অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। অবশ্য খাতায়-কলমে ওদের অফিস সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে পাঁচটা অবধি রোজ-ই-সপ্তাহে ছ-দিন। কিন্তু এগারোটার আগে কেউই বড়ো একটা আসে না। কেউ কেউ তো সাড়ে এগারোটায় আসে–আর বিকেলে সাড়ে চারটের পর-ই অফিস ফাঁকা হয়ে যায়।
আজ দেরি হয়ে গেল, কারণ সাহেব দেরি করে উঠলেন। সবুজ ওঁকে বলে একটু তাড়াতাড়ি যে, চলে যেতে পারত না, তা নয়। কিন্তু চক্ষুলজ্জাতে বাধল। এখনও অন্য অনেকের মতো ও চোখের চামড়া পুরোপুরি পোড়াতে পারেনি।
কমলাদের বাড়ির কাছাকছি ও যখন বাস থেকে নামল, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে প্রায়। পথের বাতি জ্বলে উঠেছে। বাস-স্টপ থেকে, দু-ফার্লং মতো হেঁটে গিয়ে কমলাদের একতলা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ও কলিং-বেল টিপল।
কমলা নিজেই এসে দরজা খুলল। দরজা খোলার আগে ভেতর থেকে বলল, কে?
সবুজ বলল, আমি।
কমলার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘আমি’ বলে উত্তর দিতে ভারি ভালো লাগে সবুজের। সে যে, আর কেউ নয়, সে যে, সবুজ, এই দরজায় তার যে, বিশেষ আমন্ত্রণ, তার বিশেষ সম্মান, এ-কথা তার নতুন করে মনে পড়ে যায়। এই জীবনে, এই জগতে প্রতিদিন, প্রতিরাত নিজের কাছে, নিজের ঘরে, ঘরের বাইরে সম্মান খোয়াতে খোয়াতে এসে, এই একটি জায়গায় সে নিজের সম্মানকে ফিরে পায় নতুন করে এক অদ্ভুত ভালোলাগার আশ্লেষে আবিষ্কার করে সবুজ ওর হারিয়ে-যাওয়া, নুয়ে-পড়া আমিকে।
কমলা দরজা খুলেই অনুযযাগের সুরে বলল, এত দেরি করলে কেন? তুমি খুব খারাপ।
কমলা দরজাটা বন্ধ করে দিল।
সবুজ বলল, তোমার বাহন কোথায়?
কমলা হাসল। বলল, ওকে দোকানে পাঠিয়েছি।
সবুজ বাচ্চাছেলের মতো আবদার করল তাহলে একবার এসো। এই! কাছে এসো।
কমলা বলল, কী-যে করো না? ঘরের মধ্যে আলো জ্বালানো, পরদা উড়ছে হাওয়ায়–তুমি কি আমার ক্ষতি করতে চাও?
সবুজ বলল, তুমি নিজের বিন্দুমাত্র ক্ষতিস্বীকার না করেই লাভবান হতে চাও, এই-ই তো তোমার দোষ।
কমলা হাসল। বলল, আহা রে! কী আমার লাভ? আর লাভ যেন আমার একার-ই! অসভ্য।
অসভ্যই তো! বলল সবুজ।
ওরা দু-জনে বসবার ঘর পেরিয়ে শোয়ার ঘরে গেল। শোয়ার ঘরে খাটের সামনে একটা সোফা পাতা। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবেরা ওখানেই বসে গল্প-টল্প করে।
কমলা শোয়ার ঘরে ঢুকতেই, সবুজ ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে আদর করল। কমলার ঠোঁট দুটো শুষে নিল নিজের ঠোঁটে–গাল ঘষতে লাগল ওর গালে–।
কমলা মেঘলা-দুপুরের, কবুতরের মতো অস্ফুটস্বরে কীসব বলতে লাগল বিড়বিড় করে –যেসব শব্দের অর্থ হয় না কোনো–যেসব শব্দ, শুধু উষ্ণ নিশ্বাস, কোমল সি-গালের মসৃণ শরীরের মতো পেলব কমলার বুকের দ্রুত-ওঠানামার পরিপূরক মাত্র। এইসব সুদুর্লভ ক্ষণে কথা বলে না সবুজ-শুধু অনুভব করে, অনুরণিত হয়, সমস্ত অন্তরের সমস্ত তীব্রতার
সবুজ মনোহারী দোকানের শোকেসের সামনে দাঁড়ানো অবুঝ বালকের মতো, একইসঙ্গে একই নিশ্বাসে সবকিছু পেতে চায়। ব্লাউজের মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ও কমলার সুগন্ধি পেলব স্তনে হাত ছোঁওয়াল, গাল ঘষতে লাগল।
কমলা শিউরে শিউরে উঠছিল। বলছিল, আর না। লক্ষ্মীটি, এখন আর না সবুজ।
সবুজ আলিঙ্গনাবদ্ধ কমলার শরীরের মধ্যে একটা কাঁপুনি অনুভব করল–বুঝতে পারল, সেই কাঁপুনি ওর শরীরেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।
কমলা আবার বলে উঠল, আর না গো, আর না।
সবুজ কমলার দুই বাহুতে ওর দু-হাত রেখে, ওর সামনে স্থির হয়ে দাঁড়াল, দাঁড়িয়েই, ওর দু-চোখে বার বার চুমু খেতে থাকল।
কমলা গাঢ়স্বরে বলল, আমার চোখে যে, কী দেখেছ তুমি?
সবুজ বিড় বিড় করে বলল, বুঝবে না।
তারপর আবারও বলল, তুমি বুঝবে না!
এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল।
কমলা শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, ইস, জংলি, তুমি একটা জংলি। আমার বুক জ্বালা করছে–কী শক্ত খোঁচা খোঁচা দাড়ি তোমার।
সবুজ একটু হাসল। অপরাধীর মতো বলল, সেই সকালে কামিয়েছি তো! তারপর-ই বলল, তোমার লেগেছে সোনা?
কমলা ওর বলার ধরনে ও স্বরের আন্তরিকতায় হেসে ফেলল।
বলল, হু। লেগেছেই তো! ভীষণ লেগেছে। তারপর বাইরের ঘরের দিকে যেতে যেতে, একবার তাকাল সবুজের দিকে।
সবুজ বুঝতে পারল, লাগাটাই ভালো-লাগা।
কী-এক দারুণ প্রসন্নতায় সবুজের মন ভরে গেল! সবুজ ভদ্রসভ্য হয়ে, সোফাটায় বসে। পড়ে খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিল। যে কাগজ সকালে আদ্যোপান্ত পড়েছে ও।
কমলার ঝি পারুল থলি নিয়ে ঘরে ঢুকল কমলার পেছনে পেছনে।
কমলা বলল, পারুল, শিঙাড়াগুলো এবার ভেজে তোল। চায়ের জল চাপিয়ে দে।
পারুল শুধোল, দাদাবাবুও কি এখুনি আসবে?
কমলা অন্যমনস্কর মতো বলল, আসবার তো কথা এখুনি। তবে সব ভাজিস না, দাদাবাবু এলে তখন-ই বরং গরম গরম ভেজে দিস দাদাবাবুর জন্যে।
সবুজ সপ্রশ্ন দৃষ্টি তুলে কমলার মুখের দিকে তাকাল।
পারুল চলে যেতে, কমলা চোখ দিয়ে এক অদ্ভুত ইশারায় সবুজকে বুঝিয়ে দিল যে, পারুলকে ও মিথ্যে কথা বলেছে। কুমুদ এখন আসবে না।
তারপর কমলা হঠাৎ-ই বলল, আমি এক্ষুনি আসছি, অ্যাঁ! তুমি বোসো। পারুল কি ঠিক করে ভাজতে পারবে, জানি না! একটু বোসো, কেমন?
