তৃতীয় খণ্ড – তৃতীয় অধ্যায়: শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের গুরুভাব
ঠাকুর, ‘গুরু’ ‘বাবা’ বা ‘কর্তা’ বলিয়া সম্বোধিত হইলে বিরক্ত হইতেন। তবে গুরুভাব তাঁহাতে কিরূপে সম্ভবে
আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনমাশ্চর্যবদ্বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ॥
– গীতা, ২।২৯
ঠাকুরকে যাঁহারা দু-চারবার মাত্র দেখিয়াছেন অথবা যাঁহারা তাঁহার সহিত বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ হন নাই, উপর উপর দেখিয়াছেন মাত্র, তাঁহারা গুরুভাবে ভক্তদিগের সহিত ঠাকুরের লীলার কথা কাহারও মুখে শুনিতে পাইলে একেবারে অবাক হইয়া থাকেন। ভাবেন, ‘লোকটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথাগুলো বলছে।’ আবার যখন দেখেন অনেকে ঐ ভাবের কথা বলিতেছে তখনো মনে করেন, “এরা সব একটা মতলব করে দল পাকিয়েচে, আর শ্রীরামকৃষ্ণকে ঠাকুর করে তুলচে; তিনশ তেত্রিশ কোটির ওপর আবার একটা বাড়াতে চলেচে! কেন রে বাপু, অতগুলো ঠাকুরেও কি তোদের শানে না? যাকে ইচ্ছা, যতগুলো ইচ্ছা, ওরি ভেতর থেকে নে না – আবার একটা বাড়ানো কেন? কি আশ্চর্য এরা একবার ভাবেও না গা যে, মিথ্যা কথাগুলো ধরা পড়লে অমন পবিত্র লোকটার উপরে লোকের ভক্তি একেবারে চটে যাবে! আমরাও তো তাঁকে দেখেচি! – সকলের কাছে নিচু, নম্রভাব – একেবারে যেন মাটি, যেন সকলের চাইতে ছোট – এতটুকু অহঙ্কার নাই! তারপর একথা তো তোরাও বলিস, আর আমরাও দেখেচি যে, ‘গুরু’ কি ‘বাবা’ কি ‘কর্তা’ বলে তাঁকে কেউ ডাকলে তিনি একেবারে সইতেই পারতেন না; বলে উঠতেন, ‘ঈশ্বরই একমাত্র গুরু, পিতা ও কর্তা – আমি হীনের হীন, দাসের দাস, তোমার গায়ের একগাছি ছোট রোমের সমান – একগাছি বড়র সমানও নই!’ – বলেই হয়তো আবার তার পায়ের ধুলো তুলে নিজের মাথায় দিতেন! এমন দীনভাব কোথাও কেউ কি দেখেচে? আর সেই লোককে কিনা এরা ‘গুরু’, ‘ঠাকুর’ – যা নয় তাই বলচে, যা নয় তাই করচে!”
সর্বভূতে নারায়ণ-বুদ্ধি স্থির থাকায় ঠাকুরের দাসভাব সাধারণ
এইরূপ অনেক বাদানুবাদ চলা অসম্ভব নহে বলিয়াই আমরা ঠাকুরের গুরুভাব-সম্বন্ধে যাহা দেখিয়াছি এবং শুনিয়াছি তাহার কিছু বলিতে প্রবৃত্ত হইলাম। কারণ বাস্তবিকই ঠাকুর যখন সাধারণভাবে থাকিতেন, তখন আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্ত সর্বভূতে ঠিক ঠিক নারায়ণ-বুদ্ধি স্থির রাখিয়া মানুষের তো কথাই নাই, সকল প্রাণীরই ‘দাস আমি’ এই ভাব লইয়া থাকিতেন; বাস্তবিকই তখন তিনি আপনাকে হীনের হীন, দীনের দীন জ্ঞানে সকলের পদধূলি গ্রহণ করিতেন; এবং বাস্তবিকই সে সময় তিনি ‘গুরু’, ‘কর্তা’ বা ‘পিতা’ বলিয়া সম্বোধিত হইলে সহিতে পারিতেন না।
কিন্তু দিব্য-ভাবাবেশে তাঁহাতে গুরুভাবের লীলা নিত্য দেখা যাইত। ঠাকুরের তখনকার ব্যবহারে ভক্তদিগের কি মনে হইত
কিন্তু সাধারণ ভাবে অবস্থানের সময় ঐরূপ করিলেও ঠাকুরের গুরুভাবের অপূর্ব লীলার কথা কেমন করিয়া অস্বীকার করি? সে অদৃষ্টপূর্ব দিব্যভাবাবেশে যখন তিনি যন্ত্রস্বরূপ হইয়া কাহাকেও স্পর্শমাত্রেই সমাধি, গভীর ধ্যান বা ভগবদানন্দের অভূতপূর্ব নেশার ঝোঁকে1 নিমগ্ন করিতেন, অথবা কি এক আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তাহার মনের তমোগুণ বা মলিনতা এতটা টানিয়া লইতেন যে, সে তৎক্ষণাৎ পূর্বে যেরূপ কখনো অনুভব করে নাই, এ প্রকার একটা মনের একাগ্রতা, পবিত্রতা ও আনন্দ লাভ করিত এবং আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিয়া ঠাকুরের চরণতলে চিরকালের নিমিত্ত আত্মবিক্রয় করিত – তখন তাঁহাকে দেখিলেই মনে হইত এ ঠাকুর পূর্বের সেই দীনের দীন ঠাকুর নহেন; ইঁহাতে কি একটা ঐশ্বরিক শক্তি স্বেচ্ছায় বা লীলায় প্রকটিত হইয়া ইঁহাকে আত্মহারা করিয়া ঐরূপ করাইতেছে; ইনি বাস্তবিকই অজ্ঞানতিমিরান্ধ, ত্রিতাপে তাপিত, ভবরোগগ্রস্ত অসহায় মানবের গুরু, ত্রাতা এবং শ্রীভগবানের পরম পদের দর্শয়িতা! ভক্তেরা ঠাকুরের ঐ অবস্থাকে লক্ষ্য করিয়াই গুরু, কৃপাময়, ভগবান প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকেন। আপাতবিরুদ্ধ বলিয়া বোধ হইলেও যথার্থ দীনভাব এবং এই দিব্য ঐশ্বরিক গুরুভাব যে একত্রে একজনে অবস্থান করিতে পারে, তাহা আমরা বর্তমান যুগে শ্রীভগবান রামকৃষ্ণে যথার্থই দেখিয়াছি; এবং দেখিয়াছি বলিয়াই উহারা কেমনে একত্রে একই মনে থাকে সে বিষয়ে যাহা বুঝিয়াছি তাহাই এখন পাঠককে উপহার দিতে চেষ্টা করিতেছি।
1. বাস্তবিকই তখন অধিক পরিমাণে সিদ্ধি খাইলে যেমন নেশা হয়, তেমনি একটা নেশার ঘোর উপস্থিত হইত। কাহারও কাহারও পা-ও টলিতে দেখিয়াছি। ঠাকুরের নিজের তো কথাই ছিল না। ঐরূপ নেশার ঝোঁকে পা এমন টলিত যে, আমাদের কাহাকেও ধরিয়া তখন চলিতে হইত। লোকে মনে করিত, বিপরীত নেশা করিয়াছেন।
ভাবময় ঠাকুরের ভাবের ইতি নাই
ঐরূপ চেষ্টা করিলেও যতটুকু বুঝিয়াছি ততটুকুও ঠিক ঠিক বুঝাইতে পারিব কিনা জানি না; আর সম্যক বুঝা বা বুঝানো, লেখক ও পাঠক উভয়েরই সাধ্যাতীত; কারণ ভাবমুখে অবস্থিত ঠাকুরের ভাবের ইয়ত্তা নাই। ঠাকুর বলিতেন, “শ্রীভগবানের ‘ইতি’ নাই।” আমাদের প্রত্যক্ষ এ লোকোত্তর পুরুষেরও তদ্রূপ ভাবের ‘ইতি’ নাই।
সাধারণের বিশ্বাস ঠাকুর ভক্ত ছিলেন, জ্ঞানী ছিলেন না। ‘ভাবমুখে থাকা’ কখন ও কিরূপে সম্ভবে বুঝিলে ঐকথা আর বলা চলে না
সচরাচর লোকে ঠাকুর ‘ভাবমুখে’ থাকিতেন শুনিলেই ভাবিয়া বসে যে, তিনি জ্ঞানী ছিলেন না। ভগবদনুরাগ ও বিরহে মনে যে সুখদুঃখাদি ভাব আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহাই লইয়া সদা সর্বক্ষণ থাকিতেন। কিন্তু ‘ভাবমুখে’ থাকাটি যে কি ব্যাপার বা কিরূপ অবস্থায় উহা সম্ভব, তাহা যদি আমরা বুঝিতে পারি তবে বর্তমান বিষয়টি বুঝিতে পারিব; সেজন্য ‘ভাবমুখে থাকা’ অবস্থাটির সংক্ষেপ আলোচনা এখানে একবার আর এক প্রকারে করিয়া লওয়া যাক। পাঠক মনে মনে ভাবিয়া লউন – তিনদিনের সাধনে ঠাকুরের নির্বিকল্প সমাধি হইল।
প্র – নির্বিকল্প সমাধিটি কি?
উ – মনকে একেবারে সঙ্কল্প-বিকল্পরহিত অবস্থায় আনয়ন করা।
প্র – সঙ্কল্প-বিকল্প কাহাকে বলে?
উ – বাহ্য জগতের রূপরসাদি বিষয়সকলের জ্ঞান বা অনুভব, সুখদুঃখাদি ভাব, কল্পনা, বিচার, অনুমান প্রভৃতি মানসিক চেষ্টা এবং ইচ্ছা বা ‘এটা করিব’, ‘ওটা বুঝিব’, ‘এটা ভোগ করিব’, ‘ওটা ত্যাগ করিব’ ইত্যাদি মনের সমস্ত বৃত্তিকে।
‘আমি’-বোধাশ্রয়ে মানসিক বৃত্তিসমূহের উদয়। উহার আংশিক লোপে সবিকল্প ও পূর্ণ লোপে নির্বিকল্প সমাধি হয়। সমাধি, মূর্চ্ছা ও সুষুপ্তির প্রভেদ
প্র – বৃত্তিসকল কোন্ জিনিসটা থাকিলে তবে উঠিতে পারে?
উ – ‘আমি’ ‘আমি’ এই জ্ঞান বা বোধ। ‘আমি’-বোধ যদি চলিয়া যায় বা কিছুক্ষণের জন্য একেবারে বন্ধ হইয়া যায়, তবে সে সময়ের মতো কোন বৃত্তিই আর মনে খেলা বা রাজত্ব করিতে পারে না।
প্র – মূর্ছা বা গভীর নিদ্রাকালেও তো ‘আমি’-বোধ থাকে না – তবে কি নির্বিকল্প সমাধিটা ঐরূপ একটা কিছু?
উ – না; মূর্ছা বা সুষুপ্তিতে ‘আমি’-বোধ ভিতরে ভিতরে থাকে, তবে মস্তিষ্করূপ (brain) যে যন্ত্রটার সহায়ে মন ‘আমি’ ‘আমি’ করে সেটা কিছুক্ষণের জন্য কতকটা জড়ভাবাপন্ন হয় বা চুপ করিয়া থাকে, এই মাত্র – ভিতরে বৃত্তিসমূহ গজগজ করিতে থাকে – ঠাকুর যেমন দৃষ্টান্ত দিতেন, “পায়রাগুলো মটর খেয়ে গলা ফুলিয়ে বসে আছে বা বক-বকম্ করে আওয়াজ করছে – তুমি মনে করচ তাদের গলার ভিতরে কিছুই নাই – কিন্তু যদি গলায় হাত দিয়ে দেখ তো দেখবে মটর গজগজ করচে!”
প্র – মূর্ছা বা সুষুপ্তিতে যে ‘আমি’-বোধটা ঐরূপে থাকে তা বুঝিব কিরূপে?
উ – ফল দেখিয়া; যথা – ঐসকল সময়েও হৃদয়ের স্পন্দন, হাতের নাড়ি, রক্তসঞ্চালন প্রভৃতি বন্ধ হয় না – ঐসকল শারীরিক ক্রিয়াও ‘আমি’-বোধটাকে আশ্রয় করিয়া হয়; দ্বিতীয় কথা, মূর্ছা ও সুষুপ্তির বাহ্যিক লক্ষণ কতকটা সমাধির মতো হইলেও ঐসকল অবস্থা হইতে মানুষ যখন আবার সাধারণ বা জাগ্রত অবস্থায় আসে, তখন তাহার মনে জ্ঞান ও আনন্দের মাত্রা পূর্বের ন্যায়ই থাকে, কিছুমাত্র বাড়ে বা কমে না – কামুকের যেমন কাম তেমনি থাকে, ক্রোধীর যেমন ক্রোধ তেমনি থাকে, লোভীর লোভ সমান থাকে ইত্যাদি।
সমাধি ফল – জ্ঞান ও আনন্দের বৃদ্ধি এবং ভগবদ্দর্শন
নির্বিকল্প সমাধির অবস্থা লাভ হইলে কিন্তু ঐসকল বৃত্তি আর মাথা তুলিতে পারে না; অপূর্ব জ্ঞান ও অসীম আনন্দ আসিয়া উপস্থিত হয় এবং জগৎকারণ ভগবানের সাক্ষাৎদর্শনে মনে আর পরকাল আছে কিনা, ভগবান আছেন কিনা – এ সকল সংশয়-সন্দেহ উঠে না।
প্র – আচ্ছা বুঝিলাম – ঠাকুরের নির্বিকল্প সমাধিতে কিছুক্ষণের জন্য ‘আমি’-বোধের একেবারে লয় হইল – তাহার পর?
উ – তাহার পর, ঐরূপে ‘আমি’-বোধটার লোপ হইয়া কারণরূপিণী শ্রীশ্রীজগন্মাতার কিছুক্ষণের জন্য সাক্ষাৎ দর্শনে ঠাকুর তৃপ্ত না হইয়া সদা-সর্বক্ষণ ঐ অবস্থায় থাকিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
ঠাকুরের ছয় মাস নির্বিকল্প সমাধিতে থাকিবার কালের দর্শন ও অনুভব
প্র – সে চেষ্টার ফলে ঠাকুরের মনের কিরূপ অবস্থা হইল এবং কিরূপ লক্ষণই বা শরীরে প্রকাশিত হইল?
উ – কখনও ‘আমি’-বোধের লোপ হইয়া শরীরে মৃতব্যক্তির লক্ষণসকল প্রকাশিত হইয়া ভিতরে জগদম্বার পূর্ণ বাধামাত্রশূন্য সাক্ষাৎ দর্শন – আবার কখনও অত্যল্পমাত্র ‘আমি’-বোধ উদিত হইয়া শরীরে জীবিতের লক্ষণ একটু-আধটু প্রকাশ পাওয়া ও সত্ত্বগুণের অতিশয় আধিক্যে শুদ্ধ স্বচ্ছ পবিত্র মন-রূপ ব্যবধান বা পর্দার ভিতর দিয়া শ্রীশ্রীজগদম্বার কিঞ্চিৎ বাধাযুক্ত দর্শন! – এইরূপে কখনও ‘আমি’-বোধের লোপ, মনের বৃত্তিসকলের একেবারে লয় ও শ্রীশ্রীজগন্মাতার পূর্ণ দর্শন ও কখনও ‘আমি’-বোধের একটু উদয়; মনের বৃত্তিসকলের ঈষৎ প্রকাশ ও সঙ্গে সঙ্গে শ্রীশ্রীজগদম্বার পূর্ণ দর্শন ঈষৎ আবরিত হওয়া। এইরূপ বার বার হইতে লাগিল।
প্র – কতদিন ধরিয়া ঠাকুর ঐরূপ চেষ্টা করেন?
উ – নিরন্তর ছয়মাস কাল ধরিয়া।
‘আমি’-বোধের সম্পূর্ণ লোপে ঐ কালে তাঁহার শরীর রহিল কিরূপে
প্র – বল কি? তবে তাঁহার শরীর রহিল কিরূপে? কারণ, ছয়মাস না খাইলে তো আর মানবদেহ থাকিতে পারে না এবং তোমরা তো বল যতটা শরীরবোধ আসিলে আহারাদি কার্য করা চলে, ঠাকুরের ঐ কালে মাঝে মাঝে ‘আমি’-বোধের উদয় হইলেও ততটা কখনই আসে নাই।
উ – সত্যই ঠাকুরের শরীর থাকিত না এবং ‘শরীরটা কিছুকাল থাকুক’ এরূপ ইচ্ছার লেশমাত্রও তখন ঠাকুরের মনে ছিল না; তবে তাঁহার শরীরটা যে ছিল সে কেবল জগদম্বা ঠাকুরের শরীরটার সহায়ে তাঁহার অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ দেখাইয়া বহুজন-কল্যাণ সাধিত করিবেন বলিয়া।
জনৈক যোগী-সাধুর আগমন ও ঠাকুরের অবস্থা বুঝিয়া তাঁহাকে নিত্য জোর করিয়া আহার করাইয়া দেওয়া
প্র – তা তো বটে, কিন্তু ঐ ছয়মাস কাল জগদম্বা নিজে মূর্তিপরিগ্রহ করিয়া আসিয়া কি ঠাকুরকে জোর করিয়া আহার করাইয়া দিতেন?
উ – কতকটা সেইরূপই বটে; কারণ, ঐ সময়ে একজন সাধু কোথা হইতে আপনা-আপনি আসিয়া জোটেন, ঠাকুরের ঐরূপ মৃতকল্প অবস্থা যে যোগসাধনা বা শ্রীভগবানের সহিত একত্বানুভবের ফলে তাহা সম্যক বুঝেন এবং ঐ ছয়মাস কাল দক্ষিণেশ্বরে কালীবাটীতে থাকিয়া সময়ে সময়ে ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গে আঘাত পর্যন্ত করিয়া একটু-আধটু হুঁশ আনিতে নিত্য চেষ্টা করিতেন; আর একটু হুঁশ আসিতেছে দেখিলেই দুই-এক গ্রাস যাহা পারিতেন, খাওয়াইয়া দিতেন। একেবারে অপরিচিত জড়প্রায় মৃতকল্প একটি লোককে ঐরূপে বাঁচাইয়া রাখিতে সাধুটির এত আগ্রহ, এতটা মাথাব্যথা কেন হইয়াছিল জানি না, তবে ঐরূপ ঘটনাবলীকেই আমরা ভগবদিচ্ছায় সাধিত বলিয়া থাকি। অতএব শ্রীশ্রীজগদম্বার সাক্ষাৎ ইচ্ছা ও শক্তিতেই যে ঐ অসম্ভব সম্ভব হইয়া ঠাকুরের শরীরটা রক্ষা পাইয়াছিল ইহা ছাড়া আর কি বলিব?
শ্রীশ্রীজগদম্বার আদেশ – ‘ভাবমুখে থাক্’
প্র – আচ্ছা, বুঝিলাম, তারপর?
উ – তাহার পর, শ্রীশ্রীজগদম্বা বা শ্রীভগবান বা যে বিরাটচৈতন্য ও বিরাট-শক্তি জগদ্রূপে প্রকাশিত আছেন এবং জড় চেতন সকলের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া আপাতবিভিন্ন নামরূপে অবস্থান করিতেছেন তিনি ঠাকুরকে আদেশ করিলেন – ‘ভাবমুখে থাক’!
একমেবাদ্বিতীয়ং-বস্তুতে নির্গুণ ও সগুণভাবে স্বগত-ভেদ এবং জগদ্ব্যাপী বিরাট আমিত্ব বর্তমান। ঐ বিরাট আমিত্বই ঈশ্বর বা শ্রীশ্রীজগদম্বার আমিত্ব; এবং উহার দ্বারাই জগদ্ব্যাপার নিষ্পন্ন হয়
প্র – সেটা আবার কি?
উ – বলিতেছি, কিন্তু ঠাকুরের ঐ সময়কার কথা বুঝিতে হইলে কল্পনাসহায়ে যতদূর সম্ভব ঠাকুরের ঐ সময়ের অবস্থাটা একবার ভাবিয়া লওয়া আবশ্যক। পূর্বে বলিয়াছি, ঠাকুরের তখন কখনো ‘আমি’-জ্ঞানের লোপ এবং কখনো উহার ঈষৎ প্রকাশ হইতেছিল। যখন ‘আমি’-বোধটার ঐরূপ ঈষৎ প্রকাশ হইতেছিল তখনো ঠাকুরের নিকট জগৎটা, আমরা যেমন দেখি তেমন দেখাইতেছিল না। দেখাইতেছিল, যেন একটা বিরাট মনে নানা ভাবতরঙ্গ উঠিতেছে, ভাসিতেছে, ক্রীড়া করিতেছে, আবার লয় হইতেছে! অপর সকলের তো কথাই নাই, ঠাকুরের নিজের শরীরটা, মনটা ও আমিত্ববোধটাও ঐ বিরাট-মনের ভিতরের একটা তরঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছিল। পাশ্চাত্য জড়বাদী পণ্ডিতমূর্খের দল যে জগচ্চৈতন্য ও শক্তিকে নিজের বুদ্ধি ও বুদ্ধিপ্রসূত যন্ত্রাদিসহায়ে মাপিতে যাইয়া বলিয়া বসে ‘ওটা এক হলেও জড়’, ঠাকুর এই অবস্থায় পৌঁছাইয়া তাঁহারই সাক্ষাৎ স্বরূপ দর্শন বা অনুভব করিলেন – জীবন্ত, জাগ্রত, একমেবাদ্বিতীয়ম্, ইচ্ছা ও ক্রিয়ামাত্রেরই প্রসূতি, অনন্ত কৃপাময়ী জগজ্জননী! আর দেখিলেন – সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্, নির্গুণ ও সগুণ ভাবে আপনাতে আপনি বিভক্ত থাকায় – ইহাকেই শাস্ত্রে স্বগতভেদ বলিয়াছে – তাঁহাতে একটা আব্রহ্ম-স্তম্বপর্যন্তব্যাপী বিরাট আমিত্ব বিকশিত রহিয়াছে! শুধু তাহাই নহে, সেই বিরাট ‘আমি’টা থাকাতেই বিরাট মনে অনন্ত ভাবতরঙ্গ উঠিতেছে; আর সেই ভাবতরঙ্গই স্বল্পাধিক পরিমাণে খণ্ড খণ্ড ভাবে দেখিতে পাইয়া মানবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘আমি’গুলো উহাকেই বাহিরের জগৎ ও বহির্জগতের ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ বলিয়া ধরিতেছে ও বলা-কহা ইত্যাদি করিতেছে! ঠাকুর দেখিলেন বড় ‘আমি’টার শক্তিতেই মানবের ছোট ‘আমি’গুলো রহিয়াছে ও স্ব স্ব কার্য করিতেছে এবং বড় ‘আমি’টাকে দেখিতে-ধরিতে পাইতেছে না বলিয়াই ছোট ‘আমি’গুলো ভ্রমে পড়িয়া আপনাদিগকে স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্রিয়াশক্তিমান মনে করিতেছে। এই দৃষ্টিহীনতাকেই শাস্ত্র অবিদ্যা ও অজ্ঞান বলেন।
ঐ বিরাট আমিত্বেরই নাম ‘ভাবমুখ’, কারণ সংসারের সকল প্রকার ভাবই উহাকে আশ্রয় করিয়া উদয় হইতেছে
নির্গুণ ও সগুণের মধ্যস্থলে এইরূপে যে বিরাট ‘আমিত্ব’টা বর্তমান, উহাই ‘ভাবমুখ’ – কারণ উহা থাকাতেই বিরাট মনে অনন্ত ভাবের স্ফুরণ হইতেছে। এই বিরাট আমিই জগজ্জননীর আমিত্ব বা ঈশ্বরের আমিত্ব। এই বিরাট আমিত্বের স্বরূপ বর্ণনা করিতে যাইয়াই গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ বলিয়াছেন, অচিন্ত্যভেদাভেদস্বরূপ জ্যোতির্ঘনমূর্তি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
পূর্ণ নির্বিকল্প এবং ঈষৎ সবিকল্প বা ‘ভাবমুখ’ অবস্থায় ঠাকুরের অনুভব ও দর্শন
ঠাকুরের আমিত্ব-জ্ঞানের যখন একেবারে লোপ হইতেছিল তখন এই বিরাট আমিত্বের গণ্ডির পারে অবস্থিত জগদম্বার নির্গুণ ভাবে অবস্থান করিতেছিলেন – তখন ঐ ‘বিরাট আমি’ ও তাহার অনন্ত ভাবতরঙ্গ, যাহাকে আমরা জগৎ বলিতেছি, তাহার কিছুরই অস্তিত্ব অনুভব হইতেছিল না; আর যখন ঠাকুরের ‘আমি’-জ্ঞানের ঈষৎ উন্মেষ হইতেছিল তখন তিনি দেখিতেছিলেন, শ্রীশ্রীজগদম্বার নির্গুণভাবের সহিত সংযুক্ত এই সগুণ বিরাট ‘আমি’ ও তদন্তর্গত ভাবতরঙ্গসমূহ। অথবা নির্গুণভাবে উঠিবামাত্র সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের অনুভবে ঐ একমেবাদ্বিতীয়মের ভিতর স্বগতভেদের অস্তিত্বও লোপ হইতেছিল; আর ঐ সগুণ বিরাট আমিত্বের যখন বোধ করিতেছিলেন, তখন দেখিতেছিলেন – যিনি ব্রহ্ম তিনিই শক্তি, যে নির্গুণ সেই সগুণ, যে পুরুষ সেই প্রকৃতি, যে সাপ স্থির ছিল সেই এখন চলিতেছে, অথবা যিনিই স্বরূপে নির্গুণ তিনিই আবার লীলায় সগুণ!
‘ভাবমুখে থাক্’ – কথার অর্থ
শ্রীশ্রীজগদম্বার এই নির্গুণ-সগুণ উভয় ভাবে জড়িত স্বরূপের পূর্ণ দর্শন পাইবার পর ঠাকুর আদেশ পাইলেন ‘ভাবমুখে থাক্’ – অর্থাৎ আমিত্বের একেবারে লোপ করিয়া নির্গুণভাবে অবস্থান করিও না; কিন্তু যাহা হইতে যত প্রকার বিশ্বভাবের উৎপত্তি হইতেছে সেই বিরাট ‘আমি’ই তুমি, তাঁহার ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছা, তাঁহার কার্যই তোমার কার্য – এই ভাবটি ঠিক ঠিক সর্বদা প্রত্যক্ষ অনুভব করিয়া জীবনযাপন কর ও লোককল্যাণসাধন কর। অতএব ‘ভাবমুখে’ থাকার অর্থই হইতেছে – মনে সর্বতোভাবে, সকল সময় সকল অবস্থায় দেখা, ধারণা বা বোধ করা যে আমি সেই ‘বড় আমি’ বা ‘পাকা আমি’। ‘ভাবমুখ’ অবস্থায় পৌঁছিলে, আমি অমুকের সন্তান, অমুকের পিতা, ব্রাহ্মণ বা শূদ্র ইত্যাদি সমস্ত কথা একেবারে মন হইতে ধুইয়া-পুঁছিয়া যায় এবং ‘আমি সেই বিশ্বব্যাপী আমি’ এই কথাটি সর্বদা মনে অনুভব হয়। ঠাকুর তাই আমাদের বার বার শিক্ষা দিতেন – “ওগো, অমুকের ছেলে আমি, অমুকের বাপ আমি, ব্রাহ্মণ আমি, শূদ্র আমি, পণ্ডিত আমি, ধনী আমি – এ সব হচ্চে কাঁচা আমি; ওতে বন্ধন নিয়ে আসে। ও সব ছেড়ে মনে করবে তাঁর (ভগবানের) দাস আমি, তাঁর ভক্ত আমি, তাঁর সন্তান আমি, তাঁর অংশ আমি। এই ভাবটি মনে পাকা করে রাখবে।” অথবা বলিতেন – “ওরে, অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা ইচ্ছা তা কর!”
সাধকের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত-ভাব পর পর আসিয়া উপস্থিত হয়
পাঠক হয়তো বলিবে, ঠাকুর কি তবে ঠিক ঠিক অদ্বৈতবাদী ছিলেন না? শ্রীশ্রীজগদম্বার মধ্যে স্বগতভেদ স্বীকার করিয়া ঠাকুর যখন জগন্মাতার নির্গুণ সগুণ দুই ভাবে অবস্থান দেখিতেন, তখন তো বলিতে হইবে তিনি আচার্য শঙ্করপ্রতিষ্ঠিত অদ্বৈতবাদ, যাহাতে জগতের অস্তিত্বই স্বীকৃত হয় নাই, তাহা মানিতেন না? তাহা নহে! ঠাকুর অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও দ্বৈত সকল ভাব বা মতই মানিতেন। তবে বলিতেন, ঐ তিন প্রকার মত মানবমনের উন্নতির অবস্থানুযায়ী পর পর আসিয়া উপস্থিত হয়। এক অবস্থায় দ্বৈতভাব আসে – তখন অপর দুই ভাবই মিথ্যা বলিয়া বোধ হয়। ধর্মোন্নতির উচ্চতর সোপানে উঠিয়া অপর অবস্থায় বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ আসে – তখন নিত্য নির্গুণ বস্তু লীলায় সতত সগুণ হইয়া রহিয়াছেন, এইরূপ বোধ হয়। তখন দ্বৈতবাদ তো মিথ্যা বোধ হয়ই, আবার অদ্বৈতবাদে যে সত্য নিহিত আছে তাহাও মনে উপলব্ধি হয় না। আর মানব যখন ধর্মোন্নতির শেষ সীমায় সাধনসহায়ে উপস্থিত হয় তখন শ্রীশ্রীজগদম্বার নির্গুণরূপেই কেবলমাত্র উপলব্ধি করিয়া তাঁহাতে অদ্বৈতভাবে অবস্থান করে। তখন আমি-তুমি, জীব-জগৎ, ভক্তি-মুক্তি, পাপ-পুণ্য, ধর্মাধর্ম – সব একাকার!
মহাজ্ঞানী হনুমানের ঐ বিষয়ক কথা
এই প্রসঙ্গে ঠাকুর দাস্যভাবের উজ্জ্বল নিদর্শন মহাজ্ঞানী হনুমানের ঐ বিষয়ের উপলব্ধিটি দৃষ্টান্তস্বরূপে বলিতেন। বলিতেন – “শ্রীরামচন্দ্র কোন সময়ে নিজ দাস হনুমানকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি আমায় কি ভাবে দেখ, বা ভাবনা ও পূজা কর?’ হনুমান তদুত্তরে বলেন, ‘হে রাম, যখন আমি দেহবুদ্ধিতে থাকি অথবা আমি এই দেহটা এইরূপ অনুভব করি, তখন দেখি – তুমি প্রভু, আমি দাস; তুমি সেব্য, আমি সেবক; তুমি পূজ্য, আমি পূজক; যখন আমি মন বুদ্ধি ও আত্মাবিশিষ্ট জীবাত্মা বলিয়া আপনাকে বোধ করিতে থাকি, তখন দেখি – তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; আর যখন আমি উপাধিমাত্ররহিত শুদ্ধ আত্মা, সমাধিতে এই ভাব লইয়া থাকি, তখন দেখি – তুমিও যাহা, আমিও তাহা – তুমি আমি এক, কোনই ভেদ নাই।'”
অদ্বৈতভাব চিন্তা, কল্পনা ও বাক্যাতীত; যতক্ষণ বলা কহা আছে ততক্ষণ নিত্য ও লীলা, ঈশ্বরের উভয় ভাব লইয়া থাকিতেই হইবে
ঠাকুর বলিতেন, “যে ঠিক ঠিক অদ্বৈতবাদী সে চুপ হইয়া যায়! অদ্বৈতবাদ বলবার বিষয় নয়। বলতে-কইতে গেলেই দুটো এসে পড়ে, ভাবনা-কল্পনা যতক্ষণ ততক্ষণও ভিতরে দুটো – ততক্ষণও ঠিক অদ্বৈতজ্ঞান হয় নাই। জগতে একমাত্র ব্রহ্মবস্তু বা শ্রীশ্রীজগদম্বার নির্গুণভাবই কখনও উচ্ছিষ্ট হয় নাই।” অর্থাৎ মানবের মুখ দিয়া বাহির হয় নাই, অথবা মানব ভাষা দ্বারা উহা প্রকাশ করিতে পারে নাই। কারণ ঐ ভাব মানবের মন-বুদ্ধির অতীত; বাক্যে তাহা কেমন করিয়া বলা বা বুঝানো যাইবে? অদ্বৈতভাব সম্বন্ধে ঠাকুর সেজন্য বার বার বলিতেন, “ওরে, ওটা শেষকালের কথা।” অতএব দেখা যাইতেছে ঠাকুর বলিতেন, “যতক্ষণ ‘আমি-তুমি’ ‘বলা-কহা’ প্রভৃতি রহিয়াছে ততক্ষণ নির্গুণ-সগুণ, নিত্য ও লীলা – দুই ভাবই কার্যে মানিতে হইবে। ততক্ষণ অদ্বৈতভাব মুখে বলিলেও কার্যে, ব্যবহারে তোমাকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী থাকিতে হইবে।” ঐ সম্বন্ধে ঠাকুর আরও কতই না দৃষ্টান্ত দিতেন! বলিতেন –
ঐ বিষয়ে ঠাকুরের কয়েকটি দৃষ্টান্ত। যথা – গানের অনুলোম-বিলোম; বেল, থোড়, প্যাঁজের খোলা
“যেমন গানের অনুলোম-বিলোম – সা ঋ গা মা পা ধা নি সা করিয়া সুর তুলিয়া আবার সা নি ধা পা মা গা ঋ সা – করিয়া সুর নামানো। সমাধিতে অদ্বৈত-বোধটা অনুভব করিয়া আবার নিচে নামিয়া ‘আমি’-বোধটা লইয়া থাকা।
“যেমন বেলটা হাতে লইয়া বিচার করা যে, খোলা, বিচি, শাঁস – ইহার কোনটা বেল। প্রথম খোলাটাকে অসার বলিয়া ফেলিয়া দিলাম, বিচিগুলোকেও ঐরূপ করিলাম; আর শাঁসটুকু আলাদা করিয়া বলিলাম, এইটিই বেলের সার – এইটিই আদত বেল। তারপর আবার বিচার আসিল যে, যাহারই শাঁস তাহারই খোলা ও বিচি – খোলা, বিচি ও শাঁস সব একত্র করিয়াই বেলটা; সেই রকম নিত্য ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করিয়া তারপর বিচার – যে নিত্য সেই লীলায় জগৎ!
“যেমন থোড়খানার খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে মাঝটায় পৌঁছুলুম আর সেটাকেই সার ভাবলুম। তারপর বিচার এল – খোলেরই মাঝ, মাঝেরই খোল – দুই জড়িয়েই থোড়টা।
“যেমন প্যাঁজটা খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আর কিছুই থাকে না, সেই রকম কোনটা ‘আমি’ বিচার করে দেখতে গিয়ে শরীরটা নয়, মনটা নয়, বুদ্ধিটা নয় করে ছাড়াতে ছাড়াতে গিয়ে দেখা যায়, ‘আমি’ বলে একটা আলাদা কিছুই নাই – সবই ‘তিনি’ ‘তিনি’ ‘তিনি’ (ঈশ্বর); যেমন গঙ্গার খানিকটা জল বেড়া দিয়ে ঘিরে বলা – এটা আমার গঙ্গা!”
যাক্, এখন ও-সকল কথা, আমরা পূর্বকথার অনুসরণ করি।
ভাবমুখ – নির্গুণ হইতে কয়েকপদ নিম্নে অবস্থিত থাকিলেও ঐ অবস্থায় অদ্বৈত বস্তুর বিশেষ অনুভব থাকে। ঐ অবস্থায় কিরূপ অনুভব হয়। ঠাকুরের দৃষ্টান্ত
ভাবমুখে থাকিয়া যখন বিশ্বব্যাপী আমিত্বের ঠিক ঠিক অনুভব হইত তখন ‘এক’ হইতে ‘বহু’র বিকাশ দেখিয়া ঠাকুর শ্রীশ্রীজগদম্বার নিৰ্গুণভাব হইতে কয়েক পদ নিচে বিদ্যা-মায়ার রাজ্যে যে বিচরণ করিতেন, এ কথা আর বলিতে হইবে না। কিন্তু সে রাজ্যেও একের বিকাশ ও অনুভব এত অধিক যে, এই ব্রহ্মাণ্ডে যে যাহা করিতেছে, ভাবিতেছে, বলিতেছে, সেসকলই আমি করিতেছি, ভাবিতেছি, বলিতেছি বলিয়া ঠাকুরের ঠিক ঠিক মনে হইত! এই অবস্থার অল্প বা আভাসমাত্র অনুভবও অতি অদ্ভুত! ঠাকুর বলিয়াছিলেন, একদিন ঘাসের উপর দিয়া একজন চলিয়া যাইতেছে, আর তাঁহার বুকে বিষম আঘাত লাগিতেছে! – যেন তাঁহার বুকের উপর দিয়াই সে যাইতেছে! বাস্তবিকই তখন তাঁহার বুকে রক্ত জমিয়া কালো দাগ হইয়া তিনি বেদনায় ছটফট করিয়াছিলেন।
বিদ্যা-মায়ার রাজ্যে আরও নিম্নস্তরে নামিলে তবে ঈশ্বরের দাস, ভক্ত, সন্তান বা অংশ-‘আমি’ – এইরূপ অনুভব হয়
ঐ অবস্থা হইতে মায়ার রাজ্যের আরও নিম্নস্তরে নামিয়া যখন থাকিতেন, তখন ঠাকুরের মনে শ্রীশ্রীজগদম্বার দাস আমি, ভক্ত আমি, সন্তান আমি বা অংশ আমি – এই ভাবটি সর্বদা জাগরূক থাকিত। উহা হইতেও নিম্নে অবিদ্যা-মায়ার বা কাম ক্রোধ লোভ মোহাদির রাজত্ব। সে রাজ্য ঠাকুর যত্নপূর্বক নিরন্তর অভ্যাস সহকারে ত্যাগ করায় তাঁহার মন তথায় আর কখনো নামিত না বা শ্রীশ্রীজগদম্বা তাঁহাকে নামিতে দিতেন না। ঠাকুর যেমন বলিতেন, “যে মার উপর একান্ত নির্ভর করেছে, মা তার পা বেতালে পড়তে দেন না।”
ঠাকুরের ‘কাঁচা আমি’টার এককালে নাশ হইয়া বিরাট ‘পাকা আমিত্বে’ অনেক কাল অবস্থিতি। ঐ অবস্থাতেই তাঁহাতে গুরুভাব প্রকাশ পাইত। অতএব দীনভাব ও গুরুভাব অবস্থানুসারে এক ব্যক্তিতে আসা অসম্ভব নহে
অতএব বুঝা যাইতেছে, নির্বিকল্প-সমাধিলাভের পর ঠাকুরের ভিতরের ছোট আমি বা কাঁচা আমিটার একেবারে লোপ হইয়াছিল। আর যে আমিত্বটুকু ছিল সেটি আপনাকে ‘বড় আমি’ বা ‘পাকা আমি’-টার সঙ্গে চিরসংযুক্ত দেখিত – কখনো আপনাকে দেখিত সেই বিশ্বব্যাপী আমিটার অঙ্গ বা অংশ, আবার কখনো তাহার নিকট নিকটতর নিকটতম দেশে উঠিয়া সেই বিশ্বব্যাপী ‘আমি’-তে লীন হইয়া যাইত। এই পথেই ঠাকুরের সকল মনের সকল ভাব আয়ত্তীভূত হইত। কারণ ঐ ‘বড় আমি’-কে আশ্রয় করিয়াই জগতে সকলের মনের যত প্রকার ভাব উঠিতেছে। ঠাকুর ঐ বিশ্বব্যাপী ‘আমি’-কে আশ্রয় করিয়া অনুক্ষণ থাকিতে পারিতেন বলিয়াই বিশ্বমনে যত ভাবতরঙ্গ উঠিতেছে, সকলই ধরিতে ও বুঝিতে সক্ষম হইতেন। ঐরূপ উচ্চাবস্থায় ‘ভগবানের অংশ আমি’, ঠাকুরের এ ভাবটিও ক্রমশঃ লীন হইয়া যাইত, এবং ‘বিশ্বব্যাপী আমি’ বা শ্রীশ্রীজগন্মাতার আমিত্বই ঠাকুরের ভিতর দিয়া প্রকাশিত হইয়া নিগ্রহানুগ্রহ-সমর্থ গুরুরূপে প্রতিভাত হইত! কাজেই ঠাকুরকে দেখিলে তখন আর ‘দীনের দীন’ বলিয়া বোধ হইত না। তখন ঠাকুরের চাল-চলন, অপরের সহিত ব্যবহার প্রভৃতি সমস্ত ক্রিয়াকলাপই অন্য আকার ধারণ করিত। তখন কল্পতরুর মতো হইয়া তিনি ভক্তকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “তুই কি চাস?” – যেন ভক্ত যাহা চাহেন তাহা তৎক্ষণাৎ অমানুষী শক্তিবলে পূরণ করিতে বসিয়াছেন! দক্ষিণেশ্বরে বিশেষ বিশেষ ভক্তদিগকে কৃপা করিবার জন্য ঐরূপ ভাবাপন্ন হইতে ঠাকুরকে আমরা নিত্য দেখিয়াছি; আর দেখিয়াছি, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি। সেদিন ঠাকুর ঐরূপ ভাবাপন্ন হইয়া তৎকালে উপস্থিত সকল ভক্তদিগকে স্পর্শ করিয়া তাহাদের ভিতর ধর্মশক্তি সঞ্চারিত বা সুপ্ত ধর্মভাবকে জাগ্রত করিয়া দেন! সে এক অপূর্ব কথা – এখানে বলিলে মন্দ হইবে না।
গুরুভাবে ঠাকুরের ইচ্ছা ও স্পর্শমাত্রে অপরে ধর্মশক্তি জাগ্রত করিয়া দিবার দৃষ্টান্ত – ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দ ১লা জানুয়ারির ঘটনা
১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি, পৌষ মাস। কিঞ্চিদধিক দুই সপ্তাহ হইল ভক্তেরা শ্রীযুত মহেন্দ্রলাল সরকার ডাক্তার মহাশয়ের পরামর্শানুসারে ঠাকুরকে কলিকাতার উত্তরে কাশীপুরে রানী কাত্যায়নীর জামাতা গোপালবাবুর বাগানবাটীতে আনিয়া রাখিয়াছেন। ডাক্তার বলিয়াছেন কলিকাতার বায়ু অপেক্ষা বাগান অঞ্চলের বায়ু নির্মল ও যতদূর সম্ভব নির্মল বায়ুতে থাকিলে ঠাকুরের গলরোগের উপশম হইতে পারে। বাগানে আসিবার কয়েকদিন পরেই ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল দত্ত ঠাকুরকে দেখিতে আসেন এবং লাইকোপোডিয়াম (২০০) ঔষধ প্রয়োগ করেন। উহাতে গলরোগটার কিছু উপকারও বোধ হয়। ঠাকুর কিন্তু এখানে আসা অবধি বাটীর দ্বিতল হইতে একদিন একবারও নিচের তলে নামেন নাই বা বাগানে বেড়াইয়া বেড়ান নাই। আজ শরীর অনেকটা ভাল থাকায় অপরাহ্ণে বাগানে বেড়াইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। কাজেই ভক্তদিগের আজ বিশেষ আনন্দ।
স্বামী বিবেকানন্দের তখন তীব্র বৈরাগ্য – সাংসারিক উন্নতিকামনাসমূহ ত্যাগ করিয়া ঠাকুরের নিকটে বাস করিতেছেন ও তাঁহার দ্বারা উপদিষ্ট হইয়া শ্রীভগবানের দর্শনের জন্য নানাপ্রকার সাধন করিতেছেন। সমস্ত রাত্রি বৃক্ষতলে ধুনি বা অগ্নি জ্বালাইয়া ধ্যান, জপ, ভজন, পাঠ ইত্যাদিতেই থাকেন! অপর কয়েকজন ভক্তও, যথা – ছোট গোপাল, কালী (অভেদানন্দ) ইত্যাদি, আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি আনয়ন প্রভৃতি করিয়া তাঁহাকে ঐ বিষয়ে সাহায্য করেন এবং আপনারাও যথাসাধ্য ধ্যান-ভজন করেন। গৃহী ভক্তেরা বিষয়-কর্মাদিতে নিযুক্ত থাকায় সর্বদা ঠাকুরের নিকটে থাকিতে পারেন না; সুবিধা পাইলেই আসা-যাওয়া করেন এবং যাঁহারা ঠাকুরের সেবায় নিরন্তর ব্যাপৃত, তাঁহাদের আহারাদির সকল বিষয়ের বন্দোবস্ত করিয়া দেন ও কখনো কখনো এক-আধ দিন থাকিয়াও যান। আর ইংরাজী বর্ষের প্রথম দিন বলিয়া ছুটি থাকায় অনেকেই কাশীপুরের বাগানে উপস্থিত হইয়াছেন।
অপরাহ্ণ বেলা ৩টা বাজিয়া গিয়াছে। ঠাকুর লালপেড়ে ধুতি, একটি পিরান, লালপাড় বসান একখানি মোটা চাদর, কানঢাকা টুপি ও চটিজুতাটি পরিয়া স্বামী অদ্ভুতানন্দের সহিত উপর হইতে ধীরে ধীরে নিচে নামিলেন এবং নিচেকার হলঘরটি দেখিয়া পশ্চিমের দরজা দিয়া বাগানের পথে বেড়াইতে চলিলেন। গৃহী ভক্তেরা কেহ কেহ ঠাকুর ঐরূপে বেড়াইতে যাইতেছেন দেখিতে পাইয়া সানন্দে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলেন। শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র (স্বামী বিবেকানন্দ) প্রমুখ বালক বা যুবক ভক্তেরা তখন সমস্ত রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত থাকায় হলঘরের পাশে যে ছোট ঘরটি ছিল, তাহার ভিতর নিদ্রা যাইতেছেন। শ্রীযুত লাটু (স্বামী অদ্ভুতানন্দ) তাঁহাদিগকে ঐরূপে যাইতে দেখিয়া ঠাকুরের সহিত স্বয়ং আর অধিক দূর যাওয়া অনাবশ্যক বুঝিয়া হলঘরের সম্মুখে ক্ষুদ্র পুষ্করিণীটির দক্ষিণপাড় পর্যন্ত আসিয়াই ফিরিলেন এবং অপর একজন যুবক ভক্তকে ডাকিয়া লইয়া ঠাকুর উপরে যে ঘরটিতে থাকেন সেটি ঝাঁটপাট দিয়া পরিষ্কার করিতে ও ঠাকুরের বিছানা প্রভৃতি রৌদ্রে দিতে ব্যাপৃত হইলেন।
গৃহী ভক্তগণের ভিতর শ্রীযুত গিরিশের তখন প্রবল অনুরাগ। ঠাকুর কোন সময়ে তাঁহার অদ্ভুত বিশ্বাসের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া অন্য ভক্তগণকে বলিয়াছিলেন, “গিরিশের পাঁচ সিকে পাঁচ আনা বিশ্বাস! ইহার পর লোকে ওর অবস্থা দেখে অবাক হবে!” বিশ্বাস-ভক্তির প্রবল প্রেরণায় গিরিশ তখন হইতে ঠাকুরকে সাক্ষাৎ ভগবান – জীবোদ্ধারের জন্য কৃপায় অবতীর্ণ বলিয়া অনুক্ষণ দেখিতেন এবং ঠাকুর তাঁহাকে নিষেধ করিলেও তাঁহার ঐ ধারণা সকলের নিকট প্রকাশ্যে বলিয়া বেড়াইতেন। গিরিশও সেদিন বাগানে উপস্থিত আছেন এবং শ্রীযুত রাম প্রমুখ অন্য কয়েকটি গৃহী ভক্তের সহিত একটি আমগাছের তলায় বসিয়া কথোপকথন করিতেছেন।
ঠাকুর ভক্তগণ-পরিবৃত হইয়া উদ্যানমধ্যস্থ প্রশস্ত পথটি দিয়া বাগানের গেটের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে হইতে প্রায় মধ্যপথে আসিয়া পথের ধারে আমগাছের ছায়ায় শ্রীযুত রাম ও শ্রীযুত গিরিশকে দেখিতে পাইলেন এবং গিরিশকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “গিরিশ, তুমি কি দেখেছ (আমার সম্বন্ধে) যে অত কথা (আমি অবতার ইত্যাদি) যাকে তাকে বলে বেড়াও?”
সহসা ঐরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়াও গিরিশের বিশ্বাস টলিল না। তিনি সসম্ভ্রমে উঠিয়া রাস্তার উপরে আসিয়া ঠাকুরের পদতলে জানু পাতিয়া করজোড়ে উপবিষ্ট হইলেন এবং গদগদ কণ্ঠে বলিলেন, “ব্যাস বাল্মীকি যাঁহার কথা বলিয়া অন্ত করিতে পারেন নাই আমি তাঁহার সম্বন্ধে অধিক আর কি বলিতে পারি!”
গিরিশের ঐরূপ অদ্ভুত বিশ্বাসের কথা শুনিয়া ঠাকুরের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল এবং মন উচ্চ ভূমিতে উঠিয়া তিনি সমাধিস্থ হইলেন। গিরিশও তখন ঠাকুরের সেই দেবভাবে প্রদীপ্ত মুখমণ্ডল দেখিয়া উল্লাসে চিৎকার করিয়া ‘জয় রামকৃষ্ণ’ ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলিয়া বার বার পদধূলি গ্রহণ করিতে লাগিলেন।
ঠাকুরের ঐরূপ স্পর্শে ভক্তদিগের প্রত্যেকের দর্শন ও অনুভব
ইতোমধ্যে ঠাকুর অর্ধবাহ্যদশায় হাস্যমুখে উপস্থিত সকলের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তোমাদের কি আর বলিব, তোমাদের সকলের চৈতন্য হোক!” ভক্তেরা সে অভয়বাণী শুনিয়া তখন আনন্দে জয় জয় রব করিয়া কেহ প্রণাম, কেহ পুষ্পবর্ষণ এবং কেহ বা আসিয়া পদস্পর্শ করিতে লাগিলেন। প্রথম ব্যক্তি পদস্পর্শ করিয়া দণ্ডায়মান হইবামাত্র ঠাকুর ঐরূপ অর্ধবাহ্যাবস্থায় তাহার বক্ষ স্পর্শ করিয়া নিচের দিক হইতে উপরদিকে হস্ত সঞ্চালিত করিয়া বলিলেন, “চৈতন্য হোক!” দ্বিতীয় ব্যক্তি আসিয়া প্রণাম করিয়া উঠিবামাত্র তাহাকেও ঐরূপ করিলেন! তৃতীয় ব্যক্তিকেও ঐরূপ! চতুর্থকেও ঐরূপ! এইরূপে সমাগত ভক্তদিগের সকলকে একে একে ঐরূপে স্পর্শ করিতে লাগিলেন। আর সে অদ্ভুত স্পর্শে প্রত্যেকের ভিতর অপূর্ব ভাবান্তর উপস্থিত হইয়া কেহ হাসিতে, কেহ কাঁদিতে, কেহ বা ধ্যান করিতে, আবার কেহ বা নিজে আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া অহেতুক-দয়ানিধি ঠাকুরের কৃপালাভ করিয়া ধন্য হইবার জন্য অপর সকলকে চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন! সে চিৎকার ও জয় রবে ত্যাগী ভক্তেরা কেহ বা নিদ্রা ত্যাগ করিয়া, কেহ বা হাতের কাজ ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখেন, উদ্যানপথমধ্যে সকলে ঠাকুরকে ঘিরিয়া ঐরূপ পাগলের ন্যায় ব্যবহার করিতেছেন! এবং দেখিয়াই বুঝিলেন, দক্ষিণেশ্বরে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির প্রতি কৃপায় ঠাকুরের দিব্যভাবাবেশে যে অদৃষ্টপূর্ব লীলার অভিনয় হইত তাহারই অদ্য এখানে সকলের প্রতি কৃপায় সকলকে লইয়া প্রকাশ! ত্যাগী ভক্তেরা আসিতে আসিতেই ঠাকুরের সে অবস্থা পরিবর্তিত হইয়া আবার সাধারণ সহজ ভাব উপস্থিত হইল। পরে গৃহী ভক্তদিগের অনেককে ঐ সময়ে কিরূপ অনুভব হইয়াছিল তদ্বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল, কাহারও সিদ্ধির নেশার মতো একটা নেশা ও আনন্দ – কাহারও চক্ষু মুদ্রিত করিবামাত্র যে মূর্তির নিত্য ধ্যান করিতেন অথচ দর্শন পাইতেন না, ভিতরে সেই মূর্তির জাজ্বল্য দর্শন – কাহারও ভিতরে পূর্বে অননুভূত একটা পদার্থ বা শক্তি যেন সড়সড় করিয়া উপরে উঠিতেছে, এইরূপ বোধ ও আনন্দ এবং কাহারও বা পূর্বে যাহা কখনো দেখেন নাই এরূপ একটা জ্যোতিঃ চক্ষু মুদ্রিত করিলেই দর্শন ও আনন্দানুভব হইয়াছিল! দর্শনাদি প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন হইলেও একটা অসাধারণ দিব্য আনন্দে ভরপুর হইয়া যাইবার অনুভবটি সকলের সাধারণ প্রত্যক্ষ – এ কথাটি বেশ বুঝা গিয়াছিল। শুধু তাহাই নহে, ঠাকুরের ভিতরের অমানুষী শক্তিবিশেষই যে বাহ্যস্পর্শ দ্বারা সঞ্চারিত হইয়া প্রত্যেক ভক্তের ভিতর ঐরূপ অপূর্ব মানসিক অনুভব ও পরিবর্তন আনিয়া দিল, এ কথাটিও সকলের সাধারণ প্রত্যক্ষ বলিয়া বুঝিতে পারা গিয়াছিল। উপস্থিত ভক্তসকলের মধ্যে দুই জনকে কেবল ঠাকুর “এখন নয়” বলিয়া ঐরূপ স্পর্শ করেন নাই! এবং তাঁহারাই কেবল এ আনন্দের দিনে আপনাদিগকে হতভাগ্য জ্ঞান করিয়া বিষণ্ণ হইয়াছিলেন।1
1. পরে একদিন ঠাকুর ইঁহাদেরও ঐরূপে স্পর্শ করিয়াছিলেন।
কখন কাহাকে কৃপায় ঠাকুর ঐ ভাবে স্পর্শ করিবেন তাহা বুঝা যাইত না
ইহা দ্বারা এ বিষয়টিও বুঝা গিয়াছিল যে, কখন কাহার প্রতি কৃপায় ঠাকুরের ভিতর দিয়া ঐ দিব্যশক্তির প্রকাশ হইবে তাহার কিছুই স্থিরতা নাই! সাধারণ অবস্থায় ঠাকুর নিজেও তাহা জানিতে বা বুঝিতে পারিতেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ।
‘কাঁচা আমি’টার লোপ বা নাশেই গুরুভাব-প্রকাশের কথা সকল ধর্মশাস্ত্রে আছে
অতএব বেশ বুঝা যাইতেছে, কাঁচা বা ছোট আমিত্বটাকে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই ঠাকুর ‘বিশ্বব্যাপী আমি’ বা শ্রীশ্রীজগদম্বার শক্তিপ্রকাশের মহান যন্ত্রস্বরূপ হইতে পারিয়াছিলেন! এবং ঐ কাঁচা ‘আমি’-টাকে একেবারে ত্যাগ করিয়া যথার্থ ‘দীনের দীন’ অবস্থায় উপনীত হইয়াছিলেন বলিয়াই ঠাকুরের ভিতর দিয়া শ্রীশ্রীজগন্মাতার লোকগুরু, জগদ্গুরু-ভাবটির এইরূপ অপূর্ব বিকাশ সম্ভব হইয়াছিল! এইরূপে আমিত্বের লোপেই গুরুভাব বা গুরুশক্তির বিকাশ যেসকল ধর্মগত সকল অবতারপুরুষগণের জীবনেই উপস্থিত হইয়াছিল, জগতের ধৰ্মেতিহাস এ বিষয়ে চিরকাল সাক্ষ্য দিতেছে।
গুরুভাব মানবীয় ভাব নহে – সাক্ষাৎ জগদম্বার ভাব, মানবের শরীর ও মনকে যন্ত্র-স্বরূপে অবলম্বন করিয়া প্রকাশিত
গুরুতে মনুষ্যবুদ্ধি করিলে ধর্মলাভ বা ঈশ্বরলাভ হয় না, একথা আমরা আবহমান কাল ধরিয়া শুনিয়া আসিতেছি।
‘গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুর্গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।’
– ইত্যাদি স্তুতিকথা আমরা চিরকালই বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সহিত মন্ত্রদীক্ষাদাতা গুরুর উদ্দেশে উচ্চারণ করিয়া আসিতেছি। অনেকে আবার বিদেশী শিক্ষার কুহকে পড়িয়া আপনাদের জাতীয় শিক্ষা ও ভাব বিসর্জন দিয়া মানববিশেষকে ঐরূপ বলা মহাপাপের ভিতর গণ্য করিয়া অনেক বাদানুবাদ করিতেও পশ্চাৎপদ হন নাই! কারণ কে-ই বা তখন বুঝে যে, কোন কোন মানব-শরীরকে আশ্রয় করিয়া প্রকাশ পাইলেও গুরুভাবটি মানবীয় ভাবরাজ্যেরই অন্তর্গত নহে। কে-ই বা তখন জানে যে, শরীররক্ষার উপযোগী জলবায়ু, আহার প্রভৃতি নিত্যাবশ্যকীয় বস্তুসমস্তের ন্যায়, মায়াপাশে বদ্ধ ত্রিতাপে তাপিত মানবমনের সমস্ত জ্বালানিবারণ ও শান্তিলাভের উপায়স্বরূপ হইয়া শ্রীশ্রীজগন্মাতা স্বয়ংই ঐ ভাব ও শক্তিরূপে শুদ্ধ, বুদ্ধ, অহমিকাশূন্য মানবমনের ভিতর দিয়া পূর্ণরূপে প্রকাশিত আছেন? এবং কে-ই বা তখন ধারণা করে যে, যাহার মন যতটা পরিমাণে অহঙ্কার ত্যাগ করিতে বা ‘কাঁচা আমি’-টাকে ছাড়িতে পারে ততটা পরিমাণেই সে ঐ ভাব ও শক্তিপ্রকাশের যন্ত্রস্বরূপ হয়! সাধারণ মানবমনে ঐ দিব্যভাবের যৎসামান্য ‘ছিটে ফোঁটা’ মাত্র প্রকাশ, তাই আমরা ততটা ধরিতে ছুঁইতে পারি না। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য, শঙ্কর, যীশু প্রভৃতি পূর্ব পূর্ব যুগাবতারসকলে এবং বর্তমান যুগে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণে ঐ দিব্যশক্তির ঐরূপ অপূর্ব লীলা যখন বহুভাগ্যফলে কাহারও নয়নপথে পতিত হয়, তখনই সে প্রাণে প্রাণে বুঝিয়া থাকে যে, এ শক্তিপ্রকাশ মানবের নহে – সাক্ষাৎ ঈশ্বরের! তখনই ভবরোগগ্রস্ত পথভ্রান্ত জিজ্ঞাসু মানবের মোহ-মলিনতা দূরে অপসারিত হয় এবং সে বলিয়া উঠে, ‘হে গুরু, তুমি কখনই মানুষ নও – তুমি তিনি!’
ঈশ্বর করুণায় ঐ ভাবাবলম্বনে মানব-মনের অজ্ঞান-মোহ দূর করেন। সেজন্য গুরুভক্তি ও ঈশ্বরভক্তি একই কথা
অতএব বুঝা যাইতেছে, শ্রীশ্রীজগন্মাতা যে ভাবরূপে মানবমনের সকল প্রকার অজ্ঞান-মলিনতা দূর করেন, সেই উচ্চ ভাবেরই নাম গুরুভাব বা গুরুশক্তি। ঐ ভাবকেই শাস্ত্র গুরু নামে নির্দেশ করিয়াছেন ও মানবকে উহার প্রতি মনের ষোল আনা শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাস অর্পণ করিতে বলিয়াছেন। কিন্তু স্থূলবুদ্ধি, ভক্তি-শ্রদ্ধাদি সবেমাত্র শিখিতে আরম্ভ করিয়াছে, এ প্রকার মানব-মন তো আর একটা অশরীরী ভাবকে ধরিতে ছুঁইতে, ভালবাসিতে পারে না; এজন্যই শাস্ত্র বলিয়াছেন, দীক্ষাদাতা মানবকে গুরু বলিয়া ভক্তি করিতে। সেজন্য যাঁহারা বলেন, আমরা গুরুভাবটিকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতে পারি, কিন্তু যে দেহটা আশ্রয় করিয়া ঐ ভাব আমাদের নিকট প্রকাশিত হয় তাহাকে মান্য-ভক্তি কেন করিব – ঐ ভাব তো আর তাঁহার নহে? তাঁহাদিগকে আমরা বলি – ‘ভাই, করিতে পার কর, কিন্তু দেখিও যেন নিজের মনের জুয়াচুরিতে ঠকিতে না হয়; শক্তি বা ভাব এবং যদবলম্বনে ঐ ভাব প্রকাশিত থাকে তদুভয়কে কখনো তো পৃথক পৃথক থাকিতে দেখ নাই, তবে কেমন করিয়া আগুন ও আগুনের দাহিকাশক্তিকে পৃথক করিয়া একটিকে গ্রহণ ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করিবে এবং অপরটিকে ত্যাগ করিবে, তাহা বলিতে পারি না!’ যে যাহাকে ভালবাসে বা ভক্তি করে সে প্রেমাস্পদের ব্যবহৃত অতি সামান্য জিনিসটাকেও হৃদয়ে ধারণ করে। তাঁহার স্পৃষ্ট ফুলটা বা কাপড়-চোপড়খানাও সে পবিত্র বলিয়া বোধ করে। তিনি যে স্থান দিয়া চলিয়া যান, সেখানকার মাটিটাও তাহার কাছে বহু মূল্যবান ও বহু আদরের জিনিস বলিয়া বোধ হয়। তবে তিনি যে শরীরটাতে অবস্থান করিয়া তাহার পূজা গ্রহণ করেন ও তাহাকে কৃপা করেন, সেটার প্রতি যে তাহার শ্রদ্ধা-ভক্তি হইবে – এটা কি আবার বুঝাইয়া বলিতে হইবে? যাহারা গুরুভাবটি কি তাহাই বুঝে না, তাহারাই ঐরূপ কথা বলিয়া থাকে। আর যাহার গুরুভাবের প্রতি ঠিক ঠিক ভক্তি হইবে, তাহার ঐ ভাবের আধার গুরুর শরীরটার উপরেও ভক্তি-শ্রদ্ধার বিকাশ হইবেই হইবে। ঠাকুর এই বিষয়টি বিভীষণের ভক্তির দৃষ্টান্ত দিয়া আমাদিগকে বুঝাইতেন। যথা –
গুরুভক্তি-বিষয়ে ঠাকুরের উপদেশ – বিভীষণের গুরুভক্তির কথা
শ্রীরামচন্দ্রের মানবলীলাসংবরণের অনেক কাল পরে কোন সময়ে নৌকাডুবি হইয়া একজন মানব লঙ্কার উপকূলে সমুদ্রতরঙ্গের দ্বারা নিক্ষিপ্ত হয়। বিভীষণ অমর, তিন কালই তিনি লঙ্কায় রাজত্ব করিতেছেন – তাঁহার নিকট ঐ সংবাদ পৌঁছিল। সভাস্থ অনেক রাক্ষসের সুকোমল মানবদেহরূপ খাদ্যের আগমনসংবাদে জিহ্বায় জল আসিল। রাজা বিভীষণের কিন্তু ঐ সংবাদ শুনিয়া এক অপূর্ব ভাবান্তর আসিয়া উপস্থিত হইল। তিনি গলদশ্রুলোচনে ভক্তি-গদ-গদ বাক্যে বার বার বলিতে লাগিলেন, ‘অহো ভাগ্য!’ রাক্ষসেরা তাঁহার ভাব না বুঝিতে পারিয়া সকলে একেবারে অবাক! তৎপরে বিভীষণ তাহাদের বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘যে মানবশরীর আমার রামচন্দ্র ধারণ করিয়া লঙ্কায় পদার্পণ করেন ও আমাকে কৃতার্থ করেন, বহুকাল পরে আজ আবার সেই মানবশরীর দেখিতে পাইব – এ কি কম ভাগ্যের কথা! আমার মনে হইতেছে যেন সাক্ষাৎ রামচন্দ্রই পুনরায় ঐরূপে আসিয়াছেন!’ এই বলিয়া রাজা পাত্র-মিত্র সভাসদসকলকে সঙ্গে লইয়া সমুদ্রোপকূলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং বহু সম্মান ও আদর করিয়া উক্ত মানবকে প্রাসাদে লইয়া যাইলেন। পরে তাহাকেই সিংহাসনে বসাইয়া নিজে সপরিবারে অনুগত দাসভাবে তাহার সেবা ও বন্দনাদি করিতে লাগিলেন! এইরূপে কিছুকাল তাহাকে লঙ্কায় রাখিয়া নানা ধন-রত্ন উপহার দিয়া সজলনয়নে বিদায় দিলেন এবং অনুচরবর্গের দ্বারা বাটী পৌঁছাইয়া দিলেন।
ঠিক ঠিক ভক্তিতে অতি তুচ্ছ বিষয়েও ঈশ্বরের উদ্দীপন হয়। ‘এই মাটিতে খোল হয়!’ – বলিয়াই শ্রীচৈতন্যের ভাব
গল্পটি বলিয়া ঠাকুর আবার বলিতেন, “ঠিক ঠিক ভক্তি হলে এইরূপ হয়। সামান্য জিনিস হতেও তার ঈশ্বরের উদ্দীপনা হয়ে ভাবে বিভোর হয়। শুনিসনি – ‘এই মাটিতে খোল হয়’ বলে চৈতন্যদেবের ভাব হয়েছিল? এক সময়ে এক জায়গা দিয়ে যেতে যেতে তিনি শুনলেন যে সেই গ্রামে হরিসংকীর্তনের সময় যে খোল বাজে লোকে সেই খোল তৈয়ার ও উহা বিক্রয় করে দিনপাত করে। শুনেই তিনি বলে উঠলেন, ‘এই মাটিতে খোল হয়!’ – বলেই ভাবে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হলেন! কেন না, উদ্দীপনা হলো; ‘এই মাটিতে খোল হয়, সেই খোল বাজিয়ে হরিনাম হয়, সেই হরি সকলের প্রাণের প্রাণ – সুন্দরের চাইতেও সুন্দর।’ – একেবারে এত কথা মনে হয়ে হরিতে চিত্ত স্থির হয়ে গেল। সেই রকম যার গুরুভক্তি হয় তার গুরুর আত্মীয়-কুটুম্বদের দেখলে তো গুরুর উদ্দীপনা হবেই, যে গ্রামে গুরুর বাড়ি সে গ্রামের লোকদের দেখলেও ঐরূপ উদ্দীপনা হয়ে তাদের প্রণাম করে, পায়ের ধুলো নেয়, খাওয়ায় দাওয়ায় সেবা করে! এই অবস্থা হলে গুরুর দোষ আর দেখতে পাওয়া যায় না। তখনই এ কথা বলা চলে –
‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ীবাড়ি যায়।
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়॥’1
নইলে মানুষের তো দোষ-গুণ আছেই। সে তার ভক্তিতে কিন্তু তখন আর মানুষকে মানুষ দেখে না, ভগবান বলেই দেখে! যেমন ন্যাবা-লাগা চোখে সব হলুদবর্ণ দেখে – সেই রকম; তখন তার ভক্তি তাকে দেখিয়ে দেয় যে, ঈশ্বরই সব – তিনিই গুরু, পিতা, মাতা, মানুষ, গরু, জড়, চেতন সব হয়েছেন।”
দক্ষিণেশ্বরে একদিন একজন সরল উদ্ধত যুবক ভক্ত2 ঠাকুর যে বিষয়টি তাঁহাকে বলিতেছিলেন, তৎসম্বন্ধে নানা আপত্তিতর্ক উত্থাপিত করিতেছিল! ঠাকুর তিন চারি বার তাহাকে ঐ বিষয়টি বলিলেও যখন সে বিচার করিতে লাগিল তখন ঠাকুর তাহাকে সুমিষ্ট ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “তুমি কেমন গো? আমি বলচি আর তুমি কথাটা নিচ্চ না!” যুবকের এইবার ভালবাসায় হাত পড়িল। সে বলিল, “আপনি যখন বলছেন তখন নিলুম বই কি। আগেকার কথাগুলো তর্কের খাতিরে বলেছিলাম।”
1. অর্থাৎ নিত্যানন্দস্বরূপ শ্রীভগবান বা ঈশ্বর।
2. শ্রীযুত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল।
অর্জুনের গুরুভক্তির কথা
ঠাকুর শুনিয়া প্রসন্নমুখে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “গুরুভক্তি কেমন জান? গুরু যা বলবে তা তখনি দেখতে পাবে – সে ভক্তি ছিল অর্জুনের। একদিন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সঙ্গে রথে চড়ে বেড়াতে বেড়াতে আকাশের দিকে চেয়ে বললেন, ‘দেখ সখা, কেমন এক ঝাঁক পায়রা উড়ছে।’ অর্জুন অমনি দেখিয়া বলিলেন, ‘হাঁ সখা, অতি সুন্দর পায়রা!’ পরক্ষণেই শ্রীকৃষ্ণ আবার দেখিয়া বলিলেন, ‘না সখা, ও তো পায়রা নয়!’ অর্জুন দেখিয়া বলিলেন, ‘তাই তো সখা, ও পায়রা নয়।’ কথাটি এখন বোঝ – অর্জুন মহা সত্যনিষ্ঠ, তিনি তো আর কৃষ্ণের খোশামোদ করিয়া ঐরূপ বলিলেন না? কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের কথায় তাঁর এত বিশ্বাস-ভক্তি যে, যেমন যেমন শ্রীকৃষ্ণ বললেন অর্জুনও তখন ঠিক ঠিক তা দেখতে পেলেন!”
ঈশ্বরীয় ভাবরূপে গুরু এক। তথাপি নিজ গুরুতে ভক্তি, বিশ্বাস ও নিষ্ঠা চাই। ঐ বিষয়ে হনুমানের কথা
শাস্ত্র যাঁহাকে অজ্ঞানান্ধকার-দূরীকরণসমর্থ গুরু বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন তাহা পূর্বোক্তরূপে ঐশ্বরিক ভাববিশেষ বলিয়া নির্ণীত হইলে সঙ্গে সঙ্গে আর একটি কথাও সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। তাহা এই – গুরু অনেক নহেন, এক। আধার বা যে যে শরীরাবলম্বনে ঈশ্বরের ঐ ভাব প্রকাশিত হয় তাহা ভিন্ন ভিন্ন হইলেও তোমার গুরু, আমার গুরু পৃথক নহেন – ভাবরূপে এক। মৃন্ময় মূর্তিতে দ্রোণকে আচার্যরূপে গ্রহণ ও ভক্তিপূর্বক একলব্যের ধনুর্বেদলাভরূপ মহাভারতীয় কথাটি ইহারই দৃষ্টান্তস্বরূপে বলা যাইতে পারে। অবশ্য একথাটি যুক্তিতে দাঁড়াইলেও ঠিক ঠিক হৃদয়ঙ্গম হওয়া অনেক সময় ও সাধন-সাপেক্ষ এবং হৃদয়ঙ্গম হইলেও যতক্ষণ মানবের নিজের দেহবোধ থাকে, ততক্ষণ যে শরীরের ভিতর দিয়া গুরুশক্তি তাঁহাকে কৃপা করেন সেই শরীরাবলম্বনেই শ্রীগুরুর পূজা করা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। ঠাকুর এই কথাটির দৃষ্টান্তে নিষ্ঠা-ভক্তির জ্বলন্ত নিদর্শন হনুমানের কথা আমাদিগকে বলিতেন। যথা –
লঙ্কাসমরে শ্রীরামচন্দ্র ও তাঁহার ভ্রাতা লক্ষ্মণ মহাবীর মেঘনাদ কর্তৃক কোন সময়ে নাগপাশে আবদ্ধ হন এবং উহা হইতে মুক্তি পাইবার জন্য নাগকুলের চিরশত্রু গরুড়কে স্মরণ করিয়া আনয়ন করেন। গরুড়কে দেখিবামাত্র নাগকুল ভয়ত্রস্ত হইয়া যে যেদিকে পারিল পলায়ন করিল। রামচন্দ্রও নিজভক্ত গরুড়ের প্রতি প্রসন্ন হইয়া গরুড়ের চিরকালপূজিত ইষ্টমূর্তি বিষ্ণুরূপে তাহার সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন ও তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন – যিনি বিষ্ণু তিনিই তখন রামরূপে অবতীর্ণ! হনুমানের কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রকে ঐরূপে বিষ্ণুমূর্তি পরিগ্রহ করিতে দেখা ভাল লাগিল না এবং কতক্ষণে তিনি পুনরায় রামরূপ পরিগ্রহ করিবেন এই কথাই ভাবিতে লাগিলেন। হনুমানের ঐ প্রকার মনোভাব বুঝিতে রামচন্দ্রের বিলম্ব হইল না। তিনি গরুড়কে বিদায় দিয়াই পুনরায় রামরূপ পরিগ্রহ করিয়া হনুমানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস, আমার বিষ্ণুরূপ দেখিয়া তোমার ঐরূপ ভাবান্তর হইল কেন? তুমি মহাজ্ঞানী, তোমার তো আর জানিতে ও বুঝিতে বাকি নাই যে, যে রাম সেই বিষ্ণু?” হনুমান তাহাতে বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, “সত্য বটে, এক পরমাত্মাই উভয় রূপ পরিগ্রহ করিয়াছেন এবং সেজন্য শ্রীনাথ ও জানকীনাথে কোন প্রভেদ নাই, কিন্তু তথাপি আমার প্রাণ সতত জানকীনাথেরই দর্শন চায় – কারণ তিনিই আমার সর্বস্ব! ঐ মূর্তির ভিতর দিয়াই আমি ভগবানের প্রকাশ দেখিয়া কৃতার্থ হইয়াছি –
“শ্রীনাথে জানকীনাথে অভেদঃ পরমাত্মনি।
তথাপি মম সর্বস্বঃ রামঃ কমললোচনঃ॥”
সকল মানবেই গুরুভাব সুপ্তভাবে বিদ্যমান
এইরূপে গুরুভাবটি শ্রীশ্রীজগন্মাতার শক্তিবিশেষ ও সেই শক্তি সকল মানবমনেই সুপ্ত বা ব্যক্তভাবে নিহিত রহিয়াছে বলিয়াই গুরুভক্তিপরায়ণ সাধক শেষে এমন এক অবস্থায় উপনীত হন যে, তখন ঐ শক্তি তাঁহার নিজের ভিতর দিয়া প্রকাশিত হইয়া ধর্মের জটিল নিগূঢ় তত্ত্বসকল তাঁহাকে বুঝাইয়া দিতে থাকে। তখন সাধককে আর বাহিরের কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া ধর্মবিষয়ক কোনরূপ সন্দেহ ভঞ্জন করিয়া লইতে হয় না। গীতায় শ্রীভগবান অর্জুনকে বলিয়াছেন –
যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ॥
– গীতা, ২/৫২
যখন তোমার বুদ্ধি অজ্ঞান-মোহ হইতে বিমুক্ত হইবে তখন আর এটা শুনা উচিত, ওটা শাস্ত্রে আছে ইত্যাদি কথায় আর তোমার প্রয়োজন থাকিবে না, তুমি ঐ সকলের পারে চলিয়া যাইয়া আপনিই তখন সকল বুঝিতে পারিবে; সাধকের তখন ঐরূপ অবস্থা আসিয়া উপস্থিত হয়।
ঠাকুরের কথা “শেষে মনই গুরু হয়”
ঠাকুর ঐ অবস্থাকে লক্ষ্য করিয়াই বলিতেন, “শেষে মনই গুরু হয় বা গুরুর কাজ করে। মানুষ গুরু মন্ত্র দেয় কানে, (আর) জগদ্গুরু মন্ত্র দেয় প্রাণে।” কিন্তু সে মন আর এ মনে অনেক প্রভেদ। সে সময় মন শুদ্ধসত্ত্ব পবিত্র হইয়া ঈশ্বরের উচ্চ শক্তিপ্রকাশের যন্ত্রস্বরূপ হয়, আর এ সময়ে মন ঈশ্বর হইতে বিমুখ হইয়া ভোগসুখ ও কামক্রোধাদিতেই মাতিয়া থাকিতে চায়।
“গুরু যেন সখী”
ঠাকুর বলিতেন, “গুরু যেন সখী – যতদিন না শ্রীকৃষ্ণের সহিত শ্রীরাধার মিলন হয়, ততদিন সখীর কাজের বিরাম নাই, সেইরূপ যতদিন না ইষ্টের সহিত সাধকের মিলন হয় ততদিন গুরুর কাজের শেষ নাই। এইরূপে মহামহিমান্বিত শ্রীগুরু জিজ্ঞাসু ভক্তের হাত ধরিয়া উচ্চ হইতে উচ্চতর ভাবরাজ্যে আরোহণ করেন এবং পরিশেষে তাহাকে ইষ্টমূর্তির সম্মুখে আনিয়া বলেন, ‘ও শিষ্য, ঐ দেখ!’ ইহা বলিয়াই অন্তর্হিত হন।”
“গুরু শেষে ইষ্টে লয় হন; গুরু, কৃষ্ণ, বৈষ্ণব – তিনে এক, একে তিন”
ঠাকুরকে একদিন ঐরূপ বলিতে শুনিয়া একজন অনুগত ভক্ত ‘শ্রীগুরুর সহিত বিচ্ছেদ তবে তো একদিন অনিবার্য’ ভাবিয়া ব্যথিত হৃদয়ে জিজ্ঞাসা করেন – “গুরু তখন কোথায় যান, মশাই?” ঠাকুর তদুত্তরে বলেন, “গুরু ইষ্টে লয় হন। গুরু, কৃষ্ণ, বৈষ্ণব – তিনে এক, একে তিন।”