তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন
আমাদের চারপাশে অনেক ঘটনাই আছে যা আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও পরবর্তীতে তা পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। নেপোলিয়ন বা হিটলারের কাহিনী এক্ষেত্রে উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে। নবি মুহাম্মদের ইয়াসরিবযাত্রাকে দেখলে হয়তো একটি সাধারণ অভিবাসন ছাড়া কিছুই মনে হয় না, কিন্তু আরবের নিয়তি ও বিশ্ব-ইতিহাসের এক বিশাল পরিবর্তনের শুরু আসলে এর মাধ্যমেই হয়েছিল। নবির অভিবাসন-পরবর্তী ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির কারণ, পরিপ্রেক্ষিত ও সামাজিক প্রেক্ষাপট উদ্ধারে নিয়োজিত গবেষকদের গবেষণার দুয়ারও খুলে দিয়েছিল।
এই সকল বিষয়ের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিল, অন্যতম এই ঐতিহাসিক চরিত্রের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন। যদিও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের বিষয়টি অনেকের কাছে সন্তোষজনক নাও মনে হতে পারে। তাই একে মুহাম্মদের অন্তঃপুরুষের প্রস্ফুটন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। হিজরত তাই ঐতিহাসিক এক পটপরিবর্তনের সূচনা হয়তো করেছিল, তবে সেটা নবি মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনকে অনুসরণ করে হয়েছিল, যা নিবিড়ভাবে তুলনামূলক মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
তখন পর্যন্ত নবি মুহাম্মদ ধর্মানুগত ছিলেন এবং তার সময়ের অনৈতিক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতেন। তিনি ইহজগতের শেষসীমা এবং শেষ বিচারের দিনের চিত্রকে হাতের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। মক্কায় থাকাকালে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপর তার ধারণাকে ভিত্তি করে তিনি সঙ্গীদের মহাবিশ্বের স্রষ্টার বশে আনতে, সহিংসতা, অবিচার ও গরিবদের প্রতি অনাচার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। আর মদিনায় (ইয়াসরিব) যাওয়ার পর তিনি দূরদর্শী রাজনীতিবিদ এবং সুদক্ষ এক যোদ্ধার রূপ ধারণ করেছেন। যিনি তরবারি দিয়ে লড়াই করে সকল প্রতিরোধ ভেঙে নিজস্ব ধর্মের বিস্তার ঘটিয়েছেন এবং একটি রাষ্ট্রের প্রধান হয়েছেন। সময়ের আবর্তে একজন ত্রাণকর্তা মসিহ ডেভিডে (নবি দাউদ) পরিণত হতে পারেন। একজন মানুষ যিনি বিশ বছরেরও অধিক সময় একজন স্ত্রীর সঙ্গেই জীবনযাপন করেছেন, তিনিই পরে অধিক নারীসঙ্গ লাভ করেছেন।
ইংরেজ ঔপন্যাসিক এইচ জি ওয়েলসের মতে, মানুষ সর্বদাই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু এই পরিবর্তনের ধীর গতি এবং সহজে ঠাহর করতে না পারার কারণে আমরা একজন পঞ্চাশ বছর বয়স্ক মানুষের থেকে তেমনটাই আশা করি যেমনটা তিনি বিশের কোঠায় থাকতে করতেন। যেখানে ওই ব্যক্তি ধীরে লয়ে কিন্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছেন। বয়স বাড়লে তার শারীরিক সক্ষমতা যেমন হ্রাস পায় তেমনি তার মানসিকতা, সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে পরিপক্ক হয়ে ওঠে। একজন বিশ বছরের তরুণ আর একজন পঞ্চাশ বছরের ব্যক্তির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল প্রথমজনের থাকে প্রচণ্ড শারীরিক ও আবেগময় আকাঙ্ক্ষা আর দ্বিতীয়জনের থাকে অভিজ্ঞতা অর্জন ও চিন্তা করার মতো সময়। উপযুক্ত মনে হলেও এই ধারণটি সবসময় সত্যি হয় না এবং নবি মুহাম্মদের ক্ষেত্রেও তা ভুল ছিল। মদিনায় যাওয়ার পর যে বয়সে অধিকাংশ মানুষের শারীরিক ও মানসিক কর্মতৎপরতা কমতির দিকে থাকে, সেই ৫৩ বছর বয়সে এক নতুন মুহাম্মদকে দেখা যায়। মক্কায় তের বছর ধরে তিনি যেভাবে মানবতার বাণী প্রচার করে গেছেন, মদিনায় কাটানো জীবনের শেষ দশ বছরে তিনি আর তেমনটি ছিলেন না। আল্লাহর প্রতি অনুগত নবি এরপর তার নিজের গোষ্ঠীকে বশে আনতে ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর ওপর (যারা এতদিন তাঁকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে আসছিল) কর্তৃত্ব স্থাপনে শক্তিমান এক নবির রূপধারণ করেন। সুরা শোআরা-তে বলা হয়েছে : “তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক করে দাও।”(২৬:২১৪)। সুরা শুরা-তে বলা হয়েছে তুমি সতর্ক করতে পার নগরমাতার (মক্কার) অধিবাসীদেরকে ও তার আশেপাশে যারা বাস করে তাদেরকে… (৪২:৭)। মদিনায় তিনি সতর্ককারী রূপ ত্যাগ করেন, শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধের বর্ম পরিধান করেন, ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সমস্ত আরবকে এক পতাকা তলে নিয়ে আসার লক্ষ স্থির করেন।
যিশু এবং জেরেমিয়ার আধ্যাত্মিক ধর্মপ্রচারের কথা সারণ করিয়ে দেবার মতো এবং আত্মাকে জাগরিত করবার মতো মূৰ্ছনা ও কাব্য আমরা মক্কি সুরাগুলোর মধ্যে খুঁজে পাই। যার ছিটেফোঁটা দেখা গিয়েছে মদিনার সুরাগুলোর মধ্যে। কাব্যিক ও ছন্দময় সুরগুলো সেখানে আদেশমূলক নিয়ম-নির্দেশনার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। মদিনায় সকল নিয়ম ও নির্দেশনা একজন সেনাপতির মাধ্যমে প্রদান করা হত যিনি বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ক্ষমা করতেন না। আদেশ অমান্য, নিয়ম ভাঙা বা অবহেলার জন্য গুরুতর শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার° নবির এই আকসিক পরিবর্তনকে অভ্যন্তরীণ তাড়না হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আর অ্যাডলফ হারন্যাক একে অতিমানবের মনোকষ্ট এবং তার অসাধারণ শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ-ধরনের তাড়না মহান ব্যক্তিদেরকে সকল দ্বিধাবোধ, অবসাদ এবং নৈরাশ্য প্রতিরোধে সক্ষম করে তোলে। বাধা যতোই মৃত্যুসম হোক না কেন তা প্রতিরোধে তাদেরকে ভয়শূন্য করে তোলে। অন্য কোনো কিছু দ্বারা তাদের এই সাধারণ মানুষের চেয়ে অধিক অর্জনের কৃতিত্বকে ব্যাখ্যা করা যায় না। হিজরতের পরবর্তী সময়কালে নবি মুহাম্মদের মধ্যে আমরা যে পরিবর্তনসমূহ লক্ষ করি তা শুধুমাত্র সে সময়কার ঘটনাবলীর মাধ্যমেই নয়, মক্কা ও মদিনায় অবতীর্ণ বিভিন্ন সুরার মাধ্যমেও তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মক্কি সুরা মুজ্জামিল-এ নবিকে নিষেধ করা হয়েছে এই বলে যে: “লোকে যা বলে তাতে তুমি ধৈর্য ধরো, আর সৌজন্য সহকারে ওদেরকে এড়িয়ে চলো। বিলাসবস্তুর অধিকারী অবিশ্বাসীদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। আমার কাছে শিকল, জ্বলন্ত আগুন…’ ( ৭৩:১০১২)। তফসির আল-জালালাইনে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীদের প্রতি লড়াই এবং তাদেরকে হত্যা করার যে নির্দেশনা কোরানে দেয়া হয়েছে, তার পূর্বে অবিশ্বাসীদের সাথে শিষ্টাচার বজায় রেখে দূরত্ব মেপে চলার নির্দেশনা কোরানে নাজিল হয়েছে। এই বক্তব্যটি আরও বাস্তবসম্মতভাবে সত্য হবে, যদি বলা হয়ে থাকে নবি আউস ও খাজরাজ গোত্রের সহায়তা নিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করার পূর্বে সুরা মুজামিলের উক্ত আয়াতগুলি তৈরি হয়েছে। যখন নবি এবং তার সাহাবির কাছে তরবারি ভিন্ন আর কোনো কিছুই ভরসা করার মতো ছিল না, তখনই সুরা বাকারার (মাদানি সুরা) এই নির্দেশটি আসে: আর যেখানেতাদেরকে তোমরা পাবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করবে আর যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে, তোমরাও সেখান থেকে তাদেরকে বের করে দেবে। ফিৎনা হত্যার চেয়ে মারাত্মক। (২:১৯১)। অথচ মক্কি সুরা আনআম-এ আমরা দেখি উল্লেখ করা হয়েছে: ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকে, তাদেরকে তোমরা গাল দেবে না, তা হলে, তারা অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গাল দেবে। এভাবে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের চোখে তাদের কার্যকলাপ শোভন করেছি। তারপর তাদের প্রতিপালকের কাছে তারা ফিরে যাবে। তখন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকার্য সম্বন্ধে জানিয়ে দেবেন।’ (৬:১০৮)।
বহুবচন অর্থে প্রেরিত এই উপদেশ বাণীটি নবি এবং তার স্পষ্টবাক সাহাবি ওমর ইবনে আল-খাত্তাব কিংবা হামজা বিন আব্দুল মোতালেব, কার প্রতি প্রেরিত হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। যা হোক, মুসলমানদের ক্ষমতা যখন বৃদ্ধি পেল কুরাইশদের উপাস্য দেবতাদেরকে অভিশাপ দেয়াটা আর আটকে থাকল না। অবিশ্বাসীদের প্রতি শান্তিপূর্ণ ও আন্তরিকভাবে যোগাযোগকে নিষেধ করা হলো। মদিনায় অবতীর্ণ সুরা মুহাম্মদ-এর বক্তব্য অনুযায়ী তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, তোমরাই প্রবল, আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন, তিনি তোমাদের কর্মফল ক্ষুন্ন করবেন না। 🙁 ৪৭:৩৫)।
কোরানের একই সুরায় কখনো কখনো দুটি অসঙ্গতিপূর্ণ আয়াতের উপস্থিতি রয়েছে । সুরা বাকারা কালপঞ্জি অনুসারে নবির হিজরতের পর প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল, তবে এর দৈর্ঘ্য দেখে অনুমান করা যায় সম্পূর্ণ সুরাটি একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়নি। এক বা দুই বছরের বেশি সময় ধরে খণ্ডিত আকারে এটি অবতীর্ণ হয়েছে। সেই সময়ের প্রথমদিকে অবতীর্ণ হওয়ার উপাত্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। সৎপথ ভ্রান্তপথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং যে অসত্য দেবতাকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করবে সে এমন এক শক্ত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙবে না। (২:২৫৭)। অপরদিকে একই সুরার ১৯৩ নম্বর আয়াত, যা সম্ভবত মুসলমান সম্প্রদায় শক্তিশালী হবার পরে অথবা তাদের শক্তিশালী হবার সাথে সম্পর্কিত কোনো ঘটনার পরে অবতীর্ণ হয়েছিল, যেখানে শক্তি প্রয়োগের আদেশ দেয়া হয় এভাবে: তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিৎনা দূর হয় ও আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তারা যদি বিরত হয়, তবে জুলুমকারীদের ছাড়া কারও ওপর হস্তক্ষেপ করবে না। (২:১৯৩)। সুরা তওবা (সুরা আল-বারা নামেও পরিচিত) কালপঞ্জি অনুসারে কোরানের সর্বশেষ সুরা, এখানে শক্তিপ্রয়োগের আদেশকে অনস্বীকার্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে : (১) যাদের ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ- তে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও বিশ্বাস করে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে…। (৯:২৯) । (২) আত্মীয়স্বজন হলেও অংশীবাদীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবি ও বিশ্বাসীদের জন্য সংগত নয়। (৯:১১৩) । (৩) হে নবি! অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো ও ওদের প্রতি কঠোর হও। ওদের বাসস্থান জাহান্নাম। আর কী সে মন্দ পরিণাম!’ (৯:৭৩)। (৪) হে বিশ্বাসিগণ! অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ করো। আর তারা তোমাদের কঠোরতা দেখুক… (৯:১২৩)।
মদিনায় অবতীর্ণ সুরা তাহরিম-এর ৯ নম্বর আয়াতে একই ভাষায় বলা হয়েছে: হে নবি! অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো ও তাদের প্রতি কঠোর হও। ওদের আশ্রয়স্থান জাহান্নাম। (৬৬.৯)। প্রাথমিকভাবে কোথাও কোথাও শক্তিপ্রয়োগ কিংবা রূঢ় আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়নি। যেমন মদিনায় অবতীর্ণ সুরা হজ-এ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমোদন দেয়া হলেও এতে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদটি আদেশসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। ( ২২:৩৯) একই সুরার পরবর্তী আয়াতে মুসলমানদের প্রতি অন্যায় আচরণকে সুনির্দিষ্টভাবে দেখানো হয়েছে: তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করা হয়েছে শুধু এজন্য যে তারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। ( ২২:৪০)। পারস্যের ইসলামি পণ্ডিত আল-জামাখশারির মতে পৌত্তলিক বা ইসলামে অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধ করার প্রথম অনুমোদনটি আসে ৭০টিরও বেশি কোরানের আয়াতের পরে এবং ওই আয়াতগুলোতে সহিংসতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছিল। যুদ্ধ অনুমোদনের যথার্থতা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে নবি মুহাম্মদ মানব চরিত্রকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেছেন। মক্কা থেকে বিতাড়িত হবার স্মৃতিচারণে মুসলমানদের হয়তো কুরাইশদের ওপর প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা তাড়িত করত। কোরানেও এই অকাট্য চিন্তার অলঙ্কারময় বর্ণনা অন্য একটি প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে ইজরাইলের সন্তানদের নাম করে, কিন্তু বক্তব্যটি প্রযোজ্য ছিল মুসলমানদের জন্য: “তারা বলল, যখন নিজেদের ঘরবাড়ি ও সন্তানসন্ততি থেকে দূরে পড়ে আছি তখন কেন আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো না?”(২:২৪৬)। যদি কোরানের বর্ণনায় এই যুদ্ধটি ছিল বনি-ইসরাইলের সন্তানদের কিন্তু ব্যক্তিগত দুঃখজনক সূতিও মুসলমানদেরকে প্রতিশোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্দীপ্ত করে থাকতে পারে।
নবি যখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন তখন যুদ্ধের কোনো প্রশ্নই ছিল না। সুরা আনআম-এর ৬৮ নম্বর আয়াতে দেখা যায়, নবি তখন পৌত্তলিকদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন এবং তারা নবির সাথে অভদ্র আচরণ ও কোরানের আয়াত নিয়ে উপহাস করত: ‘তুমি যখন দেখ তারা আমার নিদর্শন (কোরানের আয়াত) নিয়ে নিরর্থক আলোচনায় মেতে আছে তখন তুমি দূরে সরে যাবে যেপর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে যোগ দেয়। আর শয়তান যদি তোমাকে ভুল করায়, তবে খেয়াল হওয়ার পরে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবে না। (৬৬৮)। মক্কায় অবতীর্ণ সুরা আনকাবুত-এ কিতাবিদের মর্যাদা দিয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে : “তোমরা কিতাবিদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করবে, কিন্তু সৌজন্যের সাথে, তবে ওদের মধ্যে যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের সাথে নয়। আর বলো, “আমাদের ওপর ও তোমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য তো একই, আর তারই কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করি।”(২৯:৪৬) সুরা আনকাবুতের এই নির্দেশনাটি কেবল নবি মুহাম্মদের জন্য নয়, বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে বিধায় তা সমগ্র মুসলমান জাতির জন্যই জারি করা হয়েছে। মক্কা ও মদিনায় অবতীর্ণ (প্রথম দিকের) বিভিন্ন আয়াতে অমুসলমান কিতাবিদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেমন সুরা আল-ই-ইমরান-এ বলা হয়েছে বলো, আমি ও আমার অনুসারীরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তুমি তাদেরকে ও সাধারণ জনতাকে’ বলো, তোমরা কি আত্মসমর্পণ করেছ?” (৩:২০)। যারা বিশ্বাস করে ও যারা ইহুদি হয়েছে এবং যারা খ্রিস্টান ও সাবেয়ি (ইসলাম-পূর্ব যুগের দক্ষিণ আরবের বাসিন্দা, বাইবেলীয় বর্ণনায় সাবা রাজ্যের অধিবাসী), যারা আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার আছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (২৬২)। প্রায় একই বক্তব্য দেখা যায় সুরা মায়িদার ৭৭ নম্বর আয়াতে। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বোঝা যায় এই আয়াতগুলো সম্ভবত হিজরতের পরবর্তীকালে এক বা দুই বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
মদিনায় এক দশক অতিক্রান্ত হবার পর, বিশেষ করে মক্কা বিজয়ের পর সুরা তওবা যেন অমুসলিম কিতাবিদের (খ্রিস্টান, ইহুদিদের) ওপর বজ্রাঘাত হানে। যে মানুষগুলোর সাথে এতোদিন আল্লাহর আদেশে মুসলমানরা নম্রভাবে ভাব বিনিময় করতেন, কোনো ধরনের হুমকি প্রদান করতেন না তাদেরকে এই সুরার আয়াতগুলিতে ইসলামকে স্বীকার না করলে ভবিষ্যত শাস্তির বার্তা প্রদান করা হয়। এতোদিন কেবল নবির কাজ ছিল জনতার কাছে সতর্কবার্তা পাঠানো, উপদেশ প্রদান করা, দশ বছর পর মৃত্যুদণ্ডের ভীতি প্রদর্শনের বার্তা দিলেন। সুরা তওবার এই আয়াতে নির্দেশ দেয়া হলো : যাদের ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহ ও তার রসুল যা হারাম করেছেন তা হারাম করে না ও সত্যধর্ম অনুসরণ করে না তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যে-পর্যন্ত না তারা বশ্যতা স্বীকার করে আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ স্বেচ্ছায় জিজিয়া দেয়। (৯:২৯)। সুরা বাইয়িনা-তে বলা হলো, বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হবার পর কিতাবি ও অংশীবাদীরা সৃষ্টির অধম প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। (৯৮৬)। মদিনার ইহুদিদের উচ্ছেদ, খায়বার ও ফাদাক ইহুদি-গ্রাম দখল এবং মক্কা বিজয়ের পর নবি মুহাম্মদ এই ঐশ্বরিক নির্দেশের কথা প্রদান করেন। এ-ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পর ভিন্নমতাবলম্বীদের সাথে পূর্বের মতো নম্র ও যৌক্তিক বাক্য ব্যবহার করে কথোপকথনের প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে যুদ্ধের ময়দানে তরবারির ভাষায় ফয়সালা হবে সবকিছুর।