নিত্য কোন কালেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না, ছিল সহপাঠী। কলেজে আমার অসংখ্য বন্ধু ছিল। অধ্যাপকদের সঙ্গেও আমার হৃদ্যতা ছিল। পড়াশুনা ছাড়াও আরো বহু বিষয় নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকতাম। আর নিত্য? সে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রামে তিন পয়সার টিকিট কেটে কলেজে আসত, ক্লাস করত, আবার তিন পয়সায় হাওড়া পৌঁছে পাঁশকুড়া লোক্যালে চড়ে বাড়ি ফিরে যেত। এই ছিল ওর নিত্যকর্ম পদ্ধতি।
কলেজের পাশেই ছিল ছবিঘর আর পূরবী। আমরা মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এর-ওর কাছ থেকে পয়সাকড়ি ধার করেও সিনেমা বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলমহমেডানের খেলা দেখেছি কিন্তু নিতা নৈব নৈব চ।
শুধু কী তাই? নিত্য কোনদিন আমাদের সঙ্গে বসে কেষ্ট কাফেতে এক কাপ চা পর্যন্ত খায় নি। তবু সেই নিত্যকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের হরিদাসপুর চেকপোস্টে ও-সি দেখে কত ভাল লাগল। আমাকে পেয়ে ও নিজেও কত খুশি হলো।
এ সংসারে জীবনের সব ক্ষেত্রেই এমন হয়। বিয়ের আগে মেয়েরা যে ভাইয়ের সঙ্গে নিত্য ঝগড়া করেছে, বিয়ের পর দীর্ঘদিনের ব্যবধানে সেই ভাইকে কাছে পেয়েই মেয়েরা যেন হাতে স্বর্গ পায়। আসল কথা, পুরানো দিনের ছিটেফোঁটা স্মৃতিও বর্তমানের অনেক মধুর অভিজ্ঞতার চাইতেও মানুষের কাছে অনেক প্রিয়, অনেক আনন্দের।
উত্তরপ্রদেশের মানুষ ঠিকই বলে, দূরকা ঢোল সাহানাই বরাবর। সত্যি, দূরের ঢোল সানাইয়ের মতই মধুর।
জীবজগতের কোন কিছুই চিরকালের জন্য এক জায়গায় থাকতে পারে না। জীবন-পথের বিবর্তনের মাঝেও সে পরিবর্তন চায় পারিপার্শ্বিকের। কীট পতঙ্গ পশু-পক্ষী থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত চিরকাল ধরে ভ্রমণবিলাসী। আজও সেই সুদূর সাইবেরিয়ার নিজের ঘর ছেড়ে হাজার হাজার পাখি কিসের মোহে, কার আকর্ষণে যে আলিপুরের চিড়িয়াখানায় উড়ে আসে, তা শুধু ওরাই জানে।
অতীতে শুধু মার্কোপোলো, আলেকজাণ্ডার, হিউয়েন সাঙ, ইলতুতমিস বা ভাস্কো দ্য গামাই ঘর ছেড়ে বেরোন নি, আরো অনেকেই বেরিয়েছেন। মার্কোপোলের সব সঙ্গই কী স্বদেশে ফিরেছিলেন? আলেকজাণ্ডারের বিরাট সৈন্যবাহিনীর অনেকেই দেশে ফিরে যান নি। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তারা নতুন দেশে নতুন সংসার পেতেছেন। শুধু ওরাই না, পৃথিবীর বহু দেশের অসংখ্য সওদাগরই সমুদ্রপথে বেরিয়ে তার ফিরে আসেন নি। যারা ফিরে এসেছেন, তাদের অনেকেই আবার বেরিয়েছেন জীবনের টানে বা জীবিকার প্রয়োজনে।
মানুষের এই পথ চলা কোনদিন থামেনি, থামবে না। কাজে অকাজে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সুখে-দুঃখে মানুষকে ঘর ছেড়ে বেরুতেই হয়। হবেই। মানুষ নিজের ঘর, নিজের সংসারকে যত সুন্দর করছে, তার ঘর ছেড়ে পৃথিবী বিচরণও ততই বাড়ছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত সংঘর্ষ, পর্বতপ্রমাণ বিধিনিষেধ দিয়েও কেউ কোনদিন মানুষের পথ চলা বন্ধ করতে পারে নি। পারবে না।
মা ধরিত্রীই তো সৃষ্টির আদিমতম যাযাবর। সে তো কখনই স্থির হয়ে থাকতে পারে না। এই যাযাবর মার সন্তান হয়ে আমরা কী ঘরের কোণেও দুপাঁচজন আত্মীয়-বন্ধুর মোহে বন্দী থাকতে পারি?
যুগের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যাযাবর বৃত্তি বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আরো আরো বেশী মানুষ ঘর ছেড়ে বেরচ্ছেন। কোন অশরীরী আত্মা যেন অহর্নিশ মানুষের কানে কানে বলছেন, চরৈবেতি, চরৈবেতি! চলো, চলো, আরো চলো, আবার চলো।
পৃথিবীর কোন মহাশক্তিই মানুষের পায়ে শিকল পরাতে না পারলেও দেশ থেকে দেশান্তরে মানুষের চলা নিয়ন্ত্রিত করার জন্য আছে পাসপোর্ট, আছে ভিসা। প্রতি দেশের সীমানা অতিক্রমের সময় তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। পাসপোর্টের অঙ্গে মোহরের ছাপ মেরে সযত্নে সতর্কে তার আগমন-নির্গমনের হিসাব রক্ষা করা হয়। শুধু তাই না। বাক্স-পেঁটরা পোঁটলা পুঁটলি তল্লাসী করে দেখা হয়, বাছাধন কি নিয়ে এলেন, কি নিয়ে গেলেন।
পাশ্চাত্য দেশে ও দেশবাসীর কাছে এসব ব্যাপার ডাল-ভাত। সকালে প্যারিসে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে মিলানে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সেরে ভিয়েনায় লাঞ্চের পর কনফারেন্সে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে বার্লিনে বান্ধবীর উষ্ণ সান্নিধ্যে নাচ-গান-ডিনার শেষ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফের। আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রেয়সীর শুধু একটা চুম্বনের জন্য বস্টনের ছেলে-ছোকরাদের গাড়ি নিয়ে কানাডার কোন সীমান্ত শহরে ছুটে যাওয়া বা নায়েগ্রার ধারে ঘূর্ণায়মান কাফেতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এলে বাড়ির কেউ জানতেও পারেন না।
সমস্যা সমাজতান্ত্রিক ও এশিয়া-আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে। কোথাও রাজনৈতিক কারণে, কোথাও অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য মানুষের ঘোরাঘুরির পথে বহু বাধা, বহু বিঘ্ন।
অতীত দিনের ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ নিয়মিত সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন, হিমালয়ও অতিক্রম করেছেন। তাদের অনেকের অনেক কথাই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আজো ছড়িয়ে থাকে। তারপর কত কী অঘটন ঘটে গেল। এই বিরাট উপমহাদেশের সমস্ত মানুষগুলো যেন বাতগ্রস্ত হয়ে ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে রইল। কাশী গয়। যাত্রাকেই অন্তিম যাত্রা মনে করতেন আত্মীয়-স্বজনের দল। ওপার থেকে সাহেব-মেমের এলেন, আমরা ইংরেজি বুলি শিখলাম কিন্তু যে দেশের অতি সাধারণ সওদাগরের দল নির্বিবাদে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর নানা দিগন্তে মসলিন ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি করতেন, সে দেশেরই আলালের ঘরের দুএকটি দুলাল কালাপানি পাড়ি দিলে হৈচৈ পড়ে যেত। গঙ্গা দিয়ে অনেক অনেক জল গড়িয়ে গেছে কিন্তু আজো মানুষের শেয়ার বাজারে বিলেতফেরতের দাম বেশ চড়া।
সে যাই হোক ঝগড়া-বিবাদ সংঘাত-সংঘর্ষ ও সর্বোপরি অসংখ্য মানুষের অনেক রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে এই উপমহাদেশ টুকরো টুকরো হবার পর ভারতবাসীরা লণ্ডন নিউ ইয়র্ক-প্যারিস যেতে ভয় না পেলেও পাকিস্তান যেতে দ্বিধা করেছে। বিদ্বেষ ও হিংসার মধ্যে দিয়ে যে দুটি দেশের জন্ম, সেদেশের মানুষের মনে এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় থাকবেই। বিস্ময় ও মজার কথা পাকিস্তানের বুক চিরে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হবার পরও এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কালো মেঘ পুরোপুরি কাটে নি।
উড়োজাহাজের বড়লোক খদ্দেরদেরও বিমান বন্দরে পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষা ও মালপত্র তল্লাসী হয় কিন্তু সেখানে তেমন ভীতি বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। হতভাগ্যের দল যাতায়াত করেন হরিদাসপুর বেনাপোলের মত সীমান্ত অতিক্রম করে। এই সীমানা পার হওয়া নিয়ে সংশয় নেই, এমন মানুষ সত্যি দুর্লভ।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়দের বিদায় জানিয়ে নিত্যর অফিসে ফেরার পথে জয়ন্তী একটু চাপা গলায় আমাকে বললেন, এই বর্ডারের ভয়ে আমি বিশেষ রংপুর যাই না।
-কিসের ভয়?
-ঝামেলার ভয়, নাস্তানাবুদ হবার ভয়।
আমি কোন মন্তব্য করি না। ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, আপনি একেবারেই রংপুর যান না?
-প্রায় চোদ্দ-পনের বছর আগে একবার আমরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম। একটু থেমে বলেন, তাও হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়েছিলেন বলেই গিয়েছিলাম।
আমি একটু হেসে, একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, এই এত বছরের মধ্যে আর যান নি?
না।
হঠাৎ যেন দুষ্টু সরস্বতী আমার জিহ্বায় বসায় আমি ওকে বলি, এবার কী আমার সঙ্গে দেখা হবে বলেই…
পুরো কথাটা শেষ করার আগেই জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, জানি না; আমি কী জ্যোতিষী?
নিত্য নিজের আসন অলংকৃত করেই আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ফতোয়া জারী করল, দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনকে ছাড়া হবে।
আমরা দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে আপীল করি। জয়ন্তী বললেন, আপনি আপনার বন্ধুকে রেখে দিন কিন্তু আমাকে আর আটকাবেন না! আমাকে আবার টিকিট-ফিকিটের ব্যবস্থা করে ট্রেন ধরতে হবে।
নিত্য নির্বিকারভাবে হাসতে হাসতে বলল, আপনার গাড়ি তো মাঝ রাত্তিরে। এখন গিয়ে কী করবেন?
–টিকিট রিজার্ভেশনের চেষ্টা করতে হবে না?
–সেসব হয়ে যাবে; কিছু চিন্তা করবেন না।
আমি বললাম, না ভাই নিত্য, যশোরে আমার কাজ আছে। তাছাড়া আজই ঢাকায় পৌঁছতে পারলে ভাল হয়।
ওর মুখে এবারও সেই নির্বিকার হাসি। বলল, এত বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা। এক কাপ চা খেয়ে চলে যেতে চাইলেই কী আমি যেতে দিতে পারি?
আমরা দুজনেই অনেক অনুরোধ-উপরোধ, আবেদন-নিবেদন করলাম কিন্তু হরিদাসপুর ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভাগ্যবিধাতা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না। আমাদের চায়ের ব্যবস্থা করে নিত্য একট বেরুল। বেরুবার সময় শুধু বলল, আমি এখুনি আসছি।
ও ঘর থেকে বেরুতেই জয়ন্তী বললেন, আপনার বন্ধু এমন করে বললেন যে বেশী কিছু বলতে পারলাম না কিন্তু…
আমি ওকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনার আর কী? ও তো আপনার টিকিটের ব্যবস্থা করেই দেবে কিন্তু মুশকিলে পড়লাম আমি।
–আপনার মত সাংবাদিকের আবার মুশকিল কী?
না, না, আমার আবার মুশকিল কী? যত মুশকিল আপনার!
–একশ বার। আমি মেয়ে, আপনি ছেলে। তাছাড়া আমি একলা একলা যাচ্ছি।
আমি এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে একটু সতর্ক হয়ে চাপা গলায় বলি, কে আপনাকে একলা যেতে বলেছে?
এ সংসারে চপলতা শুধু কিশোর-কিশোরীর জীবনেই ঘটে না; জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আমরা সবাই চপলতা প্রকাশ না করে পারি না। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, চপলতা ঘটে যায়। আমি ভাবি নি, এমন চপলতা প্রকাশ করব কিন্তু যা ভাবা যায় না, তা তো ঘটে। নিত্যই ঘটে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, বোধহয় অন্যায় করলাম।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু হাসেন।
আমি খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, যাক, বাঁচালেন।
জয়ন্তী একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে?
–আপনার হাসি দেখে বুঝলাম, আপনি রাগ করেন নি।
-কেন? রাগ করব কেন?
হঠাৎ একটু চপলতা প্রকাশ করেই মনে হয়েছিল, বোধহয় আপনি অসন্তুষ্ট হবেন।
জয়ন্তী বেশ গম্ভীর হয়েই বললেন, এ সংসারে বেঁচে থাকার ঝামেলা তো কম নয় কিন্তু একটু-আধটু হাসি-ঠাট্টা বা চপলতা না হলে কী আমরা কেউ বাঁচতে পারব?
উনি একটু থেমে আবার বলেন, আমি নিজেও বেশী গম্ভীর থাকতে পারি না; আবার বেশী গম্ভীর লোককে বেশীক্ষণ সহ্যও করতে পারি না।
-আমিও তাই।
–সে আপনাকে দেখেই বুঝেছি।
এবার খুব উৎসাহের সঙ্গে প্রশ্ন করি, আমাকে দেখে আর কী বুঝেছেন?
জয়ন্তী চাপা হাসি হেসে বললেন, এখনই সব কথা বলব কেন?
ওর কথায় আমি হেসে উঠি।
একটু পরেই নিত্য ঘুরে এসে জয়ন্তীকে বলল, আপনি যশোর স্টেশনের এ-এস-এম-এর কাছে গেলেই টিকিট পেয়ে যাবেন। তাছাড়া উনি আপনাকে ট্রেনে চড়িয়ে দেবারও ব্যবস্থা করবেন।
আমি চাপা হাসি হেসে বললাম, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়!
ওরা দুজনেই হাসে।
এবার নিত্য ওকে বলে, আমরা চেকপোস্টের সবাই সামনের একটা ব্যারাকে থাকি। ওখানে তো আপনাকে নিতে পারি না। দরজার পাশে দাঁড়ান কাস্টমস-এর একজন মহিলা কর্মীকে দেখিয়ে বলল, আপনি এই দিদির সঙ্গে কাস্টমস-এর গেস্ট হাউসে চলে যান। ওখানে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করুন। আমরা দুজনে খানিকটা পরেই আসছি।
জয়ন্তী বললেন, আমার জন্য আপনাদের সবার এত কষ্ট…।
–কিছু কষ্ট না। নিত্য একটু হেসে বলল, সবাই তো মনে মনে আমাদের গালাগালি দেয়। কজন লোক আর আমাদের আপন মনে করে? মন খুলে কথা বলার মত লোক পেলে আমাদের ভালই লাগে।
জয়ন্তী আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন।
নিত্য ওর সহকর্মীদের বলে আমাকে নিয়ে ওদের ব্যারাকে গেল। বলল, চলো বাচ্চু, একটু গল্পগুজব করা যাক।
চেকপোস্টের ঠিক উল্টোদিকেই একটা লম্বা চালাঘর। মাঝে মাঝে পার্টিশন করা। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত বছর ধরে তোমাদের চেকপোস্ট হয়েছে কিন্তু তোমাদের কোয়ার্টার তৈরী হয় নি?
–না, ভাই।
–এখানে দিনের পর দিন থাক কী করে? তাছাড়া তোমাদের কেউই তো ফামিলি আনতে পারে না।
নিত্য একটু ম্লান হেসে বলল, আমাদের এসব দুঃখের কথা কে বোঝে আর কে শোনে? তাছাড়া পুলিসের লোকজনেরও যে দুঃখ কষ্ট আছে, তা কজন বিশ্বাস করে?
পাশাপাশি দুটো তক্তপোশের উপর বালিশে হেলান দিয়ে আমরা মুখোমুখি বসে কথা বলি। ও পকেট থেকে একটা লাল সিগারেটের প্যাকেট বের করতেই আমি জিজ্ঞেস করি, এ আবার কী সিগারেট। এ রকম প্যাকেট তো দেখিনি।
নিত্য পকেটটা আমার হাতে দিয়ে বলল, এ তো আমাদের দেশের সিগারেট না, ওপারের।
হ্যাঁ, তাই দেখছি।
–খেয়ে দেখ, বেশ ভাল সিগারেট।
গোল্ড লিফ সিগারেটে টান দিয়ে বলি, হ্যাঁ, বেশ ভাল সিগারেট।
নিত্যও একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলে, বললাম না!
-বনগাঁয় কী এই সিগারেট পাওয়া যায়?
ও একটু আত্ম প্রসাদের হাসি হেসে বলল, না পাওয়া গেলেও আমরা পেয়ে যাই। মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলল, লোকজন দিয়ে যায় বলেই খাই। নিজের পয়সায় কী এইসব সিগারেট খাওয়া যায়?
আমি হেসে বলি, তাহলে ভালই আছ, কী বল?
-ভাল আছি, তাও বলতে পারি না; আবার ভাল নেই, তাও বলা ঠিক হবে না।
তার মানে?
নিত্য সিগারেটে একটা টান দিয়ে তুড়ি দিয়ে ছাই ফেলে বলল, জানোই তো পুলিসের চাকরিতে সব সময় টু পাইস এক্সট্রা ইনকাম থাকে। আই-বির মত দু একটা জায়গা ছাড়া এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে আমাদের এক্সট্রা ইনকাম নেই।
ওর কথায় আমি হাসি।
–হাসছ কী ভাই? আজকাল কলকাতা পুলিসের এমন কনস্টেবলও আছে, যারা মাসে মাসে দশ হাজার টাকার বেশী আয় করে।
-বলো কী?
-তুমি তো দিল্লী চলে গেছ, তাই কলকাতার খবর রাখো না। যে পুলিশকে চোর-ডাকাত গুণ্ডা-বদমাইশরা ভয় করত, সে পুলিস আর নেই। এখন আমরাই ওদের ভয় করি।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, কেন?
একটু ম্লান হাসি হেসে নিত্য বলল, আজকাল পলিটিসিয়ানদের হাতে গুণ্ডারা, নাকি গুন্ডাদের হাতে পলিটিসিয়ানরা, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
–কিন্তু …
ও মাথা নেড়ে বলল, কোন কিছু নেই ভাই। আজকাল আমরা নেংটি ইঁদুর ধরলেও হয় বাঘ, না হয় সিংহ গর্জন করে উঠবেই।
আমি প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করি, যাই হোক, তুমি এখানে কেমন আছো, তাই বলো।
–পোস্টিং হিসেবে ভালই তবে…।
–ভালই মানে?
নিত্য একটুও দ্বিধা না করে বলল, ভালই মানে না চাইলেও বেশ টু পাইস ইনকাম আছে এখানে। আর তাছাড়া খুব ইন্টারেস্টিং।
–ইন্টারেস্টিং মানে?
–ইন্টারেস্টিং মানে বহু বিখ্যাত মানুষ থেকে শুরু করে নানা ধরনের নানা মানুষ দেখা যায়। ও একটু থেমে বলল, থানায় মোটামুটি একই ধরনের ঘটনা বা মানুষ দেখা যায় কিন্তু এখানে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা হয়।
আমি চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। নিত্য বলে যায়, এই চেকপোস্টে বসে বসে কত মানুষের কত কাহিনী যে জানলাম, কত রকমের কত ঘটনা যে চোখের সামনে দেখলাম, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ, ভাই। একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, ফেরার পথে এখানে দু একদিন থাকলে তোমাকে সব বলব।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, নিশ্চয়ই থাকব।
.
০৪.
আমার আর জয়ন্তীর বিদায় সম্বর্ধনাও মন্দ হলো না। হাজার হোক চেকপোস্টের ওসি সাহেবের বন্ধু! সেই সকাল থেকে এই অপরাহ্ন বেলা পর্যন্ত, চেকপোস্টে ও কাস্টমস কলোনীতে কাটিয়ে অনেক নতুন বন্ধু হলো। সত্যি ভাল লাগল। ঐ খাকি পোশাক দেখলেই আমরা ভুলে যাই যে ঐ পোশাকের মধ্যেও একটা মানুষ লুকিয়ে থাকে। এবং আমাদের আর পাঁচজনের মতই ওদের জীবনেও সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে। পুলিস বা কাস্টমস-এর লোকজনদের কী মন নেই? না মায়া-মমতা স্নেহ-ভালবাসা নেই।
এই তো কাস্টমস-এর নীরোদবাবু বলছিলেন, সাধারণত সন্ধ্যে হতে না হতেই বর্ডার দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।
–কেন? তখন কী দুদিকের চেকপোস্ট বন্ধ হয়ে যায়?
-না, না, সারা রাত ধরেই দুদিকের চেকপোস্ট-কাস্টমস কাউন্টারে লোক থাকে। তবে সন্ধ্যের পর গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যায় বলেই লোকজন যাতায়াত করে না।
–ও।
নীরোদবাবু একটু থেমে বললেন, বর্ডারের খুব কাছাকাছি যারা যাবেন বা কিছু ব্যবসাদার কাজকর্মে আটকে গেলে রাত্রেও যাতায়াত করেন। ওরা ছাড়া আর বিশেষ কেউ যাওয়া-আসা করেন না।
এবার আমি বলি, কী যেন বলবেন বলছিলেন?
–একটা ঘটনার কথা বলব।
-বলুন।
নীরোদবাবু সেদিন ভিতরে বসে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের কি যেন কাজ করছিলেন। একজন ইন্সপেক্টর এসে বললেন, নীরোদদা, একজন ভদ্রমহিলা আপনার জন্য আমাদের কাউন্টারের এখানে অপেক্ষা করছেন।
নীরোদবাবু একটু ব্যস্তই ছিলেন। তাই কাজ করতে করতেই জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোন আত্মীয়-স্বজন নাকি?
-তা তো জানি না।
-আচ্ছা আসছি।
হাতের কাজ সেরে উনি সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের ঘর ঘুরে কাস্টমস চেকিং কাউন্টারের সামনে গিয়ে একবার চারদিক দেখে নিলেন। না, জানাশোনা কেউ নেই। ওকে দেখেই অন্য একজন ইন্সপেক্টর বললেন, নীরোদবাবু, এই যে ইনি আপনার খোঁজ করছেন।
নীরোদবাবু কিছু বলার আগেই ঐ ভদ্রমহিলা কোলের ছোট বাচ্চাকে কোনমতে সামলে নিয়েই ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। নীরোদবাবু অবাক হয়ে বললেন, আরে! কী করছেন?
ভদ্রমহিলা নীরোদবাবুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, দাদা, আপনি আমাকে চেনেন না কিন্তু আমি আপনাকে শুধু চিনিই না সারা জীবনেও আপনাকে ভুলব না।
উনি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন বলুন তো?
ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সকৃতজ্ঞ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে নিঃসঙ্কোচে বললেন, দেখছেন তো দাদা, আমার শ্বেতী। হাজার লেখাপড়া শিখলেও ঘুষ না দিলে কী আমার মত মেয়ের বিয়ে হয়?
শুধু নীরোদবাবু না, কাস্টমস কাউন্টারের সমস্ত ইন্সপেক্টর, কর্মী ও বেশ কিছু যাত্রী অবাক হয়ে ওঁর কথা শোনেন।
ভদ্রমহিলা এবার বললেন, দাদা, আপনি দয়া না করলে আমার বিয়ে হতো না, তা কী জানেন?
বিস্মিত নীরোদবাবু বললেন, আমি আবার আপনার কী উপকার করলাম?
-হ্যা দাদা, করেছেন। ভদ্রমহিলা এক নিঃশ্বাসে বলে যান, আমার ননদের দাবী মেটাবার জন্য আমার বাবা বাধ্য হয়ে অনেক বিদেশী জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন। আপনি ঐসব জিনিসপত্র ছেড়ে না দিলে সত্যি আমার বিয়ে হতো না।
নীরোদবাবু একটু হেসে বললেন, কিন্তু আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।
–গত বছর সাতুই ফেব্রুয়ারী রাত নটা-সাড়ে নটার সময় আমার বাবা অনেক বিদেশী জিনিসপত্র নিয়ে ওপার থেকে এপারে এসেছিলেন।
প্রতিদিন কত শত শত মানুষ এই সীমান্ত দিয়ে পারাপার করেন। কে কার কথা মনে রাখে? নাকি ইচ্ছা করলেও মনে রাখা যায়? অসম্ভব। তবু নীরোদবাবু একবার সেই দেড় বছর আগের রাত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেন।
ভদ্রমহিলা একটু হেসে বলেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনি বাবাকে প্রথমে বিশ্বাস করেন নি কিন্তু তারপর হঠাৎ বাবা হাউহাউ করে কেঁদে উঠল…
হঠাৎ নীরোদবাবুর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বেশ একটু উত্তেজিত হয়েই বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনার বাবা তো বাগেরহাটে থাকেন, তাই না?
-হ্যাঁ।
–আপনার বাবার নাম তো মাধব সরকার, তাই না।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তারই মেয়ে জবা।
ঐ খাকি পোশাকপরা শুধু নীরোদবাবু না, কাস্টমস কাউন্টারের সবাই আনন্দে খুশিতে চোখের জল ফেলেছিলেন। তারপর জবা আর ঐ কয়েক মাসের বাচ্চা ও ছোট ভাইকে নিয়ে সে কী আনন্দোৎসব!
নীরোদবাবু আমাকে বলেছিলেন, জানেন বাচ্চুবাবু, ভদ্রবেশী চোর ও মিথ্যাবাদী মানুষ দেখতে দেখতে আমরা কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারি না। সেদিন রাত্রে বাগেরহাটের ঐ ব্যবসাদার মাধব সরকারকেও প্রথমে আমি বিশ্বাস করনি কিন্তু তার চোখের জলের কাছে আমি হেরে গেলাম।
আমি অবাক হয়ে ওঁর কথা শুনি।
উনি বলে যান, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, আমরাও মাঝে মাঝে মানুষের উপকার করি। এই জবার মত ভাইবোনের সংখ্যা আমাদের নেহাত কম নয়।
নীরোদবাবু লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, জীবনে নিশ্চয়ই অনেক পাপ করেছি কিন্তু তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, এইসব জবাদের কৃপাতেই শেষ পর্যন্ত বৈতরণী পার হয়ে যাব।
নিত্যর কৃপায় শুধু এপারের কাস্টমস নয়, ওপারের কাস্টমস ও চেকপোস্টও হাসতে হাসতে আমি আর জয়ন্তী পার হলাম। কপালে বোনাসও জুটে গেল। কাস্টমস সুরারিনটেনডেন্ট হবিবুর রহমান সাহেব ডাব খাওয়ালেন। ওপারের চেকপোস্টের ও-সি মহীউদ্দীন সাহেব নিজে অটোরিকশায় চড়িয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, এই দাদা-দিদিকে ঠিকমত পৌঁছে দিবি। দরকার হলে ওরা শহরের মধ্যেও তোর গাড়িতে ঘুরবেন।
ড্রাইভার সসম্ভ্রমে বলল, জী!
-আর হ্যাঁ, আজই ভাড়া নিবি না। ফেরার দিন দাদার কাছে সব শোনার পর ভাড়া পাবি।
-জী।
আমি মহীউদ্দীন সাহেবকে বললাম, ও আমাদের ঠিকই পৌঁছে দেবে। ওকে ভাড়াটা নেবার অনুমতি দিন। তা না হলে বড়ই অস্বস্তি বোধ করব।
মহীউদ্দীন সাহেব একটু হেসে বললেন, আমি জানি ও আপনাদের ঠিকই পৌঁছে দেবে কিন্তু আপনার কাছ থেকে সব শোনার পর ভাড়া দিলে আমি মনে শান্তি পাব।
এবার উনি জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ট্রেনের সময় স্টেশন মাস্টার ডিউটিতে থাকবেন না বলেই এ-এস-এম-এর কাছে আপনার টিকিট থাকবে। উনি আপনাকে ট্রেনেও চড়িয়ে দেবেন। মনে হয় কোন অসুবিধা হবে না।
জয়ন্তী কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বললেন, আপনি যখন ব্যবস্থা করেছেন, তখন অসুবিধে যে হবে না, তা আমি ভাল করেই জানি।
আমরা দুজনেই ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে অটো-রিকশায় উঠি। অটো-রিকশা স্টার্ট করার ঠিক আগে নিত্য আমাকে বলল, বাচ্চু ফেরার পথে তুমি কিন্তু কয়েকদিন এখানে থাকবে।
–হ্যাঁ, থাকব বৈকি!
এবার ও জয়ন্তীকে বলে, আপনিও যদি ফেরার পথে অন্তত একটা দিন থেকে যান, তাহলে খুব খুশি হবো।
–যদি রংপুর থেকে একদিন আগে রওনা হতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই থাকব।
মহীউদ্দীন সাহেব আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুধু নিত্যবাবুর না, আমারও নেমন্তন্ন রইল।
আমি হাসলাম।
জয়ন্তী বললেন, তা জানি।
ভোরবেলায় যখন শিয়ালদ’ স্টেশনে বনগাঁ লোক্যালে চড়ি, তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, এত সব ঘটে যাবে। কোথায় ছিলেন পার্ক সার্কাসের মাসীমা-মেলোমশাই, অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় আর জয়ন্তী? এদের কারুর সঙ্গেই আমার পরিচয় হবার কথা নয় কিন্তু এখন বার বার মনে হচ্ছে, কবে মাসীমার বাড়ি যাব, কবে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দেব? আর জয়ন্তী?
–কী ভাবছেন?
ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন ভেসে গিয়েছিলাম। জয়ন্তীর প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফিরে আসে। বলি, আজ সারা দিনের কথা ভাবছি। বনগাঁ লোক্যালে কারুর সঙ্গে আলাপ হবে, তাও ভাবিনি, আবার বর্ডারে এতজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে, তাও আশা করিনি।
-শুধু আলাপ-পরিচয় কেন বলছেন? মনে হচ্ছে সবার সঙ্গেই যেন কত দিনের পরিচয়।
–ঠিক বলেছেন। একটু থেমে বললাম, মাসীমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে।
–উনি বড় বেশী স্নেহপরায়ণা।
–মা-মাসীরা একটু বেশী স্নেহপরায়ণা না হলে কী ভাল লাগে? এর কাছে একটু বেহিসেবী স্নেহ-ভালবাসা না পেলে মন ভরে না।
জয়ন্তী একটু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার মা নিশ্চয়ই আপনাকে খুব বেশী ভালবাসেন?
আমিও হাসি। বোধহয় একটু ম্লান হাসি। বলি, সারা জীবনের মাতৃস্নেহ আমি সাড়ে তিন বছর বয়সের মধ্যেই উপভোগ করেছি বলে তিনি আর বেঁচে থাকারই প্রয়োজনবোধ করলেন না।
আমার কথা শুনে উনি যেন চমকে উঠলেন। বললেন, ঐ অত ছোটবেলায় আপনি মাকে হারিয়েছেন?
মুখে না, শুধু মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ।
নাভারণ বাজার পিছনে ফেলে অটো-রিকশা এগিয়ে চলে। আমি আপন মনে সিগারেট খেতে খেতে এদিক-ওদিক দেখি ও কত কি ভাবি।
গদখালি পেঁছিবার খানিকক্ষণ আগে জয়ন্তী জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো? কোন কথা বলছেন না যে!
-কী বলব বলুন?
সত্যি, কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। ভাবছিলাম, যেসব আলাপ পরিচয় হয়ত দীর্ঘস্থায়ী হবে না, সেখানে বেশী ঘনিষ্ঠ হওয়া কী ঠিক? এই যে মাসীমাকে আমার এত ভাল লেগেছে কিন্তু কদিন ওর সঙ্গে দেখা হবে? আদৌ দেখা হবে কী? এই জয়ন্তীর সঙ্গে কোন একজনের এমন কিছু মিল আছে যে ওকে কোন সময়েই খুব দূরের মানুষ মনে করতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু জীবনে কী আর কোনদিন এর সঙ্গে দেখা হবে?
জয়ন্তী বললেন, প্রশ্ন না করলেই কী কিছু বলতে নেই?
আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, অনেকে বলেন, রেলগাড়ির পরিচয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই যদি সত্যি হয় তাহলে…
-আপনি তো আচ্ছা লোক! সাংবাদিক হয়েও এইসব বিশ্বাস করেন?
–বিশ্বাস করি না কিন্তু যদি সত্যি হয়?
জয়ন্তী একটু হেসে বললেন, আপনি নেহাতই ছেলেমানুষ!
-বোধহয়। এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলি, পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। যে জীবনে যা কিছু আঁকড়ে ধরতে যায়, তাই যখন হারায়, তখন তার মনে একটু ভয় থাকা স্বাভাবিক নয় কী?
কথাটা বলেই মনে হলো, না বলাই উচিত ছিল। আমি কী পেয়েছি যে হারাবার ভয় করছি?
অটো-রিকশা গদখালি পার হলো।
আমার কথা শুনে উনি শুধু একটু হাসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী আজই যশোর থেকে ঢাকা যাবেন?
যশোরে একটু কাজ আছে। তাছাড়া ঢাকার শেষ ফ্লাইটও দুপুরের আগেই ছেড়ে যায়।
–তাহলে আজ যশোরে থাকবেন।
-হ্যাঁ।
–আবার কবে ফিরবেন?
–দশই ডিসেম্বর আমাকে কলকাতায় থাকতেই হবে।
দুএক মিনিট পরে জয়ন্তী আবার প্রশ্ন করেন, আপনি তো দিল্লী থাকেন?
হ্যাঁ।
কবে দিল্লী ফিরবেন?
-যদি ভাল লাগে তাহলে আট দশ দিন কলকাতায় থাকব; আর ভাল না লাগলে তার আগেই চলে যাব।
ও একটু অবাক হয়ে বলে, আট দশ দিনও কলকাতা ভাল লাগবে না?
আমি একটু ম্লান হাসি হেসে বলি, দিল্লীতে কিছুদিন কাটাবার পরই মনে হয়, কলকাতায় ছুটে চলে যাই। মাঝে মাঝেই কলকাতা চলে আসি কিন্তু কিছুতেই বেশী দিন থাকতে পারি না।
–কেন?
আমি যেন আপন মনেই বলি, কেন? তারপর বলি, কলকাতার পথে-ঘাটে আমার এত সুখ-দুঃখের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে যে বেশী দিন থাকতে পারি না।
দুএক মিনিট নীরব থাকার পর উনি বললেন, জীবনে আপনি অনেক দুঃখ পেয়েছেন, তাই না?
-দুঃখ? হ্যাঁ, পেয়েছি বৈকি কিন্তু মাঝে মাঝে এত আনন্দ, এত সুখ পেয়েছি যে সত্যি অভাবনীয়। আমি একটু হেসে ওর দিকে তাকিয়ে শাহীর লুধিয়ানভীর একটা শের-এর দুটো লাইন বলি
রাত যিতনী ভী সংগীন হোগী
সুবহ উৎনি হী রংগীন হোগী;
একটু হেসে বলি, আমার জীবনে অমাবস্যা-পূর্ণিমার মত সংগীন রাত আর রংগীন সুবহ বার বার ঘুরে এসেছে।
***
রাত্রে ট্রেনে চড়িয়ে দেবার সময় জয়ন্তী বললেন, আমি নিশ্চয়ই সাত তারিখে বর্ডার পার হবো। আপনি সাত তারিখে ওখানে থাকলে খুব খুশি হবো।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বান্দা, সাত তারিখেই বর্ডারে পৌঁছবে।
ঐ মাঝ রাত্তিরে যশোর স্টেশনের আবছা আলোতেও স্পষ্ট দেখলাম, আনন্দে খুশিতে জয়ন্তীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।