৩-৪. রাতে টুনি

রাতে টুনি তার টেবিলে বই রেখে পড়ছে, হঠাৎ তার মনে হল কেউ তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে, তাকিয়ে দেখে গাব্বু। টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই কী করছিস?”

“দেখছি।”

“কী দেখছিস?”

“তোমার চুল।”

টুনির মাথার লম্বা চুল সত্যি দেখার মতো, তবে সেটা গাব্বুর চোখে পড়বে সেটা টুনি কখনো চিন্তা করেনি। সে বলল, “দেখা হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“এখন যা। ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলবি না।”

গাব্বু বলল, “আপু, আমাকে একটা জিনিস দেবে?”

“কী জিনিস?”

“আগে বল, দেবে।”

“না জেনে কেমন করে বলব? আগে শুনি তারপর দেখি দেওয়া যায় কী না।”

মিঠু কাছেই ছিল, সে উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “আপু, তুমি রাজি হয়ো না, ভাইয়া সবসময় আজব আজব জিনিস চায়।”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “আমি মোটেও আজব কোনো জিনিস চাই না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কী চাস?”

“চুল।”

“চুল?” টুনি অবাক হয়ে বলল, “তুই চুল চাস?”

“হ্যাঁ।”

“তুই আমার কাছে চুল চাইছিস কেন? তোর নিজেরই তো মাথাভর্তি চুল।

গাব্বু বলল, “আমার লম্বা চুল দরকার। ছোট চুল দিয়ে হবে না। দেখছ না আমার চুল কত ছোট। আব্বু আমাকে চুল লম্বা করতেই দেয় না।”

“কী করবি লম্বা চুল দিয়ে?”

“হাইগ্রোমিটার বানাব।”

“সেটা আবার কী জিনিস?”

“জলীয় বাষ্প মাপার মেশিন। বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকলে চুল লম্বা হয়। তাই চুল দিয়ে একটা মেশিন বানাব। একটা রোলারের মতো জিনিসে চুল প্যাঁচানো থাকবে। চুল লম্বা হলে রোলারটা ঘুরবে। রোলারের সাথে একটা কাঁটা লাগানো থাকবে-” গাব্বু দুই হাত-পা নেড়ে তার যন্ত্র কীভাবে কাজ করবে সেটা বোঝানো শুরু করল, টুনি তখন তাকে থামাল, বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুঝেছি।”

“দেবে চুল?”

“তোর কতগুলো চুল লাগবে?”

গাব্বু বলল, “সবগুলো হলে ভালো হয়।”

টুনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, “কী বললি? সবগুলো? আমি তোকে চুল দেওয়ার জন্যে আমার মাথা ন্যাড়া করে ফেলব?”

গাব্বু বলল, “কেন? মানুষ কি মাথা ন্যাড়া করে না? আবার তো চুল উঠে যাবেই।”

টুনি রেগে বলল, “ভাগ এখান থেকে। পাজি কোথাকার! ঢং দেখে বাঁচি না। কত বড় শখ! তার মেশিন বানানোর জন্যে আমি আমার মাথা ন্যাড়া করে ফেলব!”

গাব্বু বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। সবগুলো দিতে না চাইলে অর্ধেক দাও।”

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “মাথার হাফ সাইড কামিয়ে অর্ধেক দেব? হাফ ন্যাড়া হাফ চুল?”

“হ্যাঁ। সমস্যা কী?”

“একজন মানুষের মাথার অর্ধেক ন্যাড়া আর অর্ধেক চুল থাকলে সেটা কী সমস্যা যদি তুই না বুঝিস তা হলে বুঝতে হবে তোর সিরিয়াস সমস্যা আছে। বুঝতে হবে তোর ব্রেনে গোলমাল আছে। বুঝেছিস?”

গা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তার মানে তুমি দেবে না?”

“না।”

“একটুও দেবে না।”

“একটা দিতে পারি। জাস্ট ওয়ান।”

মিঠু এগিয়ে এসে বলল, “ভাইয়া নিয়ে নাও। আপু তোমাকে একটার বেশি দেবে না।”

গাব্বু টুনির মাথার লম্বা চুলগুলোর দিকে লোভ নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার মাথায় এত চুল, আর তুমি মাত্র একটা দেবে?”

টুনি মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তুই যদি বেশি ঘ্যান ঘ্যান করিস তা হলে ওই একটাও পাবি না।”

মিঠু বলল, “ভাইয়া, বেশি ঘ্যান ঘ্যান না করে এই একটাই নিয়ে নাও। প্রত্যেকদিন একটা একটা করে নিলেই অনেকগুলো হয়ে যাবে।”

গাব্বু খুবই হতাশ ভঙ্গি করে বলল, “ঠিক আছে। তা হলে একটাই দাও।”

টুনি তার মাথার একটা চুল ছিঁড়ে দিতে যাচ্ছিল, গাব্বু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি ঠিক চুল দিতে পারবে না। আমি নাদুসনুদুস দেখে একটা বেছে নিই।”

গাব্বু দেখেশুনে একটা নাদুসনুদুস চুল হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিঁড়ে নিল, টুনি”আউ আউ” করে চিৎকার করে বলল, “বেশি নিয়ে যাসনি তো?”

গাব্বু মাথা নাড়ল, “না, বেশি নেই নাই।” তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি শুধু একটু বড় হয়ে নিই, তখন দেখ আমার এত বড় বড় চুল হবে। যখন দরকার হবে তখন পুট করে ছিঁড়ে নেব।”

মিঠু জানতে চাইল, “কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোন?”

গাব্বু মাথা নাড়ল, “উঁহু। আইনস্টানের মতোন। বৈজ্ঞানিকদের অন্যরকম লম্বা চুল থাকে।”

মিঠু মাথা নাড়ল, বলল, “না ভাইয়া, থাকে না। আজকে টেলিভিশনে বৈজ্ঞানিক রিফাত হাসানকে দেখিয়েছে, তার মাথায় মোটেও লম্বা চুল নাই।”

“তার মানে রিফাত হাসান হচ্ছে পাতি সায়েন্টিস্ট।”

টুনি বলল, “বাজে কথা বলবি না। এত বড় একজন সায়েন্টিস্টকে নিয়ে কী একটা বাজে কথা বলে দিল। ভাগ এখান থেকে। কানের কাছে আর ভ্যাদর ভ্যাদর করবি না। যা–”

গাব্বুর চোখ-মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “আপু তুমি কি জানতে চাও কেমন করে অল্প একটু পড়েই সবকিছু মনে রাখা যায়?”

টুনি বলল, “না, আমি জানতে চাই না। তুই বিদায় হ।”

“খুবই সহজ। ব্রেনের একটা অংশ আছে, তার নাম হচ্ছে এমিগডালা। এমিগডালার কাজ হচ্ছে

টুনি মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি? করবি চুপ?”

গাব্বু হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে বাবা–চুপ করছি।”

.

গভীর রাতে টুনির ঘুম ভেঙে গেল, তাকিয়ে দেখে ঘরে আলো জ্বলছে। ঘুরে গাব্বুর বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখল গাব্বু বিছানায় দুই পা তুলে বসে আছে। তার দুই চোখ বড় বড় করে খোলা এবং সে ড্যাব ড্যাব করে শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। টুনি ঘুম ঘুম চোখে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাল-ঘড়িতে রাত একটা বেজে পাঁচ মিনিট। সে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে বলল, “গাব্বু, রাত একটা বাজে। তুই এখনো ঘুমাসনি?”

গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

“কী করছিস?”

“কিছু করছি না।”

“কিছু করছিস না তো জেগে বসে আছিস কেন?”

গাব্বু গম্ভীর মুখে বলল, “আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি।”

“এক্ষুনি বললি কিছু করছিস না, এখন বলছিস এক্সপেরিমেন্ট করছিস। ব্যাপারটা কী?”

“এইটাই এক্সপেরিমেন্ট।”

“কোনটা?”

“জেগে বসে থাকা।”

টুনি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “জেগে বসে থাকা এক্সপেরিমেন্ট? আমার সাথে ফাজলেমি করিস?” তারপর ধমক দিয়ে বলল, “এক্ষুনি লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়।”

গাব্বু মাথা নাড়ল, “উঁহু। আমি জেগে থাকব।”

“জেগে থাকবি?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

গাব্বু বলল, “কেউ যদি পরপর টানা তিন দিন না ঘুমিয়ে থাকতে পারে তা হলে তার হ্যালুসিনেশন শুরু হয়। হ্যালুসিনেশান বুঝেছ তো? অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখা যায়–”

টুনি গরম হয়ে বলল, “রাত একটার সময় তোর আমাকে হ্যালুসিনেশান শিখাতে হবে না। আমি জানি হ্যালুসিনেশান কী!” সে বিছানায় উঠে বসে মেঘস্বরে বলল, “তুই যদি এক্ষুনি লাইট নিভিয়ে ঘুমাতে না যাস তা হলে তোর আর হ্যালুসিনেশান দেখার জন্যে তিন রাত জেগে থাকতে হবে না। তুই এক্ষুনি হ্যালুসিনেশান দেখা শুরু করবি।”

গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “এক্ষুনি? কীভাবে?”

“আমি উঠে এসে তোর চুলের ঝুঁটি ধরে এমন কয়েকটা ঝাঁকুনি দেব যে তোর ব্রেন তোর নাক দিয়ে বের হয়ে আসবে।”

এরকম একটা অবৈজ্ঞানিক কথা শুনে গাব্বু খুব বিরক্ত হল, বলল, “ব্রেন কখনো নাক দিয়ে বের হতে পারে না।”

টুনি চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই দেখতে চাস বের হয় কি না? দেখাব এসে?” রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলল, “দেখাব?”

গাব্বু বলল, “না। দেখাতে হবে না।”

টুনি বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনব-এর মাঝে তুই যদি লাইট নিভিয়ে শুয়ে না পড়িস তা হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।” টুনি গুনতে শুরু করল, “এক।”

গাব্বু বলল, “আপু, আমার কথা শোনো।”

টুনি গাব্বুর কথা শোনার জন্যে কোনো আগ্রহ দেখাল না, বলল, “দুই।”

“তুমি আগে শোনো আমি কী বলি।”

“তিন।”

গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “আপু, তোমার জন্যে আমি একটা কিছু করতে পারি না।”

টুনি বলল, “চার।”

“ইশ! আপু-”

“পাঁচ।”

গাব্বু এবারে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি শুয়ে পড়ছি। খালি আমি একবার বড় হয়ে নিই, তখন দেখব তুমি কী করো।”

টুনি বলল, “ছয়।”

“গাব্বু বলল, তখন আমি তিন দিন না-সাত দিন না ঘুমিয়ে থাকব। তখন দেখব তুমি কী করো।”

টুনি বলল, “সাত।”

গাব্বু তখন লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, টুনি শুনল, শুয়ে শুয়ে গাব্বু বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।

.

ঠিক তখন রিফাত হাসানও তাঁর হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। তার কারণটা অবশ্যি ভিন্ন, হঠাৎ করে তিনি টের পেয়েছেন এই দেশে তার কোনো আপনজন নেই। পরিচিত মানুষ আছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোনো প্রিয়জন নেই। নিজের দেশে যদি একজনও প্রিয়জন না থাকে তা হলে তার মতো দুর্ভাগা কে হতে পারে?

রিফাত হাসান অবশ্যি তখনো জানেন না পরদিন তার সাথে গাব্বু নামের বারো বছরের একটা ছেলের পরিচয় হবে এবং শুধু পরিচয়েই সেটা থেমে থাকবে না!

রিফাত হাসানও তাঁর হোটেল ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন, হোটেলের জানালা দিয়ে খানিকটা চাঁদের আলো তার বিছানায় এসে পড়ল।

.

০৪.

যে গাব্বুর পরপর তিন দিন তিন রাত না ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল, দেখা গেল ভোরবেলা তাকে কিছুতেই ঘুম থেকে তোলা যাচ্ছে না। আম্মু ডাকলেন, “এই গাবু, ওঠ, স্কুলে যেতে হবে না?”

গাব্বু বিড় বিড় করে কিছু একটা বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল। আম্মু আবার ডাকলেন, “ওঠ বলছি, ওঠ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

গাব্বু বিড় বিড় করে আবার কিছু একটা বলল, উঠল না। আম্মু এবার গাব্বুকে ধরে ঝাঁকুনি দিলেন, তখন সে চোখ খুলে তাকাল, ঘুম ঘুম গলায় বলল, “আম্মু, আর এক সেকেন্ড।” তারপর আবার ঘুমিয়ে গেল।

টুনি মাথা নেড়ে বলল, “আম্মু, তুমি গাব্বুকে তুলতে পারবে না। খামোখা চেষ্টা কোরো না।”

“কেন তুলতে পারব না?”

“গাব্বু সারা রাত জেগে বসে থাকে। কয়েক রাত না ঘুমিয়ে জেগে থাকলে না কী হ্যালুসিনেশান হয়–গাব্বু সেই হ্যালুসিনেশান দেখবে।”

“কী বলিস? মাথা খারাপ দেখি!”

“হ্যাঁ আম্মু। তোমার এই ছেলের পুরোপুরি মাথা খারাপ। তুমি একে ঘুম থেকে তুলতে পারবে না।”

মিঠু কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “আমি পারব।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”

“দেখবে? এই দেখো।” বলে কেউ কিছু বলার আগেই মিঠু টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে গ্লাসের পুরো পানিটা গাব্বুর শরীরের উপর ঢেলে দিল। গাব্বু তখন তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে ওঠে।

মিঠু বলল, “কিছু হয় নাই ভাইয়া। আমি তোমার শরীরে পানি ঢেলে দিয়েছি!”

গাব্বু মিঠুর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই তুই তুই…” কিন্তু বাক্যটা শেষ করতে পারল না।

মিঠুকে খুব বিচলিত হতে দেখা গেল না, সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মনে নাই ভাইয়া তুমি আমাকে বলেছিলে শরীরের মাঝে নার্ভ না কী থাকে, ঠাণ্ডা কিংবা গরম লাগলে কী যেন কী হয়, ব্রেনের মাঝে কী যেন সিগন্যাল যায়”

গাব্বুকে বিজ্ঞানের আলোচনাতেও খুব আগ্রহী হতে দেখা গেল না, নিজের ভেজা শরীরে হাত বুলিয়ে আবার বলল, “তুই তুই তুই…।”

আম্মু বললেন, “ঠিক আছে, যা হওয়ার হয়েছে। এখন ওঠ। স্কুলে যেতে হবে।”

গা মুখ গোঁজ করে বলল, “আমি স্কুলে যেতে চাই না।”

আম্মু বললেন, “স্কুলে না গেলে কেমন করে হবে? ওঠ।–”

গাব্বু খুব অনিচ্ছার সাথে বিছানা থেকে নামল। মিঠু গলা নামিয়ে টুনিকে বলল, “ভাইয়া তো সায়েন্টিস্ট। সায়েন্টিস্টদের সবসময় ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তুলতে হয়।”

.

খাবার টেবিলে বসে সবাই নাস্তা করছে, হঠাৎ দেখা গেল গা তার দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে পানির গ্লাসে একটু দুধ ঢেলে নিল। মিঠু চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দিল, “দেখো দেখো, ভাইয়া আবার সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করছে।”

আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হচ্ছে গাব্বু? পানির গ্লাসে দুধ ঢালছিস কেন?”

গাব্বু দুধ মেশানো পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, “দুধ হচ্ছে কলয়েড। পানিতে যদি একটু দুধ মেশাও তা হলে পানিতে দুধের কণাগুলো ভাসতে থাকে।”

“তোর দুধের কণা পানিতে ভাসানোর কথা না, দুধ খাওয়ার কথা।”

গাব্বু আম্মুর কথা শুনল বলে মনে হল না, অনেকটা নিজের মনে বলল, “এখন যদি এই দুধ মেশানো পানির ভেতর দিয়ে সাদা আলো দেওয়া হয় তা হলে কী হবে জানো?”

মিঠু জানতে চাইল, “কী হবে?”

“সাদা আলোর নীল অংশটা বিচ্ছুরণ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এর ভেতর দিয়ে যে আলোটা আসতে পারবে তার রং হবে লাল।”

মিঠু অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”

গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “একশ ভাগ সত্যি। এটার নাম র‍্যালে স্ক্যাটারিং। র‍্যালে স্ক্যাটারিংয়ের জন্যে সন্ধ্যাবেলা সূর্যকে লাল দেখায়, দিনের বেলা আকাশকে নীল দেখায়।”

মিঠু বলল, “সাদা আলো লাল করে দেখাও দেখি।”

গাব্বু এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “সেটা দেখানোর জন্যে দরকার সাদা আলো। একটা ছোট আয়না দিয়ে রোদটাকে এর মাঝে ফেললে–”

আব্বু বললেন, “গাব্বু, তোকে এখন স্কুলে যেতে হবে। এখন আয়না দিয়ে পানির গ্লাসে রোদ ফেলার সময় না।

আম্মু বললেন, “সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করে এখন নাস্তা শেষ করে আমাকে উদ্ধার কর।”

গাব্বু মুখ গোঁজ করে বলল, “তোমরা কেউ আমাকে কখনো কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে দাও না।”

টুনি বলল, “আউল-ফাউল কথা বলবি না। তুই কবে আমাদের কোন কথাটা শুনিস? তোর এক্সপেরিমেন্টের জ্বালায় এই বাসায় কেউ শান্তিতে এক মিনিট থাকতে পারে? তুই কখনো কারও কোনো কথা শুনিস?”

গাব্বু বলল, “অন্য কোনো বাসা হলে সবাই আমাকে সাহায্য করত। উৎসাহ দিত। তোমরা কখনো সাহায্য করো না, উৎসাহ পর্যন্ত দাও না।”

টুনি বলল, “উৎসাহ ছাড়াই আমাদের জীবন শেষ। তোকে উৎসাহ দিলে আমাদের উপায় আছে?”

আবু বললেন, “তোকে উৎসাহ দিই না কে বলেছে?”

গাব্বু বলল, “এই যে এখন এক্সপেরিমেন্টটা করতে দিলে না।”

“এখন কি এক্সপেরিমেন্ট করার সময়?”

“কখনো আমাকে কোনো বৈজ্ঞানিক জিনিস কিনে দাও না।”

“কখন তোকে কী কিনে দিইনি?”

গা মুখ শক্ত করে বলল, “কতদিন থেকে বলছি আমাকে এক বোতল সালফিউরিক অ্যাসিড আর আরেক বোতল নাইট্রিক অ্যাসিড কিনে দিতে, তুমি কিনে দিয়েছ?”

আব্বু বললেন, “দ্যাখ গাব্বু, তোকে আমি সালফিউরিক অ্যাসিড আর নাইট্রিক অ্যাসিড কিনে দেব না। সেই জন্যে তুই যদি বড় হয়ে গ্যালিলিও নিউটন

হয় আইনস্টাইন হতে না পারিস আমি তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিয়ে নেব। এই পৃথিবীকে একজন কম আইনস্টাইন দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে।”

গাব্বু ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই দেখো, তুমি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ।”

আব্বু বললেন, “আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। আমি খুবই সিরিয়াস।”

“তোমরা খালি দেখ, আমি একবার শুধু বড় হয়ে নিই, তখন আমার বাসায় আমি বিশাল একটা ল্যাবরেটরি বানাব। সেইখানে সবকিছু থাকবে, আমি পুটোনিয়াম পর্যন্ত কিনে আনব।”

মিঠু জানতে চাইল, “পুটোনিয়াম কী ভাইয়া?”

“যেটা দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমা বানায়।”

“তুমি নিউক্লিয়ার বোমা বানাবে?”

গাব্বু শীতল গলায় বলল, “খালি একবার বড় হয়ে নিই।”

মিঠু বলল, “ভাইয়া, তুমি বড় হওয়ার একটা ওষুধ তৈরি করে। এক চামুচ খাবে আর এক বছর বড় হবে। দুই চামুচ খাবে আর দুই বছর বড় হবে।”

টুনি হি হি করে হেসে বলল, “ভুলে একদিন পুরো বোতল খেয়ে ফেলবি তখন থুরথুরে বুড়ো হয়ে যাবি।”

গাব্বু এমনভাবে টুনির দিকে তাকাল যে পারলে সে এখনই টুনিকে চোখের দৃষ্টিতে পুড়িয়ে কাবাব করে দেবে।

.

টুনি, গাব্বু আর মিঠু একই স্কুলে পড়ে। স্কুলটা বাসা থেকে খুব বেশি দূরে না, তাই প্রতিদিন তিন ভাইবোন হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায়। স্কুলে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই অবশ্যি একই ব্যাপার ঘটে। খানিকদূর হেঁটে যেতে যেতেই গাব্বু পিছিয়ে পড়ে, সে যে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না তা নয়, সে পিছিয়ে পড়ে তার কারণ সবকিছুতেই তার কৌতূহল। সবকিছুই তার দেখতে হয়। আজকেও তাই হচ্ছে। খানিকদূর গিয়ে টুনি আবিষ্কার করল গাব্বু সাথে নেই, পেছনে তাকিয়ে দেখা গেল সে গভীর মনোযোগ দিয়ে কীভাবে রিকশার চাকা পাম্প করা হচ্ছে সেটা দেখছে। টুনিকে ফিরে গিয়ে রীতিমতো তার হাত ধরে টেনে আনতে হল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখা গেল গাব্বু আবার পিছিয়ে পড়েছে, এবারে সে একটা ওয়ার্কশপে কীভাবে লেদ মেশিনে একটা পাইপকে পালিশ করা হচ্ছে সেটা দেখছে। এবারে মিঠু তাকে ঠেলে সরিয়ে আনল। কিছুক্ষণ পর গাব্বু আবার পিছিয়ে পড়ল, এবারে সে পাখির খাঁচা হাতে একটা মানুষের সাথে আটকা পড়েছে!

স্কুলে পৌঁছানোর পর টুনি আর মিঠু নিজের ক্লাসে চলে গেল, এখন আর তাদেরকে গাল্লুকে নিয়ে টানাটানি আর ধাক্কাধাক্কি করতে হবে না। গাব্বু স্কুলের মাঠ দিয়ে আড়াআড়িভাবে হেঁটে নিজের ক্লাসে গিয়ে জানালার কাছে একটা সিটে নিজের ব্যাগ রেখে ক্লাস থেকে বের হয়ে এল। মাঠে ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে, সে কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। রবিন নামে তার ক্লাসের একজন ডাকল, “গা, খেলবি? আয়।”

গাৱঁ দৌড়াদৌড়ি করে খুব বেশি খেলে না, তাই খেলতে যাবে কী না সেটা চিন্তা করছিল, ঠিক তখন স্কুলঘরের দেয়ালে তার চোখ পড়ল। লাল রঙের একটা পিঁপড়ার সারি দেয়াল ধরে এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে। মাঠে ছোটাছুটি করার থেকে এই পিঁপড়ার সারিটা কোথা থেকে শুরু করে কোথায় যাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা তার কাছে অনেক বেশি মজার কাজ মনে হল। তাই সে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা খেল। আমি এখন খেলব না।”

তারপর সে পিপড়ার সারিটা দেখতে শুরু করল। জানালার নিচে দিয়ে সেটা স্কুলঘরের পেছনে গিয়ে মাটির ভেতরে কোথায় জানি ঢুকে গেছে। পিঁপড়ার সারিটা মহাউৎসাহে একটা মরা পোকাকে টেনে আনছে, সেই দৃশ্যটা সে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। পিঁপড়াগুলোর মাঝে একধরনের উত্তেজনা। সামনে যাচ্ছে পেছনে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পোকাটাকে টানছে, অন্য একটি পিঁপড়া এসে ধাক্কা দিয়ে একজনকে সরিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে। পিঁপড়ার কথা যদি বুঝতে পারত তা হলে কী মজাই না হত! সে যখন একটা কাঠি দিয়ে পিঁপড়ার সারিটাকে একটু এলোমেলো করে দিয়ে কী হয় দেখছে তখন পেছন থেকে লিটন নামে মোটাসোটা একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল, “গাব্বু, কী করছিস?”

গাব্বু বলল, “দেখছি।”

“কী দেখছিস?”

“পিপড়া।”

“পিঁপড়া? তুই আগে কখনো পিঁপড়া দেখিসনি? পিঁপড়া একটা দেখার মতো জিনিস হল?” লিটন হি হি করে দাঁত বের করে হাসল, কাছাকাছি রত্না নামে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে ডেকে বলল, “রত্না, দেখে যা, গাব্বু পিঁপড়া দেখছে।”

ক্লাসের সবারই গাৱঁর কাজকর্ম দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে, আজকাল কেউ আর অবাক হয় না। তাই রত্নাও অবাক হল না, সেও লিটনের মতো হেসে বলল, “মানুষজন যে রকম চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘ-ভালুক দেখে, গাব্বু সেরকম দেখে পিপড়া।”

লিটন আর রত্নার কথা শুনে গাবুর একটু রাগ হল, সে মুখ শক্ত করে বলল, “তোরা কখনো একটা পিঁপড়াকে ঠিক করে দেখেছিস?”

লিটন বলল, “দেখব না কেন!”

“পিঁপড়ার কয়টা পা, বল দেখি।”

“আট দশটা হবে।”

“উঁহু।” গাব্বু বলল, “ছয়টা।”

“একই কথা।”

“কখনোই একই কথা না–আট পা থাকে মাকড়সার। পিঁপড়ার চোখ কী। রকম বল দেখি।”

“চোখ আবার কী রকম, চোখের মতো।”

“উঁহু। পিঁপড়ার চোখ হচ্ছে কম্পাউন্ড আই। অনেকগুলো ছোট ছোট চোখ মিলে একটা চোখ, বাংলায় বলে পুঞ্জাক্ষী।”

“তোকে বলেছে!”

“পিপড়ার শরীরে কী হাড় আছে?”

“হাড়?” রত্না হেসে বলল, “পিঁপড়ার আবার হাড় থাকবে কেমন করে?”

“আছে।” গাব্বু গম্ভীর হয়ে বলল, “পিঁপড়ার শরীরের খোসাটাই হচ্ছে। হাড়।”

লিটন মুখ বাঁকা করে বলল, “গুলপট্টি।”

“মোটেও গুলপট্টি না। বল দেখি, পিঁপড়া কামড় দিলে ব্যথা লাগে কেন?”

লিটন বলল, “এটা আবার কী রকম প্রশ্ন? কামড় দিলে তো ব্যথা লাগবেই।”

“কামড় দিলে ব্যথা লাগে, তার কারণ পিঁপড়ার কামড়ে আছে ফরমিক অ্যাসিড।”

লিটন মুখ শক্ত করে বলল, “কাঁচকলা।”

কাঁচকলা শুনেও গাব্বু থামল না, বলল, “বল দেখি পিঁপড়া কীভাবে লাইন ধরে যায়?”

“যেভাবে যায় সেভাবে যায়।”

“উঁহু।“

রত্না হি হি করে হেসে বলল, “এক পিঁপড়া আরেক পিঁপড়াকে জিজ্ঞেস করে, ভাই কোনদিকে যাব? তখন সেই পিঁপড়া বলে, এদিকে যাও না হলে ওদিকে যাও। তখন পিঁপড়া এদিক-সেদিক যায়।”

গাব্বু বলল, “মোটেও না। পিঁপড়া যেদিকে যায় সেখানে একটা গন্ধ থাকে। পিঁপড়ারা সেই গন্ধ শুকে এঁকে যায়।

লিটন কাছে এসে নাক কুঁচকে একটু গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে বলল, “কই আমি তো কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।”

গাব্বু বলল, “তুই তো আর পিঁপড়া না। যদি তুই পিঁপড়া হতিস তা হলে ঠিকই গন্ধ পাবি।”

রত্না হেসে গড়িয়ে পড়ল, লিটন হবে পিঁপড়া? লিটনের ওজন কয় কেজি তুই জানিস? একবারে কয়টা হাম বার্গার খায় তুই জানিস? দশটা!”

লিটন রেগে উঠে বলল, “আমি মোটেও একবারে দশটা হাম বার্গার খাই না।”

“খাস।” রত্না বলল, “মিলির জন্মদিনের পার্টিতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

“মোটেও দশটা খাইনি। ছোট ছোট হাম বার্গার–”

“মোটেও ছোট ছোট না। এতো বড় বড়।”

লিটন আর রত্না হাম বার্গারের সাইজ নিয়ে ঝগড়া করতে করতে অন্যদিকে চলে গেল, গাব্বু তখন আবার পিঁপড়ার সারি দেখতে শুরু করে। মাটির নিচে যেখানে ঢুকে গেছে সেখানে খুঁড়ে দেখতে পারলে হত, পিঁপড়ার রানীটাকে নিশ্চয়ই সেখানে পাওয়া যাবে। সে হাঁটু গেড়ে বসে একটা কাঠি দিয়ে মাঠি খুঁড়তে শুরু করে।

“এই ছেলে, তুমি কী করছ এখানে?” প্রচণ্ড ধমক শুনে গাব্বু পেছন ফিরে তাকাল। তাদের প্রিন্সিপাল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিন্সিপালের গলা নেই, ঘাড়ের ওপর সরাসরি মাথা লাগানো, ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফ এবং লাল চোখ। চুল মিলিটারিদের মতো ছোট ছোট করে ছাঁটা। তিনি যখন রাগেন তখন মুখের দুই পাশের দুটি দাঁত বের হয়ে আসে, গাব্বু জানে মাংশাসী প্রাণীর মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে এরকম ধারালো দুটি দাঁত থাকে। এগুলোকে বলে কেনাইন দাঁত।

প্রিন্সিপাল আবার ধমক দিলেন, “কী করছ এখানে?”

“রানী খুঁজছিলাম স্যার।”

প্রিন্সিপাল গাব্বুর কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, “আমার সাথে ইয়ার্কি করছ? তুমি রানী খুঁজছ? স্কুলে এসেছ রাজকন্যা রানী খোঁজার জন্যে? কোন দেশের রানী তোমার জন্যে এইখানে অপেক্ষা করছে?”

“কোনো দেশের রানী না স্যার–”

”চাবকে তোমাকে সোজা করে দেব। পিঠের ছাল তুলে দেব।”

“শারীরিক শাস্তি দেওয়া উঠে গেছে স্যার। শারীরিক শাস্তি এখন আইনত বেআইনি। হাইকোর্ট বলেছে–”

প্রিন্সিপাল পারলে তখন তখনই বাঘের মতো গাব্বুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ধারালো দাঁত দুটি দিয়ে গলার রগ ছিঁড়ে ফেলেন, অনেক কষ্ট করে নিজেকে স্থির রেখে দুই হাত দিয়ে গাব্বুর মাথা ধড় থেকে ছিঁড়ে ফেলার ভান করে বললেন, “তোমার এত বড় সাহস? আমাকে তুমি হাইকোর্ট দেখাও? তুমি আমার সাথে টিটকারি মারবে, বলবে একজন রানী খুঁজে বেড়াচ্ছ, আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব? রাজা রানী রাজকন্যা তোমার জন্যে এখানে বসে আছে-মশকরা করার জায়গা পাও না?”

গাব্বু বুঝল যতই সময় যাচ্ছে ততই সে আরো বেশি বিপদের মাঝে পড়ে যাচ্ছে, রানী বলতে সে মোটেও গল্পের রাজা-রানী বলেনি সেইটা পরিষ্কার করতে হবে, তাই গলা উঁচিয়ে বলল, “স্যার, আমি পিঁপড়াদের রানীর কথা বলছিলাম। এই পিঁপড়াগুলো শ্রমিক পিঁপড়া, তাদের একটা রানী আছে, আমি সেই রানীর কথা বলছিলাম।”

প্রিন্সিপাল স্যার হঠাৎ করে বিষয়টা বুঝতে পারলেন। কিন্তু তাতে তার রাগ কমল না। তার চিৎকার শুনে আশেপাশে ছেলেমেয়েদের একটা ভিড় জমে গেছে। তাদের ভেতর থেকে একটা ছোট হাসির আওয়াজ শুরু হয়ে প্রায় সাথে সাথে থেমে গেল। প্রিন্সিপাল স্যারের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, সেটা রাগে বেগুনি হয়ে গেল। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করে বললেন, “বেয়াদব ছেলে, তোমাকে আমি সিধে করে ছাড়ব।”

কথা শেষ করে গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন। ছেলেমেয়েরা তখন। গাব্বুকে ঘিরে দাঁড়াল, লিটন বলল, “প্রিন্সিপাল স্যার এখন তোকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।”

রত্না বলল, “তুই হচ্ছিস এক নম্বর গাধা।”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কেন? আমি গাধা কেন হব?”

“গাধা না হলে কেউ প্রিন্সিপাল স্যারকে হাইকোর্টের ভয় দেখায়?”

“আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি? আসলেই তো হাইকোর্ট রায় দিয়েছে কেউ কোনো ছাত্রকে পেটাতে পারবে না।”

মিলি ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী, সেই জন্যে অহংকারে মাটিতে তার পা পড়ে না, সে মুখ সুঁচালো করে বলল, “তোর কী দরকার পড়েছিল মাটি খুঁড়ে পিঁপড়ার রানী বের করার? এর থেকে বিজ্ঞান বইয়ের দুই পৃষ্ঠা মুখস্থ করিস না কেন? আমাদের বিজ্ঞান বইয়ে পিঁপড়ার কোনো চ্যাপ্টার পর্যন্ত নাই–”

গাব্বু কী বলবে বুঝতে পারল না। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সে ভালো করে কখনো বুঝতে পারে না।

.

বাংলা, গণিত আর ইংরেজি ক্লাস পর্যন্ত গাব্বু সহ্য করল, সমাজপাঠ ক্লাস সে আর সহ্য করতে পারল না, তার মনে হল ক্লাস থেকে বের হয়ে স্কুলের বাউন্ডারি ওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। রওশন ম্যাডাম ক্লাস নিচ্ছেন, তার গলার শব্দ এত একঘেয়ে যে গাব্বুর মনে হতে লাগল যে সে পাগল হয়ে যাবে। কাজেই সময় কাটানোর জন্যে সে তার স্কুলের ব্যাগ থেকে একটা বই বের করল, বইয়ের নাম ”বিজ্ঞানের শত প্রশ্ন”।

গাব্বু সাবধানে বইটা খুলে পড়তে থাকে, এই বইয়ে লেখা বেশির ভাগ জিনিস সে জানে। একটা প্রশ্নের উত্তর ভুল, তবে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে অংশটা বেশ মজার। কাতুকুতু কেন লাগে, কী করলে কাতুকুতুর অনুভূতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়–এই অংশটা সে আগে জানতো না। বিষয়টা তখন তখনই সে পরীক্ষা করে দেখল, নিজেকে সে নানাভাবে কাতুকুতু দিতে লাগল এবং সত্যি সত্যি তার কাতুকুতু পেল না। পাশে মিলি বসেছিল, সে ভুরু কুঁচকে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কী করছিস?”

গাব্বুও গলা নামিয়ে বলল, “কাতুকুতু দিচ্ছি।”

“কাতুকুতু দিচ্ছিস? কেন?”

“নিজেকে দেওয়া যায় কি না পরীক্ষা করছি। দেওয়া যায় না।”

“নিজেকে মানুষ আবার কেমন করে কাতুকুতু দেবে?”

“দিতে পারে না। অন্যকে পারে। তোকে একটু কাতুকুতু দিই?”

“না।” মিলি চোখ পাকিয়ে বলল, “খবরদার।”

“একটু, প্লীজ।”

“না।”

“প্লীজ!” গাব্বু নরম গলায় বলল, “বেশি দেব না।” বলে সে মিলিকে কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করল, আর মিলি তড়াক করে লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠল, “ম্যাডাম! গাব্বু আমাকে জ্বালাচ্ছে।”

ম্যাডাম পড়ানো বন্ধ করে চশমার ওপর দিয়ে গাব্বুর দিকে তাকালেন, রাগী গলায় বললেন, “গাব্বু!”

গাব্বু বলল, “জি ম্যাডাম।”

“কী করছ তুমি?”

“কিছু করছি না।”

মিলি বলল, “করছে ম্যাডাম, আমাকে কাতুকুতু দিচ্ছে।”

মিলির কথা শুনে সারা ক্লাস হেসে উঠল। ম্যাডামের মুখ তখন আরও শক্ত হয়ে উঠল, শীতল গলায় বললেন, “তুমি ক্লাসে একজনকে কাতুকুতু দিচ্ছ? তোমার এত বড় সাহস?”

গাব্বু অপরাধীর মতো বলল, “না ম্যাডাম, আমি আসলে কাতুকুতু দিচ্ছি না, আমি আসলে দেখাচ্ছিলাম কীভাবে কাতুকুতু দিলে কাতুকুতু লাগে না।”

ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুমি শিখাচ্ছিলে কীভাবে কাতুকুতু দিলে কাতুকুতু লাগে না?”

“জি ম্যাডাম।”

“কীভাবে শুনতে পারি?”

গাব্বু উৎসাহ নিয়ে বলল, “খুব সোজা। এই দেখুন আমি নিজেকে কাতুকুতু দিচ্ছি” বলে গাব্বু নিজেকে নানাভাবে কাতুকুতু দেয় এবং সেই দৃশ্য দেখে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আনন্দে হাসতে থাকে। গাব্বু তখন কাতুকুতু দেওয়া থামিয়ে বলল, “আমার একটুও কাতুকুতু পায়নি। ম্যাডাম আপনি নিজেকে কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করেন, দেখবেন কাতুকুতু পাবে না। দেখেন চেষ্টা করে–”

ম্যাডাম মুখ শক্ত করে বললেন, “আমার চেষ্টা করতে হবে না। আমি জানি মানুষ নিজেকে কাতুকুতু দিতে পারে না।”

গাব্বু এবারে বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে বলল, “আমরা নিজেকে কাতুকুতু দিলে সবসময় জানি কোথায় কাতুকুতু দেওয়া হবে, সেই জন্যে কাতুকুতু লাগে না। তাই আমি যদি আপনাকে কাতুকুতু দিই আর আপনি যদি আগে থেকে জানেন কোথায় কাতুকুতু দেব তা হলে আপনারও কাতুকুতু পাবে না।”

ম্যাডাম কোনো কথা না বলে একধরনের বিস্ময় নিয়ে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। গাব্বু আবার বক্তৃতার মতো করে বলতে লাগল, “আপনাকে করে দেখাব ম্যাডাম? আপনি আপনার হাতটা আমার হাতের ওপর রাখবেন। আমি সেই হাত দিয়ে আপনাকে কাতুকুতু দেব। আপনি তা হলে আগে থেকে জানবেন আমার হাতটা কোনদিকে যাচ্ছে, কোথায় কাতুকুতু দিচ্ছে। আপনার তা হলে আর কাতুকুতু পাবে না। আমি মিলিকে এইটাই দেখাতে চাচ্ছিলাম, মিলি তখন নালিশ করেছে। আপনাকে করে দেখাব ম্যাডাম?”

ম্যাডামের চোখ কেমন যেন বিস্ফারিত হয়ে গেল, তিনি অবিশ্বাসের গলায় বললেন, “তুমি আ-মা-কে কাতুকুতু দেবে?”

“জি ম্যাডাম, আপনি যদি চান।”

“না, আমি চাই না। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা যদি তাদের স্যার-ম্যাডামদের কাতুকুতু দেওয়া শুরু করে তা হলে তাতে স্কুলের ডিসিপ্লিনের খুব বড় সমস্যা হতে পারে। বাইরে সেই খবর গেলে স্কুলের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে, বুঝেছ?”

গাব্বু নিশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝেছি।”

ম্যাডাম বললেন, “মনে হয় বোঝো নাই। ক্লাসে তোমার কোনো মনোযোগ নেই। আমি কী পড়াই তুমি সেটা শোনো না। আজব আজব বিষয় নিয়ে কথা বল। ক্লাসে ডিস্টার্ব করো। তুমি খুব বড় সমস্যা।”

গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “সমস্যা? আমি?”

ম্যাডাম মুখ শক্ত করে বললেন, “হ্যাঁ, তুমি। আমরা অনেক সহ্য করেছি, আর সহ্য করা হবে না। তুমি যদি ক্লাসের ডিসিপ্লিন নষ্ট করো এখন সেটা প্রিন্সিপালকে রিপোর্ট করা হবে। তোমার বাবা-মাকে জানানো হবে। বুঝেছ?”

গাব্বু নিচু গলায় বলল, “বুঝেছি।”

ম্যাডাম কঠিন গলায় বললেন, “এখন থেকে ক্লাসে আমি আর কোনো থিওরি শুনতে চাই না। চুপ করে ক্লাসে বসে থাকো। মনোযোগটা অন্য কোনোদিকে না দিয়ে আমি কী পড়াচ্ছি সেদিকে দাও, বুঝেছ?”

গাব্বু দুর্বল গলায় বলল, “জি ম্যাডাম, বুঝেছি।”

. স্কুল ছুটির পর যখন টুনি, গাব্বু আর মিঠু বাসায় আসছিল তখন গাব্বুকে কেমন জানি অন্যমনস্ক দেখাতে লাগল। অন্যদিনের মতো সে পিছিয়ে পড়ল না, এদিক সেদিক কোনোকিছু দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল না, আজ তার মনটা ভালো নেই। সে কিছুতেই বুঝতে পারল না, চারপাশের মানুষেরা এরকম কেন? কেউ তাকে বুঝতে পারে না কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *