৩.৩ লক্ষ্য যখন ক্ষমতা ও সিংহাসন

লক্ষ্য যখন ক্ষমতা ও সিংহাসন

১০১৭ খৃস্টাব্দের ৩রা জুলাই মোতাবেক ৪০৮ হিজরী সনের ৫ সফর। স্বগোত্রীয় ঈমান বিক্রেতাদের সম্মিলিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে সুলতান মাহমূদকে এক ভয়ানক রক্ষক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত হতে হলো। এই সংঘাত ছিল সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সৃষ্টিকারী। যে সংঘাতের নেপথ্যে ছিল ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলিম কুচক্রীদের জোটবদ্ধ ষড়যন্ত্র।

১০১৫ সালে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে ব্যর্থ ও পযুদস্ত হয়ে কাশ্মীর থেকে হাতেগোনা মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধাকে নিয়ে পরাজিতের বেশে সুলতানের গযনী ফিরতে হয়েছিল। বিশাল এই ক্ষয়ক্ষতি সামলে উঠার জন্য এবং সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠনের জন্য টানা কয়েকটি বছর প্রয়োজন ছিল সুলতানের। কারণ, কাশ্মীরের লোহাকোট দুর্গের ব্যর্থতা প্রাকৃতিক বৈরীতা এবং চক্রান্তকারী হিন্দু গাইডের চক্রান্তে সুলতান মাহমূদের সামরিক শক্তি একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন সাধারণ কোন যুদ্ধের মোকাবেলা করার সামর্থও তার বাহিনীর ছিলো না। রাজধানী গযনীর নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সৈনিক এবং সীমান্তের অস্থায়ী চৌকিগুলোতে প্রহরারত যোদ্ধারা ছাড়া তার কেন্দ্রীয় কমান্ড প্রায় জনবলশূন্য হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় বহিরাক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ তার থাকলেও প্রতিআক্রমণ করার মতো জনবল সেনাবাহিনীতে ছিলো না।

হিন্দুদের পক্ষ থেকে আক্রমণের তেমন আশঙ্কা তার ছিলো না। কারণ, তখনো পর্যন্ত হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। কাশ্মীরের লোহাকোট দুর্গে পরাজয় মেনে নিয়ে মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে টিলাযুগিয়া ক্যাম্পে কয়েক দিন অবস্থান করলেও রাজা ভীমপাল ও নন্দরায় তার উপর আক্রমণের সাহস পায়নি। অথচ এ সময় বিপুল সংখ্যাধিক্যে প্রবল হিন্দুবাহিনী আক্রমণ করলে হয়তো তাদের হাতে সুলতানকে বন্দিত্ব বরণ, নয়তো শাহাদাঁতের পেয়ালা পান করতে হতো। কিন্তু হিন্দু রাজা-মহারাজারা তাঁকে আহত বাঘের মতোই ভয়ানক ভেবে তাঁর কাছ থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন।

এমতাবস্থায় চিহ্নিত শত্রু হিন্দুদের পক্ষ থেকে কোন ঝুঁকির আশঙ্কা না থাকলেও স্বগোত্রীয় মুসলিম ক্ষমতালি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র শাসকদের পক্ষ থেকে ঝুঁকির আশঙ্কা প্রবল হতে থাকলো। অধিকাংশ প্রতিবেশী মুসলিম শাসক এককভাবে কিংবা যৌথভাবে সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করে এক বা একাধিকবার পরাজিত হয়েছিল। স্বগোত্রীয় এসব ক্ষমতালিন্দুদের প্রতিবারই সুলতান ক্ষমা করে দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রত্যাশায় ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু মসনদ ও ক্ষমতার পূজারী, নীতি-আদর্শবিচ্যুত এসব শাসক সুলতানের শক্তিশালী অবস্থানকে সব সময় তাদের বিপদ জ্ঞান করতো। তারা শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে সব সময়ই সুলতানের ধ্বংস কামনা করতো। সুলতানকে হীনবল ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে পরস্পর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারে লিপ্ত থাকতো। কুচক্রী প্রতিবেশীদের জন্য সুলতানের এই বিপর্যয় মহাসুয়োগ সৃষ্টি করে দিল। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে উঠে-পড়ে লেগে গেল তারা।

কাশ্মীরের ব্যর্থ অভিযান শেষে সুলতান মাহমূদ যখন গযনীতে ফিরে এলেন, তখন তার অবস্থা অনেকটাই ডোরকাটা ঘুড়ির মতো। বাতাসের দয়ার উপর ভর করে ঘুড়ি যেমন উড়তে থাকে, সে জানে না জমিনে পড়বে না কোন গাছের ডালে পড়ে ফেটে যাবে। সুলতান মাহমূদের সাথে কাশ্মীর অভিযান শেষে যে সামান্যসংখ্যক সৈন্য ছিলো, তারা শোক-মিছিলের আবহে রাজধানীতে ফিরছিলো। গযনীর যেসব লোক সেনাবাহিনীর আগমনবার্তা পেয়ে রাস্তায় তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য জড়ো হয়েছিলো, সৈন্যদের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে তাদের মুখে আর কোন শব্দ উচ্চারিত হলো না। বিজয়োল্লাসের তাকবীর ধ্বনি তাদের বুকের পাজরে যেন আটকে গিয়েছিল। যেসব নারী দরজা-জানালায় দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর প্রত্যাবর্তন দেখছিলো, সৈন্যদের বিপর্যস্ত দৃশ্য দেখে তারা দাঁতে আঙুল কামড়ে ধরলো।

সুলতান মাহমূদ রাজধানীর অধিবাসীদের এমন শোকাবহ নীরবতা দেখে ঘোড়া থামিয়ে তাঁর প্রধান সেনাপতি আলতানতাশকে ডেকে পাঠালেন।

“আলতানতাশ! কী হয়েছে, রাজধানীর উৎসুক সব মানুষ নীরব হয়ে গেলো কেন? সৈন্যদের মৃত্যুতে ওদের স্লোগান হারিয়ে গেলো কেন? তাদের বলল, জাতির প্রয়োজনেই সৈন্য বেঁচে থাকে। এজন্য তোমাদের সবার মরে গেলে চলবে না। তোমাদের স্লোগান বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তোমরা স্লোগান দাও, ইসলাম জিন্দাবাদ”

“সালতানাতে গযনী জিন্দাবাদ”। তোমরা আহত সৈন্যদের উজ্জীবিত করো। তোমাদের উৎসাহ ও প্রাণোচ্ছলতা তাদেরকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। যারা শাহাদাত বরণ করেছে, তারা তাদের জীবন জাতির সেবায় দান করে গেছে। তাদের কুরবানীর মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে।”

সেনাপতি আলতানতাশ উচ্চ আওয়াজে সুলতানের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন। মাঝে মাঝে গযনীর আকাশ-বাতাস সালতানাতে গযনী জিন্দাবাদ, ইসলাম জিন্দাবাদ, ইসলামের সৈনিকেরা জিন্দাবাদ, মূর্তি ধ্বংসকারী সুলতান জিন্দাবাদ, ইত্যাকার স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো।

সুলতান মাহমূদ আবারো সেনাপতির উদ্দেশে বললেন, “মহিলাদের বললো, ইসলাম তোমাদের কাছে তোমাদের ভাই-বেটাদের কুরবানী দাবী করছে। আপনজন হারানোর শোকে মাতম করলে চলবে না। তোমাদেরকে ইসলামের প্রয়োজনে স্বামী-সন্তান, ভাই-পুত্রদেরকেও কুরবানী দিতে হবে।”

সেনাপতি আলতানতাশ সুলতানের একথাগুলোও উচ্চ-আওয়াজে পুনরাবৃত্তি করলেন। একথা শুনে যেসব নারী তাদের সংগৃহীত ফুল লুকিয়ে ফেলেছিলো, আহত সৈনিকদের উপর তা ছিটিয়ে দিতে শুরু করলো। সেই সাথে নারীদের কষ্ঠ থেকে ভেসে এলো, “কোন অসুবিধা নেই, ইসলামের প্রয়োজনে আমাদের ভাই-পুত্র-স্বামীদের তোমরা নিয়ে যাও।”

সুলতান মাহমূদ রাজধানীবাসীর মনোবল বাড়িয়ে দিয়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন বটে; কিন্তু তাঁর নিজের মনের গভীরে ব্যর্থতা

ও হতাশার যে কাঁটা বিদ্ধ হয়েছিলো তা তিনি কিছুতেই সরাতে পারছিলেন না। কাশ্মীর যুদ্ধের সকল ব্যর্থতা তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি বাহিনীর বেঁচে থাকা সেনাপতি এবং গযনীতে অবস্থানকারী সেনাকমান্ডারদের ডেকে বললেন, “জয়-পরাজয় মূলত আল্লাহর হাতে। কিন্তু লোহাকোট অভিযানের যাবতীয় ব্যর্থতার দায় আমার। আমি এর সকল দায়-দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিচ্ছি। কারণ, আমি সেখানকার মৌসুমী প্রভাবকে মোটেও বিবেচনায় নিইনি। স্থানীয় সংবাদ প্রেরকদের কাছ থেকে ওখানকার অবস্থা যাচাই করিনি। সর্বোপরি হিন্দু প্রতারকদের ধোঁকায় আমি প্রতারিত হয়েছি। জাতির এই কলঙ্ক, এই ক্ষয়ক্ষতিকে বিজয়ে রূপান্তরিত করে দেখানোর দায়-দায়িত্ব এখন আমি কাঁধে তুলে নিচ্ছি।

রাজা হিসেবে রাজ্য শাসন করা আমার কাজ নয়। আমার কাজ ইসলামের বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া। তোমরা আমার একটি কথা খুব মনে রেখো। তা হচ্ছে, এখন যদি কেউ তোমাদেরকে পরাজয়ের জন্য তিরস্কার করে, তবে সেই তিরস্কারকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে তাকে আশ্বস্ত করো, তোমাদের সমর্থন-সহযোগিতা থাকলে গযনী বাহিনী অচিরেই পরাজয়ের গ্লানি মুছে দেবে।

ব্যর্থতার পুরো দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার পরও স্বস্তি পাচ্ছিলেন না সুলতান মাহমূদ। ক্রমেই তার মন অত্যন্ত অস্থিরতায় পেরেশান হয়ে উঠছিলো। মনের অস্বস্তি অস্থিরতা ও পেরেশানী থেকে মুক্তি পেতে অবশেষে তিনি তার শায়খ আবুল হাসান খারকানীর সাক্ষাতে রওনা হলেন।

গযনী থেকে একদিন ও অর্ধেক রাতের দূরত্বে অবস্থান করতেন খারকানী। অল্প কজন নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুতবেগে স্বীয় মুর্শিদের কাছে পৌঁছলেন সুলতান মাহমূদ।

বিমর্ষ, ভগ্নহৃদয় ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সুলতানকে দেখে খারকানী বললেন, “অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সুলতান পরাজিত হয়ে এসেছেন। কিন্তু তাই বলে তার চোখে পানি কেন?”

“অপমান আর ব্যর্থতার গ্লানি মুর্শিদ” বললেন সুলতান। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। আমি হাজার হাজার সহযোদ্ধাকে কাশ্মীরের বরফের নিচে রেখে এসেছি, এদের রূহ আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয় না। ওরা যেন আমাকে কানে কানে বলে যায়, “একি করলেন সুলতান কোন অপরাধে আমাদের কাশ্মীরে এনে বরফ চাপা দিলেন? আমরা তো মর্দে-ময়দান ছিলাম, আমরা তো আপনার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেঈমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাম।”

“বিভ্রান্তি। মানসিক অপরাধবোধ থেকে এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন আপনি। যে যোদ্ধারা সহযোদ্ধাদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ শাহাদত বরণকারীদের আত্মা তাদেরকে বিভ্রান্ত করে না, কোন ধরনের পেরেশানী সৃষ্টি করে না। দেখবেন, এই শহীদদের আত্মা জীবন্ত সৈনিকে রূপান্তরিত হবে। আল্লাহর নামে এখন থেকে আপনারা যেখানেই লড়াই করবেন, এসব রূহ আপনাদের শক্তি জোগাবে। আপনার মতো একজন দৃঢ়চেতা লড়াকু রণনায়কের পথে এ ধরনের বিভ্রান্তি প্রতিবন্ধক হতে পারে না। এসব নিতান্তই আবেগাশ্রয়ী বিষয় সুলতান। হতোদ্যম হবেন না। হিন্দুস্তানের অসংখ্য মজলুম আপনার পথ চেয়ে আছে, শত শত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া মসজিদ আপনার আগমন অপেক্ষায় প্রহর গুণছে।”

“আমি মারাত্মক ধোঁকায় পড়ে গিয়েছিলাম। প্রথমত মৌসুম আমাকে ধোঁকা দেয়, দ্বিতীয়ত প্রশিক্ষিত কুচক্রী হিন্দুরা মুসলমান সেজে আমাকে গাইড হিসিবে ধোকায় ফেলে।”

“হিন্দুদের এসব ধোকাবাজী কোন নতুন বিষয় নয় সুলতান!” বললেন খারকানী। ইসলামের গোড়া থেকেই কুফরীশক্তি মুসলমানদের ধোকা দিচ্ছে। ভবিষ্যতেও এই ধোকাবাজী অব্যাহত থাকবে। আপনার কাজ হলো ভবিষ্যতে যাতে এমন ধোকার শিকার হতে না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা। ভারতের আগেই হয়তো আপনাকে নিজ ভূমিতে স্বগোত্রীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।

ইহুদী ও খৃস্টশক্তি সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের মৈত্রী ও ঐক্যের শিকড় কেটে দিচ্ছে। যে খলীফা ছিলেন মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক, সেই খলীফাই এখন ক্ষমতা ও মসনদের লিলায় অন্ধ। মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় শক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আপনি যদি ইসলামের স্বার্থে যুদ্ধ-জিহাদে আগ্রহী হয়ে থাকেন। তাহলে সুলতানীর উষ্ণতা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। চেনা-অচেনা শত্রুদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখুন। স্বজাতি ও স্বদেশের জনগোষ্ঠীকে ভীতসন্ত্রস্ত না করে সামরিক শক্তি দিয়ে শত্রুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিন। তাজ ও তরবারী সহাবস্থান করতে পারে না। ভালোবাসা হয় তরবারীর সাথে থাকবে, নয়তো তখতের সাথে। যে তরবারী তাজ ও তক্তের হেফাযতের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই তরবারী ঘৃণ্য। মাত্র একটি পরাজয়ে হতোদ্যম হয়ে যাবেন না সুলতান! উঠে সে-ই, যে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। এই হোঁচট খাওয়ার পর পুনরায় গা ঝাড়া দিয়ে আবার সেই শক্তি নিয়ে দাঁড়ান, যে। অবস্থায় আপনি পড়ে গিয়েছিলেন। নিজের ভুলত্রুটি নিজের কাঁধে নিন, এ ব্যাপারে জাতিকে ভুল তথ্য পরিবেশ করবেন না।”

“আপনি বলেছেন, ইহুদী ও খৃস্টানরা আমাদের শিকড় কাটছে? এটা বলে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?” খারকানীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সুলতান।

“ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু ইহুদী জাতি।” বললেন শায়খ আবুল হাসান খারকানী। ইহুদিরা মসজিদে আকসাকে তাদের ইবাদতখানা মনে করে। ইহুদীরা চেষ্টা করছে, ফিলিস্তিনকে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রে পরিণত করে কাবাকে দখল করে নিতে এবং মুসলমানদের একক ইবাদতগাহকে ধ্বংস করে দিতে। ইহুদীরা মুখোমুখী সংঘর্ষের জাতি নয়। এরা কখনো মুখোমুখী সংঘর্ষে জড়াতে চায় না। ওদের হাতে আছে অঢেল সম্পদ। এই সম্পদ ব্যবহার করে তারা মুসলমানদের শিকড় কাটছে। হিন্দুদের মতো ইহুদীরাও মুসলিমদের ক্ষতিসাধনে কন্যা-জায়াদের ব্যবহার করে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে খৃষ্টানদেরও সহায়তা দিচ্ছে ইহুদীরা। যে কারামতী জনগোষ্ঠীর স্বরূপ আপনি উন্মোচন করে সাধারণ মানুষকে ওদের ধোঁকাবাজী পরিহার করে সঠিক ইসলামে দীক্ষা নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, কুফরী মিশ্রিত কথিত মুসলিম নামের এই গোষ্ঠীর জন্মদাতা ইহুদী পণ্ডিতেরা। আপনার বিরুদ্ধে যেসব মুসলিম শাসক অব্যাহত চক্রান্তে লিপ্ত, পর্দার অন্তরালে তাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে ইহুদীরা। আপনাকে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে রাখার নেপথ্যে ইহুদীরা জড়িত…।

অচিরেই হয়তো নিজ ভূমিতেই স্বগোত্রীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আপনাকে লড়াই করতে হবে। প্রতিবেশী প্রতিপক্ষগুলোকে পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন।

মহান আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন এবং সব সময় সতর্ক থাকুন। নিজ দেশের জনগণকে আপনার সাথে রাখুন। সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠনের চেষ্টা ত্বরান্বিত করুন এবং খাওয়ারিজমের প্রতি বিশেষ মনোযোগ নিবদ্ধ রাখুন। আমি শুনতে পেরেছি, খাওয়ারিজমে ইতোমধ্যে ইহুদীদের কারসাজী। জোরে-শোরে চলছে।”

সেই সময় খাওয়ারিজম ছিল একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। জুরজানিয়া ছিল খাওয়ারিজমের রাজধানী। বুখারা ছিল খাওয়ারিজমের একটি প্রদেশ । খাওয়ারিজম রাষ্ট্রে মামুনী খান্দানের রাজত্ব ছিল। অনেক পূর্ব থেকেই খাওয়ারিজম ছিল মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। ৯৯৫ খৃস্টাব্দে আবু আলী মামুন বিন মুহাম্মদ ইবন আলী খাওয়ারিজমে হামলা করে বাদশা আবু আব্দুল্লাহকে বন্দী করেন এবং গোটা খাওয়ারিজম রাষ্ট্রই দখল করেন নেন। দু’বছর নিজ কজায় রাখার পর ৯৯৭ সালে আবু আলী মামুন নিহত হন। কিন্তু হত্যাকারী আবু আলী মামুনের খান্দানের কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারেনি। পিতার নিহত হওয়ার পর আবু আলী মামুনের পুত্র আবুল হাসান আলী মামুন মসনদে আসীন হন। বারো বছর রাজত্ব করার পর ১০০৯ সালে অপরিণত বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর তিন বছর আগে সুলতান মাহমূদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে তিনি সুলতানের ছোট বোনকে বিবাহ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সুলতানের বোন খাওয়ারিজম ত্যাগ করে সুলতানের কাছে চলে এসেছিলেন।

আবুল হাসান আলী মামুনের ইন্তেকালের পর তার ছোট ভাই আবুল আব্বাস মামুন ক্ষমতাসীন হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র পঁচিশ বছর। আবুল আব্বাসের ছিল দুই স্ত্রী। খাওয়ারিজম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আবুল হারেস বিন মুহাম্মদ আবুল আব্বাসের পিতা আবু আলী মামুনের সময় থেকেই তিনি মন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। এই বয়স্ক মন্ত্রীর গভীর হৃদ্যতা ছিলো মামুনী খান্দানের সাথে। আবুল হারেস ছিলেন সত্যিকারের একজন মুসলমান। মুসলমানদের প্রতি তার হৃদয়ে ছিলো অকৃত্রিম ভালোবাসা। বয়সে প্রবীণ ও ঋজু এই লোকটির কোলে-পিঠেই বড় হয়েছিলেন মামুনের দুই ছেলে। তাই তিনি পিতার মতোই তাদেরকে কল্যাণজনক পরামর্শ দিতেন এবং যে কোন অকল্যাণ ও অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলতেন। খাওয়ারিজম রাষ্ট্রের বুখারা প্রদেশের গভর্নর আলাফতোগীন ছিলেন মধ্যবয়সী ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ চতুর একজন শাসক। এই লোকটিকে আলহারেস পছন্দ করতেন না। দৃশ্যত আলাফতোগীন খাওয়ারিজম রাষ্ট্রের এবং মামুনী খান্দানের আনুগত্য করলেও তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ছিলো সন্দেহজনক।

আবুল আব্বাস ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একদিন নির্ভরযোগ্য বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ মন্ত্রী আলহারেসকে একান্তে ডেকে পাঠালেন। আবুল আব্বাস একান্তে আল হারেস এর সাথে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, প্রজাদের অবস্থা তথা প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করছিলেন। মতবিনিময়ের এক পর্যায়ে আলহারেসের উদ্দেশে আবুল আব্বাস বললেন

“আমার পিতা নিহত হয়েছেন, বড় ভাইও মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি খুবই একাকীত্ব অনুভব করছি। এই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মনের মধ্যে একটি গোপন কথা কাটার মতো কষ্ট দিচ্ছে। আপনি কি এই রহস্যের কিনারা করতে পারবেন?”

“যে সব রহস্যের জাল এই বুড়োর চোখ ভেদ করতে পারবে, এমনটি আর কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। মামুনী খান্দানের অতীত-বর্তমান কোনকিছুই আমার কাছে গোপন নয়। তোমার মনের মধ্যে যদি কোন গোপন কাঁটা বিদ্ধ হয়ে থাকে, তা আমাকে দেখাও, হয়তো আমি সেটিকে অপসারণ করতে পারবো।” বললেন বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আল হারেস।

“আপনি তো জানেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পর বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন এখানে এসেছিলেন। তিনি তখন আমাকে একান্তে বলেছিলেন, আপনার বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আপনাকে খাওয়ারিজমের নতুন বাদশা হিসেবে মোবারকবাদ দিচ্ছি। সেই সাথে আজ আপনার কাছে একটি গোপন রহস্য উন্মোচন করে দেয়া কর্তব্য মনে করছি। আপনি জানেন, আপনার পিতাকে হত্যা করা হয়েছিলো। হত্যাকারীদেরও আপনি জানেন। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, আপনার ভাইও কিন্তু হত্যার শিকার হয়েছেন। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।

এ খবর শুনে আমি খুব একটা পেরেশান হইনি। কারণ, আমাদের শত্রুদের আমি জানি। কিন্তু আলাফতোগীন আমাকে বললেন, “ভাইকে এমন এক ধরনের বিষ খাওয়ানো হয়েছিল, যার প্রতিক্রিয়া ছিলো পেটের পীড়ার মতো। ধীরে ধীরে তার শরীরে এই বিষক্রিয়া চলতে থাকে; কিন্তু ডাক্তারের পক্ষে পেটের পীড়া ছাড়া ওই বিষক্রিয়াকে সনাক্ত করা সম্ভব ছিলো না।”

“এমনটি অসম্ভব কিছু নয়। শত্রুরা অনেক কিছুই তো করতে পারে।” বললেন উজীর আবুল হারেস। আপনাদের শত্রুরা আপনাদের সামরিক শক্তিমত্তার ভয়ে ভীত। তাই তারা এ ধরনের চক্রান্তের আশ্রয় নিতেই পারে।”

কিন্তু ব্যাপারটি শুধু এতেই শেষ নয় সম্মানিত উজীর। বললেন নতুন শাসক আবুল আব্বাস। আলাফতোগীন আমাকে সংশয়হীনভাবে বলেছেন, ভাইকে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন সুলতান মাহমূদ। আর সেই বিষ খাইয়েছে সুলতানের বোন এবং আমার ভাবী স্বয়ং। এই বিষ প্রয়োগের কারণ হিসেবে এ বলেছেন, সুলতান মাহমূদ ভাইকে তার অধীনতা মেনে নিতে বলেছিলেন; কিন্তু সু ভাই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এখন আমি কি আলাফতোগীনের কথা ও বিশ্বাস করবো?”

“না, তুমি বিশ্বাস করবে না।” বললেন বয়স্ক আলহারেস। আলাফতোগীনের কথা বলেই আমি এটিকে ঠিক মনে করি না। এ ছাড়াও আমি এটিকে সত্য মনে করি না এজন্য যে, সুলতান মাহমূদ রক্তে-মাংসে একজন মর্দে মুজাহিদ। তাকে বিষ প্রয়োগ করার কথা বিশ্বাস করা যায়; কিন্তু তিনি কাউকে বিষ প্রয়োেগ করাবেন এটা বিশ্বাস করা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে চিনি। তিনি যদি রাজত্ব এবং রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধিতে আগ্রহী হতেন, তাহলে বেঁচে থাকার সময় চেষ্টা থাকতো তার সব কাজে। কিন্তু তার কাজকর্ম দেখলে তুমিও বলবে, দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে রাজত্ব করা তার শখ নয়। তুমি তো জানো, কতোবার তিনি গযনী থেকে কতো দূরে হিন্দুস্তানে গিয়ে যুদ্ধ করেছেন। এখনও তিনি গযনী থেকে শত শত মাইল দূরে হিন্দুস্তানের সবচেয়ে দুর্গম এলাকায় যুদ্ধ করতে গেছেন। তিনি ইসলামের সৈনিক, ইসলামের প্রচার-প্রসারে লিপ্ত একজন ধর্মপ্রচারক। তিনি একজন সফল মূর্তি ধ্বংসকারী।”

“নতুন বাদশা আবুল আব্বাস আর বয়োজ্যেষ্ঠ উজির যখন পরস্পর এসব কথাবার্তা বলছিলেন, সুলতান মাহমূদ তখন দক্ষিণ কাশ্মীরের লোহাকোট দুর্গ অবরোধ করে বৈরী মওসুম ও দুর্ভেদ্য দুর্গপ্রাচীরের ফাঁদে আটকে গেছেন। তীব্র তুষারপাতে চাপা পড়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে তার সহযোদ্ধারা।

তুমি তো দেখতে পাচ্ছো, কতোবার স্বেচ্ছায় মৃত্যুফাঁদে পা দিয়েছেন সুলতান। বললেন হারেস। হিন্দুস্তানের রাজা-মহারাজাদের সামরিকশক্তি কোন মামুলী ব্যাপার নয়। হিন্দুস্তানের রাজশক্তির বিরুদ্ধে বর্তমান মুসলিম জগতের মধ্যে শুধু সুলতান মাহমূদই টক্কর দিতে পারেন এবং তিনি তা দিচ্ছেনও। এ ধরনের লড়াকু যোদ্ধারা কখনো কাউকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন না।”

“আমি নিহত হতে চাই না।” বললেন আবুল আব্বাস। যে আমাকে জীবিত রাখতে চাইবে এবং নিজেও জীবিত থাকতে চায়, আমি তাকে মিত্র বানাতে চাই। আপনি আমাকে পরামর্শ দিন, আমি কি তুর্কিস্তানের খানদেরকে মিত্র বানাবো, না সুলতান মাহমূদকে মিত্র বানাবো?

.

সুলতান মাহমূদকেই আমার সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী মনে হয়। সুলতান মাহমূদ সম্পর্কে আপনার বিশ্বাস যা-ই থাকুক না কেন, যেভাবে তিনি শক্তির জোরে শত্রুদের পদানত করে তাদের এলাকা গযনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেছে, একদিন হয়তো আমাকেও বলে বসতে পারে আমার আনুগত্য স্বীকার করে নাও। তাছাড়া আমার চতুর্পার্শ্বের শত্রুদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য আমার দরকার একজন শক্তিশালী মিত্র।”

“সেই শক্তি ও মিত্রের দাবী পূরণ করার ক্ষমতা একমাত্র সুলতান মাহমূদেরই রয়েছে।” বললেন উজীর আল হারেস।

“আমার মনের কথাগুলো আজ আপনার কাছে বলতে চাই সম্মানিত উজীর।” বললেন আবুল আব্বাস। শুধু কথা আর অঙ্গীকারের দ্বারা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ততোটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমার মনে মিত্রতা দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী করার একটা চমৎকার কৌশল এসেছে। আমি সুলতান মাহমূদের বিধবা বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবো। সে আমার বড় ভাইয়ের বিধবা। তাকে তখনই আমার খুব ভালো লাগতো। বয়সে সে হয়তো আমার চেয়ে এক অর্ধ বছরের বড় হবে; কিন্তু সুলতান মাহমূদ কি আমার সাথে তার বোনের বিয়ের ব্যাপারে রাজী হবেন?”

“স্মিত হেসে আবুল হারেস বললেন, “এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারবো না। তবে আপনি কি এই ঝুঁকির ব্যাপারটি ভাবেন না? আপনার ভাইকে যদি সে বিষ দিতে পারে, তবে আপনাকেও সে বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে পারে।”

“না, নাহিদা আমাকে বিষ দিতে পারে না।” আকাশের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে স্বগতোক্তির মতো করে বললেন আবুল আব্বাস। না, লাবণী আমাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে পারবে না। কিছুটা উচ্চৈঃস্বরেই উচ্চারণ করলেন আব্বাস। আবুল হারেসের দিকে তাকিয়ে বললেন, লাবণী জানতো আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি। আমি ছিলাম তার স্বামীর ছোট ভাই, দেবর ।

সে আমাকে খুবই ভালোবাসতো। আদর করে আমাকে শাহজাদা ডাকতো।… সত্য কথা বলতে কি, ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমার মনে হয়েছে, আমি ভাইয়ের শূন্যতাকে সহ্য করতে পেরেছি; কিন্তু লাবণীর চলে যাওয়াকে সহ্য করতে পারছি না।”

“আপনি কি নাহিদার ভালোবাসার টানে তাকে বিয়ে করতে চান, নাকি সুলতানের সাথে বন্ধুত্ব ও মিত্রতা মজবুত করার জন্য?

“উভয়টিই আমার লক্ষ্য।” উজিরের জিজ্ঞাসার জবাবে বললেন আবুল আব্বাস। তবে নাহিদার প্রতি আমার ভালোবাস হয়তো প্রাধান্য পাবে। আসল কথা হলো, নাহিদাও আমাকে ভালবাসতো। কিন্তু তার ও আমার এই ভালোবাসার মধ্যে কোন কদর্যতা ছিলো না। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো অনেকটা ভাই-বোনর মতো অথবা গুণবতী ভাবী আর স্নেহশীল দেবরের মধ্যে যেমনটি হয়ে থাকে।

অবশ্য এখন অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে। তখন নাহিদার সাথে আমার এতোটাই গভীর হৃদ্যতা ছিলো যে, আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আলনূরী এ ব্যাপারে আমার প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট ছিল। আল নূরীর পিতা আবু ইসহাককে আপনি জানেন। তিনি আমাদের সেনাবাহিনীর একজন শীর্ষ কমান্ডার এবং সেনাপতি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আল নূরী নাকি তার কাছে আমার ব্যাপারে নালিশ করেছে। আমি শ্বশুর সাহেবকে বলেছি, আলনূরী আমাকে ও আমার ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে নিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করেছে। ভবিষ্যতে যেন সে আর এমন দুঃসাহস না করে। আমার এই কথা বলার পর তার চেহারার যে অবস্থা আমি দেখলাম, তা মোটেও ভালো মনে হলো না।”

“সুলতান মাহমূদকে হিন্দুস্তান থেকে ফিরে আসতে দাও। তোমার এই প্রস্তাবে যেমন তোমার প্রেম-ভালোবাসা রয়েছে, তদ্রূপ এতে কৌশলী রাজনীতিও রয়েছে। এ ব্যাপারে তুমি আরো চিন্তা করো, আমিও ব্যাপারটি নিয়ে আরো ভাবি। বললেন উজির।

আবুল আব্বাস আর তার প্রধান উজির আবুল হারেস যখন সুলতান মাহমূদের সাথে মৈত্রী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে মতবিনিময় করছিলেন, সুলতান মাহমূদ তখন কাশ্মীরের বৈরী পরিবেশে ব্যর্থতার গ্লানিতে বিপর্যস্ত হচ্ছিলেন। তার অজেয় বাহিনীর সৈন্যরা ঝিলম নদীর শীতল পানিতে ভেসে যাচ্ছিল আর তুষারপাতে বরফের নিচে তলিয়ে যাচ্ছিল।

এ ঘটনার প্রায় ছয় মাস পর উজির আবুল হারেস একদিন বাদশা আবুল আব্বাসকে একান্তে বললেন, গযনী থেকে বিস্ময়কর খবর এসেছে! সুলতান মাহমূদ কাশ্মীর থেকে এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে এসেছেন যে, তার সাথে এক-দশমাংশ সৈন্যও ফিরে আসেনি। যারা ফিরে এসেছে এদের অধিকাংশই মারাত্মকভাবে আহত। এবারের ফিরে আসায় মাহমূদের সাথে হিন্দুস্তানের সোনা দানা বোঝাই জঙ্গী হাতি যেমন ছিলো না, কোন হিন্দু বন্দীও ছিলো না। তার গোটা সামরিক শক্তিই সেখানে ধ্বংস হয়ে গেছে।”

“এরপরও আমি তার বোনকে বিয়ে করতে চাই।” বললেন আবুল আব্বাস। আপনি অভিজ্ঞ ব্যক্তি। আপনার মতো অভিজ্ঞতা আমার নেই। কিন্তু আপনি মনে হয় আমার কথা সমর্থন করবেন। আমি যদি দুঃসময়ে সুলতান মাহমূদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াই, সে নিশ্চয়ই আমার প্রতি কৃতজ্ঞ ও হিতাকাতক্ষী থাকবে। কখনো যদি আমাদের উপর কোন বিপদ এসে পড়ে, তখন সে নিশ্চয়ই আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে।

আপনি বলুন তার কাছে আমার প্রস্তাব পাঠানোর উপযুক্ত সময় কোনটি হতে পারে? আমাকে কি নিজে যেতে হবে?”

“এখনই উপযুক্ত সময়।” বললেন, আবুল হারেস। তার এই শোচনীয় পরাজয়ে সহমর্মিতা জানানো দরকার। তা ছাড়া কূটনৈতিক রীতি রক্ষায় এটাও বলা যেতে পারে যে, আমরা তার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে তোমার যাওয়া জরুরী নয়। আমিই যাবো এবং বিয়ের প্রস্তাবও তাকে দিয়ে আসবো।

কয়েক দিন পর খাওয়ারিজমের প্রবীণ উজীর আবুল হারেস দু’জন দূত এবং কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষীসহ কয়েকটি উপঢৌকন বোঝাই উট নিয়ে গযনী পৌঁছলেন। সুলতান মাহমুদের কাছে খবর গেলো, খাওয়ারিজমের বাদশা আবুল আব্বাসের উজির সুলতানের সাথে দেখা করতে এসেছেন। খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবেই উজিরকে সুলতানের কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়া হলো।

খাওয়ারিজমের বাদশা শাহ্ আবুল আব্বাস মামুন সুলতানে আলী মাকাম এর খেদমতে কিছু উপঢৌকন পাঠিয়েছেন। সেই সাথে কাশ্মীর অভিযানে আপনার অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি ও পরাজয়ের জন্যে আন্তরিক সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। শাহে খাওয়ারিজম আরো বলেছেন, আল্লাহ তাআলা সুলতানকে এতোগুলো বিস্ময়কর বিজরে পর একটি মাত্র ব্যর্থতা দিয়েছেন, এটিও ধারাবাহিক সাফল্যেরই অংশ। আল্লাহ তাআলা গযনী সুলতানকে যে মনোবল ও সাহস দিয়েছেন, আশা করি পরাজয় তাকে কাবু করতে পারবে না। শাহ বলেছেন, আমি প্রয়োজনে যে কোন ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। কেননা, বিপদেই তো ভাই ভাইয়ের কাজে লাগে।”

আমাদের এখানকার রীতি ও শিষ্টাচার এটাকে সমর্থন করে না যে, একজন মুসলমান বাদশাহর সম্মানিত উজির সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে। আপনি আমার পাশের আসনে বসুন।” আবুল আব্বাসকে সম্মানের সাথে কথাগুলো বললেন সুলতান।

সুলতানের আবদারে প্রবীণ কূটনীতিক ও মন্ত্রী আবুল হারেস আসনে বসলেন। অতঃপর সুলতান মাহমূদ বললেন, “আমি খাওয়ারিজম বাদশাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আমি যখন আমার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমার এই দুঃসময়ের সুযোগে স্বার্থসিদ্ধির আশঙ্কা করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছেন। তাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, নিঃসন্দেহে নির্ভরযোগ্য বন্ধুর আমার খুব প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আমি সাহায্য-সহযোগিতা চাই না।”

খাওয়ারিজমের অভ্যন্তরীণ অবস্থার ব্যাপারে আমারও প্রবল আগ্রহ আছে। আবুল আব্বাস একেবারেই তরুণ। সাগর উপকূলে বুখারায় কী ঘটছে, এসব ব্যাপার কি সে বোঝে? সে কি জানে গভর্নর আলাফতোগীনের দৃষ্টিভঙ্গী কী?”

“সে না জানলেও এসব ব্যাপার আমার অজানা নয় সুলতান।” বললেন, উজীর আবুল হারেস। গভর্নর আলফতোগীনের কর্মকাণ্ড আমার কাছেও সন্দেহজনক মনে হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের আস্থা আছে।

আমি যতোটুকু জানি, তাতে বলতে পারি, সেনাদের উপর আপনাদের বেশী আস্থা রাখা মোটেও ঠিক নয়। বললেন সুলতান। সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিকদের নীতি নির্ধারণে কোন ভূমিকা থাকে না। মূলত সেনাপতি ও ডেপুটি সেনাপতিরাই সেনাবাহিনীর মূলশক্তি। তারাই নীতি নির্ধারণ করে, সাধারণ সৈনিকরা হয় তাদের ঘুটি। এদেরকে ব্যবহার করা হয় মাত্র। অনেক সময় সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে শাসক হওয়ার নেশা চাপে আর তাদের উচ্চাকাক্ষার বলির পাঠায় পরিণত হয় সাধারণ সৈনিকরা। দুর্নামটাও এসে পড়ে সাধারণ সৈনিকদের উপর। জনসাধারণের যতো ক্ষোভ-নিন্দা সব পড়ে সাধারণ সৈনিকদের উপর। শাস্তিও পেতে হয় তাদেরই। কর্মকর্তারা থাকে পর্দার আড়ালে, জনতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আপনাকে সেনাকর্মকর্তাদের প্রতি কড়া নজর রাখতে হবে।”

নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় উজীর ও সুলতান মতবিনিময় করছিলেন। উজীর আবুল হারেস ছিলেন অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী লোক। তিনি কথায় কথায় বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে ফেললেন।

“সম্মানিত সুলতান! আবুল আব্বাস আপনাকে সহযোগিতার প্রস্তাব করেছেন ঠিকই; কিন্তু সত্যিকার অর্থে তিনিই আপনার সাহায্য প্রত্যাশী। অবশ্য এখনই তার কোন সাহায্যের প্রয়োজনই নেই। তিনি আপনার সাথে দৃঢ় মৈত্রী গড়ে তুলতে আগ্রহী। তিনি এমন একজন শাসকের সাথে মৈত্রী গড়ে তুলতে চান, যে তাকে কখনো ধোকা দেবে না। আর এমন ব্যক্তি আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। স্থায়ী ও অটুট মৈত্রী বন্ধনের জন্য তিনি আপনার বোন, তার মৃত ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করতে চান। সুলতান যেন তার এই আবেদন গ্রহণ করেন একান্তভাবে তিনি তা কামনা করেন।”

“বিয়ের ফয়সালা আমার বোন নিজে করবেন। বললেন সুলতান। প্রশাসনিক স্বার্থ রক্ষার জন্য আমি বোনকে ব্যবহার করতে মোটেও রাজি নই। আমি তাকে পরামর্শ দিতে পারি, খাওয়ারিজম ও গযনীর সম্পর্কের গুরুত্ব বোঝাতে পারি; কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত তার উপর চাপিয়ে দিতে পারি না। কারণ, বিয়ের বিষয়টি একান্তই তার মনের ব্যাপার। আপনাকে এর জবাব পেতে হলে কিছুদিন সময় দিতে হবে।”

“খাওয়ারিজমের মসনদে আসীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আবুল আব্বাসকে একজন সুন্দর মনের মানুষ হিসেবেই আমি জানতাম।” সুলতানকে বললো তার বিধবা বোন। “তখন সে ছিল নিতান্তই বালক। এখন সে যুবক। সেই সাথে মসনদে আসীন বাদশা। এ পর্যায়ে তাকে পর্যবেক্ষণ বা তার সম্পর্কে কিছু বলা মুশকিল। নিশ্চয়ই এখন তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে।”

“তার এই পয়গামের জবাব তুমি দেবে। আমি তার প্রতিনিধিকে জানিয়ে দিয়েছি, আমি বোনের উপর এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবো না।”

“সে কথা হয়তো ঠিকই আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে আপনার পরামর্শ আমার দরকার আছে। আপনি যদি মনে করেন, খাওয়ারিজমের বাদশাকে আমি বিয়ে করলে গযনীর কোন উপকার হবে, তাহলে তাকে আমি বিয়ে করতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করবো না। কোন বাদশাকে বিয়ে করে তার প্রাসাদের রওনক বাড়ানোর আগ্রহ আমার নেই। তদ্রুপ কোন শাহের বউ হয়ে সম্রাজ্ঞী সাজার অভিলাষও আমার হয় না। যে ভাইয়ের প্রতিটি দিবানিশি কাটে অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে জিহাদরত অবস্থায়, তার বোন কোন শাহের রাজপ্রাসাদে রাজরাণী হয়ে বিলাস-ব্যসনে বিভোর হতে পারে না। আমাকে আপনি পরিষ্কার করে বলুন, খাওয়ারিজম শাহের তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে তার সাথে আমার বিয়ে হলে এখানকার মুসলিম ও গযনী সালতানাতের কোন কল্যাণ হবে কি? যদি তা হয়, তবে যে কোন দিন আমি আবুল আব্বাসকে বিয়ে করতে সম্মত আছি।”

“খাওয়ারিজমের সৈন্যদেরকে জিহাদে ব্যবহার করার সুযোগ আছে।” বললেন সুলতান মাহমূদ। ছোট হোট মুসলিম রাজ্যের শাসক এবং মুসলিম রাজা-বাদশাহরা পরস্পর বিরোধে লিপ্ত। কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের আক্রমণ আশঙ্কা ঘনীভূত হলেই কেবল মুসলিম বাদশাহরা কয়েকজন মিলে মৈত্রী গড়ে তোলে। ইসলামের স্বার্থে এরা কখনো কোন জোট বা মৈত্রী গড়তে আগ্রহী নয়।

মুসলিম শাসকরা পরস্পর বিরোধে লিপ্ত। এই সংঘর্ষ আর বিরোধকে অতি সংগোপনে ইন্ধন জোগাচ্ছে ইহুদী-নাসারা গোষ্ঠী। আমি পরস্পর বিচ্ছিন্ন মুসলিম শাসকদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই। খাওয়ারিজম একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। কিন্তু আমি খবর পাচ্ছি, খাওয়ারিজমের ভেতরে ভেতরে চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। মনে হয় আবুল আব্বাস এ ব্যাপারে মোটেও অবগত নয়। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন আবুল আব্বাসকে আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারে। এমনও হতে পারে, আমি যখন আমার সৈন্যঘাটতি পূরণে ব্যস্ত, এই সুযোগে খাওয়ারিজমের সৈন্যরা গযনী আক্রমণ করে বসবে। আমি যে কোন অবস্থায় ওদের প্রতিরোধ করতে পারবো; কিন্তু আমার সৈন্য সংখ্যা নিতান্তই কম। তা ছাড়া এটা তো হবে স্রেফ গৃহযুদ্ধ। দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের যুদ্ধে ইসলামের শক্তি ক্ষয় হবে আর এই সুবিধা নেবে অমুসলিমরা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখন গযনীর সাথে যে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের যুদ্ধে সবচেয়ে উপকৃত হবে হিন্দুস্তানের পৌত্তলিক শাসকরা।”

“আপনি যদি মনে করেন, আবুল আব্বাসের স্ত্রী হয়ে আমি তাকে আলাফতোগীনের কুমন্ত্রণা ও চক্রান্ত থেকে রক্ষা করতে পারবো, তাহলে এই বিয়েতে আমার কোন আপত্তি নেই।” বললো নাহিদ।

“এটি তুমিই ভালো বলতে পারবে। আচ্ছা, তুমি যখন তার ভাইয়ের স্ত্রী ছিলে, তখন তার উপর তোমার কেমন প্রভাব ছিলো? তখন কি তার সাথে তোমার কোন জানাশোনা ছিলো?” বললেন সুলতান।

“তখন ছিলো আমার একনিষ্ঠ ভক্ত।” বললো নাহিদ।

ওকে আমি খুবই আদর করতাম। সে আমার স্নেহ-মমতার জন্যে উদগ্রীব ছিলো। কারণ, অনেক আগেই তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। এরপর তার পিতা নিহত হন। ছোট্ট আবুল আব্বাসকে মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের শূন্যতা অনুভব করতে দিইনি আমি। সে বেশির ভাগ সময় আমার কাছেই থাকতো। শাহজাদা ছিলো সে। কিন্তু শাহজাদা হলেও মানবিক মায়ামমতার ঘাটতি শান-শওকত দিয়ে পূরণ হয় না। সে আমাকে মা ও বড় বোনের মতোই শ্রদ্ধা করতো। প্রথমে সে বিয়ে করলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার অপর এক স্ত্রীকে ঘরে তুললো। কিন্তু তবুও মনের প্রশান্তির জন্য প্রাণ খুলে দুঃখ-সুখের কথা বলতে সে আমার কাছেই ছুটে আসতো। কিন্তু তার ভাইয়ের ইন্তেকালের চার মাস পর যখন আমি তাদের প্রাসাদ ছেড়ে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ভাইজান, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, পরিণত একটি যুবক হয়েও সে তখন শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদছিলো। তার ভাইয়ের মৃত্যুতেও সে এতোটা কান্নাকাটি করেনি।”

“তাহলে তুমি তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের কজায় নিয়ে আসতে পারবে। তার হৃদয়ে শুধু গযনী সালতানাতের নয়- ইসলামের মমতা তৈরী করতে হবে। আমার সালতানাতকে ঝুঁকিমুক্ত করার চেয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে গজিয়ে ওঠা হিংস্র শয়তানগুলোকে কাবু করাই আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।”

“তার মন-দেমাগ যদি বাদশাহীর তখতে বসে বিগড়ে না গিয়ে থাকে, তাহলে আশা করি, আমি তাকে পথে আনতে পারবো। বললো নাহিদ। আপনার সদিচ্ছা পূরণে এবং ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমি আমার আবেগ-অনুভূতি কুরবানী দিতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করবো না। আমি খাওয়ারিজমের সেনাবাহিনীর দৃষ্টি কাফেরদের প্রতি ঘুরিয়ে দেবো। আমি আপনার সাথে রণাঙ্গনে জিহাদে যেতে পারবো না বটে; কিন্তু আপনার জিহাদে শক্তিবৃদ্ধিতে জীবন তো দিতে পারব।”

“নাহিদের কথাবার্তা শুনে সেদিনই প্রচুর উপহার-উপঢৌকন দিয়ে সুলতান মাহমূদ আবুল আব্বাস মামুনের কাছে পয়গাম পাঠালেন, পূর্ব প্রস্তাব ঠিক থাকলে সে সুলতানের ছোট বোন নাহিদের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।

এক মাসের মধ্যে আবুল আব্বাস ও নাহিদের বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু এ বিয়ে তো বিয়ে নয়, এই বিয়ে সুলতানের জন্য ভয়াবহ এক টর্নেডোতে রূপান্তরিত হলো, যে টর্নেডো গোটা মুসলিম বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিল। শুধু ডাঙায় নয়- সুলতান মাহমূদকে এর মূল্য দিতে সমুদ্রেও যুদ্ধ করতে হলো। উভয় পক্ষের হাজারো নৌকা জলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। ভয়াবহ এই যুদ্ধে আগে চালানো হলো অতিসূক্ষ্ম চক্রান্তের খেলা। যে কূটনৈতিক চক্রান্তের ঘুটি উভয়পক্ষই চেলে ছিল বিয়ের আসরে।

বিয়ে হয়ে গেল। অনেকটা সাদামাটাভাবেই সুলতান তার আদরের ছোট বোন নাহিদকে খাওয়ারিজমের তরুণ বাদশা আবুল আব্বাসের বন্ধনে তুলে দিলেন। আবুল আব্বাস খুশী মনে নতুন বউ নিয়ে বাড়ীতে ফিরে বিশাল আকারে ওলীমার আয়োজন করলেন।

খাওয়ারিজ শাহের এই তৃতীয় বিয়েতে রাজধানী জুরজানিয়াকে এমন আলোকসজ্জায় সাজানো হলো যে, রাতের রাজধানীও দিনের মতোই আলো ঝলমলে রূপ পরিগ্রহ করলো। প্রতিবেশী সব মুসলিম শাসকদের দাওয়াত করা হলো। হাজার হাজার মেহমানের পদভারে স্পন্দিত রাজধানী।

সুলতান মাহমূদের পক্ষ থেকে সুলতানের পরিবর্তে তার সেনাবাহিনীর দুই প্রবীণ সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈ এবং সেনাপতি আলতানতাশ প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তাদের সাথে ছিলো আরো কয়েকশত সৈনিক। এদের ছাড়াও ছিলেন গোয়েন্দা প্রধান ও নাশকতা প্রতিরোধ ইউনিটের চিফ কমান্ডার।

বিশাল এই আয়োজনে খাওয়ারিজ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রদেশ বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন হাজির হলেন বিশেষ জাঁকজমক নিয়ে। আবুল আব্বাসের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অফিসার ও সেনাপতিরাও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত। বুখারা অঞ্চলের সেনাপতি খমরতাশ আর সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রভাবশালী সেনাপতি আবুল আব্বাসের দ্বিতীয় শ্বশুর সেনাপতি আবু ইসহাক গর্বিত ভাবভঙ্গি নিয়ে অনুষ্ঠানে সমাসীন। ঘটনাক্রমে খাওয়ারিজমের এই তিন মহারথি পাশাপাশি আসনে উপবিষ্ট এবং প্রত্যেকের চেহারাতেই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বদলে চাপা উত্তেজনা ও ক্ষোভ পরিস্ফুট। দৃশ্যত তারা সবাই সুলতান মাহমুদের দুই প্রতিনিধির সাথে হাসিমুখেই হাত মেলালেন; কিন্তু কুশল বিনিময়ের পরই তারা সুলতানের প্রতিনিধিদের থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে আসন নিলেন। তাদের পাশেই গ্রাম্য বেশে আগে থেকেই বসা ছিলেন সুলতান মাহমূদের বিশেষ ইউনিটের দুই দক্ষ পরিচালক। এদেরকে বিশেষ দিক-নির্দেশনা ও দায়িত্ব দিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে বিয়ে অনুষ্ঠানে পাঠিয়েছিলেন সুলতান মাহমূদ।

“তোমরা মনে করো না, আমার বোনকে বিয়ে করে আবুল আব্বাস আমার শুভাকাক্ষী হয়ে গেছে।” বললেন সুলতান মাহমুদ। হতে পারে আবুল আব্বাস আমার সাথে সত্যিকার অর্থেই সুসম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী; কিন্তু তোমরাই তো খবর দিয়েছে, ওখানকার প্রশাসনও সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অগ্নৎপাতের জন্য লাভা তৈরী হচ্ছে। চক্রান্ত ও প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের কানাঘুষা চলছে। সেখানে গিয়ে তোমরা নিজেদেরকে আলতানতাশ ও আলতাঈ এর সফরসঙ্গী হিসেবে পরিচয় দেবে না, বরং তোমরা থাকবে সাধারণ বেশে। পরিচয় দেবে সমরকন্দের ব্যবসায়ী হিসেবে। সেখানে বহু লোকের সমাগম হবে, খেলতামাশা, আতশবাজী হবে। এসব খেলতামাশার প্রতি তোমরা মনোযোগী হবে না। তোমাদের দৃষ্টি থাকবে পর্দার অন্তরালে অতি সংগোপনে যে চক্রান্তের খেলা শুরু হয়েছে, সেদিকে। তিনজন লোকের পেছনে তোমরা ছায়ার মতো লেগে থাকবে। তাদের কথা সরাসরি শুনতে না পারলেও তাদের চালচলন, ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে চেষ্টা করবে তারা আসলে কী করতে চাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

তিনজনের মধ্যে একজন হলো, বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন, দ্বিতীয়জন আবুল আব্বাসের দ্বিতীয় শ্বশুর সেনাপতি আবু ইসহাক, তৃতীয়জন বুখারা অঞ্চলের সেনাপতি খমরতাশ।

এই দুজনকে এর চেয়ে বেশী সতর্ক ও জ্ঞান দেয়ার কোনই প্রয়োজন ছিলো । কারণ এরা উভয়েই দুটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা শাখার প্রধান। তারাই খাওয়ারিজমের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কথা তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। এই দুই ব্যক্তি যখন জুরজানিয়ার বিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হলেন, তাদের দেখে কারো বোঝার উপায় ছিলো না, এরা সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দা শাখার প্রধান এবং মাটির নিচের ঘটনাবলীও এরা দিব্যচোখে দেখতে পারে। তারা একনজর তাকালেই যে কারো ভেতরের মনোভাবও বুঝতে পারে। তারা উভয়েই ব্যবসায়ীদের মতো ঢিলেঢালা পোশাকে সজ্জিত ছিলো।

উভয়েই আলাফতোগীন, খমতাশ ও আবু ইসহাকের পিছনের সারিতে গিয়ে বসলেন। রাতের প্রজ্জ্বলিত মশালের আলোয় ঘোড়দৌড় শুরু হবে হবে অবস্থা। বিশাল মাঠের চতুর্দিকে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। এক পাশে বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে বাদশা, নতুন রাণী এবং রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আসন। তরবারী প্রতিযোগিতা, মল্লযুদ্ধ ছাড়া নানা ধরনের সামরিক কলা-কৌশল প্রদর্শনীর আয়োজন সম্পন্ন।

হঠাৎ তীব্র ও উচ্চ রণসঙ্গীত বাজিয়ে জানানো হলো নব বরবেশী বাদশা আবুল আব্বাস ও নতুন রাণীবেশী নাহিদার আগমনীবার্তা। আবুল আব্বাস নববধূ নাহিদাকে নিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছেন। নাহিদা দীর্ঘাঙ্গি, সুন্দরী যুবতী। তার প্রতিটি পদক্ষেপে রাজকীয় গাম্ভীর্যতা ও অবয়বে দীপ্তিময় আভা। যুবক বাদশা আবুল আব্বাসও অপূর্বসাজে সজ্জিত।

দৃঢ় পদক্ষেপে নাহিদাকে নিয়ে তিনি রাজকীয় আসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর বাদক দল আকাশ-বাতাস মুখরিত করে আগুন ঝরানো বাজনা দিচ্ছে। চতুর্দিকে লাখো জনতার কণ্ঠে হর্ষধ্বনি। মহামান্য বাদশা আবুল আব্বাস দীর্ঘজীবী হোক, সুখময় হোক তাদের নতুন দাম্পত্য, দীর্ঘতর হোক মামুনী শাসন। আবুল আব্বাস ও নাহিদার পিছনে পিছনে আবুল আব্বাসের প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীও রাণীর পোশাকে সজ্জিত হয়ে আসছিলো। তবে তাদের চেহারায় তেমন কোন জৌলুস ছিলো না, ছিলো না কোন আনন্দ-ফুতি আবেগ ও উচ্ছ্বাসের চিহ্ন।

সুলতান মাহমূদ তার বোনের বিনিময়ে শুধু খাওয়ারিজম শাহকে নয় গোটা খাওয়ারিজম সালতানাতকেই খরিদ করতে চাচ্ছে। বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললো আবুল আব্বাসের দ্বিতীয় শ্বশুর এবং সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাপতি আবু ইসহাক।

আবু ইসহাকের এ কথায় পিছনের দিকে তাকালেন বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন। তাদের পেছনেই সুলতান মাহমুদের দুই শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ব্যবসায়ী বেশে বসে পরস্পর কথা বলছে।

“আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?” স্মিত হেসে পিছনের দুজনকে জিজ্ঞেস করলেন গভর্নর আলাফতোগীন।

উভয়েই স্মিতহাস্যে আলাফতোগীনের প্রত্যুত্তরে মাথা দোলালেন। তারা উভয়েই মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন আলাফতোগীনের ভাষা তারা বুঝতে পারছেন না। অথচ তাদের মাতৃভাষাই ছিলো ফারসী। আলাফতোগীন ফারসী ভাষাতেই তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। আলাফতোগীন, খমরতাশ ও আবু ইসহাক প্রত্যেকেই নানাভাবে তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিপুণতার সাথেই তাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন, তাদের কোন কথাই তারা বুঝতে পারছেন না। এক পর্যায়ে তাদের একজন বললেন, ‘ফিরকতাগ। ফিরকতাগ জুরজানিয়া থেকে পূর্বদিকে অনেক দূরে অবস্থিত একটি পাহাড়ী এলাকার নাম। ওখানকার ভাষা ছিলো ভিন্ন।

“এরা আমাদের ভাষা বোঝে না”। দুসঙ্গীকে বললেন বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন। আমি ওদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম। ঠিক আছে…। আবু ইসহাক! আপনি কি যেনো বলতে চাচ্ছিলেন?”

“বলছিলাম, এ বিয়ে শুধু আবুল আব্বাস আর নাহিদার মধ্যে হয়নি। এই সম্পর্কের মাধ্যমে গোটা খাওয়ারিজমকেই বোনের বিনিময়ে খরিদ করতে চাচ্ছে সুলতান মাহমূদ। এখান থেকে সুলতান মাহমূদ আর তার বোন আবুল আব্বাসকে আঙুলের ফাঁকে ঘোরাবে, আঙুলের ইশরায় নাচাবে। সে বুঝতেই পারবে না খাওয়ারিজমের উপর গযনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আপনি কি এমন ন্যাক্কারজনক অধীনতা মেনে নেবেন আলাফতোগীন?”

“আরে, সেই সময়টা আসতে দাও না”। বললেন আলাফতোগীন। খাওয়ারিজমের মাটিতে কোন গযনী সৈন্যের পা পড়লে ওদের চিহ্নও কেউ খুঁজে পাবে না।”

“আগে থেকেই এজন্য প্রস্তুতি নেয়া দরকার।” বললেন সেনাপতি খমরতাশ।

“সেনাবাহিনী আপনার নিয়ন্ত্রণে। সৈন্যদেরকে আপনি নিজের আয়ত্তে রাখুন।”

“দেখো, এসব কথা কি এখানে আলোচনা করা ঠিক হবে?” উদ্বিগ্নকণ্ঠে বললেন সেনাপতি আবু ইসহাক।

“চিন্তার কারণ নেই। আমাদের সবচেয়ে কাছে বসা লোক দু’জন আমাদের ভাষা বোঝে না।” বললেন সেনাপতি খমতাশ।

“ওরা আমাদের ভাষা না বুঝুক, ডানে-বামে কথা চলে যেতে পারে। সতর্কতার বিকল্প নেই।” বললেন আলাফতোগীন।

আচ্ছা আবু ইসহাক! আবুল আব্বাসের উপর আপনার মেয়ের কি কোন প্রভাব আছে?”

“আছে বৈকি। কিন্তু এখন কতটুকু থাকবে সেটাই চিন্তার বিষয়। মাহমূদের বোন নাহিদা খুবই চালাক। মনে হয় এখন আর আমার মেয়ে তার প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে না।

“তাদের পিছনে বসে সুলতান মাহমূদের দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাদের কথাবার্তা শুনছিলো। আলাফতোগীন ও তার সাথীরা যখনই তাদের দিকে তাকাতো, তখনই তারা উভয়কেই ময়দানের খেলা দেখায় মগ্ন দেখতে পেতো। তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে লাখো দর্শক জনতার হৈ চৈ আর উল্লাস ধ্বনিতে গোটা এলাকা সরগরম। এরই মধ্যে সুলতান মাহমূদের দুই গোয়েন্দা গভর্নর আলাফতোগীন ও তার সাথীদের কর্থাবার্তা শোনার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু তারা বেশীক্ষণ আর সেই বিষয়ে আলাপ করলো না। প্রসঙ্গ বদল করে অতি সাধারণ মজলিসী কথাবার্তা বলতে শুরু করলো। কিন্তু প্রাথমিক কথাবার্তা শুনেই সুলতানের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলো এরা এই বিয়েতে মোটেই খুশী হতে পারেনি। ভয়ঙ্কর কোন চক্রান্তের আয়োজনে তারা ব্যস্ত। অচিরেই তারা বাদশা আবুল আব্বাসের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবে।

মাঝরাত পর্যন্ত চললো আবুল আব্বাসের বিবাহোত্তর জাকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। মাঝরাতের পর অনুষ্ঠান শেষে সবাই যার যার মতো ঘরের পথ ধরলো। দূরের অতিথিরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট অতিথিশালায় ঘুমোতে গেলো।

সবাই যার যার মতো শয়নকক্ষে চলে গেলেও বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন, প্রবীণ সেনাপতি আবু ইসহাক ও সেনাপতি খমতাশ একই কক্ষে সমবেত হলেন। মধ্যরাতের পর হঠাৎ ভেতর থেকে তাদের কক্ষের দরজা খুলে একজন বোরকা পরিহিতা মহিলা প্রবেশ করলো। ঘরে প্রবেশ করেই মহিলা তার চেহারার নেকাব খুলে ফেললো। এই মহিলা আর কেউ নয়, আবুল আব্বাসের দ্বিতীয়া স্ত্রী সেনাপতি আবু ইসহাকের কন্যা আলজৌরী।

গতরাতের সব কথাই আমি জানতে পেরেছি। একটি আসনে বসতে বসতে বললো আলজৌরী। নাহিদার বাসর রাতের জন্য যে সেবিকাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো, তাকে আমি আগেই হাত করে নিয়েছিলাম। সে আমার কথামতো বাসর রাতে আবুল আব্বাস ও নাহিদার কথাবার্তা শোনার জন্য দরজার সাথে কান লাগিয়ে রেখেছিলো। সে রাতে তার দায়িত্ব ছিলো আবুল আব্বাসের দরজার পাশে থাকা। ফলে তাকে দরজায় কান লাগিয়ে বসে থাকতে দেখেও কারো কিছু বলার ছিলো না।

সেবিকা বুদ্ধি করে কক্ষের একটি জানালার একটি পাল্লা ঈষৎ খুলে রেখেছিলো। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবুল আব্বাস নিজেই সেবিকাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে নেয়। সেবিকার উপস্থিতিতেই নাহিদা ও আবুল আব্বাসের কথাবার্তা চলতে থাকে। সেবিকার মুখে যা শুনলাম, তা আমি আপনাদের বলে দিচ্ছি। নাহিদা আবুল আব্বাসের ঘরে শুধু বউ হয়েই আসেনি- সে একটি কঠিন উদ্দেশ্য এবং ফাঁদ হয়ে এসেছে।

আবুল আব্বাসও তাকে শুধু বউ মনে করে না। আবুল আব্বাসের কথাবার্তা থেকে অনুমিত হচ্ছে, সে নাহিদার প্রেমে অন্ধ এবং নাহিদাকেই সে মনে করে মনের সম্রাজ্ঞী।

সে যুগের রাজকীয় সংস্কৃতি এবং রাজ-রাজাদের একান্ত সেবিকাদের জন্য তাদের বাসর ঘরের একান্ত কথাবার্তা শোনার বিষয়টি বর্তমানের আলোকে উদ্ভট মনে হলেও সে যুগে তা মোটেও অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো না। সেবিকা আলজৌরীর টোপ গিলে আলজৌরীকে আবুল আব্বাস ও নাহিদার যেসব অন্তরঙ্গ কথাবার্তা পাচার করেছিলো, তা ছিলো অনেকটা এরকম

আবুল আব্বাসের উদ্দেশে নাহিদা বললো, “আবুল আব্বাস! একজন তৃতীয় স্ত্রীর প্রয়োজনে যদি তুমি আমাকে বিয়ে করে থাকো, তাহলে খোলাখুলি আমাকে সেই কথা বলে ফেলো। তোমার প্রেমকে হৃদয়ের মণিকোঠায় ধারণ করে আমি অনুতাপের কান্না কেঁদে নেবো।”

“না না নাহিদা! তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিলো। নয়তো স্ত্রী হিসেবে নারীর অভাব আমার ছিলো না। কেননা, তুমি আমার ভাইয়ের স্ত্রী থাকা অবস্থাতেও তো আমাকে প্রাণাধিক স্নেহ করতে।”

“তখন ঠিকই তোমাকে ভালোবাসতাম। তবে সেই স্নেহ-ভালোবাসা ছিলো ভিন্ন। মূর্তি সংহারী এক মুজাহিদের বোনের মধ্যে চারিত্রিক স্খলন থাকতে পারে না। স্বামীকে সে ধোকা দিতে পারে না। তখন তোমার চলাফেরা

ও কথাবার্তা সবকিছুই আমার ভালো লাগতো। সেটি ছিলো একজন গুণমুগ্ধ ভাবীর দেবরের প্রতি পবিত্র মমত্ববোধ, যার মধ্যে কোন পঙ্কিলতা ছিলো না।”

“তাহলে আমি কি এটাই বুঝবো যে, আমাকে তোমার খুব ভালো লাগতো বলেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছো?” নাহিদার উদ্দেশ্যে বললো আবুল আব্বাস।

“না, আমি শুধু এজন্য তোমার সাথে বিয়েতে রাজী হইনি। বললো নাহিদা। তোমার যেমন স্ত্রীর অভাব ছিলো না, বিয়ের প্রশ্নে আমারও পুরুষের ঘাটতি ছিলো না। গযনী সালাতানাতে শত শত বীর বাহাদুর সুশ্রী যুবক আমাকে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলো। তোমাকে বিয়ে করার মধ্যে আমার ভালোবাসা ছাড়া আরো উদ্দেশ্য আছে। আমি শুধু তোমার জন্য ভালোবাসাই নিয়ে আসিনি, এনেছি একটি পবিত্র পয়গাম। এ পয়গাম কোন জাগতিক পয়গাম নয় কিংবা আমার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোন রাজকীয় বার্তাও নয়। এ পয়গাম আল্লাহর দেয়া পয়গাম।

আবুল আব্বাস! তুমি কি এ ব্যাপারে আমার সাথে একমত হবে না যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গযনীকে মূর্তি সংহারীদের শহর বলে জানবে? একথা কি তুমি অস্বীকার করতে পারবে যে, সালতানাতে গযনী প্রতিবেশী মুসলিম রাজন্যবর্গের জন্য কাঁটা হয়ে বিরাজ করছে। তারা সবাই মিলে ইসলামের এই আলোকিত অধ্যায়কে কালিমাযুক্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে?”

“তোমার এই কথাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।” বললো আবুল আব্বাস। তুমি যা বলছে তার সবই সত্য। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলার জন্য তো আরো অনেক সময় পাওয়া যাবে। আজকের শুভ রাতে তুমি এসব জটিল বিষয়ের অবতারণা করছো কেন? তুমি কি আমার প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-উচ্ছ্বাস সবকিছুকে আজ রাতেই রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দিতে চাও?”

“হ্যাঁ, তুমি যদি তাই মনে করো, তবে আজ রাতেই আমি তোমাকে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দিতে চাই। কারণ, বিয়ের প্রথম রজনীটি যে কোন মানুষের জন্য খুবই পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। সে কথা তুমি জানো আবুল আব্বাস! বাসর রাত তোমার জন্য নতুন কিছু ন। আমার জন্যও এ রাতটি জীবনের প্রথম নয় । আমি তোমার প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-উচ্ছ্বাস কিছুতেই নষ্ট হতে দেবো না। আমাকে পেয়ে যদি তোমার জীবনের স্বপ্নগুলো আরো রঙিন হয়ে থাকে, তাহলে সেই রঙিন স্বপ্নগুলোকে আমি স্বযত্নে আরো বর্ণিল করে তুলব। আমার মনের গহীনে পুষে রাখা জটিল কথাগুলো আমাকে বলতে দাও আর তোমার স্বপ্নগুলো আমাকে বুঝবার অবকাশ দাও। এখনও তো রাত অনেক রয়ে গেছে। জীবনে আরো কতো রাত আসবে। আমি তোমার প্রতিটি রাতকেই মোহনীয় করে তুলবো। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরে আমার কটি কথা শুনে নাও।

আজকের যে রাতে আমরা সুখসাগরে সাঁতার দিতে যাচ্ছি, এ রাতটি গযনীর হাজারো কন্যা-জায়া-জননীর জন্য বিষাদে ভরা। গযনীর হাজারো যুবতী আজকের এ রাতেও তাদের প্রাণপ্রিয় স্বামীদের বিরহ যাতনা নিয়ে নির্মুম নিষ্পেষণে অতিবাহিত করছে, যাদের স্বামীরা আর কোন দিন তাদের কাছে ফিরে আসবে না। আল্লাহর সেই সৈনিকেরা আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দিতে আল্লাহু আকবার স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে হিন্দুস্তান গিয়েছিলো। সেখানে গিয়ে তারা সম্পূর্ণ বৈরী আবহাওয়া ও প্রতিকূল পরিবেশে আটকে পড়ে। যেখান থেকে তাদের অনেকের পক্ষেই ফিরে আসা সম্ভবপর হয়নি। যাওয়ার আগে তারা শপথ করে গিয়েছিলো, তারা যেখানেই যাবে, সেখানে মসজিদ আবাদ করবে, আল্লাহর জমিন থেকে মূর্তিপূজাকে উৎখাত করবে। তারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়ে দিয়েছে। আমি আজ রাতের সকল ঐ প্রেম-ভালোবাসা, সুখ ও আনন্দকে তাদের পবিত্র ত্যাগের জন্য উৎসর্গ করছি…।

আবুল আব্বাস! এদের বিপরীতে তুমি সেইসব ক্ষমতালি রাজন্যবর্গের রাজসিকতার দিকে তাকিয়ে দেখ, যাদের ক্ষমতালিপ্সর জন্য প্রতিটি মুসলিম জনপদ মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। প্রতিটি মুসলিম রাজ্যেই বিরাজ করছে গৃহযুদ্ধ। আজকের এই পবিত্র রাতে যদি তুমি আমার কথা ধৈর্য সহকারে শোন, তাহলে মুসলিম রাজ্যগুলোতে ভাইয়ের তরবারী ভাইয়ের মাথা দ্বিখণ্ডিত করতে থাকবে। ভাইয়ের ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরে ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা হতেই থাকবে। আজকের এই পবিত্র রাতে আমার সেইসব মা-বোন ও তরুণী স্ত্রীদের কথা মনে পড়ছে, যাদের সকল সুখ-আহ্লাদ, স্বপ্ন-সাধনা ক্ষমতালোভী রাজন্যবর্গের অন্যায় বিদ্বেষের আগুনে জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। আবুল আব্বাস! তুমি একজন টগবগে যুবক। আমিও যুবতী। এসো, ক্ষণিকের জন্য আমরা বাসর রাতের রঙিন স্বপ্ন ও যৌবনের উচ্ছ্বাস পাশে রেখে কয়েকটি জরুরী কথা আলোচনা করি।

আবুল আব্বাস! তুমি কি আমাকে বলবে, খাওয়ারিজম শাহ কেন আজো গযনী আক্রমণ করেনি? তোমার জান্নাতবাসী পিতা কেন হত্যার শিকার হয়েছিলেন? তুমি কি জানো, গযনী আক্রমণ করার জন্য তাকে উস্কানী দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তিনি কিছুতেই গযনী আক্রমণ করতে সম্মত হননি। ফলে তাকে হত্যা করা হলো। তোমার বড় ভাই পিতার অকাল মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। দিন দিন তার দেমাগ খারাপ হতে লাগলো। আমাকে বিয়ে করার প্রথম রাতেই আমি তাকেও এসব কথাবার্তাই বলেছিলাম। তিনি আমার প্রতিটি কথা হৃদয়ের মণিকোঠায় গেঁথে নিয়েছিলেন।”

“আচ্ছা নাহিদা! তুমি কি একথা জানতে যে, ভাইয়াকে নাকি তোমার ভাই মাহমূদ বিষ পান করিয়েছিলো? সুলতান মাহমূদের অধীনতা সে মেনে নেয়নি বলেই নাকি তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে।”

“তুমি কি একথায় বিশ্বাস করো?” জিজ্ঞেস করলো নাহিদা।

“ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু আমার মধ্যে সংশয় ঠিকই তৈরী হয়েছিলো।” বললো আবুল আব্বাস।

“এখানে সংশয়-সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যে সমরনায়ক শত্রুবাহিনীর সংখ্যার তুলনায় এক-চতুর্থাংশ কিংবা এক-পঞ্চমাংশ সৈন্য নিয়ে সব সময় শত্রুদের প্রবল সামরিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম, তার মতো বীর বাহাদুর কাউকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে পারে না। এটা কাপুরুষের কাজ, বীর পুরুষের নয়।

আমার ভাইয়ের যদি প্রয়োজন হতো তোমার ভাইকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার, তাহলে তিনি জুরজানিয়া এসে এখানকার প্রতিটি ইট বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারতেন এবং তোমার ভাইকে কয়েদ করে জিন্দানখানায় ভরে রাখা তার পক্ষে মোটেও কঠিন ব্যাপার ছিলো না। আমি তোমাকে বলছিলাম, আমাকে বিয়ে করে আনার পর আমি যখন দেখতে পেলাম, এখানে গযনী সালতানাতের বিরুদ্ধে রণপ্রস্তুতি চলছে, কতিপয় কুচক্রী তোমার ভাইকে গযনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ানোর উস্কানী দিচ্ছে, তখন তোমার ভাইকে আমি এ ভয়াবহতা ও ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে বোঝালাম। তিনি আমার কথায় আশ্বস্ত হলেন এবং কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রে পা দিতে রাজী হলেন না।

অবশ্য আমারও এ ব্যাপারে সন্দেহ হতো, তোমার ভাইকে এমন কোন বিষ হয়তো খাওয়ানো হয়েছে, যা খুব ধীরে ধীরে শরীরের ভেতরে বিষক্রিয়া ঘটিয়েছে। ফলে দিন দিন তার অসুখ বেড়েই যাচ্ছিল। যদি সত্যিই তাকে বিষ খাওয়ানো হয়ে থাকে, তবে সেই কুচক্রীরাই তাকে বিষ খাইয়েছে, যারা খাওয়ারিজম ও গযনীর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধানোর চেষ্টা করছিল।

“তোমার মতে কারা সেই কুচক্রী? কে এই বিষ প্রয়োগের সাথে জড়িত?” নাহিদার প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আবুল আব্বাস।

“মূল কাজটি মুসলমানরাই করেছে। কিন্তু ওদের পিছনে হাত রয়েছে ইহুদী ও ফিরিঙ্গীদের” বললো নাহিদা। ইহুদী ও খৃস্টান চক্রান্তকারীদের সম্মিলিত চক্রান্তের ফসলই মুসলিম দেশসমূহের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ। তাছাড়া কারামতি উপজাতিদেরও এতে হাত আছে। কারণ, আমার ভাই কারামতিদের শীর্ষনেতাকে খতম করে ওদের আখড়া গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন।”

“নাহিদা! আমি অকালে নিহত হতে চাই না।” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো আবুল আব্বাস।

“এমনটি বলো না। বরং বলল, আমি আল্লাহর পথে নিহত হতে চাই।” বললো নাহিদা।

“দেখছে না, আমার ভাই বারবার হিন্দুস্তানের প্রতিকূল পরিবেশে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে চায়। আমিও এটিই চাই এবং আল্লাহ ও তাই ভালোবাসেন। তুমি আমার ভাইয়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গন চষে বেড়াও। আল্লাহর পথে তোমাকে উৎসর্গ হতে দেখলে আমি আমার সকল সুখ-স্বপ্ন কুরবান করে দিতেও প্রস্তুত। যদি তুমি এতোটা না-ই পারো, অন্তত গযনী সালতানাতের বিরুদ্ধে কোন তৎপরতা না চালিয়ে গযনীর সাথে মৈত্রী সম্পর্ক শক্তিশালী করো।”

“ঠিকই বলেছো নাহিদা। এ মুহূর্তে সুলতানের একজন শক্তিশালী মিত্র দরকার। কারণ, তাঁর সামরিক শক্তি খুবই দুর্বল হয়ে গেছে।” বললো আবুল আব্বাস।

“তোমার কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। গযনীর শক্তি এতোটা দুর্বল হয়ে যায়নি, যতোটা তোমরা মনে করছো।” বললো নাহিদা। এখনো যথেষ্ট সৈন্য রয়েছে গযনীতে। তাছাড়া হিন্দুস্তানী সৈন্যদের ব্যারাক সম্পূর্ণ অব্যবহৃত। তাদেরকে কখনো হিন্দুস্তানের কোন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয় না। তাদেরকে এদিকে ব্যবহার করার জন্য রিজার্ভ রাখা হয়েছে।

গযনী সুলতানের অধীনে ওরা খুবই সুখে আছে এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হচ্ছে। হাজার হাজার গযনীবাসী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছে। এরপরও যে সামান্য ঘাটতি আছে, তাকে পুষিয়ে নেয়ার মতো আত্মশক্তি ও মনোবল গযনী সেনাদের রয়েছে। কাজেই গযনী সালতানাতকে কোন বহিঃশত্রুর আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্য সুলতান মাহমূদের কোন সামরিক শক্তির সাথে মৈত্রী গড়ে তোলা জরুরী এই ভুল ধারণা মনের ভেতর থেকে দূর করে দাও। সুলতানের চেয়ে বরং তোমার একজন শক্তিশালী মিত্রের খুব প্রয়োজন।”

“তোমার ভাইয়ের সাথে আমি মৈত্রী স্থাপন করবো ঠিক; কিন্তু তার অধীনতা মেনে নেবে না। সে যদি খুৎবায় তার নাম উচ্চারণের প্রস্তাব করে, তবে তো আমি কখনোই তা মেনে নেবে না। নাহিদা! তোমাকে আজ একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, তোমার প্রতি ভালোবাসা ছাড়াও আমার তোমাকে বিয়ে করার অন্যতম উদ্দেশ্যে তোমার ভাইয়ের সাথে মজবুত মৈত্রী গড়ে তোলা। কারণ, ভেতরে বাইরে আমি চরম শত্ৰুবেষ্টিত। এমতাবস্থায় তার মতো একজন শক্তিশালী মিত্রের আমার খুবই প্রয়োজন। আমি আশা করি, তিনি বন্ধুত্বের হক পুরোপুরিই আদায় করবেন।”

“তার কাছ থেকে বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর অধিকার আদায় করার দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি আবুল আব্বাস। কিন্তু মৈত্রী বড় কথা নয়। মৈত্রী তখনই অর্থবহ হবে, যখন যে কোন দুর্যোগ ও বহিরাক্রমণে খাওয়ারিজম ও গযনীর সৈন্যরা একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হবে।”

“এমনটিই হবে নাহিদা, এমনটিই হবে।” বললেন আবুল আব্বাস।

এরপর আবুল আব্বাস নাহিদাকে বুকে জড়িয়ে আবেগপূর্ণ কথাবার্তা ও আচরণ করতে শুরু করলেন। সেবিকা আলজৌরীকে জানাল, সে মনে করেছিল, যে নারী বাসর রাতে রসকষহীন জীবনমৃত্যু যুদ্ধ-জিহাদের মতো নীরস ওয়াজ নিয়ে মেতে উঠেছিলো, সেই নারীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-সোহাগের বালাই থাকতে পারে না। কিন্তু এক পর্যায়ে যুদ্ধ-বিগ্রহের কথায় বিরতি দিয়ে নাহিদাও আবুল আব্বাসের কামোদ্দীপক বাসনায় এভাবে সাড়া দিলো যে, তার প্রতিটি শব্দ ও বাক্য ছিল উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনায় ভরপুর। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে আবুল আব্বাসকে কামনার উচ্ছ্বসিত আবেগ ও কামোদ্দীপক উত্তেজনাপূর্ণ কথায় নেশাগ্রস্ত করে ফেললো। ত্রিশের কোঠায় পা দেয়া নাহিদা যেনো সতেরো বছরের তরুণীতে রূপান্তরিত হলো। তার প্রতিটি হাসি ও কথায় যেন টপকে পড়ছিলো মোহনীয় মধুময় সুধা। এমনই যাদুমাখা ছিলো নাহিদার প্রতিটি কথা, যেন তা কঠিন সীসাকেও মোমের মতো গলিয়ে দিতে সক্ষম ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আবুল আব্বাসকে শান্ত-সুবোধ শিশুর মতোই প্রেমের অক্টোপাসে বেঁধে ফেলেছিলো নাহিদা। নাহিদার এই দুর্দান্ত তৎপরতার কাছে মনে হলো আবুল আব্বাস নিতান্তই আনাড়ী বালক।

বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন সেবিকাকে দেয়ার জন্য আলজৌরীর হাতে দুটি স্বর্ণমুদ্রা দিলেন। আলজৌরীকে বললেন, তুমি সেবিকাকে বাগে রেখে ওর কাছ থেকে আবুল আব্বাস ও নাহিদার মধ্যকার সব কথাই জানতে চেষ্টা করবে। গুরুত্বহীন কথা হলেও তা শুনতে অবহেলা করবে না।”

আলজৌরী এরপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। আলজৌরী চলে যাওয়ার পর আলাফতোগীন আবু ইসহাক ও অমরতাশকে বললেন, “আমি আগেই তোমাদের বলেছিলাম, এই বিয়ের মধ্যে গভীর উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। কোন উদ্দেশ্য ছাড়া মাহমূদ তার আদরের বোনটিকে আবুল আব্বাসের তৃতীয় স্ত্রী করে দুইটি সতীনের সংসারে পাঠায়নি।”

“এই মৈত্রী কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না।” বললেন আবু ইসহাক । খাওয়ারিজম শাহ আবুল আব্বাস একটা নারীলোভী তরুণ। একের পর এক নারীসঙ্গ লাভের লিন্স তাকে অন্ধ বানিয়ে ফেলেছে। আমরা তার বিশ্বস্ত প্রধান মন্ত্রী আবুল হারেসকে আমাদের পক্ষে নিয়ে নেবো।”

“আরে সাবধান! আবুল হারেস খুবই ভয়ঙ্কর লোক।” বললেন আলাফতোগীন। আবুল হারেসের সাথে এসব নিয়ে কোন কথাই বলা যাবে না। সে মামুনী খান্দানের পোষা লোক। মামুনী খান্দানের প্রতি পরম বিশ্বস্ত। যা কিছু করার আমাদেরকেই করতে হবে। আবুল আব্বাস যদি এই নারীর অন্ধভক্তে পরিণত হয়, তবে তাকে বেশী দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। আবুল আব্বাস রাজনীতিতে এখনো বালক। সে এখনো বুঝতেই পারছে না, মাহমূদ তার বোনের বিনিময়ে খাওয়ারিজম কিনে নিতে চায়।”

“সেনাবাহিনীকে আমাদের হাতে রাখতে হবে।” বললেন সেনাপতি খমরতাশ। সৈন্যদের অধিকাংশই কিন্তু খাওয়ারিজম শাহের প্রতি বিশ্বস্ত। রাজধানী জুরজানিয়ায় সেনাবাহিনী কম। অধিকাংশ সৈন্য আমার অধীনস্ত রাজ্য বুখারা ও দক্ষিণাঞ্চল হাজারাশিপে অবস্থান করছে। এসব সৈন্যকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে।

এ ব্যাপারে তোমরা আমাকে একটু সময় দাও। একটা না একটা পথ আমি ঠিকই বের করে ফেলব। গৃহযুদ্ধের জন্য সৈন্যদের প্রস্তুত করতে অভিজ্ঞ লোকের দরকার। বললেন আলাফতোগীন।

খাওয়ারিজমের রাজধানী জুরজানিয়া থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে সাগরের তীরবর্তী হাজারাশীপে ছিলো সে দেশের সবচেয়ে বড় সেনা শিবির। দীর্ঘদিন ধরেই খাওয়ারিজম রাষ্ট্রের অধিকাংশ সৈন্য সেখানে অলস সময় কাটাচ্ছিল। তখন চতুর্দিকেই ছিল যুদ্ধের ঘনঘটা। কিন্তু খাওয়ারিজম কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে না জড়ানোর কারণে এসব সৈনিক দীর্ঘদিন যুদ্ধ থেকে দূরে ছিল। সেনাবাহিনীর কমান্ডার ও সিপাহীরা দিনে-রাতে গল্প-গুজব, আড্ডা, খেল-তামাশা করে বেকার সময় অতিবাহিত করছিল। যুদ্ধ না থাকায় তাদের চর্চা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারটিও হয়ে পড়েছিল গৌণ। অধিকাংশ সৈনিক ছিলো ধর্মে-কর্মে উদাসীন, আরাম-আয়েশে আসক্ত। কমান্ডারদের সিংহভাগ গা ভাসিয়ে দিয়েছিল বিলাসিতায়।

হঠাৎ একদিন দীর্ঘ শশ্রুমণ্ডিত আপাদমস্তক সবুজ জুব্বায় ঢাকা এক দরবেশরূপী ফকীর হাজারাশীপ সেনা ব্যারাকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। দরবেশরূপী লোকটির মাথায় সবুজ কাপড়ের পাগড়ী। পাগড়ীতে হাজার দানার দীর্ঘ তসবীহ জড়ানো। তার গলায়ও ঝুলছিলো রং-বেরঙের হাজার দানার দীর্ঘ তসবীহ। তার এক হাতে একটি লাঠি আর অপর হাতে একটি কিতাব। দরবেশরূপী ফকির উচ্চ আওয়াজে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জপতে জপতে দৃঢ়পায়ে হাঁটছিলো আর থেকে থেকে তার হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করছিলো।

হাজারাশীপে অবস্থানকারী সৈন্যরা এ ধরনের কোন ফকির-দরবেশ কখনো দেখেনি। বিস্ময়কর এই লোকটির পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-অনুষ্ঠান দেখে ব্যারাকের বাইরে থাকা কিছু সংখ্যক সৈনিক তাকে অবাক বিস্ময়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে একটা ভিড় লেগে গেল এবং দরবেশকে ঘিরে বহু উৎসুক সৈনিক জমা হয়ে গেল। দরবেশ সৈন্যদের ভিড়ে দাঁড়াল এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, “সাগরতীর ডুবে যাবে, পাহাড় ফেটে যাবে… আসমান থেকে আগুন ঝরবে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’

এ কথা বলে দরবেশ তাকে ঘিরে দাঁড়ানো সৈনিকদের কারো প্রতি না তাকিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করলো। বিকট আওয়াজে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে দরবেশ যখন প্রচণ্ড শক্তিতে তার লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করলো, অভূতপূর্ব এই ঘটনায় অভিভূত হয়ে সৈন্যরা তার পথ ছেড়ে দিল।

দরবেশের এসব কর্মকাণ্ডে সম্মোহিত হয়ে কিছু সৈনিক তার পিছু পিছু চলতে লাগল। এক সৈনিক দরবেশের হাতে একটি রৌপ্যমুদ্রা গুঁজে দিলে অন্যেরাও দরবেশকে টাকা-পয়সা দেয়ার জন্য পকেট হাতড়াচ্ছিল। কিন্তু খুঁজে দেয়া রৌপ্যমুদ্রাটিকে দরবেশ মুখে পুড়ে দাঁতে কামড়ে থেতলে আকাশে ছুঁড়ে মারলো।

মুদ্রার প্রতি দরবেশের এই অনাসক্তি দেখে সবাই যার যার টাকা আবার পকেটেই রেখে দিল। কিন্তু উপস্থিত সবাই দরবেশের এই কাণ্ডে সম্মোহিত হয়ে গেল। কারণ, তারা ভেবেছিল লোকটি হয়তো কোন অভাবী ফকির।

এমন সময় দু’জন লোক খুব দ্রুত পায়ে দরবেশের পথে এসে থামল। তারা সৈন্যদের নিবৃত্ত করতে বললো, সাবধান, দয়া করে আপনারা কেউ পীর বাবাকে কষ্ট দেবেন না। তাকে কেউ কোন টাকা-পয়সা দিতে চেষ্টা করবেন না। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরিয়ে পড়লে তা কখনো বিফলে যাবে না। তাকে কেউ বিরক্ত করবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তিনি হয়তো গায়েবী নিদর্শন দিতে এসেছেন।

পনেরো-ষোল বছর আগে তাকে একবার দেখা গিয়েছিল। আপনাদের হয়তো মনে আছে, পনেরো বছর আগে সমরকন্দে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের দুদিন আগে সমরকন্দের অলি-গলিতে তাকে ঘুরতে দেখা গেছে।

তখনও তিনি এভাবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জিকির করতে করতে বলছিলেন-সমরকন্দের জমিন গোনাহগারদের বোঝা আর সহ্য করতে পারছে না। সব ভেঙে যাবে, ধুলোয় মিশে যাবে। কিন্তু তখন তার কথা কেউ বুঝতে পারেনি। দু’দিন পর বাবাজী শহর থেকে উধাও হয়ে গেলেন। তার উধাও হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে গোটা সমরকন্দ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিলো। শহরের সকল সরাইখানা ও পানশালা মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল।”

দুজনের আরেকজন বললো, পনেরো বছর পর হঠাৎ আজ এখানে তাকে দেখা যাচ্ছে। এখন তিনি সেই দিনের মতোই জিকির ও ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। আল্লাহ মালুম, তিনি যা বলছেন তা হবেই হবে। জানা নেই, কোন পাহাড় ভেঙে পড়ে কিংবা কোন জায়গায় আকাশ থেকে আগুন ঝরে। কিন্তু এটা ঠিক বিপর্যয় একটা ধেয়ে আসছে, বিপদ একটা না একটা ঘটবেই। এই দরবেশ বাবার কথা মিথ্যা হবার নয়।”

একথা শোনামাত্র উপস্থিত সৈন্যদের চেহারা ভয়ে-আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে গেল। তাদের একজন সাহস করে বললো, “এই দরবেশের কাছ থেকে কি জানার কোন উপায় নেই, বিপদ কোন দিক থেকে আসবে এবং কেন আসবে? এই বিপদ ঠেকানোর কোন পথ আছে কি না?”

আতঙ্কগ্রস্ত সৈন্যরা ভয়াবহ বিপদের কথা শুনে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে পরস্পর অবস্থার ভয়াবহতা আরো ছড়িয়ে দিল এবং কোন বাক্য ব্যয় না করেই নিজ নিজ ব্যারাকে ফিরে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাতাসের সাথে এই খবর গোটা সেনা শিবিরে ছড়িয়ে পড়ল। এক দরবেশ পনেরো বছর আগের সমরকন্দের মতো ভয়াবহ বিপর্যয় ও ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখে মুখে এই দুর্যোগের খবর আরো ভয়ঙ্কর ও ভীতিপ্রদ হয়ে গোটা শিবিরে ছড়িয়ে পড়লো । শিবির জুড়ে এই ফকিরের ভবিষদ্বাণীই হয়ে উঠলো আলোচনার একমাত্র বিষয়। প্রত্যেকের মুখেই একই কথা, এই ফকীরের কাছ থেকে এই বিপদ থেকে মুক্তির বিষয়টি কিভাবে জানা যায়? কেন, কোনদিক থেকে আসবে এই বিপদ?

পরদিন সেনা শিবিরে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো, গতকালের ভবিষ্যদ্বাণী করা দরবেশকে আজকে সমুদ্রতীরের একটি জায়গায় তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে। খবর শোনামাত্র কয়েকজন উৎসাহী সৈনিক সমুদ্র তীরের দিকে রওনা হলো। সৈন্যরা সাগর তীরে গিয়ে দেখতে পেলো, সেখানে একটি ছোট্ট তাঁবু খাটানো রয়েছে। তাঁবুর পাশেই তিন-চারজন লোক বসে আছে। সৈন্যরা সেখানে গিয়ে শুনতে পেল, তাঁবুর ভেতর থেকে ভেসে আসছে দরবেশের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জিকিরের আওয়াজ।

সেই সাথে তারা শুনতে পেলো, রক্তের বন্যা… থামিয়ে দাও, থামিয়ে দাও।

তাঁবুর বাইরে বসে থাকা লোকেরা সৈন্যদের জানালো, তারা সারা রাত এখানেই কাটিয়েছে। দরবেশ রাতভর বিরতিহীনভাবে এই জিকির চালিয়েছেন এবং মাঝে মধ্যেই তার লাঠি সাগরের পানিতে ডুবিয়ে এখানকার পানির গভীরতা পরিমাপ করেছেন।

তারা আরো জানালো, দরবেশের পা ধরে তারা মিনতি করে জানতে চাচ্ছিলো আসলে বিপদ কি ধরনের হতে পারে। তাদের অনুরোধে দরবেশ তাদের আসমানের প্রতি তাকাতে বললেন। তারা দিব্যচোখে দেখেছে, আসমানের তিনটি তারা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গোটা আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তারার টুকরোগুলো দূর-দূরান্তে গিয়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়েছে। এরপর দরবেশ আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনো সময় আছে, ফিরে এসো, আসমানের এই গজবকে থামিয়ে দাও।

তারা সৈন্যদের আরো জানালো, আমরা দরবেশ বাবার সেবা করার জন্য এখানে এসেছি। কিন্তু তিনি আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখছেন না। সৈন্যরা তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে দরবেশের তীব্র চিৎকারের জিকির শুনছিলো এবং তাঁবুর বাইরে অপেক্ষমাণ লোকদের মুখে দরবেশ সম্পর্কে নানা তথ্য অবহিত হচ্ছিল। বাইরে অপেক্ষমাণ লোকদের বক্তব্যও দরবেশের তীব্র জিকির শুনে সৈন্যরা দরবেশকে আল্লাহর জীবন্ত পয়গামবাহী দূত ভাবতে শুরু করল।

এই সৈন্যরা ব্যারাকে ফিরে গিয়ে গতকালের অনেকের দেখা দরবেশকে আরো রহস্য পুরুষে পরিণত করল।

পরদিন ব্যারাকের আরো সৈন্য আর শহরের বহু লোক দরবেশকে দেখার জন্য সমুদ্র তীরবর্তী তাঁবুর পাশে জমায়েত হলো। দেখতে দেখতে তাঁবুর জায়গাটি সৈনিক এবং শহরের লোকদের জন্য তীর্থস্থানে পরিণত হলো।

লোকজন সমুদ্রতীরে গিয়ে তাঁবুর বাইরে দাঁড়াতো। তাঁবুর ভেতরে দরবেশের উচ্চ আওয়াজে জিকির শুনতে পেতো, সেই সাথে দরবেশ তিলাওয়াত করতো কেয়ামত দিবস সম্পর্কীয় আয়াতসমূহ। থেকে থেকে দরবেশ বলছিল, “রক্তের প্লাবন ধেয়ে আসছে, মানুষ মানুষকে হত্যা করবে।… দেশের বাদশা নারীর গোলামে পরিণত হবে।”

***

সুলতান মাহমুদের দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিয়ে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে সুলতানকে জানালো, তারা বিয়ে অনুষ্ঠানে বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন, সেনাপতি আবু ইসহাক ও সেনাপতি খমরতাশ এর কথাবার্তা শুনেছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সুলতানকে জানালো, আবুল আব্বাসকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এ তিন ক্ষমতাধর ব্যক্তি চক্রান্ত করছে। অচিরেই তারা একটা কিছু ঘটাবে।”

সুলতান তাদের কথা শুনে পরামর্শ দিলেন, তোমরা আবুল আব্বাসের রাজমহল জুরজানিয়া এবং বুখারায় তোমাদের কয়েকজন গোয়েন্দাকে নিয়োগ করো, যাতে তারা ওদের চক্রান্তের খবর সময়মতো আমাদের অবহিত করতে পারে।”

সুলতানের নির্দেশে চার-পাঁচজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দাকে জুরজানিয়া ও বুখারায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। তারা জুরজানিয়া গিয়ে সুলতানের বোন নাহিদার সাথেও যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হলো। কিন্তু তারা বারংবার খবর দিচ্ছিলো, আবুল আব্বাসের পক্ষ থেকে সুলতানের বিরুদ্ধে কোন ধরনের বিরূপ তৎপরতার আশঙ্কা নেই। আসলে রাজধানীতে চক্রান্তকারীদের কোন তৎপরতা ছিলো না। চক্রান্ত চলছিলো হাজারাশীপ ও বুখারায়।

হাজারাশীপের সমুদ্রতীরের ঝুপড়ীসম তাঁবুতে বসে দরবেশরূপী ফকির হাজারাশীপ সেনাশিবিরের সৈন্যদের মধ্যে অভাবনীয় প্রভাব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।

ওদিকে হাজারাশীপ থেকে শত মাইল দূরবর্তী বুখারা রাজ্যের সমুদ্রতীরে অনুরূপ আরেক দরবেশের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো। এই দরবেশও সমুদ্রতীরে তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করছিলো। বুখারার এই দরবেশ তার তাঁবুতে একা ছিলো না, তার সাথে ছিলো আরো বহু শিষ্য মুরীদ। মুরীদের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ আর কয়েকজন নারী।

মাত্র কয়েক দিনেই দরবেশের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো যে, এই বুযুর্গ ব্যক্তি এমন একটি ওষুধ এবং তাবিজ দেয়, যা ব্যবহার করলে মানুষ কখনো বার্ধক্যের শিকার হয় না। দীর্ঘজীবন লাভ করে।

মানুষ মাত্রই দীর্ঘজীবন ও দীর্ঘ যৌবন প্রত্যাশা করে। সেনাদের প্রতিটি মুহূর্ত উৎকর্ণ থাকতে হয় কখন যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, মৃত্যুর হাতছানি।

দীর্ঘজীবন ও যৌবন লাভের দাওয়াই এবং তাবিজের কথা সেনাশিবিরে পৌঁছামাত্র এ খবর এ কান ও কান হতে হতে শিবিরময় ছড়িয়ে পড়লো। মৃত্যু আতঙ্কে ভীত সৈন্যরা এ খবরে খুবই প্রভাবিত হলো। দলে দলে সৈন্যরা সমুদ্রতীরে দরবেশের তাঁবুতে ভিড় করলো।

উভয় সৈন্যশিবিরে সৈন্যরা সমুদ্রতীরের অবস্থান নেয়া দুই দরবেশের তাঁবুতে জমায়েত হতে লাগলো। উভয় দরবেশ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললো, “তোমরা আল্লাহর পথের সৈনিক। তোমরা সুন্দর সঠিক পথে আছে। কিন্তু তোমাদের চারপাশে যেসব মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে, ওদের কেউ সঠিক পথে নেই। ওরা নামে মাত্র মুসলমান। তাদের কেউ কেউ তোমাদেরকে গোলামে পরিণত করতে তৎপর। প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রকে তোমরা মুসলমান মনে করে যদি তাদের উপর ভরসা করো, তাহলে তোমাদের উপর এমন গজব পড়বে যে, তোমাদের কোন নামগন্ধ থাকবে না।

উভয় সেনাশিবিরে দরবেশরূপী দুই ফকির তাদের সম্মোহনী ক্ষমতাবলে সৈন্যদেরকে এতোটাই প্রভাবিত করলো যে, সৈন্যরা তাদের কথা অমোঘ সত্য বলে হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করলো।

এক রাতে আলাফতোগীন তার খাস কামরায় উপবিষ্ট। তার সামনে অপরিচিত দু’জন লোক। তাদের কারো চেহারা ছবি স্থানীয় লোকদের মতো নয়। তারা মুসলমানও নয়। উভয়েই বিদেশী ইংরেজ ।

“আপনাদের এই কৌশল শেষ পর্যন্ত কি ফল বয়ে আনবে?” উপস্থিত ফিরিঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলেন বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন।

“আপনি কেন আমাদের সাহায্য করেছেন?” ফিরিঙ্গীদের একজন আলাফতোগীনকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। সৈন্যদেরকে আপনার আস্থাভাজন বানিয়ে আপনি খাওয়ারিজম রাজ্যের অধিপতি হতে চান?” এই উদ্দেশ্যেই তো আপনি আমাদের সহযোগিতা করেছেন, তাই না?”

আমরা এখানে এসে সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি, তারা খাওয়ারিজম শাহের বিরুদ্ধে কিংবা জুরজানিয়ার সৈন্যদের বিরুদ্ধে তরবারী ধরতে মোটেও সম্মত নয়। কোন ধরনের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘোর বিরোধী তারা।

আমরা হাজারাশীপ ও বুখারার সৈন্যদের ভেতরের খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছি, তারা অভ্যন্তরীণ সংঘাত তো দূরের কথা প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যুদ্ধবিগ্রহে আগ্রহী নয়। এখানকার সকল সৈন্যদেরকে মৌলিকভাবেই এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, মুসলমান কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে তরবারী ধরতে পারে না। এজন্য আমাদেরকে সর্বাগ্রে হাজারাশীপ ও বুখারাতে যেসব সৈন্য রয়েছে, তাদের মন থেকে ইসলামের আদর্শিক বিশ্বাস দূর করতে হবে।

“কল্পনা ও সংশয়বাদিতা এমন এক অস্ত্র, যা দিয়ে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি ধসিয়ে দেয়া যায়। সব মানুষই ভবিষ্যতে ঘটিতব্য এবং ঘটমান ঘটনাবলীর কারণ জানতে চায়। এটা মানুষের একটি স্বভাবজাত দুর্বলতা।

মানুষের আরেকটি দুর্বলতা হলো আবেগ ও বিস্ময়। সকল মানুষ বিস্ময়কর কথাবার্তা ও ঘটনাকে শুনতে ও দেখতে পছন্দ করে এবং আবেগকে বিবেকের উপর বিজয়ী করে ফেলে। মানুষের এই আবেগ ও বিস্ময়ানুভূতিকে সহজেই প্রভাবিত করা যায়। যে মানুষ যতো বেশী মূর্খ ও অশিক্ষিত, সে ততো বেশী আবেগপ্রবণ ও আবেগাশ্রয়ী। মানুষের তৃতীয় দুর্বলতা হলো প্রত্যেকেই চির যৌবন ও অমরত্ব লাভ করতে চায়।

আমরা আপনাদের সেনাবাহিনীর কমান্ডার ও সৈনিকদের এই মানবিক দুর্বলতাগুলোকে দুই কৃত্রিম দরবেশের দ্বারা কাজে লাগাচ্ছি। আমাদের দুই দরবেশরূপী মনোবিজ্ঞানী সিপাহী ও কমান্ডারদের ধর্মানুভূতি ও ধর্মবিশ্বাসের জায়গায় সংশয় ও কল্পনাবিলাস ঢুকিয়ে দেবে। উভয় দরবেশ কথায় কথায় ধর্মের বিধান উল্লেখ করে কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়। কিন্তু তার প্রতিটি কথার মর্ম সম্পূর্ণ ইসলামের পরিপন্থী। আমাদের এই দুই বিশেষজ্ঞ আপনাদের সৈন্যদের ধর্মানুরাগ অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক ও সৈন্যদের প্রতি অবিশ্বাস ও সংশয় সৃষ্টি করতে সক্ষম।

ধর্মবিশ্বাসে আমরা খৃস্টান। কিন্তু আপনাদের ধর্মের প্রতিটি বিধিবিধান সম্পর্কে আমরা অবগত। আমরা আপনাদের সৈন্যদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছি। আমাদের প্রশিক্ষিত মুসলিম অনুচরেরা আপনাদের সেনাশিবিরগুলোর অলিগলি ঘুরে ঘুরে নানা গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা এ কথা খুবই সাফল্যের সাথে প্রচার করছে, খাওয়ারিজমকে সুলতান মাহমূদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার নেতৃত্বের উপযুক্ত একমাত্র ব্যক্তিত্ব বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন।

খাওয়ারিজম শাহ আবুল আব্বাস এবং তার নতুন স্ত্রী নাহিদা সম্পর্কে এমনই দুর্নাম ছড়ানো হয়েছে যে, সৈন্যরা আবুল আব্বাসকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, অল্পদিনের মধ্যেই সৈন্যরা আবুল আব্বাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উন্মত্ততা শুরু করবে।

“আপনার দুজন সহকারী সেনাপতি- যারা আবুল আব্বাসের কট্টর ভক্ত ছিলো- দু’জন প্রশিক্ষিত তরুণীকে তাদের পিছনে লাগিয়ে দিয়ে আমরা তাদেরকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আপনার হয়তো জানাই ছিলো না, এই দুই প্রভাবশালী সেনাকর্মকর্তা আপনাকে মোটেও পছন্দ করতো না। এখন তারাও আপনাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। এ ছাড়াও যদি আপনার কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তবে আমাদের বলতে পারেন। আমরা আপনাকে আর্থিক, সামরিক ও পরিবহনের জন্য উপযুক্ত জন্তু দিয়ে সহযোগিতা করতে পারি।

“সেটি এখনই নয়।” বললেন আলাফতোগীন। এখনই যদি আপনাদের এসব সহযোগিতা নিই, তাহলে খাওয়ারিজম শাহ জেনে যেতে পারে। আমি একটা সুযোগের অপেক্ষা করছি, যাতে আমি আবুল আব্বাসের বিরুদ্ধে সৈন্যদের বিক্ষুব্ধ করে আমার পক্ষে নিয়ে আসতে পারি। আমি যদি খাওয়ারিজম শাহের গদি উল্টে দিতে পারি, তাহলে আপনাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।

“আমরা আপনার কাছে কোন প্রতিদান চাই না।” বললো অপর ফিরিঙ্গী। আমরা শুধু আপনার বন্ধুত্ব চাই। আপনার সাথে আমাদের শাসনতান্ত্রিক বন্ধুত্ব ও মৈত্রীস্থাপন হলেই বুঝতে পারবেন, গির্জা ও মসজিদের সম্পর্ক কতোটা হৃদ্যতাপূর্ণ। আমাদের এই স্বর্গীয় বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর পথে সুলতান মাহমূদই একমাত্র বাধা। এই ঝগড়াটে লোকটির বিনাশ খুবই জরুরী।”

“আমিও তার ধ্বংস চাই।” বললেন আলাফতোগীন। এই যুদ্ধবাজ লোকটি তার সাম্রাজ্যকে আরো বিস্তৃত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

“আপনি হয়তো জানেন, আপনার সৈন্যরা কোন মুসলিম রাষ্ট্রের সৈন্যদের সাথেই যুদ্ধ করতে সম্মত নয়। বিশেষ করে গযনীর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধের কথা তারা ভাবতেই পারে না।” বললো এক ফিরিঙ্গী।

“সৈন্যদের এই মনোভাব আবুল আব্বাসের তৃতীয় স্ত্রী নাহিদার প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের চোখ আবুল আব্বাসের শয়নকক্ষের ভেতরের খবরও রাখে। আবুল আব্বাস তার আগের দুই স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে সুলতান মাহমূদের বোনের প্রেমে পড়ে নিজের বিবেক-বুদ্ধি খুইয়ে ফেলেছে। এমনও হতে পারে, আবুল আব্বাস গযনীকে সামরিক সহযোগিতা দিয়ে বসবে; কিন্তু সে কিছুতেই গয়নী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না।”

“অনিন্দ্য সুন্দরী দুই তরুণী বুখারার শাসক আলাফতোগীনসহ দুই ফিরিঙ্গীকে সুরা ঢেলে দিচ্ছিল। এই দুই তরুণী ছিলো ফিরিঙ্গীদের সঙ্গী। আলাফতোগীন শরাবের নেশার চেয়ে তরুণীদের রূপ সৌন্দর্যে বেশী আসক্ত হয়ে পড়েছিলো। সে বারবার তরুণীদের দিকে তাকাচ্ছিলো। তরুণীদের ভুবনমোহিনী মুচকি হাসি আর মনকাড়া চাহনীতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলো। এদিকে দুই ফিরিঙ্গী অতিকৌশলে নেশাগ্রস্ত আলাফতোগীনের মন-মগজে খাওয়ারিজমের একচ্ছত্র অধিপতি তথা বাদশাহ হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তুলেছিল।

গয়নী থেকে নাহিদার একান্ত ফুটফরমায়েশের জন্য জেবীন নামের মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তিকে পাঠানো হলো। নাহিদা আবুল আব্বাসকে জানালো, জেবীন ছিলো আমার একান্ত কর্মচারী। ভাইয়া তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জেবীন খুবই বিশ্বস্ত এবং সমঝদার।

সত্যিকার অর্থেই জেবীন ছিলো অনুগত, দ্র, মেধাবী এবং পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ।

কয়েক দিনের মধ্যেই জেবীন আবুল আব্বাসের মন জয় করতে সক্ষম হয়। জেবীন আবুল আব্বাসের রাজপ্রাসাদের অন্যান্য কর্মচারী ও সেবক সেবিকার উপর নজরদারী এবং তাদেরকে বশে রাখার ব্যাপারে খুবই দক্ষতার পরিচয় দেয়। অবশ্য একাজে আগে থেকেই জেবীন ছিলো পরীক্ষিত এবং অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ।

একদিন বিকেল বেলায় প্রাসাদের বাগানে বসেছিলো নাহিদা। জেবীন নাহিদার সামনে মাথা নীচু করে দু’হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলো। অবস্থাদৃষ্টে যে কেউ মনে করবে, সে নাহিদার কথা শুনছে। বস্তুত জেবীন বলছিলো আর নাহিদা গভীর মনোযোগ দিয়ে জেবীনের কথা শুনছিলো।

“একটা কিছু ঠিকই ঘটে চলছে নাহিদা! আমাদের লোকেরা বুখারা ও হাজারাশীপ থেকে যেসব খবর আনছে, তা থেকে বোঝা যায় ওখানে কোন শয়তানী কারসাজী শুরু হয়েছে। হাজারাশীপের নদীর তীরে এক ফকির আস্তানা গেড়েছে, সে নাকি বিস্ময়কর সব ভবিষ্যদ্বাণী করছে। সে এমন ধরনের চক্রান্তমূলক কথাবার্তা বলছে যে, সেনাবাহিনীর সব লোক তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। সে এক হাতে কুরআন শরীফ আর একহাতে তসবীহ নিয়ে সারাক্ষণ ওয়াজ করে।”

“একথা কি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে, সে সত্যিই কোন দুনিয়াবিমুখ ওলী ব্যক্তি নয়?” জিজ্ঞেস করলো নাহিদা।

সে আলেম বটে; কিন্তু দুনিয়াবিমুখ নয়, বরং দুনিয়ামুখী। সে কোন দীনদার আলেম নয়, কুরআনের আড়ালে সে আসলে খ্রিষ্টবাদ ছড়াচ্ছে এবং গণমানুষকে বিভ্রান্ত করছে। গযনী সালাতানাতের বিরুদ্ধে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে সে। কুরআন শরীফের আয়াত পড়ে পড়ে সে বলছে, গযনী ও আশেপাশের সকল মুসলিম রাজ্যগুলো এবং এগুলোর শাসকগোষ্ঠী নামকাওয়াস্তে মুসলমান। ইসলামের নামের আড়ালে ওরা সবাই ক্ষমতালোভী। একমাত্র সত্যিকার মুসলিম ও মুসলমানের দেশ খাওয়ারিজম।”

“সে কি খাওয়ারিজম শাহীর বিরুদ্ধেও কোন কথাবার্তা বলে?”

“না, প্রকাশ্যে সে খাওয়ারিজম শাহীর বিরুদ্ধে বলে না।” বললো জেবীন। কিন্তু সৈনিক ও কমান্ডারদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তা এবং তাদের মনোভাব খাওয়ারিজম শাহীর জন্য খুবই ভয়ানক।…

বুখারার পার্শ্ববর্তী নদীতীরেও এমন এক দরবেশ আস্তানা গেড়েছে। সেখানে শুধু দরবেশই নয়, তার সাথে রয়েছে কিছুসংখ্যক পুরুষ ও সুন্দরী নারী। বুখারা জুড়ে এ খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে যে, দরবেশ এমন এক তাবিজ ও ওষুধ দেয়, যা সেবন ও ধারণ করলে মানুষ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এবং জীবনে কখনো বার্ধক্য স্পর্শ করে না। ওই দরবেশের সাথে যেসব সুন্দরী তরুণী রয়েছে, রাতের বেলায় তাদেরকে সেনাকমান্ডারদের সাথে আপত্তিকর আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় নদীতীর ও জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।

বুখারার সেনাদের কথাবার্তায়ও মারাত্মক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ওই ফকিরকে ঘিরে ওখানে মানুষের সমাগম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ওখানে রীতিমতো মেলা জমে গেছে। ওই ফকিরও কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াজ করে আর গযনী সালতানাতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে।

মোদ্দাকথা হলো, গযনী ও খাওয়ারিজমের মধ্যে একটা শক্তিশালী শত্রুতা তৈরীর অপচেষ্টা চলছে। আমাদের লোকেরা উভয় সেনা শিবিরের সৈন্যদের সাথে উঠাবসা করে এবং ফকিরের মুরীদ সেজে তাদের কথাবার্তা শুনেছে এবং সৈন্যদের মনোভাব চিন্তা-ভাবনার খবর নিয়েছে।

যে বুখারা ও হাজারশীপের সাধারণ সৈন্যরা কোন কাজকর্ম না থাকায় অলস বসে বসে সারাক্ষণ অশ্লীল কথাবার্তা ও নোংরা আলাপচারিচায় সময় কাটাতে, তাদের প্রত্যেকের মুখে এখন গযনীর প্রতিটি প্রাসাদ থেকে ইট খুলে নেয়ার বিষোদগার। গযনীর ধ্বংসই এখন আলোচনার একমাত্র বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া একথাও শোনা গেছে, ওখানে বহু নারীর সমাগম হয়েছে। যারা অনেকটা জ্ঞাতসারেই দেহ ব্যবসার পসরা সাজিয়ে সৈনিক ও যুবকদের চরিত্র হনন করছে।

আমাদের একজন গোয়েন্দা এমন এক তরুণীর সাথে মিলিত হয়েছিলো। সে জানিয়েছে, এসব তরুণী শুধু দেহ ব্যবসাই করে না, এরা গযনী সালতানাত ও খাওয়ারিজম শাহ আবুল আব্বাসের বিরুদ্ধে বিষ ছড়াচ্ছে। পর্দার অন্তরালে এসব দেহপসারিণীদের সম্পর্ক রয়েছে ওই দুই দরবেশের সাথে। তাদের কথাবার্তায় এ বিষয়টি একেবারে দিবালোকের মতো পরিষ্কার।…

আমাদের এক গোয়েন্দা বলেছে, বুখারার ফকিরের সাথে থাকা এক তরুণী একদিন নদীর তীরে তাকে একাকী পেয়ে ঘনবনের দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে প্রেম নিবেদন করে। তখন ছিলো সন্ধ্যা। বেলা ডুবে গেলে তরুণী তার গলা জড়িয়ে ধরে প্রেম নিবেদন করে তার পরিচয় জানতে চায়। আমাদের গোয়েন্দা নিজেকে খাওয়ারিজম সেনাবাহিনীর কমান্ডার বলে পরিচয় দেয়। সেনাকমান্ডারের পরিচয় পাওয়ার পর তরুণী এমনভাবে নিজেকে তার সামনে মেলে ধরলো যে, সে যেনো যুগ যুগ ধরে তাকেই ভালোবাসে।

আমাদের গোয়েন্দা জানিয়েছে, এসব তরুণী খুবই সুন্দরী ও প্রশিক্ষিত । আমাদের গোয়েন্দা বলেছে, আমার যদি কর্তব্যবোধ না থাকতো, আর আল্লাহর কাছে জবাবদিহির প্রশ্ন ও পাপাচারের শাস্তির ভয় না হতো, তাহলে এই তরুণীকে আমি জীবনসঙ্গিনী করার জন্য সম্ভব সবকিছুই করতাম। আমাদের গোয়েন্দা আরো বলেছে

তরুণী তার মধ্যে কামোদ্দীপনা জাগিয়ে দিয়ে গলা জড়িয়ে বললো, “তোমাদের খাওয়ারিজম শাহ তো তার তৃতীয় স্ত্রীর গোলামে পরিণত হয়েছে। গযনী সুলতানের বোন নাহিদা খাওয়ারিজম শাহের জ্ঞানবুদ্ধি সবই গিলে ফেলেছে। সে এখন আঙুলের ইশারায় খাওয়ারিজম শাহকে নাচাচ্ছে।”

“আমাদের গোয়েন্দা তরুণীকে জিজ্ঞেস করলো, “রাজমহলের কথা তুমি কিভাবে জানলে?”

তরুণী জানালো, “আমি রাজমহলেরই রক্ষিতা ছিলাম। কিন্তু গযনী ঔ সুলতানের বোন নাহিদাকে আবুল আব্বাস বিয়ে করার পর একের পর এক

সুন্দরী তরুণীদের আগমন শুরু হয়। প্রতিদিন দলে দলে গযনী থেকে সুন্দরী ও তরুণীরা খাওয়ারিজমে আসতে শুরু করে। নাহিদা একেক রাতে আবুল আব্বাসের কাছে একেক সুন্দরীকে হাজির করে। নাহিদার চক্রান্তের কারণে আবুল আব্বাস হারেমের সকল সেবিকা ও রক্ষিতাকেই তাড়িয়ে দিয়েছে।” একথা বলে তরুণী কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং বলে… তুমিই বলো, এখন আমরা কোথায় যাবো?

“আমাদের বেঁচে থাকার এখন একটাই পথ।” আচ্ছা, তুমি কি আমাকে আশ্রয় দিতে পারো? আমাকে কি এই পঙ্কিল পথ থেকে বাঁচাতে পারবে? একথা শুনে আমাদের গোয়েন্দা তাকে সান্ত্বনা দিলো এবং পরবর্তীতে তার সাথে আবারো মিলিত হওয়ার কথা বলে সেখান থেকে সরে এলো।

“এই ঘটনা থেকেই আপনি আন্দাজ করতে পারেন, সেখানে কী চলছে।” বললো জেবীন।

“আমাদের গোয়েন্দারা আরো খবর দিয়েছে, বুখারার গভর্নর আলাফতোগীনের প্রাসাদে দু’জন ভিনদেশী লোক বসবাস করছে, এদের চামড়া দেখে মনে হয় তারা ফিরিঙ্গী ইংরেজ। এরা ধর্মীয়ভাবে ইহুদীও হতে পরে কিংবা খৃষ্টানও হতে পারে। এখন আপনিই আমাদের বলুন, আমাদের কি করতে হবে? আপনি কি খাওয়ারিজম শাহকে এ ব্যাপারে জানাবেন, এখানে এসব ঘটছে?”

“না, তাকে এসব ব্যাপারে জানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, এসব খবর আমি তাকে জানালে আমাকে জবাব দিতে হবে এসব খবর আমি কি করে কার মাধ্যমে পেলাম।”

“আবুল আব্বাস আমার হাতে আছে। আমি তাকে বলতে পারতাম, আপনি হাজারাশীপ ও বুখারার সকল সৈন্যকে রাজধানীতে বদলী করুন এবং রাজধানীর সৈন্যদেরকে সেখানে বদলী করুন। এরফলে এক জায়গায় থেকে থেকে সৈন্যরা অলস ও নিফর্ম হয়ে যাবে না। কিন্তু এ মুহূর্তে তাকে এমন কোন পরামর্শ দেয়া ঠিক হবে না। ওখানকার সৈন্যরা দুই ফকিরের সংশ্রবে যেভাবে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে, এখানকার সৈন্যরা সেখানে গেলে এরাও খারাপ হয়ে যাবে।

তোমাদের প্রতি আমার নির্দেশ হলো, তোমরা কৌশলে ওই দুই ফকিরকে গায়েব কিংবা হত্যা করে ফেলল। গযনীতে এমন কিছু ঘটলে এদের গ্রেফতার করে শাস্তির মুখোমুখি করা যেতো। কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়। আচ্ছা,

আমাদের লোকেরা কি এদের হত্যা করার মতো ক্ষমতা রাখে? জেবিনকে জিজ্ঞেস করলো নাহিদা।

“ফকির দু’জনকে হত্যা করা আমাদের গোয়েন্দাদেরকে জন্য তেমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। আমাদের দরকার এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতা।” বললো জেবীন।

“ঠিক আছে, আমি এই নির্দেশ দিলাম। তোমাদের প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারটিও আমি নিশ্চিত করবো। তবে এই কাজের সাথে সাথে গযনী সুলতানের কাছে খবর পাঠিয়ে দাও, আমার নির্দেশে দুই চক্রান্তকারী ফকিরকে হত্যা করা হচ্ছে এবং হাজারাশীপ ও বুখারাতে যা ঘটছে এর বিস্তারিত খবরও দিয়ে দাও।” জেবিনকে বললো নাহিদা।

* * *

কয়েকদিন পর নদীর তীরবর্তী দরবেশের আস্তানা থেকে লোজন বাড়ী ফিরতে শুরু করে। রাত বাড়ার সাথে সাথে দরবেশের আস্তানা থেকে লোকজন সরে যেতে থাকে।

এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের ভিড় কমে যায়। অর্ধরাতে সাধারণ মানুষের ভিড় কমে যাওয়ায় দেহপসারিণী তরুণীরা খদ্দের সাথে নিয়ে দূরের নদী তীরের ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে চলে যায়।

দরবেশের আস্তানায় মানুষের ভিড় কমে গেলেও দু’জন লোক আস্তানার ধারে পাশেই ঘোরাফেরা করছিলো। দরবেশ বাইরের মশাল নিভিয়ে দিয়ে তাঁবুর ভেতরে চলে গেল। তাঁবুর বাইরে দু’জন প্রহরী প্রহরা দিচ্ছিলো। প্রহরী দু’জন প্রহরা দেয়ার লক্ষ্যে অনড় বসে ছিলো আর অজ্ঞাত দুজন লোক তাঁবুর অদূরে থেকে প্রহরীদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছিল। তাদের একজন সঙ্গীর উদ্দেশ্যে বললো

“মনে হয়, তাঁবুর বাইরে অপেক্ষমাণ এই লোক দুটি দরবেশের প্রহরী। এরা তাঁবুর সম্মুখ থেকে সরবে না।”

“এরা তাঁবুর ভেতরে চলে গেলে আমাদের কাজ কঠিন হয়ে যাবে।” বললো অপরজন।

“একটা পরীক্ষা করা যেতে পারে।” বললো প্রথমজন । তুমি ওদের কাছে গিয়ে নিজেকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার পরিচয় দেবে আর এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে যে, তুমি দরবেশের খুব ভক্ত। আর এদিকে আমি কাজ সমাধা করার চেষ্টা করবো।”

দ্বিতীয় ব্যক্তি সঙ্গীর কথামতো প্রহরীদের কাছে গিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক গল্প জুড়ে দেয়। লোকটি যখন নিজেকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে পরিচয় দেয়, তখন দরবেশের প্রহরীরা তার সাথে কথা বলতে বেশ উৎসাহবোধ করে। লোকটি প্রহরীর উদ্দেশ্যে বললো, বাবাজী হয়তো শুয়ে পড়েছেন, এখানে আমরা কথা বললে তার ঘুমের ব্যাঘাত হবে, আমাদের একটু দূরে গিয়ে কথাবার্তা বলা উচিত ।

এই বলে সে দুই প্রহরীকে একটু দূরে সরিয়ে নিলো।

দরবেশ চতুর্দিকে পর্দা ঘিরে দিয়েছিলো। অপরদিকে তার সঙ্গী অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে তাঁবুর পিছনে চলে গেলো এবং হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে ভেতরটা দেখে নিলো।

তাঁবুর ভেতরের মশালের আলোয় সে দরবেশকে পরিষ্কার দেখতে পেলো। দরবেশরূপী কুচক্রী দেদারছে শরাব গিলছে। গোয়েন্দা যে দিকটা উঁচু করে দরবেশকে দেখছিলো, এ দিকটায় ছিলো দরবেশের পিছন দিক। এই দুই আগন্তুক ছিলো গযনীর দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা।

গোয়েন্দা খুব ধীরে ধীরে তাঁবুর একটি রশি খুলে নিলো এবং হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়ল। দরবেশ তখন প্রচুর মদ গিলে বেহুঁশ। গোয়েন্দা দুপায়ের উপর ভর করে রশিতে ফাস তৈরী করে দরবেশের গলায় ছুঁড়ে দিলো এবং একটানে ফাঁস আটকে ফেলল। দরবেশের মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হওয়ার অবকাশ ছিলো না।

মুহূর্তের মধ্যেই দরবেশের দেহ নিথর হয়ে গেল। দরবেশরূপী মদ্যপের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গোয়েন্দা হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর পিছন দিক দিয়ে দূরে চলে গেলো। এদিকে তার সঙ্গী দরবেশের দুই প্রহরীর সাথে জমিয়ে গল্প করছিল। হঠাৎ তারা পেঁচার ডাক শুনতে পেলো।

পেঁচার আওয়াজ শুনে দরবেশের দুই প্রহরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার দু’জন সঙ্গীর সাথে এসে মিলিত হলো এবং তাদের উদ্দেশ্য সফল করে অন্ধকারে তাদের গন্তব্যে পা বাড়াল। পেছনে পড়ে রইলো হাজারাশীপের সেনাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী চক্রান্তকারীর মরদেহ।

তাদের পরবর্তী গন্তব্য বুখারা। কিন্তু বুখারা হাজারাশীপ থেকে অনেক দূরে। তাদের পক্ষে রাতারাতি বুধারায় পৌঁছে বুখারার দরবেশরূপী কুচক্রীকে হত্যা করা সহজ ব্যাপার ছিলো না।

একে তো বুখারার দূরত্ব অপর দিকে হাজারাশীপের দরবেশের মতো বুখারার দরবেশ তার তাঁবুতে একাকী অবস্থান করতো না। তার সাথে থাকতো আরো কয়েকজন পুরুষ ও নারী। তবুও এই দুই গোয়েন্দা তাদের কর্তব্য পালনে রাতের অন্ধকারে বুখারার পথে ঘোড়া হাঁকাল।

তারা নদীর তীর ধরে দ্রুতগতিতে বুখারার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। যেতে যেতে এক পর্যায়ে নদীর ওপারে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। সেখানে নদী ছিলো বেশ চওড়া। চওড়া হওয়ায় বোঝা যাচ্ছিল নদীর গভীরতা সেখানে কম হবে।

আল্লাহর নাম নিয়ে দুই গোয়েন্দা তাদের ঘোড়া নদীতে নামিয়ে দিলো। নদীর মাঝখানটা ছিলো যথেষ্ট গভীর। সেখানে ঘোড়াকে সাঁতরিয়ে পার হতে হলো। হাজারাশীপ থেকে বুখারার দূরত্ব ছিলো প্রায় শত মাইলের কাছাকাছি।

* * *

পরদিন ভোর হতে না হতেই হাজারাশীপের সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়লো, রাতের অন্ধকারে কে বা কারা নদী তীরের তাঁবুতে দরবেশকে হত্যা করেছে। অজ্ঞাত ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন দরবেশ। এ খবর মুহূর্তের মধ্যে শহরময় ছড়িয়ে পড়ল এবং ছড়িয়ে পড়লো সেনাশিবিরে। খবর পেয়ে ছোট-বড় অফিসার, সকল সৈনিক ও সাধারণ মানুষ নদীতীরে অবস্থিত দরবেশের আস্তানায় ভিড় জমালো।

দরবেশের মৃত্যু সংবাদের সাথে সাথে এ খবরও ছড়িয়ে পড়লো যে, গযনীর গোয়েন্দারাই দরবেশকে হত্যা করেছে। কারণ, দরবেশ গযনীর সৈন্য ও গযনী শাসকের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতেন। গযনী সৈন্যদের হাতেই দরবেশ নিহত হয়েছেন, এ কথা সবাই বিশ্বাস করলো। এ খবর হাজারাশীপ সৈন্যশিবিরে বিদ্বেষের আগুন ধরিয়ে দিল।

এই হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করে গযনী সালতানাতের বিরুদ্ধে হাজারাশীপের সৈন্যদের উত্তেজিত করতে আরো ভয়াবহ প্রচারণা চালানোর সুযোগ পেলে কুচক্রীরা।

সবার মুখে মুখেই একথা উচ্চারিত হতে থাকলো, দরবেশ যে বিপদের কথা বলছিলেন, এই বিপদ এখন মাথার উপরে এসে গেছে। সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা তো আগেই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলো, এখন দরবেশের নিহতের ঘটনায় কমান্ডাররা পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। সেই সাথে কমান্ডাররা গযনী সালতানাতের বিরুদ্ধে ক্ষোভে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো।

***

পরদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে গযনীর অকুতোভয় দুই গোয়েন্দা তীব্রগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে প্রায় শত মাইলের দূরত্ব অতিক্রম করে বুখারার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেল। পথিমধ্যে তারা মাঝে-মধ্যে স্বল্প সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি দিয়ে তাদের বয়ে নেয়া ঘোড়াকে বিশ্রাম দিয়েছে এবং খাবার খাইয়েছে। বুখারার উপকণ্ঠে পৌঁছে গোয়েন্দা দু’জনের একজন শহরে প্রবেশ করে বুখারায় বহুরূপী ফকিরের বেশ ধারণ করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণরত গযনী গোয়েন্দাদের খুঁজতে শুরু করলো।

শহরে প্রবেশ করে গোয়েন্দা বুখারায় নিযুক্ত দুই গোয়েন্দার একজনকে পেয়ে গেলো। স্থানীয় গোয়েন্দাদেরকে তাদের পরিকল্পনা জানিয়ে, এখন তাদের কি করতে হবে তা বুঝিয়ে দিল।

“খাওয়ারিজমের দরবেশরূপী নিঃসঙ্গ প্রতারককে হত্যা করা সহজ ছিলো। কিন্তু এখানকার কুচক্রী একাকী নয়। আমরা তাকে দেখেছি, সে তাঁবুতে একাকী থাকে বটে; কিন্তু তার তাঁবুর পাশেই রয়েছে সঙ্গীদের তাঁবু।” জানালো স্থানীয় গোয়েন্দারা।

“অন্যরা জেগে গেলে আমরা পাকড়াও হবো কিংবা মারা পড়বো এটাকে সমস্যা মনে করো না।” বললো স্থানীয় দুই গোয়েন্দার একজন। আমাদেরকে পাঠানোর আগে যে প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছিলো, তা একবার স্মরণ করো। আমরা ইচ্ছা করলে সুলতানকে ধোকা দিতে পারবো বটে; কিন্তু মহান আল্লাহকে আমরা কিছুতেই ধোকা দিতে পারব না। বললো অন্যজন।”

এই ভণ্ড প্রতারক কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে এবং মুসলমানদেরকে পরস্পর শত্রু বানিয়ে ফেলছে তা তোমরা সবই প্রত্যক্ষ করেছো। তোমরা জানো, এই চক্রান্তের মূলে রয়েছে ফিরিঙ্গী খৃস্টান ও ইহুদীচক্র। এরা যা করছে, তা ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করছে।

গভর্নর আলাফতোগীন খাওয়ারিজমের বাদশা হওয়ার জন্য কুরআনের অবমাননা করছে। ধর্মের প্রয়োজনে পবিত্র কুরআরে মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে আমাদের জীবন বিলিয়ে দেয়া উচিত। বললো আগন্তুকদের একজন।

ঠিক আছে, আর কথা নয়, এবার চলো। বললো স্থানীয় গোয়েন্দা।

তিনজন তিনটি অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে চতুর্থ সঙ্গীকে সাথে নেয়ার জন্য শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে অন্যজনকেও পেয়ে গেলো। তাকে সাথে নিয়ে সবাই নদীর তীরবর্তী দরবেশের আস্তানার দিকে রওনা হলো।

এরা চারজন নদী তীরের একটি ঘন জঙ্গলে তাদের ঘোড়াকে বেধে রেখে দরবেশের আস্তানার দিকে যখন রওনা হলো, তখন সাধারণ মানুষ সেখান থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। এরা চারজন দর্শনার্থীদের ভিড়ের মধ্যে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগলো।

এবার দর্শনার্থীরা সেখান থেকে চলে গেল। রয়ে গেলো শুধু নারীদের নিয়ে স্ফুর্তি করার আগ্রহী সেনাকর্মকর্তাদের দু’-চারজন। রাত গম্ভীর হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেলো নারীদের দেহ ব্যবসা এবং সেনা কর্মকর্তাদের আমোদফুর্তি।

দরবেশরূপী কুচক্রীর তাঁবু থেকে দূরে গিয়ে নদী তীরের ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে যখন প্রশিক্ষিত তরুণীরা তাদের ইঙ্গিত নাগরদের নিয়ে ফুর্তিতে মেতে উঠে, তখন ফকিরের আস্তানায় নীরবতা নেমে আসে।

আস্তানায় নীরবতা নেমে এলে গযনীর চার গোয়েন্দা ধীরপায়ে ফকিরের তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল। ফকিরের তাঁবু ছিলো চতুর্দিকে মোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা। ভেতরে প্রদীপ জ্বলছিলো।

পা টিপে টিপে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গযনীর চার গোয়েন্দা ফকিরের তাঁবুতে উঁকি দিতে গেলে একজন কিছু একটার সাথে হোঁচট খায়। তাতে হাত দিয়ে সে বুঝতে পারে এটি মটকা। মটকাতে হাত দিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে সে বুঝে নেয়, এটি জ্বালানী তেলে ভর্তি। এমতাবস্থায় দুজন ফকিরের তাঁবু ঘেঁষে বসে পড়ল।

এরা পর্দা ফাঁক করে ভেতরে দেখতে পেলো, অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় ফকিররূপী কুচক্রীর পাশে প্রায় উলঙ্গ এক সুন্দরী তরুণী বসে তাকে মদ ঢেলে দিচ্ছে। ফকির ও তরুণী উভয়েই দেদারছে মদ গলাধঃকরণ করছে। এক গোয়েন্দা তেলভর্তি মটকাটা উল্টে দিয়ে তাঁবুর পর্দা ভিজিয়ে দিলো আর অন্যরা ধারালো খঞ্জর হাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল।

হঠাৎ এদের দু’জন পর্দা উঁচু করে ফকির ও তরুণী কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের মুখ চেপে ধরলো। ফকির ও তরুণী উভয়েই ছিলো মদের নেশায় বুদ। প্রতিরোধ তো দূরের কথা তাদের পক্ষে একটু শব্দ করারও অবকাশ হলো না।

মুহূর্তের মধ্যে দুই গোয়েন্দা ধারালো খঞ্জর ফকির ও তরুণীর বুকে বিদ্ধ করলো। একবার খঞ্জর বুকে বিদ্ধ করে টেনে বের করে পুনর্বার বিদ্ধ করতেই ফকির ও তার সঙ্গীনি তরুণীর ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল। নীরবে এদের খতম করে দু’জন বাইরে বেরিয়ে এলো। অপর দুজন তাঁবুর বাইরে অপেক্ষা করছিল।

অপেক্ষমাণ এক গোয়েন্দা অত্যধিক ক্ষুব্ধ হয়ে মটকার জ্বালানী তেল অন্যান্য তাঁবুতেও ছিটিয়ে দিতে লাগলো। পার্শ্ববর্তী তাঁবুর বাসিন্দারা এতোটাই নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের কেউ এদের কোনকিছুই টের পেল না। সব তাঁবুতে তেল ছিটিয়ে দিয়ে ফকিরের তাঁবু থেকে প্রদীপ এনে সব তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিল। জ্বলন্ত তাঁবুর ভেতরে ঘুমন্ত বাসিন্দাদের আর্তচিৎকার শুরু হওয়ার আগেই তারা দ্রুত পায়ে জায়গা ত্যাগ করে ঘোড়া নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দিল।

***

দু’দিন পর নাহিদাকে খবর দেয়া হলো, দরবেশরূপী কুচক্রীদের ইহলীলা সাঙ্গ করে দেয়া হয়েছে। বুখারায় যেসব সেনাসদস্য অবস্থান করছিলো, তাদের কর্মকান্ড ছিলো জনগণের বিপক্ষে এবং আতংকজনক। বুখারাতেও ফকিররূপী ধর্মগুরুর হত্যাকাণ্ডকে গযনী বাহিনীর নৃশংসতা হিসেবে প্রচারিত হয়। এ খবরে বুখারার সৈন্যরা গযনীর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

এদিকে বুখারা ও হাজারাশীপের কথিত ধর্মতাত্ত্বিকের নিহতের ঘটনা এবং সেখানকার সেনাদের গযনীবিরোধী বিক্ষোভের খবর সুলতানের কাছে পৌঁছালো সাত দিন পর।

সুলতানের কাছে প্রথম খবর পৌঁছালো নাহিদার তৎপরতার কথা। দ্বিতীয় খবর এলো নাহিদার নির্দেশে হাজারাশীপ ও বুখারার কথিত ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয়েছে।

এসব খবর শুনে সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন সুলতান। তার ভাবনা শেষ হতে না হতেই খবর এলো নাহিদার পক্ষ থেকে আরেকজন দূত জরুরী খবর নিয়ে এসেছে।

এই দূত জানালো, আবুল আব্বাসের নিযুক্ত বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন বুখারায় তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে এবং বুখারা ও হাজারাশীপের সকল সৈন্যকে সেনাপতি আবু ইসহাক এবং সেনাপতি খমতাশ বিদ্রোহী করে তুলেছে। রাজধানী জুরজানিয়ায় যে সামান্যসংখ্যক সৈন্য রয়েছে, তারা আবুল আব্বাসের পক্ষে বটে; কিন্তু বিপুল বিদ্রোহী সৈন্যের আক্রমণে প্রতিরোধ করার মতো শক্তি তাদের নেই।

এ খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবে সুলতান মাহমূদ আবুল আব্বাসের নামে পয়গাম লিখালেন। ঐতিহাসিকদের মতে সুলতানের লেখা এই পয়গামের ভাষ্য ছিলো অনেকটা এমন

“আমার বিশ্বাস, আপনার বিরুদ্ধে ধেয়ে আসা বিদ্রোহ আপনার পক্ষে দমন করা অসম্ভব। কারণ, একে তো আপনার বয়স কম, দ্বিতীয়ত এ ধরনের বিদ্রোহ দমনের অভিজ্ঞতাও আপনার নেই। আপনার ক্ষমতাচ্যুতি কিংবা বিদ্রোহীদের হাতে আপনি নিহত হওয়ার আগেই আপনাকে আমার সহযোগিতা করা উচিত। কিন্তু এই সাহায্য ও সহযোগিতা তখনই করা সম্ভব, যখন আপনার স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অক্ষুণ্ণ রেখেই আপনি আমার অধীনতা কবুল করে নেবেন এবং আমার নামে খুতবা জারি করবেন।

আমার অধীনতা স্বীকার করে নিলেও আপনার স্বাধীকার ও স্বাতন্ত্রবোধ বজায় রাখা হবে। এই অধীনতা স্বীকার করে নিলে আপনার বিশেষ উপকার এই হবে যে, আমি আপনার ক্ষমতা বহাল রাখার জন্যে আমার সবচেয়ে চৌকস সেনাদল আপনার নিরাপত্তা রক্ষায় রাজধানী জুরজানিয়ায় মোতায়েন করতে পারবো। দ্বিতীয়ত তারা শুধু আপনাকেই নিরাপত্তা দেবে না, আপনার গোটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা আপনার নিয়ন্ত্রণে এনে দেবে।

আপনাকে সতর্ক করে দিতে বাধ্য হচ্ছি যে, এ ব্যাপারে যদি আপনার পরামর্শ একান্তই দরকার হয়, তাহলে শুধু প্রবীণ উজির আবুল হারেসের সাথেই আপনি পরামর্শ করতে পারেন। এ ব্যাপারে বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন ও সেনাপতিদের সাথে যদি পরামর্শ করেন, তারা আপনাকে বিভ্রান্ত করবে।

আপনি এতোটাই অনভিজ্ঞ যে, আপনাকে ঘিরে আপনার রাষ্ট্রের চারপাশে কী ঘটছে, আপনি এ ব্যাপারে একেবারেই বেখবর। শত শত মাইল দূরে গযনীতে বসেও আমি জানতে পারছি, বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে আপনি একেবারেই সঙ্গীহীন। আশা করবো, এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে গিয়ে আপনি অযথা কালক্ষেপণ ও সময় নষ্ট করবেন না।”

* * *

খ্যাতিমান ঐতিহাসিক বায়হাকী লিখেছেন, গযনী সুলতানের লেখা এই পয়গাম খাওয়ারিজম শাহ আবুল আব্বাসের কাছে পৌঁছুলে তিনি এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য রাষ্ট্রের সকল গভর্নর ও সেনাপতিদের সভা ডাকলেন। এ সভায় বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন, সেনাপতি আবু ইসহাক, সেনাপতি খমরতাশও বাদ পড়লো না।

এহেন পরিস্থিতিতে আবুল আব্বাস সুলতান মাহমূদের অধীনতা গ্রহণের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি পয়গামটি কাউকে না দেখিয়ে সভায় শুধু এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, গয়নী শাসক সুলতান মাহমূদ তার অধীনতা কবুল করে নিয়ে খুতবায় তার নাম পাঠ করার প্রস্তাব করেছেন।

বৈঠকে উপস্থিত একমাত্র উজির আবুল হারেস ছাড়া সকল সেনাপতি ও গভর্নরই প্রস্তাব মেনে নেয়ার বিপক্ষে মতামত দিলেন। রাজধানীর রাজপ্রাসাদে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের খবর বৈঠক শেষ হতে না হতেই দ্রুত সকল সেনাশিবিরে পৌঁছে গেলো। খবর পাওয়ামাত্রই সেনারা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল।

আবুল আব্বাস বিদ্রোহের কথা শুনে সৈন্যদের মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করে বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে প্রশমন করলেন। সেদিনের বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই মুলতবী হয়ে গেল। চারদিন পর আবারো বৈঠক ডাকা হলো। এবার বৈঠকে আবুল আব্বাস ঘোষণা করলেন, গযনীর অধীনতা মেনে নেয়া হবে না। গযনী সুলতান যদি খাওয়ারিজম আক্রমণ করে বসে, তাহলে তুর্কী খানদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়া হবে। এজন্য তুর্কি খানদের সাথে সহসাই মৈত্রীচুক্তি করা হোক এবং সেই চুক্তিকে গোপন রাখা হোক।

ঐতিহাসিক বায়হাকী লিখেছেন, আবুল আব্বাসের এই সিদ্ধান্তের খবর গযনীর গোয়েন্দারা সুলতানকে যথাসময়ে জানিয়ে দিল। সুলতান খবর পেলেন, আবুল আব্বাস তার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে তুরস্কের খানদের সাথে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করতে যাচ্ছেন।

এ খবর শুনে সুলতান মাহমূদ সৈন্য এবং পাঁচশত জঙ্গী হাতির বহর নিয়ে খাওয়ারিজমের নিকটবর্তী বলখ পৌঁছে আবুল আব্বাসকে খবর পাঠালেন, সুলতানের প্রেরিত পয়গাম না মানলে গযনী বাহিনী জুরজানিয়া আক্রমণ করবে।

সুলতানের সেনাসমাবেশের খবর শুনে তুর্কিস্তানের খান শাসকরা খাওয়ারিজম শাহের সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানালো।

তুর্কিস্তানের খান শাসকরা বলখে এসে সুলতানকে খাওয়ারিজম আক্রমণ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করলো। কিন্তু সুলতান তাদের কথায় সম্মত হলেন না। তিনি তার অভিপ্রায়ে অবিচল রইলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তুর্কি খানেরা আবুল আব্বাসকে গিয়ে সুলতানের প্রস্তাব মেনে নিতে রাজী করালো। সেইসাথে খাওয়ারিজম জুড়ে সুলতানের নামে খুতবা দেয়ার প্রস্তাব পাশ করালো।

সুলতানের দাবী পূরণে আবুল আব্বাস সম্মত হওয়ায় সুলতান বলখ থেকে তাঁর সেনা বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিলেন।

সুলতান মাহমূদের সময়কার বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আবু নসর মুহাম্মদ আল উতবী ছিলেন সুলতানের একজন ঘনিষ্টজন। উতবী বহু সফরে সুলতানের সহযাত্রী ছিলেন। সুলতানের পক্ষে তিনি কয়েকবার বিভিন্ন রাষ্ট্রে দূতের ভূমিকাও পালন করেছেন। উতবী তার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ সম্বলিত প্রামাণ্যগ্রন্থ কিতাব আল ইয়ামিনীতে লিখেছেন

“আবুল আব্বাস সুলতানের প্রস্তাব মেনে নিতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কারণ তিনি স্বাধীনতা ও স্বাধিকার হারানোর আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু তার উজির আবুল হারেস তাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, সুলতানের প্রস্তাব মেনে নেয়ার মধ্যে এতোটা ক্ষতি নেই, যতটুকু ক্ষতি সেনাবিদ্রোহে হবে। সর্বোপরি সম্মত সুলতানের প্রস্তাব মেনে নিতে আবুল আব্বাসকে নাহিদা করাতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

নাহিদা আবুল আব্বাসকে আশ্বস্ত করতে বলেছিলেন–

“আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, আমার ভাই আপনার স্বাধীনতা কখনো হরণ করবেন না। তিনি আপনাকে তার মিত্র এবং আপনাকে বিদ্রোহের আশঙ্কা থেকে নিরাপদ করতে চান।”

“আমি বুঝতে পারছি না, কে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে? আমার সেনাদের প্রতি আমার আস্থা আছে।” নাহিদার উদ্দেশে বললেন আবুল আব্বাস।

“আপনি ভুল ধারণা পোষণ করছেন। সেনাবাহিনী থেকে আপনার আস্থা এবং আপনার প্রতি সৈন্যদের বিশ্বস্ততা বিনষ্ট করে দেয়া হয়েছে।”

“কে সেনাদের মন থেকে আমার আস্থার বিলোপ ঘটিয়েছে?”

“আপনার গভর্নর আলাফতোগীন, সেনাপতি আবু ইসহাক এবং সেনাপতি ধমরতাশ।” বললেন নাহিদা।

এদের পশ্চাতে রয়েছে ফিরিঙ্গী খৃস্টান ও ইহুদী কুচক্রী গোষ্ঠী। আপনাকে বুঝতে হবে, সুলতান মাহমূদের সহযোগিতা ছাড়া আপনার বাদশাহী টেকানো অসম্ভব। আপনি আত্মশ্লাঘায় না ভুগে আমার কথায় বিশ্বাস করুন। আপনি দয়া করে গযনী সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে নিন।”

চিন্তা-ভাবনার পর অবশেষে আবুল আব্বাস সুলতানের আনুগত্য মেনে নিতে সম্মত হলেন এবং সুলতানের নামে খুতবা পাঠের ঘোষণা জারি করলেন।

সুলতানের নামে খুতবা পড়ার হুকুমনামা হাজারাশীপ ও বুখারায় পৌঁছুলে সৈন্যদের মধ্যে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব থেকেই সৈন্যদেরকে

সুলতানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিল। এবার তার নামে খুতবা পড়ার হুকুমনামা ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলো।

বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন সৈন্যদের ছোট বড় কমান্ডারদের ডেকে এনে বললো, দরবেশগণ যে বিপদাশঙ্কার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই বিপদ এখন গযনী সেনাবাহিনীর রূপধারণ করে আসছে। যে করেই হোক এ বিপদ আমাদের রুখতেই হবে। নয়তো আমাদের ও তোমাদের মা-বোনেরা. গযনীর লুটেরা হিংস্র বাহিনীর দাসী-বাঁদীতে পরিণত হবে।

হিন্দুস্তানকে লুণ্ঠনকারী সুলতান মাহমূদ এখন খাওয়ারিজমকে লুণ্ঠনের জন্য এবং এখানকার মুসলিম নারীদের বাদী-দাসীতে পরিণত করে গযনী নিয়ে যাওয়ার জন্য আসছে। পরিতাপের বিষয়, খাওয়ারিজম শাহ আবুল আব্বাস নিজেই এই ভয়ঙ্কর লুটেরাকে ডেকে আনছেন। গযনীর লুটেরাদের প্রতিরোধ করতে হলে সর্বাগ্রে আমাদেরকে খাওয়ারিজম শাহী খতম করে সেনাশাসন জারি করতে হবে।

আলাফতোগীন সেনাকমান্ডারদের উদ্দেশে বললেন, প্রত্যেক কমান্ডার নিজ নিজ ইউনিটের সেনাদের বলে দাও, দরবেশগণ তোমাদের যে ভাগ্য বদলের কথা বলেছিলো, সেই দরবেশদের হত্যাকারী খুনীরা এখন তোমাদের ভাগ্য বরবাদ করতে আসছে।

ওদিকে হাজারাশীপের সৈন্যদেরকেও সেনাপতি আবু ইসহাক এবং সেনাপতি খরতাশ একইভাবে গযনী সুলতান ও আবুল আব্বাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ উন্মাদনায় উত্তেজিত করে বিদ্রোহে ইন্ধন দিলো।

***

এই ঘটনার কয়েক দিন পরের ঘটনা। আবুল আব্বাসের একান্ত সংবাদবাহক এসে তাকে খবর দিলো, তুর্কিস্তানের কয়েকজন খান আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। তাদের সাথে গভর্নর আলাফতোগীনও রয়েছেন। তারা লেকের পাড়ের বাগানে অপেক্ষা করছেন। গভর্নর আলাফতোগীন তাদের মর্যাদা দেয়ার জন্য মহামান্য শাহকে নিজে তাদের অভ্যর্থনা জানানোর অনুরোধ করেছেন।

খবর শুনে আবুল আব্বাস তার একান্ত প্রহরীদেরকে সওয়ারী প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। এমন সময় নাহিদার কাছে খবর গেলো, বাদশা আবুল আব্বাস বাইরে কোথাও যাচ্ছেন। তিনি দৌড়ে আবুল আব্বাসের খাস কামরায় পৌঁছুলে আবুল আব্বাস তাকে বললেন তিনি কি উদ্দেশ্যে কোথায় যাচ্ছেন। নাহিদা আবুল আব্বাসকে বাইরে যেতে নিষেধ করলেন।

“তুর্কিস্তানের মেহমান এসেছে। তাদের সম্মানে আমি নিজে অভ্যর্থনা জানাতে যাচ্ছি। অসুবিধা কী? তাদের সাথে গভর্নর আলাফতোগীন রয়েছেন।”

“না, আপনি যাবেন না। এমনই যদি হতো, আলাফতোগীন দূত পাঠালো কেন? সে নিজেই তো আসতে পারতো।” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আবুল আব্বাসকে বললেন নাহিদা।

“আরে, এই মহিলাদের নিয়ে যতো সমস্যা। এখানে তুমি সমস্যার কী দেখলে? ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন নাহিদা?”

“আল্লাহর দোহাই লাগে আবুল আব্বাস! তুমি এখন বাইরে যেয়ো না। আমার মন বলছে, বাইরে কোন বিপদ অপেক্ষা করছে।”

নাহিদা আবুল আব্বাসের হাত ধরে বললেন, “আবুল আব্বাস! জীবনে কোনদিন আমি তোমাকে কোথাও যেতে নিষেধ করিনি। আজ তোমাকে করজোড় মিনতি করছি। তুমি বাইরে যেয়ো না। কোন জরুরী কাজের বাহানা করে যাওয়া বাতিল করে দাও।”

“ধুত্তরী! আমি মহিলা নাকি?”

“না, তুমি মহিলা হবে কেন? পুরুষ হলেও আজ একজন অবলা নারীর কথা রাখো। আজ আমার এই অনুরোধটুকু রক্ষা করো” বলে কেঁদে ফেললেন নাহিদা। আমি বাইরে ভয়ঙ্কর বিপদাশঙ্কা করছি।”

“স্মিত হেসে আবুল আব্বাস নাহিদার উদ্দেশে বললেন, প্রেমের টানে এতোটা উতলা হয়ে যাওয়া ঠিক নয় নাহিদা। আমাকে আমার অবস্থান থেকে নামিয়ে দিও না তুমি! বাইরে ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

“আবুল আব্বাসকে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে না পেরে বিপদাশঙ্কায় নাহিদার হিতাহিত জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো। আবুল আব্বাস নাহিদাকে পাশ কেটে বাইরে বেরিয়ে পড়লে নাহিদাও দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। তততক্ষণে আবুল আব্বাসকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়ী নিরাপত্তা রক্ষীদের ভিড়ে চলে গেছে। উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত নাহিদাকে তার একান্ত সেবিকা ও দাসীরা বোকাতে ও সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলো। কিন্তু নাহিদার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমেই বেড়ে চললো।

এর কিছুক্ষণ পরেই রাজপ্রাসাদের চতুর্দিকে বহুসংখ্যক অশ্বারোহীর দৌড়ঝাপের শব্দ শোনা গেলো। সেই সাথে সেনাদের তাকবীর ধ্বনি ভেসে এলো।

আবুল আব্বাস হয়তো ফিরে এসেছেন এই আশায় নাহিদা দৌড়ে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বিধি বাম, আসলে এরা ছিলো বিদ্রোহী সেনা, যারা রাজপ্রাসাদকে ঘেরাও করেছিলো। বিদ্রোহী সেনারা স্লোগান দিচ্ছিলো, নারীলিঙ্গু খাওয়ারিজম শাহীর পতন হয়েছে, গযনী গোলামকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, খাওয়ারিজম শাহী আলাফতোগীন জিন্দাবাদ…।

নাহিদার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। তিনি মাথা দুহাতে ধরে কোনমতে নিজের বিছানায় গিয়ে পড়ে গেলেন। ইত্যবসরে রাজপ্রাসাদ দখলের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে সর্বপ্রথম নৃশংসতার শিকার হলেন আবুল আব্বাসের বিশ্বস্ত উজির আবুল হারেস। তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করলো আলাফতোগীনের লেলিয়ে দেয়া সৈন্যরা। তারা আবুল হারেসকে শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হলো না, তার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো।

রাজপ্রাসাদের ভেতর-বাইরের সবখানে হাজারাশীপ ও বুখারার সৈন্যরা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করলো। কিন্তু আলাফতোগীনের নির্দেশে নির্বিচারে হত্যা ও লুটতরাজ থেকে বিরত রইল সৈন্যরা। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে আবুল আব্বাসের বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী ও অনুগত ভৃত্যদের খুঁজে খুঁজে বের করে এনে হত্যা করা হলো। রাজধানী জুরজানিয়াতে নিযুক্ত সৈন্যদের দুটি ইউনিট বিদ্রোহী-সেনাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তাদের সৈন্যসংখ্যা এতোটাই কম ছিলো যে, বিদ্রোহীরা তাদের সবাইকে ঘেরাও করে অস্ত্রসমর্পণে বাধ্য করল। এরপর যে ডেপুটি সেনাপতির নির্দেশে বিদ্রোহীদের মোকাবেলার জন্য এই ইউনিটের সৈন্যরা প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তুলেছিলো, তাকে এবং তার অধীনস্ত সকল কমান্ডারের ধরে ধরে হত্যা করলো।

বুখারার গভর্নর আলাফতোগীন বিজয়ী এবং রাজার বেশে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলো। সে ছিলো স্বঘোষিত বাদশা। এই বাদশাহ হওয়ার প্রতি জুরজানিয়া ও খাওয়ারিজমের সাধারণ মানুষের কোনই আগ্রহ ছিলো না। দেশের সাধারণ মানুষ তাকে কখনো রাজার আসনে বসানোর উপযুক্ত মনে করেনি।

রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে গভর্নর আলাফতোগীন খাওয়ারিজম শাহের রাজকীয় মসনদে আসীন হয়ে ফরমান জারি করল, “দেশব্যাপী ঘোষণা করে দাও, খাওয়ারিজম শাহীর পতন হয়েছে, আজ থেকে আলাফতোগীন খাওয়ারিজমের বাদশা এবং আবুল আব্বাস নিহত হয়েছে।”

অবশেষে নাহিদার আশঙ্কাই সত্যে পরিণ হলো। তুর্কিস্তানের খানের আগমনের মিথ্যা খবর দিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বাইরে এনে আলাফতোগীনের নির্দেশে বিদ্রোহী সৈন্যরা সরলমতি আবুল আব্বাসকে হত্যা করল।

সময়টা ছিলো ৪০৭ হিজরী সনের ১৫ শাওয়াল মোতাবেক ১০১৮ খৃস্টাব্দের ১৭ মার্চ।

ঐতিহাসিক বায়হাকী ও গারদিজী লিখেছেন, বিদ্রোহী সেনাদের রাজমহলে প্রবেশ করতে দেখে নাহিদার একান্ত কর্মচারী জেবীন- যে প্রকৃতপক্ষে গযনী সুলতানের একজন পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ছিলো- দৌড়ে নাহিদার কক্ষে প্রবেশ করলো। জেবীন নাহিদার কক্ষে গিয়ে দেখে নাহিদা বিছানায় পড়ে বিলাপ করছে

“আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম, মৃত্যু তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো”। এমতাবস্থায় জেবীন নাহিদার জীবনাশঙ্কা বোধ করলো। সে নাহিদাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, চিন্তা করো না শাহজাদী, যে করেই হোক আমরা তোমাকে গযনী নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো। যা ঘটে গেছে এ নিয়ে বিলাপ করে বিদ্রোহী সেনাদের তোমার প্রতি মনোযোগী করো না। বিপদে ধৈর্য ধরো এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে স্বাভাবিক হও।”

নাহিদা শরীর থেকে রাজকীয় পোশাক ছুঁড়ে ফেলে অতি সাধারণ সেবিকাদের পোশাক গায়ে জড়িয়ে মাথায় উড়না দিয়ে সাধারণ বেশে প্রাসাদ তাগ করে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এ কাজে তাকে পথপ্রদর্শন করলো তারই একান্ত কর্মচারী জেবীন।

সাধারণ সেবিকার রূপ ধারণ করে ছদ্মবেশে নিজের কক্ষ ত্যাগের উদ্দেশ্যে নাহিদা চৌকাঠে পা রাখতেই তার মুখোমুখী হলো আলজৌরী।

“তোমার খাওয়ারিজম শাহীর রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে নাহিদা! পালাবে কোথায়? বাইরে গেলে বিদ্রোহী সেনাদের হাতে খুন হবে, নয়তো উত্তেজিত সৈন্যরা তোমাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে।” ভর্ৎসনামাখা কণ্ঠে বললো আলজৌরী।

“শোন নাহিদা, আমার কথা মেনে আমার সাথে এসো। আমি হারেমে তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওখানে থাকলে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।

আর ভালো চাইলে, তুমি আমার বাবাকে বিয়ে করতে পারো। এখন তো আর তোমার পক্ষে গযনী ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে বন্দী থাকার চেয়ে আমার বাবার চতুর্থ স্ত্রী হয়ে থাকা অনেক ভালো হবে।”

“আলজৌরী!” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন নাহিদা। আমার গযনী ফেরার জন্য মোটেও তাড়া নেই। অচিরেই দেখতে পাবে গযনীর সিংহের দল এখানে পৌঁছে যাবে…।”

হঠাৎ ব্যাঘ্র মূর্তি ধারণ করে গলা চড়িয়ে আলজৌরীর উদ্দেশ্যে নাহিদা বললো–

“শয়তানী, সরে যা আমার সামনে থেকে। আমি এখনো শাহজাদী। গযনীর সিংহ সুলতান মাহমুদের বোন আমি। এখনো আমার ভাই মরে যায়নি।

ভুলে গেছো তুমি কার মেয়ে? এক নিমকহারাম সেনাপতির মেয়ে তুমি । ক্ষমতার উদগ্র লিপ্সা যাকে পরিণতির কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। যাও, গিয়ে ওদের বলো, সাহস থাকলে ওরা যেনো আমাকে হত্যা করে, নয়তো জেলখানায় বন্দী করে। এরপর তুমি নিজ চোখেই বাপের নিকহারামীর পরিণাম এবং স্বঘোষিত শাহের ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখতে পাবে।”

ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপাত্মক হাসি এবং বাঁকা চাহনী দিয়ে আলজৌরী সেখান এ থেকে চলে এলো।

এই ফাঁকে জেবীন নাহিদাকে বললো, আসুন শাহজাদী, আমরা এই ফাঁকে ও এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।

“না জেবীন! আমি চুপিসারে পালিয়ে যাবো না। আমি ধোকাবাজ প্রতারক, নিমকহারাম চক্রান্তকারী খাওয়ারিজম শাহীর মুখোমুখী হবো।”

একথা বলে ঝড়ের বেগে কক্ষ ছেড়ে বাইরের দিকে পা বাড়ালেন নাহিদা। কিন্তু জেবীনকে তার পিছু পিছু দৌড়াতে দেখে দাঁড়িয়ে বললেন, “জেবীন! আমার ভবিষ্যৎ আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। তুমি আমার ধারে কাছে থাকলে ওরা তোমাকে জ্যন্ত রাখবে না। তুমি বরং খবর নাও, এখানকার পরিস্থিতির সংবাদ দিতে কেউ গযনী রওনা হয়ে গেছে কি না। যদি কাউকে খুঁজে না পাও, তাহলে নিজেই চলে যাও। আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিয়ে নাও।”

* * *

খাওয়ারিজম শাহের মসনদে বসে আলাফতোগীন নানা শাহী ফরমান ঘোষণা করছিলো, যে মসনদে কয়েক ঘন্টা আগেও বসেছিলেন আবুল আব্বাস। আলাফতোগীনের দরবারে কিছু লোক দু’হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে ছিলো। এদের অধিকাংশই ছিলো সেনাবাহিনীর লোক। আবুল আব্বাসের শাসনব্যবস্থাপনায় জড়িত কেউ সেখানে ছিলো না। আলাফতোগীনের দরবারে কিছুটা শোরগোলের মতো নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা বিরাজ করছিল। হঠাৎ দরবারে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলো মানুষের ভিড় ঠেলে সদ্যবিধবা রাণী নাহিদা বাঘিনীমূর্তি ধারণ করে আলাফতোগীনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

“ওহ্, নাহিদা! নাহিদার দিকে তাকিয়ে বললো আলাফতোগীন। তোমার ব্যাপারে আমি কোন কিছু চিন্তা করারই অবসর পাইনি।

‘নাহিদা, আমি জানি, তুমি প্রাণ ভিক্ষা চাইতে এসেছে। তুমি হয়তো বুঝতে পারোনি, তোমার স্বামীকে কিন্তু তুমিই হত্যা করিয়েছো। তুমি তার উপর ছলনার জাদু চালিয়ে তাকে গযনীর কেনা গোলামে পরিণত করেছিলে। খাওয়ারিজমের স্বাধীনচেতা জনতা, খাওয়ারিজমের আত্মমর্যাবোধসম্পন্ন সেনাবাহিনী কোন বহির্দেশের গোলামী কখনো বরদাশত করে না। দেখতেই পাচ্ছো, সমগ্র জাতি ও সৈন্যরা মিলিত হয়ে আমাকে বুখারা থেকে টেনে এনে এই মসনদে বসিয়েছে। এখন আমি তাদের ইচ্ছাতেই শুধু এই মসনদ ছাড়তে পারি। জাতি আমার উপর যে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করছে, যেকোন মূল্যে এই। দায়িত্ব আমি পালন করবো।”

“প্রাণ ভিক্ষা নয়, আমি প্রাণ দিতে এসেছি বেঈমান!” হুংকার দিয়ে বললেন নাহিদা।

তোমার জানা উচিত, আমি যা করেছি, তা আল্লাহ্ ও এখানকার সাধারণ মুসলমানদের ঈমানের সার্থে করেছি। তাদের ধর্ম, ইজ্জত, সম ও মর্যাদার সাথে করেছি।

বেঈমান! তুমি নিজে যেমন পবিত্র কুরআনের অসম্মান করেছে, ফিরিঙ্গিদের দিয়েও পবিত্র কুরআনের অবমাননা করিয়েছে। আল্লাহ্ সবকিছু জানেন, সবকিছু দেখেন, আল্লাহর কাছে তুমি কিছুই লুকোতে পারবে না।

বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যার ফুলঝুরি দিয়ে সরলপ্রাণ জনতা ও সৈন্যদের বিভ্রান্ত করতে পারলেও অচিরেই জেনে যাবে, জনতা তোমাকে এখানে আনেনি, তুমি জনতা ও সৈন্যদেরকে ধোকা দিয়ে এখানে এসেছো। তুমি যদি জাতির কাছে এতোটাই প্রিয় ব্যক্তি হতে আর এতোটাই সম্মানী ব্যক্তি হতে, তাহলে প্রতিটি গলি আর প্রতিটি বাড়ির সামনে সৈন্য মোতায়েন করেছো কেন? শহরের লোকদেরকে তোমাকে অভ্যর্থনা জানানোর সুযোগ দিচ্ছো না কেন? তোমার এই রাজকীয় অভিষেকের দিনে শহরে মৃত্যুর মাতম কেন? শহরের মানুষ তোমার বিজয়ের জয়ধ্বনী করছে না কেন? শহরের চতুর্দিকে সেনারা টহল দিচ্ছে কেন?”

হঠাৎ দরবারে এক কোন থেকে গর্জন শোনা গেলো, “হুশ করে কথা বলো মহিলা। তুমি কি জানো না, খাওয়ারিজম শাহের সামনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো?”

“খাওয়ারিজম শাহ! সে তো ছিলো আমার স্বামী। এই খুনীরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। কিন্তু আমার আল্লাহ্ মরেননি। তিনি অবশ্যই এই খুনের প্রতিশোধ নেবেন।

আলাফতোগীনের উদ্দেশ্যে সাহিদা চিৎকার করে বললো, আলাফতোগীন! সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ও ছত্রছায়ায় তুমি খাওয়ারিজমের বাদশাহী করার মতলব নিয়ে যদি এই মসনদ দখল করে থাকো, তবে আমি তোমাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, অচিরেই তোমার এই দিবাস্বপ্ন কপুরের মতো উবে যাবে। আর যে ছাতার আশ্রয়ে ক্ষমতার আশায় খুনের নেশায় তুমি উন্মত্ত হয়ে আছে, অচিরেই এমন তুফান দেখতে পাবে, যাতে তোমার এসব আশ্রয় খড়কুটোর মতো বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, কোন চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে না।

খাওয়ারিজম শাহের মসনদ একটি পবিত্র মসনদ। মসনদের যোগ্য ব্যক্তি ছাড়া এখানে কারো বসার অধিকার নেই। তুমি মামুনী খান্দানের জুতা বহন করে তোষামোদী করে গভর্নরের পদে পৌঁছেছিলো। মামুনী খান্দান তোমার চক্রান্তকে আমলে না নিয়ে তোমাকে বুখারার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করেছিলো। কিন্তু তুমি সেই পুরস্কারের মর্যাদা রাখতে পারলে না। তোমার সীমাহীন লোভ, হিংসা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বেঈমানী তোমার ভাগ্যে আজীবন কয়েদখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পঁচে পঁচে দুর্গন্ধ ছাড়ানোর পরিণতি লিখে দিয়েছে। এটাই হয়তো তোমাকে বরণ করতে হবে।”

“নিয়ে যাও ওকে! বেচারী পাগল হয়ে গেছে। ওকে তার নিজস্ব কক্ষে রেখে বাইরে প্রহরা বসিয়ে দাও। তার নিজস্ব শয়ন কক্ষেই তাকে নজরবন্দী করে রাখো। আমি সুলতান মাহমূদকে লিখে পাঠাবো, তুমি যদি খাওয়ারিজমের উপর আগ্রাসন চালাও, তাহলে তোমার বোনের থেতলানো দেহ দেখতে পাবে। নাহিদাকে তোমরা মুক্তিপণ হিসেবে রাখতে পারো। তার উপর কোন ধরনের অত্যাচার করো না। মানুষ যাতে একথা বলতে না পারে, খাওয়ারিজম শাহী আলাফতোগীন এক বিপন্ন বিধবা অসহায় নারীর উপর জুলুম করেছে।

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তোমার কবরের উপরেও থুতু ছিটাবে। ভর্ৎসনামাখা কণ্ঠে বললেন নাহিদা। যে সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছিলো কাফের-বেঈমানদের বিরুদ্ধে ঈমানদারদের পক্ষ হয়ে লড়াই করার জন্য, সেই সেনাদেরকে তুমি নিজ ভূমি জয় করার ভ্রাতৃঘাতি হানাহানিতে প্ররোচিত করেছে। যে সেনারা সব সময় উত্তর্ণ থাকতে নির্দেশের জন্য, তাদেরকে তুমি এখন শাসক বানিয়ে দিয়েছে, এখন আর এই সেনাবাহিনীর একদিনও যুদ্ধ করার যোগ্যতা নেই।

অতঃপর উর্দ্ধতন কোন সেনাপতির নির্দেশে কয়েকজন সৈন্য নাহিদাকে দু’দিক থেকে হাত ধরে তার কক্ষে ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

সেই সময়কার বিখ্যাত ঐতিহাসিক আলফজলী তার লেখা কিতাব ‘আছারুল উজারা’ গ্রন্থে লিখেছেন–

“চার মাস পর্যন্ত আলাফতোগীন খাওয়ারিজমে চরম দুঃশাসন চালায়। গোটা খাওয়ারিজমব্যাপী সে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজেকে ইসলামের পতাকাবাহী ও ইসলামের সেবক ঘোষণা করে। কিন্তু কারো মুখ থেকে যদি তার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র বিরোধিতামূলক শব্দ বের হতো, তাকেই ধরে এনে হত্যা করতো।

দেশব্যাপী আবাসিক এলাকায় সারাক্ষণ সেনাবাহিনী টহল দিতো। কারো পক্ষ থেকে বিরোধিতার সামান্য সংশয় জাগ্রত হলেই তাকে ধরে এনে হত্যা করতো। ফলে দিন দিন সাধারণ মানুষের জীবন, মান সংকীর্ণ হয়ে এলো। খাদ্যসামগ্রীর দাম আকাশচুম্বি হলো। জনজীবনে নেমে এলো চরম হতাশা। কিন্তু সেনাবাহিনীর লোকেরা রাজকীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। দেশের উন্নত ও শ্রেষ্ঠ সব উৎপাদন তাদের ভোগ্যপণ্যে পরিণত হলো। লাখ লাখ মুসলিম জনতাকে সেনাবাহিনী তাদের গোলামে পরিণত করলো।

প্রশ্ন হতে পারে দীর্ঘ চারমাস পর্যন্ত সুলতান মাহমূদ কী করলেন? কারণ, আলাফতোগীনের সফল অভ্যুত্থানের খবর তো তিনি চতুর্থ দিনেই পেয়ে গিয়েছিলেন।

সুলতান মাহমূদের সামনে তখন দু’টি সমস্যা ছিল।

প্রথমত কাশ্মীর বিপর্যয়ের পর সৈন্যঘাটতি তখনো পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেই সাথে সুলতান এমন বিপুল শক্তি নিয়ে খাওয়ারিজম আক্রমণ করতে চাচ্ছিলেন, যাতে তিনি এক অভিযানেই গোটা খাওয়ারিজম কজায় নিয়ে নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত তিনি তার ছোট বোন নাহিদাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে চাচ্ছিলেন, যাতে আক্রমণের সময় প্রতিপক্ষ নাহিদার সামনে মানবিক কোন দুর্বলতা উত্থাপন করে তাকে মানসিকভাবে ঘায়েল করতে না পারে।

‘আছারুল উজারা’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, নাহিদাকে জীবন্ত উদ্ধারের ব্যাপারটি সুলতান তার উপদেষ্টা পরিষদে এই বলে উত্থাপন করেন-”সম্মানিত উপদেষ্টাবৃন্দ! আমার ভগ্নিপতি ও অগণিত নিরপরাধ মুসলমান হত্যার প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে আমার বুকে। আমর আদরের ছোট বোনটি আবারো বৈধব্যের শিকার হয়েছে। এখন যদি আমি এদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক অভিযানের নির্দেশ দিই, তাহলে সেটি আমার ব্যক্তিগত সার্থোদ্ধারের জন্য বলে অভিহিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ইতিহাস হয়তো বলবে, আমি ব্যক্তিগত হিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম বাহিনীকে সংঘাতে লিপ্ত করে খুন ঝরিয়েছি। আপনারা গোটা ব্যাপারটি সামনে রেখে আমার করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিন। এই বিদ্রোহ ফিরিঙ্গীরা ঘটিয়েছে এবং একটি সুন্দর শান্তিপূর্ণ মুসলিম দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। কিছুদিন পরে হয়তো দেখা যাবে, গোটা খাওয়ারিজমে ফিরিঙ্গীরা ছেয়ে গেছে। এই অঞ্চলে ফিরিঙ্গীদের উপস্থিতি গযনী ও ইসলামের জন্য কেমন হতে পারে, এ বিষয়টি আপনাদের অজ্ঞাত নয়।

“নাহিদা আমাদের গর্বের ধন, তার সাথে গযনীর ইজ্জত-আব্রুর প্রশ্ন জড়িত।” বললেন সুলতানের উজির। আমাদের প্রথম কাজ হবে তাকে ওখান থেকে বের করে আনা। আমরা আগে আক্রমণ করলে তার খুন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া আমরা যে কোন ধরনের আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিলে তার সাথে দুর্ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা আলাফতোগীনকে পয়গাম দিতে পারি, সে যেন নাহিদাকে সসম্মানে গযনী পাঠিয়ে দেয়। যদি সে তা না করতে চায়, তাহলে কমান্ডো পাঠিয়ে আগে তাকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হোক। এরপর খাওয়ারিজমে সেনাভিযানের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হবে।”

উপদেষ্টাদের সবাই উজিরের কথা সমর্থন করলেন। অতঃপর আরো কিছু ব্যাপারে শলাপরামর্শের পর সর্বসম্মতিক্রমে একটি পরিকল্পনা তৈরী করা হলো। আলাফতোগীনের নামে নাহিদাকে সসম্মানে গযনী পাঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করে একটি পয়গাম পাঠানো হলো।

***

গযনী ও খাওয়ারিজমের মধ্যে দূরত্ব তখন প্রায় পাঁচশত মাইল। তন্মধ্যে অধিকাংশ এলাকা পাহাড়ী আর বাকীটা মরুময় পাথুরে এলাকা। মরু এলাকাকে তখনকার দিনে সাহরায়ে গায’ বলে ডাকা হতো।

দূতের যেতে আসতে প্রায় কুড়ি দিন সময় লেগে গেলো। নাহিদাকে ফেরত পাঠানোর পয়গামের জবাবে আলাফতোগীন বললো, নাহিদার মুক্তি পেতে হলে গযনী সুলতান তাকে খাওয়ারিজম শাহ বলে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তার সাথে কোন ধরনের যুদ্ধ করা হবে না এই মর্মে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হবে।”

নাহিদাকে নিরাপদে ও সসম্মানে রাখা হয়েছে, তা প্রমাণ করার জন্য আলাফতোগীন নিজে গযনীর দূতকে নাহিদার আবদ্ধ কক্ষ দেখিয়ে দেয় এবং দূতের সাথে নাহিদার সাক্ষাত করায়। আলাফতোগীনের নির্দেশে বন্দী নাহিদার কক্ষ খুলে দূতের সাথে তার কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়।

নাহিদার সাথে দূতের সাক্ষাত পরবর্তীতে গযনীর প্রেরিত কমান্ডোদের জন্য উপকারে আসে। নাহিদার একান্ত কর্মচারী জেবীন জুরজানিয়ার পতন ও আবুল আব্বাসের নিহত হওয়ার সংবাদ নিয়ে নাহিদার নির্দেশে গযনী এসে পড়েছিলো। সে জুরজানিয়ার রাজপ্রাসাদের সকল নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল।

নাহিদাকে উদ্ধারের জন্য পাঁচজন কমান্ডো নির্বাচিত করা হলো। তন্মধ্যে জেবীন ছিলো পঞ্চম।

* * *

পাঁচ কমান্ডো অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে জুরজানিয়া পৌঁছে গেল। তারা জুরজানিয়া গিয়ে একটি সরাইখানায় রাত যাপন করলো। পাঁচজনের পাঁচটি ঘোড়া ছাড়াও তারা একটি অতিরিক্ত ঘোড়াও সাথে নিল।

রাজধানী জুরজানিয়া ও আবুল আব্বাসের রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত জেবীন এই কমান্ডো অভিযানে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করল। সে এক কমান্ডোকে সাথে নিয়ে শহরের ভেতরে ঢুকে রাজপ্রাসাদের আঙিনায় চলে এলো। তারা আসার সময় শহরময় সকল রাস্তায় বিদ্রোহী দখলদার সেনাদের টহলরত অবস্থায় দেখতে পেল। তারা সারাদিন ছদ্মবেশে শহর ও রাজপ্রাসাদের বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আবার সরাইখানায় ফিরে গেল।

পরদিন গযনীর পাঁচ কমান্ডো যখন সরাইখানা থেকে বের হলো, তখন তাদের পরনে ছিলো খাওয়ারিজম বাহিনীর উর্দি। তাদের হাতের বল্লমে খাওয়ারিজম সেনাদের পতাকা। এই পতাকা ছিলো খাওয়ারিজম বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের প্রতীক। তারা বিশেষ বাহিনীর বিশেষ সৈন্য হিসেবে মাথা

উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গিতে পথ অতিক্রম করছিলো। প্রত্যেকেই ছিল অশ্বারোহী এবং পাঁচজনের সাথে একটি অতিরিক্ত ঘোড়াও জিনবাঁধা ছিলো। তাদের ঘোড়াগুলোর চাল-চলনেই বোঝা যাচ্ছিল এগুলো সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিটের দীর্ঘ প্রশিক্ষিত ঘোড়া। শহরের পথ অতিক্রম করার সময় টহলরত অশ্বারোহী সৈন্যদের সাথেও তাদের সাক্ষাত হলো। তারা একই বাহিনীর সমগোত্রীয় ভাইয়ের মতো স্মিত হাসি দিয়ে তাদেরই পরিচিত নিয়মে সম্ভাষণ জানালো।

শহরের বাসিন্দারা এমনিতেই সেনাশাসনে ভীত-বিহ্বল ছিল। তদুপরি বিশেষ বাহিনীর বিশেষ ঘোড়ায় আরোহী সৈন্যদের দেখে পথ ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে তাদের যাবার পথ করে দিচ্ছিল এবং সম্মানসূচক সালাম দিচ্ছিলো। বস্তুত এই পাঁচ কমান্ডো ছিলো গযনী বাহিনীর বিশেষ দলের সদস্য। তাদের বহনকারী ঘোড়াগুলোও ছিল প্রশিক্ষিত। এ ছাড়া তারা খাওয়ারিজম বাহিনীর পোশক ও পতাকাধারী বল্লম ধারণ করেছিলো বলে বিশেষ বাহিনীর মতো করে এগিয়ে যেতে তাদের কোন বেগ পেতে হয়নি। কারণ, তারা প্রত্যেকেই ছিলো উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত। তাছাড়া তারা আগেই জেনে নিয়েছিলো খাওয়ারিজমের বিশেষ বাহিনীর রীতিনীতি।

জেবীনের দেখানো পথে অনায়াসেই গযনীর পাঁচ কমান্ডো আবুল আব্বাসের রাজপ্রাসাদের সদর দরজায় চলে গেল। এই পাঁচ কমান্ডো ভয়ানক অভিযানে নেমেছিলো। তারা জানতো, ধরা পড়লে তাদের কী ভয়ঙ্কর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সকল ভয়-শঙ্কাকে দু’পায়ে দলে তারা সদর দরজায় গিয়ে রাজমহলের ভেতরে প্রবেশ করলো।

রাজমহলের প্রহরীরা এই কমান্ডোদেরকে তাদের বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের সদস্য মনে করে কোন ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ না করে পথ ছেড়ে দিল। জেবীন তার সঙ্গীদেরকে একটি ঘোর অন্ধকার পথে নাহিদার কক্ষে নিয়ে গেল। মহলের ভেতরেও দখলদার সেনাদেরকে কয়েক জায়গায় সতর্ক প্রহরা দিতে তাদের নজরে পড়ল। কিন্তু গযনীর এই অকুতোভয় কমান্ডোরা আল্লাহর নাম নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।

রাজপ্রাসাদের একটি জায়গায় গিয়ে জেবীন সঙ্গীদের দাঁড় করিয়ে অতিরিক্ত ঘোড়াটি ও একজন সঙ্গীকে নিয়ে আরো এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জেবীন ও তার সঙ্গী ঘোড়া থেকে নেমে নাহিদার কক্ষের সঙ্গে লাগোয়া সেবিকার কক্ষে প্রবেশ করল। কক্ষের সামনে প্রহরী দাঁড়ানো। এর পরেই নাহিদার কক্ষ। কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে জেবীন স্থানীয় ভাষায় প্রহরীদেরকে বললো, “দরজা খোল, বন্দী মহিলাকে শাহে খাওয়ারিজম আলাফতোগীনের একটি পয়গাম শোনাতে হবে।”

প্রহরী দরজা খুলে দিতেই চকিতে তারা দু’জন প্রহরীকে টেনে কক্ষের ভিতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল এবং তরবারীর আগা প্রহরীদের বুকে ধরে তার গায়ের উর্দি খুলতে বাধ্য করলো। এরপর কাপড় দিয়ে প্রহরীদের হাত-পা বেঁধে তাদের মুখে কাপড় খুঁজে পিঠমোড়া করে বেধে মেঝেতে উপুড় করে ফেলে রাখল। সেই সাথে বললো, আমরা গযনীর কমান্ডো, একটু শব্দ করবে অবশ্য তো এক আঘাতেই মেরে ফেলবো।

প্রহরীর গা থেকে খুলে নেয়া একটি উর্দি নাহিদাকে দিয়ে সেটি দ্রুত পরে নেয়ার জন্য অনুরোধ করল দুই কমান্ডো।

মুহূর্তের মধ্যে নাহিদা প্রহরীর উর্দি পরে সৈনিকের বেশে তাদের সাথে বাইরে বেরিয়ে এলো। কমান্ডো দু’জন সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে দ্রুত এসে অশ্বারোহণ করল এবং নাহিদাকে সাথে থাকা অতিরিক্ত ঘোড়াটিতে সওয়ার হওয়ার জন্য ইশারা করল।

নাহিদা ছিলেন অশ্বারোহণে অভ্যস্ত এবং প্রশিক্ষিত। কমান্ডোদের ইশারা পেতেই তিনি এক লাফে দক্ষ সৈনিকের মতোই ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। এরা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হয়ে বিনা বাধায় সদর দরজা পেরিয়ে আসতে সক্ষম হলো।

ফেরার পথে শহরের পথ অতিক্রম করার সময় আগের মতোই তাদের চাল ছিলো বিশেষ বাহিনীর মতো। খুব দৃঢ়তার সাথেই তারা মূল শহর থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলো। তারা যখন শহরের সীমানায় দাঁড়িয়ে গাছগাছালীর আড়ালে এসে পড়ল, তখন সবাই এক সাথে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাঁকালো।

নাহিদাও প্রশিক্ষিত কমান্ডোদের সাথে সমানতালে অশ্ব হকিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তিনি অভিজ্ঞ কমান্ডোদের মোটেও অনুভব করতে দেননি, তিনি নিতান্তই একজন অবলা নারী। তিনি কমান্ডোদের মতোই সমানতালে এই দুঃসাহসী অভিযানে নারীত্বের সকল দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে অশ্ব ছোটালেন। এই অভিযানে তিনিও কমান্ডোদেরই একজন সঙ্গী।

* * *

ইত্যবসরে সুলতান মাহমূদ সৈন্য ঘাটতি অনেকাংশেই দূর করে ফেলেছিলেন। কয়েক মাস যাবত মসজিদের ইমাম সাহেবদের মাধ্যমে জুমআর দিনে ঘোষণা করা হচ্ছিলো, রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও দীনের সার্থে সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবকের তীব্র প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

ইমামদের এই ঘোষণার ফলে হাজার হাজার তরুণ যুবক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা প্রত্যেকেই নিজের ব্যবহার্য ঘোড়া কিংবা উট সাথে নিয়ে এসেছিল। যারা সশরীরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করতে পারেনি, তারা তাদের উট কিংবা ঘোড়া সেনাবাহিনীর প্রয়োজন মিটানোর জন্য দিয়ে দিয়েছিল।

প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সুলতান মাহমূদ যখন খাওয়ারিজমের বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ দিলেন, তখন তার সেনাসদস্যের সংখ্যা অশ্বারোহী ও পদাতিক মিলিয়ে এক লাখের উপরে এবং প্রশিক্ষিত জঙ্গী হাতির সংখ্যা পাঁচশতেরও বেশী।

সুলতান তার সৈন্যদের বলখ পর্যন্ত নিয়ে থামতে বললেন। বলখে পৌঁছার পর তার সামনে ছিলো বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকাব্যাপী মরুময় অঞ্চল। মরুময় বিজন এলাকার যাত্রাপথের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য সুলতান পূর্ব থেকেই বিজন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত তুরমুজ নামক স্থানে নদীর তীরে বিশ হাজার বড় নৌকা তৈরী করিয়ে রেখেছিলেন। অকসাস নামক এই নদীর প্রবাহ ছিলো খাওয়ারিজমের দিকে।

সুলতানের গোটা বাহিনী তাদের হাতি, ঘোড়া, উট, সৈন্য তথা আসবাবপত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামসহ বিশ হাজার জাহাজবাহী নৌকায় বোঝাই করা হলো।

নদীর ভাটির প্রবাহের সাথে বিশাল এই নৌকা বহর এগিয়ে চলল। এই নদীর ইতিহাসে এটিই ছিল কোন রাজশক্তির সবচেয়ে বড় সেনাভিযান ও নৌমহড়া।

সুলতানের এই নৌবহর হাজারাশীপ উপকূল অতিক্রম করে খাওয়ারিজমের রাজধানী জুরজানিয়ার অদূরে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলো। সৈন্যরা নৌবহর থেকে নেমে ডাঙায় শিবির স্থাপন করলো।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, দখলদার আলাফতোগীনের কাছে সুলতান মাহমূদের বিশাল নৌবহর ও সেনাসমাবেশের খবর গেলো। তখন অনাক্রমণ চুক্তি করার জন্য একজন দূতকে দিয়ে সুলতান মাহমূদের কাছে পয়গাম পাঠালো।

কিন্তু ক্ষুব্ধ সুলতান আলাফতোগীনের সন্ধিপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। সেই সাথে তিনি এমন কিছু কঠিন শর্তের উল্লেখ করে সন্ধিপ্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন, যার ফলে আলাফতোগীন ঘাবড়ে গেলো। অগত্যায় মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য আলাফতোগীন গোটা খাওয়ারিজমের সৈন্যদের এক জায়গায় জড়ো করে দেখে তাদের সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ হাজার।

দখলদার আলাফতোগীন সেনাবাহিনীর সবচেয় যোগ্য ও অভিজ্ঞ পাঁচ-ছয়জন সেনাপতিকে হত্যা করিয়েছিলো শুধু আবুল হারেস ও আবুল আব্বাসের প্রতি আনুগত্যের অপরাধে। তাছাড়া সেনাবাহিনীর বহু তেজস্বী কমান্ডারকেও বিদ্রোহের আশঙ্কায় আলাফতোগীন হয় অন্তরীণ, নয়তো হত্যা করিয়ে ফেলেছিলো। ফলে খাওয়ারিজম বাহিনীতে সুলতানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো যোগ্য সেনাপতি ও কমান্ডারের অভাব দেখা দেয়। সার্বিক অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে আলাফতোগীন প্রমাদ গুণতে শুরু করে।

কিন্তু পরাজয়ের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে- এটা বোঝার পর আলাফতোগীনের অনুসারীরা মরিয়া হয়ে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকের মোকাবেলা সুলতানের চড়া মূল্য দিতে হয়।

সুলতানের অগ্রবর্তী বাহিনী সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ আলতাঈর নেতৃত্বে মূলশিবির থেকে অনেকটাই সামনে অবস্থান নিয়েছিলো।

আলতাঈর সৈন্যরা যখন ফজরের নামাযের জামাতে শরীক হলো এবং সকল সৈন্য একসাথে জামাতে নামায আদায় করছিলো, তখন আলাফতোগীনের সহযোগী সেনাপতি খমতাশ তার গোটা বাহিনী নিয়ে আলতাঈ সহযোদ্ধাদের উপর হামলে পড়ে।

আলতাঈ ছিলেন ইতিহাসখ্যাত সেনাপতি। জীবনে অসংখ্যবার চরম দূরাবস্থার মধ্যেও তিনি পরাজয়কে জয়ে পরিণত করেছিলেন। কৌশলী ও অভিজ্ঞ সমরনায়ক হিসেবে ইতিহাস তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যার নাম সুলতান মাহমূদের সমপর্যায়ে উচ্চারিত হয়। সেদিন তিনি তার শিবিরে সকল যোদ্ধাদের নিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্তেই ফজরের নামায আদায় করছিলেন।

শত্রুবাহিনী হয়তো জানতো, সুলতানের সৈন্যরা রণাঙ্গনেও জামাতে নামায আদায় করে থাকে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য মদখোর খরতাশ তার দলবল নিয়ে পূর্ব থেকে অদূরে অবস্থান নিয়েছিলো।

যেই দেখলো, আলতাঈর তামাম সৈন্য নামায পড়ছে, ঠিক তখন এক সাথে হাজার হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে খমরতাশ নামাযরত সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সুলতানের এই সৈন্যরা ছিলো একেবারেই অপ্রস্তুত। তাদের কারো পক্ষেই প্রতিরোধ করা সম্ভব হলো না। ফলে সুলতানের নির্বাচিত চৌকস সৈন্যদের বিরাট অংশ নিহত হলো। সেনাপতি আলতাঈ মুষ্টিমেয় কয়েকজন কমান্ডার ও সহযোদ্ধা নিয়ে কোনমতে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলেন।

সুলতান মাহমূদ এই অযাচিত অতর্কিত আক্রমণ ও হতাহতের খবর শুনে তার রিজার্ভ বাহিনীকে খমরতাশের বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। এরা অগ্রসর হয়ে জানতে পারলো, খমরতাশ আলতাঈর সহযোদ্ধাদের কচুকাটা করে চলে গেছে।

সুলতানের এই রিজার্ভ বাহিনী ছিলো তার একান্ত নিরাপত্তা ইউনিট। এই ইউনিটের প্রতিজন সদস্য যেমন ছিলো ভিন্নতর শক্তির অধিকারী, তেমনি তাদের সওয়ারীগুলোও ছিল অন্য সওয়ারীর চেয়ে তেজস্বী। এরা অগ্রসর হয়ে যখন দেখল, খমরতাশ আলতাঈর বাহিনীকে তছনছ করে চলে গেছে, তখন তারা ওদের পিছু ধাওয়া করলো। খরতাশের সৈন্যরা তখনো খুব বেশী দূর অগ্রসর হয়নি। আকস্মিক আক্রমণের অস্বাভাবিক সাফল্যের পর তাদের মনোবল দারুণ বেড়ে গিয়েছিল এবং অভিযান শেষে অনেকটা আয়েশে কিছু পথ অগ্রসর হয়ে মরতাশের সৈন্যরা আরাম করার জন্য যাত্রাবিরতি করল।

এই এলাকাটি ছিল মরুময়। হঠাৎ পশ্চাৎদিকে ধূলি উড়ার আলামত দেখতে পেল খমরতাশ। সে বুঝে গেল সুলতানের বাহিনী হামলার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। খমরতাশ তার সৈন্যদেরকে জবাবী আক্রমণে প্রতিহতের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিল। প্রতিপক্ষ বাহিনীকে খমরতাশের সৈন্যরা ঘোড়ায় চড়ে তৈরী হয়ে গেল।

সুলতানের সৈন্যরা খমরতাশের বাহিনীকে ঘেরাও করার চেষ্টা করলো আর খমরতাশের সৈন্যরা ঘেরাও ভাঙার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হলো। কিন্তু সুলতানের এই বাহিনীর ঘেরাও থেকে বের হওয়া খরতাশের সৈন্যদের পক্ষে সম্ভব হলো না।

চলন্ত ও দূরন্ত সুলতানের এই সৈন্যদের সংখ্যা নিরূপণ করা খমরতাশের পক্ষে সম্ভব হলো না। খরতাশের সৈন্যরা ঘেরাও থেকে বের হওয়ার জন্য দৌড়-ঝাঁপ পাড়ছিলো আর সুলতানের বাহিনীর হাতে ঘায়েল হচ্ছিল। পলায়নপর সৈন্যদের সাথে গযনী বাহিনীর মোকাবেলা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। অল্প সময়ের মধ্যে সকল শত্রু সৈন্যকে ঘায়েল করে খোদ খমরতাশকে পাকড়াও করে ফেললো সুলতানের সৈন্যরা। মুখোমুখী সংঘর্ষে খুবই করুণ পরিণতি বরণ করতে হলো খমরতাশের। গ্রেফতার হয়ে সে সুলতানের দরবারে নীত হলো।

* * *

রাতের বেলা সুলতান মাহমূদ সৈন্যদেরকে নতুনভাবে বিন্যাস করলেন। সৈন্যদের এক অংশকে নদীর তীরে মোতায়েন করে তাদেরকে নির্দেশের অপেক্ষায় রাখলেন। তিনি তাদের বললেন, নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে তোমরা নৌবহর নিয়ে রাজধানী জুরজানিয়ার নিকটবর্তী গিয়ে শিবির স্থাপন করো।

পরদিন সুলতান মাহমূদ কোন তৎপরতা না চালিয়ে নিষ্ক্রিয় রইলেন। তিনি শত্রুবাহিনীকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, এখনই আক্রমণের জন্য তিনি প্রস্তুত নন।

আলাফতোগীন কোন বিশেষজ্ঞ সমরবিশারদ ছিল না। তার অন্যতম সেনাপতি খমতাশ ছিল বন্দী। সেনাপতি আবু ইসহাককে আলাফতোগীন নদী তীরের কোন এক জায়গায় রিজার্ভ রেখেছিল। তাছাড়া সে গুরুত্বপূর্ণ ও অভিজ্ঞ সেনাপতিদের হত্যা করিয়ে ফেলেছিল।

আলাফতোগীন সুলতানের রণকৌশল বুঝতে সক্ষম হলো না। তাছাড়া সুলতানের সেনাবিন্যাস সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। সুলতানের সেনাবিন্যাসের কোন খোঁজখবর না নিয়েই নিজেকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান এবং সুলতানের বাহিনী অপ্রস্তুত রয়েছে ভেবে আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণ ছিল ৪০৮ হিজরীর সফর মোতাবেক ১০১৭ সালের ৩ জুলাই।

‘আছারুল উজারা’ নামক ইতিহাস গ্রন্থে আলফজলী’ এই যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনায় লিখেছেন, এই আক্রমণে আলাফতোগীন নিজে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সে ছিল তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে সামনে। সে ডান বাম কোন দিকে খেয়াল না। করেই আক্রমণ করে বসে।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, এই আক্রমণে আলাফতোগীনের সাধারণ যোদ্ধারা সাহসিকতার সাথে লড়াই করে। তারা গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিচ্ছিল এবং গযনী বাহিনীকে আল্লাহর প্রিয় দুই বুযুর্গের হন্তারক বলেও স্লোগান দিচ্ছিল। তাদের হৃদয়ে খুবই সূক্ষ্মভাবে গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্মাতে সক্ষম হয়েছিল।

এই ঘৃণা ও ক্ষোভ শক্তিতে পরিণত হলো। শুধু বীরত্ব ক্ষোভ ও খুনের নেশায় যদি সামরিক লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়া যেতো, তবে এই বিজয় পাওনা ছিলো আলাফতোগীনের। কিন্তু অপরিমেয় ক্ষোভ থাকার পরও নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে সমরকৌশলে বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন সুলতান। তাঁর রণকৌশল ছিল দূরদর্শী এবং সময়োচিত।

সুলতান মাহমূদ যুদ্ধের শুরুতে ঘোড়া থেকে নেমে দু’রাকাত নামায পড়লেন এবং নামায শেষে আলাফতোগীনের ডান বাহুতে হস্তিবাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।

আলাফতোগীনের সৈন্যরা তখনো হস্তিবাহিনীর কোন সদস্যকে দেখেনি। হঠাৎ তাদের ডান বাহুকে হস্তিবাহিনী আক্রমণ করলো। জঙ্গী হাতিগুলো এগিয়ে আসার সাথে সাথে বিকট চিৎকার করছিল। হাতির চিৎকারে আকাশও যেনো কেঁপে উঠছিল।

খাওয়ারিজমের সৈন্যরা কখনো হস্তিবাহিনীর মোকাবেলা করেনি। বিশালদেহী জঙ্গি হাতির দানবীয় চিৎকার ও দৈত্যের মতো এগিয়ে আসার ভাব দেখেই আলাফতোগীনের সৈন্যরা ভড়কে গেল। তারা জানতো না হাতি দেখতে যদিও ভয়ানক; কিন্তু এদের দুর্বলতাও প্রকট।

সুলতান হস্তিবাহিনীর ডানে বামে পদাতিক সৈন্য এবং পেছনে অশ্বারোহী সৈন্যদের নিযুক্ত করলেন।

জঙ্গি হাতিগুলো যখন শত্রুসেনাদের দিকে দৌড়ে এগুচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল জমিন দুলছে। আলাফতোগীন তার সেনাদের উজ্জীবিত করার সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করলো। কিন্তু সৈন্যরা হাতির ভয়ানক চিৎকার ও কাণ্ডকারখানা দেখে ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়ল।

হস্তিবাহিনীর দুটি হাতি শক্ৰযযাদ্ধাদের মধ্যভাগে চলে গেল। মধ্যভাগে অবস্থান করছিল সেনানায়ক আলাফতোগীন। আলাফতোগীনের মধ্যভাগের যোদ্ধারা বীরবিক্রমে মোকাবেলা করলো কিন্তু এক পর্যায়ে আলাফতোগীনের দেহরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ভাঙন দেখা দিল।

দিন শেষে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধের অবসান হয়ে গেল। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ভেবে আলাফতোগীন পালিয়ে গেল; কিন্তু রণাঙ্গন থেকে তার পক্ষে নিষ্ক্রান্ত হওয়া সম্ভব হলো না। সুলতানের সৈন্যরা তাকে ঘেরাও করে পাকড়াও করে ফেলল।

***

জুরজানিয়া ছিল রাজধানী। বিদ্রোহী খলনায়ক আলাফতোগীন গ্রেফতার ও পরাজিত হলেও বিজয়কে অর্থবহ করার জন্য সুলতানের প্রয়োজন ছিল রাজধানী কজা করা।

নদীর তীরে অপেক্ষমাণ সৈন্যদেরকে তিনি নৌবহরে রাজধানী জুরজানিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। সুলতানের সৈন্যরা প্রায় চারহাজার নৌকায় আরোহণ করে রাজধানীর দিকে রওনা হলো।

সুলতানের নৌবহর জুরজানিয়ার নিকটবর্তী হলে তারা দেখতে পেলো তাদের সম্মুখ দিক থেকে অন্তত ত্রিশহাজার সৈন্যের বিশাল এক নৌবহর এগিয়ে আসছে।

তখন ভোরের সূর্য পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে। ত্রিশ হাজার নৌকার আরোহীর এই বিশাল নৌবহর ছিল আলাফতোগীনের সহযোগী সেনাপতি আবু ইসহাকের নেতৃত্বে। আলাফতোগীন এই সৈন্যদের রিজার্ভ রেখেছিল। সুযোগমতো সে এদের তলব করতো। কিন্তু এদের তলব করার আর সুযোগ হয়নি। এর আগেই আলাফতোগীন সুলতানের সেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং তার বাহিনী শোচনীয় পরাজয়ের মুখোমুখী হয়।

সেনাপতি আবু ইসহাক খবর পেয়েছিল, সুলতানের একদল সৈন্য নদীতীরে নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। সে বুঝতে পারলো, এদের পথ ও গন্তব্য রাজধানী জুরজানিয়া। আবু ইসহাক ভাবলো, জুরজানিয়ার সাধারণ লোক তাদের বিদ্রোহে ক্ষুব্ধ।

এমতাবস্থায় প্রতিপক্ষের জুরজানিয়া আক্রমণ করলে স্থানীয় সৈন্যদের মধ্যে ভাঙন দেখা দিতে পারে। তাছাড়া রাজধানীতে অনেকের পক্ষে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। এরচেয়ে বরং সকল সৈন্য নিয়ে রাজধানীর বাইরেই শত্রুবাহিনীর মোকাবেলা করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। যেই চিন্তা সেই কাজ। সেনাপতি আবু ইসহাক ত্রিশহাজার নৌকায় তার অনুগত সৈন্যদের সওয়ার করে মোকাবেলার জন্য এগিয়ে এলো।

সুলতানের নৌবহর অগ্রসর হয়ে বুঝতে পারলো, শত্রুবাহিনী নৌযুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। বস্তুত উভয় নৌবহর মুখোমুখি হতেই নৌযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধের ধরন ছিলো অনেকটা মল্লযুদ্ধের মতো।

একটি নৌকা অপর নৌকার মুখোমুখি হলে শত্রুসেনাদের উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষ লাফ দিয়ে শত্রু নৌকায় গিয়ে মল্ল যুদ্ধে প্রবৃত্ত হচ্ছিল। নৌকা পরস্পর টক্কর দিচ্ছিল আর যোদ্ধারা একে অন্যের উপর আঘাত হানতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। আর আহত ও নিহত যোদ্ধাদের তাজা রক্তে লাল হচ্ছিল নদীর পানি।

এক সংবাদবাহক এসে সুলতান মাহমূদকে খবর দিলো, জুরজানিয়ায় গযনী সৈন্যদের সাথে আলাফতোগীনের একাংশের নৌযুদ্ধ চলছে। খবর শোনামাত্রই সুলতান অশ্বারোহী বাহিনী এবং উজ্জ্বারোহী ইউনিটকে নৌসেনাদের সহযোগিতার জন্য অভিযানের নির্দেশ দিয়ে নিজেও অশ্বপৃষ্ঠে রওনা হলেন। এই সৈন্যরা যখন অকুস্থলে পৌঁছলো, তখন যুদ্ধ প্রায় স্তিমিত হয়ে এসেছে এবং নদীর মধ্যে উভয় সেনাদের মাল্লাবিহীন নৌকা পরস্পর টোকাটুকি করছে।

উষ্ট্রারোহী সৈন্যরা নদীর তীর থেকে শত্রুসেনাদের নৌকা চিহ্নিত করে শত্রুদের উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল । কোন কোন অশ্বারোহী তো এমন বীরত্ব প্রদর্শন করলো যে, ঘোড়া নদীতে নামিয়ে দিলো, কিন্তু পানির পরিমাণ বেশী ও নদীতে স্রোত থাকার কারণে তারা তেমন সুবিধা করতে পারলো না।

সুলতান মাহমূদ নদীতীরে পৌঁছে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া সকল অশ্বারোহীকে তীর নিয়ে এলেন।

এদিকে সুলতান মাহমূদের বাহিনীর সাথে দখলদার আলাফতোগীন বাহিনীর যুদ্ধ এবং আলাফতোগীনের গ্রেফতারীর খবর শুনে রাজধানী জুরজানিয়ার সাধারণ অধিবাসীরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এ সম্পর্কে তৎকালীন ঐতিহাসিক ইসকান্দারয়র লিখেছেন, রাজধানী জুরজানিয়ার মানুষ আলাফতোগীনের বারো মাসের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো।

জুরজানিয়ায় আইনের শাসন বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। ন্যায়নিষ্ঠা ও ইনসাফের নামগন্ধও ছিলো না আলাফতোগীনের সেনাশাসনে। প্রত্যেক নাগরিকের ঘাড়ের উপর গ্রেফতারীর খড়গ সব সময় ঝুলন্ত থাকতো। সাধারণ সৈনিকের কথাও তখন রাজকীয় ফরমানের মর্যাদা পেয়েছিল।

নির্যাতিত-নিপীড়িত জুরজানিয়ার সাধারণ লোকজন যখন জানতে পারলো, খমরতাশ ও আলাফতোগীন গযনী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে এবং এখন আবু ইসহাকের অনুগত সৈন্যদের সাথে নদীতে গযনী সেনাদের যুদ্ধ চলছে।

এ খবর শোনার সাথে সাথে গযনীর আবাল-বৃদ্ধ হাতের নাগালে তরবারী-বল্লম-নেজা-দা-বটি-লাঠি যাই পেয়েছে নিয়ে নদীর তীরের দিকে দৌড়াতে শুরু করে দিলো এবং পথিমধ্যে নগররক্ষায় যেসব সৈন্য সামনে পেলো, তাদের উপর হামলে পড়লো।

দিনব্যাপী চললো এই নৌযুদ্ধ। সূর্য ডোবার কিছুক্ষণ আগে শহরের লোকেরা যখন গয়নী সেনাদের সাহায্যের জন্য বেরিয়ে এলো এ খবর শোনামাত্র তীরে দাঁড়িয়ে নির্দেশদাতা সেনাপতি আবু ইসহাক পালোনোর উদ্যোগ নিল।

কিন্তু তার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। পলায়নপর আবু ইসহাককে পাকড়াও করে তার সেনাবাহিনীর লোকেরাই গযনী বাহিনীর হাতে ও সোপর্দ করলো। আর সাধারণ লোকজন গিয়ে গযনী সেনাদের সহযোগিতা ও করতে শুরু করলো। তারা খাওয়ারিজম বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণেও কুণ্ঠাবোধ করলো না।

ঐতিহাসিক বায়হাকী ও ইবনে ইস্কান্দার লিখেছেন, দখলদারদের প্রতি ক্ষুব্ধ ও ছিলেন সুলতান মাহমূদ। ক্ষুব্ধ সুলতান নদীর তীরব্যাপী উধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে তীরন্দাজদের আরো বেশী করে সঠিক নিশানায় তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। রাগে-ক্ষোভে তার মুখ থেকে ফেনা বেরিয়ে আসছিলো।

দিনের শেষে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও রাতভর চললো শত্রুসেনাদের গ্রেফতারী এবং গযনীর আহত ও নিহত সেনাদের একত্রিত করার কাজ। আহতদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিল।

রাতের বেলায়ই শহরের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং গণমান্য লোকেরা এসে সুলতানের কাছে ওইসব অপরাধীদের পাত্তা জানিয়ে দিচ্ছিল যারা কোন না কোনভাবে আলাফতোগীনের বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিলো এবং আবুল আব্বাসকে হত্যার পেছনেও যাদের হাত ছিলো।

সেই রাত্রেই ওইসব চিহ্নিত অপরাধীদের পাকড়াও অভিযান শুরু হয়ে গেল।

* * *

পরদিন প্রথম প্রহরে দখলদার খলনায়ক আলাফতোগীন, সেনাপতি আবু ইসহাক ও সেনাপতি ওমরতাশকে সুলতানের সামনে পেশ করা হলো। তৎকালীন ঐতিহাসিক বায়হাকী, উতবী এবং গরদীজী লিখেছেন, সুলতান মাহমূদকে ইতোপূর্বে এমন ক্ষুব্ধ অবস্থায় কখনো দেখা যায়নি।

ধৃত বিদ্রোহীদের নায়কদের তিনি যে শাস্তি দিলেন, তাতে হয় তো তার অন্তরাত্মাও কেঁপে উঠেছিলো। সুলতান মাহমূদকে কোন অবস্থাতেই অত্যাচারী বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এদের অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে তিনি হয়তো নিজের ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি।

হে জালেমের দল! তোমরা শুধু আবুল আব্বাসের হন্তা-ই নও। ক্ষুব্ধকণ্ঠে ধৃতদের উদ্দেশ্যে বললেন সুলতান। ক্ষুব্ধ সুলতান যখন কথা বলছিলেন, তার মুখ থেকে রাগে-ক্ষোভে থুতু বেরিয়ে আসছিলো। তার সারা শরীর ক্ষোভে থরথর করে কাঁপছিলো। তিনি ক্ষুব্ধকণ্ঠে আবারো বললেন

এই দুই মুসলিম দেশের হাজারো নিরপরাধ সেনার জীবনহানির অপরাধে তোমরাও অপরাধী। তোমাদের ক্ষমতালিপ্সা আর বেঈমানীর কারণে এতোগুলো মানুষের জীবনহানী ঘটেছে। তোমাদের অনুগত সৈন্যদের প্রাণহানির হিসেব করে দেখো, এরা না তোমাদের সৈন্য ছিলো, না আমার সৈন্য ছিলো। এরা ছিলো ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী সৈনিক। এরা ছিলো আল্লাহর সিপাহী। তোমরা ক্ষমতার মসনদ পাকাঁপোক্ত করতে এদের হত্যা করিয়েছে।

ক্ষুব্ধ সুলতান রাগে-ক্ষোভে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললেন, ওহে নিমকহারামের দল! তোমরা ওই খুন দেখোনি, যে খুন মরুর মাটি শুষে নিয়েছে। সেই রক্ত দেখোনি, যে রক্ত নদীর পানিতে ভেসে গেছে। তোমরা দেখোনি তোমাদের কারণে ময়দানে ক্ষতবিক্ষত যেসব সৈনিক তড়ফাতে তড়ফাতে মৃত্যুবরণ করেছে।

হে বিদেশী ফিরিঙ্গীদের পা-চাটা গোলামের দল! হে সত্যের ঝাণ্ডাবাহী সৈনিকের ঘাতক, হে ধোকাবাজ প্রতারক গোষ্ঠী! তোমরা হাতে পবিত্র কুরআন নিয়ে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। হে ভণ্ডের দল! নিজেদের সাচ্চা মুসলমান দাবী করে তোমরা সাধারণ মুসলমানদের ধোকা দিয়েছো। তোমরা মহাপরাক্রম আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিলে। ভুলে গিয়েছিলে মহান আল্লাহ্ কখনো মজলুমের ফরিয়াদ ফিরিয়ে দেন না।

হে হতভাগার দল! নিজেদের স্বকীয়তা ইহুদী-নাসারাদের হাতে বিকিয়ে দিয়ে তোমরা গোটা জাতির ভাগ্যকে বেঈমানদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলে। তোমাদের জ্ঞানবোধ ফিরিঙ্গী বেশ্যদের হাতে তুলে দিয়ে শুরার মাতলামীতে হারিয়ে গিয়েছিলে। তোমাদের দিল-দেমাগে ক্ষমতা ও মসনদের মোহ আসন গেড়ে বসেছিলে।

তোমরা ঈমান বিক্রি করে দিয়েছিলে? হে ঈমান বিক্রেতা বেঈমানেরা! আমি মূর্তি হন্তারক আর তোমরা সেই মূর্তির জীবন্ত প্রতীক! হিন্দুস্তানের মূর্তিগুলোকে আমি যেভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো করেছি, তোমাদেরকেও আমি সেভাবেই টুকরো টুকরো করে ফেলবো। হিন্দুদের মাটি-পাথরের দেবতাগুলোকে আমি যেভাবে ঘোড়ার পায়ে পিষেছি, তোমাদেরকেও সেভাবে পিষে ফেলবো।

হে বেঈমান নিমকহারামের দল! রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তোমাদের বিপুল অংকের ভাতা দেয়া হতো এইজন্য যে, তোমরা জনগণের সেবা করবে, নিজ দেশ ও দেশের মানুষের ঈমান-ইজ্জতের হেফাযত করবে, ইসলামের বিরুদ্ধে দুশমনদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাঁত করবে, ইসলামের হেফাযতের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেবে। কিন্তু কর্তব্য ভুলে গিয়ে তোমরা নিজ দেশকেই দখল করেছো। ধর্মের দোহাই দিয়ে জাতির জীবন-সম বিকিয়ে দিয়েছে। গণমানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে, মানুষের জীবনকে সংকীর্ণ করে দিয়েছে।

হে বেঈমানেরা, আমি যদি তোমাদের উচিত শিক্ষা না দিই, হাজারো মজলুমের বিদেহী আত্মা আমাকে অভিশাপ দেবে। যাও এদেরকে ময়দানে নিয়ে চাবুক লাগাও।

শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই ধৃত দেশদ্রোহীদের শাস্তি দেখার জন্য সেখানে ভিড় জমাল। গোটা ময়দান লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। আলাফতোগীন, আবু ইসহাক, খমতাশ ও তাদের সহযোগীদের হাজারো জনতার বেষ্টনীর মধ্যে ময়দানের মাঝখানে নিয়ে সুলতানের কমান্ডোরা চাবুক দিয়ে পেটাতে শুরু করলে হাজারো মজলুমের হর্ষধ্বনিতে গোটা এলাকা কেঁপে উঠলো।

বিদ্রোহীদের চার চারজন করে ভাগ করে চাবুক লাগানোর পর তাদের সবাইকে একটি চৌবাচ্চায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো আর রাজধানীর লোকদের বলা হলো, তারা যেনো দল বেঁধে এদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে এবং ভর্ৎসনাস্বরূপ এদের উপর থুতু ছিটিয়ে দেয়। লোকজন এদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় কেউ কেউ তাদের উপর ঢিল নিক্ষেপ করল এবং কেউ কেউ পাথর ছুঁড়ে মারলো। অনেকেই তাদের গালিগালাজ করে একপাশে দাঁড়ালো।

এরপর সুলতান মাহমূদ এমন নির্দেশ দিলেন, তাতে গোটা ময়দানে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, সুলতান এমন কঠোর নির্দেশ দিতে পারেন!

সুলতান মাহমূদ এরপর নির্দেশ দিলেন, এদের প্রত্যেকের কাঁধ বরাবর বাজুসমেত হাত কেটে দাও। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই সুলতানের কমান্ডোরা তরবারী নিয়ে দৌড়ে এলে অপরাধীরা এদিক সেদিক দৌড়াতে চেষ্টা করলো এবং চিৎকার করে করে সুলতানের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো। কিন্তু সুলতানের মনে তখনও ছেয়ে ছিলো নিরপরাধ সেইসব সিপাহীদের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য, যারা এদের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে।

তাতে সুলতান ক্ষান্ত হলেন না। তিনি আগেই পনেরোটি জঙ্গীহাতি একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। এবার তিনি নির্দেশ দিলেন, জঙ্গী হাতিগুলোকে এদের পিষে মারার জন্য ছেড়ে দাও।

প্রতিটি হাতিকেই পরিচালনা করছিলো একেকজন মাহুত। তারা হাতিকে দৌড়ালো। অপরাধীদের সবার পায়ে ছিল ডাণ্ডাবেড়ী। ওরা এদিক সেদিক সরে যাওয়ার চেষ্টা করল বটে; কিন্তু মাহুতরা হাতিগুলোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওদের সবাইকে পিষে ফেললো।

এরপর এদের নিষ্পিষ্ট মৃতদেহগুলো গলায় রশি বেঁধে আবুল আব্বাসের কবরের পাশে নিয়ে যাওয়া হলো। আবু আব্বাসের কবরের পাশে আগেই কাঠের খুঁটি পুঁতে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন সুলতান। দণ্ডিত দেশদ্রোহী হন্তারকদের মৃতদেহগুলোকে তিনি আবুল আব্বাসের কবরের পার্শ্ববর্তী কাঠের খুঁটিতে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

এদিকে শহরে সুলতানের ধরপাকড় আরো কয়েক দিন অব্যাহত থাকল। অভিযুক্তদের পাকড়াওয়ের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলে একই শাস্তি দেয়া হলো। টানা কয়েকদিন ধরপাকড় করার পর সুলতান এই অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিলেন।

সুলতান মাহমূদ সেনাপতি আলতানতাশকে খাওয়ারিজমের শাসক ঘোষণা করলেন এবং আরসালান জাযেবকে শাসকের সহকারী নিযুক্ত করলেন এবং খাওয়ারিজমকে গযনী সালতানাতের অধীন করে নিলেন। সেনাধ্যক্ষ আলতানতাশ ও তার ডেপুটি আরসালান জাযের গোয়েন্দা তৎপরতা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে খুবই দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছিলেন।

বর্তমান যুগে গোয়েন্দা বিভাগ বলতে যা বোঝায়, সুলতান মাহমূদের এ বিভাগ ছিল এরই পুরাতন রূপ। এ বিভাগের কর্মীদের মুশরেফ বলা হতো। শত্রু দেশে সে দেশেরই যেসব নাগরিককে গোয়েন্দা চর বানানো হতো, তাদেরকেও মুশরেফ নামে ডাকা হতো। ঐতিহাসিক বায়হাকী লিখেছেন, মুশরেফদেরকে সুলতান মাহমূদ মোটা অংকের ভাতা, উচ্চ প্রযুক্তি এবং আকর্ষণীয় পুরস্কার ও উপঢৌকন দিতেন। তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে তিনি ভিন্নভাবে ভাতা দিতেন। বায়হাকী লিখেছেন, সুলতান মাহমূদ এমন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ লোকদের গোয়েন্দা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতেন যে, তারা শক্রদেশে সেই দেশের শাসকগোষ্ঠী ও রাজা-বাদশাহর শ্বাস-প্রশ্বাসের খবরও বলে দিতে পারতো।

আলতানতাশ ও আরসালান জাযেব প্রাথমিক পর্যায়ে গযনী থেকে কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে নিয়ে এলেন। এরপর এরাই স্থানীয়দের থেকে লোক নির্বাচন করে গোটা খাওয়ারিজমব্যাপী তাদের গোয়েন্দাজাল বিছিয়ে দিলো।

দূরদর্শী, অতিসতর্ক, তীক্ষ্ণধীসম্পন্ন লোকদের ব্যবহার করে ইহুদী ও খৃস্টান কুচক্রীরা যেসব চক্রান্তের জাল বিস্তার করে রেখেছিল, অস্বাভাবিক কম সময়ের মধ্যে সকল দুষ্কৃতকারীকে চিহ্নিত করলেন আলতানতাশ ও আরসালান জাযেব। তারা মূল চক্রান্তকারী ও কুচক্রীদের স্থানীয় সহযোগীদের চক্রান্তের হোতাদের মতোই শাস্তি দিলেন।

শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জে বসবাসকারী সকল লোকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা হলো। তাদেরকে সকল সামরিক শাসনতান্ত্রিক অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে মুক্ত করা হলো এবং তাদের জীবন-সম্পদ ও ইজ্জত আব্রুর হেফাযতের দায়িত্ব সরকারের কাঁধে তুলে দেয়া হলো। ফলে সকল স্তরের মানুষের মধ্যে ফিরে এলো আস্থা ও বিশ্বাস।

খাওয়ারিজমের শাসনব্যবস্থা পুনর্বহালের পর সুলতান যখন গযনী ফিরে আসছিলেন, তখন যেখানে গযনী ও খাওয়ারিজম বাহিনীর প্রথম মোকাবেলা হয়েছিল। সেখানে এসে তিনি থেমে গেলেন।

জায়গাটিতে তখনো শিয়াল-শকুন এবং লাওয়ারিশ কুকুর মৃতদের হাড়-গোড় তালাশ করছিল। সুলতান মাহমূদ তার ঘোড়া থামিয়ে ফাতেহা পড়ে নিহত সৈন্যদের জন্য দুআ শুরু করলেন।

দীর্ঘক্ষণ পর তিনি যখন হাত নামিয়ে আনলেন, তখন তার চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছিল এবং কণ্ঠ দিয়ে হেঁচকি দিয়ে কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল। বস্তুত ‘বেঈমান কাফেরদের জন্য অত্যন্ত কঠোর আর ঈমানদার স্বজাতির জন্য অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী’ সেই ঐতিহাসিক শাশ্বত বাণীর বাস্তব নমুনা ছিলেন সুলতান মাহমুদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *