১৬. এক সৌভাগ্যসূচক জন্ম
গ্রীষ্মের দাবদাহ কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের নিচে অবস্থিত তৃণভূমির ঘাস পুড়িয়ে সোনালী বর্ণে পরিণত করেছে। তার ক্লান্ত ঘোড়ার খুরের নিচের মাটি শক্ত হয়ে আছে। হ্রদের পানির পরিমাণ কমে গিয়েছে এবং কাদার ফাটা আস্তরণের মাঝে সবুজ শ্যাওলার শুকনো দাগযুক্ত একটা স্তর কিনারায় দেখা যাচ্ছে পানিতে কেমন একটা পচা গন্ধ। প্রায় পাঁচ মাস অনুপস্থিতির পরেও অবশ্য তার চিন্তার কেন্দ্রে কেবলই তার আম্মিজান আর নানীজানের ভাবনা ঘুরপাক খায়। তাদের কাছে হিন্দুস্তানের সীমান্তে তার অভিযানের অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে সে ব্যাকুল হয়ে আছে। বাবর তার সেনাপতিদের ছাউনি ফেলার আদেশ দিয়ে ভারবাহী পশুগুলোর পিঠ থেকে বোঝা নামাতে বলে। সেসব বিতরণ না করা পর্যন্ত পাহারা দেবার। বন্দোবস্ত করে সে দূর্গের র্যাম্প দিয়ে দুলকিচালে ঘোড়া নিয়ে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যায়।
অন্ধকারাচ্ছন্ন তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে আলোকিত আঙ্গিনায় উপস্থিত হতে, দূর্গ প্রাকারের উপর থেকে বাদ্যবাদকের দল প্রথা অনুসারে তাকে বাজনা বাজিয়ে ফিরে সুলতানের মতো অভিবাদন জানায়। বাবর তার রেকাব থেকে পা নামিয়ে নিয়ে। সন্তুষ্টির সাথে একটা শ্বাস নেয়। এখানে ফিরে আসতে পেরে তার ভালোই লাগছে। তারপরে সে হন্তদন্ত হয়ে বাইসানগারকে এগিয়ে আসতে দেখে তাকে অভিবাদন জানাতে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বাবর বুঝতে পারে কোনো একটা দুঃসংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। “কি হয়েছে বাইসানগার? কি ব্যাপার?”
“সুলতান আপনার আম্মিজান অসুস্থ। এখানকার লোকেরা যাকে ছোপযুক্ত জ্বর বলে। পূর্বের সওদাগরদের সাথে এখানে এসেছে, তিনি সেই জ্বরে আক্রান্ত। শহরে রোগ একটা মহামারীর সৃষ্টি করেছে এবং প্রাসাদের জেনানামহলেও ছড়িয়ে পড়েছে। হাকিম তার রক্তপাত ঘটিয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এখন তরমুজের রস দিয়ে তার রক্ত শীতল করতে তিনি চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা করছেন আমাদের হেকিম…তার দু’জন পরিচারিকা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে একজন কয়েক ঘণ্টা আগে।”
“এই রোগটা কখন ছড়িয়েছে?”
“প্রায় এক সপ্তাহ আগে। তিনি জ্বরের ঘোরে কেবল আপনার কথাই বলছেন। আমি গুপ্তদূত পাঠিয়েছিলাম আপনার খোঁজে। কিন্তু আপনি কেনদিক থেকে ফিরে আসবেন- কবে নাগাদ ফিরে আসবেন সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা না থাকায়। আল্লাহতালার অশেষ মেহেরবানী আপনি ফিরে এসেছেন…”
একটা শীতল অসাড়তা বাবরের দেহ আর মনকে যেনো আড়ষ্ট করে তুলে। স্তম্ভিত। অবস্থায় সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে, লাগাম এক সহিসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আঙ্গিনা অতিক্রম করে ধীরে ধীরে জেনানামহলের দিকে এগিয়ে যায়। সে লম্বা রূপালী আস্তরণযুক্ত গাঢ় নীলকান্ত মণির কারুকাজ করা দুই দরজা বিশিষ্ট প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যেতে যেখান দিয়ে তার আম্মিজানের কামরার দিকে যাওয়া যায়। বাবরের পুরো শরীর কাঁপতে থাকে এবং সে অসুস্থবোধ করে।
তার শৈশবের কথা মনে পড়তে থাকে। পোষা বেজীকে বিরক্ত করার জন্য খানজাদা তাকে মারায় খুতলাঘ নিগার তাকে তিরস্কার করছেন। আম্মিজান পালকযুক্ত ফারগানার মুকুট তার মাথায় পরিয়ে দিচ্ছেন আর তার সদ্যমৃত আব্বাজানের আলমগীর তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে তার নামে খুতবা পাঠ হবার অব্যবহিত আগে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে তার মুখে ফুটে থাকা কষ্ট সে দেখতে পায়। যখন সে তাকে বলেছিলো খানজাদাকে সাইবানি খানের হাতে সমর্পিত করতে হবে। অসুস্থতার অনেক আগেই সেই ঘটনা তার মাঝ থেকে জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছে… নিজের উপর ক্রোধে বাবর মাথা নিচু করে।
পরিচারিকার দল দরজা খুলে দিতে, অসুস্থ কামরার বদ্ধ, ভারী বাতাস- ঘামের সাথে চন্দনকাঠ, কর্পূরের মিশ্রিত গন্ধ- তার নাকে এসে ধাক্কা দেয়। সে ভেতর থেকে বীণার বিষাদময়, মিষ্টি সুর ভেসে আসছে শুনতে পায়। সে ভেতরে প্রবেশ করতে এসান দৌলতকে তার অসুস্থ মেয়ের পাশে বীণার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে। “নানীজান…”
তিনি মুখ তুলে তাকান। কিন্তু বাজনা সাথে সাথে বন্ধ না করে রাগটা শেষ করে বীণাটা তার পাশে অধোমুখে, কষ্ট চেপে রাখা মুখের ফাতিমার হাতে দেন। “সঙ্গীত যেনো বেচারীকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। আমি ভেবেছিলাম তোমার বোধহয় আসতে দেরি হয়ে যাবে। হাকিম নিদান দিয়ে দিয়েছে…”
বাবর তার আম্মিজানকে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে। তার মুখে আর গলার কাছের যতোটুকু সে দেখতে পায় লাল রাগী চাকায় ভর্তি হয়ে আছে। সে তার কাছে এগিয়ে যেতে চাইলে এসান দৌলত হাত নেড়ে তাকে দূরে থাকতে বলে। “জ্বরটা মারাত্মক। বিশেষ করে অল্পবয়স্কদের ক্ষেত্রে। বাবর তার দিকে তাকায়। সে আরেক পা সামনে এগিয়ে আসলে, এসান দৌলত তার বয়সের তুলনায় অনেক ক্ষিপ্র গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে ধেয়ে এসে বাবরের বাহু আঁকড়ে ধরে। “হাকিম তার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন আর আমিও আছি। আমরা এখন কেবল অপেক্ষা আর দোয়া করতে পারি। এখন তুমিও যদি আক্রান্ত হও তবে কি কোনো লাভ হবে? তোমার আম্মিজান আর আমার জন্য তুমি যা করতে পারো, সেটা হলো বেঁচে থাকা, বহাল তবিয়তে।”
“কিন্তু আমি কি কিছুই করতে পারি না?”
“একটা জিনিস আছে করবার মতো। তোমার আম্মিজানের যখন জ্ঞান থাকে তখন সে সামান্যই কথা বলে। কিন্তু জ্বরের ঘোরে সে অনেক কিছুই বলে। জ্বরের ঘোরে সে কেবল আল্লাহতালার কাছে একটা কথা জানতে চেয়েছে, তার কোনো নাতি নেই কেন, কেন তোমার একজন উত্তরাধিকারী নেই। আমি তাকে বলতে চাই, তুমি আবার বিয়ে করবে এবং সুস্থ হয়ে সে তোমার আত্মজদের কোলে নিয়ে খেলতে পারবে। তার আত্মা হতাশায় ছেয়ে গেছে। লড়াই করার কোনো ইচ্ছাই তার ভিতরে কাজ করছে না। আমি তাকে কিছু একটা বলতে চাই যা তার ভিতরে বাঁচার আশা জাগিয়ে তুলবে…”
“আপনি তাকে বলবেন সে যা বলবে আমি করতে রাজি আছি। আম্মিজানকে বলবেন যে, তাকে অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, আমার বিয়ের ভোজসভায় নাচবার জন্য এবং তার অবশ্যই অসংখ্য নাতিনাতনি হবে… তাকে বলবেন আমার এখনও তাকে দরকার আছে…”
এসান দৌলত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে-সন্তুষ্ট হয়ে তার হাত ছেড়ে দেয়। “এখন যাও। আম্মিজানের শরীরের খবর আমিই তোমাকে জানাবো।”
অশ্রু দমন করে কোনোমতে বাবর নিজের কক্ষে ফিরে আসে। এসান দৌলত আর তার মায়ের কথায় যুক্তি আছে- সে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। এখন সে যখন কাবুলে থিতু হয়ে বসেছে, তখন আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধা কোথায়: তার প্রজারাও নিশ্চয়ই উত্তরাধিকারী দেখতে চায়। আর তাছাড়া বিয়ের ফলে মৈত্রী জোরদার হয়। কিন্তু সেসব এখন অপ্রাসঙ্গিক তার আম্মিজানের সুস্থ হয়ে উঠবার জন্য যদি তাকে দশটা স্ত্রী গ্রহণ করতে হয়, বিশটা সে তাই করবে…।
পরবর্তী কয়েকটা দিন মন্থর গতিতে কেটে যায়। বাবর সংবাদের অপেক্ষায় থাকে। সবসময়ে একই খবর সে শুনতে পায়- “অবস্থা অপরিবর্তিত আছে।” অভিযান থেকে ফিরে আসবার পরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার মনোযোগ দাবি করেছিলো। উপজাতি সর্দার যারা তার সাথে অভিযানে গিয়েছিলো তারা নিজেদের প্রাপ্য ভাগ। নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে এবং অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদ ভাগ করে দেবার জন্য সে বাবুরীকে দায়িত্ব দিয়েছে। তার দরবারের মুনশীরা শীঘ্রই হিসাব রাখতে শুরু করবে, কতগুলো ভেড়া বা ছাগল, কত গাঁইট উলের কাপড় এবং কত বস্তা শস্য বিলিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাবরকে অবশ্য এছাড়া নিজের লোকদের কথাও ভাবতে হবে। তাদের অবশ্যই মর্যাদা আর পদবী বাড়িয়ে পুরস্কৃত করতে হবে এবং সেই সাথে লুটের মালের ন্যায্য অংশ দিতে হবে।
সে বাবুরীকে অশ্বশালার নতুন আধিকারিক করেছে-আলী ঘোসতকে বরখাস্ত করার পরে থেকেই পদটা খালি ছিলো। তার রসিকতা আর গর্ববোধ দুটোই ভালোভাবে আলোড়িত হয়েছে এর ফলে। তার অবর্তমানে কাবুলের দায়িত্বে থাকা আর এতোদিন বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্বপালনকারী বাইসানগারকে নিয়ে সে কি করবে ভেবে পায় না। তার যদি নিজের মেয়ে বা ভাস্তি থাকত তাহলে সে তাদের মাঝ থেকে একজনকে খুশি মনে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারতো। সমরকন্দের এক প্রাচীন অভিজাত পরিবারের সন্তান বাইসানগার এবং বাবর যদি কখনও সেখানে ফিরে যেতে পারে তবে ব্যাপারটা সেখানকার লোকদের প্রীত করবে। সে যতোই বিষয়টা নিয়ে ভাবে ততোই সেটা তার মনে ধরে… বাইসানগারকে সে কদাচিত নিজের পরিবার সম্পর্কে বলতে শুনেছে এবং নিশ্চিতভাবেই তার পরিবারের কেউ সমরকন্দ থেকে তার সাথে আসেনি। অবশ্য তার মানে এই না যে, তার কেউ নেই। এতো ঝামেলা না করে জিজ্ঞেস করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। বাইসানগারকে নিজের কামরায় ডেকে পাঠিয়ে সে সরাসরি কাজের কথা পাড়ে। “আমি আপনার কাছে বিশেষভাবে ঋণী। আপনি সমরকন্দে যে মুহূর্তে আমারে কাঁধ আঁকড়ে ধরেছিলেন তারপরে থেকে আপনি সর্বদা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন…”
‘সুলতান, আমি তৈমূরের বংশের প্রতি বরাবরই বিশ্বস্ত থেকেছি এবং আগামীতেও থাকবো।’
“আর এজন্যই আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। আমার আম্মিজানের ইচ্ছা আমি শীঘ্রই আবার বিয়ে করি। আমিও ঠিক করেছি তাই করবো- সেটা দেখে যাবার জন্য যদি তিনি বেঁচে নাও থাকেন। তারপরেও এবং বাইসানগার মেয়েটা যদি আপনার বংশের কেউ হয়, তবে আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করবো। আমি এই কথাটা বলবার জন্যই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম…”।
বাইসানগারকে বিস্মিত দেখায়। বাবর এই প্রথমবারের মতো তার ধীর-স্থির, আবেগবর্জিত, সামান্য রসকষহীন সেনাপতিকে- যে লোকটা, তার ডান হাত পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও বাম হাতের বরাভয়ে বিপক্ষের যোদ্ধাদের মাঝ দিয়ে অনায়াসে সাঁতার কাটার মতো পিছলে বের হয়ে যেতে সক্ষম- ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতে দেখা যায়।
“সুলতান, আমার একটা মেয়ে আছে, কিন্তু গত দশ বছর আমি তাকে দেখিনি। আমার স্ত্রী তাকে প্রসব করার সময়ে মারা যায়। সাইবানি খান আপনার চাচাজানকে হত্যা করার পরে এবং সমরকন্দের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মনে হতে, আমি হিরাতে আমার ভাইদের কাছে নিরাপত্তার স্বার্থে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেই। তার এখন সতের বছর বয়স হয়েছে।”
“তার নাম কি?”
“সুলতান, তার নাম মাহাম।”
“আপনি কি তাকে আনবার জন্য লোক পাঠাবেন? আপনি কি আমার সাথে তার বিয়েতে সম্মতি দেবেন?”
“সুলতান, সেটা আমার সৌভাগ্য।”
“আমি তাকে আমার একমাত্র স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারবো না। মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলার জন্য আমি বাধ্য হব আরও স্ত্রী গ্রহণ করতে। কিন্তু বাইসানগার আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে, তার সাথে সবসময়ে ভালো ব্যবহার করবো, আর সে আমার প্রথম স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করবে।”
*
“সুলতান, উঠুন।” বাবর তার কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করতে সহজাত প্রবৃত্তির বশে বালিশের নিচে রাখা খঞ্জরের বাঁট আঁকড়ে ধরে। তারপরে বুঝতে পারে একটা নারী কণ্ঠ তার ঘুম ভাঙিয়েছে। মেয়েটার হাতে ধরা মোমের আলো থেকে নিজের চোখ আড়াল করে বাবর ফাতিমার গোলাকার সাদাসিধে মুখ দেখতে পায়।
প্রাসাদ রীতিনীতির-এবং নিরাপত্তার দিক থেকেও, একটা বিরল বিচ্যুতি বলতে হবে ঘটনাটাকে। তারপরে তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন আরেকটু হলে বন্ধ হবার মতো উপক্রম হয়। ফাতিমা এতো রাতে নিশ্চয়ই আম্মিজানের কক্ষ থেকে আসছে। সে নিজের নগ্নতার ব্যাপারে একেবারে বেখেয়াল অবস্থায় বিছানা থেকে লাফিয়ে নামে। “কি হয়েছে? আম্মিজান কেমন আছেন…?”
ফাতিমা কাঁদছে, কিন্তু সেটা বেদনার না আনন্দের অশ্রু। “বিপর্যয় অবশেষে কেটে গেছে- হাকিম বলেছেন এ যাত্রা মালকিন বেঁচে যাবেন।”
বাবর এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে, আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। তারপরে ফাতিমার রক্তিম বিভ্রান্তি খেয়াল করে এবং সে চোখ সরিয়ে রেখেছে দেখে। বাবর ত্রস্ত হাতে নিজের আলখাল্লা খুঁজে। সে আলখাল্লাটা কোনোমতে জড়িয়ে নিয়ে, সরু অলিন্দ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে, দ্বাররক্ষীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, রূপার কারুকাজ করা দরজা হুড়মুড় করে খুলে মায়ের কক্ষে প্রবেশ করে। পক্ক কেশ হেকিম জিহ্বা দিয়ে প্রতিবাদসূচক শব্দ করে। কিন্তু বাবর তখন সেসব দেখার মতো অবস্থায় নেই। এসান দৌলত তার মেয়ের মুখ তখন একটা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছিলেন এবং তিনি যখন তাকে সম্ভাষণ জানাবার জন্য ঘুরে তাকান, বাবর তার। চোখেমুখে স্বস্তির একটা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে।
বাবর এবার তার আম্মিজানের দিকে তাকায়। তার একদা মসৃণ ত্বক বৃত্তাকার লাল দাগে ফেটে আছে এবং ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল এবং তার দিকে তাকাতে দৃষ্টির উজ্জ্বলতা আরো বৃদ্ধি পায়। খুতলাঘ নিগার দুহাত প্রসারিত করতে, বাবর তার শয্যার পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে আলিঙ্গন করার সুযোগ আম্মিজানকে দেয়। টের পায় সে আবার তার সেই ছোট্ট বাবরে পরিণত হয়েছে এবং গভীর স্বস্তির একটা রেশ তাকে আপ্লুত করে তোলে।
*
পাঁচ হাজার উট আর দু’হাজার খচ্চরের কাফেলার কাছ থেকে যেমনটা প্রত্যাশিত ঠিক তেমনটাই ধূলোর মেঘ পশ্চিমাকাশে ঘনিয়ে উঠতে দেখা যায়। এই বিশাল জটলার মাঝেই কোথাও মাহাম আছে। হিরাত থেকে পূর্বে তার যাত্রা নিরাপদ করার লক্ষ্যে সে যদিও রক্ষীবাহিনী পাঠিয়েছিলো। কিন্তু সে পরে সিদ্ধান্ত নেয় বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে রক্ষীবাহিনী কাফেলার সাথেই যোগ দেবে।
রাতের আগেই তার হবু স্ত্রীর দূর্গে পৌঁছে যাবার কথা। পুরু গালিচা পেতে, রেশমের পর্দা দিয়ে সজ্জিত করে, সবোকৃষ্ট গোলাপজল আর চন্দনকাঠের সুবাসে তার জন্য নির্ধারিত কক্ষ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সাথে সেখানে রাখা হয়েছে তার বিয়ের উপহার- আয়েশাকে সে যে ভারী সোনার কণ্ঠহার আর বাজুবন্ধ দিয়েছিলো। এবং সে যেটা আবার ফেরত পাঠিয়েছিলো সেসব না। তার কোষাগারের সর্বোত্তম নমুনা। মূল্যবান পাথরখচিত সূক্ষ্ম কারুকাজ করা সোনার মণিহার আর মানতাসা। আচ্ছা মাহাম এখন কি ভাবছে? সে কল্পনা করতে চেষ্টা করে। নিজের বাবার সাথে, যাকে সে এতো বছর দেখেনি তার সাথে মিলিত হতে পারার কারণে উৎফুল্ল? শীঘ্রই যাকে স্বামী হিসাবে বরণ করতে হবে, সে বিষয়ে একটা শঙ্কা তার ভিতরে কাজ করছে…?
সূর্যাস্ত যাবার ঠিক আগে, বাবর পুনরায় দূর্গপ্রাকারে দাঁড়িয়ে গোধূলির ধূসর আলোয় তাকিয়ে দেখে, কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের তোরণদ্বার অতিক্রম করে পাত্রীপক্ষ ভেতরের আঙ্গিনায় প্রবেশ করে। কাফেলাটার সাথে আগত বিশেষ যত্ন নিয়ে পর্দা দেয়া গরুর গাড়ির বহরের দিকে বাইসানগার উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। যেখানে তার মেয়ে আর তার পরিচারিকার দল ভ্রমণ করছে। বাবর ভাবে সেও যদি দেখতে পেতো! কিন্তু বিয়ের অনুষঙ্গ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অগত্যা তাকে অপেক্ষা করতেই হবে…।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেদিন থেকে এক সপ্তাহ পরে শাহী জ্যোতিষের গণনা করা শুভ দিনে শুরু হয়। একটা মখমলের চাঁদোয়ার নিচে বাবর আর মাহম পাশাপাশি এসে বসলে মোল্লার দল তাদের দাম্পত্যজীবন যেনো সুখের হয় সেজন্য মোনাজাত করে। নববধূ বেচারা হাঁসের নীল ডিমের মতো রঙের রেশমের কারুকাজ করা কয়েক পরত নেকাবের আড়ালে ঢাকা পড়ে রয়েছে। যেটা আবার মূল্যবান পাথর সজ্জিত সোনার ঝালর দেয়া টুপির নিচে থেকে বের হয়ে এসেছে। যা যখন সে মাথা নাড়ছে কাঁপছে আর ঝলসে উঠছে- বিয়েতে খুতলাঘ নিগারের উপহার। বাবর নববধূকে বিয়ের ভোজসভায় নিয়ে যাবার জন্য তার হাত ধরতে, কোনো ধরণের দ্বিধা, কোনো ধরণের অনীহা অনুভব করে না বরং একধরণের উৎসুক কাঁপুনী যা কামনাতাড়িত একটা অনুভূতিতে তাকে জারিত করে তোলে।
সেই রাতে, বাসরঘরে, বাবর পরিচারিকাদের দেখে তাকে নিরাভরণ করতে। বরাবরের মতো স্বল্পবাক আর অমায়িক, কিন্তু সেই মুহূর্তে বাবরের মনে হয় মিচকে শয়তান, বাইসানগার ইচ্ছে করেই কখনও বলেনি তার মেয়ে এতো সুন্দরী। কিন্তু পরমুহূর্তে তার মনে হয় আহা বেচারা (এখন বেচারা!) মেয়ে যখন ছোট ছিলো তখন ত কে দেখেছে তারপরে আর দেখেনি তিনি (?) কিভাবে জানবেন? নববধূর ডিম্বাকৃতি মুখে বাদামী বর্ণের পটলচেরা চোখই কেবল নজর কাড়ে। আর তার কালো চুলের ঢল কোমর ছাড়িয়ে নিতম্বের ভাঁজ স্পর্শ করেছে। তার দেহাবয়ব ক্ষুদ্রাকৃতি কিন্তু সুগঠিত। মুক্তার মত দীপ্তিময় বর্তুলাকার, উন্নত স্তনযুগল, সুরু কোমর আর কটিদেশের জটিল বাকের দখল বুঝে নিতে গিয়ে বাবর মালিকানার অচেনা আবেগ আর যেকোনো মূল্যে সেটা রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষায় আপ্লুত হয়ে উঠে। নববধূকে কেউ আঘাত করতে পারে এই ভাবনাটার কল্পনা তাকে এতোটাই ক্রোধান্বিত করে তোলে যে সে বাধ্য হয় নিজেকে মনে করিয়ে দিতে যে তেমন কোনো সম্ভাবনার উদয় হয়নি আর কখনও হবেও না- তাকে আগলে রাখার জন্য সে সবসময়ে তার পাশে থাকবে…
পরবর্তী দিনগুলো যেনো আঙ্গুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়া পানির মতো বয়ে যায়। আয়েশার সাথে তার দৈহিক মিলনের পুরোটাই ছিলো শারীরিক চাহিদা নির্ভর। অন্য কোনো কিছুর কোনো ভূমিকা সেখানে ছিলো না। ফারগানার বাজারে আর বেশ্যালয়ে সে আর বাবুরী যখন বিচরণ করেছে তখন ইয়াদগারের মতো মেয়েদের সাথে তার ফষ্টিনষ্টি কখনও ভালো কোনো শিকার বা উপাদেয় খাবারের চেয়ে বেশি কিছু ছিলো না- কেবল ফুর্তিতে সময় কাটানোই তখন মূখ্য ছিলো।
মাহামের কাছে যাবার জন্য এসান দৌলতকে আজকাল আর চৌকিদারের ভূমিকা নিতে হয় না। আয়েশার কাছে তাকে পাঠাতে তিনি একটা সময়ে যে মূর্তি ধারণ করতেন। অবশ্য অনেক সময়ে এমনও হয়েছে, সদ্য মিলন শেষে, মাহামের নিখুঁত স্তনে কালো চুলের বাধভাঙা ঢল তাকে নিমেষেই কঠিন করে তুলেছে। তাকে তখন আলতো করে নিজের কাছে টেনে এনে, তার অরক্ষিত কটিদেশের মসৃণ বাঁকে হাত বুলিয়ে, দুষ্টু মেয়েটার অধীর আকুতি অনুভব করেছে এবং দ্রুত হয়ে উঠা নিঃশ্বাসের শব্দ তাকে বলে দিয়েছে আবেগের তাড়না দু’পক্ষেই প্রবল।
*
“নববধূ কেমন আছেন? হাকিমের কাছে আপনি এখনও যাননি দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছি। আমি শুনেছিলাম জ্বালাপোড়া আর নববিবাহিতদের গোপন অঙ্গের ঘর্ষণজনিত ক্ষত নিরাময়ে ধন্বন্তরী একটা মলম তার কাছে আছে…”
“নববধূ ভালোই আছেন…”
“খোদা, আপনার কি শরীর খারাপ, কি প্রশ্নের কি উত্তর…?” বাবুরী কপট চোখ কপালে তুলে বলে।
“হ্যাঁ।” বিয়ের মাসখানেক হতে চলেছে, কিন্তু বাবর এখনও মাহামের প্রতি তার অনুভূতির কথা আলোচনা করতে অনীহা বোধ করে। এমন কি বাবুরী যার সাথে সে সবকিছু আলোচনা করে, তার সাথেও না। আলাপের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আগে থেকেই তার মাথায় ঘুরতে থাকা বিষয়টা সে উত্থাপন করে। “কাবুলের অভিজাত মহল থেকে আমি আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করতে চাই। প্রজারা সেটাই চায় এবং এর ফলে তাদের সাথে আমার একটা আত্মীয়তার সম্পর্কের সৃষ্টি হবে।”
“আপনি কাউকে পছন্দ করেছেন?”
“আমি এসব ঝামেলায় নেই। আমি আম্মিজান আর সেই নাচুনে বুড়ির উপরে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছি। দু’জনে শাহী জেনানামহলে সম্ভাব্য উপযুক্ত পাত্রীদের ডেকে এনেছেন…”
“আর আপনার পক্ষ হয়ে পছন্দের ভীষণ দায়িত্ব পালন করছেন?”
“বাহ্, তোমার দেখি ভালোই বুদ্ধি খেলছে আজকাল। আর তারা অতঃপর সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। গতরাতে নানীজান মেয়েটার নামও আমাকে বলেছিলো…কিন্তু বাবুরী এবার ধানাইপানাই ছাড়ো, চাঁদ? তোমারও বিয়ে করার সময় হয়েছে? তুমি কি সন্তানের পিতা হতে চাও না?”
