৩.৪ নিয়তির অন্ধ আঘাত

যে-জীবনকে কেন্দ্র করে এতগুলো চরিত্র একদিন আবর্তিত হতে শুরু করেছিল, তারা যে কে কোথায় জড়িয়ে পড়লো, নিয়তির অন্ধ আঘাতে কে কোথায় নিঃশেষে মিলিয়ে গেল তা নিয়ে যেন সদানন্দর ভাবনার কোনও দায় নেই। সে যেন পৃথিবীতে শুধু নির্বিকার নির্বিকল্প নিরঙ্কুশ আর নিঃসঙ্গ হয়ে বাঁচবার জন্যেই জন্মেছে। অথচ তাকে জড়িয়েই লোকের যত স্বপ্ন যত সাধ, যত সাধনা। সে নবাবগঞ্জ ছেড়ে চলে আসবার সঙ্গে সঙ্গে বুঝি তাই সব কিছু ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল। কালীগঞ্জের বউএর অপঘাতে মৃত আত্মা যেন তার সঙ্গে জড়িত সবগুলো মানুষকে পেছন থেকে তাড়া করে চলছিল তখনও।

বউবাজারের একতলার ঘরখানার বিছানার ওপর শুয়ে শুয়ে সদানন্দ সেই কথাই ভাবছিল। রাত তখন কত কে জানে। হয়ত শেষ রাতই হবে। কিংবা হয়ত মাঝরাত। জামার পকেটে তখনো সেই চিঠিখানা রয়েছে। সেখানা বার করে আবার সে পড়তে লাগলো। নিজে কাউকে সুখ দিতে পারেনি সে। সুখ দিতে হয়ত চেষ্টা করেও সুখ দিতে পারেনি। হয়ত চেষ্টা করে কোনও মানুষকে সুখ দেওয়া যায় না। কিন্তু দুঃখ দেওয়া তো সহজ। দুঃখ যে-কোনও মানুষ যে-কোনও মানুষকে দিতে পারে। তার জন্যে কষ্ট করার দরকার হয় না। আমাকে দুঃখ দিয়েছে আমার পূর্ব-পুরুষ, আমি তার দায়ভাগ নিয়ে দুঃখ দিয়েছি নয়নতারাকে। এমনি করে মানুষে মানুষে বংশপরম্পরায় সুখ-দুঃখের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে আছি। এই-ই আমার দুঃখ। এর থেকে আমি মুক্তি চাই। আমি সমস্ত শৃঙ্খল থেকে অব্যাহতি চাই। আমি নিজের মুক্তি চাই, সব মানুষকেও সুখ-দুঃখের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে চাই। তা হলে কেন আমি আবার এখানে এই সমরজিৎবাবুর পরিবারের সঙ্গে শৃঙ্খলিত হতে রাজি হলুম। কেন দাসখতে সই দিতে গেলুম।

সদানন্দ এবার স্থির সিদ্ধান্ত করে নিলে। সে বিছানা ছেড়ে উঠলো। আলনা থেকে নিজের জামাটা গায়ে গলিয়ে নিলে। তারপর আস্তে আস্তে দরজার খিলটা খুললে। না, আমি এখানে থাকবো না। তুমি সম্মতি দিলেও থাকবো না, অসম্মতি দিলেও থাকবো না। আমি কোথাও থাকবার জন্যে জন্মাইনি। চলাই আমার নিয়তি। সুতরাং তুমি ভয় পেও না। কারো ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কাজ আমার নয়। নয়নতারার ভবিষ্যৎ হয়ত আমি নষ্ট করেছি, কিন্তু তার দায়িত্ব তো আমার নয়। সে দায় আমার পূর্বপুরুষের। কিন্তু তুমি আমার কে? কেউই নও। তোমাকে আমি চাক্ষুষ কখনও দেখিইনি। আমাকে এ চিঠি না লিখলেও আমি এখানে থাকতুম না। একজনের ভবিষ্যৎও নষ্ট করেছি বলে তোমার ভবিষ্যৎ আমি নষ্ট করবো এমন পাষণ্ড আমি নই।

–কে? দাদাবাবু? কোথায় যাচ্ছেন?

অত রাত্রেও মহেশ ঠিক টের পেয়েছে।

সদানন্দ থমকে দাঁড়ালো! মহেশ কাছে এসে আলোটা জ্বালিয়ে দিলে।

–কোথায় যাচ্ছেন এত রাত্তিরে?

–আমি চলে যাচ্ছি মহেশ

–চলে যাচ্ছেন? কেন? কোথায়?

–তা জানি না। তুমি কাউকে বোল না। আর বলে দিলেও আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না।

বলে সদানন্দ সদর-দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো। অন্য দিন এই সময়েই সমরজিৎবাবু গঙ্গাস্নান করতে বেরোন। রাস্তার আলোগুলো বেশ ফিকে হয়ে এসেছে।

মহেশ পেছন থেকে বললে–আপনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন কিন্তু সেখানে তো কেউ নেই আপনাদের। আমি তো গিয়ে দেখে এসেছি। আপনাদের বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে।

–কেন? তারা সব কোথায় গেল?

–আপনার মা মাস কয়েক আগে মারা গেছে—

–তাই নাকি? তা হবে!

–আপনাকে বলিনি, বাবু বলতে মানা করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মায়ের মারা যাবার খবর শুনে আপনি কষ্ট পাবেন।

সদানন্দ কিছু বললে না। শুধু হাসলো একটু। মহেশ চেনে না সদানন্দকে, তাই ও কথা বললে। সমরজিৎবাবুই কি তাকে চিনতে পেরেছেন। নইলে তিনিই বা ও কথা বললেন কেন?

বললে–তুমি কাকাবাবুকে কিছু বোল না।

–তা না-হয় বলবো না, কিন্তু আপনি চলে যাচ্ছেনই বা কেন?

সদানন্দ এর উত্তর কি দেবে। আর দিলেই কি মহেশ বুঝতে পারবে? শুধু বললে– যাচ্ছি আমার আর থাকতে ভালো লাগছে না এখানে তাই। যাই–

মহেশ আরো একটু এগিয়ে এল। বললে–বাবু যদি আপনার কথা জিজ্ঞেস করেন তো কী বলবো?

সদানন্দ বললে–কেন, আমি যে কথাগুলো বলছি এই কথাগুলোই বোল। তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে হবে না–

–তা আবার আসবেন তো?

সদানন্দ বললে–না মহেশ, আমাকে আর আসতে বোল না, এখানে যেন আর আমাকে আসতে না হয়।

–আপনি এ বাড়িতে যতদিন ছিলেন বাবুর মনে তবু একটু সুখ ছিল। বাবুর মুখে হাসি বেরিয়েছিল

সদানন্দ বললে–বাবুর মনে হয়ত সুখ ছিল, কিন্তু তোমার বড়দাদাবাবুর মনে হয়ত কষ্ট হচ্ছিল।

এ কথার উত্তর মহেশ আর কিছু বলতে পারলে না। সদানন্দ আর না দাঁড়িয়ে সোজা হন হন করে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু কোথায় যাবে সে? কোন দিকে?

রাস্তায় তখন অল্প লোক চলাচল শুরু হয়েছে। কেউ যাচ্ছে শেয়ালদা স্টেশনের দিকে। কেউ বা গঙ্গাস্নান করতে। হ্যারিসন রোড ধরে সোজা চলতে চলতে একেবারে বড়বাজারের ধার পর্যন্ত একটানা চলে এল। বেশ সোজা মসৃণ রাস্তা। সদানন্দর জীবনের মত সর্পিল নয়, জটিলও নয়। কতদিন সমরজিৎবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এ সব রাস্তায় বেড়িয়েছে সে। কতদিন হাওড়া স্টেশনের প্লাটফরমের বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছে, আবার হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে এসেছে। কতদিন রাস্তার ধারে ফেরিওয়ালার বেচা-কেনা দেখেছে, ফেরিওয়ালার হারমোনিয়াম বাজিয়ে পায়ে ঘুঙুর পরে নেচে নেচে টোটকা ওষুধ দাঁতের মাজন বিক্রি করার কৌশল লক্ষ্য করেছে। এবার শুধু যাওয়ারই পালা, ফেরবার পালা নয়। আজও সে প্লাটফরমের বেঞ্চিতে গিয়ে বসতে পারে, কিন্তু যে বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে এসেছে, সে বাড়িতে আর সে ফিরতে পারে না।

–বাবুজী!

হঠাৎ ডাক শুনে সদানন্দ পেছনে ফিরে তাকালো। আরে, এ যে সেই পাঁড়ে পাঁড়েজী।

পাঁড়েজীর সঙ্গে অনেকদিন আগে ঘটনাচক্রে আলাপ হয়ে গিয়েছিল একদিন। এই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একদিন একটা ধর্মশালার সামনে পাঁড়েজী তাকে ধরেছিল। ভদ্রলোকের মত চেহারা দেখে বলেছিল বাবুজী একটা আংরেজী চিঠি পড়ে দেবেন হুজুর?

সদানন্দ বলেছিল—দাও—

বিরাট পাথরের তৈরি ধর্মশালা। পাঁড়েজী সেইখানকার খাস দারোয়ান। ভেতরে পাথর বাঁধানো উঠোন। সামনে বিরাট গেট। সেইখানে একটা কোণের দিকে পাঁড়েজীর থাকবার ঘর। চিঠিখানা তার মালিককে দেখাতে চায়নি। সেটা এসেছিল তার দেশের কাছারি থেকে। কে একজন আত্মীয় মারা গেছে। তার সম্পত্তির ভাগীদার ছিল পাঁড়েজী। চিঠিটা সেই সংক্রান্ত। চিঠিটা পড়ে দিয়ে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল সদানন্দ। থাকবার বেশ ভালো বন্দোবস্ত। তারপর আরো কয়েক দিন দেখা হয়ে গিয়েছিল পাঁড়েজীর সঙ্গে। সে-সব পুরোনো কাহিনী। আজ এতদিন পরে হঠাৎ আবার তার সঙ্গে দেখা।

জিজ্ঞেস করলে–কোথায় যাচ্ছো পাঁড়েজী?

পাঁড়েজী বললে–-গঙ্গায় গিয়েছিলুম নাইতে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

হঠাৎ সদানন্দ বললে–তোমার ধর্মশালায় থাকা যায় পাঁড়েজী? ঘর খালি আছে নাকি?

পাঁড়েজী বললে–আপনি থাকবেন? না আউর কোই থাকবে?

সদানন্দ বললে–আমিই থাকবো, আবার কে থাকবে?

–তা হলে আসুন আমার সঙ্গে–আমি তো এখন ধর্মশালায় যাচ্ছি।

সদানন্দ বললে–তোমার ঘর আছে, জানা রইল, যদি আসি তো আসবো। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি পাঁড়েজী–

পাঁড়েজী বললে–বাড়িওয়ালা তাড়িয়ে দিয়েছে বুঝি? তা থাকুন না। আমার সঙ্গেই থাকবেন, যেকদিন থাকতে চান থাকবেন–

বলে পাঁড়েজী চলে গেল। সদানন্দ আরো জোরে চলতে লাগলো। আরো আরো জোরে। আশ্চর্য, কলকাতার রাস্তার মত এত লম্বা রাস্তা বোধ হয় পৃথিবীর কোনও দেশে নেই। নবাবগঞ্জের রাস্তা বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেত। এখানে কিন্তু তা আর শেষ হয় না, ফুরোয় না, চলে চলে যেন আর তা অতিক্রম করতে পারা যায় না। এদিকে তখন লোকের চলাচল আরো বেড়েছে। ট্রামে বাসে লোকের ভিড় বাড়ছে। ফুটপাথেও ভিড় বাড়লো বেশ। সদানন্দ বড় রাস্তা ছেড়ে এবার পাশের একটা গলিতে ঢুকলো। এতক্ষণ সদানন্দর সেই বাড়ির কথা মনে পড়লো। এতক্ষণে তার চলে আসার খবরটা বোধ হয় কাকাবাবুর কানে গেছে। কাকীমা হয়ত খবরটা পেয়ে কাকাবাবুর কাছে এসেছে। দুজনে মিলে মহেশকে জিজ্ঞেস করছেন–দাদাবাবু কেন গেছে। যাবার সময় কী বলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে। দুজনের প্রশ্নের হয়ত আর শেষ নেই তাঁদের। এমন করে এত যত্ন কেউ যে পায়ে ঠেলতে পারে এ কথাটা তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। কিন্তু আর একটা ঘরে? আর একটা মানুষের অন্তরের অন্তঃপুরে?

হঠাৎ একটা আচমকা আনন্দ যেন সদানন্দকে একেবারে বিভ্রান্ত করে দিলে।

হাঁটতে শুরু করে কোথা দিয়ে তখন কোথায় চলে এসেছিল সদানন্দ সেদিকে খেয়াল ছিল না তার। চারদিকে চেয়ে যেন তার চমক ভাঙলো। বড়বাজার থেকে একেবারে শেয়ালদ’  স্টেশনের প্লাটফরম। সমস্ত লোকজন একটা নির্দিষ্ট দিকে লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে। পাশেই দাঁড়ানো একটা ট্রেন। ট্রেনটা বুঝি তখনই ছেড়ে দেবে, ইঞ্জিনটা দূরে ফোঁস ফোঁস করে তাই সকলকে জানিয়ে দিচ্ছে, তাই সকলের এত ব্যস্ততা! সবাই ছুটছে।

কিন্তু ও কে? নয়নতারা না! সদানন্দ আরো জোরে পা দুটোকে চালিয়ে দিলে। পাশে ও কে? কার সঙ্গে এত তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠতে যাচ্ছে! না কি ভুল দেখছে সদানন্দ। চোখ দুটো দুই হাত দিয়ে ভাল করে মুছে নিলে সে। নয়নতারাই তো। অন্তত পেছন থেকে ঠিক সেই রকম। পাশ থেকে আধখানা মুখ দেখা যাচ্ছে। মাথায় ঘোমটা নেই। পাশে পাশে যে যাচ্ছিল, তার সঙ্গে খুব কথা বলছে। এখানে নয়নতারা কোত্থেকে এল! এই কলকাতায়!

আশেপাশে সামনে অনেক লোকের আড়াল পড়ছে বার বার। ওগো তোমরা সরে যাও, দেখি আমাকে ভাল করে দেখতে দাও, তোমরা আড়াল কোর না। সদানন্দ আরো জোরে পা চালাতে লাগলো। কিন্তু ওরা তখনও অনেক দূরে। এদিকে ট্রেনের গার্ড বাঁশি বাজিয়ে দিলে। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠলো। ইঞ্জিন থেকেও হুইসল বাজলো।

নয়নতারা পেছনে আর সঙ্গের ছেলেটা তখন আরো সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। ট্রেনটা চলতে আরম্ভ করতেই ছেলেটা আগে উঠে পড়েছে। উঠেই নয়নতারার একটা হাত ধরে তাকে কামরার ভেতর তুলে নিলে।

এবার পাশ থেকে সদানন্দ নয়নতারার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলে। একেবারে স্পষ্ট। হ্যাঁ আর কোনও সন্দেহ নেই, একেবারে নয়নতারাই ঠিক।

সদানন্দর কী মতিভ্রম হলো। সে চিৎকার করে ডাকলো—নয়নতারা—নয়নতারা–

সদানন্দর গলার আওয়াজটা প্রথমে নিখেলেশের কানে গেল। বললে–তোমার নাম ধরে কে যেন ডাকলো মনে হচ্ছে?

নয়নতারা বললে–কী যে তুমি বলো? আমার নাম ধরে এখানে আবার কে ডাকবে? এখানে আবার আমাকে কে চেনে?

বলে জানলা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করলে।

সদানন্দকে নয়নতারা দেখতে পেলে না, কিন্তু সদানন্দ দেখতে পেলে–সেই নয়নতারা। কোনও ভুল নেই আর। একেবারে অবিকল নয়নতারা। কিন্তু সঙ্গে কে? নয়নতারা কলকাতায় এসেছে কেন?

ট্রেনটি তখন হু-হু শব্দে প্লাটফরম পেরিয়ে দূরের দিকে মিলিয়ে যেতে লাগলো।

.

ট্রেনটা মিলিয়ে গেল বটে কিন্তু সদানন্দ অনেকক্ষণ সেই প্লাটফরমের ওপরেই হতভম্বের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। যেন এতদিন ধরে যে বইটা সে পড়ে আসছিল সেই বইটার পাতাগুলো হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া লেগে সব ওলট-পালোট হয়ে গেছে আর তারপর সেই ঝড় একেবারে বইটার প্রথম পৃষ্ঠাটাতেই এসে ঠেকেছে। বইটা যে কতদূর সে পড়েছিল তাও আর তখন তার মনে নেই, শুধু প্রথম শব্দটাই তখন তার চোখের ওপর জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠতে লাগলো–নয়নতারা, নয়নতারা—নয়নতারা–

ওই একটা শব্দ! ওই ‘নয়নতারা’ শব্দটা দিয়েই যেন তার জীবনের গ্রন্থ শুরু হয়েছিল। এতদিন পরে যখন শেষের দিকেই তার এগিয়ে যাবার কথা, তখন এ কোন্ ঝড়ের দাপটে আবার সে প্রথম পৃষ্ঠায় শব্দটায় এসে পৌঁছুল!

সত্যিই তো! নয়নতারাই তো! নয়নতারা ছাড়া আর কেউই তো নয় ও। ও যদি নয়নতারাই হয় তো সঙ্গে ও কে?

মহেশের কথাগুলো মনে পড়লো। মহেশ আজ ভোরবেলা তাকে বলেছিল–নবাবগঞ্জের বাড়িতে সে গিয়েছিল, সে দেখে এসেছে সেখানে তারা কেউ নেই। কেউ নেই তো গেল কোথায় তারা। তবে কি নবাবগঞ্জের সেই বাড়ি, সেই বাগান, সেই ক্ষেত-খামার, সব হাত বদল হয়ে গেছে? মা মারা যাবার পর কি তবে তাদের সংসার এমন করে ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে গেল যে কারোর পক্ষেই আর সেখানে থাকা সম্ভব হলো না?

মহেশ যখন তাদের নবাবগঞ্জের বাড়ির কথা বলেছিল তখন সে সম্বন্ধে তার জানবার কোনও আগ্রহ ছিল না। যে-জীবন সে সেচ্ছায় ত্যাগ করে এসেছে সেখানে ফিরে যাবার যখন কোনও প্রশ্ন আর নেই তখন কেনই বা তার আগ্রহ থাকবে! কিন্তু আজ মনে হলো মহেশের সঙ্গে আর একবার দেখা হলে ভাল হয়। আর একবার দেখা হলে সে জিজ্ঞেস করবে কার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, কে কী বললে! নয়নতারা সম্বন্ধে কেউ কিছু বলেছে কিনা, সে কোথায় গেছে তাও কেউ জানে কি না! ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা তার হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করতে লাগল।

ট্রেন চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্লাটফরমের ভিড় তখন পাতলা হয়ে গেছে।

সদানন্দ আবার ফেরবার জন্যে উল্টোদিকে চলতে লাগলো। কিন্তু কোথায়ই বা যাবে সে! যে-মানুষ নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, পৃথিবীর আদর-যত্নে যার কোন স্পৃহা নেই, সারা পৃথিবীটাই তো তার ঘর হওয়া উচিত। এখানে এই ফাঁকা প্লাটফরমের ওপরেই সে বসে পড়তে পারে, এটাকেই তার বাড়ি মনে করতে পারে সে। মাথার ওপরের আকাশটাই তার বাড়ির ছাদ, আর এই চারদিকের লোকজন-চিৎকার-রোদ-আলো-অন্ধকার, স্নেহ-ভালবাসা, ঘৃণা–এই-গুলোই তার ঘরের চারটে দেয়াল। এককথায় এই পৃথিবীটাই তার সংসার।

কিন্তু না, সংসারী লোকের পক্ষে এ রকম সংসার তো হতে পারে না। সংসারী লোকের জন্যে চাই খানিকটা আড়াল, চাই একটুখানি আব্রু। সদানন্দ নিজের মনেই বিচার করতে লাগলো। সে সংসারী লোক, না সংসার ছাড়া? সংসার-ছাড়া লোককেই তো লোকে লক্ষ্মীছাড়া বলে। লক্ষ্মীকে তো পায়ে ঠেলেছে সে। যে-লক্ষ্মী নিজে তার কাছে এসেছিল সে লক্ষ্মীকেই সে ইচ্ছে করে বিদায় দিয়েছে। লক্ষ্মীকে সে চায়নি। তার মনে হয়েছে যারা লক্ষ্মীকে ঘরে বন্দী করেছে তারা লক্ষ্মীর আশীর্বাদই পায়নি। লক্ষ্মীকে সকলের মধ্যে বিতরণ করে দিতে হবে। এমন করে বিতরণ করতে হবে যাতে সবাই লক্ষ্মীর ভাগ পায়। কিন্তু কোথায় তা ঘটছে? কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তীও তা করেননি, নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীও তা করেননি। এমন কি বউবাজরের সমরজিৎবাবুও লক্ষ্মীর প্রসাদ পাননি। সবাই শুধু লক্ষ্মীর অপমানই করেছে। কিন্তু এই সকলের সঙ্গে অসহযোগিতা করেই কি সে লক্ষ্মীর অপমানের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়?

হঠাৎ তার খেয়াল হলো যে নিজের অজ্ঞাতসারে কখন সে আবার বউবাজারের সেই গলিটার কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে। ভোররাত্রে যে বউবাজারের বাড়িটা থেকে সে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছিল আবার কেন সে সেখানেই এসে দাঁড়ালো? কার আশায়? তবে কি সে সত্যি-সত্যিই নয়নতারার খবর নেবার জন্যে এত আগ্রহী!

কিন্তু যে বাড়ি থেকে সে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে, সে বাড়িতে সে আবার কেমন করে ঢুকবে? কেমন করে সেখানে গিয়ে বলবে যে সে এসেছে!

সমরজিৎবাবুর কাছে তার আসার খবরটা পৌঁছলেই তিনি হয়ত তাকে ডেকে পাঠাবেন।

জিজ্ঞেস করবেন কী হলো, শুনলুম তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলে?

সদানন্দ বলবে–হ্যাঁ, চলে গিয়েছিলুম–

–কিন্তু কেন? কেন তুমি চলে গিয়েছিলে?

সদানন্দ বলবে–চলে গিয়েছিলুম, কারণ এখানে আপনার বাড়ির লক্ষ্মীর অপমান হয়েছে–

–লক্ষ্মীর অপমান? সে আবার কী? আমি তো তোমার কথার মানে বুঝতে পারছি না! সদানন্দ তখন নিজের কথাই ভালো করে বুঝিয়ে বলবে–একদিন আমি যেকারণে বাড়ি থেকে চলে এসেছিলুম, সেই দুর্যোগ আপনার এবাড়িতেও ঘটেছে কাকাবাবু। আপনার অনেক অর্থ আছে, সেই অর্থ আপনার পূর্বপুরুষ কী করে উপার্জন করেছেন তা আমি জানি না, যদি সৎ পথে সে অর্থ না এসে থাকে তো আমি সে অর্থ নিজের ব্যবহারের জন্যে নিতে পারি না–

সমরজিৎবাবু হয়ত সদানন্দর কথা শুনে অবাক হয়ে যাবেন। বলবেন–তুমি কি পাগল হয়ে গেছ সদানন্দ? এসব কথা তো পাগলে বলে! তোমার মত কথা বললে কি সংসার চলতো?

সদানন্দ বলবে–আপনার ছেলে মাতাল, আপনার ছেলে চরিত্রহীন, এটা দেখে যেমন আপনার খারাপ লাগছে তেমনি আপনার পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধেও তো তাই ভাবা উচিত। তাঁরা মাতাল ছিলেন কিনা, তাঁরা চরিত্রহীন ছিলেন কিনা তা নিয়ে কি আপনি কখনও ভেবেছেন? তাঁরা তেমনি প্রজাদের ওপর অত্যাচার করেছেন কিনা তারও কি বিচার করেছেন? তাঁরাও তেমনি খারাপ ছিলেন কিনা তাও তো ভাবতে হবে। তাঁদের কোনও পাপ থাকলে আপনাকে তো তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!

সমরজিৎবাবু সদানন্দের এই যুক্তি শুনে হয়ত আবাকই হয়ে যাবেন।

সদানন্দ আবার বলবে–আমি জানি কাকাবাবু, আপনি আমাকে পাগল বলবেন, আপনি আমার কথা শুনে হাসবেন। শুধু আপনি কেন পৃথিবীর সব লোকই আমার কথা শুনে বলবে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু লোকের কথা শুনে আমি চলবো, না লোকে আমার কথা শুনে চলবে? কোনটা ভাল আপনিই বলুন?

কিন্তু কথাবার্তাগুলো সবই আনুমানিক। এ-সব কথাবার্তা হয়ত হবেও না। হয়ত তাঁর কাছে তার আসার খববটাও পৌঁছবে না। শুধু মহেশকে ডেকে সদানন্দ তার প্রশ্নগুলো করেই আবার চলে আসবে।

–আচ্ছা মহেশ, তুমি তো নবাবগঞ্জে গিয়েছিলে, তা সেখানে কী কী দেখে শুনে এলে?

মহেশ বলবে–আমি তো বলেছি আপনাকে সেখানে আপনাদের বাড়ির কেউই নেই। আপনার ঠাকুর্দাদা মারা গেছেন, আপনার মা মারা গেছেন। আপনার বাবা…….

–আমি তাদের কথা বলছি না, নয়নতারা কোথায় আছে কিছু শুনেছ?

–নয়নতারা? নয়নতারা কে?

সদানন্দ বলবে–আমার স্ত্রী—

মহেশ হয়ত কিছু একটা উত্তর দিত, কিন্তু তার আগেই সদানন্দ একেবারে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছে। যে বাড়িটা থেকে ঘণ্টা কয়েক আগে সে চলে এসেছিল সেই বাড়িটার সামনেই তখন বেশ চড়া রোদ উঠেছে। আর তার সামনে অনেক লোকও জড়ো হয়েছে। অত লোক কেন ওখানে? কিসের ভিড় ওদের ওখানে? ওরা কী করছে?

দূরে রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সদানন্দ দেখতে লাগলো। আস্তে আস্তে যেন লোকের ভিড় বাড়তে লাগলো সেই বাড়িটার সামনে।

সদানন্দ সেখান থেকে চলে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। সেখানে দাঁড়িয়েই দেখলে সমরজিৎবাবুর ছেলে একটা জীপ গাড়ি করে এসে দাঁড়ালো। সেই বড়বাবু। সঙ্গে সঙ্গে আরো কয়েকজন লোক তার দিকে এগিয়ে এল। সকলের মুখই যেন গম্ভীর-গম্ভীর। যেন কী একটা আকস্মিক বিপদপাতে সকলেই হতচকিত। তবে কি জানাজানি হয়ে গিয়েছে যে, সমরজিৎবাবু তাঁর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কোন এক সদানন্দ চৌধুরীকে উইল করে দিয়ে দিয়েছে? তাতেই কি এত ভয়? তাতেই কি এত উত্তেজনা?

কিন্তু মহেশকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মহেশকে দেখতে পাওয়া গেলে তা জিজ্ঞেস করা যেত। বাড়ির মধ্যে মহেশই একমাত্র লোক যাকে জিজ্ঞেস করলে সমস্ত খবর সঠিক ভাবে পাওয়া যেত।

একজন বাইরের লোক সদানন্দের সামনে এসে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলে—

এখানে কী হয়েছে মশাই?

সদানন্দ বললে–আমি কিছু জানি না–

লোকটা কৌতূহলী প্রকৃতির। সে রাস্তার ভেতরের দিকে আরো এগিয়ে গেল। রাস্তায় চলতে চলতে ভিড় দেখে যারা অনাবশ্যক কৌতূহলী হয়ে ওঠে, লোকটা সেই জাতের।

চড়া রোদ মাথার ওপর তখন আরো চড়া হয়ে উঠলো। কিন্তু তবু যেন কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। একবার মনে হলো সে-ও কাউকে জিজ্ঞেস করে–ওখানে কী হচ্ছে? কিন্তু যেন কেমন সঙ্কোচ হতে লাগলো। কাকে সে জিজ্ঞেস করবে? কেউ যদি তাকে চিনে ফেলে! এতকাল ধরে এই বাড়িতে সে কাটিয়েছে, এতকাল ধরে এ-পাড়াতে সে বাস করে এসেছে, অনেকেই তার মুখ চেনে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আপনি এখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

হঠাৎ একটা চেনা-মুখ ভিড়ের মধ্যে ঢুকলো। সঙ্গে-সঙ্গে আরো একটা চেনা মুখ। সেই মানদা মাসি! আর তার পেছন-পেছ বাতাসী।

ওরা এসেছে কেন? ওরা কী করতে এসেছে?

হঠাৎ সমস্ত চিন্তাশক্তি যেন অসাড় হয়ে এল তার। আগের দিনই যাঁর সঙ্গে এত কথা বলেছে, তাড়াতাড়ি তাঁর এই পরিণতি সে কল্পনা করতে পারেনি। চব্বিশ ঘণ্টা আগেও তাঁর উদ্বেগ ছিল কেমন করে তাঁর পূর্বপুরুষের সমস্ত স্মৃতির পুঁজি সদানন্দ চৌধুরীর ওপর গচ্ছিত রেখে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে বিদায় নেবেন। সে ইচ্ছে তাঁর পূরণ হয়েছে। কিন্তু যাবার আগে তিনি জেনে যেতে পারেননি তাঁর সমস্ত ইচ্ছে বানচাল করে দিয়ে আর একজন অজ্ঞাতে তাঁকে প্রতারিত করেছে! জানতে পারেননি সদানন্দ চৌধুরী তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক কপর্দকও স্পর্শ করেনি। না জেনেছেন ভালোই হয়েছে, জানতে পারলে তাঁর মৃত্যুও হয়তো শান্তির মৃত্যু হতো না।

হয়ত এই-ই হয়। সংসারে এই জিনিস ঘটে বলেই সংসারকে মানুষ মায়া বলে। সেই জন্যেই হয়ত মানুষ মায়ার বন্ধন কেটে জীবদ্দশাতেই বাণপ্রস্থ অবলম্বন করে মুক্তির সন্ধান খোঁজে।

সামনে দিয়ে সমরজিৎবাবুর মরদেহটা শ্মশানের দিকে চলতে লাগলো।

সদানন্দ সমজিৎবাবুর সেই মরদেহের সামনে মাথা নিচু করে দুই হাত জুড়ে উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালো। মনে মনে সেই অদৃশ্য আত্মাকে উদ্দেশ্য করে জানাতে লাগলো–আমি আপনাকে প্রণাম করি, আপনার অনন্ত বেদনা আর অফুরন্ত মমতাকে আমি প্রণাম করি। আপনার দেওয়া সম্পত্তি গ্রহণ না করে আমি যে আপনার অজ্ঞাতসারে চলে যাচ্ছি এর জন্যে আমি দুঃখিত, কিন্তু আপনাকে আমি সম্মান করি বলেই অপরকে বঞ্চিত করার কলুষ থেকে আমি নিজেকে মুক্ত রাখলাম। আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন।

মরদেহটা ধীর গতিতে দূরে চলে গেল। মহেশের সঙ্গেও আর দেখা করা হলো না। অথচ মহেশের সঙ্গে দেখা করবার জন্যেই সে এখানে এসেছিল। আর এখানে না এলে কি সে জানতে পারতো যে এ বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তার চিরকালের মত শেষ হয়ে গেছে।

সদানন্দ রাস্তায় চলতে চলতে ভাবতে লাগলো যে-সম্পত্তির জন্যে সমরজিৎবাবুর এত উদ্বেগ শেষ পর্যন্ত তা কার ভোগে লাগবে কে জানে! আজ রেজিস্ট্রি অফিসে সমরজিৎবাবুর উইল রেজিস্ট্রি হবে কি না তা জানতেও পারবে না সে। আর জানবার দরকারও বোধ হয় হবে না।

হঠাৎ দেখলে সামনে দিয়ে মহেশ দৌড়তে দৌড়তে যাচ্ছে—

সদানন্দ ডেকে উঠলো–মহেশ–মহেশ–

কিন্তু গলা দিয়ে তার একটুকু শব্দ বেরোল না। যে অপ্রত্যাশিত ঘটনা সকাল বেলা ঘটে গেল তা জীবনে, এর পরে মহেশের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে গেল। আর তা ছাড়া মহেশকে ডেকে সে কী প্রশ্নই বা করবে? নয়নতারার কথা জিজ্ঞেস করতেই তো এসেছিল মহেশের কাছে। কিন্তু এই অসময়ে কি কাউকে নয়নতারার কথা জিজ্ঞেস করা যায়?

অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ বড়বাজারের সেই ধর্মশালাটার কথা মনে পড়লো।

.

বড়বাজারের ধর্মশালাটা কোনও দানশীল লোক পরলোকে স্বর্গপ্রাপ্তির আশায় একদিন শহরের বুকের ওপর প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল। হয়ত কোনও অবাঙালী। ভেবেছিল এই শহর থেকে তো অনেক পয়সাই কামানো গেল। এইবার পুরুষানুক্রমে এই শহরের ঋণ শোধ করা যাক। হয়ত কোনও অবাঙালী কর্তাবাবুরই কীর্তি এটা। তখনকার দিনে এর উপযোগিতা ছিল অনেক। যারা পরেশনাথের মন্দির, হাওড়ার পুল, কি গঙ্গা-মাই, কিম্বা কালীঘাট দর্শন করতে আসতো তাদের এটা কাজে লাগতো। তারপর কলকাতা ধনে-জনে আরো পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু এর সমৃদ্ধি ক্রমেই কমে গেছে। ভারতবর্ষে আরো অন্য কয়েকটা শহর কলকাতার চেয়ে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছে। যারা একদিন কলকাতাকে শোষণ করেছিল তারা আর নেই। কিন্তু তাদের বংশধররা এখন আর সোজা পথে শোষণ করে না। তাদের হাতে আছে দিল্লী। সেই দিল্লীর মসনদে যারা বসে আছে তাদের হাত দিয়ে এমন কলকাঠি নাড়ে যাতে শোষণ বলে মনে হয় না। মনে হয় গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের আড়ালে কার কোন্ কারচুপিতে রাতারাতি একটা রাজ্য বড়লোক হয় আবার আর একটা রাজ্য মুমূর্ষ হয়ে ধোঁকে। সেই ব্রিটিশ আমলের শেষ দিক থেকেই এটা চলে আসছে। ১৯১২ সালে যখন রাজধানী চলে গেল দিল্লীতে, তখন থেকেই। কিন্তু যখন কলকাতা থেকে আস্তে আস্তে সবই চলে গেল তখন ইংরেজদেরও বোধ হয় নাভিশ্বাস উঠেছে এখানে। তারা চলে গেল বটে, কিন্তু শোষণ থামলো না। শুধু হাতবদল হলো ১৯৪৭ সালের পর থেকে।

কলকাতা একটার পর একটা অনেক বিপর্যয় দেখেছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর থেকে যে-বিপর্যয় দেখতে শুরু করলো তার বুঝি আর তুলনা নেই। তখন কেবল শুরু হলো ভাঙার ইতিহাস। রাস্তায় তখন একবার গর্ত হলে আর সে গর্ত মেরামত হয় না। ভিড়ের জ্বালায় তখন মানুষ আর নড়তে পারে না। দেশ ভাগ করে দুঃখ ভোগ করার দায় কেবল বাঙালীদের ঘাড়েই যেন বেশি করে চাপলো। তখন কলকাতার গর্ব করার মত সব কিছুই চলে গেছে। থাকবার মধ্যে রইলো কেবল গোটাকতক ধর্মশালা এখানে ওখানে ছড়িয়ে। সেগুলো অন্য শহরে কাঁধে করে তুলে নিয়ে যায় না বলেই রয়ে গেল।

–পাঁড়েজী!

ধর্মশালার সামনে গিয়ে সদানন্দ দেখলে সেখানেও ভিড়। রাজ্যের ভিখিরি এসে সদরের সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের হাতেই থালা-গেলাস মগ, একটা-না-একটা কিছু রয়েছে।

একেবারে গেটের সামনেই একজন কে দাঁড়িয়ে ছিল। সদানন্দ তাকেই জিজ্ঞেস করলে– পাঁড়েজি, পাঁড়েজী নেই?

লোকটা বললে–পাঁড়েজি বাইরে গেছে, কোঠিমে নেই হ্যায়–

সদানন্দ আবার ফিরে এল। অথচ পাঁড়েজীই তাকে আসতে বলেছিল। পাঁড়েজীকে কথা দিয়েছিল সে এখানে এসে উঠবে। মাঝরাত থেকেই এমনি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। ভেবেছিল এখানে এসে সে জিরিয়ে নেবে। কিন্তু এখন আবার অন্য ব্যবস্থা করতে হবে তাকে।

কিন্তু ভাগ্য ভালো, বড়রাস্তার মোড়ে আসতেই পাঁড়েজীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

–এ কি বাবুজী, আপনি চলে যাচ্ছেন? আমি একটু বাইরে গিয়েছিলুম, আসুন, আসুন–

বলে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল পাঁড়েজি। বিরাট উঠোন ভেতরে। পাথরের তৈরি বিরাট চক্-মিলান বাড়ি। চারদিকে সার-সার ঘর। চারতলা বাড়ি। সব ঘরে লোক গিশ-গিশ করছে। অনেক মানুষের ভিড় ভেতরে। যেন কোনও বিশেষ উৎসব হচ্ছে।

কোণের দিকে একটা ঘরের দরজার তালা খুলে পাঁড়েজী বললে–আসুন ভেতরে আসুন। আমি তো সকাল থেকেই আপনার জন্যে বসে ছিলুম, আপনি এত দেরি করলেন, আমি ভাবলুম আপনি বুঝি ভুলে গেলেন–

সদানন্দ বললে–না, ভুলবো কী করে? আমি তো বলেই ছিলুম আজকে এখানে থাকবো

পাঁড়েজী বললে–আজকে কেন বাবুজী, যত দিন ইচ্ছে থাকুন না, কলকাতার বাড়িওয়ালারা বড় বসমাইশ হুজুর, ভাড়া বাকি ফেললেই তাড়িয়ে দেবে। তা আপনার বাক্স প্যাটরা সব কি সেখানেই পড়ে আছে? আপনি ছেড়ে কথা বলবেন না বাবুজী, আপনিও মামলা জুড়ে দিন। আমার জানাশোনা ভালো ভকিলসাহাব আছে, বড় জাঁদরেল ভকিল সাহেব–

পাঁড়েজী খুব কথা কইয়ে লোক। চোদ্দ বছর বয়েস থেকে এই ধর্মশালার তদারকি করে আসছে। লেখাপড়া কিছুই জানে না। পুরোন আমলের লোক। বহুদিন কলকাতায় থেকে থেকে ভালো বাঙলা বলতে শিখেছে।

হঠাৎ বললে–বাবুজী আপনি সেই আংরেজি চিঠি পড়ে দিয়েছিলেন, মনে আছে? সেই চিঠিতে আমার অনেক লাভ হয়েছে। আমি চল্লিশ বিঘে জমির মালিক হয়েছি এখন–সব আপনার কিরপায় হলো বাবুজী–

সদানন্দ তখন একটা খাটিয়ার ওপর বসে পড়েছিল। সারাদিন হাঁটার পর এই তার প্রথম বসা। এত লোক দেখেছে সদানন্দ, এত জাগয়ায় গেছে, এত লোকের সঙ্গে মিশেছে, কিন্তু এখানে এই পাঁড়েজীর অন্ধকার ঘরখানার ভেতরে বসে যে-আরাম পেলে সে তার যেন তুলনা নেই।

বললে–তোমার এই ঘরখানা বেশ পাঁড়েজী–আমি একটু শুয়ে পড়ি, কেমন?

–শুয়ে পড়ুন না, তা জামাকাপড় বদলাবেন না?

সদানন্দ বললে–যা পরে আছি এ ছাড়া আর জামা কাপড় নেই আমার

–সব বুঝি বাক্সের মধ্যে পড়ে আছে? তা থাক, কাজ চলাবার মত জামাকাপড় পরে কিনে নেবেন। পয়সা লাগবে না–

–পয়সা লাগবে না কেন?

পাঁড়েজী বললে–-পয়সা লাগবে, কিন্তু নগদ পয়সা লাগবে না। আমাদের এই ধর্মশালার মালিকের কাপড়ের ব্যাওসা। কাপড়ের কারবার করে মালিকের অনেক টাকা। বোম্বাইতে কাপড়ের মিল আছে, আমার কাপড় কিনতে হয় না– আমি আপনাকে কাপড় এনে দেব।

সদানন্দ বললে–তার চেয়ে তুমি বরং আমাকে একটা চাকড়ি যোগাড় করে দিতে পারো পাঁড়েজী?

–চাকরি? কীসের চাকরি?

সদানন্দ বললে–যে-কোনও চাকরি, যে-কোনও মাইনে। চাকরি না করলে খাবো কী? যদি কারো ছেলে পড়াবার দরকার হয় তো তাও করতে পারি, আমি বি-এ পাস, যে-কোনও ক্লাসের ছেলেকে পড়াতে পারবো–

পাঁড়েজী বললে–আমার মালিকের অনেক ছেলে আছে বাবুজী, মালিককে আমি একদিন আপনার কথা বলবো। এখন মালিকের মেয়ের বিয়ে চলছে তো–

–মালিকের মেয়ের বিয়ে?

–হ্যাঁ, দেখেছেন না ধর্মশালায় কত ভিড়। সব বরযাত্রী, কাল বিয়ে হয়ে গেছে। এখন পনেরো দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া চলবে। সব পাটনা থেকে এসেছে–

তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেল। বললে–বাড়িওয়ালা তো আপনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তা খেলেন কোথায়?

সদানন্দ বললে–খাই নি কিছু–

–সে কী, দিনভর কিচ্ছু খান নি? তা এতক্ষণ আমাকে বলেন নি কেন? দাঁড়ান আমি আসছি

বলে চট করে কোথায় বাইরে বেরিয়ে গেল। তারপর একটা মস্ত বড় শালপাতায় করে অনেকগুলো পুরি তরকারি নিয়ে এসে হাজির।

বললে–নিন্ বাবুজী, খেয়ে নিন–

সদানন্দ খাটিয়া থেকে উঠলো। শালপাতা-শুদ্ধ পুরি-তরকারিটা নিলে। সেই সময়ে ভেতর থেকে কে যেন ডেকে উঠলো–পাঁড়েজী—পাঁড়েজী–

পাঁড়েজী বললে–ওই মালিক ডাকছে, আমি আসছি বাবুজী, এখুনি আসছি—

বলে পাঁড়েজী তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেল।

সদানন্দ শালপাতাটার খাবারটা নিয়ে তখনও বসে ছিল। খুব ক্ষিদে পেয়েছিল তার। কিন্তু মুখ-হাত-পা ধোওয়া হয় নি। মুখে-হাতে-পায়ে জল দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু জল কোন্ দিকে? উঠোনের মধ্যে কোথাও নিশ্চয় কল আছে।

বাইরে উঠোনে বেরিয়ে সদানন্দ কল খুঁজতে লাগলো। অনেক শালপাতার খালি ঠোঙা উঠোনে ছড়ানো রয়েছে। একজন লোককে দেখে সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে জলের কলটা কোন্ দিকে?

–ওই যে ওদিকে—

বলে লোকটা বাইরের দিকে দেখিয়ে দিলে।

ধর্মশালা বাড়িটা অদ্ভুত। কত রকমের লোক আসছে, আবার ভেতরে থেকে বাইরে যাচ্ছে। কেউ যেন কাউকে চেনে না, চেনবার চেষ্টাও করে না। সে যে একজন অচেনা লোক এখানে এসেছে তাতেও কারো যেন মাথাব্যথা নেই। উঠোনের মধ্যে দিয়ে পার হয়ে সদানন্দ একেবারে সদরের মস্ত বড় গেটটার কাছে এসে দাঁড়ালো। কোথায়? এদিকে কল চৌবাচ্চা কোথায়? কোন্ দিকে?

হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়তেই সদানন্দ দেখলে একজন মেয়ে-ভিখিরি কোলে একটা ঘুমন্ত ছেলে নিয়ে তার হাতের শালপাতাটার দিকে হাঁ করে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।

কেমন এক রকমের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো সদানন্দর। মেয়ে-ভিখিরিটার পাশে আরো অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিও ওই শালপাতাটার দিকে।

–বাবুজী–

একটা কাতর অস্পষ্ট শব্দ। কিন্তু সামান্য শব্দটা যেন আর্তনাদ হয়ে সদানন্দর কানে এসে বাজলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সদানন্দ শালপাতাটা তার দিকে এগিয়ে দিলে। মেয়ে-ভিখিরিটা তার ছেঁড়া শাড়ির আঁচলটা পাততেই সদানন্দ তার ভেতরে পুরি-তরকারি সুদ্ধ ফেলে দিলে।

.

কিন্তু নবাবগঞ্জ তো আর কলকাতা নয়। আর কলকাতা যেমন নয় তেমনি আবার সুলতানপুরও নয়। সদানন্দর জীবনে একদিন এই কলকাতা, নবাবগঞ্জ আর সুলতানপুর যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল। এতদিন পরে এই বয়েসে ভাবতে গিয়ে বড় অবাক লাগতে লাগলো তার। সেদিন কি সদানন্দ ভাবতে পেরেছিল তার একটা জীবন এতগুলো জায়গা আর এতগুলো মানুষকে ঘিরে গড়ে উঠবে! যে-সমরজিৎবাবুকে দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল, তার চেয়েও অবাক হবার মত মানুষ যে তাকে ভবিষ্যতে আরো দেখতে হবে তাই কি সে জানতো!

কতদিন ওই শেয়ালদা স্টেশন থেকে সে ট্রেনে উঠে সুলতানপুরে গেছে। কতদিন নৈহাটি গেছে, কতদিন আবার নবাবগঞ্জে গিয়েছে। একটা জীবনে সে কত অসংখ্য মানুষের জীবন দেখতে পেয়েছে। তার একটা জীবনে কত অসংখ্য মানুষের জীবনের ছায়া পড়েছে তারই কি কোনও সীমা-পরিসীমা আছে। এক-এক সময় ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়, যে-উদ্দেশ্য নিয়ে সে নিজের জন্মভূমি পরিত্যাগ করেছিল, যে-স্বপ্ন নিয়ে সে নয়নতারাকেও ত্যাগ করেছিল, সে-উদ্দেশ্য কি তার সার্থক হয়েছে? এই চৌবেড়িয়ার রসিক-পাল মশাই এর অতিথিশালায় পড়ে থাকবার জন্যেই কি সে এত কষ্ট স্বীকার করেছে? পৃথিবী কি তার কথা শুনেছে? পৃথিবীর মানুষ কি তার মনের মত মানুষ হয়েছে? নবাবগঞ্জের মানুষের জন্যে যে সে এত কিছু করেছে তা কি সার্থক হয়েছে? সদানন্দর জন্যেই নবাবগঞ্জের লোক হাসপাতাল পেয়েছে, স্কুল পেয়েছে, তা কি কিছুই নয়? সদানন্দর জন্যেই যে নয়নতারার সংসারের দারিদ্র ঘুচেছে সেটাও কি কিছু নয়?

আর তার বাবা, নবাবগঞ্জের চৌধুরী মশাই?

শেষজীবনে যে তাঁর কষ্টভোগ হয়েছিল তার জন্যেও কি সদানন্দ দায়ী?

একদিন নবাবগঞ্জের সবাই দেখলে চৌধুরী মশাই আবার এসে হাজির। তাঁর আগেকার সে চেহারা আর নেই। সাইকেল-রিকশাটা আবার বারোয়ারিতলা দিয়ে এসে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। সঙ্গে প্রকাশ মামা।

প্রকাশ বাড়ির ভেতরে নেমে দরজার চাবিগুলো একে-একে খুলতে লাগলো। তারপর দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দোতলার ঘরের চাবিটাও খুলে ফেললে। ধুলোয় ঘর ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ঘর ঝাঁট দিয়ে তবে বসবাসের যোগ্য হলো।

খবর পেয়ে বেহারি পাল মশাই এল। মুখোমুখি দেখা প্রকাশের সঙ্গে।

–কে? পাল মশাই না? কেমন আছেন সব আপনারা?

বেহারি পাল বললে–চৌধুরী মশাই এসেছেন শুনলাম—

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ জামাইবাবু এসেছে–

–তা খবর সব ভালো তো?

একে-একে আরো সবাই এল। বুড়ো তারক চক্রবর্তীর কাছেও খবরটা গিয়েছিল। তিনিও খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলেন। বহুকালের পুরোন সব লোক। সকলের বয়েস হয়েছে। পুরোন লোক দেখলেই পুরোন স্মৃতি সব মনে পড়ে যায়। একদিন এই বাড়িতেই চৌধুরী মশাই-এর ছেলে সদানন্দর বিয়েতে সবাই দল বেঁধে নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে। কর্তাবাবুর শ্রাদ্ধেও খাওয়া-দাওয়া করেছে। চৌধুরী গিন্নী এখানেই মারা গিয়েছে। তাতে অবশ্য তেমন ঘটা হয় নি। কিন্তু সব চেয়ে যে-ঘটনাটা সকলের মনে দাগ কেটে আছে সেই নয়নতারার ব্যাপার। এতদিন পরে ছোটমশাই-এর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যেন আবার সবাই-এর পুরোন কথাগুলো নতুন করে মনে পড়তে লাগলো।

ক’দিন ধরেই নানা লোক আসা-যাওয়া করতে লাগলো। কিন্তু চৌধুরীমশাই কারো সঙ্গেই দেখা করলেন না। প্রকাশ মামাও জামাইবাবুর সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দিলে না।

সে সকলকেই বললে–না, দেখা হবে না। জামাইবাবুর শরীর খারাপ।

একজন বললে–তা এতদিন পরে চৌধুরী মশাই এলেন, একবার চোখের দেখাও দেখতে পাবো না শালাবাবু?

প্রকাশ বললে–না, আমি সকলের মতলব বুঝতে পেরেছি–

–মতলব আবার কী থাকতে পারে শালাবাবু! গাঁয়ের জমিদার গাঁয়ে এসেছে। তাঁকে একবার পেন্নাম করে চলে যাবো, তাও হবে না?

বেহারি পাল জিজ্ঞেস করলে–সদানন্দর খবর কিছু পেলে নাকি তোমরা?

প্রকাশ বললে–না না, সে বেঁচে নেই আর–

–বেঁচে নেই মানে?

বেহারি পাল প্রকাশের কথা বলার ভঙ্গি দেখে ক্ষুণ্ণ হলো। এমন করে কেউ কথা বলে?

বললে–-বেঁচে নেই মানে কী? খোঁজখবর কিছু নিয়েছ তোমরা?

প্রকাশ মামা বললে–খোঁজখবর আর নেব কী? মারা গেলে কি কারো খোঁজখবর পাওয়া যায়?

–তা জলজ্যান্ত মানুষটা মারা গেলে খোঁজখবর পাওয়া যাবে না? পুলিসের খাতাতেও তো একটা হিসেব থাকবে তার!

প্রকাশ বললে–পুলিশের কাছে কি খোঁজখবর নিইনি ভাবছেন? আমি কলকাতায় নিজে গিয়ে ছ’মাস কাটিয়েছি, পুলিসের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করেছি, কোনও ফায়দা হয়নি। এখন আমিই বা কী করবো আর জামাইবাবুই বা কী করবে?

–আর নয়নতারা?

প্রকাশ বললে–তার আর নাম করবেন না আপনি। আমারই ঘাট হয়েছিল, অমন মেয়েকে এ বাড়ির বউ করে আনা। সেই অলক্ষুণে বউ এসেই তো সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। নইলে জামাইবাবুরও এই দশা হতো না, আর দিদিও এমন বেঘোরে মারা যেত না

একজন বললে–তাহলে তো শালাবাবু, আপনারই পোয়া বারো। চৌধুরী মশাই-এর সব সম্পত্তি এখন আপনারই কব্জায়–

–আরে দূর! আমার কি তেমনি কপাল?

বেহারি পাল জিজ্ঞেস করলে–কেন বাবাজী! তুমি ছাড়া তো চৌধুরী মশাই-এর আর কেউ ওয়ারিশ রইল না!

প্রকাশ বললে–সে তো রইল না জানি। সেই জন্যেই তো জামাইবাবুকে কোথাও ছাড়ি না। কিন্তু শত্তুরের তো আর অভাব নেই মশাই। তারা যে সব তলে তলে অন্য মতলব ভাঁজছে!

–কী মতলব?

প্রকাশ বললে–সুলতানপুরের লোকদের তো চেনেন না, এমন নির্লজ্জ লোক সব, নিজের আইবুড়ো মেয়েদের সব জামাইবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে, পাঠিয়ে তাদের দিয়ে জামাইবাবুর পা টিপে দেওয়াচ্ছে, তা জানেন? আমি ভাগ্যিস ছিলুম তাই রক্ষে–

কেন? কিসের জন্যে পা টেপাচ্ছে? টাকার জন্যে? চৌধুরী মশাইকে খোসামোদ করবার জন্যে?

–আরে না, আমার জামাইবাবুকে জামাই করবার জন্যে!

–তা ছোটমশাই-এর তো আর মতিভ্রম হয়নি!

প্রকাশ বললে–মতিভ্রম এখনো না-হয় হয়নি। কিন্তু হতেই বা কতক্ষণ? আপনারা পুরুষমানুষ হয়ে এই কথা জিজ্ঞেস করছেন? পুরুষ হল পুরুষ, পুরুষ মানুষ কখনও বুড়ো হয়?

সবাই কথাটা বুঝলো। তা বটে! বিয়ে করতে আর কতক্ষণ লাগে? বিয়ে একটা করে ফেললেই হলো। টাকার যখন অভাব নেই তখন কনেরও অভাব নেই কোথাও।

তা প্রকাশ সেই জন্যেই চৌধুরী মশাই-এর কাছ ছাড়ে না। সব সময় সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সুলতানপুর থেকে চৌধুরী মশাই একলাই আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু প্রকাশ ছাড়েনি। জামাইবাবুকে এক মিনিট কাছছাড়া করতে ভয় লাগে প্রকাশের। বলে-সম্পত্তির লোভ বড় লোভ হে, ওতে লঘু-গুরু বিচার থাকে না।

চৌধুরী যখন একলা থাকেন তখন হিসেব নিয়ে বসেন। তখন প্রকাশকেও ঘরের ভেতর ঢুকতে দেন না। তখন আর কাউকেই বিশ্বাস করেন না তিনি। দরজা বন্ধ ঘরের ভেতর বসে বসে কেবল হিসেব করেন। কত বিঘে বাগান আর কত বিঘে ধান-জমি আর কত বিঘে বিল। আর বসতবাড়িটারও আলাদা একটা দলিল বার করেন। বসতবাড়িটার দামও কম করে তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকা। প্রাণকৃষ্ণ সা রেলবাজারের আড়তদার। তার সঙ্গেই লেন-দেনের কথাবার্তা চলছিল। তিন লাখ যদি পেয়ে যান তাহলে আর পীড়াপীড়ি করবেন না তিনি। যা পাওয়া যায়। এখানে না থাকলে একটা পয়সাও পাওয়া যাবে না। এখানকার তিন লাখ আর সুলতানপুরের সাত। এই পুরো দশ লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দেবেন তিনি! আর বাকি রইল সোনা-দানা। তারও একটা মোটা দাম আছে। সবটা নিজের কাছে রাখা নিরাপদ নয়। কেউ বিষ খাওয়াতে পারে। পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস নেই।

সেদিন হিসেব করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। চৌধুরী মশাই সা’ মশাইকে খবর দিয়েছেন। সকাল বেলাই আসবে। তার আগে দলিলপত্র ঠিক করে রাখছিলেন। রাত তখন অনেক। প্রকাশ বাইরের বারান্দায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

হঠাৎ বারবাড়ির সদরের দিকে নজর পড়তেই মনে হল সদর দরজা ঠেলে একটা পালকি এসে ঢুকলো। চার বেহারার পালকি। পালকিতে এত রাত্রে কে এল!

চৌধুরী মশাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখলেন।

পালকি থেকে কে একজন ঘোমটা-দেওয়া চেহারা নামলো। নেমে হাঁটতে হাঁটতে ভেতরবাড়িতে ঢুকলো। আর তাকে দেখা গেল না। তারপর সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল! সিঁড়ি দিয়ে ওপরে দোতলায় উঠেছে। তারপর একেবারে তাঁর জানলার সামনে। ঘোমটার ভেতরে মুখখানার দিকে চেয়ে যেন চেন-চেনা মনে হলো।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন–কে?

মেয়েলী গলায় উত্তর এল–আমি কালীগঞ্জের বউ–

কালীগঞ্জের বউ শব্দটা শুনতেই চৌধুরী মশাই-এর মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা আওয়াজ বেরিয়েই তিনি অচৈতন্য হয়ে সেখানে পড়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর পড়ার শব্দটা প্রকাশের কানে গেছে। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তার মনে হলো যেন অশ্বিনী ভট্টাচার্য তাকে লুকিয়ে জামাইবাবুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। আসতে গিয়ে চৌকাঠে পা লেগে হোঁচট খেয়েছে—

প্রকাশ সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠছে–তবে রে শালা অশ্বিনী, তুই এখেনেও আমাকে জ্বালাতে এসেছিস?

কিন্তু না, স্বপ্নের ঘোরটা কেটে যেতেই দেখলে জামাইবাবু অজ্ঞান হয়ে মেঝের ওপর শুয়ে পড়ে আছে।

প্রকাশ চিৎকার করে ডাকতে লাগলো–জামাইবাবু, ও জামাইবাবু কী হয়েছে আপনার? অমন করে শুয়ে পড়ে আছে কেন? জামাইবাবু—

.

শেষ পর্যন্ত সেদিন প্রকাশের হাঁক-ডাকে পাড়ার লোকজন এসে জড়ো হয়েছিল। বেহারি পাল মশাই এসেছিল, তারক চক্রবর্তী মশাই এসেছিল। নিতাই হালদারের মাচার ওপর বসে যারা অনেক রাততির পর্যন্ত তাস খেলছিল তারাও শালাবাবুর চেঁচানি শুনে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসেছিল।

সে এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল সেদিন সেই চৌধুরীবাড়িতে।

শেষকালে দরজা শাবল মেরে ভাঙা হলো। ননী ডাক্তার এল। কদিন ধরে ওষুধ খেয়ে তবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন চৌধুরী মশাই।

প্রকাশ জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছিল আপনার জামাইবাবু? অমন করে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কেন?

বেহারি পাল, তারক চক্রবর্তী, তারাও সবাই জিজ্ঞেস করলে–কিছু ভয় পেয়েছিলেন নাকি?

কিন্তু চৌধুরী মশাই কারোর কোনও কথার জবাব দিলেন না। তিনি যে সেদিন কাকে পালকি চড়ে আসতে দেখেছিলেন, কাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তাও কাউকে বললেন না। তিনি আপন মনেই সেই সেদিনকার ঘটনাটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। যতই ভাবতে লাগলেন ততই তাঁর ভয় করতে লাগলো। মনে হলো যেন তাঁর সমস্ত সম্পত্তি একটা ভারি জগদ্দল পাথর হয়ে তাঁর বুকের ওপর চেপে বসেছে। সে-বোঝা তিনি বুক থেকে আর কিছুতেই নামাতে পারছেন না।

সাতদিন পর বিছানা ছেড়ে উঠলেন। হাতের কাছে দলিল-দস্তাবেজগুলো ছিল, সেইগুলো নিয়েই তাঁর দুর্ভাবনা ছিল খুব। কাউকে বিশ্বাস নেই সংসারে। এই-গুলোর ওপরেই সকলের নজর। যতক্ষণ না সেটা তিনি প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই-এর হাতে দিতে পারছেন ততক্ষণ যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।

প্রকাশকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন–সা’ মশাই আসেননি?

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ জামাইবাবু, এসেছিল, আপনার তখন অসুখ, আপনি অসুখে পড়েছিলেন, তাই চলে গেলেন। আবার আসবেন বলে গেছেন–

চৌধুরী মশাই বললেন–আর একবার ডাকো তাকে, ডেকে পাঠাও–

প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই বহুদিনের আড়তদার। কর্তাবাবুর আমল থেকে লেনদেন আছে এ বংশের সঙ্গে। যখনই কারবারে কাঁচা টাকার তার দরকার হতো কর্তাবাবুর কাছে আসতো। কর্তাবাবুর কাছে টাকা নিতে আসতো।

সেই সা’ মশাই সেদিন এল। সা’ মশাই আসতেই চৌধুরী মশাই প্রকাশকে বললেন–তুমি ঘর থেকে একবার বেরিয়ে যাও প্রকাশ–

প্রকাশ কেমন থতমত খেয়ে গেল। বললে–আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো?

–হ্যাঁ, বেরিয়ে যাবে।

প্রকাশ তবু বুঝতে পারলে না। বললে–কেন বেরিয়ে যাবো জামাইবাবু, শেষকালে যদি কোনও দরকার-টরকার পড়ে?

চৌধুরী মশাই বললেন–না, তোমাকে আমার কোনও দরকার পড়বে না, তুমি এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাও–

প্রকাশ বললে–কিন্তু যদি আবার অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যান তখন কে দেখবে? তার চেয়ে বরং আমি থাকি—

চৌধুরী মশাই আর থাকতে পারলেন না, সোজা দাঁড়িয়ে উঠে তেড়ে গেলেন। বললেন–তুমি বেরোও বলছি, আগে বেরোও–

তবু প্রকাশ নড়ে না। বললে–আজ্ঞে আমি থাকলে দোষটা কী? আমি তো কিছু করছি না?

চৌধুরী মশাই প্রকাশের গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিলেন। বললেন–যত কিছু বলি না, তত তোমার বড় বাড় হয়েছে। বার বার বলছি বেরিয়ে যাও তবু থাকতে চাও এখানে! কেন? আমার সব জিনিস তোমার জানবার দরকার কী? সা’ মশাই-এর সঙ্গে যদি আমার দরকারী কথা থাকে তো তাও তোমায় শুনতে হবে?

চড় খেয়ে প্রকাশের তখন চোখে জল এসে গিয়েছিল। বিশেষ করে সা মশাই-এর সামনে চড় খেলে চোখে জল তো আসবেই। সেই অবস্থায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলতে লাগলো আমাকে আপনি চড় মারলেন জামাইবাবু? আজ দিদি থাকলে আমার এত অপমান সইতে হতো না–দিদি নেই বলেই……

চৌধুরী মশাই ধমক দিলেন–থামো তো, দিদির কথা আর তুলো না। তোমার জন্যেই তো দিদি মারা গেল। তুমিই তো যতো নষ্টের গোড়া–

–আমার জন্যে দিদি গেল? আমি যত নষ্টের গোড়া? আপনি বলছেন কী জামাইবাবু? প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই টাকাকড়ির লেন-দেন নিয়ে কথা বলতে এসেছিল। এই সব ঝগড়া বাগবিতণ্ডার মধ্যে তাকে পড়তে হবে তা ভাবতে পারেনি।

কথার মাঝখানেই বললে–কেন আর ও-সব নিয়ে কথা কাটাকাটি করছেন চৌধুরী মশাই, ও সব কথা এখন বন্ধ করুন না–

চৌধুরী মশাই বললেন–দেখুন না কত বড় শয়তান, আমার ছেলেকে ওই প্রকাশই ছোটবেলা থেকে বিগড়ে দিয়েছে। ওর জন্যেই তো সদানন্দ অমন করে বিগড়ে গেল–

প্রকাশ বলে উঠলো–আমি বিগড়ে দিলুম না আপনারা বিগড়ে দিলেন? আপনি আর কর্তাবাবু

–তুমি থামো, তুমি আর কথা বলো না। বেছে বেছে অমন বউকে কে আনলে শুনি? আমি, কর্তাবাবু, না তুমি? তুমি যদি অমন বউ ঘরে না আনতে তাহলে তোমার দিদি অমন করে মারা যায়? এই নবাবগঞ্জের এই বাড়ি এমন করে শ্মশান হয়ে যায়? দেখছো না এ বাড়ি কী হয়েছে? নইলে আমি এই সম্পত্তি জলের দরে বিক্ৰী করি? এই তো সা’ মশাই তো সবই জানেন, আপনিই বলুন, আপনি তো বরাবর সবই দেখে আসছেন সা’ মশাই, বলুন আপনি।

তারপরে একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন–জানেন সা’ মশাই, ছোটবেলা থেকে এ ছেলেটাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যেত, কোথায় রাণাঘাট, কোথায় কেষ্টনগর, কোথায় কলকাতা, সেই সব দেখেই তো সে বিগড়ে গেল–

প্রকাশ বললে–বা রে, বা, এখন সব দোষ হলে আমার–

–তা তোমার দোষ হবে না তো দোষ হবে আমার? তুমি বেছে বেছে ওই বউ ঘরে আনোনি? তুমি বলোনি যে ওই বউ আনলে সদানন্দ সংসারী হবে, বউএর রূপ দেখে সব ভুলে যাবে? বলোনি তুমি?

প্রকাশ বললে–তা তো বলেই ছিলুম, তা সেটা কি মিথ্যে বলেছিলুম? বলুন না সা’ মশাই আপনিও তো বউমাকে দেখেছিলেন, অমন রূপসী বউ কটা লোকের বাড়িতে আছে, আপনিই বলুন? বাইরে যার অমন রূপ ভেতরে ভেতরে যে তার মনে কালকেউটের বিষ তো আমি কী করে জানবো বলুন–

প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই বললে–সে যা হয়ে গেছে গেছে, বাবাজী তুমি চুপ করো, চৌধুরী মশাই যা বলছেন তাই করো।

প্রকাশ বললে–তাহলে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো বলতে চান?

সা’ মশাই বললেন–হ্যাঁ, যখন উনি বেরিয়ে যেতে বলছেন তখন বেরিয়েই যাও–আমাদের কাজ-কর্ম আছে, তোমার সামনে তো সে-সব কথাবার্তা হবে না–

প্রকাশ যেন কী রকম বিমূঢ় হয়ে গেল কথাগুলো শুনে। বললে–বুঝতে পেরেছি, যেই টাকাকড়ির কথা উঠেছে তখন আমি পর হয়ে গেলুম, আর যখন ভাত রান্নার কথা হবে তখনি আমি বড় আপনার লোক, না? জামাইবাবু যখন সেদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন তখন কে তাঁকে দেখেছিল শুনি? তখন তো আমি ছাড়া আর কোনও শর্মা কোথাও ছিল না–

চৌধুরী মশাইএর ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে গেল। তিনি বললেন–আর কথা নয়, তুমি এবার বেরিয়ে যাও দিকি, এখখুনি বেরিয়ে যাও, তোমাকে আর ভাত রাঁধতে হবে না, টাকা ছড়ালে লোকের অভাব হবে না আমার, তুমি একেবারে বেরিয়ে যাও এখান থেকে, এ বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যাও–

বলে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন চৌধুরী মশাই, কিন্তু সেই মুহূর্তেই কে একজন অচেনা লোক এসে হাজির হলো। লোকটিকে দেখে তিনজনেই অবাক। কে এ?

প্রকাশ সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলে–কে আপনি?

লোকটা বললে–আমি চৌধুরী মশাইএর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি–

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি চৌধুরী মশাই–

লোকটা বললে–আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল, কথাটা আমি সকলের অসাক্ষাতে বলতে চাই–

চৌধুরী মশাই এমনিতেই বিরক্ত হয়ে ছিলেন, তার ওপর আগন্তুকের কথায় মেজাজ আরো ক্ষুব্ধ হয়ে গেল। বললেন–আপনি কোত্থেকে আসছেন?

প্রকাশও সঙ্গে সঙ্গে বললো, আগে বলুন কোত্থেকে আসছেন? বলা নেই, কওয়া নেই অমনি দেখা করলেই হলো? যা বলতে চান সকলের সামনেই বলুন। তা বুঝতে পেরেছি, বিয়ের কথা বলতে এসেছেন তো?

লোকটা কেমন হয়ে গেল। বললে–বিয়ে? কার বিয়ে?

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ, চৌধুরী মশাই-এর বিয়ে। আপনি চৌধুরী মশাই-এর বিয়ের সম্বন্ধ এনেছেন তো? তা আমি বলে দিচ্ছি আমার জামাইবাবু বিয়ে করবেন না। সম্পত্তির লোভে আপনারা সবাই চৌধুরী মশাইএর বিয়ে দিতে চান, সে আমরা জানি, তা সে আমরা হতে দেব না। আমি চৌধুরী মশাইএর শালা, আমার নাম প্রকাশ রায়, আমাকে না জিজ্ঞেস করে চৌধুরী মশাই বিয়ে করবেন না–

লোকটা বললে–না, আমি সে কথা বলতে আসিনি–

–তাহলে—

চৌধুরী মশাই বললেন–তুমি চুপ করো না প্রকাশ, তোমার অত কথা বলবার দরকার কী? উনি এসেছেন আমার সঙ্গে কথা বলতে, যা বলতে হয় আমি বলবো, তুমি কে?

প্রকাশ বললে–তা সেইজন্যেই তো আমি আপনাকে একা ছেড়ে কোথাও যাই না, শেষকালে কে আপনাকে ঠকিয়ে আপনার বিয়ে দিয়ে দেবে, তখন তো আপনিই হায় হায় করবেন। সুলতানপুরের অশ্বিনী ভট্টাচার্যিটা তো আপনাকে প্রায় গেঁথেই ফেলেছিল, আমি না থাকলে ছাড়া পেতেন?

প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই-এর সময়ের দাম আছে। বাজে কাজে সময় নষ্ট হচ্ছিল বলে এতক্ষণ খুঁতখুঁত করছিল। এবার প্রকাশের দিকে চেয়ে বললে–তুমি বাবাজী একটু চুপ করো না, ভদ্রলোককে যা বলবার বলতে দাও না–

লোকটি এবার বললে–কালীকান্ত ভট্টাচার্য আপনার বেয়াই ছিলেন তো?

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, তা তিনিই কি আপনাকে পাঠিয়েছেন?

–না, তিনি আর কী করে পাঠাবেন, তিনি এক বছর আগে মারা গেছেন—

–মারা গেছেন?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি ছিলেন আমার মাস্টার মশাই, তাঁর মেয়ে নয়নতারার সঙ্গে আপনার ছেলের বিয়ে হয়েছিল তো?

নয়নতারা নাম উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে যেন আবহাওয়াটা গরম হয়ে উঠলো। চৌধুরী মশাই এতক্ষণে লোকটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখলেন।

বললেন–আপনার নাম?

লোকটা বললে–আমার নাম নিখিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়–

প্রকাশ এতক্ষণে চিনতে পারলে। বললে–ও, আপনাকে তো আমি চিনি মশাই, আপনি ছিলেন বেয়াই মশাইএর ডান হাত। তাই বলুন! তা আপনি হঠাৎ কী উদ্দেশ্যে?

লোকটি বললে–নয়নতারার বিয়ের সময় মাস্টার মশাই মেয়েকে প্রায় আট-দশ হাজার টাকার গয়না দিয়েছিলেন। আপনার পুত্রবধূকে আপনারা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই গয়নাগুলো তো তার সঙ্গে দেননি। নয়নতারার পক্ষ থেকে আমি এখন সেইগুলো দাবী করতে এসেছি–

এর চেয়ে সামনে যদি হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত হতো তাতেও বুঝি চৌধুরী মশাই এত চমকে উঠতেন না।

কিন্তু প্রকাশ রায় সহজে কিছু সহ্য করবার লোক নয়। জবাবটা দিলে সে। বললে– নয়নতারার গয়না? আপনি বউমার গয়না চাইতে এসেছেন?

নিখিলেশ বললে—হ্যাঁ–

–আপনার লজ্জা করলো না সেই গয়না চাইতে? যে বউ এই বংশের কুলে কালি দিয়েছে তার নাম করতে লজ্জা হলো না আপনার? আপনি আবার সেই গয়না বাড়ি বয়ে চাইতে এসেছেন?

নিখিলেশ বললে–আমি তো কিছু অন্যায় দাবী করিনি, যে-গয়না তার বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া হয়েছিল শুধু সেই গয়নাগুলোই চাইতে এসেছি। যখন সে আপনাদের বাড়ি থেকে চলে যায় তখন তো সঙ্গে কিছুই নিয়ে যায়নি সে। সব কিছু এখানেই রেখে গিয়েছিল আর আপনারাও তাকে কিছু গয়না পরে যেতে দেননি–

চৌধুরী মশাই এতক্ষণে আবার কথা বললেন।–তা বউমাই কি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে?

নিখিলেশ বললে–আজ্ঞে না, আমি তো মাস্টার মশাইএর সমস্ত কিছুই দেখাশোনা করতুম, নয়নতারার বিয়ের সময় জিনিসপত্র কেনা-কাটা করা থেকে শুরু করে শীতের তত্ত্ব, জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব পাঠানো পর্যন্ত সমস্তই আমাকে করতে হতো। মাস্টার মশাইএর তো কাজকর্ম করবার আর কেউ ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর যা-কিছু করণীয় সব আমিই করেছি। নয়নতারার স্বার্থ দেখা তো আমারই কাজ, তাই আমি এসেছি–

–তা বউমার সঙ্গে কি ফিরে গিয়ে আপনার দেখা হবে?

–হ্যাঁ, দেখা হবে।

–তা একটা কথা তাকে গিয়ে বলবেন যে যে বাড়ি সে এত তেজ দেখিয়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই বাড়ি থেকে চেয়ে নিয়ে যাওয়া গয়না পরতে তার ইজ্জতে বাধবে না তো? এ গয়না তার ছুঁতে ঘেন্না করবে না তো?

নিখিলেশ বললে–কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি তাতে তো মনে হয় সে তেজ দেখিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে যায়নি! সে ভদ্রভাবেই এখান থেকে চলে গেছে–

চৌধুরী মশাই বললেন–তা জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব ভেঙে চুরমার করে তছনছ করে দেওয়া যদি তেজ দেখানো না হয় তো তেজ দেখানো আবার কাকে বলে তা তো জানি না। পাড়ার লোকজন ডেকে শ্বশুর-শাশুড়ীর ইজ্জতে ঘা দেওয়া যদি তেজ দেখানো হয় তো তেজ দেখানো আর কাকে বলবো তাও তো বুঝতে পারছি না। এই তো এই সা’মশাইও সেদিন এখানে হাজির ছিলেন, ইনিও তো সাক্ষী আছেন, আমি সত্যি বলছি না কি মিথ্যে বলছি উনিই বলুন না! উনিই বলুন আজ পর্যন্ত কোনও বাড়ির বউ কারো শ্বশুরকুলে এমন করে কলঙ্ক দিয়েছে? আপনি জানেন যে সেই ঘটনার পর আমার স্ত্রী এত আঘাত পান যে সেই দিনই তিনি শয্যা নেন আর সেই শয্যাই তাঁর শেষ শয্যা হয়ে ওঠে? আমার বউমার জন্য যেমন আমার একমাত্র ছেলে বিবাগী হয়ে যায় তেমনি আমার সংসারও তারপর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

নিখিলেশ বললে–গয়না আপনি দেবেন না-দেবেন সে আপনার অভিরুচি, কিন্তু অকারণে নিজের পুত্রবধূর নামে মিথ্যে দোষারোপ করবেন না।

–মিথ্যে দোষারোপ? আপনি বলতে চান আমি এই বয়েসে মিছে কথা বলছি?

নিখিলেশ বললে–মিছে কথার আবার কম বয়েস বেশি বয়েস আছে নাকি? যাদের মিছে কথা বলা স্বভাব বুড়ো বয়েসেও মিছে কথা বলতে তাদের আটকায় না।

–তার মানে?

নিখিলেশ বললে–তার মানে বোঝাবার সময় আমার নেই। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। যদি নয়নতারার গয়নাগুলো দিতেন তো যাতে ঠিক-ঠিক নয়নতারার হাতে পৌঁছায় তা ব্যবস্থা করতে পারতুম। আমি চলি–

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ আসুন, আর বউমার সঙ্গে যদি দেখা হয় তো বলবেন যে সে যেন মনে রাখে যে মাথার ওপর ভগবান বলে একজন আছেন, তাঁর আর এক নাম দর্পহারী মধুসূদন, তিনি কাউকে রেহাই দেন না। অত বড় লঙ্কার রাজা দশানন, তিনি পর্যন্ত রেহাই পাননি তা বউমা তো কোন্ ছার। কথাটা বউমাকে জানিয়ে দেবেন–

বলতে বলতে প্রকাশ নিখিলেশের পেছন পেছন বাড়ির সদর গেটের দিকে চলে গেল।

চৌধুরী মশাই আর দেরি করলেন না। প্রকাশ চলে যেতেই দরজায় খিল দিয়ে দিয়েছেন। তারপর সিঁড়ির দিকের জানালা দু’টোও বন্ধ করে দিয়ে এসে বসলেন।

বললেন–আপনার সঙ্গে নিরিবিলিতে যে দুটো কথা বলবো সা’ মশাই তারও যো নেই, এমনিই হয়েছে আমার কপাল

সা’ মশাই বললে–আপনার শরীর খারাপ ছোটমশাই, আপনি অত ব্যস্ত হবেন না–

চৌধুরী মশাই বললেন ব্যস্ত কি সাধে হই সা’ মশাই, আজকে যদি আমার উপযুক্ত ছেলে কাছে থাকতো তো আমি কি ব্যস্ত হতুম?

সা’ মশাই বললে–তা সদানন্দের কোনও খবর পেলেন নাকি?

চৌধুরী মশাই বললেন–ছেলের নাম আর আমার সামনে মুখে আনবেন না সা’মশাই, আমি জীবনে তার আর মুখ-দর্শনও করবো না–ওই ছেলেই আমার জীবনের মস্ত অভিশাপ।

সা’ মশাই বললে–কিন্তু সেই ছেলে যদি কোনওদিন আবার ফিরে আসে?

চৌধুরী মশাই বললেন–সেই জন্যেই তো এখানকার ওখানকার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছি। বিক্রি করে দিয়ে টাকাগুলো ব্যাঙ্কে রেখে দেব, তারপর পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে টাকা ভাঙাবো আর খাবো—

.

হায় রে মানুষের আশা, আর হায় রে মানুষের স্বপ্ন! মানুষ কত আশা করেই না সংসার গড়ে আর মানুষের সৃষ্টিকর্তা কত নিপুণভাবেই না সেই সংসার আবার ভাঙে! নরনারায়ণ চৌধুরীর সেই নিজের হাতে গড়া সংসার যে এমন করে তিন পুরুষের মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে তা কি তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন। এই বাড়ির প্রত্যেকটি ইট, প্রত্যেকটি কাঠ, প্রত্যেকটি লোহার টুকরো পর্যন্ত ছিল তাঁর কাছে বড় মমতার সামগ্রী। বড় মমতা দিয়ে বড় স্নেহ দিয়ে এ বাড়ির প্রতিটি সামগ্রী তিনি একদিন সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর বংশধরদের ভবিষ্যৎ পাকা করবার জন্যে। কিন্তু তিনি কি জানতে পেরেছিলেন যে একদিন তাঁরই নাতি সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় বড়বাজারের এক অখ্যাত ধর্মশালার এক কোণে একটা অন্ধকার ঘরে তার জীবন কাটাবে!

ধর্মশালার জীবন এক অদ্ভুত ধরনের জীবন। ধর্মশালার ভেতরে কখন কে আসছে আবার কখন কে কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছে তা কারো বলবার সাধ্য নেই। হঠাৎ এক-একদিন হয়ত মানুষে-মানুষে ঘর ভর্তি হয়ে গেল, দু’দিন পরে তারপর আবার হয়ত সব ফাঁকা। তখন খাঁ-খাঁ করে ভেতরটা! কিন্তু কদিনই বা সদানন্দ তা দেখতে পায়–আর ক’দিনই বা সে নিজের ঘরে থাকে! পাঁড়েজী দুটো ছাত্র পড়ানোর কাজ করে দিয়েছিল। সকালবেলা একটা ছাত্র আছে, তারা দেয় চল্লিশ টাকা, আর সন্ধ্যেবেলা আর একজন, তারা দেয় পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু মাইনে পাবার দুদিন পরেই হাত ফাঁকা হয়ে যায়।

পাঁড়েজী বলে–আপনার কাপড়টা যে ছিঁড়ে গেছে বাবুজী, একটা কাপড় কিনুন এবার–

সদানন্দ বুঝতে পারে না। বললে–ও থাক গে যাক, ওটুকু ছিড়লে ক্ষতি কী? আমাকে তো আর ওরা কাপড় দেখে মাইনে দিচ্ছে না, আমার পড়ানো খারাপ না হলেই হলো–

পাঁড়েজী শীতের সময় একটা আলোয়ান কিনে দিয়েছিল তার মালিকের গদি থেকে। এত যে ঠাণ্ডা পড়েছে সেদিকে খেয়াল ছিল না সদানন্দর। সেই শীতের মধ্যেই হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে পড়িয়ে ফিরতো।

পাঁড়েজী বলতো–আপনার জাড়া লাগে না বাবুজী? কোনদিন আপনার বোখার হবে ঠিক–

বোখার হোক আর না হোক ক’দিন সদানন্দ খুব কাশিতে ভুগলে। কাশতে কাশতে শেষকালে প্রায়ই দম আটকে আসতো।

সেদিন পাঁড়েজী আর স্থির থাকতে পারলে না। কোথা থেকে পাঁড়েজী একটা গরমের আলোয়ান কিনে এনে দিলে। বললে—রাততিরে আপনাকে বেরোতে হয়, এটা পরে বেরোবেন বাবুজী–

তা পড়ানো তো ঘণ্টাখানেকের কাজ মাত্র! তারপরে সদানন্দ যে কোথায় যায় তা পাঁড়েজী বুঝতে পারে না। অনেক রাত্রে যখন সদানন্দ ফেরে তখন বউবাজারের রাস্তা রীতিমত ফাঁকা। তখন পা দুটো আর যেন চলতে চায় না।

ধর্মশালার বড় ফটকটা তখন বন্ধ করে দেয় পাঁড়েজী। মধ্যেখানের দরজাটা শুধু খুলে রেখে দেয়। যে তখন ভেতরে আসতে চাইবে সেই ছোট গর্তটার মধ্যে মাথা গলিয়ে তাকে ঢুকতে হবে। কেউ ভেতরে মাথা গলালেই পাঁড়েজী উঠোনের কোণে চাপাটি বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করবে –কে? কোন্ হ্যায়?

চাপাটি তৈরি করে পাঁড়েজী অনেকক্ষণ সদানন্দর জন্যে অপেক্ষা করে। উনুনের আগুন নিবে যায় তখন। তবু ফটকের দিকে চেয়ে পাঁড়েজী হাঁ করে বসে থাকে। কখনও কখনও নিজের কাঠের বাক্সটা থেকে পুরোন ‘রাম-চরিত মানস’টা বার করে উচ্চারণ করে করে পড়তে থাকে। আর উঠোনের বড় ঘড়িটার দিকে চেয়ে সময়টা মাঝে মাঝে দেখে নেয়।

প্রচণ্ড শীত পড়েছে তখন কলকাতায়। শীতে হি-হি করে সবাই কাঁপে। পাঁড়েজী গরম উনুনটার পাশে বসে হাত পাগুলো একটু সেঁকে নেয়।

ঠিক তখন সদানন্দ ঢোকে।

পাঁড়েজী দেখেই অবাক। বললে–আপনার আলোয়ান কোথায় গেল বাবুজী! সেদিন যে নতুন আলোয়ান কিনে দিলাম!

সদানন্দ সে-কথায় কান দিলে না। ঘরের ভেতরে ঢুকে হাতের বইটা রেখে বললে–রুটি করেছ নাকি পাঁড়েজী?

পাঁড়েজী সেকথার জবাব না দিয়ে বললে–আপনার আলোয়ানটা কোথায় গেল তাই বলুন বাবুজী? আলোয়ানটা কোথায় ফেলে এলেন?

সদানন্দ বললে–সে কোথায় হারিয়ে গেছে বোধ হয়

–হারিয়ে গেছে মানে? নতুন আলোয়ানটা ওমনি হারিয়ে গেল?

সদানন্দ বললে–হারিয়ে গেলে আর কী করবো বলো? আমি তো আর ইচ্ছে করে হারাইনি

–তা ছাত্রের বাড়িতে ফেলে আসেন নি তো? সেখানে ফেলে এলে কাল ঠিক ফিরে পেয়ে যাবেন।

সদানন্দ বললে–তাহলে তো ফিরে পাবোই। কালই গিয়ে সেখানে খোঁজ করবো তুমি ও নিয়ে কিছু ভেবো না।

তার পরের দিন সদানন্দ যখন বাড়ি ফিরে এল পাঁড়েজী দেখলে সেদিনও সদানন্দর গায়ে আলোয়ান নেই। বললে–কই, আলোয়ান কোথায় গেল? পেলেন না?

সদানন্দ বললে–যাক গে আলোয়ান, তুমি ওই সামান্য আলোয়ান নিয়ে আবার মিছিমিছি মাথা ঘামাচ্ছো কেন পাঁড়েজী?

পাঁড়েজী বললে–তা সত্তর টাকা দামের জিনিসটা সামান্য জিনিস হলো? আমার এক মাসের মাইনে, তা জানেন? আলোয়ানটা তাহলে সত্যি-সত্যিই হারালেন?

সদানন্দ বললে–তুমি বোঝ না পাঁড়েজী, আলোয়ানের চেয়ে জীবনের দাম অনেক বেশি তা জানো? কলকাতায় যে কত লোকের আলোয়ান নেই, তা তারা কি সব মরে গেছে? তুমি দাও, আমাকে খেতে দাও–

আশ্চর্য, যে মানুষটা লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি অকাতরে ছেড়ে আসতে পারলে তাকে পাঁড়েজী আলোয়নের মূল্য বোঝাতে চাইছে! কিন্তু তার জন্যে পাঁড়েজীরই বা এত দরদ কেন? কে এই পাঁড়েজী যে সদানন্দর জন্য এত ভাবে! সদানন্দ মাঝে মাঝে পাঁড়েজীর কথা ভেবে অবাক হয়ে যায়। সংসরে এমন ঘটনা কেন ঘটে! কেন একজন বেহারবাসী লোক তার জন্যে রাত জেগে না খেয়ে বসে থাকে? কেন তার ঠাণ্ডা লাগবে বলে তাকে আলোয়ান কিনে দেয়? সমস্ত পৃথিবীর লোক যখন নিজের স্বার্থ চিন্তা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করবার সময় পায় না তখন কেন এমন এক-একজন মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়! কোথায় ছিল পাঁড়েজী, কী এক ঘটনায় দু’জনে একদিন ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে গেল, আর কোথাকার কোন্ নবাবগঞ্জের সদানন্দ চৌধুরী তার সঙ্গে এক ছাদের তলায় এসে জীবন কাটাতে লাগলো। যখন বউবাজারের সমরজিৎবাবুর বাড়িতে সে ছিল তখনও তো সে জানতো না যে ভবিষ্যতে এখানে এই ধর্মশালায় এমন করে তাকে দিন কাটাতে হবে!

.

কিন্তু সেদিন যা হবার তাই হলো।

প্রত্যেক দিন ভোরবেলা সদানন্দ ঘুম থেকে উঠতো। উঠেই চলে যেত বাইরে। সেদিন আর সে উঠলো না। বিছানা থেকে মাথাই তুলতে পারলে না সে।

পাঁড়েজী একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর মাথায় হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠেছে।

বললে–ইস, আপনার যে বোখার হয়েছে বাবুজী, আপনার গা যে একেবারে পুড়ে যাচ্ছে–

সদানন্দ তখন অচৈতন্য একেবারে। তার নড়বারও ক্ষমতা নেই, কথা বলবারও ক্ষমতা নেই। কদিন একেবারে বেঁহুশ হয়ে কাটলো। কোথা দিয়ে দিন গেল রাত গেল তাও তার খেয়াল হলো না। যত জ্বালা পাঁড়েজীর। ডাক্তার ডেকে আনা ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব কিছুই করতে হলো তাকে। যখন জ্ঞান হলো একটু তখন সদানন্দ চেয়ে দেখলে পাঁড়েজী তার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে।

পাঁড়েজী বললে–এখন কেমন আছো বাবুজী?

সদানন্দ বললে–আমি আজকে উঠবো পাঁড়েজী, আমার হাতটা একটু ধরো তো–

পাঁড়েজী ধমক দিয়ে উঠলো–আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন তো, ডাক্তার আপনাকে শুয়ে থাকতে বলেছে, আমি দরজায় শিকলি দিয়ে যাচ্ছি, ঘর থেকে বেরোতে পারবেন না–

বলে সত্যি-সত্যিই দরজায় শিকল দিয়ে চলে যেত পাঁড়েজী।

কিছুতেই যেন সদানন্দর কিছু খারাপ হতে দেবে না পাঁড়েজী। যেন পাঁড়েজীই সদানন্দর ভালো-মন্দের নিয়ন্তা।

কিন্তু আর কতদিন সদানন্দ চুপচাপ শুয়ে থাকবে! সেদিন আর থাকতে পারলে না সদানন্দ। বললে–আমি আজ বেরোবাই, তুমি আমাকে আটকে রাখতে পারবে না পাঁড়েজী, আমাকে ছেড়ে দাও–

পাঁড়েজী বললে–কিন্তু আপনি সকাল-সকাল ফিরে আসবেন বলুন?

সদানন্দ বললে–আমি ফিরে আসি না-আসি তোমার কি? জানো আমার কত কাজ? আমার অসুখের জন্যে কত কাজ আটকে আছে?

পাঁড়েজী বললে–আপনি অসুখ বাধাবেন আর দোষ হলো আমার?

সদানন্দ বললে–তোমারই তো দোষ, তুমিই তো আমাকে বাইরে বেরোতে দাও না, ঘরে শেকলবন্ধ করে আটকে রেখে দাও–

পাঁড়েজী বললে–আপনি আলোয়ানটা না হারালে তো আর আপনার অসুখ করতো না–আপনি আলোয়ান হারালেন কেন?

সদানন্দ বললে–তা যাদের আলোয়ান আছে তাদের বুঝি অসুখ বিসুখ করে না?

বলে রাগ করে তাড়াতাড়ি ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে গেল।

কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই ধর্মশালার সামনে একটা বুড়ি মতন মেয়েমানুষ এসে হাজির। তখন ধর্মশালাটা ফাঁকা। পাঁড়েজী তখন সবে সদর গেটে এসে বসেছে। বুড়িটাকে দেখেই কেমন সন্দেহ হলো পাঁড়েজীর। বুড়িটার গায়ে বাবুজীর আলোয়ান কেন?

সঙ্গে সঙ্গে পাঁড়েজী বুড়িটাকে ধরে ফেলেছে। বললে–কে তুমি? এ আলোয়ান কোথায় পেলে? এ কার আলোয়ান?

বুড়ি বললে–আমি খোকাকে খুঁজতে এসেছি বাবা–

–খোকা? খোকা কে?

বুড়িটা তখন ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। তার হাতখানা পাঁড়েজী জোরে টিপে ধরেছে। বললে–বলো এ আলোয়ান কার? কোত্থেকে চুরি করেছ?

বুড়িটা সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেললে। বললে–আমাকে খোকা দিয়েছে এটা।

পাঁড়েজী বললে–খোকা কে আগে তাই বলো? কোথায় তোমার খোকা? কোন্ বাড়িতে থাকে?

বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো–আমার খোকা যে এ বাড়িতে থাকে গো, এই ধর্মশালায়। খোকা যে বলেছিল। কদিন ধরে খোকাকে দেখতে পাইনি তাই খোকাকে দেখতে এলুম–

পাঁড়েজী বুঝলো বুড়িটা চোর। বললে–তোমাকে আমি পুলিসে দেব, চলো থানায় চলো, চলো থানায়–

পাঁড়েজী বুড়িকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে লাগলো। বললে–বলো তোমার নাম কী? এ আলোয়ান আমি নিজে বাবুজীকে কিনে দিয়েছি, আমার চেনা আলোয়ান, আমি তোমাকে জেলে পাঠাবো, চলো–

বুড়ি ভয়ে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো। বললে–না বাবা দারোয়ান, আমাকে তুমি জেলে দিও না, তুমি খোকাকে একবার ডেকে দাও, খোকা নিজে আমাকে আলোয়ানটা দিয়েছে, আমি চাইনি, খোকাকে তুমি একবার ডেকে দাও–

পাঁড়েজী বললে–এখানে খোকা বলে কেউ নেই, তোমাকে থানায় যেতে হবে। বলো তোমার নাম কী?

বুড়ি বললে–আমার নাম কালীগঞ্জের বউ বাবা, কালীগঞ্জের বউ বললেই খোকা আমাকে চিনতে পারবে, তুমি একবার ডেকে দাও না বাবা–

হঠাৎ সদানন্দ সেই সময়ে সেই দিকেই আসছিল। ধর্মশালার সামনে আসতেই বুড়ি চিনতে পেরেছে। খোকাকে দেখে বুড়ি গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো–ও খোকা এই দ্যাখ, দারোয়ান আমায় পুলিসে ধরিয়ে দিচ্ছে–

সদানন্দও অবাক। বললে–এ কি, কালীগঞ্জের বউ, তুমি এখানে?

বুড়ি হাউ-মাউ করে তখন কাঁদছে। এ সেই আনন্দের কান্না। বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আনন্দে চোখে জল এসে সব কিছু ভাসিয়ে দেওয়া।

পাঁড়েজীও কাণ্ড দেখে অবাক। কিছুক্ষণ তার মুখে কোনও কথাও ছিল না। এবার বললে,– বাবুজী, একে আপনি চেনেন?

সদানন্দ বললে–তুমি একে কিছু বোল না পাঁড়েজী, এ আমার বড় আপনার লোক, এ হলো কালীগঞ্জের বউ।

কালীগঞ্জের বউ! কাঁহা কালীগঞ্জ, কিস্‌কা বহু সে সব কিছুই সে বুঝতে পারলে না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারলে যে বুড়ি বাবুজীর খুব আপনার লোক। কিন্তু আপনার লোক বলে অত দামী আলোয়ানটা তাকে দিয়ে নিজে ঠাণ্ডায় কষ্ট পেতে হবে!

বুড়ি তখন বলছে—ক’দিন তুমি যাওনি দেখে আমি বাবা আর থাকতে পারলুম না, তুমি বলেছিলে এই ধর্মশালায় তুমি থাকো তাই মরতে মরতে এলুম, ভাবলুম যাই দেখে আসি আমার খোকা কেমন আছে–

সদানন্দ বললে–আমার যে খুব জ্বর হয়েছিল–

–জ্বর? কেন বাবা, তোমার জ্বর হয়েছিল কেন? ঠাণ্ডা লাগিয়েছিলে বুঝি?

পাঁড়েজী মাঝখান থেকে বলে উঠলো–বোখার হবে না? একটা আলোয়ান কিনে দিয়েছিলুম বাবুজীকে তাও তোমাকে দিয়ে দিয়েছে, এ রকম করলে বাবুজীর তবিয়ৎ ঠিক থাকে?

বুড়ি বললে–তা তোমার নিজের আর আলোয়ান নেই নাকি বাবা? তা হলে আমাকে এ আলোয়ান দিলে কেন?

সদানন্দ বললে–ও সব কথা থাক, এখন কী বলতে এসেছিলে বলো? ওষুধ খাচ্ছো তুমি? ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়েছিলে আর?

–হ্যাঁ বাবা, তোমার দয়াতেই এ-যাত্রা বেঁচে গেলুম বাবা, তুমি আমার জন্যে যা করেছ সে আমি মরে গিয়েও মনে রাখবো–

সদানন্দ বললে–তা এই শরীর নিয়ে তুমি আবার এখানে আসতে গেলে কেন? কে আসতে বললে? এই শীতের মধ্যে কেউ জ্বর থেকে উঠে বেরোয়? চলো, চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিচ্ছি, চলো–

বলে সদানন্দ বুড়ির হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পাঁড়েজী বাধা দিলে। বললে–আপনি কেন যাচ্ছেন বাবুজী, আপনি আমার ঘরে থাকুন, আমি কালীগঞ্জের বহুকে কোঠি পৌঁছে দিচ্ছি–

বুড়িটা বললো বাবা, তাই ভালো; তুমি কেন যাবে বাবা, তুমি থাকো, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না, এই দারোয়ানবাবাই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেখন–

বলে পাঁড়েজীর পাশে পাশে চলতে লাগলো। সদানন্দ পেছন থেকে বললে–পাঁড়েজী, তুমি কালীগঞ্জের বউকে একেবারে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে তবে আসবে, বুঝলে? মাঝরাস্তায় ছেড়ে দিয়ে এসো না যেন–

শীতের রাত্রে বড়বাজারের রাস্তাও তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। সরু সরু গলি। এঁকে-বেঁকে চলেছে। সন্ধ্যেবেলা কারবারীরা দোকান খুলে রাস্তাটা আলোয় আলো করে রেখেছিল। একটু আগে তারা চলে গেছে। তখন সব অন্ধকার। বুড়িকে ধরে ধরে পাঁড়েজী চলছিল। কোন্ দিকে বুড়ির বাড়ি তাও জানে না পাঁড়েজী।

বুড়ি বললে–খোকা বড় ভালো ছেলে দারোয়ানবাবা, খোকা না থাকলে আমি মরে যেতুম–

বুড়ির বয়েস হয়েছে অনেক। ভালো করে সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না।

বললে–তোমাকে বাবা আর আসতে হবে না, আমি ঐটুকু হেঁটে চলে যেতে পারবো–

পাঁড়েজী ছাড়লে না তবু। বললে–না, সে হয় না বহুজী, বাবাজী বলে দিয়েছে তোমাকে বাড়িতে পৌঁছি দিতে–আমি তোমার বাড়ি তক্ যাবো, চলো–

বাড়ি মানে সেই রকম বাড়ি। সে বাড়ির না আছে দেয়াল, না আছে ছাদ। একটা বিরাট প্রাসাদের পেছনে একটা খাটালের মতন জায়গা। গরু-মোষ বাঁধা থাকে সেখানে সার সার। সকাল বেলাটার ওই জায়গাটাতেই দুধের জন্যে মানুষের ভিড়ে ভিড় হয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা তার অন্য রকম চেহারা। তখন শুধু কয়েকটা লম্ফ টিম টিম করে জ্বলে।

পাঁড়েজী প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এ কোথায় এল সে!

বললে–এখানে কোথায় থাকো তুমি বহুজী? এ তো ভঁইসের খাটাল–

বুড়ি বললে–আমি ভিখারী মানুষ দারোয়ানবাবু, এই গয়লারাই আমাকে থাকতে দিয়েছে দয়া করে–

পাঁড়েজী বললে–কিন্তু বাবুজীর সঙ্গে তোমার জানপহচান হলো কী করে?

বুড়ি বললে–এমনি রাস্তায়, আমি রাস্তায় ভিক্ষে করছিলুম, আমার থাকবার জায়গাও ছিল না, খোকা আমাকে এখানে এনে থাকতে দিলে–আমার কাপড় কিনে দিলে, শীতের জন্যে আমার গায়ের কাপড় কিনে দিলে–

পাঁড়েজী হতবাক হয়ে গেল। যে-মানুষটার নিজেরই থাকবার খাবার ঠিক নেই সেই মানুষটা কিনা আবার তার মত আর একজনের থাকা-খাওয়ার ভার স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিয়েছে। চারদিক থেকে খাটালের নোংরা দুর্গন্ধ নাকে আসছে। এতদিন ধরে পাঁড়েজী বড়বাজারে আছে, এরকম জায়গার অস্তিত্ব সম্বন্ধে তার কোনও ধারণাই ছিল না এতদিন। অথচ বাবুজী এই কদিনের মধ্যে এই জায়গারও খবর পেয়েছে।

পাঁড়েজী চলেই আসছিল। কিন্তু বুড়িটা পেছন থেকে ডাকলে।

বললে–ও দারোয়ানবাবা, একটা কথা বলি শুনে যাও–

পাঁড়েজী দাঁড়ালো। বললে–কেয়া?

বুড়ি বললে–আচ্ছা বাবা, খোকা আমাকে কালীগঞ্জের বউ বলে কেন ডাকে তা তুমি জানো? কালীগঞ্জের বউ কে?

পাঁড়েজী আরো অবাক। বললে–কালীগঞ্জের বহু তো তুমিই, তোমারই নাম তো কালীগঞ্জের বহু–

–না বাবা, আমার নাম তো রাজুবালা, আমি কেন কালীগঞ্জের বউ হতে যাবো? খোকা কেবল আমাকে ওই নামে ডাকবে। আমি যত বলি আমার নাম রাজুবালা তত খোকা আমাকে কালীগঞ্জের বউ বলে ডাকবে। কে কালীগঞ্জের বউ তা তুমি বলতে পারো বাবা?

পাঁড়েজী বললে–তা তুমি বাবুজীকে জিজ্ঞেস করলেই পারো–

বুড়ি বললে–জিজ্ঞেস করেছি, তা তার কিছু জবাব দেয় না খোকা। তুমি খোকাকে একটু জিজ্ঞেস করো তো বাবা–

পাঁড়েজী জিজ্ঞেস করবে বলতেই বুড়ি বললে–ওই দেখ আমার ঘর, একদিকে গরু-মোষ থাকে, আর একদিকে আমি থাকি। খোকা আমাকে ভিক্ষে করতে বারণ করেছে। তা আমার কপালে যদি দুঃখু থাকে তো খোকার কী দোষ, খোকা কী করবে? আমার চিরকাল এমন দুর্দশা ছিল না বাবা, একদিন এই আমিই আবার রাজরানী ছিলুম, সে সব কেউ জানে না–

বলে বুড়ি একগাদা দুঃখের কাহিনী বলতে লাগলো। সে কাহিণীর আর শেষ হয় না। কবে নাকি কোন জমিদারের বউ ছিল বুড়ি, দেওর আর ভাসুরপোরা মিলে তার সম্পত্তি গ্রাস করে নিয়েছে। বিধবা পেয়ে তাকে দিয়ে কী সব কাগজে সই করিয়ে নিয়ে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে। তারপর থেকে এই দোরে দোরে ভিক্ষে করেই তার দিন কাটছিল।

অত সব কথা শোনবার দরকার ছিল না পাঁড়েজীর। খানিকটা শুনে সোজা আবার ধর্মশালায় চলে এল।

কিন্তু ধর্মশালায় এসে দেখলে সেখানে বাবুজীর কাছে তখন আর একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে অচেনা মুখ। পাঁড়েজীকে দেখেই সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে কী হলো পাঁড়েজী, কালীগঞ্জের বউকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছ?

পাঁড়েজী বললে–হ্যাঁ বাবুজী, লেকিন বুড়ি জিজ্ঞেস করছিল ওকে আপনি কালীগঞ্জের বউ বলে ডাকেন কেন? ওর নাম তো রাজুবালা–

সদানন্দ হাসলো। বললে–ও তুমি বুঝবে না পাঁড়েজী, ও কেউই বুঝবে না।

পাঁড়েজী বললে–কিন্তু ও তো নিজেই বললে–ওর নাম রাজুবালা–

সদানন্দ বললে–রাজুবালা হোক, আর যা-ই হোক, আমি ওকে কালীগঞ্জের বউ বলে ডাকি, ওই বলে ডেকে আমি সুখ পাই পাঁড়েজী, আমি যদি সুখ পাই ওই বলে তাহলে তুমি কেন আপত্তি করছো? জানো পাঁড়েজী, পৃথিবীতে যাদেরই কেউ দেখবার নেই তারা সবাই-ই হলো কালীগঞ্জের বউ।

বলে পাশের লোকটার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলে–তারপর? তারপর কী হলো মহেশ?

মহেশ একপাশে চোরের মতন দাঁড়িয়েছিল। সে এবার বলতে লাগলো–তারপর শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পর বড়দাদাবাবু এ বাড়িতেই এসে উঠেছেন।

–আর কাকীমা?

–তাঁর কথা আর বলবেন না দাদাবাবু, বড় কষ্ট তাঁর। এককালে মার কথাতেই সংসার চলতো, এখন চলে বাতাসীর কথায়। বাতাসীকে চেনেন তো? সেই যে বড়দাদাবাবুর মেয়েমানুষ?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ তা চিনি–

–আর সেই সঙ্গে আমাদেরও হয়েছে যত হেনস্থা। বউদি এখন কেউ নয়, মাও এখন কেউ নয়, এখন সেই রাক্ষুসীটাই হয়েছে বাড়ির গিন্নী। দেখুন মানুষের কী নিয়তি! বাবু অত করে যা ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন, এখন কিনা তাই-ই সত্যি হলো!

–আর তোমার বউদি? তিনি কেমন আছেন?

মহেশ বললে–তিনি বেঁচে আছেন কি মারা গেছেন তা কারো জানবার উপায় নেই, তবে আগেও যেমন ঘর থেকে বেরোতেন না, এখন আরো তেমনি। দিন-দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছেন–

তারপর একটু থেমে বললে–এখন আমি যাই দাদাবাবু, পরে আবার আসবো–

সদানন্দ বললে–আমি তোমাকে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে ডেকেছিলুম মহেশ, সেই নবাবগঞ্জে গিয়েছিলে তুমি, সেখানকার কথা আমার আরো জানা দরকার, সেদিন সব কথা তাড়াতাড়িতে শোনা হয়নি, এখন বলো তো সেখানে গিয়ে কী দেখেছিলে তুমি—

মহেশ বললে–সবই তো বলেছিলুম আপনাকে বলেছিলুম যে সেখানে কেউই নেই, আপনার কর্তাবাবু মারা গিয়েছেন, আপনার স্ত্রীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে–

–তাই নাকি? আগে তো তুমি তা বলোনি! কী জন্যে তাড়িয়ে দিয়েছে? কেন তাড়িয়ে দিয়েছে?

–গাঁয়ের লোক যা আমাকে বললে–তাই-ই আমি আপনাকে বলছি। আমি তো আর নিজের চোখে কিছু দেখিনি। সে নাকি গাঁয়ের সমস্ত লোক দেখেছে!

সদানন্দ বললে–তা কী করেছিল নয়নতারা?

–আজ্ঞে শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করেছিল। গাঁ-সুদ্ধ লোক নাকি এসে জড়ো হয়েছিল আপনাদের বাড়িতে। সব লোক মজা দেখতে ছুটে এসেছিল। শেষকালে কান্নাকাটি ঝগড়া কিছু আর বাকি ছিল না। লজ্জায় আপনার মা মারা গেছেন, আর আপনার বাবাও দেশত্যাগী হয়েছেন–

–দেশত্যাগী হয়েছেন।

–হ্যাঁ, দেশত্যাগী হয়ে সুলতানপুরে আপনার দাদামশাই-এর দেশে গেছেন।

সদানন্দ কী যেন ভাবতে লাগলো। সেই সব পুরোন কথাগুলো একে একে সব মনে পড়তে লাগলো তার।

সেই তার জন্মভূমি, সেই তার নয়নতারা। এতকাল এই কলকাতার বউবাজারে আর এই বড়বাজারের ধর্মশালাটার মধ্যে থেকে নবাবগঞ্জের কথা সে প্রায় ভুলতেই বসেছিল। শুধু মাঝখানে একদিন নয়নতারার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল শেয়ালদা স্টেশনের প্লাটফরমে। তাও কেবল এক মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু সেই একমুহূর্তের দেখাই যেন এখনও তার জীবনে এখন অক্ষয় হয়ে রয়েছে, এই এতদিন পরেও।

খানিকক্ষণ পরে বললে–মহেশ, এবার তোমাকে আর আটকাবো না, তুমি যাও–তোমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে–

মহেশ বললে–হ্যাঁ, পরে আবার একদিন আসবো দাদাবাবু, আজ যাই–

সদানন্দ বললে–পরে হয়ত আর আমাকে পাবে না এখানে, এমনিতেই আমার শরীর খারাপ। এই দেখ না, আমি তো কদিন খুব জ্বরে ভুগে উঠলুম

পাঁড়েজী এতক্ষণ সব কথা শুনছিল পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বললে–বোখারে ভুগলেন তো আপনারই নিজের দোষে, ঠাণ্ডা লাগলে বোখার হবে না?

মহেশ তখন চলে গেছে। তার বাড়িতে নতুন মনিবের তখন অনেক হুকুম, অনেক হাঁক-ডাক।

সদানন্দ বললে–সত্যিই আমি আর থাকবো না এখানে পাঁড়েজী, কাল ভোরবেলা আমি একবার দেশে যাবো–

–দেশে যাবেন? কিন্তু আপনার ছেলে-পড়ানো? তারা কী বলবে? তাদের খবর দিয়েছেন?

সদানন্দ বললে–তারা বড়লোকের ছেলে, আমি না পড়ালে তারা আর একজন মাস্টার যোগাড় করে নেবে। কিন্তু কাল ভোরের গাড়িতে আমাকে দেশে যেতে হবেই।

বলে ঘরের মধ্যেই পায়চারি করতে লাগলো সে। এক মুহূর্তে সে যেন-কলকাতা থেকে একেবারে সোজা নবাবগঞ্জে চলে গেছে। একেবারে সোজা সেই চৌধুরীবাড়িতে। সমস্ত পাড়ার লোক জড়ো হয়েছে। সকলে ঘিরে ধরেছে নয়নতারাকে। নয়নতারা চৌধুরী বংশের সম্মান ধুলোয় লুটিয়েছে, নয়নতারা চৌধুরী বংশের মুখে কালি মাখিয়েছে, এ অপরাধের ক্ষমা নেই। সবাই বলছে এ অপরাধের জন্যে তাকে শাস্তি দাও, তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও, তাকে অপমান করে তার বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও।

রাত্রে সদানন্দ ধর্মশালার ঘরটার ভেতরে শুয়ে শুয়েও ছটফট করতে লাগলো। বহুদিন ধরে তার মনে হয়েছিল সে বুঝি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছে। সংসারের বন্ধন, সমাজের বন্ধন, এমন কি নিজের বন্ধন থেকেও সে পরিত্রাণ চেয়েছে। নিজেরও তো একটা প্রয়োজন বলে বস্তু আছে। নিজের প্রয়োজনের বন্ধনটাই মানুষের সব চেয়ে বড় বন্ধন। যে নিজেকে অস্বীকার করতে পেরেছে তার কাছে তো প্রয়োজনটা আর কোনও বন্ধন নয়। সদানন্দ এতদিন কামনা থেকে পরিত্রাণ চেয়েছে, ক্ষুধা থেকে পরিত্রাণ চেয়েছে আঘাত থেকে পরিত্রাণ চেয়েছে। সে চেয়েছে আঘাত পেতে। আঘাত পেয়ে আঘাতের ঊর্ধ্বে উঠতে। কিছু না পেয়ে সব পাওয়ার পরিতৃপ্তি পেতে। নিজের উপার্জিত অর্থ সকলের মধ্যে বন্টন করে দিতে চেয়েছে সে, যাতে অর্থ না-থাকার যন্ত্রণা সে উপলব্ধি করে। শীতের কাপড় পরকে বিলিয়ে দিয়েছে যাতে শীত পাওয়ার কষ্টটা সে উপভোগ করতে পারে। লোভ, সুখ, সৌভাগ্য থেকে সে দূরে থাকতে চেয়েছে। সংসার থেকে বনে পালিয়ে গিয়ে নয়, সংসারের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ে সে সংগ্রাম করতে চেয়েছে। এই আদর্শ নিয়েই সে এতদিন এখানে-ওখানে কাটিয়েছে।

কিন্তু সেদিন সেই ধর্মশালাটার ঘরখানার মধ্যে রাত জেগে জেগে আত্ম-সমালোচনা করতে করতে তার মনে হলো সে হয়ত ভুল করেছে। এ হয়ত তার জীবনের যোগ বিয়োগের ভুল। এ ভুল শোধরাতে হবে।

সদানন্দ পাশের ঘরের সামনে গিয়ে ডাকতে লাগলো–পাঁড়েজী—পাঁড়েজী–

পাঁড়েজী অনেক রাত থাকতেই ঘুম থেকে ওঠে। উঠে গঙ্গায় নিয়ে স্নান করে আসে। তখন অন্ধকার থাকে চারিদিক। তখন সে গলা ছেড়ে গঙ্গা-স্তোত্র আওড়ায়।

হঠাৎ সদানন্দর নজরে পড়লো গঙ্গাস্তোত্র আওড়াতে আওড়াতে পাঁড়েজী রাস্তা থেকে ধর্মশালায় ঢুকছে।

সদানন্দকে দেখেই পাঁড়েজী বললেন–এত ভোরে কোথায় যাচ্ছেন–বাবুজী, ঠাণ্ডা লাগবে যে

সদানন্দ বললে–আমি আজ ভোরের ট্রেনেই দেশে যাবো পাঁড়েজী, আমাকে ক’টা টাকা দিতে পারো?

–দেশ? কোথায় আপনার দেশ বাবুজী?

–নবাবগঞ্জ।

–নবাবগঞ্জ? সে কোথায়? কত দূর?

সদানন্দ বললে–সে তুমি চিনবে না পাঁড়েজী, সে এখান থেকে বেশি দূর নয়। এক পিঠের ট্রেন ভাড়া চার টাকার মতন পড়বে। আর বাকিটা হেঁটে চলে যাবো।

–কবে ফিরবেন?

সদানন্দ বললে–দু’একদিনের মধ্যেই ফিরব। আমাকে দশটা টাকা দিলেই চলবে–

পাঁড়েজী ঘর থেকে একটা দশ টাকার নোট এনে সদানন্দর হাতে দিলে। সদানন্দ টাকাটা নিয়েই বাইরে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে পাঁড়েজী বললে–এখুনি চলে যাচ্ছেন?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, এখান থেকে সোজা শেয়ালদা স্টেশনে হেঁটে যেতে হবে, তারপর ভোর পাঁচটার সময় ট্রেন ছাড়বে–

বলে সদানন্দ অন্ধকার রাস্তায় পা বাড়ালো। ঘড়িতে তখন বোধ হয় ভোর চারটে। চারদিকে তখনও রাস্তার আলোগুলো জ্বলছে। তবু অত ভোরেও অনেক লোক রাস্তায় বেরিয়েছে। ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া। হাড়ের ভেতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সদানন্দর মনে হলো তা হোক, তার যত কষ্টই হোক, যত শীতই করুক, এতে ভয় করলে চলবে না, এতে থেমে গেলে চলবে না, এতে হতাশ হলেও চলবে না। বাধা যত আসে তত মঙ্গল, কাঁটা যত ফোটে ততই সুখকর। এ পথের শেষে যা আছে তার দিকে লক্ষ্য স্থির রেখেই এগিয়ে যেতে হবে। পথটাও সত্যি, পথের শেষটাও সত্যি। এই পথটাকে অতিক্রম না করতে পারলে তো আর সে তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছোতে পারছে না। হোক, তার আরো কষ্ট হোক, আরো যন্ত্রণা! তার নিজের যন্ত্রণা একদিন সকলের কল্যাণ হয়ে সকলকে অভিষিক্ত করুক, এইটেই তার ভরসা, এইটেই তার আকাঙ্খা!

.

নৈহাটি স্টেশনের প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়ানোর খানিকক্ষণ পরেই ডাউন ট্রেনটা আসে। তখন হুড়-হুড় করে যে যে কামরায় পারে টপটপ করে উঠে পড়ে। আগে স্টেশনটা ছিল ছোট, পরে বড় হয়েছে। প্ল্যাটফরমও অনেকগুলো। দিনে দিনে লোকও বেড়ে যাচ্ছে। শহরও বেড়ে যাচ্ছে হু-হু করে। শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের সংখ্যাও যেন হু-হু করে বেড়ে চলেছে।

বেহারি পালের বউ বলেছিল–তা আজকেই যাবে কেন বাবা? এতদিন পরে এলে, দু’দিন দেশে থাকো না–

সদানন্দ বলেছিল-কোথায় থাকবো?

বেহারি পাল মশাইও বলেছিল–কেন, আমরা কি তোমার পর? আমাদের বাড়িতেও থাকতে পারো।

কিন্তু সদানন্দর তখন আর থাকবার ইচ্ছে ছিল না। বললে–না। আর থাকা চলবে না আমার এখানে–

বেহারি পালের বউ বললে–শেষকালের দিকে বড় কষ্ট হয়েছিল বাবা নয়নতারার। সে কাণ্ড এ গাঁয়ের সবাই দেখেছে। তা নয়নতারার আর দোষ কী বলে? ওই বউ যে এতদিন অত সহ্য করেছে, সেইটেই এক অবাক কাণ্ড–

সদানন্দ সব ঘটনাই শুনেছিল। বললে–তারপর?

বেহারি পালের বউ বললে–তারপর তোমার দাদামশাই চেপে ধরলেন তোমার বাবাকে। তারক চক্কোত্তি মশাইও বললেন–চৌধুরীবাড়ির বউকে এমন করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া চলবে না। আমরা পাঁচজনা বিচক্ষণ মানুষ থাকতে এ আমরা হতে দেবো না।

তারপর রজব আলির গাড়ি জোড়া হলো। পাড়ার সব মানুষ ভিড় করে উঠোনে তখনও দাঁড়িয়ে। যারা কেষ্টনগরের ভট্টাচার্যি মশাই-এর কাছ থেকে মেয়ে-জামাই-এর জন্যে জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব নিয়ে এসেছিল তারা তখন বাসি মুখে জলটুকু পর্যন্ত না দিয়ে আবার সেই খালি থালাবারকোশ নিয়ে চলে গেছে। অমন অলুক্ষণে কাণ্ড নবাবগঞ্জে কেউ কখনও দেখেনি। তারপর নয়নতারা এসে উঠোনে দাঁড়ালো। আমি দেখলুম নয়নতারা একটা বেনারসী শাড়ি পরেছে। বাড়ির বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছে, কিন্তু গায়ে একটা গয়না পর্যন্ত নেই। যা দু’চার গাছা সোনার চুড়ি হাতে ছিল তাই-ই শুধু তখন হাতে রয়েছে।

আমি গিয়ে বললুম–এ কী বউমা, তুমি গয়না পরলে না কেন? তোমার গয়না-টয়না সব কোথায় গেল?

নয়নতারা আমার দিকে চাইলে। তার চোখ দুটো ছল ছল করছে।

বললে–দিদিমা, আসল জিনিসেই যখন ফাঁকি তখন আর গয়না নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাবো?

বলে হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলো নয়নতারা। উঠোনে তখন অনেক লোকের ভিড়। সে-সব কোনও দিকেই তখন আর তার ভ্রূক্ষেপ নেই। একেবারে লোকের ভিড় ঠেলে সোজা কুয়োতলার দিকে চলে গেল। সেখানে মাটির জালায় জল ছিল ঘটি করে সেই জল নিয়ে মাথার সিঁথিতে ঢালতে লাগলো।

গোপালের মা ছিল দাঁড়িয়ে। সে তো দৌড়ে গিয়ে বউমার হাত দুটো ধরে ফেলেছে। বললে–করছো কী বউমা, করছো কী? সিঁদুর ধুয়ে ফেলছো কেন?

কিন্তু কে আর কার কথা শোনে তখন? নয়নতারা এক হাতে ঘটি করে তখন নিজের সিঁথির ওপর জল ঢালছে, আর এক হাতে সিঁথির সিঁদুর ঘষে ঘষে তুলে ফেলছে। সিঁথিটা একেবারে বিধবার মত সাদা করে তবে ছাড়লে।

আমিও আর থাকতে পারলুম না। বললুম–করছো কী বউমা, করছো কী?

আর আমিও নয়নতারার হাতটা চেপে ধরবার চেষ্টা করতে গেলাম। কিন্তু নয়নতারা এক ধাক্কায় আমার হাত সরিয়ে দিলে।

বললে–আমাকে বাধা দেবেন না দিদিমা–

আমি বললাম–এয়োতির চিহ্ন হলো সিঁদুর, ও কি মুছতে আছে বউমা, ওতে যে তোমার অকল্যেণ হবে–

নয়নতারা রেগে উঠলো–অকল্যাণের আর কতটুকু বাকি আছে দিদিমা যে অকল্যাণকে ভয় করবো?

বললাম–কিন্তু তুমি শুধু তোমার অকল্যাণের কথাই বা ভাবছো কেন বউমা, সদানন্দর অকল্যাণের কথাটাও তো ভাবতে হয়!

নয়নতারা বললে–তা তিনিই কি আমার কথা কখনও ভেবেছেন যে আমি তাঁর কথা ভাববো?

বলে আর এক কাণ্ড করে বসলো নয়নতারা। পেতলের ঘটিটা দিয়ে দু হাতের দুটো শাঁখা দুম্ দুম্ করে ভেঙে টুকরো টুকরো করে গুঁড়িয়ে ফেললে, আর তারপর হাতের নোয়াটা খুলে মুচড়ে বাগানের ঝোঁপের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে।

ফেলে দিয়ে বললে–এবার এ আপদগুলো ঘুচলো দিদিমা, আপনি আশীর্বাদ করুন যেন এ ভড়ং আর কখনও জীবনে না পরতে হয়—

আশপাশের লোক তখন সবাই স্তম্ভিত হয়ে নয়নতারার কাণ্ড দেখছে। নয়নতারা আর কোনও দিকে না চেয়ে সোজা রজব আলির গাড়িতে গিয়ে উঠলো।

আমি আর কী বলবো, আর কে-ই বা তখন কী বলবে।

জীবনে অনেক কাণ্ড দেখেছে বেহারি পালের বউ। আর শুধু বেহারি পালের বউ-ই বা কেন? বেহারি পাল নিজেই কি কিছু কম দেখেছে? কে কম দেখেছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকে? তারক চক্রবর্তীও তো বুড়ো মানুষ। অনেক কিছু কাণ্ড দেখা আছে তার। গোপালের মা, চৌধুরি মশাই-এর গিন্নি, চৌধুরী মশাই, প্রাণকৃষ্ণ সা’ কেউই কোনও বউএর এমন কাণ্ড আগে কখনও কোনও সংসারে ঘটতে দেখেনি, শোনেও নি।

রজব আলির গাড়ি তখন চলতে আরম্ভ করেছে। গৌরীপিসী গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু নয়নতারা তাকে গাড়িতে উঠতে দিলে না। বললে–না, তোমাকে আর উঠতে হবে না গাড়িতে, আমার সঙ্গে এসে আর ভড়ং করতে হবে না—

গৌরীপিসী আর এগোল না। কিন্তু পেছনে-পেছনে চলতে লাগলো কৈলাস গোমস্তা।

তারক চক্রবর্তী মশাই বলে দিলে–কৈলাস, তুমি বাবা আমাদের বউমাকে একেবারে কেষ্টনগরে ওর বাবার হাতে তুলে দিয়ে তবে ফিরে আসবে, বুঝলে?

কৈলাস গোমস্তা কথাটা বুঝলো কিনা তা বোঝা গেল না। সে তখন গাড়ির পেছন-পেছন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।

বেহারি পালের বউ কথা বলতে বলতে কেঁদে ভাসিয়ে ফেললে। বললে–তারপর বউমার কথা কত ভেবেছি বাবা, ভেবেছি গিয়ে একবার দেখা করে আসি, তা কোথায়ই বা যাবো, আর কোথায় গেলেই বা বউমার সঙ্গে দেখা হবে, তাও বুঝতে পারিনি। তারপর এখন তো তোমাদের বাড়ির এই হাল দেখলে, ওদিকে চেয়ে দেখলেও কান্না পায়। তোমার মা মারা যাওয়ার পর ও-বাড়ির দিকে আর চেয়েই দেখিনি আমি–

কথাগুলো শুনতে শুনতে সদানন্দ উঠলো।

দিদিমা বললে–উঠছো কেন বাবা? কোথায় যাচ্ছো?

সদানন্দ বললে–এবার যাই দিদিমা–

দিদিমা বললে–এতদিন পরে যদি ফিরে এলে তো আবার চলে যাচ্ছো কেন বাবা? দু’টো দিন না হয় থাকলেই এখানে–

সদানন্দ বললে–থাকলে আমার চলবে না দিদিমা—

দিদিমা বললে–কী এমন তোমার কাজ যে দুটো দিনও থাকতে পারবে না? তুমি আজকাল কী করছো? কোথায় আছো?

সদানন্দ বললে–থাকার আমার কোনও জায়গাই নেই দিদিমা, যখন যেখানে থাকি তখন সেইটাই আমার থাকবার জায়গা।

দিদিমা বললে–ধন্যি বাপ বটে হয়েছিল তোমার। তবে তোমাকে বলি বাবা, রেল বাজারের আড়তদার প্রাণকেষ্ট সা’ মশাই আছে, তার কাছেই তোমার বাবা এই তোমাদের সব সম্পত্তি-টম্পত্তি বেচে দিচ্ছেন। তোমার দাদামশাই নিজে কিছু জমি বাগান কিনতে চেয়েছিলেন, তা তোমার বাবা কী বললেন, জানো, বললেন–আমি মিনিমাগনা লোককে বিলিয়ে দেব, তবু আপনাকে আমি এসব কিছুই বেচবো না। তা আমাদেরই ওপর চৌধুরী মশাইএর যত রাগ, তা জানো বাবা!

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কেন, আপনাদের ওপর বাবার রাগ কেন?

–ওই যে, নয়নতারার হয়ে আমি কথা বলতুম। আমরা যে বলতুম বউমার ওপর কেন এত হেনস্তা করছেন! বউমা পাছে আমার কাছে আসে তাই শেষের দিকে তাকে আটকে রাখতো তোমার মা, তা জানো–

সদানন্দ আর শুনলো না। এবার সত্যিই ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। তার মনে পড়তে লাগলো বহুদিন আগে এই নবাবগঞ্জ থেকেই একদিন যাত্রা শুরু করেছিল সে। সহায় সম্বলহীন অবস্থায় একদিন এই চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল সে। তারপর ছোটবেলার আদর-আনন্দর মধ্যে কখন কোন্ ফাঁকে একটা দার্শনিক মনের জন্ম হয়েছিল তা সে নিজেও জানতো না। সেই মনটা সুখে-স্বস্তিতে শান্তি পেত না, দুঃখে-বেদনায় ক্লান্ত হতো না। কেবল খুঁজে বেড়াত নিজের ভেতরের নিজেকে। নিজের সেই অদৃশ্য অন্তরাত্মাকে। তাকে সে দেখতে পেত না কখনও। তবু তাকে উদ্দেশ্য করে বলতো–আমাকে বলে দাও কেমন করে আমি তোমাকে পাবো, কেমন করে আমি আমার সমস্ত জটিলকুটিল প্রশ্নের সমাধান করবো?

কিন্তু সদানন্দর এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?

কেষ্টনগরের সেই ঠিকানার কথাটা মনে ছিল সদানন্দর। বহুদিন আগে একদিন নয়নতারার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল সেই বাড়িটাতে। সেই বিয়ের ঘটনার কথাটা ভাবতেও যেন তার আতঙ্ক হলো। তার জীবনের এক মহা বিপর্যয় বুঝি সেটা।

–আচ্ছা কালীকান্ত ভট্টাচার্য বাড়িতে আছে?

রাস্তা দিয়ে একজন যাচ্ছিল। সদানন্দ তাকেই ডাকলে। বললে–এইটেই তো কালীকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়ি না? এখানকার কলেজের মাষ্টার মশাই?

ভদ্রলোক বললেন, কিন্তু তিনি তো নেই–

–নেই?

–না, তিনি তো বছর দুয়েক হলো মারা গেছেন। আপনি কোত্থেকে আসছেন?

–মারা গেছেন?

সদানন্দ কিছুক্ষণ স্তম্ভিতের মতন সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তাহলে? তাহলে নয়নতারা কোথায় আশ্রয় পেলে? নবাবগঞ্জ থেকে হাতের শাঁখা ভেঙে সিঁথির সিঁদুর মুছে চলে এসে কোথায় গিয়ে উঠলো? তাহলে কাকে আশ্রয় করে সে বাঁচবে? আশ্চর্য, সদানন্দ নিজের মনেই হেসে উঠলো। নয়নতারার জন্যে সে নিজেই তো দায়ী, অথচ সেই কিনা তার দুর্ভাগ্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে!

তবু সদানন্দ স্থির থাকতে পারলে না। ভদ্রলোক তখন অনেক দূরে চলে গেছে। সদানন্দ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে গেল। বললে–আচ্ছা কালীকান্ত ভট্টাচার্যের এক মেয়ে ছিল, তার কি হয়েছে বলতে পারেন?

ভদ্রলোক বললেন–সে মেয়ের তো নবাবগঞ্জে না কোথায় বিয়ে হয়েছিল, বোধহয় তার শ্বশুরবাড়িতেই আছে। সে মেয়ে এখানে নেই–

সদানন্দ বুঝলো ভদ্রলোক বেশি কিছু জানেন না! তাঁকে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করা বৃথা। ভদ্রলোক যেদিকে যাচ্ছিলেন সেইদিকেই আবার চলতে লাগলেন। সদানন্দ তাঁকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলে না।

তারপর আস্তে আস্তে আবার স্টেশনের দিকে চলে এল। তার প্রতিশোধ নেবার প্রচেষ্টার যে এই পরিণতি হবে তা কে জানতো! অথচ কী-ই বা সে করতে পারে! নয়নতারার সঙ্গে দেখা হয়নি ভালোই হয়েছে। দেখা হলে কী-ই বা সে বলতো! বড় জোর বলতো–আমায় তুমি ক্ষমা কোর—

যেন কাউকে ক্ষমা করতে বললেই কেউ ক্ষমা করে! যেন ক্ষমা করার ক্ষমতাই সকলের আছে! যেন ক্ষমা করার মত অপরাধ সদানন্দ করেছে!

তারপর কলকাতার ট্রেনটাতে উঠে এক কোণে নিজের আশ্রয় করে নিলে সে। আসবার সময় পাঁড়েজীকে বলে এসেছিল দু একদিনের মধ্যে সে ফিরবে। অথচ তার আগেই যে তাকে কলকাতায় ফিরতে হবে তা কি সে তখন নিজেই জানতো!

নৈহাটি স্টেশনে ট্রেনটা পৌঁছোবার আগেই গাড়ির ভেতরে হই-চই শুরু হয়ে গিয়েছিল। নৈহাটির আগের স্টেশনে একটা থার্ড ক্লাস কামরার এক কোণে একজন প্যাসেঞ্জারকে চুপ করে বসে থাকতে দেখেছিল সবাই। অত শীতের মধ্যেও লোকটার গায়ে কোনও গায়ের কাপড় ছিল না। অনেকক্ষণ ধরেই লোকটা থর-থর করে কাঁপছিল। তারপরেই হঠাৎ কী যেন হলো। লোকটা সেইখানেই বেঞ্চি থেকে টলে নিচের মেঝেতে পড়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে একটা শোরগোল উঠলো গাড়িতে।

–কী হলো মশাই? লোকটা কি পড়ে গেল নাকি?

পাশের লোকটা তখনো বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এতক্ষণে তার মুখে কথা ফুটলো।

বললে–কী জানি, আমি তো বুঝতেই পারিনি আগে, ভদ্রলোক আপন মনে এতক্ষণ তো চোখ বুঁজে বসে ছিলেন–

মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লেগেছিল সদানন্দর। কপালের সেই চোট-লাগা জায়গাটা দিয়ে তখন ঝর ঝর করে রক্ত পড়ছিল।

–আর কেউ আছে ভদ্রলোকের সঙ্গে?

না, কেউ নেই। কে আর থাকবে সদানন্দর! পৃথিবীতে সদানন্দদের মত মানুষদের হয়ত কেউই থাকে না। কেউ থাকবার জন্যে সদানন্দর মত মানুষদের হয়ত জন্মই হয় না। কেউই যদি থাকবে তার তাহলে মানুষের মুক্তি কী করে আসবে? কী করে পৃথিবীর ইতিহাস এগিয়ে চলবে? সদানন্দের কেউ যদি থাকতো তাহলে তো পৃথিবীর এগিয়ে চলা কবে থেমে যেত!

ট্রেনটা নৈহাটি স্টেশনে পৌঁছুতেই একজন বললেন–এখানে ওঁকে নামিয়ে দিন মশাই, গার্ডকে খবর দিন, ডাক্তার হাসপাতাল যা হোক সবই আছে নৈহাটিতে–

তখন অফিস টাইম। অফিসযাত্রী প্যাসেঞ্জাররা নৈহাটি স্টেশনের প্লাটফরমে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে তৈরি হয়ে। কিন্তু ট্রেনটা এসে থামতেই গার্ডের কাছে খবর চলে গেছে। খবর চলে গেছে যে একজন প্যাসেঞ্জার গাড়ির ভেতরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। গার্ডের কাছে ফার্স্ট-এড-এর বাক্স আছে। সামান্য ব্যাপার হলে গার্ড সাহেব নিজেই তার প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারে।

অন্য প্যাসেঞ্জাররা তখন ট্রেনে ওঠবার জন্যে ব্যস্ত ব্যতিব্যস্ত। তার ভেতর থেকে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে সদানন্দকে কামরা থেকে নামিয়ে আনলে। স্টেশন মাস্টার নিজে এসে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে ভিড় জমে গেল।

গার্ড বললে–এখুনি হসপিটালে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন মাস্টার মশাই, আমার মনে হয় কেসটা সিরিয়াস–

ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ একজন মহিলা সামনে এগিয়ে এল। সদানন্দর দিকে চেয়ে দেখেই বললে–এঁকে আমার কাছে দিন, আমি এঁর দেখাশোনা করবো–

সবাই মহিলাটির মুখের দিকে চেয়ে দেখলে, বিবাহিতা মহিলা। মাথার সিঁথিতে সিঁদুর। বোঝা যাচ্ছে অফিসে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছিলেন। ডেলি-প্যাসেঞ্জার। অনেকের মুখ চেনা।

স্টেশন মাস্টারও দেখেছেন মহিলাটিকে। চিনতে পারলেন।

জিজ্ঞেস করলেন–আপনার কেউ হন নাকি ইনি?

মহিলাটি বললেন–হ্যাঁ, ইনি আমার….আমার আত্মীয়–আমি এঁকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।

–আপনি এই নৈহাটিতেই থাকেন?

মহিলাটি বললেন—হ্যাঁ—

স্টেশন মাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন–আপনার নাম?

–আমার নাম নয়নতারা। নয়নতারা ব্যানার্জি।

–ইনি আপনার কী রকম আত্মীয় হন?

–আমার খুব নিকট-আত্মীয়। আপনি দয়া করে শুধু একটা স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করে দিন, শিরগির, দেরি করবেন না–খুব তাড়াতাড়ি…

.

সদানন্দর জীবনে সে এক মহা সংগ্রামের সময়। সংগ্রাম সারা জীবনই সে করেছে। সে কেবল সংগ্রাম করেছে আর বারে বারে সংগ্রামকে অতিক্রম করতে গিয়ে আর একটা সংগ্রামের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে আত্মপরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সংগ্রাম কি শুধু বাইরের সঙ্গে? বাইরের সঙ্গে যে-সংগ্রাম সে তো সহজ সংগ্রাম। কিন্তু ভেতরের সঙ্গে যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামই কঠোর। সেই কঠোর সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েই সে সেদিন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন নবাবগঞ্জ থেকে বেরিয়ে যখন সে কেষ্টনগরে গিয়েছিল তখন ভেবেছিল সে শুধু একবারের জন্যে নয়নতারার সঙ্গে দেখা করবে। দেখা করে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে। শুধু বলবে যে তুমি আমাকে ক্ষমা করো–

ক্ষমা! মুখের ক্ষমা যে ক্ষমা নয় তা কি সদানন্দ জানতো না? ক্ষমা সকলকে করাও যায় না, আবার সকলের কাছে ক্ষমা চাওয়াও যায় না। হাজার অপরাধের পরও যে ক্ষমা চায় তার ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে কোনও মহত্ত্ব নেই, কিন্তু তবু তারপরেও যে ক্ষমা করে তার ক্ষমা করার মধ্যে মহত্ত্ব আছে। কিন্তু সদানন্দ কি আশা করেছিল নয়নতারা তাকে ক্ষমা করবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *