সন্ধ্যার পর পরই নিঝুম হয়ে বৃষ্টি নেমেছে।
শ্রাবণ মাসের কায়কারবারই এমন। এই রোদ, এই বৃষ্টি। মরনিবুজির বাড়ি থেকে শেষ বিকালে যখন বাপ মেয়ে ফিরছে তখন কী সুন্দর আকাশ। দবিরের বুকে চেপে চাপা পাথর নেমে গিয়া বুকটা যেমন হালকা ফুরফুরা হয়েছে ঠিক তেমন একখান হাওয়া আসছিল পদ্মার দিক থেকে। কলুই ফুলের মতন নীল আকাশের তলা দিয়া ভেসে যাচ্ছে বাদাম দেওয়া নৌকার মতন সাদা মেঘ। দেশগ্রাম ডুবে গেছে বর্ষার পানিতে। পাখপাখালির আহারের অভাব। পদ্মার ওপারকার চরের দিকে উড়ে যায় সব পাখি। ওদিকটায় উঁচু চরাভূমি, মানুষের ঘরবাড়ি আর বর্ষাকালীন শস্যের মাঠ। ওদিকটায় চরে দিনভর আধার খায় এই দিককার পাখি। বিকাল ফুরিয়ে চারদিক থেকে ঘনাতে থাকে অন্ধকার, পাখিরা দিনের কাজ শেষ করে পদ্মা পাড়ি দিয়া ফিরা আসে।
নূরজাহানকে নিয়া নিজের ছোট্ট কোষানাও বেয়ে ফিরা আসার সময় মাথার ওপর দিয়া এরকম কত পাখি ফিরতে দেখেছে দবির। দেখে দীর্ঘ একটা শ্বাসও পড়েছে তার। আহা পাখিরা কত স্বাধীন, কত সহজ সরল জীবন পাখিদের। নিজের মতন বড় হয়, ডিমে তা দিয়া বাচ্চা ফুটায়। উড়তে শিখলেই অচেনা হয়ে যায় বাচ্চারা। যে যার নিজের আকাশে উড়ে যায়। পাখিদের সমাজে কোনও মান্নান মাওলানা নাই।
কোষানাওয়ের মাঝখানকার পাটাতনে হাসিহাসি মুখ নিয়া বসেছিল নূরজাহান। এতদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়ে মন ভরে গেছে গভীর আনন্দে। কী সুন্দর রান্নাবান্না করল মরনিবুজির লগে বসে। খেতে ভারী স্বাদ হয়েছিল পোলাও মোরগ। একদম বাড়ির নতুন বউটির মতন সবাইকে খাওয়াল সে।
নূরজাহানের এই চেহারা আজকের আগে কখনও দেখে নাই দবির। মরনিবুজির বড়ঘরে ছনছায় বসে তামাক টানতে টানতে আড়চোখে নিজের মেয়েটিকে দেখে একদিকে যেমন ভাল লাগছিল অন্যদিকে বুক ফেটে যাচ্ছিল গভীর কষ্ট বেদনায়। মান্নান মাওলানা নামের বিশাল এক অজগর পা থেকে গলা তরি প্যাঁচ দিয়ে ধরেছে কিশোরী থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠা মেয়েটিকে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও সেই প্যাঁচ ছাড়াতে পারছে না মেয়ে। দূর থেকে অসহায়ের মতন তাকিয়ে মেয়ের বাবা দেখছে তার বুকের ধন ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে ওই অজগর। নূরজাহান ধীরে ধীরে হজম হয়ে যাচ্ছে মান্নান মাওলানা নামের অজগরের পেটে।
কাল থেকে দবিরের মনের উপর দিয়া গেছে ভয়াবহ এক চাপ। এই চাপ সহ্য করা কঠিন কাজ। ল্যাংড়া বসিরের কথা শুনে, মাওয়ার বাজার থেকে এই এতটা পথ সঁতরে। আসতে যে কষ্ট হয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি কষ্টে রাতেরবেলা বারবার মনে হয়েছে এই বুঝি কলিজাটা ফেটে গেল তার। এই বুঝি মরে গেল সে।
একই ঘরে শুয়ে আছে তিনজন মানুষ। চৌকির ওপর মা-মেয়ে, মেঝেতে খড়নাড়ার দরিদ্র বিছানায় শুয়ে কাল রাতের আগেও কত শান্তিতে ঘুমিয়েছে দবির। এক বিকালেই সেই শান্তি উধাও হয়ে গিয়েছিল, কলিজা ফেটে মরণদশা হয়েছিল দবিরের। মাত্র কয়েক হাত দূরে শুয়ে যাকে নিয়া এই কাণ্ড সেই নূরজাহান আর তার মা হামিদা শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। অজগর প্যাঁচ দিয়া ধরেছে যাকে সেও জানছে না কিছু, পাশে শোয়া মা-ও জানছে না কিছু। শুধু দবিরের কলিজা পুড়ছে।
আজ মরনিবুজির লগে কথা বলবার পর, তার কাছ থেকে পরামর্শ পাওয়ার পর শরীর মন দুইটাই তাজা হয়ে উঠেছে দবিরের। বাড়ি ফিরা সন্ধ্যারাতেই খেয়ে নিয়েছে রাতের ভাত। যদিও ক্ষুধা তেমন ছিল না। দুপুরের ওরকম মোরগ পোলাও, তারপর মনের প্রশান্তি, এই অবস্থায় ক্ষুধা থাকে নাকি!
তবু নিজের দরিদ্র সংসারের ভাত আর টাকিমাছের লগে এলাইচ শাকের চচ্চড়ি, তিনজন মানুষ যখন খেতে বসেছে, সংসারের নতুন অতিথিটা এসে দাঁড়িয়েছিল খোলা দরজার সামনে, ছনছায়। একদৃষ্টে তিনজন মানুষের খাওয়া দেখছিল আর পুরপুর করে লেজ নাড়াচ্ছিল। তখনও বৃষ্টি থামে নাই। খেতে খেতেই নিজের মাছের কাঁটাটা, একটুখানি ভাত থেকে থেকেই কুকুরটার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল নূরজাহান। হাসিমাখা কণ্ঠে বলছিল, তর তো দেহি খালি খিদা আর খিদা। কী রে ভাদাইম্মা, তর কোনওদিন পেট ভরে না?
ভাদাইম্মা ঝাঁপিয়ে পড়ে নূরজাহানের ছুঁড়ে দেওয়া কাঁটাকোটা আর ভাতটুকু খেয়ে নিচ্ছিল। তারপর আবার আগের অবস্থা। বাইরে চাঁদের আলো ফুটবার কথা, একটু একটু ফুটছিল আবার ঢেকে যাচ্ছিল কালো মেঘে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে নূরজাহান উঠে গেছে চৌকিতে, হামিদা থালবাসন গুছিয়ে মাত্র বসেছে, বাইরে হঠাৎ করেই গভীর অন্ধকার, হঠাৎ করেই ঝমঝম বৃষ্টি টিনের চালে।
দবির তখন তামাক সাজাতে বসেছে।
টোফা থেকে একদলা তামাক নিয়া ঠেসে দিয়েছে কলকিতে। কার মাথায় কলকি বসিয়ে মালসা থেকে টিকা নিয়া চিমটা দিয়া ধরছে কুপির আগুনে। টিকা পুড়ে আগুন হলেই কলকিতে বসিয়ে টানতে শুরু করবে।
নূরজাহান ঘুমিয়ে পড়েছে কি না কে জানে! তার কোনও সাড়াশব্দ নাই।
সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ খোলা ছিল ওদিককার জানালা। শোয়ার আগে জানালা বন্ধ করেছে সে। মা-বাবার দিকে পিছন দিয়া শুইয়া পড়ছে। আজ অবশ্য শুইয়া পড়ার লগে লগেই ঘুমিয়ে পড়ার কথা মেয়ের। অনেকদিন পর সারাদিন সে আজ অনেক কাজ করেছে। বাড়িতে তো দুপুরবেলা ভাত খেয়েই ঘুম দেয়। আজ সেই ঘুম হয় নাই। এজন্য শুয়ে পড়ার লগে লগেই ঘুমিয়ে পড়ার কথা।
কুপির আগুনে টিকা পুড়িয়ে মাত্র কলকিতে দিয়েছে দবির, হুঁকায় মাত্র টান দিবে, হামিদা বলল, দুইয়েকখান কথা কইতে চাই।
হুঁকায় টান না দিয়া হাসল দবির। বাপ ফুইস রে (বাপ রে অর্থে)। কথা কওনের ভাল তরিকা ধরছো।
স্বামীকে হাসতে দেখে হামিদাও হাসল। তরিকার অর্থ আছে।
দবির হুঁকায় টান দিল। কী অর্থ?
কাইল রাইত্রে বাড়িতে আসনের পর থিকা তোমারে জানি কেমুন দেহা যাইতাছিল। মনে অইতাছিল কী জানি চিন্তা করো। বিয়ানে অনেক কথা অইলো তোমার লগে। তহনও মুখে চিন্তা দেখছি। তারবাদে আথকা মাইয়াডারে লইয়া গেলে মরনিবুজির বাইত্তে। হারাদিন হেই বাইত্তে কাড়াইয়া ফিরত আসনের পর বাপ মাইয়া দুইজনেই বহুত খুশি খুশি। ঘটনা কী?
নূরজাহান তোমারে কয় নাই?
কইছে। মরনিবুজি মোরগ পোলাও খাওয়াইছে। নূরজাহান নিজে রান্দনবাড়ন করছে। রান্দন খুব ভাল অইছিলো।
তয় তো ঘটনা হুনছোঐ।
না আমি হোনতে চাই আথকা মাইয়াটারে বাইত থিকা বাইর করলা ক্যা?
গুড়ক গুড়ক করে কয়েক টান তামাক খেল দবির। এতদিন ধইরা বাইত্তে বইয়া রইছে মাইয়াডা, বাইষাকাইলা (বর্ষাকাল) দিন, কোনওমিহি যাইতে পারে না, এর লেইগা অরে ইকটু বাইত থিকা বাইর করলাম।
এর লেইগা নাইলে মাইয়ার মনে আমোদ ফুরতি অইছে, তোমার মন কাইল রাইত্রে যেমুন দেখছি, বিয়ানে যেমুন দেখছি, মরনিবুজির বাইত থিকা ফিরত আহনের পর দেখি বিরাট ভাল। এইডার অর্থই আমি বুজলাম না।
বৃষ্টি তখন এত নিবিড় হয়ে নেমেছে, খোলা দরজা দিয়া বৃষ্টির হ্যাঁচলা (ছাট) আসছিল ঘরে। ছনছায় দাঁড়িয়ে ভাদাইম্মা ভিজে একেবারে চুপসে গেছে, খোলা দরজা দিয়া দুয়েকবার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছে, দবিরের তাড়া খেয়ে পারে নাই।
এখন কুকুরটার দিকে তাকিয়ে মায়া লাগল দবিরের। সারারাত যদি এরকম বৃষ্টি হয় তা হলে কি এইভাবেই ভিজবে?
তামাক টানার ফাঁকে হামিদার দিকে তাকাল সে। কুত্তাডারে ঘরে ঢুকতে দিমু নি?
হামিদা অবাক। ক্যা?
ম্যাগের মইদ্যে ভিজতাছে। হারারাইত এই রকম ম্যাগে ভিজলে…
হামিদা বিরক্ত হল। তোমার কি মাতা খারাপ অইছে? কুত্তার লগে একঘরে থাকুম? দুয়ার আটকাইয়া দেও। দেখবানে কুত্তাডা রান্নঘর মিহি গেছে গা। রান্নঘরের চালের নীচে বইয়া থাকলে ম্যাগে ভিজবো না। ওই জাগা হুগনা থাকে।
দবির খুবই উৎসাহী হল। ঠিকই কইছো। দুয়ার খোলা দেইখাই শালার পো শালায় ঘরে হানতে চাইতাছে।
তামাক টানা রেখে ভাদাইম্মাকে একটা ধমক দিল দবির। যা যা রানঘর মিহি যা। হুগনা জাগা আছে। যা।
তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার ডাসা ভাল করে লাগিয়ে তামাকে কয়েকটা টান দিল। নাকমুখ দিয়া বেদম ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে হামিদার দিকে তাকাল। কী কইবা, কও?
হামিদাও তাকাল দবিরের দিকে। আথকা মরনিবুজির বাড়ি গেলা ক্যা? মাইয়াডারে লগে লইয়া গেলা ক্যা?
মাইয়ার কথা তো একবার কইলাম। এতদিন ধইরা বাইত্তে বইয়া রইছে, মান্নান মাওলানার লগে ওই ঘটনার পর বাইত থিকা আর বাইর অয় না, এর লেইগা ওই বাইত্তে লইয়া গেলাম। মরনিবুজি ওরে জানডা দিয়া আদর করে। ওই শুয়োরের পোর হাত থিকা তো মরনিবুজিই ওরে বাঁচাইছিল।
হেইডা আমার মনে আছে।
অরে দেইক্কা যে কী খুশি অইছে না বুজি, নূরজাহানের মাগো, হেইডা তোমারে কেমতে যে কমু? মনে অইলো আপনা মাইয়াডা য্যান বহুতদিন বাদে বাইত্তে আইছে। মজনুও আমগো দেইক্কা বহুত খুশি।
মুখ তুলে নূরজাহানকে একবার দেখল দবির। আগের মতনই পিছন ফিরে শুয়ে আছে। পা দুইটা পেটের দিকে ভাঁজ করা। ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় গভীর ঘুমে। তবু হামিদাকে ইশারা করল দবির। ইশারায় জানতে চাইল মেয়ে ঘুমিয়েছে নাকি?
হামিদা মেয়ের দিকে তাকাল। খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, হ পুরা ঘুম।
সত্য?
হ। আমি আমার মাইয়ারে চিনি। ওর চালচলন কায়কারবার বেবাক আমার মুখস্থ।
তয় তোমারে একখান কথা কই। খাওনদান শেষ হওনের পর আমি আর মরনিবুজি বড়ঘরের দুয়ারের সামনে বইসা পান তামুক খাইতাছি। মজনু আর নূরজাহান দক্ষিণ পশ্চিমদিককার আমগাছটার ওইমিহি খাড়ইয়া খাড়ইয়া গল্প করতাছে আর হাসতাছে। নূরজাহানের মাগো, দেইক্কা আমার যা ভাল লাগলো।
এইডা আবার ভাল লাগনের কী অইলো?
তুমি আমার কথাডা বোজো নাই?
বুজছি বুজছি।
কী বুজছো কও তো?
মজনুর লগে নূরজাহানরে বহুত মানায়।
দবির হাসল। এই তো বুজছে। ওই বাইত্তে বইয়া বইয়া আমি খালি এই হগল কথাই চিন্তা করছি। মজনুর লগে অরে যেমুন মানায় আর মরনিবুজি অরে যেমুন আদর করে, মজনুর লগে যুদি অর বিয়া অইতো, মাইয়াডা যে কী সুখে থাকতো!
হামিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতবড় কপাল কি অর অইবো?
আল্লাই জানে।
তামাক শেষ হয়ে গেছে আগেই। দবিরের ইচ্ছা হল আরেক ছিলিম তামাক খায়, আর একটু সুখ দুঃখের আলাপ করে হামিদার লগে।
নিজের অজান্তেই তামাক সাজাতে লাগল সে।
বাইরে আগের মতন বৃষ্টি। টিনের চালায় একটানা ঝুমঝুম শব্দ। কোথাও আর কোনও শব্দ নাই। কুকুরটা শুকনা জায়গার খোঁজে রান্নাচালার দিকে চলে গেছে। বৃষ্টি পড়ে না এমন জায়গা খুঁজে এতক্ষণে হয়তো কুণ্ডলী পাকিয়েছে, হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। কুপির আলোয় দবিরের ঘরের অর্ধেকটা আলোকিত হয়েছে। সেই আলো তেমন জোরালো না, জোনাকির আলোর মতন ম্লান, মোলায়েম।
হামিদা বলল, মরনিবুজির লগে আর কোনও প্যাচাইল পাড়ো নাই?
কুপির আগুনে টিকা পোড়াতে পোড়াতে দবির বলল, আর কোন প্যাচাইল?
ল্যাংড়ায় যে সমন্দ আনলো!
একথা শুনেই বুকটা ধক করে উঠল দবিরের। পলকের জন্য বুকের সেই নেমে যাওয়া পাথর আবার চেপে বসতে চাইল বুকে। কলিজাটা মাত্র জবাই করা মুরগির মতন ছটফট করতে চাইল। কলকিতে টিকা বসিয়ে, পর পর বেশ কয়েকটা টান দিল হুঁকায়। এই ফাঁকে ভেবে নিল সকালবেলার মতন অবিরাম মিছাকথা এখন হামিদার লগে বলতে হবে। নানারকম কথায় ভুলাতে হবে তাকে।
তামাক টানার ফাঁকে দবির বলল, হ কইছি।
মরনিবুজি কী কইলো?
তোমার মতনই কইছে। দরকার অইলে বাইত্তে বহাইয়া রাখবা মাইয়া। তাও দোজবরের লগে বিয়া দিবেন না গাছিদাদা। যার বস আপনের থিকাও বেশি। নূরজাহান অইবো যার নাতিনের বসি।
হামিদা খুশি হল। ঠিকঐ কইছে। এত কষ্ট যেই মাইয়ার লেইগা করছি, এতবড় বিপদ থিকা আল্লায় যেই মাইয়ারে উদ্ধার করছে তারে অমুন মাইনষের কাছে বিয়া দিমু ক্যা? আল্লায় তো আমগো চালাইয়াই রাখছে। না খাইয়া তো আর থাকি না।
হ। মরনিবুজিও এইভাবেই কইছে।
তামাক টানার ফাঁকে হামিদার দিকে তাকাল দবির। কথা ঘুরাল। ম্যাগের যেই চেহারা ইবার দেকতাছি গো নূরজাহানের মা, মনে হয় বউন্যা অইয়া যাইবো।
অইতে পারে। বউন্যা অইলে আরেক বিপদ। ঘরে পানি উইট্টা গেলে মাচা বানতে অইবো।
অমুন বউন্যা মনে অয় অইবো না। আমগো চকিডা উচা আছে। চকিতেই থাকন যাইবো।
হামিদা আর কথা বলল না। ঝুলানো পা টেনে চৌকিতে তুলল। নূরজাহানের পাশে শুয়ে পড়ল।
তামাক টানা শেষ করে কাটা জায়গা মতন রাখল দবির। কলকিটা উপুড় করে রাখল হুঁকার পাশে, এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে টিকার আগুন। এভাবে রাখলে ধীরে ধীরে নিভে ছাই হয়ে যাবে। তারপর ফুঁ দিয়া কুপি নিভাল দবির। হামিদার পাশে শুয়ে পড়ল। বড় করে একটা শ্বাস ফেলল। শরীর ভেঙে ঘুম আসছে। বড় ধকল কাটলে শরীর ছেড়ে দেয়। দবিরেরও শরীর ছেড়ে দিল। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে দবির ভাবল, কাইল বিয়ানেই দেলরাবুজির কাছে যামু। এনামুল সাবরে যত তাড়াতাড়ি খবর দেওন যায়। যত তাড়াতাড়ি এই আজাব থিকা বাঁচন যায়।
বাইরে তখনও সেই আগের মতনই বৃষ্টি।
.
আইজ আবার কই মেলা দিলা?
কাঁধে নীল রঙের পিরন ফেলে মাজায় গামছাটা মাত্র বাঁধছে দবির, রান্নাচালা থেকে প্রশ্নটা করল হামিদা। স্বামীর কাঁধে পিরন দেখেই অনুমান করেছে, বাড়ি থেকে বের হচ্ছে দবির। খানিক আগে রান্নাচালায় বসে পান্তা খেয়েছে তিনজনে। খাওয়া শেষ করে নূরজাহান গেছে বাঁশঝাড়তলার দিকে। দুইদিনেই ভাদাইম্মা তার মহাভক্ত হয়ে উঠেছে। নূরজাহানের পায়ে পায়ে থাকে। নূরজাহান যেদিকে যায় সেও যায় পিছন পিছন। এত তাড়াতাড়ি একটা অচেনা জীব কী করে একজন মানুষের এমন বাধুক হয়ে ওঠে আল্লাহ মাবুদই জানেন।
নাস্তা পানি শেষ করে থালবাসন ধুতে ঘাটপারে গেছে হামিদা। ফিরা আইসা দেখে দবির তামাক টানছে যেখানে বসে পান্তা খেয়েছিল ঠিক সেই জায়গায় বসে। নূরজাহান বাঁশঝাড়তলায়ই আছে। ভাদাইম্মার লগে মজা করছে। সকাল থেকে রোদই ওঠে নাই। সারারাত বৃষ্টির পরও যেন আকাশের সাধ মিটে নাই। বাঁশঝাড় ছাড়িয়ে দক্ষিণদিককার ধইনচাখেতের উপরকার আকাশ দিয়া পদ্মাপাথালে উড়ে আসছে কালিবাউস মাছের মতন মেঘ। এমনিতেই থম ধরে আছে চারদিক। পোলাপানের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতন হাওয়াটুকুও নাই। রোয়াইল ফলের মতন ম্লান আলো চারদিকে।
এই অবস্থায় কোথায় মেলা দিল দবির?
তামাক শেষ করে ঘরে ঢুকেই পিরান কাঁধে বের হয়েছে দবির। মাজায় গামছা বাঁধতে বাঁধতে কোষানাওটার দিকে যাচ্ছে, তখনই প্রশ্নটা করল হামিদা।
কোষানাও থাকে বাড়ির পুবদিকে। নূরজাহান যেখানটায় শোয় ওখানটায় ওই জানালার পাশে একটা আমগাছ। আমগাছের লগে বাঁধা থাকে নাও। দিনেরবেলা দড়ি দিয়েই বাঁধা থাকে। রাতে লোহার চিকন একখান শিকল দিয়া, আমগাছের গোড়ার দিকে প্যাচিয়ে পুরানা তালাটা মারা হয়। দেশগ্রামে নৌকাচোরের আকাল নাই। তালা না দিলে দড়ি খুলে নিঃশব্দে নৌকা নিয়া চলে যাবে। দিঘলির হাটে নিয়া গোপনে বিক্রি করে দিবে।
বর্ষার মুখে মুখে নৌকার তালাটাও বের করা হয়। পুরানা তালা। বছরভর ব্যবহার করা। হয় না। জং ধরে, শুকিয়ে খটখটা হয়ে থাকে। চাবিরও একই অবস্থা। একটুখানি সরিষার তেল চাবির গর্তে ঢুকিয়ে বার কয়েক মোচড়ামুচড়ি করলে তবে কাজ করে তালা। চাবিটা চিকন সুতলি দিয়া বান্ধা থাকে।
হামিদার কথার জবাব না দিয়া আমগাছের গোড়া থেকে নৌকার তালা খুলল দবির, শিকলের প্যাঁচ খুলে নৌকার ডরায় রেখে দিল।
হামিদা বলল, ছিকল তালা ডরায় রাকতাছো ক্যা? পাইনতে ভিজ্জা জমে (জং) ধরবো! ঘরে নিয়া রাখো।
ঘরে নিয়া তালা শিকল রেখে এল দবির। নূরজাহানকে ডাকল। কই গো মা, আয় মা।
রান্নাচালা থেকে উঠানে এল হামিদা। মাইয়া লইয়া আইজ আবার কোন বাইত্তে যাইতাছো?
হামিদার দিকে তাকিয়ে হাসল দবির। দেলরা বুজিগো বাইত্তে যামু।
ক্যা?
এমতেই। নূরজাহান, আয় মা আয়। তাড়াতাড়ি আয়।
আগের বার দবিরের ডাক শুনতে পায় নাই নূরজাহান। এবার পেল, দৌড়ে এল। ভাদাইম্মাটাও আছে তার পিছন পিছন।
ল মা, ল।
নূরজাহান অবাক। কই যামু?
দেলরা বুজিগো বাইত্তে যামু। ল। আনন্দে পাকা ডালিম ফলের মতন ফেটে পড়ল মেয়েটি। সত্যই আমারে লইয়া যাইবা, বাবা?
তয় মিছানি? আমি দিহি কতক্ষুন ধইরা তরে ডাক পাড়তাছি।
নূরজাহান নলামাছের মতন একটা লাফ দিল। ইস আমার যে কী আমদ লাগতাছে? কতদিন মেন্দাবাড়িত যাই না, হাজামবাড়ি মিয়াবাড়ি গাওয়ালবাড়ি…। ইস কতদিন পর এতডি মাইনষের লগে দেহা অইবো!
হামিদা গোমড়া মুখে বলল, তরা বাপ মাইয়া তো আহ্লাাদেই আছস। বাইত্তে একলা একলা আমার অস্থির লাগে। কেউ কোনওদিন কয় না, তুমিও লও। আমি যে একজন মানুষ এইডা কের মনেই থাকে না!
হামিদার কথা শুনে বুকটা মোচড় দিয়া উঠল দবিরের। সত্যি তো, হামিদাকে নিয়া তো কোথাও যাওয়া হয় না কোনওদিন। এইটুকু একটা বাড়ির ভিতরই আটকে আছে মানুষটার জীবন। এই ঘর ওই রান্নাচালা আর ওই ছাপরা ঘরখান, বাঁশঝাড়তলা, ঘাটপার এইটুকুই তো মানুষটার দুনিয়া! খালিকালে যা-ও এবাড়ি ওবাড়ি একটু যেতে পারে, বাড়ির সামনের নামার দিকটায় গিয়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, ছাড়াবাড়িটার ওদিকটায় গিয়ে একটু হেঁটে আসতে পারে, বর্ষাকালে সেই উপায়ও নাই। চারদিকে পানি। নৌকা ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়ার উপায় নাই। এতগুলি মাস শুধু এই বাড়িতে, ওই যে মান্নান মাওলানার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিল নূরজাহান ওই সেদিনই গ্রামের অর্ধেকটা ঘুরা হয়েছিল তার। মান্নান মাওলানার বাড়ি, ঠাকুরবাড়ির উপর দিয়া মরনিবুজির বাড়ি, মেয়েকে বাঁচাতে পাগলের মতন ছুটেছিল হামিদা। ওইটারে কি আর বেড়ানো বলে!
আহা রে, সেটা একটা দিন গেছে! এত বড় ভয়ের দিন জীবনে আর কোনওদিন আসে নাই।
সেদিনকার সেই ঘটনার কথা মনে করে দবির মনে মনে বলল, আল্লাহ ওইরকম দিন য্যান ইজিন্দেগিতে আর না আহে।
তারপরই মনে পড়ল পরশু সন্ধ্যায় ল্যাংড়া বছিরের মুখে শোনা কথাটা। বুকটা ধক করে উঠল। মাওয়ার বাজার থেকে রাতেরবেলা সাঁতরে বাড়ি আসা, তারপর থেকে মরনিবুজিকে কথাটা না বলা তরি যে পাথর চেপে ছিল বুকে, সেই পাথরের ওজনও সেদিনকার সেই ঘটনার চেয়ে কম না। মান্নান মাওলানা অন্যভাবে প্রতিশোধ নিতে চাইছে নূরজাহানের উপর। নিজের বউ বানিয়ে জান খাবে মেয়েটির। এই পথ বন্ধ করার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। মরনিবুজি। এখন সেই পথেই মেয়েকে নিয়া বের হচ্ছে দবির। দেলরা বুজিকে না ধরতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! এনামুল সাহেব ছাড়া আর কেউ পারবে না মান্নান মাওলানার হাত থেকে নূরজাহানকে রক্ষা করতে।
এই অবস্থায় হামিদা বলল ওই কথা!
হামিদা যদি ঘুণাক্ষরেও জানত কী কারণে কাল থেকে মেয়ে নিয়া বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। দবির তা হলে মরে গেলেও বাড়িতে সে বসে থাকত না। বাড়িঘর ফেলে সেও রওনা দিত দবির আর নূরজাহানের লগে। ঘর দুয়ার সংসার কোনওদিকেই তাকাত না। নূরজাহান যে শুধু দবিরেরই কলিজার টুকরা তা তো না, হামিদার যে কীরকম টান ভালবাসা মেয়ের জন্য ওই সেদিনই ব্যাপারটা টের পেয়েছিল দবির।
নূরজাহান ততক্ষণে কোষানাওয়ের দিকে দৌড়ে গেছে। আহো বাবা, আহো। তাড়াতাড়ি আহো। লও মেলা দেই।
দবির আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাগের অবস্থা ভাল না মা। ছাতিডা ল।
এক ছাতিতে দুইজনের কাম অইবানি বাবা?
আমার ছাতি লাগবো না। আমি তো নাও বামু। ম্যাগ আইলে আমার পিরনডা লইয়া তুই ছাতি মাতায় দিয়া বইয়া থাকবি।
হামিদা বলল, তোমার ছাতির যা দশা, ওই ছাতি নেওন না-নেওন একঐ কথা।
আরে না, তেমুন ছিড়া না। কাম চলবো। নূরজাহান, যা মা, ছাতিডা লইয়া আয়।
নূরজাহান দৌড়ে ঘরে গিয়া ঢুকল।
দবির হামিদার দিকে তাকাল। তোমার কথা হুইনা আমার মন খারাপ অইছে। আসলেই তোমার কোনহানে যাওয়া হয় না। খালি এই বাড়ির মইদ্যেই পইড়া থাকো। আমার দিককার কোনও আততিয়স্বজনও নাই যার বাইত্তে গিয়া দুই-চাইরদিন বেড়াইয়া আহন যায়। দেশগেরামের বউঝিরা বাইস্যাকালে নাঐর যায়। বাপের বাইত্তে যায়, ভাই বইনের বাইত্তে যায়। তুমি বহুতদিন ধইরা পয়সা গেরামে যাও না, বাপের বাইত্তে যাও না। আগে দুই- চাইর বচ্ছরে একবার যাইতা। এই বাইষ্যায় তোমারে আমি তোমগো বাইত্তে লইয়া যামু। দেইখো, ঠিকঐ লইয়া যামু। কয়ডা দিন যাউক।
হামিদা কথা বলল না। উদাস হয়ে রইল।
ছাতা নিয়ে নূরজাহান তখন নৌকায় গিয়ে চড়েছে। আরাম করে বসেছে চটির পাটাতনে। ছাতিটা রাখা একপাশে। দবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, আহো বাবা, আহো।
নূরজাহানকে নৌকায় চড়তে দেখে ভাদাইম্মা এসে দাঁড়িয়েছে নৌকার সামনে। নূরজাহান হাসিমুখে বলল, তুই বাইত্তেঐ থাক ভাদাইম্মা। আমার মা’রে পাহারা দে। মা’য় একলা একলা হারাদিন কী করবো? তোর লগে কথাবার্তা কইবোনে।
হামিদার দিকে তাকিয়ে দবির বলল, যাইগো নূরজাহানের মা।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল হামিদা। আইবা কুনসুম?
হেইডা কইতে পারি না। দোফরও অইতে পারে, বিয়ালও অইতে পারে।
মাইয়াডা এতক্ষুন না খাইয়া থাকবো?
নৌকায় বসেই কথাটা শুনতে পেল নূরজাহান। বলল, আমারে লইয়া তুমি চিন্তা কইরো না মা। বাইত্তে আইয়া রাইত্রে ভাত খাইলেও আমার অসুবিধা নাই। আমদে থাকলে খিদা আমার লাগেই না।
দবির গিয়া নৌকায় উঠল। কাঁধের পিরন নূরজাহানের হাতে দিয়া পাছার চারটে বসে বইঠা ফেলল। নৌকা ধীরে ধীরে ছাড়া বাড়িটার দিকে যায়। হামিদা আর ভাদাইম্মা দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। ছাড়াবাড়ির হিজল ডুমুরের ঝোঁপের দিকে উড়ে এল একটা কানিবক। বাসায় এসে বসতেই দুই-তিনটা ছানা চিঁ চিঁ করে মা’কে ঘিরে ধরল। কার আগে কে নিবে মায়ের মুখের আধার। এতক্ষণ ছানাদের পাহারা দিচ্ছিল বাবা বক। মা আসতেই সে উড়াল দিল আধারের সন্ধানে।
এতদূর থেকে দৃশ্যটা দেখে আশ্চর্য এক ভাল লাগায় বুক ভরে গেল হামিদার। নূরজাহানও তো তাদের ওরকম এক ছানা। কখনও মা কখনও বাবা, দুইজন মানুষের কেউ না কেউ ওই কানিবক দুইটার মতনই আগলে রাখছে তাকে। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য পাহারা দিয়া রাখছে।
বড়ঘরের ছাইছে একটা ফজলি আমগাছ।
পশ্চিম দিককার ভাঙন ছাড়িয়া সমেদ খাঁ-র পুকুর। আমগাছটা ডিঙ্গি নৌকার মতন বেঁকা হয়ে আছে পুকুরের দিকে। গোড়ার কাছাকাছি এসে থেমে আছে বর্ষার পানি। আকাশের বৃষ্টি আর পাতালের পানি মিলামিশা জায়গাটা ক্যাতক্যাতা হয়ে আছে। লুঙ্গি কাছা মেরে এখানকার মাটি খুঁড়ছে বাদলা। তার হাতে বোতা (ভোতা) একখান দাও (দা)। দাওয়ের আছাড়ি নাই। গোড়ার দিকটা লম্বা গজালের মতন। সেই জায়গাটা শক্ত করে ধরে মাটি খুঁড়ছে বাদলা। হাতের কাছে কানা ভাঙা মালশা। খালি গায়ের বাদলার কালা কোলা রং মেঘের ছায়ায় কুইচ্চার মতন দেখাচ্ছে।
যে আশায় মাটি খুঁড়ছে বাদলা, সেই আশা পূরণ হতে সময় লাগল না। একটুখানি খোঁড়ার পরই দেখা গেল কিলবিল কিলবিল করছে কেউচ্ছা (কেঁচো)। ক্যাতক্যাতা মাটিতে আরামেই ছিল তারা। মাটি খুঁড়ে বাদলা তাদেরকে ভাল রকম বিপাকে ফেলেছে। মাটির আরও গভীরে মেলা দিছে তারা। খাবলা মেরে মেরে মাটিসহ কেউচ্ছা তুলে মালশায় রাখল বাদলা। চার-পাঁচ খাবলায় তার কাজ হয়ে গেল। এখন আরামছে একখান কইরা কেউচ্ছা মালশার মাটি থেকে বের করবে আর সাইজ বুঝে তিন-চার-পাঁচটা টুকরা করে বসৃসিতে (বঁড়শিতে) গাঁথবে। পালানের দক্ষিণ সীমানায় টোসখোলা ছিটকি আর ডুমুর বউন্না হিজলের জঙ্গল। দেলরা বুজিগো পায়খানা ঘর এই দিকটায়। বর্ষার পানিতে সকালের দিকেই ঝিম ধরে আছে ওদিকটা। খানিক আগে একটা ডাউক (ডাহুক) কয়েকটা ছাও নিয়া পালানের দিকে আসছিল। বাদলাকে দেখে চোখের পলকে কোনদিকে যে গেল, হদিস নাই।
তয় বাদলার মন ডাউকের দিকে নাই। সে আছে শিংমাছের আশায়। বর্ষার পানিতে জংলা মতন জায়গায় আধার খাইতে আসে শিং, ফলি, কই, মাগুর আর শোলটাকি গজারটাকি। এইসব মাছের স্বাদের জিনিস হইলো কেউচ্ছা। বসৃসিতে কেউচ্ছা গাইথথা ফালাইলেই হইলো।
বঁড়শিটা বাদলা রেখে আসছে ওইদিকে। এখন কেউচ্ছা নিয়া গেলেই হল। মাটির একটা ঘোপাও রাখছে। সকাল থেকে রোদ আর ওঠে নাই। আকাশের মেঘলাভাব চারদিক মনমরা করে রেখেছে। কেউচ্ছার মালশা হাতে নিয়া পায়খানা ঘরের ওদিকটায় এল বাদলা। দাওটা পড়ে রইল ফজলি আমগাছতলায়। দরকার হলে আবার গিয়া ওই দাও দিয়া মাটি খুঁড়ে কেউচ্ছা বের করবে।
তিনদিন ধরে মতলার একটু একটু জ্বর। বড়ঘরের বারান্দার চৌকি থেকে সে আর নামেই না। মেন্দাবাড়ির বাইরে রাবির কোনও কাজ নাই। তাও যে কাজ, এই কাজকে কাজই মনে করে না সে। দেলরা বুজির দুই ওক্তের রান্দনবাড়ন। লগে নিজের সংসারের রানটাও রান্দে। বর্ষাকালে নিমতলার চুলায় রান্দন চড়ান যায় না। রানতে হয় রান্নঘরে বইসা। উঁচা ভিটির ঘর। জোড়া চুলার একটায় দেলরা বুজির রান্না, আরেকটায় নিজেদেরটা। একলগে। দুই সংসারের রান হয়ে যায়। বিয়ানে তো আর রান্দনবাড়ন থাকে না। মুড়ি মিঠাই দিয়াই নাস্তা হয়। দেলরা বুজি শুধু এককাপ চা খান।
চা বানানো কোনও কাজ হল!
এইসব কাজ গায়েই লাগে না রাবির। বর্ষাকালে গিরস্তবাড়িতে কাজকাম কম। খরালিকালে কাজের আকাল নাই। আকাল হল বর্ষাকালে। তয় দেলরা বুজির বাড়িতে আছে বলে সুবিধা ম্যালা। খরালিকালে দেলরা বুজির সাহায্য লাগে না। মাসে দুই-চারদিন কামলা খাটে মতলা, কিছু পয়সা পায়। রাবি বাড়ি বাড়ি ধান বাইন্না পায় চাউল। সংসার ভালই চলে। বর্ষাকালে রাবির সংসার চালায় দেলরা বুজি। চাউলটা সে দেয়। মতলা বসি বাইয়া মাছ দুই-চারটা ধরলে দেলরা বুজির কাজ চলে। আবার মাঝে মাঝে মাওয়ার বাজার থেকে পদ্মার তাজা ইলিশ কিনা আনায় মতলারে দিয়া। মোতালেবরে দিয়াও আনায়। তয় মোতালেব আবার দুই-তিনটা টাকা চুরিও করে। হয়তো দুইখান ইলিশ কিনল। একটা নিজের জন্য আরেকটা দেলরা বুজির জন্য। দেলরা বুজির মাছের দাম থেকে দুই-তিনটা টাকা, পাঁচটা টাকা নিজের মাছের মধ্যে ভরে ফেলল। এজন্য মোতালেবকে দিয়া মাছ সহাজে কিনায় না দেলরা। মতলা বাজারে গেলে তারে দিয়া মাছ আনায়। মতলা দুইন্নাইর আইলসা (দুনিয়ার অলস), তয় চোর না।
মতলা তিনদিন ধরে জ্বরে পড়ে আছে, ঘোপায় জিয়াইন্না (জিয়াননা) কোনও মাছই নাই। এই তো কিছুক্ষণ আগে মোতালেব আসছিল দেলরা বুজির কাছে। বাজারে যাইতাছি বুজি। ইলশা মাছ আনাইবেন নি? মাওয়ার বাজারে মাছবলে বিরাট সস্তা। আমি আনুম দুইডা। আপনে আনাইলে টেকা দেন। একলগে একআলি (হালি) ইলিশ কিনলে পড়তা ভাল পড়বো।
দেলরা একটু দোনোমোনো করেছেন, তারপর বিশটা টাকা দিয়েছেন মোতালেবকে। তাজা বড় ইলিশ আনিছ মোতালেব।
বাদলার লগে মোতালেবের আজকাইল বহুত খাতির। বাদলাকেও বাজারে নিয়া যেতে চেয়েছিল মোতালেব। যাবি নিরে বাদলা। ল।
বাদলা তখন মুড়ি খাওয়া শেষ করে কী করবে না করবে ভাবছে। মোতালেবের কথা শুনে লাফ দিয়া উঠল। হ যামু কাকা। লন।
রাবি যাচ্ছিল রান্ধনঘরে। মোতালেব আর বাদলার কথা শুনে মোতালেবকে কিছু বলল না, বাদলার দিকে চোখ ঘোরাইয়া বলল, না যাইতে পারবি না।
বাদলা হতভম্ব, ক্যা?
বাইত্তে কাম আছে।
কী কাম?
তর বাপের শইল খারাপ। আমি রানঘরে থাকুম, তুই বইয়া থাকবি বাপের শিথানে। পানিপুনি চাইলে আউগ্নাইয়া দিবি।
মোতালেব বলল, মতলার জ্বর কোনও জ্বরঐ না। পানিপুনি চাইলে তুইঐ দিছ।
না আমি পারুম না। আমার কাম আছে। আপনের যাওন আপনে যান। বাদলা যাইবো না।
বাদলা একটু ঘ্যানঘ্যান করার চেষ্টা করল। ও মা, তুমি না করো ক্যা? আমি ইট্টু যাই। বাইত্তে বইয়া থাকতে আমার ভাল্লাগে না। ও মা!
রাবি কঠিন গলায় বলল, না।
মোতালেব বুঝে গেল, না, বাদলারে বাজারে নেওন যাইবো না। নিতে পারলে কাম অইতো।
মোতালেব চলে যাওয়ার পরও ঘ্যানঘ্যান করছিল বাদলা। তুমি আমারে যাইতে দিলা না ক্যা মা? গেলে কী অইতো?
রাবি এবার একটু নরম হল। তুই বুজছস কীর লেইগা মোতালেইব্বা তরে বাজারে নিতে চাইছিলো?
কীর লেইগা আবার? এমতেঐ।
এমতেঐ না।
তয়?
নিতে চাইছিল তরে দিয়া নাও বাওয়ানের লেইগা। তুই গেলে হেয় বইয়া থাকতো, নাও বাওন লাগতো তর।
বইতাম। আমার তো নাও বাইতে আমদ লাগে।
এবার রেগে গেল রাবি। তর নাও বাওন আমি কিলাইয়া ছুডামু গোলামের পো। যা সর আমার চোখের সামনে থিকা। কয়দিন আগে বুকের দুদ ছাড়ছো, আর অওনঐ সিয়ানা অইয়া গেছো! সর, সর আমার চোখের সামনে থিকা!
বারান্দার চৌকিতে কাঁথা মুড়া দিয়া শুয়ে আছে মতলা। মোতালেব রাবি বাদলা সবার কথাই তার কানে গেছে। ওই সামান্য জ্বরেই সে উ আ কু কা করছিল। যেন জ্বরে বেহুশ হয়ে যাচ্ছে, অন্য কোনওদিকে মন নাই। তিনজন মানুষের কেউ ফিরাও তাকাল না মতলার দিকে। দেলরা তখন টাকা বের করতে কেবিনের আলমারি খুলেছেন।
বাপের কাছে বাদলা কোনওদিনও তেমন ভিড়ে না। সে মা-ন্যাওটা পোলা। মোতালেব বাজারে চলে যাওয়ার পর মা’র লগে লগে রান্নঘর তরি আসল। হঠাৎই একটা দৃশ্যের কথা মনে করে উত্তেজিত হল। মা, ওমা। হাগতে গিয়া পায়খানার তলে আমি তো খালি সিংমাছ দেহি, কইমাছ দেহি। পায়খানার তলের পাইনতে এই হগল মাছ ভরা। গু খাইতে আহে।
রাবি ভাতের চাউল ধুতে ধুতে বলল, হ আমিও দেকছি।
আমি পায়খানায় গিয়া বসসি বাই?
কী কইলি?
হ। বসসিতে কেউচ্ছার আদার দিয়া পায়খানায় বইয়া নীচে হালাইলেঐ সিং ধরন যাইবো, কই ধরন যাইবো।
আউ ছি! ওই গুয়ের মাছ কে খাইবো? দোলরা বুজি হোনলে পিছাদা পিডাইবো।
দেলরা বুজিরে কওনের কাম নাই।
না। ওইমাছ ধরিছ না।
বাদলা একটু চুপ করে মতলব বদলাল। তয় এককাম করি মা, পায়খানার ওই মিহি জঙ্গলে গিয়া বসসি বাই। ওহেনেও সাই মাছ।
আইচ্ছা বা গা। তয় কেউচ্ছা পাবি কই?
কেউচ্ছা এক জাগায় আছে। আমি দেকছি।
কোন জাগায়?
ফজলি আমগাছ তলে।
তারপর কেউচ্ছা তোলার কাজে লেগেছে বাদলা। কেউচ্ছা তুলে পায়খানার সিঁড়ির কাছে এসে টোসখোলা আর ছিটকি ঝোঁপের ফাঁকে বঁড়শি ফেলে বসেছে। হাতের কাছে কেউচ্ছার মালশা আর মাটির খোঁপা। ঘোপায় আধঘঘাপা পরিমাণ পানি। শিং কই শোল টাকি যেটাই ধরুক ঘোপার পানিতে রাখলে সহজে মরব না। এইসব হল জিয়ল মাছ।
মাছের আশায় মাউছারাঙ্গার (মাছরাঙা) মতন পায়খানার সিঁড়িতে বসে আছে বাদলা। কঞ্চির মাথায় শক্ত সুন্দর বঁড়শি। কাইয়া লোউংয়ের (কড়ে আঙুল) মাপের হরমাইলের টোন (পাটখড়ির টোম) ভাসছে পরিষ্কার পানিতে। মাছে ঠোকর দিলেই নড়ে উঠবে টোন। বাদলার বঁড়শিতে ঠোকর দেয় না কোনও মাছ।
তখনই বঁড়শিতে মাছ ধরার একটা কায়দার কথা মনে পড়ে বাদলার। পরিষ্কার পানিতে শিংমাছ আসে খুবই কম। শিংমাছ আসে ঘোলা পানিতে। এজন্য বঁড়শিতে শিংমাছ ধরার আগে যেখানে বঁড়শি ফেলা হয় সেই জায়গায় নেমে দুই পা দিয়া গোতলাইয়া পানি ঘোলা করতে হয়। তারপর বঁড়শি ফেললেই ছুটে আসে শিংমাছ। একদিকে ঘোলা পানি আরেকদিকে কেউচ্ছার আধার। বসি হালাইয়া সারন যায় না।
কায়দাটা করল বাদলা।
বঁড়শি তুলে পায়খানার সিঁড়িতে রেখে টোসখোলা ছিটকির ঝোঁপের ফাঁকে পরিষ্কার পানিতে নেমে গেল। পানি তেমন বেশি না। বাদলার মাজা তরি। কাছামারা লুঙ্গি ভিজে গেল। ওই নিয়া ভাবল না বাদলা। পানিতে নেমে দুই-পা দিয়া কাদামাটি গোতলাতে লাগল। দেখতে দেখতে ঘোলা হয়ে গেল পানি। লাফ দিয়া সিঁড়িতে উঠে বঁড়শি ফেলল বাদলা। এই কায়দায় সত্য সত্যই কাজ হল। বঁড়শি ফেলার পর সময় লাগলই না। সুতায় টান পড়ল। হরমাইলের টোন ডুবাডুবা করে জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়া যেতে চাইল মাছে।
বাদলা হ্যাঁচকা টান দিল। বিঘত পরিমাণ একটা শিংমাছ উঠল। শিং হল শক্ত পদের মাছ। অন্য মাছের তুলনায় শইল্লে জোর বেশি, তেল বেশি। আবার কাটার ডরও আছে। শিংয়ে কাতা (কাটা) দিলে খবর আছে। বিষ্যে জান বাইর অইয়া যাইবো।
তয় শিং ধরার কায়দা বাদলা জানে। মাথার দুইপাশে গোরুর শিঙের মতন কাটা দুইখানের ফাঁক দিয়া টিবি (টিপ) দিয়া ধরতে হয়।
সেই ভাবেই শিংটা ধরল বাদলা। মুখ থেকে বঁড়শি খুলে ঘোপায় রাখল। আনন্দ উত্তেজনায় কলিজা ফেটে যাচ্ছে। ঘোলাপানি তখন ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে।
ওই একবার ঘোলা করা পানিতে তিনটা শিং ধরল বাদলা। বেশি বড় না, মাঝারি সাইজের। তারপর পানি গেল পরিষ্কার হয়ে। শিঙের আর দেখা নাই। সুতায় টান পড়ে না, টোন চিৎ হয়ে ভাসে পানিতে। বাদলার আর সহ্য হয় না। বঁড়শি তুলে আবার পানিতে নামল সে। মাজা পানিতে নেমে আগের কায়দায় পানি ঘোলা করল। এবার ধরল দুইটা শিং। প্রথমটা আগের তিনটার সাইজের। পাঁচ নম্বরটা পোকাশিং (ছোটশিং, বাচ্চা অর্থে)। বাদলার হাতের পাঞ্জার চেয়েও ছোট। পাকা তেঁতুলের মতন রং। শিংমাছ বঁড়শি থেকে ছাড়াবার সময় ক্যোত ক্যোত আওয়াজ করে। পোকাশিংয়ের সেই আওয়াজ নাই। বাদলা আগের কায়দায়ই কাটার দুইদিক টিপে ধরে বঁড়শি থেকে শিংটা ছাড়ল। ঘোপায় রাখতে গেছে পোকাশিং ভালরকম একখান কাতা দিল বাদলার ডান হাতের বুইড়া লোউংয়ে। উঁহু রে, গেছি রে গেছি রে বলে ডান হাতের অন্য লোউং দিয়া বুইড়া লোউং চেপে ধরে রান্ধনঘরের দিকে দৌড় দিল বাদলা। বঁড়শি পড়ে রইল পায়খানার সিঁড়ির ওখানে, তবে বাঁহাতে মাছের ঘোপটা ঠিকই নিয়া গেল।
.
নৌকা হাজামবাড়ি বরাবর আসতেই নূরজাহান বলল, ও বাবা, আমারে তুমি হাজাম বাইত্তে নামাইয়া দেও।
আকাশে মেঘরোদ কোনওটাই নাই। ছায়া ছায়া একখান আলো ফুটে আছে চারদিকে। বর্ষার চকমাঠ থইথই করছে পানিতে। কচুরি কাইশ্যা, ধইনচা দল আড়ালি কতপদের ঘাস আগাছা মাথা তুলে আছে পানিতে। পদ্মার দিক থেকে আসা হাওয়ায় ঝিরঝির করছে পরিষ্কার পানি, ধইনচা কাইশ্যা মাথা দোলাচ্ছে। সড়কপার ঘেঁষে নৌকা বাইছে দবির। চকমাঠ থেকে এতটাই উঁচা সড়ক, তাকাতে হয় মুখ অনেকখানি তুলে। পশ্চিম দিককার চকমাঠ থেকে পুবদিককার গিরস্তবাড়ির উঠান পালান দেখা যায় না। দেখা যায় গাছপালা, দেখা যায় ঘরের চাল।
জাহিদ খাঁ-র বাড়ির গাছপালা দেখল নূরজাহান, বড়ঘরের ঢেউটিনের চাল দেখল। দবিরের এসব দেখার সময় নাই। সে তার মতন বইঠা বাইছে নাওয়ের চারটে বসে। নূরজাহানের কথা শুনে বলল, হাজামবাইত্তে গিয়া কী করবি?
আমার তো কোনও বাইত্তেই কোনও কাম নাই। আবার সব বাইত্তেই কাম। আইজ সাত-আষ্ট মাস এই হগল বাইত্তে আমি আহি নাই। তুমি মোবাইত্তে যাও। আমি হাজামবাইত থিকা গাওয়াল বাইত্তে যামু, তারবাদে যামু মিয়াবাইত্তে, তারবাদে আমুনে মোবাইত্তে।
কেমতে আবি? নাও দোন পাবি কই? কে তরে এক বাইত থিকা আরেক বাইত্তে নামাইয়া দিবো?
হেইডা পামুনে।
যুদি না পাছ?
তয় তুমি আইয়া লইয়া যাইবা।
আমি বুজুম কেমতে তুই কোন বাইত্তে আছছ?
নূরজাহান হাসল। হ এইডা একহান কথা। তয় তুমি কইলাম একহান পথ আমারে দেহাইছছা বাবা।
কী পথ?
ওই যে মাওয়ার বাজার থিকা হাতড়াইয়া বাইত্তে আইছিলা?
এবার দবিরও হাসল। নাও দোন না পাইলে তুইও হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া এক বাইত থিকা আরেক বাইত্তে যাবি?
হ।
না মা, ওইডা তুই পারবি না। পুরুষপোলারা যেই কাম পারে মাইয়ারা সবসময় হেই কাম পারে না। মাইয়াগো অনেক অসুবিদা। এতকিছুর কাম নাই, তরে আমি একহান। সোজা পথ দেহাইয়া দেই। দেলরা বুজির লগে আমার কথার কাম আছে। আমি ওই বাইত্তে নামি, তারবাদে তুই নাও লইয়া যেই যেই বাইত্তে যাইতে চাস যা।
আমি নাও বাইয়া যামু?
হ। এডু নাও বাওন তো কোনও বাওন না। বইডার দুইহান চাইড় (চাড়) দিলে মোবাড়ি থিকা হাজামবাড়ি, হাজামবাড়ি থিকা গাওয়ালবাড়ি। গাওয়ালবাড়ির লগেই মিয়াবাড়ি। তয় তুই যেইডা করবি হেইডা আমি হিগাইয়া দেই। পয়লা যাবি হাজামবাড়ি, হাজামবাড়ি থিকা যাবি গাওয়ালবাড়ি। শেষমেশ যাবি মিয়াবাড়ি। সবশেষে মিয়াবাড়ি ক্যা যাবি ক তো?
নূরজাহান আবার হাসল। বুজছি। মিয়াবাড়ির লগে অইলো দেলরা আম্মাগো সীমানা। তোমার কাম শেষ অইলে তাগো পালানে খাড়াইয়া তুমি আমারে ডাক দিতে পারবা।
দবিরও হাসল। হ।
তয় ওইডাই করো বাবা। আগে মেন্দাবাড়িঐ যাও।
হাজামবাড়ি আর আজিজ গাওয়ালের বাড়ির মাঝখান দিয়া নৌকা বাইয়া মেন্দাবাড়ির দক্ষিণ সীমানায়, দেলোয়ারাদের পালানের দিকে চলে এল দবির। বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়াল।
নূরজাহান বলল, তয় আমি অহন আর এই বাইত্তে নামুম না।
বইঠা নূরজাহানের দিকে আগাইয়া দিয়া দবির বলল, আইচ্ছা।
পালানে নেমে বলল, দুফইরা ভাত খাইতে খাইতে আইজ মনে অয় বিয়াল অইয়া। যাইবো।
বইঠা নিয়া নূরজাহান বলল, আমার মনে অয় না।
ক্যা?
দেলরা আম্মায়ঐ দেখবানে তোমারে দুফইরা ভাত খাওয়াইতাছে।
অইতে পারে।
আর আমারেও মনে অয় কেঐ না কেঐ খাওয়াইবো। তয় আমার খিদামিদা লাগবো বইলা মনে অয় না। পর পর দুইদিন তুমি আমারে বাইত থিকা বাইর করলা, এতেই আমার পেড ভইরা গেছে। এই যে অহন ইচ্ছা সাদিন মতন এইবাইত্তে যাইতে দিতাছো এতেই আমার পেড ভইরা গেছে। দোফরে ক্যা, রাইত্রেও যুদি আমি আইজ ভাত না খাই আমার খিদা লাগবো না।
পাছার চারটে এসে বইঠায় চারি দিল নূরজাহান। মেন্দাবাড়ির বড় পুকুর পাড়ি দিয়া হাজামবাড়ি মিহি মেলা দিল।
খানিক দাঁড়িয়ে মেয়েকে কোষানাও বেয়ে পুকুর পাড়ি দিতে দেখল দবির। তারপর মাজায় বান্ধা গামছা খুলে মুখ গলা মুছতে মুছতে দেলরা বুজিদের বড়ঘরের দিকে পা বাড়াল। রানঘরের দিক থেকে তখন বাদলার চিৎকার ভেসে আসছে। উঁহু রে উঁহু রে, বিষ্যে মইরা গেলাম রে। ওমা, মা আমারে পোকাশিংয়ে কাতা দিছে।
বাদলার চিক্কইর পাক্কইরে রান্দনবাড়ন ফেলে দিশাহারা হয়ে গেছে রাবি। কী রেখে কী করবে বুঝতে পারছে না। দেলরা এসে দাঁড়িয়েছেন পুব দিককার দরজার সামনে। পরনে সাদাথান, চোখে চশমা, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ঘোপাটা রাখা আছে রান্নঘরের দরজার সামনে। ভিতরে খলবল খলবল করছে শিংমাছ। সেই ঘোপার সামনে দাঁড়িয়ে এখন ডান হাত দিয়া বাম হাতের বুইড়া লোউং টিপে ধরেছে বাদলা। আর চিক্কইর পাড়ছে।
ছেলের কিছু হলে প্রথমেই দিশাহারা হয় রাবি, তারপর চেতে যায়। এখন সেই চেতাটা চেতল। বাদলার পিঠে গুম গুম করে দুইটা কিল দিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ওই গোলামের পো গোলাম বসুসি বাইতে তরে যাইতে কইছে কে? শিংমাছ ধরতে কইছে কে?
দেলরা তার স্বভাব মতন চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে ঠান্ডা গলায় বললেন, এমতেঐ শিংয়ের কাত খাইছে, আবার অরে কিলাইতাছস ক্যা?
রাবি মুখ খিঁচিয়ে বলল, গোলামের পোয় শিংমাছ ধরতে গেছে ক্যা?
গিয়া তো ভালই করছে। শিং ধরছে। কয়ডা ধরছরে বাদলা।
বাদলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, পাঁচটা ধরছি। চাইল্ডা বড় বড়, একহান পোকা। ওই পোকাডায়ঐ আমারে খাইছে। উঁহু রে। এই যে দেহেন বাও আতের বুইড়া লোউং ফুদরি (ছিদ্র, ফুটো) কইরা হালাইছে। আর সাই বিষ। উহু রে।
বাদলার বাঁ হাতের বুড়া আঙুলের আগায় মুশুরি দানার মতন একটুখানি রক্ত লেগে আছে। দেখে দেলরা বললেন, ইট্টুহানি হলদি বাটা লাগায় রাখ। বেদম কইম্মা যাইবোনে।
রাবি তখন মতলেবকে নিয়া পড়েছে। পোলা রেখে স্বামীরে বকাবাজি শুরু করেছে। আরেক গোলামের পোয় জ্বরের ভ্যাক ধইরা পইড়া রইছে। পোলায় শিংয়ের কাতা খাইয়া মরে, গোলামের পোয় রাও করে না। মনে অয় মইরা গেছে।
রাবিকে ছোট করে একখান ধমক দিলেন দেলরা। আকথা কইচ না ছেমড়ি। কইলাম যে হলদি বাটা লাগায়া দে।
ততক্ষণে দবির এসে দাঁড়িয়েছে রানঘরের সামনে।
বাদলা ঙো ঙো করতে করতে মাকে বলল, তোমার লেইগাঐত্তো শিঙের কাতা খাইছি আমি। মোতালেব কাকার লগে বাজারে যাইতে চাইলাম যাইতে দিলা না। বাজারে গেলে শিংয়ের কাতা আমি খাইতাম? বাজারে যাই নাই দেইক্কাঐত্তো বসৃসি বাইতে গেছি।
রাবি কথা বলবার আগেই দবির বলল, কী অইছে? শিংয়ে কাতা দিছে? আরে বেড়া শিংয়ের কাতায় কিছু অয় না। দেখ বিষকাডালি (বিষকাটালি। এক ধরনের আগাছা) পাওয়া যায়নি। দুই-তিনডা বিষকাডালি আইন্না যেহেনে শিংয়ে কাতা দিছে ওহেনে বইড়া কহেকখান বাড়ি দিলেঐ দেকবি বেদনা গেছে গা।
দবিরের কথা শুনে বাদলার মুখ উজ্জ্বল হল। কান্না ব্যথা ভুলে বলল, এইত্তো, আসল বুদ্ধি পাওয়া গেছে। বিষকাড়ালির কথা তো আমার মনেই আছিলো না। মোতালেব কাকাগো ছাইছে, তেতইল গাছের ওই মিহি বিষকাডালি আছে। যাই লইয়াহি গিয়া।
বাঁ হাতের বুড়া আঙুল ডান হাতে চেপে ধরে বাদলা দৌড়ে চলে গেল মোতালেবদের বাংলাঘরের ছাইছে। সেই ঘরের চালে মোতালেবের কয়েকটা কবুতর বাকবাকুম বাকবাকুম করছে। রাবি গিয়া ঢুকেছে রানঘরে। মুখ এখনও থমথমা। বাদলার কিছু হলে সহজে মুখ থেকে রাগ বিরক্তি যায় না তার।
দেলরা তখনও দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। দবির হাসিমুখে তার দিকে তাকাল। কেমুন আছেন বুজি?
আছি ভালই। তুই আইলি কইথিকা?
বাইত থিকাঐ আইছি।
তরে দেকলাম বহুতদিন পর। নূরজাহানের ওই ঘটনার পর তরে আর দেহি নাই। ভাল আছস দবির?
দবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আছিলাম ভালঐ বুজি। তয় দুই দিন ধইরা ভাল নাই।
ক্যা, আবার কী অইলো?
অইছে একহান কারবার। হের লেইগাঐ আপনের কাছে আইছি।
আয় ঘরে আয়।
ঘরে বাদলার বাপে আছে?
হ। ও অর সামনে কথা কইতে চাস না?
না বুজি। আমি চাই না এই কথা অন্য কেঐ হুনুক।
মতলার হোনন না হোনন একঐ কথা। কে কী কইলো না কইলো ওই হগল ও মনে রাকবো না। ও আছে অর শইল লইয়া। ইট্টুহানি জ্বর অইছে হেতেই বেউস অইয়া পইড়া রইছে। হুনলি না রাবি বকাবাজি করলো!
হুনছি।
দেলরা কয়েক পলক কিছু ভাবলেন, তারপর বললেন, আইচ্ছা ঠিক আছে। তয় ল নিমতলায় বইয়া কথা কই। এইমিহি কেঐ আইবো না।
আইচ্ছা। দেলরা রাবিকে ডাকলেন। ওই রাবি, নিমতলায় চের দে আর একহান জলচকি দে। তারবাদে দুইকাপ চা বানা।
দবিরকে দেখেই বিরক্ত হয়েছে রাবি। তর মেয়ে নূরজাহান মান্নান মাওলানার মুখে ছ্যাপ ছিটিয়ে দিয়েছিল। রাবির কাছে মান্নান মাওলানা হচ্ছেন ফেরেশতা। সেই ফেরেশতার মুখে ছ্যাপ দিয়েছে যার মেয়ে তাকে দেখতে পারায় কোনও কারণ নাই রাবির। সেই মানুষের জন্য জলচৌকি আনতে হবে, চা বানাতে হবে এটা রাবি ভাবতেই পারছে না। সে একবার যার উপর রাগ বিরক্ত হয় হাজার চেষ্টায়ও সেটা আর ঠিক হয় না। ওই যে একদিন বাদলারে থাবড় দিয়েছিল মোতালেব, ঘেঁটি ধাক্কা দিয়েছিল তারপর থেকে আইজরি মোতালেবরে দুইচোক্ষের নিলায় দেখতে পারে না সে। মোতালেবকে দেখলেই থমথমা হয়ে যায় মুখ। ওদিকে বাদলার লগে মোতালেবের আইজকাইল বিরাট খাতির। বাড়িতে থাকলে বাদলা আছে মোতালেবের পিছে পিছে। ওই নিয়া রাবি রাগারাগিও করে পোলার লগে। পোলায় পাত্তা দেয় না। পোলা আছে পোলার মতন, রাবি আছে রাবির মতন। আর এই দুইজনের মাঝখানে আছে মতলা। এইসব নিয়া রাবিকেও সে কিছু বলে না, বাদলাকেও বলে না। বলে লাভও নাই। মা-ছেলে কেউ মতলারে গনায় ধরে না। সে যে মানুষ, একজনের স্বামী আরেকজনের বাপ, দুইজনের কেউ সেটা মনে রাখে না।
তয় নূরজাহানের বাপের জন্য জলচৌকি দিতে হবে, চা বানাতে হবে এটা সহ্য করা রাবির পক্ষে খুবই কঠিন। দেলরার কথা শুনে থমথমা গলায় বলল, আমি অহন কেমতে এই হগল কাম করুম? বাদলা শিংমাছ ধরছে হেই মাছ কুড়ুম, ভাত চড়াইছি, অহন আবার মোশলা বাটতে অইবো, এই হগল থুইয়া চের চকি কেমতে দিমু? আপনে গিয়া ঘরে বহেন। আর আপনে তো বুজি এই টাইমে কোনওদিন চা খান না। অহন চা খাইবেন ক্যা? চা খাইলে দোফইরা ভাত খাইতে পারবেন না। খিদা নষ্ট অইয়া যাইবো।
রাবি যে তাকে আর তার মেয়েকে দুইচোক্ষে দেখতে পারে না, ছ্যাপ ছিটানোর দিন থেকেই এটা জানে দবির। হামিদাকে নিয়া সেদিন দেলরা বুজির ঘরে নূরজাহানরে খুঁজতে এসেই বুঝছিল। তবে তারপর এতদিন কেটে গেছে, এখনও ঠিক হয় নাই রাবি। দবিরের মতন নিরীহ একজন মানুষের উপর, নূরজাহানের মতন একটা মাইয়ার উপর এখনও রাগ হইয়া রইছে। আজ এই বাড়িতে এসেই তো বাদলাকে সে বিষকাটালির কথা বলল। ওই তো একগোছা বিষকাটালি তুইলা আনছে বাদলা। রান্নঘরের ওটায় বসে বিষকাটালি দিয়া ছটছট করে বাড়ি মারছে শিংয়ে কাতা দেওয়া লোউংয়ে। তারপরও রাবির মন গলে না!
রাবির লগে একটু কথা বলতে চাইল দবির। তার আগেই দেলরা বললেন, যা কইছি ওইডা কর রাবি। তুই যুদি না পারছ তয় আমি বাদলারে কই।
দবির বলল, না না বুজি। বাদলা ছেমড়াডা শিংয়ের কাতা খাইছে। অর কাম নাই চের টাননের। আপনে নিমতলায় গিয়া খাড়ন আমি চের আনতাছি। জলচকি আমার লাগবো না, আমি একহান ফিরি আইন্না বমু নে। রাবি কাম করতাছে, করুক। আপনে চা খাইলে খান। আমার চা লাগবো না।
চেয়ার আনতে বড়ঘরে ঢুকে গেল দবির।
.
নূরজাহানকে দেখে ভাল রকম সাড়া পড়ল হাজামবাড়িতে।
বর্ষাকালে আবদুলের তেমন কাজকাম থাকে না। গোপন একটা অভাব লেগে থাকে সংসারে। শীতের দিনে লেপ তোশকের কাজ, মুসলমানির কাজ এসব থাকে। খরালিকালে গোরু তোলানোর (ষড়গোরুর অণ্ডকোষ ফেলে দেয়া) কাজও সে করে। এই কাজটা সব হাজাম করে না। হাজামদের মধ্যে যারা নিচা ধরনের তারা করে। আগে আবদুল করত না। দুই-তিন বছর ধরে করে। সংসার বড় হওয়ার ফলে এক-দুইদিন আজাইর থাকলে, রুজি রোজগার কিছু না হলেই চাউলে টান পড়ে। ছোট ভাইরা বুড়া মা আর পাগল বোন ফেলে যে যার মতন সংসার করছে। ভালই আছে তারা। শুধু মা-বোনের কথা ভাবে না। বড় পোলা হইছে বইলা সব দায় য্যান শুধু আবদুলের। এমনকী বোনগুলি তরি কোনওদিন খবর লয় না, তাদের বুড়া মা-টা কেমন আছে, পাগল বোনটা কেমন আছে। বড়ভাই আবদুলের কথা না ভাবল, আবদুলের বউপোলাপানের কথা না হয় না ভাবল, মা-বোনটার কথা কেউ ভাববে না! এই মায়ের পেটে শুধু কি আবদুলই জন্মাইছে? অন্যরা জন্মায় নাই? পাগল বোনটার ভাই কি শুধু আবদুলই? আর কেউ না? কারও কোনও দায়দায়িত্ব নাই?
নিজের তিনটা পোলাপান আবদুলের। বড়পোলা আলাউদ্দিন, বাড়ির সবাই ডাকে আলালদ্দি, তার বয়স বারো-তেরো বছর। মাজারো বারেক। তারপর একটা মাইয়া। বউ নিয়া নিজেরা পাঁচজন আর মা-বইন। সাতজন মানুষের সংসার কি য্যানত্যান! জাগা জমিন বলতেও তো কিছু নাই। এই বাড়ি আর বাড়ির লগের ওই তিন চাইর গন্ডার কোলা (ছোট খেত)। তারও তো ভাগিদার কম না। আবদুল একলা হইলে কথা ছিল। তয় এইসব নিয়া এখনও কথা তোলে নাই ভাইবইনরা। অভাব অনটনে পড়লে একদিন তুলবো। বেচার কথা। বলবো। যে যার অংশ বেইচা টাকা নিয়া যাইবো। সড়ক হওয়ার ফলে জাগা জমিনের দাম লাফায়া লাফায়া বাড়ছে। কোনদিন কোন ভাই আর নাইলে বইন আইসা বেচার চারি (তাল) তুলবো আল্লাই জানে।
এইসব আজকাল মাঝে মাঝে ভাবে আবদুল। আজ সকালেও ভেবেছে। কাল সকাল থেকে দুপুর তরি মাওয়ার বাজারে ছাতি মেরামতের ছোট ব্যাগ নিয়া বইসা ছিল। দশ টাকার কাজও হয় নাই। বর্ষাকালে ছাতি মেরামতের কাজ সে করে। তয় এই বছর এত ম্যাগবিষ্টি তাও ছাতির কামে পয়সা নাই। আবদুল দিশা পাচ্ছে না বর্ষাকালটা এবার কেমন করে কাটবে। বাড়ির সামনের কোলায় ইরি যেটুকু হইছিল মাস দুয়েকের চাউল হয় না। সেইটুকু চাউল বর্ষাকালের জন্য রেখে দেয়। ওই চাউল দিয়াই সংসার চলছে। আর বেশিদিন চলবো বইলা মনে হয় না। রুজি রোজগার না করতে পারলে না খাইয়া থাকতে হইবো।
আজ সকাল থেকে নতুন একটা পথ বের করার চেষ্টা করছে আবদুল। আলালদ্দি বড় হইছে। তারে নিয়া বিলের বাড়ির ওইদিকে গিয়া দাঐন (এক ধরনের বঁড়শি। লম্বা দড়ির তিন-চার হাত পর পর চার-পাঁচ হাত লম্বা সুতোর মাথায় বঁড়শি লাগিয়ে পেতে রাখতে হয়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেই বঁড়শি তুলে মাছ ধরতে হয়) বাইবে কিনা চিন্তা করছে। সড়কের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশগ্রামে সবকিছুর দাম বাড়ছে। বড় মাছের দাম তো বাড়ছেই, গুঁড়াগাড়ি মাছও গরিব মানুষরা বাজারে গিয়া হাত দিয়া চুঁইতে পারে না, এত দাম। সারারাত দাঐন বাইলে দেড় দুইশো টাকার মাছ ধরা যাবে। তয় বিল বাওরে, চকেমাঠে আইজ কাইল ইরির চাষ দেখে, ইরির চাষে সার কীটনাশক এইসব ব্যবহার করা হয় দেইখা, জানের ভয়ে দেশ ছাইড়া পলাইছে সব মাছ। আগে কী পরিমাণ মাছ যে বিক্রমপুরে আছিলো?
আগের দিনের কথা মনে হলেই একটা প্রবাদ মনে আসে আবদুলের–
সেই দিন নাইরে নাতি
খাবলা খাবলা খাতি
এক গরিব নানা তার নাতিকে সুখের দিনের বর্ণনা দিতে গিয়া এই কথা বলছিল। অর্থ হচ্ছে, আগের দিন ভাল ছিল। তখনকার দিন থাকলে প্রচুর খেতে পেতি। তবে আবদুলের মনে হয় এই প্রবাদের কোনও অর্থ নাই। গরিব মানুষের জন্য আগের দিন পরের দিন সব দিনই অভাবের।
হাজামরা একসময় দাঐন বাওয়ার কাজও করত বর্ষাকালে। দেশগ্রামে ইরির চাষ শুরু হওয়ার পর ছাইড়া দিছে। একদম ঠেকায় না পড়লে আইজকাইল আর কেউ বায় না। মেদিনমণ্ডলে তো একটাই হাজামবাড়ি। আবদুল ছাড়া হাজামবাড়ির কেউ আর দেশগ্রামে নাই। কে বাইবো দান। রানাদিয়া গ্রামে যারা আছে, তারা বিরাট গুষ্টি। এক বাড়িতেই শ-খানেকের উপর ঘর। ভোটের সময় বিরাট দাম তাদের। ম্যালা ভোটার এক বাড়িতে। তাদের মধ্যে একেবারেই গরিব যারা তারা কেউ কেউ এখনও বর্ষাকালে দান বায়। মাছ যা ধরে ওই দিয়া সংসার চালানো দায়। তাও ধরে। কী করবো? দিনে এক ওক্ত খাইয়া বাঁচলেও তো বাঁচতে হইবো!
ঘরের ওটায় বসে সকালবেলা আজ মোটা মোটা তিনখান আটার রুটি ঝোলা মিঠাই দিয়া খাইছে আবদুল। তারপর এতখানি বেলা হইছে ওটাতেই বইসা আছে। সংসার নিয়া, বর্ষাকালের সামনের দিনগুলি নিয়া খুবই ভাবছে।
আবদুলের বউর নাম মাজেদা। সংসার পোলাপান নিয়া ব্যস্ত থাকার পরও স্বামীর চিন্তিত মুখ কয়েকবার খেয়াল করছে সে। মেয়েটার নাম আসুরা। সে উঠানের মাটিতে বইসা ধুলাবালি দিয়া খেলতাছে। আলালদ্দি আর বারেক দুইজনের হাতে দুইখান বঁড়শি। বাড়ির পিছন দিককার হিজল তলায় গিয়া বঁড়শি ফালাইয়া বইসা আছে তারা। আধার দিছে গুঁড়া ইচা (চিংড়ি)। দুই চারটা পুঁটি ট্যাংরা, পাবদা রয়না ধরবে। দুপুরের দিকে ঘোপার ওইসব গুড়াগাড়ি মাছ নিয়া আসলে কুইটা কাইটা রান্না করবে মাজেদা। লগে শাকপাতা কিছু দিবে। সংসার তো এইভাবেই চলে। রোয়াইলতলার ঘরে আজ সাত-আষ্টমাস ধইরা কাঁথার নীচে শুইয়া থাকে তছি পাগলনি। মা বইসা থাকে তার শিথানে। রাতেরবেলা আগের নিয়মেই বারেক গিয়া ঘুমায় দাদি ফুবুর পাশে।
তছিরে নিয়াও গোপন একখান চিন্তা আছে আবদুলের। মানুষ খুন করছে পাগলনি। তারপর থেকে পাগলামি হয়েছে অন্যপদের। কাঁথার তলায় সারাদিন নিজেরে লুকাইয়া রাখে। রাতেরবেলা চুপে চুপে বাইর হয়। দিনের কাজ সারে রাতে, রাতের কাজ দিনে। দুনিয়াটাই উলটা হইয়া গেছে তছির।
তয় গত আষ্টমাসেও কারও মুখে কোনওখানে রুস্তম রিকশাআলার খুনের কথা তেমন আর ওঠে নাই। পুলিশ দারোগারাও মনে হয় ভুইলা গেছে। ভোলে নাই শুধু এই বাড়ির তিনজন মানুষ। তছি নিজে আর তার মা, আর তার ভাই। গোপন ভয়টা তাদের রয়েই গেছে।
ভাতকাপড়ের মতন এইটাও তো এক চিন্তা।
একটু আজাইর হইয়া আবদুলের সামনে আইসা দাঁড়াইছে মাজেদা। কী অইছে তোমার?
আবদুল উদাস চিন্তিত চোখে বউর দিকে তাকাইছে। না কী অইবো?
কী চিন্তা করতাছো বিয়ান থিকা?
আবদুল দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। চিন্তার কি আর সকাল আছে? কামকাইজ নাই। ঘরের চাউল ফুরাইয়া আইতাছে। কয়দিন পর তো ভাত জুটবো না!
স্বামীর পাশে আন্তরিক ভঙ্গিতে বসল মাজেদা। হ। কোলার ধান বাইন্না (ভেনে) যেই চাউল পাইছি হেইডি তো শ্যাষ অইয়া আইলো।
এতডি মানুষ সংসারে। ওড়ু চাউলে কয়দিন যায়?
হ। তয় ছাতির কাম ইবার নাই ক্যা? এত ম্যাগবিস্টি অইতাছে, দেশগেরামের মাইনষে কি বাইত থিকা বাইর অয় না? বেবাকতে কি নতুন ছাতি লইয়া বাইর অয়? ছিড়া ভাঙ্গা ছাতি নাই কেঐর?
কেমতে কমু? কাইল বাজারে বইয়া তো দশটেকার কামও করতে পারি নাই। আইজ কাইল দশটেকায় এক-দেসসের চাউলও তো পাওয়া যায় না।
আইজ যাইবা না বাজারে?
না। কী করুম গিয়া কও? নাও বাইয়া এতদূর যাওন আহন, শতখানি টেকার কাম না অইলে পোষায়, কও?
হ।
তয় অন্য একহান চিন্তা করতাছি।
কী চিন্তা?
আলালদ্দিরে লইয়া দাঐন বামু।
মাজেদা একটু চমকাল। কও কী?
হ। বিলেরবাড়ির ওই মিহি হারারাইত দাঐন বাইলে গুঁড়াগাড়ি মাছ যাঐ পাই, এক দেসসো টেকার কাম অইবো।
হেইডা অইতে পারে। তয় তোমার শইল্লে কুলাইবো?
কী করুম কও! আর তো কোনও পথ দেখতাছি না। বাপে-পুতে দাঐন বাওনের ফাঁকে ফাঁকে ঘুমাইয়া লমুনে। এক ঘণ্টা আমি ঘুমামু, এক ঘণ্টা পোলায়।
কেমতে ঘুমাইবা? কেঁতা বালিশ রাখবা কই?
ক্যা, নাওয়েই রাখুম।
তোমার নাওয়ে তো ছই নাই?
পলিথিন দিয়া কোনওরকমের একখান ছই বানাইয়া হালামুনে। বাঁশের একখান বেড়া বাইন্দা, বেড়ার উপরে পলিথিন দিয়া আইজঐ ওইহান বানামু।
তয় তো বাজারে যাওন লাগবো পলিথিন কিনতে।
হ। কম দামের পাতলা পোতলা একখান বেড়াও কিন্না আনুম কিনা চিন্তা করতাছি। তয় আইজ থিকাঐ দান বাইতে যাইতে পারি। বসি আর লায়লনের (নাইলনের) সুতা দড়ি এই হগলও কিনতে অইবো। শত তিনেক টেকা খরচা আছে।
টেকা পাইবা কই?
হেইডাঐ চিন্তা করতাছি। ঘরে তো দশটা টেকাও নাই।
হ। এমতে কি সংসার চলে!
আবদুল একটু চুপ করে রইল, মাজেদার মুখের দিকে তাকাল। দেলরা আম্মার কাছে যাই। তারে গিয়া কই, শততিনেক টেকা উধার দেন আম্মা। মাসেকখানি বাদে দিয়া দিমুনে।
হেয় কি দিব?
দিতে পারে! আগে দুই-চাইর বার বিশ-পনচাশ টেকা চাইয়া তার কাছে আমি পাইছি।
বিশ-পনচাশ আর তিনশো কি এককথা অইলো?
তাও চেষ্টা কইরা দেহি।
আবদুল উঠল। আবদুলকে উঠতে দেখে মাজেদাও উঠে দাঁড়াল। আথকা বলল, আমি যুদি তোমারে তিনশো টেকা দেই?
কথাটা যেন বুঝতে পারল না আবদুল। কী কইলা?
মাজেদা হাসল। কইলাম, আমি যুদি তোমারে তিনশো টেকা দেই?
মাজেদাকে হাসতে দেখে আবদুলও হাসল। বিপদের দিনে ঠাট্টা মশকরা করো?
না হেইডা করি না।
তয় কী করো?
কইলাম তো ঠাট্টা মশকরা করি না। হাচা কইতাছি। আমি তোমারে তিনশো টেকা দিতে পারি। তুমি আমার টেকা নিবা?
আলালদ্দির মা, ফাইজলামি কইরো না। ইহ জিন্দেগিতে একটা টেকা তোমার হাতে কোনওদিন দিতে পারি নাই। কোনওদিন একটা টেকা দিয়া কই নাই, তোমার যা মন চায় তুমি কিন্নো। হেই মানুষ আমারে দিবো তিনশো টেকা? এইডা ফাইজলামি না? পাঁচ-দশ টেকা হয় হেইডা এক কথা। তিনশো টেকা তুমি পাইবা কই?
মাজেদা আবার হাসল। কই পামু হেইডা তোমার জাননের কাম নাই। আমি তিনশো টেকা দিলে তুমি নিবা কিনা হেইডা কও।
নিমু না ক্যা? অতি অবশ্যই নিমু।
তয় টেকাডা কইলাম উধার। তোমারে আমি এমতেঐ দিতাছি না। দেলরা আম্মার কাছ থিকা উধার আনলে একমাস বাদে ফিরত দিতা না, আমার টেকাও একমাস বাদে ফিরত দেওন লাগবো। লগে লাব দেওন লাগবো পোনরো টেকা।
হাসিমুখে ভুরু কুঁচকে মাজেদার দিকে তাকাল আবদুল। তোমার কথাবার্তা কিছুই আমি বুজতাছি না। কীয়ের লাভ দেওন লাগবো?
হোনো, আমার মাজারো ভাইয়ে বাইষ্যাকালে সুদের কারবার করে। অভাবি মানুষরে সুদে টেকা উধার দেয়। একশো টেকায় এক মাসে দশ টেকা। একশো টেকা উধার নিবা, তোমারে দিবো নব্বই টেকা। সুদের দশটেকা আগেঐ কাইট্টা রাখবো। আমি হেই ভাইয়ের বইন। কেঐরে একশো টেকা উধার দিলে সুদের দশ টেকা আগেঐ আমার কাইট্টা রাখন উচিত। তয় তুমি আমার স্বামী, তোমার লগে ঐরকম কারবার আমি করতে পারি না। শতকরা দশ টেকা সুদ নেওনও ঠিক অইবো না। এইটেকা দিয়া তো তুমি আমারে আর আমার পোলাপানরেঐ খাওয়াইবা। নিজের মা বইনরেও খাওয়ামু?
হ হেইডাও খাওয়াইবা। এর লেইগা তোমার কাছ থিকা আমি সুদ নিমু কম। শতকরা পাঁচটেকা। আর সুদের টেকাডাও আগেঐ কাইট্টা রাখুম না। একমাস বাদে তুমি আমারে তিনশো পোনরো টেকা দিবা।
আইচ্ছা দিমু।
সত্য?
সত্য।
আবদুলের তখনও পর্যন্ত ধারণা মাজেদা তার লগে ফাইজলামি করতাছে। তাকে চিন্তিত দেখে, মন খারাপ দেখে তার মন ভাল করবার চেষ্টা করছে। তিনশো টাকা মাজেদা পাবে কোথায়?
আবদুলের ধারণা তছনছ করে ঘরে ঢুকল মাজেদা, ঘরের কোনও টুমটামের (আসবাবপত্রের) ভিতর থেকে পাঁচ দশ বিশ পঞ্চাশ টাকার খুচরা খাচরা মিলাইয়া পুরা তিনশো টাকা এনে দিল আবদুলের হাতে। এই লও, পুরা তিনশো।
টাকা হাতে নিয়া অপলক চোখে মাজেদার দিকে তাকিয়ে রইল আবদুল। কথা বলতে ভুলে গেল।
মাজেদার মুখে তখনও হাসি। এমতে চাইয়া রইলা ক্যা?
আবদুলের মুখটা হাঁ হয়েছিল। মাজেদার কথা শুনে মুখ বন্ধ হল। চোখে পলক ফেলে বলল, সত্যঐ এতডি টেকা তুমি আমারে দিলা?
হ। বিশ্বাস না অইলে গইন্না দেহো।
গনন লাগবো না। টেকা যে তিনশোই আছে হেইডা আমি বুজছি।
অহন বুজতে চাইতাছো এতডি টেকা আমি কই পাইলাম, এইত্তো?
হ।
পরে তোমারে কমু নে। বেইল হইয়া গেছে, তাড়াতাড়ি বাজারে যাও। নাওয়ের ছই দেওনের বেড়া কিন্না আনো, দাঐনের জিনিসপত্র কিন্না আনো, আইজ থিকা দাঐনএ বাও। পোলা লইয়া দাঐন বাইলে ভাল অইবো তোমার। এইডা আমি তোমারে কইলাম। যাও।
আলালদ্দিকে মাত্র ডাকতে যাবে আবদুল, তখনই বাড়ির ঘাটে এসে লাগল একটা কোষানাও। নাও বাইয়া আসছে নূরজাহান। কোনওরকমে কোষানাও ঘাটে লাগাইয়া, আগার চারটে রাখা দড়ি দিয়া ঘাটের খুঁটার লগে দড়ির একটা প্যাঁচ দিয়াই একদৌড়ে বাড়িতে উঠল নূরজাহান। খুশির চোটে বিরাট একটা লাফ দিল।
আবদুলের বউকে সে ডাকে ভাবি, আর আবদুলকে আবদুলদা। পারলে দুইজনকেই প্যাচাইয়া ধরে। তয় আবদুলকে সে ধরল না, ধরল মাজেদাকে। ভাবিগো, ও ভাবি। আহা রে কতদিন বাদে তোমগো দেখলাম!
নূরজাহানকে নৌকা বাইয়া আসতে দেখে আবদুল-মাজেদা দুইজনেই অবাক। মান্নান মাওলানার লগে ওই ঘটনা ঘটাবার পর নূরজাহানকে আর গ্রামের কোথাও দেখা যায় নাই। বাড়ি থেকে তারে বাইর হইতে দেয় নাই দবির-হামিদা। দেশগ্রামের বউঝিরা নূরজাহানের চেহারা কেউ আর দেখেই নাই। পুরুষপোলারাও তেমন কেউ দেখে নাই। কারণ দবিরের বাড়িতে তেমন যাওয়াআসা নাই কারও। সেই নূরজাহান আইজ একলা একলা নাও বাইয়া হাজামবাড়িতে আসছে এইটা তো বিরাট ঘটনা। একদিকে কিছুক্ষণ আগে মাজেদা আবদুলকে দিয়েছে তিনশো টাকা তারপর এইভাবে নূরজাহান আইসা হাজির, একলগে এতবড় দুইখান ঘটনা, আবদুলের দশা আথকা বোবা হয়ে যাওয়া মানুষের মতন। সে কোনও কথাই বলতে পারছে না। মাজেদা টাকা আইনা দেওয়ার পর যে অবস্থা হয়েছিল, নূরজাহানকে দেখেও সেই অবস্থা। কথাই বলতে পারছে না।
মাজেদাও নূরজাহানের মতো করেই প্যাচাইয়া ধরছে নূরজাহানরে। আনন্দ উত্তেজনায় ফাইটা পড়া গলায় বলল, তুই কই থিকা আইলি নূরজাহান? কেমতে আইলি? একলা একলা : নাও লইয়া তরে গাছিমামায় বাইর অইতে দিল? হামিদাআম্মায় তরে বাইর অইতে দিল?
নূরজাহানকে দেখে উঠানের ভিজা ভিজা মাটিতে খেলতে বসা আসুরা দৌড়াইয়া আসছে, হিজলতলার দিকে বঁড়শি বাইতে যাওয়া আলালদ্দি আর বারেক দুইজনেই বঁড়শি ফালাইয়া দৌড়াইয়া আসছে, যেন বাড়িতে আথকা একখান আমোদ আহ্লাদ শুরু হইয়া গেছে।
আবদুলের পোলাপানদের দেখে এইটারে প্যাচাইয়া ধরে নূরজাহান, ওইটারে প্যাচাইয়া ধরে। শরীরে কাদা মাটি লেগে থাকা আসুরাকে একটু কোলে নিল। আবদুল তাকায়া তাকায়া নূরজাহানরে দেখছে। যেন কতদিন পর মেয়েটাকে সে দেখছে। যেন কতদিন খাঁচায় আটকে থাকা মেয়েটি খাঁচার দরজা খোলা পাইয়া আইজ ফুড়ুত কইরা উড়াল দিয়া আসছে নিজের দুনিয়ায়। একদিকে সংসার চালাবার দুশ্চিন্তা কাইটা যাওয়া, ঘরের বউ দিছে এতগুলি টাকা, আইজ থিকা শুরু করবো দান বাওয়ার কাম, নতুন স্বপ্ন যখন চোখে মাত্র লাগছে তখনই বিরাট এক আনন্দ নিয়া যেন আসলো নূরজাহান। আবদুলের মনটা খুবই ভাল হয়ে গেল। বলল, তুই একলা একলা নাও বাইয়া কেমতে আইলি বইন?
ছটফটা গলায় ঘটনা বলল নূরজাহান। এই বাড়ি থেকে গাওয়াল বাড়ি যাবে, সেই বাড়ি থেকে যাবে মিয়াবাড়ি। সবার লগে দেখা করে যাবে মেন্দাবাড়ি। সেই বাড়ি থেকে বাবারে লইয়া যাইবো নিজেগো বাইত্তে।
খুশি আনন্দে ফেটে পড়া গলায় নূরজাহান যখন কথা বলছিল, এত সুন্দর লাগছিল মেয়েটাকে। যেন শ্রাবণ মাসের মেঘলা সকালবেলাটা হঠাৎ করেই রোদে ভরে গেছে। টাকা হাতে নিয়া ঘরে ঢুকল সে। পিরনের জেবে টাকা ভরে, সেই পিরন কান্দে ফালাইয়া ঘর থিকা বাইর হইল। মাজায় বানলো গামছা। আলালদ্দিকে বলল, ল বাজান। আমার লগে বাজারে ল। কাম আছে। একলা এত কাম আমি পারুম না।
বাজারে যাওয়ার কথা শুইনা আলালদ্দি বেদম খুশি। বাজারে গেলেই দুই-চাইর আনার লেবেনচুষ (লজেন্স) বিসকুট এইসব কিন্না দেয় বাবায়। ওইসব জিনিস খাইতে যে কী মজা! বাড়িতে আইসা ভাইবইনের কাছে গল্প করে। সেই গল্প শুইনা বারেক আর আসুরা বড়ভাইয়ের সৌভাগ্যে ভিতরে ভিতরে হিংসায় জ্বলে। আসুরা এতকিছু বোঝে না, বারেক কিছুটা বোঝে। সে একটু বড় হয়েছে। আজ বাবার মনমেজাজ ভাল দেখে তার একটা হাত ধরল বারেক। ঘ্যানঘ্যানা গলায় বলল, ও বাবা, আমিও বাজারে যামু। তুমি খালি দাদারে বাজারে লইয়া যাও। আইজ আমিও যামু।
আবদুল কিছুই ভাবল না। সরল গলায় বলল, আইচ্ছা ল।
শুনে এমন একটা লাফ দিল বারেক। যেন আজকের আগে এত খুশি জীবনে কোনওদিন সে হয় নাই। দুই ভাইয়ের আনন্দ দেখে আসুরাও তখন ঘ্যানঘ্যান করছে। বাবা, ও বাবা বাজারে যামু।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবদুল বলল, মাইয়ারা বাজারে যায় না মা।
ক্যা যায় না, বাবা?
হেইডা তুমি ডাঙ্গর অইলে বুজবা।
আমি কবে ডাঙ্গর অমু?
আর বেশিদিন না মা। এইত্তো দুই-চাইর বচ্ছর পরই অইয়া যাইবা।
তয় আমার লেইগা আইজ লেবেনচুষ আর বিসকুট লইয়াইয়ো বাবা।
আইচ্ছা মা, আনুম নে।
দুই পোলা নিয়া নৌকায় উঠতে উঠতে মাজেদাকে আবদুল বলল, এতদিন বাদে নূরজাহান বইনে আইছে আমগো বাইত্তে, আলালদ্দির মা, আমার বইনরে ভাল কইরা খাতিনদারি (আপ্যায়ন) করো। মুড়ি মিডাই দেও অরে, খাউক।
আবদুলের নৌকা সড়কপার ধরে মাওয়ার দিকে যায়, একবার সেই দিকে তাকিয়ে নূরজাহান ছটফটা গলায় বলল, তছি বুজি কো? অরে দিহি দেহি না? ফুবু আম্মায় কো? তারা কেঐ বাইত্তে নাই?
টিনের থালে একথাল মুড়ি আর একটুকরা খাজুরা মিঠাই এনে নূরজাহানের হাতে দিল মাজেদা। নে খা।
অহন আবার কী খামু? বাইত থনে খাইয়াঐত্তো বাইর অইছি।
তাও খা। তর দাদায় কইয়া গেল খাতিনদারি করতো। আমি তরে খাতিনদারি করলাম।
একমুঠ মুড়ি মুখে দিল নূরজাহান। এক কামড় মিঠাই খেল। ও ভাবিছাব, কইলা না?
মাজেদা বলল, দুইজনেঐ বাইত্তে আছে।
কো?
রোয়াইলতলার ছাপরা ঘরটা দেখাল মাজেদা। ওই ঘরে।
অহনতরি ওইঘরে কী করে? ঘুম থিকা ওডে নাই?
আসুরা আবার তার টোফাটোফি (মাটির খেলনা হাঁড়ি পাতিল) লইয়া আগের জায়গায় খেলতে বসে গেছে। একবার সেইদিকে তাকিয়ে মাজেদা বলল, আমার হরি উটছে। পাগলনি ওডে নাই।
আবদুলের পাশে ওটার উপর যেখানে বসেছিল মাজেদা আবার সেই জায়গাটায় বসল। তার দেখাদেখি নূরজাহানও বসল। পাগলনি যহন ওডে নাই তয় ওই ঘরে ফুবু করে কী?
ও তুই তো ঘটনা কিছু জানচ না।
নূরজাহান অবাক হল। কী অইছে?
পাগলনি তো অহন অন্যপদের পাগলামি ধরছে।
কোন পদের?
হারাদিন কেঁতার তলে হুইয়া থাকে। ঘরেতথন বাইর অয় না। বাইর অয় রাইত্রে। অর দিন অইয়া গেছে রাইত, রাইত অইয়া গেছে দিন। দিনের বেক (বেবাক) কাম করে রাইত্রে আর রাইত্রের কাম করে দিনে।
কও কী?
হ। আমার হরি হারাদিন বইয়া থাকে পাগলনির শিথানে।
তয় ফুবুর খানদাওন আর অন্য কাম কাইজ?
ফাঁকে ফাঁকে করে।
এইডা তো দেহি আজব কারবার।
হ। এইপদের পাগল জিন্দেগিতে দেহি নাই। ও আরেকখান কারবারও তো অইছে।
কী?
কয়দিন পর পর পাগলনি খালি নাইড়া অয়।
হায় হায় কও কী?
হ। পাগলনির মাথায় অহন চুল নাই। মাথা নাইড়া।
নূরজাহান উঠে দাঁড়াল। থালের মুড়ি অর্ধেকের মতন খাওয়া হয়েছে, মিঠাইও প্রায় শেষ। একমুঠ মুড়ি মুখে দিয়া সে বলল, ভাবি, আমি ইট্টু ওই ঘর মিহি যাই। ইট্টু দেইক্কাহি ফুবু কেমতে বইয়া রইছে, পাগলনি কেমতে ঘুমাইতাছে।
মাজেদাও উঠল। আইচ্ছা যা। তয় চুপ্নে চুল্পে যাইস। পাগলনি য্যান উদিস না পায়।
আইচ্ছা।
বিলাইয়ের মতন নরম পায়ে রোয়াইলতলার ছাপরা ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল নূরজাহান। একমুঠ মুড়ি মুখে দিল, একটুখানি মিঠাই মুখে দিল। ঘরের ঝাঁপ আলগা করে রাখা। রোদ আজ উঠেই নাই। পদ্মার ঘোলা পানির মতন আলো চারদিকে। সেই আলোয় ঝাঁপের ফাঁক দিয়া ঘরের ভিতর উঁকি দিল নূরজাহান। মুখে মুড়ি আছে, একটা-দুইটা চাবান দিয়া মুড়ি মাত্র গিলতে যাবে, দেখে রোয়াইলতলার ছাপরা ঘরের মেঝেতে লাশের মতন সিধা হইয়া শুইয়া রইছে তছি পাগলনি। পাও থিকা মাথা তরি ছিড়াভিড়া কাঁথা দিয়া ঢাকা। তার মুখ বরাবর আঁপের দিকে মুখ দিয়া বইসা আছে তছির মা। কাঁথার ভিতর থেকে একখান হাত বাইর কইরা মা’র একখান হাত ধইরা রাখছে তছি। ধরার ভঙ্গি দেইখা বুঝা যায়, সে ঘুমাইয়া আছে দেইখা মায় যে তারে ফাঁকি দিয়া ঘর থিকা বাইর হইব সেই পথ নাই। তছি উদিস পাইয়া যাইবো।
কয়েক পলক দৃশ্যটা দেখল নূরজাহান, দেখে বুকটা মোচড় দিয়া উঠল তার। আহা রে, আল্লায় যে ক্যান মাইষেরে পাগল বানাইয়া দুইন্নাইতে পাঠায়!
.
চশমার ভিতর দেলোয়ারার চোখ দেখা যাচ্ছে গোরুর চোখের মতন।
সেই চোখে পলক পড়ছে না, একটুও কাঁপছে না চোখ। মুখটা একটুখানি হা হয়েছে। তিনি তাকিয়ে আছেন দবিরের দিকে। হাতে চায়ের কাপ। দবিরের হাতেও চায়ের কাপ। দবির তার কাপে কয়েকটা চুমুক দিয়েছে। দেলোয়ারাও দিয়েছেন, তবে দবিরের চেয়ে কম। তিনি চা খান খুবই ধীর ভঙ্গিতে।
দবির কথা শুরু করেছিল একটু আগ থেকে। ল্যাংড়া বসির কেমন করে তার বাড়িতে এল, কেমন করে তাকে নিয়া গেল মাওয়ার বাজারে তারপর রসগোল্লা চা সিগ্রেট খাওয়াল, নানারকম কথার প্যাঁচ খেলাতে খেলাতে নূরজাহানের জন্য বিয়ার পাত্রের কথা বলল। পাত্রের নাম শুনে দবির যেমন কাইপা উঠছিল দেলরা বুজিও প্রায় তেমন করেই কাপলেন। হাতে চায়ের কাপ না থাকলে অভ্যাস মতন চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতেন। হাতে চায়ের কাপ থাকায়, হাতের কাছে কাপ নামিয়ে রাখার জায়গা না থাকায় কাজটা তিনি। করতে পারলেন না। স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
দবির তখন চক সাঁতরাইয়া কেমন কইরা বাড়িতে ফিরছে সেই কথা বলছিল।
রাবি আর এই দিকটায় আসে নাই। রানঘরে বইসাই বাদলার ধরা শিংমাছ কুটছে, ঘরের কোনায় রাখা থানইটার উপর রাইখা কোটা মাছ ঘষছে। চুলার ভাতে বলক আসছে, শো শো একখান আওয়াজ হচ্ছিল। মশলা আগেই বাটা হয়ে গেছে। পিয়াজ বাটা, কাঁচা মরিচ বাটা এইসব কাজও শেষ। এখন অন্য চুলায় তরকারি চড়াবে। তেলের বোতলও হাতের কাছেই।
এইসব কাজের ফাঁকে দুই-একবার ঘর থেকে বের হয় রাবি। আইজ হয় নাই দবিরের জন্য। মান্নান মাওলানার লগে ওই কারবারটা করার পর নূরজাহান দবির এদেরকে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না সে। দেলরা বুজির কথায় দবিরের জন্যও চা বানাইতে হইছে, এই রাগে মুখ থমথমা হইয়া আছে তার। রান্ধনঘর থেকে আর বাইরই হয় নাই। রান্ধনঘরের ওটায় বসে অনেকক্ষণ ধইরা পোকাশিংয়ের কাতা খাওয়া জায়গায় বিষকাটালির ডাটা ছাট ছাট কইরা পিটাইছে। তাতে বেদনা কমছে কি কমে নাই কে কইবো। বাদলা চলে গেছে মোতালেবদের সীমানায়। সেখানে গিয়া কবুতর দেখতাছে।
বাদলা চলে যাওয়ার পর দেলরা বুজির চেয়ারের সামনে, ফিরিতে বইসা চায়ে চুমুক দিয়া কথা শুরু করার আগে একবার বাদলার ফেলে যাওয়া বিষকাটালির দিকে তাকায়া ভিতরে ভিতরে একটু ধাক্কা মতন খাইছে দবির। আরে, এইডি তো বিষকাডালি না! বিষকাডালির মতন দেখতে অন্য একপদের আগাছা। হেইডাঐত্তো কই, এই দিনে গিরস্তবাড়ির নামায় বিষকাডালি আইবো কই থিকা। বিষকাডালি হয় বাইষ্যাকাল শেষ অওনের পর, যহন চকমাঠ থিকা পানি নাইম্মা যায়। খাল পুকইর পার জাইগা ওঠে, তখন ভিজা নরম মাডিতে নানান পদের আগাছা কুগাছার লগে বিষকাডালি জন্মায়। অন্য সময় বিষকাডালি বিচড়াইয়া পাওন মুশকিল। বাইষ্যাকালে তো বিরাট মুশকিল।
তয় দবির ক্যান বিষকাড়ালির কথা কইছিল বাদলারে? রাবিরে খুশি করার লেইগা। রাবিরে খুশি করনের কাম কী দবিরের? রাবি হইল দেলরা বুজির বাড়িতে থাকে। কামের বেটি। অরে এত খাতির কীর লেইগা করতে হইব?
আসলে দবির চায় দেশগ্রামের বেবাক মানুষ তারে আর নূরজাহানরে ভাল জানুক। হুজুরের লগে নূরজাহান যে অন্যায় করছে সেইটা পোলাপানের নাদানি মনে করুক বেবাকতে! রাবি হইল হুজুরের বিরাট ভক্ত। রাবিও যদি নূরজাহানের কারবারটারে নাদানি মনে করে সেইটাও দবিরের এক রকম শান্তি!
তয় বাদলার কারবারটা আজব। কোন আগাছা কুগাছা দিয়া পোকাশিংয়ের কাতা খাওয়া জায়গা ছাটাছাট পিটাইয়া ব্যথা বেদনা দূর কইরা অহন কইতর দেখতে গেছে মোতালেবগো সীমানায়!
নিমতলা থেকে বড়ঘরের বারান্দা অনেকখানি দূর। সেখানে চৌকিতে কাঁথা মুড়া দিয়া পইড়া আছে মতলা। দবিরের কথা শুইনা দেলরা বুজি যখন মাটির মতন থির হইয়া আছেন তখন মতলার গলা শোনা গেল। বাদলার মা, ও বাদলার মা। এই মিহি ইট্টু আহো! আমার জ্বরডা ইট্টু দেইক্কা দে। মনে অয় বেদম জ্বর আইছে।
রাবি রান্নঘর থেকে চিৎকার করে বলল, আমি অহন আইতে পারুম না। আমার কাম আছে।
মতলা নিয়ারার (অনুনয়ের) গলায় বলল, ইট্টু আহো। ইট্টু জ্বরডা দেহো আমার।
রাবি আগের মতনই তেজি গলায় বলল, কইলাম যে পারুম না। তর ওই ঘোড়ার আন্ডার জ্বর দেহনের কিছু নাই। গোলামের পোয় আমার জানডা খাইয়া হালাইলো।
এবার চায়ে চুমুক দিলেন দেলোয়ারা। পর পর দুই তিন চুমুকে চা শেষ করে কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখতে গেলেন, হাত বাড়িয়ে দবির কাপটা নিল। আমারে দেন বুজি। আমি রানঘরে দিয়াহি।
দেলোয়ারা কথা বললেন না, চিন্তিত ভঙ্গিতে কাপটা দবিরের হাতে দিলেন। চোখ থেকে চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে কাঁচ মুছতে লাগলেন। দবির তার আর দেলরা বুজির কাপ নিয়া রানঘরের দিকে চলে গেল। যেরকম দৌড় দিয়া গেল তেমন দৌড় দিয়াই ফিরত আসল। আইসা দেখে দেলরা বুজি আগের মতনই চিন্তিত চোখে চশমার কাঁচ মুচছেন। দবির এক পলক দেলরা বুজিকে দেখে বলল, আমি ইট্টু হাফেজ দাদার ঘর থিকা আহি বুজি।
চোখে চশমা পরে দেলরা বললেন, ক্যা?
তামুক খামু।
তামুকের লেইগা ওই ঘরে যাবি ক্যা? মতলারঐত্তো উক্কা তামুক আছে। রাবিরে ক, দিবো নে।
দবির আমতা গলায় বলল, রাবিরে কইতে ভাল্লাগে না বুজি। রাবি আমারে দেকলেই জানি কেমুন করে!
হ হেইডা আমি দেকতাছি। রাবি অইলো মান্নান মাওলানার বিরাট ভক্ত। তর মাইয়ায় ওই কামডা করনের পর থিকা তরে আর তর মাইয়ারে দেকতে পারে না রাবি। ছেমড়ির সবাবই এমুন। একবার কেঐর উপরে চেতলে সহজে ঠান্ডা অয় না। মোতালেইব্বার উপরে বাদলার লেইগা চেতছিল, বাদলার লগে মোতালেইব্বার ঠিকঐ খাতির অইছে, ছেমড়া হারাদিন আছে মোতালেইব্বার পিছে পিছে, রাবি মোতালেইব্বারে দেকতে পারে না। এনামুল অরে মজজিদ বাড়ির মাডি উড়ানের কাম দিছে এইডাও রাবি পছন্দ করে নাই। ছেমড়িডা কেমুন জানি। দেকতাছস না, মতলা ডাক পাড়তাছে আর ও কেমুন করতাছে। জামাইরে বইক্কা আন্দার করতাছে।
হ। এই ডরেঐত্তো উক্কা তামুক চাইতে পারতাছি না।
খাড়া আমি ব্যবস্থা করতাছি।
দেলোয়ারা গম্ভীর গলায় ডাকলেন, রাবি।
রাবি লগে লগে জব দিল। কন বুজি।
এই মিহি আয়।
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বাইর হইয়া আসল রাবি। চুলার পারে বইসা আছিল দেইখা মুখে গলায় চিকচিক করছে ঘাম। থমথমা মুখে দুনিয়ার বিরক্তি। একবার দবিরের দিকে তাকায়া দেলোয়ারাকে বলল, কীর লেইগা ডাক পাড়েন?
দেলোয়ারা শীতল গলায় বললেন, তর কথাবার্তায় আমি বহুত বিরক্ত হইতাছি।
ক্যা কী করছি আমি?
গলা একটু চইড়া গেছিল রাবির। দেলোয়ারা গম্ভীর মুখে রাবির চোখের দিকে তাকালেন। গলা নিচা কইরা কথা ক।
রাবি থতমত খেল। জে।
দবির এই বাইত্তে আহনের পর থিকা আমি কইলাম তর বেক কিছু খ্যাল করছি। তুই আমার চের আইন্না দেচ নাই, চা বানাইতে কইছি হের লেইগা নানান পদের তাল করছস। মতলা ডাক পাড়ে তুই ত্যাজ দেহাইয়া বকাবাজ্জি করলি, আমি কইলাম বেক কিছু বুজতাছি। তুই জানচ আমি বহুত নরম মানুষ। তয় চেতলে খবর আছে। তর পোলার লেইগা মোতালেইব্বারে কেমুন বকা বকছিলাম হেইডা কইলাম ভুইল্লা যাই না। আমারে চেতাইস না। গেরামের বেবাক মানুষ আমগো কাছে আহে। আমরা মানুষ পছন্দ করি দেইক্কা আহে। দবির আমগো বহুত পুরানা মানুষ। তুই তো হেদিন আইছস আমগো বাইত্তে, দবিররা আহে ছোডকাল থিকা। নূরজাহানের লগে মাওলানা সাবের কী অইছে না অইছে ওইডা আমরা বুজুম, ওইডা কইলাম তর বোজনের ব্যাপার না। আইজ আমি তরে খুবই নরম কইরা এই হগল কথা কইলাম। আর য্যান কোনওদিন কইতে না অয়। ত্যাজ দেহাবি, বাইত থিকা বাইর কইরা দিমু। দেশগেরামে চউরাগো আকাল নাই। অহন কইলে বিয়ালের মইদ্যে বউ পোলাপান লইয়া অন্য চউরা আইবো আমগো বাইত্তে।
দেলরা বুজি ওইভাবে কথা বলবেন এতটা আশা করে নাই রাবি। সে একদম নিভা গেল। যেন নাড়ার আগুনে আথকা ঠিলা ভরা পানি ঢাইলা দিছে কেঐ। রাবি একটা ঢোক গিলল। কোনওরকমে বলল, আমি, আমি কী করছি বুজি? আপনে খালি খালি আমারে বকতাছেন।
দেলোয়ারা আগের মতনই গম্ভীর গলায় বললেন, আমারে দিয়া আর প্যাচাইল পারাইচ। দুইন্নাহিদারি তর থিকা আমি কম বুজি না। যা কইলাম হেইডা করবি। অহন যা দবিরের লেইগা তামুক সাজাইয়া আন। আর দবির আইজ দোফরে আমগো বাইত্তে ভাত খাইবো ব্যবস্থা কর। যা।
এমন ভয় অনেকদিন পায় নাই রাবি, সে প্রায় দৌড়াইয়া চইলা গেল। আর দবির কোনওরকমে বলল, ভাত খাওনের কাম নাই বুজি। আপনে খালি আমার মাইয়াডারে রক্ষা করেন। আমার মাইয়াডারে দয়া করেন।
তুই চুপচাপ বয়। তামুক খা। আমি কথাবার্তা কই। দেহি কী করন যায়।
বিশাল এক আশায় দবিরের তখন বুক ভরে গেছে। আল্লাহ আল্লাহ! আল্লাহয় রহম করতাছে। দেলরা বুজিরের দিয়া আল্লায়ই নূরজাহানরে ওই জালেমের হাত থিকা বাঁচাইবো।
চারদিককার মেঘলা দিন তখন যেন একটুখানি আলোকিত হয়েছে।
.
গাওয়াল বাড়িতে ঢুকে নূরজাহানের মনে হল, এইটা সেই বাড়ি না। এইটা য্যান অন্য বাড়ি। আজিজ গাওয়ালের বাড়ি মনে কইরা সে বুঝি অন্য কোনও বাড়িতে ঢুইকা গেছে। যেই বাড়ি এলাগেন্দা পোলাপানের চিল্লাচিল্লিতে ভরা আছিলো সেই বাড়িতে কোনও আওয়াজই নাই। হামেদ যে আথকা আথকা গলা ছাইড়া গান গাইয়া উঠতো, আব্বাসউদ্দিনের গান, আবদুল আলিমের গান, খালেক দেওয়ান মালেক দেওয়ানের গান, কই গেল সেইসব গান! হামেদের গলার একটা গান বহুত ভাল লাগত নূরজাহানের। আব্বাসউদ্দিনের গান।
আমায় এত রাইতে ক্যানে ডাক দিলি
প্রাণ কোকিলারে!
কই গেছে সেইসব গান! এতডি পোলাপান থাকনের পরও বাড়ি এমুন নিটাল অইয়া রইছে ক্যা?
হাজামবাড়ি থেকে বাইর হইয়া, হাজামবাড়ি আর গাওয়ালবাড়ির মাঝখানকার পুকুর পাড়ি দিয়া বাড়ির পুবদিক দিয়া গাওয়াল বাড়িতে উঠছে নূরজাহান। এই দিকটায় হাতের বাঁয়ে এনামুলদের ছাড়া বাড়ির জোড়া হিজলগাছ। তারপর গাওয়াল বাড়ির বেঁকা আমগাছটা। ওই আমগাছের লগে কোষা ভিড়াইছে নূরজাহান। তখনও বাড়ির কারও কোনও আওয়াজ নাই। পুরা বাড়ি নিটাল। নূরজাহানের প্রথমে মনে হইছে বাড়িতে বুঝি লোকজনই নাই। আত্মীয় বাড়ি বেড়াইতে গেছে। ভাইবা মনটা একটু খারাপও হইছে। আহা এতদিন পর বাড়িত থিকা বাইর হইছে, এত উৎসাহ নিয়া এই বাড়ি ওই বাড়ি যাইবো, বেবাকতের লগে দেখা সাক্ষাৎ করবো, গাওয়াল বাড়িতে আইসা সেই আশাটা পূরণ হইলো না।
উঠানের দিকে আসতে আসতে সেই চিন্তা বদলাইয়া গেল। আরে, বাড়িতে তো দেখি বেবাকতেই আছে। ওই যে বানেছা আম্মায় রান্ধনঘরে রানতে বইছে, ছোট বইনটারে কোলে লইয়া বাড়ির পশ্চিম দিককার জামগাছতলায় দাঁড়াইয়া রইছে পরি। নাদের আর হামেদ বড়ঘর থেকে মাত্র বাইর হইল, দুইজনেরই পরনে লুঙ্গি আর লম্বা সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় সাদা গোল টুপি। দুই ভাইয়ের বুকের কাছে ধরা রেহালের কায়দা সিপারা (আরবি বর্ণমালার বই)। বাড়ির ঘাটে বান্দা ডিঙ্গি নৌকার দিকে যাচ্ছে দুই ভাই, নূরজাহানকে দেখে যতটা অবাক হওয়ার কথা ততটা অবাক তারা হল না। নাদের কোনও কথাই বলল না, নৌকায় উইঠা বইঠা নিয়া বসল পাছার চারটে। হামেদ নৌকায় চড়তে চড়তে হাসিমুখে বলল, এতদিন বাদে কই থিকা আইলা নূরজাহান ফুবু? তোমারে বলে বাইত থনে বাইর অইতে দেয় না?
নূরজাহান হাসল। আইজ দিছে। না দিলে তগো বাইত্তে আইলাম কেমতে?
হ হেইডা তো ঠিকই।
তয় তরা যাচ কই?
মাদরাসায় যাই।
নূরজাহান অবাক। মাদরাসায়?
হ।
কোন মাদরাসায়?
আমগো গেরামে কয়ডা মাদরাসা? একটাঐ। আমিন মুনশির মাদরাসা।
নাদের একটা ধাক্কা দিল হামেদরে। খালি আমিন মুনশি কচ ক্যা হামেদ? ক, আমিন মুনশি সাবের মাদরাসা।
হ আমিন মুনশি সাবের মাদরাসা।
নূরজাহান বলল, তরা অহন মাদরাসায় পড়চনি?
হ।
কবে থিকা?
বাইষ্যাকালের আগে থিকাঐ।
নাদের তাড়া দিল হামেদরে। এত প্যাচাইল পারিচ না হামেদ। তাড়াতাড়ি উট। আইজ কইলাম বাইত থনে বাইর অইতে দেরি অইয়া গেছে।
হামেদ আর কথা বলল না, লাফ দিয়া নৌকায় উঠল। আগার চারটে বইসা রেহাল যত্ন কইরা রাখল নাওয়ের পাটাতনে তারপর ছোট বইঠা হাতে নিল। পাছার চারট থেকে সোজা পুবমুখী নৌকা চালালো নাদের, আগার চারটে বইসা সামনের দিকে বইঠা বাইতে লাগল হামেদ। দুই ভাইয়ের বইঠার টানে ডিঙ্গি নৌকা তরতর কইরা আমিন মুনশির মাদরাসার দিকে আগাতে লাগল।
নূরজাহান তখনও বাড়ির ঘাটে দাঁড়ায়া আছে। দৃশ্যটা তার বিশ্বাসই হইতাছে না। নাদের হামেদ পড়তে যায় মাদরাসায়! কয় কী! এই বাড়ির মানুষ এমুন বদলাইয়া গেছে কবে?
উঠান পার হইয়া জামতলায় দাঁড়ানো পরির পিছনে আইসা দাঁড়াইল নূরজাহান। মাত্র ডাক দিবে পরিকে, নূরজাহানের পায়ের শব্দে তার দিকে মুখ ফিরাল পরি। নূরজাহানকে দেখে অতিকায় অবাক হল। আনন্দে ফেটে পড়া গলায় বলল, নূরজাহান ফুপু, তুমি আইলা কুনসুম? কার লগে আইলা?
নূরজাহান রহস্যের গলায় বলল, কেঐর লগে আহি নাই।
তয়?
তয় আবার কী? একলাঐ আইছি।
যাহ্।
হ। বিশ্বাস না অইলে ওই যে দেক আমতলায় আমগো কোষানাও।
তুমি একলা একলা বাইত থিকা নাও বাইয়া আইছো?
হ।
যাহ্।
সত্যঐ।
গাছিদাদায় আর দাদি তোমারে একলা একলা বাইর অইতে দিল?
নূরজাহান আবার সেই রহস্যের হাসিটা হাসল। হ দিল। আর কতদিন বাইত্তে আটকাইয়া রাখবো, ক।
তারপরও নূরজাহানের কথা বিশ্বাস করল না পরি। হাসল। না, তুমি আমার লগে মিছাকথা কইতাছো। গাছিদাদায় মনে হয় এই মিহি কোনও বাইত্তে আইছে, তার লগে তুমিও আইছো। গাছিদাদায় গেছে কোনও বাইত্তে আর তুমি আইছো আমগো বাইত্তে।
পরির বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হল নূরজাহান। তুই বহুত চালাক রে পরি। একদম ঠিক কথাডা কইছস। আমি বাবার লগেই আইছি। বাবায় গেছে মেন্দাবাড়ি, আমি হাজামবাড়ি ঘুইরা তগো বাইত্তে আইলাম।
তারপরই যেন পরিকে খেয়াল করে দেখল নূরজাহান। নাদের হামেদের মতন পরিও অনেক বদলাইয়া গেছে। লম্বা কামিজ আর সেলোয়ার পরছে। বুক এখনও ভাল কইরা ওঠে নাই, তাও ওড়না পরছে। কীরকম একটা পরহেজগার পরহেজগার ভাব। এই বাড়িটা এমুন হইয়া গেছে কবে? গাওয়াল দাদায় কই জানি গেছিল গা। অনেকদিন বাদে ফিরত আইয়া বাড়িঘর আর সংসারের মানুষজন বদলাইয়া ফালাইছে। নাদের-হামেদ মাদরাসায় পড়ে, পরির ভাব অন্যরকম, বাড়িতে কোনও চিল্লাচিল্লি নাই। বানেছা আম্মায় চুপচাপ রানঘরে বইয়া রানতাছে। গাওয়াল দাদায় কো? হেয় কি গাওয়ালি ছাইড়া দিছেনি?
এইসব কথা কীভাবে জানবে নূরজাহান?
তারপরই আর একটা কথা মনে হল নূরজাহানের। সে নাইলে বাইত থিকা বাইর অয় নাই আইজ সাত-আষ্ট মাস, বাবায় তো বাইর অইছে। তার লগে তো গাওয়াল দাদার দেহা। অইছে। গাওয়াল দাদার বাড়িঘর সংসার মানুষজন বেবাক যে বদলাইয়া গেছে এইডা কি বাবায় জানে না? জানলে নূরজাহানরে কয় নাই ক্যা?
নাকি নূরজাহানের মতন দবিরও জানে না গাওয়ালবাড়ির খবর?
পরির দিকে তাকায়া এইসব কথা ভাবছে নূরজাহান, পরির কোলে জরি ঘ্যানঘ্যানা গলায় বলল, মা’র কাছে যামু বুজি। আমারে মা’র কাছে দিয়াহো।
পরি বলল, মায় রানতাছে। অহন মার কাছে যাইতে পারবি না।
তয় তুমি আমারে নামায় দেও। আমি রান্দনবাড়ন খেলুম।
আইচ্ছা যা খেল গা। তয় পানিপুনির মিহি (পানিটানির দিকে) যাইতে পারবি না। উডানে বইয়া খেলবি। আমার চোকের সামনে।
আইচ্ছা।
পরির কোল থেকে নাইমা বড়ঘরে গিয়া ঢুকল জরি। নিজের মাটির টোফাটাফি নিয়া ঘরের ছেমায় বসে চুপচাপ খেলতে লাগল। এই ফাঁকে কী কাজে একবার বড়ঘরে আসল বানেছা। নূরজাহানকে দেখে হাসল। নরম শান্তগলায় বলল, কী লো নূরজাহান, তুই আইলি কুনসুম? কার লগে আইলি?
বলল নূরজাহান।
শুনে বানেছা বলল, বহুতদিন বাদে তরে দেকলাম। তুই অনেক ডাঙ্গর অইয়া গেছস। তয় অহন ইট্টু সাইমজা সুইমজা (বুঝেশুনে) চলিস বইন। নমজ পরিছ, আল্লাহ খোদার নাম লইছ।
নূরজাহান কথা বলতে পারল না। ফ্যালফ্যাল কইরা বানেছার মুখের দিকে তাকায়া রইল। মনে মনে বলল, ভাবিছাবে কয় কী! খাড়েদজ্জাল বইলা দেশগেরামে যে পরিচিত সে এমুন মুলাম কইরা কথা কয়! নমজ পড়তে কয়, আল্লাহ খোদার নাম লইতে কয়! কবে কেমতে এমুন বদলান বদলাইছে ভাবিছাবে! ছনুফুবুরে একওক্ত খাইতে দেয় নাই, দুর দুর কইরা বাড়িত থিকা বাইর কইরা দিত, মুখে যা আসে তাই কইয়া বকাবাজি করতো, মাইর। ধইরও দিত, হেই বানেছা এমুন অইয়া গেছে কেমতে, আঁ!
বড়ঘরের কাজ সাইরা রান্নঘরের দিকে যাইতে যাইতে বানেছা বলল, এতদিন বাদে আমগো বাইত্তে আইছস, দুফইরা ভাত খাইয়া যাইচ। তর গাওয়াল দাদায়ও বাইত্তে আছে। আমরা বেবাকতে একলগে বইয়া খামুনে। ইলশামাছ রানছি। অহন কিছু খাবি? উরুম (মুড়ি) দিমু?
নূরজাহানের হতভম্ব ভাব তখনও কাটে নাই। কোনওরকমে বলল, না ভাবিছাব। হাজামবাড়ি থিকা একথাল মুড়ি মিডাই খাইয়া আইছি। বিয়ানে বাইত্তে একবার খাইছি। এত খাইলে পেট ফাইট্টা মইরা যামু।
তয় দুইরা ভাত কইলাম খাইয়াই যাবি।
নাগো ভাবিছাব, দোফরে আমি আইজ ভাতই খামু না। রাইত্রের আগে আর কিছু খামু না। আপনেগো বাড়ি থিকা মিয়াবাড়ি যামু। বাবায় গেছে মেন্দাবাড়ি। শেষমেশ মেন্দাবাড়ি থিকা বাবারে লইয়া বাইত্তে যামু।
আমি কোনও কথা হুনুম না। তুই এতদিন বাদে আমগো বাইত্তে আইছস, দুইরা ভাত না খাইয়া তরে আমি যাইতে দিমু না। নাদের-হামেদ মাদরাসা থিকা পইড়া আইবো, তর গাওয়াল দাদায় আমার হরির ঘর থিকা বাইর অইবো, হেতক্ষণে (ততক্ষণে) আমার রান্দনবাড়ন নাওন ধোন বেবাক অইয়া যাইবো। তারবাদে জহুর নমজ পইড়া খাইতে বমু আমরা। তুই কইলাম যাবি না। পরির লগে গল্প কর।
বানেছা আর দাঁড়াল না, রানঘরে গিয়া ঢুকল। সেই ঘরের দিক থিকা এলাইচ শাক বাগাড় দেওয়ার ছিরছির একটা শব্দ আসল, তেল মশলার গন্ধ আসল।
নূরজাহান পরির দিকে তাকাল। এইসব নিয়া কথা তুলবো, পরি হাসল। তুমি অবাক অইতাছো না, নূরজাহান ফুবু? আমগো বাড়ির এই অবস্থা দেইক্কা অবাক অইতাছো না?
হ। আমার তো বেক কিছুই নতুন লাগতাছে। তরে মনে অইতাছে নতুন মানুষ, নাদের হামেদরে মনে অইছে, অহন মনে অইলো ভাবিছাবরে। তগো বাড়ির উঠানে খাড়াইয়া মনে অইতাছে এইডা তগো বাড়ি না, এইডা অন্য বাড়ি। আমি য্যান ভুল কইরা অন্য বাড়িতে আইয়া পড়ছি। আর তরা য্যান তরা না, তরা য্যান অন্য মানুষ।
হ আমরা অহন অন্য মানুষ। দাদি মইরা যাওনের পর, বাবায় দেশান্তরী অইয়া যাওনের পর, আবার ফিরত আহনের পর আমগো দীন দুনিয়া বাড়িঘর বেবাক বদলাইয়া গেছে। বাবায় বেবাক কিছু বদলাইয়া হালাইছে। মা’রে তুমি আগে দেখছো না? খাড়ে দজ্জাল আছিলো। হেই মা’য় অহন মাড়ির মানুষ। মুখে রাওশব্দ নাই। জোরে কথা কয় না। কেঐরে বকা দেয় না। বাবায় যুদি কয় অহন দিন, মা’য় কয় দিন। বাবায় যুদি কয় রাইত, মা’য় কয়, হ অহন রাইত। পাঁচওক্ত নমজ পড়ে। আমরা বেবাকতেই নমজ পড়ি। বাবার লগে পড়ে নাদের-হামেদ, মা’র লগে পড়ি আমি। জরি অহনও পড়তে পারে না। তাও আমগো লগে নমজে খাড়ায়।
একটু থামল পরি। তারপর বলল, নাদের-হামেদরে মাদরাসায় দিছে বাবায়। দুই ভাইরে কোরানে হাফেজ বানাইবো। হামেদ আগে গান গাইতো, অহন আর গানের নাম লয় না। তয় গলার আওজ সুন্দর দেইখা বাবায় অরে আয়জান (আজান) দেওন হিগাইছে। জহুর নমজের আগেঐ বাইত্তে আইবো অরা। আইয়াঐ অজু কইরা আয়জান দিব হামেদ। তারপর তিন বাপে-পুতে নমজ পড়বো দাদির ঘরে। আমি আর মা’য় পড়ম বড়ঘরে। নমজ শেষ কইরা বেবাকতে মিলা খাইতে বমু।
নূরজাহান আথকা বলল, তর বাপে অহন গাওয়াল করে না?
করে। তয় রোজ করে না। যেদিন ইচ্ছা অয় করে, যেদিন ইচ্ছা অয় না, করে না।
হারাদিন বাইত্তে বইয়া থাকে?
হ।
বাইত্তে বইয়া কী করে?
দাদির ঘরে বইয়া থাকে। ওই ঘরে দাদি যেহেনে হুইতো, যেহেনে হুইয়া মইরা গেছে ওহেনে একহান নতুন মোগলা (হোগলা) কিন্না আইন্না বিছাইয়া রাখছে। বাইত্তে থাকলে ওই গোগলায় বইয়া দোয়া দরুদ পড়ে, নমজের সময় অইলে নমজ পড়ে। কোনও কোনও রাইত্রে হারারাইত বইয়া থাকে ওই ঘরে। দোয়া দরুদ পড়ে আর কান্দে। মা’য়ও গিয়া বইয়া থাকে বাবার লগে। দাদি আর আমার ওই বইনডা মইরা গিয়া আমগো দুনিয়াদারি বদলাইয়া দিছে।
গাওয়াল দাদায় অহন কো? গাওয়ালে গেছে নি?
না, দাদির ঘরে।
দাদায় গাওয়াল না করলে তগো সংসার চলে কেমতে?
ক্যা? আমগো তো কোনও অভাব নাই। ধানের জমিন আছে না? ওই জমিনের ধান খাইয়াও তো ম্যালা ধান বেচন যায়। বহুত ইরি অয় আমগো খেতে। ধান বেচা বহুত টেকা থাকে ঘরে। চাউল আর টেকা থাকলে সংসার চলতে অসুবিধা কী? বাবায় তো কয়দিন ধইরা কইতাছে আর গাওয়াল করবো না। গাওয়াল অইলো মানুষ ঠকানের কারবার। মানুষ ঠকানের কারবার হেয় করবো না। আগে আমগো জমিনডি বরগা দেওয়া থাকতো। ইবার থিকা আর বরগা দিবো না। নিজেই কামলা লইয়া চুইবো (চষবে)। নিজেঐ গিরস্তি কইরা সংসার চালাইবো। আরেকখান নৌকা কিনবো। একখান নৌকায় আমগো অয় না। নাদের-হামেদ মাদরাসায় যায়। নৌকা লইয়া। বাবায় যুদি কোনওদিন বাজারে যায় তয় অসুবিদা অয়।
আজিজ গাওয়ালের সংসারের এই চেহারা দেখে আর পরির মুখে সব শুনে মনটা অন্যরকম হয়ে গেল নূরজাহানের। এই বাড়ির সেই মানুষটির কথা মনে পড়ল। ছনুবুড়ি। আহা কত কষ্ট পাইয়া মরছে। বেঁকা শরীর নিয়া দুইটা ভাতের আশায় এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘুইরা বেড়াইছে। মিছাকথা কইছে, কূটনামি করছে, একমুঠ ভাতের লেইগা বউর বকাবাজি তো খাইছেই, মাইর তরি খাইছে। পেডের জ্বালায় টুকটাক চুরি করছে। আহা রে! আইজ আজিজ গাওয়াল যেমুন বদলাইছে, বানেছারে যেমুন বদলাইয়া ফালাইছে, এই বদলানটা যুদি তহন বদলাইতো তাইলে কি আর ছনুবুড়ির ওই দশা অইতো। চুন্নি বদলাম লইয়া কি মরণ লাগতো?
বহুদিন পর আজ ছনুবুড়ির কথা ভেবে বুকটা হু হু করে উঠল নূরজাহানের। এই যে এখন গাওয়াল দাদায় মা’র ঘরে বইয়া মা’র লেইগা দোয়া দরুদ পড়ে আর কান্দে, আহারে এই কান্দন যুদি আগে থিকা কানতো? আগে থিকা যুদি মা’র মুখের মিহি ইট্ট চাইতো? বানেছারে যুদি ইট্টু শাসন করতো! মা’য় থাকতে মা’র কথাটা ক্যান ভাবলো না সে! অহন হারা জীবন কাইন্দা কি আর মা’রে ফিরত পাইবো?
পরি বলল, বাবায় আরেকখান নাও কিনতে যাইবো দিগলির আডে। কাইল দিগলির আড, কাইলঐ যাইবো।
নূরজাহান বলল, গাওয়াল না করলে আরেকখান নাও দিয়া কী করবো?
খাইগোবাড়ি যাইবো।
ক্যা?
খাইগোবাড়ির মজজিদের হুজুরের কাছে যাইবো মোশলা (মাশায়েল, ধর্মের কথা) হুনতে। খাইগগাবাড়ির হুজুররে বাবায় খুব ভক্তি করে।
এসময় ছুনুবুড়ির ঘর থেকে বাইর হইয়া আসলো আজিজ গাওয়াল। তারে দেইখা। আরেকখান ধাক্কা খাইলো নূরজাহান। গাওয়াল দাদারে তো চিননই যায় না। গুড়মুড়া তরি লাম্বা পাঞ্জাবি ফিনছে, পাঞ্জাবির পায়ের কাছে অল্প একটু দেখা যায় সাদা লুঙ্গি। মাথায় সাদা গোল টুপি। গলা ছাড়ায় নামছে চাপদাড়ি। হাতে তসবি। ডানহাতে তসবি গুনছে আর বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। দেখে কেমন যে লাগল নূরজাহানের। মনে হল ছনুফুবুর ঘর থিকা য্যান মানুষ না একজন ফেরেশতা বাইর হইছে। কিছু না ভাইবা নূরজাহান আগাইয়া গিয়া আজিজ গাওয়ালের পায়ে হাত দিল। খুবই ভক্তিভরে কদমবুসি করল।
তসবিসহ হাতটা নূরজাহানের মাথায় রাখল আজিজ। গভীর মায়াবী গলায় বলল, আল্লায় তোমারে বাঁচাইয়া রাখুক বইন, আল্লায় তোমারে বাঁচাইয়া রাখুক। বহুতদিন বাদে তোমারে দেখলাম। ভাল আছো বইন?
আছি দাদা।
গাছিমামায় ভাল আছে? মামানি আম্মায়?
আছে দাদা, বেবাকতেই ভাল আছে।
নূরজাহান কীভাবে এতদিন পর বাড়ি থেকে বাইর হইল, কীভাবে কার লগে এই বাড়িতে আইলো, বেবাক কথা তার কাছ থেকে শুনল আজিজ। বানেছার মতনই বলল, দোফর অইয়া গেছে, ভাত না খাইয়া কইলাম আমগো বাইত থিকা যাইয়ো না বইন।
আইচ্ছা দাদা।
আবার নূরজাহানের মাথায় হাত রাখল আজিজ। তোমারে একখান কথা কই বইন?
কন দাদা, কন।
মা-বাপের লগে কোনওদিন খারাপ ব্যভার কইরো না। তুমি তো এক মা’র এক মাইয়া, এক বাপের এক মাইয়া। অহন মা-বাপ আছে অহন বুজবা না, তারা যহন না থাকবো তহন বুজবা মা-বাপ কী ধন। তহন কাইন্দাও কুল পাইবা না। আমার মা’য় বাঁইচ্চা থাকতে আমি বুজি নাই। মা’য় মইরা যাওনের পর অহন বুজি। বুইজ্জা দিনরাইত মা’র লেইগা কান্দি। কাইন্দা কী লাব কও? মা’রে তো আর ফিরত পামু না। আমার মা’য় তো আর কোনওদিন ফিরত আইবো না। এর লেইগাই কথাডা তোমারে কইলাম। মা-বাপের মনে কোনওদিন দুঃকু দিয়ো না, তারা ব্যাজার অয় এমুন কাম কইরো না। করলে আমার লাহান জীবনভর কানবা, তয় কাইন্দা কোনও লাব অইবো না।
নূরজাহান মাথা নিচা করে আজিজের কথা শুনছিল।
জহুরের ওক্তের আগে আগেই মাদরাসার পড়া শেষ করে ফিরা আসলো নাদের-হামেদ। নৌকা ঘাটে বাইন্দা দৌড়াইয়া বাড়িতে উঠল। কায়দা সিপারা রেহাল ঘরে রাইখা ঘাটপারে গিয়া অজু করল দুই ভাইয়ে তারপর বড়ঘরের পশ্চিম কোনায় দাঁড়ায়া দুই কানের দিকে দুই হাত তুলে মধুর স্বরে আজান দিতে লাগল হামেদ। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর…
আজিজ গাওয়ালের বাড়ির উঠানে দাঁড়ানো নূরজাহানের মনে হল সে যেন অন্য এক দুনিয়াতে আইসা পড়ছে। এই দুনিয়া য্যান মেদিনমণ্ডল গ্রাম না, এই দুনিয়া য্যান অচেনা অজানা পাকপবিত্র এক দুনিয়া। এই দুনিয়ায় য্যান একজনও খারাপ মানুষ নাই। এই দুনিয়ার সব মানুষই য্যান ফেরেশতার মতন। এই দুনিয়ায় য্যান লোভ লালসা হিংসা ক্রোধ কিছু নাই। এই দুনিয়া য্যান মান্নান মাওলানা নামের কেউ নাই। এই দুনিয়ায় য্যান আছে। শুধু মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের মতন সত্যিকার ধর্মপ্রাণ মানুষ, পরহেজগার মানুষ। এই দুনিয়া য্যান বেহেশতের একটা অংশ।
.
নিমতলার ওদিকটায় পায়চারি করতে করতে দেলোয়ারা হাসিমুখে বললেন, দবির, আমি চিন্তা কইরা দেখলাম, মাওলানা সাবে প্রস্তাবটা খারাপ দেয় নাই।
রান্নঘরের ওটায় বসে অনেকক্ষণ ধরে তামাক খাচ্ছিল দবির। দেলোয়ারার ঠান্ডাগলার কঠিন ধমক খাইয়া রাবি হঠাৎ কইরাই একদম বদলাইয়া গেল। তারপর থেকে ভাবটা এইরকম যেন দবির এই বাড়ির বিরাট আত্মীয়। অনেকদিন বাদে বেড়াইতে আসছে। বিরাট খাইখাতির তারে করন দরকার। সেই এই বাড়ির বান্দি আর দবির হইল বাড়ির মালিকের মেজবান। মেজবানরে যত রকম খাতিনদারি করন দরকার সবই তার করন দরকার। সেই মোতাবেক তারপর থেকে চলতে শুরু করল রাবি। রান্দনবাড়ন আগের মতনই চলছিল। এই ফাঁকে দবিরের জন্য এত সুন্দর কইরা তামাক সাজাইলো, আপনা স্বামী যে মতলা, মতলার জন্য জিন্দেগিতে এত যত্ন কইরা তামাক সাজায় নাই। কলকিতে তামাক ঠাইসা দিয়া, চিমটা দিয়া টিকা ধইরা একদম টকটকা লাল কইরা পোড়াইলে চুলার। আগুনে। কলকির ঠাসা তামাকে টিকা বসাইয়া হুঁকার মাথায় কলকিখান এত যত্ন কইরা লাগাইলো, লাগাইয়া দবিরের কাছে আইনা বিগলিত গলায় বলল, নেন গাছিদাদা, তামুক খান। অনেকহানি তামুক দিছি। ম্যালা সমায় ধইরা খাইতে পারবেন। ভাত সালুন রান্দনও অইয়া আইছে। তামুক খাইয়া নাইয়া আহেন। বাদলার বাপের বোয়া গামছা আছে। হেইডা দিমুনে। গামছা ফিন্দা লইয়েন। তারবাদে ভাত খান। ভাত খাওনের পর চা খাইতে চাইলে আবার চা বানাইয়া দিমুনে। সালুন কইলাম ভালই আছে আইজ। বাদলা যে শিংমাছ ধরছে। হেই শিংমাছ তো আছেঐ, এলাইচ শাকের লগে গজারটাকি রানছি, আমার রান কইলাম মন্দ না। খাইয়া আরাম পাইবেন।
মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে একজন মানুষ এইভাবে বদলাইয়া যাইতে পারে এমন। কারবার জিন্দেগিতে দেখে নাই দবির। ভিতরে ভিতরে খুবই হাসি পাইতাছিল তার, আবার অন্যদিকে শরমও করতাছিল। ইসসিরে, আমার লেইগা দেলরা বুজির কাছে ছ্যাচাড়া খাইলো রাবি! এক ছ্যাচায় সিদা অইয়া গেছে। এইডা একদিক দিয়া ভালঐ অইছে। এরবাদে দেলরা বুজির কাছে আইলে রাবি আর তেড়িবেড়ি করতে পারবো না। দবিররে লইয়া, নূরজাহানরে লইয়া আবল তাবল প্যাচাইল পাড়তে পারবো না। মান্নান মাওলানার যত বড় ভক্তই হউক, দেলরা বুজি আর দবিরের সামনে তার পক্ষ লইয়া কথা কইতে পারবো না।
রাবির অবস্থা দেখে দেলোয়ারা তখন ঠোঁট টিপা হাসছেন। চেয়ার ছাইড়া উঠছেন। নিমতলায় পায়চারি করার ফাঁকে চোখ থেকে চশমা খুইলা শাড়ির আঁচলে স্বভাব মতন মুচছেন।
আকাশে মেঘের খেলাটা সকাল থেকে চলছে। মেঘের ফাঁকে অতিকষ্টে দুয়েকবার সূর্য উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। সুবিধা তেমন করতে পারে নাই। একটুখানি রোদ উঠতে না উঠতেই মেঘ আইসা ঢাইকা দিছে। আবার বৃষ্টিও হইতাছে না। না মেঘবৃষ্টি না রোদ। গিরস্তবাড়ির তরিতরকারির আঁকার তলে খাড়া রোদের দিনেও বর্ষার পানির যে রং হয়, দিনের রংটা তেমন। শ্রাবণ মাসের গরমটাও তেমন নাই। ভাল রকম একটা আরামদায়ক ভাব আছে।
রান্নঘরের ওটায় বসে তামাক টানছে দবির, ঘরের ভিতর রান্দনবাড়নে ব্যস্ত রাবি। তারপরও অতি আন্তরিক ভঙ্গিতে দবিরের লগে কথা বলছিল সে। বলার ভাবটা এমন, যেন। জিন্দেগিতে কোনওদিন গাছির লগে খারাপ ব্যবহার সে করে নাই। মান্নান মাওলানার থিকা য্যান দবিরেরই সে বেশি ভক্ত। নূরজাহানের অন্যায় য্যান কোনও অন্যায়ই না।
বড় একটা খাদায় ভাত ঠিকনা দিয়া রাবি বলল, ও গাছিদাদা, এতদিন বাদে কী মনে কইরা এই বাইত্তে আইলেন? ওই যে হেইদিন, নূরজাহান যেদিন হুজুরের মুখে ছ্যাপ দিল, তারপর থিকা তো আপনেরে আর দেখলাম না। নূরজাহানরেও দেহি না। অরে বলে আপনে আর ভাবিছাবে বাইত থনে বাইর অইতে দেন না? হায় হায় এইডা একটা কথা অইলো। অতড়ু মাইয়া। না বুইজ্জা কাম একখান কইরা ফালাইছে, হুজুরে তো বুজছে, ও নাদান মাইয়া, হুজুরে অরে মাপ কইরা দিছে। হুজুরের পোলায়ও কিছু মনে করে নাই। তয় অরে আপনেরা বাইত্তে আটকাইয়া থুইছেন ক্যা? অহন আর ডর কী? অরে আর কে
কী কইবো?
রাবির এইসব কথায় এত হাসি পাইতাছিল দবিরের। হাসতে পারছিল না শরমে। নিমতলার ওদিক থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না দেলোয়ারা। তামাক টানতে টানতে দবির একবার দেলোয়ারার দিকে তাকাল। হুঁকা থেকে মুখ তুলে বলল, না আটকাইয়া থুই নাই তো! নূরজাহানরে তো আইজ আমার লগে লইয়াইছি।
এত অবাক যেন আজকের আগে জিন্দেগিতে হয় নাই রাবি এমন গলায় বলল, লগে লইয়াইছেন?
হ।
তয় কো নূরজাহান?
আমারে এই বাইত্তে নামায় দিয়া হাজামবাড়ি গেছে।
হাজাম বাইত্তে ভাত খাইবোনি?
আরে না।
তয়?
ভাত মনে অয় দোফরে ও আইজ খাইবোই না।
ক্যা?
এতদিন বাদে বাইত থনে বাইর অইছে। খুশিতে পেডভরা।
খুশিতে পেডভরা থাকলে তো কাম অয় না দাদা। পেডে যত খুশিই থাউক, ভাতটাও পেডে দিতে অয়। নাইলে খুশি আর খুশি থাকে না।
হ কথা ঠিক।
তয়?
দবির আবার দুই-তিন টান তামাক খাইলো। তয় হাজাম বাইত্তে ও বেশিক্ষণ থাকবো না। ওই বাইত থিকা যাইবো গাওয়াল বাইত্তে, তারবাদে যাইবো মিয়াবাড়ি।
এই বাইত্তে আইবো না?
আইবো।
কুনসুম?
হেইডা কইতে পারি না।
খাওনের ওক্ত অইয়া গেল। অরে ডাক দেন। আমগো বাইত্তে আহুক। এই বাইত্তে আইয়া ভাত খাউক। ভাত যা রানছি আপনে ছাড়া আরও তিনজনে খাইলেও টান পড়বো না। আর অরে ইট্টু দেহি। আহা রে, কতদিন ছেমড়িডারে দেহি না।
রাবির এইসব কথায় দবির একসময় টের পেল রাবির জন্য অদ্ভুত একটা মায়া লাগছে তার। স্বামী সন্তান নিয়া নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয়ে আছে। কোথাকার কোন মাতবরের চর থেকে ভাতের আশায় আত্মীয়স্বজন মা বাপ ভাইবোন ছাইড়া এই বাড়িতে আইসা পইড়া আছে। স্বামীটা আকাইম্মা, রাবি নিজে কামকাইজ কইরা স্বামীসন্তানের পেট চালায়, নিজের পেট চালায়। যখন দেশগ্রামের কোনও গিরস্তবাড়িতে কাম পায় না তখন খাওন দেয় দেলরা বুজি। থাকার জায়গা তো দিছেই। এই কারণেই নিজের পছন্দ অপছন্দ বইলাও কিছু নাই রাবির। কারও উপর রাগ ক্ষোভ থাকলে সেটাও প্রকাশ করতে পারে না। নিজের মেজাজ মরজি মতন চলতে পারে না। এই ধরনের মানুষের জীবন মানেই দুই মুঠ ভাত। দুই মুঠ ভাতের আশায় সব করতে হয় তাদের। ইচ্ছা স্বাধীন বইলা কিছু নাই।
ভাতের ফ্যান গালা শেষ করে রাবি বলল, নূরজাহান অহন কোন বাইত্তে আছে দাদা?
হেইডা তো কইতে পারি না।
দেহেন না কোন বাইত্তে আছে?
ক্যা?
ডাক দেন অরে। আপনের লগে বইয়া ভাত খাউক।
তামাক শেষ করে দবির বলল, আরে না। অরে লইয়া তুমি এত চিন্তা কইরো না বইন। ও অর মতন খাইবো নে। না খাইলেও অসুবিদা নাই। আমার নিজেরও খিদা নাই। আমি আইছিলাম দেলরা বুজির লগে ইট্ট কথা কইতে। কথা কইয়া যাইতাম গা। বুজি কইলো বইতে। তারবাদে আমারে কিছু কইলো না, তোমারে আথকা কইলো, দবির এই বাইত্তে দুফইরা ভাত খাইয়া যাইবো। হুইন্না আমি ইট্টু শরম পাইছি।
ফ্যানের খাদা একপাশে রাইখা, ভাতের হাঁড়ি আবার চুলায় রাখল রাবি। চুলায় এখন আর আগুন নাই। আগুন নিভা গেছে। ভাতের হাঁড়ির সরা সরাইয়া হাতা দিয়া ভাত একটু ওলট পালট করল রাবি। সেই ফাঁকে পাইজাম চাউলের গরম ভাতের ভারী সুন্দর একখান গন্ধ ছুটল। এই গন্ধে দবিরের মনে হল, দুনিয়ার সব থিকা সুন্দর গন্ধ হইল, সুবাস হইল ভাতের। ভাতের থিকা সুন্দর সুবাস আর কোনও কিছুর নাই।
তাকাম শেষ করে কলকি পরিষ্কার করল দবির। তামাক আর টিকা পোড়ার ছাই রান্ধনঘরে ঢুইকা চুলার মুখের দিকে ফালায় দিল। হুঁকার মাথায় কলকি বসাইয়া কাটা দাঁড় করাইয়া রাখলো রানঘরের বেড়ার লগে। দেখে রাবি বলল, হায় হায় আপনে এই হগল কাম করতাছেন ক্যা দাদা? আমারে দেন। আমি করতাছি।
নারে বইন, তুমি বহুত করছো। তোমারে আর কষ্ট দিতে চাই না। আমার লেইগা দেলরা বুজি তোমার লগে রাগ করল, হেতে আমি বহুত শরম পাইছি। আর শরম আমারে দিয়ো না।
আঁচলে মুখ মুছে হাসল রাবি। কী যে কন দাদা? এইডা কোনও রাগ অইলো নি? দেলরা বুজি আমারে আরও কত কিছু কয়? এই হগল আমার গায়ে লাগে না। তয় সেয় আমারে মহব্বতও করে। বেদম মহব্বত করে। আপনা বইনের লাহান মহব্বত করে। হাজেরবেলা রোজঐ বাদলারে পড়াইতে বহায়। বাদলার বাপরে কোনওদিন কিছু কয় না। যেয় এত মহব্বত করে সেয় কোনও কোনও সময় ইট্টু বকাবাজ্জি করলে কী অয়, কন?
এসময় আবার মতলার গলা ভাইসা আসলো। বাদলার মা, ও বাদলার মা। ইট্ট আহো। আমার বহুত জ্বর। জ্বরডা ইট্টু দেহো। মাথায় ইট্টু পানি দিয়া দেও।
এবার রাবি আর রাগ হইল না। মোলায়েম গলায় বলল, ইট্টু সবুর করো। আইতাছি।
রাবি বড়ঘরে ঢোকার পর নিমতলায় আসল দবির। তখনই কথাটা বললেন দেলোয়ারা। শুইনা থতমত খাইল দবির। যেন বুঝতে পারল না কথাটা। বলল, কী কইলেন বুজি?
দেলোয়ারা হাসলেন। না কইলাম, প্রস্তাব তো খারাপ দেয় নাই মাওলানা সাবে!
কন কী আপনে?
হ। এত টেকাপয়সার মালিক, জাগাজমিনের মালিক। তর মাইয়া এতডি রেডিমেড পোলাপান পাইবো, নাতি নাতকুড় পাইবো। টেকাপয়সা গয়নাগাটি কোনও কিছুর তো আকাল থাকবো না।
দেলোয়ারার ঠাট্টাটা বুঝল দরিব। বুঝে সেও হাসল। তয় কথা বলল না।
দেলোয়ারা বললেন, আগিলা দিনে তো এমুন অইতোই। সইত্তর বচ্ছইরা বেডা বিয়া করতে পোনরো-ষোল্লো বচ্ছরের মাইয়া। আমি একখান বই পড়ছিলাম, শরশ্চন্দ্রের দেবদাস। হেই বইতে পার্বতীর বিয়া অইছিল ওইরকম এক বুইড়ার লগে।
দবির বিনীত গলায় বলল, আইজকাইল তো আর হেইদিন নাই বুজি। আর মাওলানা সাবের উদ্দেশ্য তো আপনে মনেঅয় বুজছেন। হেয় তো আর বিয়ার লেইগা নূরজাহানরে বিয়া করতে চাইছে না। তার ঘটনা তো অন্য।
হ হেইডা আমি বুজছি। আমি তর লগে ইট্টু ফাইজলামি করলাম।
তারপরই গম্ভীর হয়ে গেলেন দেলোয়ারা। পায়চারি করতে করতেই চশমা খুললেন চোখ থেকে। কাঁচ মুছতে মুছতে বললেন, মাওলানা সাবে মানুষ সুবিদার হেইডা আমি জানি। খারাপ মানুষ। তয় এত খারাপ হেইডা বুজি নাই। নূরজাহান কামডা খারাপ করছিল। আরেক হিসাবে খারাপও করে নাই। পরে তো আমরা বেবাক কথাই হুনছি, বেবাক ঘটনাই বুজছি। হেয় ইচ্ছা কইরা মাকুন্দারে গোরুচোর সাজাইয়া পিডাইলো, জেলে দিলো। মাকুন্দার অন্যায়, ছনুবুড়ির জানাজায় আইছিলো। অনেকেই ঘটনা বুজছে, বুইজাও কথা কয় না, মাওলানা আর আতাহারের ডরে। নূরজাহান সইজ্য করতে না পাইরা ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিছিল। মান্নান মাওলানা অইলো ঠান্ডা মাথার শয়তান। ওই ঘটনা লইয়া গেরামের মাইনষে তারে বুজাইতে যাইবো, নূরজাহানরে মাপ কইরা দিতে কইবো এইডা হেয় আগেঐ বুজছিল। এর লেইগা কেঐ কিছু কওনের আগেঐ হেয় কইছে, নাদান মাইয়া, না বুইজ্জা কামডা করছে, আমি অরে মাপ কইরা দিলাম।
তয় মাপ তো হেয় করে নাই।
অহন তো হেইডাঐ দেকতাছি। বিয়া কইরা নূরজাহানের উপরে শোদ লইবো।
বিয়া না দিলে নানান ভাবে আমার জানডা খাইবো।
হ।
এর লেইগাঐ উপায় না দেইক্কা আমি আপনের কাছে আইছি বুজি।
হ হেইডা তো তুই কইলিঐ।
চশমা চোখে পরলেন দেলোয়ারা। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
দবির বলল, ওই ঘটনার পর নূরজাহানের ব্যাপারে আপনে কি মাওলানা সাবরে কোনওদিন কিছু কইছিলেন বুজি?
কইছিলাম।
কবে?
ঘটনার কয়দিন পরঐ।
কী কইলেন?
না আমগো বাইত্তে তো অহন হেয় ঘনঘন আহে। এনামুল মজজিদ বানাইবো…
হেইডা তো আমরা জানি।
একদিন আইছে। আমি খালি কথাডা উডাইছি, কয় কী, ওই কথাডা আর কইয়ো না বইন। নাদান মাইয়া, অহনও পোলাপান, না বুইজ্জা আকাম একখান করছে, আমি আল্লার খাশবান্দা, দিছি মাপ কইরা।
আর কিছু কইলো না?
না। ওই লাইনে আমারে আর যাইতে দিল না। মজজিদের কথা তুইল্লা কথা ঘুরাইয়া দিল।
আমরা মনে করছি আপনে আর এনামুল তারে বুজাইয়া শুনাইয়া মানাইছেন, য্যান আমার মাইয়ার কোনও ক্ষতি না করে।
হেইডা কইলাম একখান কথা কইয়া আমি তারে বুজাইছিলাম। এনামুলও একদিন আমার সামনেই কইছে।
দবির গভীর আগ্রহ নিয়া বলল, কী কইছিলেন বুজি? কইছিলাম, মাওলানা সাব ঘটনাডা আপনে মনে রাইখেন না, অর কোনও ক্ষতি কইরেন না।
হুইনা হেয় কী কইলো?
কইলো, আরে না রে বইন, তুমি পাগল অইছোনি? যারে মাপ কইরা দিছি তার অন্যাইয়ের কথা মনে রাখুম ক্যা?
আর এনামুল সাবে কী কইছিল?
এই কথাই কইছিল। আমিই এনামুলরে কইছিলাম, মাইয়াডারে লইয়া দবির আর দবিরের বউ বিরাট পেরেশানির মইদ্যে আছে। তুমি বাজান মাওলানা সাবরে ইট্টু বুজাও। এনামুলও কথা উড়ানের আগেঐ মাওলানা সাবে আমারে যেমনে থামাইয়া দিছিলো, এনামুলরেও থামাইয়া দিলো। আরে না না, ওই হগল আর কওন লাগবো না। ওই কথা আমি মনে রাখি নাই, ওই ছেমড়ির কোনও ক্ষতি আমি করুম না।
তয় অহন যে নূরজাহানরে বিয়া করতে চাইতাছে এইডা কী? এইডা কি আমার মাইয়ার ক্ষতি না?
ক্ষতিনি খালি। বিরাট ক্ষতি। তয় তরিকাড়া হেয় ভাল ধরছে।
কেমুন?
এই হগল লইয়া কথা কইতে গেলেই কইবো, আমি তো খারাপ কিছু করতে চাইতাছি না। আমগো ধর্মে চাইরখান বিয়া তরি জায়েজ। আতাহারের মা’য় মইরা গেছে, অহন তো আরেকখান বিয়া আমি করতেই পারি। এইডা তো কোনও অন্যাই না। নূরজাহানরে আমার পছন্দ অইছে এর লেইগা প্রস্তাব পাঠাইছি। আইজকাইল বিয়ার লেইগা মাইয়ার বাড়ি থিকা পোলারে যৌতুক দেয়, আমি উলটা মাইয়ারে যৌতুক দিমু। তুই কইলি ন্যাংড়া বসির কইছে তর বাইত্তে বড় ঘর উড়াইয়া দিবো, এক-দুইকানি জমিন তর মাইয়ার নামে লেইক্কা দিব।
হ। ন্যাংড়া তো কইলো।
এই কথার পর তারে তো কেঐ কিছু কইতে পারবো না। কইলে কইবো, আমার প্রস্তাব আমি দিছি, দবির যদি না মানে তয় তো কোনও কথা নাই। জোর কইরা তো অর মাইয়ারে আমি আর বিয়া করতে যাইতাছি না।
হ এই হগল সে কইবো। তয় ভিতরে ভিতরে খেইপা থাকবো আমার উপরে, নূরজাহানের উপরে। নূরজাহানের অন্য জাগায় বিয়া অইতাছে এই খবর পাইলেঐ বিয়া ভাঙ্গানি দিবো। নানান পদের ভেজাল করবো। কুফরি কালাম দিয়া আমার মাইয়ার বিয়া আটকাইয়া রাখবো। নূরজাহানরে অন্য জাগায় আমি বিয়াই দিতে পারুম না। শেষ তরি এমুন একখান কারবার করবো, তার কাছেঐ নূরজাহানকে আমার বিয়া দেওন লাগবো। আর যুদি বিয়া হেয় একবার নূরজাহানরে করতে পারে তয় কী যে অইবো হেইডা আমি চিন্তাও করতে পারি না বুজি।
দেলোয়ারা চেয়ারে বসলেন, হেইডা আমি বুজি। উটতে বইতে অর জানডা হেয় খাইয়া হালাইবো।
তার অর্থ হইলো মাওলানা সাবে যতদিন বাঁইচ্চা থাকবে ততদিন ভইরা আমার মাইয়াডার উপরে সে শোদ লইবো।
আমারও হেইডাঐ মনেঅয়।
দেলোয়ারার পায়ের কাছে ফিরিতে বইসা পড়ল দবির। আপনে আমারে বুদ্দি দেন বুজি। আমি অহন কী করুম? কেমতে আমার নূরজাহানরে তার হাত থিকা বাঁচামু?
তার আগে আমারে আরেকখান কথা ক। মাওলানা সাবে যে নূরজাহানরে বিয়া করতে চায়, এই কথা আর কে কে জানে?
আপনেরে লইয়া তিনজন মাইনষে জানে। আমি, মরনিবুজি আর আপনে।
তর বউ জানে না?
না। তারে কইলে তো কাইন্দা কাইট্টা বিনাস করবো।
হ। নূরজাহানরেও জানাইচ না।
না না। আপনেও কেঐরে কইয়েন না বুজি। ভিতরে ভিতরে চেষ্টা কইরা দেহেন কী করা যায়।
আমার তো একজনের লগে কথা কইতেই অইবো। এনামুলের লগে।
হ হেইডা তো কইবেন। অহন আপনে আর এনামুল সাবেই আমার ভরসা। আপনেরা দুইজনে চেষ্টা করলে মাওলানা সাবে ফিরবো।
তয় তুই একখান কাম কর দবির। গোপনে গোপনে পোলা দেকতে থাক। পছন্দ মতন পোলা পাইলে মাইয়া বিয়া দিয়া ফালা। বিয়া দিয়া ফালাইতে পারলে একবারে ঝামেলা শেষ।
হ এইডা আমিও চিন্তা করছি। তয় বুজি মাইয়ার বিয়ার লেইগা তো ঘটক ধরতে অয়। বইচ্ছারে তো ধরন যাইবো না।
আরে না না, ও তোর কাম করবো না। ও করবো মাওলানা সাবের কাম।
তয় ঘটক পামু কই? অন্য ঘটক ধরলে হেই খবরও মাওলানা সাবের কানে যাইবো। গোপনে ঘটকারে টেকা খাওয়াইয়া বিয়া ভাইঙ্গা দিবো, নাইলে উলটা তার লগে বিয়ার লেইগা বইচ্ছার লগে ওই ঘটকারেও লাগাইয়া দিবো।
হ এইডাও কথা। সব দিকেই বিপদ।
এই বিপদ থিকা আপনে আর এনামুল সাবে আমারে বাঁচাইতে পারেন। বুজি, বুজি গো, আমি আপনের পায় ধরি বুজি। আপনে আমার মাইয়াডারে বাঁচান।
দুই হাতে দেলোয়ারার পা ধরতে গেল দবির, চট কইরা পা সরাইয়া ফালাইলেন দেলোয়ারা। হায় হায় করচ কী দবির। পায় ধরন লাগবো না। আমি চেষ্টা করুম, আমি অবশ্যই চেষ্টা করুম। কয়দিনের মইদ্যেই এনামুল বাইত্তে আইবো। অরে আমি বুজাইয়া কমুনে। মাওলানা সাবরে ডাকমুনে বাইত্তে। তুই এত ঘাবড়াইচ না। দেহা যাউক কী অয়।
দেলোয়ারার পা ধরতে গিয়া চোখে পানি আইছে দবিরের। গাল বাইয়া নামনের আগেই সেই পানি সে এখন কান্দের গামছা দিয়া মুচতাছে। মতলার জ্বরজ্বারি দেইখা রাবি আসতেছিলো রান্নঘরের দিকে, দবিররে চোখ মুছতে দেইখা বড়ঘর আর রান্নঘরের মাঝখানে দাঁড়ায়া রইল। গছি কান্দে ক্যান, বোঝার চেষ্টা করল।
রাবিকে দেখে দেলোয়ারা বললেন, তর রান্দনবাড়ন হইছে রাবি?
রাবি বিনীত গলায় বলল, হ বুজি আইছে। বেবাক রেডি।
তয় দবিরের লেইগা ভাত বাড়।
আপনে খাইবেন না?
আমি পরে খামুনে। আগে দবির খাউক।
আইজ দিহি নাইলেন না? নাইয়া ধুইয়া খাইবেন?
আইজ আর নামু না। খালি হাত মুখ ধুমু, অজু করুম।
পানি আইন্না দিমু?
দবিরের ভাত দিয়া তারবাদে দে।
আইচ্ছা।
রাবি মাত্র রান্নঘরে ঢুকবো, হনহন করে হাঁইটা আসলে বাদলা। ভাত দেও মা। খিদা লাগছে।
ছেলের উপর চেইতা উঠতে গেল রাবি। দেলোয়ারার দিকে তাকায়া চেতল না। ঠান্ডা গলায় বলল, নাইয়া আয়। তরে আর গাছিদাদারে একলগে ভাত দিতাছি। যা বাজান। দেরি করি না।
.
দুপুরের পর একটুখানি রোদ উঠছে।
মিয়াবাড়ির উঠানে বেঁকা হইয়া পড়ছে সেই রোদ। উঠানের মাটি ভাল রকম শুকাইছে। বিলাইটা করছে কী, শুকনা মাটি পাইয়া বাচ্চাকাচ্চা লইয়া উঠানে আইসা নামছে। নিজে কাইত হইয়া শুইছে রোদে, বাচ্চাকাচ্চাগুলি তিড়িংতিড়িং কইরা লাফাইতাছে। একটা কাঠঠোকরা পাখি ঠক ঠুক করছে চালতাগাছে। এইটুকু ছাড়া আর কোথাও কোনও আওয়াজ নাই। ভাল কইরা কান পাতলে ঝিমমারা একখান আওয়াজ পাওয়া যায়। সেইটা পোকামাকড়ের ডাক, ঝিঁঝির ডাক। এই বাড়িতে যে তিনজন মানুষ আছে, বড়বুজান কুট্টি আর আলফু, বাড়িতে উঠার পরও নূরজাহানের তা মনে হল না। মনে হল এইটা একটা ছাড়াবাড়ি। এই বাড়িতে মানুষ থাকে না।
গাওয়াল বাড়ি থেকে বাইর হইয়া মিয়াবাড়ির পুবদিককার বড় আমগাছটার তলায় আসছে নূরজাহান। কোষানাওয়ের গুড়ার লগে চিকন একখান শিকল বান্দা আছে। এই শিকল দিয়া নৌকা বাইন্দা বাড়িতে উঠছে, উইঠা দেখে এই অবস্থা।
সে খুবই অবাক। এমুন নিটাল ক্যা বাড়ি? মানুষজন গেছে কই? বড়বুজানে নাইলে এই সমায় ঘুমায়, তার কোনও আওজ থাকে না। আর যে দুইজন মানুষ আছে? কুট্টি আর আলফু। কুট্টি এই সমায় রান্দনবাড়ন শেষ কইরা, নাইয়া ধুইয়া, খাইয়া দাইয়া দোতলা ঘরের বারিন্দায় বইসা মাথা উঁচড়ায় আর আলফু পশ্চিম ভিটির ঘরের ছেমায় বইসা বিড়ি টানে। তারা দুইজন গেল কই?
উঠানে একটু দাঁড়াইলো নূরজাহান। বিলাই আর বিলাইয়ের বাচ্চাগুলি দেখল। ইস কী সোন্দর হইছে এহেকখান বাচ্চা। কোনওটা ফকফকা সাদা, কোনওটা সাদা কালোয় মিশানো। কোনওটার রং শুকনা পাতার মতন। দেখলেই কুলে লইতে ইচ্ছা করে!
নূরজাহান সেইটা করে না। এতদিন পর এই বাড়িতে আসল, যার লগে দেখা করতে আসল, কুট্টি, কুট্টি গেল কই? আর আলফু!
নূরজাহান কি কুট্টিরে ডাক দিবো? কুট্টিবুজি, ও কুট্টিবুজি। কই গেলা?
নাকি আলফুরে ডাকবো। আলফুদাদা, ও আলফুদাদা। আরে কই গেলা গা তোমরা? কেঐরে দেহি বিচড়াইয়া পাই না।
কুট্টি কি ঘাটপারে গেছে থালবাসন ধুইতে? নাকি ঘরে হুইয়া ঘুমাইতাছে! আলফুও কি কোনও ঘরে হুইয়া রইছে?
বাড়ির প্রতিটা ঘরের দিকে তাকাল নূরজাহান। দোতলা ঘর ছাড়া প্রত্যেকটা ঘরের দুয়ারে বিরাট বিরাট তালা। রান্নঘরের দুয়ার খোলা। খোলা দুয়ার দিয়া ভিতরে উঁকি দিল নূরজাহান। না, এই ঘরে কুট্টি নাই। আলফুর তো রানঘরে থাকনের কথা না। সে থাকে। দোতলাঘরের বারান্দায়। কুট্টি থাকে বড়বুজানের পালঙ্কের পাশের মেঝেতে। এই ঘরের দুয়ার আবজানো। উঠান থেকে যে চার-পাঁচ ধাপের সিঁড়ি আছে দোতলা ঘরে উঠার, সেই সিঁড়ি ভাইঙ্গা উঠল নূরজাহান, আস্তে কইরা ঠেলা দিল দুয়ারে। দুয়ার খুইলা গেল।
না বারান্দায় কেউ নাই। আলফুর বিছনা বালিশ পশ্চিম দিককার বেড়ার কাছে গুছাইয়া রাখা। বারান্দার পর ভিতর দিককার দুয়ারটা খোলা। পা টিপা টিপা সেই দুয়ারের কাছে আইসা ভিতরে উঁকি দিল নূরজাহান। ভাবছিল পাটাতনের উপরে দেখবে পাটি বিছাইয়া কাইত হইয়া ঘুমাইতাছে কুট্টি। না, কুট্টি ঘরে নাই। পালঙ্কে শ্রাবণ মাসের এই গরমেও মোটা কাঁথায় পুরা শরীর ঢাইকা ঘুমাইতাছে বড়বুজানে। খালি তার পাকাবেলের মতন মাথাটা দেখা যায়। দুয়ারের দিকে পিঠ দিয়া শুইয়া আছে। মুখ দেখা যায় না।
নূরজাহান ভাল একটা চিন্তায় পড়ল। ঘটনা কী? কুট্টি আর আলফু গেল কই? নাও লইয়া দুইজনেই কোনও মিহি গেছেনি? ছাড়া বাইত্তে কোনও কামে যায় নাই তো? হেইডা গেলে তো আলফু যাইবো। কুট্টি যাইবো ক্যা?
মিয়াবাড়ির ডিঙ্গি নৌকাটা থাকে দক্ষিণ দিককার পুকুরঘাটে। দোতলা ঘর থেকে বাইর হইয়া ঘাটপারে আসল নূরজাহান। আরে, নাও তো দেহি ঘাটে বান্দা। খালি বান্দা না, শিকলের একমাথা পাছার দিককার গুড়ার লগে প্যাঁচ দেওয়া, অন্যমাথা ঘাটপারের হিজল গাছের লগে প্যাঁচ দিয়া তালা মারা।
তয়?
ভালরকম একটা চিন্তায় পড়ল নূরজাহান। এইরকম কারবার এই বাড়িতে কোনওদিন দেখে নাই সে। সাত-আষ্টমাসে মিয়াবাড়ি এমুন অইয়া গেল কেমতে? কুট্টি কো? আলফু কো? বড়বুজানে একলা ঘুমাইয়া রইছে দোতালা ঘরে। দিন দোফরে চোর ডাকাইত আইয়া যুদি নাও ভইরা বেবাক কিছু লইয়া যায়, কেউ উদিসও পাইবো না!
বাঁশঝাড়ের ওদিক দিয়া পশ্চিম ভিটির ঘরের ছাইছে কী মনে কইরা আসল নূরজাহান। চালতাগাছটা দিনরাইত আন্ধার কইরা রাখে জায়গাটা। সেখানে আইসা থতমত খাইলো সে। চালতাতলায় নাড়া বিছানো আছে অনেকখানি জায়গায়। য্যান যখন তখন ইচ্ছা করলে এখানে আইসা বসতে পারে কেউ, ইচ্ছা করলে শুইয়াও থাকতে পারে। সেই নাড়ার বিছানায় হাত-পা ছড়াইয়া অসহায় ভঙ্গিতে বইসা আছে কুট্টি। বইসা কানতাছে। চোখের পানিতে গাল গলা ভিজা আছে। তয় কান্দনের কোনও আওয়াজ নাই। দেইখা বুকটা এমুন মোচড় দিয়া উঠল নূরজাহানের। হায় হায় এহেনে বইয়া এমতে কানতাছে ক্যা কুট্টিবুজি? কী অইছে? একজন মানুষ আইসা যে একটুখানি দূরে দাঁড়াইছে, উদিসও পাইতাছে না।
কয়েক পলক কুট্টিরে দেখল নূরজাহান। আস্তে করে একখান কাশ (কাশি) দিল। লগে লগে চমকাইয়া উঠল কুট্টি। গালে গলায় যে চোখের পানি, খেয়াল করল না, মানুষটার দিকে তাকাল। সেই ফাঁকে উইঠা দাঁড়াইল। আঁচলে চোখ পুছতে পুছতে (মুছতে মুছতে) বলল, কী রে নূরজাহান, তুই আইলি কই থিকা?
নূরজাহানকে দেখে যতখানি অবাক হওয়ার কথা কুট্টির তার ধারকাছ দিয়াও গেল না। সে। যেন নূরজাহান প্রায়ই আসে এই বাড়িতে, আগে যেমন আসত। তারে দেইখা অবাক হওয়ার কী আছে! নূরজাহান যে সাত-আষ্ট মাস ধইরা আসে না, সেই কথা কুট্টির মনে নাই। আর এইরকম বাইষ্যাকালে একলা একলা কই থিকা কেমুন কইরা আসল সে এই কথাও তার মনে হয় না। নিজের কান্দন আর যেই দুঃখে সে কানতাছিল তাই নিয়া থাকল।
নূরজাহান বলল, আইলাম গাওয়াল বাইত থিকা।
ওই বাইত্তে আইছস কুনসুম?
কান্না শেষের নাক টানাটা টানল কুট্টি।
নূরজাহান বলল, ওই বাড়ির আগে আছিলাম হাজামবাড়ি। বিয়ানে বাবার লগে বাইর অইছি। বাবায় গেছে মেন্দাবাড়ি। এই বাড়ি থিকা আমিও মেন্দাবাড়ি যামু। তারবাদে বাবার লগে বাইত্তে যামু।
ও। তয় ল, উড়ান মিহি ল।
লও।
কুট্টির লগে উঠানে আসল নূরজাহান।
কুট্টি বলল, ভাত খাইছস?
হ।
কই খাইলি?
গাওয়াল বাইত্তে। কুট্টিবুজি, গাওয়াল বাইত্তে গিয়া তো আমি অটাস (অবাক) অইয়া গেছি।
ক্যা, বেবাক মানুষ বদলাইয়া গেছে দেইক্কা?
হ।
হাজামবাড়ি গিয়া অটাস অচ নাই?
হ তছি পাগলনির কথা হুইন্না, তছির মা’রে তছির শিথানে বইয়া থাকতে দেইক্কা আইছি।
আর এই বাইত্তে আইয়া আমারে দেইক্কা আইলি?
হ তুমি চাউলতাতলায় বইয়া কানতাছিলা ক্যা? কী অইছে তোমার?
কুট্টি কথা বলল না, নিয়াস ছাড়ল।
নূরজাহান বলল, তোমার মনের কষ্ট আমি জানি কুট্টিবুজি। মা-বাপে তোমারে বাইত্তে যাইতে দেয় না। বইনগো লগে দেহা করতে পারো না। একখান বিয়া অইছিল হেই বিয়া টিকে নাই…।
রান্নঘরে ঢুইকা দুইখান ফিরি নিয়া আসল কুট্টি। একটা নূরজাহানরে দিয়া আরেকটায় নিজে বসল। বয়।
নূরজাহান বসল। বইসা কুট্টির মুখের দিকে তাকায়া অবাক হল। মুখোন আগের মতন নাই কুট্টির। শরীরও আগের মতন নাই। মুখোন একটু গোলগাল হইছে, ভরা ভরা হইছে। একটু য্যান ফলসাও হইছে। আগের মতন কাহিল শরীর নাই। বেশ ভরভরাট, সুন্দর শরীর হইছে। অনেকক্ষণ ধইরা কানছে দেইখা চোখ দুইখান ভিজা ভিজা আর লাল। তারপরও কুট্টিরে খুব সুন্দর লাগতাছে। মনের মতন বিয়াশাদি হইলে যুবতী মাইয়ারা আথকা শরীর চেহারায় যেমন সুন্দর হইয়া যায়, কুট্টির চেহারা শরীর সেইরকম! এইরকম বদলান কবে বদলাইল কুট্টি? কেমনে বদলাইল? শরীর চেহারায় এত সুখী ভাব যে মাইয়ার সে আবার পুরা বাড়ি খালি ফালাইয়া চাউলতাতলায় বইসা এমুন কইরা কান্দে ক্যা? ঘটনা কী?
কুট্টি বলল, তরে বহুতদিন বাদে দেখলাম। তর খবর আমি বেবাকঐ জানি। গাছিমামায় মামি তরে বাইত থিকা বাইর অইতে দেয় না। মাওলানা সাব আর আতাহারের ডরে তুইও বাইত থিকা বাইর অচ না। আমার বহুতদিন ইচ্ছা করছে তগো বাইত্তে যাই, তরে ইট্টু দেইক্কাহি। যাইতে পারি নাই।
নূরজাহান বলল, কেমতে যাইবা? এই বাড়ি হালাইয়া তুমি কোনওহানে যাইতে পারোনি?
হ হেইডা ঠিক। তারপরও ইচ্ছা করলে যাইতে পারতাম।
কেমতে?
তারে বাইত্তে রাইখা।
তারেডা কেডা?
তুই বোজচ নাই?
না।
আলফু। আলফুরে রাইখা। তারে রাইখা যাইতে পারতাম। কইয়া যাইতাম হেয় য্যান বড়বুজানের মিহি খ্যাল রাখে। বড়বুজানে যুদি আমারে ডাক পাড়ে তয় য্যান কয় আমি এইমিহি ওইমিহি কোনও বাইত্তে গেছি।
তয় যাও নাই ক্যা?
লাল, ফুলা ফুলা চোখ তুইলা নূরজাহানের দিকে তাকাল কুট্টি। আমার ইচ্ছা করতাছে বেবাক কথা তরে কই।
কী কথা?
যেই কথা অহনতরি কেঐরে কই নাই। কোনওদিন কেঐরে কইতেও পারুম না।
নূরজাহান চিন্তিত চোখে কুট্টির চোখের দিকে তাকাল। তোমার কী অইছে কুট্টিবুজি?
হেইডাঐত্তো তরে কইতে চাই।
তয় কও।
কইতে শরম করে, আবার শরম করেও না। তর কাছে আমার আবার শরম কী? তয় একখান চিন্তা আছে।
কী চিন্তা?
তুই যুদি কেঐরে কইয়া দেচ। আর কথাডা যুদি কোনওদিন এই বাড়ির মাইনষের কানে যায়! বড়বুজানের কানে গেলে তেমুন ডর নাই। তারে আমি বুজাইতে পারুম। মাজারো বুজানের কানে গেলে আর উপায় নাই। আমারে হেয় বাইত থিকা বাইর কইরা দিবো। আর এই বাইত থিকা বাইর কইরা দিলে আমার কোনওহানে যাওনের জাগা থাকবো না।
কুট্টির চোখের দিকে অপলক চোখে তাকায়া নূরজাহান বলল, কইতে চাইলে আমারে তুমি কইতে পারো কুট্টিবুজি। মইরা গেলেও আমার পেড থিকা হেই কথা বাইর অইব না। কেঐরে কোনওদিন কমু না আমি।
সত্য?
সত্য।
আমি তরে বিশ্বাস করলাম বইন। আর আমার বুকহান ফাইট্টা যাইতাছে। তার কথা কেঐরে না কওন তরি বুক পাতলা অইবো না আমার। বুকের ভারে বুক ফাইট্টা মইরা যামু আমি।
নূরজাহান এদিক ওদিক তাকাল। বড়বুজানে ঘুমাইতাছে হেইডা আমি জানি। আলফু দাদায় কো? তুমি যে আমার লগে কথা কইবা হেই কথা যুদি আলফুদাদায় আথকা আইয়া হুইন্না হালায়?
না হুনবো না। হেয় নাই।
কই গেছে? নাও দিহি বাড়ির ঘাডে বান্ধা দেকলাম। বাড়ির ঘাডে নাও রাইখা হেয় গেছে কই?
একপলক নূরজাহানের চোখের দিকে তাকাল কুট্টি, চোখ দুইখান ছলছল কইরা উঠল তার। বলল, তারে লইয়াইতো আমার বেবাক কথা। তার লেইগাইতে কান্দি আমি।
কথাটা বুঝতে পারল না নূরজাহান। ক্যা, কী অইছে তার? তার লেইগা তুমি কান্দো ক্যা?
তুই বোজছ নাই?
এইবার ঘটনা বুইঝা গেল নূরজাহান। মাথা নাড়াইয়া বলল, মনে অয় ইডু ইট্টু বুজতাছি। তাও আমারে তুমি বেককথা বুঝাইয়া কও। আমি কোনওদিন কেরে কিছু কমু না। আগে কও আলফুদাদায় কো? বাইত্তে নাই, না কোনওহানে গেছে?
হ গেছে? চরে গেছে। মাতবরের চরে। তাগো বাইত্তে। বউ পোলাপানের কাছে। বহুতদিন আগে যাইতে চাইছে। আমার লেইগা যায় নাই। আমি তারে যাইতে কোনওদিন না করি নাই। তার যাওনের কথা হুনলেই আমার মন খারাপ অইতো, আমি ইট্ট কানতাম। হেইডা দেইক্কা হেয় যাওন বন্দ কইরা দিতো। বাইত্তে টেকাপয়সা পাডাইতো অন্য চউরাগো লগে। ইবার আর হেয় না যাইয়া পারে নাই। তার বউয়ে খবর দিছে, এতদিন অইয়া গেছে। হেয় যায় না, হেয় যুদি ইবার না যায় তয় তার বউঐ পোলাপান লইয়া এই বাইত্তে আইয়া উটবো। এইডা হুইন্না হেয় আমি দুইজনেঐ ডরাইয়া গেছি। তার বউ যুদি পোলাপান। লইয়া এই বাইত্তে একবার আইতে পারে তয় বেক ঘটনা হেই মাগি বুইজ্জা যাইবো। বিরাট কিলিংকার (কেলেঙ্কারি) অইয়া যাইবো। মাজরো বুজানের কানে যাইবো বেক কথা। আমারে আর তারে দুইজনরেঐ বাইত থনে খেদাইয়া দিবো। আলফুর তো কোনও অসুবিদা নাই। হেয় বউ পোলাপান লইয়া চরে যাইবো গা আর নাইলে আমগো দেশের কোনও গেরামে মতলা রাবিরা যেইভাবে আছে ওইভাবে থাকবো। তয় আমার উপায় অইবো কী? আমি যামু কই? আমার তো কোনও যাওনের জাগা নাই। আর এর থিকাও বড়কথা অইলো তারে ছাইড়া আমি থাকুম কেমতে? আইজ পাঁচদিন হেয় বাইত্তে নাই, তাতেঐত্তো আমি এই বাইত্তে টিকতে পারতাছি না। আমার খাইতে ভাল্লাগে না, নাইতে ভাল্লাগে না। রাইত্রে চোক্কের পাতা এক করতে পারি না। ঘুম আহেঐ না। এর থিকা বড় বিচ্ছেদ অইয়া গেলে আমি বাঁচুম কেমতে! এই হগল ভাইবা আমি তারে কইলাম, তুমি যাও। তয় সাত-আষ্ট দিনের বেশি দেরি কইরো না। তয় কইলাম এই বাইত্তে আমি আর টিকতে পারুম না। আমি কইলাম কানতে কানতে মইরা যামু।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল নূরজাহান। হেয় কী কইলো?
কইলো সাত-আষ্ট দিন, বড়জোর দশদিন, দশদিনের মইদ্যে আমি আমু। কেঐ আমারে বাইন্দাও রাকতে পারবো না।
তয় তুমি এত কান্দাকাটি আরম্ব করছো ক্যা? আইজ তো মাত্র পাঁচদিন। আর পাঁচদিন বাদে তো হেয় আইয়াঐ পড়বো।
হেইডা তো জানিঐ। তয় আমার যে মন মানে না বইন। আমি যে তারে ছাইড়া নাইতে খাইতে পারি না, ঘুমাইতে পারি না। আমার যে দিনরাইত বেককিছু আন্ধার লাগে। আমার যে খালি চাউলতাতলায় গিয়া বইয়া থাকতে ইচ্ছা করে। রাইত্রে যে দোতলা ঘরের মাঝখানকার দুয়ার খুইলা তার কাছে চইলা যাইতে ইচ্ছা করে।
বিলাইটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়া কখন যে দোতালা ঘরে চইলা গেছে কুট্টি আর নূরজাহান কেউ সেইটা দেখে নাই। কাঠঠোকরা পাখিটা ঠোকা বন্ধ করছে, ছাড়াবাড়ির মতন ঝিমমারা শব্দটা দুইজন মানুষের কথাবার্তায় ভাইঙা খানখান হইয়া গেছে।
কুট্টির কথায় নূরজাহানের আর কিছু বুঝতে বাকি নাই। পুরা ঘটনা বোঝার ফাঁকে তার খালি মনে হয় মাত্র সাত-আষ্ট মাসে এতকিছু কেমন কইরা ঘটলো। কাইল আর আইজ মিলা চাইরখান বাড়িতে সে গেছে। হালদারবাড়ি হাজামবাড়ি গাওয়ালবাড়ি আর মিয়াবাড়ি। সব বাড়ির মানুষই তো কিছু না কিছু বদলাইছে। মজনু সিগ্রেট ধরছে, পুরাপুরি পুরুষপোলা অইয়া গেছে। হাজামবাড়ির তছি পাগলনি ধরছে নতুন পাগলামি, গাওয়াল বাড়ির বেবাকতে গেছে মুশলি অইয়া আর মিয়াবাড়ির কুট্টি-আলফুর জীবনে ঘটছে পেরেম। পিরিতির কায়কারবার। আল্লার দুনিয়াতে এত তাড়াতাড়ি এত ঘটনা ঘটে!
নূরজাহান হঠাৎ কইরা কথা বদলাইল। দোফরে নাও থোও নাই কুট্টিবুজি, ভাতপানি খাও নাই?
না কিছু করি নাই। রানছি বাড়ছি ঠিকঐ। বড়বুজানরে খাওয়াইয়া ঘুম পাডাইছি। করছি সবই। খালি নিজের কামডি করি নাই। তরে কইলাম না, আমার কিছু ভাল্লাগে না। নাইতে খাইতে ঘুমাইতে আমার খালি তার কথা মনে হয়। আমার খালি তার লেইগা কান্দন আহে।
হেয় তো এই বাইত্তে ম্যালাদিন ধইরা। তয় এতদিনে কিছু হয় নাই, আথকা তার লগে এমুন খাতির তোমার হইলো কেমতে?
নূরজাহানের চোখের দিকে তাকাল কুট্টি। ধীরে ধীরে বেশ গুছাইয়া গাছাইয়া পুরা ঘটনা বলল। সেই যে জ্বরের রাইতে আলফুর কাছে সে গেল, তারপর দিনে দিনে কী থেকে কী। হয়ে গেল, শরীর মন সব দিয়া দিল আলফুরে, কিচ্ছু বাদ দিল না। সব বলল। ওই যে এক দুপুরে নাইয়া ধুইয়া আসনের পরও তারে পাথালি কুলে কইরা চাউলতাতলার নাড়ার বিছানায় নিয়া গেছিল আলফু, সেইসবও বলল। শুনতে শুনতে নূরজাহান নিজের শরীরে কীরকম একখান কাটা দেওয়া ভাব টের পাইল। মনটা কেমন যেন হয়ে গেল তার। একজন মানুষের কথা মনে পড়ল। সেই মানুষটার নাম মজনু। মজনুর কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হইয়া গেল সে।
ব্যাপারটা খেয়াল করল না কুট্টি। সে আছে তার নিজেরে নিয়া। বলল, আমার বিয়া হইছিলো। স্বামী সহবাস আমি করছি। তয় হেইডারে আমার কোনও ঘটনা মনে অয় নাই। স্বামী আমার লগে সহবাস করতে আইলে আমি রাগ অইতাম, বিরক্ত অইতাম। ভাল্লাগতো না আমার। আর স্বামীও বুড়া বেডা, আগের বউ আছে, পোলাপান আছে, হেয় বেশি আইতোও না আমার কাছে। আর তহন এইসব আমি তেমুন বুঝিও না। আমার তহন অন্য কোনও খিদা নাই। আমার তহন খালি পেডের খিদা। তিনওক্ত খাওন পাইলে আর কিছু লাগে না আমার। আলফুর লগে থাকনের পর আমি বুজলাম জিনিসটা কী? শইলের আনন্দ কী, মনের আনন্দ কী? দুইজন মানুষ দুইজন মানুষের লেইগা শরীল মন দুইদিক দিয়া পাগল না অইলে সহবাস সহবাস না। আমি সবকিছু মিলা তার লেইগা পাগল অইয়া গেছি। সে পাগল অইয়া গেছে আমার লেইগা। এর লেইগাঐ চরের বাড়িঘরে আর যায় নাই, বউ পোলাপানের কাছে যায় নাই। টেকাপয়সা পাডাইয়া নিজের দায়িত্ব পালন করছে। সে আছিলো আমারে লইয়া। নূরজাহানরে, আমার জীবনডা এমুন অইলো ক্যা রে বইন। পয়লা জীবনে পেডের কষ্ট, খিদার কষ্ট। বাপের বাইওে, জামাই বাইত্তে দুই বাইত্তেঐ ভাতের কষ্ট করছি। আল্লায় আমারে হেই জীবন থিকা মিয়াবাড়ির ঝিয়ের জীবন দিল, পেডের। খিদা আমার মিটলো। তারবাদে আবার কোন চক্করে হালাইলো আমারে। মনের মইদ্যে একজন মানুষের লেইগা আরেকপদের খিদা বানাইয়া দিল। শইলের মইদ্যে আরেকপদের খিদা বানাইয়া দিলো। হেই খিদার কষ্টে দিনরাইত চোক্কের পানিতে ভাসি আমি। আমার জীবনডা এমুন অইলো ক্যা?
কুট্টি আবার কাঁদতে লাগল।
নূরজাহান কী বলবে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কেমন কইরা সান্ত্বনা দিব কুট্টিরে, কেমন কইরা বুঝ দিব, বুঝতে পারে না। কুট্টির মুখে সব শুইনা সে গেছে হতবাক হইয়া। এইটা কেমুন কারবার হইছে। আলফু বিয়াতো বেডা, বউ পোলাপান আছে। কুট্টিরও একবার বিয়া হইছিল…
তারপরও কুট্টিরে সান্ত্বনা দিতে চাইল নূরজাহান। তোমার কথাবার্তা আমি বেবাকই বুজছি কুট্টিবুজি। আমিও তো ডাঙ্গর অইছি। এই হগল বুজি। তয় তুমি অস্থির অইছো বেশি। দশদিনের কথা কইয়া হেয় গেছে। আইজ পাঁচদিন আর পাঁচদিন বাদে সে আইয়া পড়বো। এই কয়ডা দিন তুমি সইজ্য করতে পারছে না। মাইয়াছেইলারা এত অস্থির অইলে কাম অয়? তুমি ইট্টু ধৈর্য ধরতে পারতাছো না। পাঁচটা দিন চোক্ষের পলকে কাইট্টা যাইবো।
আঁচলে চোখ পুছতে পুছতে কুট্টি বলল, তরে যে আমি কইলাম আমার মন মানে না।
মনরে বুজাও। দশটা দিন যে তুমি তারে ছাইড়া থাকতে পারতাছো না, যুদি কোনওদিন এমুন অয়, এক দুইমাস তারে ছাইড়া তোমার থাকন লাগবো তহন কী করবা?
হেইডা আমি জানি না বইন। আমার মনে অয় আমি তহন আর বাঁচুম না। আমি তহন মইরা যামু।
এবার হঠাৎ কইরা নূরজাহান তার বয়সের থিকা অনেক বেশি বড় হইয়া গেল। বয়স্ক মানুষের কায়দায় বলল, তোমারে দুই-চাইরহান অন্যপদের কথা জিগাই?
জিগা।
তুমি যে আলফুর লগে এই কারবারডা করলা, চিন্তা কইরা করছো?
কী চিন্তা করুম?
তার লগে তোমার বিয়া হইবো কি না? তার লগে তুমি সংসার করতে পারবা কি না?
না ভাবি নাই।
ক্যা?
এত কিছু ভাইবা ঘটনা ঘটে নাই। আথকা ঘইটা গেছে। ওই যে তার জ্বরের রাইতে তার কাছে গেলাম তারবাদে আস্তে আস্তে মায়া লাগলো। তারও মায়া লাগলো আমার লেইগা। আমি তার মনডা দেখলাম, সে দেখলো আমার মন। নিজের ভাত থিকা মাকুন্দা কাশেমরে চাউলতাতলায় বহাইয়া ভাত খাওয়াইলো সে, এইডা দেইক্কা আমি বুজছিলাম তার মনডা বহুত নুলাম। এমতে এমতে বেবাক কিছু অইয়া গেল।
বুজলাম। তয় শেষ তরি এই ঘটনা কই গিয়া শেষ অইবো হেইডা চিন্তা করো নাই?
কইরা কী করুম ক? আমি তো তার বউ পোলাপানের কথা জানি। জান্নাইত্তো গেছি তার কাছে।
সে তোমারে কিছু কয় নাই?
কী কইবো?
চরের বউ পোলাপান ছাইড়া সে তোমারে বিয়া করবো কি না? তোমারে লইয়া সংসার করবো কি না!
কইছে।
নূরজাহান অবাক। কইছে?
হ।
কী কইছে?
কইছে দুনিয়াদারির কেউ জানবো না, জানুম খালি হেয় আর আমি। আমরা গোপনে স্বামী ইসতিরির লাহান এই বাইত্তে জীবন কাড়ামু।
নূরজাহান থতমত খাইল। কেমতে?
অহন যেমতে কাড়াইতাছি।
এইডা তো কোনও না কোনওদিন মাইনষে জাইন্না হালাইবো।
জানলে জানবো।
তাইলে তো মাজারো বুজানে তোমগো দুইজনরেঐ বাইত থিকা খেদাইয়া দিবো।
তহন দুইজনে অন্য বাইত্তে গিয়া কাম লমু।
হেই বাইত্তে তো আর এই বাড়ির লাহান এক লগে তোমরা থাকতে পারবা না।
পারুম।
কেমতে?
দূরের গেরামে গিয়া কাম লইয়া পরিচয় দিমু আমরা স্বামী ইসতিরি।
এইডা যহন চরে আলফুর বউ পোলাপানে জানবো?
হেতোদিনে পোলাপান বড় অইয়া যাইবো আলফুর। বউ বুড়া অইয়া যাইবো। আলফু নিজেই তহন তাগো জানাইয়া দিবো যে আমারে বিয়া করছে। মলবি ডাইকা গোপনে আমরা বিয়া কইরা লমু।
তার আগে তো অন্য কারবারও ঘটতে পারে?
কী কারবার?
বড়বুজানের যা দশা, যহন তহন মইরা যাইবো হেয়। হেয় মইরা গেলে তোমারে আর আলফুরে এই বাইত্তে রাখবো মাজরো বুজানে? এইরকম জুয়ান মর্দ পুরুষপোলা আর মাইয়া ছেইলারে, যারা বউ জামাই না, তাগো কেঐ বাইত্তে রাখে?
না রাখে না। তয় এই বাড়ি তো মাজরো বুজানে আর হালাইয়া দিবো না। কেঐরে না কেঐরে এই বাইত্তে রাখবোই। আলফু আর আমি তার হাত পাও ধইরা কমু আমগোই থাকতে দেন বাইত্তে। আমরা আপনের এতদিনের পুরানা মানুষ। আমরা তো কোনও দোষ করি নাই। আর নাইলে বুজানরে কমু, আলফুর লগে আমারে বিয়া দিয়া দেন। মোসলমান পুরুষপোলারা চাইরডা বিয়া করতে পারে, আলফু নাইলে দুইডা করলো। এক বউ চরে, এক বউ এই বাইত্তে।
নূরজাহান হাসল। তুমি যে কী কও না কও কুট্টিবুজি। কথার কোনও আগামাথা নাই। তুমি মনেঅয় একদোম পাগল অইয়া গেছ!
কুট্টি নাক টাইনা বলল, হ রে বইন আমি আসলেই পাগল অইয়া গেছি। আমার মাথা একদোম বিগড়াইয়া গেছে। তয় একখান কথা তরে আমি কই, এইডা অইলো আসল কথা, দুনিয়ার কেঐ কোনওভাবেঐ আলফুর কাছ থিকা আমারে সরাইয়া রাখতে পারবো না। তার লেইগা দুনিয়ার বেবাক মানুষের হাতে পায়ে ধরতে রাজি আছি আমি, যা করতে অয়। করতে রাজি আছি। তাও তারে ছাইড়া আমি থাকুম না। খালি মওত ছাড়া তার কাছ থিকা কেঐ আমারে ফিরাইতে পারবো না।
দোতলা ঘরের মাঝখানকার কামরা থেকে বড়বুজানের গলা ভাইসা আসলো। কুট্টি ও কুট্টি। কই গেলি রে?
কুট্টি গলা উঁচা কইরা বলল, আমি রান্নঘরে।
বিয়াল অইয়া গেছে অহন রানঘরে কী করছ?
ডাহা মিছাকথা বলল কুট্টি। রাইতের খাওনদাওন ঠিক করি।
আইচ্ছা কর বইন, কর।
কুট্টি তারপর নূরজাহানের দিকে তাকাল, উইঠা দাঁড়াইল। গলা নিচা কইরা বলল, ল, আমরুজতলার মিহি যাই। এহেনে বইয়া কথা কইলে বুড়ি হোনবো। এমুন বুড়ার বুড়া। অইছে তাও কান ভাল আছে বুড়ির। গাছের পাতা পড়লে হেই আজও পায়।
ওরা দুইজন আমরুজতলায় আসল। এখান থেকে বড় আমগাছটার ওদিকে নূরজাহানদের কোষানাওটা দেখা যায়। ওই যে দুপুরের পর একটুখানি রোদ উঠছিল, কোন ফাঁকে সেই রোদ ঢাইকা দিছে বুলবুলি পাখির গায়ের রঙের মতন মেঘ। চারদিকে এখন ছায়া ছায়া ভাব। আমরুজতলায় ছায়াখান য্যান একটুখানি বেশি। এই ছায়ায় দাঁড়াইয়া নূরজাহান বলল, অহন আসল কথাডা তোমারে জিগাই কুট্টিবুজি। এই যে এইভাবে মিলামিশা করতাছো তোমরা, তোমার পেডে যুদি পোলাপান আইয়া পড়ে তহন কী করবা?
কুট্টি কিছুই ভাবল না। সরল গলায় বলল, কী আবার করুম, পোলাপান অয়ামু। তার আগে আলফুর কাছে বিয়া বইয়া যামু।
যুদি তোমার চিন্তাভাবনার মতন বেক কিছু না অয়, যুদি ভেজাল ভেজাল লাইগ্যা যায় তয় তো কিলিংকার অইবো। দেশগেরামের মাইনষে কইবো কী তোমারে? মান ইজ্জত তো থাকবো না। মাওলানা সাবে বিচার সালিশ বহাইয়া বিরাট গন্ডগোল করবো।
হ এইডা আমি চিন্তা করছি। তয় ওই হগল লইয়া কোনওই ডর নাই আমার। যহন উদিস পামু আমার পেট অইছে তার আগেঐ আলফুরে লইয়া খাইগো বাড়ির ইমাম হুজুরের কাছে গিয়া কমু আমগো বিয়া পড়াইয়া দেন। তহন তারে আর কমু না আমার পেট অইছে। তয় হুজুরে আমারে খারাপ মাইয়া মনে করতে পারে।
বড় আমগাছের উপর দিয়া আশমানের দিকে তাকাইল কুট্টি। আমার হতিনের ছোড় পোলাডার কথা আমার বহুত মনে অয় নূরজাহান। কালাকোলা ছোট্ট একহান পোলা। হারাদিন খালি গায়ে থাকতো। মাজায় কাইতানের লগে পিতলের এই এতডু একখান ঝুনঝুনি বান্ধা। বাড়ির এই মিহি ওই মিহি দৌড়াইতো আর মাজার ছোট্ট ঝুনঝুনি ঝুন ঝুন কইরা বাজতো। হেই আওজখান অহনও আমার কানে লাইগা রইছে। সমায় সমায় আওজখান আমি পাই। পোলাডা আমার বহুত বাধুক আছিলো। খুব আইতো আমার কাছে। আমার কুলে উটতো। হতিন মাগি একদিন মনে করলো পোলাডারে আমার বাধুক বানাইয়া অরে আমার আপনা পোলার লাহান বানানের মতলবে আছি আমি। আমার কুল থিকা পোলাডারে ছিনাইয়া লইয়া গেলো। আমার কাছে আর আইতেই দিতো না। মা’র কুল থিকা পোলাডা এমুন কইরা আমার মিহি চাইয়া থাকতো, নূরজাহান রে, বইন কী কমু তরে, পোলাড়ার লেইগা আমার কইলজাড়া পুইড়া যাইতো। আলফুর লগে সহবাসের সমায় আমার খালি মনে অয় আমার যুদি ওইরকম একখান পোলা অয় তয় ওর মাজায়ও কাইতানের লগে ছোট্ট একখান ঝুনঝুনি বাইন্দা দিমু আমি। আলফুর মতন দেখতে অইবো আমার পোলা। আলফু নানান কামে এই মিহি ওই মিহি থাকবো। পুরুষপোলারা তো হারাদিন আর বাইত্তে বইয়া থাকে না। আলফুও হারাদিন আমার চোক্কের সামনে থাকবো না, থাকবো পোলাড়া। সংসারের কাম কাইজের ফাঁকে, রান্দনবাড়ন নাওন ধোওন খাওন দাওনের ফাঁকে ফাঁকে আমি খালি আমার পোলার মুখহান দেহুম। ছোট্ট একহান আলফুরে দেহুম। রাইত্রে আমার পোলারে বুকে লইয়া ঘুমামু।
কুট্টির কথা শুনতে শুনতে আবার মজনুর কথা মনে হইল নূরজাহানের। কুট্টির যেমুন আলফুর লগে হইছে, মজনুর লগে যুদি অমুন হয় নূরজাহানের তয় কি সেও কুট্টির মতন এমুন পাগল হইবো। কুট্টি যা যা চায় সেও কি তা তা চাইবো?
কুট্টি খেয়াল করল না, শরীরের অনেক ভিতর থেকে পাগলকরা একখান শরম আইসা নূরজাহানের মুখ লাল কইরা দিল। দেলোয়ারাদের সীমানার মটকুরা গাছটার তলায় দাঁড়ায়া দবির ঠিক তখনই ডাক দিল নূরজাহানরে। নূরজাহান, ও নূরজাহান। তাড়াতাড়ি আয় মা। বিয়াল অইয়া গেছে। বাইত যাবি না!
কুট্টির দিকে তাকায়া ছটফট গলায় নূরজাহান বলল, উই যে বাবায় ডাক পাড়তাছে। আমি গেলাম।
দৌড়াইয়া বড় আমগাছটার তলায় গেল নূরজাহান। গাছের লগে প্যাঁচ দেওয়া শিকল খুইলা মেন্দাবাড়ির দিকে কোষানাও চালাইয়া দিল।