৩.৩ ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফিকেশন

২১.

ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফিকেশন এর ছোট ল্যাবরেটরির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। কেন কম বসে বসে সেটা নিয়েই অলস চিন্তা করে সময় কাটাচ্ছে ডর্স। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ল্যাব এর একমাত্র কর্মীর হাতের কাজ শেষ হওয়ার জন্য।

মেয়েটাকে খুটিয়ে দেখছে ডর্স। হালকা পাতলা গড়ন, লম্বাটে মুখ। সুন্দরী নয়, পাতলা ঠোঁট, গর্তে ঢোকা চোয়াল, কিন্তু গভীর বাদামী চোখে অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার দ্যুতি। ডেস্কের নেমপ্লেটে জ্বল জ্বল করছে : সিনডা মুনেই।

কাজ শেষ করে ডর্সের দিকে ফিরল সে। “মাফ করবেন, ড, ভেনাবিলি। কাজটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাই এমনকি পরিচালকের স্ত্রীর জন্যও মাঝপথে থামিয়ে দিতে পারি নি।”

“আমার জন্য কাজ বন্ধ করলেই বরং হতাশ হতাম। তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি।”

“শুনে খুশি হলাম। কে প্রশংসা করেছে?”

“অল্প কয়েকজন। শুনেছি তুমি প্রজেক্টের সবচেয়ে দক্ষ এবং মেধাবী ননম্যাথমেটিশিয়ান।”

মুখ বিকৃত করল মুনেই। “আমাদেরকে গণিতের জগত থেকে আলাদা করে রাখার একটা প্রবৃত্তি চলছে। আমার মতে, আমি দক্ষ এবং মেধাবী হলে এই প্রজেক্টেরই দক্ষ এবং মেধাবী সদস্য। ননম্যাথমেটিশিয়ান হওয়াতে কিছু যায় আসে না।”

“অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা, আমি একমত। প্রজেক্টে তুমি কতদিন থেকে আছ?”

“আড়াই বছর। তার আগে স্ট্রিলিং এ রেডিয়্যাশনাল পদার্থ বিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন করেছি, ওই সময়েই শিক্ষানবীশ হিসেবে প্রজেক্টে কয়েক বছর কাজ করেছিলাম।”

“শুনেছি প্রজেক্টে তুমি যথেষ্ট ভালো করেছ।”

“দুবার পদোন্নতি হয়েছে, ড, ভেনাবিলি।”

“এখানে তুমি কোনো সমস্যায় পড়েছ, ড. মুনেই?–তোমার মন্তব্য গোপন থাকবে।”

“কাজগুলো কঠিন, নিঃসন্দেহে, কিন্তু আপনি যদি সামাজিক সমস্যার কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে আমার জবাব হচ্ছে না। অন্তত এমন বিশাল আর জটিল একটা প্রজেক্টে যা স্বাভাবিক তার বেশী কিছু না।”

“তোমার এই কথার অর্থ?”

“ছোটখাটো ঝগড়া, তর্ক-বিতর্ক। আমরা সবাই মানুষ।”

“তেমন মারাত্মক কিছু না।”

মাথা নাড়ল মুনেই। “তেমন মারাত্মক কিছু না।”

“আমি আরো শুনেছি, ড. মুনেই, যে তুমি প্রাইম রেডিয়্যান্টের জন্য একটা যন্ত্র তৈরি করেছ। এই যন্ত্রটার জন্যই প্রাইম রেডিয়ান্টে বিপুল পরিমাণ তথ্য ধারণ সম্ভব হয়েছে।”

উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুনেই এর মুখে।

“আপনি শুনেছেন?–হ্যাঁ, ইলেক্ট্রো ক্ল্যারিফায়ার। ওই যন্ত্রটা আবিষ্কারের পরই প্রফেসর সেলডন এই ল্যাবরেটরি তৈরি করে আমাকে দায়িত্ব দেন।”

“অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে এতবড় একটা অগ্রগতির পরেও তুমি প্রজেক্টের আরো শীর্ষ পদ পাও নি কেন।”

“আসলে, বিব্রত ভঙ্গীতে জবাব দিল মুনেই, “পুরো কৃতিত্বটা আমি একা নিতে চাই না। আমার কাজটা ছিল একজন প্রকৌশলীর–তবে আমি মনে করি অত্যন্ত দক্ষ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকৌশলী।”

“তোমার সাথে আর কে কাজ করেছে?”

“আপনি জানেন না? টামউইল ইলার। তাত্ত্বিক বিষয়গুলো সে-ই তৈরি করে দিয়েছে। আমি ডিজাইন এবং মূল যন্ত্রটা তৈরি করেছি।”

“তার মানে পুরো কৃতিত্বটাই সে নিয়েছে, ড. মুনেই।”

“না। না। আপনার ধারণা ভুল। ড. ইলার সেই ধরনের মানুষ নন। আমি যতটুকু করেছি তার জন্য পুরো কৃতিত্ব আমাকে দিয়েছেন। তিনি যন্ত্রটার নাম দিতে চেয়েছিলেন আমাদের নামে আমাদের দুজনের নামে। কিন্তু পারেন নি।”

“কেন?”

“প্রফেসর সেলডনের তৈরি করা নিয়ম। প্রতিটি যন্ত্র এবং সমীকরণ তাদের কার্যকারিতার ভিত্তিতে পরিচিত হবে, কারো ব্যক্তিগত নাম যুক্ত করা যাবে না–ঈর্ষা এবং বিদ্বেষ এড়ানোর জন্য। তাই যন্ত্রটা শুধুই ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার। যখন একসাথে কাজ করেছি তখন যন্ত্রটার নাম আমাদের দুজনের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলাম, বিশ্বাস করুন, ড. ভেনাবিলি, চমৎকার শোনাত। হয়তো একদিন প্রজেক্টের সদস্যরা নিজেদের নাম ব্যবহার করতে পারবে, আশা করি।”

“আমিও আশা করি। তোমার কথায় মনে হচ্ছে ড, ইলার চমৎকার একজন মানুষ।”

“নিঃসন্দেহে। তার সাথে কজা করে আনন্দ পাওয় যায়। এই মুহূর্তে আমি যন্ত্রটার উন্নত সংস্করণ তৈরির চেষ্টা করছি, যা হবে আরো বেশী শক্তিশালী কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। অর্থাৎ যন্ত্রটা কি কাজে লাগবে। তিনি অবশ্য আমাকে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।”

“কেমন অগ্রগতি হচ্ছে?”

“ভালোই। সত্যি কথা বলতে কি ড. ইলারকে আমি একটা প্রোটোটাইপ তৈরি করে দিয়েছি। উনি সেটা পরীক্ষা করে দেখবেন। সব ঠিক থাকলে কাজ আরো এগিয়ে নিয়ে যাব।”

“চমৎকার। যদি প্রফেসর সেলডন অবসর নেন এই প্রজেক্টের কি হবে। এই বিষয়ে তোমার কি ধারণা? যদি তাকে অবসর নিতেই হয়?”

অবাক হলো মুনেই। “প্রফেসর অবসরের কথা ভাবছেন?”

“আমি সেরকম কিছু শুনি নি। তোমার সামনে একটা হাইপোথিটিক্যাল সমস্যা তুলে ধরলাম। ধরা যাক তিনি অবসর নিলেন। তার যোগ্য উত্তরসূরি কে হবে? তোমার মুখে যা শুনলাম তাতে ধরে নিচ্ছি তুমি ড. ইলারকেই নতুন পরিচালক হিসেবে সমর্থন করবে।”

“হ্যাঁ,” কষ্টকর দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর জবাব দিল মুনেই। “নতুনদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেশী মেধাবী এবং আমি মনে করি এই প্রজেক্ট সে যোগ্যতার সাথে চালিয়ে নিতে পারবে। সমস্যা হলো, তার বয়স কম। পুরনো আর বৃদ্ধ অনেকেই আছে–তারা তরুণ একজনের নেতৃত্ব মেনে নেবে না।”

“পুরনোদের মাঝে বিশেষ কারো নাম বলতে পারবে? মনে রেখো তোমার বক্তব্য গোপন থাকবে।”

“হাতে গোনা কয়েকজন দায়িত্ব নেয়ার মতো যোগ্য, কিন্ত ড. এমারিল সবচেয়ে যোগ্য উত্তরসূরি।”

“বুঝতে পেরেছি,” উঠে দাঁড়াল ডর্স। “তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।”

ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার আর এমারিলের কথা ভাবতে ভাবতে সে চলে গেল।

.

২২.

“আবার এসেছ, ডর্স, ইউগো এমারিল বলল।

“দুঃখিত, ইউগো। এই সপ্তাহে তোমাকে দুবার বিরক্ত করতে এলাম। আসলে তোমার কাছে মানুষজন খুব একটা আসে না, তাই না?”

“আমিই আসতে দেই না। কাজের ক্ষতি হয়, চিন্তা ভাবনা করতে পারি না। তবে, তোমার কথা আলাদা। তুমি আর হ্যারি, আমার জন্য তোমরা যা করেছ তা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না।”

উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গীতে হাত নাড়ল ডর্স। “বাদ দাও, ইউগো। হ্যারির জন্য তুমি কঠোর শ্রম দিয়েছ। আমরা কিছু করে থাকলে তুমি তা ফিরিয়ে দিয়েছ হাজারগুণ বেশী। প্রজেক্টের কাজ কেমন চলছে? হ্যারি কখনো আমাকে বলে না।”

এমারিলের চেহারা উজ্জ্বল হলো, মনে হলো তার দেহে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। “ভালো, বেশ-ভালো। গাণিতিক ব্যাখ্যা ছাড়া বলা কঠিন, কিন্তু গত দুই বছরে যে অগ্রগতি হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর বলা যায় আসল অগ্রগতিটাই হয়েছে এই সময়ে। অনেকটা এইরকম যে অনবরত হাতুড়ি মারতে মারতে কঠিন দেয়ালটা ভাঙতে শুরু করেছে অবশেষে।”

“শুনেছি ড. ইলারের নতুন সমীকরণগুলো তোমাদের যথেষ্ট সাহায্য করছে।”

“অনৈরাজ্যক সমীকরণ? হ্যাঁ, ভীষণ।”

“ইলেক্টো-ক্ল্যারিফায়ারও অনেক সাহায্য করছে। যে মেয়েটা এই যন্ত্রের ডিজাইন তৈরি করেছে আমি তার সাথে কথা বলেছি।”

“সিনডা মুনেই?”

“হ্যাঁ।”

“অসম্ভব বুদ্ধিমতি মেয়ে। আমাদের সৌভাগ্য যে এমন একজন কর্মী পেয়েছি।”

“তুমি বেশীরভাগ সময়ই প্রাইম রেডিয়্যান্ট নিয়ে কাজ কর, তাই না?”

“প্রায় সারাক্ষণই এটা স্টাডি করি।”

“তখন ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার ব্যবহার কর?”

“নিশ্চয়ই।”

“তুমি কখনো ছুটি নেয়ার কথা ভেবেছ, ইউগো?”

ঘুমঘুম দৃষ্টিতে ডর্সের দিকে তাকাল এমারিল, ধীরে ধীরে চোখ পিট পিট করছে। “ছুটি?”

“হ্যাঁ। শব্দটা নিশ্চয়ই তুমি শুনেছ। অর্থও জানো।”

“আমি ছুটি নেব কেন?”

“কারণ তোমাকে আমার মনে হচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত।”

“তা খানিকটা ক্লান্ত তো বটেই। কিন্তু আমি কাজ ফেলে কোথাও যেতে চাই না।”

“তুমি কি এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী ক্লান্ত বোধ কর?”

“কিছুটা। বয়স হচ্ছে, ডর্স।”

“মাত্র ঊনপঞ্চাশ।”

“কম বলা যাবে না।”

“ঠিক আছে, বাদ দাও, ইউগো। হ্যারির কাজকর্ম কেমন চলছে? তুমি ওর সাথে দীর্ঘদিন থেকে আছ। ওর ব্যাপারে তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ বলতে পারবে না। এমনকি আমিও না। অন্তত ওর কাজের ব্যাপারে।”

“ভালোই কাজ করছে ডর্স। ওর কোনো পরিবর্তন আমার চোখে পরে নি। এই প্রজেক্টে তার মাথা এখনো সবচেয়ে তীক্ষ্ণ এবং দ্রুত কাজ করে। বয়স তার উপর কোনো প্রভাব ফেলে নি।”

“খুশির খবর। কিন্তু তার নিজের ধারণা তোমার মতো এতো ভালো না। বয়সটাকে সে ভালোভাবে নেয় নি। জন্মদিনের উৎসব পালনের জন্য তাকে রাজী করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ভালো কথা, অনুষ্ঠানে তুমি ছিলে? আমি দেখি নি।”

“কিছুক্ষণের জন্য ছিলাম। কিন্তু তুমি তো জানই, এসব পার্টিফার্টি আমার ভালো লাগে না, অস্বস্তি বোধ করি।”

“তোমার কি মনে হয় হ্যারি শেষ হয়ে গেছে? আমি তার মেধা শক্তির কথা বলছি না। তার শারীরিক সামর্থ্যের কথা বলছি। সে কি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে–এতো ক্লান্ত যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারবে না?”

অবাক হলো এমারিল। “ভেবে দেখি নি। হ্যারি ক্লান্ত হতে পারে এমনটা আমি কখনো কল্পনাও করি না।”

“হতেও তো পারে। আমার মনে হয় সে এখন তরুণ কারো হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কথা প্রায়ই ভাবে।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল এমারিল। ডর্স ঢোকার পর থেকেই একটা গ্রাফিক্স স্টাইলাস হাতে নিয়ে দোলাচ্ছিল। সেটা নামিয়ে রেখে বলল, “কি! হাস্যকর! অসম্ভব!”

“কি বলছ তুমি?”

“অবশ্যই। আমার সাথে আলোচনা না করে সে কখনোই এমন সিদ্ধান্ত নেবে না। কোনোদিন নেয় নি।”

“বোঝার চেষ্টা কর, ইউগো। হ্যারি নিঃশেষ হয়ে গেছে, যদিও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। যদি সে অবসর নেয়? প্রজেক্টের কি হবে? সাইকোহিস্টোরির কি হবে?”

সরু চোখে তাকাল এমারিল। “তুমি ঠাট্টা করছ, ডর্স?”

“না, আমি শুধু ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছি।”

“হ্যারি অবসর নিলে আমি তার দায়িত্ব নেব। সে আর আমি এই প্রজেক্ট শুরু করেছি। তখন আর কেউ ছিল না। কেউ না। শুধু আমি আর সে। হ্যারির পরে সাইকোহিস্টোরির বিষয়ে আমার চেয়ে বেশী আর কেউ জানে না। অবাক লাগছে আমিই যে তার উত্তরসূরি এটা তোমার মাথায় আসে নি কেন।”

“আমার বা অন্য কারো মনে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তুমিই যোগ্য উত্তরসূরি কিন্তু তুমি কি দায়িত্ব নিতে চাও? হয়তো সাইকোহিস্টোরির সবই তুমি জান, কিন্তু বিশাল প্রজেক্টের রাজনীতি এবং জটিলতার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চাও তুমি, আসল কাজ বাদ দিয়ে? আসলে প্রজেক্টটাকে সুন্দরভাবে চালানোর চেষ্টাতেই শেষ হয়ে গেছে হ্যারি। তুমি কি সেই দায়িত্ব নিতে পারবে?”

“হ্যাঁ, পারব এবং এই বিষয়ে আলোচনা করতে চাই না আমি। শোন, ডর্স, তুমি কি এই কথাই বলতে এসেছ যে হ্যারি আমাকে বের করে দিতে চাইছে?”

“নিশ্চয়ই না! তুমি কেমন করে ভাবলে? হ্যারিকে কখনো দেখেছ বন্ধুদের ত্যাগ করতে?”

“বেশ, তাহলে এই আলোচনা বাদ। কিছু মনে করো না, ডর্স, আমার সত্যিই অনেক কাজ আছে।” অভদ্রের মতোই ডর্সের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার কাজে ডুবে গেল সে।

“নিশ্চয়ই। আমি তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না।”

.

২৩.

“মা, ভেতরে এস,” বলল রাইখ। “কোনো অসুবিধা নেই। মানীলা এবং ওয়ানডা বাইরে গেছে।”

ভেতরে ঢুকল ডর্স, সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী প্রথমে ডানে এবং বামে তাকাল, তারপর বসে পড়ল সবচেয়ে কাছের চেয়ারটায়।

“ধন্যবাদ,” বলল সে। কিছুক্ষণ নিরবে বসেই রইল, মনে হলো যেন পুরো এম্পায়ারের বোঝা তার কাঁধে চেপেছে।

অপেক্ষা করল রাইখ, তারপর বলল, “প্যালেস গ্রাউণ্ডে তোমার দুঃসাহসিক অভিযানের কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয় নি। খুব কম মানুষের মা এমন সাহসী হয়।”

“ওই ব্যাপারে কথা বলতে আসি নি, রাইখ।”–“বল তাহলে তোমার মুখ দেখে কখনো কিছু বোঝা যায় না, তবে এখন

তোমাকে দেখাচ্ছে ভীষণ মনমরা। কেন?”

“ঠিকই বলেছ। সত্যি কথা বলতে কি মনমেজাজ ভীষণ খারাপ কারণ আমার। মনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে অথচ তোমার বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই। সে এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে চমৎকার মানুষ, কিন্তু তাকে কিছু বোঝানো অসম্ভব। সে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। এক কথায় উড়িয়ে দেবে। বলবে এটা তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমার অমুলক ভয়–এবং তাকে রক্ষা করার চেষ্টা।”

“শোনো, মা, বাবার নিরাপত্তা নিয়ে তুমি সবসময়ই অকারণ ভয় পাও। তোমার মনে যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তা ভুলও তো হতে পারে।”

“ধন্যবাদ। ঠিক তোমার বাবার মতো করেই বলেছ। আরো হতাশ হলাম। পুরোপুরি হতাশ।”

“বেশ, সব খুলে বল। প্রথম থেকে।”

“ব্যাপারটা শুরু হয়েছে ওয়ানডার স্বপ্ন দিয়ে।”

“ওয়ানডার স্বপ্ন! মা! তোমার আসলেই এখন থামা উচিত। বুঝতে পারছি কেন বাবা তোমার কথা শুনতে চায় না, বাচ্চা একটা মেয়ের স্বপ্নকে তুমি ফুলিয়ে ফাপিয়ে বিশাল ব্যাপারে দাঁড় করাচ্ছ। হাস্যকর।”

“আমার মনে হয় না ওটা কোনো স্বপ্ন ছিল। আমার মনে হয় বাচ্চা মেয়েটা যে ঘটনাটাকে মনে করেছে স্বপ্ন বাস্তবে সেখানে সত্যিকারের দুজন মানুষ কথা বলছিল এবং সেই আলোচনাকেই সে তার দাদার মৃত্যু বিষয়ক ভেবে নেয়।”

“বেপরোয়া অনুমান। সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?”

“ধরে নাও যে সত্যি। যে কথাটা সে খুব ভালোভাবে মনে রাখতে পেরেছে তা হলো, লেমনেড ডেথ। ঠিক এটাই স্বপ্নে দেখল কেন? আসলে সে অন্য কোনো শব্দ শুনেছে এবং ছোট বুদ্ধিতে যতটুকু পেরেছে শব্দটা নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে আসল শব্দটা কি ছিল?”

“আমি বলতে পারব না,” জবাব দিল রাইখ, তার কণ্ঠে অবিশ্বাস। ব্যাপারটা ধরতে পারল ডর্স। “তোমার ধারণা এটাও আমার অসুস্থ কল্পনা। কিন্তু আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে এই প্রজেক্টেই হ্যারির বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র চলছে।”

“এই প্রজেক্টে? অসম্ভব, বাচ্চা একটা মেয়ের স্বপ্নকে গুরুত্ব দেয়ার মতোই অসম্ভব।”

“প্রতিটি বড় প্রজেক্টই ঈর্ষা, ক্ষোভ আর পেশাগত বিদ্বেষে জর্জরিত।”

“নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। কিন্তু সেটা তো আর ষড়যন্ত্র নয়। বাবাকে খুন করার মতো কিছু নয়।”

“পরিমাণের পার্থক্য। হয়তো পার্থক্যটা খুব কম।”

“এই কথা তুমি কখনো বাবাকে বিশ্বাস করাতে পারবে না। আমাকেও না।” অস্থিরভাবে হেঁটে কামরার অপরপ্রান্তে চলে গেল রাইখ, আবার ফিরে এসে বলল, “আর তুমি এই ষড়যন্ত্রটা বের করার চেষ্টা করছ, তাই না?”

মাথা নাড়ল ডর্স।

“এবং ব্যর্থ হয়েছ?”

আবারও মাথা নেড়ে জবাব দিল ডর্স।

“তোমার কি মনে হয় নি, মা, ব্যর্থ হয়েছ কারণ কোনো ষড়যন্ত্রই আসলে নেই?”

মাথা নাড়ল ডর্স। “এখন হয়তো ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু তাতে একটা ষড়যন্ত্র যে আছে আমার এই বিশ্বাস টলবে না। আমার মন বলছে।”

হেসে ফেলল রাইখ। “তোমার কথাটা আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই শোনাল, মা। তোমার কাছ থেকে, আমার মন বলছে, এর চেয়ে আরো শক্ত মন্তব্য আশা করেছিলাম,

“একটা শব্দ আছে যা আমার মনে হয় বিকৃত করলে লেমনেড’-এর মতো শোনায়। লেম্যান-এইডেড।”

“লেমনেইডেড? এটা আমার কী?”

“লেম্যান-এইডেড। দুটো শব্দ। লেম্যান হচ্ছে তারাই প্রজেক্টের গণিতবিদরা যাদেরকে ননম্যাথমেটিশিয়ান বলে।”

“তো?”।

“ধরা যাক, কেউ একজন লেম্যান-এইডেড ডেথ’-এর কথা বলেছে যার অর্থ হ্যারিকে এমন এক উপায়ে খুন করা হবে যেখানে একাধিক ননম্যাথমেটিশিয়ান জড়িত থাকবে। এই শব্দটা হয়তো ওয়ানডার কানে লেমনেড ডেথ’-এর মতো শুনিয়েছে। যেহেতু শব্দটা সে আগে শুনে নি আবার অন্যদিকে সে লেমনেড এর ভীষণ ভক্ত?”

“তুমি বলতে চাও যে সব জায়গা ছেড়ে তারা বাবার অফিসে বসেই কথা বলছিল–ভালো কথা, কতজন ছিল?”

“ওয়ানডা তার স্বপ্নের বর্ণনা দেয়ার সময় দুজনের কথা বলেছিল। আমার মতে দুজনের একজন জান্তার কর্ণেল হিন্ডার লিন। কেউ একজন তাকে প্রজেক্টে ঢোকার সুযোগ করে দেয় ওই সময়েই হ্যারিকে পথ থেকে সরানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিল তারা।”

“তোমার কল্পনা ক্রমেই আরো বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে, মা। কর্ণেল লিন এবং অন্য কেউ একজন বাবার অফিসেই খুনের পরিকল্পনা করছিল অথচ জানত না যে বাচ্চা একটা মেয়ে চেয়ারে লুকিয়ে তাদের আলোচনা শুনছে। তাই না?”

“মোটামুটি।”

“সেক্ষেত্রে, যদি তাদের আলোচনায় লেম্যানের উল্লেখ থাকে তাহলে কর্ণেল লিন-এর সাথের লোকটি সম্ভবত একজন গণিতবিদ।”

“সেরকমই মনে হচ্ছে।”

“পুরোপুরিই অসম্ভব। কিন্তু যদি সত্যি হয় তাহলে কোন গণিতবিদকে সন্দেহ। করছ? প্রজেক্টে পঞ্চাশজনের মতো আছে।”

“সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয় নি। কয়েকজন গণিতবিদ আর কয়েকজন লেম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, কিন্তু কোনো সূত্র পাই নি। অবশ্য সরাসরি তো আর প্রশ্ন করা যায় না।”

“অর্থাৎ যাদের সাথে কথা বলেছ তাদের কেউই একটা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে কোনো সূত্র তোমাকে দিতে পারে নি?”

“না।”

“অবাক হই নি। ওরা সেরকম কোনো পরিকল্পনা করে নি, কারণ,–“

“তোমার কারণটা আমি জানি, রাইখ। তোমার কি মনে হয় যে মাত্র দুই একটা প্রশ্ন করলেই অপরাধীরা ভয় পেয়ে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেবে? বল প্রয়োগ করার কোনো উপায় ছিল না। গণিতবিদদের বিরক্ত করলে তোমার বাবা কি বলবে তুমি তো জানই।”

তারপর হঠাৎ কণ্ঠস্বরে জরুরী ভাব ফুটিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “রাইখ, এর মাঝে ইউগো এমারিলের সাথে দেখা হয়েছে তোমার?”

“না। জানই তো, মানুষটা সামাজিক প্রাণী নয়। ওর কাছ থেকে সাইকোহিস্টোরি কেড়ে নাও, তাহলে একতাল শুকনো চামড়ার মতো পড়ে থাকবে।”

দৃশ্যটা কল্পনা করে মুখ বিকৃত করল ডর্স। “এই সপ্তাহে ওর সাথে দুবার কথা বলেছি। মনে হয়েছে কেমন যেন গুটিয়ে গেছে ও। ক্লান্ত বলছি না, কিন্তু জগৎ সংসারের কোনো খোঁজ খবরই নেই।”

“হ্যাঁ। ইউগো এমনই।”

“ওর অবস্থা কি এখন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে?”

কিছুক্ষণ ভাবল রাইখ। “হতে পারে। ওর বয়স হচ্ছে। আমাদের সবারই হচ্ছে। শুধু তুমি বাদে, মা।”

“তুমি কি বলবে যে ইউগো তার সামর্থের সীমা পেরিয়ে গেছে এবং এখন খানিকটা ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে?”

“কে? ইউগো? ভারসাম্য হারানোর মতো কোনো কিছু নেই ওর। সাইকোহিস্টোরি নিয়ে ওকে থাকতে দাও, নীরবে বাকী জীবনটা পার করে দেবে?”

“আমার তা মনে হয় না। একটা বিষয়ের প্রতি সে আগ্রহী–ভীষণ আগ্রহী। সেটা হচ্ছে উত্তরাধিকারীত্ব।”

“কিসের উত্তরাধিকারীত্ব?”

“আমি তাকে বলেছিলাম তোমার বাবা হয়তো একদিন অবসর নেবে। তাতেই প্রকাশ পেল যে ইউগো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ–ভীষণ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ–তার উত্তরসূরি হওয়ার জন্য।”

“অবাক হই নি। কেউই দ্বিমত করবে না যে ইউগোই অবশ্যম্ভাবী উত্তরসূরি। আমার বিশ্বাস বাবাও তাই মনে করে।”

“কিন্তু এই ক্ষেত্রে তাকে আমার ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় নি। সে ভেবেছিল আমি জানাতে এসেছি যে হ্যারি তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে। চিন্তা করতে পারো হ্যারিকে নিয়ে কেউ এমন ভাববে?”

“অদ্ভুত–“ গভীর চিন্তা নিয়ে মায়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল রাইখ। তারপর বলল, “তুমি কি বলতে চাও যে ইউগোই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। বাবাকে হটিয়ে নিজেই দায়িত্ব নিতে চাইছে?”

“সেটা কি অসম্ভব?”।

“হ্যাঁ, অসম্ভব। পুরোপুরি। ইউগোর সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত পরিশ্রম, আর কিছু না। সবসময় সমীকরণের দিকে তাকিয়ে থাকলে, সারাদিন আর অর্ধেক রাত, যে কেউ পাগল হয়ে যাবে।”

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল ডর্স। “ঠিকই বলেছ।”

অবাক হলো রাইখ, “কি ব্যাপার?”

“তোমার কথা শুনে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। হয়তো কাজ হবে।” আর কোনো কথা না বলে চলে গেল সে।

.

২৪.

হ্যারি সেলডনের সাথে কথা বলার সময় ডর্সের কণ্ঠের অসম্ভটি গোপন থাকল না। “গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে চারদিন কাটিয়ে এলে। কোনো যোগাযোগ নেই আর এবারও তুমি আমাকে ফেলে একা গেছ।”

স্বামী স্ত্রী যার যার হলস্ক্রীনে পরস্পরের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারি একটা গবেষণার কাজ শেষ করে এইমাত্র ইম্পেরিয়াল সেক্টরের গ্যালাকটিক লাইব্রেরী থেকে ফিরে এসেছেন। ফিরে আসার খবর জানানোর জন্যই প্রজেক্ট অফিস থেকে ডর্সের সাথে যোগাযোগ করেছেন। রেগে গেলেও, ভাবলেন হ্যারি, ডর্সকে ভীষণ সুন্দর দেখায়। ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে তার চিবুকে আদর করতে।

“ডর্স,” শুরু করলেন তিনি, খানিকটা অনুনয়ের সুরে, “আমি একা যাই নি। অনেকেই ছিল সাথে। আর গ্যালাকটিক লাইব্রেরী অন্য সব জায়গার চেয়ে স্কলারদের জন্য অনেক বেশী নিরাপদ। এখন থেকে আমাকে প্রায়ই লাইব্রেরীতে যেতে হবে।”

“আর তুমি আমাকে না জানিয়েই যেতে থাকবে?”

“ডর্স, আমার নিরাপত্তা নিয়ে তোমার যে ভয় তার সাথে আমি সারাক্ষণ বাস করতে পারব না। এটাও চাই না যে তুমি আমার সাথে গিয়ে লাইব্রেরীয়ানদের বিরক্ত করে তোল। ওরা তো আর জান্তার সদস্য নয়। ওদেরকে আমার প্রয়োজন এবং ওদেরকে আমি রাগাতে চাই না। একটা কাজ অবশ্য করার কথা ভাবছি আমরা–কাছাকাছি একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে পারি।”

চেহারার গাম্ভীর্য দূর হলো ডর্সের। মাথা নেড়ে বিষয় পরিবর্তন করল, “তুমি কি জান গত কয়েকদিনে ইউগোর সাথে আমি দুবার কথা বলেছি?”

“চমঙ্কার। আমি খুশি হয়েছি। বাইরের পৃথিবীর সাথে ওর একটা যোগাযোগ থাকা দরকার।”

“হ্যাঁ, এখন আরো বেশী দরকার, কারণ ওর বোধহয় কিছু একটা হয়েছে। এতদিন যে ইউগো আমাদের সাথে ছিল সে আর এখন নেই। কেমন যেন অনিশ্চয়তায় ভোগে, নিজের ভেতরে গুটিয়ে গেছে আরো বেশী সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার–একটা ক্ষেত্রে সে ভীষণ আবেগপ্রবণ–তোমার অবসরের পর তোমার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া।”

“স্বাভাবিক ভাবেই আমার পরে সে-ই হবে প্রজেক্টের পরিচালক–যদি আমার আগেই মরে না যায়।”

“সে তোমার চেয়ে বেশীদিন বাঁচবে এটা তুমি আশা কর না?”

“আমার চেয়ে সে এগারো বছরের ছোট, কিন্তু পরিস্থিতির উত্থান পতন—”

“তুমি বুঝতে পেরেছ ইউগোর অবস্থা ভালো নয়। তাকে তোমার চেয়ে বয়স্ক দেখায়, এবং মনে হচ্ছে পরিবর্তনটা ইদানীং হয়েছে। সে কি অসুস্থ?”

“শারীরিকভাবে? আমার তা মনে হয় না। সে নিয়মিত চেকআপ করায়। যদিও স্বীকার করছি যে তাকে অনেক নিঃশেষিত দেখায়। তাকে আমি ছুটি নেয়ার কথা বলেছিলাম, কয়েক মাস–চাইলে সব সুযোগসুবিধাসহ এক বছরের। বলেছিলাম যেন ট্র্যানটর থেকে দূরে কোথাও চলে যায়, যেন প্রজেক্ট থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকতে পারে। জিটোরিন-এ যেতে পারত–খুব বেশী আলোকবর্ষ দূরে না। চমৎকার একটা রিসর্ট ওয়ার্ল্ড। খরচ নিয়েও ভাবতে হতো না।”

অধৈর্য ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল ডর্স। “নিশ্চয়ই সে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমিও বলেছিলাম কিন্তু এমন ভাব করল যেন ছুটি শব্দটার অর্থই সে জানে না। এক কথায় না করে দিল।”

“আমরা কি করতে পারি?” জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“একটু ভেবে দেখতে পারি। পঁচিশ বছর ধরে এই প্রজেক্টে কাজ করছে ইউগো। এতদিন কোনো সমস্যা হয় নি কিন্তু মনে হচ্ছে এখন হঠাৎ করেই সে অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে গেছে। বয়সের কারণে এটা হতে পারে না। এখনো পঞ্চাশই হয় নি।”

“তুমি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছ?”

“হ্যাঁ। তুমি আর ইউগো তোমাদের প্রাইম রেডিয়্যান্টে কতদিন থেকে ইলেক্ট্রো ক্ল্যারিফায়ার ব্যবহার করছ?”

“প্রায় দুবছর–বেশীও হতে পারে।”

“আমার ধারণা যারা প্রাইম রেডিয়্যান্ট নিয়ে কাজ করে তারাই ইলেক্ট্রো ক্ল্যারিফায়ার নিয়ে কাজ করে।”

“ঠিক।”

“অর্থাৎ তুমি আর ইউগোই সবচেয়ে বেশী?”

“হ্যাঁ।”

“আর ইউগো তোমার চেয়ে বেশী?”

“সে তার কাজের পুরো সময়টাই প্রাইম রেডিয়্যান্ট আর এর অন্তর্ভুক্ত সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে প্রশাসনিক কাজেই বেশী ব্যস্ত থাকতে হয়।”

“মানুষের শরীরে ইলেক্টো-ক্ল্যারিফায়ার কি ধরনের প্রভাব ফেলে?”

অবাক হলেন সেলডন। “তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব ফেলে বলে শুনি নি।”

“সেক্ষেত্রে একটা বিষয় আমাকে বুঝিয়ে দাও, হ্যারি। ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ারের ব্যবহার শুরু হয়েছে দুবছর হলো। এই সময়ের মাঝে তুমি হয়ে গেছ অবিশ্বাস্যরকম ক্লান্ত, যুক্তিহীন এবং খানিকটা আনমনা। কেন?”

“আমার বয়স হচ্ছে ডর্স।”

“বাজে কথা। কে বলেছে তোমাকে যে ষাট বছর হলেই মানুষ পাগল হয়ে যায়? বয়সটাকে তুমি একটা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছ। ইউগো, যদিও তার বয়স আরো কম, ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ারের সামনে তোমার চেয়ে আরো দীর্ঘ সময় কাটায়, ফলশ্রুতিতে সে হয়ে পড়েছে আরো বেশী ক্লান্ত, যুক্তিহীন, এবং আমার মতে অসম্ভব আনমনা। আর উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে ছেলেমানুষের মতো জেদ ধরতে শুরু করেছে। তোমার কাছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না?”

“বয়স আর অত্যাধিক পরিশ্রম। এটাই গুরুত্বপূর্ণ।”

“না, আসল কারণ ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার তোমাদের দুজনের উপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।”

কিছুক্ষণ নীরব থেকে সেলডন বললেন, “তোমার মন্তব্যটাকে ভুল প্রমাণ করতে পারব না ডর্স, বুঝতেও পারছি না। ইলেকট্রো-ক্ল্যারিফায়ার এমন এক যন্ত্র যা অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ ক্ষেত্র তৈরি করে, যে ধরনের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের মাঝে মানুষ প্রতিনিয়তই বসবাস করছে। তাতে কোনোরকম অস্বাভাবিক ক্ষতি হয় না। যাই হোক এই যন্ত্র ব্যবহার না করে পারা যাবে না। এটা ছাড়া প্রজেক্টের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার কোনো উপায় নেই।”

“হ্যারি, তোমাকে একটা অনুরোধ করব, রাখতেই হবে। আমাকে না বলে তুমি প্রজেক্টের বাইরে কোথাও যাবে না, কিছু করবে না। বুঝতে পেরেছ?”

“তোমার এই কথাটা কেমন করে রাখব, ডর্স? তুমি তো আমার হাত পা বেঁধে ফেলছ।”

“মাত্র কিছুদিনের জন্য, কয়েকদিন বা এক সপ্তাহ।”

“কয়েকদিন বা একসপ্তাহে কি হবে?”

“বিশ্বাস রাখ আমার উপর। সব ঠিক করে দেব।”

.

২৫.

পুরনো সাংকেতিক ভঙ্গীতে দরজায় শব্দ করলেন হ্যারি সেলডন। চোখ তুলে তাকাল ইউগো এমারিল। “হ্যারি, তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।”

“আসলে ঘন ঘন আসা উচিত। আগে তুমি আর আমি সারাক্ষণই এক সাথে থাকতাম। এখন শত শত মানুষের কথা চিন্তা করতে হয়। এখানে, সেখানে সব

জায়গাতে আর ওরা তোমার আমার মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর শুনেছ?

“কোন খবর?”

“জান্তা মাথাপিছু কর আরোপ করতে যাচ্ছে। ট্র্যানটর ভীশনে আগামীকাল ঘোষণা দেয়া হবে। এখন শুধু ট্র্যানটরে, আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোকে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন। খানিকটা হতাশ হয়েছি। ভেবেছিলাম পুরো এম্পায়ারে একসাথে প্রয়োগ করা হবে। আমি অবশ্য জেনারেলকে সব বুঝিয়ে বলতে পারি নি।”

‘ট্র্যানটরই যথেষ্ট। আউটার ওয়ার্ল্ডগুলো বুঝবে যে তাদের পালা আসতে দেরী নেই।”

“কি ঘটে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”

“যা ঘটবে তা হলো ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ এবং দাঙ্গা, নতুন কর ব্যবস্থা কাজ শুরু করার আগেই।”

“তুমি নিশ্চিত?”

এমারিল সাথে সাথে প্রাইম রেডিয়্যান্ট চালু করে নির্দিষ্ট অংশটাকে পরিবর্ধিত করে তুলল। “নিজের চোখেই দেখ, হ্যারি। এই ব্যাখ্যা ভুল হতে পারে না। বিদ্যমান নির্দিষ্ট অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই আমাদের প্রেডিকশন। যদি তা না ঘটে তাহলে ধরে নিতে হবে, যে সাইকোহিস্টোরি আমরা তৈরি করেছি সেটা ভুল, কিন্তু আমি তা মানি না।”

“আমি মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করব,” হাসিমুখে বললেন সেলডন। “তুমি কেমন আছ, ইউগো?”।

“ভালো। যথেষ্ট ভালো।–তুমি কেমন আছ? শুনলাম অবসর নেয়ার কথা ভাবছ। ডর্সও একই কথা বলেছে।”

“ডর্সের কথায় কান দিও না। তার মাথায় একটা পোকা ঢুকেছে যে প্রজেক্টে একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে।”

“কি বিপদ?”

“জিজ্ঞেস না করাই ভালো। তার সেই পুরনো রোগ।”

এমারিল বলল, “দেখলে তো, আমি একা বলে কত সুবিধা?” তারপর গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “যদি অবসর নাও তাহলে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি হবে?”

“তুমি দায়িত্ব নেবে। আর কি পরিকল্পনা থাকতে পারে?”

হাসি ফুটল এমারিলের মুখে।

.

২৬.

মূল ভবনের ছোট কনফারেন্স রুমে টামউইল ইলার দ্বিধান্বিত দৃষ্টি আর চেহারায় রাগ নিয়ে ডর্স ভেনাবিলির কথা শুনছে। অবশেষে প্রচণ্ড জোরে চীৎকার করল সে, “অসম্ভব!”

চোয়ালে একবার হাত ঘষে সাবধানে বলতে লাগল সে, “আমি আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করতে চাই নি, ড. ভেনাবিলি, কিন্তু আপনার মন্তব্য হাস্যকর–সঠিক হতে পারে না। এই সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টের কারো মনেই এধরনের ভয়ংকর পরিকল্পনা নেই। আপনার সন্দেহ অমূলক। থাকলে আমি বুঝতে পারতাম এবং অবশ্যই আপনাকে জানাতাম।”

“আমি জানি আছে,” জেদী সুরে বলল ডর্স, “এবং আমি প্রমাণ বের করতে পারব।”

“জানি না আপনাকে অসন্তুষ্ট না করে এই কথাটা কিভাবে বলা যাবে ড. ভেনাবিলি, কিন্তু চতুর একজন মানুষ যদি কোনো কিছু প্রমাণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় তাহলে সে যে কোনো এভিডেন্স যোগাড় করতে পারবে–অথবা ধরে নেবে যে। এভিডেন্স সে পেয়েছে।”

“তোমার কি মনে হয় আমি আতংকিত হয়ে পড়েছি?”

“মাস্ট্রোর নিরাপত্তা নিয়ে আপনার যে বিবেচনা–এই কাজটাতে আমি সবসময়ই আপনার সাথে আছি–বলা যায় আপনি অনেকটা বাড়াবাড়ি করেন।”

ইলারের মন্তব্যটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল ডর্স। “একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছ। চতুর একজন মানুষ যে কোনো এভিডেন্স যোগাড় করে নিতে পারবে। যেমন, আমি তোমার বিরুদ্ধেও একটা অভিযোগ দাঁড় করাতে পারি।”

ইলারের দৃষ্টি বিস্ময়ে প্রশস্ত হয়ে গেল। আমার বিরুদ্ধে? বলুন কি অভিযোগ দাঁড় করাবেন?”

“বলছি। জন্মদিনের উৎসবের পরিকল্পনা ছিল তোমার, তাই না?”

“আমি ভেবেছিলাম, হ্যাঁ, কিন্তু সন্দেহ নেই যে অন্যরাও ভেবেছিল। বয়স নিয়ে মাস্ট্রো যেভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন, মনে হয়েছিল একটা উৎসবের মাধ্যমে তার মন ভালো করে দেয়া যাবে।”

“নিঃসন্দেহে, অন্য অনেকেই ভেবেছিল, কিন্তু তুমিই উদ্যোগী হয়ে মাঠে নামলে এবং আমার পুত্রবধূকেও প্রচণ্ড উৎসাহিত করে তোল। কিভাবে যেন তাকে একটা বিশাল উৎসব আয়োজনে রাজী করিয়ে ফেললে।”

“জানি না তাকে কতখানি প্রভাবিত করতে পেরেছি, করলেও কোনো ভুল হয়েছে কি?”

“উৎসব পালন করাতে কোনো ভুল হয় নি, কিন্তু ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী উৎসবের মাধ্যমে আমরা কি আসলে জান্তার কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি নি যে হ্যারি সেলডন অসম্ভব জনপ্রিয় এবং তাদের জন্য হুমকি?”

“আমার মাথায় এই ধরনের কোনো পরিকল্পনা ছিল এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।”

“আমি কেবল সম্ভাবনার কথা বলছি। উৎসবের পরিকল্পনা করার সময় বলেছিলে মূল অফিস ভবন খালি করে ফেলতে হবে–“

“সাময়িকভাবে। কারণ ছিল।”

“–এবং কিছুদিনের জন্য সব কাজ বন্ধ থাকবে। ওই সময়ে আসলেই কেউ কাজ করে নি–ইউগো এমারিল ছাড়া।”

“মনে করেছিলাম উৎসবের আগে মাস্ট্রো একটু বিশ্রাম নিলে ভালো হবে। নিশ্চয়ই শুধু এই কারণে আপনি আমাকে অভিযুক্ত করতে পারবেন না।”

“কিন্তু তার অর্থ এই যে ফাঁকা অফিসে তুমি যে কারো সাথে আলোচনা করতে পারবে, কেউ জানবে না, কারণ অফিসগুলো ভালোমতোই শীল্ড করা।”

“অবশ্যই আলোচনা করেছি আপনার পুত্রবধূর সাথে, ক্যাটারার এর সাথে, সাপ্লায়ার এর সাথে, আরো অনেকের সাথে। প্রয়োজন ছিল বলেই করেছি। আপনার কি মনে হয়?”

“এবং যাদের সাথে আলোচনা করেছ তাদের একজন যদি হয় জান্তার সদস্য?”

ইলারের চেহারা দেখে মনে হলো ডর্স তাকে কষে একটা চড় মেরেছে। “আমি মেনে নিতে পারলাম না, ড. ভেনাবিলি। আপনি আমাকে কি মনে করেন?”

সরাসরি জবাব দিল না ডর্স। বলল, “জেনারেল ট্যানারের সাথে মিটিং এর ব্যাপারে তুমি ড, সেলডনকে বলেছিলে–প্রচণ্ড আগ্রহের সাথেই বলেছিলে–যে তার বদলে তুমি নিজে যেতে চাও। কিন্তু ড. সেলডন রাজী হন নি, বরং বিরক্ত হয়েছিলেন। ঠিক এটাই তুমি চাইছিলে।”

ছোট একটুকরো নার্ভাস হাসি ফুটল ইলারের মুখে, “আপনাকে আমি সম্মান করি তারপরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনার কথাগুলো অহেতুক ভয় পাওয়া একজন মানুষের মতোই শোনাচ্ছে, ডক্টর।”

“তারপর উৎসবের পরে তুমিই পরামর্শ দিয়েছিলে যেন ড. সেলডনের সাথে আমরা আরো কয়েকজন ডোমস এজ হোটেলে যাই, তাই না?”

“হ্যাঁ, এবং আমার মনে আছে যে আপনি এটাকে একটা ভালো পরামর্শ বলে মন্তব্য করেছিলেন।”

“হয়তো জান্তাকে খেপিয়ে তোলার জন্যই পরামর্শটা দেয়া হয়েছিল যেহেতু পুরো প্রচেষ্টাই ছিল হ্যারির জনপ্রিয়তা ফুটিয়ে তোলা? হয়তো পরামর্শটা ছিল প্যালেস গ্রাউণ্ডে আমাকে ঢুকতে বাধ্য করার জন্য?”

“আমি আপনাকে থামাতে পারতাম?” তার অবিশ্বাসী মনোভাব এখন রাগে পরিণত হচ্ছে। এই ব্যাপারে আপনি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।”

“এবং তুমি আশা করেছিলে যে প্যালেস গ্রাউণ্ডে ঢুকলেই জান্তা হ্যারির উপর আরো বেশী ক্ষিপ্ত হবে।”

“কিন্তু কেন, ড. ভেনাবিলি? কেন আমি এমন করব?”

“ড. সেলডনকে অপসারণের জন্য। তাকে হটিয়ে প্রজেক্ট পরিচালকের পদ দখল করার জন্য।”

“এই কথা আপনি ভাবলেন কেমন করে? বিশ্বাস হচ্ছে না যে আপনি সত্যি সিরিয়াস। আসলে আলোচনার শুরুতে যা বলেছিলেন ঠিক তাই করছেন–আমাকে দেখাতে চাইছেন যে একজন চতুর মানুষ কারো বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগার করতে চাইলে কি না করতে পারে।”

“ঠিক আছে, অন্য বিষয়ে কথা বলা যাক। আমি বলেছি যে ফাঁকা অফিসে জান্তার কোনো এক সদস্যের সাথে গোপন শলাপরামর্শ করার সুযোগ ছিল তোমার।”

“কথাটা অস্বীকার করতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।”

“কিন্তু তোমাদের আলোচনা কেউ একজন শুনে ফেলে। বাচ্চা একটা মেয়ে ওই কক্ষেরই একটা চেয়ারে শুয়েছিল, তোমরা দেখতে পাও নি। সে তোমাদের সব কথা শুনে ফেলে।”

ভুরু কোঁচকালো ইলার। “কি শুনেছে?”

“তার বক্তব্য অনুযায়ী দুজন মানুষ কারো মৃত্যু নিয়ে কথা বলছিল। বাচ্চা বলেই বিস্তারিত সব বলতে পারে নি, কিন্তু দুটো শব্দ তার মনে গেঁথে যায়, আর তা হলো, ‘লেমনেড ডেথ।”

“এখন মনে হচ্ছে আপনার কল্পনা মন্তব্যটার জন্য ক্ষমা করবেন–পাগলামীতে পরিণত হচ্ছে। লেমনেড ডেথ’ কথাটার অর্থ কি আর এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?”

“আমার প্রথম চিন্তা ছিল কথাটার কোনো অর্থ নেই। বাচ্চা মেয়েটা লেমনেডের ভীষণ ভক্ত, অনুষ্ঠানেও প্রচুর পরিমাণে ছিল, কিন্তু তাতে বিষ মেশানো হয় নি।”

“কিছুটা সুস্থতার পরিচয় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।”

“তারপর আমি বুঝতে পারি বাচ্চা মেয়েটা আসলে অন্যকিছু শুনেছিল কিন্তু যেহেতু তার ভাষাজ্ঞান এখনো গড়ে উঠেনি এবং পানীয়টা তার অসম্ভব প্রিয়, সে শব্দটাকে বিকৃত করে লেমনেড’ মনে করে নেয়।”

“আর আপনি মূল শব্দটাও আবিষ্কার করেছেন? নাক মুখ কুঁচকে ইলার বলল।

“আমার মনে হতে থাকে শব্দটা লেম্যান-এইডেড-ডেথ হতে পারে।”

“অর্থ কি?”

“লেম্যান বা ননম্যাথমেটিশিয়ান দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ড।”

কথা থামিয়ে ভুরু কুঁচকাল ডর্স। হাত দিয়ে বুক খামচে ধরল।

ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল ইলার। “কি হয়েছে, ড. ভেনাবিলি।”

“কিছু না,” জবাব দিল ডর্স। মনে হলো ঝাঁকুনি দিয়ে অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। কথা বলছে না।

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল ইলার। তার চেহারায় হাসি খুশি ভাবটা নেই। আর এখন। বলল, “আপনার কথাবার্তা, ড. ভেনাবিলি, ক্রমেই আরো বেশী অর্থহীন হয়ে উঠছে এবং আপনি রাগ করলেও কিছু আসে যায় না, আমি শুনতে শুনতে ক্লান্ত বোধ করছি। আলোচনাটা কি এবার শেষ করা যায়?”

“প্রায় শেষ, ড. ইলার। লেম্যান-এইডেড হয়তো আসলেই অর্থহীন। আমি নিজেও ভেবেছি।–ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার তৈরিতে তোমার আংশিক অবদান আছে।”

বুক চিতিয়ে গর্বের সাথে জবাব দিল ইলার, “পুরো অবদানই আমার।”

“নিশ্চয়ই পুরোটা নয়। আমি জানি সিনডা মুনেই যন্ত্রটার ডিজাইন তৈরি করেছে।”

“শুধুই ডিজাইন। তাও আবার আমার নির্দেশ অনুযায়ী।”

“লেম্যান। ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার হচ্ছে একটা লেম্যান এইডেড ডিভাইস।”

“শব্দটা আমি আর শুনতে চাই না। আরেকবার বললে আলোচনা এখানেই শেষ।”

ডর্স থামল না, মনে হলো ইলারের হুমকী শুনতেই পায় নি। এখন তাকে কৃতিত্ব দিচ্ছ না কিন্তু সামনাসামনি ঠিকই দিয়েছিলে–সম্ভবত তাকে কাজে আগ্রহী করে তোলার জন্য। এমনকি তুমি নাকি যন্ত্রটার নাম তোমার আর তার নামের সাথে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলে। কিন্তু লাভ হয় নি।”

“অবশ্যই। যন্ত্রটার নাম ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার।”

“সিনডা এই কথাও বলেছে যে এখন যন্ত্রটার আরো উন্নত ডিজাইন নিয়ে কাজ করছে সে–এবং পরীক্ষা করার জন্য তোমাকে একটা প্রোটো-টাইপও তৈরি করে দিয়েছে।”

“এসব কথা আসছে কেন?”

“যেহেতু ড. সেলডন এবং ড. এমারিল ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার নিয়ে কাজ করেন, সেহেতু তাদের প্রাণশক্তি কেমন যেন নিঃশেষিত হয়ে পড়ছে। ইউগো বেশী সময় এই যন্ত্র নিয়ে কাজ করে বলে ক্ষতিটা তারই হচ্ছে বেশি।”

“ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার কোনো ভাবেই মানুষের ক্ষতি করে না।”

মুখ বিকৃত করে কপালে হাত রাখল ডর্স। “আর এখন তুমি আরো শক্তিশালী ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার তৈরি করেছ যা ক্ষতি করবে আরো বেশী, ধীরে ধীরে না করে দ্রুত খুন করবে।”

“পাগলের প্রলাপ।”

“এবার যন্ত্রের নামের ব্যাপারে আসা যাক, যে নাম সিনডার মতে শুধু তুমিই ব্যবহার করতে। আমার মতে সেটা হচ্ছে ইলার-মুনেই ক্ল্যারিফায়ার।”

“আমার মনে পড়ছে না।” অস্বস্তির সাথে জবাব দিল ইলার।

“অবশ্যই মনে পড়ছে। আর নতুন শক্তিশালী ইলার-মুনেই ক্ল্যারিফায়ার দিয়ে এমন ভাবে খুন করা যাবে যে কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। সবাই ধরে নেবে নতুন অপরিক্ষীত যন্ত্র ব্যবহারের দুর্ঘটনা। এটা হবে ইলার-মুনেই ডেথ’ আর বাচ্চা মেয়েটা শুনেছে ‘লেমনেড ডেথ’।”

ডর্সের দুই হাত দেহের দুপাশে অসহায়ের মতো ঝুলে পড়ল।

“আপনি অসুস্থ, ড. ভেনাবিলি।” নরম সুরে বলল ইলার।

“আমার কিছু হয় নি। যা বলেছি তা সঠিক?”।

“দেখুন, আপনি কোন শব্দকে বিকৃত করে লেমনেড বলছেন সেটা কোনো ব্যাপার নয়। বাচ্চা মেয়েটা কি শুনেছে কে জানে? কিন্তু সব কিছুর মূলে আসছে ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার। আমাকে আদালতে নিয়ে যান অথবা বিশেষজ্ঞদের তদন্ত কমিটি তৈরি করুন–তারা ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ারের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখুক, এমনকি অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন যন্ত্রটাও মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।”

“আমি বিশ্বাস করি না,” বিড়বিড় করে বলল ডর্স। হাত আবার কপালে রেখেছে, চোখ বন্ধ। কিছুটা টলছে।

“কোনো সন্দেহ নেই আপনি অসুস্থ, ড. ভেনাবিলি। তার মানে হয়তো এবার আমার বলার পালা। বলব?”

ডর্স চোখ খুলে শুধু তাকিয়েই রইল।

“আপনার মৌনতাকেই সম্মতি বলে ধরে নিলাম, ডক্টর। ড. সেলডন এবং ড. এমারিলকে হটিয়ে প্রজেক্ট পরিচালকের পদ দখল করার চেষ্টা করে কি হবে? আপনি আমার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেবেন এবং আপনার ধারণা এই মুহূর্তেও তাই করছেন। আবার আমি দুই মহামানবকে সরিয়ে শীর্ষ পদটা দখল করলেই বা কি হতো, আপনি আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতেন। আপনি অস্বাভাবিক এক মহিলা–শক্তিশালী এবং অবিশ্বাস্য রকম গতিশীল এবং যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন, মাস্ট্রো নিরাপদ।”

“হ্যাঁ।”

“জান্তার সদস্যকে আমি এই কথাগুলো বলেছি।–কেন তারা প্রজেক্টের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলে না? ওরা সাইকোহিস্টোরির প্রতি আগ্রহী। হতেই হবে। আপনার ব্যাপারে যা বলেছি তার কিছুই বিশ্বাস করে নি–প্যালেস গ্রাউণ্ডে আপনার অভিযানের আগ পর্যন্ত। তারপর ওরা বিশ্বাস করে এবং আমার পরিকল্পনা মেনে নেয়।”

“এই তো আসল কথায় এসেছ,” দুর্বল সুরে বলল ডর্স।

“আপনাকে বলেছি ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার মানুষের ক্ষতি করে না। আসলেই করে না। এমারিল এবং আপনার প্রিয় হ্যারি বুড়ো হয়েছে–যদিও আপনি মানতে চান না। তাতে কি। ওরা সবল–পুরোপুরি মানুষ। জৈবিক বস্তুর উপর ইলেক্ট্রো ক্ল্যারিফায়ার কোনো প্রভাব ফেলে না কিন্তু ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক যন্ত্রপাতির মারাত্মক ক্ষতি করে, যদি এমন এক মানুষের কথা কল্পনা করা যায় যা ধাতু এবং ইলেক্ট্রনিক্স দিয়ে তৈরি, তখন তারও ক্ষতি হতে পারে। এধরনের কৃত্রিম মানুষের অনেক গল্প শোনা যায়। এই গল্পগুলোই মাইকোজেনিয়ানদের ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তি এবং এই বস্তুটাকে ওরা বলে ‘রোবট। যদি রোবট বলে বাস্তবিকই কিছু থাকে তাহলে সেটা; হবে সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী, গতিশীল, অস্বাভাবিক কিছু গুণাবলী থাকবে, সত্যি কথা বলতে কি, আপনার মাঝে যে গুণাবলীগুলো আছে, ড. ভেনাবিলি। শক্তিশালী ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার দিয়ে তেমন একটা রোবট থামানো যাবে, আহত করা যাবে, পুরোপুরি ধ্বংস করা যাবে। আমার কাছে ঠিক সেরকমই একটা ইলেক্ট্রো-ক্ল্যারিফায়ার আছে যা আপনি আসার পর থেকেই অল্পমাত্রার শক্তিতে চলছে। তাই আপনি অসুস্থ বোধ করছেন, ড. ভেনাবিলি–এবং সম্ভবত আপনার অস্তিত্বে এই প্রথমবার।”

কিছু বলল না ডর্স, শুধু মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ধীরে ধীরে বসল চেয়ারে।

হাসিমুখে আবার শুরু করল ইলার, “আপনি চলে গেলে মাস্ট্রো আর এমারিল। কোনো সমস্যাই না। সত্যি কথা বলতে কি মনের দুঃখে মাস্ট্রেী হয়তো নিজেই পদত্যাগ করবেন। আর এমারিল তো শিশু। দুজনের কাউকেই খুন করতে হবে না। এতদিন পরে গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কেমন লাগছে ড, ভেনাবিলি? এতদিন কেউ আপনাকে চিনতে পারে নি এটা সত্যিই বিস্ময়কর। স্বীকার করতেই হবে যে আপনি বেশ চতুর। কিন্তু আমিও বুদ্ধিমান গণিতবিদ, পর্যবেক্ষক, চিন্তাবিদ, যোগবিয়োগের খেলায় পারদর্শী। অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ আপনার অতি মানবিক ক্ষমতা প্রকাশ না করলে আমিও ধরতে পারতাম না।

“বিদায়, ড. ভেনাবিলি। যন্ত্রটাকে পুরোমাত্রায় চালু করে দিলেই আপনার খেলা শেষ।”

অবশিষ্ট শক্তি একত্রিত করে উঠে দাঁড়াল ডর্স। জড়ানো গলায় বলল, “হয়তো তুমি যা ভাবছ আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তার চেয়েও নিখুঁত” তারপর একটা অস্ফুট শব্দ করে ইলারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল ইলার। কিন্তু তার আগেই আঘাত করল ডর্স। বিদ্যুৎ বেগে হাত চালাল গলা লক্ষ্য করে। সাথে সাথে মারা গেল ইলার।

সোজা হয়ে দাঁড়াল ডর্স। হোঁচট খেতে খেতে এগোল দরজার দিকে। হ্যারির কাছে যেতে হবে। জানাতে হবে কি ঘটেছে।

.

৭.

প্রচণ্ড আতংক নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন হ্যারি সেলডন। ডর্সকে এই অবস্থায় কখনো দেখেন নি, তার মুখ বিকৃত হয়ে আছে, দেহ বাকা, হাঁটার সময় মাতালের মতো টলছে।

“ডর্স! কি হয়েছে।”

ছুটে গিয়ে ডর্সের কোমড় জড়িয়ে ধরলেন তিনি, তার হাতের উপর এলিয়ে পড়ল ডর্স। তাকে পাঁজাকোলা করে তুললেন (ডর্সের ওজন গড় পরতা মেয়েদের তুলনায় বেশী, কিন্তু সেলডন খেয়াল করলেন না) বিছানায় শুইয়ে দিলেন।

“কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলেন।

খুলে বলল ডর্স, হাসফাস করতে করতে, মাঝে মাঝেই তার কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে যাচ্ছে, আর তাকে জড়িয়ে ধরে শুনলেন সেলডন, জোর করে যা ঘটেছে তা নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছেন।

“ইলার মারা গেছে,” ডর্স বলল। “শেষ পর্যন্ত আমি মানুষ খুন করলাম প্রথমবার আরো খারাপ হলো।”

“তোমার ড্যামেজ কত খারাপ, ডর্স?”

“খারাপ। ইলার যন্ত্রটা চালু করে দিয়েছিল পুরো মাত্রায় আমি যখন ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।”

“তোমাকে রিঅ্যাডজাস্ট করা যাবে।”

“কিভাবে? ট্রানটরে–কেউ নেই–যে জানে কিভাবে। আমার ডানীলকে দরকার।”

ডানীল। ডেমারজেল। হ্যারি সেলডন ঠিকই জানতেন। তার বন্ধু একটা রোবট–তাকে একজন রক্ষাকারী দিয়ে গেছে–একটা রোবট–সাইকোহিস্টোরি এবং ফাউণ্ডেশন যেন বিজ হতে অঙ্কুরোদগমের সুযোগ পায়। সমস্যা ছিল একটাই, হ্যারি সেলডন তার রক্ষাকারীকে ভালোবেসে ফেলেন–একটা রোবটকে। এখন সব বুঝতে পারছেন। সব সন্দেহ আর প্রশ্নের জবাব তিনি পেয়ে গেছেন। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তিনি শুধু ডর্সকে চান।

“তোমাকে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেব না।”

“কোনো উপায় নেই।” দৃষ্টি মেলে সেলডনের দিকে তাকাল ডর্স। “অবশ্যই। তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ–ভাইটালপয়েন্ট-এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে?”

সেলডন পরিষ্কার কিছু দেখতে পারছেন না। চোখে কি যেন হয়েছে। আমাকে নিয়ে ভেবো না। তোমার কথা ভাব–তোমার কথা–“

“না। তুমি, হ্যারি। মানীলাকে বলবে–মানীলা–আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সে আমার চেয়ে ভালো। ওয়ানডাকে বুঝিয়ে বলবে। তুমি আর রাইখ দুজন দুজনকে দেখবে।”

“না, না, না।” সেলডন বারবার মাথা সামনে পিছনে ঝাঁকাচ্ছেন। “তুমি এমন করতে পারো না। সহ্য কর, ডর্স। প্লীজ, প্লীজ।”

দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল ডর্স, তারচেয়েও দুর্বলভাবে হাসল। “বিদায়, হ্যারি। মনে রেখো আমার জন্য যা করেছ।”

“আমি তোমার জন্য কিছুই করি নি।”

“তুমি আমাকে ভালোবেসেছ আর তোমার ভালোবাসা আমাকে করেছে মানুষ।”

ডর্সের চোখ খোলাই রইল কিন্তু তার সকল কর্মক্ষমতা থেমে গেছে।

ঝড়ের বেগে সেলডনের অফিসে ঢুকল ইউগো। “হ্যারি, দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। যা আশা করেছিলাম তার চেয়েও দ্রুত এবং ভয়াবহ–“

তারপর ডর্স এবং সেলডনের দিকে দৃষ্টি পড়ল তার। ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”

প্রচণ্ড শোক নিয়ে মাথা তুললেন সেলডন, “দাঙ্গা! এখন আর দাঙ্গা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি হবে?–এখন আর অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি হবে?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *