বিপ্লব
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অন্য দলগুলো একজোট হচ্ছিল। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭২ মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে তৈরি হলো একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। তাদের ১৫ দফা দাবির মধ্যে ছিল সরকারের পদত্যাগ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি ও সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন। জাসদ এই জোটে যোগ দেয়নি।
৭ মার্চ ১৯৭৩ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো। সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেল ২৯৩টি আসনে। এটাকে প্রহসনের নির্বাচন’ উল্লেখ করে জাসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দলের অফিসে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে রাজনৈতিক চরিত্রের দল ও ব্যক্তিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সেই দল ও ব্যক্তিরা আবার ক্ষমতাসীন হয়েছেন। সুতরাং চৌদ্দ মাসের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার আলোকে সহজেই বলা যায় যে আওয়ামী লীগ সারা দেশ ও জাতিকে শেষ অধঃপতনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।…যে জনতা অস্ত্র দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই জনতাই সকল শোষণের অবসান করবে–উৎখাত করবে অত্যাচারী, ফ্যাসিবাদী শাসক ও দুর্নীতিবাজ সরকারকে।’ দলের সভাপতি মেজর জলিল এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিরোধী দলের প্রার্থীদের পরাজিত হতে বাধ্য করা হয়েছে।’ [১]
আওয়ামী লীগ সরকারকে সত্যিকার একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার সুযোগ এল ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ঠিক হলো, নির্বাচন হবে ৩ সেপ্টেম্বর। জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগ তখন খুব জনপ্রিয়। এদের ঠেকানোর জন্য আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে যৌথ প্যানেল দিল। জাসদ-সমর্থিতরা নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। তবে মেয়েদের ও অমুসলমান ছাত্রদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের প্রভাব ছিল বেশি। তারাই বরাবর জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হলে জিতত। এর সঙ্গে যোগ হলো শামসুন্নাহার হল। এ নিয়ে রণকৌশল ঠিক করতে বসলেন স্বয়ং সিরাজুল আলম খান। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর আবু করিম মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র, দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার। ডাকসু ইলেকশন নিয়ে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তার যে কথা হয়েছে, সেটি তিনি এক আলাপচারিতায় আমার কাছে তুলে ধরলেন এভাবে :
আবু করিম : উনি বললেন, ‘তোমাদের অ্যাসেসমেন্টটা বলো– শামসুন্নাহার হলে কত ভোট পাব, রোকেয়া হলে কত ভোট পাব, জগন্নাথ হল কত ভোট দিবে।’
মাহবুব ভাই (সহসভাপতি পদে জাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী আ ফ ম মাহবুবুল হক) আমার পাশে বসা। আমরা প্রায় নয়জন ছিলাম, যারা ডাকসু ইলেকশনে শেষ পর্যন্ত থাকব বলে ঠিক করা ছিল।
তখন সিরাজ ভাই বললেন, তোমরা এ প্রসঙ্গটা বাদ দাও। সে রকম হলে আমরা সে রকম করব। হাতে সব রকম ওষুধ রাখতে হবে। আমরা তো একটা ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্ট করতে পারি।’
মহিউদ্দিন আহমদ : এভাবে বলেছে?
করিম : আমার সাজেশন হলো, যে প্রেস থেকে লেনিন-গামার (আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী নূহ-উল আলম লেনিন ও ইসমত কাদির গামা) লিফলেট-ব্যাজ ছাপা হবে, এক্সট্রা পয়সা দিয়া ওই প্রেস থেকে আমরা লেনিন-গামার কিছু ব্যাজ ছাপায়া নেব। তারপর আমাদের হল ইউনিটগুলোকে বিলি করে দেব। আমাদের যারা হার্ডকোর এবং আনোন, তারা এই ব্যাজ লাগায়া ঘুরে বেড়াবে লেনিন-গামা লেনিন-গামা বলতে বলতেআর তলে তলে আমাদের কাজ করবে।
মহি : তারপর কী হলো?
করিম : আমরা তো ডেইলি মিট করতাম। দুই-তিন দিন পর আমরা আবার বসলাম।
মহি: কোথায়?
করিম : সিরাজ ভাইয়ের এক ভাইয়ের বাসায়, ওয়ারী। ওনার যে ভাই ডাক্তার ছিলেন। গণকণ্ঠ অফিসের কাছেই। সিরাজ ভাই আমাদের সবার কথা আলাদাভাবে শুনলেন। ইলেকশনের আর কয়েক দিন বাকি। উনি বললেন, ‘আমরা জিতব। সব জায়গায় জিতব। জগন্নাথ হল নিয়ে একটু ডাউট আছে। তবে সেখানেও জিতব।’
ওনার কাছে যে কত গুপ্ত খবর। ওরে বাবা! কে কেমন বক্তৃতা করে, কে কার সঙ্গে প্রেম করে, সব খবর ওনার কাছে। [২]
ডাকসু নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয় এবং হলগুলোতে জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিল। কোথাও কোথাও ভোট গণনা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক ওই সময় লেনিন-গামার সমর্থকেরা দল বেঁধে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সব জায়গায় আক্রমণ চালিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এ রকম ন্যক্কারজনক ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি।
জাসদ-ছাত্রলীগের ছেলেরা তৈরি ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারত। একটা রক্তারক্তি হতো। কয়েকজন নেতা সন্ধ্যায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ইউকসু) অফিসে বসে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেন। সিরাজুল আলম খান দেশে ছিলেন না। কাজী আরেফ আহমদ সিদ্ধান্ত দিলেন, আমরা পাল্টা আক্রমণে যাব না। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়া যাবে না।’ ওই দিন সশস্ত্র সংঘর্ষ হলে কারা জিতত, তা বলা কঠিন। তবে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে যেত, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
.
২
জাসদ নেতারা আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন বিপ্লবের সহায়ক শক্তি। এটি একটি ‘সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন’। প্রশ্ন হলো, মূল শক্তি কোথায়? শুরু থেকেই এটি গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। এ জন্য বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জাসদের বা অন্য কোনো গণসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকেননি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমদ ও মনিরুল ইসলাম।
একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার জন্য চাই তাত্ত্বিক ভিত্তি। জাসদের নেতারা ছিলেন মূলত অ্যাকটিভিস্ট। অনেকের মধ্যেই অগ্রসর রাজনৈতিক চিন্তা থাকলেও তা ছিল ভাসা-ভাসা। এ পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেন নতুন দুজন–মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও ড. আখলাকুর রহমান। তাদের সংযুক্তি দলকে অনেক সমৃদ্ধ করেছিল।
বিপ্লবের একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করানোর কাজটি শুরু হয় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে। মুবিনুল হায়দার চৌধুরী যুক্ত হন ওই সময়। তখনই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান। এর আগে আমি পার্টি দলিলের একটা প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছিলাম। সেটার সূত্র ধরেই আলাপ। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জাসদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরির পটভূমি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। এখানে তা উল্লেখ করা হলো : মহিউদ্দিন আহমদ : আপনি কীভাবে এলেন?
মুবিনুল হায়দার চৌধুরী : এটা তো আমার বাড়ি। খুব অল্প বয়সে আমার মা বাবা মারা যায়। কলকাতায় আমার এক বড় ভাই থাকতেন। ওনার কাছে। গিয়েছিলাম।
মহি: এটা কোন সালের কথা।
হায়দার : পার্টিশনের আগে। ১৯৪৬ সালে। ওখানে একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। লেখাপড়া করতে পারিনি। মা-বাবা না থাকার কারণে ছেলেবেলায় গাইড করার মতো কেউ ছিল। না। এ সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, লাইব্রেরি-টাইব্রেরি এসব সার্কেলের মধ্যে।
একদিন বললেন, আমরা একটা স্টাডি সার্কেল করি, কলকাতার ল্যান্সডাউন রোডে। ল্যান্সডাউন রোড আর রাসবিহারী অ্যাভিনিউর মোড়ে একটা বাড়িতে। যদি চাও, আসতে পারো। ভালো লাগবে।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। বেঁচে থাকার জন্য মোরাল কিছু তো চাই। উনি আমাকে নিয়ে গেলেন। একটা ঘরে বেশ কয়েকজন বসে আছেন। এঁরা যে কত উচ্চশিক্ষিত, আমি বুঝি নাই। কয়েকজন মহিলাও আছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষ কোনায় একটা চেয়ারে বসা। উনি সেদিন নিউ ডেমোক্রেসির ওপর আলোচনা করছেন। এটা ১৯৫০ সালের কথা বলছি। তার এক বছর আগে চীনে বিপ্লব হয়েছে। এটা একটা টগবগে বিষয় ছিল। একধরনের আকর্ষণ বোধ করলাম, যা আমাকে এদের সঙ্গে জড়িয়ে দেয়। আমি আর কখনো এই চর্চা থেকে সরে আসিনি। ইট ওয়াজ সাচ আ ম্যাগনেটিক অ্যাট্রাকশন।
মহি : তখন আপনার বয়স কত?
হায়দার : আমি ১৯৩৪ সালে জন্মেছি।
মহি: তো আপনি ধীরে ধীরে এই পার্টির কাজ শুরু করলেন?
হায়দার : এগুলো বুঝতে আমার ৫-১০ বছর চলে গেছে। অ্যাকটিভিটিজ তখন থেকেই শুরু। এখানে-ওখানে মিটিংয়ে বসতাম। পোস্টার লাগাতাম। প্রতি রোববার স্টাডি সার্কেল হতো।
মহি: পার্টির নাম কী ছিল?
হায়দার : সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া। পরে ব্র্যাকেটে ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল।
মহি: আপনি খিদিরপুর জোনের দায়িত্ব নিলেন।
হায়দার : কিছুদিন ছিলাম। তারপর কমরেড শিবদাস আমাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় যেতে বললেন। এসব করছি। কমরেডরা একসঙ্গে থাকতাম। তখন আমাকে বলা হলো, তুমি পার্টি অফিসে চলে এসো।
এসব চলতে চলতে বাংলাদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হলো। আমাকে ডেকে পাঠানো হলো। ইস্ট পাকিস্তান থেকে অনেক রিফিউজি এসেছে। এদের যত রকম প্রয়োজনীয় সার্ভিস দেওয়া যায়, আমাদের সাধ্যের মধ্যে থেকে।
আমি বর্ডার এলাকায় ঘোরাঘুরি করতাম। সব জায়গায় তো আওয়ামী লীগের লোক। ওদের যে কাণ্ডকারখানা, যে সুখী জীবন যাপন করছে, এ কেমন স্বাধীনতার আন্দোলন? তোয়াহা সাহেবের দলের দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। এর বাইরে বিশেষ কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি।
ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ (১৯৭১) তো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল।
২৪ এপ্রিল। কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাকে বললেন, অনেক দিন তো দেশে যাও না। একটু ঘুরে আসো। কিছু বইপত্র নিয়ে যাও। এই আসলাম। বদরুদ্দীন উমর, রাশেদ খান মেনন, অমল সেন-এ রকম অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। চট্টগ্রামে আবুল বাশার সাহেব ছিলেন, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। ওনার সঙ্গে দেখা করেছি।
মহি : মস্কোপন্থী কারও সঙ্গে দেখা করেননি?
হায়দার : করেছি। সিপিবির অফিসে গেছি। যারা ছিলেন, তাঁদের নাম মনে পড়ছে না। কয়েকজন ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়নি। মেনন যেখানে থাকতেন, সেখানে গিয়ে দেখা করে বইটই দিয়েছি। অমল সেনসহ তাঁরা যে অফিস করেছিলেন, সেখানে গিয়েছি। দু-তিনবার গিয়ে কিছু তর্ক-বিতর্কও করেছি।
মহি : কত দিন ছিলেন বাংলাদেশে?
হায়দার : এপ্রিলের ২৭-২৮ তারিখে গিয়েছি। সোজা চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে আমার এক আত্মীয় ঢাকায় নিয়ে এল। বদরুদ্দীন উমরকে খুঁজে বের করলাম। মে মাস পুরোটাই ছিলাম। জুনের শুরুতে আমি চলে এসেছি।
চলে আসার পর কলকাতায় পার্টি অফিসে একদিন দেখি গণকণ্ঠ নামে একটা কাগজ, মে দিবস সংখ্যা। ম্যাগাজিনের মতো, একটা বিশেষ সংখ্যা। ছাত্রদের স্লোগান আছে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণিসংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব–এসব কথা। আমি একটু অবাক হলাম। ওখানে এত ঘুরলাম, ওদের খবর তো পেলাম না? কমরেড শিবদাস ঘোষ বললেন, আবার ঘুরে এসো। দেখো এরা কারা, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদের কথা বলছে। তো আবার গেলাম। ঢাকা, সেপ্টেম্বর মাসে।
বদরুদ্দীন উমর সাহেবকে বললাম। উনি বললেন, কীভাবে সিরাজুল আলম খানের কাছে যেতে হয়, রহস্যজনক ব্যাপার স্যাপার। সিআইএর লোকও হতে পারে, র-এর লোকও হতে পারে।
ঢাকায় একটা হোটেল আছে, সম্রাট হোটেল। ওখানে একটা বস্তি ছিল।
আমি ওই বস্তিতে থাকতে শুরু করলাম। আমার এক আত্মীয়া, মানে ভাগনি, তার ছেলে ঢাকায় ছাত্রলীগ করে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। মেডিকেলে পড়ত। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম, সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কীভাবে দেখা করতে পারি।
বলতে পারব না। তবে তার ফোন নম্বর জোগাড় করে দিতে পারি। গণকণ্ঠ অফিস।
হোটেল থেকে আমি গণকণ্ঠ অফিসে ফোন করলাম। প্রথম দিন পেলাম না। দ্বিতীয় দিন পেয়েছি। আমার পরিচয় দিলাম। বাড়ি কোথায় ছিল, সেটাও বললাম। উনি বললেন, আমি তো রাজনীতি করি না। আপনি আ স ম আবদুর রব অথবা শাজাহান সিরাজের সঙ্গে কথা বলুন।
ওরা তখন আওয়ামী লীগারদের হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে আছে। হাসপাতালের ঠিকানা দিলেন।
আমি বললাম, আমি তো ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি না। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। যদি তিন মাস পরেও দেখা হয়, আমি অপেক্ষা করব। কথা বলবেন না কেন?
আমি তো রাজনীতি করি না। আচ্ছা, ঠিক আছে।
ফিরে গেলাম চট্টগ্রামে। ওখান থেকে কুমিল্লায়। চট্টগ্রামে আমি কিছু বই রেখে এসেছিলাম। জাসদ নেতা হাবিবউল্লাহ চৌধুরী আমার ভাইপোকে পাঠিয়ে ওগুলো নিয়ে এসেছে। তখন আমি হাজীগঞ্জে এলাম হাবিবউল্লাহর কাছে। ওকে ছোটবেলায় দেখেছিলাম, ১৯৫৬ সালে। তখন একবার দেশে এসেছিলাম। ওকে বললাম, তোমাদের নেতা সিরাজুল আলম তো রহস্যজনক মানুষ। উনি নাকি রাজনীতি করেন না! হাবিবউল্লাহ বলল, ঠিক আছে, কালই আপনাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। দেখা করাব।
সলিমুল্লাহ হলে দেখা করার জন্য এলাম। সিরাজুল আলম খান হলের কোনো এক কামরায় ছিলেন। আমি গেস্টরুমে বসে আছি। তারপর হাবিবউল্লাহ চৌধুরী এসে বলল, চলেন। একটা গাড়িতে উঠলাম। সেই গাড়িতে শরীফ নুরুল আম্বিয়া আর শ্রমিকনেতা মান্নান ছিল।
মহি: মান্নান তখনো ছিলেন? আপনি ঠিক বলছেন?
হায়দার : হ্যাঁ। মান্নান, লাল বাহিনীর মান্নান। আমাকে গণকণ্ঠ অফিসে নিয়ে গেল। কথাবার্তা হলো। বললাম, একটা বিপ্লবী পার্টি ছাড়া তো বিপ্লবী রাজনীতি হয় না। আপনারা স্লোগান দিচ্ছেন, কিছু বিচ্ছিন্ন কথাবার্তা বললেন। মার্ক্সবাদী চিন্তাধারা আছে, এটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তো কোনো স্লোগানের বিষয় না। এটা হলো প্র্যাকটিস করার জন্য একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ইউটোপিয়ার বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।
এগুলো অত ভালো বোঝেননি তখন, আমার এটা মনে হয়েছে।
মহি : গণকণ্ঠ যখন কথা বলছিলেন, তখন কাজী আরেফ আহমদ কি ছিলেন সেখানে?
হায়দার : না। শুধু আমি আর সে। পরে গণকণ্ঠ অফিসে কাজী আরেফের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। অন্যরা বলে, উনি হলেন সেকেন্ড ম্যান। কথার একপর্যায়ে সিরাজুল আলম খান বললেন, আপনি কি কয়েক দিন থাকবেন? প্রতিদিন যদি একবার করে আসেন, তাহলে কিছু কথাবার্তা বলতে পারি।’
‘এসইউসিআই কেন একমাত্র সাম্যবাদী দল’–এটা গণদাবি পত্রিকায় প্রথম বেরিয়েছে। তখনো বই হয়নি। এর বেশ কিছু কপি নিয়ে এসেছিলাম। একটা দিলাম ওনাকে পড়ার জন্য। এই নিবন্ধে কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্ক্সবাদী চিন্তার ফারদার ডেভেলপমেন্ট ঘটিয়েছেন। রেভল্যুশনারি পার্টি গড়ার জন্য যে লেনিনিস্ট ওয়ে অব বিল্ডিং আ পার্টি, সেখানে তিনি যৌথ নেতৃত্ব সম্বন্ধে বিস্তারিত বলেছেন। তারপর কীভাবে একদল পেশাদার বিপ্লবী তৈরি করতে হবে, যৌথ নেতৃত্ব যত দিন পর্যন্ত না হবে, তত দিন পর্যন্ত ব্যক্তিবাদকে সম্পূর্ণ ডিফিট দেওয়া যাবে না, যৌথ নেতৃত্বের পার্সনিফিকেশন, অর্থাৎ যৌথ চিন্তার সার্থক প্রয়োগ একজনের মধ্যে হতে পারে প্যারালালিজম-ইনডিভিজুয়ালিজমকে বাদ দিয়ে–এসব কথাবার্তা। মার্ক্সবাদী আন্দোলনে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব কথায় তিনি খুব ইমপ্রেসড হন। তারপর আমাকে নিয়ে বসা, এর-ওর সঙ্গে বসানো, ক্লাস করানো, এসব করতে শুরু করলেন।
মহি : এটা কি বাহাত্তরের সেপ্টেম্বরেই? হায়দার : বলতে ভুলে গেছি। একদিন তার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে যাচ্ছি। এর আগে সকালে খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি জাসদ নামে নতুন একটা পার্টি হয়েছে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। ওই দিনই। ওনার সঙ্গে কয়েক দিন ধরে যে আলোচনা হচ্ছে, আমাকে ঘুণাক্ষরেও উনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি। বললাম, এটা কী ধরনের নাম। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তো ফ্যাসিস্ট পার্টির নাম। আপনি এ রকম নাম কেন দিলেন?
আমরা প্রচণ্ড একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছি তো, জাতীয়’ কথাটা না লিখলে এখানে রাজনীতিতে দাঁড়ানো মুশকিল আছে।
আমি কিন্তু অ্যাগ্রি করিনি। বলেছি, এটা কখনো হতে পারে না। এটা ঠিক না। যত রকমের বাধা থাকুক, সেটা মোকাবিলা করেই বিপ্লবী রাজনীতি করতে হবে।
এভাবেই কথাবার্তা হচ্ছিল। তখন উনি বললেন, এটা তো পার্টি না। ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, জাসদ–এদের থেকে বাছাই করা লোকদের নিয়ে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলব। জাসদ কোনো বিপ্লবী পার্টি না।
আমি এর মধ্যে একটু যুক্তি দেখলাম। এটা তাহলে একটা প্ল্যাটফর্ম। বাস্তবে তারা কী করে, সেটাই দেখার বিষয়।
এরপর আমি কলকাতায় ফিরে গেলাম।
মহি : কত দিন ছিলেন ওইবার?
হায়দার : প্রায় দুই মাস। ফিরে গিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষকে রিপোর্ট করলাম। সিরাজুল আলম খানকে বলেছিলাম, আপনি কলকাতায় আসেন। তাহলে কমরেড শিবদাস ঘোষের সঙ্গে আপনাকে বসাতে পারি। তারপর উনি কলকাতায় গেলেন।
মহি : এটা কি ১৯৭২ সালেই?
হায়দার : না, এটা ১৯৭৩ সালে।
মহি : কোন মাসে, মনে আছে?
হায়দার : মনে নাই।
মহি : ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতা গিয়েছিলেন বলে আমি জানি।
হায়দার : হতে পারে, আমার মনে নাই। তা ছাড়া এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না।
মহি : টাইমিংটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
হায়দার : সে সময় মুশতাক নামে একজন ছিল…
মহি : রেজাউল হক মুশতাক?
হায়দার : সে কী করে?
মহি: এখন তো ব্যবসা করে। তখন ছাত্রলীগ করত। ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ছিল। ছাত্রলীগের কনফারেন্সে আউট হয়ে গেল।
হায়দার : আরেকজন ছিল।
মহি: বদিউল আলম।
হায়দার : আমি একদিন বন্ধুদের নিয়ে ‘সোসাইটি’ সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গেছি। দেখি, ওরাও গেছে সেখানে।
মহি : সিরাজ ভাই আর ওই দুজন?
হায়দার : হ্যাঁ। কিন্তু ওরা আমাকে দেখে নাই। পরে অবশ্য বদিউলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল হাবিবউল্লাহ চৌধুরীর মাধ্যমে।
মহি : হ্যাঁ, ওদের দুজনের বাড়ি একই এলাকায়, হাজীগঞ্জে।
হায়দার : ওরা একটু দূরে, ব্যালকনিতে বসা। আমরা নিচে।
মহি : কী ছবি, মনে আছে? বাংলা না ইংরেজি?
হায়দার : হিন্দি ছবি। যাহোক, পরে তো ওনাকে কমরেড শিবদাস ঘোষের সঙ্গে মিট করালাম।
মহি: আপনি তাকে পার্টি অফিসে নিয়ে গেলেন?
হায়দার : অফিসে না। বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতাম। বিভিন্ন বাড়িতে।
মহি: সিরাজ ভাই তখন থাকতেন কোথায়?
হায়দার : অত তো জানতাম না। বলতেন না। আমি বেশি জিজ্ঞেস করতাম না। পরে জেনেছি, চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়িতে থাকতেন। চিত্তরঞ্জন সুতার কে, এটা কিন্তু আমি জানি না। ভবানীপুরে, রাজেন্দ্রপ্রসাদ রোড, আমাকে এ পর্যন্ত বলেছে। আমি একদিন ওখানে গিয়ে হাজির হলাম। কয়েকজন আমাকে রিসিভ করে বসাল। আমার খবর নিচ্ছে, আমি কে, কী। বললাম, সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে পরিচয় আছে তো। সে জন্য দেখা করতে এসেছি। উনি এসে আমাকে বললেন, আপনি এখানে কেন এসেছেন? এখানে আসা তো আপনার ঠিক হয়নি।’
চিত্তরঞ্জন সুতারের নাম আগে শুনি নাই, ওই দিনও বুঝি নাই। তার সঙ্গে দেখাও হয়নি।
সিরাজুল আলম খান আমার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। তারপর আমার সঙ্গে বের হলেন। নানা জায়গায় ঘুরলাম। উনি দু-তিনবার কমরেড শিবদাস ঘোষকে মিট করেছেন।
সিরাজুল আলম খান পরে আখলাকুর রহমানকে শিবদাস ঘোষের কিছু বই পড়িয়েছেন। পরে শুনেছি, উনি এসব পড়ে খুবই বিস্মিত হয়েছেন, মুগ্ধ হয়েছেন। তবে সেটা প্রকাশ করেননি।
মহি: একটু থামুন। ওখানে তো কয়েক দফা দেখা হলো, কথা হলো। তারপর উনি ফিরে এলেন। ওনার সঙ্গে আপনিও কি এসেছিলেন?
হায়দার : একসঙ্গে আসিনি। [৩]
.
৩
আখলাকুর রহমান একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। বেশ কয়েক বছর তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। ফিরে আসেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে অতিথি হিসেবে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল, তিনি জাসদে যুক্ত হবেন। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সিরাজুল আলম খান আমাকে বলেন :
উনি তো আসলেন পাকিস্তান না সৌদি আরব থেকে। ওখানে তিনি একটা ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ছিলেন না? পাকিস্তানে না ঢুকে বাংলাদেশে আসলেন। সাম হাউ উনি শুনলেন আমাদের কথা। আমরাও একদিন শুনলাম। একদিন তাকে ইনভাইট করলাম যে আমরা কথা বলব। একদিন বসলাম। এ কথাটা আমি তুললাম, ভাই, আমাদের ইকোনমিক সাইডটা দেখেন। উই আর ভেরি উইক। খেপে গেলেন।
শুধু আপনাদের ইকোনমিক সাইড দেখব? কেন?
তাহলে তো আরও ভালো। থাকেন।
ওনার মতো করে খোঁজখবর নিয়ে উনি আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন। হি ওয়াজ কনভিন্সড। মানে এরা কিছু করতে পারবে। আমরা দেখলাম তার নলেজটা খুব গভীর। তখন যে কাজটা আমাদের সামনে ছিল, আমরা যদি একটা রাজনৈতিক লাইন, পলিটিক্যাল থিসিস দাঁড় করাই–আমরা তো বলতামই, এটা হবে। একটা সোশ্যালিস্ট রেভলুশন। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব না। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হলো–সামন্তবাদী অবস্থা থেকে একটা বুর্জোয়া ও শ্রমজীবী পর্যায়ে যেতে হবে। বুর্জোয়াদের একটা ডেফিনিট রোল থাকবে। আমরা বুঝলাম, এটা হবে সোশ্যালিস্ট টেকওভার। বুর্জোয়াদের কাছ থেকে ক্ষমতা নিতে হবে। তবে অনেক ডেমোক্রেটিক আসপেক্ট নট ডান অর ফুলফিলড, এগুলোকে কভার করতে হবে। ইফ উই আর ইন দ্য পাওয়ার, তা হলেও। ইফ উই আর নট ইন দ্য পাওয়ার, তাহলে প্রু পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম। [৪]
জাসদ সব সময় সর্বদলীয় জাতীয় সরকারের দাবি করে এলেও চলছিল একা। অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটে যাওয়া বা যুগপৎ কার্যক্রমের ব্যাপারে জাসদের আগ্রহ ছিল না। অন্য দলগুলোও জাসদকে আস্থায় নেয়নি। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে জাসদের জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। তরুণদের মধ্যে ছিল এর। একচেটিয়া প্রাধান্য।
১৯৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাসদের জাতীয় কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘গণ-আন্দোলনের ভিত্তি ও কর্মসূচি’ নামে একটি ২৯ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও লাল বাহিনীকে বেআইনি ঘোষণা করা এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে ভেঙে দিয়ে এর সদস্যদের নিয়মিত সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা। [৫]
১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ জাসদ-সমর্থিত দৈনিক গণকণ্ঠএ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জাসদের চরমপত্র : জনতার দাবি মেনে নাও : শেষ সময় ১৫ই মার্চ শিরোনামে প্রথম পাতায় একটি সতর্কবাণী প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ১৫ মার্চ ১৯৭৪-এর মধ্যে ২৯ দফা দাবি মেনে না নিলে দেশের সব জায়গায় ‘ঘেরাও’ আন্দোলন শুরু হবে। ঘেরাও কর্মসূচির আওতায় স্থানীয় পর্যায়ের রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান ও সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ঘেরাও করা হবে বলে জানানো হয়। এ পর্যায়ে গণভবন, সচিবালয় ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়।
১৭ মার্চ জাসদ ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা করে। জনসভা শেষে একটি জঙ্গি মিছিল মিন্টো রোডের দিকে যায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসা ঘেরাও করে। সেখানে রক্ষীবাহিনী গুলি চালালে অনেকেই হতাহত হন। সরকারি প্রেসনোটে তিনজন নিহতের কথা বলা হলেও ইত্তেফাক-এ ছয়জন নিহত হওয়ার খবর ছাপা হয়। জাসদ দাবি করে, ঘটনাস্থলে ৫০ জন নিহত হয়েছেন। জন্মের পর জাসদের ইতিহাসে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। ওই দিন আহত অবস্থায় কয়েকজন জাসদ নেতা গ্রেপ্তার হন। পরে আরও অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন। মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, মোহাম্মদ শাহজাহান, মির্জা সুলতান রাজা, রুহুল আমিন ভূঁইয়া প্রমুখ। ওই রাতেই গণকণ্ঠের সম্পাদক আল মাহমুদকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৭ মার্চের ঘটনাটি জাসদের জন্য ছিল একটা বড় ধাক্কা।
জনসভা শেষে মিছিলটি শেষমেশ কোথায় গিয়ে থামবে, এটি মিছিলকারীরা জানতেন না। কয়েকজন সামনের দিকে ছিলেন। অন্যরা তাঁদের পেছন পেছন গেছেন। কাকরাইল মসজিদের কাছাকাছি যখন মিছিল আসে, তখন কারও হাতে চিরকুট পৌঁছে দেওয়া হয়। চিরকুটে মিছিলের গন্তব্য উল্লেখ করা ছিল। এটি সিরাজুল আলম খানের হাতের লেখা বলে শনাক্ত হয়।
১৭ মার্চ, নেতাদের অনেকেই ঢাকায় ছিলেন না। কাজী আরেফ ছিলেন সিলেটে, মনিরুল ইসলাম ছিলেন দাউদকান্দি, শরীফ নুরুল আম্বিয়া ছিলেন যশোর, মাসুদ আহমেদ রুমি ছিলেন রংপুর। ঘটনার আকস্মিকতায় রুমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। ঢাকায় এসে তিনি দলের এক সভায় অভিযোগ করেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত কীভাবে হলো? আমি তো জানি না?’ চিরকুটের প্রসঙ্গ উঠল। সিরাজুল আলম খান বললেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।
একটা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার লক্ষ্যে যাদের ছাত্রলীগ ও জাসদের কমিটির বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের একজন ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া। ১৭ মার্চের ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে তাঁর মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া জানতে একদিন তার মুখোমুখি হলাম। তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা ছিল এ রকম:
মহিউদ্দিন আহমদ : ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাওয়ের পরিকল্পনাটা কার?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : আমি এটা জানি না। আমি ছিলাম দক্ষিণবঙ্গে, খুলনা ডিভিশনে সাংগঠনিক দায়িত্বে। এত বড় টার্গেট হ্যাঁন্ডেল করবে, এটা আমার ধারণায় ছিল না।
মহি : পরে এটা নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি? কোনো অ্যানালাইসিস?
আম্বিয়া : ওই সময় ইনুও বাইরে ছিল। সে কোথা থেকে আসছে। দুপুরের পর সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে তার দেখা হইছে। সিরাজ ভাই নাকি তাকে বলেছে, নেতাদের দেইখা রাইখো। এতে বোঝা যায় না এটা সিরাজ ভাইয়ের ডিসিশন কি না। কেননা, আগের রাতেও এ ব্যাপারে ডিসিশন হয় নাই যে ঘেরাও করবে। ডিসিশন যেখানে হইছে, সেখান থেকে এইটা লিক হইয়া চইলা গেছে গভমেন্টের কাছে। এইটা আমার ধারণা। কেননা, রক্ষীবাহিনী আইসাই তো মিছিলের ওপর ব্রাশফায়ার করছে।
মহি: ইনু ভাই গুলিটুলি করেছে বলে যে গসিপ আছে, এটা কি ঠিক না?
আম্বিয়া : এ ধরনের একটা বড় মুভমেন্টের মধ্যে অনেকেই অনেকভাবে ইনভলভড হইতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
মহি : সিরাজ ভাই আমাকে পরিষ্কার বলেছেন, ১৭ মার্চের ব্যাপারে উনি জানতেন না।
আম্বিয়া : উনি তো দলের নেতা। প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি যে-ই হোক, জাসদের নেতা তো উনিই। প্রকৃত নেতা উনি। তাহলে বলতে হবে, দলটা তার কন্ট্রোলের বাইরে ছিল। এ প্রশ্ন তো আসবে।
মহি: অনুমানের কথা না। আপনি তো দলের ভেতরের লোক। দল তখন কারা কন্ট্রোল করত?
আম্বিয়া : পরে যখন আমরা ফোরাম করলাম, তখন উনি বলেন নাই আমি করছি। আবার আমি করি নাই’–এ কথাও বলেন নাই। তবে কেন এটা করা হইল, এ অভিযোগ তার বিরুদ্ধে করা হইছিল। পরে এক মিটিংয়ে জিকু ভাইয়ের বাসায় অথবা–রাজমণি সিনেমা হলের মালিকের নাম কী?
মহি: মনি।
আম্বিয়া : মনির সদরঘাটের বাসায় আমাদের মিটিং হইছিল। এটা সিরাজ ভাইয়ের কন্ট্যাক্ট। কত রকমের লোকের সঙ্গে যে ওনার লাইন!
মহি: সিরাজ ভাই কী জবাব দিয়েছিলেন?
আম্বিয়া : উনি করছেন কি করেন নাই, ওই ইস্যুতে যান নাই। করা ঠিক হইছে কি না, এই ইস্যুতে উনি ডিফেন্ড করছেন। মার্শাল মনি আর আমি ছাড়া আর কেউ এর বিরোধিতা করছে বলে মনে পড়ে না।
মহি: মার্শাল মনি আর আপনি এটার বিরোধিতা করেছেন?
আম্বিয়া : বিরোধিতা মানে, বলছি এইটা ভুল কাজ হইছে। ইনু হইল সিরাজ ভাইয়ের পক্ষে এক নম্বর প্লেয়ার।
মহি: আর কে ছিল?
আম্বিয়া : সিরাজ ভাইয়ের পক্ষে ছিল এ বি এম শাহজাহান। বলছিল, এখন তো এটা হয়ে গেছে। সিচুয়েশনটা সেভ করা যায় কীভাবে।
মহি : এই আলোচনাটা কোন সময় হলো?
আম্বিয়া : ১৭ মার্চের ২০-২১ দিনের মধ্যে। এখন কথা হলো দলটা সেভ হবে কেমনে? এখন অস্ত্র হাতে নিয়ে নেওয়া ছাড়া বিকল্প থাকতেছে না। কেননা, আমরা ডেমোক্রেটিক্যালি অফিস করব, মিটিং করব, মিছিল করব, আওয়ামী লীগ সে জায়গাটা রাখতেছে না। আওয়ামী লীগের তৈরি ফাঁদের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। তখন বুঝি নাই। এখন বুঝি। জাসদকে এই অবস্থায় ঠেলে দিছে তো আওয়ামী লীগ। অপজিশন মানে তো উকিল-মোক্তার-দোকানদার আর ট্রেড ইউনিয়ন। তারা কি আন্ডারগ্রাউন্ড লাইফ মেনটেইন করতে পারে?
মার্চের ২২-২৩ তারিখের মধ্যেই বাংলাদেশের সব জায়গায় জাসদের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিদের বাসা থেকে। তুলে নিয়ে আসল। তো বাকি লোক করবে কী? একটু নড়াচড়া করলেই তো ধরে নিয়ে যাবে? যারা ধরা পড়ছে, চার-পাঁচ বছরের আগে তো কেউ ছাড়া পায় নাই। জাসদ তো একটা ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ফ্যামিলি নিয়া বাইচা থাকাই কঠিন ছিল। অনেকেই তো ধ্বংস হয়ে গেছে। কতজনের বউ চলে গেছে!
১৭ মার্চের ব্যাপারে সিরাজ ভাই যদি বলে যে উনি এটা করান নাই। তবে আমার পক্ষে প্রমাণ করা কঠিন যে উনি এটা করাইছেন। তবে মিটিংয়ে উনি দায়িত্ব অস্বীকার করেন নাই। ডিসিশনটা উনি দিছেন। কি না, নাকি এটা জলিল ভাইয়ের ডিসিশন, নাকি রব-জলিলের ডিসিশন…। আমাদের দেশে তো একটা সাইকোলজি আছে। নেতাদের মধ্যে যদি প্রতিযোগিতা থাকে, একজন যদি বলে এক পা যাবে, অন্য
জন লাফ দিয়া দুই পা যাবে। জাসদের ঘোষিত ঘেরাও কর্মসূচি গ্রাম থেকে শুরু হয়ে জেলা পর্যায় পেরিয়ে ঢাকায় বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু ১৭ মার্চ পল্টনের জনসভা শেষ হতে না হতেই মিছিল ছুটল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির দিকে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সবাই জানতেন না গন্তব্য কোথায়। তারা পঙ্গপালের মতো ছুটেছিলেন সামনে থাকা নেতা-কর্মীদের পিছু পিছু। মিছিল একপর্যায়ে গিয়ে থামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের গেটের সামনে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। কেন এমন হলো? এ নিয়ে কথা বললাম সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে।
মহিউদ্দিন আহমদ: ১৭ মার্চ তো একটা কাট অফ পয়েন্ট। ১৭ মার্চের আগের ও পরের পার্টি তো এক না। জাসদের ১৭ মার্চের মুভটা–এটা কি আপনারা ওভার প্লে করেছিলেন?
সিরাজুল আলম খান : এখন মনে হয়, ওয়ান ফর্ম অব ওভার প্লে হয়ে গেছে। কিন্তু ১৭ মার্চ তো ডেটটা ছিল না। ১৭ মার্চের কাছে কিনারেও ডেটটা ছিল না। ডেটটা ছিল আরও পরে।
মহি: গণ-অভ্যুত্থানের?
সিরাজ : হ্যাঁ। সেটা, ওই যে কাট অফ পয়েন্ট বলো, সেটাই হয়ে গেল।
মহি: ১৭ মার্চের পর যে আঘাতটা এল, এটা বোধ হয় আর…
সিরাজ : আঘাত–সঙ্গে সঙ্গে ফোর্সেসগুলো তো ডেভলপ করতে পারছে না, রাইজ করতে পারছে না। [৮]
.
৪
জাসদের মূল শক্তি তখন এর তরুণেরা–ছাত্রলীগ। এর সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত দলের পক্ষ থেকেই নেওয়া হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আমার খোলামেলা আলোচনা হয়। পুরো বিষয়টি তিনি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। বেরিয়ে আসে নেপথ্যের অজানা সব চাঞ্চল্যকর কাহিনি, যা অন্য নেতারা এড়িয়ে গেছেন, কিংবা চেপে গেছেন। কেউ কেউ মিথ্যে বলেছেন।
মহিউদ্দিন আহমদ : ১৭ মার্চ প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করুন।
মাহমুদুর রহমান মান্না : একটা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া ছিল। তেহাত্তরে ছাত্রলীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান ছিল। সেই লক্ষ্যে একটা প্রক্রিয়া ছিল, যাকে আমরা বলতাম সেন্ট্রাল ফোরাম। সেন্ট্রাল ফোরামে বিষয়টা আলোচনায় এল। তখন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে স্টেডিয়ামের টিকিটঘরের ওখানে প্রায় প্রতিদিনই মিটিং হতো। মিটিং শেষে মিছিল করে ফিরে আসার সময় পেছন থেকে হোয়াইট ড্রেসে ডিবির লোকেরা দু-একজনকে ধরে নিয়ে যেত। পাবনার ডা. কাদরি ছিলেন এ রকম একজন। তার কোনো ট্রেস পাওয়া যাচ্ছিল না। এসব নিয়ে ফোরামে কথাবার্তা হচ্ছে। বলা হলো, আমরা ভালো রকম একটা প্রটেস্ট করব। যেহেতু এটা সন্ত্রাসবিরোধী বিষয়, অতএব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসায় যাব আমরা। সেভাবেই ১৭ মার্চের কর্মসূচি নেওয়া হয়।
বাহ্যত দেখলে এটা গণ আন্দোলনের একটা ধরন। ইতিমধ্যে কিছু কিছু সশস্ত্র তৎপরতার প্রবণতা ছিল। তখন শেখ কামালের কথিত ব্যাংক ডাকাতির কথা বেশ প্রচারিত হয়েছিল। বিবিসিসহ বিভিন্ন রেডিওতে রিপোর্ট হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী-তনয় শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করে ফেরার পথে। পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। বটতলায় একটা সাধারণ ছাত্রসভায় আমি এ প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম। এতে শেখ কামাল খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এবং ঘোষণা দিয়েছিলেন যে যেখানেই পাবেন, সেখানেই উনি আমাকে মারবেন। মানে আহত করবেন, হাসপাতালে পাঠাবেন। আমার ডেটটা। মনে নেই। মধুর ক্যানটিনে একদিন ঘেরাও করে তারা আমার মাথায় আঘাত করেছে। আমি পড়ে গেছি। হসপিটালে ছিলাম। কিন্তু এত বড় ঘটনা ঘটবে আর আমি হাসপাতালে থাকব, এটা আমার পছন্দ হয়নি। হাসপাতাল থেকে রিলিজ না নিয়ে আমি ওই প্রোগ্রামে গেছি।
মহি : ঢাকা মেডিকেল থেকে?
মান্না : হ্যাঁ। আমার মাথায় তখন ব্যান্ডেজ ছিল না। পল্টনে যথারীতি বক্তৃতা হয়েছে। যা বলার সবই বলা হয়েছে। আমার মনে আছে, সবশেষে মেজর জলিল যখন বক্তৃতা করেন, তখন তিনি এই কর্মসূচিটা ঘোষণা করেছেন। বক্তৃতা করার সময় উনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন। প্রায় ১০ ফুট উঁচু মঞ্চ থেকে তিনি লাফ দিয়ে নিচে নামেন।
মিছিল তো বেরিয়ে গেছে। মিছিলে কোনো কন্ট্রোল ছিল না। সামনের দিকে কে ছিল, দেখার উপায় নাই। অজস্র মানুষ। সেই মিছিলে আমি গেছি। একদম ফ্রন্টলাইনে না হলেও ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি ছিলাম। ওইখানে মনসুর আলীর বাসভবন কোনটা, আমরা বুঝতে পারছিলাম না। কেউ কেউ বলল, এটাই বাড়ি। এই সব বলতে বলতে। এর মধ্যে রক্ষীবাহিনীর ট্রাক এল। স্ট্রেট ফায়ারিং শুরু করল। অনেকেই তখন দৌড়ে পালাচ্ছে। আমি দৌড় দিয়ে মন্ত্রীপাড়ার মধ্যে কোনো একটা দেয়াল টপকে চলে গেছি। সরাসরি সাক্ষী হিসেবে এর বেশি আমি জানি না।
ওখান থেকে বেরিয়ে এসে ঘুরেফিরে আমরা প্রথমে ছাত্রলীগ অফিসে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আ ফ ম মাহবুবুল হক এলেন। সেখানে আমরা ১০-১২ জন। খবর পেলাম জলিল ভাই-রব ভাইকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। ওখান থেকে আমরা মিছিল বের করেছি। নীলক্ষেতের রাস্তায় যখন ১০-১২ জন মিলে স্লোগান দিচ্ছি, ‘জলিল রবের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, লোকজন ভয়ে দোকানপাট বন্ধ করতে শুরু করেছে। জাসদ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল, দে ক্যান ফাইট ব্যাক। নেতারা যখন অ্যারেস্ট হয়ে গেছে, তখন মানুষ ভয় তো পাবেই। নতুন করে কেউ আর মিছিলে যোগ দিল না।
মহি : এরপর আপনারা কী করলেন? মিছিল তো জমল না?
মান্না : কিছুক্ষণ পর আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ইউকসু অফিসে গেলাম। ওখানে আমাদের একটা কেন্দ্র ছিল। ওখানে কিছুক্ষণ বসার পর আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির মাঠে গিয়ে বসলাম। ওখানে সিরাজুল আলম খানও ছিলেন। এর মধ্যে খবর পেয়েছি হাসানুল হক ইনু অ্যারেস্ট হয়েছে। ওখানে আমরা যখন কথা বলছি, তখন হঠাৎ ইনু এসে হাজির। ইনু ভাইকে দেখে সিরাজ ভাই তো সাংঘাতিক উচ্ছ্বসিত-ইনু চলে এসেছে, আমার আর কোনো কিছু লাগবে না। সিরাজ ভাই তখন এতই প্রফুল্ল, মানে তার চেহারার মধ্যে একটা উদ্ভাস-আনন্দ।
আমরা তো তখন মনমরা। এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, জাফর মারা গেছে। শুনেছি আরও চার-পাঁচজন মারা গেছে। রব ভাইয়ের তো ফিটের ব্যারাম আছে। উনি নাকি চিৎকার করে রক্ষীবাহিনীকে বলছিলেন, ‘স্টপ ফায়ারিং।’ সব শুনে আমরা বিমর্ষ। সিরাজ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের কী মনে হয়, বলো।’ আমরা সবাই আমাদের বিমর্ষতাই ব্যাখ্যা করছি। দুঃখের কথাই বলছি। সিরাজ ভাই বললেন, ‘আমি তোমাদের কারও কথার সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি যে বাংলাদেশে প্রথম একটা বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ঘটল।’
এ কথা শুনে আমরা চাঙা হয়ে গেলাম। সিরাজ ভাই তো আমাদের কাছে ডেমি-গড়। আমরা ভাবছি, বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। আর উনি বলছেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। এত বড় বিপ্লবী কর্মকাণ্ড করে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি। এ জন্য লজ্জিত আমরা।
তারপর যেটা হলো, আমাদের সেন্ট্রাল ফোরাম বসল। কত দিন পরে মনে নেই। জাসদের ট্রেজারার ছিলেন কামরুল ইসলাম। তাঁর বাসায়, ইস্কাটনের কাছে। সম্ভবত সেই মিটিংয়ে কর্নেল তাহেরও এসেছিলেন। ড. আখলাকুর রহমান ছিলেন। ওখানেই আমাদের একটা সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি করা হয়েছিল, আমরা যেটাকে সিওসি বলি। তখন মেম্বার ছিল ১৩ জন। সেখানেই এটা আলোচনা হলো যে গণ-আন্দোলনে ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তর করতে হবে।
মহি: এটা ১৭ মার্চের কত দিন পরে?
মান্না : ঠিক মনে পড়ছে না। সম্ভবত মার্চ পার হয়ে গেছে অথবা মার্চের শেষের দিকে। সেখানে একটা বক্তব্য আসল-সংগঠন মানে। সেনাবাহিনী, সংগ্রাম অর্থ যুদ্ধ। এটা নিয়ে পরে অনেক বিতর্ক হয়েছে। আমরা আগে গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান–মানে রাশিয়ান মডেলে বিপ্লব করতে হবে–এটাই বলতাম। এখন যে কথাটা বলা হচ্ছে, সেটা তো চীন বিপ্লবে মাও সে তুংয়ের বক্তব্য। তখন এই বিতর্ক হয়নি। পরে এটা এসেছে।
আমি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। আমাদের তো অনেক নেতা-কর্মী। কয়েকজন আমাকে বলেছে। আমি জানি না, এ কথা যদি ছাপা হয়, তারা এটা স্বীকার করবে কি না। দুজনের নাম বলব আমি, মুনির হাসিব। খুব ক্যাটাগরিক্যালি তারা বলল যে ওই দিন রক্ষীবাহিনী গুলি করত না। কারণ, গুলিটা আগেই আমাদের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল। আমি বিস্মিত হয়েছি। জিজ্ঞেস করেছি–কেমন করে? ওরা বলেছে, আপনি নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ঢাকা থেকে তাদের ডিরেকশন দেওয়া হয়েছিল, আর্মস নিয়ে, আর্মড লোকজন নিয়ে আসতে। তারা হাসানুল হক ইনুর কমান্ডে ছিল এবং হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে এটা হয়েছে। আমি তো দুজনের নাম বললাম। আমার ধারণা, আবুল হাসিব খান উইল বেইল মি আউট। স্বীকার করবে। বলবে না যে সে এ কথা বলেনি। এ ছাড়া জয়নাল বলে একজন ছিল, জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। থাকত বংশালের দিকে। সে আমাকে বলেছে, আমি তো নিজেই রাইফেল নিয়া আসছি। ইনু ভাই আমাকে বলছে।’
মহি: জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিল?
মান্না : হ্যাঁ। খুব ডেডিকেটেড কর্মী ছিল। পরে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক বছর ধরে আমেরিকার কোথাও আছে।
মহি: এখন তো আপনি এভাবে মূল্যায়ন করছেন। ওই সময় কি এটা নিয়ে কোনো আরগুমেন্ট করেছেন?
মান্না; তখন তো আরগুমেন্টের কোনো জায়গা ছিল না। আপনি আবুল হাসিব খানকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। সে বলেছিল, ‘আমি ইনু ভাইকে গুলি করতে দেখেছি।’
মহি: এ কথা সে আমাকেও বলেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে বলবে না। হয়তো কাউকে বিব্রত করতে চায় না।
মান্না : সামগ্রিক ঘটনা নিয়ে আমি লিখেছিলাম। একটা বুকলেটও বের করেছিলাম। জাসদের সেন্ট্রাল কমিটি এটা অনুমোদন করেছিল। পাবলিশও করেছিল। পরে সিরাজ ভাই জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। (১৯৮০ সালে), তখন এটা উইড্র করে নেওয়া হয়। এটা উনি ওউন করেন নাই। সেখানে আমি লিখেছিলাম, আমাদের নির্দেশে কী করে এটা করা হলো।
বাস্তব বিষয়টি হলো–এরপর থেকেই সংগঠন মানে সেনাবাহিনী। আর সংগ্রাম মানে যুদ্ধ–এ লাইনে পুরো বিষয়টা তৈরি করা হয়েছে।
১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে গোলাগুলি প্রসঙ্গে হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য অন্য রকম। প্রথম গুলি তিনি ছুঁড়েছেন বলে যে কথা উঠেছে, তিনি এটি অস্বীকার করেছেন। দৈনিক প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব বলেন :
প্রথম আলো : জাসদ সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমদের লেখা প্রথমা’র বইটি পড়েছেন (জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি)?
হাসানুল হক ইনু : (হাসি) মহিউদ্দিন জাসদপন্থী ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলেন। তাঁর পঁচাত্তরের পরের অবস্থান আমি জানি না। তার সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর বই লেখার অধিকার আছে। একটা মন্তব্য করব, এত বড় একটা বই লিখলেন, আমি জাসদের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছি, দীর্ঘ পাঁচ বছর কারাগারে ছিলাম, পুনর্জাগরণে ভূমিকা রেখেছি, আমার সঙ্গে তিনি একবারও দেখা করেননি। আলোচনা করেননি। ওই বইটির আরেকটি সমালোচনা হলো, শোনা কথার ওপর বইটি লেখা।
প্রথম আলো : এই বই বলেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে আপনিই প্রথম গুলি ছুঁড়েছিলেন।
হাসানুল হক ইনু : মহিউদ্দিন ওখানে ছিল নাকি, ওখানে তো ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে কেউ অস্ত্র নিয়ে যায়নি। হাজার হাজার লোকের মিছিল গিয়েছে। বাহাত্তর সালে জাসদ করার পরে আমি প্রকাশ্যে কোথাও অস্ত্র নিয়ে কখনো নড়াচড়া করিনি। আমার এখন লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র আছে। সেই অস্ত্র কোনো দিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে কেউ দেখেনি। আমি রাজনীতির কর্মী, অস্ত্রবাজ নই।
আমি মাদারীপুরে ছিলাম। ১৭ মার্চের পল্টনে জনসভা শুরু হওয়ার পরে শেষ মুহূর্তে কোনোমতে জাসদ অফিসে ব্যাগ রেখে আমি জনসভায় ঢুকি। রব-জলিলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি। মিছিলে অংশ নিই এবং রব, জলিলসহ আমাদের ওপর যখন রক্ষীবাহিনীর গুলিবর্ষণ হয়, সেই রক্ষীবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রত্যক্ষদর্শী আমি। অল্পের জন্য রব, জলিলসহ আমি বেঁচে যাই। বরিশালের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা জাফরসহ অনেকেই নিহত হন। ওখান থেকেই রব-জলিল গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। আমি গ্রেপ্তার হওয়া থেকে বেঁচে যাই। সুতরাং এই যে প্রথম গুলি ছোঁড়ার কথাটা বলল, (অথচ) সেখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ছিল। যদি এটা লেখা হয়, তাহলে এটা অপপ্রচার এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই বই লেখা হয়েছে। [১০]
.
৫
১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে জাসদের ঘেরাও অভিযান পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর হস্তক্ষেপে পণ্ড হয়ে যায়। যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি এটিকে তাঁর রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখেছেন। এর দুই সপ্তাহ পর পয়লা এপ্রিল ১৯৭৪ শেখ মনির মালিকানাধীন ও তাঁর সম্পাদিত বাংলার বাণী পত্রিকায় আট কলামজুড়ে ব্যানার হেডলাইনে একটি প্রতিবেদন ছাপা হলো। এর শিরোনাম ছিল, দুশোরও বেশি কর্মী গ্রেফতার : হার্ডকোর সদস্যরা ধরা পড়েনিঃ জাসদ গুপ্ত সংগঠনে পরিণত হতে চলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয় :
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একটি গুপ্ত সংগঠনে পরিণত হতে চলেছে। পুলিশ গত ১৭ মার্চ থেকে পনেরো দিন অভিযান চালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাসদের প্রায় দুই শতাধিক কর্মীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু এই গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে দলটির হার্ডকোর সদস্যদের খুব কমই ধরা হয়েছে।
জাসদসূত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়, জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির ট্রটস্কিপন্থী কমুনিস্ট সদস্যদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। মেজর জলিলের সমর্থকদের এক বিরাট অংশ ধরা পড়েছে মাত্র।
জানা যায়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আবরণে দুটি রাজনৈতিক সংগঠন পাশাপাশি ও সমান্তরাল ধারায় কাজ করে যাচ্ছিল। একটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান। বিক্ষিপ্তভাবে সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করে সরকারকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলার স্ট্রাটেজি নিয়ে এই গ্রুপটি কাজ করে। গ্রুপটি সম্প্রতি একটি গোপন বৈঠকে বসে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট লীগ নাম দিয়ে একটি গোপন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভাবছিলেন। এমনকি এই উদ্দেশ্যে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি হাইকমান্ড গঠন করা হয় বলে অসমর্থিত খবরে জানা যায়। জনাব সিরাজুল আলম খান কমান্ডের সভাপতি এবং জনাব আরেফ, জনাব মনিরুল ইসলাম, জনাব হাসানুল হক ইনু সভ্য ছিলেন। অপর ব্যক্তির নাম জানা যায়নি। বিগত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদের নির্বাচনের পর দলের এই গ্রুপটি সিদ্ধান্ত নেন, গোপন ক্যাডার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে এবং দেশের বাস্তবতাকে নিজেদের স্বপক্ষে টেনে এনে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে হবে। এমনকি এদের একাংশ সম্পূর্ণ জাসদ দলটিকে একটি গুপ্ত সংগঠন হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব রাখেন। তাদের এই নতুন রাজনৈতিক তৎপরতার স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা লাভের জন্য জনাব সিরাজুল আলম খান ভারতে যান। এক খবরে জানা যায় তিনি কলকাতায় সফররত ট্রটস্কিপন্থী পাকিস্তানের জনাব তারিক আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সাহায্য চান। [১১]
বাংলার বাণীর প্রতিবেদনের তথ্যগুলো একেবারে অমূলক ছিল না। জাসদ যে একটি বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করবে, এ ধরনের ঘোষণা দলের জন্মলগ্নেই দেওয়া হয়েছিল। জাসদ নেতারা বলতেন, একটি মূল শক্তি অচিরেই গড়ে উঠবে, যার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে। কমিউনিস্ট লীগ’ নামটি বিবেচনায় ছিল। দলের আত্মগোপনে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছিল ১৭ মার্চের ঘেরাও অভিযান। তবে এটা ঠিক, জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে না থেকেও সিরাজুল আলম খান দলটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর প্রধান সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন কাজী আরেফ আহমদ, মনিরুল ইসলাম, শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও হাসানুল হক ইনু। তাঁরা এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাসদের কোনো কমিটিতে ছিলেন না। বাংলার বাণীর প্রতিবেদনে কলকাতায় ট্রটস্কিপন্থী নির্বাসিত পাকিস্তানি লেখক তারিক আলীর প্রসঙ্গটি কষ্টকল্পিত। কলকাতায় সিরাজুল আলম খানের যোগসূত্র ছিল দুটি। একটি হলো ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য আওয়ামী লীগের নেতা চিত্তরঞ্জন সুতার। কলকাতায় সিরাজুল আলম খানের দ্বিতীয় সংযোগটি ছিল শিবদাস ঘোষের সঙ্গে। শিবদাস ঘোষ ছিলেন সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়ার (এসইউসিআই) সম্পাদক। অন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলো শিবদাস ঘোষকে ট্রটস্কিপন্থী মনে করত। তবে তিনি এটা বরাবর অস্বীকার করেছেন।
.
৬
মাহমুদুর রহমান মান্নার ভাষ্য অনুযায়ী, বিপ্লবী গণবাহিনীর একটি কাঠামো তৈরি হয় ১৯৭৪ সালেই। এ নিয়ে তিনি আমাকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা এখানে তুলে ধরা হলো :
মান্না : কামরুল ইসলাম ভাইয়ের বাসায়ই গণবাহিনীর একটা কাঠামোর কথা বলা হলো, যার কমান্ডার হলেন কর্নেল তাহের, ডেপুটি কমান্ডার হলেন হাসানুল হক ইনু।
মহি : সময়টা বলতে পারেন?
মান্না : কামরুল ভাইয়ের বাসায় এই মিটিংয়ে সিদ্ধান্তটা হলো, নাকি পরে কোনো একটা মিটিংয়ে হলো, এটা আমি স্মরণ করতে পারছি না। তখন আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে মিটিং করতাম।
মহি : এটা তো ১৯৭৪ সালেই?
মান্না : হ্যাঁ, চুয়াত্তর তো বটেই।
মহি : আমি পার্টি লিটারেচারে পেয়েছি, চুয়াত্তরের জুনের ২৭-২৮ তারিখের সভায় গণবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
মান্না : কামরুল ভাইয়ের বাসায় সিদ্ধান্ত হয়, এটা মনে আছে।
মহি : ওনার বাসা কোথায়?
মান্না : এখন যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ওই গলির মধ্যে। মিটিংয়ে কর্নেল তাহের ছিলেন।
মহি: অ্যানাউন্সমেন্টটা কে করলেন?
মান্না : সিরাজ ভাই বললেন। উনি তো আমাদের প্রিন্সিপাল ফিগার ছিলেন। সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে উনি থাকতেন।
মহি: ওই মিটিংয়ে আর কে কে ছিলেন?
মান্না : কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনি, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মোহাম্মদ শাহজাহান, নূর আলম জিকু–এঁরা ছিলেন। রওশন জাহান সাথীও ছিলেন। সবার নাম মনে নেই।
মহি : মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ছিলেন?
মান্না : না। শেষমেশ এটাই হলো, আমিও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম, গণবাহিনীর কাজে। একটা এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করি। ময়মনসিংহে গেছি। রাতে ছাড়া দিনে তো বেরোনো যাচ্ছে না। তারপরও কোনো কোনো সময় বেরোতে হয়। আমাকে দেখলেই লোকের ভিড় জমে যেত। একদিন সিরাজ ভাই বললেন, এসব কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে মানে?
সবাই ছাত্রলীগ বাদ দিয়ে গণবাহিনীতে চলে যাচ্ছে? তুমিও নাকি গেছ?
আমাকে তো সিদ্ধান্ত দিয়েই পাঠানো হয়েছে।
না না, তুমি ছাত্রলীগ করো। তুমি আর কোথাও যেয়ো না। ছাত্রলীগ গোছাও।
কথাটা এ জন্য বললাম যে গণসংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, সিরাজ ভাই এটা মনে করতেন না। কিন্তু উনি যে আমাকে নির্দেশটা দিলেন–আমি যাকেই ডাকি, সে-ই তো গণবাহিনীতে ঢুকে গেছে। সবার এককথা–আরে, কী ছাত্রলীগ করব? পরে আমি তাকে এটা বলেছি। ঢাকা মহানগরের থানার যে কর্মী, সে-ও তখন ককটেল বানানো শিখছে। ওর তখন ছাত্রলীগ করার কোনো আগ্রহ নেই। এন্টায়ার অর্গানাইজেশন ওদিকে চলে গেছে। আমরাই আগে বলেছি, এ দেশে গেরিলাযুদ্ধের কোনো সুযোগ নেই। এটা হঠকারী। অথচ সেদিকেই গেলাম। এটার একটা এভিল করোলারি হিসেবে এসেছে ক্যু-বাদ। [১২]
বিপ্লবী গণবাহিনীর জন্ম কখন, এ নিয়ে দলের মধ্যে ভিন্নমত আছে। লি দশক পর জাসদের একটি অংশ যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে যায়, তখন তাদের মধ্যে ইতিহাস বদলে ফেলার একটা প্রবণতা দেখা যায়। যখন গণবাহিনী তৈরি হয়, তখনো সংসদীয় রাজনীতি বহাল ছিল। কিন্তু জাসদের যারা নতুন ইতিহাস লিখতে বসেছেন, তাঁদের বয়ান হলো, আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসন কায়েম করার পর গণবাহিনী তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে কথা হলো জাসদ নেতা শরীফ নুরুল আম্বিয়ার সঙ্গে।
মহি: সিরাজ ভাইকে বলেছিলাম, গণবাহিনী কেন করতে গেলেন?
উনি বললেন, এটা ওনার সিদ্ধান্ত না।
আম্বিয়া : তখন তো গণবাহিনী করার বিকল্প কিছু ছিল না।
মহি: আমি তাকে বললাম, জাসদ যে পার্লামেন্টারি পলিটিকসটা করে, পিকিংপন্থী লাইনের বাইরে গিয়ে, সেখানে তো গণবাহিনীকে জাস্টিফাই করা যায় না।
আম্বিয়া : বাকশাল হয়ে যাওয়ার পরে তো গণবাহিনী?
মহি : বাকশাল তো হলো পঁচাত্তরের জানুয়ারির পর। গণবাহিনী তৈরি করা হবে, এ সিদ্ধান্ত তো হয়েছে চুয়াত্তরের জুনে।
আম্বিয়া : জুনে না।
মহি : এটা তো জাসদের লিটারেচারেই আছে?
আম্বিয়া : কোন লিটারেচারে আছে?
মহি : সাম্যবাদ-এ আছে, জুনের ২৭-২৮ তারিখ গণবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গণবাহিনী কেন দরকার, কী করা দরকার, এ বিষয়ে সাম্যবাদ-এর একটা সংখ্যা আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলায় গণবাহিনীর কাজকর্ম তো শুরু হয়ে গিয়েছিল।
আম্বিয়া : ডিস্ট্রিক্টে গণবাহিনী হয় নাই। সেখানে সশস্ত্র প্রতিরোধ হইছে। আওয়ামী লীগ যতটা করছে, আমরা তো অতটা করি নাই। অস্ত্রও ওদের বেশি, লোকও ওদের বেশি, বাহিনীও ওদের বেশি।
মহি: গণবাহিনী নামে হয়তো ফরমেশনে যায় নাই।
আম্বিয়া : ফরমেশন হইছে, কমান্ড স্ট্রাকচার হইছে ১৯৭৫ সালে। প্র্যাকটিক্যালি এটা মুভ করছে ইমার্জেন্সি হওয়ার পরে।
মহি : ইমার্জেন্সির পরে সিরাজ ভাই তো চলে গেলেন। কলকাতায়। তাহলে তো উনি এই ডিসিশনের পার্ট না?
আম্বিয়া : না, এটা ঠিক না। ইমার্জেন্সি যখন হয়, আমরা সরকারের সঙ্গে যাব কি যাব না, এটা নিয়ে আমাদের একটা মিটিং হয় বাংলামোটরে, জাসদের ট্রেজারারের বাসায়। উনি কন্ট্রাক্টারি ব্যবসা করত। সিরাজ ভাই ওপেন মাইন্ডে ছিল, যাব কি যাব না। তখনকার পজিশন হইল–দল তো ডিভাইড হইয়া যাইত। অর্ধেক লোক জেলে। অন্যদের নামে কেস। এটা প্র্যাকটিক্যাল না। দল। যেভাবে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হইয়া আছে বিভিন্ন জায়গায়, এটা তখন বাকশালে যাওয়ার অবস্থায় নাই। লাস্টলি ডিসিশন হইল, উই আর নট গোয়িং।
মহি : গণবাহিনীর ফরমেশনটা হলো কখন?
আম্বিয়া : সম্ভবত পঁচাত্তরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে। আমরা তো এলাকা থেকে আসতে পারতেছি না। সিরাজ ভাই ফোন কইরা জানাইল–টুকু ভাই (কামরুজ্জামান টুক) হইল কমান্ডার, আর আমি হইলাম পলিটিক্যাল কমিসার, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের।
মহি : সিরাজ ভাই তো তখন কলকাতায়?
আম্বিয়া : না, উনি ঢাকা থেকে কল করছেন। ফোন করে দায়িত্ব দিছেন। যখন ইমার্জেন্সি হয়, তখন আমি সাতক্ষীরায় বিভিন্ন ফোরামের যৌথ সভা করছি। সেই মিটিংয়ে আখলাক স্যার গেছিল। যেদিন ইমার্জেন্সি হয়, ওই দিনই আখলাক স্যার যশোর পৌঁছান। তার পরদিন আমাদের মিটিং। আখলাক স্যার বললেন, টিভি খোলো তো দেখি, শুনি। তারপর বললেন, ‘ব্যাটা মরল।’
১৭ মার্চের পর ওই লাইনে যাওয়া ছাড়া–মাস মুভমেন্ট ব্যাকড বাই আর্মস। দলের মধ্যে যারা অস্ত্র চালাচালি করে, তারাই দলকে টেকওভার করল।
আওয়ামী লীগ তো তখন জনবিচ্ছিন্ন। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী নামিয়ে মপিং-আপ অপারেশন চলছিল। সেখানে আমাদের লোকজনও ধরা পড়ছিল। কিন্তু যুবলীগের লোকেরা ধরা পড়ছিল অনেক। তাদের হাতে অস্ত্র পাওয়া গেছে এবং তাদের ভালো করে ধোলাই দেওয়া হইছে। ধোলাই ওরা বেশি খাইছে। আমরা খুব কম। আমাদের লোক কম। সোশ্যাল স্ট্যাটাসও কম। ওরা ভাবছে, এদের মাইরা-ধইরা লাভ নাই। মাইর ওরাই বেশি খাইছে। এইটা দেখে আওয়ামী লীগের প্রেশারে। আর্মি উইড্র করা হয়। আমরা বরং অনেক ডিসিপ্লিনড ছিলাম। আমরা মানুষের ওপর অত্যাচার করি নাই। নড়াইলে গণবাহিনী হয় নাই। কিন্তু যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ঝিনেদা, মাগুরা–এসব অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ হইছে। রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে ফাইট হইছে চুয়াডাঙ্গায়। তখনো গণবাহিনী ফর্মড় হয় নাই। দেশব্যাপী সশস্ত্র প্রতিরোধ উইথ আ সেন্ট্রাল কমান্ড, এটা হইছে বাকশাল হওয়ার পর। জেলায় জেলায় যেটা হইছে, এটা আমাদের ফোর্স করছে বলে হইছে।
তেহাত্তর সালে নূরে আলম সিদ্দিকীর বাহিনী রবিউল-রশিদরে মাইরা রাস্তায় ফালায়া দিল, বেলা সাড়ে চারটার সময়। আমি তখন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট। রবিউল আর রশিদ হইল ঝিনেদা ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি আর অর্গানাইজিং সেক্রেটারি। তখন ঝিনেদার পলিটিকস নূরে আলম সিদ্দিকীর কন্ট্রোলে। মসিউরের বাহিনী দিয়া করাইছে। আওয়ামী লীগ আমাদের কোন জায়গায় নিয়া গেছে, চিন্তা করা যায় না।
চিটাগাংয়ে গণবাহিনী হয় নাই। ননায়াখালীতে লেট ডেভেলপমেন্ট হইছে। সিলেটে কিছু হয় নাই।
আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্যের কারণেই বিভিন্ন জায়গায় গণবাহিনী হইছে। গণবাহিনী হইল একটা প্রতিক্রিয়া। আওয়ামী লীগ যদি জাসদকে গর্তে ফালাইতে না চাইত-শেখ সাহেব বা তাঁর পক্ষে যারা প্ল্যান করে, তারা একটা গ্রস প্ল্যানিং করছে। সিরাজুল আলম খানের তো কোনো আন্তর্জাতিক কানেকশন নাই। শেখ সাহেব জানে। একমাত্র ইন্ডিয়ান কানেকশন। পরে তারাও পিছায়া গেছে। প্রথমে তারা চাইছিল দুইটা এক বাস্কেটে না, দুই বাস্কেটে থাকুক। পরে শেখ সাহেব প্রেশার-ট্রেশার দিয়া বা অন্য কোনোভাবেই হোক, মেন্যুভার কইরা এইটা কাইটা দিছে।
মহি : জাসদের ফরমেশনে ইন্ডিয়ার ভূমিকার কথা বলছেন?
আম্বিয়া : এটা আমার ধারণা। ওই লেভেলে তো তখন আমার প্রেজেন্স নাই। পরে তারা সইরা গেছে। সিরাজ ভাই আমারে একটা কথা কয়–নেভার ট্রাস্ট ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড আওয়ামী লীগ। তার মানে শেখ সাহেবের সঙ্গে কিছু কথা ছিল। সেটা উনি রাখেন নাই। ইন্ডিয়াও কথা রাখে নাই।
মহি: তার মানে, ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে সিরাজ ভাইয়ের কথা হয়েছিল?
আম্বিয়া : ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে কথাবার্তা তো ছিলই। ওরা তো নিয়মিতই, যখনই ফিল করত, গণকণ্ঠঅফিসে বসত। কিন্তু তাদের সঙ্গে কন্টিনিউ করে নাই। অথবা সিরাজ ভাইকে তারা ম্যানেজ করতে পারে নাই। উনি তো তখন একটা ফিগার। শেখ সাহেব আর তাজউদ্দীনের পরে তো তিন নম্বরেই উনি। এটা আমার বিবেচনায়।
মওলানা ভাসানীকে শেখ সাহেব ম্যানেজ করছে, অথবা মওলানা নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া শেখ সাহেবকে বলছে, আন্দোলন। করব, সব করব, কিন্তু তোমাকে ডিস্টার্ব করব না। অ্যান্ড হি উইল ম্যানেজ চায়না। মওলানা যদি চায়নাকে ম্যানেজ করে আর শেখ সাহেবকে ডিস্টার্ব না করে, তাহলে সিরাজুল আলম খানের আর কোনো জায়গা আছে?
১৭ মার্চের ঘটনাতেই আমরা ওই ফাঁদে পইড়া গেছি। সেখান থেকে রিকভার করার জন্য…হ্যাঁ, গণবাহিনী করার প্রশ্নে আমিও মত দিছি। কারণ, এ ছাড়া আর পথ ছিল না। আমি ১৭ মার্চের বিরোধিতা করছি। কিন্তু তখন মনে হইছে, গণবাহিনীই ছিল বাঁচার একটা রাস্তা। [১৩]
.
৭
বাংলাদেশে প্রথাগত কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠনগুলো বেশির ভাগই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) থেকে জন্ম নেওয়া। সিপিআই ভাঙলে এ দেশেও একই ধারায় দল ভাঙে। প্রায় সব কটি দল-উপদলে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি, উৎপাদনব্যবস্থা ও উৎপাদন-সম্পর্কের তত্ত্ব নিয়ে মোটামুটি ঐকমত্য ছিল। যেমন কৃষিব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। এটি আগে সম্পন্ন করতে হবে। কীভাবে সম্পন্ন হবে, এ নিয়ে মস্কো ও পিকিং বর্গের দলগুলোর মধ্যে মতভেদ সুস্পষ্ট। পিকিংপন্থীরা মনে করেন, বিপ্লবের স্তর হলো গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাপ্ত করতে হবে। তারপরে সমাজতন্ত্র। মস্কোপন্থীরা বলছেন অধনবাদী বিকাশের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব। বিতর্কের বিষয় ছিল ‘মোড অব প্রোডাকশন’। জাসদ এই বিতর্কে হাজির করল নতুন তত্ত্ব।
অধ্যাপক আখলাকুর রহমান তত দিনে জাসদের প্রধান তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি ও সিরাজুল আলম খান নেতা-কর্মীদের জন্য সমাজতন্ত্রের ক্লাস নেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত জাসদ অফিসের দোতলায় এই ক্লাস চলে। অংশগ্রহণকারীরা বেশির ভাগই ছাত্রলীগের নেতা কর্মী। একপর্যায়ে আখলাকুর রহমান দলের তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করালেন একটি পুস্তিকার মাধ্যমে, বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ। বইটির কাঠামোবিন্যাস লেনিনের লেখা রাশিয়ার কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ গ্রন্থের আদলে। আখলাকুর রহমানের বিশ্লেষণের চুম্বক অংশটি হলো :
মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে সর্বজনীন পণ্যোৎপাদনই ধনবাদী উৎপাদনব্যবস্থার প্রধান ও প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশের কৃষিতে মজুরি-শ্রমের আবির্ভাব ও নিযুক্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ধনতন্ত্র হচ্ছে পণ্যোৎপাদনের সেই স্তর, যেখানে শ্রম পণ্যে রূপান্তরিত হয়। তাই বাংলাদেশের কৃষিতে মজুরি-শ্রমের ব্যবহার কৃষি বিকাশের বৈশিষ্ট্যকেই শুধু ধনতান্ত্রিক করে না, ধনতন্ত্রের বিকাশের পথও প্রশস্ত করে।
এখানে আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে মজুরি-শ্রম ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে; ধনতন্ত্রের ত্বরান্বিত বিকাশ ও উন্নয়ন জনসংখ্যার অধিকাংশকে মজুরি-শ্রমিকে পরিণত করে; কিন্তু বিকাশের কোনো স্তরেই ধনতন্ত্র মজুরি-শ্রমের পূর্ণ বিনিযুক্তি প্রদান করতে পারে না। তা সম্ভব কেবল নির্ভেজাল সমাজতন্ত্রে। [১৪]
আখলাকুর রহমানের বইটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি। জাসদ-সমর্থিত জাতীয় শ্রমিক জোটের নেতা মেসবাউদ্দীন আহমেদের সম্পাদনায় সমীক্ষণ-এর আশ্বিন-কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) সংখ্যায় এটি আবারও ছাপা হয়। একই সময় চলছিল জাসদের ‘বিপ্লবী পার্টি’ তৈরির প্রক্রিয়া। মডেলটি এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর প্রথাগত মডেল থেকে নেওয়া। এই মডেল অনুযায়ী মূল সংগঠন হলো একটি কমিউনিস্ট পার্টি, যার নেতৃত্বে বিপ্লব হবে। সমাজে নানা পেশা-শ্রেণির স্বার্থ নিয়ে কাজ করবে এই পার্টির অঙ্গসংগঠনগুলো, যা চলতি ধারায় ‘গণসংগঠন’ বলা হতো। জাসদের ক্ষেত্রে বিষয়টা হলো একটু উল্টো। প্রথমে হলো ছাত্রসংগঠন, তারপরে জাসদ, তারপর শুরু হলো বিপ্লবী পার্টি গড়ার প্রক্রিয়া। একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে ওঠে একটি তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর। কী সেই ভিত্তি, কী তার ব্যাখ্যা–এ নিয়ে চলছিল আলোচনা এবং একটি থিসিস তৈরির চেষ্টা।
মস্কো ও পিকিংপন্থী দলগুলোর বিপরীতে একটি আলাদা রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করার জন্য তত্ত্বের তালাশ করতে গিয়ে সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়ার (এসইউসিআই) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গ্রহণযোগ্য মনে হলো। ব্যাখ্যাটি পাওয়া গেল এসইউসিআইয়ের নেতা শিবদাস ঘোষের কাছে। চীনা ধারার জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব যে এ দেশে অচল, এ প্রসঙ্গে শিবদাস ঘোষের বক্তব্য হলো :
মাও সে তুংয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রাকৃবিপ্লব চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল আধা ঔপনিবেশিক-আধা সামন্ততান্ত্রিক এবং তার চরিত্র ছিল প্রি ক্যাপিটালিস্ট ডিসেন্ট্রালাইজড মেডিয়াভ্যাল নেচারের। অর্থাৎ চীন ছিল প্রাক-পুঁজিবাদী বিকেন্দ্রীভূত মধ্যযুগীয় চরিত্রের রাষ্ট্র। উপরন্তু, গোটা চীনে অখণ্ড সুসংহত কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ছিল না। সমগ্র চীন দেশটা বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রভাবিত অঞ্চল হিসেবে আলাদা আলাদা টুকরোতে বিভক্ত ছিল এবং এই সশস্ত্র অঞ্চলগুলো আলাদা আলাদাভাবেই সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার কতগুলো ওয়ারলর্ডদের দ্বারা শাসিত হতো।…ভারতবর্ষের বর্তমান শাসনব্যবস্থার সাথে কি এর কোনো মিল আছে? বরং ভারতবর্ষে যেকোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ন্যায় একটি অত্যন্ত সুসংহত কেন্দ্রীভূত আধুনিক ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা বর্তমান এবং অত্যন্ত আধুনিক সুসংহত কেন্দ্রীভূত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মতোই এখানে একটি অত্যন্ত সুসংহত জাতীয় সেনাবাহিনী এবং একটি সার্বভৌম পার্লামেন্টের অস্তিত্ব বর্তমান আছে, যার সাথে প্রাকৃবিপ্লব চীনের কোনো মিল নেই। তাহলে দেখতে পাচ্ছেন, না রাষ্ট্রের চরিত্রে, না জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির গঠনে বা প্রকৃতিতে, না। গ্রামীণ অর্থনীতির চরিত্রে এবং মূল শ্রেণিদ্বন্দ্বে শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে, কোনো দিক থেকেই আমাদের দেশের বিপ্লবের তত্ত্ব চীনের বিপ্লবের তত্ত্বের সাথে এক হতে পারে না। ‘১৫’
শিবদাস ঘোষ চীনের মতো এ দেশের গ্রামাঞ্চলে মুক্ত এলাকা তৈরি করে শহর দখল করার কৌশলটিকে ভুল বলেছেন। তাঁর মতে, চীনপন্থীরা। গেরিলাযুদ্ধের নীতির সঙ্গে ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের’ তত্ত্বকে এক করে ফেলেছেন। তাঁর মন্তব্য হলো :
জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হোক অথবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হোক–লড়াইটা যে দেশেই শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেবে, সেই দেশেই গেরিলাযুদ্ধের নীতি ও সংগ্রামকৌশল সেই দেশের বিপ্লবীদের গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া প্রতিটি দেশের নিজস্ব আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্য যেখানেই বিপ্লবী শ্রেণি শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে এই গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন, তাঁরাই গেরিলাযুদ্ধের তত্ত্বে ও কৌশলে কিছু না কিছু সংযোজন ঘটাতে বাধ্য হবেন। তা না হলে তারাও গেরিলাযুদ্ধকে কেবল কপি করে চালাতে পারবেন না। ফলে আপনারা বুঝতে পারছেন, গেরিলাযুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করার সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে মুক্ত এলাকা সৃষ্টি করে শহর দখল করার সংগ্রামকৌশল এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব গ্রহণের, যা নকশালপন্থীরা এক করে ফেলেছেন, তার কোনো সম্পর্ক নেই। [১৬]
বিপ্লবী পার্টি গড়ার একপর্যায়ে লেখা হলো খসড়া থিসিস। ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন ‘সমভাবাপন্ন একটি বিপ্লবী গোষ্ঠীর দীর্ঘ গবেষণা, আলোচনা ও সমবেত প্রচেষ্টা’র ভিত্তিতে ‘শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা’ করার উদ্দেশ্যে এটি প্রথমবার উপস্থাপন করা হয় ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন। এটি লিখেছিলেন আখলাকুর রহমান। খসড়া থিসিসের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক হয়, যা উঠে এসেছে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর দেওয়া সাক্ষাৎকারে :
মুবিনুল হায়দার চৌধুরী : ‘পটভূমি’ নামে একটা থিসিস বের করেছিলাম। আখলাকুর রহমান যেটা লিখেছিলেন। সেটা ভুল। ভুল মানে, বিপ্লব-টিপ্লব সম্পর্কে আখলাকুর রহমানের সঠিক ধারণা নেই।
মহিউদ্দিন আহমদ : খসড়া থিসিস যেটা প্রথমে সাকুলেট করা হয়েছিল?
হায়দার : হ্যাঁ। উনি বলতেন, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব আর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাঝখানে আরেকটা বিপ্লব আছে। বাংলাদেশে সেই বিপ্লব হবে। আমি বললাম, না। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হলো, যে দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি, বুর্জোয়ারাই যেটা করতে পারত, সেটা সর্বহারা শ্রেণি করছে। তখন এটা হয়ে গেল। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। এটা অন্তর্বর্তীকালীন কোনো বিপ্লব না। আখলাকুর রহমান ট্রটস্কিবাদী চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মানে সোশ্যালিস্ট রেভলুশন ছাড়া অন্য কোনো রেভল্যুশনে তাঁরা বিশ্বাস করতেন না।
মহি : কিন্তু এটা তো এসইউসিআইয়ের লাইন ছিল?
হায়দার : এসইউসিআই যে ট্রটস্কিবাদী না, এর অনেক প্রমাণ আছে।
মহি: আমি ট্রটস্কিবাদীদের কথা বলছি না। আমি বলছি, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব…।
হায়দার : লেনিনের মত অনুযায়ী কৃষিভিত্তিক সমাজ হওয়া সত্ত্বেও ‘এপ্রিল থিসিস’-এ লেনিন বললেন–জার রোমানভের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় বসল, যেটা হলো ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। এখন যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে, ফিউডাল ল্যান্ডলর্ডদের প্রতিনিধি জার রোমানভের হাতে না, ফলে বুর্জোয়া ডেমোক্রেটিক রেভল্যুশনের ওই পর্যায় পার হয়ে গেছে। এখন বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। এ জন্যই এটা হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এপ্রিল থিসিসের এই কথা রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই প্রথমে বুঝতে পারেননি।
লেনিন বললেন, কোন শ্রেণি বা শ্রেণিগুলো কোন শ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবে, সেটাই হচ্ছে প্রতিটি বিপ্লবের মূল প্রশ্ন। লেনিনের এই তত্ত্ব যে একটা পশ্চাৎপদ দেশেও প্রয়োগ হতে পারে…কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাকে বলেই দিয়েছিলেন, ওখানে গিয়ে যা দেখবে, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কিছু উপাদান, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্ট্রাগল থাকবে। কিন্তু যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতায় বুর্জোয়ারা এসেছে, তখন তাকে উচ্ছেদ করতে গেলেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হবে। কারণ, বিপ্লবের মূল প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।
তো এর ওপর যে ‘পটভূমি’ লিখেছিলাম, সেখানে বলেছিলাম, বিপ্লব একটা পলিটিক্যাল পার্টিই শুধু করে না। বিপ্লব করে জনগণ। জনগণকে সুসংগঠিত হতে হবে। বিকল্প রাষ্ট্রশক্তি তৈরি করতে হবে। লড়াই করতে করতে পিপলস পলিটিক্যাল পাওয়ার ডেভেলপ করবে। এই পাওয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে, নেতৃত্ব দেবে পার্টি। কোনো সময় একটা পার্টি একা বিপ্লব করে না। বিপ্লব জনগণ করবে। [১৭]
পরে পরিমার্জিত আকারে খসড়া থিসিস ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৬ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অনুমোদন করা হয়। ১৯৭৪ সালের খসড়া থিসিসে বর্তমান রাজনৈতিক লাইন মূলত অভ্রান্ত দাবি করা হয়েছিল।১৮ খসড়া থিসিসে বাংলাদেশকে একটি পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বা জাতীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করে শেখ মুজিবুর রহমান এবং শাসক দল সম্পর্কে বলা হয় :
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি, যারা প্রাক স্বাধীনতা যুগে পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের দ্বারা অবদমিত ছিল, তাদেরই স্বার্থের প্রতিভূ। স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই শেখ মুজিব স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সমস্ত শক্তিগুলিকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গড়ে তোলার পরিবর্তে কেবলমাত্র তাঁর দল আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে সকলের সম্মিলিত স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত ফল আত্মসাৎ করেন এবং জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব দখল করেন। পরবর্তীকালে কারচুপি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পুঁজিবাদের স্বার্থে তিনি বাংলাদেশে বাস্তবে একটি একদলীয় স্বেচ্ছাচারী শাসন কায়েম করেন। তারপর থেকেই শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকারের গণবিরোধী স্বৈরাচারী শাসনের দেশ ও জাতি বিধ্বংসকারী ইতিহাস। [১৯]
খসড়া থিসিসে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণিকে উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্তে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়। এ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য ‘বাংলাদেশের মতো একটি পশ্চাৎপদ দেশে অতি সন্তর্পণে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে অনেকগুলি মধ্যবর্তী স্তরকে অতিক্রম করে এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অপূরিত কর্মসূচিগুলোকে ‘ডেরিভেটিভ’ কর্মসূচি হিসেবে সম্পূর্ণ করার আহ্বান জানানো হয়। [২০]
.
৮
জাসদ গোপনে সামরিক সংগঠন তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য। এ ব্যাপারে দলটির রাখঢাক ছিল না। দলের প্রকাশিত একটি দলিলে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের নির্যাতন, গেস্টাপো বাহিনী ও রক্ষীবাহিনী ইত্যাদির মোকাবিলার জন্য এবং যেকোনো প্রকার বিদেশি শক্তির হামলা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে, শ্রমিক। এলাকায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে গড়ে ওঠে “বিপ্লবী গণবাহিনী”। শুধু সেখানেই শেষ না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিপাহিদের মধ্যেও অতি গোপনে ও সতর্কতার সঙ্গে সাংগঠনিক কাজ চালানো হয়। ধীরে ধীরে প্রতিটি সেনানিবাসে গড়ে ওঠে স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশের মধ্যে “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা”। সিপাহিরা তো সাধারণ শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তেরই সন্তান। [২১]
জাসদের মধ্য দিয়ে যে গণবাহিনী তৈরি হয়েছিল, তার কমান্ড-কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। গণবাহিনী গঠনের সময় ও যৌক্তিকতা নিয়ে সাপ্তাহিক সমীক্ষণকে তিনি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
প্রশ্ন : ১৯৭৪ সালে আপনাদের গঠিত গণবাহিনী তো একটা সশস্ত্র সংগঠন? এবং ‘৭৪ সালের শেষের দিকে একে মূল সংগঠন বলা হয়েছে?
উত্তর : এ রকম কোনো দলিল নেই। ‘৭৪-এর শেষের দিকে জরুরি আইন যখন ঘোষণা হয়ে যায়, বাকশালের একদলীয় শাসন যখন কায়েম হয়, সকল দলের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় এবং বিরোধী নেতা-কর্মীদের বা কোনো বিরোধী পক্ষকে অস্ত্রের মাধ্যমে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে যে দমন করার নীতি সরকার গ্রহণ করে, তখন আত্মরক্ষার খাতিরে যে সশস্ত্র সংগ্রাম সারা দেশে গড়ে ওঠে–সেটাকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিপ্লবী গণবাহিনী গড়ে ওঠে।
প্রশ্ন : কিন্তু একদলীয় শাসন কায়েমের আগেই তো গণবাহিনী গড়ে ওঠে–’৭৪-এর মাঝামাঝি থেকে গণবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়।
উত্তর : ‘৭৪-এর মাঝামাঝি গণবাহিনীর নামে কোনো তৎপরতা ছিল না। জাসদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আত্মরক্ষার জন্য কিছু কিছু সশস্ত্র সংগঠন–যে সশস্ত্র প্রতিরোধ চলছিল চারদিকে–তাকে একটা সংগঠিত রূপ দেয়। বিপ্লবী গণবাহিনী একটা স্বাধীন সংগঠন, যাকে জাসদ সমর্থন দিয়েছিল।[২২]
বিপ্লবী পার্টির একটি কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছিল। ১৯৭৩ সাল থেকেই কাজ করছিল একটি সমন্বয় কমিটি। ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চের পর পার্টি গঠন প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়। চুয়াত্তরের ২৭-২৮ জুন এক সভায় গৃহীত হয় খসড়া থিসিস। একই সঙ্গে সমন্বয় কমিটিকে আরও বিস্তৃত করা হয়। কমিটির অন্যতম সদস্য খায়ের এজাজ মাসুদ এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন :
আমি তো ছাত্রলীগ ঘরানার মধ্যে ছিলাম না। নোয়াখালী জিলা স্কুলে পড়ার সময় ওখানে ছাত্রলীগের একটি কমিটি করা হয়েছিল। আমি ছিলাম তার আহ্বায়ক। ব্যস, ওই পর্যন্তই। ১৯৭৩ সালে আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হই। আগে থেকেই আমার চিন্তাভাবনায় ছিল ইসলামিক সোশ্যালিজম। আবু জর গিফারি ছিলেন আমার আইডল। এখানে পেলাম সিরাজুল আলম খানকে।
মগবাজারে এক জাহাজ ব্যবসায়ীর বাড়ির ছাদে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠন করা হয় সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি। সংক্ষেপে এর নাম হলো সিওসি। এটা হলো বিপ্লবী পার্টির জ্বণ। ২১ সদস্যের কমিটিতে ক্রম অনুযায়ী নামগুলো হলো : ১. সিরাজুল আলম খান, ২. আখলাকুর রহমান, ৩. মোহাম্মদ শাহজাহান, ৪. হারুনুর রশিদ, ৫. হাসানুল হক ইনু, ৬. মনিরুল ইসলাম (মার্শাল), ৭. খায়ের এজাজ মাসুদ, ৮. মেজর এম এ জলিল, ৯. আ স ম আবদুর রব, ১০. কাজী আরেফ আহমদ, ১১. শরীফ নুরুল আম্বিয়া, ১২. আ ফ ম মাহবুবুল হক, ১৩. শাজাহান সিরাজ, ১৪. এ বি এম শাহজাহান, ১৫. খন্দকার আবদুল বাতেন, ১৬. মির্জা সুলতান রাজা, ১৭. কামরুজ্জামান টুকু, ১৮. আবদুল মালেক শহিদুল্লাহ, ১৯. আবদুল্লাহ সরকার, ২০. মুস্তাফিজুর রহমান মুকুল ও ২১. মাহমুদুর রহমান মান্না। এর আহ্বায়ক হলেন সিরাজুল আলম খান। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন কারাবন্দী।
সিওসির প্রথম সাতজনকে নিয়ে তৈরি হলো স্ট্যান্ডিং কমিটি। প্রথম চারজনকে নিয়ে হলো ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটি। আমি ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির বিকল্প সদস্য হিসেবে থাকলাম। সিদ্ধান্ত হলো বিপ্লবী গণবাহিনী তৈরির। গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিসার হলেন মোহাম্মদ শাহজাহান। লে. কর্নেল আবু তাহেরকে ফিল্ড কমান্ডার এবং হাসানুল হক ইনুকে সেকেন্ড ইন কমান্ড (টুআইসি) করা হয়। পার্টির সদস্যদের জন্য সাম্যবাদ নামে একটি পুস্তিকা বের হতো। এটাই ছিল পার্টির মুখপত্র।[২৩]
গণবাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে জাসদ নেতাদের অধিকাংশের মন্তব্য প্রায় একই রকম। প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গণবাহিনী ডেপুটি কমান্ডার হাসানুল হক ইনু বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :
প্রথম আলো : তিয়াত্তরে আপনারা সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল (তিন সাংসদ নিয়ে) ছিলেন। সেই সংসদীয় গণতান্ত্রিক অবস্থায় সরকারি চাকরিজীবী কর্নেল তাহেরকে প্রধান এবং আপনাকে ডেপুটি কমান্ডার করে কী করে সশস্ত্র সংগঠন গণবাহিনী গঠন করতে পেরেছিলেন? এই স্ববিরোধিতার ব্যাখ্যা কী?
হাসানুল হক ইনু : আপনি ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমাদের তত্ত্বটা ছিল এ রকম, একটি সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করতে হবে। সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থাকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে হবে।
প্রথম আলো : তার মানে আপনারা বঙ্গবন্ধুর সরকারের উৎখাত চেয়েছিলেন?
হাসানুল হক ইনু : আমরা যখন তত্ত্ব দিই, আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রকে স্বীকার করে নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আর্থসামাজিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটিয়ে একটা বিপ্লবী সরকার কায়েম করতে চাই। এ রকম লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীর অনেক মার্ক্সবাদী দল কাজ করে থাকে। সেই হিসেবে আমরা বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ, দেশ সমাজতান্ত্রিক পথে সঠিকভাবে যাচ্ছে না।
প্রথম আলো : আজ কি মনে হয় (বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে) গণবাহিনী করাটা ভুল ছিল?
হাসানুল হক ইনু : গণবাহিনীর জন্মটা হয়েছিল যখন বঙ্গবন্ধুর সরকার একদলীয় সরকারে চলে যায় এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে…
প্রথম আলো : না, আপনার এ কথা ঠিক নয়। কারণ, বাকশাল হলো পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে, আর গণবাহিনী করলেন ‘৭৪ সালের জুনে।
হাসানুল হক ইনু : বাকশালের আগে জরুরি আইন জারি হয় এবং আমাদের সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বাকশাল হলে তাতে জাসদ অংশ নেয় না, জাসদ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তখন আত্মরক্ষার জন্য গণবাহিনীর একটি তৎপরতা শুরু হয়। গণবাহিনী জাসদের অঙ্গসংগঠন নয়, এটা এলাকাভিত্তিক আত্মরক্ষার জন্য কাজ করেছে। আমি মনে করি, তকালীন পরিস্থিতিতে সেই সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল।[২৪]
গণবাহিনী গঠন সম্পর্কে সিরাজুল আলম খান ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ নামে একটি বাহিনী তৈরির ব্যাপারে তখন সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি দাবি করেন, এটি গড়ে উঠেছিল তার অজান্তে। আমার সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ আলাপে তিনি এ ব্যাপারে তার দায়দায়িত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। আমাদের কথোপকথন ছিল এ রকম :
সিরাজুল আলম খান : গ্রামের লোক তখনো অনেক বেটার। বগুড়া পুরোটাই জাসদের, ইনক্লডিং একটা স্টেশনমাস্টার। রক্ষীবাহিনী আসবে। ওরা তো আসবে ট্রেনে করে। হেঁটে তো আসবে না ১০-২০ মাইল। তাহলে স্টেশনমাস্টার জানবে, কীভাবে সিগন্যাল দেবে আমাদের, যাতে আমরা পালাতে পারি। ওরা লাইট দিয়ে সিগন্যাল দেয় না রাতে? কী রকম মজবুত সংগঠন ছিল?
বিপদটা হয়ে গেল, যখন গণবাহিনী হলো। গণবাহিনী তো প্রথমে ছিল না। এটার নাম ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। পরে চারজনকে চারটা জোন করে দেওয়া হলো। আম্বিয়া হলো খুলনা-যশোর, মনি হলো নর্থ বেঙ্গল। ওখানে সে একাত্তরে আমার সঙ্গে ছিল। এদিকে হলো আরেফ, আর ইনু মনে হয় ঢাকাসহ সিলেট। উইদাউট মাই নলেজ…। এগুলো হলো খারাপ।
মহিউদ্দিন আহমদ : গণবাহিনীর ব্যাপারটা বলুন।
সিরাজ : যারা ভিলেজ ওয়ার্কার্স, মার্জিনাল কৃষক, এদেরকে সাহায্য করা। এরা তো গভমেন্ট থেকে কোনো হেল্প পেত না। তখন সিদ্ধান্ত হলো যে মেলামেশা করার জন্য–যেটা ভিয়েতনামিজরা করেছে। এটাও আমার মাথায় ছিল। একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে আমরা পিপলের সঙ্গে মিলে যেতে পারব। ভোটের জন্যও কাজে লাগবে, ডেভেলপমেন্টের জন্যও কাজে লাগবে। এটাই হলো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য।
যখন দেখা গেল যে গভমেন্টের ডিসিশন অনুযায়ী শেখ সাহেব থাকতেই, জাসদকে যদি নাজেহাল করা না যায়, তাহলে সরকার চালানো এককথা–দল তো গড়ে উঠবে না। দে ডিসাইডেড যে জাসদকে ধরো। এটা করতে গিয়েই–রেসিস্ট্যান্সের প্রশ্নেই হোক বা পাল্টা আক্রমণের প্রশ্নেই হোক, ছোট ছোট জায়গায় এরা রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে আর্মস কনফ্লিক্টে গেল! করতে যেয়েই, অল দিজ থিংস ওয়ার নট ইন মাই নলেজ–নলেজ ইন দ্য সেন্স, ইট। ওয়াজ নট পার্ট অব ডিসিশন, এটা হয়ে গেল গণবাহিনী, উইথ আর্মস। উইথ আর্মস তো সারা বাংলাদেশে ছিল না ছিল কুষ্টিয়াতে, বগুড়াতে, কিছুটা রংপুরে। এগুলোই প্রধান। সিলেটে ছিল না, নোয়াখালীতে ছিল না। জোর করে আর্মস ব্যবহার করতে গিয়ে গরিব মানুষদের হিট করা হয়েছে। এ রকম একটা ফর্মে চলে গেছে, উইদাউট মাই নলেজ, দ্যাট ওয়াজ আ ডিজাস্টার।
পরে যখন গণবাহিনীর অ্যাকটিভিটিজ বন্ধ করা হলো, সাসপেন্ড করা হলো, তখন অলরেডি ব্যাড নেম, যেটা পাওয়ার, সেটা হয়ে গেছে। আর কন্ট্রোলে না থাকলে যা হয়, সেটা ঘটে গেছে।
মহি : কিন্তু লিটারেচারে, যেমন সাম্যবাদ–যেখানে গণবাহিনীকে জাস্টিফাই করা, এসব কে ড্রাফট করত?
সিরাজ : এগুলো আমার হাত দিয়ে যেত না।
মহি: কে করত এসব?
সিরাজ : একজাক্ট বলতে পারব না। চিন্তা করে বলতে হবে। সাম্যবাদ–তাই না?
মহি : হ্যাঁ।
সিরাজ : এ নিয়ে একদিন কথা হয়েছিল, যখন আমরা সিওসিতে বসলাম। এগুলো আসছে কীভাবে? বলা হলো, এগুলো পরে আর আসবে না, যাবে না ইত্যাদি।
মাসুদের হাত দিয়ে গেছে–আই ডোন্ট থিংক। মাসুদ আমাকে বলে ড্রাফট করবে? যা-ই হোক, সেগুলোতে অনেক ক্ষতি হয়ে। গেছে। আমি শুধু সংগঠনের পয়েন্ট অব ভিউতে না, পলিটিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউতে বলছি। আমি তো ওই জায়গায় আর্মস স্ট্রাগল করতে পারছি না। আরেকটা হলো–আমাদের রণকৌশলটা হলো, আমরা বিপ্লবী অ্যুত্থানে যাব। আমরা তো সশস্ত্র বিপ্লবে যাব না।
মহি : এটাই তো প্যারাডক্স। পিকিংপন্থীদের যে জিনিসটা আমরা…
সিরাজ : অপোজ করলাম, এটাই আবার আমরা করলাম। সুতরাং থিওরেটিক্যালি এটা তো রং। রং মানে কী? এটা তো করাই হয়নি। ইন প্র্যাকটিস, অনেক সময় যেটা আমি চাই না, সেটাই হয়। ক্ষুধার জ্বালায় যেমন চুরি করা। চুরি করতে চাই না। কিন্তু। তাকে না জানিয়ে নিয়ে গেলাম।
ডিসিশনটা হলো যে ঢাকার চারপাশে ৩০ থেকে ৩২টা, সারা। বাংলাদেশে ৪২টা জোন ঠিক করা হলো, যেখান থেকে মাস বেইজড মাস আপসার্জ করা হবে। ঢাকার চারপাশে যে জায়গাগুলো স্ট্রং ছিল-মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী–এই নরসিংদীর বাবুল–কী ফেরোশাস, কী তার লিডারশিপ! সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া তো আছেই, কুষ্টিয়া–এ রকম ৪০-৪২টা জায়গা রেডি হচ্ছে। আর ঢাকায় হবে মিছিল, মিটিং, হরতাল। এগুলো স্ট্রিক্ট ডিসিশন। এগুলো করার মধ্য দিয়ে…।
এদিকে আমরা তখন সোলজারদের মধ্যে সৈনিক সংস্থা গড়ে তুলেছি। ঢাকার বাইরেও আছে–বগুড়ায়, কুমিল্লায়। ছাত্রদের মধ্যে। সংগঠন তো ভেরি গুড। অন্যদের তো কোনো সংগঠন নাই। শ্রমিক তো আগে থেকেই অর্গানাইজ করা আছে। সবাই তো আওয়ামী লীগে যায়নি, শ্রমিক লীগেই আছে।
একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থানমূলক পরিস্থিতিতে যাব। টেকওভারের দুইটা প্রভিশন-হয় ইলেকশন দেবে। আমার হিসাব হলো, ইলেকশন দিলে আমরা ১৭০টা জায়গায়, উইথ নো কোশ্চেন…আরও ৪০-৫০টা জায়গায় টাফ কনটেস্টের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসব। মানে টু হানড্রেড। বাকিটা আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ট্যাপরা পাবে।
মহি : আপনি কি ১৫ আগস্টের আগের সিনারিও বলছেন?
সিরাজ : আগের সিনারিও অবশ্যই। একেবারে হিসাব-নিকাশ করা। ১৭০টা জায়গায়–কোনো কোনো জায়গা, যেখানে বেইজ আছে। সেটা নালিফাই হয়ে গেল ১৭ মার্চের কারণে।
মহি : ১৭ মার্চের কারণে ডিস্টার্বও হয়ে গেল?
সিরাজ : শুধু ডিস্টার্বড না, দ্যাট প্ল্যান ওয়াজ নট অ্যাট অল ওয়ার্কড আউট। প্ল্যানটাই কাজ করল না।[২৫]
জাসদের মধ্য থেকে একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার পটভূমি ও প্রক্রিয়া এবং গণবাহিনী গঠন সম্পর্কে একাধিক ও বিপরীতধর্মী এবং অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আসছেন দলের কেউ কেউ। দায় অস্বীকারের প্রবণতা এখানে লক্ষ করা যায়। এ ব্যাপারে দলের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যটি জানা জরুরি। ১৯৭৪ সালের পরিস্থিতি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে জাসদের কর্মকাণ্ডের একটি লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় দলের মধ্য থেকে বিকাশমান বিপ্লবী পার্টির মুখপত্র সাম্যবাদ-চার-এ। ১৯৭৬ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯। জানুয়ারি ঢাকায় পার্টির কেন্দ্রীয় ফোরাম ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের বৈঠকে ফোরামের পক্ষ থেকে যে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করা হয়, তাতে পার্টির অবস্থানটি ব্যাখ্যা করা হয়। রিপোর্টে বলা হয় :
জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের জন্ম যেহেতু শোষণ নির্যাতন বৈষম্য ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে, যেহেতু এই চারটি সংগঠনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠতে থাকল দেশীয় শাসক-শোষকগোষ্ঠী এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী-সংশোধনবাদী আধিপত্যবাদী দোসরদের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ। এবং স্বভাবতই প্রথম থেকেই শাসক শোষকগোষ্ঠীর রুদ্ররোষের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই চারটি সংগঠন। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের ওপর নেমে এল ভয়াবহ শ্বেতসন্ত্রাস। এই সন্ত্রাস চূড়ান্ত রূপ নিল ১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে। এই দিন পল্টনের বিশাল জনসভার রায়ের ভিত্তিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল করে গিয়েছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে জনগণের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়াসংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করার উদ্দেশ্যে। বলা বাহুল্য, এরূপ স্মারকলিপি পেশ করার অধিকার জনগণের একটি সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সেদিনের ক্ষমতাসীন সরকার এই গণতান্ত্রিক অধিকারের কোনো মর্যাদাই রাখেনি। তারা নিরস্ত্র জনতার ওপর চালিয়েছে দানবীয় হামলা। করেছে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। ফলে সংগঠনের কর্মীসহ প্রায় ৫০ জন। মিছিলকারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হন মহিলাসহ শত শত মানুষ। গ্রেপ্তার হন মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রবসহ অসংখ্য নেতা ও কর্মী। রাতে গণকণ্ঠএর সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিন রাত্রেই মেহনতি মানুষের মুখপত্র গণকণ্ঠ অফিস তছনছ করা হয়, পরদিন জাসদ অফিস ভস্মীভূত করা হয়, অগ্নিসংযোগ করা হয় ছাত্রলীগের অফিসে। কয় দিন পরই হামলা চালানো হয় জাতীয় শ্রমিক লীগের অফিসে।
১৭ই মার্চের ঘটনা এ দেশের আন্দোলনের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই ঘটনা সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণ করে যে শাসক-শোষকগোষ্ঠী বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সামান্য সুযোগটুকুও আর দেবে না। ওই ঘটনা আরও প্রমাণ করে যে জনগণের সশস্ত্র শক্তি অতিসত্বর গড়ে না উঠলে শাসক-শোষকগোষ্ঠীর বর্বরোচিত সশস্ত্র হামলার মোকাবিলা করা কোনোক্রমেই সম্ভবপর হবে না। মেহনতি মানুষের সামগ্রিক আন্দোলনকে পরিচালিত করার জন্য একটি সঠিক বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাও এ সময় অনিবার্য। হয়ে ওঠে। এই অনিবার্যতার পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় বিপ্লবী শক্তিকে একটি কাঠামোগত রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া।…
এই প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৭৩ সালেই জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগ–এই চারটি গণসংগঠনের স্ব স্ব কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি। ১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চের ঘটনার পর এই সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে সমগ্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সমন্বয় কমিটির একটি বর্ধিত বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের বর্ধিত সভা ২৭শে ও ২৮শে জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এই বর্ধিত সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলেন তকালে জেলে আটক ৫ জন নেতাসহ মোট ৩২ জন।
৩২ জনের বৈঠক দুদিনব্যাপী ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যথাসম্ভব সত্বরতার সঙ্গে একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং এতদুদ্দেশ্যে একটি খসড়া থিসিস ও খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে। সিদ্ধান্ত হয় যে আগামীতে যখন পূর্ণাঙ্গ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে, তখনই এই খসড়া থিসিস ও গঠনতন্ত্রকে প্রয়োজনীয় সংশোধন সংযোজন-পরিমার্জন সাপেক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন ও গ্রহণ করা হবে।
এই বৈঠক আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় নয়া ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এই বৈঠকের ৩২ জন সদস্য বিপ্লবী পার্টি গঠনসহ সমগ্র ব্যাপারের কেন্দ্রীয় ফোরাম হিসাবে কার্যকর থাকবে। এই বৈঠকের তরফ থেকে পাঁচজন সদস্যের ওপর বিপ্লবী সংগঠন গড়ার যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং আরও দুজন সদস্যকে এই পরিষদের বিকল্প (অল্টারনেট) সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। এই বৈঠক কেন্দ্রীয় পত্রপত্রিকা ও দলিলসমূহ প্রণয়ন করার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি সম্পাদকীয় বোর্ডও গঠন করে। এ ছাড়া এই বৈঠকে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটিকে আরও কার্যকর রূপে ঢেলে সাজানো হয়।…
এই ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র দেশজুড়ে শুরু হয় বিপ্লবী পার্টি গঠনের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। সমগ্র দেশকে ছয়টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি অঞ্চলের সার্বিক কার্যক্রম তদারক করার জন্য একজন করে কেন্দ্রীয় সংগঠক নিযুক্ত করা হয়।… প্রতিটি জোনের অধীনে প্রত্যেক জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিপ্লবী ফোরাম গড়ে তোলার জন্যও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়।…
প্রক্রিয়াকে যথাযথ ও ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে ১৭ই মার্চের পরপরই বিপ্লবীদের মুখপত্র হিসাবে সাম্যবাদ প্রকাশ করা হয়। এরই পাশাপাশি গণসংগঠনসমূহের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয় লড়াই।…
শ্রেণিসংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ হিসাবে সর্বহারা শ্রেণির নিজস্ব বাহিনীর সংগঠন অপরিহার্য। সুতরাং মুজিব আমলের প্রথম থেকেই সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুধাবন করা হয়। মুজিবের নেতৃত্বাধীন শাসক-শোষকগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান শ্বেতসন্ত্রাস বিশেষত ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের পর সর্বহারা শ্রেণির স্বার্থ ও শক্তির রক্ষা ও বিকাশকল্পে অবিলম্বে সর্বহারা শ্রেণির নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠন অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং ২৭শে ও ২৮শে জুনের বৈঠকের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করা হয়।….
শেখ মুজিবের আমল থেকেই সামরিক বাহিনীসমূহের মধ্যে সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ কর্মী সৃষ্টির প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় বিকাশের একপর্যায়ে সামরিক বাহিনীসমূহের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা দেশের সকল সেনানিবাস ও ছাউনীসমূহে অত্যন্ত সঙ্গোপনে এবং দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যেতে থাকে।২৬।
উপরিউক্ত ভাষ্যসহ দলিলটি সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতেই সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত হয়েছিল। গণবাহিনী গঠনসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সবাই একমত ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়। গণবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত চুয়াত্তরের জুন মাসেই নেওয়া হয়। তখনো কেউ জানেন না কবে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হবে এবং একদলীয় সরকারব্যবস্থা কায়েম হবে।
.
৯
গণবাহিনী নিয়ে যে যা-ই বলুন না কেন, একটা সামরিক সংগঠন গড়ে তোলা হবে এবং এ জন্য তরুণদের বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হবে–এ চিন্তাটা নেতৃত্বের মধ্যে ছিল। এমনই একজন তরুণ হলো আবু আলম মো. শহীদ খান। রংপুরের ছেলে আবু আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। পড়াশোনায় ছিল খুবই মেধাবী। ধীরে ধীরে সে জড়িয়ে পড়ল ছাত্রলীগ-জাসদের কর্মকাণ্ডে। এ রকম অসংখ্য তরুণ জড়ো হয়েছিল বিপ্লবের স্বপ্নে সওয়ার হয়ে। আবু আলম তাদের একজন। আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় সে মেলে ধরল তার স্বপ্নযাত্রার কথা।
মহিউদ্দিন আহমদ : তুমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি গণবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হলে এবং এই ইউনিটের কমান্ডারও হলে। এ প্রক্রিয়ায় তুমি কীভাবে এলে?
আবু আলম : আমি তো তখন গ্রাম থেকে এসেছি, রংপুর থেকে। ঢাকায় এসে মুহসীন হলে উঠলাম। আসলে আমি তো ছিলাম ছাত্রলীগে। হারিসউদ্দিন সরকার ছিলেন আমাদের নেতা। তারপর ইলিয়াস ভাই, মনসুর সাহেব, পরের দিকে অলোক সরকার, জেলা মুজিববাহিনীর কমান্ডার মুস্তাফিজুর রহমান মুকুল–এঁরা ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা।
মহি : ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তুমি ভর্তি হলে কখন?
আলম : ১৯৭৩ সালে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নিয়েই কিন্তু আমরা কাজ করছিলাম। বাহাত্তরের জুলাই মাসে ছাত্রলীগের কনফারেন্সে দেখলাম, আমরা বিভক্ত। মুহসীন হলে মুশতাক ভাই, আপনারা ছিলেন। রংপুরে মুকুল ভাই, অলোকদার সংস্পর্শের কারণে জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম।
মহি : একটু স্পেসিফিক বলো। যারা ছাত্রলীগ করত, তারা সবাই তো গণবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল না?
আলম : ১৭ মার্চ (১৯৭৪) হলো। আপনাকে একটু ডিটেইলস বলছি, আমরা কী করতাম। মিটিংয়ে আমরা পেছনে বসে বাদাম খেতাম। সামনে যারা দাঁড়িয়ে থাকত, তাদের বলতাম, বসেন বসেন। আমাদের কাজ ছিল, ডিসিপ্লিনড ওয়েতে যেন পুরো পল্টন ময়দান ভরে থাকে। কিন্তু ১৭ মার্চ হঠাৎ একটা ইনস্ট্রাকশন এল, ইনস্ট্রাকশন ডাইরেক্টলি ফ্রম মাহবুব ভাই যে আজকে মাঠে লোক বসানোর কাজ করতে হবে না, আজ তোমরা গেটের কাছে থেকো। তোমাদের অন্য কাজ আছে।
অন্য কাজটা কী?
সেটা সময়মতো জানানো হবে। গো দেয়ার অ্যান্ড স্ট্যান্ড দেয়ার। আমরা, ঢাকা ইউনিভার্সিটির কর্মীরা গেটের কাছে দাঁড়ায়া আছি। আ স ম আবদুর রবের বক্তৃতা তখনো শেষ হয়নি। আমরা স্লোগান শুরু করলাম। ঘেরাও হবে, দখল হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা ঘেরাও হবে। চলো চলো, ঘেরাও করো, দখল করো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন। এভাবে। আমরা স্টার্ট করেছি। এখন যে জিরো পয়েন্ট, ওখানে আমরা আসার পর রব ভাইয়ের বক্তৃতা শেষ হয়েছে। ততক্ষণে কিন্তু আমরা চলে। এসেছি। ওই দিন ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তারিখটা কী জন্য ঠিক করা হয়েছিল, জানি না। তারপর তো সেখানে ধাক্কাধাক্কি হলো, গুলি হলো। তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা এক্সিবিশন চলছিল। আমরা ওই দিকে পালায়া গেলাম। এর এক-দুই মাস পরে ইউনিভার্সিটিরই একজন বলল, তোমাকে অন্য কাজে যুক্ত হতে হবে।
মহি: কে বলল?
আলম: ইউনিভার্সিটি লিডারদেরই একজন। বলল, তোমাকে একজন লোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
কীভাবে দেখা করতে হবে?
তুমি নিউমার্কেটে যাবা। ভেতরে একটা লোক, হাতে লাল রুমাল, তার একটা কোড আছে। সেখানে গেলাম। আমার একটা কোড ছিল। তার কোডের উত্তর দিলাম।
মহি : মানে পাসওয়ার্ড।
আলম : হ্যাঁ। না হলে চিনব কীভাবে। হাতে রুমালের কথা বলে দেওয়া ছিল। তখনো আমি জানি না আমাকে আর কোথায় যেতে হবে। এটুকু জানি, আমাকে একজনের কাছে নিয়ে যাবে। যাহোক, সেই ছেলেকে আমি চিনি না। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র না। সেখান থেকে আমরা রিকশায় চড়ে ফার্মগেটের দিকে গেলাম। ওখানে একটি হোটেল ছিল। ওখানে বসলাম। ওখানে আরেকজন লোক এসে বসল। আমার সঙ্গের তরুণটি বলল, আপনি ওনার সঙ্গে যান।
কোথায় যাব?
উনি আপনাকে নিয়ে যাবেন।
উনি আমাকে নিয়ে গেলেন বনানীতে। সেখানে একটা বাসায় দেখা হলো ইনু ভাইয়ের সঙ্গে। একটা গাড়িতে উনি আমাকে ওঠালেন। বললেন, চলো, আমরা আরেক জায়গায় যাব। দেখলাম, উনি আমাকে নিয়ে ধানমন্ডিতে আসলেন। ধানমন্ডিতে ওনার এক খালার বাসা ছিল। তার খালাতো বোন বোধ হয় ইংলিশ নিউজ-টিউজ পড়ত। তাঁর ছোট বোন একটা বিড়ালকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। বাসাটাও খুব সুন্দর, পশ। ওটাই ধানমন্ডির কোনো বাসায় জীবনে আমার প্রথম যাওয়া। খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো বাসা। দামি আসবাবে ঠাসা। আমি ভাবতে থাকলাম, আমি চাই সমাজতন্ত্র। গরিবের রাজ হবে। তো আমি এখানে কী করতেছি? হোয়াট অ্যাম আই ডুয়িং হিয়ার? বিড়ালকে খাওয়ানোর যে খরচ, তা তো গরিব মানুষকে খাওয়ানো যেত? এই বিত্তের মধ্যে আমি সমাজতন্ত্র দেখছি না।
ওখানে আমাদের চা দিল। চা খেয়ে উনি আমাকে নিয়ে গেলেন আজিমপুর। ওখানে চায়না বিল্ডিং আছে না? বাসাটার একটা নাম ছিল। নামটা ভুলে গেছি। দোতলায় একটা রুমে গেলাম। সিরাজ ভাই এখানে থাকেন, জানতাম না। আগে দেখেছি। সরাসরি তাঁর সামনাসামনি কখনো হইনি।
ইনু ভাই বললেন, ছেলেটাকে নিয়ে এসেছি। এর নাম আবু আলম। সিরাজ ভাই হেসে বললেন, তোমাকে তো একটা বিশেষ কাজের জন্য ডেকেছি। ওপেন মিটিং-মিছিলে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি ওখান থেকে আস্তে আস্তে সরে আসো। বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য তোমাকে মেম্বার করা হবে। ইনু তোমাকে সবকিছু জানাবে। তুমি ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী কাজ করবে।
দ্যাট ওয়াজ মাই ইনক্লশন। তখন পর্যায়ক্রমে আনোয়ার ভাই এবং আরও অনেকের সঙ্গে কথা হলো। আমরা ইউনিভার্সিটিতে ইউনিট করলাম। আবুল বারাকাত দুলাল ভাই ছিল পলিটিক্যাল কমিসার।
মহি: তুমি কমান্ডার আর দুলাল পলিটিক্যাল কমিসার?
আলম : পরে একটা ব্যক্তিগত ঘটনার কারণে আমাকে ইউনিভার্সিটি এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমি কেরানীগঞ্জ,
আদমজী, পোস্তগোলা–এসব জায়গায় থাকা শুরু করলাম। তখন আমি ঢাকা সিটি গণবাহিনীর পাবলিসিটি উইংয়ের দায়িত্বে। তখন তো সবাই কমান্ডার। পাবলিসিটি কমান্ডারের দায়িত্ব পেলাম।
মহি: ঢাকা সিটি গণবাহিনীর যে ফোরামটা ছিল, এটাতে রফিক, আনোয়ার, তুমি ছাড়া আর কে কে ছিল?
আলম : বাহার ছিল (২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ মারা গেছে), আবু বকর সিদ্দিক ছিল।
২৬ নভেম্বরের যে হরতাল, তার আগে তো আমরা ককটেল মারতাম। ককটেলের মুখে তো একটা কাপড় থাকে। এটাকে আগুন লাগিয়ে ছুঁড়ে মারতে হয়। আনোয়ার ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা এর একটা উন্নত সংস্করণ বের করার চেষ্টা করলাম। ঠিক হলো আমরা আর আগুন লাগাব না। ককটেলের গায়ে একটা জ্যাকেট পরানো হলো। কাপড়ের জ্যাকেট। এর মধ্যে চারটা পকেট রাখলাম। পকেটে ডিষ্টিল ওয়াটারের যে ইয়ে থাকে না…।
মহি : অ্যাম্পুল।
আলম : হ্যাঁ, তার মধ্যে সালফিউরিক অ্যাসিড রাখলাম। আর জ্যাকেটটাকে চিনি মেশানো পানিতে জ্বাল দিয়ে তাতে ভেজালাম। জ্যাকেটের মধ্যে চিনি চলে আসল। ককটেল ছুঁড়ে মারলে অ্যাসিডের অ্যাম্পুল ভেঙে চিনির সঙ্গে মিশলেই আগুন লাগবে। এটা উনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে সুন্দর করে তৈরি করতেন।
২৬ নভেম্বর হরতালের আগে আমাদের ককটেল ছোঁড়ার সিদ্ধান্ত হলো, দৈনিক বাংলার মোড়ে।
মহি : এটা তো ১৯৭৪ সালের ২৬ নভেম্বরের কথা? আলম : ওই দিন হরতাল ডাকা হয়েছিল।
মহি : ওই দিনই বোমা বানাতে গিয়ে নিখিল চন্দ্র সাহা মারা গেল।
আলম : আমাদের ককটেল মারার টার্গেট দেওয়া হলো। আমি আর ওরা দুজন।
মহি : ওরা দুজন কে?
আলম : মুশতাক আর একজন, নাম ভুলে গেছি। ফখরুল হতে পারে। দৈনিক বাংলার কাছে গিয়ে দেখলাম রক্ষীবাহিনীর ট্রাক।
ওখানে ককটেল মারা সম্ভব না। দেয়াল অনেক উঁচু।
মহি: এটা কি ২৬ নভেম্বরেই?
আলম : না, আগে। ওই সময়েরই ঘটনা। ককটেল তো মারতে হবে আগের দিন, যাতে মানুষ জানতে পারে। ওখানে তো ককটেল মারা গেল না। ফিল্ডে তো সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করতে হয়। তো সিদ্ধান্ত চেঞ্জ হলো। তাহলে চলো আমরা বাংলার বাণীতে যাই। একটা গেট দিয়ে বাংলার বাণীতে ঢুকতে হয়। দেখি ওখানেও রক্ষীবাহিনীর একটা। ট্রাক। তার মানে দুটো টার্গেটেই মারা যাচ্ছে না। তখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বঙ্গভবনের দিকে। দেখলাম বঙ্গভবনের গেটের কাছে রক্ষীবাহিনীর ট্রাক। কিন্তু ইত্তেফাক-এর সামনে কোনো। কিছু নেই। তখন উই টুক আ কুইক ডিসিশন। আমাদের তো দরকার প্রচারদৈনিক বাংলা বা বাংলার বাণীতে মারলে যা হবে, ইত্তেফাক এ মারলে আরও বেশি হবে। তখন তো আই ওয়াজ আ ইয়াং পারসন। তো ডিসিশন নিলাম, ইত্তেফাক তো আরও বেশি লোকে পড়ে। ভালো প্রচার হবে।
ইত্তেফাক-এর দেয়ালটা নিচু ছিল। রক্ষীবাহিনী যেহেতু উল্টা পাশে আছে, তো আমি মুশতাককে বললাম, এখানে ডাম্প করে দাও। মানে ফেলে দাও। মুশতাক এটা ফেলে দিল। আমরা বাদাম খেতে খেতে হাঁটছি।
ককটেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধাম করে আগুন লেগে গেল। আমরা তো জাস্ট টেস্ট করেছি। আমরা হেঁটে বঙ্গভবন পার হয়ে গুলিস্তানে। চলে এলাম। হলে ফেরার তো সুযোগ নাই। আরেকটা কোথায় মারা যায়। দু-চার মিনিটের মধ্যে আমরা টিঅ্যান্ডটি অফিসের ওখানে আরেকটা মারলাম। পরদিন তো ইত্তেফাক-এ বিশাল নিউজ, তাদের অফিসে ককটেল।
মহি: তারিখটা তোমার মনে আছে? ২৬ নভেম্বরের কয় দিন আগে?
আলম : এক দিন আগে, অথবা কোনো একটা হরতালের আগের দিন। তারিখটা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
এরপর তো যথারীতি ডাক পড়ল, কেন ইত্তেফাক-এ মারা হলো। বললাম, আমরা তো কাউকে মারতে চাইনি। আমাদের টার্গেট হলো পাবলিসিটি।
মহি : এটা কারা মারল, সেটার কি পাবলিসিটি হয়েছে?
আলম : এটা তো হরতালের আগের দিন। সবাই তো জানে কারা হরতাল ডেকেছে। মানে হলো, তোমরা কেউ কাল গাড়ি-টাড়ি বের কোরো না। আগুন লাগতে পারে। এটা হলো মানুষকে একটা বার্তা দেওয়া। কে মেরেছে, তা জানার তো দরকার নেই। যারা হরতাল ডেকেছে, এটা তাদের কাজ, এটাই মানুষ বুঝবে।
পরে বুঝলাম, ইত্তেফাক-এর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক। সে জন্য ইত্তেফাক তো টার্গেট হতে পারে না।
মহি: আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের তো খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক।
আলম : আমি জানি না, এটা কোন লেভেলের সম্পর্ক। তবে টপ লেভেলে যে একটা সুসম্পর্ক ছিল, এটা আমরা বুঝতে পারলাম।
মহি : এটা তো অনেক পরের কথা।
আলম : যাহোক, ওটা থেকেই বুঝতে পারি, সম্পর্ক ভালো ছিল।
শেখ কামাল তখন অনেককে নিয়ে গাড়িতে চলাফেরা করে। এখন কী করে তাদের ভয় দেখানো যায়। কামাল ভাই তো গাড়ি রেখে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। গাড়ি কখনো থাকে সোশিওলজি ডিপার্টমেন্টের সামনে, কখনো-বা লাইব্রেরির সামনে। ভাবলাম, কামাল ভাইয়ের গাড়িতেই এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে দেওয়া যায় কি না। নট টু হার্ম কামাল ভাই, বাট টু লেট এভরিবডি নো দ্যাট আমাদের টার্গেটের মধ্যে এটাও আছে। আমরা এটুকু করতে পারি এবং আমরা আরও বড় কাজ করতে পারি। ছোট একটা কাজ হিসেবে গাড়িটাতে আগুন-টাগুন লাগিয়ে দেওয়া যায় কি না। এই প্ল্যানটা হায়ার লেভেলে পাঠানো হলো এবং হায়ার লেভেল থেকে টপ লেভেলে গেল। আমি জেনেছি যে সিরাজ ভাই এটা শোনার পরে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে গেছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছিলেন, এসব প্ল্যান কাদের মাথা থেকে আসছে? আসলে এটা তো একটা ইউনিটের প্ল্যান, কারও ব্যক্তিগত প্ল্যান না।
মহি : প্ল্যানটা আসলে কার মাথা থেকে এসেছিল?
আলম : এটা আমার মনে নেই। এটা আসলে ফান ছিল। ফান করতে করতে…পরে এটা অ্যাকসেপ্ট করা হয়েছে। তখন বাকশাল হয়ে গেছে। নির্যাতন চলছে আমাদের ওপর। দেখাতে চেয়েছি, আমরা বড় কিছু করতে পারি কি না। এটা করব, একেবারে স্পেসিফিক কিছু না, তবে করা যায় কি না। যাহোক, সিরাজ ভাই খুব ফিউরিয়াস। কে এটা করতে বলেছে? তখন তো পার্টির ভেতরে তর্ক-বিতর্কের একটা জায়গা ছিল। এটা তো কাউকে কিল করার জন্য না। ভয় দেখানোর জন্য। আমরা সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলছি। আমাদের ১০টা লোক যদি আজ মারা যায়, তাহলে আমরা কী করব? এ রকম চিন্তা থেকেই প্ল্যানটা এসেছে। তখন উনি স্পেসিফিক ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর ফ্যামিলি, তাদের হার্ট করে এমন কোনো কিছু করবে না। তারপর থেকে কামাল ভাই এবং তাদের ছাত্রলীগের নেতাদের টার্গেট করে কোনো কিছু করা হয়নি। ঢাকা শহরে কিন্তু কিছু টার্গেট করা হয়েছিল। কিছু অপারেশনও হয়েছিল–কিছু পুলিশের লোক বা পুলিশের দালাল। কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মুজিববাদী ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কিছু করা হয়নি। [২৭]
.
১০
জাসদের বিপ্লবী পার্টি গঠনপ্রক্রিয়ার অন্যতম বাহন ছিল সাম্যবাদনামে একটি প্রকাশনা। চুয়াত্তরের ১৭ মার্চের পরপর এর প্রথম সংখ্যাটি বের হয়েছিল। এ সংখ্যায় ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরের আহ্বান জানানো হয়। ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের ঘটনাটিকে কিউবার বিপ্লবে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তার সহযোগীদের মনকাড়া দুর্গে অভিযানের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
সাম্যবাদ লেখার কাজে বিভিন্ন সময়ে জড়িত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, মো. শাহজাহান, খায়ের এজাজ মাসুদ, হারুনুর রশিদ প্রমুখ। এর দ্বিতীয় সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় চুয়াত্তরের ২৮ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা জারির পরপর। এ সংখ্যায় বিপ্লবী গণবাহিনী সম্পর্কে দলের অবস্থান বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। মূল খসড়াটি খায়ের এজাজ মাসুদের লেখা। বিরাজমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা এবং করণীয় সম্বন্ধে বলা হয় :
আজ সামগ্রিক পরিস্থিতি এক যুগ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। পতনোম্মুখ আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক ক্ষমতা বহাল রাখার জন্য মরিয়া হয়ে চালাচ্ছে শেষ প্রচেষ্টা। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র খতম করে ফ্যাসিস্ট কায়দায় একদলীয় একনায়কত্ব কায়েম করার ষড়যন্ত্র করছে। অস্ত্রবলে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও প্রতিরোধকে ভেঙে চুরমার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
এসব করা হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের প্রেক্ষিতে। মুজিব সরকার বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রকে প্রতিহত করে ধনতন্ত্র স্থাপনে বিশ্বাসী। এ সরকারের বড় বড় আমলারা সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় এ ঘৃণ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে বদ্ধপরিকর। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা স্বৈরাচারী ‘আইয়ুবতন্ত্রের’ কায়দায় বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়াদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সুনিশ্চিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত।
বিপ্লবীদের আজ অবশ্যই এরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনসাধারণ আজ মৌলিক পরিবর্তন চায়, চায় কার্যকরী পরিবর্তন। জনসাধারণের এ মনোভাবকে বিপ্লবের সপক্ষে টেনে আনতে হবে। তার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করতে হবে। যেখানে তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার নেই, সেখানে জনগণের প্রত্যেকটি প্রতিবাদকে নিঃশব্দ করে দেওয়া হয় অস্ত্রের ঝংকারে, সেখানে অস্ত্রই হবে ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র রূপ। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই আমাদের ‘সংগ্রামের প্রধান রূপ হচ্ছে যুদ্ধ আর সংগঠনের প্রধান রূপ হচ্ছে সৈন্যবাহিনী।’ গণসংগঠন ও গণসংগ্রামের মতো অন্যান্য সমস্ত কিছুও গুরুত্বপূর্ণ ও নিতান্ত অপরিহার্য; কোনো অবস্থাতেই এদের উপেক্ষা করা যাবে না; কিন্তু এগুলো সবই যুদ্ধের জন্য।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীর কর্তব্য হচ্ছে বিপ্লবী গণবাহিনীতে যোগ দেওয়া, এ বাহিনীকে গঠন করা, সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করা। বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণীর পার্টির কর্তব্য হচ্ছে নিজেকে সশস্ত্র করা; সশস্ত্র সংগ্রামের সম্মুখীন হওয়া; জনসাধারণকে রাজনৈতিকভাবে সপক্ষে টেনে এনে সশস্ত্র যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করানো; বিপ্লবী গণবাহিনীকে সংগঠিত ও পরিচালনা করা।… [২৮]
পুরো লেখাটিতে লেনিন এবং মাও সে তুংয়ের রচনা থেকে অনেকগুলো উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মাওয়ের ‘যুদ্ধ ও রণনীতির সমস্যা’ এবং ‘দীর্ঘায়িত যুদ্ধ সম্পর্কে’ প্রবন্ধের ছাপ ছিল স্পষ্ট। উল্লেখ্য যে পিকিংপন্থী কয়েকটি দল তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে যে যুক্তিগুলো দিত, এখানেও তার মিল পাওয়া যায়। মস্কো ও পিকিংয়ের রাজনৈতিক লাইনের বাইরে স্বতন্ত্র একটি পথ বের করে নেওয়ার জন্য জাসদ বাহাত্তরেই ঘোষণা দিয়েছিল। অথচ নিজেদের অজান্তেই তারা ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের পিকিংপন্থার কাছে নিজেদের সঁপে দিল।
সাম্যবাদ-দুই সংখ্যাটি লেখা হয়েছে শুধু বিপ্লবী গণবাহিনী সম্পর্কে। এর। একটি অনুচ্ছেদের শিরোনাম হলো শৃঙ্খলা ও আচরণের আবশ্যিক নীতিমালা’। এটি লেখা হয়েছে মাও সে তুংয়ের যুদ্ধ ও রণনীতির সমস্যা নিবন্ধ থেকে কপি করে। গণবাহিনীর সদস্যদের কেমন হতে হবে, এ নিয়ে বলা হয়েছে যে, মাও সে তুং বর্ণিত নীতিগুলো প্রায় সর্বজনীন এবং বিপ্লবী। গণবাহিনীর জন্য অবশ্যই করণীয়। এগুলো হচ্ছে :
শৃঙখলার নীতি :
১. সকল কাজে আদেশ মেনে চলা।
২. জনসাধারণের একটি সূচও আত্মসাৎ না করা।
৩. ধৃত অথবা সংগৃহীত সবকিছুই জমা দেওয়া।
আচরণের নীতি :
১. নম্রভাবে কথা বলা।
২. খরিদে যথোপযুক্ত মূল্য প্রদান না করা।
৩. কর্জ ফেরত দেওয়া।
৪. নিজে কোনো ক্ষতিসাধন করলে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
৫. জনসাধারণকে আঘাত না করা।
৬. ফসল নষ্ট না করা।
৭. নারীর প্রতি অনাচার না করা।
৮. বন্দীদের প্রতি অসদ্ব্যবহার না করা।২৯ কিন্তু চার বছর আগে একই আচরণবিধি তৈরি করেছিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। এটি ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে উত্থাপিত সর্বহারা পার্টির খসড়া সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে।৩০ সাম্যবাদ-এর খসড়া যিনি তৈরি করেছিলেন, তিনি মাও সে তুংয়ের মূল রচনা অনুসরণ করেছিলেন, নাকি সর্বহারা পার্টির দলিল থেকে ভাষা একটু অদলবদল করে টুকে। নিয়েছিলেন, তা বোঝা মুশকিল।
বিপ্লবী গণবাহিনীর সদস্য হওয়ার যোগ্যতা এবং সদস্যদের আচরণবিধি নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে সাম্যবাদ-তিন। আচরণবিধিতে ৩০টি অনুশাসন উল্লেখ করে বলা হয়, একজন সত্যিকার বিপ্লবী হচ্ছে সে-ই যার মধ্যে মহত্তম গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে। মহত্তম গুণাবলী বলতে আমরা বুঝি সর্বহারার সঙ্গে একাত্মতা, বিপ্লবী চরিত্র ও সাহস, সংস্কারমুক্ত তাত্ত্বিক জ্ঞান এবং আবেগহীন প্রয়োগ ক্ষমতা। সাম্যবাদ-তিন পড়লে একজন সাধারণ পাঠকের মনে হতে পারে, গণবাহিনীর কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা বা গোপনীয়তা বলে কিছু থাকবে না। এখানে তার কিছু নমুনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি :
নারী পুরুষ সম্পর্ক : কোনো সাথি যদি বিয়ে করতে চান, তাহলে। পার্টির অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে পারেন। তবে প্রতিটি সাথির দাম্পত্যজীবন, প্রেম বা বিয়ের ব্যাপারে পূর্বাহেই পার্টিকে অবহিত করতে হবে এবং এ ব্যাপারে পার্টির সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে গণ্য। করতে হবে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি : একজন বিপ্লবীকে অবশ্যই সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোহ ত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ করতে হবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিজনিত যাবতীয় চিন্তা-চেতনা।
পারিবারিক বন্ধন : একই পরিবারের একজন সদস্য হয়তো বিপ্লবী আন্দোলনে এলেন; কিন্তু আর এক সদস্য রয়ে গেলেন শাসকগোষ্ঠীর দলে। এরূপ সমাজে বহু ক্ষেত্রেই একজন বিপ্লবী একজন শ্রেণিশত্রুর সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্র খুঁজে বের করে ফেলেন এবং আত্মীয় নিধনের প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। একজন বিপ্লবীকে অবশ্যই এসব প্রতিক্রিয়াশীল আবেগ ও সামন্তবাদী বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে। [৩১]
একটা বিষয় পরিষ্কার যে ১৯৭৪ সালের জুন মাসের ২৭-২৮ তারিখের সভায় একটি সামরিক সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হলেও সামরিক সংগঠনের বিক্ষিপ্ত কাজকর্ম শুরু হয়ে যায় তার আগেই। চুয়াত্তরের ১৭ মার্চের পর দল সংসদীয় রাজনীতির ধারা বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। সামরিক সংগঠনটি ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ নামে যাত্রা শুরু করে। ধীরে ধীরে তার একটি কমান্ড কাঠামো দাঁড়িয়ে যায়।
.
১১
একসময় সিরাজুল আলম খান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডান হাত। তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কের রসায়ন তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে সবটা বোঝা কঠিন। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খান নিজে যেটুকু বলবেন বা অন্য কোনো চাক্ষুষ সাক্ষীর বয়ান থেকে যা জানা যাবে, সেটুকুই ইতিহাসের উপাদান হতে পারে।
জাসদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর একটা মার মার-কাট কাট সম্পর্ক তৈরি হলেও একদা গুরু-শিষ্যের মধ্যকার সম্পর্কটি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। সিরাজুল আলম খানের বিশ্বস্ত সহযোগী মনিরুল ইসলাম (মার্শাল) আমাকে বলেছেন, শেখ মুজিব নিয়মিতই সিরাজুল আলম খানের খোঁজখবর রাখতেন। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্ক বা তাঁকে শেখ মুজিব কী চোখে দেখতেন, তার একটি অন্তরঙ্গ বিবরণ দিয়েছেন মনিরুল হক চৌধুরী। এটা ১৯৭৪ সালের কথা। তাঁর বয়ানটি এ রকম:
একরাম (জাসদ-ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক একরামুল হক) আমার রুমে থাকে। আমি তখন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু আমারে ‘নেতা’ ডাকতেন। ওই নেতা, সিরাজের খবর রাখো?’ আমি দেখলাম যে উনি জানে। তখন সিরাজ ভাই হইল ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ড। চরম অবস্থা। বললাম, আমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। সিরাজ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ একজন তো আমার রুমেই থাকে। সে জন্য আমি খবর পাই। আমি একবার দেখাও করছি।
ভালো করছ। তুমি জানো সিরাজের জ্বর?
না, আমি তো জানি না।
তুমি দেখা করতে পারবা?
হ্যাঁ, পারব।
দাঁড়া।
শামসু না কী একটা পিয়ন আছে না, তারে ডাকল। ডাইকা আমারে একটা টাকার প্যাকেট, খুব সম্ভব লাখখানেক বা ৫০ হাজার হইতে পারে, আমারে দিয়া বললেন…। আমি বললাম, এইটা আমার দেওয়া উচিত হবে না। আমি দিলে আই উইল বি মিসআন্ডারস্ট্রড। এটা ঠিক না। এইটা আপনার ব্যাপার, আমার জানা উচিত না।
ঠিক কইছস তো তুই?
রাতেই আমি একরামরে বললাম, সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু আমি তো ভয় পাই। সিরাজ ভাই তো আন্ডারগ্রাউন্ড। কোন দিক দিয়া কী হয়। তুমি সিরাজ ভাইরে জিজ্ঞাসা কইরা আসো।
যা-ই হোক, একরাম এক দিন বা দুই দিন পরে আমারে নিয়া গেল। দেখলাম একটা লেপের মতো গায়ে দিয়া শুইয়া আছে। জ্বর।
কী মনে কইরা?
আপনারে দেখতে আসলাম।
আমারে দেখবা?
পরশুদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলল, অ্যাই, সিরাজের খবর রাখো?
আমি মাঝেমধ্যে তো যোগাযোগ রাখি। আমার যে জ্বর, উনি জানে।
আপনারে যোগাযোগ করতে বলছে। আমার কাছে একটা কী দিতেছিল, আমি আনতে সাহস করি নাই।
সিরাজ ভাইয়ের চোখে পানি। সাত দিন পরে গেছি বঙ্গবন্ধুর কাছে।
অ্যাই নেতা, থ্যাংক ইউ।
আর কিছু বলল না। আমার সঙ্গে লোকজন আছে। গণভবনে।
সিরাজ ভাইরে বঙ্গবন্ধু যে আদর করত, কোনো দিন একটা গালি দেয় নাই। আমারে তো বঙ্গবন্ধু বলছে, ‘সিরাজ একটাই হয়। ওর যত গুণ আছে, তোমাদের সব মিলায়া তার অর্ধেকও নাই। সিরাজ নিজেই অনেকরে পালে। এগুলা হইল বাটপার। বিশেষ করে রব ভাইরে বঙ্গবন্ধু দেখতে পারত না। রব ভাই সম্পর্কে ওনার ধারণা…ফটকামি করত। মনি ভাই আবার নৈতিক দিক দিয়া খুব কঠোর ছিল। ইউ ক্যান নট ইমাজিন। সিরাজ ভাইরে বঙ্গবন্ধু ভীষণ আদর করত বঙ্গমাতা বেগম মুজিব কোনো দিন কোনো খারাপ মন্তব্য করে নাই। অন্তত আমি জানি না। কিন্তু কোনো গন্ডগোল যখন লাগে, দ্বিমত যখন হইয়া যায়, তখন চতুর্মুখী প্লেয়ার পয়দা হয়। তারা এইটা জোড়া লাগতে দেয় না।
বঙ্গবন্ধু বলছিল, জাসদ যদি বড় সংগঠন হয়, আমার পরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকবে। না হইলে রাজাকাররা ক্ষমতায় আসবে। মনসুর আলীর বাড়ি অ্যাটাকের পর বঙ্গবন্ধু খেই হারায়া ফেলল।[৩২]
.
১২
রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে জাসদ কর্মীদের ধরপাকড় ও নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কিছু কিছু খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো। কোথাও কোথাও পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠেছিল। পাবনা তার একটি উদাহরণ। অভিযোগের তির ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর পরিবারের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন নির্মল সেন।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল পাবনায়। আমার এক বন্ধুর শ্যালকের বিয়ে। নাম গোবিন্দ দত্ত। ঢাকা থেকে বিমানে ঈশ্বরদী হয়ে পাবনা পৌঁছালাম। দুপুরের দিকে একটি গুলির শব্দ শুনলাম। কৌতূহল হলো। শুনলাম পাবনায় ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে একটা রিজার্ভ হাউস আছে। এই রিজার্ভ হাউসে নাকি যেকোনো লোককে ডেকে এনে যখন-তখন হত্যা করা যায়। আমাকে আরও বলা হলো, দীর্ঘদিন ধরে পাবনার আদালতে নাকি কোনো বিচার বসছে না। বিচারকেরা শঙ্কিত। তাঁদের নাকি কোনো বিচারের কাজ করতে দেওয়া হয় না। জেলা ছাত্রলীগের নির্দেশে রায় দিতে হয়।
এ কথা শুনে আমি খানিকটা অবাক হলাম। মনে হলো এ আমি কোন দেশে আছি। একটি জেলা শহরে যেকোনো সময় যে কাউকে ডেকে এনে গুলি করা যায়! আদালতে বিচার বসে না। অথচ দেশে একটি সরকার আছে। সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে কোনো কথা বলে। না। অর্থাৎ ওই শহরে বিরাজ করছে একমাত্র ভয়, শঙ্কা আর সন্ত্রাস। এ ব্যাপারে আমি নিজেই কিছুটা খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা করলাম মহকুমা হাকিমের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর দপ্তরে ঢুকেই আমার আক্কেলগুড়ুম। তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা বলছেন আটঘরিয়া থানার একটা অভিযান নিয়ে। ওই থানা নাকি জাসদের ঘাঁটি। সেই থানা অভিযান নিয়ে বিস্তারিত কথা শুনলাম। কিছুক্ষণ পর মহকুমা হাকিমের সঙ্গে কথা হলো। আমি কথা না বাড়িয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৈনিক বাংলায় উপসম্পাদকীয় লিখলাম। যত দূর মনে আছে, শিরোনাম ছিল পাবনায় একটি রিজার্ভ হাউজ”। আমার লেখার পরে মনে হলো সকলের ভয় ভাঙল। সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা বিবৃতি দিলেন সংবাদপত্রে। সরকারি মহলেও কিছু প্রতিক্রিয়া হলো। শুনেছি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কথা তুলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন, আমার সাথে নয়, নির্মল সেনের সাথে কথা বলো। আমার সঙ্গে কেউ কোনো দিন কথা বলেনি।
তবে আমার লেখার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল পাবনায়। আমার লেখায় ক্ষুব্ধ হয় ছাত্রলীগ। আমাকে তারা প্রেসক্লাবে খুঁজতে যায়। সেখানে না পেয়ে গোবিন্দ দত্তের বাড়িতে চড়াও হয়। গোবিন্দ ওরফে রণজিৎ দত্ত পাবনা শহরে তখন দুটি রেশন দোকানের মালিক। শুনেছি আমাকে আশ্রয় দেওয়ার খেসারত হিসেবে তাঁকে একটি রেশন দোকানের মালিকানা ছেড়ে দিতে হয়। পরবর্তীকালে রণজিৎ দত্ত দেশান্তরী হন। কয়েক বছর আগে ত্রিপুরা রাজ্যে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। [৩৩]
পাবনায় জেল থেকে বের করে এনে জাসদ কর্মীদের খুন করা হয় বলে তথ্য দিয়েছেন সিরাজুল আলম খান। তাঁর এ কথার সত্যতা মেলে ১১ জুন ১৯৭৩ সালে সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত রিপোর্টে। নিজস্ব সংবাদদাতার পাঠানো রিপোর্টে বলা হয় :
পাবনা, ১০ই জুন : আজ সকালে পুলিশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নয়া ভবন প্রাঙ্গণ থেকে চারটি লাশ উদ্ধার করেছে। এর আগে পাবনা শহরের সর্বত্র নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। অকুস্থল পরিদর্শনকারী অনেক ছাত্রই এ চারটি লাশ শনাক্ত করে। লাশগুলো হচ্ছে শেখর, রফিক, স্বপন ও আসমত আলী বাদশার। এদের সবাই পাবনা জেল থেকে পলাতক বিচারাধীন আসামি ছিল। এদের বিরুদ্ধে ছিল বেআইনিভাবে অস্ত্র রাখার অভিযোগ। চারটি লাশেই অসংখ্য বুলেট ও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। চারজনেরই হাত-পা এবং একজনের শুধু হাত বাঁধা ছিল। [৩৪]
.
১৩
এ সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের একটা সমঝোতার চেষ্টা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজেই এটা চেয়েছিলেন। জাসদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটি করেন তার আস্থাভাজন সাইদুর রহমান। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। একই সঙ্গে তিনি জাসদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের যোগাযোগের এই পর্বটি সম্পর্কে দুই দলের কোনো নেতা আজ পর্যন্ত মুখ খোলেননি।
সাইদুর রহমানের কথার সূত্র ধরে আমি সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কথা বলেছি। জাসদের জন্য সময়টা তখন বৈরী। নেতাদের অনেকেই জেলে। অনেকেই আত্মগোপনে। বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন দলের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগে শেখ ফজলুল হক মনির অবস্থান তখন তুঙ্গে। তিনি এলেন তাঁর পুরোনো বন্ধু সিরাজুল আলম খানের কাছে। সিরাজুল আলম খান আমাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন :
তখন বাকশাল হবে-টবে। মনি এসেছে অন বিহাফ অব শেখ মুজিব। বলছে, হি ইজ নট আ ম্যান, হি ইজ অ্যান ইনস্টিটিউশন। হি ইজ নট অ্যান অর্ডিনারি ম্যান, হি ইজ আ সুপারম্যান। তাঁকে পারসোনালাইজ করতে হলে–আর সুপারম্যানরা তো কোননা নিয়মনীতির মধ্যে থাকে না।
তুই কী বলতে চাচ্ছিস?
আয়, একসাথে থাকি।
আমি তো একসাথে থাকতে চেয়েছিলাম। তুই তো তোর শ্বশুরকে দিয়ে দল ভাগ করে ফেললি, পাল্টা কৃষক লীগ বানালি। এখন বলতেছ একসাথে কাজ করব?
এরপর মুজিব ভাই আমাকে ডাকলেন। বললেন, স্বাধীনতার পরপর তোরা একটা জাতীয় সরকারের কথা বলছিলি। আমি এ রকম একটা করছি।
আমি বললাম, এ রকম করলে তো জাতীয় সরকার হয় না। এটা হলো আওয়ামী লীগের সরকার। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দিয়েছে।
না, মুজিব ভাই, এটা হয় না। আচ্ছা, আমি আরেক দিন আসব।
সাত-আট দিন পরে…সাইদ ভাই যোগাযোগ রাখতেন। ওই একই কথা–আমি সবাইকে নিয়া একটা পার্টি করব।
বাসার তিনতলায় বসেছি। সামনে অবজারভার পত্রিকাটা রাখা। বললাম, বুলগেরিয়ায় এ রকম আছে–গভমেন্ট অব ন্যাশনাল ইউনিটি।
না, এটা বলবি না। কোয়ালিশন গভমেন্ট নিয়ে আমার ওয়ার্ল্ড এক্সপেরিয়েন্স আছে।
এটা কোয়ালিশন গভমেন্ট না। এটা হবে গভমেন্ট অব ন্যাশনাল ইউনিটি।
না রে, না। এটা হবে না। তার চেয়ে তুই জলিল আর রবকে দিয়ে দে। আরেক দিন আয়।
আরেক দিন। সিরাজ সিকদারকে মেরে ফেলছে। সাইদ ভাই এসে বলল যে মিটিংটা হবে না। আপনাকে দেশের বাইরে চলে যেতে বলছে।
তিনি আমাকেও দেশের বাইরে চলে যাওয়ার কথা বলেন–মানে, কী সর্বনাশ দেশের ওপর নেমে আসতেছে। এর আগে উনি পুলিশকে অনেকবার বলেছেন–তোমরা যা-ই করো, শুধু আমার সিরাজের ওপর যেন কোনো আঘাত না আসে। লাস্টে তো আমার সিরাজ আর নাই। আমাকে বলছেন, তুমি তোমার পথ দেখো।
টুকটাক কত কথা বলব? বড় মনের লোক ছিল। ক্যাস্ট্রো তাঁকে সতর্ক করে বলেছিলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকতে স্বাধীনতাবিরোধী কাউকে আপনি সঙ্গে রাখবেন না। ওদের মধ্যে দক্ষতা খোঁজার দরকার নাই। আপনি দেখবেন হোয়েদার দে আর লয়্যাল টু দ্য কান্ট্রি অ্যান্ড টু ইউ।’ [৩৫]
বাকশালে যোগ দেওয়া, না দেওয়ার ব্যাপারে দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন আ স ম আবদুর রব ও মোহাম্মদ শাহজাহানের কাছে। তিনি তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। রব বলেছিলেন, এটা যদি রাষ্ট্রপতির ডিজায়ার হয়ে থাকে, তাহলে এটা বিবেচনা করে দেখা দরকার। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খানের ওপর। ওই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে শরীফ নুরুল আম্বিয়া আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন :
জানুয়ারিতেই আমরা বসলাম বাংলামোটরে কামরুল ইসলামের বাসায়। সিওসির মিটিং। আরও অনেকে এসেছিলেন। একটা বর্ধিত সভার মতো হইছিল। আলোচনা হইল, এখন আর যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। সিরাজ ভাই ওপেন মাইন্ডে ছিলেন, মডারেটরের রোলে। [৩৬]
শেখ মুজিব তরুণ নেতাদের অনেককেই বাকশালে নিতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে সিরাজুল আলম খান ও কাজী জাফর আহমদকে। এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য পাওয়া যায় আওয়ামী যুবলীগের অন্যতম নেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টুর কাছ থেকে। তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় অনেকেরই যাতায়াত ছিল। সেখানে অনেকের সঙ্গে গোপন বৈঠক হতো। এক সাক্ষাৎকারে তিনি ওই সময়ের একটা বিবরণ দিয়েছেন।
মহিউদ্দিন আহমদ : আপনি একবার বলেছিলেন এবং সিরাজ ভাইও আমার কাছে এটা কনফার্ম করেছেন। ইমার্জেন্সি দেওয়ার পর তো সিরাজ ভাই ইন্ডিয়া চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আপনার বাসায় মনি ভাইসহ মিটিং হয়েছিল। আমার ধারণা ছিল, সিরাজ ভাই ইমার্জেন্সি দেওয়ার পরের দিনই ইন্ডিয়া চলে যান। কিন্তু পরে জানলাম, মনি ভাইয়ের সঙ্গে ওনার মিটিং হয়েছে। ঘটনাটা আমাকে বলুন তো? ২৮ ডিসেম্বর রাতে ইমার্জেন্সি হলো।
মোস্তফা মোহসীন মন্টু : এটা তো প্রমিজ করে রেখেছিলাম, কাউকে বলব না, প্রকাশ করব না। সিরাজ ভাই যখন প্রকাশ করে দিয়েছে, তখন আমিও বলতে পারি।
মহি: বলেন। ইতিহাসের স্বার্থে বলেন। টুডে অর টুমরো এগুলো অন্যরা লিখবে। কিন্তু তারা লিখবে ভুল। সাধারণ মানুষ তো জানবে না?
মন্টু : মনি ভাই আমাকে বলল, আমি দুইটা লোকের সঙ্গে বসতে চাই। এটা তুই অ্যারেঞ্জ কর। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না জানে।’
দুজন কে কে?
সিরাজুল আলম খান আর কাজী জাফর।
মহি : ইমার্জেন্সি দেওয়ার পরে, না আগে?
মন্টু : আগে। আমি বললাম, কী ব্যাপার? মনি ভাই বললেন, ‘দেখি ওদের ফেরত আনা যায় কি না। সবাইকে আবার একসঙ্গে করতে পারি কি না। বঙ্গবন্ধু তো একটা বড় কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ফেলল। এটাকে যদি রক্ষা করতে হয়, এখান থেকে তো আর পেছনে ফেরা যাবে না। রক্ষা যদি করতে হয়, সবাইকে নিয়া রক্ষা করতে হবে। তা না হলে একটা বিপর্যয় ঘটবে।’ এটা উনি ক্যাটাগরিক্যালি বলেছেন।
এটা কিন্তু প্রথম না। মনি ভাই এর আগেও বলেছিলেন, মোনায়েমি প্রশাসন দিয়ে স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন চলতে পারে না। এটা নিয়ে খুব বিতর্ক হয়েছিল। উনি কিন্তু আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। শুধু যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। একটা পর্যায়ে মন্ত্রীরা মনি ভাইকে ঠান্ডা করতে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছে। রিফটটা খুব শার্প হয়ে গিয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে ক্ষতিকর অধ্যায়–ইংরেজিতে একটা শব্দ বলেছিল– ‘সেটব্যাক, আমি শেখ মুজিবের ভাগনে। উনি যখন জেলের ভেতরে, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ বলে যখন কিছু ছিল না, তখন আমি শাহ মোয়াজ্জেমকে নিয়ে সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে আওয়ামী লীগের পক্ষে সেন্টিমেন্ট দাঁড় করিয়েছি। আজকে আমাকে দোষারোপ করা হয় আমি আওয়ামী লীগবিরোধী। আমি আর আওয়ামী লীগ করব না। শ্রমিক ফ্রন্টে থাকব, আমার যুব ফ্রন্টে থাকব। তার সঙ্গে আর থাকব না। এই কথাগুলো কিন্তু…।
মহি: এটা রেকর্ডে আছে। উনি একবার সব পোস্ট থেকে নিজেকে উইড্র করেছিলেন। আপনার দায় তো ইতিহাসের কাছে। তথ্যবিকৃতি না হলেই হলো।
মন্টু : এমন তথ্য যেন জনগণের কাছে না যায় যে তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তারা মারা গেছেন।
মহি : সিরাজ ভাই আর কাজী জাফরের প্রসঙ্গে আসুন।
মন্টু : আমার সব যোগাযোগ করত আমার ছোট ভাই। সিরাজ ভাই তখন আজিমপুরে চায়না বিল্ডিংয়ের কাছে থাকে। ওখান থেকে তাকে নিয়া আসলাম। মনি ভাইকেও নিয়া আসলাম। প্রায় তিন-চার ঘণ্টা কথা বলেছে।
মহি : এই বাসায়?
মন্টু : হ্যাঁ, সামনের দিকে দোতলায় দুজনকে ঘরে আটকে আমি বাইরে চলে এলাম। কিছু কান্নাকাটি হলো। সিরাজ ভাই কিন্তু একপর্যায়ে রাজি হয়ে গেছে। বলছে, ‘আর কেউ আসুক আর না আসুক, আমি চলে আসব। আমাকে কি সে (বঙ্গবন্ধু) সেভাবে বিশ্বাস করবে? আমি পদে যাব না। মন্ত্রিত্বে যাব না। সংগঠনে থাকব। কিন্তু আমার এই সব শর্ত আছে।’
মনি ভাই বলেছে, তোমার আর আমার এই সব নিয়া তো অনেক দিন ফাইট করেছি। সারা জীবন তো আমরা এটা নিয়েই কাটালাম। আমিও তো তোমার এইটা চাই। এ জন্য তো আওয়ামী লীগ ছাড়লাম। আমিও তোমার এটা সাপোর্ট করি।’
মানসিকভাবে তারা কিন্তু একমত, তারা দুজন সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকবে। দুজন সংগঠনের লোক, প্রশাসনে যেতে চায় না। লালবাগে আমাদের যে হারুন আছে, তার সঙ্গে কাজী জাফরের ভালো সম্পর্ক। পরে জাতীয় পার্টি করেছে। বাকী নামে একটা ছেলে ছিল। তাকে পাঠালাম হারুনের কাছে। হারুনকে ফোন করে বললাম, তুমি জাফর ভাইয়ের খবর জানো?
মহি: কাজী জাফরের সঙ্গে মিটিংয়ের ব্যাপারটা বলেন।
মন্টু : জাফর ভাই আসলেন। মনি ভাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। জাফর ভাই ক্যাবিনেট মিনিস্টার, ফরেন মিনিস্টার হতে চেয়েছিলেন। মনি ভাই বললেন, বঙ্গবন্ধু মরে গেলেও এটা করবে না, যতক্ষণ কামাল হোসেন আছে।
সে তো এখানে নাই? সে তো নিচ্ছে না?
না থাকলেও…তুমি স্টেট মিনিস্টার হতে পারো। আমি চেষ্টা করব। বলব তোমার কথা। ডিসিশন বঙ্গবন্ধুই নেবেন। হয়তো কামাল হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে ডিসিশন নেবেন।
আমরা কামাল হোসেনকে তেমন ইয়ে করি না। আমাদের বয়স প্রায় কাছাকাছি। যদিও সে আমাদের চেয়ে অনেক ওপরে চলে গেছে।
তারপর জাফর ভাই চলে গেল।
মহি: উনি অ্যাগ্রি করে গেলেন?
মন্টু : হ্যাঁ, অ্যাগ্রি করলেন। স্টেট মিনিস্টার, ফরেন।
মহি : পরে এটা ওয়ার্ক আউট হলো না কেন?
মন্টু : তখন তো ক্যাওস। তারপর আমার এই ঘটনা ঘটল।
মহি : তার মানে কী? আপনাকে গভর্নর করল না?
মন্টু : না, ঢাকার সেক্রেটারি থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হলো। আমাদের ছেলেদের মধ্যে একটা উত্তেজনা, আনরেস্ট হয়ে গেল।
মহি : যুবলীগের সেক্রেটারি হওয়ার কথা ছিল আপনার?
মন্টু : না। যুবলীগের সেক্রেটারি তো তোফায়েল আহমেদ। যেহেতু তোফায়েল আহমেদ যুবলীগের সেক্রেটারি, সেহেতু মনি ভাই আমাকে যুবলীগে রাখবে না। এখন আমাকে সিটি আওয়ামী লীগের (বাকশাল) জয়েন্ট সেক্রেটারি করা হলো। পরে আমাকে চেঞ্জ করে এলাহিকে করা হলো।
মহি : মনি ভাই যে সিরাজ ভাই, জাফর ভাই, এদের সঙ্গে ডায়ালগ করছেন, এটা কি বঙ্গবন্ধুর নলেজে ছিল?
মন্টু : হ্যাঁ। [৩৭]
.
১৪
গণবাহিনীর কেন্দ্রে ছিলেন ফিল্ড কমান্ডার আবু তাহের এবং ডেপুটি কমান্ডার হাসানুল হক ইনু। রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে মোহাম্মদ শাহজাহানকে পলিটিক্যাল কমিসার নিয়োগ করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের (খুলনা বিভাগ) পলিটিক্যাল কমিসার ও কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং কামরুজ্জামান টুকু। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের (রাজশাহী বিভাগ) পলিটিক্যাল কমিসার এবং কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মনিরুল ইসলাম এবং এ বি এম শাহজাহান। পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম বিভাগ) পলিটিক্যাল কমিসার হন। কাজী আরেফ আহমদ। এখানে কোনো আঞ্চলিক কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মধ্যাঞ্চলের দায়িত্ব হাসানুল হক ইনুর কাছেই ছিল। ঢাকা নগর গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিসার ছিলেন রফিকুল ইসলাম (লিটল কমরেড নামে পরিচিত) এবং কমান্ডার ছিলেন আনোয়ার হোসেন।
গণবাহিনীর জেলা ও স্থানীয় শাখাগুলো নিজ নিজ শক্তি নিয়ে তাদের মতো করে ‘প্রতিরোধ’ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। জেলা পর্যায়ের কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী (সিলেট), খন্দকার আবদুল বাতেন (টাঙ্গাইল), শাহজাহান খান (মাদারীপুর), অলোক সরকার (রংপুর), গোলাম মোস্তফা (ঝিনাইদহ), আবদুল কাইয়ুম (খুলনা), মতিয়ার রহমান মন্টু (চুয়াডাঙ্গা), মাহফুজুর রহমান (রাজশাহী), আবদুল মতিন মিয়া (রাজবাড়ী), মোস্তাফিজুর রহমান (নোয়াখালী), মারফত আলী (কুষ্টিয়া), মইন উদ্দীন খান বাদল (চট্টগ্রাম), রবিউল আলম (যশোর), আনিসুর রহমান খান (মানিকগঞ্জ) প্রমুখ।
গণবাহিনী অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছিল। ওই সময় কুষ্টিয়ায়, বিশেষ করে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গায় গণবাহিনীর কমান্ডার মতিয়ার রহমান মন্টু প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমতো আতঙ্ক। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ছিলেন মোফাজ্জল করিম। মন্টু সম্পর্কে তাঁর বয়ান থেকে জানা যায়, একশ্রেণির তরুণ কী অবলীলায় এই বিপজ্জনক পথ বেছে নিয়েছিলেন, কী ছিল তাদের প্রণোদনা। মোফাজ্জল করিমের ভাষ্যে জানা যায় একটি বিয়োগান্ত চরিত্রের নাম–মতিয়ার রহমান মন্টু।
মন্টুর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায়। লেখাপড়া সে বেশি করেনি বা হয়তো করতে পারেনি দারিদ্র্যের কারণে। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতার কথা সবার মুখে ফিরত।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। মন্টু তখন এক আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক তরুণ। চোখে তার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার স্বপ্ন। কিন্তু অচিরেই সে ভীষণ রকম আশাহত হলো কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার ক্রিয়াকলাপে। এরা মুখে দেশ গড়ার কথা, আদর্শের কথা বললেও রাতের অন্ধকারে দেশের সম্পদ সীমান্তের ওপারে পাচার করত। এ ধরনের একটা বড় পাচার মন্টু হাতেনাতে ধরে ফেলে, কোনো কোনো নেতার মুখোশ উন্মোচন করে দেয় জনগণের কাছে। ব্যস, আরকি। এমন সন্ত্রাসী’ ছেলেকে তো আর বাড়তে দেওয়া যায় না। টগবগে তরুণকে একদিন যারা স্বাধীনতার উষালগ্নে দেশমাতৃকার চরণে উৎসর্গ করেছিলেন, সেই যুবককে তারা জেলে পুরলেন নানা অভিযোগ তুলে। অথচ চুয়াডাঙ্গাবাসী তথা বৃহত্তর কুষ্টিয়াবাসী জানত মন্টু নির্দোষ। তার একমাত্র অপরাধ, সে ওই সব ক্ষমতাশালী ব্যক্তির অপকর্মে বাধা দিয়েছিল।
কিন্তু অসমসাহসী দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা মন্টুকে বেশি দিন জেলে আটকে রাখা যায়নি। হাতে-পায়ে বেড়ি নিয়ে একদিন সে জেলখানা থেকে চম্পট দিল সবার চোখে ধুলো দিয়ে। জেল থেকে কয়েক মাইল দূরে এক গ্রামে গিয়ে এক কামারশালায় নাকি হাত-পায়ের বেড়ি কাটিয়ে নিয়ে গা-ঢাকা দেয় পাকাপোক্তভাবে।
এরপর শুরু হলো মন্টুর আরেক জীবন। তার ছোট ভাই লাল্ট এবং আরও অনেক তরুণকে নিয়ে সে গড়ে তোলে মন্টু বাহিনী। এই বাহিনীর সবাই ছিল অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত গ্রামের ছেলে, কেউ কেউ ছিল মুক্তিযোদ্ধা। এরা, তাদের ভাষায়, শ্রেণিশত্রু নিধনের কর্মসূচি শুরু করে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর মহকুমা ও আশপাশে ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডু এলাকায়।
ওদিকে ছিল আবার আরেক উপদ্রব। মূলত রাজনৈতিকভাবে বিরুদ্ধচারী গোপন সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে শায়েস্তা করার লক্ষ্যে সরকার গড়ে তুলেছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনী, সংক্ষেপে জেআরবি। তবে মাঝেমধ্যে প্রয়োজনবোধ করলে কোনো কোনো অপারেশনে তারা পুলিশের সাহায্য নিত। কিন্তু পুলিশ সাহায্য করবে কি! থানা আক্রমণ, অস্ত্র লুট, পুলিশ খুন ইত্যাদি কারণে তারা এমন ডিমরালাইজড ছিল যে আমার মনে হয় ওই সব অপারেশনে গিয়ে পুলিশ ক্যাচ ফিশ, নো-টাচ ওয়াটার’ পলিসিই নিত।
তা একবার পুলিশ কিন্তু দারুণ সাহস দেখিয়ে ফেলল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে তারা চুয়াডাঙ্গার পরের রেলস্টেশন জয়রামপুরের কাছেই গ্রামের একটি বাড়িতে ঘেরাও দিল। ওই বাড়িতে মন্টু, তার স্ত্রী এবং দলের লোকজন দিনেদুপুরে খাসি জবাই করে বিরানি-টিরানি সাবড়াচ্ছিল। মন্টু অবস্থা বেগতিক দেখে সোজা ফায়ার করতে করতে পালিয়ে গেল পুলিশের ব্যুহ ভেদ করে। কিন্তু পালাতে পারল না তার বউ এবং আরও দু-চারজন সঙ্গী। পুলিশ সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে এদেরই হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে এল চুয়াডাঙ্গায়।
মন্টু গ্রামের বাইরে এসে দেখে তার বউ সঙ্গে নেই। সে তখন আবার ফিরে গেল ওই গ্রামে। গিয়ে দেখে পুলিশ তখনো গিজগিজ করছে চারদিকে। তার চোখে পড়ল গ্রামের বাইরে লাইন করে দাঁড় করানো পুলিশের গাড়িগুলোর দিকে। ওই সব গাড়ির চালক এবং সেন্ট্রিরা জমির আলের ওপর বসে বসে সুখ-দুঃখের কথা বলছিল আর আনমনে জমি থেকে মটরশুঁটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিবুচ্ছিল। হায়! ওটাই তাদের জীবনের শেষ খাওয়া। এক ব্রাশফায়ারে আটজন পুলিশ কনস্টেবল খতম। সেদিন ছিল ১৩ মার্চ ১৯৭৫। রাতে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনসে সারিবদ্ধ লাশগুলো দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এর তিন দিন পর ১৭ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী হেলিকপ্টারে কুমারখালী এলেন উপনির্বাচনের সভায় যোগ দিতে। কিছুদিন আগেই ওখানকার এমপি গোলাম কিবরিয়া সাহেব ঈদের জামাতে নিহত হন আততায়ীর গুলিতে। প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় দিয়ে সন্ধ্যার একটু পরে শহরের কাছে গড়াই নদের ফেরি পার হয়ে ফিরে এলাম কুষ্টিয়ায়।
রাত তখন প্রায় আটটা। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। অপারেটর বলল, স্যার, মুন্সিগঞ্জ বাজারের পিসিও (পাবলিক কল অফিস) থেকে মন্টু বলে একজন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। বললাম, দিন লাইন। এরপর প্রায় ৪৫ মিনিট কথাবার্তা হলো আমাদের। মন্টু কখনো আবেগে-উচ্ছ্বাসে, কখনো রেগে গিয়ে যা বলল, তার সারকথা হচ্ছে, আমরা কেন তার স্ত্রীকে আটকে রেখেছি।
মার্চ মাসের ২০ তারিখ। ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা পার হয়ে ১টা ছুঁই ছুঁই করছে। এমন সময় হঠাৎ টেলিফোন বাজল। ফোন ধরতেই ওপার থেকে শোনা গেল, স্যার, আমি মেহেরপুর এক্সচেঞ্জ থেকে অপারেটর বলছি। আপনার এসডিও অফিসে অ্যাটাক হয়েছে।
উল্কাবেগে গাড়ি চালিয়ে ছুটে চললাম সাদা শার্টের ওপর ক্রসবেল্ট বাঁধা অ্যাডিশনাল এসপিকে পাশে বসিয়ে। শহরে যখন ঢুকলাম, তখন আর গুলির আওয়াজ নেই। কোর্ট ভবন জ্বলছিল দাউ দাউ করে। এসডিওকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ট্রেজারির ‘ডাবল লকের কী খবর? শুনলাম ওটা ভাঙতে পারেনি।
সে সময় মেহেরপুর ট্রেজারি ও বরগুনা ট্রেজারি ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ক্যাশ ট্রেজারি। ভয়টা ছিল সে জন্যই। তাড়াতাড়ি এসডিওর বাসা থেকে চাবি আনিয়ে ট্রেজারির ডাবল লক খোলা হলো। এক ফাঁকে সবাই মিলে দেখে নিলাম সেদিনকার ক্লোজিং ব্যালান্স ১ কোটি ৭ লাখ কয়েক শ টাকা। তবে দুঃখের বিষয়, ট্রেজারির কোয়ার্টার গার্ডে তখন প্রায় ৭০-৮০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। এগুলোর প্রায় সব কটি নিয়ে গিয়েছিল দুষ্কৃতকারীরা। আসলে ওটাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
মেহেরপুর ট্রেজারি আক্রমণের দু-তিন দিন পর উড়ো উড়ো শোনা গেল মন্টু মারা গেছে ওই অপারেশনে। আরও ভালো করে তথ্য-তালাশ নিয়ে জানা গেল সত্য ঘটনা। নিশ্চিত হওয়া গেল, ওই আক্রমণ মন্টুর দলই করেছিল। দলে ছিল প্রায় ১০০ লোক। মন্টু সবার আগে আগে গুলি চালাতে চালাতে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল ট্রেজারির দিকে, তখনই আচমকা তলপেটে গুলিবিদ্ধ হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একটুক্ষণ পরেই সে মারা যায়।
মন্টু মারা যাবে, এটা যেন বিশ্বাসই করা যায় না। কদিন পরই আমরা খোঁজ পেয়ে গেলাম চুয়াডাঙ্গা জেলার ভেতর মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা সড়কের পাশে টুঙ্গী গ্রামে এক বাড়ির সবজিখেতে মন্টুকে তড়িঘড়ি করে মাটিচাপা দিয়ে ওই ভোরবেলায়ই কবরের ওপর উঁটাশাক, লালশাক ইত্যাদি গাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন মেহরাব আলী চৌধুরী ছুটলেন দলবল নিয়ে মন্টুর দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে নিয়ে আসতে।
স্বাধীনতার পর মন্টু যে জীবন বেছে নিয়েছিল, তার পরিণতি এটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার এই করুণ পরিণতি কেন হলো? স্বাধীনতার এত বছর পরও এ প্রশ্নের জবাব মেলে না। মিলবে কী করে? প্রশ্নই যে করা হয় না।
.
