৩.২ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা

১১.

বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারাই পাল্টে গেছে আর হ্যারি সেলডন উৎফুল্ল না হয়ে পারলেন না।

প্রজেক্ট কমপ্লেক্সের মূল কামরাটা হঠাৎ পরিপূর্ণ হয়ে উঠল হাজারো রং আর আলোতে, সেই সাথে শূন্যে তৈরি হলো হলোগ্রাফি, হ্যারি সেলডনের বিভিন্ন বয়সের ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি। ডর্স ভেনাবিলিও আছে, হাসিমুখ, কিছুটা কম বয়সী দেখাচ্ছে কিশোর রাইখ, তখনো চেহারার উগ্রতা দূর হয় নি–সেলডন এবং এমারিল, বিশ্বাসই হতে চায় না যে দুজন একসময় তরুণ ছিল, কম্পিউটারের উপর ঝুঁকে কাজ করছে। ইটো ডেমারজেলকেও ক্ষণিকের জন্য দেখা গেল, পুরনো বন্ধুর জন্য বুকটা হাহাকার করে উঠল সেলডনের সেইসাথে ডেমারজেল অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পূর্বে যে নিরাপত্তাবোধ ছিল তা আবার অনুভব করলেন।

হলোগ্রাফিক্স-এর কোথাও সম্রাট ক্লীয়নকে দেখা গেল না। এমন নয় যে তার কোনো হলোগ্রাফ নেই, আসলে জান্তার শাসনের কারণে জনগণকে বিগত ইম্পেরিয়ামের কথা মনে করিয়ে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

মূল কামরা থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ল, বন্যার তোড়ের মতো ভরিয়ে দিল কক্ষের পর কক্ষ, ভবনের পর ভবন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরিত হয়েছে একটা ডিসপ্লেতে। এমনটা সেলডন আগে কখনো দেখেন নি বা কল্পনাও করেন নি। এমনকি গম্বুজের আলো কমিয়ে কৃত্রিম রাত তৈরি করা হয়েছে যেন আগামী তিনদিন বিশ্ববিদ্যালয় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে।

“তিন দিন!” সেলডন বললেন, কিছুটা বিস্ময় কিছুটা আতংক নিয়ে।

“তিন দিন,” ডর্স ভেনাবিলি জবাব দিল, মাথা নেড়ে। “বিশ্ববিদ্যালয় এর কমে কিছুতেই মানতে রাজী হয় নি।”

“খরচ! শ্রম!” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“অনেক কম, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যা করেছ সেই তুলনায়। আর শ্রম পুরোটাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।”

এবার উপর থেকে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানারোমিক দৃশ্য ফুটে উঠল। জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তা দেখছেন সেলডন।

“তুমি খুশি হয়েছ,” ডর্স বলল। “বুড়ো হওয়ার জন্য কোনো উৎসব করতে চাও না। এই নিয়ে গত কয়েক মাস নাকি কান্না ছাড়া আর কিছু করো নি। আর এখন তোমাকে দেখলে কে বলবে।”

“হ্যাঁ, চমৎকার হয়েছে। ওরা এমন কিছু করবে আমার ধারণাই ছিল না।”

“কেন নয়? তুমি সবার কাছে আইকন। পুরো বিশ্ব–পুরো এম্পায়ার–তোমার কথা জানে।”

“জানে না,” জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন সেলডন। “প্রতি এক বিলিয়ন মানুষের একজনও আমার কথা জানে না এবং অবশ্যই সাইকোহিস্টোরির কথা জানে না। প্রজেক্টের বাইরে একজনও জানে না সাইকোহিস্টোরি আসলে কী, প্রজেক্টের ভেতরের সবার কাছেও ধারণাটা পরিষ্কার নয়।”

“সেটা কোনো ব্যাপার নয়, হ্যারি। সবচেয়ে মূল্যবান হলে তুমি। এমন কি কোয়াড্রিলিয়ন মানুষের একজন মানুষও যদি তোমার ব্যাপারে, তোমার কাজের ব্যাপারে নাও জানে এই কথা ভালোভাবেই জানে যে তুমি এম্পায়ারের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।”

“বেশ,” চারদিকে চোখ বুলিয়ে সেলডন বললেন, “কথাটা এখন আমার নিজেরও বিশ্বাস হতে শুরু করেছে। কিন্তু তিন দিন, তিন রাত! অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।”

“না, কিছুই হবে না। রেকর্ডগুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে। কম্পিউটার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতিগুলো নিরাপদে রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এক ধরনের ভারচুয়াল সিকিউরিটি ফোর্স তৈরি করেছে। ফলে কোনোকিছুরই ক্ষতি হবে না।”

“সবকিছুই তুমি তত্ত্বাবধান করেছে, তাই না, ডর্স?” ভালোবাসা মেশানো হাসির সাথে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“আমরা অনেকে মিলে করেছি। আমার একার পক্ষে সম্ভব হতো না। তোমার সহকর্মী টামউইল ইলার অসম্ভব পরিশ্রম করেছে।”

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন।

“ইলারের দোষটা কি?”

“সে আমাকে মাস্ট্রো ডাকে।”

“মারাত্মক অপরাধ।”

রসিকতায় পাত্তা দিলেন না সেলডন। “আর সে তরুণ।”

“আরো খারাপ। শোনো, হ্যারি, বয়স হচ্ছে এটা তোমাকে মেনে নিতে হবে এবং প্রথম কথা তোমাকে দেখাতে হবে যে উৎসবটা তুমি উপভোগ করছ। তাতে অন্যরা খুশি হবে, তাদের আনন্দ বাড়বে এবং নিশ্চয়ই তুমি সেটা চাও। যাও, ঘুরে বেড়াও। এখানে আমার সাথে বসে থেকো না। সবার সাথে কথা বল। তাদের কুশল জিজ্ঞেস কর। হাস। আর মনে রাখবে ব্যানকুয়েটের পর তোমাকে বক্তৃতা দিতে হবে।”

“ব্যানকুয়েট আমি পছন্দ করি না আর বক্তৃতা আমার দ্বিগুণ অপছন্দ।”

“উপায় নেই, এখন যাও।”

নাটকীয় ভঙ্গীতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সেলডন। তবে ডর্সের কথা শুনলেন। দাঁড়িয়ে আছেন মেইন হলে যাওয়ার আর্চওয়ের উপর, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভা নিয়ে। ফার্স্ট মিনিস্টারের বিশাল আলখাল্লা আর নেই, তরুণ বয়সে যে হ্যাঁলিকনিয়ান পোশাক পছন্দ করতেন তাও এখন আর ব্যবহার করেন না। বর্তমান সামাজিক মর্যাদার সাথে মানানসই পোশাক পড়েছেন। হালকা কুচি দেয়া নিভাজ প্যান্ট, চমৎকার টিউনিক, বুকের উপর রূপালি সুতার এম্ব্রয়ডারি করা ইনশিগনিয়া : সেলডন সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্ট অ্যাট স্ট্রিলিং ইউনিভার্সিটি। টাইটানিয়ামের মতো ধূসর পোশাকের উপর রূপালি কারুকার্য বীকন আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। বলিরেখা পূর্ণ মুখাবয়বের মাঝে হাস্যোজ্জ্বল দুটো চোখ। অসংখ্য বলিরেখা আর পক্ককেশ বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি আসলেই ষাট বছরের বৃদ্ধ।

প্রথমেই ঢুকলেন বাচ্চারা যে কামরায় খানাপিনা করছে সেখানে। ভেতরের আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলে শুধু খাবারের ট্রেগুলো রাখা হয়েছে। তাকে দেখে বাচ্চারা ছুটে এসে ঘিরে ধরল, বুঝে নিয়েছে এই বুড়ো মানুষটার জন্যই আজকের এই ভোজ–আর সেলডন তাদের এটো হাতগুলো এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলেন।

“বাচ্চারা, দাঁড়াও। দাঁড়াও। পিছনে যাও।”

পকেট থেকে ছোট একটা কম্পিউটারাইজড রোবট বের করে মেঝেতে রাখলেন। রোবটবিহীন এম্পায়ারে এই যন্ত্রটা যে সবাইকে অবাক করবে তিনি জানেন। ছোট লোমশ জম্ভর আকৃতি, কিন্তু আগাম সংকেত না দিয়েই আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে (উত্যু স্বরে চীৎকার করে উঠল বাচ্চারা) একই সাথে শব্দ এবং গতিও পাল্টাতে পারে।

“দেখো এটা, খেলো এটা নিয়ে, কিন্তু নষ্ট করবে না। পরে তোমাদের সবাইকে একটা করে দেয়া হবে।”

মেইন হলে যাওয়ার হলওয়েতে ফিরে এলেন তিনি এবং টের পেলেন ওয়ানডা তার পিছন পিছন আসছে।

“দাদু, ওয়ানডা ডাকল।

অবশ্যই ওয়ানডার কথা আলাদা। নিচু হয়ে তাকে শূন্যে তুলে নিলেন, মাথার উপরে তুলে আবার নামিয়ে আনলেন।

“আনন্দ করছ, ওয়ানডা?”

“হ্যাঁ। কিন্তু ওই ঘরটাতে যেয়ো না।”

“কেন, ওয়ানডা? ওটা আমার ঘর। আমার অফিস, ওখানেই আমি কাজ করি।”

“ওখানেই আমি খারাপ স্বপ্নটা দেখেছিলাম।”

“জানি, ওয়ানডা, কিন্তু ওটা তো শেষ হয়ে গেছে, তাই না?” একটু দ্বিধা করলেন। তারপর ওয়ানডাকে নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে রাখা চেয়ারগুলোর দিকে এগোলেন। চেয়ারে বসে ওয়ানডাকে কোলের উপর বসালেন।

“ওয়ানডা, তুমি নিশ্চিত যে ওটা আসলে স্বপ্নই ছিল?”

“আমার মনে হয় স্বপ্ন ছিল।”

“তুমি কি আসলেই ঘুমাচ্ছিলে?”

“মনে হয়।”

এই বিষয়ে তার কথা বলতে বোধহয় ভালো লাগছে না, তাই সেলডন বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুধু শুধু জোর খাঁটিয়ে কি লাভ।

“বেশ, স্বপ্ন তোক না হোক, ওখানে দুটো লোক লেমনেড ডেথ নিয়ে কথা বলছিল, তাই না?”

অনিচ্ছুক ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল ওয়ানডা। “তুমি নিশ্চিত ওরা লেমনেডের কথা বলেছিল?” আবার ও মাথা নাড়ল। “হয়তো ওরা অন্য কিছু বলেছিল আর তুমি ধরে নিয়েছ লেমনেড?”

“লেমনেডই বলেছিল।”

মেনে নিলেন সেলডন। “ঠিক আছে, যাও মজা কর, ওয়ানডা। স্বপ্নের কথা ভুলে যাও।”

“ঠিক আছে, দাদু।” বিষয়টা বাদ দেয়াতে সাথে সাথে উৎফুল্ল হয়ে উঠল ওয়ানডা! দৌড়ে চলে গেল সঙ্গীদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য।

মানীলাকে খুঁজতে লাগলেন সেলডন। অনেক সময় লাগল কারণ প্রতি পদে তাকে থামতে হলো, সম্ভাষণের জবাব দিতে হলো, দুদন্ড কথা বলতে হলো।

শেষপর্যন্ত বেশ কিছুটা দূরে পুত্রবধূকে দেখতে পেলেন। “মাফ করবেন–মাফ করবেন–আমাকে একজনের সাথে–মাফ করবেন-” বিড়বিড় করে এই কথাগুলো বলতে বলতে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে পথ করে নিতে হলো তাকে।

“মানীলা,” ডাক দিয়ে পুত্রবধূকে একপাশে সরিয়ে আনলেন তিনি।

“কি হয়েছে, হ্যারি?”

“ওয়ানডার স্বপ্নের ব্যাপারটা।”

“এখনো সে ওই বিষয়ে কথা বলছে?”

“হ্যাঁ, এখনো সে ভাবছে। শোনো, পার্টিতে লেমনেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাই না?”

“অবশ্যই, বাচ্চারা এই জিনিসটা ভীষণ পছন্দ করে। আমি বিভিন্ন রকম মাইকোজেনিয়ান স্বাদের তৈরি করেছি। বাচ্চারা একটার পর একটা খেয়ে দেখছে কোনটা বেশী সুস্বাদু। বড়রাও খাচ্ছে। আমি খেয়েছি। আপনিও খেয়ে দেখেন। ভালো লাগবে।”

“ভাবছি। যদি এটা আসলে স্বপ্ন না হয়, বাচ্চা মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি দুটো লোকের মুখে লেমনেড ডেথ কথাটা শুনে থাকে-” থেমে গেলেন যেন ভীষণ লজ্জিত।

“আপনি ভাবছেন যে লেমনেডের সাথে বিষ মেশানো হয়েছে? অসম্ভব। তাহলে বাচ্চাগুলো হয় অসুস্থ হয়ে পড়ত অথবা মারা যেত।”

“আমি জানি,” বিড় বিড় করে বললেন তিনি। “আমি জানি।”

এতোটাই আনমনা হয়ে হাঁটছিলেন তিনি যে ডর্সকে দেখতেই পান নি। ডর্সই কনুই ধরে তাকে থামাল।

“মুখটা এমন করে রেখেছ কেন? চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

“আমি ওয়ানডার লেমনেড ডেথ এর কথা ভাবছিলাম।”

“আমিও ভাবছি কিন্তু এখনো কিছু বের করতে পারি নি।”

“বিষ মেশানোর সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিতে পারছি না।”

“অসম্ভব। আমার কথা বিশ্বাস কর, প্রতিটা খাবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। তুমি ভাবতে পার যে আমি শুধু শুধু ভয় পাই। কিন্তু আমার দায়িত্ব তোমাকে রক্ষা করা এবং কোনো কিছুই আমাকে এই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না।”

“সবকিছুই-”

“বিষ মেশানো হয় নি। বিশ্বাস কর।”

সেলডন মুচকি হাসলেন। “বেশ, স্বস্তি পেলাম। আমারও আসলে মনে হয় না–“

“যাই হোক,” শুষ্ক কণ্ঠে বলল ডর্স, “খাবারে বিষ মেশানোর গুজবের চেয়ে আমি যে বিষয়টা নিয়ে বেশী চিন্তিত সেটা হলো, শুনেছি তুমি কয়েকদিন পরেই বদমাশ ট্যানারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছ।”

“সাবধান হও, ডর্স, চারপাশে অনেক কান আর মুখ আছে।”

দ্রুত কণ্ঠস্বর নামিয়ে ফেলল ডর্স। “ঠিকই বলেছ। দেখো চারদিকে। এই যে হাসিমুখগুলো–অথচ কে বলতে পারবে যে এই বন্ধুদেরই একজন আগামীকাল সকালে গিয়ে প্রধান বা তার অনুগত কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট করবে না? হায়রে, মানুষ! হাজার শতাব্দী পার হয়ে গেলেও বিশ্বাসঘাতকতার অভ্যাস ছাড়তে পারল না। আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। অথচ জানি কি ভীষণ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আর তাই আমি তোমার সাথে যাব, হ্যারি।”

“অসম্ভব, ডর্স। তাতে আমার জন্য আরো জটিলতা তৈরি হবে। আমি একাই যাব। কোনো সমস্যা হবে না।”

“জেনারেলকে কিভাবে সামলাতে হবে তোমার কোনো ধারণাই নেই।”

গম্ভীর হয়ে গেলেন সেলডন। “তোমার আছে? ইলারের মতো কথা বলছ। সেও মনে করে আমি একটা বোকা বুড়ো। সেও আমার সাথে যেতে চেয়েছিল। ভেবে পাচ্ছি না এই ট্র্যানটরের কতজন মানুষ আমার দায়িত্বটা নিতে চায়। তারপর পরিষ্কার ব্যঙ্গাত্মক সুরে যোগ করলেন, “এক ডজন? এক মিলিয়ন?”

.

১২.

দশ বছর এম্পায়ার চলছে কোনো সম্রাটের শাসন ছাড়াই, কিন্তু ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডের কাজকর্মে তা বোঝা যায় না। সহস্র বছরের ঐতিহ্য একজন সম্রাটের অনুপস্থিতিকে অর্থহীন করে তুলেছে।

আসলে এখন আর যে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় রাজকীয় আলখাল্লা পরিহিত কোনো ব্যক্তি সকল মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে না। কোনো রাজকীয় কণ্ঠস্বর আদেশ দেয় না; কোনো রাজকীয় ইচ্ছা আইন হয়ে চেপে বসে; কোনো রাজকীয় অনুগ্রহ বা ক্রোধ অনুভব করা যায় না; সম্রাটের কোনো আনন্দই কোনো প্রাসাদকে উত্তপ্ত করে তোলে না; কোনো সম্রাটের অসুস্থতা জনগণকে বিশ্ন করে তোলে না। ছোট প্রাসাদে সম্রাটের নিজস্ব কামরাগুলো শূন্য–কোনো রাজ পরিবারের অস্তিত্ব নেই।

তারপরেও গার্ডেনারদের বিশাল কর্মীদল বাগানের যত্ন নেয় নিয়মিত। বিশাল কর্মীবাহিনী প্রতিটি ভবনের রক্ষনাবেক্ষণ করে চলেছে নিয়মমাফিক। সম্রাটের শয্যা যেখানে বহুদিন কেউ শয়ন করে নি–প্রতিদিন তাতে নতুন চাদর পাতা হয়; কামরাগুলো প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয়; নীরবে সকল কাজ হয়ে যাচ্ছে ঠিক আগে যেভাবে হতে; সর্বোচ্চ পদ থেকে সবনিম্ন পদের প্রতিটি ইম্পেরিয়াল কর্মী পূর্বের মতোই দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কর্মকর্তারা সেভাবেই আদেশ দিয়ে যাচ্ছে সম্রাট বেঁচে থাকলে যেভাবে দিত, এবং তারা জানে যে সম্রাট ঠিক এই আদেশটাই দিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে শীর্ষপদে সেইসব কর্মকর্তারাই এখনো বহাল আছে ক্লীয়নের আমলে যারা দায়িত্ব পালন করছিল। নতুন যাদেরকে নেয়া হয়েছে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই ঐতিহ্যের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।

মনে হয় যে সম্রাটের শাসনে অভ্যস্ত এম্পায়ার একত্রিত রাখার জন্য এমন একটা “ভৌতিক শাসন” দরকার।

জান্তা কথাটা জানে–অথবা, না জানলেও কিছুটা হয়তো অনুভব করেছে। গত দশ বছরে যে সামরিক লোকগুলো এম্পায়ার নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের কেউই প্রাসাদে থাকে নি। এই মানুষগুলো আর যাই হোক তাদের শরীরে রাজরক্ত নেই এবং তারা জানে যে প্রাসাদে থাকার কোনো অধিকার তাদের নেই। জনগণের একটা অংশ মনে করে তাদের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে এবং তারা সম্রাটের প্রতি অসম্মান কোনো ভাবেই মেনে নেবে না। সেই সম্রাট জীবিত বা মৃত যাই হোক না কেন।

এমনকি জেনারেল ট্যানারও প্রাসাদে থাকার দৌরাত্ম দেখাতে সাহস পায় নি যে প্রাসাদ একটা দীর্ঘ সময় ছিল কয়েক ডজন বিভিন্ন রাজ বংশের সম্রাটদের বাসস্থান। প্যালেস গ্রাউণ্ডের বহিঃপ্রান্তের এক ভবনে সে তার বাসস্থান এবং অফিস তৈরি করেছে দৃষ্টিনন্দন কিন্তু একটা দুর্গ। দীর্ঘ একটা অবরোধ ঠেকিয়ে দেয়ার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন, চারপাশে ঘিরে থাকা ভবনগুলোতে অগণিত সৈনিকের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ট্যানার বেটে কিন্তু পেশীবহুল, গোঁফ আছে। ডাহলাইটদের মতো বুনো গোঁফ নয় বরং যত্ন করে ছাটা পরিমার্জিত গোঁফ। খানিকটা লালচে। ঠাণ্ডা নীল চোখ। তরুণ বয়সে লোকটা নিঃসন্দেহে সুদর্শন ছিল কিন্তু এখন তার মুখটা থলথলে এবং তার দৃষ্টিতে শুধু রাগই প্রকাশ পায়।

লক্ষ লক্ষ বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হয়েও যে মানুষটা নিজেকে সম্রাট বলে জাহির করতে পারে না তার ক্ষোভে ফেটে পড়াই স্বাভাবিক। তাই সে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে হিন্ডার লিনকে বলল, “আমি নিজের একটা রাজবংশ তৈরি করতে পারি।” ভুরু কুঁচকে চারপাশে তাকাল। “মাস্টার অব দ্য এম্পায়ারের জন্য এই স্থান নয় উপযুক্ত।”

নরম সুরে লিন বলল, “মাস্টার হওয়াটাই সবচেয়ে বড় কথা। কাঠের পুতুল না হয়ে কুঁড়েঘরে থেকে মাস্টার হওয়াই ভালো।”

“তারচেয়েও ভালো প্রাসাদে থেকে মাস্টার হওয়া। তাই না?”

লিনের পদবী কর্ণেল, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায় যে সে কখনোই সেনাবাহিনীতে ছিল না। তার মূল দায়িত্ব হচ্ছে ট্যানারকে সেই কথাগুলো বলা যা শুনলে সে খুশি হবে এবং কোনো পরিবর্তন না করে ট্যানারের আদেশ অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়া। মাঝে মাঝে–যদি নিরাপদ মনে হয় তাহলে ট্যানারকে সে আরো দুঃসাহসিক কাজে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে।

সে জানে আড়ালে সবাই তাকে “ট্যানারের চামচা” বলে ডাকে। এটা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। চামচা বলেই সে নিরাপদ–আর যে মানুষগুলো চামচা হতে আপত্তি জানিয়েছে তাদেরকে সে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখেছে।

নিঃসন্দেহে সেই সময় আসবে–যখন ট্যানারও নিয়ত পরিবর্তনশীল সামরিক জান্তার কোলাহলে হারিয়ে যাবে। লিন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সেই সময়টা আসার অনেক আগেই বুঝতে পেরে নিজেকে বাঁচাতে পারবে–অথবা হয়তো পারবে না। বেশ, সবকিছুর জন্যই মূল্য দিতে হয়।

“আপনি নিঃসন্দেহে একটা ডাইন্যাস্টি তৈরি করতে পারবেন, জেনারেল,” লিন বলল। “দীর্ঘ যুগের ইম্পেরিয়াল ইতিহাসে অনেকেই তা করেছে। কিন্তু সেজন্য সময় দরকার। মানুষ নতুন একটা রাজবংশ ধীরে ধীরে গ্রহণ করে। সাধারণত দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মটাকে পুরোপুরি সম্রাট হিসেবে মেনে নিত।”

“বিশ্বাস করি না। নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে দিলেই হবে। কার সাহস হবে আমাকে বাধা দেয়ার? আমার হাতে অনেক ক্ষমতা।”

“অবশ্যই, জেনারেল। ট্র্যানটর এবং ইনার ওয়ার্ল্ডগুলোতে আপনার ক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু দূরবর্তী আউটার ওয়ার্ল্ডগুলো–অন্তত এই মুহূর্তে নতুন একটা ইম্পেরিয়াল ডাইন্যাস্টি মেনে নেবে না।”

“ইনার ওয়ার্ল্ড অথবা আউটার ওয়ার্ল্ড–সেনাবাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করে সবকিছু। প্রাচীন ইম্পেরিয়াল অনুমিতি।”

“এবং যথেষ্ট ভালো অনুমিতি। কিন্তু বর্তমানে অনেক প্রদেশেরই নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী আছে, তারা সেগুলো আপনার পক্ষে ব্যবহার নাও করতে পারে। সময়টা এখন জটিল।”

“তুমি তাহলে সাবধান হতে বলছ।”

“আমি সবসময়ই তাই বলি।”

“একদিন হয়তো সব বিষয়েই বলবে।”

মাথা নোয়াল লিন। “আমি শুধু সেই পরামর্শই দেই যা আমার মতে আপনার জন্য উপকারী, জেনারেল।”

“যেমন, তুমি আমাকে ঘন ঘন হ্যারি সেলডনের কথা বলছ।”

“সেই আপনার জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ, জেনারেল।”

“বলেছ তুমি কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। সে তো একজন অধ্যাপক।”

“হ্যাঁ, অধ্যাপক কিন্তু একসময় ফাস্ট মিনিস্টার ছিল।”

“আমি জানি, কিন্তু সেটা ক্লীয়ন আমলে। তারপরে সে কি করেছে? এমন একটা কঠিন সময়ে যখন প্রাদেশিক গভর্নররা ক্রমশই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তখন। একজন সামান্য অধ্যাপক আমার জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হবে কেন?”

“অনেক সময় আমরা ভুল করি,” সতর্ক কণ্ঠে বলল লিন (কারণ জেনারেলকে কিছু বোঝাতে হলে সাবধান থাকতে হয়), “এই ভেবে যে একজন শান্ত শিষ্ট মানুষ বিপদের কারণ হবে না। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে লাগে তাদের জন্য সেলডন সত্যিকারের হুমকি। বিশ বছর আগে জোরানুমাইট আন্দোলন ক্লীয়নের শক্তিশালী। ফার্স্ট মিনিস্টার ইটো ডেমারজেলকে কোনঠাসা করে ফেলেছিল।”

মাথা নাড়ল ট্যানার, কিন্তু ঘটনাটা মনে করতে পারল না।

“সেলডন জোরানিউমকে দমন করে। তারপর ফার্স্ট মিনিস্টার হিসেবে ডেমারজেলের স্থলাভিষিক্ত হয়। জোরামাইট আন্দোলন তারপরেও গোপনে চলতে থাকে, কিন্তু সেলডন কৌশলে তাও পুরোপুরি শেষ করে দেয় যদিও ক্লীয়নের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে পারে নি।”

“কিন্তু সেলডনের কোনো শাস্তি হয় নি, তাই না?”

“ঠিকই বলেছেন, সেলডন পার পেয়ে যায়।”

“অদ্ভুত। সম্রাটের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার মানে ফার্স্ট মিনিস্টারের মৃত্যুদণ্ড।”

“সেটা হওয়াই উচিত ছিল। যাইহোক, জান্তা তাকে ছেড়ে দেয়। কারণ তাই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত।”

“কেন?”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিন। “সাইকোহিস্টোরির কারণে, জেনারেল।”

“এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না।”

সত্যি কথা বলতে কি, অস্পষ্টভাবে ট্যানারের মনে পড়ছে যে এই অদ্ভুত শব্দটা নিয়ে লিন অনেকবারই কথা বলার চেষ্টা করেছে। সে কখনো শুনতে চায়নি আর লিনও সাহস করে জোর দেয় নি। কিন্তু এই মুহূর্তে লিনের কণ্ঠের আকুতি টের পেয়ে ট্যানার সিদ্ধান্ত নিল শুনলেই ভালো হবে।

“আসলে কেউই জানে না,” লিন বলল, “শুধু বিশেষ শ্রেণীর কিছু মানুষ—আহ-বুদ্ধিজীবী মানুষরা এটার প্রতি আগ্রহী।”

“জিনিসটা কি?”

“জটিল এক গাণিতিক পদ্ধতি।”

মাথা নাড়ল ট্যানার। “বাদ দাও। আমি আমার মিলিটারি ডিভিশনগুলো গুনতে পারি। এর বেশী গণিত জানার দরকার নেই।”

“গল্পটা হচ্ছে যে সাইকোহিস্টোরি হয়তো ভবিষ্যত বলে দেয়া সম্ভব করে তুলবে।”

জেনারেলের দৃষ্টি বিস্ফারিত হলো। তার মানে সেলডন একজন ভবিষ্যত বক্তা।”

“ঠিক প্রচলিত অর্থে ভবিষ্যত বক্তা নয়। এই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক।”

“আমি বিশ্বাস করি না।”

“বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু সেলডন ট্র্যানটরে–এবং আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোর বিশেষ এক শ্রেণীর কাছে আধ্যাত্মিক মহাপুরুষে পরিণত হয়েছে। সাইকোহিস্টোরি–যদি কৌশলটাকে ভবিষ্যত অনুমানে ব্যবহার করা যায় অথবা যদি মানুষ শুধু ধরে নেয় যে ব্যবহার করা যাবে প্রশাসনের জন্য প্রচণ্ড শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠবে। আমি জানি ব্যাপারটা আপনি ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছেন, জেনারেল। কোনো একজনকে শুধু প্রচার করতে হবে যে আমাদের শাসন এম্পায়ারের জন্য শান্তি এবং অগ্রগতি বয়ে আনবে। মানুষের বিশ্বাস স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে পরিণত করবে। অন্যদিকে সেলডন যদি উল্টোটা চায়, সে তখন গৃহযুদ্ধ আর ধ্বংসের কথা প্রচার করবে। মানুষ তাও বিশ্বাস করবে এবং আমাদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়বে।”

“সেক্ষেত্রে, কর্ণেল, আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে সাইকোহিস্টোরির ভবিষ্যদ্বাণী আমরা যেমন চাই ঠিক যেন তেমন হয়।”

“হয়তো সেলডনকেই মতবাদগুলো প্রচার করতে হবে কিন্তু সে আমাদের বন্ধু নয়। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোহিস্টোরি নিখুঁতভাবে গড়ে তোলার যে প্রজেক্ট চলছে তার থেকে সেলডনকে পৃথক করা। সাইকোহিস্টোরি আমাদের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী হয়ে উঠবে যদি সেলডন ছাড়া অন্য কেউ এর দায়িত্ব নেয়।”

“দায়িত্ব নেয়ার মতো কেউ আছে?”

“অবশ্যই, শুধু সেলডনের হাত থেকে আমাদের ছাড়া পেতে হবে।”

“তাতে সমস্যা কি? মাত্র একটা আদেশ–সেলডন অদৃশ্য হয়ে যাবে।”

“জেনারেল, সরকার এই ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেই ভালো হবে।”

“ব্যাখ্যা কর।”

“আপনার সাথে সেলডনের একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছি। তখন আপনি আপনার কৌশল প্রয়োগ করে বুঝতে পারবেন আমার পরিকল্পনা কাজে লাগবে কি না।”

“সাক্ষাঙ্কারটা কখন হবে?”

“হওয়ার কথা ছিল কয়েকদিন আগেই কিন্তু প্রজেক্টের প্রতিনিধিরা তারিখটা পেছানোর আবেদন করে কারণ সেলডনের জন্মোৎসব পালিত হচ্ছে–ষাটতম। কাজেই এক সপ্তাহ পেছানোর অনুমতি দেয়াটাই উচিত বলে মনে হয়েছে।”

“কেন?” দাপটের সাথে জিজ্ঞেস করল ট্যানার। “আমি কোনো ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করা পছন্দ করি না।”

“ঠিক, জেনারেল, ঠিক। আপনার সিদ্ধান্ত বরাবরই সঠিক। কিন্তু আমার মনে হয়েছে জন্ম উৎসবটা কিভাবে পালিত হচ্ছে সেটা পর্যবেক্ষণ করা দরকার।”

“কেন?”

“যে কোনো তথ্যই প্রয়োজনীয়। আপনি কি দয়া করে উৎসবের কিছু রেকর্ড করা অংশ দেখার কষ্ট স্বীকার করবেন?”

জেনারেল ট্যানারের মুখ থেকে রাগের ভাব দূর হলো না। “দেখাটা কি খুব জরুরী?”

“আমার মনে হয় আপনি আগ্রহী হবেন, জেনারেল।”

রেকর্ডকৃত অংশের দৃশ্য এবং শব্দ ছিল নিখুঁত, ঝকঝকে এবং খানিকক্ষণের জন্য হলেও জন্ম উৎসবের আনন্দ আমেজ জেনারেলের নিষ্প্রাণ কামরাটাকে ভরিয়ে তুলল।

লিন ধারাভাষ্য দিয়ে যেতে লাগল। “মূল উৎসবটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, জেনারেল, প্রজেক্ট কমপ্লেক্সে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অংশই বাদ যায় নি। বিশাল এলাকা জুড়ে পালিত হচ্ছে। এবং যদিও এখানে দেখাতে পারছি না, কিন্তু ট্রানটরের অন্যান্য অনেক সেক্টরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রতীকি উৎসব পালিত হচ্ছে। চলবে আরও একদিন।”

“তুমি বলতে চাও এই উৎসব পুরো ট্রানটরেই পালিত হচ্ছে?”

“খানিকটা তাই। যদিও বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মানুষরাই এটা পালন করছে কিন্তু বিস্ময়করভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এমন কি অন্যান্য বিশ্বেও।”

“এই রেকর্ড তুমি কোথায় পেয়েছ?”

মুচকী হাসল লিন। “প্রজেক্টে আমাদের হাত যথেষ্ট মজবুত, তথ্য পাবার বিশ্বাসযোগ্য উৎস রয়েছে।

“তো, লিন, এই ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কি?”

“আমার বিশ্বাস, জেনারেল, এবং নিঃসন্দেহে আপনিও বিশ্বাস করেন যে হ্যারি সেলডন বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কাছে মহামানব। সাইকোহিস্টোরির সাথে নিজেকে সে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে আমরা যদি সরাসরি তাকে অপসারণ করি তাহলে আমরা বিজ্ঞানের শত্রু হয়ে দাঁড়াব। তখন এই বিজ্ঞান আমাদের কাজে লাগবে না।

“অন্যদিকে, জেনারেল, সেলডন বুড়ো হচ্ছে এবং অন্য কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয় : এমন কাউকে আমরা বেছে নিতে পারি যে তরুণ এবং আমাদের সমর্থন করবে। যদি সেলডনকে এমন কোনো উপায়ে সরানো যায় যা সবার কাছেই স্বাভাবিক মনে হবে, তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই।”

“এবং তুমি সেলডনের সাথে সাক্ষাত করতে বলছ?” জিজ্ঞেস করল জেনারেল।

“হ্যাঁ, তাকে বোঝার জন্য এবং কি করব সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। তবে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ সেলডন অসম্ভব জনপ্রিয়।”

“জনপ্রিয় মানুষদের আমি আগেও সামলেছি,” গম্ভীর সুরে বলল ট্যানার।

.

১৩.

“হ্যাঁ,” ক্লান্ত সুরে বললেন হ্যারি সেলডন, “দারুণ একটা উৎসব হয়েছে। চমৎকার সময় কেটেছে আমার। সত্তর বছরে পা দেয়ার জন্য আর তর সইছে না, তাহলে আবার একটা উৎসব উপভোগ করতে পারব। তবে সত্যি কথা বলতে কি আমি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছি।”

“তাহলে চমৎকার একটা ঘুম দাও, বাবা,” হাসি মুখে বলল রাইখ। “সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কিভাবে নির্বিঘ্নে ঘুমাব যেহেতু কয়েকদিন পরেই প্রিয় জেনারেলের সাথে দেখা করতে যেতে হবে।”

“তুমি একা যেতে পারবে না,” গম্ভীর সুরে বলল ডর্স ভেনাবিলি।

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন, “বারবার একই কথা বলবে না, ডর্স। আমাকে একাই যেতে হবে।”

“তোমাকে একা ছাড়লে একটা না একটা ঝামেলা হবেই। দশ বছর আগে কি হয়েছিল মনে আছে। নতুন গার্ডেনারদের অভ্যর্থনা জানাতে তুমি একা গিয়েছিলে, আমাকে সাথে নাও নি।”

“ভুলে তো কোনো লাভ নেই যেহেতু তুমি আমাকে সপ্তাহে দুবার করে মনে করিয়ে দাও, ডর্স। যাইহোক, এবারেও আমি একা যাব। সে জানে যে আমি নিরীহ বৃদ্ধমানুষ। আমার কোনো ক্ষতি করার কথা ভাববে কেন সে? আমি তো যাব শুধু জানতে যে জেনারেল আমার কাছে কি চায়।”

“কি চাইতে পারে তোমার কাছে?” আঙ্গুলের গাঁট কামড়াতে কামড়াতে জিজ্ঞেস করল রাইখ।

“আমার ধারণা সে তাই চাইবে ক্লীয়ন আমার কাছে যা সবসময় চেয়েছিল। নিশ্চয়ই সে জানতে পেরেছে যে সাইকোহিস্টোরি কোনো না কোনো উপায়ে ভবিষ্যৎ বলতে পারবে এবং কৌশলটাকে সে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। ত্রিশ বছর আগে ক্লীয়নকে বলেছিলাম যে আমার এই বিজ্ঞান এখনো কার্যকরী কোনো পর্যায়ে পৌঁছে নি এবং ফার্স্ট মিনিস্টিারের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে বারবার একই কথা বলেছি–আর এখন জেনারেল ট্যানারকেও আমার একই কথা বলতে হবে।”

“তোমার কথা বিশ্বাস করবে?” প্রশ্ন করল রাইখ।

“তাকে বিশ্বাস করানোর কোনো একটা উপায় বের করে নেব।”

“আমি চাই না তুমি একা যাও।” ডর্স বলল।

“তোমার চাওয়া না চাওয়াতে কিছু যায় আসে না, ডর্স।”

আলোচনার এই পর্যায়ে টামউইল ইলার নাক গলাল। বলল, “এখানে একমাত্র আমিই পরিবারের বাইরের লোক। বুঝতে পারছি না আমার কোনো পরামর্শ শুনতে আপনারা আগ্রহী হবেন কি না।

“বল,” অনুমতি দিলেন সেলডন। “সবাই বল।”

“আমি একটা সমঝোতার পরামর্শ দিতে চাই। আমরা কয়েকজন মাস্ট্রোর সাথে গেলে কেমন হয়। অল্প কয়েকজন। আমরা তার ভ্রমণ সঙ্গীর অভিনয় করতে পারি, জন্মদিনের একটা চূড়ান্ত উৎসবের সঙ্গী। দাঁড়ান, বলছি না যে সবাই মিলে জেনারেলের অফিসে যাব এমনকি ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডে ঢোকার কথাও বলছি না। গ্রাউণ্ডের বাইরের কোনো হোটেলে কামরা ভাড়া করব–ডোমস এজ হোটেলই ভালো হবে। আর একদিনের ছুটি নিয়ে একটু ফুর্তি করা যাবে।”

“এটাই বাকী ছিল,” নাক সিটকে বললেন সেলডন। “কাজ বাদ দিয়ে ফুর্তি করা।”

“আপনি না, মাস্ট্রো,” সাথে সাথে জবাব দিল ইলার। “আপনি জেনারেলের সাথে দেখা করতে যাবেন। বাকী আমরা সবাই ইম্পেরিয়াল সেকটরে আপনার জনপ্রিয়তার কথা প্রচার করব–এবং হয়তো জেনারেলের কানেও কথাগুলো যাবে। আর যদি সে বুঝতে পারে যে আমরা আপনার ফিরে আসার অপেক্ষা করছি তখন হয়তো ক্ষতি করার সাহস পাবে না।”

অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। তারপর রাইখ বলল, “ব্যাপারটা লোক দেখানো হয়ে যাবে। বাবার ইমেজের সাথে মিলবে না।”

কিন্তু ডর্স বলল, “হ্যারির ইমেজ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার চিন্তা হ্যারির নিরাপত্তা নিয়ে। যেহেতু আমরা জেনারেলের সামনে বা ইম্পেরিয়াল গ্রাউণ্ডে যেতে পারছি না সেহেতু জেনারেলের যতটা কাছে থাকা যায় তাতে লাভ হতে পারে। ধন্যবাদ, ড. ইলার, চমৎকার একটা পরামর্শের জন্য।”

“আমার পছন্দ হচ্ছে না,” সেলডন বললেন।

“আমার হয়েছে,” জবাব দিল ডর্স, “আর এভাবেই যদি তোমার কাছাকাছি থাকা যায় তাহলে আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না।”

মানীলা এতক্ষণ নীরবে সবার কথা শুনছিল। এবার বলল, “ডোমস এজ হোটেলে থাকাটা বেশ আনন্দের হবে।”

“আমি আনন্দ নিয়ে ভাবছি না,” ডর্স বলল, “কিন্তু তোমার মতামতটাকে আমি পক্ষে ভোট হিসেবে ধরে নিচ্ছি।”

আর কোনো ওজর আপত্তি টিকল না। পরের দিন সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টের ঊর্ধ্বতন বিশজন সদস্য ডোমস এজ হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। আগেই অনেকগুলো কামরা ভাড়া করে রাখা হয়েছে, যে কামরাগুলোর স্বচ্ছ ছাদের ভেতর দিয়ে ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউঞ্জে অকৃত্রিম উন্মুক্ত আকাশ দেখা যায়।

তারপরের দিন সন্ধ্যায় জেনারেলের সশস্ত্র রক্ষীরা সেলডনকে নিয়ে গেল সাক্ষাৎকারের জন্য।

ঠিক একই সময়ে ডর্স ভেনাবিলিও অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু তার অনুপস্থিতি অনেকক্ষণ কারো চোখে পড়ল না। যখন পড়ল তখন হালকা উৎসবের আমেজটা দ্রুত পরিণত হলো উৎকণ্ঠায়।

.

১৪.

দশটা বছর ডর্স ভেনাবিলি ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডে বাস করেছে। ফার্স্ট মিনিস্টারের স্ত্রী হওয়ার বদৌলতে সে যখন তখন গ্রাউণ্ডে বা গম্বুজ থেকে খোলা প্রান্তরে ঢুকতে পারত, আঙ্গুলের ছোঁয়াই ছিল তার পাস।

ক্লীয়নের হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী বিশৃঙ্খলাতে তার পাস মোছা হয় নি, এবং সেই ভয়ংকর দিনটার অনেকদিন পর সে আবার নির্বিঘ্নে গম্বুজ থেকে গ্রাউণ্ডের উন্মুক্ত প্রান্তরে ঢুকে পড়ল।

সে জানে যে মাত্র একবারই কাজটা করতে পারবে, কারণ ধরা পড়ার সাথে সাথেই তার পাস বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তার একবারই দরকার।

খোলা প্রান্তরে বেরনোর সাথে সাথে আকাশটাকে আরো কালো মনে হলো, তাপমাত্রাও কমে গেল খানিকটা। গম্বুজের নিচের জগতে রাতের বেলায় আলো খানিকটা কমিয়ে রাখা হয় আর দিনের বেলায় খানিকটা বাড়িয়ে রাখা হয়। এবং অবশ্যই তাপমাত্রা থাকে বাইরের চেয়ে অনেক বেশী উপভোগ্য।

অধিকাংশ ট্র্যানটরিয়ানই ব্যাপারটা জানে না কারণ তাদের সারাটা জীবন গম্বুজের ভেতরেই কাটে। ডর্সের কাছে এটা প্রত্যাশিত তাই মাথা ঘামাল না।

ডোমস এজ হোটেল যে গম্বুজের ভেতর সেটা থেকে বেরিয়ে প্রধান সড়ক ধরে হাঁটা শুরু করল সে। রাস্তাটা চমৎকারভাবে আলোকিত আর তাই অন্ধকার আকাশটাকে আর অন্ধকার বলে মনে হলো না।

ডর্স জানে যে ধরা না পড়ে সে একশ মিটারও এগোতে পারবে না। বিশেষ করে। জান্তা এখন যে পরিমাণ আতংকে আছে তাতে তার অবৈধ অনুপ্রবেশ সাথে সাথে ধরা পড়বে।

তার ধারণা বাস্তবে পরিণত হলো। ছোট একটা গ্রাউণ্ড কার এগিয়ে এল। জানালা দিয়ে চীৎকার করে জিজ্ঞেস করল গার্ড, “কে তুমি? কোথায় যাচ্ছ?”

ডর্স কোনো জবাব দিল না হাঁটাও থামাল না।

গার্ড আবার চীৎকার করল, “হল্ট।” তারপর গাড়ি থামিয়ে মাটিতে নামল, আর ঠিক এটাই চাইছিল ডর্স।

অলস ভঙ্গীতে হাতে ব্লাস্টার ধরে রেখেছে গার্ড, ব্যবহার করার জন্য নয় শুধু দেখানোর জন্য। “তোমার রেফারেন্স নাম্বার।”

“তোমার গাড়িটা আমার দরকার।” জবাব দিল ডর্স।

“কি!” রাগে চীৎকার করল গার্ড। “রেফারেন্স নাম্বার। জলদি!”

“আমার রেফারেন্স নাম্বার তোমার দরকার নেই।” শান্ত সুরে বলল ডর্স। তারপর গার্ডের দিকে হাঁটা শুরু করল।

এক পা পিছিয়ে গেল গার্ড। “তুমি যদি না থামো আর রেফারেন্স নাম্বার না বল, আমি তোমাকে ব্লাস্ট করব।”।

“না! ব্লাস্টার ফেলে দাও।”

গার্ডের ঠোঁট শক্ত হয়ে চেপে বসল। কিন্তু কন্টাক্টের উপর আঙ্গুল চেপে বসার আগেই ধরাশায়ী হয়ে গেল সে।–কি ঘটেছিল তা সে কখনোই সঠিকভাবে বলতে পারে নি। শুধু এটাই বলতে পেরেছিল যে, “আমি কিভাবে জানব যে সে টাইগার ওমেন।” (একটা সময় আসবে যখন এই ঘটনা নিয়ে সে গর্ব বোধ করবে।) “সে এতো দ্রুত আক্রমণ করেছে যে আমি কিছু দেখতেই পাই নি। আমি তাকে ব্লাস্ট করার চেষ্টা করলাম–ধরে নিয়েছিলাম সে কোনো পাগলাটে মেয়ে মানুষ কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে যা ঘটেছিল তা অবিশ্বাস্য।”

ডর্স বজ্র আটুনিতে চেপে ধরল গার্ডকে। ব্লাস্টার ধরা হাতটাকে চাপ দিয়ে উপরে তুলে বলল, “ব্লাস্টার ফেলে দাও নইলে তোমার হাত ভেঙে দেব।

গার্ড টের পেল তার বুকে একটা জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে। শ্বাস নিতে পারছে না। বুঝতে পারল কোনো উপায় নেই। ব্লাস্টার ফেলে দিল।

তাকে ছেড়ে দিল ডর্স ভেনাবিলি। কিন্তু পাল্টা কিছু করার আগেই ডর্সের হাতে ধরা তার নিজেরই ব্লাস্টারের মুখোমুখী আবিষ্কার করল নিজেকে।

ডর্স বলল, “আশা করি তোমার ডিটেকটরগুলো জায়গামতোই আছে। এখনি রিপোর্ট করার দরকার নেই। আগেই ভেবে রাখো উধ্বতনের কাছে কি বলবে। সত্যি কথা হচ্ছে যে একজন নিরস্ত্র মেয়েমানুষ তোমার গাড়ি আর ব্লাস্টার কেড়ে নিয়েছে এটা শোনার পর জান্তার কাছে তোমার প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবে।”

গাড়ি চালু করে প্রধান সড়ক ধরে ছুটল ডর্স। দশ বছর এখানে বাস করার ফলে সে কোথায় যাচ্ছে তা ভালো করেই জানে। গাড়িটা অফিশিয়াল গ্রাউণ্ড কার–অচেনা অনুপ্রবেশকারী নয় এবং কেউ থামাবে না। যদিও গতি নিয়ে একটু দুঃশ্চিন্তা আছে কিন্তু তাকে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। তাই ঘণ্টায় দুশ কিলোমিটার বেগে চালাতে লাগল।

মনযোগ আকৃষ্ট হলো শেষ পর্যন্ত। রেডিওর চীৎকারটাকে পাত্তা দিল না আর ডিটেক্টর জানিয়ে দিল পিছনে আরেকটা গ্রাউণ্ড কার তাকে ধাওয়া করছে।

জানে যে খবর পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, সামনে আরো গ্রাউণ্ড কার অপেক্ষা করবে, কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, ব্লাস্ট করে তাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে–অসম্ভব, আরো তদন্ত না করে এই কাজ তারা করবে না।

যে ভবনটার উদ্দেশ্যে ছুটে এসেছে সেখানে পৌঁছে দেখল আরো দুটো গ্রাউণ্ড কার অপেক্ষা করছে তার জন্য। দ্রুত নিজের কার থেকে নেমে প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে গেল সে।

দুজন গার্ড তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল, প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা গাড়ির চালক বেসামরিক পোশাকের এক মহিলা দেখে নিঃসন্দেহে অবাক হয়েছে তারা।

“এখানে কি করছ তুমি? এতো তাড়াহুড়ো কিসের?”

“কর্ণেল হিল্ডার লিনের জন্য জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছি,” শান্তসুরে বলল ডর্স।

“তাই নাকি?” গার্ডের কণ্ঠ কর্কশ। এখন তার আর প্রবেশ পথের মাঝখানে চারজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। “রেফারেন্স নাম্বার।”

“আমাকে দেরী করিয়ে দিও না।”

“রেফারেন্স নাম্বার।”

“তুমি আমার সময় নষ্ট করছ।”

হঠাৎ এক গার্ড বলল, “ওর চেহারাটা কার মতো জানো? আগের ফাস্ট মিনিস্টারের স্ত্রী ড. ভেনাবিলির মতো। দ্য টাইগার ওমেন।”

হতচকিত হয়ে চারজনই কয়েক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু একজন বলল, “তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।”

“তাই নাকি?” ডর্স বলল। “আমিই টাইগার ওমেন, কাজেই তোমরা জানো যে আমি তোমাদের চারজনের চেয়ে বেশী শক্তিশালী আর আমার রিফ্লেক্স অনেক বেশী দ্রুত। সুতরাং আমার পরামর্শ হচ্ছে, সুবোধ বালকের মতো তোমরা আমাকে ভেতরে নিয়ে যাও, তারপর দেখা যাক কর্ণেল লিন কি বলে।”

“তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো,” একই কথার পুনরাবৃত্তি এবং সেই সাথে চারটা ব্লাস্টার ডর্সের দিকে ধরা হলো।

“বেশ, তোমরা আমাকে বাধ্য করলে।”

বিদ্যুৎ বেগে আঘাত করল সে, দুজন গার্ড ধরাশায়ী হয়ে মাটিতে পড়ে গেল, ব্যথায় কাতড়াচ্ছে, কিন্তু ডর্স অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, তার দুহাতে দুটো ব্লাস্টার।

“আমি আঘাত করতে চাই নি, কিন্তু মনে হচ্ছে ওদের দুজনের কব্জি ভেঙ্গে গেছে। বাকী রইলে তোমরা দুজন আর আমি তোমাদের চেয়ে দ্রুত শু্যট করতে। পারব। তোমাদের কেউ যদি একচুল নড়–একচুলও নড়–তাহলে জীবনে কখনো যে কাজটা করি নি সেটাই করতে হবে। তোমাদের খুন করতে হবে। আমি তা করতে চাই না এবং তোমাদের অনুরোধ করছি আমাকে বাধ্য করো না।”

দুই গার্ড কোনো জবাব দিল না, দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মতো।

“আমার পরামর্শ শোনো। তোমরা দুজন আমাকে কর্ণেলের কাছে নিয়ে যাও তারপর ফিরে এসে আহত সঙ্গী দুজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।

পরামর্শটার দরকার ছিল না। কর্ণেল লিন তার অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছে। “কি হচ্ছে এখানে? কি–“

ডর্স তার দিকে ঘুরল। “আহ্! প্রথমে আমার পরিচয় দেই। আমি ড, ডর্স ভেনাবিলি, প্রফেসর হ্যারি সেলডনের স্ত্রী। অত্যন্ত জরুরী একটা বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলার জন্য এসেছি। এই চারজন আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, ফলে দুজন মারাত্মক আহত হয়। ওদের চলে যেতে বলুন। তারপর আমরা একটু কথা বলি। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না।”

লিন পালাক্রমে চার গার্ড এবং ডর্সের দিকে তাকাল। তারপর বলল, “আমার কোনো ক্ষতি করবেন না বলছেন? চারজন গার্ড যদিও আপনাকে থামাতে পারে নি। কিন্তু আমি বলামাত্রই চার হাজার গার্ড চলে আসবে।”

“ডাকুন তাদের। কিন্তু যত দ্রুতই এখানে আসুক না কেন সেটা আপনাকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট নয়, যদি আমি আপনাকে খুন করতে চাই। গার্ডদের চলে যেতে বলুন তারপর আসুন আমরা ভদ্রলোকের মতো কথা বলি।”

গার্ডদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে লিন বলল, “বেশ। ভেতরে চলুন। কথা বলি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, ড. ভেনাবিলি–আমি সহজে কিছু ভুলি না।”

“আমিও না,” জবাব দিল ডর্স। দুজনে একসাথে লিনের কোয়ার্টারে প্রবেশ করল।

.

১৫.

ভীষণ মার্জিত ভঙ্গীতে লিন জিজ্ঞেস করল, “বলুন ড. ভেনাবিলি, কেন আপনি এখানে এসেছেন?”

ডর্সের হাসিতে কোনো ক্রুঢ়তা ছিল না। আবার তাতে বন্ধুত্বের কোনো আহ্বানও নেই। প্রথমত: আমি এখানে এসেছি শুধু আপনাকে দেখানোর জন্য যে আমি এখানে আসতে পারি।”

“আহ?”

“হ্যাঁ। একটা অফিশিয়াল গ্রাউণ্ড কারে উঠিয়ে সশস্ত্র রক্ষীরা আমার স্বামীকে নিয়ে এসেছে জেনারেলের সাথে মিটিং-এর জন্য। ঠিক একই সময়ে আমিও হোটেল ছেড়ে বের হই, পায়ে হেঁটে এবং নিরস্ত্র অবস্থায় এবং আমি এখানে পৌঁছেছি এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তার আগেই পৌঁছেছি। পাঁচজন গার্ডকে মোকাবেলা করে এখানে আসতে হয়েছে আমাকে, যে গার্ডের গাড়ি ছিনতাই করেছি তাকে সহ। পঞ্চাশজন গার্ড মোকাবেলা করতে হলেও সমস্যা হতো না।”

সমর্থনের ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল লিন, “বুঝতে পারছি কেন আপনাকে টাইগার ওমেন ডাকা হয়।”

“আমাকে ওই নামেই ডাকা হয়। যাইহোক এখানে পৌঁছানোর পর প্রথম কাজ হচ্ছে আমার স্বামীর যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেটা নিশ্চিত করা। আমার স্বামী এখন জেনারেলের কজায়–এবং আমি চাই ওখান থেকে সে নিরাপদে এবং নির্বিঘ্নে বেরিয়ে আসবে।”

“যতদূর জানি এই মিটিং-এর কারণে আপনার স্বামীর কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু আপনার এতো দুঃশ্চিন্তা হলে আমার কাছে এসেছেন কেন? সরাসরি জেনারেলের কাছে যান নি কেন?”

“কারণ আমার মতে, দুজনের মধ্যে আপনার মাথাতেই বুদ্ধি আছে।”

খানিক নিশ্চুপ থেকে লিন বলল, “বিপজ্জনক একটা মন্তব্য হতে পারে–যদি কেউ শুনে ফেলে।”

“আমার চেয়ে আপনার জন্যই বেশী বিপজ্জনক। কাজেই কেউ যেন শুনতে না পারে সেই ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে। আপনি যদি ভেবে থাকেন আমাকে একটু আশ্বস্ত করলেই চলে যাব, তারপর আমার স্বামীকে বন্দী করে রাখবেন, মৃত্যুদণ্ড দেবেন, আর আমি কিছুই করতে পারব না, তাহলে সেটা আপনার দিবাস্বপ্ন।”

টেবিলের উপর পড়ে থাকা ব্লাস্টার দুটো দেখাল সে। “গ্রাউণ্ডে প্রবেশ করেছি। খালি হাতে। আপনার কাছাকাছি যখন পৌঁছাই তখন আমার হাতে দুটো ব্লাস্টার। ব্লাস্টার না থাকলেও ছুরি থাকত, ছুরি চালানোতে আমি ভীষণ দক্ষ। এমনকি ব্লাস্টার বা ছুরি ছাড়াও আমি ভীষণ বিপজ্জনক। আমরা যে টেবিলে বসে আছি তা ধাতুর তৈরি–নিঃসন্দেহে মজবুত।”

“হ্যাঁ।”

হাত উপরে তুলল ডর্স, আঙ্গুলগুলো ছড়ানো, যেন সে যে নিরস্ত্র এটাই প্রমাণ করছে। করতল নিম্নমুখী করে টেবিলের সারফেসে হাত রাখল।

তারপর আলতো ভঙ্গীতে হাত উপরে তুলে ঝট করে আঘাত করল টেবিলের উপর। প্রচণ্ড শব্দ হলো, অনেকটা ধাতুর সাথে ধাতুর সংঘর্ষের কর্কশ শব্দের মতো।

“আমার কিছু হয় নি,” ডর্স বলল, “একটুও ব্যথা পাই নি। কিন্তু দেখুন যেখানে আঘাত করেছি টেবিলের সেই জায়গাটা বাঁকা হয়ে গেছে। এইরকম একটা আঘাত যদি একই রকম শক্তিতে কোনো ব্যক্তির মাথার উপর পড়ে তবে তার মাথার খুলি পাউডারের মতো গুড়ো হয়ে যাবে। আমি এই ধরনের নৃশংস কাজ কখনো করি নি; সত্যি কথা বলতে কি আমি কখনো মানুষ হত্যা করি নি, যদিও আহত করেছি অনেককে। যাইহোক, যদি প্রফেসর সেলডনের কোনো ক্ষতি হয়–“

“আপনি এখনো হুমকি দিচ্ছেন।”

“আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যদি প্রফেসর সেলডন অক্ষত থাকেন তাহলে আমি কিছুই করব না। অন্যথায়, কর্ণেল লিন, আমি আপনাকে পঙ্গু করতে বা খুন করতে বাধ্য হব এবং আবারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি–জেনারেল ট্যানারেরও একই অবস্থা করে ছাড়ব।”

“আপনি যত বড় বাঘিনীই হন না কেন, পুরো একটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।”

“গল্প ছড়ায়, ডালপালা সহকারে ছড়ায়। বাঘিনীর মতো কিছুই করি নি আমি, অথচ আমাকে নিয়ে অনেক গল্প ছড়িয়েছে যার অধিকাংশই সত্যি নয়। আমাকে চিনতে পেরেই আপনার গার্ডরা ভয় পেয়ে যায়। ওরাই সত্য মিথ্যা মিশিয়ে ছড়াবে কেমন করে আমি আপনার কাছে পৌঁছেছি। এমনকি হয়তো সেনাবাহিনীও আমাকে মারতে করতে ভয় পাবে, কর্ণেল লিন। তারপরেও যদি ওরা আমাকে হত্যা করতে সফল হয়, জনগণের ক্ষোভের কথাটা মাথায় রাখবেন। জান্তা হয়তো এখনো ক্ষমতা ধরে রেখেছে কিন্তু সেটা খুব নড়বড়ে। আপনি নিশ্চয়ই পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তুলতে চান না। তাই একেবারে সহজ বিকল্পটা নিয়ে মাথা ঘামান। খুবই সহজ। শুধু প্রফেসর সেলডনের কোনো ক্ষতি করবেন না।”

“ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই।”

“তাহলে এই সাক্ষাঙ্কার কেন?”

“এখানে তো কোনো রহস্য নেই? জেনারেল সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে আগ্রহী। সরকারী রেকর্ড আমাদের জন্য উন্মুক্ত। সম্রাট ক্লীয়ন আগ্রহী ছিল। ফাস্ট মিনিস্টার থাকা কালীন ডেমারজেল আগ্রহী ছিল। তাহলে আমরা কেন আগ্রহী হব না? বরং আরো বেশী।”

“বেশী কেন?”

“কারণ অনেক সময় পার হয়েছে। যতদূর জানি সাইকোহিস্টোরির জন্ম হয় প্রফেসর সেলডনের মাথার ভেতর ছোট একটা ধারণার মতো। তিনি বিষয়টা নিয়ে কাজ করছেন। দিনে দিনে এর পরিধি বেড়েছে, লোকবল বেড়েছে, প্রায় ত্রিশ বছর। পুরোটাই তিনি করেছেন সরকারী আর্থিক সহায়তায়। এই দিক দিয়ে তার আবিষ্কারের একমাত্র দাবীদার সরকার। আমরা তার কাছ থেকে সাইকোহিস্টোরির কথা জানতে চাই, যা এতদিনে অনেক অগ্রসর হয়েছে অন্তত ডেমারজেল এবং ক্লীয়নের আমলে যা ছিল তার চেয়ে বেশী, এবং আমরা আশা করি তিনি আমাদের সব জানাবেন। কারো দৃষ্টির সামনে ঝুলন্ত আকাবাকা সমীকরণ চাই না আমরা, বরং আরো বাস্তব কিছু চাই। আমার কথা বুঝতে পারছেন।

“হ্যাঁ,” ভুরু কুঁচকে জবাব দিল ডর্স।

“আরেকটা কথা। ভাববেন না যে কেবল সরকারই আপনার স্বামীর ক্ষতি করতে চায় বা তার কোনো ক্ষতি হলেই আমাদেরকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেবেন। বরং আমার ধারণা প্রফেসর সেলডনের ব্যক্তিগত শত্রু থাকতে পারে। যদিও কোনো তথ্য নেই, তবে থাকাটা অসম্ভব নয়।”

“কথাটা আমি মনে রাখব। কিন্তু এখন আমি চাই আলোচনা চলাকালীন আমি যেন আমার স্বামীর পাশে থাকতে পারি আপনি সেই ব্যবস্থা করবেন। শুধু মুখের কথা নয় আমি নিজের চোখে দেখতে চাই যে তিনি নিরাপদে আছেন।”

“ব্যবস্থা করা কঠিন এবং অনেক সময় লাগবে। আলোচনার মাঝখানে বাধা দেয়া অসম্ভব, কিন্তু আপনি যদি অপেক্ষা করেন–“

“যত সময় লাগে লাগুক, আপনি ব্যবস্থা করেন। আমাকে ধোকা দিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন সেই আশা করবেন না।”

.

১৬.

জেনারেল ট্যানার বিরূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেলডনের দিকে আর আঙ্গুলের ডগা দিয়ে ডেস্কের উপর তবলা বাজাচ্ছে।

“ত্রিশ বছর,” সে বলল, “ত্রিশ বছর পার করার পরেও তুমি বলছ যে আমাকে দেয়ার মতো কিছু নেই তোমার কাছে।”

“আসলে, জেনারেল, আঠাশ বছর।”

মন্তব্যটা আমলে নিল না জেনারেল। “আর সবকিছুই হয়েছে সরকারি খরচে। তুমি জানো, প্রফেসর, কত বিলিয়ন ক্রেডিট তোমার এই প্রজেক্টে ঢালা হয়েছে?”

“সঠিক সংখ্যাটা বলতে পারব না, জেনারেল, কিন্তু রেকর্ড আছে, সেখান থেকে এক সেকেণ্ডেই আপনার প্রশ্নের উত্তর বের করা যাবে।”

“আমাদের কাছেও আছে। সরকার, প্রফেসর, অফুরন্ত তহবিলের উৎস নয়। সময় পাল্টে গেছে। ক্লীয়নের মতো অর্থায়নের ক্ষেত্রে নমনীয় মনোভাব আমরা দেখাতে পারি না। কর বাড়ানো এক কথায় অসম্ভব অথচ জরুরী অনেক প্রয়োজনেই। আমাদের ক্রেডিট দরকার। তোমাকে ডেকে এনেছি এই আশায় যে তুমি হয়তো সাইকোহিস্টোরি দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারবে। যদি না পারো তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সরাসরিই বলতে হচ্ছে যে এই প্রজেক্টে অর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই গবেষণা চালিয়ে যেতে পার, তাহলে চালিয়ে যাও অন্যথায় আমাকে এমন কিছু দেখাও যাতে এই বিপুল পরিমাণ ব্যয়টাকে যথার্থ বলে মনে হয়।”

“জেনারেল, আপনি আমার কাছে এমন একটা দাবী তুলেছেন যা আমি পুরণ করতে পারব না, কিন্তু আপনি যদি সরকারী সহায়তা বন্ধ করে দেন তাহলে আপনি ভবিষ্যত ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। আমাকে সময় দিন এবং নিশ্চয় একদিন–“

“অনেক সরকারই তোমার মুখ থেকে এই নিশ্চয়ই ‘একদিন’ কথাটা দশকের পর দশক বারবার শুনেছে। এই কথাটা কি সত্যি যে তোমার সাইকোহিস্টোরি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে জান্তার ভিত্তি অস্থিতিশীল, আমার সরকারের অবস্থা অস্থিতিশীল, কিছুদিনের মধ্যেই আমার সরকারের পতন ঘটবে?”

ভুরু কোঁচকালেন সেলডন। “আমার কৌশলটা এখনো সেইরকম পরিপক্ক হয় নি যার সাহায্যে বলতে পারব যে সাইকোহিস্টোরি ঠিক এইরকমই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে।”

“আমি বলছি যে সাইকোহিস্টোরি এইরকমই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবং তোমার প্রজেক্টে এটা প্রচলিত ধারণা।”

“না,” রেগে গেলেন সেলডন। “এরকম কিছুই নেই। হয়তো আমাদেরই কয়েকজন কিছু সমীকরণের যোগসূত্রকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে জান্তা অস্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা, কিন্তু আরো অনেক সমীকরণ আছে যেগুলো দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে যে এটা স্থিতিশীল। আর এই কারণেই আমাদেরকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে অপর্যাপ্ত তথ্য এবং রিজনিং এর মাধ্যমে অসম্পূর্ণ উপসংহারে পৌঁছানো সহজ।”

“কিন্তু তুমি যদি এইভাবে সিদ্ধান্তটা ব্যাখ্যা কর যে সরকার অস্থিতিশীল এবং সাইকোহিস্টারি তা প্রমাণ করেছে-তখন প্রকৃত অবস্থা যাই হোক না কেন আমাদের অবস্থান অস্থিতিশীল করে তুলবে না?”

“তাই হবে, জেনারেল, এবং আমরা যদি ঘোষণা করি যে সরকার স্থিতিশীল, তখন অবশ্যই স্থিতিশীলতা তৈরি হবে। এই কথাটা আমি বহুবার সম্রাট ক্লীয়নকে বুঝিয়ে বলেছি। সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে কৌশলে জনগণের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে স্বল্পমেয়াদী সফলতা অর্জন সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী অসম্পূর্ণ এবং ভুল প্রমাণিত হবে। তখন সাইকোহিস্টোরির আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”

“যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে সরাসরি বল। তোমার মতে সাইকোহিস্টোরি আমার সরকারের ব্যাপারে কি প্রমাণ করেছে?”

“প্রমাণ করেছে, আমাদের ধারণা অনুযায়ী, আপনার সরকারে অস্থিতিশীলতার উপাদান বিদ্যমান কিন্তু আমরা নিশ্চিত নই–এবং নিশ্চিত হতেও পারব না–ঠিক কিভাবে পরিস্থিতি আরো খারাপ বা ভালো করে তোলা যাবে।”

“অন্য কথায় সাইকোহিস্টোরি তোমাকে তাই বলেছে যা সাইকোহিস্টোরির সাহায্য ছাড়াই বলা যায়, আর এই অপ্রয়োজনীয় খাতে সরকার বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ ক্রেডিট বিনিয়োগ করেছে।”

“সময় একদিন আসবে যেদিন সাইকোহিস্টোরি আমাদেরকে সেই কথাই বলবে যা এর সাহায্য ছাড়া বলা সম্ভব নয়, তখন এই বিনিয়োগ হাজার হাজার গুণ হয়ে ফিরে আসবে।”

“সেই সময় আসতে আর কতদিন লাগবে?”

“আশা করি আর বেশীদিন লাগবে না। গত কয়েক বছরে আমাদের সন্তে ষিজনক অগ্রগতি হয়েছে।”

ট্যানার আবার ডেস্কে তবলা বাজানো শুরু করল। “যথেষ্ট নয়। এই মুহূর্তে আমার সাহায্যে আসবে সেই রকম কিছু বল। কাজের কিছু।”

কিছুক্ষণ ভাবলেন সেলডন, তারপর বললেন, “আমি আপনাকে একটা বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করে দিতে পারি, কিন্তু তার জন্য সময় লাগবে।”

“অবশ্যই সময় লাগবে। দিন, মাস, বছর। কিন্তু রিপোর্ট আর কোনোদিনই তৈরি হবে না। আমাকে বোকা পেয়েছ?”

“অবশ্যই না, জেনারেল। কিন্তু আমিও বোকা নই। আপনাকে একটা ব্যাখ্যা দিতে পারি। যা বলব তার পুরো দায়দায়িত্ব আমার। সাইকোহিস্টোরি গবেষণায় বিষয়টা আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু যা দেখেছি তার যে ব্যাখ্যা দেব সেটা আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু আপনি যখন বলছেন–“

“হ্যাঁ, বলছি।”

“আপনি কিছুক্ষণ আগে করের কথা বলেছেন। আপনি বলেছেন যে কর বাড়ানো কঠিন। নিঃসন্দেহে। সবসময়ই কঠিন ছিল। প্রতিটি সরকারকেই একভাবে না একভাবে সম্পদ সংগ্রহ করে কার্য নির্বাহ করতে হয়। যে দুটো মাত্র উপায়ে প্রয়োজনীয় ক্রেডিট সংগ্রহ করা যায় সেগুলো হচ্ছে, এক, প্রতিবেশীদের উপর লুটপাট চালিয়ে অথবা দুই, সরকার তার জনগণকে স্বেচ্ছায়, শান্তিপূর্ণভাবে প্রয়োজনীয় ক্রেডিট সরবরাহের জন্য আগ্রহী করে তুলতে পারে।

“যেহেতু আমরা একটা গ্যালাকটিক এম্পায়ার গড়ে তুলেছি যে এম্পায়ার হাজার হাজার বছর ধরে সমান অধিকারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে আসছে। এই অবস্থায় প্রতিবেশীদের উপর লুটপাট চালানো অসম্ভব, শুধুমাত্র কোনো ধরনের বিদ্রোহ বা জনঅসন্তোষের ঘটনা ছাড়া। কিন্তু সেই ধরনের ঘটনা তো প্রায়ই ঘটে না যা দিয়ে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগৃহীত হবে। আর যদি নিয়মিত ঘটে তাহলে সরকার এতো বেশী অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে যে বেশীদিন টিকবে না।”

গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সেলডন তার বক্তব্য চালিয়ে যেতে লাগলেন। “কাজেই, সরকারের হাতে সম্পদের কিছু অংশ তুলে দেয়ার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানিয়েই ক্রেডিট সংগ্রহ করতে হবে।

“অনুরোধটা যুক্তিসঙ্গত হলেও এবং স্থিতিশীল, দক্ষ সরকার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত কর দেয়া জনগণের উচিত হলেও তারা সেটা স্বেচ্ছায় করতে চায় না। তাদের এই অনীহা দূর করার জন্য সরকারকে প্রমাণ করতে হয় যে তারা অতিরিক্ত ক্রেডিট আদায় করছে না এবং প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও সুবিধার প্রতি তারা সচেতন। অর্থাৎ, স্বল্প আয়ের উপর কম হারে কর আরোপ, কর নির্ধারণের সময় বিভিন্ন রকম কর রেয়াতের ব্যবস্থা রাখা এরকম অনেক কৌশল অবলম্বন করা।

“সময়ের সাথে সাথে, প্রতিটি গ্রহ, প্রতিটি গ্রহের অভ্যন্তরস্থ প্রতিটি সেক্টর, প্রতিটি অর্থনৈতিক বিভাজনের চাহিদা এবং যেহেতু তারা বিশেষ সুবিধা দাবী করে, কর ব্যবস্থা দিনে দিনে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে। ফলশ্রুতিতে সরকারের কর আদায় শাখার আয়তন এবং জটিলতা এতো বেড়ে যাবে যে তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। একজন সাধারণ নাগরিক বুঝতেই পারবে না সে কেন এবং কি পরিমাণ কর দিচ্ছে। সরকার এবং কর আদায়কারী সংস্থারও একই অবস্থা হবে।

“সবচেয়ে বড় কথা, যে ফাণ্ড সংগৃহীত হবে তার বিশাল অংশ ব্যয় করতে হবে সুবিশাল কর আদায়কারী সংস্থার পেছনেই–রেকর্ড রাখা, কর্মচারীদের বেতন সুতরাং যাই করি না কেন সত্যিকার ভালো এবং কার্যকরী উদ্দেশ্যের জন্য পর্যাপ্ত ফাণ্ড কখনোই পাওয়া যাবে না।

“পরিশেষে, কর ব্যবস্থা হয়ে পড়বে অর্থহীন। জনগণের ভেতর অসন্তোষ এবং বিদ্রোহ তৈরি হবে। ইতিহাস যদিও এর জন্য দায়ী করে লোভী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, নৃশংস সেনাপতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাইসরয়–কিন্তু এই ব্যক্তিরা শুধুমাত্র অতিরিক্ত জটিল কর ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে লাভবান হয়।”

“তুমি বলতে চাও আমাদের কর ব্যবস্থা অত্যাধিক জটিল।” কর্কশ সুরে বলল জেনারেল।

“যদি না হয়, তাহলে আমি বলব যে ইতিহাসে এটাই একমাত্র কর ব্যবস্থা যার কোনো জটিলতা নেই। সাইকোহিস্টোরি আমার কাছে যদি কোনোকিছু স্পষ্ট করে প্রমাণ করে থাকে সেটা হচ্ছে অতিরিক্ত জটিল কর ব্যবস্থা।”

“এই ব্যাপারে কি করা যায়?”

“সেটা আমি বলতে পারব না। আর সেই জন্যই রিপোর্ট তৈরি করতে চাই কিন্তু সময় লাগবে।”

“রিপোর্টের কথা ভুলে যাও। কর ব্যবস্থা অত্যধিক জটিল, তাই না? এটাই তো বলছ তুমি?”

“সম্ভবত তাই।” সাবধানে জবাব দিলেন সেলডন।

“আর এটা সংশোধনের জন্য, কর ব্যবস্থাকে সরল করতে হবে–যতদূর সরল করা যায়।”

“আমাকে আরো গবেষণা–“

“বোকা। অত্যধিক জটিলতার উল্টোটাই হচ্ছে অত্যধিক সরলতা। এটা বলার জন্য কোনো রিপোর্ট দরকার নেই।”

“আপনি যা বলেন, জেনারেল।” ঠিক সেই মুহূর্তেই জেনারেল হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল, যেন তাকে কেউ ডাকছে–আসলেই ডাকছে। হাত মুঠো করল সে আর আচমকা কর্ণেল লিন এবং ডর্স ভেনাবিলির হলোভীশন প্রতিচ্ছবি কামরার ভেতর ফুটে উঠল।

বজ্রাহতের মতো চীৎকার করলেন সেলডন। “ডর্স! তুমি এখানে কি করছ?”

জেনারেল কিছু বলল না। কিন্তু তার ভুরু ভয়ংকর ভঙ্গীতে বাঁকা হয়ে গেছে।

.

১৭.

জেনারেলের রাতটা ভালো কাটে নি, লিনেরও একই অবস্থা, দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে–পর্যদস্ত।

“মেয়েটা কি করেছে আবার বল আমাকে।” জেনারেল বলল। লিনকে দেখে মনে হচ্ছে তার কাঁধে একটা বিশাল বোঝা চাপানো। এই মেয়েটাই টাইগার ওমেন। মানুষ তাকে এই ছদ্ম নামেই ডাকে। তাকে ঠিক মানুষ বলে মনে হয় না, অস্বাভাবিক প্রশিক্ষণ পাওয়া অ্যাথলেট, অসম্ভব আত্মবিশ্বাস, এবং জেনারেল, সে সত্যি ভয় পাওয়ার মতো।”

“সে তোমাকে ভয় পাইয়েছে? একটা মেয়েমানুষ?”

“আপনাকে বলছি সে কি করেছে এবং তার ব্যাপারে আরো দুএকটা কথা শুনে নিন। গল্পগুলো কতখানি সত্যি আমি জানি না কিন্তু গত সন্ধ্যায় যা করেছে সেটা

সত্যি এবং তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”

গল্পটা সে আবার বলল।

 “খুব খারাপ। আমরা কি পদক্ষেপ নিয়েছি?”

“কি করতে হবে সেটা আমাদের সামনে পরিষ্কার। আমরা সাইকোহিস্টোরি চাই ।

“হ্যাঁ, চাই। সেলডন আমাকে কর ব্যবস্থার ব্যাপারে–বাদ দাও। সেটা এই। মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি বলে যাও।”

বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থার কারণে লিনের চেহারায় খানিকটা অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল। “যা বলছিলাম, আমরা সেলডনকে বাদ দিয়েই সাইকোহিস্টোরি পেতে চাই। সে মোটামুটি ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। লোকটাকে যতই দেখছি ততই মনে হচ্ছে সে একজন বৃদ্ধ পণ্ডিত যে তার অতীত সাফল্যে বুঁদ হয়ে আছে। ত্রিশ বছর সময় পেয়েও সফল হতে পারে নি। তাকে বাদ দিয়ে নতুন কারো নেতৃত্বে সাইকোহিস্টোরি হয়তো আরো দ্রুত অগ্রসর হবে।”

“হ্যাঁ, আমি একমত। এখানে মেয়েটা এল কোত্থেকে?”

“বেশ, এটাই আসল সমস্যা। আমরা তাকে গোনায় ধরি নি কারণ সে নিজেকে সবসময় আড়াল করে রাখে। কিন্তু এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে সে বেঁচে থাকলে নীরবে এবং সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া সেলডনকে এই প্রজেক্ট থেকে সরানো কঠিন, এক কথায় অসম্ভব।”

“তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর যে সে তোমাকে আর আমাকে সত্যি সত্যিই মেরে ফেলত–যদি তার পুরুষমানুষের কোনো ক্ষতি করতাম?” জেনারেলের ঠোঁটের কোণা ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গীতে বাঁকা হয়ে রয়েছে।

“আমি সত্যিই বিশ্বাস করি এবং সে একটা বিদ্রোহের সূত্রপাত করত–ঠিক এই হুমকিগুলোই দিয়েছিল।”

“তুমি একটা কাপুরুষ।”

“জেনারেল, প্লীজ। আমি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। পিছিয়ে যাওয়া বা হাল ছেড়ে দিচ্ছি না। এই টাইগার ওমেনের ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হবে আমাদের।” বিরতি নিয়ে একটু চিন্তা করল। “আসলে আমার সোর্স আমাকে এই কথাগুলো বলেছে এবং আমিও ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছি।”

“কিভাবে তুমি এই মেয়েটাকে সরাবে?”

“আমি জানি না, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “কিন্তু কেউ হয়তো জানে।”

.

১৮.

সেলডনের রাতটা ভালো কাটে নি। নতুন দিনটাও যে ভালো যাবে তেমন কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না। ডর্সের উপর রাগ করেছেন হ্যারি সেলডন এমন ঘটনা মাত্র হাতে গোনা কয়েকবার ঘটেছে। কিন্তু এবার তিনি অসম্ভব রেগেছেন।

“বোকার মতো একটা কাজ। সবাই ডোমস এজ হোটেলে থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো? আতংকিত সামরিক শাসকের মনে ষড়যন্ত্রের ভয় ঢোকানোর জন্য সেটাই কি যথেষ্ট ছিল না?”

“কিভাবে, হ্যারি? আমরা সবাই ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম, তোমার জন্মোৎসবের চূড়ান্ত পর্যায়। আমরা কোনোরকম হুমকি প্রদর্শন করি নি।”

“হ্যাঁ, তারপর তুমি প্যালেস গ্রাউণ্ডে অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। জেনারেলের সাথে আমার আলোচনায় বাধা দেয়ার জন্য প্যালেসে ছুটে গেলে। অথচ তোমাকে হাজারবার বলেছি যে–তুমি যাবে না। আমার নিজেরও কিছু পরিকল্পনা ছিল।”

“তোমার ইচ্ছা, তোমার আদেশ, তোমার পরিকল্পনা আসবে পরে, সর্বাগ্রে তোমার নিরাপত্তা। আমার প্রধান কাজই হচ্ছে সেটা।”

“আমার কোনো বিপদ হতো না।”

“এই বিষয়ে আমি কখনোই ঝুঁকি নিতে পারব না। তোমার জীবনের উপর দুবার হামলা হয়েছে। কেন ভাবছ তৃতীয়বার হবে না?”

“দুটো প্রচেষ্টাই হয়েছিল যখন আমি ছিলাম ফাস্ট মিনিস্টার। তখন সম্ভবত আমাকে হত্যা করে অনেকেই লাভবান হতো। কিন্তু এখন বৃদ্ধ এক গণিতবিদকে কে মারতে চাইবে?”

“সেটাই আমি জানতে চাই এবং থামাতে চাই। প্রজেক্টের সবাইকে জেরা করেই কাজটা শুরু করতে হবে।”

“না। ওদেরকে শুধু শুধু বিরক্ত করবে, ওদেরকে কাজ করতে দাও।”

“আমি পারব না। হ্যারি, আমার কাজ তোমাকে রক্ষা করা এবং আঠাশ বছর ধরে তা করছি। এখন তুমি আমাকে থামাতে পারবে না।”

তার দৃষ্টি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, সেলডনের ইচ্ছা বা আদেশ যাই হোক না কেন, ডর্স তার নিজের সিদ্ধান্ত মতোই কাজ করবে।

সেলডনের নিরাপত্তা সবার আগে।

.

১৯.

“তোমাকে একটু বিরক্ত করতে পারি, ইউগো?”

“নিশ্চয়ই,” গালভরা হাসির সাথে জবাব দিল ইউগো এমারিল। “তুমি আসলে আমি কখনোই বিরক্ত হই না। কি করতে পারি তোমার জন্য।”

“আমি কয়েকটা তথ্য বের করার চেষ্টা করছি, ইউগো, ভাবলাম তুমি হয়তো সাহায্য করতে পারবে।”

“সম্ভব হলে করব।”

“প্রজেক্টে তোমরা একটা নতুন জিনিস তৈরি করেছ। প্রাইম রেডিয়্যান্ট। ঘনঘনই এটার কথা শুনছি। হ্যারিও বেশ উচ্ছ্বসিত, জিনিসটা অ্যাকটিভেট করার পর কেমন দেখাবে সবার মুখে শুনে তার একটা ছবি মনে মনে তৈরি করেছিলাম, কিন্তু বাস্তবে

আমি কখনো দেখি নি। দেখতে চাই।”

এমারিলের চেহারায় অস্বস্তি ফুটে উঠল। “প্রাইম রেডিয়্যান্ট সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টের সবচাইতে গোপনীয় এবং নিরাপত্তা বেষ্টিত বিষয়। যে সদস্যদের এই যন্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি আছে তাদের নামের তালিকায় তোমার নাম নেই।”

“আমি জানি, কিন্তু তোমার আর আমার পরিচয় আঠাশ বছরের–“

“এবং তুমি হ্যারির স্ত্রী। এটা একটা পয়েন্ট। আমাদের মাত্র দুটো স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাইম রেডিয়্যান্ট রয়েছে। একটা হ্যারির অফিসে আরেকটা এখানে। ওই যে।”

ডেস্কের উপর বসানো কালো কিউবটা দেখে অবাক হলো ডর্স। তেমন অসাধারণ কিছু মনে হলো না। এটাই।”

“এটাই। এর ভেতরেই আছে সমীকরণগুলো যে সমীকরণ ভবিষ্যৎ বর্ণনা করবে।“

“সমীকরণগুলো তুমি দেখবে কিভাবে?”

একটা বোতামে চাপ দিল এমারিল। কামরাটা অন্ধকার হয়েই আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। ডর্সের চারপাশে প্রতীক, তীর চিহ্ন, লাইন, হাজার ধরনের গাণিতিক চিহ্ন। অনবরত দৌড়াচ্ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, একটার সাথে আরেকটা প্যাচিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যখন সে নির্দিষ্ট একটা অংশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মনে হলো সেই অংশটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

“এটাই তাহলে ভবিষ্যৎ?”

“হয়তো বা,” যন্ত্রটা বন্ধ করে জবাব দিল এমারিল। “আমি সম্পূর্ণ পরিবর্ধিত করে দিয়েছিলাম যেন তুমি প্রতীকগুলো দেখতে পাও। এছাড়া কেউ খালি চোখে পড়তে পারবে না, শুধু আলো আর অন্ধকারের প্যাটার্ন দেখবে।”

“আর সমীকরণগুলো দেখে তোমরা বলতে পারবে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?”

“অন্তত তাত্ত্বিকভাবে,” জবাব দিল এমারিল। কামরাটা আবার আগের মতো আলোকিত হয়ে উঠেছে। তবে দুটো সমস্যা আছে।”

“তাই? কি সমস্যা?”

“প্রথমত: কোনো মানব মস্তিষ্ক সরাসরি এই সমীকরণগুলো তৈরি করে নি। দশকের পর দশক আমরা শুধু অধিক শক্তিসম্পন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করেছি, আর ওই যন্ত্রগুলোই সমীকরণগুলো তৈরি করেছে, কিন্তু আমরা বলতে পারছি না এগুলো বৈধ কিনা এবং কোনো অর্থ আছে কি না। পুরোপুরি নির্ভর করছে আমাদের তৈরি করা প্রোগ্রামগুলো কতখানি বৈধ এবং অর্থবহ তার উপর।”

“তাহলে সবগুলোই ভুল হতে পারে?”

“হতে পারে,” চোখ ডলল এমারিল। তার জন্য মমতা বোধ করল ডর্স। কত বুড়ো হয়ে গেছে সে, অথচ হ্যারির চেয়ে কমপক্ষে বারো বছরের ছোট। কিন্তু তাকেই বেশী বয়স্ক দেখায়।

“অবশ্য,” ক্লান্ত সুরে বলতে লাগল এমারিল, “আমরা বিশ্বাস করি সবগুলো ভুল হয় নি আর এখানেই দ্বিতীয় সমস্যার শুরু। আমি আর হ্যারি প্রথম থেকেই সমীকরণগুলো বার বার পরীক্ষা করে মডিফাই করেছি, কিন্তু ওগুলোর অর্থের ব্যাপারে কখনোই নিশ্চিত হতে পারি নি। কম্পিউটার এগুলো তৈরি করেছে, কাজেই আমরা ধরে নিয়েছি অর্থ একটা আছেই–কিন্তু কি সেটা? আমাদের বিশ্বাস কিছু অংশ আমরা বুঝতে পেরেছি। সত্যি কথা বলতে কি এই মুহূর্তে আমি সেকশন এ-২৩ নিয়ে কাজ করছি, সমীকরণের একটা বিশেষ ধরনের জটিল অংশ। এখন পর্যন্ত বাস্তব মহাবিশ্বের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি নি। তবে প্রতিটি বছরেই আমাদের সন্তে ষিজনক অগ্রগতি হচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সাইকোহিস্টোরি অচিরেই ভবিষ্যত নির্ধারণের একমাত্র কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”

“প্রাইম রেডিয়্যান্ট কতজন ব্যবহার করতে পারে?”

“প্রজেক্টের প্রত্যেক গণিতবিদই পারে, কিন্তু সেটা তাদের ইচ্ছামতো নয়। প্রথমে আবেদন করতে হয়, তারপর নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করা হয়, প্রাইম রেডিয়্যান্ট এমনভাবে এ্যাডজাস্ট করে দেয়া হয় যেন শুধুমাত্র আবেদনকৃত সমীকরণগুলোই দেখতে পারে। সমস্যা হয় যখন সবাই একসাথে ব্যবহার করতে চায়। এখন অবশ্য আবেদনের সংখ্যা কম, বোধহয় হ্যারির জন্মোৎসবের রেশ কাটে নি।”

“আরো প্রাইম রেডিয়্যান্ট তৈরির কোনো পরিকল্পনা আছে?”

“হ্যাঁ, এবং না। আরেকটা তৈরি করলে ভালোই হয় কিন্তু সেটার দায়িত্ব তো একজনকে দিতে হবে। সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা যাবে না। আমি টামউইল ইলারের কথা বলেছি–ইলারকে তুমি চেন–“

“হ্যাঁ, চিনি।”

“ইলারকেই তৃতীয় প্রাইম রেডিয়্যান্ট-এর দায়িত্ব দেয়া উচিত। তার অনৈরাজ্যক সমীকরণ এবং ইলেক্ট্রো ক্ল্যারিফায়ার তাকে প্রজেক্টের তিন নাম্বার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত করেছে–হ্যারি এবং আমার পরে। হ্যারি দ্বিধা করছে।”

“কেন দ্বিধা করছে? তুমি জান কিছু?”

“ইলার দায়িত্ব পেলে সরাসরিই প্রজেক্টের তিন নম্বর ব্যক্তিতে পরিণত হবে, বয়স্ক গণিতবিদ যারা দীর্ঘদিন থেকে প্রজেক্টের উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করছে তাদের টপকে তাদেরই মাথার উপর বসবে সে। তখন অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মনোমালিন্য তৈরি হতে পারে। আমার মতে এইসব ছোট খাটো বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই, কিন্তু হ্যারি–তুমি তো হ্যারিকে চেনই।

“হ্যাঁ, চিনি। তবে লিন প্রাইম রেডিয়্যান্ট দেখেছে।”

“লিন?”

“কর্ণেল হিল্ডার লিন, ট্যানারের চামচা।”

“অসম্ভব, ডর্স।”

“সে আমাকে প্যাচানো সমীকরণের কথা বলেছিল আর আমি এইমাত্র প্রাইম রেডিয়্যান্টে ঠিক সেটাই তৈরি হতে দেখলাম। জানি না কিভাবে কিন্তু আমার ধারণা সে এখানে এসে প্রাইম রেডিয়্যান্টের কাজ করার কৌশল দেখে গেছে।”

মাথা নাড়ল এমারিল। “আমি বিশ্বাস করি না কেউ জান্তার কোনো সদস্যকে হ্যারির অফিসে নিয়ে আসবে–অথবা আমার অফিসে।”

“এই প্রজেক্টের কে জান্তার সাথে হাত মিলাতে পারে?”

“কেউ না,” তৎক্ষণাৎ এবং দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিল এমারিল। “সেটা অকল্পনীয়। সম্ভবত লিন প্রাইম রেডিয়্যান্ট কখনো দেখে নি বরং কেউ তাকে বলেছে।”

“কে বলতে পারে?” কিছুক্ষণ চিন্তা করে জবাব দিল এমারিল, “কেউ না।”

“বেশ, একটু আগে তুমি বলেছ ইলারকে তৃতীয় প্রাইম রেডিয়্যান্টের দায়িত্ব দিলে প্রজেক্টে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হবে। কিন্তু এমন একটা প্রজেক্টে যেখানে শত শত লোক কাজ করে সেখানে প্রতিমুহূর্তেই ঝগড়া-বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে।”

“অবশ্যই। হ্যারি প্রায়ই আমাকে এই ব্যাপারে অভিযোগ করে। তাকেই এগুলো সামলাতে হয় এবং এটা যে তার জন্য কত বড় মাথাব্যথা বুঝতে পারি আমি।”

“এই ঝগড়া বিবাদ কি প্রজেক্টের ক্ষতি করার মতো খারাপ?”

“মোটেই না।”

“এমন কেউ আছে যারা অন্যদের চেয়ে বেশী ঝগড়াটে, বেশী হিংসুটে। যাদেরকে বাদ দিলে, মাত্র ৫ থেকে ৬ পার্সেন্ট কর্মী ছাটাই করে ৯০ পার্সেন্ট অন্তর্দ্বন্দ্ব কমিয়ে দিতে পারবে?”

এমারিল ভুরু বাঁকা করল। “চমৎকার আইডিয়া, কিন্তু আমি জানি না কাদের বাদ দেয়া যাবে। আমি আসলে কখনো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাই নি। জানি কখনো থামানো যাবে না, তাই এড়িয়ে চলাই ভালো।”

“অদ্ভুত। এইভাবে তুমি সাইকোহিস্টোরির প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছ না?”

“কিভাবে?”

“যেখানে তুমি নিজের ঘরের অন্তর্দ্বন্দ্বই ঠিকমতো বিশ্লেষণ করতে পারছ না সেখানে তুমি কেমন করে সেই পর্যায়ে পৌঁছানোর আশা কর যেখানে বসে তুমি ভবিষ্যত নির্ধারণ এবং তা পরিচালনা করবে?”

মুখ টিপে হাসল এমারিল। অস্বাভাবিক, কারণ সে কখনো রসিকতা করে না বা হাসে না। “ডর্স, তুমি এমন একটা সমস্যার কথা তুললে যা আমরা মোটামুটি সমাধান করে ফেলেছি। বেশ কয়েক বছর আগেই হ্যারি নিজে সমীকরণগুলো তৈরি করেছে যা দিয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বগুলো প্রকাশ করা যায় আর আমি গত বছরেই তা চূড়ান্ত করেছি।

“আমি দেখেছি যে সমীকরণগুলোকে পরিবর্তন করার উপায় আছে যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব কমানোর কৌশল পাওয়া যাবে। কিন্তু একদিকে দ্বন্দ্ব কমানোর অর্থ হচ্ছে আরেকদিকে বৃদ্ধি পাওয়া। দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট কোনো দলের ক্ষেত্রে কখনোই দ্বন্দ্ব পুরোপুরি কমে না বা পুরোপুরি বাড়ে না–অর্থাৎ যেখানে পুরনো সদস্যরা দল ত্যাগ করে না এবং নতুন সদস্যের অন্তর্ভুক্তি হয় না। ইলারের অনৈরাজ্যক সমীকরণ ব্যবহার করে আমি প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে আমরা যে পদক্ষেপই নেই না কেন কথাটা সত্যি। হ্যারি এই সমীকরণের নাম দিয়েছে, দ্য ল অব কনজার্ভেশন অব পারসোন্যাল প্রব্লেম।

“এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে সামাজিক গতিশীলতায়ও পদার্থ বিজ্ঞানের মতো কনজার্ভেশন ল কাজ করে এবং সত্যি কথা বলতে কি এই বিধিগুলো আমাদেরকে সাইকোহিস্টোরির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের সর্বোৎকৃষ্ট কৌশল উদ্ভাবনের পথ দেখিয়েছে।”

“চমৎকার, কিন্তু যদি দেখা যায় যে কিছুই বদলায় নি, অর্থাৎ খারাপ যা কিছু ছিল তার সবই থেকে গেল, অর্থাৎ এম্পায়ার একভাবে রক্ষা করতে গিয়ে অন্যভাবে তার পতন তরান্বিত করলে?

“অনেকেই এমন মতামত দিয়েছে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নি।”

“বেশ, এবারে বাস্তব সমস্যা নিয়ে কথা বলি। এমন কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব আছে যা হ্যারির জন্য হুমকি? আমি শারীরিক ক্ষতির কথা বলছি।”

“হ্যারির শারীরিক ক্ষতি? অসম্ভব। এটা তুমি ভাবলে কি করে?”

“হয়তো এমন কেউ আছে যে হ্যারিকে ঘৃণা করে তার একরোখা, জেদী, আত্মকেন্দ্রিক স্বভাব এবং সকল কৃতিত্ব একা ভোগ করার মানসিকতার জন্য? অথবা এগুলোর কোনোটাই না শুধুমাত্র দীর্ঘদিন প্রজেক্টের নেতৃত্বে রয়েছে বলেই ঘৃণা করে?”

“কারো মুখে হ্যারির সম্বন্ধে এই ধরনের কোনো মন্তব্য কখনো শুনি নি।”

অসম্ভষ্ট দেখাল ডর্সকে। “এইসব কথা কেউ তোমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবে বলে আমার মনে হয় না। যাই হোক, ইউগো, ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য এবং তোমার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য।”

তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল এমারিল। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে, কিন্তু আবার কাজ শুরু করতেই জাগতিক সব সমস্যা মুছে গেল তার মন থেকে।

.

২০.

কাজ থেকে হ্যারি সেলডনের ছুটি নেয়ার একটা পথ হচ্ছে (সেরকম পথ মাত্র কয়েকটা) রাইখকে দেখতে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক বাইরে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকে রাইখ। এই কাজটা তিনি করেন পালক পুত্রের প্রতি অসম্ভব স্নেহ থেকে। আরো অনেক কারণ আছে। রাইখ ভালো, যোগ্য, বাধ্য–কিন্তু সব ছাপিয়ে রয়েছে মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা এবং বিশ্বাস অর্জন করার অদ্ভুত সেই ক্ষমতা।

ব্যাপারটা হ্যারি আবিষ্কার করেছেন সে যখন রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বারো বছরের কিশোর। কিভাবে যেন রাইখ তার আর ডর্সের মন জয় করে নেয়। হ্যারির মনে আছে রাইখ কিভাবে রিশেলির–ওয়ির প্রাক্তন মেয়র–মন জয় করে নিয়েছিল। হ্যারির মনে আছে জোরানিউম কিভাবে রাইখকে বিশ্বাস করে এবং এই বিশ্বাসই তাকে ধ্বংস করে দেয়। এমনকি রাইখ কেমন করে যেন মানীলার মতো সুন্দরী একটা মেয়ের হৃদয় জয় করে নেয়। হ্যারি কখনোই রাইখের এই বিশেষ গুণটাকে বুঝতে পারেন নি কিন্তু পালক সন্তানের সাথে সময় কাটাতে তিনি অসম্ভব পছন্দ করেন।

স্বভাবসুলভ, “সব ভালো তো,” বলতে বলতে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলেন তিনি। রাইখ হলোগ্রাফিক ম্যাটেরিয়ালগুলো পাশে রেখে উঠে দাঁড়াল। “সব ভালো, বাবা।”

“ওয়ানডার সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।”

“ওর মায়ের সাথে বাজারে গেছে।”

আরাম করে বসলেন সেলডন। হাসিমুখে তাকালেন স্তূপ করে রাখা রেফারেন্স ম্যাটেরিয়ালের দিকে। “বই এর কাজ কেমন এগোচ্ছে?”

“ভালোই। আমি হয়তো বেঁচে থাকব না।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কিন্তু এই প্রথম, ডাহুলের সমস্যার প্রতি সরাসরি আলোকপাত করা হলো। ওই সেক্টর নিয়ে কেউ কখনো বই লেখে নি, কথাডা তোমার বিশ্বাস অয়?”

সেলডন লক্ষ্য করেছেন, রাইখ যখনই তার হোম সেক্টর নিয়ে কথা বলে তখনই ডাহ্‌লাইট বাচনভঙ্গী আবার বেরিয়ে পড়ে।

“তুমি কেমন আছ, বাবা? উৎসবটা শেষ হয়েছে বলে নিশ্চয়ই খুশি?”

“ভীষণ খুশি। প্রতিটা মিনিট আমার জঘন্য লেগেছে।”

“কেউ বুঝতে পারে নি।”

“শোনো, আমি এক ধরনের মুখোশ পড়েছিলাম। চাই নি বাকী সবার আনন্দ মাটি হোক।”

“আর মা যখন তোমার পিছু পিছু প্যালেস গ্রাউণ্ডে ঢুকেছিল তখন নিশ্চয়ই ভীষণ রাগ করেছিলে। আমার পরিচিত সবাই ঘটনাটা জানে।”

“অবশ্যই রাগ করেছিলাম। তোমার মা, রাইখ, এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে চমৎকার মানুষ, কিন্তু তাকে কিছু বোঝানো অসম্ভব। সে হয়তো আমার পরিকল্পনাটা মাটি করে দিয়েছে।”

“কি পরিকল্পনা, বাবা?”

হেলান দিয়ে বসলেন সেলডন। যাকে তিনি বিশ্বাস করেন অথচ সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে কিছু জানে না তার সাথে কথা বলা সবসময়ই আনন্দদায়ক। “তোমার বাড়িটা শীল্ডেড?”

“সবসময়ই।”

“ভালো। আমি আসলে জেনারেলকে নতুন লাইনে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছি।”

“কোন লাইনে?”

“কর ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে আমাদের, এবং আমি বুঝিয়ে দিয়েছি যে নিখুঁত কর ব্যবস্থা তৈরির যতই চেষ্টা করব ততই সেটা জটিল, নিয়ন্ত্রণহীন, ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, এক মাত্র উপায় হচ্ছে কর ব্যবস্থার সরলীকরণ।”

“যুক্তি সঙ্গত কথা।”

“খানিকটা। কিন্তু আমাদের এই ছোট আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল হয়তো অতিসরলীকরণের চেষ্টা করবে। দুই ক্ষেত্রেই কর ব্যবস্থার কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে যায়। অতিরিক্ত জটিল হলে জনগণ না বুঝেই অতি বিশাল এবং ব্যয়বহুল কর আদায়কারী সংস্থার কাছে অর্জিত সম্পদের একটা অংশ তুলে দেয়। অতি সরল হলে তারা সেটাকে পক্ষপাতমূলক মনে করে এবং ক্ষোভের সাথে প্রত্যাখ্যান করে। সব চেয়ে সরল কর ব্যবস্থা হচ্ছে মাথাপিছু কর। এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিককে সমান হারে কর দিতে হয়, কিন্তু এতে ধনী এবং গরীবকে একই পরিমাণ কর দিতে হয় বলে, এই পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থা সহজেই নজরে পড়বে।”

“আর তুমি সেটা জেনারেলকে বুঝিয়ে বল নি?”

“আমি আসলে সুযোগ পাই নি।”

“তোমার কি মনে হয় জেনারেল এখন মাথাপিছু কর আরোপ করবে।”

“আমার ধারণা করবে। যদি করে তাহলে কোনো না কোনোভাবে খবর ফাস হবে। আর দাঙ্গা বাধানোর জন্য তাই যথেষ্ট। সরকারের অবস্থান আরো নড়বড়ে হয়ে পড়বে।”

“আর তুমি উদ্দেশ্য নিয়েই কাজটা করেছ, তাই না, বাবা?”

“অবশ্যই।”

হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল রাইখ। “আমি তোমাকে বুঝতে পারি না, বাবা। ব্যক্তিগত জীবনে তুমি এম্পায়ারের আর দশটা মানুষের মতোই সহজ সরল। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় তুমি এমন পরিস্থিতি তৈরি করার পরিকল্পনা করছ যাতে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, সংঘাত আর ব্যাপক রক্তপাত ঘটবে। অনেক ক্ষতি হবে, বাবা, ব্যাপারটা তুমি ভেবে দেখেছ?”

বিষণ্ণ সুরে জবাব দিলেন সেলডন। এছাড়া অন্য কিছু ভাবি নি আমি, রাইখ। প্রথম যখন সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কাজ শুরু করি তখন বিষয়টাকে একাডেমিক রিসার্চ ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি। কখনোই মনে হয় নি একটা বৈজ্ঞানিক কৌশল হিসেবে এটা গড়ে উঠবে বা উঠলেও কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে। কিন্তু একটার পর একটা দশক যাচ্ছে আর আমরা অনেক কিছু শিখছি, তারপরই এটাকে প্রয়োগের আবশ্যিকতা দেখা দেয়।”

“যেন অনেক মানুষ মারা যায়?”

“না, যেন অল্প মানুষ মারা যায়। যদি আমাদের সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ সঠিক হয়, তাহলে জান্তা আর কয়েক বছরের বেশী টিকবে না এবং অনেক উপায়েই এর পতন ঘটতে পারে। প্রতিটিই সমান সহিংস এবং ব্যাপক রক্তপাত ঘটাবে। এই পদ্ধতিতে কর কৌশলে তা হবে অন্যগুলোর চেয়ে অনেক শান্ত এবং রক্তপাতহীন যদি আবারও বলছি–আমাদের বিশ্লেষণ সঠিক হয়।“

“যদি না হয়, তখন?”

“সেক্ষেত্রে, আমরা জানি না কি ঘটবে। সাইকোহিস্টোরি সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে আমরা কৌশলটাকে ব্যবহার করতে পারব। অনেক বছর ধরেই আমরা সুযোগ খুঁজছিলাম। যে ঘটনাগুলোকে আমরা নিশ্চিত করেছি সেগুলো অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার। আসলে কর কৌশল হচ্ছে সর্বপ্রথম ব্যাপক সাইকোহিস্টোরিক এক্সপেরিম্যান্ট।”

“আমার কাছে ভীষণ সরল মনে হচ্ছে।”

“মোটেই না। সাইকোহিস্টোরি কি পরিমাণ জটিল তোমার কোনো ধারণাই নেই। মাথাপিছু কর নির্ধারণের কৌশল অতীতকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কখনোই জনপ্রিয় ছিল না এবং কোনো না কোনোভাবে জনগণকে প্রতিবাদী করে তুলত, কিন্তু তার ফলে কখনোই কোনো সরকারের সহিংস পতন ঘটে নি। হয় সরকারের দমননীতি ছিল অত্যন্ত কঠোর অথবা মানুষ শান্তিপূর্ণ কোনো উপায়ে প্রতিবাদ জানাত। মাথাপিছু কর ব্যবস্থা যদি দুই একবারও সহিংস ঘটনার জন্ম দিত তাহলে কোনো সরকারই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করার চেষ্টা করত না। সহিংস নয় বলেই বারবার পদ্ধতিটা প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু ট্রানটরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণে পরিষ্কার কিছু অস্থিতিশীলতা ফুটে উঠেছে, যার ফলে আমাদের মনে হচ্ছে এই ক্ষেত্রে তীব্র আন্দোলন হবে এবং সরকারের দমননীতি হবে তুলনামূলকভাবে দুর্বল।”

রাইখের বলার ভঙ্গীতে সন্দেহ ফুটে উঠল। “আশা করি কাজ হবে, বাবা, কিন্তু তোমার কি মনে হয় না জেনারেল বলবে যে সে সাইকোহিস্টোরির ভিত্তিতে কাজ করেছে এবং নিজের সাথে সাথে তোমাকেও ধ্বংস করবে?”

“সম্ভবত জেনারেল আমাদের আলোচনা রেকর্ড করেছে, কিন্তু যদি প্রচার করে তাহলে সবাই দেখবে যে আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম যেন পরিস্থিতি আরো নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কিন্তু সে অনুরোধ রাখে নি।”

“মা এই ব্যাপারে কি ভাবছে?”

“তার সাথে আমি এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলি নি। এই মুহূর্তে সে অন্য কাজে ব্যস্ত।”

“তাই নাকি?”

“সে এখন প্রজেক্টের ভেতরেই ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে। তার ধারনা প্রজেক্টের অনেকেই আমাকে অপসারণ করতে পারলে খুশী।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। সম্ভবত আমিও তাদেরই একজন। প্রজেক্টের পরিচালকের পদ ছেড়ে দিয়ে সাইকোহিস্টোরির বিশাল দায়দায়িত্ব অন্যের কাঁধে তুলে দিতে পারলে বেঁচে যেতাম।”

“আসলে মাকে ওয়ানডার স্বপ্নটা এখনো ভাবাচ্ছে। জানই তো তোমার নিরাপত্তা নিয়ে মা কতখানি উদ্বিগ্ন থাকে। বাজী ধরে বলতে পারি তুমি মরে গেছ এমন একটা

স্বপ্ন দেখলেও সে ভাবতে শুরু করবে যে তোমাকে খুন করার চক্রান্ত চলছে।”

“আশা করি তেমন স্বপ্ন কেউ দেখে নি।”

দুজনেই গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *