৩.০২ উত্তরার্চিক — দ্বিতীয় অধ্যায়

উত্তরার্চিক — দ্বিতীয় অধ্যায়

এই অধ্যায়ের মন্ত্রগুলির দেবতা (সূক্তানুসারে) — ১-১২ ইন্দ্র; ১৩ অগ্নি; ১৪ ঊষা; ১৫ অশ্বিদেবদ্বয়; ১৬-২২ পবমান সোম।
ছন্দ– ১ (২
/৩), ২-১১, ১৬-১৯, ২১ গায়ত্রী; ১২/২২ (১/২) উষ্ণিক; ১৩-১৫, ২০ প্রগাথ বৃহতী; ১(১), ২২ (৩) অনুষ্টুভ।
ঋষি/৪ শ্রুতকক্ষ বা সুকক্ষ আঙ্গিরস; ২/৮/১৩-১৫ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ৩ মেধ্যাতিথি কাণ্ব, প্রিয়মেধা আঙ্গিরস; ৫ ইরিম্বিঠি কাণ্ব; ৬ কুসীদী কাণ্ব; ৭ ত্রিশোক কাণ্ব; ৯ বিশ্বামিত্র গাথিন; ১০ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র; ১১/১৭(১) শুনঃ শেপ আজীগর্তি; ১২ নারদ কাণ্ব; ১৬ অবৎসার কাশ্যপ; ১৭(২/৩) মেধ্যাতিথি কাণ্ব; ১৮(১/৩) অসিত কাশ্যপ বা দেবল; ১৮(২) অমহীয়ু আঙ্গিরস; ১৯ ত্ৰিত আপ্তা; ২০ সপ্ত ঋষি; (প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখিত); ২১ শ্যাবাশ্ব আত্রেয়; ২২ (১/২) অগ্নি চাক্ষুস; ২২ (৩) প্রজাপতি বৈশ্বামিত্র বা বাকপুত্র।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– পান্তমা বো অন্ধস ইন্দ্রমভি প্র গায়ত। বিশ্বাসাহং শতক্রতুং মংহিষ্ঠং চর্ষণীনা৷৷ ১৷ … পুরুতং পুরুতং গাথান্যাং সনতম্। ইন্দ্র ইতি ব্রবীতন৷৷ ২৷৷ ইন্দ্র ইন্নো মহোনাং দাতা বাজানাং নৃতুঃ। মহা অভিজ্বাযমৎ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২– প্র ব ইন্দ্রায় মাদনং হর্যশ্বায় গায়ত। সখায়ঃ সোমপানে৷৷৷ শংসেদুথং সূদানব উত দুক্ষং যথা নরঃ। চক্রিমা সত্যরাধসে৷৷ ২. ত্বং ন ইন্দ্র বাজযুস্তুং গব্যুঃ শতক্ততা। ত্বং হিরণ্যযুবসো৷৷ ৩৷

 সূক্ত ৩– বয়মু ত্বা তদিদৰ্থা ইন্দ্র ত্বায়ন্তঃ সখায়। কন্বা উথের্জিরন্তে৷৷ ১৷৷ ন ঘেমন্যদা পপন বর্জিপসো নবিষ্ঠেী। তবে স্তোমৈশ্চিকেত৷৷ ২৷৷ ইচ্ছন্তি দেবাঃ সুন্বন্তং ন স্বপ্নায় স্পৃহয়ন্তি। যন্তি প্রমাদমতন্দ্রঃ৷ ৩৷৷

সূক্ত ৪– ইন্দ্রায় মদ্বনে সুতং পরি ষ্টোন্তু নো গিরঃ) অকমচন্তু কারবঃ ॥১৷৷ যস্মিন্ বিশ্বা অধি শিয়ো রণন্তি সপ্ত সংসদঃ। ইন্দ্ৰং সুতে হবামহে৷৷ ২৷৷ ত্রিককেষু চেতনং দেবাসো যজ্ঞমত্নত। তমিদ বর্ধন্তু নো গিরঃ ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ—  ১সূক্ত/১সাম– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমাদের প্রদত্ত শুদ্ধসত্ত্বকে (সৎকর্মকে) সর্বতোভাবে গ্রহণকারী, সকল রকমশত্রুর অভিভবকারী, অশেষ প্রজ্ঞাসম্পন্ন, সাধকবর্গের সর্বথা। হিতসাধক, ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে সম্যক্ আরাধনা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। নিজের চিত্তবৃত্তিগুলিকে ভগবানে ন্যস্ত করার জন্য সঙ্কল্প প্রকাশ পেয়েছে)। [ভাষ্যানুসারে মন্ত্রটি ঋত্বিকদের সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে, প্রতিপন্ন হয়। সেই অনুসারে বলা হয়েছে, — হে ঋত্বিকগণ! সোমলক্ষণ অন্নকে অভিমুখ্যে যিনি দান করেন, এমন ইন্দ্রকে তোমরা প্রকৃষ্টরূপে স্তব করো। সে ইন্দ্র কেমন? তিনি সকল শত্রুর বা সকল ভূতজাতের অভিভবকারী, বহুরকম প্রজ্ঞান বা বহুরকম কর্মকারী এবং মনুষ্যগণের শ্রেষ্ঠ ধনদাতা– অথবা যজমানগণের যষ্টব্য-হেতু পূজনীয়; সেই ইন্দ্রকে প্রকৃষ্টরূপে স্তব করো। মন্ত্রাংশের অন্তর্গত অন্ধসঃ পদ সোমরসরূপ মাদক দ্রব্যের উদ্দেশে প্রযুক্ত এবং ইন্দ্রদেব, তা পান করার জন্য একান্ত আসক্ত– প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এমন ভাবই পরিব্যক্ত। কিন্তু এই মন্ত্রার্থে অন্ধসঃ পদে (পূবাপরের মতোই) শুদ্ধসত্ত্ব অর্থ গ্রহণই সঙ্গত। দেবগণ বা ভগবান্ গ্রহণ করেন– সে কোন্ সামগ্রী? পার্থিব জড়পদার্থ– অন্ন বা সোমলতার বস মাদকদ্রব্য– দেবগণের কখনই পানীয় হতে পারে না। তারা গ্রহণ করেন সকল দ্রব্যের সারভূত অংশ। তা– দ্রব্য– পদার্থ নয়– — ভাব– পদার্থ। প্রকৃত প্রস্তাবে, এই মন্ত্রটি ঋত্বিকদের সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়নি। সাধক নিজের চিত্তবৃত্তিগুলিকে সম্বোধন করে দেবতার উদ্দেশে নিজের শুদ্ধসত্ত্ব ভাবকে বা সৎকর্মকে সমর্পণ করবার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ২অ-৫দ-১সা রূপেও পাওয়া যায়]।

১/২– হে মম চিত্তবৃত্তিসমূহ! সর্ব-আরাধনীয় সর্বলোকবরণীয় যশস্বী সনাতন বলাধিপতি এই দেবতাকে তোমরা আরাধনা করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমি যেন ভগবৎপরায়ণ ও হই)। আপাতদৃষ্টিতে মন্ত্রের অন্তর্গত বিশেষণগুলি প্রায় একার্থক বলে প্রতীয়মান হতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে অবশ্যই সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আর, একার্থক বলে গ্রহণ করলেও, বোঝা যায়, এর দ্বারা প্রার্থনার ব্যাকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। — মন্ত্রের মর্মার্থ এই যে, সকলেই সেই নিত্য নিরঞ্জন ভগবানের উপাসনায় আত্মনিয়োগ করে, কিন্তু হে আমার মন! তুমি কি একাকী মোহনিদ্রায় অচেতন থাকবে? তোমার কি কখনও চৈতন্য হবে না? পশু-পাখী সকলেই প্রহরে প্রহরে তাঁকে ডাকে। তুমি কি তাদের চেয়েও হেয় নিকষ্ট? ভগবানের দেওয়া মহাধনের তুমি কি এই সৎ-ব্যবহার করলে? জাগো মন, সময় বয়ে যায় জীবনের লক্ষ্য সাধনে ব্রতী হও, ভগবানের দেওয়া শক্তির সৎ-ব্যবহার করো। হেলায় সুযোগ নষ্ট করো না। পরম আরাধ্য দেবতার শরণ গ্রহণ করো]।

১/৩– বলাধিপতি দেবতাই আমাদের পরমধনসমন্বিত আত্মশক্তির প্রদাতা হন। (ভাব এই যে, ॥ ভগবানই লোকদের আত্মশক্তি এবং পরমধন প্রদান করেন)। লোকবর্গকে পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [মানুষের যা কিছু আছে, তা ভগবানেরই দান। ভগবানের কাছ হতেই সকলে শক্তি লাভ করে। তাই তার কাছেই পরমধনের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত (ইৎ) পদটির দ্বারা কেবলমাত্র ভগবানকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। একমাত্র তিনিই ধনপ্রদানে সমর্থ]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি সামমন্ত্রের একত্ৰগথিত একটি গেয়গান আছে। তার নাম– বৈতহব্যমোকোনিধনম]।

২/১– হে আমার সহচর সুহৃৎস্বরূপ চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমাদের সম্বন্ধীয় আনন্দপ্রদ স্তোত্রকে জ্ঞানরশ্মিসম্পন্ন (জ্ঞানবিতবক) শুদ্ধসত্ত্বের বা সৎকর্মের গ্রহণকারী ভগবান্ ইন্দ্রদেবের উদ্দেশে সর্বথা সমর্পণ করো। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধক; প্রার্থনার ভাব এই যে, আপনার সকল কর্ম বা সকল স্তোত্রমন্ত্র ভগবানে সংন্যস্ত হোক)। [এই মন্ত্রটিও সাধারণতঃ ঋত্বিকদের বা পুরোহিতদের সম্বন্ধে প্রযুক্ত বলে কথিত হয়। মন্ত্রের অন্তর্গত সখায়ঃ পদ হে সখাগণ এই অর্থে তাদের সম্বোধন মধ্যে পরিগণিত হয়। সেই অনুসারে মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ দাঁড়িয়েছে, — হে সখাগণ! তোমরা হরিনামক অশ্বযুক্ত, সোমরসসমূহের পানকারী ইন্দ্রের উদ্দেশে মদকর স্তোত্র পাঠ করো। — কিন্তু আমরা মনে করি, মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। এখানে সৃখায়ঃ সম্বোধনে নিজের চিত্তবৃত্তিসমূহকে আহ্বান করা হয়েছে। চিত্তবৃত্তি যে মানুষের প্রধান সখা, , চিরসহচর নিত্য সহচর, তা বোঝাবার আবশ্যক করে না। তারা সৎপথাবলম্বী হলে মানুষের সুবন্ধু বা সুমিত্ররূপে পরিগণিত হয়; আবার যখন বিপথে গমন করে, অসৎকর্মের পরিপোষক হয়, তখনই তারা কপটবন্ধু বা কুমিত্র বলে অভিহিত হয়। সেই অনুসারে মন্ত্রের ভাব দাঁড়িয়েছে– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা সেই ভগবানের উদ্দেশ্যে আত্ম-উৎসর্গ করো। সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেব। তিনি যে কেমন, তারই পরিচয়-স্বরূপ হৰ্য্যশ্বায় এবং সোমপানে পদ দুটি দেখতে পাওয়া যায়। অশ্বের সাথে অথবা সোমরসরূপ মাদকদ্রব্যের সাথে ঐ দুই পদের সম্বন্ধের বিষয় আমরা স্বীকার করি না। তিনি যে জ্ঞানরশ্মিসমন্বিত এবং সৎকর্মের বা সত্ত্বভাবের গ্রহণকারী, ঐ দুই পদ সেই ভাবই খ্যাপন করে। অবশিষ্ট মাদনং প্রগায়ত পদ দুটিতে স্তোত্রমন্ত্র সর্বথা তার উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত করো, এমন উদ্বোধনার ভাবই পাওয়া যায়। ফলতঃ সকল বাক্য ও কর্ম ভগবানের উদ্দেশে বিনিযুক্ত করার কামনাই এখানে প্রকাশ পেয়েদ্বে]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ২অ-৫দ ২সা রূপেও প্রাপ্তব্য]।

২/২– হে আমার মন! সৎকর্মসাধকগণ যেমন ঐকান্তিক প্রার্থনা উচ্চারণ করেন, তেমনভাবে পরমধনদাতা এবং সত্যপ্রাপক দেবতাকে প্রাপ্তির জন্যই তুমি প্রার্থনা উচ্চারণ করো অর্থাৎ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনাপরায়ণ হও; আমরা যেন ভগবানকে আরাধনা করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আমরা যেন প্রার্থনাপরায়ণ হই)। [এই মন্ত্রে ভাষ্যকার স্তোতাকে সম্বোধন করে ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন। তাতে মন্ত্রের প্রকৃত ভাব রক্ষিত হয়নি। তবে প্রার্থনার মূল অর্থ রক্ষিত হয়েছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদশোভনদানযুক্ত সত্যধন ইন্দ্রের উদ্দেশে অন্য স্তোতা যেমন দীপ্ত স্তোত্র পাঠ করে, আমরাও করব। — মন্ত্রের মধ্যে প্রার্থনার ছলে আত্ম-উদ্বোধনাই প্রকটিত]।

২/৩–- বলাধিপতি হে দেব! আপনি আমাদের আত্মশক্তিদাতা হোন। সর্বশক্তিমান্ সর্বজ্ঞ হে দেব! আপনি আমাদের পরাজ্ঞানদায়ক হোন। পরমধনবান্ হে দেব! আপনি আমাদের পরমধনদাতা হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ভগবানের তিনরকম শক্তিকে সম্বোধন করে তিনরকম দান পাবার জন্য তার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। তিনি বলাধিপতি (ইন্দ্র), সকল শক্তির উৎস। প্রকৃতপক্ষে সাধনার দ্বারাই আত্মশক্তি লাভ হয়, কিন্তু সেই সাধনার শক্তি ও সিদ্ধিও তত ভগবানের কৃপা ভিন্ন লাভ করা যায় না। তাই তার কাছে প্রথমেই আত্মশক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা। তিনি পরমজ্ঞানদাতা, জ্ঞানস্বরূপ। তাই তার কাছে পরাজ্ঞান লাভের প্রার্থনা। তিনি সকল ধনের অধিস্বামী, পরমধনবান্। মানুষ যে ধনের জন্য ব্যাকুল, যা লাভ করলে জীবনের সকল কামনা বাসনার অবসান হয়– মানুষ সেই পরমধন তাঁর কাছ থেকেই প্রাপ্ত হয়। তাই তার কাছে সেই পরমধন মোক্ষের প্রার্থনা)। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি সামমন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম—শাক্ত্যম্]।

৩/১– হে ভগবান্ ইন্দ্রদেব! আমাদের অঙ্গীভূত সুহৃৎ-স্বরূপ চিত্তবৃত্তিসমূহ আপনাকে কাময়মান হোক। (ভাব এই যে আমাদের চিত্তবৃত্তিগুলি ভগবৎপরায়ণ হোক– এটাই আকাঙ্ক্ষা)। অকিঞ্চন অতিক্ষুদ্র এই প্রার্থনাকারিগণ সেই উদ্দেশে আপনাকে স্তোত্রমন্ত্র সমূহের দ্বারা স্তব করছি। (ভাব এই যে, — চিত্তবৃত্তিকে ভগবৎ-অনুসারিণী করবার জন্য এই প্রার্থনা জানাচ্ছি)। অথবা-হে ভগবনইন্দ্রদেব! আপনাকে পাবার অভিলাষী, আপনার স্তোত্রপরায়ণ (কেবল আপনারই সম্বন্ধীয় বাক্য উচ্চারণশীল) উপাসক আমরা, যখন আপনার সখিত্বলাভে সমর্থ (অর্থাৎ কর্মের দ্বারা সালোক্য ইত্যাদি অবস্থা প্রাপ্ত হবো; তখন আমাদের ন্যায় অকিঞ্চন জনও বেদমন্ত্রের দ্বারা (বেদমার্গ-অনুসরণে) মোক্ষ-অভিলাষী হবে। (ভাব এই যে, -স্তোত্রের ও কর্মের দ্বারা ভগবানের সখিত্বলাভে সমর্থ হলে আপনা-আপনিই মুক্তি অধিগত হবে)। [মন্ত্রটি ইন্দ্রদেবের সম্বোধনে প্রযুক্ত। কিন্তু এর মধ্যে একটি সখায়ঃ পদ আছে। এটিতে ভাষ্যে সমানস্থানাঃ প্রতিবাক্য গৃহীত হয়েছে আর ঐ পদটি বয়ং পদের বিশেষণ মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে। তাতে মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে, — হে ইন্দ্র! তোমায় পাবার অভিলাষী তোমার সমানস্থানীয় আমরা; তোমার সম্বন্ধীয় স্তোত্রকে তোমার যেমন প্রয়োজন, তেমনভাবে কথগোত্র উৎপন্ন আমাদের পুত্রগণ উথ– মন্ত্রসমূহের দ্বারা তোমাকে স্তব করছে। আমাদের মন্ত্রার্থে দুরকম অন্বয়ে যে অর্থ গৃহীত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অন্যভাব প্রকাশ করছে। সভায়ঃ পদটিকে দুরকম অন্বয়ে দুরকম অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে। আগের ঋকে এই পদ চিত্তবৃত্তির সম্বোধনে বিনিযুক্ত দেখেছি। এখানে সেই অর্থেও ঐ পদের প্রয়োগ প্রতিপন্ন হয়। প্রথম ব্যাখ্যায় সে অর্থের যৌক্তিকতা উপলব্ধ হয়। আরও, ঐ পদে সাধকের অবস্থায় উপনীত অর্থাৎ সাযুজ্য ইত্যাদি প্রাপ্ত অর্থ গ্রহণ করা যায়। ভগবানের ও উপাসনার দ্বারা, তার কমের দ্বারা, তার সম্বন্ধীয় বাক্যের দ্বারা, ভগবানের ধ্যান-জ্ঞান-ধারণার দ্বারা, মানুষ সেই অবস্থায় উপনীত হয়। চিত্তবৃত্তিগুলি যখন একান্তে ভগবানের অনুসারী হয়, তখন তাদেরও সখায়ঃ পর্যায়ভুক্ত করা যেতে পারে। আমাদের সখায়ঃ হয়ে তারা তখন ভগবানের সখায়ঃ হয়। ফলতঃ, ভগবানে ন্যস্তচিত্ত হলে, তার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারলে সকল শ্রেয়ঃ অধিগত হয়ে থাকে। এই ভাবই এই মন্ত্রে প্রকটিত]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২৩-৫দ-৩সা) প্রাপ্তব্য]।

৩/২– রক্ষাস্ত্রধারী হে দেব! অমৃতপ্রাপক আপনার সম্বন্ধীয় নবজীবনদায়ক সৎকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে আমি যেন আপনার বিষয় ব্যতীত অন্য কোনও বিষয় প্রাপ্ত না হই অর্থাৎ অন্য কোনও কর্ম যেন আমার চিত্তবিক্ষোভ না করে; আপনার সম্বন্ধীয় জ্ঞানই যেন প্রার্থনার দ্বারা প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন। আপনার কৃপায় আমি যেন পরাজ্ঞান লাভ করি)। [একাগ্রচিত্তে, অনন্যমনা হয়ে ভগবানের আরাধনা করবার শক্তিলাভের জন্য, মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রার্থনার মর্ম এই যে, -হে ভগবন। আমি যেন তোমার আরাধনা ব্যতীত অন্য কোনও বিষয়ে লিপ্ত না হই। মায়া মোহ প্রভৃতি রিপুগণ চারিদিকেই আমাকে আক্রমণ করছে তোমার আরাধনা থেকে আমাকে বিচ্যুত করবার জন্য মায়ারূপী সংসার আমার চারিদিকে প্রলোভনপূর্ণ সুবর্ণ জাল বুনছে। আপাতঃ মধুর ভোগলালসা আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলছে। আমার নিজের এমন শক্তি নেই যে, তাদের এই প্রচণ্ড আক্রমণ নিবারণ করে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হই। দুর্বল আমি; তাই তোমার শরণ গ্রহণ করছি। আমাকে তোমার মঙ্গলময় পথে নিয়ে যাও। মোহমায়ার আক্রমণে যেন আমার চিত্তবিক্ষোভ উপস্থিত না হয়। আমি যেন অনন্যমনা হয়ে তোমার চরণধ্যানে জীবন অতিবাহিত করতে পারি। প্রভো! ভেঙ্গে দাও মোর মায়ার শৃঙ্খল, কেটে দাও মম মোহের বন্ধন। সেই পরমমঙ্গলময় পথে আমাকে নিয়ে যাও, যেখানে মায়ানমাহের আক্রমণ নেই, সেই পরাজ্ঞান আমাকে প্রদান করো, যে জ্ঞানের আলোকে আমি, তমসার পরপারে যেতে পারি]।

৩/৩– দেবভাবসমূহ সত্ত্বভাবসমন্বিত সাধককে প্রাপ্ত হন। প্রবুদ্ধ প্রজ্ঞানসম্পন্ন সাধকগণ মায়াবন্ধন প্রাপ্ত হন না; তারা মোহ প্রাপ্ত হন না। (ভাব এই যে, সত্ত্বভাব-সমন্বিত সাধকগণ দেবভাব লাভ করে, তার দ্বারা মায়ামোহের বন্ধন ছেদন করেন)। অথবা– দেবগণ সত্ত্বভাব-সমন্বিত সাধককে রক্ষা করতে ইচ্ছা করেন, অর্থাৎ রক্ষা করেন; তারা সাধকের মায়াবন্ধন কামনা করেন না; জ্ঞানসম্পন্ন সাধকগণ পরমানন্দ প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় সাধকেরা মায়ামাহ অতিক্রম করে পরমানন্দ লাভ করেন)। [এখানে দুরকম অন্বয় অবলম্বনে দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। মূলতঃ দুটি ব্যাখ্যারই ভাব এক। সত্ত্বভাবযুত সাধকেরা ভগবানের কৃপায় মায়ামাহকে অতিক্রম করে আপন অভীষ্ট লাভ করতে সমর্থ হন। — মায়ামাহ মানুষের পতনের কারণ। আপাতঃ মধুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখভোগ ইত্যাদির বাস্তব সত্তা নেই– তা মায়া-মরীচিকা মাত্র। সংসারী মানুষ ভোগসুখের উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সংসারে সুখের সন্ধানে ছোটে। পার্থিব সুখও মরীচিৎকার মতো তাকে বিভ্রান্ত করে, তার ভোগপিপাসা বর্ধিত করে তাকে মৃত্যুমুখে টেনে নিয়ে যায়। ভোগসুখ মোহিনী মূর্তি নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মানুষ তাকে ধরতে যায়, তার পিছনে ছুটতে থাকে কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তার নাগাল পায় না। কারণ সে তো বাস্তব নয়– সে যে স্বপ্ন, মায়ার খেলা মাত্র। — এই মায়ার প্রলোভনে পড়ে মানুষ নিজেকে বিপথে পরিচালিত করে, আত্মহারা হয়। এই রাক্ষসীর ফাঁদে একবার পড়লে আর রক্ষা নেই– সে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শোষণ করবে। যাঁরা ভগবানের কৃপায় হৃদয়ে সত্ত্বভাব লাভ করতে পারেন, তারা সত্যের সন্ধান পেয়ে মিথ্যার চাতুরিতে যুক্ত হন না। ভগবান্ তাদের মায়ামোহের আক্রমণ থেকে সর্বদা রক্ষা করেন। তারাও পরিণামে পরাশান্তি লাভে সমর্থ হন]।  [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। তার নাম—কায়ম]।

৪/১– আনন্দস্বরূপ ভগবান্ ইন্দ্রদেবের উদ্দেশে আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব বা সৎকর্ম এবং স্তুতিবাক্যসমূহ সবা প্রযুক্ত হোক; এবং কর্মপরায়ণ আমাদের চিত্তবৃত্তিসমূহ সকলের অর্চনীয় জ্যোতিঃকে অর্থাৎ সেই ভগবানকে আরাধনা করুক। (ভাব এই যে, আমাদের সকল কর্ম ও স্তোত্র পরমানন্দময় ভগবানে সমর্পিত হোক; আমরা সর্বথা তার অর্চনায় নিযুক্ত থাকি)। [এই মন্ত্রের প্রচলিত অর্থে কার উদ্দেশে কিভাবে যে মন্ত্রটি প্রযুক্ত হয়েছে, তা বোঝা যায় না। ভাষ্য অনুসারে মন্ত্রের সাধারণ প্রচলিত অর্থ এই যে, -মদনশীল, অর্থাৎ মদ্যপানরত ইন্দ্রের জন্য অভিযুত সোমকে আমাদের স্তুতিলক্ষণ বাক্য বা স্তোত্ৰসমূহ সর্বতোভাবে স্তুতি করুক। তারপর স্তুতিকারী ও স্তোতৃগণ সকলের অর্চনীয় সোমকে পূজা করুক। মদ্যপ ইন্দ্রের জন্য সোমের পূজা হোক, — এমন অর্থে কি সুষ্ঠু ভাব পাওয়া যায়, পাঠকগণ তা বুঝে দেখুন। আমাদের মন্ত্রার্থে সুতং পদে পূর্বাপর শুদ্ধসত্ত্ব বা সৎকর্ম অর্থ গৃহীত হয়েছে। আমাদের মতে ঐ পদ এবং গিরঃ পদ একই পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং অর্থ উপলক্ষে সে দুটির সংযোগান্তক একটি চ পদ আমরা অধ্যাহার করেছি। সেই অনুসারে ঐ দুই পদ পরিষ্টোন্তু ক্রিয়াপদের কর্তৃপদ মধ্যে পরিগণিত। সে পক্ষে মন্ত্রাংশের, মদ্বনে ইন্দ্রায় নঃ সুতং গিরঃ পরিষ্টোভন্তু পদ কয়েকটির ভাব দাঁড়িয়েছে, — আনন্দস্বরূপ ভগবান্ সেই ইন্দ্রদেবের উদ্দেশ্যে আমাদের সকল কর্ম ও স্তোত্ৰসমূহ প্রযুক্ত হোক। তারা পরিষ্টোন্তু অর্থাৎ তার উদ্দেশে স্তুতি করুক, এইরকম অর্থ থেকেই ঐ ভাব পাওয়া যায়। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ, কারবঃ অর্কং অৰ্চন্তু পদ-কয়েকটি, পূর্বোক্ত ভাবেরই পরিপোষক অথবা বিশ্লেষক। কারব পদে কর্মপরায়ণ জনগণ বোঝায়। এখানে আমাদের চিত্তবৃত্তিসমূহ ঐ পদে লক্ষ্যস্থানীয়। অর্কং পদে জ্যোতিঃকে– জ্যোতিঃস্বরূপ দীপ্তিমান দেবতাকে বা সেই ভগবানকে বোঝাচ্ছে। এ পক্ষে প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমাদের চিত্তবৃত্তিসমূহ সর্বথা সেই ভগবানের পূজায় ব্রতী হোক। এইভাবে এই মন্ত্রের সারমর্ম আমাদের মন্ত্রার্থে বিধৃত হয়েছে। (মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৫দ-৪সা) আছে]।

 ৪/২– যে দেবতায় সকল দীপ্তি পূর্ণরূপে বর্তমান আছে, যাকে সকল সৎকর্মসাধকগণ স্তব করেন, সেই বলাধিপতি দেবতাকে শুদ্ধসত্ত্বলাভের জন্য আমরা যেন আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমরা যেন সর্বলোকপূজিত জ্যোতির্ময় ভগবানকে আরাধনা করি)। [মন্ত্রের মধ্যে ভগবানের মহিমাও পরিব্যক্ত হয়েছে। তিনি জ্যোতির আধার। বিশ্বলোকে তিনিই একমাত্র বন্দনীয়। তারই চরণে মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে– কারণ তিনিই বিশ্বের একমাত্র আশ্রয়। এমন মঙ্গলবিধায়ক যে পরম পুরুষ তার চরণে আত্মনিবেদন করবার জন্য সাধকগণ স্বভাবতঃই আগ্রহান্বিত হন। তারা মঙ্গলের পথ বেছে নিতে পারেন, তাই সেই পরম মঙ্গলদায়ক পথেই বিচরণ করেন। আমরাও যেন সেই মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারি। সপ্তসংসদঃপদে এই মন্ত্রার্থে সকল সৎকর্মসাধক অর্থই সঙ্গত]।

৪/৩– কর্মভক্তিজ্ঞানের সমন্বয়সাধনে দেবভাবসমন্বিত ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তিগণ সকর্মাত্মক জ্ঞান বর্ধন করেন। আমাদের প্রার্থনা যেন সেই জ্ঞানকেই আমাদের হৃদয়ে প্রবর্ধিত করে। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, কর্মভক্তিজ্ঞানসাধনে আমরা যেন সফলকাম হই। [ভক্তিরসের এ সাধকগণ দেবভাব লাভ করেছেন, তারা ভগবানের সাধনার সব রকম উপায়ই অবগত আছেন এবং কে তারা এই সব উপায় অবলম্বনেই সাধনমার্গে অগ্রসর হন। কর্ম-ভক্তি ও জ্ঞানসাধনের দ্বারা তারা নিজেদের মোক্ষপথ সরল ও সুগম করে তোলেন। -মন্ত্রের অপর অংশে সেই পরমমঙ্গলদায়ক সৎকর্মাত্মক অথবা ভক্তিযুক্ত জ্ঞান লাভ করবার জন্য প্রার্থনা আছে। সেই জ্ঞানলাভ করলে মানুষের আর কোন বাসনা অপূর্ণ থাকে নাঃ]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি সামমন্ত্রের একত্রগ্রথিত গেয়গানটির নাম– শ্রৌতকক্ষণ]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৫– অয়ং ত ইন্দ্র সোমো নিপূতো অধি বর্হিষি। এহীমস্য দ্রবা পিব৷৷ ১। শাচিগো শাচিপূজনায়ং রণায় তে সুতঃ। আখণ্ডল প্র হুয়সে৷৷ ২। যস্তে শৃঙ্গবৃষো ণপাৎ প্রণপাৎ কুণ্ডপায্যঃ নাস্মিন্ দন্ত্র আ মনঃ৷ ৩৷

সূক্ত ৬–আ তু ন ইন্দ্র ক্ষুমন্তং চিত্রং গ্রাভং সংগৃভায় মহাহস্তী দক্ষিণেন৷৷ ১৷৷ বিদ্যা হি ত্বা তুবিকূর্মিং তুবিদেষ্ণং তুবীমঘম্। তুবিমাত্রমবোভিঃ ৷৷ ২৷ ন হি ত্বা শূর দেবা ন মর্তাসসা দিসন্ত। ভীমং ন গাং বারয়ন্তে৷ ৩৷৷

সূক্ত ৭) অভি ত্বা বৃষভা সুতে সুতং সৃজামি পীতয়ে। তৃম্পা ব্যশ্নহী মদ৷৷ ১৷৷ মা ত্বা মূরা অবিষ্যবো মোপহস্বান আ দভ। মা কীং ব্রহ্মদ্বিষং বনঃ৷ ২৷৷ ইহ জ্বা গোপরীণসং মহে মন্তু রাধসে। সরো গৌরো যথা পিব৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৮– ইদং বসো সুতমন্ধঃ পিবা সুপূর্ণমুদর। অনাভয়ি ররিমা তে। ১৷৷ নৃভির্ধেতঃ সুভো অশ্নৈরব্যা বারৈঃ পরিপূতঃ। অশ্বা ন নিক্তো নদী৷৷ ২৷৷ তং তে যবং যথা গোভিঃ স্বাদুমকর্ম শ্ৰীণন্তঃ। ইন্দ্র ত্বস্মিৎসধমাদে৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ — ৫সূক্ত/১সাম– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! এই আপনা-আপনি সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বভাব আপনার জন্য রিপুগণ কর্তৃক বিমদিত বা বিচ্ছিন্নীকৃত হৃদয়ে নিরন্তর কর্মের বা স্তোত্রের দ্বারা সকল রকমে পবিত্ৰীকৃত হোক; এখন এই সত্ত্বভাবের প্রতি আপনি আগমন করুন; এবং করুণা করে তা গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হোক, আর আপনি এসে তা গ্রহণ করুন)। [ভাষ্য ইত্যাদি অবলম্বনে এই মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ– হে ইন্দ্রদেব! বেদীর উপর বিস্তৃত কুশের উপর দশাপবিত্রের দ্বারা শোধিত অভিনব-সংস্কারে সংস্কৃত; এখন তুমি এই সোমরসের প্রতি এস; এসে, যেখানে যেখানে রসাত্মক সোম আহুতি প্রদত্ত হচ্ছে, সেখানে যাও। এবং তা পান করো। কুশের উপর ছিটে ফোঁটা সামরস ছড়িয়ে দেবতাকে যেন প্রবুদ্ধ করা হচ্ছে, — এই ভাবই প্রধানতঃ প্রচলিত অর্থ ইত্যাদিতে প্রকাশ পাচ্ছে। যাই হোক, সে সব অর্থের আলোচনা বাহুল্য মাত্র। সোম শব্দে আমরা পূর্বাপর যে অর্থ গ্রহণ করেছি– শুদ্ধসত্ত্ব– এখানেও তা গ্রহণীয়। বাষি পদে হৃদয়কে বোঝায়। রিপুগণের উপদ্রবে হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, এটাই হৃদয়ের স্বাভাবিক অবস্থা। আমরা মনে করি সেই পক্ষেই ছিন্ন-কুশের সাথে তার সাদৃশ পরিকল্পনা কুশ যেমন ঘৃত ইত্যাদিতে অভিষিক্ত হয়ে আহুতিরূপে প্রদত্ত হয়, হৃদয় তেমনি শুদ্ধসত্ত্বে অভিষিক্ত হলে দেবপূজার উপযুক্ততা লাভ করে। তারপর, এহি ও দ্রবা পদ দুটিতে যে ভাব পরিগৃহীত হয় তা সর্বথা সমীচীন বলে মনে হয় না। একবার বলা হয়েছে এস (আগচ্ছ), পুনরায় বলা হয়েছে-যাও; এর মর্ম অনুধাবন করা যায় না। এই মন্ত্রার্থে দ্রবা পদকে দ্রবেণ পদের রূপান্তর বলে মনে করা হয়েছে। এ মন্ত্রে ইন্দ্রদেবকে (অর্থাৎ ভগবানকে বা ভগবানের বলৈশ্বর্যের বিভূতিধারী দেবকে) আহ্বান করে প্রার্থনা জানান হয়েছে যে, তিনি যেন আমার (অর্থাৎ সাধকের হৃদয়ে একটু সত্ত্বভাবের সঞ্চার করে দেন। ; তারপর তিনি তার হৃদয়ে আসুন, আসন গ্রহণ করুন, আর সেই শুদ্ধসত্ত্ব পানে প্রবৃত্ত হন। সৎকর্মের দ্বারা, হৃদয়ে সত্ত্বভাবের পরিপোষণ দ্বারা, ভগবানের প্রীতি-সাধন-কামনাই এই মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৫দ-৫সা) প্রাপ্তব্য]।

৫/২– পরম জ্যোতির্ময় সর্বলোকপূজ্য হে দেব! আপনার প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের পরমানন্দলাভের জন্য তোক অর্থাৎ আপনি আমাদের সত্ত্বভাব প্রদান করুন। শত্রুবিমর্দক হে দেব! প্রকৃষ্টরূপে আমাদের সত্ত্বভাবদানের জন্য আমরা আপনাকে আহ্বান করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হ ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমানন্দদায়ক সত্ত্বভাব প্রদান করুন)। [প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে মন্ত্রটির অর্থ সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখা যায়। যেমন, হে শক্তিযুক্ত গোবিশিষ্ট প্রখ্যাত পূজাবিশিষ্ট (ইন্দ্র)! তোমার সুখের জন্য সোম অভিযুত হয়েছে, হে আখণ্ডল! উৎকৃষ্ট স্তুতিদ্বারা তুমি আহুত হয়েছ। ওখানে শাচিগো পদের অর্থ করা হয়েছে– যার যথেষ্ট পরিমাণ গরু আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে গো পদে জ্ঞানকিরণকে লক্ষ্য করে। ভাষ্যকার তে রণায় পদের অর্থ করেছেন– আপনার সুখজননের জন্য। এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যায় বটে, কিন্তু এর l : অব্যবহিত পরেই সোমরসের অবতারণা করায় ব্যাখ্যা ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে।]।

৫/৩– হে দেব! আপনার সম্বন্ধীয় জ্ঞানদায়ক, অধঃপতন হতে রক্ষাকারী, সত্ত্বভাবদায়ক যে সৎকর্ম আছে, সেই সৎকর্মসাধনে সাধ্যকগণ ভক্তিসহকারে সম্যক্‌রূপে অন্তঃকরণ নিবেশ করেন, অর্থাৎ মনঃসংযোগ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকেরা সত্ত্বভাবদায়ক ভগবৎপ্রাপক সৎকর্মে আত্মনিবেশ করেন)। [এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা উপলক্ষে ব্যাখ্যাকারদের মধ্যেই নানারকম অনৈক্য উপস্থিত হয়েছে। একটিব্যাখ্যা অনুসারে জানা যায় যে ইন্দ্র একবার শৃঙ্গ বৃষনামক ঋষির পুত্র হয়েছিলেন; তাই ইন্দ্রের নাম শৃঙ্গবৃষোণপাৎ অর্থাৎ শৃঙ্গবৃষের পুত্র। এসব আখ্যায়িকার মূল কোথায়, তা আমরা জানি না। অন্ততঃ ঋগ্বেদে এই সব উপাখ্যানের কোন উল্লেখ নেই। (অথচ, মন্ত্রটি ঋগ্বেদ থেকে সংকলিত)। সায়ণাচাৰ্য্য আরও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিবরণকারও একটি ব্যাখ্যায় বলেছেন–শৃঙ্গবান্ বৃষ প্রধানভূতঃ গৌঃ, তাদৃশ ইন্দ্র। অথচ এই মন্ত্রে ইন্দ্রকে আনয়ন করার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে লে মনে হয় না। আমাদের মতে– শৃঙ্গ শব্দে রশ্মি, জ্ঞানকিরণ, জ্যোতিঃ প্রভৃতি অর্থ প্রকাশ করে। জ্ঞানবর্ষণ করে যে, অর্থাৎ জ্ঞানদায়ক অর্থই সঙ্গত। আবার, যে কর্মসাধনে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব প্রাপ্তি হয়, হয় সৎকর্মের প্রভাবে হৃদয়ে প্রভূত পরিমাণে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হয়, তা কুণ্ডপায়্যঃ যজ্ঞ। আমাদের ব্যাখ্যায় এই ভাবই গৃহীত। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের। একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। যথাক্রমে সেগুলির নাম-রাত্রিদৈবোদাসম্ এবং ঐর্ধসদ্মনম]।

৬/১– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আমাদের প্রতি আগমন করুন; এবং আরাধনীয় অর্থাৎ আকাঙক্ষণীয় বৈচিত্র্যসম্পন্ন পরমার্থরূপধনকে আমাদের জন্য পরমদানশীল হোন; অথবা, আমাদের উচ্চারিত স্তুতিরূপ অলৌকিকশক্তিসম্পন্ন ধনকে (আপনার গ্রহণীয় অর্চনাকে বা পূজাকে) আপনি সর্বতোভাবে গ্রহণ করুন; এবং অনুকম্পাপূর্বক আমাদের সম্বন্ধে পরম দানশীল হোন (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের প্রতি কৃপা করে পরমধন গ্রহণপূর্বক আমাদের বিতরণের জন্য এই মর্ত্যলোকে আগমন করুন)। [আমরা মন্ত্রটিতে দুরকম ভাব গ্রহণ করি। একরকম অর্থে, পরমার্থরূপ ধন গ্রহণপূর্বক ভগবানকে নিকটে আনবার কামনা প্রকাশ পায়। অন্য রকম অর্থে, আমাদের স্তব বা প্রার্থনা গ্রহণ করে তিনি আমাদের প্রতি কৃপাপরায়ণ হোন– এমন আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত। ঐ দুরকম অর্থেই বোঝা যায়, আমাদের পরিগৃহীত অর্থের ভাব ও প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির মর্ম প্রায় অভিন্নই আছে। — ভাষ্যকার মহাহস্তী পদে দেবতাকে মহাহবিশিষ্ট বলেছেন, অর্থাৎ দেবতার প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হাত আছে। অশরীরী দেবতার হাত-পায়ের কল্পনা কি ত্রুটিযুক্ত নয়? আসলে, এখানে, মহৎ হস্তের দ্বারা কর্ম, মহাহস্ত পদে তা-ই দ্যোতনা করে। এইভাবে দক্ষিণেন পদে দক্ষিণ হস্তের দ্বারা অর্থের পরিবর্তে আনুকূল্য সহায়কা করুণা প্রভৃতি অর্থ পাওয়াই সঙ্গত। এইভাবে আমরা বুঝতে পারি, এই মন্ত্রে কি ব্যাকুল প্রার্থনাই না প্রকাশ পেয়েছে। বলা হয়েছে, -হে ভগবন! ত্বরায় এস; যে ধনের জন্য সংসার লালায়িত, সেই বিচিত্র ধন নিয়ে এস; আর করুণা প্রকাশে পরমদাতার মতো সেই ধন আমাদের বিতরণ করো। অথবা, — আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করো, আমাদের প্রতি করুণাপর হও। মন্ত্রের মধ্যে এমনই প্রার্থনা দেখা যায়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৬দ-৩সা) প্রাপ্তব্য]।

৬/২– হে ভগবন! সর্বশক্তিসম্পন্ন পরমধনবান্ পরমদাতা সর্বব্যাপক রক্ষাশক্তিযুক্ত আপনাকেই আমরা যেন জানতে পারি। ভাব এই যে, আমরা যেন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করি)। [সেই পরমপুরুষকে জানলে কিছুই অজ্ঞাত থাকে না। তাকে জানলে অনন্তকে জানা যায়, অনন্তকে উপলব্ধি করতে পারা যায়, তখন সাধক মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেন। জীবনের সমস্ত দ্বন্দ্ব ভেদ ঘুচে গেলে জীবন ও মৃত্যুর সমন্বয় সাধিত হয়, মানুষ অমৃত হয়ে যায়। অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্ম হয়ে যান। কিন্তু সান্ত মানুষ তার সসীম জ্ঞানের সাহায্যে ব্রহ্মকে জানতে পারে না; সান্তের পক্ষে অনন্তের ধারণা করা অসম্ভব। তবে মানুষ কিভাবে সেই অনন্তকে জানতে পারে? মানুষ সেই অনন্ত থেকেই এসেছে তাই তার মধ্যে অনন্তের প্রেরণা আছে। অজ্ঞানতার আবরণে আবৃত বা মোহের আবেশে তা সুপ্ত থাকে। যখন সেই অজ্ঞানতা, সেই মোহ অপসারিত হয়, তখন মানুষ নিজের পূর্ণ গৌরবে দীপ্ত ভাস্বর হয়ে ওঠে; তার অন্তরস্থিত অনন্তের বীজ বিকশিত হয়। তখন সে আত্মারাম হয়ে যায়। মানুষের পরম আকাঙ্ক্ষার এই অবস্থা লাভ করবার জন্যই ব্ৰহ্মজ্ঞান-লাভের জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা দেখা যায়]।

৬/৩– সর্ব শক্তিমান্ হে দেব! অজ্ঞানতা যেমন জ্ঞানকে পরাজিত করতে সমর্থ হয় না, তেমন রিপুদের ভয়জনক, পরাজ্ঞানদায়ক আপনাকে দেবগণও ধারণ করতে সমর্থ হন না এবং মানবগণও ধারণ করতে পারে না। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সর্বশক্তিমান্ পরাজ্ঞানদায়ক ভগবান্ অপরাজেয়)। [ভগবান্ রিপুগণের ভয়জনক; কারণ তার প্রভাবে রিপুগণ বিধ্বস্ত হয়। তাই রিপুজয়কামী সাধকেরা তাঁর চরণে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভগবান্ তাঁর ভক্ত সাধককে কোলে টেনে নেন। মন্ত্রে মানুষের পরম আশার এই বার্তাই ঘোষিত হয়েছে। — গাং পদে ভাষ্যকার বৃষভংঅর্থ গ্রহণ করলেও আমাদের মন্ত্রার্থে পূর্বাপর জ্ঞানংঅর্থেই সঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি সামমন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে এবং সেটির নাম– আকুপারম্]।

৭/১– হে অভীষ্টদায়ক ভগবন! সর্বথা হৃদয় সত্ত্বভাবসমন্বিত হলে, আপনাকে লক্ষ্য করে আপনার গ্রহণের জন্য, শুদ্ধসত্ত্বকে বা সৎকর্মকে সৃষ্টি করি অর্থাৎ সম্পাদন করি। (ভাব এই যে, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের সমাবেশ হলে, ভগবানের প্রীতির-জন্য আমরা সৎকর্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হই)। তৃপ্তিকর আনন্দপ্রদ সেই শুদ্ধসত্ত্বকে আপনি সর্বথা প্রাপ্ত হোন। (প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটির ভাব এই যে, আমাদের কর্ম ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হোক)। অথবা– অভীষ্টপূরক হে ভগবন! আপনাকে লক্ষ্য করে সবতোভাবে আপনার পানের জন্য বা গ্রহণের জন্য, তৃপ্তিকর আনন্দপ্রদ শুদ্ধসত্ত্বকে বা সৎকর্মকে সষ্টি করি। (ভাব এই যে, ভগবানের তৃপ্তির জন্য আমার যেন সৎকর্মের সাধনে প্রবৃত্তি হয়)। আর, সেই সৎকর্মে বা শুদ্ধসত্ত্বে আপনি পরিব্যাপ্ত থাকুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমার কর্মসমূহ আপনার সাথে সম্বন্ধযুত হোক)। [এ পর্যন্ত এই মন্ত্রের যে কয়েকটি ব্যাখ্যা দেখা গেছে, তার সবগুলিই সোমরসনামক মাদকদ্রব্যের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট। সেই অনুসারে সুতে পদে অভিষব-সংস্কারে সংস্কৃত সোমরসের অবস্থা বিশেষকে বুঝিয়ে আসছে। সুতং পদ সোমরসকে লক্ষ্য করছে। এবং মদং পদ মদ্যপানজনিত মত্ততার পরিচয় দিচ্ছে। এইভাবে মন্ত্রের যে অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে, তার একটি উদাহরণ-হে বৃষভ ইন্দ্র! সোম অভিযুত হলে, সেই অভিযুত, সোম পানের জন্য তোমার উদ্দেশে ত্যাগ করি; তৃপ্ত চা হও, মদকর সোম পান করা। কিন্তু আমাদের দুরকম অন্বয়ে মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা নিষ্পন্ন হয়েছে, , তা মন্ত্রার্থে প্রকাশিত। যেমন, সুতে পদটি দুরকম স্থান প্রাপ্ত হয়েছে। এক রকম অর্থে ঐ পদে হৃদয়, শুদ্ধসত্ত্বভাবযুক্ত হলে– এমন মর্ম পাওয়া যায়। অন্যরকম অর্থে শুদ্ধসত্ত্বে বা সৎকর্মে এমন ভাব গৃহীত হয়েছে। সুতং পদে যে শুদ্ধসত্ত্ব বোঝায়, তা আমরা পূর্বাপর খ্যাপন করে এসেছি। মদং পদ আনন্দপ্রদ অর্থ খ্যাপন করে। এইসব বিষয় বিবেচনা করলে মন্ত্রের প্রকৃতভাব উপলব্ধি করা শক্ত হয় না]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৫দ-৭সা) প্রাপ্তব্য]।

৭/২– হে ভগবন! আপনার রক্ষাভিলাষী অজ্ঞান আমরা আপনাকে যেন আরাধনা করি, আপনার প্রতি অভক্তিপরায়ণ যেন না হই। হে আমার মন! ভগবানে অভক্তিযুত কোনও ব্যক্তিকে ভজনা করো না। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই; অভক্তের সংস্পর্শ থেকে যেন দূরে থাকি)। [অজ্ঞান দুর্বলচিত্ত মানুষ মোহমায়ার আক্রমণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, রিপুকবলিত হয়ে অধঃপতনের পথে পদার্পণ করে। এ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় ভক্তিযুত চিত্তে ভগবানের আশ্রয় গ্রহণ করা– সেই আশ্রয় লাভের জন্য প্রার্থনা করা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়ে ওঠে না। কারণ এমন হতভাগ্য মূর্খও আছে, যারা সেই পরমদেবতার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। সেই অশ্রদ্ধা ও অভক্তির অবশ্যম্ভাবী ফল মৃত্যু-জন্ম-জন্মান্তর ধরে কেবলই পাপপঙ্কে নিমজ্জন। সুতরাং মুক্তকামী জন নিজে তো ভগবানের প্রতি সেই অশ্রদ্ধা ও অভক্তি সর্বতোভাবে বর্জন করবেই, এমন কি ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তিহীন জনকে সর্বথা পরিত্যাগও করা উচিত। কারণ অসৎ সঙ্গে নরকবাসকথাটি তো সম্পূর্ণ সত্যই। সুতরাং প্রার্থনার মধ্যে সেই পাতকীদের সংস্পর্শ থেকেও যাতে ভগবান্ আমাদের রক্ষা করেন বা দূরে রাখেন, তার জন্যও প্রার্থনা নিবেদিত হয়েছে]।

৭/৩– হে ভগবন! মহৎ ধনলাভ করবার জন্য সাধকগণ পরাজ্ঞানদায়ক আপনাকে প্রার্থনার দ্বারা প্রীত করেন। হে আমার মন! পবিত্র হৃদয় ব্যক্তি যেমন অমৃত প্রাপ্ত হন, তেমনভাবে তুমি হৃদয়ে অমৃতপ্রাপক হও। ভাব এই যে, — পরাজ্ঞানকামী সাধকেরা ভগবৎপরায়ণ হন। আমরাও যেন অমৃত লাভ করি)। [মন্ত্রটির প্রথম অংশে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে। সাধকেরা প্রার্থনা আরাধনা প্রভৃতির দ্বারা ভগবানের প্রীতি সাধন করেন। সুতরাং পরাজ্ঞানকামী সাধকদের পক্ষে তাঁদের অভীষ্টলাভের কোন অন্তরায় থাকে না, অর্থাৎ তাদের প্রতি তুষ্ট হয়ে ভগবান্ তাদের সেই পরাজ্ঞান দান করেন। — মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে আত্ম-উদ্বোধন আছে। হৃদয়ে যাতে অমৃতের সঞ্চার হয়, সেই উপায় অবলম্বন করবার ভাব এই অংশে নিহিত আছে। — মন্ত্রের অন্তর্গত গোপরীণসং পদে বিবরণকারের মতোই আরাও ভগবানকে লক্ষ্য রেখেছি। ভাষ্যকার সায়ণাচাৰ্য্য কিন্তু এই পদে সোমং অর্থ নির্দেশ করেছেন। অথচ এই দ্বিতীয়ান্ত পদটি কোন ক্রিয়া বা অব্যয়ের সাথে অন্বিত হয়নি, সুতরাং ব্যাখ্যাও সঙ্গত হয়নি]। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত তিনটি সামমন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে এবং সেটির নাম– আর্ষতস্]।

 ৮/১– হে জন্মজরামরণভয়বিরহিত (হে অনন্ত)! নিখিল প্রাণিগণের আশ্রয় পরমধনপ্রদাতা দেব! আমাদের মনঃপ্রসূত বিশুদ্ধ এই অন্ন (সত্ত্বভাবরূপ ভক্তিরসামৃত) আপনাকে বিধিপূর্বক প্রকৃষ্টরূপে প্রদান করছি (উৎসর্গ করছি)। যাতে আপনার উদর পূর্ণ হয়, অর্থাৎ আপনার সম্যক তৃপ্তি সাধিত হয়, তেমনি আপনি তা পান করুন। (ভাব এই যে, — অকিঞ্চন আমরা, একমাত্র হৃদয়ের ভক্তিই আমাদের সম্বল। তুমি সেই ভক্তিসুধা পান করে পরিতৃপ্ত হও এবং আমাদের পরমাশ্রয় প্রদান করো)। [স্থূল দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, ইন্দ্র যেন একজন সাধারণ মানুষ। তিনি যেন সোমরস পান করতে খুব ভালোবাসেন। তাঁকে যেন বলা যাচ্ছ– এই শোধিত সোমরস (অন্ন) প্রচুর, পরিমাণে পান করো– যাতে তোমার উদর পূর্ণ হয়। নির্ভীক হয়ে পান করো, এটা তোনার জন্যই প্রস্তুত করেছি। — ভাষ্যকার প্রায় এমন অর্থই প্রতিপন্ন করেছেন। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে এই সোমের তাৎপর্য অন্যরকম মনে হয়। মনে হয়, এখানে যেন ভগবানকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে-হে ব্রহ্মাণ্ডভাণ্ডোদর ভগবন! তোমার উদর পূর্ণ করতে পারি এমন শক্তি আমাদের নেই। আমরা অতি অকিঞ্চন। আমাদের নিজস্ব বলতে বিশেষ আর কি আছে? তবে বহুদিন ধরে, বহু সাধনা করে সামান্য একটু সত্ত্বভাব, ভক্তিরসামৃত সংগ্রহ করেছি। হে কাম্য, হে নিখিল জনগণের আশ্রয়স্থল, হে পরমধনপ্রদাতা, জন্মজরামবণবিরহিত দেব! সেটুকু আমরা তোমাকে প্রদান করেছি। নিজগুণে তার দ্বারাই তোমার উদর পূর্ণ করে নাও। — প্রাণে নিরাশার ভাব পরিস্ফুট হয়েছে। মন্ত্রে তাই করুণ প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে] [ছন্দার্চিকের ২অ-১দ-১০সা দ্রষ্টব্য]।

 ৮/২– বিশুদ্ধ ব্যাপকজ্ঞান যেমন অমৃতের প্রবাহে মিলিত হয়, অর্থাৎ অমৃতের প্রবাহকে প্রাপ্ত হয়, তেমনই সাধকদের কতৃক পাষাণকঠোর তপস্যার দ্বারা এবং নিত্যজ্ঞান প্রবাহের দ্বারা পরিশোধিত, নির্মলীকৃত বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব সেই সাধকদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হয়। (ভাব এই যে, — তপোপরায়ণ সাধক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হন)। এই মন্ত্রের মধ্যে যে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে, তা এই যে, — সাধকেরা তাদের কঠোর তপস্যার দ্বাবা জ্ঞানযুক্ত বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব লাভ করতে পারে। সত্ত্বভাব সর্বত্রই বিদ্যমান, সকল মানুষের হৃদয়েই তা সুপ্তভাবে অবস্থিত। কিন্তু খনিগর্ভস্থ সোনাকে ধ্যবহার করতে হলে যেমন তাকে বিশুদ্ধ পরিষ্কৃত করতে না পারলে তার দ্বারা মানুষের হৃদয়ে বর্তমান থাকলেও কঠোর সাধনার দ্বারা তাকে বিকশিত ও বিশুদ্ধ না করতে পারলে তার দ্বারা সাধক মোক্ষলাভ করতে সমর্থ হন না। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সাথে পরাজ্ঞান সম্মিলিত হয়। সুতরাং সহজেই সাধক অমৃত লাভে সমর্থ হন]।

৮/৩– বলাধিপতি হে দেব! সাধকগণ যেমন জ্ঞানের সাথে সম্মিলিত করে মোক্ষসাধক আপনার প্রসিদ্ধ আত্মশক্তিকে প্রাপ্ত হন, তেমনভাবে আত্মশক্তি লাভের জন্য আমাদের কর্তৃক প্রারব্ধ সৎকর্মে আপনাকে আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় আমরা যেন জ্ঞানসমন্বিত মোক্ষসাধক আত্মশক্তি সৎকর্ম সাধনের দ্বারা লাভ করতে পার)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রটির পদের সাথে পূর্ব মন্ত্রের পদের অন্বয় করে ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন। যথারীতি এখানেও তিনি সোমরসের কথা এনেছেন। কিন্তু দুটি মন্ত্রেই সোমরসের কোন উল্লেখ নেই। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরস অহৃত করলেও ব্যাখ্যায় গোলযোগ ঘটেছে। শ্ৰীণন্তঃঅথবা অকর্ম ক্রিয়াপদের কর্তার কোনও উল্লেখ নেই। সুতরাং ব্যাখ্যাটি অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। ব্যাখ্যার সঙ্গতির দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা সাধকাঃ পদ অধ্যাহার করেছি। সাধকেরাই নিজেদের সাধনার দ্বারা মোক্ষপ্রাপক আত্মশক্তি লাভ করতে পারেন। তারাই জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয় সাধনে সমর্থ। মন্ত্রটির মধ্যে একটি উপমার প্রয়োগে প্রার্থনার স্বরূপ প্রকটিত হয়েছে। সাধকগণ যেমনভাবে মোক্ষসাধক আত্মশক্তি লাভ করেন, আমরাও যেন তেমন আত্মশক্তি লাভ করি। — এটাই প্রার্থনার মর্ম। কিন্তু দুর্বল হীনশক্তি আমরা সেই দেববাঞ্ছিত বস্তু পাবার আশা কিভাবে করতে পারি? পারি। আমাদের একমাত্র সম্বল– দুর্বলের বল সেই ভগবান্। যাঁর কৃপায় মূক ব্যক্তিও বাঁচাল হয়, পঙ্গু ব্যক্তিও পর্বত অতিক্রম করে, সেই পরমপুরুষের চরণে আমরা আমাদের প্রার্থনা নিবেদন করছি তিনি কৃপাপূর্বক আমাদের প্রত্যেক সপ্রচেষ্টাকে সাফল্যমণ্ডিত করুন– এটাই প্রার্থনা]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের এ একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে এবং সেটির নাম– গায়ম]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৯– ইদং হ্যন্বেজসা সুতং রাধাতং পতে। পিবা বৃহস্য গির্বণঃ ॥১৷৷ যস্তে অনু স্বধামসৎ সুতে নি যচ্ছ তন্বম্। স ত্বা মমতু সোম্য৷৷২৷৷ প্র তে অশ্নোতু কুক্ষ্যোঃ প্ৰেন্ত্র ব্ৰহ্মণা শিরঃ। প্র বাহু শূর রাধসা৷৩৷৷

সূক্ত ১০– আ ত্বে নি যীদতেন্দ্রমভি প্র গায়ত। সখায়ঃ স্তোমবাহসঃ ॥১॥ পূরূতমং পুরুণামীশানং বার্ষাণাম্। ইং সসামে সচা সুতে৷২৷৷ স ঘা নোযোগ আ ভুবৎ স রায়ে স পুরন্ধ্যা। গমদ বাজেভিরা স নঃ ৷৩৷৷

সূক্ত ১১– যোগেযোগে তবস্তরং বাজে বাজে হবামহে সখায় ইন্দ্রমূতয়ে৷৷৷৷ অনু প্রত্নসৌকসো হুবে তুবিপ্রতিং নরম্। যং তে পূর্বং পিতা হুবে৷৷২৷৷ আ ঘা গমদ যদি শ্রবৎ সহশ্রিণীভিরাতিভিঃ। বাজেভিরূপ নো হব৷৩৷

সূক্ত ১১– ইন্দ্র সুতেষু সোমেযু ক্রতুং পুনীষ উথ্যম্। বিদে বৃধস্য দক্ষস্য মহা হি ষঃ ॥১॥, স প্রথমে ব্যোমনি দেবানাং সদনে বৃধঃ। সুপারঃ সুশ্রবস্তুমঃ সমপসুজিৎ ॥২॥ তমু হুবে বাজাতয় ইন্দ্র রায় শুষ্মিণ। ভবা নঃ সুমে অন্তমঃ সখা বৃধে৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৯সূক্ত/১সাম– পরমার্থ-রূপ ধনের অধিপতি, স্তুতিমন্ত্রের দ্বারা অর্চনীয় হে ভগবন! আমাদের কর্মকে অনুসরণ করে আপন প্রভাবের দ্বারা অর্থাৎ অনুগ্রহপূর্বক এই কর্মের অর্থাৎ কর্ম হতে সঞ্জাত (কর্মের সারভূত অংশ) শুদ্ধসত্ত্বকে অবিলম্বে সর্বতোভাবে শহণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের কর্ম সত্ত্বসমন্বিত হোক এবং আপনি আপন মাহাত্ম্যে তা গ্রহণ করুন)। [মন্ত্রটির ওজসাও অনুপদ উপলক্ষে বিশেষ অর্থ-সমস্যা উপস্থিত হয়ে থাকে। সোমরস মাদকদ্রব্যের একটা প্রস্তুতপ্রণালী ছিল বলে কাৰ্থত হয়। সোমলতা সংগ্রহ করে দুখণ্ড প্রস্তরে পেষণপূর্বক তা থেকে রস নিষ্কাশিত করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় পরিশ্রমের প্রয়োজন ছিল। ভাষ্যকারের এবং ব্যাখ্যাকারদের সিদ্ধান্ত এই যে, ওজসা পদে সেই রস বের করার প্রয়াসকে লক্ষ করছে। অনু পদ এমন সিদ্ধান্তেরই পোষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ চলে আসছে, — হে বলাধিপতি! স্তবে তুষ্ট দেবতা। তোমার উদ্দেশে (অনু) রলের দ্বারা অভিযুত বা প্রস্তুত যে সোম (সুতং), তা তুমি শীঘ্র এসে পান করো। প্রায় সকল ভাষায় সকল অনুবাদেই এই ভাব প্রকটিত। আমরা বলি, এই মন্ত্রে আমাদের কর্মের দ্বারা সঞ্জাত কর্মের সারভূত শুদ্ধসত্ত্বকে ভগবানে সমর্পণ করবার কামনা প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রে বলা হয়েছে– আপনার আপন প্রভাবের দ্বারা অর্থাৎ করুণা প্রকাশে আমাদের কর্মসঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বকে আপনি প্রাপ্ত হোন; অর্থাৎ আমাদের কর্মের সাথে আপনার মিলন হোক। এ পক্ষে ক্লীবলিঙ্গ ইদং পদ কর্মকে বোঝাচ্ছে বলে আমরা সিদ্ধান্ত করি। অনু পদে অনুসরণ করার ভাব আসে। ওজসা পদে আপন প্রভাবের দ্বারা অর্থাৎ নিজস্ব মাহাত্মের দ্বারা বা করুণার দ্বারা ভাব প্রকাশ পায়। সে পক্ষে অস্য পদ সেই কর্মের সাথে সম্বন্ধযুত অর্থ প্রকাশ করে। আমাদের কর্মের দ্বারা যে শুদ্ধসত্ত্বভাব সঞ্জাত হয়, তার সাথে দেবতার মিলন হোক এমন প্রার্থনাই এখানে প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত প্রতি পদই এই অর্থের সহায়তা করে। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-উদ-১সা) প্রাপ্তব্য]

৯/২–- হে দেব! আপনার যে সত্ত্বভাব আছে, মঙ্গলদায়ক সেই সত্ত্বভাব আমাদের প্রদান করুন; বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবে আমাদের সমগ্র সত্তাকে নিমজ্জিত করুন অর্থাৎ আমাদের সত্ত্বভাব পূর্ণ করুন; সত্ত্বাধিপতি হে বেঁ! আমাদের হৃদয়স্থিত সেই সত্ত্বভাব আপনাকে প্রীত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় মোক্ষলাভ করবার জন্য আমরা যেন সত্ত্বভাবপূর্ণ হই)। [ভগবানের আরাধনার প্রধান উপচার– সত্ত্বভাব। সেই সত্ত্বভাব ভগবানের কৃপায় লাভ করা যায়। তার দেওয়া সত্ত্বভাবের দ্বারাই তার পূজা করতে হয়। মানুষের নিজের বলতে তো কিছুই নেই– তাই গঙ্গাজলেই গঙ্গাপূজা করতে হয়। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সাথে আমাদের মতানৈক্য আছে। যেমন একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! তোমার অন্নের জন্য যে সোম (অভিযুত) হয়েছে, সেই অভিযুত সোমে শরীর নিমগ্ন করো। তুমি সোমাহ, সোম তোমাকে হৃষ্ট করুক। শুধু মদ্যপান নয়, মদে একেবারে ডুবে যাবার জন্য দেবতাকে এমন আহ্বান, আদৌ সঙ্গত বলে বিবেচিত হতে পারে না]।

৯/৩–- বলাধিপতি হে দেব! আপনার সত্ত্বভাব আমাদের কুক্ষির উভয় পার্শ্বে ব্যাপ্ত হোক; প্রার্থনা সমন্বিত সেই সত্ত্বভাব আমাদের শ্রেষ্ঠাঙ্গ শিরদেশকে প্রাপ্ত হোক। সর্বশক্তিমান্ হে দেব! পরমধন লাভের জন্য সেই সত্ত্বভাব আমাদের হস্তদ্বয়কে প্রাপ্ত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের, সত্তা সত্ত্বভাবে নিমজ্জিত হোক, আমরা যেন সর্বতোভাবে সত্ত্বভাব-পূর্ণ হই)। [এই মন্ত্রটিতেও পূর্বমন্ত্রের ভাবই বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ভাব– শুদ্ধসত্ত্ব লাভর জন্য প্রার্থনা। পূর্ব মন্ত্রে প্রার্থনা ছিল– বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবে আমাদের সমগ্র সত্তাকে নিমজ্জিত করুন। বর্তমান মন্ত্রে শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উল্লেখ থাকায় প্রার্থনার দৃঢ়তা জ্ঞাপিত হচ্ছে। এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমগ্র সত্তাকে বোঝাবার উপায় মাত্র। মস্তকে অথবা বাহুতে সত্ত্বভাব সঞ্চারিত হোক– এই প্রার্থনার দ্বারা অবশ্য নির্দিষ্ট কোন বিশেষ অঙ্গকে বোঝাচ্ছে না। অবয়বের দ্বারা অবয়বীকে লক্ষ্য করছে। প্রচলিত– অনুবাদগুলিতে যথাপূর্ব দেবতাকে মদ্যপানের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্র গ্রথিত একটি গেয়গান আছে]।

১০/১– স্তোমবাহক (স্তুতিকারক), সখিস্বরূপ (ভগবানের সাথে সাখ্যভাবে মিলিত), হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা সত্বর আগমন করো (ভগবানে ন্যস্তচিত্ত হও); একাগ্রচিত্তে উপবেশন করো (ভগবানের সামীপ্যগামী হও); এবং ভগবান্ ইন্দ্রদেবতার স্তুতিগানে সর্বতোভাবে নিবিষ্টচিত্ত হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, আমাদের চিত্তবৃত্তি সর্ব ভগবৎপরায়ণ হোক)। সাধারণ দৃষ্টিতে প্রতীত হয়– এই মন্ত্র যেন ঋত্বিক ও যজমানগণের কথোপকথনের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়েছে। বোঝা যায়, — যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে যজমান যেন ঋত্বিকদের আহবান করছেন। — এমন অর্থই অধুনা সাধারণ্যে প্রচলিত দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু মন্ত্রের অন্তর্গত স্তোমবাহসঃ এবং সখায় পদ দুটির বিশ্লেষণে মন্ত্রের অন্য.অর্থ উপলব্ধ হয়। প্রথমটির অর্থ– যাঁরা স্তোম (স্তবস্তুতি) বহন করেন। কিন্তু ভগবানের কাছে স্তবস্তুতি বহন করে নিয়ে যেতে পারে কে? আর কে? হৃদয়েশ্বরের কাছে হৃদয়ই আমার বক্তব্যকে নিয়ে যাবে; মন ছাড়া মনোময়ের সান্নিধ্যে মনেরই অভিব্যক্তি ঘটবে; আমার চিত্তবৃত্তিগুলিই দৌতকার্যে নিযুক্ত হবে। এই ভাবই এখানে পরিস্ফুট দেখাই সঙ্গত। আবার, এমন ভাবে তাঁর স্তুতি, তাঁর গুণগানই বা করতে পারে কে? সে স্তব তিনিই করতে পারেন, যিনি সম্যকরকমে তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যার চিত্তবৃত্তি তাতে ন্যস্ত হয়েছে– যিনি তার সাথে মিলিত হয়ে সখিস্বরূপ হয়েছেন। তবেই বোঝা যায়, তাকে জানা চাই, তাতে লীন হওয়া চাই; তাঁকে পাওয়া চাই। তাতেই তাঁর স্তুতি করা সম্ভব, তাতেই সেই স্তুতি তাঁর কাছে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু কেমনে জানব-কেমনে পাব– কেমনে মিলব? আবশ্যক আকাঙ্ক্ষা– অনুধ্যান অনুসরণ; আবশ্যক-চিত্তবৃত্তির বিনিবেশ। চাই আকুল আকাঙ্ক্ষা; চাই ঐকান্তিক অনুধ্যান; চাই অনাবিল অনুসরণ; চাই চিত্তবৃত্তির সখিত্ব। সুতরাং চিত্তবৃত্তিগুলি স্তেমবাহসঃ হলেই সখায়ঃসখাস্বরূপ হয়। সেই অবস্থাই পরম ভক্তের অবস্থা। ভক্ত ভিন্ন সাধক ভিন্ন তার সখিত্ব কে লাভ করতে পারে? ভক্তের ভগবান্ বলেই তো তিনি ভক্তসখা। ভক্তিতেই মুক্তি– ভক্তিতেই সখ্যতা। তাই মন্ত্রের উদ্বোধনা এই যে, আমার চিত্তবৃত্তিগুলি আমার হৃদয়ে মানসযজ্ঞে যাগ-উপকরণ রূপে প্রস্তুত। তারাই স্তোমবাহ, তারাই সখা, তারাই তার (অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সমর্থ; তারাই তার সাথে সখিত্ব স্থাপন করতে পারে। আসুক, প্রস্তুত হোক, ভগবানের চরণে পুস্পাঞ্জলি প্রদান করুক]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৫দ-১০সা) প্রাপ্তব্য]।

১০/২– হে আমার মনোবৃত্তিসমূহ! তোমাদের ভক্তিসুধা অভিযুত হলে (তোমাদের মধ্যে = বিশুদ্ধা ভক্তির উদয় হলে, তোমরা একাত্ম হয়ে, পুরুতম (সকল শত্রুবিনাশকারী) এবং শ্রেষ্ঠ ধনের এ অধিপতি (পরম ঐশ্বর্যশালী) ইন্দ্রদেবের (ভগবানের) স্তুতিগানে (আরাধনায়) প্রবৃত্ত হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনসূচক। ভাবাই যে, আমাদের সকল মনোবৃত্তি ভগবানের অভিমুখী হোক)। [এই; মন্ত্রের প্রচলিত অর্থে এখানেও যেন ঋত্বিকগণকে সখা সম্বোধনে বলা হচ্ছে– এই সোমরস (মাদকদ্রব্য) প্রস্তুত হলে, হে ঋত্বিকগণ, তোমরা ইন্দ্রদেবের স্তুতিগানে তাঁকে আহ্বান করো। কিন্তু আমরা মনে করি, এখানেও মনোবৃত্তিগুলিকে ভগবানের অভিমুখী করবার জন্য আত্ম-উদ্বোধনের ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। কর্ম জ্ঞান, ভক্তিভগবৎ-প্রাপ্তির এই তিনরকম পন্থা শাস্ত্রে নির্দিষ্ট আছে। সেই তিনের মধ্যে আবার কর্মই প্রধান। কর্ম ভিন্ন জ্ঞানলাভ হয় না। জ্ঞান ভিন্ন ভক্তির উদয় হয় না। সকলেরই মূল কর্ম। সেইজন্য সকল শাস্ত্রেই কর্মের মাহাত্ম্য পরিকীর্তিত; সেই জন্য, সংসারকে কর্মানুসারী করবার উদ্দেশ্যে শাস্ত্রের অশেষ প্রয়াস– অশেষ প্রযত্ন দেখতে পাই। শাস্ত্র বলেছেন, কর্মই ধর্ম। কর্মই তাঁকে পাবার একমাত্র পন্থা। আর, এই মন্ত্রে সেই কর্মের প্রাধান্য কীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ও ভুক্তির মাহাত্ম্যকে পরিকীর্তিত হয়েছে। মন্ত্রে বলা হয়েছে– সোমে সুতে। অর্থাৎ সোমসুধা (ভক্তিসুধা) অভিযুত হলে। সোমসুধা-ভক্তিসুধা অভিযুত হয় কিভাবে? যখন সেই ভক্তি– ঐকান্তিকী ভক্তি বা অনন্যাভক্তিরূপে ভগবানে ন্যস্ত হয়। তাতে বহু প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। নাম শ্রবণ, নাম কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য ও সখ্য, — এই আটরকম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অনন্যাভক্তি লাভ হয়। এ সবই কর্ম– ভগবৎ-অনুসারী কর্ম। এগুলির নিয়মিত অনুষ্ঠানে অনন্যাভক্তি আপনিই অধিগত হয়। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানেরও নানা অন্তরায় আছে। সেই অন্তরায়ের কথা স্মরণ করে পাছে কেউ সে কর্মানুষ্ঠানে বিরত হয়, সেই আশঙ্কায় মন্ত্রে বলা হয়েছে, তিনি পুরূতমং, অর্থাৎ তিনি বহুশত্রুনাশক। তুমি তার কর্মানুষ্ঠান করো; তাতে যদি কোনও বাধা আসে, সে বাধা তিনিই দূর করবেন। আবার, কেবল কর্ম করো বললেই লোকে কর্মে প্রবৃত্ত হয় না। তারা প্রয়োজনের আকাঙ্ক্ষা করে– তারা ফলের কামনা রাখে। সেইজন্য ঋকে তাকে (পুরূণামীশানং-বাৰ্যাণা বলা হয়েছে। এর অর্থ তিনি প্রভূত ধনের অধিপতি, তিনি পরম ঐশ্বর্যশালী। সুতরাং তাঁকে আরাধনা করলে বা তার জন্য কর্ম করলে, তুমি শ্রেষ্ঠধনে ধনী হতে পারবে। তিনি যে ঈশানং, তা-ও কর্মের দ্বারাই উপলদ্ধি হয়। তিনি যে মহান ঈশ্বর– আর সকলেই যে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কর্মের মধ্যে সে জ্ঞানও অধিগত হয়ে থাকে। কর্মের মধ্যে দিয়েই বোঝা যাবে যে, কর্মই ব্ৰহ্ম। সুতরাং সেই কর্মই করো– যাতে সোম সুসংস্কৃত হয়– যাতে তাঁর সাথে একাত্ম হতে পারা যায়)]।

১০/৩– বহু গুণযুক্ত সেই দেবতা আমাদের পুরুষার্থ সাধন করুন: (অথবা আমাদের যোগে সংযুক্ত হোন); তিনি ধন প্রদান করুন; (অথবা, আমাদের ধনের সাথে সংযুক্ত হোন); তিনি আমাদের বহুরকম বুদ্ধি প্রদান করুন; (অথবা, আমাদের বুদ্ধির সাথে সংযুক্ত হোন); তিনি আমাদের অন্ন ইত্যাদির সাথে অথবা শক্তির সাথে আগমন করুন; (অর্থান্তরে– আমাদের অন্ন এবং শক্তি-সামর্থ্য দান-পূর্বক অনুগ্রহ করুন)। [পূর্ববর্তী মন্ত্রে ইন্দ্রদেবের সম্বন্ধে কতকগুলি গুণ-বিশেষণ প্রযুক্ত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তিনি পরম ঐশ্বর্যশালী। এ মন্ত্রে সেই সব গুণ-বিশিষ্ট ইন্দ্রদেবের কাছে প্রার্থনা জানান হয়েছে। এটাই সাধারণ মত। সেই অনুসারে প্রার্থনার প্রচলিত মর্ম এই যে, — হে ইন্দ্রদেব! আপনি আমাদের পুরুষার্থ সাধন করুন, আমাদের ধন প্রদান করুন, আমাদের নানাবিষয়নী বুদ্ধি দান করুন, এবং আমাদের অন্ন ইত্যাদি দানে অনুগ্রহ প্রকাশ করুন। আমরাও প্রায় ঐ পথেই অর্থ করেছি। এ, তবে যোগে অভূবৎ– আপনি আমাদের পুরুষার্থ বিধান করুন– এই অংশের নিগুঢ় মর্ম এই যে, হে দেব, আমাদের জ্ঞানযোগে, ধ্যানযোগে, ভক্তিযোগে এবং কর্মযোগে আমাদের হৃদয়ে আপনি পূর্ণ প্রতিভাত হোন এখন ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত। যোগ যে পুরুষাৰ্থ-সাধনের প্রধান সহায়, এ মন্ত্রে তার আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। পুরুষাৰ্যসাধন বা মোক্ষলাভের পক্ষে জ্ঞান প্রয়োজন। বিদ্যা– জ্ঞানলাভের প্রধান সহায়। বিদ্যার দ্বারা সত্যজ্ঞানের বিকাশ হয়; বুদ্ধি সত্যের প্রতি প্রধাবিত হয়। সুবুদ্ধি সৎ-বুদ্ধি না জন্মালে সত্যের অনুসন্ধানে বা ধ্যানে প্রবৃত্তি হয় না। সৎকে না জানলে, সৎস্বরূপকে না চিনলে, পুরুষার্থ লাভ– মোক্ষলাভ সম্ভবপর নয়। — পুবন্ধ্যাংশব্দের একটি অর্থ– পুরস্ত্রীগণের মঙ্গল বিধান কর; অপর অর্থ– বিবিধ-বিষয়নী বুদ্ধি প্রদান করুন। পুরস্ত্রী– অর্থাৎ অন্তঃপুরবাসিনী। যারা অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ, তারাই পুরস্ত্রী। সে হিসাবে হৃদয়-নিহিত দয়াদাক্ষিণ্য ইত্যাদি নানা সৎ গুণরাশি। দেবতার অনুগ্রহে হৃদয়ে নানা সৎ-গুণ উপজিত ও বিকাশপ্রাপ্ত হোক, পুবন্ধাং পদে এক, হিসাবে.সেই অর্থই সূচিত হয়। অন্য অর্থে নানা সৎ-বুদ্ধি লাভের প্রার্থনা ঐ মন্ত্রে পরিব্যক্ত হয়েছে। যিনি সৎ, তিনি সৎ-বুদ্ধিবিধায়ক– পুরন্ধ্যাং শব্দে সেই ভাবই পরিব্যক্ত)। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত গেয়গানটির নাম—দৈবাতিথম]।

১১/১–সৎকর্মানুষ্ঠানের দ্বারা তার প্রিয় হয়ে– আমরা, আমাদের প্রত্যেক কর্মের আরম্ভকালে ইন্দ্রিয়বৃত্তিসমূহের পরস্পর সংঘর্ষ উপস্থিত হলে, আমাদের রক্ষা করবার জন্য, সেই অতি-বলবান্ সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবানকে (যেন) আহ্বান করি। (ভাব এই যে, প্রত্যেক কর্মের আরম্ভেই সাত্ত্বিক ইন্দ্রিয়বৃত্তির সাথে দুষ্ট ইন্দ্রিয়বৃত্তির সঙ্ঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী; সেই সঙঘর্ষে আমাদের রক্ষা করবার জন্য সর্বশক্তিমান দেবতা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি)। [সেই সর্বশক্তিমান যদি কৃপাকটাক্ষপাত করেন, তবেই সৎ-অসৎবৃত্তির সংগ্রামে জয়লাভ করা যায়। এ মন্ত্র সেই জয়লাভের উপায় কীর্তন করছে। মন্ত্র বলছেন– তুমি সখায় অর্থাৎ তার সখাস্বরূপ হবার প্রয়াস পাও; তোমার প্রতিটি কর্ম তার সাথে সম্বন্ধযুত হোক; সৎ-অসৎ বৃত্তির সংগ্রাম-মাত্রেই তুমি আত্মরক্ষার কামনায় তার শরণাপন্ন হও। মন্ত্রের প্রার্থনা-আমরা যেন তাঁর সখাস্বরূপ হয়ে, আমাদের প্রতি কার্যে, আমাদের প্রতি সংগ্রামে, তাকে আহ্বান করি। প্রার্থনা অতি সরল ও সহজবোধ্য বটে; কিন্তু এর অভ্যন্তরে এক অতি গভীর তত্ত্ব। প্রচ্ছন্ন রয়েছে। -তাঁর সখাস্বরূপ বা অনুরাগভাজন হও– কিন্তু কিভাবে তা হওয়া যায়? সৎকর্মের অনুষ্ঠানই সে পক্ষের একমাত্র সহায় নয় কি? যখন সখায় অর্থাৎ সখাস্বরূপ হয়ে আমরা তার দ্বারে। উপস্থিত হবার চেষ্টা করব তখন সৎকর্মের প্রভাবে তার সাথে সম্বন্ধ স্থাপন চেষ্টা পাব– এই ভাবই মনে করা কর্তব্য নয় কি? সখায় পদের এটাই সার্থক প্রয়োগ বলে মনে হয়। সৎকর্মশীল হওয়াই সখায়ঃ পদের লক্ষ্য। তার পর, কার্যমাত্রই যদি তার সাথে সম্বন্ধযুত হয়; প্রতি কার্যে প্রতি মুহূর্তের জীবন-সংগ্রামে যদি তাকে আহ্বান করতে সমর্থ হই; তাহলেই তিনি মূর্ধিপ্রদেশে সহস্রার বিন্দু মাঝে– অধিষ্ঠিত হবেন;– তাহলেই তার সামীপ্য লাভ (পূর্ব মন্ত্রের মতো) সুসত্বর হয়ে আসবে। এ পক্ষে এ মন্ত্র পূর্ব মন্ত্রেরই অনুবৃত্তি]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৫দ-৯সা) প্রাপ্তব্য]।

১১/২– হে মোক্ষ-উপায়ভূত শুদ্ধসত্ত্বভাব! অনন্ত অতীতকাল হতে আমার পিতৃপুরুষগণ তোমাকে লাভ করবার জন্য যে ভগবানকে আহ্বান করে আসছেন, এক্ষণে আমিও সেই পুরাতন, অনন্ত-সম্বন্ধযুক্ত, এককালে সকল-সকর্মে উপস্থিতি স্বরূপ, নর-হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত (শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ) তা দেবকে যথাক্রমে (প্রতিকর্মে) আহ্বান করছি। (ভাব এই যে, আমাদের পূর্বপুরুষগণ যে দেবতাকে এ সত্ত্বভাবলাভের জন্য সর্বকর্মে আহ্বান করতেন, আমিও সত্ত্বভাব-উৎকর্ষ লাভের জন্য সেই দেবতাকে আহ্বান করছি)। [মন্ত্রটি বড়ই জটিল ও দুর্বোধ্য। সুতরাং নানাদিক থেকে এ মন্ত্রের নানা অর্থ অধ্যাহৃত হয়ে থাকে। প্রত্নস্য ও ওকসঃ পদ দুটি কত বিপরীত ভাব দ্যোতনা করে। তারপর নরঃ শব্দ। এ শব্দেও হৃদয়ে নানা সংশয়-সন্দেহ আনয়ন করে। বেদমন্ত্রের পৌরুষত্ব ও অনিত্যত্ব প্রমাণের পক্ষে এ মন্ত্রের তথাকথিত ব্যাখ্যা বেদবিরোধিগণের অস্ত্রস্বরূপ গণ্য হতে পারে; আবার, যাঁরা অন্যদেশ (মধ্য-প্রসিয়া প্রভৃতি স্থান) থেকে আর্যদের ভারতবর্ষে আগমনমূলক যুক্তির পোষকতা করতে চান, এ মন্ত্র তাদেরও সহায় হয়ে থাকে। পিতা পদ, পূর্বং পদ, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে স্পর্ধান্বিত করে। এইভাবে, এ মন্ত্রের সম্বোধ্যই বা কে, আর প্রার্থনাই বা কি, এ পর্যন্ত, এ বিষয়ে বড়ই সমস্যায় পড়তে হতো। প্রকৃতপক্ষে এই মন্ত্রের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মন্ত্রের সাথে এটির সম্বন্ধ একটু চিন্তা করা আবশ্যক। পূর্ব মন্ত্রের মর্ম এই যে, যদি আমাদের প্রার্থনা তার কর্ণে স্থান পাওয়াতে পারি অর্থাৎ যদি আমরা ভগবানের করুণালাভের উপযুক্ত কর্মের কর্মী হই, তাহলে তার অনুগ্রহ সহস্রধারায় প্রবাহিত হয়ে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে। এবার দেখা যাবে, পূর্ব মন্ত্রের সাথে এর সম্বন্ধ। মনে করা যাক, ভগবানের করুণা-লাভের উপযুক্ত কর্ম বা প্রার্থনা কি রকম? আর মোক্ষলাভের উপাধানভূত সামগ্রীই বা কি আছে? সে কি সৎকর্ম ইত্যাদির দ্বারা সঞ্জাত সেই শুদ্ধসত্ত্বভাব নয়? আমরা তাই মনে করি, — এ মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক; এ মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বভাবকেই সম্বোধন করা হয়েছে। মন্ত্রের লক্ষ্য, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের সঞ্চার। আদর্শ যেমন কার্যকরী হয়, পারম্পর্য যে রকম কর্ম-প্রবৃত্তির উন্মেষণ করে থাকে, তেমন আর কিছুই নয়। পুত্র পিতার পদাঙ্ক অনুসরণে আপনা-আপনিই সামর্থ্যবান্ হয়। এখানে সেই ভাবেরই দ্যোতনা দেখা যায়। সাধক, শুদ্ধসত্ত্বভাবের অধিকারী হওয়ার জন্য, ভগবানের শরণাপন্ন হচ্ছেন। কেমনভাবে শরণ নিচ্ছেন?– পিতৃগণ যেমনভাবে শরণ নিতেন। এখানে মনে সংশয় আসতে পারে, — বুঝি বা কালাকালের প্রসঙ্গ আছে, বুঝি বা ব্যক্তিবিশেষের সম্বন্ধ আছে। কিন্তু তা নয়। মন্ত্র যে নিত্য! অনন্ত অতীতকাল থেকে অনন্ত-কোটী সাধক, এই-ই মন্ত্রে এই-ই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হচ্ছেন; এবং মন্ত্রের ও তার সহযুত কর্মের প্রভাবে কৃতকৃতার্থ হয়ে যাচ্ছেন। এখানে এ মন্ত্রের পিতা পদে, কেবল তোমার আমার পিতাকে বোঝাচ্ছে না। পিতার পিতা, তার পিতা, অনন্ত অতীতের সাথে সম্বন্ধযুক্ত কর্মবিপাক থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত সেই পিতৃপুরুষমাত্রকেই, ঐ পিতা শব্দে আমরা আকর্ষণ করছি। পূর্বং পদও এমন কেবল তোমার আমার পূর্বের ভাব দ্যোতনা করছে না ঐ পদে সেই অনন্ত অতীতের অনন্ত সম্বন্ধ খ্যাপন করছে। প্রত্নস্য ওজসঃ পদ দুটিও সেই আনন্ত্য ভাবের জ্ঞাপক]।

১১/৩– যখন (যদি) সেই ভগবান্ আমাদের আহ্বান শুনতে পান, তখন (তাহলে) তিনি আপন সহস্র (অর্থাৎ সমগ্র) রক্ষাকারী-শক্তির সাথে এবং আমাদের প্রদেয় সকল রকম কর্মফলসমূহের সাথে অবশ্যই আমাদের নিকটে আসবেন। (ভাব এই যে, — সেই দেবতা আমাদের আহ্বান শ্রবণ করে আমাদের রক্ষার জন্য নিজের রক্ষাকারী সকল শক্তির সাথে, অবশ্যই আমাদের সমীপে আগমন করবেন)। [এ মন্ত্র ভগবানের করুণার বিষয় স্পষ্ট করে খ্যাপন করছেন। এবার আর একবার পূর্বৰ্মন্ত্রের প্রথম সামের বিষয় স্মরণ করা যেতে পারে। তাহলেই, কি অবস্থায় তিনি তোমায় রক্ষার জন্য সহস্র রকম উপায় ও কর্মফল নিয়ে আসবেন, তা বোধগম্য হবে। পূর্ব মন্ত্রের মর্মানুসারে প্রতি কর্মে এবং প্রতি সংগ্রামে তাঁর শরণাপন্ন হলে, তিনি কখনও নিশ্চিত থাকতে পারবেন না। তার প্রতি এই নির্ভরতাই তোমার একান্ত ও একমাত্র কর্তব্য। তাকে মূৰ্বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করাই তোমার কর্তব্য।  আর সেই কর্মই তোমার একমাত্র শ্রেয়ঃসাধক। এখানে এই মন্ত্রে তা-ই বিশেষ করে বলা হলো]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– সৌমেধম]।

১২/১– পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন। হৃদয়ে সৎ-ভাব সঞ্জাত হলে, সৎ-ভাব বর্ধক মোক্ষপ্রাপ্তির সামর্থ্য প্রদানের জন্য আপনি সভাব-সহযুত সৎকর্মকে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, সৎ-ভাব সমন্বিত সৎকর্ম ভগবানকেই প্রাপ্ত হয়; অপিচ, সৎ-ভাব সঞ্চার করে ভগবান্ সাধককে ও তার কর্মকে পবিত্র করেন); সেই ভগবান্ নিশ্চয়ই মহান্। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক। সৎ-ভাব সমন্বিত সাধক অবিলম্বে সৎ-ভাবের আধার ভগবানকে প্রাপ্ত হন; অতএব প্রার্থনা– হে ভগবন! আমাকে সৎ-ভাব-সমন্বিত করে মোক্ষপদে প্রতিষ্ঠিত করুন)। [মানুষ সৎকর্মের দ্বারা সস্বরূপকে প্রাপ্ত হয়। তিনি যদি প্রসন্ন না হন, তাহলে মানুষের সাধ্য কি যে সে সৎকর্ম-সম্পাদনে সমর্থ হয়। ভগবানের কাছ থেকে শক্তি আসে বলে মানুষ কর্ম করতে পারে। সাধকেরা সাধনার বলে ঈশ্বরের করুণার অধিকারী হয় এবং মোক্ষলাভে সমর্থ হয়। আবার সাধারণ অকৃতি জনও যদি ভগবানের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করেন, ভগবান্ তাদের অগ্রসর হয়ে ক্রোড়ে তুলে নেন। তারাও মোক্ষলাভে সমর্থ হন। ভগবান্ এমনই কৃপাবা। এই-ই তার মহত্ত্ব। এই মহত্ত্বই লোকগণের আরাধনার বস্তু। মানুষ নিজেকে নিজে যতটুকু পারে চালিয়ে নেয়, আর ভগবান্ তার দুর্বলতা বুঝে নিজের স্বর্ণসিংহাসন থেকে নেমে এসে তার দয়ার ভিখারীকে নিজের স্নেহবাহুর আলিঙ্গনে শুধু বিপদ থেকে রক্ষা করেন না, তাকে চিরশান্তি প্রদান করেন। তার এই পালকত্ব ও রক্ষাকর্তৃত্বই মানুষকে তার দিকে আকর্ষণ করে। মানুষ সৎকর্মের দ্বারা মোক্ষপথে একটু অগ্রসর হলেই ভগবান তাকে আরও অগ্রসর হবার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেন। কোথায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব, আর কোথায় রাজরাজেশ্বর ত্রিভুবনপতি। কিন্তু এই ক্ষুদ্রের জন্য, দুর্বলের জন্য, তার করুণাধারা প্রবাহিত হয়ে ভোগবতীধারায় মানুষকে পরিতৃপ্ত শীতল করে। এতেই তার মহত্ত্বের পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠে। বেদ তার সেই মহত্ত্বই প্রখ্যাপিত করেছেন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৪দ-১সা) প্রাপ্তব্য]।

১২/২– ভগবান্ আদিভূত স্বলোকে বর্তমান আছেন; তিনি দেবভাবসমূহের বর্ধনকারী; অপিচ, তিনি ভবার্ণবত্রাণকারী মোক্ষদাতা, মহাযশস্বী, (অথবা মহাশক্তিদায়ক), অমৃতদাতা হন। (মন্ত্রটি, নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ অমৃতপ্রদায়ক মোক্ষবিধাতা হন)। [ভগবান্ যে স্থানে থাকেন, সেই স্থানই স্বর্গ। সুতরাং সেই স্বলোকও সৃষ্টির আদিভূত অথবা সৃষ্টির পূর্ববর্তী। প্রকৃত পক্ষে এখানে স্বর্গলোক বলতে বিশেষ কোনও স্থান বোঝাচ্ছে না। কারণ, ভগবান্ স্থান ও কালের অতীত। ব্যোমনি পদের দ্বারা তার মহিমাকে লক্ষ্য করা হয়েছে মাত্র। তার কাছ থেকেই দেবভাব উৎপন্ন হয়। সুতরাং তিনি কৃপা করলেই জগতে দেবভাবের মহিমা বিস্মৃত হতে পারে। তিনি ইচ্ছা করলেই মানুষকে দেবতায় পরিণত করতে পারেন। সেই দেবভাব অথবা বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব প্রদান করে তিনি মানুষকে ভবসমুদ্রের পরপারে নিয়ে যেতে পারেন অর্থাৎ মোক্ষ প্রদান করতে পারেন। অমৃতদাতা তিনি। তাঁর অফুরন্ত অমৃতভাণ্ডার থেকে মানুষ তার কৃপায় যদি এক বিন্দু অমৃত পায়, তাহলে মানবজীবন সার্থক হয়। তিনি শুধু অমৃতের অধিকারী নন। উপযুক্ত সাধককে তার অমৃতকণা দানে চরিতার্থও করেন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও মন্ত্রটিকে ভগবানের মহিমাখ্যাপক বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় বৃত্র প্রভৃতিকে অনর্থক টেনে আনা হয়েছে]।

১২/৩– আত্মশক্তিলাভের জন্য এবং রিপুসংগ্রামে জয়লাভের জন্য প্রসিদ্ধ পাপনাশক বলাধিপতি দেবতাকেই আরাধনা করছি; হে দেব! আপনি আমাদের পরম সুখের জন্য হোন অর্থাৎ আমাদের পরম সুখ প্রদান করুন এবং আমাদের সমৃদ্ধির জন্য অন্তরতম বন্ধু হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আমাদের আত্মশক্তিসম্পন্ন এবং রিপুজয়ী করুন, আমাদের অন্তরতম বন্ধু হোন)। [তুমি অন্তরতর অন্তরতম। তুমি প্রাণরূপে জীবের জীবনীশক্তি দিচ্ছ, জ্যোতিঃরূপে আত্মায় অধিষ্ঠিত আছ। প্রাণের প্রাণ অন্তরতম সখারূপে তুমি আমার হৃদয়ে এস, তোমার প্রেমস্পর্শলাভে আমি ধন্য হয়ে যাই। হৃদয়ের নিভৃতনিকুঞ্জে আমি তোমার জন্য আসন পেতে রেখেছি। …ব্যবধান দূর করো, অন্তরের অন্তরতম দেশে এস সখা। আমার আহ্বান সাফল্যমণ্ডিত হোক। ভারতীয় সাধনাপদ্ধতির মধ্যে অথবা সমগ্র জগতের সাধনাপদ্ধতির মধ্যে, সখ্যরস সাধনার স্থান অতি উচ্চ। ….ভগবান্‌কে বন্ধুরূপে, অন্তরঙ্গ সখারূপে পাবার আকাঙ্ক্ষাই এই রসের বিশেষত্ব। — পাকরসের সাধনা, বিশেষভাবে সখ্য বাৎসল্য ও মধুর রসের সাধনা, ভারতীয় সভ্যতার ও ধর্মসাধন পদ্ধতির উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর আর কোন দেশে, কোনও ধর্মপদ্ধতিতে এই উচ্চভাব পরিদৃষ্ট হয় না। ভিন্নদেশবাসী ভিন্নধর্মাবলম্বী মানবগোষ্ঠী ভাবের ভাব-মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারেন না; কাজেই তারা এই সম্বন্ধে নানারকম অসংলগ্ন অর্থহীন মন্তব্য প্রকাশ করেন। সখ্যরসের সাধন শক্তি লাভের জন্য প্রার্থনাই এই মন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের সার্থকতা প্রদর্শন করবার জন্যই মর্মার্থে চেষ্টা করা হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্ৰগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম কৌৎসম এবং উদ্বংশীয়ম্]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১৩– এনা বো অগ্নিং নমসোর্জো নপাতমা হুবে। প্রিয়ং চেতিষ্ঠমরতিং স্বধ্বরং বিশ্বস্য দূতমমৃত৷৷ ১৷৷ স যোজতে অরুষা বিশ্বমোজসা স দুদ্রবৎ স্বাহুতঃ। সুব্রহ্মা যজ্ঞঃ সুশমী বসূনাং দেবং রাধো জনানা৷৷ ২৷৷

সূক্ত ১৪– প্রত্যু অদর্শায়্যুম্ন্তী দুহিতা দিবঃ। অপো মহী বৃণুতে চক্ষুসা তমো জ্যোতিষ্কৃণোতি সূনরী। ১৷৷ উদুষিয়াঃ সৃজতে সূর্যঃ সচা উদ্যক্ষত্ৰমর্চিবৎ। তবেদুষো দ্যুষি সূর্যস্য চ সংভক্তেন গমেমহি৷৷ ২।  

সূক্ত ১৫– ইমা উ বাং দিবিষ্টয় উত্সা হবন্তে অশ্বিনা। অয়ং বামহেহবসে শচীব বিশংবিশং হি গচ্ছথঃ ৷৷ ১৷৷ যুবং চিত্রং দদথুর্ভোজনং নরা চোদেথাং সূতাবতে। অর্বাগ্রথং সমনসা নি যচ্ছতং পিবতং সোম্যং মধূ৷৷ ২

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৩সূক্ত/১সাম– হে দেবভাবসমূহ! তোমাদের অধিকার করবার জন্য আমি, সত্যভাব রূপ বলের পুত্রস্বরূপ অর্থাৎ সৎ-ভাব হতে উৎপন্ন, সকলের প্রিয় অতিশয় জ্ঞানী বা জ্ঞাপক, (সকলের) অধিপতি, সুযোগ্য (শোভন-যজ্ঞকারী), সকলের অভীষ্টপূরক, ক্ষয়রহিত অর্থাৎ নিত্যজ্ঞানস্বরূপ দেবকে এই স্তোত্রের দ্বারা আহবান করছি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে,– জ্ঞানাগ্নিই দেবভাব-প্রাপক)। [এই সামমন্ত্রটিতে, মাত্র জ্ঞানাগ্নির গুণরাশি পরিবর্ণিত। মন্ত্রের প্রথমে বঃ পদ থাকায়, এস্থলে ভাষ্যকার ঋত্বিক যজমানের সম্বন্ধ কল্পনা করে স্তোতারঃ পদ অধ্যাহার করেছেন। আমাদের মন্ত্রার্থে পূর্বাপর অর্থসঙ্গতির পক্ষে লক্ষ্য রেখে, ঐ পদে দেবভাবনিবহ অর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে। বিলের পুত্র বলতে এই মন্ত্রার্থে শুদ্ধসত্ত্ব হতে উৎপন্ন অর্থই সঙ্গত। সাধন ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হতে হলে শুদ্ধসত্ত্বই একমাত্র প্রধান বল। সেই শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হলে, জ্ঞানাগ্নি স্বাভাবিক ভাবেই হৃদয়-প্রদেশ অধিকার করে। অতএব শুদ্ধসত্ত্ব যে জ্ঞানের জনক, তাতে আর বিচিত্রতা কি আছে? তার পর তাঁকে বলা হয়েছে– প্রিয়ং অর্থাৎ তিনি সকলের প্রিয়। তিনি চেতিষ্ঠং অর্থাৎ অতিশয় জ্ঞানী– জ্ঞাপক। তিনি ভগবানের স্বরূপ-তত্ত্ব জ্ঞাত আছেন এবং সাধককে তা জ্ঞাত করেন। এইভাবে মন্ত্রের বিশেষণ-পদগুলিতে জ্ঞানাগ্নির শ্রেষ্ঠত্ব সর্বতোভাবে পরিকীর্তিত হয়েছে। সাধন-ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করতে হলে, জ্ঞানাগ্নিই যে প্রধান সহায় এবং শ্রেষ্ঠ অবলম্বন– এ মন্ত্র তার জ্বলন্ত নিদর্শন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-৫দ-১সা) পাওয়া যায়]।

১৩/২– ভগবান্ বিশ্বরক্ষক জ্যোতির্ময় আপন তেজের দ্বারা সাধককে সংযোজিত করেন; ভগবান্ সাধককে দিব্যজ্যোতিঃ প্রদান করেন; সর্বলোক কর্তৃক স্তুত সর্ব-আরাধনীয় সৎকর্মসাধনশক্তিদাতা সেই দেবতা ঐকান্তিকতার সাথে আহূত হয়ে আমাদের হৃদয়ে শীঘ্র আগমন করুন; পরমধনসম্পন্ন সাধকদের পূজারূপ ধন ভগবানের প্রতি গমন করে। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সকলের আরাধনীয় পরমজ্যোতিঃদায়ক ভগবান্ আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [সাধকদের হৃদয়ে প্রদত্ত ভগবানের জ্যোতিঃ বিশ্বরক্ষাসমর্থ। আলোকই জীবন, অন্ধকারই মৃত্যু। জ্যোতির প্রভাবেই জগৎ বেঁচে আছে। ঐহিক ও পারত্রিক উভয় দিক দিয়ে জ্যোতির বিশ্বরক্ষাশক্তি অনুভব করা যায়। যেমন, জ্যোতিঃ বা আলো না থাকলে জীবজগৎ, উদ্ভিদজগৎ, অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্ট পদার্থই প্রাণহীন অবস্থায় পরিণত হতো। জ্যোতিধারার সূর্যহীন বিশ্বলোকের কথা কি ভাবা যায়?– এ তো একটা দিক। তার চেয়েও বহুগুণ উচ্চ ও মহান ভাব এই বিশ্বভোজসা পদের মধ্যে নিহিত রয়েছে। মানুষ এই জ্ঞানালোক ব্যতীত মানুষই হতো না, এই দিব্যজ্যোতিঃ ব্যতীত জগৎ অধ্যাত্মজীবনহীন হতো। জ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ জ্ঞান-বলেই বিশ্বের সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের নিয়ন্তা। তাই জ্ঞানজ্যোতিঃ বিশ্বের রক্ষক বলে অবিহিত। ভগবান্ কৃপা করে সেই জ্ঞানজ্যোতিঃ প্রদান করেন। মন্ত্রে এই সত্যই এ বিশেষভাবে প্রখ্যাত হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গানের নাম যথাক্রমে, — বারবন্তীয়ম, মহাবামদেব্যম্ এবং শ্রুধ্যম]।

১৪/১– জ্ঞানবৃত্তি আমার অজ্ঞানতা দূর করে, অজ্ঞান আমার প্রতি আগমন করুন, অর্থাৎ আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; সই জ্ঞানবৃত্তি জ্যোতিঃ দান করে অজ্ঞানান্ধকার দূর করুন; সেই মোক্ষপথপ্রদর্শয়িত্রী আমাকে পরাজ্ঞান দান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবান্! অজ্ঞান আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [জ্ঞান ভগবানেরই দান। তিনি সত্যম্ জ্ঞান অনন্ত। তার থেকেই জ্ঞানের উৎপত্তি। হিন্দুধর্ম কি পরম চৈতন্য সত্তা থেকেই জগতের উৎপত্তি নির্দেশ করেছেন। তিনি জ্ঞানময়। তাই জ্ঞানকে দিবঃ দুহিতা (দ্যুলোকের পুত্রী) বলা হয়েছে। সূর্যোদয়ে অন্ধকারের মতো জ্ঞানের উদয়ে অজ্ঞানতা তমঃ প্রভৃতি বিনষ্ট হয়। এই জ্ঞানের মাহাত্মেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তারা দেবত্বের বা অমৃতের বা মোক্ষের অধিকারী। তাই সেই জ্ঞানলাভের জন্যই সাধক প্রার্থনা করছেন। — জ্ঞানকে এখানে সূনরী– লোকবর্গের নেত্রী বলা হয়েছে। জ্ঞানই মানুষকে প্রকৃতভাবে সৎপথের সন্ধান দেয় এবং সেই পথে পরিচালিত করে। জ্ঞানই মানুষকে সৎকর্মের মর্ম বুঝতে সহায়তা করে। সৎকর্মের দ্বারা পরিণামে মানুষ জ্ঞানলাভের অধিকারী হয় বটে; কিন্তু যে পর্যন্ত না জ্ঞান এসে উপস্থিত হয়, সে পর্যন্ত অবিশ্বাস সন্দেহ মোহ প্রভৃতি নানারকম রিপুর সাথে সাধককে সংগ্রাম করতে হয়। সেই সংগ্রামে কখনও বা রিপু পরাজিত হয়, কখনও বা সাধক। কিন্তু জ্ঞানলাভের পর মোহে বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। জ্ঞান সার্থকতার পথে নিয়ে যায়, পথভ্রান্তি ঘটবার সম্ভাবনা থাকে না। সেইজন্যই জ্ঞানবৃত্তিকে সূনরী বলা হয়েছে। ভাষ্যে দিবঃ দুহিতা পদ দুটির অর্থ করা হয়েছে– দ্যুলোকস্য সূর্যস্য বা দুহিতা ঊষাঃ। ঊষাকে সূর্যের দুহিতা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়নি। ভাষ্যের এক টীকায় বলা হয়েছে– আদিত্যস্য প্রতিদিনমূষসঃ পশ্চাৎ ধাবমানত্বাৎ কন্যা বলাকারাপবাদঃ। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। বেদের মহান ভাবগুলি পরবর্তী কালে কেমন জঘন্য আকার ধারণ করেছে, তা প্রদর্শন করার জন্যই এইটুকুর উল্লেখ করা হলো]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৮দ-১সা) প্রাপ্তব্য]

১৪/২– জ্ঞানদেব (জ্ঞানকিরণের সাথে সাধকদের হৃদয়ে প্রাদুর্ভূত হন এবং প্রাদুর্ভূত হয়ে সাধকদের জ্ঞানযুক্ত করেন, জ্ঞানোন্মোষিকে হে দেবি (ঊষা)! আপনার এবং জ্ঞানদেবতার (সূর্যের) প্রকাশ হলে আমরা ভক্তিপূর্ণহৃদয়ে যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভক্তিসমন্বিত জ্ঞানের আলোক আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হোক)। [জ্ঞানস্বরূপ ভগবানের কৃপাতেই মানুষ তার সেই অসীম অমৃতভাণ্ডারের সন্ধান পায়। তারা সেই অমৃতপানে নিজেদের ধন্য করে। ভক্তির সাথে, হৃদয়ের ঐকান্তিক প্রার্থনার সাথে, তাঁর সেই জ্ঞানামৃত হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। ভক্তিশূন্য জ্ঞান শুষ্ক কঠোর অথবা জ্ঞানের পরিপূর্ণতায় ভক্তি আপনা-আপনিই না এসে থাকতে পারে না। সুতরাং সত্যিকার জ্ঞান হৃদয়ে সঞ্চার হলে মানুষ শ্রদ্ধাভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে তাঁর চরণে লুটিয়ে পড়ে ধন্য হয়। যাতে আমাদের হৃদয়ে ভক্তিযুক্ত জ্ঞান চিরস্থায়ী হয়, মন্ত্রের মধ্যে এই প্রার্থনাই পরিদৃষ্ট হয়। প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদি.ত ভিন্নভাব পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা থেকেও এমন একটি বৈজ্ঞানিক তথ্যের পরিচয় পাওয়া যায়, যা পাশ্চাত্যজগতে অতি অল্পদিনমাত্র হলো আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই তথ্য উদ্যৎ নক্ষত্ৰং আৰ্চবৎ– সূর্যের দ্বারা নক্ষত্রসমূহ জ্যোতিষ্মান্ হয়। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যজাতিগুলি গ্রহনক্ষত্র ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত ধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু অনাদিকাল এ থেকে বেদ এই বৈজ্ঞানিক সত্য জগতে প্রচার করে আসছেন]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– বারবন্তীয়ম, বামদেব্যম্ এবং শ্রুধ্যম]।

১৫/১– আশ্রয়দাতা আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয় (অশ্বিনা)! আমাদের হৃদয়স্থিত সৎ-বৃত্তিসমূহ– নিত্যকাল আপনাদের অনুসরণ করে। (ভাব এই যে, — এর পর আমাদের মধ্যে স-বৃত্তিগুলি ক্রিয়াশীল হোক– এই আকাঙ্ক্ষা)। সৎকর্মসাধ সামর্থ্য প্রদাতা হে দেবদ্বয়! আপনারা নিশ্চয়ই সমস্ত প্রার্থনাকারীদের কাছে গমন করেন, অর্থাৎ তাদের প্রাপ্ত হন; পাপ হতে আমাকে রক্ষা করবার জন্য, পাপী আমি আপনাদের আহ্বান করছি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবদ্বয়! কৃপা করে আপনারা আমাকে পাপ হতে উদ্ধার করুন)। [মন্ত্রটি তিনভাগে বিভক্ত। প্রথম দুটি ভাগে বলা হয়েছে যে, সৎ-বৃত্তিসমূহ দেবতারই অনুসরণ করে। মানুষ নানাভাবে নানা দেবতার নামে আরাধনা করে। কিন্তু পরিণামে সে পূজা সেই একমেবাদ্বিতীয়ং পরমব্রহ্মেরই চরণে গিয়ে পৌঁছায়, কারণ তিনি ব্যতীত আর দ্বিতীয় কেউ নেই– সবই তিনি– তাতেই সব। সেই জগৎপিতা ভগবান্ ব্যতীত মানুষ আর কার কাছে যাবে? তাই সাধক সেই পরম আশ্রয়েরই সন্ধানে বের হন। জগতের আশ্রয়দাতা যিনি, নানা রূপে নানা ভাবে নানা বিভূতির মধ্য দিয়ে বিশ্বকে যিনি পালন কবছেন, সেই পরম দয়ালের চরণেই তিনি শরণ গ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষও একদিন না একদিন সেই চরম আশ্রয়ের জন্য ব্যাকুল হবেই। পৃথিবীর মিথ্যা প্রবঞ্চনায় জগতের প্রতি সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, দুঃখে জর্জরিত হয়ে যখন সে জীবনে বীতস্পৃহ হয়ে যায়, যখন মানুষ বা জগতের প্রতি তার আর আকর্ষণ থাকে না; যখন দুঃখের আগুনে পুড়ে তার ভিতরের খাঁটী সোনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; তখন সেই পরম আশ্রয়দাতার কথাই মন হয় এবং তাঁরই শরণ নিতে বাধ্য হয়। মন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগে ভগবানের অসীম করুণার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। যে তাঁকে ডাকে, তার কাছেই তিনি যান, তাকেই সৎ পবিত্র মহৎ করবার জন্য ভগবান্ নিজের শক্তি তার মধ্যে সঞ্চারিত করেন। তাই ভগবানকে তার আধিব্যাধিনাশক যুগ্ম বিভূতিদ্বয়কে শচীবসুবলা হয়েছে। সৎকর্মই যাঁর ধন, তিনিই শচীবসু। মানুষই যে কেবল তার দুয়ারে যায়, তা নয়; বরং তিনিই মানুষের দুয়ারে আসেন– অর্থাৎ বদ্ধ হৃদয় দ্বারে এসে আঘাত করেন। যারা তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাদের কাছেই তিনি গমন করেন। তিনি যে বিশ্বের পিতা ও মাতা। তাই এই মন্ত্রে তাঁর উদ্দেশে সাধকের আহ্বান]। [এই মন্ত্রটি ছদার্চিকেও (৩অ-৮দ-২সা) প্রাপ্তব্য]।

১৫/২– সৎকর্মের নেতা হে দেবদ্বয়! আপনারা বিচিত্র, পরমধন ধারণ করেন; প্রার্থনাকারী আমাকে সেই ধন প্রদান করুন; কৃপাপরায়ণ হয়ে আমাদের সম্বন্ধীয় সৎকর্মরূপ যান আমাদের অভিমুখে স্থাপন করুন, অর্থাৎ আমাদের সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করুন; তারপর সৎকর্মসাধনে উৎপন্ন সত্ত্বভাবময় অমৃত গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — পরমদাতা ভগবান আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা-হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা যে চিত্রধন ধারণ করো, স্তুতিবান্ ব্যক্তির কাছে তা প্রেরণ করো। তোমরা একমনা হয়ে তোমাদের রথ আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করো, সোমসম্বন্ধীয় মধুপান করো। অর্থাৎ ভাষ্য ইত্যাদিতে সোম্যং মধু পদ দুটিতে সোমরস অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ঐ পদ দুটিতে আমরা সত্ত্বভাবময় অমৃত অর্থ গ্রহণ করেছি এবং তাতেই মন্ত্রের অর্থের সঙ্গতি রক্ষিত হয়েছে। ভগবানের কাছে হৃদয়ের অর্ঘ্যই গৃহীত হয়। যাতে আমাদের পূজা তাঁর চরণে পৌঁছায়, কৃপাপূর্বক তিনি যাতে আমাদের পূজা গ্রহণ করেন, এ মন্ত্রের শেষ অংশে এই প্রাথনাই দেখতে পাওয়া যায়]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম, যথাক্রমে-বারবন্তীয়ম বামদেব্যম্ শ্রুধ্যম]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৬– অস্য প্রত্নমনু দ্যুতং শুক্রং দুদুত্রে অয়ঃ। পয়ঃ সহস্রসামৃষিম্৷৷ ১৷৷ অয়ং সূর্য ইবোপদৃগয়ং সরাংসি ধাবতি। সপ্ত প্রবত আ দিব৷ ২৷৷ অয়ং বিশ্বানি তিষ্ঠতি পুনানে ভুবনোপরি। সোমমা দেবোন সুর্যঃ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৭– এষ প্রত্নেন জন্মনা দেবো দেবেভ্যঃ সুতঃ। হরিঃ পবিত্রে অতি৷৷ ১৷৷ এষ প্রত্নেন মন্মনা দেবো দেবেভ্যস্পরি। কবিৰ্বিপ্ৰেণ বাবৃধে৷৷ ২৷৷ দুহানঃ প্রত্নমিৎ পয়ং পবিত্রে পরি যিচ্যসে। ঐন্দং দেবাঁ অজীজনঃ ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৮– উপ শিক্ষাপতভুষো ভিয়সমা ধেহি শত্ৰবে। পবমান বিদা রয়িম্। ১৷৷ উপো যু জাতমপুরং গোভির্ভঙ্গং পরি ইন্দুং দেবা অযাসিষুঃ॥ ২॥ উপাস্মৈ গায়তা নরঃ পবমানায়েন্দবে। আভ দেবা ইয়ক্ষতে৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১৬/১– ভগবানের নিকট, সর্বার্থসাধক, সত্যপ্ৰাপক, জ্যোতির্ময়, দীপ্তিমান অমৃতময় করুণাধারা জ্ঞানিগণ সর্বতোভাবে লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় জ্ঞানিগণ অমৃত প্রাপ্ত হন)। [জ্ঞানিগণই অমৃতলাভের অধিকারী। যাঁরা সাধনার দ্বারা পরাজ্ঞান লাভ করেন, তারাই সর্বার্থসাধক অমৃত লাভ করে ধন্য হন। মানুষের মনে চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা অমৃতলাভের আকাঙ্ক্ষা। তাই যাতে অমৃতের স্পর্শ আছে বলে মনে করে, তারই পশ্চাতে ঘুরতে থাকে। বস্তুতঃ মানুষের মনে প্রকৃত কোন কু-অভিসন্ধি নেই বা থাকতে পারে না। তার অন্তরের সেই  অমৃতলাভের জন্যই দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু অজ্ঞানতাবশতঃ অমৃতলাভের পথ খুঁজে পায় না বলেই সে পথের সন্ধানে ফিরতে ফিরতে সহসা বিপথে চলে নিজের অধঃপতন ঘটায়। পরে যখন তার জ্ঞানোদয় হয়, তখন সে তার জীবনের চরম প্রার্থনীয় বস্তুর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে এবং তা লাভ করবার জন্য যত্নপরায়ণ হয়। জ্ঞান সেই অমৃতলাভের পকৃত উপায় নির্দেশ করে দেয় এবং জ্ঞানী-সাধক সেই অনুরূপ অমৃতপানে অমর হন। মন্ত্রে এই সত্যই বিবৃত আছে]।

১৬/২– জ্ঞানদেবতুল্য আপন কিরণের দ্বারা সূর্যদেব যেমন জগৎকে উদ্ভাসিত করেন, তেমন পরম দেব (অথবা সত্ত্বভাব) সর্বজ্ঞ (অথবা সর্বজ্ঞানদাতা) হন; সেই দেবতা সাধকদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হন; এবং দ্যুলোক ও বিশ্বকে প্রাপ্ত করেন। (ভাব এই যে, — সর্বজ্ঞাপক সর্বজ্ঞ ভগবান্ সাধকের হৃদয়কে প্রাপ্ত হন)। [ভগবান্ অথবা তার শক্তিস্বরূপ সত্যভাব দ্যুলোক-ভূলোক ব্যেপে আছেন, সর্বত্রই তাঁর মহিমা পরিদৃষ্ট হয়। ভাষ্যকার অয়ং পদে সোম অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই অর্থে সপ্ত প্রবত আ দিব পদগুলির কোনও সার্থকতা থাকে না। সপ্ত নদী এবং সপ্ত স্বর্গে সোমরস বর্তমান থাকে–এর দ্বার কোনও উচ্চ ভাবের ব্যঞ্জনা হয় না]।

১৬/৩– জ্ঞানদেবতুল্য দ্যুতিমান্ প্রসিদ্ধ পবিত্রকারক সত্ত্বভাব সকল ভুবনের উপরে বর্তমান আছেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাব লোকবর্গের সর্বশ্রেষ্ঠ মঙ্গলসাধক হন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে আমাদের মন্ত্রার্থের ভাবের ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– এই সোম যখম সংশোধিত হচ্ছেন, ইনি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের উপরিস্থ হন। এই বাক্যাংশের অর্থ কি? সোম পদে সোমরসঅর্থ গ্রহণ করলে এই বাক্যাংশের কোন সার্থকতা থাকে না। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবই জগতের নিয়াম]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দশটি গেয়গান আছে। যথা, -সত্ৰাসাহীয়ম, আমহীয়সম জরাবোধিয়ম্, ইত্যাদি]

১৭/১– সৃষ্টির আদিভূত প্রসিদ্ধ দ্যুতিমান পাপহারক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকবর্গ ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [সত্ত্বভাব ভগবানের শক্তি সত্ত্বভাবেই বিশ্বের সৃষ্টি। সুতরাং এই দিক দিয়ে সত্ত্বভাবকে সমস্ত সৃষ্টির আদিভূত বলা যায়। আবার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির মধ্যে যখন সত্ত্বগুণের প্রাধান্য ঘটে, তখনই সৃষ্টির আরম্ভ হয়। সুতরাং সমগ্র সৃষ্টির আদিভূত কারণ– সত্ত্বভাব। — সত্ত্বভাব অবশ্যই পাপনাশক, কারণ ভগবানের পুণ্যস্পর্শ সমন্বিত সত্ত্বভাবের প্রভাবে পাপ-তাপ আপনা থেকেই দূরে পলায়ন করে। সুতরাং সৌভাগ্যবান্ সাধক এই সত্ত্বভাবের অধিকারী হয়ে এই পাপমোহ প্রলোভনপূর্ণ সংসারের ঊর্ধ্বলোকে বিচরণ করতে সমর্থ হন]।

১৭/২– ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য, সাধক কর্তৃক, ঐকান্তিক সাধনের দ্বারা জ্ঞানদায়ক, দ্যুতিমান, প্রসিদ্ধ, সত্ত্বভাব হৃদয়ে উৎপাদিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকবর্গ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সাধনার দ্বারা সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [সাধনার চরম উদ্দেশ্য– ভগবৎ-লাভ। সেই পরম অভীষ্ট সাধনের প্রধান উপায় সত্ত্বভাব। যাঁর হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজিত হয়েছে, তিনি নিজের মধ্যে সত্ত্বভাবময় সেই পরমপুরুষের অনুভূতি লাভ করতে সমর্থ হন। এই অনুভূতি সাধক-জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সত্ত্বভাব সকল অভীষ্ট লাভের সহায়ভূত বলে সাধকেরা সত্ত্বভাব-প্রাপ্তির জন্য যত্নপরায়ণ হন। সাধকদের এই প্রচেষ্টার বিষয়ই মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে]।

১৭/৩– অমৃতপ্রাপক সৃষ্টির আদিভূত সত্ত্বভাব সাধকদের পবিত্র হৃদয় উপজিত হন, এবং জ্ঞান। প্রদান করে দেবভাব উৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -পবিত্রহৃদয় সাধক জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [যার হৃদয় নির্মল পবিত্র, তার হৃদয়েই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব উপজিত হয়। এই সত্ত্বভাবের সহচর জ্ঞান। তাই যিনি সত্ত্বভাব লাভ করেন, তার হৃদয়ে জ্ঞানও উপজিত হয়। তাই বলা হয়েছে– সত্ত্বভাব জ্ঞান প্রদান করেন। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– পুরাণ রসবিশিষ্ট সোম পবিত্রে সিক্ত হচ্ছেন এবং শব্দ করে দেবগণকে উৎপন্ন করছেন। দেবগণের পানীয় মাদকদ্রব্য সোম কেমন ভাবে দেবগণকে উৎপাদন করবে, বোধগম্য হয় না। ভাষ্যকার এইজন্য একটু যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। উৎপন্ন ক্রিয়াকে রূপক বলেছেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যাও খুব সন্তোষজনক নয়। ক্রন্দং পদে আমরা জ্ঞান প্রদান করেভাব গ্রহণ করেছি। শব্দ-ব্রহ্ম, শব্দ-জ্ঞান। আমরা এই দৃষ্টিতেই ঐ পদে পূর্বাপর জ্ঞানং প্রযচ্ছন অর্থ গ্রহণ করেছি]।

১৮/১– পবিত্রকারক হে দেব! আপনি প্রার্থিত বস্তুসমূহ আমাদের প্রদান করুন; রিপুগণের মধ্যে ভয় স্থাপন করুন। (ভাব এই যে, আমাদের রিপুজয়ী করুন। আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পরমধন মোক্ষ প্রদান করুন)। [ভগবান্ মানুষকে রিপুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারেন] তার কাছে মানুষ একান্তভাবে যা প্রার্থনা করে, বিশ্বমঙ্গলনীতির পরিপন্থী না হলে সে তা প্রাপ্ত হয়। তাই তার চরণেই আকাঙক্ষনীয় বস্তু লাভ করবার জন্য প্রার্থনা নিবেদন করা হয়েছে। প্রচলিত কোন কোন ব্যাখ্যার সাথে অনেকস্থলে আমাদের মতবিরোধ আছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে পবমান সোম! যারা দূরে উপস্থিত রয়েছে, তাদের সমীপবর্তী করো, শত্রুগণের ভয় উৎপন্ন করো, তাদের ধন অবগত হও। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১৮/২– সৎকর্মের ও সম্ভাবের দ্বারা পূর্ণবিকশিত, সৎকর্মসঞ্জাত, অমৃতসদৃশ, রিপুনাশক, বিশুদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা সুসংস্কৃত, সত্ত্বভাবকে দেবভাবসম্পন্ন সাধকগণ প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, দেবভাবান্বিত ব্যক্তিগণ সৎকর্মের সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [দেবভাব ও সত্ত্বভাবের মধ্যে অতি নিকট সম্বন্ধ বর্তমান একটি আবির্ভাবে অন্যটির উপস্থিতি প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। যারা নিজের হৃদয়কে পবিত্র করতে পেরেছেন তারাই সত্ত্ব-সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হতে পারেন। পরাজ্ঞান তখন তাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়। এই জ্ঞানালোকের সাহায্যে অতি সহজেই তারা নিজেদের গন্তব্য-পথ নির্দেশ করতে পারেন। জ্ঞানের তীব্র আলোকে অজ্ঞানান্ধকার পলায়ন করতে বাধ্য হয়। সুতরাং আঁধারলোকবাসী রিপুগণও সেই সঙ্গে অন্তর্হিত হয়। পরিণামে সাধক অমৃতত্ব লাভ করেন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেরও ৫অ-৩দ-১সা-তে) দেখা যায়]।

১৮/৩– সৎকর্মের নেতা হে মম চিত্তবৃত্তিসমূহ! দেবভাবপ্রাপক, পবিত্রকারক, প্রসিদ্ধ সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করো। ভাব এই যে– আমি যেন সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই) [এই মন্ত্রটি উত্তরার্চিকেরই ১অ-১দ-১সূ-১সা-রূপে দেখা যায়]। [১৭ ও ১৮ সূক্তের অন্তর্গত ছটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম-শ্রুধ্যম, প্রতীচিনে, যজ্ঞাযজ্ঞীয়ম, সফস্]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ১৯– প্র সোমাসো বিপশ্চিতেহপো নয়ন্তঃ ঊর্ময়ঃ। বনানি মহিষা ইব৷৷ ১৷৷ অভি দ্রোণানি বুভ্রবঃ শুক্রা ঋতস্য ধারয়া। বাজং গোমমক্ষর৷৷ ২৷৷ সুতা ইন্দ্রায় বায়বে বরুণায় মরুদ্ভয়ঃ। সোমা অর্ষন্তু বিষ্ণবে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২০– প্র সোম দেববীতয়ে সিন্ধুর্ন পিপ্যে অর্ণসা। অংশেঃ পয়সা মদিনো ন জাগৃবিরচ্ছা কোশং মধুশ্রুত৷ ১। অ হর্যতো অৰ্জুনো অৎকে অব্যত প্রিয়ঃ সুনুন মর্জঃ। তমীং হিন্বন্ত্যপসো যথা রথং নদী গভস্ত্যোঃ৷ ২৷৷

সূক্ত ২১– প্র সোমাসো মদচ্যুতঃ শ্রবসে নো মঘোনা। সুতা বিদথে অমুঃ৷৷ ১৷৷ আদীং হংসো যথা গণং বিশ্বস্যাবীবশতন্মতি। অত্যো ন গোভিরজ্যতে ॥ ২॥ আদীং ত্রিতস্য যোষণো হরিং হিন্বন্ত্যদ্রিভিঃ। ইন্দুমিল্লায় পীতয়ে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২২– অয়া পবস্ব দেয়ু রেভপবিত্রং পর্যেষি বিশ্বতঃ। মধোধারা অসৃক্ষত৷৷ ১৷৷ পবতে হতো হরিরতি হুরাংসি রংহ্যাঁ। অভ্যর্ষ স্তোতৃভ্যো বীরবদ যশঃ৷ ২৷৷ প্র সুব্বানায়াহ্মসো মর্তো ন বষ্ট তদ্বচঃ। অপ শ্বানরাধসং হতা মখং ন ভৃগবঃ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ—  ১৯সূক্ত /১সাম– (জলের) ঊর্মিমালা যেমন আপনা-আপনি উদ্ভূত হয়, অথবা। বনসমূহ যেমন আপনা-আপনিই প্রবৃদ্ধ হয়ে থাকে, তেমনই পরাজ্ঞানসম্পন্ন আত্ম-উৎকর্ষসাধনশীল সাধকদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব আপনা হতেই উদ্ভূত হয়ে থাকে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভাব এই যে, — আত্ম-উৎকর্ষের প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্ব আপনা-আপনিই সঞ্জাত হয়)। অথবা, -মহিমান্বিত সাধক যেমন জ্যোতিঃ প্রাপ্ত হন অথবা পশুগণ যেমন স্বভাবতঃ বনে গমন করে থাকে, তেমনই অমৃতের প্রবাহস্বরূপ পরাজ্ঞানদায়ক সত্ত্বভাবসমূহ, আমাদের হৃদয়ে আগমন করুক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — প্রভূতপরিমাণে সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক)। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ ২দ-২সা) দ্রষ্টব্য]।

১৯/২– মহান্ (অথবা জগৎপালক) দীপ্ত সত্ত্বভাব জ্ঞানযুত আত্মশক্তি প্রদান করে অমৃতের ধারারূপে সাধকদের হৃদযকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকগণ অমৃতময় সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [সত্ত্বভাব যেখানে, জ্ঞানও সেখানে। জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞানিগণের হৃদয় জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত থাকায় তারা ভীষণ রিপুগণকে পরাজিত করতে সমর্থ হন। জ্ঞানের দীপ্ত রশ্মিতে তারা অভীষ্ট লাভের প্রকৃত উপায় নির্দেশ করতে পারেন; এবং আত্মশক্তিবলে সেই উপায় অনুযায়ী সাধনেও প্রবৃত্ত হতে পারেন। তাই বলা হয়েছে-সত্ত্বভাব জ্ঞানযুত আত্মশক্তি প্রদান করে……..হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। জ্ঞান ও সত্ত্বভাবের একত্র সম্মিলনেই অমতের উৎপত্তি। সাধক সেই অমৃতলাভে সমর্থ হন]।

১৯/৩– বলাধিপতি দেবতাকে, আত্মমুক্তিদায়ক দেবকে, অভীষ্টবর্ষক দেবতাকে, বিবেকরূপী দেবগণকে, জগৎপালক দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য আমরা যেন সত্ত্বভাব লাভ করি)। [আপাতঃদৃষ্টিতে মন্ত্রে বহু দেবতার উল্লেখ আছে বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এক পরমপুরুষেরই মাহাত্ম্য বিভিন্ন ভাবে প্রখ্যাত হয়েছে। তিনিই জগৎকে পালন করছেন। তিনিই কৃপাপূর্বক মানুষের মুক্তিবিধান করেন। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। মন্ত্রের মধ্যে সেই একমেব অদ্বিতীয়ং পরম পুরুষকেই ইন্দ্র (অর্থাৎ ভগবানের বলাধিপতিরূপ বিভূতি), বায়ু (অর্থাৎ ভগবানের আশুমুক্তিদায়ক বিভূতি), বরুণ (অর্থাৎ ভগবানের অভীষ্টবর্ষক বিভূতি), মরুৎগণ (অর্থাৎ ভগবানের বিবেকরূপী বিভূতিসমূহ), বিষ্ণু (অর্থাৎ ভগবানের জগৎপালক বিভূতি) ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। যে সাধক যে ভাবের ভাবুক, তিনি ঈশ্বরের সেই ভাবের প্রকাশকেই বরণ করেন। বোঝাই যাচ্ছে, — যিনি আশুমুক্তি প্রার্থনা করেন, তিনি বায়ুরূপের; যিনি শক্তিকামী, তিনি ইন্দ্ররূপের উপাসনা করেন, ইত্যাদি। মন্ত্র এই বিভিন্ন ভাবেরই দ্যোতনা করছেন]। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দশটি গেয়গান আছে। যথা, -আশ্বম্, সোমসাম, আশুভার্গবম জরাবোধীয়ম রৌহিতকুলীম ইত্যাদি]।

২০/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব (সোম)! সমুদ্র যেমন জলের দ্বারা সমস্ত পূর্ণ করে, তেমনই তুমি ভগবানের ৮ আরাধনার জন্য অমৃতের দ্বারা আমাদের পূর্ণ করো; চৈতন্যস্বরূপ পরমানন্দদায়ক তুমি নিত্যকাল জ্ঞানামৃতের সাথে অমৃতধারণসমর্থ আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয় সত্ত্বভাবে পূর্ণ হোক)। [এই সামমন্ত্রটি চার্চিকেও (৫অ-৫দ-৪সা) প্রাপ্তব্য। সেখানে মর্মার্থ বিশ্লেষিত হয়েছে]।

২০/২– প্রিয়পুত্র তুল্য পবিত্র প্রার্থনীয় বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব বিচিত্র অমৃতের প্রবাহে সম্মিলিত হন; সত্ত্বভাব যেমন সৎকর্মরূপ যানকে প্রাপ্ত হন, তেমনই জ্ঞানকিরণসমূহ সত্ত্বভাবকে নিশ্চিতরূপে সাধকদের হৃদয়ে প্রেরণ করেন। (ভাব এই যে, সত্ত্বভাব জ্ঞান ও কর্ম পরস্পর সম্মিলিত হয়; সাধকগণ সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [পুত্র মানুষের অত্যন্ত প্রিয়। তাই সেই পরমবস্তুর প্রার্থনীয়তা প্রখ্যাপন করবার জন্য সত্ত্বভাবের সাথে পুত্রের তুলনা দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু সংসারী মানুষ পুত্রকে পুন্নামক নরক থেকে উদ্ধারের ও স্বর্গপ্রাপ্তির উপায়স্বরূপ মনে করেন। সাধারণ প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, — পুত্র জন্ম গ্রহণ না করলে পিতার মুক্তিলাভ ঘটে না। সেইজন্যও পুত্র মানুষের এত প্রিয়। তাই সত্ত্বভাবকে সেই প্রিয় ও পরিত্রাণকারক পুত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। — সত্ত্বভাব, জ্ঞান ও সর্ম সমস্তই একসূত্রে গ্রথিত। একটি লাভ হলে অন্য দুটিও মানুষ সাধনবলে সহজেই লাভ করতে পারে। মন্ত্রের শেষাংশে তাদের এই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধই সূচিত হয়েছে। [এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত বারোটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– যৌধাজয়, বজ, অভীবর্ত, গৌগবম ইত্যাদি]।

২১/১– পরমানন্দদায়ক পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব সৎকর্মসাধনশীল আমাদের সৎকর্মসাধনে সিদ্ধিপ্রদানের জন্য আমাদের প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সৎকর্মের সাধনে সিদ্ধিলাভের জন্য আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বকে প্রাপ্ত হই)। [এই মন্ত্রে সত্ত্বভাব প্রাপ্তির দ্বারা সৎকর্ম সাধনে সিদ্ধিলাভ করবার প্রার্থনা আছে। সিদ্ধিলাভ– অর্থাৎ মোক্ষলাভ। তাই সেই মোক্ষ বা পরাগতি প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব লাভের প্রার্থনা। — মদচ্যুতঃ পদে পূর্বাপর সঙ্গতি রক্ষা করে আনন্দদায়কঃ অর্থ গৃহীত হয়েছে। মঘঘানা পদে ভাষ্যে হবিষ্মতা অর্থ দৃষ্ট হয়। সৎকর্মসাধনই প্রকৃষ্ট হবিঃ। তাই ঐ পদে সৎকর্মসাধনশীলনাংঅর্থই সঙ্গত। এবসে– সিদ্ধিলাভের জন্য। কারণ কর্মে সফলতা লাভ করলেই খ্যাতি ও প্রাসদ্ধি লাভ হয়। বিদথে পদে সৎকর্মের সাধনে অর্থই সঙ্গত]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-২দ-১সা) প্রাপ্তব্য]।

২১/২– আশুফলদায়ক সৎকর্ম যেমন জ্ঞানকিরণের সাথে মিলিত হয়, সারগ্রাহী জন যেমন সাধুসঙঘকে প্রাপ্ত হন, তেমনই জ্ঞান সকল স্তোতৃগণের বুদ্ধিকে নিশ্চিত প্রাপ্ত হয়। (ভাব এই যে, — প্রার্থনাপরায়ণ সাধক সৎকর্মসমন্বিত জ্ঞান লাভ করেন)। [মন্ত্রের মধ্যে দুটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম সারগ্রাহী ব্যক্তিগণ হংসের ন্যায় অসার বস্তু পরিত্যাগ করে প্রকৃত মঙ্গলজনক বস্তু গ্রহণ করেন। হংস পদে তাই সারগ্রাহী সাধককে লক্ষ্য করে। দ্বিতীয় জ্ঞান ও কর্মের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে। সৎকর্মের ফলে সাধক জ্ঞানলাভ করেন। সেই জ্ঞান সাধকের বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিচালিত করে। যারা প্রার্থনা পরায়ণ, যাঁরা সৎকর্মান্বিত, তাদের উভয় শ্রেণীর সাধকই পরাজ্ঞান লাভ করে ধন্য হন। সৎকর্মের ফলে যেমন জ্ঞানলাভ হয়, প্রার্থনার দ্বারাও সেইরকমভাবে জ্ঞানলাভ করতে পারা যায়। প্রার্থনাও মানুষকে মোক্ষপথে সংস্থাপিত করে থাকে। মন্ত্রের মধ্যে এই ভাবই প্রকাশিত মা হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ভাষ্যের ভাব এই যে, — সোম অশ্বের ন্যায় গব্যদ্রব্যের দ্বারা স্নিগ্ধ হয়। অন্য এক ব্যাখ্যাকার অতো ন পদ দুটির অর্থ পরিত্যাগ করেছেন, যথা– হংস যেমন জলমধ্যে প্রবেশ করে, সোম তেমনই সমস্ত স্তোতাগণের মনকে বশ করে। এই সোম গব্য দ্বারা স্নিগ্ধ হয়।– মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

২১/৩– ত্রিগুণসাম্যাবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তির অধিগত অর্থাৎ তার দ্বারা প্রাপ্ত যে সত্ত্বভাব, সৎকর্মসাধনকারী ব্যক্তি, বলাধিপতিদেবতার নিশ্চিতরূপে গ্রহণের জন্য, সেই পাপহারক সত্ত্বভাবকে কঠোর সাধনের দ্বারা হৃদয়ে উৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধক কঠোর সাধনের দ্বারা ভগবৎপ্রাপক সত্ত্বভাব লাভ করেন)। [যিনি সাধনবলে ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন, তার হৃদয়ে অবিমিশ্র বিশুদ্ধতম শুদ্ধসত্ত্ব বিরাজিত, তিনিই জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ। তিনিও মানুষ বটে, তবে সেই মানুষের মধ্যে দেবত্ব সম্পূর্ণভাবে প্রকটিত। অন্যান্য লোকও সাধনবলে সেই অবস্থা লাভ করতে পারে। সেই সাধকের বিষয়ই মন্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে। সত্ত্বভাব-প্রাপ্তি মোক্ষসাধনের হেতু। ভগবানের পূজার শ্রেষ্ঠ উপচার হৃদয়ের সত্ত্বভাব। ভগবান্ সাগ্রহে তা-ই গ্রহণ করেন। ফুলচন্দন ইত্যাদি ভগবানের আরাধনার বাহ্যিক উপায় মাত্র। সাধকগণ কঠোর সাধনার দ্বারা, সৎকর্ম সম্পাদনের দ্বারা, এই পরম মঙ্গলজনক বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব লাভ করবার চেষ্টা করেন এবং ভগবানের কৃপায় তা লাভ করতেও সমর্থ হন। মন্ত্রে এই সত্যই প্রকাশিত হয়েছে]। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম– সংহিতম ও আশুভার্গবম]।

২২/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সাধকদের পবিত্র হৃদয়কে সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হন; দেবত্বপ্রাপক আপনি জ্ঞানপ্রদানপূর্বক পবিত্র ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোন এবং অমৃতের প্রবাহ হৃদয়ে সৃজন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সত্ত্বভাব প্রদান করুন। সত্ত্বভাব সাধকদের হৃদয়ে উপজিত হয়। দেবত্বপ্রাপক সেই সত্ত্বভাবকে লাভ করবার জন্য মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটির অন্যভাব লক্ষিত হয়। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তুমি এই ধারার আকারে ক্ষরিত হও। তোমার মধুপূর্ণ ধারা সমস্ত প্রস্তুত হচ্ছে। তুমি চতুর্দিকে শব্দ করতে করতে পবিত্র অতিক্রম করছ। মন্ত্রের ব্যাখ্যার প্রথমেই সোমরসের কল্পনা করা হয়েছে। সুতরাং মন্ত্রের সমস্ত ব্যাখ্যাই সেইমতো কল্পিত হয়েছে। এই ব্যাখ্যায় দেবয়ুঃ পদের অর্থ প্রদত্ত হয়নি। অন্যান্য বিষয়ও মূলানুগত বা ভাষ্যের অনুগত হয়নি। অবশ্য আমাদের মত ভাষ্য বা প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদি থেকে স্বতন্ত্র]।

২২/২– হে ভগবন! পরম আকাঙক্ষণীয় পাপহারক সত্ত্বভাব ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের কুটিল হৃদয়কে প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, আমরা যেন পাপনাশক সত্ত্বভাব লাভ করি। হে দেব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের আত্মশক্তিদায়ক সকীর্তি অর্থাৎ সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের কৃপায় আত্মশক্তি এবং সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য লাভ করি)। [মানুষ কর্ম করতে পারে বটে; কিন্তু ফললাভ ভগবানের কৃপার উপর নির্ভর করে। সৎকর্ম সাধনের দ্বারা মোক্ষলাভে অগ্রসর হওয়া যায় সত্য; কিন্তু সেই সৎকর্ম সম্পাদনের শক্তিলাভ সকলের ভাগ্যে ঘটে না। ভগবানের কৃপা হলে তবেই মানুষ সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারে। চারদিকে যে ভীষ রিপুকুল রয়েছে, মানুষের অন্তরেও কাম-ক্রোধ ইত্যাদি যে সব রিপুদল রয়েছে, তাদের জয় করতে পারলে তবেই অনায়াসে সৎপথে– মোক্ষমার্গে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। একমাত্র ভগবানের কৃপাতেই তা সম্ভবপর। তাই ভগবানের কাছে সৎকর্ম সম্পাদন করবার যথোপযুক্ত শক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসের কল্পনা থাকলেও কোনও কোনও অংশে মূলভাব রক্ষিত হয়েছে। যেমন– অতি চমৎকার ঔজ্জ্বল্যধারী সোম দ্রুতবেগে কুটিল পবিত্রের মুখ দিয়ে ক্ষরিত হচ্ছেন। তারা যাকে স্তব করেন, তাদের তিনি লোকবল ও কীর্তি প্রদান করছেন। মন্ত্রের শেষাংশের ব্যাখ্যার সাথে আমাদের ব্যাখ্যার মূলভাবগত বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১০দ-১১সা) প্রাপ্তব্য]। [এই মন্ত্রটির তিনটি গেয়গান আছে]।

২২/৩– সাধক যেমন বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব সম্বন্ধীয় জ্ঞান গ্রহণ করেন এবং সাধকগণ যেমন সৎকর্ম সম্পাদন করেন, তেমনই, হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা সাধনবিঘ্নকারী রিপুদের বিনাশ করো, অর্থাৎ বিনাশ করে জ্ঞানসম্পন্ন এবং সৎকর্মসাধনরত হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন সঙ্কর্মান্বিত এবং সৎ-জ্ঞানসম্পন্ন হই)। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৮দ-৯সা) প্রাপ্তব্য]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম আক্ষার, গৌরীবিতম, সুজ্ঞানং, কাশীজম্ এবং পৌষ্বলম]।

দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *