প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৩.২ এমন কিছু অধিবাসী আছে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১.

রু বুশোরাত, র‍্যু দ্য নরমাভি আর র‍্যু দ্য সেতোনে অঞ্চলে এখনও এমন কিছু অধিবাসী আছে যারা মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ নামে এক ভদ্রলোককে আজও মনে রেখেছে এবং তার কথা মনে করে আজও আনন্দ পায় তারা। এইসব অধিবাসী যখন বয়সে যুবক ছিল তখন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন।

১৮৩১ সালে গিলেনৰ্মাদ শুধু তাঁর বার্ধক্যের খাতিরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তিনি ছিলেন বাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যিনি ছিলেন প্রাচীন যুগের এক প্রতিভূ। তিনি উনিশ শতকের এক মধ্যবিত্ত হয়েও অষ্টাদশ শতকের সম্ভ্রমশালী এক বুর্জোয়ার ভাব দেখাতেন। তাঁর বয়স নব্বই-এর উপরে হলেও তিনি খাড়া হয়ে হাঁটতে পারতেন, জোরে কথা বলতেন, স্পষ্ট দেখতে পেতেন, মদপান করতেন এবং নাক ডাকিয়ে ঘুমোতেন। তার দু পাটির বত্রিশটি দাঁতই ছিল এবং পড়ার সময় ছাড়া চমশা ব্যবহার করতেন না। প্রেমিক প্রকৃতির লোক হলেও তিনি বলতেন, গত দশ বছর ধরে কোনও নারীর সঙ্গে কোনওরূপ সংস্পর্শ নেই তার। তিনি সম্পূর্ণরূপে নারীসংসর্গ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর বার্ধক্যের জন্য নারীদের সন্তুষ্ট করতে পারতেন না, একথা

বলে বলতেন, তিনি খুব গরিব বলেই দারিদ্র্যবশত তাদের খুশি করতে পারেন না। তিনি বলতেন, আমার সর্বস্ব খোয়া না গেলে… বস্তুত তার আয় বলতে ছিল পনেরো হাজার ফ্রা’র এক বার্ষিক আয় এবং তিনি আশা করতেন তাঁর আয় এক লক্ষ ফ্র হলে তিনি একজন নারীকে রাখতে পারতেন। তিনি মঁসিয়ে দ্য ভলতেয়ারের মতো উন্মার্গগামী ছিলেন না যিনি জীবন্মুত অবস্থায় ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে জীবনযাপন করতেন। তাঁর স্বাস্থ্য ভালোই ছিল। তিনি ছিলেন চঞ্চল ও চপল প্রকৃতির এবং সামান্য কারণে অযৌক্তিকভাবে রেগে যেতেন। কেউ তার কোনও কথার প্রতিবাদ করলে লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। তাঁর এক অবিবাহিতা কন্যা ছিল যার বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গিয়েছিল। রেগে গেলে তার মেয়ের সঙ্গে চেঁচামেচি করতেন, গালাগালি করতেন এবং তাকে চাবুক মারতেন, যেন সে সাত-আট বছরের এক বাচ্চা মেয়ে। তিনি তাঁর ভৃত্যদেরও পুরনো কায়দায় গালাগালি করতেন।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের অদ্ভুত কতকগুলি খেয়াল ছিল। তিনি এমন এক নাপিতের কাছে বরাবর চুলদাড়ি কামাতেন যে একবার পাগল হয়ে গিয়েছিল এবং যে তার সুন্দরী ও চপল প্রকৃতির স্ত্রীর জন্য ঈর্ষাবশত তার সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করে। সব বিষয়েই নিজের মতামত ও বিচার-বুদ্ধির ওপর উচ্চ ধারণা ছিল তার এবং নিজেকে খুবই বিচক্ষণ ভাবতেন। তিনি বলতেন, তাঁর এমন এক সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি আছে যার দ্বারা কোনও একটা মাছি তাঁকে কামড়ালে তিনি বলে দিতেন সেই মাছিটা কোন মহিলার গাঁ থেকে উড়ে এসেছে। মার্জিত প্রকৃতির লোক এই কথাটা প্রায়ই তিনি বলতেন। কিন্তু মার্জিত প্রকৃতির লোকের মতো তিনি কখনই ব্যবহার করতেন না। তাঁর মতে আমাদের সভ্যতার মধ্যে বৈচিত্রসাধন ও সভ্যতাকে পূর্ণতা দানের জন্য প্রকৃতি আমাদের স্বভাবের মধ্যে বর্বরতার উপাদান রেখে দিয়েছে। তথাকথিত সভ্য ইউরোপীয়দের মধ্যে এশিয়া-আফ্রিকার অধিবাসীদের অনেক গুণাগুণ আছে। বিড়াল হচ্ছে বাঘের এবং টিকটিকি গিরগিটি হচ্ছে কুমিরের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। রঙ্গশালার নাচিয়েরা এক একটা রং-মাখা নরখাদক। তারা মানুষ না খেলেও তাদের রক্ত সব শোষণ করে নেয়। এই হচ্ছে আমাদের জীবন। আমরা কাউকে গিলে খাই না, আমরা কামড়ে কামড়ে একটু একটু করে খাই। আমরা কাউকে হত্যা করি না, তার গা-টাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দিই।

.

২.

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ মেরিয়াস অঞ্চলে র‍্যু দ্য ফিরে দ্য কাভেয়ারে বাস করতেন। বাড়িটা ছিল তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি। অনেক দিনের পৈতৃক পুরনো বাড়িটাকে অবশ্য নতুন করে আবার নির্মাণ করা হয় এবং আগের নম্বর পাল্টে নতুন নম্বরও দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে প্যারিসের অনেক রাস্তারও এইভাবে নম্বর পরিবর্তন করা হয়। তাঁর বাড়িটার একদিকে ছিল রাস্তা এবং আর একদিকে ছিল বাগান।

তিনি নিচের তলায় একটা বড় ঘরে থাকতেন। সে ঘরের পর্দা আর কার্পেটে পল্লিপ্রকৃতির অনেক সুন্দর দৃশ্য আঁকা ছিল। তার ঘরের জানালার নিচেই বাগান ছিল। বাড়ি থেকে বাগানে যেতে হলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হত। গিলেনৰ্মাদ যুবকের মতো তরতর করে ওঠা-নামা করতেন সে সিঁড়িতে। তাঁর মায়ের পিতামহের কাছ থেকে এই স্বভাবটা পেয়েছিলেন। তাঁর মা’র সেই পিতামহ নাকি একশো বছর বেঁচেছিলেন এবং তার দুটি স্ত্রী ছিল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের ব্যবহারটা ছিল একজন সভাসদ আর একজন আইনজীবীর মাঝামাঝি। সভাসদ তিনি হতে পারেননি আর আইনজীবী বা উকিল হবার শখ ছিল তার। যৌবনে তিনি ছিলেন এমনই একজন যারা তাদের স্ত্রীদের দ্বারা প্রতারিত হয়, কিন্তু তাদের প্রেমিকারা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে না কোনও ভাবে। এইসব লোক প্রেমিক হিসেবে যত ভালো হয়, স্বামী হিসেবে তত ভালো হতে পারে না। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ চিত্রশিল্পের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর শোবার ঘরে নামকরা শিল্পীদের আঁকা কিছু ছবি ছিল। এই বয়সেও তিনি নিজেকে যুবক ভাবতেন এবং পোশাক-আশাকের ধরন বদলাতেন। তিনি সব সময় কোটের পকেটের ভেতরে হাত রেখে চলতেন। তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ফরাসি বিপ্লব জনকতক কাপুরুষ লোকের পাপকর্মের ফল।

.

৩.

কোনও এক রাতে একটা নাটক দেখতে গিয়ে ভলতেয়ার, লা কামারগো আর স্যানির পাশে দু জন সুন্দরীকে গিলেনৰ্মাদ দেখতে পান। তখন তিনি তাদের দিকে না গিয়ে নাহেনরি নামে এক নাচিয়ে মেয়ের কাছে চলে যান। মেয়েটি ছিল প্রায় তার সমবয়সী এবং তার সঙ্গে তার ভালোবাসা ছিল। তিনি তখন তাকে দেখেই আপন মনে মন্তব্য করেছিলেন, এর আগে যখন তাকে দেখেছিলাম তখন তাকে কত সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার মুখে ছিল খুশির হাসি, মনে আশার সম্পদ, চোখে ছিল মোহপ্রসারী আবেদন। তিনি যৌবনে যে ওয়েস্টকোট পরতেন তার কথা আজও ভুলতে পারেননি তিনি। তাঁর বয়স যখন কুড়ি ছিল তখন মার্কুই দ্য বুফার্স তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি রোজ খবরের কাগজ পড়তেন। তখন যারা মন্ত্রী বা দেশের শাসনকর্তা ছিল তাদের তিনি দেখতে পারতেন না। তিনি হাসতে হাসতে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে প্রায়ই বলতেন, কবিয়ের, হুমাল, কাসিমির–এরা হল কিনা মন্ত্রী? মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ কেন মন্ত্রী হলেন না? কথাটা হাস্যাস্পদ হলেও যারা নির্বোধ তারা সে কথাকে বিশ্বাস করে। পাঁচজনের সঙ্গে তিনি যখন থাকতেন তখন কারও নামে কোনও শক্ত কথা বলতে কোনও কুণ্ঠাবোধ করতেন না তিনি। এক আভিজাত্যসুলভ ঔদাসীন্যের সঙ্গে তিনি অম্লান বদনে। নোংরা গালাগালি দিয়ে যেতেন। তাদের যুগে ধনী সমাজে এই ধরনের গালাগালি চলত। সে যুগের কাব্যে যেমন আবেগাতিশয্য ও অতিশয়োক্তির প্রাধান্য দেখা যেত, গদ্যসাহিত্য ছিল তেমনি স্কুল প্রকৃতির। তাঁর প্রথম জীবনে তার গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে তার ধর্মপিতা বলতেন, তিনি ভবিষ্যতে একজন প্রতিভাশালী ব্যক্তি হবেন। তাই তাঁকে বলতেন, ভাগ্যবান।

.

৪.

তার জন্মস্থান মৌলিন শহরের কলেজে তিনি পুরস্কার লাভ করেন এবং ডিউক দ্য নিভার্নে তার গলায় লরেন্সের মালা পরিয়ে দেন। কনভেনশন বা শীর্ষ সম্মেলন, যোড়শ লুই ও নেপোলিয়নের মৃত্যু, বুর্বনদের পুনরাগমন, প্রভৃতি এত সব ঘটনার মাঝে সে কথাটা ভোলেননি গিলেনৰ্মাদ। তাঁর মতে নিভার্নে ছিলেন সেই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ লোক। তিনি আরও বলতেন রাশিয়ার ক্যাথারিন পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তিন হাজার রুবল দিয়ে বেস্তুসেফের কাছে গোপন সোনা কি নেবেন?

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বুর্বনদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং ১৭৮৯ সালকে ভয় করতেন। তিনি প্রায়ই গল্প করতেন কিভাবে শুধু তার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে তিনি বেঁচে যান। তা না হলে তাঁর মাথা কাটা যেত। যদি কোনও যুবক প্রজাতন্ত্রের গুণগান করত তার সামনে তা হলে তার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, আমার বয়স নব্বই, আমার মনে হয় তিরানব্বই সাল আর দেখতে পাব না। আবার অন্য সময় তিনি বলতেন, তিনি একশো বছর বাঁচতে চাইছেন।

.

৫.

