মানো মাজরায় হেড কনস্টেবলের আগমনের পর গ্রামের লোকেরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এই বিভক্তি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেল তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে।
মুসলমানরা নিজেদের বাড়িতে বসে আলাপ-আলোচনা করতে লাগল এবং ভবিষ্যত চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। পাতিয়ালা, আম্বালা ও কাপুরতলায় মুসলমানদের ওপর শিখদের নির্যাতনের যে কথা তারা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, সেই কথা এখন তাদের চিন্তায় এলো। ওরা শুনেছিল, মহিলাদের কাপড় খুলে বেত মারা হয়েছে এবং বাজারের রাস্তায় তাদের ঘুরিয়ে জনবহুল বাজারে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। সতীত্ব রক্ষার্থে অনেক মহিলা আত্মহত্যা করেছে। ওরা শুনেছে, মসজিদে শূকর হত্যা করে মসজিদকে অপবিত্র করা হয়েছে, বিধৰ্মীরা কোরআন শরিফ ছিড়ে ফেলেছে। আকস্মিকভাবে মানো মাজরার সব শিখ তাদের কাছে পরিগণিত হলো অসৎ উদ্দেশ্যে আগত আগন্তুক হিসাবে। ওদের লম্বা চুল ও দাড়ি, হিংস্রতা ও কৃপাণ মুসলিম বিদ্বেষের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত হলো। এই প্রথমবার পাকিস্তান নামটি ওদের কাছে নতুন অৰ্থ বয়ে নিয়ে এলো-আশ্ৰয় লাভের এমন এক শান্তিময় স্থান-যেখানে কোন শিখ নেই।
শিখরাও ছিল মুসলমানদের প্রতি বিরূপ ও ক্রুদ্ধ। কখনও মুসলমানদের বিশ্বাস করবে না। তারা বলে থাকে। সর্বশেষ গুরু ওদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মুসলমানদের কোন স্বদেশপ্ৰেম নেই। ভারতীয় ইতিহাসে মুসলমান শাসনামলে দেখা যায়, সিংহাসন লাভের জন্য পুত্ররা তাদের পিতাকে বদী বা হত্যা করেছে, ভাই ভাইকে অন্ধ করেছে। আর শিখদের প্রতি তারা কি করেছে? তাদের দুজন গুরুকে হত্যা করেছে, অন্য একজনকে খুন করেছে এবং তার শিশু সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করার অপরাধে তাদের হাজার হাজার লোককে তালোয়ার দিয়ে নিধন করা হয়েছে। তাদের মন্দিরে গরু জবাই করে মন্দির অপবিত্র করা হয়েছে, পবিত্র গ্রন্থ ছিড়ে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। মহিলাদের তারা কখনও সম্মান করেনি। শিখ উদ্বাস্তুরা অভিযোগ করেছে যে, মুসলমানদের কাছে ইজ্জত বিসর্জন দেয়ার আগে বহু মহিলা কুয়ায় ঝাঁপ দিয়েছে অথবা শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। যারা আত্মহত্যা করেনি, তাদের উলঙ্গ করে রাস্তায় নামানো হয়েছে, জনসমক্ষে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং শেষে হত্যা করা হয়েছে। এখন মুসলমানদের হাতে নিহত ট্রেনভর্তি শিখদের মৃতদেহ দাহ করা হয়েছে মানো মাজরা গ্রামে। পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে মানো মাজরায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। তার ওপর খুন হলো রামলাল। তাকে কে খুন করেছে, তা কেউ বলতে পারে না। তবে রামলাল যে একজন হিন্দু, এ কথা সবাই জানে। সুলতানা ও তার দলের লোকেরা সবাই মুসলমান এবং তারা পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে। একজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক-যার মাথায় পাগড়ি নেই, মুখে দাড়ি নেই- গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারও প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়ার জন্য এসব কারণ যথেষ্ট। ফলে তারা মুসলমানদের প্রতি বিরূপ হয়েছে; মুসলমানদের ভিত্তি হলো অকৃতজ্ঞতা। শিখদের ক্ষেত্রে যুক্তি কখনও দৃঢ় বলে বিবেচিত হয়নি; তারা উত্তেজিত হলে যুক্তি কোন কাজেই আসে না।
রাতটা ছিল বিষন্ন। যে মৃদুমন্দ শীতল বায়ু মেঘকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই বায়ু আবার ফিরে এলো। প্রথমে এলো সাদা কুয়াশার আকারে। ঐ কুয়াশার মধ্যে চাঁদের আলো মোটামুটি দেখা যেতে লাগল। কিন্তু এরপর এলো বড় বড় আকারে, উত্তাল তরঙ্গের মতো। চাঁদ হারিয়ে গেল আকাশে, সারা আকাশটা স্নান হয়ে গেল। ধূসর রঙের আবীরে। মাঝে মাঝে চাঁদের আলো যেন ঠিকরে পড়তে চাইছিল মেঘের আড়াল থেকে এবং ঐ চেষ্টা সফল হলে দেখা গেল, সমতল ভূমিতে চাঁদের আলো উজ্জ্বল রূপার মতো। পরে পুরো আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে পেল। বিদ্যুত চমকনি বা মেঘের গর্জন ছাড়াই আকস্মিকভাবে শুরু হল অবিরাম বৃষ্টি।
একদল শিখ চাষী সর্দারের বাড়িতে বসে ছিল। একটা হারিকেনের চারপাশে তারা বসেছিল। কেউ ছিল চারপাই-এর ওপর, বাকিরা ছিল মেঝের ওপর। ঐ লোকদের মধ্যে মিত সিংও ছিলেন।
অনেকক্ষণ ধরে কেউ কোন কথা বলল না। নীরবে প্রহর গুণলো সবাই। মাঝে মাঝে তাদের মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বেরিয়ে এলো,
সব কিছুই আমাদের পাপের শাস্তি।
হ্যাঁ, খোদা আমাদের পাপের শাস্তি দিচ্ছেন।
পাকিস্তানে অনেক জুলুম হয়েছে।
এ কারণেই খোদা চান, আমাদের পাপ কাজের শান্তি হোক। মন্দ কাজের ফল মন্দই হয়।
একজন যুবক উঠে বলল, এই ধরনের শাস্তির জন্য আমরা এমন কি খারাপ কাজ করেছি? মুসলমানদের আমরা ভাইবোনের মতো দেখেছি। আমাদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির জন্য। ওরা কেন লোক পাঠাচ্ছে?
তুমি বলছ ইকবালের কথা? মিত সিং বললেন। তাঁর সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে। তাঁর হাতে রয়েছে লোহার চুড়ি। যেমনটি থাকে, আমাদের মতো শিখদের হাতে। সে আমাকে বলেছে যে, ওর মা ওকে ওটা পরতে বলেছিল। এ কারণেই সে ওটা পরে। সে দাড়ি কামানো শিখ। সে ধূমপান করে না। লালার খুন হওয়ার একদিন পরেই সে এখানে আসে।
ভাই, আপনি সরল মনে বিষয়টি দেখছেন, ঐ যুবকটি জবাব দিল। লোহার চুড়ি পরলে মুসলমানদের কোন ক্ষতি হয় না। কোন বিশেষ কাজের জন্য একদিন ধূমপান না করলেই বা কি এসে যায়?
আমি একজন সরল ভাই হতে পারি, মিত সিং বেশ আস্থার সাথে প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু তুমি আমি সবাই জানি, ঐ খুনের ব্যাপারে বাবুর কোন হাত নেই। তিনি যদি ঐ ব্যাপারে জড়িত থাকতেন, তাহলে খুন হওয়ার পর তিনি আর গ্রামে থাকতেন না। কোন বোকার কাছেও এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
যুবকটি লজ্জা পেল।
তা ছাড়া, আরও আস্থার সাথে মিত সিং বললেন, তারা ডাকাতির জন্য মাল্লিকে তো গ্রেফতার করেছে…
মাল্লিকে কি অপরাধে পুলিশ গ্রেফতার করেছে তা আপনি জানলেন কিভাবে? যুবকটি তাঁর কথায় বাধা দিয়ে বেশ দৃঢ়তার সাথে বলল।
হ্যাঁ, ঠিক কথা। পুলিশ যা জানে তোমরা তা কিভাবে জানবে? তারা মাল্লিকে ছেড়ে দিল। বিচার ও নির্দোষ সাব্যস্ত ছাড়া তারা খুনীকে ছেড়ে দেয়, এমন কথা তোমরা কখনও শুনেছে? মিত সিং জিজ্ঞাসা করলেন উপস্থিত সকলকে।
ভাই, আপনি সব সময় যুক্তি ছাড়া কথা বলেন।
আচ্ছা, তোমরা তো যুক্তিগ্রাহ্য কথা বল। বলতো, জুঙ্কার বাড়িতে কে চুড়ির প্যাকেট ছুড়ে ফেলেছে?
আমরা কিভাবে জানিব? উপস্থিত সকলে প্রায় এক সাথে বলল।
আমি তোমাদের বলছি। ঐ লোকটা হলো জুগ্গার শত্ৰু মাল্লি। তোমরা জান, ওদের সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরেছে। ও ছাড়া জুগ্গাকে অপমানিত করার সাহস আর কাল্প আছে?
এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিল না। মিত সিং তাঁর বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত করার লক্ষ্যে আরও আস্থার সাথে বললেন, আর সুলতানার ব্যাপারে? সুলতানা। ঐ ডাকাতির ব্যাপারে ওর কি করার আছে?
হ্যাঁ ভাইজি, আপনি হয়ত ঠিকই বলেছেন, অন্য এক যুবক বলল। কিন্তু লালা নিহত হয়েছে। তাকে নিয়ে টানাটানি করে কি লাভ? এ কাজ পুলিশই করবে। জুগ্গা, মাল্লি ও সুলতানা তাদের গোলমাল মিটিয়ে ফেলুক। বাবুর জন্য আমরা যা করতে পারি তা হলো তিনি তার মায়ের কোলে ফিরে যাক-এই প্রার্থনা। আমাদের সমস্যা অন্যটা। আমাদের সাথে যেসব শুয়োরের বাচ্চা (?) আছে, ওদের নিয়ে আমরা কি করব? তারা কয়েক পুরুষ ধরে আমাদের নুন খাচ্ছে। আর দেখুন তো, কি কাজটা ওরা করল! আমরা ওদের দেখেছি ভাইয়ের মতো। কিন্তু ওরা ব্যবহার করল। সাপের মতো।
আলোচনা হঠাৎউত্তেজনাকর হয়ে উঠল।
মিত সিং বেশ রাগ করেই বললেন, ওরা তোমাদের বিরুদ্ধে কি করেছে? ওরা কি তোমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে, না তোমাদের ঘর দখল করেছে? ওরা কি তোমাদের মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করেছে? বল আমাকে, কি করেছে। ওরা?
উদ্বাস্তুদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন, ওরা ওদের বিরুদ্ধে কি কাজ করেছে। প্ৰথমে যে ছেলেটি মিত সিং-এর কাছে উত্তর জানতে চেয়েছিল, সেই নির্দয় ছেলেটি উত্তর দিল, আপনি কি বলতে চান, গুরুদুয়ারায় আগুন দেয়ার সময় বা আমাদের লোকদের হত্যা করার সময় ওরা ঘুমিয়ে ছিল?
আমি শুধু মানো মাজরার কথা বলছি। আমাদের প্রজারা আমাদের বিরুদ্ধে কি করেছে?
ওরা মুসলমান।
মিত সিং এই কথায় ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে ঘাড় উঁচু করলেন।
সর্দার অনুভব করলেন যে, ঐ বান্দানুবাদ মিটিয়ে দিতে তার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
যা ঘটে গিয়েছে তা নিয়ে কথা বলে কি লাভ, প্রজ্ঞার সাথে তিনি বললেন, এখন আমরা কি করব সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মন্দিরে যে সব উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে ওরা কিছু অঘটন ঘটাতে পারে। এতে গ্রামের সুনাম ক্ষুন্ন হবে।
কিছু আঘটন, কথাটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে আলোচনার ধারাই পাল্টে গেল। নিজের গ্রামের লোকদের ওপর বহিরাগতরা কোন অত্যাচার করার সাহস পায় কি করে? যুক্তি এখানে বড় ধরনের একটা বাধা পেল। যুক্তির উর্ধে দলীয় চিন্তা। যে যুবকটি মুসলমানদের শুয়োর বলে গালি দিয়েছিল, সেই যুবকটিই উত্তেজিত হয়ে বলল, আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের প্রজাদের ওপর কেউ হাত তুলে দেখুক না।
সর্দার তাকে থামিয়ে দিলেন। তোমার মাথা গরম। কখনও কখনও তুমি মুসলমানদের, আবার কখনও কখনও উদ্বাস্তুদের হত্যা করার কথা বলছি। আমরা কিছু বলতে গেলেই তুমি অন্য আলোচনা করছি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে সর্দার, যুবকটি রাগে গর গর করতে লাগল, আপনার যদি ঐ বুদ্ধি থাকে তাহলে কিছু বলুন আমাদের।
শোন ভাই সব, গলার স্বর নামিয়ে সর্দার বললেন, মেজাজ খারাপ করার সময় আর নেই। এখানে যারা আছে তারা কেউ কাউকে হত্যা করতে চায় না। কিন্তু অন্য লোকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারে? এখন আমাদের এখানে আছে চল্লিশ বা পঞ্চাশ জন উদ্বাস্তু। গুরুর কৃপায় ওরা শান্তিপূর্ণ লোক। ওরা শুধু কথা বলে। আগামীকাল আর একদল উদ্বাস্তুকে আমরা পেতে পারি, যারা তাদের মাবোনকে হারিয়েছে। আমরা কি তাদের এ গ্রামে আসতে নিষেধ করব? আর যদি তারা সত্যি আসে, তাহলে কি তাদের সুযোগ দেব আমাদের প্রজাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে?
আপনি লাখ টাকার একটা কথা বলেছেন, একজন বৃদ্ধ বলল, এ সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করা দরকার।
কৃষকরা তাদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করল। ওরা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করতে পারে না। আতিথেয়তা অবসর বিনোদনের কাজ নয়। আশ্রয়হীন লোক যখন তা যায় তখন তাকে আতিথ্যে গ্রহণ করা একটা পবিত্র দায়িত্ব। আমরা কি মুসলমানদের চলে যেত বলব? অত্যন্ত জোরের সাথে বলতে হবে, না। সব কিছুর উর্ধে স্থান পাবে গ্রামের লোকদের আনুগত্য। অনেকে অনেক অযাচিত কথা বলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ তাদের তাড়িয়ে দেয়ার, এমন কি শিখদের বৈঠকেও সাহস দেখাবে না। বৈঠকের মেজাজ ক্ৰোধ থেকে পরিবর্তিত হলো হতবুদ্ধিতে।
কিছুক্ষণ পর সর্দার বললেন, আশপাশের সব গ্রামের মুসলমানদের বিতাড়িত করে চন্দননগরের পাশে উদ্ধাস্তু শিবিরে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে পাকিস্তানে চলে গিয়েছে। অন্যদের জলন্ধরে বড় উদ্বাস্তু শিবিরে নেয়া হয়েছে।
হ্যাঁ, অন্য একজন বলল, কাপুরা ও গুজ্জুমাত্তা গ্রামের মুসলমানদের গত সপ্তাহে অপসারণ করা হয়েছে। মানো মাজরা গ্রামে মুসলমান আছে। কিন্তু এই গ্রামের মুসলমানদেরই কেবল অপসারণ করা হয়নি। একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছা করে, গ্রামের বন্ধুপ্রতিম লোকদের চলে যাওয়ার কথা ওরা কিভাবে বলে। আমরা আমাদের ছেলেদের ঘর থেকে চলে যাওয়ার কথা বলতে পারব, কিন্তু আমাদের প্রজাদের কাছে অনুরূপ কথা কোনদিনই বলতে পারব না। এখানে কি এমন কোন লোক আছে, যারা মুসলমানদের বলতে পারবে, ভাইসব, মানো মাজরা থেকে তোমরা চলে যাও?
এ কথার জবাব কেউ দেয়ার আগে একজন গ্রামবাসী ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে দেখল। কিন্তু হারিকেনের স্বল্প আলোয় কেউ তাকে চিনতে পারল না।
কে ওখানে? সর্দার জিজ্ঞাসা করলেন। হারিকেনের আলোর রশ্মি থেকে নিজের চোখ দু’টোকে হাত দিয়ে আড়াল করে তিনি বললেন, ভিতরে এসো।
ইমাম বখশ ভিতরে এলেন। তাঁর সাথে এলেন আরও দুজন। ওরাও মুসলমান।
সালাম চাচা ইমাম বখশ, সালাম খায়ের দিনা। সালাম, সালাম।
শুভ রাত সর্দার সাহেব, শুভ রাত, মুসলমানরা জবাব দিলেন।
উপস্থিত লোকেরা ওদের বসার জায়গা করে দিল। সবাই অপেক্ষা করল ইমাম বখাশের কথা শোনার জন্য।
ইমাম বখশ দাঁড়িতে হাত বুলালেন।
হ্যাঁ ভাইসব। আমাদের ব্যাপারে আপনাদের সিদ্ধান্ত কি? শান্তভাবে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
একটা অকল্পনীয় নীরবতায় আচ্ছন্ন হলো সমস্ত ঘরটা। সবাই সর্দারের দিকে মুখ ফেরাল।
আমাদের জিজ্ঞাসা করছেন কেন? সর্দার বললেন, আমাদের মতো গ্রামটা আপনাদেরও।
এখানে যা আলোচনা হয়েছে তা আপনারা জানেন। আশপাশের সব গ্রাম থেকেই মুসলমানদের অপসারণ করা হয়েছে। একমাত্র এ গ্রামটিই বাকি আছে। আপনারা ইচ্ছা করলে আমারাও চলে যাব।
মিত সিং সশব্দ নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি মনে করলেন, এখন তার কথা বলা ঠিক নয়। তাঁর যা বলার তা তিনি আগেই বলেছেন। তা ছাড়া তিনি শুধু একজন ধর্মীয় ব্যক্তি। গ্রামবাসী তাঁকে যেখানে থাকতে দিয়েছে, সেখানেই তিনি থাকেন। একজন যুবক বলল:
চাচা ইমাম বখশ। একটা কথা আজ আমরা স্পষ্টভাবে বলছি। আমরা যতদিন এখানে আছি ততদিন কেউ আপনাদের স্পর্শ করার সাহস পাবে না। আমরা মরে গেলে আপনারা নিজেদের রক্ষা করবেন।
হ্যাঁ,আরও একজন ঐ কথার সমর্থন করুল উষ্ণভাবে, আগে মরব। আমরা, তারপর তোমরা। তোমাদের ওপর কেউ যদি চোখ উঁচু করে তাকায় আমরা তার মাকে অপদস্থ করব।
মা, বোন ও মেয়ে, অন্যরা তার কথা শুধরে দিল।
ইমাম বখশের চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু নীরবে গড়িয়ে পড়ল। জামার কোণ দিয়ে তিনি তার নাক ঝাড়লেন।
পাকিস্তানে গিয়ে আমরা কি করব? আমরা এখানে জনেছি। আমাদের পূৰ্বপুরুষরাও এখানে জন্মেছেন। তোমাদের সাথে আমরা বসবাস করছি ভাইয়ের মতো। ইমাম বখশ আর বলতে পারলেন না, কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। মিত সিং তাঁকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। তারও কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো কান্নায়। উপস্থিত অনেকের কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেল। অনেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
সর্দার বললেন, হ্যাঁ, তোমরা আমাদের ভাই। আমরা তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়ে ও পোতা-পোতনিসহ যতদিন ইচ্ছা এখানেই থাকবে। তোমাদের স্ত্রী, পুত্ৰ-কন্যাদের কেউ যদি রূঢ় ভাষায় কথা বলে, আমরা তার প্রতিবিধান করব। তোমাদের মাথায় একটা চুলও যেন কেউ স্পর্শ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা আমরা করব। আমাদের স্ত্রী, পুত্র-কন্যারা তোমাদের স্ত্রী, পুত্ৰ-কন্যাদের নিরাপত্তা বিধান করবে। কিন্তু চাচা, আমরা সংখ্যায় অতি নগণ্য। পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু আসছে। তারা যদি কিছু করে তাহলে তার দায়িত্ব কে নেবে?
হ্যাঁ, অন্যরা এ কথা সমৰ্থন করল। আমাদের দিক থেকে তোমরা নিশ্চিন্ত। কিন্তু উদ্বাস্তুরা যদি কিছু করে?
আমি শুনেছি যে, কয়েকটি গ্রাম হাজার হাজার উন্মত্ত লোক ঘিরে রেখেছে। তাদের হাতে আছে বন্দুক ও বর্শা। ওদের প্রতিরোধ করার কোন প্রশ্নই নেই।
আমরা উন্মত্ত জনতাকে ভয় করি না, একজন বলল, ওদের আসতে দাও আগে! আমরা ওদের এমন ঠেঙ্গানি দেব যেন মানো মাজরায় আসার কথা আর কোনদিন চিন্তাও না করে।
এই চ্যালেঞ্জকারীকে কেউ লক্ষ্য করল না। গর্বিত এই বক্তব্য এমনই শূন্য মনে হলো যে, কেউ এটাকে গুরুত্ব দিল না। ইমাম বখশ আবার নাক ঝাড়লেন। ধরা গলায় বললেন, ভাইসব, আমাদের এখন কি করতে উপদেশ দাও তোমরা?
চাচা, গম্ভীর স্বরে সর্দার বললেন, আমার পক্ষে কিছু বলা কঠিন। তবে যে পরিস্থিতিতে আমরা এখন দিন কাটাচ্ছি, তাতে আমার মনে হয়। এই গোলমালের সময় তোমাদের উদ্ধাস্তু শিবিরে যাওয়াই উত্তম। তোমরা ঘরে জিনিসপত্রসহ তালা লাগিয়ে যাও। তোমরা ফিরে না। আসা পর্যন্ত তোমাদের গরু-বাছুর আমরা দেখাশোনা করব।
সদারের এই পরামর্শে সবাই নির্বক হয়ে রইল। গ্রামবাসীরা যেন দম বন্ধ করে রইল। সর্দার নিজেই বুঝতে পারলেন যে, তিনি যে কথা বলেছেন তার প্রতি দূর করার জন্য তাঁকে অবিলম্বে আরও কিছু বলা দরকার।
গতকাল পর্যন্ত, তিনি আবার শুরু করলেন, কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা তোমাদের নদী পার করে দিতে সাহায্য করতে পারতাম। কিন্তু দুদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। নদী পার হওয়ার জন্য দু’টো উপায় হলো ট্রেন ও রাস্তার ব্রিজ। ঐ দুই জায়গায় কি হচ্ছে তোমরা জান। তোমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমি পরামর্শ দিই, কয়েক দিনের জন্য ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে। পরে তোমরা চলে এসো পরিস্থিতি শান্ত হলো। আমাদের ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত থাকতে পোর। অত্যন্ত উষ্ণ আবেগে তিনি বললেন, তোমরা যদি গ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নাও, এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাব। আমাদের জীবন দিয়ে তোমাদের আমরা রক্ষা করব।
সর্দারের ঐ কথার গুরুত্ব নিয়ে কারও মনে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ রইল না। তারা মাথা নিচু করে রইল। এমন সময় ইমাম বখশ দাঁড়ালেন।
ঠিক আছে, বিষণ্ণভাবে তিনি বললেন, আমাদের যদি যেতেই হয় তাহলে আমাদের বিছানা ও জিনিসপত্র সাথে করে নিয়ে যাওয়াই ভাল। আমাদের বাপ-দাদা কয়েক শ বছরে যে ঘর সৃষ্টি করেন তা খালি করতে আমাদের এক রাতের বেশি সময় লাগবে না।
সর্দার নিজেকে বড় ধরনের অপরাধী হিসাবে মনে করলেন। আবেগে তিনি বিভোর হয়ে পড়লেন। তিনি দাঁড়িয়ে ইমাম বখশকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। শিখ ও মুসলমান চাষীরা পরস্পরকে জড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কেঁদে কি হবে, বিশ্বের নিয়ম এটাই–
সুগন্ধযুক্ত কুঞ্জের ছায়ায়
চিরদিন বুলবুল পাখি গান করে না,
চিরদিন বসন্ত থাকে না
থাকে না ফুটন্ত ফুল,
আনন্দ স্থায়ী হয় না চিরকাল,
বন্ধুত্ব থাকে না চিরদিন,
এ কথা যারা জানে না
তারা জীবনকেই জানে না।
এ কথা যারা জানে না, তারা জীবনকেই জানে না, দুঃখের সাথে এ কথা অনেকেই বলল। হ্যাঁ, চাচা ইমাম বখশ। এটাই জীবন।
চোখের পানি মুছতে মুছতে ইমাম বখশ ও তাঁর সঙ্গীরা বৈঠক ত্যাগ করল।