“আট বছর বয়স থেকে আমি একা…বন্ধন, বিয়ে এসব ভাবনা আমাকে আকৃষ্ট করে না। আমি শয্যায় বৈচিত্র পছন্দ করি এবং সেই সাথে এটা পছন্দের যে স্বাধীনতা নিয়ে আসে।”
“তুমি তোমার যতোগুলো স্ত্রী চাও গ্রহণ করতে পারো। তুমি এখন আর সেই গরীব লোকটি নও…”
“আপনি বুঝতে পারবেন না। পরিবার, উত্তরাধিকার, সাম্রাজ্য- এসব আপনার জগতের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ। বহু আগে আরম্ভ হওয়া একটা গল্পের অংশ হিসাবে আপনি নিজেকে দেখতে অভ্যস্ত এবং আপনার মৃত্যুর পরেও যা চলতে থাকবে আর সেখানে আপনার ভূমিকা সবসময়ে স্মরণ করা হবে। মানুষ আমাকে মনে রাখলো কিনা, সেটা আমি খোঁড়াই পরোয়া করি। তারা কেন আমাকে মনে রাখবে?”
“সব মানুষই চায় পৃথিবীর বুকে নিজের ছাপ রেখে যেতে। উত্তরসূরীরা যাতে তার কথা বলার গর্ব অনুভব করে…এটা কেবল রাজার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না…”
“তাই নয় কি? আমার মতো লোকেরা ইতিহাসের গর্ভে দ্রুতই হারিয়ে যায়। আমরা ইতিহাসের উপাদান হিসাবে তুচ্ছ। আমি একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি…আপনার ঐ রোজনামচায় আপনি আমার বিষয়ে কি লিখেছেন…” সাম্প্রতিক সময়ে কি আমার কথা আদৌ উল্লেখ করেছেন?” বাবুরীর ঘন নীল চোখ ঝিকিয়ে ওঠে।
বাবর সহসা বুঝতে পারে রাজার ভাগ্য, গৌরব বা খ্যাতির কোনো সম্পর্ক নেই বিষয়টার সাথে। ব্যাপারটা তারচেয়ে অনেক সরল কিছু একটা। বাবুরী, বেচারা বাবুরী আসলে ঈর্ষান্বিত। সে ছিলো বাবরের ঘনিষ্ট সহচর, বিশ্বস্ত বন্ধু, একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে বাবর কিছুই এতোদিন গোপন করেনি। মাহামের প্রতি বাবরের আবেগ সেটা বদলে দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে, গত কয়েক সপ্তাহ বাবুরীর কথা তার সামান্যই মনে পড়েছে। আর বাবুরী- প্রাপ্তবয়স্ক একটা লোক, যুদ্ধক্ষেত্রে তার মতো পরীক্ষিত আর প্রশংসিত যোদ্ধা- এতে মনে কষ্ট পেয়েছে। বাজারের সেই অরক্ষিত বাচ্চা ছেলেটা, যে উচ্ছিষ্টের জন্য লড়াই করেছে এবং বাহুবলের উপরে নির্ভর করে বেঁচে থেকেছে। তর্জনগর্জন করা নিজের প্রতি অতি আস্থাবান লোকটার খোলসের নিচে আজও বেঁচে আছে।
বহুবছর আগে ওয়াজির খান বাবুরীর সাথে তার ক্রমবৃদ্ধিমান অন্তরঙ্গতার বিষয়ে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এবং সেই পোড়খাওয়া লোকটা নিজের ঈর্ষা আর অপাংক্তেয় অনুভূতির কথা অকপটে স্বীকার করেছিলেন। ওয়াজির খানের আহত অভিমান প্রশমিত করতে সে যে কথাগুলো বলেছিলো, বাবর দেখতে পায় আজও সে ঠিক সেই কথাগুলোই আবার বলছে। “তুমি আমার সবচেয়ে প্রধান ইচকিস, আমার নিকটতম, সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা আর আমার একমাত্র বন্ধু। এই কথাটা কখনও ভুলে যেও না।” সে আলতো করে বাবুরীর কাঁধ স্পর্শ করে।
বাবুরী কাঁধের হাতটার দিকে তাকায় কিন্তু সেটা স্পর্শ থেকে মোচড় খেয়ে সরে যায় না। বাবর ভাবে, ঠিক যেনো একটা গোয়াড় স্ট্যালিয়নকে বশ মানানো। বশ মানার যতো বছরই হোক বন্যতার সামান্য ছিটেফোঁটা সব সময়েই রয়ে যায়। কিন্তু বাবুরীর কোমল হয়ে চোখের দৃষ্টি বলে দেয় তার কথাগুলো মলম হয়ে জায়গামতো প্রলেপ দিয়েছে। “বেশ, এবার তাহলে আপনার পরবর্তী স্ত্রীর কথা বলেন। কে সেই ভাগ্যবতী?” এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বাবুরী জানতে চায়।
“বাহলুল আইয়ুবের নাতি, গুলরুখ। তার বয়স উনিশ বছর এবং আমার নানীজান আমাকে বলেছেন, আমার অনেক সন্তান সে গর্ভে ধারণ করতে পারবে।”
“আচ্ছা তাহলে সেই আহাম্মক গ্রান্ড উজির আপনার শ্বশুর হচ্ছেন।”
“হ্যাঁ।”
“বেশ তাহলে তো হয়েই গেলো বাবাজীর ক-কথার জ্বালায় আর টিকতে হবে না কাউকে। আর আপনিও তার কথা এড়িয়ে যাবার অ-অজুহাতও পাবেন না।”
“সে একটা প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। তৈমূরের সেনাবাহিনী যখন কাবুলে এসেছিল তখন তারই এক পূর্বপুরুষ কাবুলের গ্রান্ড উজিরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো।”
“তাই তো বলি, তৈমূর কেনো বেশিদিন এখানে অবস্থান করেননি। তা হবুবধূ দেখতে কেমন?”
বাবর কাঁধ ঝাঁকায়। “গুলরুখ? আমি তাকে দেখিনি। সময় হলে আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো। কিন্তু মাহাম সবসময়ে আমার প্রথম স্ত্রীর মর্যাদা পাবে…”
*
১৫০৮ সালের এক শীতের সন্ধ্যাবেলা। বাবর দূর্গপ্রাসাদের প্রাকার বেষ্টিত ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তার নিঃশ্বাস অনবরত একটা কুয়াশার মেঘের জন্ম দিচ্ছে। সে তার পরণের আলখাল্লাটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নেয়। কাবুলের আকাশ বছরের এই সময়ে প্রায়ই যেমন হয়ে থাকে- নির্মেঘ এবং তারার দল এমন উজ্জ্বলভাবে চমকায় যে তাকিয়ে থাকতে যেন কষ্ট হয়। এক ঘণ্টা আগে, সে ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে থেকে শাহী জ্যোতিষের সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। “সন্তান যদি আজ রাতে ভূমিষ্ট হয়, গ্রহমণ্ডলী যখন মীনের বলয়ে অবস্থান করছে, সে আপনার বংশের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।” বৃদ্ধ লোকটা বলে, গ্রহ-নক্ষত্রের মানচিত্রের গোছা আঁকড়ে ধরা তার বয়সের ছোপ পরা হাত ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকে। বাবর তাকে আর তার সব পরিচারকদের যেতে বলে- এমনকি বাবুরীকেও। কি হচ্ছে না জানা পর্যন্ত সে একা থাকতে চায়। ছাদের এই স্থানে তাকে অন্তত মাহামের যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তনাদ শুনতে হচ্ছে না…তার প্রসব বেদনার পনের ঘণ্টা অতিক্রান্ত হতে চলেছে। নিজের সবটুকু আত্মসংযম খরচ করে সে তার কাছে ছুটে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। আর সেটা একজন পুরুষের জন্য শোভনীয় কোনো স্থানও না। তার নানীজান দূর্গ মাথায় তুলে তাকে ধমকে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে বলে, সবকিছু মেয়েদের হাতে ছেড়ে দিতে বলেন। সে মাহামের মুখটা, বিশাল দরজা তার মুখের উপরে বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে যাবার আগে একঝলকের জন্য দেখতে পায়। ঘামে ভেজা, ব্যথায় কুঁচকে আছে, কামড়ে ধরা ঠোঁট রক্তাক্ত।
“ছেলে বা মেয়ে যাই হোক কোনো ব্যাপার না। কিন্তু মাহাম যেন বাঁচে,” সে নিজেকে প্রার্থনা করতে দেখে। “আর কাউকে যদি ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তবে সেটা যেন মাহাম না হয়…” হেকিম বেশ কয়েকদিন ধরেই সতর্ক করে আসছে যে বাচ্চার আকৃতি বেশ বড়- সম্ভবত মাহামের ক্ষুদ্র অবয়বের তুলনায় একটু বেশিই বড়।
গুলরুখও গর্ভবতী। তার সন্তান ভূমিষ্ট হতে এখনও পাঁচ মাস বাকী। কিন্তু এখনই সে তরমুজের মতো ফুলে উঠেছে এবং তাকে চমৎকার স্বাস্থ্যবতী দেখায়। কিন্তু গর্ভধারণের ফলে মাহাম কেবল ক্রমাগত অসুস্থই হয়েছে। সে প্রথমদিকে কিছুই খেতে পারেনি এবং গুলরুখের মতো বিকশিত হবার বদলে তার মুখ ক্রমশ শুকিয়ে গিয়েছিলো। তার লম্বা-পাপড়িযুক্ত চোখের নিচের পেলব ত্বকে কালশিটে পড়ার মতো বৃত্তাকার কালো দাগ যেনো কেউ এঁকে দিয়েছে।
বাইসানগারও মাহামের অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেন। সেই তার একমাত্র জীবিত সন্তান। তার জন্যও কঠিন সময় গিয়েছে…
“সুলতান…দ্রুত আসেন…” মাহামের এক পরিচারিকা হাঁফাতে থাকে এবং দম ফিরে পাবার জন্য আকুপাকু করার ফাঁকে কোনোমতে কথা বলে। সে পাথরের চৌকাঠ-যার ভিতর দিয়ে সে উপস্থিত হয়েছে সেটা ধরে নিজেকে সুস্থির করতে চেষ্টা করে। বাবরের মনে হয় সে বুঝি এখানে নেই, অনেক দূর থেকে সবকিছু দেখছে…”সুলতান, আপনার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে…”
“কি বললে তুমি…?”
“রাণীমা, আপনার স্ত্রী একটা পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে…তিনিই আমাকে বলেছেন আপনাকে খুঁজে বের করতে…আর বলতে যে সব কিছু ঠিক আছে…”
“আর আমার স্ত্রী…সে কেমন আছে?”
“তিনি ভয়ানক ক্লান্ত। কিন্তু তিনি আপনাকে খুঁজছেন।” এই প্রথমবারের মতো পরিচারিকাটা তার মুখের দিকে তাকায় এবং সুলতানের চেয়ে একজন উদ্বিগ্ন পিতাকে দেখতে পেয়ে সে তার ভীরুতা ঝেড়ে ফেলে হাসে। “সুলতান, সত্যি বলছি, সব কিছু ঠিক আছে এবং আপনি রাণীমার কাছে যেতে পারেন।”
পরিচারিকাটা বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে দ্রুত হেঁটে যায়। কিন্তু বাবর সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করে না। মুহূর্তের জন্য সে নির্মল আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে, সৌভাগ্যের প্রতীক ক্যানোপাস খুঁজে। হিন্দুকুশের বরফাবৃত গিরিপথের উপরে সে যে মুহূর্তে তারাটাকে আলোকবর্তিকার মতো চমকাতে দেখেছিলো, তখন থেকে নিশ্চিতভাবে প্রতি পদক্ষেপে তারাটা তাকে পথ দেখিয়ে চলেছে। বাবর তারাটা খুঁজে পেতে, নিরবে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
***
সাদা পাগড়ী আর কালো আচকান পরিহিত মোল্লার দল তাদের প্রার্থনা শেষ করতে বাবর বাইসানগারের কোলে নীল মখমলের গালিচায় নিধিরাম সর্দারের মতো শুয়ে থাকা তার পাঁচদিনের পুত্র সন্তানের মাথার উপরে ধরে থাকা জেড পাথরের থালা থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা ছিটিয়ে দেয়।
“তুমি আমার প্রথম ভূমিষ্ট আর প্রিয়তম পুত্র সন্তান। আমি তোমার নাম রাখলাম, হুমায়ুন, সৌভাগ্যবান একজন। আল্লাহতা’লার কৃপায় তোমার জীবন সৌভাগ্যপূর্ণ হোক, আর আমার বংশে তোমার হাত ধরে সম্মান আর মর্যাদার আগমন ঘটুক।” নিজের আত্মজের কুচকানো ত্বকের ক্ষুদে মুখের দিকে তাকিয়ে যে স্নেহপরায়ণতা তার ভিতরে জন্ম নেয়, যার সাথে বাবরের আগে কখনও পরিচয় ছিলো না। সে পুত্র সন্তান কামনা করে অনেক পুত্র সন্তান- বংশ পরম্পরায় যারা তার রক্ত বহন করবে। কিন্তু পিতৃত্বের স্বাদ কেমন সেটা ভাববার অবকাশ সে আগে পায়নি। সে ভাগ্যবান যে, তাকে এখন কোনো বক্তৃতা করতে হবে না- তার কণ্ঠস্বর হয়তো তার বশে থাকতো না, বা চোখের কোণে জমে উঠা অশ্রুও সে সংবরণ করতে ব্যর্থ হতো।
বাবর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুরীর হাতে শূন্য থালাটা দিতে হুমায়ুনের ক্ষীণ কান্নার শব্দ শোনা যায়। বাচ্চাটাকে মখমলের গালিচা থেকে তুলে সে দু’হাতে উঁচু করে ধরে। যাতে তার সব অমাত্য আর সর্দাররা তাকে দেখতে পায় এবং তাদের নতুন শাহজাদাকে স্বীকার করে।
বাবরের দরবার হলের রাজকীয় মঞ্চের ডান দিকে দেয়ালের অনেক উঁচুতে মার্বেলের জাফরির ভিতর দিয়ে মাহাম, তার আম্মিজান আর নানীজান তাকিয়ে রয়েছে। তারা তাকে প্রথাগত উপহার সামগ্রী গ্রহণ করতে দেখে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে কথিত রৌপ্য মুদ্রা, রেশমের বাণ্ডিল, অভিজাত লোকদের দেয়া ঘোড়া আর শিকারী কুকুরের দল। উপজাতি সর্দারদের নিয়ে আসা ভেড়া আর ছাগলের পাল।
হুমায়ূন মধ্যরাতে ভোজসভা আর আনন্দ উদযাপন শেষ হবার অনেক আগেই মাহাম আর তার দাই-মায়ের, উজ্জ্বল চোখের এক তরুণী যে সদ্য নিজের ছেলেকে দুধ ছাড়িয়েছে, তত্ত্বাবধায়নে ফিরে যাবে। তৈমূরের বংশের কারো দাইমা হতে পারার সম্মানই আলাদা, আর সেটা সবাই হতে চায়। সে তার নতুন প্রাপ্ত দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করবে।
পুরুষ অতিথিদের হাসির শব্দে তার কল্পনার রেশ ছিন্ন হয়। তখনও বাইসানগারের কোলে থাকা মখমলের নীল গালিচায়, হুমায়ূন প্রাণপণে মোচড়াতে মোচড়াতে হলুদ প্রস্রাবের একটা বৃত্তচাপ নির্গত করে।
“সে যেনো এভাবেই আমাদের সব শত্রুকে মুতে ভাসিয়ে দেয়!” তুমূল হৈচৈয়ের ভিতরে বাবর চেঁচিয়ে উঠে বলে। কিন্তু সে এর সাথে আরও কিছু বলতে চায়। ঠিক এখনই কথাগুলো বলবার তার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু কেনো জানি একটা নতুন সংকল্প- তাকে তাড়িত করে। সে ইঙ্গিতে সবাইকে চুপ করতে বলে।
“আপনারা সবাই আজ এখানে সমবেত হয়েছেন আমার ছেলের সম্মানে, আমার বংশের শুভাকাক্ষি হিসাবে- যা তৈমূরের বংশ। আমার সময় হয়েছে তৈমূরের পাদিশাহ উপাধি, পৃথিবীর ঈশ্বর, গ্রহণ করবার। আমি, আমার ছেলে হুমায়ূন এবং আমার এখনও ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানেরা, আমাকে এর যোগ্য বলে প্রতিপন্ন করবে এবং আমাকে যারা সমর্থন জানাবে সবাই এই গৌরবের অংশীদার বলে গণ্য হবে।