কার্ক দুর্গের পতন
মিসরের পল্লী এলাকার মানুষ লোকটির পথপানে তাকিয়ে আছে। সকলের মুখে একই কথা- ইনি আকাশ থেকে নেমে এসেছেন, আল্লাহর দ্বীন নিয়ে এসেছেন। ইনি মানুষের মনের কথা বলে দেন, ভবিষ্যতের অন্ধকারকে আলোকিত করে দেখান। ইনি মৃত মানুষকে জীবিত করেন।
কে ইনি? লোকটিকে যে-ই দেখেছে, তার কারামত দেখে এতই অভিভূত হয়েছে যে, কেউ জানবার প্রয়োজন মনে করল না ইনি কে? মানুষের বিশ্বাস, লোকটি আকাশ থেকে এসেছেন এবং আল্লাহর দ্বীন নিয়ে এসেছেন। তার কারামতের কাহিনী মানুষের মুখে মুখে। কেউ তাকে পয়গাম্বর বলে বিশ্বাস করে। অনেকে তাকে বৃষ্টির দেবতা বলে জানে এবং তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের জীবন পর্যন্ত কোরবান করতে প্রস্তুত। তার ধর্ম কী, তার বিশ্বাস কী জানবার গরজ নেই কারুর।
সেকালের মিসরের যে অঞ্চলের অধিবাসীদের কথা বলছি, তারা ছিল পশ্চাৎপদ অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক সম্প্রদায়। যার ব্যাপারেই তাদের প্রতীতি জন্মত যে, তার কাছে সমস্যার সমাধান আছে, তার পায়ে গিয়েই তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ত। তবে ধর্ম পরিচয়ে তারা বেশীরভাগই মুসলমান। ইসলামের আলো তাদের কাছে পৌঁছেনি তা নয়। অনেক মসজিদও নির্মাণ করে রেখেছিল তারা। কাবার প্রভূর দরবারে পাঁচ ওয়াক্ত সেজদাবনতও হত। কিন্তু ইসলামের নির্ভুল আকীদা-বিশ্বাস থেকে ছিল তারা বঞ্চিত। তাদের ইমামরা ছিল অজ্ঞ। নিজেদের কারামত ফুটিয়ে তোলার জন্য মানুষকে আজগুবি সব কল্পকাহিনী শুনিয়ে মাতিয়ে রাখত। পবিত্র কুরআনকে তারা সাধারণ মানুষের জন্য এক অস্পৃশ্য গ্রন্থরূপে পরিচিত করেছে। ফলে সাধারণ মুসলমানরা কুরআনের গায়ে হাত দিতেও ভয় পেত।
ইমামগণ মুসলমানদের অন্তরে একটি শব্দ গায়েব বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যা কিছু আছে, সবই গায়েবী ব্যাপার। স্যাপার আর গায়েবের ইলম অর্জন করার শক্তি আছে শুধু ইমামের। ইমামরা জনসাধারণকে একটি দুর্বল পদার্থে পরিণত করে রাখে।
এখান থেকেই জনমনে অলীক বিশ্বাস ও কুসংস্কারের জন্ম নেয়। মরুঝড়ের শো শো শব্দের মধ্যে তারা প্রাণীর কণ্ঠ শুনতে পায়। ইমাম বলছেন, এসব অদৃশ্য প্রাণী তোমরা দেখতে পাবে না। তাদের বিশ্বাসে রোগ-ব্যাধি এখন জ্বিন-ভূতের প্রভাব, যার চিকিৎসা করার ক্ষমতা ইমাম ছাড়া কারুর নেই। ইমামদের দাবি, জ্বিন জাতি তাদের কজায়। মানুষ এখন গায়েব আর গায়েবের শক্তিকে এতই ভয় পেতে শুরু করেছে যে, তাদের অন্তরে ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস দুর্বল হয়ে গেছে। মুসলমানদের বিশ্বাস এসে স্থির হয়েছে এখন সেসব স্বর-শব্দে, যা তাদেরকে গায়েবী প্রাণীও তাদের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
চিত্রটি মিসরের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত সংলগ্ন পল্লী এলাকার। সে যুগে সীমান্ত বলতে স্পষ্ট কিছু ছিল না। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কাগজের উপর একটি রেখা টেনে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি বলতেন, ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্যের কোন সীমানা নেই। সীমানা মূলত বিশ্বাস-সংশ্লিষ্ট বিষয়। ইসলামের পরিধি যতটুকু, ইসলামী সালতানাতের সীমানাও ততটুকু। যেখান থেকে অনৈসলামী চিন্তা-চেতনা শুরু, সেই এলাকা অন্য দেশের।
মিসরের যে প্রান্তীয় গ্রামগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তাকে মিসরের সীমান্তগ্রাম বলা হত। সে কারণেই খৃস্টানরা মিল্লাতে ইসলামিয়ার চিন্তা-চেতনার উপর আক্রমণ চালাত এবং ইসলামী বোধ-বিশ্বাসকে দুর্বল করে তদস্থলে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রাধান্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করত। এতে প্রমাণিত হয় যে, সে যুগে সীমান্তের মর্যাদা যতটা ভৌগলিক ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল সাংস্কৃতিক। সে যুগের ঘটনাবলী থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে, তকালে মুসলমানদের পরাজিত করার জন্য অমুসলিমদের অন্যতম অস্ত্র ছিল সংস্কৃতিক আগ্রাসন। তারা জানত, মুসলমান যুদ্ধকে জিহাদ বলে। আর কুরআন মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরজ করে দিয়েছে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে জিহাদ নামায অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের এই অমোঘ বিধানটিও তাদের জানা ছিল যে, কোন অমুসলিম দেশের মুসলিম অধিবাসীরা যদি নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করে তাদেরকে অমুসলিমদের নির্যাতনের হাত থেকে উদ্ধার করা অন্য দেশের মুসলমানদের জন্য ফরজ।
ইসলামের এসব বিধানই মুসলমানদের মাঝে এমন সামরিক চেতনা সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে মুসলমান যখনই কোন দেশে অভিযান চালাত কিংব ময়দানে যুদ্ধে লিপ্ত হত, তাদের চিন্তা-চেতনায় যুদ্ধের লক্ষ্য উদ্ভাসিত হয়ে থাকত। ইসলামের সৈনিকদের জন্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা মালে গনীমত হালাল হলেও লুটপাট করা ইসলামের সৈনিকদের লক্ষ্য হত না, তারা গনীমতে, লোভে লড়াই করত না। তার বিপরীতে খৃস্টানদের যুদ্ধ হত আগ্রাসনমূলক প্রতিপক্ষের সম্পদ লুট করা ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। তাতে খৃস্টানদের একটি ক্ষতি এই হত যে, যে কোন যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সামরিক শক্তি থাকত মুসলমান অপেক্ষা পাঁচ থেকে দশ গুণ। কিন্তু তারা মুষ্টিমেয় মুসলমানদের হাতে পরাজয়বরণ করত, অন্তত বিজয় অর্জন করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াত। তারা জানত যে, পবিত্র কুরআন মুসলমানদের মধ্যে সামরিক চেতনা সৃষ্টি করে রেখেছে। তারা আল্লাহর নামে লড়াই করে, জান দেয়। তাই খৃস্টান সেনাপতিদের অন্যতম ভাবনা ছিল, কিভাবে মুসলমানদের মধ্য থেকে এই যুদ্ধ-চেতনা দূর করা যায়। তারা জানত, একজন মুসলমান দশজন খৃস্টানের মোকাবেলা করতে সক্ষম। তারা আকাশের ফেরেশতা বা জ্বিন-ভূত নয়, বরং তারা নিজেদের মধ্যে আল্লাহর শক্তি অনুভব করে থাকে, যা তাদেরকে সব ধরনের লোভ-লালসা এমনকি নিজের জীবন থেকেও উদাসীন করে তোলে। তাই সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীরও বহু আগে ইহুদী ও খৃস্টান আলেম পন্ডিতগণ মুসলমানদের সামরিক চেতনাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তাদের চরিত্র ধ্বংসের অভিযান এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসে সূক্ষ্ম বিকৃতি সাধন করে তাদের ঈমানকে দুর্বল করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এবং নুরুদ্দীন জঙ্গীর দুর্ভাগ্য যে, যখন তারা খৃস্টানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন, ততক্ষণে খৃস্টানদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অনেকখানি সফল হয়ে গেছে। ইসলামের দুশমনরা এই আগ্রাসনকে দুধারায়, পরিচালিত করেছিল। উচ্চ পর্যায়ের মুসলমানদেরকে- যাদের মধ্যে ছিল শাসক, আমীর ও মন্ত্রীবর্গ- অর্থ, নারী ও মদ দ্বারা ঘায়েল করেছিল। আর নিম্নস্তরের মুসলমানদের বিপথগামী করেছিল কুসংস্কার ও ধর্মের বিরুদ্ধে কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করার মাধ্যমে। সর্বশেষ সুলতান আইউবী ও সুলতান জঙ্গী খৃস্টানবিরোধী অভিযানে যেমন নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুন কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, তেমনি পাশাপাশি খৃস্টানরাও মুসলমানদের নৈতিক আগ্রাসনের ময়দানে নতুন পন্থা উদ্ভাবনে তৎপর হয়ে উঠে। তিন-চারজন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এমনও লিখেছেন, একটি সময় এমনও এসেছিল যে, কোন কোন খৃস্টান সম্রাট যুদ্ধের ময়দানের কথা চিন্তা করাই বাদ দিয়েছেন। তারা এই কৌশল অবলম্বন করে যে, এমন যুদ্ধে লড় যাতে মুসলমানের জিহাদী চেতনা ও সামরিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। তাদের ধর্মবিশ্বাসের উপর জোরদার। হামলা চালাও আর তাদের অন্তরে এমন সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে দাও, সাধারণ মুসলমান ও সৈন্যদের মাঝে অবিশ্বাস-অনাস্থা ও ঘৃণার জন্ম দেয়। ফিলিপ অগাস্টাস ছিলেন এই তালিকার প্রধান ব্যক্তি। এই খৃস্টান সম্রাট ইসলামের শত্রুতাকে তার ধর্মের মূল কাজ মনে করতেন এবং বলতেন, আমাদের যুদ্ধ সালাহুদ্দীন আইউবী-নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিরুদ্ধে নয়- ইসলামের বিরুদ্ধে। আমাদের এই লড়াই ক্রুশ বনাম ইসলামের লড়াই, যা আমাদের জীবদ্দশায় না হলেও কোন না কোন সময় অবশ্যই সফল হবে। তার জন্য তোমরা মুসলমানদের নতুন প্রজন্মের মন-মানসিকতায় জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেমের পরিবর্তে যৌনতার বীজ ঢুকিয়ে দাও এবং তাদেরকে ভোগ বিলাসিতায় ডুবিয়ে দাও।
নিজের এই মিশনকে সফল করে তোলার লক্ষ্যে অগাস্টাস যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের সামনে অস্ত্র ত্যাগ করে সন্ধির পথ অবলম্বন করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আমি যে যুগের (১১৬৯ সাল) কাহিনী বলছি, সে সময়ে সম্রাট অগাস্টাস নুরুদ্দীন জঙ্গীর কাছে পরাজিত হয়ে বিজিত এলাকাসমূহ প্রত্যার্পন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি জরিমানাও আদায় করেছিলেন এবং আর যুদ্ধ করবেন না বলে চুক্তি স্বাক্ষর করে জিযিয়া প্রদান করেছিলেন। কিন্তু বন্দী বিনিময়ের ক্ষেত্রে তিনি শুধু কয়েকজন পঙ্গু মুসলিম সৈনিককেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অন্য সুস্থ-সবল সৈনিকদেরকে হত্যা করেছিলেন। আর এখন তিনি কার্ক দুর্গে ইসলামের মূলোৎপাটনের পরিকল্পনা প্রস্তুতির কাজে মহাব্যস্ত। ইসলামের শত্রুতা যেন তার মজ্জাগত বিষয়। তার কোন কোন কর্মকৌশল এতই গোপনীয় হত যে, তার সমমর্যাদার খৃস্টান নেতা সেনাপতিরাও তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিল। তার সহকর্মীরা তার উপর এই অপবাদও আরোপ করেছিল যে, সম্রাট অগাস্টাস তলে তলে মুসলমানদের আপন এবং গোপনে তাদের সঙ্গে সওদাবাজী করছেন। এক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক আন্দ্রে আজবন-এর ভাষ্য মতে, এই অপবাদের জবাবে অগাস্টাস একবার বলেছিলেন, একজন মুসলিম শাসককে জালে আটকানোর জন্য আমি আমার কুমারী কন্যাদেরকেও তার হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠিত হব না। তোমরা মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি ও বন্ধুত্ব করতে ভয় পাচ্ছ। কারণ, তার মধ্যে তোমার লাঞ্ছনা দেখতে পাচ্ছ। কিন্তু তোমরা এ কথা ভেবে দেখছ না যে, মুসলমানদেরকে যুদ্ধের ময়দান অপেক্ষা সন্ধির ময়দানে মার দেয়া সহজ। প্রয়োজনে তাদের সামনে অস্ত্র ত্যাগ করে সন্ধিচুক্তিতে স্বাক্ষর কর আর ঘরে এসে তার বিপরীত কাজ কর। আমি কি এমনই করছি না? তোমরা কি জান না যে, আমার রক্ত সম্পর্কের দুটি যুবতী মেয়ে দামেস্কের এক শায়খের হেরেমে অবস্থান করছে? তোমরা কি সেই শায়খের হাত থেকে বিনা যুদ্ধে অনেক ভূখণ্ড দখল করনি? তিনি কি বন্ধুত্বের হক আদায় করেননি? তিনি আমাকে তার অন্তরঙ্গ বন্ধু মনে করেন; অথচ আমি তাকে আমার জানী দুশমন জ্ঞান করি। আমি প্রত্যেক অমুসলিমকে বলব, তোমরা মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তি করে চল এবং তাদেরকে প্রতারণা জালে আটকিয়ে মার।
.***
এ হল ক্রুসেডারদের সেই মানসিকতা, যা এক সফল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সালতানাতে ইসলামিয়ার ভিতকে উঁই পোকার ন্যায় খেয়ে ফোকলা করে চলেছিল। সেই ষড়যন্ত্রের-ই ফলে মিসরে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ লেলিহান শিখায় পরিণত হতে শুরু করেছিল, যাকে অবদমিত করার জন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে এমন এক মুহূর্তে কার্ক অবরোধ থেকে তার সৈন্য বাহিনীকে তুলে আনতে হল, যখন তিনি খৃস্টানদের শক্তিশালী একটি বাহিনীকে দুর্গের বাইরে পরাস্ত করে ফেলেছেন। কার্ক অবরোধ সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর হাতে তুলে দিয়ে তাকে সৈন্যসহ কায়রো ফিরে যেতে হল। তাতে সুলতান আইউবী হীনবল হননি বটে, কিন্তু পরিস্থিতি তার মনের উপর বিরাট এক বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছিল, তা তার চেহারায় স্পষ্টই ফুটে উঠেছিল। তার বাহিনীর সৈন্যরা এই ভেবে নিশ্চিন্ত যে, তাদেরকে বিশ্রামের জন্য কায়রো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাহিনীর কমান্ডারগণ (যারা সুলতান আইউবীর প্রত্যয় ও যুদ্ধরীতি সম্পর্কে অবগত) এই ভেবে বিস্মিত যে, তিনি নুরুদ্দীন জঙ্গীকে সৈন্যসহ ডেকে আনলেন কেন? অবরোধই বা তুলে নিলেন কি কারণে? তিনি তো জয় বা পরাজয় পর্যন্ত লড়াই করার পক্ষপাতি ছিলেন। বস্তুত, সুলতান আইউবীর হেড কোয়ার্টারের দু-তিনজন সালার ছাড়া কেউ জানত না, মিসরের পরিস্থিতি শোচনীয় রূপ ধারণ করেছে, তকিউদ্দীনের সুদান হামলা ব্যর্থ হয়েছে এবং তাকে জান বাঁচিয়ে পেছনে সরে আসতে হচ্ছে। সুলতান আইউবীর সঙ্গে আলী বিন সুফিয়ানও উপস্থিত ছিলেন। তিনিই মিসরের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির রিপোর্ট নিয়ে এসেছিলেন।
সুলতান আইউবী কার্ক ত্যাগ করে মিসর অভিমুখে রওনা হওয়ার নির্দেশ প্রদানের সঙ্গে এই আদেশও প্রদান করেন যে, পথে যাত্রাবিরতি হবে খুব কম এবং চলতে হবে অতি দ্রুত। এই নির্দেশে সকলের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, সমস্যা কিছু একটা হয়েছে।
সফরের প্রথম দিনের সন্ধ্যাবেলা। বাহিনী রাতের জন্য একস্থানে থেমে যায়। সুলতানের জন্য তাঁবু খাটান হয়। তিনি তার উচ্চপদস্থ কমান্ডার ও কেন্দ্রীয় কমান্ডের দায়িত্বশীলদের একত্রিত করেন। তিনি বললেন, আপনারা অধিকাংশই জানেন না যে, আমি কেন কার্ক অবরোধ তুলে আনলাম এবং কেনইবা বাহিনীকে মিসর নিয়ে যাচ্ছি। অবরোধ ভেঙ্গে যায়নি ঠিক, আপনারা কেউ পিছপা হননি। কিন্তু আমি একে পরাজয় না বললেও পিছপা হওয়া বলব অবশ্যই। আমার বন্ধুগণ! আমরা পিছপা হচ্ছি এবং আপনারা শুনে বিস্মিত হবেন যে, যারা আপনাদেরকে পিছপা হতে বাধ্য করেছে, তারা আপনাদেরই ভাই, আপনাদেরই বন্ধু। এখন তারা খৃস্টানদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। তারা বিদ্রোহের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে প্রস্তুত। আলী বিন সুফিয়ান, তার নায়েব ও গিয়াস বিলবীস যদি চৌকস না হতেন, তাহলে আজ আপনারা মিসর যেতেই পারতেন না। ওখানে এখন চলত খৃস্টান ও সুদানীদের রাজত্ব। আরসালানের ন্যায় কর্মকর্তা খৃস্টানদের ক্রীড়নক প্রমাণিত হয়েছে। লোকটি আল-ইদরীসের দুযুবক পুত্রকে খুন করিয়ে নিজে আত্মহত্যা করেছে। আরসালানের মতো লোকই যখন গাদ্দার প্রমাণিত হল, এমতাবস্থায় আপনারা আর নির্ভর করবেন কার উপর!
