তৃতীয় কাণ্ড। তৃতীয় প্রপাঠক
প্রথম অনুবাক
মন্ত্র- অগ্নে তেজস্বিস্তেজস্বী ত্বং দেবেষু ভূয়াস্তেজস্বন্তং মামায়ুষ্মন্তং বচ্চন্তং মনুষ্যে কুরু দীক্ষায়ৈ চ ত্বা তপসর্শ তেজসে জুহোমি তেজোবিদসি তেজো মা মা হাসীন্মাহহং তেজো হাসিষং মা মাং তেজো হাসাদিৗজস্বিনোজস্বী ত্বং দেবে ভূয়া ওজস্বন্তং মামায়ুষ্মন্তং বচ্চস্বন্তং মনুষ্যেষু কুরু ব্ৰহ্মণশ্চ ত্বা ক্ষত্রস্য চ ওজসে জুহোমোজোবিদস্যোজো মা মা হাসীন্মাহহমোজ্যে হাসিষং মা মামোজো হাসীৎ সূর্য ভ্রাজস্বিন্ ভ্রাজস্বী ত্বং দেবেষু ভূয়া ভ্রাজস্বস্তং মামায়ুষ্মন্তং বচ্চস্বন্তং মনুষ্যেষু কুরু বায়োশ্চত্বাহপাং চ ভ্ৰাজসে জুহোমি সুবদিসি সুবৰ্মা মা হাসীন্মাহহং সুবহসিষং মা মাং সুবহাসীন্ময়ি মেধাং ময়ি প্রজাং ময্যগ্নিস্তেজা দধাতু ময়ি মেধাং ময়ি প্রজাং ময়ীন্দ্র ইন্দ্রিয়ং দধাতু ময়ি মেধা ময়ি প্রজাং ময়ি সূৰ্য্যো ভ্ৰাজো দধাতু ॥১॥
[সায়ণাচার্য বলেন–অতিগ্রাহ্যগতা মন্ত্রা প্রথমেসমুদীরিতাঃ। অর্থাৎ–এই অনুবাকে অতিগ্রাহ্যের মন্ত্ৰসমূহ কথিত হয়েছে]
মর্মার্থ- হে তেজস্বী অগ্নি! আপনি দেবগণের মধ্যে কান্তি ও বলযুক্ত। দীক্ষা ও তপস্যার তেজঃ লাভের নিমিত্ত হে আগ্নেয় অতিগ্রাহ্য! তোমার যাগ করছি (ত্বং জুহোমি)। এই হোমের দ্বারা আমার দীক্ষানিয়ম ও তপস্যা নির্বিঘ্নে সিদ্ধ হোক এটাই আমার অভিপ্রায়। হে অগ্নি! আপনি তেজোভিজ্ঞ অর্থাৎ তেজঃ-সম্পর্কিত বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। আপনার প্রসাদে তেজঃ যেন আমাকে কখনও ত্যাগ করে না। আমিও যেন কখনও তেজকে পরিত্যাগ না করি, সেই হেতু তেজঃও যেন আমাকে পরিত্যাগ না করে (মাং মা পরিত্যজুত)। হে ওজস্বী (তেজস্বী) অগ্নি! আপনি দেবগণের মধ্যে বলের হেতুভূত এবং ওজঃযুক্ত (ওজস্বয়ং) আমাদের আয়ুর্বানকারক। হে ঐন্দ্র (ইন্দ্র-সম্পর্কিত) অতিগ্রাহ্য! তুমি মনুষ্যগণের মধ্যে ব্রাহ্মণজাতির ও ক্ষত্রিয়জাতির বলকারক বা বলের হেতুভূত, সেই নিমিত্ত তোমার হোম সম্পাদন করছি। হে ইন্দ্র! আপনি ওজঃ-বিদ (অর্থাৎ ওজঃ বা বলের সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন), বলহেতুভূত অষ্টম ধাতু ওজঃ যেন আমাকে পরিত্যাগ না করে (অর্থাৎ অষ্টবিধ তৈজস ধাতুর মধ্যে ওজঃ নামক অষ্টম ধাতু যা মানবের বলি, পলিত, লালিত্য, কৃশতা, দুর্বলাত, জরা প্রভৃতি নিবারণ পূর্বক দেহকে ধারণ করে রাখে, সেই ধাতুপ্রাপ্তি হতে আমি যেন বঞ্চিত না হই)। আমি কখনও ওজাকে পরিত্যাগ করব না, ওজঃও যেন আমাকে কখনও পরিত্যাগ না করে। হে শরীরকান্তি হতে বহির্ভূত রশ্মিরূপ দীপ্তির দ্বারা দীপ্যমান সূর্য! আপনি দেবগণের মধ্যে অতিরিক্ত কান্তিশালী। হে সৌর্য (সূর্য-সম্পর্কিত) অতিগ্রাহ্য! বায়ু ও জলের যে দীপ্তি (বায়োরপাং চ যম্রাজঃ), তার নিমিত্ত তোমার হোম সম্পাদন করছি। হে সূর্য! আপনি সুববিদ (অর্থাৎ স্বর্গমার্গ সম্পর্কে অভিজ্ঞ)। সেই স্বর্গমার্গ যেন আমাকে পরিত্যাগ না করে, এবং আমি যেন সেই স্বর্গ মার্গ পরিত্যাগ না করি। হে অগ্নি! আমাতে মেধা (মন্ত্র ও তার অর্থ ধারণের সামর্থ্য), প্রজা (সন্ততি, জন), ও আপনার তেজঃ দান করুন। হে ইন্দ্র! আমাতে মেধা, প্রজা ও আপনার ইন্দ্রিয় (সামর্থ্য) দান করুন। হে সূর্য! আমাতে মেধা, প্রজা ও আপনার দীপ্তি দান করুন ॥১।
[সায়ণাচার্য বলেন–দ্বিতীয়ে স্তোত্রোপাকরণপ্রতিগরাঙ্গমন্ত্র উচ্যতে। অর্থাৎ–এই অনুবাকে স্তোত্রপাঠের উপকরণ ও জপের মন্ত্রগুলি উক্ত হয়েছে]
.
দ্বিতীয় অনুবাক
মন্ত্র- বায়ুৰ্হিংকংগ্নিঃ প্ৰস্তোতা প্রজাপতিঃ সাম বৃহস্পতিরুদগাতা বিশ্বে দেবা উপগাতাররা মরুতঃ প্রতিহত্তার ইন্দ্রো নিধনং তে দেবাঃ প্রাণভৃতঃ প্রাণং ময়ি দধত্বেতদ্বৈ সৰ্বৰ্মধ্বর্য্যরুপাকুৰ্বমুৰ্গাতৃভ্য উপাকরোতি তে দেবাঃ প্রাণভূতঃ প্রাণং ময়ি দধত্বিত্যাহৈতদেব সৰ্বমাত্মদ্ধত্ত ইড়া দেবহু ৰ্ম্মনুর্যজ্ঞানীবৃহস্পতি রুকথামদানি শংসিষদ্বিশ্বে দেবাঃ সূক্তবাচঃ পৃথিবি মাতৰ্মা মা হিংসীৰ্মধু মনিষ্যে মধু জনিষ্যে মধু বক্ষ্যামি মধু বদিষ্যামি মধুমতীং দেবেভ্যো বাচমুদ্যাসং শুষেণ্যা মনুষ্যেভ্যস্তং মা দে অবস্তু শোভায়ৈ পিতরোহনু মদন্তু৷৷ ২৷৷
মর্মার্থ- সামপানের পঞ্চ ভাগ (সাঃ পঞ্চ ভাগা); যথা–হিংকার, প্রস্তাব, উষ্মীথ, প্রতিহার ও নিধন। সেই বিষয়ে হিংকার ও নিধনরূপ আদি ও অন্ত ভাগ সকলের পঠনীয়। দ্বিতীয় প্রস্তাব ভাগ প্ৰস্তোতা কর্তৃক গীত হয়। তৃতীয় উষ্মীথ ভাগটি উদ্গাতা কর্তৃক গীত হয়। চতুর্থ প্রতিহার ভাগটি প্রতিহর্তা কর্তৃক গীত হয়। এঁদের দ্বারা এইরূপে সামভাগগুলি গীত হলে অধ্বর্য ব্যতীত সকল ঋত্বিক ওম উচ্চারণপূর্বক গান করে থাকেন। যজমান হো শব্দ উচ্চারণপূর্বক গান করেন। এই সকলে বায়ু ইত্যাদি দেবতারূপে মন্ত্রের দ্বারা প্রতিপাদিত হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে সর্ব দেবতার জনকত্বের কারণে প্রজাপতিকে সমষ্টিরূপে সম্পূর্ণ সামরূপ বলা হয়েছে। বায়ু ইত্যাদি দেবতাকে প্রজাপতির একদেশত্বের দ্বারা হিংকার ইত্যাদির কর্তৃত্বে স্থাপিত করা হয়েছে। যথা–হিংকারের কর্তা বায়ু, অগ্নি প্রস্তোতা, প্রজাপতি সাম, বৃহস্পতি উদ্গতা, বিশ্বদেবগণ উপগাতা, মরুৎগণ প্রতিহর্তা এবং ইন্দ্র নিধন। এই বায়ু হতে ইন্দ্র পর্যন্ত দেবগণ প্রাণের পোষক, তাঁরা আমাতে প্রাণ স্থাপন করুন (প্রাণং ময়ি স্থাপয়)। যখন অধ্বর্য উদ্গাতাগণকে স্তোত্রপাঠের অনুজ্ঞা প্রদান করেন তখন বায়ু ইত্যাদিরূপ হিংকর্তাগণ সকলেই সেই অনুজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এই মন্ত্রে তে এতে দেবা… ইত্যাদি অর্থাৎ সেই বায়ু ইত্যাদিরূপ বিংকর্তা ইত্যাদি দেবগণ সকলেই আমাতে প্রাণ স্থাপন করুনএই ভাগটি অধ্বর্য বলবেন (অধ্বর্যক্ৰয়াৎ)। ইড়া, যিনি দেবগণের গাভীরূপা, তিনি এই স্থানে দেবগণের আহুয়িত্রী। যিনি মনু, এইস্থলে তিনি যজ্ঞের প্রবর্তক। যিনি বৃহস্পতি, এই স্থলে তিনি উথশস্ত্র সম্বন্ধী মন্ত্রবাক্যের দ্বারা হর্ষপ্রদানকারী (হর্ষো যেষু মন্ত্রবাক্যেষু তানি বাক্যান্থামদানি)।
এই স্থলে যাঁরা বিশ্বদেব, তাঁরা সূক্তসমূহের বক্তা। হে মাতৃরূপা পৃথিবি! যথাক্তনামা ইড়া ইত্যাদি দেবতার অনুগ্রহে অপরাধরহিত আমাকে হিংসা করবেন না। আপনার অনুগ্রহে আমি মধুর ন্যায় প্রিয় কার্যাবলী মনে মনে চিন্তা করব, সেইরকমই মধুর ন্যায় প্রিয় কর্মফল উৎপাদিত করব; সেইরকমে মধুর ন্যায় প্রিয় হবিঃ দেবগণের প্রতি বহন করে গমন করব; সেই রকমেই আমি মধুর ন্যায় প্রিয় বাক্য উচ্চারণ করব (মধুবৎ প্রিয়ং প্রতিগরূপং বাক্যমুচ্চারয়িষ্যামি)। সেইভাবেই দেবগণের নিকট মধুবৎ প্রিয় ও মনুষ্য হোতা ইত্যাদির শ্রবণযোগ্য মধুবৎ প্রিয় বাক্য উচ্চারণ করছি। আমার সেইরকম বাক্যে যাতে কোন ত্রুটি না ঘটে অর্থাৎ যাতে আমার কোন বাঁচিকপ্রমাদ না ঘটে, সেই নিমিত্ত পূর্বোক্ত ইড়া ইত্যাদি দেবগণ সকলেই আমাকে রক্ষা করুন (সর্বেহপি পালয়ন্তু) এবং পিতৃগণ সেই সমীচীন বাক্যসমূহ অনুমোদন করুন (সমীচীনেয়ং বাগিত্যুপলালয়) ॥২॥
[সায়ণাচার্য বলেন–অথ তৃতীয়ানুবাকে ঘাবদাভ্যাংশুগ্রহৌ প্রত্যপেক্ষিতা মন্ত্র উচ্যন্তে। অর্থাৎ এই অনুবাকে দুই অংশুগ্রহের প্রতি অপেক্ষিত মন্ত্রাবলী উক্ত হয়েছে]
.
তৃতীয় অনুবাক
মন্ত্র- বসবা প্র বৃহত্ত গায়ত্রণ ছন্দসাহগ্নেঃ প্রিয়ং পাথ উপেহি রুদ্রাস্তা প্র বৃহন্তু ত্রৈষ্টুভেন ছন্দসেস্য প্রিয়ং পাথ উপেহ্যাদিত্যাস্থা প্ৰ বৃহন্তু জাগতেন ছন্দসা বিশ্বেষাং দেবানাং প্রিয়ং পাথ উপেহি মান্দাসু তে শুক্র শুক্রমা ধূনোমি ভন্দনাসু কোতনাসু নুতনা রেশীযু মেষীষু বাশীষু বিশ্বyৎসু মাধ্বীষু ককুহাসু শরীযু শুক্রাণু তে শুক্র শুক্রমা ধূনোমি শুক্রং তে শুক্রেণ গৃহাম্যহ্নে রূপেণ সূর্যস্য রশ্মিভিঃ। আহস্মিনুগ্রা অচুচ্যবুর্দিবো ধারা অসশ্চত। ককুহং রূপং বুষভস্য রোচতে বৃহৎসোমঃ সোমস্য পুরোগাঃ শুক্রঃ শুক্ৰস্য পুরোগাঃ। যত্তে সোমাদাভ্যং নাম জাগৃবি তস্মৈ তে সোম সোমায় স্বাহোশিক্তং দেব সোম গায়ত্রণ ছন্দসাহগ্নেঃ প্রিয়ং পাথো অপীহি বশী ত্বং দেব সোম ত্রৈষ্টুভেন ছন্দসেস্য প্রিয়ং পাথো অপীহ্যম্মৎসখা ত্বং দেব সোম জাগতেন ছন্দসা বিশ্বেষাং দেবানাং প্রিয়পাথো অপীহ্যাঁ নঃ প্রাণ এতু পরাবত আন্তরিক্ষাদ্দিম্পরি। আয়ুঃ পৃথিব্যা অধ্যমৃতমাস প্রাণায় ত্বা। ইন্দ্রাগ্নী মে বর্ডঃ কৃণুতাং বর্ডঃ সোমো বৃহস্পতিঃ বৰ্চ্চো মে বিশ্বে দেবা বৰ্চ্চো মে ধমশিনা। দধন্ধে বা যদীমনু বোচভ্রহ্মাণি বেরু তৎ। পরি বিশ্বানি কাব্যা নেমিশ্চক্রমিবাভবৎ ॥৩॥
মর্মার্থ- হে সোমাংশু (সোমদেবতা সম্বন্ধি গ্রহ)! বসুনামক দেবগণ বস্ত্রের দ্বারা বদ্ধ ১সোমলতাসমূহ হতে তোমাকে প্রকর্ষের সাথে পৃথক করুক (প্রকর্ষেণ পৃথকুবন্তু)। কি সাধনের দ্বারা? না–গায়ত্রী ছন্দের দ্বারা; তুমি অগ্নির প্রিয় অনুভাব (পাথ) হও। সেইভাবে রুদ্রগণ ত্রিষ্টুভ ছন্দের দ্বারা তোমাকে পৃথক করুক; তুমি ইন্দ্রের প্রিয় অন্নভাব হও। আদিত্যগণ জগতী ছন্দের দ্বারা তোমাকে পৃথক করুক; তুমি বিশ্বদেবগণের প্রিয় অনুভাব হও। এই স্থানে হোতার চমসে (যজ্ঞপাত্রে) বসতীবরী নামিকা জলের কিছু পরিমাণ গ্রহণ পূর্বক পূর্বোক্ত তিনটি মন্ত্রে সোমাংশু দ্বারা মান্দাসু ইত্যাদি মন্ত্রে সেই চমসস্থ জলের প্রকম্পণ করণীয়। মান্দাসু ইত্যাদি সপ্তমী-অন্তক দ্বাদশটি পদ জলের গোপন নাম (গোপ্যানি নামানি)। সেগুলি হলো–মান্দাসু (মান্দা, অর্থাৎ মন্দগতিশালিনী), ভন্দনাসু (ভন্দনা বা ভদ্রা, অর্থাৎ কল্যাণকারিণী), কোতনাসু (কোতনা, অর্থাৎ জ্ঞানকারিণী), নূতনাসু (নূতনা, অর্থাৎ অভিনবা), রেশী (রেশী, অর্থাৎ শীঘ্র গমনকারিণী), মেষীষু (মেষী, অর্থাৎ স্পর্ধমানা), বাশীষু (বাশী, অর্থাৎ শব্দবতী), বিশ্বভৃৎসু (বিশ্বভৃৎ, অর্থাৎ বিশ্বের ধারিকা), মাধ্বীযু (মাধ্বী, অর্থাৎ মধুররসবতী), ককুহাসু (ককুহা, অর্থাৎ ককুৎসদৃশী, প্রধানভূতা), শরীযু (শরী, অর্থাৎ শক্তিমতী) ও শুক্রাসু (শুক্রা, অর্থাৎ দীপ্যমানা)। মন্ত্রের পূর্ণ রূপ হলো– হে দীপ্যমান সোম, তোমার দীপ্যমান সারাংশ আমি মান্দা ইত্যাদি জলে প্রকম্পিত কৃরছি। হে দধিদ্রব্য! তোমার দীপ্যমান সারাংশ সোম ইত্যাদি রূপ সারের সাথে গ্রহণ করছি। কিসের সাধনের দ্বারা?-না, সূর্যের রশ্মিতে দীপ্যমান দিবসের রসের দ্বারা। এই পাত্রে সোমরসের উগ্রা ধারা পতিতা হয়ে সঙ্গতা (অর্থাৎ মিলিতা) হচ্ছে (পতিতাস্তা ধারা অসশ্চত পাত্রে সঙ্গতাঃ)। বর্ষণকারী ইন্দ্রের বৃষ্টিলক্ষণরূপ প্রধানভূত স্বরূপ শোভা পাচ্ছে। এই বল্লীরূপ সোম রাজরূপী সোমদেবের প্রথমগামী দীপ্যামান রস দীপ্যমান ইন্দ্রের সম্মুখে গমন করছে (অর্থাৎ নিবেদিত হচ্ছে।) হে সোম! তোমার যে সদা জাগরণশীল নাম রয়েছে; হে সোম! তোমার সেই অ-তিরস্করণীয় সোম-নামের উদ্দেশে স্বাহা মন্ত্রে আহুতি প্রদান করছি (স্বাহা হুতমিদস্তু)। হে সোমদেব! আপনার যে কমনীয় তথাবিধ অংশরূপ অগ্নির প্রিয় অন্নভাবের নিমিত্ত সোমসমূহ হতে গায়ত্রী ছন্দের দ্বারা পৃথকৃত হয়েছিল, তা পুনরপি সোমসমূহে গমন করুক। এই রকম, এইভাবে আপনার যে কমনীয় তথাবিধ অংশরূপ অগ্নির প্রিয় অন্নভাবের নিমিত্ত সোমসমূহ হতে ত্রিষ্টু ছন্দের দ্বারা পৃথকৃত হয়েছিল, তা পুনরায় সোমসমূহে গমন করুক। সেই একই ভাবে, আপনার যে কমনীয় তথাবিধ অংশরূপ বিশ্বদেবগণের প্রিয় অনুভাবের নিমিত্ত সোমসমূহ হতে জগতী ছন্দের দ্বারা পৃথকৃত হয়েছিল, তা পুনর্বার সোমসমূহে গমন করুক। দূরদেশ হতে (পরাবত) প্রাণ আমাদের প্রতি আগত হোক; এই ভাবেই অন্তরিক্ষলোক হতে প্রাণ আমাদের প্রতি আগত হোক। স্বর্গলোকের উপরেস্থিত যে প্রাণ, তা-ও সেখান হতে আমাদের প্রতি আগমন করুক। হে হিরণ্য! পৃথিবীর অধ্যুপরি তুমি আয়ু ও অমৃতত্বের হেতু হও (আয়ুৰ্হেতুরমৃতত্বহেতুশ্চাসি);সেইরকমেই তোমাকে প্রাণস্থিতির নিমিত্ত ক্ষেপণ করছি। যেভাবে ইন্দ্র ও অগ্নি আমায় বল সম্পাদন করেন, সেইভাবে সোম ও বৃহস্পতি এবং বিশ্বদেবগণ আমায় তেজঃ প্রদান করুন; হে অশ্বিযুগল! আপনারা আমাতে তেজঃ সম্পাদিত করুন। যজ্ঞসম্বন্ধিনী, দীক্ষা ইত্যাদি অঙ্গসমূহের অনুবচনক্রমে বেদে অভিব্যক্ত কোনও মন্ত্র আমি বিস্মৃত হইনি (অর্থাৎ বেদে যজ্ঞ, দীক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কিত যা যা মন্ত্র আছে, তার কোনটিই আমি বিস্মৃত হইনি); কাব্যের ন্যায় বিস্পষ্টরূপে অভিহিত সর্ব অঙ্গ আমি নিরীক্ষণ করতে পারছি (অর্থাৎ কবিতা বা রসাত্মক বাক্য যেমন স্মৃতিতে বিশেষ স্পষ্টভাবে বিধৃত থাকে, বেদোক্ত মন্ত্রসমূহের সকল অঙ্গই মা আমার স্মৃতিপটে অঙ্কিত হয়ে আছে)। যেমন রথের চক্র তার নেমির (পরিধির) সর্বত্র ব্যপ্ত হয়ে থাকে, সেইভাবে এই যজ্ঞ ব্যাপ্তবান হোক। সেই নিমিত্ত (অর্থাৎ সেই কামনাতেই) আমি প্রজাপতির উদ্দেশে যাগ করছি ॥৩৷৷
[সায়ণাচার্য বলেন-অথ চতুর্থে তেষাং ব্রাহ্মণমুচ্যতে। অর্থাৎ-পুর্বোক্ত অনুবাকে যে অংশুগ্রহের মন্ত্রগুলি কথিত হয়েছে, এই চতুর্থ অনুবাকে সেগুলির ব্রাহ্মণসমূহের দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।]
.
চতুর্থ অনুবাক
মন্ত্র- এতদ্বা অপাং নামধেয়ং গুহ্যং যদাধাবা মান্দাসু তে শুক্র শুক্রমা ধূনোমীত্যা হাপামেব নামধেয়েন গুহ্যেন দিবো বৃষ্টিমব রুন্ধে শুক্রং তে শুক্রেণ গুহ্বামীত্যাহৈতদ্বা অহ্নো রূপং যদ্রাত্রিঃ সূৰ্য্যস্য রশ্ময়ো বৃষ্ট্যা ঈশতেহহ্ন এব রূপেণ সূৰ্য্যস্য রশ্মিভিৰ্দিবো বৃষ্টি চ্যাবয়ত্যাহস্মিগ্রাঃ অচুচ্যবুরিত্যাহ যথা যজুরেবৈতৎ ককুহং রূপং বৃষভস্য রোচতে বৃহদিত্যাহৈতদ্বা অস্য ককুহং রুপং যষ্ঠী রূপেণৈব বৃষ্টিমব রুন্ধে যত্তে সোমাদাভ্যাং নাম জাগৃবীত্যাহৈষ হ বৈ হবিষা হবির্যজতি যোহদাভ্যাং গুহীত্বা সোমায় জুহোতি পরা বা এতস্যাইয়ুঃ প্রাণ এতি যোহংশুং গৃহ্বাত্যা নঃ প্রাণ এতু পরাবত ইত্যাহাইয়ুরেব প্রাণমাত্মান্ধত্তেহ মৃতমসি প্রাণায় ত্বেতি হিরণ্যমভি ব্যনিত্যমৃতং বৈ হিরণ্যমায়ুঃ প্রাণোহমৃতেনৈ বায়ুরাত্মন্ধত্তে শতমানং ভবতি শতায়ুঃ পুরুষঃ শতেন্দ্রিয় আয়ুম্বেবেন্দ্রিয়ে প্রতি তিষ্ঠতাপ উপ স্পৃশতি ভেষজং বা আপো ভেষজমেব কুরুতে ॥৪৷৷
মর্মার্থ- মান্দাসু ইত্যাদি এই প্রকার মন্ত্রে মান্দা ইত্যাদি পদ জলের নির্দেশক নাম; এই নামগুলি জনোকে অপ্রসিদ্ধ (প্রসিদ্ধ্যভাবাৎ); কেবল বৈদিক মন্ত্রে প্রতীয়মান হওয়ার কারণে এগুলির গোপ্যত্ব রয়েছে (অর্থাৎ এই নামগুলি জলের গোপন-নাম বলে কথিত হয়েছে)। অধাবা শব্দের অর্থ সর্বতে যা কম্পিত করা হয়, সুতরাং মান্দা ইত্যাদি মন্ত্রগুলি অধাবা অর্থাৎ এইগুলির দ্বারা জলকে কম্পিত করা হয়ে থাকে। জলের অভিমানী দেবতাগণের প্রীতির নিমিত্ত মান্দা ইত্যাদি মন্ত্র পঠনীয়। তারপর সেই গুহ্য নামের দ্বারা (নামধেয়েন) পরিতোষ প্রাপ্ত হয়ে দেবগণ দুলোক হতে বৃষ্টি সম্পাদিত করেন। গ্রহণমন্ত্রে সূর্যরশ্মির দ্বারা দিবসের রূপ-প্রকাশের কথা ব্যক্ত হয়েছে। রাত্রি ও সূর্যের রশ্মি হলো বৃষ্টির স্বামিভূতা (প্রভুস্বরূপ)। রাত্রিরূপ ও সূর্যরশ্মিযুক্ত কাল ব্যতীত বৃষ্টির অন্য কোন কাল নেই (বৃষ্টেরন্যঃ কালোহস্তি)। সেই নিমিত্ত এই মন্ত্রভাগ পাঠপূর্বক দিন ও রাত্রিলক্ষণের দ্বারা কাল নিরূপণ করে দুলোক হতে ভূমিতে বৃষ্টিপাত করানো হয়ে থাকে। হরণমন্ত্রে প্রধানরূপ বাঁচি ককুহ ও রূপ এই দুটি পদের দ্বারা বৃষ্টিকে বিবক্ষিত করা হয়েছে। হোমমন্ত্রে সোমায় এই পদে দেবতার উদ্দেশে দধিদ্রব্য হবনের (হবিঃস্বরূপ প্রদানের) কথা উক্ত হয়েছে। যে যজমান অদাভ্য নামক দধিগ্রহ (দধিপ্রদানের নিমিত্ত পাত্র বিশেষ) গ্রহণ সোমদেবের যাগ করেন, সেই যজমান হবিঃ-স্বরূপ দেবতার উদ্দেশে যজ্ঞ করেন। যো যজমানোহংশুনামকং সোমরসং পাত্রে গৃহ্নাতি অর্থাৎ যে যজমান অংশুনামক সোমরস পাত্রে গ্রহণ করেন ইত্যাদি মন্ত্রের দ্বারা আয়ুপ্রদ প্রাণের আত্মাতে স্থাপন করার কথা ব্যক্ত হয়েছে। অমৃতমসি প্রাণায় ত্ব ইত্যাদি মন্ত্রে শাসবায়ুর বাহিরে পরিত্যাগকে প্রাণ, অন্তরাকর্ষণকে অপান এবং মধ্যে ধারণকে ব্যান বলে উক্ত হয়েছে। হিরণস্যোপরি…অর্থাৎ হিরণ্যের উপরে ধারণ এই কথার দ্বারা হিরণ্যের উপরে ব্যানের দ্বারা আত্মাতে বায়ুর ধারণ করা হয়েছে (ব্যানলেন স্বাত্মন্যায়ুধারয়ন্তি)। ইন্দ্রাগ্নী- এই মন্ত্রে যে জলস্পর্শের কথা উক্ত হয়েছে, সেই জলের ভেষজত্ব আরোপিত হয়েছে (অর্থাৎ সেই জলকে ঔষধস্বরূপ বলা হয়েছে)। (অপ উপ স্মৃতি ভেষজুং বা আপো ভেষজমেব কুরুতে) ॥৪॥
[সায়ণাচার্য বলেন-পঞ্চমেহগ্নিষ্টোমশেষং পরিত্যজ্য বিকৃতিরূপস্য দ্বাদশাহস্য শেষাঃ পৃশ্নিগ্রাহা উচ্যন্তে। অর্থাৎ–এই পঞ্চম অনুবাকে দ্বাদশাহের শেষে পৃশ্নিগ্রহ-সাধন সম্পর্কে বলা হয়েছে ]
.
পঞ্চম অনুবাক
মন্ত্র- বায়ুরসি প্রাণো নাম সবিতুরাধিপত্যেহপিনং মে দাশ্চক্ষুরসি শ্রোত্রং নাম ধাতুরাধিপত্য আয়ুৰ্ম্মে দা রূপমসি বর্ণো নাম বৃহম্পতেরাধিপত্যে প্রজাং মে দা ঋতমসি সত্যং নামেন্দ্রস্যাহধিপত্যে ক্ষত্রং মে দা ভূতমসি ভব্যং নাম পিতৃণমাধিপত্যেহপামোষধীনাং গর্ভং ধা ঋতস্য ত্বা ব্যোমন ঋতস্য ত্বা বিভূমন ঋতস্য ত্বা বিধৰ্ম্মণ ঋতস্য ত্বা সত্যায়াত্তস্য ত্বা জ্যোতিষে প্রজাপতিব্বিরাজম পশ্যত্তয়া ভূতং চ ভবাং চাসৃজত তামৃষভ্যস্তিয়োহদধাত্তাং জমদগ্নিস্ত পসাহপশ্যত্তরা বৈ স পৃশ্লী কামানসৃজত তৎ পৃশ্লীনাং পৃম্নিত্বং যৎ পৃশ্লয়ো গৃহ্যন্তে পৃশ্নীনেব তৈঃ কামান্যজমানোহব রুন্ধে। বায়ুরসি প্রাণঃ নামেত্যাহ প্রাণাপানাবেবাব রুন্ধে চক্ষুরসি শ্রোং নামেত্যাহাইয়ুরেবাব রুন্ধে। রূপমসি বর্ণো নামেত্যাহ প্রজামেবাব রুগ্ধ ঋতমসি সত্যং নামেত্যাহ ক্ষত্রমেবাব রুন্ধে ভূতমসি ভবা নামেত্যাহ পশবো বা অপামোষধীনাং গর্ভঃ পশূনেব অব রুন্ধে এতাবদ্বৈ পুরুষং পরিতস্তদেবাব রুগ্ধ ঋতস্য বা ব্যোমন ইত্যাহয়ং বা ঋতস্য ব্যোমেমামেবাভি জয়তৃতস্য ত্বা বিভূমন ইত্যাহান্তরিক্ষং বা ঋতস্য বিভূমান্তরিক্ষমেবাভি জয়তৃতস্য ত্বা বিধৰ্ম্মণ ইত্যাহ দ্যৌব্বা ঋতস্য বিধৰ্ম্ম দিবমেবাভি জয়তৃতস্য ত্বা সত্যায়েত্যাহ দিশো বা ঋতস্য সত্যং দিশ এবাভি জয়তৃতস্য বা জ্যোতিষ ইত্যাহ সুবর্গো বৈ লোক ঋতস্য জ্যোতিঃ সুবৰ্গমেব লোকমভি জয়ত্যেতাবন্তো বৈ দেবলোকাস্তানেবাভি জয়তি দশ সং পদ্যন্তে দশাক্ষরা বিরাডম্নং বিরাডুবিরাজ্যেবান্নাদ্যে প্রতি তিষ্ঠতি ॥৫৷৷
মর্মার্থ- হে সোম! তুমি যজমানের দ্বারা পীত (পান-কৃত) হয়ে শরীরের মধ্যে ধারণ ইত্যাদির দ্বারা সামান্য অকারে বায়ুর্ভূত (অর্থাৎ বায়ুরূপী) হও, আবার বিশেষ আকারে প্রাণ নামে অভিহিত হয়ে থাকো। বাহিরে নির্গমনশীল হয়ে তুমি উচ্ছ্বাসরূপ হয়ে থাকো (অর্থাৎ সোমপানের ফলে যজমানের মধ্যে উচ্ছ্বাসের প্রকাশ দেখা যায় (বহির্নির্গমশীলমুজ্জ্বাসরূপোহসি)। সেইরূপ তুমি সবিতার প্রেরক পরমেশ্বরের আধিপত্যে স্থিত হয়ে আমাকে আমার অন্তরে প্রবিষ্টমান অপান বায়ু (বায়ুবিশেষ) দান করো। তুমি চক্ষু ও শ্রোত্রের আপ্যায়নকারিত্বের নিমিত্ত উভয়রূপ (অর্থাৎ চক্ষু ও শ্রোত্ররূপ) হও। তুমি ধাতুর অর্থাৎ দেহ ও ইন্দ্রিয়ের স্রষ্টা বিধাতার আধিপত্যে স্থিত আয়ু আমাকে দান করো। তুমি শরীর বা অবয়বের সৌষ্ঠবলক্ষণরূপ কান্তি ও বর্ণের হেতু ভূত হও। এই হেতু তুমি এই উভয়কারী (অর্থাৎ কান্তি ও বর্ণদানকারী) বৃহস্পতির আধিপত্যে স্থিত হয়ে আমাকে পুত্রপৌত্র ইত্যাদি প্রজা দান করো। তুমি মনের (অর্থাৎ চিন্ত্যমানের) সত্যস্বরূপ ও তুমি বাকের (অর্থাৎ বাক্য উচ্চারণের) সত্যস্বরূপ, এই উভয়ের (চিন্তাশক্তির ও বাকশক্তির) হেতুভূত রূপ তুমি; অতএব এই উভয়ের পালক ইন্দ্রের আধিপত্যে স্থিত হয়ে আমাকে বল দান করো। সেই রকম শরীরের মধ্যে পূর্ব হতে সিদ্ধ ধাতুবৈষম্য এবং পরে অর্থাৎ ভবিষ্যতে যা হবে (অর্থাৎ যে ধাতুবৈষম্য হবে), সেই উভয়ের সমাধান হেতুত্বের নিমিত্ত তুমি উভয়রূপ; অতএব এই উভয় সমাধান-দাতা পিতৃগণের আধিপত্যে স্থিত হয়ে এবং ওষধীর সম্বন্ধী যে পশুরূপ গর্ভ তা সম্পাদন করো (অর্থাৎ অতীত ও ভবিষ্যতের যাবতীয় ধাতুবৈষম্যের সমাধানদাতৃ হলেন পিতৃগণ; সুতরাং তাদের আধিপত্যে স্থিত হয়ে ধাতু বৈষম্যের যথাযথ সমাধান পূর্বক এবং ওষধীগুণের সহায়তায় পশুগণের উৎকৃষ্ট গর্ভেৎপাদন সম্পন্ন করো)। হে সোম! সত্যের রক্ষণের নিমিত্ত, সত্যের বাহুল্যের নিমিত্ত, সত্যের ধারণের নিমিত্ত, সত্যের সত্যত্বের অর্থাৎ প্রমাদরূপ মিথ্যার রহিত্যের নিমিত্ত এবং সেই সত্যের প্রকাশের নিমিত্ত আমি তোমাকে গ্রহণ করছি (ত্বাং মিমে)। এই দশটি মন্ত্র সোমের উন্মানরূপা পৃশ্নিগ্রহ-সাধনের নিমিত্ত কথিত হচ্ছে। প্রজাপতি পূর্বে বিচারপূর্বক সৃষ্টির সাধনভূত বিরাটকে দর্শন করেছিলেন (বিরাজমপশ্যৎ)। বায়ুরসি ইত্যাদি মন্ত্রসমষ্টি দশসংখ্যা পেতত্বের কারণে দশ অক্ষরযুক্ত ছন্দসাম্যের দ্বারা বিরাট নামে উক্ত হয়েছে (বিরাডিত্যুচ্যতে)। তার দ্বারা বিরাজা (আদিপুরুষ প্রজাপতি) ভূত ও ভবিষ্যৎ জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন। সম্পূর্ণ জগৎ সৃষ্টি করে কিছুটা ভূত কিছুটা ভবিষ্যৎ, এইভাবে বিভাগ করেছিলেন। এই বিরাটু তিনি ঋষিগণের নিকট প্রকাশ করেননি (ন প্রকাশিতবা)। তখন জমদগ্নি তপস্যা পূর্বক প্রজাপতির অনুগ্রহের দ্বারা সেই বিরাটকে দর্শন করতে সক্ষম হন। সেই বিরাটের দ্বারা জমদগ্নি পৃশ্নি অর্থাৎ ধেনুস্বরূপ ভোগ সৃজন করেন (ভোগানসৃজাত)। যেভাবে বায়ুরসি ইত্যাদি দশসংখ্যক মন্ত্রে পৃশিশব্দ-অভিধেয় ধেনুরূপ ভোগ সৃজিত হয়, সেই কারণে ঐ মন্ত্রগুলিরও পৃশিনাম সম্পন্ন হয়েছে। পৃশ্নি হলো কামধেনু। পৃশিশব্দ-অভিধেয় বায়ুরসি ইত্যাদি মন্ত্রের দ্বারা গ্রহীতব্য সোমভাগ পৃশ্নিরূপেই ধারণ কর্তব্য। এই উন্মান-লক্ষণ সমন্বিত গ্রহ ধারণের দ্বারা যজমান কামধেনুসদৃশ ভোগ লাভ করেন। প্রথম মন্ত্রের দ্বারা প্রাণ ও অপানের পোষণলক্ষণ সমন্বিত কাম লাভের প্রার্থনা উক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রের দ্বারা চক্ষু-শ্রোত্রের স্থৈর্যের হেতুভূত আয়ু প্রাপ্তির প্রার্থনা উক্ত হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রের দ্বারা অঙ্গসৌষ্ঠব ও কান্তিযুক্ত প্রজাসম্পত্তি প্রাপ্তির প্রার্থনা উক্ত হয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রের দ্বারা মানসিক ও বাঁচিক সত্যসাধনের সম্পত্তি প্রাপ্তির প্রার্থনা উক্ত হয়েছে। পঞ্চম মন্ত্রের দ্বারা ভূত, ভবিষ্যৎ, অস্বাস্থ্য (অর্থাৎ ধাতুবৈষম্যজনিত ক্ষতি) পরিহার পূর্বক পশুপ্রাপ্তির প্রার্থনা উক্ত হয়েছে। পূর্ববর্তী এই মন্ত্রপঞ্চকে এইভাবে অন্যান্য সকল ফল প্রাপ্তির বিষয় উক্ত হয়েছে। পরবর্তী মন্ত্রপঞ্চকে তিন লোক, সকল দিক ও দেবলোক বিজয়ের ফলের কথা ব্যক্ত হয়েছে। এই স্থানে ঋত-শব্দ সত্যের বাচক (ঋতশব্দঃ সত্যবাচী)। এই দশাক্ষরা বিরাটু মন্ত্রের দ্বারা সর্বলোক জয় করা যায় ॥৫॥
[অথ ষষ্ঠে গবাময়নগতা পরঃসংজ্ঞকা অতিগ্রাহ্যবিশেষা উচ্যন্তে। অর্থাৎ এই অনুবাকে গবাময়ন নামক সত্রে অতিগ্রাহ্য বিশেষের কথা উক্ত হয়েছে]
.
ষষ্ঠ অনুবাক
মন্ত্র- দেবা বৈ যদ্যজ্ঞেন নাবারুন্ধত তৎপরৈরবারুন্ধত তৎ পরাণাং পরত্বং যৎ পরে গৃহ্যন্তে যদেব যজ্ঞেন নাবরুন্ধে তস্যাবরুদ্ধ্যৈ যং প্রথমং গৃহাতীমমেব তেন লোকমভি জয়তি যং দ্বিতীয়মান্তরিক্ষং তেন যং তৃতীয়মমুমেব তেন লোকমভি জয়তি যদেতে গৃহ্যন্ত এষাং লোকানামভিজিত্যৈ উত্তরেহঃ স্বমুতোহৰ্ব্বাঞ্চো গৃহ্যন্তেহভিজিত্যৈবোল্লোঁকান্ পুনরিমং লোকং প্রত্যবরোহন্তি যৎ পূৰ্বেৰ্ধহঃস্বিতঃ পরাঞ্চো গৃহান্তে সম্মাদিতঃ পঞ্চ ইমেলোকা যদুত্তরেহঃস্ব মুহতাহব্বাঞ্চো গৃহ্যন্তে তস্মাদমুতোহৰ্বাঞ্চ ইমেলোকাস্তস্মাদ্যতম্নে লোকান্মনুষ্যা উপ জীবন্তি ব্ৰহ্মবাদিনো বদন্তি কৎ সত্যাদ্য ওষধয়ঃ সম্ ভবন্ত্যোধয়ঃ মনুষ্যাণমন্নং প্রজাপতিং প্রজা অনু প্র জায়ন্ত ইতি পরানম্বিতি ব্রুয়াদ্যদত্যভ্যস্তৌষধীভ্যো গৃহামীতি তস্মাদ্য ওষধয়ঃ সং ভবন্তি যদ গৃহীত্যেষধীভত্ত্বা প্রজাভ্যো গৃহ্বামীতি তম্মদোষধয়ো মনুষ্যাণমন্নং যদ গৃহ্নাতি প্রজাভ্যন্তু প্রজাপতয়ে গৃহ্বামীতি তস্মাৎ প্রজাপতিং প্রজা অনু প্র জায়তে ॥৬॥
মর্মার্থ– গবাময়ন নামে সম্বৎসর সাধনীয় একটি সত্ৰ আছে (অস্তি গবাময়নং নাম সম্বৎসরস); তার পূর্ব অর্থাৎ প্রথম ছয় মাস ও পরবর্তী ছয় মাস, এই রকম দুটি ভাগ আছে। এই দুই ভাগের মধ্যবর্তী একটি দিন আছে, তার নাম বিষুব। বিষুবের পূর্ববর্তী তিনটি দিন পরঃসাম নামে অভিহিত; এইগুলি পূর্ববর্তী ছয় মাসের শেষ তিন দিন। সেই রকম বিষুব দিবসের পরবর্তী তিন দিনকে অবাক সাম বলা হয়; এইগুলি পরবর্তী ছয়মাসের প্রথম তিন দিন। তত্রাপি পরঃসাম নামক তিন দিবসে পর্যায় ক্রমে উক্ত তিনটি মন্ত্রের দ্বারা তিনটি অতিগ্রাহ্য নামে আখ্যাত সোমরস গ্রহণ কর্তব্য (অতিগ্রাহ্যাখ্যাঃ সোমরসা গ্রহীতব্যাঃ)। আবার অর্বাক-সাম নামক তিন দিবসে সেই মন্ত্রগুলির বিপরীতক্রমের দ্বারা তিনটি অতিগ্রাহ্য গ্রহণ কর্তব্য। বিষুব নামক মুখ্যদিনে সমাতিক্রমে (অর্থাৎ পরম্পরাক্রমে) ও বিপরীতক্রমে মোট ছয়টি অতিগ্রাহ্য গ্রহীতব্য। পুরাকালে দেবগণ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন, কিন্তু বিধিমতো অতিগ্রাহ্যরহিত্যের কারণে যজ্ঞের কোন ফল তাঁরা প্রাপ্ত হননি; পরে পরাশ্য গ্রহের দ্বারা সেই ফল প্রাপ্ত হন। যাতে অভীষ্টের সমাপ্তি হয় (অর্থাৎ অভীষ্টপ্রাপ্তি ঘটে), তা-ই পরা নামে অভিহিত। প্রথম গ্রহের দ্বারা এই ভূ-লোক, দ্বিতীয় গ্রহের দ্বারা অন্তরীক্ষলোক এবং তৃতীয় গ্রহের দ্বারা দু-লোক–এই ভাবে গ্রহের দ্বারা লোকসমূহ অভিজয় করা যায়। বিষুব দিবসের পরবর্তী দিনগুলিতে বিপরীত ক্রমে গ্রহণ কর্তব্য। (বিষুবের পূর্ববর্তী দিনগুলিতে যেমন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রহের দ্বারা যথাক্রমে ভূলোক, অন্তরীক্ষলোক ও দুলোক জয় করা হয়, তেমনই তারই বিপরীতে) বিষুবের পরবর্তী প্রথম দিবসে তৃতীয় গ্রহ, দ্বিতীয় দিবসে দ্বিতীয় গ্রহ ও তৃতীয় দিবসে প্রথম গ্রহের দ্বারা যথাক্রমে দ্যুলোক, অন্তরীক্ষলোক ও ভূলোক জয়ে প্রত্যাবর্তিত হতে হয়। বিষুব দিবসের পূর্ববর্তী দিনসমূহে প্রথম অতিগ্রাহ্য হতে আরম্ভ করে ক্রমে পরাঞ্চ গ্রহণ কর্তব্য। প্রথম গ্রহণ করে তার পর দ্বিতীয় অতিগ্রাহ্য, দ্বিতীয় গ্রহণের পর তৃতীয় অতিগ্রাহ্য; এগুলি পরাঞ্চ (এতে পরাঞ্চ)। এই নিমিত্ত ভূলোক, অন্তরীক্ষলোক ও দ্যুলোক–এই তিনটি লোক উত্তরোত্তরগত পরাঞ্চ হয়। বিষুর দিবসের উত্তরবর্তী তিনটি দিন হতে তৃতীয় গ্রহ হতে আরম্ভ করে অবাঞ্চ (অধস্তন) গ্রহ গ্রহণীয়। প্রথম দিনে তৃতীয় গ্রহ, দ্বিতীয় দিনে দ্বিতীয় গ্রহ এবং তৃতীয় দিনে প্রথম গ্রহ গ্রহণ কর্তব্য। এগুলি অর্বাঞ্চ (ত এহতের্বাঞ্চঃ)। দ্যুলোক হতে অধস্তন অন্তরীক্ষলোক, অন্তরীক্ষলোক হতে অধস্তন ভূলোক, এগুলি অর্বাঞ্চ লোক। এর দ্বারা মনুষ্যগণ নূতন স্থান প্রাপ্ত হয়। ব্রহ্মবাদীগণ বলেন-জল হতে ওষধীর উদ্ভব হয়; ওষধী হলো মনুষ্যগণের অন্নের স্বরূপ; প্রজাপতি মনু হতে প্রজাগণের উৎপত্তি হয়। এগুলির কারণ কি? এই কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তার উত্তরে কোন বুদ্ধিমান্ ব্রহ্মবাদী বলেন–পর হলো এর কারণ। অতিগ্রাহ্য গ্রহণ মন্ত্রের উৎকৃষ্টত্বের কারণে তা পর শব্দে অভিহিত হয়েছে (উদ্ধৃষ্টত্বাৎ পরশব্দাভিধেয়াঃ)।–সেই রকম, প্রথম মন্ত্রে বলা হচ্ছে–হে প্রথম অতিগ্রাহ্য! তোমাকে ওষধির উৎপত্তির নিমিত্ত (ওষধৎপত্ত্যর্থ) গ্রহণ করছি। এই মন্ত্রের দ্বারা প্রথম অতিগ্রাহ্যটি গ্রহণ করলে জল হতে ওষধির সম্যক উৎপত্তি হয়। দ্বিতীয় মন্ত্রে বলা হচ্ছে–হে দ্বিতীয় অতিগ্রাহ্য! প্রজাবর্গের জীবনের নিমিত্ত (প্রজাজীবনার্থ) ওষধি হতে তোমাকে গ্রহণ করছি। এই মন্ত্রের দ্বারা দ্বিতীয় অতিগ্রাহ্যটি গ্রহণ করলে সেই ওষধিসমূহ মনুষ্যগণের অন্ন হয়। অতঃপর তৃতীয় মন্ত্রে বলা হচ্ছে–হে তৃতীয় অতিগ্রাহ্য! তোমাকে প্রজা ও প্রজাপতির নিমিত্ত গ্রহণ করছি (প্রজার্থং প্রজাপত্যর্থং গৃহ্নামি)। প্রজা অর্থাৎ সকল প্রজাও, যারা প্রজাপতির আশ্রিত বা প্রজাপতি হতে উৎপন্ন, তাদের সকলকেই প্রাপ্তির অভিপ্রায়ে তোমাকে (অর্থাৎ তৃতীয় অতিগ্রাহ্যকে গ্রহণ করছি ॥৬॥
[সায়ণাচার্য বলেন-অথ সপ্তমে সোমাঙ্গত্বেনাহশ্রাবয়েত্যাদয়ো মন্ত্ৰা বিধীয়ন্তে। অর্থাৎ–এই সপ্তম অনুবাকে সোমাঙ্গরূপ আশ্রাবণ ইত্যাদি মন্ত্রগুলি উক্ত হয়েছে।]
.
সপ্তম অনুবাক
মন্ত্র- প্রজাপতিৰ্দেবাসুরানসৃজত তদনু যজ্ঞোহসৃজ্যত যজ্ঞং ছন্দাংসি তে বিম্বঞ্চো ব্যক্ৰাম সোহসুরাননু যজ্ঞোহপাক্ৰামদ যজ্ঞং ছন্দাংসি তে দেবা অমন্যন্তামী বা ইদমভূবন্যদ্বয়ং স্ম ইতি তে প্রজাপতিমুপাষাবৎ সোহব্রবীৎ প্রজাপতিচ্ছন্দসাং বীৰ্য্যমাদায় তদ্বঃ প্ৰ দাস্যামীতি। স ছন্দসাং বীৰ্য আদায় তদেভ্যঃ প্রাচ্ছত্তদনু ছন্দাংস্যাক্রাম। ছন্দাংসি যজ্ঞস্ততো দেবা অভব পরাহসুরা য এবং ছন্দসাং বীৰ্য্যং বেদাহশ্রা বয়াস্তু শ্ৰেীষড্যজ যে যজামহে বষট্কারো ভবত্যাত্মনা পরাহস্য ভ্রাতৃব্যো ভবতি। ব্ৰহ্মবাদিনো বদন্তি কস্মৈ কমধ্বর্যরা শ্রাবয়তীতি ছন্দসাং বীৰ্য্যায়েতি ক্রয়াদেতদ্বৈ ছন্দসাং বীৰ্যমা শ্রাবয়াস্তু শ্ৰেীষড্যজ যে যজামহে বষট্কানো য এবং বেদ সবীৰ্য্যৈরেব ছন্দোভিরéতি যৎ কিং চার্চতি যদিনা বৃত্রমহমেধ্যং তদ্যদ্যতীন পাবপদমেধ্যং তদথ কস্মদৈন্দ্রো যজ্ঞ আ সংস্থাতোরিত্যাহুরিন্দ্রস্য বা এষা যজ্ঞিয়া তনুর্যদ যজ্ঞস্তামেব দ্যজন্তি য এবং বেদোপৈনং যজ্ঞো নমতি ॥৭॥
মর্মার্থ- পুরাকালে কোনও সময়ে প্রজাপতি দেবতা ও অসুরগণকে সৃষ্টি করেন, তার পর যজ্ঞও সৃষ্টি করেন; এবং যজ্ঞের অনুষঙ্গে তিনি ছন্দও সৃষ্টি করেন। তদানীন্তন কালে দেবতাগণের মধ্যে পরস্পর ঐকমত্যের অভাবে তারা নানা পথে বিবিধ দেশে গমন করলেন। অতঃপর সেই যজ্ঞ অসুরবর্গকে অনুসরণ করায় দেবগণের নিকট হতে দূরে গমন করল। তখন দেবগণ পরস্পর ঐকমত্য প্রাপ্ত হয়ে বিচার করলেন–আমরা যে ঐশ্বর্য লাভ করেছিলাম তা সবই এখন অসুরগণের নিকট অবস্থান করছে (অর্থাৎ অসুরগণ লাভ করছে)। দেবগণ এই কথা বিচারপূর্বক এই পরাভবে অসহ্যমান হয়ে প্রজাপতির নিকট গমন করলেন (প্রজাপতিমুপাধাব)। অতঃপরে দেবগণ কর্তৃক উপসেবিত হয়ে প্রজাপতি বললেন, ছন্দরূপ বৈদিক মন্ত্রসমূহের মধ্যে বীর্য (অর্থাৎ তেজসের প্রভাব বা সার) যুক্ত করে তা আমি তোমাদের প্রদান করছি। এই কথা বলে তিনি সেই মতো করলে সকল ছন্দসমূহ অসুরদের নিকট হতে পশ্চাদপসারিত হয়ে দেবগণের প্রাপ্ত হলো। ছন্দকে অনুসরণ করে যজ্ঞও অসুরদের নিকট হতে পলায়ন করে দেবগণের প্রাপ্ত হলো। তার ফলে (ততো) দেবগণ বিজয়ী হয়ে অসুরগণকে পরাভূত করলেন। যিনি ছন্দের এই সার বা তেজঃপ্রভাবের কথা (বীর্য) জ্ঞাত হন, তিনি স্বয়ং বিজয়ী হয়ে থাকেন, অর্থাৎ তার শত্রুগণ পরাভূত হয়। সেই কারণে তেজঃপ্রভাব (অর্থাৎ বী) জ্ঞাত হয়ে ছন্দের প্রয়োগ কর্তব্য। আশ্রাবয় ইত্যাদি মন্ত্রপঞ্চক হলো ছন্দের সেই বীর্য (তেজঃপ্রভাব)। [আশ্রাবণ ইত্যাদি মন্ত্রসমূহের অর্থ ১ম কাণ্ডের ৬ষ্ঠ প্রপাঠকের ১১শ অনুবাকে বিস্তারিতভাবে রয়েছে। এতেষাং মন্ত্রানামৰ্থা যো বৈ সপ্তদশমিত্যস্মিন্ননুবাকে (সং, কা-১, প্র-৬, অ-১১) প্রপঞ্চিতাঃ] কিন্তু কিসের কামনায় রা কোন্ প্রয়োজনে অধ্বর্য এই আশ্রাবণ মন্ত্র পাঠ করেন? ব্ৰহ্মাদিগণের দ্বারা এইরকম জিজ্ঞাসিত হয়ে যিনি বুদ্ধিমান, তিনি উত্তরে বলেন–প্রজাপতি কর্তৃক ছন্দের যে বীর্য (অর্থাৎ সার বা তেজঃ প্রভাব) উদ্ধৃত হয়েছিল, তা পুনরায় লাভ করার নিমিত্ত অধ্বর্য এই মন্ত্র শ্রবণ করান। এই যজ্ঞে বা লৌকিক ব্যবহারে বীর্যদেবী যে কোন (যৎকিঞ্চিৎ) দেবতা ইত্যাদির পূজা করে থাকে, সেই সবই সবীর্য (অর্থাৎ তেজঃপ্রভাব যুক্ত) ছন্দের দ্বারাই পূজিত হয়ে থাকে (সবীযৈরেব ছন্দোভিঃ পূজিতবান্ ভবতি)। ইন্দ্র বৃত্রকে নিহত করেছিলেন, সেই বধরূপ কর্ম অমেধ্য বা অযজ্ঞিয় হয়েছিল (অর্থাৎ যজ্ঞের দ্বারা সেই পাপ ক্ষালনের যোগ্য ছিল না)। আবার ইন্দ্র যে যতিগণের সাল-বৃক ইত্যাদির মুখে দিয়েছিলেন তা-ও (যত্তদপি) পাপরূপত্ব হেতু অযজ্ঞিয়। তাহলে কোন কারণে এই যজ্ঞ সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত ইন্দ্রের নিমিত্ত সম্পন্ন হয়ে থাকে? (অর্থাৎ কি জন্য এই পবিত্র যজ্ঞ আরম্ভ হতে শেষ পর্যন্ত অজ্ঞিয় কর্মকারী ইন্দ্রের নিমিত্ত সম্পন্ন করা হয়?)–ব্রহ্মবাদিগণ এই প্রশ্ন করলে তখন বুদ্ধিমান যিনি, তিনি উত্তরে বলেন–ইন্দ্রের অযজ্ঞিয় এবং যজ্ঞিয় (দুটি তনু বা সত্তা) আছে। রাজ্য পালন বা বিস্তার কল্পে দেবরাজ ইন্দ্র যে ক্ষত্রিয় ইত্যাদিকে হিংসা করেন, তা তার অযজ্ঞিয় তনু; এটি রাজসিক (অর্থাৎ রাজার স্বাভাবিক কর্মের পর্যায়ভুক্ত হলেও হিংসাকর্মের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় অযজ্ঞিয়)। আবার যজ্ঞের নিমিত্ত ইন্দ্রের যে তনু আছে, তা যাগযোগ্য, অর্থাৎ যজ্ঞিয় তনু বা সত্তা (যজ্ঞাহা তনুঃ) এবং তা সাত্ত্বিকী (অর্থাৎ সত্ত্ব গুণাশ্রয়ী)। (যজ্ঞে যজ্ঞাঙ্গের দেবতারূপে হবির দ্বারা পূজনীয় ইন্দ্র সাত্ত্বিক বিগ্রহ, এটাই বক্তব্য)। সেই কারণেই যজমান এই যজ্ঞে ইন্দ্রের সেই যাগযোগ্য সাত্ত্বিকী তনুবই যাগ করে থাকেন। যিনি এই কথা বিদিত হন, তার নিকট যজ্ঞ নত হয় (নমতি)-(অর্থাৎ প্রাপ্তিযোগ্য হয়) ॥৭॥
[অথষ্টমেহব থাঙ্গহোমাদয়ো বক্তব্যাঃ। অর্থাৎ–অষ্টম অনুবাকে অবyথ-অঙ্গের হোম ইত্যাদি উক্ত হয়েছে ]
.
অষ্টম অনুবাক
মন্ত্র- আয়ুৰ্দা অগ্নে হবিষো জুষাণে ঘৃতপ্রতীকো ঘৃতযোনিরেধি ঘৃতং পীত্বা মধু চারু গব্যং পিতেব পুত্রমভি রক্ষতাদিম। আ বৃশ্চ্যতে বা এতদ্যজমানোহগ্নিভ্যাং যনেয়োঃ শতকৃত্যান্যত্রাবস্তৃতম বৈত্যায়ুৰ্দা অগ্নে হবিষো জুষাণ ইত্যবভৃথমবৈষ্যজুহুদাহুত্যৈবৈনৌ শময়তি নাহর্তিচ্ছতি যজমানো যৎ কুসীদম্ অপ্রতীত্তং ময়ি যেন যমস্য বলিনা চরামি। ইহৈৰ সন্নিরবদয়ে তদেতত্তদগ্নে অনুপো ভবামি। বিশ্বলোপ বিশ্বদাবস্য ত্বাহসজুহোম্যহ্মাদেকোহঁহুতাদেকঃ সমসনাদেকঃ। তে নঃ কৃন্বন্তু ভেষজং সদঃ সহো বরেণ্য।। অয়ং নো নভসা পুরঃ সংস্ফানো অভি রতু। গৃহাণামসমত্তৈ বহবো ন গৃহা অস। স ত্বং নঃ নভসম্পাত উজ্জং নো ধেহি ভদ্রয়া। পুনর্নো নষ্টমা কৃধি পুননো রয়িমা কৃধি।। দেব সংস্ফান সহস্রপোষস্যেশিষে স নো রাস্বাজ্যানিং রায়ম্পোষ সুবীৰ্য্যং সম্বৎসরীণাং স্বস্তিম। অগ্নিৰ্ব্বাব যম ইয়ং যমী কুসীদং বা এতদ্যমস্য যজমান আ দত্তে যদোষধী ভিৰ্বেদিং সৃণাতি যদপৌষ্য প্রয়ায়াগ্মীববদ্ধমেনং অনুস্মিল্লোঁকে নেনীয়েরন্যৎ কুসীদমপ্রতীত্তং ময়ীত্যুপৌষতীহৈব সন্যমং কুসীদং নিরবদায়ানৃণঃ সুবর্গং লোকমেতি যদি মিশ্রমিব চরেঞ্জলিনা সন প্রদাব্যে জুহুয়াদেষ বা অগ্নিব্বৈশ্বানররা যৎ প্রদাব্যঃ স এবৈনং স্বদয়ত্যহ্নাং বিদান্যামেকাষ্টকায়ামপূপং চতুঃশরাবং পক্তা প্রাতরেতেন কক্ষমুপৌষেদদি দহতি পুণ্যসমং ভবতি যদি ন দহতি পাপসমমেতেন হ স্ম বা ঋষয়ঃ পুরা বিজ্ঞানেন দীর্ঘসমুপ যন্তি যোবা উপদ্রষ্টারমুপশ্রোতারমনুফ্যাতারং বিদ্বান্যজতে সমমুম্মিশ্লোক ইষ্টাপূৰ্ত্তেন গচ্ছতেহগ্নিৰ্বা উপদ্রষ্টা বায়ুরূপশ্রোতাহদিত্যোহনুখ্যাতা তান্য এবং বিদ্বান্যজতে সমমুম্মিল্লোঁক ইষ্টাপূৰ্ত্তেন গচ্ছতেহয়ং নো নভসা পুরঃ ইত্যাহাগ্নির্বৈ নভসা পুরোইগ্নিমেব তদাহৈতন্মে গোপায়েতি স ত্বং নো নভসম্পত ইত্যাহ বায়ুৰ্ব্বৈ নভসম্পতিৰ্বায়ুমেব তদাহৈতন্সে গোপায়েতি দেব সংস্ফানেত্যাহাসৌ বা। আদিত্যো দেবঃ সংস্ফান আদিত্যমেব তদাহৈতন্মে গোপায়েতি ॥৮॥
মর্মার্থ- হে অগ্নি! আপনি আয়ুদা (অর্থাৎ আয়ু দান করেন); এই যজমানের আয়ুষ্পদ হন (অর্থাৎ এই যজমানকে আয়ু প্রদান করুন। আপনি হবির দ্বারা সেবমান হয়ে ঘৃতপ্রতীক বা ঘূতোপক্রম হয়েছেন, অর্থাৎ যজ্ঞে ঘৃতের দ্বারা হৃয়মান হয়েছেন। আপনি ঘৃতযোনি, অর্থাৎ ঘৃতই আপনার জ্বালার (অগ্নিশিখার) উৎপত্তির কারণ। সেই রকম স্বাদুতম শোধিত (অর্থাৎ নির্মল) গব্য ঘৃত পান করে পিতা কর্তৃক পুত্রের মতো যজমানকে রক্ষা করুন (অর্থাৎ পিতা যেমন পুত্রকে পালন করে, সেই ভাবে আপনি পুত্রবৎ যজমানকে রক্ষা করুন)। আহবনীয় ও গার্হপত্য অগ্নির নিমিত্ত ঘৃত (হবিঃ) পাক করে বরুণের পুরোডাশরূপ অবyথ হোম না করে (হোমমকৃত্বা) অন্যত্র অবভৃথ কর্মের (যজ্ঞের) নিমিত্ত জলের সমীপে (অবভূথ স্নানের উদ্দেশে) গমন করলে যজমানের অপরাধ হয়, তার ফলস্বরূপ আহবনীয় ও গার্হপত্য উভয় অগ্নি হতে যজমান বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন (বিচ্ছিন্নো ভবতি)। অতএব অবyথ স্নানের উদ্দেশে গমনের ইচ্ছা থাকলে আয়ুদা অগ্ন ইত্যাদি মন্ত্রের দ্বারা আজ্যহোম করা কর্তব্য (আজ্যমাহবনীয়ে জুহুয়াৎ)। এই আহুতির দ্বারা আহবনীয় ও গার্হপত্য অগ্নিকে শান্ত করা হয়। এইভাবে শান্তকরণের ফলে সেই যজমান কোন আর্তি (ক্লেশ বা দুঃখ-কষ্ট) প্রাপ্ত হন না। হে অগ্নি! আমি যদি কারও ঋণ পরিশোধ না করে থাকি, আপনার নিকট এই আহুতি প্রদানের দ্বারা যমরূপ উত্তমর্ণের (অর্থাৎ সেই ঋণদাতার) নিকটে আমি অঋণী হলাম (অহমনৃণো ভবামি)। এই যজ্ঞের অনুষ্ঠানে যজমানের যদি কোন সঙ্কীর্ণতা হয়ে থাকে, তবে সেই সাঙ্কর্যের পরিহারের নিমিত্ত বেদিদাহক অগ্নিতে অঞ্জলি দ্বারা নিম্নোক্ত সত্ত্ব মন্ত্রে আহুতি প্রদান কর্তব্য। মন্ত্র-বিশ্বকোপ বিশ্বদাবস্য… অর্থাৎ হে বিশ্বলোপ (অর্থাৎ সকল পাপলোপকারী বা পাপবিনাশকর্তা)! হে স-অঞ্জলি! সকল পাপের দহনে প্রবৃত্ত দাবাগ্নির মুখে (আস্যে) তোমাকে আহুতি প্রদান করছি। এই হোমের দ্বারা আহিতাগ্নি, গার্হপত্যাগ্নি ও দাবাগ্নি এই তিন অগ্নি তুষ্ট হয়ে আমাদের ভেষজ প্রদান করুন (যা আমাদের রোগকে জয় করবে), আমাদের ক্ষুধা পরিহারে সমর্থ করুন, আমাদের নিবাসস্থান দান করুন, আমাদের বল সঞ্চারিত করুন, এবং বরণীয় ধন ইত্যাদি প্রদানের দ্বারা শ্রেষ্ঠ করুন (শ্রেষ্ঠং কুর্ব) এই অগ্নি, যা আমাদের পুরোভাগে (সম্মুখে) বর্তমান, তিনি তেজের দ্বারা বর্ধমান হয়ে আমাদের রক্ষা করুন। সেই অগ্নির রক্ষণের দ্বারা আমরা যেন বহু গৃহ লাভ করি। হে নভস্পতি (অর্থাৎ আকাশের পালক) বায়ু! আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহরূপী হয়ে অন্ন ইত্যাদি রস প্রদান করুন; আমাদের নষ্ট অন্ন পুনরায় আনয়ন করে প্রদান করুন; আমাদের নিমিত্ত অপেক্ষিত (আকাঙ্ক্ষিত) ধন আনয়ন করে প্রদান করুন। হে সংস্ফান (অর্থাৎ সম্যক বৃদ্ধিযুক্ত) আদিত্যদেব! আপনি সহস্ৰসংখ্যক ধন পশু ইত্যাদির প্রভু। আমাদের দারিদ্রাভাব (দারিদ্র্যহীনতা দান) করুন, ধনের দ্বারা পুষ্টিশালী করুন, শোভন অপত্যবান্ করুন, এবং সম্বৎসরব্যাপী স্বস্তি (অর্থাৎ অনিষ্টনাশরূপ সম্পদ) দান করুন। যমস্য বলিনা চরামি ইত্যাদি মন্ত্রে অভিধীয়মান (অস্মিন্মহেভিধীয়মানো) যম হলেন অগ্নিদেব; হোমের আধারে নিয়ত অবস্থানের কারণে তিনি অগ্নি এবং বেদীরূপা এই ভূমি যমী (ইয়ং বেদিরূপা ভূমির্যমী)। যজমান বেদিদাহ না করে (বেদিমদধ্বা) ভূমি হতে প্রয়াণ করে গেলে, যমের ভৃত্যসমূহ গলায় রঞ্জুবন্ধন পূর্বক যজমানকে স্বর্গলোকে নীত করে। যিনি এই জন্মেই যজ্ঞপ্রদেশে অবস্থিত থেকেই দাহের দ্বারা দাহের নিঃশেষে অঋণী হন, তিনি স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন। যে সঙ্কীর্ণ অঙ্গজাত মিশ্রিত করে যজমান অনুষ্ঠান করেন, সেই সাস্কর্য (অর্থাৎ সঙ্কীর্ণ দোষ) পরিহারের নিমিত্ত বেদিদাহক দাবাগ্নিতে অঞ্জলির দ্বারা সত্ত্ব প্রদান কর্তব্য। এই অগ্নি বৈশ্বানর অর্থাৎ সকল পুরুষের সম্বন্ধযুক্ত (অর্থাৎ সর্বপুরুষের আকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারে পর্যাপ্তবৎ)। এই অগ্নি সঞ্জু হোমের দ্বারা তুষ্ট হয়ে মিশ্রচারী যজমানকে স্বাদু করে থাকে (অর্থাৎ তাকে মিশ্রণদোষরহিত করে থাকে)। অতঃপর বেদিদাহ প্রসঙ্গের দ্বারা বুদ্ধিপূর্বক দাহরূপ কর্মান্তর উক্ত হচ্ছে।-মাঘমাসের কৃষ্ণষ্টমীকে একাষ্টকা বলে (একাষ্টকা নাম মাঘকৃষ্ণাষ্টমী)। এবং সেই দিনটি হলো প্রতিপদ ইত্যাদি তিথিগুলির প্রবর্তয়িত্রী এবং সম্বত্রস নামক পুরুষের পত্নী (পত্নীত্বাৎ)। তথাবিধ চারটি শরাব পরিমিত দ্রব্যে নির্মিত অপূপ (পিষ্টক) পাক করে সেই অতি উষ্ণ অপুপের দ্বারা পরিদবসের প্রাতঃকালে অরণ্যে কক্ষ (শুষ্ক তৃণ) দগ্ধ করণীয়। সেই অপূপের উপরে জীর্ণ তৃণ প্রক্ষিপ্ত করণীয়। এই সমস্তই কক্ষের মধ্যে (তৃণের মধ্যে) করা কর্তব্য। এমন করলে যদি এই অপূপের অগ্নিতে সামগ্র কক্ষটি দগ্ধ হয় (দহতি), তাহলেও যে কার্যের উদ্দেশে এই দহন কৃত হলো তা অর্থাৎ সেই কার্য পুণ্যসম হয়। (অর্থাৎ সম্যক পারোত্তীর্ণ হয়, এটাই অর্থ)। কিন্তু অদাহে অর্থাৎ দহন না করলে তা পাপসম হয়ে সেই উদ্দিষ্ট কার্যের বিনাশক হয়। এই কক্ষদাহরূপ কর্মটি নির্বিঘ্নে সম্পূর্তির জ্ঞানে পূর্বকালের মহর্ষিগণ সম্বৎসরব্যাপী সত্ৰ ইত্যাদি প্রৌঢ় (প্রকৃষ্টরূপে অঙ্গীকৃত) কর্ম আরম্ভ করতেন। অগ্নি উপদ্রষ্টা (অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক), বায়ু উপশ্রোতা (অর্থাৎ প্রতিশ্রুত), আদিত্য অনুখ্যাতা (অনুকূল কর্মের নিমিত্ত খ্যাত)–এই কথা বিদিত হয়ে যিনি যাগানুষ্ঠান করেন, তিনি ইষ্ট (অর্থাৎ শ্রৌত বা শ্রুতি শাস্ত্রসম্মত) ও পূর্ত (অর্থাৎ স্মার্ত বা স্মৃতিশাস্ত্রসম্মত) কর্মের ফলস্বরূপ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন (স্বর্গলোকে সঙ্গচ্ছতে)। পুরোভাগে দৃশ্যমান জ্বালাযুক্ত (শিখাসমন্বিত) এই অগ্নি আমার কর্মফল রক্ষা করুন, এই প্রার্থনা অর্থাৎ এইরূপ প্রার্থিত হোন (গোপায়েতি প্রার্থিতবান্ ভবতি)। আকাশে সঞ্চারমান নভস্পতি (অর্থাৎ আকাশের পালক) বায়ু এবং সংস্ফান অর্থাৎ রশ্মির দ্বারা সর্বত্র অভিবর্ধমান (উৎকর্ষের সাথে ক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত) আদিত্য দেব আমার কর্মফল রক্ষা করুন ॥৮৷৷
[অথ নবমে বৃষলম্ভাখ্যং কিঞ্চিৎ কর্মাভিধীয়তে। অর্থাৎ–এই নবম অনুবাকে বৃষালম্ভ নামে আক্যাত কিছু কর্মের বিষয় উক্ত হয়েছে।]
.
নবম অনুবাক
মন্ত্র- এতং যুবানং পরি বো দদামি তেন ক্রীড়ন্তীশ্চরত প্রিয়েণ। মা নঃ শাপ্ত জনুষ সুভাগা রায়ম্পোষেণ সমিষা মদেম। নমো মহিম উত চক্ষুসে তে মরুতাং পিতস্তদহং গৃণামি। অনু মন্য সুজা যজাম জুষ্টং দেবানামিদমস্তু হব্য। দেবানানামেষ উপনাহ অসীদপাং গর্ভ ওষধীষু ন্যক্তঃ।। সোমস্য দ্রমবৃণীত পূষা বৃহন্নদ্রিরভবত্তদেষাম। পিতা বৎসানাং পতিরঘিয়ানামথো পিতা মহতাং গর্গরাণাম। বৎসো জরায়ু প্ৰতিধুক পীযুষ আমিক্ষা মন্তু ঘৃতমস্য রেতঃ। ত্বাং গাবোহবৃণত রাজ্যায় কাং হবন্ত মরুতঃ স্বাঃ। বৰ্মন ক্ষত্রস্য ককুভি শিশিয়াণস্ততো ন উগ্রো বি ভজা বসুনি। বৃদ্ধেন বা এষ পশুনা যজতে যস্যৈতানি ন ক্রিয়ন্ত এষ হ ত্বৈ সমৃদ্ধেন যজতে যস্যৈতানি ক্রিয়ান্তে ॥৯॥
মর্মার্থ- হে গাভীগণ! তোমাদের নিমিত্ত এই যুবা বৃষকে পরিদান (প্ৰদান) করছি; তোমরা প্রীতির সাথে এর সাথে ক্রীড়া করো এবং বিচরণ করো (ক্রীয়ন্তীশ্চরত)। আমাদের শাপ প্রদান করো না (নোহস্মাম্মা শাপ্ত)। তোমরা জন্ম হতেই সুভগা (অর্থাৎ সুষ্ঠুভাবে ভাগ্যবতী; সেই কারণে আমাদের শাপ প্রদান করা তোমাদের উচিত কর্ম নয়; অধিকন্তু এই তরুণকে (অর্থাৎ যুবা বৃষকে) দান করার নিমিত্ত আমাদের অনুগ্রহ করাই তোমাদের উচিত কর্ম। তোমাদের প্রসন্নতায় ধনপুষ্টি ও অন্নের দ্বারা আমাদের হৃষ্ট হওয়াই সম্ভব। হে দেবগণের জনক প্রজাপতি! আপনার সৃষ্টি ইত্যাদিরূপ মহিমাকে নমস্কার করছি, আপনার দৃষ্টিরূপ সর্বগোচর জ্ঞানকে নমস্কার করছি। আমাদের বিবক্ষিত (অর্থাৎ আমরা যা বলতে ইচ্ছুক) বিষয় আপনি অনুমোদন করুন (অনুমন্যস্ব)। আমরা বৃষভের দ্বারা শোভন যজ্ঞ সাধন করব।.এই বৃষভরূপ হব্য দেবতাগণের প্রিয় ছিল এবং সেই কারণে তা দেবগণের দ্বারা আবদ্ধ ছিল। (অর্থাৎ এই বলীবৰ্দে দেবতাগণ অতিরিক্ত প্রীতিসক্ত ছিলেন, এটাই বক্তব্য)। এবং সেই বৃষ আহুত হয়ে মেঘের জলসম্বন্ধী গর্ভ হতে মুক্ত হয়ে বৃষ্টিরূপে পুনরায় অধোমুখে ওষধিতে পতিত হয়েছে।–সেই জলরূপ গর্ভ কি প্রকারে সম্পন্ন, তা বলা হচ্ছে।–পূষা সোমের রস বরণ করেছিলেন (বৃণীত), আদিত্য সলিলাত্মক চন্দ্রের রস রশ্মির দ্বারা গ্রহণ করেছিলেন (গৃহীতবা)। এবং সেই রসরূপ জল হতে রশ্মিসমূহ সম্বন্ধী বৃহৎ পবর্তসদৃশ মেঘের সৃষ্টি হয়েছিল (মেঘোহভবৎ)। এই বৃষভ কেবল গাভীগণের পতিই নয়, সে গো-বৎসগণের পিতাও বটে, এবং গম্ভীর ধ্বনিযুক্ত (অর্থাৎ কলসীতে জলভরণকালে যেমন গর্গর শব্দ হয় তেমনই ধ্বনিযুক্ত) ও শারীরিক বৃদ্ধ (শরীর বৃদ্ধ্যা) বহু বৃষভেরও পিতা। গাভীর উদরে বা গর্ভে বৎসের অধিকরণ অর্থাৎ অধিকার পূর্বক স্থিতি, দুগ্ধের দোহনপাত্রস্থ হওয়া, ক্ষীরের অমৃতসমান হওয়া, রন্ধনের দ্বারা আমিক্ষা বা ছানার এবং নবনীতের (অর্থাৎ মাখনের) পক ঘৃতে নিষ্পন্ন হওয়া, এই সমস্তই এই বৃষভের রেতঃ অর্থাৎ সারভূত রসের পরিণামস্বরূপ (এতদীয় সারভূতরসপরিণামরূপ) এইরকম মহাভাগ বৃষ দেবগণের প্রীতির কারণ, এইটি প্রতিপন্ন করাই অভিপ্রায় (দেবাংশুপত্বিত্যভিপ্রায়ঃ)।–সৌবিষ্টকৃত মন্ত্রের পাঠ–হে বৃষভ! গাভীগণ তোমাকে সকলের রাজারূপে বরণ করে নিয়েছিল (বৃতবত্যঃ)। সুষ্ঠুভাবে অর্চনীয় দেবতাগণ তোমাকে হবিঃস্বরূপে আহ্বান করে থাকেন। ক্ষত্রিয়জাতির প্রধানভূত শরীরে আশ্রিত বলরূপে অবস্থান করে থাকো। (সর্বনিয়ামক রাজবিগ্রহের মত সকল পশুর মধ্যে বৃষভের বলাধিক্য থাকার কারণে বৃষভকে রাজাবিগ্রহের সাথে তুলনা করা হয়েছে)। সেই নিমিত্ত রাজার মতো উগ্র হয়ে তুমি আমাদের নিমিত্ত শত্রুগণের ধনসমূহ (বসূনি) ভাগ করে (বণ্টন-করে) দান করো।-যে যজমানের নিমিত্ত এই যজ্ঞাঙ্গগুলি করা হচ্ছে, সেই যজমান সর্বাঙ্গ-সমৃদ্ধ পশুর দ্বারা যাগ করছেন (এষ যজমানঃ সর্বাঙ্গসমৃদ্ধেন পশুনা যাগং করোতি) ৯।
[অথ দশমে পশু প্রায়শ্চিত্তবিশেষ উচ্যতে। অর্থাৎ–এই দশম অনুবাকে পশুপ্রায়শ্চিত্তবিশেষ উক্ত হয়েছে]
.
দশম অনুবাক
মন্ত্র- সুৰ্য্যো দেবো দিবিষভ্যো ধাতা ক্ষত্রায় বায়ুঃ। প্রজাভ্যঃ।। বৃহস্পতিস্তা প্রজাপতয়ে জ্যোতিষ্মতীং জুহোতু। যস্যান্তে হরিতো গর্ভাহথো যোনিৰ্হিরণায়ী। অঙ্গান্যহ্রতা যস্যৈ তাং দেবৈঃ সমজীগম। আ বৰ্ত্তন বয় নি নিবর্তন বৰ্তয়েন্দ্ৰ নৰ্দবুদ। ভূম্যান্টতঃ প্রদিশস্তাভিরা বৰ্ত্তয়া পুনঃ। বি তে ভিনন্নি তকরীং বি যোনিং বি গবীন্যে। বি মাতরং চ পুত্রং চ বি গর্ভং চ জরায়ু চ। বহিস্তে অস্তু বালিতি। উরুদ্রগো বিশ্বরূপ ইন্দুঃ পবমানো ধীর আনঞ্জ গর্ভম। একপদী দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদী পঞ্চপদী ষটপদী সপ্তপদ্যষ্টপদী ভুবনাহনু প্রথতাং স্বাহা। মহী দ্যৌঃ পৃথিবী চ ন ইমং যজ্ঞং মিমিক্ষম। পিতৃতাং নো ভরীমভিঃ ॥১০৷৷
মর্মার্থ- সূর্যদেব দিবিষদবর্গের (অর্থাৎ দেবতাগণের) অভিবৃদ্ধির নিমিত্ত (অভিবৃদ্ধ্যর্থং), ধাতা ক্ষত্রিয়গণের অভিবৃদ্ধির নিমিত্ত, বায়ু প্রজাগণের অভিবৃদ্ধির নিমিত্ত, বৃহস্পতি প্রজাপতিকে প্রাপ্তির নিমিত্ত (প্রজাপতিপ্রাপ্ত্যর্থং) জ্যোতিষ্মতী তোমাকে যজ্ঞাহুতি প্রদান করুন (তাং জুহোতু)। তোমরা হরিতের সারভূত অর্থাৎ হরিতবর্ণ গর্ভ, যোনি হিরণ্যের সারভূত অর্থাৎ হরিতবর্ণ; তোমার অঙ্গসমূহ কুটিল; তোমাকে দেবগণের সাথে মিলিত করছি। গর্ভের প্রবর্তক হে দেব! আপনি গর্ভকে আবর্তিত করুন। গর্ভের নিবর্তক হে দেব! তুমি গর্ভকে নির্গত করো। হে ইন্দ্ৰেশ্বর! তুমি গর্ভকে প্রকৃষ্টরূপে সকল দিকে ব্যাপ্ত করো। হে বশে (বন্ধা)! তোমার সন্তানকে গর্ভ ও জরায়ু হতে বিচ্ছিন্ন করছি। (অর্থাৎ সন্তানের জন্ম রহিত করছি)। তোমার প্রাণবৃত্তিরূপ হে আত্মা! তুমি সর্বব্যাপী হও। বহুসারাবয়বযুক্ত নানারকম শুদ্ধরূপ (ধীর স্থির) শুক্র গর্ভে গমন করুক। (অর্থাৎ প্রজাঃ ও পশুরূপ অবয়বসমূহ গর্ভে জননের নিমিত্ত গমন করুক, এটাই বক্তব্য)। একপদী, দ্বিপদী, ত্রিপদী, চতুষ্পদী, পঞ্চপদী, ষট্রপদী, সপ্তপদী ও অষ্টপদীরূপা হয়ে এই বশা ভূতজাতমাত্রেই বিস্তার লাভ করুক (প্রথম)। মহতী দুলোক ও পৃথিবী এই যজ্ঞ সিঞ্চিত করুন এবং আমাদের ভরণপ্রকারে (অর্থাৎ পোষণপূর্বক) পালন করুন (ভরণপ্রকারৈঃ পালয়তা) ॥১০৷
[সায়ণাচার্য বলেন–অথৈকাদশে যাজ্যা পুরোনুবাক্যা…। অর্থাৎ–এই একাদশ অনুবাকে যাজ্যা ও পুরোনুবাক্যা সমূহ উক্ত হয়েছে]
.
একাদশ অনুবাক
মন্ত্র- ইদং বামাস্যে হবিঃ প্রিয়মিন্দ্রাবৃহস্পতী। উথং মদশ্চ শস্যতে। অয়ং বাং পরি যিচ্যতেসোম ইন্দ্রাবৃহস্পতী। চারুর্মদায় পীতয়ে। অম্মে ইন্দ্রাবৃহস্পতিী রয়িং ধং শতথিন। অশ্বাবন্তম সহণিম্।। বৃহস্পতিঃ পরি পাতু পশ্চাদুতোত্তরম্মাদধরাদঘায়োঃ। ইন্দ্রঃ পুরস্তাদুত মধ্যততা নঃ সখা সখিভ্যো বরিবঃ কৃপোতু। বি তে বিশ্বাতজুতাসসা অগ্নে ভামাসঃ শুচে শূচয়শ্চন্তি। তুমিষক্ষাসসা দিব্যা নবগ্ধা বনা বনন্তি ধৃষতা রুজন্তঃ। ত্বমগ্নে মানুষীরীড়তে বিশশা হোত্ৰাবিদং বিবিচিং রত্নতমম্। গুহা সন্তং সুভগ বিশ্বাদৰ্শতং তুবিষ্মণসং সুযজং ধৃতশ্রিয়। ধাতা দদাতু নো রয়িমীশানো জগতস্পতিঃ। সং নঃ পূর্ণেন বাবনৎ। ধাতা প্রজায়া উত রীয় ঈশে ধাতেদং বিশ্বভুবনং জজানা। ধাতা পুত্রং যজমানায় দাতা তম্মা উ হব্যাং ঘৃতবঘিধেম। ধাতা দদাতু নো রয়িং প্রাচীং জীবাণুমক্ষিতা। বয়ং দেবস্য ধীমহি সুমতিং সত্যরাধসঃ। ধাতা দদাতু দাশুষে বসুনি প্ৰজাকামায় মীচুষে দুরাণে। তস্মৈ দেবা অমৃতাঃ সংব্যয়স্তাং বিশ্বে দেবাসা অদিতিঃ সজোষাঃ। অনু নোহনুমতির্যজ্ঞং দেবেষু মন্যতা। অগ্নিশ্চ হ্যবাহনো ভবতাং দাশুষে ময়ঃ। অন্বিদনুমতে ত্বম মন্যাসৈ শং চ নঃ কৃধি। ক্ৰত্বে দক্ষায় নো হিনু প্ৰণ আয়ুংষি তারিষঃ। অনু মন্যতামনুমন্যমানা প্রজাবন্তং রয়িমক্ষীয়মাণম। তস্যৈ বয়ং হেড়সি মাহপি ভূম সা নো দেবী সুহয় শৰ্ম্ম যচ্ছতু। যস্যামিদং প্রদিশি যদ্বিয়োচতেহনুমতিং প্রতি ভূষ্যায়বঃ। যস্যা উপস্থ উৰ্ব্বন্তরিক্ষং সা নো দেবী সুহবা শৰ্ম্ম যচ্ছতু রাকামহং সুহবাং সুষ্ঠুতী হুবে শুণোতু নঃ সুভগা বোধতু না। সীব্যত্বপঃ সূচ্যাহচ্ছিদ্যমানয়া দদাতু বীরং শতদায়মুকথ্য। যাস্তে রাকে সুমতয়ঃ সুপেশসো যাভিদাসি দাশুষে বসুনি। তাভির্নো অদ্য সুমনা উপাগহি সহস্রপোষ সুভগে ররণা। সিনীবালি যা সুপাণিঃ। কুহুমহং সুভগাং বিনাপসমস্মিন্ যজ্ঞে সুহং জোহবীমি। সা নো দদাতু শ্রবণং পিতৃণাং তস্যান্তে দেবি হবিষা বিধেম। কুহুর্বেনামমৃতস্য পত্নী হব্যা নো অস্য হবিষশ্চিকেতু। সং দাশুষে কিরতু ভূরি বামং রায়ম্পোয়ং চিকিতুষে দধাতু ॥১১৷৷
মর্মার্থ- হে ইন্দ্র ও বৃহস্পতি! এই হবিঃ আপনাদের মনোহর মুখে প্রিয় হোক (বা আহূত হোক)। উথ শস্ত্র ও হর্ষের হেতুকারক প্রতিবাক্য আপনাদের সমীপে গমন করুক।–সেই বিষয়ের ঋবিশেষ (যাজ্যা)–এই হবিঃরূপ সোম আপনাদের নিমিত্ত পরিত্যক্ত হচ্ছে। হে ইন্দ্র ও বৃহস্পতি! এই মনোহর সামগ্রী আপনাদের পানের নিমিত্ত ও আনন্দ প্রাপ্তির নিমিত্ত পরিত্যক্ত হচ্ছে। সেই বিষয়ের বিকল্পিত পুরোনুবাক্যা–হে ইন্দ্র ও বৃহস্পতি! আপনারা আমাদের নিমিত্ত শত সংখ্যক অশ্ব ও সহস্র ধন দান করুন। যাজ্যা–বৃহস্পতি আমাদের পশ্চাৎ ও অবধা দিকে হিংসকদের আক্রমণ বা আঘাত হতে রক্ষা করুন এবং ইন্দ্র সম্মুখ ও মধ্য হতে রক্ষা করুন। বৃহস্পপ্তি ও ইন্দ্র আমাদের সেইরকম সুখ প্রদান করুন, যেরকম সুখ সখার প্রতি সখা বিধান করে থাকেন। [অতপর যাজ্যা ও পুরোনুবাক্যা পরপর দেওয়া হচ্ছে। হে অগ্নি! হে শুচি (অগ্নিবিশেষ)! আপনার শুদ্ধ দীপ্তিসমূহ সর্বতো বিচরণ করছে। (কিরকম?)–তারা (অর্থাৎ দীপ্তিসমূহ) বায়ুর দ্বারা প্রেরিত হয়ে অন্য অগ্নির মিশ্রণের দ্বারা ক্রোধনশীল হয়ে বহু সামগ্রীকে শোধিত করে দ্যুলোকস্থানের যোগ্য হয়ে নিত্য অভিনব রূপে বিচরণ করছে। তারা বলাক্তারের দ্বারা সকল বৈগুণ্য (দোষ) ভঙ্গ করছে। তথাবিধ তোমার সেই দীপ্তিবিশেষ সমূহ আমাদের বননীয় (নির্বপণীয় বা নিষ্পদিত) হবিঃ সম্ভোগ করুক। হে সুভগ (সৌভাগ্যযুক্ত) অগ্নি! মনুষ্যরূপী প্রজাগণ তোমার স্তুতি করছে (স্তুবন্তি)। (কেন?)–তুমি হোত্রবিদ অর্থাৎ হোম সম্পর্কে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ; বিমিশ্রিত অগ্নিসমূহের মধ্যে বিবেচক (বিচক্ষণ); মণিরত্ন ইত্যাদি অতিশয় ধনের সম্পাদক, তুমি গুপ্তভাবে মন্ত্রের মধ্যে গোপন স্থানে বর্তমান; তুমি বিশ্বের (বা সকলের) প্রদর্শয়িতা; তুমি সুপ্রবৃদ্ধমনস্ক (অর্থাৎ তোমার মন সর্বত্র বৃদ্ধিমান); তুমি সুষ্ঠু যজ্ঞসম্পাদনে সমর্থ এবং ঘৃতসেবী (অর্থাৎ ঘৃত বা হবিঃ ভক্ষণকারী)। ধাতা অর্থাৎ বিশ্বের ধারয়িতা, জগতের পতি বা পালক পরমেশ্বর আমাদের ধন দান করুন। সেই পরমেশ্বর আমাদের সমৃদ্ধিরূপ ধনের সাথে সংযোজিত করুন। এই ধাতা পুত্র ইত্যাদির স্বামী এবং তিনি ধনেরও স্বামী হন। এই ধাতা ভুবনের সর্বপ্রকার প্রাণীজাতকে। উৎপন্ন করেছেন। এবং এই ধাতা যজমানকে পুত্র দান করেন। তথাবিধ এই দেবতার উদ্দেশে এই তব্য ঘৃতযুক্ত করছি (করবাম)। এবং সেই ধাতা আমাদের জীবনের নিমিত্ত প্রকর্ষের সাথে অনুকূল (অর্থাৎ অক্ষীণ বা পর্যাপ্ত) ধন প্রদান করুন। সত্যের আরাধনাকারী (অর্থাৎ সত্যের সাথে যজ্ঞসমূহের অনুষ্ঠাতা) আমরা দেবতার অনুগ্রহযুক্ত চিত্ত প্রার্থনা করি। হবিঃ-দানকারী (হবিদৰ্ত্তবতে) যজমানকে সেই ধাতা ধনসমূহ দান করুন। (কিরকম ভাবে?)–পুত্র ইত্যাদি প্রজাকামী হয়ে আপন গৃহে দেবগণের উদ্দেশে যাগকারী যজমানকে ধন দান করুন। মরণরহিত সকল দেবগণ এবং অদিতি সমান প্রীতিযুক্ত হয়ে সেই যজমানের গৃহে সম্মিলিত হয়ে অধিষ্ঠান করুন। অদ্য দেবগণ এই যজ্ঞের অনুমতি দান করুন (অর্থাৎ অনুমোদন করুন)। (অর্থাৎ দেবতাগণের দ্বারা প্রশংসিত হোক)। এবং হব্যবাহন অগ্নি হবিঃদানকারী যজমানের সুখময় হোন। হে অনুমতি (অনুমতি শব্দে অভিধেয় দেবতা)! আপনি আমাদের সর্বথা অনুমতি (বা অনুমোদন) দান করুন এবং সুখী করুন। আমাদের সমৃদ্ধ যাগে প্রীতিযুক্তা হোন এবং আমাদের চিরকালের জীবন (বহুকালস্থায়ী আয়ু) প্রকৃষ্টভাবে সম্পাদন করুন। সেই অনুমতি দেবী আমাদের পুত্র ইত্যাদিযুক্ত করুন এবং ক্ষয়রহিত ধনের পোষণ অনুমোদন করুন (পোষমনুমন্যতা। আমরা যেন সেই অনুমতি দেবীর ক্রোধে না স্থিত হই (অর্থাৎ তিনি যেন কখনও আমাদের প্রতি ক্রোধান্বিতা না হন); বরং যেন তাঁর অনুগ্রহ প্রাপ্ত হই। সুষ্ঠুভাবে আহ্বানযোগ্যা সেই দেবী আমাদের সুখ প্রদান করুন। জগতে যা কিছু বিবিধরূপে প্রকাশ পাচ্ছে, তার সবেতেই অনুমতি দেবী বর্তমান, কারণ জগৎ তাঁরই আজ্ঞায় অধীন। সেই অনুমতি দেবীর প্রতি গমনশীল (গারো) যজমানবর্গ হবিঃ প্রাদন করে থাকেন। যাঁর শরীরের একদেশে (এক পার্শ্বে) এই মহৎ আকাশ অবস্থান করছে (অর্থাৎ যে দেবী বিশ্বব্যাপ্ত), সেই দেবী আমাদের সুখ প্রদান করুন। সুখে আহ্বানযোগ্যা রাকা দেবীকে আমি শোভন স্তুতির দ্বারা আহ্বান করছি। [অনুমতি হলেন চতুর্দশীযুক্ত পূর্ণিমা। রাকা হলেন পূর্ণিমা]।সুভগা অর্থাৎ সৌভাগ্যযুক্তা সেই দেবী আমাদের আহ্বান শ্রবণ করুন এবং শ্রবণপূর্বক আমাদের যা অভিপ্রেত বিষয় তা বোধ করুন। তাঁর অবিচ্ছিন্ন সূচীসদৃশ অনুগ্রহ বুদ্ধিতে আমাদের কর্ম সীবনকৃত (সীব্যতু) হোক অর্থাৎ নির্দোষ হোক। তারপর তিনি বহু ধন ও উথ স্তোত্র-শস্ত্র ইত্যাদির সাথে পুত্র প্রদান করুন। হে রাকাঁদেবী! আপনার শোভনাক্রিয়াযুক্ত যে সুমতি আছে, যার দ্বারা আপনি দানশীল যজমানগণকে ধন দান করে থাকেন, সেই সৌমনস্যযুক্ত হয়ে অর্থাৎ অনুগ্রহরূপ সুমতির দ্বারা এই যজ্ঞে আমাদের অনুগৃহীত করুন। সেই সুভগা অর্থাৎ সৌভাগ্যযুক্তা দেবী আর কি করবেন?–তিনি সহস্র সংখ্যাযুক্ত পুষ্টি আমাদের দান করবেন।অতঃপর মহাস্তুতা সুপানি সিনীবালী দেবীকে (প্রতিপদযুক্তা বা চতুর্দশীযুক্তা অমাবস্যাকে) আহ্বান করছি। [৩য় কাণ্ডের ১ম প্রপাঠকের ১১শ অনুবাক দ্রষ্টব্য]। কুহু শব্দাভিধেয়া দেবীকে এই যজ্ঞে আহ্বান করছি। [কুহু হবলন অমাবস্যা]। সুভগা অর্থাৎ সৌভাগ্যযুক্তা বিদিতকর্মা সেই দেবী সুখের সাথে (সহজে) আহ্বানযোগ্যা (সুখেনাহাতুং শক্যাম)। সেই কুহু দেবী আমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষগণের শ্রবণযোগ্য যশ আমাদের প্রদান করুন। (অর্থাৎ আমরা যেন এমন যশ লাভ করতে পারি, যা শুনে আমাদের পূর্বপুরুষগণ প্রীত হবেন)। হে দেবি! তথাবিধ হবির দ্বারা আমরা আপনার পরিচর্যা করছি। এই কুথু দেবী আমাদের হবির সার জ্ঞাত হোন। কীরকম কুহু দেবী?)–তিনি দেবতাগণের সম্বন্ধীয় দর্শপূর্ণমাস ইত্যাদি হবির পত্নী বা পালয়িত্রী এবং হবির দ্বারা আহ্বানযোগ্য। সেই হেন যে দেবী, তিনি দানশীল যজমানকে প্রভূত বননীয় পারলৌকিক ফল সম্যক্রপে দান করুন (সম্যাদাতু) এবং তার মহিমা সম্পর্কে জ্ঞানবন্ত (জ্ঞাতবতে) যজমানকে ধনপুষ্টিসম্পন্ন করুন (ধনপুষ্টিং সম্পাদয় ॥১১।