৩.৪ অনন্য ভৃঙ্গার

১৮. অনন্য ভৃঙ্গার

শুকনো লতাপাতা আর গোবরের আগুন থেকে উদ্ভূত ঝাঁঝালো ধোঁয়া, শিকে বেঁধানো নধর ভেড়ার মাংসের খুশবু, আর গরম পাথরে সেঁকা রুটির পরিচিত গন্ধে বাবর শ্বাস নেয়। সন্ধ্যে শেষে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে, তার চারপাশে, সপ্তাহভর খণ্ডযুদ্ধের শেষে বিশ্রামের অবকাশ পেয়ে পরস্পরের সাথে গালগল্পে মেতে উঠে। রান্নার আয়োজন করে আর নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করে তেল দেয়। তার সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ষোল হাজার হয়েছে ভাবতেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। প্রতিদিনই উজবেকদের দ্বারা বিতাড়িত লোকজন আরও বেশি সংখ্যায় তার বাহিনীতে এসে যোগ দিচ্ছে।

 হিরাতের পূর্বদিকে বারো দিনের দূরত্বে, ঘারজিস্তানের পর্বতমালার গহীনে এই তৃণভূমিতে আর বেশিদিন তারা অবস্থান করতে পারবে না। বাবরের গুপ্তদূতদের নিয়ে আসা সংবাদ অনুসারে, সাইবানি খান কয়েক সপ্তাহ আগেই শহর ত্যাগ করেছে। শহর ত্যাগের সঠিক সময় আর বিবরণ যদিও অস্পষ্ট কিন্তু একটা বিষয়ে। সবাই নিশ্চিত যে, কিপচাক তোরণের নীচ দিয়ে একটা বিশাল বাহিনী নিয়ে সে উত্তর-পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিয়েছে। হতে পারে পুরোটাই প্রায় অরক্ষিত হিরাত আক্রমণে বাবরকে প্ররোচিত করার একটা টোপ? বা সাইবানি খান উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে এসে বাবরকে পাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়? উজবেক সেনাপতির এতোদিনে জেনে যাওয়া উচিত কাবুল থেকে পশ্চিমে অগ্রসরমান একটা বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে বাবর। তার এটাও জানা উচিত বাবরের বাহিনীকে আচমকা আক্রমণ করে সে সহজে তাকে পরাস্ত করতে পারবে। বা সম্ভবত সে বাবরকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। সম্ভবত সে এখন তার উজবেক বর্বরদের পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে উত্তর দিকে বাবরের রাজধানী কাবুলের দিকে নিয়ে চলেছে।

বাবর তার তাঁবুর বাইরে ধাতব ঝুড়িতে রাখা জ্বলন্ত কয়লার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সুনির্দিষ্ট সংবাদের অভাব কেমন অশুভ একটা অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে…ব্যাপারটা এমন, যেনো সাইবানি খান বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে… সে আগুনের উষ্ণতার উপরে হাত টানটান করে। বাম কব্জি নাড়াতে এখনও কষ্ট হয় দেখে সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তার কনুইয়ের কাছের ক্ষতস্থান দ্রুত আর সুন্দরভাবে সেরে উঠছে- পুরোটাই তার হেকিমের কৃতিত্ব- ক্ষতটা গম্ভীর হবার কারণে এর চারপাশের মাংসপেশী এখনও আড়ষ্ট হয়ে আছে। কব্জি সঞ্চালনে নমনীয়তা হ্রাস পাওয়ায় সে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠে; এই হাতে সে খঞ্জর ধরে এবং তার কাছে সেটা খুবই গুরুত্ববহ।

সেই রাতে সাইবানি খান বাবরের স্বপ্নে হানা দিলে সে সারা রাত প্রায় নিদ্রাহীন কাটায়। পরদিন খুব ভোরে দিনের আলো বাবরের রাজকীয় তাঁবুর চামড়ার অভ্যন্তরভাগ মৃদু আলোকিত করে তুললে তখনও সে অস্থিরভাবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। এমন সময় অস্থায়ী ছাউনির সীমারেখার কাছ থেকে ভেসে আসা উত্তেজিত কণ্ঠের চিৎকার আর হট্টগোলের শব্দে সে সজাগ হয়ে উঠে। গায়ের উপর থেকে এক ঝটকায় কম্বল সরিয়ে ফেলে সে লাফিয়ে দাঁড়ায় এবং তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বের হয়ে আসে।

 “কিসের এতো আওয়াজ…” সে তাঁবুর বাইরে প্রহরারত এক নিরাপত্তা রক্ষীকে ব্যাপারটা দেখতে আদেশ দেয়। সম্ভবত কিছুই না- ভেড়া বা ছাগলের মালিকানা নিয়ে মামূলি ঝগড়া। গতকালই সে পাঁচজন উপজাতীয় লোককে- দু’জন ঘিলজাইস, বাকী তিনজন পাসাইস- চাবকাতে আদেশ দিয়েছে। কিন্তু আজকেরটা অন্যকিছু। তাঁবুর সারির ভিতর দিয়ে প্রায় দৌড়ে ফিরে আসা প্রহরীর বিস্মিত অভিব্যক্তি দেখে বাবর বুঝতে পারে।

“সুলতান, বিশাল বহর নিয়ে…এক দূত এসেছে।”

“কোথা থেকে?”

“সুলতান, পারস্য, স্বয়ং শাহের তরফ থেকে…”

“তাকে আমার তাঁবুতে নিয়ে এসো।”

দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে বাবর পোশাক পরে নেয়। কারুকাজ করা কাঠের পাদানির উপরে রাখা একটা ছোট চামড়া দিয়ে মোড়ানো সিন্দুক খুলে ভেতর থেকে একটা পাথরখচিত মালা গলায় দেয়। আর তৈমূরের সোনার ভারী আংটিটা আঙ্গুলে পরে। তার গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি কিন্তু এখন আর সেটার কিছু করা সম্ভব না। যাকগে, সে অভিযানে বের হওয়া এক যোদ্ধা- সে যে অবস্থায় আছে। পারস্যের দূতকে তাকে সেই অবস্থায় মেনে নিতে হবে…

 পাঁচ মিনিট পরে, বাবরের দেহরক্ষীর দল রাজদূত আর তার চারজন পরিচারককে পথ দেখিয়ে তাঁবুর ভেতরে নিয়ে আসে। বাবর মুখ তুলে তাকিয়ে মাখন রঙের আলখাল্লা পরিহিত বছর চল্লিশেক বয়সের কালো চাপদাড়ির একজন লোককে দেখে। মাথায় উঁচু করে বাঁধা বেগুনী মখমলের পাগড়িতে সারসের সাদা একটা পালক নীলকান্তমণির কবচ দিয়ে আটকানো থাকায় তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে আরো লম্বা মনে হয়। তার চার পরিচারকের পরণে লালচে বেগুনী রঙের জোব্বা এবং তাদের প্রভুর মতো মাথায় উঁচু পাগড়ি। একজন সোনার দড়ি দিয়ে বাঁধা বেগুনী মখমলের একটা বড় থলে ধরে রয়েছে।

রাজদূত সাবলীল ভঙ্গিতে মাথা নত করে সম্ভাষণ জানায়। “আমি পৃথিবীর অধিশ্বর, পারস্যের মহান শাহ্ ইসমাইলের শুভেচ্ছা বাণী আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। তিনি আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন।”

বাবর তার মাথা সামান্য কাত করে। “আমি কৃতজ্ঞ এবং আল্লাহতালা যেনো তাকেও দীর্ঘায়ু দান করেন।”

 “সুলতান, আপনাকে খুঁজে বের করতেই আমাদের অনেক দেরি হয়েছে।”

 বাবর অপেক্ষা করে। পশ্চিমে এতো দূরে থেকে শাহ তার কাছে কি চায়?

“আমার প্রভু আপনার কাবুল ত্যাগ করে অভিযানে প্রবৃত্ত হবার কারণ জানেন। উজবেক বর্বরগুলো তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের সীমান্ত আক্রমণ করার স্পর্ধা। দেখিয়ে তাকেও ক্রুদ্ধ করে তুলেছে। সাইবানি খান ঔদ্ধত্যপনার চরমে পৌঁছে ছয় সপ্তাহ আগে হিরাত থেকে বের হয়ে এসে আমার প্রভুর ব্যবহারের জন্য আগত মালামালের একটা কাফেলাকে ইয়াজদ শহরের কাছে আক্রমণ করে। শাহ্ ইসমাইল তার মালপত্র ফেরত চাইলে, ক্রমাগত বিজয়ে উন্মাদ উজবেক নেতা তাকে একটা লাঠি আর ভিক্ষাপাত্র পাঠিয়ে দেয়। ভাবটা এমন যেনো আমাদের শাহ একজন ভিক্ষুক। শাহ ইসমাইল প্রত্যুত্তরে কিছু তুলা আর একটা চরকার সাথে একটা বার্তা পাঠান, যার বক্তব্য ছিল সাইবানি খান একজন ভেড়া-চোর। আর তার চেয়ে শ্রেষ্ঠদের অপমান না করে তার উচিত চরকা দিয়ে সূতা কাটা। কিন্তু উজবেকদের অজান্তে, আমার প্রভু এই বার্তা পাঠাবার সাথে সাথেই একদল সৈন্য পাঠান তাকে আরো একটা বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য: মুখে ফেনা উঠা অবস্থায় বুনো কুকুর যখন উন্মাদ অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়, তখন সেটার একটাই সমাধান আছে। কুকুরটাকে তখন মেরে ফেলতে হয়। আমার প্রভু, কার্যত যার সৈন্য সংখ্যা অগণিত, বুনো কুকুরটার বিহিত করেছেন আর তিনি সেটা আপনাকে জানাতে চান।”

“সাইবানি খান মৃত?”

 “হ্যাঁ, সুলতান। হিরাত ফিরে আসবার সময়ে তার মূল বাহিনীকে পারস্যের সতের হাজার অশ্বারোহী আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।”

 বাবরের মনে চিন্তার ঝড় বয়ে যায়। কথাটা যদি সত্যি হয়…সে দূতের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। যার কালো বড় বড় চোখ তাকে আয়েশার গোত্র, মাঙ্গলিঘদের কথা মনে করিয়ে দেয়।

 ‘সুলতান।” লোকটা মাথা নত করে, কিন্তু বোঝা যায় আরও গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু সে বলতে চায়। আমার প্রভু এই উপহারটা আপনাকে পৌঁছে দিতে বলেছেন।” সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচারকের হাত থেকে বেগুনী মখমলের থলেটা নিয়ে সেটার ভেতর থেকে সোনা দিয়ে মোড়ানো একটা ডিম্বাকৃতি বস্তু বের করে আনে। “আমার প্রভু যতোটা নিখুঁতভাবে এটাকে কারুকার্যখচিত করতে চেয়েছিলেন সময়াভাবে সেটা করতে পারেননি। কিন্তু আপনার কাছে আশা করি উপহারটা গ্রহণযোগ্য বলে। মনে হবে।” সে দু’হাতে যত্ন করে ধরে জিনিসটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে।

বাবর আগ্রহের সাথে সেটা পরখ করে। জিনিসটাকে দেখতে একটা বিশাল, গোলাকার পানপাত্রের মতো মনে হয়। মসৃণ, চকচকে বাইরের দিকটা দেখে মনে হয় যেন গলিত সোনায় সেটা ডোবানো হয়েছিলো এবং নিচের দিকে চারটা ছোট ছোট সোনার পায়া রয়েছে যার উপরে পাত্রটা অবস্থান করতে পারে। পাত্রের ভেতরটা ম্লান ধূসর বর্ণের এবং বাবর ভেতরটা আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে- শক্ত। সম্ভবত শিং দিয়ে প্রস্তুত। না, শিংএর উষ্ণতা আর পেলবতা নেই পাত্রটার। হাড়ের তৈরি…বাবর আবার খেয়াল করে এর আকৃতি আর আকার দেখে…মানুষের খুলির মত বড়…

“হ্যাঁ, সুলতান। সাইবানি খানের খুলিই এটা। সিদ্ধ করে মাংস ছাড়িয়ে নিয়ে পানপাত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। খুলির চামড়াটাও নষ্ট করা হয়নি। আমার প্রভু সেটার ভিতরে খড় ভরে সেটা তার মিত্র অটোমান তুরস্কের সুলতান বায়েজিদকে শুভেচ্ছা স্বরূপ পাঠিয়েছেন।”

বাবরের নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তার চরম শত্রু মারা গেছে এবং সে তার খুলি নিজের দু’হাতের মুঠোয় ধরে রয়েছে। বাবর আবার চোখ নামিয়ে পাত্রটার দিকে তাকায়। কিন্তু এইবার তার উল্লাস কিছুটা ম্লান হয়ে পড়ে। সে নিজ হাতে সাইবানি খানকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। একেবারে কাছে থেকে কখনও দেখেনি যে চোখ, সেই শীতল চোখে ভয়ের রেশ জাগিয়ে তুলে হাতের খঞ্জর বা তরবারি তার উদরে আমূল বিদ্ধ করতে করতে খানজাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলো। তার বদলে, অনেক শক্তিশালী, অনেক ধনবান এক শাসক সমস্যাটার সমাধান করেছেন…।

“আমি ইসমাইল খানের কাছে উপহারটার জন্য…কৃতজ্ঞ।”

“আমার প্রভু আপনার জন্য আরো কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। বাইরে সেগুলো রাখা আছে। আপনি যদি আমাকে অনুগ্রহ করে অনুমতি দেন আমি তাহলে আপনাকে দেখাতে পারি।”

 “চমৎকার, অনুমতি দিলাম।”

বাবরের দেহরক্ষী বাহিনী অস্ত্র প্রস্তুত রাখো, যদি পারসিক দূতের অন্য কোনো মতলব থাকে সেটা সামলাতে সতর্ক। দুপাশে সরে গিয়ে তাদের তাঁবুর বাইরে বের হয়ে আসবার পথ করে দেয়। তাঁবু থেকে তারা বের হয়ে আসলে, পারসিক দূতের আগমন সম্বন্ধে তখনও যারা জানে না-তাদের হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙে প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সারতে দেখা যায়। অস্থায়ী ছাউনির কয়েকশ গজ দূরে, ওক গাছের একটা জটলার মাঝে পারসিক রাজদূতের বাকি লোকেরা অপেক্ষা করছে চমৎকার পোশাক আর অস্ত্রে সজ্জিত সবাই। তাদের পা বাঁধা ঘোড়ার পাল হয় ঘাস খাচ্ছে, বা কাছের স্রোতস্বিনী থেকে পানি পান করছে। অবশ্য, একটা ঘোড়া চকচকে কালো রঙের শক্তিশালী উঁচু একটা স্ট্যালিয়ন- দুই সহিসের মাঝে দাঁড়িয়ে অস্থির ভঙ্গিতে ছটফট করছে, বেচারারা বহু কষ্টে নাক ফুলিয়ে মাথা নাড়তে থাকা আজদাহাটা সামলে রেখেছে। বাবর এতো সুন্দর ঘোড়া আগে কখনও দেখেনি। “সোহরাব, আমার প্রভুর অশ্বশালার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রজনন-স্ট্যালিয়ন, আপনাকে আর কাবুলের প্রজনন-ঘুড়ির জন্য তার একটা উপহার।”

“শাহকে তার উদারতার জন্য আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাবেন।” বাবর বিভ্রান্ত বোধ করে। সাইবানি খানের করোটি পাঠাবার কারণ সে না হয় বুঝতে পারে। কিন্তু শাহ এতো কষ্ট করে তাকে কেন এসব পাঠালেন? তিনি তার কাছে কি চান? পারস্য কেবল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্যই না, সেখানকার সংস্কৃতির ধারা, কবি আর শিল্পীদের প্রয়াস সবাই কদর করে। সমরকন্দ বা ফারগানা এর সীমান্ত থেকে এতোটাই দূরে অবস্থিত ছিল যে, এর শাসকদের ভিতরে কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সম্ভব ছিলো না। কিন্তু বাবর এখন কাবুলে আর দুটো স্থান পরস্পরের প্রায় প্রতিবেশী। শাহ্ ইসমাইল একজন শক্তিশালী নতুন নৃপতি। যিনি কয়েক বছর আগে পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যের উৎখাত করে নিজের সাম্রাজ্য স্থাপন। করেছেন। একজন ধার্মিক মুসলিম, তিনি তার প্রজাদের উপরে শিয়া ধর্মমত জোর করে চাপিয়ে দিয়েছেন। শিয়াদের কেউ কেউ খারেজী বলে থাকে। কারণ শিয়ারা বিশ্বাস করে বেশিরভাগ মুসলমান এমনকি বাবর নিজেও যারা সুন্নী মতাবলম্বী, যার ঘোর বিরোধী যে হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী তার চাচাতো ভাই আর জামাতা হয়রত আলী (রাঃ)…কিন্তু এসব উপহারের সাথে শাহ্’র উদ্দেশ্যের প্রাসঙ্গিকতা সে বুঝতে পারে না… বাবর নিজেকে কল্পনার মোহাবিষ্টতা থেকে বের করে আনে।

রাজদূত প্রায় রঙ্গময় একটা ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এবং এটাও আমার প্রভুর তরফ থেকে একটা উপহার।” বাবর সোহরাবের পেছনে একটা বিশাল গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পায়। ছয়টা দুধসাদা ষাড়ের একটা দল গাড়িটা টেনে এনেছে। গাড়িটার চারপাশে উজ্জ্বল হলুদ রঙের পর্দা দেয়া রয়েছে, যার উজ্জ্বলতা ফারগানার কথা মনে করিয়ে দেয়। ফারগানা…

বাবর মন্থর পায়ে গরুর গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সহসা অজানা আশঙ্কায় তার শ্বাসপ্রশ্বাসের বেগ খাপছাড়া হয়ে উঠেছে। বাতাস শীতল তবুও সে টের পায় কুলকুল করে ঘামছে। সে জানে গাড়িতে কে আছে- বা আশা করে তার ধারণাই সত্যি- কিন্তু তার সাতাশ বছরের জীবনে সে কখনও এমন আতঙ্কিত বোধ করেনি। গাড়িটার ভক্তিভরে নতজানু হয়ে থাকা চালকদের কাছে পৌঁছে বাবর থমকে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সে পর্দার বাঁধন খোলার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপরে সে আবার থমকে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দিকে তাকায় তার নিজের লোকেরা, পারস্যের দূতের লোকেরা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“পেছনে সরে যাও সবাই।” সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দেয়। সবাই বেশ কয়েক পা পেছনে সরে না যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। তারপরে পর্দার বাঁধন সরিয়ে সে ভেতরে উঁকি দেয়। ছইয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে একটা ভারী কালো ঘোমটার আড়ালে এক রমণী বসে আছে। সূর্যের আলো এসে তার উপরে পড়তে নেকাবের আড়ালে থাকা রমণী যেনো কেঁপে উঠে। “খানজাদা…?” বাবর অস্ফুট কন্ঠে কোনোমতে বলে।

 সে লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পর্দা টেনে দেয়। পাতলা রেশমের আবরণ চুঁইয়ে প্রবেশ করা আধোআলোতে সে দেখে মেয়েটা তার দিকে সামান্য এগিয়ে এসেছে। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে বাবর হাত বাড়িয়ে নেকাবটা ধরে এক ঝটকায় সেটা সরিয়ে দেয়। খানজাদার বাদামী চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে…

*

পনের মিনিট পরে বাবর গাড়ির ভেতর থেকে আবার বের হয়ে আসে। গরুর গাড়ির ছইয়ের আড়াল থাকলেও, এতোগুলো উৎসুক দৃষ্টির সামনে এটা সুখ-দুঃখের আলাপ করার সময় না। বাবর অবশ্য জানেও না যে সে সেটা পারবে কিনা- পুরো ব্যাপারটাই এতো সহসা এতো অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছে যে সে এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। সে রাজদূতকে নিজের কাছে ডেকে পাঠায়। “আপনার প্রভু আমার একটা বিরাট উপকার করেছেন।” সে আপাত নির্বিকার কণ্ঠে বলে।

“আমরা আপনার বোনের সাথে একজন শাহজাদীর মতোই আচরণ করেছি। দু’জন পরিচারিকা পুরোটা ভ্রমণে তাকে সঙ্গ দিয়েছে এবং আপনি চাইলে তারা তার সাথেই থাকবে।”

বাবর সম্মতি জানায়। “আপনি আমাদের সম্মানিত মেহমান। আমি আমাদের ছাউনির কেন্দ্রে আমার তাঁবুর পাশেই আপনার আর আপনার লোকদের জন্য তাঁবু টাঙাবার আদেশ দিচ্ছি।”

 শাহের সৌজন্যের কারণে বাবর সাথে সাথে খানজাদার সাথে একাকী সময় না কাটিয়ে পারসিক মেহমানদের মেজবানিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার বোন আর পারসিক মেহমানদের জন্য বাসস্থানের বন্দোবস্ত হতেই সে দশটা চামড়ার তাবু দিয়ে একটা বড় শিবির তৈরি করে। সেটার মেঝেতে ভেড়ার চামড়া বিছিয়ে দিতে বলে। যেখানে সে অতিথিদের উদ্দেশ্যে ভোজসভার আয়োজন করতে পারবে। রুচিশীল পারসিকদের চোখে তার আয়োজন নিশ্চিতভাবেই দরিদ্র প্রতিবেশীর আয়োজন বলে মনে হবে। কিন্তু পুরু গালিচা, কারুকার্যময় বাসনকোসন আর ভারী পর্দার অভাব সে তাদের অভিযানের সময় দখল করা নধর ভেড়ার মাংস, আর কড়া ওয়াইনের ব্যারেল দিয়ে ভালই পুষিয়ে দেবে।

 ভোজসভা আরম্ভ হবার দু’ঘণ্টা পরে বাবর নিজেকে বাহবা দেয়। রাজদূত, ডালিমের মতো লাল গাল আর চকচক করতে থাকা চোখ বলে দেয় বাবাজির হয়ে গেছে। তার কালো দাড়ির আড়াল থেকে বিড়বিড় করে অনর্গল দ্বিপদী শের বলে চলেছে। শীঘ্রই তার মাথা ঝুঁকে আসতে থাকে, কালো চোখ বন্ধ হয়ে যায় এবং একটা সময়ে সে যে গালিচার উপরে বসে ছিলো সেখানেই গড়িয়ে পড়ে।

পুরো শিবিরে অনেক রাত অব্দি উৎসবের আমেজ বিরাজ করবে। সবার কাছেই উজবেকদের পরাজয় আর তাদের নেতা সাইবানি খানের মৃত্যু একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে এনেছে। উজবেকদের প্রতি সাধারণ বিদ্বেষ অনেক বিরূপভাবাপন্ন গোত্রকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু বাবর অবশেষে একটা বিষাক্ত শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাবর তার পেছনে সমবেত হওয়া রক্ষীদলকে হাতের ইশারায় নিরস্ত করে। সে মত্ত মাতাল লোকদের এড়িয়ে আর তাদের সাথে আগুনের পাশে যোগ দেবার উদাত্ত আহবানে কান না দিয়ে শিবিরের মাঝ দিয়ে দৌড়ে যায়।

তার অস্থায়ী শিবিরের একটা নির্জন স্থানে খানজাদার জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ভেতরে প্রবেশ করে সে তাকে একাকী একটা নিচু টেবিলের সামনে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে প্রদীপের আলোয় নিমগ্ন চিত্তে কিছু একটা লিখতে দেখে। তাকে ভেতরে দেখামাত্র লেখা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ায়। প্রদীপের কাঁপতে থাকা আলোয় নয় বছর আগের সেই তরুণীর মতোই তাকে মনে হয়। কিন্তু কাছে এগিয়ে আসতে সে তার মুখে বলিরেখার চিহ্ন দেখতে পায়, যার কথা সে স্মরণ করতে পারে না। আর তার ঠোঁটের ডান পাশ থেকে ডান কানের লতি পর্যন্ত উঠে যাওয়া সাদা ক্ষতচিহ্নটাও সে আগে খেয়াল করেনি।

 “আমি আমাদের আম্মিজানের কাছে একটা চিঠি লিখছিলাম…এতগুলো বছরে এই প্রথম আমি তার কাছে চিঠি লিখতে পারছি। এসো আমার পাশে এসে বসো…”

 “খানজাদা…” সে কতটা অনুতপ্ত বলার জন্য তার বুকটা ফেটে যেতে চায়। এতোগুলো বছর সে যখন অসহায় বন্দির জীবনযাপন করেছে তখনকার তিক্ত অনুভূতির কথা, নিজের অক্ষমতার কারণে অনুভূত অপরাধবোধের কথা সে বলতে চায়…কিন্তু এখন শেষ পর্যন্ত যখন সুযোগ পেয়েছে মনের ভার লাঘব করার, তখন সে কিছুই বলতে পারে না। খানজাদা হাত বাড়িয়ে তার মুখে আলতো করে বুলিয়ে। দিতে সে নিজেকে যেনো ফিরে পায়। “আমি তোমার যথাযোগ্য যত্ন নিতে পারিনি। আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক আর উদ্ধত ছিলাম…নিজের মাথা খাটানো আমার উচিত ছিল…আমি তোমার কাছে অপরাধী যে বর্বরটার হাতে আমি তোমাকে তুলে। দিয়েছিলোম…”

“তোমার কিছুই করার ছিলো না। সেটাই ছিলো একমাত্র পথ নতুবা সেখানে সমরকন্দের দেয়ালের সামনে সে আমাদের সবাইকে হত্যা করতো। আমার সবচেয়ে বড় ভয় ছিলো যে, তুমি হয়তো তাই করবে আবেগের বশবর্তী হয়ে, শোচনীয় কিছু একটা করে বসবে…”

“আমার সেটাই করা উচিত ছিলো। তাহলে অন্তত আমি নিজের সম্মান রক্ষা করতে পারতাম।”

“না- তোমার দায়িত্ব ছিল বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা…অপেক্ষা করা…”

 “তুমি ঠিক আমাদের নানীজানের মতো কথা বলছো।”

 খানজাদার চোখ অশ্রুতে টলটল করতে থাকে। খানজাদা বাবরকে প্রথম সুযোগেই। তাদের আম্মিজান আর নানীজানের কথা জিজ্ঞেস করেছিলো এবং বাবরকে বলতে হয়েছে যে তাদের নানীজান আর ইহজগতে নেই। “আমার কথা যদি তার মতো শোনায়, তবে আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করবো। এই পৃথিবীটার রীতিনীতি তিনি ভালোই বুঝতেন- আমরা যেমনটা পছন্দ করি ঠিক সেভাবে না এবং তিনিই শিখিয়েছেন সবাই আমাদের কাছে কেমন আচরণ প্রত্যাশা করে।”

“আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের যদি অন্য কোনো বংশে জন্ম হত…”

 “মোটেই না। তুমি যদি আবার পছন্দ করার সুযোগ দেয়াও হয়, তুমি তাহলেও অন্য কোনো কিছুই পছন্দ করবে না- তুমি নিজের মনে সেটা খুব ভালো করেই জানো…”

খানজাদার মুখটা আবেগে কেঁপে উঠে।

বাবর হাত বাড়িয়ে বোনের গালের সাদা ক্ষতচিহ্নটা স্পর্শ করতে সেটা তার ত্বকের উপরে ফুলে উঠে। “কিভাবে হয়েছিলো? আমাকে কি বলবে…?”

 “সে ছিলো একটা অদ্ভুত লোক। প্রচণ্ড খেয়ালী, অনেক সময় খামোখাই নিষ্ঠুর আচরণ করতো…তার আচরণ মোটেই…মার্জিত ছিলো বলা যাবে না, আর আমাকে আমার পক্ষে অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য করতো…আমাকে অপদস্ত করতে, সে বলতো, সে চায় আমি যাতে ভুলে যাই যে আমি তৈমূরের বংশের একজন শাহজাদী। কেবল মনে রাখি যে আমি তার খেয়ালখুশির কাছে নতজানু একজন রমণী…আ-আমি তোমাকে সেসব কথা বলতে পারবো না। কিন্তু আমি খুশি যে সব পর্ব শেষ হয়েছে।” তার কণ্ঠস্বর কাঁপতে থাকে। কিন্তু আমি তার হারেমের অনেক মেয়েদের ভিতরে কেবল একজন ছিলাম। আর আমি ভাগ্যবান যে, সে আমাকে তার স্ত্রীদের একজন করেছিলো। আমাদের সবারই নির্দিষ্ট মর্যাদা ছিলো তার সব স্ত্রীই ছিলো সম্ভ্রান্ত বংশের…শোবার ঘরে সে আমাদের সাথে যতো নিষ্ঠুর আচরণ করুক না কেন ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার, ভালো খাবার আর পরিচারিকার কোনো অভাব আমাদের ছিলো না। আমরা ছিলাম তার ক্ষমতা আর বিজয়ের স্মারক…অভিযানে যাবার সময়ে সে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতো না বরং নিরাপদ স্থানে আমাদের রেখে যেতো। কেউ যদি আমাদের বন্দি করে অপমানিত করে তাহলে সেও অপমানিত হবে। শাহের লোকেরা সে কারণেই আমাকে হিরাতে খুঁজে পেয়েছিলো…”

“তার উপপত্নির দল…তাদের সংখ্যা কয়েক’শ হবে…তারা এতটা ভাগ্যবান ছিলো না। অভিযানে যাবার সময়ে সে তাদের ভেতর থেকে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে যেতো রাতের বেলা শিবিরে তার সামনে নাচতে আর যুদ্ধে যারা পারদর্শীতা দেখাতো তাদের মনোরঞ্জনের জন্য। কেউ যদি তাকে অসন্তুষ্ট করতো তবে সে সাথে সাথে তাকে হত্যা করতো। একবার এক অভিযানের সময়ে একটা মেয়ে রাতের বেলা নাচতে গিয়ে হোঁচট খেলে সে তাকে সূর্যের নিচে বালিতে বোগল পর্যন্ত পুতে রেখে দিয়েছিলো। পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি। সবাই বলে দু’দিন পরে তার বাহিনী শিবির গুটিয়ে চলে যাবার সময়েও মেয়েটা বেঁচে ছিলো। ঠোঁট আর গায়ের ত্বক অবশ্য কালো হয়ে খসে খসে পড়ছিলো…সাইবানি খানের কাছে এসব কিছুই না।”

খানজাদার শান্ত, আবেগহীন কণ্ঠস্বর- সেখানে কোন ক্রোধ বা তিক্ততার ছোঁয়া নেই- বাবরকে অভিভূত করে। সে কোথা থেকে নিজের এই বিপর্যয় মেনে নেবার শক্তি পেয়েছে।

 “আমি বুঝতে পারছি না…” সে কথা শুরু করে কিন্তু খানজাদা নিজের ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ করতে বলে। যেনো বাবর এখনও তার সেই আদরের ছোট ভাইটাই রয়েছে।

 “তোমার যেমন কাজ ছিলো ধৈর্য ধারণ করা। আমার দায়িত্ব ছিলো কোনোমতে বেঁচে থাকা। আর আমি ঠিক সেটাই করেছি। আমি নিজের অনুভূতি আর ভাবনা সব লুকিয়ে রাখতাম। আমি কখনও প্রতিবাদ করতাম না। সবসময়ে আদেশ পালন করতাম- এমনকি কখনও কখনও দায়িত্ববান। মাঝে মাঝে তার প্রতি আমার করুণা হতো। তার ভেতরে কোনো সুখ, কোনো সন্তুষ্টি কাজ করতো না। কেবল চারপাশের পৃথিবীর প্রতি একটা অদম্য প্রতিশোধস্পৃহা যা তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে বলে সে মনে করতো…”

 “কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই আমাদের পরিবারকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে এমন একটা লোকের সান্নিধ্যে সবসময়ে আতঙ্কিত থাকতে?”

 “কখনও কখনও, অবশ্যই। তার মর্জিমতো চলা ছিলো এক কথায় অসম্ভব। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার কাছ থেকে নিজের কোনো ক্ষতির শঙ্কা আমার কমে আসে…”

 “তাহলে কে, কার কাছ থেকে…?”

খানজাদা চোখ নামিয়ে নিজের মেহেদী রাঙানো মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাকায়। সে যখন বাচ্চা একটা মেয়ে, তখনও সে হাত আর পায়ে মেহেদী দিতে পছন্দ করতো। “অন্য মেয়েদের। সাইবানি খান যদিও ছিলো লাগামহীন নিষ্ঠুর, কিন্তু তারপরেও ঈর্ষা কাজ করতো। সে ছিল সুদর্শন, ক্ষমতাবান। যারা তাকে প্রীত করতে পারতো সে তাদের প্রতি উদার আচরণ করতো। মেয়েরা তার মনোযোগ পাবার জন্য মরিয়া থাকতো…একজন কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে ঈর্ষা করতো…”

 “কে?”

“সমরকন্দের গ্রান্ড উজিরের কন্যা আমাদের চাচাতো ভাই মাহমুদের স্ত্রী হবার জন্য যে তরুণীকে তুমি পাঠিয়েছিলে। সাইবানি খান মাহমুদকে হত্যা করার পরে তাকে সমরকন্দ নিয়ে আসে একজন উপপত্নী হিসাবে। সে চেয়েছিল তার স্ত্রী হতে এবং আমি তার স্ত্রী ছিলাম বলে আমাকে হিংসা করতো। কিন্তু সে আমাকে হিংসা করতো কারণ তুমি তার বাবাকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলে। সাইবানি খান আমাকে বন্দি করার ছয় মাস পরে সে আমাকে ছুরিকাহত করতে চেষ্টা করে…সে আমার চোখে আঘাত করতে চেয়েছিলো কিন্তু হেরেমের প্রহরী সময়মতো দেখে ফেলায় তার নিশানা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তারপরেও তার খঞ্জরের ফলা আমার মুখে ঠিকই আঁচড় কাটে।” খানজাদা আলতো করে ক্ষতস্থান স্পর্শ করে।

বাবর কল্পনায় ছিপছিপে, ক্রুদ্ধ চোখের এক মেয়েকে নিজের অপদার্থ বাবার প্রাণ রক্ষার জন্য কাকুতি মিনতি করতে দেখে। “তার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো?”

 “সাইবানি খান সমরকন্দের কোক সরাইয়ের ভূগর্ভস্থ কক্ষে তাকে জীবন্ত সমাধিস্ত করেছে। সে বলতে ভালবাসতো যে সেই মানুষের জীবন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রাতা। সে বলেছিলো উজির কন্যার ধৃষ্টতার জন্য সে তাকে শাস্তি দিয়েছে…”।

 রাত ক্রমশ গম্ভীর হতে থাকে এবং খানজাদা তার অগ্নিপরীক্ষার কথা ধীরে ধীরে বলতে থাকলে, বাবর অল্প অল্প করে বুঝতে পারে সে কিভাবে পাগল না হয়ে বেঁচে থেকেছে। ব্যাপারটা এমন যেনো সে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নিজেকে আশ্বস্ত করেছে চারপাশে অনভিপ্রেত যা কিছু ঘটছে- তার সাথে ঘটছে সে সবকিছুই অন্য কারো সাথে ঘটছে। অনেকটা আয়েশার মতো মনোভাব। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য, সে মনেপ্রাণে অন্য কোথাও নিজেকে কল্পনা করতে চেয়েছে এবং নিজের মনকে সে সেভাবেই ভাবতে শিখিয়েছে।

খানজাদার মুখের ম্লান হাসি দেখে তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। কিন্তু একই সাথে তার মানসিক শক্তি তাকে গর্বিত করে তোলে। তার নশ্বর দেহের সাথে যতোই অত্যাচার করা হোক, সেসব তার মনকে নতজানু করতে বা দমাতে পারেনি। এসান দৌলত যদি চেঙ্গিস খানের সত্যিকারের মেয়ে হয়ে থাকেন, তবে খানজাদাও তার যোগ্য উত্তরসুরী…তার অভিজ্ঞতা নিশ্চিতভাবেই ভীতিকর, কিন্তু সেসব তার অস্তি ত্বকে ধবংস করতে পারেনি। তার বয়স এখন প্রায় একত্রিশ বছর। আর জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় সে এক নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচারীর হাতের খেলার পুতুল ছিলো। কিন্তু পোষা বেজীর সাথে খুনসুঁটি করা সেই মেয়েটা কিভাবে যেনো আজও বেঁচে আছে। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতে চাইলে সে বহুকষ্টে নিজেকে প্রশমিত করে। আজ থেকে তার বোনের দুঃখের দিন শেষ….

*

“পৃথিবীর অধিশ্বর একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যা তিনি আশা করেন আপনার কাছে। গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।” উজ্জ্বল কমলা রঙের আরো জৌলুসময় একটা আলখাল্লা আজ পারস্যের রাজদূতের পরণে এবং কালো চাপদাড়ি সুন্দর করে সুগন্ধি দিয়ে আচড়ানো। মাথা ধরার কোনো লক্ষণ তার ভেতরে দেখা যায় না। যদিও বাবর খুব ভালো করেই জানে বেচারার মাথা এই মুহূর্তে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। রাজদূতের আত্ম-সংযম, মুখের আপাত পৃষ্ঠপোষকতাময় অভিব্যক্তি দেখে বাবর বুঝতে পারে প্রস্তাবটা ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে রুটির টুকরোর মতোই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে।

বাবর চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকে, অপেক্ষা করে। অবশেষে সময় হয়েছে তাকে প্রীত করতে শাহ কেন এতো কষ্ট স্বীকার করেছে সেটা জানবার।

“শাহ ইসমাইল উজবেক হানাদারদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন। তার ইচ্ছা ন্যায়সঙ্গত সুলতানরা এবার তাদের সালতানাতে ফিরে যাক, যাতে তার মহান। সাম্রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় আরো একবার শান্তি ফিরে আসে। তৈমূরের বংশের জীবিত শেষ শাহজাদা হিসাবে তিনি আপনাকে সমরকন্দের শাসনভার নিতে অনুরোধ করেছেন…”

বাবর টের পায় তার পেটের ভেতর হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠেছে। সমরকন্দ তার স্বপ্নের শহর, তৈ নূরের রাজধানী। “আপনার প্রভুর উদারতা অতুলনীয়।” সে সর্তকতার সাথে কথাটা বলে চুপ করে থাকে। তার আব্বাজানের মৃত্যুর পরে সে যদি কিছু শিখে থাকে তবে সেটা হলো ধৈর্য ধারণ করা। নিরবতা ভঙ্গ করার দায়িত্ব অন্যরা পালন করুক…

রাজদূত একটু কেশে উঠে গলা পরিষ্কার করে। বাবর ভাবে, ব্যাটা এইবার আসল। কথাটা বলবে।

“সাইবানি খানকে যদিও পরাস্ত আর হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু সমরকন্দ এখনও তার লোকেরা দখল করে রেখেছে। আমার সুলতান আপনার বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পারস্যের সেনাবাহিনী দিয়ে সহায়তা করতে চান।”

“এবং তারপরে?”

 “আমার প্রভু আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি ভালো করেই জানেন আপনার ধমনীতে বিজয়ীর রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করেন আপনি তার অধীনস্ত একজন সামন্তপ্রভু হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন।”

 “অধীনস্ত সামন্ত প্রভু?” বাবর হতবাক হয়ে রাজদূতের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাজদূতও বাবরের অভিব্যক্তি পড়তে পেরেছে বোঝা যায়। আপনাকে কোনো রাজস্ব প্রদান করতে হবে না। আর আপনিই সমরকন্দের শাসকের দায়িত্ব পালন করবেন। আমার প্রভু কেবল আশা করেন আপনি তাকে আপনার অধিরাজ বলে মেনে নেবেন।”

 “আর সমরকন্দ বিজয় সম্পন্ন হওয়ামাত্র পারস্যের সেনাবাহিনী দেশে ফিরে যাবে?”

 “অবশ্যই।”

“এবং এর সাথে আর কোনো শর্ত নেই? “

 “না, সুলতান।”

 “আমি প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখবো এবং আপনাকে সময়মতো আমার সিদ্ধান্ত জানাবো।”

 রাজদূত আরো একবার মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে তাঁবু থেকে বের হয়ে যায়। বোঝা গেলো দেড়েলটা কেন নিভৃত কক্ষে তার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছিলো। তার প্রস্তাবটা একেবারেই নজিরবিহীন। তৈমূরের বংশের কোনো সুলতান কোনো দিন পারস্যের অধীনতা স্বীকার করেনি…কিন্তু প্রস্তাবটা একই সাথে শাহ্ আর তার নিজের জন্য সুরক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করবে। শাহের সীমান্ত বাবরের বন্ধুভাবাপন্ন। প্ৰাবর-সালতানাতের এলাকা দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে এবং বাবর তার স্বপ্নের সমরকন্দ ফিরে পাবে। সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, বাবর নিজের সেনাবাহিনী প্রস্তুতের সাথে সাথে অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করবে। ভবিষ্যত অভিযানের সুযোগের প্রতিক্ষা করবে, আর সম্ভবত যখন সময় হবে এই অধীনস্ত সামন্তরাজের ভূমিকা জলাঞ্জলি দেবে।

সে বাইরে থেকে কারো কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে এবং তার একজন প্রহরী তাঁবুর ভেতরে উঁকি দেয়। “অশ্বশালার আধিকারিক আপনার সাথে দেখা করতে চান।” বাবর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। যুদ্ধ মন্ত্রকের সভা আহ্বান করার পূর্বে বাবুরীর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করে নেয়াটা মন্দ না।

 “বেশ, দেড়েল ব্যাটা কি চায়?” বাবরের পাশে রাখা একটা কাঠের টুলে বসতে বসতে বাবুরী বলে।

“স্ট্যালিয়নটা আর খানজাদাকে ফেরত পাঠানোটা ছিলো আসলে আমাকে নরম করার একটা কৌশল। পারস্যের শাহ আমাকে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সমরকন্দ। থেকে বাকি উজবেকদের বিতাড়িত করতে এবং সেখানে আমার শাসন কায়েম। করতে তিনি আমাকে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করতে চান। কেবল তার একটা শর্ত আছে যে, তাকে আমার অধিরাজ হিসাবে মেনে নিতে হবে।”

বাবুরীর ইস্পাত নীল চোখে বিস্ময় ঝলসে উঠে। “সমরকন্দ শাহের এক্তিয়ারের ভিতরে পড়ে না…তার কি অধিকার আছে? আর কিভাবেই বা তিনি আপনাকে আজ্ঞাবাহক সামন্তরাজ হিসাবে আশা করেন?”

“তিনি পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী নৃপতি। তিনি সাইবানি খানের ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন…যা করতে আমাদের হয়তো আরো কয়েক বছর লাগতো…যা হয়তো আমরা কখনও সম্পন্নও করতে পারতাম না…” বাবর মৃদু কণ্ঠে বলে।

 “আপনি নিশ্চয়ই তার শর্ত মেনে নিতে চাইছেন না?”

 “ক্ষতি কি? আমি সবসময়ে সমরকন্দ নিজের করে পেতে চেয়েছি- সবকিছুর চেয়ে তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আর একবার সমরকন্দ অধিকার করতে পারলে ফারগানা অধিকার করা তখন কেবল সময়ে ব্যাপার। সাথে কাবুলের সালতানা যোগ করলে আমি নিজেই নিজের সাম্রাজ্যের ভীত স্থাপন করতে পারবো…যা আমি আমার অনাগত বংশধরদের জন্য রেখে যেতে পারবো…”।

“শালা হাড়হারামী পারসিক বানচোত তার নরম নরম কথা, মিষ্টি মিষ্টি প্রতিশ্রুতি, আর চাটুকারীতা করে আপনাকে নির্ঘাত জাদুটোনা কিছু একটা করেছে। আমরা কি এজন্যই এতো কষ্ট করেছি এতোদিন? বরফাবৃত পাহাড়ে আমাদের পথ পরিক্রমা, ক্ষুধায় পরিশ্রান্ত সেইসব দিন যখন এক টুকরো রান্না করা মাংস অমৃত বলে মনে হয়েছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করা… আমাদের রক্তক্ষরণ…আমাদের বিজয় এসব কি তবে অর্থহীন?”

 “সব কিছুর বদলে আমরা কি এখন কিছু প্রতিদান আশা করতে পারি না? বিগত বছরগুলো আমাদের যেনো ঘূর্ণিঝড়ের ভেতরে কেটেছে। আমি যখনই কোথাও থিতু হতে চেষ্টা করেছি আমাকে সেখান থেকেই বিতাড়িত হতে হয়েছে। কিন্তু আমি এখনও বেঁচে আছি- আমার ভাই মাহমুদ খানের মতো আমার চামড়া ছাড়িয়ে ঢোল বানানো হয়নি বা হিরাতে আমার পুরুষ আত্মীয়দের ন্যায় জবাই হইনি, বা ফারগানায় আমার সৎ-ভাইয়ের মতো খুন হয়ে যাইনি…আমি অনুভব করছি অবশেষে সময় হয়েছে…”।

 “তাহলে বোকার মতো কিছু করে বসবেন না। আপনার বোনের ফিরে আসার ফলে বোধগম্য কৃতজ্ঞতাবোধ যেনো আপনার বিচারবুদ্ধিকে প্রভাবিত না করে। আপনার এখন একটা সেনাবাহিনী রয়েছে- দক্ষ একটা সেনাবাহিনী। পারসিকদের পারস্যেই থাকতে বলেন। আমরা নিজেদের বাহুবলে সমরকন্দ অধিকার করতে পারবো। ফিরোজা দরোজা দিয়ে আমরা আপনার লোক হিসাবেই সমরকন্দে প্রবেশ করতে চাই অন্যের ভাড়াটে গোলাম হিসাবে না।”

“তুমি বুঝতে পারছো না…” বাবর ক্রমশ ক্রুদ্ধ হতে থাকে। বাবুরী সবসময়েই এমন একগুয়ে।

 “আমি বুঝতে পারছি না। আরেকজন তৈমূর হবার উদগ্র আকাক্ষা আপনাকে অন্ধ করে তুলেছে- নির্বোধের মতো আপনি সংক্ষিপ্ত পথে সফল হতে চাইছেন।”

“তুমি সেটা কিভাবে বলছো?”

 “কারণ আমি রাস্তা থেকে উঠে এসেছি? আপনি বোধহয় সেটাই বলতে চাইছেন?” বাবুরী উত্তেজনার বশে উঠে দাঁড়িয়ে টুলটা এক লাথিতে উল্টে ফেলেছে। আমি সে কারণেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট সবকিছু দেখতে পাচ্ছি আপনার চেয়ে- আহাম্মক কোথাকার। আপনি যদি শাহের প্রস্তাব মেনে নেন, তাহলে ব্যাপারটা হবে অনেকটা কিছু দুবৃত্তের কুপ্রস্তাবে সাড়া দিয়ে আমার কানাগলি দিয়ে এগিয়ে যাবার মতো, যারা আমাকে এর বিনিময়ে পেটভরে খেতে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে…শাহ আপনাকে যে প্রজনন স্ট্যালিয়নটা পাঠিয়েছে, আপনি নিজের অজান্তে তার শাবক উৎপাদনের ঘোটকীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছেন প্রভুর প্রতিটা আজ্ঞা পালন করে তাকে সন্তুষ্ট করতে বাধ্য…আমি কখনও এতোটা বেপরোয়া হতাম না। আপনার এমনটা করা উচিত হবে না…আপনি একবার তার প্রভাবের ভিতরে চলে আসলে সে আরো বড় কোনো শর্ত নিয়ে ফিরে আসবেই…”

“তুমি আহাম্মকের মতো কথা বলছে। আমাকে একলা থাকতে দাও।” বাবর উঠে দাঁড়ায় এবং মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। বাবুরী অন্য আর সবার মতো কেন তার পরিকল্পনায় সায় দিচ্ছে না?

 বাবুরী তার আদেশ অমান্য করে। সে চলে যাবার বদলে বাবরের কাঁধ আঁকড়ে ধরে, গনগনে চোখে, তার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। আপনি আপনার যে আব্বাজানের কথা এতো বলেন, তিনি বেঁচে থাকলে কি বলতেন? বা আপনার সেই জাদরেল নানীজান ইস্পাতের মতো তীক্ষ্ণ ছিলো যার বিচক্ষণতাবোধ? আপনাকে এতো সহজে কেনা যায় দেখে, অন্য লোকের অধীনস্ত করা যায় দেখে,– প্রভুর ইচ্ছায় পাছার কাপড় তুলে তার মর্জিমত যেকোনো কিছু করতে ইচ্ছুক… তারা মরমে মরে যেতেন।”

বাবুরীর ভাষাজ্ঞান দেখে ক্রোধে অন্ধ হয়ে বাবর নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে, একপা পেছনে সরে আসে এবং বাবুরীর অবজ্ঞাপূর্ণ মুখে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়। সে বন্ধুর নাক ভাঙার একটা ভোতা শব্দ শুনতে পায় এবং ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে।

মুহূর্তের জন্য, বাবুরী নিজের খঞ্জর আঁকড়ে ধরে আর বাবরও সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের খঞ্জরের বাঁট স্পর্শ করে। কিন্তু খঞ্জর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সে ডান হাত তুলে নিজের নাক স্পর্শ করে এবং বাবরের চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে সে তার বাম হাত দিয়ে রক্তে ভেজা জোব্বার কোমরের চারপাশে জড়ানো পরিকরের শেষপ্রান্তটা খুঁজে নেয়। সেটা খুঁজে পেতে আঁকড়ে ধরে চেষ্টা করে সেটা দিয়ে রক্তপাতের বেগ প্রশমিত করতে।

“বাবুরী…”

 মুখ থেকে পরিকরের প্রান্তটা এক পলের জন্য সরিয়ে সে বাবরের পায়ের কাছে থুতু ফেলে। তারপরে ভেড়ার চামড়া দিয়ে মোড়া মেঝেতে চুনির মতো লাল রক্তের। ফোঁটার একটা ধারা ফেলতে ফেলতে সে ঝুঁকে তাঁবুর নিচু পর্দা সরিয়ে বের হয়ে যায়।

বাবর বহুকষ্টে তাকে অনুসরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। সে একজন। সুলতান এবং বাবুরীর উচিত ছিলো সেটা মনে রাখা। তাকে আঘাত করাটা তার। উচিত হয়নি কিন্তু বাবুরীও কম যায় না…ব্যাটা একটা মাথা গরম, গাড়ল। বেল্লিকটা ঠাণ্ডা মাথায়, যুক্তি দিয়ে পুরো বিষয়টা- তারমতো- ভাবলে বুঝতে পারবে বাবর। ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে… বাবর মাথা উঁচু করে, কোনোভাবে লজ্জিত না হয়ে ফিরোজা দরোজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করবে।

 “প্রহরী!” বাবর চেঁচিয়ে উঠে ডাকে। একটা লোকের মাথা তাঁবুর পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। “আমার যুদ্ধ মন্ত্রকের সভা আহবান করো।”

*

বাবর পারস্যের রাজদূত আর তার লোকজনকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিদায় জানায়। রাজদূতের ঘোড়ার পর্যানে বাবরের দস্তখত করা একটা চিঠি রয়েছে যেখানে সে শাহের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা কবুল করেছে। আজ রাতে তার শিবিরে আরও বড় উৎসবের আয়োজন করা হবে। বাবর তার সেনাপতিদের কাছে আজ রাতে ঘোষণা করবে যে পারস্যের অতিরিক্ত সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানো মাত্র তারা উত্তর-পূর্ব দিকে সমরকন্দের দিকে রওয়ানা দেবে। সেখানের উজবেকদের বিতাড়িত করে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। তার লোকেরা আরও ধনসম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনায় চেঁচিয়ে উঠে নিজেদের সম্মতি প্রকাশ করবে। শাহের কাছে সে কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা নিয়ে তর্কে যাবার সময় এটা না। শীঘ্রই সে আবার সমরকন্দের নীল-গম্বুজঅলা প্রাসাদ আর মসজিদের প্রভু বলে স্বীকৃত হবে। বিবেচনা করবে কিভাবে তার লোকদের কাছে বিষয়টা উপস্থাপন করবে। আর তারা এসব নিয়ে খামোখা কেন বিব্রত হবে? তৈমূর বংশীয় এক শাহজাদাই তাদের শাসন করছে, কোনো বর্বর পুরুষানুক্রমিক শত্রু না। পারসিকরা তাদের বহুদূরের আবাসস্থলে ফিরে যাবে। আর সেও অফুরন্ত সময় পাবে নিজের পরবর্তী অভিযান নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার।

বাবুরী গাধাটা নিশ্চয় কোথাও একাকী নিজের আহত নাক আর অহমিকার শুশ্রূষা করছে। এখন তার নিজের ক্রোধ প্রশমিত হতে আর চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবার পরে এবং শাহের প্রতিনিধি দল বিদায় নিতে, বাবর তার বন্ধুর সাথে দেখা করে নিজেদের ভেতরকার ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলতে তৎপর হয়। বলা হয়নি এমন অনেক কথা আছে যা বলতে হবে। অনেক কিছু সে বলেছে অযথাই কঠোরভাবে… তার পরনে তখনও উজ্জ্বল সবুজ আলখাল্লা- সমরকন্দের স্মরণে সে সকালে পরিধান করেছিলো- যা পরেই সে পারস্যের প্রতিনিধি দলকে বিদায় জানিয়েছে। বাবর আনমনে অস্থায়ী শিবিরের ভিতর দিয়ে বাইসানগারের তাঁবুর দিকে হেঁটে যায় যার পাশেই বাবুরীর তাঁবু।

সে পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। মেঝেতে রক্তের দাগযুক্ত কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এবং মামুলি জিনিসপত্র যার বেশিরভাগই কাপড়চোপড় এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, যেনো কেউ তাবু ত্যাগ করার আগে সাথে কি নেবে আর নেবে না সেটা ঠিক তড়িঘড়ি করে ঠিক করেছে। তাঁবুর এককোণে একটা ভাঙা কাঠের মতো দেখতে কিছুর টুকরো পড়ে আছে। বাবর কাছে যেতে বুঝতে পারে সেটা আর কিছু না বাবুরীকে সে যেদিন, কোনো বেগী, ওস্তাদ ধনুর্ধর উপাধিতে ভূষিত করেছিলো সেদিন সে তাকে এই তীর আর সোনার কারুকাজ করা তূণ দিয়েছিলো। তীরটা ভেঙে দু’টুকরো করা এবং তূণটা তোবড়ানো, যেনো কেউ সেটা মাটিতে ফেলে তার উপরে লাফিয়েছে- কারুকাজ করা পাথরগুলো খুলে গিয়েছে। বাবর একটা পাথর মেঝে থেকে কুড়িয়ে নেয়। ছোট গোলাকার পাথরটা শীতল অনুভূত হয়।

বাবর দ্রুত তাঁবু থেকে বের হয়ে আসতে গিয়ে বাজপাখি উড়াবার সময়ে বাবুরীর ব্যবহৃত কালো চামড়ার দাস্তানায় আরেকটু হলে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়তো। বাইসানগার তাঁবুর বাইরে দু’জন প্রহরীকে কি সব নির্দেশ দিচ্ছে।

 “বাবুরী কোথায়?”

 “সুলতান, আজ সকাল থেকে আমি তাকে দেখিনি।”

 “খুঁজে দেখো তার ঘোড়া আছে কিনা?”

 বাইসানগার এক উজবেক সর্দারের কাছ থেকে বাবুরীর কেড়ে নেয়া বাদামী রঙের সুন্দর ঘোড়াটার খোঁজে লোক পাঠায়, কিন্তু বাবর ততক্ষণে উত্তর জেনে গিয়েছে। “গাধাটা চলে গেছে…”

“সুলতান?”

 “বাবুরী- সে চলে গিয়েছে। তাকে খুঁজে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার জন্য লোক পাঠান। এখনই পাঠান, এই মুহূর্তে!” বাবর এতোক্ষণে বুঝতে পারে সে চেঁচিয়ে কথা বলছে।

বাইসানগার চমকে উঠে এবং দ্রুত বাবরের কথামতো লোক পাঠাবার জন্য রওয়ানা হলে বাবর বাবুরীর তাঁবুর ভিতরে আবার প্রবেশ করে। সে ভাঙা ধনুকটা মাটি থেকে তুলে নেয়। বাইসানগারের লোকের ঘোড়া নিয়ে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোনো লাভ নেই। বাবুরী যদি হারিয়ে যেতে চায় তবে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *