অজেয় দুর্গ
১০১৪ হিজরী সনের শেষ ভাগের ঘটনা। ঝিলম নদীর তীরবর্তী পাহাড়ের ঢালে সাধারণ একটি দুর্গে সুলতান মাহমুদের কিছুসংখ্যক সৈন্য অবস্থান করছিল। পাঞ্জাবের মহারাজ ভীমপালকে পরাজিত করে সুলতান মাহমূদ এ দুর্গ তার অধীনে নিয়ে এসেছিলেন। পাঞ্জাবের বিজিত এলাকায় সুলতান মাহমূদ তার নিজস্ব শাসনব্যবস্থা চালু করতে পারেননি। কারণ, গযনীতে গণ্ডগোল দেখা দেয়ায় তাকে তড়িঘড়ি করে গয়নীতে ফিরে যেতে হয়েছিল। পা বের পরাজিত মহারাজার সাথে সুলতানের কৃতচুক্তি অনুযায়ী তিনি পাঞ্জাবের যে কোন স্থানে তার সেনাবাহিনীর দু’-একটি শিবির স্থাপনের ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। চুক্তি মোতাবেক সেনাদের সর্বময় খরচ ভীমপালের বহন করার কথা ছিল।
বালনাথ দুর্গে সুলতান মাহমূদের সৈন্যদের অবস্থান কয়েক মাস হয়ে গেল। মাকরানের অধিবাসী সারওয়াগ নামের ডেপুটি সেনাপতি ছিলেন বালনাথের দুর্গপতি। হঠাৎ একদিন বালনাথ দুর্গে দু’জন অশ্বারোহী এলো। আগন্তুকদের একজন একটি মসজিদের ইমাম আর অপরজন গযনী বাহিনীর একজন সৈনিক। তারা কাশ্মীরের সীমান্ত এলাকা থেকে এসেছে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসায় তারা ছিল পরিশ্রান্ত। তাদের চেহারা ধুলোবালি মাখা আর শীতের তীব্রতায় ঠোঁট ফেটে চৌচির।
তাদের চেহারা ছবিই বলে দিচ্ছিল, তারা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে এবং পথিমধ্যে কোন বিশ্রাম ও পানাহার করেনি। এরা বালনাথ দুর্গে এসেই দুরক্ষক সরওয়াগের কাছে চলে এলো।
“আপনারা খুবই ক্লান্ত। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন, এরপর আমি আপনাদের কাছ থেকে ওখানকার খোঁজ খবর জানবো।”
“ওখানকার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তার চেয়ে আমাদের চেহারা মোটেও খারাপ হয়নি সম্মানিত দুর্গপতি।” বললেন আগন্তুক ইমাম।
“তাই! কী হয়েছে। হিন্দুরা কি আমাদের লোকজনকে বন্দী করে রেখেছে। উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন সারওয়াগ! হিন্দুরা কি আপনাদেরকে ইসলামের প্রচার কাজে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে? সুলতানের নির্দেশ বাস্তবায়নে হিন্দুরা আপনাদেরকে বাধা দিচ্ছে?”
“না, এমন কিছুই হয়নি। আমি বাধ্য হয়েই এই সিপাহীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। সে ঘটনা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে।… আমি নিজেও সৈনিক, শুধু ইমাম নই। আপনার এমনটি ভাববার অবকাশ নেই যে, আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছি। কাশ্মীর যাদুগরদের স্বর্গরাজ্য। এছাড়া ওখানে এক প্রকার অস্বাভাবিক অদৃশ্য শক্তি রয়েছে, যারা মানুষকে নানাভাবে ধোকা দেয়। এই অস্বাভাবিক শক্তি জিনও হতে পারে, মানুষের প্রেতাত্মাও হতে পারে।” বললেন ইমাম।
“মনে হচ্ছে, আপনারা হিন্দুদের যাদুটোনার শিকার হয়েছেন। বললেন দুর্গপতি সারওয়াগ। আপনি যা বলছেন, এসব কথা এতো সহজে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। সুলতান ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বহু যাচাই-বাছাই করে দুর্গপতির দায়িত্বে নিযুক্ত করেছেন। তাকে আমার সম্পর্কে বলা হয়েছিল, সেনাপতি সারওয়াগ কুসংস্কার ও অপপ্রচারে প্রভাবিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার মতো ব্যক্তি নয়। আপনি হিন্দুস্তানে জন্মগ্রহণকারী মানুষ। হিন্দুদের নানা কুসংস্কার ও ভৌতিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী পরিবেশে বড় হয়েছেন। অথচ এখন আপনি মুসলমানদের ইমাম। একজন ইমামকে অবশ্যই বাস্তববাদী ও দূরদর্শী হওয়া উচিত। কারণ, আপনি সমাজের পরিচালক। সাধারণ মানুষ আপনাকে অনুসরণ করবে।
“সম্মানিত দুর্গপতি! এতদূর থেকে নাওয়া-খাওয়া, ঘুম-বিশ্রাম ত্যাগ করে অবিরাম সফর করে আপনার কাছে ছুটে এসেছি, আপনাকে বুঝতে হবে ব্যাপারটি সাধারণ কোন ঘটনা নয়। আপনার পক্ষে ঘটনার ভয়াবহতা কল্পনা করাও কঠিন। তাই আপনি আমার সবকথা শোনার আগেই বলে দিয়েছেন আমি বাস্তববাদী নই। বললেন ইমাম।
আমি একথা এজন্য বলেছি যে, আপনারা ওখানকার ঘটনা বলতে গিয়ে যাতে আবেগাপ্রবণ হয়ে বাড়িয়ে না বলেন।” বললেন দুর্গপতি। যা হোক, এখন আপনি যা বলতে চাচ্ছিলেন বলুন।
“প্রকৃতিগতভাবেই কাশ্মীর এমন শোভামণ্ডিত অঞ্চল যে, মনে হয় কাশীর দুনিয়ার কোন ভূখণ্ড নয়, যেন এটা মানুষ নয়- জিন্নাতের আবাসস্থল। কখনো মনে হয়, এ ভূখণ্ড হয়তো মর্তের মানুষের আবাসস্থল নয়, এখানে ওইসব মানুষের রুহেরা বাস করে, যারা সবাই জান্নাতী।” বললেন ইমাম।
‘রূহ আল্লাহ তায়ালার একটি আমানত। মানুষ মরে গেলে রূহ আল্লাহর দরবারে চলে যায়। বললেন, দুর্গশাসক সারওয়াগ। কোন রূহ জমিনে বসবাস করে না। আপনি কল্পনা আর স্বপ্নের কথা বলবেন না সম্মানিত ইমাম। আসলে আপনি ওখানে কী দেখে এসেছেন, হুবহু সেই কথা বলুন।
“আমরা ওখানে গিয়ে মানুষকে ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে অবহিত করছিলাম। আমরা তাদেরকে নামায পড়াতে শুরু করি এবং মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে তাদের জানাতে থাকি। এ কথাও বুঝাতে চেষ্টা করেছি, আল্লাহর সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক কী? ওখানকার লোকজন সুলতানের নির্দেশে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল বটে; কিন্তু আমরা তাদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিলে তারা মনে প্রাণে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে।
কিছুদিন পর সেখানে রাতের বেলায় বিস্ময়কর এক আলোর ঝলকানী দেখা দেয়। অথচ তখন আসমানে না কোন মেঘ ছিল, না বৃষ্টি-বাদলের লক্ষণ ছিল। আমি যে গ্রামে ছিলাম এক পর্যায়ে ওই গ্রামেও অদ্ভুত বিজলী দেখতে পাওয়া যায়। একদিন রাতের বেলায় সেই গ্রামের মাঠে ঘোড়া দৌড়ানোর আওয়াজ শোনা যায়। এমন নয় যে, আওয়াজটি কাছে থেকে শুরু হয়ে দূরে মিলিয়ে যেত, বরং কাছে থেকেই আওয়াজটি শোনা যেত এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তা হারিয়ে যেত।
একদিন দিনের বেলায় কাঠুরিয়া লোকজন জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহে গেলে তারা জঙ্গলের মধ্যে নারীকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে এলো। তারা এসে এই খবর শোনালে অন্য লোকজন জঙ্গলে কোন বিপদাপন্ন নারীর কান্না কি-না তা যাচাই করতে গিয়ে কোন জনমানুষের অস্তিত্বই জঙ্গলে খুঁজে পায়নি।
একদিন রাতের বেলায় বিপন্ন নারীকণ্ঠের কান্না শোনা গেল। নারীর কান্না থেমে যাওয়ার পর জলদগম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো… ‘দেব-দেবীদের অভিশাপ পতিত হবে… পাহাড় ফেটে যাবে… বনে আগুন জ্বলবে… সাবধান! দেব-দেবীদের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের অসন্তুষ্ট করো না।
ইমাম আরো বললেন, এসব কথা শুনে আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, দেবদেবীদের কোন অস্তিত্ব নেই, এসব দেখে তোমাদের ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তোমরা সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করবে। কিন্তু বুঝতে পারলাম, আমার আশ্বাসবাণীতে তারা আশ্বস্ত হতে পারছে না। এই ঘটনার চার/পাঁচ দিন পর পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে চারজন লোক ভীত-বিহ্বল অবস্থায় আমাদের গ্রামে এলো। তারা এসে জানাল, তাদের গ্রাম সংলগ্ন একটি পাহাড় কেটে গেছে। ফাটা পাহাড় থেকে একটু পর পর আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। মাঝে মধ্যে ভেঙ্গে পড়ছে পাহাড়ের অংশবিশেষ। ভাঙ্গা পাহাড়ের আশপাশে অদ্ভুত আকৃতির মানুষের আনাগোনা তারা দেখতে পেয়েছে।
এসব ভীতিকর কাহিনী শুনে আমার গ্রামের লোকজন এতটাই ভীত হয়ে পড়ল যে, তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে গেল। আমি যতই তাদের কিছু হবে না বলে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করি; কিন্তু তারা ততই ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমি গ্রামের মুরুব্বীদের বোঝাতে চেষ্টা করি, যা শোনা যাচ্ছে, এগুলো হিন্দু যোগী সন্ন্যাসীদের কারসাজী। এরা সাধারণ লোকজনকে ইসলাম গ্রহণ থেকে ফেরানোর জন্য এসব যাদুটোনা করছে।
সম্মানিত দুর্গশাসক! আমি যতই আশ্বাসবাণী শোনাই না কেন, কিছু ঘটনা আসলে এমনও ঘটেছে, যেগুলোর কোন ব্যাখ্যা নেই। কোন অবস্থাতেই এগুলোকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেমন ধরুন, রাতের বেলায় পরিষ্কার মেঘহীন আকাশে বিজলী চমকানোর বিষয়টি মানুষকে বোঝানো মুশকিল। মানুষকে কি বোঝাবো, আমার নিজের কাছেই এই বিষয়টির কোন ব্যাখ্যা নেই। তাছাড়া আরো এমন ঘটনাও ঘটেছে, এ সৈনিকের মুখে আপনি তা শুনুন।
“আমাদের সেনাচৌকির অবস্থান নদীর পাড়ে।” বললো সৈনিক। হঠাৎ এক রাতে আমরা নারীকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। একাধিক নারীর কান্নার আওয়াজ শুনে চৌকির কমান্ডার যুবায়ের সাহেব আমাকে এবং অপর একজন সিপাহীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যেদিক থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এসেছিল, আমরা সেদিকে অগ্রসর হলে আওয়াজ থেমে গেল। অপর দিক থেকে দু’জন পুরুষকে আমরা আসতে দেখলাম। কমান্ডার যুবায়ের জামালী তাদের জিজ্ঞেস করলেন, নারীকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ কোন দিক থেকে এসেছে? তারা জানালো, কোন নারীর কান্নার আওয়াজ তারা শোনেনি।
ঠিক সেই সময় নারীদের কান্নার আওয়াজ আবার শোনা গেল। কমান্ডার তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এই তো কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এই মহিলারা কারা? তারা বললো, কোথায়, আমরা তো কারো কান্নার আওয়াজই শুনছি না? আমরা বিস্মিত হলাম, যে আওয়াজ আমরা দিব্যি শুনতে পাচ্ছি, একই আওয়াজ অন্যেরা শুনতে পাচ্ছে না কেন?
সেই দুই ব্যক্তি আমাদের জানালো, এই এলাকায় মাঝে মধ্যে দুজন তরুণীকে দেখা যায়। যারাই দেখতে পায়, তাদেরকেই ওরা কাছে যেতে ডাকে, কিন্তু কাছে গেলে আর ওদের পাওয়া যায় না। তরুণীরা অদৃশ্য হয়ে যায় । লোক দু’জন আরো কিছু কথা বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কমান্ডার জামালী আর কথা না বাড়িয়ে আমাদের নিয়ে চৌকিতে ফিরে এলেন। পরদিন সন্ধার পর যুবায়ের জামালী আমাকে ও অপর এক সাহসী সৈনিককে সাথে নিয়ে বের হয়ে বললেন, তিনি গতরাতের কান্নার রহস্য উদ্বাটন করতে চান। আমাদের চৌকির ধারে-কাছে কোন জনবসতি ছিল না। গোটা এলাকাটি ছিল খুবই সুন্দর। আমরা দুটি টিলাসম পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একটি পাহাড়ের ঢালে আমরা দু’জন তরুণীকে দেখতে পেলাম। ওদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আসমানী রঙের এমন পাতলা কাপড় জড়ানো ছিল যে, ওদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো দূর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তরুণীদ্বয়ের মাথা ছিল খোলা, তাদের চুলগুলো ছিল আজানু প্রলম্বিত। ওরা পরস্পর কথা বলছিল আর আমাদেরকে ইশারায় কাছে যেতে আহ্বান করছিল। ওরা যেখানটায় দাঁড়ানো ছিল, সেই জায়গাটি ছিল অসম্ভব সুন্দর। চারদিকে ঘন ঘাস আর বাহারী রঙের লতাগুল্ম ও সুশোভিত ফুলগাছের ঝোঁপঝাড়। জায়গাটি ঘন গাছ গাছালীতে ভরা ছিল। গাছের ডালপালা পরস্পর মিলেমিশে পুরো জায়গাটায় ছাতার মতো আচ্ছাদন তৈরী করেছে। সূর্যের আলো ঘনগাছের পত্রপল্লব ভেদ করে মাটিতে পৌঁছাতে পারতো না। দাঁড়ানো দু’জনকে মনে হচ্ছিল এই প্রাকৃতিক পরিবেশেরই যেন অংশ। দুই তরুণীকে দাঁড়ানো দেখে আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। তরুণীদ্বয় তাদের অবস্থানেই দাঁড়িয়ে রইল। কমান্ডার যুবায়ের জামালী বললেন, তিনি সামনে এগিয়ে যাবেন। আমরা তাকে বাধা দিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের বাধা মানলেন না। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম. তরুণী দু’জনের একজন হাতের ইশরায় যুবায়ের জামালীকে কাছে ডাকল। আমাদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কমান্ডার এগিয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি তরুণীদের কাছে যাওয়ামাত্রই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
সে কি বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল? দুর্গশাসক সারওয়াগ জানতে চাইলেন।
“না, বাতাসে মিলিয়ে যায়নি- খুব দ্রুত জমিনে তলিয়ে গেল। বললো সিপাহী।
“আমরা তাকে জমিনে তলিয়ে যেতে দেখে যখন তরুণীদের দিকে তাকালাম, তখন আর তরুণীদ্বয়কে ওখানে দেখতে পেলাম না। এই অবস্থা দেখে আমরা ভয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এলাম। এই ব্যক্তি আমাদের এলাকার ইমাম। আমরা এসে তাকে এই ঘটনা জানালাম। মনে হলো, ইনি এসব ঘটনায় আগে থেকেই ভীত।”
“আমার জীবন নিয়ে আমার কোন ভয় নেই। আমার ভয় হচ্ছে, ইতোমধ্যে আমরা যেসব লোককে ইসলামে দীক্ষিত করেছি, তারা আবার ইসলাম থেকে পৌত্তলিকতায় ফিরে যাবে।” বললেন ইমাম।
ওখানকার অধিবাসীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তারা যেহেতু হিন্দুত্ব ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাই তাদের উপর দেবদেবীদের গযব আপতিত হচ্ছে। এজন্যই তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য আসমানী মাখলুক জমিনে নেমে এসেছে।”
চৌকির সৈন্যদের মধ্যেও এই ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, সুলতান এখানে ক্ষমতাবলে মানুষকে ইসলাম গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন, এজন্যই এসব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে। বললো সৈনিক। কমান্ডার যুবায়ের জামালীর জমিনে দেবে যাওয়ার ঘটনাটি এমনই প্রভাব সৃষ্টি করেছে যে, যেই শোনে, তার চেহারাই বিবর্ণ হয়ে যায়। চৌকির সকল সৈন্যই এখন নানা সংশয় ও কুসংস্কারে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে।”
“তোমাদের মধ্যে কি এমন সাহসী কেউ ছিল না যে কমান্ডার যে জায়গায় জমিনে দেরে গেছে, সেই জায়গাটিতে গিয়ে বিষয়টির কারণ অনুসন্ধান করবে? পাহাড়ী এলাকায় ঘাস ও ঝোঁপ ঝাড়ের মধ্যে অনেক গভীর গর্ত থাকে। তাছাড়া এমনটিও তো হতে পারে, ওখানে গর্ত তৈরী করে রাখা হয়েছে আর এই দুই তরুণী স্রেফ হিন্দু যোগী-সন্ন্যাসীদের যাদুর অংশ হিসেবেই এমন মোহময় আচরণ করেছে?
সম্মানিত ইমাম, আপনি কি ঈমানের শক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত নন? আপনি কি জানেন না, ঈমান শক্তিশালী হলে তার উপর কোন যাদুটোনাই কার্যকর হতে পারে না?
দুর্গশাসকের এ কথায় ইমাম নীরব হয়ে গেলেন, সিপাহীর কণ্ঠেও আর কোন কথা উচ্চারিত হল না।
“ঠিক আছে, আমি আপনাদের সাথেই যাচ্ছি। এখানে সুলতান আমাকে শুধু শাসনকাজ চালানোর জন্য নয়, ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামের পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন। বললেন দুর্গশাসক সারওয়াগ।
এটা কোটলী কাশ্মীরের ঘটনা। দক্ষিণ কাশ্মীরের এই এলাকাটিতে তখন ছিল কোটলী রাজাদের রাজত্ব, যা পুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজুরী এলাকায় লোহা কোট নামের একটি সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। পাহাড়ের উপর অত্যন্ত মজবুত এই দুর্গ ছিল বহিরাক্রমণ থেকে অত্যন্ত সুরক্ষিত। সেই দুর্গের রাজা ছিল নন্দরায়। পাঞ্জাবের যে কোন রাজা যুদ্ধে পরাজিত হলে কোটলীর লোহাকোট দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নিতো। কারণ, এই দুর্গটি ছিল অজেয় ও অস্বাভাবিক মজবুত। রাজা জয়পাল সুলতানের কাছে শেষবারের মতো পরাজিত হয়ে এই দুর্গেই এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জয়পালের ছেলে আনন্দপালও সুলতান মাহমূদের হাতে পরাজিত হয়ে এই দুর্গেই এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। রাজা ভীমপালকে টোল্লাযুগিয়া নামক স্থানে সুলতানের সৈন্যরা পরাজিত করার পর সেও কাশ্মীরের কোন অঞ্চলে এসেই আশ্রয় গ্রহণ করে।
পূর্বেই বলা হয়েছে, সুলতান মাহমূদ রাজা ভীমপালকে তাড়া করে কাশ্মীর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। কাশ্মীরের রাজা নন্দরায়ের এক সেনাপতি তংগা সুলতান মাহমুদের প্রেরিত-অগ্রগামী দলকে ঘেরাও করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ক্ষতির জন্য তংগাকেও চড়ামূল্য পরিশোধ করতে হয়। সুলতান নিজে তংগাকে তার দলবলসহ পাকড়াও করে যুদ্ধবন্দী করে ফেলেন। তংগার এই ক্ষয়ক্ষতিতে সুলতান এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তংগা ও তংগার সকল সহযোদ্ধাকে হত্যা করে তাদের মরদেহ ঝিলম নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এর পর বিজিত এলাকায় সুলতান ফরমান জারী করেন, যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না, তাদের গ্রাম ছাড়া করা হবে। ইসলাম গ্রহণ করলে তাদেরকে সকল নাগরিক সুবিধাসহ সরকারীভাবে তাদের ধন-জন ও ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা দেয়া হবে।
দুর্গ থেকে বাইরে এসে সুলতানের মোকাবেলা করার সাহস হয়নি রাজা নন্দরায়ের। তার সামরিক শক্তি অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সুলতান মাহমূদ নন্দরায়ের এলাকায় পৌঁছে রাজা নন্দরায়ের কাছে পয়গাম পাঠালেন, তিনি যেন রাজা ভীমপালের মতোই তার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে খিরাজ দিতে স্বীকারোক্তিমূলক সন্ধিচুক্তি করেন। রাজা নন্দরায় সুলতানের বশ্যতা
স্বীকার করে নিয়ে তাকে খাজনা দিতে সম্মতি জানান। ফলে সুলতান ও রাজা নন্দরায়ের মধ্যে সন্ধিচুক্তি স্থাপিত হয়। চুক্তিতে শর্ত ছিল, নন্দরায়ের নিয়ন্ত্রিত যে কোন জায়গায় সুলতান ইচ্ছে মতো দু’তিনটি সেনাচৌকি স্থাপন করতে পারবেন এবং একজন শাসকের অধীনে গোটা এলাকার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রিত হবে। নাগরিক ট্যাক্স রাজা নন্দরায়ই আদায় করবেন। কিন্তু তিনি সুলতানের সৈন্যদের সার্বিক ব্যয় নির্বাহ করবেন এবং বার্ষিক একটি মোটা অংকের সম্মানী বিজয়ী সুলতানকে দিতে বাধ্য থাকবেন।
সুলতান মাহমূদ বিজিত এলাকার সকল সাধারণ মানুষকে ইসলামে দীক্ষা নেয়ার নির্দেশ জারী করেন। সেই সাথে এই নোটিশও জারী করেন, পেশোয়ার, লাহোর, মুলতান ও বেরায় ইসলাম শিক্ষা দেয়ার মতো পারদর্শী কয়েকশত শিক্ষককে যেন কাশ্মীর এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং এখানকার নওমুসলিমদের ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয়। এসব জরুরী নির্দেশনা দেয়ার পর কেন্দ্রের গোলযোগের খবর পেয়ে তিনি দ্রুত রাজধানী গযনীতে ফিরে যান।
একাধিক ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন, সুলতান মাহমুদ বলেছিলেন, কারো উপর কোন ধর্মমত চাপিয়ে দেয়া যায় না। আমি যদিও কাশ্মীরের সকল মানুষকেই মুসলমান হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছি, কিন্তু আমি অমুসলিমদের এই অভিযোগ প্রমাণ করতে চাই না যে, বিজিত রাজ্যের নাগরিকদের উপর সামরিক শক্তিবলে ইসলাম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
সুলতান বললেন, কাশ্মীরের লোকজন গোয়াড় ও অশিক্ষিত। এরা শাসকদের যে কোন নির্দেশকেই ধর্মীয় নির্দেশের মতো অলঙ্নীয় মনে করে। এদের রাজা মহারাজার ইচ্ছা অনিচ্ছাই এদের ধর্ম। আমি এদের একথা বোঝাতে চাই যে, ধর্মের বিধি-নিষেধের সম্পর্কে কোন শাসক কিংবা রাজা-মহারাজাদের সাথে নয়। ধর্মের সম্পর্ক একান্তই আল্লাহর সাথে। আর আল্লাহ বা মাবুদকে মাটি-পাথর দিয়ে বানানো যায় না। এই এলাকায় যদি কিছু মসজিদ তৈরী করে দেয়া যায়, তাহলে সেখানে উঁচু নীচু শাসক শাসিত একই সারিতে নামায পড়লে তারা বুঝতে পারতো, ইসলাম ধর্ম শ্রেণী বৈষম্য হিসেবে সবাই এক। রাজা হোক প্রজা হোক, শাসক হোক, কিংবা শাসিত, সবার মাথা-ই একসাথে একই মাটিতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদায় অবনত হয়।
খ্যাতিমান অমুসলিম ঐতিহাসিক স্যার আর্লিস্টিন এর ভাষায় সুলতান মাহমূদ বলেছিলেন, যদি বিজিত এলাকার গণমানুষের কাছে ইসলামের মহত্ত্ব কল্যাণকামিতা বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা না হয়, তাহলে গণমানুষের মধ্যে এই ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে যে, সুলতান বলেন এক আর করেন আরেক, যা সুলতানের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি ও ক্ষমতা সংহত করার জন্য সহায়ক, তা-ই তিনি করেন। ফলে নতুন মুসলমানরা ধর্ম থেকে নিরুৎসাহিত হয়ে ধর্মচ্যুত হয়ে যেতে পারে। আমার সালাতানাতের মধ্যে কোন মুসলমানের ধর্মচ্যুতিকে আমি বরদাশত করবো না। সাধারণ মানুষকে এটা বুঝিয়ে দিতে হবে তাদের প্রভু কে, তাদের রাসূল (সা.)-কে এবং তাদের ধর্মের বিধি-নিষেধ কী?
মহারাজা নন্দরায়ের শাসনকার্য দুটি দুর্গের ভেতরে বন্দী হয়ে পড়েছিল। আর দুর্গের বাইরে বিজিত রাজ্যে সুলতান মাহমূদ আল্লাহর নির্দেশ মতো আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাশ্মীরের নওমুসলিমদের ধর্ম শিক্ষা দেয়ার জন্য পেশোয়ার, লাহোর, মুলতান ও বেরা থেকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত বহুসংখ্যক লোক এনে নতুন এলাকায় ধর্মীয় শিক্ষা ও ইমামতি করার জন্য ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কাশ্মীর এলাকায় তৈরী করা হয়েছিল বহু মসজিদ। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই কাঠ দিয়ে একটি করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
তৎকালে ভারতের এই এলাকাটির সাধারণ মানুষের ধর্ম বলতে তাদের রাজা-মহারাজাদের তোষণই ছিল প্রধান স্তম্ভ।
রাজা-মহারাজাদেরকেই এই এলাকার সাধারণ প্রজারা দেবতার জাগতিক প্রতিনিধি বলে বিশ্বাস করতো। আসলে এদের ধর্মবিশ্বাস ছিলো জীবনে বেঁচে থাকা আর পানাহার করার স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অবরুদ্ধ, নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত এসব লোক যখন মুসলিম সৈন্যদেরকে বিজয়ী বেশে দেখতে পেল, প্রত্যক্ষ করলো মুসলমানদের সাম্য-মৈত্রী-মানবিকতা ও ভেদাভেদহীন নীতি, তখন স্বেচ্ছায়, বিনা প্ররোচনা ও বলপ্রয়োেগ ব্যতিরেকেই তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। এসব অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ নাগরিকদের হৃদয়ে ইসলামের বোধ-বিশ্বাস মজবুত করার নির্দেশনা দিয়ে সুলতান মাহমূদ জরুরী প্রয়োজনে গযনীতে ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু পরাজিত হিন্দু রাজা-মহারাজাদের জন্য সুলতানের এই ইসলাম প্রচার আয়োজন ছিল রাজত্ব হারানোর চেয়েও আরো বেশী বেদনাদায়ক। ভীমপাল কোন সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় না নিয়ে দুর্গম গ্রামাঞ্চলে গিয়ে আত্মগোপন করলেন। তাকে যখন জানানো হলো, সুলতান মাহমূদ ভারত ছেড়ে গয়নী চলে গেছেন, তখন রাজা ভীমপাল গোপন আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে দুর্গম পথে লাহোর পৌঁছলেন।
ভীমপালের লাহোর ফিরে আসার সংবাদ শুনে দীর্ঘদিন পর গোটা এলাকার রাজা-মহারাজারা এসে লাহোরে একত্রিত হলেন। শুধু রাজা-মহারাজারা নন, ভারতের বিভিন্ন খ্যাতিমান মন্দিরের খ্যাতিমান পুরোহিত পণ্ডিতগণ এসে হাজির হলেন।
ভীমপালের নেতৃত্বে এক বৈঠকে ভারতে ইসলামের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি রোধের নানা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হলো। সকল পুরোহিত পণ্ডিত অব্যাহত ব্যর্থতা ও পরাজয়ের জন্য শামরিক শাসক ও নেতাদের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছিলেন। কোন কোন পুরোহিত সুলতান মাহমূদকে হত্যার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা পেশ করলেন। ক্ষীণ আওয়াজে এমনটিও উচ্চারিত হলো, সুলতান মাহমূদকে সিন্ধু নদের ওপারেই আটকে রাখতে হবে। পেশোয়ারে প্রবেশের সুযোগ দেয়া যাবে না। আর এখানে তার রেখে যাওয়া সৈন্যদেরকে ঘেরাও করে আহার-সামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ক্ষুৎপিপাসায় ধুকেধুকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু যে যতো যুৎসই প্রস্তাবই উত্থাপন করুক না কেন, রাজা-মহারাজা ও পুরোহিত-পণ্ডিতদের এই বৈঠকে স্থির কোন যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হলো না। অনেকটা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই শেষ হলো কনফারেন্স।
মূলত অনৈক্য ও সিদ্ধান্তহীনতার মূল কারণ ছিল প্রত্যেক রাজা-মহারাজা ও পুরোহিত পণ্ডিতের নিজ নিজ কর্তৃত্ব ও রাজত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা। এক পর্যায়ে লাহোরের প্রধান পুরোহিত কণ্ঠ চড়িয়ে বললেন, সবাই এখন মুসলমানদের ভয়ে আততি। অথচ সংখ্যায় কিন্তু মুসলমানরা সব সময়ই সামান্য। মুসলমানরা এতোটা দূর থেকে এখানে এসে যুদ্ধ করছে। এখানকার প্রতিজন মানুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই মুসলমানদের শত্রু। এখানকার মাটি-মানুষ সবই মুসলিম সৈন্যদের বৈরী। তারপরও মুসলমানরাই একের পর এক রাজ্য দখল করে নিচ্ছে। আমাদের সবাইকে এ বিষয়টি ভাবতে হবে। কেন এমন হচ্ছে? সুলতান মাহমূদ কি কোন দৈত্য? জিন? না দানব? আসলে সে আপনাদের মতোই একজন মানুষ। তথাপি আপনাদের সবাইকে পরাজিত করছে। এর প্রধান কারণ হলো সে তার ধর্মের অনুশাসন মেনে চলে, সে তার ধর্মের পূজারী, ধর্মের প্রতি সে নিবেদিত। ধর্মের প্রতি এই নিবেদিতপ্রাণ হওয়াকেই মুসলমানরা বলে ঈমান। ধর্মে নিষ্ঠাই তাদের বিজয়ের প্রধান শক্তি। ধর্মের প্রতি আপনাদের এতোটা নিষ্ঠা নেই। ধর্মের চেয়ে আপনারা নিজেদের ক্ষমতা, মর্যাদা ও রাজত্ব নিয়ে বেশী ব্যস্ত।
প্রধান পুরোহিতের একথায় রাজা-মহারাজাদের মজলিসে নেমে এলো নীরবতা। পুরোহিত এই নীরবতা দেখে সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন–
“হিন্দুস্তান হিন্দুদের দেশ, দেবদেবীদের দেশ। এটা আল্লাহু আকবার এর দেশ নয়। এটা হরেকৃষ্ণ হরিহরি মহাদেব এর দেশ। কিন্তু দেবদেবীদের দেশ হলে কি হবে, এদেশে এখন দেবদেবীদের কী ধরনের অবমাননা করা হচ্ছে, তা আপনারা দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন। এই ধরিত্রী চিৎকার করে বলছে, সে তার উপরে বিচরণকারী এক মুসলমানের বোঝাও সহ্য করতে পারে না। আপনারা যদি ধরিত্রীর এই চিৎকার শুনতে না পান, অনুধাবন না করেন, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত বংশধর ও নতুন প্রজন্ম মুসলমানদের গোলামে পরিণত হবে এবং শ্রীকৃষ্ণের বাঁশী চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই ভবিষ্যত প্রজন্ম ও অনাগত বংশধরদেরকে এই অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে হবে।
আপনারা স্মরণ করুন, আমাদের পূর্বপুরুষরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের রোপিত ইসলামের বৃক্ষটিকে হিন্দুস্তান থেকে কিভাবে উপড়ে ফেলতে সক্ষম এ হয়েছিল। অথচ সেই বৃক্ষ কিন্তু মহিরুহে পরিণত হয়েছিল। চন্দ্রগুপ্ত আর অশোকের এই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল বিন কাসিমের রোপিত ইসলামের শিকড়; কিন্তু আমাদের মহান পণ্ডিত ও ঋষিগণ হৃদয়ে ধর্মের জপমালা নিয়ে ভগবানের নামে অসীম সাহসিকতা ও কৌশলের মাধ্যমে হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়া আযানের ধ্বনিকে মিটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যে পাপের শাস্তি আপনাদের প্রত্যেকেই ভোগ করতে হচ্ছে, তাহলে আপনারা সবাই সুলতান মাহমূদের এই যুদ্ধকে রাজ্যপাটের বিরুদ্ধে আক্রমণ মনে করছেন। এই ভুল ধারণা আপনাদের ত্যাগ করতে হবে। আপনাদের বুঝতে হবে, এই যুদ্ধ দুটি শাসকগোষ্ঠীর লড়াই নয়, এই যুদ্ধ দুটি ধর্মের লড়াই। দুই ধর্ম ও বিশ্বাসের এই লড়াইয়ে ক্রমাগভাবে ইসলাম বিজয়ী হচ্ছে। মহারাজা ভীমপালের শুধু পরাজয় ঘটেনি। এখানে হিন্দুত্ববাদের পরাজয় ঘটেছে। পরাজয় ঘটেছে দেবদেবী ও ভগবানে বিশ্বাসীদের। কালাঞ্জরের গোটা এলাকায় হাজারো মৌলভী ও ইমামদের ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রামে গ্রামে তৈরী করা হয়েছে মসজিদ। ইসলাম যদি এসব মানুষের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে পড়ে, তবে আর কোনদিন কারো পক্ষেই এদেশ থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করা সম্ভব হবে না।
“মাননীয় পণ্ডিত, এসব কথা আমাদের জন্য নতুন নয়, বললেন ভীমপাল। এখন আমাদের ভাবা উচিত, কালাঞ্জরের এলাকায় যেভাবে ইসলামের বীজ বপন করা হচ্ছে, তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করা। আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি যুদ্ধে সুলতান মাহমুদের কাছে পরাজিত হয়েছি, আমার সেনাবাহিনীও ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সেটিই শেষ কথা নয়। আমাদের আবারো চেষ্টা করতে হবে। একটি চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য হিন্দুস্তানের সকল রাজা-মহারাজার সহযোগিতা দরকার।”
“আপনি পরাজয় স্বীকার করেছেন। এটাও আপনাকে মেনে নিতে হবে যে, ভবিষ্যতেও আপনি আরো পরাজয়ের সম্মুখীন হবেন।” বললেন পুরোহিত। এবারের যুদ্ধে যদি চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনা না যায়, তবে প্রস্তুতির জন্য সময় নষ্ট করা হবে নিতান্তই সময়ের অপচয়। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কালা রে যেভাবে সাধারণ প্রজাদের মুসলমান বানানো হয়েছে এবং তাদের হৃদয়ে ইসলামকে বদ্ধমূল করার চেষ্টা চলছে, তা প্রতিহত করা।”
“কী করবেন? এখন তো আর আপনার পক্ষে সেখানে গিয়ে ধর্মপ্রচার করা সম্ভব নয়।” পুরোহিতের উদ্দেশে বললেন কালাঞ্জরের রাজা নন্দরায়। কেননা, মাহমূদের সৈন্যরা সেখানে চৌকি স্থাপন করে শাসনকার্য চালাচ্ছে। মুসলিম
সৈন্যরা রাত-দিন টহল দেয়। আমি শুনেছি, মাহমূদ নাকি নির্দেশ দিয়েছে, কাউকে যদি হিন্দুধর্ম প্রচার করতে পাও, তবে তাকে সেখানেই হত্যা করবে। কালাঞ্জরে আমার দুর্গ ছাড়া আর কোথাও এখন আর হিন্দুধর্মের পূজা-অর্চনা নেই। দুর্গের বাইরে সবখানেই ইসলাম ধর্মের চর্চা, ইসলাম ধর্মের আলোচনা। আপনি যে সব ইসলাম প্রচারক ও ইসলামের কথা বলেছেন, তারা পুরোমাত্রায় মুসলিম সৈন্যদের সহযোগিতা পাচ্ছে।”
তরবারী দিয়ে সব কাজ হয় না বললেন রাজা ভীমপালের প্রধান উজির। “যাদু চালাও। ওরা যদি শক্তির জোরে মানুষকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে থাকে, আমরা তরবারীর শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই আবার এসব লোককে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করতে পারি। আমরা এসব লোকের মনে ইসলাম সম্পর্কে সংশয়-সন্দেহ জন্মাতে পারি। এসব বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ, তাদের ডাকা হোক, তাদেরকে একাজ চালানোর ব্যবস্থা করা হোক। কালারের মাটি, মানুষ, ভূপ্রকৃতি, সুবিধাবাদী যাদুটোনার কারিশমা প্রদর্শনের জন্য খুবই উপযোগী। কালাঞ্জরের লোকদের মনে ভয়ানক আতঙ্ক সৃষ্টি করুন এবং অস্বাভাবিক দৃশ্যের অবতারণা করুন। যে অল্পসংখ্যক সৈন্য সুলতান মাহমূদ রেখে গেছে, তাদের মনেও আতঙ্ক সৃষ্টি করুন, সেই সাথে ওদেরকে রূপসৌন্দর্য ভোগবাদের ফাঁদে ফেলে বেকার করে দিন। গোপন ও অদৃশ্য কর্মকাণ্ডের দ্বারা যদি আমরা মুসলমানদের মোকাবেলায় এখনই কার্যক্রম শুরু না করি, তাহলে মুসলমানদের ঈমানী শক্তি বেড়ে যাবে, তখন ওদের মোকাবেলা করা আমাদের জন্য আরো কঠিন হবে।”
“হ্যাঁ, মানুষের সৃষ্টিগত দুর্বলতাগুলোতে কাজে লাগাতে হবে।” উজিরের কথাকে সমর্থন করলেন প্রধান পুরোহিত। প্রেম ও ভয় সকল মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান এবং এটি একটি প্রকৃতিপ্রদত্ত ও দুর্বলতা। ভালোবাসা ও প্রেমের আহ্বান মিথ্যা হলেও যে কোন মানুষের পক্ষেই তা তাৎক্ষণিক প্রত্যখ্যান করা কঠিন। মুসলিম সৈন্যদেরকে প্রেমের বিষ পান করিয়ে বিগড়ে দাও, তাহলে ইসলামের প্রচারক আর নওমুসলিম সবাই তোমাদের এই জালে আটকে যাবে।
রাজনৈতিক সমাধানের পথে যখন কোন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়াই বৈঠক ভেঙে যেতে উপক্রম হয়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে প্রধান পুরোহিতের চানক্য কৌশল সবাইকে আশ্বস্ত ও ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করল। এটা ছিল এমন প্রস্তাব যাতে সবাই একমত পোষণ করল এবং এ প্রক্রিয়া জোরদার করার তাগিদ অনুভব করল।
১০১৪ সনের শেষের দিনগুলোতে দক্ষিণ কাশ্মীরে বিজিত এলাকাগুলোতে ইসলাম গ্রহণকারী হিন্দু নওমুসলিমদের বিভ্রান্ত এবং মুসলিম সৈন্যদেরকে বেকার করে দেয়ার জন্য শুরু হলো হিন্দু যোগী-সন্ন্যাসী ও পুরোহিতদের যাদু-টোনার আগ্রাসন। বলতে গেলে তখন হিন্দু পুরোহিতদের রাজত্ব ছিলো গোটা ভারত জুড়ে। যেসব গ্রামে কোন অস্বাভাবিক ঘটনার দৃশ্য কেউ দেখেনি, সেসব গ্রামে বাতাসে ভর করে প্রচারিত হচ্ছিলো যতোসব ভীতিকর কাহিনী। গুজবের পাল্লা এতোটাই ভারী ছিলো যে, অমুক গ্রামে পাহাড় থেকে আগুন বের হচ্ছে, মেঘবৃষ্টিহীন আকাশে বিজলী চমকাচ্ছে, অমুক গ্রামে পথচারীদের পথ আটকে দিয়েছে সুন্দর প্রেতাত্মা। লোকমুখে এসব কাহিনী শুনেই মানুষের অন্তরাত্মা ভয়ে কেঁপে উঠতো। ভয় এক সময় পরিণত হতে সামাজিক আতঙ্কে। এমন গুজবও প্রচার পেয়েছিলো যে, গয়নী বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে জবাই করে মাংস খেয়ে ফেলছে।
সুলতান মাহমূদের সেনাচৌকির কমান্ডার যুবায়ের জামালীর মাটিতে ধসে যাওয়ার কাহিনী ছিল মারাত্মক ভয়ঙ্কর। এই ভয়ঙ্কর সংবাদটি সারওয়াগকে অবহিত করা জরুরী ছিল। কারণ, সারওয়াগ ছিলেন কালার অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক। সকল ছোট ছোট সেনাচৌকি ছিলো তার অধীনে। ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এক সৈনিক ও একজন ইমাম আঞ্চলিক কমান্ডার সারওয়াগকে ব্যাপারটি সম্পর্কে অবহিত করতে দ্রুত আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার টিলাযুগিয়ায় পৌঁছায়। টিলাযুগিয়ায় ছিলো তখনকার আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার ও কমান্ডার সারওয়াগের অবস্থান। সারওয়াগ বিষয়টি জানার পর তিনি সাথে সাথেই সংবাদদাতাদের নিয়ে কালাঞ্জর রওনা হন।
সেনাকমান্ডার সারওয়াগের সাথে তার কয়েকজন দেহরক্ষী ছিল। সেই সাথে তাদের আসবাবপত্র ও রসদ বহন করার জন্য কয়েকটি খচ্চর ও উট কাফেলার সাথী হলো। তাদের কাফেলার আগে আগে দু’জন অশ্বারোহী পথিক যাচ্ছিল। তাদের বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা সাধারণ কোন মুসাফির। অশ্বারোহী মুসাফির দু’জন সারওয়াগের কাফেলাকে দেখে আগে আগেই যাচ্ছিল।
ইমাম ও সংবাদবাহী সৈনিক যখন কালার থেকে সংবাদ নিয়ে টিলাযুগীয়াতে আসছিলেন, তখন তাদের পক্ষে দেখার অবকাশ হয়নি, এই দুই অশ্বারোহী তাদেরকেই অনুসরণ করে পিছু পিছু আসছিল। ইমাম ও সংবাদবাহী সৈনিক যখন বালনাথে প্রবেশ করেছিল, তখন অশ্বারোহীরা কোথায় যেন চলে গিয়েছিলো। এখন সারওয়াগ সিপাহী এবং ইমামকে নিয়ে যখন কালারের দিকে রওনা হলেন, তখন এরা তাদের আগে আগে চলতে শুরু করল।
সারওয়াগের কোন গাইডের দরকার ছিল না। কারণ, ইমাম ও সংবাদবাহী সৈনিক রাস্তা সম্পর্কে অবহিত ছিল। কাফেলা সাধারণ গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। পাহাড়ী পাথুরে জমিন, ঘাসের বিছানা, উঁচু-নিচু টিলা তাদের পিছনে থেকে যাচ্ছিল। কাশ্মীরের বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া তারা দেখতে পাচ্ছিলেন। ইমাম সেনাপতি সারওয়াগকে বলছিলেন, ওই যে বরফ ঢাকা উঁচু পাহাড়টি দেখা যাচ্ছে, এটির পাদদেশে যে বসতি এলাকাটি রয়েছে, এটি এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সেখানকার অধিবাসীদের সৌন্দর্য সারা ভারতে প্রবাদতুল্য।
উঁচু-নিচু টিলাময় পাহাড়ী এলাকায় যখন এই কাফেলা পৌঁছলো, তখন রাত হয়ে গেছে। বিরতিহীনভাবে তারা রাতেও কিছু পথ এগিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কিছুপথ অগ্রসর হয়ে বিশ্রামের জন্য কাফেলা যাত্রা বিরতি করল। তখন ছিল হাল্কা ঠাণ্ডার সময়। পরদিন দিনের বেলা যখন কাফেলা রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন হঠাৎ একটি ঘোড়া খুব জোরে হ্রেষারব করে লাগাম ছিঁড়ে পালিয়ে গেলো। এটি ছিল একজন নিরাপত্তারক্ষীর ঘোড়া। আরোহী তখনও ঘোড়ার পিঠে বসতে পারেনি, এর আগেই অজানা আতঙ্কে চম্পট দিল ঘোড়া।
সবাই দেখতে পেল তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট লম্বা একটি সাপ ঘাসের উপর গড়াচ্ছে। জায়গাটি ছিল ঘন সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। ছোট ছোট আগাছা জাতীয় গাছে থোকা থোকা ফুল ফুটে রয়েছে। প্রকৃতি যেন পরিকল্পিতভাবে জায়গাটিকে রং-বেরঙের বৃক্ষাদি লাগিয়ে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে। ছোট ছোট টিলা আর উঁচু-নিচু খানা-খন্দকের মাঝে মাঝে সমতল জমিন। এ যেন কোন দক্ষ ভাস্কর্যের তৈরী মনোরম মনোসেন্ট।
সাপ দেখে সামান ও খাদ্যসামগ্রী বোঝাই উট ও ঘোড়া ছুটে পালাল। ঘোড়া ও খচ্চরগুলোকে পালাতে দেখে সবাই ওগুলোকে ধরতে পিছু পিছু দৌড়াল, সাপ মারার অবকাশ কারো হলো না। জায়গাটি এমন যে, ঘোড়া আর খচ্চর সামানপত্র নিয়ে কোথায় পালিয়েছে আন্দাজ করাই কঠিন। সাপের ভয়ে পালানো কোন জন্তুকে আয়ত্ত্বে আনা কঠিন।
সবাই যখন ঘোড়ার খোঁজে টিলার আড়ালে হারিয়ে গেল, ঠিক এই সময়ে টিলার আড়াল থেকে অকুস্থলে দু’জন লোকের আগমন ঘটল। সাপটি তখনও ধীরে ধীরে ঘাসের উপর গড়াগড়ি করছে। এদের একজন এসে সাপটিকে একটু আড়ালে নিয়ে একটি থলের মধ্যে ভরে থলের মুখ বন্ধ করে ঘোড়ার জিনের সাথে থলেটি বেধে ফেলল। সেখানে আরো একটি ঘোড়া দাঁড়ানো ছিল।
সাপ পাকড়াওকারী লোকটি একটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অপর গোড়াটির জীন ধরে বিপরীত দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তার সাথীও এসে অপর ঘোড়াটিতে সওয়ার হল। ধীরে ধীরে উভয়েই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
সেদিন সারওয়াগের কাফেলার পুরো সময় ঘোড়া ও রসদবাহী খচ্চর ধরার পেছনেই কেটে গেল। হঠাৎ আগমনকারী দু’জনের একজন অপরজনকে বলল
“সামনে চল, এরা ফিরে যাবে না।”
“ফিরে যেতেও পারে। তবে এদের উপর নজর রাখতে হবে।” বলল অপরজন।
দিনের শেষ প্রহরে সারওয়াগের ছোট্ট কাফেলার অর্ধেক সওয়ার ও অর্ধেক পায়ে হেঁটে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। বহু চেষ্টার পর তারা তিন চারটি ঘোড়া আর মালবাহী দুটি খচ্চর ও উটকে ধরতে পেরেছিল। সারওয়াগ দৃঢ়চেতা সেনাধ্যক্ষ। কোন বাধাই তাকে লক্ষচ্যুত করতে পারে না। তিনি কাফেলার সাথীদের বললেন, পায়ে হেঁটে যারই ক্লান্তি লাগে সওয়ার হবে। আমি এখন থেকে হেঁটেই যাবো। হিন্দুস্তানের এসব নাগ আমাদের মিশন ভণ্ডুল করে দিতে পারবে না।
এ পর্যায়ে তারা পাহাড়ী এলাকায় এসে পৌঁছলো। একদিকে বিশাল পাহাড়, আর একদিকে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের ঢাল। একটু পরপরই তাদের পথ মোড় নিচ্ছিল। কখনও তাদেরকে দু’পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে অতিক্রম করতে হচ্ছিল। তারা যতোই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল, শীতের প্রকোপ ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কনকনে শীতের বাতাস। অবশ্য জায়গাটি এমন যে, পানাহার সামগ্রী সাথে না থাকলেও তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরতে হতো না। জায়গাটিতে প্রচুর পানি আছে। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ী ঝরনা বেয়ে স্ফটিকস্বচ্ছ পানি নিচে পড়ছে। নানা ধরনের ফলজ গাছে বাহারী ফল ঝুলছে। যে কয়টি জন্তু তাদের সাথে ছিল, এদের খাবারের অভাব ছিল না। এলাকাটি পশুর খাবার উপযোগী সবুজ ঘাসে ভরা।
এমন জায়গায় এসেই তাদের রাত হয়ে গেল। একটি পাহাড়ের ঢালে রাতের বিশ্রামের জন্য তাঁবু ফেলল তারা। রাতের বেশীর ভাগ সময় কাটলো এলাকাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথাবার্তায়। তাদের তাঁবুর পাশেই বাধা ছিল জন্তু কয়টি। সকাল বেলায় আবারো রওনা হওয়ার জন্য ঘোড়ায় জীন আটকানো হলো এবং কাফেলা এগোতে শুরু করল।
অন্যদেরকে সওয়ার করে কাফেলার সরদার সারওয়াগ হেঁটেই অগ্রসর হচ্ছিলেন। তিনি ইমাম সাহেবকে একটি ঘোড়ায় সওয়ার করালেন। দলনেতা পায়ে হেঁটে রওনা হওয়ায় সারওয়াগের নিরাপত্তা রক্ষীরাও পায়ে হেঁটেই যাচ্ছিল। হঠাৎ ইমাম সাহেবের ঘোড়া এদিক ওদিক লাফালাফি শুরু করল। যারা ঘোড়ায় চড়ে অভ্যস্ত, তারা ঘোড়ার এসব আচরণের অর্থ জানে। ঘোড়ার অবস্থা দেখে সারওয়াগ ইমামকে বললেন, জলদী ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়ুন! ইমাম সাহেব ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ার সাথে সাথেই ঘোড়াটি তীব্র হ্রেষাব করে ছুটে পালাল। সাথে সাথে অন্য ঘোড়াগুলোও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে হ্রেষাব করতে লাগল।
হঠাৎ একজন বলে উঠল, সাপ! সাপ! এবার একই রং ও একই মাপের দু’টি সাপকে দেখা গেল। সবগুলো ঘোড়া নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে লাগাম ছিঁড়ে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। সবাই ঘোড়া ধরতে পিছু পিছু দৌড়াল। কারো আর সাপ মারার খেয়াল হলো না। দু’টি ঘোড়া পাহাড়ের ঢালু জায়গায় দৌড়াতে গিয়ে পা পিছলে নিচে প্রবাহমান ঝিলম নদীতে পড়ে গেল। সারওয়াগের দুই সৈনিক পাহাড়ের উঁচু ঢালু থেকে দেখল তাদের অতি জরুরী সফরসঙ্গী দুটি ঘোড়া আতঙ্কিত হয়ে পালাতে গিয়ে পাহাড়ে পা পিছলে নদীতে পড়ে গেছে আর স্রোতস্বীনী ঝিলমের তীব্র স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। নদী থেকে ঘোড়া দুটোর তীরে উঠে আসার কোন অবকাশই ছিল না।
পাহাড়ের ঢালে রাতযাপনকারী সারওয়াগের কাফেলা সকালবেলায় রওনা হওয়ার সময় যখন অবশিষ্ট সওয়ারী ঘোড়া দুটোকেও হারিয়ে বিষণ্ণমনে সেখান থেকে রওনা হয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর ফেলে যাওয়া সেই জায়গাটিতে এলো সারওয়াগের কাফেলাকে আড়াল থেকে অনুসরণকারী দুই অশ্বারোহী। এরা এসে ঘাসের উপরে গড়াগড়িরত অবস্থায় সাপ দুটোকে ধরে থলের মধ্যে আটকিয়ে তাদের একটি ঘোড়ার জীনের সাথে সাপভর্তি থলেটি ঝুলিয়ে দিল।
কি সব অদ্ভুত ব্যাপার সম্মানিত সেনাপতি। এই এলাকা দিয়েই তো আমি দু-তিন দিন আগে এই সৈনিককে নিয়ে আপনার কাছে পৌঁছেছি। তখন তো কোন সাপ আমার নজরে পড়েনি! এখন শীতের সময়। শীতের সময় সাধারণত সাপ গর্তে থাকে। সাপ শীত সহ্য করতে পারে না।
“ভেবে দেখুন ইমাম সাহেব! মনে হয় আমরা আসল গথ ভুলে অন্য পথে এসে পড়েছি। দেখুন না কোন জনবসতি কি চোখে পড়ছে? এমন জনমানবহীন এলাকায় রাস্তা ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ইমাম সাহেবের উদ্দেশে বললেন সেনাপতি সারওয়াগ।
সেনাপতি সারওয়াগের মনোবল এখনও চাঙ্গা। তিনি পায়ে হেঁটেই কাফেলাকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সবাইকে পায়ে হেঁটে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার জন্য উজ্জীবিত করছিলেন। সারওয়াগের প্রবল ধারণা জন্মালো, ইমাম সাহেব হয়তো আসল রাস্তা ভুলে অন্যপথে কাফেলাকে নিয়ে যাচ্ছেন। চলতে চলতে সন্ধ্যার আগে পথের একটি মোড়ে তারা দুজন অশ্বারোহীকে দেখতে পেল। অশ্বারোহী দু’জন তাদের কাছাকাছি এসে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল এবং রাস্তার কিনারায় দু’হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সারওয়াগ তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, উভয়েই মাথা নিচু করে সারওয়াগকে কুর্নিশ করল। সারওয়াগ ইমাম সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনি এদের ভাষা বোঝেন, এদের তুলুন এবং এদের কাছ থেকে পথের কথা জিজ্ঞেস করে নিন।
ইমাম সাহেব লোক দুটিকে উঠতে বললেন। ইমাম সাহেবের কথায় তারা উঠলো বটে; কিন্তু একজন হাত জোড় করে ভিখারীর মতো করে বললো
“আমরা আপনাদের গোলাম। আপনারা মুসলমান। আমরা আপনাদের ধর্ম গ্রহণ করেছি।”
ইমাম সাহেব এদেরকে তাদের গন্তব্যের কথা জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা ঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছি তো?”
“না, আপনারা পথ ভুল করেছেন। বললো একজন। আমরা বহুদূর থেকে আপনাদের দেখে এসেছি। আমরা অবাক হচ্ছি, এ পথ দিয়ে আপনারা কী করে জীবন নিয়ে ফিরে এলেন! আমরা তো এই এলাকাটিকে মৃত্যুপুরী বলে থাকি। বাঘের মতো হিংস্র জন্তুও এই অঞ্চলে আসে না। এই এলাকাটি সাপের এলাকা। আপনারা যে দিকে যাচ্ছেন, এ পথে প্রতিটি গাছের ডালে ডালে একেকটি সাপকে ঝুলে থাকতে দেখবেন। আপনারা এ পথ ছেড়ে অন্য পথে চলুন। বলেই সে রাস্তার কথা বলতে শুরু করল। কিন্তু এ পথটি খুবই জটিল। ঘন ঘন মোড় নিতে হবে। এ পথে গেলে বারবার আপনাদের পথ হারানোর আশঙ্কা আছে। এজন্য আমরা আপনাদের সাথেই যাচ্ছি।
“ইমাম সাহেব পথিকের বক্তব্য সারওয়াগকে জানালে সারওয়াগ ওদেরকে সাথে নিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন। আরো বললেন, এরা আমাদের পথ দেখিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিলে এ কাজের জন্য আমরা তাদেরকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবো।”
“আগন্তুক দুই অশ্বারোহী সারওয়াগের কাফেলার গাইডের দায়িত্ব পেল।
চলতে চলতে সারওয়াগ ইমাম সাহেবের মাধ্যমে গাইডদের কাছে জানতে চাইলেন, তোমরা কি এই এলাকার বিস্ময়কর ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছু জান?
জবাবে তারা বললো, “আমরা তো সেই জায়গা থেকেই পালিয়ে এসেছি। আমরা ভয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ এলাকা ছেড়ে এদিকে এসে পড়েছি।” জবাব দিলো। তাদের একজন।
“তোমরা কি কোন পাহাড় থেকে আগুন বেরোতে দেখেছো?”
“আমরা অনেক দূরে থাকি। আমরা সরাসরি আগুন দেখিনি। তবে অনেক দূর থেকে আগুনের শিখা দেখেছি। মনে হচ্ছিল যেন আসমান জ্বলছে। আমরা রাতের বেলায় আসমানে বিজলী চমকাতেও দেখেছি।… আমরা এমন আওয়াজও শুনেছি… কেউ নিজেদের বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করো না…। বললো সেই লোক।
“তোমরাও কি বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছো?”
“জি হ্যাঁ। আমরা ইসলামকে সত্যধর্ম বলে বিশ্বাস করি। এজন্য আমরা ওখান থেকে চলে এসেছি। আমরা আপনাদের ধর্ম কিছুতেই ত্যাগ করবো না।”
“গাইড দুজনই একের পর এক সেইসব ঘটনা আরো ভয়াবহ রূপ দিয়ে সারওয়াগকে জানাল, যে ঘটনা সারওয়াগকে ইমাম ও সংবাদবাহী সিপাহী শুনিয়েছিল। এদের দু’জনই তাদের কথাবার্তায় আতঙ্কিত ভাব ফুটিয়ে তুলেছিল। ইমাম সাহেব ও সারওয়াগ তাদের অভয় দিচ্ছিলেন, এতো আতঙ্কের কিছু নেই। তোমাদের কোনই ক্ষতি হবে না। গাইড দুজন অনুগত দাসের মতো কাফেলাকে পথ দেখিয়ে আগে আগে যাচ্ছিল।
দক্ষিণ কাশ্মীরে দেওকোট নামের একটি জনবসতি। দেবদারু আর চিলি কাঠের তৈরী বিশ-পঁচিশটি বাড়ি নিয়ে দেওকোট গ্রাম। গ্রামের সকল অধিবাসীই হিন্দু। এ গ্রামে দেবদারু কাঠের একটি ছোট্ট মন্দিরও আছে। মন্দিরের অনতিদূরে গযনী বাহিনীর একটি ছোট্ট চৌকি। চৌকিতে প্রায় জনাত্রিশেক সৈনিকের অবস্থান। আজমীর নামের এক লোক এই ছোট্ট সেনাচৌকির কমান্ডার। আজমীর মুলতানের অধিবাসী। এক সময় আজমীর ছিল কারামতী সম্প্রদায়ের লোক। মুলতান দখল করে সুলতান মাহমূদ যখন কারামতীদের ধর্মীয় ভণ্ডামীর মুখোশ উন্মোচন করে দেন, তখন বহু কারামতী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুন্নী মুসলমানে দীক্ষা নেয়। আজমীর ছিল সেই কারামতীদেরই একজন।
কমান্ডার আজমীর একদিন নিয়মিত সেনাটহলের উদ্দেশ্যে সাথীদের নিয়ে গ্রামে টহল দিচ্ছিল। সুলতান মাহমূদের নির্দেশে সেই গ্রামের মন্দিরটি অপসারণ করে মসজিদ তৈরী করা হয়েছিল। মসজিদে একজন ইমামও নিযুক্ত করা হয়েছিল। ইমাম সেখানকার অধিবাসীদের কুরআন-হাদীস শিক্ষা দিতেন এবং লোকজনকে ইসলামের ইবাদত-বন্দেগীর রীতি-পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। এ গ্রামের লোকজনও ছিল অদ্ভুত ঘটনায় আতঙ্কিত। কারণ, তারাও গ্রামের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে আগুন জ্বলতে দেখেছিল এবং রাতের বেলায় বিজলীর আলোয় আকাশ উদ্ভাসিত হতে দেখেছিল।
এক রাতে এমনই বিজলী চমকানোর সময় ইমাম সাহেব ঘর থেকে বাইরে গেলে তিনজন বিবস্ত্র নারীকে দেখতে পান। তখন ছিল তীব্র বাতাস। বাতাসে বিবস্ত্র তরুণীদের চুলগুলো উড়ে তাদের চেহারা ঢেকে দিচ্ছিল। তরুণীরা সেই পাহাড়ের ঢালে দাঁড়ানো ছিল। রাত ছিল অন্ধকার। বিপরীত পাহাড় থেকে আলো দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। সেই আলাতে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীদের। ঘটনাক্রমে ইমাম সাহেব সেদিন ঠিক এ সময়ে ঘরের বাইরে এসেছিলেন। তিনি দেখলেন, কিছুক্ষণ জ্যোতি ছড়িয়ে পাহাড়ী আলো বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর আবার একই জায়গা থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে আলোক রশ্মি । কিন্তু পরে আর তরুণীদের সেখানে দেখা যায়নি।
পরদিন ইমাম সাহেব চৌকিতে গিয়ে কমান্ডার আজমীরকে গতরাতে তার দেখা দৃশ্যের কথা জানালেন। ইমাম সাহেব আজমীরকে জানালেন, গ্রামের লোকজন বলাবলি করছে, ইসলাম যদি সত্য ধর্মই হয়ে থাকে, তাহলে ইমাম সাহেব তাদেরকে অবশ্যই এ ধরনের অলৌকিক কোন কিছু দেখাবে। গ্রামের লোকেরা আরো বলাবলি করছে, ধর্মচ্যুতির কারণে তাদের উপর মুসিবত ধেয়ে আসছে। এজন্য তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে।
আজমীর ইমামের কথা শুনে গ্রামে গিয়ে অধিবাসীদের আতঙ্ক দূর করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে অধিবাসীদের ভয় দূর হয়নি; বরং সে নিজেই কিছুটা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছে। কারণ, সে আলেম ছিল না। ইসলামের সহীহ আকীদা-বিশ্বাসের অকাট্য কোন দলীল-প্রমাণ সম্পর্কে তার কোন জ্ঞান ছিল না। সে শুধু জানতো “কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বললে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে” এই নির্দেশের কথা।
গ্রাম প্রদক্ষিণ করে মসজিদে গিয়ে কমান্ডার আজমীর ইমাম সাহেবকে বললো, আমি একজন সৈনিক আর আপনি আলেম। আপনার ইলম এসব ঘটনার কী ব্যাখ্যা দেয়? আপনি এ সম্পর্কে লোকজনকে একটা বুঝ দিন। তা না হলে আমাদের সৈনিকরাও তো ইসলাম ছেড়ে দেবে।
আমি তরবারী দিয়ে লড়াই করতে পারি, মানুষ শাসন করতে পারি, যে কোন দুর্ভেদ্য দুর্গের প্রাচীর ডিঙাতে পারি, কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ এবং নাদান একজন মানুষ। আপনার ও ইসলামের আকীদা-বিশ্বাসের পাহারাদারী করার জন্য আমাকে এখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সুলতান নির্দেশ দিয়েছেন যেন মানুষের মন জয় করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু এখানে এমন সব ঘটনা ঘটছে যে, তাতে মানুষের মনের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে নানা সংশয়-সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সম্মানিত ইমাম, এ সম্পর্কে আপনি আমাকে কিছু বলুন, আল্লাহ না করুন শেষে আমি নিজেই পথভ্রষ্ট হয়ে না যাই।
বাস্তবে এসব অদ্ভুত ঘটনার বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দেয়ার মতো প্রজ্ঞা ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস ও হিন্দুদের কঠিন চক্রান্ত সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ইমামের কাছে ছিল না।
ফলে যৌক্তিক কোন আশ্বাস বাণী ছাড়াই কমান্ডারসুলভ ভঙ্গিতে গ্রামবাসীকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে হুমকি ধমকি দিয়ে চৌকির কমান্ডার আজমীর নিজের চৌকিতে ফিরে এলো। আজমীর নিজেও বিভ্রান্তির শিকার। গ্রামের লোকেরা রাতের অন্ধকারে যে আওয়াজ শুনেছিল, নীরব ও একাকীত্বে আজমীর নিজেই সেই আওয়াজ শুনতে শুরু করল- “ইসলাম যদি সত্যিই সৃষ্টিকর্তার ধর্ম হয়ে থাকে, তবে এসব ঘটনার বিপরীতে কোন অলৌকিক ঘটনা দেখাও না!”
“আজমীরের সেনাচৌকির অবস্থানও ছিল একটি পাহাড়ের ঢালুতে। কাঠের তৈরী দু’তলা বিশিষ্ট একটি ঘরকে সেনাচৌকি বানানো হয়েছে। রাতের বেলায় উদ্বিগ্ন মনে চৌকির দুতলার জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল কমান্ডার আজমীর। রাত যেমন তীব্র ঠাণ্ডা, তেমনই ঘন অন্ধকার। দশ হাত দূরের কোন জিনিসও দেখা যাচ্ছিল না। কাশ্মীরের প্রাকৃতিক গাছ গাছালীর নানা ফুলের সুবাসে মনোমুগ্ধকর একটি মনমাতানো পরিবেশ। নাম না জানা অচেনা ফুলের গন্ধে মোহিত চারদিক।
আজমীর ছিল নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু এখানে এসে সে ইসলামকে নিয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখী। আজমীর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো, হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস নিতান্তই একটি বাতিল ধর্মবিশ্বাস। মূর্তিপূজা সর্বৈব একটি কুফরী কাজ। কিন্তু ইসলাম যে সত্য ধর্ম, এ বিষয়টি বাস্তবতার নিরীখে সংশয়ের শিকার নওমুসলিম আজমীরের কাছে প্রমাণ করার মতো কোন উপাদান ছিল না। সে জোর দিয়ে বলতে পারছিল না, ইসলমাই সত্য।
নিস্তব্ধ রাতের এই একাকীত্বে চিন্তা-ভাবনায় হঠাৎ ছেদ ঘটালো দূরের একটি পাহাড়ের ঢালের আলোকরশ্মি। ঘন অন্ধকার রাতেও রশির আলোর ঝলক ছিল বেশ তীব্র। আলোটি কয়েকবার চমকালো আবার বন্ধ হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখে কমান্ডার আজমীরের গায়ের পশম খাড়া হয়ে গেলো। সে ভাবতে লাগল, সকাল হলেই গ্রামের মানুষের মুখে শোনা যাবে- রাতে গ্রামের পাহাড়ে তারা আগুন জ্বলতে দেখেছে। অথবা বলবে, রাতের বেলায় অমুক পাহাড় আগুন উদগীরণ করেছে।”
অবস্থাদৃষ্টে কমান্ডার আজমীর এতোটাই পেরেশান হলো যে, সে সিজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে নিবেদন করল, হে পরওয়ারদেগার! তুমি তোমার পবিত্র নামের মর্যাদা রক্ষা করো। তুমি তোমার প্রিয় ধর্ম ইসলামের পবিত্রতা ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখো। তুমি আমার ঈমানের দ্যুতি দেখাও, আমি যাতে এসব অদ্ভুত আগুনের রহস্য উদ্মাটন করতে পারি এই ক্ষমতা দাও।”
রাত শেষে ভোরের আলো যখন দিনের বার্তা ঘোষণা করলো, তখনও সেই রাতের ঘটনা কমাণ্ডার আজমীরের মনে পাথরের বোঝা হয়ে বিরাজ করছিল। সে দায়িত্ব অনুভব করছিল, এসব অস্বাভাবিক ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে তার ধর্মের পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে। কিন্তু এসব অলৌকিক ঘটনার রহস্য উঘাটনের মতো ইলম ও প্রজ্ঞা কিছুই তার ছিল না। সূর্য যখন অনেকটা উপরে উঠে গেল, তখন একটি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে সে একাকীই বেরিয়ে পড়ল। সে চুপি চুপি গ্রামের মানুষের ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করল।
সে সময় কাশ্মীরের এই এলাকাটি ছিল ঘন গাছ গাছালীতে ভরা। ঘন বনজঙ্গলে প্রায়ই হিংস্র জীব-জন্তুকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো। মাঝেমধ্যে হরিণও পাওয়া যেতো। তীর-ধনুক আজমীরের সাথেই ছিল। একটি বর্শাও থাকতো তার সাথে সব সময়।
যেতে যেতে চৌকি থেকে অনেকটা দূরে একটি জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল সে। জঙ্গলের পাশ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছিল পাহাড়ী নদী। হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো নারী-কণ্ঠের হাসির আওয়াজ। অতি সন্তর্পণে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকালো আজমীর। তার নজরে পড়ল নদীতে তিনটি রূপসী তরুণী জলকেলী করছে আর হাসাহাসি করছে। একজন অপরজনের গায়ে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর তরুণী তিনজন। কোমর থেকে তাদের উৰ্দ্ধাংশ সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন। নিম্নাঙ্গে যদিও একখণ্ড কাপড় আছে, কিন্তু তাও এতোটাই পাতলা যে, শরীরের পশমগুলো পর্যন্ত দিব্যি দূর থেকে বোঝ যাচ্ছে।
তরুণীদের অস্বাভাবিক রূপসৌন্দর্যে বিস্মিত হলো না আজমীর। কারণ, আল্লাহ তাআলা প্রকৃতিগতভাবেই এই এলাকাটিকে দুনিয়ার মধ্যে সবেচেয়ে সুন্দর করে বানিয়েছেন। এখানকার সব মানুষই সুন্দর। আজমীরকে যে বিষয়টি অবাক করলো, তা হলো, এখানকার ধারে কাছে কোন জনবসতি নেই। দূরের জনবসতি থেকে কেউ এখানে গোসল করতে আসে না। তাছাড়া তরুণীদের দেখে নিকটবর্তী গ্রামের অধিবাসী মনে করার কোনই যুক্তি নেই। এদের রূপ-সৌন্দর্যের সাথে আশপাশের গ্রামের তরুণীদের কোন তুলনাই হতে পারে না। এদেরকে গ্রাম্য তরুণী বলারও কোন অবকাশ নেই। আজমীরের মনে পড়ল, এই এলাকায় জনশ্রুতি আছে, অনেকেই নাকি গ্রাম থেকে দূরে পাহাড়ের ঢালে বা নির্জন স্থানে সুন্দরী নারীদের দেখতে পায়। লোকজনের ভাষায় এরা হয়তো প্রেতাত্মা, নয়তো স্বর্গের জ্বিন-পরী।
কমান্ডার আজমীর মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়ে তরুণীদের দেখছিল। হঠাৎ এক তরুণী একদিকে তাকিয়ে আর্তচিৎকার করে দৌড় দিল। দেখাদেখি আরেক তরুণীও দৌড়ে পালাল। তৃতীয় তরুণীটি নদীর পাড়ে বসা ছিল। সে উঠে দৌড় দিতে গিয়ে নদীতে পড়ে গেল। সেখানে পানি ছিল হাঁটু পরিমাণ। ঠিক এমন সময় একটি বিশালকায় বন্য শূকর গর্জন করতে করতে পানির দিকে অগ্রসর হলো। তরুণী পানি থেকে সোজা হয়ে উঠে যেই ভয়ঙ্কর দাঁতাল বন্য শূকর দেখতে পেল, অমনি আর্তচিৎকার করে আবারো পানিতে গড়িয়ে পড়ল। বিশালদেহী বন্য শূকরটি এবার তরুণীকে ধরার জন্য পানিতে নেমে তরুণীর দিকে অগ্রসর হতে লাগল।
আজমীরের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল এই তরুণী কোন প্রেতাত্মা কিংবা জীন পরী নয়- নিতান্তই মর্তের মানুষ। কমান্ডার ঘোড়ার লাগাম টেনে অশ্বপৃষ্ঠে এড়ি দিল। তাড়া খেয়ে ঘোড়া দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেল। কমান্ডার আজমীর বর্শাটিকে ডান হাতে নিয়ে নিশানা নিল। লক্ষ্যভেদী আঘাত হানতে হবে। কারণ, বন্য শূকর লাফিয়ে লাফিয়ে নর্তন-কুর্দন করে তীব্র গর্জন করে তরুণীকে শিকার করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। তরুণীকে ধরে ফেলবে ফেলবে অবস্থায় কমান্ডার আজমীর প্রচণ্ড জোরে শূকরের দিকে বর্শা নিক্ষেপ করলে বর্শাটি তীরের মতো উড়ে গিয়ে শূকরের পাজরে আমূল বিদ্ধ হল। বিকট চিৎকার করে শূকরটি লাফিয়ে উঠে পানিতে উল্টে পড়ল। বন্য শূকরটি আবারো পানি থেকে উঠে ঠায় কয়েকটি চক্কর দিয়ে পানিতে ঢলে পড়ল। আজমীর এক লাফে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দৌড়ে নদী থেকে তরুণীকে তুলে আনল। দাঁতাল বন্য শূকরটি তখনও পানিতে পড়ে ধীরে ধীরে গোংড়াচ্ছে আর পা ছড়িয়ে দাপাদাপি করছে।
তরুণী বেহুঁশ। তার সাথী তরুণীরা কোথায় পালিয়েছে পাত্তা নেই। আজমীর সংজ্ঞাহীন তরুণীকে পাজাকোলা করে এনে ঘোড়ার পিঠে শুইয়ে দিল এবং নদীর তীরে পড়ে থাকা কাপড়গুলো এনে তরুণীর উলঙ্গ দেহটা ঢেকে দিয়ে চৌকির দিকে রওনা হলো। সে বেহুঁশ তরুণীটিকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছিল আর মনে মনে ভাবছিল এই তরুণীদের পরিচয় উদ্ধার করতে পারলে হয়তো অনেক গোপন রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।
আজমীর ভেবে কূল পাচ্ছিল না, এতো সুন্দরী এই তিন তরুণী এখানে কোত্থেকে এসেছে! আর ওর সাথীরাই বা কোথায় হারিয়ে গেছে। এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যে এসে এরা নদীতে ঝাপাঝাপিই বা করছিল কোন উদ্দেশ্যে? এরা কি একবারও ভাবেনি, জঙ্গলের ভেতর থেকে যে কোন সময় কোন হিংস্র জন্তু এসে তাদের জন্য বিপদ হতে পারে? আকাশ-পাতাল ভাবনার কোন কিনার হওয়ার আগেই সংজ্ঞাহীন তরুণীকে নিয়ে চৌকিতে পৌঁছে গেল কমান্ডার আজমীর।
সেনাচৌকিতে পৌঁছানোর পর তরুণী ক্ষীণ কণ্ঠে আওয়াজ করল। তরুণী নিজে থেকেই শয়ন থেকে উঠতে চেষ্টা করছিল। কমান্ডার আজমীর তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে দিল। তরুণীর জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিন্তু নিজেকে এই অচেনা সেনাচৌকিতে দেখে শূকর দেখার চেয়ে আরো বেশী ঘাবড়ে যাওয়ার ভাব চোখে মুখে ফুটে উঠলো। অত্যধিক ভীত হওয়ার কারণে তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। আজমীর স্থানীয় ভাষায় কথা বললে বুঝতে পারল তরুণী। আজমীর তাকে পরিধেয় কাপড়-চোপড় ঠিকঠাক করে নিতে বলল।
“আপনিই কি আমাকে জংলী দাতাল শূকরের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন?” ধরা গলায় আজমীরের উদ্দেশে বলল তরুণী।
“আমি যদি সেখানে না থাকতাম এবং আমার হাতে যদি বর্শা না থাকতো, তাহলে তোমার পক্ষে জীবন বাঁচানোই মুশকিল ছিল। এতোক্ষণে বন্য শূকরের আঘাতে তোমার ক্ষত-বিক্ষত দেহ নদীর স্রোতে ভেসে যেতো। আমিই সেই হিংস্র শূকরটিকে হত্যা করেছি। এখন আর তোমার কোন ভয় নেই। তুমি নিরাপদ। তুমি যেখানে যেতে চাও তোমাকে নিরাপদে সেখানেই পৌঁছে দেয়া হবে। আতঙ্কিত তরুণীকে আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে বলল কমান্ডার আজমীর।
কাপড় পরার জন্য তরুণী অপর একটি খালি কক্ষে চলে গেল। আজমীর এতোক্ষণ দেখছিল তরুণীকে। মানুষও এতো সুন্দর হতে পারে? এ যেনো কল্পনাকেও হার মানায়!
কাপড় পরে ফিরে এসে তরুণী আজমীরের কাছে জানতে চাইলো, “এখন আমার সাথে কী ধরনের আচরণ করা হবে?”
