অধ্যায় ২১
খুব বেশি বদলায়নি জায়গাটা, শেষবার যখন দেখেছিল তারচেয়ে একটু বদলেছে, সেটা শুধু এই শুন্য উঠোনটায় দাঁড়ালেই বোঝা যায়। উঠোনের চারপাশে যে ঘরগুলো ছিল তার একটাও অবশিষ্ট নেই। আগুনে পুড়ে কয়লার মতো হয়ে গেছে। তার নিজের ঘরটা প্রায় নিশ্চিহ্ন। এখানেই জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে তার, খুব সুন্দর ছিল সেইসব দিনগুলোে। এক বৃদ্ধের মমতার ছায়াতলে কিশোর একটি ছেলে ভুলে থাকতে পেরেছিল তার অতীত, তার পরিবার, শিক্ষিত হয়েছিল নানাজ্ঞানে। আজ এতোদিন পর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল মিনোসের। সেদিন সকালে পালানোর পর আজ সে ফিরে এসেছে। নতুন এক উদ্দেশ্যে। তার অভিভাবক বৃদ্ধের শেষ ইচ্ছে পূরন করার দায়িত্ব নিয়ে। এখান থেকেই শুরু করতে হবে। ম্যাপটা মাথায় গেঁথে নিয়েছে মিনোস। সেই আলোর সন্ধানে বের হতে হবে, দেরি করার মতো সময় হাতে নেই।
বৃদ্ধ মরে গেছে, মিশে গেছে মাটির সঙ্গে, তার দেয়া শেষ চিহ্নগুলোই এখন পর্যন্ত মিনোসের সম্বল। অতিমানব হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে তার হাতে সপে গেছে জীবনের শেষ সঞ্চয়। এতো চমৎকার মানুষের দেখা আর কখনো পাবে কি না সন্দেহ আছে মিনোসের। উঠোনের একপাশে গিয়ে বসল সে। আশপাশে আগে কিছু বাড়িঘর ছিল, এখন জায়গাটা বিরানভূমি, যেন কোনকালেই এখানে কোন মানুষ বাস করতো না।
সাথে কিছু ফল ছিল, সেগুলো খেয়ে নিলো মিনোস। তারপর হাঁটা শুরু করলো, নদী তীরের উদ্দেশ্যে। কতোদিনের যাত্রায় বের হয়েছে সে নিজেই জানে না, বৃদ্ধের বলা কথাগুলো সত্যি ছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার। বৃদ্ধকে কখনো মিথ্যে কথা বলতে শোনেনি সে। যাত্রাটা শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে, অনেকটা সময় বৃথাই নষ্ট হয়েছে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানোতে।
উঠে দাঁড়াল মিনোস, বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। রওনা দেয়ার জন্য উপযুক্ত সময়, নদী তীরে গিয়ে আগে একটা নৌকা যোগাড় করতে হবে। সন্ধ্যার এই সময়টায় সাধারনত কেউ থাকে না নদীর আশপাশে। সৌভাগ্যক্রমে কোন নৌকা যদি পাওয়া যায় তাহলে এখুনি রওনা দেবে সে, পাওয়া না গেলে তৈরি করে নিতে হবে নিজ হাতে।
নদীটাও বদলায়নি,সেই আগের মতোই ধীর গতিতে বয়ে চলেছে। পুরো মিশরের জন্য আশির্বাদ এই নদী। অদূর ভবিষ্যতে এর তীরে গড়ে উঠবে আরো বড় শহর, এই ধারনা সত্যি হবে কি না তা এখনো জানে না মিনোস। এখন পর্যন্ত লক্ষ্যহীন এক জীবন নিয়ে চলছে সে, কিন্তু এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, নদীর আশপাশে কাউকে দেখা গেল না। একটু দূরে একটা ভেলা বাঁধা আছে, সম্ভবত পরিত্যক্ত, অনেকদিন কেউ ব্যবহার করেনি। এগিয়ে গেল মিনোস। বেশ কয়েকটা গাছের গুঁড়ি এক করে বানানো হয়েছে ভেলাটা, এক ধরনের গাছের আঁশ দিয়ে বাঁধন দেয়া হয়েছিল, যা এখন প্রায় খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। একে ব্যবহার উপযোগী করতে কিছুটা সময় লাগবে, অন্তত একদিন তো লাগবেই। আজ রাতে তাই নদীর আশপাশে কোথাও ঘুমিয়ে নেবে বলে ঠিক করলো মিনোস। সকালে উঠে মেরামত করে নিলেই হবে। নদীর পাড় থেকে কিছু দূরে বড় একটা গাছ বেছে নিলো সে, এরকম খোলা জায়গায় ঘুমানো বিপজ্জনক, বিশেষ করে সাপের ভয় আছে। কিন্তু আর কোন উপায় নেই। রাতে এখানেই ঘুমাতে হবে…।
পিঠে বিনোদ চোপড়ার হাত পড়াতে চমকে উঠলেন তিনি, চোখের সামনে ছবির দৃশ্যের মতো পুরানো দিনগুলো ভেসে উঠছিল, সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন।
বসতে পারি? পাশে বসার অনুমতি চাইল বিনোদ চোপড়া। মাথা নাড়ালেন তিনি।
পাশে বসল বিনোদ চোপড়া, শেষ বিকেলের আলোয় চেহারাটা বেশ মলিন দেখাচ্ছে। অনেকদিন থেকেই বেশ চুপচাপ লোকটা। হয়তো নিজেকে আড়াল রাখতে চাইছে, ভাবলেন তিনি।
আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, বিনোদ চোপড়া বলল।
বলুন।
প্যারিস থেকে চলে এসেছিলাম রহস্যময় একজোড়া জুতোর মালিককে খুঁজে বের করার জন্য, ড. কারসনের পিছু পিছু। তারপর আপনার সাথে রয়ে গেছি, কেন রয়ে গেছি নিজেও জানি না। অথচ প্যারিসে আমার সব আছে, বাড়ি-গাড়ি, অভিজাত শ্রেনীর মানুষের সাথে উঠাবসা।
রহস্যময় জুতোজোড়ার কথা কিন্তু আপনি আমাকে আগে বলেননি, বললেন তিনি, কিছুটা উৎসুক হয়ে উঠেছেন।
লুভর মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে এখন, ড. কারসন নাকি বাংলাদেশ থেকে জুতোজোড়া নিয়ে গিয়েছিলেন, হীরে বসানো, প্রায় চারশো বছর বা তারো আরো আগের। এতে আগের জুতো বাংলাদেশের মতো জায়গায় কেন সেটাই ছিল আমার প্রশ্ন, এর অ্যান্টিক মূল্য কোটি টাকা।
জুতোর মালিক কে বলে আপনার ধারনা?
বেশ ঘাটাঘাটি করে জানলাম সেইন্ট জারমেইন বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, ঐ ধরনের জুতো এক জোড়া ছিল তার, প্যারিসে বেশ নাম করেছিলেন তিনি একসময়, অভিজাত সমাজের মধ্যমনি হয়ে উঠেছিলেন। উনাকে নিয়ে নানা মিথ প্রচলিত আছে।
যেমন?
তিনি অমর, বলে একটু চুপ থাকল বিনোদ, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে, ধন্যবাদ, আমি ভেবেছিলাম আপনি হেসে উড়িয়ে দেবেন। আসলে আরো কিছু কথা প্রচলিত আছে, যেমন তিনি…
কয়েকটা ছোট হীরে মিলিয়ে অনেক বড় হীরে বানাতে পারতেন, অনেক প্রাচীন সব গল্প করতেন যেগুলো একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীর পক্ষেই করা সম্ভব, খাওয়া-দাওয়া করতেন সীমিত, কয়েকশ বছর ধরে তাকে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে, একই রুপে, ভিন্ন নামে, ইত্যাদি, বললেন তিনি, তাকালেন বিনোদ চোপড়ার দিকে, লোকটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
আপনি কি করে জানেন এতো সব? অবাক বিনোদ চোপড়া প্রশ্ন করলো।
কৌতূহল, আর কিছু না, হাসলেন তিনি। অমরত্ব খুব কঠিন ব্যাপার, মি. বিনোদ। এ ব্যাপারে মাথা না গলানোই ভালো হবে।
হু, আমারো তাই ধারনা।
আপনি এসেছেন টাকার সন্ধানে, সেই সন্ধান আপনি পাবেন, এতোটুকু বলতে পারি, বিনোদ চোপড়ার কাঁধে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
বিনোদ চোপড়া চুপচাপ বসে রইল, অদ্ভুত লোকটা চলে যাচ্ছে। বিষণ্ণতা আচ্ছন্ন করল তাকে। শুধু টাকার জন্যই সব কিছু করে না সে, কৌতূহল তার রক্তে মিশে গেছে। অ্যান্টিক শিকারিরা যদি কৌতূহলী না হয়, তাহলে সে ব্যবসায় ভালো করতে পারবে না। জানার আগ্রহই তাদের ব্যবসার মূল ভিত্তি।
বিনোদ চোপড়া কৌতূহলী। এই লোকটা সেই কৌতূহল আরো অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
*
অধ্যায় ২২
আহমদ কবিরকে জানালা দিয়ে হোটেলে ঢুকতে দেখল রাশেদ, হাতে একটা খাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নিজের অজান্তেই। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বড় একটা বোঝা নেমে গেছে। রাজুকে ইশারা করলো তৈরি হয়ে নিতে। আহমদ কবির যে কোন সময় রুমে আসবে বলে আশা করছে।
রাশেদ তৈরি হয়েই ছিল, দরজায় নক হওয়ার সাথে সাথে খুলে দিলো। যা আশা করছিল, তাই। আহমদে কবির দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা খাম নিয়ে, হাসি মুখে।
বিনে পয়সায় কাজটা করে দিলাম, বুঝলে? রাশেদের হাতে খামটা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন আহমদ কবির।
এতো তাড়াতাড়ি কাজটা হবে, ভাবিনি, রাশেদ বলল।
তোমরা যাচ্ছো কবে? একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন আহমদ কবির।
কোথায়?
যে জন্য এই পাস নিয়ে এলাম, হাসলেন আহমদ কবির, এক্ষুনি ভুলে গেলে?
আসলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল রাশেদ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে যখন আহমদ কবিরকে আসতে দেখছিল, তখন আরো কিছু চোখে পড়েছিল, কি সেটা এখন মনে পড়ছে না।
ও, হ্যাঁ, তিব্বত, কালই রওনা দেবো, রাশেদ বলল।
কিভাবে যাবে জানা আছে তো?
হ্যাঁ, ঝাংমু দিয়ে যাবো, কোদারি গ্রাম হয়ে, রাশেদ বলল।
আমারো ইচ্ছে ছিল তিব্বত যাওয়ার, কিন্তু যাওয়া হবে না মনে হচ্ছে, একটু বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন আহমদ কবির।
আপনি আমাদের সাথে যেতে পারতেন, রাজু বলে উঠলো ওপাশ থেকে, সে তৈরি, বাইরে যাওয়ার জন্য।
ন-না, তোমরা যাও, আমি বয়স্ক মানুষ, ঝামেলায় ফেলবো, আহমদ কবির বললেন, জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাকালেন বাইরের দিকে।
আসলেই আপনি গেলে খারাপ হতো না, এই এলাকা আপনি ভালো চেনেন, রাশেদ বলল।
না, বাদ দাও। আমার আসলে কিছু কাজও ছিল, জানালা থেকে সরে দাঁড়ালেন আহমদ কবির। তোমরা খেয়েছো?
এখনো খাইনি,বাইরে যাচ্ছি খেতে, রাজু বলল।
ঠিক আছে, যাও তোমরা, আমি একটু রুমে যাই, বলে চলে গেলেন আহমদ কবির।
লোকটার মধ্যে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে, যেন স্থির হতে পারছে না, ভাবল রাশেদ।
খাম খুলে পাসগুলো দেখল, লাসা আর সিগটসে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে, অন্য কোথাও যেতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, যতোটুকু শুনেছে রাশেদ, সেই অনুমতি সহজে মেলে না। চায়নীজ সরকার তিব্বতকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রন করছে যেন বাইরের কোন প্রভাব এখানে না পড়ে। সাধারন জনগণ যেন পর্যটকদের খুব বেশি সান্নিধ্যে আসতে না পারে। এছাড়া সীমাবদ্ধ এলাকায় চলাচলের অনুমতি দেয়া মানে অন্য এলাকায় দেখা গেলে সেটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। অদ্ভুত সব নিয়ম-কানুন, ভাবলো রাশেদ।
রাজু তৈরি, বেরিয়ে পড়লো রাশেদ। কাঠমুন্ডুটা একটু ঘুরে দেখা দরকার, আগামীকাল তিব্বতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে কাঠমুন্ডু ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা নাও হতে পারে। বের হওয়ার সময় দুজনের কোমরে পিস্তলগুলো নিতে ভুলল না যেগুলো গতরাতে প্রশান্ত থাপার বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে পেরেছিল।
***
ন্যাশনাল হাইওয়ে মাখনের মতো মসৃন, চীনা ইঞ্জিনিয়ারদের অনবদ্য সৃষ্টি। গত এক দশকে তিব্বতকে চীনার সাথে যোগ করার জন্য প্রায় অসাধ্য সাধন করেছে এই ইঞ্জিনিয়ারের দল। দুই পাশে উঁচু পাহাড়, মাঝখানে একটা রেখার মতো সোজা, কখনো এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তাটা। এই হাইওয়ে ধরে তিব্বত থেকে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। সেজন্য ধন্যবাদ ওরা অবশ্যই পাবে, মনে মনে ভাবল সুরেশ। ভাঙ্গাচোড়া জীপটাও এখন প্রায় একশ কিলোমিটার বেগে চলছে। পেছনের জীপটার সাথে তাল মেলানোর জন্য গতি কমাচ্ছে সে মাঝে মাঝে। রিয়ার ভিউ মিররে নিজেকে একবার দেখে নিলো সুরেশ। আর দশটা ত্রিশ উত্তীর্ন তিব্বতী লোকের মাঝ থেকে তাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যাবে। এই মেকআপও একট আর্ট, ট্রেনিংয়ের একটা গুরুত্বপূর্ন জায়গা জুড়ে ছিল কিভাবে সাধারন জনগনের সাথে মিশে যেতে হবে। কেউ যেন আলাদা করতে না পারে তার আসল পরিচয়। স্থানীয় ভাষা শিক্ষা, সমাজব্যবস্থা, আচার-রীতিনীতি, এই সব বিষয়ে বিশেষ ট্রেনিংয়ের পর এরকম একটা অদ্ভুত দেশে নিজেকে নিয়ে এসেছে সুরেশ। বছরের অর্ধেকটা তার ঝামুতেই কাটে। সাধারন একজন গাড়ি চালকের বেশে, যার কোন চালচুলো নেই। পরিবারের সদস্যরা সবাই তিব্বত ছেড়ে বিভিন্ন দিকে পাড়ি জমিয়েছে, এই ধরনের একটা পরিচয় যোগাড় করতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছিল একসময়।
মাঝে মাঝে যাত্রীদের দেখে নিচ্ছে সুরেশ। ড. কারসন চোখ বন্ধ করে আছেন, গভীর মনোযোগে কিছু একটা ভাবছেন। ড. লতিকা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে, সেখানে মুগ্ধতা লক্ষ্য করলো সুরেশ। শুরুতে এই দেশে এসে এমন মুগ্ধতা তাকেও গ্রাস করেছিল। কিন্তু যে ধরনের কাজে সে অভ্যস্ত তাতে প্রকৃতির হিংস্র রুপের সাথেই তার পরিচয় বেশি। আপাত অদ্ভুত সুন্দর, বিশাল এই পাহাড়গুলো এক ধরনের মৃত্যুফাঁদ। আশপাশের একশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন লোকালয় নেই। ড. কারসন কিংবা ড. লতিকার মতো মানুষ এখানে একদিনও টিকবে কি না সন্দেহ আছে তার। ড. লতিকাকে এখন পর্যন্ত নরম-শরম মানুষ মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনে এই মেয়ে যে দৃঢ় হতে পারে তা ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে সুরেশ। বাবার বদলী হিসেবে এসেছে, এই ধরনের অভিযানে কি ধরনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন সে সম্পর্কে ভালোই ধারনা থাকার কথা মেয়েটার।
নিজের উদ্দেশ্য নিয়ে আরেকবার ভাবল সুরেশ। এখানে শুধু ড. কারসন আর দলকে নিরাপত্তা দিতে তাকে পাঠানো হয়নি,এর সাথে আরো বেশ কিছু স্বার্থ আছে। তিব্বত, চীন এবং ভারতের সম্পর্কে এক নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করতে পারে সাম্ভালা খুঁজে পাওয়া, বিশেষত শত্রু পক্ষের আগে সাম্ভালায় নিজের অবস্থান শক্ত করতে চায় ভারত সরকার, আর সেই জন্যই তাকে পাঠানো।
শিস দিচ্ছিল সুরেশ, তিব্বতি একটা গানের সুর। পেছনের জিপের দিকে নজর রাখছে একই সাথে। ড্রাইভার তার পরিচিত। যে কোন কাজে বিশ্বাস করা যায়। সন্দীপকে দেখা যাচ্ছে একটা বই খুলে বসেছে। এমনিতে কথাবার্তা বললেও গত কিছুদিন ধরে বেশ নীরব দেখা যাচ্ছে লোকটাকে।
দুপুর হয়ে এসেছে, সেই সকালে রওনা দেয়ার পর টানা চারঘন্টা গাড়ি চালাচ্ছে সুরেশ, কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল, এছাড়া ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ। ড. কারসনের দিকে তাকাল, গাড়ির হর্ন বাজালো দুবার, বিনা কারনে, সম্ভবত ড. কারসনের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য।
চোখে খুলে তাকালেন ড. কারসন।
কিছু বলবে সুরেশ?
লাঞ্চ করা দরকার, ছায়া পাওয়া যাবে এমন এক জায়গায় দাঁড়াবো, সুরেশ বলল।
ঠিক আছে, বলে আবার চোখ বন্ধ করলেন ড. কারসন।
আবার শিস দিল সুরেশ, ড. লতিকার চেহারায় বিরক্তি দেখা গেলেও থামল না।
ক্ষুধা পেয়েছে খুব, পর্যাপ্ত পরিমানে খাবার সাথে নেয়া হয়েছে, বেশিরভাগ শুকনো খাবার, সেই সাথে আছে রান্না করার যাবতীয় সামগ্রী। রান্নাটা সম্ভবত তাকেই করতে হবে, বাকিদের উপর তেমন ভরসা পেলো না সুরেশ। সামনে তাকাল, অনেক দূরে একটা জায়গা মনে ধরেছে, বেশ ছায়া আছে।
বেশ কিছু ইউক্যালিপ্টাস গাছ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে একজায়গায়, উপরের দিকে মাথাগুলো পরস্পরের সাথে মিলে গেছে, যেন নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করছে ওরা। জায়গাটা হাইওয়ের পাশেই বলা যায়, জীপগাড়িটা পার্ক করলো সুরেশ। দেখাদেখি পেছনের জীপটাও চলে এসেছে পেছনে। গাড়ি থেকে নামল সবাই।
ড. লতিকাকে দেখে খুব উফুল্ল মনে হচ্ছে, প্রকৃতির এই রুপ আগে কখনো দেখেনি,অন্তত ইউরোপ বা আমেরিকায় যে ধরনের পরিবেশ দেখে এসেছে তার চেয়ে এই রুপ একেবারে আলাদা। যেন আলাদা একটা ঘ্রান আছে, স্বাদ আছে। সুরেশ এগিয়ে গেল ড. লতিকার দিকে।
আমরা এখানে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেবো, সুরেশ বলল।
ঠিক আছে, জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে, হেসে বলল ড. লতিকা।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন ড. কারসন, হাতে দূরবীন, কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছেন মনোযোগ দিয়ে, তার পেছনেই আছে সন্দীপ। ভাবাবেগমুক্ত চেহারা, যেন পৃথিবীর কোন কিছুর প্রতিই তার কোন আগ্রহ নেই।
মাটিতেই একটা কাপড় বিছিয়ে নিয়েছে সুরেশ, সাথে কিছু খাবার নিয়ে এসেছে, প্লেটে খাবার ভাগ করে দিচ্ছে। হিসেব করে খেতে হবে, কততদিন লোকালয়ের বাইরে থাকতে হবে তার ঠিক নেই।
ড. কারসন, পেছন থেকে মৃদু স্বরে ডাকল সন্দীপ।
ঘুরে দাঁড়ালেন ড. কারসন, তাকালেন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে।
আমি বলছিলাম কি, জায়গাটা ঠিক আমার পছন্দ হচ্ছে না, সন্দীপ বলল।
কেন?
আমাদের একটু আড়ালে যাওয়ার দরকার ছিল, এরকম হাইওয়ের পাশে খাবার দাবার নিয়ে বসে পড়লাম, আমতা আমতা করলো সন্দীপ, এখানে আমাদের শত্রুর অভাব নেই। ড. আরেফিনকে যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা আমাদের পেছনে থাকতে পারে।
কথাটা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না, কিন্তু এরমধ্যে সুরেশ খাবার সাজিয়ে বসেছে।
সুরেশ, আমরা পাঁচ মিনিট বসবো, ড. কারসন বললেন, বেশ জোর গলায়।
পাঁচ মিনিট বিশ্রামে হবে? হেসে জিজ্ঞেস করলো সুরেশ।
হবে, বলে এগিয়ে গেলেন ড. কারসন, পেছনে সন্দীপ। ড. লতিকা আগেই বসে পড়েছিল মাটিতে পা কাপড়টার উপর, তার হাতে একজোড়া কমলা।
হঠাৎ সুরেশ ইশারা করলো, যেন সবাই চুপ থাকে। কী কারনে ইশারা করেছে। বুঝতে না পারলেও যে যার মতো স্থির হয়ে গেল।
আপনার দূরবীনটা দিন, সুরেশ বলল।
ড. কারসনের হাত থেকে দূরবীনটা নিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে তাকাল। তার চেহারায় চাঞ্চল্য কারো চোখ এড়াল না।
এখানে আর এক মিনিটও না, তাড়াহুরো করে খাবার-দাবার গুছিয়ে নিতে শুরু করলো সুরেশ। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। বুঝতে পারছে না কি করবে।
সবাই গাড়িতে যান, সুরেশ বলল, সেই গাড়িটা দেখতে পেয়েছি। ওদের সামনে পড়া ঠিক হবে না।
কিন্তু আমাদের… ড. কারসন বললেন, আমাদের কাছে তো পাস আছে।
আমি কাদের কথা বলছি বুঝতে পারছেন? জিপের দিকে এগুতে এগুতে সুরেশ বলল, অন্য ড্রাইভারকেও ইশারা করলো।
না।
নেপালের হাইওয়েতে যারা আমাদের উপর আক্রমন করেছিল, সন্দীপ বলল।
ওরা এখানে? ঐ গাড়ি তুমি নিশ্চিত?
এটা ওদের দেশ, নেপালে ওদের অবাধ যাতায়াত, সুরেশ বলল, গাড়ির সীটে বসতে বসতে। আর গাড়িটা আমি চিনি, বেশ কিছু জায়গায় এখনো গুলির দাগ লেগে আছে, এছাড়া নাম্বার প্লেটটা আমার মুখস্থ।
সম্ভবত ওরাই ড. আরেফিনকে ধরে নিয়ে গেছে, আমরা যদি… সন্দীপ বলল পাশ থেকে।
সন্দীপ বাবু, জিপ স্টার্ট দিতে দিতে বলল সুরেশ, আপনি গাড়িতে যান, দেরি করবেন না।
সুরেশের কথায় কিছু একটা ছিল, তাড়াহুরো করে পেছনের জীপে চেপে বসল সন্দীপ। অল্পকিছুক্ষনের মধ্যে ছেড়ে দিল জিপ দুটো। এখন গতিবেগ আরো বাড়িয়েছে সুরেশ, সামনে এমন একটা জায়গা চেনে সে, যেখানে জিপ দুটো ঢোকাতে পারলে বাইরে থেকে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
পেছনের গাড়িটা এখন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, সেই গাড়িটা যেটা নেপালের হাইওয়েতে আক্রমন করেছিল। আয়নায় ড্রাইভার আর তার পাশের আরোহীকে দেখার চেষ্টা করল সুরেশ, বেশ খানিকটা দূরে বলে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না, তবে এই লোকগুলোকে গতবার দেখা যায়নি এটা নিশ্চিত সে, বিশেষ করে গতবার যে গাড়ি চালিয়েছিল, নিশ্চিতভাবেই তার গায়ে গুলি লাগতে দেখেছিল সে। এখনকার ড্রাইভার লোকটার চেহারা একেবারেই অপরিচিত, পাশের আরোহী বয়স্ক মানুষ, তিব্বতী লামাদের মতো পোশাক পরনে।
এই ধরনের লোকদের সাথে একজন লামার কী কাজ, তার তো থাকার কথা কোন বৌদ্ধ মন্দিরে কিংবা পাহাড়ি গুম্ফায়?
গতি আরো বাড়াল সুরেশ। দেখা যাক কে জেতে।
***
কাঠমুন্ডুতে নেমেছেন কিছুক্ষন হলো। সঙ্গি সোহেল গেছে ডলার ভাঙ্গাতে, এয়ারপোর্টের এক কোনায় দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখে নিচ্ছেন তিনি। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসতে পেরেছেন কাঠমুন্ডুতে। প্রথমে গিয়েছেন কোলকাতা, সেখান থেকে কাঠমুন্ডু। তার আর নিজের জন্য নতুন পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে রেখেছিল সোহেল আগে থেকেই। নতুন পাসপোর্ট অনুযায়ী এখন তারা ভারতীয় নাগরিক। কাজটা করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে সোহেলকে, ছেলেটার একটা গুনের প্রশংসা করেন তিনি মনে মনে। কোন কাজ ধরলে শেষ না দেখে ছাড়ে না, এই পাসপোর্ট জোড়ার জন্য বেশ কষ্ট করতে হয়েছে ছেলেটাকে। এর পুরষ্কার সোহেলকে দেবেন তিনি। বাধ্যদের সবসময়ই পছন্দ করেন তিনি, অবাধ্যদের জন্য রয়েছে চরম শাস্তি।
পার্কিং লটে লোকটার থাকার কথা, অথচ আসেনি। সময় নষ্ট করা একদমই পছন্দ করেন না তিনি। সোহেলকে দেখতে পেলেন দূরে, হন্তদন্ত হয়ে আসছে।
কবির ভাই চলে এসেছে প্রায়, হাপাতে হাপাতে বলল সোহেল।
এখনো প্রায়? শান্ত স্বরে বললেন তিনি।
চুপ করে রইল সোহেল, বস যখন রেগে যায় তখন কথা না বলাই ভালো, এটা সে জানে।
আর খবর কী?
প্রশান্তকে দিয়ে যে কাজটা করাতে চেয়েছিলাম, সেটা ব্যর্থ হয়েছে, মাথা নীচু করে বলল সোহেল।
নিজেকে কোনরকম শান্ত রাখলেন তিনি। তার বর্তমান নামের সাথে অবশ্য এই রুপের কোন মিল নেই, পাসপোর্টে তার নতুন নাম রুদ্রপ্রতাপ সিং। সোহেল নিজের নাম নিয়েছে অভিজিত সাহা।
এবার দূরে লোকটাকে দেখলেন তিনি। অনেকদিন পর দেখলেন, সবসময় ফোনেই যোগাযোগ হয়, আহমদ কবির একটা ট্যাক্সি ক্যাব থেকে নামল, ভাড়া মিটিয়ে প্রায় দৌড়ে চলে এলো।
রাত হয়ে গেছে, রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। কাঠমুন্ডু শহরটাকে চমৎকার দেখাচ্ছে।
ওরা এখন কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
হোটেলেই আছে।
ঠিক আছে।
একটা কথা বলতে চাইছিলাম, আমতা আমতা করে বলল আহমদ কবির।
আকবর আলী মৃধার সামনে এলে সাধারনত এমন হয় তার, যদিও বহুদিন দেখা নেই। দেখা যাচ্ছে পুরানো অভ্যাসটা যায়নি।
কী?
ওরা তিব্বতে যাচ্ছে, আগামীকাল সকালে, আহমদ কবির বলল।
তিব্বতে কেন?
তা জানি না।
তিব্বতে যাওয়া হবে না ওদের, আজ রাতেই যা করার করতে হবে, বললেন তিনি, আমরা কোন হোটেলে উঠছি? সোহেলের উদ্দেশ্যে বললেন।
হোটেল ঠিক করা আছে, সোহেল বলল।
সোহেলকে ইশারা করলেন, আহমদ কবিরের ট্যাক্সি দাঁড়ানোই ছিল, সোহেল দরজা খুলে দিলে তিনি উঠে পড়লেন। সোহেল আর আহমদ কবির সঙ্গি হলো তার।
*
অধ্যায় ২৩
একটার পর একটা পাপ করেছে সে একসময়, সেই পাপগুলো এতোদিনে হয়তো মুছে গেছে, আবার হয়তো মুছেও যায়নি। সেই পাপ তার রক্তে মিশে আছে। সারাজীবন তপস্যা করলেও হয়তো মুক্তি মিলবে না, কিন্তু হাল ছাড়েনি সে। নিজেকে বদলে ফেলেছে আমূল। তাতেও কি কাজ হয়েছে? পাপের যে মূলবিষয়গুলো সেগুলো কী মন থেকে মুছে ফেলা গেছে, লোভ-কাম-ঘৃনা? মনে হয় না। এখন যে কর্মকান্ডের সাথে সে জড়িত আপাত দৃষ্টিতে দেখলে তাকে নিঃস্বার্থ হয়তো বলবে সবাই, কিন্তু আসলেই কি তার কোন স্বার্থ নেই? দিনের পর দিন অচেনা, উদ্ভট এক লোকের পেছনে অযথাই ঘুরে বেড়াচ্ছে? একদম না। বরং সবকিছু তার প্ল্যান করা। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, অন্তত লোভ জিনিসটা যায়নি তার ভেতর থেকে। হ্যাঁ, লোভই তার বড় পাপ, এই লোভের কারনেই আজ তার এই পরিণতি। এভাবে তিলে তিলে মরে যাবার চেয়ে একবারে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিল। যে মানুষটার কাছে তার পরিবার-পরিজন, বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র অর্থহীন, তার জন্য মৃত্যুই আসলে একমাত্র সমাধান। নিজের লোভকে বাঁচাতে গিয়ে সর্বস্ব হারাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সেই লোভ আর পূরন হয়নি। আসলে লোভ এমন একটা মানবিক বৈশিষ্ট্য যা ত্যাগ করা প্রায় অসম্ভব। যদিও সেই পথে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিল সে। কিন্তু তখনই দেখা হলো এই অদ্ভুত লোকটার সাথে, যার পেছন পেছন সুদূর মেঘালয় থেকে এই তিব্বত পর্যন্ত চলে এসেছে সে।
তার লোভ একটাই, সাম্ভালা? না। তার লোভ সম্রাট অশোকের অজানা নয়জন রহস্যমানব নিয়ে, ওরা যে গুপ্তজ্ঞান ধারন করেন তা হাসিল করাই এখন তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
যে জীবন সে বেছে নিয়েছে তাতে আগের জীবনের কথা ভুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু চাইলেই কি সব ভোলা যায়? বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চমৎকার একটা পরিবার ছিল তার। নিজের লোভের কারনে, নিজের ভুলে সব হারাতে হয়েছে তাকে। লন্ডন থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল ভারতে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক মাফিয়ার লাখ ডলার আত্মসাতের দায় মাথায় নিয়ে, তারপর একসময় দিল্লির গলি-ঘুপচিতে ছোটখাট ছিনতাই। মাস্তানি করে বেড়ানো জগা হয়ে উঠেছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের অঘোষিত রাজা। কিন্তু এই অঘোষিত রাজার প্রতিদ্বন্ধী ছিল, তারা সুযোগ খুঁজছিল জগাকে সরানোর। তার নিজের ঘনিষ্ট কয়েকজন বন্ধু হাত মিলিয়েছিল ওদের সাথে। জগা যখন আরো বড় বড় দানের স্বপ্নে বিভোর শত্রুপক্ষ অতর্কিতে আক্রমন করলো তার দূর্বল জায়গায়। পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন করে দিলো। প্রান নিয়ে কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছে জগা। চেয়েছিল ফিরে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে, কিন্তু তা আর নেয়া হয়নি। উলটো তার জীবনটাই বদলে গেল এক রহস্যময় গুরুর সংস্পর্শে এসে। নিজেকে সমাজ, সংসার থেকে গুটিয়ে নিলো জগা। সাধু-সন্ন্যাসীর জীবনে আকষ্ট হয়ে নিজে সেই বেশ ধারন করল, একসময় তার নাম হয়ে গেল যজ্ঞেশ্বর, এমন একজন সন্ন্যাসী যার অতীত বলে কিছু নেই, কোনকালে ছিলও না।
কিন্তু তাই বলে কী কিছুই মনে নেই? একমাত্র শিশু পুত্রের হাসিমুখ এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় সে। বুকে কষ্টের আলোড়ন হলেও নিজেকে স্থির রাখতে পারে সে, না পেরে কোন উপায়ও নেই। সে জীবনে আর ফিরে যেতে চায়নি যজ্ঞেশ্বর, বরং কাঙ্গালের মতো দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানোতেই এখন সব আনন্দ।
তারপরও একটা আকর্ষন তার আছে, যে গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিল সে, তিনিই বলেছিলেন অদ্ভুত একটা দলের কথা। যাদের সদস্য সংখ্যা নয়, সম্রাট অশোকের আমল থেকেই তারা বেঁচে আছে তিব্বতের কোন এক অঞ্চলে, দুহাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। মানবকল্যানই তাদের প্রধান লক্ষ্য, মানবজাতি যখনই কোন বিপদের সম্মুখীন তখনই তারা সমাধান নিয়ে হাজির হয়। সেই সমাধান তারা নিজেরা করে না, মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। এই নয়জনের কাছে আছে গুপ্তজ্ঞান, যে জ্ঞান ধারন করতে পারলে যাবতীয় দুঃখকষ্টকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়।
আশপাশে তাকাল যজ্ঞেশ্বর। একটু দূরে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে লখানিয়া সিং, নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরের কোন পাহাড়চূড়ার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কেমন ঘোর লাগা ভাব আছে। বিনোদ চোপড়া বিষয়ী মানুষ। সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে সেই বা কেন তাদের সাথে যাচ্ছে ভেবে অবাক হয় যজ্ঞেশ্বর।
দুপুরের এই সময়টা বিশ্রামেব। যজ্ঞেশ্বর পদ্মাসনে বসে ধ্যানে বসেছে। কিন্ত তার মন আজ বিক্ষিপ্ত, কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না ধ্যানে। সেই মেঘালয় থেকে যাত্রা শুরু করে অনেকদূর আসা হয়েছে, তার মন বলছে গন্তব্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন দরকার লখানিয়া সিংয়ের পূর্ন বিশ্বাস, যদিও এতোদিন একসাথে থাকার পর মনে হয়েছে লখানিয়া সিং অন্তত তার ক্ষতি করবে না। কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন কাজ, এর মাশুল তাকে দিতে হয়েছিল পুরো পরিবারকে হারিয়ে। এছাড়া বিনোদ চোপড়াও আছে, তার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুব একটা ধারনা না থাকলেও একটা বিষয়ে নিশ্চিত যজ্ঞেশ্বর, অর্থ সংস্থানের বড় কোন উৎসের খোঁজ না পেলে মিছে মিছে সময় নষ্ট করতো না বিনোদ। সবকিছু বুঝেও লখানিয়া সিং কেন চুপ মেরে আছে এটাই মাথায় ঢোকে না যজ্ঞেশ্বরের। লোকটা সব জানে, টের পায় কিন্তু প্রকাশ করে না।
আর ঘন্টাখানেক বসে থেকে উঠে দাঁড়াল যজ্ঞেশ্বর, পাহাড়ের এই জায়গাটা থেকে আশপাশের এলাকা পরিস্কার দেখা যায়। পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে এই হাইওয়ে, রাস্তাটা সাপের মতো একেবেকে দূরে কোথায় গিয়ে মিলেছে তা বোঝা যায় না এতোদূর থেকে। রাস্তা প্রায় খালি বলা যায়, অনেক দূরে দুটো জিপ। চোখে পড়লো তার।
যজ্ঞেশ্বর জী, কি দেখছেন অমন করে? প্রশ্ন শুনে পেছনে তাকাল যজ্ঞেশ্বর, লখানিয়া সিং তার পেছনে দাঁড়ানো, এতো দ্রুত আর নিঃশব্দে কিভাবে তার পেছনে এসে দাঁড়ালো লোকটা ভেবে অবাক হলেও প্রকাশ করলো না।
যতোদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়, এরমধ্যে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
সময় হলেই জানতে পারবেন, যজ্ঞেশ্বরজী, আমাদের সবার উদ্দেশ্য সফল হবে।
সবার উদ্দেশ্য? ঠিক বুঝলাম না, বলল যজ্ঞেশ্বর, মুখে অবাক হওয়ার ভাব ফুটিয়ে তুলল, লখানিয়া সিং অস্বস্তিকর কোন প্রসঙ্গের অবতারনা করুক তা সে চাচ্ছে না।
আমাদের সবারই নিজ নিজ লক্ষ্য আছে, উদ্দেশ্য আছে, মানবজন্ম তো আর উদ্দেশ্যহীন নয়, নাকি? উলটো প্রশ্ন এলো লখানিয়া সিংয়ের কাছ থেকে।
জি, আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ উদ্দেশ্য, লক্ষ্য আর পরিণতির জন্য দায়ি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল যজ্ঞেশ্বর, এক বছর বয়েসি সন্তানের চেহারাটা আবার ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।
মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল, একজন সন্ন্যাসীর চোখে পানি থাকতে নেই।
*
অধ্যায় ২৪
দুপুরের রোদে অনেক তেজ, চোখ বন্ধ করে কোনমতে শুয়ে আছে মিনোস। একটানা দাঁড় বেয়ে ক্লান্ত সে। নৌকা থেকে নেমেছে কয়েকবার। ম্যাপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। সূৰ্য্যের অবস্থান, নদীর গতিবিধি অনেক কিছুই লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে তাকে। আশপাশের কোন কিছু যাতে চোখ এড়িয়ে না যায় সেদিকে নজর দিতে হচ্ছে অনবরত। বৃদ্ধ যে জায়গাটা চিহ্নিত করেছেন তা এখনো বের করতে পারেনি সে। তিনমাথা পাহাড়, পাহাড়ের মাঝখানে আলোক শিখার মতো একটা চিহ্ন, উপরে একপাশে সূৰ্য্য আর নদী, ঠিক এরকম কোন জায়গা এখনো চোখে পড়েনি তার। পড়বে বলে মনে হচ্ছে না। বৃদ্ধ হয়তো শেষ বয়সে উল্টোপাল্টা অনেক কিছু ভাবতেন, তাই এমন অদ্ভুত একটা জিনিস তিনি রেখে গেছেন মিনোসের কাছে। এর পেছনে এভাবে সময় নষ্ট করার কোন মানে খুঁজে পাচ্ছে না মিনোস। কি পাওয়া যাবে সেখানে? সেই আলোক শিখা কিসের? সত্যিই কি তা কোন আলো, না অন্য কিছু?
অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরলেও উত্তর দেয়ার কেউ নেই, তাকেই সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।
হঠাৎ মনে হলো রোদের তেজ কমে গেছে, চোখ খুলে তাকাল মিনোস। গত কিছুদিন ধরে নদীর ধারের ফলমূল খেয়েই সে চলেছে। কিন্তু এখন এমন জায়গায় আছে সেখানে গাছপালা, জীবজন্তু বা মানুষ কোন কিছুরই চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, যেন প্রানহীন একটা জায়গা। কোনকালেই এখানে প্রানের কোন চিহ্ন ছিল না। নৌকাটা পাড়ের সাথে বেঁধে উপরে বেশ কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করলো মিনোস। দূরদূরান্ত পর্যন্ত সব ফাঁকা। অনেক দূরে নদী যেন দিগন্তের সাথে মিশে গেছে, তারপরে কি আছে তা জানার প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো তার মনে।
নৌকায় ফিরে এসে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে রইল মিনোস। এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই তার সামনে। যে কাজ শুরু করেছে তা মাঝপথে বন্ধ করে দেয়ার কোন মানে নেই। এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসাটাই তাহলে বৃথা হয়ে যাবে।
মাথা ব্যথা করছিল, সেই সাথে শরীরে বল পাচ্ছিল না, নদীতে দুহাত দিয়ে আঁজলা ভরে পানি খেয়ে নিলো মিনোস। রোদের তাপ আবার বাড়ছে। দূর্বল হাতে দাঁড় বাওয়া শুরু করল মিনোস আর কিছুক্ষন পরেই জ্ঞান হারাল। তার হাত থেকে দাঁড়টা পানিতে পড়ে তলিয়ে গেল। নৌকা চলতে থাকলে নিজের মতো, স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে।
জ্ঞান যখন ফিরল তখন বিকেল। রোদ পড়ে এসেছে। চোখ খুলে তাকিয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ শুয়ে রইল মিনোস। হ্যাঁ, তার ঘুম এখনো ভাঙেনি। সে স্বপ্ন দেখছে এখনো। স্বপ্ন ছাড়া এমন অদ্ভুত দৃশ্য কে কবে দেখেছে!
একটু দূরে যজ্ঞেশ্বর তার ধ্যানে বসেছে, বিনোদ চোপড়া গভীর ঘুমে। এখনো ভোরের আলো ফোটেনি। তবে সকালের প্রথম আলো যে কোন সময় আলোকিত করে তুলবে চারদিক। বড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। অদ্ভুত সব চিন্তা আসছে মাথায়, অনেক ঘোরা হয়েছে। এবার সময় বিশ্রামের, শেষ বিশ্রাম। কেউ আর বিরক্ত করবে না তাকে, নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে হবে না সবার চোখের সামনে থেকে। একমাত্র সাম্ভালাই সেই সুযোগ দিতে পারে। সেই অপূর্ব রাজ্যেই সম্ভব তার মতো একজন অস্বাভাবিক মানুষের স্বাভাবিক হিসেবে বেঁচে থাকা। নিজের জীবনের শুরুর দিকে কথা ভাবছিলেন এতোক্ষন। সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। স্বপ্ন ছাড়া এমন অদ্ভুত দৃশ্য… আবার স্মৃতির গভীরে ডুবে গেলেন তিনি।
চারদিকে অস্বাভাবিক রকম সবুজ, আকাশ গাঢ় নীল। অচেনা সব উদ্ভিদ, বড় বড় ফুল ফুটে আছে এখানে সেখানে, আগে কখনো এমন ফুল দেখেনি মিনোস। নীল আকাশে সূৰ্য্যটা বেশ স্বস্তিদায়ক, আলো আছে কিন্তু তাপ নেই। নদীর পানি স্বচ্ছ, সেখানে লাল-নীল মাছের দল ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দাঁড় নেই, কিন্তু নৌকাটা এমনিতেই পাড়ের সাথে লেগে আছে। নৌকায় দাঁড়িয়ে আশপাশে তাকাল মিনোস। আরো অদ্ভুত জিনিসটা তখনই চোখে পড়ল।
বেশ কতোগুলো পাহাড়, একটা আরেকটার গা ঘেষে আছে, বিশেষ করে মাঝখানের তিনটা পাহাড় আর এগুলোর চূড়া দেখে মনে হলো ঠিক এরকম কিছুই বৃদ্ধের ম্যাপে দেয়া আছে। নৌকা থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নামল মিনোস।
হাঁটু পর্যন্ত উঁচু, নরম সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছে, এতো মসন পথে এর আগে কখনো হাঁটেনি সে। আমি কী মরে গেছি? নিজেকেই প্রশ্ন করলো মিনোস। স্বর্গ কি এমনই? এখানে সেখানে উড়াউড়ি করছে কিছু পাখি, ওদের কিচিরমিচিরে চারপাশ মুখরিত।
জন-মানব কেউ নেই, এখানে কোথাও মানুষ বাস করে তেমন কোন চিহ্নও দেখা গেল না। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড় থেকে অনেকদূর ভেতরে চলে এসেছে মিনোস, সামনে ঘন বন, তারপর পাহাড় শুরু। এই ধরনের বনে জম্ভজানোয়ার থাকার কথা, কিন্তু কোন প্রানীর সাড়া শব্দ পেল না। নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে সে, যে কোন সময় ভাঙবে। বনে ঢোকার আগে একটু ইতস্তত করলো মিনোস। ভেতরে কি আছে তার জানা নেই। তার কৌতূহলী মন চাচ্ছে ভেতরে ঢুকতে, কিন্তু মনের একটা অংশ থেকে সাড়া পাচ্ছে না সে, মনে হচ্ছে দারুন বিপদে পড়তে যাচ্ছে।
ঝুঁকি নিতে ভালো লাগে তার, আপন জন কেউ নেই, সে মরে গেলে জানবেও না কেউ হয়তো। এরচেয়ে চেষ্টা করে মরে যাওয়া ভালো। পা বাড়াল মিনোস।
বনটা অন্য সাধারন বনের মতোই, গাছপালা ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই বনের গাছপালাগুলো অস্বাভাবিক, অন্তত এই ধরনের গাছ এর আগে তার চোখে কখনো পড়েনি,গাছের ডালে ডালে অদ্ভুত সব ফল ঝুলে আছে। খাওয়ার কেউ নেই। হাত দিয়ে একটা পেড়ে নিলো, ডালিম আর আপেলের মাঝামাঝি একটা ফল, মুখে দিতে গিয়েও দিলো না। ফলটা বিষাক্ত কিছু কি না তা জানার কোন উপায় নেই।
হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে অনুসরন করছে। সাবধানে চারপাশে তাকাল মিনোস। সব শুনশান, স্বাভাবিক।
আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল মিনোস, কোন শব্দ শোনার আশায়। কিন্তু না, কোন শব্দ নেই, এমনকি নদীর পানি, বাতাস, সবই যেন চুপ মেরে আছে।
বনের মাঝখান দিয়ে হাঁটছে মিনোস। পায়ে হাঁটা পথ আছে, সরু, হয়তো মানুষের যাতায়াত আছে কিংবা ছিল। এই পথ কোথায় গিয়ে মিশেছে জানা নেই, তবে তার মন বলছে এই পথ ধরেই যেতে হবে। বনের ওপারেই পাহাড়গুলোর অবস্থান। পেছনে আবার শব্দ শোনা গেল, কেমন হুটোপাটির শব্দ। দাঁড়িয়ে পড়ল মিনোস। তার হাতে আত্মরক্ষার জন্য ছোট একটা ধারাল পাথর, এই পাথরটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা ভালোই জানা আছে।
আবার সব শুনশান। বাতাস বইতে শুরু করেছে হঠাৎ করে, অদ্ভুত মাদকতাময় একটা গন্ধ আছে সে বাতাসে। গন্ধটা পরিচিত নয়, তবে সুন্দর। এই ধরনের গন্ধ যদি গায়ে মাখা যেতো খুব ভালো হতো তাহলে, ভাবছিল মিনোস। সে হাঁটছে, কেবল হাঁটছেই। অনেক দূর চলে এসেছে, বনের মাঝখানে, আরেকটু এগিয়ে দারুন বিপাকে পড়ল সে।
সরু পায়ে হাঁটা পথটা সামনে একটা জায়গায় তিনভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা সোজা চলে গেছে, বাকি দুটো ডানে আর বামে। যে পথে এসেছে সেটা ধরলে বলা যায় ঠিক চৌরাস্তার মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে মিনোস। মন বলছে এখানে একটা পথ সঠিক, বাকিগুলোতে গেলে বিপদ হতে পারে। কিন্তু সঠিক পথ বের করার কোন উপায় তার জানা নেই, ভাগ্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া।
আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল মিনোস। বৃদ্ধের সাথে অনেক অনেক কথা হয়েছে, অনেক আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। বৃদ্ধ প্রায়ই বলতে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত না নিতে। কাজ করার আগে অনেকবার ভেবে দেখাটা নাকি বুদ্ধিমানের লক্ষন। নিজেকে এতোদিন বুদ্ধিমান ভেবে এসেছে মিনোস, আজ তা প্রমান করার দিন।
ডানের পথটা চমৎকার, বেশ চওড়া হয়ে এগিয়ে গেছে। দুপাশে ফল-ফুল, গাছগুলোও বেশ চমৎকার, যেন বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা বানানো হয়েছে, বা দিকের রাস্তাটা ঠিক উলটো, আরো সরু হয়ে গেছে পথ, বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন, মাঝে মাঝে দুএকটা মাকড়শার জাল দেখা যাচ্ছে। এই পথে বহুদিন কোন মানুষ হাঁটেনি এটা নিশ্চিত। সোজা রাস্তাটা একেবারে স্বাভাবিক, ঠিক যে পথ দিয়ে এসেছে ঠিক তেমনই। যে কোন একটা রাস্তা বেছে নিতে হবে তাকে। একটু ভুল হলে তার চরম মাশুল দিতে হতে পারে।
উপরে আকাশের দিকে তাকাল মিনোস। গাছপালা ছাড়িয়ে খোলা আকাশটা দেখা যাচ্ছিল না। বাতাসে থেমে গেছে। ডান আর বামে চলে যাওয়া রাস্তাটা আবার দেখে নিলো, তারপর পা বাড়াল, বাম দিকে।
রাশেদ একেবারেই বেরসিক, এমন একটা পর্যটন শহরে এসেও এতো নিস্পৃহ কিভাবে থাকতে পারে তরুন একটা ছেলে ভেবে পায় না রাজু। বিদেশে এসে সারাক্ষন যদি হোটেলেই বসে থাকতে হয় তাহলে লাভ কি হলো? এরচেয়ে ঢাকায় থাকা ঢের ভালো ছিল।
সন্ধ্যার পরপর স্থানীয় একটা বারে গিয়েছিল দুজন। সেখানে ইউরোপীয়, আমেরিকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের পর্যটক জমা হয়েছে। উঁচু বিটে গান বাজছিল, ছোট ছোট টেবিলে আসর নিয়ে বসেছিল স্থানীয় ভারতীয়রা। এই ধরনের বারগুলো সাধারনত ওরাই নিয়ন্ত্রন করে। নিজেদের জন্য ছোট একটা টেবিল বেছে নিয়েছিল রাজু, বিয়ার অর্ডার করেছিল। কিন্তু এসব জিনিসে সঙ্গি লাগে, সঙ্গি ছাড়া সব পানসে। রাশেদকে সেধেছিল, খেতে রাজি না হওয়াতে বের হয়ে এসেছে রাজু।
এখন আবার সেই হোটেল রুম, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাজু। রাশেদ বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, পরনের কাপড় ছাড়েনি,এমনকি পায়ে জুতো জোড়াও খুলতে ভুলে গেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুমায়নি,কিছু একটা ভাবছে। এতো চিন্তার কী আছে, মাথায় ঢুকল না রাজুর। আগামীকাল তারা দুজন তিব্বতের দিকে রওনা দিচ্ছে। তিব্বতে যাওয়া প্রথম বাঙ্গালী তারা না, এই তথ্যটা রাজুর জানা আছে। অতীশ দীপংকর হাজার বছর আগেই তিব্বতের মাটিতে পা রেখেছেন, গত কয়েকবছরে বেশ কয়েকজন এভারেস্ট জয়ও করেছে। কাজেই তিব্বত নিয়ে অযথা টেনশনের কিছু নেই।
একটা সিগারেট ধরাল রাজু। রাশেদ কি নিয়ে চিন্তা করছে সে জানে, ড. আরেফিন। লোকটাকে সহি-সালামতে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই তাদের মিশন কমপ্লিট। কিন্তু তার আগে এক-আধটু মজা করা যাবে না?
ঘুমাচ্ছিস না কেন?
প্রশ্ন শুনে চমকে যায় রাজু। রাশেদ বেশ বিরক্ত তার উপর এটা বোঝাই যাচ্ছে।
কাল কিন্তু আমরা ভোরেই রওনা দেবো, আবার বলল রাশেদ।
আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না, রাজু বলল, সিগারেটে টান দিতে দিতে, আমি নিশাচর হলেও সময় নিয়ে হেলাফেলা করি না।
এতো দেখি ভুতের মুখে রাম নাম, বিছানায় উঠে বসল রাশেদ। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকাল। হ্যাঁ, বারোটার অনেক বেশি বাজে। ঘুমানো দরকার, কিন্তু রাজু জেগে আছে বলে তারও ঘুম আসছে না।
তুই কিন্তু অনেক বিরক্ত করিস, অনুযোগের সুরে বলল রাশেদ। একটা সিগারেট দে।
খোলা জানালা থেকে সরে দাঁড়াল রাজু, টেবিলের দিকে এগুলো, খুট করে একটা শব্দে দাঁড়িয়ে গেল। চারপাশে তাকাল, শব্দটার উৎস খুঁজছে। রাশেদের দিকে তাকাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে, কিন্তু রাশেদ কোন শব্দ শোনেনি। তাকিয়ে আছে রাজুর দিকে। কিছু একটা বলতে যাবে রাজুর ইশারায় থেমে যাবে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল রাশেদ। রাজু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, শব্দটা আবার হবে, সেজন্য প্রস্তুত। দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
বিছানার পাশে ব্যাগ রাখা আছে দুজনের, রাশেদ কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো একটা, অন্যটা হাতে নিয়ে নিলো। এখানে-সেখানে পড়ে থাকা ম্যানিব্যাগ, পাসপোর্ট, মোবাইল ফোন এগুলো গুছিয়ে নিলো তড়িঘড়ি। দুই-একটা কাপড়-চোপড় ছাড়া তেমন কিছু বাইরে নেই। বালিশের নীচে পিস্তল দুটো ছিল। বের করে আনল রাশেদ, একটা নিজের হাতে নিয়ে অন্যটা রাজুর দিকে বাড়িয়ে দিল।
প্রায় মিনিট দুয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দুজন, সব চুপচাপ। কোন শব্দ নেই কোথাও। রাশেদের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসল রাজু, দরজার পাশে জেমস বন্ড স্টাইলে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদও হাসল। আক্রমনটা হলো তখন।
শিস দেয়ার মতো শব্দে দুটো বুলেট দরজার লকের পাশে আঘাত করেছে। প্রায় ছিটকে পড়ল রাজু। হাতে এখনো পিস্তল ধরে রেখেছে, গুলি করার সাহস পাচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে শত্রুরা সাইলেন্সর রিভলবার ব্যবহার করেছে। রাশেদের দিকে তাকাল রাজু, সোজা জানালা ইশারা করল রাশেদ। এই রুম থেকে বের হওয়ার এই একটাই পথ।
পরপর আরো কিছু বুলেট আঘাত হানল দরজায়। মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে জানালার দিকে এগুচ্ছে রাজু। রাশেদ জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে, নীচের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এভো উঁচু থেকে লাফ দিলে কি হতে পারে। হাত-পা যে ভাঙবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে থাকলেও সমস্যা, আক্রমন যারা করেছে তারা পেশাদার, সাইলেন্সর লাগানো রিভলবার নিয়ে এসেছে, ওরা সংখ্যায় কতোজন সে সম্পর্কে ধারনা নেই। এই রুমে পড়ে থাকা মানে নিশ্চিত মৃত্যু। তাদের দুজনের হাতেও পিস্তল আছে, কিন্তু কোনভাবেই কাউকে খুন করার পক্ষপাতি নয় রাশেদ। এই জানালা দিয়ে লাফ দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
এবার ক্রমাগত দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন। অন্তত চারজনের কম হবে না, ভাবল রাশেদ। আর বেশিক্ষন অপেক্ষা করা যাবে না। যে কোন সময় দরজা ভেঙে ঢুকে পড়বে ওরা।
জানালার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে রাজু। পিস্তল তাক করে আছে দরজার দিকে। ইশারায় রাশেদকে ঝাঁপ দিতে বলল।
ইতস্তত করার সময় নেই। দুটো ব্যাগ দুই কাঁধে নিয়ে দাঁড়াল রাশেদ, প্রস্তুত। ঝাঁপ দেয়ার জন্য। নীচের দিকে তাকাল, তিনতলা উঁচু থেকে নীচের অবস্থাটা বোঝা যাচ্ছে না। সেখানে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু।
লাফ দিলো রাশেদ।
ঠিক তখনই গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো চারদিক।
চুপচাপ কিছুক্ষন শুয়ে রইল রাশেদ। হাড় ভাঙেনি মনে হচ্ছে, কিন্তু মচকে গেছে। পা দুটো সোজা করতে কষ্ট হচ্ছে। উপরে কি হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। রাজুর পিস্তলে গুলি ভরা ছিল। গুলিটা রাজুর পিস্তল থেকেই করা হয়েছে। আক্রমনকারিদের রিভলবারে সাইলেন্সর ছিল। ঝপ করে কিছু একটা পড়ল পাশে। অচেনা একটা লোক। দাঁড়িগোফের কারনে চেহারা প্রায় ঢাকা পড়েছে। ঢাকা না পড়লেও এই চেহারা কোনদিন দেখেছে কি না মনে করতে পারলো না রাশেদ। বুক থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে। হাল্কা গোলাপী রঙের শার্টটা লাল হয়ে যাচ্ছে রক্তে। ভায়োলেন্স পছন্দ করে রাশেদ, কিন্তু রাজু সম্ভবত ঠিক উল্টোটা। অবশ্য এই লোকটাকে গুলি না করলে এতোক্ষনে লাশ হিসেবে রাজুকে পাওয়া যতো।
রুমে বাতি জ্বলছে। লোকজন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আক্রমনকারিদেরও না। গুলির শব্দে পুরো হোটেল জেগে উঠেছে। রুমে এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না ভেবে অবাক হলো রাশেদ, অন্তত রাজু তো থাকবে। আক্রমনকারিরা হয়তো পালিয়েছে রাজুর লাশ ফেলে, তার উপর প্রতিশোধ নিতে আসবে সময়মতো, আরো অতর্কিতে। এতোক্ষনে নিশ্চয়ই পুলিশে খবর চলে গেছে, যে কোন সময় নেপালি পুলিশের আবির্ভাব ঘটবে। এখানে বেশিক্ষন থাকাটা নিরাপদ না।
গড়িয়ে একটা ঝোঁপের পাশে চলে গেল রাশেদ। খারাপ লাগছে তার, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে রাজুকে হয়তো আর দেখতে পাবে না। নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়ে বন্ধুকে বাঁচিয়েছে। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু নেমে এলো।
হঠাৎ পিঠে টোকা পড়াতে চমকে পেছনে তাকাল রাশেদ। হাতে পিস্তল তুলে নিয়েছে। কিন্তু সদাহাস্যময় মুখটা দেখে জড়িয়ে ধরল প্রিয় বন্ধুকে। রাজু বেঁচে আছে!
*
অধ্যায় ২৫
প্রথমে মনে হয়েছিল গাড়িটা তাদের উদ্দেশ্যেই আসছে, কিন্তু যখন পাশ কাটিয়ে চলে গেল তখন হাঁপ ছাড়ল সুরেশ। আক্রমন আশা করেছিল সে, কিন্তু এবার সঙ্গিদের মধ্যে একজন নারী থাকায় বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। মেয়েটা একটা অভিযানে এসেছে, গোলাগুলির মধ্যে পড়তে আসেনি। ঐ গাড়িটায় বসে থাকা লামাকে একঝলক চোখে পড়েছে। এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছে মনে হলো। কিন্তু লামারা সবাই দেখতে প্রায় একইরকম, ভাবলো সে।
সাধারন গতিতে চলছে এখন জীপদুটো। পেছনের জীপে সন্দীপ একা, ওর কাছে একটা পিস্তল দিয়ে রেখেছিল সুরেশ, আত্মরক্ষার জন্য। মিররে পেছনে জীপটা দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সন্দীপ।
ড. কারসন অনেকক্ষন যাবতই উশখুস করছেন, কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন মনে হলো।
ড. কারসন, কিছু বলবেন? ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো সুরেশ।
ঐ ভদ্রলোক, বিড়বিড় করে বললেন ড. কারসন, ওকে আমি কোথাও দেখেছি।
ওদেরকে দেখে আমারও তাই মনে হলো, ড. কারসন।
কিন্তু এই লোকটাকে আমি চিনি।
তাহলে মনে করার চেষ্টা করুন, সুরেশ বলল, জিপের ক্যাসেট প্লেয়ারে কিশোর কুমারের গান ছেড়ে দিল।
ড. লতিকা তাকিয়ে আছে ড. কারসনের দিকে।
কোথায় দেখেছেন ঐ লোকটাকে?
সেটাই তো মনে পড়ছে না, ড. কারসন বললেন, সুরেশ, গান বন্ধ করো। মনে পড়েছে।
গম্ভীর মুখে ক্যাসেট প্লেয়ার অফ করলো সুরেশ।
এই লামাকে দেখেছিলাম, ধর্মশালার দিকে এক বৌদ্ধ মন্দিরে, ড. কারসন বললেন। এই লোক এখানে কেন?
কারন উনি জানেন, ড. আরেফিন কোথায় আছেন, সুরেশ বলল, উনিই হয়তো এই অপহরনের সাথে জড়িত।
জীপে নিরবতা নেমে এলো। ড. আরেফিনকে যদি এই লোক অপহরন করে থাকে, তাহলে এক্ষুনি ওর পিছু নেয়া দরকার।
সুরেশ, ঐ গাড়িটাকে অনুসরন করো, ড. কারসন বললেন।
কিন্তু…
কোন কিন্তু না, ড. আরেফিনকে আমার দরকার।
ঠিক আছে, বলল সুরেশ। এখনো গতি বাড়ালে হয়তো ঐ গাড়িটার নাগাল পাওয়া যাবে, সেখানে ড. আরেফিনকে পাওয়া যাবে কি না তাতে অনেক সন্দেহ আছে তার। কিন্তু দলনেতার কথার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই।
পেছনের জিপের উদ্দেশ্যে ইশারা করলো, এক্সেলেটরে চাপ বাড়াল সুরেশ।
***
নিজেকে শিকারি ভাবতে ভালো লাগে তার, ধাওয়া করতে ভালো লাগে, একসময় শিকার তার ফাঁদে পা দেয়, তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেই শিকারকে যন্ত্রনা দিতে ভালো লাগে। যন্ত্রনা পেতে পেতে শিকার একসময় মরে যায়, এটাই আনন্দ। একটা নেশার মতো এই আনন্দের খোঁজ তার সবসময়।
তাই নির্দিষ্ট একটা শিকারের পেছনে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে খারাপ লাগছে না। উলটো প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনা বাড়ছে, বিশেষ করে গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে শিকার আশপাশেই আছে। চোখ খুললেই দেখতে পাবে। শিকার দেখতে কেমন, তার শক্তিমত্তা সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই, তবু মনে হয় বেশ বেগ পেতে হবে এই শিকারকে কাবু করতে গিয়ে। এই ধারনাটা আরো বেশি আনন্দের, পানশে শিকার ভালো লাগে না। যুদ্ধ করে জেতাটাই সবসময় পছন্দ মিচনারের।
দিনে ঘুমিয়ে রাতের অন্ধকারে হেঁটে চলছে, কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। চারপাশে বিশাল সব পাহাড়, বরফে ঢাকা পথ, অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি। বরফে ঢাকা পার্বত্য এলাকায় সে আগেও ছিল, কিন্তু এই জায়গাটা অন্যরকম। এর খাঁজে খাঁজে যেন রহস্য লুকিয়ে আছে।
সন্ধ্যার পর বের হয়েছে মিচনার, চাঁদের আলোয় হাঁটছে আনমনে। এই এলাকার লোকজন সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরে, খুব ভোরে উঠে আবার কাজে নেমে যায়। কাজেই কারো মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাহাড়ের গা ঘেষে যে চমৎকার রাস্তা চলে গেছে দূর দিগন্তে, তার পাশ দিয়ে যাচ্ছে সে। অদ্ভুত ভালো লাগছিল। তার খালি গায়ে চাঁদের আলো পড়েছে। দূর থেকে কেউ তাকালে তাকে অশরীরী ছাড়া কিছু ভাববে না।
কোমরে গোঁজা ছুরিটা বের করে আনল মিচনার। নিহত সৈনিকদের একজনের কাছ থেকে নিয়েছিল। উপরের দিকটা একটু বাঁকা হয়ে গেছে ছুরিটা, চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে। হাতে নিয়ে একটু খোঁচা দিলো আঙুলে, যথেষ্টই ধারাল ছুরি, কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আঙুল থেকে। হাসল মিচনার, খুবই ভালো জিনিস। চায়নীজদের সম্পর্কে অনেককাল শুনেছে, কয়েকদিন আগে দেখাও হলো, কিন্তু সেটা খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হয়নি ওদের জন্য।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরের এক পাহাড়ের দিকে চোখ পড়ল তার। শরীর শক্ত হয়ে উঠল নিমিষেই, হাত মুঠো হয়ে গেছে নিজের অজান্তেই। দাঁত কিড়মিড় করে বাজখাই গলায় চেঁচাল মিচনার। তার প্রতিদ্বন্ধী ঐ পাহাড়ের কোথাও আছে, তার মন বলছে।
হাঁটা বন্ধ করে এবার দৌড়ানো শুরু করলো মিচনার। পাহাড়টা অনেক দূরে, দ্রুত না ছুটলে হয়তো হাতছাড়া হয়ে যাবে শিকার। চিতা যেমন শিকারের পেছনে ছোটে, মিচনারও ছুটছে। তার চেহারায় আদিম শিকারির ছাপ।
*
অধ্যায় ২৬
সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষন হলো। পুরো রাজদরবারে অল্প কয়েকজন মানুষ জড়ো হয়েছে। সংখ্যায় তারা নয় জন। এছাড়া আছেন রাজদরবারের অধিকর্তা, সম্রাট স্বয়ং, তাদের সামনে পায়চারি করছেন তিনি। নয় জন দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। প্রত্যেকের চেহারাই বিন্ন, চিন্তাযুক্ত। সম্রাট বারবার তাকাচ্ছেন তার সামনে দাঁড়ানো নয় জনের দিকে। অন্যান্য সন্ধ্যার মতো রাজদরবারে আজ হাজার প্রদীপ জ্বালানো হয়নি। অল্প কিছু প্রদীপ জ্বলছে, তার আলোয় পুরো পরিবেশটাই কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ছায়া ছায়া অন্ধকারে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে বলে মনে হলো তার। পুরো রাজদরবারে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি। বাইরের কেউ নেই। কথা শুরু করা যায়।
আপনাদের বিশেষ উদ্দেশ্যে এক করা হয়েছে, বলে চলেছেন তিনি। পুরো দরবার খালি করা হয়েছিল আগেই, শুধু মাত্র নিজের একান্ত দেহরক্ষী আছে, যে কথা বলতে পারে না।
খালি দরবারে তার ভারি কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছিল।
আমি রক্তপাত চাই না, শান্তির এক রাজ্য চাই, যেখানে কোন হানাহানি, মারামারি থাকবে না, তাকালেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নয় জন বিশেষ ব্যক্তির দিকে, লোকগুলোর পরনে অতি সাধারন পোশাক, হাতে মোটা খাতার মতো জিনিস, তাদের চেহারা ভাবলেশহীন, অচঞ্চল চোখ।
যে পথে আমি অগ্রসর হচ্ছি সেখানে অনেক বাঁধা, সেই বাঁধাগুলোকে আমি বুদ্ধের শান্তির বানী দিয়ে দূর করতে চাই, তবু কিছুটা সংশয়াচ্ছন্ন আমি, হাঁটছেন আর বলছেন কথাগুলো, আপনারা সবাই যার যার কাছে সিদ্ধহস্ত, আপনাদের কাছে এমন কিছু আছে যা মানবসভ্যতাকে বদলে দিতে পারে। সেই পরিবর্তন ভালো বা মন্দ দুদিকেই হতে পারে। কাজেই আমি চাই…
মহামান্য সম্রাট, সর্ব ডানে দাঁড়ানো একজন বলে উঠলো, আমাদের অন্তত চেষ্টা করা উচিত। যে গৌরব আমরা হারিয়েছি তা ফিরে পাওয়ার উপায় এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। এখনই সময় তা ব্যবহার করার।
নিজের কথাগুলো যথার্থ কি না তা বোঝার জন্য বাকি সবার দিকে তাকাল সে, কিন্তু সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।
সেই চেষ্টা আমরা করবো না, সম্রাট বললেন, তার এখন বয়স হয়েছে, নিজেকে শান্তির ধর্মে নিবেদন করেছেন অনেক আগেই, এখন আর কোন ধরনের পরিবর্তন দেখার সাহস তার নেই। পুরো ভারতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছেন, দূর শ্রীলঙ্কায় নিজের ছেলে আর মেয়েকে পাঠিয়েছেন ধর্ম বিস্তারের কাজে। আর কোন ধরনের ঝুঁকি নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং পরিস্থিতি যেন আরো খারাপের দিকে না যায় সেদিকে এখন বেশি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।
আমি সম্রাট অশোক, বললেন তিনি, পুরো দরবার কেঁপে উঠলো তাঁর গুরুগম্ভীর কণ্ঠে, আর কোন হানাহানি চাই না, চাই না রক্তে ভেসে যাক আমার রাজ্য। হাজার বছর আগে রামরাজ্যে কি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। যুদ্ধ আরো যুদ্ধ ডেকে আনে, পায়চারি করতে করতে বললেন তিনি।
তাহলে আমাদের কী করতে বলছেন? এবার জিজ্ঞেস করলো আরেকজন। ব্রাক্ষন সমাজের সর্বোচ্চ পদে আসীন তিনি। সম্রাট অশোক তাকে কিংবা তার সঙ্গিদের বাধ্য করেননি ধর্মান্তরিত হতে।
আপনারা আমার রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন, সম্রাট অশোক বললেন, এমন এক রাজ্যের সন্ধান আমি আপনাদের দেবো, যেখানকার খোঁজ কেউ জানে না।
আমরা চলে যাবো? পরিবার-পরিজন ছেড়ে?
হ্যাঁ, আপনাদের পরিবারের দায়-দায়িত্ব সব আমার, সম্রাট অশোক বললেন, যে জ্ঞান ঐ বইগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে তা রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমি চাই না এই জ্ঞান কোন খারাপ লোকের হাতে পড়ক। তাহলে তা পৃথিবীতে যুদ্ধ ডেকে আনবে, রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।
আমরা কোথায় যাবো?
হিমালয়ের দেশে, বিশেষ একজন আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।
কিন্তু…
কোন কিন্তু নয়, জোর গলায় বললেন তিনি, কাল ভোরে রওনা দেবেন আপনারা। সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
জি হুজুর, মহারাজ, সমস্বরে বলল সবাই।
দায়িত্বে অবহেলা করবেন না, যে দায়িত্ব আপনাদের উপর অর্পন করেছি আশা করি প্রান গেলেও তা থেকে বিচ্যুত হবেন না।
জি হুজুর, মহারাজ।
আমি বিশ্রামে যাচ্ছি। সকালে দেখা হবে, বললেন সম্রাট, প্রহরীকে ইশারা করলেন, প্রধান দরজা খুলে গেল। এক এক করে নয়জন চলে গেল দরবারের বাইরে, তাদের সামনে পেছনে কুড়িজন সৈন্যের একটা দল রাখা হয়েছে, পাহারা দেয়ার জন্য। যাতে কেউ আক্রমন করলে প্রতিরোধ করা যায়।
এই নয়জনের উপর বিশেষ এক দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। যে রহস্যময় জ্ঞান ওরা লিপিবদ্ধ করেছে তা অন্য কারো হাতে পড়ুক তা চান না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই জ্ঞান ওরা লুকিয়ে রাখবে, এটাই ওদের দায়িত্ব। তার বদলে ওরা পাবে চিরস্থায়ী সুখ, চিরযৌবন। হিমালয়ের দেশে সেই লুকানো রাজ্যে আছে চিরস্থায়ী সুখ আর চিরজীবন। আগামীকাল একজন আসবেন সেখান থেকে, এই নয়জনকে নিয়ে যাবার জন্য। তিনি নিজেও হয়তো ওদের সাথে যেতে পারতেন, কিন্তু সেটা তার প্রজাসাধারনের উপর অন্যায় করা হবে। তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে পুরো ভারতবর্ষের লক্ষ কোটি জনগন। এই জনগনকে তিনি ফেলে যেতে পারেন না।
কয়েক সহস্রাব্দের জ্ঞান লিপিবদ্ধ আছে ওদের কাছে থাকা বইগুলোতে। এমন সব অস্ত্রের বর্ননা আছে যা তৈরি হলে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যেমন ধারনা করা হয় রামরাজ্যের পতন হয়েছিল ঐ দৈবি অস্ত্রগুলো ব্যবহারের কারনেই। আকাশে উড়তে পারে এমন যান তৈরি হয়েছিল, সেই যানে চড়ে যুদ্ধও হয়েছিল বহু দূর দেশের এক সভ্যতার সাথে। সেই যুদ্ধে কেউ জেতেনি,কিন্তু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল রামরাজ্য। এগুলো বহুদিন আগের কথা, সত্যি কি না তিনি জানেন না। কিন্তু ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। এরচেয়ে লুকানো জ্ঞান লুকানোই থাক।
রাজদরবার থেকে নিজের প্রাসাদে চলে এলেন তিনি। এখানে তাঁর আলাদা একটি শয়নকক্ষ আছে, রাণীদের কারো প্রবেশাধিকার নেই সেখানে। আজ রাতে এই কক্ষে ঘুমাবেন বলে ঠিক করলেন।
চমৎকার শয়নকক্ষটির নকশা পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের করা। চন্দ্রগুপ্ত একসময় এই কক্ষে ঘুমাতেন। কক্ষটির অবস্থান প্রাসাদের পূর্ব দিকে, কক্ষটিতে ঢোকার দরজা একটি, জানালাও একটি, পূর্বমুখী। ভোরের প্রথম আলো এই কক্ষকে আলোকিত করে তোলে সবার আগে। এই কক্ষটি অশোকেরও খুব প্রিয়।
বিছানাটি সেগুনকাঠে তৈরি, চমৎকার কারুকার্যময়, প্রায় দশটি ধাপ বেয়ে উঠতে হয়। উপরে উঠার আগে নীচে পাথরের বাটিতে রাখা দুধ খেয়ে নিলেন তিনি। আজ রাতে এটুকুই তাঁর খাবার। কাল ভোরের আগেই ঘুম থেকে উঠতে হবে।
ভোরের আগেই ঘুম ভাঙল। আলো এখনো ফোটেনি। জানালার দিকে তাকালেন। মনে হলো একটা ছায়া দেখতে পেলেন। দীর্ঘাকৃতি একজন মানুষের ছায়া। এই সময় তার কক্ষে অনুপ্রবেশের সাহস কারো নেই। বিছানায় উঠে বসলেন। ভয় জিনিসটা তাঁর চরিত্রে নেই, কেউ যদি তাকে হত্যা করতে আসে, তাহলেও সমস্যা নেই। বিনা যুদ্ধে তিনি কাউকে ছেড়ে দেবেন না। বালিশের একপাশে একটা ছোরা থাকে সবসময়। আত্মরক্ষার জন্যই রাখা। এর আগে কখনো প্রয়োজন পড়েনি। বালিশের নীচে হাত দিলেন তিনি। নেই।
দীর্ঘাকৃতি ছায়াটা আরো ঘন দেখা যাচ্ছে এখন, একজন মানুষের অবয়ব পরিস্কার দেখতে পেলেন। মানুষটা লম্বা, চোখ দুটো বড়, অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করছে। মানুষটার হাত দুটো খালি। কিন্তু পেশিবহুল হাতদুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে খালি হাতেই এই লোকটা ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। লোকটার শুভ্র শশ্রুমন্ডিত মুখে ঈষৎ হাসির রেখা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত করে দিলো পরাক্রমশালী সম্রাট অশোককে।
কে আপনি? কি চান? বললেন সম্রাট। নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছেন যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য।
আমিই সে।
মানে?
অনেক দূর থেকে এসেছি, অনেক দূর যেতে হবে।
ধাঁধা পছন্দ নয় আমার, নীচে নামার জন্য তৈরি হলেন সম্রাট অশোক, যা বলার সরাসরি বলুন।
আমি পথ প্রদর্শকমাত্র।
এবার কিছুটা বোধগম্য হলো ব্যাপারটা। ধাপগুলো বেয়ে ধীরে সুস্থে নেমে এলেন সম্রাট, এই লোককে বিপজ্জনকভাবার কোন কারন নেই। আপনি বিনা অনুমতিতে আমার শয়নকক্ষে কিভাবে এলেন?
জবাবে হাসল লোকটা।
বাইরে সবাই প্রস্তুত। আমি আসি।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জানালার দিয়ে প্রথম আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। তৈরি হয়ে নিতে হবে তাড়াতাড়ি। নয়জনের দলটার রওনা দেয়ার সময় হয়ে গেছে, কারো চোখে পড়ার আগেই এই শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে ওদের।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন সম্রাট, জানালার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলেন নিজের অজান্তেই। পেছনে ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন, কক্ষে কেউ নেই। একেবারে ফাঁকা। যেন কেউ কখনো ছিলও না। তিনি নিজেই নিজের সাথে কথা বলেছেন এতোক্ষন! কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব!
পোশাক-আশাক পড়ে যখন বাইরে এলেন তখন সূর্য উঠে গেছে। সাত-সকালে মন্ত্রীদের কাউকে আশা করেননি,সেনাপতি আয়ুষ্মনকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলেন। বর্ষীয়ান এই সেনাপতির দায়িত্ব ছিল নয়জনের নিরাপত্তার।
মহারাজ।
বলুন, আয়ুষ্মানজী।
ওরা নেই।
নেই মানে?
চলে গেছে। পালিয়ে গেছে। একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এতে পাহারার পরও আমাদের প্রহরীদের কারো চোখে পড়েনি ওদের চলে যাওয়া।
মৃদু হাসলেন সম্রাট। অবাক হওয়ার কথা থাকলেও অবাক হলেন না। সকালের ব্যাপারটা তাহলে স্বপ্ন ছিল না। হিমালয়ের কোলের সেই অজানা রাজ্য থেকে যে এসেছিল সেই এই নয়জনকে নিয়ে গেছে। একটু অস্বস্তি লাগলেও মনে মনে খুশি হলেন সম্রাট অশোক। যে গুপ্তজ্ঞান লুকানোর জন্য এই আয়োজন সেটা সম্ভবত স্বার্থক। সেই অজানা রাজ্যের খোঁজ পাওয়া জাগতিক কোন মানুষের পক্ষে হয়তো কোনভাবেই সম্ভব না। গুপ্তজ্ঞান তাই নিরাপদ থাকবে, মানবসভ্যতার প্রয়োজনে সময়মতো তা কাজে লাগাবে নয়জন।
আমরা কি দিকে দিকে লোক পাঠাবো? জিজ্ঞেস করল সেনাপতি, তাকে বেশ লজ্জিত মনে হচ্ছিল।
কোন প্রয়োজন নেই, মৃদুস্বরে বললেন অশোক।
ভোরের প্রথম আলোতে অনেক দিন পর নিজেকে অনেক নির্ভার মনে হচ্ছিল তাঁর। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। চোখে কালো কাপড় বেঁধে নিয়েছিল ওরা, ফলে কোথায় যাচ্ছেন, কি করতে চাচ্ছে লোকগুলো তাকে নিয়ে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা করতে পারছেন না ড. আরেফিন। মেরে ফেলতে চাইলে এতোক্ষনে মেরে ফেলতো। আপাতত এটুকুই সান্তনা। তরুন চায়নীজ অফিসারের কাছে দয়া একধরনের হীনমন্যতা। ছুরির খোঁচায় তার গলা কেটে ফেলতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করবে না ছেলেটা, হয়তো উপরের মহলের নির্দেশ মেনে কাজ করছে তরুন।
এখন যেখানে আছেন সেটা সম্ভবত কোন কাভার্ড ভ্যানের পেছনের অংশ। এবড়ো থেবড়ো পথে চলতে গিয়ে ঝাঁকিতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অভিযোগ করার সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে খাবার আসছে। চোখ বন্ধ রেখে শুধু মুখের উপর থেকে বাঁধন খুলে নেয় ওরা। কি খেতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে ধারনাই থাকে না তার। অন্ধের মতো খেয়ে যান। বেশিরভাগ সময়ই থাকে কলা আর রুটি। গত কিছুদিন এই দুটো জিনিস খেতে খেতে অরুচি এসে গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও অভিযোগ করার উপায় নেই, যা দেবে তাই খেতে হবে।
সন্ধ্যার পরপর ভ্যান থেকে তাকে নামিয়ে নিতে এলো একজন। এই লোকটাকে কখনো দেখেননি,কিন্তু লোকটার গায়ের বোটকা গন্ধ থেকে বুঝতে পারেন গত কয়েকদিন এই লোকটাই তার দেখাশোনা করছে। তরুন চায়নীজ অফিসারের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। হয়তো নিরাপদ জায়গায় রেখে অন্য কোথাও গেছে।
ভ্যান থেকে নামার সময় চারপাশের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন ড. আরেফিন। একেবারে নীরব এলাকাটা, জীব-জন্তু পাখি কোন কিছুরই শব্দ নেই। তার হাত দুটো পেছনদিক দিয়ে বাঁধা, চোখ আর মুখে শক্ত বাঁধন। একমাত্র নিঃশ্বাস নেয়া ছাড়া আর কোন কাজ করার উপায় নেই। প্রতিদিন সন্ধায় আর সকালে নিয়ম করে ভ্যান থেকে নামানো হয়, দারুন অস্বস্তি হয় ড. আরেফিনের। নিজের কোন প্রাইভেসি নেই, কিন্তু শারীরিক এসব কর্ম না সারলেও নয়। কাজেই লজ্জা হলেও অপহৃত হওয়ার পর থেকে এই ব্যাপারটায় প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন তিনি।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় এলোপাতারি দৌড় দিতে, কিন্তু জানেন অস্ত্রসহ প্রহরীরা দুই হাতের মধ্যেই আছে। তিনি দৌড় দিলে ওরা সহজেই ধরে ফেলবে, কিংবা ফায়ারিং প্র্যাকটিস করবে। সেই সুযোগ ওদের দেয়া যাবে না। আরো অনেক ধৈৰ্যশীল হতে হবে তাকে, এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ আসবেই। শুধু সঠিকভাবে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
*
অধ্যায় ২৭
হোটেল সানসাইন থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা। সারারাত লুকিয়ে থেকেছে হোটেল থেকে একটু দূরে একটা মন্দিরে। সেখান থেকে হোটেলে আসা পুলিশের দলকে দেখেছে। পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি,সম্ভবত আক্রমনকারিরা কেউ ধরা পড়েনি। একটা হোটেলে গোলাগুলি হলো অথচ পুলিশ কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেফতার করলো না ব্যাপারটায় অবাক হয়েছে রাশেদ। এমন হওয়ার কথা না। ঐ লোকগুলো গ্রেফতার হলে হয়তো কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেতো। কারা তাদের উপর আক্রমন করেছে বুঝতে পারছে না রাশেদ। এখানে তারা ঠিক কী উদ্দেশ্য এসেছে তা আফরোজা আরেফিন ছাড়া আর কারো জানার কথা না। দুই দুইবার বেঁচে আসতে পেরেছে, কিন্তু সামনে কী আছে কে জানে।
সকাল হতেই মন্দির থেকে সোজা চলে এলো দরবার স্কয়ারে। সারারাত ঘুম হয়নি,গায়ের জামা-কাপড় এখানে সেখানে ছিঁড়ে গেছে। লাল চোখ আর থমথমে চেহারায় দুজন ঘুরে বেড়াতে লাগল এদিক-সেদিক। একটু দূরেই বাসস্ট্যান্ড দেখা গেল। সেখানে কিছুক্ষন পরপর গাড়ি ছাড়ছে বিভিন্ন পর্যটন এলাকার উদ্দেশ্যে। বেশিরভাগ গাড়িই যাচ্ছে পোখরা নয়তো নাগরকোটের দিকে। পর্যটকদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের লোক আছে, দুই একজনের মুখে বাংলাও শুনতে পেল রাশেদ। কিন্তু ধারে কাছে ঘেষল না। কোদারি যাওয়ার বাস খুঁজতে হবে। কিন্তু সেই বাস আরো ভোরে একটা ছেড়ে গেছে, দুপুরের দিকে একটা ছাড়বে। উপায় না দেখে দুপুরের বাসে দুটো টিকিট কাটলো রাশেদ। কোদারি পার হয়েই তিব্বতে ঢুকতে হবে। পকেটে থাকা পাসপোর্ট আর তিব্বতের পাসদুটো দেখে নিলো রাশেদ। পকেটে টাকাও আছে, ব্যাগ দুটো হারালেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। রাজুকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। কোমরে গোঁজা পিস্তল নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছে বোঝা যাচ্ছে।
চল, নাস্তা করে নেয়া যাক, রাশেদ বলল।
আমিও তাই ভাবছিলাম, পেটে কিছু নেই, একদম খালি, রাজু বলল।
বাসস্ট্যান্ডের পাশেই ছোট রেস্টুরেন্ট। ডিম ভাজা আর পাউরুটি অর্ডার দিলো রাশেদ। কোনার দিকে একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসে পড়লো।
তোর কি ধারনা? জিজ্ঞেস করলো রাজু।
কিসের ধারনা, বুঝলাম না।
তোর পেছনে এতো লোক লেগে আছে কেন? একটু ক্লিয়ার করে বলতো? জিজ্ঞেস করলো রাজু, তাকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। পরিচিত হবার পর থেকে কখনোই এতো গম্ভীর অবস্থায় দেখেনি রাশেদ ওকে।
আমি জানি না। সম্ভবত ড. আরেফিনকে যারা অপহরন করেছে তারাই লেগেছে আমাদের পেছনে।
আমার তা মনে হয় না।
কেন বলতো?
প্রথম কথা আমরা যে ড. আরেফিনকে উদ্ধার করতে এসেছি সেটা জানি আমি আর তুই, আর জানে আফরোজা আরেফিন। তিনি নিশ্চয়ই কাউকে বলবেন না।
সেটা আমিও জানি।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, রাতে আমাদের রুমে যখন হামলা হয় তখন পরিচিত একটা কণ্ঠ আমি শুনেছি।
পরিচিত কণ্ঠ?
হ্যাঁ, আহমদ কবিরের। ঐদিন রাতেও তাকে আমরা পেয়েছিলাম যে বাড়িতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার কাছে।
কিন্তু তিনি তো আমাদের পাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তিব্বত যাওয়ার!
সেটা করেছেন আমাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য। কারন তিনি জানতেন আমরা তিব্বতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার আগেই তিনি আমাদের খতম করতে পারবেন।
আমি এভাবে চিন্তা করিনি। ভালো পয়েন্ট।
টেবিলে নাস্তা দিয়ে গেল এই সময়। কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে রাশেদের দিকে তাকাল রাজু।
এই আহমদ কবির তোর আসল শত্রু না, তিনি শত্রু হলে নিজেই একটা কিছু করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি অপেক্ষা করেছেন, সময় নিয়েছেন, আলাদা লোক লাগিয়েছেন।
তোর কি ধারনা?
এর পেছনে অন্য কেউ আছে যাকে তুই চিনিস, কিন্তু বুঝতে পারছি না।
পাউরুটি আর ডিম খেতে খারাপ লাগছিল না রাশেদের। রাজুর প্রতিটি কথা যুক্তিসঙ্গত। আহমদ কবির লোকটাকে ভালো মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের সাথে মিশেছে লোকটা।
আমি জানি কে আমাদের পেছনে লেগেছে, রাশেদ বলল, শুধু খবরটা যাচাই করে নিতে হবে বাংলাদেশ থেকে।
কাকে সন্দেহ হয় তোর?
তুই চিনবি না, রাশেদ বলল, নাস্তা করে এখানে কোথাও সাইবার ক্যাফেতে যাবো। কোদারির বাস সেই দুপুরের দিকে।
হাসল রাজু।
আমার ধারনা তাহলে ঠিক, হ্যাঁ?
সত্যি বলতে কী, তোর মাথা ইদানিং বেশ চমৎকার চলছে, হেসে উত্তর দিলো রাশেদ, সেই সাথে হাতও, কোমরের দিকে ইশারা করলো যেখানে পিস্তল গুঁজে রাখা।
রেস্টুরেন্টের কাউন্টারে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল এইসময়। হাতে একটা ছবি নিয়ে কাউন্টারে বসা লোকটাকে দেখাচ্ছে। ছবিটা দূর থেকে বোঝ না গেলেও মনে হলো কাউন্টারে বসা লোকটা রাজু আর রাশেদের দিকে তাকাল। মাথা নীচু করে ফেলল রাশেদ, দেখাদেখি রাজুও। টেবিলটা শেষমাথায় একেবারে কোনায় বসানো, পুলিশ অফিসার একঝলক দেখে নিলো সবাইকে। তারপর এগিয়ে এলো রাশেদদের টেবিলটার দিকে।
পুলিশ আসতে দেখে কিছুটা অস্বস্তি হলেও চেহারা স্বাভাবিক রাখল রাশেদ। রাজু অতি স্বাভাবিক থাকতে গিয়ে টেবিলে একটা হিন্দি গানের তাল তুলছে। তাদের পাশে একটা চেয়ার খালি ছিল। পুলিশ অফিসার তাকাল দুজনের দিকে। চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল।
বুকে সাটা ব্যাজের দিকে তাকাল রাশেদ, রামনারায়ন লেখা সেখানে। এরচেয়ে বেশি কিছু জানার প্রয়োজন নেই আর। এক কাপ চা দিয়ে গেল বেয়ারা পুলিশের সামনে। আয়েশ করে চা খেল পুলিশ। আড়চোখে বারবার রাশেদ আর রাজুর দিকে তাকাচ্ছে।
আপনারা বাঙ্গালি? পরিস্কার হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল পুলিশ অফিসার। চা খাওয়া শেষ হয়েছে। বুক পকেট থেকে ভাঁজ করা ছবিটা বের করে আনল। মেলে ধরল দুজনের সামনে।
হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়েছে রাশেদ। এবার ছবিটার দিকে তাকাল। পরিচিত একটা চেহারা। প্রশান্ত থাপার, এই ছেলেটাই তাদের দুজনকে নিয়ে গিয়েছিল গত পরশু রাতে, না চেনার প্রশ্নই আসে না।
এই লোকটাকে চেনেন?
মাথা নাড়ল রাশেদ, না-সূচক।
মজার ব্যাপার কি জানেন, এই প্রশান্ত থাপাকে মৃত উদ্ধার করা হয়েছে, শহরতলীর একটা বাসা থেকে। তার সাথে দুজন যুবককে দেখা গিয়েছিল যে রাতে সে মারা যায়।
আচ্ছা,মদু কণ্ঠে বলল রাশেদ।
প্রশান্ত থাপা বাংলাদেশে একসময় অনেকদিন ছিল। আপনাদের সাথে কোনভাবে ওর পরিচয় হয়েছিল?
কখনোই না, এবার বেশ জোরের সাথে বলল রাশেদ, রেস্টুরেন্টের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
দেখুন, পর্যটকদের আমরা বিরক্ত করি না, আসলে আমাদের দেশটাই তো টিকে আছে পর্যটনের উপর। তবু, আরেকবার ভাবুন তো, কোথাও একে দেখেছেন কি না?
সত্যি বলছি, এই ছবিটা দেখার আগে এই চেহারা কখনো চোখেই পড়েনি, রাশেদ বলল।
ঠিক আছে, আপনারা কোন হোটেলে উঠেছেন?
উত্তর কি দেবে বুঝতে পারছে না রাশেদ, যে হোটেলে উঠেছিল সেটার নাম বললে ঝামেলা হতে পারে। পুলিশ অফিসার নিশ্চয়ই জানে সেখানে গতরাতে গোলাগুলি হয়েছে। আবার উল্টোপাল্টা নাম বললেও সমস্যা, সেখানে খোঁজ করতে গেলে তাদের কোন হদিসই পাবে না, তাতে উলটো সন্দেহ বাড়বে।
হোটেল ড্রিম প্লাজা, এই নামটা সকালে আসার পথে চোখে পড়েছিল রাশেদের, সেটাই বলল।
রাজুকে দেখে মনে হলো সে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
ঠিক আছে, প্রয়োজন হলে আপনাদের আবার খুঁজে নেবো, বলে উঠে দাঁড়াল রামনারায়ন। এনজয় ইউর স্টে।
থ্যাঙ্কস, অস্ফুট স্বরে বলল রাশেদ।
পুলিশ অফিসার বের হওয়ার সাথে সাথে উঠে পড়ল রাশেদ। বিল চুকিয়ে দিয়ে বাইরে চলে এলো।
এখন দুটি কাজ সামনে। একটা সাইবার ক্যাফেতে যাওয়া, খবরটা যদিও দেশের মাটিতেই দেখে এসেছিল, প্রিজন ভ্যান থেকে আকবর আলী মৃধার পলায়ন, কিন্তু সেই মৃধা যে নেপাল পর্যন্ত চলে আসবে সেটা কল্পনা করা কঠিন। অন্য কাজটা হচ্ছে কোদারির বাসের জন্য অপেক্ষা করা। বাস আসতে যদি দেরি হয় তাহলে প্রয়োজনে জিপ ভাড়া করতে হবে।
***
অন্ধকারাচ্ছন্ন পথটা দিয়ে হাঁটছে মিনোস। একটু আগেও দিনের আলোয় চারপাশ আলোকিত ছিল, অথচ এখন কেমন অদ্ভুত এক পরিবেশে পা বাড়িয়েছে সে নিজের অজান্তেই। পথটা সরু, আঁকাবাঁকা, এখানে সেখানে মাকড়সার ঝুল। কিছু কিছু জায়গায় বুনো জংলী ঝোঁপ পথটা ঢেকে রেখেছে। চারপাশ থেকে অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যাচ্ছে, সাপের হিসহিস, বাঘের গর্জন, হায়নার ডাক। এসব কিছুকে অগ্রাহ্য করে একটানা হেঁটে চলেছে মিনোস। এই পথের শেষেই আছে তার পুরষ্কার। যদিও সেই অদ্ভুত আলো সত্যিই আছে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। অনেকটা পথ হেঁটে একটু দাঁড়াল মিনোস। চারপাশে তাকাল, উপরে দেখল। মাথার উপর মেঘ সুৰ্য্যকে ঢেকে রেখেছে। অদ্ভুত শব্দগুলো এখন বদলে গেছে। মানুষের চিৎকার, হাহাকার, আর্তনাদ এই ধরনের বিকৃত শব্দে কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। কিন্তু মন বলছে এসব মায়া, তাকে আসল লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য। বুড়োর কথা আর ম্যাপ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই পথের শেষেই পাওয়া যাবে সেই অদ্ভুত আলো। সামনে এক পা বাড়াল মিনোস, কেন জানি মনে হচ্ছে এবার প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে দিতে হবে।
পা দেয়ার সাথে সাথে চমকে উঠলো মিনোস। পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, দুপাশের বুনো জংলী গাছের ডাল ধরে কোনমতে নিজেকে সামলাল। পা সরিয়ে চুপচাপ দাঁড়াল। সামনের বেশ অনেকটা জায়গা এখন ফাঁকা। মাটি ধ্বসে গিয়ে বিশাল এক খাদ তৈরি হয়েছে। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকাল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারময় খাদের তলদেশ দেখা যাচ্ছে না, নীচু হয়ে একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে খাদে ফেলল। পতনের শব্দ পাওয়া গেল না, পাথরের টুকরোটা সম্ভবত পড়ছে। আর পড়ছে। এই খাদ পার হয়ে ওপাশে যেতে হবে। একটু এদিক-সেদিক হলে মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।
কয়েক পা পিছিয়ে এলো মিনোস। সামনের ফাঁকা অংশটা পার হওয়া তার জন্য অনেক কঠিন একটা কাজ। কিন্তু এখন পিছিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। এতোদূর এসে হার মানতে রাজি নয় সে। আরো দুপা পেছাল, মাপ নেয়ার চেষ্টা করছে মনে মনে। অনেকদূর থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিলে হয়তো এই খাদ পার হওয়া সম্ভব হতেও পারে। আরেক পা পিছিয়ে বুঝতে পারল সমস্যা অন্যদিকে। পেছনেও ধ্বস শুরু হয়েছে।
কোনমতে স্থির হয়ে দাঁড়াল মিনোস। সারা শরীর ঘেমে গেছে তার এরমধ্যে। পেছনেও ঠিক একই মাপের একটা খাদ তৈরি হয়েছে। তারমানে সামনে এগুনো ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার সামনে।
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো মিনোস। চোখ বন্ধ করে বুকে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করল নিজের সাথে, এতো সহজে হার মেনে নেয়ার জন্য জন্মায়নি সে। তিন-চার পা দৌড় দিয়েই ঝাঁপ দিতে হবে। এতো বড় খাদ এভাবে পাড়ি দেয়ার ঝুঁকি নেয়া আত্মহত্যার সামিল।
এক পা এগিয়েই ঝাঁপ দিলো মিনোস…
হ্যাঁ, ঝাঁপ সে দিয়েছিল, সাহস করেই। তারপর অনেকটা পালকের মতো ভেসে ভেসে খাদের ওপারে পৌঁছেছিল। অদ্ভুত! এমনটা কখনো তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু এখনো সেই দৃশ্যটা চোখে ভাসে। নীচে অতল গভীর অন্ধকার, তার উপর দিয়ে পালকের মতো হাল্কা একজন মানুষ ভেসে গিয়ে খাদের অপর পাশে পড়ল। গায়ে কাটা দিয়ে উঠে এখনো ভাবলে। বাস্তব কখনো কখনো কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায়। তিনি নিজে যেমন, সাধারন কোন মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না, তার ভেতর কী শক্তি লুকিয়ে আছে, অনেক সময় তিনি নিজেও সেটা জানেন না।
যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া দুজনকেই চোখে চোখে রাখছেন। গত কিছুদিন ধরে বোঝার চো করেছেন এদের আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। বিনোদ চোপড়া খুব কঠিন মানুষ না, খুব সহজেই তাকে বোঝা যায়। অ্যান্টিক শিকারি এই মানুষটি তার সঙ্গে আছে বিচিত্র অভিযান আর দারুন কোন অ্যান্টিক সংগ্রহের আশায়, যা সে হয়তো কোটি টাকায় বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু যজ্ঞেশ্বরের মনোভাব বোঝা যাচ্ছে না, ইদানিং আগের হাসিখুশিভাবটা নেই, সবসময়ই চিন্তিত। উদাস হয়ে কিছু একটা ভাবে। চাইলে ওর মনের কথা জেনে নিতে পারেন, কিন্তু যজ্ঞেশ্বর একসময় নিজে এসেই বলবে তার কাছে, আপাতত এটুকু মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে চান।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শীতল হাওয়া বইছে। বুকের মধ্যে কেন জানি অদ্ভুত একটা উন্মাদনা টের পাচ্ছেন তিনি। যেন কিছু একটা তার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, অদ্ভুত শিরশিরানি একটা অনুভূতি। একটু পর রওনা দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বর তৈরি। দাঁড়ালেন তিনি।
হাওয়াটা কোনদিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করলেন। নীচু হয়ে একমুঠো ধুলো ছড়িয়ে দিলেন হাওয়ায়। পূর্ব দিক থেকে আসছে। নাক বাড়িয়ে দিয়ে কোন একটা গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। এবার কান পাতলেন, যেন বিশেষ কোন শব্দ শুনতে চাচ্ছেন। শব্দটা যেন ধরা দিয়েও দিচ্ছে না। বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে তার কাজকর্ম।
কি শুঁকছেন? জিজ্ঞেস করল যজ্ঞেশ্বর।
বিপদের গন্ধ।
বিপদ?
শুধু বিপদ না, মহাবিপদ। আর এক সেকেন্ড দেরি করা যাবে না, চলুন, বলে দৌড়াতে শুরু করলেন তিনি।
তার দেখাদেখি যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়াও দৌড়াচ্ছে। অন্ধকারে দৌড়াতে কষ্ট হলেও তারা শুধু তাদের সামনে লখানিয়া সিং-কে অনুসরন করছে। অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়াচ্ছে মানুষটা, তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে দুজনকে। এমনিতে মালপত্রসব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে লখানিয়া সিং। কিন্তু ওগুলোর ওজনও বিন্দুমাত্র গতি কমাতে পারেনি তার।
চাঁদ উঠেছে। তিনজন মানুষ দৌড়াচ্ছে, উঁচু-নীচু পথে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে। আরো দূরে আরো একজনকে ক্ষিপ্র গতিতে দৌড়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো পড়ে তার সারা শরীর কেমন চকচক করছে।
*
অধ্যায় ২৮
সারাদিনের ধকল শেষে তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছে দলটা। একটানা ধাওয়া করে অনেকদূর গিয়েছিল সুরেশ, কিন্তু জীপে সমস্যা থাকায় বাদ দিয়েছে। ঐ বুড়ো বৌদ্ধ লামাকে ধরতে পারলে কিছু না কিছু তথ্য পাওয়া যেতো ড. আরেফিনের ব্যাপারে। জীপটা অনেক পুরানো, চাইলেই বদলে ফেলা যায়, কিন্তু তাতে লোকজনের চোখে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। সাধারন গরীব একজন জীপচালকের পক্ষে নতুন জিপ কিনে ফেলা কিছুটা অস্বাভাবিক।
তাঁবুতে একা বসে আছে সুরেশ। ভাবছে। আরো চারটা ছোট ছোট তাঁবু আছে তার চারপাশে, মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে সেখানে চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট টর্চলাইট জ্বালিয়ে কোমরে লুকানোট্রান্সমিটার বের করে আনল সে। অত্যন্ত শক্তিশালী এই ট্রান্সমিটারের ফ্রিকোয়েন্সী আলাদা। চীনা গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তা বলয়ে এই ফ্রিকোয়েন্সী ধরা পড়ে না। হেডকোয়ার্টারে প্রতিরাতে রিপোর্ট পাঠাতে হয়, সাংকেতিক ভাষায়। সেই সাংকেতিক ভাষাও পরিবর্তিত হয় প্রতিদিন, যেমন আজ সে ব্যবহার করবে কোড নাইন। অজানা নয়জনকে উৎসর্গ করে এই কোডটা চালু করেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। সেই অজানা নয়জন যারা হাজার বছর আগেই এমন সব জ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন যার হদিস এখনকার বিজ্ঞানীরাও জানেন না। সম্রাট অশোকের নয়জন যারা সম্রাট নির্দেশে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছেন হিমালয়ের কোন দূর্গম অঞ্চলে যাতে সেই গুপ্ত জ্ঞান অসৎ কোন ব্যক্তির হাতে না পড়ে। এই কাহিনিগুলোকে নিছক গাল গল্পছাড়া আর কিছু মনে হয় না তার। কিন্তু তাদের দলেও এমন লোকজন আছে যারা বিশ্বাস করে অজানা নয়জনের অস্তিত্ব।
দুই মিনিটের মধ্যে ট্রান্সমিটিং শেষ করলো সুরেশ। ঘুম খুব সহজে আসবে না। বাইরে গিয়ে আগুনের পাশে কিছুক্ষন বসে থাকা যায়। চা খাওয়া যায়। তাঁবুর চেইনখুলে বাইরে এসে দাঁড়াল সে।
ড. লতিকা বসে আছে আগুনের সামনে। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে দিয়ে উষ্ণতা নেয়ার চেষ্টা করছে। মেয়েটা মৃদুভাষী, বিশেষ একটা দূরত্ব রেখে চলে সবার সাথে। দেখতেও বেশ, এমন একটা মেয়ে এখনো অবিবাহিতা ভাবতেও অবাক লাগে সুরেশের কাছে।
ড. লতিকার পাশে গিয়ে বসল সে। মেয়েটা তাকিয়ে হাসল।
লতিকা জি, ঘুম আসছে না? জিজ্ঞেস করল সুরেশ।
এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস নেই। আপনি জেগে আছেন যে, অনেক টায়ার্ড নিশ্চয়ই আপনি।
কিছুটা টায়ার্ড, তবে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবো আপনাকে।
৬০০
আরো কিছু টুকিটাকি কথা হচ্ছিল দুজনের মধ্যে। সুরেশের ডানদিকের তাঁবুর চেইন খুলে সন্দীপ বেরিয়ে আসতে গিয়েও লতিকা আর সুরেশের কথাবার্তা শুনে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। ব্যাপারটা চোখ এড়ায়নি সুরেশের। কোন কারনে লতিকার কাছে আসতে অস্বস্তি হয় সন্দীপের, এটুকু পরিস্কার বুঝতে পারল।
কথাবার্তা বিশেষ জমছিল না, কোন কারনে লতিকার মনও খারাপ। দুইজন চা হাতে নিয়ে আরো বেশ কিছুক্ষন গল্প করল। তারপর পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে যার যার তাঁবুতে ঢুকে পড়ল।
ছোট একটা বাতির আলোয় আলোকিত হয়ে আছে ড. লতিকার তাঁবুটা। সাধারনত কোন ধরনের অভিযানে গেলে এই বস্তুটা সাথে নিতে ভোলে না সে। এছাড়া সাথে থাকে কিছু বই, বেশিরভাগই নানা ধরনের এক্সপেডিশনের উপর। রাতে অন্তত একটা বই না পড়লে তার ঘুম আসে না। তবে আজ নানা কারনে বইয়ে মন বসাতে পারছিল না লতিকা।
এখানে আসার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সাম্ভালা নয়। আরো বড় একটা ব্যাপার আছে এর পেছনে। হামবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, অদ্ভুত এক সোসাইটি নিয়ে। অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ এখন সেই সোসাইটির সদস্য, ধারনা করা হয় হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পেছনের পটভূমিকায় ছিল এই সোসাইটি, অন্যভাবে নাৎসি বাহিনীর জন্মদাত্রী বলা হয় একে। থুল সোসাইটি। নামটাই অদ্ভুত। নাৎসি প্রতিষ্ঠার পরপরই থুল সোসাইটি তার গৌরব হারিয়েছে, হারিয়েছে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ইদানিং কালে এই ফুল সোসাইটির নানাধরনের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। অদ্ভুত চিন্তাভাবনা ধারন করে থুল সোসাইটির সদস্যরা। তারা ভ্রিলোলোজি নামক অদ্ভুত এক বিজ্ঞানের কথা বলে যেখানে ভ্রিল হচ্ছে এমন এক শক্তি যা দিয়ে যে কোন কিছু আয়ত্তে আনা যায় এবং এর সাধনার মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্যপ্রাপ্তি সম্ভব। ভ্রিলোলোজিতে আরো অনেক কিছুই বলা আছে, থুল সোসাইটি ইউরোপের গন্ডি ছাড়িয়ে এখন আমেরিকায়ও বিস্তার লাভ করছে। এই সোসাইটি একসময় মাটির সাথে প্রায় মিশে গিয়েছিল, কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশেষ একজনের নেতৃত্বে যেন নতুন জীবন লাভ করেছে। থুল সোসাইটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অদ্ভুত অদ্ভুত সব মিথের পেছনে লেগে আছেন সেই ভদ্রলোক, অন্তত সাম্ভালার মতো আজগুবি একটা বিষয়ের পেছনে ছোটা তার মতো বৈজ্ঞানিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির শোভা পায় না। থুল সোসাইটির মূল বিষয়টিই হচ্ছে হাজার বছর পুরানো, হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিস সভ্যতা, আসল আর্য জাতির বিবর্তন, ভ্রিল এবং এর ব্যবহার নিয়ে কাজ করা। এইসব মিথের সাথে সাম্ভালা অবশ্য খুব ভালোভাবেই যায়।
ড. কারসনই সম্ভবত সেই ভদ্রলোক যিনি থুল সোসাইটিকে চাঙা করেছেন, তেমন অকাট্য প্রমান অবশ্য লতিকার কাছে নেই। থাকলেও হয়তো তেমন কিছু করা যেতো না, বর্তমান পৃথিবীতে যে কেউ যে কোন মতবাদের বিশ্বাসী হতে পারে, তা অন্য মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হলেই হলো। আপাত দৃষ্টিতে থুল সোসাইটি এখনো মানবসমাজের জন্য ক্ষতিকর কিছু করেনি,তাদের ধ্যান-ধারনা এখন পর্যন্ত কাগজে কলমে আর চিন্তাভাবনার মধ্যেই সীমিত আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে আবার নাৎসি বাহিনীর মতো নতুন কোন দানব তৈরি করে বসবে না তার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। গত কিছুদিন ধরেই তাই ড. কারসনের চলাফেরা, কথাবার্তার উপর বিশেষ নজর রাখছে সে। এরমধ্যে একটা বিষয় তার নজর এড়ায়নি,ভদ্রলোকের নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিসপত্রের উপর দুটো বিশেষ সংখ্যা, ৫১১৩ আর ৬১১৮। এই সংখ্যাগুলোর মানে কী এখনো বের করতে পারেনি সে। এগুলো কি কোন অ্যাকাউন্ট নাম্বার, এমন কোন সংখ্যা যা থুল সোসাইটির বিশেষ কোন কার্যক্রম নির্দেশ করে, নাকি সাম্ভালার অবস্থানের নির্দেশক? সংখ্যাগুলো অবিরাম মাথার ভেতরে ঘোরে, কিছু একটা বলতে চায় যেন। সহজ কিছু, কিন্তু অল্পের জন্য ফস্কে যায় বারবার।
বালিশের তলায় বইটা খুঁজে রেখে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল লতিকা। পর্যাপ্ত পরিমানে শীতবস্ত্র পড়ার পরও বেশ ঠান্ডা লাগছে। উত্তর দিক থেকে শীতল হাওয়া হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে যেন। আগুন এখনো জ্বলছে, তবে নিভু নিভু। একটা কাঠের টুকরো দিয়ে জ্বলন্ত কয়লা উসকে দিলো লতিকা। আশপাশে পড়ে থাকা বেশ কিছু কাঠ ফেলল আগুনে। এবার বেশ বেগে জ্বলে উঠেছে আগুন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে উতা নিলো লতিকা।
পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে টের পেল। এই রাতে এখানে বহিরাগত কারো আসার কথা নয়। তবু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেও ভয় করছিল। আগুন্তক যেন বুঝতে পারল লতিকার ভয়, অভয় দেয়ার জন্য বলল, ভয় নেই লতিকা। আমি সন্দীপ।
ইচ্ছে হচ্ছিল উঠে যেতে, কিন্তু অভদ্রতা করতে কেমন বাঁধল লতিকার।
কিছু বলবেন? ঘাড় না ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করল সে।
আসলে বলার মতো কিছু নেই, পাশে বসল সন্দীপ, আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে, সরাসরি লতিকার দিকে তাকাতেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে তার।
বলার মতো কিছু নেই যেহেতু, তাহলে গুডনাইট মি. সন্দীপ, বলে উঠে দাঁড়াল লতিকা, তাঁবুর দিকে পা বাড়াল। এক হাত ধরে ফেলল সন্দীপ, কিন্তু এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে ঝড়ের গতিতে তাঁবুতে ঢুকে পড়ল লতিকা।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সন্দীপের বুক চিরে। এই ধরনের ব্যবহারই তার প্রাপ্য।
*
অধ্যায় ২৯
ছোট ছোট সাইবার ক্যাফে এখানে সেখানে। কম্পিউটারে সিনেমা দেখা ছাড়া আর কিছু। করেনি রাজু কোনদিন, তাই রাশেদের উপর ভরসা করা ছাড়া কোন গতি নেই তার। ইন্টারনেট স্পীড খুব একটা খারাপ না। একের পর এক সার্চ দিয়ে যাচ্ছে রাশেদ গুগলে, বাংলাদেশি বিভিন্ন পত্রিকার পুরানো সংখ্যা বের করে দেখছে। ঠিক কি খুঁজছে তা বুঝতে পারছে না রাজু। আকবর আলী মৃধা, লরেন্স ডি ক্রুজ, এই নামগুলো দিয়ে বারবার বিভিন্ন সাইটে খবর দেখার চেষ্টা করছে।
রাশেদকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। এরমধ্যে দুটো নিউজ তার নজর কেড়েছে। একটি আকবর আলী মৃধাকে নিয়ে, অপরটি লরেন্সকে নিয়ে। আকবর আলী মৃধা তার জন্য হুমকিস্বরুপ, অন্যদিকে লরেন্সকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারছে না। কোনভাবে লরেন্স যদি জেনে থাকে তারা তার পূর্বপূরুষের গুপ্তধনের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, তাহলেও সেও তাদের হন্যে হয়ে খুঁজবে।
আকবর আলী মৃধাকে নিয়ে একটি খবর ঢাকা থাকতেই জেনেছিল, পিশাচশ্রেনীর এই লোকটা এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তরের সময় পালিয়েছে। কিন্তু এখনকার খবরটা আগের খবরের ফলো-আপ বলা যায়। এখানে বলা হচ্ছে, আকবর আলী মৃধা সম্ভবত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় আছে, ভারত সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে এই ঘৃন্য অপরাধিকে বাংলাদেশের কাছে তুলে দেয়ার জন্য। যদিও এ ব্যাপারে এখনো কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এখানে এমন আশংকাও করা হয়েছে আকবর আলী মৃধা নাম পাল্টে ভারত থেকে পালিয়ে নেপাল চলে গেছে। এই লাইনটা আন্ডারলাইন করে রাখল রাশেদ। আকবর আলী মৃধা সম্ভবত এখন নেপালে এবং গতরাতের হামলার জন্য এই লোকটাই দায়ি। অন্যদিকে লরেন্স ডি ক্রুজ সম্পর্কে যে খবরটা এসেছে তা কিছুটা দুঃখজনক। পাহাড়ের ত্রাস সঞ্জয় সিংকে সরিয়ে সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও অস্ত্র ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিল লরেন্স, কিন্তু অতি সম্প্রতি তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ধারনা করা হচ্ছে লরেন্সের পরিণতি হয়তো সঞ্জয় সিংয়ের মতোই হয়েছে। তাকে একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে এবং কেউ যদি তার হদিস দিতে পারে তাহলে সংবাদদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে। লরেন্স মরেনি এটা নিশ্চিত রাশেদ, পূর্বপুরুষের গুপ্তধনের সন্ধান সে সারাজীবনই করবে। হয়তো সে কারনেই আত্মগোপন করেছে।
কাজেই পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে, আকবর আলী মৃধা এখন কাঠমুন্ডুতে এবং গতরাতের আক্রমনের জন্য দায়ি। তার সঙ্গি হচ্ছে আহমদ কবির। এছাড়া তার আরো সাঙ্গপাঙ্গ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আকবর আলী মৃধার সাথে একবারই দেখা হয়েছিল সরাসরি। লিলিকে অপহরন করেছিল লোকটা, বিনিময়ে চেয়েছিল অদ্ভুত সেই বইটা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রহস্যময় একজনের উপস্থিতির কারনে সেবার বেঁচে গিয়েছিল রাশেদ, সাথে ড. আরেফিনও ছিলেন। কিন্তু এবার পিছু ছাড়বে না লোকটা। দুই বছর হাজতবাসের প্রতিশোধ অবশ্যই নেবে। প্রিয় বন্ধু শামীম লোকটার প্রিয় ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও ওর প্রান নিতে একটুও বাধেনি।
দুপুর বারোটা বাজেনি। সাইবার ক্যাফের কাজ শেষ। ক্ষুধা লেগেছে বেশ, রাজুকে নিয়ে বাইরে চলে এলো রাশেদ। বাস আসবে দুটোর পর, এতোন বিনাকাজে এই এলাকায় ঘোরাঘুরি করাটা কঠিন হয়ে যাবে। অবশ্য চারপাশে পর্যটক গিজগিজ করছে। বছরের এই সময় হিমালয়ের উদ্দেশ্যে অভিযান কম হয়, নইলে এই স্কয়ারে নাকি আরো লোক সমাগম হতো।
দুটো টুপি কিনল রাশেদ, রাজুর মাথায় পড়িয়ে দিল একটা। রোদের হাত থেকে বাঁচার পাশাপাশি টুপিগুলোর কারনে তাদের চেহারা পুরোপুরি দেখা যাবে না, এই চিন্তাটাও কাজ করছিল। সামনে একটা মন্দির, হনুমানজীর। সেখানে পরিচিত চেহারাটা দেখে রাজুকে গুতো দিল রাশেদ। আহমদ কবির। তার আশপাশে আরো কিছু লোক আছে বোঝা যাচ্ছে। যোগাযোগ রাখার জন্য বারবার নিজের চারপাশে ছড়ানো লোকগুলোর দিকে তাকাচ্ছে আহমদ কবির। তার হাতে একটা মোবাইল ফোন।
ছোট একটা দোকানের আড়ালে চলে এলো রাশেদ, রাজুও এলো।
আহমদ কবির, আমাদের খুঁজছে, ফিসফিস করে বলল রাশেদ।
শুধু আহমদ কবির না, উনার সাথে আরো অন্তত পাঁচজন আছে, ঐ দেখ, বলে আঙুল দিয়ে ইশারায় আরো পাঁচজনকে দেখাল রাজু।
লোকগুলোর হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাউকে খুঁজছে। এরমধ্যে স্বাস্থ্যবান একজনকে বিশেষ পরিচিত মনে হলো। চোখে সানগ্লাস, গায়ে ভারি ওভারকোট পড়া থাকলেও তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা পরিচিত। সেই একবার দেখেছিল, তারপরও মনে হলো ভুল হচ্ছে না। এই লোকটাই আকবর আলী মৃধা। নিজে মাঠে নেমেছে এবার।
এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো আমরা? জিজ্ঞেস করল রাজু।
রাশেদ ভাবছিল কী করা যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই এ পাশে চলে আসবে দলটা। তার আগেই উধাও হয়ে যেতে হবে যে করেই হোক।
একটু দূরে রাস্তার পাশে একটা ট্যাক্সি দাঁড়ানো। ড্রাইভার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, যাত্রীর আশায়।
রাজুকে ইশারা করলো রাশেদ।
এক দৌড়ে ঐ ট্যাক্সির কাছে চলে যাবি, ঐ ট্যাক্সি ভাড়া করবি কোদারি গ্রাম পর্যন্ত, ভাড়া যা লাগে দেবো, রাশেদ বলল, যেতে রাজি হলে ইশারা করবি, আমি আসব তখন।
মাথা নাড়ল রাজু। চারপাশ দেখে নিলো একবার, আহমদ কবির আর তার দল এখনো অন্যপাশে দেখছে। যথাসম্ভব দ্রুত এবং নিঃশব্দে দৌড়ানোর চেষ্টা করল রাজু। কিন্তু হলো না। ইউরোপীয় একজন পর্যটকের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল নীচে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, যাতে দূর থেকে বোঝা না যায় এখানে কোন দূর্ঘটনা ঘটেছে, তাহলে হয়তো শত্রুপক্ষ টের পেয়ে যাবে। ইউরোপীয় পর্যটকের দিকে হেসে চোখ টিপল রাজু, যেন খুব আনন্দের ব্যাপার ঘটেছে। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গেল ট্যাক্সির দিকে।
কোমরে হাত দিয়ে পিস্তলের অস্তিত্ব বুঝে নিলো রাশেদ। রাজুর দিকে তাকাচ্ছে আবার আকবর আলী মৃধা আর তার দলবলের দিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। ওদের সবার কাছে অস্ত্র আছে এটা নিশ্চিত। সহজে ওদের হাতে ধরা দেবে না বলে ঠিক করল রাশেদ। তাতে যদি পিস্তলের ব্যবহার করতে হয়, কোন আপত্তি নেই তার। রাজু ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে, কথাবার্তার গতি খুব ধীর মনে হচ্ছে রাশেদের কাছে। রাজুকে আকবর আলী মৃধা চেনে না সম্ভবত, কিন্তু আহমদ কবির তো চেনে। এমন খোলা জায়গায় যতো কম সময় থাকা যায় ততোই ভালো। কিন্তু রাজুকে দেখে মনে হচ্ছে কম ভাড়া না হলে অন্য ট্যাক্সি দেখবে সে। রাজু এদিকে তাকাচ্ছেও না, তাকালে হয়তো ইশারায় ট্যাক্সিটা নিয়ে ফেলতে বলতো রাশেদ। আকবর আলী মৃধার অবস্থান এখন খুব কাছেই। যে কোন সময় রাশেদ যে দোকানের পাশে আড়াল নিয়েছে সেখানে চলে আসতে পারে।
বেশ কিছুক্ষন পর মনে হলো ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে রাজুর কথাবার্তা ফলপ্রসু হয়েছে। পেছনের দরজা খুলে বসে পড়েছে রাজু। ট্যাক্সিটা দোকানের পাশ দিয়েই যাবে, তখনই হয়তো তুলে নেবে রাশেদকে। দোকানের আড়াল থেকে আরেকবার আকরব আলী মৃধার অবস্থানটা দেখে নেয়ার জন্য মাথা বাড়াল রাশেদ।
অবাক কান্ড, কেউ নেই সামনের খোলা জায়গাটায়। অনেক দূরে শুধু আহমদ কবিরকে দেখা যাচ্ছে, বাইনোকুলার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সাথের লোকগুলো আর আকবর আলী মৃধা গেল কোথায়?
প্রশ্নটার উত্তর পেতে দেরি হলো না। পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল রাশেদ। আকবর আলী মৃধা তার অবস্থান টের পেয়ে গেছে, দোকানের অন্যপাশ দিয়ে পেছন থেকে আসছে। ঘুরে তাকিয়ে লোকটাকে দেখে নিলো রাশেদ, এই লোকটাই আকবর আলী মৃধা। এগিয়ে আসছে তার দিকে, কোমরে হাত, আগ্নেয়াস্ত্র বের করে আনবে যে কোন সময়।
এই সময় ঝড়ের গতিতে ট্যাক্সি ড্রাইভার এসে দাঁড়াল পাশে, মাথা নীচু করে একেবেকে দৌড় দিল রাশেদ, রাজু পেছনের একটা দরজা খুলে রেখেছে পেছনের সীটে বসেই। প্রায় ড্রাইভ দিয়ে ট্যাক্সিতে ঢুকে পড়ল রাশেদ, একটা গুলি ট্যাক্সির পেছনের বডিতে লাগল এই সময়। সম্ভবত সাইলেন্সর লাগানো আছে রিভলবারে, ধারনা করল রাশেদ। ড্রাইভার এক্সেলেটরে চাপ দিয়েছে সর্বশক্তিতে। চাকার ঘর্ষনের শব্দে আশপাশের পর্যটকরা চমকে রাস্তা ছেড়ে দিল। আকবর আলী মৃধা সোজা দাঁড়িয়ে আছেন, হাতের রিভলবারটা তাক করে আছেন রাশেদের দিকে। মাথা নীচু করে ফেলল রাশেদ, রাজুকেও বাধ্য করল। বুলেটটা ট্যাক্সির জানালার কাঁচে ছিদ্র করে চলে গেল। আকবর আলী মৃধাকে এবার দৌড়াতে দেখল রাশেদ। মাথা অল্প উঁচু করে বাকিদের অবস্থান দেখে নিলো। যতো দ্রুত সম্ভব এই এলাকা ছাড়তে হবে।
এবার ট্যাক্সির চাকা বরাবর বেশ কিছু বুলেট খরচ করলেন আকবর আলী মৃধা। রাশেদ দেখল বেশ দক্ষতার সাথে এগিয়ে চলেছে তাদের ট্যাক্সিটা। ড্রাইভার বেশ পাকা হাতে পর্যটকদের এড়িয়ে বড় রাস্তায় উঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এলোপাথারি গাড়ি চালানোতে আশপাশের সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। যে যার মতো দৌড়াচ্ছে। এদের পাশ কাটিয়ে যেতে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে ড্রাইভার।
এবার আহমদ কবিরকে পাশ কাটালো ট্যাক্সি, বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে লোকটা রাশেদ আর রাজুর দিকে, বুঝতে পারছে না কিভাবে চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে তাদের শিকার।
সামনে রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়, তার মাঝে একেবেকে চালাচ্ছে ট্যাক্সি চালক। রাজুর দিকে তাকাল রাশেদ, কোমরের দিকে ইশারা করলো। মাথা ঝাঁকাল রাজু, কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে আনল।
ড্রাইভারকে কতো দিয়েছিস? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
যা দিয়েছি তাতে আগামী তিন-চারমাস কাজ না করলেও চলবে ওর, রাজু বলল।
ভেরি গুড, রাজুর পিঠে আলতো করে চাপড় দিলো রাশেদ, দিন দিন বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে রাজু, খুবই ভালো লক্ষন। কোথায় যাচ্ছি আমরা?
তিব্বত সীমান্তে, কোদারি, যেখান থেকে ড. আরেফিন শেষবার যোগাযোগ করেছিলেন।
ভেরি গুড, বলল রাশেদ, সামনে তাকাল, রাস্তা প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, গতি বাড়িয়ে দিয়েছে ড্রাইভার, পেছন থেকে ধাওয়া করলেও খুব সহজে নাগাল পাবে না ওদের। তবে আকবর আলী মৃধা যে পেছন পেছন আসবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই রাশেদের। এতোদূর আসতে পেরেছেন আর বাকিটা পারবেন না সেটা অসম্ভব।
কাঠমুন্ডু শহরের বাইরে চলে এসেছে ট্যাক্সি, সীটে হেলান দিয়ে বসল রাশেদ। ট্যাক্সি এখন হাইওয়েতে চলছে। রাজুর দিকে তাকাল, বেশ ফুর্তিতে আছে মনে হলো। বারবার জানালা দিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, হাসছে কোন কারন ছাড়াই।
কাজ আরো কঠিন হয়ে গেল, ভাবছে রাশেদ। আগে শুধু ড. আরেফিনকে নিয়ে চিন্তা করলেই হতো, এখন বিষফোঁড়ার মতো যোগ হয়েছে পুরানো শত্রু, আকবর আলী মৃধা।
***
আকাশে চাঁদ উঠেছে সুন্দর। চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল মিচনার। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে। কোন দিকে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার প্রতিপক্ষ জেনে গেছে সে আসছে। সেভাবেই এগুচ্ছে মানুষটা এখন। ঠিক হাতের নাগালে চলে এসেও যেন ফসকে যাচ্ছে। এখানে তিনজন মানুষ ছিল। প্রত্যেকের গন্ধ আলাদা করে চিনতে পারল মিচনার। ঠিক কিভাবে বসেছিল, শুয়ে ছিল বা পাথরে হেলান দিয়ে বসেছিল, প্রতিটি অংশ মনে মনে কল্পনা করে নিলো। পাথরে হেলান দিয়ে যে বসেছিল সেই তার প্রতিদ্বন্ধী। লোকটা চারদিকে নিজের ছাপ রেখে গেছে, এতে ব্যাপারটা আরো ঝামেলাপূর্ণ মনে হচ্ছে মিচনারের কাছে। ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে যাতে বোঝা না যায় ঠিক কোনদিকে গেছে সে। ডানে-বামে এগুলো মিচনার। দুটো দিকেই মানুষটার গায়ের গন্ধ পাওয়া গেল, বাকি দুজনের কোন গন্ধ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। তিনজন মানুষের আলাদা আলাদা গন্ধ এখন আর নেই। সব মিলে মিশে এক হয়ে গেছে।
ফিরে এসে সেই পাথরটায় হেলান দিয়ে বসল মিচনার। এখানে বসে প্ল্যান করেছে তার প্রতিপক্ষ। এখানে বসে অনেক দূরে কিছু কিছু পাহাড় দেখা যায়, জোছনার আলোয় পাহাড়গুলোকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে যে কোন সময় নড়ে উঠবে, লম্বা লম্বা পা বাড়িয়ে হেঁটে আসবে তার দিকে। উঠে দাঁড়াল মিচনার, তার প্রতিপক্ষ ধীরস্থির, যে কোন কিছু করার আগে অনেকবার চিন্তা করে, ঠিক কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে তার পরিস্কার কোন ধারনা না থাকলেও লোকটার নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য আছে, গন্তব্য আছে, সেই গন্তব্যটা জানা থাকলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যেতো।
আজ এখানেই বিশ্রাম নেবে বলে ঠিক করল মিচনার। এই এলাকাটা জনমানবহীন, কাজেই দিনের আলোয় ওদের পিছু নিতে কোন সমস্যা হবে না। পাথরে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল মিচনার, ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু ঘুমালে চলবে না তার। ঘুমের অপর নাম মৃত্যু।
এবার হাঁটতে থাকল সে। ঠিক কোনপথে এখান থেকে প্রতিদ্বন্ধী লোকটা চলে গেছে, তা বোঝার চেষ্টা করছে সে। ঐ লোকটা ক্ষিপ্রগতির হলেও সঙ্গি দুজন ততোটা ক্ষিপ্ত নয়। এখানে সেখানে কিছু কিছু চিহ্ন রেখে গেছে। সেই চিহ্ন ধরে ঢিমে তালে হাঁটছে মিচনার। কোথায় পালাবে লোকটা, মুখোমুখি হতেই হবে। সেই সময় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত।
*
অধ্যায় ৩০
খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে সুরেশের, সবার জন্য নাস্তা তৈরি করে ফেলল সে কিছুক্ষনের মধ্যে। তারপর ক্যাম্পের চারপাশে এক চক্কর দৌড়ে নিলো। প্রচন্ড শীতের মধ্যেও ঘাম ঝরাতে পেরে ভালো লাগছে তার। এতোক্ষনে সবার উঠে পড়ার কথা। একা একা কফি খেতে খারাপ লাগছিল না। পাঁচ মিনিট পরই ড. কারসন পাশে এসে বসলেন। ওর মগে কফি ঢেলে দিলো সুরেশ।
গুড মর্নিং, ড. কারসন, হেসে বলল সুরেশ।
গুড মর্নিং, কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন ড. কারসন, তুমি খুব ভালো কফি বানাও সুরেশ।
থ্যাঙ্কস।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে ড. লতিকা আর সন্দীপও যোগ দিলো। লতিকাকে বেশ সতেজ দেখাচ্ছিল, অন্যদিকে সন্দীপকে দেখে মনে হচ্ছিল রাতে ঘুম হয়নি ঠিকমতো। বাকি দুজনকে কফি ঢেলে দিলো সুরেশ। শুকনো খাবার হিসেবে সাথে কিছু টোস্ট আনা হয়েছে, কিন্তু কোন আগ্রহ দেখা গেল না কারো মধ্যে। সম্ভবত টোস্ট জমে শক্ত হয়ে গেছে যে কামড় বসানোই কঠিন। যদিও জিপের ড্রাইভারের কাছে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না, একটু দূরে বসে কফিতে ডুবিয়ে টোস্ট খাচ্ছে সে।
পরস্পরকে শুভ সকাল বলা শেষ। চারজন বসে নিরবে কফি খাচ্ছে। ড. কারসন সবার দিকে তাকালেন। তিনি কিছু বলবেন বলে উশখুশ করছেন।
লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা, ড. কারসন বললেন, খুব সাবধানে এগুতে হবে আমাদের। ড. আরেফিন থাকলে খুশি হতেন, কিন্তু এখন তাকে ছাড়াই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, এছাড়া আমাদের কয়েকজন লোক লাগবে, সামনে এমন জায়গায় যাবো যেখানে জিপ নিয়ে যাওয়া যাবে না…
আমার একটা প্রশ্ন ছিল,সন্দীপ বলল কথার মাঝখানে।
ঠিক আছে, প্রশ্ন করুন মি. সন্দীপ, ড. কারসন বললেন, কথার মাঝখানে কেউ আটকে দিলে সাধারনত মেজাজ খারাপ হয় তার, কিন্তু আজ নিজেকে সামলে নিলেন খুব ভালোভাবেই।
সাম্ভালা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মতামতগুলো আপনাকে আগেই বলেছি, আমার ধারনা এর সাথে পৃথিবীর বাইরের কোন শক্তি জড়িত, গতকাল রাতে তার একটা সামান্য প্রমান আমি পেয়েছি।
একটু নড়েচড়ে বসল সবাই, কি প্রমান? জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।
আকাশে বেশ কিছু গোলাকার বস্তু দেখেছি আমি, অনেকটা ইউএফওর মতো, হাতে মোবাইল ছিল, তাতে কিছু ছবি তুলতে পেরেছি, যদিও জিনিসগুলো বেশিক্ষন ছিল না আকাশে।
সন্দীপ মোবাইল ফোনটা বাড়িয়ে দিল ড. কারসনের দিকে। সবাই ঝুঁকে পড়ে তাকাল মোবাইল স্ক্রীনের দিকে। কালো অন্ধকার আকাশে ছোট ছোট সাদা ফোঁটার মতো কিছু জিনিস চোখে পড়ছে। ওগুলো কি আসলেই ফ্লাইং সসার কি না তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
এই ছবিগুলো পরিস্কার না, ড. কারসন বললেন, তাছাড়া সাম্ভালার সাথে ইউএফওর কোন যোগাযোগ থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।
আমি কিছু বলতে চাই এক্ষেত্রে, এবার সুরেশ বলে উঠল, সবাই তাকাল তার দিকে, এই জিনিসগুলো আপনিই প্রথম লক্ষ্য করেছেন তা কিন্তু নয়। তিব্বত-ভারত সীমান্তে প্রায়ই এই জিনিসগুলো লক্ষ্য করা যায়। ভারত সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং ধারনা করা হয়, এই ধরনের দূর্গম এলাকায় চীন সরকারের কোন সামরিক পরীক্ষাগার আছে, সেখানে এমন ধরনের বাহন তৈরির প্রচেষ্টা চলছে যা তৈরি হলে তাদের সামরিক বাহিনী হয়ে উঠবে অপ্রতিরোধ্য। ভারত সরকার অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে তিব্বত-ভারত সীমান্তের এই এলাকাগুলোতে। এছাড়া এইসব অঞ্চলে সাধারন মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেশ কয়েক বছর হলো। আমি নিজে এই ধরনের একটি প্রজেক্টে কাজ করছি।
ইন্টারেস্টিং, হতাশ দেখাল সন্দীপকে, আমার আর কিছু বলার নেই।
ধন্যবাদ, সন্দীপ, ড. কারসন বললেন, তো যা বলছিলাম, আমাদের কিছু লোকজন দরকার, যারা আমাদের মালপত্র বহন করবে, পাশাপাশি খননকাজে সাহায্য করবে। সুরেশ, অন্তত চারজন লোকের ব্যবস্থা করবে তুমি, আজকের মধ্যে।
তাহলে আর দেরি করা ঠিক হবে না, এক্ষুনি বেরুতে হবে, সুরেশ বলল, সবচেয়ে কাছের জনপদ এখান থেকে বেশ দূরে, আমি একটা জিপ নিয়ে যাচ্ছি।
ঠিক আছে, যাও, ড. কারসন বললেন। নাস্তা শেষ করে আমার তাঁবুতে আসবেন মি. সন্দীপ, তুমিও এসো, বলে উঠে দাঁড়ালেন ড. কারসন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে রওনা দিলো সুরেশ। ক্যাম্প থেকে হাত নাড়ালেন ড. কারসন। আপাতত এই একজনের উপরই যতো ভরসা তার। বাকি দুজন এখনো নাস্তা করছে চুপচাপ। নিজের তাঁবুর দিকে এগুলেন তিনি। আর বেশি দূরে নেই তিনি, সন্দীপের তোলা ছবিগুলো তাই প্রমান করে।
***
টানা অনেকক্ষন দৌড়ে এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন, এই ধরনের জায়গায় সাধারনত বৌদ্ধ লামারা থাকে, পাহাড়ের চূড়ায় বা খাঁজে লুকানো গুম্ফা। অন্যান্য গুম্ফার মতো এই গুফাটা পাহাড়ের চূড়ায় না বানিয়ে একটা গুহার মধ্যে বানানো হয়েছে। গুম্ফা একধরনের বৌদ্ধ মন্দির, এখানে তারা সাধনায় বসে, নির্বান লাভের সাধনায় জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়া উর্ধ্বে চলে যায় তারা। পৃথিবীর কোলাহল থেকে দূরে, সব ধরনের আশা-আকাংখাকে পিছু ফেলে এমন একেকটা গুফা হয়ে দাঁড়ায় তাদের বাসস্থান। এখানে অতিরিক্ত কোন কিছু রাখার অবকাশ নেই, জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় যা যা দরকার তার সবই থাকে গুফাতে। নেপাল, তিব্বত, ভূটান, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গুম্ফাগুলো। কিছু কিছু গুম্ফার ইতিহাস হাজার বছর প্রাচীন।
বাইরে এখনো চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে পৃথিবী, ছোট এই গুম্ফাটা ভালো করে পর্যবেক্ষন করে দেখলেন তিনি। গুফাটা পরিত্যক্ত। বেশ অদ্ভুত লাগল, এই ধরনের গুফা সাধারনত খালি থাকে না। মনে হচ্ছে এখানে গত কয়েক বছরে কারো পা পড়েনি। বাইরে থেকে কোন ধরনের আলো এখানে আসে না, তাই স্যাঁতস্যাঁতে আর ফ্যাকাশে ভাবটা প্রবল। এক কোনায় মোমবাতির সলতে আর গলা মোম দেখা গেল। অল্প কিছু কাঠের তৈরি জিনিস এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে। যে এখানে থাকতো খুব অল্প সময়ের মধ্যে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেছে। অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে পারেনি,গৌতম বুদ্ধের মূর্তি আছে একটা, পাথর কেটে বানানো, হয়তো ভারি বলে নিয়ে যায়নি সাথে। সাথে টর্চ ছিল, গুম্ফার একেবারে শেষের দিকে জায়গাটায় অন্ধকার যেন দানা বেঁধে আছে, যজ্ঞেশ্বরকে ইশারায় কাছে ডাকলেন তিনি। সন্ন্যাসীর কাছেও একটা টর্চ আছে, বেশি ভেতরে যাওয়ার আগে দেখে নেয়া উচিত। কোথায় কোন বিপদ ঘাপটি মেরে আছে বলা যায় না। বিনোদ চোপড়াকে গুফার বাইরে রাখা হয়েছে পাহারা দেয়ার জন্য। এখন পর্যন্ত কোন বিপদ সংকেত আসেনি তার কাছ থেকে।
একপা একপা করে এগুচ্ছেন তিনি। সাথেই যজ্ঞেশ্বর, লোকটার চেহারায় ভয়ের ছাপ পড়েছে। একজন সন্ন্যাসী মানুষের এতোটা ভয় পাওয়ার কথা না, জীবনটাই যাদের ঈশ্বরের সেবায় উৎসর্গিত তাদের ভয় পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমি কিছু ভয় সব মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু থাকে। আদিম ভয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে অন্ধকারের ভয়। সেই ভয় মানুষকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যতদিন না তারা আগুন আবিষ্কার করেছে। সেই ভয়ের বীজ এখনো মানুষ তার জিনে ধারন করে। এখনো অন্ধকার হলে মানুষের প্রথম চেষ্টা থাকে আলোর ব্যবস্থা করা।
গুম্ফার পেছনের দিকের অংশটা অস্বাভাবিক শীতল। কোনমতে টর্চ ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে যজ্ঞেশ্বর। ডানে-বামে আলো ফেললেন তিনি, স্তূপ করে ফেলে রাখা কিছু জিনিস চোখে পড়ল একেবারে কোনার দিকে। ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝার উপায় নেই। বেশ অনেকগুলো টংকা, একটার উপর একটা সারি করে সাজানো। দীর্ঘদিন মানুষের হাত পড়েনি বোঝাই যাচ্ছে। হাঁটু গেড়ে বসে আস্তে করে উপরের টংকাটা তুলে নিলেন হাতে। টর্চের আলোয় রঙিন টংকা যেন ঝলমল করে উঠল। জিনিসগুলোর বয়স হবে অনেক, একটু ছোঁয়াতেই কেমন পড়ে যেতে চাইল হাত থেকে। যজ্ঞেশ্বরকে ইশারা করলেন আরো কাছে টর্চ ধরতে। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটা টংকা সাজানো আছে, একটার উপর একটা রাখা। টংকাগুলো সিল্কে তৈরি, রঙবেরঙের সুতো দিয়ে এমব্রোয়ডারি করে ছবিগুলো আঁকা হয়েছে। হাজার বছরের কম হবে না বয়েস। মুখে হাসি ফুটল তার। এগুলো ঠিকঠাকভাবে নিয়ে যেতে পারলে বিনোদ চোপড়ার সমস্যা মিটে যাবে, ইউরোপীয় যাদুঘরে কিংবা ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করতে পারবে। যজ্ঞেশ্বরকে ইশারা করলেন ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে আসার জন্য। সন্ন্যাসী চলে গেলে টংকাগুলোকে আবার দেখে নিলেন। সবার উপর যে টংকাটা ছিল, সেটা গৌতম বুদ্ধকে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছে। মাঝখানে একটা বিশাল পদ্মফুলের মাঝে ধ্যানে মগ্ন বুদ্ধ। তার চারপাশে সবুজ সাগর আর নীল আকাশ, সেখানে বিচরনরত অনেক প্রানী। সেকালের তিব্বতীরা টংকায় এমন রঙ ব্যবহার করতে যা বছরের পর বছর অবিকৃত থেকে যেত। গুম্ফার এই কোনাটা বেশ শুকনো, হয়তো এ কারনেই অনেক বছর পরেও টিকে আছে টংকাগুলো।
যজ্ঞেশ্বর ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে এলো। সাথে এলো বিনোদ চোপড়া। ঠিক যতোটা আশা করেছিলেন তার চেয়ে বেশি খুশি দেখাচ্ছে বিনোদ চোপড়াকে। কিন্তু ব্যাগটা আপাতত নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ধীরে-সুস্থে টংকাগুলোকে ব্যাগে ভরে বের হয়ে এলেন গুম্ফা থেকে। পাহাড়ের খাঁজ কেটে বানানো এই গুম্ফাটা খুব ভালো আশ্রয়স্থল হতে পারে। কিন্তু এটা এমন এক জায়গা যেখানে একবার আটকা পড়ে গেলে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো অবস্থা হবে, বের হওয়ার পথ থাকবে না। তার প্রতিপক্ষ কতোটা শক্তিশালী তা জানা নেই। এটুকু বোঝা গেছে, খুব সহজ হবে না লোকটাকে হারানো। এর আগে অল্পের জন্য ঝামেলা এড়ানো গেছে, যতোক্ষন পর্যন্ত সাম্ভালার খোঁজ না পাওয়া যায়, প্রতিপক্ষকে নিয়ে ভাবতে চান না তিনি। তাই যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করছেন সব কাজে। এমন কোন চিহ্ন রেখে যেতে চান না যাতে খুব সহজেই তার নাগাল পেয়ে যায় প্রতিপক্ষ।
তবে আজ রাতটা অন্তত গুফায় কাটানো যায়। যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া দুজনেই বেশ অনেকটা পথ দৌড়ে ক্লান্ত।
গুম্ফার মাঝখানে পড়ে থাকা মোমে আগুন জ্বালালেন তিনি। সঙ্গি দুজন ঘুমিয়ে পড়ল গুম্ফার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। উথাল-পাতাল জোছনায় মনে আবার উড়ে চলে গেল হাজার বছর আগের কোন এক দিনে।
হ্যাঁ, খাদটা পার হয়েছিল মিনোস অদ্ভুতভাবেই। খাদের এপাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল সে। এমন অসম্ভবকে সম্ভব করার কথা স্বপ্নেও কখনো ভাবেনি।
এছাড়া একটু আগেও চারপাশ যেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এসেছিল, এখন দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করেছে। আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারদিক, পথের দুপাশে নাম না জানা অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফুটে আছে, চমঙ্কার শীতল বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। হাঁটতে কোন কই হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে সে। সামনে কী আছে যদিও জানা নেই, কিন্তু ভয় বলে কোন কিছু অনুভব করছে না মিনোস। বরং সময়টা উপভোগ করছে। এই পরিবেশ, এই ভেসে ভেসে যাওয়া, এর সবই হয়তো তার দিবাস্বপ্ন, ঘুম ভাঙলেই দেখবে নৌকায় শুয়ে আছে, ঢেউয়ের দোলায় নৌকা অল্প অল্প দুলছে।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর পথ শেষ হয়ে এলো। হঠাৎ করেই পথ রোধ করে আকাশ কুঁড়ে চলে গেছে বেশ কিছু পাহাড়। এরমধ্যে তিনটি পাহাড় সবচেয়ে উঁচু। পাহাড় তিনটি যেন প্রকৃতির আশ্চর্য্য খেয়ালে তৈরি। দৈর্ঘ্য, উচ্চতা আর প্রস্থে প্রায় সমান। উপরের দিকে পাহাড় তিনটির চুড়াগুলো পরস্পরের সাথে মিশে গেছে যেন। ঠিক এরকম তিনটি পাহাড় চুড়াই আঁকা আছে পোড়া মাটির ফলকে। এর মাঝখানে সেই গোলাকার আলোকবর্তিকা। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব? পাহাড়গুলো নিরেট পাথরের, এগুলোর মাঝখান দিয়ে যাওয়ার কোন পথই চোখে পড়লো না মিনোসের।
বৃদ্ধের কথা মনে পড়ে গেল। এমন একটা জায়গার কথা বুড়ো মানুষটা জেনেছিলেন কিভাবে? আর জানলে তিনি নিজে কেন চেষ্টা করলেন না অদ্ভুত সেই আলোকবর্তিকার কাছে যেতে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য বৃদ্ধ বেঁচে নেই আজ।
শীতল বাতাসের গতি বাড়ছে, খোলা জায়গায় বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। দৌড়ে পাহাড়গুলোর দিকে এগুল মিনোস। সুৰ্য্য এখন মেঘে ঢেকে গেছে, চারপাশ আবার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এ সবই কি কোন পরীক্ষা? তার সাহসের? যে পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে পারবে সে-ই যেতে পারবে আলোকবর্তিকার কাছে? এসব প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে, ভাবল মিনোস। কোনভাবেই সাহস হারানো চলবে না। পরীক্ষা কি না জানে না, তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই পুরো আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো। মনে হচ্ছে রাত নেমে এসেছে হঠাৎ করেই। শীতল হাওয়ার গতিবেগ বাড়ছে। সোজা উপরে উঠে যাওয়া পাহাড়গুলোর নীচে কোন আশ্রয় নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। বৃষ্টি শুরু হলো এরমধ্যে। বৃষ্টি অনেক দেখেছে মিনোস, কিন্তু বড় বড় ফোঁটায় মুষলধারে এমন বৃষ্টির মুখোমুখি হয়নি কোনদিন। পাথরের টুকরোর মতো বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা শরীরে পড়ছে। কোনমতে মাথার উপর দুহাত দিয়ে দৌড় দিলো মিনোস, অন্ধকারে দ্বিগিবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল একবার, সারা শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে, বজ্রপাতের শব্দে কানা তালা লাগার যোগাড়। কিন্তু ভুক্ষেপ করছে না মিনোস। অন্ধের মতো দৌড়াচ্ছে। খোলা জায়গার দিকে না গিয়ে পাহাড়গুলোর পাশ দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আবার হোঁচট খেল। এবার সোজা মাথায় আঘাত লেগেছে, জ্ঞান হারাল মুহূর্তেই।
ভেতরে খুটখাট শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, বহু শতাব্দি পুরানো জীবন থেকে মুহূর্তেই ফিরে এলেন কঠিন বাস্তবে। মোমের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে গুম্ফা। ঢোকার মুখে একপাশে বিনোদ চোপড়াকে দেখলেন, শুয়ে আছে, ভারি কম্বল গায়ে দিয়ে। ওর পাশে যজ্ঞেশ্বরের শুয়ে থাকার কথা। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর নেই। হাতের টর্চ দিয়ে গুফার শেষ মাথায় আলো ফেললেন। হ্যাঁ, যজ্ঞেশ্বর আছে। উবু হয়ে বসে কি যেন দেখছিল। টর্চের আলোর আভাস পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, চেহারা দেখতে পেলেন না তিনি দূর থেকে। তবে সন্ন্যাসী দুহাত তুলে দিয়েছে নিজের অজান্তেই। হয়তো ভেবেছে আক্রমন করতে যাচ্ছেন তিনি।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। লোকটার পেছনে সেই ব্যাগটা যেখানে টংকাগুলো রাখা হয়েছিল। সবগুলো টংকা এখন বাইরে। মনে হচ্ছে বেশ অনেকক্ষন ধরেই ওগুলো ঘাঁটছিল যজ্ঞেশ্বর।
যজ্ঞেশ্বরজী, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, শান্ত গলায় বললেন তিনি, হাত নামান।
বেশ অপ্রস্তুত দেখাল যজ্ঞেশ্বরকে।
টংকাগুলোতে কি খুঁজছিলেন?
যজ্ঞেশ্বর নিরুত্তর।
নির্দ্বিধায় বলতে পারেন আমাকে, বললেন তিনি, আরেকটু এগিয়ে গেলেন।
যজ্ঞেশ্বর পিছিয়ে গেল এক পা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার।
এই টংকাগুলোতে বিশেষ একটা ছবি আছে, ধীরে ধীরে বলল যজ্ঞেশ্বর, ভেবেছিলাম, আপনাকে বলবো, তবে পরে।
পরে কেন?
আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম।
কিসের ছবি, আমাকে বলুন?
সেই হারিয়ে যাওয়া নয়জনের ছবি, আমি নিশ্চিত না, কিন্তু মনে হচ্ছে এই লোকগুলোই সম্রাট অশোকের সেই রহস্যময় নয়জন।
এ ব্যাপারে আমার তেমন কিছু জানা নেই, নিজের অজ্ঞানতা স্বীকার করতে দ্বিধা করলেন না তিনি।
এই লোকগুলো সম্ভবত তিব্বতের কোথাও লুকিয়ে আছে, অন্তত দুহাজার বছর ধরে। ওদের কাছে আছে গুপ্তজ্ঞান, সাতটি বিশেষ বই। যখন বুঝলাম আপনি বিশেষ কিছুর খোঁজে তিব্বতে যাচ্ছেন, আমিও সঙ্গি হলাম। অনেক শুনেছি এই ব্যাপারে, মনে হলো চেষ্টা করে দেখি।
এ কথাটা আমাকে আগে বললেই পারতেন।
বলিনি,ভেবেছিলাম পরে কোন একসময় বলবো।
এগিয়ে গেলেন তিনি, যজ্ঞেশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়ালেন।
আগেই বলেছি, আমাদের সবার লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য আলাদা, বললেন তিনি, ঐ টংকাটা দেখা যাবে?
মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি, দেখাদেখি যজ্ঞেশ্বরও বসল। পেছন থেকে ব্যাগটা এনে ভেতর থেকে টংকাগুলো বের করে মেঝের উপর রাখল সাবধানে। এর আগে গুনে দেখেননি ঠিক মতো, এবার গুনলেন তিনি, আটাশটা টংকা। যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকালেন, ইশারায় একটা টংকা দেখাল যজ্ঞেশ্বর।
মোমবাতির আধো আলোতে টংকাটা মেলে ধরলেন তিনি। এখানেও পদ্ম, তবে গৌতম বুদ্ধের পরিবর্তে নয়জন মানুষ নয়টা পদ্মে বসা। তাদের সবার হাতেই এক ধরনের পুঁথি। লাল আর সবুজ রঙের প্রাধান্য বেশি। পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করে ধরালেন তিনি। অল্পসময়ে টংকাটা আরো গভীর মনোযোগে দেখলেন। টংকার একেবারে উপরের দিকে ডান কোনায় সোনালী একটা গোলক চোখে পড়ল। লম্বা একটা দন্ডের উপর বসানো। খুব লক্ষ্য করে না দেখলে বোঝা কঠিন।
আপনার কি ধারনা যজ্ঞেশ্বরজী, হেসে বললেন তিনি, এই লোকগুলো এখনো জীবিত? বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে?
আমার মতো অনেকেরই ধারনা তারা বেঁচে আছেন, বিপদে আমাদের উদ্ধার করবেন, যজ্ঞেশ্বর বলল, এছাড়া আপনি যে জায়গার খোঁজ করছেন তেমন জায়গা যদি সত্যি সত্যি থেকে থাকে, তাহলে সেটাই তাদের বাসস্থান হওয়া উচিত।
কথাগুলোর গভীরতা বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বর খারাপ বলেনি,বেশ যুক্তি আছে। সাম্ভালার মতো জায়গা এঁদের জন্য আদর্শ বাসস্থান হতে পারে।
এছাড়া ঐ সোনালী গোলকটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন? টংকাটা দেখিয়ে বলল যজ্ঞেশ্বর।
হ্যাঁ।
সম্ভবত সাম্ভালায় প্রবেশের চিহ্ন ওটা। আপনার কি ধারনা?
আমার কোন ধারনা নেই, বলে উঠে পড়লেন তিনি, এই একটা টংকা ছাড়া বাকি সবগুলো বিনোদ চোপড়ার জন্য থাকবে।
একটা ছাড়া বাকি টংকাগুলো ব্যাগে গুছিয়ে রাখল যজ্ঞেশ্বর।
আপনি ঘুমাবেন না, লখানিয়া জী?
না, গুম্ফার প্রবেশপথের কাছে চলে এসেছেন তিনি, আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না।
***
এখানে দিন-রাত বলে কিছু নেই, সবসময় অন্ধকার। ভ্যানের পেছনে যেখানে তাকে রাখা হয়েছে সেখানে চোখ বেঁধে রাখার কোন প্রয়োজন নেই, এমনিতেই সেখানে খুব বেশি আলো ঢোকে না। ছোট একটা জানালা দিয়ে যে বাতাস ঢোকে তাতে মাঝে মাঝে দম নিতে কষ্ট হয় তার। এমন বিপদে পড়বেন জানলে হয়তো কখনোই এই ধরনের অভিযানে আসতেন না, কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব নিয়ে চিন্তা করা মানে সময়ের অপচয় করা। এরচেয়ে চিন্তা করা ভালো। গত কিছুদিন ধরে যে ধরনের শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে সারা জীবন এই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে, যদি জীবন নিয়ে ফিরতে পারেন তো।
আজ অনেকদিন হলো কাপড়-চোপড় বদলানো হয় না, গোসল করার তো প্রশ্নই আসে না। শীতল এলাকা, তাই ঘাম হচ্ছে কম, তবু কেমন অস্বস্তি হয় ড. আরেফিনের। একদিনও গোসল ছাড়া থাকতে পারেন না তিনি, অথচ এখানে দিনের পর দিন পানির স্পর্শ পাচ্ছেন না। ড. কারসন আর তার দলবল কী করছে কোন ধারনাই নেই। হয়তো এরমধ্যে সাম্ভলায় পৌঁছে গেছেন ওঁরা, কিংবা মরে পড়ে আছেন বরফে চাপা পড়ে, কিংবা ধরা পড়েছেন সাম্ভালার রক্ষকদের কাছে, অনেক কিছুই হতে পারে। তবে এটুকু নিশ্চিত তিনি, তাকে উদ্ধার করার জন্য কেউ আসছে না। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যা করার নিজেকেই করতে হবে।
ছোট-খাট একটা প্ল্যান করে রেখেছেন তিনি। আজ রাতে সেই প্ল্যান কার্যকর করা যাবে, ব্যাপারটা নির্ভর করছে খাবার নিয়ে আসবে কে তার উপর। দুজন আসে সাধারনত খাবার নিয়ে, তরুন চাইনীজ অফিসার নিজে, ওর ঐ লোকটা, যার গায়ে বেশ দুর্গন্ধ। দ্বিতীয়জন আসলে প্ল্যানটা কাজে লাগানো একটু হলেও সহজ হতে পারে।
বিকেল না সন্ধ্যা বুঝতে পারছেন না তিনি। ভ্যানের পেছনের দরজা খুলে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন। এই সময় কারো আসার কথা না। ধীর পায়ে লোকটা হেঁটে এলো তার কাছে। কোন দুর্গন্ধ পেলেন না, এমনকি তরুন চাইনীজ অফিসার যেমন তাড়াহুরা করে আসে, সেভাবেও আসেনি লোকটা। এ নিশ্চয়ই অন্য কেউ।
তার চোখের উপর থেকে একটানা কালো কাপড় খুলে ফেলল লোকটা। কিছুক্ষন চোখে অন্ধকার দেখলেন। সামনে দাঁড়ানো লোকটার পরনে গেরুয়া চোখে পড়ল শুধু। উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন এই সেই বৃদ্ধ লামা।
মুখের উপর বাঁধনটা খুলে দিলো বৃদ্ধ লামা। তাকে বেশ সহানুভূতিশীল মনে হলো হঠাৎ করে।
আপনি? অবাক কণ্ঠে বললেন ড. আরেফিন। আমি একজন শিক্ষক মানুষ, গবেষনার কাজে এখানে এসছি। এই ধরনের আচরন আপনার মতো একজন বৌদ্ধ লামার কাছে আশা করিনি।
উত্তেজিত হবেন না ড. আরেফিন, বৃদ্ধ লামা বললেন, বেশ চমৎকার ইংরেজি বলেন বৃদ্ধ। আপনাকে মুক্ত করে দেবো বলে ঠিক করেছি, তবে সেজন্য আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
আপনার শর্ত আমি জানি এবং পরিস্কার শুনে রাখুন, আমি শিক্ষক, গুপ্তচর নই, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ড. আরেফিন।
এবার ভ্যানে আরেকজনকে উঠতে দেখলেন তিনি, সেই তরুন চাইনীজ অফিসার।
সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, তাই না স্যার? বেশ ব্যঙ্গ করে বলল তরুন। আপনি ওকে আমার হাতে ছেড়ে দিন, বৃদ্ধ লামাকে উদ্দেশ্য করে বলল এবার।
আমি বৃথা রক্তপাত পছন্দ করি না, তুমি ভালো করেই জানো, ধমকের সুরে বললেন বৃদ্ধ লামা। ঠিক আগামীকাল সন্ধ্যায় আবার আসবো আমি, তখন রাজি না হলে এই তরুনকে আর ঠেকাতে পারবো না। ওর নৃশংসতার অনেক প্রমান আমি নিজে দেখেছি।
হাসলেন ড. আরেফিন, বেশ মজা পেয়েছেন বৃদ্ধের হুমকিতে।
ভালো থাকবেন, বললেন ড. আরেফিন, কাল আবার দেখা হবে… বাকিটুকু শেষ করতে পারলেন না, তরুন অফিসার মুখ আর চোখের উপর শক্ত করে কালো কাপড় দিয়ে বাঁধন দিলো।
একটু পর ভ্যানের পেছনের ডালা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলেন তিনি। ঠিক করে ফেললেন আজ যেই আসুক, প্ল্যান কার্যকর করতে হবেই।