সকালবেলা একটুখানি বৃষ্টি হইছে।
বৃষ্টির পর থেকে সারাবাড়িতে লেবুপাতার গন্ধ। রান্নঘরের পিছন দিকটায়, ভাঙনের দিকে একটা বাতাবি লেবুর ঝোঁপ। সেই ঝোঁপ থেকে আসছে গন্ধটা। বৃষ্টির পর আথকা
লেবুপাতার গন্ধ ছুটছে ক্যান কে জানে!
এই গন্ধে মনের ভিতর আনন্দটা অনেকখানি বাইড়া গেছে পারুর। ট্রে-তে কইরা আতাহারের জন্য নাস্তা নিয়া যাবে বাংলাঘরে। শাশুড়ি মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে নিজ থেকেই সংসারটা নিজের হাতে নিয়া নিছে পারু। সে এই বাড়ির বড়বউ ছিল। এখন মাজারো বউও হবে। শাশুড়ি বেবাক কিছু ঠিক কইরা দিয়া গেছেন। তিনি বাঁইচা থাকতে আলাদা সংসার আছিল পারুর। মোতাহার বাইচা থাকা অবস্থায় সংসার ভাগ কইরা দিছিলেন শ্বশুরে। সে মারা যাওয়ার পরও ওই অবস্থাই ছিল। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর কিছুদিন সেই অবস্থা চলছে, তারপর একদিন নিজ থেকেই পুরা সংসার নিজের হাতে নিয়া নিল পারু। কারণ সংসারটা এলোমেলো হইয়া গেছিল। রহিমা এই বাড়ির পুরানা ঝি। সংসার ভালই সামলায়। তাও শাশুড়ি বাঁইচা থাকতে তিনি দেখাইয়া দিতেন সব। কোনদিন কী রান্না হইবো বইলা দিতেন। আতাহার কী তরকারি পছন্দ করে, মান্নান মাওলানা কোন মাছ পছন্দ করেন এইসব বইলা দিতেন। তার কথা মতন রান্দনবাড়ন করতো রহিমা। তিনি মারা যাওয়ার পর বেবাক কিছু উলটাপালটা হইয়া গেছে। রহিমা বুঝতে পারে না। কোনদিন কী নাস্তা হইবো বাড়িতে, দুপুরে মাছ তরকারি কী হইবো, রাত্রে কী হইবো? রোজই এইসব নিয়া আতাহারের রাগারাগি, মান্নান মাওলানার রাগারাগি। একদিন দুপুরে খাইতে বইসা তরকারি পছন্দ হয় নাই দেইখা ভাতের থাল ফিক্কা (ছুঁড়ে) ফালাই দিছে আতাহার। আরেক দিন রাত্রে পারলে রহিমারে থাবড় মারেন মান্নান মাওলানা। তরকারিতে নুনকাটা হইছে।
এই অবস্থা দেইখা পারু নিজ থেকে বিয়ানবেলা একদিন রান্নঘরে আইসা ঢুকছে। রহিমারে লইয়া পরোটা বানাইছে, সুজির হালুয়া বানাইছে সেন্টুর দোকানের খাঁটি ঘি দিয়া। লগে ঘন দুধের চা। খাইয়া আতাহার বেদম খুশি, মান্নান মাওলানা বেদম খুশি। পারুর পোলাপান তিনটাও খুশি। বিয়ানবেলা ভাল নাস্তা খাওয়ার পর আনন্দে মন ভইরা গেল। বাড়ির লোকজনের। মান্নান মাওলানা বাজারে গিয়া বড় একখান শোলমাছ কিনা আনলেন। সেই মাছ ছোট ছোট টুকরা কইরা, বেশি বেশি তেল মশলা আর পিয়াজ দিয়া ভুনা করছে। লগে ঘন মুশরি ডাইল, উস্তাভাজি, লেবু ঝোঁপ থেকে একখান লেবু ছিড়া আইনা, পিরিচে কইরা একটুকরা লেবু, দুই-তিনখান কাঁচা মরিচ আর ছোট গোল পিঁয়াজ চোকলা ছাড়াইয়া এত সুন্দর কইরা আতাহার আর মান্নান মাওলানার সামনে দিছে পারু, একদিকে সুন্দর। কইরা সাজাইয়া দেওয়ার খাবার অন্যদিকে এত ভাল রান্ধন, দুপুরেও বেবাকতে খুশি।
তারপর থেকে নিজের সংসার রান্দনবাড়ন কেমনে কেমনে বন্ধ হইয়া গেল পারুর। নিজের অজান্তেই মান্নান মাওলানার সংসারে ঢুইকা গেল তার সংসার। দুইদিন পর। আতাহারের লগে বিয়া হইলে তো এইটাই হইবো। দুইদিন বাদে যেইটা হইবো সেইটা দুইদিন আগেই হইলো।
এইভাবেই চলছে সংসার। তয় একখান অন্য কারবারও এর লগে লগে হইছে। রাত্রে আতাহার আর পারুর মিলামিশাটা একটুখানি কমছে। এইটা অবশ্য পারুই করছে। এই বর্ষাকাল শেষ হইলে, শীতের দিনের মাঝামাঝি বিয়া হইবো আতাহারের লগে। তারপর তো রোজ রাত্রেই একলগে থাকবো। তখন তো আর কোনও অসুবিধা নাই। এইজন্য এখন একটু সবুর করা ভাল। তাও একদম যে মিলামিশা চলছে না তাও না। চলছে। তয় আগের মতন ঘনঘন না। একটু রইয়া সইয়া।
শাশুড়ি মারা যাওয়াতে বিয়াটা পারুর দেরি হইয়া গেল। তিনি বাঁইচা থাকলে এতদিনে বিয়া হইয়া যাইতো। কারণ এই ধরনের বিয়াতে তেমন ধুমধাম হয় না। মাইনষে হাসাহাসি করে। পারু আর আতাহারের ঘটনা দেশগ্রামের অনেকেই জানে। এইসব নিয়া কথাবার্তা আড়ালে আবডালে বলে, সামনাসামনি বলে না মান্নান মাওলানা আর আতাহারের ডরে। তারপরও ধুমধাম কইরা বিয়া হইলে হাসাহাসি মাইনষে করবো। বিয়া হইবো একেবারেই ঘরোয়া ভাবে। মান্নান মাওলানার নিজের বাড়ির মানুষজন, মাইয়া মাইয়ার জামাইরা আর নাতি নাতকুড়, ওইদিকে পারুর মা বাপ ভাই বইন, বইনজামাই আর পোলাপান। পুরানা আত্মীয়। তাও দুইদিককার। প্রথমে একটু দূরের আত্মীয় তারপর হইল বিবাহসূত্রের আত্মীয়। একদিন আগে পারুদের বাড়ির সবাই এই বাড়িতে আসবো, একদিন থাইকা মাইয়া বিয়া দিয়া চইলা যাইবো। শুরু হইবো পারুর নতুন জীবন। বেবাক ছেঁড়াভেড়া হইয়া গেল হরির মরণে।
তয় এইসব নিয়া দুঃখ নাই পারুর। ব্যবস্থা তো যা করার তিনি কইরা দিয়া গেছেন। তিনি বাইচা থাকলে এই বর্ষাকালেই বিয়া হইয়া যাইতো। কেরায়া নৌকা লইয়া বেসনাল। গ্রাম থেকে পারুর মা বাপ ভাইবইন, বইনজামাই আর পোলাপানরা আসতো বিয়ার দিন আর তার আগে পরের দুইদিন, তিনটা দিন কাটত বেদম আনন্দে। তারপর যে যার মতন ফিরা যাইত, বাড়িতে পুরানা অবস্থাই নতুন কইরা ফিরত আসত। আগে পারু আতাহার পলাইয়া পলাইয়া যা করত ওইটা তখন জায়েজ হইয়া যাইবো।
শীতের দিনের বিয়ায় অবশ্য মজা বেশি। মানুষের চলাফিরায় সুবিধা। কাপড়চোপড় পরায় সুবিধা। বর্ষাকালে বিষ্টি বাদলায় বিরাট অসুবিধা। তারপরও বিয়া তো আল্লাহপাকের হাতে। তিনি যখন আদেশ করবেন তখনই হইবো। হউক শীতের দিনে। কয়েকটা মাস দেরি করতে পারুর কোনও অসুবিধা নাই। আতাহার যখনই রাতেরবেলা তার কাছে যায়, এইসব নিয়া কথা বলে সে। এখন কোনও কোনওদিন দিনেরবেলাও বলে। আতাহার ক্যান য্যান এইসব নিয়া কথা বলতে চায় না।
পারু বললে সে খালি মিচকা (মুচকি) হাসি দেয়। দুয়েকদিন পারু তারে ধরছে। আমি ওই হগল কথা কইলেই তুমি এমুন মিচকা হাসি দেও ক্যা? ঘটনা কী?
আতাহার তারপরও হাসে। আমার শরম করে। এইডা শরমের হাসি।
কীয়ের শরম?
বড়ভাইর বউর লগে বিয়া হইতাছে।
ইস ঢং। বড়ভাইর বউর লগে পিরিত করনের সমায় শরম করে নাই, বড়ভাইর বউর পেডে তিনহান পোলাপান পয়দা করতে শরম করে নাই, অহন বিয়ার কথা হুইন্না তার শরম করে। দিমু খেচা পেডের মইদ্যে।
আইজ সকালে বাংলাঘরে আতাহারের জন্য নাস্তা নিয়া যাইতে যাইতে এই কথাগুলি। মনে হইল পারুর। বেলা অনেকখানি হইছে। বাড়ির বেবাকতেরই খাওয়া হইছে। খালি আতাহারের হয় নাই। কারণ সে ঘুম থেকে উঠছে কিছুক্ষণ আগে। উইঠা বেবাক কাম কাইজ সাইরা আবার বাংলাঘরে ঢুকছে। টেকনের আগে রানঘরের দিকে তাকায়া বলছে, রহি, নাশতা দে।
আসলে তো রহিমারে বলল না, বলল পারুরে। একজনের উছিলায় আরেকজনরে বলা।
ট্রে-তে বেবাক কিছু সাজাইয়া নিয়া আসছে পারু। আতাহার হাতলআলা চেয়ারে বইসা আছে। সামনে টেবিল। ট্রে-টা টেবিলে নামাইয়া রাখলো পারু। ঠাট্টার গলায় বলল, নেন, বান্দি আপনের নাস্তা পানি লইয়া হাজির। নিজের হাত দিয়া খাইতে পারবেন, নাকি খাওয়াইয়া দেওন লাগবো?
আতাহার তার সেই মিচকা হাসিটা হাসল। খাওয়াইয়া দিতে চাইলে দিতে পারো। দিবা? হাঁ করুম?
আতাহারের পিঠে একটা ধাক্কা দিল পারু। ইস। আহ্লাদ!
কীয়ের আহ্লাদ? বউরা জামাইরে খাওয়াইয়া দেয় না?
দেয়।
তয়?
অহনতরি তো বউ অই নাই।
সরা পড়াইন্না (ধর্মমতে পড়ানো বিবাহ) বউ অও নাই। আর সবই অইছো।
একটা রুটি ছিড়া লগে কিছুটা লাবড়া নিয়া মুখে দিল আতাহার। পারু দাঁড়ায়া রইল পাশে। আতাহারের খাওয়া দেখতে লাগল।
আজকের নাস্তা আটার রুটি আর বর্ষাকালের নানানপদের তরকারি লাবড়া। লাবড়া জিনিসটা খুবই ভাল রান্ধে পারু। খাইতে খুবই স্বাদের হয়। চায়ের বড় কাপে ঘন দুধের চা আছে। সেই চা পিরিচ দিয়া ঢাইকা রাখছে পারু। ঠান্ডা হইলে আবার গরম করন লাগবো। অনেক সময় চায়ে রুটি ভিজাইয়াও খায় আতাহার।
তয় বেশিক্ষণ আজ আতাহারের পাশে থাকতে পারল না পারু। শ্বশুর চা খান নাস্তা পানি খাওয়ার অনেকক্ষণ পর। তার নাস্তা খাওয়া হয়ে গেছে অনেক আগে। এখন চা খাইবেন। ছটফটা গলায় সে বলল, তুমি নাস্তা করো। আমি যাই।
ক্যা?
আব্বার চা দেওন লাগবে।
আইচ্ছা দেও গিয়া।
বাংলাঘর থেকে বাইর হইয়া রানঘরে আসলো পারু। চা বানানোই আছে। খালি একটু গরম করতে হইবো। পারুরে দেইখা চায়ের কেটলি চুলায় দিল রহিমা। হাফিজদ্দি হাতের কামকাইজ সাইরা রান্নঘরে বইসাই নাস্তা করছিল। খাওয়া শেষ কইরা ঢক ঢক কইরা এক গেলাস পানি খাইল। তারপর তামাক সাজাইতে বসল। লুঙ্গি কাছা মারা, খালি গায়ের লোকটাকে মানুষ মনে হয় না। মনে হয় বাড়ির ভাঙনের দিকে গজায়া থাকা ঝোঁপজঙ্গল। কাছে থাকলেও চোখে পড়ে না। পারু যখন শ্বশুরের জন্য চা নিয়া বড়ঘরের দিকে মেলা দিছে, হাফিজদ্দি তামাক সাজাইয়া রানঘরের সামনে বইসা গুরুক গুরুক কইরা টান শুরু করছে। তার তামাকের গন্ধে লেবুপাতার গন্ধটা মাইর খাইয়া গেল।
বড়ঘরে ঢুইকাই থতমত খাইলো পারু। ল্যাংড়া বসির বইসা আছে মান্নান মাওলানার চকিতে। মান্নান মাওলানা বইসা আছেন চেয়ারে আর বসির চৌকির কোনায়। শ্বশুরের সামনে মাথায় ঘোমটা দিয়াই আসে পারু। তারপরও বেগানা পুরুষপোলা বসিররে দেইখা ঘোমটা আরও ঠিকঠাক করার চেষ্টা করল। কোনওরকমে চা দিল মান্নান মাওলানার হাতে। আব্বা, আপনের চা।
মান্নান মাওলানা চা নিয়া বললেন, বসিররে চা দেও এককাপ। তোমার আর আহনের কাম নাই। রহিরে দিয়া পাড়াও।
আইচ্ছা।
যতটা দ্রুত সম্ভব বাইর হইয়া গেল পারু। মনের মধ্যে ছোট্ট একখান খটকা ল্যাংড়া বসিররে দেইখাই লাগছে তার। ঘটকা আইছে ক্যান বাড়িতে? কার বিয়ার ঘটকালি করবো?
তারপর ঘটনাটা বুঝল সে। জাপানে থাকা দেওর, ছোট দেওর আজাহারের লেইগা। বিয়ার সমন্দ লইয়াঐ মনে হয় ঘটকায় এই বাইত্তে আইছে। এইটা ছাড়া তো তার আহনের কারণ নাই। আতাহারের বিয়া তো তার লগে ঠিকঐ হইয়া রইছে। তয় আর এই বাড়িতে বিয়ার উপযুক্ত পুরুষপোলা কেডা? এই বয়সে হৌরে তো আর বিয়া করবো না।
মান্নান মাওলানার বিয়ার কথা ভাইবা খিলখিল কইরা হাইসা উঠতে ইচ্ছা করল পারুর।
মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকায়া ল্যাংড়া বসির হাসিমুখে বলল, হুজুর এইডা আপনের বড়পোলার বউ?
জানালা দিয়া বাইরে তাকায়া ছিলেন মান্নান মাওলানা। বসিরের কথায় তার দিকে মুখ ফিরালেন। হ।
বিরাট সোন্দর মাইয়া।
সোন্দর মাইয়া না অইলে পোলারে বিয়া করাইতামনি বেড়া।
হ হেইডা ঠিকঐ। আপনের চোকে সোন্দর মাইয়া ছাড়া লাগে না।
আমার পোলাগো চোক্কেও লাগে না।
তয় আপনের বড়পোলার বউর যে এতদিন আগে বিয়া অইছে, একদোম বুজা যায় না। তিনহান পোলাপান আছে, একদোম বুজা যায় না।
কী বুজা যায়?
বুজা যায় অহনতরি বিয়া অয় নাই।
মান্নান মাওলানা চোখ পিতিপিতি (ছোট করে) কইরা বসিরের দিকে তাকালেন। পারুরে তুই আগে দেহচ নাই?
না।
আইচ্ছা। এবার আমার বাইত্তে আইছস তাও পারুরে দেহচ নাই?
দেহি নাই। তয় জানি বেবাকঐ।
মান্নান মাওলানা গম্ভীর হলেন। কী জানচ?
বেদ্দপি না নিলে কইতে পারি।
থাউক কওনের কাম নাই। আসল কথা ক।
বসির ইচ্ছা কইরাই বলল, আসল কথা জানি কোনডা?
আরে বেড়া দউবরার কথা। অর মাইয়ার লেইগা যে বিয়ার পোরোসতাব নিয়া তার কাছে যাইতে কইলাম, গেছিলি তুই?
এই কথাডা আমি আপনেরে ইট্টু পরে কইতে চাই হুজুর।
ক্যা?
আগে অন্যকথা সারতে চাই।
কোন কথা?
আপনের মাজারো পোলার বিয়ার কথা।
আইচ্ছা ক।
তার আগে কইতে চাই আপনের জাপাইন্না পোলার বিয়ার কথা।
মান্নান মাওলানা বিরক্ত হলেন। তুই বড় প্যাচাইলা পদের মানুষ বইচ্ছা। একলগে কত প্যাচাইল যে পিরচ?
বসির হাসল। দরজার কপাটের লগে খাড়া করাইয়া রাখা তার ছাতিটা একবার দেখল, দূরে কদমগাছটার লগে নাও বাইন্দা বইসা রইছে ফইজু, এতদূর থেকেও ফইজুর নিরস মুখটা একবার দেখল বসির। তারপর বলল, ঘটকালির কাম করি হুজুর। প্যাচাইল পারনঐ আমার কাম। প্যাচাইল পাইরা পইরা ত্যাড়া জিনিসরে ভাবদি (সোজা) করি।
আমার লগে ভাবদির কাম নাই। আসল কথা ক।
তয় একখান একখান কইরা কই।
আইচ্ছা ক।
মাথায় ঘোমটা দেওয়া রহিমা বিলাইয়ের মতন নিঃশব্দে এককাপ চা নিয়া ঢুকল এই ঘরে। যেমন নিঃশব্দে ঢুকল, তেমন নিঃশব্দে চায়ের কাপ বসিরের হাতে দিয়া বাইর হইয়া গেল। মান্নান মাওলানা তার চা আগেই শেষ করছেন। কাপটা টেবিলের কোনায় রাখা। বেড়ার লগে লাগানো পুরানা টেবিলের ওইপাশে কয়েকখান ধর্মীয় বই, রেহালে রাখা কোরআন শরীফ। চায়ে চুমুক দিয়া টেবিলটার দিকে একবার তাকাল বসির। আগে কই আপনের জাপাইন্না পোলার বিয়ার কথা।
মান্নান মাওলানা নিরস মুখে বললেন, অর বিয়ার কথা কইয়া লাব নাই।
ক্যা? জাপানে বিয়া কইরা হালাইছেনি?
হেইডা কইতে পারি না। তয় আমারে সাফ জানাইয়া দিছে অহন বিয়াশাদি করবো না, দেশেও আইবো না।
তয় কারবার সাইড়া হালাইছে।
কোন কারবার?
জাপানে বিয়া কইরা হালাইছে।
কেমতে বুজলি?
এইডা বুজা যায়। বিক্রমপুরের ম্যালা পোলাপান আছে জাপানে। তাগো খবরাখবর আমি রাখি। জাপাইন্না পোলার বিয়ার ঘটকালিও তো করি। অহন জাপান দেশে বিরাট ধরপাকড় চলতাছে। যাগো কাগজপত্র নাই, তাগো ধইরা ধইরা পয়লা জেলে নেয়। তিন-চাইর মাস জেল খাড়াইয়া পেলেনে উড়াইয়া দেয়। এই ডরে বহুত পোলাপান পলাইয়া থাকে। যেই মালিকের কারখানায় কাম করে হেই মালিকের কারখানার ভিতরেঐ গোডাউনের মতন ঘরদুয়ারে থাকে। টাউনের দিকে থাকেঐ না, থাকে গেরামের দিকে। গেরামের দিকে পুলিশ যায় কম।
হ এই হগল খবর আমার কাছেও আছে।
এর লেইগা অনেকে করছে কী, জাপানি মাইয়া বিয়া কইরা ফালাইছে। জাপানি মাইয়া বিয়া করলেঐ কাগজপত্র অইয়া যায়। সারাজীবন জাপানে থাকন যায়। আপনের ছোড পোলায় মনে হয় এই কারবার করছে।
হেইডা কইরা থাকলে তো ভালঐ। আমি তো চাই ও জাপানি মাইয়া বিয়া করুক। হারাজীবন জাপানে থাকুক। আমারে খালি টেকা পাডাইলেই অইলো। আমার দরকার টেকার। বউ জাপানি না চিনা হেইডা দিয়া আমার কিছু যায় আহে না।
তয় হুজুর, জাপানি মাইয়া বিয়া করতে খরচা অনেক। জাপানি বউ লইয়া জাপানে থাকতেও ম্যালা খরচা। যেই হগল পোলা জাপানি বউ লইয়া জাপানে থাকে তারা দেশে বেশি টেকা পাডাইতে পারে না।
আরে না রে বেড়া, পারে। বউ ভাল অইলে পারে। খাড়েদজ্জাল অইলে পারে না। আমি তো হুনছি মুনশিগইঞ্জের ওইদিকে, সুখবাসপুর বজ্রযুগিনী এই হগল গেরামে পেরায় বাড়িতেই জাপানি বউ। জাপান ছাইড়া বিক্রমপুরে আইয়া সংসার করতাছে।
হ হেইডা ঠিক আছে। আবার অনেকের তো জাপানে একহান বউ আবার বাংলাদেশেও একহান বউ। এক বউয়ে জানে না আরেক বউয়ের কথা। আপনের পোলায় ইচ্ছা করলে এইডাও করতে পারে।
আরে বেড়া ও জাপানে বিয়া করছে কি না হেইডাঐত্তো জানি না। তারবাদে তো দেশে বিয়া করনের কথা উটবো।
তয় এইডার খবর লন। ফকিরবাড়ির একটা পোলা আছে না জাপানে, অরে দিয়া খবর লন।
হ এই চেষ্টা আমি করতাছি। এর মইদ্যে গেছিলাম একদিন ফকিরবাড়ি। পোলাডার নাম বুলবুল। বুলবুলের বাপ নাই, মা আছে। তারে আমি কইয়াইছি। হেয় বুলবুলরে জানাইবো। বুলবুল তারে জানাইলে হেয় জানাইবো আমারে।
কথার ফাঁকে ফাঁকে চা শেষ করছে বসির। কাপটা পাশে রাইখা বলল, জাপানে বিয়া করা না করা কোনও ব্যাপার না। জাপানি বউ রাইখা আপনের পোলায় যুদি দেশে আহে, যুদি বিয়া করতে চায়, ভাল মাইয়া আমি দিতে পারুম। কোনও অসুবিদা অইবো না। বছরে এক-দুইমাস দেশে আইয়া দেশি বউর কাছে থাকবো, আবার যহন জাপানে যাইবো জাপানি বউর লগে থাকবো। মামলা ডিসমিস।
আইচ্ছা ওইডা পাওয়া যাইবো নে। তুই অহন দউবরার কথা ক।
বসিরের খুব ইচ্ছা করল জেব থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বাইর কইরা একখান সিগ্রেট ধরায়। তয় সেইটা সম্ভব না দেইখা কথা বাড়াইয়া দিল। কথার তালে থাকলে সিগ্রেটের নেশা ভুইলা থাকা যাইবো।
হাসিমুখে বসির বলল, আস্তে আস্তে উপরে উঠি হুজুর।
মান্নান মাওলানা কথাটা বুঝলেন না। বললেন, অর্থ কী?
অর্থ হইল ছোট থিকা বড়। পয়লা আপনের ছোডপোলার কথা কইলাম, অহন কমু মাজারো পোলার কথা তারবাদে কমু পোলার বাপের কথা।
মান্নান মাওলানা হাসলেন। তুই বহুত ট্যাটনরে বইচ্ছা।
বসিরও হাসল। কথা বলল না।
মান্নান মাওলানা বললেন, আইচ্ছা ক। আতাহারের বিয়ার কথাই ক। বইলতলির মাইয়ার বাপে কী কইলো?
তারা মনে অইলো রাজি না।
ক্যা?
মনে অয় গোপনে আতাহারের খোঁজখবর লইছে।
কী খোঁজখবর?
পোলার সবাব চরিত্র। গার্জিয়ানরা যেই হগল খোঁজখবর লয় আর কী!
একটু থামল বসির, মাথা নিচা করল। মনে অয় বেবাক খবরই তারা জানছে।
কোন বেবাক খবর?
বড়ভাইর বউর লগে আতাহারের সম্পর্ক…
মান্নান মাওলানা খুবই অবাক হলেন। যা বেডা। এইডা তারা কেমতে জানবো? কই বইলতলি আর কই মেদিনমণ্ডল। এক গেরাম থিকা আরেক গেরাম ম্যালা দূর। এত দূর গেরামের এত গোপন খবর তারা কেমতে জানবো?
জানতে পারে হুজুর। পারুর মাজারো বইনের বিয়া হইছে পয়সা গেরামে। পয়সা আর বইলতলি পাশাপাশি গেরাম। ওই বাড়ি থিকাও জানতে পারে।
মাথার টুপি খুলে টাক মাথাটা হাতাতে লাগলেন মান্নান মাওলানা। চোখে মুখে চিন্তার ছায়া।
বসির কয়েক পলক তাঁকে খেয়াল করল তারপর বলল, তয় ওই সমন্দর থিকাও ভাল সমন্দ আইজ আমি আতাহারের লেইগা আনছি।
বসিরের মুখের দিকে তাকালেন মান্নান মাওলানা। সত্য।
তয় মিছা নি? আমার কারবারঐ ঘটকালির। এক সমন্দ না অইলে আরেক সমন্দ আনুম। দেরি করুম ক্যা? দেরি করলে আমার সংসার চলবো কেমতে?
অহনকার সমন্দ কোন গেরামের? কোন গেরামের মাইয়া?
গাদ্দা (গাওদিয়া)।
অবস্তা কেমুন?
বহুত ভাল। তিন ভাইয়ের এক বইন। তিন ভাইয়ের এক ভাই জাপানে আর দুই ভাই সৌদিতে। টেকাপয়সার আকাল নাই। বইন বেবাকতের ছোড। কেলাস নাইন তরি পড়ছে।
আরে থো তর কেলাস নাইন। আমার কেলাস মেলাস লাগবো না। কেলাস দিয়া আমি কী করুম? আমার কাম টেকার। যেইবাড়ির তিনপোলা বিদেশে হেই বাড়িতে টেকার আকাল নাই। এই সমন্দ তুই ঠিক কর।
ঠিক পেরায় আমি কইরা ফালাইছি।
আলহামদুলিল্লাহ। মাইয়া কেমুন?
মাইয়া কেমুন জিগাইলেননি?
হ।
পরি, পরি। বিরাট সুন্দরী মাইয়া। আদপ লেহাজ জানা।
আরে বেড়া বড়বাড়ির মাইয়া তো এমুনঐ অইবো। তয় লেখাপড়া এত কম ক্যা?
আপনে না কইলেন কেলাস মেলাস আপনের লাগবে না, তয় আবার লেখাপড়ার কথা জিগান ক্যা?
মান্নান মাওলানা একটু থতমত খাইলেন। না এই আর কী, জিগাইলাম আর কী!
তয় হোনেন, এইডা আমিও জিগাইছিলাম। মাইয়ার বাপের নাম ওয়াজদ্দি। জিগাইলাম, ওয়াজদ্দিসাব, মাইয়াডারে মেট্রিক পাশ করান নাই ক্যা? বিয়ার বাজারে মেট্রিক পাশটা আইজকাইল লাগে।
সে কী কইলো?
কইলো, হ এইডা আমি বুজি। তয় মাইয়াডা পড়তে চাইলো না। তিনপোলার পর এক মাইয়া তো, ইট্টু বেশি আল্লাইদ্যা। ও যেইডা কয় হেইডাঐ সই (ঠিক)। আমি আর অর মা’য় আর আমার তিনপোলায় কমলা যা কয় ওইডাই করি।
মাইয়ার নাম কমলা নি?
হ কমলা খাতুন। ওই গানের লাহান নাম। সুন্দরী কমলা। হে হে।
মান্নান মাওলানার বাড়িতে এসে হে হে করা হাসিটা এই প্রথম হাসল বসির। সেই হাসি খেয়াল করলেন না মান্নান মাওলানা। বললেন, হ হ বুজছি। তয় কেলাস নাইন তরি পড়াও কম না। আমার তো ইসকুল কলেজের পড়াডা আসলে দরকার নাই। আমার দরকার কোরান শরিফ পড়ন। হেইডা পারে তো?
ল্যাংড়া বসির হা হা কইরা উঠল। এইডা আপনে কী কইলেন হুজুর? মোসলমান ঘরের মাইয়া, বড়গিরস্ত বাড়ির মাইয়া কোরান শরিফ পড়তে পারবো না? বহুত ভাল পারে হুজুর। একদোম ছইি (সঠিক) কইরা পাড়ে। হোনলে আপনে বেউস অইয়া যাইবেন।
মাশাল্লা, মাশাল্লা।
শইল্লের রংখানও মাশাল্লা। দুধের লগে আলতা গোলাইয়া দিলে যেমুন রং অয় ঠিক অমুন রং। লাম্বাচুড়া আপনের ওই বড়পোলার বউর লাহান। চাইয়া দেহনের মতন মাইয়া। আপনের বাড়ির বউ অইয়া আইল দেগেরামের মাইনষে বউ দেইক্কা কইবো, না, মাওলানা সাবে পোলার বউ আনছে একখান। হাজারে একজন। হাজারে কী, লাখে একজন। হে হে।
মান্নান মাওলানা মুগ্ধ। বাহ্। তয় ওয়াজদ্দি সাবরে আমার পরিচয় দিছস?
দিছি।
হুইন্না কী কইলো?
খুশি, বেদম খুশি। কইলো এই রকম পাকপবিত্র বাড়ির পোলাঐত্তো আমি চাই। হুজুরের পোলা তো আর খারাপ অইতে পারে না। আলেমের ঘরে জালেম পয়দা অয় এইরকম কথা আমরা হুনছি। তয় বেবাক আলেমের ঘরে জালেম পয়দা অয় না। আলেমের ঘরে আলেমও অয়। আমি কইলাম, হ, আতাহার আলেম টাইপ। কী ঠিক কইছি না হুজুর। হে হে।
মান্নান মাওলানা গম্ভীর গলায় কথা অন্যদিকে ঘুরালেন। পোলায় যে আই এ ফেল, কাম কাইজ কিছুই করে না, এই হগল কছ নাই তো?
আরে না। পাগল অইছেন নি আপনে। আতাহার কী করে না করে সবঐত্তো জানি আমি, বিয়ার বাজারে এই হগল চলেনি। বিয়ার বাজারে জালেমরে আলেম কইতে অয়। হে হে। আমি ওইপদের কথাই কইছি। কইছি পোলা আই এ পাশ। কনটেকদারি করে।
মান্নান মাওলানা চমকাল। কনটেকদারি করে?
হ।
আথকা এইডা কইলি ক্যা?
কইলাম এতবড় কনটেকদার আলী আমজাদ অইলো আতাহারের দোস্ত। কনটেকদারগো লগে কনটেকদারেরঐত্তো দুস্তি অয়। কইছি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মাটির কনটেকদার আলী আমজাদের লগে পার্টনারশিপে কনটেকদারি করে আতাহার সাবে। মাওলানা হুজুরের তো জাগাসম্পত্তির আকাল নাই, আকাল খালি নগদ টেকার। এর লেইগা অল্প পুঞ্জি (পুঁজি) লইয়া দোস্তের লগে কনটেকদারি ধরছে আতাহারে। অহন বিয়া কইরা হৌরবাড়ি থিকা টেকাপয়সা লইয়া বড়ভাবে কনটেকদারির কাম ধরবো। পার্টনারশিপে করবো না। কী কেমুন বানাইছি কথাখান, কন হুজুর? হে হে।
মান্নান মাওলানা হাসলেন। ভালঐ কইছস। কইলাম না তুই বিরাট ট্যাটন।
ল্যাংড়া বসির তার হে হে হাসিটা এইবার প্রাণ খুইলা হাসল। ট্যাটন না অইলে এই লাইনে কইরা খাওন যায় না হুজুর। ঘটকালির লাইনে যে যতবড় ট্যাটন তার ততবেশি পয়সা।
অহন পয়সার কথা ক।
আমি বুজছিলাম হুজুর, অহনঐ আপনে এই কথাডা কইবেন।
আরে বেড়া এইডাঐত্তো আসল কথা। কমু না?
হ কইবেন না?
তয় ক।
আগে মাইয়ার কথা বেকিছু হোনেন।
আর কী হুনুম, আর কী বাকি আছে?
আছে, আর ইট্টু কথা বাকি আছে।
তয় কইয়া ফালা।
বসির আমতা গলায় বলল, মাইয়ার চোক্কে হুজুর ছোট্ট একখান ডিফিকট (ডিফেক্ট) আছে।
মান্নান মাওলানা চমকালেন। মাইয়া কানা?
ওই দেহে হুজুরে কয় কী? আরে কানা অইবো ক্যা?
তয় কি ট্যাড়া?
অতি সামাইন্য, সামাইন্য ট্যারা। লক্ষ্মীট্যারা যারে কয়। এমতে দেইক্কা আপনে বুজবেন না। খ্যাল কইরা দেখলে বুজবেন। ওই চায় (তাকায়) দিল্লি, দেহে (দেখে) লাহোর ওইপদ না। হে হে।
মান্নান মাওলানা হতাশ হলেন। এইত্তো বেডা একখান ভেজালের মইদ্যে হালাইলি।
এইডা কোনও ভেজালঐ না। মাইয়া দেকলে যুদি আপনেগো পছন্দ না অয় তয় আমারে কইয়েন। অহন হুজুর আরেকখান কথাও আপনেরে কই, আপনের পোলার তো ডিফিকটের আকাল নাই। বড়ভাইর বউর লগে ইটিস পিটিস, মদপানি খাইয়া পইড়া থাকে, মস্তান, বিরাট মস্তান। আমি যতই কই আলেমের ঘরে আলেমঐ অইছে আতাহার, আসলে তো আলেম অয় নাই। অইছে তো জালেম। এইরকম পোলার কাছে কোন ভাল ঘরের মাইয়া বিয়া দিবো কন? আপনে মাইয়ার বাপ অইলে আপনে দিতেন? কন?
মান্নান মাওলানা কথা বললেন না।
বসির বলল, আপনে যা চান ওইডা পাইতে অইলে ইকটু ডিফিকট মিফিকট থাকা মাইয়া লাগে। ওয়াজদ্দিসাবের মাইয়া, সুন্দরী মাইয়া এই কারণে আপনের পোলার কাছে বিয়া দিতে রাজি অইবো। দুই-তিনলাখ টেকাও আমি নিয়া দিতে পারুম।
মাত্র দুই তিন-লাখ?
তয় কত?
লাখ দশেক দিবো না?
কন কী হুজুর? দশলাখ?
হ।
না এইডা মনে অয় সম্ভব না।
তয় কত সম্ভব?
বেশি ঠেলাঠেলি করলে চাইর-পাঁচতরি উটতে পারে।
তুই কথা কইয়া দেখ।
দেখতে পারি। তয় আমার অনুমানই ঠিক অইবো। বড়জোর চাইর-পাঁচ। আর লক্ষ্মীট্যারা মাইয়ারা ভাইগ্যবতি অয়। এই মাইয়ার লেইগাঐ বলে ওয়াজদ্দির এত উন্নতি। তিনপোলা বিদেশে। ওয়াজদ্দি সাবের এত জাগাসম্পত্তি। আপনে বিবেচনা করেন হুজুর। আগে মাইয়া দেহেন। বেবাকতে মিলা দেইখা বোজনের চেষ্টা করেন মাইয়া যে লক্ষ্মীট্যারা হেইডা ধরতে পারেন কি না। আর ওয়াজদ্দি সাবরাও পোলা দেহুক। আতাহাররে দেহুক। আতাহারের খোঁজখবর লউক। তারবাদে আমি টেকা পয়সার কথা ফাইনাল করুম নে।
মান্নান মাওলানা আমতা গলায় বললেন, আতাহারের খোঁজখবর লইলে তো বিপদ।
কীয়ের বিপদ?
দেশগেরামে তো আমগো শতরুর আকাল নাই। কে কোনহান দা (কোন দিক দিয়ে) কী কইয়া দিবো, ভাঙ্গানি দিয়া দিব।
হ এইডা একখান কথা।
এইডার কী করবি?
আপনে চাইলে এইডা আমি ম্যানিজ করতে পারুম।
কেমতে?
কেমতে করুম ওইডা আপনে আমার উপরে ছাইড়া দেন। আপনে এক কাম করেন হুজুর, আইজ আমারে একখান ডেট দেন। ওই ডেটে আপনেরা কয়জন যাইবেন মাইয়া দেখতে আমি হেই ব্যবস্তা করি। মাইয়া দেকতে তো আতাহারও যাইবো, আপনেরা দেকবেন মাইয়া, তারা দেখবো পোলা, এক দেহায় বেবাক কারবার ফিনিশ। তারবাদে আমি আমার কাম করুম। মাইয়া আপনেগো পছন্দ অইলে বিয়া আল্লার রহমতে অইয়া যাইবো।
আমরা মাইয়া পছন্দ করনের পরও তো কথা থাকে বেডা।
কী কথা?
তারা পোলা পছন্দ করে কিনা?
হে হে, কী যে কন হুজুর? আতাহারের লাহান পোলা কেঐ পছন্দ না কইরা পারে। চেহারা সুরত তো মাশাল্লা আপনের পোলার। খালি সবাব চরিত্র…। তয় সবাব চরিত্র তো বাইরে থিকা দেহা যায় না। আপনে ডেট দেন, ওয়াজদ্দি সাবের মাইয়ারে দেহেন, তারবাদে দেহেন কেমতে এই বিয়া আমি হওয়াই।
ল্যাংড়া বসির আথকা উঠে দাঁড়াল। অহন আরেক কাপ চা দিতে কন হুজুর। এই ফাঁকে আমি ইট্ট কাম সাইরা আহি। বাংলাঘরের ওই মিহি কাম সারনের জাগা আছে না?
আছে। যা।
ফিরত আইসা আপনের বিয়ার কথা কমুনে। এই ফাঁকে আপনে কবে মাইয়া দেকতে যাইবেন ভাইবা রাখেন।
মান্নান মাওলানা বুঝলেন বসির সিগ্রেটই খাইতে যাইবো। ভাব দেখাইলো এমন, যেন পেশাব করতে যাইতাছে। শালার পো শালায় বিরাট ট্যাটন।
ল্যাংড়া বসির তার ল্যাংড়া পা টাইন্না মাত্র উঠানে নামছে, মান্নান মাওলানা জানালা দিয়া রানঘরের দিকে তাকায়া চিৎকার কইরা বললেন, রহি, দুই কাপ চা দিছ।
.
তামাক বিড়ির ভাল রকমের একটা নেশা ফইজুর আছে।
তামাক না পেলে বিড়ি দিয়া কাজ চালায়। আজ বিড়িও নাই। দুইদিন আগে কাজির পাগলা বাজার থেকে এক প্যাকেট কুম্ভিপাতার বিড়ি কিনা দিছিল বসির। কোন ফাঁকে শেষ হয়ে গেছে উদিসই পায় নাই ফইজু। বাড়িতে থাকলে তামাকটা খাইতে পারে, নৌকায় পারে না। কোষা নৌকায় তামাকের ব্যবস্থা রাখা বিরাট মুশকিল। হুঁকা কলকি তামাকের ডিবা, টিকা আর নাইলে নাইরকলের ছোবা এইসব রাখতে অসুবিধা হয়। আগা নাইলে পাছার চারটের নীচে রাখে কোনও কোনও গিরস্তে। তয় টিকা রাখে না। টিকা ধরানো বিরাট হাঙ্গামার কাম। চিমটা লাগে, কুপি আঙ্গান লাগে। তার থেকে নাইরকলের ছোবায় সুবিধা। একখান ম্যাচবাত্তি হইলেই হয়। ডিবা থিকা তামাক বাইর কইরা কলকিতে ঠাইসা দিয়া, তার উপরে নাইরকলের ছোবা গুলটি পাকাইয়া (গোল করে) ম্যাচের কাঠি দিয়া আঙ্গাইয়া দিলেই হয়। তারপর ফুঁ দিয়া দিয়া আগুন কইরা তামাক টানতে শুরু করলে, তামাকের টানে টানে নাইরকল ছোবার আগুন তামাক পোড়াইতে থাকে। টানে টানে নেশা।
ল্যাংড়া বসির গিয়া মান্নান মাওলানার ঘরে ঢোকার পর থেকেই তামাক বিড়ির নেশাটা বেদম পাইছে ফইজুর। ব্যবস্থা নাই দেইখা মুখ কালা কইরা কোষানাওয়ের পাছার চারটে বইসা রইছে। এখান থেকে বাড়ির রান্নঘরটা দেখা যায়। একজন বউ মতন মানুষ। জলচৌকিতে বইসা রান্দনবাড়ন দেখাই দিতাছে আর একজন ঝি মতন মানুষ রান্দনবাড়ন শুরু করছে। চুলায় আগুন জ্বলছে, চুলার পারে বইসা অল্প একটু মশলা বাটল ঝি-টা, পিঁয়াজ তরতারি কুটল। এখনও মাছ কুটতে বসে নাই। মাছের একটা ঘোপা এই এতদূর থেকেও দেখছে ফইজু। তয় সব কিছু ছাপায়া তার চোখে পড়ল লুঙ্গি কাছা মারা কামলা মতন একজন মানুষ খালি গায়ে রান্নঘরের ছেমায় বইসা তামাক টানতাছে। এই দেইখা নেশাটা ফইজুর মাথা চাড়া দিয়া উঠল। পেটের খিদাটা আইজ আর নাই ফইজুর। নেশার খিদাটা আছে। বিয়ানবেলা আইজ বসিরের বাড়ি থেকে ভরপেট খুদের বউয়া খাইয়া বাইর হইছে। পেট একদম ভরা। দুপুরের আগে আর খিদা লাগবো না। তয় তামাক বিড়ি কোনও না কোনওটা খাইতেই হইবো।
কী করে ফইজু?
নিজের বাড়িতে গত তিনদিন ধইরা যায় না ফইজু। বড়পোলা বদুর ঘরে পোলা হইছে। গাদিঘাটের ভোজকোমড়ের মতন একখান পেট লইয়া পোলার বউ আসুরা বিরাট একখান আজাবের মধ্যে ছিল। তিনদিন আগে দুপুরবেলা পোলা হইছে আসুরার। বিয়ান রাইত থেকে বেদনা উঠছিল। এইটা দেইখা সেদিন আর কেরায়া নাও লইয়া বাইর অয় নাই। বাড়িতেই ছিল। সীতারামপুরের কারিগর পাড়ার ধরণী বেগমরে গিয়া নিয়া আসছে। তয় পোলা হওনের কষ্ট খুব বেশি পায় নাই আসুরা। বিয়ানরাত থেকে দুপুরতরি বেদনা, তারপর খালাস। বাড়িতে বিরাট আনন্দ। মাজারো পোলা কুতুব মাওয়ার বাজারে গেছিল মাছের কারবারে, লগে আছিল ছোডপোলা কাসু। বদুরও পোলা হইলো দুইভাইও বাড়িতে আইসা হাজির। বিরাট আমদ আহ্লাদ শুরু হইয়া গেল বাড়িতে। খাতুন বিরাট খুশি। রানঘরের সামনে বইসা তামাক টানছিল ফইজু। তারে একখান ঠেলা দিয়া বলল, তুমি দাদা হইয়া গেছ। নানা হইছিলা বহুত আগে, আইজ হইলা দাদা। যাও তাড়াতাড়ি আয়জান। (আজান) দেও। বাইত্তে পোলা অইলে আয়জান দিতে হয়। মাইয়া অইলে দিতে অয় না। আল্লার নিয়ম।
আজান দিতে জানে ফইজু। রোজার দিনে রোজাটা সে করে। তারাবিও পড়ে। কোনও ওক্তের (ওয়াক্তের) নামাজই বাদ দেয় না। তয় এইমাত্র তামাক টানছিল, শরীরডা পাকসাফ নাই, পেশাব কইরা পানি নিছে কিনা মনে নাই। পায়খানা সারছে, হাত সাবান দিয়া ধুইছে। কিনা মনে নাই। এই অবস্থায় আজান দেওয়া যাইবো না। আগে নাইয়া ধুইয়া, অজু সাইরা তারপর আজান।
সেইভাবেই কাজটা সারল ফইজু। নাইয়া ধুইয়া, অজু কইরা ধোয়া লুঙ্গি পিরন পইরা, মাথায় টুপি দিয়া পশ্চিমের ভিটির ঘরের কোনায় দাঁড়াইয়া আজান দিল। বদুর ঘরে তখন ওঁয়া ওঁয়া করতাছে মাত্র দুনিয়াতে আসা পোলাটা।
তারপর নাতির মুখ দেখছে ফইজু। আনন্দে ডগেমগো হইয়া ওই অতটুকু নাতি কুলে কইরা উঠানে আনছে খাতুন। এই যে দেহো তোমার নাতি। নাতির মুখ দেখছো, কিছু দেও তারে।
ফইজু কী দিবো? কী আছে তার?
দুইটা টাকা ছিল জেবে। সেইটাই দিল। দেইখা এমন একখান মুখ খিচানি দিল খাতুন! এমুন ফউকরা (ফকির, গরিব অর্থে) দাদা আমি ইহজিন্দেগিতে দেহি নাই। নাতির মুখ দেইখা দেয় দুইটেকা। যাও, সরো তুমি আমার চোক্কের সামনে থিকা।
খুবই শরম পাইছিল ফইজু। আর দুই-একবার যে নাতির মুখোন দেখবো, সুযোগই পাইলো না। নাতির উপরে শকুনের পাখনার মতন পাখনা মেইলা রাখলো খাতুন। পোলার মা আসুরাও ভাল মতন দেখতে পারে না পোলার মুখ। খালি বুকের দুধ দেওনের সময় খাতুন একটু সইরা আসে।
বাড়িতে ফইজুর দশা খুবই কাহিল। খাতুন তারে মানুষই মনে করে না। তার উপরে হইছে নাতি। তিনপোলা বাড়িতে, মাইয়া মাইয়ার জামাইরা খবর পাইয়াঐ নিজেগো পোলাপান লইয়া এই বাড়িতে আইসা উঠবো, কবুতরখোলা থিকা আসবো আসুরার মা বাপ ভাইবইন। বিরাট আমদ আহ্লাদ শুরু হইবো বাড়িতে। খাতুনের নানান পদের অপমান। উঠতে বসতে সইতে হয় ফইজুর, খাওন দাওন চাইয়া পায় না। এই অবস্থায় বাড়িতে মেজবান আইলে খাতুন কী না কী করে তার লগে, কোন অপমান করে, এই ডরে দুপুরের ভাত না খাইয়াই ছোট পোলা কাসুরে ফইজু অনুনয়ের গলায় বলছিল, আমারে ইট্টু ঘটকার বাইত্তে নামাইয়া দিয়া আবি বাজান। আমি কয়দিন ওই বাইত্তে থাকুম নে।
বাপের মনটা বুঝলো কাসু। ক্যান ঘটকার বাড়িতে কাম লইছে সে, ক্যান ওই বাড়িতে গিয়া থাকতে চায় বুঝল। কয়েক পলক কী জানি ভাবল, তারবাদে বলল, লও।
তারপর থেকে আর বাড়িতে যায় নাই ফইজু। ঘটকের বাড়িতেই আছে। আছে পেটে ভাতে। তাও ঘটক সিকি আধলিটা দেয় বিড়ি খাওয়ার জন্য। আইজ দেয় নাই। ঘটকালির তালে আছে তো, ফইজুর কথা মনে নাই।
ফইজুর পরনে সেদিনকার সেই লুঙ্গি আর পিরন। মাঝখানে একটা দিন গেছে। আর একখান লুঙ্গি পিরন তার আছে, একজোড়া পরে আরেক জোড়া খোয়। নমজটাও নিয়মিত সেদিনকার পর থেকে পড়ছে। টুপি থাকে পিরনের জেবে। অনেকক্ষণ নাওয়ে বইসা মান্নান মাওলানার বাড়ির কামলা লোকটারে তামাক টানতে দেখল ফইজু তারপর আর সহ্য করতে
পাইরা বাড়িতে উঠল। রান্নঘরের ওই দিকে আইসা আস্তে কইরা একখান কাশ দিল। রানঘরে পারু রহিমা আছে, ছনছায় বইসা তামাক টানছে হাফিজদ্দি। তিনজন মানুষ একলগে ফইজুর দিকে তাকাল। হাফিজদ্দি তামাক টানা বন্ধ কইরা বলল, কী?
কথার তালে নাকমুখ দিয়া বেদম ধুমা বাইর হইলো।
ফইজু বলল, ইট্টু তামুক খাইতে চাই।
ও।
জলচৌকিতে বসা পারু তাকাল ফইজুর দিকে। বহেন। হাফিজদ্দি, তারে একখান ফিরি দেও আর তামুক সাজাইয়া দেও।
পারুর কথায় হাফিজদ্দি ব্যস্ত হল। দিতাছি।
হাফিজদ্দি হুঁকা রাইখা রান্ধনঘর থেকে একখান ফিরি নিয়া ফইজুরে দিল। বহেন, বহেন। তারপর তামাক সাজাতে ব্যস্ত হল।
পারু বলল, আপনে ঘটকের লগে আইছেন, তামুক খাইতে ইচ্ছা করছে, এই মিহি আহেন নাই ক্যা? নাওয়ে বইয়া রইছেন ক্যা?
ফইজুর বড় ভাল লাগল পারুকে। বিনয়ের গলায় বলল, না, আপনেরা কেঐ কিছু মনে করেন কিনা।
কী মনে করুম?
না আমরা মা কামলা মানুষ! আপনেগো এত বড় বাড়ি! মাওলানা সাবে রাগী মানুষ!
না আপনেরা বাইরে থিকা যেমুন হোনেন হেয় তেমুন না।
তার মাজারো পোলা হুনছি বিরাট রাগী। এর লেইগা ডর করছে বাইত্তে উটতে।
আরে না। এইসব কিছু না। দেশগেরামের মাইনষে কত রকমের কথা কয়। আপনে বহেন। আরাম কইরা বহেন।
পারু রহিমার দিকে তাকাল। চা তিনকাপ বানা রহি। তারেও এককাপ দে। লগে মুড়ি দে।
শুইনা ফইজু একেবারে কাঁচুমাচু হইয়া গেল। না না এতকিছুর কাম নাই। খালি ইট্টু তামুক অইলেই অইবো।
পারু হাসিমুখে বলল, আগে চা মুড়ি খান তারবাদে তামুক খাইয়েন। হাফিজদ্দি, তামুক পরে সাজাও।
কলকি পরিষ্কার কইরা তামাক ভইরা চুলা থেকে আগুন তুইলা মাত্র কলকিতে দিবে হাফিজদ্দি, পারুর কথায় থামল। চুলার একপাশের বেড়ার লগে হুঁকা দাঁড় করাইয়া রাখল।
পারু বলল, তুমি আথালে যাও। ওই মিহি থাকো গিয়া।
আইচ্ছা।
হাফিজদ্দি পা চালায়া গোয়ালঘরের দিকে চলে গেল। তার লগে লগে বড়ঘরে গেল রহিমা। রিকাবিতে মুড়ি আর ছোট একমুচি খাজুড়া মিঠাই আইনা ফইজুর হাতে দিল। পারু বলল, খান। মুড়ি মিঠাই খাইয়া চা খান তারবাদে তামুক খাইয়েন।
ফইজুর এত ভাল লাগল পারুর ব্যাবহার। এই বাড়ির খবরাখবর তেমন সে জানে না। মুড়ি মিঠাই খাইতে খাইতে বলল, একখান কথা জিগাই মা?
পারু বলল, জিগান।
আপনে যে এই বাড়ির বউ হেইডা আমি বুজছি। মাওলানা সাবের কোন পোলার বউ?
কথাটার জবাব দিল রহিমা। ঘোপার ভিতর হাত ঢুকাইয়া একটা কইরা কইমাছ বাইর করছে সে, ছাই দিয়া ধইরা সেই মাছ কুটবো, বঁটিতে মাত্র আইস্টা (আঁশ) ছাড়াইতে শুরু করছে, ফইজুর কথা শুইনা বলল, আছিল বাড়ির বড়বউ। অহন অইবো মাজারো বউ।
বুজছি বুজছি। হুজুরের বড়পোলায় মইরা গেছে এর লেইগা অহন মাজারো পোলার লগে বিয়া হইবো।
হ।
এইডা একখান কামের কাম হইবো। এমুন একখান বউ, এই বসে বিধবা অইয়া থাকবো, এইডা আল্লায়ও সইবো না। এর লেইগাঐ হুজুররে দিয়া একপোলার বউরে আল্লায় আরেকপোলার বউ বানাইতাছে।
ফইজুর কথা শুনে শরম করছিল পারুর। সে কোনও কথা বলতে পারছে না। চুপচাপ মাটির দিকে তাকায়া বইসা রইল। মনে বিষম খুশির ভাব।
ফইজু মুড়ি চাবাতে চাবাতে চিন্তিত গলায় বলল, বড়পোলার বউর বিয়া হইবো মাজারো পোলার লগে, বেবাক ঠিকঠাক, তয় এই বাইত্তে ঘটক আইছে ক্যা?
এই জবাবটা পারু দিল। এই বাইত্তে আরেকখান পোলা আছে। ছোডপোলা। জাপানে থাকে। সে দেশে আইসা বিয়া করবো। এর লেইগাঐ ঘটক আইছে।
হ হেইডাঐ অইবো।
তারপর আবার চিন্তিত হল ফইজু। তয় ঘটকে আবার দবির গাছির বাইত্তে গেছিলো ক্যা? গাছিরে এত খাতির কইরা…
পারুও অবাক হল। দবির গাছির বাইত্তে গেছিল?
হ।
কবে?
এইত্তো দুই তিনদিন আগে।
এবার হাসল পারু। গাছির মাইয়ার লেইগা কোনও মিহি মনে অয় সমন্দ দেকছে, এর লেইগাঐ ওই বাইত্তে গেছে। ঘটকের কামত্তে এইরকম।
হ এইডা ঠিকঐ কইছেন মা। ওই বাইত্তে যাওনের লগে এই বাইত্তে আহনের কোনও সমন্দ নাই।
ফইজুর মুড়ি অর্ধেকখানি খাওয়া হইছে, বাংলাঘর থেকে বাইর হইয়া আসলো আতাহার। তার পরনে জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট। পায়ে কেডস। ঘর থেকে বের হয়েই আথালের দিকে তাকায়া বলল, হাফিজদ্দি নাও রেডি কর। আমি বাইর অমু।
লগে লগে আথাল থেকে বের হয়ে আসল হাফিজদ্দি। অহনই রেডি করতাছি দাদা। আপনে আহেন।
তারপর রান্নঘরের দিকে তাকাল আতাহার। অচেনা লোকটাকে পারুর কাছাকাছি বইসা মুড়ি মিঠাই খাইতে দেইখা আগায়া আসল। এই, তুমি কে?
ফইজু কথা বলবার আগেই পারু বলল, ঘটকের লগে আইছে। তার নাও বায়।
ও আইচ্ছা।
তুমি যাও কই?
বাজার মিহি যামু। বাইত্তে ভাল্লাগতাছে না।
আইচ্ছা যাও।
আতাহার বাইর বাড়ির দিকে চলে গেল।
এক চুলায় চায়ের পানির লগে দুধ চিনি চাপাতা একলগে দেওয়া হইছে। বলক দিয়া সেই চায়ের ভাল রকম গন্ধ ছুটছে। মাছ কোটা হাতে ট্রেতে সাজানো তিনখান কাপে চা ঢালতে যাবে সে, পারু বলল, তোমার কাম নাই চা বানানের। আমি বানাইতাছি।
চটপটা হাতে তিনকাপ চা বানাইয়া ফেলল পারু। একটা কাপ ফইজুর দিকে আগায়া দিয়া বলল, খান।
রহিমা বলল, তয় অহন হুজুরের ঘরে চা দিতে যাইবো কে?
আমি বেবস্তা করতাছি।
শিরিনকে ডাকলো পারু। শিরি, ওই শিরি। এই মিহি ইট্টু আয় তো মা।
শিরি প্রায় লগে লগে আসল। কী মা?
দুই কাপ চায়ের ট্রে মেয়ের হাতে দিয়া পারু বলল, তর দাদার ঘরে দিয়ায়।
আইচ্ছা।
চায়ের ট্রে নিয়া মান্নান মাওলানার ঘরের দিকে পা বাড়াইছে শিরি, পারু বলল, নসু নূরি কো?
নসু অঙ্ক করতাছে। আর নূরি গেছে মন্তাজ দাদাগো ওই মিহি। হিরা মনিকের লগে খেলতাছে।
আইচ্ছা ঠিক আছে। তুই যা।
শিরিন যখন মান্নান মাওলানার ঘরে ঢুকছে, তার প্রায় লগে লগেই বাংলাঘরের ওদিক থেকে ল্যাংড়া বসিরও তার ল্যাংড়া পা টাইনা টাইনা সেই ঘরে আইসা ঢুকল। একবার সেইদিকে তাকাল ফইজু। চায়ে চুমুক দিয়া বলল, আমি জানি না মা আপনে কোন গেরামের মাইয়া, কোন বাড়ির মাইয়া। তয় আপনে যে বহুত ভাল ঘরের মাইয়া হেইডা আপনের চেহারা ছবি দেইক্কা যেমুন বুঝা যায়, আচার ব্যবহারেও বুঝা যায়। বহুতদিন বাদে দেশ গেরামে এইরকম একহান বউ দেখলাম। আল্লার কাছে দোয়া করি মা, আল্লায় য্যান আপনেরে ভাল রাখে। আল্লায় য্যান আপনের মনের বেবাক আশা পূরণ করে। স্বামী পোলাপান লইয়া আপনে য্যান সুখে থাকেন।
ফইজুর কথা শুনে পারুর খুব ইচ্ছা করল তার পায়ে হাত দিয়া কদমবুসি (সালাম) করতে। রহিমা সামনে আছে, ঘটকের গোমস্তারে কদমবুসি করছে মান্নান মাওলানার ছেলের বউ এটা সে কীভাবে নিবে কে জানে।
মনের ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারল না পারু।
.
বেদ্দপি না নিলে একখান কথা কইতাম হুজুর।
মান্নান মাওলানা চায়ে চুমুক দিলেন। জানালা দিয়া বাইরে তাকিয়ে বেলা কতখানি হল বুঝে আবার বসিরের দিকে তাকালেন। তর তো বেড়া কথাই শেষ অয় না!
বসির শব্দ করে চায়ে চুমুক দিল। কেমতে শেষ হইবো, কন? হে হে। তিনজন মাইনষের বিয়ার কথা এত তাড়াতাড়ি শেষ অয়? তয় হুজুর আপনের বাইত্তে দুইরা ভাত খাইয়া যাওনের ইচ্ছা আমার নাই। দুফইরা ভাত আমি বাইত্তে গিয়াঐ খামু। আমার গোমস্তা ফইজু তামুক তুমুক খাইছে। অহন খালি কথা শেষ কইরা বাইত্তে মেলা দিমু।
অইছে। ক কী কবি?
ওই যে আপনেরে কইছিলাম আপনের বড়পোলার বউ পারু আমার একদোম চোক্কে লাইগ্যা রইছে।
হ কইছচ। তয় তুই কি পারুর বিয়ার ঘটকালি করতে চাসনি?
হ।
মান্নান মাওলানা চায়ে চুমুক দিতে গিয়া থামলেন। কী? তিন পোলাপানের মা, দশ-বারো বচ্ছর অইলো বিয়া হইছে, আমার বাড়ির বউ, তারে তুই বিয়া দিতে চাস?
হ চাই হুজুর। হে হে। তয় অন্য কোনওখানে না। আপনের বাইত্তেঐ বিয়া দিতে চাই।
মান্নান মাওলানা চায়ে চুমুক দিলেন। তর কথা আমি বুজছি।
পানির লাহান সোজা কথা। বুজবেন না ক্যা? হে হে।
বসির চায়ে চুমুক দিল। এই বিয়াড়ায় আপনের সুবিদা অইলো তিনখান। এক, আহাতারের লেইগা অন্য জাগায় মাইয়া দেকতে হইবো না। আপনের পোলার সবাব চরিত্র লইয়া কথা কইতে হইবো না। আপনের এমুন পরির লাহান বউডারও বদলাম ঘুচবো।
বউর বদলাম কী?
এইডা কি আপনেরে কওন লাগবো? বড়ভাইর বউর লগে মাজারো ভাইর সম্পর্ক। তিনহান পোলাপান হইছে। আতাহারের লগে পারুরও তো বদলাম। যেহেনেঐ বিয়ার কথা কইতে যামু, তারা যহন আতাহারের খোঁজখবর লইবো তহনঐত্তো এই হগল কথা উঠবো।
মান্নান মাওলানা চায়ে বড় করে চুমুক দিয়া বললেন, তুই কোন বালের ঘটক।
ক্যা আমার অসুবিদা কী?
ঘটকালির কামে দিনরে রাইত কইরা কাম করতে হয়।
আমি তো হেইডাঐ করতাছি। ওয়াজদ্দি সাবের মাইয়ার লগে আপনের পোলার বিয়া আমি দিয়া দিতে পারুম।
তয়?
তয় কথা হইলো, হে হে, দেওর ভাবীর ইটিস পিটিস সম্পর্ক অইলো গুয়ের লাহান। যত ঘোঁটবেন হেতো গন্দ ছুটবো। এর লেইগা কইছিলাম, পারু বিরাট সুন্দরী বউ। রেডিমেড তিনহান পোলাপানও পাইলো আপনের পোলায়, আসলে তো অরঐ পোলাপান। সবকিছুই জায়েজ অইয়া গেল। এক, গু ঘোটতে অইলো না। দুই, সুন্দরী বউ পাইলেন, তিন, তিনহান নাতি নাতকুড় জায়েজ অইলো।
ফুরুক করে চায়ে বড় একখান চুমুক দিলেন মান্নান মাওলানা। রাগী গলায় বললেন, চ্যাডের (পুরুষাঙ্গ) কথা কইছ না। দুনিয়াতে এমুন সম্পর্ক বহুত থাকে। জুয়ান বয়সের দেওর ভাবি বহুত জাগায় এমুন সমন্দ রাখে। হেতে কথাও অয় না। আতাহাররে বিয়া করাইয়া আমি খাট পালং আলমারি আর সোনাদানা তো ঘরে আনুমই, কমপক্ষে পাঁচলাখ টেকাও আনুম। হ পারুর লগে আতাহারের বিয়ায় আমি রাজি আছি, পাঁচলাখ টেকা দিবি তুই।
হে হে, কী যে কন হুজুর।
তয় এত বালের প্যাচাল পারচ ক্যা?
ওই যে কইলাম, পারু আমার চোক্কে লাইগ্যা রইছে।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়া বসির বলল, আইচ্ছা হুজুর, পারুর বাপের বাড়ির অবস্থা কেমুন?
আছে, খারাপ না। বাপে পুতেরা রুজি রোজগার করে, এক বইনজামাইয়ের বিরাট অবস্থা। জাগাসম্পত্তি আছে ভাল।
তয়?
তয় কী?
পারুর বাপের বাইত্তে আমি যাই।
ক্যা?
গিয়া আতাহারের লগে পারুর বিয়ার প্রস্তাব দেই। পাঁচলাখ টেকার কথাও কই।
ক্যা পারুরে লইয়া তর এত চিন্তা ক্যা?
চিন্তাডা হুজুর আপনের হওন উচিত আছিল। হে হে। এত কম বসে ব্লাড়ি অইছে। মাইয়াডা। বাকি জীবন কাটাইবো কেমতে? যার লগে সম্পর্ক হেও যুদি অন্য জাগায় বিয়া কইরা হালায় তয় জিন্দেগিড়া ছারখার অইয়া যাইবো মাইয়াডার।
অর জিন্দেগি লইয়া তর চিন্তা করনের কাম নাই। দিন পোনরোর মইদ্যে ওয়াজদ্দি সাবের মাইয়া আমরা দেকতে যামু, ব্যবস্থা কর।
আইচ্ছা করতাছি। হে হে। তয় আইজ টেকা দিবেন পাঁচশো।
পাঁচশো টাকার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন মান্নান মাওলানা। ক্যা পাঁচশো টেকা দিমু ক্যা?
কেরায়া নাও লইয়া গাঐদ্দা যাওন আহন লাগবো। নাও ভাড়াই যাইবো গা আড়াই তিনশো টেকা। আর আমারে শ দুয়েক দিবেন না?
না না এত দিতে পারুম না। দুইশো দিমু নে। তুই কাম শুরু কর। তয় পাঁচলাখ লইয়া দেওন লাগবো কইলাম।
কইয়া লাব নাই। পাঁচশোর কমে গাঐদ্দা যাইয়া আইয়া এই কামে আমার পোষাইবো হুজুর।
তয় তিনশো দিতাছি। পরে আবার দিমুনে।
না হুজুর, পারুম না।
তুই তো বেডা বিরাট ঠ্যাটা।
আমার তো মনে হইতাছে আপনে আমার থিকা বড় ঠ্যাটা। নিজের বিয়ার কথা উডাইলেন না, পোলার বিয়া লইয়াঐ দামাদামি আরম্ব করলেন। আরে আপনের বিয়ার লেইগা তো বিরাট খরচা আছে। হেইডা তো আইজঐ করন লাগবো। আতাহারের লেইগা পাঁচশো দিবেন আর নিজেরডার লেইগা দিবেন পাঁচশো। পুরা একহাজার আগে গণেন। আমার হাতে দেন তারবাদে ওয়াজদ্দির মাইয়া কমলা অইবো আপনের পোলার বউ, আর দবির গাছির মাইয়া নূরজাহান হইবো আপনের বউ।
নূরজাহান নামটা শোনার লগে লগে চেহারা অন্যরকম হয়ে গেল মান্নান মাওলানার। মনে হল যেন এখনই তাঁর মুখের সামনে দাঁড়ায়া মুখে যত ছ্যাপ ছিল সব ছ্যাপ তাঁর মুখে ছিটাইয়া দিল নূরজাহান। মুখটা শক্ত হয়ে গেল মান্নান মাওলানার। টাকা পয়সার কথা ভুলে ল্যাংড়া বসিরের মুখের দিকে তাকালেন তিনি। দউবরারে প্রস্তাব দিছস?
হে হে, দিছি মাইনি? এমুন দেওয়া দিছি। হাতড়াইয়া বাইত্তে গেছে।
কী?
ঘটনাটা বলল বসির। কীভাবে দবিরকে বাড়ি থেকে মাওয়ার বাজারে নিয়া গেছে, সেন্টুর দোকানে বসাইয়া চা রসোগোল্লা আর সিগ্রেটের পর সিগ্রেট খাওয়াইছে, শেষমেশ প্রস্তাব শুনে দবির কী করছে সব শুনে মান্নান মাওলানা হাসলেন। এইডা আমার জাননের কাম আছিল।
জানলেন তো। অহন কী করবেন?
আমি কিছু করুম না, করবি তুই। আমার সাফ কথা, দইবরার মাইয়ারে আমি বিয়া করুম, ব্যবস্থা করবি তুই।
কামডা বহুত কঠিন।
টেকাও কঠিনঐ পাবি। একদিকে ওয়াজদ্দি সাবের মাইয়া কমলারে আইন্না দিবি আতাহারের লেইগা। শাওন মাস তো শেষ অইয়া আইলো, তারবাদে চাইর-পাঁচটা মাস। পৌষ নাইলে মাগ মাসে আতাহাররে বিয়া করামু। তারবাদে এই ধর আরও তিন-চাইর মাস, বৈশাখমাসে দউবরার মাইয়ারে আইন্না দিবি আমার লেইগা। তর কারবার ফিনিশ। আর ওর মইদ্যে যুদি আমার ছোডপোলায় রাজি অইয়া যায়, যুদি দেশে আহে তয় অর বিয়ার ঘটকালিও তুই করবি। এক বাইত্তে এতডি বিয়া, তর বচ্ছরের কামাই রুজি অইয়া যাইবো।
ওই কামাই রুজি থিকা আইজ একহাজার দেন।
এই না কইলি পাঁচশো।
এইডা তো আতাহারের লেইগা। আপনের লেইগাও পাঁচশো দেন। গাছির বাইত্তে আবার যাওন লাগবো না!
মান্নান মাওলানা একেবারে অন্য রকম একটা কথা বললেন। দউবার মাইয়াডা তর কেমুন লাগছে?
কথাটা ধরতে পারল না বসির। বলল, হে হে কেমুন আবার লাগবো?
না, কথা অইলো পারুর মতন তোর চোক্কে লাইগ্যা রয় নাই তো?
থাকলে কী অইতো?
দেখা গেল অরে লইয়াও তুই অন্য একহান প্যাঁচ খেলাইলি। দাদা নানার বইস্যা বেডার। লগে অতডু ছেমড়ির কেমতে বিয়া অয় এই হগল লইয়া একখান লেকচার মারলি।
মান্নান মাওলানার চোখের দিকে তাকিয়ে বসির বলল, হুজুর, আপনেরে একহান কথা কই। ঘটক অই আর যাই অই, আমিও কইলাম মানুষ। ভালঘরের পোলা। ঘটকালি কইরা খাই আমি ঠিকঐ, তয় আমিও কইলাম অনেক কিছু বিবেচনা করি। আমার ভিতরেও একজন আসল মানুষ আছে। পারুরে দেইক্কা সেই আসল মানুষটা বাইর অইয়া আইছিল। দেইক্কাঐ কথাডি আপনেরে কইছি। পারুর লগে আতাহারের বিয়া অইলে আমার কইলাম। কোনও লাব নাই, আমার লোসখান। একখান পয়সাও আমি পামু না। তাও কথাডা আপনেরে কইছি। সব সময় টেকার কথা আমি ভাবি না। কোনও কোনও সমায় মানুষ নিয়াও ভাবি। আসলেঐত্তো গাছিদাদার মাইয়ার লগে বিয়াড়া আপনের সাজে না। জাতে পদেও বনে না, বসেও বনে না। আপনে নূরজাহানরে ক্যান বিয়া করতে চান হেইডাও আমি বুজি। আপনে আমারে সমন্দ লইয়া যাইতে কইছেন, আমি গেছি। তয় হেইদিনডার কথাও আপনের মনে আছে, যেদিন পয়লা আপনে আমারে গাছিদাদার মাইয়ার কথা কইলেন। হুইন্না আমার লাহান ঘাঘু মালও কইলাম চইমকা উঠছিলাম। হায় হায় এতবড় কামেলদার মানুষে এইডা কী কয়? তারপর ভাবছি, আপনের মতন মাইনষে যহন কইছেন, চেষ্টা আমার করন উচিত। তয় মাগনা চেষ্টা করলে তো আমার পেট ভরবো না, এর লেইগা কামডা আমি হাতে লইছি।
হে হে করা হাসিটা বসির আবার হাসল। বাপ পোলা দুইজনের বিয়ার চেষ্টাঐ আমি চালাইয়া যামু হুজুর। দেহা যাউক কী অয়? চেষ্টা কইরা ব্যর্থ আমি তেমুন হই না। ঘটকালির লাইনে আমার রেকট (রেকর্ড) ভাল। দেহা গেল দুই কামেঐ সাকসেসফুল হইছি। অহন দেন একহাজার টেকা।
অনেক টালটি পালটি করে ছয়শো টাকা ল্যাংড়া বসিরকে দিলেন মান্নান মাওলানা। দুপুর তখন প্রায় হয়ে আসছে। বাইরে খাড়া রোদ।
.
সীতারামপুরমুখী নৌকা বাইতে বাইতে ফইজু বলল, হুজুরের পোলার বউডা এত ভাল ঘটকদাদা, কী কমু আপনেরে।
বসির বসে আছে কোষানাওয়ের মাঝখানে। মাথায় ছাতি। রোদ এখন একটু ম্লান। আকাশের পুব-দক্ষিণ কোণ থেকে একটুকরা ছাইবর্ণের মেঘ ধীরে ধীরে উড়ে আসছে আকাশের মাঝ বরাবর। সূর্য ঢাকা প্রায় পড়েছে। এখনই রোদের জায়গায় ছায়ায় ভরে যাবে চারদিক। ঝিরঝিরা একখান হাওয়াও আছে।
বসিরের হাতে রমনা সিগ্রেট। আরামছে ফুক ফুক করে টানছে। মান্নান মাওলানার বাড়িতে এই এক আজাবের মধ্যে সে ছিল। সিগ্রেট খেতেই পারছিল না। তাও এক ফাঁকে বুদ্ধি করে, পেশাব করার ইঙ্গিত দিয়া বের হয়েছিল। বাংলাঘরের ওদিকে গিয়া পেশাবও করেছে সিগ্রেটও খেয়েছে। তাও যত তাড়াতাড়ি টেনে শেষ করা যায় সেই কায়দায়। এত হুড়াহুড়ি কইরা সিগ্রেট খাইয়া মজা আছে নি! সিগ্রেট খাইতে হয় রসাইয়া রসাইয়া, আরাম কইরা। টানে টানে নেশা হইবো। মনে হইবো দুনিয়াতে সিগ্রেট খাওনের থিকা আরামের কাম আর কিছু নাই।
এই যেমন এখন।
সিগ্রেটে টান দিয়া ফইজুর দিকে তাকাল বসির। কেমতে বুজলি? তরে চা মুড়ি খাওয়াইলো, তামুক খাওয়াইলো এই হগল দেইক্কাঐ বুইজ্জা গেলি?
খালি দেইক্কাঐ বুজি নাই, কথাবার্তা কইয়াও বুজছি।
কী কইলো তরে?
না তেমুন কিছু না। যেই খাতিরডা আমারে করলো, হেইডা দেইক্কা বুজলাম। আমারে তো তার খাতির করনের কথা না। আমি হইলাম আপনের গোমস্তা। নাও বাই। আমি তাগো বাড়ির কামলারে তামুক খাইতে দেইক্কা বাইত্তে উটছি, যুদি একটু তামুক খাওন যায়। গেছি রানঘরের সামনে, বউড়া আমারে পয়লাঐ তামুক খাইতে দিল না। মুড়ি মিডাই দিল, চা দিল, তারবাদে তামুক দিল। তামুক সাজাইয়া দিছিল কামলা বেড়ায়, আগুনডা দিছে ওই ঝি বেডি।
বুজছি বুজছি, এত ফিরিস্তি দেওনের কাম নাই। পারু তরে কী কইলো হেইডা ক?
ফইজু অবাক। পারু কেডা?
আরে ওইত্তো যার কথা তুই কইতাছস। হুজুরের পোলার বউ।
বউডা বিধবা অইছে হুইন্না আমার মনডা বহুত খারাপ অইছে ঘটকদাদা। তারবাদে আবার মনডা ভাল অইয়া গেছে যহন হোনলাম হেয় আবার এই বাড়ির বউ অইতাছে।
বসির বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। কী? কার বউ অইতাছে?
ওই ঝি বেডি কইলো হুজুরের মাজারো পোলার লগে দুই-চাইর মাসের মইদ্যেই বিয়া হইবো পারুর।
কচ কী?
হ বেডি কইলো তো?
আর পারু কী কইলো?
সেয় কিছু কয় নাই। শরমে মাথা নিচা কইরা মিষ্টাইয়া মিষ্টাইয়া হাসলো।
ফুক ফুক করে সিগ্রেটে দুইটা টান দিল বসির। ভাল চিন্তার মইদ্যে হালালি তো?
এতে আপনের চিন্তার কী অইলো?
আরে বেড়া আমারে তো হুজুরে আতাহারের লেইগা বিয়ার সমন্দ দেকতে কইতাছে।
এবার ফইজুও চমকাল। কন কী?
হ।
এইডা কেমতে অয়? একমিহি বাড়ির বড়পোলার বিধবা বউর লগে বিয়ার কথা হোনলাম, বউর সামনে বইয়াই হোনলাম, তারবাদে অন্যমিহি আবার…। আমি তো কিছুই বুজতে পারতাছি না ঘটকদাদা। কথা সত্য না অইলে তো বউডা অমুন শরম পাইতো না। কথা সত্য না অইলে বাড়ির ঝি’র এতবড় সাহস হইবোনি বউর সামনে বইয়া বেগানা মাইনষেরে ওই হগল কথা কওনের?
হ। তর কথা ঠিক। তয় তুই তো ওই বাড়ির ঘটনা কিছুই জান না। হোন আমার কাছ থিকা।
তারপর পারুর লগে আতাহারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, মোতাহারের শারীরিক সমস্যা, পারুর তিনটা পোলাপানই যে আতাহারের ঔরসে সবই ফইজুকে বলল বসির। শুনে ফইজুর হাত থেকে বইঠা প্রায় খসে পড়ে। গভীর বিস্ময়ের গলায় বলল, কন কী ঘটকদাদা?
হ বেডা। এইডা তো দেশগেরামের বেবাকতেই জানে। তুই জান না?
না দাদা। আমি গরিব মানুষ, সংসারে বিরাট ভেজালের মইদ্যে থাকি। মাইনষের কথায় কান দেওনের আজাইর পাই নাই।
বুজছি বুজছি। হোন ফইজু, পারুরে আইজঐ আমি পয়লা দেখলাম। দেইক্কা মাইয়াডা আমার চোক্কে এক্কেবারে লাইগ্যা গেল। কী সোন্দর মাইয়া। আমি আতাহার আর পারুর ঘটনা জানি। জাইন্নাও হুজুরের কথায় আর টেকাপয়সার কাম হইবো দেইক্কা আতাহারের লেইগা মাইয়া দেখতাছিলাম। বইলতলি গ্রামের এক মাইয়া দেখছি, তারা আতাহারের খোঁজখবর লইয়া জানছে পোলার সবাব চরিত্র ভাল না। না কইয়া দিছে। তারবাদে মাইয়া দেকলাম গাদ্দা। ওয়াজদ্দি সাবের মাইয়া কমলা। হুজুররে কইছি মাইয়ার একখান খুঁত আছে, মাইয়া লক্ষ্মীট্যারা। তয় এমতে সোন্দরঐ। এইডা আমি মিছাকথা কথা কই নাই। মিছা কথা কইছি ট্যারাডা লইয়া। আসলে মাইয়া লক্ষ্মীট্যারা না, পুরা ট্যারা। একমিহি চাইলে আরেক মিহি দেহে। তাও হুজুরে কয় এই মাইয়া আমারে আইন্না দে। খাট পালং আলমারি আর সোনাদানার লগে পাঁচলাখ নগদ দেওন লাগবো। এইডা কইলাম সম্ভব। ওই ট্যারা মাইয়া পাঁচ-দশলাখ খরচা কইরা ওয়াজদ্দি সাবে পার করবো। আমারও ভাল ঐ টেকাপয়সার কাম হইবো। তারবাদেও পারুরে দেইক্কা হুজুররে আমি কইলাম….
পারু আর আতাহারের ব্যাপারে মান্নান মাওলানাকে যা যা বলেছিল সবই ফইজুকে বলল বসির। তারপর মান্নান মাওলানাকে একটা গালি দিল। বেবাক হুইন্না শালার পো শালায়। আমারে কয় কী, তয় পাঁচলাখ টেকা তুই আমারে দে। শালায় একবারও ভাবলো না, ওর। বাড়ির বদলাম যাতে বাইরে আর না রটে এর লেইগাঐ কথাডা আমি কইছি। নিজের লোসখান মাইন্না লইয়াঐ কইছি। ঠিক আছে, তারবাদে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছি ওয়াজদ্দি সাবের ওই টেরি মাইয়াঐ শালার বাড়ির বউ কইরা আমি আইন্না দিমু, তয় এমুন ঝুলাইতে ঝুলাইতে আনুম, এমুন টেকা খামু অর কাছ থিকা ওই হালার আলিস (গুহ্যপথের ভিতর দিককার মাংস) বাইর কইরা হালামু।
ফইজু মন খারাপ করা গলায় বলল, হেইডা তো করবেন, তয় পারু মাইয়াডার তো জিন্দেগি ছারখার অইয়া যাইবো। যেই দেওরের লেইগা এত বদলাম মাইয়াডার, যার পোলাপান পেডে লইছে, যারে মন পেরান শরীল বেবাক দিছে, যারে লইয়া অহন নতুন সংসার করনের খোয়াব দেখে, আহা এমুন মাইয়াডার বেককিছু ছারখার হইয়া যাইবো। বহুত দুঃখ পাইবো মাইয়াডা।
এর লেইগাঐ নিজের লোসখানের কথা না ভাইবা কথাডা শালারে আমি কইছিলাম। শালায় তারপর বালছাল চ্যাট ম্যাট এমুন সব কথা কইলো, শালায় বলে মাওলানা, মাথায় টুপি আছে, টুপি মাথায় দিয়া এই হগল কথা কওন যায়। অর যে অজু ভাইঙ্গা যাইবো, একবারও ভাবলো না? শালার পো শালায় মানুষ না, খাডাস। টেকাপয়সার লোভে আপনা পোলার বউডার জিন্দেগি বিনাস করতাছে।
হেয় নাইলে এই চিন্তা ভাবনা করতাছে, আর তার পোলায়? আতাহারে?
আরে ওই শুয়োরের পোয় তো আরও খারাপ। ভাবীর লগে এতদিন থাকছে অর অহন নতুন মাইয়া দরকার। টেকার দরকার। অর কি অহন আর পুরানা পিরিতি ভাল লাগবোনি?
ফইজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আহা রে, পারুর জিন্দেগি বিনাস অইয়া যাইবো। এত সোন্দর মাইয়াডার কপাল যে আল্লায় ক্যান এমুন করল?
সীতারামপুরের খালে ঢুকে বসিরের দিকে তাকিয়েছে ফইজু, দেখে বসির আবার সিগ্রেট ধরিয়েছে। দেখে ফইজুরও খুব ইচ্ছা করল একটা সিগ্রেট খায়। অন্য সময় হলে বসিরের কাছে সিগ্রেট চাওয়ার সাহস হত না। এখন হল। খুবই বিনয়ের গলায় বলল, ঘটকদাদা, আমারে একখান সিকরেট দিবেন?
বসির কিছুই মনে করল না, প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট বের করল। নে।
তারপরই বলল, ধরাইয়া দেই। তুই তো নাও বাইতাছস, ধরাবি কেমতে?
ম্যাচ জ্বেলে ফইজুর সিগ্রেটটা ধরিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিল বসির। সিগ্রেট নিয়া মুগ্ধ ভঙ্গিতে টান দিল ফইজু। ধুমা ছেড়ে বলল, বহুত খুশি হইলাম ঘটকদাদা, বহুত খুশি হইলাম।
বসির কথা বলল না।
ফইজু মনে মনে বলল, এক মানুষের ভিতরে আসলে থাকে দুইজন মানুষ। খারাপ আর ভাল। দুইজন মানুষই সমায় সমায় বাইর হয়। ঘটকদাদার ভিতরের ভাল মানুষটা আইজ এইমাত্র একবার বাইর হইলো। আরেকবার বাইর হইছিল পারুর বিষয়ে হুজুরের লগে কথা কওনের সমায়। আল্লাহপাকের কারবারঐ এমুন। পুরা ভাল কইরাও বানাই নাই কেঐরে, আবার পুরা খারাপ কইরাও বানায় নাই। ভালর মইধ্যেও কমবেশি খারাপ আছে, খারাপের মইদ্যেও কমবেশি ভাল আছে।
এখন রোদ নাই দেখে ছাতি বুজাইয়া ফালাইছে বসির। খোলা আশমানের তলায়, চারদিকে বর্ষার পানি, ঝিরঝিরা হাওয়ায় সিগ্রেট টানতে টানতে উদাস হয়ে আছে। হঠাৎই ফইজুর দিকে তাকাল সে। আরেকখান কথা হোনলে তো তুই চইমকা উটবি ফইজু।
ফইজু সিগ্রেট টানছে আর আয়েশি ভঙ্গিতে বইঠা বাইছে। বসিরের কথা শুনে তার দিকে তাকাল। কী কথা?
ওই যে কয়দিন আগে দবির গাছির বাইত্তে গেছিলাম, ক্যান গেছিলাম জানচ?
ঘটকালির কামে গেছেন। গাছির মাইয়া ডাঙ্গর অইছে তার বিয়ার সমন্দ লইয়া গেছেন।
হ এইডা ঠিকঐ আছে। তয় পাত্র কে জানচ?
না হেইডা জানি না দাদা। কে? কার লেইগা সমন্দ লইয়া গেলেন?
মান্নান মাওলানা।
ফইজু আঁতকে উঠল। কী?
আরে হ বেড়া। নূরজাহানরে বিয়া করতে চায় শালার পো শালায়। আমারে দিছে ঘটকালির কাম।
কন কী?
হ।
হায় হায় এইডা কোনও কথা হইলো? অতডু একটা মাইয়া! হুজুরের নাতনির থিকাও ছোড়।
কীর লেইগা করতে চায় হেইডা তুই বুজছস?
না।
আরে বেড়া ওই যে নূরজাহান তার মুখে ছ্যাপ দিছিল…
বুজছি বুজছি হেইডার শোদ লওনের লেইগা।
এইত্তো বুজছস।
এবার ফইজুও মান্নান মাওলানাকে বসিরের মতন করেই গালি দিল। শালার পো শালায় তো আসলেই মানুষ না। তহন হুনছি হেয় নূরজাহানরে মাপ কইরা দিছে, আর অহন…
শালার পো শালায় কঠিন মাল। ঘুরাইয়া পাচাইয়া কোনও না কোনওভাবে নূরজাহানের উপরে শোদ লইবো। বিয়া একবার করতে পারলে তো বোজচঐ, যতদিন শালায় বাঁইচ্চা থাকবো হেতদিন অইত্যাচার করবো মাইয়াডার উপরে। আমার প্রস্তাব হুইন্না এর লেইগাইত্তো গাছিদাদায় ওদিন আমার নাওয়ে আর ওডে নাই। সাঁতরাইয়া বাইত্তে গেছে।
ফইজু চিন্তিত গলায় বলল, তয় আপনে অহন কী করবেন? দুইহান খুবঐ খারাপ কামের মইদ্যে তো পইড়া গেছেন।
হ হেইডা পড়ছি। তয় আমি আমার তরিকা বাইর কইরা ফালাইছি। আমি শালার পো শালারে নাকে রসি দিয়া ঘুরামু। আতাহারের লেইগা ওয়াজদ্দি সাবের মাইয়া কমলার কথা কইয়া দুই-চাইর মাস ঘুরামু, নূরজাহানের কথা কইয়াও ঘুরামু। খালি মিছাকথা কমু আর খালি টেকা খামু। ওই হালায় যতবড় ধাউর অর থিকা বড় ধাউর অইলাম আমি। অর আমরক্ত আমি বাইর কইরা হালামু।
ফইজুর তখন শুধুই পারুর কথা মনে পড়ছে। আহা এত ভাল মাইয়াডা পড়ছে এমুন। দুইডা শয়তানের হাতে!
পারুর জন্য ফইজুর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
.
দুলালের সেলুনের সামনের বেঞ্চে বসে উদাস হয়ে বিড়ি টানছে নিখিল।
মালেক দরবেশের বাড়ির ওদিককার চকটুকু পার হয়ে মাওয়ার বাজারের রাস্তায় উঠে, দূর থেকেই নিখিলকে দেখতে পেল আতাহার। পুরানা জিনসের প্যান্ট আর হাফহাতা আকাশি রঙের শার্ট পরে বসে সিগ্রেট টানছে।
দ্রুত হেঁটে নিখিলের সামনে এসে দাঁড়াল আতাহার। কী রে নিখিলা, এহেনে বইয়া রইছস ক্যা?
নিখিল হাসল। খেরি করুম, মুকহানও বানামু (চুল কাটানো এবং শেভ করা)।
আতাহার তীক্ষ্ণচোখে নিখিলের মাথার দিকে তাকাল। হ চুল ভালই বড় হইছে। তয় বড়চুলে নিখিলারে মন্দ লাগে না। মুখের দাড়ি মোচও বড় অইছে। তাতেও নিখিলারে দেখতে খারাপ লাগে না।
বলল, তুই বাইত্তে মুক বানাছ না?
বানাই। তয় আইজ কয়দিন ধইরা বানাই নাই। ভাবছিলাম একলগেই খেরি করুম আর মুখ বানামু। এর লেইগাঐ আইজ বাজারে আইছি। নাইলে তগো বাড়ি মিহি যাইতাম।
নাও লইয়া আইছস?
না, জাউলা বাড়ির পবনার নাওয়ে আইছি।
তয় আমগো বাইত্তে যাইতি কেমতে?
কোনও না কোনও ব্যবস্থা কইরা যাইতাম। চাইলে নাও জোগাড় অইয়া যায়।
না আইজ ভেরি করনের কাম নাই।
ক্যা?
ল আমার লগে।
কই যামু?
আরে উট বেড়া। কই যামু কইতাছি।
আমার যে খেরিডা করান দরকার দোস্ত, মাথাহান মুখহান বানান দরকার।
ক্যা ডারলিংয়ের লগে দেহা করতে যাইবানি?
নিখিল হাসল। ডারলিং তো আমার নাই দোস্ত, আছে তোমার।
হেই ডারলিং আমি বাদ দিতাছি।
কী?
ওই তুই উট তো। অহন এত প্যাচাইল পাড়তে পারুম না।
সিগ্রেটে শেষ টান দিয়া ছুঁড়ে ফেলল নিখিল। তারপর উঠল। দোকানের ভিতর একজনের চুল কাটছে দুলাল। তার কাটা হলেই নিখিলেরটা কাটবে। নিখিল তাকে বলল, আইজ চুল কাডামু না রে দুলাল। আমার দোস্তে আইয়া পড়ছে। কাইল পশশু আইয়া কাডামু নে।
দুলাল হাসিমুখে বলল, আইচ্ছা দাদা।
আতাহার তখন পকেট থেকে সিগ্রেট বের করেছে। নিজে সিগ্রেট ধরিয়ে নিলিখকে বলল, খাবিনি আরেকখান?
না রে দোস্ত। পরে খামুনে। তয় তুই মেলা দিলি কই?
সিগ্রেটের ধুমা ছেড়ে আতাহার বলল, ল আগে বাজারে যাই। সেন্টুর দোকানে গিয়া বহি। চা খাই। আলইম্মা সুরজা অরাও আইবো। ইট্টু আড্ডা চাডামি মারি।
হ ল। কয়দিন ধইরা তো আমরা চাইর দোস্তে একলগে অইতেই পারি না।
হ যেই ম্যাগ বিষ্টি নামে। বাইত থনে বাইরঐ অওন যায় না।
সেন্টুর দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিখিল বলল, ডারলিংয়ের কথা কইতে কইতে থাইম্মা গেলা দোস্ত! ডারলিংরে বাদ দিতাছো অর্থ কী?
অর্থডা অহনতরি কেঐরে কই নাই। আলইম্মা আর সুরজারে তো কমুঐ না। তরে কইতে পারি।
অগো না কইলে আমারে কবি ক্যা?
অগো থিকা তরে আমি অনেক বেশি বিশ্বাস করি।
ক্যা এত বিশ্বাস করছ ক্যা আমারে?
আমি জানি, তর পেডে বোম মারলেও গোপন কথা কেঐ বাইর করতে পারবো না।
হ এইডা ঠিক। আমি কেঐর কথা কেঐরে কই না।
এর লেইগাঐ তরে কওন যায়।
তয় ক।
আতাহার আবার সিগ্রেটে টান দিল। পারুরে অহন আর আমার ভাল্লাগে না।
নিখিল একেবারে কেঁপে উঠল। কচ কী?
হ। এতদিন ধইরা একজনের লগে সহবাসে আমি আরাম পাই না।
পারু এত সোন্দর মাইয়া তারবাদেও তুই কচ এই কথা।
হ। আমি অন্য জাগায় বিয়া করুম। ল্যাংড়া আমার লেইগা সমন্দ ঠিক করতাছে।
তর মা’য় মরণের আগে আমারে না একদিন কইলি তোর মা’য় চাইতাছে পারুর লগেই তর বিয়া পড়াইয়া দিবো। তর বাপের লগেও আলাপ করছে।
সিগ্রেটে টান দিয়া হাসল আতাহার। হ এই রকমই মায় ভাবছিল। আমি আর বাবায় উপরে উপরে তার কথায় রাজি হইছিলাম, ভিতরে ভিতরে আমগো বাপ-পোলার আছিল
অন্য মতলব।
কেমুন মতলব?
মা’রে আর পারুরে বুজতে দিমু না কিছু। ঘটকায় গোপনে অন্য জাগায় বিয়া ঠিক করবো। এমুন জাগায় বিয়া ঠিক করবো যেহেন থিকা খাট পালং আলমারি আর সোনাদানার লগে নগদ টেকাও পাওয়া যাইবো। ওই টেকা দিয়া ব্যাবসা বাণিজ্য কইরা আমি বড়লোক অইয়া যামু। মা’রে আর পারুরে তহন বাবায় আর আমি মিলা বুজ দিমু।
এইডা তো দোস্ত বিরাট বেইমানি।
আমি আর আমার বাপে ইমানি-বেইমানি বুজি না বেডা। আমরা বুজি খালি মাল। টেকা পয়সা।
সিগ্রেটে বড় করে টান দিয়া আতাহার বলল, মা’য় মরলো ক্যা জানচ তুই?
না তো? তয় তর মা’র হাট এটাক করছিল এইডা তুই আমারে কইছস।
হ মা’র হাটের অসুখ আছিল। তয় আথকা হাট এটাক তার করল ক্যা হেইডা হোন। সিনামার লাহান কাহিনি।
সেন্টুর দোকানের পুবদিক থেকে হেঁটে আসছিল ওরা। দোকানের পাশে খোলা একটুখানি জায়গা। আতাহার বলল, ল এহেনে খাড়ইয়া ঘটনা তরে কই। তারবাদে দোকানে ঢুকি।
ঠিক আছে।
জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আতাহার পর পর দুইবার সিগ্রেটে টান দিয়া সিগ্রেটের পিছন দিকটা ছুঁড়ে ফেলল। আমি আর আমার বাপে বাংলাঘরে বইয়া আমগো পেলান লইয়া কথা কইতাছিলাম। মায় আইতাছিল ওইঘর মিহি। আমগো বেবাক কথা হেয় হুইন্না হালাইতাছে। হুইন্না আর সইজ্য করতে পারে নাই। লগে লগে হাট এটাক করছে। ফিনিশ অইয়া গেছে।
আতাহারের মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল নিখিল। মাথা নেড়ে বলল, ঘটনা আইজ আমি বুজলাম। তয় পারুর অবস্থা কী?
সে তো মনের আনন্দে আছে। অহনও জানে অর লগে আমার বিয়া অইবো। মা’য় মরছে দেইক্কা বিয়া পিছাইছে। শীতের দিন আইলেঐ বিয়া অইয়া যাইবো।
হাসলো আতাহার। হ শীতের দিনেঐ বিয়া আমি করুম। তয় পারুরে না। অন্য মাইয়া।
পারুরে তহন ম্যানেজ করবি কেমনে?
পয়লা বাবায় অর লগে কথা কইবো, তারপরে আমি কমু।
কী কবি?
কমু এই বিয়ায় আমার মত আছিল না। বাবার কথায় রাজি হইছি।
আর তর বউ যহন তগো বাড়িতে আইয়া হুনবো পারুর লগে তর সম্পর্ক আছিল, পোলাপান তিনডা তর, তহন তর নতুন বউ কী মনে করবো?
চ্যাট মনে করবো। এইরকম কত অয়।
একটু থামল আতাহার তারপর বলল, তয় দোস্ত, তরে বিশ্বাস কইরা কথাডি আমি কইলাম। এই কথা য্যান কেঐর কানে না যায়।
নিখিল ম্লান হেসে বলল, না যাইবো না। ল অহন সেন্টুর দোকানে যাই। চা খাওন। লাগবো। তর কথা হুইন্না আমার মাথা ধইরা গেছে।
আতাহার হাসল। তোমার মাথা আবার বেশি মুলাম দোস্ত। কথায় কথায় ধরে।
.
ভেন্না কাঠের নৌকাখানি
মাঝখানে তার গুড়া
আগার নাইয়া পাছায় গেলে
গলুই পড়ে খইয়া রে মাঝি বাইয়া যাও রে…
সেন্টুর দোকানে কোনও গাহেক নাই। আলমগীর আর সুরুজ বসে আছে একটা বেঞ্চে। সামনের টেবিলে তবলার মতন চাটি বাজিয়ে নিচা গলায় গান গাইছে আলমগীর। সুরুজ তেমন মুগ্ধ না, সেন্টু মুগ্ধ হয়ে আলমগীরের গান শুনছে।
আতাহার আর নিখিল এসে ঢোকার লগে লগে গান থামাল আলমগীর। আইছো দোস্তরা? আহো আহো। এত দেরি করলা ক্যা?
নিখিল বলল, আমরা যে আমু তরা জানতি?
সুরুজ বলল, জানুম না? আতাহার তো আমগো খবরঐ দিছে তোরা বাজারে আবি। সেন্টুর দোকানে বইয়া আমরা আড্ডাবাজি করুম।
আতাহার তো আমারে কিছু কয় নাই।
আতাহার হাসল। আমি তো বেডা তগো বাড়ি অইয়া আইছি। বাইত্তে উডি নাই। নৌকা থিকা জিগাইলাম তুই বাইত্তে আছসনি? তর বাপে আছিল বাইত্তে, কইলো, না, বাজারে গেছে। আমার ইচ্ছা আছিল তরে বাইত্তে থিকা লইয়ামু।
নিখিল একটা বেঞ্চে বসল। ও এই মতলব।
আতাহার বসল নিখিলের পাশে। সেন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, চা দেন সেন্টুদাদা। ফাসকেলাস চা দেন।
আলমগীরের দিকে তাকাল আতাহার। এই ফাঁকে গানহান শেষ করো দোস্ত। বহুত ভাল্লাগতাছিল তোমার গান।
আলমগীর কোনও কথা ছাড়াই আগের মতন গাইতে লাগল…
মাঝি বাইয়া যাওরে
অকুল দরিয়ার মাঝে
আমার ভাঙ্গা নাও রে মাঝি
বাইয়া যাও রে…
গান শেষ হওয়ার পর আতাহার বলল, দোস্তে আইজ বহুত মুডে আছে। ঘটনা কী?
আলমগীর হাসল। কোনও ঘটনা নাই। তগো লগে দেহা হইলো এই আনন্দে গান ধরছিলাম।
সুরুজ বলল, দোস্তে আমার বিরাট বয়াতি।
সেন্টু চায়ের গেলাসে দুধ চিনি মিশিয়ে কেটলি থেকে চায়ের লিকার ঢালল গেলাসে। চায়ের সুন্দর গন্ধে ভরে গেল চারদিক। তারপর চায়ের চামচে ফটাফট শব্দ করে গেলাসে চায়ের লিকার আর দুধ চিনির মিশেল দিতে দিতে সে বলল, আলমগীর দাদার গলাখান ভগবানের দয়ায় বিরাট সোন্দর। চেষ্টা করলে বিরাট বয়াতি অইতে পারতো দাদায়। খালেক দেওয়ান মালেক দেওয়ানের লাহান।
আলমগীর লজ্জা পেল। আরে ধুর। কই এত বড় বড় বয়াতি আর কই আমি। আরে আমি তো সেহের আলী পিয়নের পোলা হালিমের লাহানও অইতে পারতাম না।
নিখিল বলল, হালিম তো রেডিয়ো টেলিভিশনে পল্লিগীতি গায়। ভাল নাম করছে।
সুরুজ বলল, হ আমিও হুনছি।
সেন্টু চা বানিয়ে টিনের থালায় করে ওদের সামনে নামিয়ে রাখল। যে যার গেলাস নিয়া চুমুক দিল।
সেন্টু তাকিয়ে ছিল আতাহারের দিকে। আতাহার চায়ে চুমুক দেওয়ার পর বলল, চা কেমুন অইছে দাদা?
তেমুন সুবিদার অয় নাই।
সেন্টুর মুখটা কালো হয়ে গেল। সুবিদার অয় নাই? কন কী? আমার চা তো আইজ তরি কেউ খারাপ কয় নাই।
আলমগীর বলল, আমার তো ভালই লাগতাছে।
সুরুজ বলল, হ ভাল।
আতাহার নিখিলের দিকে তাকাল। তুই কী কচ রে নিখিলা?
আমি কিছুই কমু না।
ক্যা?
অসুবিদা আছে।
কী অসুবিদা?
আলমগীর আরেক চুমুক চা খেয়ে বলল, অর অসুবিদাটা আমি বুজছি।
আতাহারও চায়ে চুমুক দিল। কী অসুবিদা ক তো আমারে?
আলমগীর নিখিলের দিকে তাকালো, কমুনি রে নিখিলা?
ক।
সত্যঐ কমু?
তয় মিছানি!
আলমগীর আতাহারের দিকে তাকাল। ও ভালমন্দ কিছু কইবো না ক্যা জানচ? কইবো না একখান কারণে। ভাল কইলে আমরা মনে করতে পারি সেন্টু দাদায় আর অরা একজাত দেইখা, হিন্দু দেইখা সেন্টুদাদার খারাপ চারেও নিখিলা ভাল কইতাছে। আর খারাপ হইলে সেন্টুদাদায় মনে করবো, জাতভাই অইয়াও নিখিল আমার চা খারাপ কইলো।
শুনে নিখিল একেবারে হা হা করে উঠল। যা বেডা। এই হগল চিন্তা আমার মাথায়ই আহে না। হিন্দু মোসলমান গইনা আমি কথা কই না।
সেন্টু বলল, আমিও কোনওদিন ওইভাবে চিন্তা করি না। চা একদিন ইকটু খারাপ একদিন ইকটু ভাল হইতেই পারে। হাতে বানাইন্না জিনিস সবসময় একরকম নাও অইতে পারে।
আলমগীর চায়ে চুমুক দিয়া নিখিলের দিকে তাকাল। হাসিমুখে বলল, নিখিলা, তয় ক আইজ সেন্টুদাদার চা কেমুন অইছে।
সুরুজ বলল, হ রে নিখিলা, কইয়া হালা।
আতাহার হাসিমুখে বলল, তয় আমারে খুশি কর নাইলে সেন্টুদাদারে খুশি কর। একজনরে তো খুশি করন লাগবো।
নিখিল হাসল। চা লইয়া আইজ আমি কোনও কথাই কমু না। আইজ আমি অন্যকথা কমু।
কী কথা?
এই যে হিন্দু মোসলমানের প্যাঁচটা আমগো চাইর দোস্তের মইদ্যে লাগছে, এই প্যাঁচটা কি আগে আছিল? আছিল না। কে লাগাইছে ক তো?
আলমগীর বলল, আমি জানি। এইডা লাগায়া দিয়া গেছে ওই শালা মাটির কনটেকদারে। আলী আমজাদ। যেদিন প্যাঁচটা হেয় লাগাইছিল আমিঐ পয়লা ধরছিলাম কথাডা। কইছিলাম দুস্তির মইদ্যেও ধর্মের প্যাঁচখান আপনে লাগায়া দিলেন মিয়া। আপনে বহুত ত্যান্দর।
আতাহার চায়ে চুমুক দিয়া বলল, হ আমারও মনে আছে।
তারপর সেন্টুর দিকে তাকাল সে। আমার কথা হুইন্না মনে কষ্ট নিয়েন না সেন্টুদাদা। আমি আপনের লগে ফাইজলামি করছি। চা আপনের ভাল অইছে। বহুত ভাল। একদোম। ফাসকেলাস।
এবার সেন্টুর মুখে হাসি ফুটল। সত্য কইতাছো?
হ দাদা, সত্যঐ কইতাছি।
নিখিলের দিকে তাকাল আতাহার। এইবার তুই ক নিখিলা, সেন্টুদাদার চা তর কেমুন। লাগছে। অহন আর আমারে তর খুশি করনের কাম নাই।
নিখিল তার চায়ে শেষ চুমুক দিল। কাপ নামিয়ে রেখে বলল, সিগ্রেট দে।
আতাহারও তার চায়ে শেষ চুমুক দিল। আগে চায়ের কথা ক, তারবাদে সিগ্রেট।
ফাইজলামি করি না আতাহার।
আমি ফাইজলামি করতাছি না। আগে তর কওন লাগবো।
কইলাম না, এইডা লইয়া আমি আইজ কথাই কমু না। সেন্টুদাদার চা তর ভাল লাগছে তুই তার সুনাম কর। মন্দ লাগলে দুরনাম কর। আমি কোনওডাই করুম না।
বহুদিন পর খুবই সাহসী একটা কাজ তারপর করল নিখিল। আতাহারের টি-শার্টের বুক পকেটে ক্যাপস্টান সিগ্রেটের প্যাকেট। আতাহারের পকেট থেকে টেনে সিগ্রেটের প্যাকেটটা বের করল। নিজের পকেটে ম্যাচ ছিল। যেন নিজের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট ধরাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে আতাহার প্যাকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরাল। মুখ ভরে ধুমা ছেড়ে প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রেখে দিল।
নিখিলের কারবারে আতাহার তো অবাক হয়েছেই, আলমগীর আর সুরুজও অবাক। সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নিখিলের দিকে। ওদের ওইরকম তাকানো দেখে হাসল নিখিল। কী রে, এমতে চাইয়া রইছস ক্যা?
সুরুজ বলল, তর সাহস দেইখা।
কী করছি আমি?
আতাহারের জেব থিকা প্যাকেট লইয়া সিকরেট ধরাইলি।
এইডা সাহসের কিছু না।
তয় কী?
আতাহার আমার দোস্ত। দোস্তর জেবে হাত দিয়া প্যাকেট বাইর কইরা সিকরেট আমি ধরাইতেই পারি। আমার জেবেরটাও আতাহার পারে। তরটা পারে আলমগীর, আলমগীরেরটা পার তুই। তরটা পারে আতাহার, আলমগীরেরটা পারি আমি। দুস্তির নিয়মঐত্তো এইরকম, নাকি?
আলমগীর হাসল। সে চা খায় একটু সময় নিয়া। সবার চা শেষ হওয়ার পরও তার গেলাসে এক চুমুক চা রয়ে গেছে। সেই চা চুমুক দিয়া খেল সে। তর লগে চাইর-পাঁচদিন পর দেখা হইলো নিখিলা। এই চাইর-পাঁচদিনে তুই ইকটু বদলাইছস। এমুন কামও তর কোনওদিন দেহি নাই, এমুন কথাও তর মোখে কোনওদিন হুনি নাই।
আতাহার নিখিলের পিঠে ভাল রকম একটা থাবড় দিল। হাসিমুখে বলল,
সাবাস বাপের বেড়া
বাইচ্চা থাক চিরকাল
খুইট্টা যা চ্যাটের বাল
শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ততক্ষণে আতাহারের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট নিয়ে ধরিয়েছে সবাই।
নিখিল বলল, আমগো দুস্তির মইদ্যে হিন্দু মোসলমানের প্যাঁচখান যে লাগাইয়া দিল, তার খবর কী রে আতাহার? তর দোস্ত আলী আমজাদ!
আরে কনটেকদারের তো কোনও খবরঐ নাই। দশ-বারোদিন আগে বাজারে একদিন। দেহা হইছিল। কইলো আমার লগে দেহা করতে আমগো বাইত্তে আইবো, আহে নাই।
আলমগীর বলল, তার তো অহন কোনও কামও নাই। বাইষ্যাকালে মাডির কাম কম। ওই যে দেহচ না কুমারবুগ মিহি অইয়া আধাবিধি অইয়া পইড়া রইছে রাস্তা। মাডি হালান অয় নাই। বাইষ্যাকালের পানিতে ভরা। এই কাম তো আলী আমজাদেরঐ আছিল।
সুরুজ সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, হ। কামডা হেয় শেষ করল না ক্যা?
আতাহার বলল, কেমতে করবো? ধুমাইয়া কাম করল রাইত দিন। দেড়-দুইমাস করল তাও শেষ করতে পারল না। মাওয়ার ঘাট তরি যাওনের আগেঐ ম্যাগ বিষ্টি আরম্ব অইয়া গেল। ম্যাগ বিষ্টিতে তো মাডির কাম করন যায় না।
নিখিল বলল, তার লেইগা রাস্তার কাম পিছাইয়া গেল। ওই মিহি দেখগা কোলাপাড়া তরি রাস্তার ইটা বিছাইন্না শেষ। ছিন্নগর তরি রাস্তা পাকা অইয়া গেছে। ওইটারে কয় কারপেটিং। কারপেটিং অইয়া গেছে। আর আমগো এই মিহি আইয়া আমরা রইলাম। আটকাইয়া। ইটাঐ বিছাইন্না অইলো না।
সেন্টু বলল, মাডির কাম না অইলে ইটা বিছাইন্না অইবো কেমতে?
তার অর্থ হইল শীতের দিনের আগে আর কাম শুরু অইতাছে না।
হ।
সিগ্রেট টানতে টানতে উঠে দাঁড়াল আতাহার। ল একখান কাম করি।
আলমগীর বলল, কী?
পুক কুমারবুগ যাই।
সুরুজ বলল, কার বাইত্তে?
কনটেকদার সাবের বাইত্তে।
নিখিল বলল, আথকা তার বাইত্তে যাবি ক্যা?
যাই ইট্টু আড্ডা চাডামি মাইরাহি। তার ইট্টু খোঁজখবরও লইলাম। কাম বন্দ দেইক্কা আমগো লগে যোগাযোগ দুস্তি বেবাকঐ বন্দ কইরা দিল। ঘটনা কী ইট্টু বুইজ্জাহি।
আলমগীর বলল, আমি যামু না রে?
ক্যা?
কনটেকদাররে আমার তেমুন পছন্দ অয় না।
ক্যা হেয় তর কী করছে?
হালায় ইট্টু বেশি ট্যাটন।
সুরুজ বলল, আমরাও কম ট্যাটন না।
তুমি আমার বালের ট্যাটন। তুমি হালায় অইলা ভোদাই। বালও বোজো না।
বুজি সবঐ। কই না আর কী!
সিগ্রেটে টান দিয়া আতাহার বলল, এত প্যাচাইলের কাম নাই বেডা। ল যাই, দেইক্কাহি কনটেকদাররে। অর বাইত্তে তো কোনওদিন যাই নাই, দেহি হালায় খাতির করে কেমুন? দোফরে ভাত ভোত খাওয়ায়নি?
নিখিল বলল, যুদি না খাওয়ায়?
না খাওয়াইলে না খাওয়াইবো। আমরা কোনও দোকানপাটে বইয়া চা বিসকুট আর নাইলে বনরুটি কেলা খাইয়া লমু। আমরা কি ফকিন্নি নিরে বেড়া। জেবে টেকা আছে না? আলইম্মা, কথা কইচ না। ল।
প্যান্টের পকেট থেকে চায়ের দাম দেওয়ার জন্য মানিব্যাগ বের করল আতাহার। চারকাপ চায়ের দাম আট টাকা। একটা দশটাকার নোট সেন্টুর দিকে বাড়িয়ে দিল সে। সেন্টুদাদা, চায়ের দাম রাখেন।
টাকাটা ধরল না সেন্টু। হাসিমুখে বলল, না আইজ চায়ের দাম নিমু না।
ক্যা?
তোমার মুখ দেইখা আমি বুজছি, তুমি আমার চাড়া যেমুন আশা করছিলা হেমুন আইজ অয় নাই। তাও আমারে খুশি করনের লেইগা চা ভাল কইছো। এই চা’র দাম আমি নিমু না। আরেকদিন আইয়ো। ফাসকেলাস চা তোমগো বানাইয়া খাওয়ামুনে। হেদিন দাম দিয়ো।
আরে না, এইডা কোনও কথা অইলো নি!
এইডাঐ কথা। যাও দাদারা, যাও। যতই হাদো আইজকার চায়ের দাম আমি কিছুতেই নিমু না।
সেন্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল নিখিল। ঠিকই আছে। আইজকার চায়ের দাম আপনের না নেওনঐ উচিত সেন্টুদাদা। আইজকার চা আপনের সত্যঐ ভাল অয় নাই।
নিখিলের একথায় ওই যে আতাহারের পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করায় যেমন অবাক হয়েছিল সবাই তেমন অবাক হল। সেন্টুর দোকান থেকে বের হতে হতে আতাহার বলল, নিখিলা আমি তো বিশ্বাস করতে পারতাছি না।
কী বিশ্বাস করতে পারতাছস না?
তর কথাবার্তা।
কী কইলাম আমি?
এই যে সেন্টুদাদার চায়ের কথা কলি!
চা ভাল না অইলে কমু না!
আলমগীর বলল, তুই তো কোনওদিন এত সাফকথা কচ না। আইজ পয়লা দেখলাম।
সুরুজ বলল, হালায় কেমুন জানি বদলাইয়া গেছে।
আতাহার বলল, ভাল বদলান বদলাইছে। সাহস বাইড়া গেছে। ভাল রে দোস্ত। সাহস বাড়ন বহুত ভাল।
আলমগীর বলল, অইছে, বাদ দে এই প্যাচাইল। অহন কনটেকদারের বাইত্তে যাবি কেমতে? নৌকা কো?
আতাহার বলল, তুই নৌকা লইয়া আহছ নাই?
হ। আমি আমগো নাও লইয়া আইছি। সুরুজ আইছে আমার লগে। তয় হেই নাও তো আমি সারাদিন রাকতে পারুম না। বাইত্তে পাড়ায় দেওন লাগবো। আমগো কামলা হজু বইয়া রইছে নাওয়ে।
তয় তারে যাইতে ক গা। আমগো নাওয়ে কইরা চাইরজনে যামু নে। হাফিজদ্দি নাও বাইয়া যাইবো। অরেও কনটেকদারের বাইত্তে খাওয়াইয়া লমু নে।
আলমগীর বলল, তয় ল ওইভাবেঐ যাই।
মাওয়ার বাজারে আসার নৌকাগুলি এই দিনে মালেক দরবেশের বাড়ির ওদিকটায়। থাকে। ওরা চারজন পা চালিয়ে দরবেশ বাড়ির সামনের মাঠটায় এল। এসে দেখে ততক্ষণে আরও অনেক নাও সেদিকটায়। চারদিককার গ্রামের বাজারি লোকরা যে যার নাও নিয়া বাজারে আসছে। কামলা গোমস্তারা আছে নাও পাহারায়, গিরস্তরা গেছে বাজারে। আলমগীরদের নৌকা আর আতাহারদের নৌকা কোন ফাঁকে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। হজু আর হাফিজদ্দি জমিয়ে গল্প করছিল। চারবন্ধুকে হেঁটে আসতে দেখে গল্প বন্ধ করে নাও ছাড়ার জন্য তৈরি হল তারা। হজুকে আলমগীর বলল, তুই বাইত্তে যাগা হজু। মা’রে কইচ আমি আতাহারের লগে আছি। পুব কুমারবুগ যামু কনটেকদার সাবের বাইত্তে। আইতে আইতে বিয়াল অইবো।
চার বন্ধু তারপর আতাহারদের নৌকায় চড়ল।
.
মান্নান মাওলানার পাতে বড় একটা কইমাছ তুলে দিয়ে পারু বলল, ঘটক আইছিল ক্যা?
উস্তা ভাজি দিয়ে কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়েছেন মান্নান মাওলানা। পারু কইমাছ তুলে দেওয়ার সময়ও তাঁর মুখে ভাত। কোনওরকমে ভাতটা গিললেন তিনি, একটু থতমত খেলেন, তবে পারুকে বুঝতে দিলেন না কিছুই। খুবই স্বাভাবিক গলায় বললেন, আজাহারের বিয়ার একখান প্রস্তাব লইয়া আইছে।
তহুরা বেগম মারা যাওয়ার পর থেকে সংসারের ভার যেমন কাঁধে তুলে নিয়েছে পারু, তেমন শ্বশুরের তিনবেলার খাওয়ার দায়িত্বটাও নিয়েছে। আতাহারেরটা তো নিয়েছেই, মান্নান মাওলানারটা নিয়েছে এমনভাবে যেন মা মারা যাওয়ার পর সংসারের বড়মেয়ে তার বুড়া বাপের দায়িত্ব নিয়েছে। তহুরা বেগম বেঁচে থাকতে এই ঘরের পালঙ্কে বসে ভাত খেতেন মান্নান মাওলানা। খাওয়ার সময় হলে পালঙ্কে দস্তরখান বিছিয়ে দিত রহিমা। খাবার সাজিয়ে দিত, হাত ধোয়ার জন্য দিত পিতলের চিলমচি আর তহুরা বেগম এসে বসতেন পাশে। রেকাবিতে ভাত তুলে দিতেন, তরকারি তুলে দিতেন, মান্নান মাওলানা ধীরে ধীরে খেতেন আর তহুরা বেগম সংসার নিয়া পোলাপান নিয়া টুকটাক কথা বলতেন। মান্নান মাওলানা খেতে খেতে কথা বলতেন।
এখনও আগের নিয়মটাই আছে। জহুর নমাজের পর পরই রহিমা তার অভ্যাস মতন পালঙ্কে দস্তরখান বিছায়, চিলমচি দেয়, ভাত তরকারি সাজিয়ে দেয় আর তহুরা বেগমের জায়গায় এসে বসে পারু। অতিযত্নে শ্বশুরের রেকাবিতে ভাত তরকারি তুলে দেয়, তিনি তার ভঙ্গি মতন খেতে শুরু করেন।
খাওয়ার সময়ও মান্নান মাওলানার মাথায় টুপিটা আছে। খানিক আগে জহুর নমাজ পড়েছেন। হাতে তসবি ছিল। তসবি এখন বালিশের কাছে রাখা। এই অবস্থায়ও পারুর কথা শুনে ডাহা মিথ্যা কথাটা তিনি বললেন।
রান্নাবান্না শেষ করে গোসল সেরেছে পারু। তার আগে ছোট মেয়েটাকে ডেকে এনেছে গনি মিয়ার সীমানা থেকে। মেয়েটা প্রায় সারাদিনই থাকে ওদিকটায়। মতিমাস্টারের প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে দুটি, হিরা মানিক সারাদিন বসে থাকে উঠানের পাশের জামগাছতলায়। মাটিতে লেছড়ে পেছড়ে পঙ্গু শরীরে যতটা পারে নড়াচড়া করে, অবোধ্য ভাষায় শব্দ করে, হাসে। নূরি কেমন কেমন করে ছেলেমেয়ে দুইটার লগে মিশা গেছে। যেন চার-পাঁচ বছরের এতটুকু বাচ্চাটা প্রতিবন্ধী ভাইবোন দুটির কথাবার্তা আচার আচরণ সবকিছুর অর্থ বোঝে। তাদের সঙ্গে খেলে, কথা বলে, হাঁটে। আর একজন মানুষও আছে এই তিনটি শিশুর সঙ্গে। মুকসেদ আলী। দেশগ্রামে মুকসেইদ্দা চোরা নামে পরিচিত। সাত-আট মাস হল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সেই যে বাড়িতে এসে বসেছে, চুরি ধাউরামি ছেড়ে দিয়ে মানুষ হওয়ার লাইন ধরেছে। এই বয়সে মতিমাস্টারের ছাত্র হয়েছে। লেখাপড়া শিখার ছাত্র না, মানুষ হওয়ার ছাত্র। সারাদিন আছে মতিমাস্টারের লগে। মাস্টার এদিক ওদিক ছাত্র পড়াতে যায়, খাইগোবাড়ির ইসকুলে যায়। নিজের নাও নাই মাস্টারের। হদ্দ গরিব মানুষ। মুকসেদ থাকে ভাইয়ের সংসারে। ছোট ভাই, ভাইর বউ আর পোলাপান তাকে খাতির যত্ন যতটা করার করে। সয় সম্মানও করে। কারণ এই ভাইর জীবনটা মুকসেদই গড়ে দিয়েছে। তার চুরির টাকায় নিজের হয় নাই কিছুই মুকসেদের, সবই হয়েছে ভাইয়ের। খেতখোলা গোরু বাছুর বাড়িঘর। বউ পোলাপান আরামে আছে মুকসেদের জন্যই। তবে বেইমানিটা মুকসেদের ভাই জমসেদ মুকসেদের লগে করে নাই। ভাইকে রেখেছে মাথার ওপর। ভাই যা বলে তাই সই। গিরস্তি করার নৌকা একখান আছে জমসেদের। মুকসেদ এসে বাড়িতে থান গাড়ার পর দক্ষিণের ভিটির ভাঙাচোরা ঘরটা সে ঠিকঠাক করে দিয়েছে ভাইকে। এইবার বর্ষা শুরু হওয়ার পর পরই দিঘলির হাট থেকে ছোট্ট একখান কোষানাওও কিনা আনছে ভাইর জন্য। সেই নাও নিয়া মতিমাস্টারের লগে লাইগা আছে মুকসেদ। মাস্টাররে নিয়া নাও বাইয়া ছাত্র বাড়ি যায়, ইসকুলে যায়। মাস্টার ঘণ্টা-দুইঘণ্টা ধরে ছাত্র পড়ায়। মুকসেদের মতন এতবড় নামকরা চোর বাড়ির গোমস্তার মতন নাওয়ে বসে থাকে। নমাজ ধরে নাই, তবু তার মাথায় সাদা গোল টুপি। পরনে লুঙ্গি পিরন। মোচদাড়ি কামানো ছাইড়া দিছে। কাঁচাপাকা দাড়িমোচে মুকসেদকে এখন আর দাগি চোর মনে হয় না। মনে হয় দেশগ্রামের সাদাসিধা গিরস্তলোক। মতিমাস্টারের ছাত্রবাড়ির ঘাটে কোষানাওয়ের চারটে বসে সে আকাশ দেখে, গ্রামের গাছপালা আর বর্ষাকালের পানি দেখে, আকাশ আর মাটির মাঝখান দিয়া উড়ে যায় যেসব পাখি সেইসব পাখি দেখে, পানির তলার মাছ দেখে, রোদ দেখে, হাওয়া টের পায় আর আল্লাহপাকের কুদরতের কথা ভাবে। নিজের ফেলে আসা চোরজীবন নিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আহা একটা জীবন চুরি কইরা কাটল। দিনরাত পরিশ্রম করে সংসার ছেলেমেয়ের জন্য সোনাদানা টাকাপয়সা তামা পিতল কত কিছু জোগাড় করে গিরস্তলোক, আর সেইসব চুরি করে, তাদের সর্বনাশ করে নিজের জীবন চালিয়েছে মুকসেদ। চুরির অপরাধে গিরস্তের হাতে ধরা পড়ে মার খেয়েছে, দিনের পর দিন জেল খেটেছে। এরকম না হয়ে তার জীবনটা তো অন্যরকমও হতে পারত। দেশগ্রামের স্বাভাবিক গিরস্তলোকের জীবন। জামসেদের যেমন হয়েছে। বউ পোলাপান, গোরু বাছুর, ঘরবাড়ি আর চাষের জমিন! জীবনের যে স্বাভাবিক চক্র সেই চক্রের মধ্যেই যদি থাকতে পারত মুকসেদ।
আজ এই বয়সে এসে কোষানাওয়ের চারটে বসে এইসব কথা ভাবে মুকসেদ। ওদিকে বাড়ির ভিতরে মতিমাস্টার হয়তো তার ছাত্রকে তখন পড়াচ্ছেন,
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে…
মানুষের জীবন তো আসলে এক ছোট নদীই। বাঁকে বাঁকেই তো চলছে জীবন। এই বয়সে এসে মুকসেদের জীবন যেমন বাঁক নিয়েছে আরেক দিকে। চোরজীবন হারিয়ে গেছে জীবনের ফেলে আসা বাঁকে।
নতুন কোষানাও নিয়া মুকসেদ যেদিন মতিমাস্টারকে বলল, মাস্টার সাব, আমি আইজ থিকা আপনের নৌকার মাঝি। বর্ষার শুরু দিককার কথা। ততদিনে মুকসেদের লগে সম্পর্ক অনেক স্বাভাবিক হয়েছে মতির। লোকটা সারাদিন তার ছেলেমেয়ে দুটির পাশে আছে। তাদের লগে হাসছে খেলছে, মজা করছে। পারুর ছোট মেয়েটাও এসে জুটছে। চারজনের ভাল একটা দল। মাস্টার তখন চিন্তায় পড়েছেন এই বর্ষা আর বৃষ্টি বাদলায় ছাত্র পড়াবার কাজটা কীভাবে করবেন। নৌকা তো নাই। গনি মিয়াকে যে বলবেন, দাদা একখান নৌকা কিনা দেন। পুরানা ধুরানা হইলেই চলবো। আমার তো নাইলে না খাইয়া মরণ। ছাত্র পড়াতে যাই কেমনে!
বলে লাভ নাই। গনি মিয়া বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন নিজের স্বার্থে। একটা পয়সা দিয়াও সাহায্য করেন না। ওই থাকতে দেওয়া পর্যন্তই। ঢাকার যাত্রাবাড়িতে ছয়তলা বাড়ি তুলে ফেললে কী হবে, জাপানি টাকায় বড়লোক হয়ে গেলে কী হবে, দশ-বিশটা টাকাও হাতে ওঠে না। দুনিয়ার কিরপিন।
এই অবস্থায় মুকসেদের কোষানাও আর ওই কথা, মতিমাস্টার হা হা করে উঠেছিলেন। হায় হায় দাদা, এইটা কী বলেন? না না এইটা হয় না।
মুকসেদ হেসেছে। হয় মাস্টার সাব, হয়। কইছি না, আমি মানুষ হইতে চাই। আপনে আমারে মানুষ হওনের পথটা দেখান।
পথ তো আপনে পাইয়াই গেছেন। যেই কাজ করতেন সেইটা ছাইড়া দিছেন। ওই কাজ ছাইড়া দেওয়ার অর্থই তো মানুষ হওয়ার পথ।
তারপরও আপনের সেবা কইরা আর একটু মানুষ হইতে চাই। আপনে মাস্টার সাব না করবেন না। না করলে মনে বহুত কষ্ট পামু আমি। মাস্টার মানুষ হইয়া মাইনষের মনে আপনে কষ্ট দিতে পারেন না।
এই কথার পর আর কী বলার থাকে! মুকসেদকে নিয়াই আছেন মতিমাস্টার। রোদ বৃষ্টিতে তিনি ছাতি মাথায় দিয়া কোষানাওয়ের মাঝখানে বসে থাকেন আর মাথায় টুপি দিয়া নাও বেয়ে যায় মুকসেদ। এই গ্রাম ওই গ্রাম। সকালবেলা, বিকালবেলা। ভাইয়ের এই পরিবর্তনে জামসেদ তো অবাকই, তার বউ পোলাপানও অবাক। আর মুকসেদ বিড়ি সিগ্রেট ছাইড়া দিছে, পান তামাক ছাইড়া দিছে এটাও একটা আশ্চর্য ঘটনা। সাত-আট মাসে একটা মানুষ পুরাপুরি বদলাইয়া গেল। নতুন মানুষ হয়ে গেল!
মুকসেদের এইসব কথা পারু শুনেছে মতিমাস্টারের বউর কাছ থেকে। দেশগ্রামের নামকরা চোর, তাগড়া জুয়ান মুকসেদ দিনরাত পড়ে আছে মতিমাস্টারের বাড়িতে, মতিমাস্টারের বউ আর মুকসেদকে নিয়া দেশগ্রামের মানুষ কথা তুলতে পারে, ভেবে ভাল একটা তরিকা ধরছে মুকসেদ। মাস্টারের বউকে ডাকে বইন। আর ভঙ্গি এত বিনয়ী, মনে। হয় সত্যি সে মাস্টারের বউয়ের ভাই। বয়সে যত বড়ই হোক।
শিরি আর নসু নিজেরাই নিজেদের কাজগুলি করে। নাওয়া ধোওয়া, শরীরে মাথায় তেলপানি দেওয়া। শুধু নূরির কাজগুলি করতে হয় পারুকে। আজ রান্নাবান্না শেষ করে, নূরিকে নিয়া নিজে গোসল করেছে পারু। ততক্ষণে মান্নান মাওলানার নমাজ শেষ। রহিমা খাবার নিচ্ছে তাঁর ঘরে। মাথায় নতুন বউর মতন ঘোমটা দিয়া পারু এসে বসেছে শ্বশুরের সামনে। তার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে। কইমাছটা তুলে দিয়েই প্রশ্নটা করল, ডাহা। মিথ্যাটা মান্নান মাওলানা ছেলের বউকে বললেন।
আতাহারের লগে তার বিয়ার ব্যাপারটা তহুরা বেগমের কথায় মেনে নিয়েছেন মান্নান মাওলানা, এটা জানার পর থেকে শ্বশুরের প্রতি বেদম একটা ভক্তি শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে। পারুর। শ্বশুরের যে-কোনও কথাই তার কাছে বিরাট দামি। অন্য সময় তাঁর লগে কথ বার্তা তেমন হয় না। হয় শুধু দুপুর আর রাতের খাবারের সময়। সকালের নাস্তার সময় কথাবার্তার তেমন সুযোগ নাই। নাস্তা করার সময় আর কতটা! ওইটুকু সময়ে কী কথা হবে!
আজাহারের বিয়ার কথা শুনে পারু একটু চিন্তিত হল। আম্মায় মইরা যাওনের পর থিকা তো আজাহারের তেমন রাও শব্দ নাই।
কইমাছের পিঠের দিকটা ভাঙতে ভাঙতে মান্নান মাওলানা বললেন, রাও শব্দ নাই অর্থ কী?
চিঠিপত্র লেখে না। টেকাপয়সাও পাড়ায় না আগের লাহান।
হ পোলাডারে লইয়া আমি ইকটু চিন্তিত। জাপানে বিয়াশাদি করল কি না কে জানে!
ওইডা না জাইন্না অর বিয়াশাদির চেষ্টা করন…
হ ঠিক অইতাছে না। তয় আমার কথা অইলো, বাপ হিসাবে আমার দায়িত্ব অইলো লায়েক পোলা মাইয়ার বিয়াশাদি দেওন। আমি মাইয়া মুইয়া দেইখা রাখলাম। মাইয়া পছন্দ অইলে ঢাকা গিয়া আজাহাররে ফোন করুম। ও যুদি কয় হ দেশে আইবো, বিয়া করবো তয় কথা ফাইনাল করুম, নাইলে না কইরা দিমু। তহন আমার আর কোনও দায় রইল না। বাপ হিসাবে আমি আমার দায়িত্ব শেষ করতে চাইছি। বিদেশে থাকা পোলা হেইডা করে নাই। দায় আমার না, দায় পোলার।
বড় এক লোকমা ভাত মুখে দিলেন মান্নান মাওলানা। চাবাতে চাবাতে বললেন, সব দায়িত্বই আমি শেষ কইরা আনছি। মাইয়াগো বিয়া দিছি, মোতাহাররে বিয়া করাইছিলাম, পোলাডা গেল মইরা। সমস্যা আছিল আতাহার আর তোমারে লইয়া হেই সমস্যাডাও মিটা গেছে। তোমার হরি বাঁইচ্চা থাকলে এতদিনে বিয়াশাদি তোমগো অইয়া যাইতো। হেয়। মইরা গেল দেইখা বিয়া আমি পিছাইয়া দিলাম। পৌষ-মাঘ মাসে বিয়া হইয়া যাইবো। বিয়া হইয়া গেলে আতাহারও লাইনে আইবো, সংসার দেখবো। তহন আমার আর কোনও দায়িত্ব নাই। এনামুল সাবে মজজিদ করতাছে আমি থাকুম মজজিদ লইয়া।
শ্বশুরের কথা শুনে ভিতরে ভিতরে আনন্দে ফেটে পড়ছিল পারু। অতিকষ্টে আনন্দটা সে চেপে রাখছিল। শ্বশুর হওয়ার পরও মান্নান মাওলানাকে সে পছন্দ করত না। তার স্বভাব চরিত্র সবই পারু জানে। রহিমার লগে সম্পর্কের কথা জানে। মন্তাজের ঘরে গিয়া ফিরোজার লগে খাতির করবার চেষ্টা করছে এইসবও সে উদিস পাইছে, মাকুন্দা কাশেমের মতন এত পুরানা নিরীহ একজন মানুষকে যেভাবে চোর সাজাইয়া, মাইর ধইর কইরা জেলে দিল, ছনুবুড়িরে নিয়া ফতোয়া দিল, সহ্য করতে না পেরে নূরজাহান তার মুখে ছ্যাপ দিল, নূরজাহান জানত নিরীহ মানুষটাকে কেন এই দশা করলেন মান্নান মাওলানা। এই বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকেই একে একে বাড়ির ভিতরকার চেহারাটা পারু দেখেছে, মান্নান মাওলানার চরিত্র টের পেয়েছে। নিজে জড়িয়ে গেছে আতাহারের লগে এই কারণে মুখ ফুটে অনেক কিছুরই প্রতিবাদ সে করতে পারে নাই। চালনি যদি সুঁইরে কয় তর পাছায় ছিদ্র, সেটা কেমন হবে। নিজে এক দোষে দুষি হয়ে অন্যের দোষ সে ধরতে যাবে কেন?
অনেক কিছু দেখেও পারু এজন্য কখনও কোনও কথা বলে নাই। নিজেরে নিয়া ছিল, আতাহারকে নিয়া ছিল। তার শরীর, তার মাথা ধরা এসব থেকে মুক্তিই ছিল তার বেঁচে থাকা। স্বামীর কাছ থেকে ধাক্কা খেয়ে এক বিকালে সে চলে গিয়েছিল আতাহারের হাতে। সেই হাত ধরেই দশ-এগারোটা বছর পার করেছে। এখন বাকি জীবনটা পার করার ব্যবস্থা হচ্ছে। মান্নান মাওলানা যত খারাপ লোকই হোক, আতাহারও তেমন সুবিধার ছেলে না, তবু তারা যে পারুর জীবনটা একটা সোজা পথে এনে দিচ্ছে এইজন্য মান্নান মাওলানার ওপর খুবই খুশি সে। খুবই কৃতজ্ঞ সে মানুষটার কাছে।
দশ-বারোটা বাছাই করা কইমাছ আজ রান্না করেছে পারু। রহিমারে বলছে সবচাইতে বড় দুইখান হুজুররে দিতে। তার একখান খেয়ে শেষ করেছেন মান্নান মাওলানা। এখন পরেরটা তার পাতে তুলে দিল পারু। এক চামচ ভাত দিল। ঝোল দিল অনেকখানি।
এই বয়সেও মান্নান মাওলানা খান প্রায় দুই মানুষের খাবার। অনেকক্ষণ ধরে রসাইয়া রসাইয়া খান। পরের কইমাছ পাতে পড়ার পর বললেন, শিরি নসুরা খাইছে?
মাথার ঘোমটা একটুখানি নেমে গিয়েছিল। সেই ঘোমটা টেনে পারু বলল, এতক্ষণে মনে হয় খাইয়া হালাইছে।
তোমার ছোটডাঃ নূরি?
শিরি অরে খাওয়াই দিছে। আগে অরে খাওয়াইয়া, নসুরে খাওয়াইয়া তারবাদে শিরি খায়।
তোমার বড় মাইয়াডা বহুত লক্ষ্মী অইছে। বহুত সংসারী অইবো মাইয়াডা। এই বয়সেই সবকিছু গুছাইয়া গাছাইয়া করে।
লেখাপড়ায়ও ভাল।
পরের কইমাছ ভাঙতে ভাঙতে মান্নান মাওলানা বললেন, আতাহার কই গেছে?
বিয়ার কথা হওয়ার পর থেকে আতাহারের নামটা উঠলেই শরম পায় পারু। এখনও সেই শরমটা পেল। মাথা নিচা করে বলল, হাফিজদ্দিরে লইয়া বাজারের দিকে গেছে।
দোফর অইয়া গেল অহনতরি আইলো না। বাইত্তে হাফিজদ্দির কামকাইজ আছে না? গোরুর ঘাসমাস আছেনি?
আছে। আথালে দেকলাম বিয়ানে অনেক কচুরি আর দল দিয়া রাখছে হাফিজদ্দি। গোরুডি হারাদিন ধইরা খাইতে পারবো।
অগো খাওনদাওন লাগবো না।
হেয় দোস্তগো লগে চা মিষ্টি খাইবোনে বাজারে বইয়া।
ও নাইলে খাইলো, হাফিজদ্দির খাওন লাগবো না? ওই বেডা না খাইয়া অর লগে বইয়া থাকবো?
একথার জবাব দিল না পারু। বলল অন্যকথা। আজাহারের লেইগা কোন গেরামের সমন্দ আনছেন ঘটকে?
লগে লগে মান্নান মাওলানা বলল, মাইয়াগো গেরাম অইলো মালিরঙ্ক। বাপের অবস্থা ভাল। ভাইভুইরা বিদেশে থাকে। তয় এই হগল সমন্দ আইন্না লাব কী? আজাহারের মতলবঐত্তো বুজতাছি না।
আপনে একবার ঢাকা গিয়া ফোনে অর লগে কথা কন।
ও হেইডাঐ করুম।
মাছভাত খেয়ে দুধভাত নিয়েছেন মান্নান মাওলানা। রেকাবি ভরতি সামান্য ভাত, একদলা খাজুড়া মিঠাই। আগে ভাত মিঠাই খেয়ে ফুরুক করে দুধে একটা চুমুক দিলেন। এক চুমুকে রেকাবি খালি। তারপর পানি খেলেন। তার খাওয়া দাওয়া শেষ। এখন রেকাবি আর তরকারি পেয়ালা বাটি যতটা সম্ভব নিয়া যাবে পারু। যা থাকবে রহিমা এসে নিবে। মান্নান মাওলানা এখন একটা ঘুম দিবেন।
মান্নান মাওলানার ঘর থেকে বের হয়ে পারু দেখে আগের রোদেলা ভাবটা নাই। আকাশ মেঘলা হয়েছে। যখন তখন নামবে বৃষ্টি। আকাশের দিকে তাকিয়ে তার প্রথমে মনে হল হিরা মানিকের কথা। নূরিকে ডাকতে গিয়া সে দেখছে জামতলার ভিজা মাটিতে বসেই খেলছে পোলাপান দুইটা। তার ছোট মেয়েটাও আছে তাদের সঙ্গে। ভিজা মাটিতে ছেড়ে পেছড়ে বসার ফলে জামা কাপড়ে ভিজা ভিজা ভাব। তাও হাছড় পাছড় করে খেলছে, খলবল খলবল করে হাসছে। নূরিও তাদের লগে হাসছে মজা করছে।
ভিজা মাটিতে কেন পোলাপান দুইটারে বসাইছে মাস্টারের বউকে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিল পারু। বউটা মুশুরি ডাল বাগার দিয়া বলল, ঘরে থাকতেই চায় না। আর বাইত্তে তো কেঐ নাই। আপনের ছোড মাইয়াডা আহে খেলতে। আমি থাকি রান্নঘরে। রানঘর থিকা চোক্কে চোক্কে রাখতে পারি অগো। চাইরমিহি পানি। লেছড়াইতে লেছড়াইতে পানিপুনির মিহি যায়গানি রান্দনবাড়নের ফাঁকে ফাঁকে চাইয়া চাইয়া দেহি।
তখনই মতিমাস্টারকে নিয়া কোষানাও কইরা আসলো মুকসেদ। মতিমাস্টারের মাথায় ছাতি, মুকসেদের মাথায় টুপি। নূরিকে নিয়া ফিরার সময় পারুর মনে হয়েছিল, ছাত্র বাড়িতে গিয়া মাস্টার তো বাড়িতে ঢুইকা ছাত্র পড়ায়, মুকসেদ বইসা থাকে নাওয়ে। রইদ বিষ্টিতে কি এমতেই বইয়া থাকে নাকি তারও একখান ছাতি আছে, ছাতি মাথায় দিয়া বইসা থাকে!
এখন একবার সেই কথাটা মনে হল পারুর। চোখের সামনে একটা দৃশ্য দেখতে পেল সে। দোগাছির ওদিককার এক গিরস্ত বাড়ির ঘাটে কোষানাও নিয়া বসে আছে মুকসেদ। লগে ছাতি নাই। পাছার চারটে বসে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজছে সে।
কেন যে এই দশ্যটা পারুর চোখে ভেসে উঠল! মানুষ যে মনের চোখ দিয়া কতকিছু দেখে!
.
বাপ চাচাঁদের মিলে কয়েক শরিকের বাড়ি আলী আমজাদদের।
বাড়িতে ঢোকার মুখের ঘরটাই আলী আমজাদের। পাটাতন করা ঘর না, মাটির ভিটির ঘর। তবে উঠান থেকে ভাল রকম উঁচা। লম্বা ধরনের বড় সাইজের ঘর। সামনের দিকটায় দুই থাকের ওটা। তারপর ঘরে ঢোকার দরজা। বর্ষার পানি বারবাড়ির কাছে এসে থেমে আছে। বারবাড়ি থেকে অনেকখানি জায়গা হেঁটে গিয়ে আলী আমজাদের ঘর। সেখানটায় দুইটা আমগাছ, একটা কদম আর একটা বকুল গাছ। ঘরের পশ্চিমদিকে, চালের উপর এসে পড়েছে একটা ঝাঁপড়ানো তেঁতুলগাছ।
বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়াল হাফিজদ্দি। আতাহাররা চারজন নেমে সোজা এসে দাঁড়াল আলী আমজাদের ঘরের সামনে। আতাহার একখান কাশ দিয়া বলল, কনটেকদার সাব বাইত্তে আছেননি? ও কনটেকদার সাব।
ভিতর থেকে লগে লগে সাড়া এল, কেডা?
আতাহার বলল, আমার গলাও আপনে চিনতে পারেন না? ভাইজান, অধমের নাম আতাহার। পিতা আবদুল মান্নান মাওলানা। সাং মেদিনীমণ্ডল।
আতাহারের নাম শুনে যতটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বের হয়ে আসবার কথা আলী আমজাদের ততটা ব্যস্তভঙ্গিতে সে আসলে না। একটু ধীর স্থির ভঙ্গিতেই আসল। পরনে সাদার ওপর হালকা বেগুনি ডোরা দেওয়া পুরানা লুঙ্গি। গায়ে ময়লা একখান স্যান্ডোগেঞ্জি ছিল সেই গেঞ্জির উপর ফুলহাতা নীল রঙের শার্ট পরতে পরতে বের হয়ে এল। মুখে আট-দশদিনের দাড়িমোচ, মাথার চুল এলোমেলো। আগের সেই ভাবটা যেন নাই। ভুড়ি একদমই কমে গেছে। দাড়িমোচের কারণেই কি না, মুখটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।
আলী আমজাদকে দেখে আতাহাররা চারজনই অবাক। আতাহার কথা বলবার আগেই আলমগীর বলল, এমুন বদচেহারা হইছে ক্যা আপনের? শইল খারাপনি?
হ রে ভাই শইলডা ইট্টু খারাপ। আহো ঘরে আহো তোমরা।
ওরা চারজন ঘরে ঢুকল।
ঘরের মাঝ বরাবর ঢেউটিনের বেড়া। বেড়ার পুবপাশে ভিতর দিককার দরজা। ঘরটা উত্তর-দক্ষিণে। উত্তর দিকে বারবাড়ি। হাফিজদ্দি নাও নিয়া সেদিকটায় বসে আছে।
এই ঘরে সস্তা ধরনের কাঠের একসেট সোফা আছে। সোফার গদি কটকটা হলুদ আর খয়েরি রঙের ডোরা দেওয়া। তবে ছিড়াভিড়া। এদিক ওদিক ফেঁসে গেছে গদির গিলাপ। ভিতরকার ফোম দেখা যায়। সেগুলিও ময়লা। কাঠের একটা সেন্টার টেবিল আছে। সেটার দশাও সুবিধার না। পশ্চিম পাশে একটা চকি। চকিতে অতি সাধারণ বিছানা। চকির উত্তর মাথার খালি জায়গায় আলী আমজাদের ফিফটি সিসির হোন্ডাটা দাঁড় করানো। পুরানা একটা চাদর দিয়া ঢাকা হোন্ডা।
আলী আমজাদের ঘরে ঢুকে ওরা চারজন একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সড়কের কাজে এত টাকাপয়সা কামাই করল যে লোক, তার ঘরের এই দশা ক্যান? ঘর আর আলী আমজাদের চেহারা একই রকমের বিষণ্ণ। ঘটনা কী?
শার্টের বুতাম লাগাতে লাগাতে আলী আমজাদ বলল, বহো বহো।
ওরা যে যার মতন বসল।
আলী আমজাদ বসল চৌকিতে। আথকা কী মনে কইরা?
আতাহার বলল, আপনেরে কতদিন দেহি না, আইজ চাইর দোস্তে একলগে অইছি, ভাবলাম আপনের লগে ইট্টু দেহা করি।
নিখিল বলল, তয় আইয়া মনে হয় ভাল করি নাই।
ক্যা?
আপনার শইল খারাপ।
আতাহার বলল, মনে অয় মনও খারাপ।
আলী আমজাদ হাসল। কথা বলল না।
সুরুজ বলল, জ্বর আইছেনি আপনের?
না।
তয়?
আছে ইট্টু সমস্যা আছে।
আলী আমজাদ আতাহারের দিকে তাকাল। চা খাইবা? চা দিতে কমু?
না না দোফরবেলা চা খামু না। এইডা তো ভাত খাওনের টাইম।
ভাত খাইবা? ভাত রানতে কমু?
আতাহার সামান্য সময় কী ভাবল তারপর বলল, না থাউক। বাইত্তে গিয়াঐ খামু নে।
পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেটা বের করে আলী আমজাদের দিকে আগায়া দিল। নেন, সিকরেট খান।
আলী আমজাদ নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে সিগ্রেট নিল। আতাহার ম্যাচ জ্বেলে তার সিগ্রেট ধরায়া দিল। তারপর নিজে ধরাল, দোস্তদের দিল। আলী আমজাদের ঘরের অর্ধেকটা সিগ্রেটের ধুমায় ভরে গেল।
এসময় ভিতর দিককার দরজার মুখে চারটা পোলাপান দেখা গেল। দুইটা মেয়ে, দুইটা ছেলে। বড়টার বয়স এগারো-বারো বছর হবে। মেয়ে। তার পরেরগুলি বড়টার চেয়ে এক-দেড় বছর করে ছোট হবে। বোঝা গেল আলী আমজাদের চার পোলাপান বাড়িতে কারা আসছে দেখার জন্য দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুই মেয়ে দুই ছেলে আলী আমজাদের।
আলী আমজাদ তাদের দিকে তাকাল। বড়মেয়েকে বলল, ফরিদা, তর মারে ক, পাঁচ কাপ চা বানাইতে। আর মুড়ি মিডাই দিতে ক।
আতাহার বলল, না না দরকার নাই।
আলী আমজাদ স্নান গলায় বলল, খাও দাদা, খাও।
পোলাপানের দল তখন দরজা থেকে উধাও। নিখিল শুরু থেকেই তীক্ষ্ণচোখে আলী আমজাদকে খেয়াল করছিল। হঠাৎ বলল, আপনের অন্য কোনও অসুবিদা অয় নাই তো কনটেকদার সাব?
আলী আমজাদ চমকে নিখিলের দিকে তাকাল। কী অসুবিদা?
রাস্তার কামকাইজ লইয়া?
না।
আতাহার বলল, তয় কামের অর্ডার আপনের যা আছিল ওইডা তো আপনে শেষ করেন নাই। আপনের কথা আছিল ফেরিঘাট তরি মাটি হালাইবেন, আপনে কুমারবুগ তরি আইয়া থামাইয়া দিলেন।
কী করুম কও? বাইষ্যাকাল আইয়া পড়ল। ম্যাগ বিষ্টি শুরু অইলো। ম্যাগ বিষ্টিতে তো আর মাডি কাড়নের কাম করন যায় না।
আলমগীর বলল, এইডা ঠিক। তয় আপনের লেইগা রাস্তার কাম অনেক পিছাইয়া গেল।
সুরুজ বলল, এতদিনে রাস্তা চালু অইয়া যাইতো। আপনে মাডির কাম শেষ করলে, ইট বিছাইন্না অইয়া যাইতো, কারপেটিং অইয়া যাইতো। রাস্তা চালু অইয়া যাইতো।
আলী আমজাদ কথা বলল না, খোলা দরজা দিয়া বাইরে তাকিয়ে সিগ্রেট টানতে লাগল।
নিখিল বলল, এই হগল লইয়া আপনে কোনও ঝামেলায় পড়েন নাই তো?
না কীয়ের ঝামেলা?
তবে আলী আমজাদের গলায় তেমন জোর পাওয়া গেল না। তার মেয়ে ফরিদা দুই হাতে দুই প্লেট মুড়ি নিয়া আসল, টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে যেভাবে আসছিল সেভাবেই চলে গেল। আবার দুই প্লেট মুড়ি নিয়া আসল। সেই ফাঁকে কিশোরী মেয়ের স্বভাব অনুযায়ী আড়চোখে নিজের বাপ ছাড়া প্রত্যেকের মুখ একবার দেখল।
ফরিদা দেখতে তেমন ভাল হয় নাই। অতি সাধারণ, আলী আমজাদ টাইপের চেহারা, শরীর। একটু গাবদা গোবদা। তবু কিশোরী বেলার লাবণ্য মুখে একটুখানি আছে। আতাহার একটু তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখল। একমুঠ মুড়ি নিয়া মুখে দিতে গিয়া, সিগ্রেটে শেষটান দিল। পায়ের কাছে ফেলে কেডস দিয়া পিষা দিল।
সিগ্রেট প্রায় সবারই শেষ। দুপুর শেষ হতে চলল। পেটে ক্ষুধা সবারই। সিগ্রেট ফেলে মুড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই।
নিখিল বলল, আতাহার, হাফিজদ্দিও তো না খাওয়া…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আতাহার বলল, চাকর বাকর লইয়া তর এত চিন্তার কাম নাই বেডা। অগো না খাইয়া থাকনের অব্বাস আছে। বাইত্তে গিয়া ভাত খাইবোনে।
নিখিল ভেবেছিল তার কথা শুনে আলী আমজাদ হয়তো তার মেয়েকে ডেকে বলবে, মা ফরিদা, বাইর বাড়ির সামনে তর আতাহার কাকার নৌকা আছে। যেই বেড়া নৌকা বাইয়া আইছে তারেও মুড়ি মিডাই দিয়া আয়।
আলী আমজাদ সেই লাইনে গেলই না। যেন কথাটা সে শোনেই নাই এমন ভঙ্গিতে সিগ্রেট টানতে লাগল। চোখে চিন্তার ছায়া।
আতাহাররা তখন একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। যে চিন্তা নিয়া এই বাড়িতে আসছিল, আচ্ছা চাটামি খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি হবে, হাসি মজা ঠাট্টা হবে তার কিছুই নাই। যার বাড়ি সেই আছে মেন্দা মাইরা।
পরিবেশ হালকা করার জন্য আতাহার বলল, আপনের ঘটনা কী কনটেকদার সাব? আসলে অইছে কী? খোলসা কইরা কইতাছেন না ক্যা?
গলা একটু নিচা করে বলল, ভাবির লগে কাইজ্জা করছেননি?
আলী আমজাদ ম্লান হাসল। না রে ভাই।
তয়?
আলমগীরও আতাহারের মতন গলা নিচা করে বলল, আরেকখান বিয়া করবেন। কইছিলেন, তাও আমগো গেরামের নূরজাহানরে, হেই বিয়ার কী করলেন?
সিগ্রেটে শেষ টান দিল আলী আমজাদ। এক বিয়াতেই আড়াবিচি কারে উইট্টা গেছে (অণ্ডকোষ মাথায় উঠে যাওয়া অর্থে), চাইরহান পোলাপান, তারবাদে আবার বিয়া?
সুরুজ বলল, আপনের লাহান মাইনষের দুইহান ক্যা, চাইরহান বিয়া করলেই বা অসুবিদা কী? এত টেকাপয়সা আপনের। সড়কের কাম কইরা লাল অইয়া গেছেন।
টোকা মেরে দরজা দিয়া সিগ্রেট বাইরে ফেলল আলী আমজাদ। কথা বলল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ফরিদা ট্রে-তে করে পাঁচ কাপ চা নিয়া আসল। চায়ের কাপগুলির দশা ভাল না। ঠেকা কাম চলে, এমন। প্রথম চায়ের কাপটা আলী আমজাদই নিল। আতাহারের দিকে তাকিয়ে বলল, নেও। চা খাও।
যে যার মতো চায়ের কাপ নিল।
এসময় অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল আলী আমজাদ। আলমগীরের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা ঘরে বইয়া চা খাও, আমি আর আতাহার চায়ের কাপ লইয়াঐ বাইর বাড়ির মিহি যাই। অর লগে আমার কথা আছে।
আতাহার বলল, না না তার দরকার নাই। চা শেষ কইরা সবাই বাইরে যাউক। আমার সিগ্রেটের প্যাকেট লইয়া যাইবো। বাইরে খাড়াইয়া সিগ্রেট খাইবো আর আপনে আমি ঘরে বইয়াঐ কথা কমু নে।
তয় ঠিক আছে।
আতাহারের কথা মতোই হল সব। আলমগীররা তিনজন চা শেষ করে, আতাহারের সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ নিয়া বারবাড়ির দিকে চলে গেল। আলী আমজাদ আর আতাহার তখনও তাদের চা শেষ করে নাই।
ওরা বেরিয়ে যেতেই আতাহার বলল, কী অইছে? আলী আমজাদ আবার ফরিদাকে ডাকল। মা ফরিদা, আমার সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ দিয়া যা।
দিতাছি বাবা।
ফরিদা একদৌড়ে এসে সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ দিয়া গেল। সিগ্রেট দেখে অবাক আতাহার আলী আমজাদ খেত ক্যাপস্টান সিগ্রেট, আজ দেখি বগলা সিগ্রেটের প্যাকেট! মনে মনে বলল, শালায় কি পথের ফকির হইয়া গেছেনি? এই দশা ক্যা? মুখে বলল, বগলা ধরছেন ক্যা? আগে না ক্যাপিস্টিন খাইতেন?
আলী আমজাদ সিগ্রেট ধরিয়ে বলল, আগের দিন আমার নাই রে দাদা। আমি ফিনিশ অইয়া গেছি।
আবার আগের সেই কথাটা বলল আতাহার। কী অইছে আপনের?
ধরা খাইয়া গেছি।
কই ধরা খাইছেন? কী ঘটনা?
কনটেকটারি কামে ধরা খাইছি।
কেমনে?
আমি তো কাম করতাম সাব কন্টাক্টে। আসল কনটেকদারের কাজ থিকা মাটির কাম লইয়া করতাম। তুমি তো দেখছো, পয়লা থিকাই ধুমাইয়া কাম করতাম। পোনরো দিন কাম করতাম, পোনরো দিনের বিল লইয়া লইতাম। শেষদিকে কামের চাপ এমুন বাড়ন বাড়ল, যেই মাইট্টাল পাই তারেঐ কামে লই। দিন রাইত চব্বিশঘণ্টা কাম করি। হেজেক বাত্তি জ্বালাইয়া কাম করছি। বিরিফকেস ভইরা টেকা লইয়া গেছি সাইটে। মাইট্টাইলগো টেকা দিছি। ধরা খাইলাম শেষদিকে আইয়া। খাইবানি একখান বগলা?
না।
তয় নিখিলারে ডাক দেও। কেপিস্টিন দিয়া যাউক।
অহন আর সিকরেট খামু না। আপনে কন।
আলী আমজাদ সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, শেষদিকে আইয়া এত মাইট্রাল লইয়া, রাইত দিন কাম কইরাও সারতে পারলাম না। কথা আছিল বৈশাখমাস, বড়জোড় জস্টিমাসের মাঝামাঝি সময়ের মইধ্যে ফেরিঘাট তরি মাটি হালানের কাম শেষ করুম, রাস্তা বাইন্দা। হালামু। পারলাম না। আসল কনটেকদার হইল আসলাম সাহেব। ঢাকায় দৌড়াইয়া গেলাম তার কাছে। কইলাম পুরা ঘটনা। হেয় চেইত্তা গেল। কইলো আমি কিছুই বুজুম না। তোমার লগে কথা আছে ওই কথা মতন কাম করন লাগবো নাইলে বিল পাইবা না। বহুত নিয়ারা করলাম তারে, বহুত চেষ্টা করলাম। হেয় কোনও কথাই হোনলো না। তার ওই এক কথা, যেই টাইমের মইদ্যে যতাহানি কাম করনের কথা অতাহানি কাম। কইরা আমার ইনজিনিয়াগো বুজাইয়া দেও, তারা রাস্তা মাইপা তোমার বিল দিয়া দিবো। হেতোদিনে আমি ফকির অইয়া গেছি। দশটা টেকাও নাই জেবে। ওই যে কুমারবুগ তরি আইয়া, চৌরাস্তা থিকা পশ্চিম মিহি ইট্টু আউগগাইয়া কাম বন্দ কইরা দিলাম। তহন জস্টিমাসের শেষদিক। ম্যাগ বিষ্টি শুরু অইয়া গেছে। তখন থিকাই আমার দশা খারাপ। আমি খালি ঢাকা দৌড় পাড়ি। আসলাম কনটেকদারের অফিসে গিয়া বইয়া থাকি। তারা আমার লাহান মানুষ কোরঐ (কেয়ারই) করে না। এককাপ চাও খাইতে দেয় না। আসলাম সাব তার রোমে আমারে ঢুকতেই দেয় না। ম্যানেজার দিয়া না কইরা দেয়।
আতাহার বলল, এইডা তো মাস দুই আগের কথা। এতদিনে আপনের লগে তো কহেকবার দেহা অইলো আমার। আপনে দিহি কিছু কইলেন না। মুক তো তহন এত ব্যাজারও দেহি নাই।
তহন তরি আশায় আশায় আছি, বেবস্তা অইবো। টেকাপয়সা পাইয়া যামু। তিনদিন আগে বুইজ্জা গেছি আর কোনও উপায় নাই। টেকা তো গেছে, অহন জেলেও যাইতে অইতে পারে।
কন কী?
হ। আসলাম কনটেকদারের কম্পানির নামে কেস অইয়া গেছে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাবে এই রাস্তার ব্যাপারে খুবই কঠিন। টাইম বাইন্দা দিছিল। এমুক টাইমের মইদ্যে অবশ্যই কাম শেষ করন লাগবো। সেই টাইম মতন কাম শেষ অয় নাই। তিনি চাপ দিছেন যোগাযোগ মন্ত্রীরে। যোগাযোগ মন্ত্রী হইলেন বিরাট কঠিন মানুষ। যেই মন্ত্রীর লেইগা বিক্রমপুরের উপরে দিয়া এই সড়ক খুলনা তরি গেল, ইসলাম খান সাব, আমিনুল ইসলাম খান সাব, তার লগে যোগাযোগ মন্ত্রীর খুব ভাল সম্পর্ক। তিনি যোগাযোগ মন্ত্রীরে কইছেন, কী ভাই, কাম শেষ অয় না ক্যা? মাওয়া তরি গাড়ি যাইবো কবে? হুইন্না যোগাযোগ মন্ত্রী গেছেন খেইপ্পা। একদিকে প্রেসিডেন্ট এরশাদের চাপ আরেকদিকে আমিনুল ইসলাম সাবের ওই কথা, আসলাম কনটেকদারের কোম্পানির নামে যোগাযোগ মন্ত্রী শোকজ করছেন। তারবাদে কেস হইয়া গেছে। আমার তো সাতাইশ-আঠাইশ লাখ টেকার বিল, তার তো কুট্টি কুট্টি টেকার বিল। বেবাক আটকাইয়া গেছে। তারপর কেস। করছে তার নামে আর সে কেস করছে আমার নামে। বিল তো আমি জিন্দেগিতেও পামু না। অহন জেলে যাওন লাগবো। আর এইরকম কেসে জেলে গেলে বেইল (বেল, জামিন) অইবো না। বেইল অওনের চেষ্টাই করবো কে? কোর্ট কাঁচারিতে টেকা পয়সা লাগবো না? উকিল মুক্তারকে টেকা দেওন লাগবো না? আমার তো অহন সংসার চলে না। এই হগল চলবো কেমতে!
একটু থামলো আলী আমজাদ। তারপর বলল, ঢাকা থিকা কাইল বাইত্তে আইছি আমি। তোমার ভাবিরে অহনতরি এই হগল কথা কই নাই। হেয় হোনলে তো ডরে মইরা যাইবো। পোলাপানডি ডরে মইরা যাইবো। কী যে করুম আমি অহন কিছুই বুজতাছি না।
আলী আমজাদের ঘটনা শুনে আতাহার স্তব্ধ হয়ে গেছে। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। টেবিলের উপর রাখা আলী আমজাদের বগলা সিগ্রেট একটা নিয়াই ধরাল। এই সিগ্রেটটা খুবই কড়া। বড় করে টান দিয়াও কড়া না ঠান্ডা সিগ্রেট বুঝতে পারল না।
আলী আমজাদ বলল, মাসেকখানি আগে তোমগো বাইত্তে একদিন গেলাম না! হে দিন একখান ভুয়া সংবাদ পাইছিলাম। আসলাম কনটেকদারের অফিসের একজনরে ধরছিলাম, ভাই, আপনেরে কিছু টেকাপয়সা দিমুনে, দেহেন আমার কামডা কইরা দিতে পারেন নি। হেয় আশা দিছিল, পারবো। তয় তারে টেকা দেওন লাগবো ফাইভ পারসেন্ট। অর্থাৎ লাখে পাঁচ হাজার। তাতেই রাজি হইছিলাম। কোনওরকমে দশহাজার জোগাড় কইরা দিছি। ওইদিন হেয় খবর পাডাইছে, বেবস্তা অইয়া গেছে। আপনে ঢাকায় আহেন। শুইনা মনডা এত ভাল লাগলো, গেলাম তোমার লগে দেহা করতে। পরদিন গেলাম ঢাকা। আসলাম সাবের অফিসে গিয়া হুনি ওই হালায় আরও তিনজন সাব কনটেকদারের কাছ থিকা একই কায়দায় টেকাপয়সা খাইয়া পলাইছে। আসলাম কনটেকদারের ম্যানেজারে আমারে কইলো, বিল পাওনের কোনও আশা নাই। অহন জেলে যাওন কেমতে ঠেকাইবেন। হেই চেষ্টা করেন গিয়া। সরকার আমগো সাবরে ধরলে আমগো সাব ধরবো আপনেরে। এইবার ঢাকা গিয়া হোনলাম, কেস অইয়া গেছে। আমি যহন তহন এরেস্ট অমু। আসলাম সাব কুট্টিপতি। তার টেকা আছে। সে টেকা দিয়া বেবাক মিটমাট কইরা হালাইবো। মরুম আমি।
অনেক পর কথা বলল আতাহার। তয় অহন আপনে কী করবেন?
আলী আমজাদ হতাশ গলায় বলল, কিছু জানি না। কেঐরে কিছু না কইয়া, বউ পোলাপান হালাইয়া পলামু।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। নূরজাহান মাইয়াডা আছে না, অরে একদিন আমার এই সোনার দাঁতটা লইয়া কইছিলাম, সোনার দাম বাড়ছে, আমার দাঁতটারও অহন অনেক দাম। এইডা আমার একখান সম্পদ। বেচলে ভাল টেকা পামু। আমার পকেডে চাইর আনা পয়সাও নাই। এই সোনার দাঁতহান লইয়াঐ পলামু। তোমার ভাবিরে একহান চিডি লেইক্কা রাইখা যামু, মটর সাইকেলডা বেইচ্চা যেই কয়দিন চলতে পারে চলবো। তারবাদে বাপের কাইল্লা (কালের) কিছু জাগাজমিন আছে ওইডি বেইচ্চা য্যান খায়। আমার আশা য্যান ছাইড়া দেয়।
এমন দাপটের একজন মানুষের এই অধঃপতন, আতাহারের যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। বগলা সিগ্রেটে টান দিচ্ছে ঠিকই, তাকিয়ে আছে আলী আমজাদের মুখের দিকে।
আলী আমজাদ বলল, আমার মুখে বহুত খারাপ গন্দ। এর লেইগা আমার মুখের সামনে বেশি আইতো না নূরজাহান। আমার মুখের গন্দে বলে অর উকাল আহে। সোনার দাঁত দামি অইয়া গেছে হুইন্না, বিপদে আপদে পড়লে এই দাঁত আমি বেচুম হুইন্না কইছিল, সোনারুগো কাছে যাওনের আগে দাঁতহান ভাল কইরা মাইজ্জা লইয়েন। নাইলে এমুন পচাগন্দের দাঁত সোনারুরা কিনবো না। হাসির কথা। তয় আইজ আর আমার হাস (হাসি) আহে না। সত্যঐ যেদিন দাঁতহান বেচুম, খুইল্লা ভাল কইরা ছাই দিয়া মাইজ্জা লমু।
আলী আমজাদের কথা খুবই এলোমেলো মনে হচ্ছে আতাহারের। কই কনটেকটারি কাজের বিল, আসলাম কনটেকটার আর কই নূরজাহান আর সোনার দাঁত। কনটেকদার শালার পো শালায় কি পাগল অইয়া যাইতাছে নি?
আলী আমজাদ বলল, আমি বুজছি ক্যান আমার কপালে এই শনি লাগছে। রাস্তার কামে তিনডা বহুত খারাপ কাম আমি করছি। বদর নামে আমার একখান মাইট্টাল আছিল। কান্দিপাড়া বাড়ি। বহুত ভাল আছিল পোলাড়া। যেমুন কাজের, তেমুন ফুর্তিবাজ। একদিন কাজির পাগলা বাজার থিকা চা আর রসোগোল্লা আনছিল। হিসাবের পয়সা অরে আমি দিছি। একটা পয়সাও ওহেন থিকা চুরি করন সম্ভব না। তাও ছেমড়ারে আমি চোর কইলাম। মনে বহুত দুঃখ পাইছিল ছেমড়াডা। আমি কি আর ও খালি আমারে কয়, আপনে আমারে চোর কইলেন? আমি চোর না সাব। আমি বহুত ভালবংশের পোলা। আমি অরে চোর কইছি, ওই এক কথায় মাথাডা য্যান খারাপ অইয়া গেল ছেমড়াডার। যারে পায় তারেঐ কয়, কন, আমি বলে চোর। সপ্তার টেকা নেওনের লেইগা লাইনে খাড়ইছে, কাম করছে চাইরদিন, তাও ঠিকঠাক মতন করে নাই, ওই যে মাথাডা ইট্টু ইট্টু খারাপ অইছে। আমি তো তহন ওই হগল বুজি না, হেকমতরে কইলাম, কাম ঠিক মতন করে নাই। সাতদিন তো করেই নাই, করছে চাইরদিন, চাইরদিনের পয়সাও পুরা দেওন উচিত না। ঠিক মতন কাম করে নাই তো, দিমু ক্যা? বদর কইলো, দিয়েন না সাব, টেকা দিয়েন না। এই চাইরদিনের টেকা আমি চাই না। তাও আপনে কন, আমি চোর না। শেষ তরি মাথাডা বিগড়াইয়া গেল ছেমড়ার, আর কামঐ করল না, বহুত দুঃখ লইয়া গেল গা। হেই ছেমড়ার অদিশাপটা (অভিশাপ) আমার লাগছে। আমি একটা নির্দোষ মানুষরে দুষি করছিলাম। বিরাট গুনার কাম করছিলাম। হেই গুনার শাস্তি আল্লায় তো আমারে দিবোই।
আর একটা সিগ্রেট ধরাল আলী আমজাদ। হেকমতরেও সন্দ করতাম আমি। আমার খালি মনে অইতো সাইটে গিয়া দেহুম হেকমত নাই, কাম ফাঁকি দিয়া কোনও বাইত্তে ঘুমাইতাছে। মাইট্টালগো কাছ থিকা একটেকা দুইটেকা কইরা কমিশন খাইতাছে। মাইট্টাল লাগাইছে ষাইটজন, ওহেনে হয়তো একজন দুইজন কম আছে। সপ্তাহ নেওনের দিন লাইনে আইন্না খাড়া করাইয়া দিছে দুইজন বেশি মাইট্টাল। ওই টেকা ভাগ কইরা নেয়। বহুত চেষ্টা কইরা, বহুত রকমভাবে পরীক্ষা কইরা দেখছি, না, হেকমত খুবই খাঁটি একজন মানুষ। একজন খাঁটি মানুষরে আমি চোর মনে করছি, এইটাও বড় একখান গুনা। এই গুনার শাস্তিও আল্লায় আমারে দিবো। আমার সাইটে দিনরাইত চব্বিশ ঘণ্টা কাম করতে করতে জয়েনডিস (জন্ডিস) অইয়া গেল হেকমতের। পেরায় মরণদশা। আমি অর মিহি চাইয়াও দেকলাম না। কাম থিকা ছাড়াইয়া দিলাম। হেকমত বাঁইচ্চা আছে না মইরা গেছে জানিও না। পাপে বাপেরেও ছাড়ে না। এই হগল পাপে আমারে ছাড়বো না। এই হগল পাপেই আমারে ধরছে।
একটু থামল আলী আমজাদ। তারপর আরও কী বলতে গেল, আতাহার বলল, আপনে যে এহেনে বইয়া এই হগল কইতাছেন, ভাবিছাবে আর আপনের পোলাপানরা হোনতাছে না?
না।
তারা কো?
ঘরে কেঐ নাই।
কেমতে বুজলেন।
আমার কাছে কেঐ আইলে পোলাপানরা আগে আইয়া দেইক্কা যায়। গিয়া অর মা’রে কয়। হেয় মনে করে পুরুষপোলারা একলগে বইলে কতপদের কথাবার্তা কয়, হেই হগল না হোননঐ ভাল। এর লেইগা হেয় পোলাপান লইয়া ভিতর বাড়ির উডানে যায়গা। বাড়ির বউঝিগো লগে গল্প গুজব করে। পোলাপানরা তাগো মতন খেলে।
তয় ঠিক আছে।
উদাস চিন্তিত চোখে কিছুক্ষণ সিগ্রেট টানল আলী আমজাদ। তারপর বলল, আর আসল গুনার কামডা তো তুমি জানোঐ। কামারগাঁওয়ের বুড়া একটা মাইট্টাল, নমজ পড়তে বইছিল, অন্য মাইট্টালরা অর উপরেই মাডি হালাইছে। হেই রাইত্রে আমি আছিলাম তোমগো বাইত্তে। বিয়ানে হেকমত আইয়া খবর দিল মাডির তল থিকা মাইনষের একহান হাত বাইর অইয়া রইছে। হায় হায় রে, এতবড় গুনাহ আল্লায় সইবো না। এর লেইগাঐ আল্লায় আমারে বেবাক দিয়া বেবাকঐ আবার ফিরত নিতাছে। আর গুনার শাস্তি হিসাবে জিন্দেগিড়া আমার ছারখার কইরা দিতাছে। কাইল বিয়ানেই আমি পলামু। সংসার বউ পোলাপানের কপালে যা আছে তাই অইবো। আমি চইলা যামু সিলেট। সিলেটে গিয়া। হযরত শাহজালাল সাবের দরগায় পইড়া থাকুম। দরগার ফকির মিসকিনরা যেমতে খাইয়া। পইরা বাঁচে, অমতেই বাঁচুম। যহন মরণ আইবো মইরা যামু। ওহেন থিকা দারোগা পুলিশে আমারে ধরবো না। তয় সড়কের কামে তিনহান যেই বিরাট গুনার কাম আমি করছি, ওই গুনার শাস্তি হিসাবে আল্লায় আমার মনের মইদ্যে যেই জেলখানা বানাইয়া দিছে, ওই জেলখানা থিকা মরণ ছাড়া বাইর অইতে পারুম না আমি। মনের জেলখানায় আমার যাবজ্জীবন অইয়া গেছে।
বিকালবেলা যখন চার দোস্ত চকের মাঝখান দিয়া বাড়ি ফিরছে, দুপুরে ভাত না খাওয়া হাফিজদ্দি যখন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বইঠা বাইছে, আকাশে এখন মেঘ নাই, বিকালবেলার রোদ বর্ষার পানির মতন নরম কোমল, পদ্মা থেকে হাওয়া আসছে, মাথার উপর দিয়া উড়ে যাচ্ছে পাখি, তখন আলমগীর একবার জিজ্ঞাসা করল, কনটেকদার সাবে এতক্ষণ ধইরা কী কইলো তরে?
আতাহার উদাস গলায় বলল, পরাইভেট (প্রাইভেট) কথা। কেঐরে কওন যাইবো না। তোমার ভাস্তি হাসু গেল কই? আর দিহি এই বাইত্তে আহে না?
বিকালবেলা বড়ঘরের ওটায় বসে পারুর মাথায় তেল দিয়া দিচ্ছে রহিমা। হাতের কাছে ছোট্ট একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে অনেকখানি নারকেল তেল আর রহিমার কোলে লম্বা কালো রঙের একটা কাঁকুই। চুলের গোড়ায় গোড়ায় তেল দিয়া মাথা আঁচড়ে দিবে রহিমা। তেলটা চুলার আগুনে একটুখানি গরম করে আনছে রহিমা। চুলের গোড়ায় গোড়ায় তেল দিয়া, খানিকক্ষণ ঘষে তারপর আবার তেল নিচ্ছে আঙুলের ডগায়, আবার ঘষছে চুলের গোড়ায়। এই কাজ শেষ করে তারপর মাথা আঁচড়ে দিবে।
পারুর কথা শুনে একটু চমকাল রহিমা। হাসুর কথা মনে পড়ল। অনেকদিন পর এই বাড়ির কেউ হাসুর নামটা নিল। যদিও তার কথা রহিমার মনে পড়ে রোজই। সেই যে মউছামান্দ্রার বাড়ি থেকে, পুরুষমানুষের কারণে রাতে ঘুমাতে না পেরে এই বাড়িতে ফুফুর কাছে চলে আসত, দিনভর ফুফুর লগে কামকাইজ করত, রাতেরবেলা ফুফুর পাশে শুয়ে আরামছে ঘুমাত। এই বাড়ি থেকে যেতেই চাইত না। শেষ তরি মান্নান মাওলানারে বইলা হাসুরে এই বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করছিল রহিমা। আর তখনই জ্বরে পড়ল মাইয়াটা। সতেরো দিনের জ্বরে মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে গেল।
এই কথা দুনিয়ার আর কেউ জানে না। জানে শুধু হাসু নিজে আর রহিমা। হাসু যে মউছামান্দ্রার ওই বাড়িতে আর ফিরত যায় নাই, এই কথাও তারা দুইজন ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে হাসু রহিমাকে বলে গিয়েছিল ঢাকায় গিয়া কাজ কাম জোগাড় কইরা একটু খাড়ইতে পারলে কোনও না কোনও ভাবে রহিমারে এই বাড়ি থেকে নিয়া যাবে। ঢাকায় ফুফু-ভাস্তি, না না ফুফু-ভাতিজা জীবন কাটাবে। আহা রে, কবে যে আসবো সেই দিন। কবে যে হাসুর লগে আবার দেখা হইবো।
দিনভর কাজে ব্যস্ত থাকে বলে হাসুর কথা সেভাবে ভাবতে পারে না রহিমা। ভাবে রাতেরবেলা, হাসুর কথা মনে হয় রাতেরবেলা। মনে হয় আর বুকটা পোড়ে। রোজ রাতেই মনে মনে হাসুর লগে সে কথা বলে। হাসু, হাসু রে, তর লেইগা যে আমার কইলজাড়া পোড়ে তুই হেইডা উদিস পাছ না?
আহা কই আছে হাসু, কী করতাছে, কী খাইতাছে আল্লাই জানে! যেহেনেঐ থাকে আল্লায় য্যান অরে ভাল রাখে। পুরুষপোলাগো হাত থিকা নিজেরে বাঁচানের লেইগা মনে মনে ও যা চাইছিল আল্লায় তো আর হেইকথা হুনছে। অরে তো মাইয়া থিকা পোলা বানাইয়া দিছে। বাকি জীবনডাও ও যা চায় আল্লায় য্যান অর হেই আশাও পূরণ করে।
পারু বলল, কী অইলো, কথার জব দেও না ক্যা?
রহিমা যেন ভুলেই গিয়েছিল পারুর কথার জবাব দেওয়া হয় নাই। একটু হাসল সে। হাসু তো দ্যাশে নাই।
দেশে নাই?
হ।
তয় কই গেছে?
ঢাকা গেছে গা।
ক্যা?
ডাহা মিছাকথা বলতে শুরু করল রহিমা। কোন এক বড়লোকের বাইত্তে কাম লইছে। খাওনদাওন, কাপড়চোপড় বাদে ছয়শো টেকা বেতন। এর লেইগা মউছামান্দ্রার ওই বাড়ির কাম ছাইড়া ঢাকা গেছে গা।
ভালই করছে। ঢাকায় কামের মাইনষের অনেক দাম। ভাল বাইত্তে যুদি কাম পায় তয় বহুত আরামে থাকবো। ভাল খাইবো ফিনবো, টেলিভিশন দেখবো। রিকশায় গাড়িতে কইরা এই মিহি ওই মিহি যাইবো। চেহারা সুরত বদলাইয়া যাইবো। একদিন না একদিন বিয়াশাদিও অইয়া যাইবো। হাসু তো আছিল একটু বেডা বেডা পদের, টাউনে থাকলে হেই ভাবটা থাকবো না। বদলাইয়া যাইবো। এমতে চেহারা সুরত খারাপ আছিল না ছেমড়ির। দেশগেরামের এত কষ্টের কামে চেহারা খারাপ অইয়া গেছিল।
রহিমা মনে মনে বলল, মাইয়ার চেহারা তার আর কোনওদিনও অইবো না। দিনে দিনে অর চেহারা অইবো জুয়ান মরদো পুরুষপোলার লাহান। বিয়া করলে অর গরভে না অর ঔরসে অইবো পোলাপান।
কথা তারপর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল রহিমা। আতাহার বাজানে আইজ কই গেল? বিয়ানে বাইর অইলো, বিয়াল অইয়া গেল অহনও বাইত্তে আইলো না? কই খাইলো না খাইলো…
পারু বলল, তার খাওনের আকাল আছেনি? কোন দোস্তের বাইত্তে গিয়া খাইছে কে জানে? আর নাইলে মাওয়ার বাজারের হইটালে খাইয়া লইছে।
হেয় নাইলে খাইলো, হাফিজদ্দি খাইবোনে কই?
হ এইডা আমিও চিন্তা করছি। হেয় তো আর হাফিজদ্দির কথা চিন্তা করবো না। বেডারে। মনে অয় হারাদিন না খাওয়াইয়া রাখছে।
মাথায় তেল ডলা শেষ করে লম্বা কাকুই দিয়া পারুর চুল আঁচড়ে দিচ্ছে রহিমা। মাথায় এত ঘনচুল পারুর, বাড়ির বড়পোলার বউ, তিনটা পোলাপান, এগারো-বারো বছর হল। বিয়া হইছে, সেটা পারুকে দেখে মনেই হয় না। এখনও আবিয়াত মেয়েদের মতন অবস্থা। এই জন্যই তো হুজুরের মাজারো পোলায় এমুন পাগল তার লেইগা হইছে। এতদিনকার সম্পর্ক। তিনটা পোলাপানের বাপ হইয়াও নতুন কইরা পারুরেই বিয়া করতাছে।
শিরি আর নসু সাচ্চারা খেলছে উঠানে। নূরি গেছে গনি মিয়ার সীমানায়। হিরা মানিকের লগে খেলা করছে হয়তো। আর নয়তো ছেলেমেয়ে দুইটার মতন অবোধ্য ভাষায় তাদের লগে কথা বলছে, হাসছে।
বিকালবেলা সাজগোজের অভ্যাসটা পারুর আছেই। আজ সে কচুরিফুল রঙের শাড়ি পরেছে। তেল দিয়া সুন্দর একখান খোঁপা করছে, চোখে একটুখানি কাজল, কপালে ছোট্ট কালো টিপ, হাসি আনন্দে ঝলমল করা মেয়ে। আতাহারের লগে বিয়ার কথা ঠিকঠাক হওয়ার পর থেকে সে আর হাঁটে না, প্রজাপতির মতন উড়ে উড়ে বেড়ায়। মান্নান মাওলানা বাড়িতে না থাকলে খিলখিল করে হাসে। হাসি আনন্দে ফেটে পড়ে।
আজ মান্নান মাওলানা বাড়িতে। আতাহার নাও নিয়া গেছে, হাফিজদ্দিরে নিয়া গেছে। যদিও ছোট্ট আরেকটা কোষানাও আছে। ইচ্ছা করলে ওই নাও নিয়া বাইর হইতে পারেন হুজুরে। তবে বাইর হন নাই। এই তো কিছুক্ষণ আগে আছর নামাজের আজান দিলেন। নিজের ঘরে বসে নামাজ পড়লেন। এখনই রহিমাকে ডাকবেন চা নাস্তার জন্য।
শ্বশুরের বিকালের চা-নাস্তাও পারুই দেয় আজকাল। তবে পারুকে ডাকেন না মান্নান। মাওলানা। ডাকেন রহিমাকে।
এখনও ডাকলেন। রহি, চা-নাস্তা দে।
দিতাছি।
বলেই দৌড়ে রান্নঘরের দিকে গেল রহিমা। পারুর মাথার কাজ তখন একদমই শেষ। রহিমাকে বলল, পটে টোস বিসকুট আছে। চা আর তিন-চাইরখান টোস বিসকুট দেও। আমি ইট্ট গনি কাকাগো ওই মিহি যাই।
আইচ্ছা যান।
পারু তারপর যেন একটা উড়াল দিল। পুব-উত্তরের ঘরের মাঝখানকার চিপা দিয়া। মন্তাজদের সীমানার ওদিকটায় চলে এল।
এই দিকটা সব সময়ই নির্জন। মাত্র দুইজন মানুষের বাস। মন্তাজের বুড়া মা আর তার দেখভাল করবার জন্য যুবতী আত্মীয় মেয়ে ফিরোজা। খুবই নিরীহ চুপচাপ ধরনের। মেয়ে। গলার আওয়াজ তার শোনাই যায় না। নিঃশব্দে রান্নাবান্না করে, সংসারের কাজ। করে, বুড়ির নাওয়াধোওয়া খাওয়াদাওয়া সবই করায় এত সুন্দর করে, কোনও অভিযোগ নাই, ঝগড়াঝাটি মনোমালিন্য নাই বুড়ির লগে। অদ্ভুত একটা জীবন। সপ্তাহে সপ্তাহে ঢাকা। থেকে মন্তাজের লোক আসে মোবারক। সে আইসা হাটবাজার কইরা দিয়া যায়। সবই। জিয়ল মাছ দিয়া যায়। ঘোপা ভরা সেইসব মাছ একেকদিন একেক পদেরটা বের করে। ফিরোজা। কুটেকেটে রান্নাবান্না করে। তরিতরকারি, চিনি মিঠাই অন্যান্য খাবারদাবার ঢাকা
থেকে নিয়া আসে মোবারক। সাগরকলা, পাউরুটি, বিসকুট। বেপারি বাড়ির ইদরিস দুধ। দিয়া যায় সকালবেলা। মাসকাবারি পয়সা। সব ব্যবস্থা এত সুন্দর, মন্তাজের বুড়িমা যেমন আরামে আছে, ফিরোজাও আছে মন্দ না।
আজ বিকালবেলা গনি মিয়ার সীমানার দিকে যাওয়ার সময় পারু দেখে ফিরোজা দাঁড়িয়ে আছে উত্তর দিককার আমগাছটার তলায়। পরনে দুর্বাঘাসের মতন রঙের শাড়ি। আমগাছটার অদূরে, বাড়ির ঘাটে বর্ষার পানি। এদিকটায় দাঁড়ালে বিশাল চকমাঠের উত্তরে দোগাছি গ্রাম, উত্তর-পুবে সীতারামপুর, উত্তর-পশ্চিমে মেদিনীমণ্ডলের শেষ সীমানা দেখা যায়। বিকালবেলার রোদে মায়াবী হয়ে আছে চারদিক। চকেমাঠে গিরস্তের দুই-একখান নৌকা এদিক ওদিক যায়, বর্ষার পানিতে মাথা তুলে থাকা ঘাস বিচালি, ধইনচা হাওয়ায় হাওয়ায় দোল খায়। কুব কুব করে ডাকে ডাহুকপাখি। এই বর্ষাভাসা খোলা চকমাঠের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফিরোজা। কী দেখে কে জানে! কী ভাবে কে জানে।
পারু এসে তার পিছনে দাঁড়াল।
ফিরোজা এতটাই মগ্ন হয়ে আছে চকমাঠের দিকে তাকিয়ে, একজন মানুষ যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে উদিসই পেল না। পারু একেবারে পোলাপানের ভঙ্গিতে পিছন থেকে ফিরোজার চুল ধরে টান দিল। চমকে পিছন ফিরে তাকাল ফিরোজা। হাসল। ও ভাবিছাব! আপনে আইলেন কুনসুম?
আইছি বেশিক্ষুন হয় নাই। পিছন থিকা তরে দেখতাছিলাম। তুই এমুন কইরা কী দেহছ রে? পেরায় পেরায়ই তরে দেহি এহেনে খাড়াইয়া চকের মিহি চাইয়া থাকচ।
দেখি না কিছুই, আবার বেবাকঐ দেহি। অহন দেহি বাইষ্যাকালের পানি, চক দিয়া দুই-একখান নৌকা যায়, হেই নৌকা দেহি। চকের কচুরিপেনা দেহি, ধইনচাখেত দেহি। আকাশ দিয়া পাখি উইড়া যায়, হেই পাখি দেহি। বাইষ্যাকালের পানিতে দুই একখান মাছে ডাব (ঘাই) দেয়, মাছের ডাব দেহি। আর দেহি ওই যে তিনমিহি তিনখান গেরাম, গেরামের বাড়িঘর, গাছগাছালি এই হগল।
এই হগল দেহনের কী আছে?
কী যে দেহনের আছে কইতে পারি না। তয় দেহি। চাইয়া চাইয়া দেহি। দেখতে ক্যান জানি ভাল্লাগে। যহন কোনও কামকাইজ থাকে না, একদোম আজাইর থাকি তহন এহেনে খাড়ইয়া চকের মিহি চাইয়া থাকি। এই চাইয়া থাকনটাই আমার আনন্দ।
একলা একলা চকের মিহি চাইয়া কী চিন্তা করচ?
তেমুন কিছু চিন্তা করি না ভাবিছাব।
নিজেগো বাড়িঘরের কথা চিন্তা করচ না, মা-বাপ ভাইবইনের কথা চিন্তা করচ না?
মাঝে মাঝে করি। সব সময় করি না।
ক্যা?
তাগো কথা আমার বেশি মনে পড়ে না।
তয় কী মনে পড়ে তর?
পারুর ঠোঁটে রহস্যময় একটু হাসি ফুটল। অন্য কেঐর কথা মনে পড়ে? তার কথা ভাবছ?
ফিরোজা অবাক হল। অন্য কার কথা মনে পড়বো? কার কথা ভাবুম?
বোজচ নাই?
না।
আরে ছেমড়ি আমি কইছি তর মনের মানুষের কথা। যারে তুই মন দিছস। যার লগে তর বিয়া হইবো।
এবার মিষ্টি করে হাসল ফিরোজা। আমার তো তেমুন কেউ নাই ভাবিছাব। মন দেওনের মতন মানুষ তো আমি অহনতরি পাই নাই। বিয়াশাদির কথাও চিন্তা করি না। আমগো মতন গরিব ঘরের মাইয়াগো বিয়াশাদির ঠিক আছেনি! দেহা গেল এই বাইত্তে কাম করতে করতে বুড়া অইয়া গেলাম তাও বিয়া অইলো না। বিয়ার বস গেল গা, এমনেই চেহারা সুরত সুবিধার না, বস অইলে চেহারা সুরত আরও বিগড়াইবো, তহন আর বিয়া করবো কে?
তর বিয়ার দায়িত্ব বলে মন্তাজ কাকার? অর মারে তুই দেহচ, সে তোর বিয়া দিয়া দিবো।
হেইডারও ঠিক নাই।
ক্যা, ঠিক নাই ক্যা?
দাদি মরলে তারবাদে সেন আমারে লইয়া কাকায় চিন্তা করবো। হের মরণের কি ঠিক আছে? কাইলও মরতে পারে, আবার এই অবস্থায় পাঁচ-দশ বচ্ছর বাঁইচাও থাকতে পারে।
হ এইডা ঠিক। মাইনষের বাঁচন মরণের কথা আল্লাহ মাবুদ ছাড়া কেঐ জানে না।
তয় ভাবিছাব আপনেরে আমি একখান কথা কই। এই যে খরালিকালে আমি চকের মিহি চাইয়া থাকি, বাইষ্যাকালে চাইয়া থাকি, এই চাইয়া থাকতে থাকতে আমার খালি মনে অয়, আমি একদিন কেরে কিছু না কইয়া এই চক দিয়া হাইট্টা যামু গা।
পারু চমকাল। কই যাবি গা?
হেইডা আমি জানি না।
কী?
হ। আমি জানি না আমি কই যাইতে চাই। তয় যাইতে চাই।
তগো বাইত্তে যাইতে চাছ?
না।
অন্য কোনও আততিয় বাইত্তে?
না তাও না।
তয় কই যাইতে চাছ?
কইলাম না, হেইডা আমি জানি না। তয় যাইতে চাই। কই যে যাইতে চাই জানি না।
পারু হাসল। ধুরো ছেমড়ি। তুই একটা পাগল।
ফিরোজা কথা বলল না, হাসল। এই কথাডা আমি একদিন নিখিল দাদারে কইছিলাম আর আইজ কইলাম আপনেরে। আর কেঐরে কোনওদিন কই নাই।
চোখ মুখের সুন্দর ভঙ্গি করল পারু। কী লো ছেমড়ি, নিখিলের লগে ভাব চক্কর করছস নি? আ? মোসলমান মাইয়া অইয়া হিন্দু পোলার লগে পেরেম?
আরে না।
তয়?
তয় কী?
তার লগে কীয়ের এত কথা?
সে মানুষটা বড় ভাল ভাবিছাব। শয়তান বদমাইশ না। বদচোখে আমার মিহি কোনওদিন চায় নাই। খরালিকালে একবিকালে এহেনে এমতে খাড়ইয়া রইছি আমি, হেয় আইসা আমার সামনে খাড়ইলো। কথায় কথায় তারে আমি এই কথাডি কইছিলাম। হুইন্না হেয়ও আপনের লাহান অবাক অইছে।
তারপরই যেন পারুকে খেয়াল করে দেখল ফিরোজা। দেখে মুগ্ধ হল। ইস আপনেরে যা সোন্দর লাগতাছে না ভাবিছাব।
পারু লগে লগে বলল, সোন্দর তো লাগনের কথাঐ।
ক্যা, আথকা আইজ বেশি সোন্দর লাগবো ক্যা?
আথকা না, আমার হরি মইরা যাওনের কয়দিন আগে থিকাঐ আমারে সোন্দর লাগে। তুই খ্যাল কইরা দেহ নাই।
এইবার বুজছি। আতাহার দাদার লগে বিয়া অইবো এর লেইগা আপনে সোন্দর অইয়া গেছেন। বিয়ার আগে কোনও কোনও মাইয়া খুব সোন্দর হয়।
বিয়ার পরেও হয়।
সেইটা আপনেও অইবেন। আরও সোন্দর অইবেন। অবশ্য আপনে এমতেই সোন্দর। বিরাট সোন্দর। আতাহার দাদার ভাগ্যি ভাল আপনের লাহান বউ পাইতাছে।
খালি বউ না, মনের মানুষও।
হ, হেইডা তো জানিঐ। তয় আল্লার কাছে হাজার শুকুর, যারে আপনে মন দিছেন, যার লেইগা এতকিছু করছেন তার লগেঐ আপনের বিয়া হইতাছে। আপনের হরি একখান কামের কাম কইরা গেছে। হুজুরেও যে আপনের আর আতাহার দাদার মন বুইজ্জা বেবাক কিছু মাইন্না নিছে এইডাও আল্লার কুদরত। আল্লার ইশারা ছাড়া গাছের পাতা লড়ে না। আপনে ভাল মানুষ দেইখা আল্লায় আপনের মনের আশা পূরণ করছে। আপনেরে লজ্জা শরমের হাত থিকা বাঁচাইছে। দেশগেরামের বেবাকতেই কমবেশি আপনের আর আতাহার দাদার ঘটনা জানে। অহন বিয়াশাদি হইয়া গেলে এই হগল কথা আর কেঐ কইবোও না, মনেও রাখবো না। এইরকম ঘটনা দুনিয়াতে অনেক হয়। আপনের পোলাপান তিনডাও বড় অইয়া মনে কোনও দুঃখ পাইবো না। আপনেরে কোনও দোষ দিতে পারবো না। নাইলে বড় অইয়া অরা মনে করতো আমার মা’য় ভাল আছিল না, বাপরে ছাইড়া চাচার লগে সম্পর্ক করছে। অহন আপনের সবদিক ঠিক থাকবো। পোলাপানের কাছে কোনওদিনও ছোড অইতে অইবো না আপনের।
ফিরোজার কথা শুনে খুবই অবাক পারু। আরে এই মাইয়া তো দেকতে যত সাদাসিধা, বলদা পদের মনে অয়, আসলে তো তা না। মাইয়ার তো বুদ্দিসুদ্দি ভাল। বহুত কিছু চিন্তা করা মাইয়া। অর বাইরে এক রকম মনের মইদ্যে আরেক রকম! আল্লায় যে কার ভিতরে কী দিয়া রাখছে বাইরে থিকা দেইখা বোঝনের কোনও উপায় নাই। আইজ এই বিয়ালে ফিরোজার লগে কথা না কইলে তো অর ভিতরের এই চিন্তা ভাবনাগুলি জানা হইতো না।
পারুকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিরোজা হাসল। কী দেকতাছেন ভাবিছাব?
তরে।
আমারে নতুন কইরা দেহনের কী অইলো?
তরে এতদিন আমি যা ভাবছি তুই তা না।
কী ভাবছেন আমারে?
সোজাপদের মাইয়া।
আমি সোজাপদের মাইয়াঐ। বলদা।
আরে না। তুই খুবই চালাক মাইয়া। তর বুদ্দিসুদ্দি ভাল।
কেমতে বুজলেন?
তর কথা হুইন্না। যেই হগল কথা আমারে কইলি, কেঐরে লইয়া কেঐ চিন্তা না করলে এই হগল কথা কইতে পারে না। আমি বহুত খুশি অইলাম তর কথা হুইন্না।
আর আমি খুশি আপনের কথা চিন্তা কইরা। আল্লায় আপনের মনের আশা পূরণ করতাছে। আপনের মান সনমান বাঁচাইতাছে, পোলাপানের কাছে কোনওদিন আপনেরে ছোড করবো না, এইডা চিন্তা কইরা আমি বহুত খুশি।
মন্তাজদের বড়ঘর থেকে মন্তাজের বুড়ি মা অবোধ্য ভাষায় শব্দ করতে লাগলেন এসময়। সেই শব্দে চঞ্চল হল ফিরোজা। ওই যে দাদি উটছে। ডাক পাড়তাছে আমারে। ভাবিছাব, আমি গেলাম।
হ যা।
ফিরোজা দৌড়ে চলে গেল।
ফিরোজা চলে যাওয়ার পরও আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে রইল পারু।