৩.৩ বিরহের দিনে শবনম বলেছিল

বিরহের দিনে শব্‌নম বলেছিল, তুমি আমার বিরহে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না। আমি তার সে আদেশ পালন করেছি। বিধাতা ঘাড় ধরে করিয়ে ছিলেন।

যখন চিরন্তন মিলনের সুখ স্বপ্ন সে দেখেছিল তখন সে বলেছিল—ওই তার শেষ কথা এখনও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি-‘তুমি আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।’ এ কথা স্মরণ হলে ভাগ্য-বিধাতার মুখ ভেংচানি দেখতে পাই।

কিন্তু শব্‌নম তার কথা রাখে নি। সে তার শেষ আদেশ দিয়ে গিয়েছিল, আমি যেন বাড়িতে থাকি, সে ফিরে আসবে। সে আসে নি।

ক’বছর হল, আবদুর রহমান?

কাবুল শহর আর তার আশপাশের গ্রামে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। লিগেশনের ভারতীয় কর্মচারী আমাকে বার বার পরিষ্কার বললেন, সে আর্কের ভিতর নেই। আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁর গুপ্তচর তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। আমার সামনেই তাকে তিনি ক্রস করলেন। এমন সব অসম্ভব অসম্ভব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন যেগুলো কখনও আমার মাথায় আসত না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, অনুসন্ধানে কণামাত্র ত্রুটি হয় নি।

তার কিছুদিন পর তিনি একজন একজন করে তিনজন চর পাঠালেন। এরা কাবুল শহর ও উপত্যকার সব কটা গ্রাম ভালো করে দেখে নিয়েছে। ওগুলো আমি নিজে অনুসন্ধান করেছি বহুবার। কোনও কোনও গ্রামে আমার আপন ছাত্র আছে। মনসূরের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় খানা-তালাশী হাট-মাঠ তালাশী সব কিছু করেছে, কিন্তু আমার সামনে আসে নি-মনসূরকে নিফলতা জানিয়ে গিয়েছে। আমাকে তাদের গ্রামে, তাদের গৃহে অপ্রত্যাশিতভাবে আসতে দেখে তারা আমাকে কোথায় বসাবে, কি সেবা করবে ভেবে না পেয়ে অভিভূত হয়েছে। তিনশ বছর আগে ভারতবর্ষে গুরু তার শিষ্যগৃহে অযাচিত আগমন করলে যা হত এখানে তাই হল। তারও বেশী। গুরুপত্নীর অনুসন্ধানে গাফিলী করবে এমন পাষণ্ড আফগানিস্থানে এখনও জন্মায় নি। লিগেশনের সব ক’জন চরই একবাক্যে স্বীকার করলে, তারা এমন কোনও জায়গায় যেতে পারে নি যেখানে আমি এবং আমার চেলারা তাদের পূর্বেই যায় নি।

এত দুঃখের ভিতরও মনসূর একদিন একটি হাসির কথা বলেছিল। তার ক্লাসের সব চেয়ে দুর্দান্ত ছেলে ছিল ইউসুফ। মনসুর বললে, এই কবুল উপত্যকার প্রথম চেরি, প্রথম নাসপাতিতা সে যেখানেই পাকুক না কেন-খায় ইউসূফ। শব্‌নম বীবী ইউসুফের চোখের আড়ালে বেশীদিন থাকতে পারবেন না। এ শহরের সব দুঁদে ছেলের সর্দার সে-ই।

ওদের নিয়ে সে লেগেছে। কোন বাড়িতে কে বীবীকে লুকিয়ে রাখতে পারবে আর ক’দিন?

আমি শুধালুম, আর সবাই আমাকে দেখতে এল, সে এল না?

‘সে বলেছে, বর না নিয়ে সে আপনার সঙ্গে দেখা করবে না।’

আমি যে অবস্থায়, তখন আমার কাছে সম্ভব অসম্ভব কোনও পার্থক্য নেই। তবু জানি উপত্যকার বাইরে এখন কেউ যেতে পারে না, এবং বাইরের লোক আসতে পারছে না বলেই খাওয়া-দাওয়ার অভাবে গরীব দুঃখীদের ভিতর দুর্ভিক্ষ লেগে গিয়েছে। সিগারেট তো কবে শেষ হয়েছে ঠিক নেই—চালান আসে হিন্দুস্থান থেকে—এ বাড়ি ও বাড়িতে তামাকের জন্য হাত পাতা-পাতি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাবুলের পূর্বদিকের গিরিপথ বরফে সম্পূর্ণ বন্ধ। পশ্চিমের পথে গজনীর ডাকাতরা বসে আছে, বাচ্চা একটু বেখেয়াল হলেই উপত্যকায় ঢুকে লুটপাট আরম্ভ করবে এবং তারপর শহরের পালা। এই পশ্চিমের পথ দিয়েই আবদুর রহমান গিয়েছে আওরঙ্গজেব খানকে খবর দিতে। যাবার সময় সে দরবেশের পোশাক পরে নিয়েছিল, এ ছাড়া আর কোনও মানুষ ডাকাতদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পায় না।

উত্তরের পথে বাচ্চা-ই সকাওর গ্রাম। সে পথে তারই লোকজন ছাড়া কেউ আস-যাওয়া করে না। দক্ষিণ দিকে পথ নেই, যেটুকু আছে তার উপর কত ফুট বরফ কে জানে!

পুরুষের পক্ষে বেরনো অসম্ভব, দরবেশবেশী আবদুর রহমানও শেষ পর্যন্ত কান্দাহার পৌঁছবে কি না সে নিয়ে সকলেরই গভীর দুশ্চিন্তা, মেয়েছেলেদের তো কথাই ওঠে না। এই কাবুল উপত্যকাতেই শব্‌নম আছে, কিংবা?

রাস্তায় যেতে যেতে একদিন দুই সম্পূ্ণ অজানা লোককে কথা বলাবলি করতে শুনেছিলুম। একজন বললে, আওরঙ্গজেব খানের মেয়ে বোধ হয় কোনও বাড়িতে-গ্রামেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশী—আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বোধ হয় খুন হয়েছেন।

অন্যজন শুধালে, তাকে খুন করবে কেন?

সে বললে, বাচ্চার ভয়ে, জাফরের সঙ্গী-সাথী আত্মীয়-স্বজনের ভয়ে। ধরা তো পড়বেই একদিন। তখন তার উপায় কী?

আমি জানতুম বাচ্চা শব্‌নম বীবীর সন্ধানের জন্য কোনও হুকুম দেয় নি। জাফরের আত্মীয়-স্বজনের তার জন্য রক্তের সন্ধানে বেরবার কথা; তারাও বেরোয় নি।

কোন ভরসায় তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলুম সে কথা বলতে পারব না। আপন পরিচয় দিয়ে তাদের করজোড়ে শুধিয়েছিলাম, তারা আমাকে কোনও নির্দেশ দিতে পারে কি না? দুজনাই অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে বার বার মাফ চেয়ে বললে, তারা সত্যই কোন খবর জানে না-চা-খানায় আলোচনার খেই করে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল মাত্র। দ্বিতীয় লোকটি দৃঢ়কণ্ঠে একাধিকবার বললে, আমার বাড়িতে কোনও মেয়েছেলে একবার ঢুকে আশ্রয় নিতে পারে, তবে আমি খুন না হওয়া পর্যন্ত তার দেখভাল করব।

কোনও খবরের সন্ধানে মানুষ এ-দেশে যায় সরাইয়ে কিংবা বড় বাজারে। বাজার বন্ধ। সরাইয়ে নূতন লোক তিন মাস ধরে আসে নি। পুরনোরা আটকা পড়ে কষ্টেশ্রেষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সরাইয়ের মালিক আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও আমাকে প্রচুর খাতির-যত্ন করলে। বললে, ইউসুফ প্রায়ই এসে খবর নেয়, নূতন কোনও মুসাফির কোনও দিক দিয়ে শহরে ঢুকতে পেরেছে কি না! ওকে আমরা সবই খুব ভাল করে চিনি। আগে এলে আমাদের ভিতর সামাল সামাল রব পড়ে যেত। এখন এসে একবার সকালের দিকে তাকায়, নূতন কেউ এসেছে কি না, আমাকে একটি প্রশ্ন শুধোয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে চলে যায়। এই যে আমার চত্বরে বরফজল জমেছে, আগে হলে ইউসুফ স্কেটিং করে করে এখানে পুরো দিনটা কাটিয়ে দিত।

আমি তাকে শুধালাম, তার কি মনে হয়, শব্‌নম কোথায়?

অনেক চিন্তা করে বললে, দেখুন, আমি সরাই চালাই! তার পূর্বে আমার বাবা ওই সরাই-ই-চালাতেন। আমার জন্ম এই উপরের তলার ছোট্ট কুঠরিতে। চোর-ডাকু, পীর-দরবেশ, ধনী-গরীব, দূর-দরাজের মুসাফিরদের উপর কড়া নজর রেখে তাদের দেখভাল করে আমার দাঁড়ি পাকল। আমাকে সব খবরই রাখতে হয়। আমি অনেক ভেবেছি। এই সরাইয়ে শীতের রাতে আগুনের চতুর্দিকে বসে দুনিয়ার যত গুণী-জ্ঞানী ঘড়েল বদমাশরা এই নিয়ে অনেক আলোচনা করেছে, কিন্তু সবাই হার মেনেছে।

তারপর অনেকক্ষণ ভেবে বললে, একমাত্র জায়গা কোনও দরবেশের আস্তানা। সেখানে অনেক গোপন কুঠরি গুহা থাকে। রাজনীতি খেলায় কেউ সম্পূর্ণ হার মানলে হয় পালায় মক্কা শরীফে—সময় পেলে না হয় আশ্রয় নেয় দরগা-আস্তানায়।

আমি প্রত্যেক আস্তানায় একাধিকবার গিয়েছি।

আবার ভেবে বলবে, তা-ই বা কি করে হয়? বয়স্ক লোকদের ফাঁকি দেওয়া যায়। কিন্তু বাচ্চাদের কাছ থেকে কোনও জিনিস গোপন রাখা অসম্ভব। ইউসুফ যখন লেগেছে তখন-? না, সে হয় না। আপনিও তো প্রত্যেক দরগায় গিয়েছেন। পীর দরবেশরা অন্তত আপনাকে তো গোপন খবরটা দিয়ে আপনার এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতেন। দরবেশও তো মানুষ! দরবেশ হলেই তো হৃদয়টা আর খুইয়ে বসে না।

বিদায় দেবার সময় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বার বার সহৃদয় নিশ্চয়তা দিলে, যে কোনও সময়ে কোনও দিকে যদি সে খবর পায় তবে নিজে এসে আমায় খবর দিয়ে যাবে।

জীবনই অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন আর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক-একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবী-মালা হয় তারই নাম জীবন।

একটি অক্ষ দিয়েই আমার সম্পূর্ণ মালা।

সেই অক্ষবিন্দুতে দেখলুম প্রতিবিম্বিত হচ্ছে বহু জনের মুখ। এরা কেন এত দরদী? এদের কি দায়, আমি শব্‌নমকে খুঁজে পেলুম কি না? আল্লা আমাকে মারছেন। তাই দেখে তো ভয় পেয়ে এদের উচিত আমার সঙ্গ বর্জন করা। কই, তারা তো তা করছে না! হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ল এদের এই অঞ্চলের একটি কাহিনী :-

বাচ্চারা পেয়েছে বাদাম। ভাগাভাগি নিয়ে লেগেছে ঝগড়া। পণ্ডিত নস্‌র উদ্দীন খোজা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করতে করতে আল্লার প্রশংসাধ্বনী (হাম্‌দ) উচ্চারণ করছিলেন। ছেলেরা তাকে মধ্যস্থ মানলে ভাগ বখরা করে দেবার জন্যে। তিনি হেসে শুধালেন, ‘আল্লা যেভাবে ভাগ করে দেয় সেই ভাবে, না মানুষের মত ভাগ করে দেব?’ বাচ্চারাও কিংবা বলব বাচ্চারাই আল্লার গুণ মানে বেশী, সমস্বরে বললে, ‘আল্লার মত।’

খোজা কাউকে দিলেন পাচটা, কাউকে দুটো, কাউকে একটাও না। বাচ্চারা অবাক হয়ে শুধালে, ‘একি? একে কি ভাগ করা বলে?’ খোজা গম্ভীর হয়ে বললেন, চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখ, আল্লা মানুষকে কোনও কিছু সমান সমান দিয়েছেন কি না। সেরকম সমান ভাগাভাগি শুধু মানুষই করে।

তাই বুঝি করুণাময় আমার প্রতি অকরুণ হয়েছেন দেখে মানুষ সেটা সহানুভূতি দিয়ে পুষিয়ে দিতে চায়! তাই বুঝি তিনি যখন বিধবার একমাত্র শিশুকে কেড়ে নেন তখন স্বপ্নদেবী তাঁকে বার বার মা-জননীর কোলে তুলে দেন। তাই বুঝি সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টিতে বার বার অসম্পূর্ণতা রেখে দেন মানুষ যাতে করে সেটাকে পরিপূর্ণ করে তুলে ধরতে পারে।

কিন্তু আমার গুরু, আমার একমাত্র সাম্যে, মুহম্মদ সাহেব যে বার বার বলেছেন, তিনি আল্লার পরিপূর্ণতা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেন, শঙ্কর যে বলেন তিনিই পরিপূর্ণ সত্য, অন্য সব মিথ্যা—তার কি?

আমার এই দুঃসহ বিরহ-ভার আর অসহ অনিশ্চয়তা?

মিথ্যা।

মানলুম। কিন্তু এই যে এতগুলো লোকের অন্তরের দরদ তাদের কথায় ভাষায়, তাদের চোখের জলে টল টল করছে?

মিথ্যা।

মানি নে। আল্লা যদি তাঁর পরিপূর্ণতা কোনও জায়গায় প্রকাশ করে থাকেন তবে সেটা দরদী হৃদয়ে। সৃষ্টির সঙ্গেকার সেই প্রাচীন কথা আজ কি আমাকে নতুন করে বলতে হবে, ‘বরঞ্চ আল্লার মসজিদ ভেঙ্গে ফেল, কিন্তু মানুষের হৃদয় ভেঙো না।’

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, বাসর রাতে লায়লী-মজনূ কাহিনী শেষ করেছিল শব্‌নম ওই কথা বলে, পরমেশ্বর এ সংসারে প্রকাশ হয়েছেন একটিমাত্র রূপে-সে প্রেমস্বরূপ।

আচ্ছান্নের মত বাড়ি ফিরেছিলুম।

জানেমনের ঘরে শব্‌নমের সখী।

তিনি বললেন, সেই ভালো। ওকে নিয়ে যাও সূফী সাহেবের কাছে। পাগলকে মানুষ নিয়ে যায় সাধুসন্তদের কাছে। আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছি?

সখীর বর সঙ্গে চললেন। সখী অনুযোগের সুরে বললে, কোথায় না তুমি জ্যোতিহীন বৃদ্ধ চাচাশ্বশুরের সেবা করবে, না তিনি তোমার চিন্তায় ব্যাকুল।

স্বামী বললে, থাক না এ সব কথা।

এই প্রথম একটি লোক পেলুম, যিনি আমাদের কথা কিছুই জানেন না।

সব কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাচ্চা, তোমার চাচাশ্বশুর জানেন না, এমন কি কথা আমার আছে যা তোমাকে আমি বলব? তিনি সংসারে থেকেও বৈরাগী। তিনি ‘সূফ’ (পশম) না পরলেও সূফী।

আমি অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে বললুম, তিনি আমাকে কিছু বলেন নি।

বললেন, তিনিই বা বলবেন কী, আমিই বা বলব কী। আমরা যা-কিছুই বলি না কেন, তুমি তো সেটা বোঝবার চেষ্টা করবে তোমার মন দিয়ে। সেই মন কী, তুমি তাকে চেন? এ যেন একটা কাঠি দিয়ে কাপড় মেপে দেখলে বারো কাঠি হল। যদি সেই কাঠিটা কতখানি লম্বা সেটা তোমার জানা না থাকে তবে কাপড় মেপে বারো বার না বাইশ বার জেনে তো লাভ হল না। নিজের মন হচ্ছে মাপকাঠি। সেই মনকে প্রথম চিনতে শেখ।

সখী বললে, সে মন চেনা যায় কি প্রকারে?

সূফী সাঝে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলুম।

বললেন, ‘মনকে শান্ত করতে হবে। বিক্ষুদ্ধ জলরাশিতে বনানী প্রতিবিম্বিত হয় না।’

আমি শুধালুম, আরম্ভ করতে হবে কী করে?

কণামাত্র চিন্তা না করে বললেন, ‘সূফী-রাজ ইমাম গাজ্জালী সকল সূফীদের হয়ে বলেছেন, “মন্দ আচরণ থেকে নিজেকে সংহত করে, বাহ্য জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়গণের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে, নির্জনে চক্ষু বন্ধ করে, অন্তর্জগতের সঙ্গে আত্মার সংযোগ স্থাপন করে, হৃদয় থেকে আল্লা আল্লা বলে তাকে স্মরণ করা।”

আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি হেসে বললেন, বুঝেছি। তুমি আল্লার উপর বিরূপ। তাতে কিছু যায় আসে না। মানুষের বিরূপ ভাব তাঁর প্রেমকে ছাড়িয়ে যেতে পারে-এ তার দম্ভ। কিন্তু সেকথা এস্থলে অবান্তর। তুমি সে দিকে মন দিতে চাও না, তবে আপন আত্মার দিকে সমস্ত চৈতন্য একাগ্র কর। সেই আত্মা—যিনি সুখ দুঃখের অতীত। হাদীসে অছে, “মন্ অরফা নফসহু ফকদ্‌ অরফা রব্বাহু।” যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে।

অরেক বার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে গেল।

‘মন সর্বক্ষণ অন্য দিকে যায়? তাতেই বা ক্ষতি কী? যাকে তুমি ভালবাস তার সঙ্গে যদি একাত্ম দেহ হয়ে গিয়ে থাক তবে নিজের আত্মার দিকে, না তার দিকে মন রুজু করেছ তাতে কী এসে যায়। সে তো শুধু নামের পার্থক্য।’

বেদনা আমার জিহ্বার জড়তা কেটে ফেলেছে। বললুম, একাত্ম দেহ হতে পারলে তার বিরহে বেদনা পেতুম না, আর চিন্তা অসহ্য হত না।

গভীর সস্মেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভয় নেই। ঠিক পথে চলেছ। একাধিক সূফী বলেছেন, আল্লার দিকে মন যাচ্ছে না আত্মার দিকে মন যাচ্ছে না-? না-ই বা গেল। তোমার কাছে সব চেয়ে যা প্রিয় তাই নিয়ে ধ্যানে বস। সে যদি সত্যই প্রিয় হয় তবে মন সেটা থেকে সরবে কেন?—আর মূল কথা তো মনকে একত্র করা, অর্থাৎ মনকে শান্ত করা।’

‘আসলে কী জান, মন গঙ্গাফড়িঙের মত। খনে সে এদিকে লাফ দেয়, খনে ওদিকে লাফ দেয়। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকেতে চায় না। কিংবা বলতে পার, কাবুল উপত্যকার চাষার মত ছায়ায় জিরোচ্ছে, কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতে-যেতেই রৌদ্রে গিয়ে কাজ করছে, ফের ছায়ায় ফিরে আসছে, ফের রৌদ্র, ফের ছায়া।’

‘তার গায়ে জ্বর-তোমার মত। তাকে এক নাগাড়ে সমস্ত দিনই ছায়ায় শুইয়ে রাখতে হবে। তবে ছাড়বে তার জ্বর।’

তোমার মন হবে শান্ত।

সূফী সাহেব থামলেন। আমি সব কিছু ভুলে গিয়ে শুধালুম, তার পর?

ইচ্ছে করে অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, তার পর আর কি বাকী রইল? তখন মালিক যা করার করবেন। তুমি তখন শান্ত হ্রদ-মালিক তাঁর ছায়া ফেলবেন। তোমার অজ্ঞেয় অগম্য কিছুই থাকবে না।

হেসে বললেন, তাঁকে তো কিছু একটা কর দিতে হয়। সব দুর্ভাবনা কি তোমার?

আমি সেই পুরাতন প্রশ্ন শুধালুম, যে প্রশ্ন আজ নয়, বহুকাল ধরে মনে জেগে আছে-‘বিরাট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা যখন চিন্তা করি, কল্পনাতীত অন্তহীন দূরত্বের পিছনে বিরাটতর অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের সংবাদ যখন বৈজ্ঞানিকেরা দেয় তখন ভাবি, আমি এই কীটের কীট, আমার জন্য আর কে কতখানি ভাবতে যাবে?’

সূফী সাহেব বললেন, ‘সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে তোমার উপর।’

‘এই যে কোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা বললে তুমি কল্পনা কর না কেন, তিনি আরও কোটি কোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক। তা হলেই তো তিনি সম্পূর্ণ একটা ব্রহ্মাণ্ড তোমার-একমাত্র তোমারই দেখাশোনার জন্য মোতায়েন করতে পারেন। তা হলেই দেখতে পাবে, লক্ষ লক্ষ ফিরিশতা-দেবদূত তোমার দিকে অপল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের হিসাব রাখছেন হাজার হাজার দেবদূত, তোমার প্রতিটি হৃদস্পন্দনের খবর লিখে রাখছেন লক্ষ লক্ষ ফিরিশতা। আর তুমি যদি কল্পনা কর তোমার খুদা মাত্র দশটা ব্রহ্মাণ্ডের মালিক তা হলে অবশ্য তুমি অসহায়।

‘কিন্তু তিনি তো অনন্ত রাজ। তিনি সংখ্যাতীতের মালিক।’

‘কত সহস্ৰ ব্ৰহ্মাণ্ড চাও, একমাত্র তোমারই তদারকি করার জন্য?’

আমি অভিভূত হয়ে তাঁর কথা শুনে যাচ্ছি এমন সময় তিনি আমাকে যেন সর্বাঙ্গ ধরে দিলেন এক ভীষণ নাড়া। বললেন, কিন্তু এ সব কথা বৃথা, এর কোনও মূল্যই নেই। কারণ গোড়াতেই বলেছি, আপন মনকে না চিনে সেই মন দিয়ে কোনও কিছু বোঝার চেষ্টা করা বৃথা। তার প্রমাণস্বরূপ দেখতে পাবে, বাড়ি পৌঁছতে না পৌঁছতেই তোমার গাছতলার ছায়ার চাষা আবার রৌদ্রে ঘোরাঘুরি করছে তোমার মন আমার কথাগুলোর দিকে আর কান দিচ্ছে না। এবং এগুলো আমার কথা নয় বড় বড় সূফীরা যা বলেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করেছি মাত্র।

আমি নিরাশ হয়ে বললুম, তা হলে উপায়?

বেশ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘মনকে শান্ত করা। আর ভুলে যেয়ো না, সাধনা না করে কোন কিছু হয় না। পায়লোয়ানের উপদেশ পড়ে মাংসপেশী সবল হয় না, হেকিমীর কেতাব পড়ে পেটের অসুখ সারে না। মনকে শান্ত করতে হয় মনের ব্যায়াম করে।

‘আর ঠিক পথে চলেছে কি না তার পরখ-প্রতিবার সাধনা করার পর মনটা যেন প্রফুল্লতর বলে মনে হয়। ক্লান্তি বোধ যেন না হয়। পায়লোয়ানরাও বলেছেন, প্রতিবার ব্যায়াম করার পর শরীরটা যেন হালকা, ঝরঝরে বলে মনে হয়।’

না হলে বুঝতে হবে, ব্যায়ামে গলদ আছে।

আমাদের সামনে হালুয়া ধরে বিদায় দিলেন।

আমরা আসন ছেড়ে উঠেছি এমন সময় তিনি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাচ্চা, তোমার একটি আচরণে আমি খুশী হয়েছি। গ্রামের চাষা তিন মাস রোগে ভুগে শহরে এসে হেকিমের কাছ থেকে দাওয়াই নিয়েই শুধায়, “কাল সেরে যাবে তো?” -তুমি যে সেরকম শুধাও নি, ফল পাবে কবে?

‘ফল নির্ভর করে তোমার কামনার দৃঢ়তার উপর। দিল্‌কে একরুজু করে যদি প্রাণপণ চাও, তবে দেখবে নতীজা নজ্‌দিক—ফল সামনে।’

ধর্মে ধর্মে তুলনা করার মত মনের অবস্থা আমার তখন নয়। তবু মনে পড়ে গেল, সংস্কৃত ব্যাকরণের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে গুরুকে শুধিয়েছিলুম, ‘অনায়াসে সংস্কৃত কাব্য পড়তে পারব কবে?’ তিনি বলেছিলেন, “তীব্র সংবেগানাম্ আসন্ন?” অর্থাৎ আবেগ তীব্র থাকলে ফল আসন্ন।

তার পর বলেছিলেন, শুধু, ভাষার ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্রই এটা প্রযোজ্য—পতঞ্জলি বলেছেন ‘যোগসূত্রে’ সাধনার ক্ষেত্রে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *