৩-৪. বোধিসত্ত্ব এর পরবর্তী কাজ

০৩.

বোধিসত্ত্ব এর পরবর্তী কাজটি পেলেন কিছুটা উন্নত ধরনের।

 ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে তিনি এক দুপুরবেলা চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ সেখানে বিরাট ছায়া বিস্তার করে আছে। অজস্র লাল ফুলের মধ্যে এসে বসেছে এক ঝাঁক টিয়া। টিয়াগুলির কোলাহল শুনে তিনি খুব মজা পাচ্ছিলেন। ওদের ভাষা তিনি খুব ভাল বোঝেন। তিনি নিজেই পাখিজন্ম নিয়েছিলেন, মনে পড়ে গেছে, টিয়াগুলি অতি ব্যাকুল ভাবে বলাবলি করছে যে তাদের ঝাঁক থেকে একটি পাখি নিরুদ্দেশ। সে কি ধরা পড়ল কোনও ব্যাধের হাতে? অথবা সে কি একা চলে গেল পাহাড়ের দিকে।

বোধিসত্ত্বের ইচ্ছে হল তিনি হঠাৎ টিয়া হয়ে ওদের ঝাঁকে মিশে যান। ওদের কাছে গিয়ে বলবেন, এই তো আমি এসেছি।

কিন্তু তিনি নিজের ইচ্ছে মতো শরীর বদল করতে পারেন না। তাঁর কোনও অলৌকিক শক্তি নেই। তিনি জন্ম-মৃত্যুর অধীন। তাকে এই মানব-জন্ম সম্পূর্ণ করে যেতে হবে। কী এই জীবনের সার্থকতা? সত্যের অনুসন্ধান? সত্য কী? সত্য কি এক না বহু?

বোধিসত্ত্ব শুয়ে শুয়ে এই রকম সাত-পাঁচ ভাবছেন, এমন সময় একটি সাদা রঙের সুদৃশ্য স্টেশন ওয়াগন থামল তাঁকে ছাড়িয়ে একটু দূরে। গাড়িটা আবার পিছিয়ে এসে একেবারে তার পাশে দাঁড়াল। যেহেতু বোধিসত্ত্ব সহজে বিস্মিত বা চমকিত হন না, তাই তিনি চোখ মেললেন না, কোনও কৌতূহলই দেখালেন না।

গাড়িটিতে রয়েছে কয়েক জন দেশি ও বিদেশি মানুষ। এই বিদেশিরা এসেছে হল্যান্ড, ডেনমার্ক ও সুইডেন থেকে। সচ্ছল, উদারহৃদয় পুরুষ-রমণী, এরা চায় দরিদ্রের সেবা করতে। পৃথিবী থেকে গরিবরা দ্রুত কমে যাচ্ছে, সহজে আর গরিব খুঁজে পাওয়া যায় না, যত গরিব এখন শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে। তাই দরিদ্র সেবার আত্মপ্রসাদ পেতে হলে শ্বেতাঙ্গদের আসতে হয় এত দূরে, এই গরম ও ঘামের বিশ্রি আবহাওয়ার দেশে।

দাতার মস্তক থাকে উঁচু, গ্রহীতাকে কুঁজো হয়ে আসতে হয়, এটাই নিয়ম। এবং দাতার আশপাশে কয়েক জন তৈলাক্ত মুখওয়ালা মানুষ থাকে।

গাড়ির সামনের সিটে জানালার পাশে অত্যন্ত লম্বা-চওড়া যে-মানুষটি বসে আছেন, তার নাম নোয়েল এন্ডারসেন। তার মুখে ডাচ চুরুট। তিনি রাস্তার দিকে বাম হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন, এই মানুষটিকে দেখো।

গাড়ির ভেতরে বসা সাত জন নারী-পুরুষ, এদের মধ্যে দু’জন বাঙালি, মুখ বাড়িয়ে বোধিসত্ত্বকে দেখল।

নোয়েল এন্ডারসেন বললেন, দ্বিপ্রহরে এই লোকটি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে। এ দৃশ্য পাশ্চাত্যে অকল্পনীয় নয় কি? প্যারিসের ক্লোসার বা মার্কিন দেশের বামরাও দুপুরে কিছু না কিছু করে। কিন্তু এর কোনও কাজের চিন্তা নেই। শুকেনু, এই লোকটি কি ভিখারি?

এক জন বাঙালি অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল, চেহারা দেখে তো তা মনে হয় না।

মাথায় রঙিন তালপাতার টুপি-পরা এক জন মধ্যবয়স্কা মেমসাহেব বললেন, ভিখারিদেরও স্বাস্থ্য ভাল হতে পারে। ম্যালনিউট্রিশানেও মানুষ অনেক সময় মোটা হয়।

আর এক জন সামরিক অফিসারের মতো চেহারার সাহেব বলল, ইন্ডিয়াতে এসে প্রথম যে-জিনিসটি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি, সেটা হল এখানকার কাক। এত কাক আর কোন দেশে আছে? এবং এখানকার সব কাকই বেশ স্বাস্থ্যবান। এদের দেখলেই বোঝা যায়, এ দেশটি কত নোংরা। কারণ কাক নোংরা খেয়ে বাঁচে।

মধ্যবয়স্কা মেমসাহেবটি বললেন, যে-সব পাখি নোংরা খেয়ে বাঁচে, ইন্ডিয়ার শহরগুলিতে সেই সব পাখির সংখ্যা খুব বেশি। এবং সেই জন্যই রাস্তায় এত কুকুর এবং গোরু। যত দিন রাস্তাগুলো নোংরা থাকবে, তত দিন এরাও থাকবে।

আলোচনা অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে বলে নোয়েল এন্ডারসেন হাত তুলে সবাইকে চুপ করিয়ে দিলেন। বোঝা যায়, তিনিই দলের নেতা। তিনি বললেন, শুকেনু, এই লোকটির মধ্যে আমি ঘুমন্ত ভারতবর্ষকে দেখতে পাচ্ছি। কাজ করার শক্তি আছে কিন্তু সেই শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

বাঙালিদের মধ্যে একজনের নাম সুখেন্দু। সে কিঞ্চিৎ রসিকতা করার চেষ্টায় ঝকমকে ইংরেজিতে বলল, মিস্টার এন্ডারসেন, আমরা ভারতীয়রা দার্শনিক জাত তো। তাই কাজ না করে দর্শন চিন্তায় সময় কাটাতে ভালবাসি।

নোয়েল এন্ডারসেন বললেন, পৃথিবীর কোনও দার্শনিক মানুষকে কাজ করতে নিষেধ করেননি। ভগবদগীতায় কর্মের প্রশস্তি আছে। লর্ড শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, প্রত্যেককেই নিজ নিজ কাজ করে যেতে হবে।

সুখেন্দু একটু কুঁকড়ে গেল। সাহেবদের মুখে ভগবদগীতার কথা শুনলে তাদের কী-রকম যেন পুরুত-পুরুত মনে হয়।

নোয়েল এন্ডারসেন গাড়ির দরজা খুলে নিচে নেমে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে সুখেন্দু ও বিমলেন্দু নামে দুই বাঙালি নেমে এল। এবং টুপি-পরা মেমসাহেব।

নোয়েল এন্ডারসেন জিজ্ঞেস করলেন, শুকেন, আমি এই লোকটির সঙ্গে কথা বলতে পারি?

সুখেন্দু বলল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!

তক্ষুনি সে বোধিসত্ত্বের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এই, ওঠো, ওঠো। এই এখানে ঘুমোচ্ছ কেন?

 বোধিসত্ত্ব চোখ মেলে এই বিচিত্র মানব-সমন্বয়ের দিকে তাকালেন।

 সুখেন্দু বলল, ওঠো, সাহেব তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

বোধিসত্ত্বের চোখে চোখ পড়তেই নোয়েল এন্ডারসেন হাত তুলে তাকে নমস্কার করলেন। বোধিসত্ত্ব প্রতি নমস্কার ফিরিয়ে দিলেন।

নোয়েল এন্ডারসেন সুখেন্দুকে বললেন, তুমি ওকে বলল, আমরা ওর ঘুম ভাঙাবার জন্য দুঃখিত।

সুখেন্দু এই বাক্যের অনুবাদ অবান্তর মনে করে স্বরচিত প্রশ্ন করল, এই দুপুরবেলা এখানে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ কেন? তোমার বাড়ি কোথায়?

বোধিসত্ত্ব আকাশের দিকে আঙুল দেখালেন।

তুমি কি চাষবাসের কাজ করো? তোমার নিজের জমি আছে? না তুমি বর্গাদার?

বোধিসত্ত্ব পরিষ্কার গলায় বললেন, আমি কিছুই করিনা।

নোয়েল এন্ডারসেন জিজ্ঞেস করলেন, শুকেন, এই লোকটি কী বলছে?

সুখেন্দু গলায় খানিকটা তুচ্ছতা ফুটিয়ে বলল, এ বলছে, এ কোনও কাজ করে না, এবং তার জন্য লজ্জিতও নয়।

একে যদি আমরা কোনও কাজ দিই, তাহলে কি এ করতে রাজি হবে?

 মি. এন্ডারসেন, একে আমরা কোন কাজে দেব?

আমাদের সেবা প্রতিষ্ঠানে একে গ্রহণ করা যেতে পারে। এর বুদ্ধি ও শিক্ষা কতটুকু তা আমরা বিবেচনা করে দেখব। যদি কিছুই না থাকে, তবে শারীরিক পরিশ্রম অন্তত করতে পারবে।

মি. এন্ডারসেন, আমাদের কর্মীর সংখ্যা এখনই যথেষ্টরও বেশি। এর পর আরও এক জন –।

তবুও আরও এক জন লোককে নেওয়া যেতে পারে। এক জন সুস্থসবল লোকের কোনও কাজ নেই, এ দেখলে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। জানো শুকেন, কাজের কখনও কোনও অভাব হয় না। এই ইন্ডিয়াতে যেটির অভাব, তা হচ্ছে কাজের অনুপ্রেরণা। আমি দেখতে চাই, এই লোকটিকে কাজে লাগানো যায় কি না। তুমি একে জিজ্ঞেস করো।

সুখেন্দু বোধিসত্ত্বের দিকে ফিরে বলল, এই, তুই কাজ করবি? সাহেব তোকে কাজ দিতে চাইছেন।

বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ?

নোয়েল এন্ডারসেন বললেন, মানব সেবার কাজ।

সুখেন্দু বলল, খাওয়া-থাকা পাবি, কিছু হাতখরচও পাবি। রাজি থাকিস তো এক্ষুনি চল আমাদের সঙ্গে।

তালপাতার টুপি-পরা মেমসাহেবটি ইতিমধ্যে বোধিসত্ত্বের তিনখানি ছবি তুলেছেন, এবার তিনি কৃষ্ণচূড়া গাছের গুঁড়িতে একটি কৌতূহলী কাঠবেড়ালি দেখতে পেয়ে ক্যামেরা ঘুরিয়েছেন সে-দিকে।

সহজে বিস্মিত হন না যে বোধিসত্ত্ব, তিনিও এবার প্রায় বিস্মিত হলেন। তিনি মনে মনে বললেন, সাবাস নতুন যুগের মানুষ। এক-এক নতুন কীর্তি তোমাদের। এ-রকম কথা আগে কোথাও কখনও শোনা যায়নি। সেবা-প্রবৃত্তি মানুষের ব্যক্তিগত। কিন্তু এক জন এসে আর এক জনকে সেবাকার্যের জন্য প্ররোচিত করছে এবং সে-জন্য পয়সাও দিতে চাইছে, এ ব্যাপারটি সত্যিই অভিনব।

তিনি বিশেষ কৌতূহলী হয়ে বলেলেন, নিশ্চয়ই চাই। আমি ধন্য হব।

সাহেবটি একটুক্ষণ বোধিসত্ত্বের মুখের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে চান, এই লোকটির মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি আছে কিনা।

নোয়েল এন্ডারসেন সুখেন্দুকে বললেন, ওকে জিজ্ঞেস করো এক-একটা গাছে যদি সাতটা করে পাখি বসে, তাহলে তিনটি গাছে মোট পাখির সংখ্যা কত হয়?

এই প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে বোধিসত্ত্ব সুখেন্দুকে বললেন, আপনি তার আগে এই মহাপ্রাণ বিদেশিকে জিজ্ঞেস করুন, এক জন নারীর গর্ভে যখন সন্তান থাকে তখন সেই নারীর কি একটা আত্মা না দু’টি আত্মা? সংখ্যাতত্ত্ব এইভাবে শুরু হয়।

সুখেন্দুর দুই ভুরুর মাঝে গভীর ভাঁজ পড়ল। সে তীব্র দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল বোধিসত্ত্বের দিকে।

বিমলেন্দু নামে অপর যে-বাঙালিটি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, সে-ও এই প্রশ্ন শুনে হাসল। কারণ তার নিজের স্ত্রী গর্ভিণী। সে মৃদুস্বরে নোয়েল এন্ডারসেনকে বলল, লোকটি বুদ্ধিমান। পরে আমরা একে আরও যাচাই করব। এখন চলুন, যাওয়া যাক।

গাড়ির মধ্যে বোধিসত্ত্বকে বসতে দেওয়া হল তালপাতার টুপি-পরা মেমটির পাশে। মেমটির ফ্রক উরু পর্যন্ত উঠে আছে। তার কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অতি সূক্ষ্ম চামড়া রঙের মোজায় ঢাকা আছে, তা সহজে অন্যদের নজরে পড়ে না।

বোধিসত্ত্ব আড়ষ্ট ভাবে বসে রইলেন। নারী সম্পর্কে তার বহু জন্মের পূর্ব সংস্কার আছে, সেটা তিনি সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। তার মনে হল, এই পিঙ্গলবর্ণা নারীর নিশ্বাস তার গায়ে লাগছে, যা বাইরের বাতাসের চেয়েও বেশি উষ্ণ।

সুখেন্দু বলল, তুমি এ-রকম ঝোপের মতো দাড়ি-গোঁফ রেখেছ কেন, তুমি কি সাধুগিরি-টিরি করো নাকি?

বোধিসত্ত্ব বলল, না।

তাহলে আমাদের ওখানে গিয়ে দাড়ি কামিয়ে ফেলো। রাত্তিরবেলা বাচ্চা ছেলেরা তোমাদের দেখলে ভয় পেয়ে যাবে।

বোধিসত্ত্ব বললেন, আচ্ছা।

মেমটি একটি সিগারেট ধরাল। তারপর গ্রীবা বক্র করে বলল, এ লোকটির ধোতি পরার স্টাইলটা অন্য রকম। আগে দেখিনি।

বোধিসত্ত্ব ধুতিটা পাট করে কোমরে জড়িয়েছেন। কাছাকোঁচা নেই। উড়নিটা কোমরবন্ধের মতো, বাঁ-দিকে গিট।

সুখেন্দু বলল, হুঁ, আমিও দেখিনি। আমাদের গ্রামে-ট্রামে যে কত রকম ব্যাপার আছে, আমরাও জানি না।

বোধিসত্ত্ব এই কথোপকথনের মর্ম বুঝলেন। প্রাক্তন স্কুল শিক্ষকের উড়নিটি তিনি কেন যে একবারও কাঁধে ঝুলিয়ে না রেখে, বাঁ-দিকে গিট দিয়ে কোমরে বেঁধে রাখেন, তা তিনি নিজেও জানেন না।

তার উলটো দিকের আসনে বসে আছে একটি অল্পবয়সি বিদেশিনি মেয়ে। তার শরীরে উজ্জ্বল লাল পোশাক। সে একটিও কথা না বলে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বোধিসত্ত্বের দিকে। কয়েক বার চোখাচোখি হতেও সে দৃষ্টি ফেরাল না। বোধিসত্ত্বই মুখ নিচু করে রইলেন।

গাড়ি এসে থামল বাঁকুড়া শহরের কাছাকাছি একটি গ্রামে। ভারতবর্ষের আর যে-কোনও গ্রামেরই মতো এটি। শুধু বৈশিষ্ট্য এই, এরমধ্যে গোটা সাতেক অতি সুদৃশ্য বাড়ি আছে। বাড়িগুলো কাঠের ও করুগেটের চাল। দেয়ালের রঙ অতি ঠাণ্ডা নীল আর ছাদের রঙ হলুদ। গ্রামের মধ্যে এটি একটি আলাদা কলোনি, যেখানে প্রায়ই বহু দূর থেকে এসে সাহেব-মেমরা থাকেন। এই সাহেব-মেমরা উচ্ছৃঙ্খল বৈচিত্র্যপ্রেমী ঠিক নন। একটি মহৎ উদ্দেশ্যে এঁরা ওয়েলফেয়ার নামে একটি সংস্থা বানিয়ে সেই সংস্থার পক্ষ থেকে এই পুরো গ্রামটিকে পোষ্য নিয়েছেন। অনন্তকালের মধ্য থেকে মাত্র তিনটি বছর সময় ধার দিয়েছে সরকার বাহাদুর। তার মধ্যে এই ডুমুরগাছিকে বানিয়ে তুলতে হবে এক আদর্শ গ্রাম।

গাড়ি থেকে মানুষ ছাড়াও প্রচুর জিনিসপত্র নামল। শক্ত মোটা পিস বোর্ডের প্যাকিং। সেগুলো দড়ি দিয়ে বাঁধা, সেই দড়িগুলোও কী সুন্দর! শিশু সাপের মতো চকচকে। এক গাদা কালো কালো ছেলে মেয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে সেই গাড়ির সামনে, তারা মুগ্ধ চোখে সেই দড়িগুলোই দেখছে।

এই গ্রীষ্মেও নোয়েল এন্ডারসেনের পরনে একটি জোব্বা, গাঢ় নীল রঙের। সেটা ঠিক রবি ঠাকুরের পোশাকের মতো নয়, পাদ্রিদের মতোও না। কেননা নীল রঙের, বরং মনে হয় একটি বর্ষাতি, আসলে পোশাকটি তার নিজস্ব পরিকল্পিত। এতে আছে ছ’টি পকেট।

নোয়েল এন্ডারসেন প্রথমে সেই কালো কালো শিশুদের দিকে হাত জোড় করে বললেন, নামাসকার, নামাসকার।

ছেলে-মেয়েরা এক সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, নমস্কার সাহেব, নমস্কার।

নোয়েল এন্ডারসেন হাত দুটি পকেটে ঢুকিয়ে বার করে আনলেন অনেক টফি চকোলেট। অমনি ছেলে মেয়েরা সেগুলি কাড়াকাড়ি করে নেবার জন্য ছুটে এল। সাহেব সস্নেহে বললেন, নাও। ওয়ান বাই ওয়ান। গেট ইন আ কিউ –।

সুখেন্দু ও বিমলেন্দু বাচ্চাগুলোকে ধমকে ধমকে লাইনে দাঁড় করাল। সাহেব তখন প্রত্যেককে তিনটে করে টফি দিতে লাগলেন, এবং সেই সঙ্গে কারুর গাল টিপে, কারুর চুল নেড়ে খুনসুটি করলেন।

নোয়েল শব্দটির অর্থ বড় দিন। যেন এই সাহেব এক দাড়িহীন সান্টাক্লস। তার সহাস্য মুখখানিতে শিশুর সরলতা মাখানো। তালপাতা টুপি-পরা মেমসাহেব অনর্গল ছবি তুলে যাচ্ছেন।

বোধিসত্ত্ব এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। কেন যেন এই দৃশ্যটি তার খুব পরিচিত মনে হল। বহুবার বহুরূপে এই দৃশ্য দেখেছেন। মনশ্চক্ষে সাহেবটির চেহারা বদলে গেল, তার জায়গায় এল অন্য কেউ। কিন্তু বাচ্চা ছেলে মেয়েদের চেহারা বিশেষ বদলাল না।

ডুমুরগাছি গ্রামের এই কলোনিটিকে কোনও আশ্রম বলা চলে না।

এর নাম হল ওয়েলফেয়ার, এর ইউনিট নাম্বার ফাইভ। এখানে নারী-পুরুষ মিলিয়ে মোট উনিশ জন স্থায়ী কর্মী আছে। সকলেই বেরিয়ে এসেছে পিতৃসংস্থায় প্রতিনিধিদের স্বাগত জানাতে। পরিচ্ছন্ন চেহারার তরুণ-তরুণী সব, এদের মধ্যে বৃদ্ধ মাত্র এক জন। এখানে বোধিসত্ত্ব হলেন কুড়ি নম্বর।

সুখেন্দু এক জন তরুণ কর্মীকে ডেকে বোধিসত্ত্বকে দেখিয়ে নিম্ন স্বরে বলল, এই লোকটি এখানে থাকবে। বড় সাহেবের খেয়াল জেগেছে, ওকে দিয়ে কিছু কাজ করাবে। কী কাজ ও পারবে জানি না। যাই হোক, সে পরে হবে, ওকে একটা থাকার জায়গা দাও।

তরুণ কর্মীটি বলল, বাবাঃ, চেহারা দেখলে ভয় করে। পাগল-টাগল নয় তো? রাস্তা থেকে তুলে আনলেন?

হ্যাঁ-অ্যাঁ। এই লোকটা বোধহয় পাগল নয়, পাগল আমাদের এই এন্ডারসেন।

এর সঙ্গে তো বিছানা-টিছানা জামাকাপড় কিছুই নেই। একেবারে ঝাড়া হাত-পায়ে এসেছে দেখছি।

যাই হোক, ব্যবস্থা তো করতেই হবে। সাহেবদের খেয়াল যখন। গোস্বামী চলে গেছে, ওর ঘরটা খালি আছে না? সেখানেই আপাতত ও থাকুক। স্টোর থেকে একটা কম্বল আর গোটা দুয়েক ধুতি দিয়ে দিয়ো। পরে আমি কাগজপত্রে সই করে দেব।

তরুণ কর্মীটি বোধিসত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এসো আমার সঙ্গে। লোকটি গোড়া থেকেই বোধিসত্ত্বকে অপছন্দ করেছে, মুখে তার চিহ্ন স্পষ্ট। প্রথম পরিচয়ে নবাগতের প্রতি বিরাগ পোষণ করা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। অচেনা মানুষকে মানুষ বিশ্বাস করে না। অথচ এই তরুণ কর্মীটি যার নাম বিকাশ, একদিন সে-ই, এই ইউনিট নাম্বার ফাইভে, বোধিসত্ত্বের সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ হবে।

প্রত্যেকটি ঘরই একটি আলাদা আলাদা বাড়ি। লাইনের একেবারে শেষের ঘরটির দরজা খুলল বিকাশ। ভেতরে ঢুকে জানলা খুলল। ঘরের মধ্যে একটি তক্তপোশ ও একটি করে টেবল-চেয়ার। বিকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এইসব ঘর ভদ্রলোকদের থাকবার জন্য, রাস্তার ভিখিরির জন্য নয়। তার ঘরে একটি অতিরিক্ত চেয়ার দরকার, পরে নিয়ে যেতে হবে এ ঘরেরটা। এ লোকটা চেয়ার নিয়ে কী করবে?

বিকাশ তখনও জানে না যে কয়েক দিন পরে সে নিজেই এই ঘরে এসে অধিকাংশ সময় কাটাবে। চেয়ার দরকার হবে তার নিজেরই বসবার জন্য।

ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে সে বলল, কাজ করতে এসেছ, সঙ্গে জিনিসপত্র তো কিছুই আনোনি। কম্বল টম্বল আমি দিয়ে যাচ্ছি একটু পরে। আর শোনো, গাড়িটা যেখানে এসে থামল, তার সামনে একটা বড় হলঘর দেখছ তো? সেটাই ডাইনিং হল। ঠিক সাতটার সময় ঘন্টা বাজবে, তখন ওখানে খেতে যেতে হবে। বুঝেছ?

বোধিসত্ত্ব ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালেন।

বিকাশ বেরিয়ে যাবার পর বোধিসত্ত্ব ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন ঘরখানি। নতুন কাঠের সুগন্ধ এখনও রয়ে গেছে। টেবিলের সামনে দেয়ালে ঝুলছে একটা আয়না। নদীর জলের চেয়ে এই আয়নায় প্রতিবিম্ব অনেক বেশি স্পষ্ট। সেই জন্য আরও বেশি অচেনা। নিজেকে একটি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ হিসেবে দেখলেন তিনি। এবং একটি অচেনা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীরের মতো এই ঘরটাও এখন তার নিজস্ব। গাছতলা থেকে উঠে এসে আজ থেকে তিনি গৃহস্থ হলেন।

এতক্ষণের মধ্যে ওরা কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করেনি। রাস্তার ভিখারি কিংবা উন্মাদের নাম জানার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ।

তিনি কি কুঁয়ার সিং, না বুধকুমার? কিন্তু সেই মুহূর্তে বোধিসত্ত্বের চোখের সামনে ভেসে উঠল অন্য একটি দৃশ্য।

.

০৪.

 বোধিসত্ত্ব চুল ছেঁটেছেন, দাড়ি-গোঁফ নির্মূল করে ফেলেছেন। তার পরিধানে এখন পরিচ্ছন্ন ধুতি ও সাবান কাচা পাঞ্জাবি। অবশ্য হলুদ রঙের উত্তরীয়টি কোমরে বেঁধে রাখার অভ্যেস তিনি ছাড়েননি।

তার এই রূপ পরিবর্তনের ফলে তিনি তুই বা তুমি থেকে আপনিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন অবিলম্বে। তার একটি নামও আছে। তিনি নিজের অনেকগুলি নাম ঠিক করেছিলেন, কিন্তু শেষে ভাবলেন যে, পৃথিবীতে এসে তার প্রথম পাওয়া নামটিই রক্ষা করা উচিত। সুতরাং মাটি কাটার ঠিকাদার প্রদত্ত কুঁয়ার সিং নামটিকেই তিনি একটু বাঙালি করে বললেন, কুমার সিংহ। এখানকার অনেকেই তাকে কুমারবাবু বা কুমারদা বলে ডাকে।

ইউনিট নাম্বার ফাইভের কার্যবিধি বহু রকমের। এখানে আছেন তিন জন কৃষি-বিশেষজ্ঞ, যাঁরা মাঠে চাষিদের সঙ্গে জলকাদার মধ্যে নেমে চাষিদের শিক্ষা দিচ্ছেন আধুনিক কৃষি-পদ্ধতি। একটি প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করে সেখানে দেওয়া হচ্ছে হাতে-কলমে কাজভিত্তিক শিক্ষা। সেখানকার ছাত্ররা লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম হাতের কাজ তো শিখছেই, তাছাড়া কোন ধরনের ব্যবসা করতে গেলে কী কী ধরনের অভিজ্ঞতা লাগে, সে-সম্পর্কেও জ্ঞান সঞ্চয়ন করছে। এক জন ডাক্তার প্রতি বাড়ি ঘুরে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি শেখাচ্ছেন বাড়ির মেয়েদের। এ ছাড়া গ্রামের তাঁতি, জোলা, জেলে, গোয়ালা প্রভৃতি সকলকেই আনা হয়েছে এই পরিকল্পনার আওতায়। গ্রামের বারোশো অধিবাসীর মধ্যে এক জনও বাদ যায়নি। এদের শুধু নানা রকম সাহায্য দেওয়াই উদ্দেশ্য নয়, আসল উদ্দেশ্য এদের স্বাবলম্বী হতে শেখানো। কারণ তিন বছর তো মাত্র সময়। তারপর ইউনিট নাম্বার ফাইভ এখান থেকে সব কিছু গুটিয়ে চলে যাবে। কাজ শুরু হয়েছে মাত্র সাত মাস আগে।

সকালে ইউনিট থেকে গ্রামের লোককে দুধ বিলি করা হয়। হল্যান্ড থেকে সরাসরি আসে অতি উৎকৃষ্ট ধরনের দুধ। পেছনের পুকুরঘাটে সেই খালি দুধের ব্যারেলগুলো স্তূপাকার হয়ে আছে। অচিন্ত্য গোস্বামী নামে এক জন কর্মী এখানকার কাজ ছেড়ে অন্য জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ায় বোধিসত্ত্বকে দেওয়া হয়েছে তার দুধ বিলির কাজ।

এ কাজটি মোটেই সহজ নয়।

গ্রামের লোক অতি কূট-কৌশলী হয়। নিজেদের মঙ্গল ছাড়া আর যাবতীয় কিছুই তারা খুব ভাল বোঝে। হল্যান্ডের বিখ্যাত দুধ পান করেও তিন মাসের মধ্যে গ্রামের কোনও লোকের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন না হওয়ায় ইউনিট নাম্বার ফাইভের কর্মীরা সন্দিহান হয়ে ওঠে। কয়েক দিন গোপনে খোঁজ নেবার পর জানা যায়, দুধ নেবার পরই গ্রামের ছেলে-মেয়েরা মাঠের রাস্তা ধরে শর্টকাটে দৌড়ে চলে যায় বাঁকুড়া শহরে। সেখানকার বিভিন্ন চায়ের দোকানে এবং অনেক গৃহস্থ বাড়িতে উচ্চমূল্যে সেই দুধ সরবরাহ করা হচ্ছে নিয়মিত।

এর প্রতিকারের জন্য একটা ব্যবস্থা করা হল। সুইডেন থেকে নোয়েল এন্ডারসেনই পরামর্শটি লিখে পাঠিয়েছিলেন। তিনি জানালেন যে, শুধু দুধ আর দেওয়া হবে না, এবার থেকে দুধের সঙ্গে ফ্যারেক্স মিশিয়ে দেওয়া হবে সমান সমান পরিমাণে। ফ্যারেক্সের ডোনেশান তিনিই জোগাড় করে দিয়েছিলেন। ফ্যারেক্সে মেশানো দুধে চা হয় না। এর স্বাদ অন্য রকম বলে গৃহস্থ বাড়িও এ দুধ কিনতে চাইবে না। কিন্তু গ্রামের লোকের পক্ষে এই মিশ্রিত দুধ আরও বেশি স্বাস্থ্যকর।

গ্রামের লোকদের বিচিত্র কৌতুক বোধ আছে। তারা এইনতুন পানীয়ের নাম দিয়েছে আলুনি দুধ। আগে তারা ভোরবেলা এসে লাইনে দাঁড়াত দারুণ ব্যগ্র ভঙ্গিতে, শরীর সবসময় দুলছে, কখন দুধটা পেলেই ছুট দেবে। এখন তাদের আগ্রহ অনেক কম। এখনও আসে ঠিকই, কিন্তু আসে হেলতে দুলতে, লাইনে দাঁড়িয়ে ঘটি বাজিয়ে এক জন কেউ চেঁচিয়ে বলে, ও সাহেবদাদা, তোমার আলুনি দুধ গোলা হল? অমনি একটি হাসির ধুম পড়ে যায়। যে-দুধ বিক্রি হয় না, সে-দুধকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। আগে কারুর ঘটি থেকে দুধ চলকে পড়লে আপশোসের শেষ থাকত না, এখন তারা হাতের দুধভর্তি ঘটিটা নিয়ে যায় দোলাতে দোলাতে। যেন সাহেবদের দেওয়া দুধ গ্রহণ করে তারা সাহেবদের ও তাদের কর্মচারীদেরই ধন্য করে দিচ্ছে। সত্যি, কৃতজ্ঞতাবোধটা যেন ক্রমশ উঠে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে।

সাত মাস আগে এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল বারোশো। এর মধ্যেই সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে তেরোশো চব্বিশে। এটা ঠিক জন্মহার বৃদ্ধির ব্যাপার নয়। অন্য অন্য গ্রাম থেকে লোক চলে আসছে এ গ্রামে। এ সম্পর্কে ওয়েলফেয়ার-এর ইউনিট নাম্বার ফাইভের একটি কঠোর নীতি আছে। তারা শুধু একটি গ্রামকেই উন্নত করতে এসেছে, সমস্ত ভারতবর্ষ উদ্ধার করা তাদের দায়িত্ব নয়। তারা কয়েক স্কোয়ার মাইলের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের ওপর পরীক্ষা চালাতে এসেছে, এই সংখ্যার তারতম্য হলে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। সুতরাং বাইরের থেকে অন্য লোকদের অনুপ্রবেশ রোধ করা হচ্ছে যথাসাধ্য। কিন্তু প্রতি দিনই কয়েক জন আসে এবং তারা হলফ করে বলে, তারা এ গাঁয়েরই লোক, কিছু দিনের জন্য বাইরে গিয়েছিল। গাঁয়েরও কিছু লোক তাদের আত্মীয় বলে দাবি করে। তবে যারা কোনও বাড়িতে আশ্রয় জোগাড় করতে পারে না, তাদের অবাঞ্ছিত বেড়ালছানার মতো গ্রামের সীমানার বাইরে পার করে দিয়ে আসা হয়।

সুতরাং এ গ্রামের জেলে যখন বিনামূল্যে সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য নাইলনের জাল পায়, তখন পাশের গ্রামের জেলেরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এ গ্রামের জমিতে সবসময় ফট ফট ফট ফট করে চলে খাঁটি বিলিতি পাম্প, কোনও সময়েই জলের কষ্ট নেই। পাশের গ্রামের জমিতে তখন খরা। বস্তুত ডুমুরগাছি গ্রামের সঙ্গে পাশের হিরাকুঁচ গ্রামের কোনও আপাত তফাত নেই, কিন্তু অকস্মাৎ ডুমুরগাছি গ্রামটি যেন বড়লোকের রক্ষিত হয়ে ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলেছে। উপমাটি অন্যভাবে দেওয়া যায়। হঠাৎ এক জন লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পায়, তার ঠিক পরের নম্বরের কুপনধারী কিছুই পায় না।

দুধ গোলার ব্যাপারে সাহায্য করে পূর্ণিমাদি আর অনন্ত। কোনও বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের গৃহিণী হলেই মানাত পূর্ণিমাদিকে, কিন্তু তিনি অল্প বয়সেই বিধবা। নিঃসন্তান এই স্ত্রীলোকটি নিছক বেঁচে থাকার জন্য নানা ঘাটের জল খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত চুঁচড়োর এক অনাথ আশ্রমের কেরানি হয়েছিলেন। সেখান থেকে এসেছেন এই চাকরিতে তিন বছরের কড়ারে। এখানে এসে তিনি প্রকৃত একটি সংসার পেয়েছেন। বছর পঁয়তিরিশের মতো বয়েস, ভারি স্বাস্থ্য, মুখখানি পূর্ণিমার চাঁদের মতোই গোল, সবার সঙ্গে বকে বকে কথা বলতে ভালবাসেন, কিন্তু সবাই জানে, তার অন্তরটি স্নেহে পূর্ণ। জীবনে তিনি অনেক দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু মনের মধ্যে তিক্ত, কটু, কষা রস জমেনি।

বিরাট বিরাট ডেকচিতে দুধ ও ফ্যারেকসের মধ্যে গরম জল মিশিয়ে পূর্ণিমাদি দুধ গোলা সম্পূর্ণ করেন। অ্যালুমিনিয়ামের হাতায় সেই দুধ তুলে কয়েক বার ঢালাঢলি করে তিনি নিশ্চিন্ত হন। তারপর তিনি বোধিসত্ত্বকে বলেন, শোনো, তুমি তো নতুন এসেছে, প্রত্যেককে তিন হাতা করে দেবে, আর কার্ডে দাগ কেটে দেবে। কার্ড না থাকলে দিয়ো না কিন্তু, রোজই অনেকগুলো ভেজাল ঢুকে পড়ে।

অনন্তর সঙ্গে ধরাধরি করে বোধিসত্ত্ব বড় ডেকচিগুলো নিয়ে এলেন বড় হলঘরটির বারান্দায়। গনগনে রোদের নিচে তখন লম্বা লাইন পড়েছে। তিনি গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে লাইন থেকে এক জন চেঁচিয়ে উঠল, আলুনি এসে গেছে। আলুনি এসে গেছে।

প্রত্যেকের হাতে খোপে খোপে তারিখ দেওয়া কার্ড। লাল পেনসিল দিয়ে তিনি একটা খোপে দাগ দিয়ে প্রত্যেককে তিন হাতা করে দুধ ঢেলে দিচ্ছেন। বার বার নিচু হয়ে হাতায় করে দুধ তুলতে হয় বলে আধ ঘণ্টার মধ্যে বোধিসত্ত্বের পিঠ ব্যথা হয়ে এল। তখনও লাইনে অনেক লোক বাকি। তিনি পিঠের ব্যথাটি অগ্রাহ্য করলেন। মনে মনে বললেন, আমি দান করছি। সব খাদ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এই দুধ। এই দুধ দানের পুণ্যফল কার? আমার? কিন্তু দানের এই বস্তুটি আমার নয়। বরং এর বিনিময়ে আমি পেয়েছি গ্রাসাচ্ছাদন।

তিনি আবার ভাবলেন, এইবিনিময় ব্যবস্থা মেনে নেবার জন্য আমার আত্মা কি বিশুদ্ধতর হবে, না মলিনতর হবে? দেখা যাক কিছু দিন সময় নিয়ে।

গ্রামে প্রতিটি পরিবারকে দুধ বিতরণ করতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগে। তখনও শেষ ডেকচিতে প্রায় অর্ধেক দুধ রয়ে গেছে। কিছু শিশু ও বৃদ্ধ অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা দূরে। এদের কার্ড নেই, কিন্তু প্রত্যেকের হাতেই একটি করে পাত্র আছে, এরা হিরাকুঁচ গ্রামের দুর্ভাগা।

পূর্ণিমাদি চলে গিয়েছিলেন রান্নাঘরে তদারকিতে। শেষের দিকে ফিরে এসে তিনি ডেকচিতে উঁকি দিয়ে বললেন, ও মা, এখনও এতখানি রয়ে গেছে? তুমি কম কম দাওনি তো?

বোধিসত্ত্ব অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে পড়লেন। যে-জিনিস তার নিজের নয়, সেই জিনিস দান করতে গিয়েও কি তিনি কৃপণতা করেছেন? তিনি তো প্রত্যেক বার হাতা পুরোপুরি ভরেই তুলতে চেয়েছিলেন। হাত কি কেঁপে গিয়েছিল?

অনন্ত বলল, আজ বোধহয় সবাই আসেনি। তিন ঘর যে-বামুন আছে তারা তো এমনিতেই আসে না।

পূর্ণিমাদি ঠোঁট উলটে বললেন, হুঁ, বামুন না ছাই!

অনন্ত বলল, পূর্ণিমাদি, বামুনদের ওপর আপনার এত রাগ কেন? আগেও দেখেছি।

পূর্ণিমাদি বললেন, খাঁটি বামুন কোথায়, আমাকে একটাও দেখাতে পারো? আমি তো এ পর্যন্ত দেখিনি। সবাই ভড়ং করে আর শাস্তরের নাম নিয়ে মিথ্যে কথা বলে।

বোধিসত্ত্ব পূর্ণিমাদির কাছ থেকে এ-রকম কথা শুনবেন আশা করেননি। তিনি পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

পূর্ণিমাদি আবার বললেন, কুমারভাই, তুমি আবার বামুন-টামুন নও তো!

বোধিসত্ত্ব হেসে বললেন, না।

কী জানি বাবা! তোমাকে দেখে কিন্তু সাধু মনে হয়। তুমি আগে সাধু ছিলে?

না!

তুমি আগে কোথায় ছিলে?

পথে।

তার আগে?

পুর্ণিমাদি, আপনি আগে কোথায় ছিলেন?

চুঁচড়োর অনাথ আশ্রমে।

তার আগে?

বুঝেছি, তুমি আমার কথার উত্তর দেবে না। সাধুরাই তাদের আগের জীবনের কথা বলতে চায় না।

উত্তর দেবনা নয়। উত্তর জানি না।

বুঝেছি, বুঝেছি! এবার হাঁড়ি-কড়া সব তুলে ফেলো। বেলা হয়ে গেছে!

দূরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, বোধিসত্ত্ব হাতছানি দিয়ে তাদের ডাকলে পূর্ণিমাদি আঁতকে উঠে বললেন, ও কী করছ?

বোধিসত্ত্ব বললেন, এই দুধ ওদের দিয়ে দি।

পূর্ণিমাদি বললেন, না না, তাহলে কী গণ্ডগোল হবে তুমি জানো না! আজ যদি পাঁচ জনকে দাও, কাল তাহলে পঞ্চাশ জন আসবে। পরদিন পাঁচশো জন। একবার যদি রটে যায় যে, এখানে বিনা কার্ডে দুধ পাওয়া যায়… নোয়েল সাহেব এতে ভীষণ রাগ করবেন।

বোধিসত্ত্ব বললেন, তাহলে ওদের মধ্যে থেকে শুধু এক জনকে আমি তিন হাতা দুধ দেব।

 পূর্ণিমাদি অবাক হয়ে বললেন, কেন?

ওদের মধ্যে এক জনের অন্তত এই দুধ পাবার কথা।

 পাবার কথা? কে বলল, কে কথা দিয়েছে?

 আপনি, আমি, অনন্ত, এখানকার সকলেই কি এ-রকম কথা দিইনি?

পূর্ণিমাদি অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। বোধিসত্ত্ব একেবারে সামনে যে দশ-এগারো বছরের রোগা ময়লা মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল, তার দোমড়ানো টিনের বাটিতে দুধ ঢেলে দিলেন। তারপর হাতাটি অনন্তর হাতে তুলে দিয়ে উঠোন পেরিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে।

পূর্ণিমাদি বললেন, কথা দিয়েছি? আমরা কখন কথা দিলাম রে, অনন্ত? এর মানে কী?

 যথাসময়ে এই ঘটনাটি নোয়েল এন্ডারসেনের কানে গেল।

নোয়েল এন্ডারসেন ভোরবেলা উঠেই একটি অতি ছোট হাফ প্যান্ট ও লাল রঙের গেঞ্জি পরে গ্রামের গৃহস্থদের গোয়ালঘরগুলি পরিদর্শনে যান। তিনি গো-পালন ও গো-চিকিৎসার ব্যাপারে প্রায় এক জন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ। এই গ্রামে লোকদের বছরের পর বছর বিনামূল্যে দুধ খাইয়ে যাবার বাসনা তার নেই। দুধের ব্যাপারে গ্রামবাসীদের স্বয়ম্ভর হবার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। সেই জন্য আমস্টারডাম নগরী থেকে বাছাই করা সুবৃহৎ ষাঁড়ের বীর্য বিমানে উড়িয়ে আনা হচ্ছে এখানে। তারপর এই বাংলার হাড়-জিরজিরে দুঃখিনী ছলো ছলো আঁখি গোরুগুলিকে সেই বীর্যের সাহায্যে নিয়োগ প্রথায় গর্ভবতী করা হবে। এক সময় তারা জন্ম দেবে মোটা মোটা বাছুরের। তারপর সেই দো-আঁশলা গোরুর পাল দুধের বন্যা বইয়ে দেবে।

এ ব্যাপারে নেয়েল এন্ডারসেনের উৎসাহ অসীম। তিনি কোনও চাষির দুর্গন্ধ গোয়াল ঘরে ঢুকে নিজের হাতে খ্যাংরাঝাঁটা নিয়ে সেখানকার নোংরা পরিষ্কার করতে করতে বলেন, শেম, শেম। তোমরা গরুকে মা বলো, থ্রি হান্ড্রেড থার্টি মিলিয়ন দেবতা থাকে এই গোরুর পেটে, সেই গোরুকে তোমরা এমন অযত্নে এমন ময়লার মধ্যে রাখো?

বাষট্টি বছর বয়সেও নোয়েল এন্ডারসেনের চেহারাটি যুবা-পুরুষের মতো। তার থেকে দশ বছরের ছোট এক বৃদ্ধ চাষি শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে অবাক হয়ে দেখে এই পাগল সাহেবকে।

ন’টা সাড়ে ন’টার সময় নিজের প্রকোষ্ঠে ফিরে নোয়েল এন্ডারসেন শশা, কলা ও বাতাবি লেবুর রস দিয়ে সাত্ত্বিক ধরনের ব্রেকফাস্ট সারলেন। তিনি নিঃসন্তান ও বিপত্নীক। ভারতে তিনি এই নিয়ে এলেন এগারো বার। সুইডেনে তার জানাশুনো, কয়েক জন ভারত থেকে অনাথ শিশু নিয়ে গিয়ে নিজেদের পরিবারে রেখে পুত্রবৎ লালন করছেন। কিন্তু নোয়েল এন্ডারসেন উদ্যোগ করে দত্তক নিয়েছেন গোটা একটা ভারতীয় গ্রামকে।

মধ্যবয়স্কা মেমটির নাম ইনগ্রিড হ্যামেলিন। পড়ন্ত যৌবনেও তিনি শরীরের বাঁধুনি রেখেছেন যথাসাধ্য আঁটসাঁট করে। দশ বছর আগে ইনি এর দ্বিতীয় স্বামীকে পরিত্যাগ করেছেন, আজও তৃতীয় স্বামী পছন্দ হয়নি। প্রথম স্বামীর মৃত্যুতে ইনি প্রাসাদসমেত বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। দ্বিতীয় স্বামীটি সেই সম্পত্তির প্রতি অতিরিক্ত লোভ দেখাবার জন্যই বিতাড়িত হল। এখন কোনও পুরুষ শ্ৰীমতী ইনগ্রিডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করলেই তিনি মনে করেন, পুরুষটির অন্য উদ্দেশ্য আছে। পুরুষটি তাকে চায় না, চায় সম্পত্তি। পুরুষ জাতি সম্পর্কেই সন্দিহান হয়ে উঠেছেন তিনি। মনের মধ্যে রয়ে গেছে ভালবাসার জন্য হাহাকার, কিন্তু ভালবাসার সামনে অবরোধ তুলে আছে পার্থিব বিষয়। তাই তিনি ঠিক করেছেন এ-সব বিলিয়ে দিয়ে যাবেন দীন দরিদ্রের মধ্যে। ওয়েলফেয়ার সংস্থার মোটা চাঁদা আসে তার কাছ থেকে।

অন্য একটি মেয়ের নাম রোজানা। সে যুবতী এবং ভাষাতত্ত্বের ছাত্রী। সেবার কাজে সে এখনও মন-প্রাণ ঢালেনি, সে এসেছে নিছক কৌতূহলে। দলে অন্য একটি যুবক আছে, তার নাম কিম রজার্স, সে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ওয়েলফেয়ার-এর অন্য একটি ইউনিট দেখাশুনা করে।

নোয়েল এন্ডারসেন ব্রেকফাস্ট সেরে এদের সকলকে নিয়ে এবং সুখেন্দু ও বিমলকে ডেকে কিছুক্ষণ ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করলেন। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমরা পথ থেকে যে-লোকটিকে কুড়িয়ে এনেছি, সে কী-রকম কাজ করছে?

সুখেন্দু বলল, সম্ভবত লোকটি পাগল। সে কাজ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু তার কথাবার্তা উলটো পালটা।

ইনগ্রিড হ্যামেলিন জিজ্ঞেস করলেন, কীরকম?

সুখেন্দু লোক-পরম্পরায় শোনা সকালের ঘটনাটি বিবৃত করল এবং বলল, সে কয়েক দিন হল এখানে এসেছে। অথচ তবু সে বলল যে, সকলকে দুধ দেবার পরও নাকি আরও একজনকে দুধ দেবার কথা দেওয়া আছে।

সুখেন্দুর চৌকশ ইংরিজি অনুবাদে বিষয়টি বিদেশিদের কাছে আরও দুর্বোধ্য ঠেকল। নোয়েল এন্ডারসেন বলল, লোকটিকে ডাকো।

বোধিসত্ত্ব এসে দরজার কাছে দাঁড়ালেন। তার ছায়া পড়ল ঘরের সব কটি মানুষের মুখের ওপর। সকলেই বসে ছিল ছোট ছোট মোড়ায়। নোয়েল এন্ডারসেন নিজের মোড়াটি ছেড়ে দিয়ে বিছানায় উঠে গিয়ে বললেন, বসুন।

বোধিসত্ত্ব সকলকে প্রণাম করে বসলেন। নোয়েল অ্যান্ডাবসেন সুখেন্দুর দিকে চেয়ে বললেন, তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো, আমাদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হবার আগে কুমার সিংহ কোথায় ছিল, কী ছিল রে জীবিকা।

বোধিসত্ত্ব দ্বিধাহীন কণ্ঠে উত্তর দিলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি, তা আমার স্মরণ নেই। আমি কে, তা আমি জানি না।

ঘরের সকলেই সচকিত হয়ে উঠল। সুখেন্দু মন্তব্য করল, বলেছিলাম কিনা, এর মাথায় বেশ গোলমাল আছে।

ইনগ্রিড বললেন, এটা অ্যামনেশিয়া হতে পারে। ওর চোখের দৃষ্টি তো সুস্থ মানুষের মতো। ওকে জিজ্ঞেস করুন তো, ওর কিছু অন্তত মনে পড়ে কিনা। কিছু ছোটখাটো ঘটনা?

বোধিসত্ত্ব একবার ভাবলেন বলবেন যে, হ্যাঁ, আমার মাঝে মাঝেই একট একটা ঘটনা মনে পড়ছে, এক একটা দৃশ্য দেখছি। তবে সেগুলির কোনওটাই আমার এ জন্মের নয়।

কিন্তু তিনি একথা এখন প্রকাশ না করাই মনস্থ করে চুপ করে রইলেন।

সুখেন্দু বলল, বোঝাই যাচ্ছে এর কিছুই মনে পড়ে না। দেখুন, ও দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।

নোয়েল এন্ডারসেন বললেন, এক হিসেবে তো ভালই। নতুন করে এর জীবন শুরু হচ্ছে। কুমার সিংহ, আপনি একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন জীবন শুরু করুন।

বোধিসত্ত্বহঠাৎ তীব্রভাবে বললেন, নতুন জীবন আর পুরনো জীবন কী? প্রত্যেক মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য এক।

আপনার মতে কী সেই উদ্দেশ্য?

সত্যের অনুসন্ধান।

হ্যাঁ ঠিক। ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো।

বোধিসত্ত্ব আরও তীক্ষ্ম স্বরে বললেন, ঈশ্বর কে?

মাই গড! আপনি জানেন না, ঈশ্বর কে? ঈশ্বরের দয়ায় আপনি নিশ্বাস ফেলছেন। এই পৃথিবীর ধূলিকণা থেকে মহাকাশ পর্যন্ত যা কিছু, সবই নিয়ন্ত্রণ করছেন ঈশ্বর। আমরা সবাই তার সন্তান।

বোধিসত্ত্ব ওষ্ঠে ব্যঙ্গের হাসি ফুটিয়ে বললেন, মানুষ এখনও ডুবে আছে অজ্ঞতার অন্ধকারে। এ জগতের কোনও সৃষ্টিকর্তা বা নিয়ন্ত্রণকর্তা নেই। মানুষের জীবন তারই নিজস্ব। তার প্রতিটি কাজের জন্য একমাত্র সে নিজেই দায়ী। তার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল ঈশ্বর নামে এক আজগুবি অস্তিত্বের ওপর নির্ভরতা। প্রতিটি মানুষই তার নিজের প্রভু। তাছাড়া আর কেউ নেই।

এই কথাগুলি বলে বোধিসত্ত্ব নিজেই বেশ খানিকটা লজ্জিত হয়ে পড়লেন। এ-রকম কথা তিনি এখানে এই সময়ে বলতে চাননি। তিনি এঁদের কথা শুনতে আগ্রহী। তিনি চান এই নতুন যুগটিকে জানতে।

একমিনিট ঘরের সবাই নিস্তব্ধ হয়ে রইল। শুধু রোজানা নামের তরুণী মেয়েটি এই স্তব্ধতা ভেঙে হেসে উঠল উচ্ছল ভাবে। সকলে দ্বিতীয় বার চমকে গিয়ে তাকাল ওর দিকে। রোজানা বলল, ইনি যা বললেন, তা এমন কিছু নতুন কথা নয়। কিন্তু ভারতে এসে এমন কথা শুনব, আশা করিনি। এ এক নিয়তি-নির্ভর জাতি, তাই এখানে এত দারিদ্র।

বিমলেন্দু বলল, মাপ করবেন, আমি একটা কথা বলতে চাই। আপনারা ভারতে এসে শুধু দারিদ্রটাই দেখেন, মানসিক সম্পদটা আপনাদের চোখে পড়ে না।

রোজানা বলল, আমিও আপনার কাছে মাপ চেয়ে নিয়ে বলছি, এ পর্যন্ত সে-রকম কোনও মানসিক সম্পদ সত্যিই আমার চোখে পড়েনি। আপনারা প্রাচীন ঐতিহ্যের গর্ব করেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আধুনিক কালে কোথায় সে-চিন্তায় ঐশ্বর্য? আধুনিক ভারতীয়দের লেখা বেশ কিছু সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের বই আমি পড়ে দেখেছি। খুবই অগভীর সেগুলো। যুক্তির বদলে ভাবালুতায় পূর্ণ। যেসব নেতারা আপনাদের দেশ শাসন করেন, তাঁরা প্রকাশ্যে যে সব ভাষণ দেন, তা ঠিক শিশুর মতো। শিশুরা যেমন কল্পনাপ্রবণ ও মিথ্যেবাদী হয়। তারা যা উচ্চারণ করেন, তা বিশ্বাস করেন না। তাহলে কোথায় গেল সেই মানসিক সম্পদ?

ইনগ্রিড বললেন, রোজানা, লক্ষ্মীটি, আমরা এখানে রাজনীতি আলোচনা করব না।

বিমলেন্দু বলল, আপনাদের দেশের নেতারাই-বাকী এমন ভাল ভাল কথা বলেন? সবাই ক্ষমতায় থাকার জন্য নিজের সুবিধে মতো কথা বলে।

রোজানা বলল, আমাদের নেতারা দার্শনিক নয়। তারা মানুষের জীবন বা নৈতিক উন্নতি সম্পর্কে কোনও কথা বলার অধিকার গ্রহণ করে না। তারা দেশের লোকের জন্য রুটি, মাংস, দুধ, বিদ্যুৎ ও অস্ত্রশস্ত্রের কথা বলে। এগুলির ঠিক মতো ব্যবস্থা না করতে পারলে তাদের লাথি মেরে নামিয়ে দেওয়া হয় চেয়ার থেকে।

সুখেন্দু কথাটা ঘোরাবার জন্য বলল, আসল কথাটা কি জানেন, আপনাদের দেশে লোকেরা যেমন কাজ করতে পারে, তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর। সেই জন্যই আপনাদের দেশে গরিব নেই। কিন্তু আমাদের দেশে জনসংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, সেই পরিমাণে খাবার নেই, প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, জমি নেই। লোকে কাজ করতে চাইলেও কাজ পায় না।

রোজানা বলল, ভারতীয়দের আর একটা স্বভাব, কিছুমা জেনে বা অর্ধেক জেনে কোনও বিষয়ে জ্ঞানীর মতো কথা বলা। এমনকী তারা নিজের দেশ সম্পর্কেও জানেনা। আপনি এইমাত্র যা বললেন, তা ঠিক নয়।

ইনগ্রিড বললেন, রোজানা, পিজ।

বিমলেন্দু মনে মনে বলল, দুর শালি! এ-দেশে এসে তোরা ডলার ছড়াচ্ছিস বলে যা খুশি তাই বলে যাবি? বুক কাটা ব্লাউজ পরে এমন ঘুরিস যেন আশেপাশে যারা আছে, তারা মানুষই না! ভারি তো একটা পুঁচকে দেশ থেকে এসেছিস, ইন্ডিয়াকে চিনতে হলে তোদের সাত জন্ম লাগবে।

নোয়েল এন্ডারসেন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, রোজানা, একমিনিট। আমি শুকেনুকে কয়েকটা তথ্য মনে করিয়ে দিতে চাই।

সুখেন্দু তাড়াতাড়ি বলল, ব্রিটিশরা এ-দেশটাকে ছিবড়ে করে দিয়ে গেছে।

নোয়েল এন্ডারসেন হাত তুলে বললেন, প্লিজ, আমাকে বলতে দাও। পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি চাষযোগ্য উর্বর জমি আছে ভারতবর্ষে। এর লোকসংখ্যা ষাট কোটি হলেও জনবসতির ঘনত্ব জার্মানি, হল্যান্ড, জাপান, ব্রিটেনের চেয়ে কম। চিনের থেকে ভারতের জনসংখ্যা কুড়ি কোটি কম, কিন্তু চিনের তুলনায় এখানে দশ কোটি একর জমি বিনা চাষে ফেলে রাখা হয়েছে। যদিও ভারত ও আমেরিকার জমির উৎপাদন ক্ষমতা সমান এবং ভারত সরকারই একথা স্বীকার করেছেন। আ হান্ড্রেড নিউ গেইনস’ নামক রিপোর্টে আছে যে, ভারতের পক্ষে স্বয়ম্ভর হওয়া যে-কোনও দিন সম্ভব।

সুখেন্দু একটু থতমত খেয়ে গেল।

 বিমলেন্দু মনে মনে বলল, সাহেবরা লক্ষ-কোটির হিসেবগুলো পটাপট মুখস্থ বলে দেয় এমন ভাবে যে, মনে হয় সত্যি। কে জানে, এই কথাগুলো সত্যি কি না।

সে রসিকতার লোভে বলল, জানো সাহেব, মিথ্যে তিন রকম আছে –লাই, ড্যাম লাই আর স্ট্যাটিসটিকস!

কেউ এই রসিকতা উপভোগ করল না।

এই সব কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে। লো-জার্মান সম্ভূতা এই ভাষাটি সম্পর্কে বোধিসত্ত্বের কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তাই তিনি বুঝতে পারলেন না। তিনি চুপ করে রইলেন।

ইনগ্রিড বললেন, তোমরা রাজনীতি আর চাষবাস নিয়ে কী সব বলতে শুরু করলে? এই গ্রাম্য লোকটি একটি অদ্ভুত কথা বলেছে! ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেই নাকি মানুষের মঙ্গল? নোয়েল, তুমি এই লোকটিকে আরও প্রশ্ন করো!

নোয়েল এন্ডারসেন কপালে ও বুকে ক্রশচিহ্ন এঁকে বললেন, ঈশ্বর এমনই করুণাময় যে, তিনি নিজ পুত্রকেও অবিশ্বাসী কিংবা বিরোধী হতে প্রশ্রয় দেন। কিন্তু ধর্মহীন জীবন পশুর জীবন। ধর্মাচরণ করে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার চেষ্টাই মানব-জীবনের একমাত্র সাধনা। এই সাধনার একটি পথ মানুষের সেবা। সব ধর্মেই সেবার কথা আছে।

রোজানা বলল, নোয়েল, তুমি ভুলে যাচ্ছ, এমন ধর্মও আছে, যাতে ঈশ্বরের স্থান নেই।

নোয়েল বললেন, জানি, জানি, তুমি বৌদ্ধধর্মের কথা বলছ তো। কিন্তু আমি মনে করি, ওটা নৈরাশ্যবাদীদের ধর্ম। ওই ধর্মে, মানুষের জন্মকেই একটি দুঃখের অভিজ্ঞতা বলা হয়েছে। আমি যেটুকু পড়েছি বা জেনেছি, তাতে আমি দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছি, রোজানা, ওই ধর্ম আমার চায়ের কাপ নয়। ধর্মাবলম্বীরা শুধু নিজের মুক্তি চায়, দীন-দুঃখীর সেবার কথা বলে না।

ইনগ্রিড বললেন, যাই বলল আর তাই বলল, গৌতম বুদ্ধ ছিলেন সত্যি এক মহামানব। আমি তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। কোথাও তার মূর্তি দেখলে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসে।

নোয়েল বললেন, নিশ্চয়ই গৌতম বুদ্ধ পরম শ্রদ্ধেয়। অবশ্য পৃথিবীর সব মানুষ তার কথা ঠিকঠাক মেনে চললে এত দিনে পৃথিবী থেকে মানুষজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। সকলেই যদি নির্বাণ লাভ করত…।

রোজানা বলল, নোয়েল, তুমি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে পুরোপুরি জানো না, তোমার জ্ঞান ভাসা ভাসা।

নোয়েল একটু আহত ভাবে হেসে বললেন, তোমার এত অল্প বয়সে তুমি এত বেশি জানলে কী করে রোজানা?

কারণ গোরুর চিকিৎসায় আমাকে সময় ব্যয় করতে হয়নি, আমি বেশি বই পড়েছি।

সুখেন্দু বলল, একথা ঠিক, খ্রিস্টান ধর্মেই মানুষের সেবা করার কথা বেশি আছে। তারা সারা পৃথিবীতে সেবা প্রতিষ্ঠান চালায়।

নোয়েল বললেন, সব ধর্মেই সেবার কথা আছে। হিন্দু ধর্মে আছে, ইসলামে আছে। কিন্তু খ্রিস্টানরা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলকে সেবার কথা ভাবে। এক জন খ্রিস্টান সাধু অখ্রিস্টানকেও বুকে তুলে নেয়।

বিমলেন্দু মনে মনে বলল, হু! তারপর সেই বোকাসোকা গরিব লোকগুলোকে ভুলিয়ে ভুলিয়ে খ্রিস্টান করে ফেলে! হিন্দু ধর্ম কত উদার, জানিস শালা? হিন্দুরা কখনও অন্য ধর্মের লোকদের ডেকে ডেকে হিন্দু বানায় না! আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে তোদের সবকটা খ্রিস্টান মিশনারিকে ঝেটিয়ে তাড়াতাম।

রোজানা বলল, খ্রিস্টানরা বিশ্বব্যপী উদারতা দেখায়, তার কারণ তাদের টাকা বেশি আছে।

সুখেন্দুবলল, আজকাল আরব শেখদের তুলনায় আমেরিকার কোটিপতিরাও গরিব। কিন্তু দ্যাখো, আমাদের পাশের রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে আবার মুসলমান রাষ্ট্র বানিয়ে তারপর আরব শেখরা সেখানে টাকা ঢালছে। মুসলমান ছাড়া অন্য কারুকে সাহায্য করতে তাদের বয়ে গেছে।

রোজানা বলল, তোমরা হিন্দুরাও কোনও মুসলমান দেশকে কখনও সাহায্য করতে গেছ, এমন কথা ইতিহাসে নেই। যাই হোক, আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, সেবার ব্যাপারটা আর কিছুই না, শুধু কিছু মানুষের আত্মম্ভরিতায় সুড়সুড়ি দেওয়া। খ্রিস্টানরা এত মিশন বানায়, কারণ তারা মনে করে, তারা অন্যদের থেকে উন্নত। ধর্মবিশ্বাসে তারা শ্রেষ্ঠ। যে-কোনও সৎ খ্রিস্টানই আত্মপ্রতারক!

ইনগ্রিড বললেন, রোজানা তুমি ক্যাজুইস্টদের মতো কথা বলছ। শুধু তর্ক করার জন্যই তর্ক। শুধু কুযুক্তি!

রোজানা বলল, যদি আমার কথা শুনতে খারাপ লাগে, তাহলে আমি চুপ করে যাই।

নোয়েল প্রশ্রয় দিয়ে বললেন, না না, তুমি বলো। সামান্য ঘরোয়া আলোচনায় কোনও ধর্মেরই কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। খ্রিস্টানদের তুমি আত্মপ্রতারক কেন বললে? আমি নিজেকে একজন খাঁটি খ্রিস্টান বলে মনে করি। আমি কি আত্মপ্রতারক?

রোজানা জোর দিয়ে বলল, নিশ্চয়! তুমি এই শতাব্দীর যা কিছু সুখ ও আরাম ভোগ করছ, তা সবই বাইবেল-বিরোধী। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মই বাইবেল-বিরোধী বিশ্বাস থেকে। দেয়ারফোর টেক নো থট, সেয়িং, হোয়াট শ্যাল উই ইট? অর, হোয়াট শ্যাল উই ড্রিংক? অর, হোয়ার ইউদাল শ্যাল উইবি ক্লোথড? … ফরইয়োর হেভেনলি ফাদার নোয়েথদ্যাটঈহ্যাভ অবঅল দিজ থিংস..সেন্ট ম্যাথু চ্যাপটারসিক। নোয়েল, তুমি অস্বীকার করতে পারে যে, যিশুর এই বাণীটি প্রত্যাখ্যান করার জন্যই পশ্চিমী সভ্যতার এত সমৃদ্ধি। আমার চাই, আমরা চাই, আরও চাই–এই শব্দই তো শোনা যাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে।

নোয়েল বললেন, রোজানা ডার্লিং, তুমিও বোধহয় যিশুর ওই বাণীটির সঠিক অর্থ বোবঝনি। যদি তুমি সঠিক ধর্মপথে থেকে ঈশ্বরের আরাধনা করো, তাহলে তোমার যা পার্থিব প্রয়োজন, তা ঠিকই মিটে যায়। ঈশ্বর জানেন, তোমার প্রয়োজন কী কী।

রোজানা আবার হেসে উঠল।

 ইনগ্রিড বললেন, ধর্মপথে থাকলে ঈশ্বরের কাছ থেকে সবই পাওয়া যায়।

রোজানা বলল, যেমন তুমি পেয়েছ? অতুল সম্পত্তি! এটা কার ধর্মপথে থাকার জন্য, তোমার না তোমার প্রথম স্বামীর?

নোয়েল বললেন, শোনো, থামো ইনগ্রিড, আমি ওকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। তুমি যে গৌতম বুদ্ধের কথা বলছিলে, আমি পড়েছি, গৌতম বুদ্ধ এক জঙ্গলের মধ্যে বসে তপস্যা করছিলেন দিনের পর দিন। তিনি নিজের খাওয়ার চিন্তা করেননি, কিন্তু ঈশ্বরই তাকে বাঁচিয়ে রাখলেন, সেই বনের মধ্যেও সুজাতা নামক একটি মেয়ে তাঁকে সুন্দর খাদ্য এনে দিল।

রোজানা বলল, প্রথম কথা, গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বরের জন্য ধ্যান করেননি। তিনি নিরীশ্বর ছিলেন। তিনি ধ্যানে বসেছিলেন পরম জ্ঞান লাভের জন্য। দ্বিতীয় কথা, সুজাতা নামের মেয়েটির কাছ থেকে খাবার গ্রহণ করার জন্য গৌতম বুদ্ধ নিন্দিত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে যে আর পাঁচজন ব্যক্তি ধ্যানে বসেছিলেন, তারা বুদ্ধকে যোগভ্রষ্ট এবং অসংযমী মনে করে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়!

গৌতম বুদ্ধ অসংযমী? এই তথ্য তুমি কোথায় পেলে?

এটা খুবই জানা একটি সংবাদ। বহু নির্ভরযোগ্য বইতে আছে। এখানে উপস্থিত ভারতীয়দের জিজ্ঞেস করে দেখো, তারা নিশ্চয়ই জানবেন।

সুখেন্দু ও বিমলেন্দু মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। সুখেন্দু মান বাঁচাবার জন্য বিড় বিড় করে বলল, হ্যাঁ, আছে বোধহয়!

রোজানা বলল, সেটা অবশ্য বুদ্ধের ব্যর্থতার কোনও প্রমাণ নয়। সিদ্ধি লাভ করার পর তিনি সেই পাঁচ জন শিষ্যকে খুঁজে বার করলেন বেনারসের কাছে। সেই পাঁচ জন তখনও বুদ্ধকে দেখে অবজ্ঞা করছিল। বুদ্ধ তাদের কাছেই প্রথম প্রচার করলেন তার নতুন ধর্ম। তিনি বলেছিলেন, যেমন ভোগ বিলাসও ঠিক পথ নয়, তেমনি কিছু কিছু সাধুর মতো অতিরিক্ত আত্মনির্যাতনও মুক্তিপথে বাধা হয়। ক্ষত্রিয়দের প্রতিনিধি গৌতম ব্রাহ্মণ ধর্মের চেয়ে একটি সরল পথ বার করতে চেয়েছিলেন। একটি মধ্যপথ। সে যাই হোক, তোমার উপমাটি মাঠে মারা গেল।

চতুর্থ যে-বিদেশিটি এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, দেয়ালে ঠেস দিয়ে চুপচাপ সিগারেট টেনে যাচ্ছিল, সে এবার বলল, একটু গরম কফি পান করলে বেশ হত!

বিমলেন্দু সঙ্গে সঙ্গে অতি উৎসাহ দেখিয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি স্যার!

সে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ইনগ্রিড বোধিসত্ত্বের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা এই লোকটিকে এতক্ষণ শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছি। এ আমাদের কথা কিছুই বুঝছে না। কিন্তু কথা হচ্ছে নোয়েল, যে-লোকে ঈশ্বর বিশ্বাস করে, তাকে কি আমরা এখানে সেবার কাজে রাখতে পারি? যদি নিজের অন্তরের গরজ না থাকে।

বোধিসত্ত্ব আবার মুখ খুললেন। ইনগ্রিডের দিকে তাকিয়েই তিনি বললেন, ঈশ্বর বা ধর্ম নিয়ে আলোচনায় সময় নষ্ট করে শুধু তারা, যাদের বুদ্ধি অপরিণত। যারা স্বভাবতই পরনির্ভর। বুদ্ধিমান মানুষ নিজের বিবেক অনুযায়ী পথ ঠিক করে নেয়। নিজের বিবেককে যুক্তি দিয়ে পরিচ্ছন্ন করার কাজেই সময়ের সব চেয়ে সার্থক ব্যবহার হয়।

সুখেন্দু একটু বিরক্ত ভাবেই কথাগুলি অনুবাদ করল।

ইনগ্রিড কিছু উত্তর দেবার আগেই রোজানা বলল, উনি একশো ভাগ ঠিক কথা বলেছেন। বহু শতাব্দী আগে, যখন সমাজ-ব্যবস্থা ছিল অতি সরল, যখন মানুষ নিজেব ছোট গণ্ডির বাইরে পৃথিবী সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানেননি, তখন কয়েক জন, ভাল ধরনের লোক তাদের কাছাকাছি লোকদের জন্য কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। আজকের এই জটিল পৃথিবীতে সেই পুরনো আমলের কথাগুলোকেই ধর্ম বলে মান্য করা ছেলেমানুষি ছাড়া কিছুই না।

নোয়েল বললেন, তাহলে কি এই যুগে মানুষ ধর্মহীন হয়ে থাকবে? তাহলে মানুষে মানুষে বন্ধন থাকবে কীসের? অথবা এই যুগের জন্য নতুন কোনও ধর্মের প্রয়োজন।

সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। আমি এই লোকটির সঙ্গে আরও কথা বলতে চাই। মনে হয়, এই লোকটির চিন্তা পরিষ্কার। এক-একসময় মানুষ নিজের কাছেই হেরে যায়। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সামনে কোনও পথ দেখতে পায় না, তার বিবেকও তাকে কিছু নির্দেশ দিতে পারে না। সেই সময়কার নৈরাশ্য সে কাটিয়ে উঠবে কী করে? কোন সত্যকে আঁকড়ে ধববে? এই উত্তর আমিও জানি না। এই লোকটি কি জানে।

রোজানা উঠে এসে বোধিসত্ত্বের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, হে কুমার সিংহ, আপনি কি আমাকে ঈশ্বর নিরপেক্ষ, ধর্মনিরপেক্ষ কোনও পরম সত্যের সন্ধান দিতে পারেন? কিংবা তার দরকার নেই। এমনিই আমি আপনার সঙ্গে বিরলে কিছু কথা বলতে চাই।

বোধিসত্ত্ব বললেন, হে কুমারী, তোমার মুখে বুদ্ধির দীপ্তি ও সততার ঔজ্জ্বল্য আছে। কিন্তু মনে হয়, তোমার অনুসন্ধান এবং আমার অনুসন্ধান আলাদা।

কেউ কারুর কথা এক বর্ণও বুঝতে পারলেন না।

 ইনগ্রিড বললেন, আমি এই লোকটিকে পছন্দ করছি না।

নোয়েল ঝুঁকে পড়ে ইনগ্রিডের কাঁধে হাত রেখে বললেন, প্লিজ ইনগ্রিড, এই লোকটিকে আরও কয়েকদিন সুযোগ দেওয়া উচিত। এই সময়ে বিমলেন্দু হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল। তার হাতে কফি নেই, সে হাঁফাচ্ছে। সে একটু দম নিয়ে বলল, একটা সাংঘাতিক ব্যাপার হয়েছে। পূর্ণিমাদিকে সাপে কামড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *