৩-৪. সন্ধের পর

মানবেন্দ্র আবার ঘর থেকে বেরুলেন সন্ধের পর। বেশ শীত পড়েছে। শালটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে তিনি মন্থর গতিতে হাঁটছিলেন। বাগানে চেয়ার পেতে ওরা বসে আছে। ওদের সঙ্গে যাতে চোখাচোখি না হয়, সেই জন্য তিনি তাকিয়ে আছেন অন্য দিকে।

একটি মেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে। জড়তাহীন স্বচ্ছ গলা। নারী দু’জনের মধ্যে কোন জন গায়িকা– সেটা জানার কৌতূহল ছিল মানবেন্দ্রর। রবীন্দ্রসঙ্গীত তিনি পছন্দ করেন না। ত্রিসপ্তকের মাত্র একটি সপ্তকে ওই গানগুলি গাওয়া হয় –একে সঙ্গীত বলে না। তার সপ্তকে তুলতে হলেই অধিকাংশ গায়ক-গায়িকা ফলসেটো ব্যবহার করে প্রকাশ্যে তাই শোনানো হয়, রেকর্ড হয়, আশ্চর্য ব্যাপার।

বারান্দাটুকু পার হতে হতে মানবেন্দ্র গানটির চারটি লাইন শুনলেন–

আমারে করো তোমার বীণা,
লহো গো লহো তুলে
উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি
মোহন অঙ্গুলে।
কোমল তবু কমল করে 
পরশ করো পরাণ-পরে,
উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া ।
তব শ্রবণমূলে।

শুনতে শুনতে মানবেন্দ্রর চোখের সামনে ভেসে উঠল ৩৩ সংখ্যা। তিনি ভুরু কোঁচকালেন। অন্য কথা ভাববার চেষ্টা করলেন। এই ৩৩ সংখ্যাটা বিরাট বড় হয়ে তার পথ জুড়ে যেন দাঁড়াল। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, যাও! কিন্তু গেল না!

মানবেন্দ্রর স্মৃতিশক্তি একসময় ছিল অসাধারণ। মাঝখানে কয়েকটা বছর অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে তা অনেকটা নষ্ট হয়ে গেলেও এখনও সে-ক্ষমতা মাঝে মাঝে ফিরে আসে। এ-রকম ফিরে এলেই তিনি বরং বিরক্ত হন। কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে যে, মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি সমস্ত অস্ত্রের কথা ভুলে যাবেন।

মানবেন্দ্র আসলে দেখতে পাচ্ছেন গীতবিতানের একটি পৃষ্ঠা, তার ঠিক মাঝখানে ৩৩ নম্বর গান, আমার করো তোমার বীণা..। এর ঠিক নীচেই ভালোবেসে, সখী, নিভৃত যতনে.. সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গান তিনি পছন্দ না করলেও, এককালে শুধু সাহিত্যগুণের জন্য গোটা গীতবিতানটা প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলেন।

পৃষ্ঠাটার ওপরে লেখা আছে প্রেম। এটা প্রেম বিষয়ক গান। এ আবার কী ধরনের প্রেম? আমারে করো তোমার বীণা, লহো গো লহো তুলে-এই বর্ণনা কি শারীরিক? একটি মেয়েকে কোলের ওপর বসিয়ে তার ঊরু ও বুকের ওপর দুটি হাত রাখলে অনেকটা বীণার মতোই মনে হতে পারে বটে। কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের তরুণ সম্পাদক কি এ-রকম শারীরিক বর্ণনা দেবেন? না। সেই জন্যই লিখেছেন, পরশ করো পরাণ-পরে। শরীর স্পর্শ করার ব্যাপার নয়, পরাণের ওপর আঙুল রাখতে বলছেন। একটা উদ্ভট ব্যাপার। সত্যি সত্যি একটি নারীকে বীণা কিংবা তম্বুরার মতো কোলের ওপর বসানো কি এর চেয়ে অনেক সুন্দর দৃশ্য নয়? উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া তব শ্রবণমূলে-এ-রকম একটা বাজে লাইন কল্পনাও করা যায় না। শ্রবণমূলে? এখানে শ্রবণমূলে মানে ঠিক কী?

এই সব কথা চিন্তা করতে করতে মানবেন্দ্র টুরিস্ট লজের অফিস ঘরে ঢুকছিলেন, এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ পেলেন।

আচ্ছা একটু শুনুন।

মানবেন্দ্র মুখ ফেরালেন। হিরণ্ময় বসু। প্রত্যেক দলের মধ্যেই এক জন বোকা লোক থাকে। ওদের দলের মধ্যে এ হচ্ছে সেই ভিলেজ ইডিয়েট, মানবেন্দ্র এক নজরে দেখেই বুঝেছেন।

আমাকে কিছু বলছেন?

 হিরণ্ময় বসু বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনিই কি সেই মানবেন্দ্র মজুমদার, মানে রাইটার?

মানবেন্দ্র একটু ইতস্তত করলেন। মিথ্যে কথা চট করে তার মুখে আসে না। তিনি নির্লিপ্ত ভাবে বললেন, হ্যাঁ।

হিরন্ময় বসুর মুখখানা হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। সে বলল, আমি ঠিকই ধরেছি। আমি আগেও দুএকবার দেখেছি আপনাকে।

হিরন্ময় বসু গলা চড়িয়ে বাগানে বসে থাকা দলটির উদ্দেশে বলল, এই অসীম, তুই বাজিতে হেরেছিস।

মানবেন্দ্র চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, পুলিশে গ্রেপ্তার করা আসামির মতো। তিনি বুঝতে পেরেছেন, আজ আর তার সান্ধ্যভ্ৰমণ হবে না।

হিরন্ময় বসু বলল, আসুন না, আমাদের সঙ্গে একটু বসবেন। আমরা চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম।

যে-ব্যাপারে মানবেন্দ্রর সম্পূর্ণ অনিচ্ছা, তাতেও আজকাল তিনি আগ্রহে রাজি হয়ে যান। ইদানীং নিজেকে কষ্ট দেবার ব্রত নিয়েছেন কিনা।

তিনি হাসিমুখে বললেন, চলুন।

অন্য পুরুষ দুজন মানবেন্দ্রকে অত্যন্ত সম্মান দেখিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হিরন্ময় দৌড়ে বারান্দা থেকে অতিরিক্ত একটা চেয়ার এনে বলল, বসুন, আপনি এখানে বসুন।

মানবেন্দ্রর চেয়ার ঠিক শ্যামলা রঙের ছিপছিপে মেয়েটির মুখোমুখি। সে-ই গান গাইছিল। মানসী রায়চৌধুরী। চোখের দৃষ্টি খুব স্নিগ্ধ। মেয়েদের মুখের কয়েকটি বিভিন্ন প্যার্টান আছে। যে-কোনও মেয়েকে দেখলেই অনায়াসে বলা যায়, একে অনেকটা অমুকের মতো দেখতে। যেমন অনুরাধা ব্যানার্জির মুখের আদল অনেকটা দীপার ছোট বোন জয়ার মতো। কিন্তু মানসী রায়চৌধুরীর মুখ দেখে অন্য কোনও মেয়ের কথা মনে পড়ল না। অথচ খুব যেন চেনা চেনা। এটা কী করে হয়?

মানসী রায়চৌধুরীর উদ্দেশে মানবেন্দ্র ভদ্রতা করে বললেন, আমি আসার জন্য আপনার গান বন্ধ হয়ে গেল।

মানসী নম্রভাবে বলল, আমি এমনিই গাইছিলাম।

গৌতম ব্যানার্জি বলল, আমি আপনার অনেক লেখা পড়েছি। কখনও আপনাকে দেখিনি। তাই হিরন্ময় যখন বলল, ঠিক বিশ্বাস করিনি।

অসীম রায়চৌধুরী বলল, আমি একদমই বিশ্বাস করিনি।

এসব ক্ষেত্রে যা বলা উচিত, মানবেন্দ্র সেই বাঁধাধরা কথাটাই বললেন। লেখার সঙ্গে লেখকদের চেহারা একদমই মেলে না। তাছাড়া—।

একটু থেমে, সকলের মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মানবেন্দ্র আবার বললেন, আমার নামে এক জন আধুনিক গায়ক আছেন, অনেকে আমার নাম শুনে তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন।

গৌতম ব্যানার্জি বলল, না, আমরা সেকথা ভাবিনি। চেহারার জন্যও না। মানে, হঠাৎ এ-রকম জায়গায় একজন লেখকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, কী-রকম যেন অবিশ্বাস্য লাগে। তাছাড়া আমরা ভেবেছিলুম, আপনার আরও অনেক বেশি বয়েস হবে। লেখকদের তো আমরা সাধারণত খুব প্রবীণ মনে করে থাকি। আমার সঙ্গে শৈলজানন্দ আর অচিন্ত্যকুমারের আলাপ আছে।

ওঁরাও একসময় তরুণ ছিলেন এবং তরুণ বয়েস থেকেই বিখ্যাত। আর আমার বয়েসটাও কম নয়।

হিরন্ময় বসু মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, গৌতমও এক সময় কিন্তু লিখত-টিখত।

গৌতম অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে বলল, না না, সে কিছু নয়।

মানবেন্দ্র একটু অবাক হলেন। গৌতম অত্যন্ত সুশ্রী যুবা পুরুষ। চওড়া কাঁধ, টানা টানা চোখ, রঙ অত্যন্ত ফর্সা হলেও বোক বোকা ভাবটি নেই, দাড়ি কামাবার পর গালে নীল রঙের আভা পড়ে। অত্যন্ত ভদ্র। মার্জিত কথা বলার ভঙ্গি। দেখলেই বোঝা যায়, জীবনে খুব সার্থক, ভাল চাকরি কিংবা নিজস্ব ব্যবসা আছে, রূপসী স্ত্রী। এই রকম মানুষ তো সাধারণত সাহিত্য-টাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী হয় না। বাংলা সাহিত্য জিনিসটাই তো এখন মধ্যবিত্তদের ব্যাপার।

অনুরাধা ব্যানার্জি পট থেকে ঢেলে এককাপ চা এগিয়ে দিল মানবেন্দ্রর দিকে। কী সুন্দর পেলব তার আঙুলগুলো। সেই আঙুলে চামচে ধরে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে ক’চামচ চিনি?

সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে মানবেন্দ্র বললেন, পাঁচ চামচ।

কোনও আধুনিক মানুষই চায়ে এক চামচ-দেড় চামচের বেশি চিনি নেয় না। সকলেই স্বাস্থ্যবিধি মানে। অনুরাধা তার নদীর মতো ভুরুদুটি তুলে বলল, পাঁচ?

মানবেন্দ্র আবার বললেন, হ্যাঁ। অনেকেই নিশ্চয়ই আপনাকে বলে যে, আপনার হাতের ছোঁয়াতেই চা মিষ্টি হয়ে যায়? আমি একটা উলটো কথা বললাম।

অন্যরা হাসল। এটা মোটেই উচ্চাঙ্গের রসিকতা নয়। বরং একটু অসমীচীন। কিন্তু মানবেন্দ্র প্রথম থেকেই অনুরাধাকে অপছন্দ করে ফেলেছেন। কারণ তিনি বোধহয় আগেই বুঝে ফেলেছেন যে, অনুরাধাও তাকে পছন্দ করবে না। কী করে এটা বুঝলেন? এক ধরনের পাগলামির যুক্তিবোধ। তিনি সত্যিই সেই অত্যন্ত মিষ্টি বিস্বাদ চা খেতে লাগলেন।

হিরন্ময় বলল, আপনি মানসীর গান শুনবেন? ও খুব ভাল গান করে। ইচ্ছে করলেই রেডিয়োতে গাইতে পারে। কিন্তু ও নিজেই কিছুতেই রাজি হয় না।

মানবেন্দ্র ওই ভিলেজ ইডিয়টির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, আপনার পরিচয়টা কিন্তু এখনও জানা হল না।

অসীম বলল, হিরন্ময় আমাদের বন্ধু, স্টুয়ার্ট অ্যান্ড লয়েডসে আছে, এখন ব্যাচিলার।

এই সব আলোচনার থেকে গান ভাল। মানবেন্দ্র মানসীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি একটা গান করুন।

গৌতম সমর্থন করল তাকে। এবং আরও বলল, মানসীর একটা গুণ আছে, ওকে বেশি অনুরোধ করতে হয় না। কখনও বলে না, সঙ্গে বই নেই কিংবা গলা খারাপ।

মানসী তাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল, থাক হয়েছে! কী গান গাইব?

 গৌতম বলল, যেটা খুশি।

মানসী এবার মানবেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার সামনে গান গাইতে কিন্তু আমার লজ্জা করছে।

এই প্রথম তার মানবেন্দ্রর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। মেয়েটি খুব স্বাভাবিক গলায় স্পষ্টভাবে কথা বলে। কিন্তু একটু কম কথা বলে মনে হয়।

মানবেন্দ্র বুঝতে পারলেন, তিনি এদের মাঝখানে লেখক সেজে একটু ভারিক্কিভাবে বসে আছেন। এঁরা তাকে বিশেষ অতিথির সম্মান দিচ্ছে। তিনি এই সম্মানের যোগ্য নন। এরা তো জানে না, তিনি কত জায়গায় কত রকম অপমান সহ্য করেন, এখনও।

অনেকের কাছেই এক জন সাহিত্যিকের কোনও দাম নেই। যারা সুখী সুখী জীবন কাটায়, বেশি বই-টই পড়ে না, তাদের কাছে এক জন লেখক মানে এমন আর কী! তারা অনেক গল্প-উপন্যাস পড়ে লেখকের নামটাও মনে রাখে না। মানসী যে বলল, আপনার সামনে– তার মানে ঠিক কী? মানসী তাকে চেনে?

মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

মানসী বলল, আমি তো ঠিক গান শিখিনি। এমনিই ইচ্ছে হলে…আপনার ভাল লাগবে কি না।

মানবেন্দ্র বললেন, একটু আগে বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে আপনার গান শুনছিলাম। আর একটা গান করুন।

মানসী ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ চিন্তা করল। গুন গুন করল একটা সুর। তারপর ধরল —

কেন যে মন ভোলে আমার মন জানে না।
তারে মানা করে কে, আমার মন মানে না। …

গানটি শেষ করতে সময় লাগল মিনিট পাঁচেক। মানবেন্দ্র একেবারে গুম হয়ে বসে রইলেন। গানটা তাকে অসম্ভব স্পর্শ করেছে। যেন এটা তার নিজেরই কথা। এক জন পাগলের কথা। কেউ বোঝে না তারে, সে যে বোঝে না আপনারে-এ-রকমভাবে আগে ভেবে দেখেননি। আগাগোড়া এত সরল ভাষা, কিন্তু একটা তুলনাহীন লিরিক। তারে মানা করে কে–এখানে মানা শব্দটা কী চমৎকার নতুন বিশ্বাসই করা যায় না, ‘উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া’ যাঁর লেখা, তিনিই এটা লিখেছেন।

গান শেষ হবার পরও মানবেন্দ্র একটুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। তারপর সচকিত হয়ে উঠলেন। একটা কিছু বলা দরকার। গান নয়, গানের কথাগুলোই তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে।

তিনি মুখ তুলে মানসীকে বললেন, গানটা নতুন ভাবে শুনলাম।

এ-সব গান কি কখনও পুরনো হয়? এই ধরনের আজেবাজে কথা বলতে শুরু করল হিরন্ময়। মানবেন্দ্র সে-দিকে মনোযোগ দিলেন না। তিনি দেখলে লাগলেন মানসীকে।

মানসী সোজা চেয়ে আছে মানবেন্দ্রর দিকে। কী অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। যেন সে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু মানবেন্দ্র সব সময় চোখের ভাষা পড়তে পারেন না। তিনি বোঝেন স্পর্শের ভাষা। তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন, আবার তাকালেন। তখনও মানসী চেয়ে আছে, কিছু বলতে চাইছে। মানবেন্দ্রর ভেতরের পাগলামিটা হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার দুর্দান্ত ইচ্ছে জাগল হাতখানা বাড়িয়ে মানসীর থুতনিটা একটু ছুঁয়ে দেবার। তিনি নিজেকে দমন করতে পারছেন না। হাতটা নিশপিশ করছে। ওকে একবার ছুঁতেই হবে। আর কিছু না, শুধু একটা ছোঁয়া। যেন ওকে একবার ছুঁয়ে দিলেই বোঝা যাবে, ও কী বলতে চাইছে। মানসী বেশ খানিকটা দূরে বসে আছে। অত দূর হাত পৌঁছবে না।

মানবেন্দ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

গৌতম জিজ্ঞেস করল, এ কী, আপনি যাচ্ছেন!

 মানবেন্দ্র কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন মানসীর দিকে।

মানসী বলল, বসুন!

যেন একটা হুকুম। মানসীর ওই কথাতেই মানবেন্দ্রর ঘোর কেটে গেল। তিনি কী করতে যাচ্ছিলেন। এত লোকজনের সামনে– মানসী কি বুঝতে পেরেছে তার উদ্দেশ্য? নইলে কেন শুধু বলল, বসুন। ঠিক হুকুমের সুর। যেন সিংহকে পোষ মানাবার অভ্যেস আছে ওর! স্বাভাবিক ভাবে কি ওর বলা উচিত ছিল না, আপনি আর একটু বসুন!

মানবেন্দ্ৰ গৌতমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি একটা চুরুট আনতে যাচ্ছিলাম। ঘরে ফেলে এসেছি।

অসীম তক্ষুনি তার সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সিগারেট নিন না! আপনার সিগারেট চলে না?

মানবেন্দ্র সিগারেট নিয়ে ধরালেন। প্রথম ধোঁয়া টেনেই ভারি ভাল লাগল। প্রায় চার-পাঁচ মাস বাদে তিনি আবার সিগারেট টানছেন। যেন হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে নতুন চুম্বন।

কিন্তু মানবেন্দ্র লক্ষ্য করলেন, তার হাত কাঁপছে। বেশ চোখে পড়ার মতো কাঁপুনি। এ-রকম তো আগে কখনও হয়নি। অন্যরা যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেই জন্য তিনি হাতটা রাখলেন ঊরুর ওপরে। তার পর টের পেলেন, তার বুকের মধ্যেও দুপ দুপ শব্দ হচ্ছে বেশ জোরে। এই শব্দ অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছে না তো?

গৌতম জিজ্ঞেস করল, আপনি যে এখানে একটা ঝরনার কথা বলছিলেন।

প্রশ্নটা শুনে মানবেন্দ্র এমন ভাবে তাকালেন যেন একটা নতুন কথা শুনলেন। ঝরনা? এখানে আবার ঝরনা কোথায়?

গৌতম আবার বলল, আপনিই তো একটা ঝরনার কথা বলেছিলেন।

ততক্ষণে মানবেন্দ্র খানিকটা কৃত্রিম উৎসাহের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, সেটা দেখে যাবেন, যদি পারেন। এমন কিছু নয়, কিন্তু জায়গাটা খুব নির্জন, খানিকটা জঙ্গল মতো।

কত দূরে?

মাইল তিনেক।

ঝরনাটার কথা তো এখানে আর কেউ বলেনি।

 আমি হাঁটতে হাঁটতে এক দিন গিয়েছিলাম। হাঁটা-পথ ছাড়া আর কোনও পথও নেই অবশ্য।

আমরা তো পরশু সকালেই চলে যাব ঠিক করেছি, তাহলে কালই দেখে ফেলতে হয়।

 সব মিলিয়ে ঘণ্টা দু-এক লাগবে।

 হিরন্ময় মাঝখান থেকে বলল, আপনি কি এখানে কিছু লেখবার জন্য এসেছেন?

 মানবেন্দ্র সংক্ষিপ্ত ভাবে উত্তর দিলেন, না।

আপনি এখানে নতুন কী লিখছেন?

কিছুনা।

হিরন্ময় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, গৌতম তাকে বাধা দিয়ে মানবেন্দ্রকে বলল, আপনি বোধহয় নিজের লেখা সম্পর্কে কোনও রকম আলোচনা করতে চান না, তাই না? অনেক সহিত্যিক চায় না, আমি জানি।

এই কথারও উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই, এইভাবে মানবেন্দ্র ঈষৎ স্মিত মুখে চুপ করে বসে রইলেন।

অনুরাধা বলল, রাইটাররা কী করে এত সব বানান বুঝতে পারি না। আচ্ছা, সবই কি বানানো না কিছুটা সত্যি থাকে?

মানবেন্দ্র মুখের হাসিটা একটু চওড়া করে বললেন, সবই সত্যি। একটুও বানানো নয়।

 আপনারা যা লেখেন সবই সত্যি?

 হ্যাঁ।

অনুরাধার মুখখানি এই কথার পর একটু ম্লান হয়ে গেল। যেন সে বুঝতে পেরেছে মানবেন্দ্র তার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। তার কথার কোনওই গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

মানবেন্দ্র সেটা লক্ষ্য করে এবার একটু বেশি উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আপনি বিশ্বাস করলেন না? পৃথিবীতে যা আছে, তা ছাড়া মানুষ আর কিছুই কল্পনা করতে পারে না। এমন কী মানুষ যে মিথ্যে কথা বলে, কোথাও না কোথাও সেগুলোও সত্যি।

অনুরাধা বলল, আপনি আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে পারেন?

 মানবেন্দ্র বললেন, যদি আর্টিস্ট হতাম, অর্থাৎ পেইন্টার, তা হলে এক্ষুনি বলতাম, পারি। লেখকদের পক্ষে চট করে বলা শক্ত।

কেন?

এক জন ডাক্তার অপারেশান টেবিলে তার পেসেন্টকে যেমন ভাবে জানে, এক জন লেখককে তার চেয়েও বেশি জানতে হয় তার পাত্র-পাত্রীদের।

বাবাঃ, আপনি এমন ভাবে বললেন, যেন আমি ভাবলাম, আমি সত্যিই একটা অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছি। ভাবলেই ভয় করে!

মানবেন্দ্র সিগারেটে আর একটা দীর্ঘ টান দিয়ে বললেন, তাছাড়া, জানেন তো, অবৈধ প্রেম ছাড়া গল্প হয় না! বেশ সুখী বিবাহিত জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত সার্থক কিছু লেখা হয়নি।

অনুরাধা একবার চট করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলল, কী করে জানলেন, আমার সেরকম কিছু প্রেম-টেম নেই? বিয়ে করলেই কি সব শেষ হয়ে যায়।

সিনেমার নায়িকা হিসেবে কিন্তু আপনাকে খুব ভাল মানাত!

তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে হিরন্ময় বলল, অনুরাধাকে তো সত্যজিৎবাবু একবার পছন্দ করেছিলেন ওঁর একটা ছবির জন্য। কিন্তু অনুরাধার মা-বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না।

হিরন্ময়কে তার বন্ধুপত্নীদের জন্য বেশ গর্বিত দেখা যায়। এক জন ইচ্ছে করলেই রেডিয়োতে গান গাইতে পারত, গায় না। এক জন সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সুযোগ পেয়েও নেয়নি। এই রকম গুণান্বিতা তৃতীয় কোনও মেয়ে পাচ্ছে না বলেই বোধহয় সে নিজে বিয়ে করতে পারছে না।

মানবেন্দ্র তাকালেন মানসীর দিকে। যদিও সে প্রায় কোনও কথাই বলছে না। অথচ তার দৃষ্টিতে মনে হয়, সেই সব চেয়ে বেশি কথা বলছে। মানবেন্দ্র চোখের ভাষা বোঝেন না।

বাচ্চারা খেলা করছে অদূরের বারান্দায়। মাঝে মাঝে তাদের চ্যাঁচামেচি ও ঝগড়ার আওয়াজ শোনা যায়। এই দুই রমণীর মধ্যে কার দুটি বাচ্চা, কার একটি? এদের দেখলে কিন্তু বোঝা যায় না এরা জননী। শুধু নারী হয়ে বসে আছে এখন।

গৌতম মানসীকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আর একটা গান গাইবে?

 মানসী বলল, না, আজ থাক।

 অনুরাধা বলল, আর একটা গান কর না, ও তোর গান শুনতে এত ভালোবাসে।

মানবেন্দ্র একটু চমকে তাকালেন।

মানসী বলল, আমি তো সব সময়েই গান করছি।

অনুরাধা মানবেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি একদম গান জানি না।

 অসীম বলল, কিন্তু অনুরাধা, তোমারও সেতারে ভাল হাত ছিল, চর্চাই করলে না।

 হিরন্ময় সেই সঙ্গে যোগ করল, নিখিল ব্যানার্জির ছাত্রী ছিল।

মানবেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন তিনি এখান থেকে উঠে পড়লে কিছুই অভদ্রতা হবে না। কিন্তু কেউ যেন তাকে পেরেক দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে। তিনি বার বার তাকাতে লাগলেন গৌতমের দিকে। এত সুন্দর যুবাপুরুষটি যে-কোনও কারণেই হোক তার স্ত্রীকে খুব ভয় পায়। সে আড়ষ্ট হয়ে আছে। অসীমের ব্যবহার সহজ ও স্বাভাবিক।

আড্ডা ভাঙল রাত নটায়। মানসীই প্রথম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই, বোধহয় বাচ্চাদের খিদে পেয়েছে।

মানসী আর একবার তাকাল মানবেন্দ্রর দিকে। কোনও বিদায়-বাক্য উচ্চারণ করল না।

একটু বাদেই সবাই উঠল। মানবেন্দ্র তার পরেও অনেকক্ষণ বসে রইলেন সেখানে। অন্যরা খাবার ঘরে গেল, বেয়ারা ডাকতে এল তাকে খেয়ে যাবার জন্য। তিনি ফিরিয়ে দিলেন। চুপ করে বসে থেকে তিনি যেন কোনও কিছুর প্রতীক্ষা করছেন। তারপর, সকলেই যখন যে-যার ঘরে চলে গেল খাওয়া দাওয়া সেরে, তখন মানবেন্দ্র চলে এলেন নিজের ঘরে। বেয়ারাকে ডেকে বললেন ঘরেই খাবার দিতে। তারপর বই খুলে গভীর মনোযোগে ডুব দিলেন।

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ মানবেন্দ্র বইটা মুড়ে রেখে এসে দাঁড়ালেন ঘরের দরজার কাছে। এর মধ্যেই অন্য সব ঘরে আলো নিভে গেছে, টুরিস্ট লজটা একেবারে নিস্তব্ধ।

বাগানে চেয়ারগুলো এখনও ঠিক সেইভাবে পাতা রয়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে মানবেন্দ্রর একবার সামান্য দৃষ্টিবিভ্রম হল। তিনি দেখলেন, চেয়ারগুলো যেন ভর্তি, যে যেখানে ছিল, সে সেখানেই বসে আছে। এমনকী নিজেকেও দেখতে পেলেন সেখানে।

আকাশে ফট ফট করছে জ্যোৎস্না। কী নিথর, সুন্দর এই রাত্রি। এখানকার রাত্রির আকাশে সব তারাই খুব স্পষ্ট। মানবেন্দ্র দেখতে পেলেন কালপুরুষকে, কোমরবন্ধে তলোয়ার এঁটে যেন পাহারা দিচ্ছেন এই গ্রহটিকে।

সে-দিকে তাকিয়ে মানবেন্দ্র অস্ফুট ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমার আয়ু আর কত দিন?

 কালপুরুষ বললেন, আরও অনেক দিন। এখনও তো জীবনের অর্ধেকও কাটেনি।

মানবেন্দ্র বললেন, কেন? একথা বলার পর আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে মানবেন্দ্র নিজেকে প্রশ্ন করলেন, আমি কি বেশি দিন বাঁচতে চাই না? নিশ্চিয়ই চাই। সব মানুষই চায়। তবু কেন যেন মনে হচ্ছে আর বেশি দিন আয়ু নেই। পাগল হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভাল।

পায়ের শব্দ না করে মানবেন্দ্র হেঁটে এলেন বাগানে। যে-চেয়ারটাতে তিনি বসেছিলেন, সেই চেয়ারটাতেই বসলেন। তারপর প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। মানসী আসবে।

মানসী শুয়ে আছে নিজের বিছানায়। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বামীকে ঘুম পাড়াতে তার কতটা সময় লাগবে, কে জানে! যত সময়ই লাগুক, মানবেন্দ্র অপেক্ষা করবেন। মানসীর নিশ্চয়ই এক সময় মনে পড়ে যাবে, মানবেন্দ্রকে সে কোনও কথাই বলেনি। এমনকী, বিদায় নিয়েও যায়নি। মানসী একবার শুধু তাকে হুকুম করেছিল, বসুন। তারপরে তো আর বলেনি, আমি যাচ্ছি, আর আপনার বসে না থাকলেও চলবে!

বিরাট লম্বা লম্বা এক একটা মিনিট কাটতে লাগল। মানবেন্দ্র পায়ের ওপর পা তুলে চুপ করে বসে আছেন। শীত পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। খোলা মাঠে হিম পড়ছে মাথায়। মানবেন্দ্রর ভ্রূক্ষেপ নেই।

কতক্ষণ কাটল কে জানে। শীতে হাত-পায়ে খিল ধরে যাচ্ছে। তাছাড়া আছে মশা। মানসী আসবে। মানসীর কিছু বলার আছে। তাছাড়া মানসীকে জিজ্ঞেস করতেই হবে, ওকে দেখে কেন আমার বুক কাপল, এখনও কাঁপছে। এটা একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। অনেক দিন তো এরকম হয়নি।

এক সময় মানবেন্দ্রকে উঠে পড়তেই হল। তবু তিনি খুব সতর্ক ভাবে পায়চারি করতে লাগলেন বারান্দায়। হয়তো মনের ভুলে মানসী ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু রাত্তিরে কি তার একবারও ঘুম ভাঙবে না? অনেকের তো ভাঙে। ঘুম ভাঙলেই মানসীর মনে পড়ে যাবে, মানবেন্দ্রকে সে হুকুমের সুরে বলেছিল, বসুন! একথা বলার পর তো কেউ বিদায় না নিয়ে যায় না। মানসী নিশ্চয়ই বাইরে এসে দেখবে, লোকটা এখনও বসে আছে কিনা। যদি মানসী একবার দরজা খুলে বাইরে বেরোয়, মানবেন্দ্র তার সামনে গিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলবেন, চুপ!

কোনও ঘরের দরজা খুলল না। মানবেন্দ্র দেখে রেখেছেন, কোনটা মানসীর ঘর। একসময় তিনি নিঃশব্দে সেই ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। চোরের মতো দরজায় কান লাগিয়ে শুনবার চেষ্টা করলেন, ভেতরে নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায় কিনা! মানসী কী ভঙ্গিতে শুয়ে আছে? পাশ ফিরে? সে কি রাত্রে শাড়ি ছেড়ে পোশাক পরে?

ডাইনিং হলের দিকে কীসের যেন একটা শব্দ হল। মানবেন্দ্র দারুণ চমকে উঠলেন। এখানকার বেয়ারারা কেউ জেগে উঠতে পারে, এ-দিকে আসতে পারে। গেটে দারোয়ান আছে। এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

মানবেন্দ্র ফিরে এলেন নিজের ঘরে। দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে মানবেন্দ্রর খেয়াল হল, মানসী যদি আসে, যদি দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যায়? তা তো হতেই পারে না। তিনি দরজাটা আধখানা ভেজিয়ে রাখলেন। তারপর একটা চেয়ার টেনে বাগানের দিকে জানলাটার কাছে বসে রইলেন। এখান থেকে চেয়ারগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মানসী যেই এসে চেয়ারে বসবে, অমনি তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে সেখানে যাবেন। কিংবা ওখানে মানসী তাকে দেখতে না পেলে আসবে এই ঘরের দিকে।

ধ্যানে ঈশ্বরকে ডাকার মতো মানবেন্দ্র চোখ বুজে তীব্র ইচ্ছার তরঙ্গ পাঠিয়ে দিয়ে মনে মনে বলতে লাগলেন, মানসী, তোমার ঘুম ভেঙে যাক। মানসী, তুমি জেগে ওঠো, তুমি আমার কাছে চলে এস!

মানবেন্দ্র যখন শেষ আশা ছাড়লেন, তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। তার মুখখানা দারুণ বিমর্ষ হয়ে গেল। এ কী এক অসম্ভব চিন্তায় তিনি নিজেকে এতক্ষণ কষ্ট দিচ্ছিলেন। মানসীর সঙ্গে তাঁর আজই আলাপ হয়েছে, কথা হয়েছে মাত্র দুতিনটে, সাধারণ কথা। সেই মেয়েটি কেন রাত্রে তার স্বামীর পাশ থেকে উঠে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে? এ কখনও হয়? ভুল ধারণা! শীতের মধ্যে এতটা রাত জেগে যে তিনি বসে রইলেন, এটা কি নিছক পাগলামি নয়? নিজের কাছে তিনি আবার হেরে যাচ্ছেন।

মানবেন্দ্র একটা কাচের গেলাস তুলে ছুঁড়ে মারলেন মেঝেতে। ঝন ঝন শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে অনেক বেশি তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। তবু সেই শব্দেও কারুর ঘুম ভাঙল না।

কিন্তু মানবেন্দ্র ধাতস্থ হলেন।

মাথা ঠাণ্ডা করে তিনি ভাবলেন, একটা কাচের গেলাস ভাঙা কিছুই নয়। মানুষ শখ করেও ভাঙতে পারে। আমি এ-রকম আগেও ভেঙেছি। শব্দটা আমার ভাল লাগে। একে পাগলামি বলে না।

টেবিলের ড্রয়ার খুলে তিনি ঘুমের ওষুধের শিশিটা বার করলেন। এর গোটা চল্লিশ-পঞ্চাশেক খেলেই সব ঠিক হয়ে যায়। তার কাছে বিরানব্বইটা আছে। ইচ্ছে করেই এতগুলো এই ওষুধ কাছে রেখেছেন। এর থেকে একটা দুটোর বেশি কখনও যে খেতে ইচ্ছে করে না, এটাই তো তার স্বাভাবিকতা। বেঁচে থাকার ইচ্ছের মতো স্বাভাবিক আর কী!

দুটো ট্যাবলেট খেয়ে মানবেন্দ্র আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।

.

০৪.

পরদিন ঘুম ভাঙার পরই মানবেন্দ্র ঠিক করেছিলেন, ওই দলটা টুরিস্ট লজ ছেড়ে যাবার আগে তিনি আর ঘর থেকেই বেরুবেন না। একদিন দেড় দিন ঘরের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়া তার পক্ষে কিছুই না। ওদের সঙ্গে আর দেখা করতে চান না তিনি। জীবনে আর জটিলতা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওরা যদি তাঁর কাছে বিদায় নিতে আসে, তিনি এখান থেকে শুকনো ভদ্রতা সেরে দেবেন।

ঘরে বসেই ব্রেকফার্স্ট খেয়ে তিনি আবার বই খুলে বসলেন। টিকটিকিগুলো কিংবা মথটার কথা তিনি ভুলেই গেছেন।

একটু পরে একটা শব্দে তিনি বই থেকে চোখ তুলে তাকালেন। একটি বাচ্চা মেয়ে তার দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

মানবেন্দ্র মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। মেয়েটিও কিছু বলল না। বাচ্চারা এই রকম হয়, অনেক সময় মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, কোনও কথা বলে না। মানবেন্দ্রও ছোটদের সঙ্গে একেবারেই ভাব জমাতে পারেন না।

মেয়েটি মিনিট দুএক ও-রকম ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি বুঝি এ ঘরে থাক?

হ্যাঁ।

এটা তোমার বাড়ি?

না, এটা তো গভর্নমেন্টের বাড়ি।

মেয়েটি ঘরের মধ্যে এগিয়ে এল কয়েক পা। বছর পাঁচেক বয়েস। বেশ ফর্সা রঙ, সম্ভবত গৌতম-অনুরাধারই মেয়ে হবে। টেবিলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, তোমার ওই বইটাতে ছবি আছে?

না তো।

তোমার কাছে কোনও ছবির বই নেই?

উঁহু।

আমার অনেক ছবির বই আছে, কিন্তু সেগুলো আনিনি। কলকাতায় ফেলে এসেছি। তুমি ছবি আঁকতে পারো না?

 হ্যাঁ। আমি অনেক ছবি এঁকেছি।

আমার কাছে সাদা কাগজ আছে, কলম আছে, তুমি ছবি আঁকবে?

তোমার লাল-নীল পেনসিল নেই?

বাইরে থেকে কার গলা শোনা গেল, রিনি! রিনি!

বাচ্চা মেয়েটি হেসে বলল, আমার নাম রিনি।

 মানবেন্দ্র এবার হেসে বললেন, ও তাই বুঝি! আমার নাম মানবেন্দ্র। নমস্কার রিনি দেবী।

দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে মানসী। জিজ্ঞেস করল, আপনাকে বিরক্ত করছে বুঝি?

না, না।

রিনি, কেন এখানে এসেছ?

রিনি সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি কিন্তু কোনও জিনিসে হাত দিইনি। তারপর সে এক ছুটে মায়ের পাশ দিয়ে বাইরে চলে গেল।

মানসী একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দরজার কাছে। রহস্যময় গভীর দৃষ্টি। মানবেন্দ্রর মনে হল, মানসীর দৃষ্টির রঙ গাঢ় নীল।

তিনি মানসীকে ঘরের ভেতরে এসে বসার জন্য অনুরোধ করলেন না। তিনিও মানসীর চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন।

মানসী নিজে থেকেই ঘরের মধ্যে এক পা এগিয়ে এসে বলল, বাঃ, কী সুন্দর প্রজাপতিটা!

মথটা তখনও দেয়ালে তার রূপ মেলে দিয়ে বসে আছে। ও এখনও বেঁচে আছে, এটা সত্যিই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।

মানসী বলল, এত বড় প্রজাপতি আগে কখনও দেখিনি।

প্রজাপতি নয়, মথ। একরঙা, ডানাগুলো একটু মোটা।

 ও হ্যাঁ। ওগুলো তো রাত্তিরে আসে।

ও নিজে নিজেই আমার ঘরে এসেছে পরশু রাত্তিরবেলা।

মানসী আরও এগিয়ে দেয়ালের কাছে এসে মথটাকে দেখতে লাগল। কোনও রকম আড়ষ্টতা নেই তার মধ্যে। সে নিজে থেকেই কথা বলছে।

মানবেন্দ্রর মনে মনে হাসি পেল। কাল প্রায় সারা রাত তিনি মানসীর জন্য অপেক্ষা করে জেগে বসে ছিলেন। মানসী সেকথা কোনও দিন জানতে পারবে না। ওকে বললেও বিশ্বাস করবে না। আজ সকালে মানসী নিজের থেকেই এসেছে। এখন দিনের আলো, এখন সব কিছু অন্য রকম। মানসী তো মথ নয়, প্রজাপতি, তাই ও রাত্রে আসেনি।

মুখ ফিরিয়ে আচম্বিতে মানসী বলল, আমি আপনাকে অন্য রকম ভেবেছিলাম।

তার মানে?

যে-মানবেন্দ্র মজুমদারকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি, তাকে আমি অন্য রকম ভেবেছিলাম।

আমাকে আপনি…চেনেন?

চিনি না? বাঃ।

ও। অন্য রকম মানে কী-রকম ভেবেছিলেন? গল্পের নায়কের চেহারা আর লেখকের চেহারা কখনও এক রকম হয় না।

আমি চেহারার কথা বলছি না। চেহারায় কী আসে যায়। পুরুষরা যত চেহারা নিয়ে মাথা ঘামায়, মেয়েরা কিন্তু ততটা নয়।

আমার অভিজ্ঞতা অন্য রকম।

আপনার কি সবকিছু সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আছে?

না, তা নেই। সে-রকম দাবি করতে পারি না।

আপনি যে এত গম্ভীর তা ভাবিনি।

আমি গম্ভীর? না তো! এক এক সময় আমি খুবই বক বক করি। তবে সব সময় কথা বলতে ভালো লাগে না, তা-ও ঠিক। কিন্তু আপনিই তো কাল প্রায় সব সময় চুপ করে ছিলেন।

আমি তো গান গাইলাম।

গান তো কথা নয়।

আপনার ওপর আমার খুব রাগ আছে। কখনও দেখা হলে বলব ভেবেছিলাম।

আমি তাহলে ঠিকই বুঝেছিলাম, আপনি আমাকে কিছু বলতে চান। বিশ্বাস করুন, কাল সন্ধেবেলাই আপনার চোখ দেখে মনে হয়েছিল আমাকে কিছু বলবেন। আলাদা ভাবে। তাহলে আমি ভুল করিনি।

আপনি অতীনকে মেরে ফেললেন কেন?

মানবেন্দ্রর চোখে-মুখে একটা উৎসাহের দীপ্তি এসেছিল, হঠাৎ আবার সেটা নিভে গেল। তিনি নিরাশভাবে বললেন, ও, এই কথা!

হঠাৎ ওকে মেরে ফেলেই বইটা শেষ করে দিলেন।

গল্পের নায়করা তো কোনও এক সময় মরবেই।

ও কি শুধু গল্পের নায়ক? আমাদের কাছে সত্যি হয়ে উঠেছিল, ও তো অনেক আগেই মরতে পারত, বিপ্লবের সময় কিংবা জেলখানায়। শেষ পর্যন্ত ওকে দীপ্তিদির কাছে ফিরিয়ে এনে তারপর হঠাৎ।

আপনি একটু বসবেন?

 আমরা সবাই এক্ষুনি বেরুচ্ছি।

তবু দুএক মিনিট।

না, ওরা আমাকে খোঁজাখুঁজি করবে।

 মানবেন্দ্র দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে মানসীর একটা হাত ধরে কাতর ভাবে বললেন, তুমি একটু বসো!

মানসী একটুও চমকাল না। মানবেন্দ্রর হাতের দিকে একবার তাকাল, তারপর নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে বসে পড়ে বলল, আপনার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেও আমার ভাল লাগবে। কিন্তু আপনার তো অত সময় নেই।

আমার অফুরন্ত সময়।

কিন্তু আমি যে আগে সকলের মুখে শুনেছি, আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ।

তার মানে, আমার কথা কে বলেছে তোমাকে?

মানসীকে আপনি থেকে হঠাৎ তুমি সম্বোধন করার জন্য মানবেন্দ্র কোনও কৈফিয়ত দিলেন না। এইটাই যেন খুব স্বাভাবিক। যদিও মানবেন্দ্র অচেনা নারীদের কক্ষনও তুমি সম্বোধন করেন না।

আপনাকে অনেকে চেনে। তার মধ্যে দুএক জনকে আমি চিনি। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল আপনার সঙ্গে দেখা করার। অনেক দিন থেকে।

মানবেন্দ্র দুঃখিত ভাবে বললেন, কেন দেখা করোনি?

ইচ্ছে থাকলেই কি সব কিছু করা যায়। তাছাড়া, আপনার মতো ব্যস্ত লোকের সঙ্গে দেখা করা, যদি বলতেন…।

সেই সব ব্যস্ততা এখন ফুরিয়ে গেছে।

আমিও দেরি করে ফেলেছি।

মানসী এই কথাটা বলল মুখ নিচু করে, খুব আস্তে। মানবেন্দ্র ভাল করে শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, কী?

মানসী বলল, না, কিছু না।

মানসী আবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অন্য কারুর সঙ্গে আলাপ করতে অনেক দেরি লাগে। কিন্তু আপনাকে আমি মনে মনে অনেক দিন থেকেই চিনি।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমিও তোমাকে অনেক দিন থেকে চিনি।

না, সেটা ঠিক নয়।

 মানসী এগিয়ে গেল দরজার কাছে, সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি কাল অনুরাধাকে ও-রকম মনে আঘাত দিয়ে কথা না বললেই পারতেন।

মনে আঘাত দিয়েছি?

হ্যাঁ দিয়েছেন। ও যখন বলল ওকে নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা…।

কারুকে একবার দেখলেই কি গল্প লেখা যায়।

আপনার সব নায়িকাই তো ওই রকম সুন্দর হয়।

আমার মনে হয়, তুমি– ।

অনুরাধা সত্যিই চায়, ওকে নিয়ে কেউ…।

আমার মনে হয়, তুমি…।

 আপনি আমাকে তুমির বদলে আপনি বললেই ভাল করতেন। সেটাই ভাল দেখায়।

আমি কাল সন্ধে থেকেই মনে মনে তোমাকে তুমি বলে ফেলেছি, সেটা এখন আর ফেরানো যায় না।

মানসী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে একটু হাসল। সেই হাসিতে ভরে গেল সম্পূর্ণ ঘরটা। হাসির সময় মানসীর মুখটা সম্পূর্ণ অন্য রকম দেখায়। মনে হয়, এ পৃথিবীর মানুষই নয়। অন্য কোনও গ্রহ থেকে কিছু দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে।

মানসী বলল, সব লেখকই বুঝি এ-রকম পাগল হয়?

মানবেন্দ্র বলতে গেলেন, অন্যদের কথা জানি না। কিন্তু তিনি আর মানসীকে দেখতে পেলেন না। হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে যাবার মতো মানসী চকিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।

মানবেন্দ্রই উঠে এলেন দরজার কাছে। কিন্তু সংকল্পটা রক্ষা করলেন, ঘর থেকে বেরুলেন না।

মানবেন্দ্র ডান হাতখানা মেলে সে-দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই হাত দিয়ে তিনি মানসীর হাত ছুঁয়েছিলেন। কোনও রকম আপত্তি তো ও করেনি। একটুখানি ছুঁয়েই অনেক কিছু পাওয়া যায়।

ঘরে যেন একটা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। হয়তো মানসী কোনও দুর্লভ পারফিউম মেখে এসেছিল। কিন্তু সে যতক্ষণ ঘরে ছিল, ততক্ষণ তো এই গন্ধটা পাওয়া যায়নি।

তিনি চলে এলেন মাঠের দিকের জানলার কাছে। অনেকখানি বিস্তৃত প্রান্তর ও তার মাথার ওপর সমান্তরাল আকাশের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে মনটাও একটু বড় হয়ে যায় মনে হয়। আজ বেশ জোরে হাওয়া বইছে। একজন লোক একা একা হেঁটে যাচ্ছে মাঠের মধ্য দিয়ে। কাঁধে একটা ঝোলা। লোকটি যেন দিগন্তেরও ও-পার পর্যন্ত হেঁটে যাবে। এই সব লোক দেখলেই পথিক কথাটা মনে পড়ে।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরই মানবেন্দ্র দেখতে পেলেন, গৌতমদের গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে। সামনের সিটে পুরুষ তিন জন, পেছনে মেয়েরা ও বাচ্চারা। মোটর গাড়ির যাত্রী ও যাত্রিণীদের জন্য পথিক-এর মতো এমন সুন্দর কোনও শব্দ এখনও তৈরি হয়নি।

সেদিক থেকে চোখে ফেরাতেই তিনি দেখতে পেলেন জানলার ঠিক নিচের চন্দ্রমল্লিকা ফুলটিকে। ফুলটা আজ বেশ যুবতী হয়েছে। হাওয়ায় দোলাচ্ছে মাথা।

মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?

 ফুলটি মাথা দোলাতে দোলাতে উত্তর দিল, আমি সব দেখছি! আমি সব দেখছি।

ও, তুমি সব দেখছ? আমার এই শুকনো ঘরে আজ একটি মেয়ে এসেছিল, তুমি দেখেছ?

তিনি ফুলটির ওপর আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে আবার বললেন, আচ্ছা বলো তো ফুলকুমারী, ফুলেরও কি হিংসে থাকে? তুমি না বলছ? আমি বিশ্বাস করি না। হ্যাঁ থাকে, আমি জানি।

ফুলটার ওপর হাত রেখে আঙুলে একটা সুন্দর অনুভূতি হল। মানবেন্দ্র ভাবলেন, নারীর থেকে ফুলও কম সুন্দর নয়।

জানলার কাছ থেকে সরে এসে তিনি তিলককামোদের একটা সুর ধরলেন। মাথার ওপর হাত তুলে ব্যায়ামের ভঙ্গি করলেন খানিকক্ষণ। তারপর বেয়ারাকে ডেকে সিগারেট আনতে দিলেন এক প্যাকেট। মনটা খুব খুশি লাগছে। আজ চুরুটের বদলে সিগারেটই খেতে হবে।

মনটা খুশি খুশি লাগছে কেন? একটি মেয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেছেন, সেই জন্য? নারী-সঙ্গ পাওয়ার জন্য তার মনটা সব সময় উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু নিজেকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করার জন্য, কষ্ট দেবার জন্যই তো তিনি এখানে এসেছেন?

তাছাড়া যে-কোনও নারীই এখন তাকে আর আকর্ষণ করে না। এক সময় ছিল, যখন অন্ধের মতো নারীদের শরীরে এমন কিছু খুঁজে বেড়াতেন যা কখনও পাওয়া যায় না। এখন সেই ভুল ভেঙেছে। এক সময় তার রূপের প্রতি মোহও ছিল সাঙ্ঘাতিক। চোখ ঠিকরোনো রূপসী নারীদের দেখলেই পতঙ্গের মতো তাদের চারপাশে ঘুর ঘুর করতেন। প্রেমে ব্যর্থ হতে ভারি ভাল লাগত।

এখন সেই মোহ ঘুচেছে। এখন বুঝতে পারেন, সকলেই যাদের রূপসী বলে, তারা আসলে সুন্দর নয়। রূপকে আবিষ্কার করতে হয়। সৌন্দর্য হচ্ছে একটা অভিজ্ঞতা। অন্য সবকিছুর থেকে আলাদা হওয়াই সৌন্দর্যের একটা বড় শর্ত। ফুল প্রকৃতপক্ষে সুন্দর নয়, কারণ, এক জাতের ফুল সব এক রকম। ফুল সেই রকমই সুন্দর যেমন বাঘ সুন্দর, জেপ প্লেন সুন্দর, গোরুর চোখ সুন্দর, বৃষ্টির পর আকাশ সুন্দর, কিংবা একটা স্বাস্থ্যবান আপেল কিংবা কোকিলের স্বর। নারীর সঙ্গে এসব কিছুরই তুলনাই হয় না। অনুরাধাকে সকলেই সুন্দরী বলবে, কিন্তু মানবেন্দ্র প্রথমেই মুগ্ধ হয়েছিলেন মানসীকে দেখে। মানসীকে দেখে চেনা মনে হয়েছিল। অন্য কারুর মতো দেখতে নয়, মানবেন্দ্রও আগে কখনও ওকে দেখেননি, তবু চেনা। এই অনুভূতির ব্যাখ্যা তিনি করবেন কী করে?

এ বিষয়ে মানবেন্দ্রর কোনও সন্দেহও রইল না যে, মানসী তার জন্যই ঠিক এই সময়ে এসেছে এই বাংলোতে বেড়াতে। পৃথিবীতে কোথাও একটা কার্যকারণের হেড অফিস আছে, সেখান থেকে অনেক বাছাবাছি করে শুধু মানসীকেই পাঠানো হয়েছে প্রায়-উন্মাদ লেখকের শুশ্রূষার জন্য।

এ-রকম হয়। অনেক দিন আগে একবার মানবেন্দ্র বদ্ধমাতাল হয়ে মাঝরাত্রির পর ট্যাক্সিতে চেপেছিলেন। এমন বেঘোর অবস্থা যে, চিনতে পারছিলেন না রাস্তা। ট্যাক্সিওয়ালা বহু রাস্তা ঘুরে হয়রান হয়ে পড়ে। মানবেন্দ্র তাকে অনবরত ধমকাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বেহালার সখেরবাজার ছাড়িয়ে একটা ফাঁকা রাস্তায় ট্যাক্সিওয়ালা ও তার সহকারী মানবেন্দ্রকে গাড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দেয় রাস্তায়। দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, তবু মানবেন্দ্র দাড়ি চেপে ধরেছিলেন ড্রাইভারের। তার সহকারী তখন একটা লোহার ডাণ্ডা দিয়ে মারল তার ঘাড়ে। তিনি ঘুরে পড়ে গেলেন, তবু এত বেশি জেদ, ভয় পেলেন না, বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, তোমাদের গাড়ির নম্বর আমি দেখে রেখেছি, তোমাদের সহজে ছাড়ব না। তখন তারা দুজনে মানবেন্দ্রকে একেবারে মেরে ফেলাই মনস্থ করে। মেরেই ফেলত, কিন্তু ঠিক সেই সময় উলটো দিক থেকে আর একটা ট্যাক্সি এসে থামে। সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার কেন যে অকারণে দয়ালু হয়, তার কারণ বোঝা যায় না। সে অন্য দুজনকে নিবৃত্ত করে নিজের ট্যাক্সিতে মানবেন্দ্রকে তুলে নিয়ে যায় এবং হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুইয়ে রাখে। পরে মানবেন্দ্র প্রথম ট্যাক্সির নাম্বার ধরে ড্রাইভারকে ঠিক খুঁজে বার করেছিলেন ঠিকই। ক্ষমা চাইবার জন্য। দুজনেই দুজনের কাছে ক্ষমা চায়।

আর একবার মানবেন্দ্র বিষম দারিদ্রের মধ্যে পড়েছিলেন। তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। কোনও দিক থেকেই কোনও রোজগারের আশা নেই। মাস আষ্টেক আগে রাগারাগি করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আর কিছু জোটাতে পারেননি। প্রকাশকদের কাছেও প্রাপ্য নেই কিছু। অতিরিক্ত আত্মম্ভরিতার জন্য কারুর কাছ থেকে ধার চাইতেও পারেন না। সেই সময় হঠাৎ রাস্তায় একজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা। স্কুল-জীবনের বন্ধু। তারপর বহু বছর দেখা হয়নি, এখন সে একটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে মোটমুটি বড় চাকরি করে। সে বলল, তোকেই আমি খুঁজছিলাম রে, মানবেন্দ্র। তুই তো আজকাল লিখিস-টিখিস, নামটাম হয়েছে, আমাদের কোম্পানির জন্য একটা ছোট বিজ্ঞাপনের ছবির স্ক্রিপ্ট লিখে দিতে পারবি? কাজটা এমন কিছু নয়, হাজার আড়াইয়ের মতো টাকা পাবি।

তখন অন্তত দুহাজার টাকারই বিশেষ দরকার ছিল। এই রকম আরও অনেকবার হয়েছে। তার বিশ্বাস ছিল, সঙ্কটের সময় কেউ না-কেউ এসে যাবে। কিন্তু অসুখের ব্যাপারে তো কেউ এ-রকম সাহায্য করতে পারে না। এখন যেন মনে হচ্ছে, মানসীই এসেছে তাকে বাঁচাতে।

বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মানবেন্দ্র বললেন, মানসীকে আমার চাই। কিন্তু মানসীর স্বামী আছে, সন্তান আছে। চাইলেই-বা তাকে পাওয়া যাবে কী করে? পাওয়া মানে কী-রকম পাওয়া?

মানবেন্দ্র স্নানের জন্য জামা-টামা খুলতে লাগলেন। নিজের শরীরটার দিকে তাকিয়ে মায়া হল। চোখের নিচে গাঢ় কালি পড়েছে। দুচোখের পাশেই কাকের পায়ের ছাপ। মেদ জমেছে গায়ে। দিনের পর দিন উপুড় হয়ে শুয়ে লিখে লিখে জীবনীশক্তি ক্ষয় করেছেন। তাতে পৃথিবীর কোনও উপকার হয়নি। এবার পৃথিবী বুঝি বিদায় করতে চাইছে তাকে। না, আমি সহজে যাব না।

নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে মানবেন্দ্র বললেন, যতই চালাকি করো আমি কিছুতেই বুড়োহচ্ছি না। তুমি, মানবেন্দ্র, তোমার হাত দিয়ে মানসীকে ছুঁয়েছ। এর মর্যাদা রাখতে হবে।

হঠাৎ আবার তার খটকা লাগল। মানসী কি তার ঘরে একটু আগে সত্যিই এসেছিল? নাকি এটা তার চোখের ভুল? চঞ্চলকে যেমন তিনি ভুল দেখেছিলেন। আসলে কোনও একজন বন্ধুর জন্য তার মনটা বোধহয় আঁকুপাঁকু করছে। মানসী কি তার বন্ধু হবে।

মানসী সত্যিই এ ঘরে এসেছিল কি না এর প্রমাণ নেবার জন্য মানবেন্দ্র বাথরুম থেকে ওই অবস্থাতেই ফিরে এলেন ঘরে। মানসীর রেখে যাওয়া গন্ধটা নেওয়ার চেষ্টা করলেন। ঠিক যেন পেলেন না। তিনি হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন একটুক্ষণ। সত্যি এসেছিল? চোখের ভুল নয়?

জানলার পাশ থেকে ফুলটা মাথা দুলিয়ে বলল, আমি সব দেখছি! আমি সব দেখছি।

তখন মানবেন্দ্রর খেয়াল হল, তার শরীরে একটুও সুতো নেই। বাইরের দরজাটা খোলা। আরে, সত্যি কি আমি পাগল হয়ে গেলাম নাকি! মানবেন্দ্র দৌড়ে এসে দরজাটা বন্ধ করলেন, তারপর ফুলটাকে বললেন, তুমি ভারি দুষ্টু হয়েছ তো!

তিনি জানলার কাছে এসে বললেন, তুমি তো সব দেখেছ, তুমি বলো তো, একটু আগে মানসী কি এ ঘরে এসেছিল?

দেয়ালে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। মানবেন্দ্র মুখ ফিরিয়ে দেখলেন বেহুলা। কোনও কথার মাঝখানে টিকটিকি ডেকে উঠলে নাকি সেই কথাটা সত্যি হয়। কিন্তু এটা তো একটা প্রশ্ন। যাই হোক, ও বোধহয় বলছে, আমার ধারণাটাই সত্যি। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ বেহুলা।

তারপর ফুলটার চিবুক ধরে নেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি কী সুন্দর! তোমাকে আমি ভীষণ ভালবাসি। মানবেন্দ্র আবার বাথরুমে ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়ে বললেন, ভণ্ড কোথাকার! নিজের কাছেও মিথ্যে না বললে চলে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *