নীচে একটি গাড়ি থামিবার আওয়াজ হইল।
ধৃতিকান্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিলেন যে, গাড়ি হইতে দাসীসহ রেশমি নামিল।
বাগানের বৈদ্যুতিক আলোর রেশমি লঘুপায়ে হাঁটিয়া আসিতেছিল। অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়াইয়া ধৃতিকান্ত অপলকে রেশমির অলক্ষ্যে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন।
পাঠক! জীবনে যদি আপনি কাহাকেও তেমন করিয়া ভালোবাসিয়া থাকেন নিজের সমস্ত ‘আমিত্ব’ নিভাইয়া দিয়া মিটাইয়া দিয়া বিনিময়ে ভালোবাসার জনের নিকট হইতে কিছুমাত্র প্রত্যাশা না করিয়াই ভালোবাসিয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনি হয়তো রেশমির প্রতি ধৃতিকান্তর সেই প্রগাঢ় মমতাসম্পন্ন চাহনির তাৎপর্য কিছুমাত্র বুঝিলেও বুঝিতে পারিবেন।
ধৃতিকান্ত সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া অসিয়া দ্বারের নিকট পৌঁছাইলেন।
দ্বারের শিকলে শিঞ্জিনী রব উঠিল।
ধৃতিকান্ত ইচ্ছা করিয়া মজা দেখিবার নিমিত্ত কহিলেন, কে?
এখনও এই বয়সেও মজা করিবার ও মজা দেখিবার সাধ ধৃতিকান্তর মিটে নাই। মনে মনে ধৃতিকান্ত এখনও মাঝে মাঝে কিশোর হইয়া উঠেন।
দ্বারে পুনর্বার আওয়াজ হইল।
উত্তরে রেশমি কহিল, আমি।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, আমি? আমি কে? সকলেই তো আমি!
দ্বারের অপর প্রান্ত হইতে চাপা দীপ্ত হাসির আভাস ভাসিয়া আসিল।
এমন করিয়া একমাত্র রেশমিই হাসিতে জানে।
রেশমি কহিল, দরজা খোলো। আমিই। তোমার আমি।
ধৃতিকান্ত দ্বার খুলিয়া কপাট মেলিয়া দাঁড়াইলেন।
দাসী বুদ্ধিমতীর ন্যায় দ্রুতপদে উপরে উঠিয়া গেল।
রেশমি তখনও হাসিতেছিল।
তাহার দুই চক্ষু এবং অধরপ্রান্ত হইতে সেই হাসি মুছিয়া যাইবার পর সে কহিল– এখনও একইরকম রইলে তুমি। একটুও কি বদলাবে না?
ধৃতিকান্ত কহিলেন, না। বদলাবার কারণ খুঁজে পাই না যে। আমাদের চারধারের সব কিছু এত ভীষণরকমভাবে বদলে গেল যে, আমাদের নিজেদেরও বদলালে চলবে কী করে?
রেশমি কহিল, চলো ওপরে যাই।
ধৃতিকান্তর পাশ কাটাইয়া যাইবার মুহূর্তে ধৃতিকান্তর হস্তে রেশমির বাহুর স্পর্শ লাগিল।
রেশমি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, এ কী! তোমার যে, অনেক জ্বর।
জ্বর? কই জানি না তো! এই বলিয়া ধৃতিকান্ত হাসিলেন।
বলিলেন, কতরকম জ্বর হয় তুমি জান? এ কোন জ্বর?
রেশমি রাগিয়া কহিল, তোমার সব কিছুতে এই ছেলেমানুষি আমার ভালো লাগে না। কহিয়াই, ধৃতিকান্তকে সঙ্গে করিয়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতে লাগিল।
এক্ষণে রেশমি আসিয়া পড়িয়াছে। ধৃতিকান্তর অসুস্থ শরীরের এবং মেজাজের সমস্ত ভার ইবর্তমানে রেশমির। ধৃতিকান্ত যত বড়ো দাম্ভিক পুরুষ-ই হউন না কেন, এই একটি অন্য আর একটি মাত্র স্থান ব্যতীত এই স্থানে তাঁহার সমস্ত জারিজুরিই পন্ড হইয়াছে। ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে।
যথাসম্ভব সত্বর বেশভূষা বদলাইয়া লইয়া স্নান করিয়া ধৃতিকান্তর ঘরের শয্যা স্বহস্তে পুনর্বার ঠিক করিয়া দিয়া রেশমি একপ্রকার জোর করিয়াই ধৃতিকান্তকে শোওয়াইয়া দিল। কক্ষের উজ্জ্বল বাতি নিভাইয়া দিয়া নীল ঘেরাটোপের অভ্যন্তরে নরম বাতি জ্বালাইয়া দিল।
তাহার পর শয্যাপার্শ্বে একটি মোড়া টানিয়া লইয়া আসিয়া বসিল।
ধৃতিকান্তর কপালে হাত দিয়া চিন্তিত কণ্ঠে কহিল, জ্বর তো অনেক দেখছি। আবার বুঝি অত্যাচার করেছ?
ধৃতিকান্ত হাসিয়া কহিলেন অত্যাচার? একমাত্র তোমার উপর ছাড়া কোনোদিনও কোনোরকম অত্যাচার-ই তো আর কারও উপরেই করিনি।
রেশমি বলিল, তোমার উকিল হওয়া উচিত ছিল। তোমার সঙ্গে কথায় পারিনি কখনো; পারবও না।
-চেষ্টাও কোরো না।
-তোমার উদ্দেশ্যটা কী বলতে পারো? মরতেই যদি চাও তাহলে আমার কাছে আসা কেন? মরার সময়েও কি আমাকে জ্বালাবে এমন করে?
-তুমি জ্বলো কেন? আমার জন্যে জ্বলার দরকার কী? তুমি তো এমনিতেই সবসময়ে উজ্জ্বল।
–এসব থিয়েটারি কথা তোমাদের বাংলাদেশের শরৎবাবুর নাটক-নভেলের লোকেরা বলত। শ্রীকান্তর পিয়ারী তার জন্যে বোকার মতো সব কিছু করেছিল বলে তুমি ভেবো না, আমি তোমার পিয়ারী হতে যাব। ওসব দিন আর এখন নেই।
আছে–আছে। ধৃতিকান্ত কহিল।
না। নেই। রেশমি কহিল।
ধৃতিকান্ত কহিল, কলকাতা ছেড়ে বেনারসে কেন এলাম জান এবার?
-কেন?
-কলকাতায় ছইওয়ালা একটাও গোরুর গাড়ি পাওয়া গেল না বলে।
-তার মানে?
-তার মানে ডাক্তার ভৌমিক আমার লিভার টিপে যেদিন বললেন যে, তোমার সময় হয়ে গেছে ধৃতি, এবার একটা দামি শাল গায়ে জড়িয়ে কোনো ছইওয়ালা গোরুর গাড়ি চড়ে তোমার যদি কোনো পার্বতী-টার্বতী থাকে তাহলে তার বাড়ির সামনে গিয়ে নিরুপদ্রবে মরতে পারো।
-তা গোরুর গাড়ি পেলে না, না হয় ট্যাক্সি করেই যেতে। পার্বতী তো সেখানেই ছিল। উম্মার সহিত রেশমি কহিল।
–ছিল না, ছিল না। পার্বতী সে হতে পারল কই?
তারপর ধৃতিকান্ত একটু থামিয়া কহিলেন, কলকাতায় কি খোঁজ করলে ছইওয়ালা গোরুর গাড়ি পাওয়া যেত না; যেত। সেখানে খোঁজ করলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়, আর গোরুর গাড়ি! আসলে পার্বতীই পাওয়া গেল না।
তারপর একটু থামিয়া কহিলেন, তুমিই বলো পার্বতী কি সকলে হতে পারেনা হতে জানে?
রেশমি কহিল, আমি তা বলব কী করে? তোমার অনেক প্যায়েরভি শুনেছি, হরকত দেখেছি–এখন দয়া করে একটু চুপ করে থাকো। মুরতেজাকে পাঠিয়েছি ডাক্তার জয়সওয়ালকে নিয়ে আসতে, তিনি এসে যা বলবেন, তার নড়চড় হবে না। যা করতে বলবেন তাই-ই করতে হবে। কোনোরকম বেয়াদবি চলবে না তোমার। আমি আর কেউ নই। তোমাকে কী করে ঢিট করতে হয় তা আমি জানি।
–তা আবার জান না! হাসিয়া ধৃতিকান্ত কহিলেন।
ধৃতিকান্তর জ্বরটা এক্ষণে বেশ বেশিই আসিয়াছে। বর্তমানে পেটে সবসময়েই ব্যথা করে। শারীরিক ও নানারূপ মানসিক কারণে ধৃতিকান্ত বেশ কয়েক বৎসর হইল নিজের মৃত্যুকামনা করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু মৃত্যু কাহারও কামনার তোয়াক্কা করে না। যে তাহাকে কামনা করে, তাহার কামনা পূরণ করে না। যে তাহাকে ভয় পায়, তাহার নিকট বিনা-নোটিশেই আসিয়া উপস্থিত হয়।
মুখে যে-প্রকার লঘুবাক্যই কহুক না কেন, ধৃতিকান্তর মুখপানে চাহিয়াই রেশমি বুঝিতে পারিয়াছিল যে, তাঁহার শরীরাভ্যন্তরে নিদারুণ কোনো যন্ত্রণা বোধ হইতেছে।
ধৃতিকান্তর যন্ত্রণার ছাপ রেশমির কুঞ্চিত তে প্রতিবিম্বিত হইল।
রেশমি ধৃতিকান্তর বাম হস্তটি স্বীয় ক্রোড়ে তুলিয়া লইয়া তাহার দুই নরম করকমলে ধরিয়া রহিল।
ধৃতিকান্ত যেন স্বপ্নমধ্যে কহিলেন, বড়োভালো লাগে জান।
-কী?
-তোমার কাছে একটু থাকতে পেলে। তুমি কাছে থাকলে বড়োশান্তি লাগে।
–শান্তির দাম কী? অন্য জন তোমাকে শুধু বাইরের শান্তিই দিতে পারে। অন্তরের শান্তি তো তোমার নিজেকে পেতে হবে। সে শান্তি তো বাইরের কেউই তোমাকে দিতে পারে না। এমনকী তোমার রেশমিও না।
অন্তরের ‘শান্তি’ বলতে তুমি কী বলতে চাইছ?
কী আবার? বিরক্ত গলায় রেশমি কহিল, তুমি বুঝতে পারো না কী বলতে চাইছি?
–না। সত্যি পারি না। কী?
-যে তোমার সবচেয়ে কাছের লোক তার কাছ থেকেই শান্তি পেলে না। না পেয়ে শান্তি দিতেও পারলে না তাকে। সেই একজনের-ই মন পেলে না তুমি! তোমাকে শান্তি দেব আমি কী করে? আমি তো একজন সস্তা সহজলভ্যা তওয়ায়েফ। সে সাধ্য আমার কি আছে? আমার সাধ্য কতটুকু?
ধৃতিকান্তর কপালে বলিরেখা ফুটিয়া উঠিল। এতাবৎকাল যে, শারীরিক যন্ত্রণা তাঁহার মুখমন্ডলে অঙ্কিত ছিল, সে যন্ত্রণা ছাপাইয়া উঠিয়া গভীরতর কোনো যন্ত্রণার ছায়া তাঁহার সমস্ত মুখমন্ডল অন্ধকার করিয়া তুলিল।
বড়ো বেদনার সহিত ধৃতিকান্ত কহিলেন, আঃ রেশমি আর কেন? এক-ই কথা কতবার আর কতরকম করে বলবে? শান্তি চাই না। তোমার কাছেও শান্তি চাই না। তুমি যাও!
অভিমানভরে ধৃতিকান্তর হস্ত স্বীয় ক্রোড় হইতে শয্যামধ্যে নিক্ষেপ করিয়া রেশমি মোড়া ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
কহিল, ডাক্তার আসতে এতদেরি করছে কেন তা টেলিফোনে জিজ্ঞেস করতে হবে।
বলিয়াই, রেশমি দ্রুতপদে কক্ষ ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
সে চলিয়া গেল বটে কিন্তু কমধ্যে তাহার সদ্যস্নাতা শরীরের সুগন্ধ রাখিয়া গেল।
কিয়ৎক্ষণ পরে একটি সাইকেল-রিকশা থামিবার শব্দে ধৃতিকান্ত বুঝিলেন যে, ডাক্তার আসিলেন।
রেশমি ডাক্তারকে সঙ্গে লইয়া কমধ্যে প্রবেশ করিল।
তাহার মনের উদবেগ মিথ্যা-বিরক্তি দ্বারা ঢাকিয়া কহিল, ভালো করে দ্যাখো তো জয়সওয়াল ভাইয়া। শক্ত হাতে এঁর চিকিৎসা করো। নইলে আমাকে খুনের দায়ে পড়তে হবে।
ডাক্তার জয়সওয়াল ধৃতিকান্তকে বহুবৎসর হয় জানিতেন।
কহিলেন, ওঁর চিকিৎসা ওঁর নিজের হাতে। আমি নিমিত্তমাত্র। আমি ওষুধ লিখে দিতে পারি, পথ্য বলে দিতে পারি; কিন্তু বাঁচামরা ওঁর নিজের হাতে।
আরও বিরক্ত হইয়া রেশমি কহিল, তাহলে আর ডাক্তারি করো কেন? ছেড়ে দিয়ে পিপুলতলায় বসে ফকির হয়ে গেলেই পারো। বক্তৃতা রেখে চিকিৎসা যাতে ভালো করে হয়, তাই-ই করো।
ডাক্তার কোনো উত্তর দিল না। সে রেশমিকে ভালো করিয়াই জানে। রেশমির সহিত ধৃতিকান্তর সম্পর্কের কথাও তাহার অজানা নহে। কিন্তু এই সম্পর্ককে সে কখনো ব্যাখ্যা করিতে পারে নাই। এই সম্পর্কের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য অনেকানেক সম্পর্কর কোনোই মিল নাই। এই সম্পর্কর কোনো ব্যাখ্যা হয় না বলিয়া তাহার বোধ হয়।
ডাক্তার ধৃতিকান্তকে পরীক্ষা করিয়া কক্ষ হইতে বাহিরে আসিয়া সিঁড়ির নিকটে দাঁড়াইলেন।
রেশমির মুখ গম্ভীর।
রেশমি নিম্নকণ্ঠে শুধাইল, কী বুঝলে ডাক্তার?
জয়সওয়াল নিম্নস্বরে কহিল, একেবারেই ভালো নয়। দিন আর বেশি বাকি নেই। বড়োজোর মাস দুই। সিরোসিস অফ লিভারের এমন খারাপ কেস আমি এতদিন ডালকা মন্ডিতে, যেখানে শরাবিদের ম্যায়ফিল, যেখানে আমার পশার, সেখানেও দেখিনি। সত্যিই বলছি, আর দিন বেশি নেই।
রেশমি তাহার ঘনকৃষ্ণ অক্ষিপল্লব তুলিয়া গভীর বিষণ্ণতার সহিত জয়সওয়ালের পানে তাকাইল। তাহার পর মুখ আনত করিয়া কহিল, কিছুতেই বাঁচানো যায় না?
-না। কিছুতেই না।
তাহার পর জয়সওয়াল কহিল, এখন উনি যাতেই আনন্দ পান, তাই-ই করতে দেওয়া উচিত। শেষ দিন ক-টি যাতে আনন্দে থাকেন, শুধু তাই-ই করা দরকার। এ ছাড়া করার কিছুই দেখি না।
বুঝলাম। রেশমি কহিল।
ডাক্তার জয়সওয়ালের রিকশা পথের ধুলায় ‘কির কির’ শব্দ তুলিয়া চলিয়া গেল।
ধৃতিকান্ত শয্যায় শুইয়া সেই শব্দ শুনিলেন।
সেই শব্দ মিলাইতে-না মিলাইতে বাহিরে একটি গাড়ি থামিবার আওয়াজ হইল। গাড়ি হইতে একইসঙ্গে একাধিক ব্যক্তির নামিবার আওয়াজ শুনা গেল।
‘ধপ ধপ’ শব্দে গাড়ির দরজা খুলিবার ও বন্ধ হইবার আওয়াজও শুনা গেল।
ধৃতিকান্ত ভাবিলেন, হয়তো কেহ রেশমির নিকট আসিয়া থাকিবে।
দ্বারের শিকলে আবার শিঞ্জিনী রব উঠিল।
মুরতেজা সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া দ্বার খুলিয়া দিল, সে আওয়াজও ধৃতিকান্তর কর্ণে আসিল।
দ্বার খুলিয়া দিতেই একইসঙ্গে সিঁড়িতে অনেকগুলি পদধ্বনি শুনিলেন ধৃতিকান্ত।
আগন্তুকেরা সিঁড়ি বাহিয়া উঠিতেছে।
কে যেন জড়িত কণ্ঠে ডাকিল, রেশমি–কাঁহা হ্যায় তু রেশমি? মেরি পেয়ারি।
সঙ্গে সঙ্গে আরও দু-তিনজনের কন্ঠে একইসঙ্গে রেশমির নাম ধ্বনিত হইল।
রেশমি বোধ হয় তাহার কক্ষ হইতে বাহিরে আসিয়া অভ্যন্তরের বারান্দায় দাঁড়াইল।
তাহার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ও ক্রোধের আভাস ফুটিল।
রেশমি কহিল, কা বাত রঘুনন্দনবাবু?
যাহাকে উদ্দেশ করিয়া রেশমি প্রশ্ন ছুড়িল, সে অত্যন্ত জড়িত কণ্ঠে কহিল, বাত ক্যা? গানা শুনেগি জারা।
রেশমি কহিল, এখন আমার পক্ষে গান গাওয়া সম্ভব নয়। অন্যের ইচ্ছামতো আমি আর গান গাই না।
কে একজন কহিয়া উঠিল, দেহ বেচে আর গলা বেচে বেশ ভালোই রেস্ত করে নিয়েছ বলো?
রেশমি কহিল, তাতে আপনার কী? জবান সামহালকে বাত কিজিয়ে।
রঘুনন্দন কহিল, তোকে রাগালে ভারি ভালো দেখি আমি মাইরি রেশমি। ঠিক আছে। গান। নাই বা শোনালি, একটু গল্প তো কর। শুধু তুই আর আমি। খাটে শুয়ে একটু গল্প-টল্প; একটু আদর-টাদর।
তাহার পর-ই কহিল, এখুনি বুঝি চান করলি? লা-জওয়াব দেখাচ্ছে তোকে, যদিও সাজুগুজু করিসনি–বলিয়াই, জড়িত কণ্ঠে আবৃত্তি করিল:
উলঝি সুলঝি রহনে দেও
কিঁউ শরপর আফৎ লাতি হো।
দিলকা ধড়কান বাড়তি হ্যায়
যব বাঁলোকো সুলঝাতি হো।
ধৃতিকান্ত শয্যায় শুইয়াই মনে মনে শায়েরের বাংলা তর্জমা করিয়া লইলেন। অর্থাৎ উশকোখুশকোই থাকো। বিনা সাজেই ভালো। এমনিই তো তোমাকে দেখে মরে থাকি। তার ওপর চুলটুল আঁচড়ে আমার বুকের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তোমার লাভ কী?
তারপর পুনরায় কহিল সেই আগন্তুক, দেখ স্বপ্নের মধ্যে তোকে বহুবার পেয়েছি একবারটির তরে জীবনে পেতে চাই।
রেশমি বলিল, আপনাদের জোড়হাত করে বলছি, আপনারা যান। আমি আজকাল আর গান গাই না। কারও সামনেই না। তা ছাড়া আমার ঘরে বিমারি রিস্তাদার আছে।
একজন বলিল, এমন জওয়ানি এমন খুশবু–এমনিই মাঠে মারা যাচ্ছে?
অন্যজন আবার শায়ের আওড়াইল:
সামা জ্বলতি হ্যায় যিসমে কোই উজালা হি নেই।
হুসন বেকার হয় যিসকা কোই চাহনেওয়ালা হি নেহি।
অর্থাৎ সে প্রদীপের কী দাম, যে প্রদীপ উজ্জ্বল হয়ে নাই-ই জ্বলল–? সুন্দরীও তো বেকার–যার কোনো চাহনেওয়ালাই নেই।
রঘুনন্দন কহিল, রিস্তাদার? কে রিস্তাদার?
এইবারে রঘুনন্দনের স্বর রুক্ষ হইয়া উঠিল।
ধৃতিকান্তর উদরের যন্ত্রণা অত্যন্ত তীব্র হইয়াছিল। জ্বরও অনেক। তবুও তিনি শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া ধীরে ধীরে দুয়ার ঠেলিয়া আসিয়া বারান্দায় দন্ডায়মান হইবার পূর্বেই রেশমির ওপর বলপ্রয়োগ করিয়া রঘুনন্দন রেশমিকে তাহার সাঁড়াশির ন্যায় হস্তদ্বারা টানিয়া হ্যাঁচড়াইয়া শয্যাকক্ষে পৌঁছিয়াছে।
রেশমির চিৎকার, মত্ত লোকগুলির হায়নার ন্যায় অট্টহাস্য, সমস্ত মিলিয়া ধৃতিকান্ত তাঁহার মস্তিষ্কমধ্যে এমন-ই উত্তেজনা বোধ করিলেন যে, অত্যন্ত অসুস্থতা ও বার্ধক্য সত্ত্বেও আপনাকে সামলাইতে পারিলেন না।
রেশমির বন্ধ দুয়ারে তিনি সজোরে পদাঘাত করিলেন।
একদিন ছিল, যখন ধৃতিকান্ত একাই এই সবকয়টি নীচ ইতর কামিনা মনুষ্যদিগকে ঠাণ্ডা করিয়া দিতে পারিতেন খালিহাতেই। কিন্তু এক্ষণে, ধৃতিকান্তর সে যৌবন নাই, শরীর অবসন্ন; অসুস্থ। এক্ষণে কি তিনি রেশমির ইজ্জত বাঁচাইবার জন্যে কিছুমাত্রও করিতে পারিবেন?
ধৃতিকান্তকে রেশমির দুয়ারে পদাঘাত করিতে দেখিয়া দুইটি লোক ছুটিয়া গিয়া ধৃতিকান্তর উদরে যুগপৎ সজোরে পদাঘাত করিল।
একজনের আঘাত ধৃতিকান্তর যকৃত-এ লাগিল। প্রায় জ্ঞান হারাইয়া ধৃতিকান্ত ভূমিতে পতিত হইলেন।
ভিতর হইতে রেশমির চাপা ক্রন্দনের সহিত মিশ্রিত হইয়া কোনো জানোয়ারের আদিম স্বর ভাসিয়া আসিতেছিল।
মুরতেজা কোথা হইতে একটি যষ্টি লইয়া আসিয়া আগন্তুকদের মধ্যে একজনের মস্তকে সজোরে আঘাত করিল।
সে তৎক্ষণাৎ ‘হ্যায় রাম’ বলিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।
সে পড়িয়া যাইবামাত্র অন্য সকলে মুরতেজার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া, তাহার-ই হস্তের যষ্টি কাড়িয়া লইয়া তাহাকে আঘাতের পর আঘাত করিয়া রক্তাক্ত ও অর্ধমৃত করিয়া ফেলিল।
কতক্ষণ পর ধৃতিকান্তর জ্ঞান ফিরিয়া আসিয়াছিল তিনি জানেন না।
একদিন যিনি সবল ছিলেন কিন্তু আজ যিনি অসহায় দুর্বল, তাঁহার পক্ষে নিষ্ক্রিয় দাঁড়াইয়া প্রিয়জনের অসম্মান নিজচক্ষুতে প্রত্যক্ষ করার ন্যায় তীব্র ঘৃণাময় অনুভূতি আর বোধ করি কিছুই হইতে পারে না।
তিনি ধীরে ধীরে দুয়ার ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেছিলেন এমন সময়ে ভিতর হইতে দ্বার খুলিয়া গেল।
ধৃতিকান্ত দ্বারের সম্মুখে দন্ডায়মান রঘুনন্দনের বক্ষের উপরে ঝুঁকিয়া প্রায় তাহার বক্ষোপরিই পড়িয়া গেলেন।
রঘুনন্দন তাঁহাকে এক ঠেলা মারিয়া পুনর্বার মাটিতে ফেলিয়া দিল।
ধৃতিকান্ত ভালো করিয়া এই প্রথম ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিহিত রঘুনন্দনের পানে চাহিলেন। তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিতে থাকিতে ধৃতিকান্তর এই প্রত্যয় জন্মিল যে, এই পৃথিবীতে এক ধরনের ‘মনুষ্য’ নামক জানোয়ার বাস করে তাহাদের অবয়ব, কথোপকথন, চাল-চলন কিছুই মনুষ্যোচিত নয়। তাহারা যেন-তেন প্রকারেণ প্রচুর জনবল ও অর্থের অধিকারী হইয়া এই দেশের সমুদয় প্রাপ্তব্য ও অপ্রাপ্তব্য বস্তুকেই নিজেদের কুক্ষিগত করিয়া ফেলিতে ফেলিতে এই বিশ্বাস জন্মাইয়া ফেলিয়াছে যে, পৃথিবীতে এমন কিছুই নাই যাহা অর্থের বা প্রতিপত্তির বা বাহুবলের বিনিময়ে পাওয়া যায় না।
ধৃতিকান্ত উন্মুক্ত কবাটের মধ্য দিয়া চাহিয়া দেখিলেন, রেশমি উড্রান্ত বিস্রস্ত অবস্থায় উপুড় হইয়া শয্যামধ্যে পড়িয়া আছে। তাহার কবরী খসিয়া ভাঙিয়া পড়িয়াছে। শ্রাবণের মেঘরাশির ন্যায় তাহার কেশভার তাহার পৃষ্ঠ ছাইয়া আছে।
রঘুনন্দন দুয়ারে দাঁড়াইয়া পাঞ্জাবির পকেট হইতে একটি মোটা দশটাকার নোটের পুলিন্দা বাহির করিয়া হতবুদ্ধি অপমানিতা রেশমির দিকে নিক্ষেপ করিয়া হাস্যমিশ্রিত ঘৃণাভরে কহিল, সব গুড় গোবর হোয়ে গ্যাও। লেরে রেশমি, গোবরকি কিম্মত।
ধৃতিকান্ত উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
কহিলেন, জবান সামহালকর বাত কিয়া করো কামিনা। তেরা আখ উখাড় লেগা ম্যাঁয়।
রঘুনন্দন ধৃতিকান্তকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়াই রেশমিকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, ই গন্ধা জাগেমে ইয়ে গোবরকা লিয়ে তেরি পাস ঔর কভভি না আউঙ্গা।
ধৃতিকান্ত কিছুমাত্র বলিবার বা করিবার পূর্বেই রঘুনন্দন কোমর হইতে একটি চাকচিক্যময় ছয়-ঘরা রিভলবার বাহির করিল।
কহিল, পহচান্তা তু মুঝকো? ক্যা রে বাঙ্গালি বাবু, দেখোগে মেরি জবান?
ধৃতিকান্ত ম্লান হাসিলেন।
কহিলেন, নিশ্চয়ই দেখব। তবে আজ নয় রঘুনন্দন। আজ তুমি মাতাল হয়ে আছ। আর একবার অন্তত আসতে হবে তোমাকে এই গন্ধা জায়গায়। সাবধানে থেকো রঘুনন্দন। ভেট তুমসে হোগা। জরুর হোগা।
ধৃতিকান্তর কথা শেষ হইতে না হইতেই রঘুনন্দনের সুরামত্ত অনুচরেরা পুনরায় আসিয়া তাঁহার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল। তাঁহার উদরে পুনরায় পদাঘাত করিল।
একজন যষ্টির বাড়ি মারিল। তাহা ধৃতিকান্তর মস্তকে না পড়িয়া স্কন্ধে পড়িল।
ধৃতিকান্তর ধারণা হইল, তাঁহার বাম স্কন্ধটি যেন, চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেল।
মুহূর্তমধ্যে আগন্তুক রঘুনন্দন তাহার বশংবদদিগের সহিত যেমন-ই ঝড়ের বেগে আসিয়াছিল, তেমন-ই ঝড়ের মত্ততায় ফুল ঝরাইয়া পাতা উড়াইয়া চলিয়া গেল। একবারও পশ্চাতে চাহিয়া দেখিল না।
ধৃতিকান্তর তখন নিজের বা রেশমির কথা ভাবিবার অবকাশ ছিল না। তাঁহার অন্তর-শরীর ও বাহির-শরীরের সমুদয় যন্ত্রণার কথা বিস্মৃত হইয়া দাসীকে দিয়া একখানি গাড়ি ডাকাইয়া সত্বর বেহুশ মুরতেজাকে লইয়া ডাক্তার জয়সওয়ালের গৃহাভিমুখে চলিলেন।
দাসী এতক্ষণ তাহার কমধ্যে শিকল তুলিয়া দিয়া বসিয়াছিল। রঘুনন্দনের অনুচরবর্গের চাহনি নাকি আদৌ পছন্দ হয় নাই।
আগন্তুকেরা চলিয়া যাওয়ামাত্রই, সে কক্ষ হইতে নির্গত হইয়া উচ্চকণ্ঠে ক্রন্দন জুড়িয়া দিল।
মুরতেজাকে হাসপাতালে লইয়া যাইলেই উত্তম হইত। কিন্তু তৎক্ষণাৎ লইয়া গেলে পুলিশে ডায়ারি করিতে হইবে।
ডায়ারি করিতে অসুবিধা ছিল না কোনো। কিন্তু ধৃতিকান্তর এরূপ জ্ঞান ছিল যে, কোতোয়ালির পুস্তকমধ্যে সমস্ত অন্যায় নথিভুক্ত করার সহিত, সেই অন্যায়ের আশু প্রতিবিধান ও শাস্তির আদৌ কোনো সংযোগ নাই। এতদব্যতীত রেশমির ইজ্জৎ-এর কথা ভাবিয়া, ধৃতিকান্ত তাহা না করাই মনস্থ করিলেন। সেই মুহূর্তে ধৃতিকান্তর মনে রেশমির ইজ্জৎ-এর ভাবনা ব্যতীত অন্য কোন ভাবনা ছিল, তাহা ধৃতিকান্তই জানেন।
পাঠক! আপনার মনে হইতে পারে যে, রেশমির বৃত্তি নৃত্যগীত, অতএব রেশমির ন্যায় নাচনেওয়ালি-গানেওয়ালির আবার ইজ্জত কী?
এই প্রশ্ন আপনার মনে আসা অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু যাঁহারা তৎকালীন তওয়ায়েফদের জানিতেন তাঁহারা বিলক্ষণই জ্ঞাত ছিলেন যে, ইজ্জত তাঁহাদের নিশ্চয়ই ছিল।
প্রকৃত তওয়ায়েফ শুধু গীত-ই গাহিতেন নৃত্যই করিতেন। বংশপরম্পরায় নৃত্য করিতে করিতে তাঁহাদের পায়ের অঙ্গুলিসমূহ একটি বিশেষ গড়ন পাইত। তাঁহারা যত্র-তত্র যাহাকে তাহাকে শরীর দান করিতেন না। আদৌ যদি-বা করিতেন ভালোবাসিয়াই করিতেন, কিন্তু কাহাকে যে, করিতেন তাহা তওয়ায়েফের খাস দাসীরাও পর্যন্ত বহুসময় জানিতে পারি না।
যে তওয়ায়েফের শরীরের খবর রাখাই দুরূহ ছিল তাহার মনের খবর রাখা তো ততোধিক দুরূহ হওয়াই স্বাভাবিক। এতদবতীত ইজ্জত এমন-ই এক বস্তু যে, কেহ কেহ তাহা লইয়াই জন্মায় এবং তাহা লইয়াই কবরে যায়।
আবার কেহ-বা এ বস্তু যে, কী তাহা জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত কখনো জানিবার সুযোগ পর্যন্ত পায় না।
পাঠক নিশ্চয়ই স্বীকার করিবেন যে, ভিক্ষা লওয়া যাহার বৃত্তি, সেই ভিখারিনিরও ইজ্জত বলিয়া কোনো বস্তু থাকে। কখনো বা কোনো দুর্বিনীত দাতার ঔদ্ধত্যে ভিখারিনির ইজ্জতও আহত হইতে পারে। এবং হৃদয়ের অভ্যন্তরস্থ সেই অতিকোমল গোপন অসূর্যম্পশ্যা স্থানটিতে আঘাত লাগিলে ভিখারিনিও ভিক্ষালব্ধ মূল্যবান ধন অবহেলাভরে ধুলায় ফেলিয়া দর্পভরে চলিয়া যাইতে পারে।
কিন্তু রেশমি কখনো ভিখারিনি ছিল না। কোনো বাবদেই না। ধৃতিকান্ত এ জীবনে রেশমির ন্যায় আত্মসম্মান-জ্ঞানসম্পন্ন গরবিনি অভিমানিনী কোনো নারীই দেখেন নাই।
.
ডাক্তার জয়সওয়াল যে-রোগীকে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে জবাব দিয়া আসিয়াছিলেন তাঁহাকেই একজন আহত ব্যক্তির জিম্মাদারি লইয়া গাড়ি করিয়া তাঁহার নিকট আসিতে দেখিয়া যারপরনাই বিস্মিত হইলেন।
ডাক্তার জয়সওয়াল মুরতেজাকে লইয়া তাঁহার দাওয়াখানার অভ্যন্তরস্থিত ক্ষুদ্র কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন।
দাওয়াখানার বারান্দায় একটি চৌকিমধ্যে বসিয়া ধৃতিকান্ত পথবাহিত অবিরাম জনস্রোত, সাইকেলরিকশা ও গাড়ির স্রোতের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে চাহিয়া নানা কথা ভাবিতেছিলেন।
এই জীবনে ধৃতিকান্ত অনেক ভোগ করিয়াছেন, দুই চক্ষু মেলিয়া অনেক সৌন্দর্য দেখিয়াছেন, কান ভরিয়া শুনিয়াছেন নূপুরের ঝুমঝুম, চুড়ির নিক্কণ, অবশ-করা সংগীত। সমস্ত স্পর্শেন্দ্রিয় দ্বারা এ সংসারে যাহা কিছু রেশম-পেলব স্পর্শিতব্য সপ্রাণ ও নিষ্প্রাণ বস্তু আছে তাহা, স্পর্শ করিয়াছেন, ঘ্রাণেন্দ্রিয় দ্বারা তাবৎ সুগন্ধ নিঃশেষে শুকিয়া লইয়াছেন।
এ জীবন সম্বন্ধে তাঁহার কোনোই খেদ নাই।
খেদ এইটুকুই যে, কোনো একজনের অঙ্কশায়িনী হইয়া, অঞ্চলাশ্রিত হইয়া তিনি বাধ্য কুকুরের ন্যায় বাঁধা থাকিতে অপরাগ হইলেন।
তাঁহার এই অপারগতা যেমন, তাঁহাকে বন্ধনহীনভাবে মুক্তির উদার আনন্দে অভিষিক্ত করিয়াছে, তেমনি তাঁহাকে ব্যথাও দিয়াছে। নিজে যত-না ব্যথা পাইয়াছেন তাহা হইতে বেশি ব্যথা পাইয়াছেন অন্যরা। অন্যের ব্যথা তাঁহাকে বরাবরই পীড়িত করিয়াছে।
ঈশ্বর তাঁহাকে অনেক সৌভাগ্য দিয়াছেন। অনেক মহামূল্যবান বস্তুতে ও প্রাণে তিনি মাল্যবান হইয়াছেন। কিন্তু কোনো কিছুই চিরতরে ধরিয়া রাখা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। যাহা কিছুই এ জীবনে পাইলেন তাহার মূল্যায়ন সম্পূর্ণ করিবার পূর্বেই তাহা তিনি হারাইয়া বসিয়াছেন।
ইদানীং শরীর অত্যন্ত পীড়িত হওয়ার পর একা থাকিলেই পুষ্করিণীর ঘাটে ডুবাইয়া-রাখা উচ্ছিষ্ট পাত্ৰমধ্যে ক্ষুদ্র মৎস্যের ঝাঁক যেরূপ ভিড় করিয়া আসে, তাঁহার মস্তিষ্কমধ্যে অতীতের ভাবনা তেমন-ই ভিড় করিয়া আসে।
বাঁধাইয়া রাখা ফ্রেমের মধ্যের মৃত ব্যক্তির ফোটো-বদ্ধ মূর্তি হঠাৎ জীবনপ্রাপ্ত হইয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলে, যেমন অনুভব হইত, তেমন-ই এক অনুভূতির মধ্যে তাঁহাকে নিমগ্ন করিয়া তাঁহার সমস্ত অতীত তাঁহার চোখের সম্মুখে বারংবার আসিয়া দাঁড়ায়।
ধৃতিকান্ত অস্বস্তি বোধ করেন। ভবিষ্যৎ-এর দিকে চাহিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝিতে পারেন যে, তাঁহার ভবিষ্যৎ নাই। বর্তমানও প্রায় সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্তির পথে।
ধৃতিকান্তর নাম কে রাখিয়াছিলেন তাহা তাঁহার স্মরণ নাই কিন্তু এতবড়ো পরিহাস আর কেহই তাঁহার সহিত অদ্যাপি করেন নাই। তাঁহার চরিত্র ও অবয়বে বুদ্ধি, ঔদার্য, প্রেম ও পৌরুষ যাহাই থাকুক না কেন ‘ধৃতি’র কণামাত্র কখনো ছিল না।
তাঁহার ন্যায় সদাচঞ্চল যাযাবর মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ এই চর্মচক্ষে তিনি নিজেও এ সংসারে কখনোই দেখেন নাই।
কোনো বিশেষ সুখের ঘরে ঘোড়া বাঁধিতে না বাঁধিতেই ঘোড়া খুলিয়া লইয়া দ্রুতবেগে ধূলি ছিটাইয়া পথ-মধ্যস্থ প্রস্তরে অশ্বক্ষুরের অগ্নি চমকাইয়া তিনি দূর হইতে দূরান্তরে চলিয়া গিয়াছেন। পূর্বমুহূর্তের সুখটিকে অবহেলায় স্বহস্তে ভাঙিয়া ফেলিয়াছেন।
অতএব খুব-ই স্বাভাবিক কারণে তাঁহাকে কেহই বোঝে নাই। কাহাকেও তিনি নিজসম্বন্ধে কিছু বুঝাইবার চেষ্টা হইতেও সর্বদা নিশ্চেষ্ট ছিলেন। কারণ তাঁহার চরিত্রে “ধৈর্য’ বলিতেও কিছুই ছিল না। যে-সময় ব্যয় করিলে, তিনি নিজেকে বুঝিবার মুহূর্তের নিকটে আসিতে পারিতেন, সে-সময় ব্যয়কে ‘অপব্যয়’ ছাড়া অন্য কিছুই তিনি কখনো মনে করেন নাই।
অশ্বের ক্ষুর, তাঁহার দুর্দম ‘জেদি’ পৌরুষ তাহাকে যেস্থানে লইয়া গিয়াছে, সেস্থানেই তিনি পৌঁছিয়াছেন। একদন্ড স্থির হইয়া থাকিয়া ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ তাঁহার জীবনে কখনো আসে নাই।
যাঁহারা পশ্চাতে চাহিয়া দেখেন এবং নিজের জীবনের কর্ম ও গতি সম্বন্ধে অনুশোচনা অথবা আত্মশ্লাঘা বোধ করিয়া থাকেন, ধৃতিকান্ত সেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের দলে কদাপি নাম লিপিবদ্ধ করেন নাই। তিনি যূথবদ্ধতায় কোনো শর্তেই বিশ্বাস করেন নাই–করেন নাই। দাসত্ব বা বন্দিত্বে–সে বন্দিদশা কোনো রাজগৃহেই হউক অথবা কোনো সুন্দরী নর্মসহচরীর শয্যাতেই হউক।
ধৃতিকান্ত এ জীবনে নারীচরিত্র যেমন বুঝিয়াছিলেন তেমন করিয়া পুরুষচরিত্র বোঝেন নাই। নারীচরিত্রের এই নীড়-বাঁধিবার, সংসারের প্রাত্যহিকতা, সন্তান-সন্ততি, ঠাকুর-দেবতা, দাস-দাসী সমভিব্যাহারে এই কূপমন্ডুক’ মনোবৃত্তি তাঁহাকে বড়োই পীড়িত করিয়াছে। এ জীবনে কোনো কোনো নারীর দানে তাঁহার জীবন সুষমামন্ডিত হইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু চরিত্রের গভীর অন্তস্তলে ঈর্ষাসঞ্জাত যে-দৈন্য থাকে–যে, পুরুষকে তাহারা পাইল, তাহাকে চিরদিনের ন্যায় বন্দি করিয়া রাখিবার যে-প্রবৃত্তি থাকে, সেই প্রবৃত্তিকে তিনি চিরদিন-ই করুণা করিয়া আসিয়াছেন।
অনেকানেক পুরুষের মধ্যে অন্যের চিত্ত অথবা শরীর জয়ের যে, অতিনীচ ও অন্যদিগের প্রতি পরম-অবমাননাকর আত্মশ্লাঘা থাকে তাহা তাঁহার মধ্যে কখনো পরিলক্ষিত হয় নাই। যাঁহার নিকট হইতে যাহাই পাইয়াছেন, তাহার জন্য ঈশ্বরের নিকট তাঁহার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। যাহা কিছুই যাহাকেই দিতে পারিয়াছেন, তাহা দিতে পারিয়াই এই অনাবিল আনন্দ বোধ করিয়াছেন। আর যাহা দিতে পারেন নাই, তাহা না দিতে পারার জন্যে অন্তরের অন্তস্তলে তিনি চিরদিন এক সুতীব্র মূককষ্ট বোধ করিয়াছেন।
এ-সংসারে ধৃতিকান্তর ন্যায় অতি স্বল্প ব্যক্তিই, এমন মর্মে উপলব্ধি করিয়াছেন যে, দাতার কোনো ভূমিকাই নাই, সমস্ত তাৎপর্য ও কৃতিত্বই গ্রহীতার। যে দেয় তাহার সেই দানের মধ্যে কোনোই মহত্ত্ব নাই, যে তাহা স্বকীয় আত্মমর্যাদার সঙ্গে, স্মিতহাস্যে কোনোরূপ হীনম্মন্যতা বা উচ্চমন্যতা ব্যতীত গ্রহণ করিবার ক্ষমতা রাখে, সব কৃতিত্ব তাহার-ই। শুধুমাত্র তাহার-ই একার। এ, সংসারে উদ্দেশ্যহীনভাবে দেনা-পাওনার নীচ মনোবৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠিয়া যাঁহারা কাহাকেও কিছু দিয়াছেন ও দিয়া অথবা কাহারও নিকট হইতে কিছু পাইয়া ধন্য হইয়াছেন। তাঁহারাই একথা অন্তরে অন্তরে পরমসত্য বলিয়া জানেন।
ধৃতিকান্ত জীবনে কখনো পরাজয় স্বীকার করিতে চাহেন নাই।
এই পরাজয়ের সঙ্গে বিত্ত বা শারীরিক সামর্থ্যের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু সংসারে এমন কেহই নাই, যিনি পরাজয় স্বীকার করিতে বাধ্য হন নাই, জীবনের কোনো-না-কোনো ক্ষেত্রে। সেই অর্থে পরাজিত তিনি নিশ্চয়ই হইয়াছেন। পরাজিত হইয়া যে-কোনো জয়ই যে, অনেকানেক পরাজয়ের মূল্যেই লভিতে হয়– সেকথা তিনি মর্মে মর্মে বুঝিয়াছেন।
সব বুঝিয়াও কখনো-কখনো মন অবুঝ হইয়া উঠিয়াছে–কিছুতেই বুঝ মানিতে চাহে নাই।
একদিন অপরিমেয় অর্থ ছিল বলিয়াই আজ কপর্দকহীন অবস্থায় তিনি অর্থই অনর্থের মূল’ একথা স্বীকার করেন নাই। অথবা এই আর্থিক কারণের দুর্দশাকে অর্থের অনর্থতার সম্বন্ধে চাপাইয়া নিজের মনকে প্রবোধও দেন নাই। অর্থশালী অবস্থাতেই ‘অর্থের অনর্থতা’ সম্বন্ধে তাঁহার বিশ্বাস আজিকার ন্যায়-ই দৃঢ় ছিল। অর্থ মনুষ্যদিগের দৃষ্টিভঙ্গি আবিল করিয়া ফেলে, কিন্তু ধৃতিকান্তর দৃষ্টি কখনো অর্থের কারণে আবিল হয় নাই। কোনোরূপ জাগতিক ঐশ্বর্যই তাঁহার অন্তরের চিরন্তন অপার্থিব ও অনাবিল সৌন্দর্যকে ম্লান করিতে সক্ষম হয় নাই। যখন ভোগ করিয়াছেন, তখন চূড়ান্ত করিয়াছেন। যখন ত্যাগ করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে, তখন সহাস্যে সর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছেন।
অর্থ বা প্রতিপত্তির নিক্তিতে বৃতিকান্তর বিচার কখনোই সম্ভব নহে। যদি সে-বিচার কেহ কখনো করিতে উদ্যোগীও হন।
.
ডাক্তার জয়সওয়াল অনেকক্ষণ ধরিয়া বিশেষ যত্নপূর্বক মুরতেজার ক্ষতস্থানগুলির কেশ মুন্ডন করিয়া ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগাইয়া সেলাই করিয়া দিলেন। ধৃতিকান্তর স্কন্ধ ভালোমতন পরীক্ষা করিয়া কহিলেন যে, হাড় ভাঙে নাই। প্রলেপ দিবার নিমিত্ত একটি মলম দিয়া কহিলেন যে, প্রলেপ দিলে যন্ত্রণার উপশম হইবে।
অতঃপর সমস্ত কাজ সমাপন করিয়া নিজে মুরতেজাকে লইয়া গাড়িতে বসাইয়া দিলেন।
মুরতেজার ততক্ষণে জ্ঞান ফিরিয়া আসিয়াছিল।
বাটীতে ফিরিবার পথে মুরতেজার সহিত ধৃতিকান্তের নিম্নস্বরে কীসব কথোপকথন হইল।
তাহা এতই নিম্নস্বরে হইল যে, গাড়ির চালক পর্যন্ত শুনিতে পাইল না। গাড়ির পশ্চাৎপটের আরশিতে সে শুধুই দেখিতে পাইল, একজন শীর্ণ, দীর্ঘ, বয়স্ক মানুষের একজোড়া চক্ষু অন্ধকারে ব্যাঘ্রের চক্ষুর ন্যায় জ্বলিতেছে।
ধৃতিকান্ত যখন মুরতেজাকে লইয়া বাটীতে ফিরিয়া আসিলেন, তখন রাত্রি অনেক।
কোনো কক্ষেই কোনো সাড়াশব্দ নাই। রেশমির ঘরে তখনও বাতি জ্বলিতেছে। দাসী সেই কক্ষের সম্মুখের বারান্দায় মেঝের উপর অঞ্চল বিছাইয়া শুইয়া পড়িয়াছে।
এইমুহূর্তে বাহিরের ম্যায়ফিলের ঘরে ঢাকনাবিহীন তম্বুরার উপরে কোনো উড়ন্ত মাছি ক্ষণকালের জন্য বসিয়াই বোধ করি উড়িয়া গেল। তাহাতে একটি পিড়িং’ ধ্বনি উঠিল।
সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই সামান্য ঝংকৃত আওয়াজ নিস্তব্ধতাকে যেন, আরও গভীর করিয়া তুলিল।
ধৃতিকান্ত নিঃশব্দে রেশমির কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, রেশমি, যেমনভাবে শুইয়াছিল তেমন-ই শুইয়া আছে।
ধৃতিকান্ত রেশমির পৃষ্ঠে হস্ত রাখিয়া ডাকিলেন, রেশমি, ও রেশমি।
রেশমি প্রথমে উত্তর করিল না।
কিন্তু অমন মমতাময় সমবেদনায় ভারাক্রান্ত স্বরের উত্তরে কাহারও পক্ষে নিরুত্তর থাকা সম্ভব নহে।
রেশমি কহিল, উঁ।
রেশমি ওঠো। ধৃতিকান্ত কহিলেন।
রেশমি তথাপি উঠিল না।
তখন ধৃতিকান্ত স্বহস্তে রেশমির দুই বাহু ধরিয়া তাহাকে শয্যাপরি উঠাইয়া বসাইলেন।
ধৃতিকান্ত দেখিলেন, রেশমির মুখ কাঁদিয়া ফুলিয়া গিয়াছে, সুরমা মুখময় মাখামাখি হইয়া রহিয়াছে। অশ্রুর নামকিন গন্ধের সহিত ইত্বরের গন্ধ মিশ্রিত হইয়াছে। তাহার মুখমন্ডলে এমন-ই এক হতাশা এবং বিষণ্ণতার ছায়া ঘনাইয়াছিল যে, তাহা দেখিয়া ধৃতিকান্তর বক্ষ ভাঙিয়া যাইতে লাগিল।
ধৃতিকান্ত এ জীবনে একাধিক নারীকে ভালোবাসিয়াছেন। বিনিময়ে ভালোবাসা পান নাই, একথা বলিলে কৃতঘ্নতা হইবে। কিন্তু রেশমি তাঁহার ভালোবাসা যেরূপ দাবিহীন স্নিগ্ধ প্রশান্ততায় স্বীকার করিয়াছে এবং তাহার জীবনে প্রত্যর্পণ করিয়াছে, তাহার কোনো তুলনা তিনি দেখেন নাই।
যাহাকে ভালোবাসিয়াছেন, তাহার চক্ষু জলে ভরিয়া রহিয়াছে, তথাপি তাহার এইমুহূর্তের যন্ত্রণার সমব্যথী হওয়া ছাড়া, বর্তমানে বয়স্ক অশক্ত, অর্থহীন, প্রসার প্রতিপত্তিহীন ধৃতিকান্তর আর কিছুই করিবার নাই।
মূক ধৃতিকান্ত স্বীয় চক্ষের চাহনি দিয়া রেশমির চক্ষের সমস্ত কষ্ট শুষিয়া লইতে চাহিলেন।
অনেক, অনেকক্ষণ নীরব মর্মবেদনা ও সমবেদনায় স্তব্ধ দুইজন মানুষ একে অপরের চক্ষে চাহিয়া বসিয়া রহিল।
ধৃতিকান্ত বহুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া বলিলেন, ওঠো। খাবে চলো।
রেশমি কহিল, আমি খাব না।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, তুমি কি চাও আমি এখুনি তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?
না। জোরের সঙ্গে অনুচ্চারিত অথচ বহুগভীরে প্রোথিত কোনো দাবির স্বরে তাহার সমস্ত সত্তা আবারও কহিল, না, তুমি যাবে না।
শয্যা হইতে উঠিতে গিয়া রেশমির হস্ত আবার ধৃতিকান্তের শরীরে লাগিল।
রেশমি উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিল, তোমার গা যে, এখনও জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। একটুও কমল না যে জ্বর।
পরক্ষণেই দাসীর নাম ধরিয়া ডাকিয়া ধৃতিকান্তের পথ্য তৈয়ার করিতে বলিয়া, আদেশের স্বরে ধৃতিকান্তকে কহিল, তুমি গিয়ে তোমার ঘরে শোবে কি শোবে না!
–শোব। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আর।–বসে থাকতেও না। যদি তুমি উঠে খাও, তাহলে এখুনি যাই!
যাচ্ছি। বলিয়া রেশমি ধীর পায় শয্যাকক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল।
ধৃতিকান্ত কোনোক্রমে টলিতে-টলিতে আসিয়া নিজকক্ষে শুইয়া পড়িলেন। ঘেরাটোপের মধ্যের ক্ষীণ বাতিটুকুও নিভাইয়া দিলেন।
উন্মুক্ত বাতায়ন দিয়া দশমীর চন্দ্রের আলো ঘরময় ও তাঁহার শয্যায় লুটাইয়া পড়িয়াছিল।
মাহমুরগঞ্জের এই অঞ্চলটি বেশ নির্জন। পূর্বে আরও নির্জন ছিল। ইদানীং সম্মুখের বহুবিস্তৃত কোনো মহারাজার বাটীর চত্বরে বহুঅট্টালিকা উঠিয়াছে। ইদানীং রাজা মহারাজারা ভিখারি হইয়াছেন, তাঁহাদের স্থলে রঘুনন্দনরা তাঁহাদের আসনে আসীন হইয়াছে। ইহারা তাঁহাদের সমস্ত গুণাবলি সযত্নে বর্জন করিয়া, তাঁহাদের সমস্ত দোষের উপর-ই সম্পূর্ণ জবরদখল লইয়াছে।
এই বৎসরে ঠাণ্ডা এখনও তেমন পড়ে নাই। দিনে কিঞ্চিৎ গরম বোধ হয়। সন্ধ্যার পর নদীর দিক হইতে একটি মিষ্ট বাতাস উঠে। ধৃতিকান্তর কক্ষলগ্ন মালতীলতার পাতায়-পাতায় সে বাতাস ফিসফিস শব্দ তোলে।
যে-স্থলে নূতন অট্টালিকাসমূহ উঠিয়াছে, সেই চত্বরে কোনো পাহারাদার বাঁশি বাজাইয়া সারারাত্র পাহারা দেয়। মধ্যে-মধ্যে সেই বাঁশির স্বরকে কোনো রাতচরা পাখির স্বপ্ন বলিয়া ভ্রম হয়।
ধৃতিকান্ত শয্যাকক্ষের দুয়ারে কুলুপ লাগান নাই, কিন্তু বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন।
এখন বাটীর অভ্যন্তরে কোনো শব্দ নাই, বাহিরেও নহে।
কোনো পুরুষকণ্ঠে বহুদূর হইতে আশাবরী রাগে কে যেন, আলাপ করিতেছে। সারেঙ্গির শব্দ নাই, তম্বুরাও নাই। কিংবা হয়তো আছে বহুদূর হইতে আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছে। বলিয়া শুধু কণ্ঠস্বরই কর্ণে বাজিতেছে।
এই গভীর প্রায়-নিস্তব্ধ চন্দ্রালোকিত রাত্রের আশাবরির কোমল স্বরটি ধৃতিকান্তকে সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণার কাতরতা হইতে এক আনন্দময় মানসিক অবস্থায় ধীরে ধীরে উন্নীত করিতেছিল।
এমতাবস্থায় কতক্ষণ কাটিয়া গিয়াছে ধৃতিকান্ত জানেন না।
হঠাৎ দ্বারের শিকলে কোনো শব্দ হইল।
ধৃতিকান্ত শয্যায় উঠিয়া বসিলেন।
সেই শব্দ আবারও হইল।
কোনো অভিসারিণীর কোমল হস্তে বড়োআদরে সোহাগে, বড়োদ্বিধায় সেই কোমল শব্দ মাখামাখি হইয়াছিল।
ধৃতিকান্তর সমস্ত পুরাতন কথা মনে পড়িয়া গেল।
এই সেই শব্দ।
কত বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে, এই কক্ষে এই দ্বারে এমন-ই চন্দ্রালোকিত এক রাত্রিতে তিনি এই শব্দ শুনিয়াছিলেন।
এই শব্দ ভুল করিবার নহে।
ধৃতিকান্ত উঠিয়া আসিয়া দ্বার খুলিলেন।
দেখিলেন, চতুর্দিকের বারান্দার বাতি নিভানো।
চন্দ্রালোকে বারান্দার একটি দিক ভরিয়া রহিয়াছে।
অর্গলমুক্ত দ্বারের সম্মুখে রেশমি দাঁড়াইয়া। দীর্ঘাঙ্গী, তন্বী; রেশমি।
সে তাহার শারীরিক কালিমা মুছিয়া ফেলিবার নিমিত্ত আবারও স্নান করিয়াছে। কোন ইত্বর মাখিয়াছে তাহা সেই-ই জানে। পৃষ্ঠোপরি উন্মুক্ত তাহার কেশরাশি।
রেশমি আসিয়া ধৃতিকান্তের বক্ষে মস্তক রাখিয়া দুই বাহুতে তাহার স্কন্ধ বেষ্টন করিয়া অনেকক্ষণ নির্বাক দাঁড়াইয়া রহিল।
ধৃতিকান্ত ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিয়াছিলেন।
রেশমি ধৃতিকান্তর বক্ষদেশে একবার অস্ফুটে চুম্বন করিল।
ধৃতিকান্ত স্বগতোক্তি করিলেন।
-কুড়ি বছর পর। তাই না? কুড়ি বছর পর হবে না?
শায়ীন ধৃতিকান্তর দক্ষিণ বাহুতে মস্তক রাখিয়া তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্বে শুইয়া পড়িয়া রেশমি তর্জনীর দ্বারা ধৃতিকান্তর অধর স্পর্শ করিয়া কহিল, হিসেব করো না।
তাহার পর কহিল, কুড়ি বছর হয়ে গেল এরই মধ্যে! আমার যেন মনে হয় সেদিন।
–সেদিন-ই তো।
ধৃতিকান্ত কিঞ্চিৎ নীরব থাকিয়া কহিলেন, হিসেব করতে আমারও ভালো লাগে না। সত্যিই সেদিন। কিন্তু আমার জীবনের রেওয়ামিল বানানোর সময় হয়েছে যে, রেশমি! খতিয়ান, জাবেদা সমস্ত কিছুতেই দাগ কেটে, হিসেব মিলিয়ে দিয়ে সকলের কাছ থেকে ছুটি নেওয়ার সময় হয়েছে। হিসেব-নিকেশ পাওনা-দেনা, বাকি-বকেয়া এসব কিছু একদিন না একদিন মেটাতে তো হয়-ই। সকলকেই হয়।
কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, তোমার কাছে যে, শুধু দেনাই রইল রেশমি। কিছুই তো শুধতে পারলাম না। শোবার সময়ও বুঝি আর নেই। সময় থাকতে থাকতে সে দেনাটুকু অন্তত স্বীকার করে যেতে দাও।
–ওসব কথা এখন থাক। অন্য কথা বলো। পুরোনো কথা। পুরোনো দিনগুলো কত ভালো ছিল তাই না?
পরমুহূর্তেই রেশমি কহিল, ইশ তোমার জ্বরটা যে, এখনও একটু কমল না। জয়সওয়ালের ওপর ভারি রাগ হচ্ছে আমার।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, মিছিমিছি রাগ করো কেন? আমার এই জ্বর এখন আমার নিত্যসঙ্গী। একে বন্ধুভাবে মেনে নিয়েছি। এরজন্যে আমার বিশেষ কোনো অসুবিধে নেই, যতটুকু অসুবিধে তা, গা গরম থাকলেও আছে, না-থাকলেও আছে। আজকাল এক পা হাঁটলেও লিভারে ব্যথা করে। আমাকে নিয়ে আলোচনা বন্ধ করো। অন্য কথা বলো।
তাহার পর বলিলেন, আজকের রাতটা ভারি শান্ত সুন্দর, তাই না? হয়তো সব রাত-ই সুন্দর, কিন্তু সব রাতে সে-সৌন্দর্যের রূপ বুকের মধ্যে গড়িয়ে আসে না। হয়তো বহুবছর পরে তুমি আমার কাছে আছ, কাছে এসেছ তাই এই রাতের সৌন্দর্য এমন করে ধরা পড়েছে।
পরক্ষণেই ধৃতিকান্ত কহিলেন, জানো, কে একজন আশাবরিতে আলাপ করছিল একটু আগে। বড়োভালো লাগছিল। একটু চুপ করো, শুনতে পাবে।
রেশমি উৎকর্ণ হইয়া শুনিল।
তাহার পর বলিল, এ যে, সে লোক নয়। ছেলেটি সময়কালে বড়ো গাইয়ে হবে। বড়োমিষ্টি আওয়াজ। একেবারে খোলা জোয়ারি। নাড়া বেঁধেছে শিউপ্রসাদজির কাছে।
পুনরায় কহিল, ভালো করে শোনো–গানটিও তোমার জানা।
ধৃতিকান্ত মনোযোগ সহকারে শুনিতে লাগিলেন।
কিয়ৎক্ষণ শুনিবার পরে বলিলেন, চেনা-চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু পদগুলি মনে করতে পারছি না। কতদিন গান-বাজনা ছাড়া।
রেশমি পুলকভরে শুধাইল, মনে পড়ে? পড়ে না?
তুয়া চরণ কমল পর মন-ভ্রমর ভাল ভাণ যাঁউ চন্দ্রচকোর।
–পড়েছে পড়েছে। মনে পড়েছে।
ধৃতিকান্ত কহিলেন। এখনও যে, তাহার স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় নাই একথা জানিয়া বৃতিকান্ত বড়োই আহ্লাদিত হইলেন।
বহুদিন পর গানের কথাগুলি ধৃতিকান্তর মনে বিস্মৃতির দিগন্ত হইতে কোনো পেলব পক্ষীর ন্যায় দ্রুতপক্ষে স্মৃতির পিঞ্জরে ফিরিয়া আসিতেছিল।
রেশমি কহিল, মনে আছে? এ গান নিয়ে একদিন খুব বচসা হয়েছিল তোমার, আমার ও আসগরের মধ্যে। আসগর বলেছিল আশাওরির এই পদটা ধ্রুপদের ঢংয়ে গাইলেই এর মহিমা সত্যিকারের ফুটে ওঠে। আসলে, এটা যাঁর গান, তিনি নাকি ধ্রুপদ ভেবেই একে বেঁধেছিলেন। কিন্তু সেই সময় বানারসে ও অন্যান্য জায়গায় এই গান অনেকেই গাইত আর অনেক গায়ক একে খেয়ালের ধাঁচে ফেলে গাইত বলে আশাওরির মেজাজ বাঁচত না। আসলে খেয়ালের ঢংয়ে এই গান নিয়ে এদিক ওদিক হিললেই ওই গানটার মধ্যে ভৈরবী কী জৌনপুরীর খাদ এসে পড়ত। মনে পড়ে?
ধৃতিকান্তর মুখমন্ডল উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
তিনি কহিলেন, ঠিক ঠিক।
পুনরায় কহিলেন, আসগরের কথাও প্রায়-ই মনে পড়ে। সেদিনও একা বসে ওর কথা মনে করছিলাম। চলো কাল আমরা ওর কবরে গিয়ে ফুল আর মোমবাতি দিয়ে আসি। বহুদিন যাওয়া হয়নি।
চলো। রেশমি অস্ফুটে কহিল।
ধৃতিকান্ত হঠাৎ-ই কহিলেন, রেশমি একটু সরে শোও না।
রেশমি অভিমানভরে দ্রুত সরিয়া গেল।
কহিল, শোনো, তুমি আমাকে ঘেন্না করো, না? চিরদিনই তুমি আমাকে ঘেন্না করেছ। আমি চলে যাচ্ছি তোমার ঘর থেকে।
ধৃতিকান্ত নিরুত্তর রহিলেন।
অনেকক্ষণ পর সে নিজেই আবার কহিল, কী করব বলো? আমাদের পেশা এমন যে, এমন অপমানিত হওয়াটার ঝুঁকি বুঝি এই পেশার সঙ্গে জড়ানো থাকেই। আমি আওরত মানুষ–কী করতে পারতাম বলো?
ধৃতিকান্ত হাসিয়া উঠিলেন। কহিলেন, তুমি এখনও বড়ো হলে না? যা করার তা আমিই করব। তুমি দেখো।
তাহার পর কহিলেন, এখন অন্য কথা বলো।
রেশমি পুনর্বার কহিল, এজন্যে তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কিন্তু সরে শুতে বললে কেন তা বলো?
ধৃতিকান্ত কিঞ্চিৎ নীরব রহিলেন। তাহার পর অনিচ্ছা সহকারে কহিলেন, পেটে ব্যথা লাগছিল। লিভারের অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, পেটে হাত ছোঁওয়ালেই লাগে। তোমার রঘুনন্দনের পদাঘাতের ফলে সঙ্গে সঙ্গে মরে গেলাম না কেন তাই ভাবি, লোকে মণিকর্ণিকাতে মরতে আসে, আমি এসেছিলাম সেই আশায়। কিন্তু মরা হল কই? এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো।
রেশমি অনুশোচনার সহিত কহিল, ইশ। তোমার কত কষ্ট! কিন্তু এমন দশা করলে কী করে শরীরটার? তোমাকে তো আগে কখনো শরাব ছুঁতে পর্যন্তও দেখিনি আমি। এ নিয়ে তোমার দোস্তরা তোমাকে কত মজাক করেছে। তুমি শেষে শরাবি হবে, এ আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, কেন হলাম, তাই জিজ্ঞেস করছ?
তাহার পর কহিলেন, আমি নিজেও নিজেকে শুধিয়েছি, প্রায়ই শুধোই।
পরক্ষণেই হঠাৎ কহিলেন, জানলার কাছে একটা খাতা আছে নিয়ে আসবে?
রেশমি বিস্মিত হইয়া শয্যাপরি উঠিয়া বসিল।
কহিল, কী হবে? কী আছে খাতায়?
ধৃতিকান্ত হাসিলেন।
কহিলেন, আজকালকার ছেলেরা বলে, লিভার না পচলে নাকি মগজ খোলে না। তোমার খুদা, আমার ঈশ্বরের কৃপায় এই চোখ মেলে এই কিমতি দুনিয়ায় যা দেখলাম, যা শিখলাম তাই-ইলিখতে শুরু করেছি।
পুনর্বার কহিলেন, আমি শায়ের লিখছি। শেষসময়ে তোমার চোখে গুণী হওয়ার চেষ্টা করছি।
রেশমির দুই চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
কহিল, তুমি তো তুমিই। তোমার আবার বিশেষ গুণের দরকার কী? আমি তো তার প্রয়োজন দেখি না কোনো। আমার কাছে তোমার তুমি’ হওয়াটাই সবচেয়ে বড়োগুণ। অন্য কেউই যে, আমার চোখে ‘তুমি’ হতে পারল না।
ধৃতিকান্ত সস্নেহে রেশমির বাহু স্পর্শ করিয়া কহিলেন, সবার তো তোমার চোখ নেই। সবাই তো আর আমাকে তোমার চোখে দেখল না।
রেশমি কহিল, যারা দেখল না, খুদা তাদের মাপ করুন। সে বেচারাদের চোখ-ই নেই; কী করবে?
পরক্ষণেই রেশমি কহিল, আনছি খাতা। শায়ের শোনাবে তো?
আমি ভাবতে পারছি না যে, তুমি শায়ের লিখবে? মির্জা গালিবের মতো? জিগর মোরাদাবাদীর মতো?
ধৃতিকান্ত সস্নেহে কহিলেন, তুমি কি পাগল? কাদের সঙ্গে কার তুলনা? তা ছাড়া, এ তো বাংলা কবিতা। বাংলায় কবিতাই হল ‘শায়ের। যদিও কবিতা আর শায়ের ঠিক এক নয়। তুমি কি বুঝতে পারবে?
রেশমি বাতায়ন নিকটস্থ মেজ হইতে খাতাখানি লইয়া আসিয়া ঘেরাটোপের মধ্যবর্তী স্নিগ্ধ বাতিটি জ্বালাইয়া কহিল, নাও এনে দিলাম। পড়ো, না শুনি।
ধৃতিকান্ত সম্বন্ধে বহুবৎসর হয় কেহই এত ঔৎসুক্য দেখায় নাই।
জীবনের শেষ অঙ্কে পৌঁছাইয়া, যে-অঙ্কের নিমিত্ত কাহারও কোনো কামনা থাকে না, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী দাবিদারহীন এইসময়ের ছত্ৰতলে দাঁড়াইয়া কম্পমান দুর্বল ধৃতিকান্তর আজি এই গভীর রজনিতে হঠাৎ-ই মনে হইল যে, তিনি বুঝি নিভিয়া যাইবার পূর্বে নিজেকে সেই পুরাতন জরাজীর্ণ আপনাকে হয়তো প্রথমবার ভালোবাসিতে শুরু করিয়াছেন।
তাঁহার জীর্ণ রং-চটা বহুবৎসরের পুরাতন খাতাখানি উন্মুক্ত করিতে করিতে ধৃতিকান্ত ভাবিতে লাগিলেন যে, মনুষ্যমাত্রই আপনাকে যেরূপ ভালোবাসিয়া থাকে সেরূপ বোধ হয় আর কাহাকেও ভালোবাসিতে পারে না। ইহার কারণও নিশ্চয়ই আছে। কারণ হয়তো তাহার নিজের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বর ওপর-ই তাহার পারিপার্শ্বিক সমগ্র জগতের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব নির্ভরশীল–হয়তো সে নিজেই সেই জগতের কেন্দ্রবিন্দু। সেই কেন্দ্রবিন্দুর যখন কেন্দ্র হইতে বিচ্যুত হইবার সময় উপস্থিত হয়, সেইক্ষণে বুঝি, আপনার প্রতি প্রেম অত্যন্ত প্রগাঢ় হইয়া উঠে।
এইকথা চিত্তে উদিত হইবামাত্রই ধৃতিকান্তর আপনাকে বড়োই নীচ ও দীন বলিয়া বোধ হইল।
ধৃতিকান্ত একটি দীর্ঘনিশ্বাসত্যাগ করিয়া ভাবিলেন, রেশমি তাঁহাকে যে-প্রকার স্বার্থহীন ভালোবাসা এ জন্মে বাসিল তেমন করিয়া তিনি কখনোই রেশমিকে ভালোবাসিতে পারেন নাই। রেশমিই তাঁহার একমাত্র অচঞ্চল নিষ্কন্ন প্রেমিকা। অথচ উহার সহিত-ই তাঁহার কোনো শারীরিক সংসর্গ কখনো ঘটে নাই। একসময় রেশমি তাহা কামনা করিয়াছিল, তিনিই বিমুখ ছিলেন। কেন যে, ছিলেন তাহা আজিও বুঝিয়া উঠা সম্ভব হয় না। বর্তমানে এ প্রসঙ্গ অবান্তর। বড়োই দেরি হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এই কারণে তাঁহার চিত্তে কোনো ক্ষোভ নাই। তিনি ইহাও জানেন যে, আজ রেশমিরও ক্ষোভ নাই। নারীশরীরের প্রতি তাঁহার যে, অনাসক্তি ছিল এমন নহে, কিন্তু রেশমির সান্নিধ্যে, রেশমির চক্ষুর চাহনিতে, তিনি এ জীবনে যাহা পাইলেন ও চিরদিন পাইয়া আসিয়াছেন সেই প্রাপ্তির সহিত তুলনা করিলে তাঁহার জীবনের অন্য সমস্ত প্রাপ্তিই তুচ্ছ বলিয়া প্রতীয়মান হয়।
ধৃতিকান্ত ভাবিলেন আশ্চর্য। ঈশ্বরের কী অপার করুণা! খুদার কী দোয়া। তাহা না-হইলে এমন জাগতিক অপ্রাপ্তির মধ্যে এমন সুগভীর প্রাপ্তি লুক্কায়িত থাকা ও সেই প্রাপ্তিকে বহুযুগব্যাপী বিকশিত রাখা কী করিয়া সম্ভব হয়?
পাঠক! এই অপ্রাপ্তির মধ্যের শান্ত স্নিগ্ধ অফুরান আনন্দ শুধু তাঁহারাই বুঝিবেন– যাঁহাদের জীবনের এইরূপ গভীর প্রশান্তি লভিবার সৌভাগ্য ঘটিয়াছে।
রেশমি অধৈর্য হইয়া উঠিয়াছিল।
শয্যাপরি পা মুড়িয়া বসিয়া বাতায়নের দিকের দেওয়ালে হেলান দিয়া সে পুনর্বার কহিল, কী হল? শোনাবে না? এতবার করে বলছি, শোনাও-না বাবা!
ধৃতিকান্তর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হইয়াছে। বালিশের তল হইতে পড়িবার চশমা বাহির করিয়া বক্ষোপরি খাতা উন্মুক্ত করিয়া কহিলেন, কেন শরাবি হলাম শোনো।
তাহার পর হঠাৎ-ই কহিলেন, এ কবিতা তুমিই প্রথম শুনবে এবং হয়তো তুমিই শেষ। এই খাতা আমি তোমাকেই দিয়ে যাব। তোমাকে দেওয়ার মতো আজ তো আমার কিছুই আর নেই।
রেশমি কহিল, ‘কিছুই’ বলতে কী বলছ জানি না। অনেক কিছুই তো দিয়েছ একদিন। যদিও সেই হিরে-জহরত-এর কোনো দাম ছিল না আমার কাছে। একথা তোমাকে বরাবর বলেছি। সেদিন তোমার কাছে এসব কিছু অনেক ছিল, তাই হয়তো আমাকে সেদিন বিশ্বাস করতে পারোনি পুরোপুরি। হয়তো ভেবেছ, আমার সেকথা তওয়ায়েফের বাঁধা বুলি। মন রাখা কথা।
কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া রেশমি কহিল, কিন্তু আজ? আজকেও কি সন্দেহ যায়নি তোমার? এতদিনেও কি প্রমাণ পাওনি যে, তোমাকে সেই প্রথমদিন দেখার পর থেকে শুধু তোমার জন্যেই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম!
রেশমি পুনরায় কহিল, তুমি বড়োবোকা। সব পুরুষ-ই বোকা। কিন্তু তোমার মত এতবড়ো বোকা আমি দেখিনি!
তাই তো! ধৃতিকান্ত কহিলেন।
তাই–তো! রেশমি হাসিয়া কহিল।
তাহার পর কহিল, নইলে তুমি রেশমিকে ভালোবাসতে যাবে কেন? আর একজন তওয়ায়েফকে ভালোবেসে নিজের এ-হালই বা করবে কেন? ঘর পেলে না, সংসার পেলে না, ছেলে-মেয়েও পেলে না, আমার-ই মতো। নিজেকে নিয়ে কেউ কি এমন খেলা খেলে?
তাহার পর কথা ঘুরাইবার জন্যে রেশমি পুনরায় কহিল, তুমি কি পড়বে, না পড়বে না?
পড়ছি শোনো। ধৃতিকান্ত কহিলেন:
বোতল ছুঁয়ে করছে শপথ
প্রতিটি দিন, আর খাবে না–
দিন ঝরে যায়, দিনের মনে
কথার খেলাপ যখন তখন।।
ছিলে মিয়া অন্যরকম
হয়ে গেলে বেহেড মাতাল কা
রণ কি কেউ বলতে পারে?
মিয়ার এমন অধঃপতন।।
কার্য হলে কারণ থাকেই
একটা কিংবা অনেকগুলো,
কারণগুলো ধুনে ধুনে–
বুক করেছে পেঁজা তুলো।।
পারল না তো একলহমায়
থামিয়ে দিতে কলজেটাকে
তাইতো মিয়া মরছে রোজ-ই
কিস্তিবন্দি পহচান-মরণ।।
কাঁধ ঝুঁকেছে সামনে দিকে
মাথার মধ্যে স্মৃতির পাহাড়
এই দুনিয়ার বুঝল স্বরূপ
শেয়ালকাঁটার ন্যাবার বাহার।।
উড়িয়েছিল অনেক ধুলো
নানা মুদি, হরেক জন,
ফেলে-দেওয়া ভুলের খেরো,
ঠগের হাসি, বিজ্ঞাপন।।
অনেক দূরে আসল মিয়া
আর শোনে না হাটের গোল
নদীর পাড়ে হিঁদুর মড়া
দিচ্ছে কারা হরির বোল।।
ভাবনা ভুলে ঢালল মিয়া
আওয়াজ হল : ডাবুক-বুক
হাসল মিয়া আপন মনে,
বোতল বলল? কী উজবুক!
রেশমি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কহিল, বাঃ কী সুন্দর লিখেছ তুমি! যদিও সব বাংলা কথা বুঝি না। আমি, তবু মানে বুঝতে অসুবিধে হল না কোনো।
তাহার পর কহিল, আর একটা শোনাও না।
ধৃতিকান্তর পান্ডুর ক্লান্ত বলিরেখাঙ্কত মুখমন্ডলে এক উজ্জ্বল আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটিল। ধৃতিকান্ত স্বভাবে কবি ছিলেন, কিন্তু কখনো কবি’ বলিতে যাহা বুঝায় তাহা ছিলেন না। তাঁহার এই অভিজ্ঞতাহীন ও হাস্যকর লিখন যে, রেশমির সত্য-সত্যই ভালো লাগিয়াছে– ইহা জানিয়া তিনি যারপরনাই আত্মশ্লাঘা বোধ করিলেন। যদি রেশমির ভালো লাগিয়া থাকে, তবে তাহাই ধৃতিকান্তর পক্ষে যথেষ্ট পুরস্কার। অন্য কাহারও প্রশংসার জন্য কাঙালপনা করিবার স্পৃহা অথবা সময় কিছুই তাঁহার অবশিষ্ট নাই।
রেশমি ধৃতিকান্তর গন্ডে নিজ গন্ড স্পর্শ করিয়া তাঁহার ঘন শ্বেত ও কৃষ্ণ কেশরাশির অভ্যন্তরে তাহার অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে কহিল, আরও শোনাও।
বহু-বহু বৎসর পর ধৃতিকান্তর অকস্মাৎ-ই মনে হইল, এত সত্বর না মরিলেও হয়তো চলিত। তিনি যে, এখনও কিছুমাত্র আনন্দ সৃষ্টি করিতে পারেন এবং সংগীতের ন্যায় অন্য কোনো সৃষ্টির দ্বারা তাহা যৎসামান্যই হউক না কেন অন্যকে আনন্দিত করিতে পারেন, এই ধারণা তাঁহার অন্তরস্থ সিন্দুকের মধ্য হইতে বহু পূর্বেই লোপাট হইয়া গিয়াছিল।
ধৃতিকান্ত সেই মুহূর্তে সমস্ত শারীরিক অস্বস্তির কথা ভুলিয়া অর্ধশায়ীন অবস্থায় উখিত হইলেন, তাহার পর দুই হস্তে চক্ষুসম্মুখে খাতাখানি ধরিয়া পড়িতে লাগিলেনঃ
কসম খেয়ে বলছে মিয়া
এই দুনিয়া চশমখোর,
ভালোই যদি ভুলেও করো,
করছ যার, সে ভাঙবে গোড়।.
ঘর্মে-কর্মে ওয়াক্ত ওসুল
মৎ-পুছো ভাই খাল-খরিয়াত
চবুতরার ঘুঘুর মতন।
মেহনতিতেই খাস-তবিয়ত।।
ভুলেও যদি খোঁজ নিতে যাও
ফায়দা কীসে, পরের আরাম,
ভাই-বিরাদর পাড়বে গালি :
মিয়া শারা সুরতহারাম।।
বলছে মিয়া দুঃখে অনেক
আপনা নিয়ে আলগা থাকো,
পরের ভাবনা পরকে ভাবাও
ট্যাঁক আর দিনের হিসেব রাখো।।
রেশমি রীতিমতন উত্তেজিত হইয়া উঠিল।
কহিল, এটা আরও বেশি বুঝলাম, কারণ অনেক উর্দু কথা আছে।
তাহার পর কহিল, তুমি একটা বই ছাপাও তোমার শায়েরির।
ধৃতিকান্ত হাসিয়া উঠিলেন। কহিলেন, তুমি পাগল বলে তো আর অন্যরা পাগল নয়। অন্যদের কথা ছাড়ো, তাদের কাছে বই ছাপিয়ে নাম জাহির করে কী হবে? তুমি যে, ইনাম দিলে–তাই-ই আমার সবচেয়ে বড়ো শিরোপা। এর বেশি কী হবে? তারা তো মন্দও বলতে পারে? খামোখা আমার মনের আনন্দটা তাদের নোংরা হাতে ধুলোয় ফেলে দেওয়ার জন্য তুলে দিয়ে লাভ কী?
রেশমি সোজা হইয়া বসিয়া কহিল, কথা বোলো না, আরও শোনাও।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, সব শুনলে তো, রাত কাবার হয়ে যাবে।
যাক না! রেশমি কহিল। রাত তো কাবার হওয়ার জন্যেই। অন্য সব রাত তো বরবাদির রাত। জীবনের কত রাত তো ঘুঙুর পায়ে নেচে-নেচে আর রঘুনন্দনের মতো কত লোকের নোংরা চোখের শিকার হয়ে বরবাদ করলাম। এই একটি রাত বেহেস্ত হয়ে থাকবে। আজ সারারাত শায়েরি শুনব আমি। বরি খুশবু পাচ্ছি তোমার শায়েরিতে।
তাহার পর-ই কহিল, একটু দাঁড়াও, পানের কৌটোটা নিয়ে আসি।
কিয়ৎক্ষণ পর হংসসদৃশ রৌপ্যনির্মিত তাম্বুলকরঙ্ক হস্তে লইয়া রেশমি পুনর্বায় আসিল। তাহা হইতে মঘাই পান বাহির করিয়া সুগন্ধি জর্দা সহযোগে মুখে পুরিল। মুখ খুলিয়া কথা কহিতেই সেই জর্দার খুশবু ঘরময় ছড়াইয়া পড়িল।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, আমাকে দুটো দাও।
চক্ষু রাঙাইয়া শাসনের স্বরে রেশমি কহিল, একেবারেই না। তোমার এত অসুখ, জর্দা পান। খায় না।
দাও বলছি। ধৃতিকান্ত কহিলেন।
রেশমি তাঁহার চক্ষে অনেকক্ষণ পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া কহিল, কোনো কথা শোনো না তুমি, ভারি বেয়াদপ। কোনোদিন-ই শুনলে না, তো আজ। বলিয়া করঙ্গ খুলিয়া তাম্বুল বাহির করিয়া দিল।
তাম্বুল মুখে পুরিতে পুরিতে ধৃতিকান্ত কহিলেন, তোমার মতো মিষ্টি করে এ-জীবনে আর কেউ আমাকে বকল না। যখন বকো তখনও মনে হয় আদর করছ। তোমার মতো আর কেউ ভালোবাসতে জানে না, কেন বলো তো রেশমি?
রেশমি কথা ঘুরাইয়া কহিল, শুরু হল তোমার প্যায়েরভি। আমি তো তোমার ব-খিদমতে রেশমিই। আমি এমনিতেই তো তোমার-ই আছি। আমাকে এত প্যায়েরভি কেন?
পরক্ষণেই কহিল, নাও, কথা বোলা না, শোনাও।
ধৃতিকান্ত পৃষ্ঠা উলটাইয়া পড়িতে শুরু করিলেন :
‘মিয়ার মুখোশ, বিবির মুখোশ,
ছেলের মুখোশ, মুখোশ চাই?
মুখোশওয়ালা যাচ্ছে হেঁকে
লেঙ্গে মুখোশ? হাতেমতাই।।
‘পাকড়ো’ ‘পাকড়ো’ বলল মিয়া
পাকড়াবে কে? পাকড়ায়েব?
হর-ঘড়ি সব মুখোশ বদল
বেগর-মুখোশ মুখ গায়েব।।
আসলি সুরত কেউ যে ইয়ার,
দেখতে চায় না এই দুনিয়ার,
ছিঁড়লে মুখোশ দেখবে গিধ্বর
শিস দেবে না আর মুনিয়ায়।।
আব্বাজানের মুখোশ উদার
কামিনাদের মুখোশ হাসে,
মুখোশ যখন খোলে মাশুক
আসিক তখন পালায় ত্রাসে।।
দেছে খুদা একটাই মুখ
কিন্তু মিয়া দেখায় কাকে?
গোসলখানার আয়না ছাড়া
দেখানো যায় শুধুই মাকে।।
মুখোশভারে কেটেছে মুখ
বলছে মিয়া হায় কী জুলুম–
নাঙ্গা সকল যেই বেরুল
উঠবে আওয়াজ; হালুম-হুলুম।।
যে উষ্ণ মুখ গর্ভে ঘুমোয়
সেই ঘুমোবে হিম কবরে,
জিন্দগিতে বেগল-মুখোশ
পুছল না কেউ এই শহরে।।‘
পাঠ থামাইয়া ধৃতিকান্ত কহিলেন, হয়েছে?
রেশমি পানের পিক গিলিল মরালী গ্রীবা ঘুরাইয়া।
সেকালের গহরজান বাইজি পানের পিক গিলিলে তাঁহার শ্বেতশুভ্র মসৃণ গন্ডদেশের অভ্যন্তরে যখন সেই রক্তিম পিক গড়াইয়া নামিত তখন নাকি তাহা দৃষ্টিগোচর হইত।
রেশমির গাত্রচর্ম কালো, কিন্তু বড়োই উজ্জ্বল কালো। ধৃতিকান্ত তাহার গন্ডদেশে চাহিয়া রহিলেন। কিন্তু সেই ঘেরাটোপের ক্ষীণ আলোকে সমস্ত রেশমিকে একটি কোমল উজ্জ্বল পক্ষী বলিয়া তাঁহার ভ্রম হইল। তাহার গন্ডদেশে পানের রক্তিম পিকের সঞ্চরণ ধৃতিকান্তর গোচর হইল না।
পানের পিক গিলিয়া রেশমি আবদারের সুরে কহিল, আরও শোনাও। থামলে কেন?
তাহার পর কহিল, আমার কিন্তু ভারি আনন্দ হচ্ছে। এত আনন্দ হচ্ছে যে, বোঝাতে পারব না। তোমাকে কী করে ইনাম দেওয়া যায় বল তো?
ধৃতিকান্ত অন্যমনস্কভাবে কহিলেন, তুমিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ইনাম। এর চেয়ে বড়ো ইনাম তো আর কিছুই হতে পারে না। ভাবতেও পারি না আমি।
রেশমি অধৈর্য কণ্ঠে কহিল, কথা বলে সময় নষ্ট হচ্ছে। পড়ো, পড়ো।
ধৃতিকান্ত পুনরায় পৃষ্ঠা উলটাইয়া পাঠ করিতে লাগিলেন :
পেল অনেক ভালোবাসা
নিজেও অনেক বাসল ভালো,
ভাঙতে গিয়ে অন্ধকারকে
ভুল করে সে ভাঙল আলো।।
সইত না তার কোনো আলোই
চোখ ধাঁধত রোশনাইতে
একলা ঘরে অন্ধ মিয়া
ইচ্ছেও নেই চোখ চাইতে।।
অন্ধকারে দেখতে না পায়
উজল আলোয় আরোই তো নয়;
খোদার কাছে মাঙল সে বর
মরে যেন জোনাকি হয়।।
পাঠশেষে রেশমির উদগ্রীব, উৎসুক মুখপানে ধৃতিকান্ত চাহিয়া রহিলেন।
রেশমি কহিল, একটা কথা বলব?
ধৃতিকান্ত কহিলেন, বলো।
সমস্ত জীবন তুমি সত্যি সত্যিই যার জন্যে বাউন্ডুলে হয়ে গেলে, কোথাও ঘর বাঁধতে পারলে না, শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়ালে এখানে ওখানে, তাকে নিয়ে কিছু লিখেছ?
ধৃতিকান্ত কহিলেন, শ্যাওলার মতো আমি কখনো ভাসিনি জীবনে। ভাসতে পারলে জীবনের সহজ সুখের জলে সুখী হওয়া যেত। যেমন করে বেশির ভাগ লোককে সুখী হতে দেখি। কিন্তু জীবনের জলে যে, আমি নিজের ইচ্ছেমতো সাঁতরাতে চেয়েছিলাম স্রোতের বিপরীতে; আমার ইচ্ছেমতো গন্তব্যে যেতে চেয়েছিলাম। তাই-ই তো আমার হাড়-গোড় সব ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল, পাথরে পাথরে ঠোক্কর খেয়ে, ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে গেল আমার সমস্ত আমি।
তাহার পর কিঞ্চিৎ থামিয়া, দম লইয়া কহিলেন, তুমিও যদি আমাকে শ্যাওলা বলো, তাহলে বড়ো দুঃখ হয়।
রেশমি দুঃখিত স্বরে কহিল, আমি অত মানে বুঝে বলিনি। আমি বেগর পড়ে-লিখে আওরত। মুখ তওয়ায়েফ। আমি কি তোমার মত অত ভাষা-টাষা জানি? আমার মনে হল, তাই-ই বললাম। কিছু মনে কোরো না। আমার কথার মানে আমার মুখের কথায় ধোরো না। মনের কথা বুঝে নিয়ে ধোরো।
পরক্ষণেই রেশমি কহিল, তুমি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে। বললে না; লিখেছ কি না?
ধৃতিকান্ত কহিলেন, তা জেনে তোমার লাভ কী?
লাভ কিছু নেই। কিন্তু তোমাকে যে, দুঃখ দিল, অথচ যে, এমন করে তোমার ভালোবাসা পেল, তার সম্বন্ধে তোমার মনের কথা জানতে ইচ্ছে করে না? তাকে দেখিনি কখনোও, তার সম্বন্ধে তোমার কাছে কখনোও কিছু শুনিওনি। কিন্তু তোমাকে যতদিন ধরে দেখছি, ততদিন ই বুঝেছি যে, তুমি আমার কাছে থাকলেও কখনোও থাকেনি। কথা বলতে বলতে, হঠাৎ উদাস হয়ে গেছ, গভীর রাতে তোমার ঘর থেকে ঘুমের মধ্যে তোমার যন্ত্রণাভরা অবোধ্য স্বগতোক্তি শুনেছি। শুনে তোমার জন্যে কষ্ট পেয়েছি। তোমার কলজেতে তার জন্যে শূন্যতা, তা আমার সব কিছু দিতে চেয়েও ভরাতে পারিনি। কখনোও পারিনি।
ধৃতিকান্ত চুপ করিয়াছিলেন।
তাঁহার ক্লান্ত, নিস্পৃহ, বয়স্ক মুখাবয়বে সেই ক্ষীণ আলোকে অকস্মাৎ যেন কোনো বিষণ্ণতা ছাইয়া আসিল। যাহাকে চিরদিন ভুলিতে চাহিয়াছেন, অথচ পারেন নাই, যতই ভুলিতে চেষ্টা করিয়াছেন, ততই তাহাকে যেন বেশি করিয়া মনে পড়িয়াছে–সেই তাহার-ই মুখটি ধৃতিকান্তর বুকের অভ্যন্তরে পুনর্বার ফিরিয়া আসিল।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, অন্য কথা বলো।
–না।
জোরের সঙ্গেই রেশমি কহিল, অন্য কথা বলব না। সেই একজনের জন্যেই এ জীবনে তোমাকে আমি কখনো যেমন করে পেতে চেয়েছিলাম, তেমন করে আমার কখনোও পাওয়া হল না। রাগ বলব না, ঘৃণাও নয়, তার সম্বন্ধে নিজে একজন আওরত হয়ে আমার ঔৎসুক্য থাকা স্বাভাবিক। তুমি নিজে কখনোও কিছু বলেনি, আমি শুনতেও চাইনি। কিন্তু না-বলা কথা অনেক বলা-কথার চেয়ে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাই-ই এত করে বলছি যে, যদি তাকে নিয়ে কোনো কিছু লিখে থাকো, তবে একটু পড়ে শোনাও। তোমার মনের ভেতরে একবারের জন্যে আমায় একটু উঁকি মেরে দেখতে দাও।
ধৃতিকান্ত হাসিলেন। অন্যমনস্ক স্বরে কহিলেন, আজ তুমি সারারাত এমন হুরির মতো আমার সঙ্গে থাকবে জানলে, মুরতেজাকে বলে একটু তামাকের বন্দোবস্ত করে রাখতাম। আলবোলাতে টান দিতাম শুয়ে শুয়ে।
রাগতস্বরে রেশমি কহিল, থাক আর ওসব খেয়ে কাজ নেই। ডাক্তারদের কথা যদি একটাও না শুনবে, তবে আমি ডাক্তার ডেকে মরি কেন?
ডাকো কেন? ধৃতিকান্ত কহিলেন।
তাহার পর কহিলেন, তুমি ছাড়া আমার মতো মারিজের ইলাজ করতে পারে এমন ডাক্তার তো আমার জানা নেই।
রেশমি ধৃতিকান্তর বক্ষোপরি তাহার চিকন মুখ রাখিয়া চোখ বুজিয়া পোষা বিড়ালের ন্যায় সোহাগে নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, তুমি আমার মনের মধ্যে উঁকি দিতে চাও, কিন্তু কখনো কোনো গভীর ইঁদারার মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখেছ?
রেশমি মুখ না তুলিয়াই কহিল, দেখেছি।
–কী দেখতে পেয়েছে?
–অন্ধকার।
–শুধু অন্ধকার-ই নয়, ভালো করে চেয়ে দেখলে দেখতে পেতে পচা পাতা, কুৎসিত ব্যাং, আবর্জনার বৃত্ত–এসব জলের ওপর। যেখানে জল-ই ভালো করে দেখা যায় না, তাই জলের ভেতরে কী তা দেখারও উপায় থাকে না কোনো।
তাহার পর, ধৃতিকান্ত পুনরায় কহিলেন কখনোও নিজেকে ডেকেছ ইঁদারার মধ্যে মুখ । নামিয়ে? অন্য কাউকেও কি ডেকেছ? আমি ডেকেছি, বার বার। তার নাম ধরে ডেকেছি আমার মাথার মধ্যে তার নাম গমগম করে বেজেছে। শুধু বেজেছে আমার-ই ডাক। সাড়া পাইনি তার। তারপর নিজের নাম ধরে ডেকেছি। মনে হয়েছে, নিজের নামটাও বুঝি হারিয়ে গেল, সেই অন্ধকার স্যাঁতসেতে, গভীরতার মধ্যে।
রেশমি মুখ তুলিয়া কহিল, এমন করে বলছ কেন? আমার ভালো লাগে না। অন্য কথা বলো।
ধৃতিকান্ত কহিলেন, লিখেছি তাকে নিয়ে। এত তোমার শোনার ইচ্ছে–শোনো। কিন্তু তুমি তার চেয়ে অনেক বড়ো, তুমি তুমিই! তোমার সঙ্গে তার তুলনা করো কেন?
তাহার পর কহিলেন, আমাদের রবিঠাকুরের একটা কবিতা আছে জান?
কী কবিতা? রেশমি শুধাইল।
তুমি যে তুমিই ওগো সেই তব ঋণ
আমি মোর প্রেম দিয়ে শুধি চিরদিন।
বাঃ! রেশমি কহিল।
তাই বলছিলাম তোমার সঙ্গে অন্যের তুলনা কেন করো? ধৃতিকান্ত কহিলেন।
–সে তুমি বুঝবে না। তুমি আওরত হলে, শুধু আওরত-ই নয়, তোমার যদি আমার মন থাকত, তাহলে বুঝতে পারতে। পরক্ষণে কহিল থাক, আর কথা বলব না। পড়ো এবারে।
ধৃতিকান্ত যেন অতীতের ধূসর পান্ডুলিপিতে, অনেক চেষ্টা করিয়া, ঘষা কাঁচের চশমার ভিতর দিয়া দুই চক্ষু-গোলক বারংবার সঞ্চারণ করিয়া অতিকষ্টে সেই লিপি খুঁজিয়া বাহির করিলেন।
ছিল সে এক কালো মেয়ে
মিয়া তারে বাসল ভালো
চান করে সে আসলে ঘরে
আঁধার মনে ফুটত আলো।।
অনেক ভালো বেসেছিল
দিয়েছিল কিছু টাকাও
টাকার কোনো দাম ছিল না
ফুল দেছিল থোকা থোকা।।
সেই মেয়েটা এমনি বোকা
ফুলগুলো সব ফেলল ছিঁড়ে।
পা-ছড়িয়ে গুনল টাকা
আয়নাতে সে দেখল হিরে।।
কেটে গেল বছরগুলো
খেলতে খেলা ভালোবাসার
কলকাত্তা শহর ঢুঁড়ে
জুটাল বর অনেক আশার।।
তারপরে সে বলল মিয়ায়
বরের সঙ্গে যুক্তি করে
ফিরিয়ে দেবই টাকা তোমার
পাই-পয়সার হিসেব করে।।
তাই শুধু না, বলল আরও
ধান্দা তোমার বুঝনু শালা
আর এসো না আমার বাড়ি
আসো যদি, জুতোর মালা।।
ভাবল মিয়া ধান্দা যদিই–
বুঝল সে কি যুগের পরে?
ধান্দাতে আর ভালোবাসায়
তফাত ও কি বুঝতে নারে?
বলল মেয়ে খেলার শেষে,
দেবই ফেরত, ফেরত সব,
কাঁদতে কাঁদতে বলল মিয়া,
অতীত পতিত অতীত সব।।
তারপরেতে রাঙাল চোখ
বলল, শুধব তোমার ধার
টাকাই যেন এই দুনিয়ায়
মানব-ধর্ম সারাৎসার।।
ভাবছে মিয়া একলা বসে
টাকার ঋণ তো শোধাই যায়,
যে-ঋণগুলি যায় না শোধা
থাকবে জমা বকুল ছায়।।
একটা ছিল বড়ো বকুল
গন্ধ মিষ্টি কী রমরম
কালো-চোখে চাইত মিয়া
বাইরে বৃষ্টি ঝমর-ঝম।।
বুঝল মিয়া স্বরূপটা তার
ইন্তেজারেই শেষ হল সে
হল খতম তামাম ওয়াক্ত
ফায়দা কী গো হিসেব কষে?
পয়সা-টাকা পাওনা দেনার
কিম্মত কি এই দুনিয়ায়?
বুকের মধ্যে নাই-যদি পাও
চাইলে যারে; সেই মুনিয়ায়?
রেশমি কহিল আরও শোনাও। রেশমি কী যেন ভাবিতেছিল।
ধৃতিকান্তর একবারে পার্শ্বে থাকিয়াও সেই ক্ষণে সে যেন, বহুদূরে চলিয়া গিয়াছিল। রেশমির মুখমন্ডলে কী এক অসীম বেদনার রং মাখামাখি হইয়াছিল।
ধৃতিকান্ত বুঝিতে পারিলেন না যে, এই বেদনা কাহার নিমিত্ত? ইহা কি ধৃতিকান্তর নিমিত্ত। তাহার নিজের-ই নিমিত্ত!
ধৃতিকান্ত সম্পূর্ণভাবে কোনো নারীকেই এতাবৎ বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। এইমুহূর্তে রেশমিকে তাঁহার সম্পূর্ণ অপরিচিত বলিয়া মনে হইল।
রেশমি, অন্যমনস্কতার সহিত অস্ফুটে কহিল শোনাও, শোনাও।
ইলতিমাস হলই যদি
তবে একটা গান-ই গাও
মিয়ার গানে আবেগ বেশি
কম সেখানে সুরের ভাও।।
মোড়ন, ঢোঁড়ন, সুরের লচক
আছে তবু মিয়ার গানে,
সেই গানেতেই ফুটবে বকুল
খুশবু উড়বে তাহার পানে।।
যার চোখে সে গাইল চেয়ে
জিন্দগি তামাম; তামাম শোধ
গাইল গজল দিলরুবাতে
দিল না মানে কোনোই বোধ।।
সেই যে মেয়ে, রইল চেয়ে
গাইল না সে দ্বৈত গান
একলা জীবন; একলা মরণ
জিন্দগি নয়; গোরস্থান।।
দিয়ে যাবে শেষের দিনে
আঁজলা ভরে লাজুক প্রাণ;
‘সুখে থাকো আমার প্রিয়া’
বাঁধল মিয়া শেষের গান।।
এই শায়েরি পাঠ শেষ হইবামাত্র রেশমি হঠাৎ কহিল, তুমি এবার শুয়ে পড়ো। তোমার শরীর ভালো না। আমি যাই। রাত অনেক হল।
এইপর্যন্ত বলিয়াই ধৃতিকান্তের পানে আর একবারও না-চাহিয়া, তাহার জলের পাত্র শয্যাপারে তেপায়ায় বসাইয়া, রেকাবি দ্বারা তাহা চঞ্চল হস্তে ঢাকিয়া রেশমি দ্রুতপদে ধৃতিকান্তের কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।
ধৃতিকান্ত চক্ষু হইতে চশমা নামাইলেন। নামাইয়া শয্যাপার্শ্বের তেপায়ার উপর রাখিলেন। রাখিয়া, বাতি নিভাইয়া দিলেন।
কক্ষমধ্যে অন্ধকার ধাইয়া আসিল। রাত্রি মধ্যযামে। এক্ষণে আর চন্দ্রালোক কমধ্যে প্রবেশ করিতেছে না।
বাহিরে তখনও সেই পাহারাদার তাহার বাঁশি বাজাইয়া ফিরিতেছে। বন্যপক্ষীর দূরাগত করুণ স্বরের ন্যায় সেই স্বর গভীর রাত্রির অখন্ড নিস্তব্ধতা বহুগুণ বৃদ্ধি করিয়াছে।
ধৃতিকান্ত হাঁটু মুড়িয়া, পাশ ফিরিয়া শুইলেন।
ধৃতিকান্তর মস্তিষ্কমধ্যে কে যেন, ক্ষীণস্বরে কহিল, পাহারাদার। তুমি কি পাহারা দিতেছ? কাহার ধন? এক্ষণে তুমিও ঘুমাইয়া পড়ো; যেমন ধৃতিকান্ত ঘুমাইতে যাইতেছেন।
প্রৌঢ় ধৃতিকান্ত যেন যুবক পাহারাদারকে কহিলেন, এ জীবনে যতই পাহারা দাও না কেন যাহার চুরি হইবার, যাহা হারাইবার, তাহা হারাইয়াই যায়। কোনো পাহারাদারের-ই ক্ষমতা নাই যে, সে ক্ষতি রুধিতে পারে। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে এই মিথ্যা পাহারার প্রহসন আর কেন?
ধৃতিকান্ত ভাবিতেছিলেন, তিনি নিজেও তো জীবনের দিন ও রাত্রির অনেক প্রহর পাহারাদারি করিয়াছেন। তাহাতে লাভ কিছুমাত্র হয় নাই। যাহা থাকিবার শুধু তাহামাত্রই থাকে; আর যাহা চুরি হইবার তাহা প্রহরী অতন্দ্রসজাগ থাকিলেও চুরি হয়-ই। যাহা চুরি হইবার নিমিত্ত পূর্বনির্দিষ্ট অদৃষ্ট-নির্ধারিত আছে, তাহা চুরি হইবেই।
ধৃতিকান্ত আবারও কহিলেন, নিরুচ্চারে, পাহারাদার, ও পাহারাদার! তোমার বাঁশি থামাও।
.
০৪.
অতিপ্রত্যুষে ধৃতিকান্তর নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখনও আকাশে চন্দ্র রহিয়াছে। বাহিরে কোনো আওয়াজ নাই। দুই-একটি ক্ষুদ্রপক্ষী তাঁহার কক্ষসংলগ্ন মালতীলতায় উড়িয়া বেড়াইয়া কিচ কিচ’ করিয়া চিকন গলায় ডাকাডাকি করিতেছে।
মাহমুরগঞ্জ মহল্লাটি জনবিরল ও অপেক্ষাকৃত নির্জন। গতকল্য তেওহারের দিন বলিয়াই পথ দিয়া ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কস-এর প্রতি ধাবমান জনপ্রবাহে পথ ভরিয়া ছিল।
পূর্বে এ-অঞ্চলে বহু রাজন্যবর্গের প্রকান্ড উদ্যানসংলগ্ন অট্টালিকাসমূহ ছিল। মহল্লাটি ভদ্র ও অভিজাত। যে-বাটীতে বর্তমানে ধৃতিকান্ত আছেন তাহা রেশমির মাতা নুরুন্নেসা কোনো রাজন্যর সংগীতপ্রীতির নিদর্শনস্বরূপ পাইয়াছিলেন। সেই রাজন্যর নুরুন্নেসাপ্রীতিও সংগীতি প্রীতি হইতে কম ছিল না। লোক-পরম্পরায় ধৃতিকান্ত শুনিয়াছিলেন যে, রেশমি সেই রাজন্য ও নুরুন্নেসার মিলনের-ই মধুর স্বীকৃতি। সেই কারণেই হয়তো রেশমির ব্যবহার কথোপকথন চাল-চলন রাহান-সাহান তমদুন সমস্ত কিছুতেই এক বিশেষ আভিজাত্য পরিলক্ষিত হয়।
গতযৌবনা অবস্থায় নুরুন্নেসাকে ধৃতিকান্ত প্রথম দেখিয়াছিলেন। তিনি তখনও অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর সময়েও তাঁহার রূপলাবণ্যে কিছুমাত্র ঘাটতি পড়ে নাই। সেই রাজন্যের গাত্রচর্ম কৃষ্ণ হইলেও ধৃতিকান্ত শুনিয়াছিলেন যে, তিনি নাকি অত্যন্ত রূপবান ও সুদেহী পুরুষ ছিলেন। রেশমি তাঁহার মাতার গাত্রবর্ণ পায় নাই সত্য, কিন্তু এক গাত্রচর্মের বর্ণ ব্যতীত নুরুন্নেসা এবং সেই রাজন্যর সমস্ত রূপ ও গুণ-ই রেশমির মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে বৰ্তাইয়া ছিল।
ধৃতিকান্ত মুখ-হাত ধুইয়া প্রথমেই মুরতেজার কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
রাত্রিতে নাকি তাহার সামান্য জ্বর আসিয়াছিল। এক্ষণে নাই। মুরতেজার নিকট হইতে ধৃতিকান্ত শুনিলেন যে, রাত্রিতে তিনবার আসিয়া রেশমি তাহার সেবা করিয়া গিয়াছে এবং ঔষধ সেবন করাইয়া গিয়াছে। রেশমি মাত্র কিয়ৎক্ষণ হইল মুরতেজার তত্ত্বতালাশ সম্পন্ন করিয়া গিয়া শুইয়াছে।
দাসী উঠিয়াছিল। সে ধৃতিকান্তকে সত্বর চা তৈয়ার করিয়া দিল।
ধৃতিকান্তর আজিকাল কিছুই খাইতে ইচ্ছা যায় না। কোনো খাদ্য বা পানীয়ই গলাধঃকরণ করিতে পারেন না। কোনো কিছুই আর পরিপাক করিবার ক্ষমতা নাই। যাহা তিনি কাহাকেও কহেন নাই তাহা এই যে, ইদানীং ঔষধের ক্যাপসুল যে-অবস্থায় তিনি সেবন করেন, ঠিক সেই অবস্থাতেই মলের সহিত তাহা নির্গত হয়। তাহার পরিপাক যন্ত্রের ক্ষমতা এতই সীমিত হইয়া পড়িয়াছে যে, ঔষধের বহিরাবরণটি গলাইবার শক্তিও সে-যন্ত্রের আর নাই। এই কারণেই ধৃতিকান্ত ইদানীং ঔষধ সেবনও বন্ধ করিয়া দিয়াছেন।
বহুবৎসরের কু-অভ্যাস বলিয়া সকালে চা লইয়া বসেন। সামান্যই পান করেন। উষ্ণ চা উদরে পৌঁছিবামাত্র উদর জ্বলিয়া যায়, যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হইয়া উঠে।
মুরতেজার নিকট হইতে রঘুনন্দনের ঠিকানা সংগ্রহ করিয়া ধৃতিকান্ত পাঞ্জাবিটি গলাইয়া লইয়া বাটীর বাহির হইয়া পড়িলেন।
রথযাত্রা চৌমহনীর পূর্বে সাইকেলরিকশা মিলিবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু অতখানি রাস্তা তাঁহার পক্ষে পদব্রজে যাওয়াও বড়োই কষ্টকর। তথাপি শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া তিনি চৌমহনী পর্যন্ত অতিধীর পদক্ষেপে আসিলেন। সাইকেলরিকশায় উঠিয়াই চালককে সর্বপ্রথম একবার বিশ্বনাথ গলির উদ্দেশে যাইতে বলিলেন।
ধৃতিকান্ত চিরদিন-ই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু কখনোও পৌত্তলিকতা বা কোনো বিশেষ ধর্মে বিশ্বাস করেন নাই। বারাণসীতে এতবার আসিয়াছেন তবুও কদাপি বিশ্বনাথজিকে দর্শন করেন নাই। আজিও তিনি বিশ্বনাথজিকে দর্শন করিবার নিমিত্ত যাইতেছেন না।
জীবনে নিজ বুদ্ধি-বিচার ও মতানুসারে যেইদিন হইতে চলিতে আরম্ভ করিয়াছেন সেইদিনের পর কোনো মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করেন নাই। তথাপি যখন-ই চিত্তে অশান্তি বোধ করিয়াছেন অথবা কাহারও নিমিত্ত কিছু প্রার্থনা করিবার প্রয়োজন হইয়াছে, কোনো মন্দির বা মসজিদ বা গির্জার চত্বরে অথবা কোনো নির্জন স্থানে একাকী নিশ্ৰুপে বসিয়া থাকিয়াছেন। পুণ্যার্থী বহুলোকের মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া দেবালয়ের নিকটস্থ স্নিগ্ধ সুগন্ধি ও সৌম্য শান্তিতেই তাঁহার বক্ষ ভরিয়া উঠিয়াছে। উহাপেক্ষা অধিক পুণ্যর প্রত্যাশা তিনি কখনোই করেন নাই।
গতরাত্রে অকস্মাৎ রেশমি তাঁহার কক্ষ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাওয়ার পর হইতেই তিনি রেশমির কারণে এক নীরব অব্যক্ত কষ্ট বোধ করিতেছেন।
ঘুমের মধ্যেও বোধ করি সেই কষ্ট তাঁহাকে মথিত করিয়াছে।
অদ্য রেশমিকে দিতে পারেন, এমন কিছুই তাঁহার নাই। রেশমি তাঁহাকে নিকটে রাখিতে চাহিয়াছিল। চাহিয়াছিল যে, ধৃতিকান্তর জীবনের যে-সময়টুকু অবশিষ্ট আছে তাহা রেশমিকেই তিনি দান করেন। রেশমিকে–ঠিক যেমন করিয়া সে চাহে–তেমন করিয়াই শুধু তাহাকেই তিনি ভালোবাসেন।
ধৃতিকান্ত নিজে রেশমিকে জানাইতে চাহেন নাই যে, তাঁহার সময় আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে। এ জীবনে অন্য একজনকে যেমন করিয়া ভালোবাসিয়াছেন তেমন করিয়া আর কাহাকেও ভালোবাসিবার সম্ভাবনা ও উপায় নাই। ভালোবাসার বিচার নিক্তিতে কখনোই হওয়া সম্ভব নহে। জীবনের প্রতিটি সম্পর্কই অন্য সম্পর্ক হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এক সম্পর্কের সহিত অন্য সম্পর্কের কোনো তুলনা হয় না। তুলনা করার চেষ্টাও বাতুলতা মাত্র। তথাপি যে ভালোবাসে এবং যে ব্যক্তি সেই ভালোবাসার পাত্র হয়, একমাত্র তাহারা দুইজনেই জানে যে, সেই সম্পর্কের গভীরতা কতখানি–সেই সম্পর্কের শিকড় তাহাদের নিজ নিজ মনোজগতের কতখানি গভীরে প্রোথিত হইয়াছে।
ধৃতিকান্তর বড়োই দুর্ভাগ্য যে, অন্যজনকে যাহা দিয়াছিলেন তাহা বুঝিবার বা এমনকী তাহার মূল্যায়ন করিবার ন্যায় মানসিক ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত ঈশ্বর সেই নারীকে দেন নাই, তাহাকে দেন নাই। সকলের মনের কাঠামো এক নহে। তাহার মনোমন্দিরে ধৃতিকান্তর প্রেমের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা সেই নারীর পক্ষে সম্ভব হয় নাই। হয়তো ইহা ঈশ্বরের কারসাজি। যাহাকে হৃদয়ের সর্বস্ব দিয়া এ জনমের ন্যায় নিঃস্ব হইয়াছেন, সে এই দানের কদর করিল না। এইকথা ভাবিয়া তিনি আশ্চর্য হন যে– এমনকী সেই দানের গভীরতা বুঝিবার ক্ষমতা পর্যন্ত বিধাতা তাহাকে দিলেন না। অথচ সেই দান যে, পাইলে মস্তকে ধারণ করিয়া রাখিত, সেই-ই বুঝিল সেই দানের মহিমা–অথচ তাহাকেই বঞ্চনা করিয়া যে, সেই প্রাপ্তির যোগ্য নহে সেই নারীকেই ধৃতিকান্ত সর্বোচ্চ সম্মান দিলেন।
জীবনের অক্ষের ছকে চাল একবার চালা হইয়া গেলে তাহা বোধ হয় আর ফেরত হয় না। কেহ সঠিক চাল দিয়া যাহা চাহিয়াছিল তাহা পায়; কেহ বা পায় না। এবং যাহা পায় সেই প্রাপ্তিকে যে, চালিত চাল ফেরত লইয়া মহিমান্বিত ও সম্পূর্ণ করিবে তাহারও আর কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকে না।
এক্ষণে প্রৌঢ়ত্বের শেষসীমায় পৌঁছাইয়া ধৃতিকান্ত অনেক বুঝেন। তাঁহার বুদ্ধি এখন অনেক পরিপক্ক। কিন্তু যৌবনের খেলায় সদম্ভ নির্বুদ্ধিতার সহিত যে-ভুল করিয়াছেন তাহার প্রায়শ্চিত্ত প্রৌঢ়ত্বের সমস্ত বুদ্ধি একত্র করিয়াও আর করিতে পারা যায় না।
চবুতরায় যেইরূপভাবে কবুতর ধান্য খুঁটিয়া খায়, ধৃতিকান্তর মনে হয় প্রত্যেক মনুষ্যও জীবনের এই চিরায়ত চবুতরায় সেইরূপভাবেই খুঁটিয়া খাইয়া বাঁচিয়া থাকে।
যে যেরূপ ভাগ্য লইয়া আসে–যাহার অদৃষ্টে যেরূপ লিখন; সেইরূপ ধান্যই তাহার জোটে।
কেহ ঘৃণায় খুঁটিয়া খায়; কেহ বা প্রেমে। কেহ কৃতজ্ঞতায় খুঁটিয়া খায় কেহ বা অকৃতজ্ঞতায়। খাইতে-খাইতে লোভী পক্ষীর ন্যায় কেহ ডানা ঝাঁপটায়, চক্ষুদ্বারা অন্য ভাগীদারকে অন্যায় আঘাত করে। কেহ-বা অভিমানভরে সরিয়া আসিয়া জীবনের সস্তা সহজ-দীন প্রতিযোগিতা হইতে নিজেকে দূরে রাখিয়া অভুক্তই থাকে।
এই চবুতরায় স্থান বড়ো অকুলান।
এইকথা এতদিনে সার বুঝিয়াছেন ধৃতিকান্ত যে, এ চবুতরায় কর্কশ, চিৎকৃত, স্কুল-নিম্নরুচি পক্ষীরাই পেট ভরিয়া খায়। যাহারা অভিমানভরে সম্মান লইয়া সরিয়া থাকে, তাহারা অভুক্ত থাকিতে থাকিতে একদিন শুকাইয়া মরিয়া যায়। ধৃতিকান্তর মনে হয় যে, এই সত্য জীবনের তাবৎ শারীরিক মানসিকক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
সরিয়া থাকিতে থাকিতে একদিন সেই সংখ্যালঘিষ্ঠ পক্ষীর দল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে বলিয়াই তাঁহার ধারণা। এক্ষণে ধৃতিকান্তর এমত বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে–সেই অভিমানী পক্ষীকুলের নিশ্চিহ্ন-প্রায় অস্তিত্বর শেষ প্রতিভূদিগের মধ্যে বুঝি তিনিও একজন।
ইদানীং যুবক-যুবতীরা তাঁহার সহিত কথোপকথনকে সময়ের অপব্যবহার বলিয়া মনে করে যে, শুধু তাহাই নহে, তাঁহাকে এবং তাঁহার সমবয়স্ক সকলকেই তাহারা এড়াইয়া চলে। যদি তাহা না চলিত তাহা হইলে ধৃতিকান্ত তাহাদের ডাকিয়া কহিতেন যে, পরমভ্রান্তিতেও কখনোও অভিমানী হইও না।
কিন্তু যৌবনের দম্ভে ও নির্বুদ্ধি উচ্চমন্যতায় মনুষ্যমাত্রই যে-ভুল করিয়া থাকে, সেই ভ্রান্তির মাশুল স্বীয়-স্বীয় জীবনের দিনান্ত বেলায় আসিয়া তাহাদের দিতেই হয়। ধৃতিকান্তর প্রপিতামহ, পিতামহ, পিতা এবং ধৃতিকান্ত নিজেও সেই একই ভ্রান্তির শিকার হইয়াছেন। তাঁহার পুত্ৰ থাকিলে তাহার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিত না।
বিশ্বনাথ গলির সম্মুখে আসিয়া রিকশামধ্যে বহুক্ষণ তিনি বসিয়া রহিলেন। সেই প্রত্যুষে দোকান-পাট তখনও খোলে নাই। কিন্তু পুণ্যার্থীদের ভিড় শুরু হইয়া গিয়াছে। তিনি একবার ইচ্ছা করিলেন যে, রিকশা হইতে অবতরণ করিয়া গলিমধ্যে কিয়দূরে অগ্রসর হইবেন।
কিন্তু শরীরের অনুমতি পাইলেন না।
রিকশা ঘুরাইয়া মহল্লার নাম দেখিয়া যখন রঘুনন্দনের বাটীর রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন তখন বেশ বেলা হইয়া গিয়াছে।
রিকশায় বসিয়া-বসিয়াই ঠিকানা লক্ষ করিতে করিতে চলিলেন ধৃতিকান্ত। রিকশাওয়ালাকে কহিলেন ধীরে ধীরে চলিতে। পাছে রিকশাওয়ালা তাঁহার উদ্দেশ্য কিছুমাত্র বুঝিয়া ফেলে, সে কারণে ধৃতিকান্ত তাহাকে ঠিকানা বলিলেন না বা রঘুনন্দনের নামও বলিলেন না।
দূর হইতে বাটীটি প্রতীয়মান হইল। ঠিকানা চিনিয়া লইতে একটুও ভুল হইল না। ফটকের উপরে প্রকান্ড অক্ষরে তাহা লিখিত রহিয়াছে। রঘুনন্দনের প্রচন্ড স্কুলরুচির বিজ্ঞাপনস্বরূপ।
যেমনটি ভাবিয়াছিলেন তেমনটিই দেখিলেন। স্বর্ণমুদ্রার অকৌলীন্যর ছাপ বাটীটির সর্বাঙ্গে পরিস্ফুট। রুচি বা পরিমিতিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র চিহ্নও কোথাও নাই। বেগল-মেহনতে অর্জিত অর্থ যে, কী নিদারুণ কদর্যতার সহিত ব্যয় করা যাইতে পারে রঘুনন্দনের বিরাট অট্টালিকা তাহার প্রকৃষ্ট নিদর্শন।
যাহাই হউক ধৃতিকান্ত এইবার রিকশা ঘুরাইয়া রামপুরা অভিমুখে চলিলেন। সেই মহল্লায় তাঁহার এক পুরাতন জিগরিদোস্তের বাটী ছিল।
এই বৎসর আসিবার পর তাঁহার সহিত দেখা করা হইয়া উঠে নাই। শারীরিক সংগতি ছিল না। তিনবৎসর পূর্বেও যখন আসিয়াছিলেন তখনও নহে। তাহার পূর্বেও নহে। অর্থাৎ ধৃতিকান্ত মনে-মনে গণনা করিলেন যে, তাহার সহিত প্রায় দশবৎসরকাল দেখা হয় নাই। ছত্রপাল সিং তাহার যৌবনের মৃগয়ার দোস্ত। বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণিতে, মির্জাপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে উইণ্ডহাম ফলসের নিকট যে, স্থলে সাম্প্রতিককালে রিহাণ্ড বাঁধ এবং রেণুকোটের অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা হইয়াছে সেইসমস্ত অঞ্চলে এই বন্ধুর সহিত ধৃতিকান্ত রাইফেল স্কন্ধে চষিয়া ফেলিয়াছিলেন। এই সমস্ত অঞ্চল তাঁহাদের দুইজনের-ই নিজ-নিজ হস্তরেখার ন্যায় পরিচিত ছিল।
ছত্রপালের চরিত্রের সহিত ধৃতিকান্তর চরিত্রের একদিকে যেমন মিল ছিল, অন্যদিকে তেমন-ইঅমিল ছিল।
ছত্রপাল সেই মুষ্টিমেয় মনুষ্যদিগের মধ্যে অন্যতম, যাঁহারা পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বদলাইতে পারেন; যাঁহাদের মধ্যে সূক্ষ্মতা-স্থূলতার এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ দেখিতে পাওয়া যায় এক ভূমি-রাজত্ব থাকিতে-থাকিতেই অন্য কলকারখানার রাজত্ব স্থাপন করিবার ন্যায় দূরদৃষ্টি ছত্রপালের ছিল। বহির্জগতে তাহার রাজত্বের রূপ বদলাইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহার অন্তর্জগতের কোনোই বদল হয় নাই। ছত্রপালকে শেষবার যখন দেখেন ধৃতিকান্ত দশবৎসর পূর্বে, তখনও তাঁহাকে দিলখোলা খুশ মেজাজেই দেখিয়াছেন। যৌবনের ছত্রপালে আর সেদিনের ছত্রপালে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করেন নাই।
ছত্রপালের প্রকান্ড অথচ অত্যন্ত সুন্দর বাটীর নিকট রিকশা পৌঁছাইবার পর-ই ধৃতিকান্তর মনে দ্বিধা উপস্থিত হইল।
দশবৎসর পূর্বের ধৃতিকান্ত এবং এই প্রভাতের ধৃতিকান্ত এক ব্যক্তি নহেন। যদি ছত্রপাল চিনিতে না পারেন, যদি যথাযযাগ্য আন্তরিকতার সহিত তাঁহাকে গ্রহণ না করেন? আজ তো তিনি ভিখারি!
এই ভাব মনে উদিত হইবার পরমুহূর্তেই ধৃতিকান্ত নিজের নীচতার দরুন নিজেকে তিরস্কার করিলেন।
ফুলের কেয়ারি পার হইয়া ধৃতিকান্ত অভ্যন্তরের প্রধান দ্বারের সম্মুখে রিকশা হইতে কোনোক্রমে অবতরণ করিলেন।
একটি যুবক গ্যারাজ হইতে সাদা রঙের একখানি গাড়ি বাহির করিতেছিল। তাহার দেহের গড়ন ও মুখাবয়ব দেখিয়া ধৃতিকান্তর ধারণা হইল সে ছত্রপালের পুত্রই হইবে।
ধৃতিকান্তকে দেখিয়া ধনী পিতার উদ্ধত পুত্রর পক্ষে স্বাভাবিক রুক্ষস্বরে সে প্রশ্ন করিল, আগন্তুক কী চাহেন? এই বাটীতে কাহাকে তাঁহার প্রয়োজন?
যুবকটি শুধাইল পূর্বাহ্নে কি ছত্রপালবাবুকে সংবাদ দেওয়া আছে? না দেওয়া থাকিলে তাঁহার পক্ষে সাক্ষাৎ করা সম্ভব নয়।
ধৃতিকান্ত লজ্জিত হইয়া কহিলেন যে, পূর্বে সংবাদ পাঠাইতে পারেন নাই, তবে ছত্রপালবাবু গৃহমধ্যে থাকিলে তাঁহার নাম বলিলে হয়তো সাক্ষাৎ করিতেও বা পারেন।
যুবকটি কহিল, আপনার এ নিশ্চয়ই অনুমান। সাক্ষাৎ করিবার সময় পাইবেন কি বলা শক্ত!
ইহা বলিয়া একজন ভৃত্য মারফত সে ভিতরে সংবাদ পাঠাইল।
ধৃতিকান্ত যুবকটির ব্যবহারে দুঃখিত হইলেন না। কারণ তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, ছত্রপালের ন্যায় ব্যক্তির বাটীতে শত-শত প্রকারের উমেদার যে, পূর্বাহ্নে না বলিয়া-কহিয়া চলিয়া আসে এবং ইহাদের বিরক্ত করে তাহা সহজেই অনুমেয়। তিনি নিজে যখন ধনী ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন তখন তাঁহার নিকটও মলিনবেশ ও দীন চেহারা লইয়া বহুব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত হইয়া তাঁহার অনুচরদের বিরক্তির সঞ্চার করিতেন। আজ অর্থ নাই, প্রতিপত্তি নাই, আজ আর কেহই আসে না। নিজে আজ অর্থহীন হইয়া অর্থবান বন্ধুর বাটীতে বন্ধুপুত্রের এবংবিধ রূঢ় ব্যবহারকে তিনি নৈর্ব্যক্তিকভাবেই গ্রহণ করিলেন।
এতদিনে মূল্যহীন মিথ্যা অভিমানের খাদ তিনি ঝরাইয়াছেন, ঝরাইতে পারিয়াছেন বলিয়া যারপরনাই আনন্দিত বোধ করিলেন।
ইতিমধ্যে সংবাদ পাইয়া ভৃত্যের সহিত ছত্রপাল স্বয়ং দৌড়াইয়া বাহিরে আসিলেন এবং বন্ধুকে বক্ষে জড়াইয়া ধরিয়াই তাহার শারীরিক অবস্থা বুঝিতে পারিলেন। অপেক্ষমান সাইকেলরিকশা দেখিয়া তাঁহার আর্থিক অবস্থাও বুঝিতে তাঁহার একমুহূর্তও বিলম্ব হইল না।
তৎক্ষণাৎ পুত্রকে ডাকিয়া পরিচয় করাইয়া দিলেন। ভৃত্যকে কহিলেন ভাড়া দিয়া রিকশাওয়ালাকে বিদায় করিতে।
ছত্রপালের পুত্র করজোড়ে তাঁহাকে নমস্কার জানাইল। ধৃতিকান্তর পরিচয় পাইয়া তাহার মুখের রুক্ষভাব কিঞ্চিৎ নম্র হইল। কিন্তু কোনোরূপ বাড়াবাড়ি রকমের ভক্তি দেখাইল না, সে পিতৃবন্ধুকে।
ধৃতিকান্তর বড়োই ভালো লাগিল ছত্রপালের পুত্রকে, যে, যাহাকে-তাহাকে পদস্পর্শ করিয়া প্রণাম করে না, অহেতুক শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখায় না।
ধৃতিকান্ত ছত্রপালের সহিত অন্দরে যাইতে যাইতে ভাবিলেন যে, বিবাহ করিলে এবং যথাসময়ে বিবাহ করিলে তাঁহারও হয়তো এই যুবকটির ন্যায় একটি পুত্র থাকিতে পারিত।
ছত্রপালের পুত্রের নাম যশপাল। তাহাকে ধৃতিকান্তর ভালো লাগিল এই কারণে যে, সে উদ্ধত ও স্বাধীনচেতা প্রকৃতির। ধৃতিকান্তর প্রকৃতিও যৌবনে অবিকল এই রূপই ছিল। নিজের বিচার-বিবেচনায় যাহাকে ভক্তি করিতে ইচ্ছা করিত–করিতেন, নচেৎ অন্য কাহারও বাক্যে, এমনকি স্বীয় পিতার বাক্যেও যাহা তিনি নিজ-বিবেচনায় না করিতে চাহিতেন তাহা করেন নাই।
ছত্রপাল চিৎকার করিয়া স্ত্রীকে ডাকিলেন। হুলস্থুল কান্ড বাধাইয়া দিলেন।
ধৃতিকান্তর স্কন্ধে সজোরে চপেটাঘাত করিয়া কহিলেন, এতদিন আসিসনি কেন? দোস্ত নেহি, তু শালে দুশমন হো।
চপেটাঘাত, যে-স্কন্ধে গতরাত্রে রঘুনন্দনের যষ্টি পড়িয়াছিল, সেই বাম স্কন্ধে পতিত হইবামাত্র অস্ফুটে আওয়াজ করিয়া ধৃতিকান্ত গালিচাপোরি পতিত হইলেন।
ধৃতিকান্তর শরীরের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অবস্থা যে, নিতান্তই শোচনীয় তাহা ছত্রপাল বুঝিতে পারিলেন।
ছত্রপাল ইতিমধ্যে বহুপ্রকার খাদ্যের ফরমাশ করিয়া দিয়াছিলেন, যাহা-যাহা তাহারা খাইতে ভালোবাসিতেন, যৌবনে। যাহা-হা করিতে ভালোবাসিতেন, তাহার সব-ই এক নিঃশ্বাসে বলিয়া ফেলিয়াছিলেন তিনি। কহিয়াছিলেন, আরে দোস্ত আয়া ঘরপর, আভভি সিরিফ আরাম দো-চার মাহিনা কমসে কম, ডাঁটকে খানা কমসে কম দো-চার বোত্তল হুইস্কি, কমসেকম ওর দো-চার তওয়ায়েফকা গানা–রেশমি কমসেকম।
রেশমিকে ছত্রপাল জানিতেন। ধৃতিকান্ত ও ছত্রপাল সেই এক-ই মৃগয়ায় ছিলেন, সেই রাজন্য বন্ধুর বাংলোয়। কিন্তু ছত্রপালের রেশমি ও ধৃতিকান্তর সম্পর্কের গভীরতা সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না।
ধৃতিকান্ত অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ করিতেছিলেন। কহিলেন, দোস্ত তুমসে ম্যায় জারা একেলা মিলনে চাহতা হুঁ! কুছ বাতে হ্যায়।
জরুর জরুর বে-ফিককর। বলিয়াই, ছত্রপাল সকলকে করতালি নির্দেশে কক্ষ হইতে বাহিরে যাইতে নির্দেশ করিলেন। উহারা নিষ্ক্রান্ত হইবামাত্র স্বহস্তে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন।
ছত্রপালের পুত্র কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবার সময়, ধৃতিকান্তর মুখপানে এমন-ই দৃষ্টিতে তাকাইল যে, ধৃতিকান্তর বুঝিতে ভ্রম হইল না যে, যশপাল ভাবিতেছে যে, এই দুঃস্থ পিতৃবন্ধু পুরাতন দোস্তির সূত্র ধরিয়া কিঞ্চিৎ অর্থসাহায্য লইবার আশায় আসিয়াছে।
ধৃতিকান্ত এক্ষণে ভাবিলেন, তিনি বিবাহ করেন নাই উত্তম হইয়াছে। তাঁহার যদি যশপালের ন্যায় একটি পুত্র থাকিত, তাহা হইলে সে-ও তো তাঁহার কোনো আবাল্য-বন্ধুকে এমন-ই তাচ্ছিল্যের চক্ষে দেখিত। তাঁহার কেহই যে নাই, পুত্র-কন্যা কিছুই নাই একথা বিবেচনা করিয়া আশ্বস্ত হইলেন।
ছত্রপালকে সব বলিলেন ধৃতিকান্ত। আদ্যোপান্ত। তাঁহার নিজের শারীরিক অসহায়তায় কথা এবং রেশমির অপমানের কথা।
সর্বশেষে কহিলেন, ভাই তোকে একটা রিভলবার বা পিস্তল জোগাড় করে দিতে হবে আমায়। অন্তত একদিনের জন্যে। আমার যা ছিল, কিছুই আর নেই। যৌবনে তো অনেক-ই শিকার করেছি। এখন শেষজীবনের শেষ শুয়োর মেরে শিকারের খতিয়ান বন্ধ করব।
ছত্রপাল কহিলেন, তুই তো বললি রঘুনন্দনকে বলেছিলি রেশমির কাছে এনে ক্ষমা চাওয়াবি। তারজন্যে ওকে জানে মারবার কী দরকার? জানে মারলে বাড়াবাড়ি হবে। আমি তোর কথা ভেবেই, তারপরে ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা তোর ওপর বদলা নিতে পারে বলেই বলছি।
ধৃতিকান্ত ক্লান্তকণ্ঠে কহিলেন, আমার কী-আর বাকি আছে যে, বদলা নেবে? নিলে তো এই প্রাণটাই নেবে? প্রাণের অবস্থা তো দেখছিস? যেকোনো মুহূর্তে এমনিতেই নিভে যাবে, তা রঘুনন্দন নিতে চাইলে নিক না। রেশমির বে-ইজ্জতির প্রতিকারের জন্যে যদি যায়, তো যাক এই ফালতু প্রাণ। ক্ষতি দেখি না তাতে কোনো।
ছত্রপাল কহিলেন, তোর শরীরের যা অবস্থা, তুই হাঁটতে পর্যন্ত পারছিস না–তুই কি করে কী করবি? কত শিকার আমরা একসঙ্গে করেছি। তুই এই শুয়োরটাকে আমার হাতে ছেড়ে দে। তোর পেয়ারের রেশমিকে অপমান করেছে, শালাকে আমি শিখলিয়ে দেব। রঘুনন্দন ভূমিহার আর আমি ক্ষত্রী। ক্ষত্রীর বাচ্চাকে চেনেনি এখনও।
ধৃতিকান্ত বাধা দিয়া কহিলেন, না তুই সংসারী লোক, তোকে এরমধ্যে একেবারেই জড়াব না। আমার কোনো পিছুটান নেই; কিছুমাত্র হারাবার ভয় নেই, তাই যা করার আমি একাই করব।
একাই করবি? বলিয়া ছত্রপাল কিয়ৎক্ষণ কী ভাবিলেন।
পুরুষমানুষ হিসাবে, যে অপমানিত হইয়াছে বা যাহার প্রিয়জন অপমানিত হইয়াছে, বদলা যে তাহার নিজেরই লওয়া দরকার এই ন্যায্য কথাটাই অন্য পুরুষ হইয়া তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইল না।
কিন্তু তিনি বলিলেন, যো-ভি-হো, ওকে শিক্ষা দেওয়ার সব বন্দোবস্ত আমি করে দেব। তুই নিজেই শিক্ষা দিবি। কিন্তু প্রাণে মারা চলবে না। আমার সামনে তোকে কোতোয়ালির পুলিশে খুনের দায়ে ধরে নিয়ে যাবে, তা হতে দেব না।
তাহার পর কী ভাবিয়া কহিলেন, এই ব্যাপারটা আমার ওপরই ছেড়ে দে। আমাকে সাতটা দিন সময় দিস। আমি ব্যাটার খাল-খরিয়াত রাহান-সাহান সব খোঁজ করে নিই আগে। তারপর তোকে জানাব। রেশমির অপমান, আমারও অপমান। এ-ব্যাপারে তুই নিশ্চিন্ত থাক। আমি জবান দিচ্ছি।
এমন সময় বন্ধ দুয়ারে করাঘাতের শব্দ হইল।
ছত্রপাল ধৃতিকান্তর মুখপানে তাকাইয়া কহিলেন, তোর ভাবি।
তাহার পর অনুমতি চাহিয়া কহিল, খুলি?
ধৃতিকান্ত মস্তক হেলাইয়া সম্মতি জানাইলেন।
ছত্রপাল উঠিয়া দ্বার খুলিলেন।
ভাবি দাসীর হস্তে নানারূপ খাদ্যদ্রব্যাদি সাজাইয়া আনিয়া দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াইয়া ছিলেন।
কহিলেন, দুই বন্ধুতে মিলে কোন হুরি-পরির আলোচনা হচ্ছিল দরজা বন্ধ করে শুনি?
ধৃতিকান্ত কহিলেন, যার ঘরে এমন পরি, তার চোখে কি অন্য কোনো হুরি-পরি লাগে?
ভাবি ছত্রপালের প্রতি অপাঙ্গে একবার তাকাইয়া বলিলেন, পুরুষমানুষের জাতকে বিশ্বাস নেই। আপনারাই-না বলেন যে, ঘরকা-মুরগি ডাল বরাবর।
তওবা-তওবা–বলিয়া ধৃতিকান্ত দুই কর্ণ দুই হস্তে চাপা দিলেন।
বলিলেন, ভাবিযে-ধৃতিকান্ত খেতে ভালোবাসত, সে এ-লোক নয়।
আমার ওয়াক্ত শেষ। মরার আগে আপনাকে একবার দেখে গেলাম। মরার সময় যেন, আপনার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতে পারি।
ভাবি খিলখিল শব্দে হাসিয়া উঠিলেন।
তাঁহার সুন্দর মুখশ্রী হাসিতে সুন্দরতর হইল।
কহিলেন, পুরুষমানুষমাত্রই মিথ্যেবাদী। তবে আপনি মিথ্যে কথাগুলো এমন সুন্দর করে বলেন যে, বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
এই কথায় তিনজন-ই বহুক্ষণ ধরিয়া হাসিতে লাগিলেন।
ধৃতিকান্তর শরীরে আর শক্তি ছিল না। মাহমুরগঞ্জ গিয়া কখন নিজকক্ষে শুইয়া পড়িবেন সেকথাই ভাবিতেছিলেন।
কিয়ৎক্ষণ গল্পগুজব করিয়া ছত্রপাল নিজে স্বপুত্র ধৃতিকান্তকে পৌঁছাইবার নিমিত্ত বাহির হইলেন।
যশপাল গাড়ি চালাইতেছিল। দুই বন্ধুতে পশ্চাতে বসিয়াছিলেন।
যশপাল অত্যন্ত বেগে বেপরোয়াভাবে এবং ঝুঁকি লইয়া বিভিন্ন যানবাহন ও পদাতিকের স্রোতমধ্যে গাড়ি চালাইতেছিল।
ছত্রপাল তাহাকে মৃদু তিরস্কার করিয়া ধীরে গাড়ি চালাইতে কহিলেন। যৌবনে যে, বাহাদুরি-প্রবণতা সকলের মধ্যেই দৃশ্যমান হয় যশপালের মধ্যে তাহাই ধৃতিকান্ত দেখিতে পাইলেন।
ছত্রপালের কথা শুনিবামাত্র যশপাল সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাইয়া দিয়া পিতাকে কহিল, তোমার পছন্দ না হলে তুমি চালাও গাড়ি।
ছত্রপাল পুত্রের মুখপানে বারেক তাকাইয়া বলিলেন, ঠিক আছে, আমিই চালাব।
তাহার পর কহিলেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি, আমার ইচ্ছামতোই সব কিছু চলবে। আমার গাড়ি, আমার ব্যবসা, সব কিছুই।
যশপাল নৈর্ব্যক্তিক উত্তেজনাহীন স্বরে কহিল, তোমার ইচ্ছামতো নিশ্চয়ই তোমার গাড়ি চলবে। সেটাই ন্যায্য। আমিও তাই চাই। কিন্তু আমি যখন আমার নিজের গাড়ি চালাব, তখন তুমিও আমার ইচ্ছাকে মেনে নেবে। তোমার নিজের মতামত আমার ওপর জোর করে চাপাবে না। কখনোই এক ড্রাইভারের গাড়ি চালানো অন্য ড্রাইভারের পছন্দ হতে পারে না। হয় না। এটা যেন মনে রেখো।
ছত্রপাল ধৃতিকান্তের মুখপানে তাকাইয়া কহিলেন, আজীব লেড়কা।
তাহার পর স্বগতোক্তির ন্যায় কহিলেন, দুনিয়া কিতনা বদল হো যা রহি হ্যায়।
ধৃতিকান্ত হাসিয়া ঘটনাটা লঘু করিলেন।
বলিলেন, যশপাল তো অন্যায্য কিছু বলেনি। খুব-ই ন্যায্য কথা।
যশপাল বাম পার্শ্বে সরিয়া যাইবামাত্র ছত্রপাল চালকের আসন গ্রহণ করিলেন।
এক্ষণে ছত্রপাল গাড়ি চালাইতেছিলেন।
ধৃতিকান্ত আবারও ভাবিলেন, তাঁহার পুত্র না থাকিয়া ভালোই হইয়াছে। থাকিলে, সে যৌবনের ধৃতিকান্তর ন্যায় একরোখা ও স্বাধীনতাপ্রিয় হইত। এবং তাহা হইলে ধৃতিকান্তর সহিত তাহার প্রচন্ড মতবিরোধ যে, হইত তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই।
যশপালের মধ্যে ধৃতিকান্ত তাঁহার যৌবনের মূর্তি দেখিতে পাইলেন। যশপালের ন্যায় স্বাধীন ও স্বীয় তীব্র মতামতের কারণে পিতাকে তিনি মানেন নাই, স্বেচ্ছায় পৈতৃক সম্পত্তির কোনো অংশই গ্রহণ করেন নাই। পৈতৃক সম্পত্তি যে, গ্রহণ করেন নাই তাহাতে তাঁহার আত্মাভিমান অক্ষুণ্ণ রহিয়া ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু যতদিন তাঁহার পিতা জীবিত ছিলেন, ততদিন সেই বৃদ্ধ এ-কারণে বড়োই মর্মপীড়া বোধ করিয়াছিলেন। ধৃতিকান্তর অনুমান সত্য কী নহে–তাহা আজ আর জানিবার উপায় নাই। এক্ষণে ধৃতিকান্ত তাঁহার পিতার তৎকালীন বয়সে ও মানসিকতায় পৌঁছাইয়া তাঁহার পরলোকগত পিতার নিমিত্ত দুঃখ বোধ করেন। বর্তমানে তাঁহার পিতা জীবিত থাকিলে ধৃতিকান্তর কারণে যেসব দুঃখ তিনি পাইয়াছিলেন, সেই দুঃখ মুছাইবার চেষ্টা ধৃতিকান্ত অবশ্যই করিতেন। যদিও নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিমতো কোনো অন্যায়-ই তিনি তাঁহার পিতার প্রতি করেন নাই। ইহা অন্যায়ের প্রশ্ন নহে, ন্যায়েরও নহে। ভুল বুঝাবুঝির প্রশ্ন, আত্মাভিমানের প্রশ্ন।
কিন্তু এক্ষণে আর কিছুমাত্রই করিবার নাই।
এ সংসারে অনেক অন্যায় ঘটে ও ঘটানো হয়। একে অন্যের উপর অনেক অবিচার করেন। কিন্তু সময় থাকিতে কেহই স্ব-স্ব অভিমান ত্যাগ করিয়া সেই অন্যায় স্বীকার করিতে বা মকুব করিতে পারেন না। যখন তাহা স্বীকার বা মকুব করিবার ন্যায় মানসিক অবস্থায় পৌঁছানো যায়, তখন প্রায়শই দেখা যায় যে, একপক্ষ অপর পক্ষের নিমিত্ত আর অপেক্ষা করিয়া বসিয়া নাই।
ধৃতিকান্ত ভাবিলেন, জীবন বড়ো জটিল ও বক্র। ইহামধ্যে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম টপ্পার কাজের ন্যায় এতই খোঁজ-খাঁজ যে, উহা টানাটানি করিয়া সমান্তরাল করিতে করিতে জীবন-ই ফুরাইয়া যায়।
ধৃতিকান্তর বোধ হইল যে, দুঃখের বিষয় ইহাই যে, একজীবনে, সমস্ত জীবনের ঠেকিয়া, ধাক্কা খাইয়া কাঁদিয়া-কাটিয়া যাহা কিছু শিখা যায়, সেইসব দুঃখময় অভিজ্ঞতা হইতে যে, শিক্ষালব্ধ জ্ঞান সঞ্চিত হইয়া উঠে, তাহা পরবর্তী জীবনে কোনো উপকারেই লাগানো যায় না। সমস্ত ভুলিয়া বসিয়া স্লেট মুছিয়া পুনরায় নূতন করিযা জমাটবদ্ধ অন্ধকার অজ্ঞানতা হইতে জ্ঞানের ‘অ, আ, ক, খ’ দিয়া পুনরায় আরম্ভ করিতে হয়।
মাহমুরগঞ্জে পৌঁছাইয়া ছত্রপাল কহিলেন আজ আর নামব না রে। অফিসের তাড়া আছে। একদিন অফিস ফেরত আসব।
যশপাল সঙ্গে থাকায় ছত্রপাল রেশমির নামও উচ্চারণ পর্যন্ত করিলেন না।
ধৃতিকান্ত মনে মনে দুঃখিত হইলেন।
মুখে কহিলেন, আচ্ছা, তাই আসিস।
ছত্রপালের গাড়ি ধুলা উড়াইয়া চলিয়া গেল।
পাশাপাশি আসনাসীন দুই বিবদমান প্রজন্মর দুই প্রতীক পিতা ও পুত্রকে গাড়ির কাঁচের মধ্য দিয়া পশ্চাৎ হইতে দেখিয়া বহুকাল পূর্বের ধৃতিকান্তর নিজের যৌবনবয়সের মূর্তি ও তাহার পরলোকগত পিতার মুখাবয়ব হঠাৎ-ই চক্ষের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল।
ধৃতিকান্তর চক্ষুদ্বয় অকস্মাৎ জ্বালা করিয়া উঠিল।
হয়তো গাড়ির চাকায় উড্ডীন পথের ধুলা চক্ষুমধ্যে প্রবেশ করিয়া থাকিবে।