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বিবাহিত লোকদের প্রেম সম্বন্ধে একটা নিজস্ব তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন। তিনি বলতেন, কোনও লোক যদি তার স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীকে ভালোবাসতে না পেরে অন্য মেয়েকে ভালোবাসে তা হলে তার মনের শান্তি বজায় রেখে অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য একটামাত্র উপায় অবলম্বন করতে হবে। তার টাকার থলেটা তার স্ত্রীর হাতে দিয়ে দিতে হবে। তার স্ত্রীকে সব সময় ব্যস্ত রাখতে হবে হিসাবপত্রের কাজে। ব্যাংকের নোট গুনতে গুনতে তার যেন হাতে কড়া পড়ে যায়। তার স্ত্রীকে তখন চাষের কাজ দেখাশোনা, বাড়ি মেরামত, করদান, মামলাপত্র দেখা প্রভৃতি সব কাজ করতে হবে। স্ত্রী তখন এই ভেবে মনে মনে সান্ত্বনা পাবে যে তার স্বামী তাকে ভালো না বাসলেও সে ইচ্ছা করলে স্বামীর সব কিছু ধ্বংস করে দিতে পারবে, স্বামীর সব কিছু এখন তারই হাতে। গিলেনৰ্মাদও তার জীবনে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করেন। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর অব্যবস্থার জন্য তাঁর বহু ক্ষতি হয়ে যায়। সেই স্ত্রীর মৃত্যুর পর অভাব দেখা যায়। তিনি দেখেন তাঁর আয় বলতে শুধু আছে বছরে পনেরো হাজার ফ্রাঁ। তিনি যে টাকা লগ্নি করেন তার মাত্র তিনের চার অংশ অবশিষ্ট আছে। তিনি ঠিক করেন যা আছে জীবনে সব খরচ করে যাবেন তিনি। কিছুই রেখে যাবেন না। তাছাড়া কোনও সম্পত্তি রেখে গেলে তা তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে বাজেয়াপ্ত হয়ে যেতে পারে।

আমরা আগেই বলেছি র‍্যু দ্য ফিলের বাড়িটা তাঁর নিজের। তাঁর দু জন ভৃত্যের মধ্যে একজন পুরুষ আর একজন নারী। পুরুষ ভৃত্যটি যখন তাঁর বাড়িতে আসে তখন তিনি তার নতুন নতুন নাম দেন। যেমন নিয়ম, কোতয়, পিকার্দ প্রভৃতি। তার বয়স ছিল প্রায় পঞ্চান্ন। সে বেশি জোরে হাঁটতে বা চলাফেরা করতে পারত না। সে বলত, তার নাম বাস্ক। রান্না করার জন্য নারীভৃত্যটি যখন প্রথম তার বাড়িতে কাজের জন্য আসে তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কত মাইনে নেবে?

মেয়েটি তখন বলে, মাসে তিরিশ ফ্রাঁ।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তখন বলেন, আমি তোমাকে পঞ্চাশ ফ্রাঁ করে দেব। কিন্তু তোমার নাম হবে নিকোলেত্তে।

.

৬.

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের দুঃখ মানেই রাগ। মনে কোনও কারণে দুঃখ পেলেই প্রচণ্ডভাবে রেগে যেতেন তিনি। তাঁর কতকগুলি কুসংস্কার ছিল এবং ইচ্ছামতো অবাধে সেগুলো মেনে চলেছেন। প্রতিটি চালচলনে তিনি যে ভাব প্রকাশ করে যেতেন তা হল চিরযুবক এক প্রেমিকের। তিনি বলতেন, এই ভাব দেখিয়ে প্রচুর নাম-যশ পাওয়া যায় এবং এর থেকে অনেক উপহারও জুটে যায় তার।

একবার একটা বড় ঝুড়িতে করে একটা জিনিস পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার বাড়িতে। ঝুড়িটা খুলে দেখা যায় একটি নবজাত শিশুপুত্র তার মধ্যে শোয়ানো আছে। এ নিয়ে হৈ-চৈ পড়ে যায় তার বাড়িতে। পরে খোঁজ-খবর করে জানা যায় মাস ছয়েক আগে তার বাড়ির যে ঝিকে তিনি বরখাস্ত করেন এই ছেলেটি তার এবং সে নাকি বলে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদই হলেন এ শিশুর জনক। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বয়স তখন আশি। তিনি এতে দারুণ রেগে যান। রেগে গিয়ে বলেন, কুলটা মেয়েটার কী দুঃসাহস! একথা কেউ বিশ্বাস করবে?

কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি ঠাণ্ডা হয়ে আর সবাইকে বোঝাতে থাকেন, তোমরা এতে ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? তোমরা জান না তাই। নবম চার্লস–এর অবৈধ সন্তান ডিউক অ্যাঙ্গুলিমের বয়স যখন পঁচাশি তখন পনেরো বছরের একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বোর্দোর আর্কবিশপের ভাই মার্কুই দ্য আলুয়ে তিরাশি বছর বয়সে এক পরিচারিকার গর্ভে পুত্রসন্তান উৎপাদন করেন। সেই অবৈধ সন্তান পরবর্তী জীবনে নাইট উপাধি লাভ করে এবং কাউন্সেলার হয়। এ যুগের বিশিষ্ট বিখ্যাত লোক আব্বে তারারদ ছিলেন সাতাশি বছরের এক বৃদ্ধের ঔরসজাত সন্তান। বাইবেল পড়লেই জানতে পারবে এসব ব্যাপার এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়।

এত সব বলার পর তিনি ঘোষণা করেন, অবশ্য এই শিশুটি আমার সন্তান নয়। যাই হোক, দোষটা তো তার নয় এবং তার দেখাশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। এইভাবে অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করেন তিনি। কিন্তু লা ম্যাগনন নামে যে কুলটা ঝি তার এই অবৈধ সন্তানকে পাঠিয়েছিল সে আবার এক বছর পর আর একটি নবজাত শিশুপুত্রকে এইভাবে ঝুড়িতে করে পাঠিয়ে দেয় মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে। এটা কিন্তু খুবই বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তখন দুটি শিশুকেই তাদের মা লা ম্যাগননের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই সঙ্গে তিনি তাকে বলে আসেন এদের ভরণপোষণের জন্য তিনি প্রতি মাসে আট ফ্র করে পাঠিয়ে দেবেন। তবে একটা শর্তে সে যেন এ কাজ আর না করে। তিনি আরও বলেন, ছেলেদের যেন ঠিকমতো দেখাশোনা করা হয় এবং তিনি মাঝে মাঝে এসে তাদের দেখে যাবেন।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের এক ভাই ছিল। তিনি যাজক ছিলেন। অ্যাকাডেমি দ্য পয়তিয়েরে রেক্টার বা প্রধান হবার পর তিনি মারা যান ঊনআশি বছর বয়সে। তাতে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বলেন, আমার ভাই খুবই অল্প বয়সে মারা গেছে। তাঁর এই ভাই খুবই কৃপণ প্রকৃতির লোক ছিলেন। যাজক থাকাকালে ভিক্ষা দেওয়াটা তিনি এক ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতেন। কিন্তু যত সব অচল মুদ্রা ভিক্ষা হিসেবে দিয়ে স্বর্গে যেতে গিয়ে নরকের পথ পরিষ্কার করেন। অথচ তাদের বাবা ভালোভাবে সম্মানের সঙ্গে ভিক্ষা দিতেন। তিনি সত্যিই উদার প্রকৃতির ও পরোপকারী লোক ছিলেন। তিনি ধনী হলে তার জীবনযাত্রা সত্যিই আরও অনেক ভালো হত। তিনি সব সময় কোনও কাজের পদ্ধতির ওপর জোর দিতেন। পদ্ধতিটা যেন ভালো হয়। একবার একজন ব্যবসাদার তার সঙ্গে প্রতারণা করে এক সম্পত্তির অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে। তখন তিনি মন্তব্য করেন, এভাবে আমাকে ঠকানো তার উচিত হয়নি। পদ্ধতিটা আরও ভালো ও দ্র হওয়া উচিত। বনপথের কোনও দস্যুর মতো ওরা আমার এ সম্পত্তি কেড়ে নিল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের দু বার বিয়ে হয়। দুটি স্ত্রীর গর্ভে দুটি কন্যাসন্তান হয়। বড় মেয়েটি বেঁচে আছে আর ছোট মেয়েটি তিরিশ বছর বয়সে মারা যায়। বড় মেয়েটি অবিবাহিত রয়ে যায়, কিন্তু ছোট মেয়েটি মৃত্যুর আগে এক সামরিক অফিসারকে বিয়ে করে মারা যায়। অফিসারটি ওয়াটারলু যুদ্ধের সময় কর্নেল হয়েছিল। গিলেনৰ্মাদ এই বিয়েটা সমর্থন করতে পারেননি। তিনি বলেন, এটা আমাদের পরিবারের পক্ষে অপমানজনক। একটিপ নস্যি নিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেন তিনি। ঈশ্বরে তাঁর কোনও বিশ্বাসই ছিল না।

.

৭.

এই হল মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের জীবনযাত্রা প্রণালী। তার মাথার চুল একেবারেই ওঠেনি। সে চুল ছিল একেবারে সাদা এবং ভালোভাবে আঁচড়ানো। তিনি ছিলেন সত্যিই একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর মহত্ত্ব এবং চপলতা দুই-ই ছিল তার মধ্যে।

১৮১৪ সালে যখন রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় তখন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বয়স হয়েছিল চুয়াত্তর এবং তিনি ফবুর্গ সেন্ট জার্মেনে থাকতেন। আশি বছর বয়সে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে আসেন মেরিয়াসের বাড়িতে। তখন তিনি সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন একেবারে।

মেরিয়াসের বাড়িতে আসার পর কতকগুলি নিয়ম করেন গিলেনৰ্মাদ। তিনি সন্ধ্যার আগে বাড়িতে কোনও অতিথি বা আগন্তুকের সঙ্গে দেখা করতেন না। তিনি ঠিক বিকাল পাঁচটার সময় নৈশভোজন শেষ করতেন। তার পর লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। যে কোনও কাজই থাক, দিনের বেলায় কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পেত না। এটাই ছিল সেই শতকের ভদ্রলোকদের রীতি এবং এই রীতিটাই তিনি মেনে চলতেন। তিনি বলতেন, যারা শ্রেষ্ঠ এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি তারা দিনের বেলায় ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন নিজেদের। রাত্রিকালে আকাশে নক্ষত্রের আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বুদ্ধির আলোয় দেদীপ্যমান হয়ে ওঠেন তাঁরা। তিনি জনসমাজ থেকে দূরে থাকতেন। কারও সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। রাজারও খাতির করতেন না। এটাই ছিল তাদের যুগের রীতি।

.

৮.

আমরা মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের মেয়েদের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এই দুটি মেয়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল দশ বছরের। যৌবনে তাদের দু জনের চেহারা ও চরিত্রের মধ্যে কোনও মিল ছিল না। ছোট মেয়ে ছিল বরাবরই খুব আনন্দোচ্ছল। তার সব দিকেই ঝোঁক ছিল –ফুল, কবিতা, গান-বাজনা সবই ভালোবাসত সে। একটি অতৃপ্ত অত্যুৎসাহী আত্মা ছোট থেকে অনন্ত আকাশে যেন উড়ে বেড়াত। বীরত্ব সম্পর্কে একটা রোমান্টিক ধারণা ছিল তার।

বড় মেয়েরও একটা দিবাস্বপ্ন ছিল। সে শুধু এক ধনী কন্ট্রাকটারকে স্বামী হিসেবে পাবার স্বপ্ন দেখত। সে হবে লক্ষপতি। অথবা তার স্বামী হবে এক বড় অফিসার। সে হবে সম্মানিত অফিসার পত্নী –কত দাসদাসী, বলনাচের আসর, কত সভা-সমিতি। দুই বোনের এইখানেই ছিল মিল।

দু জনেরই একটা করে স্বপ্ন ছিল। দু জনেরই দুটো পাখনা ছিল। কিন্তু একজনের পাখনা ছিল দেবদূতের আর অন্যজনের পাখনা ছিল রাজহাঁসের।

পৃথিবীতে কোনও উচ্চাশাই সম্পূর্ণরূপে পূরণ হয় না। আমাদের এ যুগে মর্ত্য কখনও স্বর্গ হয়ে ওঠে না। ছোট বোন তার আকাঙ্ক্ষিত পুরুষকে বিয়ে করেছিল, এবং বিয়ের কিছুকাল পরে মারা যায়। কিন্তু বড় বোন বিয়ে করেনি জীবনে।

আমাদের কাহিনীর প্রয়োজনে যখন এই মেয়েটি প্রথম আসে তখন তার বুদ্ধি না থাকলেও এক অটল দৃঢ়তার ভাব দেখায়। তার নাকটা ছিল তীক্ষ্ণ। সে বাড়ির বাইরে কোথাও যেত না। বাড়ির বাইরের কেউ তার আসল নাম জানত না। সবাই জানত, তার নাম ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ। সে তার সতীত্ব সম্বন্ধে খুব বেশি পরিমাণে সজাগ ও সতর্ক ছিল।

তার এই অস্বাভাবিক সতীত্ববোধ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায়। সে পোশাকটা এমনভাবে পরত যাতে তার দেহের কোনও অংশ দেখা না যায়। সতীত্ববোধ এমনই এক আশ্চর্য দুর্গ যে দুর্গে যত কম আক্রমণের ভয় থাকে তত বেশি তা সুরক্ষিত করা হয়। এই সতী মেয়ে জীবনে শুধু একবার এক সামরিক অফিসারের চুম্বন গ্রহণ করেছিল। থিওদুল নামে এই অফিসার সম্পর্কে তার এক ভাইপো ছিল। সতীত্ব বস্তুটা অর্ধেক গুণ আর অর্ধেক দোষ।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদের এই সতীত্ববোধের সঙ্গে ছিল এক গোঁড়া ধর্মচেতনা। সে ছিল কনফ্রেরি দ্য লা তার্জ সম্প্রদায়ভুক্ত। কোনও ধর্মীয় উৎসব বা তিথির দিনে সে সাদা ঘোমটা দিত মাথায়। মাঝে মাঝে সে বিশেষভাবে প্রার্থনা করত। গির্জায় জেসুরের বেদির সামনে বসে ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকত। মাঝে মাঝে তার আত্মাটা যেন মেঘেদের রাজ্য ও নীল বনরাশির মাথায় উড়ে যেত।

তার শুধু একজন বান্ধবী ছিল। তার নাম ছিল ম্যাদময়জেল ভবয়। সে-ও ছিল তারই মতো শুচিশুদ্ধ সতী কুমারী এবং ধর্মপ্রাণ।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ অনেক বেশি গুণশীলা হয়ে ওঠে। তার হিংসা বলে কোনও জিনিস ছিল না। এক দুর্বোধ্য বিষাদের ভারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত তার মুখখানা। বিষাদের অর্থ সে নিজেই জানত না। তার চেহারাটা দেখে মনে হত তার জীবনটা শেষ হয়ে আসছে যে জীবন শুরুই হয়নি কখনও।

বিশপ বিয়েনভেনু’র বোন যেমন তার দাদার সংসার চালাত তেমনি ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ তার বাবার সংসারের সব কাজকর্ম দেখাশোনা করত। দু জনে দু জনকে অবলম্বন করে থাকত।

বাপ আর মেয়ে আর একজন থাকত সে সংসারে। সে হল একটি ছোট ছেলে যে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কাছে আসত। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ সব সময় দাঁত খিঁচিয়ে কড়া ভাষায় কথা বলতেন তার সঙ্গে। বলতেন, এদিকে এস স্যার।

কখনও আবার তার ছড়িটা তুলে ডাকতেন। বলতেন, এস, অপদার্থ কোথাকার! আসল কথা, ছেলেটাকে তিনি ভালোবাসতেন। ছেলেটা ছিল সম্পর্কে তাঁর নাতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *