৩.৪ বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী

১১৬.

বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী

প্রায় সকলেরই ওয়াটারপ্রুফ আর টুপির সামনেটা ভেজা, পেছনটা সে-তুলনায় শুকনো। বন্দুকগুলো এবার আর কাঁধে ঝোলানো না, হাতে চেপে ধরা। ঘাড় সোজা, মুখ শক্ত। সবার আগে কম্যাণ্ড্যান্ট। সবার পেছনে ঘোষ। তারও পেছনে গাড়িটা। ঘোষের লেফট-রাইট-লেফট-এর তালে-তালে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের ক্যাম্পে এসে ঢোকে।

তাদের দেখতে পেয়েই বাংলাদেশের কম্যাণ্ড্যার লুঙি পরে খালি গায়েই বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর এরকম কুচকাওয়াজে তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে খাকি জামাটা পরে আসে। জামাটা পরতে-পরতেই প্যান্টের দিকে হাত যায়, কিন্তু প্যান্ট মানেই জুতো। তাতে ত আবার একটু সময় লাগবে। সুতরাং বাংলাদেশের কম্যাণ্ড্যান্ট লুঙির ওপর জামাটা চাপিয়েই বেরিয়ে আসে আবার। একজন তার ওপর ছাতা খুলে ধরে সঙ্গে যায়। কিন্তু একটু যেতে না যেতেই বাতাসে ছাতাটা উল্টে গেলে সে তাড়াতাড়ি আর-একটা ছাতা আনতে ছোটে।

ইতিমধ্যে ঘোষের নির্দেশে ভারতীয় বাহিনী এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আবার স্ট্যাণ্ড এ্যাট ইজ হওয়া মাত্র ভারতীয় কম্যাণ্ড্যান্ট গিয়ে বাংলাদেশের কম্যাণ্ড্যারকে জড়িয়ে ধরে। বাংলাদেশের কম্যাণ্ডার ভারতীয় কম্যাণ্ড্যান্টকে জড়িয়ে ধরে বলে, আরে দাদা, আপনি ত আমারে ডর খাওয়াইয়্যা দিবার ধরিছেন, এলায় রাইফেল কাঁধে মিলিটারি মার্চ করি ঢুকি পড়িসেন। এ ত সীমান্তে গুলিবিনিময় হওয়া ধরিত, চলেন, চলেন, বলে কম্যাণ্ড্যান্টকে জড়িয়ে বারান্দার দিকে এগতে গিয়ে কম্যাণ্ড্যার হাত দিয়ে একটা ভঙ্গি করে যাতে সকলকেই আসতে বলা হয়। বারান্দায় ওঠার আগে কম্যাণ্ড্যান্ট হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে, আরে ভাই, দাঁড়াও। ঘোষ।

ঘোষ আসতেই বলে, ঐগুলো কিচেনে পাঠাও।

সে কী? কিচেনে আবার কী? কম্যাণ্ডার জিজ্ঞাসা করে।

আরে দুইডা ভাতে সিদ্ধ দেয়ার মতন পাঠা ছিল। ওদের ঐখানে রাইখ্যা আইলে ত সর্দি লাইগ্যা। মরত। তার থিকা ভারতবাংলাদেশ মৈত্রীর ভোগে লাগুক, চলো, চলো, এবার কম্যাণ্ড্যান্টই আগে পা বাড়ায়।

কম্যাণ্ড্যান্ট আর কম্যাণ্ড্যার বারান্দায় উঠতে না-উঠতেই বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে সবাই হৈ হৈ করে মাঠে নেমে যায়, ভারতীয় জওয়ানদের প্রায় হাতে ধরেধরে বারান্দায় তুলে নিয়ে আসে। বারান্দাতে উঠেই ভারতীয় জোয়ানরা প্রথম মাথার টুপি খুলে ফেলে, তার পর ওয়াটারপ্রুফের বোতামে হাত দেয়। বাংলাদেশের প্রায় সবারই পরনে লুঙি, কারো কারো গায়ে গেঞ্জি। তাই এই সময়টুকুতে সত্যি মনে হতে থাকে যে ভারতীয় বাহিনী এই ক্যাম্পে নিমন্ত্রণ খেতেই এসেছে।

ভেজা ওয়াটারপ্রুফগুলো বারান্দার বাটামে ঝোলানো, ভেজা গামবুটগুলো খুলে একপাশে রাখা–এই সবে প্রথম দিকের কয়েকটি মিনিট যায়। এর মধ্যে গাড়ির ভেতরে প্যাকেট করে নিজেদের লুঙি বা পাজামা, গামছা ইত্যাদি জোয়ানরা নিয়ে আসে, এক জোয়ান গিয়ে কম্যাণ্ড্যান্টের প্যাকেটটা দিয়ে আসে কম্যাণ্ড্যারের ঘরে। এই নানা ছুটোছুটি হৈহৈ-এর মধ্যে যখন ভারতীয় জোয়ানরাও কিছুক্ষণ পর লুঙি বা পাজামার ওপর গেঞ্জি চাপিয়ে গল্প করতে বা তাস খেলতে বসে যায় তখন দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে চেহারাগত আর-কোনো পার্থক্য থাকে না। বাংলা ভাষার উচ্চারণের বৈচিত্র্য বাংলা দেশের বাহিনীর ভেতরে যতটা, ভারতীয় বাহিনীর মধ্যেও ততটাই। রামাশিস আর পরশমণি শুধু আলাদা। বাংলাদেশের ক্যাম্পে কোনো হিন্দিভাষী ছিল না, নেপালি ত নয়ই। রামাশিস আর পরশমণি এক ফাঁকে কিচেনে গিয়ে জেনে আসে, মাংস-ভাত ছাড়া কিছু হচ্ছে কিনা।

কিচেনে এখানে বাংলা দেশের সীমান্তরক্ষীরাই রান্না করছে। তারা বলে, কেন্ দাদা, ডাইল হইব, ছোলার ডাইল।

রামাশিস বলে ব্যস, ব্যস, হামলোগ ভেজ খায়গা, দোঠো আলু কি বেগুন সিদ্ধ লাগাবেন, ব্যস।

কিচেনের লোকরা প্রথমে ভেজটা বুঝতে পারে না। বোঝার জন্যে তাদের একটু ভাবতে হয়, নিরামিষ খাবেন? মাংস খাবেন না? ক্যা?

পরশমণি বলে, না, হামরা ত খাই না। এমনি ভেজই খাব।

বাংলাদেশের একজন হঠাৎ বুঝতে পারে, আরে দাদা বলে গিয়ে রামাশিসকে জড়িয়ে ধরে হে-হে করে হেসে ফেলে। তারপর তার অন্যান্য সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে, দাদারা ভাইবছে আমরা বড় গোস্ত খাওয়াইয়্যা দিব নে–হে-হে-হে-হে।

এত বড় একটা খবর ত আর চেপে রাখা যায় না। রামাশিস আর পরশমণিকে নিয়ে কিচেনের সবাই গিয়ে বারান্দায় ওঠে। তারপর যে-হলঘরটাতে সবাই মিলে গুলতানি করছে তার দরজায় দাঁড়িয়ে একজন চিৎকার করে–এই শুনো ভাই সবাই।

এতজন লোক দরজায় এসে চেঁচামেচি করায় সকলেরই নজর পড়ে এদিকে। তখন কিচেনের সেই কর্মীটি রামাশিস আর পরশমণিকে দেখিয়ে বলে, ইন্ডিয়ার এই দাদারা কিচেনে গিয়া কয় কি, লোকটি ভেজ শব্দটি মনে করতে পারে না, নিরামিষ খাইব। ক্যা? না, দাদারা ভাইবছে আমরা বড় গোস্ত খাওয়াইয়্যা দিব নে।

সকলে মিলে হেসে ওঠায় রামাশিস দু হাত তুলে বলে, আরে না, না, আমরা ভাবলাম কিয়া পাকা হ্যায়, দেখভাল করে আসি। পরশমণি আর রামাশিস বসে পড়ে। কিচেনের লোকজন আবার কিচেনে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ায়। একজন মুখ বাড়িয়ে বলে, দাদার মুরগাটার চারটা ঠ্যাংই রাইখ্যা দিব।

ভেতর থেকে একজন তাদের পেছনে চিৎকার করে–ল্যাজ আর শিংখানও দিস দাদারে।

পরশমণি আর রামাশিস তাড়াতাড়ি একটা তাসের দলের পেছনে ভিড়ে যায়।

এখন এই ঘরটার চারদিকে তাকালে চট করে বাংলাদেশীদের আর ভারতীয়দের আলাদা করা যাবে না–সবাই এমনই মিশে গেছে। মানুষরা মিশে গেলেও তাদের পোশাক-আশাক এবং আনুষঙ্গিক কিছু-কিছু জিনিশ মিলছিল না। এখানে এই ঘরের দেয়ালে দুই রক্ষীবাহিনীর বন্দুকই সার দিয়ে দাঁড় করানো। কিন্তু বন্দুকগুলো দেখতে একরকম নয়। এই ঘরের ভেতরে টাঙানো দড়িতে দুই বাহিনীরই কিছু-কিছু ইউনিফর্ম ঝুলছে। তার রং আলাদা। দেয়ালে, জানলায় ও দরজার কপাটে, সিনেমার নায়ক-নায়িকার ছবি সাঁটা–তার ভাবভঙ্গি আর চেহারা ভারতীয়দের পরিচিত না। তাস খেলতে-খেলতে বা নেহাৎ শুয়ে-শুয়েই কোনো জোয়ান হিন্দি গান গুনগুন করে। বাংলাদেশের কেউ বলে, আরে দাদা জোরে করেন না, শুনি। দুইদেশের সিগারেট প্যাকেট আলাদা।

এই দুই ক্যাম্পের লোকজন পরস্পরের চেনা। অনেকেই অনেককে নাম ধরে ডাকে। হাটে দেখা হয়। ডিউটি করতে গিয়ে দেখা হয়। চৌকি মারতে গিয়ে দেখা হয়। সেই ঘনিষ্ঠতা না থাকলে বাংলাদেশের সীমান্ত ক্যাম্পের কম্যাণ্ড্যারের পক্ষে কি আর সম্ভব হত বন্যার মুখে তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা?

কিন্তু সেই ঘনিষ্ঠতায় ত কোনোদিন এরকম এক জায়গায় থাকাখাওয়া হয়নি। তাই যেটুকু আনন্দ হচ্ছে–সেটা পিকনিকের আনন্দের মত। সেই আনন্দটুকুকেই সবাই একটু বাড়িয়ে নিতে চাইছে।

বাংলাদেশের কম্যাণ্ড্যার ভারতীয় কম্যাণ্ড্যান্টকে জিজ্ঞাসা করে, দাদা, একডা স্কচ রাইখছি আপনার তানে। বাহির করি?

কম্যাণ্ড্যান্ট আধশোয়া হয়ে বলে, করেন।

.

১১৭.

দুই সেনাপতির সংলাপ

 কম্যাণ্ড্যারের ঘরে দুটো ক্যাম্পখাট পাতা–দুটোর মাঝখানে দেয়াল ঘেঁষে একটা টেবিল, টেবিলের ওপর একটা লণ্ঠন, আর পায়ের দিকে দুটো দরজা–দু দিকের বারান্দায় যাওয়ার। ঘরটাতে দুটো খাটই পাতা থাকে। আর-এক জন যে থাকে সে হয়ত আজ অন্য কোথাও শোবে, বা, হয়ত দুটো খাট পাতা থাকলেও ব্যবহার হয় একটাই।

কম্যাণ্ড্যান্ট লুঙি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরে উত্তর দিকের খাটটাতে বসে। তার রিভলবারসহ বেল্ট খুলে বালিকাকেশ টেনে বের করে। খাল। ডালাটা পুরো খুলতে ওপর রেখে, তালা বন্ধ খুলে বালিশের পাশে রাখা। কম্যাণ্ড্যার টেবিলের ওপর দুটো গ্লাশ রাখে, তারপর চৌকির তলা থেকে এক টিনের সুটকেশ টেনে বের করে। আবার উঠে টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর থেকে একগোছা চাবি নিয়ে কোমর ভেঙে সুটকেশের তালাটা খোলে। ডালাটা পুরো খুলতে হয় না, বা হাতে তুলে রেখে ডান হাতটা ঢুকিয়ে একেবারেই বোতলটা বের করে হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর রেখে, তালা বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায় কম্যাণ্ড্যার। তারপর চাবিটা ড্রয়ারে রেখে পা দিয়ে সুটকেসটা আবার খাটের তলায় ঠেলে দেয়।

আপনাদের ভাই এই একটা বড় সুবিধা–সিগারেট, পান ফার্স্ট ক্লাশ, মদও পান ফার্স্ট ক্লাশ, বেনসন এ্যান্ড হেজেস-এর প্যাকেটটা হাতে তুলে কম্যাণ্ড্যান্ট বলে।

সে ত দাদা আপনাদেরই বা কম কেনে? যারা স্কচ খাওয়ার তারা স্কচই খায়, কম্যাণ্ড্যার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বোতলের ছিপি খোলে।

আরে যারা খাওয়ার, তারা ত খাইবেই, আপনাদের এখানে যারা না খাওয়ার তারাও ত খাইতে পারে, ইচ্ছা কইরলে।

উল্টাটাও ত আছে দাদা।

উল্টাটা আবার কী?

যেইলা স্কচ চায় না, দেশী চায়, স্যালায় খাবেটা কী?

অ। ফরেন লিকার তৈরি হয় না?

হয় এখন একটা ডিস্টিলারিতে। কিন্তু আসলে হামরালার বেশিটাই একেবারে খাঁটি ফরেন।

তা যাই কন। খাইতে চাল্যে ত খাইতে পায়। আর এই সিগারেট–এ ত আপনাদের সব দুকানেই পাওয়া যায়।

আরে ইন্ডিয়ার য্যাম ক্যাপস্টান-ট্যাপস্টান, এইঠে. স্যানং এই সব সিগারেট।

কিন্তু ঐযে কইল্যাম খাঁটি ফরেন। আমাদের ত নিজেদের ফ্যাক্টরি, ফরেন পাব কুথায়?

 হামলার একটা স্টেট এক্সপ্রেসের ফ্যাক্টরি আছে কিন্তু সেও ত পুরা ফরেন।

কম্যাণ্ড্যান্টের সামনে গ্লাশটা এগিয়ে দিয়ে কম্যাণ্ড্যার গ্লাশটা নিয়ে নিজের চৌকিতে বসে। কম্যাণ্ড্যারের বয়স বেশি নয়, রংপুরের রাজবংশী ছেলে, তার কথার মধ্যে রাজবংশী ভাষা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা আছে। কিন্তু রংপুরেরই এই বর্ডারে কাজ করছে বলে সে-সুযোগ খুব একটা বেশি পাচ্ছে না। ভবিষ্যতে যদি যশোহরের দিকে বদলি হয়, তা হলে বেশ খানিকটা কাটিয়ে উঠতে পারে। কম্যাণ্ড্যান্টের বয়স বেশি–সেই সুবাদে এর আগেই দুজনের দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বটে কিন্তু তা না হলেও কম্যাণ্ড্যান্ট এই দুজনের মধ্যে সব সময়ই বড়র স্বীকৃতি পেত। কম্যাণ্ড্যান্ট এখানে লুঙিগেঞ্জি পরে বসে আছে ত অত বড় একটা দেশ ইন্ডিয়ারই লোক হিশেবে-বাংলাদেশের কাছে সেটা একটা মহাদেশই বটে। গ্লাশটা তুলে ধরে কম্যাণ্ড্যান্ট বলে, কী? টোস্ট করব্যান নাকি? কী কইবেন? ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী?

কম্যান্ড্যার একটু হাসে, সে যাদের করার করিবার দেন। আপনি ত আর এই ফ্লাড না হইলে আসিতেন না। ফ্লাডের নামে টোস্ট করি।

হে-হে করে কম্যাণ্ড্যান্ট হেসে ওঠে, আরে, আপনার ত বুদ্ধি আছে খুব। ত কোন ফ্লাডের নামে কইরবেন–যে-ফ্লাডের ভয়ে এইখানে আসছি, না যে-ফ্লাডের চোটে এইখানে আরো দুই দিন থাকব?

কম্যাণ্ড্যার হো-হো হেসে ফেলে-কোন ফ্লাড কায় জানে। গ্লাশটা তুলে এগিয়ে দেয়, কম্যাণ্ড্যান্টও গ্লাশটা তার গ্লাশের সঙ্গে মেলায়, কম্যাণ্ড্যার বলে–থ্রি চিয়ার্স ফর ফ্লাড়।

কম্যাণ্ড্যান্ট চুমুক দিয়ে গ্লাশটা রেখে বলে, আপনাগ এইখানে নাকি ফ্লাডের লোকজন আইস্যা উইঠছে? কোথায়?

কম্যাণ্ড্যার তার মাথার দিকের বেড়াটা দেখিয়ে বলে–ঐ দিকে, রান্নাঘরের পাছত ত্রিপলের দুইখান ছাউনি ফেলি দিছি। বিকালে ত শুনিলাম শ-খানেক হবা পারে, এ্যালায় আরো বাড়ি গিছে নিশ্চয়। ইন্ডিয়ার লোজকনও ত আসিছে শুনিছু। বিকালের টাইমত ইন্ডিয়াই বেশি আসিছে। এখনো।

তা ইন্ডিয়ার ক্যাম্পসুষ্ঠু আইসছি, মানষেরা যাবে কোথায়? আপনারা কি ক্যাম্প খুইলছেন নাকি?

আরে না না, ত্রিপলের ছাউনি কিছু, মাথাখান বাঁচিবে আর জল নামিলে ত চলি যাবে। এই ডাঙাখান ত অনেক উচা।

এইখানে টিভি নাই?

হ্যাঁ, আছে ত। দেখিবেন? এখন তে লেকচার হছে। খাড়ান, ফিল্ম হবার সময় যাম। কটা বাজে এখন?

কম্যাণ্ড্যার বালিশের তলা থেকে ঘড়ি বের করে দেখে বলে, সাত। কম্যাণ্ড্যান্ট নিজের ঘড়ি দেখে সময়টা মেলাতে গিয়ে আবার দেখে, সাড়ে সাত, তোমার ঘড়ি শ্লো নাকি?

আরে না, মোর ঘড়ি রোজ মিলাই।

আমার ঘড়ি ত ভাই ফাস্ট যায় না।

একটু পরে কম্যান্ডার হো হো হেসে বলে, আরে আপনার ত ইন্ডিয়ার টাইম, হামরালার ত বাংলাদেশের টাইম। এইঠে নটায় ফিল্ম দিবে। দেখব।

আমাদের নর্থ বেঙ্গলে ত বাংলাদেশের টিভিই সবাই দেখে, তোমাদের আর দিল্লির। কলকাতা ত রাই যায় না।

আমাদের সাউথ বেঙ্গলে কলকাতাখান দেখা যায়, শীতকালে।

টিভি এক, নদী এক, ফ্লাড এক, শুধু টাইমটা আলাদা?

 কেনে? কহিলেন যে সিগারেট আলাদা, মদ আলাদা

নদীডাও আলাদা হইব।

 কোন নদী? তিস্তাবুড়ি?

বুড়ি না ছুড়ি কে জানে। আমাদের ইন্ডিয়ায় ত পাহাড়ের তলায় বিরাট তিস্তা ব্যারাজ বান্ধানো হইচ্ছে।

তিস্তার বাঁধ?

 বাধ। স্লুইস গেট। ফ্লাড হবার পারব না। জল আটক থাকব। শীতের সময় ছাড়া হয়। বিরাট নাকি ব্যারাজ-তিস্তার মাঝখান দিয়্যা।

স্যালায় আমরা জল পাম কোটত?

 জলের কি অভাব পড়ছে তোমার? প্রতি বছরই ত ফ্লাড পাও।

ফ্লাড হবার তানেই ত রংপুরের এইঠে, পাটগ্রামে, এ্যালায় ফলন ভাল হয়। এ ফ্লাডত আপনাদের মানষি মরে, আর আমাদের ফসল বাড়ে।

সেই জন্যই ব্যারাজ হচ্ছে, তিস্তা ব্যারাজ। ফ্লাডও নাই, মানষে মইরবেও না।

কিন্তু নদীখান ত ভাগ হবা ধরিবে। আপনাদের হাত চাবি–জল দিলে জল পাব, না দিলে শুখা।

শুখা ত শুখা। তখন এক টিভিটাই এক থাইকব-তোমরা কলকাতা দেখবা, আমরা রংপুর দেখব। আর সব আলাদা-নদী আলাদা, ফ্লাড আলাদা, টাইম আলাদা।

আলাদাখান এত বাড়া ভাল না হয়, কম্যান্ড্যার কম্যান্ডান্টের গ্লাশ আবার ভরে দিয়ে, নিজের গ্লাশটাও ভরে নেয়।

.

১১৮.

ঘোষের ইণ্ডিয়ায় একবার প্রত্যাবর্তন

ঘোষ একেবারে একলা হয়ে যায়।

বাংলাদেশের ক্যাম্পে জোয়ানরা জোয়ানদের সঙ্গে মিশে গেছে, কাস্টমসের লোক কাস্টমসের ঘরে গিয়ে উঠেছে। ফোনের লোক ফোনের লোকের ঘরে। কিন্তু ঘোষেরই যেন কোনো ঘর ছিল না।

আসলে আছে নিশ্চয়ই। বাংলাদেশের ক্যাম্পে কি কমাণ্ডার আর জোয়ানদের মাঝখানে আর-কেউ নেই নাকি? কিন্তু ঘোষের সঙ্গে তাদের পরিচয় হওয়ার সময় হয় নি। বাংলাদেশের ক্যাম্পে পৌঁছে, কোনো রকমে এক কাপ চা খেয়েই সে ছজন জোয়ানের সঙ্গে গাড়িটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েছে। চালডাল যে কবস্তা পারে নিয়ে আসতে হবে-কম্যাণ্ড্যান্ট যেমন বলে দিল।

ঘোষ ও তার লোকজন বাতাসের সঙ্গেই যাচ্ছিল। তাদের ওয়াটারপ্রুফের পিঠ ভিজছিল বুকটা শুকনো ছিল। পিঠে হাওয়া নিয়ে হাঁটার সুবিধে। তাছাড়া, তাড়াও ত একটা ছিল। এখন যদি তাড়াতাড়ি যেতে পারে, ফেরার সময়ের দেরিটা তা হলে পুষিয়ে যাবে। গাড়ি বেশি ভারী হলে টানা মুশকিল হবে।

চালডালটা যদি নষ্ট হত তা হলে তাদের কোনো ক্ষতি ছিল না, বরং লাভ ছিল। হেডকোয়ার্টার থেকে নতুন রেশন আসত, এগুলো কম দামে বেচে দিয়ে কম্যাণ্ড্যান্টও সে ভাগ করে নিতে পারত। ফ্লাডের পর এ-সব জিনিশের চাহিদা থাকে। কিন্তু নতুন রেশন আসতে দেরিও হতে পারে। দেরি হবেই। অন্তত সেকদিনের রেশন বাঁচাতে হবে। ঘোষ মনে-মনে হিশেব কষতে কষতে হটেকত বস্তা চাল বাঁচালে নতুন রেশনের সময় পর্যন্ত চালানো যাবে অথচ বেচার মত অন্তত কয়েক বস্তা ভেজা চাল থেকে যাবে। নদীতে জল যা দেখেছে তাতে আজ তাদের ক্যাম্পে জল উঠবেই। জলটা কতদিন থাকবে–সেটা অবিশ্যি এখনই বোঝা যাচ্ছে না। ঘোষ মাঝেমধ্যে নদীর দিকে টর্চ মারে কিন্তু টর্চের আলো জলের কুয়াশায় বেশিদূর যায় না।

জোয়ানরা গাড়িটা টানতে-টানতে প্রায় দৌড়ে-দৌড়ে আগে চলে যাচ্ছে। ঘোষকে একা-একাই হাঁটতে হয়। ওরা আগে পৌঁছেও দাঁড়িয়ে থাকবে–গুদামের চাবি তার কাছে।

ঘোষ পায়ের কাছে ও আশেপাশে দু-একবার টর্চ মেরে বুঝতে চেষ্টা করে যাওয়ার সময় কম্যাণ্ড্যান্টের সঙ্গে সে যে হ্যাঁড়িগুলোতে তিস্তার জল ঢুকতে দেখেছিল সেগুলো কোথায় গেল। সে ও কম্যাণ্ড্যান্ট ত সে রকম নিচু জায়গা বারকয়েক পেরল।

টর্চ নিবিয়ে বা দিকে তাকিয়ে ও আকাশের দিকে চেয়ে ঘোষ আন্দাজের চেষ্টা করে-সেই খুঁড়িগুলো পেরিয়ে এল কি না। সে আর কম্যাণ্ড্যান্ট ত তাদের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে গেল, তারপর নদীর পাড় দিয়ে এগল। তা হলে কি ওগুলো আসলে খুঁড়ি ছিল না? নদীর পাড়ই ছিল? কিন্তু তখন তা হলে সেটা নজরে পড়ল না? সে আর কম্যাণ্ড্যান্ট ত ঐ খুঁড়ির জল দেখলও কিছুক্ষণ।

ঘোষ দাঁড়িয়ে পড়ে। তার পথ ভুল হওয়া সম্ভব নয়। সোজা হাটছে।

কিন্তু আরো কয়েক পা গিয়ে তার মনে পড়ল–ওগুলো যদি খাড়িই হবে তা হলে গাড়িটা সেখান দিয়ে নামিয়ে তোলা হল কেমন করে? তা হলে নিশ্চয়ই খাড়ি ছিল না–পাড়টাই ভেঙে আর-একটু ভেতরে ঢুকে গেছে। কিন্তু সে আর কম্যাণ্ড্যান্ট ত সে-সব জায়গা দিয়ে হাঁটলও। তা হলে গাড়িটা চলেছে কিন্তু সে টের পায় নি নাকি? তার রাস্তা ভুল হচ্ছে না ত? ঘোষ দাঁড়িয়ে পড়ে।

দাঁড়িয়ে পড়ার পর সে পেছন থেকে হামলে পড়া বাতাসের আওয়াজ দুই কানের পাশে পায়। কিন্তু বৃষ্টি পায় না। তার ওয়াটারপ্রুফের ওপর বৃষ্টির ছাট লাগার আওয়াজ সঁ সঁ করে কানে বাজে। বৃষ্টিটা বোধ করার জন্যে সে ঘুরে দাঁড়ায়। মুখের চামড়ার ওপর বৃষ্টির ছাটগুলো একসঙ্গে এসে বেঁধে। ঘোষ আবার ঘোরে ও হাঁটতে শুরু করে। আর, কয়েক পা হাঁটতেই সে যেন চেনা জায়গার একটা আভাস পায়। সে দাঁড়িয়ে পড়ে টর্চটা জ্বেলে বাঁ দিকে আরো কয়েক পা হাটে, হ্যাঁ, তাদের ক্যাম্পের কাটাতারের বেড়া শুরু হল। সে তা হলে পথ হারায় নি। কিন্তু খাড়িগুলো গেল, কোথায়।

সেন্ট্রিবক্সের গেটটা খোলাই ছিল–গাড়ি গেছে। গেটটা পেরতেই ছপ করে জলে পা পড়ল। ঘোষ পায়ের কাছে টর্চ জ্বালে, গামবুটের নীচে ঘোলা জল, টর্চের আলোতে পাতলা দেখাচ্ছে। ফ্লাডের জল তা হলে ক্যাম্পে ঢুকে গেছে। টর্চ নিবিয়ে কয়েক পা ছপ ছপ করে হাঁটে ঘোষ। আকাশে খোলা চাঁদনি–তাতে মেঘ দেখা যায় বা মেঘের আভাস পাওয়া যায় মাত্র। এখন মাটির দিকে তাকালে জলে সেই মেঘের আবছায়া পাওয়া যায়। ঘোষ আবার টর্চ জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার টর্চের আলোকবৃত্তের মধ্যে জলের দ্রুত সরলরেখাগুলো পরস্পরের সঙ্গে না মিশে বা থেকে ডাইনে যাচ্ছে আর বৃষ্টির ছাটে। নুয়েপড়া ঘাসগুলো জলের টানে সোজা হয়ে যাচ্ছে।  

টর্চটা বাতাসে নাড়িয়ে ঘোষ আঁকে, এই, তোমরা এসে গেছ?

ক্যাম্পের বারান্দা থেকে টর্চ জ্বলে ওঠে, দু-তিনটে। ওরা চিৎকার করে কিছু বলে শোনা যায়, বোঝা যায় না। মাঠটা পেরিয়ে ঘোষ একেবারে গুদামের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় বারান্দার নীচেই গাড়িটা লাগিয়ে রেখেছে।

সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠতে-উঠতে ঘোষ বলে, জল ত ঢুকে গেছে।

 জোয়ানদের একজন বলে, হ্যাঁ স্যার। ওরা ত কেউ নামল না, আর্মারির বারান্দা থেকে। টর্চটা ধরো ত, গুদামের তালা খুলতে-খুলতে ঘোষ জিজ্ঞাসা করে, কী, জল কি বারান্দায় উঠবে নাকি?

তা ত উঠিবার পারে স্যার, যাওয়ার তানে ত জল না আছিল, আর এলায় ত সপসপাছে।

গুদামের দরজা খোলামাত্র বাতাসের ধাক্কায় কপাটটা পুরো খুলে আবার সেই খোলার বেগের প্রত্যাঘাতে ঘোষের মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যায়। গুদামের ভেতরে কোনো খালি টিন ছিল হয়ত–সেটা খুঁটির গায়ে লেগে ঝন ঝন আওয়াজ ওঠে। একসঙ্গে অনেকগুলো টর্চ জ্বলে ওঠে। ওরা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে।

শোনো, তোমরা যা টানতে পারবে, তাই নাও, শেষে রাস্তায় ফেলে দিতে না হয়।

 স্যার, এলায় ত নিগিবার কষ্ট হবে। একবস্তা চাউল আর একবস্তা আটা নিগিবার পারি।

তা হলে তাই নাও। আর ডালের ছোট বস্তা নাও একটা।

জোয়ানরা দু জন করে এক-এক বস্তা মুহূর্তে তুলে নেয়। একজন দরজাটা ধরে থাকে, দুটো বস্তা নিয়ে বারান্দার কিনারায় রাখে। ঘর থেকে ওরা বেরিয়ে গেলে ঘোষ টর্চ জ্বেলে দেখে কেরোসিনের একটা সিড় টিন নীচে আছে। একবার ভাবে, জোয়ানদের রওনা করে দিয়ে টিনটা তার ঘরে রেখে দেবে কিনা। মুহূর্তের মধ্যেই আবার ভাবে, পরে দেখা যাবে।

এই শোনো, ঘোষ দরজার দিকে টর্চ ফেলে। একজন জোয়ান এগিয়ে আসে।

এই টিনটা ঐ বস্তাগুলোর ওপর রেখে দাও, ঘোষ টর্চের আলো দেখায় জোয়ানটিকে। সে টিনটা তুলে চালের বস্তার ওপর রেখে ঠেলে দেয়।

জোয়ানরা সবাই নীচে নেমে গিয়েছিল। ঘোষ গুদামের দরজাটা বন্ধ করার জন্যে টানতেই বাতাসের ধাক্কায় একটা কপাট তার হাত থেকে ছিটকে যায়।

এই, একটু ধরো ত।

এক জোয়ান বারান্দার ওপর ভর দিয়ে উঠে আসে। সে দরজার কড়াদুটো টেনে ধরলে ঘোষ তালা লাগাতে পারে। জোয়ানটা আবার লাফিয়ে নীচে নামে। গাড়ির জোয়ালটা ততক্ষণে দু জন উঁচু করে তুলেছে, আর দুজন পেছনে হাত দিয়েছে।

এই, তোমরা বস্তা তোলার পর গুদামে ক বস্তা থাকল? ঘোষ বারান্দা থেকে সিঁড়ির দিকে যেতে-যেতে জিজ্ঞাসা করলে এরা থেমে যায়। কিন্তু কেউ আর-কিছু বলে না। একটু পর একজন হেসে ফেলে বলে, কিছু ত দেখি নাই রো, খপ করি ধইচছি, গট করি বাহির হছি। বলেও সে হে-হে করে হাসে, আরো দু-একটি অস্পষ্ট হাসির সঙ্গে নিজের স্বর মিলিয়ে।

আচ্ছা, আচ্ছা, যাও, আমি একটু আর্মারিটা দেখে যাই। 

ওরা একটা হ্যাঁচকা টানে গাড়িটা চালু করে, তারপর এগিয়ে যায়। আর ওদের দিকে পেছন ফিরে ঘোষ একবার বারান্দা ও সার-সার ঘরের দরজার ওপর দিয়ে টর্চটা ফেলে। বাতাসের আঘাতে দরজাগুলোতে আওয়াজ উঠছে। অথচ জনমনিষ্যি নেই। মাত্র এই একটু আগেও ত তাদের ক্যাম্পটা কী রকম গমগম করছিল, না?

সামনের মাঠটায় দাঁড়িয়েই ঘোষ আর্মারির দিকে টর্চ ফেলে, এই তোমরা ঠিক আছ ত?

 বারান্দা থেকে টর্চ জ্বলে, ঘোষ শুনতে পায়, হ্যাঁ স্যার, ঠিক আছি।

ঘোষ টর্চটা জ্বেলেই একটু এগিয়ে যায়। তারপর গলা তুলে বলে, কাল সকালে তোমাদের বদলি এলে তোমরা বাংলাদেশের ক্যাম্পে চলে যেও।

জল ত বাড়িবার ধরিছে। জল বাড়িলে বদলি আসিবে ক্যানং করি স্যার?

ঘোষ একটু ভাবে। তারপর আবার আর্মারির দিকে কয়েক পা এগিয়ে টর্চটা ফেলে দাঁড়ায়। পেছন থেকে একটা আওয়াজ পেল–গাড়িটা বোধহয় সেন্ট্রি বক্স পেরল।

শোনো, জল বাড়লেও কেউ-না-কেউ আসবে। আর বারান্দায় জল উঠলে তোমরা ছাতে চলে যেও। ঘোষ ছাতে টর্চ ফেলে–ভিজে ত্রিপলের ঢাকনাটা অন্ধকারের মত দেখাচ্ছে।

আমরা ঠিক আছি স্যার, ভাববেন না, বারান্দা থেকে জবাব আসে। ঘোষ এবার ঘুরে তাড়াতাড়ি গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করে।

.

১১৯.

বন্যার মুখে একটু ভেজা ধর্ষণ দিয়ে চরপর্বের শেষ অধ্যায়

 ঘাসবনে পা দিয়ে জলের ওপর টর্চটা ফেলে ঘোষ দেখে এখন জলের তলায় পুরো রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে-ঘাসগুলো সোজা হয়ে গেছে। এইটুকুর মধ্যেই কি জল আরো বাড়ল? ঘোষ ছপছপ করতে করতে গেটের কাছে পৌঁছয়। গেটটা খুলেই রেখে গেছে ওরা। বেরিয়ে গেটটা বন্ধ করার জন্যে ঘুরতেই সেন্ট্রিবক্সের তলা থেকে কেউ বেরিয়ে এসে ডাকে, বাবু।

ঘোষ চমকে যায়। টর্চটা জ্বালতেই মেয়েটি গেট দিয়ে বাইরে চলে আসে। গেটটা আর ঠেলে না দিয়ে টর্চটা জ্বালিয়ে রেখেই ঘোষ জিজ্ঞাসা করে, কী ব্যাপার?

না বাবু, মুই ক্যাম্পত যাম, তোমার নখত।

ক্যাম্প? কিসের ক্যাম্প?

বানভাসির ক্যাম্প বাবু। মোর গাঁওখান ভাসি গেইসে।

ও, ঘোষ গেটটা ঠেলে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে, মেয়েটিও তার পেছন-পেছন চলে। গাড়িটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে, বাতাসে আওয়াজ আসছে। এতক্ষণ বাতাস পিছে নিয়ে আসতে-আসতে তাড়াতাড়ি পা ফেলাটা যেন রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই ভাবে পা ফেলতে গিয়ে বাতাসের প্রথম ধাক্কায় একটু পেছিয়েই যায় ঘোষ। তারপর বুকটা ঝুঁকিয়ে হাঁটতে শুরু করে। আর মাঝে-মাঝে টর্চ ফেলে।

কয়েক পা যাওয়ার পর তার সন্দেহ হয় মেয়েটা কি আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে টর্চ ফেলে দেখে, মেয়েটা ত আসছেই। সঙ্গে একটা কুকুরও।

হাঁটতে-হাঁটতে ঘোষ জিজ্ঞাসা করে, তুমি কোন গাঁয়ের?

দক্ষিণপাড়ার বাবু।

 তুমি একা-একা এই রাত্তিরে যাচ্ছ কেন? তোমার বাড়ির সবাই কোথায়?

মোর ত বাড়ি নাই বাবু। মোর মানষিও নাই। মুই নিদ গেছু। আর-সব মানষি জল দেখি কোটত চলি গেইছে!

মেয়েটির কথা ঘোষ শুনতে পায় না। সে আর-একটু আস্তে হাঁটে, মেয়েটি প্রায় তার পাশাপাশি চলে আসে। তারও প্রায় পাশাপাশি সেই কুকুরটি।

তুমি গ্রামের লোকের সঙ্গে গেলে না কেন?

মোক ত ডাকছি। কিন্তুক মুই যেইলা গেইছি, দেখি নৌকা নাই।

ও। তোমাদের লোকজন নৌকো করে ক্যাম্পে গেছে? ঘোষের যেন খুব খারাপ লাগে না একা-একা যাওয়ার বদলে গল্প করতে করতে যেতে।

সব নৌকা করি চলি গেইল। তার বাদে মুই হাঁটা ধরিছু।

তুমি ওদের সঙ্গে গেলে না কেন, যারা গাড়ি নিয়ে গেল– ঘোষ হাত তুলে সামনেটা দেখায়।

ডর খাইছু বাবু। অত মানষি চিল্লাছে। ভাবিছু উমরায় আগত যাক, মুই পাছত-পাছত যাম। ত দেখি, তোমরালা একেলা আসিবার ধরিছু। স্যালায় ভাবিছু, এলায় এই বাবুটার সাথত যাম।

তুমি কি ইণ্ডিয়ার?

না বাবু, মুই কারো না হয়।

 না। তোমাদের গ্রামটা কি ইণ্ডিয়ায় না বাংলাদেশে?

না বাবু। মুই কারো না হয়।

তোমার বাড়ি নেই?

না বাবু। বাড়ি নাই রে।

তোমার কোনো লোকজনও নেই?

 না বাবু। মোর কুনো মানষি নাই।

তোমার ইণ্ডিয়া বাংলাদেশও নেই?

না বাবু। মুই কারো না হয়।

এ ছিটমহলের কোথায় কতটুকু ভারত, আর কোথায় কতখানি বাংলাদেশ বোঝা মুশকিল। মেয়েটি ইণ্ডিয়ারই কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে একটু ভেবে ঘোষ জিজ্ঞাসা করে, তুমি কার নাম শুনেছ রাজীব গান্ধী না এরশাদের?

না বাবু, মুই শুনো নাই রো। মুই নাম শুনো নাই।

 তোমার ওখানে ভোট ফর হয়? পঞ্চায়েত হয়?

হবা পারে বাবু। ভোট হবা পারে। হবা পারে।

ঘোষ বাঁয়ে তাকায়–ঘোলাটে চাঁদনি তিস্তার জলের ওপর পড়ে আছে এমন, মনে হচ্ছে তিস্তাটা একটা দেয়ালের মত আকাশে উঠে গেছে। ঘোষ ডাইনে তাকায়–দুই সীমান্তের মাঝখানে মালিকানাহীন প্রান্তর এখন জলে ডুবছে। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের দিকে বাতাস ফ্লাডের মতই ছুটে আসছে। ঘোষ মেয়েটির ওপর টর্চ ফেলে, দাঁড়িয়ে। মেয়েটিও দাঁড়িয়ে পড়ে। সে প্রথমে টর্চের দিকে তাকায়, তারপর চোখ কোচকায়। কুকুরটা মেয়েটির পায়ের কাছে টর্চের আলোর বৃত্তের মধ্যে এসে দাঁড়ায়।

কী দেখিলেন বাবু? মোক দেখিসেন?

টর্চ নিবিয়ে ঘোষ আবার হাঁটা শুরু করে। এত সপসপে ভিজে গেছে মেয়েটি যে দেখেও কিছু বোঝ যায় না। বাতাসের বেগ ঠেলে যেতে হচ্ছে বলেই হোক, বা অন্য কোনো কারণেই হোক, ঘোষের গতি একটু কমে আসে। ক্যাম্পে তার ঘরে নিয়ে যেতে পারলে মেয়েটিকে একটু শুকিয়ে দেখে নেয়া যেত। ক্যাম্পটা ত এখন সুনসান। যাওয়া যায়। কিন্তু আমারির বারান্দা থেকে ওরা যদি টর্চ ফেলে? ঘোষ আগে গিয়ে, মেয়েটিকে পরে আসতে বলতে পারে। কিন্তু মেয়েটি যদি তখন না আসে? সেন্ট্রি বক্সটায় যাওয়া যায় অবিশ্যি।

ঘোষ একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করে, ক্যাম্পে তোমার কে আছে।

কায়-না-কায় ত থাকিবে বাবু।

তোমার ত বাড়ির কেউ নেই বললে?

 না বাবু। মোর বাড়ি নাই রো।

না। বাড়ির লোকজনও ত কেউ নেই বললে?

না বাবু। মোর মানষি কুনো নাই রো।

 ইণ্ডিয়া বাংলাদেশও নেই?

 না বাবু। মোর ঐলা কিছু নাই রো।

তোমার দেশ নেই? একটা?

না বাবু। মোর দেশ নাই রে।

তা হলে ক্যাম্পে আর তোমার কে থাকবে?

 মানষিলা ত থাকিবে বাবু, বানভাসি মানষিলা।

গাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া জোয়ানদের অতর্কিত চিৎকার ঘোষ আর শুনতে পায় না। ওরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বা, তিস্তার আওয়াজটাই এখন প্রবলতর। তা হলে কি পায়ে-পায়ে ওরা তিস্তার কাছেই চলে এসেছে, পাড়ে? ঘোষ বায়েটর্চ ফেলে মাটিতে ঘোলাটে জল, তারপর তিস্তার ওপরের ঘোলাটে কুয়াশা। সেই আলোটাই ঘুরিয়ে মেয়েটার ওপর আবার ফেলে। মাথায় চুল থেকে সারাটা শরীর সপ সপ করছে, নিংড়োলে জল বেরবে। মেয়েটি এবার মুখ তুলে আবার জিজ্ঞাসা কর, কী দেখিসেন বাবু? নদীতে বান উঠিছে?

টর্চটা জ্বালিয়ে রেখেই ঘোষ মেয়েটির দুই কাঁধে হাত দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। মেয়েটির ঘাড়ের পেছন থেকে টর্চের আলো সীমান্ত-অন্তবর্তী এলাকায় অকারণ ছড়িয়ে থাকে। তাতে দেখা যায় কুকুরটা অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। এতদিন সীমান্তে সীমান্তে চাকরি করছে ঘোষ–সে নিশ্চিতরূপে জেনে যায় এই মেয়েটিও বর্ডারের আরো অনেক তাদের মত, যাদের বাড়িঘর নেই, মানুষজন নেই। এমন-কি। দেশটেশও নেই।

ঘোষ সেই আপাদমস্তক ভেজা মেয়েটাকে স্রোতের মত বাতাসের ভেতর ভেজা মাটিতে শোয়ায়।

চরপর্বটা এখানেই শেষ করা যায়। এর পর ত এই মেয়েটি ক্যাম্পে যাবে। সেখানে সে আরো সব বানভাসি মানুষের সঙ্গে থাকবে। সেই বানভাসি মানুষদের বেশির ভাগেরই পরিবার আছে, ঘরবাড়ি আছে, বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ত আছেই। আবার, এই মেয়েটির মত দু-চারজনও আছে। সেখানে মেয়েটি আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারবে। ঘোষ যে তাকে এই ভেজা শরীরে ভেজা মাটিতেই শোয়াল–সেটা তার জীবনে এতই ঘটেছে যে গল্প করার কিছু নেই।

পর্বের শেষ অধ্যায় হিশেবে ধর্ষণটা ঠিক লাগসই হল না। এ যেন প্রায় পরস্পরের সম্মতিতেই ঘটল। তবুও ত একটা ধর্ষণই, অসম্মতির কোনো সুযোগই যেখানে নেই। ক্যাম্পের বানভাসি লোকজন ত খানিকটা জানাই–সেখানে আর ফিরে যাওয়ার দরকার নেই।

বরং চরপর্ব এখানেই শেষ হোক।

.

 পাহাড়ের তলা থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা পর্যন্ত তিস্তার ভেতর ত কতই চর। কোনো চর ডাঙার চেয়েও স্থায়ী। কিন্তু ডাঙা যেমন ভাসে, এই সব চরও ত তেমনি ভাসতে পারে। প্রতি বছরই নানা বন্যার সময় এই সব চরে মানুষকে ঘরছাড়ার ভয় পেতে হয়।

চরে যারা আবাদ করে তারা জল আর মাটির সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্কটাকেই বড় করে দেখে। তেমন। ভাবনাচিন্তা করে দেখে না, শরীরের অভ্যাসে দেখে। ভাল মাটি, যদি খাটা যায় ফসলও পাওয়া যাবে। আর, সব জমিরই নিজস্ব ফসল আছে। সেইটি বুঝে নিতে হয়–কোন জমিতে কী ফলবে? আগে কেউ কখনো শুনেছে তিস্তার বালুবাড়িতে এত ভাল তরমুজ হয়?

জলের সঙ্গেও সেই মৈত্রীর সম্পর্কটাই অটুট থাকে। তুমি জলের একেবারে ভেতরে এসে ডাঙার ফসল ফলাচ্ছ–জল তার জায়গা ছেড়ে দিয়েছে বলেই না ফলাচ্ছ!

কিন্তু বছরের এই কয়েকটি মাসজলের সঙ্গে সেই মৈত্রীর সম্পর্কটা ভেঙে যায়। জল যে সব সময়ই তার হারানো জায়গার দখল নেয়, তা নয়। জলের শক্তি তখন মানুষের শক্তির চাইতে অনেক গুণ বেশি। তখন জলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে যাওয়ার মানে মৃত্যু, শত্রুতা করতে চাওয়ার মানেও মৃত্যু। তখন জলকে পথ ছেড়ে দিতে হয়। অনেক সময়ই দেখা যায়, জল নেমে গেলে মানুষ আবার তার পুরনো, ঘরবাড়ি ফিরে পায়। কিন্তু দু-একটা চর আর চর হয়ে জাগতে নাও পারে। সেই অনিশ্চয়তাটুকু থেকেই। যায়। তা থেকে পরিত্রাণ নেই, তা থেকে উদ্ধারও নেই। সেই কারণেই চরের মানুষ চর ছাড়তে-ছাড়তেও ছাড়ে না, যেন, না-ছাড়লেই চরটা তাদের থেকে যাবে।

জল, আকাশ, এর কোনো কিছুই ত দেশীয় সীমান্তের উর্ধ্বে নয়। বাতাসের আর, আলোর কোনো সীমানা নেই–তা ছাড়া সব কিছুরই আছে। সেই সীমানা যখন লোপাট হয়ে যায়, তখন সেই সীমানানির্ধারক শাসনকাঠামোও লোপাট। সীমানায়-সীমানায় এত ভাগাভাগি আঁটাআঁটি সত্ত্বেও ত কত মানুষমানুষীই আছে যাদের কোনো দেশই নেই, কোনো সীমান্তই নেই। সীমান্ত শুধু তাদের ধর্ষিত জীবনকে আরো একটু বিড়ম্বিত করে মাত্র! সে বিড়ম্বনা থেকে তিস্তা-পারেরও দেশহীন মানুষেরও কোনো মুক্তি নেই।

মুক্তি যখন নেইই, তখন চরপর্বের কাহিনী শেষ হোক-নদীর মত তরল মাটিতে নদীর মতই ভেজা মেয়েকে যখন সীমান্ত ভেঙে শুতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *