“পদিপিসী থপ করে মাটিতে থেবড়ে বসে বললেন-–‘চোপরাও শালা। নয়তো সব প্রাইভেট ব্যাপার। খবরের কাগজে ছেপে দেবা’ বলে কাগজপত্র বের করে ফেলে দিয়ে, ঐ-সব ধনরত্ন বর্মিবাক্সে ভরে নিয়ে, আবার রান্নাঘরে গিয়ে জলচৌকিতে বসে কড়াটা উনুনে চাপালেন। সারারাত ঘুমলেন না, বাক্স আগলে জেগে রইলেন, ভোর না-হতেই আবার গোরুর গাড়ি চেপে শালবনের মধ্যে দিয়ে লাল আলোয়ান গায়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।”
পাঁচুমামা এবার থামল। আর আমি মাথা বাগিয়ে জিগগেস করলাম–”তারপর?” এবং সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোকও নিশ্বাস বন্ধ করে বললেন–”তারপর? তারপর?” পাঁচুমামা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনার কী মশাই?” ভদ্রলোক অপ্রস্তুতপানা মুখ করে বললেন– “না, না– গল্পটা বড় লোমহর্ষণ কিনা–”
পাঁচুমামা আরো কি বলতে যাচ্ছিল, আমি হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে ইংরজিতে বললাম–”চুপ, চোখ ইজ জ্বলজ্বলিং।” পাঁচুমামা তাঁকে কিছু না বলে আবার বলতে লাগল–”এত কষ্ট করে পাওয়া বর্মিবাক্স নিয়ে পদিপিসী সারাদিন গোরুর গাড়ি চেপে বাড়িমুখো চলতে লাগলেন। দুপুরে সজনে গাছতলায় গাড়ি থামিয়ে খিচুড়ি আর সজনে ফুল ভাজা খাওয়া হল, তার পর আবার’গাড়ি চলল। এমনি করে রাত দশটা নাগাদ পদিপিসী বাড়ি পৌঁছুলেন। কেউ মনেই করে নি পিসী এত শিগগির ফিরবেন, সবাই অবাক। সবাই বেরিয়ে এসে পদিপিসীকে আর জিনিসপত্র পোটলা-পাটলি টেনে নামাল। তার পর গোলমাল, চ্যাঁচামেচি, ডাকাতের গল্প, অবিশ্যি ডাকাতের সঙ্গে খুড়োর যোগের কথা পদিপিসী ছাড়া কেউ সন্দেহও করে নি, পদিপিসীও চেপে গেলেন। হঠাৎ বাক্সটার কথা মনে পড়তে বগল থেকে সেটাকে টেনে বের করে দেখেন, যেটাকে বর্মিবাক্স বলে সযত্নে গাড়ি থেকে-নামিয়েছিলেন সেটা আসলে পানের ডিবে। বমিবাক্স পাওয়া যাচ্ছে না।”
পাঁচুমামা চোখ গোল করে চুল খাঁড়া করে চিঁচিঁ করে বলতে লাগল আর আমি আর সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক নিশ্বাস বন্ধ করে শুনতে লাগলাম। “সে বাক্স একেবারে হাওয়া হয়ে গেল। সেই রাতদুপুরে পদিপিসী এমন চ্যাঁচামেচি শুরু করলেন যে বাড়িসুদ্ধ সবাই যে যেখান থেকে পারে মশাল, মোমবাতি, লণ্ঠন, তেলের পিদিম জ্বেলে নিয়ে এসে এ ওর পা মাড়িয়ে দিয়ে মহা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পদিপিসী নিজে হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিলেন। বললেন, ‘নেই বললেই হল! এই আমার বগলদাবী করা ছিল, আর এই তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। একটা আধহাত লম্বা শক্ত কাঠের বাক্স একেবারে কর্পূরের মতন উড়ে গেল। একি মগের মুল্লুক?
“বলে গোরু খুলিয়ে, গোরুর গাড়ির ছাউনি তুলিয়ে, বাঁশের বাঁধন আলগা করিয়ে, গাড়োয়ানের দুহাতি ধুতি ঝাড়িয়ে আর রমাকান্তকে দস্তুর মতো সার্চ করিয়ে এমন এক কাণ্ড বাঁধালেন যে তার আর বর্ণনা দেওয়া যায় না। শেষে যখন গোরু দুটোর ল্যাজের খাঁজে খুঁজতে গেছেন তখন গোরু দুটো ধৈর্য হারিয়ে পদিপিসীর হাঁটুতে এইসা গুতিয়ে দিল যে পদিপিসী তখুনি বাবাগো মাগো বলে বসে পড়লেন। কিন্তু বসে পড়লে কি হবে, বলেইছি তো সিংহের মতন তেজ ছিল তার, বসে-বসেই সারারাত বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জাগিয়ে রাখলেন। কিন্তু সেবাক্স আর পাওয়াই গেল না। এতক্ষণ যারা খুঁজছিল তারা কেউ বাক্সে কী আছে না-জেনেই খুঁজছিল। এবার পদিপিসী কেঁদে ফেলে সব ফাঁস করে দিলেন। বললেন, “নিমাইখুড়ো আমাকে দেখে খুশি হয়ে ঐ বাক্স ভরে কত হীরে-মোতি দিয়েছিল, আর সে তোরা কোথায় হারিয়ে ফেললি।” তাই-না শুনে যারা খুঁজে-খুঁজে হয়রান হয়ে বসে পড়েছিল, তারা আবার উঠে খুঁজতে শুরু করে দিল। শুনেছি তিন দিন তিন রাত ধরে মামাবাড়িসুদ্ধ
কেউ খায়ও নি ঘুমোয়ও নি। বাগান পর্যন্ত খুড়ে ফেলেছিল। যাদের মধ্যে বিষম ভালোবাসা ছিল তারাও পরস্পরকে: সন্দেহ করতে লেগেছিল।”
আমি আর সেই চিমড়ে ভদ্রলোক বললাম, “তার পর? তার পর?” পাঁচুমামা বলল, “তার পর আর কি হবে? এক সপ্তাহ সব ওলটপালট হয়ে রইল, খাওয়া নেই শোয়া নেই, কারু মুখে কথাটি নেই। সারা বাড়ি সবাই মিলে তোলপাড় করে ফেলল। কত যে রাশি-রাশি ধুলো, মাকড়সার জাল, ভাঙা শিশি-বোতল, তামাকের কৌটো বেরুল তার ঠিক নেই। কত পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া চিঠি বেরুল; কত গোপন কথা জানাজানি হয়ে গেল; কত হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু পদিপিসীর বর্মিবাক্স হাওয়ায় উড়ে গেল। এমন ভাবে হাওয়া হয়ে গেল যে শেষ অবধি অনেকে এ কথাও বলতে ছাড়ল না যে বাক্স-টাক্স সব পদিপিসীর কল্পনাতে ছাড়া আর কোথাও ছিল না। কেবলমাত্র রমাকান্ত বার বার বলতে লাগল–নিমাইখুড়োর বাড়ি থেকে পদিপিসী যে খালি হাতে ফেরেন নি এ কথা ঠিক গোরুর গাড়িতে আসবার সময়ে বাক্সটা চোখে না-দেখলেও পদিপিসীর আঁচল চাপা শক্ত চৌকো জিনিসের খোঁচা তার পেটে লাগছিল, এবং সেটা পানের বাটা নয় এও নিশ্চিত, কারণ পানের বাটার খোঁচা তার পিঠে লাগছিল।
“বাক্সের শোকে পদিপিসী আধখানা হয়ে গেলেন। অত হীরে-মোতি লোকে সারাজীবনে কল্পনার চোখেও দেখে না আর সে কিনা অমন করে কোলছাড়া হয়ে গেল! শোকটা একটু সামলে নিয়ে পদিপিসী আবার রমাকান্তকে নিয়ে নিমাইখুড়োর খোঁজে গেছিলেন যদি কিছু পাওয়া যায়। গিয়ে দেখেন বত্রিশবিঘার শালবনের মাঝখানে নিমাইখুড়োর আড্ডা ভেঙে গেছে, জনমানুষের সাড়া নেই, বুনো বেড়াল আর হুতুমপ্যাচার আস্তানা। “তার পর কত বছর কেটে গেল। বাক্সের কথা কেউ ভুলে গেল, কেউ আবছায়া মনে রাখল। একমাত্র পদিপিসীই মাঝে-মাঝে বাক্সের কথা তুলতেন। আরো বহু বছর বাদে পদিপিসী স্বর্গে গেলেন। যাবার আগে হঠাৎ ফিক করে হেসে বললেন, এই রে। বাক্সটা কী করেছিলাম এদিন পরে মনে পড়েছে। বলেই, চোখ বুজলেন। তাই শুনে পদিপিসীর শ্রাদ্ধের পর আর-এক চোট খোঁজাখুজি হয়েছিল কিন্তু কোনো ফল হয় নি।”
চিম্ড়ে ভদ্রলোক বললেন, “তারপর?”
পাঁচুমামা বলল, “সেই বাক্স আমি বের করব। কিন্তু আপনার তাতে কী মশাই?”
পাঁচুমামা এইখানে চিম্ড়ে ভদ্রলোকের দিকে একদৃষ্টে কটমট, করে চেয়ে থাকার ফলে চিমূড়ে ভদ্রলোক উঠে গিয়ে সুড় সুড় করে নিজের জায়গায় বসে নিবিষ্ট মনে দাঁত খুটিতে লাগলেন ইতিমধ্যে বেশ রাত হয়ে যাওয়াতে তার স্ত্রী-পুত্র পরিবার সবাই ঘুমিয়ে-টুমিয়ে পড়ে একেবারে স্তুপাকার হয়ে রয়েছে দেখা গেল।
আমি আশা করে বসেই আছি পাঁচুমামা লোমহর্ষণ আরো কিছু বলবে, কিন্তু পাঁচুমামা দেখলাম চটিটি খুলে ঘুমোবার জোগাড় করছে। তাই দেখে আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক থাকতে না পেরে দাঁত খোটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “একশো বছর ধরে যা এত খোঁজা সত্ত্বেও পাওয়া যায় নি, তাকে যে আবিষ্কার করবেন, কোনো পায়ের ছাপ বা আঙুলের ছাপ জাতীয় চিহ্নটিহ্ন কিছু পেয়েছেন?”
পাঁচুমামা বলল, “ঠিক পাই নি, তবে পেতে কতক্ষণ? পদিপিসীর শেষ কথায় তো মনে হয় যে চোখের সামনেই কোথাও আছে, চোখ ব্যবহার করলেই পাওয়া যাবে। লুকিয়ে রাখবার তো সময়ই পান নি। আর মনে পড়ে যখন হাসি পেয়েছিল তখন নিশ্চয় চোরেও নেয় নি। কিন্তু পাঁচশোবার বলছি মশাই আপনার তাতে কী?” চিম্ড়ে ভদ্রলোক কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
সবাই শুয়ে পড়ল আর আমি একা জেগে অন্ধকার রাত্রের মধ্যে ঝোপেঝাড়ে হাজার-হাজার জোনাকি পোকার ঝিকিমিকি আর থেকেথেকে এঞ্জিনের ধোঁয়ার মধ্যে ছোট-ছোট আগুনের কুচি দেখতে লাগলাম। ক্রমে সে-সব আবছা হয়ে এল, আমার চোখের সামনে খালি দেখতে লাগলাম বড় সাইজের একটা বর্মিবাক্স, লালচে রঙের উপর কালো দিয়ে আঁকা বিকট হিংস্র এক মাছ প্যাটনের ড্রাগন, তার চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে, নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, জিভ লকলক করছে। আরো দেখতে পেলাম যেন বাক্সর চাকনিটা খোলা হয়েছে আর তার ভিতর পায়রার ডিমের মতন, মোরগের ডিমের মতন, হাঁসের ডিমের মতন, উটপাখির ডিমের মতন সব হীরেমণি আমার চোখ ঝলসে দিচ্ছে। হঠাৎ ঘচ করে ট্রেন থেমে গেল।
মামাবাড়ির স্টেশনে পৌঁছলাম গভীর রাতে স্টেশনের বেড়ার পেছনে কতকগুলো লম্বা-লম্বা শিশুগাছের পাতার মধ্যে একটা ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া সিরসির করে বয়ে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে জনমানুষ নেই। ছোট্ট স্টেশন বাড়ির কাঠের দরজার কাছে স্টেশনমাস্টার একটা কালো শেড় লাগানো লণ্ঠন নিয়ে হাই তুলছেন। পান খেয়েছেন অজস্র, আর বহুদিন দাড়ি কামান নি। একটা গাড়ি নেই, ঘোড়া নেই, গোরুর গাড়ি দূরে থাকুক, একটা বেড়াল পর্যন্ত কোথাও নেই।
আমি পাঁচুমামার দিকে তাকালাম; পাঁচুমামাও ফ্যাকাশে মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তখন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, “তুমি যে প্রায়ই বল আমরা এখানকার জমিদার, এরা তোমাদের প্রভুভক্ত প্ৰজা, এই কি তার নমুনা? আমি তো ভেবেছিলাম আলো জ্বলবে, বাদ্যি বাজবে, মালাচন্দন নিয়ে সব সারে সারে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার পর আমরা চতুর্দোলায় চেপে মামাবাড়ি যাব। গিয়ে গরম-গরম–”
পাঁচুমামা এইখানে আমার খুব কাছে ঘেঁষে এসে কানে-কানে বলল, “চোপ ইডিয়ট! দেখছিস না চার দিক থেকে অন্ধকারের মতন বিপদ ঘনিয়ে আসছে? রক্তলোলুপ নিশাচররা যাদের পিছু নিয়েছে তাদের কি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা শোভা পায়?”
চমকে উঠে বক্ততা থামিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেলাম একটা নিবুনিবু দু-সেলওয়ালা টর্চ জ্বেলে চিমড়ে ভদ্রলোক গাড়ি থেকে রাশিরাশি পোটলা-পাটলি ছেলেপুলে ও মোটা গিন্নিকে নামাচ্ছেন। তারা নামতে না-নামতেই গাড়িটাও ঘড়ঘড় করে চলে গেল, আর অন্ধকার লম্বা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে কেমন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল। তার মধ্যে শুনতে পেলাম পাঁচুমামা আমার ঘাড়ের কাছে ফোঁসফোঁস্
করে নিশ্বাস ফেলছে। এমন সময় অন্ধকার ভেদ করে কে চ্যাঁচাতে লাগল, “অ পাঁচুদাদা, অ মেজদিমণির খোকা। বলি এয়েচ না আস নি?” পাঁচুমামার যেন ধড়ে প্রাণ এল, খচমচ, করে ছুটে গিয়ে বলল, “ঘনশ্যাম এলি! আঃ বাঁচালি!”
ঘনশ্যাম কিন্তু পাঁচুমামার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল, “ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না পাঁচুদাদা। এ দিকে বড় গোরু তো আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়েছেন, কত টানাটানি করলাম, কত কাকুতিমিনতি করলাম, কত ল্যাজ মোচুড়ালাম। শেষ অবধি গাড়ির বাঁশ খুলে নিয়ে পেটের নীচে চাড় দিয়ে পর্যন্ত ওঠাতে চেষ্টা করলাম। সে কিন্তু নড়েও না, ঐরকম বসে ঘাস চাবায়।”
পাঁচুমামা বলল, “অ্যা ঘনশ্যাম। তবে কী হবে?”
ঘনশ্যাম বলল, “হবে আবার কী? চল দেখবে চলা”
আমরা সেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাঁকর-বেছানো প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেটের মধ্যে দিয়ে ওদিকে ধুলোমাখা রাস্তায় এসে পড়লাম। সেইখানে দেখি রাস্তার ধারে একটা গোরুর গাড়ি তার একটা গোরু পা গুটিয়ে: মাটিতে বসে-বসে দিব্যি ঘুমুচ্ছে, অন্য গোরুটা তার দিকে হতাশভাবে তাকিয়ে জাবর কাটছে।
সত্যি-সত্যি সে গোরু কিছুতেই উঠল না। তখন ঘনশ্যাম পাঁচুমামাকে আর আমাকে জিনিসপত্রসুদ্ধ গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে সেই গোরুটার জায়গায় নিজেই গাড়ি টানতে শুরু করে দিল। গাড়ি আমনি চলতে লাগল।
স্টেশন ছাড়িয়েই ডানহাতে পুরনো গোরস্থান। সেখানটাতে আবার মস্ত-মস্ত বুলো-ঝুলো পাতাওয়ালা উইলোগাছ জমাট অন্ধকার করে রয়েছে। সেখানে পৌঁছতেই পাঁচুমামা ফিসফিস করে আমাকে ইংরিজিতে বলল, “এখানে সব সিপাই বিদ্রোহের সময়কার কবর আছে।” অমনি ঘনশ্যাম গাড়ি থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বলল, “ইংরিজিতে সব ভূতের গল্প বললে ভালো হবে না পাঁচুদাদা। এইখানেই গাড়ি নামিয়ে চম্পট দেব বলে রাখলাম।”
পাঁচুমামা ব্যস্ত হয়ে বলল, “আরে ভূতের গল্প নয় রে ঘনশ্যাম। কবরের কথা বলছিলাম।” ঘনশ্যাম আরো বিরক্ত হয়ে বলল, “ভূতের কথা নয় মানে? কবর, আর ভূত কি আলাদা? ইংরিজি জানি না বলে কি তোমাদের চালাকিগুলোও ধরতে পারব না নাকি! না পাঁচুদা, আমার পোষাবে না” বলেই ঘনশ্যাম গাড়িটা দুম্ করে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
এমন সময় খটখট,-খটাখট শব্দ করে একটা ছ্যাকড়া গাড়ি এসে উপস্থিতা আমাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম সাদা ফ্যাকাশে মুখ করে চিম্ড়ে ভদ্রলোক জ্বলজ্বলে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পাঁচুমামা তথুনি হাত-পা ছুঁড়ে মূৰ্ছা গেল। ঘনশ্যাম বললে, “ইয়ার্কি ভালো লাগে না পাঁচুদাদা।” বলে আবার গাড়ি টানতে শুরু করল। পাঁচুমামাও রুমাল দিয়ে মুখ মুছে উঠে বসল। অনেক রাতে মামাবাড়ি পৌঁছলাম। মনে পড়ল পদিপিসীও এমনি দুপুর রাতে রমাকান্তকে নিয়ে নিমাইখুড়োর বাড়ি থেকে ফিরেছিলেন। সত্যি, বর্মিবাক্সটা গেল কোথায়? পাঁচুমামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “হাত থেকে পড়ে-উড়ে যায় নি তো?”
পাঁচুমামা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “সস চুপ, এটা শক্রর আস্তানা। বুক থেকে হৎপিণ্ড উভড়ে নিলেও পদিপিসীর বর্মিবাক্সর নাম মুখে আনবি না।”
গাড়িবারান্দার নীচে গোরুর গাড়ি নামিয়ে ঘনশ্যাম সিঁড়ির উপর বসে পড়ল। ঘরের মধ্যে থেকে প্যাঁচা, ফিঙে, নটবর, খেন্তি, পেঁচী, ইত্যাদিরা সব বেরিয়ে এল মজা দেখবার জন্যে। কিন্তু গাড়ি থেকে লটবহর নামাতে কেউ সাহায্যও করল না। পাঁচুমামাও নেমেই কোথায় জানি চলে গেল। শেষ অবধি আমি মনে-মনে ভারি রেগে জিনিসপত্র দুমদাম করে মাটিতে ফেলতে লাগলাম। সেই দুমদাম শুনে দিদিমা বেরিয়ে এসে আমাকে চুমুটুমু খেয়ে একাকার। দিদিমা আমাকে সেজ-দাদামশাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন।
দেখলাম সেজ-দাদামশাই ইয়া শিঙ-বাগানো গোফ, হিংস্র চোখ, দিব্যি টেরিকাটা চুল নিয়ে ইজিচেয়ারে বালাপোশ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। বুকের ভিতর ধক করে টের পেলাম শক্র নম্বর ওয়ান! সেজ-দাদামশাইকে প্রণাম করতেই একটু মুচকি হেসে আমাকে মাথা থেকে পা অবধি দেখে নিয়ে বললেন, “হুঁ।“
.
০৪.
ভীষণ রাগ হল। রেগেমেগে দিদিমার সঙ্গে খাবার ঘরে গিয়ে আমার দাদামশাই যে বড় পিঁড়িতে বসতেন তাতে আসন হয়ে বসে লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, ফুলকপির-ডালনা, চিংড়িমাছের মালাইকারি, চালতার অম্বল, রসগোল্লার পায়েস, এক নিশ্বেসে সমস্ত রাশি-রাশি পরিমাণে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষ হলে দেখলাম পাঁচুমামাও কোন সময় আমার পাশে বসে খুঁটে খুঁটে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
দু-একবার তাকালাম। পাঁচুমামার ভাবখানা যেন আমায় চেনেই না। তখন আমার ভারি দুঃখ হল। পাঁচুমামাও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু হাত ধোবার সময় কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস্ করে বলল,
“দুজনে বেশি ভাব দেখালে মতলব ফেঁসে যাবে। ওল্ড লেডি নম্বর ওয়ান স্পাই।” আমি একটু আপত্তি করতে গেলাম, কারণ দিদিমাকে আমার ভালো লাগছিল।
পাঁচুমামা বলল, “চোপ, আমার খুড়ি আমি চিনি না।”
পুরনো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, হাতে মোমবাতি নিয়ে দিদিমার সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় বিশাল এক শোবার ঘরে শুতে গেলাম। কতরকম কারুকার্য করা ভীষণ প্রকাণ্ড আর ভীষণ উঁচু এক খাটে শুলাম। সেটা এমনি উঁচু যে সত্যিকারের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তাতে উঠলাম। খাটের উপর আবার দু-তিনটে বিশাল-বিশাল পাশবালিশ। আর খাটের নীচে মস্ত-মস্ত কাঁসা-পেতলের কলসি-টলসি কি সব দেখতে পেলাম। দিদিমা একটা রঙচঙে জলচৌকির উপর মোমবাতিটা নামিয়ে রেখে আমাকে বেশ ভালো করে ঢাকা দিয়ে, মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আজ টপ করে ঘুমিয়ে পড় তো মানিক। আমি খেয়ে এসে তোমার পাশে শোব। কাল তোমাকে পদিপিসীর বর্মিবক্সর গল্প বলব। একা শুয়ে থাকতে ভয় পাবে না তো?” পদিপিসীর নাম শুনে আমার বুক ঢিপটিপ করতে লাগল। মুখে বললাম, “আলোটা রেখে যাও, তা হলে কিছু ভয় পাব না।” দিদিমা আদর করে চলে গেলেন। পাঁচুমামা কেন বলল স্পাই নম্বর ওয়ান!
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, যখন ঘুম ভাঙল দেখি ভোর হয়ে গেছে। দিদিমা কখন উঠে গেছেন। আমিও খচমচ করে খাট থেকে নেমে আস্তে-আস্তে গিয়ে ঘরের সামনের বাড়ান্দায় দাঁড়ালাম। দেখি ফুলবাগান থেকে, আর তার পেছনে আমবাগান থেকে কুয়াশা উঠছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। সেইজনেই হোক, কিংবা আমগাছতলায় যা দেখলাম সেইজন্যেই হোক, আমার সারা গা সিরসির করে উঠল। দেখলাম ছাইরঙের পেন্টেলুন আর ছাইরঙের গলাবন্ধ কোট পরে মুখে মাথায কম্ফটার জড়িয়ে চিম্ড়ে ভদ্রলোক চোখে বাইনাকুলার লাগিয়ে একদৃষ্টে বাড়ির দিকে চেয়ে রয়েছেন। তাই-না দেখে আমার টনসিল ফুলে কলাগাছ।