বাড়ি এল সে। এসে দেখল, রাজীব কথা বলছে সুকুমারীর সঙ্গে। আজকাল সে রোজ সন্ধ্যাবেলা এখানে আসে। তিলি আর ষোড়শী রাঁধছে।
মেঘনাদ এসে হেসে দাঁড়াল। তাকে দেখে চমকে উঠল তিলি। বললে, একী, কালিঝুলি মেখে এলে কোত্থেকে?
মেঘনাদ বললে, কারখানা থেকে গো ! যা ছিলাম, এদ্দিনবাদে আবার সেই বেশেই এলাম। খারাপ লাগছে নাকি দেখতে?
তিলি ঠোঁট উলটে বলল, বিচ্ছিরি !
বলে হেসে উঠল। মেঘনাদ বলল, তোমার দিদি কোথায়।
: ভাড়াটেদের ঘরে। ষোড়শীকে বলল, ডেকে দে তো বউদি।
ষোড়শী ডেকে নিয়ে এল লীলাকে। মেঘনাদ বলল, ঝুমি, তোমার নামে বেকারির নাম দিলাম, লীলা বেকারি।
লীলা দৃপ্ত চকিত ভঙ্গিতে ফিরে বলল, কেন?
লীলার কি রূপ আরও বেড়েছে? যেন বেড়েছে। তীব্র দীপ্তি তার কৃশ তনু অঙ্গে।
মেঘনাদ হেসে বলল, তুমি মহাজন-গিন্নি, সেই জন্য।
বিদ্রুপে ফেটে পড়ল লীলা। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ অথচ অশ্লীল মুখভঙ্গি করে বলে উঠল, সত্যি নাকি? যা করছ, তা-ই করো, আবার গিন্নিকে নিয়ে টানাটানি কেন?
তিলির ভ্রূ জোড়া কুঁচকে উঠল। মেঘনাদ হাসতে পারছে না। কিন্তু রাগ করলে না। বলল, বিনয়বাবু বলছিলেন লীলা বেকারি নাম দিতে।
অসহ্য রোষে ফুঁসে উঠল লীলা, তোমার বিনয়বাবু যা খুশি তা-ই বলতে পারে। তাতেই কি সব হবে?
অকস্মাৎ জ্বলন্ত উনুন থেকে ঠকাস করে কড়াটা নামিয়ে রেখে তীব্র স্বরে বলে উঠল তিলি, তাই তো হয় বলে জানি। নিজে কি তা জানিসনে?
বলে বাতাসের আগে বেরিয়ে গেল তিলি। চমকে উঠল ষোড়শী। ছুটে এল সুকুমারী।
লীলার চোখে মুখে গায়ে গলে পড়ছে তরল আগুন। চোখের আগুনে ঝলসে দিতে চাইছে মেঘনাদকে। তীব্র অস্ফুট গলায় খালি বলল, শয়তানের রাজত্ব, পুড়ে যাক, ছাই হয়ে যাক। বলে ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ঘরের।
ভাড়াটে মেয়ে পুরুষেরা উঁকি মারছে। সুকুমারী, ষোড়শী ভীত চোখে তাকিয়ে আছে মেঘনাদের দিকে।
ধোঁয়া কালিমাখা একটি বিশাল শরীর। সারা শরীরে ও মুখে একটা অমানুষিক অভিব্যক্তি। গাল দুটো কুঁচকে ঢেকে গেছে বড় বড় চোখ দুটি। তার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে। এক ধাক্কায় ধ্বসিয়ে দেবে সমস্ত বাড়িটা। তারপর সুকুমারীর দিকে চেয়ে অদ্ভুত নিচু মোটা গলায়। বলল, পাপ মা, সব পাপ।
বলে বাইরের ঘর দিয়ে বেরিয়ে গেল একেবারে রাস্তায়। রাজীবকেও লক্ষ করল না দরজার কাছে।
সুকুমারী শান্তভাবে অথচ কাঁপতে কাঁপতে রান্না নিয়ে বসল।
তিলি বসে পড়েছে গিয়ে পিপুলের আড়ালে অন্ধকারে। কিছুতেই নিজেকে রোধ করতে পারছে সে। পিপুলের বুকে মুখ চেপে ফুলে ফুলে উঠছে নিঃশব্দ কান্নায়।
রাজীব এসে দাঁড়াল সেখানে। কাউকে দেখা যায় না এখান থেকে। রাজীব অসঙ্কোচে তিলির পিঠে একটি হাত রেখে ডাকল, ঠুমি
তিলি ফিরল না, কান্নাও থামল না। তেমনি কাঁদতে লাগল। কিন্তু রাজীবের রক্তে দোলা লাগল। পিঠ থেকে সে ঘাড়ে হাত দিল তিলির। কাছে বসে আকর্ষণ করল। ডাকল আবার, তুমি !
ঠুমি নড়ল না। কিন্তু থিতিয়ে এল যেন কান্নার বেগ। সান্ত্বনা দিতে এসে রক্তে তোলপাড় লেগে গেল রাজীবের। সে ঝুঁকে পড়ে ঠোঁট ছোঁয়াল তিলির ঘাড়ে। তিলি চমকাল না, কাঁপল না। ছেলেমানুষদের ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত মেয়েমানুষের মতো বলে উঠল, আঃ, এরকম করছেন কেন আপনি।
রাজীবের বুকের আগুন হঠাৎ নিবু নিবু হয়ে এল তিলির গলা শুনে। যেন এর চেয়ে তিলি ভয় পেলে, সম্মানের ভয়ে রেগে উঠে পালালে ভাল হত, আশা থাকত। বলল, তুমি, তুমি কাঁদছ—
তিলি বলল, আমি কাঁদছি তো কী হয়েছে। আপনার কি ইউনিয়ন-টিউনিয়ন সব উঠে গেছে। আর কোনও কাজ নেই?
রাজীবের হাত শিথিল হয়ে এল। রাগ নয় অনুরাগ নয়, শাসন। আশ্চর্য ! রাজীব মনে জোর পায় না একটুও। বলল, সে কথা তোমাকে বলতে চাই তুমি। বিনয় চৌধুরী আমার সর্বনাশ করেছে।
ওই একই নাম সর্বত্র। তিলি বলল, সর্বনাশ করেছে, আমাকে বলে কী হবে। গিয়ে শোধ নিন। এখানে বসে থাকলে কী হবে।
: শোধ নেব ঠুমি, দারুণ শোধ নেব।
: তাই নিনগে। সংসারের জ্বালায় আপনার জন্য কাঁদতেও পারব না?
কোথায় রাজীবের সেই চিল চোখ। করুণ গলায় বলল, কিন্তু তুমি, তোমার কাছে আমি অনেক কিছু চাই।
অদ্ভুত মিষ্টি সুর, তবু যেন নির্বিকার গলায় বলল তিলি, চান, নিয়ে যাবেন। এখন যান।
সে ঘরে চলে গেল আবার। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রাজীবের বুকটা শুধু ভরে উঠল।
তবু শূন্য বুকটার মধ্যে হাহাকার উঠতে লাগল।
চালিস খেয়ে এসে বলল, কত্তা, আপনাকে খেতে ডেকেছে। সকলের খাওয়া হয়ে গেছে।
মেঘনাদ কোনও জবাব দিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল তন্দুরের হাঁ মুখের দিকে। সত্যি যেন একটা বিকটাকার দানব লাল মুখগহ্বর খুলে হাঁ করে রয়েছে। আগুনের শিখা আর নেই। সব জ্বলন্ত অঙ্গার। মেঘনাদের বুকটাও অমনি লাল। সেখানেও তন্দুর জ্বলছে। আজ প্রথম, নতুন। রকমভাবে মনে হচ্ছে, লীলা তার জীবনের একটা দিক ভেঙে দিয়েছে।
ফিরে এল সে বাড়িতে। রাত হয়েছে বেশ। ঘুমন্ত সুপ্ত পাড়া। পিপুলের ছায়ায় এসে দাঁড়াতেই, অন্ধকার ছুঁড়ে তিলি বেরিয়ে এল। বলল, এত রাত করলে?
মেঘনাদ বলল, ইচ্ছে করে করিনি। তোমাদের বাড়িতে গণ্ডগোল দেখে পালিয়ে গেলাম।
রাজীবের সামনে সেই তিলি মেয়েটি নয় এখন সে। বলল, বোনাই, আমি আর এখানে থাকতে পারছিনে
: কোথায় যাবে তুমি ঠাকরুন !
ওই স্নেহের নামটা শুনলেই বুকের মধ্যে বাষ্প জমে উঠে তিলির। বলল, তোমার কাছে একদিন একটা কথা বলব বলেছিলাম।
: আজ বলবে সে কথা?
: হ্যাঁ। একটু থেমে বলল, বোনাই, বাবা, মা, সোনাদা ওরা বড় গরিব। তুমি আমাকে একটা বিয়ে দিয়ে দেও।
মেঘনাদ কয়েক মুহূর্ত বিমূঢ় হয়ে রইল। গলায় শব্দ আসছে না। থেমে থেমে বলল, আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাও তুমি ঠাকরুন।
তিলির কণ্ঠরুদ্ধ। তবু ফিসফিস করে বলল, আর থাকতে পারছিনে বোনাই। এখানে আমার আর ঠাঁই না থাকাই ভাল। আর
: আর?
: আর কবে বিয়ে হবে? বয়স যে অনেক হল।
মেঘনাদের বুকের মধ্যে বোবা যন্ত্রণা। বলল, তোমার যদি সুখ হয় ঠুমি তবে তাই করব আমি।
: সুখ বলো না বোনাই। বলো, নিষ্কৃতি।
: কার নিষ্কৃতি?
: তোমার, আমার, সকলের।
: লোকের কাছে মনের কথা বলে আমি বোকা বনে যাই। কিন্তু তুমি ঠাকরুন, তোমাকে বিয়ে দিয়ে আমার নিষ্কৃতি কীসের? তোমাকে যে বড় সুহৃদ বলে জানি।
: থাক থাক সে সব কথা বোনাই।
বলতে বলতে মুখ ঢাকল তিলি দু হাতে।
মেঘনাদ বলল, তবে কান্নাও থাক। তবে, আগে আমাকে পুরোপুরি আরম্ভ করতে দেও কাজকর্ম, তারপরে
তিলি আবার বলল, থাক।
.
: থাক নয়, বলতে হবে আমাকে কী হয়েছে। কী হয়েছে বিনচৌ-এর, সে দিন সেই চিঠিটা আসার পর থেকে।
লীলা মুখোমুখি দাঁড়াল বিনয়ের। দোতলা থেকে রাস্তা দেখা যাচ্ছে, দূরের রাস্তা। বিনয় বিষণ্ণ স্নান চোখে তাকিয়ে আছে দূরে। করুণ হেসে বলল, বিনচৌ-এর সব দুঃখ কি তুমি ঘোচাতে পারবে লীলা?
: না পারি শুনতে তো পারি।
বিনয় এখন মনে মনে ভাবছে, থাক থাক এ সব। কিন্তু তার ভেতরে আর একটি মন আছে। স্ব-বিরোধী সেই মন। সে বিদ্রোহ করে থাবা শাণাচ্ছে, উসকে দিচ্ছে তাকে। বিনয় তাকিয়ে আছে অন্যদিকে, কিন্তু দূরাভিসারী দৃষ্টি লীলাকেই দেখছে। বলল, তোমাকে বলা যায় না লীলা। বলতে বলতে দুশ্চিন্তার কয়েকটি রেখা ফুটে উঠল বিনয়ের মুখে।
লীলা বলল, কেন?
: তুমি মেয়েমানুষ, তাই। তোমাকে ভালবাসি, তাই।
গাঢ়, গভীর অথচ দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন গলা বিনয়ের।
ভালবাসা ! কেমন যেন অর্থহীন গা জ্বালানো বলে মনে হয় কথাটি। তবু, বিনয়ের সঙ্গে সত্যি কোথায় বাঁধা পড়েছে লীলা। তার সংসার পোড়ানো বুকের চিতায় একটা হৃদয়গত আমেজের মতো। গলায় তার গাঢ়তা নেই, খরতা আছে। বলল, ভালবাসলে বলা যায় না, এমন কথাও আছে নাকি?
বিনয়ের গলার ভেতরটা কাঁপছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। একটা মন ভয় পাচ্ছে, রাগ করছে, বলছে, খবরদার! ওরে রাক্ষস, বলিসনে বলিসনে। তবু বলে ফেলল, লীলা, আমার সাত হাজার টাকা দেনা আছে। দু তিন দিনের মধ্যেই শোধ করতে হবে।
চকিত সংশয়ে বেঁকে উঠল লীলার ভ্রূ। বলল, বিনচৌ-এর দেনা? কেন, বিনচৌ-এর কি টাকা নেই?
অদ্ভূত করুণ বিষণ্ণ অথচ তিক্ত গলায় বলল বিনয়, জানি, তাই ভাবে সবাই। আমার ঠাকুর চাকরও তা-ই ভাবে। লীলা, যা দেখছ, সব সাজানো। ভেতরটা একেবারে ফোঁপরা, শূন্য। এই বাড়ি, ঘর, কারখানা..।
তখনও লীলা তাকিয়েছিল অপলক তার চোখের দিকে। সংশয়টা বোধ হয় কেটে আসছে। আর বিনয়ের ভেতরটা বলছে, আর নয়, আর বলিসনে বিনচৌ। তবু বিনয় আবার বলল, তোমার স্বামীর সব টাকাই ব্যবসায় খাটতে আরম্ভ করেছে। নইলে, তার অনেক উপকার করেছি, তার কাছেই চাইতাম।
লীলা জানে না কী উপকার করেছে বিনয় মেঘনাদকে। তবু জানে, বিনয় ছাড়া গতি নেই লোকটার। লীলা হঠাৎ বলল, বিনচৌ-এর বউ কোথায়? সেও কি এ সব জানে না?
বিনয় বলল, আমার বউ আর কোনওদিন আসবে না।
: কেন?
সত্যি কথাই আর একরকমভাবে বলল বিনয়, তাকে আমি কোনওদিন ভালবাসিনি, সেও নয়। তা ছাড়া, তার চরিত্র
বিনয় চুপ করল। কিন্তু লীলা অদ্ভুত নিষ্পলক সাপের মতো চেয়ে আছে বিনয়ের দিকে। বিনয়ের ভেতরটা কোঁকড়াচ্ছে।
লীলা বলল, বউ কোথায় গেছে?
: দিল্লিতে, বোধ হয় তার বাপের কাছে।
বলতে বলতেই আত্মসম্মানে যেন লাগল বিনয়ের। বলল, ও সব কথা থাক লীলা।
থাকল, কিন্তু লীলা যেন প্রতিটি ভঙ্গি বিনয়ের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সে তেমন করে আর হাসে না। মাঝে মাঝে নিঃশব্দ বিদ্যুৎ জ্বলে ঠোঁটে। হঠাৎ হেসে বলল, বিনচৌ দেখছি খুব বড় সওদাগর। সপ্তডিঙার শুধু সাজনগোজন সার।
বিনয় প্রেম ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে বলল, সব যাক, লীলার ভালবাসা তো থাকবে। সে আমাকে ওইটুকু দিতে পারে।
লীলা হেসে উঠল খিলখিল করে। বড় তীব্র হাসি। কিন্তু লীলার বুকটা কেন যেন জ্বলছে। তার কেবলই মনে হতে লাগল, বিনয় তার কাছে কিছু চায়। বিনচৌ-এর বিষণ্ণ চোখে করুণ ব্যাকুলতা। কিন্তু মানুষটা কেমন যেন ভীরু দুর্বল। শুধু চাওয়া, প্রাণ ভরে চাইতেই পারে। আর যেন কিছু নয়।
লীলা চলে যাওয়ার পর ঠোঁটে ঠোঁট টিপে ধিক্কার দিয়ে উঠল তার ভেতরের মন, পারলিনে বলতে, হাতের মুঠোয় পেয়ে ছেড়ে দিলি। কিন্তু সময় যায়নি এখনও।
বিনয় কয়েকটি চিঠি বার করল। সবগুলিই দিল্লি থেকে লেখা সুলতার সাম্প্রতিক চিঠি। সবগুলিই বিনয়ের চিঠির জবাব, আমি যাব না আর কোনওদিন। তুমি আইনের সাহায্য নিতে পারো। সুলতা।
আইন! আইন ! বিনয়ের টানা চোখে রক্ত ছুটে আসে।
রাত্রি আটটার পর আবার এল লীলা। বিনয় বলল, রাত্রে এলে?
লীলা হেসে বলল, থাকতে এলাম।
বিনয় চেষ্টা করে হাসল। বলল, থাকো কিন্তু পাড়ায় টিকতে দেবে না যে লোকে।
: অন্য পাড়ায় না হয় যাব।
বিনয় বলল, ভাববার বিষয়।
লীলা সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, আঁচলের আড়াল থেকে বার করল একটি পেতলের বাক্স। তার গহনার বাক্স । বলল, আমার সব গহনা। এতে সাত হাজার হয়ে যাবে।
বিনয় যেন ভয় পেয়ে চমকে উঠল। সোনা পেয়েও ভয় হয়, চমকায় বিনয়। লীলা বলল, নেও।
বিনয় বলল, কিন্তু লীলা, তোমার বাড়ির লোকেরা
কিন্তু এই কয়েক মুহূর্তেই বিনয়ের ভয় কেটে গিয়ে লোভ দুর্বার হয়ে উঠেছে। পেতলের বাক্সের সোনার ঝকমকানি তার চোখে। সে মুখে বলতে পারেনি। লীলা কাজে করে এনেছে।
লীলা বলল, বাড়ির লোক কী করবে জানিনে। বিনচৌ-এর দরকার, তাই এনেছি।
বিনয় বলল, এত ভালবাসো তুমি।
ভালবাসা ! ভালবাসা ! তীব্রস্বরে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করল লীলার, জানিনে কীসের ভালবাসা। কোথায় আছে ভালবাসা। কিন্তু বলল, তা জানি না। বিনচৌ যদি অমন করে বলে—
কী করে বলে, তাও ঠিক বোঝে না লীলা। বিনচৌ তার বিষণ্ণ ব্যাকুল চোখে তার কাছে এতদিন ভিক্ষা চেয়েছে। সে দিয়েছে সব। দিয়ে তার শান্তি কতখানি হয়েছে জানে না। না দিলে শান্তি নেই, জানে।
লীলা বসেছিল খাটে। তার কাছে হাঁটু মুড়ে বসল বিনয় । বলল, বলে তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু লীলা তোমার গলার একটি হার রাখো বলে সে হার, চারখানি চুড়ি আর কানের দুল পরিয়ে দিল লীলাকে। কোনও প্রতিবাদ করল না লীলা। শুধু একটু হাসল।
লীলা চলে যাওয়ার পর, একলা ঘরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল বিনয় গহনার বাক্সের দিকে। সমস্ত বিশ্বটা বড় বিস্ময়ের লাগছে তার কাছে। লীলাকে যে যেন চিনতে পারছে না। আবার সুলতার চিঠিগুলি দেখতে লাগল সে। চিঠিগুলি ফুঁসছে, যাব না, যাব না, কোনওদিন যাব না।
এই সুলতার ঘর। এই ঘরে সে রাত্রে কোনওদিন ঢোকেনি। আজ এই ঘরে বসে চোখের ঘুম একেবারে গেছে বিনয়ের। সেও ফুঁসছে, কামড়াচ্ছে তার বুকের মধ্যে। আর দুটি ভীরু মুখ, চারটি ভীরু চোখ তাকে যেন দেখছে শান্তিনিকেতনের গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে। তারপর, আবার কাল আছে ইউনিয়নের মিটিং। রাজীব চেষ্টা করছে ফেঁসো কারখানায় স্ট্রাইকের জন্য। ছুটছে। কলকাতা প্রদেশ অফিসে, তলে তলে যোগ দিচ্ছে বেয়াড়া শ্রমিকদের সঙ্গে। হেসে কথা বলছে। বিরুদ্ধ দলের সঙ্গে। যারা আজকে তাদের দলের গোটা শাসনক্ষমতাটাই ধুলোয় লুটিয়ে দিতে চায়। এদিকে, কোম্পানি দৃঢ়ভাবে নোটিশ আনছে, চিপ র্যাশন বন্ধের। জানিয়েছে বিনয়কে আগেই।
সুলতা, লীলা, ইউনিয়ন, গহনা…
বারান্দায় কাকের ডাকে চমকে উঠল বিনয়। রাত শেষ হয়ে গেছে।
.
কারখানা জমে উঠেছে। প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে মাল তৈরির পরিমাণ। মালিক বলে চেনা যায় না মেঘনাদকে। সে গেদো আর ছিট, উভয় মালেরই মিস্তিরি। প্রতিদিন স্নান করে, শুদ্ধবস্ত্রে, এখনও সেই মশলা তৈরি করে। মশলাই আসল। স্বাদ গন্ধ শুধু নয়, মশলার উপর নির্ভর করে। মালের নরম শক্ত হওয়া। ফেটে যাবে কি শক্ত হয়ে যাবে, বেশি ময়দায় কম মাল হবে না বেশি মাল হবে, সব নির্ভর করে মশলার উপর। সেই মশলা কাউকে করতে দেয় না মেঘনাদ। নুরুল ভাল মিস্তিরি। আরও কয়েকজন নতুন লোক এনেছে ল্যাংচা ম্যানেজার হরিহর। তারাও, গেদো মালের মিস্তিরি মন্দ নয়। কিন্তু বাজারে নতুন পসার করার সময়, ভরসা করা যাচ্ছে না তাদের উপর।
তা ছাড়া মশলা বড় গোপন জিনিস। গুরুর কাছে দিব্যি-খেয়ে সাকরেদ দীক্ষা পায়, কোনওদিন কাউকে বলবে না। মেঘনাদের প্রথম গুরু এক জন মুসলমান। দ্বিতীয় গুরু লালমিঞা। এমন কী কোনও মিস্তিরিও তার মশলার কথা আর এক জনকে বলবে না। বড় বড় মেশিনওয়ালা কারখানায় এই মিস্তিরিদেরই বলে কেমিস্ট। মাইনে তাদের হাজার বারোশো। তেমন তেমন কারখানায় দেড় হাজার, দু হাজার। এদের নিয়ে আবার টানাটানি কাড়াকাড়ি হয়।
সবাই মেঘনাদের কাজই দেখে। যেন অসুর। টিণ্ডাল, মিস্তিরি, কারিগর সব কাজই করছে। আর মাঝে মাঝে মেশিনটির দিকে চেয়ে দেখছে। ঘর উঠতেই বিজয়ের কাছ থেকে মেশিন এসে পড়েছে। একদিন এমনই সারি সারি মেশিনে ভরে উঠবে এই ঘরগুলি। আরও বড় মডেল, নতুন মডেল আসবে। হিটার আসবে। ভেজা আর শুকনো কাঠের জন্য মাথায় হাত দিয়ে বসতে হবে না।
সেই দিন, সেই দিন আসবে কবে। পাশে পাশে লীলার মুখ ভেসে ওঠে। বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতেও তার লজ্জা করে আজকাল। হয়তো, এই লোকটির কাছে কত ঠাট্টা বিদ্রূপ করে লীলা তাকে নিয়ে। লীলার মুখোনি মনে পড়লে, কাজে মাতে সে আরও বেশি। লীলা, তিলি, কোনও বোনেরই বড় একটা কাছাকাছি হয় না। তিলি খেতে দেয়, মেঘনাদ চুপ করে খায়। শুতে গেলে যখন যায়, তখন লীলা অঘোরে ঘুমোয়। যদি জেগে থাকে, যদি কখনও জাগাতে প্রাণ চায়। মেঘনাদের, তখনই হয় নতুন যন্ত্রণার উদ্ভব।
কাজ, কাজ শুধু।
নিজের হাতে ময়দা মেপে দেয় কারিগরদের। নিজের হাতে ওজন করে মালের ছাঁচ কেটে দেয়।
আর তার পায়ে পায়ে ঘোরে চালিস। চালিস নইলে কাজ জমে না তারও। কাজের মাঝেই পেট বাজিয়ে গান ধরে। মেঘনাদের ধমক খেলে থামে। হঠাৎ নাচ শুরু করে দেয়। বলে, কত্তা ঝুমির ঝুরি নইলে চলবে না।
আচমকা দংশনে ব্যথা লাগে বুকে। বলে, ঝুমির ঝুরির বড় আদর হবে না রে।
আচ্ছা, করা যাক।
ইদ্রিস কাজ ছেড়ে এসেছে হোটেলের। তারও খুব উৎসাহ। করা হল ঝুমির ঝুরি। চলল না এখানকার বাজারে। এখানে চায় সবাই রুটি, বড় বড় বিস্কুট। কারখানার টিফিনে যাতে পেট ভরে। শৌখিন মালের বাজার নেই।
মেঘনাদের পুরো কলসিটি উপুড় হয়ে গেছে। শুন্য হয়ে গেছে, আর এক ফোঁটাও জল নেই। সঞ্চয়ের কলসিটায়। এবার কিছু ঘরে আসা দরকার। যা আসে তা বড় নগণ্য। দু দিন বাদে খরচ পোষাবে না।
হিসাব লেখে নকুড়। কিন্তু লেখায় খোঁড়া ম্যানেজার হরিহর। বলে, কত লিখলেন স্যার ফাদার-ইন-ল। দশ টাকা জমা লিখুন, পাইকের রাখোহরির নামে । বাকি সত্তর টাকা।
নকুড়ের কলম ঝুলে যায়। জমা খরচের পড়তা দূরের কথা, আশমান জমিনের চেয়েও ফারাক বেশি। কিন্তু নকুড় বোবা হয়ে গেছে। ভাবে, এইটাই বোধ হয় এ ব্যবসার রীতি। কার ব্যবসা, কে করে, যেন কিছুই জানে না। ছানি পড়া চোখে, কিলবিলে কপাল তুলে চেয়ে থাকে।
অফিসঘরে, টিন ভরতি মাল। হরিহর মুঠো ভরে মুখে দিয়ে চিবোয়। বলে, কী হল?
নকুড় বলে, জমা খরচটা ঠিক বনছে না যে ল্যাংচা হরি।
: নট ল্যাংচা হরি স্যার ফাদার-ইন-ল, ম্যানেজার বলবেন। ইওর সন-ইন-ল তাই বলেন। যা বলছি, তাই লিখে যান।
বলে চোখ মারে রাখোহরিকে। রাখোহরি মাল নিয়ে চলে যায়।
বিনয়ের দেওয়া এ বিশ্বস্ত লোকটি এ অঞ্চলের সকলের পরিচিত। আঠারো বছর বয়সে, হরিহর ছিল বিনয়ের জ্যাঠার চেলা। ছেলে কুলীন বাঁড়জ্জে ঘরের। বউ ছেলেমেয়েও আছে। গুণের মধ্যে বড় গুণ, ভাল রেস খেলতে জানে, মদ খেতে পারে, আর পারে মারামারি করতে। ওই করেই একটি পা গেছে। কিন্তু লেখাপড়া না করেও ইংরাজি বলে সে মন্দ নয়। বিশেষ করে, এ ইংরেজি হল, বাংলাদেশের যুদ্ধোত্তর কালের ইংরেজি।
কখনও বিস্কুট খাচ্ছে, পাউডার মিলক গিলছে মুঠো মুঠো । নকুড়কে বলে, চলবে নাকি স্যার?
হাঁ করে চেয়ে থাকে নকুড়। কেন যেন ভয় করে ল্যাংচা হরিকে। মনে হয়, তার মনের গোপন গুহায় লেংচে লেংচে ফিরছে লোকটা অষ্টপ্রহর। যেন জানে সব, নকুড়ের পাপ। চেনে সোনাদুলিচরের ভূতটাকে।
তাই হিসাবের খাতা লিখতে হাত কাঁপলেও মেঘুকে খাতাখানি দেখাতেও হাত ওঠে না।
হরিহর ঘাবড়ায় একটু মেঘনাদকে দেখলে। সব সময় পেছনে লাগে চালিসের। চালিসও সহ্য করে না তাকে। চালিস বেশ বুঝতে পারছে, রুটির মিস্তিরি বদনের সঙ্গে হরিহরের কিছু একটা, গোপন ব্যাপার আছে। অনেক দিন সে দেখেছে, রাত্রে বসে বসে দুটিতে কীসের ফুসফুস গুজগুজ করে।
বদনের বড় গুণ হল, মেঘনাদ না থাকলেই গেদো মালের ময়দার খামি দিয়ে, চিত হয়ে শুয়ে থাকা উলঙ্গ মেয়েমানুষের মূর্তি তৈরি করবে। সবাইকে ডেকে দেখাবে আর মূর্তি থেকে খাবলা খাবলা তুলে, ওজন করবে, ছাপ কাটবে। বলবে, শালা মেয়েমানুষ সব রুটি হয়ে গেল। খা কত খাবি।
এ দৃশ্যে মিস্তিরি কারিগর, সবাই হেসে মরে। হাসে, তবু বুড়ো ইদ্রিস বলে, হেই খোদা, উল্লুকের দোষ নিয়ো না। কিন্তু বাদবাকি সবাই বদনের এই খেলায় জমে যায়। নুরুল আর ইদ্রিস, বাপ ব্যাটা চোখাচোখি করে। ইদ্রিসের চোখে খবরদারি, এই দেখে যেন ব্যাটা আবার মেয়েপাড়ায় ছুটে না যায়। ঘরে তার সোহাগী বিবি রয়েছে।
তবু আধো অন্ধকার তন্দুর ঘরে, তন্দুরের আগুনের লাল আলোয় এই মানুষগুলিকে মনে হয়, নরকের প্রেত। ময়দার মেয়ে মূর্তির দিকে তাকায় যেন, বুভুক্ষু শেয়ালের মতো।
গদাধর বলে একটি রিক্রুট আছে হরিহরের, গেদোর কারিগর। সে আবার কোনও কোনও সময় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ওই মূর্তির উপর। তখন সকলের গলা থেকে একটি মিলিত শব্দ ওঠে। হাসির শব্দ নয়। ভীত চমকিত সেই শব্দ অস্ফুট আর্তনাদ। শুধু চালিস চেঁচিয়ে বলে, শালা খচ্চর, দাঁড়া, মালিককে আমি বলে দেব। বলে সে দিয়েছে অনেকবার। মেঘনাদ ধরতে পারেনি একদিনও।
হরিহর বলে, বেশ তৈরি করিস মাইরি। কেষ্টনগরের আর্টিস্টের থেকে কড়া আর্টিস্ট তুই। একে বলে স্কালপচারিস্ট। একে ময়দা, তায় মেয়েমানুষ। লাইফ দিতে পারিসনে, যাকে বলে প্রাণ?
বদন বলে, প্রাণ নেই বলেই তো এটা ভাল। থাকলে আর এত খাবলা খাবলা খেতে হত না।
লীলা বেকারিতে জমজমাট আসর বেঁধেছে হরিহর। মেঘনাদ এদের সব কিছু বোঝে না। কিন্তু আন্দাজ করে, হরিহরের আছে একটি মধুচক্র। সিরাজদিঘার কারখানার অনেকে বেশ্যাবাড়ি যেত। কাজের সময় কারিগর কম পড়ত তার। ছুটে যেত বারোবাসরের পাড়ায়। ধরে নিয়ে আসত, ঘাড়ে ধরে। দরকার হলে রাগের মাথায় দু এক ঘা কষাত। এখানে সে সব তো আছেই, তার উপর আছে সিনেমা দেখা। সোজাসুজি মেঘনাদের কাছেই পয়সা চেয়ে বসে।
সেই জন্য মাঝে মাঝে বিজয়ের দরকার হয়। অথচ নুরুল ইদ্রিসের দলকে কিছুই বলতে হয় না। খামির দলা নিয়ে মেয়েমানুষ করার ব্যাপারটা একদিন মেঘনাদের সহ্যের সীমা ছাড়াল। একদিন বদন মেয়েমানুষের মূর্তি করে, গায়ে লিখে দিল লীলা। তারপর চেঁচিয়ে বলল, নে, কে এবার বিনচৌ হবি, চলে আয়।
জানত না, মেঘনাদ আছে কাছাকাছি। সে এসে দাঁড়াল সেখানে। হরিহর তাড়াতাড়ি বলল, এই যে স্যার, আপনি এসে পড়েছেন। চলে চলুন এখান থেকে, এ সব ছোটলোকের কাজ।
খামির মূর্তির নাভির কাছে লেখা রয়েছে লীলা। মেঘনাদের মুখটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সম্মান বাড়াবার জন্য কোনওদিন লালায়িত ছিল না সে। কিন্তু যন্ত্রণা সম্মানবোধের ধার ধারে না। সে হঠাৎ বদনকে দু হাতে টেনে তুলে, প্রায় ছুড়ে ফেলে দিল ঘরের বাইরে।
বদন একবার চিৎকার করে উঠল, ওরে বাবারে।
হরিহর বলল, মার্ডার হয়ে যাবে স্যার।
কিন্তু আশ্চর্য ! মেঘনাদ শুধু শান্ত গলায় বলল, ইদ্রিস মিঞা, কাজে হাত দেও, দাঁড়িয়ে থেকো না।
হরিহরকে বলল, আপনি অফিসে যান।
: ইয়েস স্যার। কপালে হাত ঠেকিয়ে লেংচে লেংচে চলে গেল হরিহর। বদন ততক্ষণ পালিয়েছে। অনেকে খুশি হল, কিন্তু একটা ভয় ভয় ভাব গেল না।
আর মেঘনাদ ছিটের তন্দুরের পেছনে গিয়ে বসে পড়ল মাজা-ভাঙা সাপের মতো। আর এতদিন বাদে তার প্রথম মনে হচ্ছে, মনে যেন তার সে বল নেই, দেহে তেমন শক্তি নেই। বুকটা অষ্টপ্রহর টনটন করে।
তারপর, এখান থেকেই চোখে পড়ে, ধুলো পড়া মেশিনটা। অমনি শিরদাঁড়ায় বিদ্যুতের ঝিলিক অনুভব করে। ছুটে এসে, ঝাড়ন দিয়ে ঝাড়তে আরম্ভ করে। এখনও কত কাজ বাকি। এই তো সবে শুরু। এখনই ভেঙে পড়লে চলবে কেন।
.
রাত্রি তখন বারোটা হবে। চালিস সিনেমা দেখে ফিরছে। দেখল মালখানার পেছনের দরজা থেকে এক বস্তা ময়দা মাথায় করে কে বেরুচ্ছে। কী করে সম্ভব। মালখানার চাবি তো মেঘনাদের কাছে থাকে।
তারপর দেখল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ল্যাংচা হরি।
দরজাটা অদ্ভুত কায়দায় বন্ধ করে, ফিরতেই দুরে দেখতে পেল চালিসকে।
কাছে আসতেই চালিস বলল, দরজা কী করে খুললে ম্যানেজারবাবু।
হরিহর বলল, কীসের দরজা খোলা। বাড়ি যাওয়ার আগে সব দেখেটেখে যাচ্ছি।
: আর ময়দাটা যে গেল বদনের মাথায়। চুরি করে নিয়ে ব্ল্যাক করো তুমি?
খপ করে চালিসকে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল তন্দুরের ঘরে। বলল, চল শালা, তোকে তন্দুরের মধ্যে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারব আজ।
কিন্তু তার আগেই চালিসের গলা টিপে ধরল সে। চালিসের গলায় স্বর নেই। বেড়ালের মুখে ইঁদুরের মত ছটফট করতে লাগল সে। হরিহর বলল, কর্তাকে বলবি?
কোনও শব্দ নেই। হরিহর ছেড়ে দিল। দিতেই চালিস তীব্র চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে গেল। গেল একেবারে মেঘনাদের কাছে। মেঘনাদ সব শুনে তখুনি এল। এসে দেখল, সব যেমন বন্ধ ছিল, তেমনিই আছে। চালিসকে বলল, দরজার কাছে বোস।
বলে সে নিজে বাতি জ্বালিয়ে বসল খাতাপত্র নিয়ে। গুনে গুনে দেখল ময়দা আর চিনির বস্তা। খাতার হিসাব খুলে বলল, আশ্চর্য ! হিসাব রাখে তার শ্বশুরমশাই নকুড়, সেখানে তো কোনও গণ্ডগোলই নেই।
ইতিমধ্যেই নুরুল ইদ্রিস এরাও এসে বসেছে কাছাকাছি।
পাইকেরদের খাতা খুলে চক্ষুস্থির মেঘনাদের। একশোর উপর পাইকেরের নাম উঠেছে খাতায়। আর প্রত্যেকের নামেই বাকি মোটা মোটা টাকা। তিন মাসের মধ্যে কুল্যে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা পড়ে আছে তাদের কাছে।
লালমিঞার কথা মনে পড়ছে। নিজের হাতে হিসেব কষবি, দেখবি লাভ লোকসান। আশ্চর্য ! যে নকুড়ের ভরসায় হিসেব দেখেনি সে, সেই নকুড় তাকে একটি কথাও বলেনি। বেমালুম হরিহরের কথায় কাজ করে গেছে।
আর মাসখানেক এইভাবে চালালে, সমস্ত আশা ভরসা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মেঘনাদ ইদ্রিসকে বলল, ইদ্রিস, তোমরা শুতে যাও। আমি রাতে থাকব এখানে।
ইদ্রিস বলল, বাবু, বড় তখলিফ হচ্ছে আপনাকে দেখে। আমাদের কিন্তু কোনও গোস্তাকি নেই।
মেঘনাদ হাসল। এমন নিদারুণ হাসি, আর কেউ কোনওদিন দেখেনি। বলল, সে কি আমি জানি না ইদ্রিস। জানি না শুধু, আমার সামনে কী আছে। জানি না শুধু, যা চেয়েছিলাম, তা করতে পারব কি না।
সবাই গেল। চালিস বসে রইল। মেঘনাদ বলল, তুই গেলিনে?
চালিস চুপ। মেঘনাদ বলল, ঘুম পায়নি নাকি রে?
চালিস কাঁচা মুখ বুড়োটে করে বলল, কিত্তা, ওই ল্যাংচা ম্যানেজারকে যদি আপনি না তাড়ান, তা হলে সব্বেনাশ হবে।
মেঘনাদ হিসাবে ডুবে গেল হাসতে হাসতে।
সকালবেলা বিনয় এল। হরিহর গিয়ে তাকে সব বলেছে।
মেঘনাদ বলল, আপনার ম্যানেজারবাবুকে আর চাইনে।
বিনয়ের চোখে অন্যমনস্কতা। বলল, হরিহর বলছিল, ও চুরি করেনি। যদি চুরি কেউ ধরে দিতে পারে, সে কান কেটে দেবে।
মেঘনাদ বলল, কান কাটার দরকার নেই। আমি তাকে রাখব না আর বিনয়বাবু।
বিনয়ের চোখ বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কিন্তু ঠোঁটের পাশে কঠিন রেখা দেখা দিল। অদ্ভুত দৃঢ় গলা শোনাচ্ছে মেঘনাদের। এমন গলা আর কোনওদিন শোনেনি মেঘনাদের।
বিনয়ের সমস্ত চেহারার মধ্যে একটি নিশিজাগা উশৃঙ্খল ছায়া পড়েছে। তাকে দেখাচ্ছে একটু বেশি বয়স্ক। সে খালি বলল, বেশ, তাই হোক।
তারপর প্রতিটি পাইকেরের মুখোমুখি হল মেঘনাদ নিজে। কিন্তু অর্ধেকের উপর পাইকেরের কোনও পাত্তাই নেই।
.
সকাল গেল। দুপুরও যায় যায়। রাজীব আর তিলিদের বাড়ি থেকে যায় না।
তিলি বলল, বাড়ি যাবেন কখন?
রাজীব বলল, এবার যাব ঠুমি। বিনয়বাবু আবার আমাকে কমিটিতে নিতে চাইছেন। ভাবছি, যাব, গিয়ে আমি ওর শোধ নেব।
তিলি বলল, তাই নিনগে।
: একটা কথা ছিল ঠুমি—
বিরক্তি ফুটে উঠল তিলির মুখে। বলল, বলুন।
: কাউকে বলবে না?
: না।
রাজীব একটু কাঁচুমাচু করে বলল, তুমি বলেই বলছি। হয়তো বিনয়দার সঙ্গে আমার আবার মিল হয়ে যাবে! তা ছাড়া আমার আর রাস্তা নেই। বাহান্ন সালে না দাঁড়াতে পারি, সাতান্ন সালেও আশা আছে। কিন্তু তোমাকে না বলে গেলে…জানো…আমার হাত দিয়ে মেঘনাদবাবুর একটি সর্বনাশ হয়েছে।
ভয়ে ও রাগে ক্ষ্যাপা সিংহিনীর মতো ফিরে দাঁড়াল তিলি, কার সর্বনাশ? বোনাইয়ের? কী সর্বনাশ বলুন।
তিলির মূর্তি দেখে রাজীব ঘাবড়ে গেল। এমন মূর্তি কোনওদিন দেখেনি সে। ভাবেওনি, এমন মূর্তিও আছে ঠুমির মধ্যে।
সে এক পা পিছিয়ে বলল, সে কথা আমি বলতে পারব না তুমি।
তিলি প্রায় ঝাঁপ দিতে এল রাজীবের উপর, তবে বললেন কেন?
রাজীব আরও পেছুল। বলল, মেঘনাদবাবুকে তুমি একটু সাবধানে কাজ করতে বলল। আমি আর কিছু বলতে পারব না।
বলে সে বেরিয়ে গেল। তিলি পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল। সর্বনাশ ! আর কত সর্বনাশ থাকতে পারে। বউ যার পায়ের তলার মাটি খাচ্ছে দিবানিশি সর্বনাশী নদীর মতো, তার আরও কত সর্বনাশ আছে। আরও কতদিন এ পাপপুরীতে থাকতে হবে। বোনাই কবে তাকে বিদায় করবে। এতদিন বাদে অমর্ত মুদি টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। সেই টাকা, বিজয় মেঘনাদ বাবা মা, কারও কাছে চাইতে পারছে না তিলি । অমর্ত সেই চিরকালের ইশারাই করছে। একদিন, একটি রাত্রি…