১৫
এর মধ্যে ঘটে গেল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড। এক সেনা-অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব সপরিবার নিহত হলেন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেন। মন্ত্রিসভার অল্প কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছাড়া সবাই খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। গণবাহিনীর কমান্ডার আবু তাহের এবং ডেপুটি কমান্ডার হাসানুল হক ইনু ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে দেখা করেন। তাহের খন্দকার মোশতাকের কাছে অবিলম্বে সামরিক শাসন জারি এবং বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি জাতীয় সরকার ঘোষণার দাবি জানান। তাহেরের কথায় কান দেননি মোশতাক। তবে তিনি ২০ আগস্ট সামরিক আইন জারি করে ১৫ আগস্ট থেকে তা বলবৎ হবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করেন। অভ্যুত্থানের ৯ দিন পর ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। ভারতে প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিযুক্ত করা হয়।
জাসদের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিকল্পনা হোঁচট খায় আগস্ট অভ্যুত্থানের কারণে। ওই সময় সিরাজুল আলম খান ছিলেন কলকাতায়। অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেমনটি তারা চেয়েছিলেন, সেটি হয়নি। চুয়াত্তরের ১৭ মার্চের কারণে অনেক হিসাব-নিকাশ আগেই বদলে গিয়েছিল। ১৫ আগস্ট সব এলোমেলো করে দিল।৩৯।
সিরাজুল আলম খান জানুয়ারি (১৯৭৫) মাসে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন পঁচাত্তরের মার্চে। জুলাইয়ের শেষ দিকে তিনি আবারও কলকাতায় চলে যান। ফিরে আসেন সেপ্টেম্বরে। সে সময় তার সঙ্গী ছিলেন মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। ওই সময়ে সিরাজুল আলম খানের গতিবিধি সম্পর্কে মুবিনুল হায়দার চৌধুরী আমাকে যা বলেছেন, তা এখানে তুলে ধরা হলো :
মুবিনুল হায়দার চৌধুরী : বাকশাল যেদিন হলো, ২৫ জানুয়ারি বোধ হয়, সিরাজুল আলম খান সেদিন কলকাতায় ছিলেন। বাকশাল হবে, এটা তিনি জানতেন।
মহিউদ্দিন আহমদ : সিরাজুল আলম খান আমাকে যেটা বলেছেন–২৮ ডিসেম্বর (১৯৭৪) দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলো। এরপর শেখ মুজিবের সঙ্গে ওনার একটা মিটিং হওয়ার কথা ছিল–২ জানুয়ারি (১৯৭৫)। মিটিংটা ক্যানসেল হয়ে যায়। তারপর তিনি কলকাতায় চলে যান।
হায়দার : যেদিন ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করে, তার পরদিনই উনি কলকাতায় যান।
মহি: আমি কার কাছে যেন শুনেছিলাম, কোথাও লিখি নাই, যেহেতু এটা ভেরিফায়েড না। উনি আর আপনি নাকি ইমার্জেন্সি দেওয়ার পর একসঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলেন?
হায়দার : আমি যশোর পর্যন্ত ওনার সঙ্গে গেছি। তারপর ওনাকে বাসে তুলে দিয়ে আমি ব্যাক করে চলে এলাম।
মহি : বেনাপোলের বাসে?
হায়দার : হ্যাঁ।
মহি : আপনি ঢাকায় চলে এলেন?
হায়দার। না। আমি খুলনায় গেলাম। সেখান থেকে পরে পরিচিত লোক সঙ্গে নিয়ে ভেড়ামারা এসে শিকারপুর দিয়ে বর্ডার পার হলাম। তারপর কলকাতায় ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
মহি : ভবানীপুরে?
হায়দার : না। উনি পার্টি অফিসে এসেছিলেন–এসইউসিআই। তারপর যোগাযোগ করলেন আমার সঙ্গে।
মহি : পার্টি অফিস কোথায়?
হায়দার : ৪৮ লেনিন সরণি। আগে এটা ছিল নন্দলাল স্ট্রিট।
মহি : সিরাজ ভাই আমাকে যে স্টোরিটা বলেছেন–উনি ইমার্জেন্সি দেওয়ার পর কলকাতা চলে যান। মার্চে কিছুদিনের জন্য। ফিরে এসেছিলেন। তারপর আবার চলে যান। সেকেন্ড টাইম উনি আসেন সেপ্টেম্বরে। ওই সময় তার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছিল।
হায়দার : প্রথম যেবার বেনাপোল দিয়ে গেলেন, তারপর তো ওনার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পাসপোর্ট আর ব্যবহার করার মতো ছিল না। বেশ কিছুদিন থাকার পর আমরা আবার কলকাতা গেলাম। এবার বিলোনিয়া-আগরতলা হয়ে।
মহি : এটা কি ১৫ আগস্টের আগে?
হায়দার : হ্যাঁ। শেখ মুজিব যেদিন নিহত হলেন, সেদিন কিন্তু উনি আমাদের সঙ্গে কলকাতায়। বললাম, কী ব্যাপার, কিছু জানেন নাকি? উনি বললেন, এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না? আমাকে পরিষ্কার করে কিছু বললেন না।
মহি : এরপর আপনারা সেপ্টেম্বরে আবার ঢাকায় ফিরে এলেন?
হায়দার : ওনাকে নিয়ে ব্যাক করলাম। পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জে আমাদের পার্টির একজন, ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, এসইউসিআইয়ের একজন কমরেড, নাম জালাল, তার বাসায়। উঠলাম। সেখান থেকে হলদিবাড়ি। হলদিবাড়ি হলো কোচবিহার জেলার একটা এলাকা। রাতে এক বাড়িতে ছিলাম। উনি দাড়ি শেভ করে ফেললেন। ওখান থেকে চিলাহাটি হয়ে আমরা ভেতরে আসি।
আমাদের কাছে ১০-১৫ হাজার টাকা ছিল। সব ১০ টাকার নোট। বেশ বড় বোঝা। তখন ভোর। আমরা এক জায়গায় বসলাম। বর্ডার পার হওয়ার ব্যাপারে আমি তো ওনার চেয়ে বেশি এক্সপার্ট। বললাম, একজন লোক আমাদের অবজার্ভ করছে। হকচকিত হবেন না। নরমাল থাকেন। যাহোক, অসুবিধা হয় নাই। সেই লোকের সাহস হয়নি আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করতে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের একটু ভিন্ন ধরনের লোক মনে হচ্ছে তো? নজরে পড়তেই পারে। জালালকে দিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটালাম। আমরা ট্রেনের একটা কামরায় উঠলাম।
মহি: এটা কোন জায়গায়?
হায়দার : চিলাহাটি রেলস্টেশন। বাংলাদেশের রেলপথ ওখানেই শেষ। ওখান থেকেই দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তা।
ট্রেনের কামরায় এক ভদ্রলোক এসে আমাদের পাশে বসলেন। বললেন, “আমি কাস্টমস অফিসার। কোত্থেকে এসেছেন?
উনি বললেন, আমাদের তো এই গ্রামে বাড়ি।’ অনর্থক একটা স্টোরি বানানোর চেষ্টা। ওরা এই এলাকায় থাকে না? সবাই সবাইকে চেনে। বললাম, না না, আমরা দার্জিলিং গিয়েছিলাম বেড়াতে। এখন ফিরে যাচ্ছি। আমার কথা ওই লোকের কাছে রিজনেবল মনে হলো। আমাদের বলল, কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব আপনাদের একটু ডেকেছেন।
চলেন যাই। ট্রেন থেকে নামলাম।
আমাদের কাছে টাকা দেখে বলল, ‘এত টাকা?’ এই সব প্রশ্ন, হাবিজাবি কথা। তখন নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ একজন ওনাকে ভালো করে দেখছে। ওনার তো তখন দাড়ি নেই। হঠাৎ ওই লোক বলে উঠল, ‘আপনি সিরাজুল আলম খান না দাদা?
আমরা তাকে টাকাপয়সা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারতাম। কোনো ঝামেলা হতো না। মনে মনে ঠিকও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু সুপারিনটেনডেন্ট চিনে ফেলেছে। তার ছেলে আবার জাসদ করে। তখন উনি আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। সেখান থেকে নীলফামারী গেলাম। জালালের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম। সেখানে তাকে নিয়ে যেতে এক লোক এসেছে। আমাকেও নিয়ে যাবে সঙ্গে, মোটরসাইকেলে করে। আমি আর তার সঙ্গে গেলাম না। আমি ওখান থেকে দিনাজপুর চলে গেলাম। কয়েক দিন পর গেলাম ঢাকায়।
মহি: এটা কি ৭ নভেম্বরের আগে?
হায়দার : আগে।
মহি : ঢাকায় এসে আবার ইন্ডিয়ায় গেলেন কেন?
হায়দার : সেটা ওনার প্রয়োজন। আর আমি তো আসা-যাওয়া করিই।
মহি : কলকাতায় উনি কোথায় কোথায় যেতেন? কী করতেন?
হায়দার : আমি তো সবটা জানি না। আমার সঙ্গে দেখা হলে কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে যেতাম। এ ছাড়া মেট্রো সিনেমা হলের পেছনে একটা রেস্তোরাঁয় আমরা মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতাম। সেখানে বাংলাদেশের একটা ছেলে–তার বাবা কলকাতা করপোরেশনে চাকরি করত। একটা বাচ্চা ছেলে। খুব মিষ্টি চেহারা। সে এসেছিল ঢাকা থেকে। পরে সে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে একটা ঘটনায় মারা যায়।
মহি: এটা কি বাচ্চু?
হায়দার : না। বাচ্চু না। বাচ্চুকে আমি চিনতাম। সে তো সিরাজুল আলম খানের সঙ্গেই থাকত আজিমপুরের একটা বাড়িতে। আমিও কিছুদিন সে বাড়িতে থেকেছি।
মহি : তাহলে বাহার, মাসুদ কিংবা হারুন?
হায়দার : মাসুদ। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বোমা মেরে কলকাতায় চলে এসেছে। এখানে রাস্তায় দেখা হয়েছে। ও একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমি তাকে কলকাতায় চিকিৎসা করিয়েছি। ওর জন্য খুব কষ্ট হয়। একেবারে কচি ছেলে।
মহি : সিপাহি বিদ্রোহের সময় আপনি কোথায়?
হায়দার : তখন আমি ঢাকায়। আমি একটা বস্তিতে থাকি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদল নিয়ে জাসদের ভেতরে আলাপ হয়েছিল। দলের মূল্যায়ন ছিল, এর ফলে ভারত-সোভিয়েত প্রভাব থেকে দেশ কিছুটা মুক্ত হবে। তবে তাতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়বে। পঁচাত্তরের অক্টোবরে প্রকাশিত জাসদের একটি দলিলে এ তথ্য উঠে এসেছে। এখানে প্রাসঙ্গিক অংশটুকু উদ্ধৃত করা হলো :
শেখ মুজিবের হত্যার মধ্য দিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বর্তমানে বাংলাদেশে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তার দ্বারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রের কোনোই পরিবর্তন সাধিত হয়নি। শেখ মুজিব এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ–দুজনই বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি। মিলিটারি, পুলিশ প্রশাসন, সরকারি আমলা, কর্মচারীদের মধ্যে মুজিব ও তাঁর পরিবারের চূড়ান্ত ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপের জন্য যে চরম মুজিববিরোধী মানসিকতা গড়ে উঠেছিল, তারই পরিণতিতে খন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রেখে কার্যত সামরিক বাহিনী শেখ মুজিবকে অপসারণ করে রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করেছে। এর দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় বুর্জোয়া বা প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রেসিডেনশিয়াল শাসনপদ্ধতি চালু করার মারফত শেখ মুজিব কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত করার ক্ষেত্রে সংশোধনবাদী সোভিয়েত এবং ভারতের পুরোপুরি সাহায্য ও সমর্থনের ফলে শেখ মুজিব যতটুকু পরিমাণে সোভিয়েত ও ভারতের শাসকগোষ্ঠীর চাপের কাছে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, এই পরিবর্তনের ফলে বৈদেশিক ক্ষেত্রে তাঁর হাত থেকে বাংলাদেশ খানিকটা মুক্ত হবে এবং ততটুকু অর্থে বাংলাদেশে পশ্চিমি, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ সহজতর হবে। [৪১]
.
১৬
৩ নভেম্বর ভোরে সেনাবাহিনীর একটি অংশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান ঘটায়। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হন। খালেদ মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে সেনাপ্রধান হন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মো. সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
বঙ্গভবনে যখন ক্ষমতার পালাবদল চলছে, তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ চারজন জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। এঁরা হচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। হত্যাকাণ্ডের দায় বর্তায় খন্দকার মোশতাক ও ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের ওপর। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকা থেকে ব্যাংকক চলে যান। এটা ছিল ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যকার সমঝোতার একটি অংশ।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে সাধারণ সৈনিকেরা ভালোভাবে নেননি। সারা দেশে একধরনের চাপা উত্তেজনা ছিল। অভ্যুত্থানকারীরা ভারতের দালাল হিসেবে প্রচার পান। ওই সময় জাসদ ছিল বেশ তৎপর। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সেনানিবাসে লিফলেট বিতরণ করে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানায়। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা সেনানিবাসে ঘটে যায় সিপাহি অভ্যুত্থান।
৬ নভেম্বর মাঝরাত থেকে লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে ইংরেজি সাপ্তাহিক ওয়েভ-এর সম্পাদক কে বি এম মাহমুদের বাসা থেকে অভ্যুত্থান পরিচালনা করছিলেন। সৈনিক সংস্থার হাবিলদার আবদুল হাইকে তিনি দায়িত্ব দিলেন ‘জিয়াকে মুক্ত করে তার কাছে নিয়ে আসতে। এ পর্যায়ের একজন অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা হয়েও তাহের কী করে ভাবলেন একজন হাবিলদার-সিপাহির কথায় একজন জেনারেল তাঁর নিজস্ব ভিত সেনানিবাস ছেড়ে চলে আসবেন? এ ধরনের চিন্তা নিতান্তই স্কুলবুদ্ধির পরিচায়ক, একেবারেই বালখিল্য।
৭ নভেম্বরের ‘বিপ্লব’ নিমেষেই পরিণত হলো অ্যান্টি-ক্লাইমেক্সে। সকালে শহীদ মিনারে জাসদের তরুণেরা অপেক্ষা করছিলেন, তাহের ও জিয়া আসবেন এবং ভাষণ দেবেন। তারা কেউ আসেননি। জিয়া ও মোশতাকের। ছবি নিয়ে সৈনিকেরা ট্রাক মিছিল করেছিলেন। জাসদের তরুণেরা মোশতাকের ছবি ট্রাক থেকে টেনে নামাতে গেলে সৈনিকদের সঙ্গে বচসা হয়। পরদিন বায়তুল মোকাররমে জাসদের জমায়েতে সেনাসদস্যরা হামলা করেন, গুলি ছোড়েন। গুলিতে আ ফ ম মাহবুবুল হক আহত হন।
সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের হাতে পথচারীরা লাঞ্ছিত হন। লম্বা চুলওয়ালা তরুণেরা যথেষ্ট দুর্ভোগের শিকার হন। গণকণ্ঠএর স্টাফ রিপোর্টার মোস্তাফা জব্বার সহকর্মী ডালিমকে সঙ্গে নিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ঢাকা ক্লাবের সামনে তারা সেনাসদস্যদের বাধার মুখে পড়েন। দুজনের মাথায় লম্বা। চুল। সৈন্যরা তাদের মাথায় সিঁথি বরাবর ক্ষুর চালিয়ে চুল কামিয়ে দিলেন। সে এক কিম্ভুতকিমাকার অবস্থা! দুজনের মাথায় দুই পাশে লম্বা চুল ঝুলছে, মাঝখানটা একেবারে ফাঁকা। তারা তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন সেখান থেকে। পরে পুরো মাথা ন্যাড়া করে তবে স্বস্তি। [৪২]
এ অভ্যুত্থানে সেনানিবাসের সর্বস্তরের সৈনিকেরা ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের অবস্থান ছিল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে। অন্তরীণ জিয়াউর রহমানের প্রতি তাদের সমর্থন, আস্থা ও ভালোবাসা ছিল। এটাই ছিল জিয়ার শক্তি। এ শক্তির বলেই তিনি খুব তাড়াতাড়ি তাঁর অবস্থান সংহত করতে সক্ষম হন। তাহেরকে তখন জিয়ার সঙ্গে দর-কষাকষিতে নামতে হয়। একজন সাবেক কর্মকর্তা ও বহিরাগত হিসেবে সেনানিবাসে তাহেরের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মেজর জিয়াউদ্দিন ছাড়া আর কোনো সেনা কর্মকর্তাকে তিনি পাশে পাননি।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম জাসদের বিপ্লবী পার্টির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিসার মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ৭ নভেম্বরের বিপর্যয়ের একটা ব্যাখ্যা দিলেন :
মহিউদ্দিন আহমদ : জাসদ বিপ্লব করল। রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে গণবাহিনীর কথা বলা হলো। আপনারা ক্ষমতা নিলেন না কেন?
মনিরুল ইসলাম : আমরা যে দাবিই করি না কেন, আমাদের একক শক্তিতে তো অভ্যুত্থান হয়নি।
মহি: তাহলে অভ্যুত্থান ঘটাতে গেলেন কেন? আরও অপেক্ষা করতেন? আপনাদের সামনে উনসত্তরের গণভ্যুত্থানের মডেল তো ছিল?
মনিরুল : আমরা কীভাবে অপেক্ষা করব? ঘটনা তো ঘটে যাচ্ছে? আমরা পার্টিসিপেট না করলেও ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান হতো।
মহি : তাহলে এই অভ্যুত্থানে আপনাদের অংশ নেওয়ার রাজনৈতিক লজিকটা কী?
মনিরুল : লিফলেট দিয়ে তো সৈনিকদের উসকে দেওয়া হয়েছে, উত্তেজিত করা হয়েছে। এখান থেকে ফেরা যেত না।৩ জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখেই ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাহের। জাসদকে বুঝিয়ে রাজিও করিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়ার সঙ্গে কী সমীকরণ দাঁড়াবে, এ নিয়ে তাহেরের হিসাব ছিল নিতান্তই অপরিপক্ক। অভ্যুত্থানের মূল শক্তিকেন্দ্র যে জিয়া, এটা পরে প্রমাণিত হয়েছে।
ওই সময় তাহের এবং জাসদ ভারতবিরোধী জিগির তুলে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে অতি-জাতীয়তাবাদী মনস্তত্ত্ব তৈরি করেছিল। সেনা মনস্তত্ত্বে কাল্পনিক বা সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন’ সম্পর্কে ভীতি ছিল। ফলে জাসদের প্রচার জিয়াউর রহমানের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে সাহায্য করে। সেনাবাহিনী এবং সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, জিয়া ভারতবিরোধী। তিনি জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করছেন এবং জাসদ বিশৃঙ্খলা তৈরি করে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেশের। ক্ষতি করতে চাইছে।
৬ নভেম্বর রাত এবং ৭ নভেম্বর ভোরের মধ্যবর্তী অংশের একজন সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী ছিলেন সাপ্তাহিক ওয়েভ পত্রিকার সম্পাদক কে বি এম মাহমুদ। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে তাঁর বাসাটি ছিল জাসদের অনেক নেতা কর্মীর রীতিমতো এক আড্ডাখানা। ওই রাতে তাহের সেখানেই ছিলেন। সাপ্তাহিক পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কে বি এম মাহমুদ বলেন :
আমি প্রথম সাইফুল বারীর বাড়ি গেলাম। তিনজন বা চারজন সৈনিক আমার গাড়িতে ছিল। আমি বললাম, বারী ভাই, চলেন বেতার খুলতে হবে। তখন চারদিকে নানা রকম গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। বারী ভাইয়ের সহধর্মিণী আমার পায়ে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘ভাই, আমার তিনটে বাচ্চা পিতৃহারা হবে। আপনি মাফ করে দেন। ওনাকে মাফ করে দেন। আমি বললাম, ভাবি, আমার সাতটা বাচ্চা যদি পিতৃহারা না হয়, আপনার তিনটে বাচ্চাও পিতৃহারা হবে না।
সৈনিকেরা বলছে, ধরে নিয়ে যাব। আমি বললাম, না, থামেন, উনি আমার বড় ভাইয়ের মতো। পেশায় দুই বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। একসঙ্গে চাকরি করেছি। আমি তখন বললাম, বারী, আমাকে বলেন কী করা যাবে। বললেন, “তুমি একটু মহাপরিচালক জামান। সাহেবকে অনুরোধ করো। আমি বললাম, আমার তো ওনার সাথে কোনো পরিচয় নেই। বলল, “আমি ফোন লাগিয়ে দিচ্ছি, তুমি কথা বলো।’ তিনি ফোন লাগিয়ে দিলেন জামান সাহেবকে। তিনি থাকেন। ঢাকা কলেজের বিপরীতে। আমি ওনাকে বললাম, ভাই, আমি। মাহমুদ বলছি। একটা আকস্মিক ঘটনা আছে। বাংলাদেশ বেতার খুলতে হবে। বলে আমি একটু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলাম। বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমার তো পরিবহন নেই, কী করে যাব?’ বললাম, আসছি আপনাকে এগিয়ে নিতে।
গেলাম ওনাকে বেতারকেন্দ্রে নিয়ে যেতে। ততক্ষণে শামসুদ্দিন বলে একটা ছেলে ছিল, গণকণ্ঠএ চাকরি করত, ও আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। ওখানে বসে আমরা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে একটা কুকে পাঠালাম জিয়াউর রহমানের বক্তৃতা ধারণ করার জন্য। অপেক্ষা করলাম। সিরাজুল আলম খান দূরালাপনীতে আমাকে তিলিপি বলে দিলেন, যেটা আমি সম্প্রচার করিনি। কোনো যৌক্তিকতা নেই। আগে যেসব কথা হয়েছে, সেগুলো বাদই দিতে হয়। এখন আমি বুঝি ওটা কেন বলেছিল। [৪৪]
মাহমুদের ভাষ্যে আরও কিছু কথা ছিল, যেগুলো ব্যক্তিগত, মন্তব্যমূলক। পরে তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল যে সিরাজুল আলম খান চেয়েছিলেন সবাইকে ধ্বংস করে দিতে। তারপরে যে একাধিক হত্যাচেষ্টা কর্নেল তাহেরের ওপর হয়েছে, যেগুলো আমি মনে করি এ ধরনের ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ। [৪৫]
মাহমুদ পরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন তিনি কারাগারে তাহেরের সহবন্দী ছিলেন। জলিল-রব-তাহেরদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছিল, তার বিচার চলেছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে একটি বিশেষ সামরিক আদালতে। মাহমুদ অবশ্য বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন। জেলে থাকা অবস্থায় তাহেরের সঙ্গে তার কথার সূত্র ধরে মাহমুদ বলেন, যখন আমি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে বিচারাধীন, তখন তার সঙ্গে আমার একান্তে কিছু কথা হয়। তার কতগুলো মন্তব্যে আমার মনে হয়েছিল জেলে যাওয়ার পর উইথ হাইন্ডসাইট (ফিরে দেখা) তিনি অনুভব করেছিলেন, ৭ নভেম্বর আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দ্বারা যা ঘটানো হয়েছিল, তার আলটিমেট উদ্দেশ্য ছিল আমাদের অজান্তে একটি প্রতিবিপ্লব ঘটানো। মামলা চলাকালে (জুন ১৯৭৬) মাহমুদের সঙ্গে তাহেরের একান্ত কথাবার্তা উঠে এসেছে সাপ্তাহিক-এ ছাপা হওয়া এই সাক্ষাৎকারে।
তাহের : মি. মাহমুদ, ইতিহাসে আমাদের ৭ নভেম্বর একটি প্রতিবিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
মাহমুদ : আজ অবধি যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় এ সম্ভাবনা ভালোমতোই আছে।
তাহের : এ রকম যাতে না হয়, এ জন্য কি কোনো পথ বের করা যায়? (কিছুক্ষণ নীরব থেকে) আমি কিছু একটা করব।
মাহমুদ তখন বুঝতে পারেননি, কিছু একটা করা সম্বন্ধে তাহের কী বলতে চেয়েছিলেন? ‘পরবর্তী কয়েক দিনের কোর্ট প্রোসিডিংসে তাহেরের দৃঢ় অবস্থান ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। তাহের ফাঁসির কাঠগড়ায় যাবার জন্য যে প্রস্তুত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠল। যাতে তার জীবনের বিনিময়েও অন্তত ৭ নভেম্বরের কাউন্টার রেভলুশন চরিত্রটি কিছু পরিমাণে হলেও মুছে ফেলা যায়।’ [৪৬]
৭ নভেম্বর এবং পরের বিয়োগান্ত পরিস্থিতির জন্য মাহমুদ দায়ী করেন সিরাজুল আলম খানকে। তাঁর মতে, ৭ নভেম্বর কী ঘটতে যাচ্ছে, তার পূর্ণ রাজনৈতিক উপলব্ধি তাহেরের ছিল না। তাকে যেটা করতে বলা হয়েছিল, তিনি সেটাই করেছিলেন। এর ফল কী দাঁড়াবে, এর লক্ষ্য কী, ৭ নভেম্বরের আগে এটা জানতেন শুধু সিরাজুল আলম খান। মাহমুদের মূল্যায়ন হলো :
অবিশ্বাস্য কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে একটি যুবশক্তির উদ্ভব হয়েছিল, যাঁরা ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। যাঁরা তাঁদের শ্রেণিচরিত্র ভুলে সংগঠিত হয়েছিলেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ দেশে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে। ওই সময় পৃথিবীর কোনো দেশেই এত অল্প সময়ে এই মাপে ও কলেবরে কোনো বিপ্লবী শক্তির উত্থান হয়নি, যা বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছিল। কারণ, আমাদের তরুণেরা কোনো আদর্শের সন্ধান পেলে তার জন্য মরতে। ভয় পায় না।
দুর্ভাগ্য এই যে বাংলাদেশের এই অবিশ্বাস্য উত্থানের যে কারিগর ও রূপকার ব্যক্তিটি, তিনিই আমাদের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে পর্দার অন্তরালে এক নীলনকশার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যার দায় মেটাতে অবশেষে নিজেই যবনিকা টানেন। বাংলাদেশের প্রথম প্রগতিশীল যুব আন্দোলনের, সেই নীলনকশার চার্টেড কোর্স অনুযায়ী। সফলভাবে নিক্ষেপ করেন এক প্রজন্মের পুরো যুবশক্তিকে বঙ্গোপসাগরে, যার সঙ্গে তুলনীয় হ্যাঁমিলিনের বংশীবাদকের সেই কাহিনিটি। [৪৭]
.
১৭
১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের সব সময় যোগাযোগ ছিল। অভুত্থানকারীরা ৩ নভেম্বর দেশ ত্যাগ করেন। ওই দিন তাহের। মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে দিনভর বঙ্গভবনে ছিলেন। তাদের মধ্যে সমঝোতা। হয় যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে জিয়াউর রহমান আবার সেনাপ্রধান হবেন এবং আগস্ট অভ্যুত্থানের কুশীলবরা দেশে ফিরে আসবেন। তাহেরের পরামর্শে ৬ নভেম্বর রাতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে যে ১২ দফা। দাবিনামা তৈরি করা হয়েছিল, তার ১০ নম্বর দফায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়–যেসব সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ হলো, ৩ নভেম্বরের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। এ তথ্যটি জাসদের হাজার হাজার তরুণের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। তারা অনেকেই ১২ দফা পড়েও দেখেননি। ৭ নভেম্বর সকালে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ছিটকে পড়ে তাহের ব্যাকফুটে চলে যান। এবং জিয়াবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
৭ নভেম্বর নিয়ে জনমনে যেমন ধোয়াশা ছিল, দলের মধ্যেও ছিল বিভ্রান্তি। সবাই সবটা জানেন না। বোঝা যায়, চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে একাধিক কেন্দ্র। ছিল। সবাই ঘটনাটি যার যার মতো ব্যাখ্যা করেছেন। এ নিয়ে দলের সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ কখনোই হয়নি। কোনো রকম ভুল। বিচ্যুতি হয়ে থাকলে তার অকপট স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়নি। একজন অন্যজনের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে সাফ রাখতে চেয়েছেন। জয়ের কৃতিত্বের অনেক দাবিদার, কিন্তু ব্যর্থতার দায় কেউ নিতে চান না।
জাসদের সভাপতি মেজর জলিল জেল থেকে ছাড়া পান ৮ নভেম্বর রাতে। ২৩ নভেম্বর তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। মাঝের সময়টুকু তিনি দলের কাজে সময় দিয়েছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন। কী বুঝেছেন, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। ওই সময় তিনিও কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রয় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি উঠে এসেছে :
প্রশ্ন : ‘৭৫-এর ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উত্তর : ৭ নভেম্বর স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা একটা সংগঠিত ঘটনা ছিল এবং জাসদ তা সংগঠিত করে। এ সম্পর্কে আপনারা পরে জানতে পারবেন। আমার মনে হয় এখনো সময় আসেনি।
প্রশ্ন : প্রেসিডেন্ট জিয়া কি তখন আপনাদের সঙ্গে ছিলেন?
উত্তর : আমাদের সঙ্গে ছিলেন না। তবে ওয়াদা করেছিলেন, আমাদের সঙ্গে আসবেন।
প্রশ্ন : ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য না থাকলে জাসদ ৭ নভেম্বরের ঘটনাকে সংগঠিত করল কেন?
উত্তর : রুশ-ভারতের হামলাকে প্রতিহত করার জন্য। লক্ষ্য ছিল জাতীয় সরকার গঠন করা।
প্রশ্ন : জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অন্য কোনো দলের সঙ্গে আপনারা কি আলোচনা করেছিলেন?
উত্তর : ৭ নভেম্বরের ঘটনার গতি এত তীব্র ছিল যে আমাদের কোনো কন্ট্রোল ছিল না। ১১ নভেম্বর মোশতাক সাহেবের (খন্দকার মোশতাক আহমদ) বাসায় আমি একটি বৈঠক করি জাতীয় সরকার
গঠনের লক্ষ্যে। কিন্তু ২৩ নভেম্বর পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে।৪৯ জাসদের বিপ্লব পরিকল্পনা, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি, সেনানিবাসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন–এসব বিষয়ে ভিন্নমতের একটি বয়ান পাওয়া যায় কে বি এম মাহমুদের কাছ থেকে। সাপ্তাহিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জাসদের লক্ষ্য ও কৌশল সম্বন্ধে যে তথ্য দেন, তা হলো :
জাসদ একসময় আমাকে সমঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে তারা একটা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন করছে। একটা দৃশ্যমান পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭৬ সালের প্রথমার্ধে একটা অভ্যুত্থান হওয়ার কথা। এর চরিত্রটা ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে অগ্রসর হবে। এতে সশস্ত্র বিশ্বস্ত অনুচরেরা এবং সেনাবাহিনীতে জাসদের সশস্ত্র ক্যাডাররা অংশ নেবে। এ গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা মোর্চা সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যেটাতে জাসদ কৃষি ও স্বরাষ্ট্র–এই দুটো মন্ত্রণালয় নেবে। এটা একটা পরিষ্কার পরিকল্পনা, যেটা ১৯৭৩-এর শুরুতে বিশ্বাস করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা ছিল।
জিয়ার সঙ্গে দুটো বৈঠকে গিয়েছিলাম। এক বৈঠকে আ স ম আবদুর রব উপস্থিত ছিলেন এবং আমার সহযোগিতা চেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে সিরাজুল আলম খান আমাকে অনুরোধ করলেন, মাহমুদ ভাই, আপনার বন্ধু জিয়াউর রহমানের সঙ্গে একটু আলাপ শুরু করেন। জিয়ার সঙ্গে স্বাধীনতার পরে পরিচয় হলেও ওই সময় সেনাবাহিনীতে যারা ছিলেন, তাতে জিয়ার মধ্যে দুর্নীতি ছিল না। জিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উদ্দেশ্য কী–যদি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে একসময় আমাদের গণবাহিনীতে আসবেন। যদি সমাজতন্ত্রের শত্রু হন, তাহলে তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। আর যদি নিরপেক্ষ হন, নিরপেক্ষ জায়গায় রেখে দেব, ছোঁব না। এটাই ছিল রণকৌশল। [৫০]
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের অনুঘটক হিসেবে জাসদ কৃতিত্ব দাবি করলেও তারা কেন ক্ষমতা দখল করল না, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এটা কি তারা চায়নি, নাকি ক্ষমতা দখল করার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না? এ নিয়ে দলের নিজস্ব মূল্যায়নটি এ রকম :
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে এতই যদি প্রস্তুতি ছিল, আর এসব কথা যদি সত্যিই হয়ে থাকে তবে জাসদ ও বিপ্লবী গণবাহিনী ৭ তারিখে ক্ষমতা দখল করল না কেন? এর উত্তর অতি সহজ। ৭ নভেম্বরের জরুরি পরিস্থিতিতে জাসদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তৎক্ষণাৎই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও ষড়যন্ত্রকারী ভারতীয় দালালদের কুমতলবকে নস্যাৎ করে দেওয়া–একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে এককভাবে ক্ষমতা দখল করা নয়। দেশবাসীর সামনে মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রবের বক্তব্যই এ কথা প্রমাণ করেছে। মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রব দাবি করেছিলেন :
ক) বাকশাল ব্যতীত সকল প্রকাশ্য ও গোপন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা হোক।
খ) নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হোক এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক।
গ) ভারত-রাশিয়া-আমেরিকার অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিনিধি মারফত জাতিসংঘে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হোক।
ঘ) ভারতের আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে ‘জনতার প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করতে হবে।
চ) সকল রাজবন্দীকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। (সংক্ষেপিত)[৫১] ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হল ছিল ‘বিপ্লবের একটি কেন্দ্র। এ নিয়ে মান্নার সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হয়। তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :
মাহমুদুর রহমান মান্না : আমি সিওসির মেম্বার। মজার ব্যাপার হলো ৬ নভেম্বর রাতে যে মিটিং হলো, সেখানে আমি ছিলাম না। ৬ নভেম্বর বিকেলে বায়তুল মোকাররমের সামনে আমাদের একটা মিটিং এবং মিছিল ছিল। আমি ওই মিটিংয়ে গেছি, কিন্তু মিছিলে। যাইনি। রাতের ট্রেনে আমার চিটাগাং যাওয়ার কথা। আমি বাসায় চলে এসেছি। তারপর চিটাগাং রওনা হয়েছি। ঘটনা হলো, ওই রাতে নেতারা বসেছে। সেখানে এ প্রশ্নটা এসেছে–আর্মির মধ্যে এই অবস্থা।
মহিউদ্দিন আহমদ : এর বর্ণনা মাসুদ আমাকে দিয়েছে। সে ওই মিটিংয়ে ছিল। এটা ইএসসির (ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটি) মিটিং ছিল।
মান্না : আমি ৭ তারিখ সকালে চিটাগাং পৌঁছেছি। রাঙ্গুনিয়াতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে গেছি। সবাই তো আমাকে দেখে অবাক। মান্না ভাই, আপনি আসছেন? খবর জানেন না? বিপ্লব হয়ে গেছে!
খুব বিব্রতকর অবস্থা আমার। ডা. করিমের বাসায় গেলাম। ওই দিন বা পরের দিন ঢাকায় ফিরে এসেছি। মাসুদ আপনাকে কী বলেছে জানি না। ওই দিন সিরাজ ভাই সম্ভবত হেজিট্যান্ট ছিলেন। মাসুদ ওয়াজ নট ইন ফেবার অব দিস অন দ্যাট নাইট। তাহের ভাই বোধ হয় বলেছিলেন, আজকেই হতে হবে।
মহি : টুনাইট অর নেভার।
মান্না : তাহের ভাই-কী বলব–হি ওয়ান দ্য ডিসিশন ইন হিজ ফেবার। ইনু ভাই তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। সিরাজ ভাই পরে বলেছেন, উনি এসবের কিছু জানেন না। আসলে জানেন, কিন্তু ডিজঅ্যাগ্রি করেন নাই। পরে তার ভূমিকা দেখে মনে হয়েছে, উনি এটা অ্যাপ্রুভ করছিলেন না। কিন্তু উনি এটা রেজিস্টও করেন নাই। তাহের ভাই খুব পারসুয়েসিভ ছিলেন।
মহি : সাম্যবাদ কারা ড্রাফট করত?
মান্না: সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে–আমার ধারণা–কখনো মাসুদ লিখেছে, কখনো মধু লিখেছে। এটা আমার অনুমান।
মহি : আমি যাকেই জিজ্ঞেস করি, সে-ই বলে, ‘আমি জানি না।’
মান্না : সংগঠন মানে সেনাবাহিনী আর সংগ্রাম মানে যুদ্ধ–এই লিটারেচার ড্রাফট করেছে মাসুদ। মাসুদ এর মধ্যে ছিল।
মহি : এটা সাম্যবাদ-দুই।
মান্না : হ্যাঁ। মাসুদ কিন্তু এই লাইনের পক্ষে ছিল। [৫২]
.
১৮
১৫ আগস্ট হয়েছিল বলেই ৩ নভেম্বর ঘটেছিল। আর ৩ নভেম্বরের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই হয়েছিল ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ১৫ আগস্ট আর ৭ নভেম্বরকে একসূত্রে গাঁথা যায়। সব কটি ঘটনার সুলুকসন্ধান করলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে। বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। যেখানেই পেরেছি, সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছি।
১৫ আগস্ট এবং ৭ নভেম্বর এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে গণবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নেতা শরীফ নুরুল আম্বিয়া ঢাকায় ছিলেন না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি ওই সময়টি নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। এখানে তা উদ্ধৃত করছি :
মহিউদ্দিন আহমদ : কর্নেল তাহেরের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সমীকরণটি কী ছিল? বিশেষ করে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ব্যাপারে?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : সিরাজ ভাই তাহেরকে ডিজওউনও করেন নাই, ফেসও করেন নাই। আবার নিজেও কোনো পথ বাইর করেন নাই।
মহি : আমার অনুসন্ধান বলে, তাহের ওয়াজ ইনভলভড ইন ফিফটিনথ আগস্ট। তিনি ফিল্ড লেভেলে অ্যাকশনে ছিলেন না। কিন্তু তাঁর নলেজে ছিল।
আম্বিয়া : থাকতে পারে।
মহি: ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তাহেরের স্টেটমেন্টে এটা আছে। সকালে মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ তাকে ফোন করেছে। তারপর তাহের রেডিও স্টেশনে গেছেন। রশিদ তাকে ফোন করে। কেন?
আম্বিয়া : যোগাযোগ না থাকলে ফোন করবে কেন?
মহি : উনি এসে খন্দকার মোশতাককে যে সাজেশনগুলো। দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন–প্রথমটাই হলো, ডিক্লেয়ার মার্শাল। ল। একটা পলিটিক্যাল পার্টি তো মার্শাল ল দিতে বলতে পারে না? খন্দকার মোশতাক তো মার্শাল ল দিল পাঁচ দিন পরে?
আম্বিয়া : নলেজে ছিল, এটা প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু উনি প্ল্যানিংয়ে ছিল, এটা প্রমাণ করা কঠিন। হয়তো ঠিক, হয়তোবা না।
মহি : অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লিগ্যাসি অব ব্লাড বইয়ে আছে, শেখ মুজিব নিহত হন ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে। তাহের আগের দিন রাতে ডিসাইড করেছেন, পরদিন ভোর পাঁচটায় তিনি ঢাকায় আসবেন। যদিও তিনি একটু দেরি করে এসেছেন।
আরেকটা ব্যাপার হলো জিয়ার সঙ্গে তার কানেকশনটা। তাহের তো নিজেই নিজেকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। তাহের কিন্তু ফেঁসেছেন। জেলখানায় দেওয়া তাঁর স্টেটমেন্টের কারণে। তখন তাঁরা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি, আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর পাওয়ারে ফিরে আসবে। তারা ভেবেছেন, আর্মি এদের ক্রাশ করে দিয়েছে। তা না হলে ওই স্টেটমেন্ট উনি এভাবে দেন না।
জিয়া যখন গৃহবন্দী হলেন, তখন তিনি তাহেরকে ফোন করেছেন তাঁকে হেল্প করার জন্য। যারা সার্ভিং অফিসার, যারা জিয়ার খুব ক্লোজ, যেমন মনজুর, মীর শওকত আলী, আমিনুল হক–এরা তো জিয়ার লোক। এদের কাউকে উনি ফোন করেন নাই। উনি করেছেন তাহেরকে, যিনি আর্মিতে আর নাই। আদৌ জিয়া তাকে ফোন করেছেন কি না। কারণ, জিয়াকে যখন ইনটার্ন করা হয়, তখন তার রুমের টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল।
আম্বিয়া : এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
মহি: জিয়া যে তাহেরকে ফোন করেছেন, এই কনভারসেশনের সাক্ষী কে?
আম্বিয়া : তাহের নিজেই হয়তো গুল মাইরা দিছে।
মহি : হতে পারে। জিয়ার অনুরোধে আমি তার প্রাণ বাঁচাতে গেছি–এই ধারণা দেওয়ার জন্য। জিয়াকে যখন ইনটার্ন করা হয়, তাকে যে মারা হবে না, এটা তো অলরেডি এনসিওর করা হয়েছে। এ দায়িত্বটা ছিল মেজর হাফিজের। মেজর জিয়াউদ্দিন ছাড়া আর কোনো অফিসার তো তাহেরের সঙ্গে ছিল না? এবং পরবর্তী সময়ে তাহেরের ফাঁসির ব্যাপারে এভরিবডি ওয়াজ আনঅ্যানিমাস। জাসদ যে পরে তাহেরকে ক্যারি করেছে, এটা জাসদের জন্য আরও বেশি ডিজাস্টার হয়েছে। এ জন্য জাসদকে আরও পে করতে হবে।
আম্বিয়া : বিচার করবে?
মহি : আস্তে আস্তে এগুলো বের হবে তো? এই যে খালেদ মোশাররফকে ইন্ডিয়ান এজেন্ট হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা, ক্যান্টনমেন্টে লিফলেট ছড়ানো–সবকিছু তো জিয়ার পক্ষে করা হয়েছে?
আম্বিয়া : ৭ নভেম্বরের পরে তাহেরের দ্বিতীয় অভ্যুত্থানটা করতে যাওয়া…মামলা তো হইল সে কারণেই। এটা করা উচিত হয় নাই। সিরাজ ভাইয়ের একটা পজিশন নেওয়া উচিত ছিল। এরপর দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হওয়ার সুযোগ নাই। কোনো ফোর্সই নাই তোমার। কোন শক্তিতে তুমি দ্বিতীয় অভ্যুত্থানে যাও। দেশে কোনো ফোর্স নাই। ইন্টারন্যাশনাল কোনো অ্যারেঞ্জমেন্ট নাই, সাপোর্ট নাই, আর তুমি অভ্যুত্থানে চইলা যাও?
সিরাজ ভাই পরে জিয়ার সঙ্গে ইয়া করতে গেছিল। দ্যাট ওয়াজ টু লেট। তাহেরকে তো তাহলে ডিজওউন করতে হবে। সে রকম অবস্থা দলের আছে কি না তখন? আনোয়ারের নেতৃত্বে সিটি গণবাহিনী তো তখন আমারে মাইরা ফেলার ডিসিশন নিছে।
মহি: কেন?
আম্বিয়া : এরা তো সব বিপ্লবী। আমার কারণেই নাকি তারা কোনো বিপ্লব করতে পারতেছে না!
৭ নভেম্বরের পর সিরাজ ভাইয়ের উচিত ছিল জিয়ার সঙ্গে অ্যারেঞ্জমেন্টে যাওয়া। এই যে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে, এদের জীবন-জীবিকারও তো একটা দায়দায়িত্ব আছে। জিয়ার পার্টি না। হয়েও জিয়াকে প্যাসেজ দিয়া ডেমোক্রেটিক লাইনে পার্টি ডেভেলপ করা; রিপ্লেসিং আওয়ামী লীগ, যেহেতু জিয়ার অপজিশন নাই। [৫৩]
পঁচাত্তরের টালমাটাল দিনগুলো নিয়ে রয়ে গেছে অনেক ধোঁয়াশা, অনেক বিভ্রান্তি। সবাই সবটা জানেন না। যারা জানেন, তাঁরা সবটা বলেন না। বিষয়টি নিয়ে আমি সিরাজুল আলম খানের মুখোমুখি হলাম। আমাদের কথোপকথনের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি :
মহিউদ্দিন আহমদ : ৭ নভেম্বরে আপনাদের প্ল্যানটা কী ছিল?
সিরাজুল আলম খান : ওই যে বললাম না, ৪০-৪২টা জায়গা থেকে…শহরের মধ্যে আন্দোলন রাখা–মিছিল, মিটিং, স্ট্রাইক, হরতাল ডাকা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মিলিয়ে একটা অভ্যুত্থানমূলক, একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থান, বিপ্লবী সশস্ত্র অভ্যুত্থান, ক্ষমতা দখল। হয় ক্ষমতা দখল, না হয় ইলেকশন দিতে বাধ্য করা, আর ন্যাশনাল গভমেন্ট ফর্ম করা। কোনোটাই হলো না। লিডাররা সবাই তো জেলে চলে গেল। অন্যরা আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেটাই ইন ডিফারেন্ট ফর্ম আবার ওয়ার্ক আউট করা হলো সেভেনথ নভেম্বর। একই শক্তিগুলো। সেভেনথ নভেম্বরের ফোর্সেসগুলো, আমরা ছাড়াও দেয়ার ওয়ার আদার ফোর্সেস ইন দ্য ফিল্ড। চুয়াত্তর সাল পর্যন্ত তো আমরা ছাড়া ফিল্ডে কোনো ফোর্স নাই। কিন্তু বাই সেভেনটি ফাইভ, ১৫ আগস্টের পর অন্যান্য ফোর্স ভেরি মাচ অ্যাকটিভ। তারা ফ্যাক্টর। সেগুলোকে সমন্বয় করা, সেগুলোকে ডিফিট দেওয়া, সেগুলোর পরিবর্তে পজিটিভ ফোর্স গ্রো করানো–এটা হলো না। না হওয়ার কারণে সেভেনথ নভেম্বর একটা সাকসেস হওয়ার পরেও ইট ওয়াজ আ কাইন্ড অব অ্যাবরশন।
তারপর তো হোল স্টোরি ওয়াজ ডিফারেন্ট। আমি অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম। সেভেনটি সিক্সে ২৬ নভেম্বর অ্যারেস্ট হয়ে যাওয়ার পর বোঝাই গেল, ওই গেম আর চলবে না। সোসাইটি হ্যাঁজ চেঞ্জড। পিপলস মাইন্ড হ্যাঁজ চেঞ্জড। সোশ্যাল ফোর্সেস আর ডিফারেন্ট। পলিটিক্যাল পার্টিজ লুক অ্যাট দ্য প্রবলেম ইন আ ডিফারেন্ট ওয়ে।
সাত নভেম্বরের পরে-কলকাতার একটা ইংরেজি পত্রিকা ছিল না?
মহি : ফ্রন্টিয়ার?
সিরাজ : ফ্রন্টিয়ার। পড়েছ সেই রিপোর্টটা?
মহি: কোনটা?
সিরাজ : ৭ নভেম্বরের ওপরে? এডিটর নিজে লিখেছিলেন। ১৯১৭ সালের লেনিনের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পর সেভেনথ নভেম্বর পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি অনন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছিল। বাট ইট ওয়াজ ফয়েলড।
মহি : একটা প্রশ্ন কিন্তু উঠেছে। জাসদ এবং ১৫ আগস্ট। এখন রেকর্ডে যেসব কথা আসছে, কর্নেল তাহের ওয়াজ ভেরি মাচ আ পার্ট অব ফিফটিনথ। অগাস্ট। হি হ্যাড অল দ্য লিয়াজোঁ উইথ ডালিম, রশিদ। এবং ওই সময় উনি মুভও করেছেন। জিয়াকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্য। এ জিনিসগুলো এখন আসতেছে। এবং নূর-টুর এদের সবার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বিকজ অব হিজ ওল্ড অ্যাসোসিয়েশন। আবার একই সঙ্গে তিনি সেনাবাহিনীর কাছে জাসদের রিপ্রেজেন্টেটিভ। কর্নেল তাহেরকে। জাসদ যদি ক্যারি করে, তাহলে ১৫ আগস্টের একটা…
সিরাজ : ইন্টারপ্রিটেশন?
মহি : একটা লায়াবিলিটি চলে আসে।
সিরাজ : চলে আসে?
মহি: অবভিয়াসলি চলে আসে।
সিরাজ : জাসদের ওপর না আসলেও কর্নেল তাহেরের ওপর আসে।
মহি: জাসদের ওপর আসে, যেহেতু জাসদ তাহেরকে ওউন করেছে।
সিরাজ; হতে পারে। একজনের একটা ইনডিভিজুয়াল রোল থাকতে পারে না?
মহি: কর্নেল তাহের তো সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি করত।
সিরাজ : সেটাই তো বলছি। আলাদা রোল হতে পারে। আলাদা আইডেন্টিটি থাকতে পারে।
মহি: ইভেন তাহের যেদিন অ্যারেস্ট হন, চারজন একসঙ্গে অ্যারেস্ট হয়েছিলেন–তাহের…।
সিরাজ : এস এম হল থেকে, হাউস টিউটরের বাসা থেকে।
মহি : হ্যাঁ। মোস্তফা সরোয়ার (বাদল) ছিলেন হাউস টিউটর। যেহেতু তার ওখানে মিটিং হচ্ছিল, সেখান থেকে তাহের অ্যারেস্ট হলেন। বাদল ভাইও অ্যারেস্ট হলেন। তাঁর সঙ্গে সৈনিক সংস্থার জোবায়ের আনসারি ছিলেন। তিনি পরে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। তিনিও অ্যারেস্ট হন। আরেকজন যিনি অ্যারেস্ট হয়েছিলেন, তিনি সর্বহারা পার্টির লোক। ফাররোখ আহমদ নাম। তিন বছর জেলে ছিলেন। তার মানে ওখানেও তার সঙ্গে সর্বহারা পার্টির লোক ছিল। জিনিসটা খুব…
সিরাজ : সিম্পল ইকুয়েশন।
মহি: সিম্পল না। বেশ জটিল। উনি অনেক দিকে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে জিয়া তো জাসদকেই টার্গেট করল। এ জন্যই আমি বলি, ১৫ আগস্টে জাসদের কোনো ভূমিকা নাই–এটা ১৫ আগস্ট থেকে নভেম্বরের সেকেন্ড উইক পর্যন্ত, জিয়ার সঙ্গে হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত জাসদের যে সমস্ত লিটারেচার–সেখানে ১৫ আগস্ট সম্পর্কে কোনো ক্রিটিক্যাল কথাবার্তা নাই।
সিরাজ : নাই তো? এর সঙ্গে জাসদের তো কোনো কানেকশন নাই?
মহি: এ রকম কোনো বিশ্লেষণ নাই।
সিরাজ : শেখ মুজিবের পতন চেয়েছে, বাট নট ইন দিস ওয়ে। রাজনৈতিক পতন চেয়েছে।
মহি: নট ইন দিস ওয়ে–এর মধ্যে এই কথাটা আসে নাই। এটা হচ্ছে পরবর্তীকালের বয়ান।
সিরাজ : কিলিংয়ের মধ্যে এটা আসে না। জাসদ আসে না। ইনডিভিজুয়ালি একজন হতে পারে। জাসদ কেন এ রকম করবে যে শেখ মুজিবকে ফ্যামিলিসুদ্ধ মেরে ফেলতে হবে? কেন?
মহি: না না না। ফ্যামিলির ব্যাপারটা তো কেউই বলবে না। যারা মেরেছে, তারাও এটা বলবে না।
সিরাজ; এটার আর আলোচনার দরকার নাই। (রেকর্ডিং) স্টপ করো।
মহি: ঠিক আছে, ওই বিষয়টাই আর আলাপ করব না।
সিরাজ : না না, আলাপ করতে পারি। [৫৪]
(এ পর্যায়ে আমি রেকর্ডিং বন্ধ করলাম)।
.
১৯
জলিল-রব জেল থেকে ছাড়া পেলেন পঁচাত্তরের ৮ নভেম্বর। ৯ নভেম্বর তাঁরা ঢাকায় এলেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নায়েক সিদ্দিক ৭ নভেম্বরেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে গেট খুলে ভেতর থেকে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা এম এ আউয়াল এবং মোহাম্মদ শাহজাহানকে বের করে নিয়ে আসেন। ভেতরে জাসদের আরও অনেক কর্মী ছিলেন। আউয়াল আর শাহজাহান তাদের বললেন, ‘আপনারা অপেক্ষা করুন। আমরা বাইরের পরিস্থিতি দেখেশুনে পরে আপনাদের রিলিজ করার ব্যবস্থা করব।’ এ কাজটি তারা আর করেননি। অথচ তখন ওই পরিস্থিতিতে সবাই বেরিয়ে আসতে পারতেন। যাঁরা ভেতরে থেকে গেলেন, তারা বের হয়েছিলেন কয়েক বছর পর। [৫৫]
৭ নভেম্বর সকালেই জাসদের বিপ্লবের মৃত্যু হয়েছিল। জেনারেল জিয়া সেনানিবাসে তার অবস্থান সংহত করতে সক্ষম হন। তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। বিদ্রোহী সৈনিকেরা ধীরে ধীরে সবাই কাজে যোগ দেন। তাহেরের অনুগত বেশ কয়েকজন তখনো বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। তারা রয়ে গেলেন বাইরে।
১৩ নভেম্বর ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে তাহেরের বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) আবু ইউসুফের বাসায় একটি সভায় জিয়ার বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হয়। ১৫ নভেম্বর রায়েরবাজারে একটা কাঠের আড়তে তারা আবারও বৈঠক করেন। সিরাজুল আলম খান এ দুটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর অজান্তেই আরেকটি অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বৈঠকের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিপদ নেমে আসে।[৫৬]
নেতারা সবাই একে একে গ্রেপ্তার হতে থাকেন। জলিল, রব, ইনু, আবু ইউসুফ গ্রেপ্তার হন ২৩ নভেম্বর। ২৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল থেকে গ্রেপ্তার হন তাহের। ধরপাকড় চলতে থাকে। গ্রেপ্তারকৃতদের একজন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণবাহিনীর সাবেক কমান্ডার আবু আলম মো. শহীদ খান। আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে অনেক কথা বলেছে। এখানে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করলাম :
মহিউদ্দিন আহমদ : তুমি বলেছিলে, তুমি অ্যারেস্ট হয়েছিলে পঁচাত্তরের ডিসেম্বরে।
আবু আলম: ৯ ডিসেম্বর।
মহি : তুমি একটা অস্ত্রসহ ধরা পড়েছিলে। কী একটা রিভলবার ছিল।
আলম : মেজর আজিজ বা আজিম, এ রকম একটা নাম খোদাই করা ছিল। পারসোনাল রিভলবার, যেটা চলে এসেছিল, ৭ নভেম্বর সৈনিক সংস্থা যে অভ্যুত্থান করে, তাদের মাধ্যমে আমাদের ইউনিটে। রিভলবারটা আসলে আমার কাছে থাকত না। কোথাও থাকত। ওই দিন আমার কাছে ছিল।
মহি: এটা তোমাকে কে দিল? রফিক?
আলম : না। এটা মধুর ক্যানটিনে হ্যান্ডওভার করা হয়। আমাদের তো অনেক লোক। তার মধ্যে কেউ হয়তো এটা মধুর ক্যানটিনে নিয়ে এসেছিল। রফিক ভাই মধুর ক্যানটিনে ছিল এবং উনি জানে, আমরা কোথায় যাই, কী কাজ আমাদের। আমাদের কোনো বড় কাজ ছিল না। চিঠি বিলিটিলি করা, এ ধরনের কাজ ছিল। কোনো কারণে কেউ যদি আমাদের আটকে ফেলে, তাহলে ব্যত্তিগত নিরাপত্তার জন্য ওটা ব্যবহার করতে পারব, এ রকম চিন্তা।
মহি: আমি বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছি। ৭ নভেম্বর সারা দিন তো ক্যান্টনমেন্টে উত্তেজনা ছিল। রাতে গোলাগুলি হয়েছে। কিছু অফিসার মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে একজন ছিলেন মেজর আজিম। কিছু লোক ভেগে গেছে। কিছু আর্মস বাইরে চলে এসেছে।
আলম; ওই আর্মসের কিছু আমরা পেয়েছি। ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় সৈনিক সংস্থার অনেকেই এসেছিল। তারা কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিল। ওগুলো রেখে তারা আবার চলে গেছে। ওখান থেকেই আমাদের এখানে চলে আসে।
৬ নভেম্বর রাত থেকেই আমরা জানতাম, আজ ক্যান্টনমেন্টে কিছু একটা ঘটতে পারে। খায়ের এজাজ মাসুদসহ মুহসীন হলে আমরা সবাই রেডি ছিলাম যে আমরা জিরো আওয়ারে মিছিল বের করব। আমরা কিন্তু মিছিল বের করেছিলাম। সব হল থেকে মিছিল বের হয়েছিল। সকালে শহীদ মিনারে জিয়াউর রহমান এবং তাহের এসে বক্তব্য দেওয়ার কথা। শহীদ মিনারে আমরা মাইক-টাইক লাগিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সে সময় খন্দকার মোশতাকের সমর্থনে একটা মিছিল এসেছিল। মিছিল ঠিক না। কয়েকটা ট্রাক আর বেবিট্যাক্সি। সেখানে মোশতাকের ছবি আর নিচে বসে একজন চোঙা ফোকাচ্ছে। আমরা দেখলাম, আরে এই খন্দকার মোশতাক তো ব্লাডি খুনি, বঙ্গবন্ধুকে শুধু না, গণবাহিনীর অনেককেই সে মেরেছে তার ৮২ দিনের শাসনে। সুতরাং আমরা কী করলাম–এদের মিছিল করতে দেওয়া যাবে না। তখন ওই গাড়ির বহরে আমরা ইন্টারভিন করলাম। তারা সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। এর ১০ মিনিটের মাথায় আর্মির দুটো জিপ এসে শহীদ মিনারে নির্বিচার গুলি করল। আমাদের বেদম পেটাল, ৭ তারিখ সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত।
মহি : জিয়াউর রহমান জাসদের সঙ্গে আছে, সাপোর্ট দেবে, পার্টিতে এ ধারণা তো দিয়েছিল তাহের। তাই না?
আলম : এটা তো অবশ্যই তাহেরের কাছ থেকে এসেছে। আমি তো ওই লেভেলে ছিলাম না। কনফার্ম করতে পারব না।
মহি : জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল দুইজনের। আমার অনুসন্ধানে যেটুকু পেয়েছি। একটা ছিলেন তাহের, আরেকটা যোগাযোগ সিরাজ ভাইয়ের নিজের। ওটা ডিফারেন্ট চ্যানেলে। সিরাজ ভাইয়ের যোগাযোগটা আরও কয়েক দিন কন্টিনিউ করেছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে ১৯৮১ সালে সিরাজ ভাই জিয়ার সঙ্গে একবার দেখাও করেছেন। তার কিছুদিন পরেই জিয়া নিহত হন।
আলম : আমি সিরাজ ভাইয়েরটা জানি না, তাহের ভাইয়েরটা জানি।
মহি: ৭ নভেম্বর ভোরবেলা তাহের এবং ইনু যখন ক্যান্টনমেন্টে যান, জিয়ার তো প্রথম প্রশ্নই ছিল, ‘সিরাজুল আলম খান কোথায়? জিয়া তো সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে ডিসকাস করতে চেয়েছিল। সে জানে যে পার্টি তার। সমস্যা হলো, আমরা অনেক সময় আবেগ দিয়ে বিচার করি, আর সম্পর্ক দিয়ে। জাসদ প্রথম থেকেই একটা অবস্থান নিয়ে নিয়েছে যে জিয়া বিট্রেয়ার আর তাহের হিরো। ফলে জাসদ যেটাই বলবে, ওই কেমিস্ট্রিকেই ভিত্তি করে। তাই না? যেমন অবস্থানগত কারণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত আছে বলে আমরা ভারতে চলে গেছি। ফলে একটা সমীকরণ তৈরি হয়ে গেছে। এটা আমরা চেঞ্জ করতে পারব না। আমরা তখন থেকে দিল্লির চোখ দিয়ে অনেক কিছু দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। পুরো ক্যানভাসটা কিন্তু আমাদের সামনে নাই। এটা বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল। এবং তিনি এ বিষয়গুলো বুঝতেন। যেটা তাজউদ্দীনও বোঝেন নাই, আমরাও বুঝি নাই।
জিয়াকে তাহের ধারণা দিয়েছেন, আমার পেছনে বিশাল পার্টি আছে। আর তাহের জাসদকে ধারণা দিয়েছেন, আমার পেছনে জিয়া আর তার সেনাবাহিনী আছে। এটা প্লে করতে গিয়ে তাহের…
আলম : ওখানে আরও বিষয় থাকতে পারে। তাহের তো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের বিষয়গুলো কন্ট্রোল করার জন্য ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের কাউকে থাকতেই হবে। আপনি কাকে দায়িত্ব দিচ্ছেন? জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসার দায়িত্ব আপনি দিলেন নায়েক সিদ্দিক, হাবিলদার আবদুল হাই আর তার কয়েকজন লোককে!
মহি: নায়েক-হাবিলদারের কথায় জিয়া আসবে?
আলম : জিয়া হচ্ছেন একজন মেজর জেনারেল।
মহি: আর্মির চিফ।
আলম: একজন হাবিলদার তাঁকে উদ্ধার করে এলিফ্যান্ট রোডে নিয়ে আসবে। এটা তো হয় না? বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উচিত ছিল ক্যান্টনমেন্ট দখল করা। সেখানে তাহের বসে থাকবেন। পলিটিক্যাল লিডাররা যদি যেতে হয়, সেখানে যাবেন। প্রথম মিসটেক এটাই। আপনি একজন নায়েক বা হাবিলদারকে দায়িত্ব দিলেন জিয়াকে নিয়ে আসার জন্য। ততক্ষণে বিভিন্ন বাহিনীর বড় সাহেবরা জিয়ার কাছে চলে গেছে। জিয়া অন্য জায়গা থেকেও মেসেজ পাচ্ছেন। বন্দী অবস্থায় জিয়া কোনো মেসেজ পাচ্ছিলেন না। যেই তিনি মুক্ত হয়ে গেলেন, তার লোকজন অর্গানাইজড হয়ে গেল।
মহি : জিয়াকে সৈনিক সংস্থার লোকেরা মুক্ত করেছে, এটাও তো ঠিক না। ওরা যাওয়ার আগেই তিনি মুক্ত হয়ে গেছেন।
আলম : ওরা যাওয়ার আগে কারা মুক্ত করল?
মহি: সৈনিকেরাই করেছে, জেসিওরা করেছে, বাট দে আর নট পার্ট অব সৈনিক সংস্থা। সুবেদার মেজর আনিসুল হক আর মেজর মুহিউদ্দিন করেছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যত সিপাহি, এনসিও, জেসিও ছিল–এদের একটা বড় অংশ জিয়ার প্রতি সিমপ্যাথেটিক ছিল, তারা ইনভলভড হয়ে গিয়েছিল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে, জিয়ার পক্ষে। প্রত্যেকেরই তো আলাদা আলাদা স্বার্থ আছে। তারাই এটা করেছে এবং তারাই জিয়াকে নিয়ে এসেছে। সৈনিক সংস্থার ওরা যাওয়ার আগেই জিয়া সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে বসে গেছে, সারাউন্ডেড বাই অল অফিসার্স।
আলম : কথা সেটাই। আপনি যদি সেনাবিদ্রোহ ঘটান, তাহলে আপনাকে হেডকোয়ার্টার্সে থাকতে হবে। সেই রিস্ক নেওয়া উচিত ছিল, অথবা তাহের সাহেব ওই জুডিশিয়াস ডিসিশনটা নিতে পারেন নাই। সুতরাং পরে এসে আপনি তো জোর করে কিছু করাতে পারবেন না। ততক্ষণে জিয়া তো তাঁর ফরম্যাটের মধ্যে ঢুকে গেছেন।
মহি : ৭ নভেম্বর ফার্স্ট আওয়ারেই তো বিপ্লব শেষ। এরপর রাতে যে কিলিংগুলো হয়েছে, ওটা সুইসাইডাল হয়েছে। ওটা না হলে কিন্তু তাহেরের ফাঁসি হতো না। ১০-১২ জন অফিসার কিলড হয়েছে। এরা একেবারেই ইনোসেন্ট।
জেলে তোমার বন্ধুবান্ধব কে কে ছিল?
আলম : ঢাকা জেলে হেলাল ছিল সব সময়। বদিউল আলম ভাই ছিল। শাহজাহান খান, মোহাম্মদ শাহজাহান ছিল। আ স ম আবদুর রব একটু দূরে থাকত। জিকু ভাই ছিল, লতিফ মির্জা ছিল। আরও অগুনতি নেতা-কর্মী। জাসদের লোকে তো জেল তখন ঠাসা। জিকু ভাই সুন্দর আবৃত্তি করতেন।
মহি: উনি তো সিনেমার নায়ক ছিলেন। সিনেমা বানাতেন। আমি তার ছবি দেখেছি। সেখানে তিনি নায়ক। তখন তো তাঁকে চিনতাম না।
আলম : জেলখানায় আমাদের সবার তো ডিভিশন ছিল না। যাদের ডিভিশন ছিল, তাদের বাজার একসঙ্গে করে আমরা রান্না করে খেতাম। [৫৭]
.
২০
জাসদের যে জনভিত্তি ছিল, ১৫ আগস্টের পর সেটা দুর্বল হয়ে যায়। জাসদ তখনো কেন সরকারের বিরোধিতা করছে, এটা মানুষের বোধের মধ্যে ছিল না। মানুষ দেখছে, আওয়ামী লীগ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে, কিন্তু জাসদ আগের মতোই ‘বিপ্লব’ বলে স্লোগান দিচ্ছে। ৭ নভেম্বরের পরও গণবাহিনীর কাজকর্মে ভাটা পড়েনি। বিভিন্ন জেলায় যারা সক্রিয় ছিলেন, তাঁরা অনেকে ‘অ্যাকশনে’ গেছেন।
টাকাপয়সার টানাটানি। গণবাহিনীর আঞ্চলিক ইউনিটগুলোকে ঢাকা থেকে প্রায়ই চাপ দেওয়া হতো–টাকা পাঠাও। ঢাকার কাছেই কালীগঞ্জ। সেখানে গণবাহিনীর একটি দল আছে। কমান্ডার হলেন আলী হোসেন। ডেপুটি কমান্ডার এমদাদ। সবাই ডাকে ইমদু। ইমদু পাটি-অন্তঃপ্রাণ। কোনো উপায় না দেখে একবার সে রেলের ওয়াগন ভেঙে সরিষা লুট করল। সরিষা বেচে যে টাকা পাওয়া গেল, সেটা ঢাকায় গিয়ে দিয়ে এল কাজী আরেফ আহমদের হাতে। আরেফ তখন ঢাকার দায়িত্বে।
ইমদু পরে বদলে গিয়েছিল। আলী হোসেনের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। একবার তাকে ঢাকায় মধুর ক্যানটিনে ডেকে এনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। টের পেয়ে ইমদু পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গুলি করা হয়। ইমদুর পায়ে গুলি লেগেছিল। পরে সে এর শোধ নেয়, আলী হোসেনকে খুন করে। দলের যখন দুঃসময়, তখন আত্মরক্ষার জন্য সে বিএনপির সঙ্গে ভিড়ে যায়। বিএনপির বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। সরকারি দলের প্রশ্রয়ে সে হয়ে ওঠে ভয়ংকর সন্ত্রাসী। অনেক ডাকাতি খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তার পরিণাম হয়েছিল ভয়ংকর। বিএনপি সরকারের শেষ দিকে যুবমন্ত্রী আবুল কাসেমের বাসা থেকে সে গ্রেপ্তার হয়। বিচারে তার ফাঁসি হয়েছিল। রাজনীতি একজন তরুণকে কীভাবে বদলে দেয়, ইমদু তার একটি উদাহরণ।
ঢাকা নগর গণবাহিনীর ১২ নম্বর ইউনিট ছিল চকবাজারে। এর পলিটিক্যাল কমিসার ছিলেন খোরশেদ আলম, কমান্ডার আবু বকর সিদ্দিক–তাঁদের ওপর আদেশ এল টাকা জোগাড়ের। তাঁরা আটজনের একটা দল নিয়ে একটা অভিযানে বের হলেন। সঙ্গে দুটি মোটরবাইক আর দুটি বাইসাইকেল। তাঁরা ডাবল-রাইডিং করে গেলেন মগবাজারে এক চাকরিজীবীর বাড়িতে। ওই বাড়ির লোকজনের এক আত্মীয়ের মারফত গণবাহিনীর দলটি খবর পায়, সেখানে গেলে কিছু পাওয়া যাবে। যাহোক, তারা ওই বাড়িতে ঢুকে রীতিমতো লুটপাট করে। সেখানে পাওয়া গেল ৩৭ ভরি সোনা এবং ৭৫ হাজার টাকা। লুট করা টাকা এবং সোনা তুলে দেওয়া হলো নগর কমান্ডারের হাতে। তিনি এর বিলি-ব্যবস্থা করলেন। চকবাজার। ইউনিটটি কোনো কিছু পায়নি।
জাসদের তখন দুঃসময়। সংগঠন চালানো তো দূরের কথা, সংগঠক ও কর্মীরা বেঁচে থাকার সংস্থানও করতে পারছিলেন না। জনবিচ্ছিন্নতার কারণে চাঁদা সংগ্রহের সম্ভাবনা তলানিতে ঠেকে। অনেক জায়গা থেকে জবরদস্তি করে টাকা আদায় করা হতো। যেসব জেলা থেকে ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বেশি টকা পাঠানো হতো, ওই জেলার সংগঠনকে বেশি শক্তিশালী মনে করা হতো। এ সময় দুটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটে। একটি রাজশাহীতে, অন্যটি কক্সবাজারে। রাজশাহীর নিউমার্কেট শাখা পূবালী ব্যাংক থেকে দেড় লাখ টাকা ছিনিয়ে আনে গণবাহিনীর সদস্যরা। টাকা জমা দেওয়া হয় রাজশাহী জেলা গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিসার ডা. এম এ করিমের হাতে। তিনি তখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে কাজ করেন। থাকেন শহরের হেতিমখাঁ এলাকায় অবস্থিত মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ৩২ নম্বর কামরায়। এত টাকা দেখে তিনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েন। ভয়ে কাঁপতে থাকেন। শেষে টয়লেটের মধ্যে সব টাকা ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাশ করে দেন।
ছিয়াত্তরের অক্টোবর-নভেম্বরে গণবাহিনীর একটি দল কক্সবাজারের চকরিয়া থানায় রূপালী ব্যাংকের ঈদগাহ শাখায় আক্রমণ চালিয়ে পৌনে চার লাখ টাকা সংগ্রহ করে। চট্টগ্রাম জেলা গণবাহিনীর কমান্ডার মইন উদ্দীন খান বাদল ঢাকায় খবর পাঠান যে ৩০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। ঢাকায় সিওসির সমন্বয়কের দায়িত্বে তখন ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। বাদল তার হাতে ১০ হাজার টাকা জমা দেন। বাকি টাকার হিসাব পাওয়া যায়নি।
সশস্ত্র রাজনীতির নিজস্ব একটা ধর্ম আছে। এটা একবার শুরু হলে শিগগির তাতে ছেদ পড়ে না। ওই সময়ের একটি পর্যালোচনা করেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :
মাহমুদুর রহমান মান্না : ১৯৭৬ সালে যখন জেলে গেলাম, জেলের ভেতরে মেজর জিয়াউদ্দিনকে পেলাম। আরও পেলাম হাবিলদার আবদুল হাই, সার্জেন্ট রফিক–৭ নভেম্বরে অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত অনেককেই পেলাম।
মহিউদ্দিন আহমদ : কত তারিখে অ্যারেস্ট হলেন?
মান্না : ১৯৭৬ সালের ১৮ মার্চ। আমাদের যে ফারাক্কা মিছিল ছিল, তার আগে। জেলখানায় ওদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, ওরা বিপ্লবের ধারেকাছেও নাই। তারা মনে করে, সব অফিসার মাইরা ফেলতে হবে, শুধু কর্নেল তাহের থাকবে।’ এ রকম কথাবার্তা।
জেলে তখন ছিল বদিউল আলম। সে নিউ জেলে আসল। তার সঙ্গে শেয়ার করতে শুরু করলাম। তার সঙ্গে আমার মতের মিল পেলাম। আরেকজন ছিল–সুলতান। বুয়েটের। আমরা তো স্টাডি সার্কেল করতাম।
মহি : জেলের ভেতরে?
মান্না : হ্যাঁ। তখন তো কেউ মানা করত না। জেলের মধ্যে পরিবেশ অন্য রকম ছিল। ওইখানে সুলতান আমাকে বলেছে-মান্না ভাই, ভাবলে আমার তো এখনো গা ছমছম করে।
কেন?
বিশ্বাসবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ওটা টার্গেট ছিল হিট করার।
মহি : বিশ্বাসবাড়ি?
মান্না : মানিকগঞ্জের কোনো একটা থানায় একটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চতুর্দিকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গণবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোক, গায়ে আগুন, সে দৌড়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে। তাকে গুলি করা হয়েছে। সে পড়ে গেছে, মরে গেছে। কয়েকটা লোক আগুনে পুড়ে মারা গেছে। ওই বাড়ির মালিক, বিশ্বাস, তাকে গণদুষমন ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল। এটা বলতে গিয়ে সুলতান শিউরে উঠছিল।
মহি : মানিকগঞ্জের আনিসও আমাকে এ ধরনের একটা ঘটনার কথা বলেছিল। এক দোকানদারের কাছে ৫০০ টাকা চাঁদা চেয়েছিল। সে দেয়নি বলে ঠুস করে গুলি–তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
মান্না : আনিস তো ছিল কমান্ডার আর সুলতান ছিল বোধ হয় ডেপুটি কমান্ডার। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। আমাকে বলত–মান্না ভাই, আমার কী হবে। এটা কি কোনো দিন মাফ হবে?
মহি: গিল্টি ফিলিং?
মান্না : এ রকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে। এসব করে যে পারা যাচ্ছে, সরকারের কিছুই হচ্ছে না, তখন…
মহি : জাসদের যে অরিজিনাল স্ট্যান্ড, সেখান থেকে যে শিফট, সেখানে সিরাজ ভাই কি ইনস্ট্রমেন্টাল ছিলেন? নাকি তাহের ওয়াজ ইনস্ট্রমেন্টাল?
মান্না : ইনস্ট্রুমেন্টাল মানে কী? সিরাজ ভাই ওয়াজ দ্য মাস্টারমাইন্ড। উনিই করেছেন। কিন্তু হি ওয়াজ ইনফ্লুয়েন্সড বাই হাসানুল হক ইনু, আর একেবারে শেষের দিকে, তাহের ভাই। আমি এ ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার নই। [৫৮]
.
২১
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সফল হলো না। ২৬ নভেম্বর ঢাকার ধানমন্ডিতে ভারতীয় হাইকমিশনে হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করতে গিয়েছিল ছয়জন তরুণের একটি দল। এদের চারজন–বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে নিহত হয়। আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হয় বেলাল ও সবুজ। দলের জন্য এটা ছিল একটা বিরাট ধাক্কা।
খন্দকার মোশতাক আহমদ এক বেতার ভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরের বছর (১৯৭৬) ১৫ আগস্ট থেকে প্রকাশ্য রাজনীতির অনুমোদন দেওয়া হবে এবং ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম একই অঙ্গীকার করেন। এর কিছুদিন পর জাসদের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হন এবং অন্যরা আত্মগোপনে চলে যান। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে সামরিক আদালতে শুরু হয় গোপন বিচার। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে পারে, সে সম্পর্কে জাসদ নেতাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। সামনে যে ভয়ংকর দিনগুলো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তার আভাস তাদের চিন্তায় ছিল না বললেই চলে। ১৯৭৬ সালের পয়লা জুলাই প্রকাশিত হয় সাম্যবাদএর ষষ্ঠ ও শেষ সংখ্যা। এখানে জাসদ নেতৃত্বের তখনকার মূল্যায়নের একটি প্রতিফলন দেখা যায় :
ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী অঙ্গীকার করেছে যে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ উন্মুক্ত করে দেবে। সম্ভাব্য নির্বাচন ও অবাধ রাজনৈতিক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক জনগণের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের আশা, কল্পনা ও অনুমান কার্যকর রয়েছে। অনেকেই আশা করছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের একটি পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। নির্বাচন ও। রাজনীতি-সংক্রান্ত এরূপ চিন্তাচেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা ও
অনুমানের মধ্যে কোনো ভ্রান্তি থাকলেও জনগণ তা পুরোপুরি। উপলব্ধি করতে পারবে ১৫ আগস্ট (১৯৭৬) তারিখে বা তার। কাছাকাছি সময়ে। সুতরাং এমতাবস্থায় রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে গায়ে পড়ে কোনোরূপ শক্তি পরীক্ষায় যাওয়া আমাদের উচিত হবে না; উচিত হবে না এমন কোনো কর্যক্রম গ্রহণ করা যাতে শত্রুরা অপপ্রচারের সুযোগ পায় এবং সে অপপ্রচারের দরুন জনগণেরও মনে হতে পারে যে জাসদ বুঝি সত্যি সত্যিই ঐক্যবিরোধী এবং জাসদই বুঝি গণতন্ত্র, নির্বাচন ও শান্তির অন্তরায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে
যে আমাদের আজকের প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে জনগণের মধ্যে থেকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র সম্পর্কিত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রধানত নিঃশেষ করে আনা। এমতাবস্থায় আমাদের কার্যক্রম হবে নিম্নরূপ :
১. সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য যেহেতু একটি তাত্ত্বিক ও বাস্তব অপরিহার্যতা, সেহেতু এরূপ ঐক্যের জন্য সকল পর্যায়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া…
২. সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা ও বাকশালীদের চক্রান্ত সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার অভিযান চালিয়ে এদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা…
৩. বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে নেতাদের শাস্তিদানের জঘন্যতম চক্রান্তের ব্যাপারটিকে সামনে নিয়ে আসা;…এই বিচারের প্রহসন যে জাতীয় ঐক্যকে ব্যাহত করবে, গণতন্ত্রকে মিথ্যা প্রমাণ করবে এবং সর্বোপরি বিদেশি চক্রান্ত, বিশেষত ভারতীয় হামলা ও ভারতীয় চরদের গোলযোগের পথকেই সুগম করে দেবে–এ ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করে তোলা; এবং এরূপ ভয়াবহ চক্রান্তের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা…
৪. সকল অংশের জনগণের সঙ্গে ব্যাপক সংযোগ গড়ে তোলা…
৫. গণসংগঠনসমূহ কার্যকররূপে পুনর্গঠিত করা…
আন্দোলনের স্লোগানসমূহ : স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা; ভারতীয় হামলা ও ভারতীয় চরদের চক্রান্ত প্রতিহত করা; ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করা; নেতাদের বিচারের নামে প্রহসন বন্ধ করা…। [৫৯]
ওই সময় সামরিক সরকার আওয়ামী-বাকশাল ও ভারতবিরোধী জিগির তুলে একধরনের উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা করছিল। জনমত ছিল আওয়ামী লীগ এবং ভারতবিরোধী। সামরিক শাসকদের সুরে সুর মিলিয়ে জাসদও একই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছিল। সামরিক ট্রাইব্যুনালে জাসদ নেতাদের বিচারের বিষয়টি গৌণভাবে দেখা হচ্ছিল।
১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ডাইরেক্টরের বাসায় জাসদ-গণবাহিনীর নেতারা আবার বৈঠকে বসলেন। প্রস্তাব এল, রণকৌশল বদলাতে হবে। সব জায়গা থেকে খারাপ খবর আসছে। রাজশাহীতে গণবাহিনীর ১১ জনকে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলেছে। ‘যেহেতু জনবিচ্ছিন্নতা এসে গেছে, অতএব সশস্ত্র সংগ্রাম স্থগিত রাখতে হবে।’ খায়ের এজাজ মাসুদ এই প্রস্তাবের প্রচণ্ড বিরোধিতা করে বললেন, ‘যারা বিপ্লবকে ভয় পায়, তারাই এ ধরনের কথা বলে।’ [৬০]
১৭ জুলাই বিশেষ সামরিক আদালতের রায়ে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশ হলো। মেজর জলিল ও সার্জেন্ট আবু ইউসুফ পেলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২১ জুলাই তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় নেতারা অক্টোবরের ২৪ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত সিওসির এক সভায় বিপ্লবী পার্টি গড়ার প্রক্রিয়া থামিয়ে দেন। সিদ্ধান্ত হয়, গণসংগঠনগুলোকে আবারও সক্রিয় করতে হবে। দলের সমস্ত দায়িত্ব ‘এক ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করে পার্টি বিলোপ করা হয়। ওই ব্যক্তি হলেন সিরাজুল আলম খান।
.
২২
পঁচাত্তরের ২৬ নভেম্বরের পর সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটে। নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। এ প্রসঙ্গে মুবিনুল হায়দারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়। আমাদের কথাবার্তা ছিল এ রকম :
মহিউদ্দিন আহমদ : আপনাদের মধ্যকার বিরোধের মূল কারণ কী?
মুবিনুল হায়দার চৌধুরী : কিছুদিন আগে ৭ নভেম্বর স্মরণে একটা অনুষ্ঠানে বলেছি, বিপ্লব হলো জনগণের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের ফলে সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থান। আর এরা কিছু গোলাগুলি করে মিলিটারিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিল। এটা কোনো বিপ্লবের ধারণাই না। সিরাজুল আলম খানকে আমি এটা বলেছি। ওনার সঙ্গে আমি ব্রেক করলাম কবে? আমি বলেছিলাম, আপনি যে থিসিস সঠিক মনে করেছিলেন, সেই থিসিসে বিপ্লব সম্পর্কে যে ধারণা, তাকেই আপনি ডিফাই করলেন। ভায়োলেট করলেন। সম্পূর্ণ ভুল রাজনীতির দিকে চলে গেছেন। এটাই আপনার প্রবণতা। ১৭ মার্চ (১৯৭৪) যে ঘটনা ঘটালেন, সেটাও আপনার একটা ভুল। এটা যদি একটা মাস মুভমেন্ট হয়, তাহলে লাখো জনতা নিয়ে ঘেরাও করতে হতো। আপনি জাসদের কিছু লোক নিয়ে ঘেরাও করলেন। মাঝখানে ৫০টা লোক মরে গেল। একদম ভুল রাজনীতি। এসব পর্যালোচনা করা, ভুল হলো কি না খতিয়ে দেখা, ওনার মধ্যে এসব একদমই ছিল না।
মহি: ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে যে ইন্টারভেনশন হলো, এর আগে যে ডিসিশনটা হলো, এখানে আপনি যুক্ত ছিলেন না?
হায়দার : না। কিছু জানতাম না।
মহি : এই যে বিপ্লবী পার্টি গড়ার একটা প্রক্রিয়া চালু ছিল, আপনি তো এর মধ্যে যুক্ত ছিলেন?
হায়দার : আমি কোনো দিন জাসদ করিনি। তবে ওইটার মধ্যে ছিলাম।
মহি: আমি তো জানতাম আপনি থিওরেটিশিয়ান।
হায়দার : আলোচনা করেছি, কথা বলেছি।
মহি : ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে শুনলাম যে এই প্রসেসটা ডিজলভ করে দেওয়া হলো। ওই মিটিংয়ে আপনি ছিলেন?
হায়দার : ডিজলভ করার প্রক্রিয়া কি আমি সমর্থন করতে পারি?
মহি: আপনার সঙ্গে ওনার রাজনৈতিক সম্পর্ক ছেদ হলো কখন?
হায়দার : ওই যে, ছেলেগুলি যখন মারা গেল।
মহি : ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫।
হায়দার : আমি বললাম যে আর কোনো দিন এরা ঠিক পথে চলতে পারবে না। এটা ভুল পথ।
মহি : ইন্ডিয়ান হাইকমিশন রেইডের সিদ্ধান্তটা এল কোথা থেকে? হায়দার : ওরা নিজেরা নিজেরা করেছে। বিধানকৃষ্ণ সেন তখন জাসদের অস্থায়ী দায়িত্বে। আবদুল্লাহ সরকার আর বিধান সেন তখন। হাটখোলায় একটা বাড়িতে থাকে। সেখানে আমি মাঝেমধ্যে দেখা করতে যেতাম। ওই দিনও গেছি। হঠাৎ টেলিফোন। শরীফ নুরুল আম্বিয়া আসছে। আমি ছাড়া আর কেউ বের হতে পারছে না। ওরা তো পরিচিত। আমি বেরিয়ে এসে আম্বিয়াকে ঘরে নিয়ে আসলাম। ঘরে ঢোকার পথেই আম্বিয়া বলল, আমরা সমর সেনকে হাইজ্যাক করছি।
কী হাইজ্যাক করছেন?
তাকে এখান থেকে হাইজ্যাক করে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে।
সমর সেনকে আপনি কেমন করে হাইজ্যাক করবেন?
আমাদের লোক ওখানে ঢুকেছে। তারপর হেলিকপ্টার আসবে। এসে নিয়ে যাবে।
ঘরে ঢুকেই আমি কিছু বলিনি। বললাম, রেডিও খোলেন। রেডিওতে শোনা যাচ্ছে, দুষ্কৃতকারীরা এই এই কাজ করেছিল, তাদের অমুক অমুক মারা গেছে। আম্বিয়াকে বললাম, এই বিপ্লব করছেন তো? আমি আর আপনাদের সঙ্গে নেই।
মহি : আম্বিয়ার রিঅ্যাকশন কী?
হায়দার : কী রিঅ্যাকশন? এক কোনায় বসে আছে। কোনো জবাব দিতে পারে? কী বলবে?
মহি : উনি আমাকে অন্য রকম স্টোরি বলেছেন। উনি বলেছেন, উনি এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।
হায়দার : কনস্পিরেসি…এই কাণ্ডটা যে করবে, এটা সে না-ও জানতে পারে, যদি তার কথা সত্য বলে ধরে নিই। কিন্তু সে এসে আমাকে যে রিপোর্ট করল, এটা তো সত্য।
মহি : আম্বিয়া আপনাকে বলেছেন, সমর সেনকে হাইজ্যাক করে বগুড়ায় নিয়ে যাবে। তার মানে হাইজ্যাকিংয়ের একটা প্ল্যান আছে। হোস্টেজ করে বগুড়ায় নিয়ে গিয়ে হয়তো কিছু দাবিদাওয়া আদায় করবে। এ বিষয়টা তিনি জানেন। এটা তো তাহলে তার কাছে গোপন না?
হায়দার : হয়তো যারা পরিকল্পনা তৈরি করেছে, তিনি তার মধ্যে ছিলেন না।
মহি: সে হয়তো প্ল্যানারদের কেউ না। কিন্তু তার নলেজের বাইরে না। জাসদের ওপর বই লেখার সময় আমি তাঁর ইন্টারভিউ করেছি। উনি বলেছেন, উনি কিছু জানেন না। আনোয়ার হোসেন এটা প্ল্যান করেছে। পরে আম্বিয়ারা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আনোয়ারকে ফায়ারিং স্কোয়াড়ে দেবেন। পরে আনোয়ারকে ঢাকা সিটি গণবাহিনীর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এরপর সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি?
হায়দার : আমি চট্টগ্রাম চলে গেলাম। উনি বারবার খবর দিচ্ছেন, হায়দার ভাই যেন আসেন। তারপর ঢাকায় এলাম। দেখা হলো। আমি জানিয়ে দিলাম, আমি আপনার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখব না। কারণ, আপনি বিপ্লবী রাজনীতির যে প্রতিশ্রুতি, যা কিছু যুক্তিসংগত, তার সবকিছু ভায়োলেট করেছেন। আপনি কয়েকটা বাচ্চা ছেলেকে হাইজ্যাকার বানিয়েছেন। তারা মারা গেল। উনি। আমার হাত ধরে বললেন, আমার কি কষ্ট হচ্ছে না? আমি তাদের কত ভালোবাসতাম?
ভালোবাসার ছেলেদের এভাবে পাঠায় কেউ? ওদের কি বিপ্লবী কাজকর্ম করার মতো বয়স হয়েছে? ম্যাচিউর কাউকে তো আপনি পাঠালেন না? আপনি জঘন্য ধরনের ভুল রাজনীতি করেছেন। আপনি এতগুলো লোককে বিভ্রান্ত করেছেন। আপনার সব ভুলের কনফেশন হওয়া দরকার। আপনি তো কোনো জায়গায় থাকতে পারেন না। এ রকম ভুলভ্রান্তি করা লোক কি শীর্ষ স্থানে বসে থাকতে পারে?
মহি : উনি এসব অভিযোগের কী জবাব দিলেন?
হায়দার : উনি আর কী বলবেন। কাতর হয়ে আছেন। কাতর!
তারপর আমি এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম–মাহবব মান্না। বাদল, মুস্তাফিজ, একরাম। বদিউল তো তখন জেলে। এদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে করতে তারা একটা সার্কেল হিসেবে গড়ে উঠল। এটাই পরে বাসদ হলো।
ডাকসু ইলেকশন করার পরে (১৯৭৩) অত তাড়াতাড়ি পার্টি তৈরি করার প্রয়োজন ছিল না। আরও অনেক ভাঙা-গড়া, সাংস্কৃতিক লড়াই, তাত্ত্বিক লড়াই করার মধ্য দিয়ে পার্টি গড়ার প্রশ্ন আসে। এদের ওস্তাদেরা যে রাজনীতি শিখিয়েছিল, তা ভোলাতে আরও ১০ বছর লাগবে বলে আমি মনে করতাম। ভুলিয়ে আবার নতুন করে গড়ে তোলা। ব্রেনওয়াশ বলে একটা কথা আছে না? এদের ব্রেনওয়াশ হওয়া দরকার ছিল। এরা সঠিক চিন্তাভাবনা দ্বারা কখনো পরিচালিত হয়নি। সব ইনডিভিজুয়ালিস্টিক ওয়ে অব থিংকিং দ্বারা পরিচালিত। কোনো কালেকটিভনেস ডেভেলপ করেনি। কোনো লক্ষ্য তৈরি করতে পারেনি। শুধু কথার ফুলঝুরি।
মহি: ১৯৭৬ সালের পর সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি?
হায়দার : হয়েছে। ১৯৮০ সালে যখন আমরা পার্টি করি (বাসদ), তার দুই দিন আগে দেখা হয়েছে। বলেছি, আপনাদের সাথে মতের মিল না হওয়ায় আমরা আলাদা পার্টি করছি। বললেন, আপনি বাসায় আসবেন। মা আপনাকে খুব ভালোবাসে। আমি যেতাম না। রাস্তায় হঠাৎ একদিন দেখা। কলাবাগানের ওখানে। হাত ধরে বললেন, একদম যোগাযোগ রাখেন না? এই আরকি। কারও সঙ্গে আমার বিরোধ নেই। আমরা শুধু একমত নই। আর আমি কখনো মিথ্যা কথা বলি না।[৬১]
.
২৩
দলের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হলেও সিরাজুল আলম খান তখনো ঢাকায়, আত্মগোপনে। আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের অভিজ্ঞতা তার কম নয়। আজ এক শেল্টারে থাকেন, তো কাল অন্য একটায়। তার ভক্তরা এসব শেল্টার জোগাড় করে দেয়। কারও সঙ্গে যোগাযোগ না হলে বিপদে পড়ে যান তিনি। পলাতক জীবনের একটি ছবি ফুটে উঠেছে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারে। আশ্রয়ের খোঁজে মাঝরাতে তিনি গিয়েছিলেন তাঁর পূর্বপরিচিত ইকবাল আনসারি খানের বাসায়। আনসারির ডাকনাম হেনরি। ওই নামেই তাকে পরিচিতজনেরা চিনতেন। শোনা যাক সিরাজুল আলম খানের কথা :
আমি হেনরি ভাইয়ের বাসায় গেলাম। নক করলাম। বাবুর্চি-কাম কাজের ছেলে দরজা খুলে বলল, দাঁড়ান, স্যারকে বলি। কতক্ষণ পর সে ১০ টাকা নিয়ে এসে–স্যার বলেছে, এই টাকাটা রাখতে, আজকে অন্য জায়গায় থাকতে।
মহি : কখন?
সিরাজ : জিয়াউর রহমানের কারফিউয়ের সময়, রাত ১২টায়।
মহি : ওই সময়?
সিরাজ : আমাদের সালাম আছে না? ওর বউ বানু। ও ছিল আমার কুরিয়ার। ১২টা বেজে গেছে। কোথায় যাব? শ্রমিকদের কোর্ট থাকে না?
মহি : লেবার কোর্ট?
সিরাজ : হ্যাঁ। এখানে একজন লোক আছে। তার সঙ্গে বানু। যোগাযোগ করেছে। বলল, আপনি তো ওনাকে চেনেন?
বললাম, তুমি চলে যাও। আমার সঙ্গে থাকা লাগবে না। তোমার দেরি হয়ে যাবে। ওই লোক কাছে-কিনারেই থাকে।
সে দরজা খুলে বলে, ভাই, আমার ওয়াইফকে আমি বোঝাতে পারিনি। রাত তো ১২টা বেজে গেছে।
তর্ক তো আর করা যায় না। বের হয়ে একটা স্কুটার পেলাম। কিন্তু থাকব কোথায়? তখন আমার মা-ভাইরা থাকে ইস্কাটনে। ভাবলাম, ওখানেই থাকব। পরদিন জায়গা চেঞ্জ করব। বাংলামোটর ক্রস করার সময় পুলিশ থামাল। আমি ডানে বসা, বাঁয়ে বানু।
কে উনি?
বানু বলল, হুজুর।
ও, আচ্ছা।
গেলাম বাসায়। গিয়ে দেখি বাসা তালাবদ্ধ। সবাই দেশের বাড়ি গেছে। এটা ঈদের আগে। কীভাবে ঢুকব এখন? যে ছেলেকে রেখে গেছে, সে তো খাবারদাবারসহ ঘরের মধ্যে। ৮-১০ দিন থাকবে, বের হবে না, এ রকম একটা হিসাব-নিকাশ করে দিয়ে গেছে। দুই তিন ঘণ্টা ওই অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। গ্রামে, বগুড়া এবং ঢাকার রূপগঞ্জ এলাকায় তো আমি বেশির ভাগ সময় থাকতাম। [৬২]
জাসদ নেতাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মোহমুক্তি ঘটেছে। অনেকেই বিরক্ত, অনেকেই ক্ষিপ্ত। মাঝেমধ্যে সিরাজুল আলম খানের শেল্টার জোগাড় করে দিতেন রেজাউল হক মুশতাক।[৬৩] এমনই এক শেল্টার হলো মোহাম্মদপুরে হুমায়ুন রোডের এক বাসায়। সেখানে থাকেন খোদা বখশ চৌধুরী, আনসার আহমদ ও ডা. সালাম। খোদা বখশ ও আনসার সূর্য সেন হলে থাকতেন। ছাত্রলীগের। এখন চাকরি করেন। সিরাজুল আলম খান সেখানে কয়েক দিন গেছেন। তার সঙ্গে থাকতেন। রীনা, তাঁর কুরিয়ার। তারা সকালের দিকে আসতেন। সন্ধ্যার পর আবার চলে যেতেন অন্য কোথাও। একদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার একটু আগে খোদা বখশ, আনসার ও সালাম বাইরে বেরোলেন চা-নাশতা খেতে। বাসায় তখন সিরাজুল আলম খান ও রীনা। ঘণ্টা দুয়েক পর তাঁরা বাসায় ফিরে শুনলেন, পুলিশের লোক তাদের দুজনকে ধরে নিয়ে গেছে। দিনটা ছিল ২৬ নভেম্বর ১৯৭৬।[৬৪]
সিরাজুল আলম খানের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে জাসদের একটি পর্ব শেষ হলো।
.
তথ্যসূত্র
১. গণকণ্ঠ, ১০ মার্চ ১৯৭৩
২. আবু করিম
৩. মুবিনুল হায়দার চৌধুরী
৪. সিরাজুল আলম খান
৫. গণকণ্ঠ, ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৩
৬. এম এ করিম
৭. শরীফ নুরুল আম্বিয়া
৮. সিরাজুল আলম খান
৯. মাহমুদুর রহমান মান্না
১০. ‘আমি আগুন-সন্ত্রাসীদের মাইনাসের পক্ষে : হাসানুল হক ইনু’, বিশেষ সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ৮ জুলাই ২০১৮
১১. বাংলার বাণী, ১ এপ্রিল ১৯৭৪
১২. মাহমুদুর রহমান মান্না
১৩. শরীফ নুরুল আম্বিয়া
১৪. রহমান, আখলাকুর (১৯৭৪), বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ, সমীক্ষণ পুস্তিকা, ঢাকা; সমীক্ষণ, প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, আশ্বিন-কার্তিক ১৩৮১, পৃ. ৬৮-৬০
১৫. ঘোষ, শিবদাস (১৯৮৯), কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এসইউসিআই একমাত্র সাম্যবাদী দল, এসইউসিআই, কলকাতা, পৃ. ৪২-৪৪
১৬. ওই
১৭. মুবিনুল হায়দার চৌধুরী
১৮. খসড়া থিসিস (পরিমার্জিত), ২৭ জুন ১৯৭৪ প্রণীত খসড়া থিসিসের মুখবন্ধ।
১৯. ওই, পৃ. ২৮
২০. ওই, পৃ. ৪৫-৪৬
২১. সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রকে রুখে দাঁড়ান: জঙ্গি জনতার ঐক্য গড়ে তুলুন, জাসদ-ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগ-কৃষক লীগ বিপ্লবী গণবাহিনী, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭৫, পৃ. ১২-১৩
২২. সমীক্ষণ, জাসদের রাজনীতি : তিন নেতার সাক্ষাৎকার’, সুমন মাহমুদ ও জহিরুল আহসান, বর্ষ ১, সংখ্যা ১৪, ৩১ অক্টোবর ১৯৯১
২৩. খায়ের এজাজ মাসুদ।
২৪. প্রথম আলো, ৮ জুলাই ২০১৮
২৫. সিরাজুল আলম খান।
২৬. সাম্যবাদ-চার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, পৃ. ১০-১৯
২৭. আবু আলম মো. শহীদ খান
২৮. সাম্যবাদ-দুই, পৃ. ১১-১২
২৯. ওই, পৃ. ৮
৩০. সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ৫৮-৬০
৩১. সাম্যবাদ-তিন, পৃ. ৬-৭, ১৭-১৯
৩২. মনিরুল হক চৌধুরী
৩৩. সেন, পৃ. ৫৮০-৫৮১
৩৪. দৈনিক বাংলা, ১১ জুন ১৯৭৩
৩৫. সিরাজুল আলম খান।
৩৬. শরীফ নুরুল আম্বিয়া
৩৭. মোস্তফা মোহসীন মন্টু।
৩৮. মন্টুকাহিনী’, মোফাজ্জল করিম, প্রথম আলো, ১ এপ্রিল ২০০৫
৩৯. সিরাজুল আলম খান।
৪০. মুবিনুল হায়দার চৌধুরী
৪১. বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিপ্লবের পর্যায় (খসড়া থিসিসের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা), সম্পাদনা : রায়হান আলম, ২৬ অক্টোবর ১৯৭৫; খসড়া থিসিস (পরিমার্জিত), পৃ. ৩৩
৪২. মোস্তাফা জব্বার
৪৩. মনিরুল ইসলাম
৪৪. বিস্তৃত নিয়তি : কে বি এম মাহমুদ, আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার’, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসাদুজ্জামান, সাপ্তাহিক, ঈদসংখ্যা ২০১৫
৪৫. ওই
৪৬. ওই
৪৭. ওই
৪৮. Dalim, Shariful Haq (2015), Bangladesh: Untold Facts, Jumhoori Publications, Lahore, p.440-441
৪৯. বিচিত্রা, ৮ বর্ষ, ৪৬ সংখ্যা, ১৮ এপ্রিল ১৯৮০
৫০. বিস্তৃত নিয়তি : কে বি এম মাহমুদ
৫১. সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রকে রুখে দাঁড়ান : জঙ্গি জনতার ঐক্য গড়ে তুলুন, পৃ. ১৪-১৬
৫২. মাহমুদুর রহমান মান্না
৫৩. শরীফ নুরুল আম্বিয়া
৫৪. সিরাজুল আলম খান
৫৫. সুমন মাহমুদ।
৫৬. শরীফ নুরুল আম্বিয়া
৫৭. আবু আলম মো. শহীদ খান
৫৮. মাহমুদুর রহমান মান্না
৫৯. সাম্যবাদ-ছয়, পৃ. ২২-২৪
৬০. খায়ের এজাজ মাসুদ
৬১. মুবিনুল হায়দার চৌধুরী
৬২. সিরাজুল আলম খান
৬৩. রেজাউল হক মুশতাক
৬৪. খোদা বখশ চৌধুরী