“যার আশঙ্কা তুমি করছো, এমনটি করতে চাইলে সেই নদীর তীরেই আমি করতে পারতাম।” বলল আজমীর।
আমি তোমার সম্পূর্ণ উলঙ্গ শরীর কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। এখানে কোন বদ মতলবে তোমাকে নিয়ে আসিনি। তোমার জীবন রক্ষার তাগিদেই তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। এখন বল, কোথায় যেতে চাও তুমি? যেখানে যেতে চাও, সেখানেই তোমাকে রেখে আসবো।”
“আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি এই এলাকার কোন লোক নও। তোমার কথাবার্তা এই এলাকার মনে হয় না। তোমার চালচলনও এই অঞ্চলের মানুষের সাথে মিলে না। তাছাড়া তুমি কোন গরীব গ্রাম্য বাবার সন্তানও নও।”
“আমি যদি আপনাদের কোন প্রশ্নেরই জবাব না দিই, তাহলে আমার সাথে কী আচরণ করা হবে?”
“তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া ছেড়ে দেবো না। তোমাকে পবিত্র আমানতের মতো সযত্নে এখানে রাখবো।” বললো আজমীর।
খিক খিক্ করে হেসে ফেলল তরুণী। হঠাৎ সে আজমীরের সাথে এভাবে কথা বলতে শুরু করল, আজমীর তার কতো দিনের চেনা-জানা লোক। সে স্বেচ্ছায় আজমীরের কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছিল।
তরুণীর এই বিগলিত ও স্বেচ্ছা সমর্পণের মনোভাব দেখে আজমীর বললো, “আমি একজন মুসলমান। আমি আমার সুলতান ও দায়িত্বের সাথে গাদ্দারী করতে পারি না। তুমি ভাবাবেগ সম্পর্কে আমাকে একটা পাথর মনে করতে পার।”
তরুণী আজমীরকে তার মায়াজালে আবদ্ধ করার জন্য আরো কিছু কৌশল প্রয়োগ করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পারল, প্রকৃতপক্ষেই আজমীর একটা পাথর।
অবশেষে তরুণী আজমীরের উদ্দেশ্যে বলল, আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আমি যেমনটি আপনাকে ভেবেছিলাম, আপনি মোটেও তেমন নন। এখন আমার কর্তব্য আমার সত্যিকার অবস্থা আপনাকে জানানো। এরপর আপনার যা ইচ্ছা আপনি করতে পারেন।…
“আমি সেই প্রেতাত্মাদের একজন, যারা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সুন্দরী তরুণীর বেশে গোচরীভূত হয়। কিন্তু আমি প্রেতাত্মা নই মানুষ। আমার সাথে আরো যে দু’জন তরুণী ছিল, তারাও মানুষ। কালাঞ্জর দুর্গ আমাদের ঠিকানা। আমাদের অস্থায়ী ঠিকানা যেখান থেকে আপনি আমাকে উঠিয়ে এনেছেন, সেখান থেকে কিছুটা দূরের পাহাড়ের উপর। আজ রাত আমাদের উপর দায়িত্ব ছিল বিপরীত পাশে অবস্থিত পাহাড়ের উপর থেকে বিজলী চমকানো এবং আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটানো।
“বিজলী চমকানোর রহস্যটা আসলে কী?”
“আপনি ইচ্ছা করলে ওইসব লোকদের পাকড়াও করতে পারেন। অবশ্য সমস্যা হলো, ওরা এততক্ষণে হয়তো আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। ওরা যদি আমাকে জীবিত বা মৃত উদ্ধার করতে না পারে, তাহলে তাদের গোপন রহস্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে পারে। আপনি কি এদের পাকড়াও করার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?”
“যেখান থেকে আমি তোমাকে তুলে এনেছি, আমি তোমাকে সেখানে ছেড়ে দিয়ে আড়ালে বসে থাকবো। ওরা হয়তো তোমাকে খুঁজতে আসবে, তখন ওদের আমি পাকড়াও করবো।” বলল আজমীর।
তুমি যদি আমাকে ধোকা দিতে চেষ্টা করো, তাহলে মনে রাখবে তুমি সব সময় আমার তীরের নিশানার মধ্যেই থাকবে।”
“আমি আপনাকে ধোঁকা দেবো না। আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। ওঁ আমি আপনাকে এর প্রতিদান দেব।”
কমান্ডার আজমীর তরুণীকে যেখান থেকে তুলে এনেছিল, সেখানে পৌঁছে দিল। আজমীরের বর্শার আঘাতে নিহত বন্য শূকরটি মরে সেখানেই পড়ে আছে। অল্প পানি থাকায় স্রোত সেটিকে ভাসিয়ে নিতে পারেনি।
তরুণী ছাড়া পেয়ে নদীর তীর ধরে উজানের দিকে অগ্রসর হতে এবং এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাদের লোকজনকে তালাশ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর নদীর অপর তীরে দু’জন পুরুষকে দেখতে পেল তরুণী। তারা তরুণীকে ডাকল। তরুণী তাদেরকে হাতের ইশারায় এ পাড়ে আসার জন্য ডাকল। উভয়ে পাহাড়ী নদীর হাঁটুসমান পানি ভেঙে এ পাড়ে এসে তরুণীকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোত্থেকে এসেছে, এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?”
এরা যখন দাঁড়িয়ে পরস্পর কথা বলছিল, তখন নদীর তীরের ঘন ঝোঁপের আড়াল থেকে চারসঙ্গী সিপাহীসহ আজমীর ময়দানে বেরিয়ে এলো। তরুণীর পরিচিত পুরুষ দুজন আজমীরকে দেখে ঘাবড়ে গেল। আজমীরের হাতে তাক করা তীর-ধনুক। সে হুমকির স্বরে ওদের বলল, “পালাতে চেষ্টা করো না, যেখানে আছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক।”
আজমীরের হুমকি ও তার সাথে সশস্ত্র সঙ্গীদের দেখে তরুণীর দলের লোকজন ঘাবড়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। ইতোমধ্যে আজমীরের সাথীরা তাদের ঘিরে ফেলল।
“আমাদেরকে তোমাদের আস্তানায় নিয়ে চল।” তরুণীর দলের লোক দুজনকে নির্দেশের স্বরে বলল আজমীর।
তারা আজমীরের কথার কিছুই বুঝতে পারেনি এমন হাবভাব দেখিয়ে কৌশলে নির্দেশটি এড়িয়ে যাওয়ার ফন্দী করল। কিন্তু আজমীর তাদের বলল, কোন ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিলে তোমাদের হত্যা করা হবে। যদি ভালো চাও, তবে আমার নির্দেশ মতো তোমাদের আস্তানায় নিয়ে যাও।
আজমীরের কাছে তাদের সব চক্রান্তের জাল ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তরুণীকে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় গালমন্দ ও তিরস্কার করতে লাগল দুই পুরুষ। “হারামজাদী, তুই আমাদের সবকিছু প্রকাশ করে দিয়েছিস!”
ওদের কথাবার্তায় পাত্তা না দিয়ে আজমীর তরবারী কোষমুক্ত করে তাড়া দিয়ে বলল, বাঁচতে চাও তো আগে আগে আমাদের নিয়ে চলো।
আজমীরের নির্দেশে আগে আগে পথ দেখিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আরো গহীন জঙ্গলের দিকে যেতে লাগল লোক দুজন। কিছুক্ষণ পর লোক দু’জন একটি টিলার উপরের দিকে চড়তে লাগল। ঘন গাছ গাছালী ও লতাগুল্মে আকীর্ণ জায়গাটিতে কোন জনমানুষের পা পড়েনি। অনেকক্ষণ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠার পরও পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানো গেল না। অনেকটা উপরে এসে দেখা গেল এ জায়গাটায় পাহাড় দেয়ালের মতো খাড়া। এ জায়গায় পাহাড়ের উপর শুকনো কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে একটি ঝুপড়ী। ঝুপড়ীর কাছে বিশাল একটি শুকনো কাঠের স্তূপ। ঝুপড়ীর বাইরে লোকজনের কথাবার্তা শুনে ঝুপড়ী থেকে দুই তরুণী বেরিয়ে এলো। আজমীর উভয় তরুণীকে নদীতে জলকেলী করতে দেখেছিল। এরা বাইরে বেরিয়ে তাদের লোকজনকে ঘিরে রাখা সৈনিকদের দেখে ঘাবড়ে গেল।
কমান্ডার আজমীর ঝুপড়ীতে উঁকি দিয়ে দেখলো, ঝুপড়ীর ভেতরে একটি বিশালকায় কাঠের ফ্রেমে স্বচ্ছ আয়না। আরো আছে আয়নার চেয়েও আরো বেশী স্বচ্ছ বিশালাকার গ্লাস।
“এগুলো কী?” পুরুষ দু’জনকে জিজ্ঞেস করল আজমীর।
“এগুলো কিছু না। আমরা এমনিতেই এদিকে এসেছি।”
পুরুষ দুজনকে টালবাহানা করতে দেখে বন্য শূকরের আক্রমণ থেকে প্রাণে বাঁচানো তরুণীর দিকে তাকাল আজমীর। এই তরুণী এর আগেই জীবন বাঁচানোর জন্য আজমীরের প্রতি কৃতজ্ঞ। সেই সাথে একান্তে পেয়েও তার সাথে কোন পাশবিক আচরণ না করে তাকে আমানতের মতো পবিত্র জ্ঞানে নিরাপত্তা দেয়ায় সে আজমীরের কাছে ওয়াদা করেছিল, তার কাছে তাদের সব রহস্যই প্রকাশ করে দেবে। প্রদত্ত প্রতিশ্রতি অনেকটাই ইতোমধ্যে পূরণ করেছে সে। বাকীটুকু পূরণ করতে সঙ্গী পুরুষদের উদ্দেশ্যে তরুণী বলল, এখন আর টালবাহানা করা নিষ্ফল। কারণ, আমাদের অনেক কিছুই জেনে গেছে এরা।
তারা কমান্ডার আজমীরকে উপরে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল। পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে চতুর্দিকে তাকিয়ে আজমীর দেখতে পেল, গাছগাছালীর উপর দিয়ে তার চৌকি দেখা যাচ্ছে। গাছের ফাঁক দিয়ে আজমীর নদীর তীরের যে জায়গাটায় গিয়েছিল, সেই জায়গাটাও আবছা মতো দেখতে পেল।
আজমীরকে জানানো হলো, ওই যে শুকনো কাঠের স্তূপ দেখা যাচ্ছে, খাড়া পাহাড়ের এই জায়গায় রাতের বেলায় এই শুকনো কাঠের স্থূপে আগুন জ্বালানো হবে। এই আগুন পাহাড়ের নিচের গ্রামবাসীর দৃষ্টির আড়ালে থাকবে। এরপর বিশাল এই আয়নাটি সমতল পাহাড়ের যে জায়গাটায় তারা দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে রাখা হবে। জ্বলন্ত আগুনে ঢেলে দেয়া হবে তেল। তাতে আগুনের শিখা বহু উঁচুতে উঠে যাবে। জ্বলন্ত আগুনের ঝলক পড়বে আয়নার উপর। তখন আয়নাটিকে দু’-তিনবার বিরতি দিয়ে সেনাচৌকি ও গ্রামের দিকে ঘুরানো হবে। জ্বলন্ত আগুনের ঝলক আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়ে সেনাচৌকি ও গ্রামে প্রতিফলিত হবে। খুব অল্প সময়ে আয়নাটি ঘুরানোর কারণে আয়নায় প্রতিবিম্বিত আলোর ঝলকানীকে অজ্ঞাত লোকের কাছে বিজলীর ঝলক মনে হবে।
এদের কথার মর্ম উপলব্ধি করা আজমীরের পক্ষে মোটেও কঠিন ছিল না। কারণ, তরুণী তাকে আগেই জানিয়েছিল, আজ রাত তাদের পরিকল্পনা ছিল গ্রামের উপর বিজলী চমকানো এবং পাহাড়ে আগুন জ্বালানো। কয়েক দিন আগে অন্য পাহাড় থেকে গ্রামের উপর বিজলী চমকানোর বিষয়টিও এখন আজমীরের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
“এটা বুদ্ধির খেলা” বলল দু’ পুরুষের একজন।
রাতের অন্ধকারে আগুনের আলো এই আয়নায় প্রতিবিম্বিত হলে আলোর ঝলক সৃষ্টি করে। আর প্রতিবিম্বিত আলোকে পাহাড়ের নিচে বসবাসকারী গ্রামের লোকজন দেখে মনে করে আসমানের বিজলী। পাহাড়ের উচ্চতা সম্পর্কে জ্ঞাত লোকেরাও এটা ভাবতে পারে না, এই আলোর ঝলকানী পাহাড়ের চূড়া থেকে এসেছে। রাতের অন্ধকারে আলোর ঝলক দেখিয়ে দিনের বেলায় আমাদের প্রশিক্ষিত লোকজন গ্রামের মানুষের মধ্যে এই আলোকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের অলৌকিক কাহিনী প্রচার করে। আর লোকদের মধ্যে এসব কাহিনী বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে, জন্ম নেয় কল্পনা আর অবাস্তবতা মিলিয়ে ভৌতিক সব কল্পকাহিনীর গুজব।
আমাদের লোকেরা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে প্রচারণা চালায়, দেবদেবীদের ধর্ম ত্যাগ করার কারণে দেবতাগণ তোমাদের উপর রুষ্ট হয়েছেন। তোমরা আবার স্বধর্মে ফিরে না এলে গযব নেমে আসবে। বিভিন্ন রকম বিপদাপদে পতিত হবে তোমরা। এসব থেকে বাঁচার একটাই উপায়, তওবা করে আবার স্বধর্মে ফিরে এসো এবং দেবদেবীদের সন্তুষ্ট করার জন্য বেশী করে পূজা-অর্চনা করা।
লোকজন নির্জন স্থানে সুন্দরী উলঙ্গ পরীর বেশে যাদের দেখে প্রেতাত্মা কিংবা পরী মনে করেছে, এ তিন তরুণীই ছিল কথিত পরী বা প্রেতাত্মা। এরা এই এলাকার অধিবাসী নয়। লাহোর ও বাটান্ডার রাজমহলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশিষ্ট তরুণী এরা।
আল্লাহ তাআলা কমান্ডার আজমীরের বিগলিত মোনাজাত কবুল করেছেন। সে তার ঈমানের দ্যুতি এখন নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছে। তার কাছে সব অদ্ভুত ও আসমানী গজবের কাকাহিনীর অন্তরালে এসব যোগীদের ভণ্ডামীর ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন বিভ্রান্ত নওমুসলিম গ্রামবাসীকে এ ব্যাপারে অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করল কমান্ডার আজমীর। দুই যোগী পুরুষ ও তিন তরুণীকে পাকড়াও করে সেনাচৌকিতে এনে কঠোর প্রহরায় রাখল আজমীর। সেই সাথে তাদের জিজ্ঞেস করল, আর কোন কোন জায়গায় তাদের লোজন এমন কাণ্ডকারখানা ঘটাচ্ছে?
* * *
এদিকে সেনাপতি সরওয়াগের কাফেলা পথে পাওয়া দুই গাইডের দেখানো পথে অগ্রসর হচ্ছিল। ইমাম সাহেব কয়েকবার দুই গাইডকে উদ্বিগ্নকণ্ঠে বললেন, কী ব্যাপার! এতো সময় লাগছে কেন? এতো দিনে তো আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা!
জবাবে দুই গাইড ইমামকে বোঝালো, অত্যধিক নিরাপত্তার কারণে তারা দীর্ঘপথে অগ্রসর হচ্ছে। কারণ, এ পথটি সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজ।
আসলে গাইডদের নিয়ে যাওয়া পথ মোটেও সহজ ছিল না। গাইডদ্বয় কাফেলাকে বিভ্রান্ত করে অচেনা দুর্গম দীর্ঘ পথে নিয়ে যাচ্ছিল।
একদিন রাতের বেলা এক জায়গায় বিশ্রাম করার জন্য যাত্রাবিরতি করল কাফেলা। তখন গাইড দু’জন কাফেলার প্রধান সরওয়াগকে জানাল, “আগামীকাল দ্বিপ্রহরের আগেই তারা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। বিরতিহীনভাবে দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করার ফলে কাফেলার সবাই ছিল খুবই ক্লান্ত। যাত্রাবিরতি দিয়ে হাল্কা কিছু খাওয়া-দাওয়ার পর গা এলিয়ে দিতেই সবাই ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
সকালে যখন তাদের ঘুম ভাঙল, তখন উভয় গাইড উধাও। খোঁজাখুঁজি করে তাদের কোথাও পাওয়া গেল না। খোঁজাখুঁজি করাও সহজ ছিল না। চতুর্দিকে উঁচু পাহাড়। ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ে ঢাকা পাহাড়। গাছ গাছালী ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। তারা কোথায় এসেছে, কোন দিকে যেতে হবে কিছুই জানে না তারা। যে পথে এসেছে এই পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ তাদের জানা নেই।
আফসোস! হিন্দুদের চক্রান্তের শিকার হয়েছি আমরা। এরা দু’জন জানতো, আপনি আমাদের এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নানা গল্প বলছিলেন, এরা এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে। ইমামের উদ্দেশ্যে বললেন সেনাপতি সরওয়াগ।
“আমরা যখন বালনাথ দুর্গের পাশ দিয়ে আসছিলাম, তখন আমি দু’জন অশ্বারোহীকে দূরে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি মনে করেছিলাম, ওরা হয়তো কোন পথিক। কে জানে ওরাই কি সেই পথিক কি-না?” বললো এক সিপাহী।
“প্রথম যখন আমরা সাপ দেখি, তখন আমি ওদের দেখেছিলাম, কিন্তু তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না।” বললো অপর এক সিপাহী।
“তোমাদের দেখা লোকেরা এরাই হোক বা অন্য কেউ হোক, তাতে কী আসে যায়?” বললেন সারওয়াগ। আসল কথা হলো, আমরা এক ভয়ানক প্রতারণার শিকার হয়েছি। এখন এখান থেকে কিভাবে বের হওয়া যায় চিন্তা কর। আর একটা কাজ কর, আমাদের পুটলীতে খাওয়ার মতো যা কিছু আছে সব ফেলে দাও। এতে ওরা বিষ মিশিয়ে রেখে যেতে পারে। সেনাপতির নির্দেশে খাবার যা কিছু ছিল বিষ সব ফেলে দেয়া হলো।
এবার শুরু হলো অজানা-অচেনা পথে কঠিন এক সফর। এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সারা দিন কেটে গেল। রাতটা কোনমতে কেটে গেল বটে; কিন্তু অত্যধিক ঠাণ্ডায় কেউই স্বস্তি পেল না। পরদিনও এভাবেই অজানা অচেনা পথে ঘুরে ঘুরে কেটে গেল। পরদিন রাতে যে সময় সারওয়াগের কাফেলা ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য একটু উষ্ণ জায়গা খুঁজছিল, ঠিক সেই সময় প্রতারক দুই হিন্দু গাইড লোহাকোট দুর্গে বসে দুর্গপতির কাছে তাদের কাজের বর্ণনা দিচ্ছিল, কিভাবে তারা সারওয়াগের কাফেলাকে অচেনা পাহাড়ী জায়গায় ফেলে এসেছে। সেখান থেকে ওদের বেরিয়ে যাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়।
“তোমরা ওদের হত্যা করে এলে না কেন?” দুর্গপতি আফসোস করে বলল। সুলতান মাহমূদ কোন সাধারণ লোককে আঞ্চলিক কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়নি। তোমরা খুবই মূল্যবান শিকার হাতে পেয়েছিলে। তোমাদের কাজে আমি খুবই খুশী। কিন্তু ওদের ইহলীলা সাঙ্গ করে আসতে পারলে বেশী খুশী হতাম।’
“কালাঞ্জর থেকে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কোন মুসলমান সেনাকে যেন কেউ হত্যা না করে। আমরা জানি না এ নির্দেশ কেন দেয়া হয়েছে। নয়তো খুব সহজেই আমরা ওদের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারতাম।
“কালাঞ্জরের মহারাজা ভেবেচিন্তেই বলেছেন, তিনি হয়তো সুলতান মাহমূদকে এই বার্তাই দিতে চান, চুক্তি অনুযায়ী এখানে তার সৈন্যরা নিরাপদেই আছে। তবে তারা নিজেরাই যদি অচেনা জায়গায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে মারা যায়, তাতে আমাদের কি করার আছে?”
আসলেও তাই হলো। সারওয়াগকে তার কাফেলাসহ অচেনা পথে ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া থেকে কে রক্ষা করবে? তারা নিজেরাই তো ওখানে গিয়েছে। দুদিন একটানা ঘুরেও তারা না পেল কোন পথের সন্ধান, না পেল কোন জনবসতির চিহ্ন। দূরে কাছে কোথাও কোন জনমানবের চিহ্ন তাদের চোখে পড়ল না। পানাহারবিহীন এই নির্জন জঙ্গলে প্রায়ই তাদের চোখে পড়ে জোড়ায় জোড়ায় পাহাড়ী বাঘ। সিংহের গর্জনও কানে আসে। পৃথিবীর এতো সৌন্দর্যমণ্ডিত মায়াবী এই জমিন তাদের কাছে এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো।
খুবই কার্যকর একটা চাল দিয়েছে হিন্দু চক্রান্তকারীরা। সারওয়াগ ছিলেন এই এলাকার আঞ্চলিক সেনাপ্রধান। প্রধান সেনাধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে নওমুসলিমদেরকে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য তারা যে চক্রান্তের আয়োজন করেছিল, সারওয়াগের অনুপস্থিতিতে সেই কর্মকাণ্ড চালানোর প্রধান প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেল। হিন্দু যোগী-সন্ন্যাসী ও পুরোহিতরা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে খুবই দক্ষ ও নিপুণ। মন্দিরগুলোতে পুরোহিতরা পূজারীদের বলতে লাগল, গোমা-তা যেমন পবিত্র, মুসলমানরা তেমনই অপবিত্র। মুসলমানদের হত্যা করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা ধর্মের প্রধান কাজ। মন্দিরের পুরোহিতরা মুসলমান হত্যাকে ধর্মের সবচেয়ে বড় পুণ্যের কাজ বলে ঘোষণা করে। সেই দিনের পুরোহিত আর নব্য ভারতের হিন্দু নেতাদের নীতির আদর্শের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আজো ভারতকে মুসলমানশূন্য করার ব্যাপারে সকল হিন্দুই এক ও অভিন্ন মত পোষণ করে।
১০১৪ খৃস্টাব্দের একদিন। রাজা নন্দরায় কালার দুর্গে বসে দুষ্কৃতকারী দলপতির কাছ থেকে তাদের কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট শুনছিলেন। রাজা নন্দরায় দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা বিজিত এলাকাসমূহের নওমুসলিমদের বিভ্রান্ত করে পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনা এবং মুসলিম শাসকদের উৎখাত করার চক্রান্তের জাল বুনেছিলেন, তা মুসলিম সৈন্য ও শাসকদের কাছে ধরা পড়ে যায়। তারা যাদুটোনা এবং সুন্দরী নারীদেরকে প্রেতাত্মারূপে গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের কাছে হিন্দু দেবদেবীদের গযবের আলামত হিসেবে উপস্থাপন করতে পাহাড়ের উপর থেকে কৃত্রিম আলো ফেলে বিজলী তৈরী করে। দুষ্কৃতকারী দলের নেতা বলছিলো, আমাদের প্রশিক্ষিত দলের দুই পুরুষ সদস্য ও তিন কিশোরীকে মুসলিম সৈন্যরা আসবাবপত্রসহ পাকড়াও করেছে এবং তাদেরকে গ্রামে গ্রামে নিয়ে গিয়ে মানুষকে সবকিছু দেখিয়ে বলেছে, এরাই হলো তোমাদের দেখা আসমানী গজবের প্রতীকী প্রেতাত্মা আর এইসব আসবাব হলো আসমানী বিজলীর রসদ।
কমান্ডার আজমীর যে কয়জনকে গ্রেফতার করেছিল, তাদের জীবন ভিক্ষা এবং বিনা শাস্তিতে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কুচক্রী দলের অন্য সদস্যদেরও ঠিকানা-পরিচয় জেনে নিয়েছিল।
তরুণীকে ব্যবহার করে আজমীর তার পুরুষ ও অন্য সাথীদের যেভাবে পাকড়াও করে, ঠিক একই কৌশলে অন্যান্য কুচক্রীদেরও সে পাকড়াও করতে সমর্থ হয়।
একদিন আজমীর কয়েক গ্রামের লোকজনকে একত্রিত করে কুচক্রী দলকে তাদের সামনে দাঁড় করিয়ে বলতে বাধ্য করল, এ পর্যন্ত দেবদেবীদের নামে তাদের কাছে যা প্রচার করা হয়েছে, তার সবই ছিলো শুধুই গুজব, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। গ্রামের অনেকেই অপকর্মকারীদের চিনে ফেলল। চক্রান্তকারীরা গ্রামের লোকদের কাছে তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ করে দেয়। সন্ধ্যার পর আজমীর কুচক্রীদেরকে রাতের বিজলী চমকানোর মহড়া দিতে এবং তরুণীদেরকে প্রেতাত্মারূপে আবির্ভূত হয়ে দেখাতে বাধ্য করে।
মহারাজা নন্দরায় যখন দেখতে পেলেন, তার চক্রান্ত ভণ্ডুল হয়ে গেছে, তখন তিনি যেসব ইমাম ও প্রশিক্ষক নওমুসলিমদেরকে ইসলাম শিক্ষা দিচ্ছে এবং ইবাদত-বন্দেগীর তালিম দিচ্ছে, তাদের হত্যা করে লাশগুলো এমনভাবে গুম করার নির্দেশ দেন, যাতে এর কোন আলামত কেউ খুঁজে না পায়। যেসব ক্যাম্পে গযনী বাহিনীর সৈন্যরা অবস্থান করছে, তাদেরকে ক্যাম্প থেকে একজন দু’জন করে বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশ দেন রাজা নন্দরায়।
এক রাতে আজমীর তার ক্যাম্পের একটি কক্ষে একাকী বসে ছিল। তার পাশেই একটি কক্ষে চক্রান্তকারী পুরুষ ও তরণীদের আটকে রাখা হয়েছিল। ওদের কক্ষের সামনে কমান্ডার আজমীর প্রহরার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। বন্দীদের একথাও বলে দিয়েছিল সে আগামীকালই তোমাদের দলের পুরুষদের বালনাথ পাঠিয়ে দেয়া হবে। আঞ্চলিক কমান্ডার সেনাপতি সারওয়াগের হাতে তোদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। আর তরুণীদেরকে সেনাপ্রহরায় কালাঞ্জর পাঠিয়ে দেয়া হবে।
রাতের মধ্যভাগে এক সিপাহী কমান্ডার আজমীরকে এসে জানালো, এক বন্দী তরুণী আপনার সাথে কথা বলতে চায়।
কমান্ডার আজমীর তরুণীকে ডেকে পাঠাল। সে যে তরুণীকে নদী থেকে তুলে এনেছিল, সে-ই ছিল সাক্ষাত প্রত্যাশী।
“সম্মানিত কমান্ডার, আজ রাতেও কি আপনি আমাকে কাছে ডাকবেন না? অন্তত আজ রাতটি আপনার কাছে কাটাতে ইচ্ছে করছে আমার।”
তরুণীর কথায় হাসি পেল আজমীরের। সে বলল, আমি অনুভব করি, তুমি অস্বাভাবিক সুন্দরী। আল্লাহর কসম, তোমার মতো রূপসী নারী আমি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। তোমার বিস্মিত হওয়ার বিষয়টিকে আমি বুঝি না এমন নয়। আমার মতো একজন যুবকের পক্ষে দীর্ঘদিন স্ত্রীসঙ্গবিহীন জীবন কাটানোর পর তোমার মতো রূপসীকে হাতের নাগালে পেয়ে একটুও আকৃষ্ট না হওয়ার ব্যাপারটি তোমাকে অবাক করেছে। অথচ তোমরা প্রত্যাশা কর, আমি
তোমাদের রূপের প্রতি আকৃষ্ট হই। কিন্তু তুমি যদি আমার মতো মুসলমান হতে, তোমার উপরে যদি আমার মতো এমন কঠিন দায়িত্ব ন্যস্ত থাকতো, তুমি যদি ঈমানের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হতে, তাহলে আর তোমার কাছে ব্যাপারটি অস্বাভাবিক মনে হতো না। তোমাদের দৃষ্টি মানুষের দেহের প্রতি, এটা তোমাদের ধর্মের শিক্ষা আর আমাদের দৃষ্টি থাকে আত্মার প্রতি। আত্মাকে কেন্দ্র করেই আমাদের ধর্মবিশ্বাস আবর্তিত। এটাই আমাদের ধর্মের শিক্ষা।”
“তোমার ভালোবাসা পেতে আমি যদি মুসলমান হয়ে যাই?”
“কালনাগিনীর বিষ খুলে নিলেও সে কালনাগিনীই থাকে। তাকে যদি মধুও পান করাও, তবুও তার দেহে বিষই উৎপাদিত হবে এবং এক সময় ঠিক নাগিনীর মতোই ছোবল মারবে। কারণ, এটাই তার ধর্ম।…”
আমি এখানে প্রেমপ্রীতির খেলা আর বিয়ে-শাদী করে সুন্দরী নারী নিয়ে ফুর্তি করতে আসিনি। তোমার এই অপরূপ সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। এটা আমার ঈমানের শক্তি। এ কারণে আমার দৃষ্টি নিজের যৌবনের প্রতি যেমন পড়ে না, তদ্রপ তোমার মতো রূপসীর দেহবল্লরীর প্রতিও আমি আকর্ষণ বোধ করি না। শোন সুন্দরী! আমার ধর্ম আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, শত্রুপক্ষের কোন অবলা নারী যদি তোমাদের হাতে বন্দী হয়, তখন তাদের অসহায়ত্বের সুযোগে তাদের রূপরসের স্বাদ নেয়া মহা অপরাধ। নারী বন্দীদেরকে তোমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখবে।”
আজমীরের কথা শুনে তরুণীর চোখে পানি এসে গেল। সে আজমীরের চৌকিতে তার সাথে গা মিশিয়ে বসল। আজমীরের কাঁধে একটি হাত রেখে তরুণী এমনভাবে তার শরীরে গা এলিয়ে দিয়ে বসল যে, তার এলো চুলগুলো আজমীরের নাকে-মুখে স্পর্শ করছিল। বিগলিত কণ্ঠে তরুণী আজমীরকে বলল–
“আপনি আমাকে বন্য শূকরের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন আপনি আমাকে মুক্ত করে পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে চাচ্ছেন। এতোটা দিন আমাদের মতো তিনটি যুবতী মেয়ে সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার উপর আপনার দয়া-অনুগ্রহে কাটালাম, তারপরও আপনি আমাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া তো দূরে থাক আমাদের রূপ যৌবনের প্রতি একটু গভীরভাবে তাকিয়েও দেখেননি। আপনি পাথর হয়ে রইলেন…।”
কথা বলতে বলতে নীরব হয়ে গেল তরুণী। এক পর্যায়ে দুহাতে আজমীরের চেহারা তার দিকে ঘুরালো। মমতা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আজমীরের প্রতি তার আত্মনিবেদনের ভাব তরুণীর চোখে-মুখে ফুটে উঠলো।
হঠাৎ তরুণী বললো, “আমি তাজা রক্তের গন্ধ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আপনি কোন গভীর বেদনায় আক্রান্ত। আজমীর, আপনি কি আহত?”
আস্তে করে বামহাতটি উপরে উঠালো আজমীর। তার হাতে একটি ধারালো খঞ্জর। খঞ্জরের অগ্রভাগ রক্তমাখা। তরণী তার ডানপাশে বসে ছিল। সে দেখতে পায়নি, সে যখন আজমীরের গলা জড়িয়ে গায়ে গা এলিয়ে দিয়ে আজমীরের দেহে কামনার আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করছিল, এই প্রমোদনা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অতি সন্তর্পণে আজমীর তার কোমরে রক্ষিত খঞ্জর কোষমুক্ত করে ধীরে খোলাপায়ের উপরিভাগে বিদ্ধ করল। তরুণী রক্তমাখা খ র দেখে বসা থেকে উঠে আজমীরের মুখোমুখি দাঁড়াল। তখন আজমীরের পায়ের ক্ষতস্থানের দিকে তার নজর পড়ল। ফিনকী দিয়ে সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে সেদিকে কতোক্ষণ তাকিয়ে রইল তরুণী।
“এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই সুন্দরী।” আমি মানুষ, ফেরেশতা নই। আমি পুরোপুরি সক্ষম একজন যুবক। তোমার শরীরের স্পর্শ ও রেশমী চুলের ছোঁয়া আমাকে স্বীয় কর্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছিল। আমি শুধু সুলতানের চাকুরী করি না, আল্লাহর দরবারেও আমার কর্তব্য সম্পর্কে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ভূখণ্ডে একজন সুলতান আর মহারাজাদের সংঘাত রাজ্য দখল নিয়ে নয়, এটি সত্য ও ন্যায় এবং অসত্য ও অন্যায় মতবাদের সংঘাত।
আমি সাময়িক একটু সুখ ভোগের জন্য আমার আজীবন লালিত স্বপ্ন ও আদর্শকে জলাঞ্জলী দিতে পারি না। তোমার রূপ-সৌন্দর্য ও সমর্পিত নিবেদন উপেক্ষা করে মনের মধ্যে চাপও সৃষ্টি করতে চাই না। এজন্য তোমার দিকে থেকে দৃষ্টি ফেরাতে নিজের পায়েই খঞ্জর বিদ্ধ করেছি।… ঠিক আছে তুমি এখন নিজের কক্ষে চলে যাও।…
তরুণী আজমীরের একটি হাত টেনে নিয়ে তার চোখে স্পর্শ করাল এবং তাতে চুমো খেয়ে নিজ কক্ষে চলে গেল।
পরদিন সকালে তিন তরুণীকে তিনটি ঘোড়ায় সওয়ার করে দশজন অশ্বারোহী সহযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কমান্ডার আজমীর কালারের পথে রওনা হয়ে গেল। তরুণীরা বারবার তাদের ঘোড়া আজমীরের ঘোড়ার পাশে নিয়ে আসছিল। কিন্তু আজমীর তাদের প্রতি মুচকি হাসি উপহার দেয়া ছাড়া কোন কথা বলেনি।
মধ্যরাতের পরে কালার দুর্গের প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছলো আজমীরের কাফেলা। দুর্গের অনতিদূরে তরুণীদের নামিয়ে দিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে আসতে উদ্যত হলো আজমীর।
জীবন বাঁচানোর কৃতজ্ঞতায় আজমীরের কাছে নিজেকে সমর্পণকারী মেয়েটি আজমীরের পথ আগলে দাঁড়িয়ে বিনীত কণ্ঠে বললো, “আপনার উপকারের কোন প্রতিদান আমি দিতে পারিনি। আমার দেহ ছাড়া আপনাকে দেয়ার মতো আর কিছু ছিলো না আমার। এজন্য আজীবন একটা দুঃখবোধ আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে।”
“আমি কোন প্রতিদান চাই না। আমাকে আমার প্রভু উত্তম প্রতিদান দিবেন। তুমি তোমাদের রাজাকে গিয়ে বলো, যুদ্ধ হয় রণাঙ্গনে পুরুষে-পুরুষে। নারীকে দিয়ে কখনো যুদ্ধ জেতা যায় না।”
সহযোদ্ধাদের নিয়ে ফিরে আসার পথে আজমীরের মন ছিল ফুরফুরে। আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে নিজেকে সমর্পণ করার পর আল্লাহ তার আবেদন মঞ্জুর করেছেন। তার ঈমানের নূর সে প্রত্যক্ষ করেছে। সেই সাথে অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করতে পেরেছে সে।
এদিকে সেনাপতি সারওয়াগ অচেনা পাহাড়ের ঘূর্ণিপাকে ঘুরে ঘুরে হয়রান। তিন-চারদিন বিরতিহীন ঘুরে-ফিরেও পাহাড়ের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছার কোন পথ পায়নি তারা। এই এলাকায় যদি খাওয়ার উপযোগী সুমিষ্ট ফলজ গাছের সমারোহ এবং সুপেয় পানির প্রাচুর্যতা না থাকতো, তাহলে এতোদিনে তাদের পক্ষে জীবন বাঁচানোই অসম্ভব হয়ে যেতো।
লোহাকোট দুর্গের হিন্দু রাজাকে প্রথম এ খবরটি দেয়া হলো যে, বালনাথ দুর্গের মুসলিম দুর্গপতি এবং গযনী সুলতানের আঞ্চলিক প্রশাসক সেনাপতি সারওয়াগ একজন ইমাম ও কয়েকজন সৈন্য নিয়ে পাহাড়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদেরকে হিন্দুরা বিভ্রান্ত করে পাহাড়ের মধ্যে এনে ছেড়ে দিয়েছে। লোহাকোট দুর্গের দুর্গপতি কালবিলম্ব না করে এ খবরটি রাজা নন্দায়কে জানাল। রাজা নন্দরায় এ খবর শুনেই নির্দেশ দিলেন, ওদের সবাইকে পাকড়াও করে দুর্গে নিয়ে আসা হোক।
এক দিন পর পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম সেনাচৌকির এক সিপাহী কমান্ডার আজমীরের চৌকিতে এসে সেই চৌকির কমান্ডারের পক্ষ থেকে জানাল
“আমি খবর পেয়েছি, কালাঞ্জর দুর্গের একটি সেনাদল আমাদের সেনাবাহিনীর একটি ছোট্ট কাফেলাকে গ্রেফতার করে কালাঞ্জর নিয়ে যাচ্ছে। আমার পক্ষে এটা জানা সম্ভব হয়নি যে, এই মুসলিম সৈন্যরা কারা এবং কোন চৌকির সৈনিক? আমি ওদের উদ্ধার করতে যাচ্ছি, কিন্তু আমার জনবল খুবই কম। যথাসম্ভব জনবল দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করুন।”
“সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তার চৌকির বাছাই করা দশজন সিপাহীকে নিয়ে আজমীর নিজেই রওনা হলো। পথ ছিল দুর্গম এবড়ো-থেবড়ো। তারপরও আজমীর ও সাথীরা চার-পাঁচ ঘণ্টর মধ্যে সংবাদ প্রেরণকারী চৌকির কমান্ডারের কাছে পৌঁছে গেল।
গযনী বাহিনীর কয়েকজন সদস্যক কালারের সৈন্যরা গ্রেফতার করার খবরটি দিয়েছিল স্থানীয় একজন অধিবাসী। সে জানালো, হিন্দুদের দলের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাটজনের কম হবে না। আজমীর ও সংবাদদাতা কমান্ডার ত্রিশজন সিপাহী নিয়ে উদ্ধার অভিযানে রওনা হলো। সংবাদদাতা লোকটিই ছিল তাদের গাইড। বেশী দূর যেতে হলো না তাদের। ঘন্টাখানিক অগ্রসর হওয়ার পর ময়দান পেরিয়ে একটি পাহাড়ী উপত্যকায় পৌঁছে তারা দেখতে পেল হিন্দুবাহিনীর বেষ্টনীতে গমনকারী কয়েকজন মুসলিম যোদ্ধাকে। দূর থেকেই তারা সেনাপতি সারওয়াগকে চিনতে পারল। সেই সাথে অন্য সিপাহীরাও ছিল তাদের পরিচিত।
কাছাকাছি গিয়ে আজমীর হিন্দুদের শাসিয়ে বলল, “বন্দীদের এখানেই ছেড়ে দিয়ে তোমরা চলে যাও।”
হিন্দুরা আজমীরের হুমকির কোন মৌখিক জবাব না দিয়ে মোকাবেলার প্রস্তুতিতে সারিবদ্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথে আজমীরের নেতৃত্বে সহযোদ্ধারা হিন্দুদের উপর হামলে পড়লো। হিন্দু ও মুসলমান উভয় পক্ষের সবাই ছিল অশ্বারোহী। হিন্দুদের হাতে বন্দী সারওয়াগের সাথীদের সবাইকে ওরা পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করেছিল। শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ। অল্পক্ষণের মধ্যে বন্দীদেরকে মুক্ত করতে সক্ষম হলো আজমীরের দল। উভয় পক্ষের মধ্যেই হতাহতের ঘটনা ঘটলো।
এক পর্যায়ে হিন্দুবাহিনী পালিয়ে গেলে বন্দীদশা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত সারওয়াগ ও তার সাথীরা নিহত যযাদ্ধাদের ঘোড়াগুলো ধরে সেগুলোতে সওয়ার হয়ে নিকটবর্তী মুসলিম সেনাচৌকির দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু এই দলের মধ্যে কমান্ডার আজমীরকে দেখা গেল না।
কমান্ডার আজমীরের ঘোড়া আহত হয়ে রণাঙ্গন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। আজমীর ঘোড়া না ছেড়ে এটিকে নিয়ে চৌকিতে ফেরার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পলায়নপর সাত-আটজন হিন্দু সৈন্য পেয়ে গেলো তাকে। ওরা আজমীরকে একাকী পেয়ে ঘেরাও করে ফেলল। ঘোড়াটি দুর্বল হয়ে পড়ায় তার পক্ষে পালানো সম্ভব ছিলো না। একাকী এতোজনের মোকাবেলা করাও সম্ভব ছিলো না তার। অগত্যা অসহায় আজমীরকে গ্রেফতারী বরণ করতে হলো। হিন্দুরা তাকে ঘোড়ার পিঠে বেধে কালাঞ্জর নিয়ে গেল। পথিমধ্যে আরো হিন্দু সৈন্য এদের সাথে মিলিত হলো। তারাও দু’জন মুসলিম সৈন্যকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছিল।
মুহূর্তের মধ্যে দুর্গে রটে গেল, কয়েকজন মুসলিম সৈন্যকে বন্দী করা হয়েছে। রাজমহলের ভেতরের রক্ষিতা ও নর্তকীদের কাছে চলে গেল মুসলিম সৈন্য গ্রেফতার করে আনার খবর। বন্য শূকরের আক্রমণ থেকে আজমীরের উদ্ধার করা নর্তকী এ খবর শুনে তৎক্ষণাৎ বের হয়ে এলো। কারণ, মুসলমান সৈন্যদের বন্দীশালায় বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে সে। মুসলমানদের উন্নত মানসিকতা, ধর্মনিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা ও সর্বোপরি আদর্শের পরাকাষ্ঠা সে গযনী বাহিনীর মধ্যে দেখেছে। এখন সেই গযনী বাহিনীর সৈনিককে হিন্দুদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার খবরে সে তাদের নিজ চোখে দেখার আগ্রহ দমাতে পারলো না। কমান্ডার আজমীরের বীরত্ব, হৃদ্যতা, মানবিকতা, উন্নত নৈতিকতার কারণে গোটা গযনী বাহিনীর প্রতিই সেই তরুণীর হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভক্তির আসন সৃষ্টি হয়েছিল। ধর্মীয় চাপে মুসলমানদের প্রতি যতই হিংসা থাকুক না কেন, হৃদয়ের গভীরে শ্রদ্ধার আসনটিকে সে সরিয়ে দিতে পারছিলো না। তাই নিজ চোখে মুসলমান বন্দীদের দেখার জন্য যখন সে বন্দীদের কাছে পৌঁছল, আজমীরকে দেখে হতচকিয়ে গেল তরুণী, তখন মুহূর্তের মধ্যে সে সিদ্ধান্ত নিল, যে লোক হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে, তাকে বাঁচাতে আমি সম্ভাব্য সব কিছুই করব। যেই ভাবনা সেই কাজ।
হিন্দু সৈনিকদের কমান্ডারকে হাতের ইশারায় একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে তরুণী তার কানে কানে আজমীরকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলো। সে কমান্ডারকে জানালো, এই মুসলিম সৈনিক কিভাবে তার জীবন বাঁচিয়েছিলো এবং এর প্রতিদানে নিজেকে পেশ করার পরও সে তা গ্রহণ করেনি। তরুণী কমান্ডারকে বললো, তুমি এ কাজ করলে তোমাকে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশী পুরস্কার দেবো এবং তাকে এমনভাবে দুর্গের বাইরে পাঠাবো যে, কেউ ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারবে না।
তখনও পর্যন্ত বন্দীরদেরকে কোন সরকারী উচ্চ মহলের কাছে পেশ করা হয়নি। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে। বন্দীদেরকে তখন বন্দীশালায় রেখে দেয়ার কথা। হিন্দু কমান্ডারকে ছলে-বলে-কৌশলে আজমীরের মুক্তিদানে সম্মত করিয়ে তরুণী অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আজমীরকে একটি ঘন ঝোঁপ-ঝাড় ও গাছগালাছীর আড়ালে নিয়ে গেল। আজমীরকে এখানে বসিয়ে রেখে তরুণী দৌড়ে চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে কিছু কাপড় ও একটি ঘোড়া নিয়ে এলো। তাড়াতাড়ি আজমীরের গায়ে পরিয়ে দিল হিন্দু ঋষি-পুরোহিতদের কাপড় এবং তাকে একজন বয়স্ক পুরোহিতের পোশাকে সজ্জিত করে মাথায় বিশেষ পাগড়ী বেধে দিল এবং ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অগ্রসর হতে বলে নিজে আগে আগে চলল।
শাহী নর্তকী এগিয়ে গিয়ে প্রধান ফটকে প্রহরারত দায়িত্বশীল অফিসারকে বললো, “বাবাজি আমাদের কাছে এসেছিলেন। এখন জরুরী কাজে তাকে দুর্গের বাইরে অবস্থিত কাছের গ্রামে যেতে হচ্ছে। সেখানে দু’জন লোক মারা গেছে। তিনি পৌঁছুলে পরেই শুরু হবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। অন্দরমহল থেকে আমাকে দ্বার খুলিয়ে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।”
দ্বাররক্ষী জানতো, এই তরুণী রাজমহলের নর্তকী। রাজপ্রাসাদ ও মহলে এই তরুণী প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কেও অবহিত দ্বাররক্ষী। তাই কোন ধরনের দ্বিধা-চিন্তা না করে দ্বার খুলে দিল সে। পুরোহিতবেশী আজমীর বিনা বাধায় ফটক পেরিয়ে গেল। তাকে বের করে দিয়ে পুনরায় বন্ধ করে দিল ফটক। আজমীর দুর্গ থেকে বেরিয়ে ঘোড়া না হাঁকিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলো। দুর্গ থেকে অনেক দূরে গিয়ে সে পুরোহিতের বেশধারী জামা খুলে ফেলল এবং পেট মোটা করার জন্য জামার নিচে গুঁজে দেয়া কাপড়ও ছুঁড়ে ফেলে দিল। মাথার বিশেষ পাগড়ীও ফেলে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে চৌকির উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকাল আজমীর।
একটানা ঘোড়া হাঁকিয়ে পরদিন অপরাহ্নে নিজের চৌকিতে পৌঁছল আজমীর। সেনাপতি সারওয়াগ ও তার যেসব সঙ্গী হিন্দুদের হাতে বন্দী হয়েছিল, তারা মুক্ত হয়ে আজমীরের সেনাচৌকিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কারণ, সব কাছের চৌকির মধ্যে আজমীরের চৌকিই ছিল সবচেয়ে মজবুত ও নিরাপদ।
“আরে আজমীর যে! এ দুদিন তুমি কোথায় ছিলে? এখন কোত্থেকে এলে? দুদিন পর আজমীরকে চৌকিতে ফিরতে দেখে জানতে চাইলেন সেনাপতি সারওয়াগ।
“আগে জরুরী কথা শুনুন।” বললো কমান্ডার আজমীর। আমার ঘোড়া অচল হয়ে গিয়ে আপনাদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। আমার একাকীত্ব ও ঘোড়র অচলাবস্থা আমাকে বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য করে। একজনের সহায়তায় আমি কালাঞ্জর দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ। কালাঞ্জরের রাজা এখানকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রেখেছিল, আপনি তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আল্লাহর মেহেরবানী যে, তাদের এ চক্রান্ত ভণ্ডুল হয়ে গেছে। আপনাকে গ্রেফতার করে কালাঞ্জর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই প্রমাণ করে, এখানকার ছোট ছোট সব হিন্দু রাজারা আর আমাদের করদরাজা হিসেবে থাকতে রাজি নয়। এরা গোপনে সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। কালার দুর্গ থেকে আমি জানতে পেরেছি, কালার দুর্গে দু-তিনজন রাজার সকল সৈন্য একত্রিত হচ্ছে। লাহোরের মহারাজা ভীমপাল নিজে বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে কালার দুর্গে আসছেন। সম্ভবত সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ড ভীমপালের হাতে থাকবে। মহারাজারা কালার দুর্গে একত্রিত হয়েই সুলতানকে কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পয়গাম পাঠাবে। এরপর আমাদের ছোট ছোট চৌকিগুলো ধ্বংসের কাজ শুরু হবে।”
“এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক।” বললেন সেনাপতি সারওয়াগ। যে কোন পরাজিত শক্তি প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করতেই পারে। হিন্দু এমন এক দ্বিমুখী জাতি যে, এরা পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে হলে তোমার সামনে তরবারী ফেলে দিয়ে পায়ে পড়ে, ভিক্ষুকের মতো প্রাণভিক্ষা চাইবে। তখন যদি ওদের মুক্তির বিনিময়ে বলো তোমাদের সকল কন্যা, জায়া, ভগ্নিকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে, তাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করবে না। কিন্তু কোনমতে তোমার তরবারীর কামুক্ত হতে পারলেই বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল মারবে। হিন্দুদের সাথে আমাদের যুদ্ধ রাজত্বের সীমা কিংবা ধন-সম্পদ নিয়ে নয়, আমাদের সাথে হিন্দুদের সংঘাতের একমাত্র কারণ ধর্মীয় বিশ্বাস। এ যুদ্ধ যতদিন পর্যন্ত হিন্দুস্তানে একজন হিন্দু কিংবা মুসলমান থাকবে, ততোদিন পর্যন্তই অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, হিন্দুরা কখন আমাদের আক্রমণ করে।”
“আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, হিন্দুদের আক্রমণ দেখার জন্য আমাদের নিষ্ক্রীয় বসে থাকা ঠিক হরে না। আজই একজন দূত গযনী সুলতানের কাছে এই আশঙ্কার সংবাদ দিয়ে পাঠানো দরকার। আমাদের উচিত হবে শত্রুদের শক্তি ও সামর্থের ব্যাপারে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর না ভোলা। কারণ, যখন ওদের আক্রমণ শুরু হয়ে যাবে, তখন অল্প কজন লোক দিয়ে আপনি ওদের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা কিভাবে করবেন? বললো কমান্ডার আজমীর।
আজমীরের প্রস্তাব খুবই যৌক্তিক মনে হলো সেনাপতি সারওয়াগের। তিনি তখনই মৌখিক পয়গাম দিয়ে গযনীর উদ্দেশ্যে দু’জন সৈনিক পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। তাদেরকে বলা হলো, পথিমধ্যে যথাসম্ভব কম বিশ্রাম নেবে এবং প্রয়োজন হলে প্রত্যেক চৌকি থেকে ঘোড়া বদল করে নেবে।
প্রত্যাশার চেয়েও কম সময়ে দূত গযনী পৌঁছে গেল। সুলতান মাহমুদ তাঁর সেনাবাহিনীর সকল সৈনিকের মধ্যেই এ বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, কয়েক মিনিটের বিলম্ব অনেক ক্ষেত্রে গোটা বাহিনীর পরাজয়ের কারণ হতে পারে। সুলতানের এই শিক্ষার কারণে সংবাদবাহক প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গযনী পৌঁছে গেল। সংবাদবাহক যখন সুলতানকে কাশ্মীরের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করছিল, তখন তার যবান চললেও মাথা দোল খাচ্ছিল আর যন্ত্রণায় তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ক্ষুধা-পিপাসা এবং বিরতিহীন ক্লান্তিতে তার দেহ অবসন্ন হয়ে পড়েছিল।
এ প্রসঙ্গে ইংরেজ ইতিহাস গবেষক স্যার হেনরী হোয়াৰ্থ ১৮৯৮ সালে ও লেখা এক নিবন্ধে ঐতিহাসিক ইবনে ইসপান্দেয়ার-এর সূত্রে লেখেন, “কাশ্মীরের গোলযোগ ও সেনাপতি সারওয়াগের গ্রেফতারী এবং রাজা নন্দরায় ও ভীমপালের চক্রান্তের খবর শুনে সাথে সাথেই সুলতান সেনাবাহিনীকে অভিযানে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে কখনো অভিযানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কৌশল সম্পর্কে সৈন্যদের অবহিত করা ছাড়া তাকে অভিযানের নির্দেশ দিতে দেখা যায়নি। এর কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষকগণ বলেছেন, ইসলামের নীতি-আদর্শের প্রশ্নে সুলতান ছিলেন খুবই আপোসহীন ও আবেগপ্রবণ। তিনি তখন বলেন, দক্ষিণ কাশ্মীরের যে এলাকায় তিনি মৌখিকভাবে ইসলামী শাসন জারী করে এসেছিলেন এবং স্থানীয় অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশ মান্য করে স্থানীয় অধিবাসীদের সিংহভাগ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং নওমুসলিমদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য তার নির্দেশে বহু মসজিদ-মক্তব স্থাপিত হয়েছিল। বহু সংখ্যক ইমাম ও শিক্ষক লাহোর বাটান্ডা ও অন্যান্য জায়গা থেকে কাশ্মীরে পাঠানো হয়। কিন্তু পরাজিত হিন্দু রাজারা বহুমুখী চক্রান্তের জাল বিস্তার করে নওমুসলিমদের বিভ্রান্ত করে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, আঞ্চলিক প্রশাসক সেনাপতি সারওয়াগকে চক্রান্তকারীরা বন্দী করেছে। সেই সাথে সুলতানের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন সুলতান এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, স্বভাবজাত যুদ্ধ চিন্তা ও পরিকল্পনা করে নেয়ার অবকাশ তার হয়নি। স্বাভাবিক অবস্থায় নিজেকে ফিরিয়ে এনে তিনি ভাবতেই পারেননি, কোথায় কোন অবস্থায় কাদের সাথে মোকাবেলায় রওনা হচ্ছেন তিনি। ফলে তার বাহিনী কাশ্মীরে পৌঁছার আগেই সেখানে প্রচণ্ড শীত ও তুষারপাত শুরু হয়ে যাবে এদিকটি তিনি চিন্তা করেননি। তিনি ভাবতেই পারেননি, অত্যধিক ঠাণ্ডা আর তুষারপাত তার পরাজয়ের কারণ হতে পারে কিংবা অভিযানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে পারে।
ঐতিহাসিক হায়দার কিরগানী ‘তারিখে রাশেদী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “হতে পারে অতীতের অব্যাহত বিজয়ের মনোবল ও শত্রুদের চক্রান্তের ক্ষুব্ধতায় সুলতান অভিযানের সময়, ক্ষেত্র, অবস্থা ও প্রতিবন্ধকতার কথা বিবেচনা না করেই সৈন্যদের রওনা হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিংবা কাশ্মীরের প্রাকৃতিক অবস্থা, শীতকালে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ব্যাপারে তাঁর বাস্তব কোন ধারণা ছিল না। কাশ্মীরের পথঘাট সম্পর্কেও তার ধারণা ছিল অস্বচ্ছ।
বস্তুত পেশোয়ার থেকে আরো কিছু সৈন্য সাথে নিয়ে স্বভাবজাত দ্রুততার চেয়ে আরো বেশী ক্ষিপ্রতায় তিনি কাশ্মীরের সীমানায় পৌঁছেন। ১০১৫ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম দশকে সুলতান তার সৈন্যদল নিয়ে কাশ্মীর পৌঁছেন। তখন পাহাড় ও সমতল সবজায়গা তুষারপাতের কারণে বরফে ঢাকা পড়ে গেল। সুলতানকে তাঁর গোয়েন্দা সূত্র খবর দিল, রাজা ভীমপাল ও নন্দরায় এখন কালার দুর্গে নয়, লোহাকোট দুর্গে অবস্থান করছে। কালার দুর্গ অবরোধ করে কালক্ষেপণ না করে লোহাকোট দুর্গ অবরোধের পরামর্শ দেয়া হলো। কারণ, লোহাকোট দুর্গ দখলে এসে গেলে কালাঞ্জর অবরোধ ছাড়াই দখলে এসে যাবে।
এদিকে লোহাকোট দুর্গে অবস্থানকারী মহারাজাদের কাছে খবর এলো, সুলতান মাহমূদ এসে গেছে। মহারাজা নন্দরায় চক্রান্ত ও দুষ্কৃতিকারী দলের প্রধানকে ডেকে বললেন, “তোমার সেই লোকদের নিয়ে এসো।” কিছুক্ষণের মধ্যে রাজা নন্দরায়ের সামনে দশ-বারোজন লোকের একটি দলকে এনে দাঁড় করানো হলো।
“তোমাদের কী করতে হবে তা কি তোমাদের জানা আছে?” সামনে দণ্ডায়মান লোকদের জিজ্ঞেস করলেন রাজা নন্দরায়।
“জি মহারাজ! আমরা আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত। আমরা সুলতানের কাছে গিয়ে বলবো, আমরা এই এলাকার মুসলমান। এই অঞ্চলের পোশাক পরেই আমরা তার সামনে যাবো। আমরা তার কাছে আবেদন করবো, আমরা আপনার অভিযানে শরীক হতে চাই এবং আপনার সেনাদের গাইড দেয়ার প্রয়োজনেই আমরা এসেছি। কারণ, মৌসুমী তুষারপাত পথঘাট সবই তলিয়ে দিয়েছে। বহুল ব্যবহৃত পথের কোনই চিহ্ন নেই। এমন অবস্থায় লোহাকোট কোন পথে যাওয়া যাবে আমরা সেই পথ জানি। আমরা নিষ্ঠাবান মুসলমানের মতোই কথাবার্তা বলবো। তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আমরা শুদ্ধ উচ্চারণে কলেমা ও নামায শিখে নিয়েছি।”
“সাবাস! যেভাবেই হোক তোমরা ওকে লোহাকোট নিয়ে আসবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, লোহাকোট থেকে তাকে ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হবে। ফিরে যাওয়ার পথে তোমরাই হবে তাদের পথপ্রদর্শক। তখন তোমরা তোমাদের আসল উস্তাদী দেখাবে।”
এই দশ-বারোজন লোক ছিল কট্টর হিন্দু। এরা ছিল প্রশিক্ষিত দুষ্কৃতিকারী। এরা সুলতান মাহমূদকে বিভ্রান্ত করার জন্য দাড়ি রেখেছিল। চালচলন, কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদে তারা প্রত্যেকেই সাচ্চা মুসলমানরূপে নিজেদের উপস্থাপন করার সব কৌশল রপ্ত করেছিল।
লোহাকোট দুর্গের দিকে অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন সুলতান। পথের দুর্গমতা, অত্যধিক ঠাণ্ডা এবং তুষারপাতকে উপেক্ষা করলেন তিনি। কাশ্মীরে তার যেসব সেনাচৌকি ছিল, তারা লোহাকোটে পৌঁছানোর জন্য অভিজ্ঞ গাইড বাছাই করে রেখেছিল। কারণ, সেই যুগের রীতি ছিল কোন সেনাবাহিনী যদি কোন অচেনা জায়গায় আক্রমণ চালাতো, তখন স্থানীয় লোকদের থেকে গাইড সগ্রহ করতো।
লোহাকোটের দিকে অগ্রসর হলে পথিমধ্যে দশ-বারোজনের একটি কাফেলা এসে সুলতানের বাহিনীতে যোগ দিল। এই দলের লোকেরা সুলতানের সহযোগিতার ব্যাপারে খুবই উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছিল। তারা নিজেদেরকে নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে সুলতানের সামনে নিখুঁতভাবে পেশ করে। তারা এও বলে, আমরা দীর্ঘদিন এসব হিন্দুরাজাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছি। আজ আমরা ওদের জুলুমের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। তাদের আবেগময় আবেদন আর মুসলমান হিসেবে নিখুঁত ভাবভঙ্গিমায় আশ্বস্ত হয়ে তাদের একেকজনকে গাইড হিসেবে প্রত্যেকটি সেনা ইউনিটে ভাগ করে দিলেন সুলতান। সেনাপতিদের বললেন, তাদের কথামতো অগ্রসর হতে।
লোহাকোট দুর্গ সম্পর্কে অনেক কাহিনীই শুনেছিলেন সুলতান। কিন্তু যখন লোহাকোর্ট দুর্গকে প্রত্যক্ষ করলেন, তখন তার মনে হলো, তাকে লোহাকোট দুর্গ সম্পর্কে খুব কমই বলা হয়েছে।
সুলতান মাহমূদ ছিলেন দুর্গজয়ের উস্তাদ। কিন্তু লোহাকোট দুর্গ দেখে তিনি বিরাট এক ধাক্কা খেলেন। দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন কেন লোহাকোট দুর্গ অজেয় দুর্গ হিসেবে খ্যাত। দুর্গটি ছিল বিশাল এক পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এটি যেমন ছিল দুর্ভেদ্য, দ্রুপ এর গঠনও ছিল মজবুত। সম্পূর্ণ পাথর ও মাটির মিশ্রণে বিশাল পুরুত্বে তৈরি ছিল দুর্গের প্রাচীর। তাছাড়া দুর্গের চারকোণে ছিল চারটি সুউচ্চ বুরুজ। এই বুরুজ থেকে যে কোন আক্রমণকারী দলকে সহজেই তীরের আঘাতে ঘায়েল করা সহজ ছিল। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, প্রাকৃতিকভাবেই দুর্গের চতুর্দিকে ছিল গভীর খাদ। প্রতিটি ফটকের সামনের ত্বর ছিল অনেক ঢালু। ফটকগুলো বিশালকায় লোহার ডাণ্ডা দিয়ে তৈরি। হাতির কাঁধে শক্ত গাছের কাণ্ড রেখে এগুলোকে আঘাত করলেও ভাঙ্গা সম্ভব ছিল না।
সুলতান মাহমূদ দুর্গকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সকল সৈন্যকে এক জায়গায় একত্রিত করলেন। একটি অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে কাছের একটি টিলার উপরে দাঁড়িয়ে তিনি তার সৈন্যদের সাহস জোগানো এবং হিম্মত বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বললেন, হে আল্লাহর সৈনিকেরা! তোমরা গযনী সালাতানের জন্য নয়, আল্লাহ ও রাসূল সা. এর উদ্দেশ্যে যুদ্ধে এসেছে। আমরা এই এলাকার লোকজনকে ইসলামের দীক্ষা দিয়ে আল্লাহর নাফরমানী থেকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে এখানকার বেঈমান রাজা-মহারাজারা এদের উপর নির্যাতনের তুফান চালাচ্ছে। আজকে তোমাদেরকে এই বেঈমানদের রক্তে ইসলামের প্রদীপ জ্বালাতে হবে।
“ওই যে দুর্গ তোমরা দেখছো, এই দুর্গ তোমাদের দেখে উপহাস করছে। এখানকার মৌসুমও তোমাদের কুটি করছে। তোমরা মরুময় পাথুরে ময়দানে লড়াই করে অভ্যস্ত। আজ এখানে প্রমাণ করে দাও, শীত ও বরফে যদি আসমান-জমিন সব কিছুও জমাট বেধে যায়, তারপরও মুসলমানের রক্ত জমে না। ঈমানের উষ্ণতা বরফের পাহাড়কেও গলিয়ে পানি করে দিতে পারে।
দেখো, আমরা বহুদূর থেকে এসেছি। আমরা এখানে এসেছি আল্লাহর পয়গাম তার বান্দাদের কাছে পৌঁছে দিতে। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে শপথ নাও, কঠিন দুর্ভেদ্য এ দুর্গে ইসলামের পতাকা না উড়িয়ে আমরা ফিরে যাবো না।”
সরাসরি সৈন্যদের সামনে এমন আবেগী ভাষণ সুলতান তেমন দিতেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি কমান্ডারদের মাধ্যমে সৈনিকদের উজ্জীবিত করার পয়গাম দিতেন। কঠিন ও কঠোর ট্রেনিং দিয়ে সুলতান মাহমূদ তার প্রতিজন সৈন্যকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ত্যাগী, কষ্ট সহিষ্ণু ও সাহসী করে গড়ে তুলতেন। তাদেরকে আবেগী বক্তৃতা দিয়ে উজ্জীবিত করার তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু লোহাকোট দুর্গের অবস্থা ও তুষারপাতের বিরূপ পরিস্থিতি সুলতানের মনে যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনাকে এতোটাই দুঃসাধ্য করে তুলেছিল যে, কঠিন থেকে কঠিনতর বিপদেও যার মধ্যে কখনো কোন ভাবান্তর দেখা যায়নি, রণাঙ্গনের কঠিন পরিস্থিতিও যাকে পেরেশান, উদ্বিগ্ন ও আশাহত করতে পারেনি, সেই পাহাড়সম সাহসিকতার অধিকারী সুলতানের হৃদয়ে লোহাকোট দুর্গ জয় এতোটাই দুঃসাধ্য মনে হচ্ছিল যে, তার কণ্ঠের আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। ভাষণ দিতে গিয়ে তাঁকে বারবার থামতে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি যথার্থ শব্দটি বলার জন্য স্মৃতিপট হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
যে কোন রণক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরুর আগে সুলতান দু’রাকাত নফল নামায পড়তেন। কিন্তু এদিন ঘোড়া থেকে নেমে তিনি তা করেননি। এমন কিছুও বলেননি যে, আমি জয়ের ইঙ্গিত পেয়েছি, বিজয় আমাদেরই হবে। অনেক রণাঙ্গনে তিনি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ভাষণ শেষে তিনি তার ঘোড়াকে টিলার উপর থেকে নিচে নামিয়ে আনলেন।
লোহাকোট দুর্গের চারপাশে আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চকিত হতে লাগলো। যে পাহাড়ের উপর দুর্গ অবস্থিত এর বাইরে উঁচু নীচু অসংখ্য টিলা। এসব টিলা ও সমতল সব জায়গাতেই প্রচুর গাছগাছালী। দুর্গের বাইরের ঢালুতেও প্রচুর বৃক্ষাদি ছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে দুর্গের ঢালের বৃক্ষাদি কেটে সাফ করা হয়েছে।
সুলতান মাহমূদ দুর্গের চতুর্দিক ঘুরে পর্যবেক্ষণ করলেন। দুর্গ প্রাচীর ও বুরুজের উপর থেকে হিন্দু সৈন্যরা তাকে হুমকি দিচ্ছিলো এবং নানা তিরস্কারসূচক বাক্য ছুঁড়ে দিচ্ছিলো। হিন্দু সৈন্যরা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলছিল, “মাহমূদ! তোমার খোদা তোমার ভাগ্যে বরফের কবর লিখে রেখেছে।”
চতুর্দিকের টিলা ও পাহাড়ের উপর তীরন্দাজ নিযুক্ত করে সুলতান দুর্গপ্রাচীরে অবস্থানকারী সৈন্যদের উপর তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। তীরন্দাজদের তীরের সহায়তা নিয়ে প্রাচীর ভাঙায় পারদর্শী সৈন্যদেরকে তিনি দুর্গ প্রাচীরের নিচে সুড়ং খননের জন্য নির্দেশ দিলেন। তিনি জানতেন, কাশ্মীরের পাহাড়গুলো নিরেট পাথরের নয়, পাথুরে মাটির হয়ে থাকে। কাজেই এতে খননকাজ তেমন কঠিন হবে না। সুলতান মাহমূদ ভেবেছিলেন, কয়েক গজ সুড়ং খনন করতে পারলেই খননকারীরা দুর্গ প্রাচীরের উপরের তীর থেকে নিজেদের হেফাজত করতে পারবে এবং নির্বিঘ্নে খননকাজ চালাতে পারবে।
প্রাচীর ভাঙা ও সুড়ং খননকারী দল নির্দেশ পেয়েই খননকাজে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের তৎপরতা থেমে গেল। একজনের পক্ষেও জীবন নিয়ে ফিরে আসা সম্ভব হলো না। দুর্গ প্রাচীর থেকে বৃষ্টির মতো তীর এসে তাদের সবাইকে বিদ্ধ করলো । সুলতানের তীরন্দাজরা আশপাশের পাহাড় ও টিলার উপর থেকে যেসব তীর নিক্ষেপ করছিলো, বেশী দূরত্বের কারণে তা দিয়ে দুর্গ প্রাচীরের শত্রু তীরন্দাজদের দমানো সম্ভব হলো না।
কয়েক সৈনিক জীবনবাজী রেখে প্রধান ফটকে অগ্নিসংযোগ করার জন্য দাহ্য পদার্থ এবং ফটক ভাঙার জন্যে হাতুড়ী-শাবল নিয়ে ফটকের দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু ফটকের সামনের চত্বর ছিলো ঢালু এবং বরফে ঢাকা। মুসলিম সৈন্যরা ঢালু বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে বরফের মধ্যে পড়তে লাগল আর উপর থেকে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীরবিদ্ধ হয়ে গড়িয়ে নিচে পড়তে লাগল। তাদের মধ্যেও দু-চারজন ছাড়া কারো পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব হলো না।
অন্যান্য ফটকেও অনুরূপ হামলা করার চেষ্টা হলো। একটি ফটকে কিছু জানবাজ আঘাত করতে শুরু করেছিল। কিন্তু দুর্গপ্রাচীরের উপর থেকে ফটক ভাঙচুরকারীদের উপর জ্বলন্ত কাঠ এবং আগুনের সলিতা নিক্ষেপ করলো শত্রুবাহিনী। তাদের সবার শরীরই ঝলসে গেলো।
ঐতিহাসিক উবী, গারদিজী, ইবনুল আছীর এবং দুজন ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ লিখেছেন, রাতের বেলায়ও সুলতানের সৈন্যরা দুর্গ প্রাচীরের নিচে সুড়ং খননের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু দিনের বেলায় সুলতান দেখতে পেলেন, দুর্গ প্রাচীরের নিচের খাড়িতে মুসলিম সৈন্যদের লাশের স্তূপ জমে গেছে। অবস্থা দেখে সুলতানের চেহারা রাগে-ক্ষোভে কালো হয়ে গেলো। তিনি পাগলের মতো দুর্গের চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছিলেন আর সুড়ং খননের জন্য নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সুলতানের নির্দেশে মুসলিম কমান্ডার ও সৈন্যরা অকাতরে তাদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছিল।
পরদিন সন্ধ্যার আগেই চতুর্দিকে প্রচন্ড অন্ধকার নেমে এলো। হিমশীতল রাতের অন্ধকারে শুরু হলো প্রবল তুষারপাত আর সেই সাথে ঝড়ো হাওয়া। তীব্র ঝড়ো হাওয়া আর প্রচণ্ড তুষারপাতে মানুষ তো দূরে থাক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গি ঘোড়াগুলোও টিকতে পারছিলো না। জীবন বাঁচানোর জন্য জঙ্গি ঘোড়াগুলো এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করলো; কিন্তু আশ্রয় নেয়ার মতো কোথাও কোন আড়াল ছিলো না।
সমতল-অসমতল সব জায়গা বরফে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। কোনটা খাদ কোনটা টিলা বোঝা যাচ্ছিল না। তুষারপাত ও ঝড়ের গতি যেদিকে ছিল, সেদিকে ছিল কাশ্মীরের বিখ্যাত ঝিলম নদী। প্রবল বাতাসের ধাক্কা অশ্বারোহী ও ভারবাহী সব জন্তু ওদিকেই হটতে বাধ্য হচ্ছিল। ঝিলম নদীর তীর ছিল সরু; কিন্তু উঁচু ও খাড়া। নদী ছিল অপ্রশস্ত, গভীর ও তীব্র স্রোতস্বিনী। নদী তীরের সবকিছু বরফে ঢাকা পড়ে গেল। বাতাসের ধাক্কায় অশ্বারোহী, আরোহীহীন জন্তু সবই নদী গর্ভে গড়িয়ে পড়ছিল। তীব্র স্রোত আর বরফঢাকা খাড়া তীর বেয়ে কারো পক্ষে উপরে উঠে আসার উপায় ছিল না। সেই রাতের অন্ধকারে কতো সিপাহী আর কতত ভারবাহী জন্তু ঝিলম নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছিল, তার প্রকৃত হিসেব রাখা সম্ভব ছিল না।
রাত শেষে যখন ভোরের সূর্য উচিত হল, তখন কারো পক্ষে বলার উপায় ছিলো না, এটিই গতকালের ঝিলম তীর আর লোহাকোট দুর্গের চারপাশ। হাজার হাজার মুসলিম যোদ্ধা বরফের নিচে তলিয়ে গেল। উঁচু বরফের আস্তরণ পড়ে গেল সবখানে। সুলতানকে বেঁচে থাকা কমান্ডারগণ বিনয়ের সাথে বললেন-টানা বিজয়ের নেশায় আমরা এই অভিযানকে সেইভাবে বিবেচনা করিনি। এটাই হয়তো আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো। এবার ক্ষান্ত হওয়া যাক। আল্লাহ চাহে তো আমরা আবার আসবো। যারা এখনও বেঁচে আছে, তাদের জীবন রক্ষার দিকটিই প্রাধান্য দেয়া হোক।
সুলতান মাহমূদ কমান্ডারদের পরামর্শ মেনে নিয়ে সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ব্যর্থতার দায়ও নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন তিনি। কিন্তু ফিরে যাওয়ারও পথ ছিলো না। সবকিছু বরফে তলিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমন বেগতিক অবস্থায় পথিমধ্যে যোগ দেয়া গাইডেরা এগিয়ে এলো। তারা এই দুঃসময়ে সুলতানকে আশ্বাস দিলো, মাননীয় সুলতান! দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, এখনো ফেরার একটি পথ পরিষ্কার আছে।
সেনাবাহিনী তখন বিক্ষিপ্ত। তারা প্রধান তিনটি অংশে বিভক্ত। পরিচয়, গোপনকারী হিন্দু গাইডেরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো।
তীব্র তুষারপাত রাতের বরফে তুফান আর সুড়ং খননের ব্যর্থ অভিযানে অর্ধেকের চেয়ে বেশী সৈন্য আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকী অর্ধেকের কম সৈন্য তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পরিচয় গোপনকারী শত্রু গাইডের দেখানো পথে যখন গযনী ফিরতে রওনা হলো, এর পরিণতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক কারিশমা লিখেছেন–
“তীব্র তুষারপাত ও তুষার ঝড়ের পরদিন সুলতান মাহমূদ অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। কিন্তু ফেরার পথে হিন্দু পথপ্রদর্শকরা তাদেরকে ভুল পথে নিয়ে এতোটাই বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয় যে, টানা এক সপ্তাহ গোটা বাহিনীকে তারা অচেনা-অজানা তুষার পথে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হত্যা করে। তীব্র ঠাণ্ডা, অপর্যাপ্ত পানাহার, ব্যর্থতার গ্লানি আর সহযোদ্ধা হারানোর শোকে এমনিতেই মুসলিম যোদ্ধারা ছিলো ক্লান্ত, হতোদ্যম ও মনোবলহারা। এমতাবস্থায় বরফে ঢাকা পিচ্ছিল পথে বেশিরভাগ সৈন্যকে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হচ্ছিল। যুদ্ধাস্ত্র ও জরুরী সামানপত্র কাঁধে করে বহন করতে হচ্ছিল তাদের। শত্রু পক্ষের গুপ্ত গাইড ঝিলম নদীর সংকীর্ণ তীর ধরে তাদের নিয়ে যাচ্ছিল। অগ্রসর হতে গিয়ে বারংবার পা পিছলে গভীর নদীর অতলে গড়িয়ে পড়ছিল মুসলিম যোদ্ধারা। তাছাড়া জায়গা জায়গায় ছিল বরফের ফাঁদ। দৃশ্যত সমতল দেখা গেলেও হালকা বরফের নিচে লুকিয়ে ছিল গভীর গর্ত। এসব ফাঁদে পা দিয়ে বহু যোদ্ধা বরফের চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে থাকে। বহু ঘোড়া ও ভারবাহী জন্তুও বরফের চোরাবালিতে পড়ে জীবন ত্যাগ করতে থাকে। তীব্র ঠাণ্ডায় যেসব যোদ্ধা চলার শক্তি হারিয়ে বসে পড়তো, তার পক্ষে আর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতো না। এভাবে সুলতানের অসংখ্য যোদ্ধাকে জীবন দিতে হলো। অথচ এরা প্রত্যেকেই ছিল সুলতান মাহমুদের বাহিনীর চৌকস যোদ্ধা।
দুর্গজয় তো সম্ভব হলোই না, তদুপরি ব্যর্থতা মেনে নিয়ে ফিরতে গিয়ে শক্র গাইডের পাল্লায় পড়ে শত শত যোদ্ধাকে কুরবানী দিতে হলো। বন্ধুবেশী শত্রু গাইডেরা এক দিন গোটা বাহিনীকে ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। বরফঢাকা পাহাড়ী পথে চক্কর খেয়ে সিংহভাগ সহযোদ্ধাকে হারিয়ে সুলতান মাহমূদ যখন টিলাযুগিয়ায় অবস্থিত সেনাপতি সারওয়াগের সেনাক্যাম্পে পৌঁছলেন, তখন তার সাথে মাত্র হাতে গোনা কয়েকশত যোদ্ধা। ব্যর্থ, ক্লান্ত, শোকাহত সুলতান কয়েকদিন সারওয়াগের ক্যাম্পে অবস্থান করে গযনী ফিরে এলেন।