সবুজ একা ঘরে বসে ছিল। ঘরের চারিদিকে চেনা আসবাব–টুকিটাকি। বড়ো ডাবল বেড খাটটা-পাট-পাট করে বিছানার ওপর ফিকে হলুদ বেড-কভার পাতা। আজ অবধি সবুজ কখনো এই খাটকে বেডকভার তোলা অবস্থায় দেখেনি। ওর ভাবতেও কেমন গা শিউরে ওঠে। এই খাটে শুয়ে, বেডকভারের নীচের দুগ্ধফেননিভ বেডশিটে, তার বিছানা আলো-করা, নরম নগ্নতায় কমলা শুয়ে থাকে–রোজ। হ্যাঁ! রোজ রোজ আদর খায় কুমুদের।
আজ অবধি কখনো চরম আদর করেনি সবুজ কমলাকে। কখনো সুযোগ হয়নি। ও এখনও জানে না, কমলা তা সত্যি-সত্যিই চায় কি না। মেয়েরা বড়ো অদ্ভুত। ওরা এই একটা ব্যাপারে অনেক বিবেচনা করে। অন্য ব্যাপারগুলো ব্যাপার-ই নয় বুঝি। কিন্তু সবুজের মাঝে মাঝে বড়ো ইচ্ছে করে, একদিন কমলার, কমলারঙা সম্পূর্ণতায় তাকে সম্পূর্ণভাবে পায়।
এর আগে, অনেকদিন আগে, একদিন এ-প্রসঙ্গ তুলেও ছিল সবুজ, কিন্তু কমলা পিছিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, কুমুদ যে, আমাকে বিশ্বাস করে সবুজ, ও যে আমার ওপর বড়ো নির্ভর করে। আমাদের তো ছেলেপেলে নেই; হবেও না–যদিও দোষটা আমার নয়–তা-ই, ও যেন আমার ওপর অন্য যেকোনো স্বামীর চেয়েও বেশি নির্ভরশীল। এটা থাক। বাকি থাক এটা। বড়ো খেলো হয়ে যাব আমি কুমুদের কাছে।
তারপর কী ভেবে, সবুজের নিভে-যাওয়া, মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল, যা দিই তোমাকে, যা দিতে পারি, তা নিয়ে কি, তুমি খুশি নও? এটা না নিলেই কি তোমার নয়? তুমি একদিন ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে যে, নিছক এই দেওয়ার চেয়েও, অনেক দামি দান তোমাকে দিয়েছি আমি। তুমি বুদ্ধিমান। তোমার বোঝা উচিত।
এততেও যখন, সবুজ মুখ গোঁজ করে বসেছিল, তখন ওর কাছে উঠে এসে কমলা ওর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিল, আমি তো বলিনি যে, কখনোই দেব না। দেব হয়তো
কোনোদিন। কিন্তু এখানে নয়, এই কলকাতায় নয়, এই ডিজেলের ধোঁয়ায়, এই আওয়াজে, এই বিয়েরখাটে নয়। অন্য কোনোখানে, বাইরে কোথাও নির্জনে, যেখানে আমার নিজেকে চোর-চোর বলে মনে হবে না–যেখানে বাধা পাওয়ার ভয় থাকবে না–যেখানে ধীরে-সুস্থে, অবহেলায়, শিশিরের ফিসফিসানির মধ্যে, ঝিঁঝির ডাকের মধ্যে, বাইরের বন-প্রান্তরের বুকে ফুটফুট করা চাঁদের আলোর মধ্যে তুমি আমাকে পেতে পারবে। আমি তো তোমার-ই। চিরদিনের তোমার। আমার ভালোবাসা কি শুধু, এই প্রমাণটুকুর ওপরই নির্ভরশীল? এই প্রমাণ ছাড়া কি একে অন্যভাবে কিছুতেই প্রমাণিত করা যায় না?
তারপর-ই নিজের মনে বলে উঠেছিল, তোমরা, পুরুষমানুষরা বড়োবোকা সবুজ। দামি জিনিসটাকে সস্তা ভাবো, আর খেললো জিনিসটাকে ‘দামি’!
জানে না, সবুজ জানে না, অন্য পুরুষমানুষের কথা জানে না, ও শুধু নিজের কথা জানে। সবুজের মনে কোথায় যেন, কী একটা কাঁটার মতো বেঁধে। কমলা আর তার সম্পর্কের মধ্যে, এই না-পাওয়ার ঘটনাটা, কেমন একটা ব্যবধান রচিত করে রাখে। সবুজ ভাবে, কমলা কেন বোঝে না যে, এটা তো একটা পাওয়ামাত্র নয়, একটা শারীরিক পরিপ্লতিই নয়; এ যে, এক চরম মানসিক স্বীকৃতি। একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে জীবনে একবার, শুধু একবারের জন্যেও, এ-সম্পর্ক স্থাপিত হলে বোঝা যায়, বিশ্বাস করা যায়, বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, একের অদেয় কিছুই ছিল না অন্যকে। দু-জনে অন্তত একবারের জন্যে হলেও, কোনো একমুহূর্তের জন্যে মিলিত হলেও, জানা যায়, জন্ম-জন্মান্তরের, চিরদিনের, প্রাগৈতিহাসিক সম্পর্কের সেই-শিহরতোলা, সোনালি সিলমোহর পড়েছিল সেই সম্পর্কে। একদিন। কোনোদিন।
জানে না। সবুজ হয়তো বোকা। হয়তো সমস্ত পুরুষরাই বোকা। অথবা তাদের রুচি, তাদের বোধ, তাদের রোমান্টিকতা মেয়েদের তুলনায় অন্যরকম। সম্পর্কের গভীরতার ব্যাপারে পুরুষরা যতটা বিশ্বাস করে প্রমাণের ওপর, মেয়েরা হয়তো ততটা করে না। কিন্তু কমলাকে কী করে জানাবে ও? কমলারা কমলা; সবুজরা সবুজ। হয়তো দু-জনেই ঠিক; অথবা ভুল। কিন্তু ভুল অথবা ঠিকের কোনোটাই এক-ই কারণ-নির্ভর নয়।
কিছুক্ষণ পর কমলা এল, নিজে হাতে ট্রে নিয়ে। রেকাবিতে গরম শিঙাড়া, চিলি সস এবং জলের গ্লাস। ট্রে-টা নামিয়ে রেখেই কমলা বলল, নাও, খেয়ে নাও-গরম-গরম। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই খুব।
সবুজ বলল, নাঃ পেয়েছিল, এখন পেট ভরে গেছে।
কমলা অবাক হল। বলল, সে আবার কী?
সবুজ বলল, একটু আগে খেলাম না!
কমলা বুঝল কথাটা, ওর মুখ আরক্ত হয়ে গেল, বলল, খালি ওইসব, না? অসভ্য!
সবুজ বলল, তুমি? তুমি খাবে না?
কমলা বলল, হবে হবে, তুমি খাও তো আগে। তোমাকে সামনে বসে খাওয়াতে, খুব। ভালো লাগে আমার। কেন ভালো লাগে জানি না। কিন্তু বিশ্বাস করো ভীষণ ভালো লাগে।
সবুজ চামচে করে শিঙাড়া ভেঙে ভেঙে, মুখ নীচু করে খায়-খেতে খেতে একবার কমলার দিকে তাকায়–কমলার দিকে তাকিয়ে, ওর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। কমলা ওকে কত আদর করে, কত কী খাওয়ায়, কত দেওয়ায় ভরে দেয় সবুজকে–অথচ সবুজ বদলে কিছুই করতে পারে না। তার আর্থিক সাচ্ছল্য নেই–অর্থ না থাকলে কী দিয়ে ও তার ভালোবাসা প্রকাশ করবে?-মেয়েরা একটু হাসি হেসে-এক চিলতে চিকন চোখের চাউনিতে এতকিছু দিতে পারে, দেয়, অথচ পুরুষরা কী গরিব-প্রকৃতি তাদের নিঃস্ব করে রেখেছে। তাদের যা-কিছু সার্থকতা, যা-কিছু দাম তো, মেয়েদের মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে। তারা দাম দিলে তবেই সবুজরা দামি হয়, দামি বলে প্রতিপন্ন হয় নিজের কাছে।
কমলা পারুলকে ডেকে বলল, চায়ের জলটা হয়ে গেলে আমাকে ডাকিস, আমি চা করব। সবুজবাবু এক চামচ চিনি খান, জানিস তো? থাক, তোর করতে হবে না–তুই ডাকিস।
ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। সবুজ সোফায় বসেছিল, কমলা খাটের এক কোনায়। একটা ফলসা পাড়ের, ফলসা-ডুরেতোলা তাঁতের শাড়ি পরেছিল কমলা, সঙ্গে অফ-হোয়াইট স্লিভলেস ব্লাউজ। গলায় একটা মঙ্গলসূত্রম।
কমলার মতো চুল আজকাল দেখা যায় না মেয়েদের। খোলা অবস্থায় ওর চুল হাঁটু অবধি নেমে আসে। এলো-খোঁপা বেঁধেছিল কমলা। ওর হাঁসের মতো নরম অথচ ঋজু গ্রীবায় সেই চুলের ভার নেমে এসেছিল। অবাক হয়ে, ভালোলাগায় মরে গিয়ে সবুজ তাকিয়েছিল কমলার দিকে। আর চুপ করে খাচ্ছিল।
হঠাৎ সবুজ বলল, আমার ভারি অবাক লাগে। ভাবলে সত্যি অবাক লাগে। কী?
শুধিয়েছিল কমলা।
–তোমার মতো একজনের কী দেখে ভালো লেগেছিল, আমার মতো সাধারণ চেহারার, বিত্তহীন, গুণহীন লোককে? আমার মধ্যে কী যে, দেখেছিলে তুমি, তা তুমিই জানেনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমি বুঝি খেলা করো আমাকে নিয়ে, আমাকে আসলে তুমি ভালোবাসো না, আমি তোমার পুতুল। যতদিন কাছে রাখো, তোমার কাছাকাছি থাকি, ততদিন ভয়ের কারণ দেখি না। কিন্তু যেদিন তোমার পুতুলখেলা শেষ হবে, যেদিন আমাকে তুমি দূরে ছুঁড়ে ফেলবে, সেদিনের কথা ভাবি। তোমার তো কত স্তাবক–তোমার রূপের, তোমার গুণের; কিন্তু আমার যে, তুমি ছাড়া কেউ নেই। তুমি যে আমার কী, আমার কতখানি, আমার সমস্ত অস্তিত্বের জন্যে আমি যে, কতখানি তোমার ওপর নির্ভর করি, তা তুমি কখনো বুঝেছ? জানি না। কিন্তু বড়ো ভয় করে আমার।
কমলা খিলখিল করে হাসল–ওর সুন্দর পরিচ্ছন্ন দাঁতগুলিতে আলো ঝিলিক মারল।
কমলা হাসল। বলল, তোমার কী আছে তুমি জানো না। তুমি কি নিজেকে জানো? আমরা কেউই কি, নিজেকে জানি? অন্যরা ছাড়া আমাদের নিজেদের তো, কোনো অস্তিত্বই নেই– প্রয়োজনও হয়তো নেই। আমার চোখে তুমি যে-কী, তা তুমি কখনো জানবে না, আমিও হয়তো কোনোদিন জানব না যে, তোমার চোখে আমি কী। এটা না হয় অজানাই থাকল। যা জানা গেছে, যেটুকু জানা হয়েছে একে অন্যকে, তাই নিয়েই খুশি থাকি আমি, খুশি আছি। তুমি পারো না কেন? অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে বর্তমানটাকে মাটি করে যারা, আমি তাদের দলে নই।
সবুজ বলল, তুমি কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলো! ইচ্ছে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমার কথা শুনি! তোমার সামনে বসে। শুধু তুমি আর আমি।
কমলা হাসল। বলল, সকলের সঙ্গে পারি না। তুমি হয়তো কথা বলিয়ে নিতে জানো। কই? কুমুদের সঙ্গে তো হু-হাঁ’ দিয়েই সারি। মনে হয় নতুন করে, সুন্দর করে বলার মতো কোনো কথা নেই আর ওর সঙ্গে। একে অন্যকে বড়োবেশি জানা হয়ে গেছে, বড়কাছ থেকে। কারও মধ্যেই আর অন্যকে চমকে দেওয়ার মতো, নতুন কিছু, গোপন কিছু বুঝি অবশিষ্ট নেই। থাকলে ভালো হত।
কিছুক্ষণ পর কমলার, নিজে হাতে বানানো দু-কাপ চা খেয়ে, গল্প করে একসময় উঠল সবুজ।
বলল, চলি! আটটা বাজে।
কমলা দরজা অবধি এল। পারুল ভেতরে ছিল। সবুজ কমলার, ডান হাতখানি তুলে নিয়ে নিজের ঠোঁটে ছোঁওয়াল। ছুঁইয়ে হাত নামিয়ে দিতেই, কী-এক অদৃষ্টপূর্ব আবেগে কমলা তার কাঁধের দু-পাশে, দু-হাত জড়িয়ে ওর গলায় চুমু খেল। ফিসফিস করে বলল, আবার এসো। কেমন? তুমি এলে খুব ভালো লাগে।
সবুজ নিজেই ছিটকিনিটা নামাল, নামিয়ে দরজার পাল্লা খুলল।
কমলা বলল, হাজারিবাগে যাচ্ছ তো? না গেলে ভালো হবে না কিন্তু।
সবুজ বলল, খুব চেষ্টা করব। আমার কি যেতে ইচ্ছে করে না? সত্যিই চেষ্টা করব।
পথে নেমে, মুখ নীচু করে সবুজ হাঁটতে লাগল। ওর মনে হল যে, ও হাঁটছে না, বুঝি ভেসে চলেছে। ওর মাথার মধ্যে কোনো অদৃশ্য সেতারির সেতারে আনন্দের ধুন বাজতে লাগল।-সরকারি কেরানি, গলির মধ্যের অন্ধকার ঘরে থাকা ছানা-পোনা নিয়ে দিন-আনা দিন-খাওয়া সুবজ হঠাৎ বিড়লার চেয়েও বড়োলোক হয়ে গেল, ইন্দিয়া গান্ধীর চেয়েও বেশি প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠল। যদি কোনো ভিখারিনি সেইমুহূর্তে এসে তার কাছে কিছু চাইত, তাহলে ওর যা কিছু আছে সব–সব–হাতঘড়ি, কলম, চিমসেপড়া চামড়ার মানিব্যাগের সব ক-টি টাকা ও দিয়ে দিত–একবারও না ভেবে।
পথটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে এসে হঠাৎ পেছন ফিরে চাইল সবুজ, হঠাৎ-ই দেখতে পেল, খোলা-দরজায়, দু-হাতে দুই কপাট ধরে কমলা একরাশ আলোর মধ্যে তার পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সবুজের বুকের মধ্যে, কী-যেন একটা উৎসারিত হয়ে উঠল। আনন্দ সময় সময় বড়ো কষ্টকর হয়। ওর খুব ইচ্ছে হল, একদৌড়ে ফিরে যায় আবার ওর স্বর্গে, ফিরে গিয়ে কমলার কোলে মাথা রেখে একটু শোয়–ওর জীবনের–ওর জীবিকার, ওর সংসারের, সব অসহায় ও অসহনীয় অপারগতার, হীনম্মন্যতার ক্লান্তি ও অপনোদন করে।
কিন্তু ও মোড়ে এসে বাঁক নিল।
পথের পাশে একটা ডাস্টবিন–তা থেকে উপচে পড়েছে নানারকম পূতিগন্ধময় আবর্জনা। একটা কুকুর এবং দু-জন ভিখারি তারমধ্যে থেকে খুঁটে খুঁটে কী-যেন খাচ্ছে।
সবুজও এমনি করেই খুঁটে খুঁটে খায়। খেয়েছে সারাজীবন–খেয়ে, বেঁচে থেকেছে, যা অন্যের উচ্ছিষ্ট, খেয়েছে অসম্মানের সঙ্গে–সেই উচ্চম্মন্য দয়ার দান।
এ ডাস্টবিন থেকে নয়, অন্য অনেক ডাস্টবিন থেকে, খেয়েছে অন্যরকম ডাস্টবিন থেকে। প্রতিদিন।
কিন্তু পরক্ষণেই ওর নাক ভরে গেল। আবর্জনার গন্ধে নয়, চান-করে-ওঠা কমলার গায়ের সাবানের গন্ধে, ওর পাটভাঙা তাঁতের শাড়ির মাড়ের মিষ্টিগন্ধে।
সবুজ এক দারুণ দামি আতরের সুবাসে ঝুঁদ হয়ে বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে হেঁটে চলল।
.
০৪.
বাসে উঠে সবুজের মনে পড়ল যে, খোকার জন্যে একটা হরলিকস কিনে নিয়ে যেতে বলেছিল হাসি। সবুজের কিছু মনে থাকে না। কোনোদিন-ই সংসারী ছিল না ও, কখনো হতে পারবে বলে বিশ্বাসও নেই। আর যে, বাজার পড়েছে তাতে বড়ো বড়ো সংসারীরাই ল্যাজে গোবরে হয়ে গেল, তা ও তো কোন ছার।
আসলে বিয়ে করাটাই ওর ভুল হয়েছে। এই ঘর-সংসারের দায়িত্ব নেওয়া। ওর ভেতরে একটা বিবাগি বাস করে–যার কিছুই ভালো লাগে না। আসলে ও বুঝতে পারে যে, দিন দিন ও ভেতরে ভেতরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পলে পলে, প্রতিদিন। যা-কিছু ভালো ছিল, ভালোত্ব ছিল ওর বুকের ভেতরে, তা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে। সাঁতার কাটার জোর নেই আর। খড়কুটোর মতো ভেসে চলেছে নিশ্চিত আর্থিক ও আত্মিক সর্বনাশের দিকে।
ওর বিয়ের সময়, খোকা হওয়ার সময়, হাসির অসুখের সময়, ছোটোবোন নীলার বিয়ের সময় প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা থেকে যা-ধার হয়েছিল, তার ধার শোধ দিতেই সে, আজীবন মরে থাকবে। তা ছাড়া টাকার আজ কি দাম আছে কোনো?
পাঁচ-সালা, দশ-সালা, পনেরো-সালা, দূর-শালা পরিকল্পনাগুলো দেখে দেখে ওর কেবল ই সুকুমার রায়ের আবোল-তাবোলের ‘খুড়োর কল’-এর কথা মনে পড়ে। খুড়োর পিঠের সঙ্গে সোজাসুজি এক টুকরো কাঠ-বাঁধা–তা থেকে মাথার ওপর দিয়ে সমান্তরালে আর একটা কাঠ বেরিয়েছে–সেই কাঠের প্রান্তে–খুড়োর মুখের থেকে দেড় হাত দূরে এক টুকরো মাংস বাঁধা। ও এবং ওর মতো আরও কোটি কোটি লোক খুড়ো হয়ে গেছে আজ। খুড়োরা দৌড়োচ্ছে, মাংস খাবে বলে দৌড়োচ্ছে, প্রাণপণ দৌড়োচ্ছে, কিন্তু মাংসের নাগাল পাচ্ছে না কিছুতেই। মুখের থেকে মাংস যত দূরে ছিল, তত দূরে তো বটেই, তার চেয়ে রোজ-ই আরও দূরে সরে যাচ্ছে।
যাক গে।
ও ভেবে কী করবে? জনগণের প্রতিভূ আত্মত্যাগী সব সংসদ-সদস্য আছেন–তাঁরা নিশ্চয়ই দেশের কথা ভাবছেন। আর তাঁদের হোল-টাইম অকুপেশন তো দেশ সেবা করাই। তাঁদের মতো এত সৎ, ন্যায়পরায়ণ, দেশহিতৈষীরা থাকতে, সবুজরা দেশের কথা ভেবে কী করবে?
বিয়ের পর হাসি এবং ও ঠিক করেছিল, ওদের একটি মাত্র সন্তান হবে। ছেলেই হোক কী মেয়েই হোক, তাকে ভালো করে মানুষ করবে, ভালো জামা-কাপড় পরাবে, ভালো স্কুলে দেবে, তার জন্যে প্রাইভেট টিউটর রাখবে। অনেক শখ ছিল ওদের। বিয়ের সময়, আজ থেকে দশ বছর আগে, টাকার যা দাম ছিল, তাতে খোকাকে ভালোভাবে মানুষ করার কোনো অসুবিধেও ছিল না। কিন্তু সব গন্ডগোল হয়ে গেল। এখন এই ছেলে-বউকে বাঁচিয়ে রেখে, নিজে বেঁচে থাকাটাই বড়োসমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাস থেকে নেমে, বাড়ির দিকে আসতে আসতে একটু ঘুরে পরে গলিতে ঢুকল সবুজ।
ফণীর দোকান খোলা থাকলে হরলিকস পেলেও পেতে পারে। ফণী সবুজের-ই সমবয়সি হবে কিন্তু দেখলে বেশি বয়সি বলে মনে হয়। ও সবুজের বন্ধু নয়। শত্রুও ঠিক বলা যায় না। সবুজ জানে না, ওকে ঠিক কোন শ্রেণিতে ফেলা যায়, ফেলা যেতে পারে।
ফণীদের অবস্থা আগে খুব-ই ভালো ছিল, হাসিদের বাপের বাড়ির পাশে মস্তবাড়ি ছিল ফণীর বাবার। ফণী বাবা-মা-র একমাত্র ছেলে। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে, ফণীর বাবা হঠাৎ মারা যান–চোদ্দো বছরের ফণীকে রেখে। মা মারা যান ছ-মাস বাদে। তারপর জ্যাঠা কাকাদের অনুগ্রহে কোনোক্রমে বেঁচে থাকেন ফণীবাবু–হাসির ফণীদা। একদিন সে আশ্রয়ও তার যায়। কাকারা সব-ই ঠকিয়ে নেয়, ফণীকে তাড়িয়ে দেয়।
ফণী মানুষটি একটু অদ্ভুত ধরনের। চোখ দুটো খুব অস্বাভাবিক। চোখে চাইলে মনে হয়, পৃথিবীর কদর্যতা দেখে দেখে, ব্যথা পেয়ে উদাসীন হয়ে গেছে ও। অথচ আশ্চর্য! সেই উদাসীনতার মধ্যে কোনো অনুযোগ নেই, বঞ্চনার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই।
ফণী একজন সাধারণ, নির্ভেজাল, দুবলা-পাতলা, মিনমিন করে কথাবলা বাঙালি। দোকান করেছে ইদানীং এ পাড়ায় একটা বস্তির পাশে। মনোহারী দোকান। এক বন্ধুর আর্থিক আনুকূল্যে। দোকানে দিনের প্রায় বারো ঘণ্টা কাটায় ফণী। দোকানেই রাত কাটায়। অন্ধকার, গুমোট দরজা-জানলা-বন্ধ টিনের ঘরে। বন্ধু ফণীকে মাসে আড়াইশো টাকা করে দেন। পরে নাকি পার্টনার করবেন।
প্রথমে সবুজ হাসিকে বলেছিল যে, দু-বেলা তো ফণী এখানেই খেতে পারে, পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালাদের হোটেলে রুটি-তড়কা না খেয়ে। হাসি বোধ হয় বলেও ছিল কথাটা। ফণীবাবু বলেছিলেন এমনি-এমনি খাবেন না। মাসে একশো টাকা করে নিতে হবে। তাতে হাসি রাজি হয়নি।
সে বছর দুয়েক আগেকার কথা। আজকে সবুজের মনে হয়, হাসি রাজি না হয়ে ভালোই করেছে। আজকের দিনে একজন বাইরের লোককে দু-বেলা বাড়িতে এনে খাওয়াতে দেড়শো টাকার কম খরচে হয় না। তা ছাড়া দু-বছর আগে, সবুজ যে-চোখে দেখত ফণীকে, আজ আর সে-চোখে দেখে না। এ দু-বছরে সবুজ অনেক বদলে গেছে।
তবুও বাড়িতে ভালো-মন্দ কিছু রান্না হলেই হাসি খোকাকে দিয়ে খবর পাঠায়। ফণীবাবু এসে খেয়ে যান। এক রবিবারে মাছ ধরতে গিয়ে সবুজ একটা বড়ো কাতলা মাছ পেয়েছিল। ফণীবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিল হাসি। তা ছাড়া বাড়িতে যেদিন-ই মাংস হয়, মাংসের ঝোল ভাতও খেয়ে যান ফণীবাবু।
ফণীবাবুর চেহারায় ও চরিত্রে এমন একটা দুঃখী, ভালোমানুষি ভাব ছিল যে, হাসির এই ফণীদা-প্রীতিকে প্রথম প্রথম সবুজ অন্যচোখে দেখেনি। সবুজের অনুপস্থিতিতেই হাসির ফণীদা বেশি আসে হাসির কাছে, তা সবুজ জানত–কিন্তু তা নিয়ে কোনোদিনও মাথা ঘামায়নি ও। কিন্তু একদিন, সেই একদিনের ঘটনাটা এখনও মনে গেঁথে আছে সবুজের। সেদিন অফিস থেকে দুপুর বেলায়-ই চলে এসেছিল ও জ্বর নিয়ে। জানে, দুপুরে হাসি বিশ্রাম করে শোয়ার ঘরে, তাই বাইরের ঘরের কড়া না নেড়ে ও খিড়কির দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। যদু উঠোনের পাশে বারান্দায় শুয়েছিল–দরজা খুলে দিল। বারান্দায় উঠেই যদুকে ও শুধিয়েছিল, বউদি কোথায়। যদু শুধু আঙুল দিয়ে শোয়ার ঘর দেখিয়ে দিয়েছিল।
শোয়ার ঘরে ঢুকতেই সবুজ চমকে উঠেছিল। হাসির শাড়ি-টাড়ি এলোমেলো বিছানার বেডকভার কুঁচিমুচি হয়ে রয়েছে।
ঘরের এককোনায় ফণীবাবু ইজিচেয়ারে বসেছিলেন পায়জামা আর গেঞ্জি পরে। হাসির চোখমুখ প্রথমে, ধরা-পড়া-চোরের মতো মনে হয়েছিল সবুজের। কিন্তু সে খুব বুদ্ধিমতী। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়েছিল। ফণীবাবুর চোখে-মুখে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেনি সবুজ। এ লোকটার চোখ দুটো বোধ হয় পাথরের। যে বিষণ্ণ ভাব তার চোখে আঁকা হয়ে গেছে, আঁকা রয়েছে, তা বুঝি অন্য কোনোরকম সহানুভূতিতেই আর বদলাবে না।
সেইদিন-ই সবুজের বুকের মধ্যে সন্দেহটা প্রথম উঁকি মারে। হাসির এই ফণীদা-প্রীতি যে, নেহাতই এক গোবেচারার প্রতি সহানুভূতি নয়, এ কথাটা সেদিন-ই প্রথম মনে হয় সবুজের।
হাসিকে ও কিছু বলেনি। যদিও খুব অপমানিত বোধ করেছিল ও। যদি হাসি সবুজের চেয়ে ভালো, যেকোনো একদিক দিয়েও ভালো, এমন কাউকে ভালোবাসত, তবে তার অতটা দুঃখ হত না; কিন্তু এই ফণী, মনোহারী দোকানে চুলের তেল আর সাবান বিক্রি করা, চুপচাপ মিনমিনে চরিত্রের আধবুড়ো ফণী যে, ওকে হারিয়ে দিল, এই ভাবনাটাই ওকে বড়ো পীড়া দেয়।
এরপর থেকেই অনেকানেক ভাবে ফণীকে জব্দ করার চেষ্টা করেছে সবুজ। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে।
যেদিন-ই হাসি ফণীকে খেতে বলেছে, সেদিন-ই ইচ্ছে করে ফণী আসার আগে, পেট ভরে যাওয়া সত্ত্বেও বেশি করে ভাত চেয়ে, বেশি করে মাংস চেয়ে খেয়েছে ও, যাতে ফণীর জন্যে আর হাসির জন্যে হাড় ছাড়া, হাঁড়ির নীচের একমুঠো ভাত ছাড়া কিছু না থাকে। অনেকবার ফণীর দোকান থেকে অনেক টাকার জিনিস এনেছে ধারে-কখনো পয়সা দেয়নি। ফণী নিশ্চয়ই তার মাইনে থেকে, তার খাওয়ার টাকা থেকে হয়তো একবেলা খেয়েই সেই দাম শুধেছে তার বন্ধুকে। কিন্তু আশ্চর্য! ফণী এসব কথা কখনো হাসিকেও বলেনি; বলে না। বললে, হাসি সবুজকে হয়তো জানাত।
যখন ভাত-মাংস খেয়ে ফেলত সবুজ, তখনও হাসি কিছু বলত না মুখে। তার বড়ো বড়ো পাতাঅলা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত সবুজের মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে। সবুজ জানে, অনেকদিন-ইখাওয়া হত না হাসির। ফণী যখন দোকান বন্ধ করে ঠা-ঠা রোদ্দুরে খেতে আসত, তখন হাসি সামনে বসে তাকে তার নিজের খাবার খাওয়াত।
একদিন ফণী আসার কথা শুনে সবুজ নিজে খেয়ে নেওয়ার পর, হাসি যখন চান করতে গেছে, তখন সবুজ রান্নাঘরের শিকল খুলে বেড়াল দিয়ে সব ভাত-মাংস খাইয়ে দিয়েছিল। সেদিন হাসি অথবা ফণী কেউই খেতে পায়নি। ওরা শুধু জল খেয়ে থেকে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে সারাদুপুর গল্প করেছিল। আশ্চর্য-ওখানে পাখা নেই, ওখানটা ভীষণ গরম, অথচ কী করে যে, ওরা অতক্ষণ ওখানে থাকল, কীসের জন্যেই বা থাকল, তা ওরাই জানে। প্রেমালাপ নয়, কিছু নয়; শুধু দু-জনের মুখোমুখি দু-জনে বসে অনর্গল কথা বলে যাওয়া। যেসব কথার মানেই নেই কোনো–যেকথা কথাই নয়।
শোয়ার ঘরে, পাখার নীচে, খোকাকে একপাশে নিয়ে, কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে-শুয়ে ওদের অভুক্ত রেখে, গরমে কষ্ট পাইয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ পেয়েছিল সবুজ সেদিন।
সেইদিন, এতদিনের মধ্যে একমাত্র সেইদিন-ই, রোদ পড়লে, দোকান খোলার জন্যে ফণী চলে গেলে, হাসি ঘরে এসে ঢুকেছিল। খোকা পার্কে ফুটবল খেলতে বেরিয়ে গিয়েছিল। হাসি এসে সবুজের মুখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকদিন পর সবুজ ভালো করে, দিনের আলোয় হাসির মুখের দিকে তাকিয়েছিল–ও বহুদিন পর হঠাৎ-ই লক্ষ করেছিল যে, হাসি বড়ো রোগা হয়ে গেছে–গালের নীল শিরাগুলো দেখা যাচ্ছে–চোখের নীচে কালি পড়েছে। তবু সেই জীর্ণ শরীরে চোখের উজ্জ্বলতা নেভেনি একটুও, বরং বেড়েছে।
হাসির দু-চোখে জল টলটল করছিল। হাসি, যতক্ষণ সেই জলের ফোঁটা ধারা হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে না পড়েছিল, ততক্ষণ চুপ করেই ছিল। চোখের জলের ধারা থেমে গেলে, শুধু একটা কথাই বলেছিল হাসি–একটা শব্দ। সবুজের ক্রুর নিষ্ঠুর চোখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলেছিল, ইতর’!
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, তুমি বড়ো ইতর’!
সেসব অনেক দিনের কথা। কিন্তু সবুজের বরাবর-ই মজা লেগেছে এই ভেবে যে, হাসির মতো সাধারণ, কঙ্কালসার, রুগণ সমস্তক্ষণ সংসারের ভারে নুজ, রান্নাঘরে পড়ে-থাকা মেয়ের মধ্যে কী দেখেছে ফণী? অবশ্য ফণী-ই বা কী? যেমন চেহারা, তেমনি ছিরি! যেমন প্রেমিক, তেমনি তার প্রেমিকা। মনে মনে বলেছে সবুজ, আর নিপীড়ন করছে ওদেরদু জনকেই। যে নিরুপায়, যে সমস্ত ব্যাপারে তার-ই ওপর নির্ভরশীল, তাকে নিপীড়ন করার মধ্যে, তাকে কাঁদাবার মধ্যে যে-কী দারুণ আনন্দ, এ কথা সবুজের মতো বোধ হয় আর কেউই জানেনি।
সত্যি কথা বলতে কী, বহুদিন হতে চলল, হাসিকে আদর করে যতটুকু না আনন্দ পেয়েছে সবুজ, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছে ওকে পীড়ন করে, ওর চোখের সামনে ওর ভালোবাসার জনকে অভুক্ত রেখে, অপমান করে।
সবুজের ইচ্ছে আছে, একদিন ফণীর দোকান থেকে একবাক্স দামি সাবান, অনেক ওডিকোলন, পাউডার ইত্যাদি ইত্যাদি কিনে নিয়ে গিয়ে কমলাকে দিয়ে আসবে। সবুজ দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, শালা ফণী। আমার বউয়ের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি, তার ট্যাকস দিবি না?
দূর থেকে ফণীর দোকানের ন্যাংটা বালবটা দেখা যাচ্ছিল। দোকানের পাশের খাটালে বর্ষার পোকা হয়েছে নানারকম। বালবটার চারপাশে পোকা উড়ছে।
কাছে যেতে সবুজ দেখতে পেল যে, একজন রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানের সামনে ফণীকে যা-তা বলে গালাগালি করছে। পাঁউরুটি বাসি ছিল বলে।
ফণী উত্তেজনাহীন চাপা গলায় ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছে। বলছে, রুটি তো আমরা তৈরি করি না ভাই, কোম্পানি থেকে দিয়ে যায়–রুটি জমিয়েও রাখি না, কোম্পানির লোক এলে ওদের নিশ্চয়ই একথা বলব।
এ-পাড়ায় রিকশাওয়ালাদের মধ্যে অনেক গুণ্ডা আছে। অনেকে আবার পার্টি-ফার্টিও করে। একে গুণ্ডা তায় আবার পার্টিবাজ–একেবারে সোনায় সোহাগা।
সবুজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা রেলিশ করছিল।
রিকশাওয়ালা অন্য কাউকে এমন করে কথা বললে ও হয়তো ঘুসি কষিয়ে দিত নাকে– তারপর যা হত, হত। ও জানে যে, ওর বাঙালের রক্তে রাগ চড়লে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কিন্তু যা, বলা হচ্ছে, তা ফণীকে। তা ছাড়া রিকশাওয়ালাটাও ওর চেনা।
মনের ঝাল মিটিয়ে রোগাসোগা নীরব ফণীকে পালোয়ান রিকশাওয়ালা অপমান করল। কিন্তু যে, অপমানের প্রতিবাদ করে না, তাকে অপমান করে মজা নেই।
কিছুক্ষণ পর রিকশাওয়ালা বোধ হয় নেহাতই ক্লান্ত হয়ে চলে গেল।
তখন সবুজ এগিয়ে এল ফণীর কাছে। ন্যাংটা আলোটায় ফণীর মুখটা বিব্রত, ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ফণী খুব ঘামছিল। পোকাগুলো উড়ছিল ওর নাকের সামনে।
ফণী চমকে উঠে বলল, কী ব্যাপার? সবুজবাবু!
সবুজ বলল, একটা হরলিকস চাই খোকার জন্যে। আছে?
ফণী বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ।
বলেই শিশি বের করে, ধুলো ঝেড়ে শিশিটা এগিয়ে দিল।
সবুজ দামের কথা শুধোল না। কবে দাম দেবে তাও বলল না, ফণীর মুখের দিকে রিকশাওয়ালাটার অসভ্য চোখের চেয়েও নোংরা চোখে তাকাল ও।
তারপর বলল, চলি।
সবুজ পথে পা-বাড়ানোর পরই ফণী পিছু ডাকল ফিসফিস করে, সবুজবাবু?
সবুজ ঘুরে দাঁড়িয়ে, ফিরে গেল ওর দিকে।
ও অনুমান করতে লাগল কী বলতে পারে ফণী! দাম চাইবে? বলবে কী যে, আর ধার দেব না আপনাকে? কী বলে ফণী, তাই আঁচ করতে লাগল ও।
সবুজের মনে হল, ফণী আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে।
দাড়ি কামায়নি বোধ হয় আজ। দুপুরে খেয়েছে কি না কে জানে?
ফণীর মুখে তাকিয়ে সবুজের মনটা হঠাৎ একমুহূর্তের জন্যে দ্রবীভূত হয়ে উঠল। পরক্ষণেই ও আবার শক্ত হয়ে গেল।
ফণী বলল, বলছিলাম কী….
সবুজ সোজা ওর চোখে তাকিয়ে বলল, বলুন না মশাই! অত আমড়াগাছি কীসের জন্যে?
ফণী বলল, বলছিলাম যে, হরলিকসটার দাম দিতে হবে না। ওটা তো খোকার জন্যে! দাম নেব না।
সবুজ বলল, আচ্ছা! ঠিক আছে।
ধন্যবাদ দিল না, আর কিছু বলল না।
ফিরে যাওয়ার সময় মনে মনে বলল, তা তো নেবেই না। তবে চাইলেই বা তোমাকে দিচ্ছিল কে?
বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় ন-টা বাজল সবুজের।
বাড়ি ঢুকেই দেখল বাড়িতে খুশি-খুশি আবহাওয়া। রান্নাঘর থেকে ইলিশমাছের গন্ধ বেরোচ্ছিল। বাথরুমে চান করার শব্দ পাচ্ছিল সবুজ। হাসি চান করছে।
খোকা পড়ছিল তখনও, কিন্তু সবুজকে দেখেই দৌড়ে এল।
বলল, দ্যাখো বাবা, ফণীমামা কী দিয়েছে আমায়!
বলেই, একটা ফুটবল দেখাল।
সবুজরা এরকম ফুটবল ছোটোবেলায় দেখেনি। সাদা-কালো চৌকো-চৌকো রং করা ফুটবলটার গায়ে। খোকা আবার উত্তেজিত হয়ে বলল, ফণীমামা রসগোল্লা এনেছে; ইলিশমাছ। মায়ের জন্যে শাড়িও।
সবুজ জামাকাপড় খুলতে খুলতে অন্যমনস্ক গলায় বলল, হঠাৎ?
খোকা বলল, ফণীমামা ওই দোকানের পার্টনার না কী বলে, তাই হয়েছে। ফণীমামা বড়োলোক হয়েছে বাবা, হ্যাঁ।
চোখ বড়ো বড়ো করে আবার বলল খোকা।
সবুজ বিরক্তিমাখা গলায় বলল, স্কুলের পড়া শেষ হয়েছে, না ফণীমামার গল্প করলেই কাল পড়া পারবে?
খোকা নিভে গিয়ে আবার পড়ার টেবিলে ফিরে গেল।
হাসি চান করে তোয়ালে জড়িয়ে ঘরে এল। কোনো কথা বলল না সবুজের সঙ্গে। হাসির গা দিয়ে সাবানের গন্ধ বেরোচ্ছিল। এ অন্য সাবান। কমলার গা দিয়ে অন্যরকম গন্ধ বেরোয়। চান করার পর।
হাসি খাটের ওপর রাখা নতুন শাড়িটা যত্ন করে পরল। চুল ভিজোয়নি ও। বড়ো করে সিঁদুরের টিপ পরল, একটু পাউডার ঘষল গালে। তারপর খুব খুশি-খুশি গলায় সবুজের দিকে ফিরে বলল, বুঝলে ভগবান বলে এখনও কিছু আছে।
সবুজ তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, আছে নাকি?
–আমার মনে হয় আছে। ভালো করলে এখনও ভালো হয়। ভালো লোককে ভগবান
এখনও দেখেন।
সবুজ বলল, তোমার ফণীদাই তাহলে, পৃথিবীর একমাত্র ভালোলোক। ভগবানের দৃষ্টি যখন আমাদের ওপর পড়ছে না, পড়েনি, তখন আমরা সকলেই খারাপ লোক, কি বলো?
হাসি ওর আজকের আনন্দটা সবুজের সঙ্গে ঝগড়া করে নষ্ট করতে রাজি ছিল না। বলল, সব ব্যাপারে তুমি নিজেকে টেনে এনে তুলনা করো কেন সকলের সঙ্গে? তুমি কারও ভালো হওয়া দেখতে পারো-না, না?
তারপর বলল, তোমার ওপরও পড়বে হয়ত দৃষ্টি কোনোদিন, যদি ভালো থাকো; ভালো হও।
পরক্ষণেই বলল, এক্ষুনি খাবে? চান করবে না?
সবুজ বলল, আমার খিদে নেই! খাব না ভাবছি।
হাসি প্রায় কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল।
বলল, ওরকম কোরো না। খাও, লক্ষ্মীটি! কতদিন পর ইলিশমাছ রান্না করেছি। মাছ ভাজা, মাছের তেল, মাছের ঝোল-বড়ো বড়ো পেটি। কাল মাথা দিয়ে কচুর শাক করব আর কাঁটা-টাঁটা দিয়ে টক।
তারপর একটু চুপ করে থেকে স্বগতোক্তির মতো বলল, ওরকম করতে নেই। লোকটার তো আপনার বলতে কেউ-ই নেই, আমি ছাড়া; পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল, আমরা ছাড়া। একটু ভালো ব্যবহার, একটু সহানুভূতির জন্যে, যে-লোকটা দৌড়ে দৌড়ে আসে, তার সঙ্গে তুমি এমন ব্যবহার করো কেন? সে তো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি সে যা পেয়েছে আমার কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে, তার বহুগুণ করে সে ফেরত দিয়ে দিয়েছে–। আমাদের ভালোবেসে, খোকাকে ভালোবেসে।
একটু থেমে হাসি বলল, তুমি যেন কীরকম! অদ্ভুত তোমার প্রকৃতি।
সবুজ নিজেকে সামলে নিল।
বলল, আচ্ছা, খাব। চান করে আসি। ফণীবাবুর উন্নতি আজ তাহলে সেলিব্রেট করতেই হবে?
চান-টান করে হাসির সঙ্গে অনেক, অনেকদিন পর একসঙ্গে রান্নাঘরের দাওয়ায় আসন পেতে খেয়েছিল সবুজ। অনেকক্ষণ ধরে, রসিয়ে রসিয়ে খেয়েছিল।
খাওয়া হয়ে গেলে নিজে হাতে পানও সেজে এনেছিল হাসি।
তারপরে শোয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
ছোটো জিরো-পাওয়ারের নীলরঙা বালবটা জ্বলছিল ঘরে।
পান চিবোতে-চিবোতে সবুজ শুধোল, ফণীবাবু খেয়ে গেল না?
–না। ফণীদার খাবার তুলে রেখেছি। কাল দুপুরে খাবে। বলল, দোকানে অনেক হিসাবপত্রের কাজ আছে আজ।
ফণীর-আনা ইলিশমাছ, রসগোল্লা খেয়ে, পান চিবোতে চিবোতে ফণী সম্বন্ধে যেন, হঠাৎ উদার হয়ে উঠল সবুজ।
বলল, ফণীবাবুর শরীরটা যেন কেমন ভেঙে গেছে। হাসি বলল, বেশিদিন বোধ হয় বাঁচবে না। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই; তার ওপর কী অমানুষিক খাটুনি। ফণীদার একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। তুমি তো কত জায়গায় ঘোরো, কত লোকের সঙ্গে মেশো, ভালো একটি মেয়ে দেখে দাও-না ফণীদার জন্যে। ফণীদাকে সংসারী দেখতে পারলে আমার মনটা খুবশান্ত হবে। তারপর কী ভেবে, একটু চুপ করে থেকে বলল, তোমার ভালো লাগবে না?
সবুজ পানের পিক গিলে বলল, কিন্তু ফণীদার এ-জন্মে আর কাউকে কি মনে ধরবে? একজন যে, তার চোখ-জুড়ে আছে।
হাসি তক্ষুনি মুখ নামিয়ে নিল।
ও খুশি হয়েছে না দুঃখী হয়েছে সবুজের কথায়, তা সবুজ বুঝতে পারল না।
বলল, ফণীদারা কত বড়োেলোক ছিল, কত আরামে মানুষ হয়েছে। কাকারা সব ঠকিয়ে না নিলে, কি ফণীদার আজকে এই অবস্থা হয়! আমি তো ফণীদার জন্যে কিছুই করতে পারলাম, পারবও না। তুমি সব-ই জানো। তবু তুমি এমন করে ওকে কেন যে, অপমান করো জানি । তোমার বুকের মধ্যে কী আছে, আমার ভারি দেখতে ইচ্ছে হয়।
সবুজ কথা ঘোরাল।
বলল, সকলের বুকের মধ্যেই যা থাকে, হৃদয়-ফুসফুস, এই-ই সব।
হাসি বলল, হৃদয় আছে তোমার? এতদিন হয়তো ছিল। আজ আছে কি না জানতে ইচ্ছে হয়।
সবুজ উত্তর না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে বিছানায় এল। বলল, এসো কাছে এসো, খাওয়া-দাওয়া ভালোই হল তোমার ফণীদার দয়ায়, ফণীদার দয়ায় আজ তোমাকে একটু কাছেও পাওয়া যাক। তুমি আমার স্ত্রী, তুমি যে, কেমন দেখতে, এই কথাটাই প্রায় ভুলে যেতে বসেছি।
হাসি ইতস্তত করছিল। হাসির চোখ দুটোতে ভয় জেগে উঠল। হঠাৎ।
সবুজ তাকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে একটানে ফণীর দেওয়া শাড়িটা খুলে ফেলল। এ শাড়িটা প্রথম থেকেই সহ্য করতে পারছিল না সবুজ। শাড়িটা খুলে ফেলতেই হাসি আবার চেনা হাসি হয়ে গেল। বাড়িতে হাত-মেশিনে সেলাই করা শায়া, ব্লাউজ; অতিসাধারণ সবুজের স্ত্রী সেই হাসি।
হাসি সময় নষ্ট না করে ভেতরের জামাটা খুলে ফেলল। রোগা-হাসির শিশু-মুঠি স্তন অপ্রস্তুতভাবে ফুটে উঠল তার ফর্সা বুকে।
হাসি মুখটা ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। এখনও বড়ো লাজুক ও; বিয়ের দশ বছর পরেও। সবুজ জানে না ফণীর কাছেও, এতখানি লজ্জাবতী কি না।
সবুজ আবার বলল, এসো।
বলেই, নিজের গলার স্বরের কঠোরতায় ও নিজেই চমকে উঠল।
বহুবছর হল, হাসি নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। বলির পাঁঠার মতো, কাঠগড়ার আসামির মতো। তার নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো দাম নেই, তা জেনে গেছে সে। স্বামীর দীর্ঘ উপেক্ষার দ্বারা, তার স্বার্থপরতার দ্বারা নিপীড়িত হয়ে হয়ে, শিলীভূত হয়ে গেছে সে। এখন হাসি বোঝে না, ও-বুঝতে ভুলে গেছে, কীসের এই দম্ভ তার স্বামীর? কী সে দিয়েছে, তাকে এ, জীবনে? তবুও বশংবদ প্রজার মতো একবেলা দু-মুঠো ভাত এবং অন্য বেলা দুটি রুটি-তরকারির বিনিময় এবং তাদের দুজনের রক্ত-মাংসে গড়া ছেলেটির প্রতি ভালোবাসার আশ্চর্য শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত থেকে, সে তার স্বামীর চাহিদা মিটিয়েছে।
কিন্তু সবুজের মতো স্বামীরা যা-কিছু পেয়েছে, পেয়ে এসেছে, সব-ই একতরফের পাওয়া। ওরা মিলিত হয়নি কখনো তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে। শরীরে অথবা মনে। ওরা হাসিদের ধর্ষণ করেছে। চিরদিন-ই বিবাহিত জীবনের প্রথম দিন থেকেই।
হাসি শুয়েছিল চিত হয়ে। নীল আলোটা তার ছিপছিপে ফর্সা স্নিগ্ধ, নরম লাজুক শরীরে মাখামাখি হয়েছিল। সবুজ এগিয়ে গিয়ে হাসিতে পৌঁছোল বমি-পাওয়া, ঘেন্না-হওয়া স্থূলতার সঙ্গে। হাসির নিথর ঠাণ্ডা নিস্পন্দ শরীরের গভীরে যে, মন’ বলে একটা দারুণ উষ্ণ, স্পন্দিত ব্যাপার, তার খোঁজ এখন ও রাখে না। রাখতে চায়ও না, বোধ হয়।
আসলে হাসিকে চায়নি সবুজ। আজকাল ওকে একেবারেই চায় না।
সবুজ চোখ বুজে ফেলেছিল। কল্পনায় কমলার ঘর, কমলার বিরাট খাটটাকে চোখের সামনে দেখছিল, আর দেখছিল কমলাকে। আরও দেখেছিল সবুজ, একটি ঘামে-ভেজা, খোঁচা-খোঁচা দাড়িঅলা জীর্ণক্লিষ্ট মুখ। ফণীকে দেখছিল সবুজ। তখনও দেখতে পাচ্ছিল।
হাসির শরীরের মধ্যে দৌড়ে যেতে যেতে, সবুজ দাঁতে দাঁত চেপে বলছিল, দেখ ফণী, তোর হাসি তোর কেউই নয়। হাসি আমার, আমার একার।
হাসিও চোখ বুজে ফেলেছিল। ওর পাতলা ঠোঁট দুটো বোজা ছিল। হাসির বন্ধ চোখের সামনেও, একটি তরল ভালোবাসায় জরজর একজন ব্যথিত পুরুষের মুখ ভেসে ছিল। সে মুখে কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই; যে-মুখে শুধু এক আশ্চর্য পরিণতিহীন ভালোবাসার আনন্দ।
হাসি মনে মনে, বুকের মধ্যে এক দারুণ চাপা কষ্টের মধ্যে নিরুচ্চারে বলছিল, ফণীদা, বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি ভালোবাসি–তোমাকে কিছু দিতে যে, পারিনি, তার জন্যে আমাকে ক্ষমা কোরো ফণীদা।
পুরোনো ও পরিচিত পথে দ্রুত কুচকাওয়াজ করার ভোঁতা একঘেয়ে ক্লান্তির পর সবুজ যখন হাসির পাশে শুয়ে পড়ল, তখন হঠাৎ ওর হাত লাগল হাসির গালে। সবুজ বুঝতে পারল, হাসির গাল ভিজে গেছে জলে।
বিরক্তির সঙ্গে বলল, জল এল কোথা থেকে? হাসি তুমি কাঁদছ নাকি? কাঁদছ কেন? এ আবার কী ন্যাকামি?
হাসি কথা বলল না প্রথমে।
তারপরে বলল, চোখে কী একটা পোকা পড়ল। একটা পোকা।
–ও! বলল সবুজ।
সুবজ জানে, পোকাটা কী! পোকাটা কে?
সবুজ জানে, এ পোকা ফ্লিটে কী ধুনোর ধোঁয়ায় মরবে না।
সবুজ পাশ ফিরে অন্যদিকে মুখ করে শুতে শুতে নিজের মনে বলল, ফণীটা আমাকে এই বিছানাতেও হারিয়ে দিল।
সবুজ যেন, এই প্রথম জানতে পারল যে, সব খেলাতেই ওয়াক-ওভারের নিয়ম নেই। প্রতিপক্ষর অনুপস্থিতিতেও হারতে হয় কোনো কোনো খেলায়। জীবনের, ভালোবাসার; এই আশ্লেষের আশ্চর্য খেলায় তো নিশ্চয়ই!