রাত্রি অনেক। বসন্তের আবির্ভাব ঘটছে। এ বাড়ির টিনের চালায় বাতাস কেটে কেটে যাচ্ছে। পত্রহীন রিক্ত পিপুল। যেন বনস্পতি পিতৃদশার বেশ ধরেছে।
তিলি দেখছে, লীলা পায়চারি করছে বারান্দায়। রাত্রে, মেঘনাদ আজকাল আর বাড়ি থাকে না। লীলা মধ্যরাত্রে উঠে রোজ বাইরে আসে আর পায়চারি করে। সন্ধ্যা হলে বিনয়ের বাড়ি যায় প্রায়ই।
বারান্দা থেকে নেমে উঠোনের দিকে গেল লীলা। সবাই ঘুমোচ্ছে। তিলি উঠল। দরজা খুলল নিঃশব্দে। দেখল উঠোনের পেছনে, শজনেতলা দিয়ে যাচ্ছে লীলা। তিলি গেল পেছন পেছন।
সামনে মাঠ, কয়েকটি গাছ, আশেপাশে আসশেওড়ার ঝোঁপ। লীলা ধীরে ধীরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে লীলা। বিনচৌ-এর বাড়ি তো ওদিকে নয়। তিলির ভয় করছে। লীলার জন্য ভয়, আশেপাশের মানুষের চোখকে ভয় ।
লীলা গিয়ে দাঁড়াল জংলা পুকুরের ধারে। নড়ে-চড়ে না, নিশ্চল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে জলের দিকে।
তিলি এসে দাঁড়াল কাছে, কথা বন্ধ দুই বোনের। তবু তিলি বলল, এখানে এসেছিস যে রাত্রে। মরতে নাকি?
অন্ধকারেও জ্বলছে লীলার চোখ । অবাক হয়ে খালি দেখল তিলিকে। বলল, না, বেড়াচ্ছি।
তিলি বাঁকা হেসে বলল, বিনচৌ-এর পিরিতের এত জ্বালা?
পিরিতের জ্বালা ! অদ্ভুত হাসল লীলা।
তিলি হঠাৎ বলল, গয়নার বাক্স কী করেছিস, কোথায় রেখেছিস?
: দিয়ে দিয়েছি বিনচৌকে।
তিলি জানত, গহনার বাক্স লুকিয়ে রেখেছে লীলা । কিন্তু বিনচৌকে ! কেঁপে উঠল তার বুকের মধ্যে। সে ভুলে গেল রাত্রি, বাইরের এই জংলা পুকুরের ধার। বলল, সব?
:হ্যাঁ।
: তবে তুই মর এই পুকুরে ডুবে, আমি দেখি। মর মর, তোর পায়ে পড়ি মর। যেন আর একটা লোকের মরণ তুই চোখে দেখতে না পাস। তাতে তোর মরেও লজ্জা।
আর একটা লোক হল মেঘনাদ। বলল লীলা, মরেই তো আছি।
তিলি হঠাৎ বলল, কাউকে ভালবাসলে কি মানুষ এমনি হয়? এমন রাক্ষুসী। বিনচৌকেও কি ভালবাসিসনে।
ভালবাসা ! এই সংসারে ভালবাসা ! দেহ ছারখার করে দাও, মন পুড়িয়ে দাও, সোনা-দানা ঐশ্বর্য, যা আছে সব বিলিয়ে ছড়িয়ে ধ্বংস করে দাও। তবু নিজের বুকে সব শুন্য। চারদিকে বিলোল কটাক্ষ, বিষণ্ণ ব্যাকুলতা, চারদিকে ফিসফিস, ভালবাসা, ভালবাসা ! সবটাই দারুণ ধ্বংসের মন্ত্র।
সব পুড়ক, নিজে পুড়ক, এ বিশ্ব পুড়ক। জীবন কখনও ভরে না। মন কখনও ভরে না। বিনচৌ ! একদিকে তার লোভ, আর একদিকে তার ভয়। আগুন নেই মনের কোথাও। সমস্তটাই ছাইয়ের উত্তাপ। শ্মশানের বিষণ্ণতা তার চোখে।
তিলি বলল ফিসফিস করে, তুই মরছিস মর। কিন্তু আর যাকে মারছিস এ সংসারে তার দাম অনেক বেশি।
লীলা বলল, বোনাইকে বিয়ে কর তুই।
তিলি বাধা দিল না তার কান্না। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ওলো রাক্ষুসী, সে কপাল আমি করিনি। সে সৌভাগ্য আমার জন্মে নেই। তার অতবড় বুকটার সবটুকু যে সে তোকে দিয়ে বসে আছে। নইলে তাই করতুম, তাই চাইতুম। তিলি বাড়ি ফিরে এল। লীলা জলের কাছে এগিয়ে গেল আরও।
লীলার চোখে আবার বিনচৌ। চোখে যার অভুক্ত প্রেতের বিষণ্ণতা। যার ছায়া পড়ে না। কোথাও। মাটিতে, মনে, কোথাও নয়। একটি নিঃস্ব জঞ্জাল। কাকে বোঝাবে একথা লীলা। তার মতো মেয়ে কি আর আছে এই দেশে, এই সমাজে, যে হৃদয়ের কারবারে গোপন করেনি নিজেকে লোকচক্ষুর কাছে। স্বামী, বাপ, মা, ভাই, বোন, কারও কাছে ফেরেনি লুকিয়ে। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, সবই পায়ের তলায় রেখে যে, এই যুগের পরকীয়া ব্যভিচারে নেমেছে। নেমেছে, কিন্তু সোনাদুলির লতাই খালের ধারে যে আগুন জ্বলছিল, তা নিবল না। কী ভীষণ একা সে। এ সংসারে কি তার মতো দুটি নেই! থাকলে তারা কী করছে, কেমন করে বেঁচে থাকছে, জানতে বড় সাধ হয়।
লীলা গোপন করেনি তার ক্ষুধা, বাসনা, অভাব। কিন্তু পৃথিবীতে, এইটুকু শক্তি, এইটুকু মহত্ত্বও কি কারও নেই, যে কিছু নিয়ে কিছু দিতে পারে। যা চায় লীলা তার সামান্যতম বস্তু।
ঘৃণায় কাঁটা দিয়ে উঠল লীলার শরীরে। কী অদ্ভুত ভীরু, দুর্বল, নীচ অথচ সাজানো গোছানো অমায়িক ওই বিনচৌয়েরা। ওকে সোনাগুলি দিয়ে তার জ্বালা যেন একটু কমেছিল। একটি সোনার হার দিয়ে বিনচৌ-এর গলায় ফাঁস লটকালেও লোকটা আরামে হয়তো মরে যেত। আপনা থেকে বমি করে উগরে দিত হয়তো প্রাণটা !
তার কাছে কী চেয়েছিল লীলা ! কী ! লীলা নিজে কেন ছায়াহীন, রক্তহীন প্রেতিনী হতে পারল না। তবে বিনচৌয়ের মরা ডালে বাস, নরকের সংসার পাততে পারত সে
এত যে আগুন, এত যে জ্বালা, তবু মানুষের মন, মেয়ে মানুষের মন কেন বাসা বেঁধে রয়েছে সেখানে। যেখানে জীবন, সংসার, শান্তি অনেক দুঃখেও চোখের জলে যেখানে হাসির মেলা।
দূরে ভেসে উঠল একটি মূর্তি। যার কাপুরুষতা নেই, ভাঁড়ামি নেই, পুতুপুতু করে কোনও কিছু। ধরে রাখবার দুর্বলতা নেই। যে চাইলে দিতে জানে, জানে না দিতে শুধু লীলাকে। যে তাকায়নি লীলার দিকে, ফেলে দিয়ে গেছে আঁস্তাকুড়ে। যার কাজ যার বুকের আগুন, আর সব আগুনই ছাই করে দিয়ে গেছে।…সেই মেঘনাদ ! মেঘনাদ !…মুখটা মনে পড়ছে না লীলার। সামনে দিয়ে শেয়াল যাতায়াত করছে। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে নিশাচর পাখি।..কিন্তু মুখটা মনে পড়ছে না তো। মুখটা, সেই মুখটা কেমন দেখতে। একটি কচি মুখ, শিশু, লীলার সেই মৃত সন্তানের মতো। না না না, তবে ! সেই মুখটা কেমন ! গোঁফদাড়ি হীন, থলথলে মাংস, জুলজুলে চোখ, নরকরক্ষীর মতো? না না না…।
চিৎকার করে উঠতে গিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিল সে।
আজ তাকে তিলি চায়! চব্বিশের অনুঢ়া বুকে এই বুঝি প্রথম দাগ, যাকে বলেছিল সে, তোর কী আছে, তুই কী বুঝবি?
সত্যি তিলি কী বুঝবে, কী বুঝবে তার !
.
বিনয় ডেকেছে একবার মেঘনাদকে।
বিনয় বসেছিল বাইরের ঘরে। পিওন এসে একটি রেজিষ্ট্রি চিঠি দিয়ে গেল, সই করিয়ে। খুলল বিনয়। উঁকিলের চিঠি। অবাক হল সে। কলকাতার উঁকিল লিখছে, আমার দিল্লিবাসিনী মক্কেল শ্ৰীমতী সুলতা দেবী, তাঁর সন্তানসহ কেন আলাদা বাস করিতে পারিবেন না,…তারিখের মধ্যে তার কারণ জানাইবেন।
আলাদা ! সেপারেশন ! আর আসবে না কোনওদিন সুলতা! আশ্চর্য ! ভয় ও ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল বিনয়ের
কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখল, যেন অবিকৃত মুখ সুলতার। তেমনি নির্বিকার শান্ত। যেন বলছে, দশ বছর ধরে অপেক্ষা করেছি, তুমি ফিরতে পারলে না। তোমার দেওয়া সমস্ত অপমানে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়েছি, তবু প্রহর গুনেছি। দিন চলে গেছে, আর পারিনে। কিন্তু কই, সুলতা তত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে না, বিদ্রূপ করছে না। খিলখিল করে হেসে ঠাট্টা করছে না তাকে নিয়ে বন্ধুমহলে! তবু কী কঠিন মুখ তার, কী ভয়ংকর নির্লিপ্ত চাহনি। এত কঠিন যে, ছেড়ে যাওয়ার এই শেষ মুহূর্তেও উঁকিলের চিঠির মতোই, নিবের ডগায় খসখস শব্দের মতো বলছে, যেখানে তোমার ছায়া, সেখানে আর যাব না।
অনেক দিন আগের সেই সব দিনগুলির কথা মনে পড়ছে। আর বুকের মধ্যে কনকন করে উঠছে। হয়তো, বিবাগী, বৈরাগিনী, এই ব্যর্থ সুলতার কাছে আজ আবার কেউ আসবে, কোনও নবীন মানুষ। যে তার দুই ছেলের মায়ের বুকে আবার রং ফোঁটাবে।
জ্বর বিকারগ্রস্ত মনে হতে লাগল নিজের। মনে হচ্ছে, লীলা হাসছে তার সামনে দাঁড়িয়ে। হাসছে নিঃশব্দে, শাণিত চোখে। যে চোখ বিনচৌ-এর ভালবাসার ছায়াহীন প্রেত প্রাণটাকে আজ উলটেপালটে দেখতে পারে। যে তার প্রাণের আগুন নেড়েচেড়ে দেখেছে শুধু ছাই সর্বস্বতা।
হঠাৎ একটি মস্তবড় ছায়া দেখে চমকে উঠল বিনয়। দেখল মেঘনাদ এসেছে। এক মুহূর্ত তার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। পর মুহূর্তেই অতিরিক্ত উৎসাহে, দৃঢ় গলায় বলল, বসুন। মেঘনাদ বসল। বিনয় আরও কয়েক মিনিট যেন কিছু ভাবল। তারপর দ্রুত গলায় বলে উঠল, পারমিটটা। আমার কাছে রয়েছে।
হ্যাঁ।
: আপনি জানেন বোধ হয়, বেঙ্গল গভর্নমেন্ট বিস্কুট ম্যানুফ্যাকচারিং বন্ধ করে দিয়েছে। অবশ্য, আমাদের পারমিটে তা বন্ধ হয়নি।
মেঘনাদ বিনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না, বিনয় কী বলবে।
বিনয় বলল তার বিষণ্ণ চোখ তুলে, একটা অন্যায় হয়ে গেছে। সে জন্য আপনাকে আমি তিন হাজার টাকা দেব।
তিন হাজার টাকা। ভেতরটা গুড়গুড় করছে মেঘনাদের। কীসের অন্যায় আবার।
বিনয় বলল, পারমিটটা রাজীব আমার নামে করিয়ে এনেছিল। কথাটি বলার আগে ভিতরে ভিতরে বিনয় প্রস্তুত হয়েছিল একটা ভয়ংকর কিছুর জন্য। কিন্তু আশ্চর্য। কিছুই হল না।
মেঘনাদ তেমনি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল বিনয়ের দিকে। ভেতরে তার আগুন লেগেছে। চকিত বজ্রপাতে, কিছু অনুভব করার আগেই যেন সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর সেই আগুনের আভায় মুখটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের মতো লাল হয়ে উঠেছে।
বিনয় মেঘনাদের দানবীয় শরীরটার দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে উঠল। যেন পালাতে পারে সুযোগমতো। বলল আবার, ঘুষের টাকাটা আপনাকে আমি দিয়ে দেব। অবশ্য তিনবারে দেব টাকাটা। কিন্তু ব্যবসায় আমাকে অর্ধেক অংশীদার করে নিতে হবে। নইলে পারমিটটা দিয়ে আমি নিজেই…।
মেঘনাদ তাকিয়ে দেখল, সামনে বিনয়ের সেই চোখ। মনে হল, এ তো বিষণ্ণ নয়, শ্মশানের কুকুরের চোখ । শ্মশানের ছাইগাদায় পড়ে থাকা, শবভুক ঢুলুঢুলু চোখওয়ালা কুকুর। চোখে তার শবের স্বপ্ন, পোড়া মাংসের নেশায় জুলজুলে।
তার সমস্ত বোধশক্তি কয়েক মুহূর্তের জন্য লোপ পেয়ে গেল। তবু তার সারা শরীরের পেশিতে পেশিতে একটা অদ্ভুত বোবা উত্তেজনা পাক খেয়ে উঠল। তার মাথার মধ্যে একটা বিষধর পোকা বোঁ বোঁ করে পাখা ঝাপটাতে লাগল, তুই বোকা, মূর্খ, এ সংসারে অনুপযুক্ত।
সে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে বিনয় আরও শক্ত হল। তার কোনও কথা জিজ্ঞেস করতেও সাহস হল । মনে হল মেঘনাদ যেন ফুলছে। ফুলতে ফুলতে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়।
মেঘনাদ উঠে দাঁড়াল। কিন্তু হঠাৎ যেতে পারল না। মনে হচ্ছে, তার যেন কিছু করার রয়েছে এ ঘরে, নিদারুণ কিছু বলার আছে বিনয়কে।
কয়েক মুহূর্ত শুধু বাইরের পথচারীদের টুকরো কথা শোনা গেল।
তারপর হঠাৎ আর একবার সেই সন্ত্রস্ত জুলজুলে চোখ দুটো দেখে মেঘনাদ বেরিয়ে এল রাস্তায়।
.
এই রাস্তা, উত্তরে দক্ষিণে লম্বা। শ্রীহীন বস্তি, ছন্নছাড়া কতকগুলি দোকান, ধুলায় ধূসর এই রাস্তা কতদিন সে দেখেছে। আজ যেন অচেনা অচেনা লাগছে। ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো অনেকখানি হেঁটে চলে গেল দক্ষিণে।
কারখানার পর কারখানা। কী বিরাট আর বিশাল! ভলকে ভলকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে চিমনি দিয়ে। মেঘনাদের মনের মধ্যে কে যেন চিৎকার করছে, এই কারখানাগুলি তবে হল কী করে। সে কেন পারল না, কী দোষ ঘটেছিল তার।
: কে? মেঘু নাকি?
মেঘনাদ তাকাল। বোধহীন দৃষ্টি। তাকিয়ে মনে হল, যেন গত জন্মের চেনা মানুষ তার সামনে। দেখল, নসীরাম গণকার। বেঁচে আছে আজও! তিন মাথা এক হয়েছে। পাকাচুল যেন আবার কালচে হচ্ছে। বসেছে রাস্তার ধারে। পিজবোর্ডে লিখে রেখেছে, বাস্তুহারা গণৎকার, বিশিষ্ট হস্তরেখাবিদ। একবার পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
নসীরাম বলল, আহা হা, অনেকদিন বাদে দেখলাম বাবা তোমাকে। আরে আরে? তোমার কপালে যে মা লক্ষ্মীর সোনার আসন আঁকা দেখেছি। ধনপতি সওদাগরের ভাগ্যরেখা দেখছি। তোমার কপালে। বসো বাবা, একটু হাতটা
বলতে বলতে থেমে গেল নসীরাম। চোখ পড়ে গেল মেঘনাদের চোখে। মনে হল, তার শতোত্তর গণকার বুকে এমন তীব্র খোঁচা আর কখনও খায়নি সে। তার বলিরেখা চামড়া কুঁকড়ে উঠল সর্বাঙ্গের। ভয় হল, মারবে নাকি মদন সা’র বেটা মেঘু।
আবার তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে সিরাজদিঘার কথা বলতে আরম্ভ করল। মা, গদি, ব্যবসা, হিন্দু, মুসলমান।
মেঘনাদ ফিরে এল। কোনও কথা, কারও কথাও জিজ্ঞেস করল না।
কেবল মাথার মধ্যে কতগুলি কথা কোলাহল করতে লাগল।
ধনপতি সওদাগর। বদর বদর ডিঙা যায়, শতকে বৈঠা ছপছপ পড়ে। সাতসাগরের জলে কেন মাটি ঠেকে যায় বৈঠায়। দ্যাখ দ্যাখ কী হল। জল নেই, সাতসাগর শুকিয়ে বালি। এ কার। কোপ। মনসা জল শুষেছিল চান্দের, ধনপতির লক্ষ্মী। দেবীর কোপ পড়েছে।
আর মেঘনাদের উপর কোপ পড়েছে কার । লীলার মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে। না, না, সে তার কিছুই করেনি। সে যা করেছে, তার নিজের জন্য করেছে। মেঘনাদের সমস্ত কাজের কাছে সে তুচ্ছ। মেঘনাদ তো কারও প্ররোচনায় কাজ করেনি। কাজ করেছে নিজের বিশ্বাসে, উৎসাহে।
তবে? তার কেন এমন হল। মনে পড়ল বাবার কথা, গদিতে বসা লক্ষ্মণ সায়ের কথা।…তারই পাশে পাশে মেঘনাদের আশা। বোধ হয় ভুল হয়েছে। হয়তো তার জীবন ছিল ঘুনসিতে চাবি বাঁধা, হরিনাম সার করা, সিন্দুকরক্ষী সাহা মহাজনের পচা জীবন। যে জল খাবে বাতাসার ছায়া দেখে। যার পিঠের ঘামাচি মেরে দেবে হিসাবরক্ষক তার কলমের নিব দিয়ে। যে বাজারে থাকবে মেয়েমানুষ নিয়ে, বাড়ির মেয়েরা ডাকবে রজক, নরসুন্দর, চাকরবাকরকে। পয়সা যার হরি, রাধাকৃষ্ণ, খোলকরতালের মিঠা বুলি।
কিংবা হয়তো লেখাপড়া শেখেনি বলে হেরে গেল এ সংসারে। এ যুগের সীমান্তে ঢুকতে, যে রাস্তা পার হতে হয় পলে পলে, অনেক কষ্টে, সেই পথ পার হতে পারেনি সে।
কিন্তু তা-ই কি সব। বিনয় না হয়ে, তার জায়গায় যদি একজন অবিদ্বান এই চক্র সাজিয়ে বসত, তা হলে কি সর্বনাশের চেহারা কিছু সুন্দর হত। মূখের শয়তানি, সেও যে ভয়ংকর। শয়তান শয়তান, তার বিদ্যা অবিদ্যা নেই।
কিন্তু কারখানার আশা ! মেশিনের কারখানা, আধুনিক যন্ত্র, তার গর্জন, নতুন কাজ, অনেক মানুষ, আজকের মানুষ, এ-ই তো প্রাণভরে চেয়েছিল সে।
কারখানায় এসে উঠল মেঘনাদ। কাঠ নেই, ফুরিয়ে গেছে। তন্দুরের চিতা জ্বলবে না। ছিটের কাজ বন্ধ। ময়দা নেই। ময়দা নেই কোথাও। কয়েক হাজার টাকা বাকি পাইকেরদের কাছে। সে পাইকেররা ভূত কি মানুষ, কেউ জানে না। তারা সব অদৃশ্যজীব। নতুন করে পারমিট পাওয়া, সে অনেক দূরের জল। তা ছাড়া, বিনয় নিজে এবার কারখানা করবে। সে তার সব কিছুতে বাধা দেবে। প্রাণপণে।
মেঘনাদ ডাকল ইদ্রিসকে। বলল, ইদ্রিস, বোধ হয়, তোমাদের সর্বনাশ করলাম। আমার কারখানা আজ থেকে বন্ধ। আমি আর ব্যবসা চালাতে পারব না।
সকলে তাকে ঘিরে এল। একে একে শুনল সব কথা। সকলের নতুন পাতা সংসার এই লীলা বেকারিতে। সব চলে যেতে লাগল।
কেবল চালিস পিতৃমাতৃহীন ছেলেটার মতো দাঁড়িয়ে রইল। মেঘনাদ বলল, চলে যা, নইলে না খেয়ে মরবি।
চালিস বলল, কত্তা, আমি থাকি। এরপর পাঁচ সের ময়দার কাজও তো করতে হবে। মেঘনাদ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপরে বাড়ির দিকে চলল।
খেতে দিয়ে তিলি অবাক হয়ে গেল। যত দিচ্ছে, ততই খেয়ে যাচ্ছে বোনাই। একবারও না করছে না। এত ভাত তো কোনওদিন খায় না।
বলল, বোনাই, কী হয়েছে?
: কেন?
: তোমাকে অন্যরকম লাগছে। তোমার তো কোনও দুঃখই বাকি নেই। তবে? তোমার কী হল আবার?
মেঘনাদ বলল সব কথা তিলিকে। তিলি পাথরের মতো জমে গেল। মনে পড়ল রাজীবের কথাগুলি।
তারপর একে একে সবাই শুনল।
সন্ধ্যাবেলায় বিজয় এসে বলল, কী হবে বোনাই?
মেঘনাদ বলল, পারলাম না বিজয়।
একটু থেমে বলল, বিজয় তোমাকে বলেছিলাম, যন্ত্রের কারখানা করব। পারলাম না। আমি চুরি করতে পারলাম না, জোচ্চোরি করতে পারলাম না, শয়তানি করতে পারলাম না। এ দেশে, এ সময়ে, আমি যন্ত্রের কারখানা কেমন করে করব। কিন্তু কোনও কাজ শিখিনি আর জীবনে। সওদাগরিও হল না আমার। আমাকে এবার একটা ছোট হাত তন্দুর করতে হবে।
বিজয় বলল, বোনাই, একটা কথা বলব?
: বলো।
: জানি তোমার অনেক দুঃখ। এত বড় মার আমি খেলে পাগল হয়ে যেতাম। কিন্তু এই কারখানা, যন্ত্র, এ সব ছাড়া কি আর তুমি কিছু চাও না জীবনে?
: বিজয়, তুমি কিছু কি চাও না এই মিস্তিরিগিরি ছাড়া
: চাই বোনাই, সেই তো আমার জীবনের যন্ত্রণা। মানুষ বলে এই কি আমার পরিচয় যে, শালা বিজা মিস্তিরি। না, হেসো না বোনাই। আমি বড় হতে চাই। মিস্তিরির কাজে আমার ঘৃণা নেই। কিন্তু আমি শুধু মিস্তিরি । এ অপমান আমার সয় না। তবু সইতে হয়। আমার জ্ঞান নেই, লেখাপড়া নেই। বেশ্যাবাড়ি বলে ভুল করে আমার বাড়িতে লোকে ঢুকে পড়ে, শালা এমন আমার থাকবার আস্তানা। বোনাই, ধর্মে কর্মে, রাস্তায় ঘাটে, আর এই পেট, সব নিয়ে আমার শুধু অপমান। আমি যে অনেক কিছু চাই।
মেঘনাদ বলল, আমিও তাই চেয়েছিলাম বিজয়। পুরনো ছেড়ে নতুন, নতুন জ্ঞান, শিক্ষা, কাজ, জীবন সবই আরও সুন্দর, আজকের যুগে যার সম্মান আছে, আমি তাই চেয়েছিলাম আমার সর্বস্ব দিয়ে।
বিজয়ের খালি মনে হল, নতুন কাজ, সম্মান, সে সব কিছুই নয়, শুধু মুনাফা আর মুনাফা।
কিন্তু বোনাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা তার টনটন করে উঠল শুধু। লোভী আর মুনাফাখোর মানুষকে তো বোনাইয়ের মতো দেখায় না।
: বড় মহাজন। তা আমি হয়েছিলাম। সিরাজদিঘায় আমি বড় গদির মালিকই হয়েছিলাম। বাড়িঘর, নৌকা কারখানা, বউয়ের গায়ে সোনা, সবই করেছিলাম। কিন্তু আমার মন ভরেনি। অমন গদির মহাজন হওয়ায় বড় ঘেন্না ধরে গেছল। মানুষ হয়ে জন্মেও যদি সংসারের সঙ্গে তাল না রাখতে পারলাম, তবে কী করলাম। হরিনাম দিয়ে টাকা রেখে লাভ কী। যে কারবারে সাহাদের অত নাম, অত মান, অত গর্ব, আমার কি তা কিছুই থাকতে নেই। তবে যদি বলল জীবনটাকে আমি টাকা সার করেছিলাম। তা হলে সার ব্যাটা হয়ে আমি গোত্র বদল করতে সাহস করেছিলাম কেন। বিজয়, সংসারে পিশাচেরও টাকা থাকে। কিন্তু আমার বুকের পাটা, আমি নতুন কাজ, নতুন জিনিস করতে চেয়েছিলাম। আর কী যন্ত্রণা। দেখো, এমন মার খেয়েও আমার বুকের পাটা একটু টসকাল না।
তারপর বলল, কিন্তু ভুলই হয়তো করেছিলাম। কেন না, নইলে মনে হচ্ছে কেন, একাজে আজ এ দেশে চোর-জোচ্চোর, শহুরে শয়তান না হলে হবে না। নইলে বলি, এ সংসারে কল কারখানারও বুঝি নতুন কোনও জন্মান্তর হবে। তা না হলে পাপে যে সংসার ভরে যাবে বিজয়। পাপকে এত ঘৃণা আর কখনও করতে পারিনি। দিন গুনব বিজয়, পাপ কবে শেষ হবে। তবে…
হেসে বলল, এবার পেট চালাবার পালা। আমাকে আগুন দিতে হবে আবার তন্দুরেই।
বিজয় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বানাইয়ের দিকে। কথাগুলি বুঝল না, কিন্তু মনটা ধরে ঝাঁকানি দিয়ে দিল বোনাই।
.
দু দিন পর সে লীলার কাছে বলল, তোমার কাছে কোনওদিন কিছু চাইনি। তোমার সোনা আমাকে দেও, আমি ফিরিয়ে দেব আবার।
লীলা বলল, সে সব নেই !
: কী করেছ?
: বিনচৌকে দিয়ে দিয়েছি।
: বিনচৌকে ! হঠাৎ লীলাকে তুলে দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল বারান্দায়।
চমকে উঠল মেঘনাদ। আঁ, কী করছে সে। মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে গেল।
.
ছোট হাত তন্দুর তৈরি করেছে মেঘনাদ নিজেই চালিসকে নিয়ে।
দিন কয়েক পরে মেঘনাদ পাঁচ সের ময়দার ব্যাগ কাঁধে করে ঢুকল কারখানায়। তার গায়ে একটি পুরনো ঝোলা পাঞ্জাবি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় রেলওয়ে কুলি। এই পাঁচ সের ময়দাও চোরাবাজার থেকে কিনতে হয়েছে তাকে। থামলে একটি দিনও চলবে না। যত কমই হোক, মাল তৈরি করে ফেরি করে বেচতে হবে রাস্তায় রাস্তায়।
লীলা এসেছে কারখানায়। মেঘনাদ ময়দাটা রাখতেই, ব্যাগটা তুলে নিয়ে গেল সে। ভ্রু কুঁচকে উঠল মেঘনাদের। দেখল বড় কাঠের পাত্রে ময়দা ভেজাচ্ছে লীলা
চালিস আর তিলি বাইরের থেকে ভয়ে ভয়ে উঁকি মেরে দেখছিল। মেঘনাদকে দেখে তাদের বুকের মধ্যে কাঁপছে। কিন্তু ভয় নেই লীলার।
একটি অতিমানবের মতো ধীরে পা ফেলে ফেলে মেঘনাদ লীলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দু হাত দিয়ে ছোঁ মেরে তুলল লীলার শাড়ি ধরে। রুদ্ধ মোটা গলায় বলল, কেন?
খোলা চুলে লীলার মুখের আধখানা ঢাকা পড়েছে। সেই দিনের আঘাতের দাগ এখনও মুখে। মেঘনাদের মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। ঢোক গিলছে, কষ্ট হচ্ছে মেঘনাদের থাবায় পাখির মতো ঝুলে থাকতে। চিকচিক করছে চোখের কোণ দুটি। তবু ঠোঁট দুটি আশ্চর্য রকম টেপা। ভেজা ভেজা চোখের মণিতে এক নতুন ঔজ্জ্বল্য, ভাবে এক বিচিত্র দৃঢ়তা। এই নতুন। পরিবেশেও চেনা যায়, এই সেই লীলা। যে ছেড়ে যাওয়ার জন্য সব করে, ফিরে আসার দিনেও, সে ফিরে আসে তার নিজের মতোই। তার ঠোঁটের পাশে, মেঘনাদের সে দিনের আঘাতের দাগ আজ যেন ভালবাসার জয়ের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। থেমে থেমে স্পষ্ট চাপা গলায় বলল, কাজ না করে আর কতদিন থাকব।
মেঘনাদের চোয়াল দুটি কাঁপছিল, ঢোক গিলছিল। সেও কথা বলতে পারছিল না। লীলার কথা শুনে হঠাৎ তার বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল। প্রায় শুন্যে দুলিয়ে ন্যাকড়ার পুতুলের মতো লীলাকে সে এনে বসাল তার মেশিনটার উপরে। তারপর নিজেও বসল মেশিনটার নীচে। নিজের মুখটা ঢাকতে চাইছে।
লীলা দু হাত বাড়িয়ে দিল তার প্রকাণ্ড রুক্ষ মাথাটায়। মনে হল, এতবড় পুরুষের এমন পুজো সে আর কোনওদিন পায়নি। মেঘনাদ বলল, পারবে, কাজ করতে?
মেঘনাদের চোয়াল দুটি কাঁপছে, ঢোক গিলছে। সেও কথা বলতে পারছে না।
: পারব !
: তবে করো।
লীলা উপুড় হয়ে পড়ল কাঠের পাত্রে। মেঘনাদ তুলে নিল জ্বালানি কাঠ। তন্দুরে আগুন দিতে হবে। চালিসও এল। ছোট তন্দুরে ঝাঁটা বুলাতে লাগল।
তিলিও এল। লীলা ডাকল তাকে, আয়।
ছোট চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠল।
মেঘনাদ বলল, তুমিও এলে তুমি ঠাকরুন এ কারখানায়।
তিলি হাসবার চেষ্টা করে বলল, একটা কথা বলতে এলুম। বোনাই, তোমার কাছে যা চেয়েছিলুম !
মেঘনাদ বলল, হবে, ঠুমি ঠাকরুন। অনেকদিন রয়েছ, আর কিছুদিন থাক। এত তাড়া কীসের। ধরে তো রাখব না।
তিলি হাসল চোখ নামিয়ে। অনেকদিন থেকেছি, আর কতদিন ! কতদিন !
তন্দুরের মুখ থেকে লোলায়মান অগ্নিজিহ্বা ছুটে ছুটে আসতে লাগল বাইরে।
.
কিন্তু কয়েকদিন পর, সবাইকেই আসতে হয় কারখানায় বাস করতে। তিলি, সুকুমারী, নকুড়, ষোড়শী আর তার ছেলে, সবাইকেই।
বিজয় গ্রেপ্তার হয়েছে কারখানা থেকে। শস্তা রেশন বন্ধের প্রতিবাদে, শ্রমিকেরা কারখানার মধ্যে অবস্থান ধর্মঘট করেছিল। তিন দিন বিজয় বাড়ি আসেনি, হাজার হাজার শ্রমিক ঘরে ফেরেনি। বউ বেটি ছেলে তাদের খাবার দিয়ে এসেছে কারখানায়। ঘেরাও হয়ে ছিলেন সাহেব ম্যানেজার। তাঁকে খাবার দিয়ে যেতেন মেমসাহেব। পুলিশ তিনদিন ধরে ঘেরাও করেছিল শুধু শ্রমিকদের। কিন্তু কিছুই করেনি। তারপর হঠাৎ, ভোজবাজির মতো, শ্রমিকদের মধ্যে একটা গণ্ডগোল লেগে গিয়েছিল। ওতপাতা রাত্রিচর জীবের মতো পুলিশ হঠাৎ গ্রেপ্তার করতে আরম্ভ করেছিল। তাদের প্রথম আসামি বিজয়
মেঘনাদ অবাক হয়ে এই নতুন স্বদেশি দলকে দেখছিল। চুরি নয়, ডাকাতি নয়, কোম্পানির কাছে শস্তা রেশন চাইলে তাকেও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরাও তো তা হলে স্বদেশি ! কিন্তু কী বিচিত্র স্বদেশি। পেটের দায়ে স্বদেশি। বিজয়ের কথা মনে পড়ল, বোনাই, সব মিলিয়ে আমার শুধু অপমান। আমি যে অনেক কিছু চাই। সেই অপমানিত স্বদেশি বিজয়েরা, কিন্তু কী ভয়াবহ। বিভীষিকার রাজ্য ঘিরে আছে তাদের।
মেঘনাদের মনে হল, পাপ যেন একটি দীর্ঘসূত্র গাঁথা মালা। অনেক তার রং, মাথার উপর করাল সন্ত্রাসের রাজ্য, সব এক ঠাঁই। আর এতবড় স্বপ্ন নিয়ে, বিজয় মিস্তিরির সঙ্গে একাকার হয়ে গেল মেঘনাদ।
বুক চাপড়ে চিৎকার করে উঠল নকুড়, সুকুমারী। কে খাওয়াবে? কে পরাবে?
মেঘনাদ বলল, আমি একলা তো সামলাতে পারব না। সবাই মিলে কাজ করে খাব। ভয় কীসের!
সবাই মিলে ভাড়া ঘর ছেড়ে দিয়ে কারখানায় বাস তুলে নিয়ে এল। কেবল তিলি আর ষোড়শীকে, হাত ধরে অনুনয় করে নিয়ে আসতে হল মেঘনাদকে।
অমৃত মুদি এল দাদ চুলকোতে চুলকোতে। টাকাটা আর ফেলা রাখা যায় না। অবশ্য বউ তার মারা গেছে। এই বয়সে ছেলেমেয়ে নিয়ে, দোকান চালিয়ে সংসার চালানো বড় কঠিন। নকুড় সা’র ছোট মেয়েরও অবিশ্যি বয়স হয়েছে। যদি তার সঙ্গে বিয়ে দেয় তা হলে টাকার কথাই ওঠে না। কথাটি প্রকাশ্যে লোক জানিয়েই বলল অমৃত।
মেঘনাদ তার মস্ত বড় শরীরটি অমৃতর সামনে এনে দাঁড়াল। তা তো হয় না মশাই। আপনার টাকাটা আমি দিয়ে দেব।
অমৃত বলল, সবাই সব কিছু দিয়ে দেয়। আপনিও তো দিলেন সা মশাই। শালীকে নিজের কাছে রাখতে চান, রাখুন। তবে, দেবটেব করবেন না, নগদ বিদায় করুন।
মেঘনাদ বলল, নগদ বিদায়ের, যে উপায় নাই।
অমৃত আশ্চর্য নির্বিকার কিন্তু বিষাক্ত হাসি হেসে বলল, মশাই, দায়ে পড়েই বলছি, তা হলে যা হোক একটা নগদ-বিদায় করুন। দুটোতেই ওকথা বললে চলবে কেন।
মেঘনাদের চোখে রক্ত ছুটে এল। তার পেছনেই তিলি আর লীলা দাঁড়িয়ে আছে। নকুড় আর সুকুমারী ঘরের মধ্যে। মেঘনাদ বলল, আপনি কত টাকা পান?
: উনাশি টাকা, চৌদ্দ আনা, তিন পয়সা। মশাই বিজা মিস্তিরিকে অত কেউ কোনওদিন ধার দেবে না। আমি দিয়েছিলাম কেন? না, পরে যখন একটা কিছু সম্পর্ক
মেঘনাদ বলল, আমি কালকেই আমার মেশিন বেচে আপনার
তিলি চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠল, বোনাই ! ছি ছি ছি, কী সব বলছ তুমি। সামনে চৈত মাস। ওকে বলো, বোশেখ মাসের প্রথম যে বের দিন আছে, সেই দিন যেন আসে। কিছু দিতে পারবে না, সেটা বলে দেও। খালি সাত পাক ঘুরিয়ে তুলে নিয়ে যেতে হবে।
মেঘনাদ আর লীলা রুদ্ধশ্বাস বোবার মতো তাকিয়ে রইল তিলির দিকে। অমৃত বলে উঠল, আরে নিশ্চয় নিশ্চয়, আমি আধ পয়সাও চাই না। ছি রাধা করুণা করুন, আমি যেন ঘরে তুলতে পারি। ব্যস বাস আর কিছু বলতে হবে না।
বলে সে হনহন করে চলে গেল।
মেঘনাদ খালি গলায় বলল, ঠুমি ঠাকরুন
তিলি হাসবার চেষ্টা করে বলল, মেশিন বিক্রি, অমন পাপের কথা বোলো না বোনাই।
তারপর সত্যি সশব্দে হেসে বলল, তোমাকে বলেছিলাম, তুমি পারলে না, আমার ব্যবস্থা আমিই করলুম। আজকালকার মেয়েরা যে তাই করে।
কিন্তু আশ্চর্য ! লীলা একটি কথাও বলতে পারছে না।
তিলি আবার বলল, বোনাই, সংসারে মন নিয়ে বড় জ্বালা। আমার মন বলছে, আমাকে ওখানেই যেতে হবে।
মেঘনাদ বলল, কিন্তু ঠুমি, এখানে যে মন নয়, টাকা।
তিলি বলল, না বোনাই, শুধু টাকা নয়। আমার কি মন নেই, আমি কোন মন নিয়ে তোমার এখানে থাকব?
বলে, মুখ আড়াল করতে গিয়েও লীলার চোখে চোখ পড়ে গেল।
লীলা আচমকা হু হু করে কেঁদে উঠে দু হাতে জড়িয়ে ধরল তিলিকে। এমন করে কেউ কোনওদিন লীলাকে কাঁদতে দেখেনি। এ যেন সেই লীলাই নয়। সে বলল, তোর সব মন নিয়ে। তুই থাক তুমি। তোকে আমি কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারব না ভাই।
তিলি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অদ্ভুত নিরাসক্ত গলায় বলল, দ্যাখ দিদি, ভাল যদি বাসলি বোনাইকে, এত ভালই বাসলি যে, ঠুমি রাককুসির জন্যও আর সোয়ামিকে একটু দুঃখু দিতে চাসনে? এত ভাল ভাল নয়, আমারও ভাল লাগে না।
বলে সে তরতর করে ঘরে ঢুকে গেল।
লীলা তেমনি মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইল। মেঘনাদ তার মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মুক্তর শজনে গাছের ফাঁক দিয়ে কুটি কুটি রংঝালরেরমতো এসে ছড়িয়ে পড়ছে ফাল্গুনের শেষ রোদ। চড়াই পাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ছে, বসছে লাফাচ্ছে।
মেঘনাদ বলল, মহাজনগিন্নি জীবনের এতটা খালি, ঠুমি নিয়ে তার কতটুকু আর আমরা ভরাব। দুঃখের কথা সবাই বলে, সুখের কথা কেউ বলে না। ঠুমি সংসারের নিয়মের কথা বলেছে, সে কথা আমার চেয়ে আর কে বেশি বুঝবে। ও সব থাক, চলো, কাজের সময় হয়েছে।
চালিস ফিরে এল, সারাদিনের বিস্কুট ফেরি শেষ করে।