তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ
হিজরতের পর প্রথম দশকে আমরা ইয়াসরিবে নতুন একটি রাষ্ট্রের সূচনা দেখতে পাই। মক্কায় তের বছর ধরে নবি মুহামদের লক্ষ ছিল মানুষের নিকট ইসলাম প্রচার করা, উপদেশ দেয়া ও শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা। ইয়াসরিবে এসে তার নবুওতের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে। মানুষকে প্রভাবিত করে তাদেরকে নতুন ধর্মীয় বিধি গ্রহণ করানো মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ-পর্যায়ে এসে সকল ধরনের কৌশলই প্রয়োগের বিবেচনা করা হয়েছিল। আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার যেসব ধারা শেখানো হয়েছিল তা এখানে গুরুত্ব রাখেনি।
সেসময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, বিনা উস্কানিতে হামলা এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট উপগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ যারা মোটেও আগ্রাসী মনোভাবের ছিল না। গুপ্তচরেরা জানিয়েছিল এরা মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণু হতে পারে। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই এধরনের সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। কুরাইশদের বাণিজ্যিক গাড়িবহরে হামলার মাধ্যমে মুহাজিররা অনেক দিন থেকে লাভবান হয়েছিলেন। এতে যেমন কুরাইশরা আহত হয়েছিল, তাদের পণ্য দখল করা গিয়েছিল তেমনি মুহাজিরদের সামরিক দক্ষতা ও মর্যাদা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল; এবং সর্বোপরি সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকেও ভয় দেখানো সম্ভব হয়েছিল। ওই একই সময়ে ইসলামের বেশিরভাগ আইন ও বিধিবিধান প্রকাশ করা হয়েছিল এবং ইসলামি অর্থনৈতিক ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল।
নবি মক্কায় থাকাকালে কোনো আইন প্রয়োগ করা হয়নি। ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার এ-প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন : মক্কায় যা নাজিল হয়েছে তা একটি নতুন ধর্মের সূচনা করে না। মক্কায় নাজিল হওয়া কোরানের আয়াতগুলোর বেশিরভাগই ধর্মপ্রাণ হওয়ার, একমাত্র আল্লাহর উপাসনা ও প্রশংসা করা, অন্যদের প্রতি খেয়াল রাখা এবং পানাহারের ক্ষেত্রে পরিমিত পরিমাণ বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মক্কায় শুধু পাঁচটি ফরজ পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যেমন : (এক) এক আল্লাহর অস্তিত্বে এবং নবিদের কাজে বিশ্বাস রাখা, (দুই) নামাজ পড়া, (তিন) জাকাত প্রদান করা। তখন স্বেচ্ছায় মুক্তহস্তে দানের মাধ্যমে এটা করা হতো। (চার) রোজা রাখা। তখন ইহুদিদের মতো করে পালন করা হতো। (পাঁচ) হজ। তখনকার কাবা ঘর পরিদর্শনের কথা বোঝানো হয়েছে।
বিশিষ্ট তফসিরকারক জালালউদ্দিন সুয়তির মতে মক্কায় থাকাকালীন সময়ে ইসলামি আইনে কোনো শাস্তির নির্দেশ ছিল না। কারণটা স্বাভাবিক। কোনো আইন তখনো কার্যকর হয়নি। আল-তাবারির মতে যে সুরাগুলোতে কোনো ধরনের আইনগত বাধ্যবাধকতা করে দেয়া হয়েছে সেগুলো নিঃসন্দেহে মদিনায় নাজিল হয়েছে। বিবি আয়েশাকেও বলতে শোনা গিয়েছে, মক্কার কোরানের একমাত্র বিষয় ছিল বেহেশত আর দোজখ। হালাল আর হারামের নীতিমালা ইসলামের প্রসারের পর সৃষ্টি করা হয়েছে।
নবির জীবনের শেষ দশকে যে আইন ও নীতিমালা প্রণিত হয়েছে তা ইসলামকে শুধু যে আইনগত অনুমোদন দিয়েছে তাই নয় একটি আরব রাষ্ট্র গঠনের রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছে। নবির প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল নামাজের জন্য কিবলাকে জেরুজালেমের সবচেয়ে দূরের মসজিদ (আল-আকসা মসজিদ) থেকে সরিয়ে মক্কার কাবা শরিফের দিকে নিয়ে আসা। ফলে ইহুদিদের থেকে পৃথকভাবে ধর্মাচরণ করা সম্ভব হয়। এতে করে ইসলাম ধর্মের স্বতন্ত্রতা তৈরি হওয়ার ফলে মদিনার মুসলমানরা হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারে। আরবের প্রায় সকল গোষ্ঠী কাবা শরিফকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত। পৌত্তলিক উপাসনালয় থেকে কাবা একসময় সকল আরবীয়দের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম ও ইসমাইলের ঘরে পরিণত হয়। রোজা রাখার ক্ষেত্রেও নবি ইহুদিদের নিয়ম অনুসরণ থেকে সরে আসেন। মহরম মাসের দশম দিন থেকে রোজা রাখার নিয়ম পরিবর্তন করে রমজান মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে পুরো রমজান মাসই রোজা রাখা হবে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শাস্তি ও ক্ষতিপূরণসহ আরও বিভিন্ন ফৌজদারি আইন প্রণয়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নাপাক, খৎনা এবং খাদ্য ও পানীয়ের উপর নিষেধাজ্ঞার আইনগুলোও এসময় প্রণীত হয়। যদিও এসব আইনের বেশিরভাগই ইহুদি বা অন্যান্য পৌত্তলিক আরবীয় আইন থেকেই নেয়া হয়েছিল তবুও স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য বেশ কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন এখানে আনা হয়েছিল। ইহুদি ও পৌত্তলিকতার ছোঁয়া থাকলেও এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এসবের উদ্দেশ্য ছিল সমাজে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্র-সম্প্রদায়ের সবার মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা। প্রত্যেক সম্প্রদায় বা জাতির সভ্যতার মধ্যেই অন্য সম্প্রদায়ের সভ্যতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিটি ধর্মেই বেশকিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান থাকে যা সম্পাদনের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। এগুলোর সংগঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছুটা হলেও কোনো ধরনের গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই মক্কার উদ্দেশ্যে হজযাত্রা এবং সেখানে গিয়ে হাজিদের পালন করা আচার-আচরণের পিছনে কোনো দার্শনিক যুক্তি খুঁজে পান না।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে নবি মুহামদের কাবার উদ্দেশ্যে যাত্রার সিদ্ধান্তটি বেশ আশ্চর্যজনক ছিল। তিনি কি সত্যিই কাবাকে ‘আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করতেন? না-কি তার যেসব অনুসারীর কাছে কাবা দর্শন করা প্রাচীনকাল থেকে মেনে চলা এক ঐতিহ্য ছিল, তাদের জন্যই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল কুরাইশদের সাথে হতাশাজনক হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে। সেই কুরাইশদের সাথে যারা মুসলমানদেরকে কাবা শরিফে প্রবেশে বাধা দিতো। তাহলে ওই সিদ্ধান্ত কি মুসলমানদের সামরিক শক্তি দিয়ে কুরাইশদের মোড়লিপনা থামাতে এবং সাধারণ মক্কাবাসীকে নিজের নতুন ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য নেয়া হয়েছিল? যে ব্যক্তি নিজের নতুন ধর্ম ও আইনকে আরব জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং নিজের কাছের মানুষদের সকল ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে ছুড়ে ফেলেছিলেন, তিনিই আবার কিভাবে পুরানো ধর্মের প্রধান অংশটিকে নতুন মোড়কে তার নিজের ধর্মে যোগ করলেন? ইসলামের প্রধান স্থপতি ও আইনপ্রণেতা নিরাকার বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদকে সবার উপরে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন, মানুষকে বলে এসেছেন যে, এক আল্লাহের ওপর বিশ্বাসই সফলকাম হওয়ার একমাত্র পথ। তিনি বলেছেন : . তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি সাবধানি। (৪৯:১৩)। তবে কি নবি জাতিগত অনুভূতিতে বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন? কাবা ঘরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকে কি তিনি আরবের জাতীয় পরিচিতির প্রতীক বানাতে চেয়েছিলেন? যাই হোক না কেন, এই সিদ্ধান্তটি এতটাই বিস্ময়কর ও ইসলামি নিয়ম-নীতি হতে বিচ্যুত ছিল যে মুসলমানদের অনেকেই কিছুটা মনোক্ষন্ন হয়েছিলেন। অনেকেই সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে চলাচলের নিয়মের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ এটা আরবীয় পৌত্তলিকদের ধর্মাচার ছিল। কিন্তু সুরা বাকারা-এর এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলামে স্থায়ীভাবে স্থান দেয়া হয়েছিল : নিশ্চয় দুটি পাহাড় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। (২:১৫৮)।
হজের সময় হজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরে চুমু খাওয়া সম্পর্কে একটা বহুল প্রচলিত হাদিস আছে। নবির সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান সাহাবিদের অন্যতম হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাব ওই কালো পাথরকে উদ্দেশ্য করে একদা বলেছিলেন ; আমি জানি তুমি একটা পাথর ছাড়া কিছুই নও, মানুষকে সাহায্য করা বা ক্ষতি করার তোমার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি আল্লাহর রসুলকে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে কখনো চুম্বন করতাম না। বরং কাবাঘর হতে বহিষ্কৃত করে তোমাকে দূরে নিক্ষেপ করতাম। সূত্র ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ২, বুক ২৬ নম্বর ৬৬৭- অনুবাদক)। প্রভাবশালী ইসলামি দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি’ হজ সম্পর্কে বলেছেন, তিনি হজের আনুষ্ঠানিকতার কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পাননি, কিন্তু তারপরও তা করেছেন, কারণ এটা একটি প্রতিপাদিত ঘটনা। ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণকারী সুফি সন্ন্যাসী রাবেয়া বসরি (৭১৭-৮০১ খ্রিস্টাব্দ) হজ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “হজে গিয়ে আমি শুধু ইট আর একটি ভবন দেখেছি। এর থেকে আমি কি পুণ্য অর্জন করবো?” পারস্যের বিশিষ্ট সুফি সাধক বায়োজিদ বোস্তামি (৮০৪-৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ) হজে যাবার পূর্বে এক বৃদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করেন। বৃদ্ধ ব্যক্তি তাঁকে বলেছিলেন: “আমাকে ঘিরে সাতবার প্রদক্ষিণ কর। কাবাতে গিয়ে তাওয়াফ করা আর আমাকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করা একই কথা। সুবিধা হলো তোমার সময় বাঁচবে আর দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে। বায়েজিদ তাই করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। FE : Benjamin Walker, Foundations of Islam: The Making of a World Faith, Rupa & Co, Nwe Delhi, India, 2002, pp. 216, – অনুবাদক) । কোরানের সুরা তওবা-তে একটি আয়াত আছে যা এই ধোঁয়াশার ওপর কিছুটা আলোকপাত করে। হে বিশ্বাসীগণ! অংশীবাদীরা তো অপবিত্র; তাই এ-বছরের পর তারা যেন মসজিদ-উল-হারামের কাছে না আসে। যদি তোমরা দারিদ্রের ভয় কর তবে জেনে রাখো আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদের অভাব দূর করতে পারেন। (৯:২৮)। তফসির আলজালালাইন-এর বক্তব্য অনুযায়ী এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ আরবদেরকে বিজয় ও সম্মান দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন। এই সুরা (তওবা) সময়ের ক্রমানুসারে কোরানের সর্বশেষ সুরা। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দ বা হিজরি ১০ সালে মক্কা বিজয়ের পর এটি নাজিল হয়েছিল। অমুসলিম গোষ্ঠী কর্তৃক মক্কা ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের কারণে মক্কার মানুষদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কথা ছিল। কারণ তাদের ব্যবসার প্রতিপত্তি ও জীবন-জীবিকার মান অন্যান্য আরবীয় গোষ্ঠীর নিয়মিত ভ্রমণের উপর নির্ভর করত। যদিও মক্কাবাসীরা এবং নবি একই গোষ্ঠীর ছিলেন তবে তাদের বেশিরভাগই মুসলিম হয়েছিলেন বাধ্য করার কারণে। মক্কা যদি তার জৌলুশ হারাতো, তবে ইসলাম-ত্যাগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ারও ঝুঁকি ছিল। তাই মুসলমানদের জন্য মক্কা-ভ্রমণকে (হজ) বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার মাধ্যমে এই ঝুঁকিকে প্রশমিত করা হয়েছে। এমন বিশ্লেষণকে আপাতত শুধু অনুমান-নির্ভর বলা যায়। এ-বিষয়টি আসলে কতটুকু সত্য তা শতভাগ কখনো জানা যাবে না। ইসলামের হজ-ব্যবস্থায় পূর্বের পৌত্তলিকদের রেওয়াজ বহাল রাখার কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। বিশ্বনন্দিত আরব কবি আবুল-আলা আল-মারি**হজনিয়ে মন্তব্য করেছেন এভাবে: ‘এই পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। (শয়তানের প্রতি) পাথর ছুড়তে আর কালো পাথর চুম্বন করতে। কী উদ্ভট কথাই না তারা বলে! তবে কি সত্য অবলোকন করতে গিয়ে মানুষ অন্ধত্ব বরণ করেছে।
মদিনায় সুরা-পান ও জুয়া খেলা নিষিদ্ধকরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এবং তা প্রয়োগ করা হয়েছিল। মদিনায় শুরুর দিকে জাকাত প্রদানকে কেন ঐচ্ছিক ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এক পর্যায়ে নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে জাকাতকে কর আদায়ের অন্যতম প্রক্রিয়ায় কেন রূপান্তরিত করা হয়েছিল তা বুঝতে পারা মোটেও কঠিন কিছু না। আর ওই একই সময়ে ধর্মীয় যুদ্ধ বা জিহাদকে আইনগত ভিত্তি প্রদান করা হয়েছিল যার সদৃশ আর কোনো বিধান ছিল না। প্রথমে যুদ্ধের অনুমতি শুধুমাত্র সুরা হজে এই আয়াতের মাধ্যমে দেয়া হয়েছিল: “যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। ( ২২:৩৯)।
এক পর্যায়ে ক্রিয়াপদগুলোকে নির্দেশনামূলক বানিয়ে ও বাক্যের ভাবকে আরও জোরালো করে যুদ্ধকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সুরা বাকারা, সুরা আনফাল, সুরা তওবাসহ বিভিন্ন মাদানি সুরাতে বলপ্রয়োগের নির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে। লক্ষণীয় হচ্ছে মক্কি সুরায় পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে মাদানি সূরাগুলো এমন সব বিষয় দিয়ে পূর্ণ, যা পাঠ করলে মনে হয় অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে জিহাদ করা অনেক বেশি বাধ্যতামূলক নবি আরবদের নিয়ন্ত্রণ করা ও তাদের নিয়ে তরবারি ব্যবহার না করে একটি ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করা কতটা কঠিন তা বুঝতে পেরেই এই সিদ্ধান্তটি বেছে নিয়েছেন। কারণ সমগ্র আরবের মূল সংস্কৃতির মধ্যে যুদ্ধ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে গাঁথা। তাই আরবীয়দের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে যুদ্ধকে অস্বীকার করার কোনো পথ ছিল না। জিহাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে মানুষের মূল্যবান মানবিক অধিকারগুলোকে অবজ্ঞা করার প্রয়োজন হতো। যেমন চিন্তা করার স্বাধীনতা বা ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের স্বাধীনতা। আর এ-কারণে আরবের আশেপাশে বিভিন্ন অঞ্চলে সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছিল, যেগুলোর জবাব দেয়া সহজ ছিল না। যেমন, একটি ধর্ম বা মতবাদ প্রচার বা পালনে মানুষকে তরবারির দ্বারা বাধ্য করা কতটুকু যৌক্তিক? মানবিকতা ও ন্যায় বিচারের নীতির সাথে এগুলো কি আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ?
স্পষ্টত আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অনাচার ও ভ্রষ্টাচার বিভিন্ন আঙ্গিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। তবে নূ্যনতম প্রজ্ঞার অধিকারী কোনো ব্যক্তির কাছে সাধারণ মানুষের চিন্তার বা বিশ্বাস করার স্বাধীনতাকে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক কেড়ে নেয়ার চেয়ে নির্মম ও অযৌক্তিক স্বৈরাচার আর কিছু হতে পারে না। প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে কোনো শাসকের অমানবিক প্রচেষ্টাকেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষকেও শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় চিন্তা করতে বা শাসকগোষ্ঠীর মতবাদ অনুসারে চলতে বাধ্য করা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সকল জাতিকেই কোনো না কোনো সময় এ ধরনের পীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সংকীর্ণ অবস্থানে দেখেছি। এমন প্রবণতা সাধারণ জনগণের মধ্যেও দেখা যায়, যখন তারা অন্যের মতামত ও বিশ্বাসকে মূল্য দিতে অপারগ হয়ে স্বৈরাচারী নীতিতে নিজেরাও বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। মানবজাতির ইতিহাসে বিভিন্ন অন্ধকার যুগের সূত্রপাত এই ধরনের রক্ষণশীল পন্থার কারণেই হয়েছিল। এই উগ্রতা বা গোঁড়ামি মানুষদের ভিন্নমতাবলম্বী অন্য মানুষকে পোড়াতে, শিরোচ্ছেদ করতে, ফাঁসিতে ঝোলাতে, অঙ্গহানি করতে ও বন্দী করে রাখতে এমনকি জাতিগত গণহত্যা সাধনেও উদ্বুদ্ধ করেছে। বর্তমান যুগে আমরা বিভিন্ন দেশে নাৎসি ও কমিউনিস্ট শাসকদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার ঘটনা উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই।
ইতিহাসের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়েছে এ-নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যে প্রশ্নটি এখানে চিন্তার উদ্রেক ঘটায় তা হলো মানবাধিকারের এই লঙ্ঘনগুলো কি আধ্যাত্মিক স্রষ্টার দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তিনি তো পূর্বে জানিয়েছিলেন : ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। (২:২৫৬)। এছাড়া তার সিদ্ধান্ত হচ্ছে : . . . যার ধ্বংস হওয়ার কথা সে যেন (সত্যাসত্যের) প্রমাণ স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যার জীবিত থাকার কথা সে যেন (সত্যাসত্যের) প্রমাণ স্পষ্ট প্রকাশের পর জীবিত থাকে। (৮:৪২)। আল্লাহ তো নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “আমি তোমাকে বিশ্বের জন্য আশীৰ্বাদ হিসেবে পাঠিয়েছি। (২১:১০৭) এবং তুমি অবশ্যই সুমহান চরিত্রের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছ। (৬৮:৪)।
মক্কায় থাকাকালীন ৯০ তম সুরা বালাদ নাজিলের সময় আবুল আসাদ নামের একজন দাম্ভিক ব্যক্তির কথা পূর্বে বলা হয়েছে। তার বিপুল সম্পদ ছিল। শারীরিকভাবেও তিনি অনেক শক্তিশালী ছিলেন। ওকাজ মেলায় তিনি কাপেটের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিতেন, যদি কেউ তার পায়ের নিচ থেকে ওই কার্পেট সরাতে পারে তবে তাকে বড় অঙ্কের অর্থ পুরস্কার দেয়া হবে। যুবকেরা অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন দিক থেকে কাপেট টানাটানি করত। কিন্তু কার্পেট ছিড়ে না যাওয়া পর্যন্ত টানতে থাকত আর আসাদ যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন সেখান থেকে কেউ তাঁকে সরাতে পারতেন না। এমন দাম্ভিক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা সত্ত্বেও সুরা বালাদে নবি মুহাম্মদের অগাধ বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোরানের এই সুরার সুমিষ্টতা অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা যায় না। তথাপি এই সুরার ৪ থেকে ১৭ নম্বর আয়াতের অর্থ দুর্বল অনুবাদের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করছি ; আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করেই সৃষ্টি করেছি। সে কি মনে করে যে কেউ কখনও তাকে কাবু করতে পারবে না? সে বলে, আমি প্রচুর ধনসম্পদ ব্যয় করেছি। সে কি মনে করে যে তাকে কেউ দেখেনি?আমি কি তাকে দুটো চোখ, জিহা আর ঠোঁট দিইনি? আর দুটো পথই কি আমি তাকে দেখাইনি? সে তো কষ্টসাধ্য পথ অবলম্বন করেনি? তুমি কি জান কষ্টসাধ্য পথ কী? সে হচ্ছে, দাসমুক্তি কিংবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান এতিম আতীয়কে বা দুর্দশাগ্রস্ত অভাবীকে; তার ওপর তাদের শামিল হওয়া যারা বিশ্বাস করে, পরস্পরকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেয় ও উপদেশ দেয় দয়াদাক্ষিণ্যের।’ (৯০৪-১৭)।
যে পৈত্রিক-ধর্মত্যাগী ব্যক্তি মক্কায় তার নিজস্ব বিশ্বাস ও অন্যদের প্রতি আল্লাহর অনুকম্পা প্রচার করে গিয়েছেন দীর্ঘ তের বছর ধরে, সেই মানুষটিই মদিনায় গিয়ে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যুদ্ধের নির্দেশ দিতে থাকলেন: তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেয়া হল। (২:২১৬), . . . যে সত্যধর্ম অনুসরণ করে না তাদের সাথে যুদ্ধ করবে…’ (৯:২৯), কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম চাইলে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না… (৩.৮৫), ‘যখন তোমরা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে মোকাবিলা কর তখন তাদের ঘাড়েগর্দানে আঘাত করো। শেষে যখন তোমরা ওদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করবে তখন ওদেরকে শক্ত করে বাঁধবে…। (৪৭:৪)
এরকম কয়েক ডজন কঠোর আয়াত মদিনায় নাজিল হয়েছিল। মক্কায় ‘লোহার মূল্য’ উল্লেখ করা হয়নি, তবে মাদানি সুরা হাদিদ-এ বলা হয়েছে: আর আমি দিয়েছি লোহা, যার মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য নানা উপকার; আর এ এজন্য যে, আল্লাহ যেন জানতে পারেন কে না-দেখে তাঁকে ও তার রসূলদেরকে সাহায্য করে। (৫৭:২৫)। এ আয়াত থেকে মনে হতে পারে, মক্কায় হয়তো নবির কাছে লোহা (লোহা দিয়ে তৈরি অস্ত্র) ছিল না, কিংবা লোহা ব্যবহারের সুযোগ ছিল না কিংবা আল্লাহ রসুলের দুর্ভোগ চিহ্নিতকরণের উপায় নির্ধারণে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। মক্কায় থাকতে আল্লাহ মুহাম্মদকে আদেশ করেছিলেন: ‘তুমি মানুষকে হিকমত ও সৎ উপদেশ দিয়ে তোমার প্রতিপালকের পথে ভাক দাও ও ওদের সাথে ভালোভাবে আলোচনা করো। তার পথ ছেড়ে যে বিপথে যায় তার সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক ভালো করেই জানেন। আর যে সৎপথে আছে তাও তিনি ভালো করে জানেন। ( ১৬:১২৫)।
এভাবে একটি আধ্যাত্মিক কাঠামো থেকে ইসলাম ক্রমেই আক্রমণ-প্রতিরক্ষাভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। ইসলামের অগ্রযাত্রা গাজওয়া থেকে লব্ধ মালামাল ও জাকাতের মাধ্যমে অর্জিত রাজস্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মদিনায় হিজরতের পরে নবির যাবতীয় পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্তগুলো একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে নেয়া হয়েছে। অবশ্য যুদ্ধবন্দী হত্যা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ তার নির্দেশে সংঘটিত বেশকিছু কাজই বিদেশি পণ্ডিতদের কাছে নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে।
বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে নবি অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছিল, তিনি কি এই যুদ্ধবন্দীদের কিছু মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিবেন, যার মাধ্যমে ইসলামের যোদ্ধাদের বেতন দেয়া যেতে পারে? নাকি তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা উচিত হবে? নাকি তাদেরকে গৃহবন্দী করে রাখা হবে? তখন বাস্তববাদী ও দূরদর্শী সাহাবি হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাব (যাকে ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়) পরামর্শ দিলেন, যুদ্ধবন্দীদের মেরে ফেলাই যৌক্তিক হবে। ওমরের মতে মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তি দেয়া ঠিক হবে না, কারণ এতে করে তারা পুনরায় শত্রুপক্ষের বাহিনীতে যোগ দিয়ে আরও তীব্রভাবে যুদ্ধ করতে পারে। আবার এদেরকে দাস হিসেবে রাখলে বা অন্তরীণ করে রাখলে তাদের পাহারা দিয়ে রাখার পেছনে অনেক খরচ হবে প্রতিনিয়ত। তাই যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করলে তাদের সমস্ত গোষ্ঠী যেমন ভয় পেয়ে যাবে তেমনি ইসলামের সামরিক মর্যাদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। সূরা আনফালের এই আয়াতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়: দেশে সম্পূর্ণভাবে শক্র নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দি রাখা কোনো নবির পক্ষে সমীচীন নয়। তোমরা চাও পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান পরলোকের কল্যাণ। (৮৬৭)।
বদর যুদ্ধে বন্দীদের মধ্যে দুইজন হচ্ছেন কুরাইশ বংশের বিখ্যাত সাহিত্যিক নদর বিন আল-হারিস এবং ওকুবা বিন আবু মোয়াইত। উল্লেখ্য নদর বিন আল-হারিস একসময় আল হিরার লাখমিদ রাজদরবারের রাজকবিও ছিলেন। তিনি ফেরদৌসি নামের একটি মনোমুগ্ধকর কবিতাও লিখেছিলেন। নদর পূর্বে বিভিন্ন সময় কোরানের সুরার মতো কবিতা লেখার দাবিও করেছিলেন। তিনি দাবি করতেন, কোরানের আদ-সামুদ-লুতের বর্ণনার চেয়ে তিনি আরও সুন্দর করে পারস্যের বিখ্যাত রুস্তমইসফানদার এররাজকীয়ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী-গাথা বলতে পারেন। নবি নদর ও ওকবা দুজনকে শিরোচ্ছেদ করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সাহাবি আল-মিক্দাদ বিন আমর চেয়েছিলেন নদরের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দিতে। তিনি নবিকে বললেন, “এই লোক আমার বন্দী। তাই সে আমার গনিমতের মাল হিসেবে বিবেচ্য। নবি মিক্দাদকে জিজ্ঞেস করলেন, নদর লোকটি কোরানের আয়াত নিয়ে পূর্বে যেসব কটুক্তি করেছে, তা কি ভুলে গেছ? নদর সম্পর্কে কোরানে মন্তব্য করা হয়েছে: যখন তাদের কাছে আমার আয়াত আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, “আমরা তো শুনলাম, ইচ্ছা করলে আমরাও এরকম বলতে পারি, এ তো শুধু সেকালের উপকথা। (৮:৩১)। শেষ পর্যন্ত নদরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। মিকুদাদও তার উপর থেকে নিজের দাবি তুলে নিয়েছিলেন। নদরের মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল। এর পরে যাত্রা বিরতিতে কবি ওকবা বিন আবু মোয়াইতকে নবির সামনে হাজির করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ আসিম বিন সাবিতকে দেয়া হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিককার নবির জীবনী-লেখক ইবনে ইসহাক তার সিরাত রসুল আল্লাহ’ বইয়ে জানিয়েছেন, সাহাবি আসিম বিন সাবিত ওকবা বিন মোয়াতকে হত্যা করতে উদ্যত হলে ওকবা কাঁদতে কাঁদতে নবিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমি মারা গেলে আমার সন্তানদের কি হবে? নবি উত্তরে বলেছিলেন: জাহান্নামের আগুন। [ দ্রষ্টব্য ; মুসলিম শরিফ, চ্যাপ্টার ৩৮, বুক নম্বর ১৯ নম্বর ৪৪২১-৪৪২২ – অনুবাদক)।
মক্কা বিজয়ের পর নবি মুহাম্মদের পক্ষ থেকে বিরুদ্ধবাদীদের জন্য একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে সেখানে কিছু ব্যতিক্রম ছিল। ছয়জন পুরুষকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যার নির্দেশ দেয়া হলো। এমনকি কাবা ঘরে দেখলেও তা প্রযোজ্য ছিল। এরা হচ্ছেন : সাফওয়ান বিন উমাইয়া, আব্দুল্লাহ বিন আল-খাতাল, মিকাস ইবনে সাবাবা আল-লায়থি, ইকরিমা বিন আবু জেহেল, আল হুরায়েস ইবনে নুকায়েদ বিন ওহাব এবং আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ। শেষোক্ত ব্যক্তি মদিনায় হজরত উসমানের পিতামাতা কর্তৃক পালিত সন্তান ছিলেন। তিনি একসময় নবি মুহাম্মদের বেশ প্রিয়ভাজন ব্যক্তি ছিলেন। বিভিন্ন অনুলিখনের সময় নবি একবার এক আয়াতের শেষে যখন বলেছিলেন ; এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ (আরবিতে আজিজ’, ‘হাকিম) শব্দগুলো যোগ করার জন্য, আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ বাক্যটি সংশোধন করে পরামর্শ দিলেন, এবং আল্লাহ সব জানেন ও বিজ্ঞ’(আরবিতে আলিম’, ‘হাকিম) লেখার জন্য। নবি অমত করলেন না, লেখার অনুমতি দিলেন। কোরান আল্লাহর বাণী হলে নিশ্চয়ই কারো পক্ষে পরিবর্তন-সংযোজন করা সম্ভব নয়। তাহলে আব্দুল্লাহ বিন সাদের মতো একজন সাধারণ অনুলেখক কোরানের আয়াতের পরিবর্তন করে চলছেন, এটা সাদের মনেও সন্দেহ সৃষ্টি করে। তিনি কোরানের অলৌকিতায় সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই ইসলাম ত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের দলে যোগদান করেন। পারস্যের ফার্স রাজ্যে জন্মগ্রহণকারী ইসলামি পণ্ডিত ও কাজি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর আলবায়দাওয়ি (মৃত্যু ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দ) তার “আছরার উত-তাজিল ওয়া আছরার উত-তায়িল শিরোনামের কোরানের তফসিরে বলেছেন : নবি একদিন কোরানের সুরা মুমিনুন-এর ১২ থেকে ১৪ পর্যন্ত আয়াত লেখার জন্য আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহকে বললেন। আয়াতগুলো হচ্ছে : ‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে। তারপর তাকে বীর্যরূপে এক নিরাপদ আধারে রাখি, পরে আমি বীর্যকে তৈরি করেছি একটি জমাট রক্তপিণ্ডে, তারপর রক্তপিণ্ড থেকে মাংসপিণ্ড তৈরি করেছি, তারপর মাংসপিণ্ড থেকে হাড় তৈরি করে, অতঃপর হাড়গুলোকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। ( ২৩:১২-১৪)। নবি এতটুকু বলার পর আব্দুল্লাহ বিন সাদ বলে উঠলেন, নিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান!” নবি বললেন, “এই বাক্যটি লাগিয়ে দাও। আবদুল্লাহ বিন সাদ তখন হতবাক হয়ে গেলেন। মানুষের বক্তব্য কোরানের আয়াতে সংযুক্ত হয় কিভাবে? তার মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। আল্লাহর নামে প্রচারিত কোরানের বাণী তাহলে কার? শেষে আব্দুল্লাহ বিন সাদ ইসলাম ত্যাগ করে কুরাইশ দলে যোগ দিয়ে প্রচার করতে থাকেন; ‘কোরান আল্লাহর ঐশীবাণী নয়, এটা নবি মুহাম্মদের নিজস্ব বক্তব্য। আমি নিজেও কোরানের কয়েকটি আয়াত সংশোধন করে দিয়েছি। পারস্যের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আল-তাবারি (৮৩৯-৯২৩ খ্রিস্টাব্দ) কোরানের ৬ নম্বর সুরা আনআম-এর ৯৩ নম্বর আয়াতের তফসিরে আব্দুল্লাহ বিন সাদ- এর “মুরতাদ হয়ে যাওয়া নিয়ে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তার বহুল প্রচারিত হিস্ট্রি অব আল-তাবারি’বইয়ে (ইংরেজিতে অনুদিত দ্যা লাস্ট ইয়ারস অব দ্যা প্রফেট, ভলিউম ৯, পৃ. ১৪৮) আব্দুল্লাহ বিন সাদ- এর মুরতাদ হয়ে যাওয়া এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ আছে। – অনুবাদক)।
তথাপি আব্দুল্লাহ বিন সাদের ভাগ্য ভালো। মক্কা বিজয়ে পর হত্যা- তালিকায় নাম থাকার সংবাদ তিনি দুধভাই হজরত উসমানের মাধ্যমে পেয়ে যান। প্রাণ বাঁচাতে ভীত আব্দুল্লাহ বিন সাদ হজরত উসমানের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। উসমানও দুধভাইকে রক্ষার জন্য মক্কা বিজয়ের তাৎক্ষণিক উত্তেজনা প্রশমনের আগ পর্যন্ত কিছু দিন লুকিযে রাখেন। পরে তিনি একদিন সুযোগ মতো সাদকে নিয়ে নবির সামনে উপস্থিত হন ও তাঁকে ক্ষমা করে দেবার অনুরোধ জানান। দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর নবি সম্মতিসূচক উত্তর প্রদান করেন। নবি হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন উসমানের মধ্যস্থতা মেনে নেন। ইরাকের বাগদাদে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত ইবনে সাদ আল-বাগদাদি (৭৮৪-৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ) তার কিতাব আল-তাবাকাত আল-কবির বইয়ে (ভলিউম ২, পৃ. ১৭৪) উল্লেখ করেছেন, হজরত উসমান তার দুধভাইকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কয়েকজন সাহবি যখন নবিকে তার এই দীর্ঘ নীরবতার কারণ জিজ্ঞাসা করেন, নবি উত্তরে বলেন: আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি প্রাণভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আমি ভেবেছিলাম আব্দুল্লাহ বিন সাদ আমার সামনে এসে কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়াবেন এবং তোমাদের মধ্যে কেউ একজন তার গর্দান কেটে ফেলবে। এমনটা বলার কারণ হলো নবি পূর্বেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, যেকোনো স্থানে সাদের রক্ত ঝরানো জায়েজ হবে, যদি তা কাবা শরিফের পর্দায় লেগে যায় তাহলেও সমস্যা নেই। মদিনার এক আনসার নবির বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বললেন: নবি কেন ইশারা করেননি? নবি পুনরায় জানালেন, আল্লাহর রসূলদের চোখ মিথ্যা হতে পারে না। অর্থাৎ তিনি নীরব থাকার ভান করে চোখ দিয়ে হত্যা করার ইশারা দিতে পারেন না। হজরত উসমান খলিফা হওয়ার পর আব্দুল্লাহ বিন সাদকে উত্তর আফ্রিকা আক্রমণে আরব সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। এই যুদ্ধে আব্দুল্লাহ বিন সাদ তার দায়িত্ব এতো সুচারুরূপে পালন করেছিলেন যে উসমান মিশর দখলকারী আমর ইবনে আল-আসকে সরিয়ে আব্দুল্লাহ বিন সাদকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
হত্যা- তালিকায় উল্লেখিত আব্দুল্লাহ বিন আল-খাতালসহ তার ফারহানা ও কারিবা নামের দুইজন দাসীও ছিলেন। যারা নবিকে ব্যঙ্গ করে গান গাইতেন। তাদের তিনজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা ও সারা নামের দুইজন নারীকে একই কারণে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সারাবানু আব্দুল মোতালেব গোত্রের আমর বিন হাশিমের মুক্তদাসী ছিলেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা নবির প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়ায় তাঁকে ক্ষমা করা হয়েছিল। আর মুক্তদাসীসারা নবির কাছে অনুনয়-বিনয় করে প্রাণভিক্ষা পেলেও পরে হজরত ওমর তাঁকে ঘোড়ার নীচে পদদলিত করে হত্যা করেন।
বানু-নাজির গোত্রের ইহুদি কাব বিন আল-আশরাফের হত্যাকাণ্ডের কথা পূর্বে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। কাবের পিতা ছিলেন তাঈ গোত্রের এবং মাতা বানু-নাজির গোত্রের। বদরের যুদ্ধের পর ইসলামের ক্রমবর্ধনশীলতা দেখে কাব মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কুরাইশদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং লড়াই অব্যহত রাখার অনুরোধ জানান। কিছুদিন পর ৬২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন এবং মুসলিম নারীদের নিয়ে প্রণয়াত্মক কবিতা লিখেন। এ কবিতায় তিনি নিজের কামজনিত ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছিলেন। নবি এসংবাদ শুনে ক্ষুব্ধ হন। তিনি সাহাবিদেরকে বলেন, “আমার হয়ে কাব বিন আল-আশরাফকে শায়েস্তা করার জন্য কে আছ? তখন মুহাম্মদ বিন মাসলামা নামের একজন সাহাবি নিজের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। নবি তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন। মুহাম্মদ বিন মাসলামার সাথে ছিলেন আবু বিন জবর আল-হারিস বিন আউস, আব্বাস বিন বশির এবং কাবের এক জ্ঞাতি ভাই আবু নায়েলা। আবু নায়েলাকে সঙ্গে রাখার কারণ ছিল কাব যেন সন্দেহ করতে না পারেন এবং ইয়াসরিবের শেষ প্রান্তে অবস্থিত তার সুরক্ষিত বাড়িতে লুকিয়ে না থাকেন। নবি শহরের শেষ মাথা পর্যন্ত তাদের সাথে যান এবং সেখান থেকে তাদের বিদায় জানিয়ে আল্লাহর নিকট তাদের সাহায্য করার জন্য দোয়া করেন। মাসলামার নেতৃত্বে তারা কাবের বাড়ির ভেতরে ঢুকেন। আবু নায়েলাকে দেখে কাব বিন আল-আশরাফ সন্দেহ করেননি। তিনিও তাদের সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে কথা বলতে থাকেন এবং শহরের দিকে হাঁটতে থাকেন। এক- পর্যায়ে মাসলামাসহ বাকিরা কাবের ওপর চড়াও হন এবং ধস্তাধস্তির পর তাকে হত্যা করেন। ইয়াসরিবে পৌছে মাসলামা দেখেন নবি গভীর রাত অবদি জেগে আছেন এবং শুভ সংবাদের অপেক্ষা করছেন। হজরত জাবির বিন আব্দুল্লাহর বর্ণীত হাদিস অনুযায়ী . . . . মুহাম্মদ বিন-মাসলামা দুজন সঙ্গী (আবু বিন জবর আল-হারিস বিন আউস এবং আব্বাস বিন বশির) নিয়ে প্রথম দিন কাব বিন আল-আশরাফের কাছে গিয়ে বললেন, “ওই মানুষটি (নবি মুহাম্মদ) আমাদের কাছে কর দাবি করছেন, তিনি আমাদেরকে বড়ই জ্বালাতন করছেন। কাব বললেন, ঈশ্বরের কসম! ওই লোকটির উপদ্রবে তোমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। মাসলামা বললেন, ‘যেহেতু আমরা তাকে নবি বলে মেনে নিয়েছি, তাই সহজে ছেড়ে আসতে পারি না। আমরা এখন দেখার অপেক্ষায় আছি কোন পথে কিভাবে তার ধ্বংস হয়। আমরা এসেছি তোমার কাছে, তুমি যদি এক বস্তা খাদ্য আমাদের কর্জ দিয়ে সাহায্য করো। কাব রাজি হলেন। মাসলামা যাবার আগে বললেন, “আমরা আগামীকাল আসবো। পরের দিন গভীর রাতে তারা আসলেন। পথিমধ্যে মাসলামা তার সঙ্গীদেরকে বললেন, আমি যখন কাবের মাথা দুহাতে চেপে ধরবো তখনি তোমরা তাকে আক্রমণ করবে। কাব ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, এতো গভীর রাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কাব বললেন, আমার বন্ধুরা এসেছে একটু সাহায্য চায়। কাবকে নিয়ে ঘর হতে বের হওয়ার পর কিছু দূর গিয়ে মাসলামা বললেন, কী দারুণ মিষ্টি সুগন্ধ তোমার চুলে, আমি কি একটু শুকে দেখতে পারি? সহাস্য মুখে গর্বিত কণ্ঠে কাব বললেন, আরব দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী আমার ঘরে, তাই এই সুগন্ধ! মাসলামা চুলের সুগন্ধ শুকার ভান করে চুলসহ কাবের মাথা শক্ত করে দুহাতে চেপে ধরেন। সাথে-সাথে সঙ্গীরা দুদিক থেকে কাবের পাঁজর বরাবর তরবারি ঢুকিয়ে দেন। তারপর মাসলামা কাবের মস্তক কেটে নবির পায়ের কাছে নিয়ে রাখলেন। দ্রষ্টব্য : বুখারি শরিফ, ভলিউম ৫, বুক ৫৯, নম্বর ৩৬৯ – অনুবাদক)।
আরেকজন প্রভাবশালী ইহুদি ও আউস গোত্রের পুরনো বন্ধু সালাম বিন আবিল হুকায়েক ইয়াসরিব থেকে খায়বার চলে গিয়েছিলেন। খাজরাজদের কয়েকজন ওই ইহুদি নেতা সালামকে হত্যার অনুমতি প্রার্থনা করেন। নবি অনুমতি দেন এবং আব্দুল্লাহ বিন আতিককে দলের নেতা হিসেবে নিয়োগ দেন। তারা তাদের কাজ ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন করেছিলেন এবং ফিরে আসার পর নবিকে সমস্বরে ‘আল্লাহ মহান বলে সংবাদটি প্রদান করেছিলেন। কাব ও সালাম নিহত হওয়ার পর আরেকজন ইহুদি ধর্মাবলম্বী ইয়াসির বিন রেজামকে হত্যা করার জন্য আব্দুল্লাহ বিন রাওহার নেতৃত্বে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। ইয়াসির খায়বারে গিয়ে বেদুইনদের একটি বড় গোষ্ঠী বানু গাতাফানকে নবির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উৎসাহিত করছিলেন। হোজায়েল গোষ্ঠীর নেতা খালেদ বিন সুফিয়ান নাখলায় নিজের গোত্রের লোকদেরকে নবির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উস্কানি দিয়েছিলেন। নবি সংবাদটি শুনে আব্দুল্লাহ বিন ওনায়েসকে পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্দেশ দেন। পরে খালেদকে হত্যা করা হয়।
রেফা বিন কায়েস নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালে নবি ক্ষুব্ধ হন এবং ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আব্দুল্লাহ বিন হাদ্রাদকে নির্দেশ দেন। আব্দুল্লাহ প্রথমে তীর ছুড়ে রেফাকে হত্যা করেন, পরে কুড়াল দিয়ে মস্তক আলাদা করে ফেলে নবির সামনে নিয়ে আসেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে হত্যার জন্য মক্কার একজন পেশাদার খুনি আমর ইবনে উমাইয়াকে নিয়োগ করা হয়। আবু সুফিয়ান বিষয়টি টের পেয়ে পালিয়ে যান। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও আমর ইবনে উমাইয়া আবু সুফিয়ানকে হত্যা করতে পারেননি। উমাইয়া রাগের মাথায় একজন নিরীহ কুরাইশকে হত্যা করেন এবং অন্যজনকে গ্রেফতার করে ইয়াসরিবে নিয়ে যান। ১২০ বছর বয়সী একজন বয়োবৃদ্ধ আবু আফাককে হত্যা করা হয়েছিল কারণ তিনি নবির সমালোচনা করেছিলেন। নবির নির্দেশে সালেম বিন ওমর এই কাজ করেছিলেন। বয়োবৃদ্ধ মানুষকে হত্যা করায় ইয়াসরিবের ইহুদি নারী কবি আসমা বিনতে মারওয়ান ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি বানু খাতমা গোত্রের অধিবাসী। তার স্বামী ইয়াজিদ বিন জায়েদ, এবং পাঁচটি সন্তান নিয়ে তাদের সংসার। আসমা বিনতে মারওয়ান নবির বিরুদ্ধে একাধিক কবিতা লিখে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি ইয়াসরিববাসীকে উত্তেজিত করতে চেয়েছিলেন মুহাম্মদের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে। বদর যুদ্ধের পর ইসলামের প্রসার মেনে নিতে পারেননি। তিনি কবিতায় আউস, খাজরাজসহ ইয়াসরিবের বিভিন্ন গোত্র, যারা নবিকে সহযোগিতা করতেন এবং যারা নিস্পৃহ ছিল উভয়কে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিককার নবির জীবনী-লেখক ইবনে ইসহাক তার সিরাত রসুল আল্লাহ (ইংরেজিতে অনুদিত দ্যা লাইফ অব মুহাম্মদ) বইয়ে বলেছেন, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসের ২৫ তারিখ নবির নির্দেশে উমায়ের বিন আদিয়া আল-খাতামি ঘুমন্ত অবস্থায় পাঁচ শিশুসন্তানসহ আসমা বিনতে মারওয়ানকে হত্যা করেন।
বদর যুদ্ধের দুই বন্দী আবু আজ্জা আল-জুমাহি ও মুয়াবিয়া বিন মুগিরাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়ে ইয়াসরিবে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন নবি। ওহুদের যুদ্ধে নবি-বাহিনীর পরাজয় হলে মুয়াবিয়া পালিয়ে আত্মগোপন করেন এবং আবু আজ্জা পুরোপুরি মুক্তির জন্য আবেদন করেন। নবি তৎক্ষণাৎ আবু আজ্জাকে এবং মুয়াবিয়া বিন মুগিরাকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করেন। উভয় নির্দেশই পালন করা হয়। জোবায়ের বিন আল-আওয়াম আবু আজ্জার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।
ইয়াসরিবের খাজরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের প্রথম দিকে ইসলামের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ক্রমে যখন ইসলামের প্রসার বাড়তে থাকে, নবির সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় তখন তিনি তখন মুহাম্মদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। তিনি নবি মুহামদের বিরোধিতা করে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচার করতে শুরু করেন। মুসলমানরা তাঁকে মুনাফেকদের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করেন। এক পর্যায়ে হজরত ওমর খাজরাজের নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবায়েরকে হত্যা করাই উচিৎ বলে মন্তব্য করেন। তবে নবির আরেক অনুসারী, খাজরাজ গোত্রের সাদ বিন উবায়দা আব্দুল্লাহর প্রতি সদয় হবার অনুরোধ করেন। তিনি আরও বলেন, “আমাদের শাসক হবার ইচ্ছা যাতে আব্দুল্লাহ বিন উবায়েরের পূরণ না হয়, সেজন্য আল্লাহই আপনাকে আমাদের কাছে প্রেরণ করেছেন। অন্যথায় আমরা এতোদিন তার মাথায় মুকুট পরিয়ে তার হাতে সীলমোহর তুলে দিতাম।
বর্তমানকালের মিশরীয় বুদ্ধিজীবী মুহামদ হোসেন হায়কলের (১৮৮৮-১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ) লেখা দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ নামের নবি মুহাম্মদের জীবনী-গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : নবি হজরত ওমরের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমি যদি তখন তোমার কথা অনুসরণ করে আব্দুল্লাহ বিন উবায়কে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করতাম তবে তার গোত্রের আত্মীয়-স্বজনেরা প্রতিশোধ নেবার জন্য আমাদের ওপর আক্রমণ করত। কিন্তু আমি এখন আদেশ দিলে তার আত্মীয়রা বরং সেটা আগে পালন করবে। হায়কলের মতে, আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের এর ছেলে অন্য কারো হাতে নিজের পিতার মৃত্যু দেখার চেয়ে নিজেই তার পিতাকে হত্যা করতে আগ্রহী ছিলেন। নবি নির্দেশ দিলে তিনি নিজেই এমনটা করবেন বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মিশরীয় ইসলামি পণ্ডিত জালালউদ্দিন আল-সুয়তি (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) মন্তব্য করেছেন, কোরানের সুরা নিসা-এর ৮৮ নম্বর আয়াতটি আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের প্রেক্ষিতে এসেছে: তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে যে, তোমরা মুনাফিকদের সম্বন্ধে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলে, যখন আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন? আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তোমরা তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও? আসলে আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোনো পথ পাবে না। (৪৮৮)। সুয়তির বর্ণনায়, আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের প্রতি ক্রোধের কারণে নবি তার অনুসারীদের বলেছিলেন যে, লোকটি সবসময় নিজ বাড়িতে প্রতিপক্ষ শিবিরের লোকজন নিয়ে বৈঠক করেন এবং বিপদ ঘটানোর চেষ্টা করেন, সে লোকটিকে সরিয়ে দিতে কেউ রাজি আছেন কি-না? ঘটনাক্রমে আব্দুল্লাহ বিন উবায়কে একসময় ক্ষমা করা হয়। এরপর তিনি হিজরি ৯ সালে (৬৩১ খ্রিস্টাব্দ) মারা যান। নবি তার শেষকৃত্যের আয়োজনও করেছিলেন।
যেসব হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র পরাক্রম প্রদর্শন কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে সংগঠিত হয়েছিল, সেগুলোকে কৌশলে অনেক সময় অনেকে ইসলামের জন্য নিবেদিত সেবা বলে চালিয়েছেন। যেমন ইয়াসরিবে এক ইহুদি দোকানদার ভালো ব্যবসা করতেন। অনেক মুসলমান ক্রেতার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। যেদিন নবি বানু কুরাইজা গোত্রের সকল ইহুদি পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দেন, সে-সময় মুহায়সা বিন মাসুদ দৌড়ে এসে ইবনে সুনাইনা নামের ওই নিরীহ দোকানদারটিকে হত্যা করেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য মুহায়সা বিন মাসুদকে একজনই মাত্র তিরস্কার করেছিলেন, সে হচ্ছে তার আপন ভাই।
অষ্টম হিজরিতে রোমানদের বিরুদ্ধে যখন সমর অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছিল তখন নবির কাছে বার্তা আসে, শোয়ালেম নামের এক ইহুদির বাড়িতে বেশকিছু লোকের সমাগম হয়েছে। কিভাবে রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের এই যুদ্ধ প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। নবি তখন সাহাবি তালহা বিন ওবায়দুল্লাহসহ কয়েকজনকে সে-বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। একজন মাত্র মানুষ আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিলেন। কিন্তু পালাতে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। সুরা তওবার একটি আয়াতে যেসব মুসলিম গরমের কারণে এই অভিযানে যোগ দিতে পারেনি, তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে: আর তারা বলল, গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না। বলো, জাহান্নামের আগুনই সবচেয়ে গরম। (৯:৮১)।