সুলতান আইউবীর বক্তব্য শুনে শ্রোতারা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। অস্থিরতা ও উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠে সকলের চোখে-মুখে। সুলতান নীরব হয়ে সকলের প্রতি চোখ বুলালেন। তৎকালের এক ঐতিহাসিক কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ডায়েরীর সূত্রে উল্লেখ করেন যে, তখন দুটি প্রদীপের কম্পমান আলোয় সকলের মুখমণ্ডল এমন দেখাচ্ছিল, যেন তাদের কেউ কাউকে চেনে না। আইউবীর বক্তব্য শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই। সুলতান। আইউবীর ভাষা অপেক্ষা বর্ণনাভঙ্গী ও উপস্থাপনার ঢং তাদেরকে বেশী প্রভাবিত করছিল। সুলতানের কণ্ঠে জোশ ছিল না বটে, তবে এতই গাম্ভীর্য ছিল যে, সবাই প্রকম্পিত হয়ে উঠে। তিনি বললেন, আপনাদের মধ্যেও গাদ্দার আছে বলে আমি মাফ চাইব না। আমি আপনাদেরকে এ কথাও বলব না যে, আপনারা কুরআন হাতে নিয়ে হরফ করে বলুন, আপনারা ইসলাম ও সালতানাতে ইসলামিয়ার অফাদার। কারণ, আমি জানি, যারা ঈমান বিক্রি করতে জানে, তারা কুরআনে হাত রেখেও মিথ্যা অঙ্গীকার করতে পারে। আমি আপনাদেরকে শুধু এটুকু বলব যে, যে ব্যক্তি মুসলমান নয়, সে-ই আপনাদের দুশমন। দুশমন যখন আপনার সঙ্গে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব প্রকাশ করে, তখনও তার মধ্যে দুশমনী লুকিয়ে থাকে। তারা আপনাকে আপনার ভাইয়ের বিরুদ্ধে, আপনার ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে এবং যখনই মুসলমানদের উপর তার শাসন করার সুযোগ আসে, তখন সে মুসলিম নারীর সম্ভ্রমহানি এবং ইসলামের মূলোৎপাটন করে থাকে। এ-ই তার লক্ষ্য। আমরা যে লড়াই লড়ছি, তা আমাদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয়; এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতা লাভের বা কোন দেশ দখল করার প্রচেষ্টা নয়। এটি হল দুটি বিশ্বাসের লড়াই- কুফর ও ইসলামের। এ যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না কুফর কিংবা ইসলাম নির্মূল হবে।
গোস্তাখী মাফ করুন সালারে আজম!- এক সালার বললেন- আমরা যে গাদ্দার নই, তা যদি প্রমাণই করতে হয়, তাহলে আপনি আমাদেরকে মিসরের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করুন। দেখবেন, আমরা প্রমাণিত করব যে, আমরা কী। আরসালান সেনাবাহিনীর নয়- প্রশাসনের কর্মকর্তা ছিলেন। আপনি গাদ্দার প্রশাসনিক বিভাগগুলোতে খুঁজে পাবেন- সেনাবাহিনীতে নয়। কার্ক দুর্গের অবরোধ আপনি তুলে নিয়েছেন। আমরা আনিনি। মোহতারাম জঙ্গীকে ডেকে এনেছেন আপনি- আমরা নই। আমাদের পরীক্ষা হবে যুদ্ধের ময়দানে নিরাপদ পিছু হটার মাধ্যমে নয়। আপনি বলুন, মিসরে কী সব ঘটছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আলী বিন সুফিয়ানের প্রতি তাকিয়ে বললেন, আলী! এদেরকে বল, মিসরে কী হচ্ছে।
আলী বিন ফিয়ান বললেন
গাদ্দাররা দুশমনের সঙ্গে যোগ দিয়ে সুদানের রণাঙ্গনের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য উধাও করে ফেলেছে। দেশের পল্লী এলাকাগুলোতে অপরিচিত লোকজন এসে খাদ্যদ্রব্য, তরিতরকারী ইত্যাদি চড়া মূল্যে ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে। গোশত এখন দুষ্প্রাপ্য বস্তু। ময়দানে রসদ প্রেরণ করা হলেও অজ্ঞাত কারণে বিলম্ব ঘটান হচ্ছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, রসদ রওনা করিয়ে দুশমনকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে দুশমন রসদের বহর পথে ধরে ফেলেছে। শহরে অপরাধপ্রবণতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এমন আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে জুয়াবাজির প্রসার ঘটান হয়েছে যে, আমাদের যুবসমাজ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। ফৌজে নতুন ভর্তির জন্য পল্লী অঞ্চলগুলোতে তোক পাওয়া যাচ্ছে না। গরু-মহিষ, ছাগল-দুম্বা-ভেড়াও উধাও হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় চরিত্র ধ্বংস করার আয়োজন করা হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদেশের রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। খৃস্টানরা তাদেরকে এই প্রলোভন দেখিয়েছে। অজ্ঞাত উৎস থেকে বিপুল অর্থ-সম্পদ তাদের হাতে আসছে। যেহেতু সরকারের সব ব্যবস্থাপনা তাদের হাতে, তাই তারা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছে, যা দুশমনের জন্য অনুকূল। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল, পল্লী এলাকাগুলোতে আজগুবি ধরনের নতুন নতুন বিশ্বাসের প্রসার ঘটছে। মানুষ ইসলাম পরিপন্থী চিন্তা-চেতনা লালন ও পালন করতে শুরু করেছে। সেসব ভিত্তিহীন ও ইসলামবিরোধী চিন্তাধারা আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। এ এক বিরাট আশংকার বিষয়।
আপনি কি তার প্রতিকার করেননি? উপস্থিতদের একজন জিজ্ঞেস করল।
জি, করেছে- আলী বিন সুফিয়ান জবাব দেন- আমার গোটা বিভাগ অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ ও তাদের গ্রেফতার করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আমি আমার গুপ্তচর ও সংবাদদাতাদেরকে পল্লী এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে রেখেছি। কিন্তু দুশমনের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা এতই বেড়ে গিয়েছে যে, দুষ্কৃতিকারীদেরকে ধরা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সবচে বড় সমস্যা হল, আমাদের মুসলমান ভাইরা ই দুশমনের গুপ্তচর ও দুষ্কৃতিকারীদের আশ্রয় ও সহযোগিতা প্রদান করছে। আপনারা শুনে বিস্মিত হবেন যে, পল্লী এলাকার কোন কোন মসজিদের ইমামও দুশমনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে।
এমন তো হতে পারে না যে, আমি প্রশাসনকে সেনা বিভাগের হাতে তুলে দেব!- সুলতান আইউবী বললেন- সেনাবাহিনীকে যে কাজের জন্য গঠন করা হয়েছে, যদি তারা যথাযথভাবে তা পালন করে যায়, তাহলে দেশের জন্যও মঙ্গল, তাদের জন্যও কল্যাণকর। একজন কোতোয়াল যেমন সালার হতে পারেন না, তেমনি একজন সালারও কোতোয়ালের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তবে প্রত্যেক সালারকে অবশ্যই খবর রাখতে হবে, প্রশাসন কী করছে। এক্ষেত্রে সামরিক বিভাগ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছে না তো? আমার বন্ধুগণ! আল্লাহ আমাদেরকে ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন। মিসরের পরিস্থিতি আপনারা শুনেছেন। সুদানের হামলা ব্যর্থ হয়েছে। তকিউদ্দীন তার ভুলের জন্য সুদানের মরুভূমিতে আটকা পড়ে আছে। তার বাহিনী ছোট ছোট দলে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। তার নিরাপদে পেছনে সরে আসার সম্ভাবনাও নজরে আসছে না। তাছাড়া মোহতারাম জঙ্গী কার্ক জয় করতে পারবেন কিনা, তাও আমার জানা নেই। তিনিও যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তার দায়ভার আমাকেই বহন করতে হবে। আমি জানি, আপনারা কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতেও যুদ্ধের ময়দানে দুশমনকে পরাজিত করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দুশমন যে ময়দানে হামলা করেছে, তাতে দুশমনকে পরাস্ত করা আপনাদের পক্ষে বাহ্যত সহজ বলে মনে হয় না। আপনারা ধারাল তরবারী। আপনারা মরুভূমির শাহসাওয়ার। কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে, ক্রুসেডারদের এই যুদ্ধক্ষেত্রে আপনারা অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলবেন।
মজলিসের ভেতরে বেশকিছু লোকের জোরালো কণ্ঠ শোনা গেল। তারা ইসলাম ও দেশের স্বার্থে জীবন দিতে প্রস্তুত। শুনে সুলতান আইউবী বললেন
বর্তমানে মিসরে যে সৈন্য আছে, তারা যখন কার্ক ও শোবকের ময়দান থেকে মিসর ফিরছিল, তখন তাদের কমান্ডার-দায়িত্বশীলদের জযবাও ঠিক এমন ছিল, যেমনটি এখন আপনাদের। কিন্তু কায়রো পৌঁছে যখন তারা দুশমনের সবুজ বাগান দেখতে পেল, তখন তারা বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। আর আজ তাদের নৈতিক অবস্থা এমন যে, আপনারা তাদের উপর ভরসা করতে পারছেন না।
আমরা এ ধরনের প্রত্যেক কমান্ডারকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হব। তেজোদ্বীপ্ত কণ্ঠে এক সালার বললেন।
আমরা সর্বপ্রথম নিজেদেরকে গাদ্দারদের থেকে পবিত্র করব। বললেন আরেকজন।
আমার পুত্রও যদি খৃস্টানদের আপন বলে প্রমাণ পাই, তাহলে নিজ তরবারী দ্বারা তার মাথা কেটে আমি আপনার পায়ে এনে ফেলব। বললেন প্রবীণ এক নায়েবে সালার।
আমি এরূপ আবেগময় উত্তেজনাপূর্ণ কথার পক্ষে নই। সুলতান আইউবী বললেন।
উপস্থিত সামরিক কর্মকর্তাদের সকলেই উত্তেজিত, ক্ষিপ্ত। এরা এমন মানুষ, যারা সুলতান আইউবীর সামনে মুখ খুলে কথা বলতে ভয় পেত। কিন্তু যখন শুনতে পেল যে, তাদের সহকর্মীরা দুশমনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজ সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্যত, তখন তারা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে। একজন তো সুলতান আইউবীকে এমনও বলে ফেলল যে, আপনি সবসময় আমাদেরকে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করতে এবং ধৈর্যের সাথে কাজ করতে বলে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমনও সৃষ্টি হয়ে থাকে যে, তখন ধৈর্য ও সহনশীলতা ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। আপনি অনুমতি দিন, আমরা পথে আর কোথাও যাত্রাবিরতি না দিয়ে সোজা কায়রো পৌঁছে যাই। আমরা ঐ বাহিনীকে নিরস্ত্র করে বন্দী করে ফেলব।
পরিবেশ এতই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে যে, নিয়ন্ত্রণে রাখা সুলতান আইউবীর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। উত্তেজনার মধ্যেই তিনি আরো কিছু কথা বলে ও শুনে বৈঠক মুলতবী করে দেন। প্রত্যূষে কাফেলা আবার রওনা হয়। সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলে তারা। সুলতান আইউবী তার আমলাদের থেকে খানিক আলাদা হয়ে এগুচ্ছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, আলী বিন সুফিয়ান তার সঙ্গে নেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাহিনীকে দুবার কিছু সময়ের জন্য থামানো হয়। রাতেও কাফেলা চলতে থাকে। রাতের প্রথম প্রহর শেষ প্রায়। সুলতান। আইউবী রাতে অবস্থানের জন্য যাত্রাবিরতি দেন। সুলতানের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আলী বিন সুফিয়ানের আগমন ঘটে।
সারাদিন কোথায় ছিলে আলী! সুলতান জিজ্ঞেস করেন।
গতরাতে আমার মনে একটি সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল- আলী বিন সুফিয়ান জবাবে দেন- তার বাস্তবতা খতিয়ে দেখার জন্য দিনভর বাহিনীর মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছি।
কী, সন্দেহ! বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জানতে চান সুলতান আইউবী।
রাতে আপনি দেখেননি যে, সকল সালার, কমান্ডার ও ইউনিট দায়িত্বশীলরা কিভাবে মিসরে অবস্থানরত বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- তাতে আমার মনে সন্দেহ জাগে যে, এরা নিজ নিজ অধিনস্থ সিপাহীদেরও ক্ষেপিয়ে তুলবে। বাস্তবে আমার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তারা বাহিনীকে এমন সব কথাবার্তা দ্বারা উত্তেজিত করে তুলেছে যে, গোটা বাহিনীর মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছে। আমি সাধারণ সৈনিকদের বলতে শুনেছি যে, আমরা যুদ্ধের ময়দানে আহত হচ্ছি, শহীদ হচ্ছি আর আমাদের সহকর্মী অন্য সৈনিকরা কায়রোতে বসে মৌজ করছে আর ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করার চেষ্টা করছে। আমরা মিসর গিয়ে নিই, আগে তাদেরকে শেষ করে তারপর সুদানে আটকাপড়া বাহিনীকে সাহায্য করব। মহামান্য আমীর! আমরা যদি এ ব্যাপারে আগাম কোন ব্যবস্থা না নিই, তাহলে এই বাহিনীর কায়রো পৌঁছামাত্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আমাদের এই বাহিনী এখন সম্পূর্ণ প্রতিশোধপরায়ণ। সবাই উত্তেজিত। আর মিসরের বাহিনী পূর্ব থেকেই অজুহাতের সন্ধানে রয়েছে।
আমি এ জন্য আনন্দিত যে, অবিরাম যুদ্ধক্লান্ত এই বাহিনীর মধ্যে এমন স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছে- সুলতান বললেন- কিন্তু আমাদের দুশমনের একান্ত কামনা যে, আমাদের বাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়ে আপসে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক।
সুলতান আইউবী গভীর চিন্তায় ডুবে যান। কিছুক্ষণ পর বললেন
কৌশল একটা পেয়েছি। কায়রো থেকে উল্লেখযোগ্য দূরে থাকা অবস্থায় আমি আমার একজন বিচক্ষণ ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন দূত পাঠিয়ে মিসরের বাহিনীকে অন্যপথে কার্ক অভিমুখে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেব। এমনও হতে পারে যে, আমি আগেভাগে গিয়ে বাহিনীকে রওনা করাব। এতে আমাদের সঙ্গে যে বাহিনী আছে, তারা ওখানে পৌঁছে কোন সৈন্য দেখতে পাবে না। বিষয়টা তদন্ত করে তুমি ভালই করেছ আলী। বিষয়টা আমার মাথায় আসেনি।
***
সীমান্তবর্তী পল্লী অঞ্চলের রহস্যময় সেই লোকটি ভক্ত-সহচরদের নিয়ে দলবেঁধে সফর করে বেড়ায়। লোকটি বৃদ্ধ নয়। তার কাজল-কালো, গৌরবর্ণ মুখাবয়ব। মাথায় লম্বা চুল। দুচোখে চাঁদের চমক। দাঁতগুলো তারকার ন্যায় শুভ্র। দীর্ঘকায় সুঠাম দেহ। কথা বললে শ্রোতারা অভিভূত হয়ে পড়ে। সঙ্গে থাকে তার বিপুলসংখ্যক সহচর ও অগণিত উট। তার কাফেলা জনবসতি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে অবস্থান নেয় এবং লোকদের সঙ্গে মিলিত হয়। জনবসতিতে অনুপ্রবেশ করে না সে কখনো।
যে রাতে আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলছিলেন যে, আমাদের এই কায়রোগামী বাহিনী মিসরে অবস্থানরত সৈন্যদের ব্যাপারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, সে রাতে রহস্যময় সেই লোকটি কায়রো থেকে বেশ দূরবর্তী এক খজুরবীথি-ঘেরা এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। তার নিয়ম ছিল, সে কখনো জ্যোৎস্না রাতে কাউকে সাক্ষাৎ দিত না। দিনের বেলা কারো সঙ্গে কথা বলত না। অন্ধকারের রাতগুলোই ছিল তার প্রিয়। তার মাহফিল এমন সব বাতি দ্বারা আলোকিত হত, যার একটির রং ছিল অন্যটি থেকে আলাদা। সেই আলোরও বিশেষ এক প্রভাব ছিল, যা উপস্থিত লোকদের উপর যাদুর ন্যায় ক্রিয়া করত।
বর্তমানে লোকটি যেখানে অবস্থানরত, তার খানিক দূরে একটি লোকালয়, যার অধিকাংশ অধিবাসীই মুসলমান। সুদানী হাবশীও আছে কিছু। এলাকায় একটি মসজিদও আছে, যার ইমাম স্বল্পভাষী মানুষ। একটি যুবক ছেলে আজ দেড়-দুমাস হল তার নিকট দ্বীনি তালীম হাসিল করতে আসা-যাওয়া করছে। মাহমদু বিন আহমদ নামক এই যুবকটি এসেছে অন্য এক এলাকা থেকে। তার সব ভাবনা ইমাম আর তার ইলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আরো একটি জিনিস নিয়ে তার কৌতূহল আছে- একটি মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটির নাম সাদিয়া। সাদিয়া মাহমুদকে ভালবাসে। মেয়েটি কয়েকবার তাকে তার বকরীর দুধপান করিয়েছে।
দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে লোকালয় থেকে দূরে এক চারণভূমিতে। যেদিন সাদিয়া তার চারটি বকরী ও দুটি উট চড়াতে সেখানে গিয়েছিল, সেদিন মাহমুদও চলার পথে সেখানে পানি পান করার জন্য থেমেছিল। দুজনের চোখাচোখি হলে সাদিয়াই প্রথম জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথা থেকে এসেছেন, কোথায় যাচ্ছেন? মাহমুদ জবাব দেয়, আমি কোথাও থেকে আসেনি এবং কোথাও যাচ্ছি না। শুনে সাদিয়া ফিক্ হেসে ফেলে। সাদিয়া জিজ্ঞেস করে, আপনি কি মুসলমান? সুদানী? মাহমুদ জবাব দেয়, আমি মুসলমান। মেয়েটি মুচকি হাসে। মাহমুদ মেয়েটির সঙ্গে এমন কিছু কথা বলে, যা তার কাছে ভাল লাগে। সাদিয়া তাকে সুদানের যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তার কথার ধরনে বুঝা যায়, ইসলামী ফৌজের প্রতি তার সমর্থন রয়েছে। মেয়েটি সুলতান সালাহুদ্দীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মাহমুদ তার এমন সব প্রশংসা করে যে, সুলতান আইউবী মানুষ নন- আসমান থেকে নাযিল হওয়া ফেরেশতা। সাদিয়া জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, সালাহুদ্দীন আইউবী কি সেই ব্যক্তি অপেক্ষাও বড় বুযুর্গ, যিনি আকাশ থেকে এসেছেন এবং মৃত প্রাণীকে জীবিত করে ফেলেন।
না, সালাহুদ্দীন আইউবী মৃত প্রাণীকে জীবিত করতে পারেন না। মাহমুদ জবাব দেয়।
আমরা শুনেছি, সালাহুদ্দীন আইউবী নাকি জীবন্ত মানুষকে খুন করে ফেলেন! সন্দেহমূলক প্রশ্ন করে সাদিয়া মানুষ এ-ও বলছে, তিনি নাকি মুসলমান এবং আমাদের ন্যায় নামায-কালাম পড়েন?
তোমাকে কে বলেছে যে, তিনি মানুষ খুন করেন? মাহমুদ জিজ্ঞেস করে।
আমাদের গ্রাম দিয়ে অনেক মুসাফির আসা-যাওয়া করে। তারা বলে, সালাহুদ্দীন আইউবী নাকি খুব খারাপ মানুষ। সাদিয়া জবাব দেয়।
তোমাদের মসজিদের ইমাম কী বলেন? মাহমুদ জিজ্ঞেস করে।
তিনি অত্যন্ত ভাল কথা বলেন- সাদিয়া জবাব দেয়। তিনি বলেন, সালাহুদ্দীন আইউবী সমগ্র মিসরে ও সুদানে ইসলামের আলো বিস্তার করার জন্য এসেছেন। তিনি বলেন, ইসলাম-ই আল্লাহ পাকের একমাত্র সত্য দ্বীন।
মাহমুদ বিন আহমদ মেয়েটির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে থাকে। আলোচনা থেকে সে জানতে পারে যে, তার গ্রামে এমন কিছু লোক আসা যাওয়া করে থাকে, যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করে; কিন্তু কথা বার্তা এমন বলে যে, তাতে কিছু লোকের মনে ইসলামের ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি হয়ে গেছে। মাহমুদ সাদিয়ার মনের সংশয় দূর করে দিয়েছে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব ও মধুর ভাষায় তার উপর এমন প্রভাব বিস্তার করে ফেলে যে, মেয়েটি অকপটে বলেই ফেলে, আমি এখানে প্রায়-ই বকরী চড়াতে আসি। আপনি এ
পথে আসলে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। মাহমুদ মেয়েটিকে আবেগ ও বাস্তবতার মাঝে ফেলে রেখে তার গ্রামের দিকে রওনা হয়ে যায়।
সাদিয়া একাকি দাঁড়িয়ে ভাবে, লোকটি কে? কোত্থেকে এল? যাচ্ছে-ইবা কোথায়? লোকটির পোশাক অত্র এলাকার বটে, কিন্তু তার গঠন-আকৃতি, তার কথা-বার্তা প্রমাণ করছে সে এখানকার কেউ নয়।
সাদিয়ার সন্দেহ যথার্থ। মাহমুদ অত্র এলাকার মানুষ নয়। বাড়ি তার ইস্কান্দারিয়া। আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ সদস্য। বেশ কয়েক মাস যাবত সে অর্পিত দায়িত্ব পালনার্থে সীমান্তবর্তী পল্লী এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। তার থাকা-খাওয়ার ঠিকানা গোপন। সঙ্গে আরো কয়েকজন গুপ্তচর রয়েছে, যারা অত্র এলাকার-ই বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। কদিন পর পর তারা নির্ধারিত গোপন ঠিকানায় একত্রিত হয় এবং প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে একজনকে কায়রো পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই আলী বিন সুফিয়ান সংবাদ পাচ্ছেন যে, দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে কী সব ঘটনা ঘটছে।
মাহমুদ বিন আহমদ সাদিয়াকে তার গ্রামের মসজিদের ইমাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। তার কারণ, ইতিপূর্বে দুটি গ্রামের বিভিন্ন মসজিদে সে এমন ইমামের সন্ধান পেয়েছে- যাদেরকে তার সন্দেহ হয়েছিল। এলাকার লোকদের থেকে সে জানতে পারে যে, ইমামরা এখানে নতুন এসেছেন। এর আগে এসব মসজিদে ইমাম ছিলেন-ই না। তারা দুজন-ই জিহাদের বিরুদ্ধে ওয়াজ করেন, কুরআন হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। রহস্যময় সেই লোকটিকে সমর্থন করেন এবং জনসাধারণকে তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। মাহমুদ ও তার দুসহকর্মী মিলে এই ইমামদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে কায়রো পাঠিয়ে দেয়। আর এখন সে যাচ্ছে সাদিয়ার গ্রামের দিকে। তার একথা শুনে বেশ ভাল লেগেছিল যে, সেই গ্রামে ইমাম সুলতান আইউবীর ভক্ত ও ইসলামের জন্য নিবেদিত। মাহমুদ বিন আহমদ সেই মসজিদকে নিজের ঠিকানা বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
***
মাহমুদ সাদিয়ার এলাকার মসজিদে পৌঁছে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বলে, আমি ধর্মীয় শিক্ষা লাভের জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনি আমাকে দ্বীনের তালীম দিন। ইমাম তাকে তালীম দেবেন বলে ওয়াদা দেন এবং তাকে মসজিদে-ই থাকার প্রস্তাব করেন। মাহমুদ মসজিদে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। সে ইমামকে বললে, দু-তিন দিন পরপর আমাকে বাড়ি যেতে হবে। ইমাম নাম জিজ্ঞেস করলে মাহমুদ নিজের আসল নাম গোপন রেখে অন্য নাম বলে। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সে দূরবর্তী কোন সীমান্ত এলাকার কথা বলে। ইমাম মুচকি হেসে বলে উঠলেন, মাহমুদ বিন আহমদ! আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, তুমি তোমার কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন নও। ইস্কান্দারিয়ার মুসলমানরা দায়িত্ব পালনে বড় পাকা।
মাহমুদ সহসা চমকে ওঠে। সে মনে করেছিল ইনি খৃষ্টানদের চর। কিন্তু ইমাম তাকে দীর্ঘ সময় সন্দেহের মধ্যে পড়ে থাকতে দিলেন না। বললেন, অন্তত তোমার কাছে আমার পরিচয় প্রকাশ করে দেয়া উচিত। আমি তোমার ই বিভাগের একজন কর্মকর্তা। আমি তোমার সব সঙ্গীকেই- যারা এ অঞ্চলে কর্মরত আছে-জানি। তোমরা কেউ আমাকে চিননা। আমি আলী বিন সুফিয়ানের সেই স্তরের কর্মকর্তা, যারা দুশমনের উপর দৃষ্টি রাখার পাশপাশি নিজেদের গুপ্তচরদের উপরও নজর রাখে। আমি ইমাম সেজে গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব পালন করছি।
তারপরও আমি আপনাকে বিচক্ষণ বলব না-মাহমুদ বিন আহমদ বলল-আপনি যেভাবে আমার সামনে নিজেকে প্রকাশ করলেন, তেমনি দুশমনের কোন গুপ্তচরের সামনেও করতে পারেন।
আমি নিশ্চিত ছিলাম তুমি আমার-ই মানুষ-ইমাম বললেন-প্রয়োজনের তাগিদেই আমি নিজেকে তোমার সামনে প্রকাশ করে দেয়া আবশ্যক মনে করেছি। আমার দুজন রক্ষী আছে। তারা ছদ্মবেশে এই এলাকায় অবস্থান করে। তবে আমার আরো লোকের প্রয়োজন ছিল। ভালোই হল, তুমি এসে পড়েছ। এই গ্রামে দুশমনের সন্ত্রাসীরা আসছে। তুমি নিশ্চয় ঐ লোকটির কথা শুনে থাকবে, যার সম্পর্কে প্রসিদ্ধি আছে যে, সে ভবিষ্যতের সংবাদ বলতে পারে এবং মৃত প্রাণীকে জীবিত করতে পারে। এই গ্রামটিও তার সেই সব অদেখা কারামতের কবলে চলে গেছে। আমি গ্রামবাসীদেরকে প্রথমদিকে বলেছিলাম যে, এর সবই মিথ্যা। কোন মানুষ লাশের ভিতরে জীবন ঢুকাতে। পারে না। কিন্তু তার প্রভাব এতই ব্যাপক যে, মানুষ আমার বিরোধী হয়ে উঠে। আমি সংযত হয়ে যাই। কারণ, আমি এই মসজিদ থেকে বের হতে চাইনা। আমার একটি আচ্ছা এবং একটি ঠিকানার তো প্রয়োজন। এখানকার পথহারা মানুষগুলোকে ইসলামের সোজা রাস্তাও তো দেখাতে হবে। পনের বিশদিন পর রাতে দুজন লোক আমার নিকট আসে। আমি তখন মসজিদে একা। তাদের উভয়েই ছিল মুখোশপরা। তারা আমাকে হুমকি দেয়, আমি। যেন এখান থেকে চলে যাই। তাদেরকে বললাম, আমি অসহায় মানুষ, আমার– আর কোন ঠিকানা নেই। তারা বলল, এখানে থাকতেই যদি চান, তাহলে দারস বন্ধ করে দিয়ে সেই ব্যক্তির কথা প্রচার করুন, যিনি আসমান থেকে এসেছেন এবং আল্লাহর সত্য ধর্ম নিয়ে এসেছেন। আমি তখন ইচ্ছে করলে দুজনের মোকাবেলা করতে পারতাম। অস্ত্র তো সবসময় সঙ্গে-ই রাখি। কিন্তু লড়াই করে কাউকে হত্যা বা নিজে নিহত হয়ে তো আমি কর্তব্য পালন করতে পারতাম না। আমি কৌশল অবলম্বন করি। আমি তাদেরকে নিশ্চয়তা দেই যে, আজ থেকে তোমরা আমাকে তোমাদের-ই লোক মনে কর। তারা বলল, আপনি যদি আমাদের কথামত আজ করেন, তাহলে আপনি দুটি পুরস্কার পাবেন। প্রথমত আপনার জীবন রক্ষা পাবে। দ্বিতীয়ত আপনার অর্থের অভাব হবে না।
তারপর আপনি আপনার বয়ানের ধারা পাল্টিয়ে দিয়েছেন?-মাহমুদ জিজ্ঞেস করে।
এক রকম-ইমাম জবাব দেন-এখন আমি দুরকম কথাই বলি। আমার স্বর্ণমুদ্রার নয়-প্রয়োজন শুধু জীবনটার। আমি কর্তব্য পালন না করে মরতে চাই না। গ্রামের বাইরে গিয়ে তোমাকে বা তোমার অন্য কোন সহকর্মীকে খুঁজে বের করাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সে রাতে আমার দেহরক্ষীরাও আমার কাছে ছিল না। এখন আল্লাহ নিজেই তোমাকে আমার সামনে এনে দিয়েছেন। তুমি আমার কাছে আমার শিষ্য হয়ে থাক। কথা বলবে সরল-সহজ গ্রাম্য মানুষদের মত। গ্রামের চার-পাঁচজন মানুষ এমন আছে, যারা আমাকে সঙ্গ দিতে প্রস্তুত। আমরা যদি কাছাকাছি কোন সীমন্ত রক্ষী বাহিনী পেয়ে যেতাম, তাহলে কাজ হত। তবে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কোন কমাণ্ডারের উপর ভরসা রাখাও বিপজ্জনক। দুশমন সোনা-দানা আর নারী দিয়ে অনেককে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। তারা বেতন খায় আমাদের কোষাগারের, আর কাজ করে দুশমনের।
মাহমুদ বিন আহমদ ইমামের কাছে থেকে যায়। সেদিনই ইমাম তার দুদেহরক্ষীর সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন।
সন্ধ্যার সময় সাদিয়া মসজিদে ইমামের জন্য খাবার নিয়ে আসে। মাহমুদকে দেখে প্রথমে থমকে যায়। তারপর মুচকি হাসে। মাহমুদ জিজ্ঞেস করে, আমার জন্য খাবার আনবে না? সাদিয়া খাবারের পাত্র ইমামের হুজরায় রেখে ছুটে যায়। কিছুক্ষণ পর কয়েকটি রুটি ও এক পেয়ালা বকরীর দুধ নিয়ে আসে।
সাদিয়া চলে যায়। ইমাম মাহমুদকে বললেন, এটি অত্র অঞ্চলের সবচে সুন্দরী মেয়ে। বয়স কম। বুদ্ধিমতীও বটে। মেয়েটির বেচা-কেনার কথা-বার্তা চলছে।
বেচা-কেনা না বিবাহ? বিস্ময়ের সাথে মাহমুদ জিজ্ঞেস করে।
বেচা-কেনা-ইমাম বললেন-তুমি জান না, এদের বিবাহ মূলত ক্রয় বিক্রয়-ই হয়ে থাকে। কিন্তু সাদিয়ার ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের পেরেশান হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তার ক্রেতা একজন সন্দেহভাজন মানুষ। লোকটি এখানকার বাসিন্দা নয়। মনে হচ্ছে, যারা আমাকে হুমকি দিয়েছিল, এরা তারাই। তুমি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে, ওরা মেয়েটিকে ওদের রঙে রঙিন করে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। তাই মেয়েটিকে রক্ষা করা জরুরী। তাছাড়া মেয়েটি মুসলমান। সালতানাতের পাশাপাশি আমাদেরকে দেশের মেয়েদের সম্ভ্রমের হেফাজত করাও আবশ্যক। আমি আশা রাখি, এই সওদা হতে পারবে না। সাদিয়ার পিতাকে আমি আমার মুরীদ বানিয়ে রেখেছি। কিন্তু সমস্যা হল, লোকটি গরীব ও নিঃসঙ্গ মানুষ। সমাজের রীতি-নীতি উপেক্ষা করে টিকে থাকার মত শক্তি তার নেই। এক কথায়, জগতে সাদিয়ার মোহাফেজ আমরা ছাড়া আর কেউ নেই।
মাহমুদ ইমামের শিষ্য হয়ে যায়। দিন যেতে থাকে। সাদিয়ার সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ ঘটতে থাকে। মেয়েটি বকরী নিয়ে চারণভূমিতে যায়, মাহমুদও যথাসময়ে সেখানে গিয়ে হাজির হয়। দুজনে কথা হয়, গল্প হয়।
মাহমুদ সাদিয়াকে জিজ্ঞেস করে, ঐ যে কে যেন তোমাকে কিনতে চায়, লোকটা কে?
সাদিয়া তাকে চিনে না। লোকটা অপরিচিত-অন্য এলাকার মানুষ। গরু ও মহিষ ক্রয় করার আগে মানুষ যেভাবে দেখে থাকে, ঐ লোকটাও এসে সাদিয়াকে সেভাবে দেখে গেছে।
সাদিয়ার ভাল করেই জানা আছে যে, সে কারো স্ত্রী হবে না। আরবের কোন বিত্তশালী ব্যবসায়ী-আমীর বা উজীর তাকে নিজের হেরেমে বন্দী করে রাখবে আর কোন পুরুষের স্ত্রীত্বের মর্যাদা না পেয়ে-ই বৃদ্ধা হয়ে মরে যাবে। কিংবা নাচ-গান শিখিয়ে তাকে বিনোদনের উপকরণে পরিণত করবে। মেয়েটি তার গ্রামের সৈন্যদের কাছে এরূপ মেয়েদের অনেক কাহিনী শুনেছে।
একটি অনুন্নত এলাকার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সাদিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। নিজের ভালোমন্দ সম্পর্কে সচেতন সে। প্রথম সাক্ষাতে মাহমুদের মনে স্থান করে নেয়। তারপর যখন বুঝল যে, মাহমুদও তাকে কামনা করতে শুরু করেছে, তখন সে মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে, সে বিক্রি হবে না। মেয়েটি জানত, ক্রেতাদের থেকে রক্ষা পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। একদিন সাদিয়া মাহমুদকে জিজ্ঞেস করে
আপনি কি আমাকে কিনে নিতে পারেন না?
পারি-মাহমুদ জবাব দেয়-কিন্তু আমি যে মূল্য দেব, তা তোমার পিতা গ্রহণ করবেন না।
কত মূল্য দেবেন?
আমার কাছে দেয়ার মত আমার হৃদয়টা ছাড়া আর কিছুই নেই-মাহমুদ জবাব দেয়-জানিনা তোমার হৃদয়ের মূল্য জানা আছে কিনা।
আপনার অন্তরে যদি আমার ভালবাসা থাকে, তাহলে এই মূল্য আমার জন্য অনেক বেশী-সাদিয়া বলল-আপনি ঠিকই বলেছেন যে, আমার পিতা এই মূল্য গ্রহণ করবেন না। কিন্তু আমি একথাও বলে দিব যে, আমার পিতা আমাকে বিক্রি করতে-ই চান না। তার সমস্যা হল, তিনি গরীব এবং নিঃসঙ্গ মানুষ। আমার কোন ভাই নেই। ক্রেতারা তাকে হুমকি দিয়েছে, তিনি যদি তাদের মূল্য গ্রহণ না করেন, তাহলে তারা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে।
তোমার পিতা এত মূল্য কেন গ্রহণ করছেন না?-মাহমুদ জিজ্ঞেস করে-মেয়েদেরকে বিক্রি করার তো এতদঞ্চলে নিয়ম আছে।
আব্বা বলছেন, ওদেরকে মুসলমান বলে মনে হয়নি-সাদিয়া বলল-আমিও আব্বাকে বলে দিয়েছি, আমি অমুসলিমদের কাছে যাব না। আপনি যদি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে আমি এখনই যেতে রাজি আছি।
আমি প্রস্তুত- মাহমুদ বলল।
তাহলে চলুন-সাদিয়া বলল- আজ রাতেই চলুন।
-মাহমুদ বলে ফেলল-আমি আমার কর্তব্য সম্পাদন না করে যেতে পারব না।
কী কর্তব্য?-সাদিয়া জিজ্ঞেস করে।
মাহমুদ বিন আহমদ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সাদিয়াকে বলা সম্ভব নয় যে, তার কর্তব্য কী। সে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু সাদিয়া ছাড়বার পাত্রী নয়। মাহমুদের হঠাৎ স্মরণ এসে যায়। বলল, আমি ইমামের কাছে ধর্মশিক্ষা নিতে এসেছি তা সম্পন্ন না করে যাব না।
ততদিন জানিনা আমি কোথায় চলে যাব!-হতাশ কণ্ঠে বলল সাদিয়া।
মাহমুদ বিন আহমদ নিজের কর্তব্যের উপর একটি মেয়েকে প্রাধান্য দিতে পারেনি। তার মনে এই সন্দেহ জাগ্রত হয় যে, এই মেয়েটি দুশমনের চরও তো হতে পারে যে, আমাকে বেকার করে দেয়ার জন্য তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে! মাহমুদ মেয়েটিকে যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন অনুভব করে।
***
সুলতান আইউবীর বাহিনীর অবস্থান কায়রো থেকে আট-দশ মাইল দূরে। তাকে অবহিত করা হয়েছিল যে, এই বাহিনী উত্তেজিত এবং মিসরের বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত। সুলতান আইউবী সেখানেই ছাউনী ফেলার নির্দেশ দেন এবং নিজে সৈন্যদের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে শুরু করেন। তিনি নিজে সৈন্যদের জযবা যাচাই করে দেখতে চান। তিনি একজন অশ্বারোহী সৈন্যের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। সঙ্গে আরো কয়েকজন সৈন্য এসে তার চতুর্পার্শ্বে ভীড় জমায়। তিনি তাদের কুশল জিজ্ঞেস করেন এবং স্বাভাবিক কথা-বার্তা বলতে শুরু করেন। হঠাৎ এক সিপাহী মুখ খুলল। গোস্তাগী মাফ করুন সালারে আজম! এখানে ছাউনী ফেলার প্রয়োজন তো ছিল না। আমরা তো সন্ধ্যা নাগাদ-ই কায়রো পৌঁছে যেতে পারতাম!
তোমরা দীর্ঘদিন লড়াই করে এসেছ-সুলতান আইউবী বললেন-আমি তোমাদেরকে এই খোলা ময়দানে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দিতে চাই।
আমরা এসেছি লড়াই করতে, যাচ্ছিও লড়াই করতে।-সিপাহী বলল।
লড়াই করতে যাচ্ছ? কিছুই জানেন না এমন ভান ধরে সুলতান বললেন-আমি তো তোমাদেরকে কায়রো নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে তোমরা তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হবে!
ওরা আমাদের দুশমন-সিপাহী বলল-আমাদের বন্ধুরা বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে ওরা আমাদের শত্রু।
খৃষ্টানদের চেয়েও ঘৃণ্য শক্র- আরেক সিপাহী বলল।
কেন সালারে আজম-কায়রোতে গাদ্দারী ও বিদ্রোহ চলছে, একথা কি সঠিক নয়? জিজ্ঞেস করে অন্য এক সিপাহী।
কিন্তু সমস্যা হয়েছে শুনেছি-সুলতান আইউবী বললেন- আমিও দোষীদের শাস্তি দেব।
আপনি সমগ্র বাহিনীকে কী শাস্তি দেবেন? এক সৈন্য বলল- শাস্তি আমরা দেব। আমাদের কমান্ডারগণ আমাদেরকে কায়রোর পুরো ঘটনা শুনিয়েছেন। আমাদের সঙ্গীরা শোবক ও কার্কে শহীদ হয়েছে। কার্ক-শোবকে আমাদের মা-বোন-কন্যাদের সম্ভ্রম লুষ্ঠিত হয়েছে। কার্কে তো এখনো হচ্ছে। আমাদের সঙ্গীরা প্রাচীরের উপর থেকে নিক্ষিপ্ত আগুনে জ্বলে-পুড়ে শহীদ হয়েছে। আমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস কাফেরদের দখলে। আর আমাদের সেনাবাহিনী কিনা কায়রো বসে মৌজ করছে, আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে! যাদের কাছে শহীদের মর্যাদা নেই, নিজ কন্যার মান-সম্ভ্রমের মূল্য নেই, তাদের বেঁচে থাকারও অধিকার নেই। আমরা খবর পেয়েছি, তারা ইসলামের দুশমনের দোস্ত হয়ে গেছে। যতক্ষণ না আমরা গাদ্দারদের মস্তক ছিন্ন করব, ততক্ষণ শহীদদের আত্মা আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। আমরা যে জখমী ভাইদের সঙ্গে নিয়ে এসেছি, আপনি তাদের প্রতি একটু তাকান। তাদের কারো পা নেই, কারো হাত নেই। এরা কি চিরদিনের তরে এই জন্য পঙ্গুত্ববরণ করে নিল যে, আমাদের সাথী-বন্ধুরা দুশমনের হাতের খেলনায় পরিণত হবে? না, আমরা তা বরদাশত করব না। তাদেরকে আমরা নিজ হাতে শাস্তি দেব।
দেখতে না দেখতে বিপুল সৈন্য সুলতান আইউবীর চারদিকে এসে জড়ো হয়। সকলের চোখে প্রতিশোধের আগুন, মুখে প্রতিবাদী ভাষা। সুলতান আইউবী তাদের এই জোশ এই চেতনা অবদমিত করে তাদের মন ভাঙ্গতে চাইছেন না। তিনি তাদেরকে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়ার উপদেশ দিলেন- কোন নির্দেশ দিলেন না।
সুলতান নিজ তাঁবুতে ফিরে আসেন। উপদেষ্টা ও নায়েবদের ডেকে এনে বললেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বাহিনী এখানেই অবস্থান করবে। তিনি বললেন
আমি চাক্ষুস দেখেছি যে, এই বাহিনী মিসর গেলে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে। সেনাবাহিনী যদি পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হয়, তাহলে দুশমন লাভবান হয়। আমি আজ রাতেই কায়রো যাচ্ছি। কেউ যেন টের না পায় যে, আমি এখানে নেই। সৈন্যদের স্পৃহাও দমন করার চেষ্টা করবেন না।
কতিপয় জরুরী নির্দেশ ও পরামর্শ দিয়ে সুলতান আইউবী বললেন
আমাদের কায়রোর যে বাহিনী বিদ্রোহ করতে উদ্যত, আমার দৃষ্টিতে তারা নির্দোষ। জাতির যে যুবক শ্ৰেণী মদ-জুয়া ও মানসিক বিলাসিতায় অভ্যস্ত হতে চলেছে, আমার মতে তাদেরও কোন দোষ নেই। আমাদের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই ভুল তথ্য দিয়ে তাদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ঐ কর্মকর্তাদেরই ইঙ্গিতে দুশমন আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শহরে নগ্নতা ও বিলাসিতার উপকরণ ছড়িয়েছে। দেশের এই নৈতিক অধঃপতন এ কারণেই বিস্তার লাভ করার সুযোগ পেয়েছে যে, আমাদের প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল এসব প্রতিহত করা, তারাই এ কাজে মদদ যুগিয়েছে। দুশমন তাদেরকে ভাতা দিচ্ছে। যখনই কোন জাতির রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা দুশমনের হাতের খেলনায় পরিণত হয়, তখন সেই জাতির পরিণতি এমনই নয়। আমাদের একদল সৈন্য সুদানের মরুভূমিতে বিক্ষিপ্ত হয়ে না খেয়ে লড়ছে, মরছে আর প্রশাসন তাদের রসদ ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে বসে আছে। এসব কি দুশমনের ষড়যন্ত্র নয়, যা সফল করে তুলছে আমাদেরই কর্মকর্তারা আমাদের কোন কোন ভাই মিসরের ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখছে। তারা সর্বাগ্রে সেনাবাহিনীকে জনগণের চোখে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে, যাতে ক্ষমতা দখল করে তারা ইচ্ছেমত শাসন করতে পারে। আমার বন্ধুগণ! আমার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কোন খায়েশ নেই। আমার বিরুদ্ধবাদীদের কেউ যদি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারে যে, সে আমার লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে, তাহলে আমি তার বাহিনীতে একজন সাধারণ সিপাহী হয়ে কাজ করব। কিন্তু এমন লোকটি কে? ওরা অবশিষ্ট জীবন রাজা হয়ে কাটাতে চায়। তার জন্য দুশমনের হাতে হাত মিলাতে হলেও তারা প্রস্তুত। আর আমি আমার জীবদ্দশায়ই জাতিকে এমন এক স্তরে উত্তীর্ণ করতে চাই, যেখানে তারা তাদের দ্বীনের দুশমনের মাথায় পা রেখে রাজত্ব করবে। আমাদের ঐসব লোভী ও গাদ্দার শাসকদের দৃষ্টি বর্তমানের উপর। আর আমার নজর জাতির ভবিষ্যতের প্রতি।
সুলতান আইউবী বলতে বলতে থেমে যান। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, এক্ষুণি আমার ঘোড়া প্রস্তুত কর। তিনি যাদেরকে সঙ্গে নেবেন, তাদের নাম উল্লেখ করে বললেন, চুপিচুপি এদেরকে ডেকে আন এবং বলে দাও তাদের কায়রো যেতে হবে। আমার তবু এখানে এভাবেই থাকবে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে, আমি এখানে নেই।
সুলতান আইউবী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি আপনাদেরকে পরিষ্কার করে বলছি, মিসরের যে বাহিনী বিদ্রোহ করতে চাচ্ছে, আমি তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে যাব না। তোমরা কেউ তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখবে না। আমি এ্যাকশন নেব তাদের বিরুদ্ধে, যারা সেনাবাহিনী ও দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত ও অপদস্ত করার কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। আমাদের এই বাহিনীই যখন দুশমনের মুখোমুখি হবে এবং দুশমন তীর ছুঁড়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাবে, তখন তাদের স্মরণ এসে যাবে যে, তারা আল্লাহর সৈনিক। তখন তাদের মাথা থেকে বিদ্রোহের পোকা বেরিয়ে যাবে। আপনারা যখন নিজ নিজ সন্তানদেরকে তাদের দ্বীনের দুশমনকে দেখিয়ে দেবেন, তখন তাদের চিন্তা চেতনা আপনা-আপনিই জুয়া থেকে সরে গিয়ে জিহাদমুখী হয়ে যাবে। আমি আপনাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় বলছি, ইসলাম ও ইসলামী সালতানাতের অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষা সেনাবাহিনী ছাড়া সম্ভব নয়। খৃস্টান ও ইহুদীদের প্রত্যয়, তাদের যুদ্ধরীতি ও গোপন তৎপরতার আলোকে আমি বলে দিতে পারি যে, তারা আমাদের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে ইসলামের মূলোৎপাটন করতে চায়। কোন মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। আমাদের আজকের ভুল পদক্ষেপ ইসলামের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দেবে। আমি বলতে পারি না, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর আমাদের বিচ্যুতি, ব্যর্থতা ও সফলতা থেকে লাভবান হতে পারবে কিনা।
মোহতারাম আমীরে মেসের!- এক উপদেষ্টা বলল- আমাদের ভাইয়েরা যদি গাদ্দারীর বিদ্যায়-ই পান্ডিত্য অর্জন করতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ বংশধর গোলাম হয়েই থাকতে বাধ্য হবে। তারা জানবেই না, আযাদী কাকে বলে এবং জাতীয় মর্যাদাইবা কী? আমাদের কাছে কি এর কোন প্রতিকার নেই?
জাতির মন-মস্তিষ্ককে সচেতন কর- সুলতান বললেন- জনগণকে প্রজা বল না। দেশের প্রতিটি মানুষই আপন আপন ক্ষেত্রে রাজা। দেশের একজন মানুষকেও জাতীয় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত কর না। আমাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাথায় রাজা ও খলীফা হওয়ার ভূত সাওয়ার হয়েছে। তাই তারা জাতিকে প্রজা বানিয়ে তাদেরকে নিজেদের ক্ষমতা পাকাঁপোক্ত করার কাজে ব্যবহার করতে চায়। মনে রেখ, জাতি শুধু কতগুলো দেহের সমষ্টিই নয়, যাদেরকে তোমরা পশুপালের ন্যায় হাঁকাতে থাকবে। জাতির মধ্যে মেধা মস্তিস্কও আছে। আত্মা আছে। আছে জাতীয় মর্যাদাবোধও। তোমরা জাতির এই গুণগুলোকে শাণিত কর, যাতে তারা নিজেরাই ভাল-মন্দ বিবেচনা করতে শিখে। সচেতন দেশবাসী যদি অনুভব করে যে, দেশে সালাহুদ্দীন আইউবী অপেক্ষা ভাল ও যোগ্য নেতা আছেন, যিনি সালতানাতে ইসলামিয়াকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি সমুদ্রের ওপার পর্যন্ত তার বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হবেন, তাহলে যে কেউ আমার পথরোধ করে সাহসিকতার সঙ্গে বলতে পার যে, সালাহুদ্দীন! তুমি মসনদ ছেড়ে দাও, আমরা তোমার অপেক্ষা যোগ্য নেতা পেয়ে গেছি। এমন সচেতনতা ও সাহিসকতা দেশের মানুষের থাকা উচিত। তোমরা দোয়া কর, আমার মধ্যে যেন ফেরাউনী চরিত্র ঢুকে না পড়ে যে, কেউ আমার বিরুদ্ধে কথা বলল আর আমি অমনি জল্লাদ ডেকে তার মাথাটা কেটে ফেললাম। আমার আশংকা, মিল্লাতে ইসলামিয়া এরূপ ফেরাউনদের বলির শিকার হতে যাচ্ছে। আমার ভয় হচ্ছে, এ জাতিকে একদিন প্রজা ও পশুতে পরিণত করা হবে। তখন মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না। থাকলেও থাকবে নামমাত্র। ধর্ম পরিচয়ে তারা মুসলমানই থাকবে, কিন্তু সভ্যতা হবে খৃস্টানদের।
এমন সময়ে এক মোহাফেজ ভেতরে প্রবেশ করে বলল, ঘোড়া প্রস্তুত। যে তিন-চারজন নায়েব সালারকে তলব করা হয়েছিল, তারাও এসে পড়েছেন। সুলতান আইউবী চারজন মোহাফেজ সঙ্গে নিলেন। অন্যদের বললেন, তোমরা আমার এই শূন্য তাঁবুটি পাহারা দাও। কেউ যেন বুঝতে না পারে যে, আমি এখানে নেই। যেসব আমলা তার সঙ্গে যাবে, তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা সাবধানে অমুক স্থানে চলে যাও, আমি যথাসময়ে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব। একজন স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে সুলতান আইউবী তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়েন।
***
অন্ধকার মরুভূমি। দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছে চৌদ্দটি ঘোড়া। সুলতান আইউবী ভোরের আলো ফোঁটার আগেই কায়রো পৌঁছুতে চান। আলী বিন সুফিয়ানকে তিনি সঙ্গে রেখেছেন। চৌকিতে সৈন্যরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। জাগ্রত সান্ত্রীরাও টের পায়নি যে, তাদের সালার বেরিয়ে গেছেন। আর কায়রোবাসীদের তো কল্পনায়ও নেই যে, তাদের সুলতান এই মুহূর্তে কায়রো ঢুকে যেতে পারেন।
রাতের শেষ প্রহর। সুলতান আইউবীর কাফেলা কায়রোতে প্রবেশ করে। তাদের কোন সান্ত্রীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হল না। কোন সান্ত্রী ছিলও না সেখানে। সুলতান তার সঙ্গীদের বললেন, এ হল, বিদ্রোহের প্রথম ধাপ। শহরে কোন প্রহরী নেই। বাহিনী ঘুমিয়ে আছে- বেপরোয়া, উদাসীন। অথচ দুটি ময়দানে আমাদের যুদ্ধ চলছে। দুশমনের হামলার আশংকা আছে প্রতি মুহূর্তে।
গন্তব্যে পৌঁছে যান সুলতান আইউবী। মুহূর্ত বিলম্ব না করে তিনি মিসরের অস্থায়ী সেনা প্রধানকে তলব করেন। আল-ইদরীসকেও ডেকে পাঠালেন। সেনাপ্রধান সুলতান আইউবীকে দেখে ভয় পেয়ে যান। সুলতান আল ইদরীসের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। আল-ইদরীস বললেন, আমার ছেলেরা যদি যুদ্ধের ময়দানে নিহত হত, তাহলে আমি আনন্দ পেতাম। কিন্তু আফসোস, ওরা নিহত হল প্রতারণার শিকার হয়ে। তিনি বললেন, এখন পুত্রদের বিরহে মাতম করার সময় নয়। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে অন্য উদ্দেশ্যে তলব করেছেন। বলুন, হুকুম কী?
ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান ইসলামের জন্য নিবেদিত মুসলমান। সুলতান আইউবী তাঁদের দুজনের নিকট থেকে কায়রোর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট নেন এবং জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের দৃষ্টিতে প্রশাসনের কোন্ কোন্ কর্মকর্তা সন্দেহভাজন। তিনি বিশেষ করে সেনা কর্মকর্তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তারা সুলতান আইউবীকে কয়েকটি নাম বলেন। তিনি নির্দেশ দিতে শুরু করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশটি হল, সন্দেহভাজন কর্মকর্তাগণ কায়রোয় কেন্দ্রীয় দফতরেই অবস্থান করবে এবং সকল সৈন্যকে সূর্যোদয়ের আগে আগেই অভিযানে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত করবে। আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে সুলতান আইউবী একটি পরিকল্পনা তৈরিতে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। আলী বিন সুফিয়ানকেও কিছু পরামর্শ দিয়ে বিদায় করে দেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাক্যাম্পে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সৈন্যদেরকে সময়ের আগেই জাগিয়ে তোলা হল। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর হেডকোয়ার্টারে ডেকে নেয়া হয়। তারা ভেবে বিস্মিত যে, এ সব কী হয়ে গেল! তারা শুধু এতটুকু জানতে পেরেছেন যে, সুলতান আইউবী এসে পড়েছেন। তারা সুলতানের ঘোড়াও দেখেছিলেন, কিন্তু তাকে দেখেননি। সুলতানও এসে পরিকল্পনামাফিক নিজেকে তাদের থেকে গোপন রেখেছেন।
ভোরের আলো এখনো ফোটেনি। সৈন্যরা সারিবদ্ধ দণ্ডায়মান। পদাতিক ও আরোহীদের সারির পেছনে রসদ ও অন্যান্য সামানপত্রে বোঝাই উটের বহর। সুলতান আইউবী দেশের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে গঠন করেছেন যে, কখনো তাৎক্ষণিক নির্দেশ পেলে যেন এক ঘন্টার মধ্যে রসদ ও অন্যান্য সামানসহ প্রস্তুত হয়ে যায়। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল এখানেও। বাহিনী রাত শেষ হওয়ার আগেই রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
সুলতান আইউবী ঘোড়ায় আরোহন করেন। মিসরের ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানও তাঁর সঙ্গে। সুলতান সারিবদ্ধ দণ্ডায়মান বাহিনীর প্রতি চোখ বুলান এবং একটি সারির সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করতে শুরু করেন। মুখে তার হাসি হাসি ভাব। তিনি বলছেন, শাবাশ! শাবাশ! ইসলামের বীর সেনানীরা। তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হোক।
সালাহুদ্দীন আইউবীর ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই অবনত। সৈন্যরা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে আছে তাদের মহান সেনাপতির মুখের প্রতি। সেই সঙ্গে তার মুচকি হাসি আর প্রশংসামূলক উক্তি সৈন্যদের আরো প্রভাবিত, আরো উজ্জীবিত করে তোলে। মিসরের গবর্নর ও সালারে আজমের সাধারণ সৈন্যদের এতটুকু ঘনিষ্ঠ হওয়াই ছিল যথেষ্ট।
সমগ্র বাহিনী পরিদর্শন করে এবার সুলতান আইউবী সেনাদের উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে ভাষণ দান করেন। তিনি বললেন
আল্লাহর নামে জীবনদানকারী মুজাহিদগণ! তোমরা শোবকের দুর্ভেদ্য দুর্গ- যা ছিল কুফরের সবচেয়ে নিরাপদ আস্তানা- বালির স্তূপ মনে করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলে। তোমরা খৃস্টানদেরকে মরুভূমিতে বিক্ষিপ্ত করে হত্যা করেছিলে এবং অনেকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান করে নিয়েছ। তোমাদের সঙ্গীরা, তোমাদের বন্ধুরা তোমাদের চোখের সামনে শহীদ হয়েছে। তোমরা তাদের লাশ নিজ হাতে দাফন করেছ। তোমরা সেই কমান্ডো শহীদদের কথা স্মরণ কর, যারা দুশমনের সারির মধ্যে ঢুকে পড়ে শাহাদাতবরণ করেছে। তোমরা তাদের জানাযা পড়তে পারনি, দাফন করতে পারনি। এমনকি তাদের মৃতদেহটা পর্যন্ত তোমরা এক নজর দেখতে পারনি। দুশমন তাদের লাশের সঙ্গে কী আচরণ করেছে, তা তোমরা জান। তোমরা শহীদদের বিধবা স্ত্রী ও এতীম সন্তানদের কথা স্মরণ কর, যাদের স্নেহ-মমতা-ভালবাসা আল্লাহর নামে কোরবান হয়ে গেছে। আজ শহীদদের আত্মা তোমাদের ডাকছে। তোমাদের আত্মমর্যাদা ও পৌরুষকে চীৎকার করে আহ্বান করছে। দুশমন কার্ক দুর্গকে এত দুর্ভেদ্য ও মজবুত করে তুলেছে যে, তোমাদের সঙ্গীরা প্রাচীরের উপর থেকে নিক্ষিপ্ত আগুন ভেদ করে প্রাচীর ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে…।
ইসলামের মর্যাদার প্রহরীগণ! কার্ক দুর্গে তোমাদের বোন-কন্যাদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হচ্ছে। বৃদ্ধদেরকে পশুর ন্যায় খাটান হচ্ছে। যুবকদেরকে বন্দীশালায় আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু যে আমি খৃস্টানদের পাথরের কেল্লা ভেঙ্গে চুরমার করেছিলাম, সেই আমি মাটির দুর্গ জয় করতে পারলাম না। আমার শক্তি তোমরা। আমার ব্যর্থতা তোমাদেরই ব্যর্থতা।
সুলতান আইউবীর কণ্ঠস্বর আরো উঁচু হয়ে যায়। তিনি দুবাহু ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বললেন
তোমরা আমার বুকটা তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দাও। আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। কিন্তু আমার জীবন হরণ করার আগে আমাকে অবশ্যই এ সুসংবাদ শোনাতে হবে যে, তোমরা কার্ক দুর্গ জয় করে নিয়েছ এবং সম্ভ্রমহারা মা-বোন-কন্যাদের উদ্ধার করেছ।
তৎকালের ঐতিহাসিক আসাদুল আসাদী লিখেছেন, সুলতান আইউবীর ভাষণ মুসলিম সৈনিকদের অন্তরে তীরের ন্যায় গেঁথে যাচ্ছিল। তাদের চেহারা রক্তিম হয়ে ওঠে এবং তারা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। তাদের হৃদয় থেকে বিদ্রোহের আগুন নিভে যেতে শুরু করে। সুলতান আইউবীর উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়।
সালতানাতে ইসলামিয়ার মুহাফিজগণ! তোমাদের তরবারীগুলো ভোতা করে দেয়ার জন্য খৃস্টানরা তাদের মেয়েদের ইজ্জত ও হাশীশ ব্যবহার করছে। তোমরা হয়ত জান না, খৃস্টানরা তাদের একটি মেয়ের ইজ্জত বিলিয়ে এক হাজার মুজাহিদকে বেকার করে তুলছে। একটি মেয়েকে দিয়ে আমাদের হাজার মেয়ের চরিত্র নষ্ট করছে। তারা তোমাদের মাঝে একটি চরিত্রহীনা মেয়ে ঢুকিয়ে আমাদের হাজার হাজার মেয়ের চরিত্র বিনষ্ট করছে। তোমরা যাও, আপন বোন-কন্যাদের ইজ্জত রক্ষা কর। তোমরা সেই কার্ক অভিমুখে রওনা হচ্ছ, যেখানে পবিত্র কুরআনের পাতা ছিন্নভিন্ন পড়ে আছে ও কাফিরদের পায়ে দলিত হচ্ছে। যেখানে তোমাদের মসজিদগুলো খৃস্টানদের শৌচাগারে পরিণত হয়েছে। যে খৃস্টানরা তোমাদের ভয়ে থরথর করে কাঁপত, ওখানে তারা তোমাদের নিয়ে ঠাট্টা করছে। শোষক তোমরা জয় করেছিলে; কার্কও তোমাদের-ই জয় করতে হবে।
সুলতান আইউবী বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করেননি যে, তারা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। তিনি কারো ব্যাপারে সংশয়-সন্দেহের ইঙ্গিতও করেননি। তার স্থলে তিনি বাহিনীর চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধকে উত্তেজিত করে তোলেন, যার ফলে যে বাহিনী এতক্ষণ এই ভেবে বিস্মিত ছিল যে, এত সাত সকালে কেন আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হল, এখন তাদের বিস্ময়ের কারণ হল, কেন আমাদেরকে এক্ষুণি কার্কের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে না!
সুলতান আইউবীর ভাষণের পর সমস্ত বাহিনী এখন উত্তেজিত। তিনি ঊর্ধ্বতন ও অধঃস্তন কমান্ডারদের ডেকে পাঠান। তারা এলে তিনি তাদেরকে রওনা হওয়া সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বাহিনীকে যে পথে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন, সেটি সেই রাস্তা থেকে অনেক দূরে, যে পথে রণাঙ্গনের বাহিনী ফিরে আসছে। সুলতান আইউবী যে কমান্ডারদেরকে কার্ক থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি তাদেরকেও রওনাকারী বাহিনীর সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। তাদেরকে তিনি আগেই গোপনে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। বাহিনী যখন রওনা হওয়ার নির্দেশ পায়, তখন সৈন্যদের তাকবীর ধ্বনিতে কায়রোর আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। আবেগের অতিশয্যে জ্বলজ্বল করে ওঠে সুলতান আইউবীর মুখমণ্ডল।
বাহিনী যখন সুলতান আইউবীর দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়, তখন তিনি একজন দূতকে পয়গাম দিয়ে সেই ছাউনীর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন, যেখানে রণাঙ্গন থেকে আগত বাহিনী অবস্থান নিয়ে আছে। দূতকে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার নির্দেশ দেয়া হয়। বার্তা হল, পয়গাম প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীকে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা করাও।
পথের দূরত্ব ছিল আট-দশ মাইল। দূত দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তৎক্ষণাৎ বাহিনী রওনা হওয়ার নির্দেশ পায়। সূর্যাস্তের পর বাহিনীর অগ্রগামী ইউনিট কায়রোতে ঢুকে পড়ে। পেছনে পেছনে ঢুকে পড়ে অন্যান্য ইউনিটও। তাদেরকে থাকার জন্য সেই স্থান দেয়া হয়, যেখানে গতরাত পর্যন্ত কার্কের উদ্দেশ্যে রওনাকারী বাহিনী অবস্থান করছিল। কমান্ডাররা সৈন্যদেরকে অবহিত করে যে, এখানকার বাহিনীকে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এরা ছিল ক্ষুব্ধ উত্তেজিত। আলী বিন সুফিয়ান এদেরকে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছেন।
সুলতান আইউবী পরম বুদ্ধিমত্তার সাথে বিদ্রোহের আশংকাও দূর করে দেন এবং গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও নিঃশেষ করে দেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কমান্ডার ও সেসব সেনা কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠান, যারা সীমান্ত বাহিনীগুলোর জিম্মাদার। সীমান্তে কত সৈন্য আছে এবং কোন্ কোন্ স্থানে আছে জেনে নিয়ে তিনি সে পরিমাণ সৈন্য সকাল সকাল যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। সুলতানকে অবহিত করা হয়েছিল যে, সীমান্ত বাহিনীগুলো দেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য ও সামরিক বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র বাইরে পাচার করার ব্যাপারে দুশমনের সহযোগিতা করছে। সুলতান আইউবী এই বাহিনীগুলোর কমান্ডারকে বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেন এবং সীমান্ত থেকে প্রত্যাহৃত বাহিনীগুলো সম্পর্কে নির্দেশ দেন, যেন তাদেরকে ওখান থেকেই রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
***
সাদিয়া দুবেলা মসজিদে ইমামকে খাবার দিয়ে যায়। মাহমুদ বিন আহমদ শিষ্য পরিচয় নিয়ে ইমামের নিকট থেকে ধর্মশিক্ষা অর্জন করছে। সাদিয়া যে চারণভূমিতে বকরি চরায়, মাঝে-মধ্যে সেখানেও যাওয়া-আসা করে সে। ওখানে টিলা আছে। জায়গাটা সবুজ-শ্যামল। পানির অভাব নেই। এলাকাটা লোকালয় থেকে খানিক দূরে।
সাদিয়া মাহমুদকে নিজের মোহাফেজ ভাবতে শুরু করেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, মাহমুদ তাকে কাফেরদের হাত থেকে রক্ষা করবেই। কিন্তু মাহমুদ, এখন-ই তাকে নিজ গ্রামে নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। সাদিয়া মাহমুদকে এমনও বলে যে, তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে রেখে এস, তারপর বিদ্যা অর্জন কর। মাহমুদ তাকে বলতে পারছে না যে, তার বাড়ি মিসরের অন্য প্রান্তে, যেখানে ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না।
মাহমুদ তার অভিজ্ঞতা বলে বুঝে ফেলেছে, সাদিয়া দুশমনের ক্রীড়নক নয়। কর্তব্যের পথে প্রতিবন্ধক না হলেও আরো আগেই মাহমুদ মেয়েটিকে এলাকায় নিয়ে যেত। তাছাড়া মসজিদের ইমাম তারই বিভাগের একজন অফিসার, যার উপস্থিতিতে সে কর্তব্যে অবহেলা করতে পারে না। ইমাম তাকে এ-ও বলেছিলেন যে, তুমি আমার সঙ্গেই থাক। মাহমুদের দৃষ্টিতে এটি তার প্রতি তার অফিসারের নির্দেশ।
একদিন হঠাৎ গ্রামে হুলস্থুল শুরু হয়ে যায়। কিছু অপরিচিত লোকের চেহারা চোখে পড়তে শুরু করে। সকলের মুখে একই কথা–তিনি আসছেন। তিনি আকাশ থেকে এসেছেন। মৃতকে জীবন দানকারী আসছেন…।
আজ গ্রামের প্রতিটি মানুষ বেজায় খুশি। তারা বলছে, তাদের উদ্দেশ্য পূরণকারী আসছেন।
সাদিয়া দৌড়ে আসে। মাহমুদ বিন আহমদকে বলে, শুনেছ, তিনি আসছেন। তুমি কি জান, আজ আমি তার কাছে কি চাইব? আমি তাকে বলব, মাহমুদ যেন আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যায়। তারপর তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।
মাহমুদ কোন জবাব দিতে পারল না। এখনও সেই রহস্যময় লোকটিকে দেখেনি সে। মাহমুদের ডিউটি এলাকায় এই প্রথমবার-ই আসছেন তিনি। তার কেরামতের কাহিনী এ এলাকার মানুষ শুনেই আসছে শুধু।
মাহমুদ বাইরে বেরিয়ে পড়ে। অপরিচিত লোকদের মধ্যে তার দুজন গোয়েন্দা সহকর্মী দেখতে পায়। তাদের কর্মস্থল অন্য এলাকা। মাহমুদ তাদেরকে এখানে কেন এসেছে জিজ্ঞেস করে। তারা বলে, আমরা গায়েবজানা লোকটিকে দেখতে এসেছি। তবে তারা এসেছে গুপ্তচর হিসেবে নয়। তারা লোকটির দ্বারা চরমভাবে প্রভাবিত। তারা কোথাও লোকটির কারামত দেখেছে। সেই কাহিনী তারা মাহমুদের কাছে এমনভাবে বিবৃত করে, যেন এতে তাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। তাদের বিবরণে মাহমুদও প্রভাবিত হয়ে পড়ে। মাহমুদের এ দুসহকর্মী গায়েবজানা লোকটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। মাহমুদ ভাবে, আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দারা যার দ্বারা প্রভাবিত হয়, সে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়ে পারে না।
সাদিয়া যেখানে উট-বকরী চরানোর বাহানা দেখিয়ে মাহমুদের সঙ্গে মিলিত হত, মাহমুদ সেই সবুজঢাকা এলাকায় চলে যায়। কিন্তু এখন সেখানে ভিন্ন পরিবেশ। দুব্যক্তি দূরে থাকতেই তাকে থামিয়ে দেয় এবং বলে, খোদার প্রেরিত পয়গাম্বর আসছেন। এ জায়গা তার জন্য পরিস্কার করা হচ্ছে। তিনি এখানে অবস্থান করবেন।
মাহমুদ দূর থেকে তাকিয়ে দেখে, টিলার ভিতরে গুহামত কি যেন তৈরী করা হচ্ছে এবং জায়গাটা সমতল করা হচ্ছে। এখন সেখানে কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। গ্রামের মানুষ কাজ-কর্ম ত্যাগ করে সেদিকে ছুটছে আর নির্দিষ্ট স্থানে এসে জড়ো হচ্ছে। জায়গাটা পরিচ্ছন্ন করা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা পালাক্রমে এসে এসে জনতাকে আগন্তুকের অলৌকিক কাহিনী শোনাচ্ছে। মানুষ আনন্দিত ও অভিভূত হচ্ছে।
রাতেও মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটির প্রতি তাদের ভক্তি বিশ্বাসের অবস্থা এই যে, সেদিন তারা মসজিদে যাওয়ার কথাও ভুলে যায়। পরদিন ভোর হতে না হতেই মানুষ আবার সেখানে সমবেত হতে শুরু করে। রাতে আপরিচিত লোকদের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। তারা সেখানে গর্তও খনন করছিল। তাদের সঙ্গে কয়েকটি উটও আছে, যেগুলো মালামাল দ্বারা বোঝাইকরা। মালপত্র নামানোর কাজ শুরু হয়। তার মধ্য থেকে অনেকগুলো তবু বেরিয়ে এল। তারা তাঁবুগুলো স্থাপন করতে শুরু করে।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। তারপর রাত। অন্ধকার রাত। তিনি অন্ধকার রাত ছাড়া মানুষকে সাক্ষাৎ দেন না। সন্ধ্যার পরও মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। উৎসুক জনতার একধারে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো মেয়ে। তাদের মধ্যে আছে সাদিয়াও।
মেহমানদের জন্য যে জায়গাটা পরিস্কার করা হচ্ছিল, সেখানে প্রদীপ জ্বলছে। সাদিয়া যে মেয়েদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, দুজন লোক তাদের পিছনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েগুলো তাদের দেখেনি। সম্মুখে আছে তিন-চারজন। এরা অপরিচিত। মেয়েদের কাছে এসে তারা বলে উঠে, এই,তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তারা মেয়েগুলোকে সরাবার জন্য তাড়া দেয়। মেয়েরা ছুটে পালাতে উদ্যত হয় এবং এক একজন এক একদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একজন পিছন থেকে সাদিয়ার গায়ের উপর কম্বল ছুঁড়ে মারে। শক্ত দুটি বাহু দ্বারা তার কোমর ঝাঁপটে ধরে। তারপর কম্বল পেছানো অবস্থায় কাঁধে তুলে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়ে। এক তো অন্ধকার। দ্বিতীয়ত সঙ্গী মেয়েরা যার যার মত পালিয়ে গেছে। তাই সাদিয়ার অপহরণ ঘটনা দেখেনি কেউ।
পরদিন ভোরবেলা। চারণভূমি অভিমুখে মানুষের ঢল নেমেছে যেন। জনতার বিশাল এক মিছিল এগিয়ে চলছে চারণভূমির দিকে। মিছিলের সম্মুখে ষোল-সতেরটি উট। প্রতিটি উটের উপর একটি করে পালকি। প্রতিটি পালকি পর্দা দ্বারা ঢাকা। তার কোন একটিতে তিনি উপবিষ্ট। সামনে বাজছে দফ ও সানাই। দফ-সানাইয়ের বাজনার তালে গুনগুন করে কি যেন গাইছে কিছু মানুষ। উটগুলোর ঘাড়ে ঝুলন্ত বড় বড় ঘন্টার আওয়াজ সেই বাজনার-ই অংশ বলে মনে হচ্ছে। জনতার এত বিপুল সমাগম, কিন্তু কোন হৈ হুল্লোড়, চেঁচামেচি নেই। নিঝুম-নীরব এগিয়ে চলছে সকলে। এটি মুরীদ ও ভক্তদের মিছিল। এরা কোথা কোথা থেকে পীর সাহেব-এর পিছনে পিছনে হেঁটে চলছে। এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেন পালকি বহনকারী উটটি আকাশ থেকে অবতরণ করছে।
কাফেলাটি সবুজ-শোভিত জায়গায় চলে যায়। এলাকাটা চারদিক থেকে টিলায় ঘেরা। একস্থানে অনেকগুলো তাঁবু বসানো আছে পূর্ব থেকেই। তন্মধ্যে একটি তাঁবু বেশ বড়। উৎসুক জনতাকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে কেউ দেখতে পেল না পাকি থেকে কে নামল আর কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। ভক্তদের ভীড় দূরে সরে গিয়ে একস্থানে বসে পড়ে। সাদিয়ার গ্রামের মানুষ তাদের থেকে পবিত্র মানুষটির গল্প-কাহিনী শুনতে থাকে। মানুষ যত গোঁয়ার, পশ্চাদপদ ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়, আজগুবি, কল্প-কাহিনীর প্রতি তত দুর্বল হয়। সেই পরিবেশ-ই বিরাজ করছে এখন এখানে।
এ দৃশ্য অবলোকন করছেন ইমামও। দেখছে মাহমুদ বিন আহমদও। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে মাহমুদ। কায়রো থেকে তার এবং তার সহকর্মীদের কাছে নির্দেশ এসেছে, সীমান্ত এলাকায় নতুন এক বিশ্বাসের বিস্তার ঘটছে। সে সম্পর্কে তথ্য নিয়ে রিপোর্ট দাও, সেসমস্ত আসলে কী এবং কারা তার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কায়রো এখনো এ ব্যাপারে কোন তথ্য পায়নি। তার কারণ, রহস্যময় লোকটি এ-যাবত যে কটি এলাকায় গমন করেছে, সেসব এলাকার গুপ্তচররাও তার ভক্তে পরিণত হয়ে গেছে। তারা তার বিপক্ষে কোন কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। সীমান্ত বাহিনীগুলোও তার প্রভাবে প্রভাবিত। পালা। এবার, ইমামের। তিনি যাচাই করে দেখবেন, এসব আসলে কী? ভাওতা? ভন্ডামী? বুযুর্গী? তিনি লক্ষ করছেন, মানুষ শুধু তার গল্প শুনে এত-ই প্রভাবিত হয়ে পড়ছে যে, তারা মসজিদে যাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। লোকটাকে এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে।
ইমাম ও মাহমুদ একস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদিয়ার পিতা এসে তাদের সামনে দাঁড়ান। অস্থিরচিত্তে বললেন, সাদিয়া রাত থেকে নিখোঁজ। তার সঙ্গী মেয়েরা বলছে, রাতে তারা এখানে কোথাও দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কয়েকজন লোক এসে তাদেরকে সম্মুখ থেকে তাড়া দেয় এবং চলে যেতে বলে। ভয়ে তারা এদিক-সেদিক দৌড় দেয়। এক মেয়ে বলল, সে তাদের পিছনে দুটি লোক দেখেছিল। তারপর কী হয়েছে কেউ বলতে পারেনা।
সাদিয়ার পিতা সাদিয়ার সন্ধানে নেমে পড়ে। মাহমুদও তার সঙ্গ নেয়। এখানে কোথায় পাওয়া যাবে সাদিয়াকে। তারপরও পিতার মন! বেচারা অস্থিরমনে এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে। মাহমুদও তার সঙ্গে ঘুরছে। হঠাৎ অপরিচিত এক ব্যক্তি তাদেরকে থামতে বলে। তারা থেমে যায়। লোকটি জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি কাউকে খুঁজছ? সাদিয়ার পিতা বললেন, হ্যাঁ, গত রাতে আমার একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে।
হ্যাঁ, এই একটু আগেই কে যেন আমাকে বলল, তুমি তার বাপ। অপরিচিত লোকটি সাদিয়ার গঠন-আকৃতির বিবরণ দিয়ে বলল- তুমি মেয়েটিকে এখানে খুঁজে পাবেনা। এতক্ষণে সে মিসরের সীমানা পার হয়ে অনেক দূর চলে গেছে হয়ত। গতকাল সন্ধায় আমি একটি ঘোড়া দেখেছিলাম। একটি অতিশয় রূপসী যুবতী মেয়ে তার সঙ্গী মেয়েদের থেকে সরে ঘোড়াটির কাছে চলে যায়। আরোহী ঘোড়ার কাছেই দাঁড়ানো ছিল। মেয়েটি তার সঙ্গে কথা বলে। আরোহী ঘোড়ায় চড়ে কয়েক পা সরে আড়ালে চলে যায়। মেয়েটি এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার পিছনে পিছনে চলে যায়। নিকটে গিয়ে সে নিজেই আরোহীর সামনে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। আরোহী ঘোড়া হাঁকিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আজ কে একজন আমাকে বলল, মেয়েটি তোমার কন্যা। এখন আর ওকে তালাশ করে লাভ নেই।
সাদিয়ার পিতার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মাহমুদ ভাবে ভিন্ন কিছু। সে গোয়েন্দা। তার বিশ্বাস, লোকটি জ্বলন্ত মিথ্যা কথা বলছে। তার বক্তব্যের আগাগোড়া পুরোটাই অসত্য। ঘটনাটা দেখেছে যখন সে একা, তাহলে অন্য কেউ কি করে তাকে বলল, মেয়েটি কার কন্যা? গোয়েন্দাদের বিশেষভাবে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যে, কারো কথা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করবে না এবং প্রথম প্রথম যে কাউকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে।
মাহমুদ অপরিচিত এই লোকটির পিছু নেয়, লোকটি ভীড়ের মধ্যদিয়ে টিলার পিছনে চলে যায় এবং অসংখ্য তাঁবুর কোন একটির মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যায়। মাহমুদ নিশ্চিত, সাদিয়া এসব ভাবুর-ই কোন একটিতে আছে এবং তার অপহরণে এই লোকটির হাত আছে। লোকটি সাদিয়ার সেই কাষ্টমারদেরও একজন হতে পারে, যারা এক পর্যায়ে সাদিয়ার পিতাকে মেয়ের অপহরণের হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু সাদিয়ার পিতা লোকটাকে চিনেনি। সাদিয়ার পিতা যাতে মেয়েকে খুঁজে না বেড়ায়, সেজন্য লোকটি তাকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে।
মাহমুদ ইবনে আহমদ গভীরভাবে ভালবাসে সাদিয়াকে। সে মেয়েটিকে উদ্ধার করার প্রত্যয় নেয়। মসজিদে গিয়ে ইমামকে বিষয়টি অবহিত করে। ইমাম গোয়েন্দা বিভাগের একজন বিচক্ষণ কর্মকর্তা। তিনিও অভিমত ব্যক্ত করেন যে, এই গরীব লোকটিকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে। মাহমুদ এলাকায় অবস্থানকারী দুগোয়েন্দার কথা উল্লেখ করে বলে, আমি সাদিয়াকে উদ্ধার করব; এ-কাজে আমার ওদের সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। এ মুহূর্তে টিলার অভ্যন্তরে যাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
***
সূলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী তার বাহিনীকে কার্ক অবরোধের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন এবং কিভাবে দুর্গ ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করা যায় ভাবতে থাকেন। তিনি প্রথম দিন-ই তাঁর কমান্ডারকে বলে দেন, যে দুর্গ সালাহুদ্দীন আইউবী জয় করতে পারেননি, তা তোমরাও সহজে পদানত করতে পারবে না। সালাহুদ্দীন আইউবী তো অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানোর মত মানুষ।
সুলতান আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গীকে অবহিত করে গেছেন যে, তিনি দুর্গজয়ে কি কি পন্থা প্রয়োগ করেছেন। দুর্গের অভ্যন্তরে কি কি আছে, তাও তিনি জঙ্গীকে জানিয়ে গেছেন। খৃষ্টানদের রসদ কোথায়, পশুপাল কোথায়, জনবসতি কোন দিকে সব-ই তিনি জঙ্গীকে জানিয়ে গেছেন। তিনি গোয়েন্দা মারফত এসব তথ্য জেনেছিলেন। তিনি ভিতরে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার মিনজানীক ছোট হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। তার বিপরীতে খৃষ্টানদের কাছে আছে বড় বড় কামান, যার গোলা বহুদূর পর্যন্ত। পৌঁছে যায়। আইউবীর মিনজানীকের পাল্লা কম। এ কারণে দুর্গের ফটকেও আগুনের গোলা নিক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছে না। কোন দিক থেকে মুজাহিদরা প্রাচীর ভাঙ্গার চেষ্টা করলে উপর থেকে খৃষ্টানরা জ্বলন্ত কাঠ ও অঙ্গারের ড্রাম গড়িয়ে ছেড়ে দেয়।
নুরুদ্দীন জঙ্গী তার নায়েবদের নিয়ে বৈঠক করেন। তিনি বললেন
সালাহুদ্দীন আইউবী আমাকে বলেছিলেন, তিনি বড় মিনজানীক তৈরি করিয়ে ভিতরে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে পারতেন। কিন্তু সমস্যা হল, ভিতরে মুসলমান বসতিও আছে। তিনি এমন কোন পন্থা অবলম্বন করতে চাচ্ছিলেন না, যাতে একজন মুসলমানেরও ক্ষতি হয়। কিন্তু আমি আইউবীর চিন্তাধারার পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। আমি এত বড় মিনজানীক তৈরি করার ব্যবস্থা করেছি, যার দ্বারা নিক্ষিপ্ত আগুন ও ভারী পাথর বহু দূর গিয়ে পতিত হবে। তাতে ভিতরে দুএকজন মুসলমানের ক্ষতি হলেও বৃহত্তর স্বার্থে তা মেনে নিতে হবে। আমার বন্ধুগণ! তোমরা যদি কার্কের মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা জানতে, তাহলে বলতে, ওদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। ওখানে একজন মুসলমানেরও ইজ্জত নিরাপদ নয়। মুসলিম মেয়েরদের খৃষ্টানদের বিছানায় রাতযাপন করতে হচ্ছে। পুরুষরা বন্দীদশায় বেগার খাটছে। তারা হয়ত এ দুআ-ই করছে যে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি দুনিয়া থেকে নিয়ে যাও। আমাদের অবরোধ যত দীর্ঘ হবে, তাদের দুর্দশাও তত দীর্ঘতর হতে থাকবে। তাছাড়া আমাদের এ অভিযানে মুসলমানদের ক্ষতি হলেও কজনের আর হবে। যতটুক হবে, সে কোরবানী আমাদের দিতেই হবে। আপনারাও তো মরবার জন্যই এসেছেন। ইসলামকে জিন্দা রাখতে হলে কিছু জীবন হারাতে-ই হবে। আমি বিষয়টা আপনাদেরকে এজন্য অবহিত করলাম, যেন আপনারা কেউ আমার উপর এই অভিযোগ আরোপ করতে না। পারেন যে, আমি একটি দুর্গ জয় করার জন্য নিরপরাধ মুসলমানদেরকে পুড়িয়ে মেরেছি।
না, আমরা কেউ তেমনটা ভাবব না- এক সালার বললেন- এখানে আমরা নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে আসিনি। ফিলিস্তীন মুসলমানদের। আমরা এখানে আমাদের রাসূলের বাদশাহী বহাল করতে এসেছি। প্রথম কেবলা বাইতুল মোকাদ্দাস আমাদের- ইহুদী-খৃষ্টানদের নয়।
আমরা ইহুদীদের এ দাবিও সমর্থন করি না যে, ফিলিস্তীন ইহুদীদের আদি জন্মভূমি- অন্য একজন বললেন- আমরা প্রত্যেকে আগুনে পুড়ে মৃতবরণ করতে প্রস্তুত আছি। আমরা এ যুদ্ধজয়ে আমাদের কলিজার টুকরা সন্তানদেরকেও কোরবান করতে কুণ্ঠাবোধ করব না।
সুলতান নুরুউদ্দীন জঙ্গী দুঠোঁটে মুচকি হাসি টেনে বললেন
আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, ফিলিস্তীনকে নিজেদের আবাসভূমিতে পরিণত করার জন্য ইহুদীরা কোন্ কোন্ ময়দানে লড়াই করছে। তারা তাদের ধন- সম্পদ ও বোন-কন্যাদের সম্ভ্রম খৃষ্টানদের হাতে তুলে দিয়েছে এসং তাদের দ্বারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাচ্ছে। তারা তাদের সম্পদ ও মেয়েদের মাধ্যমে, আমাদের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টি করছে। তাদের প্রধান টার্গেট সালাহুদ্দীন আইউবী ও মিসর। মিসরের বড় বড় শহরগুলোতে দুশ্চরিত্রা নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এরা সবাই ইহুদী কন্যা। দুঃখজনক সত্য হল, আমাদের মুসলিম নেতৃবর্গ ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা ইহুদীদের জালে আটকে গেছে। এবার কাফেররা তাদেরকে আপসে সংঘাতে লিপ্ত করবে। যদি আমাদের হুঁশ ফিরে না আসে, তাহলে ইহুদীরা একদিন না একদিন ফিলিস্তীনকে কজা করে নিবেই। আর মুসলমানরা বুঝতেও পারবে না যে, তাদের সেই পারস্পরিক দ্বন্ধের পিছনে ইহুদী ও খৃষ্টানদের হাত আছে। তা হবে অর্থ, নারী আর মদের প্রতিক্রিয়া, যার প্রভাব ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। আমাদের যদি ভবিষ্যৎ বংশধরকে সম্মানজনক জীবন উপহার দিয়ে যেতে হয়, তবে তার জন্য বর্তমান প্রজন্মের কিছু সন্তানকে কোরবান করতেই হবে। আমি আগামী মাসের নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার আগেই কার্ক জয় করতে চাই। হোক তা কার্কের ধ্বংস্তূপ, থাকুক তাতে মুসলমানদের ভস্মিভূত লাশ। আমরা আর অপেক্ষা করতে পারিনা। ইহুদী-খৃষ্টানদেরকে আমাদের রোম সাগরে ডুবাতেই হবে। এ কাজ আমি আমার জীবদ্দশাতে-ই সম্পন্ন করে যেতে চাই। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমাদের পরে ইসলামের পতাকা গাদ্দার ও ক্রুশ-প্রেমিক মুসলমানদের হাতে চলে যাবে।
নুরুদ্দীন জঙ্গী একদল কারিগরও সঙ্গে রেখেছিলেন। তিনি সংশ্লিষ্ট কারিগরদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা লম্বা লম্বা খেজুরের ডাল কেটে মিনশনীক তৈরি করে। কারিগররা দিন-রাত অবিশ্রাম মিনজানীক তৈরির কাজে ব্যস্ত। তার পাশাপাশি নুরুদ্দীন জঙ্গী ভারী ভারী পাথরেরও স্তূপ তৈরি করে ফেলেন। তাঁর কাছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর রেখে যাওয়া জ্বালানীও রয়েছে। বিপুল পরিমাণ তরল দাহ্য পদার্থ তিনি সঙ্গে করেও এনেছিলেন।
সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর আগুনের গোলা তৈরির কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ঠিক এ সময়ে মিসর থেকে সুলতান আইউবীর প্রেরিত বাহিনীও এসে পৌঁছে। তাদের সম্পর্কে নুরুদ্দীন জঙ্গীকে জানানো হয়েছিল, তারা বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সুলতান জঙ্গীও তাদের মধ্যে বিদ্রোহের আভাষও পেলেন না। সুলতান জঙ্গী সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায় বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মানুষ। তিনিও এই বাহিনীকে এক জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুললেন, যেমনটা জ্বালাময়ী ভাষণে উত্তেজিত করে প্রেরণ করেছেন সুলতান আইউবী।
একদিন। সূর্য ডুবে গেছে। খৃষ্টান ম্রাট ও উচ্চপদস্থ সেনা কমান্ডারগণ দুর্গের ভিতরে বৈঠক করছেন। তাদের কথা-বার্তা প্রমাণ করছে, দুর্গ অবরোধ সম্পর্কে তাদের কোন অস্থিরতা নেই। তারা এ-ওজানে যে, সুলতান আইউবী মিসর চলে গেছেন এবং নুরুদ্দীন জঙ্গী এসে তার দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন। বৈঠকের দিন সকালে তারা জানতে পারে যে, মিসর থেকে নতুন সৈন্য এসেছে। এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য তাদের এ বৈঠকের আয়োজন।
সবেমাত্র তাদের আলোচনা শুরু হয়েছে। এমনি সময়ে বিস্ফোরণের ন্যায় একটি শব্দ তাদের কানে আসে। ধসেপড়া ইট-পাথরের পতনের শব্দও শুনতে পায়। খৃষ্টান সম্রাট ও কমান্ডারগণ দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। তারা যে কক্ষে বৈঠক করছিল, তারই সংলগ্ন অন্য একটি কক্ষের ছাদ ফেটে গেছে। একটি ভারী পাথরের আঘাতে ছাদ ফেটে যাওয়ার শব্দ-ই বিস্ফোরণের মত মনে হয়েছিল। তার-ই সন্নিকটে এসে পড়েছিল আরো একটি পাথর। অবস্থা আশংকাজনক মনে করে খৃষ্টানরা সেখান থেকে সরে যায়। তারা বুঝে ফেলেছে। যে, মুসলমানরা মিনজানীক দ্বারা পাথর নিক্ষেপ করছে। তারা দুর্গের প্রাচীরের নিকট গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে; কিন্তু অন্ধকারের কারণে কিছু-ই দেখা গেল না।
এটি নুরুদ্দীন জঙ্গীর তৈরিকরা মিনজানীকের প্রথম পরীক্ষামূলক ব্যবহার। নুরুদ্দীন জঙ্গী মধ্যরাতের পর পুনরায় অভিযান পরিচালনা করেন। তাতে খৃষ্টানদের প্রধান কার্যালয়ের দুটি ছাদ ধসে পড়ে এবং কয়েকটি কক্ষের দেয়াল ফেটে যায়। এই ক্ষয়ক্ষতি তেমন মারাত্মক না হলেও তাতে খৃষ্টানদের মনোবলে ভাটা পড়ে যায়, তাদের মনে ভয় ধরে যায়। দেয়ালের কয়েকটি ফাটল হেডকোয়ার্টারের রক্ষীসেনা ও অন্যান্য আমলাদেরকে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য করে। ভোর নাগাদ নুরুদ্দীন জঙ্গীর এই ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ এক ভয়াবহ সংবাদ হয়ে নগরীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অথচ, মধ্য রাতের পর নুরুদ্দীন জঙ্গীর নতুন উদ্ভাভিত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের পর তা অকার্যকর হয়ে যায়।
***
সাদিয়া মহল্লার বাইরে যেখানে বকরী চরাত, সে ভূখন্ড এখন এমন এক জনবসতিতে পরিণত হয়েছে, যার চাকচিক্য তথাকার লোকদের চোখে এক স্বর্গীয় পরিবেশ বলে মনে হচ্ছে। সূর্য অস্ত গেছে বেশ আগে। এখন চারদিক অন্ধকার। উৎসুক জনতা পর্বতময় এলাকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়ে গেছে। তবে কারো কোন টিলার উপরে ওঠার অনুমতি নেই। একধারে বসিয়ে রাখা হয়েছে সবাইকে। যে যেখানে বসেছে, সেখান থেকে নড়াচড়া করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাউকে কোন নির্দেশ দেয়া হচ্ছেনা; শুধু তার ভয় দেখানো হচ্ছে যে, কারো কোন আচরণে যদি তিনি রুষ্ট হন, তাহলে সকলের উপর বিপদ নেমে আসবে। সবাই নীরব-নিশ্চুপ বসে আছে। কারো মুখে রা নেই।
জনতার অবস্থানের খানিক দূরে বড় বড় দুটি পালংক পাতানো। বেশ চমৎকার পালংক। উপরে জাজিম বিছানো। পালংকের পিছনে কতগুলো পর্দা ঝুলছে। পর্দাগুলোর গায়ে চকমক করছে কতগুলো তারকা। এক স্থানে বিশেষ পদ্ধতিতে স্থাপন করা আছে কতগুলো প্রদীপ। সেই প্রদীপের আলোতে-ই তারকাগুলো ঝলমল করছে। পর্দার পেছনে কতগুলো টিলা, যার পাদদেশে গুহা খনন করছে অপরিচিত মানুষগুলো। টিলার পিছনে কতটুকু সমতল ভূমি। সেখানে নানা রংয়ের তাঁবু পাতানো।
পরিবেশ পরিস্থিতিতে উৎসুক জনতা এত-ই প্রভাবিত যে, তারা পরস্পর কানে-কানেও কথা বলছে না। যে রাতে সাদিয়া অপহৃত হয়েছিল, এটি তার পরের রাত। জনতার সম্মুখে ঝুলিয়ে রাখা পর্দা ধীরে ধীরে দুলতে শুরু করে। পর্দার তারকাগুলো আকাশের তারকারাজির ন্যায় টিমটিম করছে এবং এমন জনতা এ, তিনি এনেমাগকে সবরকম অবতারণ বাজনা শোনা যাচ্ছে, যা মানুষ ইতিপূর্বে কখনো শুনেনি। যাদুর ন্যায় ক্রিয়া করছে বাজনাটি। পার্বত্য এলাকার নীরব রাতে এই বাজনা জনতার অন্তর ভেদ করছে মনে হচ্ছে। এমনও মনে হচ্ছে যে, বাজনার এই তাল জনতার মাথার উপর দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছে, যা দেখাও যাবে ছোঁয়াও যাবে। ফলে মানুষ বারবার উপরে ও ডানে-বায়ে তাকাতে শুরু করে। কিন্তু তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর যাদুময় এই বাজনার সঙ্গে যোগ হয় অন্য এক গুঞ্জন। স্পষ্ট মনে হচ্ছে, বেশকিছু মানুষ একত্রিত হয়ে একই সুরে গুনগুন করে গান গাইছে। তাতে নারী কণ্ঠও আছে। তার সঙ্গে যখন টিলার সামনে ঝুলন্ত লম্বা পর্দাগুলো দুলতে শুরু করছে, তখন মনে হচ্ছে, যেন রাতের এই পরিবেশের উপর মাদকতা নেমে এসেছে।
উৎসুক জনতা এখন সম্পূর্ণরূপে বিমুগ্ধ, অবচেতন। এমন সময়ে কোথাও থেকে বলিষ্ঠ আওয়াজ উঠে, তিনি এসে পড়েছেন, তিনি আসমান থেকে অবতরণ করেছেন। তোমরা তোমাদের দেল-দেমাগকে সবরকম ভাবনা-চিন্তা থেকে শূন্য কর। তিনি তোমাদের দেল-দেমাগে খোদার সত্য বাণী অবতারণ করবেন।
ঝুলন্ত পর্দাগুলো একটু নড়ে উঠে। পর্দার আড়াল থেকে এক ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে। আকারে-গঠনে তিনি মানুষ বটে, কিন্তু বাজনামুখর, ভীতিপ্রদ ও আলোক-উজ্জ্বল এই পরিবেশে তাকে কোন এক ঊর্ধ্ব জগতের প্রাণী বলে মনে হল। তার মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত দীর্ঘ। রেশমের ন্যায় চিক চিক করছে চুলগুলো। কাজল কালো। গোলগাল পরিপুষ্ট সুদর্শন মুখমণ্ডল। মুখে দীর্ঘ ঘন দাড়ি। গায়ে সবুজ রঙের চোগা, যা পর্দার-ই ন্যায় তারকাখচিত। আলোয় ঝলমল করছে তারকাগুলো। তেমনি চমক বিরাজ করছে লোকটির দুচোখেও। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বাঙ্গে প্রভাব বিরাজ করছে লোকটির, যাতে জনতা বিমুগ্ধ, বিমোহিত। পাশাপাশি বাজছে মিউজিক, আরো নানারকম গুনগুন শব্দ। মানুষ পূর্ব থেকেই তার অনুরক্ত। এখন বিস্ময়কর এক পরিবেশে তিনি তাদের চোখের সামনে উপস্থিত। এতক্ষণ জনতা উপবিষ্ট ছিল মাথানত করে। এখন তারা আরো অবনত আরো ভক্তিবিগলিত।
তিনি পর্দার সম্মুখে দাঁড়িয়ে দুবাহু উপরে মেলে ধরলেন এবং বললেন
তোমাদের উপর খোদার রহমত নাযিল হোক, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, যিনি তোমাদেরকে দেখার জন্য চোখ দিয়েছেন, শোনবার জন্য কান দিয়েছেন, বুঝবার জন্য মেধা দিয়েছেন ও কথা বলার জন্য জবান দিয়েছেন। কিন্তু তোমাদেরই ন্যায় কিছু মানুষ যাদের চোখ তোমাদেরই ন্যায়, জবানও তোমাদেরই ন্যায়- তোমাদেরকে গোলামে পরিণত করে খোদার নেয়ামত ও দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এখন তোমাদের অবস্থা হল, তোমাদের চোখ আছে বটে, কিন্তু তোমরা কিছু দেখতে পাচ্ছ না, তোমাদের কান আছে সত্য, কিন্তু তোমরা সত্য কথা শুনতে পাচ্ছ না। তোমাদের বিবেক আছে ঠিক, কিন্তু তা মিথ্যা ও অলীক বোধ-বিশ্বাসে পরিপূর্ণ। তোমরা কথা বলতে পার ঠিক, কিন্তু সেই লোকদের বিরুদ্ধে তোমরা একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পার না, যারা তোমাদেরকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। তারা তোমাদেরকে, তোমাদের উট-ঘোড়া ও তোমাদের যুবক সন্তানদেরকে ক্রয় করে নিয়েছে। তারা তোমাদের যুবক পুত্রদের দিয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করাচ্ছে, যেমনি মানুষ লড়াই করায় দুটি কুকুর দিয়ে। তারা তোমাদের উট ও ঘোড়াগুলোকে তীর-বর্শা দ্বারা ঝাঁঝরা করিয়ে মেরে ফেলছে। তোমাদের সন্তানদেরকে খুন করিয়ে মরুভূমিতে নিক্ষেপ করছে। আমি সেই চোখ, যা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। আমি সেই মস্তিষ্ক, যা বিশ্বমানবতার কল্যাণ নিয়ে ভাবে এবং আমি সেই জবান, যা মানুষকে খোদার বাণী শোনায়। আমি খোদার জবান।
আপনি কি অক্ষয় যে, আপনি কোনদনি মৃত্যুবরণ করবেন না?- সভার মধ্য থেকে একটি আওয়াজ ভেসে উঠে। সব মানুষ নীরব, নিস্তব্ধ। কেউ কেউ ভয়ও পেয়ে গেছে, লোকটার এতবড় দুঃসাহস যে, তার কথার মাঝে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল? এই অপরাধে সকলের উপর গজব নেমে আসবে না তো!
তুমি পরীক্ষা করে দেখে নাও- তিনি বললেন-আমার বুকে তীর নিক্ষেপ কর।
লোকটির কণ্ঠে ও বলার ভঙ্গীতে যাদুর ক্রিয়া। তিনি আবার বললেন, এখানে যদি কোন তীরান্দাজ থাক, তাহলে আমার বুকে তীর চালাও। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে মজলিসে। তিনি ক্ষুব্ধ ও উচ্চকণ্ঠে বললেন, আমি নির্দেশ দিচ্ছি, উপস্থিত লোকদের মধ্যে কারো কাছে তীর-কামান থাকলে আমার সামনে চলে আস।
চারজন তীরান্দাজ- যারা আশপাশের কোন মহল্লার অধিবাসী নয়- ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে। তারা ভয়ে জড়সড় যেন। তিনি বললেন, গুণে গুণে ত্রিশ কদম এগিয়ে এসে তোমরা আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যাও। তারা তা-ই করে। তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে যায়।
ধনুকে তীর সংযোজন কর।
চারজন তৃনীর থেকে তীর নিয়ে যার যার ধনুকে সংযোজন করে।
আমার হৃদপিন্ডকে নিশানা বানাও।
তারা ধনুক তাক করে নিশানা ঠিক করে।
আমি মরে যাব, সে কথা না ভেবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তীর ছোড়।
তীরান্দাজগণ ধনুক সরিয়ে নেয়। তারা ভাবে, লোকটি মরে যাবে।
আমার হৃদপিন্ডকে নিশানা বানিয়ে তীর ছোঁড়। তিনি গর্জে উঠে বললেন- অন্যথায় যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, ওখানেই অঙ্গার হয়ে যাবে।
তীরন্দাজগণ ভয় পেয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তারা ধনুক উপরে তুলে নিশানা তাক করে। জনতা নিথর, নিস্তব্ধ, যেন এখানে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। মিউজিক বাজছে। তার সঙ্গে অদৃশ্য কিছু মানুষের গুনগুন শব্দ কানে আসছে। একসঙ্গে চারটি ধনুক থেকে শা করে চারটি তীর বেরিয়ে যায়। তীরগুলো সব তার ঠিক বুকের মাঝখানটায় গিয়ে বিদ্ধ হয়। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। বাহু দুটো উপরে তোলা, ঠিক আগের মতো। ঠোঁটে তার মুচকি হাসির রেখা।
চারজন খঞ্জরধারী এগিয়ে আস- তিনি বললেন- তীরন্দাজরা চলে যাও।
বিস্ময়াভিভূত তীরান্দাজগণ মাথা নিচু করে ফিরে যায়। অন্য চারজন লোক একদিক থেকে এগিয়ে আসে। তিনি বললেন, খঞ্জর হাতে নিয়ে আমার থেকে পনের কদম দূরে গিয়ে দাঁড়াও। তারা তা-ই করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি নিশানায় খঞ্জর নিক্ষেপ করতে জান?
তারা বলল, হ্যাঁ, জানি।
তিনি বললেন, চারজন একসঙ্গে আমার বুকে খঞ্জর নিক্ষেপ কর।
চার খঞ্জরধারী পূর্ণ শক্তিতে তার গায়ে খঞ্জর নিক্ষেপ করে। সবকটি খঞ্জর তার বুকে গিয়ে বিদ্ধ হয়। তিনি পূর্ববৎ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। চারটি খঞ্জরের আগা তার বুকে বিদ্ধ। তিনি হাসছেন। ভীড়ের মধ্য থেকে আওয়াজ উঠে, শাবাশ…। মৃত্যুর ফেরেশতা তার হাতে।
আমি অক্ষয় কিনা জিজ্ঞেস করেছিলে, জবাব পেয়েছ? বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রশ্ন করেন তিনি।
এক বেদুইন দৌড়ে আসে এবং তার পায়ে সেজদাবনত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। তিনি ঝুঁকে হাতে ধরে তাকে তুলে দেন এবং বললেন, খোদা তোমার উপর রহম করুন।
তাহলে তো তুমি মৃতকেও জীবিত করতে পার- এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বলল- আল্লাহ আমাকে একটি পুত্রসন্তান দিয়েছিলেন। ছেলেটা মারা গেছে। আমি শুনেছি আপনি মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারেন। আমি বহুদূর থেকে পুত্রের লাশ বহন করে নিয়ে এসেছি। আমি বুড়ো মানুষটার উপর আপনি দয়া করুন, ছেলেটাকে জিন্দা করে দিন। বৃদ্ধ হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
চারজন লোক কাফন প্যাচান একটি লাশ নিয়ে এগিয়ে আসে। লাশটি তার সম্মুখে রাখা হয়। তিনি বললেন, একটি বাতি আন। লাশটি তুলে সবাইকে দেখিয়ে নিয়ে আস, যেন কেউ বলতে না পারে যে, ছেলেটি জীবিতই ছিল।
লাশটি বহন করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখিয়ে আনা হল। তার মুখমণ্ডলের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এক ব্যক্তি বাতি ধরে সবাইকে লাশের মুখমণ্ডল দেখায়। চেহারাটা মৃত মানুষেরই ন্যায় ফ্যাকাশে। চোখ দুটো আধাখোলা। মুখখানা সামান্য হা করা। জনতাকে দেখানোর পর লাশটি নিয়ে আবার তার সম্মুখে রাখা হল। বাজনার লয় পাল্টে গেছে এবং আগের চেয়েও হৃদয়কাড়া হয়ে উঠেছে। তিনি দুবাহু আকাশপানে উঁচিয়ে ধরে উচ্চকণ্ঠে বললেন, জীবন ও মৃত্যু তোমারই হাতে। আমি তোমার পুত্রের পুত্র। তুমি তোমার পুত্রকে কুশ থেকে রক্ষা করেছ এবং আমাকে ক্রুশের মর্যাদা দান করেছ। তোমার পুত্র ও তার ক্রুশ যদি সত্য হয়, তাহলে আমাকে শক্তি দাও, যাতে আমি এই হতভাগ্য বৃদ্ধের পুত্রকে জিন্দা করে দিতে পারি। তারপর লাশের উপরে শূন্যে এমনভাবে হাত ঘুরাতে শুরু করেন, যেন হাত দুটি তার কাঁপছে। কাফনের কাপড়টা ফড় ফড় শব্দ করতে শুরু করে। তিনি শূন্যে আরো বেগে হাত ঘুরাতে থাকেন এবং কাফনও আরো শব্দ করে ফড় ফড় করে উঠে। দর্শকদের অনেকে ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ে। মহিলাদের কেউ কেউ হাউমাউ করে চীৎকার জুড়ে দেয়। দৃশ্যটা এ কারণেও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে যে, মৃতকে জীবনদানকারী লোকটির বুকে চারটি তীর ও চারটি খঞ্জর বিদ্ধ হয়ে আছে।
কাফনের ভেতরে নড়াচড়া অনুভূত হয়। লাশ উঠে বসে পড়ে। দুহাত কাফনের ভেতর থেকে বের করে আনে। নিজ হাতে মুখমণ্ডল থেকে কাফনের কাপড় সরিয়ে ফেলে এবং চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে উঠে, আমি কি পবিত্র জগতে পৌঁছে গেছি।
না, জীবিতকারী তাকে ঠেস দিয়ে তুলে দাঁড় করান- তুমি সে জগতেই আছ, যেখানে তুমি জন্ম নিয়েছিলে। যাও, পিতার সঙ্গে বুক মিলাও।
পিতা দৌড়ে গিয়ে পুত্রকে জড়িয়ে ধরে। অস্থিরচিত্তে পুত্রকে চুম্বন করে আদর দেয়। আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে জীবনদানকারীর পায়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। জনতা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় এবং পরস্পর ফিসফিস করতে শুরু করে। জলজ্যান্ত কাফনে মোড়ানো একটি মৃতদেহ এখন তাদের চোখের সামনে হাঁটছে। মরা মানুষ জীবিত হয়ে গেছে!
কিন্তু আমি আর কাউকে জিন্দা করব না- তিনি বললেন-জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আমি যে খোদার দূত হয়ে এসেছি, তোমাদেরকে শুধু সে কথাটুকু বুঝাবার জন্য এইমাত্র আমি খোদর নিকট থেকে অনুমতি নিয়েছি যে, আমাকে সামান্য সময়ের জন্য এমন শক্তিদান করুন, যাতে আমি মৃতকে জীবিত করতে পারি। খোদা আমাকে সেই শক্তি দিয়েছেন।
আপনি কি যুদ্ধে নিহত সৈনিকেও জীবিত করতে পারেন? সভার মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করল।
না- তিনি জবাব দেন- যারা যুদ্ধ করে মারা যায়, খোদা তাদের প্রতি এতবেশী অসন্তুষ্ট হন যে, তাকে আর তিনি দ্বিতীয় জীবন দান করেন না। পরজগতে তাকে তিনি নরকে নিক্ষেপ করেন। খোদা মানবজাতিকে কাউকে খুন করার জন্য সৃষ্টি করেননি। বরং এ জন্য সৃষ্টি করেছেন যে, যেভাবে তোমাকে একজন পিতা জন্ম দিয়েছেন, তেমনি তুমিও অন্যকে জন্ম দিবে। এ জন্যই তোমাদেরকে ঘরে চারটি করে বউ রাখতে বলা হয়েছে। নারী ও পুরুষের কাজ একটাই- সন্তান জন্ম দেয়া এবং সেই সন্তান যখন বড় হবে, তার মাধ্যমেও সন্তান জন্ম দেয়ান। এ-ই তো এবাদত।
***
তিনি যখন একের পর এক অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন, ঠিক তখন টিলার পেছনে সে জায়গাটিতে লুকিয়ে আছে দুজন লোক, যেখানে রংবেরঙের তাঁবু খাটান রয়েছে। একটি তাঁবুর মধ্য থেকে কতগুলো মেয়ের কথা ও হাসাহাসির শব্দ কানে আসছে। লোক দুজন হলেন সাদিয়ার গ্রামের মসজিদের ইমাম ও তার শিষ্য মাহমুদ বিন আহমদ। মাহমুদ নিশ্চিত, সাদিয়া এখানেই কোথাও আছে। মাহমুদ ধর্মজ্ঞানে পরিপক্ক নয়। খোদার এই দূতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সে কোন সিদ্ধান্ত স্থির করার যোগ্যতা তার নেই। ইমাম বলেছিলেন, কোন মানুষ মৃতকে জীবিত করতে পারে না। রহস্যময় এই লোকটি জনতাকে কি সব প্রদর্শন করছে, সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপই নেই। তিনি বরং কৌশল অবলম্বন করেছেন যে, মানুষ তার কারামত দর্শনে নিমগ্ন থাকুক, আর এই সুযোগে আমি তার ভেদ-রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাই।
ইমাম ও মাহমুদ সাদিয়াকে খুঁজে ফিরছে। তাঁবুগুলোর জায়গাটা অন্ধকার। কেবল তিনটি তাঁবুতে আলো জ্বলছে। তিনটির সবকটির পর্দা, ভিতর-বাহির উভয় দিক থেকে আটকানো। পাহারার বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই। দুতিনজন লোক দূরে একস্থানে বসে কথা বলছে। তারা প্রহরী। দেখে ফেললে বিপদ আছে। টিলার অপরদিক থেকে তার কথা বলার আওয়াজ আসছে এবং বাজনা-মিউজিক-এরও শব্দ ভেসে আসছে। তবে এই বাজনার উৎস কোথায় বুঝা যাচ্ছে না।
ইমাম ও মাহমুদ আলোময় একটি তাঁবুর নিকটে গিয়ে কান পেতে মেয়েদের কথা শোনার চেষ্টা করে। মেয়েদের কথাবার্তা তাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। এক নারীকণ্ঠ বলছে, ম্যাজিক এখানেও সফল হচ্ছে। আরেকজন বলল, বড় মূর্খ সম্প্রদায়।
মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার এই একটাই পন্থা যে, তাদেরকে ম্যাজিক দেখিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বানিয়ে দাও- আরেক নারীর কণ্ঠ।
জানি না ও কি অবস্থায় আছে।
কে?
নতুন চিড়িয়া- এক মেয়ে বলল-তোমাদের স্বীকার করতেই হবে, ওটা আমাদের সকলের চেয়ে রূপসী।
মেয়েটা দিনভর কেঁদেই চলেছে- একজন বলল।
আজ রাতেই তার কান্না থেমে যাবে- এক মেয়ে বলল- ওকে খোদার পুত্রের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
মেয়েদের অট্টহাসি শোনা যায়। একজন বলল, খোদা কি স্মরণ করবেন যে, আমরা তাকে কেমন পুত্র দিয়েছি। বড় কামেল মানুষ।
মেয়েরা পরস্পর অশ্লীল কথোপকথন শুরু করে। ইমাম ও মাহমুদ বুঝে ফেলেছেন, নতুন চিড়িয়া সাদিয়া ছাড়া কেউ নয়। তারা সর্বোতভাবে নিশ্চিত হন যে, এসব কর্মকাণ্ড ম্যাজিক-যাদু বৈ নয়। পশ্চাৎপদ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য এ এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ইমাম মাহমুদের কানে কানে বললেন, এই মেয়েগুলোর অশ্লীল কথা-বার্তা ও মদের গন্ধই প্রমাণ করে এরা কারা এবং কী করছে…। আমরা ক্ল পেয়ে গেছি বলা যায়।
ইমাম ও মাহমুদ বড় তাবুর নিকট চলে যান। তাঁবুটি একটি টিলা ঘেঁষে তৈরি করা। টিলা ও তাঁবুর পেছন দরজার মাঝখানের ব্যবধান এক-আধ গজের বেশী নয়। তাঁবুর সন্নিকটে গিয়ে তারা উঁকি দিয়ে তাকায়। তাঁবুর পর্দা মধ্যখানে রশি দিয়ে বাঁধা। ভিতরে উঁকি দিয়ে তাকানোর জন্য এক স্থানে এক চোখ পরিমাণ ফাঁকা। ইমাম ও মাহমুদ এই ছিদ্রপথে উঁকি দিয়ে তাকান। ভিতরে লম্বা একটি পালংক পাতানো।
পালংকে জাজিম বিছানো। তার উপর অতি আকর্ষণীয় চাদর। দুধারে দুটি প্রদীপ জ্বলছে। একধারে মদের সোরাহী ও গ্লাস রাখা। পালংকের উপর সাদিয়া বসা। ভিতরের সাজ-সজ্জা ও শান-শওকত প্রমাণ করে, এটি-ই এই কাফেলার নেতার তাঁবু। সাদিয়ার পার্শ্বে উপবিষ্ট একজন নারী ও একজন পুরুষ। সাদিয়াকে বধূসাজে সাজাচ্ছে তারা।
আজ সারাটা দিনই তুমি কেঁদে কাটালে- সাদিয়াকে উদ্দেশ করে মহিলা বলল- তবে একটু পর-ই তোমার মনে হাসি ফুটে যাবে এবং তুমি নিজেকে চিনতেই পারবে না। তুমি বড় ভাগ্যবতী মেয়ে যে, যে মহান ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে এসেছেন, তিনি তোমাকে পছন্দ করেছেন। তিনি শুধু তোমার জন্য এ এলাকায় এসেছেন। বিশ দিনের দূরত্ব থেকে গায়েবী চোখে তিনি তোমায় দেখেছিলেন। স্বয়ং খোদা তাকে তোমাদের গ্রামে নিয়ে এসেছেন। ইনি যদি না আসতেন, তাহলে তোমার পিতা তোমাকে কোন অসহায় বেদুইনের কাছে বিয়ে দিয়ে দিতেন কিংবা কারো কাছে বিক্রি করে ফেলতেন।
মহিলার কথাগুলো সাদিয়ার উপর যাদুর ন্যায় ক্রিয়া করতে শুরু করে। সাদিয়া নীরবে শুনছে। চরম উত্তেজনা এসে গেছে মাহমুদের। ইমাম তাকে ঠেকিয়ে রাখেন। তিনি দেখতে চান যে, সাদিয়াকে কিসের জন্য সাজানো হচ্ছে।
খানিক পর টিলার অপর দিক থেকে ঘোষণা হয়, তিনি খোদার প্রেরিত পয়গম্বর এবং যার হাতে আমাদের সকলের জীবন ও মৃত্যু, যার চোখ গায়েব দর্শনে সক্ষম, এখন তিনি রাতের অন্ধকার ভেদ করে আকাশে চলে যাচ্ছেন। তোমরা কেউ তাঁবু এলাকার দিকে দৃষ্টিপাত করবে না এবং টিলার উপরে উঠবে না। কেউ সেদিকে যাওয়ার বা দেখার চেষ্টা করলে, সে চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যাবে। আগামী রাত তিনি তোমাদের প্রত্যেকের আকুতি শুনবেন।
ইমাম ও মাহমুদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁবুর ভিতর পুরুষ ও মহিলা সাদিয়াকে সাবধান করিয়ে দেয় যে, তিনি আসছেন। খবরদার কোন প্রকার বে-আদবী যেন না হয়।– তিনি এসে পড়েছেন। সম্মুখ দিক থেকে পর্দা তুলে তাবুতে প্রবেশ করেন। বুকে তার চারটি তীর ও চারটি খঞ্জর বিদ্ধ হয়ে আছে। দেখে ইমাম ও মাহমুদ অবাক হয়ে যান। সাদিয়া ভয়ে আৎকে উঠে। অস্ফুট একটা চীৎকার বেরিয়ে যায় তার মুখ থেকে। তিনি মুচকি হাসলেন এবং বললেন, ভয় পেয় না বেটী! এই মোজেজা খোদা আমাকে দিয়েছেন যে, তীর-খঞ্জর আমাকে মারতে পারেনা। তিনি সাদিয়ার গা ঘেঁষে বসে পড়েন।
এই ভেল্কি আমি একবার কায়রোতে দেখেছিলাম- মাহমুদের কানে কানে ইমাম বললেন- আমি জানি, তীর- খঞ্জর কোথায় গেঁথে আছে। তিনি উঠে। দাঁড়ান। তাঁবুর পদাটা ভিতর থেকে রশি দ্বারা বেঁধে দেন।
আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। চোখাচোখি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ইমাম ও মাহমুদ। বেপরোয়া হয়ে উঠেন তারা। বাইরে থেকে পর্দাটা খুলে ফেলেন। শা করে ঢুকে পড়েন ভিতরে। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি পিছনে ঘুরে তাকান। অমনি তারা ঝাঁপটে ধরেন লোকটাকে। মাহমুদ সাদিয়াকে ইংগিত করে বলে, পালংকের উপর থেকে চাদরটা তুলে এর গায়ের উপর ছুঁড়ে দাও। হতভম্ব সাদিয়া তা-ই করে। লোকটার দেহ বেশ শক্তিশালী মনে হল। ইমাম ও মাহমুদ তাকে চাদর পেঁচিয়ে শক্তভাবে আটকে ফেলেন। বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া হল। ইমামের নির্দেশে সাদিয়া তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে যায়। মাহমুদ চাদর পেচানো বন্দীটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ধরা পড়ার ভয় প্রতি পায়ে। তারা সতর্কপদে বন্দী ও অপহৃতা সাদিয়াকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। রাতের আঁধার তাদের বেশ সহযোগিতা করে।
অনেক পথ ঘুরে তারা গ্রামে পৌঁছে। চলে যায় সোজা মসজিদের ইমামের হুজরায় নিয়ে ভেল্কিবাজকে কাঁধ থেকে নামানো হয়। বন্ধন খুলে দেয়া হয়। তার বুকে তীর ও খঞ্জর গেঁথে আছে। সাদিয়াকেও তারা হুজরায় রাখে। আশংকা আছে, ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে ভেল্কিবাজের দলের লোকেরা এসে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের একথা ভাববারও পরিবেশ নেই যে, তাদের খোদার পুত্র কোথায়। জনসমাবেশের পর এখন তারা মদ নারী নিয়ে ব্যস্ত। তারা ভাবতেও পারছে না, তাদের মনিব নতুন চিড়িয়াসহ অপহরণ হতে পারে।
ইমাম ও মাহমুদ ধৃত ভেল্কিবাজকে পরিধানের চোগা খুলতে বলেন। সে প্রথমে তীর ও খঞ্জর টেনে বের করে। তারপর চোগা খুলে। ভিতরের পোষাকও খোলানো হয়। পোষাকের নীচে গায়ে নরম কাঠ বাঁধা। কাঠের উপরে চামড়া জড়ানো। তার বুকটা সম্পূর্ণ কাঠ দ্বারা ঢাকা। চামড়া জড়ানো এই কাঠে-ই বিদ্ধ হয়েছিল তীর ও খঞ্জরগুলো। সে ইমাম ও মাহমুদকে বলল, কি চাও বল- সোনা-রূপা, উট যা চাও, যত চাও দেব; আমাকে ছেড়ে দাও।
তুমি ছাড়া পাবে না। ইমাম বললেন।
ইমাম মাহমুদকে বললেন, নিকটবর্তী চৌকিটা কোথায় তা তোমার নিশ্চয় জানা আছে। সেখানকার সব সৈনিকদের নিয়ে আস।
মাহমুদ যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। হুজরা থেকে বের হয়। ইমামও উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে মাহমুদকে কানে কানে বলেন, আগে এখানকার সহকর্মীদের আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
মাহমুদ ইমামের ঘোড়ার জিনে বসে-ই সাওয়ার হয়ে রওনা দেয়। ইমামের এ এলাকার গোয়েন্দাদ্বয়কে যথাস্থানে পেয়ে যায়। তাদেরকে এক্ষুণি মসজিদে গিয়ে ইমামের সঙ্গে দেখা করতে বলে চৌকি অভিমুখে ছুটে চলে। ঘন্টা দেড়েকের পথ।
মাহমুদ ছুটে চলেছে। কিন্তু তার মনে সংশয়। চৌকির কমান্ডারকে চিনে সে। লোকটা নীতিহারা। খৃষ্টান ও সুদানীরা ঘুষ দিয়ে তাকে দলে ভিড়িয়ে রেখেছে। মাহমুদ সে রিপোর্টও কায়রো পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মাহমুদ প্রায় নিশ্চিত যে, কমান্ডার তার বাহিনীকে দিবে না কিংবা টালবাহানা করে কালক্ষেপন করবে, যাতে শত্ৰু হাত থেকে ছুটে যেতে পারে। তা-ই যদি হয়, তাহলে কী করবে ভাবছে মাহমুদ। অথচ, রাত পোহাবার আগেই বাহিনী নিয়ে গ্রামে পৌঁছতে হবে তাকে। সৈন্য না পেলে ইমাম ও তার গোয়েন্দাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। কারণ, ধৃত দাগাবাজের হাতে অনেক লোক আছে। তার সাধারণ ভক্ত-মুরীদরাও অনেকে তার জন্য নিবেদিত।
ইমামের কাছে খঞ্জর আছে। তার গোয়েন্দারাও এসে গেছে। তাদের কাছেও খঞ্জর আছে। তারা ভেল্কিবাজকে পাহারা দিয়ে আটকে রাখে। লোকটি মুক্তির জন্য এত মূল্যের অফার দিয়ে যাচ্ছে যে, ইমাম ও তার গোয়েন্দারা কখনো তা স্বপ্নেও দেখেনি। ইমাম তাকে বললেন, আমি এখন মসজিদে বসা আছি। এটি সেই আল্লাহর ঘর, যিনি তোমাকে সত্য দ্বীনসহ আকাশ থেকে নামিয়েছেন। আর এই বুঝি তোমার সত্য দ্বীন? দেখ দোস্ত! আমি কায়রো সরকারের একজন কর্মকর্তা। যত লোভ-ই দেখাও, আমি তোমাকে ছাড়তে পারি না। আমি ঈমান বিক্রি করতে পারি না।
মাহমুদ বিন আহমদ চৌকিতে গিয়ে পৌঁছে। কমান্ডারের তাঁবু তার চেনা। তাঁবুতে আলো জ্বলছে। ঘোড়ার পদশব্দ শুনে কমান্ডার তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ইনি কে! কমান্ডারকে মাহমুদ চিনতে পারছে না। মাহমুদ নিজের পরিচয় দেয়। কমান্ডার তাকে তাঁবুতে নিয়ে যায়। কমান্ডার জানালেন, গতকাল সন্ধায় পুরাতন বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তার পরিবর্তে একটি নতুন বাহিনী এসেছে। এই রদবদল হয়েছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নির্দেশে। এরা সুলতান আইউবীর সঙ্গে ময়দান থেকে আসা বাহিনী।
মাহমুদ কমান্ডারকে জানায়, আমরা বিরাট এক শিকার পাকড়াও করেছি এবং তার পুরো গ্যাং ধরার জন্য এক্ষুণি চৌকির সব সৈন্য প্রয়োজন। রাতারাতি-ই তাদেরকে ঘিরে ফেলতে হবে।
বাহিনীর সেনাসংখ্যা পঞ্চাশের অধিক। কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে তৈরি হয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার নির্দেশ দেন। তাদের কাছে আছে বর্শা, তরবারী, তীর ও তীরন্দাজ। মাত্র আট-দশজন সিপাহীকে চৌকিতে রেখে দেয়া হয়। এরা এসেছে কার্ক অবরোধ অভিযান থেকে। অটুট চেতনার অধিকারী এরা।
কমান্ডার দ্রুত ঘোড়া ছুটান। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাহমুদ। গন্তব্যের নিকটে পৌঁছে ঘোড়ার গতি কমিয়ে দেয়া হয়, যাতে অপরাধীরা টের না পায়। তবে অপরাধীরা টের পাওয়ার মত অবস্থায় ছিলও না। মদ ও নিদ্রা তাদেরকে অজ্ঞান করে রেখেছে।
কমান্ডার মাহমুদের দিক-নির্দেশনায় এলাকাটা সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলেন এবং অভিযান ভোর নাগাদ মুলতবী রাখেন। মাহমুদ ইমামকে সংবাদ জানিয়ে দেয় যে, বাহিনী যথাসময়ে এসে গেছে। সাদিয়া ইমামের হুজরায়-ই অবস্থান করছে। ইমাম একজন দূত পাঠিয়ে সাদিয়ার পিতাকেও ডেকে আনেন।
তাকে এক নজর দেখার উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভক্ত-মুরীদ দর্শনার্থীরা রাতের কারামত দর্শনের পর খোলা আকাশের নীচে, শুয়ে পড়েছে। তাদের পবিত্র মানুষ তাদেরকে বলেছিল, আগামী রাত আমি তোমাদের আর্জি শুনব। সকালের আলো ফোঁটার আগেই তারা জেগে ওঠে। আবছা অন্ধকারে অনেকগুলো ঘোড়া দেখতে পায় তারা। ঘোড়াগুলোর আরোহীরা সৈনিক বলে মনে হল তাদের কাছে। বিষয়টা তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তাদের জানা নেই যে, মৃত প্রাণীকে জীবনদানের ক্ষমতাওয়ালা মানুষটি মসজিদের হুজরায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে।
বাহিনীর কমান্ডার দামেস্ক-এর অধিবাসী। নাম রুশদ ইবনে মুসলিম। সরকারের সাধারণ একজন কর্মচারী। কিন্তু সীমান্ত চৌকিতে এসে তিনি তার সিপাহীদের উদ্দেশে যে ভাষণ প্রদান করেন, তাতে তার বিরাট ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। তিনি বললেন
গোটা দেশ শুধু তোমাদের উপর ভরসা করে ঘুমায়। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সব সময়-ই তোমাদের সঙ্গে আছেন। তোমরা যদিও তাকে দেখতে না পাও, তাহলে তাকে আমার চোখে দেখ। আমরা সকলেই এক একজন সালাহুদ্দীন আইউবী। এখানে কেউ যদি পুরাতন বাহিনীর সিপাহীদের ন্যায় ঈমান বিক্রি কর, তাহলে আমি হাত-পা বেঁধে তাকে মরুভূমিতে ফেলে আসব। তার শাস্তির নির্দেশ আমি কায়রো থেকে নেব না। আমি আল্লাহ থেকে নির্দেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকি।
ভোর হল। রুশদ ইবনে মুসলিম দেখলেন, তাঁবুগুলোতে কোন নড়াচড়া নেই। তার মানে ওদের জাগতে এখনো দেরী। তিনি জনতাকে বললেন, তোমরা একটু সরে গিয়ে বস; কিন্তু চলে যেও না, অপেক্ষা কর। তোমাদের কাংখিত পবিত্র মানুষটিকে অতি কাছে থেকেই তোমরা দেখতে পাবে।
জনতাকে সরিয়ে দিয়ে কমান্ডার তিন-চারজন অশ্বারোহী সিপাহীকে বিভিন্ন টিলার উপর দাঁড় করিয়ে দেন, যাতে অপরাধীদের কেউ পালাতে না পারে। অবশিষ্ট সৈনিকদেরকে নির্দেশ দিলেন, তোমরা ঘোড়া থেকে নেমে চারদিকে থেকে ভেতরে ঢুকে পড়। কেউ প্রতিরোধ করলে তাকে হত্যা করে ফেল। কেউ পালাবার চেষ্টা করলে তাকে তীর ছুঁড়ে মেরে ফেলে। অবশ্য পালাবার সুযোগ নেই এখানে।
কমান্ডার খোলা তরবারী হাতে একটি তাঁবুতে প্রবেশ করেন। দেখলেন, একটি অর্ধনগ্ন মেয়ে ও দুজন পুরুষ ঘুমিয়ে আছে। তরবারীর আগার খোঁচা দিয়ে তিনি তাদের জাগাবার চেষ্টা করেন। তারা জাগ্রত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো গালাগাল শুরু করে দেয় এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এবার কমান্ডারের তরবারীর আগা তাদের চামড়া ছেদ করে যায়। তিনজনই বিড় বিড় করে ওঠে। তাদের বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যান্য তাঁবুগুলোতেও যেসব নারী ও পুরুষদের পাওয়া গেল, সকলের একই অবস্থা। একটি তাঁবুতে পাওয়া গেল অনেকগুলো সারিন্দা-হারমোনিয়াম।
ধৃত আসামীদের সবাইকে একস্থানে জড়ো করে পাহারা বসিয়ে দেয়া হল। তাদের উট ও অন্যান্য জিনিসপত্র সব জব্দ করা হল। ইমাম মসজিদের হুজরা থেকে বড় আসামীকে নিয়ে আসেন। তার দুহাত পিঠমোড়া করে বাঁধা। রাতে যেস্থানে সে মোজেজা দেখিয়েছিল, তাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। পিছনটায় এখনও পর্দা ঝুলছে। তার সাঙ্গপাঙ্গদের তার সম্মুখে বসিয়ে দেয়া হল। তাদেরও প্রত্যেকের হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা। উদ্ধারকৃত বাদ্যযন্ত্রগুলো সামনে রাখা হল। ইমাম জনতাকে এগিয়ে আসতে বললেন। জনতা হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে। ইমাম বললেন, তোমরা লোকটাকে বল, যদি তুমি খোদার দূত বা খোদার পুত্র হয়ে থাক, তাহলে তোমার হাতের বন্ধন খুলে ফেল। এ নাকি মরা মানুষ জীবিত করতে পারে। আমি এর দলের একজনকে খুন করব। তোমরা একে বল, যেন এ তাকে আমার হাত থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখে কিংবা মারা গেলে জীবিত করে নেয়। বলেই ইমাম তার দলের একজনকে ধরে আনেন এবং কমান্ডারের হাত থেকে তরবারীটা নিয়ে আঘাত হানতে উদ্যত হন। লোকটি চীৎকার করে বলে উঠে, আমাকে ক্ষমা করে দিন। এ লোকটি আমাকে জীবিত করতে পারবে না। এ বড় পাপী মানুষ। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে খুন করবেন না।
জনতার সংশয় এখনো কাটেনি। ইমাম লোকটার চোগা এবং অন্যান্য কাপড়-চোপড়ও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। নিয়ে এসেছেন তার দেহ থেকে খুলে নেয়া নরম কাঠ এবং চামড়াও। ইমাম নিজে কাপড়গুলো পরিধান করেন। কাউকে না দেখিয়ে চামড়া মোড়ানো নরম কাঠটাও বুকে বেঁধে নেন। তারপর চোগা পরিধান করেন। তিনি কমান্ডারকে বললেন, আপনার চারজন তীরন্দাজকে আমার সামনে আসতে বলুন। তারা আসে। ইমাম তাদেরকে বললেন, আমার থেকে ত্রিশ কদম দূরে গিয়ে দাঁড়াও। আমার বুকটাকে নিশানা বানিয়ে তীর ছোঁড়।
তীরন্দাজরা রুশদ ইবনে মুসলিমের প্রতি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। রাতে মাহমুদ কমান্ডারকে তীর-খঞ্জরের কাহিনী বিস্তারিত শুনিয়েছিল। কমান্ডার তার তীরন্দাজদের নির্দেশ দেন, তীর চালাও। তারা নিশানা ঠিক করে তীর ছোঁড়ে। চারটি তীর ইমামের বুকের ঠিক মাঝখানটায় এসে গেঁথে যায়। ইমাম বললেন, এবার চারজন এগিয়ে এসে আমার বুকে চারটি খঞ্জরের আঘাত হান। চারজন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ইমামের বুকে খঞ্জরের আঘাত হানে। খঞ্জর ইমামের বুকে গিয়ে আটকে যায়।
ইমাম তীরন্দাজদের বললেন, আরো একটি করে তীর ধনুকে সংযোজন করে নাও। তিনি দাগাবাজ পবিত্র মানুষটিকে সামনে এনে দাঁড় করান। জনতাকে উদ্দেশ করে উচ্চস্বরে বললেন, এ লোকটি নিজেকে অক্ষয় বলে দাবি করে। আমি তোমাদেরকে দেখাব, লোকটি আসলে কী। তিনি তীরন্দাজদের বললেন, এর হৃদপিন্ডকে নিশানা বানিয়ে তীর নিক্ষেপ কর।
চারটি ধনুক উপরে উঠে প্রস্তুত হয়ে যায়। লোকটি দৌড়ে ইমামের পেছনে চলে আসে। মৃত্যুর ভয়ে লোকটি থর থর করে কাঁপছে আর ইমামের নিকট জীবন ভিক্ষা চাচ্ছে। ইমাম তাকে বললেন, সামনে আস এবং জনতাকে বল যে, তোমরা খৃস্টানদের নিয়োজিত সন্ত্রাসী ও দাগাবাজ। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি জনতার দিকে মুখ করে উচ্চস্বরে বলতে শুরু করল, আমি অক্ষয় নই। আমি তোমাদের-ই ন্যায় মানুষ। তোমাদের ঈমান নষ্ট করার জন্য খৃস্টানরা আমাকে নিয়োজিত করেছে। তারা আমাকে বেতন দেয়।
আর শামউনের কন্যা সাদিয়াকে এ ব্যক্তিই অপহরণ করিয়েছিল জনতার উদ্দেশ্যে ইমাম বললেন- আমরা ওকে উদ্ধার করেছি।
ইমাম চোগাটা খুলে ফেলেন। ভেতরের কাপড়ও খুলেন। দেহ থেকে কাঠটা আলাদা করে রুশদ ইবনে মুসলিমের একজন সিপাহীর হাতে দিয়ে বললেন, এটিকে উপস্থিত জনতার প্রত্যেককে দেখিয়ে আন। সিপাহী কাঠটা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখিয়ে আনে। ইমাম কাঠটা উঁচিয়ে ধরে জনতার উদ্দেশে বললেন, তীর আর খঞ্জর এই কাঠে বিদ্ধ হত।
জনতার সামনে সব রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়। ইমাম বললেন, এবার যাও, ঘুরে-ফিরে ওদের ভণ্ডামীর সাজ-সরঞ্জাম কোথায় কি আছে দেখ। মানুষ হুড়মুড় করে ছুটে যায়।
ঝুলন্ত পর্দার পেছনে একটি গুহা তৈরি করা হয়েছিল। রাতে ওখানে বসেই বাদকরা বাজনা বাজাত। মানুষ তাঁবুগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে। সবগুলো
তাঁবুতে মদের উৎকট গন্ধ। সব জায়গা ঘুরে-ফিরে দেখার পর জনতাকে আবার এ স্থানে বসিয়ে ইমাম ভণ্ডটার ভণ্ডামীর বিস্তারিত বিবরণ দেন। ইমাম তথ্য বের করে নিয়েছেন যে, রাতে যে ছেলেটিকে জীবিত করা হয়েছিল, সে তাদেরই লোক। এখন রশি দিয়ে বাঁধা কয়েদীদের একজন সে। তাকে জনতার সম্মুখে নিয়ে আসা হল। দেখান হল আরো এক ব্যক্তিকে, যে রাতে বৃদ্ধর ভান ধরে লাশের পিতা সেজেছিল। যে চারজন তীরন্দাজ রাতে তীর চালিয়েছিল, তাদেরকেও সামনে নিয়ে আসা হল। তারাও সেই দলেরই মানুষ। এবার ইমাম জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন–
মুসলমানগণ! মনোযোগ সহকারে শোন! এরা সবাই ক্রুশের পূজারী। তোমাদের ঈমান ধ্বংস করতে এসেছে। তোমরা জান যে, কোন মানুষ মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারে না। স্বয়ং আল্লাহও মরে যাওয়া মানুষকে জীবিত করেন না। কারণ, আল্লাহ নিয়ম ও আইন অনুযায়ী কাজ করেন। তিনি একক; তার কোন শরীক নেই। তার কোন সন্তান নেই। ক্রুশের পূজারী এই লোকগুলো ইসলামের আলোকে নির্বাপিত করার লক্ষ্যে এসব অস্ত্র ব্যবহার করছে। মিথ্যার পূজারী এসব মানুষ তোমাদের ঈমান, ঈমানী চেতনা ও তোমাদের তরবারীকে ভয় করে। এরা ময়দানে তোমাদের মোকাবেলা করার সাহস রাখে না। এ কারণে এসব আকর্ষণীয় পন্থা অবলম্বন করে তোমাদের অন্তরে সন্দেহ ও কু-মন্ত্রণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে, যাতে তোমরা ইসলামের হেফাজতের জন্য ক্রুশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে না পার। এই মিসরেই ফেরাউন নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছিল। মহান আল্লাহ সেই খোদায়ী দাবীদারকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আমার বন্ধুগণ! তোমরা নিজেদের মর্যাদা বুঝ। দুশমনকে ভালভাবে চিনে নাও।
উপস্থিত জনতা- যাদের সকলেই মুসলমান- অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে। লোকগুলো অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ। ফলে সব ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি করে ফেলা তাদের স্বভাব। ভক্তিতেও সীমালংঘন, বিরোধেও সীমালংঘন। তারা একজন পাপিষ্ঠ ভরে ভেল্কিবাজি দেখে তাকে খোদার পুত্র বলে বরণ করে নিয়েছিল। আর পরে তার বিপক্ষে বক্তব্য শুনে এমন উত্তেজিত হয়ে উঠল যে, ক্ষুব্ধকণ্ঠে ধ্বনি তুলে তার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ইমাম আসামীদেরকে কায়রো পৌঁছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতার ভীড়ের মধ্য থেকে তাদেরকে জীবিত বের করে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। কমান্ডার রুশদ ইবনে মুসলিম যে কোন প্রকারে হোক জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইমাম তাতে সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, তা করতে গেলে এই সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলো মারা যাবে। তা না করে বরং তাদের হাতেই ঐ পাপিষ্ঠদের জীবনের অবসান ঘটুক। তারা বুঝুক, যে লোকটি খোদার দূত ও পুত্র হওয়ার দাবি করল, সে একটা পাপিষ্ঠ মানুষ- যাকে যে কোন মানুষ হত্যা করতে পারে।
ইমাম, রুশদ ইবনে মুসলিম ও মাহমুদ একদিকে সরে যান। কমান্ডার একটি টিলার উপরে উঠে তার সিপাহীদের ডেকে বললেন, তোমরা যে যেখানে আছ, সেখানেই থাক; ওদেরকে বাধা দিও না।
কিছুক্ষণ পরের দৃশ্য। ঘটনাস্থলে ইমাম, মাহমুদ, কমানডার রুশদ ইবনে মুসলিম ছাড়া আর কেউ নেই। রাতে যেখানে ভেল্কি দেখানো হয়েছিল, সেখানে ভেল্কিবাজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের লাশগুলো পড়ে আছে। জনতার রোষানল থেকে মেয়েরাও রেহাই পায়নি। খুন হয়েছে তারাও। ক্ষতবিক্ষত লাশগুলো পড়ে আছে। একটিও চেনার উপায় নেই। উত্তেজিত জনতা তাঁবু, পর্দা ও অন্যান্য সব সরঞ্জাম লুট করে নিয়ে গেছে। অপরাধী চক্রের উটগুলোও জনতা নিয়ে গেছে। লাপাত্তা হয়ে গেছে রুশদ ইবনে মুসলিমের নটি ঘোড়াও। মানুষ বুঝতে পারেনি যে, এগুলো তাদেরই সৈন্যদের ঘোড়া। সব মিলে মনে হচ্ছিল যে, হঠাৎ একটি ঝড় এসে সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
আমার কায়রো যেতে হবে– ইমাম কমান্ডার ও মাহমুদকে বললেন ঘটনাটি সরকারকে অবহিত করতে হবে।
***
দিন কয়েকের মধ্যে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যেসব আইন জারি করলেন ও যেসব পদক্ষেপ হাতে নিলেন, তা ছিল বৈপ্লবিক- এতই বৈপ্লবিক যে, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহল ও ভক্তদের পর্যন্ত চমকে দিল। তিনি সর্বপ্রথম আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীসের সন্দেহভাজন তালিকাভুক্তদের বাড়ী-ঘরে তল্লাশি চালান। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমান্ডের বেশ কজন পদস্থ কর্মকর্তাও ছিল। তল্লাশিতে তাদের ঘরে প্রচুর পরিমাণ হিরা-জহরত, মূল্যবান সহায় সামগ্রী ও ভিনদেশী অতিশয় রূপসী নারী উদ্ধার হয়। কারো কারো ঘরে এমন কতিপয় চাকর পাওয়া যায়, যারা মূলত সুদানের অভিজ্ঞ গুপ্তচর। তাছাড়া অভিযোগের পক্ষে আরো অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। সুলতান আইউবী পদমর্যাদা নির্বিশেষে তাদের প্রত্যেককে বন্দীশালায় নিক্ষেপ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, এদের সঙ্গে সাধারণ বন্দীর ন্যায় আচরণ কররে। সুলতান আইউবীর এই পদক্ষেপের ফলে তার কেন্দ্রীয় কমান্ড ও উপদেষ্টা পরিষদের বেশকটি পদ শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু তিনি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না।
সুলতান আইউবী আঘাত হানলেন সেসব লোকদের উপর, যারা ইসলামের স্বঘোষিত ইজারাদার সেজে বসেছিল। উপদেষ্টাগণ সুলতান আইউবীকে পরামর্শ দেন যে, ধর্ম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। সাধারণ মানুষ মসজিদের ইমামদের ভক্ত। আপনার এই অভিযানে জনসমর্থন আপনার বিপক্ষে চলে যাবে। সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, তাদের মধ্যে কজন এমন আছে, যারা ইসলামের মর্ম বুঝে? মানুষ তো তাদের ভক্ত হয়েছে এই জন্য যে, তারা তাদের সর্বশক্তি ব্যয় করে থাকে নিরীহ জনসাধারণ তাদের অনুরক্ত হোক। আমি জানি এই ইমামরা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, নিজেদের সম্মান ও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য জনসাধারণকে ইসলামের সঠিক বুঝ ও আসল চেতনা থেকে অজ্ঞই রাখে। জাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষালয় হল মসজিদ। মসজিদের চার দেয়ালের ভেতরে বসে মানুষের কানে যা-ই দেয়া হয়, তা-ই মর্মমূলে পৌঁছে যায়। এ হল মসজিদের পবিত্রতা ও মহত্বের ক্রিয়া। কিন্তু আমাদের দেশে মসজিদের অপব্যবহার হচ্ছে। মসজিদে বসে একজন ইমাম পীর মুরশিদ সাজছে। এখনই যদি আমি অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে আমলদার আলেমদের নিয়োজিত না করি, তাহলে কিছুদিন পর মানুষ ইমাম ও পীর মুরশিদদের পূজা করতে শুরু করবে। এই বে-এলেম ও বে-আমল আলেমরা নিজেদেরকে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার দূত বানিয়ে নেবে এবং ইসলামের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
যাইনুদ্দীন আলী বিন নাজা আল-ওয়ায়েজ একজন বিজ্ঞ চিন্তাশীল ও আমলদার আলেম। সুলতান আইউবী পরামর্শ নেয়ার জন্য তাকে ডেকে আনলেন। যাইনুদ্দীন বিন আলী ব্যক্তিগত উদ্যোগে গুপ্তচরবৃত্তির একটি ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। একবার তিনি খৃস্টানদের ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য দিয়ে বহু কুচক্রীকে ধরিয়েও দিয়েছিলেন। তিনি ধর্ম এবং ধর্ম বিষয়ে যেসব অপতৎপরতা চলছিল, সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন। তিনি এই বলে সুলতান আইউবীর মনোবল বাড়িয়ে দেন যে, আপনি যদি আজ ধর্মকে অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে কাল জাতি আপনার আদেশ-নিষেধ মান্য করার জন্য আগে নামধারী ধর্মগুরুদের অনুমতি নেয়া আবশ্যক মনে করবে আর আপনিও সেই রীতি মেনে নিতে বাধ্য হবেন। আর এতদিনে খৃস্টানরা মুসলমানদের ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় কুসংস্কার ও অনৈতিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়েই ফেলেছে।
বিজ্ঞ আলেম যাইনুদ্দীন বিন আলীর সমর্থন পেয়ে সুলতান আইউবী সঙ্গে সঙ্গে লিখিত ফরমান জারি করলেন যে, যাইনুদ্দীন বিন আলী বিন নাজা আল ওয়ায়েজের তত্ত্বাবধানে দেশের সকল মসজিদের ইমামদের ইলম, আমল ও চরিত্র ইত্যাদি বিষয়ে তদন্ত পরিচালিত হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নতুন ইমাম নিয়োগ করা হবে। ইমাম নিযুক্তির ব্যাপারে সুলতান আইউবী যে কটি শর্ত আরোপ করলেন, তার মধ্যে অন্যতম হল, ইমাম বিজ্ঞ আলিম হওয়ার পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। সুলতান আইউবী জিহাদ, দর্শন ও সামরিক চেতনাকে ধর্ম ও মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে পৃথক করতে রাজি নন।
তিনি দেশে এমন সব খেলাধুলা ও বিনোদনের উপকরণ ও পদ্ধতিকে অবৈধ ঘোষণা করেন, যাতে জুয়াবাজি ও চরিত্রহীনতার সংমিশ্রণ রয়েছে। তার নির্দেশে আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগ বিনোদনের বিভিন্ন আখড়ায় হানা দিয়ে নানারকম উলঙ্গ ছবি ইতাদি আপত্তিকর জিনিস উদ্ধার করে। গ্রেফতার করে অনেক কুচক্রীকে। তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও শক্রর পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে আজীবনের জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে। তার পরিবর্তে সুলতান আইউবী বিনোদনের জন্য তরবারী চালনা, ঘোড়সওয়ারী, অস্ত্র ছাড়া লড়াই ও কুস্তি ইত্যাকার খেলাধুলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। তিনি বিদ্যালয় ও মসজিদে জ্ঞান প্রতিযোগিতার রেওয়াজ চালু করেন।
সুলতান আইউবী সীমান্ত বাহিনীগুলোর প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। তিনি অবগত আছেন যে, শহর-নগর ও রাজধানী থেকে দূরে বসবাসকারী মানুষ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দ্রুত শিকার হয়ে পড়ে এবং তারাই সর্বপ্রথম দুশমনের আক্রমণের শিকার হয়। তাদের মানসিক ও দৈহিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুলতান আইউবী বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নেন। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে তিনি যেসব বাহিনী প্রেরণ করেছেন, তিনি নিজে তাদেরকে দিক-নির্দেশনা ও কঠোর নীতিমালা প্রদান করেন। বাহিনীর কমান্ডারদের নিয়োগ করেছেন বেছে বেছে ঈমানী চেতনা, বিচক্ষণতা ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে। রুশদ ইবনে মুসলিমও সেসব কমান্ডারদেরই একজন, যিনি যেইমাত্ৰ মাহমুদের একটু ইঙ্গিত পেলেন যে, একজন গুরুত্বপূর্ণ আসামী ধরা পড়েছে, অমনি বাহিনী নিয়ে ছুটে চললেন। কমান্ডার যুদি আগের জন হত, তাহলে মাহমুদ গিয়ে তাকে খৃস্টান ও সুদানীদের পরিবেষ্টিত মদ-নারীতে মত্ত পেত আর টালবাহানা করে সময় নষ্ট করে কুচক্রীদের পালাবার সুযোগ করে দিত।
কমান্ডার রুশদ ইবনে মুসলিম, মাহমুদ ইবনে আহমদ ও ইমাম- যার নাম ইউসুফ ইবনে আজর- এ মুহূর্তে সুলতান আইউবীর কক্ষে উপবিষ্ট। তারা সুলতানকে নিহত ভেল্কিবাজের কাহিনী শোনাচ্ছেন। আলী বিন সুফিয়ানও বৈঠকে উপস্থিত। সুলতান আইউবী সীমাহীন আনন্দিত যে, এতবড় একটি সাংস্কৃতিক আক্রমণ প্রতিহত করা গেল। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান বললেন, সবেমাত্র আক্রমণ প্রতিহত করা শুরু হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া দূর করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। আমি তথ্য পেয়েছি যে, সীমান্ত এলাকাগুলো থেকে সেনাবাহিনীতে ভর্তির লোক পাওয়া যাচ্ছে না। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার অধিবাসীরা সুদানীদের বন্ধু এবং মিসর সরকারের বিরোধী হয়ে গেছে। তাদের জিহাদী জযবা নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারা তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য, ও গবাদিপশু আমাদেরকে দেয় না- এসব তারা সরবরাহ করে সুদানীদের। সেসব এলাকার মসজিদ এখন বিরান। মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে দাগাবাজ ও ভেল্কিবাজ পীরদের পূজা করতে শুরু করেছে। তাদের মনমানসিকতাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়মতান্ত্রিক অভিযান শুরু করা আবশ্যক। আলোচ্য ভেল্কিবাজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের যদি হত্যা না করা হত, তাহলে তাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে জনতার মাঝে প্রদর্শন করে কাজ হাসিল করা যেত।
সুলতান আইউবী তার বৈপ্লবিক পরিকল্পনায় সীমান্ত এলাকাগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত রেখেছিলেন। এবার সেদিকে আরো বেশি দৃষ্টি দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার জন্য এ মুহূর্তে সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরী তকিউদ্দীন ও তার বাহিনীকে সুদান থেকে বের করিয়ে আনা। কায়রো পৌঁছেই তিনি পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। রাতে এক তিলও ঘুমান না তিনি। তিনি নিজে সুদানের ময়দানে যেতে পারছেন না। আভ্যন্তরীণ ঘোলাটে পরিস্থিতি তাঁকে যেতে দিচ্ছে না। তিনি কায়রো ফিরে এসেই তকিউদ্দীনকে এ সংবাদ দেয়ার জন্য দূত প্রেরণ করেন যে, আমি মিসর এসে গেছি।
দূত ফিরে এসেছে। সে সংবাদ নিয়ে এসেছে যে, তকিউদ্দীনের এ পর্যন্ত বহু সৈন্য মারা গেছে এবং কিছু সৈন্য দুশমনের হাতে ধরা পড়েছে কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে গেছে। দূত জানায়, তকিউদ্দীন তার অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু দুশমন তাদের ধাওয়া করে ফিরছে। তকিউদ্দীন জবাবী আক্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। আপাতত তার কয়েক প্লাটুন সৈন্য প্রয়োজন, যাদের সহযোগিতায় তিনি বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবেন।
সুলতান আইউবী সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারটি কমান্ডো ইউনিট এবং কয়েক প্লাটুন অভিজ্ঞ সৈনিক সুদান পাঠিয়ে দেন। সুদান পৌঁছে তারা অভিযান শুরু করে। তকিউদ্দীনকে দুশমনের ধাওয়ার হাত থেকে মুক্ত করে বেরে করে আনাই তাদের লক্ষ্য। তারা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে দুশমনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। কমান্ডো ইউনিটগুলো দুশমনকে অস্থির করে তোলে। কাঙ্খিত সময়ের আগেই তারা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।
তকিউদ্দীন সুদান আক্রমণে যারপরনাই ব্যর্থ হয়। সাফল্য শুধু এতটুকু অর্জিত হয় যে, তকিউদ্দীন, তার কেন্দ্রীয় কমান্ডের সালার ও অবশিষ্ট সৈন্যরা নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলেন। মিসরের সীমান্তে প্রবেশ করে তকিউদ্দীন টের পেলেন যে, তিনি তাঁর বাহিনীর অর্ধেক সুদানে খুইয়ে এসেছেন।
***
ওদিকে কার্ক জ্বলছে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর কারিগররা প্রয়োজন অনুপাতে দূরপাল্লার মিনজানিক তৈরি করে নিয়েছে। এসব মিনজানিক দ্বারা পাথর ও আগুন নিক্ষেপ করা হচ্ছে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ভেতরের কয়েকটি টার্গেট ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রসদের ডিপোর আগুনের প্রথম গোলাটি দুর্গের সেইদিক থেকে নিক্ষেপ করা হয়, যেদিক থেকে রসদের ডিপো খানিকটা কাছে। সৌভাগ্যবশত গোলা নিশানায় গিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। আগুনের লেলিহান শিখা জঙ্গী বাহিনীর মনোবল বাড়িয়ে দেয়। মুসলমানরা দূরপাল্লার তীর-কামানও তৈরি করে নিয়েছে। অতিশয় শক্তিশালী সিপাহীরা এগুলো ব্যবহার করছে। কিন্তু আট-দশটি তীর নিক্ষেপ করার পর তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। সুলতান জঙ্গী আরো একটি দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বেশ কজন শক্তিশালী সিপাহী বেছে নেন এবং তাদেরকে নির্দেশ দেন, তোমরা দুর্গের ফটকের উপর ঝাঁপিয়ে পড় এবং ফটক ভাঙ্গতে শুরু কর। ফটক ভাঙ্গার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তাদের সরবরাহ করা হয়।
জঙ্গীর এই জানবাজ বাহিনী ফটকের দিকে ছুটে যায়। উপর থেকে খৃস্টানরা বৃষ্টির মত তীর ছুঁড়তে শুরু করে। কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদ শহীদ হয়ে যায়। জখম হয় কজন। সুলতান জঙ্গী দূরপাল্লার তীরান্দাজদের তথায় সমবেত করেন। সাধারণ তীরন্দাজদের একটি দলকেও ডেকে নেন। সবাইকে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড় করিয়ে প্রাচীরের উপর অবস্থানরত খৃস্টান সেনাদের উপর তীর নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্র মুসলিম তীরন্দাজরা শাঁ শাঁ করে তীর ছুঁড়তে শুরু করে। জানবাজদের আরেকটি দল ফটকের দিকে ছুটে যায়। জঙ্গীর সৈন্যদের তীর ছোঁড়া এবার মুষলধারার বৃষ্টির রূপ ধারণ করে। প্রাচীরের উপর ডাক-চিৎকার শোনা যায়। খানিক পর প্রাচীরের উপর কতগুলো ড্রাম দেখা যায়। সেগুলো জ্বলন্ত কাঠ ও অঙ্গারে ভরা। তারা ড্রামগুলো বাইরের দিকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ড্রাম ঠেলে বাইরের দিকে দেয়ার জন্য যেইমাত্র একজন মাথা জাগায়, অমনি সে মুজাহিদদের তীরের নিশানায় পরিণত হয়। ফলে দুএকটি ড্রাম বাইরে এসে পড়লেও অন্য সবগুলো প্রাচীরের উপরই উপুড় হয়ে যায়। প্রাচীরের উপর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। আগুন নিক্ষেপকারীরাই নিজেদের আগুনে পুড়ে মরতে শুরু করে।
সুলতান জঙ্গীর একজন কমান্ডার জঙ্গীর আক্রমণের এই পন্থা দেখে ঘোড়া হাঁকিয়ে দুর্গের পেছন ফটকের দিকে ছুটে যায় এবং সেখানকার কমান্ডারকে বিষয়টি অবহিত করে। দুকমান্ডার মিলে পেছন ফটকেও একই পদ্ধতির হামলা পরীক্ষা করতে শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে মুজাহিদরা কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের এ অভিযানও সফল হয়। মুসলিম তীরন্দাজরা খৃস্টান সেনাদেরকে উপর থেকে আগুন নিক্ষেপ করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়। সুলতান জঙ্গীও দুকমান্ডারের এ অভিযান সম্পর্কে অবহিত হন।
সুলতান জঙ্গী এবার মিনজানিক দ্বারা দুর্গের ভেতরে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। মুসলিম বাহিনী কার্ক দুর্গের উভয় ফটকের দুঃসাহসী আক্রমণ অভিযান দেখে কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করেই দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একভাগ দুর্গের সামনে চলে যায়, অপর ভাগ পেছনের ফটকের দিকে। উভয় পয়েন্টে প্রাচীরের উপর এত অধিক তীরবর্ষণ করা হয় যে, উপরের প্রতিরোধ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। কার্ক দুর্গের সামনের ও পেছনের উভয় ফটক ভেঙ্গে ফেলা হয়। সুলতান জঙ্গীর বাহিনী দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়ে। শহরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। জনসাধারণের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। নিরীহ মানুষগুলো ছুটাছুটি শুরু করে দেয়। এই সুযোগে খৃস্টান সম্রাট ও কমান্ডারগণ দুর্গ থেকে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা নাগাদ খৃস্টান বাহিনী অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য হয়। সুলতান জঙ্গী বন্দী মুসলমানদেরকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেন। খৃস্টান সম্রাটদের শহরময় অনুসন্ধান করা হয়; কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না।
কার্কের দুর্ভেদ্য দুর্গ মুসলমানদের দখলে আসে। বাইতুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের চোখে পড়তে শুরু করেছে। এ ঘটনা ১১৭৩ সালের শেষ তিন মাসের।