিত রাতে পাহাড়ের উপর থেকে শত্রুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে কি সে এখনও আগ্রহী? বা তারার কিংখাবের নিচে, তরবারি পাশে নিয়ে, যখন আগামীকালের গর্ভে কি আছে তা অজানা। কিন্তু আজকের চেয়েও তা বিপদসঙ্কুল আর অনিশ্চিত হবে সেটা নিশ্চিত জেনে, ঘুমাতে যাওয়া? বাবর জানে অভিযানে বেরিয়ে পড়ার জন্য তার এই হ্যাংলামোর কোনো মানে হয় না। কিন্তু সত্যি কথা হলো সমরকন্দে মাত্র ছয় সপ্তাহ কাটাবার পরেই সে আবার বেরিয়ে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। সে কাবুলে ফিরে গিয়ে দেখতে চায় সেখানে সবকিছু ঠিক আছে। যদিও সেখানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সে যথেষ্ট সুরক্ষিত করেই এসেছে। সে ফারগানা পুনরুদ্ধার করতে চায়। উজবেকদের নাজেহাল দশা হবার পরে স্থানীয় গোত্রপতিরা, যাদের দলে যোদ্ধার চেয়ে কুকুরের সংখ্যা বেশি, যা নিজেদের ভিতরে সুবিধামত ভাগ করে নিয়েছে। সমরকন্দ ছেড়ে বের হতে পারলে সে একটা মোক্ষম আঘাতে তাদের রাজা হবার শখ মিটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তার আগে তাকে শহরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শহরের অভিজাত নাগরিকদের সে ডেকে পাঠিয়েছিল কিভাবে সমরকন্দ আগামীতে শাসিত হবে, সেটা ঘোষণা করবে বলে এবং এখন তারা তার জন্য অপেক্ষা করছে- কোনো সন্দেহ নেই সবাই দায়িত্ববিহীন পদমর্যাদার পারিশ্রমিকের জন্য মুখিয়ে আছে।

বাবর তার দরবার মহলে প্রবেশ করে মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। বাইসানগারের নির্দেশে অপেক্ষমান প্রজারা সবাই নরম গালিচার উপরে নতজানু হয়ে কুর্নিশ করে। উজবেকরা পালিয়ে যাবার সময়ে তাড়াহুড়োর কারণে গালিচাগুলো নিয়ে যেতে পারেনি। বাবর যান্ত্রিকভাবে তাদের কুর্নিশের জবাব দেয়, অন্য কোনো একটা ভাবনা তার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনীর এতোদিনে দেশে ফিরে যাওয়া উচিত ছিলো। বাবরকে সুলতান হিসাবে স্বীকার করে খুতবা পাঠ শেষ হওয়ামাত্র যদিও বেশিরভাগ সৈন্যই দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলো। সঁইপ্রস্তুতকারকদের দরোজার বাইরে তৃণভূমিতে এখনও হাজারখানেক ঘোড়সওয়ার তাঁবু খাঁটিয়ে অপেক্ষা করছে। সেখানে তাদের সাথে শাহের ব্যক্তিগত মাওলানা মোল্লা হুসেন অবস্থান করছেন। সে যখনই তার কাছে জানতে চেয়েছে পার্সীরা তাদের সেনাপতিকে- শাহের গাট্টাগোট্টা চেহারার কঠোর দর্শন এক চাচাতো ভাই নিয়ে কবে পারস্যে ফিরে যাবে। তাকে প্রতিবারই শুনতে হয়েছে তিনি নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। আদেশ পাওয়ামাত্রই সে তার লোকদের নিয়ে ফিরে যাবে।

 বাবর তাদের ফিরে যাবার আদেশ দিতে না পারলেও সমরকন্দের রাস্তায় তারা যাতে চলাফেরা না করে সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। জনগণের বিরূপতা এখনও হ্রাস পায়নি। বাবর শাহের আনুগত্য মেনে নিয়েছে জানাজানি হবার পরে তাদের ভিতরে, সে যেমন আশা করেছিলো যে একজন শক্তিশালী সম্রাটকে মিত্র হিসাবে লাভ করে তারা আশ্বস্ত হবে। উল্টো হয়েছে। একটা সন্দেহ শহরের নাগরিকদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। শহরের মোল্লারা ইতিমধ্যে কয়েকবার তার সাথে দেখা করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে যে শাহ তাদের ধর্মের ব্যাপারে আদৌ নাক গলাবে না। শহরের মাদ্রাসার এক বয়োবৃদ্ধ মোল্লা, যার মুখ তার পরণের আলখাল্লার মতোই ফ্যাকাশে ধূসর, তিনি তো বাবরকে খারেজী পার্সীদের সাথে সন্ধি করায় তাকে রীতিমত তিরস্কার করেন। আর পার্সীদের শহর থেকে বের করে দিতে বলেন। “এমনকি উজবেকরা- যদিও আমাদের শহর তারা লণ্ডভণ্ড করেছে তারা আল্লাহতালার সত্যিকারের অনুসারী অন্তত ছিলো…” তিনি বলেন। “উজবেকরা…” বাবর স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তাকে এই কথা কখনও শুনতে হতে পারে। পার্সীদের যেভাবেই হোক ফেরত পাঠাতে হবে।

“সুলতান।” বাইসানগারের কথায় তার চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। “আপনার প্রজারা অপেক্ষা করছে আপনার বক্তব্য শোনার জন্য।”

বাবর তার হাতের কাগজের ভাঁজ খুলে যেখানে সর্বশেষ শাহী নিয়োগের তালিকা লেখা রয়েছে- ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের আলখাল্লা পরিহিত এক মোটাসোটা সওদাগর উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু সে যখন কাগজের ভাঁজ খুলছে, তখন মখমল আবৃত গিল্টি করা সিংহাসন যে যাতে উপবিষ্ট সেটা একপাশে হেলে পড়ে। বাবর শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করে নিজেকে আর সিংহাসন সোজা করতে কিন্তু তাতে ফল হয় বিপরীত সে আলুর বস্তার মতো সিংহাসন নিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ে। বাতাসে মড়মড় শব্দ আর দরবারের সবকিছুই যেনো কেঁপে উঠে। উজ্জ্বল। টালিযুক্ত চুনসুড়কির একটা দলা তার পাশে আছড়ে পড়ে।

কটু-স্বাদের ধোঁয়ায় বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং বাবর টের পায় তার শ্বাস আটকে আসছে। কিন্তু সে মরীয়া হয়ে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করতে মুখ পাথরের কণায় ভরে উঠে। তার চোখ খুলে রাখতেও কষ্ট হয়। দু’হাতে মাথা ঢেকে সে অপেক্ষা করে এই বুঝি আরেক টুকরো চুনসুরকির দলা তার মাথায় ভেঙে পড়লো। কিন্তু উদ্বিগ্ন কয়েক মুহূর্ত কাটাবার পরে যেমন আকস্মিকভাবে কম্পন শুরু হয়েছিলো ঠিক সেভাবেই সব শান্ত হয়ে যায়। তার চারপাশে বাড়তে থাকা গোঙানির শব্দে বাবর সতর্কতার সাথে মাথা তুলে এবং অঝোরে পানি ঝরতে থাকা চোখ কোনোমতে সামান্য ফাঁক করে তাকায়। কয়েক স্থানের পাথর স্থানচ্যুত হলেও কোক সরাইয়ের ছাদ আর দেয়াল ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে নিয়েছে। তৈমূরের নির্মাতারা দারুণ কাজ করে গিয়েছে। কিন্তু চারপাশে ভালো করে তাকালে সে মেঝেতে বাইসানগারকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তার উজ্জ্বল সবুজ রঙের শাহী আলখাল্লা এখন ধূসর হয়ে গিয়েছে।

“প্রহরী!” বাবর চিৎকার করে। কিন্তু বুঝতে পারে না সাড়া দেবার মতো অবস্থায় কেউ আছে কিনা। অবশ্য তার আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে সাথে সাথে সে ধাবমান পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। পাশের কক্ষে দায়িত্বরত দেহরক্ষী দলের দুজনকে সে উড়তে থাকা ধূলোর ভিতর দিয়ে দৌড়ে আসতে দেখে। “আমার ব্যক্তিগত হেকিমকে ডেকে পাঠাও। আর অন্য কাউকে খুঁজে পেলে তাকেও নিয়ে এসো। গ্রান্ড উজির সাথে আরও অনেকে আহত হয়েছেন।” বাবর নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এবং টলোমলো পায়ে বাইসানগারের পাশে গিয়ে বসে তার গলার পাশে আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে। যুদ্ধক্ষেত্রে বহুবার আহত সহযোদ্ধার গলায় সে এভাবে হাত রেখেছে। হ্যাঁ, গ্রান্ড উজির জীবিত- সে তার রক্তের ক্ষীণ কিন্তু ছন্দোবদ্ধ ধারা অনুভব করতে পারে। তার কপালে একটা বিশাল কালশিটে দাগ বেগুনী বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। বাইসানগারের চোখ পিটপিট করে এবং সে চোখ খুলে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে বাবরের দিকে তাকায়।

“ভূমিকম্প হয়েছিলো… হেকিম আসছে।” বাবর তার আলখাল্লার বাইরের অংশ ছিঁড়ে সেটা গোল করে মুড়ে একটা বালিশের মতো করে সেটা বাইসানগারের মাথার নিচে গুঁজে দেয়। “আমি জেনানামহলের অবস্থা দেখতে যাচ্ছি।”

 দরবার কক্ষে তার চারপাশে বিভ্রান্ত লোকেরা উঠে দাঁড়িয়ে অপরকে দাঁড়াতে সাহায্য করছে। কিন্তু অনেকেই তখনও অনড় অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চুনসুড়কির দলার উপর দিয়ে হড়বড় করতে করতে বাবর বের হয়ে এসে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে উপরে জেনানামহলের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। একেকবারে দুটো করে ধাপ টপকে যাবার ফাঁকে সে কালো পাথরের গায়ে চওড়া ফাটল খেয়াল করে এবং মশালসমূহ তাদের নির্ধারিত স্থান থেকে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে- সে লাথি। মেরে তাদের একপাশে সরিয়ে দেয়। কিন্তু তৈমূরের দেয়াল এখানেও ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে নিয়েছে।

সিঁড়ির শেষ প্রান্তে সে লম্বা দ্বৈতদরোজা দেখতে পায়- কিশোর বয়সে বাবর আর তার লোকেরা দরজাটা ভাঙার পরে পুনরায় নতুন করে রূপার আস্তরণ আর টালি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে- অক্ষতই দাঁড়িয়ে আছে। যদিও দরজার উপরের পাথরের সরদলে একটা ফাটল দেখা দিয়েছে এবং কারুকার্যময় টালির ছাদের অংশ বিশেষ খসে মেঝেতে প্রজাপতির ডানার মতো উজ্জ্বল টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। বাইরে অবস্থানরত পরিচারক দলের কাউকেই সে দেখতে পায় না। দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য সে পরে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেবে ভাবতে ভাবতে বাবর কাঁধ দিয়ে দরজার পাল্লায় ধাক্কা দেয় এবং খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।

সে ভেতরে যে মুখটা প্রথম দেখতে পায় সেটা মাহামের, কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল মাথার চারপাশে আলুথালু হয়ে ঝুলে আছে। বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে সে কামরার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, উল্টে পড়া আসবাবপত্র, ভাঙা বাসনকোসন আর ছিটকে পড়া খাবার ছাড়া পুরো কামরাটা অক্ষতই আছে বলা চলে। ফোঁপাতে থাকা হুমায়ুনকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে মাহাম চকচকে চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

“হুমায়ূন দেখেছো? আমি বলেছিলাম না, ভয় পাবার কিছু নেই… এক বোকা দৈত্য কেবল পা দাপিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করেছিলো…আমি বলেছিলাম না তোমার আব্বাজান ঠিকই আসবেন।” বাবর মাহামের কপালে আলতো করে চুমু খায় এবং হুমায়ূনকে তার কোল থেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে তার দেহের উষ্ণতা অনুভব করে। তিন বছর বয়স হবার কারণে বেচারার নাদুসনুদুস ভাব অনেকটাই কমে এসেছে। ছেলেটার বাদামী চোখ- একেবারে তার মায়ের মতোই- বাবরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবী সুলতান কান্না থামিয়ে জুলজুল চোখে বাবরের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।

*

“ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কততটা ভয়াবহ?”

 “বেশ ভালোই ক্ষতি হয়েছে। অনেক বাসস্থান আর শস্যগোলার ক্ষতি হয়েছে, সুলতান। কোক সরাইয়ের মতো শক্ত ছিলো না সেগুলো। প্রায় একশজন মতো লোক ধবংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে এবং আরও তিনশ জন লোক আহত হয়েছে।” বাইসানগারের মাথার বিশাল উজিরের পাগড়ির নিচে, তার মুখ এখনও বিশ্রীভাবে ফুলে রয়েছে যদিও সে দ্রুতই আরোগ্য লাভ করছে।

 “পুনর্গঠনের জন্য শাহী কোষাগার থেকে সব ধরণের সুবিধা দেয়া হবে শহরবাসীদের সেভাবেই জানিয়ে দাও- আর কারো প্রয়োজন হলে তাকে আমাদের শস্যভাণ্ডার থেকে সাহায্য দাও…শীতকাল এসে পড়েছে। আমি চাই না আমার লোকেরা এসময় অভুক্ত থাকুক।”

“হ্যাঁ, সুলতান।”

 বাইসানগার বিদায় নিতে বাবর তার অষ্টভূজাকৃতি সোনার পানি দিয়ে কারুকাজ করা ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য ব্যবহৃত কক্ষে চুপচাপ বসে থাকে। নিজেকে তার ভাগ্যবান বলে মনে হয়। তার দুই বেগমই- মাহাম আর গুলরুখ- আর তার দুই নয়নের মণি হুমায়ূন এবং কামরান সুস্থ আছে। খানজাদা, কাবুলে খুতলাঘ নিগারের সাথে নিরাপদে রয়েছে। কিন্তু তার শাসনকালের প্রারম্ভে এমন বিপর্যয় একটা অশুভ সংকেত হিসাবে বিবেচিত হবে। শহরের লোকজন ইতিমধ্যে ভূমিকম্পের জন্য পার্সীদের উপস্থিতিকে দায়ী করতে শুরু করেছে। জুম্মার নামাজের জন্য মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি বাবরের বিষণ্ণ ভাবনার জাল বারবার ছিন্ন করে। সে ভুলেই। গিয়েছিলো আজ শুক্রবার এবং বড় মসজিদে সবার সাথে তাকে নামাজ আদায় করতে হবে। শহরের লোকেরা এতে প্রীত হবে। আর সেও খানিকটা আধ্যাত্মিক স্বস্তি খুঁজে পাবে, যা হয়তো তার অস্থিরতা আর অস্বস্তি কাটাতে সাহায্য করবে।

 বিশ মিনিট পরে, জরির কাজ করা সবুজ একটা জোব্বা, কোমরে গাঢ় সবুজ বেণী। করা পশমের পরিকর, আর তার উপরে নরম লোমের আস্তরণ দেয়া আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায়, গলায় সোনার কলাই করা একটা কণ্ঠহার, পায়ের হরিণের হলুদ চামড়ার তৈরি নাগরা আর কোমরে আলমগীর ঝুলিয়ে রাজকীয় সাজে সজ্জিত হয়ে বাবর ঘোড়ার চেপে কোক সরাই থেকে বের হয়ে এসে তৈমূরের মসজিদের সুউচ্চ ধনুকাকৃতি খিলান, ইওয়ান, বরাবর এগিয়ে যায়। তার দেহরক্ষীর দল বর্শার ফলা দিয়ে সামনের জনাকীর্ণ সড়ক পরিষ্কার করতে থাকে। কিন্তু জুম্মার নামাজে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যাওয়া নামাজীদের কলরবের বদলে আজ চারপাশে কেমন একটা নিরানন্দ বিষণ্ণতা বিরাজ করছে।

মসজিদের বাইরে আঙ্গিনায় পৌঁছে গাছের উড়তে থাকা সোনালী ঝরা পাতার মাঝে বাবর ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে এবং অনুসরণরত দেহরক্ষী দল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ইমাম সাহেব- বৃদ্ধলোকটা যিনি পার্সীদের ব্যাপারে তাকে তিরস্কার করতে কোক সরাই গিয়েছিলেন- মেহরাবের কারুকাজ করা মার্বেলের বেদীর একপাশে দাঁড়িয়ে ওয়াজ নসিহত করছেন। মসজিদে নামাজীদের প্রথম সারির ঠিক মধ্যস্থলে সুলতানের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে এবং মাথা নিচু করে সেজদা দেয়। ইমাম সাহেব মানব জীবনের নশ্বরতা নিয়ে আলোচনা করছেন এবং ভূমিকম্পে যারা ক্ষগ্রিস্থ হয়েছে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বাবর টের পায়, অসংখ্য চোখ তার দিকে উৎসুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে ইমাম সাহেবের কথা শুনছে।

ইমাম সাহেব সহসা কথা বন্ধ করেন। চমকে মাথা তুলে তাকিয়ে বাবর দেখে তিনি মসজিদের প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে সে দরজায় শাহের ব্যক্তিগত মোল্লা ইমাম হুসেনের লম্বা, চাপদাড়িঅলা গাট্টাগোট্টা অবয়বটা দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পায়। তার মাথায় চূড়াকৃতি লাল টুপি আর পরণে শিয়াদের আজানুলম্বিত লাল আলখাল্লা। তার অনুগামী ছয়জন পার্সী অশ্বারোহী সদস্যদের মাথাতেও লাল সালুর সুস্পষ্ট কিজিল-বাশ টুপি। মিম্বারে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মোল্লার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি তার দিকে এগিয়ে যান চারপাশে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষের শব্দে কর্ণপাত না করে।

 হুসেন সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকান। “আপনার অতিথি হিসাবে, শিয়া আর সুন্নী, সব মতাবলম্বী বিশ্বাসীদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত এই দিনে আমি কি ওয়াজ করতে পারি?”

বহু কষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করে যা অনায়াসে প্ররোচণা আর অভব্যতার নিদর্শন। হিসাবে গণ্য হতে পারে। বাবর কাঠখোট্টাভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং বয়স্ক মোল্লাকে মিম্বার থেকে নেমে আসতে ইঙ্গিত করে।

হুসেন তার স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। “আমাকে কথা বলার সুযোগ দেবার জন্য আমি সুলতানের কাছে কৃতজ্ঞ। পরম করুণাময় আল্লাহতালার অপার করুণা তার উপরে বর্ষিত হোক। কয়েকমাস আগে, পৃথিবীর অধিশ্বর পারস্যের শাহ্ ইসমাইলের সহায়তায় আপনারা এক অশুভ শক্তির হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। আপনাদের শত্রু উজবেকরা লেজ তুলে পালিয়েছে এবং আপনারা আপনাদের সুলতানকে ফিরে পেয়েছেন। শাহ্ এজন্য খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি আর খুশি হয়েছেন যে মহামান্য সুলতান বাবর শাহ্ ইসমাইলকে অধিরাজ হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছেন…শাহ্ আপনাদের সুলতানকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করেন। কিন্তু, সে জন্য অবশ্য, ভাইদের একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে হয়। শাহ্ আমাকে আদেশ দিয়েছেন। আপনাদের সুলতানকে একজন বিশ্বাসী শিয়া হিসাবে স্বীকার করে নিতে। যাতে তার প্রজারাও একই বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে…” একটা সম্মিলিত আঁতকে উঠার শব্দ মসজিদে ভেসে উঠে…

“না!” বাবর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। “আমি শাহের প্রতি আমার আনুগত্য ঘোষণা করেছি বটে, কিন্তু আমার ধর্মবিশ্বাস একান্তই আমার নিজস্ব ব্যাপার। আমি কখনও সেটা বদলাবো না বা আমার লোকদেরও জোর করে মত পরিবতনের শিকার হতে দেবো না। বহু শতাব্দি ধরে তৈমূরের বংশধর এখানে শাসক হিসাবে রয়েছে। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো লাভ হয়নি। আমাকেও হবে না। তোমার প্রভুকে সেটা বলে দেবে…”।

 হুসেনের কালো চোখের মণি ঝলসে উঠে, সে মিম্বারের রেলিং আঁকড়ে ধরে। বোঝাই যায়, সে কারো চড়া কণ্ঠস্বর, এমন সেটা সুলতানের হলে, শুনতে অভ্যস্ত না। “আমার প্রভু অনেক উদারতা দেখিয়েছেন। ভুলে যাবেন না আপনি আপনার সালতানাতের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ।”

বাবর সতর্কতার সাথে তার বাক্য চয়ন করে। “আমি অনেক ব্যাপারেই শাহের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি আরও জানি তিনি একজন বিচক্ষণ মানুষ, যিনি তার বিশ্বস্ত বন্ধুর উপরে অসম্ভব কিছু চাপিয়ে দেবেন না। স্পষ্টতই কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আমি অবিলম্বে পারস্যে বার্তাবাহক পাঠাবো তা নিরসন করার অভিপ্রায়ে। আমি আপনাকেও পারস্যে ফিরে যাবার পরামর্শ দেবো। আপনার আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার অভাব তিনি নিশ্চয়ই অনুভব করছেন এবং আপনার অনুপস্থিতির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।”

হুসেন তার চাপদাড়িঅলা বিশাল মাথাটা আক্ষেপে এপাশ ওপাশ করে। বাবর ভাবে, অনেক হয়েছে। নিজের দেহরক্ষীদের ইশারায় অনুসরণ করতে বলে সে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে। মসজিদের উপস্থিত নামাজীরা এতোক্ষণ পর্যন্ত চুপচাপ সব কিছু দেখছিলো আর শুনছিলো। কিন্তু এখন সে তার পেছনে একটা গুঞ্জন শুনতে পায়- ভীমরুলের ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো সেটা বাড়তে থাকে। সে হেঁটে আঙ্গিনা অতিক্রম করে ঘোড়ায় চেপে বসতে, লোকজন পিলপিল করে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসতে থাকে। কেউ কেউ শাহ আর তার মোল্লার বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ। কণ্ঠে কিছু বলছে এবং অন্যেরা বাবর বুঝতে পারে তাকে উদ্দেশ্য করে অপমানসূচক মন্তব্য করছে।

 মসজিদ থেকে বের হয়ে আসা নামাজীদের সাথে শীঘ্রই কোলাহলের কারণ খুঁজতে আশেপাশের বাড়িঘর থেকে বের হয়ে আসা লোকজন যোগ দেয় এবং কি ঘটছে। জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে। তার দেহরক্ষী দলের সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও এবং বাবরের কর্চির উঁচুতে ধরে থাকা সমরকন্দের সবুজ রঙের শাহী নিশানও। তারা কোক সরাইয়ের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথ ধরলে মসজিদের উদ্দেশ্যে আগুয়ান লোকজনের চাপে প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

 পুরো পরিস্থিতি একটা দাঙ্গার রূপ নিতে চলেছে। মসজিদের পার্সী গর্দভগুলোকে যেকোনোভাবে রক্ষা করতে হবে নতুবা সমরকন্দ আক্রমণ করতে শাহের কোনো অজুহাতের প্রয়োজন হবে না। “দ্রুত কোক সরাইয়ে গিয়ে বাড়তি লোকবল নিয়ে এসো। এখনই!” বাবর তার দু’জন লোককে আদেশ দেয়। তারপরে তরবারির বাঁটে হাত রেখে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভীড়ের ভিতর দিয়ে মসজিদের দিকে এগিয়ে যাবার ফাঁকে, বাকিদের তাকে অনুসরণ করতে বলে। মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে সে উপস্থিত ক্রুদ্ধ লোকদের শান্ত করতে একটা বক্তব্য রাখে।

“পবিত্র কোরানের নামে কসম করে আমি বলছি যে একজনও নারী, পুরুষ বা শিশুকে জোর করে গোত্রান্তরিত করা হবে না!” সে গলার সর্বশক্তি দিয়ে বলে। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দেয় না। বরং একটা ক্রুদ্ধ চিৎকারে চারপাশ গমগম করে উঠে। বাবর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে, মোল্লা হুসেন মসজিদের প্রবেশ দ্বার দিয়ে বের হয়ে আসছেন, পার্সী দেহরক্ষীর দল উদ্যত তরবারি হাতে তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। একটা পচা তরমুজ বাতাসে ভেসে হুসেনের দিকে এগিয়ে গেলে সে সেটা কাটাবার কোনো চেষ্টাই করে না। তরমুজটা তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়তে তার আলখাল্লায় কমলা রঙের আঁশ আর বিচি ছিটকে এসে লাগে। এর ঠিক পরপরই কিছু একটা উড়ে যায় যা দেখতে অনেকটা কাঁচা গোবরের মত। লোকদের সাহস বেড়ে গেলে একটা পাথরের টুকরো মোল্লার বাম কান ছুঁয়ে গিয়ে মসজিদের দেয়ালে আছড়ে পড়ে দেয়ালের কারুকাজ করা নীল টালির একটা চটা খসিয়ে দেয়।

লোকজন এবার আরও সাহসী হয়ে উঠে, হাতের কাছে যা পায় তুলে নিয়ে গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে সামনে এগিয়ে আসে এবং ছুঁড়ে মারতে থাকে। ঘৃণায় তাদের মুখগুলো বিকৃত হয়ে আছে, ঠোঁট উল্টান আর চোখ যেনো ছিটকে বের হয়ে আসবে। তরবারি বের করে বাবর তার দেহরক্ষীদের পার্সী আর ক্রুদ্ধ শহরবাসীদের মাঝে একটা দেয়াল সৃষ্টি করতে বলে। তারপরে, তার ঘোড়ার পাজরে খোঁচা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে সে শেষবারের মতো চেষ্টা করে কুদ্ধ জনতাকে শান্ত করতে। কিন্তু তারা ততক্ষণে কোনো কথা শোনার অবস্থায় আর নেই। পার্সীদের পেড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর লোকগুলো তাকে পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কমলা পাগড়ি পরিহিত বিশালদেহী এক লোক তার ঘোড়ার লাগাম আঁকড়ে ধরে। লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো নাকি তাকেই আক্রমণ করতে এসেছিলো বাবর পরিষ্কার বুঝতে পারে না। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে খঞ্জর বের করে লোকটার বাহুতে আঘাত করে। ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে লোকটা লাগাম ছেড়ে দেয় এবং সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে। বাবরের ভীত ঘোড়াটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে এবং এক পায়ের খুর দিয়ে লোকটার মুখে ঘুষির মতো আঘাত করে। একটা পাথরের মতো টুপ করে সংজ্ঞাহীন লোকটা মাটিতে আছড়ে পড়ে।

অন্যেরা এতোক্ষণে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে টানাটানি শুরু করেছে তাকে ঘোড়াসুদ্ধ মাটিতে আছড়ে ফেলার মতলব। তারা কি জানে তারা কাকে আক্রমণ করেছে? বাবর পাগলের মত চারপাশে তরবারি চালাতে থাকে। নিজের দেহরক্ষী দলের কাছে ফিরে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার আক্রমণকারীরা সংখ্যায় অনেক বেশি। তাদের একজনের হাতে কসাইয়ের চাপাতির মতো দেখতে কিছু একটা ঝলসায়। বাবরকে আঘাত করার বদলে সে চাপাতিটা দিয়ে তার ঘোড়ার গলায় একটা মোক্ষম কোপ বসিয়ে দেয়। বিশাল পশুটা সামনের পা মুড়ে একটা বিকট আর্তনাদের মতো থরথর শব্দ করে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

 বাবর রেকাব থেকে পা বের করে লাফিয়ে পাশে গড়িয়ে যায়। সে অসংখ্য কণ্ঠস্বরকে বলতে শুনে, “বিশ্বাসঘাতক!” এবং “খারেজী; নব্যতান্ত্রিক!” তারপরে লোকদের সাঁড়াশির মতো হাত নিজের দেহে অনুভব করতে সে মোচড় কেটে কোনোমতে পায়ের ভীড়ের ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকে যতক্ষণ না চারপাশে পায়ের দঙ্গলের চাপ পাতল। হয়ে আসে। বাবর তার দেহরক্ষীদের থেকে ক্রুদ্ধ জনতার চাপে আলাদা হয়ে পড়তে বুঝতে পারে যতো শীঘ্র সম্ভব তাকে কোক সরাইয়ে ফিরে যেতে হবে। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বাবর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং মাথা নিচু করে দুহাতে উদ্যত অস্ত্র নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে।

একটা বাঁক ঘুরে সে একটা ছোট ফাঁকা চত্বরে এসে উপস্থিত হয় এবং সে পেছনে যে হট্টগোল ফেলে এসেছে এখনও যার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে তার তুলনায় জায়গাটা অনেকটা শান্ত দেখায়। ভূমিকম্পের কারণে দু’পাশের বাড়িঘর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; দোমড়ানে মোচড়ানো কজা থেকে লোহা থেকে বাঁধান দরজাগুলো হাস্যকর ভঙ্গিতে ঝুলছে এবং দেয়ালে ফাটল ধরছে কিছু কিছু এতোটাই বিশাল যে অনায়াসে প্রাপ্তবয়স্ক একজন লোক প্রবেশ করতে পারবে। বাড়ির মালিক তাদের পরিত্যাগ করেছে আর যেসব এখনও বাসযোগ্য অবস্থায় আছে সেগুলোর মালিকও ভয়ের কারণে সেখানে আপাতত বাস করছে না।

 প্রাঙ্গনটার এক কোণে, একটা পুরাতন বাড়ির ছাদের প্রান্তভাগের কাছে পুরো বাড়িটাই বিধ্বস্ত হয়েছে- একটার উপরে আরেকটা ছাদ নিখুঁতভাবে ধ্বসে পড়েছে। একটা কুঁয়ো রয়েছে। বাবর দৌড়ে সেখানে যায় এবং চামড়ার মশকটা পানিতে ডুবিয়ে ঈষৎ লোনা পানি আজলা ভরে পান করে। মুখ মুছে সে চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। যুদ্ধক্ষেত্রে বা হামলার সময়ে যেমন আত্যন্তিক লক্ষ্যে সবকিছু বিবেচনা করতে থাকে, তেমনিভাবে এখনও তার মস্তিষ্ক কাজ করছে। তার ভাবতে অবাক লাগে বসে থেকে থেকে সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো আর কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো আর এতো তাড়াতাড়ি তার মনোবাসনা এভাবে পূর্ণ হবে।

তাকে দ্রুত এখান থেকে সরে পড়তে হবে। যেকোনো সময়ে চিৎকার করতে থাকা, ক্রুদ্ধ জনতা- পাশের কিংবা তার পাশের গলিপথ অতিক্রম করে তাকে খুঁজে পাবে। তার ডানপাশে প্রাঙ্গন থেকে একটা সরু গলিপথ এগিয়ে গেছে। সে গলিপথটা ধরে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে যে ভূমিকম্পের ফলে সেটা ভেঙে পড়া বাড়িঘরের ধবংসস্তূপে একেবারে আটকে আছে।

 “ঐ যে ওখানে- হারামজাদা আমাদের সবাইকে খারেজী করতে চেয়েছিলো।” গলির দেয়ালে হেলান দিয়ে বাবর পেছনে প্রাঙ্গনের দিকে ফিরে তাকায়, দেখে আটদশজন লোকের একটা দল, পরণের কাপড় ঘেঁড়া, মুখে রক্ত লেগে আছে। হাতের কাছে লাঠিসোটা যে যা পেয়েছে নিয়ে ছুটে আসছে। নিঃসন্দেহে বেচারারা প্রাণপণে দৌড়ে এসেছে কারণ সবার মুখেই বিক্ষুব্ধতা আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সদ্য খুন করেছে এমন যোদ্ধার অভিব্যক্তি তাদের চোখেমুখে, বাবর বহুবার যা দেখেছে। দোকানদার বা কারখানার কারিগর এই লোকগুলো- যে পেশারই হোক না কেন খুন করেছে আর রক্তের স্বাদ পেয়েছে।

 কিন্তু তারা তাকে দেখছে না। বস্তুত পক্ষে সে বুঝতে পারে তারা তাকে দেখেইনি। তারা বাবরের দৃষ্টিসীমার বাইরে এবং উঁচুতে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সতর্কতার সাথে সে প্রাঙ্গনের দিকে পিছিয়ে আসে। তারপরেই সে কেবল দেখতে পায় লোকগুলি কি দেখছে। তারা যে “হারামজাদা”কে ধাওয়া করছে তিনি আর কেউ নন, মোল্লা হুসেন, প্রাঙ্গনের একটা উঁচু অক্ষত ভবনের উপর তলা থেকে তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার লাল টুপি কোথায় যেনো পড়ে গেছে, কালো চাপদাড়ির উপরে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কিন্তু ধাওয়াকারীদের দিকে চোখ পড়তেই তার কালো চোখের মণি ঠিকই ঝলসে উঠে।

“সব সুন্নীরাই খারেজী।” সে উপর থেকে গর্জে উঠে। “তোমাদের কেউই বেহেশতে যেতে পারবে না। তোমাদের আত্মা গোবরে পতিত হবে। সাহস থাকলে আমাকে হত্যা করতে পার। আমি শহীদের দর্জা পাব, আর আজ রাতে আমি বেহেশতে আমার শিয়া ভাইদের সাথে মিলিত হবো…”

 লোকগুলোকে উসকানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না, তারা ভবনটার কাঠের প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। যা কেউ- সম্ভবত, হুসেন নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। লোকগুলো দরজা ভাঙার জন্য যুতসই কিছু খুঁজতে থাকে। বাবর নিজেও মোল্লাকে ঘৃণা করে কিন্তু তারপরেও বেচারাকে সে খুন হতে দিতে পারে না। উপরের দিকে তাকিয়ে, সে দেখে যে চত্বরের দুপাশে যে বাড়িগুলো তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোর ছাদ কাঠের পাটাতন দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত রয়েছে, যার উদ্ভব হয়েছিলো তৈমূরের সময়ে শহরের মেয়েরা যাতে আলো বাতাসে হাঁটবার পাশাপাশি লোকচক্ষুর অন্তরালে পরস্পরের সাথে দেখা করতে পারে।

দেয়ালের টিকে থাকা অংশের কাছাকাছি অবস্থান করে এবং ধবংসস্তূপের উপরে যাতে আছড়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রেখে, হুসেন যে বাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে তখনও তড়পানো চালিয়ে গিয়ে তার নিজের কর্মকাণ্ডকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে সাহায্য করছে, সেই বাড়ির ত্রিশ গজ দূরে বেড়ে উঠা একটা লম্বা গাছ বেয়ে সে উপরে উঠতে চেষ্টা করে। গাছটার ডানে বামে প্রসারিত ডালপালা সে রাখার অবলম্বন হিসাবে ব্যবহার করে এবং যদিও গাছটার লালচে সোনালী রঙের বেশির ভাগ পাতা ঝরে পড়েছে। তারপরেও যতোটুকু টিকে আছে সেগুলো তাকে ভালোই আড়াল করে রাখে। হাঁসফাঁস করতে করতে বাবর গাছ বেয়ে উঠতে থাকে এবং শীঘ্রই মোল্লা যেখানে দাঁড়িয়ে তখনও সমানে চেঁচিয়ে চলেছে তার পাশের বাড়িটার ছাদে উঠে আসে।

দুটো বাড়িকে যুক্ত করে রাখা কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে দোয়াদুরূদ পড়তে পড়তে যাতে সেটা তার ওজন নিতে পারে। বাবর দুলতে থাকা পাটাতনটা অতিক্রম করে। তারপরে আলতো পায়ে হেঁটে গিয়ে যাতে হুসেন তার উপস্থিতি টের না পায়। সে সামনের কাঠের পাটাতটা টেনে খুলে এবং সতর্কতার সাথে সেটার পেছনে অবস্থিত সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে সাদা রঙ করা একটা ছোট চিলেকোঠায় এসে উপস্থিত হয়। চিলেকোঠার এক কোণে আরেক প্রস্থ চওড়া সিঁড়ি, হুসেন সম্ভবত যেখানে রয়েছে সেদিকে নেমে গেছে। খঞ্জরটা হাতে নিয়ে বাবর বিড়ালের মতো আলতো পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে নিচে নামতে থাকে। কয়েক ধাপ নামার পরে, সে নিচের দিকে উঁকি দেয়। মোল্লা বাবাজি একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে হাতপা নাড়ছেন। বাবর সামনে এগিয়ে যায় এবং তার হাতে ধরা খঞ্জরের অগ্রভাগ আলতো করে লোকটার পিঠে ঠেকায়।

 “নিচের কেউ যেনো বুঝতে না পারে আমি এখানে রয়েছি।” সে ফিসফিস করে বলে। “ভালো মানুষের মতো জানালার কাছ থেকে সরে এসো- এখনই!” খঞ্জরটা এই উদ্ধত মূখের পাঁজরে আমূল গেঁথে দিতে পারলে বা তাকে নিচের লোকগুলোর মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তার রাগ কিছুটা কমতো- ব্যাটার সেটাই প্রাপ্য। কিন্তু সমরকন্দের স্বার্থে সেরকম কিছুই সে করতে পারবে না।

 বাবরকে বিস্মিত করে হুসেন তার কথামতো জানালা থেকে সরে আসে।

 “ঘুরে দাঁড়াও।”

মোল্লা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবরকে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তার চোখে ক্ষণিকের জন্য স্বস্তি ফুটে উঠে। সম্ভবত একটু আগে শহীদের দর্জা নিয়ে বেহেশতে শিয়া ভাইদের সাথে খানাপিনা করার ব্যাপারে সে হয়তো ঠিক ততোটা উৎসুক না। এমন সময়ে, একটা প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ, সাথে বুনো উল্লাস আর উৎসাহী চিৎকার বলে দেয় যে নিচের ক্রুদ্ধ জনতা দরজাটা প্রায় ভেঙে ফেলেছে।

 “সিঁড়ি দিয়ে জলদি ছাদে যান- এখনই।”

মোল্লা তার আলখাল্লা সামলে নিয়ে আধা দৌড় আধা হোঁচট খেতে খেতে আদেশ অনুযায়ী কাজ করে।

 বাবর তার পরিকরে খঞ্জরটা গুঁজে রাখতে রাখতে বুঝতে পারে মোল্লাকে সামলাতে তার আর কোনো ঝামেলা হবে না, সে তাকে অনুসরণ করে। ছাদে উঠে এসে কাঠের পাটাতন বন্ধ করার ফাঁকে সে চিন্তা করতে চেষ্টা করে কোনদিকে যাবে। গাছ বেয়ে নামবার চেষ্টা করলে আর দেখতে হবে না, আর সে ঠিক বুঝতেও পারে না মোল্লা গাছ বেয়ে নামতে পারবে কিনা।

বাবর ছাদের উপর দিয়ে দৌড়ে আরেক প্রান্তে যায় এবং নিচের দিকে তাকায়। নিচে একটা চওড়া রাস্তার দুপাশে সে সারি দিয়ে কামারশালার মতো কিছু দেখতে পায়- সম্ভবত শহরের অস্ত্রশালা এদিকেই। শুক্রবার হওয়াতে দোকানগুলো বন্ধ আর একেবারে নির্জন। ছাদ থেকে শান বাঁধানো রাস্তা কমপক্ষে পঁচিশ ফিট নিচে আর দুপাশের মাটির দেয়ালেও সে আশাব্যঞ্জক কিছু দেখতে পায় না। কিন্তু নীচ থেকে ভেসে আসা আরেকটা জোরালো আওয়াজ হলে সে বুঝতে পারে ভাববার জন্য তার হাতে বেশি সময় নেই। প্রবেশদ্বার আর বেশিক্ষণ উত্তেজিত জনতাকে আটকে রাখতে পারবে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। “আপনার পরিকর খুলেন এখনই।”

চোখ পিটপিট করে, মোল্লা তার কথা মতো কাজ করে। কোমর থেকে প্রায় নয় ফিট লম্বা ভারী জরির কাজ করা রেশমের মোটা পরিকর খুলে দেয়। বাবর এবার নিজের পরিকর থেকে খঞ্জরটা খুলে নিয়ে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জুতোর ভেতরে খুঁজে রেখে, মোটা, শক্তিশালী উলের তৈরি বেশ ছোট সাত ফুট লম্বা পরিকরটা খুলে নেয়। তাদের এরপরেও লাফ দিতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে এরচেয়ে ভালো কিছু উপায় ভাবতে পারছে না…সে পরিকর দুটো একসাথে বেঁধে নিয়ে উলের দিকটা তার কাছে শক্তিশালী মনে হয়েছে- ছাদে স্থাপিত কপিকলের, শস্যদানা বা অন্য রসদ সংরক্ষণের জন্য ছাদে তোলার কাছে ব্যবহৃত, সাথে আটকায়। তারপরে অন্যপ্রান্তটা নিচের দিকে ছুঁড়ে দেয়।

 “আপনি প্রথমে নামবেন। আমাদের দুজনের ভিতরে আপনার ওজন বেশি- আমি আপনার ওজন কিছুটা সামলাতে চেষ্টা করবো।”

 মোল্লা কোনোরকম ইতস্তত করে না। বাবর কিনারার দিকে পিঠ করিয়ে নিজে দাঁড়ায় এবং পরিকরের অন্য প্রান্তটা ধরে তার পিঠের পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে ডান হাতে ধরে এবার শক্ত করে দাঁড়ায়। বাবর ইঙ্গিত করতে হুসেন সতর্কতার সাথে ছাদের কিনারা টপকে নিচে নামতে শুরু করে। জোড়া দেয়া পরিকর যেনো হাল ছেড়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং গিঁটটা যেনো ছিঁড়ে যাবে।

 “তাড়াতাড়ি!” বাবর চেঁচিয়ে ওঠে এবং টের পায় তার হাতে ধরা পরিকরটা সহসা ঢিলা হয়ে গিয়েছে। সে নিচের রাস্তায় উঁকি দিয়ে দেখে মোল্লা বাবাজি নিচের লাল আলখাল্লার স্তূপে জবুথবু ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে এবং কাঁধ ডলছে। ক্রুদ্ধ উত্তেজিত চিৎকার আর কাঠের পাটাতন খোলার শব্দ শুনে বাবর বুঝতে পারে তার হাতে আর বেশি সময় নেই। সে আবার পরিকর দুটো গিঁট দিয়ে বেঁধে শক্ত করে ধরে ভাগ্যের উপর ভরসা করে লাফ দেয়…সে লাফিয়ে নামার সময়ে পা দিয়ে দেয়ালের গায়ে ধাক্কা দেয় পতনের বেগ কমাতে চেষ্টা করে কিন্তু সহসা তার হাত পিছলে যায়।

নিচের একটা কাঠের স্তূপ সামান্য হলেও তার পতনের বেগ সামলে নেয়। মোল্লা যেখানে আছড়ে পড়েছিলো সেখানেই পড়ে থেকে কাতরাচ্ছে এবং ছাদের উপর থেকে উঁকি দেয়া মুখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকগুলো কুৎসিত ভাষায় গালমন্দ করে চলেছে। যেকোনো মুহূর্তে তারা জোড়াতালি দেয়া দড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করবে। বাবর মোল্লাকে ধরে দাঁড় করাবার ফাঁকে পেছন থেকে ধাবমান ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। এক সারিতে বাবরের দেহরক্ষী বাহিনী রাস্তাটা দিয়ে ছুটে আসে। তাদের মধ্যে দু’জন ইতিমধ্যে ধনুকে তীর সংযোজিত করেছে, ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা আক্রমণকারীদের বাড়াবাড়ি করতে দেখলে ছুঁড়ে মারবে, তারা অবশ্য ততোক্ষণে পেছনে সরে গিয়ে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে।

“সুলতান, বিচ্ছিন্ন হবার পরে থেকেই আমরা আপনাকে পাগলের মতো খুঁজছি। আমাদের দ্রুত করতে হবে। পুরো শহরে ক্রুদ্ধ জনতা পাগলের মতো ঘুরছে…” তার দেহরক্ষীর একজন ঘোড়া থেকে নেমে লাগামটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। বাবর ক্লান্ত ভঙ্গিতে টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ঘোড়ায় চেপে বসে। তার দুজন যোদ্ধা একটা ঘোড়ায় চাপে এবং তখনও কাতরাতে থাকা মোল্লা আরেকজনের পিছনে চেপে বসলে ছোট দলটা কোক সরাইয়ের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে দ্রুত ঘোড়া ছোটায়।

*

“আমি আমার সৈন্যবাহিনী পশ্চিমে আমার নিজের সীমান্ত রক্ষার উদ্দেশ্যে সরিয়ে নিচ্ছি এবং আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত সহায়তা করতে অপারগ। বস্তুতপক্ষে আমি আপনাকে কেনই বা সহায়তা করবো? আপনি আমার উদারতার মুখে থুতু নিক্ষেপ করে আমার ধর্মবিশ্বাসকে অপমানিত করেছেন। সমরকন্দে কি হয়েছে মোল্লা হুসেন আমাকে সব খুলে বলেছে-কিভাবে তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত করে সেখানের রাস্তায় কুকুরের মতো তাড়া করা হয়েছে। তাকে আর তার সত্যিকারের ধর্মমত প্রত্যাখ্যান করে আপনি আর আপনার প্রজারা কার্যত আমাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তার বিরুদ্ধে করা অন্যায়ের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতালা যেনো আপনাকে ক্ষমা করে দেন।”

 বাবর শাহ্ ইসমাইলের চিঠির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয় বদ মোল্লাটা শাহকে বলেনি যে বাবর- নিজে ব্যক্তিগতভাবে তার মোটা গর্দানটা রক্ষা করেছে। ধীরে ধীরে, ইচ্ছাকৃতভাবে সে চিঠির নিচের সিংহ চিহ্নিত লাল মোমের শীলমোহরটা ছিঁড়ে নিয়ে শাহের ব্যক্তিগত স্মারক- টুকরো টুকরো করে। তারপরে টুকরোগুলো, শীতকালের মাঝামাঝি শহরের দেয়ালে মাথা কুটতে থাকা তুষারের ঝাপটার হিম ঠাণ্ডা, যা কোক সরাইয়ের পাথুরে দেয়াল ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে, প্রশমিত করতে তার কক্ষে দিন রাত প্রজ্জ্বলিত কাঠের আগুনের উষ্ণ সবুজ শিখায় ছুঁড়ে দেয়।

 “সুলতান, আমরা এমন কিছুই আশা করছিলাম…” বাইসানগার মৃদু কণ্ঠে কথাটা বলে।

“আমি জানি। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে শাহ্ উজবেকদের হামলার মুখে শহরটা অরক্ষিত রেখে দিচ্ছেন- আমি কল্পনাও করিনি তার জীঘাংসা এতোটা প্রবল হতে পারে…” বাবর তাকিয়ে মোম গলতে দেখে এবং আগুনের ভেতরে কাগজের টুকরো উজ্জ্বল হয়ে দপ করে জ্বলে উঠে তার সাথে সব আশাও ভষ্ম করে দেয়। “তিনি সব সময়ে তার আদেশ পালন হয়েছে দেখতেই অভ্যস্ত। তিনি একবার আপনার আনুগত্য পাবার পরে তাই আশা করেছিলেন আপনিও তার সব আদেশই পালন করবেন।”

“বাবুরী ঠিক এই কথাটাই আমাকে বলেছিলো… এতো সরল ছিলাম আমি। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি শাহের কোনো দুরভিসন্ধি আছে… তিনি একবারও বলেননি আমাকে বা আমার প্রজাদের জোর করে গোত্রান্তরিত করা হবে এবং তার জানা উচিত ছিলো বিনা রক্তপাতে তিনি তার অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারবেন না। মোল্লা হুসেনের ওয়াজের পরে শহরের উত্তেজনা প্রশমিত করতেই আমাদের একমাস সময়। লেগেছিলো।”

‘সুলতান, অন্তত মন্দের ভালো, পার্সীরা বিদায় হয়েছে…”।

“ঠিক আছে, কিন্তু তারা আমাদের বিপদে ফেলে গিয়েছে। আমি সুলতান হবার পরে পরেই তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া উচিত ছিলো। আমার প্রজারা তাহলে আমার ব্যাপারে কম সন্দিহান বোধ করতো। কিন্তু আমি সেটা না করে তাদের জামাই খাতির করে সমরকন্দে রেখেছিলাম, যাতে আমার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং তারপরে ঠিক যখন তাদের সাহায্য আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমরকন্দ রক্ষা করতে তখন তারা দেশে ফিরে গিয়েছে। উজবেকরা ইতিমধ্যে বোখারা আবার দখল করে নিয়েছে। শীতকাল বিদায় নেয়া মাত্র তারা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার নিয়োগ করা গুপ্তদূতের দল যদিও খবর নিয়ে এসেছে যে, কাবুল পড়বে। আমার নিয়োগ করা ও আর তার আশেপাশের এলাকা শান্ত রয়েছে। কিন্তু আমি সেখান থেকেও অতিরিক্ত বাহিনী এখানে নিয়ে আসতে পারবো না। তাহলে প্রথমবার সমরকন্দ অধিকার করার পরে না ভেবেই আমি যেনো ফারগানাকে বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়েছিলোম এবারও ঠিক সেভাবেই কাবুলকে বিদ্রোহ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকির ভিতরে ফেলে দেবো। আমি অবশ্য শহরটা সুরক্ষিত আর রসদ মজুদ করতে পারি। কিন্তু শহরের লোক কি আমাকে সমর্থন করে? শহর রক্ষাকারী দেয়ালের ভিতরে আর বাইরে একই সাথে আমি শত্রুর মোকাবেলা করতে পারব না।”

 “সুলতান, এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।”

“বাইসানগার, আমি নিজেও এর উত্তর জানি না…”।

*

পেছনে ফিরে তাকিয়ে কি লাভ? সূর্যাস্তের গোলাপী, বেগুনী আর কমলা আভা সমরকন্দের বিস্ময়কর, চমকপ্রদ দৃশ্যপট আড়াল করে ফেলেছে। প্রকৃতিই যেনো তার নিষ্ক্রমনে উল্লাস প্রকাশ করছে। কাল সকালে হয়তো আজকের সূর্যাস্তের মতোই আরেকটা মহিমান্বিত সকাল পাঁচ মাইল দূরে শিবির স্থাপনকারী উজবেকদের স্বাগত জানাতে বিকশিত হবে।

কে ভাবতে পেরেছিলো সাইবানি খান মারা যাবার পরে তারা আরেকজন যোগ্য নেতার অধীনে এতোদ্রুত নিজেদের সংঘটিত করবে? উজবেকরা আসলে পিঁপড়ের মতো একটা জাতি; কেউ যখন পায়ের নিচে পিষে যায় তখন পেছন থেকে অন্যেরা সামনে এগিয়ে আসে এবং তাদের নিরন্তর সামনে এগিয়ে চলার গতি বজায় থাকে…

 কেবল শাহই তাকে- খারেজী সুলতানের তকমা দিয়ে সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেনি, সমরকন্দের লোকদের সে নিজে এরচেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ করেছে। প্রায় একমাস আগে, বসন্তের প্রথম দিনে, পারস্যের বাহিনী বোখারার পশ্চিমে শীতকাল অতিবাহিত করার উদ্দেশ্যে স্থাপিত উজবেক শিবিরে হামলা করে। তাদের বন্দি করে পারস্যের বাহিনী প্রমাণ করতে চেয়েছে শাহ্ আর তার সাম্রাজ্যে অতীত আক্রমণের জন্য কেবল না, শিয়া আর সুন্নীদের ভিতরে মতভেদের জন্যও তাদের শাস্তি দিতে তারা এবার বদ্ধপরিকর। শাহ্ ইসমাইলের অনুরোধে, পারস্যের মসজিদে, মোল্লার দল এখন সব সুন্নীকে আল্লাহতালার শত্রু হিসাবে ঘোষণা করছে। আর উজবেকরা- বাবর আর সমরকন্দের অধিবাসীদের মতো সুন্নী মুসলমান। পারস্যের সেন্যবাহিনী বন্দি উজবেকদের শিয়া ধর্মমত গ্রহণের আদেশ দেয় এবং তারা মানতে রাজি না হলে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে।

সমরকন্দের অধিবাসীরা বাবরের প্রতি নিজের মনোভাব গোপনের কোনো চেষ্টাই করেনি। উজবেকরা যদি ফিরে আসতে চায় তবে তাদের আসতে দেয়া হোক। ধর্ম বিশ্বাসের শত্রুর চেয়ে রক্তের শত্রু অন্তত মন্দের ভালো। নির্মম সত্যটা হলো তারা শাহের হাত থেকে আর তার শিয়া ধর্মমত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য উজবেকদের বেশি বিশ্বাস করে- বাবরকে তারা একেবারেই বিশ্বাস করে না। শাহের সাথে পূর্ববর্তী সন্ধির জন্য বাবরকে চরম মূল্য শোধ করতে হয়েছে। বাবর। বৃথাই তাদের সাইবানি খানের নিষ্ঠুরতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু দেখা গেছে তাদের স্মৃতিশক্তি বড়ই দুর্বল। শহরের ভিতরে প্রায় বিদ্রোহী পরিস্থিতি আর শহর ত্যাগ করার জন্য, উত্তরের কারশী এবং অন্যান্য শক্ত ঘাঁটি থেকে ধেয়ে আসা লক্ষাধিক উজবেক সৈন্যের মহড়ার সামনে বিপর্যস্ত বাবর, শহরের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে চরমপত্র ঘোষণা করে: শহর আর আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতি রক্ষা করতে আমাকে সাহায্য করো- নতুবা আমাকে কাবুলে ফিরে যেতে হবে।” তার ডাকে শহরবাসী সাড়া দেয়নি।

 কাবুলে তার শাসন অন্তত বলবৎ রয়েছে আর তার পরিবারও সেখানে নিরাপদেই আছে। সে মাহাম, গুলরুখ আর তার সন্তানদের, একটা শক্তিশালী অনুগামী দল সহকারে আগেই রওয়ানা করিয়ে দিয়েছে। এবার তারও যাবার সময় হয়ে এসেছে। গত কয়েক সপ্তাহ তার কেবলই বাবুরীর কথা মনে পড়েছে। তার বন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। সমরকন্দের জন্য বাবরের মোহ- যা কখনই তার নিজের ছিলো না তাকে অন্ধ করে ফেলেছিলো। তাকে এবার তার নিজের নির্বুদ্ধিতার মূল্য পরিশোধ করতে হবে। সমরকন্দের কথা একেবারে ভুলে গিয়ে কাবুল থেকে অন্যান্য অঞ্চলে তার নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার উপায় অনুসন্ধান করতে হবে।

কিন্তু একটা বিষয়ে সে অন্তত সন্তুষ্টিবোধ করতে পারে। সে শাহের প্রজনন স্ট্যালিয়নটা- নির্বীয করে ফেরত পাঠিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *