কিংবদন্তি ও বাস্তবতা
প্রথম খণ্ড । ভাগ ৩ – কিংবদন্তি। পরিচ্ছেদ ৩
নারীর কিংবদন্তি সাহিত্যে বড়ো ভূমিকা পালন করে; কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে কী এর গুরুত্ব? প্রথা ও ব্যক্তির আচরণকে এটা কতোটা প্রভাবিত করে? এ-প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে বর্ণনা করা দরকার বাস্তবের সাথে এ-কিংবদন্তির সম্পর্ক কেমন।
কিংবদন্তি আছে নানা ধরনের। মানুষের অবস্থার এক অপরিবর্তনীয় দিককে পরিশোধিত করে–যেমন, মানবজাতিকে ‘ভাগ’ করা হয় দু শ্রেণীর মানুষে–এটি, নারীর কিংবদন্তিটি, এক অনড় কিংবদন্তি। প্লাতোয়ী ভাবের জগতে এটা প্রক্ষেপ করে এমন এক বাস্তবতা, যার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে প্রত্যক্ষভাবে বা ধারণাবদ্ধ করা হয়েছে অভিজ্ঞতা ভিত্তি করে; ঘটনা, মূল্য, তাৎপর্য জ্ঞান, পর্যবেক্ষণলব্ধ সূত্রের বদলে এটা গ্রহণ করে এক লোকোত্তর ভাব, যা শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়, প্রয়োজনীয়। এ-ভাব বিতর্কের উর্ধ্বে, কেননা এটা বিদ্যমানের বাইরের : এটা ভূষিত ধ্রুব সত্যে। তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, ঘটনাচক্রজাত, নানা ধরনের জীবন যাপনকারী বাস্তব নারীদের বিপক্ষে এ-কিংবদন্তিমূলক চিন্তা উপস্থাপন করে চিরন্তনী নারী, যা অনন্য ও অপরিবর্তনীয়। যখন রক্তমাংসের নারীদের আচরণ বিরুদ্ধে যায় নারীধারণার এসংজ্ঞার, তখন বাস্তব নারীদেরই নির্দেশ করা হয় ভুল বলে : বলা হয় না যে নারীত্ব একটা ভুল ধারণা, বরং বলা হয় সংশ্লিষ্ট নারীরাই নারীধর্মী নয়। কিংবদন্তির বিরুদ্ধে অভিজ্ঞতার সত্যগুলো অচল। তবে, একভাবে, এর উৎস আছে অভিজ্ঞতার মধ্যেই। এটা খুবই সত্য যে নারী পুরুষ থেকে ভিন্ন, এবং এ-ভিন্নতা প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হয় বাসনায়, আলিঙ্গনে, প্রেমে; কিন্তু প্রকৃত সম্পর্কটি হচ্ছে এক পারস্পরিকতার সম্পর্ক; এভাবে এটা সৃষ্টি করে খাঁটি নাটক। কাম, প্রেম, বন্ধুতু, এবং এগুলোর বিপরীতগুলো, যেমন, প্রতারণা, ঘৃণা, প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে সম্পর্কটি হচ্ছে দুটি সচেতন সত্তার মধ্যে যুদ্ধ, যাদের প্রত্যেকেই হতে চায় অপরিহার্য, এটা হচ্ছে স্বাধীন সত্তাদের পারস্পরিক স্বীকৃতি, যারা প্রতিপন্ন করে পরস্পরের স্বাধীনতা, এটা হচ্ছে বিরূপতা থেকে অংশগ্রহণের দিকে অস্বচ্ছ উত্তরণ। নারীর অবস্থান নেয়া হচ্ছে ধ্রুব অপর-এর অবস্থান নেয়া, যাতে কোনো পারস্পরিকতা নেই, সে যে একজন কর্তা, একজন সহচর মানুষ, সমস্ত অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে তা অস্বীকার করা।
বাস্তবে, অবশ্য, নারী দেখা দেয় বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে; কিন্তু নারী বিষয়টি ঘিরে গড়ে ওঠা প্রতিটি কিংবদন্তির লক্ষ্য হচ্ছে নারীকে সংক্ষেপিত রূপে হুবহু ধারণ; প্রতিটিই হতে চায় অনন্য। পরিণামে, দেখা দেয় একরাশ পরস্পরবিরুদ্ধ কিংবদন্তি, এবং নারীত্বের ধারণা প্রকাশ করে যে-সব অদ্ভুত অসঙ্গতি, সেগুলোর কথা ভেবে বিবর্ণ হয়ে ওঠে পুরুষেরা। যেহেতু এসব আদিরূপের অধিকাংশের সাথে কিছুটা মিল আছে প্রত্যেক নারীরই–যেগুলোর প্রত্যেকটি দাবি করে যে সেটিই ধারণ করে নারী সম্পর্কে একমাত্র সত্য–তাই আজকালকার পুরুষেরাও এমন বিস্ময়ে বিচলিত হয় তাদের সঙ্গী নারীদের রূপে, যেমন প্রাচীন সোফিস্টরা বিস্মিত হতো একথা ভেবে যে মানুষ কী করে একই সময়ে হয় গৌর ও কৃষ্ণ! সে-পুরুষেরা, যারা ভাগ্যান্বেষী, জোচ্চোর, ফটকাবাজ, তারা সাধারণত ত্যাজ্য হয় তাদের গোত্রের দ্বারা; কিন্তু নারীরা আইনের মধ্যে থেকেও কামকলা প্রয়োগ করে পটাতে পারে তরুণদের, এমনকি পরিবারের কর্তাদের, ফলে নাশ হতে পারে তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি। এমন কিছু নারী আত্মসাৎ করে তাদের শিকারদের ধনসম্পত্তি বা অবৈধ প্রভাব খাঁটিয়ে পায় উত্তরাধিকার; এ-কাজকে যেহেতু খারাপ মনে করা হয়, তাই যারা এটা করে, তাদের বলা হয় ‘নষ্টনারী’। কিন্তু সত্য হচ্ছে এর বিপরীতে তারা অভিভাবক দেবদূতীরূপে উপস্থিত হতে পারে অন্য কোনো পরিবেশে–বাড়িতে তাদের পিতা, ভাই, স্বামী, বা প্রেমিকদের সঙ্গে; যে-বিলাসিনী নারী ‘লোম তোলে’ ধনী পুঁজিপতির, সে হয়তো চিত্রকর ও লেখকদের কাছে দয়াবর্তী পৃষ্ঠপোষিকা। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আম্পাসিয়া বা মাদাম দ্য পপাদোরের ব্যক্তিত্বের দ্ব্যর্থতা বোঝা সহজ। নারীদের যদি চিত্রিত করা হয় আরাধনাকারী ম্যান্টিস, ম্যানড্রেক, দানবীরূপে, তাহলে তাদের মধ্যে কাব্যদেবী, দেবী মহামাতা, বিয়াত্রিসেকেও পাওয়া খুবই গোলমেলে ব্যাপার।
দলগত প্রতীক ও সামাজিক শ্রেণীরূপগুলোকে যেহেতু সাধারণত সংজ্ঞায়িত করা হয় বিপরীতার্থক শব্দযুগলের সাহায্যে তাই পরস্পরবিপরীত মূল্যধারণকে মনে হবে চিরন্তনী নারীর এক সহজাত বৈশিষ্ট্য বলে। দেবীর মতো মায়ের সাথে সম্পর্কিত ধারণা হচ্ছে নিষ্ঠুর সৎ মা, লক্ষ্মীর মতো তরুণীর সাথে সম্পর্কিত বিকারগ্রস্ত কুমারী : তাই কখনো কখনো বলা হয় যে মা মৃত্যুর সমান, প্রত্যেক কুমারীই হচ্ছে বিশুদ্ধ আত্মা বা শয়তানের কাছে উৎসর্গিত দেহ।
কিংবদন্তিকে তাৎপর্য শক্তির সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়; তাৎপর্য সীমায়িত থাকে বস্তুর মধ্যে; এটা মনের কাছে ধরা দেয় যাপিত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে; আর সেখানে কিংবদন্তি হচ্ছে এক সীমাতিক্রমী ধারণা, যা মানসিক উপলব্ধিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যায়। মিশেল লিরিস লআজ দঅম-এ যখন নারীর যৌনাঙ্গ সম্পর্কে তার স্বপ্নবিভাব বর্ণনা করেন, তখন তিনি বলেন তাৎপর্যপূর্ণ জিনিশের কথা, তিনি কোনো কিংবদন্তি বর্ণনা করেন না। নারীর শরীর দেখে বিস্ময় জাগে, ঋতুস্রাবে ঘেন্না লাগে মূর্ত বাস্তব উপলব্ধি থেকে। যে-অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে নারীশরীরের ইন্দ্রিয়সুখাবহ গুণ, তাতে কিংবদন্তির কিছু নেই, এবং এগুলো যদি কেউ ফুল বা উপলের সাথে তুলনা করে বর্ণনা করেন, তাতে তিনি কিংবদন্তির জগতে যান না। কিন্তু নারী হচ্ছে দেহ, দেহ হচ্ছে রাত্রি ও মৃত্যু, বা দেহ হচ্ছে মহাজগতের মহিমা, এসব বলা হচ্ছে পার্থিব সত্য ছেড়ে শূন্য আকাশে উড়াল দেয়া। কেননা পুরুষও নারীর কাছে দেহ; এবং নারী নিতান্ত এক দৈহিক কস্তু নয়; এবং দেহ প্রত্যেকের কাছে প্রত্যেক অভিজ্ঞতায় প্রকাশ করে বিশেষ তাৎপর্য। এটা খুবই সত্য যে নারী–পুরুষের মতোই প্রকৃতির ভেতরে শেকড়ছড়ানো এক মানুষ; পুরুষের থেকে সে অধিকতর দাসতে বন্দী তার প্রজাতির কাছে, তার পশুত্ব অনেক বেশি স্পষ্ট; কিন্তু যেমন পুরুষের ভেতরে তেমনি নারীর ভেতরেও বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হয় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে, সেও মানুষের জগতের অন্তর্ভুক্ত। তাকে প্রকৃতির সাথে সমীভূত করা নিতান্তই পূর্বসংস্কারজাত কাজ।
শাসক জাতের কাছে কম কিংবদন্তিই বেশি সুবিধাজনক হয়েছে নারীকিংবদন্তির থেকে : এটা প্রতিপাদন করে সমস্ত বিশেষাধিকারের যাথার্থ্য, এমনকি অনুমোদন করে সেগুলোর অপব্যবহার। শারীরবৃত্তিক যে-সব দুঃখকষ্ট ও ভার নারীর নিয়তি, সেগুলো দূর করা নিয়ে পুরুষের মাথাব্যথা নেই, কেননা সেগুলো ‘প্রকৃতির ঈপ্সিত’ : সেগুলোর অজুহাতে পুরুষ বরং বাড়িয়ে চলে নারীর দুঃখকষ্ট, যেমন, কামসুখ লাভের কোনো অধিকার দেয়া হয় না নারীকে, তাকে খাটতে বাধ্য করা হয় ভারবাহী পশুর মতো।
এসব কিংবদন্তির মধ্যে নারীর ‘রহস্য’-এর কিংবদন্তিটি পুরুষের মনে যতোটা দৃঢ়ভাবে নোঙর ফেলে আছে, ততোটা আর কোনো কিংবদন্তি নয় এর আছে অজং সুবিধা। প্রথমত, যা কিছু অব্যাখ্যেয় মনে হয়, এটা দিয়ে সে-সব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়; যে-পুরুষ নারীকে বোঝে না, সে সুখ পায় মনের একটা মন্ময় উনতাকে বস্তুগত প্রতিরোধ দিয়ে বদল করে; নিজের অজ্ঞতা স্বীকারের বদলে সে নিজের। বাইরে বোধ করে এক ‘রহস্য’-এর উপস্থিতি; এ এমন এক অজুহাত, যা একসঙ্গে তুষ্ট করে আলস্য ও অহমিকাকে। প্রেমাহত হৃদয় এভাবে এড়িয়ে যায় বহু নিরাশা : প্রেমিকার আচরণ যদি হয়খামখেয়ালপুর্ণ, কথাবার্তা হয় মূঢ়, তাহলে এসব কিছুকে অব্যাহতি দেয়ার কাজ করে এ-রহস্য এবং পরিশেষে, আবার রহস্যের কল্যাণে, স্থায়ী করা হয়সে-নঞর্থক সম্পর্ক কিয়র্কেগার্দের কাছে যা অশেষভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিলো সদর্থক অধিকারের থেকে।
নারী, এক অর্থে, নিশ্চয়মই রহস্যময়, মেটারলিংকের ভাষায় ‘যেমন সমগ্র বিশ্বই রহস্যময়’। পুরুষ নারীর কামসুখের রীতি, ঋতুস্রাবের ঝামেলা, এবং সন্তান প্রসবের যন্ত্রণা সম্পর্কে অজ্ঞ। সত্য হচ্ছে দু-পক্ষেই আছে রহস্য : পুংলিঙ্গসম্পন্ন অপরূপে, প্রত্যেক পুরুষেরও আছে আন্তর একটি রূপ, একটি অন্তর্গত সত্তা, যা নারীর পক্ষে অভেদ্য; অন্যদিকে নারীও অজ্ঞ পুরুষের কামসুখ সম্পর্কে। কিন্তু যে-বিশ্বজনীন সূত্র আমি বর্ণনা করেছি, সে-অনুসারে পুরুষ যে-সমস্ত ধারণা দিয়ে বিশ্ব সম্পর্কে চিন্তা করে সেগুলো তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, ধ্রুরূপে প্রতিষ্ঠিত : এখানে, যেমন সবখানে, তারা পারস্পরিকতাকে ঠিকভাবে বুঝতে পারে না। পুরুষের কাছে এক রহস্য, তাই নারীকে বিবেচনা করা হয় সারসত্তায় রহস্যময়।
তার পরিস্থিতি খুবই দায়ী নারী সম্পর্কে এ-ধারণার জন্যে। তার শারীরবৃত্তিক প্রকৃতি খুবই জটিল : সে নিজে এর এমন অধীন যেনো সে অনুবর্তী বাইরের কোনো নিরর্থক কাহিনীর; তার দেহকে নিজের সুস্পষ্ট প্রকাশ বলে মনে হয় না তার কাছে; এর ভেতরে তার নিজেকেই নিজের অচেনা মনে হয়।
তবে সাধারণভাবে যাকে নির্দেশ করা হয় রহস্য বলে, তা সচেতন সত্তার কোনো মন্ময় একাকীত্বও নয়, গোপন জৈবিক জীবনও নয়। শুধুযোগাযোগের স্তরেই শব্দটি প্রকাশ করে তার প্রকৃত অর্থ : এটা কোনো শুদ্ধ নিঃশব্দতায়, অন্ধকারে, অনুপস্থিতিতে পরিণত করা নয়, এটা জ্ঞাপন করে এক বিভ্রান্তিকর রূপ, যা নিজেকে প্রকাশ করতে ও স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। নারী এক রহস্য, একথা বলার অর্থ এ নয় যে সে নীরব, বরং এর অর্থ হচ্ছে তার ভাষা দুর্বোধ্য; সে আছে, কিন্তু অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঢাকা; এসব অনিশ্চিত রূপ পেরিয়ে সে আছে। সে কী? দেবদূতী, দানবী, অনুপ্রাণিত, অভিনেত্রী? মনে করা যেতে পারে যে এসব প্রশ্নের উত্তর আছে, কিন্তু সেগুলো আবিষ্কার করা অসম্ভব, অথবা এও মনে করা যেতে পারে কোনো উত্তরই যথার্থ নয়, কেননা এক মৌল দ্ব্যর্থবোধকতা নারীসত্তার বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ : হয়তো নিজের অন্তরে সে নিজের কাছেও অনিরূপণীয় : একটি স্ফিংক্স।
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে সে কী তা স্থির করতে গিয়ে সে-ই ব্ৰিত বোধ করবে; তবে এটা এজন্যে নয় যে গৃঢ় সত্যটি এতোই অস্বচ্ছ যে শনাক্ত করা যায়না : এটা এজন্যে যে এ-এলাকায় কোনো সত্য নেই। একজন অস্তিত্বশীল যা করে, সে তা ছাড়া আর কিছুই নয়; সম্ভবপর বাস্তবকে পেরিয়ে ছড়িয়ে থাকে না, সারসত্তা অস্তিত্বের পূর্ববর্তী নয় : বিশুদ্ধ মন্ময়তায়, মানুষ কিছু নয়। তাকে পরিমাপ করতে হবে তার কাজ দিয়ে। কোনো কৃষাণী সম্পর্কে কেউ বলতে পারে যে সে একটি ভালো বা। খারাপ শ্রমিক, কোনো অভিনেত্রী সম্পর্কে বলা যায় যে তার প্রতিভা আছে বা নেই; কিন্তু কেউ যদি কোনো নারীকে বিবেচনা করে তার সীমাবদ্ধ রূপে, তার আন্তর সত্তায়, তাহলে আসলে তার সম্পর্কে কিছুই বলা সম্ভব নয়, তখন তার কোনো বৈশিষ্ট্যই থাকে। তার কাম বা দাম্পত্য সম্পর্ক, সমস্ত সম্পর্কে, নারী যেখানে একটি অনুগত দাসী, অপর, তাকে সেখানে দেখা হয় তার সীমাবদ্ধতার মধ্যে। লক্ষণীয় যে নারী সহকর্মীদের, সহচরদের কোনো রহস্য নেই; অন্য দিকে, যদি অনুগত দাসটি হয় পুরুষ, যদি একজন প্রবীণ বা ধনী নারী বা পুরুষের কাছে তরুণটি, উদাহরণস্বরূপ, পালন করে পরিহার্য বস্তুর ভূমিকা, তখন সেও হয়ে ওঠে রহস্যাবৃত। এটা আমাদের কাছে উন্মোচন করে নারীর রহস্যের তলদেশের এক ভিত্তিমূল, যা প্রকৃতিতে আর্থনীতিক।
কোনো ভাবাবেগকে কোনো বস্তু বলে মনে করা যায় না। জিদ লিখেছেন, ‘ভাবাবেগের ক্ষেত্রে বাস্তবিককে কাল্পনিকের থেকে পৃথক করা হয় না’। কাল্পনিক ও বাস্তবিকের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব শুধু আচরণ দিয়ে। পুরুষ যেহেতু পৃথিবীতে আছে এক সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থানে, সে সক্রিয়ভাবে দেখাতে পারে তার প্রেম; অনেক সময় সে ভরণপোষণ করে নারীটির, বা কমপক্ষে আর্থিকভাবে সাহায্য করে; নারীটিকে বিয়ে করে তাকে দেয় সামাজিক মর্যাদা; সে তাকে উপহার দেয়; তার আর্থিক ও সামাজিক স্বাধীনতা তাকে উদ্যোগ নিতে সাহায্য করে। অধিকাংশ সময়ই পুরুষটি থাকে ব্যস্ত, নারীটি কর্মহীন : পুরুষটি যতোক্ষণ নারীটির সাথে থাকে ততোক্ষণ সে নারীটিকে সময় দেয়, নারীটি নেয় : তা কি সুখের সাথে, সংরাগের সাথে, না কি শুধু প্রমোদের জন্যে? নারীটি কি এসব গ্রহণ করে প্রেমে, না কি নিজের স্বার্থে? সে কি তার স্বামীকে বা তার বিয়েকে ভালোবাসে? এমনকি পুরুষটির প্রমাণও দ্ব্যর্থতাবোধক : এটা-সেটা উপহার কি ভালবেসে দেয়া হয়েছে, না কি করুণা করে? কিন্তু কোনো নারী যখন কোনো পুরুষের সাথে সম্পর্কবশত পায়অজস্র সুবিধা, তখন কোনো নারীর সঙ্গে কোনো পুরুষের সম্পর্ক পুরুষটির জন্যে ততোটা মাত্র লাভজনক যতোটা সে ভালোবাসে নারীটিকে। তাই তার মনোভাবের সম্পূর্ণ চিত্র থেকে তার প্রীতির মাত্রা অনেকটাই নির্ণয় করা যায়।
অধিকাংশ নারীর জন্যেই সীমাতিক্রমণের পথ রুদ্ধ : কেননা তারা কিছুই করে না, তাই তারা নিজেদের কিছু করে তুলতে ব্যর্থ হয়। তারা নিরন্তর ভাবে তারা কী হতে পারতো, এবং এটা তাদের মনে প্রশ্ন জাগায় তারা কী? এটা এক নিষ্ফল প্রশ্ন। পুরুষ যে ব্যর্থ হয় নারীত্বের গূঢ় সারসত্তা আবিষ্কারে, তা শুধু এজন্যে যে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। বিশ্বের প্রান্তিক অবস্থানে রেখে এ-বিশ্ব দিয়ে নারীকে বস্তুনিষ্ঠভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে না; তার রহস্য শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই লুকিয়ে রাখে না।
এছাড়াও, সব উৎপীড়িতের মতোই, নারী ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করে রাখে তার বস্তুগত সত্য; দাস, ভৃত্য, দরিদ্র, যারা নির্ভরশীল কোনো প্রভুর-খেয়ালখুশির ওপর, তারা সবাই তার দিকে মেলে রাখতে শেখে একটি পরিবর্তনহীন হাসি বা একটা বিভ্রান্তিকর নির্বিকারত্ব; আসল ভাবাবেগ, বাস্তবিক আচরণ তারা সযত্নে গোপন করে রাখে। অধিকন্তু কিশোরী বয়স থেকে নারীকে শেখানো হয় পুরুষের কাছে মিথ্যে কথা বলতে, ফন্দি আঁটতে, ধূর্ত হতে। পুরুষের সাথে কথা বলার সময় সে মুখের ওপর পরে থাকে একটা কৃত্রিম ভাব; সে সতর্ক,কপটতাপূর্ণ, সে করে অভিনয়।
কিন্তু কিংবদন্তিমূলক চিন্তাধারায় শনাক্ত করা হয়েছে যে-নারীত্বের রহস্য, তা এক গভীরতর ব্যাপার। আসলে, এটা অবিলম্বে জ্ঞাপন করা হয় ধ্রুব অপর-এর পুরাণে। বিশুদ্ধ সীমাবদ্ধ রূপে এটা স্পষ্টতই হবে এক রহস্য। এটা নিজেই হবে এক রহস্য এ-ঘটনা থেকে যে এটা নিজের কাছেই রহস্য; এটা হবে ধ্রুব রহস্য।
একইভাবে এটা সত্য যে তাদের আসল মনোভাব গোপন করে রাখার ফলে সৃষ্টি হয় যে-গোপনীয়তা, তার বাইরে ততোখানি রহস্যই থাকে কৃষ্ণকায়ে, পীতকায়ে, যতোখানি ধ্রুবভাবে তাদের মনে করা হয় পরিহার্য অপর। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে আমেরিকার নাগরিকেরা গভীরভাবে হতবুদ্ধি করে গড়পড়তা ইউরোপীয়দের, কিন্তু কেউ তাদের কখনো ‘রহস্যময়’ মনে করে না : স্ত্রভাবে তারা বলে যে আমেরিকার নাগরিকদের তারা বুঝতে পারে না। এবং একইভাবে নারীও সব সময় পুরুষকে ‘বোঝে’ না; তাই বলে পুরুষের রহস্য বলে কোনো জিনিশ নেই। ব্যাপার হচ্ছে ধনী আমেরিকা, এবং পুরুষ, আছে প্রভুর ধারে, আর দাসদেরই আছে রহস্য।
একথা সত্য, রহস্যের সদর্থক বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা ধ্যান করতে পারি শুধু প্রতারণা করার উদ্দেশ্যের প্রদোষকালীন পার্শ্বপথে; কিন্তু কোনোকোনো গৌণ দৃষ্টিভ্রমের মতোই তার দিকে একদৃষ্টে তাকালে, তা অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। ‘রহস্যময়ী’ নারীদের চিত্রিত করতে গিয়ে সাহিত্য সব সময়ই ব্যর্থ হয়; শুধু উপন্যাসের শুরুতেই। তারা দেখা দেয় অদ্ভুত, বিভ্রান্তিকর চরিত্ররূপে; কিন্তু গল্পটি যদি অসমাপ্ত থেকে না যায়, তবে শেষে তারা ত্যাগ করে তাদের রহস্য এবং তারপর হয়ে ওঠে নিতান্তই সামঞ্জস্যপূর্ণ ও স্বচ্ছ মানুষ। উদাহরণস্বরূপ, পিটার শিনির বইগুলোর নায়কেরা সব সময়ই বিস্মিত হয়নারীদের অভাবিত চপলতায় : তারা কখন কী করবে সে-সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণাই করা যায় না, তারা সব হিশেবনিকেশকে বিপর্যস্ত করেদেয়। ঘটনা হচ্ছে একবার যখন পাঠকদের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায় তাদের কার্যকলাপের কারণ, তখন দেখা যায় যে ওগুলো কাজ সাধনের খুবই সরল পদ্ধতি : এ-নারীটি ছিলো একটি গুপ্তচর, ওইটি ছিলো চোর; প্লট যতোই চাতুর্যপূর্ণই হোক-নাকেননা, রহস্যের জট খোলার একটি চাবি থাকে সব সময়ই; লেখকের যদি থাকতো বিশ্বের সমস্ত প্রতিভা ও কল্পনাশক্তি, তাহলে এটা অন্য রকম হতে পারতো না। রহস্য কখনোই মরীচিকার থেকে বেশি কিছু নয়, দেখার জন্যে আমরা যখন কাছাকাছি আসি, তখন তা অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমরা দেখতে পাই যে পুরুষের কাছে তার উপকারিতা দিয়েই অনেকাংশে ব্যাখ্যা করা যায় কিংবদন্তি। নারীর কিংবদন্তি একটা বিলাস। এটা দেখা দিতে পারে তখন, পুরুষ যখন মুক্তি পায় তার জীবনযাপনের জরুরি চাহিদাগুলো থেকে; সম্পর্কগুলো যতো বাস্তবিকভাবে যাপিত হয়, ততোই কম আদর্শায়িত হয়। প্রাচীন মিশরের ফেলা, বেদুইন চাষী, মধ্যযুগের কারিগর, আজকের শ্রমিক তার বিশেষ নারীটির সাথে সম্পর্কে থাকে তার কাজ ও দারিদ্র্যের মধ্যে, তা এতো সুনির্দিষ্ট যে তাকে কোনো শুভ বা অশুভ অলৌকিক আভা দিয়ে অলঙ্কৃত করা যায় না। যেসব পর্ব ও সামাজিক শ্রেণী স্বপ্ন দেখার মতো অবকাশ পেয়েছিলো, সেগুলোই সৃষ্টি করেছে নারীত্বের, শাদা বা কালো, ভাবমূর্তি। তবে বিলাসের সাথে ছিলো উপযোগীতাও; এসব স্বপ্ন অপ্রতিরোধ্যভাবে চালিত হয়েছিলো স্বার্থ দিয়ে। এসব কিংবদন্তির মাধ্যমে কার্যকর রীতিতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজগুলো ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলোতাদের বিধিবিধান ও প্রথা; কিংবদন্তিরূপেই গোত্রীয় অবশ্যকর্তব্যগুলো প্রত্যেকের চেতনায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিশ্বাসরূপে। ধর্ম, প্রথা, ভাষা, কাহিনী, গান, চলচ্চিত্র প্রভৃতি যোগাযোগমাধ্যমের ভেতর দিয়ে এসব কিংবদন্তি ঢোকে এমন সব মানুষের মধ্যেও, যারা খুবই কঠোরভাবে আবদ্ধ বাস্তুব অবস্থার দাসত্বে। এতে প্রত্যেকে দেখতে পায় তার নীরস অভিজ্ঞতাগুলোর শোধিত রূপ: যে-নারীকে সে ভালোবাসে, তার দ্বারা প্রতারিত হয়ে সে ঘোষণা করে যে নায় এক বাতিকগ্রস্ত জরায়ু; অন্য কেউ তার নপুংসকতা দিয়ে আবিষ্ট হয়ে নারীকে বলে আরাধনাকারী ম্যান্টিস; আবার একজন উপভোগ করে তার স্ত্রীর সঙ্গ : দ্যাখো, নারী হচ্ছে সঙ্গতি, বিশ্রাম, সুপ্রসন্ন মৃত্তিকা। পকেট-মাপের একটি ধ্রুবর বিনিময়ে, যা থাকে অধিকাংশ পুরুষেরই, চিরন্তনের জন্যে অভিরুচি পরিতৃপ্ত হয় কিংবদন্তিতে। ক্ষুদ্রতম আবেগ, তুচ্ছ বিরক্তি হয়ে ওঠে এক শাশ্বত ধারণার প্রতিফলন–এমন এক প্রতিভাস, যাতে অহমিকা বোধ করে প্রীতিকর শ্লাঘা।
কিংবদন্তি হচ্ছে মিথ্যে বস্তুনিষ্ঠতার এক ফাঁদ, যার দিকে হঠকারীর মতো ছুটে যায় সে-পুরুষ, যে নির্ভর করে আগে-থেকে-প্রস্তুত মূল্যায়নে। এখানে আমরা আবার। জড়িয়ে পড়ি বাস্তবিক অভিজ্ঞতার স্থানে বসানো একগুচ্ছ মূর্তি এবং এর জন্যে দরকার যে-মুক্তমনের বিচার, তার সাথে। একজন স্বায়ত্তশাসিত অস্তিত্বের সঙ্গে খাঁটি সম্পর্কের স্থানে নারীর কিংবদন্তি স্থাপন করে মরীচিকার এক অপরিবর্তনীয় ধারণা। ‘মরীচিকা! মরীচিকা’! চিল্কার করে ওঠেন লাফৰ্গ। ‘আমাদের উচিত তাদের খুন করা, কেননা তাদের আমরা বুঝতে পারি না; তার চেয়ে ভালো তাদের অষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, শিক্ষা দেয়া, এমন করা যাতে তারা ছেড়ে দেয় তাদের রত্নের জন্যে রুচি, তাদের করে তুলতে হবে আমাদের সত্যিকারের সমান সঙ্গী, আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু, তাদের ভিন্নভাবে পোশাক পরাতে হবে, তাদের চুল ছোটো করে ছাটাতে হবে, যাকিছু এবং সব কিছু বলতে হবে তাদের সাথে’। পুরুষ যদি নারীকে প্রতীকের ছদ্মবেশ পরানো ছেড়ে দেয়, তাহলে পুরুষের কোনো ক্ষতি নেই। লাক্লস, স্তেদাল, হেমিংওয়ের নায়িকাদের কোনো রহস্য নেই, সেজন্যে তারা কম আকর্ষণীয় নয়। নারীর মধ্যে একজন মানুষকে স্বীকার করলে পুরুষের অভিজ্ঞতা দরিদ্র হয়ে ওঠে না : এতে এর বৈচিত্র্য, এর ঐশ্বর্য, বা এর তীব্রতা এতোটুকুও কমে না, যদি তা ঘটে দুটি মানুষের মধ্যে। সমস্ত কিংবদন্তি বর্জন করা হলে ধ্বংস করা হয় না দুটি লিঙ্গের সব নাটকীয় সম্পর্ক, পুরুষের কাছে নারীর বাস্তবতা দিয়ে খাঁটিরূপে প্রকাশিত তাৎপর্য এতে অস্বীকার করা হয় না; এতে বাতিল হয় না কবিতা, প্রেম, অভিযাত্রা, সুখ, স্বপ্নদেখা। যা চাই, তা হচ্ছে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে আচরণ, ভাবাবেগ, সংরাগ।
‘হারিয়ে গেছে নারী। নারীরা কোথায়? আজকালকার নারীরা নারীই নয়!’ আমরা দেখেছি এসব রহস্যময় পদ কী অর্থ বোঝায়। পুরুষদের চোখে এবং সেনারীবাহিনী, যারা দেখে পুরুষদের চোখ দিয়ে, তাদের কাছে- নারীর শরীর থাকা বা স্ত্রী অথবা মা হিশেবে নারীর কাজগুলো করাই ‘খার্টি নারী’ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। কামে ও মাতৃত্বে কর্তা হিশেবে নারী স্বায়ত্তশাসন দাবি করতে পারে; তবে ‘খাঁটি নারী’ হওয়ার জন্যে নিজেকে তার স্বীকার করে নিতে হবে অপর-রূপে। আজকালকার পুরুষেরা দেখিয়ে থাকে মনোভাবের এক ধরনের কপটতা, যা নারীর মনে সৃষ্টি করে বেদনাদায়ক ক্ষত : সব মিলিয়েতারা নারীকে একজন সহচর মানুষ, একজন সমান মানুষ হিশেবে মেনে নিতে চায়; কিন্তু তবু চায় যে নারী থাকবে অপ্রয়োজনীয়। নারীর কাছে এ-দুটি নিয়তি অসুঙ্গতিপূর্ণ একটির সাথেও ঠিকমতো মেলাতে না পেরে সে দুলতে থাকে একটি থেকে আরেকটিতে, এবং এ থেকে জন্মে তার ভারসাম্যের অভাব। পুরুষের কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনের মধ্যে কোনো ছেদ নেই : কাজকর্মে ও বিশ্বে পুরুষ যতো বেশি প্রতিষ্ঠা করে তার অধিকার, তাকে দেখায় ততো বেশি পৌরুষসম্পন্ন; তার মধ্যে মিলিত হয় মানবিক ও প্রাণশক্তিগত গুণগুলো। আর সেখানে নারীর স্বাধীন সাফল্যগুলো তার নারীত্বের বিরোধী; কেননা ‘খাঁটি নারী’র কাছে চাওয়া হয় যে নিজেকে সে করে তুলবে বস্তু, করে তুলবে অপর।
এটা খুবই সম্ভব যে সংশোধিত হতে চলছে পুরুষের সংবেদনশীলতা ও যৌনতা। ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছে এক নতুন সৌন্দর্যতত্ত্ব। সমতল বুক ও সংকীর্ণ নিতম্বের ফ্যাশন–ছেলেদের মতো অবয়ব–যদিও টিকেছে স্বল্প সময় ধরে, তবু অতীত শতাব্দীগুলোর অতি-অতি-বৃদ্ধিশীল আদর্শ আর ফিরে আসে নি। চাওয়া হয় যে নারীর দেহ হবে মাংস, তবে সতর্কভাবে; এটাকে হতে হবে তন্বী এবং মেদে বোঝাই হতে পারবে না; হতে হবে পেশল, কোমল, সবল, এটাকে জ্ঞাপন করতে হবে। সীমাতিক্ৰমণতার ব্যঞ্জনা; অতিশয় ছায়াবৃত উষ্ণগৃহের উদ্ভিদের মতো বিবর্ণ হবে না এটা, তবে ভালো হয় যদি হয় রোদে-খোলা-থেকে কর্মজীবী পুরুষের কবন্ধের মতো রোদ-পোড়া তামাটে। নারীর পোশাক ব্যবহারিক হয়ে উঠছে বলে তাকে কামহীন দেখালে চলবে না : বরং ঘটেছে উল্টোটা, খাটো স্কার্ট পা ও উরুকে করে তুলেছে এতো আকর্ষণীয় যে তা আগে কখনো ঘটে নি। কাজ যে কেড়ে নেবে নারীর যৌনাবেদন তার কোনো কারণ নেই। নারীকে একই সঙ্গে একজন সামাজিক ব্যক্তি ও কামের শিকার বলে ভাবা বেশ পীড়াদায়ক।
যা নিশ্চিত তা হচ্ছে আজ নারীদের পক্ষে একই সাথে স্বায়ত্তশাসিত মানুষ হিশেবে তাদের মর্যাদা ও তাদের নারীসুলভ নিয়তি মেনে নেয়া খুবই কঠিন; এটা সে-নির্বোধ ভুল ও অস্থিরতার উৎস, যার জন্যে তাদের কখনো কখনো মনে করা হয় ‘বিলুপ্ত লিঙ্গ’। সন্দেহ নেই যে মুক্তির জন্যে কাজের থেকে অন্ধ দাসত্বের কাছে আত্মসমর্পণ অনেক বেশি আরামপ্রদ : মৃতরা জীবিতদের থেকে অনেক ভালোভাবে খাপ খায় মাটির সাথে। সব দিক দেয়ই অতীতে ফেরা যতোটা কাম্য, তার থেকে বেশি অসম্ভব। যা অবশ্যই আশা করতে হবে, তা হচ্ছে যে-পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে যাচ্ছে, পুরুষদের তা অকুণ্ঠিতচিত্তে মেনে নিতে হবে; শুধু তখনই নারী সে-পরিস্থিতিতে বাস করতে পারবে মানসিক যন্ত্রণা ছাড়া। তখনই পাওয়া যাবে লাফর্গের প্রার্থনার উত্তর : ‘আহ, তরুণীরা, কখন তোমরা হবে আমাদের ভাই, অন্তরঙ্গভাবে আমাদের ভাই পরিশেষে শোষিত হওয়ার ভয় ছাড়া? কখন আমরা সত্যিকারভাবে ধরবো হাত শক্ত করে?’ তখন ব্রেতোর ‘মেলুসিন, আর থাকবে না পুরুষ কর্তৃক তার ওপর চাপিয়ে দেয়া দুর্যোগের ভারের নিচে। মুক্ত মেলুসিন…’ ফিরে পাবে মানুষের মাঝে তার স্থান। তখন সে হবে একজন সম্পূর্ণ মানুষ, ‘যখন রাবোর চিঠি থেকে উদ্ধৃত করছি, নারীর অসীম দাসত্ব ধ্বংস হবে, যখন সে নিজের মধ্যে ও নিজের জন্যে বাঁচবে, পুরুষ–এ-পর্যন্ত ঘৃণার্হ –তাকে হতে দেবে স্বাধীন’।