১১ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ সোমবার
সকাল থেকেই মাথা ভার হয়ে আছে, ঠিক হয়ে বসতেই পারছি না। এই অবস্থায় অনেক সময় কাটাইয়া দিলাম বারান্দায়। ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। কিছু খেতেও ইচ্ছা করছে না। প্রায় ১১টার সময় ডাক্তার সাহেব এলেন, বললাম আমার অবস্থা। তিনি বললেন রক্তচাপটা দেখতে হবে। রক্তচাপ আমার নাই (ব্লাড প্রেসার যাকে বলা হয়)। কোনোদিন তো ছিল না। দেখা যাক কি হয়! এই খুঁতখুঁতে ব্যারাম বেশি কষ্ট দেয়। যদি কিছু একটা হয় ভালভাবে হয়েই শেষ হয়ে যাওয়াই উচিত। চোখ বুজে থাকলে ভাল লাগে। মেট বার বার তাগিদ দিতেছে কিছু খাবার জন্য। সকালে তো কিছু খেয়েছি, আবার কি? হঠাৎ মেজাজটা খারাপ করে ফেললাম। পরে দুঃখিত হলাম। বললাম, ভাল লাগে না কিছুই খেতে। আমার বেগমের দৌলতে কোনো জিনিসের তো আর অভাব নাই। বিস্কুট, হরলিকস, আম, এমন কি মোরব্বা পর্যন্ত তিনি পাঠান। নিজে আমি বেশি কিছু খাই না, কারণ ইচ্ছা হয় না। আবার ভয়ও হয় যদি পেট খারাপ হয়ে পড়ে। আবারও একদিন রক্ত পড়েছে। পাইলস ভাল হয়ে গিয়াছিল, আবার হলো। উপায় তো নাই। আমি একলাই শুধু ভুগি না কয়েদিরা প্রত্যেকই কোনো না কোনো ব্যারামে ভোগে। বিশেষ করে রাজবন্দিরা, কারণ এদের তো কোনো কাজ নাই। খাও শুয়ে থাক আর বদহজমে ভোগ, তারপর একটা একটা করে রোগে তোমাকে আক্রমণ করুক এইতো সরকার চায়। স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাক। আরামপ্রিয় হয়ে উঠুক। বাইরে গেলে আর কাজ করতে পারবে না।
আজ পাবনার রণেশ মৈত্রের সাথে আমার হঠাৎ দেখা হলো। ল’ পরীক্ষা দিতে পাবনা থেকে আনা হয়েছিল। দুই একদিনের মধ্যে চলে যাবেন এখান থেকে। বললাম, আপনার ছেলেমেয়ের কি খবর? বললেন, কি আর খবর, না খেয়েই বোধ হয় মারা যাবে। স্ত্রী ম্যাট্রিক পাশ কাজ কর্ম কিছু একটা পেলে বাঁচতে পারতো; কিন্তু উপায় কি! একে তো হিন্দু হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, তারপর রাজবন্দি, কাজ কেউই দিবে না। একটা বাচ্চা আছে। বন্ধু-বান্ধব সাহায্য করে কিছু কিছু, তাতেই চালাইয়া নিতে হয়। গ্রামের বাড়িতে থাকার উপায় নাই। মৈত্র কথাগুলি হাসতে হাসতে বললেন। মনে হলো তাঁর মুখ দেখে এ হাসি বড় দুঃখের হাসি।
সন্ধ্যায় তালা বন্ধ করার সময় বাইরের দরজাটা একটু খুলেছিল, তাই দেখা হয়ে গেল হঠাৎ। আবার বললাম, “পাবনা যাবেন বোধ হয়। বন্ধু মোশতাককে পাবনায় জেলে নেওয়া হয়েছিল। বোধ হয় সেখানেই আছে, কেমন আছে জানি না। তাকে খবর দিতে বলবেন।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বোধ হয় দুই তিন মিনিট হবে। এক জেলে থেকেও আমরা রাজনৈতিক বন্দি বলে একে অন্যের সাথে দেখা বা কথা বলতে পারি না। আমার সাথে তো কাহাকেও কথা বলতে দেয় না।
খবরের কাগজ এসেছে অনেক বেলায়। কোনো সংবাদই নাই। তবে আতাউর রহমান সাহেবের একটি বিবৃতি আছে খাদ্য সমস্যার উপর মোনায়েম খাঁ সাহেব সরকারি প্রেস নোটের প্রতিবাদ করে। ঘরে বসে বিবৃতি দিয়ে চাউলের দাম কমানো যায় না। সক্রিয় কর্মপন্থা দরকার। সে সাহস জনাবদের নাই। বিবৃতি ও বক্তৃতা দিয়েই নেতা হয়ে থাকতে চান আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদ।
১২ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ মঙ্গলবার
ভালই লাগে না, কি যে করব বুঝে উঠতে পারি না। মাথা ব্যথাটা এখন অনেক কমেছে। খবরের কাগজে পড়বার মতো কিছু থাকে না। একঘেয়ে। সংবাদ। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কি বললেন, কি করবেন, কোথায় গেলেন, কার সাথে দেখা করলেন, দেশের উন্নতি, অগ্রগতি, গুদাম ভরা খাদ্য, অভাব নাই, বিরাট বিরাট প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়েছে, কাজ শুরু হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু তথাকথিত মুসলিম লীগের নেতারা এক ঈমান, এক রাষ্ট্র, এক মুসলমান, এক দেশ, এক নেতা বলে সর্বক্ষণ গলা ফাটাচ্ছে। আবার কেহ কেহ বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তানের উপর আনুগত্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেহ কেহ মুরব্বিয়ানাচালে দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেটও দিয়ে থাকেন। দুনিয়ায় নাকি পাকিস্তানের সম্মান এতো বেড়ে গেছে যে আসমান প্রায় ধরে ফেলেছে। নানা বেহুদা প্রশংসা, তবুও তাই পড়তে হবে। সময় যে কাটে না। ডন কাগজও দেখলাম, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো ভাল খবর পাওয়া যায় নাই! ঐ একই প্যামফ্রেট। আমার তো মনে হয় সরকার বিরাট প্ল্যান নিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত দেশে একদলীয় সরকার করতে চেষ্টা করবে। ভুল হবে এ চেষ্টা করলে। ভীষণ আত্মকলহ ও বিশৃঙ্খলা শুরু হবে কেহ তা দমাতে পারবে না। আমাদের মতো রাজনীতিবিদরা অনেকে পিছনে পড়ে থাকবে। কারণ তালে তাল মিলায়ে চলতে পারবে না।
দুপুরে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কারণ মাথার ব্যথা যেন আর না হয়। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আধা ঘণ্টার উপর হবে। উঠে আবার কাগজ নিয়ে পড়তে পড়তে সিকিউরিটি সিপাই এসে বলল, আপনার সাক্ষাৎ আছে, চলুন। বললাম, কে এসেছে। বলতে পারে না। ভাবলাম উকিল সাহেবরা এসেছেন। এডভোকেট রব সাহেব ও আবুল হোসেন সাহেব এসেছেন। তাঁদের সাথে আলাপ করতে করতে দেখি আরেকটা সাক্ষাৎ দিয়েছে আমার বেগমের সাথে। রব সাহেবকে বললাম, হাইকোর্টে রীট পিটিশন করতে- কেন মোশতাক, তাজউদ্দীন, নূরুল ইসলাম ও অন্যান্য নেতাদের মফস্বল জেলে আলাদা আলাদা করে রেখেছে? আর আমাকে কোন আইনের বলে Solitary confinement-এ রাখা হয়েছে! জেল আইনে দু’ মাসের বেশি কাউকেও রাখতে পারে না। একাকী এক জায়গায় রাখা উচিত না। রব সাহেব আইন দেখে রীট পিটিশন করবেন বললেন। তারপরই আমার বেগম ও বাচ্চারা এল। হঠাৎ দেখা পাওয়ার অনুমতি পেল কি করে! রব সাহেব চলে গেলেন। আমি কিছু সময় বাচ্চাদের সাথে আলাপ করলাম। মাকে আব্বা খুলনা থেকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। অনেকটা ভাল এখন, তবে আপাততঃ ঢাকা আসবে না। রেণু বলল, কামাল খুব লেখাপড়া আরম্ভ করেছে। আগামীবারে ম্যাট্রিক দিবে। সকলকে মন দিয়ে পড়তে বলে বিদায় নিলাম। বেশি সময় কথা বলার উপায় নাই- ছোট্ট কামরা জেল অফিসের, বিজলি পাখা বন্ধ। ছোট্ট বাচ্চাটা গরমে কষ্ট পাচ্ছে। ছোট মেয়েটা স্কুল থেকে এসেছে। বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলে গেটে দাঁড়াইয়া ওদের বিদায় দিলাম। গেট পার হয়েও রাসেল হাত তুলে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। বোধ হয় বুঝে গিয়েছে এটা ওর বাবার বাড়ি, জীবনভর এখানেই থাকবে!
অনেক খাবার নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যায় কিছু কিছু বন্ধু-বান্ধবদের দিলাম। আবার রাতেও খাবার সময় আশে পাশে কিছু দিলাম, কারণ নষ্ট হয়ে যাবে।
রাতে আমার আব্বাকে স্বপ্নে দেখে জেগে উঠলাম। আব্বার চেহারা মলিন হয়ে গেছে বলে মনে হলো। ভোর রাতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আবারও স্বপ্নে দেখি নবাবজাদা নছরুল্লাহ খানকে। অনেক বুড়া হয়ে গেছেন, দাড়ি পেকে গেছে। আর কিছুই আমার মনে নাই। উঠতে অনেক দেরি হলো ঘুম থেকে।
১৩ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ বুধবার
একই সমস্যা একই সমাধান, গুলি করা। ভারতবর্ষে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালাইয়া আটজনকে হত্যা করেছে। কয়েকশত লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। জনসাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বামপন্থী দলগুলির ডাকে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে যেয়ে গুলি খেয়ে জীবন দিল। শত শত কর্মী গ্রেপ্তার হলো। কংগ্রেস নেতারা সারাজীবন জেল খেটেছিলেন। গুলির আঘাত নিজেরাও সহ্য করেছেন। আজ স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তারাই আবার জনগণের উপর গুলি করতে একটুও কার্পণ্য করেন না। আমরা দুইটা রাষ্ট্র পাশাপাশি। অত্যাচার আর গুলি করতে কেহ কাহারও চেয়ে কম নয়। গুলি করে গ্রেপ্তার করে সমস্যার সমাধান হবে না। ভারতের উচিত ছিল গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা স্থায়ী শান্তি চুক্তি করে নেওয়া। তখন পাকিস্তান ও ভারত সামরিক খাতে অর্থ ব্যয় না করে দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারত। দুই দেশের জনগণও উপকৃত হত। ভারত যখন গণতন্ত্রের পূজারি বলে নিজকে মনে করে তখন কাশ্মীরের জনগণের মতামত নিতে কেন আপত্তি করছে? এতে একদিন দুইটি দেশই এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য হবে।
রাশিয়া উত্তর ভিয়েতনাম সরকারকে সামরিক সাহায্য প্রেরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাশিয়া পূর্ব থেকেই অনেক সাহায্য দিয়াছে। আমেরিকানরা যতই নিজকে শক্তিশালী মনে করুন, রাশিয়া যখন হ্যানয় সরকারকে সাহায্য করতে আরম্ভ করেছে তখন যুদ্ধে জয়লাভ কখনই করতে পারবে না। এর পরিণতিও ভয়াবহ হবে। একমাত্র সমাধান হলো তাদের ভিয়েতনাম থেকে চলে আসা। ভিয়েতনামের জনসাধারণ নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নিবে।
২৫শে আগস্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা হতে জনাব শোয়েব বিদায় গ্রহণ করে বিশ্বব্যাংকের চাকরি গ্রহণ করবেন। শেষ পর্যন্ত শোয়েব সাহেবকেও যেতে হলো। ভুট্টো সাহেবকে তাড়ানোয় চীনা লবীর লোকেরা খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। নিশ্চয়ই আমেরিকানদের চাপে তাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। শোয়েব সাহেবকে তাড়াইয়া দেখালেন যে আমেরিকানদেরও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ধার ধারেন না। তাই আমেরিকা লবীর নেতা শোয়েবকেও তাড়াইলেন। এটা শোয়েবের সাথে পরামর্শ করেই করা হয়েছে বলে মনে হয়—জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। তাকে জায়গা মতোই পাঠান হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা। মনে হয় চাকরী পাকাপাকিই ছিল। আমেরিকানদের দালালি করেছেন মন প্রাণ দিয়ে। পাকিস্তানকে বন্ধক দিয়েছেন তার একটু প্রতিদান তো জনাব শোয়েব পাবেনই!
সকালেই খবর পেলাম চটকল শ্রমিক ফেডারেশন সেক্রেটারি জনাব মান্নান জামিন পেয়েছে। আজই চলে যাবে, আমার সামনেই বিশ সেলে ছিল, সাধারণ কয়েদি করে রাখা হয়েছিল। রাতে ও মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতো। শুনতাম রাতভর জেগে বসে থাকত। ডিপিআর অস্ত্র নিক্ষেপ করে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখতেও পারতো। যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত যেতে দিয়েছে। এত কষ্ট করার পরও মান্নানের মুখে হাসি দেখেছি। মোটেই ভয় পায় নাই। তার উপর আমার বিশ্বাস আছে-শ্রমিকদের স্বার্থ বিসর্জন সে দিবে না, তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের মতো।
আজ বিকালে পাবনার রামললিতকে ঢাকা জেল থেকে অন্যত্র পাঠাইয়া দিয়েছে।
বিকালে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। আমি বারান্দায়ই পায়চারী করতেছিলাম। বৃষ্টি কিছু কম হয়েছে, দেখা গেল রণেশ বাবু যেতেছেন। তাকে আদাব করে বিদায় দিলাম, আর বললাম, যদি পাবনা জেলে যান তবে বন্ধু মোশতাককে বলবেন, চিন্তা না করতে। আমাদের ত্যাগ বৃথা যাবে না।
জমাদার সাহেব তালাবন্ধ করতে এলেন। বৃষ্টির দিন তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিয়ে বিদায় হলেন।
১৪ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ বৃহস্পতিবার
১৭৮৯ সালের ১২ই জুলাই ফরাসি দেশে শুরু হয় বিপ্লব। প্যারি নগরীর জনসাধারণ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা করে। ১৪ই জুলাই বাস্তিল কারাগার ভেঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্ত করে এবং রাজতন্ত্র ধ্বংস করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭ বৎসর পরেও এই দিনটি শুধু ফ্রান্সের জনসাধারণই শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করে না, দুনিয়ার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনসাধারণও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
তাই কারাগারের এই নির্জন কুঠিতে বসে আমি সালাম জানাই সেই আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের, যারা প্যারি শহরে গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মুক্তিকামী জনসাধারণ এই দিনটার কথা কোনোদিনই ভুলতে পারে না।
গতকাল পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের পূর্ণ বেঞ্চ পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধি বলে অনেক ব্যক্তির ২২টা রীট আবেদন বাতিল করে দেন।
দেশরক্ষা বিধি বলে নিম্নলিখিত নেতৃবৃন্দকে আটক রাখা হয়েছে। কতকাল এদের রাখবে কে জানে?
১। মিয়া মানজার বশীর, ২। খাজা সিদ্দিকুল হাসান, ৩। চৌধুরী কলিমুদ্দিন, ৪। মহম্মদ ইসমাইল, ৫। সিকান্দার হায়াত, ৬। সরদার মহম্মদ জাফরুল্লা, ৭। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ, ৮। মালিক গোলাম জিলানী, ৯। খাজা মহম্মদ রফিক, ১০। সরদার শওকত হায়াৎ, ১১। খাজা আহম্মদ সাফদার, ১২। চৌধুরী মহম্মদ হোসেন, ১৩। আবু সাঈদ এনতার, ১৪। সৈয়দ মকসুদ, ১৫। জনাব আবদুল আজিজ, ১৬। খলিফা শাহনেওয়াজ, ১৭। মাহবুব মোস্তফা, ১৮। কমর ইদরিস, ১৯। সালাউদ্দিন শেখ, ২০। হেলাল আহম্মদ শেখ এবং ২১। মাহমুদ আহমেদ সিন্ধী।
আজ ঢাকা জেলের ডিআইজি সাহেব কয়েদিদের দেখতে ভিতরে এসেছিলেন। আমাকেও দেখতে এসেছিলেন, কিছু সময় বসেছিলেনও। ধর্মকথা আলোচনা করলেন। বললাম, ইসলামের কথা আলোচনা করে কি লাভ? পাকিস্তানের নাম তো ইসলামিক রিপাবলিক রাখা হয়েছে। দেখুন না ‘ইসলামের’ আদর্শ চারিদিকে কায়েমের ধাক্কায় ঘুষ, অত্যাচার, জুলুম, বেঈনসাফি, মিথ্যাচার, শোষণ এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে যারা আল্লায় বিশ্বাস করে না, তারাও নিশ্চয়ই হাসবে আমাদের অবস্থা দেখে। দেখুন না রাশিয়ায় যেখানে ধর্ম বিশ্বাস করে না সেখানে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেষ্টা করছে, ঘুষ, শোষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষের বাঁচবার অধিকার স্বীকার করেছে।
গ্রেট বৃটেনে দেখুন, ন্যায়ের রাজ্য কায়েম করেছে। বেকার থাকলে সরকার থেকে ভাতা দেওয়া হয়-যে পর্যন্ত কাজের বন্দোবস্ত না করতে পারে। বৃদ্ধ অথবা অচল হয়ে পড়লেও পেনশন দেওয়া হয়। চিকিৎসার এবং ঔষধের জন্য এক পয়সাও খরচ করতে হয় না। বাচ্চা হলে দুধ খাওয়ার জন্য সরকার অর্থ দিয়ে সাহায্য করে, যাতে শিশু দুর্বল হয়ে না পড়ে। অন্যায়ভাবে কাহাকেও কারাগারে বন্দি করতে পারে না।
ডিআইজি সাহেব খুব ধর্মভীরু, বেশি সময় তিনিই বলেন, আমি শুনি। মাঝে মাঝে দুই এক কথা আমি বলি।
১৫ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ শুক্রবার
কি ব্যাপার, আমি যে ঘরে থাকি তা মাপামাপি করছে কেন? চল্লিশ ফুট লম্বা, চারফুট চওড়া, কয়টা জানালা, কয়টা দরজা সব কিছু লিখে নিতেছে জমাদার সাহেব। বললাম, ব্যাপার কি? সরকার জানতে চেয়েছে? আরও একটু লিখে নেন না কেন, দক্ষিণ দিকে ছয়টা জানলা, কিন্তু তার এক হাত দূরে চৌদ্দ ফুট উঁচু দেওয়াল, বাতাস শত চেষ্টা করেও ঢুকতে পারে না আমার ঘরে। জানলা নিচে, দেওয়াল খুব উঁচু। উত্তর হলো, ও সব লেখা চলবে না। লেখুন না আর একটু-দেওয়ালের অন্য দিকে গরুর ঘর, পূর্বদিকে পনের ফিট দেওয়াল ও নূতন বিশ। ভয়ানক প্রকৃতির লোক-যারা জেল ভেঙে দুই একবার পালাইয়াছে তাদের রেখেছিল এখানে। আর উত্তর দিকে ৪০ সেল, সেখানে ৪০ পাগলকে রেখেছে। আর পশ্চিম দিকে একটু দূরেই ৬ সেল ও ৭ সেল, যেখানে সরকার একরারী আসামি রেখেছেন। আর এরই মধ্যে শেখ সাহেব’। তিনি বললেন ‘ও বাত হামলোক নেহী লেখতে ছাকতা হায়, নকরি নেহি রহে গা।
আধা ঘণ্টা পর দেখি সিভিল সার্জন সাহেব জেল ডাক্তার নিয়ে এসেছেন। আমার কি কি রোগ হয়েছে দেখার জন্য। বললাম, ভালই আছি। পাইলস হয়েছে, কিছু কষ্ট দেয়। পেটটা মাঝে মাঝে খারাপ হয়। আমাশা আছে। ঘুম একটু কম হয়। বসে থেকে মোটা হয়ে নিষ্কর্মা হয়ে যাবো আর কি! ওজন দেখলেন। ভাঙা একটা মেশিনে, সাত পাউন্ড নাকি বেড়েছে। ভালই, ভুড়ি হতে আর বেশি দেরি হবে না। যাহোক ভদ্রলোক চলে গেলেন।
ভাবলাম সরকারও বোধ হয় আমার স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। অথবা হাইকোর্টে বলতে হবে যে, দেখ কি ভালভাবে শেখ সাহেব’কে রেখেছি আমরা। কোনো কষ্ট দিচ্ছি না। আমাকে যে একলা এক জায়গায় কারও সাথে কথা বলতে বা দেখা করতে দেওয়া হয় না, সে কথা বোধ হয় চাপা দিবারই চেষ্টা করবেন। আজকালকার দিনে সত্য কথা একটু কমই বলা হয়। ওটা নাকি, নয়া ডিকটেটোরিয়াল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
আজ সকালে আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারি মোহাম্মদউল্লাহ এডভোকেট সাহেবকে গ্রেপ্তার করে এনেছে।১০ সেলেই রেখেছে। দ্রলোক শুধু অফিসের কাজকর্ম দেখেন। কোনোদিন জীবনে একটা বক্তৃতাও করেন নাই, কোনো সভা সমিতিতে বেশি যেতেন না, কোনোদিন মফস্বলে যান নাই, সভা করতে। আজ ১৫ বৎসর নীরবে অফিসের কাজকর্ম করে থাকেন। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবকে যখন গ্রেপ্তার করেছে তখন আওয়ামী লীগের কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। মোহাম্মদ উল্লাহ সাহেবের ছেলেমেয়েদের খুব কষ্ট হবে, কারণ অর্থাভাব কিছুটা আছে, উপার্জন না করলে চলে না। বড় নিরীহ ভদ্রলোক, কোনোদিন কিছু দাবি করে নাই। একবার জাতীয় পরিষদের সদস্য পদের জন্য নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল মাত্র ১২ ভোটে পরাজিত হয়। কয়েক বৎসর পূর্বে যক্ষা রোগে ভুগে, ভাল হয়ে গিয়েছিলেন। জেলে এসে আবার আক্রান্ত না হয়। একই কারাগারে থেকেও আমার সাথে দেখা হওয়ার উপায় নাই।
আজ দূর থেকে তিনজনের মুখ দেখলাম হাসপাতালে। হাফেজ মুছা, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী ও রাশেদ মোশাররফ হাসপাতালে এসেছে অসুস্থ হয়ে। আমার এখান থেকে হাসপাতালের দোতালায় দাঁড়ালে চেহারাটা দেখা যায়। তবে অনেক দূর, চিৎকার করে বললেও কথা শুনবে না।
১৬ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ শনিবার
১৯৬৬-৬৭ সালের নয়া আমদানী নীতি পড়লাম, বোঝা গেল প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণ টিকে থাকতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানিরা যাও দুই একজন কিছু কিছু আমদানি করত, তারাও শেষ হয়ে যেতে বাধ্য হবে।
বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ অবাধ আমদানি নীতির এই সুযোগে তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকসমূহের সহায়তায় যথেষ্ট পরিমাণ আমদানী করে বাজার থেকে ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে। একচেটিয়া পুঁজিবাদী সৃষ্টি করার আর একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার ক্ষুদ্র শিল্পপতিরাও এবার চরম আঘাত খেতে বাধ্য হবে। কারণ বোনাস ভাউচার দিয়ে আমদানি করে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিদের সাথে প্রতিযোগিতায় না পেরে তাদের কাছেই বিক্রি করতে বাধ্য হবে তাদের শিল্পগুলি। জেলের মধ্যে বসে একথা চিন্তা করে লাভ কি? যার সারাটা শরীরে ঘা, তার আবার ব্যথা কিসের! গোলামের জাত গোলামি কর। আমি কারাগারে আমার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আরামেই আছি! ভয় নাই, মাহমুদ আলি, জাকির হোসেন, মোনায়েম খান, আবদুস সবুর খান, মহম্মদ আলী এরকম অনেকেই বাংলার মাটিতে পূর্বেও জন্মেছে, ভবিষ্যতেও জন্মাবে।
দুপুর বেলা কাগজ পড়ছি। হঠাৎ হৈ চৈ করছে কয়েদিরা। কান খাড়া করে শুনলাম। কোর্টের ভিতর ঢাকা গ্যাং ডাকাতি মামলার ১০০ জনের মতো আসামির উপর ঘর বন্ধ করে টিয়ার গ্যাস মেরেছে। কয়েকজনের অবস্থা ভাল। জেলগেট থেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়াছে। আমার কাছেই আসামী একজন থাকে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছিল? সে কোর্ট থেকে এসেছে। বলল, সাত-আট বৎসর আমরা হাজতে। বিচার হয় না। মাঝে মাঝে কোর্টে নিয়ে যায়, আর ফিরিয়ে আনে। সিআইডিরা ইচ্ছা করেই দেরি করায়। একরারীদের উপর নির্ভর করে এই মামলা। তারা ইচ্ছামত কোর্টে যায়। আবার ইচ্ছা হলো না, সিআইডির পরামর্শে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাত-আট বৎসর হাজতে। আমাদের কি আর আছে! বাড়ি ঘর আত্মীয় পরিজন কিছুই তো নাই। যারা ছিল, না খেয়ে মরে গেছে বা কোথাও ভিক্ষা করে খেতেছে। আসামীদের পক্ষ থেকে হাকিমকে জানালো, স্যার আমাদের বিচার করুন। এখনও নিম কোর্টে, এরপর হবে জজকোর্টে। কারণ ডাকাতি ও খুনী মামলার আসামিই বেশি। গ্যাং কেস আন্তঃজেলা মামলা।
হাকিম সাহেবও নাকি সিআইডির উপর রাগ করেছে কয়েকবার। আজ যখন কোর্টে নিয়ে বলেছে, আজ মামলা হবে না, একরারী কোর্টে আসে নাইতখনই এরা প্রতিবাদ করে বলেছে, আমাদের এখানেই রেখে দিন আমরা আর জেলে যাবো না। আর যায় কোথা ! গ্যাস পার্টি এনে এরা কোর্টে যেখানে জালের বেড়ার মধ্যে ছিল সেখানে টিয়ার গ্যাস ছেড়ে দিল। কোনো দয়া মায়া নাই। বাকি মানুষ পালাবার পথ পায় নাই। অনেকে চক্ষু মেলতেই পারে না। অনেকে বমি করতে করতে বেহুশ হয়ে গেছে। ছয় জনের অবস্থা নাকি খারাপ। জেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ইনসাফ কি এদেশ থেকে একেবারেই উঠে গেল? যাহার যাহা ইচ্ছা তাহাই করে। কিছু কিছু কর্মচারী এতো বেড়ে গেছে, মনে করে, যা ইচ্ছা করতে পারে। শুধু লাট সাহেবকে খুশি রাখতে হবে। ফলাফল যে শুভ হবে না সে বুঝি! তবে পাকিস্তানকে এরা কোথায় নিয়ে চলেছে! ভাবলাম সাত-আট বত্সর যদি একটা মামলা চলে তারপরে যদি শাস্তি হয় তবে অবস্থা কি হয়! ভুগতেই হবে তোমাদের। তোমরা যে স্বাধীন দেশের নাগরিক’! ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান তোমাদের রাষ্ট্র! ভুগতেই হবে তোমাদের দেশের খাতিরে। ইহকালে কষ্ট করলে কি হবে, পরকালে অনেক কিছু পাবা। হুরপরি, চিন্তা নাই।
মুড়ি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে কারাগারে। কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ, আদা আর সরিষার তৈল দিয়ে একবার মাখালে যে কি মজা তাহা আমি তো প্রকাশ করতে পারি না। আমার না খেলে চলে না। সিপাহি জমাদার সাহেবরা যাদের ডিউটি পড়ে তারা মেটকে বলে চুপি চুপি মুড়ি খেয়ে নেয়। যদি বড় সাহেবরা দেখে! আমি দেখেও দেখি না, কারণ মেটকে বলে দিয়েছি মুড়ি চাইলে ‘না’ বলবা না।
আমি মুড়ি খেতে বসলেই আমার নেতা শহীদ সাহেবের কথা মনে পড়ে। আজ তুমি কোথায়? তোমার মানিক মিয়া, মুজিব ও কর্মীরা কারাগারে বন্দি, অন্যায়ভাবে জুলুম চলছে চারিদিকে, হাহাকার করছে দেশের লোকেরা। তোমার হাতে গড়া ইত্তেফাক আজ বন্ধ। পাকিস্তান আজ এতিম। জানি তোমার দোয়া আছে আমাদের উপরে। জয় জনগণের হবে, কিন্তু জনগণ তোমার সেবা পাবে না।
১৭ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ রবিবার
বাদলা ঘাসগুলি আমার দুর্বার বাগানটা নষ্ট করে দিতেছে। কত যে তুলে টী আবার কয়েকজন কয়েদি নিয়ে বাদলা ঘাস ধ্বংসের অভিযান শুরু করলাম। অনেক তুললাম আজ। কয়েদিরা আজ তাদের কাপড় পরিষ্কার করবে। বেশি সময় রাখা যায় না, তাই তারা চলে গেল। আমি কিছু সময় আরও কাজ করলাম ফুলের বাগানে। তারপর পাইপ নিয়ে বই নিয়ে বসে পড়লাম। ভুড়ি হতে চলেছে আমার বসে থাকতে থাকতে। ভীষণ খারাপ লাগে ভুঁড়ি হলে। ব্যায়াম করবার উপায় নাই, হাঁটুতে বেদনা। বিকালে হাঁটাচলা করি, একলা কত সময় হাঁটা যায়! ভাল লাগে না, তাই আবার চুপ করে বসে থাকি।
খবর এল আওয়ামী লীগের আর এক নেতাকে নিয়ে এসেছে ধরে। বলল, জালাল সাহেব। বুঝতে বাকি রইল না মোল্লা জালালউদ্দিন, এডভোকেট। ঢাকার প্রায় সকলকেই আনা হয়েছে, জালালই প্রতিষ্ঠানের একটিং সেক্রেটারীর ভার নিবে। ওকেই সেক্রেটারী করার কথা আমি বলেছিলাম। অফিসটা বোধ হয় বন্ধ করতেই চায়। কেই বা চালাবে, সকলকেই তো গ্রেপ্তার করেছে। কয়েকজন তো এবড়ো হয়ে রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হতে পারবেন না। কর্মীদের অবস্থা কি হবে, কে চালাবে! টাকা কোথায় পাবে?
সরকার পিছন দরজা দিয়ে বন্ধ করতে চায়। লাভ হবে না। সকলকে এক সাথে আনছে না, এক একজন করে নিয়ে আসছে। সব কয়জন সেক্রেটারীকে নিয়ে এসেছে, এখন একমাত্র মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগম আছে।
জেলখাটা ও কষ্টকরা শিখতে দেও, এতে কর্মীদের মধ্যে ত্যাগের প্রেরণা জাগবে। ত্যাগই তো দরকার। ত্যাগের ভিতর দিয়েই জনগণের মুক্তি আসবে। জালালকে ১০ সেলে রাখা হয়েছে। দেখা হবার উপায় নাই আমার সাথে। এখন আর আমাকে আঘাত করতে পারে না। চঞ্চলও আমি হই না। আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s Digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি’, কোনো বইই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই। নভেল পড়তে দেয়। প্রেমের গল্প যত পার পড়ো। একজন রাজনীতিক এগুলি পড়ে সময় নষ্ট করে কি করে! কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী!
আজ আমি বাবুর্চিগিরি করেছি। কলিজা দিয়েছিল, পাকাতে হবে। আমি ও বাবুর্চি দুইজনই প্রায় সমান। কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান। তবু ধারণা করে নিয়ে পাকালাম, মনে হলো মন্দ হয় নাই। খাইলাম কিছুটা।
এক একটা মূল্যবান দিন চলে যেতেছে জীবনের। কোনো কাজেই লাগছে না। কারাগারে বসে দিনগুলি কাটাইয়া দিতেছি।
১৮ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ সোমবার
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই কারাগারে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হতেছে। নরসিংদী আওয়ামী লীগের দুইজন কর্মীকেও গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। তবুও দেখে আনন্দই হলো যে, ২৩ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করেছে। কাজ করে যেতে হবে। ৬ দফা দাবির সাথে কোনো আপোষ হবে না। আমাদেরও রাজনীতির এই শেষ। কোনো কিছুই আওয়ামী লীগ কর্মীরা চায় না। তারা শুধু চায় জনগণ তাদের অধিকার আদায় করুক।
ন্যাপের সভাপতি নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সব দলকে এক করতে চান, আজ তাদের সভায় বলেছেন। নিম্নতম কর্মসূচি দিয়ে চুপচাপ তাহার নতুন বাড়ি বিন্নার গ্রামে যেয়ে বসে থাকলেই দেশ উদ্ধার হয়ে যাবে! সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন আওয়ামী লীগ শুরু করেন সেই সময় হতে এই ভদ্রলোক বহু খেলা দেখাইয়াছেন। মিস জিন্নাহর ইলেকশন ও অন্যান্য আন্দোলনকে তিনি আইয়ুব সরকারকে সমর্থন করার জন্য বানচাল করতে চেষ্টা করেছেন পিছন থেকে। তাকে বিশ্বাস করা পূর্ব বাংলার জনগণের আর উচিত হবে না। এখন আর তিনি দেশের কথা ভাবেন না। আন্তর্জাতিক’ হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার কাছে টেলিগ্রাম পাঠান আর কাগজে বিবৃতি দেন। বিরাট নেতা কিনা? ‘আফ্রো-এশীয় ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের মজলুম জননেতা।‘ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঁচুক আর মরুক তাতে তার কি আসে যায়! আইয়ুব সাহেব আর একটা ডেলিগেশনের নেতা করে পাঠালে খুশি হবেন। বোধহয় সেই চেষ্টায় আছেন।
নূরুল আমীন সাহেব সকল দলকে ডাকবেন একটা যুক্তফ্রন্ট করার জন্য। ৬ দফা মেনে নিলে কারও সাথে মিলতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নাই। মানুষকে আমি ধোঁকা দিতে চাই না। আদর্শে মিল না থাকলে ভবিষ্যতে আবার নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিতে বাধ্য। সেদিকটা গভীরভাবে ভাবতে হবে। আইয়ুব সরকারের হাত থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনতে হলে আদর্শের সাথে যাদের মিল নাই তাদের সাথে এক হয়ে গোঁজামিল দিয়ে থাকা সম্ভবপর হতে পারে না। এতে আইয়ুব সাহেবের ক্ষতি কিছু করা গেলেও জনগণের দাবি আদায় হবে না। এত অত্যাচারের মধ্যেও ছয় দফার দাবি এগিয়ে চলেছে। শত অত্যাচার করেও আন্দোলন দমাতে পারে নাই এবং পারবেও না। এখন যারা আবারও যুক্তফ্রন্ট করতে এগিয়ে আসছেন তারা জনগণকে ভাওতা দিতে চান। যারা আন্দোলনের সময় এগিয়ে আসে নাই তাদের সাথে আওয়ামী লীগ এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ এতে উপকার থেকে অপকার হবে বেশি। কোনো নিমতম কর্মসূচির কথা উঠতেই পারে না। নিম্নতম কর্মসূচি হলো ছয় দফা। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ঠিক না হলে কোনো দাবিই আদায় হতে পারে না। পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পূর্বে ঠিক হওয়া দরকার।
লোহার শিকগুলি ও দেওয়ালগুলি বাধা দেয় সন্ধ্যার পূর্বে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ দেখতে। বাইরে যখন ছিলাম খোলা আকাশ দেখার সময় আমার ছিল। ইচ্ছাও বেশি হয় নাই। কারণ কাজের ভিতর নিজকে ডুবাইয়া রাখতাম।
১৯ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ মঙ্গলবার
আমীর মোহাম্মদ খান, পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর- ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত ও মানিক মিয়া সাহেবের গ্রেপ্তারের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে একটা সন্তোষজনক মীমাংসা করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। গতকালই আলাপ হওয়ার কথা ছিল। কি যে হয়েছে জানি না। সমস্ত সময়ই একই চিন্তা আমাকে পীড়া দিতেছিল। এই জংলী আইন দিয়ে যদি এরা দেশ শাসন করতে থাকে, তবে ফলাফল কি হবে তা বলা কষ্টকর। একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কোনো কারণ না দর্শাইয়া বাজেয়াপ্ত করা, একজন শ্রেষ্ঠ সম্পাদক ও কাগজের মালিককে বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষেপ করা, কি জঘন্য প্রকৃতির কাজ হতে পারে তাহা চিন্তা করতেও ভয় পায় বলে মনে হয় না। কোনো খবরই আমরা পাইতেছি না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডি এসেছেন। পূর্ব বাংলার ছোটলাট মোনায়েম খান সাহেবও রাওয়ালপিন্ডি গিয়াছেন। নবাব আমীর মোহাম্মদ খানও ওখানেই আছেন। কিছু একটা হবে বলে সকলেই আশা করছেন। নিশ্চয়ই মোনায়েম খান সাহেব বাধা দিবেন। হাইকোর্টেও মানিক ভাইয়ের রীট আবেদন চলছে। রায় স্থগিত রাখা হয়েছে। আমাদের জেলখানায় কিভাবে কাটছে ভুক্তভোগীই বুঝতে পারবেন। যাহা কিছু একটা ফয়সালা হয়ে গেলে আমরাও নিশ্চিন্ত হই।
মওলানা ভাসানী সাহেব হঠাৎ সুস্থ হয়ে ঢাকায় এসেছেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ৬ দফা সমর্থন করেন না। তবে স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করেন। কারণ, তাঁর পার্টির জন্ম হয় স্বায়ত্তশাসনের দাবির মাধ্যমে। কাগমারি সম্মেলনের কথাও তিনি তুলেছেন। তিনি নাকি দেখে সুখী হয়েছেন যে, একসময়ে যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করবার জন্য তার বিরোধিতা করেছেন তারাই আজকাল স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছে। মওলানা সাহেব বোধহয় ভুলে গিয়াছেন, ভুলবার যদিও কোনো কারণ নাই, সামান্য কিছুদিন হলো ঘটনাটা ঘটেছে। খবরের কাগজগুলি আজও আছে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কর্মীরা আজও বেঁচে আছে। তারা জানে, বিরোধ ও গোলমাল হয় বৈদেশিক নীতি নিয়ে। সে গোলমালও মিটমাট হয়ে গিয়েছিল সম্মেলনের পূর্বের রাতে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ। মওলানা সাহেবই সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সমর্থন করে ওয়ার্কিং কমিটিতে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ১২ জন সদস্য কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে আছে, শহীদ সাহেবকে নিয়ে ৮০ জন সদস্যের মধ্যে। ১২ জনের নেতা প্রধানমন্ত্রী, কেমন করে বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন করা সম্ভবপর হবে। শহীদ সাহেব যখন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন করে দিয়েছেন, ব্যক্তি স্বাধীনতা জনগণকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং চেষ্টা করেছেন তাড়াতাড়ি সাধারণ নির্বাচন দিতে তখন আমরা বৈদেশিক নীতি নিয়ে আর হৈচৈ করবো না-যে পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচন না হয়। ওয়ার্কিং কমিটিকে তিনি বলেছিলেন, পার্লামেন্টারী পার্টির হাতে ক্ষমতা দিতে। বৈদেশিক নীতি বিষয়ে পার্লামেন্টারী পার্টি যাহা ভাল মনে করে, করবেন। সম্মেলন শান্তিপূর্ণভাবে হয়ে যাওয়ার পরে মওলানা সাহেব খবরের কাগজে অসত্য বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, বৈদেশিক নীতির প্রস্তাব পাশ হয়েছে এবং ভাসানীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক নীতির উপরে কোনো প্রস্তাবই নেওয়া হয় নাই, আর হবে না বলেও ঠিক করা হয়েছিল। মওলানা সাহেব জানতেন, কাউন্সিল সভায় তাঁর কোনো প্রস্তাবই পাশ হবে না। কারণ, সদস্যগণ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে শ্রদ্ধা করতেন এবং সমর্থন করতেন। কয়েক মাস পরে ঢাকার নিউ পিকচার্স হাউস ও গুলিস্তান সিনেমা হলের সম্মেলনে ভাসানী সাহেব মাত্র ৪৩ ভোট পেয়েছিলেন ৮৩৪ ভোটের মধ্যে। সেখানে স্বায়ত্তশাসনের কোনো কথাই ওঠে নাই। কারণ, আওয়ামী লীগের যেদিন জন্ম হয় সেইদিন থেকেই স্বায়ত্তশাসনের বিষয় নিয়ে সংগ্রাম করছে। মওলানা সাহেব বোধহয় ভুলে গেছেন যে, ১৯৫৫-৫৬ সালে পার্লামেন্টে যখন শাসনতন্ত্র তৈয়ার হয়, তখন স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব করে আওয়ামী লীগ প্রত্যেক দফায় সংগ্রাম করেছিল। এখনও কেন্দ্রীয় আইন সভার রেকর্ড থেকে তা পাওয়া যাবে। আর আমার কাছেও সেগুলি আছে। এমনকি জনাব আবুল মনসুর আহমদ সাহেব বলেছিলেন, আমরা দুইটা দেশ; কিন্তু একটা জাতি তৈয়ার করতে হবে’ (বাকি কথাগুলি আমার ঠিক মনে নাই)। সেইজন্যই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এই রকম শত শত এমেন্ডমেন্ট আবুল মনসুর আহমদ সাহেব, জহিরুদ্দিন, দেলদার সাহেব, খালেক সাহেব, আমি ও আরও অনেকে দিয়েছিলাম। স্বায়ত্তশাসন না দেওয়ায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবসহ আমরা সকলে ওয়াক আউট করেছিলাম।
আওয়ামী লীগ ভেঙে যখন ন্যাপ করা হলো, তখন বৈদেশিক নীতির উপরই হয়েছিল বলে এতদিন মওলানা সাহেব বলতেন, এবার নতুন কথা শুনলাম। কিছুদিন বেঁচে থাকলে অনেক নতুন কথাই তিনি শোনাবেন। যেমন, তিনি কোনোদিনই মওলানা পাশ করেন নাই তবুও মওলানা সাহেব না বললে বেজার হন।
ন্যাপ কেন হয়েছিল? আদর্শের জন্য নয়। মওলানা সাহেবের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা খুব বেশি। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেন নাই এবং তাঁর মধ্যে এতো ঈর্ষা দেখা দেয় যে, গোপনে ইস্কান্দার মির্জার সাথে হাত মিলাতেও তার বিবেকে বাধে নাই। তিনি মির্জা সাহেবকে মিশরের নাসের করতে চেয়েছিলেন।
তাঁকে লোকে চিনতে পেরেছে, তার অনশন আমার জানা আছে। নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে তিনি আইয়ুব সাহেবকে সমর্থন করবেন, না আন্দোলন করবেন তার কথায় বোঝা কষ্টকর। মওলানা সাহেব ৬ দফা সমর্থন না করলেও আন্দোলন চলছে, চলবে এবং আদায়ও হবে। জনগণ ৬-দফাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে।
২০শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ বুধবার
ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত ও মানিক ভাইয়ের গ্রেপ্তার সম্বন্ধে কোনো ফয়সালা বোধহয় হবে না। মোনায়েম খান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও নবাব কালাবাগ সাহেবকে বলেছেন পূর্ব বাংলার ৬ দফার আন্দোলন শেষ করে দিয়েছেন। আর কিছুদিন থাকলে একদম নস্যাৎ করে দিতে পারবেন। তাই হয়তো কোনো সমঝােতায় আসলেন না সরকার। খুব ভাল কাজ বোধহয় করলেন না। পরিণতি বেশি ভাল হবে বলে মনে হয় না। মানিক মিয়া রাজনীতি করেন না, তবে তাঁর নিজস্ব মতবাদ আছে। তাঁকে দেশরক্ষা আইনে বন্দি করা যে কত বড় অন্যায় ও নীতিবিরুদ্ধ তা কেমন করে ভাষায় প্রকাশ করব। সাংবাদিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো একটা ভরসা বোধহয় পেয়ে থাকবেন। গতকাল থেকে আমার, তাজউদ্দীনের, খন্দকার মোশতাকের ও নূরুল ইসলাম চৌধুরীর রীট আবেদনের শুনানি শুরু হয়েছে। জানি না কি হবে। তবে আমাদের ছাড়বে না সরকার, তা বুঝতে পারি। দেশরক্ষা আইন থেকে মুক্তি পেলে, অন্য কোনো আইনে জেলে বন্দি করতে পারে। আর আমার কথা আলাদা। আটটা মামলা চলছে, আরও কয়েকটা বন্দোবস্ত করে রেখে দিয়েছে। দরকার হলে চালু করে দিবে। ধন্য তোমায় মোনায়েম খান সাহেব, ধন্য তোমার রাজনীতি!
নূরুল আমীন সাহেব ঐক্যবদ্ধ হতে অনুরোধ করেছেন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকলেই দাবি আদায় হয় না। নূরুল আমীন সাহেব যাদের নিয়ে দল করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলনের ও জেলে যাবার কথা শুনলে প্রথমে ঘরের কোণেই আশ্রয় নিয়ে থাকেন। আর পিছন থেকে আন্দোলনকে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। বেশি গোলমাল দেখলে পাসপোর্ট নিয়ে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিদেশে রওয়ানা হয়ে যান। ৬ দফার দাবিতে যে গণঐক্য দেশে গড়ে উঠেছিল, যার জন্য হাসিমুখে কত লোক জীবন দিল, কত লোক কারাবরণ করছে, তখন এই ঐক্যবদ্ধ করার আগ্রহশীল নেতারা কেহ ঘর থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নাই। আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরা ‘সংগ্রাম করবে’! অন্য কেহ বিশ্বাস করলে করতে পারে, কিন্তু আমি করি না। কারণ এদের আমি জানি ও চিনি।
জনসাধারণেরও আর ‘নেতাদের ঐক্যের’ ওপর বিশ্বাস নাই। জনগণের ঐক্যই প্রয়োজন। তাহা পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠেছে। শুধু সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলেই দাবি আদায় হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সংগ্রামী দল, সংগ্রাম করে যাবে। আদর্শের মিল নাই, সামান্য সুবিধার জন্য আর জনগণকে ধোঁকা দেওয়া উচিত হবে না। নিম্নতম কর্মসূচিই ছয় দফা। সেই সঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্তি, কৃষকদের পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, গরিব কর্মচারীদের সুবিধা ও খাদ্য সমস্যা সম্বন্ধে কর্মসূচি নেওয়া চলে। তবে ৬ দফা বাদ দিয়া কোনো দলের সাথে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। আর করবেও না।
দিনভরই আমি বই নিয়ে আজকাল পড়ে থাকি। কারণ সময় কাটাবার আমার আর তো কোনো উপায় নাই! কারও সাথে দু’এক মিনিট কথা বলব তা-ও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। বিকালের দিকে একা একা হাঁটাচলা করি, আর দুনিয়ার অনেক কথাই ভাবি। অনেক পুরানা স্মৃতি আমার মনে পড়ে। বন্ধু-বান্ধবরা আমার সাথে কখন কিভাবে, কি ব্যবহার করেছেন তাও মনে পড়ে। কত মানুষ আমাকে ভালবেসেছে, কতজন আবার ঘৃণাও করেছে। একাকী বসে সে কথাও ভাবি। আমার যেমন নিঃস্বার্থ বন্ধু আছে, আমার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে, তেমনই আমার শত্রু আছে, যারা হাসতে হাসতে জীবনটা নিয়ে নিতে পারে। আমাকে যারা দেখতে পারেন না, তারা ঈর্ষার জন্যই দেখতে পারে না। জীবনে আমার অনেক দুঃখ আছে সে আমি জানি, সেই জন্য নিজেকে আমি প্রস্তুত করে নিয়েছি। আমার মনে সবসময়েই বেশি পীড়া দেয় যখন আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চেহারা ফুটে উঠে আমার চোখের সামনে।