প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

৩.২ শহরের ঘিন্‌জি থেকে দূরে

শহরের ঘিন্‌জি থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক গলির মধ্যে একটা বড় বাড়ির এক অংশে পরেশদা মাকে নিয়ে বাস করে। বাড়িখানার মালিকও পরেশদার সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বাড়ির এক অংশে পরেশদাকে অমনিই থাকতে দিয়েছিলেন; কিন্তু পরেশদা মাসে তিন টাকা করে ভাড়া জোর করে দিয়ে থাকে। একতলায় একটা বড় ও একটা ছোট ঘর, বেশ বড় একটা উঠোন। দোতলায় এই উঠোনের চারদিকে ছাত ও ছাতের একদিকে পাশাপাশি দুটো বড় ঘর-দিব্যি খোলামেলা। রান্না একতলাতেই হয়।

আমরা যখন পৌঁছলুম, তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। কার্তিকের শেষাশেষি। শীত খুব জাঁকিয়ে না পড়লেও বাংলাদেশে অঘ্রানের মাঝামাঝি যেমন ঠান্ডা পড়ে তেমনি শীত। সদর-দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পরেশদা অনেকক্ষণ ধরে ধাক্কা-ধাক্কি করার পর এক বুড়ি ঝি দরজা খুলে দিলে।

দরজা খুলে–সিধে চলে এস–বলে পরেশদা এগিয়ে চলল, তাকে অনুসরণ করে আমরা চললুম। উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে আমরা ছাতে উঠলুম-ঘোর অন্ধকার। পরেশদা চেঁচিয়ে কি বলায় বুড়িটা গজগজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে পাশের ঘর থেকে দুটো হ্যারিকেন লণ্ঠন নিয়ে এল। পরেশদা লণ্ঠন জ্বালাতে জ্বালাতে বললে, যেদিন বাড়িতে এসে দেখি যে, আলো জ্বলেনি, সেইদিন বুঝতে পারি মা বিছানা নিয়েছেন। বুড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বললে, ইনি আবার লণ্ঠন জ্বালাতে পারেন না–জংলি কোথাকার!

ইতিমধ্যে আলো জ্বালানো হয়ে গেলে একটা হ্যারিকেন নিয়ে বুড়ি চলে গেল, আর-একটা হাতে নিয়ে পরেশদা ঘরের ভেজানো দরজায় ধাক্কা দিয়ে আমাদের বললে, এস।

আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকতেই পরেশদা বললে, আজকের মতন ভাই এইখানেই জায়গা করে শুতে হবে। কাল জিনিসপত্র সরিয়ে সব ব্যবস্থা করা যাবে।

আমরা বললুম, তোমাকে কিছু ব্যস্ত হতে হবে না, সব আমরা নিজেরাই ঠিক করে নিচ্ছি। পরেশদা তার আপিসের বেশ ছেড়ে ওই ঘরেই ধুতি-জামা পরল। তারপর কোণ থেকে একটা ঝাঁটা নিয়ে পরিষ্কার করতে আরম্ভ করে দিলে। সুকান্ত তার হাত থেকে জোর করে ঝাঁটা কেড়ে নিয়ে নিজে ঝাঁট দিতে শুরু করায় পরেশদা বললে, আচ্ছা, তা হলে আমি ও-ঘরে একবার মাকে দেখে আসি।

ঘর পরিষ্কার করে কম্বল বিছিয়ে একটু বসতে-না-বসতেই পরেশদা ফিরে এসে বললে, মাকে দেখে বিশেষ সুবিধের বলে বোধ হচ্ছে না।

–কেন, কিরকম দেখলে?

–কিরকম আচ্ছন্নের মতন পড়ে আছেন। ডাকলুম, কিন্তু কোনো সাড়া দিলেন না–কখনও এরকম তো দেখিনি। সকালবেলা রান্না করেছেন–যখন আপিসে যাই তখন খেতে দিয়েছেন।

–কতক্ষণ এরকম হয়েছে?

–তা তো বুঝতে পারছি না।–বলে পরেশদা ঝিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে যে, সে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে খোলা না পেয়ে বাড়িওয়ালাদের বাড়ির ভেতর দিয়ে এ-বাড়িতে ঢুকেছে। সে এসে অবধি দেখছে যে, মাইজী অমনি করে শুয়ে আছেন।

পাশের ঘরে গিয়ে দেখলুম, পরেশদার মা একটা খাটে শুয়ে আছেন–বুকের ওপর হাত দুটি জোড় করে রাখা। কোমর অবধি একখানা দিশি কম্বলে ঢাকা রয়েছে। অতি শীর্ণ, দেখলেই বুঝতে পারা যায় যে, দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করছেন। ঘরের মেঝেতে লণ্ঠনটা রাখা ছিল, তাতে খাটের ওপটা ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। তবুও যা দেখলুম তাতে মনে হল যে, রোগিণীর চেহারা খর্ব, চোখ বোজা থাকলেও তা কোটরাগত–কেবল টিকলো নাকটা বিগত রূপের নিশানস্বরূপ তখনও খাড়া রয়েছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, যেন দেহে প্রাণ নেই, কিন্তু কিছুক্ষণ লক্ষ করে বোঝা গেল, খুব ধীরে ধীরে নিশ্বাস পড়ছে। পরেশদা একবার খুব আস্তে ডাক দিলে, মা!

কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পরেশদা লণ্ঠনের আলোটা খুব কমিয়ে ঘরের এক কোণে রেখে ইশারা করে আমাদের ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে, রান্নার ব্যবস্থা করে ডাক্তার আনা যাবে। কি বলো?

সে ঝিকে ডেকে আটা ইত্যাদি বার করে দিয়ে বললে, আটা মেখে ঘুঁটেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তুমি চলে যেতে পার।

পরেশদাকে বললুম, তুমি মুখ-টুখ ধোও। মার কাছেই থাক, আমরা রান্না করছি–শুধু রুটি তৈরি করবার সময়ে তুমি এলেই চলবে।

আমরা ডাল ধুয়ে চড়িয়ে দিয়ে আলু ও কুমড়ো কুটতে আরম্ভ করে দিলুম। কিছুক্ষণ বাদে পরেশদা হাত-মুখ ধুয়ে এসে বললে, এই ভাই আমার সংসার।

জিজ্ঞাসা করলুম, মা কিরকম?

–সেই রকম পড়ে আছেন।

বললুম, তুমি ডাক্তার ডেকে নিয়ে এস।

পরেশদা বললে, তাই যাই ভাই! আমি ফেরবার আগে যদি তোমাদের ডাল ও তরকারি রান্না হয়ে যায় তো উনুনে বড় দেখে খান-দুই গোবর ফেলে রেখে দিও। আমি এসে রুটি তৈরি করব।

সেখানে একটা সুবিধা এই দেখলুম যে, উনুন ধরাবার হাঙ্গামা পোয়াতে হয় না। তাল-তাল গোবর যে অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকে সেই অবস্থাতেই শুকিয়ে তা ওজনদরে বিক্রি করা হয় এবং তাই জ্বালিয়ে রান্না চলে। কতকগুলো উনুনে ফেলে তাতে কেরোসিন তেল ঢেলে দেশলাই জ্বালিয়ে দিলেই উনুন ধরানো হয়ে গেল।

বেরিয়ে যাবার আগে কোথায় কি দ্রব্য থাকে তা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে ঝিকে ডেকে পরেশদা বললে, তুমি আজ একটু দেরিতে যেয়ো। মা’র অসুখ, সেখানে গিয়ে একটু ব’স, আমি ডাক্তার আনতে যাচ্ছি–আমি ফিরে এলে তুমি যেয়ো।

ঝিটা বকবক করতে করতে ওপরে উঠে গেল। পরেশদা বেরিয়ে যেতে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে আমরা সমারোহে রাঁধতে আরম্ভ করলুম। গল্প করতে করতে সময় কেটে যেতে লাগল। রান্না করতে তখনও আমরা কেউ জানি না, রাঁধতে দেখেছি মাত্র। কখনও কোনো রকমে ভাত ও খিচুড়ি এর আগে রেঁধেছি। একবার হাতা দিয়ে তুলে দেখা গেল, ডাল যেন সেদ্ধ হয়ে গেছে–এবার নামিয়ে সম্বরা দিতে হয়। কাঁচা-মুগের ডালে কি সম্বরা দেওয়া যায়! আমি বললুম, দুটো শুকনো লঙ্কা। জনার্দন ও সুকান্ত পূর্ববঙ্গের লোক, তাদের একজন বললে, সরষে ফোড়ন দাও। আর একজন বললে, না না কালোজিরে দাও।

কিন্তু পরেশদা বলে গেলেও সেই ক্ষীণ আলোতে কোথায় যে কি আছে তা খুঁজে পেলুম না। ঝিকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে দিতে পারবে মনে করে ওপরে গিয়ে দেখি যে, মেঝের ওপরে ময়লা ওড়নাটা পেতে সেই সন্ধারাতেই সে তোফা ঘুম লাগিয়েছে–অগত্যা নেমে আসতে হল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হলুদ ও লঙ্কার গুঁড়ো আবিষ্কার করা গেল। একটা বাটিতে ঘিয়ের মতন একটু ছিল। তাই দিয়েই ডালের সম্বরা দেওয়া হল।–নুন খুঁজে পাওয়া গেল না, কাজেই দেওয়াও হল না।

ডাল নামিয়ে আলু ও কুমড়ো সেদ্ধ করতে চড়িয়ে দেওয়া গেল। সুকান্ত ও জনার্দন বাজারে ঘি ও নুন আনতে বেরিয়ে গেল। উনুনটা নিবে এসেছিল বলে কয়েকখণ্ড শুকনো গোবর দিয়ে নীচু হয়ে জোরে ফুঁ দিতে লাগলুম, ঘর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে উঠল। একবার এমনি করে ফুঁ দিয়ে মুখ তুলেছি এমন সময় দরজার সামনে দেখলুম, এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে। সে এক অদ্ভুত মূর্তি, ঠিক যেন একখানা সম্পূর্ণ নরকঙ্কাল একটা ছেঁড়া ময়লা কাপড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-দুটো কোটরগত হলেও অপরূপ ঔজ্জ্বল্যে জ্বলজ্বল করছে। ওদিকে উঠোনের মধ্যে কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির অন্ধকার ও শীতের ধোঁয়ায় এক ভয়াবহ পটভূমির সৃষ্টি করেছে, আর সামনে সেই কঙ্কাল। ঘরের মধ্যেকার উনুনের আগুন জ্বলছে আর নিবছে, আর তাই সেই জ্বলজ্বলে চোখে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! সে-মূর্তি দেখে ভয়ে সেই শীতকালেও আমার ঘাম ছুটতে আরম্ভ করে দিলে। কিন্তু একটু পরেই কে যেন আমার মধ্যে বলে উঠল–ইনি পরেশদার মা। তখুনি নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে গিয়ে তাঁকে একটা প্রণাম করে বললুম, মা, আপনি উঠে এলেন কেন? আমরা তো নিজেরাই সব করে নিচ্ছিলুম।

মা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, তোমাকে তো–চিনতে পারছি না–তুমি কে বাবা?

সব বললুম। আমার কথা শুনে তিনি মাতৃহৃদয়ের সমস্ত মধু ঢেলে বললেন, আ মরে যাই –মরে যাই বাছা আমার! তা আমাকে ডাকতে হয়! কোথায়-পরু গেল কোথায়? অ পরু!

বললুম, পরেশদা ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছেন।

–ওমা, কেন? তার শরীর ভালো আছে তো?

–তিনি ভালোই আছেন। আপনি সন্ধেবেলা অমন নিঝুম হয়ে পড়েছিলেন, আপনাকে ডেকে সাড়া না পেয়ে তিনি ভয় পেয়ে ডাক্তার আনতে গিয়েছেন।

মা বললেন, জোরে ডাকলেই হত। আমার কি মরণ আছে বাবা-আহা, তোমাদের কত কষ্টই হল!

পরেশদার মা উনুন থেকে কড়া নামিয়ে রীতিমত রান্না শুরু করে দিলেন। ইতিমধ্যে সুকান্ত ও জনার্দন বাজার থেকে ফিরে এলে তাদের পরিচয় জানলেন। তরকারি নামিয়ে রুটি করছেন, এমন সময় পরেশদা ডাক্তার নিয়ে এসে হাজির হল।

ডাক্তার এসে দেখলেন যে, তাঁর মুমূর্ষু রুগি রুটি সেকঁছেন। ঘরে অভ্যাগত এসেছে–মরবার সময় তাঁর নেই।

পরেশদা হাঁকডাক করে মাকে ওপরে নিয়ে গেল। ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে রোগিণীকে পরীক্ষা করে প্রেসিক্রিপশন লিখে দিয়ে যাবার সময় আমাদের সবাইকে বলে গেলেন যে, রুগির অবস্থা ভালো নয়। দিনরাত একেবারে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। ফল দুধ ইত্যাদি পথ্য। কিন্তু পথ্য যাই হোক–বিশ্রামের দরকার। আপনাদের ভরসা দিতে আমি পারছি না, তবে এরকম অবস্থা থেকেও সুস্থ হয়ে উঠতে আমি দেখেছি–চিকিৎসা আরও অনেক আগে আরম্ভ হওয়া উচিত ছিল। রুগির মানসিক শক্তি অসামান্য, কারণ তাঁর শরীরের যে অবস্থা তাতে উঠে হেঁটে কাজ করা একরকম অসম্ভব।

ডাক্তারের সঙ্গে পরেশদাও বেরিয়ে গেল ওষুধ আনতে। সেখানে আবার ন’টা সাড়ে ন’টার মধ্যে সব ডাক্তারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শীতের দিনে তো কথাই নেই। পরেশদা যাবার সময় মাকে শুইয়ে রেখে গেল। আমরা তিনজনে রান্নাঘরে বসে রুটিগুলো সেঁকব কি না ভাবছি এমন সময় দেখি, মা নেমে এসেছেন।

–এ কি, আপনি নামলেন কেন?

-আর খানকয়েক রুটি আছে সেঁকে দিয়ে যাই।

–কিন্তু ডাক্তার যে আপনাকে শুয়ে থাকতে বলে গেলেন!

–বলুগে ডাক্তার। –তিনি আর-কিছু বলতে পারলেন না। বেশ বোঝা গেল, অশ্রুতে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে এল। রুটি উনুনে ফেলে সেঁকবার সময় মুখখানা আগুনের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন–সেই আগুনের আভায় আমি স্পষ্ট দেখলুম, তাঁর দুই চোখ দিয়ে দুটি ধারা শুকনো গাল বেয়ে নামছে–ভাবতে লাগলুম, এ অশ্রুর উৎস কোথায়?

খানকয়েক মাত্র আর রুটি ছিল, সেগুলো সেঁকে দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে মা ওপরে চলে গেলেন, আমরা উনুনের ধারে বসে হাত-পা সেঁকতে লাগলুম। ঘণ্টাখানেক পরে পরেশদা ওষুধ নিয়ে ফিরে এল। মাকে ওষুধ খাইয়ে সেই শীতে স্নান করে পরেশদা আমাদের সঙ্গে এসে খেতে বসল। ওপরে যখন উঠলুম তখন এগারোটা বেজে গেছে–আগ্রা নগরী সুষুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে।

পরেশদার মা সেই যে গিয়ে বিছানায় শুলেন আর তাঁকে উঠতে হল না। ডাক্তার ঠিকই বলেছিল। অসামান্য মানসিক শক্তিবলেই তিনি এতদিন হেঁটে কাজ করছিলেন–সেদিন শেষ শক্তিটুকু ব্যয় করে আমাদের জন্যে রান্না করে দিয়ে শয্যাগ্রহণ করলেন।

পরের দিন সকালবেলা আমরা রান্না করলুম। রান্না এমন কিছুই না–ভাত, ডাল ও একটা আলু কিংবা কুমড়োর ঘ্যাঁট! সে-কাজ করতে আমাদের ভালোই লাগছিল, কিন্তু পরেশদা শুনলে না। সে এক ব্রাহ্মণের মেয়েকে জোগাড় করে নিয়ে এল, সে এসে দু-বেলা রেঁধে দিয়ে যেতে লাগল। আমরা নিজেদের টাকা দিয়ে চাল ডাল ও জিনিসপত্র কিনে আনতে লাগলুম। পরেশদা সামান্যই মাইনে পেত–অবিশ্যি তাতে তার সংসার সচ্ছলভাবেই চলে যেতে পারত–আমরা আসা সত্ত্বেও। কিন্তু মা’র অসুখে একদিন অন্তর ডাক্তার ডাকা ও তা ছাড়া ওষুধপত্তর এবং অন্যান্য খরচের ঠেলায় সে-বেচারি বিব্রত হয়ে পড়ল। পরেশদার আপিসেরও দু-একটি বন্ধু এই সময় দেখাশুনো ও খোঁজখবর করতেন।

এক ভদ্রলোক, তাঁর ওই দেশেই বাড়ি, তিনি প্রায় প্রত্যহ সন্ধেবেলায় আসতেন এবং আমাদের বলতেন যে, পরেশ হয়তো চক্ষুলজ্জার খাতিরে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু তোমরা তার ছোট ভাই, তোমাদের বলা রইল যখন যা প্রয়োজন হবে-অর্থ, লোকজন, সেবার জন্য নারী–যদি কিছু সাহায্যের প্রয়োজন হয় তো নিঃসঙ্কোচে আমায় বলবে।

অনেক চেষ্টা করেও আজ লোকটির নাম মনে করতে পারছি না, হয়তো এমন সময় মনে পড়বে তখন আর কোনো কাজে লাগবে না–স্মৃতি চিরদিন আমার সঙ্গে এমনি লুকোচুরি খেললে।

পরেশদা প্রতিদিন সকালে মা’র সমস্ত কাজ করে বেলা দশটার পর আপিসে বেরিয়ে যেত। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমরা এক-একজন পালা করে তাঁর কাছে গিয়ে বসতুম। সন্ধের সময়ে পরেশদা আপিস থেকে সমস্ত দিনের সংবাদ নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটত–কারণ ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, প্রতিদিনের সংবাদ যেন তাঁকে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে তিনি মাতৃসেবায় লেগে যেতেন আবার পরদিন ভোরবেলা অবধি।

প্রায় প্রতিদিনই সন্ধেবেলাটায় আমি রোগিণীর কাছে বসে তাঁর সঙ্গে গল্প-সল্প করতুম। বাইরে থেকে বুঝতে না পারা গেলেও ডাক্তার বলতেন যে, রোগিণীর অবস্থা উত্তরোত্তর মন্দের দিকেই চলেছে–কোনো ওষুধই ধরছে না। রোগিণী অধিকাংশ সময়েই সেই আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকলেও হঠাৎ মাঝে মাঝে বেশ সজীব হয়ে উঠতেন-তখন মনেই হত না যে, ওইরকম একটা সাংঘাতিক রোগে তিনি ভুগছেন। যতটুকু সময় ভালো থাকতেন, শুধু কথা বলতেন একেবারে বিরাম-বিহীন ভাবে। আমাদের উপদেশ দিতেন বাড়ি ফিরে যেতে। বলতেন, এ সংসার বড় খারাপ জায়গা–কোথায় কি বিপদ লুকিয়ে জাল পেতে বসে আছে। টপ করে সেই ফাঁদে পড়ে যাবি আর সামলাতে পারবি না। কখনও বলতেন আমি জীবনে কোনো কামনাই পোষণ করিনি, শুধু একটি মাত্র সাধ ছিল যে মরবার আগে পরুর বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারে স্থিতি করে যাব; কিন্তু সে-ও এই তোদেরই মতো মা’র আশ্রয় ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে এমন ফাঁদে পড়ে গেল যে, তা থেকে আর পালাবার পথ রইল না–সবই আমাদের বরাত। তা না হলে পরুর মতো ছেলে মাকে ছেড়ে পালাবে কেন? বালক সে বুঝতে পারেনি যে, মা’র কোলের চাইতে নিরাপদ আশ্রয় আর নেই।

বললুম, কিন্তু পরেশদা তো মা’র দুঃখ ঘোচাবে বলেই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। আমার কথার আর কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর তিনি আপন-মনে বলতে লাগলেন, আমার আবার দুঃখ কি বাবা! আমি সুখেই আছি–তোমরা সুখী থাকলেই আমার সুখ।

সেদিন মা’র কথায় মনে হল, পরেশদার জীবনের সঙ্গে নিশ্চয় কোনো রহস্য জড়িয়ে আছে, যার জন্যে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার মনে করে সে-সম্বন্ধে পরেশদাকেও আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিনি।

আর একদিন সন্ধেবেলা মা’র ঘরে তাঁর চৌকির সামনেই পরেশদার চৌকিতে বসে আছি, সুকান্ত ও জনার্দন দুজনেই পরেশদার সঙ্গে সেই ক্যান্টনমেন্টে ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছে। নীচের তলায় মধ্যে মধ্যে রাঁধুনি ও ঝিয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মা’র দিকে চেয়ে আছি–খুবই ধীরে ধীরে তাঁর নিশ্বাস পড়ছে। সাধারণত এই সময়টা তাঁর আচ্ছন্ন ভাব কিছুক্ষণের জন্যে কেটে যায়, কিন্তু সেদিন তখনও কাটেনি। তাঁর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি, হঠাৎ দেখলুম তিনি চোখ খুলে মাথা ঘুরিয়ে একবার আমার দিকে চাইলেন। কিন্তু আমাকে কোনো কথা না বলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আসনের দিকে কি দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ এইভাবে দেখতে দেখতে অতি ক্ষীণস্বরে যেন কি বললেন।

আমি চৌকিতে বসে-বসেই জিজ্ঞাসা করলুম, মা, কিছু বলছেন?

দেখলুম, আবার তিনি চোখ বুজে ফেললেন। কিছুক্ষণ সেই ভাবে কেটে যাবার পর আবার চোখ চেয়ে কি যেন বললেন। এবার আমি চৌকি থেকে নেমে তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, কি বলছেন মা?

অতি ক্ষীণস্বরে তিনি বললেন, ঘরে যিনি এসেছেন তিনি কে?

আমি চারিদিকে চেয়ে দেখলুম, কেউ কোথাও নেই। বললুম, কই, কেউ তো আসেনি, মা। মা বললেন, দেখতে পাচ্ছিস না, এই যে সামনে–মাথায় জটওয়ালা এক সন্ন্যাসী–ওই যে একেবারে তোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল–এমনকি পাশের দিকে চাইতেও সাহস হচ্ছিল না। শেষকালে জোর করে মন থেকে ভয় ঝেড়ে ফেলে পাশের দিকে চেয়ে দেখলুম, কেউ কোথাও নেই। মা কিন্তু দুই হাত যুক্ত করে কাকে বার বার নমস্কার করতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর আমি জিজ্ঞাসা করলুম, বাতিটা কি একটু বাড়িয়ে দেব মা? মা বললেন, না, ঠিক আছে।

আবার জিজ্ঞাসা করলুম, মা, সন্নোসীকে কি এখনও দেখতে পাচ্ছেন?

মা বললেন, না, তিনি চলে গেছেন। কালও অনেক রাত্রে একবার তাঁকে দেখেছিলুম। একেবারে আমার বিছানা ঘেঁসে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি নমস্কার করতেই তিনি হেসে চলে গেলেন।

সেদিন রাত্রে খেতে খেতে মা’র কথা ওঠায় পরেশদাকে এক সন্ন্যাসীর কথা বললুম। পরেশদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, লক্ষণ ভালো নয়। মা শিগিরই চলে যাবেন–এসব হচ্ছে তারই ইঙ্গিত।

আজকের এই বিষণ্ণ শীত-সন্ধ্যায় অতীতের সেই সন্ধ্যাটির কথা ভাবতে ভাবতে আর-একটি সন্ধ্যার চিত্র আমার স্মৃতিপটে স্পষ্ট হয়ে উঠছে–এই দিনটির ঠিক দশ বছর পরে শ্রাবণের এক মেঘভরা সন্ধ্যায় তেমনি এক অন্ধকার ঘরে এক রুগির পাশে বসে ছিলুম–রুগি আর কেউ নয়, আমারই ছোট ভাই অস্থির। কয়েকদিন থেকে তার জ্বর চলেছে, কিছুতেই ছাড়ে না। আমার সামনেই মেঝেতে উঁচু গদির ওপরে সে শুয়ে রয়েছে–চোখে আলো লাগে বলে ঘরের বাতি নিবিয়ে দিয়ে বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই ভাইয়ে গল্প হচ্ছে-অস্থির বলছিল, ওই টোব্যাকো-মিশ্চারগুলো আর পাকাতে ভালো লাগে না। টিনটা তুই নিয়ে যা, কাল সকালে আমার জন্যে এক-টিন ভালো তৈরি সিগারেট এনে দিস।

এমনিধারা হালকাভাবে এ-কথা সে-কথা চলেছে এমন সময় কথার মাঝখানে অস্থির বলে উঠল, দেখ স্থরে এই বুড়োটাকে চিনিস?

–কে রে! কে বুড়ো?

–ওই যে আলমারির পাশে বসে রয়েছে।

অস্থিরের শয্যার পাশে প্রায় পায়ের কাছে একটা আলমারি ছিল, আমি সেটার আশেপাশে বেশ করে দেখলুম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলুম না। অস্থির বললে, আজ দু’দিন ধরে লোকটা দিনরাত ওইখানে বসে আছে, ভাই। আমি এত চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই চিনতে পারছি না–তুই চিনতে পারলি?

বললুম, কই ভাই, আমি তো কারুকে দেখতে পাচ্ছি নে।

–দেখতেই পাচ্ছিস নে–কি আশ্চর্য!

পরের দিনই অপ্রত্যাশিতভাবে অস্থিরের অসুখ সঙ্গিন অবস্থায় দাঁড়াল — ঠিক দু’দিন পরে সে চলে গেল।

এরা সত্যই কি সে-সময় কারুকে দেখতে পেয়েছিল, না, সবই রোগার্ত মস্তিষ্কের বিকৃত কল্পনা মাত্র! কে এ প্রশ্নের জবাব দেবে?

পরের দিন ডাক্তার এসে বেশ করে পরীক্ষা করে বলে গেলেন, রোগিণীর বুকের দু-দিকেই সর্দি জমেছে বটে; কিন্তু দু-একদিনের মধ্যে কিছু হবে বলে মনে হয় না। এই ভাবে রোগ বৃদ্ধি পেতে থাকলে সাত-আট দিন পরে মারা যাবার সম্ভাবনা।

পরদিন থেকে মা’র সেই আচ্ছন্ন ভাবটা খুবই বেড়ে গেল। দিনে রাতে প্রায় সমস্তক্ষণই সেইভাবে পড়ে থাকতেন। যতক্ষণ পরেশদা বাড়ি না থাকতেন, ততক্ষণ আমরা তিনজনেই পালা করে তাঁর কাছে থাকতুম। সুকান্ত ও জনার্দন বিকেলে বেড়াতে যেত বলে সেই থেকে রাত্রি অবধি আমাকেই রোগিণীর কাছে থাকতে হত।

আজ অতীতের সেইসব ছবি ধীরে ধীরে মানসপটে ফুটে উঠছে। সেই শীতের সন্ধ্যাগুলি, সেই ছোট ঘরে পাছে একতলার ধোঁয়া এসে ঢোকে তাই জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ করা, ঘরের এক কোণে সদ্য-জ্বালা হ্যারিকেনটা রাখা আছে। তার শিখাকে যতদূর সম্ভব নাবিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে আবার যেটুকু আলো বেরুচ্ছে তাও একখানা বইয়ের ছেঁড়া মলাট দিয়ে আড়াল করা হয়েছে। সামনেই চৌকির ওপর যে রোগিণী নিঃসাড় অবস্থায় পড়ে রয়েছে, তার জীবন-প্রদীপও ওই দীপশিখারই মতো স্তিমিত।

নিস্তব্ধ সন্ধ্যাকালে আমি সেই চৌকিতে বসে বসে ভাবতে থাকি–আমার স্মৃতিকে নামিয়ে দিতে থাকি বিস্মৃতির গভীরে, জন্ম-জন্মান্তরের পারে। মৃত্যুপথযাত্রী কে এই নারী, যাকে আমি আজ মা বলে ডাকছি, যাকে সেবা করছি–বিনা দ্বিধায় যিনি আমার সেবা গ্রহণ করেছেন। এঁর সঙ্গে কি আমি জন্ম-জন্মান্তরের কোনো সম্বন্ধে বাঁধা আছি, না সমস্তটাই অকস্মাতের খেলা। অকস্মাতের খেলাও তো সুসম্বদ্ধ নিয়ম মেনে চলে–কল্পনায় সময়টা হু-হু করে কেটে যায়।

এমনি একদিন সন্ধেবেলা মা’র মুখের দিকে চেয়ে বসে আছি, হঠাৎ চোখ চেয়ে তিনি যেন কাকে খুঁজতে লাগলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, মা, কিছু বলছেন?

তিনি একখানা হাত তুলতেই আমি হাতখানা ধরে আস্তে আস্তে নামিয়ে দিলুম। মা খুব ধীরে ধীরে বললেন, এইখানে ব’স, আমার খাটে–এই আমার পাশে।

আমি সেই অপরিসর জায়গায় কোনো রকমে কুঁকড়ে বসলুম। মা ধুঁকতে ধুঁকতে বলতে লাগলেন, তোদের হাতের এই সেবাটুকু পাবার জন্যে এতদিন অপেক্ষা করছিলুম–তা না হলে অনেক আগেই আমি মরে যেতুম। এই মাকে মনে থাকবে বাবা? হঠাৎ এই কথা শুনে আমি অশ্রু রোধ করতে পারলুম না। জিজ্ঞাসা করলুম, তোমার সঙ্গে কি আমার জন্ম-জন্মান্তরের সম্বন্ধ? কি সে সম্বন্ধ আমায় বলো না মা?

একটুখানি সম্মতিসূচক হাসিতে সেই রোগক্লিষ্ট বিবর্ণ মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল–হতে পারে সে আমার দৃষ্টিবিভ্রম।

সেই রাত্রে আহারাদি সেরে ঘরে আমরা ঘুম দিচ্ছি, বোধ হয় রাত্রি তখন বারোটা–পরেশদা দরজা ধাক্কা দিয়ে আমাদের তুলে বললে, মা মারা গেলেন।

পরেশদার বাড়ি থেকে শ্মশান বোধ হয় চার মাইল দূরে, যমুনার ধারে। সেই শীতের রাত্রে আমরা চারজনে মৃতদেহ সেই চার মাইল দূরের শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করলুম–আমার জীবনে এই প্রথম শববাহন।

পরের দিন থেকেই পরেশদার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করতে লাগলুম। মায়ের মৃত্যুতে তাকে একফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখিনি। নীরবে সে আমাদের সঙ্গে শব বহন করে শ্মশানে গেল, মুখাগ্নি ও অন্যান্য কৃত্য যা কিছু করে ফিরে এল। কোনোরকম হা-হুঁতাশ বা শোকের কোনো প্রকাশ তার মধ্যে দেখতে পেলুম না। আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা হাসি আগেও যেমন করত তেমনি করতে লাগল–তবুও যেন মনে হতে লাগল, সে আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। শ্মশান থেকে ফিরে আসবার কিছু পরে আমাদের সেই ব্ৰাহ্মণী এসে রাঁধবার ব্যবস্থা করতেই সুকান্ত তাকে বললে, আজ আর রান্না করে কাজ নেই, আমরা বাজার থেকে কিছু আনিয়ে নিয়ে খেয়ে নেব খন–কি বলো পরেশদা?

পরেশদা আমাদের তিনজনকেই ওপরে মা যে ঘরে মারা গিয়েছিলেন সেই ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে, দেখ ভাই, তোমাদের একটা কথা বলি। আমার মা’র স্বাস্থ্য কোনোদিনই ভালো ছিল না, বিশেষ করে এই শেষ দশবছর তিনি মুমূর্ষু অবস্থাতেই ছিলেন বললে হয়। কিন্তু এবারকার বন্ধন মোচন হতে দেরি হচ্ছিল কেন জান?

–কেন দাদা?

–তোমাদের জন্যে। তোমরা ছিলে তাঁর পূর্ব-পূর্ব জন্মের সন্তান। কেন তা বলতে পারি না, তবে কোনো বিশেষ কারণে তোমাদের জন্যেই তাঁর এতদিন মৃত্যু হয়নি। তোমরা আসবে, তোমাদের সেবা নিয়ে তবে তাঁর প্রাণ বেরুবে–এই ছিল নির্দিষ্ট বিধান। আমার ইচ্ছা আমার সঙ্গে তোমরাও তাঁর জন্যে অশৌচ গ্রহণ কর। এতে তাঁর শান্তি হবে।

তারপরে হেসে বললে ভাই, জানই তো মেয়েদের সংস্কার। আমার সঙ্গে তোমরাও যদি তাঁর শ্রাদ্ধ কর তা হলে তিনি হালকা হবেন–মুক্তি পাবেন।

আমার বেশ মনে আছে, পরেশদা বিশেষ করে ওই ‘হালকা’ শব্দটির ব্যবহার করেছিল। পরেশদার অনুরোধে আমরা তখুনি আমাদের পূর্বজন্মের মায়ের আত্মার তৃপ্তির জন্য অশৌচ ধারণ করলুম। রাঁধুনি ব্রাহ্মণীকে তার প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়ে বলা হল, শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে যাবার পর সে যেন দেখা করে। তখুনি সবাই বাজারে গিয়ে নতুন ধুতি কেনা হল। পরেশদা আমাদের তিনজনকে তিনখানা গরম ধোশা কিনে দিলে-পরদিন থেকে শ্রাদ্ধের জোগাড়ে মন দেওয়া গেল।

মায়ের সম্পত্তির মধ্যে দু-তিনটে থানধুতি ও একখানা অতি ছিন্ন গরম গায়ের কাপড় ছিল। ভিখিরি ডেকে পরেশদা একে একে সেগুলো বিলিয়ে দিলে। কাঠের তৈরি একখানা ডালাভাঙা বাক্স ছিল মায়ের ঘরে–বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে সেটা এনেছিলেন। সংসার খরচের পয়সাকড়ি যখন যা পেতেন তাতে রেখে দিতেন। এই বাক্সটা ঝাড়া-মোছা করতে করতে একজোড়া সোনার শাড়ি পাওয়া গেল–সেই পুরনো দিনের বাংলা পাঁচের মতন আকৃতির মাক্‌ড়ি।

পরেশদা বললে, মায়ের বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া এই মাড়ি। কিন্তু বাবার হাত থেকে এ-দুটোকে তিনি রক্ষা করলেন কি করে! নিশ্চয় তাঁর মনে ছিল না।

পরেশদাই হবিষ্যান্ন রেঁধে আমাদের ভাগ করে দিয়ে নিজেও বসততা। রাত্রিবেলা দুধ আর মিষ্টি খাওয়া হত। প্রতিদিন সন্ধাবেলা শীতের অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে ওঠার পর পরেশদা আমাদের নিয়ে যে-ঘরে মা মারা গিয়েছিলেন সেই ঘরে গিয়ে বসততা। মায়ের শূন্য চৌকিখানার ওপরে একটা রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলত, আর আমরা সেটার সামনেই পরেশদার চৌকিখানায় বসতুম–পরেশদা মায়ের গল্প করতে থাকত। পরেশদা বলত, মা আমার চিরদুঃখিনী ছিলেন। আট-ন’বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাবার পর ঠাকুরদা মাকে নিয়ে এসেছিলেন। ঠাকুরদার সংসারে কোনো স্ত্রীলোক ছিল না–সেই অল্পবয়সে মা আমার বাংলাদেশ থেকে সুদূর পশ্চিমে এসে সংসারের হাল ধরেছিলেন। ঠাকুরদা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন একরকম চলেছিল, কিন্তু তিনি মারা যাবার পরই বাবা নিজমূর্তি ধারণ করলেন। দিল্লির যত গুণ্ডা বদমায়েস ছিল তাঁর বন্ধু। দিনরাত মদ, ভাং প্রভৃতি নানারকমের নেশা করতেন–বলতে গেলে কোনো সময়েই তিনি প্রকৃতিস্থ থাকতেন না। শুধু তাই নয়, সংসারের প্রতি তাঁর আদৌ মন ছিল না। কি করে যে সংসার চলে অথবা চলবে, সে-বিষয়ে কোনো হুঁশই তাঁর ছিল না। ঠাকুরদার কিছু টাকা ছিল–বাবা তা দু’দিনেই ফুঁকে দিলেন। তারপরে তাঁর নজর পড়ল মায়ের গয়নাগুলোর দিকে। সেজন্যে প্রতিদিন মারধর চলত– এক-একদিন মায়ের সঙ্গে-সঙ্গে আমার ওপরেও প্রহার চলত। আমরা মায়ে-পোয়ে কতদিন যে অনাহারে বসে বসে কেঁদে দিন কাটিয়েছি, তা আর কি বলব!

পরেশদা প্রতিদিনই অত্যন্ত দরদ দিয়ে মায়ের কথা বলতে থাকত। মা যে কত সহ্য করতেন তাঁর যে কত গুণ ছিল, সে’কথা বলতে বলতে কখনও কখনও অশ্রুতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যেত, আর কথা বলতে পারত না। দুঃখে ও সহানুভূতিতে আমাদের বুকের ভেতরটা মোচড় দিতে থাকত, কোনো প্রশ্ন করতে পারতুম না, চুপ করে অশ্রু রোধ করবার চেষ্টা করতুম। এক-একদিন এমনও হয়েছে আমরা দু’পক্ষই চুপ করে বসে আছি, ওদিকে সেই ক্ষীণপ্রভ প্রদীপশিখাও নিবে গিয়েছে, অন্ধকারের মধ্যে আমরা চারজন চুপচাপ বসে আছি। শেষকালে পরেশদাই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে উঠে গিয়ে বাতিটা জ্বালিয়ে দিত।

ক্রমে শ্রাদ্ধের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। পরেশদার আপিসের দুই-একটি বন্ধু, তার বাড়িওয়ালা–এরা সব এসে পরামর্শ দিতে লাগল। সেখানে যে দু-চারজন বাঙালি ছিলেন পরেশদার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ছিল না। এই সময় তাঁদের শরণাপন্ন হওয়ার কথায় পরেশদা বললে, এখানকার এই বন্ধুরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তখন আমাদের এদের মতেই চলা উচিত। বাঙালিরা এসেই এখন পাঁচ-শো রকমের ফ্যাকড়া তুলবে–এটা কর, ওটা করো না, এ কি করছ হে! ইত্যাদি। এদের মতের সঙ্গে তাদের মতের মিল হবে না, মাঝে থেকে আমার মাতৃশ্রাদ্ধ পণ্ড হবে। দিল্লিতে দেখেছি কিনা! দুই তরফ রক্ষা করতে গিয়ে অনেক শ্রাদ্ধই সেখানে পণ্ড হয়েছে–দিল্লিতে থাকলে এদের কাছে ঘেঁষতেই দিতুম না!

যা হোক, শেষে ঠিক হল ওই দেশেরই দ্বাদশটি ব্রাহ্মণকে খাওয়ানো হবে এবং এখানকারই ভালো ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতকে দিয়ে শ্রাদ্ধ করানো হবে।

মাতৃশ্রাদ্ধ যতই এগিয়ে আসতে লাগল, পরেশদা ততই ব্যস্ত হয়ে পড়তে লাগল। সে বাইরে গেলেই আমরা তিনজনে পরামর্শ করতে থাকতুম–মায়ের শ্রাদ্ধ হয়ে গেলে এখানে থাকা আর আমাদের সমীচীন হবে কি না! যদি এখান থেকে চলেই যেতে হয়, তা হলে আমরা আগ্রা থেকেই চলে যাব বলে স্থির করলুম। দিল্লিতে যাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সেখানে আমাদের তিনজনেরই জানাশোনা লোক থাকায় যেতে মন সরছিল না। যদি পরেশদার ওখান থেকে সরে পড়তেই হয় তো কবে নাগাদ যেতে হতে পারে, তা জানা দরকার। শ্রাদ্ধের ঠিক দিন-দুই আগে সন্ধের পর আমরা রোজ যেমন মায়ের ঘরে গিয়ে বসি, সেদিনও তেমনি বসেছি। এ-কথা সে-কথা চলেছে, এমন সময় একটু ফাঁক পেতেই আমি পরেশদাকে জিজ্ঞাসা করে ফেললুম, হ্যাঁ দাদা, মায়ের শ্রাদ্ধ হয়ে গেলেই কি আমরা চলে যাব?

আমার প্রশ্ন শুনে পরেশদা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, না, তোমরা চলে যাবে কেন? হয়তো আমাকেই চলে যেতে হবে।

রহস্যটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল বুঝতে পেরে পরেশদা বললে, ব্যাপারটা তোমাদের খুলে বলাই উচিত, এর আগে এক মা ছাড়া এ কথা আর কেউ জানত না।

পরেশদা বলতে আরম্ভ করলে, তোমাদের তো আগেই বলেছি আমার বাবা মা’র ওপরে ভয়ানক অত্যাচার করতেন। একটি পয়সাও তিনি রোজগার করতেন না, অথচ তাঁর নেশা ইত্যাদির জন্যে রোজ পয়সা চাই। মা’র কিছু গহনা ছিল, কিছু বাপের বাড়ি থেকে পেয়েছিলেন আর ঠাকুরদাও অনেক কিছু করিয়ে দিয়েছিলেন। এই গহনাগুলোর জন্যে বাবা প্রায়ই মাকে মারধর করে একটা একটা নিয়ে যেতেন। মা’র কান্না আমি সহ্য করতে পারতুম না, আমিও কাঁদতে থাকতুম। মার সঙ্গে কাঁদছি দেখলে আমার ওপরেও বাবার রাগ হত, আর সেইসঙ্গে আমাকেও নিদ্দম ঠেঙানি দিতেন।

বাবা যখন মারা গেলেন, আমার বয়স তেরো কি চোদ্দো। কয়েকদিন পরেই পাওনাদারেরা এসে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে। পাড়ার একজন আমাদের একখানা ঘর ছেড়ে দিলে, বললে, ভাড়া লাগবে না, থাক তোমরা।

সেই সময়ে মা যে কি করে দিন চালাতেন জানি না। মাকে রোজই দেখতুম, একলা বসে বসে কাঁদছেন। আমি ঠিক করলুম, চাকরি করলে মা’র দুঃখ কিছু ঘুচতে পারে। কিন্তু দিল্লি শহরে কে আমায় চাকরি দেবে? ঠিক করলুম, কলকাতায় গিয়ে লোকের বাড়িতে চাকরি করলেও তো দু’পয়সা পাব। মাইনের টাকাটা মাকে পাঠিয়ে দিলে তবু তিনি দু-বেলা খেতে পাবেন। পৈতের সময় আমি গোটা-তিনেক সোনার আংটি পেয়েছিলুম–সেইগুলো মা’র বাক্স থেকে চুরি করে এক সোনারকে বেচে গোটা-পঁচিশেক টাকা পাওয়া গেল। এই টাকা ভরসা করে একদিন সন্ধ্যাবেলায় কলকাতা-যাত্রী এক ট্রেনে বিনা-টিকিটে সওয়ার হওয়া গেল।

কিন্তু গাড়ি ছাড়ামাত্র আমার ভয়ানক কান্না পেতে লাগল। এতক্ষণে মা আমার দেখা না পেয়ে কিরকম উতলা হয়েছেন ভেবে আমার ভয়ানক কষ্ট হতে লাগল। ভেবে-চিন্তে ঠিক করলুম, একটা কোনো বড় জায়গায় নেমে মাকে একখানা চিঠি লিখে আবার যাত্রা শুরু করা যাবে।

পরদিন গয়া স্টেশনে নেমে পড়লুম। সেখানে এক পাণ্ডার বাড়িতে উঠে মাকে চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে স্টেশনে যাবার উদ্যোগ করছি, এমন সময় পাণ্ডাজী বললে, সে হতে পারে না, গয়াতে এসে মৃত বাপের পিণ্ডি না দিলে মহাপাপ হবে।

তার পরে ভাই, সেই মহাপাপ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে, পঁচিশ টাকা থেকে পাঁচটি টাকা খরচ করে বাপের পিণ্ডি দিলুম–যে বাপ শিশু বয়স থেকে উঠতে-বসতে আমাকে ঠেঙিয়েছে, আমার আত্মীয়স্বজনহীনা রুগ্না মায়ের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। স্বামী, পিতা, কিংবা পুত্ৰ কোনো হিসাবেই যে কখনও কোনো কর্তব্য পালন করেনি, তাকে স্বর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে গয়া থেকে সরে পড়ব, এমন সময় এক সুবিধা জুটে গেল।

আমি আসবার আগের রাত্রে পাণ্ডাদের বাড়িতে একটি ভদ্রলোক এসেছিলেন। ইনি পাণ্ডাদের পুরনো যজমান, অনেকদিন থেকেই জানাশোনা–বাবা মা’র পিণ্ডি দিতে গয়ায় এসেছিলেন। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করলেন। কোথায় বাড়ি, কি বৃত্তান্ত ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করায় আমি অকপটে তাঁকে আমার সব কথা বলে ফেললুম। আমার কথা শুনে তাঁর দয়া হল। তিনি বললেন, ভাই, তুমি আমার সঙ্গে কলকাতায় চলো। সেখানে আমার বাড়িতে তুমি থাকবে, আমি তোমার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেব। তোমার মাকেও কিছু করে পাঠাবার বন্দোবস্ত করা যাবে–যদি তাঁর দিক দিয়ে কোনো বাধা না থাকে, তবে তাঁকেও কলকাতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। কি বলো? আমি তখুনি রাজি হয়ে গেলুম। তিনি বললেন, তাঁরা রাজগীরে বেড়াতে এসেছেন। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন, এখন ভালো হয়ে উঠেছেন, আর দিন-পনেরো বাদেই কলকাতায় যাবেন।

আমরা আরও দিন-দুই গয়াতে কাটিয়ে পাটনায় এলুম। সেখান থেকে অনেক ঘোরপ্যাঁচ খেয়ে রাজগীরে পৌঁছলুম। ভদ্রলোকের গিন্নিটি তাঁর চাইতেও ভালোমানুষ। আমাকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন। তাঁদের সন্তানাদি ছিল না, ভদ্রমহিলা দুঃখ করে বলতে লাগলে, পরের ছেলে মানুষ করতেই পৃথিবীতে এসেছিলুম–

যাই হোক, রাজগীর জায়গাটি আমার বড় ভালো লাগল। সুন্দর নির্জন জায়গা, কাছে দূরে–যতদূর দেখা যায় পাহাড়ের পর পাহাড়। দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমি এইসব পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতুম, বড় ভালো লাগত। মা’র জন্যে মন কেমন করলেও শিগিরই আমাদের ভালো একটা কিছু হবে–এই আশায় মনটা খুবই উৎফুল্ল থাকত। এইসব পাহাড়ে মাঝে মাঝে অনেক সন্ন্যাসী, যোগী, ফকির ইত্যাদি দেখতুম। ছেলেবেলা থেকে কেন জানি না, ফকির-সন্ন্যাসীদের ওপর আমার প্রবল ভক্তি ছিল। আমার ঠাকুরদার এক সন্ন্যাসী-গুরু ছিলেন, ঠাকুরদার এক ভাই সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ত্যাগ করেছিলেন। মা’র কাছে শুনতুম, ঠাকুরদার এই গুরু মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতেন–তিনি নাকি অনেক অলৌকিক ক্রিয়া করতেন। ঠাকুরদা মারা যাবার পর তিনি আর আসেননি। মা’র কাছে সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে আরও অনেক গল্প শুনে তাঁদের ওপর ভক্তির মাত্রা আমার আরও বেড়ে গিয়েছিল। এইসব পাহাড়ে সন্ন্যাসী-ফকির দেখলেই তাঁদের কাছে গিয়ে বসতুম। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করতেন কেউ চুপ করে থাকতেন, কিছুক্ষণ বসে আমিও উঠে যেতুম। আমি মনে করতুম, এইরকম বসতে-বসতেই হয়তো কোনোদিন অলৌকিক ক্রিয়া কিছু দেখবার সৌভাগ্য হয়ে যাবে।

একদিন আমার আশ্রয়দাতা ও তাঁর স্ত্রী পাটনায় তাঁদের এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কথা হল, তাঁরা পাটনায় তিন-চার দিন থেকে ফিরে আসবার দু-তিন দিন পরেই আমরা কলকাতায় যাব। রাজগীরে তাঁদের দুটি চাকর আর আমি রইলুম বাড়িতে পাহারা দেবার জন্যে।

সেদিন বেলা ন’টা বাজতে না বাজতে আমি বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা পাহাড় দেখা যেত। আমি ঠিক করলুম সেদিন এই পাহাড়টাতে যাব। এর আগে কয়েকদিন সেটাতে যাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সন্ধে হয়ে যাবার ভয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হয়েছে। সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ চলতে-না-চলতেই আমি বুঝতে পারলুম, কি যেন একটা শক্তি আমার দেহ-মনে সঞ্চারিত হয়েছে। আমি যেন দৌড়ে চলতে লাগলুম সেই পাহাড়টার দিকে। মনে পড়ে, রাস্তায় একবার কি দুবার বিশ্রামের জন্যে বসতে হয়েছিল, কিন্তু বেলা একটা বাজবার আগেই আমি পাহাড়টার তলায় গিয়ে উপস্থিত হলুম।

পাহাড়ে অনেক ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠতে লাগলুম। একটা জায়গায় একটা গুহার মতন দেখে দাঁড়ালুম। সেটার মধ্যে যে কেউ থাকে তা বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যায়। আমার যেন মনে হল ভেতর থেকে একটু একটু করে ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে আসছে। জায়গাটা ভারি সুন্দর। গুহার সামনেই অনেকখানি পরিচ্ছন্ন সমতল জায়গা দেখে সেখানে গিয়ে বসলুম। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, অতক্ষণ হাঁটা ও পাহাড়ে ওঠার জন্যে পরিশ্রান্তও হয়েছিলুম–কিছুক্ষণ বসে থেকে, হাতে মাথা রেখে সেইখানেই লম্বা হয়ে পড়লুম। শরীর ছিল ক্লান্ত–যেমনি শোয়া অমনি ঘুম।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাই স্বপ্ন দেখছিলুম, আমি যেন কলকাতায় গিয়ে ব্যবসা করে অনেক অর্থ উপার্জন করছি–মা সেখানে রয়েছেন, তিনি যেন কাকে কি বলছেন আর হাসছেন। সেদিন স্বপ্নে সেই প্রথম দেখলুম মা’র মুখে হাসি–আর, সেই শেষ। বেশ আনন্দে সময়টা কাটছিল, এমন সময় আসরে উদয় হলেন এক সন্ন্যাসী। তাঁর যেমন লম্বা-চওড়া চেহারা, তেমনি লম্বা জটা মাথায়। চোখ দিয়ে যেন করুণা ঝরে পড়ছে। কিছুক্ষণ সেই দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে অতি স্নিগ্ধ ও স্নেহার্দ্র স্বরে সন্ন্যাসী বললে, বেটা পরেশনাথ আ গ্যয়া তুম্!

তখুনি ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠেই দেখি, স্বপ্নে-দৃষ্ট সেই সন্ন্যাসী সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন। প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিলুম, সংবিৎ ফিরতেই আমি একেবারে ভূমিষ্ঠ হয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম।

সন্ন্যাসী আমাকে তুলে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তার পরে আমার হাত ধরে সেই অন্ধকার গুহার মধ্যে নিয়ে গেলেন। অনেকখানি সরু পথ দিয়ে গিয়ে একটা ঘরের মতন জায়গা–গুহার পক্ষে সেই স্থানটুকুকে বেশ বড়ই বলা যেতে পারে। সূর্যের আলো সেখানে সামান্যই পৌঁছয় এক কোণে কাঠ জ্বালিয়ে ছোঠ একটি ধুনি করা হয়েছে। গুহার মধ্যে হলেও কিন্তু জায়গাটা ঝুপ্‌সি নয়। সেখানে বেশ হাওয়া বইছিল, কারণ দেখলুম ধুনি থেকে যে ধোঁয়া উঠছে তা বাইরের দিকে উড়ে যাচ্ছে–তবে কোথা দিয়ে যে বাতাস আসছে তা বুঝতে পারলুম না।

একজায়গায় রোঁয়া-ওঠা একটা চামড়া পড়ে ছিল। সন্ন্যাসী সেই আসনে বসে আমাকে আদর করে পাশে বসিয়ে বসলেন, আমি আশা করেছিলুম, তুমি এর আগেই এখানে এসে উপস্থিত হবে। তুমি গয়াতে এলে, তারপর রাজগীরে এসেছ, তাও জানতে পেরেছিলুম।

আমি মনে-মনে ভাবলুম, কে ইনি? কি করেই বা আমার সব খবর জানতে পারলেন? আমি চুপ করে আছি দেখে সন্ন্যাসী বললেন, বাবা পরেশনাথ, তুমি বোধ হয় আমাকে চিনতে পারছ না?

পরেশদা, বলে চলল, তোমাদের আগেই বলেছি যে, আমার ঠাকুরদারা দুই ভাই ছিলেন। আমার ঠাকুরদার নাম ছিল নরনাথ বাঁড়ুজ্জে, তাঁর বড়ভাইয়ের নাম ছিল দীননাথ। এই দীননাথ কিশোর বয়সেই গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গিয়েছিলেন। সন্ন্যাসী হবার পর ইনি দু’বার বাড়িতে এসেছিলেন। মা’র মুখে তাঁর চেহারার যে বিবরণ শুনেছিলুম তা অনেকটা এঁর সঙ্গে মেলে। এঁর কথা শুনে চট করে আমার সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরদার কথা মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি কি আমার দীনুদাদা?

সন্ন্যাসী অপূর্ব মধুর হাসি হেসে বললেন, নেহি বেটা, মায় তুমহারা দীনদাদা নেহি হুঁ। সন্ন্যাসী বললেন, আমি তোমার পূর্বজন্মের গুরু–ভালো করে মনে করবার চেষ্টা কর। পরেশদা আমাদের বলতে লাগল, একবার ভেবে দেখ আমার অবস্থা। সেই বিদেশে অপরিচিত জায়গায় চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়, তারই এক গুহায় সন্ন্যাসীর সামনে বসে আছি, বয়স চোদ্দো কি পনেরো। কি আশ্চর্যের বিষয়, আমার কিছুই ভয় হচ্ছিল না, বরং মনে হতে লাগল–এখানে আমার কোনো অনিষ্ট হবে না, আমি যেন অতি আপনার লোকের কাছে রয়েছি।

সন্ন্যাসী আবার ধীর মধুর হেসে বললেন, বেটা, মনে করবার চেষ্টা কর।

আমি যতদূর সম্ভব মনকে একাগ্র করবার চেষ্টা করতে লাগলুম, কিন্তু কিছুই মনে পড়ল না। সন্ন্যাসী আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মনে পড়ছে?

বললুম, কই, না, কিছুই মনে করতে পারছি না।

তখন তিনি আমাকে আরও কাছে এসে বসতে বললেন। আমি ঘেঁষে-ঘেঁষে তাঁর কাছে এগিয়ে গেলুম। তিনি বললেন চোখ বন্ধ কর।

চোখ বন্ধ করতেই তিনি তাঁর প্রকাণ্ড একখানা হাত দিয়ে আমার চোখদুটো কিছুক্ষণের জন্যে ঢেকে রেখে হাত তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কিছু দেখতে পাচ্ছ?

— পাচ্ছি প্রভু।

রুদ্ধ-নিশ্বাসে আমরা তিনজনেই বলে উঠলুম, কি দেখলে!!!

আমাদের প্রশ্ন শুনে পরেশদা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে, সেকথা থাক্। তবে এইটুকু শুনে রাখ যে, আমি আমার পূর্বজন্মের রূপ দেখলুম, বাড়িঘর দেখলুম, আর দেখলুম একটা নির্জন জায়গায় এই সন্ন্যাসীই আমাকে দীক্ষা দিচ্ছেন।

গুহার এক কোণে এতক্ষণ একটা লোক বসে ছিল। লোকটার মাথামুখ সব একটা ময়লা কাপড়ে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো আর নাকটা বার করা–ঠিক ধুমির পাশেই সে বসে ছিল। দেখলুম, পূর্বজন্মে আমার দীক্ষার সময়েও সেই লোকটা দূরে বসে আছে। যে জায়গাটাতে আমার দীক্ষা হয়েছিল, তার একটু দূরেই একটা বড় নদী দেখতে পেলুম।

অল্পক্ষণ পরেই দৃশ্যপট বদলে গেল। চোখের সামনে ফুটে উঠল সেই গুহা, সেই অর্ধনিবন্ত ধুনি, আমার সামনে বসে আছেন সেই সন্ন্যাসী, অদূরে সেই মুখ-ঢাকা লোকটি।

সন্ন্যাসী বললেন, বৎস, যদিও তোমার আসল দীক্ষা হয়ে গেছে, তবুও জন্মে জন্মে দীক্ষার অনুষ্ঠান করতে হয়। আজই তোমাকে আমি সেই দীক্ষা দেব–প্রস্তুত হও।

তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না, সন্ন্যাসীদের ওপরে আমার যতই ভক্তিশ্রদ্ধা থাকুক না কেন, সেই চোদ্দো-পনেরো বছর জীবনের মধ্যে কোনোদিনই সন্ন্যাসী হবার আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে জাগেনি। অজ্ঞাত মানসলোকের কোনো আহ্বানও কখনও জানতে পারিনি। কিন্তু গুরু যখন বললেন–বৎস, প্রস্তুত হও, তখন আমার সুপ্ত মন হঠাৎ জেগে উঠে বললে, আমি প্ৰস্তুত

তারপরে গুরু আমাকে একখানা ছোট গেরুয়া রঙের কাপড় দিলেন পরতে। আমার সঙ্গে একটা পিরান ছিল, তার পকেটে সেই আংটি-বেচা টাকাগুলো ছিল, সব গুরুর হাতে তুলে দিলুম। তিনি সেগুলো নিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়াতেই সেই লোকটি ধুনির পাশ থেকে উঠে এসে সেগুলো তাঁর হাত থেকে নিয়ে গুহার আর এক কোণে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

আমাকে সামনে বসিয়ে গুরু কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ালেন। শেষকালে একটি নাম দিয়ে বললেন, পাঁচশো-বার একাগ্র হয়ে ওই নাম জপ কর।

আমি গুরুর সামনে থেকে উঠে গিয়ে একটা আলো-আঁধারি জায়গায় বসে নাম জপ করতে আরম্ভ করে দিলুম। কিন্তু কিছুক্ষণ জপ করতে-না-করতে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লুম। কতক্ষণ সেইভাবে ছিলুম বলতে পারি না; তবে জ্ঞান ফিরে আসার পর অনুভব করতে লাগলুম যে, একটা অপূর্ব আনন্দে আমার মন কানায় কানায় ভরে উঠেছে। গুরুদেব কাছেই বসে ছিলেন, তাঁরই একটু দূরে সেই লোকটা–আমি উঠে গুরুকে প্রণাম করে গুহার বাইরে চলে গেলুম।

বাইরে এসে যে দৃশ্য দেখলুম, তা জীবনে এর আগে কখনও দেখিনি। দেখলুম, তখন রাত্রির অন্ধকার নেমেছে পৃথিবীতে, কিন্তু দূরে কাছে সব গাছগুলো জ্বলছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে না–প্রতিটি পাতা ঘিরে একটা সরু আলোর রেখা। কখনও প্রত্যেক পাতা থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, কখনও বা সেই আলো স্নিগ্ধ স্থির হয়ে যাচ্ছে। সে-দৃশ্য বর্ণনা করা তো দূরের কথা কল্পনা করাও যায় না।

খুব ধীরে ধীরে বাতাস বইছিল। বাতাসের মধ্যে যেন গান শুনতে পেতে লাগলুম। ক্রমে আমার চারিদিকের গাছ, পাথর, বাতাস সবই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে বিশ্বনিয়ন্তার প্রশস্তি গাইতে আরম্ভ করে দিলে। আমারও ইচ্ছা করতে লাগল, তাদের সঙ্গে ঈশ্বরের নামগান করি, কিন্তু আমি মোটেই গান জানতুম না। আমাদের ইস্কুল বসবার আগে ছাত্রেরা সুর করে একটা সংস্কৃত স্তোত্র পড়ত, আমি সেইটেই গাইতে আরম্ভ করে দিলুম। আনন্দে আমার শরীরটা থেকে থেকে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল।

সে-রাত্রি এমনি করেই কাটল।

তার পরে রোজ সকাল-সন্ধ্যায় প্রায় এক ঘণ্টা করে গুরুর কাছে উপদেশ শুনতে হত আর বিকেলে ঘণ্টাখানেক নামজপ–এই ছিল কাজ। আমি কোথা থেকে এসেছি, আমার নাম কি–কিছুই মনে নেই। আমার অতীত সম্পূর্ণরূপে মন থেকে মুছে গেল।

একদিন গুরু তাঁর সেই লোকটিকে বললেন, ওরে জুগনু, এবার আশ্রমটা পরিষ্কার-ঝরিষ্কার কর, আমাদের ফেরবার সময় হল। বরফ-পড়া আরম্ভ হয়েছে কি না দেখিস।

জুগনু চুপ করে রইল।

গুরুদেবের এই জুগনু লোকটি ছিল অদ্ভুত। আমি যে-ক’দিন সেখানে ছিলুম, তাকে একদিনও কথা বলতে শুনিনি, কোনোদিন তাকে স্নান করতে কিংবা খেতে দেখিনি। দিনরাত গুরুদেবের সামনে বসে থাকত, কখনও ঘুমুতেও দেখিনি। গুরুদেব যদি তাকে কোনো কাজে পাঠাতেন, সে চলে গিয়ে তখনি ফিরে এসে তাঁর সামনে দাঁড়াতেই বুঝতে পারতেন, জুগনু কি বলছে।

প্রতিদিন জুগনু আমাদের খাবার নিয়ে আসত, কোথা থেকে আনত কে জানে! যেত আর দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে কাঁচা শালপাতায় জড়িয়ে খাবার আনত, একেবারে গরম। অথচ সেখানে চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে লোকালয় ছিল না। সকালবেলা একটি বড় কমণ্ডলু-ভরা দুধ বোধ হয় দু-সের হবে–কোথা থেকে এসে উপস্থিত হত, তা জানি না। তারপরে বেলা প্রায় একটা-দেড়টার সময় জুগনু নিয়ে আসত গরম পুরি ও তরকারি। রাত্রেও তাই, কখনও কখনও ওর সঙ্গে কিছু মিঠাই বা চাটনিও থাকত।

এইরকম কতদিন কেটে গেল, তার সঠিক জ্ঞান ছিল না। পরে হিসাব করে দেখেছি, এক মাস সাতাশ দিন আমি গুরুর কাছে ছিলুম।

একদিন পাহাড়ে একজায়গায় বসে আছি। পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়েছে। আকাশটা অসম্ভব রকমের লাল হয়ে উঠেছে, সেই দিকে একমনে চেয়ে আছি, হঠাৎ আমার বিস্মৃতির আবরণ ভেদ করে মা’র কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগল।

নিমেষের মধ্যে স্মৃতিপটে সব ফুটে উঠতে লাগল। আমি তো ভয়ানক উতলা হয়ে উঠলুম, –ভাবতে লাগলুম, মা’র দুঃখ দূর করবার জন্যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম, আর আমি কি করছি! আমার মনে হতে লাগল মা’র প্রতি কর্তব্য সবার আগে। সেখান থেকেই উঠে চলে যাব, না, গুরুকে জিজ্ঞাসা করে যাব ভাবছি, এমন সময় দেখলুম গুরু আমার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আশ্চর্য! তাঁকে আমার কোনো কথা বলতেও হল না। তিনি আমার কাছে এসে সস্নেহে বললেন, কি বেটা, মা’র কথা মনে পড়ছে?

বললুম, আমার মা বড় দুঃখিনী, আমি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই।

গুরু বললেন, সে কি বেটা, তুমি যখন জন্মাওনি, তখন মা’র কে ছিল? সবার চাইতে বড় মা যিনি, তিনি তোমাকে, আমাকে, তোমার মাকে–সবাইকে দেখছেন। তাঁর ওপর নির্ভর কর, তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখ।

কিন্তু গুরুর কথায় কোনো সান্ত্বনাই পেলুম না, শেষকালে আমি কাঁদতে আরম্ভ করে দিলুম। সেদিন সন্ধ্যার পর নাম জপ করতে অসুবিধা হতে লাগল। যতবার একাগ্র হবার চেষ্টা করি, মা’র বিষণ্ণ মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে, শেষকালে জপ বন্ধ করে বসে রইলুম।

পরের দিন আবার গুরুকে আমার মনের অবস্থার কথা বললুম, তিনি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলেন। গুরুর কাছেই একটা হরিণের চামড়ায় আমি শুতুম। সে-রাত্রে শোবার আগে গুরুদেব হাসতে হাসতে জুগনুকে বললেন, জুগনু, পরেশনাথের জামা-কাপড় নিয়ে এসে ওকে দিয়ে দে, কাল সকালে ও চলে যাবে।

জুগুনু অদৃশ্য হতেই গুরু বললেন, বেটা পরেশনাথ, কাল সকালে তুমি মা’র কাছে চলে যেয়ো। কিন্তু যাবার আগে তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তুমি পরমাত্মার কাছে নিবেদিত, সংসার তুমি করতে পাবে না। মা’র মৃত্যুর পরে তোমাকে আবার এই জীবনে ফিরে আসতে হবে।

আমি গুরুদেবকে বললুম, প্রভু, সংসারে মা-ই আমার একমাত্র বন্ধন। মাকে সুখে রাখব–এ ছাড়া আমার অন্য কাম্য নেই; মা’র মৃত্যুর পর সেখানে আমার কোনো আকর্ষণই থাকবে না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তাঁর মৃত্যু হলেই আমি চলে আসব, কোথায় আপনার দেখা পাব বলে দিন।

গুরুদেব বললেন, সে তোমায় ভাবতে হবে না, দেখা ঠিক পাবে।

পরের দিন সকালবেলায় গুরু আমাকে আমার জামা-কাপড় ও টাকা-ক’টা দিয়ে বললেন, আমি তোমাকে যে মন্ত্র দিয়েছি তা প্রতিদিন রাত্রে শোবার সময় জপ করবে। খুব বিপদে পড়লে আমাকে ডেকো, আমি দেখা দেব।

গুরু আমাকে যে কাপড় দিয়েছিলেন তা ছেড়ে নিজের ধুতি জামা পরলুম, তারপর তাঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লুম। রাত্রেই মনে-মনে স্থির করে রেখেছিলুম, আর কলকাতায় না গিয়ে, সিধে দিল্লিতে মা’র কাছে চলে যাব। তবুও যাবার আগে আমার সেই আশ্রয়দাতার সঙ্গে দেখা করে যাই মনে করে প্রথমেই সেখানে গিয়ে দেখলুম যে, সে-বাড়িতে অন্য ভাড়াটে এসেছে। কাছেই এক মুদীর দোকানের মালিকের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তার কাছে গিয়ে জানতে পারলুম যে, আমার সেই আশ্রয়দাতা ভদ্রলোক ক’দিন ধরে আমার অনেক খোঁজ করে অত্যন্ত নিরাশ হয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন। হিসাব করে দেখলুম, সন্ন্যাসীর কাছে এক মাস সাতাশ দিন ছিলুম–এই সময়ের কোনো জ্ঞানই আমার ছিল না।

সেইদিনই বিকেলের ট্রেনে পাটনায় এসে রাত্রি এগারোটার ট্রেনে চড়ে দিল্লি রওনা হলুম। এই অবধি বলেই পরেশদা চুপ করল।

কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করে পরেশদা আবার শুরু করলে, সে আজ দশ বছর কি তারও কিছু বেশি হবে। এই দশ বছর মাকে ছেড়ে আর কোথাও যাইনি। মা চলে গেলেন, পৃথিবীর সমস্ত বন্ধন থেকে আমাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। আমি বিয়ে-থা করলুম না বলে মার মনে ক্ষোভ ছিল। কাল রাত্রে তিনি এসে আমায় বলে গেছেন, তাঁর আর কোনো ক্ষোভ নেই।

জিজ্ঞাসা করলুম, শ্রাদ্ধের পর কি তুমি চলে যাবে?

–কোথায় যাব?

-তবে?

–গুরুদেব বলেছিলেন, সে-বিষয়ে তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। তবে আমাকে সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে। আমায় যে যেতে হবে সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আজ, কাল কি হয়তো দু’দিন দেরি হতে পারে–এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি কি করে আর তোমাদের ভরসা দিতে পারি বলো? তোমাদের যখন প্রথম নিয়ে আসি, সেইদিনই এ-কথা বলে রেখেছিলুম–কিন্তু আমার আশা ছিল, মা আরও কিছুদিন বাঁচবেন। তিনি আর বছরখানেক বাঁচলেও তোমাদের স্থিতি করে দিয়ে যেতে পারতুম, কিন্তু ঈশ্বরের তা ইচ্ছা নয়।

এবার পরেশদা মিনতির সুরে বললে, তোমাদের কাছে আমার একটি অনুরোধ এই যে, আমার কিছু একটা হেস্তনেস্ত হয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত তোমরা এইখানেই থাক। এবারের যাত্রায় যিনি আমার মা ছিলেন, পূর্ব-পূর্ব কোনো জন্মে তিনি তোমাদেরও মা ছিলেন। সেই সম্বন্ধে তোমরা আমার ভাই হও–তোমাদের কাছে আমার এইটুকু জোর নিশ্চয় খাটবে, কি বলো?

প্রতিজ্ঞা করলুম, তোমার কিছু না হওয়া পর্যন্ত আমরা এইখানেই থাকব। পরেশদা হেসে হেসে বললে, আশা করি, বেশিদিন তোমাদের ধরে রাখব না। শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা হতে লাগল। কথা হল ওই-দেশীয় ব্রাহ্মণেরা যখন ভোজনে বসবেন তখন আমরা অর্থাৎ ম্লেচ্ছ মছলি-খোর বাঙালি ব্রাহ্মণেরা কাছে আসতে পারব না। দূর থেকে ভোজনপর্বের তদারক করলে অবিশ্যি তাঁরা কোনো আপত্তি করবেন না। সেখানকার শ্রাদ্ধভোজী ব্রাহ্মণদের খবর দেবার ভার নিলেন পরেশদার ওই-দেশীয় দুজন বন্ধু।

পরেশদা যাঁর বাড়িতে থাকত, অর্থাৎ তার বাড়িওয়ালার কাছাকাছিই আর একটা বড় বাড়ি ছিল–সেই বাড়িটা খালি ছিল। ঠিক হল সেখানেই শ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মণ ভোজন ও খাবার-দাবার তৈরি সবই হবে। খাবারের মধ্যে পুরি, একটা আলু-কুমড়োর ঘ্যাঁট, হিং দিয়ে কাঁচা তেঁতুলের খাট্-মিঠা চাটনি আর লাড্ডু।

লাড্ডু কিরকমের হবে তাই নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে কি আন্দোলন! লাড্ডু-তৈরি সম্বন্ধে অনেকগুলি বিশেষজ্ঞ এসে উপস্থিত হলেন। কারু বাড়ি আগ্রা, কেউ-বা দিল্লির ওস্তাদ, কেউ-বা মথুরার, কেউ-বা সাণ্ডিলার কারিগর–লখনউয়ের কাছে সাণ্ডিলা বলে জায়গা আছে, সেখানকার লাড্ডু ভারত-বিখ্যাত। যা হোক, সবাই মিলে অনেক তক্কাতক্কি আলাপ-আলোচনা করে স্থির হল যে এক পোয়া ওজনের একহাজারটি লাড্ডু তৈরি হবে। এতে সওয়া-শো থেকে দেড়-শো টাকা খরচ হবে। লাড্ডু কিরকম হবে তার নমুনা একদিন ব্রাহ্মণেরা এসে বাড়িতে তৈরি করে আমাদের খাইয়ে গেল।

শ্রাদ্ধের দিন পরেশদা মাথা নেড়া করলে। বললে, তোমাদের আর মাথা কামাতে হবে না, শুধু শ্রাদ্ধ করলেই চলবে।

সেইরাত্রে সারারাত্রি ধরে আমরা পালা করে ভিয়েনের কাছে বসে রইলুম। পরদিন খুব সকালে যমুনায় স্নান করে আসা গেল। বেলা যখন আটটা–তখনও শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্ম শেষ হতে অনেক দেরি, তখন থেকেই ব্রাহ্মণেরা একে একে আসতে আরম্ভ করলেন। সাড়ে-ন’টা দশটার মধ্যেই বারোটি বিরাট মনুষ্য পর্বত এসে হাজির হলেন।

কিছুক্ষণ পরেই ব্রাহ্মণেরা ভোজনে বসে গেলেন। তাঁরা আমাদের বলতে লাগলেন, আমরা অতি উদার-মতাবলম্বী। তোমরা কাছে এলে আমাদের খাওয়া পণ্ড হবে না, অক্লেশে কাছে এসে আমাদের ভোজন দেখতে পার–তবে বাপু খাদ্যদ্রবে হাত-টাত দিও না যেন!

ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করবার জন্যে আগে থাকতেই অন্য ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করা হয়েছিল, তারা পরিবেশন করতে লাগল, আর আমরা দূর থেকে স্পর্শ বাঁচিয়ে তদারক করতে লাগলুম। ঘণ্টা-দুয়েক কেটে গেল, কিন্তু তখনও ব্রাহ্মণেরা সমান উৎসাহে লাড্ডু ওড়াতে লাগলেন। বাংলাদেশে কে কবে আধ মণ খেতে পারত বলে যাঁরা সেকালের গৌরব করেন, তাঁরা দয়া করে একবার এখানকার ব্রাহ্মণদের খাওয়া দেখে আসবেন–বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হবে না, খাওয়াবেন শুনলে তারা আপনিই এসে হাজির হবে।

পরেশদার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। ব্রাহ্মণেরা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে লাগলেন–খালি খাওয়ার গল্প। মথুরার চোবেরা কিরকম খেতে পারে, কোন্ কোন্ চোবে খেতে-খেতে আসনে বসেই দেহত্যাগ করেছিলেন–সেইসব মহাত্মাদের চরিত্র-কথা।

একদিকে পুরি তরকারি, বিশেষ করে লাড্ডু মণ-মণ উড়তে লাগল, অথচ তাঁদের ক্ষুন্নিবৃত্তির কোনো লক্ষণই নেই। বেলা প্রায় দুটো বাজল, তখনও তাঁরা খেইে চলেছেন–বোধ হয় তিন-চার-শো লাড্ডু চেখেই মেরে দিলেন। যদি খাবার কম পড়ে যায়–সেই ভয়ে কাছেই এক হালওয়াইকরের দোকানে কি কি মিষ্টান্ন মজুত আছে তার খোঁজ নিয়ে আসা গেল।

খাওয়া চলেছে–বেলা তখন প্রায় তিনটে। শীতের বেলা, রোদের ঝাঁজ কমে এসেছে। নিমন্ত্রিতদের কাছে বেইজ্জত হবার আশঙ্কায় আমরা সব কাঁটা হয়ে আছি। এমন সময় দেখা গেল, দরজা দিয়ে মাথা নীচু করে এক সন্ন্যাসী প্রবেশ করলেন। সন্ন্যাসীর বিরাট দেহ, বোধ হয় সাত ফুট উঁচু ও সেই অনুপাতে দেহের পরিধি, তার ওপরে মাথায় প্রকাণ্ড জটা। সন্ন্যাসীর পেছনে আর একজন ঢুকল–যার মুখখানা একটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা, শুধু চোখদুটো খোলা রয়েছে।

এই লোকটাকে দেখেই আমি বুঝতে পারলুম–এই হচ্ছে সেই জুগনু, যার কথা পরেশদার মুখে আগেই শুনেছি। পরেশদা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে চেয়ে দেখলুম, ঠিক সম্মোহিত ব্যক্তির মতন দৃষ্টিহীন চোখে সে চেয়ে রয়েছে। সন্ন্যাসী চারিদিকে চেয়ে অতি মধুর কণ্ঠে বললেন, কাঁহা হ্যয় মেরা বেটা পরেশনাথ?

পরেশদা ধীরপদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসীকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। তার পরে সে উঠে দাঁড়াতেই সন্ন্যাসী দু’হাত বাড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে আমাদের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালেন, তারপরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন–জুগনু তাঁদের পেছু পেছু বেরিয়ে গেল। জুগনুর চলন দেখে মনে হল, সে যেন একটু খুঁড়িয়ে চলে।

উঠোন-ভর্তি লোক ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কারুর মুখ দিয়ে টু শব্দ পর্যন্ত বেরুল না।

ব্রাহ্মণভোজন তখনও চলেছে। আরও ঘণ্টাখানেক ধরে খেয়ে সমস্ত খাবার নিঃশেষ করে পান চিবোতে চিবোতে যখন তাঁরা বেরুলেন, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।

এ-বাড়ির কাজকর্ম মিটিয়ে ও-বাড়ি অর্থাৎ পরেশদা যেখানে থাকত সেখানে গিয়ে দেখি, সব ভোঁ-ভোঁ–কেউ কোথাও নেই। আমরা আলো জ্বালিয়ে বাজার থেকে খাবার এনে খেলুম। আশা করেছিলুম যে, পরেশদা তার গুরুকে নিয়ে এখানেই এসেছে–অন্তত মাতৃশ্রাদ্ধের দিনটাতে সে চলে যাবে না। কিন্তু শেথায় সে? রাত্রি দ্বিপ্রহর অবধি অপেক্ষা করে আমরা শুয়ে পড়লুম।

ভোর হতেই বাড়িওয়ালার সঙ্গে পরামর্শ করবার জন্যে তাকে ডাকা হল। পরেশদা যখন সন্ন্যাসীর সঙ্গে বেরিয়ে যায়, সেও সেখানে উপস্থিত ছিল। আমরা তাকে বললুম, এবার আমরাও চলি। কারণ আমরা ছিলুম পরেশদার আশ্রিত লোক। সে-ই যখন চলে গেছে, তখন আর আনাদের এখানে থাকার কোনো মানে হয় না।

বাড়িওয়ালা জিজ্ঞাসা করলে, পরেশবাবু কি আর আসবেন না? আপনারা ঠিক জানেন?

— ঠিক জানি।

বাড়িওয়ালা বললে, আচ্ছা, আপনারা আজকের দিনটা তো থাকুন এখানে।

সেদিন বাড়িওয়ালা আপিস থেকে ফিরে আসবার পর তাকে ডেকে পরেশদার সমস্ত মালপত্র জিম্মা করে দিয়ে পরদিন সকালে আমরাও সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লুম।

বেরিয়ে তো পড়লুম, এখন যাই কোথায়? যে বাড়িখানা আমরা ভাড়া নেব বলে ঠিক করেছিলুম, দেখলুম তখনও সেটার দরজায় তালা দেওয়া রয়েছে। বাড়িওয়ালার কাছে চাবি চাইতে গেলে এবারে সে আর সহজে ছাড়লে না, একটি মাসের ভাড়া আগাম নিয়ে নিলে। যা হোক, আমরা বাড়িতে গিয়ে ধোওয়া-মোছা করে তিনজনের জন্যে তিনখানা দড়ির খাঁটিয়া কিনলুম। সেদিন আর রান্নাবান্নার হাঙ্গামা না করে একটা দোকানে কচুরি-জিলিপি মেরে সারাদিন তাজমহলে কাটিয়ে দেওয়া গেল। সন্ধ্যার একটু আগে পরেশদার বাড়িতে খবর নিয়ে জানা গেল, সে এখনও ফেরেনি। বাড়ির দিকে যেতে যেতে একজায়গায় দেখলুম, একটা লোক রাস্তার ওপরেই একটা টেবিল পেতে তাতে চায়ের কাপ, বোতল-ভর্তি বিস্কুট প্রভৃতি সাজিয়ে রেখেছে।

আগ্রায় এসে অবধি চা পেটে পড়েনি। এসব জায়গায় সে-সময়ে চা-খাওয়ার তেমন চলন ছিল না। শীতকালে কোনো কোনো ইংরেজি-ভাবাপন্ন শৌখিন মাঝে-মাঝে চা খেতেন বটে, কিন্তু রাস্তাঘাটে চায়ের দোকান বড় একটা পাওয়া যেত না। সে-সময়ে কলকাতা শহরেই দু-চারটে মাত্র চায়ের দোকান দেখতে পাওয়া যেত। চা দেখে আমাদের মহাপ্রাণী উল্লসিত হয়ে উঠল। তখুনি দোকানদারকে তিন কাপ চায়ের হুকুম করে চেয়ারে বসে পড়া গেল। একটু পরেই দোকানদার ঝকঝকে পাত্রে আমাদের চা এনে দিলে। বেশ আরাম করে চা খাচ্ছি ও রাস্তার নানারকম ফেরিওয়ালার মজাদার বুকনি শুনছি–এমন সময় এক বাঙালি ভদ্রলোক দেখলুম গট্ গট্ করে হেঁটে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে সোজা আমাদের কাছে এসে বললেন, মশাই, আপনাদের দেখে তো বাঙালি হিন্দু বলে বোধ হচ্ছে!

আমরা বললুম, হ্যাঁ, আপনার অনুমান ঠিকই হয়েছে।

ভদ্রলোক কণ্ঠস্বরে একটু ধমকের রেশ মিশিয়ে বললেন, আপনারা করছেন কি? উঠে আসুন–উঠে আসুন–

বললুম, এখনও চা খাওয়া শেষ হয়নি যে!

–তা হোক, চলুন আমাদের বাড়িতে, সেখানে চা খাবেন।

এই বলে ভদ্রলোক পকেট থেকে চারটে পয়সা বের করে দোকানদারকে দিয়ে চোস্ত উর্দুতে তাকে বললেন, মাপ করো ভাই, এরা আমার আপনার লোক, এদের নিয়ে যাচ্ছি বলে কিছু মনে করো না।

আমরা পুরো কাপ শেষ করতে পারিনি–প্রত্যেকের কাপেই অর্ধেকটা চা তখনও রয়েছে। আমরা শশব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লুম। দোকানদার অবাক হয়ে একবার আমাদের দিকে আর একবার সেই ভদ্রলোকের দিকে চাইতে লাগল।

লোকটি দেখতে খুবই মোটা, লম্বাও মন্দ নয়। বয়স পরে শুনেছি ত্রিশ বৎসর, কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে চল্লিশের কম মনে হয় না। মাথার চুল উঠতে আরম্ভ করেছে। মুখে খুব বড় একজোড়া গোঁফ, দাড়ি কামানো। ধুতি মালকোঁচা করে পরা, কিন্তু দৈহিক স্থূলত্বের দরুন তা প্রায় হাঁটুর ওপরে উঠেছে। গায়ে গেঞ্জির ওপরে খুব পাতলা মসলিনের মতন সাদা কাপড়ের ঢিলে-হাতা পাঞ্জাবি। জামাও কুঁচকে-কুঁচকে নানা স্থানের মাংসপিণ্ডের চাপে–মনে হয় ছোট হয়েছে। এর ওপরে পাট-করা একখানা সিল্কের চাদর পৈতের মতন করে বুকে বাঁধা। সেই পশ্চিমের শীতে ভদ্রলোকের অঙ্গে র‍্যাপার তো নেই-ই বরং দেখলুম তাঁর কপাল ও মুখ বিন্দু-বিন্দু ঘামে ভর্তি। এক-মুখ পান রয়েছে–গালফোলা সে-অবস্থা দেখলেই বুঝতে পারা যায় যে, দোক্তা টানার অভ্যেস আছে।

ভদ্রলোকের সঙ্গে কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর তিনি বললেন, আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে এখানকার লোক নন। যা হোক, ওখানে চা খেতে আছে! জানেন, লোকটা মুসলমান!

তখন হিন্দু পানি-পাঁড়ে ও মুসলমান-ভিস্তির যুগ! আমাদের দেশোদ্ধার-কল্পে নেতারা হিন্দু-মুসলমান-মিলনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে যতই গলাবাজি করুন না কেন, প্রকাশ্যে মুসলমানের দোকানে বসে পানাহার চালানো তাঁরাও তখন কল্পনা করতে পারেননি। বিশেষ করে যুক্তপ্রদেশের মতন জায়গায় হিন্দুরা সুদূর ভবিষ্যতেও এ-ব্যাপার সম্ভব হবে বলে মনে করতে সাহসী হত না। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমরা বললুম, তাতে কি হয়েছে মশায়! আমরা হিন্দু-মুসলমানে ভেদাভেদ মানি না। এই করেই তো আমাদের দেশ উচ্ছন্নে গেল।

আমাদের মুখ থেকে এমন উত্তর ভদ্রলোক আশা করেননি। তিনি কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করে বললেন, খুব সত্যি কথা, আপনারা যা বলছেন তা খুবই সত্যি কথা। কিন্তু আমি বেশ ভালো করে জানি যে, ওই দোকানদার বিলিতি চিনি ব্যবহার করে। আপনারা বিলিতি চিনি নিশ্চয় ব্যবহার করেন না!

–নিশ্চয়ই না।

–যাক্ গো, যা দু-এক ঢোক পেটে গিয়েছে তার আর কি হবে! অজাতে খেলে কোনো দোষ নেই।

আরও কিছুদূর এগিয়ে ভদ্রলোক বললেন, চলুন আমাদের বাড়িতে, সেখানে চা খাবেন। চলতে চলতে ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে পৌঁছনো গেল। সেখানে পরস্পরের পরিচয় গ্ৰহণ করা হল। ভদ্রলোক তাঁর নাম বললেন শ্রীসত্যসেবক চক্রবর্তী। তাঁর বাবা সরকারি উচ্চ কর্মচারী ছিলেন। তাঁরা পুরুষানুক্রমে পশ্চিমেই বাস করেন। কাশীতে বাড়ি-ঘর আছে, কিন্তু এ-জায়গাটা বাবার ভালো লাগে আর জিনিসপত্রও কাশীর চেয়ে সস্তা, তাই এইখানেই তাঁরা বাস করেন। তাঁরা তিন-চারটি ভাই, কেউ এম. এ., কেউ বি. এ., দুজন এখানেই চাকরি করেন, তিনি কিন্তু কিছুই করেন না।

কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝতে পারলুম অর্থাৎ তিনি বুঝতে দিলেন, আপাতত তিনি পরের উপকার করে বেড়ান, স্বদেশসেবাও কিছু কিছু করে থাকেন, তবে গোপনে। আমরা নেহাত সদ্য বাংলাদেশ থেকে আসছি আর তিনি লোক দেখলেই চিনতে পারেন–এই কারণেই ‘স্বদেশসেবা’র কথাটি আমাদের কাছে প্রকাশ করলেন।

কথাবার্তার মধ্যে ভদ্রলোক একবার বললেন, আপনারা আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, আমি আপনাদের ‘তুমিই বলব–অবিশ্যি যদি কোনো আপত্তি না থাকে।

এতে আমাদের আর কি আপত্তি থাকতে পারে! তখন থেকেই আমরা তাঁকে ‘সত্যদা’ বলে ডাকতে আরম্ভ করে দিলুম, আর তিনি আমাদের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ বাদেই চা আর তার সঙ্গে কিছু মিষ্টি এল। খাবার খেতে খেতে পরেশদার কথা উঠল–দেখলুম, পরেশদার সঙ্গে সেখানকার কোনো বাঙালির পরিচয় না থাকলেও তার বিস্ময়কর অন্তর্ধানের খবরটি সকলেই জানে। যা হোক, আহারাদির পর আমরা তখনকার মতন বিদায় নিলুম। কথা রইল কাল বেলা সাড়ে-তিনটের সময় আমরা তাঁর কাছে আসব, তিনি আমাদের সেখানকার কোনো কোনো বাঙালি বাসিন্দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।

পরের দিন সত্যদা আমাদের একটি আড্ডায় নিয়ে গেলেন। এখানে আগ্রা শহরের প্রায় .অধিকাংশ বাঙালিই সন্ধেবেলা এসে জমায়েত হন। সেদিন কি-একটা ছুটি থাকায় আড্ডায় জনসমাগম অন্য দিনের চেয়ে বেশি হয়েছে। আমরা যখন উপস্থিত হলুম, তখন তাঁদের মধ্যে সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরেশদার অন্তর্ধান নিয়ে খুব জোর আলোচনা চলেছে। আমরা যাবার একটু পরেই সে-আলোচনা থেমে গেল।

সেই সভায় উপস্থিত প্রায় সকলেই সত্যদার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, কিন্তু সত্যদা তাঁদের সঙ্গে বেশ সমানভাবেই কথাবার্তা বলতে লাগলেন। একটু পরেই একজন মুরুব্বি-গোছের ভদ্রলোক আমাদের দেখিয়ে সত্যদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তার পরে সত্য, এই বালখিল্যদের জোগাড় করলে কোথা থেকে?

সত্যদা বেশ রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে বললেন অনেকদিন থেকেই এদের এখানে চলে আসবার জন্যে লেখালেখি করছিলুম, কিন্তু বাবুরা আর সময় করে উঠতে পারছিলেন না। সম্প্রতি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বড়ই জ্বালাতন আরম্ভ করায় দিনকতক একটু গা-ঢাকা দেবার প্রয়োজন হয়েছে। লিখলুম, এখানে কোনো শালা কিছু করতে পারবে না, পত্রপাঠ চলে এস। তাই চলে এসেছে। এখন কিছুকাল থাকবে এখানে।

সত্যদার কথায় উপস্থিত সকলে–আমরা সুদ্ধু–চনমনিয়ে উঠলুম। আড্ডার যাঁরা এতক্ষণ আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে পরম উদাসীন হয়ে বসে ছিলেন তাঁরাও বিস্ফারিত লোচনে আমাদের দেখতে লাগলেন। সত্যদা গোপনে অথচ সশব্দে পাশের লোকটিকে বলতে লাগলেন, গুদের কথা তো আগে কতবার বলেছি তোমাদের। কি সব ছেলে! এক-একটি হিরের টুকরো বললেই হয়। যেমন ঘোড়ায় চড়তে পারে, তেমনি সাঁতারে ওস্তাদ। বন্দুক দাও–একশোর মধ্যে একশোটাই ‘বুলস্ আই’-এ হিট করবে। তেমনি তিরধনুক বলো, তলোয়ার বলো–কিছুতেই কম যাবে না। ওই যে সেদিন–বলে সত্যদা কণ্ঠস্বর একটু নামিয়ে বলতে লাগলেন, একজন পুলিসে-অফিসার খুন হল–বলেই চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন।

সকলে বিস্ময়মিশ্রিত সম্ভ্রমের সঙ্গে আমাদের দেখতে লাগলেন। বোধ হয় তাঁরা আমাদের চেহারা ও বয়সের সঙ্গে সত্যদা-বর্ণিত গুণাবলীর মিল খুঁজতে লাগলেন। আড্ডার দু-একজন লোক একটু একটু করে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ মশায়, শুনেছিলুম যে কোন বাঙালির নায়কত্বে একলক্ষ নাগা সন্ন্যাসী নাকি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে আছে–একি সত্য কথা?

সত্যদা একটু দূরে বসে আর-একদলের সঙ্গে কি সব বলাবলি করছিলেন, সেই নাগা সৈন্যদের কথা কানে যাওয়া মাত্র তিনি সেখানে থেকেই বলে উঠলেন, ওদের কোনো কথা জিজ্ঞাসা করো না, কারণ কোনো কথা প্রকাশ করা ওদের বারণ আছে। আমাকে জিজ্ঞাসা কর। তারপর বললেন, হাঁ, নাগা সন্ন্যাসীদের কথা যা শুনেছ, তার সবটা সত্যি না হলেও বারো-আনা সত্যি–যা রটে তার কিছু বটে।

একটু চুপ করে থেকে সত্যদা বলে উঠলেন, কিন্তু তোমাদেরও সব তৈরি হতে হবে। ঘরে

বসে আরাম চলবে না।

সবাই চুপ করে রইলেন।

সত্যদা সেদিন সেখানে বসে আমাদের সম্বন্ধে এমন-সব গাল-গল্প ছড়াতে লাগলেন যে, তাঁর উদ্ভাবনী-শক্তির প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমরা চমকে চমকে উঠতে লাগলুম। যা হোক, পরের দিন বিকেলবেলা আবার দেখা করতে বলে সেদিন তিনি বিদায় নিলেন।

যত দিন যেতে লাগল, সত্যদার আসল পরিচয় পেয়ে আমরা ততই মুগ্ধ হতে লাগলুম। এমন সার্থকনাম ব্যক্তি ইতিপূর্বে অন্তত আমার চোখে আর পড়েনি। নাম ছিল তাঁর সত্যসেবক, কিন্তু সত্যের ত্রিসীমানার মধ্যে তিনি চলাফেরা করতেন না। শুধু তাই নয়, এমন সবজান্তা ব্যক্তি ও সংসারে দুর্লভ। সত্যদাকে যখন যা জিজ্ঞাসা করা যেত, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তর পাওয়া যেত। একটা দৃষ্টান্ত দিই, আগ্রার কেল্লার চারিদিকে গভীর পরিখা আছে। তার পরেই খানিকটা ঘাসওয়ালা জমি ও তার পরে রাস্তা। পরিখার পরেই যে জমি আছে সেখানে একজায়গায় লাল পাথরের একটা ঘোড়ার মূর্তি আধখানা পোঁতা আছে–এখন আছে কি না তা বলতে পারি না, অন্তত সে-সময় ছিল। একদিন সত্যদাকে জিজ্ঞাসা করলুম, এই ঘোড়ার মূর্তিটা এখানে কেন সত্যদা?

সঙ্গে সঙ্গে সত্যদা উত্তর দিলেন, সম্রাট আকবর প্রতিদিন সকালে কেল্লার ছাত থেকে ঘোড়ায় চড়ে লাফ মেরে নীচের রাস্তায় পড়ে বেড়াতে যেতেন। ঘোড়া একেবারে পরিখার এ-পারে পড়ে মারত দৌড়–তার পরে পঞ্চাশ মাইল ঘুরে আবার তিনি কেল্লায় ফিরে আসতেন। একদিন এইরকম লাফ মারতে গিয়ে ঘোড়াটা আর পরিখা পার হতে পারলে না। পরিখার মধ্যে ছিল পাঁক, ঘোড়াটা সেই পাঁকের মধ্যে ডুবে মরে গেল আর সম্রাট তার ওপরে ছিলেন বলে বেঁচে গেলেন। বিশ্বাসী ঘোড়ার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ তার পাথরের প্রতিমূর্তি তৈরি করে তিনি ওইখানে স্থাপন করেছেন।

সত্যদা বলতেন, আমি প্রতিদিন সকালবেলা ছাতের ওপর বসে সূর্যের দিকে চেয়ে যোগ করি–সূর্যের দিকে চেয়ে আমার গুরুর দেওয়া মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকি। অনেকক্ষণ পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, আমি যেন একটা বিন্দুতে পরিণত হয়েছি। তার পরে হু-হু করে উড়তে উড়তে একেবারে চলে যাই সূর্যের কাছে। কখনও বা সূর্যটাই একটা বিন্দুর মতো হয়ে ছুটতে ছুটতে চলে আসে আমার কাছে।

একদিন সুকান্ত ন্যাকা সেজে বলে ফেললে, আচ্ছা সত্যদা, সূর্যটা কিরকম?

সত্যদা অমনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ওঃ সে একেবারে জবাকুসুম সংকাশং–!

সত্যদা বললেন আগে আমাদের দেশে সূর্যে যাওয়ার ব্যাপারটা খুবই চলতি ছিল-তা না হলে কি সূর্যসিদ্ধান্তের মতন বই লেখা যায়?

সে-সময় তাজমহল ও কেল্লার পরিচর্যার জন্য একজন উচ্চশ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত হতেন। সে-সময়ে এই কাজে একজন ইংরেজ নিযুক্ত ছিলেন। তাজমহলের বাগানটি তাঁর দেখাশোনার ফলে খুবই সুন্দর হয়ে উঠেছিল। সে-বাগানের গাছের ফুল ফল বা পাতা ছেঁড়া বারণ ছিল। যেসব জায়গায় গাছ ছিল না, সেখানকার ঘাস সর্বদা এমন পরিষ্কার ও সমান করে ছাঁটা থাকত যে সেদিকে চেয়ে দেখতে হত। আমাদের দেশীয় লোকেরা তাজ দেখতে গিয়ে দলে দলে এইসব ঘাস-জমিতে বসততা আর ঠোঙা, পাতা, শিশুদের ময়লায় জায়গাগুলো অত্যন্ত নোংরা করে দিয়ে চলে যেত। সেই ইংরেজ পরিদর্শক এইসব নোংরামিতে আপত্তি করত এবং মাঝে মাঝে চাবুক হাতে লোক তাড়া করত–কখনও ‘কখনও বা এর তার ঘাড়ে দু-এক ঘা চাবুক বসিয়েও দিত।

একদিন সত্যদা বললেন, কাল তোমাদের রিভলভার দেব। এই লোকটা রোজ সন্ধেবেলা যমুনার পোলের ওপর বেড়াতে আসে, ব্যাটাকে সাবড়ে দাও।

সত্যদার প্রস্তাব শুনে বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে লাগল। মনে হল, বেশ তো নাগা সন্ন্যাসী নিয়ে দিন কাটছিল–কিন্তু এসব আবার কি! বললুম, অনেক-দিন রিভলভার-চালানো অভ্যেস নেই যে দাদা!

সত্যদা বললেন, আচ্ছা, আগে দিনকয়েক ভালো করে অভ্যেস করে নাও। কাল রিভলভার নিয়ে যাওয়া যাবে প্র্যাকটিশ করতে।

.

সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে রিভলভার সম্বন্ধে পরামর্শ করি আর ভয়ে গায়ে কাঁটা দিতে থাকে। ভাবতে থাকি যে, আমরা কি মনে করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম আর কি হল! দিব্যি চাকরি-বাকরি করব, সুখে শান্তিতে খাব-দাব, জীবনযাত্রা নির্বাহ করব, তা নয়–রিভলবার কি রে বাবা! খুন-খারাপি রক্তপাত এসবের প্রতি আমাদের কারোরই কোনো আকর্ষণ ছিল না। মনে-মনে আমরা যে খুব অহিংসা অথবা বৈষ্ণবভাবাপন্ন ছিলুম তা নয়। আমরা কল্পনা করতুম, যুদ্ধের পোশাক পরে, বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে দল বেঁধে ‘বন্দে মাতরম্’ গাইতে গাইতে যুদ্ধে চলেছি, মেয়েরা এসে গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছে–দেশের জন্যে সেরকম ভাবে মরার মধ্যে সমারোহ আছে, মাদকতাও আছে। কিন্তু রিভলভার নিয়ে লুকিয়ে একজনকে হত্যা করে পলায়ন করা তারপরে ধরা পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা–সে-কথা যে কল্পনা করতেও ভয় লাগে। অবিশ্যি অন্য কেউ সে-কর্ম করলে তাকে প্রাণ খুলে তারিফ করতে পারি–কিন্তু নিজের হাতে হত্যা! ব্যাস্ রে!

সত্যি কথা বলতে কি, রাত্রে বার বার ফাঁসির স্বপ্ন দেখে চমকে উঠতে লাগলুম। পরের দিন ভয়ে ভয়ে সত্যদার বাড়িতে গেলুম। কিন্তু কোথায় কি? কালকের রিভলভার আজ গাঁজার কলকেতে পরিণত হয়েছে। সত্যদার সে-কথা মনেও নেই–আমরাও খুঁচিয়ে আর তা মনে করিয়ে দিলুম না।

দিনকয়েক চেপে থেকে একদিন জিজ্ঞাসা করে ফেললুম, সত্যদা, সেই রিভলভারের কি হল?

সত্যদা অমনি বললেন, দেখ হে, ব্যাটার আয়ু কিছু বেড়ে গেছে। গুরুদেব রিভলভার চালাতে বারণ করেছেন। ওঁদের মারবার একটা নতুন কায়দা তিনি বলে দিয়েছেন। শুধু আগ্রায় নয়, সারা ভারতবর্ষে যেখানে যত ইংরেজ ও সাদাচামড়া আছে তাদের বাবুর্চিদের জোগাড় করতে হবে। ব্যাটাদের খাবারের সঙ্গে বাঘের গোঁফ মিশিয়ে দিলে রক্ত-আমাশা হয়ে ঠিক তিনদিনে সব সাফ হয়ে যাবে–শিবের বাবাও রক্ষা করতে পারবে না।

যুদ্ধের এই অভিনব অস্ত্রের কথা শুনে আমরা যে কি পর্যন্ত আশ্বস্ত হলুম তা কি বলব! যাক্, রিভলভারের হাত থেকে আপাতত উদ্ধার পাওয়া গেল।

সত্যদা বলতে লাগলেন, ভারতবর্ষের সমস্ত দেশীয় রাজ্যে খবর পাঠানো হয়েছে–বাঘের গোঁফ জোগাড় হচ্ছে। ওদিকে কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ ইত্যাদি জায়গায় বড় বড় হোটেলের বাবুর্চিদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ চলেছে–দেখ-না কি হয়!

রিভলভার না পাওয়ার কারণ শুনে আমরা যে খুবই নিশ্চিন্ত ও আশ্বস্ত হলুম, তা বোধ হয় বুঝিয়ে বলবার দরকার হবে না। সত্যদা বলতেন, তিনি গুরুর আদেশ ছাড়া কোনো কাজ‍ই করেন না। গুরুদেব থাকেন হিমালয় পাহাড়ের কোন্ শিখরে, নিভৃত এক গুহার মধ্যে। সে স্থান এতই দুর্গম–মানুষ তো দূরের কথা, এমনকি পিঁপড়ে পর্যন্ত সেখানে পৌঁছতে পারে না। কিন্তু গুরুর কৃপায় সত্যদার যখনই দরকার হয় তখনই একনিমেষে সেখানে পৌঁছে যান– অবিশ্যি সূক্ষ্ম শরীরে। গুরু নাকি মাঝে মাঝে স্বপ্নে তাঁকে দেখা দিয়ে থাকেন। তিনি এ-কথাও বলে দিয়েছেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হতে আর দেরি নেই।

ওখানকার বাঙালিরা ছাড়া ওই-দেশবাসী অনেক লোকও সত্যদাকে চিনত এবং অনেক ধনী ব্যক্তি তাঁকে খাতিরও করত। আমি এ পর্যন্ত অনেক বাঙালিকে ভালো উর্দু বলতে শুনেছি, কিন্তু সত্যদা যখন ওই-দেশীয় লোকদের সঙ্গে হৈ-হৈ করে কথা বলতেন তখন বুঝতে পারা যেত না, উর্দু তাঁর মাতৃভাষা নয়।

ওই-দেশীয় লোকদের নানা আড্ডায় সত্যদা আমাদের নিয়ে গিয়ে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিতেন। কোথাও বলতেন–সরকারি কলেজের ইংরেজ অধ্যাপক ঠেঙিয়ে আমরা পালিয়ে এসেছি, কোথাও বা বলতেন–লেফটেন্যান্ট গবর্নর ফুলারকে সেলাম করিনি বলে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মোট কথা, আমরা যে কেওকেডা লোক নই সে-কথা অনেকেই জেনে গেল। সত্যভাষণ সম্বন্ধে সত্যদার মনোভাব যাই হোক-না কেন, এমনিতে তাঁর ব্যবহার ছিল খুবই মিষ্টি ও অমায়িক। তা ছাড়া, আমাদের বড় ভালোবাসতেন–কাজেই কয়েক দিনের মধ্যেই আমরাও তাঁর খুবই অনুগত হয়ে পড়লুম।

আমাদের মতনই ওই-দেশীয় দুটি যুবক ছিল সত্যদার মহাভক্ত, তারা দুজনেই ছিল কলেজের ছাত্র। একজনের নাম বিরিজনাথ আর একজনের নাম হোতিলাল। এরা যেদিন আসত, সেদিন আমরা অন্য কোথাও না গিয়ে সত্যদার বৈঠকখানাতেই আসর জমাতুম।

সে-সময়ে বাংলাদেশের বাইরে বাঙালিদের খুবই খাতির ছিল। বিশেষ করে ‘স্বদেশী’র কোনো-কিছুতে যুক্ত ব্যক্তিকে লোকে খুবই সম্ভ্রমের চোখে দেখত। সত্যদার কাছে আমাদের ওইরকম পরিচয় পেয়েই হোক কিংবা বয়সের ধর্মেই হোক, প্রথম দিনেই বিরিজনাথ ও হোতিলালের সঙ্গে আমাদের খুবই ভাব জমে গেল। আলাপের দু-তিন দিন পরেই একদিন বিরিজনাথ আমাদের জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা, বাঙালিরা তো বোঙা (বোমা) তৈরি করতে খুবই ওস্তাদ–বলি, কিছু জানা-টানা আছে?

সুকান্ত বললে, জানা নেই, তবে তোমার দরকার থাকে তো ফরমূলা আনিয়ে দিতে পারি।

তারপরে শোনা গেল বিরিজনাথ বোমা তৈরি করতে একজন ওস্তাদ। শোনা গেল বিরিজনাথরা ছোটখাটো জমিদার। শহরে বোমা তৈরি করে দেশে নিয়ে গিয়ে তার পরীক্ষা করে। তার তৈরি বোমায় একটা ছোট খোলার ঘর একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। বিরিজনাথ কথায় কথায় বলত, মার্ দুঙ্গা শালেকো এক বোঙা ইত্যাদি।

ব্যাপার দেখে তো আমরা মনে-মনে পরমাদ গুনতে লাগলুম। আগ্রা শহরে কেল্লা ও তাজমহলের মাঝামাঝি জায়গায় একটা চমৎকার বাগান আছে-বাগানটি সে-সময় তৈরি হচ্ছিল। বাগানটির নাম ছিল ভিক্টোরিয়া গার্ডেনস্। ভারতবর্ষের অনেক শহরেই তখন ভিক্টোরিয়া গার্ডেনস্ ছিল। এখনকার কথা বলতে পারি না, কিন্তু সে-সময় আগ্রার ভিক্টোরিয়া গার্ডেনস্ে চমৎকার একটি ভিক্টোরিয়ার প্রতিমূর্তি ছিল। প্রতিমূর্তির চারিদিকে ফোয়ারা, তারই মাঝখানে জলের মধ্যে মূর্তিটি খাড়া করা ছিল। একদিন বিরিজনাথ কোথা থেকে হস্তদন্ত হয়ে এসে বললে, আজ রাত্রে বোঙা মেরে ভিক্টোরিয়ার ওই মূর্তিটি সে উড়িয়ে দেবে। সে কোথা থেকে বোমা তৈরি করবার একটা নতুন ফরমূলা পেয়ে বোমা তৈরি করেছে। আজ রাত্রে তার পরীক্ষা হবে।

সর্বনাশ! বিরিজনাথের সঙ্কল্প শুনে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছে উঠল। সত্যদা আধ মিনিট-টাক্ চোখ বুজে থেকে বললেন, গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা না করে আমি হাঁ কিংবা না কিছুই বলতে পারি না।

হোতিলাল কিন্তু মহা আপত্তি করতে লাগল। সে বললে, মিছিমিছি এসব জিনিস নষ্ট করে কি হবে? কারণ একদিন-না-একদিন এখানকার সব ছেড়ে ছুঁড়ে ব্যাটাদের লম্বা দিতেই হবে–তখন এসব তো আমাদেরই হবে।

বিরিজনাথ বলত, আজ হাসপাতাল উড়িয়ে দেব, কাল স্টেশন উড়িয়ে দেব, ইত্যাদি। যমুনার ওপরে দোতলা পোলটার ওপর তার আক্রোশ ছিল সব-থেকে বেশি। কিন্তু হোতিলাল তাকে বাধা দিয়ে বলত, আরে ইয়ার, যানে দো–

আজ মনে হচ্ছে, হোতিলালের দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। কারণ সাজা হুঁকো হাতে পেয়েও কর্তারা যা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছেন তাতে মনে হয়, ঢেলে সাজতে হলে না-জানি এঁরা কি কেলেঙ্কারিই না করতেন! কিন্তু দূরদৃষ্টি প্রখর থাকলেও বন্ধু হোতিলালের নিকট-দৃষ্টি কম ছিল, কারণ কয়েক বছর পরেই বিপ্লবীদের সঙ্গে মিশে কোথায় বোমা মেরে সে ধরা পড়ে, এবং ফলে তার দ্বীপান্তর না ফাঁসি হয়েছিল তা ঠিক মনে পড়ছে না।

সত্যদার কল্যাণে আমাদের মান, ইজ্জৎ ও যশের মাত্রা যেমন বাড়তে লাগল, সেই অনুপাতে তবিলের সিকি-দুয়ানির সংখ্যা কমতে লাগল। বিস্কুটের টিন খালি হয় হয়–এমন অবস্থায় সত্যদাকে একদিন বলে ফেললুম, এবার অর্থ উপায়ের একটা সুরাহা না করলে তো চলে না দাদা।

আমাদের কথা শুনে সত্যদা বললেন, এর আর কি! তোমরা কিছু ভেবো না, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।

সত্যদা পরামর্শ দিলেন, আগে তোমরা বাড়িটা ছেড়ে দাও। আমি একটা ডেরা তোমাদের ঠিক করে দিচ্ছি, আপাতত সেখানে গিয়ে ওঠ। মাস পোয়ালেই বাড়িভাড়ার ভাবনাটা তো আর ভাবতে হবে না। তার পরে ধীরে সুস্থে একটা ব্যবসা-ট্যাবসা লাগিয়ে দিচ্ছি।

পরদিন সত্যদা আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুটি ওইদেশীয় লোক, একজন ধনী ব্যবসাদার। সত্যদা প্রথমে ভদ্রলোকের কাছে আমাদের খুব তারিফ করে, শেষকালে বললেন, এরা এখন কিছুকাল এ-দেশে থাকবে। তোমার বাড়ির পেছনদিকে–সেই অমুক ব্যক্তি যেখানটায় থাকত–সেটা খালি আছে?

ভদ্রলোক বললেন, খালি নেই, কিন্তু তাতে কি! তোমরা বন্ধুরা থাকবেন–এ তো আমার ভাগ্যের কথা। আমি এখনি খালি করিয়ে দিচ্ছি।

দিন-দুই পরে আমরা ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ডেরায় উঠে এলুম। একটা বড় ঘর। রাস্তার দিকে অর্থাৎ সামনেই খানিকটা বারান্দা আছে। বাড়ির ভেতর থেকে এ-ঘরে আসবার দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একতলায় খানিকটা উঠোন ও একটা ছোট-মতন ঘর, সেটাকে আমরা রান্নাঘর করলুম। বাড়িতে ঢোকবার দরজা সিঁড়ি সবই আলাদা। আসল বাড়ির খানিকটা অংশ হলেও ব্যবস্থা সবই আলাদা।

আমাদের অর্থ ফুরিয়ে আসছে দেখে আমরা শুধু ঘি দিয়ে ভাত আর আলুভাতে খেতে আরম্ভ করে দিলুম। কথায় বলে–বড়লোকের এবং সেই বড়লোক যদি ভদ্রলোক হয়, তবে তার আওতায় থাকলে মানুষের অনেক কষ্টের লাঘব হয়। আমরা আসবার পর প্রায়ই আমাদের জন্যে কখনও মিঠাই, কখনও নানা রকমের আচার, কখনও পুরি প্রভৃতি আসতে লাগল। সত্যদার কল্পিত আমাদের অশেষ গুণের কথা সে-বাড়ির অন্তঃপুর আবধি পৌঁছেছিল এবং সেখান থেকে করুণার নির্ঝর খাদ্যে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে লাগল। মাঝে মাঝে আমরা মালিকের বৈঠকখানায় গিয়ে বসতুম। তিনি আমাদের খুব খাতির করতেন ও কলকাতার স্বদেশী আন্দোলনের ঘটনাবলী শুনতে চাইতেন। মধ্যে মধ্যে আমরা তাঁকে ‘বন্দে মাতরম্’, গান আবৃত্তি করে শোনাতুম। ভদ্রলোক বড় বড় দুটি চোখ বার করে সেই ধ্বনি শুনতেন আর বলতেন-সাবাস!

আমরা যে-ঘরে বাস করতুম ঠিক তার পাশের ঘরখানিতে দুপুরবেলা বাড়িওয়ালা শেঠদের বাড়ির মেয়েদের মজলিস বসততা। পাঁচ-সাতটি মেয়ে দুপুরবেলা কলরোল করে আমাদের দিবানিদ্রাটি মাটি করত। আমরা তাদের কথাবার্তা কিছু বুঝতে পারতুম, কিছু বুঝতুম না। তাদের দেখতে পেতুম না, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর ধরে আন্দাজ করতুম কে কিরকম দেখতে–কার কত বয়স হয়েছে। এই অদৃশ্য কুলবালাদের নামকরণও করেছিলুম একটা একটা করে। কেউ খন্‌খনে, কেউ ঝড়ঝড়ে, কেউ বাজখাঁই, কারুর নাম বা মিষ্টি গলা। মধ্যে মধ্যে বাড়িওয়ালাদের বাড়ির মেয়েরা দল বেঁধে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেড়াতে যেত–আমাদের চোখে পড়লে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতুম, কোনটি কে? সে-ঘরে মাঝে মাঝে মেয়েরা দশ-পঁচিশ খেলতে বসততা। মনে পড়ে সেইসব দিনে গোলমালের আর মাত্রা থাকত না। সে-সময় কখনও কখনও খনখনের সঙ্গে বাজখাঁইয়ের যেত ঝগড়া লেগে আর মিষ্টিগলা তাদের মাঝে পড়ে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করত–সুরে আর বেসুরে মিলে বিচিত্র ধ্বনির তরঙ্গ উঠত সেদিন। কোনো কোনো দিন ঘরখানা নিঃশব্দে পড়ে হা-হা করতে থাকত–সেদিন মনে হত, আজ দুপুরটা বৃথাই কাটল।

একদিন অনেক রাত্রে জনার্দন আমাকে ঠেলে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে ফিসফিস করে বললে, কিছু শুনতে পাচ্ছ?

কিছুক্ষণ কান খাড়া করে থেকে কিছুই শুনতে না পেয়ে বললুম, কই কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না–বাতিটা জ্বালাও না।

জনার্দন বললে, না, বাতি জ্বালিও না। কান পেতে থাক, এখুনি শুনতে পাবে।

কি আর করি! অন্ধকারে সজাগ হয়ে বসে রইলুম। কিছুক্ষণ বাদেই জনার্দন আমার গা টিপে বললে, ওই শোন।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি এতক্ষণ মনে করছিলুম হয়তো কোনো চোরের পদধ্বনি কিংবা সিঁদ-কাটা বা বাক্স-ভাঙার আওয়াজ পাব। কিন্তু সেই নীরন্ধ্র অন্ধকারের বুক ফুঁড়ে অতি ক্ষীণ নারীকণ্ঠের রোদনধ্বনি এল আমার শ্রবণে। অতি মৃদু,–কখনও শোনা যায়—-কখনও শোনা যায় না এমন সুরে কোনো নারী তার বুকের ব্যথা উজাড় করে দিচ্ছে। একটু পরেই বুঝতে পারলুম যে, কান্নার শব্দটা আসছে আমাদেরই পাশের ঘর থেকে–দিনের বেলায় কলহাস্যে যে-ঘর মুখরিত হয়ে ওঠে। বসে বসে কিছুক্ষণ কান্না শুনে শুয়ে পড়া গেল। তখনও কান্না থামেনি, এক-একবার সে-শব্দ বেড়ে উঠে করুন ঘুমপাড়ানি ছড়ার মতন হতে লাগল –সেই একঘেয়ে করুণ সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লুম।

তার পরের রাত্রে সজাগ হয়ে রইলুম, কিন্তু কোনো শব্দ শুনতে পেলুম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *