৩.২ উপসংহার : লক্ষ্মীর বাক্য শুনিবামাত্র

লক্ষ্মীর বাক্য শুনিবামাত্র রাজার জন্মান্তর বৃত্তান্ত সমুদায় স্মরণ হইল। তখন মকরকেতু কাদম্বরীকে তাঁহার স্মৃতিপথে উপস্থিত করিয়া শরাসনে শর সন্ধান করিলেন। তখন গন্ধর্ব্বকুমারী কাদম্বরীর বিরহবেদনা রাজার হৃদয়ে অতিশয় যন্ত্রণা দিতে লাগিল। এ দিকে বসন্তকাল উপস্থিত। সহকারের মুকুলমঞ্জরী সঞ্চালিত করিয়া মলয়ানিল মন্দ মন্দ বহিতে লাগিল কোকিলের কুহুরবে চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত হইল। অশোক, কিংশুক, কুরুবক, চম্পক প্রভৃতি তরুগণ বিকসিত কুসুম দ্বারা দিঙ্মণ্ডল আলোকময় করিল। অলিকুল বকুলপুষ্পের গন্ধে অন্ধ হইয়া ঝঙ্কার পূর্ব্বক তাহার চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতে লাগিল। তরুগণ পল্লবিত ও ফলভরে অবনত হইল। কমলবন বিকসিত হইয়া সরোবরের শোভা বৃদ্ধি করিল। ক্রমে মদনমহোৎসবের সময় সমাগত হইলে, একদা কাদম্বরী সায়াহ্নে সরোবরে স্নান করিয়া ভক্তিভাবে অনঙ্গদেবের অর্চ্চনা করিলেন। চন্দ্রাপীড়ের শরীর ধৌত ও মার্জ্জিত করিয়া গাত্রে হরিচন্দন লেপন করিয়া দিলেন এবং কণ্ঠদেশে কুসুমমালা ও কর্ণে অশোকস্তবক পরাইয়া দিলেন। উত্তম বেশ ভূষায় ভূষিত করিয়া সস্পৃহ লোচনে বারংবার নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। একে বসন্ত কাল তাহাতে নির্জ্জন প্রদেশ। রতিপতিও সময় বুঝিয়া অমনি শর নিক্ষেপ করিলেন। কাদম্বরী উন্মত্ত ও বিকৃতচিত্ত হইয়া জীবিতভ্রমে যেমন চন্দ্রাপীড়ের মৃত দেহ গাঢ় আলিঙ্গন করিবার উপক্রম করিতেছেন, অমনি চন্দ্রাপীড় পুনর্জীবিত হইয়া উঠিলেন। কাদম্বরী ভয়ে কাঁপিতেছেন, চন্দ্রাপীড় সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ভীরু! ভয় কি? এই দেখ, আমি পুনর্জীবিত হইয়াছি। আজি শাপাবসান হইয়াছে। এত দিন বিদিশা নগরীতে শূদ্রক নামে নরপতি ছিলাম, অদ্য সে শরীর পরিত্যাগ করিয়াছি। তোমার প্রিয়সখী মহাশ্বেতার মনোরথও আজি সফল হইবেক। আজি পুণ্ডরীকও বিগতশাপ হইয়াছেন। বলিতে বলিতে চন্দ্রলোক হইতে পুণ্ডরীক নভোমণ্ডলে অবতীর্ণ হইলেন। তাঁহার গলে সেই একাবলী মালা ও বামপার্শ্বে কপিঞ্জল। কাদম্বরী প্রিয়সখীকে প্রিয় সংবাদ শুনাইতে গেলেন, এমন সময়ে পুণ্ডরীক চন্দ্রাপীড়ের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চন্দ্রাপীড় সমাদরে হস্ত ধারণ ও কণ্ঠগ্রহণ পূর্ব্বক মৃদু মধুর বচনে বলিলেন, সখে! তোমার সৌহার্দ্দ কখন বিস্মৃত হইতে পারিব না। আমি তোমাকে বৈশম্পায়ন বলিয়াই জ্ঞান করিব। তোমাকে আমার সহিত মিত্রতা ব্যবহার করিতে হইবেক।

গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ ও হংসকে এই শুভ সংবাদ শুনাইবার নিমিত্ত কেয়ূরক হেমকূটে গমন করিল। মদলেখা আহ্লাদিত হইয়া তারাপীড় ও বিলাসবতীর নিকটে গিয়া কহিল, আপনাদের সৌভাগ্যবলে, যুবরাজ আজি পুনর্জ্জীবিত হইয়াছেন। রাজা, রাণী, শুকনাস ও মনোরমা এই বিস্ময়কর শুভসমাচার শ্রবণে পরম পুলকিত হইয়া শীঘ্র আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। চন্দ্রাপীড় জনক জননীকে সমাগত দেখিয়া বিনীত ভাবে প্রণাম করিবার নিমিত্ত মস্তক অবনত করিতেছিলেন, রাজা অমনি ভুজযুগল প্রসারিত করিয়া ধরিলেন। কহিলেন, বৎস! জন্মান্তরীণ পুণ্যফলে তোমাকে পুত্ত্ররূপে প্রাপ্ত হইয়াছি বটে; কিন্তু তুমি সাক্ষাৎ ভগবান্ চন্দ্রমার মূর্ত্তি! তুমিই সকলের নমস্য; তোমাকে দেখিয়া আজি দেবগণ অপেক্ষাও সৌভাগ্যশালী হইলাম। আজি জীবন সার্থক ও ধর্ম্ম কর্ম্ম সফল হইল। বিলাসবতী পুনঃ পুনঃ মুখচুম্বন ও শিরোঘ্রাণ করিয়া সস্নেহে পুত্ত্রকে ক্রোড়ে করিলেন। তাঁহার কপোলযুগল হইতে আনন্দাশ্রু বহিতে লাগিল। অনন্তর শুকনাস ও মনোরমাকে প্রণাম করিলেন। তাঁহারাও যথোচিত স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক যথাবিহিত আশীর্ব্বাদ করিলেন। ইনিই বৈশম্পায়নরূপে আপনাদিগের পুত্ত্র হইয়াছিলেন বলিয়া চন্দ্রাপীড় পুণ্ডরীকের পরিচয় দিলেন। পুণ্ডরীক জনক জননীকে ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন। কপিঞ্জল কহিলেন, শুকনাস! মহর্ষি শ্বেতকেতু আপনাকে বলিয়া পাঠাইলেন, “আমি পুণ্ডরীকের লালন পালন করিয়াছি বটে, কিন্তু ইনি তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত। অতএব তোমার নিকটেই পাঠাইতেছি! ইঁহাকে বৈশম্পায়ন বলিয়া জ্ঞান করিও, কদাচ ভিন্ন ভাবিও না”। শুকনাস কহিলেন, মহর্ষির আদেশ গ্রহণ করিলাম, তিনি যাহা আজ্ঞা করিয়াছেন তাহার অন্যথা হইবেক না। বৈশম্পায়ন বলিয়াই আমার জ্ঞান হইতেছে। এইরূপ নানা কথায় রজনী প্রভাত হইল। প্রাতঃকালে চিত্ররথ ও হংস, মদিরা ও গৌরীর সহিত তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সমুদায় গন্ধর্ব্বলোক আহ্লাদে পুলকিত হইয়া আগমন করিল।

আহা! কি শুভদিন! কি আনন্দের সময়! সকলের শোক দুঃখ দূর হইল। আপন আপন মনোরথ সম্পন্ন হওয়াতে সকলেই আহ্লাদের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন। গন্ধর্ব্বপতির সহিত নরপতির এবং হংসের সহিত শুকনাসের বৈবাহিক সম্বন্ধ নির্দ্ধারিত হওয়াতে তাঁহারা নব নব উৎসব ও আমোদ অনুভব করিতে লাগিলেন। কাদম্বরী ও মহাশ্বেতা চিরপ্রার্থিত মনোরথ লাভ করিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। আপন আপন প্রিয়সখীর অভিলষিত সিদ্ধি হওয়াতে মদলেখা ও তরলিকার সমুদায় ক্লেশ শান্তি হইল।

চিত্ররথ সাদর সম্ভাষণে কহিলেন, মহারাজ সকল মনোরথ সফল হইল। এক্ষণে এই অধীনের সদনে পদার্পণ করিলে চন্দ্রাপীড়কে কাদম্বরী প্রদান ও রাজ্য দান করিয়া চরিতার্থ হই। তারাপীড় উত্তর করিলেন, গন্ধর্ব্বরাজ! যেখানে সুখ, সেই গৃহ। আমি এই আশ্রমকেই সুখের ধাম ও আপন আলয় বলিয়া স্থির করিয়াছি। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি এই স্থানেই জীবন যাপিত করিব। তুমি বধূসহিত চন্দ্রাপীড়কে আপন আলয়ে লইয়া যাও, বিবাহমহোৎসব নির্ব্বাহ কর। আমি এই আশ্রমেই থাকিলাম। চিত্ররথ ও হংস জামাতা ও কন্যাকে আপন আপন আলয়ে লইয়া গেলেন ও মহাসমারোহে মহোৎসব আরম্ভ করিলেন। পরিশেষে উভয়েই জামাতার প্রতি আপন আপন রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।

এই রূপে চন্দ্রাপীড় ও পুণ্ডরীক প্রিয়তমাসমাগমে পরম সুখী হইয়া রাজ্যভোগ করেন। একদা কাদম্বরী বিষণ্ণমুখী হইয়া চন্দ্রাপীড়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, নাথ! সকলেই মরিয়া পুনর্জ্জীবিত হইল; কিন্তু সেই পত্রলেখা কোথায় গেল জানিতে বাসনা হয়। চন্দ্রাপীড় কহিলেন, প্রিয়ে! আমি শাপগ্রস্ত হইয়া মর্ত্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিলে, রোহিণী আমার পরিচর্য্যার নিমিত্ত পত্রলেখারূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তাঁহাকে পুনর্ব্বার চন্দ্রলোকে দেখিতে পাইবে এই বলিয়া তাঁহার কৌতুক ভঞ্জন করিয়া দিলেন। হেমকূটে কিছু কাল বাস করিয়া আপন রাজধানী উজ্জয়িনী নগরে গমন করিলেন। তথায় পুণ্ডরীকের প্রতি রাজ্যশাসনের ভার দিয়া কখন গন্ধর্ব্বলোকে, কখন চন্দ্রলোকে, কখন পিতার আশ্রমে, কখন বা পরমরমণীয় সেই সেই প্রদেশে বাস করিয়া সুখ সম্ভোগ করিতে লাগিলেন।

সম্পূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *