গযনীর তুফান
দিল্লী থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় দুশ মাইল দূরে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী একটি শহরের নাম কনৌজ। সুলতান মাহমুদের শাসনামলে কনৌজ ছিল একটি শক্তিশালী হিন্দুরাজ্যের রাজধানী। ওখানকার মহারাজা ছিল রাজ্যপাল। উত্তর হিন্দুস্তানে কনৌজের রাজকুমারদের অনেক কদর ছিল।
দিল্লী থেকে আশি মাইল দূরে যমুনা নদীর তীরবর্তী মাথুরা ছিল হিন্দুদের একটি মহাতীর্থস্থান। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্ব থেকে মাথুরা হিন্দুদের একটি তীর্থস্থান। হিন্দুদের কৃষ্ণ মহারাজ নাকি মাথুরাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আজো পর্যন্ত মাথুরায় প্রতিবছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর সমাবেশ ঘটে। তীর্থযাত্রীরা ওখানে গিয়ে পূজা-অর্চনা করে তাদের ভাষায় পাপের স্খলন ঘটায়।
মাথুরায় একটি কেন্দ্রীয় মন্দির ছাড়াও ছোট বড় আরো কয়েকটি মন্দির ছিল। এসব মন্দির শক্ত পাথরের গাঁথুনী দিয়ে তৈরী। এসব মন্দিরের ছিল বহু গোপন কক্ষ। এ মন্দিরের ভেতরের চোরাগলিতে হারিয়ে গেলে অজানা কারো পক্ষে বেরিয়ে আসা সহজ ব্যাপার ছিলো না।
মাথুরা শহরের চারপাশ ছিল শক্ত দেয়ালে ঘেরা। শহরের ভেতরে একটি মজবুত দুর্গ ছিল। মাথুরা কোন স্বাধীন রাজ্য ছিল না। মাথুরার নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল কনৌজের মহারাজা এবং পার্শ্ববর্তী মহাবন রাজ্যের রাজার উপর।
মহাবন রাজ্যের রাজার নাম ছিল কুলচন্দ্র। এরা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী আরো কয়েক রাজ্যের মহারাজারা মাথুরার নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের কিছু সেনাসদস্যকে এখানে নিয়োগ করেছিল।
মাথুরার নিকটবর্তী রাজ্য মহাবন ছিল একটি জঙ্গলাকীর্ণ রাজ্য। রাজধানীর নাম ছিল মহাবন। মহাবনের অবস্থান ছিল মাথুরা থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে যমুনা নদীর তীরে।
সুলতান মাহমূদের সময় এই রাজ্য ছিল খুবই শক্তিশালী ও বিত্তশালী। কিন্তু সুলতান মাহমূদ এসব রাজ্যের রাজাদের কাছে দানবের মতোই আতঙ্কে পরিণত হয়েছিলেন। সুলতান ইতোমধ্যে থানেশ্বর পর্যন্ত দখল করে সেখানে নিজস্ব সেনা চৌকি স্থাপন করেছিলেন। পাঞ্জাবের মহারাজা ভীমপাল মুখোমুখী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুলতানের সাথে মৈত্রীচুক্তি করেছিলেন। ছোট ছোট রাজ্যের রাজা ও রায়বাহাদুররা তো সুলতানের নাম শুনলেই ভয়ে কাঁপতো।
১০১৭ সালে সুলতান মাহমূদ যখন খাওয়ারিজমকে গযনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেন, তখন মাথুরাতে চলছিল বাৎসরিক তীর্থ উৎসব ও পুণ্যার্থী সমাবেশ। সে বছর মাগুরায় এতো বিপুল পুণ্যার্থীর সমাবেশ ঘটেছিল যে, মনে হচ্ছিল সারা ভারতের সকল হিন্দুই যেন মাথুরায় এসে জমায়েত হয়েছিল।
শহরের প্রধান মন্দির এবং যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ তীরবর্তী এলাকায় সমবেত মানুষদের মনে হচ্ছিল যেন পিপড়ার চাক। পিঁপড়ার মতোই গোটা শহর এবং যমুনা তীরে লোকজন গিজ গিজ করছিল। হাজার হাজার নারী-পুরুষের পদভারে প্রকম্পিত ছিল মাথুরা নগরী।
শহরের কোন জায়গা খালি ছিল না। শহরের বাইরেও কয়েক মাইল পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের তাঁবু আর তাঁবু। দূরবর্তী এলাকা এমনকি বনবাদারের ধারে-পাশে রঙিন বাহারী তাঁবুগুলো ছিল রাজা-মহারাজাদের পরিবার পরিজনের। কোন হিন্দু রাজা-মহারাজা এ বছরের মাথুরা গমন থেকে বিরত থাকেননি।
রাজা-মহারাজাদের তাঁবুগুলোর পাশেই ছিল তাদের নিরাপত্তাকাজে নিয়োজিত সৈন্য-সামন্তদের তাঁবু। তাদের সাথে জঙ্গী হাতি ও ঘোড়াও ছিল। রাজা-মহারাজারাও যমুনার পুণ্যস্নান এবং মাথুরার প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন।
সবচেয়ে বেশী বাহারী এবং বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরী হয়েছিলো কনৌজের মহারাজা রাজ্যপাল এবং পাঞ্জাবের মহারাজা ভীমপালের তাঁবু। তাদের তাঁবুতে কেউ গিয়ে বলার অবকাশ ছিল না, এগুলো সাময়িক তৈরী বরং এসব তাঁবুর রাজকীয় গঠনশৈলী এবং জাঁকজমকে মনে হতো কোন রাজপ্রাসাদ। রাজকীয় তাঁবুগুলো নানা রঙের ফানুস, রেশমী কাপড়ের পর্দা ও ঝালরে সাজানো।
রাজা মহারাজাদের রাণী এবং তাদের রক্ষিতা সেবিকা দাসদাসীরাও তাদের সাথে ছিল। ছিল নাচ গান আমোদ ফুর্তির জন্য বাদক ও নর্তকী দল। কিন্তু মাথুরার প্রধান পুরোহিত ও পণ্ডিতদের হাভভাব দেখে কারো পক্ষেই নাচ গানের মতো আমোদ ফুর্তির আসর গরম করা সম্ভব হলো না। অন্যান্য বছর কয়েক সপ্তাহব্যাপী এখানে মেলা বসতো। প্রতি রাতেই বসতো নাচগানের আসর। সাধারণ মানুষেরাও নাচ গানের আসর জমাতো।
রাজা-মহারাজাদের উদ্যোগে নাচ গানের পাল্লা হতো। কিন্তু এবারের হাজার হাজার মানুষের এই সমাবেশে কোন আনন্দ-ফুর্তির আমেজ ছিলো না। কেমন যেন উদাস উদাস ভাব, সবার মধ্যেই এক ধরনের চাপা বেদনার সুর। এক ধরনের যাতনার অভিব্যক্তি সবার চেহারায়।
তীর্থযাত্রী হিন্দুদের এই হতাশা ক্ষোভের মূল কারণ ছিলেন সুলতান মাহমূদ। সুলতান মাহমূদ ছিলেন হিন্দুদের জন্য জীবন্ত আতঙ্ক, ঘৃণা আর ত্রাসের নাম। মাথুরার প্রত্যেক পুরোহিতের কণ্ঠে ছিল এমন আওয়াজ
“বিষ্ণুদেব আর কৃষ্ণদেবীর অভিশাপ থেকে তোমরা কেউ রেহাই পাবে । দেবদেবীদের অপমান অপদস্থ করিয়ে তোমরা কি করে জীবন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছো? কি করে তোমরা রাতের বেলায় নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো এবং পেটপুরে আহার করতে পারো? যে পর্যন্ত তোমরা গযনীর প্রতিটি ইট খুলে না নেবে আর মাহমুদ গযনবীর তাজা রক্ত দিয়ে কৃষ্ণমাতার পা ধুইয়ে না দেবে, তততদিন পর্যন্ত তোমরা দেব-দেবীদের অভিশাপ থেকে রেহাই পাবে না। এখন গঙ্গাজল ও যমুনা জলও তোমাদের পাপ ধুইয়ে সাফ করতে পারবে না।”
পুরোহিতের এ ধরনের আতঙ্কজনক কথাবার্তার কারণে পূজারীরা সরাসরি কৃষ্ণমূর্তির চোখের দিকে তাকাতেও ভয় পেতো। পূজারীরা যখন মূর্তির পায়ে মাথা রেখে পূজা-অর্চনা করতো, তখন বিগলিত চিত্তে তাদের দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতো। মন্দিরের শাখাধ্বনি ও ঘন্টাগুলোর আওয়াজও যেন উদাস হয়ে পড়েছিল। এগুলোর মধ্যে পূজারীরা অনুভব করতো এক ধরনের হতাশার সুর।
ছোট শিশু-সন্তানের মায়েরা তাদের শিশুদেরকে দেবদেবীদের অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য দেবদেবীদের পায়ে তাদের পরিধেয় অলঙ্কারাদি খুলে নজরানা দিতো। প্রত্যেকটি সামর্থবান পুরুষ পূজারী মূর্তিদের সামনে হাতজোড় করে শপথ করছিল, যে করেই হোক তারা মূর্তির অসম্মান ও দেবদেবীদের অমর্যাদার প্রতিশোধ নেবে। অনেকেই চিৎকার করে বলতো, এখন মাহমুদ হিন্দুস্তানে এলে আর তাকে ফিরে যেতে দেবো না।
কনৌজের রাজা রাজ্যপাল যখন পূজা করার জন্য কৃষ্ণমূর্তির সামনে গেলেন, তখন তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী জগন্নাথও সঙ্গে ছিল । জগন্নাথ ছিল শক্ত-সুঠাম-দীর্ঘদেহী সুদর্শন যুবক। তার চেহারা-ছবিতে যৌবনের দীপ্তি প্রস্ফুটিত ছিল। তার মুচকি হাসিতে দুর্নিবার আকর্ষণ এবং তার চাহনী ছিল জাদুময়।
জগন্নাথ ছিল আক্ষরিক অর্থেই একজন দক্ষ ক্ষণজন্মা যোদ্ধা। তরবারী চালনায় ও তীরন্দাজিতে তার পারদর্শিতা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। কনৌজের মহারাজার কাছে জগন্নাথের প্রায় দু’বছর হয়ে গেছে। প্রথম দর্শনেই জগন্নাথ মহারাজার হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছিলো।
একবার এক জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় কনৌজের মহারাজা হরিণ শিকার করতে এসেছিলেন। মহারাজা একটি হরিণকে তাক করে তীর ছুঁড়লে তীর ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগেই হরিণ স্থান ত্যাগ করে। এ সময় হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলো জগন্নাথ।
মহারাজার নিরাপত্তারক্ষীরা হরিণটিকে স্থানচ্যুত করার জন্য তাকে গালমন্দ করেই ক্ষান্ত হলো না, রীতিমতো হুমকি-ধমকিও দিলো। জগন্নাথ মুচকি হেসে মহারাজাকে বললো, আমি যদি দুরন্ত হরিণকে তীরবিদ্ধ করতে না পারি, তাহলে আপনি আমার ঘোড়া নিয়ে নেবেন এবং আমাকে পাহাড়ের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেন।
সবাই জানে, হরিণ যখন দৌড়াতে থাকে, তখন এতো দ্রুত ও দীর্ঘ লাফ দেয় যে, মনে হয় হরিণটি যেনো বাতাসে উড়ছে। একটি চলন্ত হরিণের একেকটি লাফের পরিধি হয় অন্তত পঁচিশ-ত্রিশ গজ এবং মাটি থেকে সাত/আট হাত উপড়ে উঠে যায় হরিণ।
মহারাজা জগন্নাথের কথায় মজা করার জন্য তার নিজেরে ধনুক এবং একটি মাত্র তীর দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আবার কোন হরিণ আমাদের নজরে এলে আমরা সেটিকে তাড়িয়ে দেবো, তখন তুমি সেটি শিকার করবে। তুমি যদি এক তীরে হরিণটি শিকার করতে ব্যর্থ হও, তাহলে কিন্তু আমরা তোমার ঘোড়া ঠিকই ছিনিয়ে নেবো।
তাদের বেশী দূর যেতে হলো না। হঠাৎ এক জায়গায় সাত-আটটি হরিণ পেয়ে গেলেন তারা। মহারাজার নির্দেশে তার লোকেরা হৈ চৈ করলে হরিণ দৌড়ে পালাতে লাগল। পলায়নপর হরিণের পেছনে জগন্নাথ ঘোড়া ছোটালো। তার পেছনে মহারাজাও ঘোড়া ছোটালেন। ছুটন্ত হরিণ যেন বাতাসে ভর করে উড়তে লাগল।
জগন্নাথ তার ঘোড়ার বাগ দাতে কামড়ে ধরল এবং ধনুক সামনে নিয়ে তাতে তীর ভরে নিক্ষেপ করল। একটি ছুটন্ত হরিণ মাটি স্পর্শ করে আর লাফ দিতে পারলো না। একটু উপরে লাফ দিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আর সঙ্গী হরিণগুলো দৌড়ে পালিয়ে গেল। ততক্ষণে জগন্নাথের ঘোড়াও আহত হরিণের পাশে এসে দাঁড়াল। উড়ন্ত হরিণের শিরদাঁড়ায় জগন্নাথের ছোঁড়া তীর বিদ্ধ হওয়ায় হরিণটি আর লাফ দিতে সক্ষম হলো না। অতঃপর মহারাজা রাজ্যপালও তার কাছে পৌঁছে গেলেন।
আমি বিজিরায়ের সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলাম মহারাজ। নিজের পরিচয় দিতে রাজ্যপালের উদ্দেশে বললো জগন্নাথ। বিজিরায় সুলতান মাহমূদের মোকাবেলায় এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করলেন যে, তার অর্ধেক সেনা মারা গেলো আর বাকী অর্ধেক মাহমুদের কাছে বন্দী হয়ে গেল। এতে আমার মন বিষাদে ভরে গেলো। আমি সেখান থেকে লাহোর চলে এলাম।
কিন্তু এখানকার সৈন্যরাও সুলতানের কাছে পরাজিত হলো। বর্তমানে লাহোরের রাজা সুলতান মাহমূদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ । আমি একজন সৈনিক। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডার ছিলাম।
আমি এখন কোন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। আমি শুনেছি, কনৌজের রাজপুতদের আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আজ আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্যই আমি এই জঙ্গলে প্রবেশ করেছিলাম।
মহারাজা তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝতে পারলেন, এই সুদর্শন যুবক শুধু তীর-তরবারীতেই পারদর্শী নয়, তার মাথায় বুদ্ধিও আছে। সে যেমন মেধাবী, তেমনই দূরদর্শী। মহারাজা জগন্নাথের বুদ্ধিমত্তা ও সামরিক পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে জগন্নাথকে তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
জগন্নাথ ছিলো গোড়া হিন্দুবাদী। সে মাহমুদ গযনবী ও অন্যান্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় গালমন্দ করতো এবং চরম শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলার ব্যাপারে সে ছিলো একজন তুখোড় বক্তা। বর্তমানে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের যেমন একান্ত রাজনৈতিক উপদেষ্টা থাকে, জগন্নাথকেও কনৌজের মহারাজা রাজ্যপাল তার একান্ত উপদেষ্টার পদে আসীন করেছিলেন।
মহারাজা জগন্নাথের জন্য বিশেষ ধরনের চমকদার পোশাক তৈরী করালেন। মহারাজা যখন দরবারে আসীন হতেন, তখন জগন্নাথ মহারাজার পেছনে পূর্ণ রাজকীয় জাঁকজমক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, তার হাতে থাকতো স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া বর্শা। মহারাজা যেখানে যেতেন, জগন্নাথ তার সাথে থাকতো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, জগন্নাথ মহারাজের আভিজাত্যের অংশে পরিণত হলো।
রাজ্যপালের ছিলো তিন রাণী। রাণীদের নিরাপত্তার দায়িত্বও ছিল জগন্নাথের উপর ।
কোন রাণী কোথাও গেলে জগন্নাথ ঘোড়ায় চড়ে রাণীর পিছু পিছু যেতো। রাণীমহলেও জগন্নাথ ছিলো রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক।
.
মহরাজা রাজ্যপাল মাথুরার প্রধান মন্দিরে পূজার জন্য প্রবেশ করলেন। তার পিছু পিছু জগন্নাথও পূজামণ্ডপে প্রবেশ করল। মহারাজা মর্মর পাথরের তৈরী কৃষ্ণমূর্তির পায়ে মাথা রেখে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত প্রার্থনা করছিলেন আর শপথ করছিলেন তিনি মাহমুদ গযনবীর কর্তিত মস্তক এই মন্দিরে দেবীর পদতলে এনে রাখবেন। তখন পেছন থেকে মূর্তির প্রতি করজোড় নিবেদন করে জগন্নাথ বললো, আর আমি দেবীর শপথ করছি, যদি মাহমুদকে এখানে না আনতে পারি, তাহলে নিজের মাথা নিজেই দেবীর চরণে বলিদান করবো।
জগন্নাথের কথা শুনে চকিতে পেছন ফিরে মহারাজা জগন্নাথকে দেখলেন। জগন্নাথ দুচোখ বন্ধ করে হাতজোড় করে ভজন আওড়াচ্ছিল। এমতাবস্থায় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তাদের সামনে দিয়ে সুগন্ধি লোবানের তশতরীতে রাখা ধূপের পাত্র ঘুরিয়ে নিল। মহারাজা ধূপের পাত্র থেকে লোবানের ভষ্ম নিয়ে কপালে লাগাল। মহারাজা গলা থেকে অত্যন্ত উচ্চে মূল্যের হারটি খুলে মূর্তির পায়ে রেখে দিলেন।
মহারাজ! শ্রীকৃষ্ণের এই অচ্যুত হীরে-মোতির দরকার নেই, কৃষ্ণদেবীর প্রয়োজন তাজা টাটকা চমকানো রাঙা রক্ত। ভারতমাতা তার সুপুত্রদের কাছ থেকে তাজা খুন প্রত্যাশা করে। ভারতমাতার সম্ভ্রমহানী ও বেইজ্জতির জন্য মহারাজাদের উচিত ছিল জগত-সংসার ত্যাগ করে বনবাসী হয়ে যাওয়া।
অবশ্যই আমরা এর প্রতিশোধ নেব। বললেন মহারাজা। মাহমুদ গযনবীর কর্তিত মস্তক এই মন্দিরের সদর দরজায় ঝুলন্ত দেখা যাবে। বললেন মহারাজা রাজ্যপাল।
* * *
দিনের বেলা মাথুরার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীতে তীর্থযাত্রী স্নানকারীদের এতোটাই ভিড় ছিল যে, কোথাও এক বিঘত ফাঁকও ছিলো না। ফলে মহিলাদেরকে অনেকটা দূরে গিয়ে গঙ্গাস্নানের পর্ব সারতে হতো। তীর্থযাত্রীদের মাথুরাগমন ও পূজা উদযাপনের অন্যতম একটি অংশ ছিল গঙ্গাস্নান। আজো হিন্দুদের ধর্মমতে গঙ্গা ও যমুনা নদী সকল পাপ ধুয়ে মুছে তীর্থযাত্রীদের পবিত্র করে দেয়। অনেক হিন্দু পুণ্যার্থী নাভী সমান গঙ্গাজলে নেমে পূজা-অর্চনার নানা মন্ত্র জপ করে।
এ বছরে রাজা-মহারাজাদের রাণীগণ এবং তাদের একান্ত রক্ষীতারা সাধারণ প্রজানারীদের সাথে দিনের বেলায় গঙ্গাস্নানে অংশগ্রহণকে অবমাননাকর মনে করে তারা রাতের বেলায় নিরিবিলি গঙ্গাস্নানের পর্ব সেরে নিতো।
এক সন্ধ্যায় কনৌজের মহারাজা রাজ্যপালের কনিষ্ঠা স্ত্রী চম্পাকলি মহারাজাকে বললেন, তিনি আজ সন্ধ্যায় গঙ্গাস্নান করতে আগ্রহী। পুণ্যকাজে মহারাজা তাকে বারণ করতে পারেন না। তাই তিনি জগন্নাথকে বললেন, সে যেনো আজ রাত কিছুটা গম্ভীর হলে ছোট রাণী চম্পাকলিকে গঙ্গাস্নানের জন্য যমুনায় নিয়ে যায়। বড় দুই রানীকে জগন্নাথ একরাত আগেই গঙ্গাস্নান করিয়ে এনেছে। বড় দুই রাণীকে নিয়ে জগন্নাথ যমুনা তীরে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। রাণীদ্বয় স্নান শেষ করে এলে তাদের নিয়ে জগন্নাথ তাঁবুতে ফিরে আসে।
চম্পা বড় দুই রাণীর সাথে যায়নি। সে যুবতী ও সুন্দরী। অপর দুই রাণী বয়স্কা। মহারাজ তাদেরও সাথে এনেছিলেন। কারণ, তারা উভয়েই ছিলেন তার সন্তানের মা। মহারাজার উপর চম্পার প্রভাব ছিল বেশী। অন্য দুই রাণী এজন্য চম্পার প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিল।
এ ঘটনার প্রায় দু’বছর আগে কোন এক ব্যবসায়ীর উপঢৌকন হিসেবে। চম্পা মহারাজার কাছে আসে। চম্পা কোন কুলীন ঘরের কন্যা ছিল না। কিন্তু বংশগতভাবে সে ছিল সুন্দরের অধিকারিণী। বংশে সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল চম্পাকলি।
মহারাজার এক জায়গীরদারের নজর পড়েছিল চম্পার প্রতি। সে চম্পাকে পাওয়ার জন্য চম্পার বাবাকে বিপুল অর্থসম্পদ উপঢৌকন দিয়ে চম্পাকে স্ত্রী হিসেবে রাখার অঙ্গীকার করে হাতিয়ে নেয়। জায়গীরদার রীতিমতো শাদীর উৎসব আয়োজনও সম্পন্ন করে।
কিন্তু সবশেষে সে চম্পাকে কনৌজ নিয়ে গিয়ে মহারাজাকে উপঢৌকন হিসেবে পেশ করে। মহারাজা চম্পাকে দেখে রাজপ্রাসাদে রক্ষিতা হিসেবে রাখার পরিবর্তে প্রথা অনুযায়ী চম্পাকে বিয়ে করে ফেলেন। মহারাজার বয়স তখন পঞ্চাশেরও বেশী। আর চম্পার বয়স মাত্র সতেরো-আঠারো।
অস্বাভাবিক সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী চম্পা প্রথম দিন থেকেই অর্ধবয়স্ক রাজার হৃদয়রাজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। আর আগের রাণীদ্বয় প্রাসাদে পুরনো আসবাবপত্রের মতোই শুধু শোভা বর্ধনের পর্যায়ে উপনীত হলেন।
.
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হতেই চম্পাকলি তাদের প্রাসাদোসম রাজকীয় তাঁবু থেকে বের হলো। তার সাথে ছিল একজন একান্ত সেবিকা। জগন্নাথ চম্পার জন্য বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল। চম্পা তাঁবু থেকে বেরিয়ে সেবিকাকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে যেতে থাকলে জগন্নাথ তাদের অনুসরণ করলো। তারা যেতে যেতে মাথুরার চারপাশে সাময়িকভাবে তৈরী হাজারো তাঁবু এলাকা পেরিয়ে গঙ্গা নদীর সেই স্থানে এসে পৌঁছল, যেখানে চম্পাকলির গঙ্গাস্নান করার করা।
এই জায়গাটি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ। এখানটায় কোন জনমানুষের সমাগম ছিলো না। চম্পাকলি তার একান্ত সেবিকাকে বললো, তুমি ওখানে চলে যাও, যেখানে সাধারণ প্রজাদের কন্যা-জায়া-বধূরা স্নান করে। জগন্নাথ নদীর পানি থেকে কিছুটা দূরেই থেমে গেল ।
সেবিকা অন্ধকারে দূরে চলে গেল। চম্পাও স্নানের উদ্দেশ্যে পানির দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু সে স্নান না সেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো ।
“এদিকে এসো জগন! আমার সেবিকা চলে গেছে। ওকে আমি দেরী করে আসতে বলেছি।” জগন্নাথকে ডেকে বলল চম্পা।
চম্পার ডাকে জগন্নাথ তার পাশে এগিয়ে গেল। জায়গাটি ছিল ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তদুপরি ঝোঁপঝাড়ে ভরা। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছিল এক শ্মশানের চিতায় কোন হিন্দুর মরদেহ সৎকারের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তার সামনে দিয়ে নদীর বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল দুটি নৌকা। নৌকাগুলোকে মনে হচ্ছিল জ্বলন্ত মশাল যেনো পানির উপর সাঁতার কেটে এগুচ্ছে। চম্পা জগন্নাথকে দুর্বাঘাসের উপর বসিয়ে নিজের মাথা জগন্নাথের উরুতে রেখে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
“জগন! তুমি পাশে না থাকলে আমি এই রাজাকে হয় বিষ খাওয়াতাম, নয়তো নিজেই বিষ পান করতাম। জগন্নাথের আঙুলে বিলি কেটে চম্পা বলল। কিন্তু আমি দেখছি, রাজাকে তুমি এতোটাই ভালোবাসো যে, তুমি কোন অবস্থাতেই তাকে ছাড়তে চাও না।
এই রাজমহল আর তার রাজার চাকরীই কি তোমার কাছে জীবনের সবচেয়ে প্রিয়? কিন্তু আমার কাছে এই রাজপ্রাসাদ, এই রাজকীয়তা, রাণীর বেশ একেবারেই পানসে, অসহ্য। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে আমি জগতের মানুষকে দেখিয়ে দিতাম, জীবনের কাছে এসব রাজপ্রাসাদ-রাজকীয়তা নেহায়েতই তুচ্ছ। তুমি সাথে থাকলে আমি বনবাসেও থাকতে রাজি। মাটির ডেড়াও আমার কাছে এই প্রাণস্পন্দনহীন প্রাসাদের চেয়ে উত্তম।
আচ্ছা জগন! তুমি এই বন্দিশালা থেকে কেন বের হও না? তুমি কেননা আমাকে এই প্রাসাদের ঘেরাও থেকে মুক্ত বাতাসে নিয়ে যাও না? কতো দিন পর্যন্ত আমরা এভাবে চুরি চুপকি করে মিলিত হবো?”
“একথা তো তুমি আমাকে শতবার বলেছে। আর আমি প্রতিবারই তোমাকে বলেছি, একটু ধৈর্য ধরো, সুযোগের অপেক্ষা করো; সময়-সুযোগ হলে আমি ঠিকই তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবো। চম্পাকলির চেহারায় আলতোভাবে হাত বোলাতে বোলাতে বললো জগন্নাথ।
আজ আবারো আমি তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এসব আবেগ বেশীক্ষণ থাকে না। আজ যদি তুমি আমার হাত ধরে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাও, তবে কদিন পরেই তুমি আবার এই প্রাসাদ ত্যাগের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠবে। জানো, পৃথিবীতে আমার দুহাত জমিনও নেই। আমার হাতে কোন অর্থকড়িও নেই। বলতে গেলে আমার অবস্থা অনেকটা অপরাধীর মতো। এমতাবস্থায় আমাকে যেখানেই পাকড়াও করা হবে, সেখানেই হত্যা করা হবে।’
তুমি তো ভেরা থেকে এসেছে, সেখানে মুসলিম শাসন চলছে। আমরা যদি পালিয়ে ওখানে চলে যাই আর সেখানে গিয়ে মুসলমান হয়ে যাই, তাহলে মুসলমানরা কি আমাদের ঠাই দেবে না?
আমার এখন ধর্মের প্রতিও বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। বলে উঠে বসতে বসতে চম্পাকলি বললো, জানো আমি ইচ্ছা করলে যে কোন মুহূর্তে মহারাজাকে বিষ পান করাতে পারি। মরে গেলে তুমি আমাকে নিয়ে চলে যাবে। রাজা মরে গেলে আমাদের আর পাকড়াও করার কে থাকবে?
ওই যে চিতায় আগুন দেখতে পাচ্ছো, দূরের শ্মশানে মরদেহ পোড়ানোর আগুনের দিকে ইশারা করে চম্পাকে জগন্নাথ বললো, মহারাজা মারা গেলে তোমাকে চিতার আগুনে পুড়ে সতীদাহ হতে হবে। তোমাকে জীবন্ত মহারাজের চিতায় তুলে দেয়া হবে। আমার উপর বিশ্বাস রাখো চম্পা, আমি তোমাকে ধোকা দেবো না।’
তুমি তো ভেরাতে গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাই না? আচ্ছা, ওরা কি খুব বেশী শক্তিশালী আমাদের রাজপুতরা তাদের পরাজিত করতে পারছে না কেন?’
“হ্যাঁ, গযনীর সৈন্যরা খুবই শক্তিশালী। মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা যতো কম থাকে, তাদের শক্তি ততোই বেশী থাকে। মুসলমান সৈন্যরা মহারাজা ভীমপালের হাঁটু ভেঙ্গে দিয়েছে। এখন তার কাছ থেকে খিরাজ নিচ্ছে।
কাশ্মীরে পরাজিত হয়ে ফেরার সময় সুলতান মাহমূদের হাতে সৈন্য খুব কম ছিল এবং সবাই ছিল আহত । কিন্তু এসব মুষ্টিমেয় আহত সৈন্য মহারাজ ভীমপালের এলাকা দিয়ে অতিক্রম করার সময়ও অধমৃত এই সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে সুলতান মাহমূদসহ তাদের বন্দী করার সাহস হয়নি ভীমপাল মহারাজার।
জগন্নাথ, তুমি তো ধর্মের খুবই ভক্ত। যদি কিছু মনে না করো, তাহলে আমি আজ তোমাকে দু’টি কথা বলতে চাই। জগন্নাথের কোমর পেঁচিয়ে ধরে বললো চম্পাকলি। দেখো জগন! পুরোহিতরা আমাদেরকে দেবদেবীদের অভিশারে ভয় দেখায়। তারা বলে, মুসলমানরা আমাদের যেসব দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে দিয়ে5ে, যেসব মন্দির মিসমার করে দিয়েছে, সেইসব আমাদের অভিশাপ দেবে।…
কিন্তু এতোটা সময় পেরিয়ে গেলো, আমি তো কোথাও দেবদেবীদের অভিশাপ পড়ার কথা শুনলাম না। বরং আমি তো দেখছি গযনী বাহিনী আমাদের উপর অভিশাপ হয়ে আসছে।
আমি শুনেছি, মুসলমানরা এমন প্রভুর ইবাদত করে, যিনি নিরাকার, কেউ তাকে দেখতে পায় না। আমার তো মনে হয় সেই খোদা-ই হয়তো সত্য খোদা। আমরা ছোটকাল থেকে থানেশ্বরের বিষ্ণুদেব সম্পর্কে শুনেছি, যারা বিষ্ণুদেবের পূজা করে, তারা কখনো পরাজিত হয় না। কিন্তু গযনী সুলতানের আক্রমণ থেকে সেই বিষ্ণুদেবকেও কেউ রক্ষা করতে পারলো না। পূজারীদেরও বাঁচাতে পারলো না কেউ।
দেবতা নিজেও পারল না নিজেকে রক্ষা করতে। তুমি কি এসব দেবদেবীকে বিশ্বাস করে পূজা করো।
“তুমি জীবনবিমুখ হয়ে বিষিয়ে উঠেছে। ফলে ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। এজন্য ধর্ম সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বলছো চম্পা। চম্পার রেশমী চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো জগন্নাথ। ধর্ম সম্পর্কে তোমার মনে যা ইচ্ছা বলো, কিন্তু আমার ভালোবাসায় সন্দেহ পোষণ করো না।“
“তোমার প্রতি আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। তুমি প্রেমের প্রশ্নে আমাকে যতো কঠিন পরীক্ষায়ই করো না কেন, আমি ঠিকই শতভাগ উতরে যাবো। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে আমি কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি নই।’ জগন্নাথকে বললো চম্পা।
ইত্যবসরে সেবিকা গলা খাকারী দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিল। চম্পা রাণী বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। জগন্নাথ তার জায়গায় বসে রইল। কিছুক্ষণ পর রাণী জগন্নাথকে ডাকার উদ্দেশ্যে রাণীদের ব্যবহার্য বিশেষ « আওয়াজ দিল এবং সেবিকাকে নিয়ে আগে আগে হাঁটতে শুরু করল।
* * *
পরদিন মহারাজা রাজ্যপাল জগন্নাথকে ডেকে বললেন, জগন্নাথ, আজ তোমার ছুটি। তুমি স্বাধীনভাবে যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারো।
জগন্নাথ মহারাজার অনুমতি নিয়ে রাজকীয় পোশাক পরিধান করে কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
মাথুরা জুড়ে লাখো মানুষের সমাগম। চতুর্দিকেই মানুষ আর মানুষ। গোটা মাথুরা এলাকা যেনো এক বিশাল মেলায় পরিণত হলো। উৎসব উপলক্ষে জায়গায় জায়গায় গনক, জ্যোতিষী ও সাধু-সন্ন্যাসীরা তাদের মজমা বসিয়ে মানুষদের গোল লাগিয়ে লাগল। অনেক জায়গায় কবিয়ালরা গানের আসর জমালো, নর্তকীরা নাচের আসর জমালো, কেউ বা শারীরিক নানা কসরত খেলা দেখিয়ে দর্শক শ্রোতা ও আগত লোকদের মাতিয়ে রাখল।
লোকজন জ্যোতিষী ও গণকদের কাছে তাদের হাত দেখিয়ে তাদের ভাগ্য জানার চেষ্টা করছিল। সাধুরা মজমা জমিয়ে পুণ্যার্থীদের প্রসাদ বিতরণ করছিল। জগন্নাথ প্রতিটি মজমাতে একটু উঁকি দিয়ে ঘটনা আঁচ করে আবার অন্যখানে উঁকি দিচ্ছিল।
যেতে যেতে সে একটি গাছের নিচে দু’ সাধু সন্তুকে বসা দেখল। তাদের শুধু আব্রুটুকু ঢাকা আর সারা শরীর উলঙ্গ। গা জুড়ে ধূপ ভষ্মের প্রলেপ। মাথায় দীর্ঘ চুল। চুলগুলো ছাই-ভষ্মে জটাধা। তাদের দীর্ঘ দাড়িও জটাধা। জটাধারী এই সাধু সস্তুদের ঘিরে বহু লোকের মজমা।
জগন্নাথ এই মজমায় গিয়ে উঁকি দিল। সে ভেতরের অবস্থা দেখা ও বোঝার জন্য দাঁড়াতেই এক লোক সাধুদের জিজ্ঞেস করল
সাধুবাবা! আমাদেরকে ওই দুরাচার ম্লেচ্চাদের কথা কিছু বলুন, যারা পাহাড়ের ওপাশ থেকে এসে আমাদের মন্দিরগুলোকে ধ্বংস করে চলে যায়?”
“মুসলমানরা…….। এরা লোভী। সম্পদের লোভেই এরা ভারতে আসে। তাই এরা আমাদের মন্দিরের সম্পদ লুট করে চলে যায়। এরা আমাদের কোন দেবদেবীকে ভয় করে না। ওরা জানে না, মহাভারতে বাসুদেব ও বিষ্ণুদেবের যে ক্রোধের কথা বলা হয়েছে তা সত্য।
দেবদেবীর ক্রোধ অবশ্যই মুসলমানদের উপর পড়ছে যদিও এখন তা আমাদের উপর পড়ছে। গযনীর বাদশা মাহমুদ খুবই জালেম ও আগ্রাসী। সে যেদিকে অভিযান চালায়, বানের পানির মতো আসতে থাকে, তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না, জঙ্গীহাতিও পালিয়ে যায়। নদীর তীব্র স্রোতও তার পথ। রুখতে পারে না। পাহাড়ও তার অগ্রাভিযান থামাতে পারে না।
এই সন্ন্যাসী মুসলমানদের বদনাম করছিল। কিন্তু মুসলমানদের সম্পর্কে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছিল। এই সন্ন্যাসী তীর্থযাত্রীদেরকে গযনী বাহিনীর এমন কিছু ভয়াবহ অভিযানের কথা বললো, যা শুনে আতঙ্কে শ্রোতাদের চোখ উল্টে যাওয়ার অবস্থা হলো।
জগন্নাথ নীরবে দাঁড়িয়ে সবকিছুই শুনছিল। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে জগন্নাথের উপর সন্ন্যাসীর চোখ পড়লে হঠাৎ ক্ষণিকের জন্যে সন্ন্যাসীর যবান বন্ধ হয়ে গেলো এবং কালবিলম্ব না করেই আবার সন্ন্যাসীর কথা চলতে থাকল।
এক পর্যায়ে সন্ন্যাসী দেবদেবীদের ক্রোধ থেকে বাঁচার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করল। কিছুক্ষণ পর জগন্নাথ ওখান থেকে সরে গেল।
ঘুরতে ঘুরতে একটি পুরনো মন্দিরের সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াল জগন্নাথ। সেখানে দাঁড়িয়ে সেই দুই সন্ন্যাসীকে জগন্নাথ আসতে দেখতে পেলো। তাদের দেখেও জগন্নাথ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল। এই মন্দিরটি ছিল পরিত্যাক্ত। এর কিছু অংশ ভগ্নতূপে পরিণত হলো। হঠাৎ সে শুনতে পেল ‘তাশ!’
ডাক শুনেও সে থামল না এবং পেছনে ফিরেও দেখলো না, আবার সে শুনতে পেল, ‘তাশ! তাশকীন!’
একমনে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল জগন্নাথ। উভয় সন্ন্যাসী তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে বললো, আরে আমীর বিন তাশকীন!’ এবার দাঁড়াল জগন্নাথ এবং তার চেহারায় ক্ষোভের অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো।
“আরে এখানে কেউ শুনতে পাবে না। ভয় করো না।’ বললো দুই সন্ন্যাসী।
জগন্নাথরূপী তাশকীন সন্ন্যাসী হিশাম সমরকন্দীর কানে কানে বললো, ‘হিশাম সমরকন্দী! কেউ না শুনলেও আমার নাম ধরে ডাকা তোমাদের উচিত হয়নি। তোমরা নির্বোধ হয়ে গেলে নাকি? এখানে বসো। আমি আমার হাত দেখাচ্ছি।‘
আমার হাত ধরে দেখতে থাকবে এবং কথা বলতে থাকবে। তোমরা দুজন ছাড়া এখানে আরো কি কেউ আছে?”
“আরো দু’জন আছে। জবাব দিল সন্ন্যাসীরূপী হিশাম। ওরাও কায়সের মতোই মুশরেফ তথা গোয়েন্দা। তারাও সন্ন্যাসীরূপেই অবস্থান করছে।
বহির্দিশে গোয়েন্দাকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে গযনী সালতানাতে মুশরেফ’ বলে ডাকা হতো। সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দা বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা স্থানীয় লোকদেরও তাদের পক্ষে চর নিয়োগ করতে এবং তাদেরকে বিপুল আর্থিক ভাতা দিতো।
সন্ন্যাসীরূপী এই দুজনের নেতা ছিল গযনীর গোয়েন্দা বিভাগের অন্যতম কর্মকর্তা হিশাম সমরকন্দী। মাথুরায় ভারতের বিপুলসংখ্যক হিন্দু সমাবেশ ঘটতে যাওয়ার খবর শুনে তাকে মুলতান থেকে মাথুরায় পাঠানো হয়। সে স্থানীয় লোকদের সাথে নিয়ে সন্ন্যাসীরূপে তীর্থযাত্রী হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানদের সম্পর্কে আরো আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে লাগল।
হিশামের সঙ্গী সন্ন্যাসীরূপী অপর গোয়েন্দা ছিল মুলতানের অধিবাসী কায়েস। তারা দুজন ছাড়াও আরো দু’জন মুলতানী মাথুরায় তৎপর ছিল। তারা হিন্দু সমাবেশের কোথাও ছদ্মবেশ ধারণ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।
হিশাম ভিড়ের মধ্যে জগন্নাথরূপী আমীর বিন তাশকিনকে চিনে ফেলে। কারণ, তারা উভয়েই ছিল গযনীর অধিবাসী। কিন্তু কর্মসূত্রে হিন্দুস্তানে এই তাদের প্রথম সাক্ষাত। কিন্তু কায়েস তাশকীনকে চিনতো না। এরা প্রত্যেকেই স্থানীয় হিন্দুদের রীতি-রেওয়াজ ও কৃষ্টিকালচার নিপুণভাবে রপ্ত করেছিল। হিন্দু ধর্মের খুটিনাটি সম্পর্কেও তারা ছিল জ্ঞাত।
‘তোমার ঠিকানা কোথায়? তাশকীনকে জিজ্ঞেস করল হিশাম। কাজের কাজ কিছু করতে পেরেছো?
“আমি চলে যাচ্ছি। হিন্দুর বেশ ধারণ করে এখানে এসেছিলাম, এখন কাজ শেষ করে চলে যাচ্ছি।” বললো তাশকীন।
আরে! তুমি আমাদের কাছে নিজেকে আড়াল করছো কেন? হেসে বললো হিশাম। আমি তোমাকে মহারাজা কল্লৌজের সাথে দেখেছি। তুমি হয়তো তার নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। তোমাকে দেখে কিন্তু তুমি যে ধরিআমাদের তাশকীন তাতে মোটেও সন্দেহ হয়নি। তোমাকে তো আমি উস্তাদ মনে করি।”
“আমাদের তিনজনের একসঙ্গে এক জায়গায় বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না।” বললো তাশকীন। কায়স! তুমি একটু ঘোরাফেরা করো । রাতে আবার আমরা একসঙ্গে মিলিত হবো।”
কায়েসের চলে যাওয়ার পর আমের বিন তাশকীন হিশামের উদ্দেশ্যে বললো, হিশাম! তুমি তো আস্ত একটা বোকা দেখছি। তুমি স্থানীয় লোকদের উপর এতোটাই আস্থা ও বিশ্বাস রাখো যে, আমার মতো স্পর্শকাতর অবস্থানে থাকা ব্যক্তির কথাও তুমি তাকে জানিয়ে দিলে? তাকে কি তুমি গুরুত্বপূর্ণ কাজে পরীক্ষা করেছো? সে কি কোন জটিল কাজ সমাধা করেছে?
“লোকটি নির্ভরযোগ্য। অবশ্য তাকে এখনো স্পর্শকাতর কোন কাজে ব্যবহার করিনি।” বললো হিশাম।
“আল্লাহ যেনো তাকে নির্ভরযোগ্য রাখেন। বললো তাশকীন। তবে মনে রাখবে হিশাম! আমাদের কাজ খুবই স্পর্শকাতর ও জটিল। তুমি তো জানোনা এ কাজে নিজের আবেগ, উচ্ছ্বাস, অনুভূতিকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আর এই আবেগ সে-ই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যার মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমান আছে এবং যারা আমাদের মতো জাতির প্রতি দায়বদ্ধ।
হিন্দুস্তানের কোন মুসলমানের উপর এতোটা ভরসা করা যায় না। এসব লোক দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুদের যাতাকলে নিষ্পেষিত । এরা হিন্দুদের প্রভাবে খুব অল্প সময়েই প্রভাবিত হয়ে যায়। এরা হিন্দুদের কুসংস্কার ও হিন্দু কালচার খুব সহজেই গ্রহণ করে ফেলে। নিজেদের অক্ষমতা ও নানা অসুবিধার শিকার হলে এরা হিন্দুদের সন্তুষ্ট করার জন্য উদগ্রীব হয়ে যায়।
এখানকার কোন মুসলমানকে নির্ভরযোগ্য মনে হলেও আমার মতো জটিল কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের তথ্য দেয়া ঠিক নয়। কারণ, এখানকার হিন্দু শাসকরা সামান্য সন্দেহ হলেই মুসলমানদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়, তাদের নির্বিচারে হত্যা করে।
“ঠিক আছে, আমি ওকে আরো পাকাঁপোক্ত করে নেবো।’ বললো হিশাম।
হিশাম, এ লোক আমাকে কনৌজের মহারাজার সাথে দেখেছে। এখন সে আমার পরিচয়ও জেনে গেছে। সে যদি কোন কারণে হিন্দুদের হাতে ধরা পড়ে অথবা হিন্দুদের পক্ষ থেকে লোভনীয় কোন উপঢৌকনের টোপ পায়, তাহলে সে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারে। যে কোন অবস্থায় তার জন্য আমি মোটা অংকের শিকার।
একটু ভেবে দেখো! আমি কনৌজের মহারাজার একান্ত নিরাপত্তা রক্ষী। সবাই আমাকে জগন্নাথ বলেই জানে। এমতাবস্থায় আমাকে যদি কেউ স্বরূপে ধরিয়ে দিতে পারে, তাহলে মহারাজা তাকে তার দেহের ওজন পরিমাণ হীরা-জহরত উপঢৌকন দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করবে না।
‘তুমি যদি তাকে সন্দেহ করো, তাহলে আজই আমি তাকে হত্যা করে লাশ গায়েব করে ফেলবো।’ বললো হিশাম। আমি এখন আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি দুঃখিত।
‘না, সংশয়ের বশীভূত হয়ে কারো জীবনহানি ঘটানো ঠিক হবে না।’ বললো তাশকীন। এর চেয়ে বরং তার উপর কড়া দৃষ্টি রাখো এবং তাকে ঈমান ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে আরো পাকাঁপোক্ত করার চেষ্টা করো।
‘আমরা যা করছি, তা তোমার কাছে কি ভালো লেগেছে। তাশকীনের কাছে জানতে চাইলে হিশাম। এখানকার সাধারণ মানুষজনকে মন্দিরের পুরোহিত এবং পণ্ডিতরাই আতঙ্কিত করে ফেলেছিল। এর উপর আমরা আতঙ্কের মাত্রাটি আরো বাড়িয়ে দিলাম।
এখানকার লোকেরা হিন্দু সাধু-জ্যোতিষী-সন্ন্যাসী- গণকদের সর্বৈব মিথ্যা কথাগুলো সম্পূর্ণ সত্য বলে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আমরা সন্ন্যাসীরূপ ধারণ করে তাদের বোঝাচ্ছি, মাহমূদ গযনবীর কাছে জিন ভূত থাকে। এসব জিন-দানবেরা সামরিক-বেসামরিক সব ধরনের প্রতিপক্ষকে গ্রাস করে আর সামনে দুর্গ-দেয়াল-পাহাড়-পর্বত যাই থাকুক না কেন সবকিছু তছনছ করে ফেলে…।
এর ফলে এখানকার মা-বোন-স্ত্রীরা তাদের স্বামী-পুত্র ভাইদের সেনাবাহিনীতে যেতে দেবে না। তারা কিছুতেই চাইবে না, তাদের ঘর উজাড় করে আপনজনেরা বেঘোরে মুসলমানদের হাতে প্রাণ বিজর্সন দিক…। আচ্ছা তুমি ওখানে কী করছো তাশকীন?”
“কনৌজের মহারাজার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানার ও বোঝার চেষ্টা করছি।’ বললো তাশকীন। মহারাজা সুলতানের প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ। যেসব রাজা-মহারাজা গযনী বাহিনীর হাতে পরাজতি হয়েছে, তাদের খুবই গালমন্দ করে। এখানে ভারতের অধিকাংশ রাজা-মহারাজারা এসেছে। তাদের একটা বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে তারা ভবিষ্যত কর্মসুচী ঠিক করবে। তখন বোঝ যাবে, তারা কী করতে চায়?”
“সুলতানের পক্ষে এখনই কোন অভিযানে বের হওয়া সম্ভব নয় তুমি কি সেই খবর জানো তাশকীন? বললো হিশাম।
‘হ্যাঁ, খাওয়ারিজমে সুলতানের খুবই রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধ করতে হয়েছে। হিশামের অসমাপ্ত কথা পূর্ণ করে বললো তাশকীন। এসব খবর যথাসময়েই আমি পেয়েছি।
সুলতানও জানেন, লাহোরের মহারাজা ভীমপাল কনৌজের মহারাজাকে সুলতানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। আমার এখানে আসতে হয়েছে কনৌজের মহারাজার তৎপরতা জানার জন্য।
এরা কি গযনী আক্রমণ করতে চায়? না ভারতের সব রাজা মহারাজারা ঐক্যবদ্ধ সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে সুলতানকে হুমকি দিতে চায়? এরা হয়তো সম্মিলিতভাবে সেনা সমাবেশ করে সুলতানকে পরাজতি করার চেষ্টা করবে। আমার কাজ হলো এখানকার রাজা মহারাজাদের সামরিক শক্তির আন্দাজ করা এবং এরা কি সামরিক কৌশল নেয় তা জানা।”
“ও, এজন্যই হয়তো আমাদের বলা হয়েছে, মাথুরার হিন্দু সমাবেশে জনগণের মধ্যে গযনী বাহিনী সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে।”
“এখন তুমি চলে যাও। বললো তাশকীন। মনে রেখো, স্থানীয় গোয়েন্দা মুশরেকদের উপর এতোটা নির্ভরশীলতা ঠিক নয়। এদেরকে কৌশলে ব্যবহার করো।”
* * *
সে দিন সন্ধ্যায় চতুর্দিক অন্ধকার করে কাকের চোখের মতো নীল হয়ে গেল আকাশ। সেদিন মাথুরায় আগত সকল রাজা-মহারাজাদের দাওয়াত ছিল কনৌজের মহারাজার আস্তানায়।
মহারাজা কনৌজের রাজকীয় তাঁবুতে নানা বর্ণের ফানুস ও বাহারী শামিয়ানা দিয়ে সাজানো হলো। কনৌজ মহারাজার তাঁবু ছিলো বিশাল জায়গা জুড়ে। এর ভেতরে নিরাপত্তারক্ষী, রাণীদের থাকার কক্ষ, রাজার বৈঠকখানা, মহারাজার আরামের কক্ষ, সেবক সেবিকাদের থাকার কক্ষ, নর্তকী, গায়ক বাদকদলের জন্য আলাদা থাকার রুম ছিল। তবু তো নয়, যেন বিশাল ময়দান জুড়ে এক রাজমহল।
জিয়াফত অনুষ্ঠানে রাজা মহারাজাদের শরাব পান করানোর জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল সুন্দরী যুবতী ও প্রশিক্ষিত তরুণী। এরা অর্ধনগ্ন পোশাকে সজ্জিত হয়ে রাজ-মহারাজাদের আপ্যায়ন করছিল।
অধিকাংশ রাজা-মহারাজাদের সাথে ছিলো দু-তিনজন করে রাণী। অনেক রাজা-মহারাজার একান্ত নিরাপত্তারক্ষীও তাদের সাথেই ছিল। আমীর বিন তাশকীন একান্ত নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কনৌজের মহারাজার পেছনে সশস্ত্র অবস্থায় দণ্ডায়মান ছিল। খাবার-দাবার চলার সময় চম্পারাণী আড়চোখে বারকয়েক জগন্নাথরূপী আমীর বিন তাশকীনকে দেখে নিল। কিন্তু তাতে তাশকীনের কোন ভাবাবেগ ঘটলো না, সে মন্দিরের পাথুরে মূর্তির মতোই নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল।
আহারপর্ব শেষ হলে বাদ্যযন্ত্রের বাজনা শুরু হলো। বাজনার আওয়াজ যখন উচ্চাঙ্গে উঠলো, তখন মঞ্চের এক কোণ থেকে সাদা ওড়না গায়ে জড়িয়ে পায়রার মতো পাখনা মেলে নাচের মুদ্রায় দৃশ্যমান হলো এক নর্তকী।
ঠিক এই সময়ে বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠলো এক রাশভারী কণ্ঠ- “বন্ধ করো এসব পাপাচার!”
সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেলো বাদকদলের উন্মাতাল বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ আর নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গেলো নর্তকী।
সবাই অবাক চোখে দেখলো মঞ্চের মাঝখানে মাথুরার বড় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দণ্ডায়মান। ক্ষোভে তার ঠোঁট কাঁপছে। দুচোখে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। প্রধান পুরোহিতের এই অগ্নিমূর্তি দেখে রাজা-মহারাজা ও রাণীদের এই প্রমোদ মহলে নীরবতা নেমে এলো। আবারো ধ্বনিত হলো গম্ভীর কণ্ঠ “স্বঘোষিত নির্ভীক মহারাজা ভীমপাল গযনীর সুলতানের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজতি হয়ে তার সাথে অধীনতামূলক চুক্তি করেছে। তোমরা কি এর জন্য উৎসব করছো?’ ক্ষুব্ধ পুরোহিত কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বললো।
তোমরা কি দেবদেবীদের অপমানের আনন্দ-উৎসব করছো? তোমাদের ধর্মালয় মন্দিরগুলোর উপর দিয়ে মুসলমানরা তাদের জঙ্গী ঘোড়া ছুটিয়েছে। এজন্য কি তোমরা নর্তকীদের সাথে নিয়ে এসেছো?
রাজপুতদের তাজা রক্ত বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে এজন্য আনন্দ করছো তোমরা? নর্তকী নাচিয়ে কী আনন্দ করবে, তোমরা নিজেরাই পায়ে নূপুর আর হাতে চুড়ি পরে নাচো…।”
“আমাদের ক্ষমা করে দিন পণ্ডিত মহারাজ।” এক রাজা দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে বললো। আজ আমরা এই ফায়সালা করার জন্যই একত্রিত হয়েছি- গযনী বাহিনীকে কী করে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়া যায়?”
“তোমাদের সবার উপর শ্রীকৃষ্ণ ও বাসুদেবের গজব আসি আসি করছে। তোমাদের কারণেই আবারো ভারতের মাটিতে অগণিত মুহাম্মদ বিন কাসিম জন্ম নিচ্ছে। এ কারণে তোমরা দেবদেবীদের অভিশাপ থেকে রেহাই পাবে না।”
পণ্ডিতের কথা শেষ হতে না হতেই আকাশে তুমুল মেঘের গর্জন শোনা গেল। সন্ধ্যার আগ থেকেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছিল এবং চারদিকে নেমে এসেছিল ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। হালকা বিজলীও চমকাচ্ছিল। কিন্তু মেঘের তর্জন গর্জন বেড়ে দেখতে দেখতে তীব্র হয়ে উঠলো আকাশের গর্জন। এরই মধ্যে পণ্ডিত রাজা-মহারাজাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল এবং তাদেরকে সনাতন ধর্ম রক্ষায় অবহেলা ও উদাসীনতার জন্য দোষারোপ করছিল। রাজা মহারাজাদেরকে পণ্ডিত দেবদেবীদের অভিশাপের ভয় দেখাচ্ছিল।
হঠাৎ ঝুলন্ত ঝাড়বাতিগুলো খুব জোরে দুলে উঠলো এবং টাঙানো শামিয়ানার সাথে হোঁচট খেলো। শামিয়ানাগুলো উপরে উঠে গেল তীব্র বাতাসের ধাক্কায়। দেখতে দেখতে এমন তীব্র বাতাস বইতে শুরু করলো যে, তাঁবুগুলোকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে তীব্র বাতাস রূপ নিলো প্রচণ্ড ঝড়ের। ঝড়ের তাণ্ডবে জ্বলন্ত ফানুসগুলো নিচে আছড়ে পড়ল এবং চতুর্দিকে তেল ছড়িয়ে পড়ল, শামিয়ানাগুলো ছিঁড়তে শুরু করলো। জ্বলন্ত ফানুস ও জ্বলন্ত মশালের আগুনে ছিঁড়ে পড়া শামিয়ানা ও তাঁবুতে আগুন ধরে গেল। প্রচণ্ড ঝড়ের সাথে এমন তীব্র বিজলী ও কানফাটা মেঘের গর্জন ও বজ্রপাত শুরু হলো, যেনো আসমান ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
ভেঙেপড়া ফানুস এবং মশালের আগুনে ছিঁড়ে যাওয়া তাঁবুর কাপড়ে আগুন ধরে গেলে বাতাস তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিল । আগুনের ধোয়া আর তীব্র ঝড় ও ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখার উপায় ছিলো না।
এরই মধ্যে পণ্ডিতের কণ্ঠে শেষবাক্য উচ্চারিত হলো, এই দেখো বিষ্ণুদেবের অভিশাপ ঝড়ের রূপে এসে গেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ও আতঙ্কিত সকল রাজা-মহারাজা নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য যে যেদিকে পারল দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু ততক্ষণে বজ্রপাত ও বিজলীর সাথে শুরু হয়েছে ভারি বর্ষণ।
তীব্র ঝড়ের শনশন আওয়াজ, ভারি বৃষ্টি আর মেঘের গর্জনের সাথে বর্জপাতের আওয়াজ মিলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো।
অদূরে বাঁধা রাজা-মহারাজাদের হাতি ও ঘোড়াগুলো আতঙ্কিত চিৎকার ও হেষারব করতে লাগল। অবস্থা আরো গুরুতর হয়ে উঠলো। প্রবল বৃষ্টি যখন তাঁবুর জ্বলন্ত আগুন নিভিয়ে দিল এবং তুফানে ছেঁড়া-ফাটা তাঁবুর খুঁটি উড়তে শুরু করলো।
রাজা-মহারাজাদের একান্ত নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের মনিবদেরকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণবাজী রেখে সবাই দৌড়ে অকুস্থলে পৌঁছালো। এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছিল মহারাজা কনৌজের দরাজ কণ্ঠ, জগন্নাথ! যেখানেই থাকো, চম্পারাণীকে মন্দিরে নিয়ে যাও।
সেখান থেকে মন্দির ছিল অনেক দূরে। সবাই যে যার মতো করে শহরের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছিল। গোটা তাঁবু এলাকায় দৌড় ঝাঁপ শুরু হয়ে গেল।
এমতাবস্থায় তুফানের আঘাতে ঘন গাছগাছালীতে আকীর্ণ মাথুরার গাছপালগুলো ভেঙে পরতে শুরু করেছে। ভাঙা গাছের ডাল মাটিতে আঁছড়ে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। তাশকীন রাজার বলার আগেই চম্পাকে তার আয়ত্ত্বে নিয়ে এসেছিল এবং কাঁধে তুলে মন্দিরের দিকে ছুটছিল।
শহরের চতুর্দিকে আগত লাখো হিন্দু তীর্থযাত্রীর অস্থায়ী তাঁবু ছিল। অনেক লোক তাঁবু ছাড়াই খোলা আসমানের নিচে আসবাবপত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। এসব লোক তাদের আসবাবপত্র ঝড়ের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়ে জীবন বাঁচাতে ঝড়ের শুরুতেই শহরের দিকে দৌড়াতে শুরু করে দিল। শহরবাসী তীর্থযাত্রীদেরকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বরবাড়ীর দরজা খুলে দিয়েছিল। মাথুরার প্রতিটি মন্দির ছিল খোলা। মানুষজন মন্দিরেও আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছিল।
ঝড়ের তাণ্ডব তখন বেড়েই চলছে। সেই সাথে তীব্র বৃষ্টি, বিজলী আর বজ্রপাতের সাথে আহত-আতঙ্কিত মানুষের আর্তচিৎকার শুরু হয়ে গেল।
আতঙ্কিত শিশু, নারী ও আহতদের চিৎকারে গোটা মাথুরা এলাকা যেনো নরকে পরিণত হলো।
দৃশ্যত এ তুফান যেনো কেয়ামত হয়ে উঠেছিল। এই তুফানের মধ্যে হিশামের সহযোগী মুলতানের অধিবাসী কায়েস নদীর তীর থেকে শহরের দিকে আসছিল। সে ছিল একাকী। তীব্র তুফানের আওয়াজ, বিজলীর ঝলক আর মেঘের গর্জনের মধ্যে অতি নিকট থেকে তার কানে ভেসে এলো কোন নারী বা শিশুর আর্তচিৎকার।
বিজলীর আলোয় তার সামনের একটি গাছের গোড়ায় একটি নারীর মতো নজরে পড়লো এবং ওখান থেকে আবারো আর্তচিৎকার শোনা গেল। আর্তচিৎকার শুনে তীব্র বাতাসের ধাক্কা সামলে কায়েস সেদিকে দৌড়াল। গিয়ে ডালপালা উড়ে যাওয়া একটি গাছের গোড়ায় এক মহিলাকে আতঙ্কিত অবস্থায় দেখতে পেল। মহিলা ভয়ে তীরবিদ্ধ পাখির মতো কাঁপছে।
ভয় পেয়েছো? তুমি এখন আর একা নও, আমি তোমার সাথে আছি। আতঙ্কিত নারীকে অভয় দিতে বললো কায়েস।
এই আতঙ্কিত নারী ছিল এক পুণ্যার্থী কিশোরী। সন্ধ্যায় সে গঙ্গাস্নান করতে নদীতে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময় ঝড় শুরু হয়ে যায়। সবাই যখন জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়াতে লাগলো, তখন অন্ধকারের মধ্যে সে সঙ্গীদের হারিয়ে ফেলেছিল। কায়েসকে দেখে আতঙ্কিত কিশোরী তাকে জড়িয়ে ধরলো।
আকাশের তীব্র গর্জন, চোখ ধাঁধানো বিজলী ও ঝড়ের প্রচণ্ডতায় কায়েসের মতো টগবগে যুবকের চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলো। এমন সময় তাদের অতি কাছে একটি গাছের উপর ঘটলো তীব্র শব্দে বজ্রপাত। আতঙ্কিত তরুণী বজ্রপাতের আওয়াজে মা বলে চিৎকার করে কায়েসের শরীরে এভাবে লেপ্টে গেলো, যেনো সে কায়েসের শরীরে বিলীন হয়ে নিজেকে রক্ষা করবে।
তীব্র ঝড়কে দেবতার ক্রোধ বিশ্বাস করে মাথুরার মন্দিরগুলোতে একটানা ঘন্টা ও শাখা বাজতে শুরু করল। ঝড়ের এই বিপদে মন্দিরের শিঙ্গ।গুলোর বেসুরো আওয়াজ যেন আক্রান্ত বাঘের গর্জন।
মন্দিরের পূজারী ও পণ্ডিতেরা কৃষ্ণ ও বাসুদেব মূর্তির পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মন্দিরগুলোর পণ্ডিতেরা ‘হরি হর মহাদেব’ জয় হরিহর জগদিশ’ ধ্বনি করছিল। সকল হিন্দুই এই ঝড়কে দেবতাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ বলে বিশ্বাস করেছিল।
ঘরে ঘরে হিন্দুদের যেসব মূর্তি ছিলো, অধিবাসীরা সেইসব ক্ষুদ্র মূর্তির সামনে হাতজোড় করে আবেদন নিবেদন করছিল। বস্তুত এটি দেবতাদের ক্রোধ, না আল্লাহর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ এটা বুঝার ক্ষমতা পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী হিন্দুদের ছিলো না। বেসুরো সিংগার আওয়াজ ঝড়ের ভয়াবহতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছিল।
সকল রাজা-মহারাজা, তাদের সেনাবাহিনীর বীর সেনাপতি ও কমান্ডাররাও এই ঝড়ের ভয়াবহতায় থরথর করে কাঁপছিল। তারা এই ঝড়কে মনে করেছিল জিনভূত ও দেও-দানবদের সংহারী যুদ্ধ। মনে হচ্ছিল, এই ঝড় দুনিয়াকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে।
* * *
কায়েস আতঙ্কিত তরুণীকে কাঁধে তুলে নিয়ে ঝড়ের মধ্যেই একটি জরাজীর্ণ মন্দিরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তরুণী কায়েসের গলা জড়িয়ে ধরে কায়েসের গালের সাথে তার চেহারা মিশিয়ে রেখেছিল। তরুণী ছিল অনেকটাই অচেতন। বিজলীর চমক আর বজ্রপাতের শব্দে সে খানিকটা হুঁশ ফিরে পেতো।
তীব্র ঝড়ের মধ্যে কায়েস তরুণীকে কাঁধে নিয়ে এগুতে পারছিলো না, তার পা উপড়ে যাচ্ছিল। ঝড়ের ঝাঁপটায় গাছের ডালপালা নুয়ে পড়ে কায়েসকে আঘাত করার উপক্রম হল। বারবার সে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল, তবুও সে তরুণীকে কাঁধ থেকে ফেলে দেয়নি।
এমন সময় প্রচণ্ড এক বজ্রপাত ঘটলো। সেই সাথে কাছে এমন এক ভয়ানক চিৎকার শোনা গেল, যাতে কায়েসেরও জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো ।
সম্পূর্ণ বেহুঁশ না হলেও কিছুটা অপ্রকৃস্থ অবস্থায় কায়েস বিজলীর আলোকে তার সামনে দেখতে পেলো দু’টি আতঙ্কিত হাতি নূর উঁচিয়ে এদিকে দৌড়ে আসছে। অবস্থা এমন যে, তার অবস্থান থেকে হাতির দূরত্ব ছিল মাত্র বিশ/ত্রিশ গজ।
আতঙ্কিত হাতি দুটো পাশাপাশি আসছিল। এর আগেই প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে কাঁধে বোঝা নিয়ে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে অগ্রসর হতে গিয়ে কায়েসের চলৎশক্তি ফুরিয়ে আসছিল। আতঙ্কিত হাতি দুটো ভয়াবহ তীব্রতায় চিৎকার করে পাশাপাশি দৌড়ে আসছিল।
অবস্থা বেগতিক দেখে হাতির পায়ে পিষ্ট হওয়া থেকে বাঁচতে কায়েস শরীরের অবশিষ্ট সবটুকু শক্তি দিয়ে ডান দিকে দৌড় দিল। কিন্তু কয়েক কদম এগোতেই পা পিছলে পড়ে গেল এবং কাঁধের তরুণীকে দূরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
নিজে হাতির পায়ে পিষ্ট হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই গড়িয়ে কিছুটা সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। এমন সময় হাতি তার উপর দিয়ে চলে গেল। ছুটন্ত হাতির একটি পা এসে পড়ল তার পাজরে।
বিজলীর ঝলকানিতে সহায়তাকারী হাতির পদপিষ্ট হয়েছে দেখে তরুণী চিৎকার দিয়ে এসে কায়েসের গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং পরম মমতায় কায়েসের মাথাটা কোলে নিয়ে বললো, তুমি ঠিক আছো? ঠিক আছে কি না বল, কথা বলো। তরুণীর মমতাময়ী স্পর্শে কায়েস চোখ মেলে তাকাল এবং উঠে বসল! কিছুক্ষণ পর কায়েস তরুণীকে বলল, ঠিক আছে, আমার কিছু হয়নি।
* * *
অনেকক্ষণ পর তারা একটি ভগ্নস্তূপের মতো পুরনো মন্দিরে পৌঁছল। মন্দিরটি ছিল জমিন থেকে অনেক উঁচুতে। কায়েস ও হিশাম, আমীর বিন তাশকীনের সাথে এই ভগ্নমন্দিরেই মিলিত হয়েছিল।
তরুণীকে বগলদাবা করে নিয়ে কায়েস মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকল। এক পর্যায়ে তরুণী কায়েসের পাঞ্জা ছাড়িয়ে বলল, আমাকে ছাড়, আমি নিজেই উঠতে পারব।
তখনো তুফানের তীব্রতা এতটুকু কমেনি। কিন্তু কায়েসকে স্বেচ্ছায় হাতির পদতলে পড়তে দেখে তরুণীর সাহস বেড়ে গিয়েছিল। তারা দু’জন পরস্পর কোমর পেঁচিয়ে ধরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে অন্ধকারের মধ্যেই একটি পরিত্যক্ত কক্ষে প্রবেশ করল।
কক্ষে পৌঁছে ঝড় তুফানের তীব্রতা থেকে নিরাপদ বোধ করলে তরুণী অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়ে কায়েসের পা জড়িয়ে ধরে পায়ে মাথা রেখে কৃতজ্ঞতা জানাল।
‘আরে, একি! আমাকে গোনাহগার বানিও না তুমি! পরম আদরে পা থেকে তরুণীর মাথা তুলতে তুলতে বললো কায়েস। ঘটনার আকস্মিকতা এবং ঘোতর জীবনহানিকর বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে কায়েসের আবেগ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেল।
সে নিজের পরিচয় গোপন রাখার ব্যাপারটি একদম বিস্মৃত হয়ে তরুণীকে এমন ভাষায় কথা বললো যে, তার আত্মপরিচয় এক নিমিষেই উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। কায়েস আরো বললো, আমাদের ধর্মে মানুষ মানুষকে সিজদা করা পাপ। মানুষ মানুষের পায়ে সিজদা দিতে পারে না। মানুষ একমাত্র নিরাকার আল্লাহকে সিজদা দিতে পারে।”
‘তুমি কি মুসলমান?” বিস্ময়াভিভূত হয়ে বললো তরুণী।
“আমি যদি বলি যে, আমি মুসলমান, তাহলে তুমি আমাকে তেমনই ঘৃণা করবে, যেমন একজন হিন্দু মুসলমানকে ঘৃণা করে?”
‘ঘৃণা? তোমাকে ঘৃণা করবো আমি? তুমি না হলে তো আজ আমি বেঁচেই থাকতাম না…। আচ্ছা, তুমি মুসলমান হলে তো এই তুফান যে দেবতাদের অভিশাপ তা বিশ্বাস করবে না।”
“আমি তোমার ধর্মকে অসম্মান করতে চাই না।” বললো কায়েস। এটা আসলে আমার প্রভুর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ পাথরের তৈরী মূর্তির পূজারীদের উপর বর্ষিত হচ্ছে। এই ঝড় আল্লাহর নির্দেশে হচ্ছে। সেই আল্লাহর পক্ষ থেকেই আমি শক্তি ও সাহস পেয়েছি। যার ফলে এমন কঠিন অবস্থার মধ্যেও আমি তোমাকে কাঁধে তুলে এখানে নিয়ে আসতে পেরেছি।
কায়েস সাধু-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে গঙ্গাতীরে গিয়েছিল। তার পরনে ছিল একটি লেজুট মাত্র। তার মুখে ছিল কৃত্রিম দাড়ি এবং সারা শরীরে ছাইভস্ম মাখানো ছিল। ঝড়বৃষ্টি তার শরীরের কৃত্রিম সব আবরণ ধুয়ে ফেলল এবং লেজুট কোথাও খুলে পড়ে গেল।
তরুণী তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বিবস্ত্র কেন?
সে তরুণীর প্রশ্নের জবাবে জানাল, তুফানের আগমুহূর্তে সে নদীতে গঙ্গাস্নান করতে গিয়েছিল। তীরে কাপড় রেখে সে গঙ্গাস্নানে নেমেছিল। এরপরই তুফান শুরু হয়ে যায় এবং ঝড় তার তীরে রাখা কাপড় উড়িয়ে নিয়ে যায়। অতঃপর জীবন বাঁচাতে সে এদিকে দৌড়াতে শুরু করে।
কায়েস তরুণীকে জানালো, সে মাথুরায় মেলা দেখতে এসেছিল। সে তরুণীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়ী কোথায়?”
জবাবে তরুণী বুলন্দ শহরের কোন একটা জায়গার নাম বললো। তরুণী আরো জানালো, তাদের গোটা পরিবারই এই উৎসবে এসেছে। তার বাবাও তাদের সাথে আছে। শহরের বাইরে ছিল তাদের তাঁবু।
.
কায়েস তরুণীকে জানাল, এখন আর সেখানে কোন তবু পাওয়া যাবে না এবং গোত্রের কোন লোককেও সেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আজ রাত এখানেই কাটাতে হবে।
যদি কিছু মনে না করো, তাহলে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আবেদনের সুরে থেমে থেমে বললো তরুণী।
তুমি একজন তরুণ যুবক। আর আমি তরুণী। এখনো আমার বিয়ে হয়নি…। রাতটা আমাদের এখানেই কাটাতে হবে।
তরুণীর কণ্ঠে ছিল নিজেকে সমর্পণের আবেদন।
কায়েস বলল, দেখো, আমি নিজের জন্য তোমাকে তুলে আনিনি। তোমার মা-বাবার কাছে তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই তোমাকে এনেছি…। আমি তোমার কাছ থেকে একটা প্রতীজ্ঞা নিতে চাই।… আমি যে মুসলমান একথা কাউকে জানাতে পারবে না। আমি মুসলমান জানতে পারলে হিন্দুরা আমার সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করবে। আমি জগদিশ নামে পরিচয় দেব।’
তরুণীর নাম ছিল ঊষা। ইতোমধ্যে তাদের উভয়েই উভয়ের প্রকৃত নাম জেনে গেছে। ঊষা কায়েসের প্রতিটি শর্ত এবং প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য শপথ করে নিল।
অতঃপর তারা সেই ভগ্নমন্দিরেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল। ক্লান্ত-শ্রান্ত যুবতী ঊষার দুচোখ ভেঙে ঘুম আসলেও বারবার তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। তুফানের ভয়ে ভাঙেনি, ভাঙছিল পরিচয় পাওয়া এই ভিন্নধর্মী মুসলমান যুবকের সংস্পর্শে রাতযাপনের ভয়ে।
আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় রাতের দ্বিপ্রহর কাটিয়ে শেষ প্রহরে উষার এমন ভারী ঘুম এলো যে, সে যখন ঘুম থেকে চোখ খুললো, তখন তার কক্ষ দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে।
কায়েস সেই কক্ষের দরজায় বসে ঘুমন্ত ঊষাকে দেখছিল। রাতের ঝড় রাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সকাল বেলায় সূর্য উঠলো ঝলমলে আকাশে প্রখর রৌদ্র-প্রতাপ নিয়ে। গত রাতের কেয়ামতের আলামত দিনের বেলার আকাশে মোটও ছিল না।
ঘুম থেকে উঠে অনেক বিস্ময়ে ঊষা কায়েসকে দেখছিল এবং কায়েসও মুগ্ধনয়নে ঊষার দিকে তাকিয়ে ছিল। কায়েস অবাক হচ্ছিল ঊষার রূপ-সৌন্দর্য দেখে। জীবনে সে এমন সুন্দরী মেয়েলোক দেখেনি।
আর উষা অবাক হচ্ছিল কায়েসের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও তার রূপ-যৌবন, দৈহিক সৌন্দর্য ও সুঠাম-সবল দেহসৌষ্ঠব দেখে। সবচেয়ে বেশী বিস্ময়ের কারণ ছিল, এমন একটি টগবগে তরুণ তার মতো তরুণীকে কাছে পেয়েও একটু স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। অথচ কোন হিন্দু যুবকের বেলায় এমনটি ভাবা যেতো না।
বিস্ময়ের ঘোর দূর হতেই নীরবতা ভেঙে কায়েস ঊষার উদ্দেশে বললো, এখন তোমার বাবা-মাকে খুঁজে বের করার পালা। উঠো, এখন তাদের খুঁজতে বের হই।
ঊষার তখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। সে শোয়া থেকে উঠার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলো না। ঊষার চোখে কৃতজ্ঞতাবোধ ছাড়াও অন্য ব্যাপার ছিল। কায়েস তাকে আবারো তাড়া দিল। কিন্তু তবুও সে উঠলো না। কায়েস তার দিকে গ্রসর হয়ে কাছে গিয়ে বসল। পূর্ববৎ শোয়া অবস্থায়ই উষা বললো, “তুমি আমাকে জীবন দিয়েছে। তুমি কি এভাবে বাকী জীবনটা আমাকে নিরাপত্তা ও সুখ দিতে পারো না?”
ঊষার এ কথায় কায়েস কোন জবাব দিলো না।
“দেখো, তুমি আমাকে রাতের বেলায় আকস্মিক পেয়েছে, এটা আমার কাছে স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।” বললো ঊষা। এটাও আমার কাছে স্বাভাবিক ঘটনা নয় যে, তুমি এরপরও আমার গায়ে হাত দাওনি।
তুমি আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেও সেই বুড়োটার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না, যার সাথে আমার বিয়ের কথা পাকাঁপোক্ত হয়ে রয়েছে। দয়া করে তুমি আমাকে সাথে নিয়ে যাও…। হিন্দু নারীদের জীবন পুরুষের পদতলেই থাকে।
হিন্দু মেয়েদের পিতা-মাতা যার সাথে ইচ্ছা বিয়ে দিয়ে দেয়। স্বামী যদি মারা যায়, তাহলে সহমরণ হিসেবে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দিতে হয়। যদি তা না করে, তাহলে আজীবন বিধবার বেশ ধারণ করে এই মাথুরার মন্দিরে কাটাতে হয়।
এখানে আসার পর এক বিধবা বান্ধবীর সাথে আমার দেখা হয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর দু’বছর যাবত সে এখানে আছে। মুখে সবাই বলে সে সতী-সাধ্বী জীবন যাপন করছে। কিন্তু বান্ধবীটি আমাকে জানিয়েছে, প্রতি রাতেই তাকে কোন না কোন পুরোহিতের সাথে থাকতে হয়। কায়েস…! তুমি আমাকে সাথে নিয়ে চলো। আমি বাকী জীবন তোমার সেবাদাসী হয়ে কাটিয়ে দেবো।
কায়েস ছিল টগবগে যুবক। একটি যুবককে এক পরমা সুন্দরী নিজেকে সমর্পণ করছে। দীর্ঘ সময় বহু কষ্টে সে নিজেকে নীরব এই মোমের কাছে না গলে ধরে রেখেছিল। কিন্তু সরব আগুনের শিখায় কায়েসের না-গলা ধৈর্যের শিকল গলে গেলো।
সে তরুণীকে এড়ানোর জন্য বললো, না, আমি আমানতের খেয়ানত ও করতে পারি না। তবে তোমার এই আবেদনও প্রত্যাখ্যান করতে পারছি না। … আমার হৃদয়টা চিরে যদি দেখো, তাহলে সেখানে একমাত্র তোমারই ছবি আঁকা হয়ে গেছে, এখানে আর কারো ঠাই নেই। তোমাকে আমি আর কারো ও হাতে তুলে দিতে পারবো না। ঠিক আছে, এখন উঠো, চলো।”
ওরা টিলাসম মন্দির থেকে বের হয়ে বাইরের অবস্থা দেখে হয়রান হয়ে গেল। গত রাতের ঝড় ভয়ানক অবস্থা ঘটিয়ে গেছে। গত সন্ধ্যায়ও যেখানে ছিল তাঁবুর সারি, সেখানে আজ আর তাঁবুর কোন চিহ্ন নেই। লোকজন এদিক-সেদিক তাদের আসবাব পত্র তালাশ করছে। সকল তাঁবু লণ্ডভণ্ড। এলোপাতাড়ি গাছপালার ভাঙ্গা ডালপালা সারা এলাকা জুড়ে ছড়ানো। আর চতুর্দিকে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন, আর থৈ থৈ পানি।
কায়েস উষাকে সাথে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরের উপর থেকে নিচে নেমে এলো। তারা উষার বাবা-মার খোঁজে কিছুদূর এগোতেই উচ্চকণ্ঠে ভেসে এলো, “উষা, ঊষা”!!
ঊষা চিৎকার শুনে ওখানেই দাঁড়িয়ে গেল। সে কায়েসকে বললো, এই তো আমার বাবা! এখন আর আমাদের পক্ষে পালানো সম্ভব নয়।”
দীর্ঘদেহী, চওড়া বুকওয়ালা, বিশাল গোঁফধারী শক্ত সামর্থবান এক মধ্যবয়সী লোক দৌড়ে এসে ঊষাকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। ঊষাও তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বাবা এর নাম জগদীশ। সেই গত রাতে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। গতরাতে সে আমাকে নদীর তীর থেকে বেহুঁশ অবস্থায় তুলে এনে এই মন্দিরে রেখে রাতভর জাগ্রত থেকে পাহারা দিয়েছে। উষা এক নিঃশ্বাসে গতরাতের পুরো ঘটনা তার বাবাকে জানাল।
ঊষার কথা শুনে তার বাবা জগদীশরূপী কায়েসকে জড়িয়ে ধরে বললো, বলো বাবা, তুমি কী চাও? তোমাকে আমি উপহার দেবো। তুমি স্বর্ণ চাইতে পারো, ইচ্ছা করলে আমার ঘোড়াটিও চাইতে পারো। যাই চাও, আমি তোমাকে দিয়ে দেবো।”
“আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। একাজ আমি কোন পুরস্কারের লোভে করিনি। পুরস্কার যদি দিতেই চান, তবে আপনার এই মেয়েটিকেই আমাকে দিয়ে দিন। বললো কায়েস। কারণ, কাউকে না কাউকে তো আপনার এই মেয়ে দিতেই হবে। এটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে দামী পুরস্কার। আমি কেমন মানুষ তা এই সময়ের মধ্যে আপনার মেয়ে ঠিকই জেনে গেছে।
কায়েসের কথা শুনে ঊষার বারা নীরব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো, তোমার মতো বীর বাহাদুর যুবকদের আমি সম্মান করি। তোমার দেহ সৌষ্ঠব খুবই সুন্দর। যথার্থ অর্থেই তুমি সুপুরুষ। আমি সেনা অফিসার। বংশগতভাবেই আমরা সৈনিক। তোমার মতো সুপুরুষ যুবকের হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিয়ে আমি তোমাকে সেনাবাহিনীতে চাকরী দিতে পারি। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনীর এক উচ্চ কর্মকর্তার সাথে আমার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, এ প্রস্তাবকে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। এ দাবী ছাড়া তুমি অন্য কিছু বলতে পারো।”
“আপনি কোন সেনাবাহিনীতে আছেন?” জানতে চাইলো কায়েস।
“আমি বুলন্দশহরের রাজার সেনাবাহিনীতে আছি।” জবাব দিল ঊষার বাবা।
কায়েস উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই ঊষার বাবার সাথে সেনাবাহিনী সম্পর্কে আলাপ শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে উষার বাবা সুলতান মাহমূদ সম্পর্কে কথা বলতে লাগল। সে বললো, তাকে পরাজিত ও বন্দী করার জন্যই ভগবান এখনো আমাকে জীবিত রেখেছেন।
বংশগতভাবে এবং পেশাগতভাবে সৈনিক হওয়ার কারণে যুদ্ধ ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলছিল ঊষার বাবা। কিন্তু কায়েসের মনে তখন এসব বিষয়ের চেয়ে উষার আগ্রহই প্রবল। ঊষার বাবা কায়েসের সাথে ঊষার বিয়ের ব্যাপারে যখন অসম্মতি জানালো, তখন কায়েস একেবারে চুপসে গেল। তার চেহারা মলিন হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল তার দেহ থেকে যেনো আত্মা বের করে নেয়া হয়েছে।
কায়েস ভাবতে লাগলো। কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে ঊষার বাবা।
ঊষাকে হারানোর যন্ত্রণা কায়েসের বোধজ্ঞান ও কর্তব্য চিন্তাকে ছাপিয়ে তার মানসিক দুর্বলতাকে তুঙ্গে তুলে আনলো এবং তাকে আবেগতাড়িত করে ফেললো।
ঊষার বাবা যদি কায়েসকে বিদায় করে দিতো কিংবা ঊষাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতো, তাহলে কায়েস হয়তো এতোটা প্রভাবিত হতো না। কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দরী ও নিবেদিতা কান্তিময় চেহারার অধিকারিনীক উষা তার চোখের সামনেই আবেদনময়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। উষার বাবা খুবই সৌজন্য এবং সৌহার্দ্য মনোভাব নিয়ে কায়েসের সাথে কথাবার্তা বলছিল আর কায়েস ভাবছিল ঊষাকে পাবার ফন্দি কীভাবে করবে।
এক পর্যায়ে ঊষার বাবা গযনীর গোয়েন্দা প্রসঙ্গে আলাপ শুরু করে দিল। বললো, “এরা খুবই ভয়ানক, আমাদের মেলার মধ্যেও এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা আমাদের দুর্বলতাগুলো সময়ের আগেই মাহমুদকে জানিয়ে দেয়। ফলে মাহমূদ আমাদের দুর্বল জায়গাগুলোতেই আঘাত করে।
আমাদের সেনাবাহিনীতে গযনীর গোয়েন্দা পাকড়াও করার জন্য মোটা অংকের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আমি যদি কোন মুসলিম গোয়েন্দাকে ধরতে পারি, তাহলে তাকে আমি জীবিতাবস্থায় আমার রাজার কাছে পেশ করবো না। তার মাথাটা কেটে নিয়ে যাব।
একথা শুনে চিন্তিত কায়েসের চিন্তার অবসান হয়ে গেল। সে এবার উষাকে পাবার একটা সোজা পথ পেয়ে গেল। এদিকে উষা একথা শুনে তার বাবার আড়ালে দাঁড়িয়ে কায়েসের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ মুচকি হাসল।
এই মুচকী হাসি ঊষাকে পাবার কায়েসের আকাভক্ষাকে আরো তীব্র করে তুললো। কায়েস বলে বসলো, “আমি যদি আপনাকে দু’-তিনজন মুসলিম গোয়েন্দা ধরিয়ে দিই, তাহলে কি আমি আপনার কাছে যা দাবী করেছি তা দেবেন?”
আরে তুমি গযনীর গোয়েন্দা পাকড়াও করবে কিভাবে?”
“এ ব্যাপারে আপনি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।” বললো কায়েস। আপনি তাদের ধরবেন এবং তাদের জীবিত রাখবেন। তাদের জীবিত রাখলে এদের দেয়া তথ্য দিয়ে আপনি গযনীর আরো গোয়েন্দাদেরকে ধরতে পারবেন।”
“কবে ধরিয়ে দেবে তুমি?” জানতে চাইলো উষার বাবা। ওরা কোথায় আছে”
“এখনই ধরিয়ে দেবো…! আজকের মধ্যেই।” জবাব দিল কায়েস।
“ওরা এই মেলাতেই আছে। যদি আমি তাদের ধরিয়ে দিতে না পারি, তাহলে আপনি আমার মাথা উড়িয়ে দেবেন।”
“সত্যিই যদি তুমি তাদের ধরিয়ে দিতে পারো এবং ধরা পরার পর ওরা গযনীর গোয়েন্দা প্রমাণিত হয়, তাহলে মাথুরার বড় মন্দিরে অনুষ্ঠান করে আমার মেয়েকে আমি তোমার হাতে তুলে দেবো। কিন্তু রাজার কাছ থেকে
পুরস্কার কিন্তু আমি নেবো। তাতে আমার প্রমোশন হবে। আমি আরো বেশী সৈন্যের কমান্ডার হয়ে যাবো।”
“ঠিক আছে, আমি রাজি। আমার সাথে চলুন।”
***
গত একটি রাত কায়েসের সাথে হিশাম ও তাশকীনের কোন দেখা-সাক্ষাত হয়নি। হিশাম ও তার আরো দুই সহকর্মী দিনের বেলায় হন্যে হয়ে কায়েসকে খুঁজছিল। তারা সাধুর বেশ ধারণ করেই তুফানের মধ্যে এক মন্দিরে রাতযাপন করেছে।
সন্ধ্যায় কায়েস তাদের আস্তানায় ফেরেনি। তাই দিনের বেলায় তার সহকর্মীরা তাকে তালাশ করতে লাগল । গত রাতের তুফান সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার ফলে সেখানে কাউকে খুঁজে পাওয়া সহজ ছিলো না। সারা শহরের গলি ঘুপছিতে হাজার হাজার মানুষ ঠাই নিয়ে ছিলো। শহর ও শহরতলী কাদা পানিতে একাকার হয়ে পড়েছিল।
দুপুরের দিকে এক সঙ্গীর সাথে হিশামের দেখা হলো। সে হিশামকে জানালো কায়েসকে সে দেখেছে। সে সাধুর বেশে নেই। সে এমন পোশাক গায়ে জড়িয়েছে যে, দেখে এটিকে তার নিজের পোশাক মনে হয়নি। তার সাথে আরেকজন লোক আছে। লোকটির অবয়ব ও শারীরিক গঠন থেকে বোঝা গেছে সে সেনাবাহিনীর কোন কর্মকর্তা। তার কোমরে তরবারী ঝুলানো। পোশাকে কয়েকটি পদবীর চিহ্ন। লোকটিকে দেখে আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। একথা শুনে হিশাম তার সঙ্গীকে বললো, “তুমি আমাদের সাথীদেরকে লুকিয়ে যেতে বলো।”
কায়েসের এক সঙ্গী কায়েসকে দূর থেকে দেখেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। কারণ, কায়েসের পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল সন্দেহজনক। তার সঙ্গে থাকা লোকটির ভাবভঙ্গিতে সন্দেহ আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল। এসব গোয়েন্দাদের স্বভাব হলো এরা সবকিছুকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। কায়েসের অবস্থা সংশয়পূর্ণ হওয়ায় সে কায়েসের দৃষ্টির আড়ালে থেকে সেখান থেকে সটকে পড়েছিল।
ঊষার বাবা কায়েসকে সাথে করে তাদের স্বজনদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ঝড়ের মধ্যে যেখানে রাতযাপন করেছিল। সেখানে সে কায়েসকে তাদের কাপড়-চোপড় পরিয়ে তার সঙ্গীদের ধরার জন্য বেরিয়ে পড়ল।
সঙ্গীর কাছে কায়েসের সন্দেহজনক অবস্থার কথা শুনে তাশকীনের সতর্কবাণী মনে পড়ল হিশামের। তাশকীন তাকে স্বপক্ষের স্থানীয় গোয়েন্দাদের উপর বেশী আস্থা ও নির্ভরতা না রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। কারণ, এখানকার মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুদের শাসনাধীনে থাকার ফলে হিন্দুদের খাতির তোয়াজ করার অভ্যাসের কারণে সহজেই হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়।
হিশাম তার গোপন আস্তানায় গিয়ে শরীর থেকে সন্ন্যাসীর বাহ্যিক রূপ খুলে ফেলল। শরীরে লাগানো ছাই-ভষ্মের প্রলেপ ধুয়ে ফেলল এবং হাজার দানার মালা, ত্রিশূল, লাঠি এবং জটাধা কৃত্রিম দাড়ি খুলে কাপড় বদল করে হিন্দু সৈনিকের পোশাক গায়ে জড়াল। সে একটি খঞ্জর কোমরে গুঁজে কায়েসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর হিশাম কায়েসকে দেখতে পেল। উষার বাবার সাথে একটি পুরনো দালানের বাইরে আঙিনার একটি খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে সে বসে আছে। হিশাম ভিন্নপথে পুরনো দালানের ভেতরে প্রবেশ করে এদিকে এলো যে কক্ষের বাইরে কায়েস বসে আছে।
কক্ষের একটি জানালার দিকে পিঠ দিয়ে কায়েস ও উষার বাবা বসা ছিল। তারা বাইরের দৃশ্য এবং গমনাগমনরত লোকজনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। হিশাম নিঃশব্দে সেই জানালার কাছে গিয়ে বসে পড়ল। হিশামের বসার জায়গা থেকে কায়েস ও উষার বাবার দূরত্ব তিন-চার হাত মাত্র।
“আপনি হতাশ হবেন না। আমরা ওদেরকে অবশ্যই পেয়ে যাবো। ওরা তিনজন। তিনজনকেই ধরে ফেলা যাবে।” উষার বাবার উদ্দেশ্যে বললো কায়েস।
এ তিনজনের কথা আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু চতুর্থজনের কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।” বললো উষার বাবা। তুমি দাবী করছো, কনৌজের মহারাজার একান্ত নিরাপত্তা রক্ষী দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিটিই গযনীর চর। তাছাড়া তুমি তার সামনে না যাওয়ার কথা বলছে।
আমি ভাবছি, মহারাজার একান্ত লোকের বিরুদ্ধে কিভাবে অভিযোগ করবো যে, সে গযনীর চর! কারণ, কনৌজের মহারাজা খুবই দূরদর্শী ও পরাক্রমশালী মহারাজা।”
“তাকে পাকড়াও করার ব্যাপারেও আমি আপনাকে কৌশল বলে দেবো।” বললো কায়েস।
“জানালার আড়ালে বসে হিশাম তার জামার নিচ থেকে ধীরে ধীরে খ রটি বের করল। খঞ্জরের আগা বিষে ডোবানো ছিল। এমন বিষ যে কারো শরীরে এর একটু আঁচড় লাগলেই মুহূর্তের মধ্যে মারা যাবে সে।
হিশাম খঞ্জরটি হাতের আড়াল করে দাঁড়াল এবং পূর্ণশক্তি দিয়ে খঞ্জরটি ছুঁড়ে মারল। খঞ্জরটি সোজা গিয়ে কায়েসের পাজরে বিদ্ধ হলো। খঞ্জরবিদ্ধ কায়েস উহ্ বলে দাঁড়াল বটে; কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল। হিশাম এক মুহূর্ত দেরী না করে জানালার পাশ থেকে সটকে পড়ল এবং অন্য কক্ষে চলে গেল।
ঊষার বাবা ছিল প্রশিক্ষিত সেনাকর্মকর্তা। সে বুঝে ফেলল খঞ্জর কোন দিক থেকে আসতে পারে। সে পুরনো দালানের ভেতরের দিকে দৌড়াল। কিন্তু ততক্ষণে হিশাম অন্য দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে কায়েসের পাঁজর থেকে খ রটি তুলে নিয়ে রাস্তার মানুষের মধ্যে মিশে গেল।
ঊষার বাবা পুরনো দালানের মধ্যে হত্যাকারীকে তালাশ করতে লাগল। আর এদিকে হিশাম যেদিক থেকে এসেছিল ওদিকে চলে গেল। ঊষার বাবা হয়রান হয়ে পুরনো দালানের ভেতরে-বাইরে হত্যাকারীকে তালাশে ব্যস্ত রইল। ততক্ষণে কায়েস মরে গেছে।
* * *
সেই রাতে প্রধান মন্দিরের পুরোহিত সকল রাজা-মহারাজাদের মন্দিরে ডেকে পাঠালো। রাজা-মহারাজাদের ডেকে এনে প্রধান পুরোহিত বললো, ‘আমি আপনাদেরকে এই সোনা-রুপার স্কুপ দেখাতে এনেছি।
সোনা-রুপা ও নগদ টাকার বিশাল স্তূপ রাজাদের দেখিয়ে পুরোহিত বললো, গত রাতে তুফানের সময় আমি আপনাদের মাহফিলে ছিলাম। সেই সময় সম্পর্কে মন্দিরে পূজারত পুরোহিতরা আমাকে জানিয়েছে, কৃষ্ণ দেবতার চোখ প্রথমে নীল বর্ণ ধারণ করে, পরে সাদা এবং রক্তবর্ণ ধারণ করে। এরপরই তার চোখ থেকে এই ভয়াবহ তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ে। মন্দিরের সকল শাখা-ঘণ্টা নিজে থেকেই বাজতে শুরু করে। এর পরপরই শুরু হয়ে যায় ভয়াবহ তুফানের তাণ্ডব।…
“আপনারা কি দেবতাদের ইঙ্গিত বোঝেন না? গত রাতের তুফান ছিল দেবতাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। রাতেই মন্দিরে লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছিল। হাজারো পূজারী দেবীর পদতলে মাথা রেখে কান্নাকাটি করেছে। আমি পরিষ্কার ইঙ্গিত পেয়েছি, যে পর্যন্ত মাহমুদের মাথা কেটে কৃষ্ণদেব ও বাসুদেবের পদতলে রাখা না হবে, ততোদিন পর্যন্ত দেবতাদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না।
গত রাতে এখানে বহু লোক হতাহত হয়েছে। আপনাদেরও হয়তো এমন পরিণতি বরণ করতে হবে। আমি সকল পূজারীকে বলে আসছি, যে পর্যন্ত হিন্দুস্তানে ইসলামের ক্রমসম্প্রসারণের পথ রুদ্ধ করা না হবে, ততোদিন দেবতাদের অভিশাপ আসতেই থাকবে।
আমি পূজারীদের বলেছি, মুসলমানদেরকে চিরদিনের জন্য পরাজতি করার জন্য বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। মন্দিরে আসা সকল নারী তাদের পরনের অলংকার এবং পুরুষেরা তাদের নগদ অর্থের ঝুপ করে ফেলেছে।
এ অর্থ এখনই আমি আপনাদের হাতে তুলে দেবো না। আপনাদের সেনারা যখন গযনীর সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে, তখন সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করার বোঝা থেকে আমি আপনাদের নিষ্কৃতি দেবো।
যুদ্ধের পুরো ব্যয়ভার বহন করবে মাথুরার প্রধান মন্দির। কারণ, আপনাদের জয় আমার জয়, আপনাদের পরাজয় আমার পরাজয়। ভগবান আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কি আপনাদের অন্তরে সনাতন ধর্মের মর্যাদা, ভালোবাসা এবং ইসলামের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি কি না!”
মনে রাখবেন, সেই দলই বিজয় লাভ করে, যাদের হৃদয়ে শত্রু ও শত্রুবাহিনীর ধর্মের প্রতি ঘৃণা আছে। ঘৃণা একটি বিরাট শক্তি। এতো দূরে এসেও মুসলমানরা আপনাদের পরাজিত করে যায় এর মূল কারণ হলো তাদের অন্তর আপনাদের প্রতি ঘৃণায় ভরা থাকে।
মুসলমানরা আমাদের ধর্মকে মিথ্যা মনে করে। এখন আপনাদেরই প্রমাণ করতে হবে আমাদের ধর্ম সত্য। আপনাদেরকে গযনী সেনাদের উপর আসমানী গ্যব হয়ে উঠতে হবে।”
দীর্ঘ জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রধান পুরোহিত রাজা মহারাজাদের অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা এবং ইসলাম বিদ্বেষে উস্কে দেয়ার পর আশ্বাসবাণী শোনালো, “ভগবান আমাকে ইশারা দিয়েছে মুসলমানরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে।”
দীর্ঘ ভাষণের পর পণ্ডিত বসে পড়লে লাহোরের মহারাজা জয়পাল, কনৌজের মহারাজা রাজ্যপাল, মহাবনের রাজা কুয়াল চন্দ্র ছাড়াও বুলন্দশহরসহ ছোট বড় সকল রাজা-মহারাজাদের সেই ঐতিহাসিক বৈঠক হলো, যে বৈঠকের কারণে মুসলমান মাহমুদকে ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভিযান : পরিচালনা করতে হয়েছিল। সুলতান মাহমূদ রাজাদের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের বিপরীতে এমন ঐতিহাসিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, সমরবিশারদগণ সেই অভিযানকে অভাবনীয় বলে অভিহিত করেন।
ইউরোপীয় ঐতিহাসিক স্যার আর্লস্টেন লিখেছেন, “সুলতান মাহমূদ গযনী থেকে মাথুরা পর্যন্ত প্রাবনের মতো একটির পর একটি দুর্গ জয় করে এগিয়ে এলেন এবং শেষ পর্যন্ত কনৌজের মাথুরাকে ধ্বংসস্তুতে পরিণত করলেন।”
তৎকালীন ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তার এই অবিস্মরণীয় সাফল্য ও বিজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তার গোয়েন্দা বাহিনীর। তিনি ভারতের রাজা মহারাজাদের সমর প্রস্তুতির পূর্ণ খবর জায়গায় বসেই পেয়ে যেতেন। যার ফলে তিনি বিদ্যুদ্বেগে অগ্রাভিযান চালাতেন এবং প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত অবস্থায় এসে চেপে ধরতেন।
* * *
লাহোরের মহারাজা ভীমপাল এবং কালাঞ্জর (কোটলী কাশ্মীর) এর রাজা জানকি বাহ্মী সুলতান মাহমূদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। তাদের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল যে, ভীমপাল গযনীর বিরুদ্ধে কোন প্রকার সামরিক তৎপরতা চালাবে না। হিন্দুস্তানে গযনী সৈন্যদের যতো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে সেই সহযোগিতা দিতে বাধ্য থাকবে। কোটলী কাশ্মীরের রাজারও সুলতানের সাথে একই ধরনের চুক্তি হয়েছিল।
১০১৭ সালের বর্ষা মওসুমের পূজা উৎসবে হিন্দুস্তানের অন্যান্য রাজাদের মতো এই দুই রাজাও মাথুরার প্রধান মন্দিরে বসে গযনী বাহিনীকে পরাজিত করে গযনীকে ধ্বংস করার নীলনক্সা প্রণয়নে শামিল ছিল।
রাজা ভীমপাল সেই রাজাদের বৈঠকে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি প্রকাশ্যে থাকবেন না, কিন্তু অন্তরালে সবধরনের সহযোগিতা করবেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তিনি ও তার খান্দান এ পর্যন্ত সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে তিনবার লড়াই করেছে, আর কেউ তা করেনি।
এসব যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির সবই তার নিজস্ব তহবিল থেকে নির্বাহ করতে হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই তাকে সুলতান মাহমুদের সাথে অধীনতামূলক চুক্তি করতে হয়েছে।
এই মহাপরিকল্পনার শীর্ষ দায়িত্ব দেয়া হলো কনৌজের মহারাজার উপর। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, এই মহাপরিকল্পনার দায়িত্ব পালনের সবচেয়ে উপযুক্ত ছিলেন কনৌজের মহারাজা রাজ্যপাল।
তিনি ছিলেন দক্ষ সমরবিশারদ। তার সামরিক শক্তিও ছিলো অন্যদের চেয়ে বেশী। উত্তর ভারতে কনৌজের মহারাজাকে সম্মানের চোখে দেখা হতো। বস্তুত তাই সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো কনৌজের মহারাজার উপর।
মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রত্যেক রাজা-মহারাজা তাদের অর্ধেক সৈন্য সম্মিলিত বাহিনীতে দেবে আর বাকী অর্ধেক সৈন্য নিজেদের হাতে বিভিন্ন দুর্গের সুরক্ষা এবং সুলতান মাহমুদের জবাবী আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
সম্মিলিত বাহিনী পেশোয়ারের দিকে অগ্রাভিযান চালাবে এবং সুলতান মাহমুদকে খায়বর দুর্গের পার্শবর্তী ময়দানে মুখোমুখি হতে বাধ্য করা হবে। এর আগে সৈন্যদের কিছু অংশ বিভিন্ন পাহাড়ী গিরিপথে নিয়োগ করা হবে। যাতে সুলতান মাহমুদের বাহিনীকে আগমন পথেই চোরাগুপ্তা আক্রমণ করে দুর্বল করে দেয়া হবে।
এই পরিকল্পনায় সবাই ঐক্যমত্য পোষণ করে। সব রাজা-মহারাজা কৃষ্ণ ও বাসুদেব মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গীকার করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রত্যেকেই নিজেদের জীবনও সম্পদ অকাতরে ব্যয় করবে।
আমীর বিন তাশকীন কনৌজের মহারাজার একান্ত নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে বৈঠকে হাজির ছিল। শুধু কনৌজের মহারাজা নয়, আরো কয়েকজন রাজা মহারাজার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীও নির্বিকার মূর্তির মতো নিজ নিজ রাজাদের পেছনে দণ্ডায়মান ছিল।
মাথুরা থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে পূর্ব-উত্তরে রামগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত বুলন্দশহর। তখন এটি ছিল একটি রাজ্যের রাজধানী। বল শহরের রাজা হরিদত্ত এই মহাবৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের এক পর্যায়ে রাজা হরিদত্ত বললেন, মুসলমানরা কেন প্রতিবারই সাফল্য পায়, প্রতিক্ষেত্রেই তাদেরই কেন জয় হয়।
আমাদেরকে ভাবতে হবে কোন জাদু বলে মুসলমানরা জয়লাভ করে, আর আমাদের মধ্যে কী ঘাটতি রয়েছে….। আজ আমি আপনাদেরকে তাদের একটি গুণ সম্পর্কে অবহিত করতে চাই। গযনীর গোয়েন্দাব্যবস্থা খুবই জোরদার। গোয়েন্দারাই গযনী বাহিনীর সবচেয়ে বড় শক্তি।
আমি আপনাদের একথাও বলে দিতে পারি, এখানেও গযনীর গোয়েন্দা রয়েছে এবং আমাদের সব কথাই সে শুনছে। গতরাতের ঝড়ে বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, জানা গেছে, আজ একজন গযনী গোয়েন্দাকে তার সহকর্মীরাই হত্যা করেছে।
আমার এক সেনাকর্মকর্তা ঘটনাক্রমে এক গযনীর গোয়েন্দার আসল রূপ জানতে পেরেছিল। সেই গোয়েন্দা তার তিন সহকর্মীকে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এক খঞ্জরের আঘাতে সে মারা যায়। হত্যাকারীকে ধরা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তা থেকেই আপনারা বুঝতে পারেন মুসলমানদের গোয়েন্দাব্যবস্থা এবং তাদের শক্তি কত। রাজা হরিদত্ত ঊষার বাবার কাছে শোনা কায়েসের ঘটনা সবিস্তারে ব্যক্ত করলেন এবং উষা ও কায়েসের মধ্যে ঘটে যাওয়া আকষ্মিক আকর্ষণ, উদ্ধার ও একজন অপরজনকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুলতার কথাও সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। অবশেষে রাজা হরিদত্ত বললেন, মৃত গোয়েন্দা এমন এক গযনী গোয়েন্দার কথা জানিয়েছে, যার নাম উল্লেখ করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কারণ, সেই গোয়েন্দা এমন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, যদি অভিযোগ সত্য না হয়, তাহলে আমাদের মধ্যে শত্রুতা, ভুল বোঝাবুঝি ও অনৈক্য সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
রাজা হরিদত্ত আড়চোখে একবার আমীর বিন তাশকীনের দিকে তাকালেন। আমীর বিন তাশকীন নির্মোহ নির্বিকার চিত্তে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। হরিদত্তের কথায় সে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল বটে; কিন্তু দৃশ্যত ভাবলেশহীন নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল।
কয়েকজন রাজা-মহারাজা হরিদত্তকে আলোচিত গোয়েন্দার নাম উল্লেখ করার তাকীদ দিলেন। কিন্তু রাজা হরিদত্ত বললেন, বিষয়টি তিনি আগে ব্যক্তিগতভাবে নিরীক্ষা করবেন। বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হলে সেই গোয়েন্দাকে সবার সামনে হাজির করবেন।
রাজা-মহারাজাদের সেই ঐতিহাসিক বৈঠক শেষে কনৌজের মহারাজা রাজা হরিদত্তকে বললেন, যেহেতু তাকে সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর চীফ কমান্ডার এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, এজন্য এতো উঁচু পর্যায়ে কোথায় গযনীর গোয়েন্দা রয়েছে বিষয়টি তার জানা খুবই দরকার।
রাজা হরিদত্ত বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ, আমীর বিন তাশকীন তাদের সাথেই আসছিল। ঝড় মহারাজাদের তাঁবুগুলো উড়িয়ে নেয়ার পর শহরে তাদের জন্য বাড়ি খালি করানো হলো।
মহারাজা কল্লৌজের জন্য যে বাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছিল, তিনি সেই বাড়িতে রাজা হরিদত্তকে নিয়ে গেলেন এবং জগন্নাথরূপী আমীর বিন তাশকীনকে ছুটি দিয়ে দিলেন।
চম্পা ছিলো কনৌজ মহারাজার সবচেয়ে প্রিয় রাণী। সে মহারাজার আগমন অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল। রাজা হরিদত্তকে সাথে নিয়ে মহারাজা তার কক্ষে প্রবেশ করলে চম্পারাণী আপ্যায়নের শুরুতেই তাদের শরাব ঢেলে দিল এবং মহারাজার সান্নিধ্যে বসে গেল। রাজা হরিদত্ত সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে চম্পার দিকে তাকালে মহারাজা রাজ্যপাল হরিদত্তের সংশয়পূর্ণ দৃষ্টি বুঝে ফেললেন। কারণ, চম্পার উপস্থিতিতে রাজা হরিদত্ত আসল কথা না বলে প্রসঙ্গ ঘোরানোর চেষ্টা করছিলেন।
মহারাজা চম্পার উদ্দেশে বললেন, আমরা দুজন একটা জরুরী বিষয়ে কথা বলবো, তুমি কিছুক্ষণের জন্য অন্য ঘরে থাকো।
চম্পা মহারাজার নির্দেশে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো বটে; কিন্তু কী কথা হবে তাদের মধ্যে। এই কৌতূহলে সে দরজার আড়ালে তাদের কথাবার্তা শোনার জন্য উত্তর্ণ হয়ে রইল।
‘আমি আপনাকে এই কথাই বলতে চাই যে, মন্দিরে আমি যে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলাম বলে কথা শুরু করলো রাজা হরিদত্ত । আমার এক সামরিক কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছে, জগন্নাথ নামের আপনার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী আসলে জগন্নাথ নয়, আমীর বিন তাশকীন। সে গযনীর উচ্চ পর্যায়ের একজন দক্ষ গোয়েন্দা। যে গোয়েন্দা ওদেরই কারো হাতে নিহত হয়েছে, সেই আমার কর্মকর্তাকে একথা বলেছিলো। হয়তো আমার একথা আপনার পছন্দ নাও হতে পারে। তবে…।
‘আপনার কথা আমার কাছে মোটেও মন্দ মনে হয়নি’ হরিদত্তের অসম্পূর্ণ কথা কেড়ে নিয়ে জবাব দিলেন মহারাজা। কিন্তু ব্যাপারটি আমার কাছে বিস্ময়কর লাগছে যে, কোন ভিনদেশের গোয়েন্দা আমাকে এভাবে ধোকা দিতে পারে। আমি আপনার এই অভিযোগকে মোটেও অস্বীকার করবো না, বিষয়টি আমি এখনই যাচাই করবো।”
রাজা হরিদত্ত আরো বললেন, সুন্দরী নারী আপনার জন্য অভাব হওয়ার কথা নয়। আমি এ কথাও জানতে পেরেছি, আপনার প্রিয় চম্পারানী ও আপনার এই ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীর মধ্যে গোপন সম্পর্ক রয়েছে। সেদিন আপনার ছোট রাণীর যে সেবিকা রাণীর সাথে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই আপনি এর সত্যতা যাচাই করতে পারবেন। আমার সন্দেহ হয়, চম্পা ও এই নিরাপত্তারক্ষী দু’জনে আপনার জন্য একটা মায়াবীনি প্রতারণা হয়ে বিরাজ করছে।”
‘হরিদত্ত! আমাকে বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলুন। আমি এখনই সেবিকাকে আপনার সামনে ডেকে আনছি। আর সকালেই আপনি নিরাপত্তারক্ষী ও চম্পার লাশ দেখতে পাবেন।’
বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর জন্য আমি আমার সেই সামরিক কর্মকর্তাকে সাথেই নিয়ে এসেছি। সে বাইরে দাঁড়ানো আছে। আপনি গোয়েন্দা সম্পর্কে তার মুখেই শুনতে পারেন, বলে রাজা হরিদত্ত চম্পা ও তাশকীনের গোপন সম্পর্কের বিস্তারিত বলতে শুরু করলো।
দুই রাজার একান্ত কথোপকথন দরজার আড়াল থেকে শুনে চম্পা পা টিপে টিপে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এলো এবং বিদ্যুদ্বেগে তাশকীনের কক্ষে প্রবেশ করল।
“এখনই বের হও এবং ঘোড়া বের করো’। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তাশকীনকে বললো চম্পা। আমাদের দুজনের গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে।”
“কী রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে? কী বলছো তুমি?” চম্পাকে উৎসুক্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো তাশকীন।
“আরে এতোকিছু জানতে চেয়ো না, আগে পালানোর ব্যবস্থা করো। আবারো উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো চম্পা। বুলন্দশহরের রাজা হরিদত্ত মহারাজাকে বলেছে, তুমি জগন্নাথ নও গযনীর মুসলমান আমীর বিন তাশকীন।… সে মহারাজাকে আমাদের দুজনের গোপন সম্পর্কের কথাও জানিয়ে দিয়েছে। মহারাজা এখনই আমার একান্ত সেবিকাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।”
“তুমি কি আমাকে ধরিয়ে দিতে এসেছে, না আমাকে এখান থেকে বের করে দেয়ার জন্য এসেছো?” চম্পাকে জিজ্ঞেস করল তাশকীন।
“বেশী কিছু জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করো না। জলদি করো। আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে এসেছি। তাড়াতাড়ি করো। আমাকে একটা চাদর দাও। আমি আমার শরীর ঢেকে ফেলবো। জলদি করো, ওরা হয়তো তোমাকে খুঁজতে এখানে এসে যাবে।”
“ওরা যা বলছে, তা ঠিকই আছে চম্পা।” এতোদিন আমি তোমার কাছেও আমার প্রকৃত পরিচয় গোপন করেছিলাম। আমি মুসলমান। আমার নাম আমীর বিন তাশকীন। এ কথা শোনার পরও কি তুমি আমার সাথে যাবে? ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাবে?”
“আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে এবং তোমার সাথেই মরতে এসেছি। ধর্ম আমার কাছে বড় বিবেচ্য বিষয় নয়। এখন তুমিই আমার সব। তুমি যা বিশ্বাস কর আমিও তাই করি। আর দেরী নয়, জলদি কর, আমাকে চাদরটা দাও।
তাশকীন একটি চাদর চম্পার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে দিল এবং তার বিশেষ খঞ্জরটিও কোমরে খুঁজে নিল। এরপর চম্পাকে নিয়ে আস্তাবলের দিকে অগ্রসর হলো।
এদিকে মহারাজা ক্ষুব্ধকণ্ঠে তার দ্বাররক্ষীদের নির্দেশ দিলেন, এক্ষুনি চম্পা ও তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী জগন্নাথকে হাজির করা হোক।
তাশকীন একটি অন্ধকার জায়গায় চম্পাকে দাঁড় করিয়ে রেখে যেখানে সামরিক ঘোড়া বাঁধা থাকে, সেদিকে অগ্রসর হলো। সেনাদের মধ্যে জগন্নাথরূপী তাশকীনের মর্যাদা এমন ছিল যে, তার নির্দেশ কোন প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই সবাই মানতে বাধ্য ছিল। এই অবস্থান সে অনেকটা নিজের আচরণ, বুদ্ধিমত্তা এবং পদবী দিয়ে তৈরী করে নিয়েছিল।
সে ঘোড়ার সহিসকে বললে খুব তাড়াতাড়ি তুমি ঘোড়াটিকে জীন বেধে দাও।
এদিকে রাজমহল তল্লাশি করে মহারাজাকে জানানো হলো, চম্পা রাণীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলতে পারছে না তিনি কোথায় আছেন।
মহারাজা নির্দেশ দিলেন, জগন্নাথ ও চম্পারাণীকে দ্রুত খুঁজে বের করো। ওরা যদি পালাতে চেষ্টা করে, তবে যেখানেই পাবে সেখানেই ওদের খতম করে দেবে।
মহারাজার নির্দেশ পেয়ে তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দশবারজন সৈনিক দৌড়াল । তখন রাত অন্ধকার হয়ে গেছে। একটি জ্বলন্ত মশাল থেকে তারা আরো তিন-চারটি মশাল জ্বালিয়ে নিল।
এদিকে তাশকীনের ঘোড়ায় তখন জীন বাঁধা হয়ে গেছে। সে দ্রুত ঘোড়াটিকে নিয়ে চম্পাকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, ওখানে পৌঁছল। সে চম্পাকে তার পেছনে আরোহণ করিয়ে যেই পালানোর জন্য ঘোড়াকে ঘুরালো, তখন দেখতে পেল চার-পাঁচটি মশাল জ্বালিয়ে একদল অশ্বারোহী দৌড়ে এদিকে আসছে।
শহরের প্রধান গেট খোলা ছিল বটে; কিন্তু এ মুহূর্তে প্রধান গেট দিয়ে তাদের বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। তাশকীন আবার ঘোড়া ঘুরিয়ে ছুটতে শুরু করলেই রাজার নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে হুমকি দিল।
দাঁড়িয়ে যাও, নয়তো এক্ষুনি তীর ছোঁড়া হবে। কিন্তু তাশকীন দাঁড়াবার পাত্র নয় । সে থামল না, ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। একটু এগুতেই চম্পা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো। চিৎকার দিয়ে চম্পা বললো, আমার পিঠে দুটি তীর বিদ্ধ হয়েছে। বলেই সে ঘোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল।
আরো একটু এগুতেই তাশকীনের ঘোড়া হ্রেষাব করে উঠলো এবং তার গতি শ্লথ হয়ে গেল। তাশকীন বুঝতে পারল ঘোড়াও তীরবিদ্ধ হয়েছে। ঘোড়া যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল তখন ছুটন্ত ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ল তাশকীন। তার দু’পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ করে দুটি তীর ছুটে গেল। ভাগ্যগুণে তার মাথা অক্ষত রয়ে গেল।
এরপর একটি সংকীর্ণ গলিতে ঢুকে পড়ল তাশকীন এবং পশ্চাদ্ধাবনকারীদের আগেই গলির দু-তিনটি মোড় পেরিয়ে গেল। এ সময়ে চম্পার কথা তার ভাবার অবকাশ ছিল না। কারণ, বিষাক্ত তীরের আঘাতে তততক্ষণে বেচারী হয়তো মরে গেছে। চম্পার খুনের বদলা নেয়ারও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, সে এসেছিল আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে, এজন্য নিজেকে রক্ষা করে যে করেই হোক গযনী পৌঁছাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।
তাশকীন জানতো, শহরের সীমানা প্রাচীরের একটি অংশ একেবারে নদীর তীর ঘেঁষে রয়েছে। তখন বর্ষাকাল, এমনিতেই নদীতে পানি ছিল বেশী। তদুপরি পূর্বরাতের প্রবল বর্ষণে নদীর পানি সীমানা ছুঁই ছুঁই করছিল। তাশকীনকে পশ্চাদ্ধাবনকারীরা ধর ধর, গেল গেল, ওই দিকে, এ দিকে, ইত্যাকার চিৎকার ও চেঁচামেচি করে আসছিল।
তাশকীন ইতোমধ্যে একটি দালানের উপরে উঠে গেল, যে দালানের ছাদ সীমানা প্রাচীরের বরাবর যুক্ত ছিল। নীচে নিরাপত্তা রক্ষীদের হৈ চৈ শুনে সীমানা প্রাচীরের উপরে অবস্থানরত দুই প্রহরী তাশকীনের পথ আগলে দাঁড়াল। তাশকীন এক প্রহরীর কাছে গিয়ে তরবারী ওর পেটে ঢুকিয়ে দিলে অপর প্রহরী দৌড়ে পালাল।
এদিকে মশালধারী সৈন্যরা সীমানা প্রাচীরের কাছে চলে এলো। তাশকীন দেয়ালে উঠে নদীর দিকে অগ্রসর হলো এবং যেখানে দেয়াল একেবারে নদীর তীর ঘেঁষে সেখানে পৌঁছে, সে সীমানা প্রাচীরের উপর থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পশ্চাদ্বাবনকারীরা আর তার নাগাল পেল না।
মাধুরা থেকে গযনীর দূরত্ব প্রায় সাত মাইল। পথিমধ্যে অন্তত সাতটি বড় নদী রয়েছে। তাছাড়া বেশীর ভাগ পই ছিল পাহাড়ী। তৎকালীন ঐতিহাসিকদের মতে একজন সক্ষম মানুষের এ প পাড়ি দিতে অন্তত তিনমাস সময়ের প্রয়োজন ছিল।
***
সুলতান মাহমূদ গযনবী এর আগেই খাওয়ারিজমকে গযনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। খাওয়ারিজমের অনুগত সৈন্যদেরকে তিনি গযনী সৈন্যদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাছাড়া খাওয়ারিজম যুদ্ধে লোকবলের ঘাটতি পূরণে তিনি সেনাবাহিনীতে ভর্তির বিষয়টিতে জোর দেন।
তিনি মসজিদে মসজিদে এই ঘোষণা জারি করেন যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময় হিন্দুস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র পরিণত হতে চলেছিল। কিন্তু সেখানকার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মুসলমানরাও এখন পৌত্তলিকতার পদতলে পিষ্ট হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, মুসলমানদের আয়ের উৎসগুলোকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সেখানে প্রতিনিয়ত সামরিক শক্তি সঞ্চয় করছে।
ইসলামের পয়গামকে দুনিয়ার কোণে কোণে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত।
সেই সাথে হিন্দুস্তানের বুতখানাগুলো থেকে বুত অপসারণ করে অগণিত বনী আদমকে পৌত্তলিকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করাও আমাদের ঈমানী কর্তব্য। পৌত্তলিকতা এমন এক ভয়ানক চক্র, এদেরকে যদি ধ্বংস করে দেয়া না যায়, তবে এরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কঠিন মুসীবত হয়ে দেখা দেবে।
মসজিদগুলোতে ইমাম ও খতীবগণ সুলতানের এই ঘোষণার আলোকে মানুষকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে উৎসাহিত করতেন। কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে আবেগময়ী ভাষায় প্রদত্ত খতীব ও ইমামদের এসব উজ্জীবনীমূলক সুবক্তব্য শুনে সাধারণ মুসলমানরা উজ্জীবিত হলেন এবং দেশের প্রতিটি জনপদে তার এই ঘোষণা আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হলো।
সুলতান আরো ঘোষণা করলেন, রাষ্ট্র পরিচালনা খুবই স্পর্শকাতর এবং কঠিন কাজ। এই কঠিন দায়িত্ব আল্লাহ্ তাআলা আমার উপর অর্পণ করেছেন। শুধু শাসন করা সুলতানের কাজ নয়। জাতি ও গণমানুষের জীবন-জীবিকা সুচারুরূপে চালানোর জন্য সহায়তা করা, তাদের সঠিক নিরাপত্তা দেয়া এবং জাতির মান-মর্যাদা সমুন্নত রাখা সুলতানের অন্যতম কর্তব্য। তবে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, এই পরিমাণ সামরিক শক্তি সঞ্চয় করা দরকার ইসলামের শত্রুরা যতো শক্তিশালী হোক না কেন যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। কোন মুসলিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর যদি জুলুম-অত্যাচার হতে থাকে, তবে যে কোন মুসলিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উচিত মজলুমদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া এবং দেশ ও জাতিকে নিয়ে মজলুমদের নিরাপত্তা বিধানে জিহাদ করা।
এই মুহূর্তে আমার খুব দরকার জাতির সিংহ-শাদূলদের সহযোগিতা। হে গযনীর সিংহ শার্দুলেরা! তোমরা এসো! আমি তোমাদের নিয়ে মৃত্যুর আগে এই কর্তব্য পালন করতে চাই।”
সুলতান মাহমূদ যেমন ছিলেন একজন বিচক্ষণ ক্ষণজন্মা সমরনায়ক, তেমনই ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। হিন্দুস্তানের বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি যে সহায়-সম্পদকজা করতেন, এগুলোর একটি অংশ তিনি সেনাদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন এবং একটি বড় অংশ খরচ করতেন শিক্ষা ও জনগণের সেবায়, গণমানুষের জীবন-মান উন্নয়নে। তার শাসিত সালতানাতে যেহেতু গণমানুষ সুখ-সাচ্ছন্দ্যে, জীবন-যাপন করতো। এজন্য সুলতানের প্রতিটি নির্দেশেই ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করত।
১০১৭ সালের শেষ দিকে তিনি সেনাবাহিনীতে নতুন লোক ভর্তির জন্য দেশব্যাপী মহড়া শুরু করে দিলেন। তিনি তার সেনা কমান্ডারদের বলতেন, আমাকে আমার পিতার উপদেশ পালন করতে হবে।
তিনি বলতেন, তোমাকে হিন্দুস্তানের বুতখানাগুলো ধ্বংস করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি স্বপ্নেও বারবার এ কাজের জন্য তাগিদ পেয়েছি। আমার পীর ও মুর্শিদ শায়খ আবুল হাসান খিরকানীও এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। মনে হয় আমার জীবন আর বেশী দিন নেই। মৃত্যুর আগে আমি এই কাজটি শেষ করে যেতে চাই।
* * *
বেশ কিছু দিন থেকে সুলতান হিন্দুস্তান থেকে নতুন খবরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি একথা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন যে, হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজারা তার বিরুদ্ধে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। ১০১৭ খৃস্টাব্দ শেষ হলো। ১০১৮ সাল শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু তখনও তিনি নতুন কোন সংবাদ পাচ্ছিলেন না।
একদিন তাকে খরব দেয়া হলো, হিন্দুস্তান থেকে আমীর বিন তাশকীন নামের একজন লোক এসেছে।
‘তাশকীন এসেছে!’ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন সুলতান। তাকে জলদি এখানে নিয়ে এসো।
তাশকীন যখন সুলতানের কক্ষে প্রবেশ করল, তখন তাকে দেখে বিস্ময়ে সুলতান পেছনে সরে গেলেন। তার চেহারা নীল হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে মনে হচ্ছিল একটি জীবন্ত কংকাল।
তার শরীরে ধুলোর আস্তরণ। চেহারা দেখে মোটেই চেনা যাচ্ছিল না, এটিই তুখোড় গোয়েন্দা আমীর বিন তাশকীন। তার কোমর ভেঙে গিয়েছিল। সে পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে পারছিলো না। সুলতান তাকে একটি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসালেন এবং শীঘ্রই তার জন্য খাদ্য পানীয় আনার জন্য নির্দেশ দিলেন।
‘আমি তিন মাসের পথ দেড় মাসে অতিক্রম করেছি সুলতান। কাঁপা কাঁপা ক্ষীণকণ্ঠে বললো তাশকীন। মাথুরাতে আমার ধরা পড়ার উপক্রম হয়েছিল। আল্লাহর বিশেষ রহমতে আমি বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।
আমি এক পর্যায়ে একটি ঘোড়া চুরি করে মরতে মরতে বেঁচে গেছি এবং পালিয়ে এসেছি। ঘোড়ার প্রয়োজনে একটি নিরপরাধ লোককে হত্যা করতে হয়েছে। সাঁতরে প্রমত্তা নদী পার হতে হয়েছে। দেড় মাস পর্যন্ত আমি ঘোড়ার উপরই খেয়েছি এবং ঘোড়ার উপর বসেই ঘুমিয়েছি…। আপনি একটি হিন্দুস্তানের মানচিত্র আনান।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাশকীনের জন্য খাদ্য-পানীয় হাজির করা হলো। সুলতানের নির্দেশে তাশকীন কিছুটা খাদ্য এবং পানীয় পান করে শরীরটাকে একটু তাজা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বসলো।
হিন্দুস্তানের সকল রাজা-মহারাজারাদের নাম ধরে ধরে তাশকীন বলতে লাগল, যারা মথুরার মন্দিরের বিশেষ বৈঠকে শরীক হয়েছিল। তাশকীন সুলতানকে তাদের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা জানিয়ে মানচিত্রে হাত দিয়ে দেখাতে লাগল, কোথায় কনৌজ মাথুরা, বুলন্দশহর এবং মহাবন।
তাশকীন সুলতানকে জানাল, এলাকাটি ঘন জঙ্গলাকীর্ণ হওয়া ছাড়াও প্রমত্তা গঙ্গা ও যমুনা নামের দুটি নদী খুবই ভয়ানক। অতঃপর মাথুরা ও মহাবন। বুলন্দশহরের আশে পাশের ঘোট ঘোট দুর্গগুলোর অবস্থান দেখিয়ে বললো, এগুলোতে সম্মিলিত বাহিনীর বাইরে প্রত্যেক রাজা-মহারাজারা তাদের অর্ধেক সৈন্যকে প্রহরায় নিয়োগ করবে।
আপনি ভীমপালের পিতা জয়পালকে পেশোয়ারের যে ময়দানে পরাজিত করেছিলেন, সম্মিলিত বাহিনী এখানে এসে আপনার মোকাবেলা করতে চায়। তারা লুঘমান পর্যন্ত প্রতিটি গিরিপথে ওদের সৈন্য বসিয়ে রাখবে, আমাদের সেনাদের ঘায়েল করতে এবং চোরাগুপ্তা হামলা করে আমাদের জনবল ধ্বংস করে দিতে। তারপরও যদি আমাদের সৈন্যরা বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যায়, তবে হোট ছোট দূর্গগুলোর রিজার্ভ সৈন্যরা আমাদের সেনাদের পথরোধ করবে।
‘লাহোরের ভীমপালের ইচ্ছা কী?’ তাশকীনকে জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।
“ভীমপাল আপনাকে খুব ভয় করে। তবে নেপথ্যে সে ওদের সাথে পুরোপুরি সহযোগিতায় আছে।” বললো তাশকীন।
“এমনটি তো তার করা উচিত।“ বললেন সুলতান। কারণ, পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে কে না চাইবে? হিন্দুস্তানের রাজপুতরা খুবই সাহসী ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। তাশকীন! তুমি কি বলতে পারো কবে নাগাদ সম্মিলিত বাহিনী একত্রিত হবে এবং অভিযান শুরু করবে।
‘ওদের প্রস্তুত হতে কমপক্ষে এক বছর লাগবে সুলতান। অবশ্য মাথুরার প্রধান পুরোহিত দ্রুত অভিযানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে তাকীদ দিচ্ছে।
‘ওরা লুঘমান আর পেশোয়ারে পৌঁছার জন্য আমরা অপেক্ষা করবো না।‘ বললেন সুলতান। আমরা মাথুরা ও কনৌজেই ওদের মুখোমুখি হবো…। তাশকীন। তুমি পুরো একমাস বিশ্রাম করো। তোমার শরীরের উপর দিয়ে মারাত্মক ধকল গেছে। এ কাজের জন্য তোমাকে মোটা অংকের পুরস্কার দেয়া হবে। অচিরেই পুরস্কার তোমার বাড়ীতে পৌঁছে দেয়া হবে। বললেন সুলতান। তুমি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে শরীরটাকে ঠিক করে নাও। এরই মধ্যে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সুলতান মাহমূদ সব সময় তার সেনাপতি ও সেনা কমান্ডারদের বলতেন, শত্রুদেরকে তাদের প্রস্তুতিরত অবস্থাতেই গিয়ে আক্রমণ করবে। এবারও তিনি সেনাপতি এবং কমান্ডারদের ডেকে বললেন, শক্রদেরকে প্রস্তুতরত অবস্থায় গিয়ে পাকড়াও করতে হবে।
শত্রুদের কখনো আক্রমণের সুযোগ দেয়া যাবে না। আমি আপনাদের আগেই বলেছি, হিন্দুস্তানের সকল রাজা-মহারাজা আমাদের বিরুদ্ধে মহা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা তাদেরকে এমন অবস্থায় গিয়ে পাকড়াও করতে চাই, যখন তারা সম্মিলিত বাহিনী তৈরীর জন্য সফরে থাকবে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে মাধুরা।
আমীর বিন তাশকীন আমাকে জানিয়েছে, মাথুরার বুতকে নাকি খুবই পবিত্র মনে করা হয় এবং মাথুরাই হলো তাদের প্রধান দেবতা শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি । শ্রীকৃষ্ণকে হিন্দুরা পয়গম্বর মনে করে।
তাশকীন আমাকে বলেছে, মাথুরায় শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি বানানো হয়েছে মর্মর পাথর দিয়ে এবং কৃষ্ণমূর্তির দুটো চোখ নাকি খুবই দামী হীরের তৈরী। গোটা হিন্দুস্তানের হিন্দুরাই নাকি কৃষ্ণমূর্তির পূজার জন্য মাথুরা গমন করে।
আমাদেরকে দ্রুত অভিযানে নামতে হবে। এবার আমরা পাঞ্জাব হয়ে যাবো না। পাঞ্জাবের মহারাজা আমাদের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে পূর্বের অবস্থানে নেই। রাজা ভীমপালও নাকি এই আক্রমণ প্রস্তুতিতে পুরোপুরি সহযোগিতা দিচ্ছে।
এবার আমাদের সফর হবে কাশীর হয়ে। পাঞ্জাবের পাশ দিয়ে অবস্থিত কাশ্মীরের পাহাড়ী অঞ্চল দিয়ে আমরা অগ্রসর হবো।
তোমাদের মনে রাখতে হবে, পথে আমাদের অন্তত সাতটি নদী পার হতে হবে। ছোট বড় অনেক পাহাড় ও জঙ্গল দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। আরো মনে রাখতে হবে, আমরা নিজের দেশ থেকে অনেক দূরে গিয়ে লড়াই করবো। সেখানে আমাদের কোন রসদ সাহায্য মিলবে না এবং কোন আসবাবপত্রের চালানও আমরা পাবো না। রাস্তা থেকেই আমাদের রসদ সংগ্রহ করতে হবে।
সুলতান মাহমূদ হিন্দুস্তানের মানচিত্র সামরিক কর্মকর্তাদের দেখিয়ে বললেন, ‘আমরা এই পথ দিয়ে অগ্রসর হবো। মাধুরা আমাদের লক্ষ্যবস্তু হলেও শুরুতে আমরা মাথুরাকে এড়িয়ে যাবো। মাধুরা আক্রমণের আগে আশপাশের ছোট ছোট রাজ্য ও দুর্গগুলোকে দখল করে নেবো।
আমাদের এ অভিযান কিন্তু সহজ হবে না। বললেন সুলতান। আমাদেরকে জীবন বাজি রাখতে হবে। কনৌজের মহারাজা, ভীমপালের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুনেছি, সে নিজে যেমন লড়তে পারে, তেমনি সৈন্যদেরকেও লড়তে জানে।
আমাদের যেসব গোয়েন্দা মাথুরার উৎসবে উপস্থিত হয়েছিল, তারা গণমানুষের মধ্যে গযনী সৈন্যদের সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে লাখো মানুষের জমায়েত হয়েছিল। সাধারণ লোকেরা এতোটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, গযনী সৈন্যদের আগমন খবর শুনলে ওরাই মানুষজনকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলবে।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কারো ধর্মীয় পবিত্র স্থানে আক্রমণ হলে অনুসারীরা জীবন বাজি রাখতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করে না।”
সুলতান মাহমূদ সেনাপতি ও কমান্ডারদের জরুরী দিক-নির্দেশনা দিয়ে মাত্র তিন দিন প্রস্তুতির সময় দিয়ে চতুর্থ দিন রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন।
১০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শনিবার মোতাবেক ৪০৯ হিজরী সনের ১৩ জুমাদিউল আউয়াল গযনী থেকে তাঁর সৈন্যরা রওনা হয়। এই অভিযানে তার সৈন্যসংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য পাওয়া যায়। উতবী লিখেছেন, এই অভিযানে সুলতান মাহমূদের নিয়মিত সৈন্য ছিল এগারো হাজার আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা কুড়ি হাজার। কিন্তু বাস্তবতার বিচারে তা যৌক্তিক মনে হয় না।
ঐতিহাসিক ফারিতা লিখেছেন, মাথুরা অভিযানে সুলতান মাহমূদের সৈন্যসংখ্যা ছিল একলাখ অশ্বারোহী এবং বিশ হাজর পদাতিক। এই বিশাল বাহিনী তিনি তুর্কিস্তান, খাওয়ারিজম, খুরাসান এবং প্রতিবেশী মুসলিম রাজ্যগুলো থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। গবেষক প্রফেসর মুহাম্মদ হাবীব বলেছেন, মাধুরা অভিযানে সুলতান মাহমূদের সৈন্যসংখ্যা ছিল একলাখ সওয়ারী ও পদাতিক এবং বিশহাজার ছিল স্বেচ্ছাসেবী।
বিশাল এই সেনাবহর প্রায় কয়েক মাইল দীর্ঘ ছিল। বিশাল এই বাহিনী সিন্ধু ও ঝিলম নদী ভরা বর্ষায় পার হয়েছিল। গরুগাড়ী ও ঘোড়াগাড়ী এবং মালবাহী গাড়ীগুলোকে নদী পারাপারের জন্য নৌকার সেতু বানানো হয়েছিল।
এই অভিযানে সুলতান একজন দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন অনুভব করলেন। তিনি বর্তমান কোটলী কাশ্মীর (কালাঞ্জর) এর রাজার কাছে এই পয়গাম দিয়ে দূত পাঠালেন যে, কনৌজ পর্যন্ত পৌঁছাতে তার একজন দক্ষ রাহবার (পথ প্রদর্শক) এর প্রয়োজন। কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষীও দূতের সাথে পাঠালেন সুলতান।
‘গযনীর সুলতান আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।‘ কোটলী কাশ্মীরের (কালাঞ্জর) রাজার দরবারে হাজির হয়ে রাজার উদ্দেশ্যে বললো সুলতানের প্রেরিত দূত। সুলতান আপনাকে সেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যে চুক্তিতে আপনি গযনীবাহিনীর যে কোন প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা করুতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
সুলতান আরো বলেছেন, আমার গন্তব্য অন্যদিকে, আপনি আমার এই বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আপনার রাজ্যে আসতে বাধ্য করবেন না। আপনি যদি স্বাধীনতা ও স্বাধিকার বজায় রাখতে চান, তবে দ্রুত আমার প্রয়োজন পূরণ করে দিন।
আমাকে এমন একজন রাহ্বার দিন, যে কোন অবস্থাতেই আমাকে ধোকা দেবে না। তার যে কোন ধরনের ধোকাবাজী বা চালাকীকে আমি আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা মনে করবো।’
সুলতানের পয়গাম শুনে রাজা চিন্তায় পড়ে গেলেন। দূত আবারো বললো, সুলতানের সাথে যে পরিমাণ সেনা রয়েছে, আপনার রাজ্যে হয়তো এ পরিমাণ মানুষও নেই।
কোটলী কাশ্মীরের রাজা চিন্তা দীর্ঘায়িত না করে তখনই তার ছেলে শাহীকে কারো মতে মালীকে দূতের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। রাজার ছেলে সুলতানের কাছে পৌঁছালে তিনি শাহীকে বললেন, তুমি সবচেয়ে কম সময়ে যাওয়া যায় এমন পথ দিয়ে আমাদের নিয়ে চল।
পথিমধ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট দুর্গ পড়লো। সুলতান এগুলোকে অবরোধ করে দুর্গপতিদের বললেন, তোমরা দুর্গ আমাদের কাছে হস্তান্তর করে দাও। অধিকাংশ দুর্গপতি অবরোধের আগেই সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল।
সুলতান মাহমূদ প্রত্যেক দুর্গ থেকে প্রয়োজন মতো মালসাম্রগী নিয়ে প্রতিটি দুর্গে কিছুসংখ্যক নিয়ন্ত্রণকারী রেখে সামনে অগ্রসর হলেন এবং এসব দুর্গের হিন্দু সৈন্যদেরকে ঠেলাগাড়ি ও রসদ পরিবহনের কাজে লাগালেন।
ইবনুল জাওযী লিখেছেন, মাথুরা অভিযানে সুলতানের সামনে যতো ছোট এবং মাঝারী দুর্গ পড়েছিল, সবই জয় করে তিনি সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ঐতিহাসিক স্যার আর্লস্টিন লিখেছেন, যেসব বনভূমিতে বাতাসও পথ হারিয়ে ফেলতো, সেইসব বনভূমি দিয়ে অনায়াসে সুলতান তার বিশাল সেনাবাহিনীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাঞ্জাব এলাকার পাঁচটি নদী যেনো তিনি উড়াল দিয়ে পেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্লাবনের মতোই বুলন্দ শহরে উপনীত হন।
পূর্বপরিকল্পনা মতো মাথুরাকে এড়িয়ে গেলেন সুলতান। ১০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর তিনি যমুনা নদী পার হলেন। যমুনা পার হওয়ার পর তার সামনে এলো সারসভা দুর্গ। তিনি দুর্গ অবরোধের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু দুর্গ অবরোধ সম্পন্ন হওয়ার আগেই দুর্গপতি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে গেল । দুর্গপতি পালিয়ে গেলে দুর্গের সৈন্যরা কোনরূপ বাধাবিপত্তি না দিয়ে সবাই হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করলো। এতে সুলতান ত্রিশটি জঙ্গীহাতি পেলেন।
এ পর্যন্ত এসে তার একটি ক্যাম্প দরকার ছিল। সুলতান বিনাযুদ্ধেই কাঙিক্ষত ক্যম্প পেয়ে গেলেন। এই দুর্গকে সুলতান তার রসদাগার বানিয়ে নিলেন এবং দুর্গের ধনাগার থেকে তিনি খাজনা হিসেবে পেলেন দশ লাখ দিরহাম।
সারসভাকে রসদাগার করে সুলতান বুলন্দশহরের দিকে রওনা হলেন। তাদের অবস্থান থেকে বুলন্দশহর অন্তত একশো মাইল দূরে ছিল। সেখানে পৌঁছাতে তাদের দুটি নদী পেরিয়ে যেতে হবে। একটি গঙ্গা, অপরটি গঙ্গা নদীর শাখা রামগঙ্গা। সুলতান রসদপত্র রাখার জন্য সুরক্ষিত দুর্গ হাতে পাওয়ার কারণে তিনি রসদপত্রকে আর টেনে নেয়া সমীচীন মনে করলেন না। তিনি শুধু অস্ত্র ও সেনাদের সাথে নিলেন। কয়েদীদের দিয়ে নৌকার সেতু তৈরী করিয়ে সৈন্যসামন্ত পার করে বুলন্দশহর অবরোধ করলেন।
বুলন্দ শহরের শাসক ছিল হরিদত্ত। এই হরিদত্ত কনৌজের মহারাজাকে বলেছিলেন, তার একজন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছে, কন্নৌজের মহারাজার একান্ত কর্মকর্তা জগন্নাথ আসলে মুসলমান এবং গযনী সুলতানের দক্ষ গোয়েন্দ। চম্পারাণীর সাথে তার গোপন সম্পর্ক রয়েছে। হরিদও হিন্দুস্তানের অন্যান্য রাজা-মহারাজাদের মতোই মন্দিরের বৈঠকের পর অীকার করেছিল হিন্দুধর্ম ও মহাভারতের পৌত্তলিকতা বজায় রাখতে সে জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করবে। কিন্তু বুলন্দশহরের অধিবাসীরা যখন জানতে পারলো, গযনীর সৈন্যরা অবরোধ করেছে, তখন সাধারণ লোকজনের মধ্যে দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে গেল। শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। চারদিকে দেখা দিল হৈ চৈ। এই আতঙ্ক ছড়িয়েছিল গযনীর কৌশলী গোয়েন্দারা।
সুলতান মাহমুদ দুর্গের প্রধান ফটকে তার লোকজন পাঠিয়ে ঘোষণা করালেন, শহরের সকল সশস্ত্র লোকেরা যদি হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে শহরকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করা হবে।
জঙ্গীহাতিগুলোকে প্রধান ফটকে ধাক্কা মেরে ফটক ভাঙার জন্য সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিলেন সুলতান। রাজা হরিদত্ত এই অবস্থা দেখে দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার পেছনে দশ হাজার সেনাও হাতিয়ার ফেলে দিয়ে হাত উঁচু করে এসে রাজার পেছনে দাঁড়াল। হরি দত্তকে সুলতানের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে সুলতানের উদ্দেশ্যে সে বললো
“আমি নিজের, আমার জাতিগোষ্ঠী ও জনগণের নিরাপত্তা চাই। আমি এবং আমার এই দশ হাজার সৈন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণে আগ্রহী। দয়া করে আপনি আমাদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করুন।”
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, আসলে এই দশ হাজার সৈন্য ছিল না। এদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ নাগরিক। তারাই হরিদত্তকে বাধ্য করেছিল শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যেননা তিনি শান্তিচুক্তি করেন। যদি রাজা তা না করেন, তাহলে নাগরিকরা তাদের অনুগত সৈন্যদের দিয়ে প্রধান ফটক খুলে দেয়ার ব্যবস্থা নেবে। কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন, রাজা হরিদত্ত ধোকা দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
* * *
সুলতান মাহমূদ দশ হাজার লোেকের এই বাহিনীর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করলেন এবং রাতের বেলায় গঙ্গা নদী পারাপারে তাদের ব্যবহার করলেন। নদী পেরিয়ে তিনি মাথুরাকে পাশ কাটিয়ে মহাবনের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি আগেই খবর পেয়েছিলেন মহাবনের রাজা কুয়ালচন্দ্র যুদ্ধের জন্য তার সৈন্যদেরকে প্রস্তুত করে রেখেছেন। ঘন জঙ্গল ছিল স্থানীয় শাসক কুয়াল চন্দ্রের বিরাট সহায়ক। তার সেনারা জঙ্গী হাতিগুলোকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিল।
সুলতান মাহমূদ জঙ্গলকে এড়িয়ে তার সেনাদের একটি বড় অংশকে জঙ্গলের দুই প্রান্তে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি শুধু অগ্রবর্তী দলকে জঙ্গলের ভেতরে এমনভাবে প্রবেশ করালেন দেখে মনে হবে তারা মহাবনের সেনাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে একেবারেই বেখবর।
সুলতানের অগ্রবর্তী সেনারা যখন জঙ্গলের মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছল তখন কুয়ালচন্দ্র তার সৈন্যদেরকে আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে দিল। সুলতানের অগ্রবর্তী দলের সকল সৈন্য ছিল অশ্বারোহী। আক্রমণ শুরু হতেই তারা সবাই জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ল। জঙ্গল ছিল খুব ঘন। এখানে তীরন্দাজদের তীর তেমন কার্যকর কোন ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না। ওরা যখনই তীর ছুঁড়তে সুলতানের যোদ্ধারা খুব সহজেই তাদের লক্ষ্যচ্যুত করে ফেলতো।
এমতাবস্থায় হঠাৎ করে কুয়াল চন্দ্রের সৈন্যদের উপর ডানবাম এবং পেছন দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ শুরু হলো। শত্রুদের উপর স্বগোত্রীয়দের ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু হতেই সুলতানের অগ্রবর্তী সৈন্যরা এদিক ওদিক সটকে পড়ল। হিন্দু সৈন্যদের তখন সুলতানের সৈন্যদের হাতে কাটা পড়া নয়তো পালিয়ে প্রাণ বাঁচানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিল না।
ঐতিহাসিক স্যার আর্লস্টিন এই যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে লিখেন, এতো বিশাল জঙ্গল হওয়ার পরও গযনীর হাজার হাজার সৈন্য কুয়ালচন্দ্রের সৈন্যদের খোঁজে জঙ্গলে চিরুণী অভিযান চালাল। জঙ্গলের পিছনে ছিল গঙ্গানদী। যে গঙ্গানদী পেরিয়েই পথ ঘুরে সুলতানের বাহিনী কুয়ালচন্দ্রের বাহিনীকে পেছন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে কুয়াল চন্দ্রের সৈন্যরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল; কিন্তু তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় ছাড়া অধিকাংশই সুলতানের সৈন্যদের হাতেই প্রাণত্যাগ করল।
রাজা কুয়ালচন্দ্রকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। মুসলিম সৈন্যরা যখন বিজয়ী বেশে তার প্রাসাদে প্রবেশ করল, তখন রাজপ্রাসাদের পাহারাদার তাদের জানাল, রাজার ছিল একজনই মাত্র স্ত্রী ও একটি মাত্র সন্তান। তিনি তরবারী দিয়ে উভয়কে হত্যা করে নিজেই নিজের তরবারী বুকে বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করেন।
রাজমহলের পাহারাদার মুসলিম সৈন্যদেরকে প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে তাদের মৃতদেহ দেখাল। মহাবন থেকে এ পঁচাশিটি হাতি এবং বিপুল পরিমাণ সোনাদানা সুলতানের হস্তগত হলো।
মাথুরা সম্পর্কে সুলতানের দুধর্ষ গোয়েন্দা আমীল বিন তাশকীন তাকে জানিয়ে দিয়েছিল, মাথুরা শহরের প্রতিরক্ষাদেয়াল খুবই মজবুত। কাজ মহারাজার দু’টি সেনাদলই মূলত মাথুরার নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। মহাবনে রাজাও তাদের সহযোগিতা করেন। সারসভা ও বুলন্দশহরের শাসকরা এমন আত্মশ্লাঘা অনুভব করতো যে, কেউ তাদের উপর বহিরাক্রমণ করে মাথুরা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। কারণ, প্রকৃতিগতভাবে যমুনা ও গঙ্গা নদী মাথুরার সুরক্ষার ব্যবস্থা বিরাট সহায়ক ছিল।
ইতিহাস বলে, সুলতান মাহমূদ অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আগে চারপাশের ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে পরাজিত করে পথের সব বাধা-বিপত্তি দূর করেন। এরপর প্রতিবন্ধক মহাবনের সামরিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মাথুরার দিকে অগ্রসর হন।
তিনি দূর থেকে মাথুরা শহরকে দেখে বিস্মিত হয়ে দারুণ! দারুণ!! বলে চিৎকার করেন। এরপর একদিন তিনি গযনীর গভর্নরকে মাথুরা শহরের সৌন্দর্য এবং হিন্দুদের নির্মাণনৈপুণ্য সম্পর্কে লিখেন, মাথুরা নগরীর স্থাপনা ও নির্মাণশৈলী এখানকার অধিবাসীদের বিশ্বাসের মতোই মজবুত ও বাহারী। এখানকার অধিকাংশ ধর্মীয় স্থাপনা মর্মর পাথরে তৈরী। গঠনশৈলী দেখেই বোঝা যায়, এসব মন্দির ও ইমারত যেনতেন ভাবে তৈরী হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বছরের পর বছর সময় ও বহু শ্রমের বিনিময়ে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব স্থাপনা তৈরীতে হিন্দুরা কোটি কোটি দিনার খরচ করেছে। মন্দিরগাত্রে নিপুণ কর্মকৌশলে ফুটিয়ে তুলেছে হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস। কোন কোন স্থাপনা তৈরীতে হয়তো শত বছরও ব্যয় করা হয়েছে। বস্তুত এই শহরের রূপ-সৌন্দর্য আমার পক্ষে কোন ভাষায়ই বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
মাথুরা পর্যন্ত পৌঁছাতে সুলতানের তেমন কোন জনবল ব্যয় করতে হয়নি, যার ফলে অনেকটা নিশ্চিত ও দৃঢ়চিত্তে তিনি মাথুরার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। মহাবনের পালিয়ে আসা সৈন্যদের অনেকেই মাথুরা শহরে পৌঁছে মুসলিম সৈন্যদের সম্পর্কে ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। অপরদিকে গোয়েন্দা হিশাম ও তার সঙ্গীরাও লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল।
মহাবন থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যরা মাথুরায় এসে লোকজনের মধ্যে এমনই ভীতি ছড়িয়ে দিলো, ‘গযনী বাহিনীর সামনে বিশাল বটবৃক্ষও টিকে থাকতে পারবে না।’
এসব আতঙ্ক ছড়ানোর ফলে শহরের অধিবাসীরা প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা না করে জীবন বাঁচাতে এবং বিপদ অপসারণের জন্য মন্দিরগুলোতে গিয়ে জমায়েত হয়ে বিপদঘন্টা বাজাতে শুরু করলো।
গযনীর সৈন্যরা মাথুরা শহর অবরোধ করলে সামান্য প্রতিরোধ হলো বটে; কিন্তু তা গযনী বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে বানের খড়কুটোর মতোই ভেসে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই খুলে গেল শহরের প্রধান গেট। সুলতান মাহমুদ বিজয়ীবেশে শহরে প্রবেশ করে প্রথমেই গেলেন মাগুরার প্রধান মন্দিরে। সেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও বাসুদেবের অতি মূল্যবান মূর্তি প্রতিস্থাপিত ছিল। এই মূর্তিগুলো ছিল খুবই মূল্যবান উপাদানে তৈরী। এ দুটি মূর্তির গঠন ছিল অস্বাভাবিক সুন্দর। খুবই দামী ও উজ্জ্বল হীরে দিয়ে বানানো হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ ও বাসুদেবের মূর্তি। কৃষ্ণমূর্তির দুটি চোখ ছিল দীপ্তিময় হীরের দ্বারা গঠিত। পাঁচটি বিশাল মূর্তি ছিল সম্পূর্ণ সোনার তৈরী এবং এগুলোর চোখে ছিল দামী হীরে। এই হীরের তৎকালীন বাজার মূল্য ছিল পঞ্চাশ হাজার দিনার।
সবচেয়ে ছোট মূর্তিটিতে পাঁচশ কেজি সোনা ছিল। একটি মূর্তিকে গলিয়ে পাওয়া গিয়েছিল ৯৮০০০ (আটানব্বই হাজার) গ্রাম সোনা। এ ছাড়া একশ। মূর্তি ছিল সম্পূর্ণ রুপার তৈরী।
বিজয়ী সুলতান মাহমূদ পাথরের মূর্তিগুলোকে ভেঙে ফেললেন এবং সোনার মূর্তিগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে গলিয়ে ফেললেন। হিন্দুদের এই পবিত্র শহর থেকে পৌত্তলিকতার বিষময় উপাদান দূর করতে তিনি কুড়ি দিন মাথুরা শহরে অবস্থান করলেন। এই কুড়ি দিন পর্যন্তই শহরের বিভিন্ন স্থাপনা জ্বলছিল এবং মাথুরা শহর একটি ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
এদিকে মহারাজা কনৌজ সুলতানের আগমন খবর শুনে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে জোর চেষ্টা চালাতে লাগলেন। কারণ, সুলতানের পরবর্তী লক্ষ্য কনৌজ। এবার কনৌজের মহারাজা রাজ্যপালের পালা।
তৃতীয় খণ্ড সমাপ্ত