ফেরাউনের গুপ্তধন
ফিলিস্তীনে খৃস্টানদের কনফারেন্স চলছে। যে কোন জয়, যে কোন পরাজয়, পিছুহটা কিংবা সফল অগ্রযাত্রার পর বৈঠকে মিলিত হওয়া তাদের নিয়ম। বসে তারা মতবিনিময় করে, মদপান করে ও নারী নিয়ে আমোদ করে। তাদের বিশ্বাস, মদ আর নারী ছাড়া যুদ্ধজয় করা যায় না। তারা নিজেদের মেয়েদেরকে মুসলমানদের এলাকায় গুপ্তচরবৃত্তি, নাশকতা ও মুসলিম শাসকদের চরিত্র হননের জন্য লেলিয়ে দিচ্ছে আর নিজেরা অধিকৃত এলাকাসমূহ থেকে মুসলমান মেয়েদের অপহরণ করে নিজেদের বিনোদন উপকরণে পরিণত করছে।
গোয়েন্দারা তাদেরকে রিপোর্ট প্রদান করল যে, সালাহুদ্দীন আইউবী বলে থাকেন, খৃস্টানরা হল নারী ব্যাপারী আর মুসলমান হচ্ছে নারীর সম্ভ্রমের মোহাফেজ। শুনে খৃস্টান সম্রাট ও কমান্ডারগণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। একজন উপহাস করে বলল, লোকটা এই সহজ কথাটা বুঝতে পারছে না যে, ক্রুশের পুত্ররা যেমন সৈনিক হয়ে ধর্মের কাঁজে তাদের দেহকে ব্যবহার করছে, তেমনি মেয়েরাও মুসলমানদেরকে বেকার করে তোলার জন্য নিজেদের দেহকে ব্যবহার করছে। আরেকজন বলল, সালাহুদ্দীন আইউবী এখনো টের পায়নি যে, তার জাতির অসংখ্য ছোট ছোট শাসক-কেল্লাদার ও সালারকে আমাদের এক একটি মেয়ে, সোনার এক একটি থলে এমনভাবে ঘায়েল করে রেখেছে যে, সেই পরাজয়ে তারা গর্ববোধ করছে এবং সুখ অনুভব করছে। এমতাবস্থায় সালাহুদ্দীন আইউবী আমাদের থেকে ইসলামের মর্যাদা কিভাবে রক্ষা করবে?
এ হল খৃস্টানদের প্রথম দিকের কনফারেন্সগুলোর বক্তব্যের সারাংশ। কিন্তু ১১৭৩ সালের শেষদিকে যখন বাইতুল মুকাদ্দাসে খৃস্টান সম্রাট ও নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন, তখন তাদের উপর অন্যরকম ভাব বিরাজ করছিল। এবার তারা সুলতান আইউবীকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছেন না। কারো মুখে হাসি নেই। কারো এ কথাও স্মরণ নেই যে, মদ-নারী ছাড়া তাদের বৈঠক চলে না। কার্ক থেকে তারা বড় লজ্জাজনক অবস্থায় পেছনে সরে এসেছে। তাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন কার্ক-এর কেল্লাদার রেজনাল্ডও। রেজনাল্ড একজন বিখ্যাত সমরবিদ। সুলতান আইউবীর বাহিনীর সঙ্গে তিনি বারকয়েক সংঘর্ষে লিপ্তও হয়েছিলেন। এ বৈঠকে উপস্থিত আছে রেমান্ডও, যিনি কার্ক অবরোধের সময় সুলতান আইউবীর বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছিলেন। রেমান্ড ও রেজনাল্ড দুজন মিলে এমন পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন, যা নিয়ে তারা বেজায় উস্ফুল্ল ছিলেন। কিন্তু সুলতান আইউবী কার্ক অবরোধ বহাল রাখতে সক্ষম হন এবং রেমান্ডের অবরোধ এমনভাবে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন যে, এবার তার বাহিনীই উল্টো সুলতান আইউবীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদের সব রসদ-পাতি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে সৈন্যরা আহত উট-ঘোড়াগুলো যবাই করে খেতে শুরু করে। তার অর্ধেকেরও বেশী সৈন্য আইউবীর হাতে মারা পড়ে। কিছু বন্দী হয় এবং অবশিষ্টরা পালিয়ে যায়।
রেজনাল্ড-এর ভাগ্য ভাল যে, নূরুদ্দীন জঙ্গীর বাহিনী যখন কার্ক দুর্গে ঢুকে পড়ে, তখন ভেতরের ভীত-সন্ত্রস্ত জনতার হৈ-হুঁল্লোড় ও ছুটাছুটির ফাঁকে তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যথায় আজ এই কনফারেন্সে তিনি অংশ নিতে পারতেন না।
আজকের এই বৈঠকে খৃস্টানদের সেই যুদ্ধবাজ সরদারদের বিপুলসংখ্যক উপস্থিত আছেন, যাদেরকে বলা হয় নাইট। এটি একটি উপাধি, যা রাজার পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়। কনফারেন্সে উপস্থিত আছেন আক্রার পাদ্রীও, যিনি ক্রুশের প্রধান মুহাফিজের মর্যাদায় ভূষিত। তাছাড়া উপস্থিত আছেন গে অফ লুজিনান, তার ভাই আমারলক ও মুসলমানদের প্রধান শত্রু ফিলিপ অগাস্টাস। নাইট ও অন্যান্য কমান্ডারদের সঙ্গে এ কনফারেন্সে উপস্থিত আছেন খৃস্টানদের সম্মিলিত ইন্টেলিজেন্স প্রধান হরমুন ও তার দু-তিনজন সহযোগী। প্রথম প্রথম সবাই চুপচাপ বসে থাকেন, যেন তারা কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। অবশেষে ফিলিপ অগাস্টাস প্রথম মুখ খুলেন। তিনি ক্রুশের প্রধান মুহাফিজ কে সভাপতি ঘোষণা করে তাকে উদ্বোধনী ভাষণ দেয়ার অনুরোধ জানান।
আমার সেই লোকদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে লজ্জা লাগছে, যারা শপথ ভঙ্গ করেছে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং বাইতুল মুকাদ্দাসে জীবিত ও সহীহ সালামত এসে পৌঁছেছে- আক্রার পাদ্রী বললেন- আমি যীশুখৃষ্টের কাছে লজ্জিত। ক্রুশ দেখলে আমার চোখ লজ্জায় অবনত হয়ে আসে। তোমরা কি সবাই ক্রুশে হাত রেখে অঙ্গীকার করনি যে, জীবন দিয়ে হলেও তোমরা তার দুশমনকে নির্মূল করবে! তোমরা কি এই শপথ নাওনি যে, পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য প্রয়োজন হলে নিজেদের জীবন, সম্পদ ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হবে না? কিন্তু তোমরা কজন এমন আছ, যাদের গায়ে সামান্য একটু আচড়ও লেগেছে? একজনও নেই! তোমরা শোবক দুর্গ মুসলমানদের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলে। এবার ফেলে এসেছ কার্ক। আমি জানি, যারা ময়দানে জয়লাভ করে, তারা মাঝে মধ্যে পরাজিতও হয়। দুটি জয়ের পর একটি পরাজয় কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু তোমাদের পরপর দুটি পরাজয়, দুটি পিছুটান প্রমাণ করছে যে, ক্রুশ ইউরোপেই বন্দী হয়ে গেছে এবং এমন একটি সময়ও আসন্ন, যখন ইউরোপের গীর্জাগুলোতে মুসলমানদের আযানের ধ্বনি গুঞ্জরিত হবে।
এমনটা কক্ষনো হবে না- ফিলিপ অগাস্টাস বললেন- ক্রুশের মহান মুহাফিজ! এমনটা হবে না কখনো। আমাদের এই পরাজয়ের পেছনে কিছু কারণ ছিল। আমরা বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখেছি এবং আপনার উপস্থিতিতে এখনও বিষদ পর্যালোচনা হবে।
সম্ভবত তোমরা ভেবে দেখনি যে, মুসলমানদের গন্তব্য এখন বাইতুল মোকাদ্দাস- ক্রুশের মহান মুহাফিজ বললেন- তোমরা কি জান না, সালাহুদ্দীন আইউবী বাইতুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করার শপথ নিয়েছিল? তোমাদের কি জানা নেই যে, বাইতুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা, যার স্বার্থে তারা আপন সন্তানদের পর্যন্ত কুরবানী করতে পারে?
আমরা মুসলমানদের মধ্যে গাদ্দারীর বীজ বপন করেছি- ফিলিপ অগাস্টাস বললেন- আমরা মুসলমানদের মধ্যে এত গাদ্দার তৈরি করেছি, যারা সালাহুদ্দীন আইউবী ও নূরুদ্দীন জঙ্গীকে বাইতুল মোকাদ্দাসের পথে বিভ্রান্ত করে পিপাসায় মেরে ফেলবে।
তাহলে সেই মুসলমানরা কারা, যারা তোমাদের হাত থেকে এত শক্ত দুটি কেল্লা কেড়ে নিল?- ক্রুশের মুহাফিজ বললেন- তোমরা এ কথাটা ভুলে যেও না যে, মুসলমান একটি কঠিন জাতি। মুসলমান গাদ্দারীর পথ অবলম্বন করলে আপন ভাইয়ের গলায়ও ছুরি চালাতে পারে। কিন্তু সেই গাদ্দার মুসলমানেরই মধ্যে যখন জাতীয় চেতনা জেগে উঠে, তখন নিজের গলা কাটিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত আদায় করে। মুসলমান গাদ্দারও যদি হয়ে যায়, তোমরা তাদের উপর ভরসা রেখ না। বেশী দূর যেতে হবে না, কেবল নিকট অতীতের দশটি বছরের ঘটনাবলীতে চোখ বুলাও। হিসাব করে দেখ, গাদ্দার মুসলমানরা তোমাদেরকে কতটুকু ভূখণ্ড দিয়েছে? মিসরে পা রাখার মত সাহস তোমাদের এখনো হয়েছে কি? আজ মুসলমান ফিলিস্তীনে বসে আছে। কাল তোমাদের বুকে এসে বসবে। মনে রেখ আমার বন্ধুগণ! সালাহুদ্দীন আইউবী ও নূরুদ্দীন জঙ্গী যদি তোমাদের থেকে বাইতুল মোকাদ্দাস কেড়ে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে ইউরোপকেও তোমরা ধরে রাখতে পারবে না। তবে সমস্যা ফিলিস্তীন- ইউরোপের নয়, সমস্যা পৃথিবীর কোন ভূখণ্ড নিয়ে নয়। আসল সমস্যা হল ক্রুশ ও ইসলামের। এটি দুটি ধর্ম ও দুটি আদর্শের লড়াই। এ দুটির যে কোন একটির পতন হতেই হবে। কিন্তু তোমরা কি ক্রুশের পতন মেনে নেবে?
না, পবিত্র পিতা! এমন কখনো হবে না- সভার পারিষদবর্গের মধ্যে জোশ সৃষ্টি হয়ে যায়- এত নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই মহান পিতা!
তাহলে তোমরা সেই কারণগুলো খুঁজে বের কর, যার ফলে তোমাদের একের পর এক পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে- ক্রুশের মুহাফিজ বললেন- আমি তোমাদেরকে যুদ্ধ সম্পর্কে কোন উপদেশ দিতে পারি না। আমি তো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সৈনিক, আমি কালীসার মুহাফিজ। আমি কালীসার কুমারীদের শপথ করে বলছি, তোমরা দশজন কট্টর মুসলমানকে আমার সামনে নিয়ে আস, আমি তাদেরকে ক্রুশের পূজারী বানিয়ে ফেলব। তোমরা একটু ভেবে দেখ, তোমাদের এত বিশাল শক্তিধর সেনাবাহিনী মুসলমানদের ক্ষুদ্রতম একটি বাহিনীর মোকাবেলা কেন করতে পারছে না? তোমাদের পাঁচশ আরোহী সৈনিককে একশ পদাতিক মুসলিম সৈনিক কিভাবে পরাস্ত করে? কারণ একটাই- মুসলমান লড়াই করে ধর্মীয় চেতনা নিয়ে। তারা যখন তোমাদের মোকাবেলায় আসে, আসে বিজয় কিংবা মৃত্যুর শপথ নিয়ে। আমি শুনেছি, তাদের কমান্ডাররা তোমাদের পেছনে চলে যায় এবং অতর্কিত হামলা করে তোমাদের কোমর গুঁড়িয়ে দিয়ে তোমাদের তীর খেয়ে চালনীর ন্যায় ঝাঁঝরা হয়ে যায় কিংবা নিরাপদে কেটে পড়ে। ভেবে দেখ, দশ-বারজন মুসলমান দলবদ্ধ হয়ে কিভাবে তোমাদের হাজার হাজার সৈন্যের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে? এ আর কিছু নয়- ধর্মীয় বিশ্বাস। তারা মনে করে, খোদা তাদের সঙ্গে আছেন, আছেন খোদার রাসূলও। এমন দুঃসাহসী অভিযানে তারা নির্দেশনা তাদের কমান্ডার থেকে গ্রহণ করে না, গ্রহণ করে কুরআন থেকে। আমি অতি মনোযোগ সহকারে কুরআন অধ্যয়ন করেছি। মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই করে, কুরআন তাকে জিহাদ বলে। জিহাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। এমনকি ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব নামাযের চেয়েও বেশী। কাজেই তোমরাও যতক্ষণ না নিজেদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা মুসলমানদের পরাজিত করতে পারবে না।
আক্রার পাদ্রী তার পরাজিত শাসকমণ্ডলী ও কমান্ডারদের মধ্যে নবপ্রেরণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন এবং বললেন, তোমরা নিজেরা বসে পর্যালোচনা কর যে, এসব পরাজয়ের কারণগুলো কী, এর দায়-দায়িত্ব কার কার উপর বর্তায় এবং কিভাবে এই পরাজয়গুলোকে বিজয়ে পরিণত করা যায়। নিজেদের সর্বশক্তি বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতি নিবদ্ধ কর। মনে রেখ, সালাহুদ্দীন আউবী ফেরেশতা নয়- তোমাদেরই ন্যায় একজন মানুষ। তার শক্তি শুধু একটাই যে, সে একজন পাকা ঈমানদার।
পাদ্রী বৈঠক ত্যাগ করে চলে যান।
পাদ্রীর চলে যাওয়ার পর সভাসদদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা-পর্যালোচনা ও বাকবিতণ্ডার পর তারা কতিপয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। একটি সিদ্ধান্ত এই যে, আমরা আর জবাবী আক্রমণ করব না; বরং সুলতান আইউবী ও নূরুদ্দীন জঙ্গীকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার এবং যুদ্ধ অব্যাহত রাখার সুযোগ প্রদান করব। তাদেরকে তাদের অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হবে এবং এদিক-ওদিক দিয়ে লড়াইয়ে জড়িয়ে রাখা হবে। এভাবে তাদের রসদ সরবরাহের পথ দীর্ঘ ও অনিরাপদ হয়ে পড়বে।
আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ইউনানী, লাতিনী ও ফ্রিংকীদেরকে অতিশীঘ্র প্রস্তুত করা হবে, যাতে তারা সমুদ্রের তীরে মিসরের উত্তর-পশ্চিমের এতটুকু এলাকা দখল করে নেবে, যাকে ঘাটিরূপে ব্যবহার করা যায় এবং ফিলিস্তীনের প্রতিরক্ষা ও মিসর আক্রমণে কাজে লাগান যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়, তাহল ইসলামী ভূখণ্ডে মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংসের কার্যক্রম তীব্রতর করে তুলতে হবে।
মিসরের সীমান্ত এলাকাগুলোতে মুসলমানদের মধ্যে কুসংস্কার ও ইসলামবিরোধী চিন্তা-চেতনা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে পরিচালিত খৃষ্টানদের যে মিশনটি সাফল্যের দোড়গোড়ায় উপনীত হওয়ার পর নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে, গোয়েন্দা মারফত সে সংবাদ কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে। গোয়েন্দারা খৃস্টান কর্মকর্তাদের কাছে এ সংবাদও পৌঁছায় যে, আমাদের নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেসব মুসলমানদেরকে দলে ভিড়িয়েছিল, তারাই তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
বৈঠকে এ তথ্যও পরিবেশন করা হয় যে, অধিকৃত এলাকাগুলোতে মুসলমানদের জীবনধারাকে দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে তারা দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। আমরা তাদেরকে শান্তিতে-নিরাপদে পালাতেও দিচ্ছি না। আমরা পলায়নপর কাফেলার পথরোধ করে তাদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছি এবং মেয়েদেরকে অপহরণ করে নিয়ে আসছি।
বৈঠকে এ পদক্ষেপটির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বলা হয় যে, মুসলিম নিধনের এটি একটি উত্তম পন্থা।
বৈঠকে একটি সিদ্ধান্ত এই গ্রহণ করা হয় যে, মুসলমানদের মধ্যে খৃস্টবাদের প্রচার করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন বিরাট অংকের বাজেট। এ কাজ পূর্ব থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে এবং অর্থও দেদারছে ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু তাতে কিছু সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে। একটি সমস্যা হল, যথাস্থানে অর্থ প্রেরণ করতে হচ্ছে উটের মাধ্যমে। বেশ কবার এমনও হয়েছে যে, অর্থ ও স্বর্ণমুদ্রা বোঝাই উট মিসরের সীমান্ত প্রহরীদের হাতে ধরা পড়েছে কিংবা দস্যুদের হাতে লুণ্ঠিত হয়েছে। এ সমস্যার সমাধানে এমন একটি পন্থা বের করে নেয়া দরকার যে, অর্থ-কড়ি, সোনা-দানা ও অন্যান্য মূল্যবান বস্তু সেখান থেকেই হস্তগত করা যায়, যেখানে এগুলো ব্যয় করতে হবে। দীর্ঘদিন যাবত এ নিয়ে মাথা ঘামান হচ্ছে। খৃষ্টানদের ইন্টেলিজেন্স প্রধান হরমুন সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানেরই ন্যায় অস্বাভাবিক বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। তিনি আগেই ভেবে ঠিক করে রেখেছেন যে, মিসরের ভূমি নিজের মধ্যে এত অধিক সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে, যা দ্বারা গোটা পৃথিবীকে ক্রয় করা সম্ভব। কিন্তু সেসব ধন-ভাণ্ডার হস্তগত করা আকাশের তারকা হাতে নেয়ার সমান। এসব ধন-ভান্ডার ফেরাউনদের সমাধিস্থলে পুঁতে রাখা আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, যখন কোন ফেরাউন মৃত্যুবরণ করত,তখন তার সঙ্গে তার রাজকীয় সব ধন-সম্পদ, সোনা-দানা, হিরা-জহরত পুঁতে রাখা হত। মিসর থেকে ফেরাউনদের এসব গুপ্তধন উদ্ধার করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার কথাই ভাবছেন হরমুন।
ফেরাউনদের দাফন করার জন্য মাটির নীচে বিশাল পরিসরের একটি মহল নির্মাণ করা হত। ফেরাউনরা নিজেরাই নিজেদের জীবদ্দশায় এই মহল তৈরি করে রেখে যেত। তার জন্য তারা এমন একটি স্থান বেছে নিত, যেখানে পৌঁছা কারো পক্ষে যেন সম্ভব না হয়। মৃত্যুর পর নিয়ম অনুযায়ী তাকে তথায় দাফন করে সমাধিস্থলটি এমনভাবে বন্ধ করে দেয়া হত যে, নির্মাণকারী কারিগররা ছাড়া অন্য কারো জানা সম্ভব হত না যে, এটি কিভাবে খোলা যাবে। দাফন কাজ সমাপ্ত করার পর মৃত ফেরাউনের স্বজনরা মহল নির্মাতা কারিগরদের মেরে ফেলত।
ফেরাউনদের বিশ্বাস ছিল, তারা খোদা। আরেক বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পরও তাদের এই প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বহাল থাকবে। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা পাহাড় কেটে এবং পাহাড়ের নীচে মাটি খনন করে প্রাসাদোপম হলঘর ও অন্যান্য কক্ষ তৈরি করিয়ে তাতে বিপুল পরিমাণ হিরা-জহরত ও সোনা রূপা গচ্ছিত রাখত। তাছাড়া ভেতরে লাশের সঙ্গে ঘোড়াগাড়ী, ঘোড়, গাড়োয়ান ও মাঝি-মাল্লাসহ নৌকা রেখে দিত। সেবার জন্য দাস-দাসী এবং সুন্দরী নারীও সঙ্গে দেয়া হত। সব মিলে অবস্থা এই দাঁড়াত যে, মারা গেল একজন মানুষ, আর তার সঙ্গে দাফন করা হল বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ ও অসংখ্য মানুষ। সবশেষে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এমনভাবে সমাধির মুখ বন্ধ করে দেয়া হত, যেখানে প্রবেশ করা দুনিয়ার কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
ফেরাউনী যুগের পরিসমাপ্তি ঘটার পর যখনই যে রাজা মিসরের শাসন ক্ষমতায় আসীন হন, সবাই ফেরাউনদের সমাধিগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সকলেই ব্যর্থ হন। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে ফেরাউনদের সমাধিসমূহ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তাদের কেউ কেউ সমাধির ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু তারা আর ফিরে আসতে পারেনি; কোথায় হারিয়ে গেছে, তা আর কারো জানা সম্ভব হয়নি। দুএকজন প্রাণ নিয়ে ফিরে আসলেও তারা আপাদমস্তক অন্যদের জন্য শিক্ষার উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণে একটি বিশ্বাস বদ্ধমূল যে, ফেরাউনরা খোদা ছিল না বটে, কিন্তু মৃত্যুর পরও তাদের কাছে এমন শক্তি রয়ে গেছে, যার বলে তারা সমাধিতে গমনকারীদের শাস্তি দিয়ে থাকে। মানুষের কাছে এ বিশ্বাস গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ হল, যখনই যে বাদশা যে কোন ফেরাউনের সমাধিতে হাত দিয়েছে, তার রাজত্বে পতন এসেছে। অনেকে আবার একই কারণে ফেরাউনদেরকে অপয়া বলেও মনে করে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর যুগেরও পূর্বে খৃস্টানদের জানা ছিল, মিসর গুপ্তধনের দেশ। খৃস্টানরা যে কটি কারণে মিসর দখল করতে চাইছিল, এটিও তার একটি কারণ। দীর্ঘ সংঘাত-লড়াইয়ের পর খৃস্টানদের কাছে যখন সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করে মিসরের দখল নেয়া কঠিন মনে হল, তখন তারা ভাবতে শুরু করল যে, মিসরীয়দের কারো দ্বারা-ই এসব গুপ্ত ধনভাণ্ডারের সন্ধান করতে হবে এবং সেই অমূল্য সম্পদ উদ্ধার করে কাজে লাগাতে হবে।
খৃস্টানরা যেভাবে হোক জানতে পারল যে, মিসর সরকারের পুরাতন কাগজপত্রে এমন কিছু তথ্য ও নকশা রয়েছে, যাতে কিছু কিছু সমাধির দিক নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু সেসব কাগজ উদ্ধার করা তো আর সহজ ব্যাপার নয়। খৃস্টানরা শুধু এ তথ্য নেয়ার জন্য মিসরে দক্ষ ও অভিজ্ঞ গুপ্তচর পাঠায় যে, কাগজগুলো কোথায় আছে এবং কিভাবে গায়েব করা যায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলদের হাত করা সম্ভব ছিল না। সুলতান আইউবী যে সময়ে কার্ক ও শোবকের লড়াই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং যে ঘোলাটে পরিস্থিতিতে তার অনুপস্থিতিতে মিসর ষড়যন্ত্রের উর্বর ভূমি ও বিদ্রোহের অগ্নিগর্ভের রূপ ধারণ করেছিল, সেই সুযোগে খৃস্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুন এ ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করেন যে, সুলতান আইউবীর সেনাবাহিনীর পদস্থ এক কমান্ডার আহমার দরবেশকে হাত করে নেন। আহমার ছিলেন সুদানী। তার বিরুদ্ধে গাদ্দারীর কোন অভিযোগ ছিল না। সুলতান আইউবীর পরম আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। তিনি সুলতান আইউবীর কমান্ডে যুদ্ধও করেছেন। সেনাবাহিনীতে বেশ সুনাম ছিল তার। পরে জানা গেল যে, এক খৃস্টান মেয়ে আহমারের মস্তিষ্কে সুদানপ্রেম ও সুলতান আউইবীর বিরোধী চেতনা জাগিয়ে তুলেছিল। এসথিনা নাম্মী এই মেয়েটি আহমারকে মিসরের সীমান্ত অঞ্চলের কিছু এলাকার শাসনক্ষমতা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল। লোকটি ছিল মুসলমান, কিন্তু খৃস্টানরা তার মাথায় এ দর্শন ঢুকিয়ে দেয় যে, তুমি আগে সুদানী, পরে মুসলমান।
নূরুদ্দীন জঙ্গী যখন কার্ক দুর্গ জয় করে নেন এবং সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরে গাদ্দারদের মূলোৎপাটনে ব্যস্ত, ততক্ষণে আহমার দরবেশ কয়েকজন খৃস্টান গুপ্তচরের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। তিনি কারো মনে এমন কোন সন্দেহ পর্যন্ত জাগ্রত হতে দেননি যে, তিনি দুশমনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছেন। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র পর্যন্ত তিনি সকলের কাছে এতই বিশ্বস্ত যে, অনায়াসে তিনি পুরনো দলিল-দস্তাবেজ পর্যন্ত পৌঁছে যান। সেখান থেকে তিনি খৃস্টানদের কাঙ্খিত কাগজপত্রগুলো চুরি করে নিয়ে আসেন।
আহমার দররেশ যা চুরি করে আনল, সেগুলো মূলত কাগজ নয়- কাগজ ও কাপড়ের মাঝামাঝি একটা কিছু। তাতে স্পষ্ট ভাষায় কিছু লেখা নেই, আছে কতগুলো আঁকিবুকি দাগ ও কিছু নকশা-নমুনা। লেখাজোখা কিছু থাকলেও তা সেই ফেরাউনী আমলের ভাষা, যা বুঝবার উপায় নেই।
আহমার দরবেশ কাগজগুলো খৃস্টানদের হাতে তুলে দেন। তারা অনেক চিন্তা-গবেষণা করে, তা থেকে যা উদ্ধার করে তার মর্ম হল, কায়রো থেকে প্রায় আঠার ক্রোশ দূরে একটি পরিত্যক্ত পাহাড়ী অঞ্চল অবস্থিত। যার ভেতরে সম্ভবত হিংস্র প্রাণীও অনুপ্রবেশ করে না। তার-ই অভ্যন্তরে এক স্থানে কোন এক ফেরাউনের সমাধি।
তথ্যটি কতটুকু সঠিক, তা কেউ জানে না। তবু ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখবে আহমার। এটা যে ফেরাউনের সমাধি, তার নাম র্যামন্স দ্বিতীয়। তার সমাধি অনুসন্ধান ও খনন করার জন্য খৃস্টানরা কায়রোতে কজন চতুর, বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ গোয়েন্দা প্রেরণ করে। মারকুনী তাদের দলনেতা। ইতালীর অধিবাসী মারকুনী একজন অভিজ্ঞ পর্যটক ও পর্বত বিশেষজ্ঞ। আহমারের নির্দেশনায় তারা এমন ছদ্মবেশ ধারণ করেছে যে, তাদের আসল রূপ ধরার উপায় নেই কারো। তাদের দুজন এখন আহমারের গৃহভৃত্য। আহমারের সহযোগিতায় এরা ফেরাউনদের সমাধি খনন করে মহামূল্য সম্পদ, হিরা জহরত উদ্ধার করবে। তারপর খৃস্টানরা সেই সম্পদ ব্যবহার করবে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজে, ফেদায়ীদের পেছনে ব্যয় করে সুলতান আইউবীকে খুন করাবে। বিনিময়ে যখন মিসর খৃস্টান কিংবা সুদানীদের দখলে আসবে, তখন খৃষ্টানরা আহমারকে কোন এক এলাকার গবর্নর বানাবে। এতকিছুর বিনিময়ে এই হবে আহমারের পুরস্কার। আহমার এ দায়িত্বও বরণ করে নিয়েছে যে, এই গুপ্তধন অনুসন্ধানকালীন যদি সুলতান আইউবী খৃস্টান কিংবা সুদানীদের উপর আক্রমণ করে বসেন, তাহলে তিনি তার বাহিনীকে আইউবীর যুদ্ধ পরিকল্পনার বিপক্ষে ব্যবহার করবেন।
মিসর থেকে ফেরাউনী গুপ্তধন উদ্ধার করে খৃস্টানদের হাতে তুলে দেয়াই এখন আহমারের একমাত্র মিশন। লোকটির দেল-দেমাগ সম্পূর্ণরূপে খৃস্টানদের কজায়। অভিযানের যে দুসদস্য ভৃত্যবেশে তার ঘরে অবস্থান করছিল, মারকুনীর নেতৃত্বে তাদেরকে সমাধি অভিমুখে রওনা করিয়ে দেন। তিনি। জায়গার নকশাটাও সঙ্গে দিয়ে দেন। অপর এক গোয়েন্দার মাধ্যমে হরমুনের নিকট সংবাদ পৌঁছান যে, গুপ্তধন অনুসন্ধানের অভিযান শুরু হয়ে গেছে। হরমুন কনফারেন্সে খৃস্টান সম্রাট প্রমুখদের অবহিত করেন যে, এ সমাধির সন্ধান যদি পেয়েই যাই, তাহলে তা থেকে যে পরিমাণ সম্পদ উদ্ধার হবে, তা দ্বারা মিসরীয়দের হাতেই মিসরের মূল উপড়ে ফেলা যাবে। হরমুনের মুখে সম্ভাব্য সাফল্যের আনন্দের দ্যোতি।
***
১৯৪৭ সালের মার্চ মাসের শেষ দিন। কায়রো থেকে আঠার ক্রোশ দূরে একস্থানে তিনটি উট দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি উটের পিঠে একজন করে আরোহী। প্রত্যেকের মুখমণ্ডল কাপড় দিয়ে ঢাকা। একজন চোগার পকেট থেকে চওড়া একটি কাগজ বের করে। খুলে গভীর দৃষ্টিতে দেখে সঙ্গীদের বলে, ঠিক আছে, জায়গা এটাই। তিনজনই উটের পিঠে বসা। তার ইশারা পেয়ে উট তিনটি সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
সম্মুখে দেয়ালের মত খাড়া দুটি টিলা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে সরু রাস্তা, যেখান দিয়ে একটি উট চলতে পারে। এক সারিতে উট তিনটি ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরের পর্বতগুলো আকারে এমন, যেন ছাদবিহীন বিশাল এক প্রাসাদ। বালির অন্তহীন সমুদ্রে এ পার্বত্য এলাকাটি তিন-চার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। বাইরে এখানে-ওখানে অনেকগুলো টিলা ও চত্বর। পেছনে শক্ত মাটির পাহাড়।
সূর্য অস্ত যাওয়ার অনেক আগেই এখানে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কেউ কখনো এ ভূতুড়ে পার্বত্য এলাকার ভেতরে প্রবেশ করার সাহস করেনি। করবেই বা কেন, এর অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করার প্রয়োজনই তো কারো হচ্ছে না। মরুভূমির মুসাফিরদের প্রয়োজন পড়ে শুধু পানির। কিন্তু এমন শুষ্ক পার্বত্য অঞ্চলে পানি পাওয়া যাবে ভুলেও তো ভাবে না কেউ।
এলাকাটি মানুষের কোন গমন পথের পার্শ্বেও নয়। মাইলের পর মাইল দূর থেকে চোখে দেখা যায় শুধু। এলাকা সম্পর্কে জনসমাজে অনেক ভীতিকর কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। মানুষ বলাবলি করে, এটি নাকি শয়তানের আড্ডাখানা। আল্লাহ যখন শয়তানকে আকাশ থেকে জমিনে নামিয়ে দেন, তখন শয়তান এখানেই অবতরণ করেছিল। সামরিক দিক থেকেও এলাকাটির কোন গুরুত্ত নেই। সে কারণে সৈন্যরাও কখনো এ এলাকার ভেতরে প্রবেশ করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
মিসরের এ ভয়ংকর ভূখণ্ডের ইতিহাসে এ তিনজন মানুষই বোধ হয় প্রথম, যারা এর অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করল। এর ভেতরে তাদের ঢুকতে হবেই। কারণ, পুরাতন দলিল-দস্তাবেজ ও নকশা এ স্থানকেই চিহ্নিত করছে। সন্দেহে ফেলে দিল শুধু নকশার একটি রেখা। রেখাটা একটি নদীর। কিন্তু এখানে কখনো কোন নদী ছিল না। চিহ্নিত স্থানে এখন চোখে পড়ছে অনেকখানি লম্বা একটি নিম্নাঞ্চল, যার প্রস্থ বার কি চৌদ্দ হাত। ভেতরের বালির আকার আকৃতি প্রমাণ করছে, শত শত বছর আগে এ পথে পানি প্রবাহিত হত। এই নিম্নাঞ্চলের পরিধি নিকটে কোথাও গিয়ে থেমে যাওয়ার পরিবর্তে চলে গেছে নীল দরিয়া অভিমুখে। উষ্ট্ৰচালকরা নিশ্চিত যে, তারা যে জায়গার অনুসন্ধান করছে, এটিই সে জায়গা।
অভিযানের দলনেতা মারকুনী ও তার দুসঙ্গী সবাই খৃস্টান। তারা সুলতান আইউবীর এক কমান্ডার আহমার দরবেশ- এর দিক-নির্দেশনায় ফেরাউন। র্যামন্স দ্বিতীয়-এর সমাধির অনুসন্ধানে এসেছে। নকশা অনুযায়ী সঠিক জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে তারা। এবার ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে নকশার তথ্য কতটুকু সঠিক।
মারকুনী স্বাভাবিক কণ্ঠে তার সঙ্গীদের বলল, নিজেকে খোদা দাবিদার ফেরাউন নিজের শেষ বিশ্রামাগার এ জাহান্নামে বানাতে এসেছে, তা আমার বিশ্বাস হয় না। আহমার ও হরমুন আমাদেরকে অনর্থক এক পরীক্ষায় ফেলে দিলেন!
মারকুনী কঠিনপ্রাণ মানুষ। হিম্মত হারাবার মত লোক নয়। সকলের সামনে এগিয়ে চলছে সে। পেছনে সঙ্গীরা। অনেকখানি ভেতরে ঢুকে পড়েছে তারা। এলাকার রূপ-আকৃতি একস্থানে একরকম। মাটির রং কোথাও গাঢ় বাদামী, কোথাও খয়েরী, কোথাও বা লাল। স্থানে স্থানে বালির উঁচু উঁচু ঢিবি। কোথাও মাটির খাড়া টিলা। ঢালু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বালি গড়িয়ে পড়ছে দেখা যাচ্ছে।
আরো অনেকখানি এগিয়ে যায় মারকুনী। সামনে আর পথ নেই। মারকুনী ডানে-বাঁয়ে তাকায়। একদিকে একটি টিলা চোখে পড়ে তার। টিলার মধ্যখানে এমনভাবে ফাটা, যেন ভূমিকম্পে ফেটে ফোকর হয়ে গেছে। মারকুনী সেই ছিদ্রপথে উঁকি দিয়ে দেখতে পায়, একটি গলিপথ চলে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। উটের চলা কঠিন হবে মনে হয়। তবু মারকুনী তার উটটি ঢুকিয়ে দেয় সরু গলির ভেতর। পেছনে পেছনে ঢুকে পড় অন্য দুজন সঙ্গীও। দুপার্শ্বের টিলার দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে চলতে শুরু করে উটগুলো। আরোহীরা পা বাইরে রাখতে পারছে না। তাই তুলে রেখে দিয়েছে উটের উপর। উটগুলোর পেটের ঘষায় টিলার দেয়ালের মাটি খসে নীচে পড়ছে। পথটা ক্রমেই উঠে গেছে উপরদিকে। মারকুনী এগিয়ে চলছে সঙ্গীদের নিয়ে। উটের পায়ের আঘাতে দুপার্শ্বের টিলা দুটো কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি টিলা দুটো ভেঙ্গে পড়ে দুদিক থেকে চাপা দিয়ে পিষে ফেলবে তিনটি উট ও তাদের চালকদের।
সামনে অগ্রসর হয়ে উপরদিকে তাকায় মারকুনী। দূর উপরে টিলার উভয় চূড়া পরস্পর মিশে গেছে। সম্মুখে আবছা অন্ধকার। কিন্তু দূরে একস্থানে আলোর মত চোখে পড়ে, যাতে মারকুনীর মনে আশা জাগে, ও পর্যন্তই গলি শেষ; তারপর প্রশস্ত জায়গা।
সরু গলিপথটি এখন যেন একটি সুড়ঙ্গ। উটের পায়ের আওয়াজ ভীতিকর এক গুঞ্জরণ সৃষ্টি করে চলেছে তাতে। মারকুনী সামনের দিকে এগিয়ে চলে। রাস্তা এখানে একটিই; ফলে পথ ভোলার আশংকা নেই। সামনে যে আলো পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আর সুড়ঙ্গপথ শেষ হয়ে আসছে।
মারকুনী সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছে। সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তারা। দাঁড়িয়ে যায় তিনটি উট। মারকুনী চারদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নতুন জায়গাটি দেখে নেয় এক নজর। এখানে চতুর্দিকে পুরাতন একটি দুর্গের সুউচ্চ অনেকগুলো প্রাচীর চোখে পড়ল। দুর্গটি মানুষের নির্মিত নয়- প্রাকৃতিক। এলাকাটি মূলত পাহাড়ী। পাহাড়গুলো তিন চারশ গজ পর্যন্ত ঢালু। কোনটি অনেক উঁচু, কোনটি নিচু। গোলাকার এই জায়গাটা চারদিক থেকেই বন্ধ বলে মনে হল। মারকুনী উটগুলো একস্থানে বসিয়ে রেখে সঙ্গীদের নিয়ে পায়ে হাঁটতে শুরু করল। বালি-মাটির পাহাড়। হাঁটতে হচ্ছে পা টিপে টিপে। পা ফসকে পড়ে যাওয়ার আশংকা প্রবল।
এলাকায় কোন রাস্তা পাওয়া গেল না। একটি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পায়ে হাঁটা যায়, এমন একটি ফাঁকা জায়গা। সে পথ ধরেই হাঁটছে মারকুনী ও তার সঙ্গীরা। এলাকার মাটি ও টিলা প্রমাণ করছে, শত শত বছর যাবত এখানে কোন মানুষের পা পড়েনি।
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর মারকুনী ও তার সঙ্গীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে। ডানদিকের পাহাড়ের কোলঘেঁষে পা টিপে টিপে হাঁটার চেষ্টা করছে অভিযাত্রী দল। বাঁ-দিকের এলাকাটি নীচের দিকে চলে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। এটি সুবিশাল ও গভীর এক গর্ত। এখান থেকে নীচে পতিত হওয়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু। গর্তের অপর পাড়েও উঁচু উঁচু পাহাড়।
তুমি কি বিশ্বাস কর যে, র্যামন্স ফেরাউনের জানাযা এ-পথে অতিক্রম করেছিল? মারকুনীকে জিজ্ঞেস করল তার এক সঙ্গী।
আহমার দরবেশ তো এ পথের কথাই বলেছেন- মারকুনী বলল- আমি নকশাটা যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তাতে বুঝা যায়, আমাদের রাস্তা এটিই। র্যামন্সের মৃতদেহ অতিক্রম করেছিল অন্য পথে। সে পথটি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সেটি ছিল একটি গোপন পথ, যা শত শত বছরের ব্যবধানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে পথটি খুঁজে বের করতে পারলে আমরা র্যামন্স-এর সমাধি পেয়ে যাব।
যদি বেঁচে থাকি, তবেই তো!
হ্যাঁ, আমি এ ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা দিতে পারি না- মারকুনী বলল-তবে এ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, সমাধি পর্যন্ত যদি পৌঁছতে পারে, তাহলে তোমাদের দুজনকে লাল করে দেব।
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর পথ এখন খানিকটা চওড়া। পার্শ্বের গর্তের পরিধিও শেষ হয়ে গেছে। সম্মুখে এমন দুটি পাহাড়, যার পাদদেশ একটির সঙ্গে অপরটি মিলিত। এ দুপাহাড়ের মধ্যখান দিয়ে তারা ঢুকে পড়ে। সামান্য অগ্রসর হওয়ার পর এখন সামনে আর পথ নেই। পাহাড় দুটি এখানে এসে মিলে গেছে। তারা বা-দিকে উপরে ওঠে যায়। শ খানেক গজ উপরে ওঠার পর সরু একটি গলি চোখে পড়ে। গলিটি সেখান থেকে বেয়ে গেছে নীচের দিকে। চারদিকের পাহাড়ী পরিবেশ অত্যন্ত ভীতিকর মনে হল। তারা সরু গলিপথ বেয়ে নীচের দিকে নেমে যায়।
কয়েকটি বাঁক ঘুরে আরা নীচে নেমে আসে। সম্মুখে বিশাল-বিস্তৃত সুগভীর এক খাদ। এত গভীর যে, খাদের তলদেশ দেখা যায় না। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। সে এক ভীতিকর পরিবেশ। গলিপথ অতিক্রম করে বাইরে বের হয়ে এ দৃশ্য দেখেই কয়েক পা পিছিয়ে আসে মারকুনী ও তার সঙ্গীরা।
এখানকার আবহাওয়া প্রচণ্ড গরম। মাটির সঙ্গে কি যেন এক ধাতু মিশ্রিত, যার তাপেই গরমটা এত অসহ্যকর। পাহাড়ের পাদদেশে বালুকারাশি চিকচিক করছে। সূর্যতাপ এত প্রখর যে, বালি থেকে খুঁয়ার মত উঠছে।
খাদের এক পার্শ্বে আপনা-আপনি গড়ে উঠা একটি দেয়াল চোখে পড়ল। এটি মূলত মাটি ও বালির টিলা, যা দেখতে দেয়ালের মত। টিলার উপরটা যতটুকু চওড়া, নীচটাও ঠিক ততটুকু। পুরু আধা হাতের বেশী হবে না। উপরটা কোথাও গোলাকার, যার উপর দিয়ে অতিক্রম করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তবে মারকুনীকে খাদ পার হতে হলে এই দেয়াল বেয়েই হতে হবে, যা পোলসেরাত অতিক্রম করার নামান্তর। দেয়ালটার দৈর্ঘ্য পঞ্চাশ গজেরও বেশী হবে। মারকুনীর এক সঙ্গী বলল, আমার মতে এর উপর দিয়ে অতিক্রম না করে তুমি আত্মহত্যার অন্য কোন ভাল পথ বেছে নাও।
গুপ্তধনের ভাণ্ডার রাস্তায় পড়ে থাকে না- মারকুনী বলল- আমাদেরকে এ পথেই অতিক্রম করতে হবে।
আর ফসকে নীচে জাহান্নামের আগুনে পড়তে হবে। বলল অপর সঙ্গী।
আমরা কি ক্রুশে হাত রেখে শপথ করিনি যে, ক্রুশের মর্যাদা ও ইসলামের মূলোৎপাটনের জন্য প্রয়োজনে আমরা জীবন দেব? মারকুনী বলল আমাদের সহকর্মীরা কি যুদ্ধের ময়দানে জীবন উৎসর্গ করছে না? আমি কাপুরুষের ন্যায় ফিরে গিয়ে আহমার দরবেশকে বুঝ দিতে পারি যে, শত শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেখানকার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে নদী ছিল, এখন সেখানে পাহাড় আর নকশার যেখানে পাহাড় দেখান হয়েছে, সেখানে এখন কিছুই নেই; কালের বিবর্তনে সব উলট-পালট হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কাপুরুষ সাজতে পারব না, আমি মিথ্যা বলব না। তোমাদের মত আমার মনেও ভয় ধরে গেছে। আমি তার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। তোমরা আমার মনের ভীতি বৃদ্ধি কর না বন্ধুরা। তোমরা যদি আমার সঙ্গ না দাও, তাহলে তা ক্রুশের সঙ্গে প্রতারণা বলে গণ্য হবে এবং তার শাস্তি হবে বেদনাদায়ক। আমি তোমাদের আগে আগে হাঁটব। কোথাও পা ফসকে পড়ার আশংকা দেখা দিলে বসে পড়বে; ঘোড়ার পিঠে যেভাবে বস, ঠিক সেভাবে। তারপর বসে বসেই সামনে অগ্রসর হতে থাকবে।
হঠাৎ গরম বাতাসের ঝাঁপটা তীব্র হতে শুরু করে। বাতাসের ঝাঁপটা খেয়ে বালুকারাশি উড়তে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো নারীর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। তারা শুনতে পাচ্ছে যে, দু-তিনজন নারী একযোগে উচ্চকণ্ঠে ক্রন্দন করছে। মারকুনীর সঙ্গীরা ঘাবড়ে যায়। মারকুনী কান খাড়া করে বিষয়টা অনুধাবন করার চেষ্টা করে। এক সঙ্গী বলল, এই জাহান্নামে কোন মানুষ জীবিত থাকতে পারে না; এরা মানুষ নয়- প্রেতাত্মা।
এসব কিছুই নয়- মারকুনী বলল- প্রেতাত্মাও নয়, জীবন্ত নারীও নয়। এটা বাতাসের শব্দ। এ এলাকায় কোন কোন টিলায় লম্বা লম্বা ছিদ্রপথ আছে, যা উভয় দিক থেকে ভোলা। কোন কোন টিলা এমন যে, সেগুলোর গা ঘেঁষে যখন বাতাসের ঝাঁপটা অতিক্রম করে, তখন এ ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়, যা তোমরা এ মুহূর্তে শুনতে পাচ্ছ। এতে আমাদের ভয় পাবার কিছু নেই।
তবু মারকুনীর সঙ্গীদের ভয় কাটছে না। মারকুনীর ব্যাখ্যায় তারা আশ্বস্ত হতে পারছে না যে, এ কান্নার শব্দ কোন জ্বিন-ভূত বা প্রেতাত্মার নয়। মারকুনীর ব্যাখ্যা তারা মেনে নিতে পারল না।
বাতাসের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উড়ন্ত বালুকারাশি মেঘের মতো ছেয়ে গেছে। ফলে এখন আর বেশী দূর পর্যন্ত দেখা যায় না। প্রথমে মারকুনী দেয়ালের উপর পা রাখে। জায়গাটা এত কাঁচা যে, বালি মাটিতে মারকুনীর পা ধসে যায়। মারকুনী আরেক পা তুলে সম্মুখে অগ্রসর হয়। তাকায় নীচের দিকে। খাদের গভীরতা দেখে দুঃসাহসী অভিযাত্রী মারকুনীর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। খাদের তলা দেখা যায় না। মনে হচ্ছে এর কোন তলা-ই নেই।
মারকুনী কয়েক পা এগিয়ে যায়। এখানে ডানে-বাঁয়ে কোন টিলা নেই। মারকুনী হাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে যেন। কান্নার শব্দ আরো উচ্চ হয়ে যায়।
মারকুনী তার সঙ্গীদের বলল, পা টিপে টিপে সাবধানে এগিয়ে আস। নীচের দিকে একদম তাকাবে না। এই ভেবে অগ্রসর হও, যেন তোমরা সমতল ভূমিতে হাঁটছ।
মারকুনীর সঙ্গীদ্বয় পূর্ব থেকেই ভীত-সন্ত্রস্ত। পা কাঁপছে, হাঁটু থর থর করছে। কাঁপছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত। তবু দেয়ালের উপর উঠে তারা কয়েক পা অগ্রসর হয়। প্রবলবেগে বয়ে যাওয়া বাতাস তাদের পা উপড়ে ফেলে। গা দুলতে শুরু করে। মারকুনী তাদের সাহস যোগাচ্ছে আর ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে।
দেয়ালের মধ্যখানে পৌঁছে যায় মারকুনী। সামনে দেয়ালের কিছু অংশ ভাঙ্গা এবং নীচু। প্রস্থ এত কম যে, দাঁড়িয়ে হাঁটা সম্ভব নয়। মারকুনী বসে পড়ে এবং ঘোড়ার পিঠে বসার মত করে দুপা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সে অবস্থায়ই সামনে অগ্রসর হতে থাকে। দেয়ালের প্রস্থ ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ ও গোল হয়ে চলেছে। মারকুনী খুব সাবধানে অগ্রসর হতে থাকে। পেছনে তার সঙ্গীদ্বয়ও এগিয়ে আসছে। হঠাৎ এক সঙ্গীর ভীতিপ্রদ আর্তচীৎকার ভেসে আসে মারকুনী, আমাকে ধর।
কিন্তু ধরার জন্য তার কাছে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। লোকটি একদিকে কাৎ হয়ে যায় এবং কোন অবলম্বন না থাকার কারণে পড়ে যায়। তার চীৎকারের শব্দ শুনছে মারকুনী ও তার অপর সঙ্গী। শব্দটা ক্রমান্বয়ে দূরে চলে যায়। তারপর ধপাস করে ভারী কোন বস্তু পড়ে গেলে যেরূপ শব্দ হয়, তেমন একটা আওয়াজ শোনা যায় এবং চীৎকারের শব্দ থেমে যায়। সঙ্গীর পরিণতি বুঝতে বাকী নেই মারকুনীর। মারকুনী নীচের দিকে তাকায়। জাহান্নামসম অতল খাদে পড়ে যাওয়া সঙ্গীর আর্তচীকারের ধ্বনি ভয়ানক এই বিরান ভূমিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এখনো।
আমাকে তোমার সঙ্গে রাখ মারকুনী- অপর সঙ্গী বলল। কণ্ঠস্বর থর থর করে কাঁপছে তার- আমি এমন করে মরতে চাই না।
মারকুনী তার সঙ্গীকে সাহস যোগায়। নিজে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। দেয়াল এখন উপরের দিকে উঠছে। মারকুনী বসে বসেই এগিয়ে চলছে। নারী কণ্ঠের সেই ক্রন্দন শব্দ এখনো কানে আসছে যথারীতি। পড়েযাওয়া সঙ্গীর চীৎকারধ্বনিও প্রতিধ্বনির ন্যায় ঘুরে ফিরছে।
এখন দেয়ালটা কিছু চওড়া। মারকুনী মোড় ঘুরিয়ে সঙ্গীর হাত ধরে। ধীরে ধীরে দেয়াল বেয়ে দুজন উঠে যায় উপরে। দেয়াল খানিকটা পুরু হওয়ার কারণে কিছুটা অনায়াসে এগুতে পারার কথা। কিন্তু বাতাসের গতি এতই তীব্র যে, ভারসাম্য রক্ষা করে চলা দুষ্কর। তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে। এক সময় দেয়াল পার হয়ে তারা সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মারকুনী। পাশাপাশি সঙ্গীর নির্মম মৃত্যুতে তার বুকটা বেদনায় ভারী হয়ে উঠে। স্বস্তির নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসে সঙ্গী হারানোর বেদনার দীর্ঘশ্বাস।
সম্মুখে দুটি টিলার মধ্যখান দিয়ে একটি সংকীর্ণ পথ। একমাত্র সঙ্গীকে নিয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়ে মারকুনী। মারকুনীর সঙ্গী তাকে জিজ্ঞেস করে, জেফ্রে কি মরেই গেল? কোনভাবে কি তাকে উদ্ধার করা কিংবা এক নজর দেখা যায় না? আমরা কি লোকটাকে এভাবে রেখেই ফিরে যাব?
সঙ্গীর প্রতি তাকায় মারকুনী। তার চোখে-মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে না সূচক মাথা নাড়ে। মারকুনীর চোখে পানি এসে গেছে। কিছু না বলে অপর সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়। তারপর ধীরপায়ে সম্মুখপানে এগিয়ে চলে।
এটিও একটি গলিপথ। মারকুনী যত সামনে অগ্রসর হচ্ছে, পথটা ততই প্রশস্ত হচ্ছে। মারকুনী সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের সৌভাগ্য যে, যেদিকেই যাই পথ পেয়ে যাই। তাও একটিমাত্র পথ। পথ একাধিক হলে ধাঁধায় পড়ে যাওয়ার আশংকা ছিল।
গলি শেষ হয়ে গেছে। শেষ প্রান্তের রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত। সামনে পাহাড়ের চড়াই। এখনও তীব্র বাতাস বইছে। এই ভয়ানক এলাকায় কতদূর পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, সে হিসাব নেই মারকুনীর। সে এতটুকুই জানে যে, জগত থেকে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। ক্রুশের নামে দেওয়ানা হতে চলেছে মারকুনী। ফেরাউনের সমাধি খুঁজে বের করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে এতটুকুই জানে যে, সেখান থেকে উদ্ধারকৃত সম্পদ দ্বারা মুসলমানদের ক্রয় করে তাদেরকে ইসলামী সাম্রাজ্যেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে এবং পৃথিবীতে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
সন্ত্রস্ত সঙ্গীকে নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে চলে মারকুনী। এখন তারা যেদিকে অগ্রসর হচ্ছে, বাতাস সেদিক থেকেই প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ের চড়াই সরে গেছে ডানে-বাঁয়ে। সামনে সুবিস্তৃত নীল আকাশ চোখে পড়ছে। মারকুনী চড়াই বেয়ে উপরে উঠছে।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় মারকুনী। নাক টেনে বাতাস শুঁকে সঙ্গীকে বলে, তুমিও শুঁকে দেখ, বাতাসের ঘ্রাণে পাহাড়ী এলাকার ঘ্রাণ না?
তোমার মাথাটা আসলেই খারাপ হয়ে গেছে- মারকুনীর সঙ্গী বলল পাহাড়ী এলাকায় পাহাড়ের ঘ্রাণ থাকবে না তো থাকবে কী? তুমি বোধ হয় ভাবছ, তুমি এখন ইতালীতেই আছ। তোমার নাকে সম্ভবত তোমার বাড়ির ঘ্রাণ আসছে।
সঙ্গীর খোঁচামারা কথায় মারকুনীর কোন ভাবান্তর ঘটল না। চেহারায় তার অন্য প্রতিক্রিয়া। বাতাস শুঁকে শুঁকে কি যেন উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে সে। তারপর সঙ্গীকে বলল, তুমি বোধ হয় ঠিকই বলেছ যে, পাহাড়ের কাঠিন্য আমার মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। এখানে তো পানি থাকতে পারে না। আমি সম্ভবত কল্পনায় খেজুর, সবুজ-শ্যামলিমা ও পানির ঘ্রাণ শুকছি। এসব ঘ্রাণ তো আমার চির পরিচিত। বোধ হয় আমার ঘ্রাণশক্তি আমাকে ধোকা দিচ্ছে। এই জাহান্নামে পানির চিহ্নও থাকার কথা নয়।
মারকুনী!- হঠাৎ মারকুনীর সঙ্গী তার বাহু চেপে ধরে তাকে থামিয়ে দেয় এবং বলে- আমিও একটি ঘ্রাণ শুকছি- মৃত্যুর ঘ্রাণ। মনে হচ্ছে আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। চল বন্ধু! যেদিক থেকে এসেছি, সে-পথেই ফিরে যাই। তুমি যদি মনে কর আমি ভীরু, তাহলে তুমি আমাকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে পরীক্ষা নাও, দেখবে আমি একশ মুসলমানের গলা না কেটে মরব না। লোকটির কণ্ঠে ভীতির ছাপ, দুচোখে টলটলায়মান অশ্রুর ফোঁটা।
মারকুনী স্বল্পবাক মানুষ। সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল, আমরা একশ নয়- এক হাজার মুসলমানের গলা কাটব; তারপরও মরব না। তুমি আমার সঙ্গে থাক।
মারকুনী সঙ্গীকে নিয়ে পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। চড়াই বেশী উঁচু নয়। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। এখন আর রোদের তাপ নেই, কিরণও নেই। সারাদিনের ক্লান্তিতে পা আর এগুতে চাচ্ছে না। তারা সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে পা টেনে হাঁটছে। একসময় পৌঁছে যায় পাহাড়ের শীর্ষ চূড়ায়। ধূলিবালিতে তাদের চোখ-মুখ সর্বাঙ্গ মলিন হয়ে গেছে। দুচোখ মেলে দেখে মারকুনী। সামনে ঢালু ও ছোট ছোট পাথর। একটি পাথরের উপর উঠে দাঁড়ায় সে। সঙ্গীকে ডাক দিয়ে হঠাৎ বসে পড়ে। সঙ্গীকে উদ্দেশ করে বলে, তোমার যদি মরুভূমি সম্পর্কে ভাল অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে তুমি বুঝতে পারবে সামনে মরিচিকা দেখা যাচ্ছে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখ, ওটা আসলেই মরুভূমি কিনা।
সঙ্গী মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকায়। চক্ষুদয় বন্ধ করে আবার খোলে। আবার গভীরভাবে নিরীক্ষা করে তাকায়। সে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, ওটা মরিচিকা নয়।
দৃশ্যটা আসলেই মরিচিকা ছিল না। কতগুলো খেজুর গাছের মাথা তাদের চোখে পড়ছিল। পাতাগুলো হরিদ্রা বর্ণের। গাছগুলোর অবস্থান নিম্ন এলাকায় বলে মনে হল বেশ দূরে।
মারকুনী পাথরের উপর থেকে নেমে সম্মুখে চলে যায়। এবার মনে ভয় ধরে গেছে দুঃসাহসী খৃস্টান সেনাকমান্ডার মারকুনীর। সঙ্গী পেছনে পেছনে হাঁটছে তার। জায়গাটায় নানা বর্ণ ও নানা আকারের পাথরখণ্ড ছড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে। কোনটি এমন, যেন একজন মানুষ হাঁটুতে মাথা গেড়ে বসে আছে। কোনটি বেশ বড়, কোনটি হোট। এগুলোর ফাঁকে পথের সন্ধান করছে মারকুনী।
সূর্যটা পশ্চিম আকাশে আরো নীচে নেমে গেছে। পাহাড়ের চূড়াগুলো স্পর্শ করছে যেন অস্তাচলগামী লাল সূর্যটা। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে মারকুনীর। ভয়ের তীব্রতায় বুকটা ধড়-ফড়, দুরু দুরু করছে। পা টেনে টেনে পেছনে পেছনে হেঁটে চলে অসহায় সঙ্গী।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় মারকুনী। মোড় না ঘুরিয়েই ধীরে ধীরে সরতে শুরু করে পেছন দিকে। মনে হয় মারকুনী ভয়ংকর কিছু দেখেছে। সঙ্গীও তার কাছে এসে দাঁড়ায় এবং বিস্ময়ভরা চোখে তার প্রতি তাকায়।
***
একটি নিম্ন এলাকা দেখতে পাচ্ছে মারকুনী ও তার সঙ্গী। এলাকাটির বিস্তার এক বর্গ মাইলের কম নয়। চারপাশে মাটি ও বালির উঁচু উঁচু প্রাকৃতিক দেয়াল। এলাকাটা সবুজ-শ্যামলে ঢাকা। কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু। অনেকগুলো খেজুর গাছ চোখে পড়ছে। বুঝা যাচ্ছে, ওখানে প্রচুর পানি আছে।
এই জাহান্নামে এমন সবুজ-শ্যামল এলাকা চোখের ভেল্কি নয় তো? না, মারকুনী যা দেখছে, সবই সত্য, বাস্তব। এই ভূখণ্ডের ঘ্রাণই একটু আগে মারকুনী অনুভব করেছিল।
তার থেকে সামান্য সামনে কতগুলো পাহাড় দেখতে পায় মারকুনী। পাহাড়গুলো মাটিরও নয়, বালিরও নয়- পাথরের। রং কালচে। হঠাৎ মারকুনী নিজে দ্রুত বসে পড়ে, টেনে সঙ্গীকেও বসিয়ে দেয়। আরো একটি বিস্ময়কর কি যেন দেখতে পেয়েছে সে। দুজন মানুষ নিম্নভূমিতে এদিকেই এগিয়ে। আসছে। আপাদমস্তক উলঙ্গ। এক চিলতে সুতাও নেই পরনে। গায়ের রং গাঢ় বাদামী। বেশ সুদর্শন। লোকগুলো পুরুষ।–
হঠাৎ করে একদিক থেকে বেরিয়ে আসে এক মহিলা অন্যদিকে হেঁটে যাচ্ছে সে। সেও মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিবস্ত্র। মাথার চুলগুলো এলোমেলো, হাঁটু পর্যন্ত লম্বিত। আকার-গঠনে এদের কাউকেই কাফ্রি বা জংলী বলে মনে হয় না।
এরা প্রেতাত্মা- মারকুনীর সঙ্গী বলল- এরা মানুষ নয় মারকুনী! সূর্য ডুবে যাচ্ছে। চল, পেছনের দিকে পালিয়ে যাই। রাতে এরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। তুমি বিশ্বাস কর মারকুনী! আর কিছু সময় এখানে কাটালে আমরা জীবিত ফিরে যেতে পারব না! চল, পেছন দিকে ফিরে যাই।
মারকুনীরও ধারণা, এরা মানুষ নয়, অন্য কিছু হবে। তবু সঙ্গীকে বুঝাতে চেষ্টা করছে, এরা মানুষই; তুমি অহেতুক ভয় পাচ্ছ। মারকুনী নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে, আসলে এরা কি? মানুষই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এরা কারা? এমন উলঙ্গ কেন? এরা তো বাতাসে উড়ছে না; মাটিতেই হাঁটছে। দূরে একস্থানে তিনটি শিশুকে দৌড়াদৌড়ি-ছুটাছুটি করতে দেখতে পায় মারকুনী। শিশুগুলো এদেরই সন্তান হবে নিশ্চয়। ওদের চলাফেরা তো ঠিক মানুষেরই ন্যায়।
মারকুনী উপুড় হয়ে পেটে ভর করে সরিসৃপের ন্যায় সামনে এগিয়ে যায়। তার সঙ্গীও তার পার্শ্বে গিয়ে শুয়ে পড়ে। দুজন শুয়ে শুয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। ওখানকার দেয়ালগুলো খাড়া নয়- কিছুটা ঢালু। বালিও প্রচুর। মারকুনীর সঙ্গী বোধ হয় আরো একটু সামনে এগুবার চেষ্টা করে কিংবা কি হল কে জানে, হঠাৎ সে পড়ে যায় এবং গড়াতে গড়াতে নীচে গিয়ে পতিত হয়।
ওখান থেকে উপরে উঠে আসা অসম্ভব। মারকুনী পেছনে সরে গিয়ে এমন একটি পাথরের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করে, যেখান থেকে নীচের অবস্থা দেখা যায়। মারকুনীর সঙ্গী যে ঢালু দিয়ে নীচে পড়ে গেল, তার উচ্চতা ত্রিশ কি চল্লিশ গজের বেশী হবে না। মারকুনী দেখতে পেল, তার সঙ্গী ওঠে আসার চেষ্টা করছে। সে তার সঙ্গীকে কোন সাহায্য করতে পারছে না।
যে উলঙ্গ পুরুষ দুজন স্বাভাবিক গতিতে এদিকে আসছিল, তারা এবার দৌড়াতে শুরু করে। দৃশ্যটা উপর থেকে দেখে ফেলে মারকুনী। কিন্তু তার সঙ্গী বিষয়টা টের পায়নি। মারকুনী তাকে ডাক দিয়ে সতর্কও করতে পারছে না। এখানে কোন মানুষ আছে, তা বুঝতে দিতে চাইছে না সে। লোক দুজন এসে মারকুনীর সঙ্গীকে পেছন থেকে ঝাঁপটে ধরে। তার সঙ্গে খঞ্জর আছে, আছে ছোট তরবারীও। কিন্তু অস্ত্র খুলে হাতে নেয়ার মওকা পেল না সে। লোক দুজন তাকে টেনে নীচে নামিয়ে ফেলে। যে উলঙ্গ মহিলা দুজন কোথাও যাচ্ছিল, ছুটে আসে তারাও। এসে পড়ে ক্রীড়ারত শিশুরাও। তারা নিজ ভাষায় কাকে যেন ডাক দেয়। কোথা থেকে ছুটে আসে দশ-বারজন মানুষ। তারাও সবাই উলঙ্গ। একজন তার বন্ধুর কোমর থেকে তরবারীটা খুলে নেয়। মাটিতে ফেলে দেয়া হয় লোকটাকে। মারকুনী উপর থেকে দেখতে পায়, লোকগুলো তরবারী দ্বারা তার সঙ্গীর ধমনী কেটে ফেলে। দর দর করে লাল টাটকা রক্ত বেরুতে শুরু করে। সবাই নাচতে শুরু করে। কি যেন গাইছে তারা। খিলখিল করে হাসছেও। এমন সময় ক্ষীণকায় এক বৃদ্ধ এসে পড়ে। তার হাতে তার দেহের উচ্চতার সমান লম্বা একটি লাঠি। তাকে দেখে সবাই একদিকে সরে দাঁড়ায়।
বৃদ্ধের পরনেও কিছু নেই- উলঙ্গ। তার লাঠির মাথায় দুটি সাপের ফণা। ফেরাউনদের বৈশিষ্ট্যমূলক চিহ্ন এটা। বৃদ্ধ মারকুনীর সঙ্গীর গায়ে হাত লাগায়। সে এখন নিথর। মারা গেছে মারকুনীর সঙ্গী। বৃদ্ধ নিজের এক হাত উপরে তুলে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলে। তার সঙ্গে উলঙ্গ মানুষগুলো যাদের মধ্যে দুজন নারী এবং কয়েকটি শিশু রয়েছে- সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। বৃদ্ধ এখন কি যেন বলছে। সে পুনরায় উপরে হাত উঠায়। এবার সবাই সেজদা থেকে উঠে দাঁড়ায়। একজন বৃদ্ধকে ঢালুর দিকে ইঙ্গিত করে বলছে, লোকটা ওদিক থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েছে। বৃদ্ধের ইশারা পেয়ে তারা মারকুনীর সঙ্গীর মৃতদেহটা তুলে নিয়ে যায়। মারকুনীর মনে ভয় জাগে, এই রহস্যময় মানুষগুলো উপরে উঠে দেখে কিনা যে, নীচে পড়ে যাওয়ার লোকটার সঙ্গে আর কেউ ছিল কিনা। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে মারকুনী।
সূর্য ডুবে গেছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করেছে মারকুনী। জীবন যায় যাক, এ জায়গা এবং এই মানুষগুলোর ভেদ-রহস্য উদ্ধার করবেই সে। তরবারীটা তুলে নেয় ডান হাতে। বাঁ-হাতে খঞ্জর। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাঁটা দেয় একদিকে।
রাতের অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে ধীরে ধীরে। কোথাও কোন আওয়াজ নেই, শব্দ নেই। ভয়ংকর নীরবতা বিরাজ করছে এলাকায়। ডান-বাঁয়ে ও পেছনের দিকে কান রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে মারকুনী। নিম্নাঞ্চলের পাশ ঘেঁষে এগুচ্ছে সে। এবার ক্ষীণ কণ্ঠের শব্দ তার কানে আসতে শুরু করে। শব্দটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। খানিক পর সে যে আওয়াজটা শুনতে পায়, তা নাচ-গান ও শোরগোলের আওয়াজ। আওয়াজটা যেদিক থেকে আসছে, সেদিকে এগিয়ে যায় মারকুনী। দেখতে পায় এক ভয়ংকর দৃশ্য।
বাঁ-দিকে আরেকটি প্রশস্ত এলাকা। কয়েকটি মশাল জ্বলছে সেখানে। গাছ-গাছালি আছে সেখানেও। অন্তত পঁচিশজন নারী-পুরুষ ও শিশু গোল হয়ে নাচছে ও গাইছে। তাদের মধ্যখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের উপর ঝুলছে হাত-পা বাঁধা একটি মানুষের লাশ। আগুনে ছেকা হচ্ছে লাশটাকে। মারকুনী বুঝতে পারে এটা তার সঙ্গীর মৃতদেহ। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে মারকুনীর। ভয়ানক এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাঠিওয়ালা বৃদ্ধ। লাশের দেহের গোশত কেটে সকলের মাঝে বন্টন করছে বৃদ্ধ।
দৃশ্যটা গভীর রেখাপাত করে মারকুনীর মনে। আর স্থির থাকতে পারল না সে। ফিরে রওনা হয় পিছন দিকে- যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। পথটা মনে আছে তার। সতর্ক পায়ে চলছে মারকুনী। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় পোলসেরাতসম সেই দেয়ালের কাছে, যার উপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছিল তার এক সঙ্গী। খাদের ভেতর থেকে শিয়ালের চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পায় মারকুনী। মারকুনী বুঝতে পারে, জংলী শিয়ালরা তার সঙ্গীর লাশটা ছিঁড়েকুড়ে খাচ্ছে আর চেঁচামেচি করছে। তার অপর সঙ্গীকে ভক্ষণ করছে জংলী মানুষ। বাতাসের এখন তেজ নেই। মারকুনী অন্ধকারে সাবধানে দেয়ালটা পার হয়ে ওপার চলে যায়।
রাতের এখন শেষ প্রহর। মারকুনী ও তার সঙ্গীদ্বয় যেখানে তিনটি উট রেখে পায়ে হেঁটে পাহাড়ে ঢুকে পড়েছিল, পৌঁছে যায় সেখানে। এবার এক মুহূর্তও দেরী করবে না সে। উটের সঙ্গে বাঁধা মশক থেকে এক ঢোক পানি পান করার বিলম্বও সহ্য হচ্ছে না তার। চড়ে বসে একটি উটের পিঠে। সঙ্গে নিয়ে নেয় অপর দুটি। হাঁটতে শুরু করে উট।
***
পরদিন সন্ধ্যাবেলা। একজন সম্ভ্রান্ত মিসরী বণিকের বেশে আহমার দরবেশের ঘরে প্রবেশ করে মারকুনী। মারকুনীকে দেখেই আহমার জিজ্ঞেস করে, তুমি একা কেন? অন্য দুজন কোথায়?
জবাব না দিয়েই ধপাস করে একটি চেয়ারে বসে পড়ে মারকুনী। হুঁশ-জ্ঞান ঠিক নেই তার। আহমারকে ইঙ্গিতে সামনে বসতে বলে। আহমার মারকুনীর সামনে মুখোমুখি বসে পড়ে। কিছুটা শান্ত হয়ে কথা বলতে শুরু করে মারকুনী। অভিযানের প্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতি পদের কাহিনী শুনিয়ে যায় আহমারকে।
মারকুনীর দুসঙ্গীর করুণ মৃত্যুতে একবিন্দু দুঃখ প্রকাশ করলেন না আহমার। তিনি যখন শুনতে পেলেন যে, উলঙ্গ হিংস্র মানুষগুলো মারকুনীর এক সঙ্গীকে খেয়ে ফেলেছে, তখন তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি কি নিজ চোখে দেখেছ যে, ওদের কারো পরনেই কাপড় নেই? তুমি কি সত্যিই বৃদ্ধের লাঠির মাথায় সাপের ফণা দেখেছ? তুমি কি ভালভাবেই দেখেছ যে, তারা আমাদের লোকটির গোশত খাচ্ছে? অভূতপূর্ব কৌতূহল আহমার দরবেশের কণ্ঠে।
আমি আপনাকে স্বপ্নের কাহিনী শোনাচ্ছি না- শান্ত সমাহিত কণ্ঠে বলল মারকুনী- আমার মাথার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়েছিল, আমি আপনাকে তারই বিবরণ দিচ্ছি। নিজ চোখে যা যা দেখেছি, তা-ই আমি আপনাকে শোনাচ্ছি।
ফেরাউনও এ কথাই বলেছেন, যা তুমি শুনিয়েছ আহমার দরবেশ বসা থেকে উঠে মারকুনীর কাঁধে হাত রাখলেন এবং আনন্দের আতিশয্যে অনেকটা চীৎকার করে বললেন- তুমি রহস্য উদঘাটন করে ফেলেছ মারকুনী! এরাই সেই লোক, আমি যাদের সন্ধান করছিলাম। এই গোত্রটি ষোল শতক পর্যন্ত ওখানে বসবাস করছে। এরা ভাবতেও পারেনি যে, কালের বিবর্তন তাদেরকে মানুষের গোশত খেতে বাধ্য করবে। কাগজের লেখাগুলো তুমি পড়তে পারবে না, আমি পড়তে সক্ষম হয়েছি। তাতে লেখা আছে, ধনভাণ্ডারের রক্ষণাবেক্ষণ করবে সাপ। কিন্তু আমার সমাধির হেফাজত করবে মানুষ, যারা কয়েক শতক পর সাপ ও হিংস্র প্রাণীতে পরিণত হয়ে যাবে। আমার সমাধির সীমানায় কোন মানুষ প্রবেশ করলে রক্ষীরা তাকে খেয়ে ফেলবে। কালের বিবর্তন তাদেরকে উলঙ্গ করে ফেলবে। কিন্তু আমি যেখানে আমার অন্য জগতের ঘর তৈরি করেছি, সেখানে তাদেরকে পোশাক পরান হবে। বাইরের কোন মানুষ তাদের গুপ্তাঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পারবে না। যে-ই তাকাবে, সে ওখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না।
আমি তো জীবিত ফিরে এসেছি! মারকুনী বলল।
কারণ, তুমি নীচে যাওনি- আহমার বললেন- তুমি কালো রঙের যে পাথুরে পাহাড়ের কথা বলেছ, তারই পাদদেশে কোন এক স্থানে র্যামন্সের লাশ ও ধনভাণ্ডার লুকিয়ে রাখা আছে। আর এই উলঙ্গ মানুষগুলো? এদের পূর্বপুরুষরা ব্যামন্সের সময় থেকে ওখানে পাহারার দায়িত্ব পালন করছে। তাদের মৃত্যুর পর তাদের বংশধর একের পর এক এ দায়িত্ব পালন করে আসছে। এভাবে পনের-ষোল শতাব্দী কেটে গেছে। আমি বলতে পারব না, ওরা কি খেয়ে জীবন বাঁচায়। বোধ হয় হিংস্র প্রাণীর ন্যায় তারা মরুভূমির পথিকদের শিকার করে সিদ্ধ করে খায়। ওখানে পর্যাপ্ত পানি আছে। খেজুরেরও অভাব নেই। কাজেই ওদের বেঁচে থাকা বিস্ময়কর নয়। তারা আজও ফেরাউনকে খোদা বলে বিশ্বাস করে। তাদের বিশ্বাসে যদি ফাটল ধরত, তাহলে তারা ওখানে থাকত না। তুমি কি তাদের কাছে কোন অস্ত্র দেখেছ?
না।
সংখ্যায় তারা কতজন হবে?
রাতে যখন তারা একত্রিত ছিল, তখন পঁচিশজন ছিল।
এমনই হবে। এর চেয়ে বেশী হওয়ার কথায় নয়।
আমি তাদের কাছে দুটি উটও দেখেছি। আরো থাকতে পারে, তবে আমি দেখেছি দুটোই।
তার মানে তারা বাইরেও আসে- আহমার দরবেশ বললেন- বাইরে তারা অবশ্যই আসে। পথচারীদের শিকার করতে বাইরে তাদের আসতেই হয়। শোন মারকুনী, কান পেতে শোন! ওখানে নিশ্চয়ই এমন একটি সোজা পথ আছে, যে পথে তারা বাইরে আসা-যাওয়া করে। সেটি পাহাড়ের কোন একটি গোপন পথ হবে। আমি তোমাদেরকে যে পথের কথা বলেছিলাম, তা এমন কোন পথ নয়, যে পথে বারবার আসা-যাওয়া করা যায়। ওখানে অন্য আরো একটি পথ আছে, যার সন্ধান ঐ হিংস্র উলঙ্গ মানুষগুলোর নিকট থেকে নেয়া যায়। কিভাবে নেয়া যায়, আমি তার পন্থা ভেবে দেখেছি। ওখানে যথারীতি হামলা করা যেতে পারে। তার জন্য তোমার এক সঙ্গী যেখানে খাদে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। সেখানে আরো কিছু লোককে মারতে হবে। এই ত্যাগ অত্যন্ত জরুরী। তুমি বল, পঁচিশ-ত্রিশজন লোককে- যাদের মধ্যে নারী-শিশু বৃদ্ধও আছে- হত্যা করার জন্য এবং তাদের দু-তিনজনকে জীবিত ধরার জন্য; তোমার কত সৈন্যের প্রয়োজন? সর্বনিম্ন সংখ্যা বল। তুমি হবে সে বাহিনীর রাহবার ও সেনাপতি।
পরিকল্পনাটা আমি বুঝে ফেলেছি- মারকুনী বলল- আমার মাথায়ও একটা বুদ্ধি এসেছে। আমরা ওদেরকে হত্যা করতে পারি। দু-তিনজনকে জীবিত ধরাও সম্ভব। কিন্তু আমি আপনাকে এ নিশ্চয়তা দিতে পারি না যে, তারা ওখানকার সব গোপন তথ্য আমাদেরকে দেবে। গোত্রের অন্যদেরকে মরতে দেখে তারাও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে, তবু মুখ খুলবে না। আমি এমন এক কৌশল অবলম্বন করব যে, তাড়া খেয়ে তাদের দুএকজন বাইরের দিকে পালাতে শুরু করবে আর আমরা তাদের পিছু নেব। আমাদের রাস্তা চেনা হয়ে যাবে।
তুমি বড় বিচক্ষণ মারকুনী!- আহমার দরবেশ বললেন- বল, কত লোকের প্রয়োজন?
পঞ্চাশজন- মারকুনী জবাব দেয়। অধিকাংশ লোক আমার নির্বাচিত হতে হবে, আমিই তাদেরকে খুঁজে নেব। তবে কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে আমি আমার শর্তের কথা জানাতে চাই।
তুমি দাবি অনুপাতে পুরস্কার পাবে- যা চাইবে ঠিক তা-ই দেব। আহমার বললেন।
আমি গুপ্তধনের ভাগ চাই- মারকুনী বলল- এমন একটি বিপজ্জনক অভিযান আমার দায়িত্বের আওতাভুক্ত নয়। আমি একজন গুপ্তচর ও নাশকতা কর্মী। আমাকে ফেরাউনের গুপ্তধন খুঁজে বের করার জন্য প্রেরণ করা হয়নি। এটা আপনার নিজের কাজ। পুরস্কার নয়। আমি চাই উদ্ধারকৃত ধনের ভাগ, যা চাইব ঠিক তা। আপনার পরিকল্পনা সফল হলে আপনি তো একটি প্রদেশের শাসনকর্তা হয়ে যাবেন; আর আমি গুপ্তচর গুপ্তচরই রয়ে যাব। কাজেই আমার সম্পদ চাই।
এ অভিযান কারো ব্যক্তিগত নয়- আহমার বললেন- এটি মিসর, কুশ ও সুদানের শাসন ক্ষমতা দখল করার খৃষ্টীয় পরিকল্পনা।
নিজ দাবিতে অনড় থাকে মারকুনী। বেকায়দায় পড়ে যান আহমার দরবেশ। আহমার জানেন র্যামন্সের সমাধি পর্যন্ত পৌঁছা মারকুনী ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তার দাবি মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই আহমারের। মারকুনী বলল, কতদিন পর্যন্ত মরুভূমিতে কাটাতে হবে তার কোন ঠিক নেই। শক্ত ও শুকনো খাবার আমি পছন্দ করি না। কাজেই, আমাকে অতিরিক্ত দু তিনটি উটও দিতে হবে, যা আমি সঙ্গীদের নিয়ে রান্না করে খাব। আর আর কুদুমীকেও দিতে হবে।
কুদুমীকে?- বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন আহমার- এমন উঁচু স্তরের ভূবনমোহিনী রূপসী গায়িকাকে দেব তোমার সঙ্গে এমন বিপজ্জনক অভিযানে! আর সেও তো যেতে রাজি হবে না?
অতিরিক্ত বিনিময় দিলে সে রাজি হয়ে যাবে- মারকুনী বলল- আমি.. তার জন্য এমন ব্যবস্থা করে দেব যে, মেয়েটা টেরই পাবে না, সে মরুভূমিতে আছে নাকি কোন বিপজ্জনক মিশনের সঙ্গে আছে। আমি তার মূল্য বুঝি।
সে যুগের রীতি ছিল, কোন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী সফরে গেলে প্রিয়তমা স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। স্ত্রীদের মধ্যে কাউকে ভাল না লাগলে টাকার বিনিময়ে পছন্দমত কোন নর্তকী-গায়িকা কিংবা বেশ্যা মেয়েকে নিয়ে যেত। সেনা কমান্ডাররাও যুদ্ধের সময় স্ত্রী কিংবা ভাড়াকরা সুন্দরী কোন মেয়েকে সঙ্গে। রত। সে যুগে রূপসী যুবতী মেয়ে ছিল সোনার চেয়েও দামী। আর সে কারণেই ইহুদী-খৃস্টানরা সালতানাতে ইসলামিয়ার মূলোৎপাটনের জন্য নারীকে ব্যবহার করত। কাজেই মারকুনীর ন্যায় একজন দুঃসাহসী ও বিপজ্জনক অভিযানের নায়কের একটি সুন্দরী নর্তকীকে সঙ্গে নেয়ার দাবি করা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু আহমার দরবেশের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে তার কুদুমীর মত এমন এক পরমাসুন্দরী যুবতী নতকীর দাবি উত্থাপন করায়, যার গমনাগমন আমীর ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নিকট। মেয়েটা সুদানের বাসিন্দা। মুসলমান। আর অতিশয় রূপসীই নয়- তার চালচলন, ভাবভঙ্গীমায়ও ছিল অনুপম এক যাদু। বড় বড় ব্যক্তিত্বদের দেমাগ সদা খারাপ করে রাখত মেয়েটা। এই কুদুমী মারকুনীর সঙ্গে বিপজ্জনক এক অভিযানে জনমানবশূন্য ধু-ধু মরু অঞ্চলে চলে যাবে, তা কল্পনায়ও আসে না। কিন্তু মারকুনীর কুদুমীকে চা-ই চাই। শেষ পর্যন্ত আহমার দরবেশকে প্রতিশ্রুতি দিতেই হল যে, ঠিক আছে, কুদুমীকে পাবে।
কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। পঞ্চাশ ব্যক্তির সন্ধানে নেমে পড়ে মারকুনী ও আহমার। কায়রোতে খৃস্টান গোয়েন্দা ও সন্ত্রাসীর অভাব নেই। মারকুনী অধিকাংশ লোক তাদের থেকেই নিতে চাইছে। কারণ, তারা তার বিশ্বস্ত। আহমার দরবেশেরও একই অভিমত। একটি নাশকতাকারী গ্রুপ আছে আহমার দরবেশেরও। সুলতান আইউবীর এই সেনাপতি তলে তলে, এ গ্রুপটিকে তৈরি করে রেখেছে। তারা সবাই মুসলমান। তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য খৃস্টানদেরই ন্যায়। আহমার দরবেশ নিজের ঈমান নীলাম করে এ লোকগুলোকেও ঈমান বিক্রেতা বানিয়ে দিয়েছে। এরা সবাই সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন। এদের ওঠাবসা হাসান ইবনে সাব্বাহর ফেদায়ীদের সঙ্গে। এই গ্রুপের মধ্য থেকেও কয়েকজনকে বাছাই করে নেয় আহমার দরবেশ।
মারকুনী নিজে কুদুমীর নিকট আহমার দরবেশের পয়গাম নিয়ে যায়। আহমার কোন সাধারণ ব্যক্তি নন। তিনি একজন পদস্থ সেনা কর্মকর্তা। আর মিসরে শাসন চলছে কার্যত সেনাবাহিনীর। কুদুমী আহমারকে ভালভাবে চেনে ও শ্রদ্ধা করে। মেয়েটি অম্লান বদনে সম্মত হয়ে যায়। মারকুনী তাকে জানায়, আমরা ফেরাউনের সমাধি থেকে হিরে-জহরত উদ্ধার করতে যাচ্ছি। শুনে কুদুমী এতই উৎফুল্ল হয়ে উঠে যে, সে এক্ষুণি যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। মারকুনী অত্যন্ত সুচতুর ও সতর্ক মানুষ। মুখের কথায় রাণী কিওপেট্রা বানিয়ে ফেলে কুদুমীকে। কুদুমী একজন নর্তকী। তার চেতনা বলতে কিছু নেই। সে চেনে শুধু নিজের রূপ-যৌবন, অর্থ আর হিরে-জহরত। নিজের রূপ-যৌবনে কখনো ভাটা পড়বে না বলেই তার বিশ্বাস। মারকুনী তাকে একথা জানায়নি যে, সমাধি থেকে উদ্ধার করা গুপ্তধন কোথায় কি কাজে ব্যয় করা হবে।
পঞ্চাশজন লোক খুঁজে বের করতে পনের-বিশদিন কেটে যায়। তাদ্রের অধিকাংশ খৃস্টান নাশকতাকারী। অন্যরা মুসলমান। তারাও খৃস্টানদের নাশকতা কর্মী।
উটে চড়ে সবাই কায়রো থেকে বেরিয়ে যায়। তবে একত্রে নয়- তারা তিন তিনজন ও চার চারজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে মুসাফির ও ব্যবসায়ীর বেশ ধরে আলাদা আলাদভাবে বেরিয়ে গেছে। কুদুমীকে নিয়ে যাওয়া হয় একজন পর্দানশীল সম্ভ্রান্ত বধূরূপে। মারকুনী সাজে তার স্বামী। কুদুমী ছাড়াও মারকুনীর সাথে আরো দুজন লোক, তাদের একজন খৃস্টান অপরজন মুসলমান। মুসলমানের নাম ইসমাইল। ইসমাইল আহমারের খাস লোকদের একজন। খৃস্টানদের দালাল, ভাড়াটিয়া খুনী। সমাজে তার কোন মর্যদা নেই কিন্তু মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা তাকে সালাম দিয়ে চলে। মারকুনীও তাকে ভালভাবেই চিনে এবং এ অভিযানের একজন বিশ্বস্ত কর্মী বলে মনে করে।
সকলেই ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় রওনা হয়। আঠার ক্রোশ দূরে কোথায় গিয়ে একত্রিত হতে হবে, তা সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে। সকলের সঙ্গে তীর ধনুক-তরবারী এবং রশি ও খননযন্ত্র।
সকলের আগে মারকুনী, ইসমাইল, কুদুমী ও তাদের অপর সঙ্গী গন্তব্যে পৌঁছে যায়। মারকুনী তাদেরকে পাহাড়ী এলাকার ভেতরে নিয়ে যায়।
সূর্য ডুবে গেছে। তারা তাঁবু স্থাপন করে। তাদের অন্যান্য সঙ্গীদের এ রাতেই এসে পৌঁছানোর কথা। ইসমাইল কুদুমীকে চেনে; কিন্তু কুদুমী ইসমাইলকে জানে না।
***
এক ময়দানে লড়াই করছেন নূরুদ্দীন জঙ্গী। কার্ক দুর্গ জয় করে সেখানকার এবং তার আশপাশের আরো কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ সম্পন্ন করে ফেলেছেন তিনি। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত টহল দিয়ে ফিরছে তার বাহিনী, যাতে খৃস্টানরা কোনদিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করতে চাইলে যথাসময়ে তা প্রতিহত করা যায়। বিভিন্ন পয়েন্টে খৃস্টান বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত- সংঘর্ষও চলছে তাদের।
উদ্ধারকৃত এলাকার নিয়ন্ত্রণভার সুলতান আইউবীর বাহিনীকে বুঝিয়ে দিয়ে বাগদাদ ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে চাইছেন নুরুদ্দীন জঙ্গী। আইউবীর অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন তিনি। কিন্তু সুলতান আইউবী যুদ্ধে লিপ্ত অপর রণাঙ্গনে, যে রণাঙ্গন মিসরে খুলে বসেছে খৃস্টান ও তাদের মদদ পুষ্ট মুসলিম গাদ্দাররা। এ ময়দানই বেশী ভয়ংকর। তবে এমন আন্ডারগ্রাউন্ড যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করার যোগ্যতা আছে সুলতান আইউবীর। মোকাবেলা করছেনও পুরোদমে। কিন্তু তৃতীয় আরো একটি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে, তা এখনও জানতে পারেননি তিনি। এটি হল ফেরাউনদের সমাধি অনুসন্ধানের অভিযান।
রাতের আহারের পর হলরুমে প্রবেশ করেন সুলতান আইউবী। আলী বিন সুফিয়ান, গিয়াস বিলবীস এবং বেশ কজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা কক্ষে উপস্থিত। সেদিনই নুরুদ্দীন জঙ্গীর দীর্ঘ একখানা পত্র সুলতান আইউবীর হস্তগত হয়। তিন্নি পত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো উপস্থিত কর্মকর্তাদের পাঠ করে শোনান। সুলতান জঙ্গী লিখেছেন
প্রিয় সালাহুদ্দীন! আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুন ও নিরাপদ রাখুন। কার্ক ও তার আশপাশের এলাকাসমূহ এখন শত্রুমুক্ত। আমাদের সৈন্যরা দূর দূরান্ত পর্যন্ত টহল দিয়ে ফিরছে। মাঝে মধ্যে খৃস্টান সৈন্যদের সঙ্গে তাদের ছোটখাট সংঘাতও হচ্ছে। খৃস্টানরা আমাকে নানা কৌশলে বুঝাতে চাচ্ছে যে, তারা এখনো পরাজিত হয়নি। তোমার গড়া গেরিলা বাহিনী সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তারা বহু দূর-দূরান্ত পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। তুমি তাদের উপর যে পরিশ্রম করেছ, তারা তার মূল্য পরিশোধ করছে। তোমার গোয়েন্দারা তাদের চেয়েও সাহসী ও বুদ্ধিমান। আমি এতদূরে বসে তাদেরই চোখে দুশমনের সব তৎপরতা প্রত্যক্ষ করছি…..।
সর্বশেষ তথ্য যা পেলাম, তাতে বুঝা যাচ্ছে, খৃস্টানরা আপাতত জবাবী আক্রমণ চালাবে না। তারা আমাদেরকে উৎসাহিত করছে, যেন আমরা এগিয়ে গিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করি। তুমি তো জান, বাইতুল মোকাদ্দাস- যা আমাদের প্রথম কেবলা, আমাদের লক্ষ্য আমাদের থেকে কত দূরে। আমি জানি, তুমি এই দূরত্বকে ভয় পাওয়ার লোক নও। তবে দূরত্বটা যত না বেশী, তার চেয়ে বেশী পথের দুর্গমতা ও প্রতিবন্ধকতা। বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছতে হলে পথে আমাদের অনেক দুর্গ জয় করে অগ্রসর হতে হবে। তন্মধ্যে কয়েকটি দুর্গ তো অত্যন্ত দুর্ভেদ্য। দূর-দূরান্তের এসব দুর্গ দ্বারা খৃষ্টানরা বাইতুল মোকাদ্দাসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্ত করে রেখেছে। তোমার গোয়েন্দারা আমাকে আরো জানিয়েছে যে, খৃষ্টানরা ইউনান, ল্যাটিন ও ইতালীয়দের নৌ-বাহিনীকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। তারা কামনা করছে যে, এ তিনটি রাহিনী একসঙ্গে মিসর আক্রমণ করে উত্তর এলাকায় সৈন্য নামিয়ে দিক। এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তুমি তৈরি থাক। তোমাদের কাছে দূরে অগ্নিগোলা নিক্ষেপণযোগ্য মিনজানিকে বেশী থাকতে হবে। আমার পরামর্শ হল, উত্তর এলাকার মাটি যদি অনুমতি দেয়, তাহলে দুশমনের নৌ-বহরকে সমুদ্রের তীর পর্যন্ত আসতে দাও, ওখানে মোকাবেলা করার প্রয়োজন নেই। দুশমনকে এই আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হতে দাও যে, তারা তোমাদের অজ্ঞাতে মিসরে ঢুকে পড়েছে। সৈন্যরা জাহাজ থেকে কূলে নেমে আসার পর অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে জাহাজগুলোকে পুড়ে ফেল এবং খৃস্টান সৈন্যদেরকে পছন্দমত কোন এক ময়দানে নিয়ে কোণঠাসা করে ফেল…।
আমি তোমার অপারগতা সম্পর্কে বেখবর নই। তোমার দূত আমাকে সব কথাই বলেছে। তবে আমি কাবার প্রভুর শপথ করে বলতে পারি, খৃস্টানদের রাজারা সবাই যদি ঝড়ের ন্যায়ও ছুটে আসে, আল্লাহর রাসূলের উম্মতদের। কোন ক্ষতি করতে পারবে না। উম্মত রক্ত দিতে জানে, জানে মাথা দিতে। কিন্তু একদল ঈমান বিক্রয়কারী গাদ্দার আমাদেরকে শিকল পরিয়ে রেখেছে। তুমি কায়রোতে আটকা পড়ে আছ। আমি বাগদাদ থেকে বের হতে পারছি না। নারী, মদ আর সোনার থলে আমাদের দুর্ভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। আমাদের ঘরে যদি শান্তি থাকত, স্বস্তি থাকত, তাহলে তুমি-আমি দুজনে মিলে ক্রুশের মোকাবেলা করতে পারতাম। কিন্তু কাফেররা এমন ফাঁদ পেতে রেখেছে যে, মুসলমানরাও কাফের হতে চলেছে। এই কাফের মুসলমানরা এতই অন্ধ যে, বুঝতেও পারছে না, দুশমন তাদের বোন-কন্যাদের ইজ্জত নিয়ে খেলা করছে। কার্কের মুসলমানরা যেরূপ মানবেতর জীবন-যাপন করছিল, তা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। খৃস্টানরা তাদের উপর যে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল, তা শুনলে তোমার গা শিউরে উঠবে। আমি জাতির গাদ্দারদেরকে কিভাবে বুঝব যে, দুশমনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সরাসরি দুশমনি করার চেয়েও বেশী ভয়ংকর…।
তুমি দুঃখ প্রকাশ করেছ যে, তোমার ভাই, ভাল ভাল কর্মকর্তা ও সুযোগ্য কমান্ডারগণ তোমার হাতে নিহত হচ্ছে। শোন সালাহুদ্দীন! ওরা তোমার হাতে নিহত হচ্ছে, দুঃখের বিষয় এটা নয়। দুঃখজনক বিষয় হল, স্বজাতির কর্ণধার হওয়া সত্ত্বেও তারা গাদ্দারীর পথ বেছে নিল! মুসলমানের হাতে মুসলমান নিহত হচ্ছে দেখে খৃষ্টানরা উল্লাস করছে, এটা হল আফসোসের বিষয়। তুমি গাদ্দারদের ক্ষমা করতে পার না। গাদ্দারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমি তোমার অপেক্ষা করছি। তুমি যখন আসবে, সঙ্গে বেশীসংখ্যক সৈন্য নিয়ে আসবে। খৃষ্টানরা তোমাদেরকে দুর্গের অভ্যন্তরে লড়াইয়ে লিপ্ত করিয়ে তোমাদের শক্তি নিঃশেষ করে দিতে চায়। এমন যেন না হয় যে, বাইতুল মোকাদ্দাসের পথেই তোমরা সব শক্তি হারিয়ে ফেলবে। তুমি যখন আসবে, মিসরের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে আসবে। সুদানীদের ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। আমি জানতে পেরেছি, তোমার আর্থিক সমস্যাও আছে। আমি তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে পারলে ভাল হবে। কায়রো থেকে যথাশীঘ্র বেরিয়ে আসার চেষ্টা কর। তবে ভেতর ও বাইরের পরিস্থিতি দেখে-শুনে আসবে। আল্লাহ তোমার সহায় হোন।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী উপস্থিত কমান্ডার-কর্মকর্তাদেরকে নুরুদ্দীন জঙ্গীর বার্তাটি পাঠ করে শোনান। তিনি তাদেরকে আশার বাণী শোনান যে, সেনাবহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য পল্লী এলাকাসমূহ থেকে লোক আসতে শুরু করেছে। দুশমন কুসংস্কার বিস্তারের যে অভিযান শুরু করেছিল, তা সফলভাবে দমন করা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন স্থানে এখনো তার ক্রিয়া রয়ে গেছে। একটি আবহ উঠেছিল দেশের বিভিন্ন মসজিদ থেকে। তাও কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে। খৃস্টানরা আমাদের ধর্ম-বিশ্বাসে যেসব অলীক চিন্তা-চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছিল, তিন-চারটি মসজিদের ইমামও মানুষের মন-মস্তিষ্কে সেই চিন্তা-চেতনা ঢুকাতে শুরু করেছিল। তারা আল্লাহর দূত সেজে বসেছিল। আমি এমন মানুষেরও দেখা পেয়েছি, যে বিপদে পড়ে সরাসরি আল্লাহর নিকট দোয়া করার পরিবর্তে ইমামদেরকে নজরানা দিয়ে থাকে যে, ইমামরা তার জন্য দোয়া করবে। মানুষের মধ্যে এই বুঝ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যে, সাধারণ মানুষ না সরাসরি আল্লাহর নিকট কিছু চাইতে পারে, না আল্লাহ সরাসরি তাদের কথা শুনেন। সুলতান আইউবী বললেন, আমি সেই ইমামদেরকে অপসারণ করে সেই মসজিদগুলোতে এমন ইমাম নিয়োগ করেছি, যাদের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা কুরআনের অনুকূল। তারা এখন লোকদেরকে এই শিক্ষা দিচ্ছে যে, আল্লাহ আলেম-বেআলেম, ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা সকলের জন্য সমান। তিনি সরাসরি যে কারো দোয়া শুনে থাকেন, ভাল কাজের পুরস্কার ও মন্দ কাজের শাস্তি প্রদান করেন। আমি আমার জাতির মধ্যে এই শক্তি ও চেতনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি, যেন তারা নিজেদেরকে এবং আল্লাহকে চেনার চেষ্টা করে। আমার বন্ধুগণ! তোমরা তো দেখেছ, তোমাদের দুশমন শুধু যুদ্ধের ময়দানেই লড়াই করছে না, তারা তোমাদের মন-মগজে নতুন বিশ্বাস ও চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটানোরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অভিযানে ইহুদীরা সকলের আগে। ইহুদীরা এখন আর তোমাদের মুখোমুখি এসে লড়াই করবে না। তারা তোমাদের ঈমানকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। এ কাজে তারা শীঘ্র সফল হতে না পারলেও ব্যর্থও হবে না। এমন একটি সময় আসবে, যখন আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত এই সম্প্রদায়টি মুসলমানদেরকে দুর্বল পেয়ে এমন চাল চালবে যে, তারা লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হবে- তাদের খঞ্জর সালতানাতে ইসলামিয়ার হৃদপিণ্ডে আঘাত হানবে। তোমরা যদি তোমাদের ইতিহাসকে এই যিল্লতির হাত থেকে রক্ষা করতে চাও, তাহলে আজই পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ কর- জনগণের কাছে যাও। নিজেকে শাসক ও জনগণকে শাসিত ভাবতে ভুলে যাও। জনমনে এমন আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত কর, যেন তারা দেশ-জাতি-দ্বীনের জন্য জীবন কুরবান করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
সুলতান আইউবী বললেন, খৃস্টানদের কাছে আছে মদ আর সুন্দরী নারী। আর আমাদের আছে এ দুয়ের মোহ। জাতির অন্তর থেকে মদ-নারী-সম্পদের এই লোভ দূর করতে হবে। তার জন্য ঈমানের পরিপক্কতা প্রয়োজন।
আমীরে মোহরাতাম!- ঊর্ধ্বতন এক কমান্ডার বললেন- আমাদের সম্পদেরও প্রয়োজন আছে। ব্যয় নির্বাহ আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থের অভাবে অনেক কাজে আমাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
আমি তোমাদের এ সমস্যার সমাধান করব- সুলতান আইউবী বললেন সব সময়ের জন্য তোমাদেরকে একটি সত্য মেনে নিতে হবে যে, মুসলমানদের কাছে সম্পদ, সৈন্য ও অস্ত্রের অভাব অতীতেও ছিল, এখনও আছে। এর ব্যতিক্রম কখনো ঘটেনি। আমাদের প্রিয়নবী (সাঃ) তার জীবনের প্রথম যুদ্ধটিতে লড়েছিলেন মাত্র তিনশ তেরজন প্রায় নিরস্ত্র সৈন্য নিয়ে। সে যুদ্ধে কাফেরদের সৈন্য ছিল এক হাজার। তারা সবাই ছিল অস্ত্রসজ্জিত। পরবর্তীতে যখন সেখানে কাফেরদের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়েছে, এ অনুপাতেই হয়েছে। তাছাড়া মুসলমানদের কাছে মোটের উপর সম্পদের অভাব কখনো ছিল না। কিন্তু সে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে ছিল গুটিকতক লোকের হাতে। এখনও আমাদেরও ঠিক একই অবস্থা। ছোট ছোট যেসব প্রদেশের মালিক মুসলমান, তাদের কাছে বিপুল সম্পদের স্তূপ পড়ে আছে।
সম্পদের স্তূপ এ অঞ্চলেও পড়ে আছে সালারে আজম!- গিয়াস বিলবীস বললেন- আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমরা একটি নতুন অভিযান শুরু করতে পারি। আপনি জানেন যে, মিসর গুপ্তধনের জায়গা। অতীতে এখানে যখন যে ফেরাউনই মারা গেছে, নিজের সম্পদ-ধনভাণ্ডার সঙ্গে করে মাটির নীচে নিয়ে গেছে। ঐ সকল সম্পদ কার ছিল? ছিল গরীব মানুষগুলোর, যাদেরকে অভুক্ত রেখে তাদের থেকে সেজদা আদায় করা হত। সে যুগের মানুষ ফেরাউনদেরকে খোদা বলে মান্য করত শুধু এ কারণে যে, তাদের পেটে খাবার ছিল না, পরনে কাপড় ছিল না। তাদের ভাগ্য ছিল ফেরাউনদের হাতে। তাদের জীবন-মৃত্যু দু-ই ফেরাউনরা নিজ হাতে তুলে নিয়েছিল। মানুষদের। দ্বারা মাটি খুঁড়ে পাহাড় কেটে ফেরাউনরা পাতালে তাদের সমাধি তৈরি করেছিল, যা ছিল ঠিক প্রাসাদের ন্যায়। মানুষের ধনভাণ্ডারকে তারা তার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। মহামান্য সুলতান যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমরা ফেরাউনদের সেই সমাধির অনুসন্ধান শুরু করে দেই এবং ধনভাণ্ডার উদ্ধার করে দেশ ও জাতির স্বার্থে ব্যবহার করি।
উনি ঠিকই বলেছেন আমীরে মোহতারাম।- গিয়াস বিলবীসের পক্ষে মজলিস থেকে একাধিক আওয়াজ উঠে।
আমরা এর আগে বিষয়টা কখনো ভেবে দেখেনি। বললেন একজন।
এই অভিযানে আমরা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারি। বললেন আরেকজন।
জনসাধারণের মধ্য থেকে নতুন একটি বাহিনী গঠন করে এ অভিযান শুরু করা যায়। বললেন আরেকজন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ কাজে বেতন দিয়ে অসামরিক লোকদের ব্যবহার করা যেতে পারে। সমর্থন জানায় অন্যজন।
একরকম শোরগোল পড়ে যায় মজলিসে। প্রত্যেকে কিছু না কিছু বলছেন। চুপচাপ বসে আছেন শুধু একজন- সুলতান আইউবী। দীর্ঘক্ষণ পর সভাসদগণ টের পান যে, তাদের আমীর ও সেনাপতি কথা বলছেন না। হঠাৎ নীরবতা ছেয়ে যায় মজলিসে। এখন কেউ-ই কথা বলছেন না, নিস্তব্ধ বসে আছেন সবাই। সুলতান আইউবী সকলের প্রতি একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মুখ খুললেন। বললেন
আমি গিয়াস বিলবীসের এই প্রস্তাব অনুমোদন করি না।
সবাই নিশুপ-নিস্তব্ধ। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে হলময়। সুলতান আইউবীর কথার উপর কথা বলবে এমন সাহস কারো নেই। সুলতান বললেন
আমি চাই না, আমার মৃত্যুর পর ইতিহাস বলুক সালাহুদ্দীন আইউবী কবর-চোর ছিল, কবর-ডাকাত ছিল। ইতিহাস আমাকে অপদস্থ করলে তা তোমাদের জন্যও অপমান বলে গণ্য হবে। ভবিষ্যৎ বংশধর বলবে সালাহুদ্দীন আইউবীর মন্ত্রী-উপদেষ্টাগণও কবর-চোর ছিল। ইতিহাসের এমন তথ্য খৃষ্টানদের জন্য এক উপাদেয় খোরাকে পরিণত হবে। তারা তোমাদের কুরবানী ও ইসলামী চেতনাকে ডাকাতী ও দস্যুতা আখ্যা দিয়ে তোমাদেরকে তোমাদের-ই বংশধরের মাঝে অপমানিত করবে। আর তাতে শুধু তোমরা-ই নও, আমাদের ইতিহাসও কলংকিত হয়ে পড়বে।
গোস্তাখী মাফ করুন আমীরে মোহতারাম!- আলী বিন সুফিয়ান বললেন-অতীতে অল্প কদিনের জন্য মিসর খৃষ্টানদের কজায় এসেছিল। ক্ষমতা পেয়ে তারা সর্বপ্রথম এখানকার গুপ্তভাণ্ডারসমূহ অন্বেষণ শুরু করেছিল। কায়রো উপকণ্ঠে আমরা যে পরিত্যক্ত ভগ্ন প্রাসাদগুলো থেকে খৃষ্টান সন্ত্রাসী ও ফেদায়ীদের একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছিলাম, সেটিও কোন এক ফেরাউনের সমাধি ছিল। খৃষ্টানরা সেখান থেকে সব ধনভাণ্ডার নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খৃস্টানদের শাসনক্ষমতা বেশীদিন টিকে থাকেনি। না হলে তারা মিসরের সব গুপ্তধন উদ্ধার করে নিয়ে যেত। মাননীয় গিয়াস বিলবীস ঠিকই বলেছেন যে, এই ধনভাণ্ডারের যদি কোন মালিক থেকে থাকে, তাহলে সে আর যে হোক ফেরাউন নয়। এসব সম্পদের মালিক ছিল দেশের জনগণ। আমি আপনাকে এ পরামর্শ দেয়ার সাহস করি যে, এসব গুপ্তধন উদ্ধার করে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা হোক।
আর আমি তোমাকে জ্ঞাত করতে চাই- সুলতান আইউবী বললেন এসব ধনভাণ্ডার যখন তোমাদের হাতে আসবে, তখন তোমরাও ফেরাউন হয়ে যাবে। মানুষকে এত দুঃসাহস কে দিল যে, মানুষ নিজেকে খোদা দাবি করবে? সম্পদ আর সম্পদের মোহ-ই তো! মানুষকে মানুষের সামনে সেজদা করতে কিসে বাধ্য করল? দারিদ্র্য আর ক্ষুধা-ই তো! তোমরা খৃস্টানদের কথা বললে যে, তারা ফেরাউনের একটি সমাধি লুট করেছে। শোন, যখন প্রথম ফেরাউনের মরদেহ তার সমুদয় সম্পদসহ মাটিচাপা দেয়া হয়, তখন থেকে কবর-চুরির সূচনা হয়। মানুষ হিংস্র হায়েনার ন্যায় প্রথম ফেরাউনের কবরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিজেদের দ্বীন-ঈমান ত্যাগ করে মানুষ গুপ্তধনের উপর লুটিয়ে পড়েছিল। তারপর একের পর এক ফেরাউন মৃত্যুবরণ করতে থাকে আর কবর-চুরি নিয়মিত একটি পেশার ন্যায় চলতে থাকে। তারপর এই কবরচুরির প্রবণতা রোধ করার জন্য প্রত্যেক ফেরাউন নিজের জীবদ্দশায় : মৃত্যু-পরবর্তী সমাধির জন্য এমন দুর্গম জায়গা ঠিক করে যেতে শুরু করে, যেখানে পৌঁছা কারো পক্ষে সম্ভব না হয় এবং মৃত্যুর পর তাদের উত্তরসূরী ও স্থলাভিষিক্তরা সেই সমাধি এমনভাবে বন্ধ করে রাখতে শুরু করে, যেন কেউ তা খুলতে না পারে। তারপর একসময় যখন ফেরাউনদের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে, তখন মিসরের শাসনক্ষমতা যখন যার হাতে আসে, তখনই সে সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করার প্রতি মনোনিবেশ করে। আমি জানি, ফেরাউনদের অনেক সমাধি এমনও আছে, সেগুলো কোথায় আছে কেউ জানে না। সেগুলো মূলত পাতালপ্রাসাদ। মিসরের শাসকবর্গ ও হানাদাররা কেয়ামত পর্যন্ত এসব সমাধি খুঁজতে থাকবে…।
জানো, ঐ শাসকদের পতন কেন ঘটেছে তার একমাত্র কারণ, তাদের দৃষ্টি ঐ ধনভাণ্ডারের প্রতিই নিবদ্ধ ছিল। তারা প্রজাদের এই বুঝ দিয়েছিল যে, সম্পদ আছে তো সম্মান আছে। হাতে অর্থ নেই, তাহলে তোমাদের এবং তোমাদের সুন্দরী স্ত্রী-কন্যাদের মালিকও তারা, যাদের দৌলত আছে। আমার বন্ধুগণ! তোমরা সালাহুদ্দীন আইনবীকে সেই সারিতে দাঁড় করিও না। আমি জাতিকে এ বুঝ দিতে চাই যে, আসল সম্পদ হল জাতীয় মর্যাদা আর ঈমান। কিন্তু তা তখনই সম্ভব হবে, যখন আমি নিজে এবং তোমরা যারা সরকারের স্তম্ভ, অন্তর থেকে সম্পদের মোহ দূর করতে পারবে।
আমরা তো এই ধনভাণ্ডার অন্বেষণ ব্যক্তিগত স্বার্থে করতে চাই না- এক কমান্ডার বললেন- আমরা জাতীয় স্বার্থে এ অভিযানে হাত দিতে চাই।
আমি জানি, আমার এই অস্বীকৃতি তোমাদের কারো পছন্দ নয়- সুলতান আইউবী বললেন- আমার কথা বুঝতে হলে তোমাদের মস্তিষ্ক থেকে অন্যসব চিন্তা দূর করে ফেলতে হবে। আমার বিবেক আমাকে বলছে যে, যে সম্পদ বাহির থেকে আসে- হোক তা জাতীয় প্রয়োজনে- তা শাসকদের ঈমান নড়বড়ে করে দেয়। এ ইল সম্পদের অভিশাপ। আমার বুঝ হল, আমার নিকট যদি ঘোড়া ক্রয় করার জন্য অর্থ না থাকে, তাহলে আমি বাহিনীর সঙ্গে পায়ে হেঁটে বাইতুল মোকাদ্দাস গিয়ে পৌঁছব, তবু ঘোড়া কেনার জন্য কবর খুঁড়ে লাশের গায়ের অলংকার চুরি করে বিক্রি করতে পারব না। আমার লক্ষ্য বাইতুল মোকাদ্দাসকে খৃস্টানদের থেকে উদ্ধার করা; ঘোড়া ক্রয়ের জন্য অর্থ সগ্রহ করা নয়। তোমরা যখন গুপ্তধনের অনুসন্ধান শুরু করবে, তখন জনসাধারণের মধ্যে অনেকে যেখানে সেখানে কবর-চুরি করতে শুরু করবে। মিসরে এমন ঘটনা ঘটে আসছে। আর যখন ঐসব গুপ্তধন তোমাদের হাতে চলে আসবে, তখন তোমরা একজন অপরজনের শত্রুতে পরিণত না হলেও পরস্পরের মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা সৃষ্টি হবে। নিঃসন্দেহে অর্থের প্রাচুর্য মানুষের পারস্পরিক ভালবাসা নষ্ট করে দেয়। বান্দার হক আদায় করার উৎসাহ নিঃশেষ করে দেয়। এই ধনৈশ্বর্যই মানুষকে খোদার আসনে বসিয়েছিল। আজ সেই খোদারা কোথায়? তারা তো আকাশে উঠে যায়নি, মাটির নীচেই দাফন হয়ে আছে। আমার বন্ধুগণ! আমি নতুন একটি অপরাধের বীজ বপন করতে চাই না। তোমরা এই ধনভাণ্ডারের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। আরে, তোমাদের মধ্যে এই যে গাদ্দার তৈরি হয়ে আছে, তা তো এই সম্পদের-ই লীলা। তোমরা দুজন গাদ্দারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান কর তো আরো চারজন তৈরি হয়ে যায়। তোমরা নিজ হাতে উপার্জিত-উৎপাদিত সম্পদ দ্বারা জীবন নির্বাহ করার চেষ্টা কর। তোমরা মুসলমান। নিজেদের ভাগ্য কাফেরদের হাতে তুলে দিও না। অন্যথায় সবাই গাদ্দার হয়ে যাবে। ফেরাউনরা মারা গেছে। ঐ মৃত দেহগুলোকে মাটির নীচেই চাপা পড়ে থাকতে দাও।
আপনার অনুমোদন ছাড়া আমরা এ জাতীয় কোন অভিযান শুরু করব না। বললেন একজন।
গিয়াস!- সুলতান আইউবী গিয়াস বিলবীসের প্রতি তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন- আজ হঠাৎ করে এই গুপ্তধনের কথা তোমার মাথায় আসল কিভাবে? আমি মিসর আসলাম চার বছর হয়ে গেল। এর আগে কোনদিন তো তুমি এমন প্রস্তাব পেশ করনি?
ইতিপূর্বে এই চিন্তা কখনো আমার মাথায় আসেওনি আমীর মোহতারাম!- গিয়াস বিলবীস বললেন- মাস দুয়েক আগে জাতীয় গ্রন্থাগারের কেরানী আমাকে বলল, পুরাতন কাগজপত্র থেকে কিছু কাগজ হারিয়ে গেছে। আমি সেই কাগজগুলোর ধরণ ও গুরুত্ব জিজ্ঞেস করলে সে বলল, কাগজগুলো এমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, খুঁজে বের করতে হবে। তাতে ছিল কিছু নকশা ও ফেরাউনদের আমলের কিছু লেখাজোখা। অনেক পুরাতন ও ছেঁড়াফাড়া ছিল কাগজগুলো। কেরানী যখন ফেরাউনদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করল, তখন আমার মনে খেয়াল চাপল যে, সেসব লেখা ও নকশাগুলোতে ফেরাউনদের গোপন সমাধি সম্পর্কে তথ্য থাকতে পারে। যে ফাইল থেকে কাগজগুলো গুম হয়েছিল, আমি তা দেখেছি। আমি বিষয়টিকে এই বলে গুরুত্ব দেইনি যে, ওসব লেখা-জোখা এ যুগে কে আর বুঝবে।
তোমার এ ধারণা সঠিক নয় গিয়াস!- সুলতান আইউবী বললেন মিসরে এমন অনেক লোক আছে, যারা এসব লেখা, নকশা ও ইশারা-ইঙ্গিত বুঝতে সক্ষম। এসব কাগজ ও নকশা চুরি হওয়া বিস্ময়কর ঘটনা নয়। এই চুরি গ্রন্থাগারের কোন লোভী কর্মকর্তা করে থাকবে। এ কাগজগুলোর প্রতি আমার কোন কৌতূহল নেই- আমার দৃষ্টি চোরের প্রতি। লোকটি তোমাদেরই বন্ধু-বান্ধবদের কেউ কিনা কে জানে। চোরটিকে খুঁজে বের করতে হবে। আলী! বিলম্ব না করে অভিযান শুরু কর।
আমার মনে হচ্ছে, কাগজগুলোর কিছু না কিছু গুরুত্ব অবশ্যই আছে আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আমি মোহতারাম গিয়াস বিলবীসের সঙ্গে কথা বলেছি। বেশ কিছুদিন যাবত আমাদের সংবাদদাতা ও গোয়েন্দারা আমাদেরকে শহরে একটি রহস্যময় তৎপরতার সংবাদ দিয়ে আসছে। কুদুমী নাম্মী এক নর্তকী আছে। বিশেষ মহলে মেয়েটি সকলের কাছে পরিচিত, যাকে বিত্তশালীদের পানশালার প্রদীপ বলা চলে। আজ পাঁচদিন যাবত মেয়েটি নিখোঁজ রয়েছে। একটি নর্তকীর শহর থেকে উধাও হয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা নয়। কিন্তু কুদুমীকে আমি বিশেষ নজরে রেখেছি। আমি গোয়েন্দা মারফত জানতে পেরেছি যে, মেয়েটির কাছে অজ্ঞাতপরিচয় ও সন্দেহভাজন দুজন লোক যাওয়া-আসা করত। হঠাৎ একদিন তার ঘর থেকে বোরকা পরিহিত একজন মহিলাকে বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। মহিলা অপরিচিত এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যাচ্ছিল। আমার সন্দেহ, কুদুমীই নিজের বেশ বদল করে বেরিয়ে গেছে। আমার আরেক দল গোয়েন্দা কিছু লোককে সন্দেহজনক অবস্থায় দক্ষিণ দিকে যেতে দেখেছে। আমার সন্দেহ, এসব তৎপরতা হারিয়ে যাওয়া কাগজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমার আরো সন্দেহ হচ্ছে, এরা খৃস্টান সন্ত্রাসী চক্রই হবে। তবে আসল ঘটনা যাই হোক, আমি এসব তৎপরতার রহস্য উদ্ঘাটন করে ছাড়ব।
হ্যাঁ, তুমি অনুসন্ধান শুরু করে দাও- সুলতান আইউবী বললেন- আর ঐসব গুপ্তধনের কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেল। আমি জানি, জাতির কল্যাণ সাধন এবং খৃস্টানদের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধ লড়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমি কারো নিকট সাহায্য চাইব না। মোহতারাম নুরুদ্দীন জঙ্গী আমাকে সাহায্য করবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন। আমি তার এ সাহায্য গ্রহণ করব না। আর্থিক সাহায্য মায়ের পেটের ভাইও যদি করে, তবু তা মানবিক উৎকর্ষ, শ্রম ও দ্বীনদারীর জন্য ক্ষতিকর। তারপরও মানুষ গুপ্তধনের সন্ধানে দিশেহারার মত ঘুরে ফিরছে। শোন আলী! মিসরের মাটি বন্ধ্যা হয়ে যায়নি। পরিশ্রম কর; এ মাটিতেই সোনা ফলবে। দেশের জনগণকে বুঝাও, তাদের প্রতি সরকারের কর্তব্য কি। তাহলে তারা নিজেদেরকে প্রজা ভাবা ছেড়ে দেবে। তাদেরও কি কি কর্তব্য আছে, তাও তাদেরকে অবহিত কর। দেশের জনগণ যদি কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে, তাহলে দেশের উন্নতি হতে পারে না। তোমরা যে ভূখণ্ডের সংরক্ষণে রক্ত ঝরাবে না, যে দেশের মর্যাদার জন্য ঘাম ঝরাবে না; সে ভূখণ্ড সে দেশ তোমাদের পাওনা আদায় করবে না। তারপর দেশের শাসকগোষ্ঠী বিদেশের ধনভাণ্ডারের অনুসন্ধানে নেমে পড়বে আর জনগণ বিভক্ত-বিশৃঙ্খল হয়ে কাফেরদের গোলামে পরিণত হবে।
***
মিসরের গবর্নর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যে ধনভাণ্ডারে হাত দেয়া অপছন্দ করছেন, সেসব যে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় রক্ষিত, সে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তারই এক জেনারেলের প্রেরিত পঞ্চাশ ব্যক্তির বাহিনী। মারকুনী, ইসমাইল, কুদুমী এবং অপর এক খৃষ্টান পৌঁছে গেছে সন্ধ্যায়। তাদের অন্য সঙ্গীরা- যাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে প্রেরণ করা হয়েছিল গন্তব্যে পৌঁছতে শুরু করেছে সে রাতেই। মধ্যরাত পর্যন্ত পৌঁছে যায় পঞ্চাশজনের সব কজন।
জায়গাটা এমন যে, এর পাশ দিয়ে কোন পথিক কখনো পথ অতিক্রম করেনি। অত্যন্ত ভয়ানক জায়গা। সীমান্ত থেকে দূরে হওয়ার কারণে এখানে কখনো কোন সীমান্ত বাহিনীর নজরও পড়েনি।
মারকুনী রাতারাতি সবাইকে ভেতরে পৌঁছিয়ে দেয়, যাতে বাইরে থেকে। কেউ দেখে না ফেলে। সে সঙ্গীদের বলে দেয়, তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত ইচ্ছা ঘুমাতে পার; ঘুম থেকে উঠে এখান থেকে পায়ে হেঁটে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। নিজে কুদুমীকে নিয়ে তাঁবুতে ঢুকে পড়ে।
একটি পাহাড়ের পাদদেশে ঘুমিয়ে পড়ে সকলে। পরদিন সকালে যখন তারা জাগ্রত হয়, তখন ভোরের রক্তিম সূর্য টিলার উপরে উঠে গেছে। এই অভিযানে সঙ্গে সরঞ্জাম, যন্ত্র ও অস্ত্রপাতি কি কি সঙ্গে নিতে হবে, মারকুনী আগেই তা বলে দিয়েছিল। সরঞ্জামাদির মধ্যে আছে শক্ত ও মোটা রশি, কোদাল ও বেলচা ইত্যাদি। অস্ত্রের মধ্যে তীর-ধনুক ও তরবারী। পথের দুর্গমতা সম্পর্কেও সকলকে অবহিত করা হয়েছে। মারকুনীর এক সঙ্গী যে. দেয়াল অতিক্রম করতে গিয়ে নীচে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিল, সেই দেয়াল সম্পর্কেও ধারণা দিয়ে সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নারীকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ইত্যাদি সব বিষয়ে কাফেলার প্রত্যেককে পূর্ব ধারণা দিয়ে রেখেছে মারকুনী। এখান থেকে উটে সওয়ার হয়ে অগ্রসর হওয়া যাবে না। যেতে হবে পায়ে হেঁটে। তাই উটগুলো বেঁধে রেখে দেখাশোনার জন্য মাত্র এক ব্যক্তিকে রেখে দেয়া হয়েছে। কুদুমীকেও এপথে নেয়া যাবে না। মারকুনীর আশা, খুঁজলে অন্য কোন নিরাপদ পথ পাওয়া যাবে, যে পথে কুদুমীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে সে। কুদুমীর হেফাজতের জন্যও একজন লোকের প্রয়োজন। এ-কাজের জন্য কেবল ইসমাইলই উপযুক্ত ব্যক্তি।
মারকুনী ইসমাইলকে বলল, তুমি কুদুমীকে নিয়ে এখানেই থাক। তবে মনে রাখবে, কুদুমীর মর্যাদার তুলনায় তুমি কিছুই নও। তুমি তার আরাম ও হেফাজতের দায়িত্ব পালন করবে। আমি শিগগির ফিরে আসব। এসে তোমাদের দুজনকে নিয়ে যাব।
মারকুনী দলবল নিয়ে রওনা হয়ে যায়। এ-পথ তার চেনা। নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে এগিয়ে চলে মারকুনী। দলের অন্যরা যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছে, ততই ভয় চেপে বসছে তাদের মনে। পাহাড়ী এলাকা সম্পর্কে তারা সবাই সম্যক অবহিত। কিন্তু এমন এলাকা, এ ধরনের পাহাড় তারা আগে কখনো দেখেনি। যে জায়গাটায় নারী কণ্ঠের কান্নার শব্দ শোনা যায়, সেখানে পৌঁছে হঠাৎ সবাই হতচকিত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করে। তারা নিশ্চিত, কতগুলো নারী একযোগে কান্নাকাটি করছে। ভয়ে গা ছম ছম করে ওঠে সকলের। সর্বাঙ্গ কাটা দিয়ে উঠে তাদের। কিন্তু এ অভিযানের জন্য তাদেরকে যে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তার শক্তি এতই বেশী যে, এই ভীতিকর অবস্থা তার কাছে চাপা পড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া তারা তো খৃস্টানদের বেতনভোগী কর্মচারী। মারকুনী তাদের অফিসার। তারা পুরস্কারের লোভ ও কুমের চাপে এগিয়ে চলছে সম্মুখপানে। কান্নার শব্দ শুনে তারা যখন হঠাৎ মকে উঠে, তখন মারকুনী তাদের বলে, এগুলো নারী বা প্রেতাত্মা কিছুই নয় এটা বাতাসের শব্দ। তারপরও তাদের ভয় কাটেনি। পরস্পর চোখাচোখি করে? সাহসের ভান দেখিয়ে এগুতে থাকে।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। কাফেলা সেই প্রশস্ত ও সুগভীর খাদের নিকট পৌঁছে মানদীপ্ত দাস্তান গেছে, মারকুনী যেটি একবার অতিক্রম করেছিল। প্রাকৃতিক সরু দেয়াল বেয়ে এখন তাদের এ খাদ পার হতে হবে। দলের সদস্যদের নিয়ে মারকুনী সমস্যায় পড়ে যায়। দেয়ালে পা রাখতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। মারকুনী সকলের সামনে। দেয়ালে পা রেখে এগুতে শুরু করে সে। তার দেখাদেখি এক এক করে অন্যরাও দেয়ালে উঠে যায়। এক পা দুপা করে অগ্রসর হতে শুরু করে তারা সূর্য ডুবে গেছে। আলো না থাকায় খাদের গভীরতা কারো চোখে পড়ছে না। মারকুনীর সঙ্গীদের জন্য এটা ভালই হল।
মারকুনী দেয়াল অতিক্রম করে ওপার পৌঁছে গেছে। হঠাৎ এমন একটি আর্তচীৎকার তার কানে আসে, যা ধীরে ধীরে নীচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে। খানিক পর ভেসে আসে আরো একটি ভয়ংকর চীৎকার শব্দ। এটিও নীচের দিকে চলে গিয়ে হাল্কা ধপাস শব্দের সঙ্গে নীরব হয়ে যায়। এরূপ পাঁচটি চিৎকার ধ্বনি শুনতে পায় মারকুনী।
মারকুনীর কাফেলার সদস্যরা দেয়াল অতিক্রম করে ওপার গিয়ে সমবেত হয়। গুনে দেখা গেল, পাঁচজন কম। মারকুনী জানায়, সামনে আর বড় কোন সমস্যা নেই। আমরা গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। আর একটু অগ্রসর হলে সোজা পথ পেয়ে যাব।
গভীর রাত। মারকুনী তার সঙ্গীদের নিয়ে সে স্থানে পৌঁছে যায়, যার নীচে বিস্তৃত সবুজ-শ্যামল ভূখণ্ড। মারকুনী সবাইকে সেখান থেকে সামান্য দূরে লুকিয়ে রাখে। দুব্যক্তিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে অন্যদের বলে, সঙ্গে যা আছে খেয়ে শুয়ে পড়। আমি সময়মত তোমাদেরকে জাগিয়ে দেব।
সঙ্গীদ্বয়কে নিয়ে স্থান পর্যবেক্ষণে নেমে পড়ে মারকুনী। নীচে বরের নীরবতা। ঘোর অন্ধকার। কোথাও এক ফোঁটা আলোও চোখে পড়ছে না। আর সামনে অগ্রসর হতে ভয় পাচ্ছে মারকুনী। রাত পোহাবার আগে আক্রমণ চালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় সে। ফিরে যায় ঘুমন্ত সঙ্গীদের নিকট।
***
কুদুমী ও ইসমাইল রয়ে গেছে পিছনে। এমন নিরিবিলি পরিবেশ ভাল লাগে না কুদুমীর। কোলাহলপূর্ণ মদ আর নাচ-গানের আসরের হৈ-হুঁল্লোড় তার প্রিয়। কিন্তু মারকুনী তাকে এই ভয়ংকর নির্জন এলাকায় নিয়ে এল এবং এই একটি মানুষের সঙ্গে এখানে রেখে গেল!
ইসমাইল কুদুমীকে জানে। কুদুমী ইসমাইলকে চিনে না। ইসমাইল অপরাধ জগতের মানুষ। তবে তার দৈহিক গঠন ও আলাপ-ব্যবহারে কুদুমীর কাছে তাকে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বলে মনে হল। ইসমাইলের কাছে ঘেঁষতে চায় কুদুমী। কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না ইসমাইল।
সন্ধ্যার পর ইসমাইল ভুনা গোশত গরম করে কুদুমীকে খেতে দেয়। মদের গ্লাস সামনে রেখে বলে, খেয়ে শুয়ে পড়। প্রয়োজন হলে আমাকে আমার তাঁবু থেকে ডেকে নিও।
ইসমাইল কুদুমীর তাঁবু থেকে বেরিয়ে যায়। কুদুমী খাবার খায়, মদ পান করে। ইসমাইলের পরামর্শ মোতাবেক এখন তার শুয়ে পড়া দরকার। কিন্তু একা একা ভাল লাগছে না তার। মনটা ছটফট করছে। নিজের রূপ-লাবণ্যে গর্ব আছে কুদুমীর। ইসমাইল তার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। এমন একটা আশাও মনে মনে পোষণ করে কুদুমী। কিন্তু ইসমাইল সম্পূর্ণ উদাসীন। রূপসী কুদুমীকে নিয়ে কোন ভাবনাই যেন নেই তার।
কুদুমীর চোখে ঘুম আসছে না। নিজের তাঁবু থেকে বের হয় সে। চলে যায় ইসমাইলের তাঁবুতে। ইসমাইল এখনো সজাগ। কুদুমীর আগমন টের পেয়ে বাতি জ্বালায় সে। জিজ্ঞেস করে কেন এসেছ? কুদুমী বলল, একা একা ভাল লাগছে না, তাই এলাম। বলতে বলতে ইসমাইলের কাছে ঘেঁষে বসে পড়ে মেয়েটি। জিজ্ঞেস করে
তুমি বোধ হয় মুসলমান?
ধর্ম নিয়ে তোমার কৌতূহল কিসের?- ইসমাইল জবাব দেয়- তোমার সব সম্পর্ক তো মানুষের সাথে। মানুষের জন্যই তোমার জীবন, তোমার মরণ! নামটা আমার ইসলামী ইসমাইল। কিন্তু আমার কোন ধর্ম নেই।
এ্যা!- মুখে মুচকি হাসি টেনে বিস্ময়ের সাথে কুদুমী বলল- তুমি ইসমাইল! আহমার দরবেশের খাস লোক।
প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় ইসমাইল।
মরকুনী সম্পর্কে কথা তোলে কুদুমী। বলে, লোকটা নিজের নাম বলেছে সোলায়মান সেকান্দার। কিন্তু তাকে মুসলমান বলে মনে হয় না!
লোকটা মিসরী নয়- ইসমাইল বলল- সুদানীও নয়। নামও তার সোলায়মান সেকান্দার নয়।
তাহলে তিনি কে?- কুদুমী জিজ্ঞেস করে- তার আসল নাম কি?
তার আসল নাম আমি জানি; কিন্তু তোমাকে বলতে পারব না ইসমাইল বলল- এই ভেদ লুকিয়ে রাখার জন্য আমি তার নিকট থেকে বিনিময় পেয়ে থাকি। তার সম্পর্কে তোমার কৌতূহল না থাকাই উচিত যে, সে কে। তুমি উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তার মনোরঞ্জনের জন্য এখানে এসেছ। এটা তোমার পেশা। সে তোমাকে গুপ্তধনের ভাগও দেবে বলে ওয়াদা করেছে নিশ্চয়।
সে তো আমার প্রাপ্য- কুদুমী বলল- তিনি আমাকে যে বিনিময় দিয়েছেন, এই ভয়ংকর বিয়াবানে আসার বিনিময় হিসেবে তা নিতান্তই কম। তোমার ধারণাই সঠিক যে, আমি গুপ্তধনের ভাগ পাওয়ার ওয়াদা নিয়েই এসেছি।
তোমার কি বিশ্বাস হয় যে, সে তোমাকে গুপ্তধনের ভাগ দেবেঃ ইসমাইল জিজ্ঞেস করে- তোমার কি বিশ্বাস হয়, সে তার সেই কাঙ্খিত গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যাবে, তুমি যার ভাগ নিতে এসেছ?
আমি এতই দামী মেয়ে যে, মানুষ আমাকে ধন-ভাণ্ডারের বিনিময়েও কিনতে প্রস্তুত- গর্বের সুরে কুদুমী বলল- এই লোকটি তো আমার উপযুক্ত মূল্য আদায়ই করতে পারবে না। আমি আমীরজাদা আর শাহজাদাদের গোলাম বানিয়ে রাখি।
কয়দিন?-ইসমাইল মুচকি হেসে বলল- বড়জোর আর দুবছর। তারপর তোমার দাম এতই কমে যাবে যে, তুমি অলিগলিতে পাগলের ন্যায় ছুটতে থাকবে, কেউ তোমাকে জিজ্ঞেসও করবে না। যাদের কাছে ধনভাণ্ডার আছে, তারা আরেক কুদুমীকে জোগাড় করে নেবে। কাজেই এত গর্ব কর না কুদুমী।
কেন করব না?–কুদুমী বলল- এই লোকটি- যিনি নিজের নাম সোলায়মান সেকান্দর বলে জানিয়েছেন- আমার রূপের জাদুতে এমনভাবে ফেঁসে গেছেন যে, আমাকে একাধিকবার কসম খেয়ে বলেছেন, তিনি শুধু আমারই জন্য গুপ্তধন উদ্ধার করতে যাচ্ছেন। তিনি আমাকে ইস্কান্দারিয়া নিয়ে যাবেন। সেখানে সমুদ্রের পাড়ে আমার জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। তারপর আমি আর নর্তকী থাকব না। কেন, তোমার কি তাতে সন্দেহ আছে?
সন্দেহ নয়- আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে তোমার কাছে মস্তবড় মিথ্যে বলেছে- ইসমাইল বলল- আমি তো এসেছি এটা আমার চাকুরী। আহমার দরবেশের নির্দেশ আমাকে মান্য করতে হয়। তিনি আমাকে বললেন, যাও, আমি এসেছি। এটা আমার পেশা। আমি ভাড়াটিয়া, পাপী। বিনিময় পেয়ে আমি খুনও করতে পারি। কিন্তু আমি মিথ্যে বলতে পারি না। অপরাধ করতে গিয়ে আমি কখনো ধরা পড়িনি। আহমার দরবেশ আমকে বাঁচিয়ে রাখেন। আমার মধ্যে আরেকটি গুণ কিংবা দোষও বলতে পার আছে যে, আমি নারীকে শ্রদ্ধা করি। কেন করি তা জানি না। একজন নারী ড্র হোক কিংবা বেশ্যা হোক, আমি তাকে সম্মান করি। আমি নারীকে ধোকা দিতে পারি না। তোমাকে আমি ধোকার মধ্যে রাখব না। আমি তোমাকে একথা বলে দেয়া আমার নৈতিক কর্তব্য মনে করি যে, এ ধনভাণ্ডার তোমার মহল নির্মাণের লক্ষ্যে উদ্ধার করা হচ্ছে না। এই ধন ব্যবহৃত হবে মিসরের মূলোৎপাটনের কাজে। তারপর মিসরে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, মসজিদগুলোকে গীর্জায় পরিণত করা হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে এই ধনভাণ্ডার মিসরের বাইরে চলে যাবে। আমি জানি, মিসর নিয়ে তোমার কোন কৌতূহল নেই। নেই আমারও। আমরা দুজনই পেশাদার। পাপ করা আমাদের পেশা। আমার তোমাকে শুধু দুটি কথা বলার ছিল, বলেছি। শোন, আবারও বলছি, প্রথম কথা- তোমার রূপ-যৌবন আর বেশি দিন টিকবে না। দ্বিতীয় কথা- এই লোকটি তোমাকে সঙ্গে করে এনেছে ফুর্তি করার জন্য। তার দৃষ্টিতে তুমি একটি বেশ্যা। সদয় হয়ে সে দুএকটি হীরক খণ্ড তোমার হাতে গুঁজে দিলেও দিতে পারে, তার বেশী নয়। সে যদি কারো জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করেও, সে হবে অন্য কোন মোড়শী কন্যা- তুমি নও। তোমার চেহারায় আমি চুলের ন্যায় সরু দুটি রেখা দেখতে পাচ্ছি, যা আজ ভালই লাগছে। কিন্তু কদিন পর রেখা দুটো গম্ভীর হয়ে তোমাকে মূল্যহীন করে ফেলবে।
ইসমাইলের ঠোঁটে মুচকি হাসি। বলার ধরনটা এমন যে, তাতে না আছে তিরস্কার না আছে প্রতারণার আভাস। আছে হৃদ্যতা ও বাস্তবতা, যা কুদুমী এর আগে কখনো শুনেনি। কুদুমীর ধারণা, বরং আশা ছিল, ইসমাইল তাকে কাছে টেনে নেবে। প্রেম নিবেদন করবে। কিন্তু ইসমাইল তাকে সেই চোখে দেখলই না। বরং উল্টো তাকে এই বুঝ দেয়ার চেষ্টা করল যে, এই পাপের জগতে সে দুদিনের মেহমান মাত্র। কুদুমী বরাবরই নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত। নিজেকে তার ক্লিওপেট্রা মনে করত সে। কিন্তু আজ ইসমাইল তাকে এমন এক ধারণা দিল, যাকে সে ফেলতে পারছে না। ইসমাইলের বলার ধরনই এমন যে, তার বক্তব্য কুদুমীর মনের গভীরে গেঁথে যায়।
রাত কেটে যাচ্ছে। তবু কুদুমীর চোখে ঘুম আসছে না। ইসমাইলের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাতে ভাল লাগছে তার। ইসমাইলও তাকে নিরাশ করল না। রাতের শেষ প্রহর। এবার দুচোখের পাতা এক হয়ে আসে কুদুমীর।
বেশ বেলা হলে যখন কুদুমীর চোখ খুলল, তখন সে ইসমাইলের তাঁবুতে। ইসমাইল তাঁবুর বাইরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কুদুমী তাকে জাগিয়ে তুলে বলল, আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি- বড় বিস্ময়কর স্বপ্ন। কী দেখলাম, পুরোপুরি মনে নেই। এতটুকু মনে আছে যে, কে যেন আমাকে বলছে, সোলায়মান সেকান্দারের ধনভাণ্ডারের চেয়ে ইসমাইলের কথাগুলোর মূল্য বেশী। বলেই কুদুমী হেসে ওঠে- এমন হাসি, যাতে নর্তকীর কৃত্রিমতা নেই আছে একটি নিষ্পাপ মেয়ের নির্মল সরলতা।
***
সূর্য এখনো উদিত হয়নি। পরিকল্পনা মোতাবেক মারকুনী তার সঙ্গীদেরকে উপযুক্ত জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে। রাত পোহাবার পর এখন নীচের সবুজ-শ্যামল এলাকায় উলঙ্গ নারী-পুরুষের হাঁটা-চলা চোখে পড়তে শুরু করে। মারকুনী তার এক দুঃসাহসী ও নির্ভীক সৈনিককে নীচে অবতরণ করার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিল। আগের অভিযানে তার এক সঙ্গী যে ঢালু গড়িয়ে নীচে পড়ে, এই রহস্যময় লোকগুলোর সুস্বাদু খাবারে পরিণত হয়েছিল, সেই ঢালু বেয়ে নীচে নেমে যেতে হবে তাকে। লোকটি ঢালের। উপরে বসে নিজেকে নীচের দিকে গড়িয়ে দেয়। গড়াগড়ি খেতে খেতে নীচের সমতল ভূমিতে গিয়ে পড়ে সে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে যায় এবং হাঁটতে শুরু করে। তিন-চারজন মানুষখেকো লোক তাকে দেখে ফেলে। তাকে ধরার জন্য তারা ছুটে আসে। আনন্দে চিৎকার করছে তারা। তারা যখন লোকটির নিকটে চলে আসে, অমনি উপর থেকে শাঁ করে চারটি তীর ধেয়ে আসে এবং তাদের প্রত্যেকের বুকে এসে বিদ্ধ হয়। ওদিক থেকে আরো দুজন উলঙ্গ পুরুষ দৌড়ে আসে। তারাও তীরের নিশানায় পরিণত হয়। মারকুনী উপরে একটি পাথরের সঙ্গে রশি বেঁধে রেখেছিল। রশির অপর মাথা নীচের দিকে ছেড়ে দিয়ে রশি বেয়ে প্রত্যেককে নীচে নেমে যেতে নির্দেশ দেয়।
রশি বেয়ে বেয়ে এক এক করে নীচে নেমে যায় মারকুনীর দলের সকলে। মারকুনী রশিটা খুলে নীচে ফেলে দেয় এবং নিজে গড়ানী খেয়ে নেমে যায়। এই ঢালু বেয়ে নীচে অবতরণ করা মারকুনীর পক্ষে ব্যাপার নয়। মারকুনীর নেতৃত্বে তরবারী উঁচিয়ে একদিকে ছুটে চলে বাহিনী। আরো কয়েকজন উলঙ্গ মানুষ সামনে পড়ে তাদের। তরবারীর আঘাতে টুকরো করে ফেলা হয় তাদেরকে। দূর থেকে দেখে পেছন দিকে পালিয়ে যায় কয়েকজন।
নীচের এই সবুজ-শ্যামল এলাকটা কয়েক ভাগে বিভক্ত। মারকুনী দেখতে পায় পলায়নপর সবগুলো মানুষ একই অংশে ঢুকে পড়েছে। সে তাদের পিছু নেয়। লোকগুলো চিৎকার করছে শুনতে পায় মারকুনী। চিৎকারের শব্দ অনুসরণ করে ধাওয়া করতে থাকে সে। দলের অন্যরা যাকে যেখানে পাচ্ছে, নির্বিচারে হত্যা করছে সবাইকে। পলায়নপর লোকগুলোর অনুসরণ করছে মারকুনী একা। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর লোকগুলো নজরে আসে মারকুনীর। তারা তিনজন। পালাবার পথ খুঁজছে তারা। মারকুনী ও তাদের মাঝে এখন সামান্য ব্যবধান। একদিকে একটি পাহাড় দেখতে পায় মারকুনী। পাহাড়ের পাদদেশে একস্থানে একটি গুহার মুখ। পলায়নপর লোকগুলো ঢুকে পড়ে এ-পথে। ঢুকে পড়ে মারকুনীও। মারকুনীর হাতে তরবারী।
এটি গুহা নয়- সুড়ঙ্গপথ। হতে পারে প্রাকৃতিক, কিংবা কোন ফেরাউনের তৈরি। কয়েকটি মোড় আছে সুড়ঙ্গটির। ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সম্মুখে কথা বলার শব্দ কানে আসছে তার। মারকুনী এগিয়ে যায় সামনের দিকে। বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একস্থানে আলো চোখে পড়ে। সেই আলোতে তিনজন মানুষকে দৌড়াচ্ছে দেখে সে। এটি সুড়ঙ্গের অপর মুখ। লোকগুলোকে হত্যা করতে চাইছে না মারকুনী। মিশন তার সফল হতে চলেছে।
ভেতর থেকে বেরিয়ে যায় পলায়নপর লোক তিনজন। বেরিয়ে পড়ে মারকুনীও। দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় একজন। কাছে গিয়ে দেখে মারকুনী। একজন বৃদ্ধ, আগেরবার তার সঙ্গী নীচে পড়ে যাওয়ার পর যাকে দেখেছিল, সে।
সুড়ঙ্গের বাইরে বালুকাময় ও পাথুরে টিলা, বড় বড় পাথরখণ্ড। একদিকে কালো পাহাড় উপরে চলে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। মারকুনী বৃদ্ধকে হাতে ধরে তুলে দাঁড় করায়। তাকে তার পলায়নপর সঙ্গীদ্বয়কে ফিরিয়ে আনতে বলে ইঙ্গিতে।
মারকুনীর ইঙ্গিত বুঝে ফেলে বৃদ্ধ। ডাক দেয় সঙ্গীদের। তারা দাঁড়িয়ে যায়। বৃদ্ধ তাদেরকে ফিরে আসতে বলে। তারা ফিরে আসে।
বৃদ্ধ মারকুনীর সঙ্গে মিসরী ভাষায় কথা বলে। সে বলল, আমি তোমার ভাষা বুঝি ও বলতে পারি। আমাকে খুন করে তুমি কিছুই পাবে না।
মারকুনীও মিসরী ভাষা জানে। সে বৃদ্ধকে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। তোমার সঙ্গীদেরও খুন করব না। আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার পথটা দেখিয়ে দাও।
তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও? জিজ্ঞেস করে বৃদ্ধ।
হ্যাঁ- মারকুনী জবাব দেয়- আমি তোমাদের রাজত্ব থেকে বেরিয়ে যেতে চাই।
বৃদ্ধ তার সঙ্গীদেরকে কি যেন বলল। তারা অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত। বৃদ্ধ মারকুনীকে বলল, এদের সঙ্গে যাও, এরা তোমাকে সোজাপথ দেখিয়ে দেবে।
তুমিও সঙ্গে চল- মারকুনী বলল- এরা আমাকে ভুল পথে নিয়ে যাবে।
বৃদ্ধ মারকুনীকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দেয়। কতগুলো টিলার মধ্যদিয়ে হেঁটে তারা অপর একটি টিলার উপর উঠে যায়। তারপর আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে এক খোলা ময়দানে গিয়ে উপনীত হয়। ভেতরে যাওয়া-আসার সোজাপথ পেয়ে যায় মারকুনী।
বৃদ্ধ মারকুনীকে বলল, তুমি এবার চলে যাও। অন্যথায় খোদার গজব তোমাকে ভস্মীভূত করে ফেলবে। কিন্তু মারকুনী তো এমনিতেই চলে যেতে আসেনি। তার অভিযানের অগ্রযাত্রা শুরু হল মাত্র। এই বিজন পাহাড়ী এলাকায় যাওয়া-আসার সোজা পথ পেল মাত্র। ভয় দেখিয়ে তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে নেয় সে। তারপর এই বলে যে-পথে এসেছিল, সে-পথে ফিরিয়ে নিয়ে যায় যে, আমার কিছু লোক ভেতরে আটকা পড়ে আছে, তাদেরকেও বের করে আনতে হবে।
মারকুনীর হাতে খাপখোলা তরবারী। তার ভয়ে তিনজনই তটস্থ। তারা মারকুনীর সঙ্গে ফেরত রওনা হয়।
পথটা ভালভাবে চিনে নেয় মারকুনী। বাক-মোড় সব রপ্ত করে নেয়। বৃদ্ধ ও তার সঙ্গীদের নিয়ে সুড়ঙ্গপথের একমুখ দিয়ে প্রবেশ করে অন্যমুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
বৃদ্ধ মারকুনীকে সে স্থান দিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে মারকুনীর সঙ্গীকে ভুনা করে কেটে কেটে ভক্ষণ করা হয়েছিল। সেখানে কয়েকটি উলঙ্গ মানুষের লাশ পড়ে আছে। বেশকটি শিশুর লাশও আছে। মারকুনীর সঙ্গীরা শিশুদেরকে হত্যা করে ফেলেছে। বৃদ্ধ এই গণহত্যা বোধ হয় আগে দেখেনি। তাই অকস্মাৎ চমকে উঠে থেমে যায়। ধৈর্য সংবরণ করে মারকুনীকে জিজ্ঞেস করে, এই নিরপরাধ লোকগুলোকে খুন করে তোমরা কী পেয়েছ?
তোমরা আমার একজন সঙ্গীকে আগুনে সিদ্ধ করে খেয়েছিলে। সে তোমাদের কী ক্ষতি করেছিল? প্রশ্ন করে মারকুনী।
সে অপরাধ জগতের মানুষ ছিল- বৃদ্ধ জবাব দেয়- আমাদের এই পবিত্র সাম্রাজ্যে এসে সে একে নাপাক করেছিল।
তোমরা এখানে কেন থাক?- মারকুনী জিজ্ঞেস করে- ফেরাউন র্যামন্স দ্বিতীয়-এর সমাধি কোথায়?
এ দুটি প্রশ্নের জবাব আমি তোমাকে দেব না। বৃদ্ধ জবাব দেয়।
ইত্যবসরে মারকুনীর সঙ্গীদের কয়েকজন এখানে এসে সমবেত হয়। মারকুনী তাদেরকে বলল, এদের মহিলাদেরকে নিয়ে আস। আক্রমণের আগেই মারকুনী সঙ্গীদের বলে রেখেছিল, কোন নারীকে হত্যা করবে না, উত্যক্তও করবে না। তাদেরকে পণ হিসেবে আটকে রাখবে।
মারকুনীর সঙ্গীরা দশ-এগারজন মহিলাকে সামনে নিয়ে আসে। তাদের দুতিনজন বৃদ্ধা। দুতিনজন কিশোরী। অন্যরা যুবতী। সবাই উলঙ্গ। গায়ের রং ফর্সা। বেশ সুন্দরী। মাথার চুল কোমর পর্যন্ত লম্বা। সোনার তারের ন্যায় চিক চিক করছে সকলের চুল।
আমরা যদি তোমাদের এই মেয়েগুলোকে তোমাদের চোখের সামনে অপমান করে হত্যা করি, তা কি তোমাদের কাছে ভাল লাগবে? বৃদ্ধের প্রতি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মারকুনী।
তার আগে তোমরা আমাকে হত্যা করে ফেল। বলল বৃদ্ধ।
না, তা করব না। তোমার সামনেই এদের সম্ভ্রমহানি করে হত্যা করব। বলল মারকুনী।
শোন! বৃদ্ধ বলল- তোমাদের মহিলারা কাপড়ে আবৃত থাকে। তাদের তোমরা পোশাকের তলে লুকিয়ে রাখ। কিন্তু তারা অশ্লীলতা পরিহার করে না। তোমরা নারীর খাতিরে রাজ্য বিসর্জন দাও। তোমরা নারীকে নাচাও, তাদেরকে দিয়ে পাপ করাও। আর আমাদের মহিলারা কাপড় পরিধান করে না- উলঙ্গ থাকে। কিন্তু অশ্লীলতা করে না। আমাদের কোন পুরুষ অন্য পুরুষের স্ত্রীর প্রতি সেই দৃষ্টিতে তাকায় না, যে দৃষ্টিতে তোমরা আমাদের নারীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছ। আমি তো তোমাদের এই কুদৃষ্টিপাতকেও সহ্য করতে পারি না। তোমরা পবিত্র খোদা রামন্স-এর ধনভাণ্ডার লুট করে নিয়ে যাও, তবু আমার কন্যাদের ইজ্জতের উপর হাত দিও না।
ঠিক আছে, আমি তোমাকে ওয়াদা দিচ্ছি। তুমি আমাকে র্যামন্স-এর সমাধিটা দেখিয়ে দাও- মারকুনী বলল- আমি তোমাদের ইজ্জতের উপর হাত দেব না।
দস্যুর ওয়াদা বিশ্বাস করা যায় না- বৃদ্ধের দুঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি যাদের অন্তরে লোভ থাকে, তাদের চোখে লজ্জা থাকে না। তারা যে মুখে ওয়াদা করে, সে মুখেই তা ভঙ্গ করে। তুমি তো সেই জগতের মানুষ, যেখানে সম্পদের জন্য নারীকে বলি দেয়া হয়। আর শোন দোস্ত! তুমি মিসরী নও। আমি তোমার চোখে নীল নদের পানি নয় সমুদ্রের চমক দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমার দেহ থেকে সমুদ্রের ওপারের ঘ্রাণ পাচ্ছি, মিসরের নয়।
আমি র্যামন্স-এর সমাধির সন্ধানে এসেছি- ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মারকুনী বলল বেশী কথা না বলে তুমি আমাকে সমাধিটা দেখিয়ে দাও।
তা দেখিয়ে দেব- বৃদ্ধ জবাব দেয়। তার আগে আমি তোমাকে একথা অবহিত করা জরুরী মনে করছি যে, সমাধির ভেতরে গিয়ে তোমরা জীবিত বের হয়ে আসতে পারবে না।
কেন, তোমার সৈনিকরা কি ভেতরে লুকিয়ে আছে যে, ওরা আমাদেরকে হত্যা করে ফেলবে? মারকুনী জিজ্ঞেস করে।
না- বৃদ্ধ জবাব দেয়- তোমাদেরকে হত্যা করার মত আমার কাছে কোন সৈন্য নেই। তোমার লোকেরাই তোমাকে হত্যা করে ফেলবে। তারপর তোমার লাশটা ওখান থেকে কেউ তুলেও আনবে না।
তুমি কি গায়েব জান?- মারকুনী জিজ্ঞেস করে- যে তুমি ভবিষ্যতের সংবাদ বলতে পার?
না- বৃদ্ধ জবাব দেয়- আমি অতীত দেখেছি। আর যে অতীতকে বিবেক ও অন্তরের চোখে দেখেছে, সে তার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। আমি দেখতে পাচ্ছি, মৃত্যু তোমার দুচোখে এসে বসেছে।
মারকুনী খিলখিল করে হেসে ফেলে। বলে- বুড়ো! তুমি জংলী মানুষ। ওসব প্যাচাল বাদ দিয়ে বল, সমাধিটা কোথায়?
তোমার সামনে- বৃদ্ধ জবাব দেয়- ঐ তো উপরে। আমার সঙ্গে এস।
মারকুনী কি যেন চিন্তা করে। তারপর সঙ্গীদের বলে, এই মেয়েগুলোকে সসম্মানে রাখ। বৃদ্ধের সঙ্গে গল্প কর। ঐ লোক দুটোর সঙ্গেও দুর্ব্যবহার কর না। আমি কুদুমী ও ইসমাইলকে নিয়ে আসি।
মারকুনী নতুন আবিষ্কৃত সোজা পথে বেরিয়ে যায়।
***
বৃদ্ধের দেখান পথে বাইরে বেরিয়ে আসে মারকুনী। মিসর থেকে এসে কোন্ পথে এই ভয়ানক বিজন এলাকায় প্রবেশ করেছিল, তা মনে আছে তার। কুদুমী ও ইসমাইলকে কোথায় রেখে এসেছে, তাও আন্দাজ করতে পারছে সে। বের হয়ে সেদিকে ছুটে চলে মারকুনী।
অন্তত দুমাইল পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছে যায় মারকুনী। মনে আনন্দের সীমা নেই তার। এখন সে যেখানে দাঁড়িয়ে, এখানেই ইসমাইল ও কুদুমীকে রেখে সে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু একটি দৃশ্য দেখে হঠাৎ মারকুনীর মনের আনন্দ উবে যায়। বদলে যায় চেহারার রং। কুদুমী ও ইসমাইল একই তাঁবুতে একত্রিত বসা। এ দৃশ্য সহ্য হল না মারকুনীর। প্রচণ্ড ক্ষোভ ঝরে পড়ে ইসমাইলের প্রতি। বলে, আমি না তোমাকে বলেছিলাম, নিজের মর্যাদা রক্ষা করে থাকবে! ওর পাশে বসে তুমি কী করছ?
এই বিজন এলাকায় আমি একা বসে থাকব?- কুদুমী বলল- ও আসেনি, আমি নিজেই ওকে ডেকে এনেছি। ওর দোষ নেই।
আমি তোমাকে সঙ্গে করে শুধু এবং শুধুই নিজের জন্য এনেছি- ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মারকুনী বলল- আমি তোমাকে বিনিময় দিয়েছি। কাজেই তোমাকে আমি অন্য পুরুষের সঙ্গে দেখতে চাই না, দেখতে পারি না। নিজের ঘরে শত পুরুষকে ডেকে আনতে পার; কিন্তু এখানে তুমি আমার কেনা দাসী।
গত রাতে ইসমাইল নিষ্ঠমনে কুদুমীর হৃদয়ে এমন ধারণা সৃষ্টি করেছিল, যা তার অন্তরে মারকুনীর বিরুদ্ধে সন্দেহ ও বিরাগের জন্ম দেয়। যার ফলে কুদুমী মারকুনীকে নিজের একজন খদ্দের ভাবতে শুরু করেছে। এবার মারকুনী যখন তাকে ক্রীতদাসী বলে অভিহিত করে বসল, তখন তার অন্তরে মারকুনীর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে গেল। কুদুমী ভাল ও মন্দ মানুষের পার্থক্য বুঝতে শুরু করেছে। অথচ ইসমাইল তাকে ঘুণাক্ষরেও বলেনি যে, আমি ভালমানুষ। বরং সে বলেছিল, আমি ভাড়াটিয়া অপরাধী, ভাড়াটিয়া খুনী।
কুদুমী মারকুনীকে তাড়িয়ে দিতে পারে না। কারণ, সে চুক্তিবদ্ধ। পাওনাটা বুঝে নিয়েই তবে এখানে এসেছে সে। ভবিষ্যতে গুপ্তধনের ভাগ পাওয়ারও কথা আছে। অবশ্য এখন তা সংশয়পূর্ণ মারকুনী ইসমাইলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে, কুদুমী তা সহ্য করতে পারে না।
ইসমাইল কোন কথা বলছে না। অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে মারকুনীর প্রতি। কিছুক্ষণ পর উঠে মারকুনীর বাহু ধরে তুলে সামান্য আড়ালে নিয়ে গিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আহমার দরবেশ বৈধ হয় তোমাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলেনি! তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জান না। আমি তোমাকে ভালভাবেই জানি। তুমি আমার দেশ ও জাতির মূলোৎপাটন করতে এসেছ। আর আমি এত জঘন্য পাপী যে, ভাড়ায় তোমার সঙ্গ দিচ্ছি। তোমাকে আমি আমার রাজা স্বীকার করতে পারি না। আমি আমার পারিশ্রমিক কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করব আর গুপ্তধন উদ্ধার হলে তার থেকেও উপযুক্ত ভাগ নেব।
তুমি এসব কথা আহমার দরবেশের কাছে বল গিয়ে- মারকুনী একজন সেনা কমান্ডারের ন্যায় বলল- এখানে তুমি আমার অধীন। গুপ্তধন যা উদ্ধার হবে, সব আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আমি যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যাব।
শোন সুলায়মান সেকান্দার!- ইসমাইল পূর্বের ন্যায় ক্ষীণ ও হাসিমাখা কণ্ঠে বলল- আমি জানি, তুমি মারকুনী- সুলায়মান সেকান্দার নও। আমি একজন পেশাদার অপরাধী। তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি যে, তোমার এসব কথা আমাকে অপরাধী থেকে মিসরী মুসলমানে পরিণত করবে। আমি তোমাকে আরো হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, মুসলমান জাতীয় চেতনায় এতই অন্ধ যে, যদি কোন মুসলমানের লাশের মধ্যেও এই চেতনা জেগে ওঠে, তাহলে সেও উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আমাকে তুমি অপরাধীই থাকতে দাও, তাতেই তোমার মঙ্গল।
মারকুনী অনুভব করল, লোকটা বড় পাকা। এ মুহূর্তে তাকে শত্রুতে পরিণত করা ঠিক হবে না। ইসমাইলের কাঁধে হাত রেখে এবং মুখে বন্ধুসুলভ হাসি টেনে বলল, তুমি অহেতুক ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়েছ। আসল কথা হল, আমি চাই না যে, এই বেশ্যা মেয়েটা তোমার আমার কারো মস্তিষ্কে জেঁকে বসুক। ও বড় চতুর মেয়ে। আমাদের দুজনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে সব গুপ্তধন হাতিয়ে নেয়ার বুদ্ধি আঁটছে। তুমি আমাকে শত্রু মনে কর না। আহমার দরবেশ কি তোমাকে বলেননি যে, তিনি তোমার ব্যাপারে কী ভাবছেন?
গুপ্তধন পেয়ে যাব আশা করা যায় কি? জিজ্ঞেস করে ইসমাইল।
পেয়ে গেছি- মারকুনী জবাব দেয়- আমি তোমাদের দুজনকে নিতে এসেছি।
ইসমাইল গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মারকুনীর প্রতি। তাকিয়ে আছে কুদুমীও। মনটা তার ক্ষুণ্ণ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। উট দেখাশোনা করার জন্য রেখে যাওয়া লোকটাকে ডাক দেয় মারকুনী। লোকটা ছুটে আসে। মারকুনী উটগুলোকে একটার পেছনে একটা বেঁধে নেয়ার নির্দেশ দেয় তাকে। গুটিয়ে নেয়া হয় তাঁবু দুটোও।
ইসমাইল ও কুদুমীকে নিয়ে আসে মারকুনী। মনোরম সবুজ-শ্যামল জায়গা দেখে, বিমুগ্ধ হয়ে পড়ে কুদুমী। উঁচু একটি পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি ঝিল। পাহাড়ের নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। দেখে মনটা ভরে যায় কুদুমীর।
মারকুনী গোত্রের উলঙ্গ বৃদ্ধ নেতার কাছে চলে যায়। কুদুমী ইসমাইলের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরতে শুরু করে। হঠাৎ ছোট্ট একটি শিশুর লাশ চোখে পড়ে কুদুমীর। শিশুটি উলঙ্গ। সারা গায়ে রক্ত- যেন রক্ত দিয়ে গোসল করেছে বাচ্চাটা। ভয়ে আঁৎকে উঠে মেয়েটি। সর্বাঙ্গ কাটা দিয়ে উঠে তার।
দুজন এগিয়ে যায় আরো সামনে। এবার এক স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে দুটি লাশ। এগুলো বয়স্ক মানুষের মৃতদেহ। উভয় লাশের গায়ে তীরবিদ্ধ। কুদুমীর ভয় আরো বেড়ে যায়। কাঁপতে শুরু করে সে।
দুজন এগিয়ে যায় আরো সম্মুখে- যেখান দিয়ে মারকুনীর লোকেরা উপর থেকে নীচে নেমেছিল সেখানে। খোলামেলা জায়গা। এখানে পড়ে আছে আরো কয়েকটি লাশ। পাঁচ-ছয়টি শিশুর লাশ। অন্যগুলো বড়দের। সবগুলো লাশের মুখ ও চোখ খোলা। গায়ে নির্যাতনের ভয়ানক আলামত। মিসরের রূপসী কন্যা কুদুমী এমন বীভৎস দৃশ্য স্বপ্নেও দেখেনি কখনো। ছোট একটি শিশুর লাশ দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠে সে।
মারকুনীর তিন-চারজন লোক চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে। কুদুমী মাথা চক্কর খেয়ে লুটিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ইসমাইল তাকে আগলে ধরে। মারকুনীর লোকদেরকে অবহিত করা হয় যে, মেয়েটি লাশ দেখে ভয় পেয়েছে। একজন পানি আনতে ছুটে যায়। কুদুমী অল্প সময়ের মধ্যেই সম্বিৎ ফিরে পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই লাশগুলো কাদের? এদেরকে হত্যা করা হল কেন?
ইসমাইলের ঘটনা জানা ছিল না। মারকুনীর এক লোক কুদুমীর প্রশ্নের জবাব দেয়। কুদুমী ইসমাইলের প্রতি তাকায়। পীতবর্ণ ধারণ করেছে তার মুখের রং। ইসমাইল বলল, এই লোকগুলো আমাদের চেয়ে ভাল। এরা গুপ্তধন পাহারা দিত। এরা মানুষ খেত, পোশাক পরত না ঠিক; কিন্তু আমানতদার ছিল। এরা যদি ফেরাউনের সমাধি খুঁড়ে ধনভাণ্ডার তুলে নিয়ে যেত, তাহলে কে ঠেকাত? আর আমরা? আমরা দস্যু, খুনী। অথচ আমরা নিজেদেরকে সভ্য দাবি করি। এসব মারকুনীর কারসাজি।
আমি সেই সম্পদ থেকে কিছুই নেব না, যার জন্য এই নিষ্পাপ শিশু ও নিরপরাধ লোকগুলোকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে- কুদুমী বলল এদের কাছে কোন অস্ত্র দেখতে পাচ্ছি না। এরা নিরস্ত্র ছিল।
বৃদ্ধকে নিয়ে একটি পাথরখণ্ডের পেছনে চলে গেছে মারকুনী। বৃদ্ধ তাকে বলল, উপরে উঠে পড়; সেখানে ঐ যে বড় একটা পাথর দেখা যাচ্ছে, যদি তুমি পাথরটা সেখান থেকে সরাতে পার, তাহলে তুমি সেই জগতের দরজা দেখতে পাবে, যেখানে রামন্স-এর লাশের বাক্স ও তার ধনভাণ্ডার রাখা আছে। পাথরটা যেদিন এখানে স্থাপন করা হয়েছিল, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কেউ তা নাড়ায়নি। পনেরশ বছর যাবত এই পাথরকে কেউ স্পর্শও করতে পারেনি। আমরা পনেরশ বছর পর্যন্ত এর রক্ষণাবেক্ষণ করছি। আমি তোমাকে রামন্স-এর মৃত্যুর কাহিনী এমনভাবে শোনাতে পারব, যেন তিনি এই গতকাল আমার চোখের সামনে মারা গেছেন। এই কাহিনী আমাকে আমার বাপ-দাদারা শুনিয়েছেন। দাদাকে শুনিয়েছেন, তার বাপ-দাদা। আমি আমার গোত্রের সব মানুষকে সেই কাহিনী শুনিয়েছি।
তোমার এসব কথা আমি পরে শুনব- বলেই মারকুনী পাথরটির উপর উঠে যায়। তার চেহারায় অস্থিরতার ছাপ। আর বিলম্ব সইছে না যেন তার। উপরের পাথরটা আলাদা স্থাপন করা কিংবা সেটি সরানো সম্ভব, তা তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। এদিক-ওদিক খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মারকুনী। কিন্তু পাথরটা যে আলাদা, তার কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না। নীচে নেমে আসে মারকুনী।
আমি জানি, তুমি বিশ্বাস করবে না যে, এই পাথরটির দুটি অংশ আছে বৃদ্ধ বলল- উপরের যে অংশটি পেছনের পাহাড়ের সঙ্গে মিলিত, সেটি পাহাড়েরই অংশ বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তব তা নয়। এটি মানুষের হাতের কৃতিত্ব। এর গাঁথুনী কুদরতী বলে মনে হলেও মূলত এটি মানুষেরই কারিগরী। র্যামন্স নিজের তত্ত্বাবধানে এটি তৈরি করিয়েছেন। তার নীচে এবং পাহাড়ের বুকে যে জগত বিদ্যমান, তাও র্যামন্স তার জীবদ্দশায় তৈরি করিয়েছেন এবং বাইরের জগতের মানুষ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত গোপন রাখার জন্য এই পাথর ও তার সমাধি তৈরি করিয়ে কারীগরদের বন্দী করে রাখেন। মৃত্যুবরণ করার পর তার লাশের বাক্স এই সমাধিতে রাখা হয়। একজন জীবন্ত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও তাতে রাখা হয়। তারপর কারিগরদের বন্দীশালা থেকে বের করে এনে তাদের দ্বারা উপরে পাথরটা স্থাপন করিয়ে তাদেরকে মেরে ফেলা হয়। তারপর এখানকার বিভিন্ন গুহায় বারজন লোককে বাস করতে দেয়া হয়। তাদের মিসরের বারটি সুন্দরী নারী দেয়া হয়। তাদের দায়িত্ব এ এলাকার পাহারাদারী করা। আজ তুমি যাদেরকে হত্যা করেছ এবং এখনো যারা এখানে জীবিত আছে, তারা সবাই সেই বার দম্পতিরই বংশধর।
এখন বলুন, এই পাথরটা এখান থেকে সরাতে পারি কিভাবে? জিজ্ঞেস করে মারকুনী।
তোমার কি চোখ নেই? বৃদ্ধ জবাব দেয়- তোমার কি বিবেক নেই? পাথরের ঐ চূড়াটা দেখ, তার সঙ্গে কি রশি বাঁধতে পার না? তোমার লোকদের গায়ে যদি শক্তি থাকে, তাহলে সবাই মিলে রশিটা টান। তাতে হয়ত পাথরটা নীচে নেমে আসতে পারে।
মারকুনীর আর তর সইছে না। যত তাড়াতাড়ি সমাধির মুখটা উন্মুক্ত করে ফেলতে চাইছে। নিজের লোকদের ডাক দেয় সে। সঙ্গে নিয়ে আসা সরঞ্জামাদির মধ্যে রশিও আছে। মোটা একটা রশি হাতে নেয়। একজনকে উপরে উঠিয়ে রশির এক মাথা পাথরের চূড়ার সঙ্গে বাঁধতে বলে। তারপর রশির অন্য মাথায় ধরে নীচ থেকে টান দেয়ান জন্য সবাইকে নির্দেশ দেয়। নিজে উঠে যায় উপরে। নীচ থেকে সবাই সর্বশক্তি ব্যয় করে রশি ধরে হেইয়ো বলে টান দেয়। মারকুনী দেখতে পায়, রশির টানের সঙ্গে পাথরটা দুলছে। একবার এতটাই নড়ে উঠে, যে, তার ফাঁক দিয়ে মারকুনী সমাধির ভেতরটা দেখে ফেলে। মনোবল বেড়ে যায় তার। ধ্বনি দিতে শুরু করে সে। এবার আরো জোরে টান মারে তার লোকেরা। স্থান থেকে পাথরটা অনেকটা সরে যায়। মারকুনী তার সঙ্গীদের বিশ্রাম নিতে বলে। সূর্য কালো পাহাড়ের পেছনে চলে গেছে। সঙ্গে করে মদ নিয়ে এসেছিল মারকুনী। তার নির্দেশে মদ হাজির করে একজন। মারকুনী বলল, পান কর, শক্তি সঞ্চয় করে পাথরটাকে কংকরের ন্যায় নীচে ফেলে দাও।
সবাই মদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মারকুনী ঘোষণা দেয়, আজ রাতে আমি তোমাদেরকে দুটি উট রান্না করে খাওয়াব।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। নতুন উদ্যম সৃষ্টি হয় সকলের মাঝে।
ইতিমধ্যে পশ্চিম দিগন্তেরও নীচে চলে গেছে সূর্য। অন্ধকার ছেয়ে যাওয়ার আগেই কয়েকটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। সকলে রশি ধরে আরেকবার শক্তির পরীক্ষা দিতে শুরু করে।
মারকুনী উপরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রদীপের কম্পমান আলোতে পাথরের উপরিভাগ সম্মুখে ঝুঁকে সরে যেতে দেখতে পায় সে। পূর্বাপেক্ষা আরো জোরে ধ্বনি তোলে সে- আনন্দ ধ্বনি। হঠাৎ ভয়ংকর এক শব্দ তুলে পাথরটা গড়িয়ে পড়ে এবং উল্টে নীচে পড়ে যায়। মারকুনীর লোকেরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সে জায়গাটা অপ্রশস্ত। তার পেছনেও বড় একটি পাথর। উপর থেকে পাথরটা এত তীব্রবেগে পড়ে যে, নীচ থেকে লোকগুলো সরবার সুযোগ পায়নি। নীচে আলোও কম। পাহাড় ও পাথরে ঘেরা এই জগতটা কয়েকটি সমস্বর চিৎকার ধ্বনিতে কেঁপে উঠেই আবার নীরব হয়ে যায়। মারকুনী হন্তদন্ত হয়ে নীচে নেমে আসে। একটি বাতি হাতে নিয়ে দেখে পতিত পাথরের নীচ থেকে রক্ত বইছে। কারো হাত দেখা যাচ্ছে, কারো পা, কারো মাথা। মস্তবড় পাথরটার চাপা খেয়ে থেতলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে প্রত্যেকের দেহ।
মারকুনী কারো দৌড়ানোর শব্দ শুনতে পায়। ভাবে, কে যেন বেঁচে গেছে, সে-ই পালাচ্ছে। কান খাড়া করে এদিক-ওদিক তাকায় সে। নজর পড়ে পার্শ্বে অবস্থিত পাথরটির উপর। তার উপর চারজন লোক দাঁড়িয়ে। আবছা অন্ধকার। লোকগুলো কারা চেনা যাচ্ছে না। মারকুনী ধীরপায়ে গম্ভীর মুখে পাথরটির দিকে এগিয়ে যায়। একটি বাতি হাতে নিয়ে নিরীক্ষা করে দেখে। একজন বৃদ্ধ। অপরজন ইসমাইল। তৃতীয়জন মারকুনীর অন্য এক সঙ্গী। চতুর্থজন কুদুমী। কুদুমী যেন আপাদমস্ত ভীতির মূর্তপ্রতীক। এ মুহূর্তে একটি নিশ্চল পাথর যেন মেয়েটা। অন্যরাও সবাই নীরব-নিস্তব্ধ। ঘটনার আকস্মিকতায় থ খেয়ে আছে সবাই।
সবার আগে মুখ খুলে বৃদ্ধ। বলে, আমি তোমাকে সাবধান করেছিলাম যে, আমি তোমার চোখের মধ্যে মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি। আমি আমার কর্তব্য বিসর্জন দিয়ে তোমাকে ভেদ বলে দিয়েছি। আমি জানতাম, এই ভেদ তোমার জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা আর মৃত্যুই আমার কর্তব্য পালন করে দেবে। যা হোক, এখন কি তুমি ফিরে যাবে?
না- ক্ষীণ কণ্ঠে মারকুনী জবাব দেয়। আমি আমার মিশন সম্পন্ন করব; এই সঙ্গীরা আমার সাহায্য করবে। বলেই মারকুনী তার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করে, মনে হচ্ছে কে যেন রক্ষা পেয়ে পালিয়েছে। কে পালাল?
আমাকে জিজ্ঞেস কর- বৃদ্ধ বলল- তোমার চারজন লোক আমার দুব্যক্তির সঙ্গে পালিয়ে গেছে। কিন্তু আমার লোকেরা তাদেরকে বের হওয়ার পথ দেখাবে না। তাদেরকে ভেতরেই পথ হারিয়ে মরতে হবে। ভাল হত, যদি তারা অন্যদের সঙ্গে পাথরের নীচে এসে জীবন দিত। এ মৃত্যু সহজ ছিল। যা হোক, আজ রাতের জন্য কাজ বন্ধ করে দাও; আমি সকালে তোমাদেরকে ভেতরে নিয়ে যাব।
***
মারকুনীর মনে এই দুর্ঘটনার কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যেন কিছুই ঘটেনি। বৃদ্ধকে নিজের সঙ্গে বসিয়ে খানা খাওয়ায় মারকুনী। ইসমাইল বৃদ্ধকে একটি চাদর প্রদান করে। বৃদ্ধ চাদরটি গায়ে জড়িয়ে নেয়। কুদুমীর মুখে রা নেই।
তোমরা আমার এক সঙ্গীকে খেয়েছিলে- বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে মারকুনী বলল- তার আগে কত মানুষ খেয়েছ?
যত পেয়েছি- বৃদ্ধ জবাব দেয়। আমাদের বংশধারায় নরমাংস খাওয়ার প্রচলন কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা আমি বলতে পারব না। যে ইতিহাস আমার কানে দেয়া হয়েছে, তাতে পনেরশ বছরের আগের একটি ভবিষ্যদ্বাণীও আছে। কেউ বলেছিল, যারা খোদা রামন্স-এর সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ করবে, বিজন পার্বত্য এলাকা তাদেরকে নিজের শীতল কোলে আগলে রাখবে, তারা পানি ও ছায়া থেকে বঞ্চিত হবে না, তারা দুনিয়ার মোহ, সোনা-রূপা ও মদ-নারীর মোহ থেকে মুক্ত থাকবে। ফলে তাদের শরীর আবৃত করার প্রয়োজন পড়বে না। তাদের অন্তরে পরস্পর ভালবাসা থাকবে। তাদের মধ্যে কোন লালসা থাকবে না। লালসাই মানুষকে খুনী, ডাকাত ও অসাধুতে পরিণত করে। মানুষ কখনো সম্পদের লালসার শিকার হয়, কখনো নারীর। লোভী মানুষের দ্বীন-ধর্ম, নীতি-নৈতিকতা বলতে কিছু থাকে না। লালসাই সব অনিষ্টের মূল। আমাদেরকে এই লালসার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, একটি সময় আসবে, যখন রামন্স-এর রক্ষণাবেক্ষণকারীরা নরমাংস ভক্ষণ করবে। তারা এখান থেকে বাইরে বের হবে, মানুষ শিকার করে আনবে। কোন পশু পেলেও খেয়ে ফেলবে। অন্যথায় তাদের বংশধারা নিঃশেষ হয়ে যাবে।
তোমরা কি এখনো ফেরাউনদেরকে খোদা বলে বিশ্বাস কর? কুদুমী বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে।
মানুষ বড় দুর্বল প্রাণী-বৃদ্ধ বলল- তারা নিত্য খোদা বদল করে থাকে। অনেক সময় মানুষ নিজেই খোদা সেজে বসে। এ মুহূর্তে আমার খোদা তোমরা। কারণ, আমার জীবন ও আমার কন্যাদের ইজ্জত এখন তোমাদের হাতে। এই ভেদ আমি তোমাদেরকে খোদা বিশ্বাস করে ফাঁস করেছি। কেননা, আমি মৃত্যুকে ভয় করি, আমার কন্যাদের সম্ভ্রমহানিকে ভয় করি। ফেরাউনও তোমাদেরই ন্যায় সেকালের জনগণের ঘাড়ে তরবারী রেখে বলেছিল, আমি খোদা! তখন নিরীহ মানুষমুলা বাধ্য হয়ে বলেছিল, হ্যাঁ, তুমিই আমাদের খোদা। ক্ষুধা-দারিদ্র মানুষকে বাস্তব জগত থেকে বহু দূরে নিয়ে নিক্ষেপ করে। মানুষের ভেতরকার মনুষ্যত্ব মরে যায়। আসল খোদা যাদেরকে আশরাফুল মাখলুকাত আখ্যা দিয়েছেন, তাদের দেহটাই শুধু রয়ে যায়। যার কারণে তখন পেটের জ্বালায় পড়ে মানুষ সেই মানুষের সামনে সেজদায় অবনত হয়ে পড়ে, যে তার জঠর জ্বালা ঠাণ্ডা করে। মানুষের এই দুর্বলতাই রাজার জন্ম দিয়েছে, ডাকাত-দস্যু সৃষ্টি করেছে, মানুষকে শাসক-শাসিত ও জালিম-মজলুমে পরিণত করেছে। হিরে-জহরত মানুষকে পাপী বানিয়েছে। এই যেমন ধর, (কুদুমীকে উদ্দেশ্য করে) তুমি কে? তুমি এদের কার স্ত্রী? এদের কাকে তুমি আপন বলতে পার? কুদুমী নর্তকী, তা জেনে ফেলেছে বৃদ্ধ।
বৃদ্ধের প্রশ্নে বিব্রত হয়ে পড়ে কুদুমী। নানা কারণে পূর্ব থেকেই মনটা তার বেচাইন। এবার যোগ হল নতুন মাত্রা। বৃদ্ধের প্রশ্ন ঘামিয়ে তুলল মেয়েটিকে। তাকে কিছু বলতে না দেখে বৃদ্ধ বলল, তুমি তোমার সুশ্রী চেহারা আর যৌবনের কারণে নিজেকে খোদা ভাবছ। আর তোমার খদ্দেররা তোমাকে ভাবছে খোদা। তোমরা আমাকে জংলী বা হিংস্র মনে কর না। আমার কাছে কাপড় আছে, যা মাঝে-মধ্যে পরিধান করে আমি কায়রো যাই, তোমাদের সভ্য জগতটা দেখি। তারপর ফিরে এসে খুলে ফেলি। তোমাদের জগতে আমি শাহজাহাদেরকে ঘোড়া গাড়ীতে চড়ে ভ্রমণ করতে দেখি। দেখি তোমার ন্যায় শাহজাদীদের। দেখি নর্তকী-গায়িকাদের। আর দেখি তাদেরকে, যারা ওদেরকে নাচায়-গাওয়ায়। আমি ফেরাউনদের আমলের অনেক কথা শুনেছি। আর এ-যুগের ফেরাউনদেরকেও দেখছি। আমি তাদের পরিণতিও দেখেছি। দেখতে পাচ্ছি তোমাদেরও পরিণতি, যা তোমরা নিজেরা দেখতে পাচ্ছ না। তোমরা সম্পদের লোভে এতগুলো নির্দোষ প্রাণীকে হত্যা করলে! এটা তোমাদের অপরাধ, যার শাস্তি থেকে তোমরা রেহাই পাবে না, যেমনটি রক্ষা পায়নি ফেরাউনরা। আমি আগামীদিন ভোরে তোমাদেরকে সমাধির ভেতরে নিয়ে যাব। তখন তোমরা ফেরাউনের পরিণতি দেখতে পাবে। র্যামন্স যদি খোদা হত, তাহলে তার এই পরিণতি হত না। খোদা তো তিনি, যিনি জগতের সবকিছুকে পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়- নিজে পরিণতি ভোগ করে না। পাহাড়ের তলে কংকাল হয়ে পড়ে আছে যে মানুষটি, আমি তাকে কখনো খোদা বলে স্বীকার করিনি। আমি ও আমার গোত্র তাকে পাহারা দেই না। আমরা দুনিয়ার লোভ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি বিশ্বাস স্থির করে নিয়েছি। আমরা সেই বিশ্বাসেরই রক্ষণাবেক্ষণ করছি শুধু।
থেমে থেমে কাঁপা কণ্ঠে কথা বলছে বৃদ্ধ। তার প্রতি বিমোহিতের ন্যায় অপলক তাকিয়ে আছে কুদুমী। বৃদ্ধের বক্তব্যে কুদুমী নিজের পরিণতি দেখতে পাচ্ছে। মারকুনীর মুখে অবজ্ঞার হাসি। লোকটা মদপান করছে। সে বৃদ্ধকে বলল, তুমি তোমার মহিলাদের নিকট চলে যাও। সকালে তাড়াতাড়ি ওঠে পড়বে। এসে আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে যাবে।
বৃদ্ধ চলে যায়। মারকুনী কুদুমীকে বলে, চল, আমরা শুয়ে পড়ি।
আমি তোমার সঙ্গে যাব না। মারকুনীকে সঙ্গ দিতে অস্বীকৃতি জানায় কুদুমী।
মারকুনী কুদুমীর প্রতি গা এলিয়ে দেয়। কুদুমী সরে যায় পেছন দিকে। মারকুনী মেয়েটিকে ধমক দেয়। ইসমাইল দুজনের মাঝে এসে দাঁড়ায়। কিছু না বলে মারকুনীর চোখে চোখ রাখে সে। মারকুনী পেছনে সরে যায়। কেটে পড়ে ধীরে ধীরে। ইসমাইলের বুকে মাথা গুজিয়ে শিশুর ন্যায় কাঁদতে শুরু করে কুদুমী।
***
ভোরে ঘুম থেকে জাগ্রত হয় মারকুনী। বৃদ্ধকে খোঁজ করে। পাওয়া গেল। পাওয়া গেল না মহিলাদেরকেও। ডাকাডাকি করা হল, এদিকে-ওদিক ঘুরে দেখা হল। কিন্তু নেই- একজনও নেই। তবে মারকুনী তাদের তেমন প্রয়োজনও অনুভব করছে না। র্যামন্স-এর সমাধির মুখ তো এখন উন্মুক্ত। ভেতরে কোথায় কি আছে, বৃদ্ধ তার জানেই বা কি।
মারকুনী ইসমাইল, কুদুমী ও অপর সঙ্গীদের নিয়ে সেই পাথরের উপরের উঠে যায়, সেখানে সমাধির ভেতরে প্রবেশ করার পথ। মারকুনী ভেতরে নেমে পড়ে।
সুপ্রশস্ত এক গর্ত, যা সুড়ঙ্গের রূপ ধারণ করে চলে গেছে একদিকে। মারকুনীর হাতে প্রদীপ। কিছুদূর গিয়ে সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে গেছে। সুড়ঙ্গের প্রান্তসীমায় কোদালের আঘাত হানে সে। আঘাত খেয়ে এমন এক শব্দের সৃষ্টি হয়, যেন পেছনের জায়গাটা ফোলা। এটি পাথরের দরজা। উপর্যুপরি আঘাত করা হয় তাতে। এক কিনারা দিয়ে ভেঙ্গে যায় দরজা। ফঁক দিয়ে ভেতরের খোলা জায়গা চোখে পড়ে মারকুনীর। আরো পিটিয়ে দরজাটা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে সরিয়ে ফেলা হয়। ভেতর থেকে পনের-ষোলশ বছরের পুরনো দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসে। অসহনীয় উৎকট দুর্গন্ধে সবাই পেছন দিকে সরে যায়। নাকে মুখে কাপড় চেপে ধরে সবাই। কিছুক্ষণ পর আবার তারা অগ্রসর হয়। প্রদীপ হাতে ভেতরে ঢুকে পড়ে। কয়েক পা সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটি সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে।
সিঁড়িগুলোর উপরে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে মানব-মস্তিষ্কের খুলি ও কংকাল। ঢাল-বর্শাও পড়ে আছে সেগুলোর আশপাশে। এগুলো সমাধির পাহারাদারদের হাড়-কংকাল। প্রহরার জন্য তাদেরকে জীবন্ত ভেতরে দাঁড় করিয়ে রেখেই সমাধির মুখটা এভাবে ভারী পাথর দ্বারা সীল করে দেয়া হয়েছিল।
সিঁড়িগুলো তাদেরকে অনেক নীচে এক স্থানে নিয়ে যায়। এখানে একটি প্রশস্ত কক্ষ। এখানকার মাটি পাথুরে। অসংখ্য কারিগর দীর্ঘ সময় ব্যয় করে কক্ষটির দেয়াল ও ছাদ এমন নিপুণভাবে খোদাই করেছে, যেন এটি এই বিংশ শতাব্দীর আধুনিক মডেলের প্রাসাদ। অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি নৌকা স্থাপন করে রাখা আছে কক্ষটির এক জায়গায়। নৌকাটির মধ্যেও পড়ে আছে অনেকগুলো হাড়গোড়-কংকাল-খুলি। এরা ছিল এই নৌকার মাঝি-মাল্লা।
কারিগরদের নিপুণ হাতে খোদাইকরা একটি অন্ধকার পথ অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায় মারকুনী ও তার সঙ্গীদের। এই কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে একটি সুসজ্জিত ঘোড়াগাড়ী। গাড়ীটির সম্মুখে আটটি ঘোড়ার বিক্ষিপ্ত কংকাল। সামনের আসনে মানব-হাড়ের স্তূপ। অন্যত্র পড়ে আছে আরো কয়েকটি মানব-কংকাল।
এই কক্ষ অতিক্রম করে আরো একটু অগ্রসর হওয়ার পর পাওয়া গেল আরো একটি কক্ষ, ঠিক যেন শীষমহল। কক্ষটির ছাদ বেশ উঁচু। কক্ষের একটি দেয়াল ঘেঁষে উপর দিকে উঠে গেছে কতক সিঁড়ি। সিঁড়ির উপর পাথর নির্মিত একটি চেয়ার। এই চেয়ারে বসে আছে র্যামন্স-এর একটি মূর্তি। মূর্তিটিও পাথরের তৈরি।
সিঁড়ির উপর ইতস্তত কতগুলো মানব-কংকাল ও খুলি ছড়িয়ে আছে এখানেও। একটি খুলির সঙ্গে একটি মুক্তার হার চোখে পড়ে কুদুমীর। নীল বর্ণের একটি হীরাও আছে সঙ্গে। পার্শ্বে পড়ে আছে মহিলাদের কানে ব্যবহার্য কয়েকটি সোনার অলংকার ও কয়েকটি আংটি। অন্যান্য কংকালের গায়েও অনুরূপ নানা ধরনের অলংকার দেখতে পায় কুদুমী।
মারকুনী একটি হার তুলে হাতে নেয়। দেড় হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও হিরা ও মুক্তাগুলো এখনো ঝকঝক করছে। এতটুকুও মন্দা পড়েনি তাতে। প্রদীপের আলোয় হিরাগুলো নানা বর্ণের কিরণ ছড়াচ্ছে। মারকুনী হারটা কুদুমীর গলায় পরিয়ে দিতে উদ্যত হয়। কুদুমী চিৎকারকরে সরে ইসমাইলের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। খিলখিল করে হাসি দিয়ে মারকুনী বলে, আমি বলেছিলাম না, তোমাকে আমি রানী ক্লিওপেট্রা বানিয়ে দেব। ভয় কর না কুদুমী। এসব হার-অলংকার তোমারই।
না- কেঁপে উঠে কুদুমী- না, আমি এসব খুলি ও হাড়-কংকালের মধ্যে আমার পরিণাম দেখতে পেয়েছি। এরাও আমারই ন্যায় রূপসী ছিল। এটা ঐ খোদার প্রিয়ার হার, যিনি এখানে কোথাও মৃত পড়ে আছেন। আমি সেই লোকদের আঞ্জাম দেখে ফেলেছি, অহংকার যাদেরকে খোদায় পরিণত করেছিল।
কুদুমী এতই ভয় পেয়ে যায় যে, সে ইসমাইলকে ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়ে বলে, আমাকে তুমি এখান থেকে নিয়ে চল, নিয়ে যাও আমাকে এখান থেকে। আমি এখন কংকাল ছাড়া কিছুই নয়।
কুদুমীর গলায় একটি হার ছিল। হারটা খুলে সে সেটি একটি কংকালের উপর ছুঁড়ে মারে। হাতের আঙ্গুল থেকে মহামূল্যবান আংটিগুলো খুলে ফেলে দেয়। তারপর চিৎকার করে বলে ওঠে, আমি আমার পরিণতি দেখে ফেলেছি। ইসমাইল তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল।
ইত্যবসরে মারকুনী অন্য একটি কক্ষে চলে যায়। এই সুযোগে কুদুমীকে আত্মসংবরণ করার পরামর্শ দিয়ে ইসমাইল বলল, এতকিছুর পর এ মুহূর্তে আমরা এখান থেকে চলে গেলে সমুদয় সম্পদ এই দুখৃস্টান তুলে নিয়ে যাবে।
আরো একটি পথ চোখে পড়ে ইসমাইলের। প্রদীপ তার হাতে। কুদুমীকে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায় ইসমাইল। আরো একটি প্রশস্ত কক্ষে প্রবেশ করে তারা। কক্ষের মধ্যখানে একটি চবুতরায় একটি বাক্স রাখা আছে। বাক্সের ভেতর একটি মানুষের লাশ। লাশের মুখমণ্ডলের দিকটা ভোলা। এ-ই সেই ফেরাউন র্যামন্স দ্বিতীয়, যাকে মানুষ খোদা বলে বিশ্বাস করত ও সেজদা করত। লাশটা মমি করা। চেহারাটা সম্পূর্ণ অক্ষত। চোখ দুটো খোলা।
ইসমাইল র্যামন্স-এর মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত। তাকায় কুদুমীও। তারপর চোখাচোখি করে দুজন।
এদিক-ওদিক চোখ বুলায় ইসমাইল ও কুদুমী। এখানেও হাড়ের কংকাল দেখতে পায় তারা। অত্যন্ত আকর্ষণীয় কয়েকটি বাক্সও দেখতে পায়। একটি বাক্সের ঢাকনা খোলা। বাক্সটার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে তারা। কতগুলো সোনার অলংকার, হিরা-জহরত পড়ে আছে তাতে। একটি মানুষের বাহুর হাড় ও একটি হাতের হান্ডিও ছড়িয়ে আছে তার মধ্যে। মাথার খুলি ও অন্যান্য হাড়-কংকাল পড়ে আছে বাইরে বাক্স সংলগ্ন।
হায়রে মানুষ!- দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইসমাইল বলল- লোকটা মারা যাওয়ার আগে অলংকার হিরা-জহরত তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তার আশা ছিল, সে এখান থেকে জীবন নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তার আগেই লোকটা স্বর্ণালংকারেরই উপর মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল! বৃদ্ধ ঠিকই বলেছিল যে, লালসা-ই মানুষের বড় শত্রু। ইসমাইল বাক্সটার প্রতি হাত বাড়িয়ে বলল, কুদুমী! তুমিও লোভে পড়েই এসেছ। আমি তোমাকে কিছু দিয়ে দেব।
না ইসমাইল!- ইসমাইলের বাক্সর প্রতি বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে ফিরিয়ে আনে কুদুমী- আমার লালসা মরে গেছে। কুদুমী মৃত্যুবরণ করেছে।
ইসমাইল পুনরায় বাক্সে হাত ঢুকিয়ে দেয়। হঠাৎ কুদুমী চিৎকার করে বলে ওঠে, নিজেকে রক্ষা কর ইসমাইল!
ইসমাইল ঝানু লোক। একদিকে লুটিয়ে পড়ে চক্কর কাটে সে। খানিক সরে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দেখে, মারকুনী তরবারী উঁচিয়ে তার উপর আক্রমণ করতে উদ্যত। ইসমাইল সরে যাওয়ায় তরবারীর আঘাতটা গিয়ে পড়ে বাক্সর উপর। মারকুনী জোরালো কণ্ঠে বলে, এ ধনভাণ্ডার আমার।
ইত্যবসরে মারকুনীর সঙ্গীও এসে যায়। ইসমাইলের কাছে খঞ্জর আছে, যা দ্বারা তরবারীর মোকাবেলা করা যায় না। পার্শ্বেই একস্থানে একটা বর্শা। পড়ে আছে দেখতে পায় কুদুমী। মারকুনী ইসমাইলের উপর আঘাত হেনে চলেছে। ইসমাইল দক্ষতাবলে হাতের প্রদীপকে ঢাল বানিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করে চলেছে। মারকুনীর সঙ্গীও তার সঙ্গে যোগ দেয়। ধনভাণ্ডার দেখে মাতাল হয়ে গেছে খৃস্টানদ্বয়। কুদুমী কী করছে, সেদিকে তাদের নজর নেই।
কুদুমী বর্শাটা কুড়িয়ে নেয়। অপেক্ষা করতে থাকে সুযোগের। একসময় মারকুনীর পিঠটা চলে আসে কুদুমীর সামনে। কুদুমী তার সর্বশক্তি ব্যয় করে হাতে বর্শাটা ছেদিয়ে দেয় মারকুনীর পাজরে। টেনে বের করে আঘাত হানে আবারো। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারকুনী।
মারকুনীর সঙ্গী কুদুমীর উপর তরবারীর আঘাত হানতে উদ্যত হয়। এ সময় ইসমাইল খঞ্জরের আঘাত হানে তার উপর। লোকটির পাজর থেকে পেট পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়। লুটিয়ে পড়ে সে-ও।
কুদুমী যে গুপ্তধনের ভাণ্ডার থেকে ভাগ নিতে এসেছিল, সঙ্গে নিয়ে আসা নিজের গলার হার, মূল্যবান আংটি ও নাক-কানের অলংকার সব সেখানে খুলে ছুঁড়ে ফেলে ইসমাইলের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসে। নির্মল বায়ু গায়ে লাগে কুদুমীর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। চলতে চলতে ইসমাইলকে বলে- বলতে পার, আমরা কোথা থেকে এসেছি? তুমি কি আমাকে চেন? বল তো আমি কে?
এসব প্রশ্ন তো আমারও- ইসমাইল বলল- আমরা অতীত জীবনের সব পাপ ভেতরে ছুঁড়ে ফেলে এসেছি।
এই বিজন পার্বত্য এলাকা থেকে বের হওয়ার পথ তাদের জানা আছে। তারা পাহাড়ী এলাকা থেকে বেরিয়ে আসে। অল্প কটি উট দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। অন্যগুলো কোথায় গেছে, কি হয়েছে, কে বলবে। দুটি উটের পিঠে চড়ে বসে দুজন। কায়রো অভিমুখে রওনা হয় তারা।
***
পরদিন রাত দ্বিপ্রহর। গিয়াস বিলবীস ইসমাইল ও কুদুমীর মুখ থেকে ঘটনার ইতিবৃত্ত শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কথার তাৎপর্য এখন আমার বুঝে এসেছে। তিনি বলেছিলেন, এসব ধনভাণ্ডার থেকে তোমরা দূরে থাক।
গিয়াস বিলবীস নগরীর কোতোয়াল। ইসমাইল ও কুদুমী তাকে ভালভাবেই চিনত। তারা গুনাহের কাফফারা আদায় করতে চাচ্ছিল। পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে তারা আহমার দরবেশের নিকট না গিয়ে সোজা চলে যায় গিয়াস বিলবীসের কাছে। কাহিনীর ইতিবৃত্ত শুনিয়ে তারা বলল, এই ঘটনার মূল নেপথ্য নায়ক আহমার দরবেশ।
গিয়াস বিলবীস সঙ্গে সঙ্গে আলী বিন সুফিয়ানকে ডেকে পাঠান। তাকে ঘটনা শুনান হল। আহমার সাধারণ কোন ব্যক্তি মন। তারা সুলতান আইউবীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন এবং আহমার দরবেশকে গ্রেফতার করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। সুলতান আইউবী অনুমতি প্রদান করেন। গিয়াস বিলবীস ও আলী বিন সুফিয়ান কয়েকজন সেনাসদস্য নিয়ে আহমার দরবেশের বাড়িতে হানা দেয়। সমস্ত ঘরে তল্লাশি নেয়া হয়। অন্য সবকিছুর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পুরনো সেই কাগজগুলোও পাওয়া গেল। আহমার দরবেশকে গ্রেফতার করা হল।
রাত পোহাবার সঙ্গে সঙ্গে আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীসের সঙ্গে এক প্লাটুন সৈন্য র্যামন্স-এর সমাধি অভিমুখে রওনা হয়ে যায়। সুলতান আইউবী নির্দেশ দেন, সমাধিটা আগে যেভাবে বন্ধ ছিল, ঠিক সেভাবেই বন্ধ করে রেখে আসবে। তিনি কাউকে ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করে দেন। ইসমাইল তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
সুলতান আইউবীর বাহিনী সমাধি এলাকায় গিয়ে উপনীত হয়। রক্তাক্ত এক কাহিনীর জীবন্ত এক গ্রন্থ যেন এলাকাটি। এখানে লাশ, ওখানে লাশ। এখানে রক্ত, ওখানে রক্ত। রক্তের ছোঁয়ায় ম্লান হয়ে গেছে এলাকার মনমুগ্ধকর সবুজের সমারোহ।
সুলতান আইউবীর সৈন্যরা সমাধির মুখটা পূর্বের ন্যায় সুবিশাল সেই পাথর দ্বারা বন্ধ করে দেয়। ফেরাউন রামন্স চোখের আড়ালে চলে যায় পুনর্বার। শুধু নতুন করে নিজের বুকে তুলে নেয় আরো দুটি পাপীর লাশ।