৩.৩ বন্যার কার্যকারণের সেই মুহূর্তটি

১০৬.

বন্যার কার্যকারণের সেই মুহূর্তটি

অফিসাররা স্বাধটা ফাঁকা করে দিয়ে চলে গেলে জানা জিনিশই আর-একবার জানা হয়, নৌকো করে সরিয়ে আনার মত বিশেষ কিছু দুই নম্বরে আর নেই। মেয়েরা ও বাচ্চারা ত উঠেই এসেছে, চৌপত্তিতে ঘোরাফেরা করছে, পুরুষমানুষরাও আসছে-যাচ্ছে। এখন, ধীরেন সাহার নৌকোটা একবার যায়, তাতে কোনো বাড়ির জিনিশপত্র কিছু কিছু আনাও হয়। কিন্তু তারপর নৌকোটা কোথাও নিয়ে যাওয়া হয় যেন বেঁধেছেদে তৈরি রাখবার জন্যেই সিবিল এমার্জেন্সির অফিসারের অনুমতিসহ। যতদিন জল থাকবে, মানুষজনকে যাতায়াত করতে হবে, ততদিনই নৌকোটা সরকারের ভাড়া পাবে। অফিসারের ভাড়া করা নৌকো ত আর পঞ্চায়েত খারিজ করতে পারবে না।

কিন্তু এই অফিসারদের আসা, সিবিল এমার্জেন্সির লাল গাড়ি, নৌকো ভাড়া করা; ঘুঘুডাঙা থেকে চিড়ে আর গুড় আনতে রিক্সা পাঠানো, এর ফলে, যেন বন্যাটা ঘোষণা হয়ে গেল। এই ক-দিনের ঝড়বৃষ্টিতে ও হাঁটুজল থেকে কোমর জলে ডুবেও বন্যাটা যেন ততখানি বন্যা ছিল না, এখন এটা সরকারি বন্যা বলে সাব্যস্ত হয়ে গেল। আরো যদি বাড়ে, তাহলে হেলিকপ্টার আর সৈন্যবাহিনীর কথা আসবে। কোনো বন্যায় কেউ কখনো হেলিকপ্টার দেখে নি, একজন সৈন্যও দেখে নি। কিন্তু মোটামুটি এটাই ঠিক হয়ে গেছে–ঐ দুটো দিয়ে বন্যার আর-এক অবস্থা বোঝানো হবে।

অফিসারদের আসা-যাওয়ায় নদী-আকাশের চেহারাটা যেন আরো সত্য হয়ে ওঠে। নদীর কোনো পার থেকে বাতাসের ছুটে আসা দেখা যায় না, অত প্রবল বাতাসে আকাশের সমস্ত মেঘ তছনছ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যেন মেঘে তৈরি নয়–এমনই অনড় থাকে এ আকাশ। আর আকাশেও প্রত্যাহত বাতাস এসে আছড়ে পড়ে এই বাধে দাঁড়ানো মানুষগুলোর গায়ে।

বাতাসের বিপরীতে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে একা-একা মহেশ্বর জোতদার চিৎকার করে ওঠে, এ্যালায় ত গরুগিলাক আনিবার নাগে হে, হে-এ এ ভাদই-ভাই কোথায় না জেনেই।

মহেশ্বর এমন ঘোষণা করেছিল একথা সত্য। বিপরীত ঝঞ্ঝার সেকথা ভাদইয়ের দিকে না এসে পশ্চিম থেকে পশ্চিমে চলে গেছে–এই ঘটনাও সত্য। সেই মুহূর্তে ভাদই, কান্দুরা আর কানকাটু বাঁধের ঢাল বেয়ে জলে নেমে যায়–এ ঘটনাও সত্য। এই তিনের মধ্যে কার্যকারণের কোনো সংযোগ না-ও থাকতে পারে। কিন্তু থাকতেও পারে।

এখন ত এখানে রিলিফ ক্যাম্প প্রায় হয়েই গেল–চিড়ে আসছে, গরুর খাবারও নিশ্চয় আসবে, সুতরাং গরুগুলোকে নিয়ে আসা উচিত।

অথবা, শনিবারের বিকেলের এই মুহূর্তে, মহেশ্বর-ভাদই কান্দুরা কানকাটু একসঙ্গে বুঝে ফেলে এই মুহূর্তটি আত্মরক্ষার শেষ সময়, যেন তারা সেই অদৃশ্য পাহাড়ের অজ্ঞাত সব নতুন হ্রদের গায়ের ফাটলচিহ্ন দেখতে পেয়ে গেছে, জলের রঙে হঠাৎ যেন তারা মৃত্যু দেখতে পায়, অথবা অনির্দিষ্ট নদীপার থেকে উত্থিত বাত্যার আওয়াজে শুনতে পায় ধ্বংসের ধ্বনি। অফিসারের আসা থেকে ভাইদের জলে নেমে পড়ার ভিতর হয়ত কোনো কার্যকারণ ছিল না। কত কাকতালীয়কেই ত আমরা কার্যকারণ বলে ভুল করি। অথবা কত কার্যকারণকে আমরা কাকতালীয় মনে করি।

ভাদই, কান্দুরা আর কানকাটু জলে মেনে যায়। জলের বাধাটুকু বাদ দিয়ে, তাদের হাঁটায় কোনো অনিশ্চয়তা থাকে না। পা পায়ের অভ্যাসে পায়ের তলার মাটি চিনে নেয়। কখনো উঁচু, কখনো নিচু, কখনো কোনো গর্তের ভেতর হঠাৎ কোমর পর্যন্ত ডুবে যায়, তারপরই আবার হাঁটু জেগে ওঠে। ওদের তিনজন একই জায়গায় নেমেছিল–কিন্তু ছড়িয়ে গেল তিন দিকে। ভেতরে ছড়ানো উঁচু ডাঙাগুলিতে গরুগুলো ছড়িয়েছিটিয়ে বাধা ছিল, সেই সব জায়গা থেকে হা-স্বা ডাক দীর্ঘায়িত এক কোরাসে ছড়িয়ে পড়ে, যেন ওরা জেনে গেছে এরা তিনজন আসছে। সেই কোরাস থেমে যাওয়ার পর আবার কোনো একক গাভীস্বর মেঘের চাপা ডাকের মত নদীর পারের দিকে ছড়িয়ে পড়ে–সেই সব মেঘের ডাক, যেগুলো আমাদের দেখতে পাওয়া মেঘেরও অনেক ওপরে থাকে। বানভাসি গরুরা বুঝে গেছে, এবার তাদের সরানো হবে। তারা দড়িতে শিং ঘষে মাটিতে ক্ষুর ঠুকতে শুরু করে।

এক গোছা পাটের দড়ি গলায় জড়িয়ে ভাদই আবার ফিরে আসতে হটে। জলের ভেতর ভাইকে যেন আর অত ছোট দেখায় না, শুধু তার খাটো শরীরে কাঁধের আর হাতের পেশিগুলো ফুলে-ফুলে ওঠে–জল কাটানোর জন্যে ত ভাইকে দুটো হাত নাড়িয়ে যেতে হয়। ভাদই কোথায় সঁতরায় আর কোথায় হাঁটে সে ত বোঝাই যায় না, জলে তার এই একবার ওদিকে যাওয়া, আর একবার এদিকে আসা এমনই, যেন, সে জল চষে বেড়াচ্ছে।

বাঁধের তলায় এসে ভাদই মহেশ্বর জোতদারকেই হুকুম করে–বাশ ফেলাও কেনে, বাশ ফেলাও।

মহেশ্বর বাঁশের গোছ থেকে একটি বাঁশ নিয়ে বাঁধের ঢাল বেয়ে নেমে জলের কিনারা থেকে ভাইয়ের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেটা জলে পড়তেই ভাদই আবার চিৎকার করে, আরা ফেলাও কেনে, আরো ফেলাও

মহেশ্বরকে আবার উঠতে হয়। আবার একটা বাশ নিয়ে সে ঢাল বেয়ে নীচে নামে, এবার জল কিনারা পর্যন্ত যায় না, সেখান থেকেই গড়িয়ে দেয়–জলে পড়লে ভাদই নিয়ে নেবে। কিন্তু বাশটা দুটো কাটা গাছে এমনই আটকে যায় যে মহেশ্বরকে আরো খানিকটা নেমে পা দিয়ে সেটাকে গড়িয়ে দিতে হয়।

সেই বাঁশটা ধরতে ভাইকে বেশ কিছুটা এগিয়ে আসতে হয়, তার কোমর থেকে জল ধীরে-ধীরে নেমে যায়, আর বাঁধের একেবারে কাছাকাছি এসে ভাদই মহেশ্বরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, কায় একখান একখান করি বাঁশ আনিবার ধরিছেন, ফ্যালান কেনে, বাশ ফ্যালান। জলের ভেতর থেকে ভাদই তার এক হাত বাড়িয়ে দেয়। ভাদই বাতাসের দিকে পেছন ফিরে ছিল, তাই তার কথাগুলো বাতাসের বেগে এসে এই বাধটিতে আছড়ে পড়ে। মহেশ্বর এমন ভাবে তার কাপড়টা তুলে হাঁটু ভেঙে বাধ বেয়ে ওঠে, যেন মনে হয়, ভাইয়ের হুকুম এই মুহূর্তে অমান্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

মহেশ্বর যখন একবার-দুবার, বাঁধময়, ও দূরেও, তার চোখ ঘোরায় এমন কাউকে দেখতে যে বঁশগুলো নীচে জলে ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবে, তখন নীচে, জলের অনেক অভ্যন্তর থেকে কান্দুরা ডাকে–ভাদইগে। ভাদই বাঁধের নীচের জলে আজানু দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঘাড়টা ঘুরিয়ে হক, দেয়

হে-এ-এ

ছাড়ু কি না ছাড়?

না ছাড়ু, না ছাড়ু।

ভাদইয়ের না-ছাড়ু, আওয়াজটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যে প্রলম্বিত ও তীব্র হয় তা প্রতিধ্বনিও হতে পারে। কিন্তু এত বিপরীত বাতাসে প্রতিধ্বনি আসে না। তা হলে হয়ত কান্দুরাই কথাটাকে আর-একটু দূরে কানকাটুর কাছে ছড়িয়ে দিল এখন গরুগুলিকে ছেড়ো না।

বন্যার জল যখন আসে, তখনও তার আসাটা দেখা যায় না, আসে ত থিতু জলের সঙ্গে বা স্রোতের সঙ্গে মিশে। জলটা শুধু উঁচুতে উঠতে থাকে–কোনো আওয়াজ নেই, কোনো ভাঙন নেই, পাতালের জল যেন উথলে ওঠে। কিন্তু বাতাস ত তেমন নীরবে, অব্যাহত আসে না। একে ত এখন তিস্তার এপার-ওপার সত্যি দেখা যায় না ঝকঝকে রোদের দিনেও দেখা যায় না। জল বা বালির ঝিকমিকে দৃষ্টি আটকে যায়। এখন ত আরো দেখা যায় না–ছাই রঙের আকাশ নদীর একেবারে ওপরে নেমে মাঝখানে যেন নদীর ওপর দেয়াল হয়ে আছে। আর বাতাস সেই অদৃশ্য দেয়ালের পেছন থেকে তিস্তার এত বড় বিস্তারটা পার হয়ে যায় প্রায় যেন নীরবেই, অথবা, জলের যে-শব্দটা এখন আলাদা করে চেনা যায় না সেই শব্দের সঙ্গে মিশে আত্মগোপন করে। তারপর বাঁধের ওপর আছড়ে পড়ে সংহত সমস্ত শক্তিকে একসঙ্গে মুক্ত করে দিয়ে।

কিন্তু ভাদই কান্দুরা কানকাটু যেখানে, নদীর সেই শুকনো খাত, আসলে বড় তিস্তার বুকের চাইতেও নিচু। সেখানে এই বাতাস নেই, এই আওয়াজ নেই। সেখানে জলের আওয়াজ মাটির ভেতর থেকে উঠে আসছে, তারপর ছড়িয়ে পড়ছে এই জলের ওপরেই, বাতাসের সঙ্গে মিশছে না।

মহেশ্বর সেই বাতাসে তছনছ হয়। সে কাউকে দেখতে পায় না। বাধে কেউ নেই, সব চৌপত্তিতে। অথবা এই বাতাসে মাথার চুল, কাপড়চোপড়, সমস্ত এমন এলোমেলো হয়ে আছে যে একবার চোখ বুলিয়ে কাউকে চেনা যায় না। মাথার ওপরে এমন বাতাস আর পায়ের নীচে এমন জল না থাকলে মহেশ্বর জোতদারের উচিত একবার চোখ তুলেই হুকুম করার লোক পাওয়া। কিন্তু নীচে জলের মধ্যে ভাদই হাত বাড়িয়ে আছে বাঁশের জন্যে, যে গরুগুলোকে তুলে আনা হবে, তার ভেতর মহেশ্বরের গরুরই সংখ্যা বেশি, এদের দিয়েছে ফসলের ভাগ পেতে। ফসলের ভাগ পেয়ে গেলে জমির ভাগ কায়েম হয়।

কিন্তু মহেশ্বর এখন ত কাউকে পায় না বাশগুলো বাঁধের ওপর থেকে, নীচে ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। ভাদই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে। অগত্যা তাকে দুটো বাশ দু হাতে নিয়ে এগতে হয়। বাঁধের কিনারায় এসে ঢালের দিকে ছুঁড়ে দেয়। কোথায় পড়ল না দেখে আবার ফিরে যায়। আবার দুটো বাশ এনে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে দেয়। কোথায় পড়ল না দেখে আবার ফিরে যায়।

মহেশ্বর যখন বোঝে, তাকেই হাতে করে করে বাশগুলো নিয়ে-নিয়ে ভাইয়ের হাতে দিতে হবে, তখন সে ঠিক করে ফেলে, একটা-একটা করে বাশ নেয়ার বদলে বরং সবগুলো বাশই বাঁধের ঢালে ছড়িয়ে দিয়ে, পরে, পা দিয়ে দিয়ে গড়িয়ে দেবে। কিন্তু বাঁধের উত্তর দিক থেকে গামবুটু আর খাকির মোবাইল সিবিল এমার্জেন্সি চিৎকার করে হাত তোলে। বাতাসে চিৎকারটা শোনা যায় না, হাত তোলাটা দেখা যায়। মহেশ্বর দাঁড়ায়। তারপর দু পা গিয়ে বাঁধের একেবারে মাথায় যে ধাশগুলো পড়ে ছিল সেগুলো পা দিয়ে ঢালে নামিয়ে দেয়। দিয়ে, দেখে, একটা বাশও জলে পড়ল না।

জলের ভেতর থেকে ভাদই চিৎকার করে ওঠে, আরে কী করিছেন, তাড়াতাড়ি দেন কেনে বাশ, তাড়াতাড়ি দেন–

অগত্যা মহেশ্বরকে ঢাল বেয়ে নামা শুরু করতে হয় জলের দিকে, নামতে নামতে পা দিয়ে বাঁশগুলোকে সে গড়িয়ে দিতে থাকে। বাশগুলো যেন ডাঙায় নেই, জলে আছে–এমন ভাবে ঘুরে-ঘুরে যাচ্ছে। মহেশ্বরকে একবার ডাইনে, একবার বয়ে গিয়ে বাশগুলোকে পা দিয়ে ঠেলতে হয়। হয়ত একটু রেগে গিয়েই থাকবে মহেশ্বর। সে বাশগুলোকে বেশ জোরে-জোরে লাথি মারে। আর তাতেই দু-একটা বাশ ভাইয়ের হাতের সীমানায় গিয়ে পড়ে। ভাদই দুটো লম্বা বাশ তার আগে ভাসিয়ে দিয়ে নিজে সেগুলোর পেছনে ভাসে।

ঠিক সেই সময়ই মোবাইল এমার্জেন্সি বাঁধের ওপর থেকে চিৎকার করে ওঠে, এ আপনি কী করছেন, বাশগুলো আমাদের লাগবে-কাওশেড করার জন্যে।

মহেশ্বর বাঁধের ঢাল থেকে মাথা তুলে চিৎকার করে বলে–এইলা তোমার বাবার তালই রাখি গেইসে এইঠে?

শোনা গেল না বলে, নাকি মানে বোঝা গেল না বলে, মোবাইল এমার্জেন্সি কানে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কী বললেন?

একটা বাঁশ হাতে নিয়ে এমার্জেন্সিকে মারার জন্যেই যেন তুলে মহেশ্বর পেছনে ছুঁড়ে দেয়। বাশটি যে জলে পড়ল তার কোনো শব্দও ওঠে না। মহেশ্বর আঙুল এমার্জেন্সির দিকে তুলে জিজ্ঞাসা করে তোমার বাবায় আনিছে এই বাশ? তোমার বাবায়? যেন এমার্জেন্সির বাপ বাঁধের ওপরে এমার্জেন্সির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

এমার্জেন্সি তখনো কানের পেছনে একটা হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কী বলছেন?

একটা রাগ দু বারের বেশি তিনি বার করা যায় না। মহেশ্বর এমার্জেন্সিকে আঙুল দিয়ে বাঁশগুলো দেখিয়ে, নদীর ভেতর ভাইকে দেখায়। তারপর আবার বাশগুলোকে লাথি দিয়ে দিয়ে গড়াতে চায়।

বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে এমার্জেন্সি দেখে।

তারপর, বাঁধের ওপর থেকে দুটো বাশ নিয়ে বাঁধের ঢালের দিকে নামে। দু-এক পা নেমে বা হাতের বাশটা মাটিতে নামিয়ে রাখে আর ডান হাতের বাশটা মাথার ওপর তুলে, দুই হাতে ধরে। তার সামনে যেন কোনো লক্ষ আছে। সেই লক্ষ সে এই ওপর থেকে বিদ্ধ করবে, এমন ভাবে তাক করে। ভাল করে তাক করতে বা-পাটা একটু পেছিয়ে দেয়। বোঝে যে এই ঢালে এর চাইতে শক্ত ভাবে পা রাখতে পারবে না। মোটা শরীরটাকে একটু দুলিয়ে জলের দিকে বাঁশটা ছুঁড়ে দেয়। বাশটা বেশ খানিকটা ওপর থেকে বাঁধের ঢালেই চলে যায়, কিন্তু লম্বালম্বি পড়ে বলে একটা ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে, ভাইয়ের বা দিকে, পেছনে। জলে যদি সে বাশ ভেসে যায় সেই ভয়ে ভাদই লাফিয়ে এদিকে আসে, একটু যেন সাঁতার কেটেই।

.

১০৭.

জলগোধূলি

এখন এই নির্জন বাধে, নির্জন বন্যায় ও নির্জন ঝড়ে-জলের ভেতর দাঁড়িয়ে, হেঁটে সাঁতার কেটে ভাদই একটা বাঁশের সঙ্গে আর-একটা বাঁশকে জুড়ে-জুড়ে লম্বা করছে, আর বাঁধের ওপর থেকে মহেশ্বর জোতদার আর এমার্জেন্সি অফিসার ঠেলে-ঠেলে তাকে বাশ জোগান দিয়ে যাচ্ছে বাঁধের ঐ ঢাল বেয়ে, কখনো পা দিয়ে বাশ গড়িয়ে, কখনো হাত দিয়ে ছুঁড়ে, কখনো জলের কাছে গিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে। ভাদই একটার পর একটা বাশ জুড়ে যাচ্ছে আর পাটের দড়ি দিয়ে গিঠ দিচ্ছে। বাশটা হাতে যাওয়ার পর জোড়া দিয়ে গিঠ, বাধতে তার খুব বেশি সময় লাগছিল না। পিঠের কাছে যে তার কাস্তে গেঁজা ছিল, অথবা, কান্দুরা বা কানকাটু কারো ছিল-সে নিয়ে এসেছে, তা বোঝা যায় যখন ভাদই গিঠ বাঁধার পর দড়ি কাটে। এই রকম করে বাশ বেঁধে ভাদই নিয়ে যাবে, অন্তত কাছাকাছি কোনো একটা উঁচু জায়গা পর্যন্ত। দু লাইনে বাধা বাশ বন্যার জলের সঙ্গে সঙ্গে ভাসবে। এখন গরুগুলোকে এই দুই সারির মাঝখানে ছেড়ে দিলে সবগুলো সিধে বাধে উঠবে। না হলে এমন জলেভরা জায়গাটা তাদের এতই অপরিচিত যে একসঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলে যেতে পারে বড় স্রোতের দিকে। তখন এই জলের মধ্যে ভাদই কান্দুরা কানকাটুর সাধ্যও নেই গরুর পালকে বাঁচায়। দুই দিকে বাঁশের নিশানা থাকলে গরুর পালের ভুল হবে না। তা ছাড়াও, জল আরো বাড়লে, সব ডুবে গেলে, এই বাঁশের নিশানাটা অন্তত থাকবে–সব ডোবার আগে এই নিশানা ধরেই ত যাতায়াতের দরকার হতে পারে।

ভাদই এই বাঁশের লাইন টেনে নিয়ে গেল সামনের উঁচু ডাঙাটিতে–সেটার ওপরও এখন জল উঠেছে। সেখানে একটা পাতলা বাশ কাদায় এমনভাবে গাড়ে যাতে একটু স্রোতেই সেটা নুয়ে যায়। নুয়ে গেলে উপড়ে যাবে না। আর যদি যায়, তাহলে বাঁশের লাইনের ওদিকের মাথাটা বাধা থাকছে বাঁধের ঢালে। জল উঠলে সেই বাঁধনকে ভোলা যাবে। তখন যদি দরকার হয়, আর, জলের ভেতরের এই পাতলা বাশটাও যদি উপড়ে যায় তা হলে, বাঁধ থেকে এই বাঁশের লাইনটা ধরে অন্তত এই ডাঙাটা পর্যন্ত ত আসা যাবে।

কিন্তু তখন আসার দরকারটা কী? এখন না হয় গরুগুলোকে ঠিক ভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্যে লাইন দরকার। যখন সারা তল্লাট জলে ডুবে যাবে, এমন কি বাধ থেকেও লোক সরানোর দরকার হতে পারে, তখন, এই বাঁশের লাইন ধরে জলেব তলের ঘরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কী দরকার হবে?

দরকার হোক না-হোক, বাঁশের এই নিশানা ধরে ত সবাই বুঝতে পারবে ঐখানে জলের নীচে তাদের ঘরবাড়ি, জমিজিরেত।

এখনই সেই সব সম্পত্তির ওপর নদী। উঁচু উঁচু ডাঙাগুলোতে ঘরবাড়ির চাল দেখা যাচ্ছে, বেড়াগুলোও। নিচু জমির ঘরগুলোর চালের টুই জেগে আছে। জলের চেহারা ভাল নয়। আজ সারারাত এই বাতাস চলবে, বৃষ্টি চলবে, তাতে এই জল ফুলে উঠবে। সকালে দেখা যাবে–এখানে আর বাড়িঘর বলতে কিছুই নেই, শুধু নদী। তার ওপর এখনো ধস নেমে চলেছে। এমন সব পাহাড়ের গর্তেগুহায় জল জমে-জমে যে-হ্রদ হয়ে আছে, সেগুলো একসঙ্গে ফেটে গেলে পাহাড়ের জলে এখানে নতুন নদী তৈরি হবে। ভাদই কান্দুরা কানকাটু সেই নতুন নদীর জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নিকটতম একটু ডাঙাতে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ডুবিয়ে ভাদই একটানা লম্বা ডাক দেয় বা থেকে ডাইনে তার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে–হে-এ-এ কান-দূরা-আ-আ-কা-আনকা-আ-টু-উ-উ-উ। নদীর ওপারের বাতাস সে আহ্বানকে এই পারে পৌঁছে দেয়, তছনছ করে, যেন ভাইয়ের আহ্বান এদিকেই ছিল। কিন্তু নদীর ভেতরটা ফাঁকা বলে, ভাইয়ের বাতাসবিরোধী ডাক কান্দুরা কানকাটুর কাছে পৌঁছে যায় ঠিকই।

ডেকে ভাদই ওদিককার জলে নেমে পড়ে। সেখানে ডুব জল ও স্রোতের টান। তাতে ভাদই তার ছোট্টখাট্ট কোমল শরীরটাকে একটা কাঠের মত ভাসিয়ে দিয়ে আরো দূরের ডাঙাগুলোর কোনো একটাতে চলে যায়, কান্দুরা ও কানকাটুর মতই।

দু রাত্রির বাসি এই ঝড় ও বন্যায় আজকের এই প্রায় শেষবেলায় ওরা যেন শেষবারের জন্যে খতিয়ে নিচ্ছে এই বসতির সীমা-সরহদ্দ–মানুষের দখল থেকে যে-জমি নদী পুনর্দখল করেছে। সেই সীমার সবটুকু নয়, কিন্তু বেশ ছড়ানো-ছিটনো অনেকখানিতে, মাত্র তারা তিন জন এখন জলে সাঁতার কাটছে বা হাটছে বা দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর, সেই সব উঁচু ডাঙায় বেঁধে রাখা গরুগুলোকে নিয়ে তারা একসঙ্গে জলে নামে। এগিয়ে আসে সেই উঁচু ডাঙাটার দিকে, যেখানে ভাদই বাশ বেঁধে রেখে গেছে।

তারা তিন দিক থেকে আসছিল। কান্দুরা ছিল দক্ষিণের ডাঙায় আর ভাদই ছিল উত্তরের ডাঙায়। কানকাটু মাঝের ডাঙা থেকে গরুগুলোকে জলে নামায়। তিনদিক থেকে জলে নেমে পড়ায় এই এক স্বস্তি যে গরুর পালগুলিকে অন্তত কিছুটা সামলাতে পারবে, চট করে কোনো একটা পাল এদিক-ওদিক চলে যেতে পারবে না। যদি উত্তরের দিকে চলে যায় তাহলেই বিপদ। এদিকে গেলে ত তাও বাধ পাবে।

এই তিন-তিনটি পালকে একদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে হেট হেট হুট হুট করার কোনো দরকার ছিল না, তবু, ভাদই, কান্দুরা আর কানকাটু মাথার ওপর ছড়িমত কিছু একটা ঘোরাচ্ছিল আর জিভ দিয়ে টাকরায় আওয়াজ তুলছিল যেন তারা মাঠ বা রাস্তা দিয়ে পালগুলিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই আওয়াজেই হোক, আর, তাদের সামনে উঁচু বাধে এই গৃহপালিত গরুগুলো মাটির ইশারা পায় বলেই হোক, তারা যতটা সম্ভব দ্রুতগতিতে ঐ বাঁধের দিকেই ছুটছিল।

ছোটায় একটাই অসুবিধে ছিল। এই গরুর পালও এই নদীখাত এমন সরাসরি পেরতে অভ্যস্ত নয়। তা ছাড়া, কোথাও, তাদের কারো কারো বুক জল, কোথাও, কোনো-কোনো বাছুর ডুবে যায়, কোথাও-বা গাভিনের হাঁটু জেগে ওঠে ও সেই জলস্রোতের মধ্যেও জলস্থলের পার্থক্য না-বোঝা বাছুর, মায়ের বাটে হামলায়, পর মুহূর্তেই বাছুরসহ সেই গাই প্রায় পিঠ পর্যন্ত জলের ভেতরে চলে যায়।

কোনো একটি গরুও হাম্বা ডাকে না, যেন, এই গরুর পাল জানে যে তাদের সমবেত ডাকে, আকাশ আর জলজোড়া বাতাস বৃষ্টি আর সেই দূর পাহাড়ের গোপন সব হ্রদ সঙ্কেত পেয়ে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব তারা এই নতুন নদী পেরিয়ে পুরনো মাটিতে পা রাখতে চায়।

কিন্তু ভাদই, কান্দুরা আর কানকাটুর হয়ত কিছু সাহসের দরকার হয়, একটু অতিরিক্ত সাহসের। একা-একা এই পাহাড়-ভাঙা জল ডিঙতে সে-সাহসের দরকার হয় না, কিন্তু এই এতগুলো গরু নিয়ে এত দিক থেকে এই দৈনন্দিনের বাইরের জলরাশি পেরতে তাদের হয়ত দরকার হয় সেই সাহসের অতিরিক্ততাটুকু। তারা, নদীর ঐ ক্রমবিস্তারের মাঝখানে, পায়ে-কোমরে বুকে-পিঠে, আর, কখনো সারা শরীরে; ঐ জলরাশির আবর্তনের মাঝখানে, দেখে, এ-আকাশ যেন নদীর ওপর চেপে বসেছে, এরপর যেন নদী ও আকাশের মাঝখানে কোনো রেখাও থাকবে না। ভাদই হকার দিয়ে ওঠে, পার্থক্য এখনো এটুকু আছে এইটি নিজেকে বোঝাতে-হে-ই, হে-ট, হেট, খবোরদা–আ-রো-হে, খবোরদার, কান্দুরা চেঁচায়–কানকাটু বায় মারি দে, বয়ে মার।

যে-জলমগ্ন ডাঙায় ভাদই বাশ বেঁধে রেখে গিয়েছিল, গরুগুলো সেখানে উঠে পলমাত্র দেরি না করে হু হু বেগে সেই দুই বাঁশের লাইনের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এতক্ষণ যেভাবে আসছিল, তেমন ছড়িয়ে নয়, দুই বাঁশের ভেতরের সেই জায়গাটুকুতে গায়ে গা লাগিয়ে এই এতগুলো গরু যেন একটা অগ্রসরমাণ সঁকো হয়ে যায়, মাঝখানে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে থাকে কান্দুয়া, ভাদই আর কানকাটু। আচ্ছন্ন আকাশেও এক অদৃশ্য সূর্যাস্ত ঘটছিল। সেই অভ্যস্ত গোধূলিলগ্নে, সেই বিকেলে, সেই প্রবল ঝঞ্ঝায় এই যেন অপ্রাকৃত জলরাশি ভেদ করে ভাদই কান্দুরা কানকাটু তাদের ধেনুদল নিয়ে প্রায় ফিরে আসে–

.

১০৮.

‘সীমান্তবাহিনী’র দুই অর্থ

 তিস্তার মধ্যে নোয়াপাড়া, মেচিয়াপাড়া, সয়েদপাড়া, দহগ্রাম–এই চারটি চর বা ছিটমহল। এ নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছে, কারণ, এই চারটি জায়গা আগেকার পূর্ব পাকিস্তান ও এখনকার বাংলাদেশকে কোনো এক চুক্তি অনুযায়ী দিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে পাটগ্রাম থানা ছিল জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে। তিস্তা এখানে বরাবরই সীমান্তবাহিনী। মণ্ডলঘাটের পর তিস্তা পুব পারে মেখলিগঞ্জ আর পশ্চিমপারে হলদিবাড়ি এই দুই জায়গার মধ্যে দিয়ে তখনকার কোচবিহার রাজস্টেট, এখনকার কোচবিহার জেলা, পার হয়ে পাটগ্রামের পশ্চিম সীমা দিয়ে রংপুরের দিকে চলে যেত। তখন পাটগ্রামের পশ্চিমের এই নদীই ছিল রংপুর আর জলপাইগুড়ির মাঝখানের সীমান্ত। এই নদীর একেবারে মাঝখানে, পাটগ্রামের একেবারে ভেতরে নোয়াপাড়া, মেচিয়াপাড়া, সয়েদপাড়া, দহগ্রাম ও আরো অনেক নাম-না-থাকা চর আসলে ছিল কোচবিহার রাজ্যের ছিটমহল ও সেই কারণে কোচবিহারের ভারতভুক্তির পর ভারত ইউনিয়নের ও পশ্চিমবঙ্গের অংশ। কিন্তু সে ত ম্যাপের অংশ। অন্য একটা রাষ্ট্রের একেবারে ভেতরে এই কয়েকটি চরের মত ছিটমহলে ভারত ইউনিয়ন বা পশ্চিমবঙ্গ তার নিত্যিনৈমিত্তিক দখল কায়েম রাখবে কী করে? কেনই বা রাখবে? যে-সব স্থায়ী জায়গা, নদীর গতিপথ বদলানোয়, অনেক দিন ধরে কার্যত নদীর চর হয়ে গেছে অথচ সেটলমেন্টে সেসব জায়গা মূল ভূখণ্ডের অংশ, তাদের জুরিসডিকশন লিস্ট নম্বর আছে, সেই সব জায়গাই ত ছিটমহল। এই সব মহল ত নদীর ভাঙাচোরায় ছিট হয়ে গেছে। কোথাও এক নম্বর আর পাঁচ নম্বর হয়ত ভারতের, দুই তিন চার হয়ত বাংলাদেশের। আবার কোথাও হয়ত আট নম্বর আর নয় নম্বর বাংলাদেশের, ছয়, সাত আর দশ ভারতের। এই রকম এক-একটা চর নিয়ে এক-একটা রাষ্ট্র হয়ে থাকা দুই রাষ্ট্রের পক্ষেই অসুবিধের। সেই জন্যেই দুই দেশের মধ্যে কিছু লেনদেন সেরে ছিটমহলগুলোকে যতদূর সম্ভব একটু সাজিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু সাজিয়ে নেয়া হলেও ত নদী নদীই থাকে। চর চরই থাকে। আর, নদী নদী থাকলেও বা চর চর থাকলেও ত সেখানে রাষ্ট্র থাকে, রাষ্ট্রের সীমান্ত থাকে, সীমান্তে বর্ডার আউটপোস্ট থাকে। কাস্টমসের লোকজন থাকে, সীমান্তবাহিনী থাকে, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের ক্যাম্প থাকে, সেই ক্যাম্পের নিজস্ব অস্ত্রভাণ্ডার থাকে। তেমনি, আগে যেমন পাকিস্তানের • থাকত, এখন তেমনি বাংলাদেশেরও বর্ডার আউটপোস্ট থাকে, কাস্টমসের লোকজন থাকে, বাংলাদেশ রাইফেলসের ক্যাম্প থাকে, সেই ক্যাম্পের নিজস্ব অস্ত্রাগার থাকে।

কিন্তু এত কিছু ব্যবস্থা যে-সীমান্তকে রক্ষা করার জন্যে সে সীমান্তটিই এখানে থাকে না। দুই দেশের আইনসঙ্গত বা বেআইনি যাত্রীরা কেউই এত বর্ডার থাকতে এই চরের বা নদীর জলের বর্ডার পেরতে চায় না। অথচ এই বর্ডার বা নদীর চরে যে-সব মানুষজন থাকে তারা তাদের বাজারের জন্যে বা খাবারদাবারের জন্যে কাছাকাছির বন্দর এলাকায় বা হাটেই ত যায়। না গিয়ে উপায় থাকে না বলেই যায়। এমনকি ভারতীয় বর্ডার আউটপোস্টের খাবারদাবারের জন্যে, রবি আর বৃহস্পতি, সয়েদের হাটে নৌকো নিয়ে না গিয়ে উপায় থাকে না। সয়েদের হাটটা বসেই একটা অদ্ভুত জায়গায়–ওটা ত পুরোপুরি পাটগ্রাম, কিন্তু ঠিক হাটখোলায় নদীর সঙ্গে লাগানো একটা ফালি আছে ভারত ইউনিয়নের, কারণ, দেশভাগের সময় এই ফালিটা কোচবিহারের ছিটমহলের মধ্যেও আবার ছিল জলপাইগুড়ি জেলার ছিটমহল। সয়েদের হাটটা বসে এই সীমান্ত জুড়ে–তাই হাট করতে-করতেই ভারতীয় ইউনিয়নের বর্ডার আউটপোস্ট আর বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের লোকজন বাংলাদেশে ঢুকে যায় ও বাংলাদেশের বর্ডারের লোকজন ভারত ইউনিয়নে চলে আসে। হাটটা চলেই ত প্রধানত দুই বর্ডারের লোকজনের জন্যে-নইলে এত একটেরে হাটে কি এত পাঠা, খাশি বা মুরগি আসে?

হাটখোলটার পশ্চিম দিকটা বাংলাদেশের আর পুব দিকটা ভারতের। ঠিক আধাআধি নয় বাংলাদেশেরটাই আসল কিন্তু ভারতের দিকে, রাজকিশোরী পাড়ার অংশটাতে, মুরগিহাটা। ওদিকেই পাঠা-মুরগি, এমন-কি দু-চারটে গরু বাছুরও বিক্রি হয়। দু-এক সময় গরুবাছুর নিয়ে গোলমালও বাধে বর্ডারের চোরাই গরু ধরা পড়ে যায়। দু-একবার বাংলাদেশের চোর, ভারতে গিয়ে গরু চুরি করে এনে বেচছে, ভারতীয় বর্ডারের লোকরা ধরে ফেলেছে হাটে, তারপর হাটের ভেতরে ভারতের এলাকায় নিয়ে এসে প্রচুর মার দিয়েছে। বাংলাদেশ বর্ডারের লোকজনও এসে সে মারে হাত লাগিয়েছে। আর-একবার এক চোরকে বাংলাদেশেরই বর্ডারের লোকরা ধরে ফেলেছিল কিন্তু সে এক দৌড়ে ভারতীয় এলাকায় গিয়ে নিজেকে ভারতের লোক বলে ঘোষণা করল। এক দেশের নাগরিকতা ত্যাগ ও আর-এক দেশের নাগরিকতা গ্রহণের মত নাটকীয় ঘটনাও কেমন হাসির বিষয়ে হয়ে ওঠে–উমরায় ত কুচলিহাটার চোরাবলাই। চোরা বলাই সম্ভবত স্বনামখ্যাত বলেই আত্মরক্ষার জন্যে এমন একটা উপায় ভাবতে পারে। কিন্তু এই ঘটনায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের একজন চোরা বলাইয়ের ঘোষণাকে মেনে নিয়ে তাকে ভারতীয় নাগরিকের স্বীকৃতি দিয়ে ঘাড় ধরে টেনে এনে তার পাছায় একটা লাথি কষায়–এতটাই জোরে যে সে হাটের এক তরকারিঅলার ঘাড়ে গিয়ে পড়ায় তার কুমড়োগুলো চারদিকে গড়িয়ে যায়। কুমড়োগুলোর কোনো-কোনোটা বাংলাদেশে চলে যায়, কোনো-কোনোটা ভারত ইউনিয়নের ফালি জমির আরো গভীরে। কুমড়োঅলা সেগুলের পেছনে-পেছনে দুই রাষ্ট্রের ভেতরে ছুটোছুটি করবে নাকি পেছন থেকে হঠাৎ তার ঘাড়ে যে চোরা বলাই এসে পড়ল তাকে চেপে ধরবে এটা সাব্যস্ত করতে না করতেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী এসে চোরা বলাইয়ের চুল ধরে তাকে সঁড় করায়। এদিকে বাংলাদেশ বর্ডার ফোর্সের লোজন বলাইকে নিতে এলে ভারতীয়রা বলে, দাদা, একে কয়েক দিনের জন্যে ধার দেন, আমাদের ঠাকুরের এসিস্ট্যান্টটা ভেগেছে।

বাংলাদেশ বর্ডারের লোকজন বলল, নিয়্যা যান কেনে দাদা, আপনাদের ক্যাম্পে ফাটক দেওয়া গেইল। চোরা বলাইয়ের মাথার ওপর নেমে আসে হাট করার বিরাট ঝুড়ি, এতক্ষণ সেটা এক জোয়ান দড়ি বেঁধে টানতে-টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও একটা সতর্কতা থাকে। সীমান্তের কাছে কোনো হাট সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে না, তার অন্তত ঘণ্টা দু-তিন আগে শেষ হতে হবে, যাতে, হাটের লোজন সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে যেতে পারে ভারতীয় বর্ডারের এ-নিয়ম এই হাটেও মানা হয়, যদিও এ হাটটাকে বাংলাদেশের হাট বলার আইনি সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু এই নিয়মটা মেনে নিয়ে দুই বর্ডারের সরকারি লোকজন যেমন তাদের নৌকো করে সেই সয়েদপাড়া-দহগ্রামের ছিটমহল-চরমহলগুলোতে সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্যে ফিরে যায়, তেমনি, এই বড় চর এলাকার বাসিন্দারাও নিজ-নিজ জায়গায় ফেরে। হাটে ত শুধু চরের লোকরাই আসে না, পাশাপাশি গায়ের লোজনও আসে–তারাও হাটশেষে তাদের গ্রামে পৌঁছয়। সয়েদের হাটের হাটখোলা, হাটের লোজন, দুই বর্ডারের সেপাই-জোয়ান, গরু-পাঠা-মুরগি, এমন-কি চোররাও, দুই রাষ্ট্রের এই সীমান্তকে মেনে নিয়েই সীমান্ত লঙ্ঘন করে। তিস্তা এখানে প্রকৃত সমতলের বিস্তার পেয়েছে। সেই সমতলে, ও সেই বিস্তারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জায়গাগুলিতে, সীমান্ত ত একেবারে অনতিক্রম্য ও সুনির্দিষ্ট। তিস্তা সেই অনতিক্রম্যতা ও নির্দিষ্টতাকে অন্য সময় একটা আকারও দেয়। তখন তিস্তার চরের মধ্যে টিনের লাল রং দেখে ভারতীয় বর্ডার ক্যাম্প ও টিনের সবুজ রং দেখে বাংলাদেশ বর্ডার ক্যাম্প চিনে নেয়া যায়। তখন চরের ওপর কাটাতারের যে-বেড়া একটা সীমান্তের সঙ্কেত হয়ে থাকে, সেটা মেনে নিয়ে তিস্তাও যেন নিজের ভেতরে একটা অঘোষিত কাটাতারের বেড়া তোলে।

কিন্তু এখন বন্যার তিস্তা সেই সমস্ত সীমান্তচিহ্নকে লোপাট করে দেয়। যেমন সূর্যের আলো বা রাত্রির অন্ধকার সীমান্ত মেনে চলে না, তিস্তাও এখন সেরকম। আজ শনিবারের বিকেল। চারপাশ থেকে তিস্তা এই চরগুলোর ওপর উঠে আসছে, কোনো একটি চরের ওপর নয়–সেই নাউয়াপাড়া থেকে ঐ নীচের ছয় নম্বর দহগ্রাম পর্যন্ত সবগুলো চরের ওপর দিয়ে তিস্তা বয়ে গিয়ে ছিটমহল, চরমহলের আন্তর্জাতিক সমস্যা দূর করে দেবে। বুধবার থেকে জল বাড়ছে। কিন্তু এখানকার বৃষ্টি ত থেমেও গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার শেষ রাত থেকে হঠাৎ আকাশ ক্রমেই বিবর্ণ হতে শুরু করে আর বাতাস যেন খুবলে মাটি তুলে ফেলতে চায়। এখন এই শনিবারের বিকেলে ঘোলা আকাশ আর ঘোলা তিস্তা মিলে যেন একটা সুড়ঙ্গের মত হয়েছে।

.

১০৯.

বাংলাদেশের দূত ইন্ডিয়ায়

ভারতের সীমান্ত চৌকিতে রেডিও-টেলিফোন বেজে ওঠে। এক্সচেঞ্জে কেউ ছিল না। এখন ডিউটি কিশোরীচাঁদের, সে কম্যান্ড্যান্টের ঘরের সামনে অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। একটা এল-প্যাটার্ন ব্যারাকের মাথায় কম্যাভ্যান্টের ঘর আর তার সমকোণে, শেষে এক্সচেঞ্জ-সুতরাং ফোন বাজলে শুনতে পাওয়ারই কথা। কিন্তু বাতাসটা বিপরীত দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল আর কম্যান্ড্যান্টের ঘরে এরাও নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে কথা বলছিল–তাই ফোনের বাজনা আর শোনা যায় না।

ওপরে ভামনির ছাউনি আর পাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে এই একটাই ব্যারাক–এই ব্যারাকের দক্ষিণ আর পুবের দিকটা অফিস আর পশ্চিম ও উত্তর দিকটা প্রাইভেট। আসলে ভামনির ঘর একটা–সেই ঘরটা দুভাগ করা, বাঁশের বাতার পার্টিশন দিয়ে। এই প্রাইভেট-দিকে অবিশিষ্ট একটা ঘর খুব লম্বা–সেখানে জওয়ানরা থাকে। অফিসের দিকের মাঠটা পরিষ্কার–এক দিকে ভলি আর ফুটবল খেলার মাঠ, তারও পরে অনেকটা দূর পর্যন্ত মাঠটা ঘাসেঘাসে ছড়িয়ে গেছে। সেখানকার ঘাসগুলো বড়কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নেতিয়ে আছে। তারও পরে কাটাতারের বেড়া। প্রাইভেট-দিকটাতে একটা আলগা ঘর রান্নার জন্যে। আর-একটা ছোট আলগা ঘর- ইটের দেয়াল, চুনকাম করা, লাল টিন, একটা বারান্দা, একটা কোল্যাপসিবল গেট, তার পেছনে একটা কাঠের দরজা–এই ঘরটাতেই বন্দুক ও হয়ত আরো কিছু অস্ত্র থাকে। বারান্দায় দুজন শাস্ত্রী পোশাক পরেই পাহারা দিচ্ছে।

এই ছোট ঘরটা ও শাস্ত্রীরা ছাড়া আর-কোথাও রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো পরিচয় নেই। এমনকি কমান্ড্যান্টের অফিসের সামনে লোহার যে-ফ্ল্যাগস্টাফটিতে ভারতের জাতীয় পতাকা রোজ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত ওড়ে, সেই ফ্ল্যাগস্টাফটি ভিজে ও তার গায়ের দড়িটি স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে! বৃষ্টির জলে ফ্ল্যাগস্টাফের রং অনেকটা ধুয়ে গেছে–শাদা রঙের মাঝে-মাঝেই লোহার দাগ। ফ্ল্যাগস্টাফটা একটা সিমেন্ট বানো বেদির ওপরে। বেদিটাকে গোল করে ইটের কেয়ারি-এক দিকে একটু ফাঁক। ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ আগস্ট ওখান দিয়ে গিয়ে কম্যান্ড্যান্ট পতাকা উত্তোলন করে। অন্য দিন নাইট ডিউটির সেন্ট্রি পতাকা তুলে দিয়ে ডিউটি থেকে অফ হয়। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ফ্ল্যাগস্টাফের কেয়ারি কাদায় ঢাকা পড়েছে। ফ্ল্যাগ গত কয়েকদিন ভোলা হচ্ছে না। প্রথম দিনের বৃষ্টিতেই এত ভিজে গেছে। যে কম্যান্ড্যান্টের অফিসের বেড়ায় শুকোবার জন্যে গুঁজে দেয়া হয়েছিল। বুধবারে শুকয় নি। বৃহস্পতিবারে দিনের বেলায় শুকবার আশা ছিল, কিন্তু তারপরই ত এই বৃষ্টি বাতাস শুরু হল। এখনো, ফ্ল্যাগটা শুঁকতে দেয়াই আছে–কিন্তু একটা ছোট লাঠিতে ফ্ল্যাগটা ঝুলিয়ে দিয়ে লাঠিটা বেড়ায় খুঁজে দেয়া, যেন বাইরে বৃষ্টি বলে অফিসের ভেতরে ফ্ল্যাগ তোলা হয়েছে। ফ্ল্যাগটা একটা বড় ভেজা ন্যাতার মত নেতানো। রংগুলোও একটু মিশে গেছে। গেরুয়াটার ভেতরে সবুজের ছোপ, বা সবুজের ভেতরে গেরুয়ার ছোপ অত চোখে নাও পড়তে পারে কিন্তু শাদার ভেতরে গেরুয়া আর সবুজের ছোপ খারাপ লাগবে। ক্যাম্পে আর স্পেয়ার নেই। নতুন ফ্ল্যাগ চাইতে হবে।

এখন চরের মত হয়ে গেলেও আসলে ত এটা ছিটমহল, এখানকার মাটি তাই পুরনো ও শক্ত, তিস্তার বেলেমাটির মত আলগা নয়। গাছগাছড়ায় পুরো গ্রামটি ঘেরা। শুধু ঘেরাই নয়, ভরাও। সীমান্তের নিয়মঅনুযায়ী এই আউটপোস্টের ভেতরের প্রায় সমস্ত গাছ কেটে ফেলা হয়েছে–যে দুটি-একটি গাছ এদিকে-ওদিকে ছড়ানো সেটাও ক্যাম্পের দরকারেই। একটা বিরাট আমগাছ-কম্যান্ড্যান্টের প্রাইভেট-এর সোজা পশ্চিমে, প্রায় নদীর কাছাকাছি। ওখানে চাঁদমারি হয়। আর-একটা বড় সিসু গাছ থেকে গেছে ঐ বন্দুকের পাকা ঘরের পেছনে সিধে উত্তরে। কেন, তা এখন আর অনুমান করা যায় না। কিন্তু এরকম দু-একটি গাছ বাদে ক্যাম্পের চারপাশ, চারপাশেই অন্তত মাইলখানেক জায়গাও, একেবারে খোলামেলা। সেই ঘাসবনের সীমানায় কাটাতারের বেড়া ঘেঁষে খুটির ওপর গার্ডরুম–একটা পুবে, একটা পশ্চিমে। সেখানে দুই শাস্ত্রীর রাতদিন বাইনোকুলার নিয়ে পাহারা দেয়ার কথা। কোনো দিনই কেউ ওখানে একা-একা বসে থাকে না। যার নাইটডিউটি থাকে সে আর কাউকে সঙ্গে নিয়ে রাতটা ওখানে ঘুমিয়ে আসে। এখন ত কোনো কথাই নেই–ক্যাম্প ভাসতে বসেছে, এখন আবার গার্ডরুম কী?

ভারতের সীমান্ত চৌকিটাই এ রকম একটু বেখাপ্পা ও একটেরে, কারণ, এখানে দেশ নেই কিন্তু সীমান্ত আছে তিস্তার যে-ঘোলাটে স্রোত এই সীমান্তের ওপর আছড়ে পড়ে বায়ে-ডাইনে ভাগ হয়ে যাচ্ছে সেটাকে যদি দেশ বলে ধরা যায়, তা হলে অবিশ্যি দেশ আছে। কিন্তু শীতের সময় যদি পাতলা, শুকনো, মাঝে মাঝে বালি-বেরনো ঐ নদীটাকে দেশ বলে মনে হতেও পারে, এখন ত মনে হচ্ছে ঐ নদীর মুখ থেকে ভেতর দিকে যত সরে যাবে তত বাঁচবে–সেই ভেতরটাই যেন দেশ। কিন্তু এই দ্বীপের মত ছিটমহলেরও মাত্র একটা অংশে ইন্ডিয়া, বাকি সবই ত বাংলাদেশের।

ফলে, বাংলাদেশের সীমান্ত চৌকিটার প্রাধান্য অনেক বেশি। তারা ত নিজেদের দেশের ভেতরে বসে বসে নিজেদের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। তাদের ত আর কোনো সময় মনে হয় না যে তারা দেশের বাইরে গিয়ে দেশকে পাহারা দিচ্ছে। এমন-কি, এখন যে তিস্তার বন্যা সেই ইন্ডিয়া থেকে এত জল নিয়ে এই বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে, আজ এই শনিবার বিকেলে আর ভরসা হচ্ছে না যে রাতের ঘন্টা কটা নিরাপদে কাটবে, আর এখন তাড়াতাড়ি, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই একটা কিছু উপায় ভেবে রাখতে হচ্ছে–তাতেও ত ভারতের সীমান্তচৌকির সমস্যা আর বাংলাদেশের সীমান্তচৌকির সমস্যা এক নয়। বাংলাদেশের ওরা হয়ত সবাই মিলে এতক্ষণ নৌকোয় ডাইনে-বায়ে কোথাও পার হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার ত পার হওয়ারও জায়গা নেই, পার হতে হলে সেই বাংলাদেশেরই কোথাও যেতে হবে। সপ্তাহে একদিন বা দুদিন কয়েকজন মিলে হাট করে আনা এক জিনিশ, আর সেখানও ত আইনের এই ছুতোটুকু থাকে যে হাটটা অর্ধেক ভারতে বসে, সুতরাং বেআইনি চালান বন্ধ করার জন্যে তারা রাউন্ডে যায়। কিন্তু তাই বলে পুরো ক্যাম্প তুলে দিয়ে বাংলাদেশেরই এক জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেয়া ত আর যায় না। আবার, না নিয়ে উপায়ই বা কী?

কমান্ড্যান্ট বলে, এক কাজ করো। তোমরা এখন নৌকোটা নিয়্যা ওপার যাও। কয়েকটা শিফটে যত জন পারো যাও। আমি বাকিদের নিয়্যা এইখানে থাকি। রাত্তিরে যদি জল ঘরে ঢোকে, তখন আমরাও নৌকায় চইড়া বসব।

বিভূতি ঘোষ বয়স্ক লোক। সে বলে, কথাটা মন্দ বলেন নি। তা হলে রাতে না গিয়ে এখনি চলে যান না!

কোথায় যাব? কম্যান্ড্যান্ট জিজ্ঞাসা করে।

রাতের ঐ অন্ধকারের মধ্যে, তখন পুরো ফ্লাড, যেখানে ভেসে যাবেন।

কমান্ড্যান্ট তার চেয়ারে হেসে দুলে-দুলে ওঠে, ঘোষের কথা শুনো।

 তা হলে আর এত মিটিংটিটিঙের দরকার নাই, যা হওয়ার তা হবে, বটুক বর্মন বলে ওঠে।

কী হবে তা ত বোঝাই যাচ্ছে। কী নিত্যানন্দ, বলল আবার, গায়ের লোকজন কী করছে?

 নদী ত দক্ষিণের গায়ে তখনি ঢুকে গেছে–আমি ত সেই সকালে দেখে এসেছি।

তারপর জল ত আরো বাড়ল। দক্ষিণের লোকজন বলছিল–তাদের গরুবাছুর ক্যাম্পের মাঠে এনে রাখবে।

তা আনে নাই যখন, জল কমতেও পারে, কম্যান্ড্যান্ট বলে, কী বলো বিভূতি ঘোষ?

আপনার ত দেখছি বেশ আমোদ হয়েছে। এখন ইলিশমাছ আর খিচুড়ি হলেই হয়।

আরে ফ্লাডেই যদি মরতে হয় ইলিশমাছ খায়্যা মরাই ভাল, কম্যান্ড্যান্ট চেয়ারের মধ্যে হেসে ওঠে।

এমন সময় আপাদমস্তক ওয়াটার পুফে মোড়া একজন একটা সাইকেলে চড়ে হুড়মুড় করে এসে নামে। সাইকেলটাকে সিঁড়িতে রেখে লোকটি বারান্দায় ওঠে। বারান্দায় উঠে সে তার ওয়াটারপ্রুফের টুপি খোলার পরও কেউ চিনতে পারে না। তারপর ওয়াটারপ্রুফের বোম খুলতেই বটুক বর্মন বলে ওঠে, আরে আজিজ, তুমি?

আর আজিজ? রেডিও-টেলিফোন বাজি বাজি হয়রান হই গেসি। স্যালায় সাইকেল নিগি রওনা দিছু। উঃ কী বাতাস। কম্যান্ডার পাঠি দিসে।

.

১১০.

ইন্ডিয়া বাংলাদেশ বার্তাবিনিময়

সে কী? তোমরা ফোন করছিলা নাকি? কম্যান্ড্যান্ট চেয়ার থেকে পা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করে। আজিজ তখন ভেজা ওয়াটারপ্রফুটা কোথায় রাখবে সেই জায়গা খুঁজছিল, শেষে আর জায়গা না পেয়ে ফিরে গিয়ে তার সাইকেলের সিটের ওপরই রাখে। এমনভাবে ভাজ করে রাখে আজিজ, যাতে বাইরের দিকটা বাইরে থাকে।

আজিজের পরনে লুঙি, স্যান্ডো গেঞ্জি আর গামবুট। লুঙিটা ভাজ করে কোমরে গোজা। এইবার আজিজ কম্যান্ড্যান্টের দিকে তাকিয়ে বলে তোমরালার টেলিফোন কি অফ করি রাখিছেন?

কেন? অফ কেন? কার ডিউটি ছিল? কম্যান্ড্যান্ট তার চেয়ারের দুই হাতল ধরে জিজ্ঞাসা করে একটু উঁচু গলায়। কিশোরীচাঁদ ভিড়ের ভেতর থেকে এক্সচেঞ্জের দিকে সরে যায়। কিন্তু তাড়াতাড়ি হেঁটে বা দৌড়ে যায় না। তা হলে ত ধরাই পড়ে যাবে ডিউটি তার ছিল। তা ছাড়া বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে এই দুর্যোগে মেসেঞ্জার এল কেন সেটাও সে জেনে যেতে চায়। এমনিতে এ ক্যাম্পে কে কোথায় কখন ডিউটি করছে তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই-রুটিন কাজগুলো হয়ে গেলেই হল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে ফোন করে না পাওয়াটা সাধারণ ব্যাপার না। তার ওপর আবার ফোন না পেয়ে সাইকেল চড়ে মেসেঞ্জার এসেছে।

আজিজ তখন বলছে, স্যার, ক্যাভার সাহেব জানিবার চাহেন তোমারালার পাছত কোনো ফ্লাড ওয়ার্নিং আসিছে কি আসে নাই?

কেন? তোমাদের কাছে কিছু এসেছে নাকি? কম্যাভ্যান্ট একটু ঝুঁকে পড়েন।

সে ত বাবু কহিবার পারিম না। মোক কহি দিছে তোমারালার ওয়ার্নিং আসিছে কি আসে নাই পুছিবার তানে, আজিজ বলে। কম্যান্ড্যান্ট একটু ভাবে, তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন–এই, এক্সচেঞ্জে কে আছে? কোনো ওয়েদার মেসেজ আসছে না কি?

ততক্ষণে কিশোরীচাঁদ এক্সচেঞ্জের কাছে চলে গেছে। সেখান থেকে সে জবাব দেয়, না, আসে নাই।

তুমি ত ফোনের কাছে ছিলাই না, জাইনল্যা কেমন কইর‍্যা? কম্যান্ড্যান্টের গলায় আধা-তিরস্কার।

আমি ত এখানেই ছিলাম, কিশোরীচাঁদ এক্সচেঞ্জের দরজা থেকে গলা তুলে বলে।

 ছিল্যা ত ছিল্যা। এখন দেখো, কোথাও ফ্লাডের কোনো খবর পাও কিনা–কোচবিহার দেখো, জলপাইগুড়ি হেডকোয়ার্টাস দেখো। আজিজ, তোমাদের কোনো খবর নাই? কম্যান্ড্যান্ট জিজ্ঞাসা। করে।

খবর আর কোটত পাম? এ্যালায় ত দুই নম্বর ভাসি গেইসে।

দুই নম্বর? ভাইস্যা গিছে? কম্যান্ড্যান্ট দাঁড়িয়ে পড়ে, সেখানে ত তোমাগো অনেক লোক।

হ্যাঁ, সগায় আসি ক্যাম্পত ভিড় করিবার ধরেছে।

তোমাদের ক্যাম্পে দুই নম্বরের লোকজন আইস্যা গিছে? সাইরছে। তা হালি ত এই ক্যাম্পতেও আইসবার ধরব, কম্যান্ড্যান্ট এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, এ-ই দ্যাখোত দক্ষিণপাড়ার খবর কী? কম্যান্ড্যান্ট চিৎকার করে বলে। এখানে যে-ভিড়টা জমে ছিল সেটা ধীরে-ধীরে কেমন সরে যায়। এক বিভূতি ঘোষ দাঁড়িয়ে থাকে। কম্যান্ড্যান্ট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই বৃষ্টির ছাটটা আচমকা বাতাসে এদিকে ফেরে, কম্যান্ড্যান্ট তাড়াতাড়ি পেছিয়ে আসে, আজিজ দেয়ালের দিকে মুখ করে আর ঘোষ ঘরের ভেতর ঢোকে।

স্যার, কম্যান্ডার কহি দিছেন, আপনার সঙ্গে ফোনে কথা কহিবার চান। উমরায় ফোনের পাশতই আছেন আপনি ফোন ধরিলেই কাথা কহিবার পারিবেন।

আরে, তাই নাকি, খাড়াও, তা হইলে কথা কয়্যাই নেই, কম্যান্ড্যান্ট ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই আজিজ বাধা দিয়ে বলে, স্যার, আমার আর-একখান ম্যাসেজ আছে স্যার, সেইটা শুনি ফোনখান ধরেন।

আছে নাকি? কও, কও।

স্যার, কম্যান্ডার বলিছেন, এ্যালায় রাতিভর পানি বাড়িবার ধরিবে, এ্যানং বাতাস দিবা ধরিছে, তোমরালার ক্যাম্পের সায় হামলার ক্যাম্পে আজি রাতিত্ সাগাই নিমন্ত্রণ খাইবেন।

অ্যাঁ? সাগাই দিছে তোমার কম্যান্ড্যার? হে-হে করে হেসে ওঠে কম্যান্ড্যান্ট।

হ্যাঁ, স্যার, সগায় আজি হামরালার ক্যাম্পত চলেন, ওইঠে রাতিটা থাকিবেন, কালি সকালে বাও-জল কমিলে এইঠে আসিবেন। আজিজ তার মেসেজ শেষ করে।

আরে শুইনছ বিভূতি ঘোষ, সারা ক্যাম্পড়া তুইল্যা যাইতে হবে, কাম দেখছনি?

বলে কম্যান্ড্যান্ট আবার হে-হে করে একচোট হেসে ওঠে। তার হাসিতে মনে হয়, এটা বাইরের দুর্যোগের কোনো ব্যাপার নয়, ফুর্তির ব্যাপার।

আপনি ত চিল্লিয়েই যাচ্ছেন, ও যে আপনাকে একটা ফোন করতে বলল, বিভূতি ঘোষ কম্যান্ড্যান্টকে মনে করিয়ে দেয়।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলোত কানেকশন করতে, কম্যান্ড্যান্ট ফোনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়। বিভূতি ঘোষ রিসিভারটা তুলে বলে, বাংলাদেশকে কানেকট করো, তারপর কম্যান্ড্যান্টকে বলে, ধরুন। কম্যান্ড্যান্ট তখন আজিজকে বলছিল, তোমরা কি পাঠাটাঠা কাইট্যা সাগাই ডাইকতে বারাইছ? এই কথাটা শেষ করতে করতে হাতটা বাড়িয়ে দিলে বিভূতি ঘোষ রিসিভারটা ধরিয়ে দেয়।

রিসিভারটা একটু ধরে থেকে কম্যান্ড্যান্ট চিৎকার করে ওঠেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তারপর গলাটা নেমে আসে, ইয়েস, ইন্ডিয়া স্পিকিং, ইন্ডিয়া স্পিকিং, ইন্ডিয়া স্পিকিং। হ্যালো, কম্যান্ড্যান্ট ইন্ডিয়ান বর্ডার আউটপোস্ট, দহগ্রাম, স্পিকিং। তারপর হঠাৎ গলা চড়িয়ে দেয় কম্যান্ড্যান্ট, যেন ভিড়ের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে, যাকে খুঁজছিল তাকে পেয়ে গেছে, আরে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মোতাহার ভাই? আরে, আজিজ আইসছে ত, কয়, সবার নাকি সাগাই খাওগার কথা হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, কম্যান্ড্যান্ট হাসতে থাকে। বিভূতি ঘোষ নিচু স্বরে বলে, উনি কী বলতে চাইছেন, সেটা আগে শুনে নিন, তারপর হাসুন। শুনে, কম্যান্ড্যান্ট হাসি থামিয়ে বলে ওঠে, হ্যাঁ,বলেন,কী হইল? তারপর রিসিভারে শুধু , ই করে যায়। টেলিফোন থেকে একটা গো গো আওয়াজ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। বাইরের বাতাস কোনো বাধার সামনে আচমকা পড়ে গিয়ে আওয়াজ তোলে, আবার কোথাও প্রয়োজনের চাইতে বেশি চওড়া পথ পেয়ে কেমন হা-হা করে ওঠে। ফোনে বাংলা দেশের কম্যান্ডারের গলা বাইরে থেকেও বোঝা যাচ্ছিল, ঘোষ সেটা কান পেতে শোনে।

গো-গো আওয়াজটা থেকে যায়। এবার ভারতের কম্যান্ড্যান্টকে জবাব দিতে হবে কিন্তু কম্যান্ড্যান্ট চট করে যেন জবাব খুঁজে পায় না। একটু চুপ করে থাকে, তারপর বলে, হ্যালো, মোতাহার ভাই? ওদিক থেকে আবার সেই গো গো আওয়াজ আসে–একটু সময়ের জন্যে। কম্যান্ড্যান্ট আবার একটু সময় নেয়, তারপর বলে, মোতাহার ভাই, আমাদের হেডকোয়ার্টাসে ত ফোনের কোনো লাইনই পাচ্ছি না, আপনি বলতেছেন ক্যাম্প, মানে আমাদের ক্যাম্প ভাসিবেই? আবার সেই গো-গো আওয়াজ। কম্যান্ড্যান্ট যেন হঠাৎ জবাবটা পেয়ে যায়।

হ্যালো মোতাহার ভাই। আমি এডু সবার সাথে কথা বইল্যা নেই, দেখি জলপাইগুড়ি বা কোচবিহারের সঙ্গে কনট্যাক্ট করা যায় কিনা। তারপর আপনারে ফোন দিব নে।

বাংলাদেশ থেকে আবার গো গো আওয়াজ আসে।

 না, না, হাফ অ্যান আওয়ার, না, ধরেন ফিফটিন মিনিটস পরে আপনারে ফোন করব। না। বুঝছি ত, দেরি হয়্যা গেলে সব দিকেই লোকন। তবে, আমার একটা রিকুয়েস্ট। যদি আমাগো আপনাদের ঐখানে শিফট কইরতেই হয়, তা হলে আমাগো র‍্যাশন আমরা সঙ্গে নিয়্যা যাব।

বাংলাদেশ থেকে আরো একটা সংক্ষিপ্ত গোগোর পর কম্যান্ড্যান্ট আবার হে হে হাসি শুরু করে কিন্তু শেষ করতে পারে না, আচ্ছা, রাখি। রিসিভারটা রেখে দিয়ে রিসিভারে হাত রেখেই কম্যান্ড্যান্ট ঘোষকে বলে–সবাইরে ডাকো। ওরা শিফট কইরবার কয়। ফ্লাড নাকি সামনে বাড়তেছে। রাত্তিরে নাকি এই ক্যাম্পে জল ঢুইকবে।

.

১১১.

ইন্ডিয়ার গোপন আলোচনা

 কম্যাণ্ড্যান্ট টেবিলের সামনে তার চেয়ার ছেড়ে টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসে দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বিভূতি ঘোষ সবাইকে খবর দিতে যাওয়ায় এখন কম্যাণ্ড্যান্টের চোখের সামনে ক্যাম্পের মাঠটুকু, মাঠটুকুর শেষের ঘাসবন, ঘাসবনের শেষের গাছগাছালি। কিন্তু সেই গাছগাছালি দেখাচ্ছে যেন দিগন্তসীমা বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট এত ছড়াচ্ছে। এমন কি সামনের ঐ ঘাসবনটাই যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। ক্যাম্পের এই মাঠটুকুতে ঘাস বা গাছ নেই বলে বাতাস আর বৃষ্টির পাক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাতাস এত জোরে আছড়ে পড়ে এত দ্রুত পাক খাচ্ছে যে বৃষ্টির জল কুয়াশার মত জমাট বেঁধে বাতাসের ধাক্কায় আবার আবর্তের মত হয়ে যাচ্ছে। কমান্ড্যান্ট যেন এই প্রথম বৃটিাকে বুঝতে চায়।

দরজা থেকে আজিজ বলে, স্যার, মুই যাছ? তার গায়ে ওয়াটার প্রুফ, মাথায় টুপি

 অ্যাঁ? হা, হা। তোমার সাহেবরে সালাম দিও আজিজ।

 হ্যাঁ স্যার, দিম।

কম্যাণ্ড্যান্ট তাকিয়ে দেখে আজিজ সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, বাতাস সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে যেন। যাবে কী করে, আসার সময় ত বাতাসটা পিঠে ধাক্কা দিয়েছে, এখন তা বুকে দেবে।

কম্যাণ্ড্যান্ট সেটা দেখতে-দেখতেই আজিজ তার চোখের আড়ালে চলে যায়। আজিজকে সারাটা রাস্তা হেঁটেও যেতে হতে পারে। হতে পারে না, হেঁটেই যেতে হবে। সাইকেলটা এখানে রেখে গেলে পারত; তা হলে তাড়াতাড়ি যেতে পারত।

বিভূতি ঘোষ ঘরে ঢুকে কম্যাণ্ড্যান্টের পেছনে চলে যায়, তারপর কোণ থেকে একটা টুল টেনে নিয়ে বসে বলে, ওরা বলল কী, ফ্লাড আসবেই?

হু।

 আমাদের রেডিয়াতেও ত তাই বলছে।

হুঁ।

তা হলে ত শিফট করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

তা হলে আবার সবাইকে ডাকলেন কেন?

কম্যাণ্ড্যান্ট কোনো জবাব দেয় না। আসলে সে একটা দ্বিধার মধ্যে পড়েছে। যদি ক্যাম্প তুলে দিয়ে। ওদের ওখানে শেলটার নিতে হয়, সেটা তারই সিদ্ধান্ত। ক্যাম্পের আর সবাইও বলবে-কম্যাণ্ড্যান্টের হুকুমে গিয়েছি। কিন্তু গেলে ত ওই কয়েক ঘণ্টার জন্যে বা রাত্তিরের জন্যে ইন্ডিয়ার সীমান্তে কোনো পাহারা থাকবে না।

ক্যাম্পের অন্য অনেকে একে-একে এসে যায়–অনেকে বলতে জনা দশবার মাত্র। তার মধ্যে। কাস্টমসের একজন আছে। কেউ-কেউ ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ায়, কেউ-কেউ দরজার বাইরে। যারা। দরজার বাইরে তারা চিৎকার করে, কী বলবেন স্যার বলুন, বৃষ্টিতে, দাঁড়ানো যাচ্ছে না এখানে।

 তা ওখানে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আর কথা কইবা কী কইর‍্যা, ভিতরে আস, ভিতরে আস, বলে, চেয়ার থেকে উঠে কম্যাণ্ড্যান্ট নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। কম্যাণ্ড্যান্ট এতক্ষণ যে-চেয়ারে বসে ছিল, সেটা বিভূতি ঘোষ টান দিয়ে পেছনে নিয়ে যায়। কাস্টমসের ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে সেই চেয়ারটিতে গিয়ে বসে। তার পেছন-পেছন আর-সবাইও ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। কম্যাণ্ড্যান্ট বলে, দরজাটা বন্ধ কইর‍্যা দ্যাও।

দরজার কাছে যে-ছিল সে দরজাটা আবজে দেয়।

 শুইনছ ত সব, তা হইলে কও তোমরা, কী করা যায়?

এর আবার বলা কওয়ার কী আছে? ফ্লাড আইসলে ত সামনের উঁচু ডাঙায় উঠতেই হবে।

 তোমরা শুইনছ ত, বাংলাদেশের কম্যাণ্ড্যার আমাদের অনুরোধ কইরছে আইজ রাইত তাদের ক্যাম্পে কাটাইতে।

ত তাই চলুন। যেতে হলে ত এখনই যেতে হবে। না হলে সন্ধ্যা হয়ে গেলে ত আরো বিপদ।

পুরা ক্যাম্পে তালা মাইরা চলা যাব সবাই? কম্যাণ্ড্যান্ট জিজ্ঞাসা করে, আসলে জলপাইগুড়ির সঙ্গে একটা কনট্যাক্ট হইলেই আর-কোনো ঝামেলা হইত না। কিন্তু হেডকোয়াটার্সের পার্মিশন ছাড়া ক্যাম্পটা এরকম বন্ধ কইর‍্যা দিব? কম্যাণ্ড্যান্ট চুপ করে, অন্যরাও সমস্যাটা নিয়ে ভাবে।

এই, কে ছিলা এক্সচেঞ্জে? কম্যাণ্ড্যান্ট সবার দিকে তাকায়।

আমি ছিলাম, কিশোরীচাঁদ বলে। বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা এত জোরে খোলে যে পাল্টা ধাক্কায় আবার বন্ধ হতে যায়। এবার একজন দরজাটা এটে বন্ধ করে ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেয়। ফলে, বাতাসের আওয়াজটা কম আসে।

কী? কোনো মেসেজ দিব্যার বা নিব্যার পারল্যা?

 না, না। কিসের? অল ডেড।

কোচবিহারও ডেড?

যাহা কোচবিহার, তাহা জলপাইগুড়ি। স্যার, এই রকম ফ্লাডে আবার কবে আমরা মেসেজ পাই? সব জায়গাতেই ত জল।

হ্যাঁ। আর মনেই বা রাইখছে কেডা যে এইখানে তিস্তার মুখে একখান ইন্ডিয়া আছে? কম্যাণ্ড্যান্টের গলায় যেন একটু বিষাদ। সেই বিষাদে সে একবার দরজা দিয়ে বাইরে তাকাতে চায়। দরজাটা বন্ধ থাকায় বাইরেটা দেখা হয় না বটে কিন্তু তার তাকানোটা থাকে।

তা হলে করবেনটা কী, সেটা ত আপনাকেই ঠিক করতে হবে, টাইমও ত আর নেই, বিভূতি ঘোষ টুল থেকে বলে।

 আচ্ছা, এই নিয়ে এত ভাবার কী আছে? এখানে ফ্লাডের জল আসছে- আপনারা কি ফ্লাডে ভাসবেন নাকি? যদি ভাসতে চান, ভাসুন, আর যদি ভাসতে না চান বাংলাদেশের ক্যাম্প চলুন, কাস্টমসের লোকটি বলে।

কম্যান্ড্যান্ট তার দিকে একটু তাকিয়ে থাকে। তার তাকানোতে বোঝা যায় সে অন্য কিছু ভাবছে।

আপনি ত ভাবছেন ইন্ডিয়া ছেড়ে বাংলাদেশে গিয়ে উঠবেন কিনা। তা এখানে ত আপনার বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশই নেই। উঠবেন কোথায়? কাস্টমসের ভদ্রলোক আবার বলে।

কম্যাণ্ড্যান্ট তার দিকে তাকিয়েই ছিল। এবার তার ঠোঁটে একটু হাসি দেখা যায়।

আর ক্যাম্প ছাড়ছেন কোথায়? বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে টর্চ ফেললেই ত দেখা যাবে। রাতে না হয় একবার এসে দেখে যাবে কেউ, কাস্টমসের লোকটিই আবার বলতে থাকে, ব্যাপারটা ত রাতের কয়েক ঘণ্টা, এই নিয়ে এত ভাবার কী আছে?

যদি হেডকোয়াটার্স থিক্যা কোনো মেসেজ আসে? কম্যাণ্ড্যান্ট জিজ্ঞাসা করে।

 নো রিপ্লাই হবে। বুঝবে ফ্লাডে সব নষ্ট হয়ে গেছে, বটুক বর্মন জবাবটা দেয়।

কম্যাণ্ড্যান্ট সোজা হয়ে বসে, শোনো, তা হলে এখনই মুভ করো। সবাই ফুল ইউনিফর্মে– ইউনিফর্ম ভিজে ত ঢোল হয়ে যাবে, বটুক বর্মনই বলে।

ক্যান? তোমাদের ওয়াটারপ্রুফ নাই নাকি? না। ইউনিফর্ম ছাড়া বাংলাদেশের ক্যাম্পে যাওয়া যাবে না। ফুল ইউনিফর্ম উইথ আর্মস।

 আর্মস নিগি করিবেনটা কী?

এতগুলা আর্মস আমি কি এইখানে খালি রাইখ্যা যাব নাকি? তা হালে যাওনের কাম নাই। কম্যাণ্ড্যান্ট তার সিদ্ধান্ত জানায়।

আমরা নেয়ার পরও ত থাকবে–সেগুলো?

সে-সব আমি অর্ডার দিচ্ছি। তিনজন এক্সট্রা সেন্ট্রি ডিউটিতে থাকব আর্মারির ছাদে, ঐখানে ত্রিপল ফিট করো। কুইক। আর সবাই ইন ফুল ইউনিফর্ম উইথ আর্মস টু বাংলাদেশ ক্যাম্প, কম্যাণ্ড্যান্ট উঠে দাঁড়ায়।

.

১১২.

টু বাংলাদেশ উইথ আর্মস’ : আয়োজন

গত কয়েকদিন ধরে সারাটা ক্যাম্প এই বৃষ্টি আর বাতাসে যেন ধীরে-ধীরে চাপা পড়ে গিয়েছিল। বুধবারের কথা ছেড়ে দিলেও বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে এই বৃষ্টি ক্যাম্পটাকে যেন গিলে ফেলল। বোধহয় এর ভেতরে একটা নিয়ম সকলের অজ্ঞাতেই কাজ করে। সাধারণত রাতভর বৃষ্টি হয়ে সাকালে রোদ ওঠে। তাতে কারো কিছু এসে যায় না, বরং রাতের বৃষ্টিতে একটু আরামে ঘুমনো যায়। সারা বর্ষাকালে দু-চারবার রাতের বৃষ্টি সকালে ছাড়ে না, সারা দিন হয়ে সন্ধের দিকে হয়ত ধরল, বা, সে রাতেও হয়ে, তার পরদিন সকালে বেশ পরিষ্কার হল। তাতেও কারো কোনো কাজ আটকায় না–বর্ষার মধ্যে অন্তত দু-চারবার এরকম বৃষ্টি না হলে চলবে কেন? কিন্তু দুরাতেও যে বৃষ্টি থামে না, তৃতীয় রাত্রির দিকে গড়িয়ে যায় আর সে রাত পোহানোর পরও দেখা যায় আকাশটা নেমে এসেছে, বাতাসের জোর আরো বেড়েছে আর বাতাসের বেগে বৃষ্টির জল আকাশেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে-সে বৃষ্টি তখন ধীরে-ধীরে পুরো ক্যাম্পটাকে দখল করে নেয়। এমনিতেই ত কাজকর্ম কিছু নেই। তবু সকালের পি-টি, সপ্তাহে একদিন রুট মার্চ, তরি-তরকারির বাগান করা, ডিউটি শিফট, দিনরাত ধরে এক-একটা গ্রুপের সীমান্ত এলাকায় চৌকি দেয়া–এসব কাজের মধ্যে দিনটা ত একরকম ব্যস্ততাতেই কেটে যায়। কিন্তু এরকম বৃষ্টিবাতাসে সেই সব কাজই একে-একে বন্ধ হয়ে যায়। পি-টি সবচেয়ে আগে বন্ধ হয়, রুটমার্চের কথাই ওঠে না, ডিউটি-শিফট নিয়মমত হয় বটে কিন্তু আমারির বারান্দায় ছাড়া অন্য কোথাও সেটা বোঝাও যায় না, দু-একটা গ্রুপ ওয়াটার প্রুফ চাপিয়ে ছোটখাট চৌকিতে বেরয় বটে কিন্তু সে শরীরের খিল ভাঙবার জন্যে। খাওয়াদাওয়াও একঘেয়ে হয়ে আসে। রাতদিন শুয়ে বসে বা তাস খেলে সময় আর কিছুতেই কাটে না। এক এক সময় মনে হয়–এক্যাম্পে বোধহয় জনমনিষ্যি থাকে না। আলসেমি কাটানোর জন্যে হঠাৎ-হঠাৎ কারো চিৎকার-চেঁচামেচি ছাড়া মানুষজনের স্বাভাবিক স্বর শোনাই যায় না।

কম্যাণ্ড্যান্ট হুকুম দেয়া মাত্র হঠাৎ সারাটা ক্যাম্প যেন জেগে উঠল। বাতাসের ভেতরও যাতে শোনা যায় এমন চড়া গলায় ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি শুরু হয়ে গেল। যে-মাঠটা গত কয়েক দিন ধরে খালি পড়েছিল, সেখান দিয়ে ওয়াটার প্রুফ মাথায় দৌড়ে চলে যায় কেউ। কেউ আবার পিঠের দিকটাতে ওয়াটার পুফের ঢাকনি দিয়ে জলের ছাট আটকে বারান্দায় কোনো কাজ সারে। পেছনের দিক থেকে নানা রকম চিৎকার আর আওয়াজ উঠতে শুরু করে। বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে নিমন্ত্রণ অন্তত পুরো ক্যাম্পটাকে জাগিয়ে দিল।

উপেন, রামাশিস আর আসিন্দির আর্মারির ছাদে উঠে ত্রিপল খাটাচ্ছিল। ছাতের ওপরেই লোহার পাইপ থাকে, সে পাইপ ফিট করার জন্যে ছাদের মধ্যে বড় নল লাগানো আছে। সেই নলগুলোর মধ্যে। পাইপগুলো ঢুকিয়ে নাটবল্ট লাগাতে হয়। উপেন নাটবল্ট লাগাচ্ছিল আর টাইট দিচ্ছিল। আর রামাশিস ও আসিন্দির তলা থেকে কাঠের মই বেয়ে ত্রিপল টেনে তুলছিল। ত্রিপলটা ভারী–মাঝখান দিয়ে একটা ছোট বাশ চালিয়ে দু জনে কাঁধে করে সেটা তুলছিল। রামাশিস ওপরে, আসিন্দির নীচে। মইয়ের মাঝামাঝি উঠতেই রামাশিসের দিক থেকে ত্রিপলটা গড়িয়ে আসিন্দিরের দিকে চলে যায়। ফলে ত্রিপলের পুরো ওজনটাই আসিন্দিরের ওপর চাপে।

খাড়া কেনে, খাড়া কেনে, বলতে বলতে আসিন্দির ডান হাত দিয়ে বাঁশটা উঁচু করে ধরে চেঁচায়, তিরপলখান টানি নে রামাশিস, টানি নে।

রামাশিস মইয়ে হেলান দিয়ে ডান হাতে বাঁশটাকে ধরে রেখে, বাঁ হাতে ত্রিপলটা টানে কিন্তু নাড়াতে পারে না। আর-একবার জোরে টানে, তাতেও ত্রিপলটা নড়ে না।

 কিয়া? তিরপল ঠিক হ্যায় ত রে? রামাশিস জিজ্ঞাসা করে।

আরে ঠিক না-ঠিক সে ত টাঙিবার তানে দেখিম, এলায় বাশখান নামি দাও কেনে। আসিন্দিরের কথা শুনে রামাশিস তার দিকের বাশটাকে মইয়ের ওপরে রেখে এবার মইয়ে হেলান দিয়ে দুই হাতে ত্রিপলটাকে টানে। প্রথম টানটা একটু সাবধানে দেয়। তার গায়ে ওয়াটার প্রুফ, পা খালি। জোরে টান দিলে যদি পিছলে যায়, তা হলে মই থেকে উপুড় হয়ে ত্রিপল-আসিন্দির সব নিয়ে একেবারে মাটিতে পড়বে। প্রথম টান দিয়ে একটু বুঝে নিয়ে সে দু হাতে দ্বিতীয় টানটা দিতেই ত্রিপলটা সড়াৎ করে সরে আসে।

ঠারো, ঠারো, বলে রামাশিস এবার তার বাশটাকে মইয়ের আরো উঁচুতে তুলে দিয়ে ত্রিপলের পাশ দিয়ে দু ধাপ নেমে, ত্রিপলের তলা দিয়ে ধাশটা ধরে।

হাঁ, ঘোড়াসে টান লাগাও, বলে সে বাশটাকে পেছনে টানে, আসিন্দিরও বুঝে বাশটা ধরে থাকে। এবার রামাশিস বা হাতে বাশটাকে উঁচু করে ধরে, উঠো, আভি উঠো, বলে মইয়ের সিঁড়ি ভাঙে।

এরকম করে রামাশিস তিনটি সিঁড়ি ভাঙতেই বাঁশের মাথাটা ছাতের ওপর উঠে যায়। রামাশিস বলে, থোড়াসে নামাও, আসিন্দির নীচে নামায়। মাথার বাশটা ছাতের ওপর পড়ে। রামাশিস চেঁচায়, এ উপীন, পাকড়ো ভাইয়া, জলদি। উপেন এসে বাঁশের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার হাতে রেঞ্চ আর প্লায়ার্স। আসিন্দির আর রামাশিস এবার বাশটাকে উঁচু করতে করতে মইয়ের সিঁড়ি ভাঙে। তাদের দিকের বাশটা উঁচু হতে থাকে। ত্রিপলটা গড়িয়ে গিয়ে হাতের ওপর পড়ে। উপেন বাশটা ধরে নেয়। বাশটাকে ছাতের ওপর ফেলে দিয়ে সে আবার নাটকটু টাইট করতে যায়।

ছাতের পুব সীমায় আর পশ্চিম সীমায় তিনটে-তিনটে ছটা টিউব দাঁড় করানো, মাঝখানেরটা উঁচু, দুপাশে সমান মাপের নিচু। এই ছটা লাগানো হয়ে গেলে আবার আড়াআড়ি তিনটে লাগানো হবে–তার ওপর দিয়ে ত্রিপলটা ফেলা হবে। উপেন খাড়া টিউব সবগুলোই লাগিয়ে ফেলেছিল। রামাশিস সেগুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখে আবার পুবের দুটো টিউবের গোড়া টাইট করে। ততক্ষণে আসিন্দির আর উপেন আড়াআড়ি টিউবটা নিয়ে প্রথম লাইনের খাড়া টিউবের সঙ্গে লাগাতে থাকে। এই লাগানোর জন্যে টিউবের মাথাগুলির মাঝখানে কাটা ও দুদিকে ফুটো। নাটকগুলো উপেনের পকেট। সে পকেটে হাত দিয়ে একটা নাট বের করে টিউবগুলোর মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে হাতে কন্টু লাগায়। সেজন্যে আসিন্দিরকে বিপরীত দিকে টিউবটা উঁচু করে ধরে রাখতে হয়।

এক দিকের বন্টু লাগিয়ে আসিন্দিরের দিকে এসে সে-দিকের টিউবগুলোতে নাটবল্ট উপেন লাগানো শুরু করতেই রামাশিস এসে উপেনের হাত দিয়ে লাগানো নাটক টাইট দিতে থাকে।

আসিন্দির গিয়ে ত্রিপলটার ভাজ লম্বালম্বি খুলতে শুরু করে। খুলতে গিয়ে তাকে ত্রিপলটা দু হাতে একটু টেনে আনতে হয়–তার পর ভাজ খুলে-খুলে এগিয়ে যায়। ভাজটা খুলে ফেলার পর আসিন্দির দেখে দড়ি নেই। এখন ত্রিপলের দুই মাথায় আর মাঝখানে দড়ি বেঁধে টিউবের ওপর ফেলে ওদিক থেকে টানতে হবে। আসিন্দির মইয়ের দিকে যেতে-যেতে বলে, খাড়াও কেনে, মুই দড়ি আনিবার যাছু।  

আসিন্দির নাইলনের দড়ি নিয়ে আসতে-আসতেই রামাশিস আর উপেনের টিউব ফিট করা হয়ে যায়। তারপর দড়ি বেঁধে টেনে তুলতে গিয়ে ত্রিপলটা ঠেকে যায়। আসিন্দির দড়িটা পরের টিউবের সঙ্গে বেঁধে ত্রিপলটাকে বাশ দিয়ে খোঁচাতেই সেটা টিউবের ওপর উঠে যায়। তখন আবার তার পরের টিউবে, যেটা একটা উঁচু সেটাতে তুলতে হয়।

আর্মারির ছাতে ত্রিপলের ছাউনি উঠে যায়।

.

১১৩.

বাংলাদেশ অভিমুখে কুচকাওয়াজ

 ইতিমধ্যে সেই ফ্ল্যাগ তোলার মাঠে বা পি-টির মাঠে একে-একে সবাই এসে জড়ো হচ্ছে। এখন আর-কেউ বৃষ্টির জন্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নেই, বরং, সকলেরই বারান্দা ছেড়ে মাটিতে নামার তাগাদা যেন বেশি। প্রত্যেকেই ইউনিফর্ম পরে নিয়েছে, পায়ে গামবুট আর গায়েমাথায় ওয়াটারপ্রুফ। বিভূতি ঘোষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হুইসল বাজাচ্ছে।

বটুক বর্মন, পরশমণি সুন্দাস, আষাঢ়, সুভদ্র আর পঞ্চানন টানতে-টানতে ও ঠেলতে-ঠেলতে একটা ঠেলাগাড়ি নিয়ে আসছে পেছন থেকে। গাড়িটা দেখতে অনেকটা জিপগাড়ির সঙ্গে লাগানো ট্রেইলারের মত। বড় বড় টায়ারের চাকা, সামনে কাঠের দুটো উঁচু দণ্ড, জোয়ালের মত–সেটা ধরে টানা যায়, বা গাড়ির পেছনে লাগিয়ে নেয়া যায়। ওরা গাড়িটা টেনে এনে রাখে। তারপর আবার ফিরে যায়।

 এবার ওরা একে-একে কাঁধে করে করে আনতে থাকে দুটো পাঠা, দুবাণ্ডিল কলাপাতা, পলিথিনের চাদর দিয়ে মোড়া হোট-ছোট কিছু প্যাকেট। পাঠাদুটো গাড়ির মধ্যে প্রথমে এদিক-ওদিক তাকায়, তারপর পাশের ঢাকনাটা পা দিয়ে টপকাতে চায়। কিন্তু বারকয়েক পিছনে গিয়েই বোঝে যে ওখানে ওঠা যাবে না। তখন গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভ্যা-ভ্যা করে বারকয়েক চেঁচিয়ে চুপ করে যায়। বোধহয় ঐটুকু সময়ের মধ্যে ওদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায়, বিপদের আশঙ্কাটাও ওদের কেটে যায়। তবু চাপা গলায় একটা ছোট ভ্যা-ভ্যা ডেকে দেয়, একসঙ্গে নয়, একটার পর আরেকটা।

অনেকেই ততক্ষণে বৃষ্টির মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বাতাস তাদের গায়ের ওপর হামলে পড়ছে, বৃষ্টির ছাট তাদের মুখের ওপর এসে সুচ বেঁধায় কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাদের যেন এই বৃষ্টিতে ও হাওয়াতে দাঁড়াতেই ভাল লাগছে। এতগুলো লোকের এই বৃষ্টিতে মাঠে এসে দাঁড়ানোর মধ্যেই যেন বৃষ্টি ও বাতাসকে অস্বীকার করা আছে।

কম্যাণ্ড্যান্ট তার ঘর থেকে নীচে নামে, সিঁড়ি দিয়ে, একটু ধীরে-ধীরে। তার গায়েমাথায় কোথাও ওয়াটারপ্রুফ কিছু ছিল না। সিঁড়িয়ে পা দিতেই বৃষ্টি আর হাওয়ার মধ্যে পড়ে যায়। এক জওয়ান দৌড়ে গিয়ে কম্যাণ্ড্যান্টের ঘরের মধ্যে ঢুকে ওয়াটারপ্রুফ নিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন বৃষ্টি আর হাওয়ার মধ্যেই কম্যাণ্ড্যান্ট সেই গাড়ির দিকে খানিকটা এগিয়ে গেছে। জওয়ানটি পেছন থেকে ওয়াটারপ্রুফটা মেলে ধরে ডাকে, স্যার। কম্যাণ্ড্যান্ট দাঁড়িয়ে হাত দুটো পেছনে মেলে দেয়, এ বৃষ্টি কি আর এই কোটে ঠেকবেনে? বলতে বলতে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কম্যাণ্ড্যান্ট কোর্টটা পরে, কিন্তু বোম লাগায় না, তারপর টুপিটা নিয়ে ভেজা মাথায় চাপাতে গেলে জওয়ানটি বলে ওঠে, স্যার, মাথাটা মোছেন।

কম্যাণ্ড্যান্ট হাত বাড়ায়। সে দৌড়ে গাড়িটার কাছে গিয়ে একটা পলিথিনের ব্যাগ থেকে তোয়ালে নিয়ে ছুটে আসে। কম্যাণ্ড্যান্টও দু পা এগিয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়ে মাথাটা মুছে টুপিটা চাপায়।

কী ঘোষ? চলো, স্টার্ট দাও। তোমার ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা কী কইরল্যা?

আমারিতে ডিউটি দেবে তিনজন না, ছয় জন। আর্মারির ওপরে ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। জল যদি আর্মারিতে ঢোকে তা হলে আর্মস এমিউনেশন হাতে তুলে রাখবে। এই ত ব্যবস্থা। আর সবাই যাচ্ছি।

তা হলে চলো, আর দেরি কইর‍্যা লাভ কী?

গাড়িটার ভেতর থেকে একটা পাঠা নিচু স্বরে ডেকে ওঠে, ভ্যা-অ্যা। অন্য পাঠাটি যেন সেই ডাকের সঙ্গত রাখার জন্যে আরো নিচু স্বরে আরো সংক্ষিপ্ত ডাকে, ভ্যা।

কী? ফল ইন করাব নাকি? ঘোষ জিজ্ঞাসা করে।

করো, বেশ মার্চ কইরতে কইরতে যাওয়া যাবেনে, কম্যাণ্ড্যাট বলে।

 ফল ইন করলে ঐ গাড়ি নেয়া যাবে কী করে? বটুক জিজ্ঞাসা করে।

 কম্যাণ্ড্যান্ট ঘোষের দিকে তাকায়। কম্যাণ্ডাণ্ট বলে, তা হালি এমনিই চলল।

ঘোষ হুইসল মুখে দিয়ে হুইসল নামিয়ে আনে, না। ফল ইন করতে হবে। ফল ইন করে আমারিতে গিয়ে আর্মস নেয়া হবে, তারপর আবার ফল ইন। তারপর ডিসপার্স।

কম্যাণ্ডাণ্ট ঘাড় হেলাতেই ঘোষ চেঁচিয়ে হুকুম দেয়–ফ-অ-ল ইন।

যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা দুজন করে দাঁড়িয়ে পড়ে। যারা তখনো ঘরে ও বারান্দায়, তাদের ভেতর। একটা তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। কেউ-কেউ বারান্দা থেকে লাফিয়ে মাঠে নামে, নেমেই দৌড়য়। বাতাসের আওয়াজের চাইতেও গামবুটে কাদা ভেঙে দৌড়নোর আওয়াজ প্রবল হয়। সেই আওয়াজের মধ্যেই ঘোষের হুকুম আবার শোনা যায়–অ্যাটেনশন।

তখনো ভেতরের দিক থেকে কারো কারো দৌড়ে আসার আওয়াজ বাধানো বারান্দা দিয়ে ধপধপ করতে-করতে ছুটে আসে, তারপর আচমকা থেমে যায়। বারান্দা থেকে মাঠে লাফিয়ে নেমে তারা লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘোষের হুকুমে লাইনটা চলতে শুরু করে। ঘোষ পাশে-পাশে হাঁটতে-হাঁটতে লেফট লেফট করতে করতে আর্মারির দিকে এগয়। লাইনটা যখন আর্মারির সামনে পৌঁছয় তখনো একজন এক হাতে এক জোড়া গামবুট ঝুলিয়ে খালি পায়ে জলের মধ্যে দৌড়তে-দৌড়তে লাইনের শেষে এসে দাঁড়ায়।

আর্মারি থেকে যে-যার রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে এসে আবার লাইনে দাঁড়ানো শুরু করে। আমারির ভেতরে লাইন বেঁধেই সবাই একে-একে ঢোকে, যেখানে যার রাইফেল থাকে, সেখান থেকে রাইফেলটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে আবার লাইনে এসে পঁড়াতে-দাঁড়াতে বারকয়েক ঝাঁকি দিয়ে রাইফেলটাকে কাঁধের ওপর ফিট করে নিচ্ছে। এমন-কি লাইনে দাঁড়ানোর পরও কাধ ঝাঁকিয়ে রাইফেলটা ঠিক করে নিতে হয়।

এই লাইনের প্রতিটি লোকের কাঁধে বন্দুক ওঠা মাত্রই পুরো লাইনটার চেহারা যেন পাল্টে যায়। এতক্ষণ ছিল ওয়াটারপ্রুফ, গামবুট আর টুপির লাইন। তাকালেই বৃষ্টিবাদলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বন্দুক কাঁধে উঠতেই বৃষ্টিবাদল অবান্তর হয়ে যায়। এমনকি এই যে বাতাস এই ধাঁধা লাইনের গায়ে হামলে পড়ছে আর টুপির আচ্ছাদনের ভেতরেও বৃষ্টির ছুরি বিধছে সেসব যেন রোদের মতই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতা মেনে নিয়েই এই পুরো লাইনটা রাইফেল কাঁধে তুলে নিয়েছে, আর, রাইফেল কাঁধে ওঠা মাত্রই এই বাহিনীর পেশাগত পরিচয় যেন প্রধান হয়ে ওঠে–ইন্ডিয়ার সীমান্তরক্ষার কাজ।

কম্যাণ্ড্যান্ট ঘোষকে বলে, মার্চ করাই খানিকটা নিয়া যাও, তারপর ছাড়ো।

এক জওয়ান এসে কম্যাণ্ড্যান্টের সামনে দাঁড়িয়ে তার বেল্টসহ রিভলবারটা মেলে ধরে। কম্যাণ্ড্যান্ট ওয়াটার প্রুফটা ফাঁক করলে জওয়ানটি নিচু হয়ে কম্যাণ্ড্যান্টের কোমরে বেল্টটা বাধতে থাকে। ঘোষ নির্দেশ দেয়, এই তোমরা চারজন গাড়িটা নিয়ে এসো। এ-টেনশন।

এদের পায়ে বুট ছিল না বলে খট শব্দটি উচ্চকিত হল না। কিন্তু এখানে আর সেই আগের বারের মত দৌড়োদৌড়ি হুড়োহুড়ি পড়ল না। সবাই যে-যার জায়গায় দাঁড়িয়েই ছিল। ঘোষের নির্দেশে পুরো লাইনটা এক ছন্দে চলতে শুরু করল। তাদের ডান ঘাড়ের ওপরের শূন্যতায় মাথার পাশে রাইফেলের নল দুলে ওঠে, দলের চলার ছন্দ মেনে দুলে ওঠে।

পুরো লাইনটা ঘাসবনের দিকে চলে। ঘাসবনের ভেতরে তাদের প্রথম পা ফেলামাত্র বৃষ্টিতে নুয়ে পড়া ঘাসে ঢাকা-পড়ে-থাকা পথটা পায়ে-পায়ে তৈরি হয়ে যেতে থাকে।

.

১১৪.

বন্যার বাতাসের মুখে দুটি পাঁঠা

 ঘাসবনের ভেতর পুরো লাইনটা ঢুকে গেলে ঘোষ অর্ডার দেয়া বন্ধ করে। লাইনটা কিন্তু চলতে থাকে যেন অর্ডার দেয়া হচ্ছে এমন তালে-তালেই। এই পথটাতে লাইন ভেঙে চলার মত জায়গা নেই। এইটুকু সময় তালে-তালে পা ফেলার অভ্যেস কিছুক্ষণ থাকে। ধীরে ধীরে বাতাসের ধাক্কায় ওয়াটারপ্রুফের কলার আর ঝুল ফতফত করে আছড়ে পড়ার আওয়াজ ওঠে। ধীরে-ধীরে তাদের পা ফেলার একটা সমবেত আওয়াজ শোনা যায়। এবং আরো ধীরে এই লাইনটার শাস ফেলার একটা। আওয়াজও এই বাতাসের মধ্যে আলাদা হতে থাকে।

যে রাস্তাটা এখন ঘাসে ঢাকা সেটা পায়ে চলা রাস্তা নয়। বর্ডার ক্যাম্প থেকে পাথর আর ইটের টুকরো ফেলে পিটিয়ে রাস্তাটা তৈরি করা হয়। বছরে একবার রাস্তাটার মেরামত হওয়ার ফলে ভৈঙেচুরে যায় না। লাইনের পেছনের গাড়িটা দুজন ঠেলছে, দুজন টানছে। তাদের বন্দুকগুলো গাড়ির ভেতর রাখা হয়েছে। গাড়িটার ওপরে ত্রিপলের ঢাকনাটা বাতাসে ফুলে ওঠে বটে কিন্তু ওড়ে না-এক-এক দিকে তিনটে স্কুর মধ্যে পাত দিয়ে মোড়া ত্রিপলে ফুটোগুলো ঢুকিয়ে দেয়। পাঠাদুটো সেই ত্রিপলের তলা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তাই ত্রিপলটা বাতাস ছাড়াও নড়ছে। বাতাসের ধাক্কায় ত্রিপলটা একটু উঁচু হয়ে যাওয়ায় তার ভেতরে বাতাস ঢুকে পড়ছে–তারপর কিছুক্ষণ পাঠাদুটো চুপচাপ।

জলে ভেজা ঘাস নুয়ে পড়ে এই যে রাস্তাটাকে ঢেকে রেখেছে সেটা শেষ হওয়ার আগেই তিকার আওয়াজ কানে আসে। কম্যাণ্ড্যান্ট লাইনের পেছনে-পেছনে যাচ্ছিল। লাইনের মাঝ থেকে ঘোষ সরে দাঁড়ায়, তারপর কম্যাণ্ড্যান্টের দিকে ঘুরে বলে, নদীর আওয়াজ শুনছেন?

কম্যাণ্ড্যান্ট তখনো অত স্পষ্টভাবে নদীর আওয়াজটাকে আলাদা করতে পারে নি, সে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে ঘাড়টা দোলায়। ততক্ষণে লাইনটা আরো খানিক এগিয়ে গেছে। ঘোষ তাও চেঁচিয়ে বলে, নদীর আওয়াজ। এবার কম্যাণ্ড্যান্ট সম্মতিতে ঘাড় দোলায়।

 ঘাসবনের শেষে সেই কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরি উঁচু সেন্ট্রি বক্স। আসলে একটা ঘরই–দরজাও আছে। দরজাটা বাতাসে একবার বন্ধ হচ্ছে, আর খুলছে। কম্যাণ্ড্যান্ট একবার তাকিয়ে চেঁচায়–এই, ঐ দরজাটা আটক্যাইয়্যা দিয়্যা অ্যাসো। বলে, কম্যাণ্ড্যান্ট থামে। আবার বলে, লাস্ট কে ডিউটিতে ছিল্যা? দরজা খোলা রইখ্যাই সব চল্যা অ্যাসো? লাইনের সবচেয়ে পেছনে, কম্যাণ্ড্যান্টের সামনে যে-দুজন ছিল, তাদের বা দিকের জওয়ানটি লাইন থেকে বেরিয়ে মইয়ের মত সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। সে উঠতে-উঠতেই আরো দুবার দরজাটি খোলে ও বন্ধ হয়। কিন্তু এই সেন্ট্রি বক্সগুলো বড়বড় কাঠ। আর খুঁটি আর বড়বড় পেরেক আর নাটবল্ট দিয়ে এমন ভাবে তৈরি যে ঘরটা বাকাচোরা হয়েই থাকে। সেই কারণেই এত বাতাসেও দরজাটা খুব জোরে পড়ে না।

সেন্ট্রি বক্সের তলায় কাটাতারের বেড়ার ভেতর গেট–যে-দুজন সামনে ছিল, তার গেটের সঙ্গে খুঁটির পেঁচানো তারটা খুলে গেটটা ঠেলে দেয়। সেই ফাঁক দিয়ে দলটাকে একটু বায়ে বেঁকে বাইরে বেরতে হয়। সে রকমভাবে বেরতে গিয়ে লাইনটা ভেঙে যায়। বেরিয়ে গিয়ে কেউ আর লাইনে দাঁড়ায় না। গেট দিয়ে বেরিয়েই কেউ-কেউ ঘুরে দাঁড়ায়, কেউ হাত দুটো ওপরে তুলে আড়মুড়ি ভাঙার ভঙ্গি করে আর কেউ-কেউ ডাইনে ঘুরে হাঁটতেই থাকে–থামে না।

এই জায়গাটায় একেবারেই কাঁচা ঘাস আর ঘাসের মধ্যে কাদা। ডাইনে না বেঁকে সোজা গেলেই নদী। ঘাসবনের ভেতর দিয়ে আসার সময় বাতাসের যে-আওয়াজ উঠছিল, গেটটা পেরনোর পরই সেই আওয়াজটা যেন বদলে যায়। কিন্তু বদলাবার ত কথা নয়–একটা কাটাতারের বেড়ায় আর বাতাসের আওয়াজ বদলাবে কেন। বাতাসটা একই রকম ভাবে বইছে, বৃষ্টির ছাটও একই রকম ভাবে পড়ছে, কিন্তু এদের হাঁটাটাও বদলে গেল। এতক্ষণ লাইন বেঁধে হাঁটার একটা আলাদা আওয়াজ লি, সেটা এখন আর নেই। ঘাসে ঢাকা পথ কিছুটা দেখে-দেখে আসতে হচ্ছিল, এখন তাও করতে হবে না। ফলে, নদীর আওয়াজ আর বাতালের আওয়াজ মিলে যে ঝারব তৈরি হচ্ছে সেটা কানে আসে। আর, কান একবার এলে ত ঐ আওয়াজটাই থাকে-আর-কোনো আওয়াজ শোনা যায় না।

গাড়িটা এসে গেটে আটকে যায়। যে-চারজন গাড়িটা নিয়ে আসছিল তার ভেতর থেকে একজন এসে গেটটা ঠেলে দেয়, কিন্তু গেটটা বেশি খোলে না। আর একবার আর-একটু জোরে ঠেলতে গেটের ওপর দিকটা নড়ে, তলার দিকটা সরে না। এই গেটও ত ঐ ভাবেই তৈরি, তাছাড়া গেটটা পুরো খোলার ত দরকারও পড়ে না সাধারণত। উপেন এগিয়ে গিয়ে মাটিটা দেখে চেঁচায়, ঠেলিলেই খুলিবে নাকি? এইঠে ত মাটি উচ্যা হয়্যা আছে।

মাটিটা ক্যাটা দাও, কম্যাণ্ড্যান্ট বললে উপেন গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে মাটিটায় লাথি মারে। তাতেই নরম মাটি একটু গর্ত হয়ে যায়, গেটটা টান দিতেই কিছুটা খুলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জোয়ানরা ধাক্কা দিয়ে গাড়িটা গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়, একটু গেলেই গাড়িটা আটকে যায়। উপেনের পাশে তখন বটুক বর্মন গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে দেখে চেঁচায়, এই গেটখান উঁচু করি ধরো কেনে, ধরো উঁচু করি। বলে সে নিজেই গেটটা ধরে টেনে তোলে, উপেন হাত লাগায়, উপেনের বন্দুকটা দুলে সামনে চলে এলে সে সেটাকে পেছনে ঠেলে দেয়, আর দু-জন এসে হাত লাগাতেই গেটটা বেশ খানিকটা উঁচু হয়, পেছনের জোয়ানরা গাড়িটা ঠেলে দেয়, গাড়িটা এগিয়ে আসে কিন্তু চাকাটা আটকে যায়। উঁচু করে ধরে থেকেই উপেন চেঁচায়, ঐ দিকোটা টানি নেন আর এই দিকোটা ঠেলেন। গাড়ির বাঁ দিকটাকে ভেতরে ঢোকানোর জন্য দুই জোয়ান-টানে কিন্তু গাড়িটা কাত হয় না। কমান্ড্যান্ট গিয়ে উল্টোদিক থেকে ঠেলা দিতে শুরু করে। কমাণ্ড্যান্টের সঙ্গে আরো দুজন হাত লাগাতেই গাড়ির জোয়ালটা হট করে বায়ে ঘুরে যায়-কারো মাথায় লাগতেও পারত, কিন্তু গাড়ির ডান চাকাটা গেট গলে বেরিয়ে আসে। এবার সবাই মিলে জোয়ালটা ধরে টানতেই গাড়িটা বা দিকে মুখ করে গেট পেরিয়ে যায়।

কম্যাণ্ড্যান্ট বলে, গেটখানা বন্ধ কইর‍্যা দ্যাও।

ঘোষ বলে, হ্যাঁ। নইলে ফ্লাডের জল ঢুকে যাবে।

কম্যাণ্ড্যান্ট বলে ওঠে, সব কথারই ত জবাব আছে ঘোষ। এই গেটটেটগুল্যা ত রোজই ভোলা বন্ধ হওয়ার কথা। সে হয় না ক্যান?

ততক্ষণে গাড়ি ঘোরানো হয়ে গেছে। আবার হাটা শুরু হয়। যারা এগিয়ে গিয়েছিল, তারা এদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘুরে আবার এদিকেই আসছে। কিন্তু গাড়িটা দেখে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর ঘুরে সোজা চলতে থাকে।

ঘোষ, সবারে কয়্যা দাও বাংলাদেশের ক্যাম্পের আগে যেন আবার লাইন হয়, মার্চ কইর‍্যা টুইকতে হবে,কম্যাণ্ড্যান্ট বলে। ঘোষ এক জোয়ানকে খবরটা দিয়ে আগের দলের কাছে পাঠায়। সে দৌড়তে শুরু করে বটে কিন্তু ওয়াটার প্রুফ আর বাতাসের ধাক্কায় এগতে পারে না।

ঘোষ, চলো নদীটা দেইখতে-দেইখতে যাই, বলে কম্যাণ্ড্যান্ট একটু কোনাকুনি নদীর দিকে হাটা শুরু করে।

এখন দলটা চার টুকরো। আগে একদল চলে গেছে। যারা গাড়িটা বের করার জন্যে গেট খোলাখুলিতে ব্যস্ত ছিল তারা একটা দল হয়ে এগয়। কম্যাণ্ড্যান্ট, ঘোষ আর দুই জোয়ান নদীর দিকে যায়। আর গাড়ি নিয়ে এখন ছয়জন চলে। যে-জোয়ানটিকে ঘোষ পাঠিয়েছিল আগের দলটাকে খবর দিতে সেই এক দলছুট ছুটছিল।

ভারতের এই সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবাংলার নানা জেলার লোজন আছে, নদীয়ারই বেশি। তা ছাড়া কমান্ড্যান্ট যেন পশ্চিমবাংলারই নয়, বাংলাদেশের। নেপালি আছে কয়েকজন, বেশ কয়েকজন বিহারিও আছে। পাঞ্জাবি ছিল জনা তিন, তারা সবে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। দহগ্রামের এই এমন এক ইন্ডিয়াতেও–যেটাকে ইন্ডিয়াই ফ্লাডের সময় ভুলে গেছে–বোঝা যাচ্ছে ইন্ডিয়াটা অনেক বড় দেশ।

.

১১৫.

দেশের জন্যে দুঃখ

 নদীর কাছ পর্যন্ত কম্যাণ্ড্যান্টকে আর যেতে হয় না, তার আগেই কোনো-কোনো জায়গায় নদী তাদের কাছে চলে আসে। এই মাঠ ত আর সমান না, কোথাও বেশ নিচু, কোথাও উঁচু। সেই সব নিচু জায়গায় নদীর জল ঢুকে গেছে। আর সেইসব জায়গায় জল যেরকম তোড়ে ঢুকছে তাতে মনে হয়, আর-কিছুক্ষণের মধ্যেই এই পাড় একেবারে ভেসে যাবে। কম্যাণ্ড্যান্ট এরকম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখে নদীর জল এসে ঐ নিচু জমির কিনারায় ঘা মেরে আবার ফিরে যাচ্ছে, আবার নতুন স্রোত এসে ঘা মারছে।

ঘোষ, দেইখছ কাণ্ডখান!

হ্যাঁ, এখানে এরকম জল, মানে আমাদের ক্যাম্পের উত্তরে দক্ষিণপাড়া ত ভেসে গেছে এতক্ষণ?

কই, ওরা যে ক্যাম্পে আইস্যা উইঠবে কইল, এ্যালো না ত!

 বুঝে গেছে যে ক্যাম্পও ভাসবে, তাই অন্য কোথাও গিয়ে উঠেছে হয়ত!

আর কুথায় উইঠবে? আর ত সব ফরেন ল্যাণ্ড?

ফরেন ল্যাণ্ডেই গেছে এতক্ষণ! না গিয়ে ভাসবে নাকি?

ওরা নদীর আরো কাছে যাবার জন্যে দু-চার পা এগিয়েই থেমে পড়েনদীর এপার-ওপার ত দূরের কথা, সামনে একটু দূরেই নদীটা আর দেখা যাচ্ছে না। নদীর খোলা বুকের ওপরে আকাশ আর নদী এখন আলাদা করা যায় না-বাতাস সেই অবকাশ দিয়ে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে নদীর মতই বেগে কিন্তু বিপরীত মুখে। সেই বাতাসে বৃষ্টির ধারাপাত আর মাটিতে নামছে না বাতাসে কাত হয়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে, আকাশেই আবর্ত তৈরি করছে। আর তাতে নদীর বুকের ওপর এমন কুয়াশা তৈরি হয়েছে যে, কিছু দেখা যাচ্ছে না। নদীর স্রোত চলছে মাটির ঢাল অনুযায়ী। অত জল অতখানি ঢাল বেয়ে যখন গড়াচ্ছে তখন তার একটা আলাদা আওয়াজ ওঠে, আকাশ গমগম করে। কিন্তু এখন ত সে আওয়াজটাও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বিপরীতমুখী বাতাসের ধাক্কায়। বাতাসের স্রোত.আর জলস্রোতের সংঘর্ষে যে-আওয়াজ উঠছে তাতে মনে হয় নদী তার খাত থেকে উঠে এসে নতুন খাত তৈরি করে ফেলবে।

দূর থেকে একটা চিৎকারের মত ভেসে আসে। কম্যাণ্ড্যান্ট জিজ্ঞাসা করে, কিসের চিৎকার? একটু কান পেতে শোনে ঘোষ, তারপর বলে, চিৎকার না, গান গাইছে, আমাদের ছেলেরা।

তা হালে তাড়াতাড়ি চলো, না হইলে আবার অন্ধকার হইয়্যা যাব। তোমাদের সঙ্গে টর্চ লাইট আছে ত? কম্যাণ্ড্যান্ট জিজ্ঞাসা করে।

হা স্যার, আছে, একজন জোয়ান ওয়াটারপ্রুফের বোতাম খুলে টর্চটা দেখাতে গেলে কম্যাণ্ড্যান্ট বলে, থাক, থাক, থাইকলেই হইল।

ওরা নদীর পাড় ধরেই একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে। তাড়াতাড়ি হাঁটতে গেলে বাতাসের ধাক্কা জোরে লাগে, পা পেছিয়ে যায়, বুক আর ঘাড়টা এগিয়ে আসে। ওরা ঘাড়টা নিচু করে হাঁটে-মুখে যাতে বৃষ্টির ছাট কম লাগে। কম্যাণ্ড্যান্ট হাত দিয়ে একবার মুখ মুছে নেয়। এই বাতাস আর বৃষ্টির বিপরীতে এদের ঐ চলা দেখে বোঝা যায় এদের প্রত্যেকেরই স্বাস্থ্য কী রকম পেটানো। সেই স্বাস্থ্যই নিশ্বাসের আওয়াজে প্রমাণিত হয়ে ওঠে–চারজনের নিশ্বাসের আওয়াজ এই বাতাসনদীর আওয়াজের ভেতরেও শোনা যায়। কখনো কখনো তাদের ছোট-ছোট খাড়িমত পার হতে হচ্ছিল নদীর জল যেখানে ছোট-ছোট নালী দিয়ে ঢুকে পড়ছে।

 একটু এগিয়ে তারা গাড়িটা গায়। পাঠাদুটো তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। তাদের আর গাড়িটার মাঝখানে বেশ খানিকটা মাঠ। চেঁচালে শুনতে পাবে না। ঘোষ বলে, পাঠাদুটোকে বোধহয় ত্রিপল চাপা দিয়েই মেরে ফেলল। এই, ওদের গিয়ে বলো ত ত্রিপলের ঢাকনাটা খুলে দিতে।

একজন জোয়ান ছুটে গেলে কম্যাণ্ড্যান্ট ডাকে, ঘোষ।

ঘোষ কোনো জবাব দেয় না। কিন্তু কম্যাণ্ড্যান্ট যখন কিছু বলে না, ঘোষ জিজ্ঞাসা করে, কিছু বলছিলেন নাকি?

কম্যাণ্ড্যান্ট হাঁটতে-হাঁটতে ঘোষের দিকে তাকায়। কিন্তু কিছু বলে না। এরা বেশ তাড়াতাড়িই হাঁটছিল। শ্বাসের আওয়াজ উঠছে জোরে-জোরে। কম্যাণ্ড্যান্ট কিছু ভাবছে।

কম্যাণ্ড্যান্ট আবার ডাকে, ঘোষ।

এবার ঘোষ বলে, বলুন।

আজ ত পাঠাটাঠা কাইট্যা পিকনিক হবে নে। হ্যাঁ। তা ত হবে। ওরা ত নেমন্তনই করেছে। আমাদের পাঠা কি আর আমাদের খাওয়াবে?

সেই জোয়ানটা গাড়ির কাছ থেকে ফিরে আসছে। এবার বাতাস পেছনে বলে, একটু তাড়াতাড়িই।

হ্যাঁ। আজ না হয় অগ পাঠাই খ্যাইলা। কাইল ত তোমাগো পাঠা খাইতে হব। অগ ত আর পঁঠার ফরেস্ট নাই।

হ্যাঁ। তা, নাই। বলছেন কাল দুপুরেও এ-বৃষ্টি ছাড়বে না?

 না-ছাড়লে ত বাইল্যা। বাংলাদেশের ক্যাম্পেই থাইক্যা যাবা নে। ছাইড়লে যাবা কোথায়? জল দেইখল্যা না? রাত্তিরের মধ্যে সব ভাইস্যা যাবে।

 হ্যাঁ। সেরকমই ত মনে হয়। এদিককার নদীগুলো বড় গোলমেলে। আমাদের ওদিকের নদীগুলো দেখে আপনি বুঝতে পারবেন, টাইম পাবেন। কিন্তু এ ত একেবারে ট্রেচারাস। কোনো আন্দাজই পাবেন না।

আরে, তোমাগো দ্যাশে বৃষ্টির জলে ফ্লাড়, আর এ্যাখন ডিভিসির জলে।

এখানে ত ডিভিসিও নাই, শুধুই বৃষ্টি।

ওরা দ্বিতীয় দলটাকে পেরয়। কম্যাণ্ড্যান্ট, ঘোষ, দুই জোয়ান যাচ্ছে নদীর পাড় দিয়ে আর উপেনদের দলটা যাচ্ছে আর-একটু ভেতরে দিয়ে। কম্যাণ্ড্যান্টদের চলার গতি দেখে ওরাও তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে।

এখানে পাহাড় আছে। পাহাড় ভাইঙ্গ্যা জল এখানে নামে। শোনো, কই কি, এই গাড়িটা আবার ফেরত পাঠাও। চাইল আর ডাইল আর আলুগুলা নিয়্যা আসুক। এদের ক্যাম্পে কয়দিন থাইকতে হব, কে জানে? আর আমাগো ক্যাম্পে জল ঢুইকলে ত চাইল সব নষ্ট হইয়া যাবে নে।

সব চাল আনতে বলেন?

 পারলে তাই। না-পারলে, যা পারে।

ঘোষ একবার পেছন ফিরে দেখে, তারপর সামনে তাকায়, এই কাদামাটিতে অত লোড নিয়ে কি এই গাড়ি আসতে পারবে? ফেঁসে যাবে।

কম্যাণ্ড্যান্ট কোনো জবাব না দিয়ে হেঁটে যায়। তারপর বলে, গাড়িতে যেকয় বস্তা পারবে গাড়িতে আনুক, আর না-হয় ত জোয়ানরা কাঁধে কইর‍্যা আনুক।

এতটা রাস্তা?

যা পারে তাই আনুক ত।

ওরা সামনের দলের কাছে পৌঁছে যায়। তারা দাঁড়িয়েই ছিল। একটু দূরে বাংলাদেশের ক্যাম্প, সবুজ টিন দেখা যাচ্ছে–সেন্ট্রি বক্স। এখান থেকেই লাইন করতে হবে। সবাই মিলে পেছনের লোকজনের জন্যে অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে আর বাংলাদেশের ক্যাম্পের দিকে তাকিয়ে দেখে। ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মাত্র এইটুকু দূরত্বে এসে যেন কিছুটা অসহায় বোধ করে ফেলে, এবার সত্যি সত্যি তাদের দেশ ছেড়ে যেতে হচ্ছে। এরা যেমন, সামনে, বাংলাদেশের ক্যাম্পের দিকে তাকায়, তেমনি, পেছনে, তাকায় যে-পথটা দিয়ে তারা এল, সেই পথের দিকেও। ঐ পথেই ত ইন্ডিয়া, তাদের দেশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *