প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

৩.৩ আগ্রায় রাত্রে শীত

আগ্রায় রাত্রে শীতের ঠেলায় প্রায়ই আমার ভালো করে ঘুম হত না। ভালো বিছানা তো দূরের কথা, বিছানা বলতে আমাদের কিছুই ছিল না বললেই হয়। যদিও সে-সময় আগ্রায় অতি সামান্য খরচেই লেপ-তোশক তৈরি করা যেত, কিন্তু আমরা তা করিনি। কারণ আমাদের কখন কোথায় যেতে হয়, কোথায় আশ্রয় পাই বা না-পাই, বিছানার মতো অত বড় লটবহর বাড়াবার দরকার কি! আমাদের তিনজনের জন্যে তিনটে বালিশ ও একটা পাতলা কম্বল ছিল। কিন্তু ধরণীর বুকে আগুন আছে বলে ভূতাত্ত্বিকেরা যতই প্রচার করুন না কেন, প্রতি রাত্রে সেই পাথরের মেঝে ফুঁড়ে যে জিনিসটি উঠে আমাদের নিদ্রার ব্যাঘাত করত তা আগুন নয়, আগুনের উলটো পিঠ। ঠান্ডা থেকে বাঁচবার জন্যে আমরা মেঝেতে ধুতি জামা কাগজ ইত্যাদি পেতে বিছানা গরম করবার চেষ্টা করতুম। ভাগ্যে পরেশদা তিনজনকে তিনটে ধোশা কিনে দিয়েছিল–তাই চাপা দিয়ে শুয়ে পড়া যেত। প্রথম রাত্রে বয়সের ধর্মে ঘুমিয়ে পড়তুম বটে, কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের ঠেলায় ঘুম ভেঙে যেত, বিশেষ করে পাশ ফেরবার সময়।

এইরকম এক রাত্রে শীতের চোটে উশখুশ করছি, জনার্দন ও সুকান্ত দিব্যি ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে, এমন সময় আবার সেই নারীর কান্নার আওয়াজ কানে এল। বন্ধুদের না তুলে আমি দরজার ফাঁক দিয়ে কারুকে দেখা যায় কি না তার চেষ্টা করতে লাগলুম, কিন্তু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।

ওদিকে কান্না কখনও থামছে, কখনও বাড়ছে, কখনও বা একেবারে থেমে যাচ্ছে। একবার কানে এল–ও আমার প্রাণের রাজা, ও আমার একমাত্র ‘তুই’আমায় ছেড়ে কোথায় আছিস! একবার কি ভুলেও মনে পড়ে না!

মনে-মনে হিসাব করে ঠিক করলুম, এ নারী নিশ্চয়ই পতিহারা বিধবা। কিন্তু দিনকয়েক চেষ্টা করে সন্ধান নিয়ে জানতে পারলুম যে, ও-বাড়িতে বিধবা কেউ নেই। এদিকে একদিন-দু’দিন অন্তর দু’-তিনদিন উপরি-উপরি সেই কান্না শুনতে পাই। কোনোদিন খুবই মৃদু, কোনোদিন ওরই মধ্যে একটু জোরে।

তারপরে একদিন শুনলুম–হে পরমাত্মা! সে যে মা ছাড়া আর কারুকেই জানত না–তুমি তাকে দেখো–

এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, সন্তান-শোকে আকুলা জননী নারী। সন্ধান নিয়ে জানতে পারা গেল, আমার অনুমান ঠিক। বছর-দুয়েক আগে শেঠের একমাত্র ছেলে মারা গিয়েছে–অনেক পুজো হোম যজ্ঞ করে, অনেক সন্ন্যাসীকে গাঁজা খাইয়ে মাদুলি জোগাড় করে নাকি সেই ছেলে হয়েছিল। দেবতা সন্তান দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সে কেবল পুত্রশোক দেবার জন্যে। ছেলেটি চার বছরের হয়ে মারা গিয়েছে।

এই সংবাদ পাওয়ার পর কি জানি কেন সেই অজানা অদেখা নারীর প্রতি সমবেদনায় আমিও ব্যথিত হয়ে উঠলুম–সেই রোদনের সুরে আমিও বাঁধা পড়ে গেলুম। নিশীথ রাত্রে সেই নির্দিষ্ট সময়ে তার কান্না শোনা আমার যেন একটা নেশার মতন হয়ে দাঁড়াল। যেদিন কান্নার সুর শুনতে পাওয়া যেত না, সেদিন আমার অস্বস্তি বোধ হত। মনে হত, বিশ্বনিয়ন্তার রচিত একখানি করুণ কাব্য শুনতে শুনতে হঠাৎ যেন ছন্দপাত হল। এক-একদিন এমনও হয়েছে–আমি আগে উঠে সেই বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে বসেছি তার কিছুক্ষণ পরে কান্না আরম্ভ হয়েছে। পুত্রশোকবিধুরা সেই জননীর রোদনধ্বনির মধ্যে আমি যেন আমার নিজের জননীর রোদনধ্বনির আভাস পেতুম। আমার মনে হত, আমার মা-ও নিশীথ রাত্রে তাঁর পলাতক পুত্রের জন্য এমনি করে অশ্রু বিসর্জন করছেন। সে-কথা মনে হওয়া-মাত্র চোখে জল ঠেলে আসত–সেই অন্ধকারে বসে বসে আমিও অশ্রুপাত করতুম। এমনি করে কেউ কারুকে না দেখে, বন্ধ দরজার দু’পাশে দুজনে বসে কত রাত্রি আমরা কেঁদে কাটিয়েছি তার হিসাব প্রকৃতির ভাণ্ডারে জমা হয়ে আছে।

এইভাবে আমাদের আগ্রায় দিন কাটতে লাগল। একদিন-দু’দিন অন্তর আমরা পরেশদার সেই বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে পরেশদার খবর করি। সে-ভদ্রলোক বলতে থাকে, পরেশচন্দ্র আমাকে মজিয়ে গিয়েছে। তার জিনিসপত্র পড়ে রয়েছে এখানে, বাড়িখানা ভাড়া দিতে পারছি না। জিনিসগুলো নিয়ে কি করব তাও বুঝতে পারছি না। দিল্লিতে তার কেউ নেই কার কাছে এখন এসব জিনিস জিম্মা করে দিই–এরকম ফ্যাসাদে আজ পর্যন্ত কোনো বাড়িওয়ালা পড়েনি।

আমরা তাকে কতবার বুঝিয়ে বললুম যে, পরেশদা ফিরবে না। সেকথা লোকটি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। সে বললে, তা হলে পরেশচন্দ্র অন্তত একটা চিঠি লিখেও আমাকে জানিয়ে দিত।

একদিন সত্যদা বললেন, ওহে, সুখবর আছে। এখানকার একজন ধনী জমিদার আমার বন্ধুলোক, সে কয়েক পুরুষ ধরে লগ্নীর কারবার করে অনেক টাকা করেছে। লোকটা কিছুদিন থেকে একটা ব্যবসা করবার তালে ঘুরছে। কাল সন্ধেবেলা সে আমার কাছে এসেছিল। তোমাদের কথা বলতেই সে লাফিয়ে উঠল। বললে–এইরকম লোকই আমি খুঁজছি; এদের যদি পাই তা হলে আমি কারবারে নামতে রাজি আছি। আমি বলেছি, তাদের যদি লাভের অংশ দাও তা হলে তোমার খাতিরে তাদের বলে-কয়ে তোমার সঙ্গে ব্যবসায় নামতে রাজি করাতে পারি। প্রস্তাব শুনে তো আমরা আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলুম। সত্যদা বললেন, কথা হয়েছে কাল সন্ধেবেলা তোমাদের নিয়ে আমি তার কাছে যাব। কথাবার্তাও হবে আর রাত্রের আহারও ওইখানেই হবে।

সেদিন বিদায়ের সময় সত্যদা বিশেষ করে বলে দিলেন, ওঁহে, কাল একটু তাড়াতাড়ি এসো। সে আবার এখান থেকে অনেক দূরে, এক্কা না হলে যাওয়া যাবে না।

মোটা মানুষ হলেও সত্যদা অসম্ভব হাঁটতে পারতেন–পাঁচ-সাত মাইল যাওয়া ও আসা তাঁর কাছে কিছুই ছিল না বললেই হয়।

আশায় ও আনন্দে সারারাত্রি ভালো করে ঘুমই হল না আমাদের। পরদিন দুপুরেই ওখানে গিয়ে হাজির হলুম। তারপরে দু’খানা এক্কা করে প্রায় দু-ঘণ্টা বাদে আমরা এক গ্রামে, সেই জমিদার-বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। জমিদার-সাহেব মোটাসোটা লোক, রাস্তার ওপরেই বড় তক্তপোশের ওপর বসে ছিলেন, দু-চারজন মোসাহেবও তাঁকে ঘিরে রেখেছেন, দেখলাম। জমিদার-সাহেব বললেন, আপনাদেরই অপেক্ষায় বসে আছি। দু-পক্ষ থেকে আদর-আপ্যায়ন হবার পর সকলেই সেই চৌকিতে আসন নিলাম।

প্রথম দর্শনে জমিদার-সাহেবকে ক্যাবলা-ভোলা লোক মনে হলেও তাঁর কথাবার্তা শুনে মনে হল, বেশ চতুর লোক। বিশেষ করে অর্থের লেন-দেন ব্যাপারে ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন না করেও বেশ সাবধানী। নিজের প্রাপ্য কড়ির ষোলো আনা বুঝে নেবেন বটে, তবে অন্যের প্রাপ্য কড়ির ‘একপয়সাও তঞ্চকতা করবেন না ধরনের’। ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন এবং একখানা দৈনিকও নিয়ে থাকেন। আগ্রা শহরেও কাউকে কলকাতার কোনো ইংরেজি দৈনিক নিতে দেখিনি।

জমিদার-সাহেব আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত নম্রভাবে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আমাদের বয়স তখন সতেরো এবং জমিদাবাবুর বছর পঁয়ত্রিশ হবে। কিন্তু তিনি আমাদের তারিফ করবার জন্যে বলতে লাগলেন, আপনারা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়–তা ছাড়া আমাদের বুদ্ধি জগদ্বিখ্যাত, ইত্যাদি। অন্যকে বড় বলা ও মান দেওয়া উর্দু কৃষ্টির একটা লক্ষণ। যেমন—আপকা দৌলতখানা–

যা হোক, সত্যদা আমাদের জন্য জমি তৈরি করেই রেখেছিলেন। আমরা যে দেশ- ভক্তি ও সততার অবতার-বিশেষ, সে-সম্বন্ধে দেখলুম জমিদার-সাহেবের সন্দেহ-মাত্র নেই। যদিও সঙ্গে সঙ্গেই তিনি প্রকাশ করলেন, বাবুসাহেব, টাকা বড় খারাপ জিনিস–টাকার লোভে অতিবড় সাধুঁকেও আমি পাকা চোরে পরিণত হতে দেখেছি।

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এ-কথাও তিনি প্রকাশ করলেন যে, তাঁরা সাতপুরুষ জমিদারিই করে এসেছেন–ব্যবসার মতো হীনবৃত্তি তাঁদের বংশে কখনও কেউ অবলম্বন করেননি। অবিশ্যি বিষয় অথবা অলঙ্কারাদি বন্ধক রেখে সুদে টাকা খাটানোর ব্যবসাও তাঁরা করে থাকেন। টাকা মারা যাবার সম্ভাবনা তাতে নেই বললেই চলে। কিন্তু আজকাল দুনিয়ার ঢং ফিরেছে। অনেক বড় বড় জমিদার ব্যবসায় নামছেন এবং তাতে দেশের উপকারও হচ্ছে দেখে তিনিও ব্যবসারূপ হীনবৃত্তি অবলম্বন করবেন বলে স্থির করেছেন। এতে ওষুধ ও পথ্য অর্থাৎ একাধারে অর্থবান হওয়া এবং দেশের কাজ করা–এক ঢিলে দুই পাখিই মারা হবে।

বলেই নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেললেন।

অতি বিনয়-সহকারে জমিদার-সাহেব আমাদের আবার বললেন, আপনারা গুণী এবং জ্ঞানী, বলুন আমার এই খেয়াল ঠিক আছে কি না!

আমরাও তাঁর তারিফ করে বললুম, আপনার এই খেয়াল খুবই ঠিক আছে। আপনি একজন এতবড় জমিদার হয়ে সামান্য ব্যবসাদারি করতে যে রাজি হয়েছেন, এতে আপনার মহানুভবতাই প্রকাশ পাচ্ছে। এখন কি ব্যবসা করবেন সে-বিষয়ে কিছু চিন্তা করেছেন কি?

ভদ্রলোক একটু রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে সত্যদার দিকে একবার চেয়ে বললেন, নিশ্চয়। সে একটা কিছু না ভেবেই কি আপনাদের এত কষ্ট দিয়েছি! দেখুন, আপনাদের দেশে বয়কট চালু হবার আরম্ভ থেকেই আমি এ-বিষয়ে চিন্তা করছি। অনেক ভেবে স্থির করেছি, আপাতত মোজা ও গেঞ্জির কল আনিয়ে এখানে সেইসব তৈরি করবার ব্যবস্থা করা যাক। এই ব্যবসা চালাবার ভার থাকবে আপনাদের ওপর। আপনারা যদি এ-ব্যবসাকে লাভবান করে তুলতে পারেন, তা হলে পরে আমরা ব্যবসা আরও বাড়াব ও অন্যান্য ব্যবসার জন্যেও টাকা ঢালব–আপনারাও তাতে থাকবেন।

আমরা বললুম, খুবই ভালো কথা। কলকাতায় কয়েক জায়গায় মোজা-গেঞ্জির কল বসেছে দেখেছি, কিন্তু তারা এখনও পর্যন্ত কেউ কিছু করে উঠতে পারেনি।

আমাদের কথা শেষ করতে না দিয়ে ভদ্রলোক হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। বললেন, বাবুসাহেব, সেসবই আমি জানি এবং তারা কেন যে কিছু করে উঠতে পারেনি তাও জানি। ওরকম দু-একটা কল কিনে ব্যবসা হয় না। এ-সম্বন্ধে আমি জাপান, জার্মানি, আমেরিকা প্রভৃতি জায়গায় চিঠি লিখে ক্যাটালগ আনিয়েছি। সেখানকার অনেক কোম্পানির এজেন্ট আছে কলকাতা ও বোম্বাই শহরে। তারা বলেছে, কল বসিয়ে আমাদের লোককে শিখিয়ে দিয়ে যাবে। এখনও বাজারে অন্য কেউ আসেনি, আমার বিশ্বাস, এই সময়ে যদি আমরা বাজারে নামতে পারি তো কেল্লা-ফতে করতে পারব। আমি ঠিক করেছি, প্রথম দফায় দশহাজার টাকা ফেলব। এই টাকায় যন্ত্রপাতি কেনা হবে, এবং কিছু টাকা অন্যান্য কাজের জন্যে রেখে দেওয়া হবে। ব্যবসা যদি ভালো চলে, ধরুন মাস ছয় পর থেকে এই দশহাজার টাকার শতকরা সাড়ে বারো টাকা করে সুদ এবং বছরে আড়াই-হাজার টাকা করে আমাকে শোধ দিয়ে দিতে হবে। টাকা ক্রমে ক্রমে শোধ হয়ে গেলে লাভের শতকরা পঞ্চাশ টাকা আমার আর বাকি পঞ্চাশ টাকা আপনাদের। অবশ্য যতদিন আমার টাকা শোধ না হচ্ছে ততদিন সমস্ত সম্পত্তির মালিক থাকব আমি। অর্থাৎ আপনারা যদি ব্যবসা চালাতে না পারেন, তবে আমি আপনাদের সরিয়ে দিয়ে আবার অন্য লোকের সঙ্গে বন্দোবস্ত করতে পারি কিংবা যন্ত্রপাতি বিক্রয় করে যতখানি সম্ভব আমার টাকা তুলে নিতে পারি। আপনারা এখুনি জবাব দেবেন না–তিন দিন ভেবে দেখুন, তার পরে এই শর্তে যদি রাজি থাকেন তা হলে বাবুজীকে অর্থাৎ সত্যদাকে জানিয়ে দেবেন, তা হলেই আমি টের পেয়ে যাব।

সেদিন আর কোনো কথা হল না। আমরা সেখান থেকে উঠে অন্য একটা বাড়িতে খেতে গেলুম। শুনলুম, এই বাড়িটাই নাকি জমিদার-সাহেবের আসলে বৈঠকখানা।

কিছুক্ষণ রহস্যালাপের পর আমাদের খেতে দেওয়া হল।

এর আগে সত্যদার কল্যাণে ও-দেশীয় দু-তিনজন ধনীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। বলা বাহুল্য, যাঁরা নিমন্ত্রণ করেছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন হিন্দু। লোকের বাড়িতে খেয়ে নিন্দে করতে নেই, তবুও সত্যের খাতিরে বলতে হয় যে, সেই আমিষবর্জিত খানা খেয়ে আমাদের তৃপ্তি হত না। তার ওপরে তরকারি, আচার ও মিষ্টি নামে পাতে যা পড়েছিল তা আমাদের রসনায় খুব স্বাদু বলে মনে হয়নি। এখানেও সেইরকম আহার্যেরই আয়োজন হয়েছে বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু দেখলুম আমাদের এই জমিদারসাহেব হিন্দু হলেও আহার সম্বন্ধে খুবই উদার ও শৌখিন। দেখা গেল, তিনি আমাদের জন্য ভুরি-ভোজনের আয়োজন করেছেন। ছাগ-মাংসের বিরিয়ানি ও কাবাব, পরোটা ও সুখা মুরগির মাংস, তা ছাড়া রাবড়ি ইত্যাদি মিষ্টি।

অনেকদিন পরে মাংস পেয়ে তো খুব ঠাসা গেল। খেতে বসে নানারকম গালগল্প হতে লাগল। সত্যদা বললেন, বিরিয়ানি জিনিসটি মুসলমানদের আমদানি

শেঠজী সত্যদার এই কথার ভীষণ প্রতিবাদ করে বললেন, এ-জিনিসটি আমাদের শাস্ত্রীয় খাদ্য। আমাদের পুরাতন ধর্মগ্রন্থে এই খাদ্যের উল্লেখ আছে–আপনি খোঁজ করে দেখবেন। হ্যাঁ, তবে ‘বিরিয়ানি’ শব্দটা হয়তো মুসলমানদের, এ-বিষয়ে ঠিক করে কিছু বলতে পারব না।

জমিদার-সাহেবের এই উক্তি আমি ভুলিনি। কারণ বিরিয়ানির মতন অমন একটা সুখাদ্য ভারতের বাইরের কোনো জায়গা থেকে আমদানি হয়েছে এমন কথা সেই ‘স্বদেশী’ যুগে শুনে আমাদের দেশাত্মবোধে আঘাত লেগেছিল। তাই কোন্ শাস্ত্রে বিরিয়ানি উল্লেখ আছে সারাজীবন তার খোঁজ করেছি, পাইনি। শেষকালে বিরিয়ানি খাওয়া যখন শরীরে আর সহ্য হয় না, তখন তা আবিষ্কার করেছি। পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যে এখানে তা উল্লেখ করছি।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য একস্থানে কিরকম আহারের ফলে কিরকম সন্তান হবে উপদেশচ্ছলে তার অবতারণা করেছেন। এইখানে একজায়গায় তিনি বলেছেন–অথ য ইচ্ছেৎ পুত্রো মে পণ্ডিতো বিজিগীতঃ সমিতিঙ্গমঃ শুশ্রূষিতাং বাচং ভাষিতা জায়েত সর্বা বেদাননুব্রবীৎ সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাংসৌদনং পাঁচয়িত্বা সপিষ্মন্তম্ অশ্বীয়াতাম্।

অর্থাৎ যদি কেউ ইচ্ছা করেন যে তাঁর পুত্র পণ্ডিত এবং মীটিং-মারায় ওস্তাদ হবে, প্রিয় অথচ মিষ্টভাষী, সর্ববেদে পারদর্শী অর্থাৎ সবজান্তা এবং এর ওপরেও দীর্ঘায়ু হবে, তা হলে তিনি মাংসের সঙ্গে চাল ও ঘৃত (ডালদা অথবা ওই জাতীয় কোনো স্নেহপদার্থও চলতে পারে মিশ্রিত করে পাক করে আহার করুন।

এই খাদ্যটি যে আধুনিক বিরিয়ানির পূর্বপুরুষ, তাতে সন্দেহ নেই।

যাই হোক, সেদিন আহারাদির পর একটু গল্পগুজব করে জমিদার-সাহেব আমাদের বিদায় দিলেন। বিদায়ের সময় বলে দিলেন, আমার প্রস্তাব যদি আপনাদের মনোনীত হয় তা হলে বাবুজীকে অর্থাৎ সত্যদাকে জানাবেন, তাঁর সঙ্গে আমার কথা হবে।

ফেরবার সময় সত্যদা বললেন, আর কি, এবার ভগবানের নাম করে ঝুলে পড়।

আমরা বললুম, নিশ্চয় সে কথা আর বলতে! একেবারে কথা দিয়ে এলেই হত। এমনিতেই তো জিনিসপত্র আনা ইত্যাদিতে দেরি হবেই, তার ওপরে-

আমাদের বাধা দিয়ে সত্যদা বললেন, না হে না, বোঝ না। সব দিক ভালো করে বিবেচনা না করলে শেষকালে পস্তাতে হতে পারে। তোমরাও প্রস্তাবটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেখ, আমিও ভেবে-চিন্তে দেখি।

আমরা মাঝে মাঝে আমাদের আশ্রয়দাতা বাড়িওয়ালা শেঠের বৈঠকখানায় গিয়ে বসতুম।. আমরা গেলে ভদ্রলোক ভারি খুশি হতেন এবং অনেক.রাত্রি অবধি উঠতে দিতেন না, বাড়িতে ফিরে আবার রান্না-বান্নার হাঙ্গামা করতে হবে বলে একরকম জোর করেই উঠে আসতে হত। পরের দিন আমরা বাড়িওয়ালার বৈঠকখানায় গিয়ে বসতেই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, কাল আপনারা অমুক জায়গায় নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন শুনলুম!

জিজ্ঞাসা করলুম, তাঁকে চেনেন নাকি?

খুব চিনি। সে যে আমাদের আত্মীয় হয়। হঠাৎ সে আপনাদের নেমন্তন্ন করলে কোন সুবাদে? বললুম, তাঁর সঙ্গে মিলে আমরা ব্যবসা করব। সেই সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে গিয়েছিলুম। আমাদের কথা শুনে বাড়িওয়ালা দেখলুম দস্তুরমতন উৎসাহী হয়ে উঠলেন। আমাদের সঙ্গে কিরকম শর্তে সে ব্যবসায় নামতে রাজি হয়েছে, কথায় কথায় সে প্রসঙ্গও এসে পড়ল। সব শুনে ভদ্রলোক বললেন, আপনারা এই শর্তে ব্যবসায় নামতে রাজি হয়েছেন?

বললুম, হ্যাঁ, একরকম রাজি হয়েছি বইকি

এবার তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, বাবুজী, আমি আপনাদের ভালোর জন্যেই বলছি, ওর সঙ্গে কোনো ব্যবসা করবেন না। আপনাদের ভালোমানুষ ও অনভিজ্ঞ পেয়ে ও আপনাদের দিয়ে নিজের ব্যবসাটি জমিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। এই যে ব্যবসায় ও টাকা দিচ্ছে, তার সুদ নিচ্ছে টাকায় দু-আনা করে। ব্যবসা যতই চলুক, আমার বিশ্বাস এত সুদ দিয়ে কোনোদিনই তার টাকা শোধ করতে আপনারা পারবেন না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেওয়া যায় যে, আপনারা সুদও দেবেন আসলও শোধ করবেন; কিন্তু এই সময়টিতে আপনাদের খরচ কি করে চলবে, সে-কথা ভেবে দেখেছেন কি? শেষকালে ব্যবসাটি যখন বেশ চালু হয়ে যাবে, তখন টাকা শোধ করতে পারছেন না বলে দেবে আপনাদের তাড়িয়ে।

সত্যি কথা বলতে কি, টাকা সম্পূর্ণ শোধ হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত আমাদের চলবে কি করে, সে-কথাটা আমরা ভাবিইনি। এতদিন পরে একটা কিছু যে জুটল, সেই আনন্দেই একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম। তা ছাড়া আমাদের মুরুব্বি সত্যদাও যখন প্রকাশ করলেন যে, তোমাদের বরাত খুবই ভালো, নইলে গায়ে পড়ে লোকটা ব্যবসা করতে চাইবে কেন? তখন এই প্রস্তাবের মধ্যে কোনো গলদ থাকতে পারে, তা ধারণাই করতে পারিনি।

কিন্তু সত্যদাকে যখন আমরা ব্যাপারটা খুলে বললুম, তখন তিনি হাঁ হয়ে গেলেন এবং বললেন, আজই গিয়ে লোকটার সঙ্গে একটা ফয়সাল্লা করে ফেলছি।

ইতিমধ্যে আমাদের বাড়িওয়ালা শেঠ একদিন ডেকে বললেন, আপনারা যদি ব্যবসা করতে চান তো আমি একটি প্রস্তাব আপনাদের দিতে পারি, আপনারা ভেবেচিন্তে দেখুন

তিনি বললেন, দিল্লিতে তাঁর একটা বড় বাড়ি আছে, সেখানে আপাতত দশটা মোজা ও দশটা গেঞ্জির কল বসানো যাক। এর জন্যে মূলধন যা লাগে তা তিনি দেবেন। লাভের শতকরা পঞ্চাশ টাকা তিনি নেবেন আর শতকরা পঞ্চাশ টাকা আমরা পাব। পরে ব্যবসা ভালো চলতে থাকলে তিনি আরও টাকা ফেলবেন। এই ভাবে তিনি লক্ষ টাকা ফেলবেন। এর মধ্যে যদি ব্যবসা উঠে যায় কিংবা বিক্রি করতে হয়, তবে দেনা মিটিয়ে উদ্‌বৃত্ত টাকা এইভাবে ভাগ করে নেওয়া হবে। আর বরাবর আমাদের তিনজনকে খাবার ও অন্যান্য খরচের জন্যে একত্রে মাসে এক-শো টাকা করে দিয়ে যাবেন। ভদ্রলোক বললেন, আপনারা ভেবে-চিন্তে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে দেখুন

হাতে চাঁদ পাওয়া আর কাকে বলে! এই প্রস্তাব শুনে তো আমরা একেবারে লাফিয়ে উঠলুম। আমাদের এতদিনকার পাথরচাপা বরাত যে এবার পাপড়ি বিস্তার করতে আরম্ভ করেছে সে-বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ঠিক করা গেল যে, আমাদের আশ্রয়দাতা শেঠের প্রস্তাবের কথা সত্যদাকে এখন আর বলে কাজ নেই। আগেকার প্রস্তাবটার ফলাফল কি হয়, তাই দেখা যাক। আনন্দের আতিশয্যে সে-রাত্রে এক দোকান থেকে কিছু রান্না মাংস কিনে আনা গেল। কিন্তু একসঙ্গে অত সুখ সহ্য হল না, কারণ ঝালের চোটে সে-মাংস মুখে তুলতে পারলুম না। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা এখানে বলে রাখি যে, ঝাল খাওয়া সম্বন্ধে পূর্ববঙ্গের লোকের বৃথাই বদনাম হয়েছে–দিল্লি, আগ্রা ও পাঞ্জাবের লোকেরা যা ঝাল খায়, তার কাছে চট্টগ্রামের লস্করদেরও শিশু বলা চলতে পারে।

যা হোক, মাংসের হাঁড়ি আবার কোঁচায় লুকিয়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একজায়গায় ফেলে আসতে হল।

পরের দিন সত্যদার ওখানে যেতেই তিনি বললেন, কাল তোমাদের শেঠের ওখানে গিয়েছিলুম। লোকটাকে যত সিধে মনে হয়েছিল মোটেই তা নয়। তোমাদের কথা তুলতেই বললে, এখন ওসব থাক, পরে হবে। ব্যাটা ন্যাজে খেলাচ্ছে বলে মনে হল।

দিন-দুই পরে সত্যদা আবার বললেন, না হে, লোকটিকে যত খারাপ মনে করেছিলুম সে তা নয়। কাল এসে সে বললে–আমি ভেবে দেখলুম, যতদিন না আমাদের কারবারে লাভ হচ্ছে ততদিন বাবুদের জন্যে একটা মাসোহারা ঠিক করে না দিলে তাদের দিন চলবে কি করে! আমাকেও তোমাদের এই কারবারে টানবার চেষ্টায় আছে–আজ আমার এক বন্ধু উকিলের কাছে যাব পরামর্শ করতে।

ওদিকে আমাদের বাড়িওয়ালা শেঠ ডেকে বললেন, আমাদের এস্টেটের উকিলকে ব্যবসা সম্বন্ধে লেখাপড়ার একটা খসড়া তৈরি করতে বলেছি। খসড়া তৈরি হলে সেটা আপনাদের উকিলকে দেখিয়ে একটা পরামর্শ করে লেখাপড়ার তারিখটি ঠিক করে ফেলা যাবে।

সব দেখে শুনে আমরা তো আনন্দে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে উঠলুম। জনার্দন আনন্দের চোটে মাতৃভাষায় কথা-বলাই ছেড়ে দিলে। সে বলতে লাগল–এবার বরাতসে পাথর হট গিয়ে ডেফিনিটলি বরাত খুল গিয়া।

আমাদের পাথর-চাপা বরাত যে সত্যিই খুলে গিয়েছে সে-সম্বন্ধে সেদিন আমাদের তো কোনো সন্দেহই ছিল না–সত্যদা, যিনি সব প্রস্তাবকেই সন্দেহের চোখে দেখতেন, তাঁরও ছিল না। এই জাতক যাঁরা পড়েছেন তাঁদের মনে এ-সম্বন্ধে যদি কোনো সন্দেহ জেগে থাকে–এবার তবে তারই নিরাকরণ করি।

কাশী প্রভৃতি ভারতবর্ষের অন্যান্য আরও অনেক শহরের মতন আগ্রা শহরেও বাঁদরের উৎপাত অত্যন্ত বেশি। সমস্ত দিনই পালে পালে বাঁদর ছাতে ছাতে ঘুরছে। ছাতে কিছু রাখবার জো নেই। চাল, ডাল, কাপড়, বড়ি, আচার বা জিনিসপত্র যাই কিছু রাখা হোক না কেন, সেখানে লাঠি-হাতে কোনো পুরুষ যদি না থাকে তা হলে বাঁদরে তা নষ্ট করে ফেলবেই। মজা এই যে, তারা একজন স্ত্রীলোক বা দু-চারজন বালক-বালিকাকে গ্রাহ্যই করে না–বিশেষ যদি তাদের হাতে লাঠি না থাকে। আমাদের ঘরের সংলগ্ন একটু ছোট ছাত ছিল, কিন্তু বাঁদরের অত্যাচারে সেখানে কিছু রাখবার জো ছিল না। সুকান্ত বাঁদর দেখলেই তাড়া করত–একদিন বাগে পেয়ে সে একটা বাঁদরকে লাঠি দিয়ে এমন মেরেছিল যে, বাঁদরটা দোতলা থেকে রাস্তায় পড়ে গিয়ে একেবারে মৃতপ্রায় হয়েছিল। ভাগ্যে কেউ দেখেনি! পাড়ার লোকেরা কিছুক্ষণ হৈ-চৈ করে সকলে বাঁদরের পরিচর্যার মন দিলে। এত অত্যাচার করা সত্ত্বেও বাঁদরকে মারবার উপায় ছিল না। ওখানকার লোকেরা বলত যে, বাঁদর তো বাঁদরামি করবেই।

একদিন সুকান্ত ভুলক্রমে ঘরের বাইরে জুতো রাখায় একপাটি জুতো বাঁদরে তুলে নিয়ে দিলে চম্পট। কি আর করা যাবে–একটুক্ষণ দেখে বাঁদরের হাত থেকে জুতো উদ্ধার করা অসম্ভব বুঝে সুকান্তর জন্যে সদলবলে জুতো কিনতে বেরুনো গেল।

আগ্রায় জুতো জামা তখন কলকাতার তুলনায় অসম্ভব রকমের সস্তায় পাওয়া যেত। পাঁচসিকে-দেড়টাকায় যে জুতো পাওয়া যেত, কলকাতায় তার দাম ছিল অন্তত সাড়ে-তিনটাকা সে কথা যাক, আমরা একটা বড় দোকানে ঢুকে নানা রকমের জুতো দেখছি, দর করছি–দোকানে আরও দু-তিনজন খদ্দের এখানে-ওখানে বসে জুতো পরছে। আমাদের পাশেই মাথায় গোল-টুপি পরা এক ভদ্রলোক জুতো পরীক্ষা করছিল, এমন সময় আমাদের মুখে বাংলা কথা শুনে ফিরে দেখেই ছাড়লে : কেডা রে, ছোটকা নাকি! তুই এখানে কি করশ?

সুকান্ত একমনে জুতো দেখছিল, সে মুখ ফিরিয়ে বললে, কে বাবা, রাশনাম ধরে ডাক ছাড়লে!

লোকটি মাথায় গোল টুপিটা খুলে বললে, কি রে, আমারে চেনশ না?

সুকান্ত তখনও তার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে সে বললে, আমি তোর দাদা সন্তোষের বন্ধু রণদা।

সুকান্ত বললে; ও, এবার বুঝতে পেরেছি।

লোকটা আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলে। সুকান্ত আমাদের ফিসফিস করে বললে, তার দূরসম্পর্কের এক পিসতুতো ভাইয়ের বন্ধু সে। রণদার কথাবার্তায় জানতে পারা গেল যে, বার-তিনেক বি. এস-সি ফেল মেরে এবার তিনি আগ্রা কলেজের মুখোজ্জ্বল করতে এসেছেন।

আমাদের জুতো কেনা হয়ে গেলে রণদাও আমাদের সঙ্গে চলল। কথায়বার্তায় তাকে বেশ মাইডিয়ার লোক বলে মনে হল। সে বলতে লাগল, ভাই, কলকাতা ছেড়ে এই নির্বান্ধব পুরীতে এসে যে কি মুশকিলেই পড়েছি তা আর কি বলব! এমন একটা লোক পাই না যে মাতৃভাষায় দুটো প্রাণের কথা কই। তোমাদের দেখে বড় ভালো লাগল। এখানে কি করতে এসেছ?

সুকান্ত বললে, আমরা বেড়াতে এসেছি। দিন-দশেক পরে দিল্লি যাব। সেখানে যা দেখবার তা দেখে কলকাতায় ফিরব।

কথা বলতে বলতে রণদা একেবারে আমাদের বাড়িতে এল। সে খুব আত্মীয়তা দেখিয়ে বলতে লাগল, যে ক’টা দিন এখানে আছ, মাঝে মাঝে এসে বিরক্ত করব।

তারপর কিছুক্ষণ বসে কলকাতার সব খবরাখবর নিয়ে সেদিনের মতন সে বিদায় নিলে। পরদিন বিকেলবেলা বাড়ি থেকে বেরবার উদ্যোগ করছি, এমন সময় রণদা এসে হাজির। সে বললে, ওরে ছোট্‌কা কাল এখান থেকে ফেরবার পথে আমি সন্তোষকে তার করেছিলুম–ছোটকারা এখানে রয়েছে, কি করব? আজ সকালে সে-টেলিগ্রামের জবাব এসেছে। বলে একখানা টেলিগ্রাম আমাদের দিলে। তাতে লেখা আছে : ওদের গ্রেপ্তার কর, আমরা আজই দিল্লি এক্সপ্রেসে রওনা হচ্ছি, পরশু এগারোটার আগ্রা ফোর্ট স্টেশনে পৌঁছব, স্টেশনে এসো।

টেলিগ্রামখানি পাঠ করে একেবারে গ্ল্যাড় হয়ে যাওয়া গেল। প্রথম থেকেই এই রণদা লোকটিকে আমার পছন্দ হয়নি তার গায়ে-পড়া ভাব দেখে। তার এইসব কাণ্ড দেখে আমার এত রাগ হয়ে গেল যে, আমি আর থাকতে না পেরে বলে ফেললুম, আপনি আবার ওস্তাদি করে কলকাতায় তার করতে গেলেন কেন?

নির্লজ্জের মতন হাসতে হাসতে রণদা বললে, তার করব না? তোমরা পলায়ন করার পর থেকে সেখানে কি শুরু হয়েছে জান? মারপিট খুনোখুনি চলেছে প্রত্যহ–কাগজে কাগজে আলোচনা-ঝগড়ার আর শেষ নেই। সকলেই বলছে–তোমাদের ছেলেধরায় ধরে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়েছে। এইসব ব্যাপার আমি আগেই কাগজে পড়েছিলুম। তোমাদের সঙ্গে দেখা হবার অনেক আগেই আমি জানতুম যে, তোমরা বাড়ি থেকে লম্বা দিয়েছ। যা হোক, যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে, এখন ভালোয় ভালোয় ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও সুড়সুড় করে।

রণদা আমাদের ওখানে বসে প্রায় রাত্রি আটটা অবধি আড্ডা দিলে। যাবার সময় বললে, দেখ, কাল বেলা এগারোটার গাড়িতে ওরা আসছে। আমি এই বেলা দশটা নাগাদ এখানে এসে স্টেশনে নিয়ে যাব তোমাদের। ওরা বোধ হয় জন-তিনেক আসছে, তোমাদের এখানে এসেই উঠবে। আগ্রায় আসছে, অন্তত সপ্তাহখানেক ওদের ধরে রাখতে হবে কি বল?

আমরা বললুম, নিশ্চয় সে-কথা আর বলতে!

সুকান্ত বললে, কাল তা হলে আপনিও আমাদের এইখানেই খাবেন। অত বেলায় আর কোথায় যাবেন–

রণদা বললে, বেশ বেশ, সে ভালোই হবে। দেখ, আগ্রা শহরে খুব চমৎকার বালুসাহি (টিক্রি) হয়, কিছু আনিয়ে রেখো তো।

বললুম, বেশ, আমাদের চেনা দোকান আছে, সেখানে খুব ভালো বালুসাই তৈরি করে।

রণদা আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোড়, পেরোতে-না-পেরোতে সুকান্ত উঠে কম্বলটা পাট করতে আরম্ভ করে দিলে।

–কি হচ্ছে?

–এই বালুসাহির অর্ডার দিচ্ছি।

তখনকার মতো তাকে থামিয়ে পরামর্শ করা গেল, আগে স্টেশনে গিয়ে দেখা যাক, সুবিধা মতন ভাগবার ট্রেন কখন আছে! তখুনি দরজায় তালা দিয়ে স্টেশনে গিয়ে জানলুম, ভোর পাঁচটায় একটা ট্রেন ছাড়বে ভরতপুরের দিকে। ঠিক করা গেল, ওই ট্রেনেই সরে পড়া যাবে। স্টেশনে থেকে ফিরে এসে বাড়িওয়ালা শেঠকে বলা গেল, বিশেষ একটা গোপনীয় কথা আপনাকে বলব, কিন্তু কারুকে বলবেন না।

বাড়িওয়ালা বললেন, সে কি কথা! গোপনীয় কথা যখন, তখন প্রাণ গেলেও কারুকে বলব না।

বললুম, কলকাতা থেকে আমাদের কাছে এইমাত্র খবর এল যে, আমরা অবিলম্বেই যেন আগ্রা থেকে সরে পড়ি।

আমাদের কথা শুনে ভদ্রলোকের চোখ-দুটো ঠিকরে বেরিয়ে পড়বার উপক্রম হল। বললুম, উপস্থিত আমরা এলাহাবাদে যাচ্ছি; কিন্তু কোনো লোক, সে পুলিসের হোক আর যেই হোক, যদি আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করে তো বলবেন, তারা দিল্লি হয়ে পাঞ্জাবের দিকে যাবে বলে গেছে।

ভদ্রলোক বললেন, কোনো ফিকির করবেন না, তাই বলে দেব।

একটু দম নিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি আর ফিরবেন না? –নিশ্চয় ফিরব। কিন্তু কবে ফিরব, তা এখন ঠিক করে বলতে পারছি না কাল বেলা দশটার গাড়িতে আমরা যাব, ফেরবার সময় হলেই আপনাকে জানাব।

দুঃসময়ে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিয়ে শেঠজীর কাছ থেকে বিদায় নিলুম। সেই রাত্রেই একবার পরেশদার খোঁজ নিতে যাওয়া গেল। সেখানে গিয়ে শুনলুম যে, এখনও পর্যন্ত তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পরেশদার বাড়িওয়ালা বললেন যে, তিনি পুরো একবছর দেখে তারপর যা হয় করবেন। আবার একবার তাঁকে পরামর্শ দিলুম–যা করবার এখুনি তা করে ফেলতে পারেন, একবছর অপেক্ষা করবার কিছু দরকার নেই।

সত্যদার কাছে বিদায় নিয়ে যাবার ইচ্ছা হতে লাগল। ভদ্রলোক বিনা স্বার্থে আমাদের জন্যে অনেক করেছেন। কিন্তু তাকে জানাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে সেদিকে আর অগ্রসর হলুম না। সে-রাত্রে আর রান্নাবাড়ার হাঙ্গামা নেই। বাজার থেকে খাবার খেয়ে বাড়িতে এসে গা এলিয়ে দেওয়া গেল, তখন বারোটা বেজে গিয়েছে।

সারারাত্রি আধ-ঘুম ও জাগরণেই কাটল। তখন বোধ হয় রাত্রি চারটে, চারিদিক ঘোর অন্ধকার। শেষ রাত্রের শীতে আগ্রা তখনও সুষুপ্তির কোলে পড়ে স্বপ্ন দেখছে, চারিদিক ঘন কুয়াশার জালে আচ্ছন্ন–সেই কনকনে ঠান্ডায় আমরা তিনজন রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম।

সেখান থেকে ইস্টিশান অনেক দূরের পাল্লা। জামা, কাপড়, বালিশ, শতরঞ্চি ইত্যাদি নিয়ে তিনটি বোঁচকা তিনজনের কাঁধে ঝুলছে। বোঝার ভারে হেলে-দুলে সরু গলিপথ দিয়ে আমরা চলেছি কখনও আস্তে, কখনও জোরে, কখনও দৌড়ে–চল্–চল্‌–পালা–পালা–পূর্বজন্মের কোন খাতক কোথায় আত্মগোপন করে আছে, তার কাছ থেকে যতখানি আদায় করে নিতে পারা যায়। কোন্ জন্মের কোন্ মাতৃঋণে বাঁধা আছি কোন্ নারীর সঙ্গে–কোন্ ভাই, কোন্ দাদা, কোন বোন কে কোথায় ছড়িয়ে আছে কে জানে, সে বন্ধন অক্ষয়। দৌড়–দৌড়–দৌড়। কোথায় কোন সন্তান-শোক-বিধুরা জননী গভীর নিশীথে বসে অশ্রুমোচন করছে তার সঙ্গে অশ্রু মেলাতে হবে, চল্–চল্–এরই মধ্যে ধরা পড়লে চলে! জানি নিশ্চয় জানি, আমার ভাগ্যাকাশে আজ যে মেঘসঞ্চার হয়েছে সৌভাগ্যের অরুণোদয়ে কালই তা অপসারিত হবে। কণ্টকময় অন্ধকার বিপদসঙ্কুল পন্থ বালারুণ-রশ্মিপাতে আবার ঝলমল করে উঠবে, ভবিষ্যতের আকাশে দিগ্বধূরা রামধনুর রঙের ওড়না উড়িয়ে আবার হোলিখেলায় মেতে উঠবে, আবার অতর্কিতে যতদিন না অশনি এসে পড়ে। পালা–পালা–দৌড়–দৌড়। অন্ধকারে কখনও মনে হয়, পুলিসে তাড়া করেছে–দূরে কোনো গৃহস্থের ঘর মিটিমিটি প্রদীপ–আমাদেরই মনের আশার মতন কখনও জ্বলছে, কখনও নিবছে–এমনি করতে করতে স্টেশনে এসে দেখলুম, আমাদের ট্রেনখানা দাঁড়িয়ে আমাদেরই মতন ধুঁকছে–টিকিট করবার আর অবসর নেই–একখানা খালি কামরায় ঢুকে ‘যা হবার তাই হবে’ বলে এলিয়ে পড়া গেল।

.

ভরতপুর স্টেশনে গিয়ে যখন নামলুম, তখনও সূর্যাস্ত হতে প্রায় ঘণ্টাতিনেক দেরি আছে। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন যাত্রী নেমে স্টেশনের দরজা পার হয়ে চলে গেল। কিন্তু আমাদের কাছে টিকিট নেই বলে সেদিকে না গিয়ে অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে স্টেশনের বাইরে বেরুতে পারা যায় কি না তারই ঘোঁৎঘাঁৎ খুঁজতে লাগলুম। কিন্তু বৃথাই আমরা ভয় পেয়েছিলুম; কারণ একটু পরেই বুঝতে পারলুম যে, টিকিট-চেকার বলে কোনো লোক সেখানে উপস্থিত নেই। সেই আমাদের প্রথম পাপ বলে এত ভয় পেয়েছিলুম। কিছুদিন পরেই জানতে পারলুম, আমরা যাকে পাপ মনে করেছিলুম, সে-পাপের প্রচলন ও অঞ্চলে খুবই বেশি। সে-যুগে ওসব জায়গায় বিনাটিকিটে রেলে যাতায়াত করাকে বিশেষ অন্যায় বলে মনে করা হত না। সরকার তার প্রজাদের জন্যে রেল তৈরি করে দিয়েছে, তাতে চড়ে যাতায়াত করব, তার আবার পয়সা দেব কি–এই রকম একটা মনোভাব সাধারণ অশিক্ষিতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কত লোক যে সে-সময় বিনাটিকিটে রেল-যাতায়াত করত তার আর ঠিকানা নেই। অনেক বিনা-টিকিটের যাত্রীকে রেলের কর্মচারীরা যখন ধরত তখন তাদের মুখ দেখে মনেই হত না যে, টিকিট কাটার মতন কোনো অন্যায় ও অসঙ্গত বিধান সম্বন্ধে তাদের কোনো জ্ঞান আছে। প্রায় ক্ষেত্রেই রেলের লোকেরা বিনাটিকিটের যাত্রীদের তখনকার মতন কিছুক্ষণ আটকে রেখে শেষে ছেড়ে দিত। সাধু-সন্ন্যাসী অর্থাৎ যাদের অঙ্গে গেরুয়া-বসন অথবা হাতে কমণ্ডলু থাকত, তারা তো খোলাখুলিভাবে জোর করে বিনাটিকিটে যাতায়াত করত। রেলকর্মচারীরা তাদের কাছে টিকিট চাইত না, আর যাত্রীরাও তাদের খাতির করে বসবার, এমনকি শোবার জায়গা পর্যন্ত করে দিত।

আমরা তো বিনা বাধায় স্টেশনের ফটক পার হয়ে এলুম। সুকান্ত বললে, যা হোক, এতদিনে রেলভাড়া সমস্যার একটা সমাধান হল।

সকাল থেকে আহারাদি কিছুই হয়নি। স্টেশনের হুদ্দোর মধ্যেই এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে বগি-থালার মতন বড় আর পাতলা চাপাটি একপয়সায় একটা করে আর একপয়সায় মহাশের মাছের ইয়া বড় দাগা ও তৎসহ ঝোল কিনে পেট ভরে খাওয়া হল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবধি মৎস্য-মুখ করা হয়নি। খেতে খেতে জনার্দন বললে, ওরা বোধ হয় এতক্ষণ বালুসাহি খেয়ে দিবানিদ্রা উপভোগ করছে।

জনার্দনের কথায় অনেকক্ষণ পরে প্রাণ ভরে হাসা গেল। যা হোক, অককাল পরে পেট ভরে স্ব-খাদ্য ও সুখাদ্য খেয়ে পা বাড়ানো গেল অজানার পথে।

শহরের মধ্যে ঢুকে দেখলুম, সমস্ত জায়গাটা যেন থমথম করছে–নির্জীব, প্রাণহীন–শীতে যেন সব কুঁকড়ে গেছে। পথে অত্যন্ত ধুলো, লোকজন যা দু-একটা চলছে তাদের মাথা থেকে পা অবধি ধুলোয় ধূসরিত। লোকগুলো বেশ লম্বা-চওড়া, দেখলেই মনে হয় শক্তিমান। প্রায় সকলেই মাথা-মুখ পেঁচিয়ে থুতনি দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে সাদা কাপড়ের পাগড়ি বেঁধেছে—অবিশ্যি পাগড়ির কাপড় সাদা কোনকালে ছিল, এখন ধূলি-মলিন। কারুর পায়ে ছেঁড়া জুতো–এত ছেঁড়া যে তাকে আর জুতো বলা চলে না। বাড়িগুলোও সব ধুলোয় আচ্ছন্ন, উঁচু বাড়ি নেই বললেই হয়, বাড়িগুলোর অবস্থাও খারাপ। বাড়িগুলোর ওপরে এমন ধুলোর প্রলেপ পড়েছে যে, সেগুলো ইটের না পাথরের তৈরি তা বোঝাই মুশকিল। বড় বড় আকাশচুম্বী গাছ, তাদেরও ওই দুর্দশা–পাতাগুলো সব শুকনো ধুলোমাখা, ডালগুলোর অবস্থাও তাই। পথে দু-চারটে ছাগল দেখতে পাওয়া গেল, আকারে ও প্রকারে তারা আমাদের দেশের ছাগলের চেয়ে বড়, দুধও বোধ হয় দেয় বেশি, কিন্তু দেহ তাদের ধুলোয় ধূসরিত। আগেই বলেছি, চলতে চলতে মনে হতে লাগল, জায়গাটা যেন ধুলো মেখে কুঁকড়ি-সুঁকড়ি মেরে পড়ে রয়েছে। বেলা তখন সাড়ে তিনটে কি চারটে হবে, কিন্তু তখনই মনে হল যে পুরবাসীরা দোরতাড়া লাগিয়ে সব শুয়ে পড়েছে। ধর্মশালার খোঁজে খানিকটা ঘুরে বেড়ালুম, কিন্তু খুঁজে পেলুম না। দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করেও কিছু সন্ধান করতে পারলুম না। তারা কি যে বললে,’ কোন ভাষায় বললে, তাও বোধগম্য হল না। মনে হতে লাগল, আচ্ছা জায়গায় এসে পড়েছি যা হোক!

এদিকে বোঁ-বোঁ করে বেলা পড়ে আসতে লাগল, তখনও মাথা গোঁজবার জায়গা ঠিক করতে পারলুম না, ওদিকে বোঁচকা বইতে বইতে প্রাণান্ত হবার উপক্রম।

এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় শহরের প্রান্তে এসে পড়া গেল। একজায়গায় দেখলুম, একটা বড় ভাঙা একতলা বাড়ির সামনে গোটা তিন-চার দড়ির খাঁটিয়া পড়ে আছে। গোটা পাঁচ-ছয় কুকুর তাদের অসংখ্য বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কাছেই শুয়ে ছিল, আমাদের দেখে তারা চেঁচাতে আরম্ভ করে দিলে। কুকুরগুলোর কিছু দূরেই একটা লোক সেইরকম পাগড়িতে মাথা-মুখ ঢেকে কতকগুলো ছাগলের বাচ্চাকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল! তারই অদূরে দেখলুম, আর একটা লোক একটা বড় ছাগলের দুধ দুইছে–আর একপাশে কয়েকটা ধাড়ি ছাগল মিলে এক আঁটি শুকনো ঘাস নিয়ে টানাটানি করছে।

আমাদের দেখে কুকুরগুলো চেঁচিয়ে উঠতেই, যে-লোকটা ছাগলের বাচ্চাগুলোকে ধরে ছিল, সে সচকিত হয়ে ফিরে কটমট করে আমাদের দেখতে লাগল। আমরা দাঁড়িয়ে ভাঙা বাড়িটা দেখছি–প্রকাণ্ড দরজা, তার পেছনে বিরাট ধ্বংসস্তূপ পড়ে রয়েছে একেবারে পাহাড়ের মতন উঁচু–ইতিমধ্যে যে-লোকটা দুধ দুইছিল সে উঠে দাঁড়াতেই এ-লোকটা বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দিলে। এবারে বুঝতে পারা গেল, যে ছাগল দুইছিল সে স্ত্রীলোক। দুধের পাত্রটা নিয়ে সে সম্মুখের সেই প্রকাণ্ড দরজা দিয়ে ভেতরে গেল, আর এ-লোকটা এগিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের দেশ কোথায়?

–আগ্রা শহরে।

কিছুক্ষণ আমাদের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করলে, এখানে কি চাই?

বললুম, আমরা এখানে নতুন এসেছি, ধর্মশালা খুঁজে বেড়াচ্ছি। ধর্মশালা কোথায় বলতে পার?

লোকটা আবার একবার বেশ করে আমাকে দেখে বললে, এই তো ধর্মশালা–এইখানে থাকতে পার।

জিজ্ঞাসা করলুম, এই ধর্মশালার মালিক কি তুমি?

সে বললে, হ্যাঁ।

–তোমার নাম কি?

–রামসিং।

বললুম, কোথায় ঘর দেখাও তো।

সে আমাদের ডেকে সামনের সেই প্রকাণ্ড ভাঙা ঘরে নিয়ে গেল। মাঠের মতন বড় ঘর। দেড়শো-দুশো বছর আগে সেখানে হয়তো কোনো রাজদপ্তর ছিল, কারণ বাস করবার জন্যে মানুষ অত বড় ঘর কখনও বানায় না। ঘরের দেওয়ালের মাঝে মাঝে গর্ত। কোনো গর্ত পাথর, কাঠ, পাতা ইত্যাদি দিয়ে ভরাট করবার চেষ্টা করা হয়েছে, কোনো গর্ত এমনিই হাঁ হয়ে আছে! শেয়াল, বাঘ, নেকড়ে, গরু, মোষ ও যে-হাতি হস্তীমূর্খ নয় সেও কায়দা করে অনায়াসে সে-গর্ত দিয়ে ঘরের বাহিরে যাতায়াত করতে পারে। ঘরের একদিকে দুটো দড়ির খাঁটিয়া, তার ওপর কতকগুলো ছেঁড়া ময়লা ন্যাকড়া পড়ে আছে। এদিক-ওদিক হাঁড়িপাতিলের মতনও কিছু কিছু জিনিস ছড়ানো রয়েছে। বোঝা গেল, এগুলি সব রামসিং-দম্পতির সম্পত্তি। কিন্তু সেই মান্ধাতার আমলের ধুলোর ওপর কি করে শোওয়া যাবে জিজ্ঞাসা করায় রামসিং বললে, খাঁটিয়া দিতে পারি, রোজ একপয়সা করে ভাড়া লাগবে। অর্থাৎ ধর্মশালার জন্যে একপয়সা, খাঁটিয়ার জন্যে একপয়সা–একুনে তিনজনে ছ’পয়সা। আমরা বললুম, ধর্মশালার জন্যে ভাড়া দেব না, খাঁটিয়ার জন্যে তিনজনে দৈনিক তিনপয়সা দিতে পারি। দেখ, রাজি থাক তো বলো?

লোকটা সোজা বলে দিলে, না, হবে না।

আমরা চলে আসছি দেখে রামসিংহিনী রুখে উঠল, কোথায় যাচ্ছ?

–দেখি, অন্য কোথাও জায়গা পাওয়া যায় কি না!

সে জিজ্ঞাসা করলে, তোমরা কত বলছ?

–আমরা বলছি খাঁটিয়া-সমেত জঁন-প্রতি রোজ একপয়সা করে দেব।

–বেশ, তাই দিও। বলে সে বাইরে গিয়ে দুহাতে দু’খানা রৌদ্রতপ্ত খাঁটিয়া তুলে নিয়ে এসে ঘরের মধ্যে এক জায়গায় রেখে বললে, শুয়ে পড়।

এরই মধ্যে শুয়ে পড়ব কি! তবু যা হোক বোঁচকাগুলো নামিয়ে একটু হালকা হওয়া গেল। ইতিমধ্যে আর একখানা খাট এসে পড়ল। কিন্তু সেগুলোতে কি ধুলো রে বাবা! যত ঝাড়ি তত পড়ে। শেষকালে আর চেষ্টা না করে তিনখানা খাট ঠেকাঠেকি করে তার ওপরে শতরঞ্চি বিছানো গেল। এক-একটা ধুতি চাদর করা গেল। রামসিংকে বললুম, আমরা বাইরে চললুম, খেয়ে-দেয়ে সন্ধের মধ্যেই আসব।

রামসিং কোনো কথা বললে না। তার গিন্নি বললে, রাত্তিরে রাস্তা দেখতে পাবে না, হারিয়ে যাবে। খেয়ে-দেয়ে অন্ধকার হবার আগেই ফিরে এসো।

সেখান থেকে বেরিয়ে ঘুরে-ফিরে শহরটাকে ভালো করে দেখে বেড়াতে লাগলুম। আগ্রা, এলাহাবাদ, কাশী, পাটনার তুলনায় ভরতপুরকে শহরই বলা চলে না। এর অনেকদিন পরে আর-একবার ভরতপুরে যাবার সুযোগ হয়েছিল। আগের চেয়ে শহরের অনেক উন্নতি হয়েছে দেখলুম বটে, কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে অন্যান্য শহরেরও অনেক উন্নতি হয়েছে, কাজেই তুলনায় তার মাপ সমানই আছে।

একটু ঘোরাফেরা করতে-না-করতেই অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল আর সেইসঙ্গে শীত পড়তে লাগল দারুণ। আমাদের সঙ্গে পরেশদার দেওয়া সেই ধোশা ছিল। আগ্রায় কোনো রকমে তার দ্বারা শীত নিবারণ হত, কিন্তু এখানে সন্ধেবেলাতে সেই ধোশা ভেদ করে ঠান্ডা যেন গায়ে বিঁধতে লাগল। রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা দেখতে পেলুম না, তাই সূর্যের আলো থাকতে-থাকতেই একরকম ছুটে আমাদের সেই ডেরায় ফিরে এলুম। জায়গাটা একেই নির্জন ছিল, সে-সময় একেবারে যেন খাঁ-খাঁ করছিল। বাইরে কুকুর ছাগল কিছুই নেই, দরজায় একটা চটের পর্দা ঝুলছে, কারণ কপাটের বালাই নেই। কাঁপতে কাঁপতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়া গেল।

ঘরের মধ্যে সেই প্রায়ান্ধকারে যতদূর দৃষ্টি চলে তার মধ্যে দেখতে পেলুম যে, সেখানে ছোটখাটো একটি চিড়িয়াখানা তৈরি হয়েছে। এদিকে সিংহ ও সিংহিনী দুটো খাটে পড়ে রয়েছে, তাদের আপাদমস্তক শতচ্ছিন্ন ময়লা কাপড়ে ঢাকা। বোধ হয় গোটা-পঁচিশেক কুকুর স্থানে স্থানে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। ধাড়ি ছাগলগুলো বড় বড় পাথরের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা, বাচ্চাগুলোকেও একটু দূরে তেমনই করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ধাড়ি বাচ্চা সবাই ঘোর নিদ্রায় অভিভূত। আমরাও পা টিপে টিপে খাটের কাছে গিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লুম।

ঘরের মধ্যে ক্রমেই অন্ধকার ঘনিয়ে উঠতে লাগল। দেওয়ালের বড় বড় গর্ত দিয়ে দেখতে লাগলুম বাইরে তখনও স্বল্প আলো আছে। তার ভেতর দিয়ে সেই বিরাট উঁচু-নীচু ধ্বংসস্তূপ দেখা যেতে লাগল। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরে বড় বড় গাছ লতা জন্মেছে। ক্রমে সেই নিস্তব্ধ বনস্থল ধীরে ধীরে মুখর হয়ে উঠতে লাগল। ঝিঁঝিপোকা ও অন্য কি-সব রাতপাখির অদ্ভুত চিৎকারে সমস্ত জায়গাটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমে ধীরে ধীরে বাইরের আলোটুকু নিবে গেল।

আগের দিন রাতে ঘুম না হলেও সেদিন ট্রেনে প্রায় সব সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলুম। তা ছাড়া সন্ধেবেলায় ঘুমোনো কোনোদিনই অভ্যেস নেই। তার ওপর সেই অজানা শহর অদ্ভুত আশ্রয় ও বিচিত্র পরিবেশ, এর মধ্যে নিদ্রাদেবীর মতো বেপরোয়া ব্যক্তিও প্রবেশ করতে ভরসা পান না। কাজেই সেই অন্ধকারে চোখ চেয়ে পড়ে পড়ে ভাবতে লাগলুম হাজার রকমের ভাবনা। কিন্তু প্রাণ খুলে যে চিন্তা করব তারই জো আছে কি! অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে শীত বাড়তে লাগল। এমন সাংঘাতিক শীত আগ্রাতে একদিনও ভোগ করতে হয়নি। তার ওপরে দেওয়ালের সেই বড় বড় ফুটো দিয়ে হু-হু করে বাতাস ঢুকতে লাগল ঘরের মধ্যে। শীতে খালি এ-পাশ ও-পাশ করে গরম হবার চেষ্টা করছি আর ভাবছি সৃষ্টিকর্তা যদি পশুপক্ষীদের মতন মানুষের অঙ্গেও শীতাতপ থেকে বাঁচবার জন্যে কোনো আবরণ দিতেন, তা হলে এই কষ্টভোগ আর করতে হত না। এমন সময়ে সেই অন্ধকার ভেদ করে জনার্দনের কণ্ঠ থেকে ঋষভ রাগে বেসুরো প্রস্রবণ ছুটল-”আমাদের কোথায় আনিলে–আনিয়ে তরঙ্গমাঝে তরী ডোবালে!”

জনার্দনের গান শুনে হাসব কি কাঁদব তাই ভাবছি, এমন সময়ে সুকান্ত বললে, বৎস জনার্দন, ধৈর্য ধর, তরী তরঙ্গমাঝারে পড়েছে মাত্র, ডুবতে এখনও দেরি আছে।

কিন্তু কে কার কথা শোনে! জনার্দন একমুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার ষাঁড়-চ্যাচানি চেঁচাতে আরম্ভ করলে “কোথা রইল পিতা-মাতা, কোথা রইল বন্ধু ভ্রাতা–আমার প্রাণপ্রিয়ে রইল কোথা বন্ধু সকলে”–বলে এমন এক তান ছাড়লে যে কুকুরগুলো জেগে উঠে ধমকের সুরে ‘চোপ চোপ চুপ রহো’ করে চেঁচাতে লাগল, ছাগলগুলো শুরু করলে ব্যা-ব্যা, ওদিক থেকে মৃদু সিংহনাদও শোনা যেতে লাগল।

চারিদিক থেকে ওইরকম প্রতিবাদ হতে থাকায় জনার্দন চুপ করল বটে, কিন্তু শীত তো আর সহ্য হয় না। শীতের চোটে শুয়ে থাকা আর সম্ভব হল না। আগ্রায় রাতে আমরা মোমবাতি জ্বালাতুম, কয়েকটা মোমবাতি সঙ্গেও ছিল। তাড়াতাড়ি উঠে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কুঁকড়ে-সুঁকড়ে বসলুম। জনার্দন তো শীতের চোটে সশব্দে হি-হি করতে লাগল। শেষকালে সেই কম্পিত গলায় আবার সে গান ধরলে। তখুনি তার মুখে হাত চাপা দিয়ে থামিয়ে দেওয়া গেল। জনার্দন বলতে লাগল, ভাই শীতের চোটে তো মারা গেলুম, তোরা দুজনে আমাকে জড়িয়ে ধর।

সুকান্ত বলল, উনি আবার তিব্বতে যেতে চাইছিলেন!

এমনি করে হাসাহাসি করতে করতে এবার বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়া গেল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, একবার ঘুম ভেঙে যেতে দেখলুম, দূরে রামসিংহের খাটের কাছে একটু ছোট্ট আলো জ্বলছে। দেখলুম, রামসিংয়ের বউ দুটো ভাঙা হাঁড়িতে দুটো আগুন করে তাতে বাতাস দিচ্ছে। কিসের আগুন তা বুঝতে পারলুম না, তবে সিংহিনীর হস্ততাড়িত বাতাস লাগার ফলে সেই ভাঙা হাঁড়ির গহ্বরদেশ লাল হয়ে উঠতে লাগল ও সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গাটা ধোঁয়ায় ভরে যেতে লাগল। খানিক পরে আগুন বেশ লাল হয়ে উঠলে সিংহিনী একটা সিংহের খাটের নীচে ও একটা নিজের খাটের নীচে রেখে কোনো কথা না বলে আলোটা নিবিয়ে দিলে। অন্ধকারে সেই ভাঙা হাঁড়ির আগুন জ্বলতে-নিবতে লাগল আর আমি শুয়ে শুয়ে গোপাল ভাঁড়ের গল্পের সেই ব্রাহ্মণের মতন চোখ দিয়ে আগুন পোয়াতে লাগলুম।

পরদিন সকালবেলা উঠে দেখা গেল, আমাদের সবারই মুখগুলো ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে–শুধু তাই নয়, হাত-পা ফেটে একেবারে চৌচির অবস্থা.। দেশসুদ্ধ লোক মাথা-মুখ ঢেকে থাকে কেন, এতক্ষণে তার একটা হদিশ পাওয়া গেল। আমরা আর কালবিলম্ব না করে বিছানা থেকে ধুতি তুলে নিয়ে বেশ করে মাথা মুখ পেঁচিয়ে বেঁধে ফেললুম।

সকাল হতেই দেখা গেল, দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ নানা আকারের পাত্র নিয়ে রামসিংহের দরজায় হাজির হতে লাগল। দেখলুম, কর্তা গিন্নি উভয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। একজন দুধ দোয় আর একজন মেপে মেপে দেয়। শুনলুম, সেখানে ছাগলের দুধ ও মোষের দুধের একই দর–ছ’পয়সা সের। যাদের ছেলেপিলের ঘর তারা ছাগলের দুধই নেয়।

কিছুক্ষণ এইসব ব্যাপার দেখে আমরা চরা করতে বেরুলুম। শহরে ঘুরতে-ঘুরতে মনে হল কাল জায়গাটাকে যত দুঃখী মনে করেছিলুম আসলে সেটা তত নয়। সেখানে ভালো রাস্তা, ভালো বাড়িঘর যে একেবারেই নেই তা নয়। সেখানে একটি কেল্লা আছে, জবরদস্ত রাজা, রাজপুত্র ও রাজকর্মচারী সবই আছে, তবে বেশির ভাগ লোকের অবস্থাই আমাদের মতন।

শহরে ঘুরতে ঘুরতে অনেক জায়গাতেই দেখা গেল, ছাগলের দুধ বিক্রি হচ্ছে। আমাদের জনার্দনের নানারকম ব্যবসার প্ল্যান মাথায় গজাত। সে থেকে থেকে বললে, এখানে থেকে ছাগলের দুধের ব্যবসা করা যাক।

জনার্দন নানারকম প্ল্যান বাতলাতে লাগল, ছাগল থেকে গরু, গরু থেকে মোষ, বাচ্চা যা হবে তার মদ্দাগুলো বেচে ফেলা হবে। তারপরে দুধ থেকে মাখন, পনির ইত্যাদিও হতে

পারবে–দ্যাখ্–দ্যাখ্ করে ব্যবসা ফলাও হয়ে পড়বে।

জনার্দনের প্ল্যানটা আমাদের নেহাত মন্দ লাগল না। আশাকুহকিনী আবার কানের কাছে গুঞ্জন শুরু করে দিলে।

.

আমরা স্টেশনে যে-দোকানে রোজ খেতে যেতুম, সেই দোকানে চা বিক্রি হত। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা গেল, তুমি কোথা থেকে দুধ কেন?

সে বললে, এখান থেকে মাইল তিনেক দূরে শহরের এক জায়গা থেকে।

–আচ্ছা, আমরা যদি রোজ তোমায় এখানে দুধ দিয়ে যাই। তবে আমাদের কাছ থেকে নেবে?

লোকটা বললে, চায়ের জন্যে আমরা ছাগলের দুধ নিই–ও-জন্যে ছাগলের দুধই ভালো। আমাদের সারা দিন-রাতে পাঁচ সেরেরও বেশি দুধের দরকার হয়।

আমরা বললুম তাই দেব, কিন্তু নগদ দাম দিতে হবে।

লোকটা রাজি হয়ে গেল। সে বললে, তোমাদের আরও খদ্দের জোগাড় করে দিতে পারি। লোকটার কথা শুনে আমরা খুব উৎসাহিত হলুম। ভাবলুম, সত্যিই ছাগলের দুধের ব্যবসা করলে তো মন্দ হয় না। আমরা বসে-বসে তার সঙ্গে এই সম্বন্ধে আরও অনেক আলোচনা করতে লাগলুম। কোথায় ভালো ছাগল পাওয়া যায়–কোথাও ঘর ভাড়া পাওয়া যায় কি না, ইত্যাদি আরও অনেক কথা হল।

দিন-দুয়েক আলোচনা করে এই দোকানদারের কাছ থেকে অনেক সন্ধান পাওয়া গেল। সে বললে, স্টেশনের কাছেই একটা খোলার বাড়ি খালি ছিল, সেটা পেলে তোমাদের ছাগল রাখাও চলবে, থাকাও চলবে। অনেকখানি খোলা জায়গাও আছে সেখানে। সেটা এখনও খালি আছে কি না তার খোঁজ করতে হবে।

আবার উৎসাহ ও আশায় বুক দশ-হাত ফুলে উঠল। আমরা বসে থাকবার ছেলে নয়–মোজা-গেঞ্জির কারবার ফেল হয়ে গেছে বলে কি জীবনে হতাশ হয়ে বসে থাকতে হবে! দুধের কারবার করে বড়লোক হয়েছি শুনলে হয়তো অনেকে নাক সিঁটকোবে–তা সিঁটকোক গে, আমরা তাদের গ্রাহ্য করি না। ব্যবসায়ে ছোটবড় নেই, এই করেই তো বাঙালি জাতটা গেল!

সেদিন তাড়াতাড়ি ফিরে রামসিংয়ের স্ত্রীকে বললুম, দেখ, রাত্রে তো শীতের চোটে ঘুমতে পারি না; আমাদের জন্যে একটা করে আঙ্গেঠি জ্বালিয়ে দিতে পার?

সে বললে, একটা তো সারারাত্রি জ্বলবে না–তোমাদের একটা করে দিচ্ছি, রাত্রে যখন শীত অসহ্য হবে তখন উঠে জ্বালিয়ে নিও।

সে তিনটে ভাঙা হাঁড়িতে শুকনো ছাগলের নাদি ভরে দিলে। দেখলুম, ঘরের একদিকে পাহাড়ের সমান উঁচু ছাগলের নাদি জমা করে রাখা হয়েছে–একটি নাদি তারা নষ্ট হতে দেয় না। সারা বছর ধরে নাদি জমা হয়।

এবার তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, তোমার নাম কি?

সে বললে, সূরয।

জিজ্ঞাসা করলুম, সূরয কি? তোমায় কি বলে ডাকব? সূর্যবাঈ?

সে একটু লজ্জিত হয়ে বললে, হ্যাঁ, এই নামেই ডেকো–সূরযবাঈ।

একটু পরে সূরযবাঈ বললে, আঙ্গেঠির জন্যে একটা করে পয়সা দিতে হবে।

শীতের ঠেলায় পয়সা দিতে রাজি হতে হল। সেই হরে-দরে দৈনিক ছ’পয়সা করেই লাগতে লাগল।

স্টেশনের সেই দোকানদার খবর দিলে, সেই বাড়ির বাড়িওয়ালা এখানে নেই, দিনকতক পরে আসবে–তবে বাড়িটা এখনও খালি আছে।

যা হোক, আমরা অন্য বাড়িও দেখতে লাগলুম। ছাগলও দু-চারটে দেখা গেল, দরদস্তুরও চলতে লাগল। স্টেশনের কাছের বাড়িটার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলুম। কারণ স্টেশনের একজন হকারের সঙ্গে ঠিক হয়েছিল যে, সে কিছু কমিশন নিয়ে যাত্রীদের গরম দুধ বিক্রি করবে। যাত্রীদের দুধ বিক্রি করতে পারলে খুব লাভ হয়। কারণ একসের দুধে একসের জল মিশিয়ে রঙটা শুধু সাদা রাখলেই হয়। দুধটা এমন গরম করতে হবে যে, স্টেশনে যতক্ষণ গাড়ি থাকবে ততক্ষণ গরমের চোটে খদ্দের তা মুখে দিতে পারবে না। তারপরে গাড়ি ছেড়ে দিলে আর কি! ছাগল ও বাড়ি দেখার সঙ্গে এইসব ব্যবসার মারপ্যাঁচও শেখা চলতে লাগল।

রামসিং ও তার স্ত্রীর সঙ্গে একটু একটু করে ভাব হতে লাগল। অতি দরিদ্র তারা, কিন্তু একসময়ে নাকি তাদের পূর্বপুরুষেরা রাজা ছিল। একদিন এখানে তাদের প্রকাণ্ড প্রাসাদ ছিল। সেই প্রাসাদেরই অবশিষ্ট একমাত্র এই ভাঙা ঘরে রাজবংশের শেষ স্ত্রী-পুরুষ বাস করছে। তাদের এখনও কিছু জায়গাজমি আছে, কিন্তু অর্থ ও লোকের অভাবে সে-জমি নিজে চাষ করতে পারে না। অন্য লোকে চাষ করে তাদের দয়া করে যা দেয় তাই নিতে হয়। তারা স্বামী-স্ত্রীতে মিলে খেটে এই দুধের ব্যবসা করে। তাও যদি ছাগলগুলোকে ভালো করে খেতে দিতে পারত তো দুধ কিছু বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু তারা নিজেরাই পেট ভরে খেতে পায় না। সকালবেলা এক-একজন খান-ষোলো করে মোটা রুটি নুন দিয়ে খায়, তার সঙ্গে একটা কি দুটো পিঁয়াজ জুটল তো ভুরিভোজন হয়ে গেল। বিকেলেও তাই, তবে কোনো-কোনোদিন ওরই’ মধ্যে এক-আধ-ফোঁটা দুধ জুটে যায়। খাদ্য অতি সামান্য, অথচ মোটা না হলেও তাদের চেহারা ছিল বিরাট। আমরা ভাবতুম, এই সামান্য খাদ্যে তাদের পুষ্টি হয় কি করে!

রামসিং ও তার স্ত্রী, তারা দুজনেই ছিল স্বল্পভাষী। নিজেদের মধ্যেও তারা খুব কমই কথাবার্তা বলত। সকালবেলা সেখানে অনেক খদ্দের এসে জুটত বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গেও যতদূর সম্ভব কম কথা কইত তারা। সকাল থেকে স্বামী-স্ত্রীতে যে যার বাঁধা কাজ করে যেত। তারপর বিকেল হতে-না-হতে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে কাপড় চাপা দিয়ে লাগাত ঘুম।

একদিন সকালবেলা উঠে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা গেল। দেখলুম যে, রাম সিং ও সূরযবাঈয়ের মধ্যে খুব কথাবার্তা চলেছে। সুকান্ত ঠাট্টা করে বললে, আজ যে সিংহ-সিংহিনীতে খুবই প্রেমভাব দেখছি।

তারা নিজেদের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত, যার একটি বর্ণও আমরা বুঝতে পারতুম না। দুজনে খুব কথা চলছে দেখে আমরা তো বেরিয়ে পড়লুম। বিকেল নাগাদ ফিরে দেখি, তারা তখনও যে যার খাটে বসে উচ্চৈঃস্বরে প্রেমালাপ করছে। রামসিং মাঝে মাঝে শুয়ে পড়ছে আবার উঠছে–এইরকম প্রায় ঘণ্টাখানেক চলল, তারপর দুজনেই কাপড় চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্য দিন ফিরে এসে বরাবর দেখেছি, তারা দুজনেই ঘুমুচ্ছে।

কিছুক্ষণ বিড়ি-টিড়ি টেনে আমরাও শোবার ব্যবস্থা করতে লাগলুম। সেখানে এসে অবধি আমাদেরও সন্ধার আগেই শুয়ে-পড়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বিছানাপত্তর ঝাড়া হচ্ছে এমন সময় আবিষ্কার করা গেল, সেদিন সূরযবাঈ প্রেমালাপে মত্ত থাকায় আমাদের আঙ্গেঠিগুলোতে ইন্ধন দেয়নি। নিজেরাই আঙ্গেঠি ভরে নিয়ে শুয়ে পড়া গেল।

রাত্রি কত হয়েছিল তা বলতে পারি না, জনার্দন জোরে ধাক্কা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বললে, ওঠ, ওঠ, শিগগির ওঠ।

ধড়মড় করে উঠে দেখি, সিংহ ও সিংহিনীতে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অন্য দিনের মতন সেদিকে একটা বাতি জ্বলছে, আর স্বামী-স্ত্রীতে নিঃশব্দে মারপিট চলেছে। স্ত্রীকে স্বামী প্রহার

·করছে–সে-দৃশ্য এর আগেও দেখেছি এবং সেইটেই শাস্ত্রসম্মত বলে এতকাল জেনে এসেছিলুম, কিন্তু এখানে যা দেখলুম তা অভূতপূর্ব। দুজনেই–একে অন্যকে ঘুষো, কিল, চড়, লাথি লাগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। বোধ হয় আমরা ঘরে রয়েছি বলে কেউ টু শব্দটি করছে না। ঘুষোঘুষি ঠুস্সা-ঠাস্সা চলতে চলতে হঠাৎ একবার সূর্যবাঈ তার শোবার খাটখানা তুলে ঝেড়ে দিলে স্বামী মাথার ওপরে। সে-আঘাত বাঁচাতে গিয়ে রামসিং নিজের খাটে পা লেগে গেল পড়ে। যাঁহাতক সে পড়ে যাওয়া অমনি কুস্তিগীরের তৎপরতায় সূরযবাঈ লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। কাছেই একটা বড় পাথর পড়ে ছিল, সেখানা সে তুলে নিয়ে রামসিংহের মাথায় দমাদ্দম করে মারতে শুরু করে দিলে। শীতের চোটে আমাদের শরীরে কাঁপন তো ধরেই ছিল, এই দৃশ্য দেখে তার সঙ্গে ভয়ের কাঁপনও এসে যোগ দিলে। মনে হতে লাগল, সকালবেলায় এদের একটার সঙ্গে আমাদেরও তো থানায় টেনে নিয়ে যাবে। তারপরে দিশি রাজ্যের কাজীর বিচারে এই সূত্রে চরম দণ্ড হয়ে যাওয়ায় বিচিত্র নয়।

ওদিকে স্বামীর মাথায় সূরয পাথর ঠুকেই চলেছে। ভাগ্যে তার মাথায় মোটা করে কাপড় জড়ানো ছিল, তা না হলে তার খুলিটি বোতলচুরে পরিণত হত। চোখের সামনে যখন এই খুনোখুনি অথবা কে খুন হয় কাণ্ড চলেছিল, তখন আমার পুরুষের মন এই প্রার্থনা করতে লাগল যে, খুন যদি একটা দেখতেই হয় তবে নারীর হাতে পুরুষের কাত হওয়ার দৃশ্য যেন দেখতে না হয়। পুরুষের এত বড় অপমান’ সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়ানো বড়ই দুর্বহ হবে।

ওদিকে সিংহিনী ক্ষিপ্রহস্তে সিংহের মস্তকচূর্ণের কাজে ব্যস্ত, এমন সময় রামসিং কি করে ঠিকরে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সূরযও উঠে যেমনি পাথরটা ছুঁড়ে তাকে মারতে যাবে, অমনি রামসিং টপ করে তার হাতখানা ধরে অন্য হাত দিয়ে সূরযের গলাটা চেপে ধরে তাকে দেওয়ালের দিকে ঠেলে নিয়ে চলল। মেঝেতে কুকুরগুলো নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্ছিল–এরকম দৃশ্য দেখে দেখে বোধ হয় তাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে সেই হুটোপাটিতে কার একখানা পা একটা কুকুরের পেটে পড়তেই সেটা ক্যাক করে একবার চেঁচিয়ে উঠেই আবার অন্য জায়গায় গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। ওদিকে রামসিং সূরযকে ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালে নিয়ে গিয়ে ঠেসে ধরে গায়ের জোরে মুখে দশ-বারোটা ঘুষো মারতেই সূরযের দীর্ঘ ঋজু দেহ ন্যালবেলে হয়ে দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল। তার পড়বার ধরন দেখে মনে হল, সে মরে গেল।

সূরয তো ওইরকম ভাবে পড়ে রইল। রামসিং সেদিকে গ্রাহ্য না করে বেশ নিশ্চিন্তমনে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জিনিসগুলোকে গুছোতে আরম্ভ করলে। সূরযের খাঁটিয়াখানা একপাশে আকাশের দিকে চার পা তুলে পড়ে ছিল। রামসিং সেখানা তুলে স্বস্থানে ঠিক করে রেখে নিজের খাটে গিয়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

প্রদীপটা সেইভাবে জ্বলতে লাগল।

ব্যাপার দেখে আমরা তো স্তম্ভিত! এর পর আঙ্গেঠি জ্বালানো ঠিক হবে কি না তাই পরামর্শ করতে লাগলুম। জনার্দন বললে, আর আঙ্গেঠি জ্বালিয়ে কাজ নেই, কারণ রামসিংয়ের যা মেজাজ হয়ে আছে, ধোঁয়া নাকে গেলে কি হবে বলা যায় না। কাল সকালে পুলিসের লোকেরা রামসিংহের সঙ্গে আমাদের কোমরেও দড়ি বেঁধে কেমন করে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে–এই দৃশ্যটা মনের পটে আঁকবার চেষ্টা করতে লাগলুম।

সুকান্ত বললে, তারপরে আমরা তিনটিতে এক নারীহত্যার ব্যাপারে জড়িত হয়েছি–খবরটা কাগজে পড়ে বাড়ির লোকে কি গ্ল্যাড-ই হবে!

–কিন্তু যেতে দাও। ভবিষ্যতের গর্ভে যা আছে তাই ঘটবে, এখন তো শুয়ে পড়। রাত্রে ওই সার্কাস দেখে পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, ঠিক অন্য দিনেরই মতন দুধের খদ্দেরে জায়গাটা ভর্তি। সূরজ দুধ দুইছে আর রামসিং মেপে মেপে দুধ দিচ্ছে! রামসিংহের দিকে চেয়ে দেখলুম, তার মুখ ও কপালের দুই-এক জায়গায় কালিশিরে পড়েছে–মুখের বাকিটা দাড়িগোঁফ ও কাপড়ে ঢাকা।

সূরযের মুখখানা দেখবার ইচ্ছা করছিল, কিন্তু সে এমন করে মাথা গুঁজে দোহন-কার্যে ব্যস্ত ছিল যে, ভালো করে দেখাই গেল না। যাক বাবা! সে যে প্রাণে বেঁচে আছে–এই আমাদের ভাগ্য মনে করে দৈনিক চারণের কাজে বেরিয়ে পড়া গেল।

সেদিন কি-একটা কাজে আহারাদির পরে বাসস্থানে ফেরবার প্রয়োজন হয়েছিল। ফিরে এসে দেখি যে, রামসিং তার খাটে একদিকে পা ঝুলিয়ে বসেছে আর সূরয তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, রামসিং তার মাথার উকুন বাছছে। দৃশ্যটি দেখে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে গেল। ঝড়ের পরে প্রকৃতির শান্ত অবস্থা একেই বলে। কাল যে সূরয পরমানন্দে স্বামীর মাথা চুর করতে ব্যস্ত ছিল, আজ সে পরম নির্ভয়ে তারই কোলে মাথা পেতে দিয়েছে। কাল ছিল তারা পশুর পর্যায়ে, আজ তারা মানুষের পর্যায়ে উঠে গেছে। আর একদিন দেখেছিলুম তাদের অন্য রূপ–সে-ঘটনাটি বলেই তাদের কথা শেষ করব।

সূরয ও রামসিং যে-রাত্রে খুনোখুনি করে মরছিল, তারই কয়েকদিন দিন পরের কথা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল, চারদিকে খুব মেঘ জমেছে, রোদের দেখা নেই, মাঝে মাঝে ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে লাগল। বাইরে বেরিয়ে মনে হতে লাগল, শীতে যেন হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে–একটু একটু ঠান্ডা বাতাস বইছিল। নেহাত খাওয়ার জন্য স্টেশনে যেতেই হবে, তাই আমরা সেই ঠান্ডাতেই অগ্রসর হতে লাগলুম। পথে লোকচলাচল বিশেষ দেখলুম না। স্টেশনে গিয়ে শুনলুম যে, শীতকালে নাকি এখানে এইরকম হয়ে থাকে–এইরকম হওয়াই নাকি ভালো, তা না হলে শস্যের অপকার হবে। তারা বললে, শীত এ আর কি দেখছ! আরও বাড়বে। মাঝে মাঝে এইসময় নাকি এমন ঝড়-বৃষ্টি হয় যে, লোকে ঘর থেকে বেরুতে পারে না।

শীতের ঠেলায় আমাদের মনে হতে লাগল, শস্যের উপকার করতে গিয়ে দেবতা এই যে মানুষ মারবার ব্যবস্থা করেছেন–এটা বিশেষ বিবেচনার কাজ হয়নি। যা হোক, স্টেশনে আহারাদি সেরে আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ও শীতে শীৎকার সহযোগে কাঁপতে কাঁপতে বাসস্থানে ফিরে এলুম। ভিজে পরদা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, সেই বেলাবেলিই রামসিং ও সূরয তাদের সংসার-পাট সব ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ছাগলের ধাড়ি বাচ্চা সব বাঁধা হয়ে গেছে–অন্য দিন কুকুরগুলো এদিক-ওদিক চলে যায় খাদ্য-অন্বেষণে, কিন্তু সেদিন দুর্যোগ দেখে এরই মধ্যে ডেরায় ফিরে এসে তারা যে যার জায়গায় কুণ্ডলী পাকিয়েছে।

দেখলুম, রামসিং খাটে বসে তার বিরাট হাতের চেটোয় গাঁজা ডলছে আর সূরয তাদের আঙ্গেঠি দুটোতে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করছে। আমরা হি-হি করতে করতে ধুতি জামা বদলে ঘরের মধ্যেই ছাড়া কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে খাটে বসে কাঁপতে লাগলুম। ওদিকে রামসিং গাঁজা সেজে আঙ্গেঠি থেকে একটু আগুন তুলে কলকেতে দিয়ে লাগালে দম–বাবা ঘর একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। গোটা দু-তিন দম লাগিয়ে সে কলকেটা সূরযকে দিলে। সেও যে দম লাগালে তাকেও রামদম বলা যেতে পারে। তারপর ফাঁকা কলকেটা স্বামীর হাতে দিয়ে দুজনের খাটের নীচে দুটো আঙ্গেঠি ঠেলে দিয়ে দুই খাটে বসে তারা গল্প করতে লাগল।

ওদিকে আমাদের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে উঠতে লাগল। ভাবতে লাগলুম, দিনেই যখন এই অবস্থা তখন রাত কাটবে কি করে! উঠে গিয়ে সূরযকে বললুম, দেখ, আমাদের বড় শীত করছে, দিনের বেলায় আঙ্গেঠি জ্বালাব?

সূরয বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, জ্বালিয়ে নাও না।

আমি ফিরে আসছিলুম, এমন সময় সে বললে, আমি জ্বেলে দেব আঙ্গেঠি?

দেখলুম, তার মেজাজটা খুবই শরীফ রয়েছে। বললুম, দাও-না দয়া করে।

সূরয আমাদের আঙ্গেঠিগুলো তুলে নিয়ে এল। আমি নিজের খাটের কাছে যাচ্ছি এমন সময় রামসিং বললে, দেখ, আগুন জ্বালিয়ে কাঁহাতক শরীর গরম রাখবে? তার চেয়ে এক কাজ কর।

–কি কাজ?

–কিছু গাঁজা আনিয়ে নাও। শীত যখন অসহ্য হবে তখন মাঝে মাঝে গাঁজায় দম লাগাবে–শরীর একেবারে গরম হয়ে উঠবে।

ফিরে এসে বন্ধুদের কাছে রামসিংয়ের প্রস্তাব পেশ করা গেল। পরামর্শ চলল–শেষকালে গাঁজা খাব! না না বাবা, মাথা-টাথা খারাপ হয়ে শেষে পাগল হয়ে রাস্তায় নেচে নেচে বেড়াতে হবে!

আমি আর রামসিংয়ের কাছে ফিরে গেলুম না। একটু বাদে সূরয তিনটে আঙ্গোঠ ভরে এনে দিলে। আমরা তাতে আগুন ধরিয়ে নিজের নিজের খাটের নীচে রেখে ঠিক তার ওপরেই উবু হয়ে বসে আগুন তাপতে লাগলুম। কিন্তু ছাগলের নাদির আর তেজ কতটুকু! কষ্টে-সৃষ্টে ঘণ্টাখানেক তাপ বিকিরণ করেই সেগুলি ভস্মে পরিণত হল। এইভাবে শীত চললে রাত্রে কি অবস্থা হবে বসে বসে তাই ভাবছি, এমন সময় রামসিং–যে এতক্ষণ মাথা-মুড়ি দিয়ে পড়ে ছিল, সে ধড়মড় করে উঠে বসে আবার গাঁজা তৈরি করতে আরম্ভ করে দিলে। সূর্যবাঈ এতক্ষণ এদিক-ওদিক কি করে বেড়াচ্ছিল, শুভকার্যের সূচনা দেখে সে গুটিগুটি স্বামীর পাশে এসে বসল। কিছুক্ষণ বাদে রামসিং কলকেতে গাঁজা ঠেসে সেটাকে টানবার জন্যে বাগিয়ে ধরলে আর সূরয উঠে তাতে দেশলাই জ্বেলে আগুন দিতে লাগল।

আমরা হাঁ করে তাদের এই কসরত দেখছি, এমন সময় কোথাও কিছু নেই আমাদের জনার্দন টপ করে উঠে কোনো কথা না বলে তাদের কাছে চলে গেল। সেখানে পৌঁছে সে সূরযকে কি জানি বললে। সূরয তার মুখের দিকে চেয়ে দেশলাইটা তার হাতে দিতেই সে একটা কাঠি জ্বালিয়ে রামসিংয়ের করধৃত কলকের ওপরে ধরতে রামসিং মারলে টান–তারপরেই মুখ দিয়ে বার করলে রাশীকৃত ধোঁয়া। এর পর রামসিং কলকেটা দিলে জনার্দনের হাতে। জনার্দনও বিনা দ্বিধায় সেটাকে বাগিয়ে ধরে টান মেরে প্রায় রামসিংয়ের মতনই আর-একরাশ ধোঁয়া বের করে কলকেটা সূরযের হাতে দিলে। এইভাবে পালা করে টেনে টেনে তারা তিনজনে মিলে সেই ক্ষুদ্রকায়া কলকে থেকে একটি মেঘলোকে সৃষ্টি করে তার মধ্যে বসে রইল।

বাইরে তখন প্রবল ধারায় বৃষ্টি চলেছে–সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া সে ঝড়েরই নামান্তর। আমি ও সুকান্ত বসে বসে তাদের দেখতে লাগলুম। প্রথমে কিছুক্ষণ তারা তিনজনেই স্থির হয়ে বসে রইল। তারপরে জনার্দন উঠে সূরযের খাটে গিয়ে বসল। একটু পরেই সূরয এসে বসল তার পাশে। শেষে তারা তিনজনে কি-সব কথাবার্তা বলতে লাগল। হিন্দি-উর্দু বলতে পারে না বলে এতদিন জনার্দন রামসিং কিংবা সূরয কারুর সঙ্গেই কথা বলত না। এখন দেখলুম, গাঁজার কল্যাণে সে হাত নেড়ে তাদের সঙ্গে খুব কথা বলছে। জনার্দনের কথাগুলোও বৃথা যাচ্ছে না, কারণ তার কথা শুনে কখনও সূরয হাসছে, কখনও রামসিং হাসছে। রামসিংয়ের পোড়ার-মুখে আমরা এতদিন কখনও হাসি দেখিনি। সেই রামসিংয়ের মুখে হাসি দেখে মনে-মনে জনার্দনকে তারিফ করে তাকে ডাক দিলুম।

জনার্দন কাছে আসতেই বললুম, কি রে, গাঁজা খেলি শেষকালে?

জনার্দন বললে, কি করব! শেষকালে কি শীতে মারা যাব নাকি? গাঁজা গ্র্যান্ড জিনিস রে! এই দেখ, আমার আর কিচ্ছু শীত লাগছে না।

এই বলে জনার্দন গায়ের কাপড়খানা খুলে ছুঁড়ে খাটে ফেলে দিয়ে বলতে লাগল, শীত তো লাগছেই না, তা ছাড়া যা চোখে পড়ছে তাই সুন্দর বলে মনে হচ্ছে। মাইরি, তোরাও এক এক ছিলিম খেয়ে দেখ।

গাঁজা খাওয়ার বিরুদ্ধে আমাদের মনে প্রথমে যত প্রবল আপত্তিই থাকুক-না কেন, জনার্দন কলকে ধরে টান মারতেই তার প্রাবল্য অনেকখানি কমে গিয়েছিল। তারপর জনার্দনের যুক্তি ক্রমেই আমাদের আপত্তির ভিত টলিয়ে দিতে লাগল। শেষকালে যখন সে বললে, আমরা তো আর নেশা বা ফুর্তি করবার জন্যে খাচ্ছি না, শীত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে কম্বল কেনবার পয়সা নেই, তাই গাঁজা খেয়ে শীত নিবারণ করছি, স্রেফ প্রাণের দায়ে–

বাস্, আর বেশি যুক্তির প্রয়োজন হল না। এখন গাঁজা পাওয়া যায় কোথায়? এই শীত ও জল-ঝড়ের মধ্যে সে-জিনিস আহরণই বা করবে কে?

জনার্দন বললে, সে আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।

সে আবার রামসিংয়ের কাছে গিয়ে তাকে কি সব বলে আমাদের কাছে এসে বললে, দু’-আনা পয়সা দাও।

পয়সা নিয়ে গিয়ে রামসিংয়ের হাতে দিতে সে মাথায় গায়ে ভালো করে কাপড় জড়িয়ে নিয়ে সেই জল-ঝড়ে গাঁজা কিনতে বেরিয়ে গেল।

জনার্দন আর আমাদের কাছে ফিরল না, সে ওদিকেই রয়ে গেল। আমরা বসে বসে দেখতে লাগলুম, গাঁজা খেয়ে তার কর্মপটুতা যেন বেড়ে গেছে। সে সূরযের সঙ্গে নানা কাজ করে ঘুরতে লাগল। শুধু তাই নয়, দেখলুম, তার সঙ্গে জনার্দনের হাসি-ঠাট্টাও চলছে। কিছুক্ষণ পরে সূরয ছাগল দুইতে আরম্ভ করলে আর জনার্দন ছাগলের বাচ্চা ধরে রইল। তাদের বাক্যালাপও খুব চেঁচিয়ে হচ্ছিল বটে; কিন্তু ঘরখানা এত বড় যে, একদিকে কিছু বললে, অন্যদিকে আওয়াজ শোনা যায় মাত্র, তার ওপরে বায়ু ক্রমেই অসম্ভব রকমের ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিলেন বলে তাদের কথা আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলুম না।

এইভাবে কিছুক্ষণ কাটবার পর বাইরের ঝড় যেন আরও উদ্দাম হয়ে উঠতে লাগল। আমাদের সেই জায়গাটা ছিল শহরের একপ্রান্তে। বাড়ি-ঘর বেশি না থাকায় স্থানটি একটু জংলী গোছের। ঘরের দু-দিকের দেওয়ালে খুব বড় বড় দুটো গর্তের কথা আগেই বলেছি। সেই ফুটো দিয়ে এখন কামানের মতন গর্জন করতে করতে হাওয়া ও জল ঘরে ঢুকতে আরম্ভ করলে। ক্রমে ক্রমে শীতও হয়ে উঠতে লাগল অসহ্য। মেরুপ্রদেশ ছাড়া শীতকালে সমতল ভূমিতেও যে এমন দুর্যোগ হতে পারে তা আমাদের জানা ছিল না। হা-পিত্যেশ করে আর কতক্ষণ গাঁজার আশায় বসে থাকব? ভাবছি, প্রাণটা থাকতে থাকতে রামসিং এখন ফিরে এলে হয়! ওদিকে একটা একটা করে সূরয চার-চারটে ছাগল দুয়ে ফেললে। তার পরে একটা বড় আঙ্গেঠি জ্বেলে তার ওপরে দুধ-ভর্তি পেতলের একটা বড় লোটা বসিয়ে সেটাকে নিজের খাটের নীচে রাখলে–তারপরে সে আর জনার্দন পা তুলে খাটে বসে রইল।

সেই যুগল-মূর্তি দেখতে দেখতে আমাদের দুঃসময় কাটতে লাগল।

খানিকক্ষণ বাদে রামসিং ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল।

এতক্ষণে এলি বাপ!–বলে আমরাই ছুটে তার কাছে এগিয়ে গেলুম। দেখলুম, বৃষ্টিতে তার সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়েছে, বেচারি শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। তাড়াতাড়ি করে সে জামাটা খুলে ফেলে মাটিতে বসে পড়ে জ্বলন্ত আঙ্গেঠি থেকে দুধের গরম ঘটিটা নামিয়ে আগুন পোয়াতে আরম্ভ করে দিলে। মিনিট পাঁচেক আগুন পোয়াবার পর সে ট্যাক থেকে একটা কাগজের মোড়ক বার করে সূরযের হাতে দিয়ে বললে, তৈরি কর্।

সূরয কাগজের মোড়কটা খুলে তার কুলোর মতন হাতের চেটোয় কিছু মাল তুলে নিয়ে ডাঁটি বিচি ইত্যাদি ফেলে দিয়ে সেগুলিকে কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে তাতে কয়েক ফোঁটা জল দিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে টেপাটেপি আরম্ভ করে দিলে। তারপরে বিধিমতে পেষণ ও কর্তন ইত্যাদির পালা শেষ হয়ে গেলে কলকেতে ঠেসে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে সূরয বললে, নাও–পিও।

–সেকি কথা! তুমি এত কষ্ট করে তৈরি করলে আগে তুমি টানো।

আমাদের অনুরোধে সূরয সলজ্জ বধূর মতো একটু হেসে লজ্জিত হয়ে কামানটিকে বাগিয়ে ধরলে, আর আমরা ওপর থেকে দেশলাই মারতে লাগলুম। সূরযের পর আমার ও সুকান্তের হাতে-খড়ি হল। প্রথম সেবকের পক্ষে আমরা ভালোই উতরে গেলুম।

প্রথম ছিলিমে আমাদের দু-টান করেও হল না। রামসিং অনুমতি চাইলে, শীতে কালিয়ে গিয়েছি, একটা বড় করে কলকে সাজব?

–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়। অত কিন্তু হচ্ছ কেন ভাই?

অবিলম্বে দ্বিতীয় ছিলিম তৈরি হল। আরও তিনটি করে টান মেরে নেশায় বুঁদ হয়ে গেলুম। নেশার প্রথম দিন, ঠিক যেন ফুলশয্যার রাত্রি। সে অনুভব করা যায় মাত্র, তার আর ব্যাখ্যা করা চলে না। দুনিয়ার রঙই গেল বদলে। সেই, ভাঙা ঘরখানাকে মনে হতে লাগল– যেন দেওয়ান-ই-খাস। দড়ির ঝোলা খাটকে মনে হতে লাগল–তখত-এ-তাউস্। রামসিং সূরয ও আমাদের মধ্যে যে জাতি, ধর্ম, সংস্কার ও শিক্ষার প্রাচীর ছিল তা ধোঁয়ার ফুৎকারে কোথায় মিলিয়ে গেল। মনে হতে লাগল, এই দুনিয়ার তারাই আমাদের পরম বন্ধু। সাম্যবাদকে যাঁরা গাঁজাখুরি ব্যাপার বলে থাকেন–তাঁদের কথা যে একেবারে অসত্য নয়, তার প্রমাণ আমরা ব্যক্তিগত জীবন থেকে দিতে পারি। সরাব ও সিদ্ধির নেশার অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে হয়েই গিয়েছিল, এইবার গাঁজায় হাতে-খড়ি হল।

যাঁরা যোগ-যাগ করে থাকেন এমন অনেকের মুখেই শুনেছি যে, আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের মধ্যেই এবং এর অতীতে আরও কয়েকটি জগৎ আছে–অনেকে এগুলিকে বলেছেন সূক্ষ্মজগৎ। সাধনার পথে অগ্রসর হতে হতে যোগী এইসব জগৎ দেখতে পান। কিন্তু গাঁজার গুণে সেই দৃশ্যমান জগতই সেবকের চোখে অন্যরূপে ধরা দেয়। অরূপকে দেখে সে রূপময় নির্গুণকে দেখে গুণময়। অসুন্দর তার চোখে সুন্দররূপে ধরা দেয়। অমন যে জাঠের মেয়ে সূরযবাঈ–আমাদের চেয়ে মাথায় আধহাত উঁচু–যার চলনে ফেরনে বলনে কখনও কোনো সময়ে একটা মাধুর্যের লেশ চোখে পড়েনি, তাকেই সুন্দরী ও মাধুর্যময়ী বলে মনে হতে লাগল–ধন্য গাঁজা, তুয়া গুণ কহই না পার।

একটুখানি খোশগল্প ও হাসাহাসি চলবার পর রামসিং আবার আগের মতন মাথায় কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। সূরয গাঁজার মোড়কটা আমাদের হাতে দিতে শুয়ে পড়বার জোগাড় করছিল কিন্তু আমরা তাকে শুতে নাঁ দিয়ে একরকম টেনেই নিয়ে গেলুম আমাদের খাটের কাছে।

চারজন মুড়ি-ঝুড়ি দিয়ে বেশ জমাটি হয়ে বসে গল্প শুরু করে দেওয়া গেল। কিছুক্ষণ থেকে বাতাসের সেই উদ্দাম ভাব কমে গিয়ে চেপে বৃষ্টি নেমেছিল। সূরয বলতে লাগল, এই বৃষ্টিতে এখানকার শস্যের খুব ভালো হবে।

আমরা বললুম, শস্যের ভালো হলে আর তোমাদের কি লাভ বল? তোমরা তো আর চাষবাস কর না।

সূরয বললে, আমরা চাষ নাই-বা করলুম যারা করবে তাদের তো ভালো হবে। তা ছাড়া আমাদের যে-জমিতে অন্য লোক চাষ করে, তারা বেশি শস্য পেলে আমরাও তো তার ভাগ পাব।

চাষবাস, জমি-জায়গার কথা হতে হতে সূরয আবার আগের মতন গম্ভীর বিষণ্ন ও মৌন হয়ে পড়ল। আমাদের সামনের দেওয়ালে সেই প্রকাণ্ড গর্ত দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছিল–বিরাট ভগ্নস্তূপ ছোট বড় নানা আকৃতির ঢিপি—-যতদূর দৃষ্টি চলে। তার ওপরে রাজ্যের জঙ্গল জন্মেছে। বড় বড় গাছ বেয়ে লতা উঠেছে, তাতে নানা রঙের ফুল ধরেছে। আবার অনেকখানি গাছপালা শুকিয়ে গেছে। আমরা এসে অবধি দেখেছি, এই ভগ্নস্তূপে, এমনকি উঁচু উঁচু গাছের ডগা অবধি ধুলোর আস্তরণে ঢাকা। ‘বৃষ্টিতে সেই আবরণ ধুয়ে গিয়ে জঙ্গলের এক নতুন রূপ আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল।

সেই ভগ্নস্তূপের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমাদের মৌন সূরয আবার মুখর হয়ে উঠল। সে বলতে লাগল, এই যে ভাঙা বাড়ি দেখা যাচ্ছে–একদিন, সে বোধ হয় তিন-চার শো বছর আগে হবে, ছিল এক বিরাট প্রাসাদ। তারা ছিল এই অঞ্চলের রাজা। প্রাসাদ যেমন বড় দেখছ, ঐশ্বর্যও তাদের কম ছিল না। হাতি ঘোড়া, গরু মহিষ, দাস দাসী, সৈন্য সামন্ত সবই ছিল, কিন্তু সেসবই ধীরে ধীরে চলে গিয়েছে–সেই বিরাট প্রাসাদের মধ্যে এই ভাঙা ঘরখানি মাত্র অবশিষ্ট আছে। আর সেই রাজবংশে বাতি দিতে আছি ওই রামসিং আর আমি। ছাগলের দুধ বেচে জীবিকা নির্বাহ করছি, তাও দু-বেলা পেট ভরে অন্ন জোটে না।

বলতে বলতে সূরযের চক্ষু সজল হয়ে উঠল। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললুম দুঃখ করো না। আমরা শুনেছি ভারতবর্ষের সম্রাটের বংশধরেরা আজ রেঙ্গুনে দপ্তরীগিরি করছে, চিরদিন সমান যায় না।

সূরযকে জিজ্ঞাসা করলুম, তুমিও কি এই রাজবংশেরই মেয়ে?

সূরয বললে, হ্যাঁ। কয়েক পুরুষ আগে আমরা এই ভাঙা বাড়ি ছেড়ে দিয়ে রাজপুতানায় গিয়ে বাসা বেঁধেছিলুম। কিন্তু এই জঙ্গলের সঙ্গে জনমে জনমে বাঁধা পড়ে আছি, যাবো কোথায়! রামসিংয়ের বাপ তার ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে এখানে নিয়ে এল–আমরা স্বামী ও আমি, আমরা একই বংশের ছেলে-মেয়ে।

গল্প বলতে বলতে সূরয বেশ একটা করুণ আবহাওয়া সৃষ্টি করলে। সে আবার শুরু করলে, আমাদের শিরায় রাজরক্ত বইছে–বলতে গেলে আমরা রাজার মেয়ে ও রাজার ছেলে, আজ ছাগলের দুধ বেচে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছি।

প্রসঙ্গটা বদলে ফেলবার জন্যে বললুম, আচ্ছা, তোমরা কখনও ওই ভগ্নস্তূপের মধ্যে গিয়েছ?

সূরয উদাসভাবে বললে, যাই, দরকার পড়লে যেতে হয় বইকি।

বললুম, কি সর্বনাশ! ওই জঙ্গলের মধ্যে আবার দরকার কিসের?

সূরয একটু হাসবার চেষ্টা করে বললে, যখন ছাগলের দুধ থাকে না, দু-বেলা দুখানা করে রুটিও বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমরা স্বামী-স্ত্রীতে চলে যাই ওই জঙ্গলের ভেতরে, আমাদের বজ্রদের কাছে–তারা যা দেয় তাই দিয়েই চলে তখন।

বলে কি রে বাবা! তখন নেশার শেষ অবস্থা, একটু ঘুম-ঘুম লাগছিল, শরীরটা আলস্যে ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু সূরযের এই শেষকথাটা যেন কেমনধারা লাগল। চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলুম, তার মানে? ওর ভেতর গুপ্তধন আছে নাকি?

সূরয বললে, আরে, সে তো আছেই। আমাদের পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত ধন ওইখানে পোঁতা আছে। পূর্বপুরুষেরা মরে যাবার পর দেও হয়ে সেইসব ধন আগলাচ্ছে। আমরা মরে গেলে আমাদেরও সেই কাজ করতে হবে। কারও সাধ্য নেই, সেইসব টাকাকড়ি-জহরতে হাত দেবার। তা হলে তৎক্ষণাৎ সেই ব্যক্তির মৃত্যু হবে। কত লোক, কত চোর-ডাকাতের দল যে সেইসব গুপ্তধনের সন্ধানে ওখানে গিয়েছে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই, কিন্তু কেউ কিছুই পায়নি। যারা সন্ধান পেয়েছে, দেওরা তাদের মেরে ফেলেছে–ওখানে গেলে দেখতে পাবে, চারদিকে সেইসব মৃত মানুষের কঙ্কাল ছড়ানো রয়েছে।

–তবে! কি ধন তোমরা আনতে যাও ওখানে?

সূরয বললে, আমাদের প্রাসাদের সবটাই কিন্তু পাথর দিয়ে তৈরি ছিল না, তার মধ্যে কাঠের দরজা-জানলা কড়ি-বরগাও ছিল। বগেরা সেইব কড়ি বরগা দরজা জানলা এখনও পর্যন্ত সযত্নে রেখে দিয়েছেন। দুঃখের দিনে আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে সকালবেলা কুড়ুল হাতে করে চলে যাই ওই গহন রহস্যের মধ্যে। খুঁজে খুঁজে বড় দেখে একখানা কড়ি সারাদিন ধরে দুজনে মিলে চেলা করে সেই সন্ধেবেলা নিয়ে ফিরে আসি –পরদিন বাজারে সেই কাঠ বিক্রি করে আবার যতদিন চলে–আবার যাই, আবার নিয়ে আসি–এমন করেই তো আমাদের দিন চলে। ছাগলের দুধ বিক্রি করে বা তোমাদের মতন যাত্রী রেখে বছরের আর ক’টা দিনই বা চলে?

জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা ওখানকার কাঠের সন্ধান আর কেউ জানে না?

–জানে বইকি। কিন্তু সেসব জায়গা এমন ভয়ানক ও দুর্গম যে, লোকে যেতে সাহস করে না। তা ছাড়া সেসব কাঠ তো আমাদের সম্পত্তি। বড় বড় সাপ জড়িয়ে আছে সেসব কাঠে। তারা সব দেও, আমাদেরই পূর্বপুরুষের লোকজন। পাপকাজ করেছিল বলে সাপ হয়ে আমাদের সম্পত্তি আগলাচ্ছে। আমরা মরে গেলে তারা সব মুক্তি পাবে।

–তারা তোমাদের কিছু বলে না?

–কেন বলবে! তারা তো আমাদেরই লোক ছিল আর আমাদের জন্যেই ওখানে রয়েছে। আমরা গেলেই তারা সরে যায়। তা ছাড়া সব সময়েই যে আমরা কড়ি বরগা দরজা জানলা নিয়ে আসি তা নয়। দেখতে পাচ্ছ ওখানে কত বড় বড় গাছ জন্মেছে এইসব গাছ কেটেও মাঝে মাঝে বিক্রি করা চলে, রাজার বংশের লোক আমরা, পরের নোকরি তো আর করতে পারি না। পরমাত্মার কৃপায় এই করেই দিন গুজরান হচ্ছে। শীতকালে ওখানে বাঘ এসে লুকিয়ে থাকে, তারা মানুষ গরু প্রভৃতি মেরে ওইখানে টেনে নিয়ে যায়। তা ছাড়া কত রকমের শের ও শের-এ-বব্বর বাস করে ওই ভাঙা প্রাসাদে তার আর ঠিক-ঠিকানা নেই, কিন্তু বগূদের দয়ায় তারা আমাদের কিছুই বলে না। এইসব দেওয়ালে এত বড় বড় যে গর্ত রয়েছে, বাঘ ইচ্ছা করলেই এর মধ্যে দিয়ে ঢুকে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু দেওরা রক্ষা করে।

এবারে সত্যিই আমাদের নেশা একেবারে ছুটে গেল। গাঁজা সস্তার জিনিস, তার আর জান কতটুকু! তার পেছনে এমন করে শের, শের-এ-বব্বর প্রভৃতি জানোয়ার ও দেও লাগলে কতক্ষণ তাদের সঙ্গে লড়াই করতে পারে! রামসিং ও সূরযের বজ্রদের দেও তাদের রক্ষা করে বলে তারা যে আমাদের ওপরেও দয়া করবে এমন কোনো কথা নেই।

আমাদের চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার জোরও বাড়তে আরম্ভ করল। সূরয আমাদের কাছ থেকে উঠে গিয়ে আঙ্গেঠিগুলো সব ভরে প্রত্যেক খাটের নীচে একটা করে রেখে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *