৩.২১
সুনীতির শ্বশুরবাড়ি থেকে হাতিবাগান মার্কেট হাঁটা পথের দূরত্বে। মিনিট সাত আটেকের মধ্যে বিনুরা সেখানে পৌঁছে গেল।
মার্কেটটা বিশাল, অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সামনে চওড়া ট্রাম রাস্তা। আনন্দ জানিয়ে দিল, রাস্তাটার নাম কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। ট্রাম লাইন উত্তর দিকে সোজা চলে গেছে গ্যালিফ স্ট্রিটে। শ্যামবাজারে ওটার গা থেকে আরেকটা লাইন বেরিয়ে বেলগাছিয়ায়। দক্ষিণ দিকে লাইনটা গিয়ে থেমেছে ধর্মতলায়। বৌবাজার আর গ্রে স্ট্রিটের মুখে আরও দু’টো লাইন এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। খানিকটা ঘুরপথে ওই দুই রুট দিয়ে ডালহৌসি যাওয়া যায়।
খুব ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে দু’একবার উত্তর কলকাতার এই অঞ্চলে এসেছিল বিনু। তার খুব ঝাঁপসা স্মৃতি এখনও থেকে গেছে। পারা-ওঠা, ঘষা আয়নায় ছায়া পড়লে যেমন দেখায় অনেকটা সেইরকম।
আনন্দ ট্রাম লাইনের যে জটিল ভৌগোলিক বর্ণনা দিল তার সামান্যই মাথায় ঢুকল বিনুর। সে ভাবল, এখন কলকাতাই তার স্থায়ী ঠিকানা। ক্রমশ এই শহরের রাস্তাঘাট, ট্রামরুট, বাসরুট সম্পর্কে সড়গড় হয়ে উঠবে।
মার্কেটের নিচের তলায় রাস্তার দিকে সারিবদ্ধ দোকান। জামাকাপড়ের, বাসনকোসনের, রেডিমেড পোশাকের, গয়নার, মিষ্টির। বেশ ক’টা দোকান ঘুরে বিনুর জন্য চার প্রস্থ ধুতি শার্ট পাজামা আন্ডারওয়ার গেঞ্জি, ঝিনুকের জন্য খান পাঁচেক শাড়ি ব্লাউজ সায়া কিনল আনন্দ। অনেকগুলো ব্রাউন। পেপারের প্যাকেট হয়েছে। দুটো বড় চটের ব্যাগ কিনে প্যাকেটগুলো তার ভেতর পুরে নিল ওরা।
কেনাকাটা সারতে ঘন্টাখানেক লেগে গেল। রাস্তায় প্রচন্ড ভিড়। ট্রাম বাস রিকশা মোটর ঘোড়ার গাড়ি আর মানুষের দঙ্গল। যেদিকেই তাকানো যাক, তুমুল ব্যস্ততা। কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে নেই। সবাই ছুটছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেই চলেছে।
আনন্দরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। বিনুর হাতে জামাকাপড়ের ব্যাগ ছিল। আনন্দকে সেটা দিয়ে সে বলল, আপনি বাড়ি চলে যান। আমি হিরণদা আর ছোটদির সঙ্গে দেখা করে আসি। কিভাবে ওদের বাড়ি যেতে হবে বলে দিন।
আনন্দ অস্বস্তি বোধ করল। সুধাদের কাছে বিনুর যাওয়ার কারণ তার অজানা নয়। তাদের বাড়ির যা পরিবেশ সেখানে আর এক লহমাও থাকা বিনুদের, বিশেষ করে ঝিনুকের পক্ষে আদৌ সম্মানজনক নয়। কী নিদারুণ কষ্টভোগ করে ওরা পাকিস্তান থেকে একটু আশ্রয়ের খোঁজে কাল মধ্যরাতে তাদের বাড়ি ছুটে এসেছিল, কিন্তু কিছুই করা গেল না। নিজের অক্ষমতা আনন্দকে ভীষণ ক্লেশ দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে পীড়নটা চলছে কাল রাত থেকে। বিব্রত মুখে সে বলল, তুমি তো কলকাতার কিছুই চেনো না। একা কি যেতে পারবে? বলেই থমকে গেল। বিনু তাকে পৌঁছে দিতে বললে, সুধাদের বাড়ি গিয়ে চূড়ান্ত অপ্রস্তুত হতে হবে। আনন্দ জানে, সুধারা কোনও প্রশ্ন করবে না, জানতে চাইবে না কেন ঝিনুককে ঘাড় থেকে নামিয়ে তাদের কাছে গছাতে এসেছে। কিন্তু ওদের জানতে না চাওয়ার মধ্যে অনেক নীরব প্রশ্ন মাথা উঁচিয়ে থাকবে। সুধাদের চোখের দিকে তাকানো যাবে। লজ্জার একশেষ। মরমে একেবারে মরে যেতে হবে।
বিনু বলল, ঠিকানা যখন জানি, ঠিক চলে যেতে পারব। কাল রাত্তিরেও কারোর সাহায্য ছাড়াই তো ঝিনুককে নিয়ে আপনাদের বাড়ি এসেছিলাম।
যাক, ছেলেটা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে যাবার জন্য জোর করে নি। অস্বাচ্ছন্দ্য অনেকটাই কেটে গেল আনন্দর। ধীরে সুস্থে বিশদভাবে টালিগঞ্জ যাবার রুটটা জলের মতো বিনুকে বুঝিয়ে দিল সে। হাতিবাগান থেকে ট্রামে এসপ্ল্যানেডের কার্জন পার্ক। সেখান থেকে ফের ট্রাম ধরে টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের পর সেকেন্ড স্টপেজ। কন্ডাক্টরকে আগে বলে রাখলে ঠিকমতো নামিয়ে দেবে। তারপর রাস্তা পেরিয়ে বাঁ দিকে খানিকটা ঢুকলেই জাফর শা রোডে সুধাদের বাড়ি।
আনন্দ বলতে লাগল, যদি মনে হয় রাস্তা গুলিয়ে যাচ্ছে, লোকজনকে জিজ্ঞেস করে নিও।
বিনু আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয়, আচ্ছা–
এসপ্ল্যানেড রুটের একটা ট্রামের ফার্স্ট ক্লাসে বিনুকে তুলে দিল আনন্দ। অফিস টাইমের ঠাসাঠাসি ভিড় এখন নেই। তবু ট্রামে প্রচুর প্যাসেঞ্জার। তার মধ্যে এক কোণে দাঁড়াবার একটু জায়গা পেয়ে গেল বিনু। চার পাঁচটা স্টপেজ পেরুবার পর জানালার পাশে একটা সিটও।
বাইরে রাস্তার দু’ধারে লাইন দিয়ে উঁচু উঁচু বাড়ি, মানুষজন, সিনেমা হল, পার্ক, ধাবমান গাড়ি ঘোড়া।
সেই কোন ছেলেবেলায় এখান থেকে রাজদিয়ায় চলে গিয়েছিল বিনু। কলকাতা ক্রমশ ঝাঁপসা হতে হতে তার কাছে হয়ে উঠেছিল ধূসর স্মৃতির শহর। এত কাল বাদে ফিরে এসে সতত চঞ্চল এই মহানগরের বিশালতা আর চোখ ধাঁধানো জলুসে তার রোমাঞ্চিত হবার কথা। কিন্তু চারপাশের দৃশ্যাবলী, হইচই এবং যানবাহনের পাঁচমিশালি চড়া আওয়াজ তার মাথায় কোনও ছাপই ফেলছে না। সব কিছু ছাপিয়ে বার বার তারপাশা গোয়ালন্দ আর শিয়ালদা স্টেশনের চিত্র চোখের সামনে ফুটে উঠছে। সর্বস্ব খুইয়ে আতঙ্কতাড়িত মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসছে। হাজারে হাজারে। সীমাসংখ্যাহীন। এ শহরে তাদের কেউ নেই। কিন্তু বিনুর অনেকেই আছে। আছে তার ঘনিষ্ঠ পরিজনেরা। তবু লক্ষ লক্ষ উৎখাত শরণার্থীর মতো তাকেও শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে হচ্ছে। একই উদ্দেশ্যে। প্রয়োজন সামান্য একটু আশ্রয়, যেখানে ঝিনুক আর সে সহজভাবে নিশ্বাস ফেলতে পারবে।
কার্জন পার্কে এসে টালিগঞ্জের ট্রাম ধরল বিনু। এদিকের ট্রামে ভিড় নেই। অল্প ক’টি যাত্রী কামরার এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।
একসময় ট্রাম ছাড়ল। বাঁয়ে চকচকে, মসৃণ চৌরঙ্গি। তার ওধারে পর পর মেট্রো সিনেমা, হোয়াইটওয়ে লেডলোর বিশাল বিল্ডিং, নিউ মার্কেট, মিউজিয়াম ইত্যাদি পেরিয়ে এগিয়ে চলল কিনুরা। পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত ঢিলেঢালা মেজাজে চলার পর হঠাৎ গতি বেড়ে গেল ট্রামটার। রাস্তার ওপাশে। এখনও বাড়ির পর বাড়ি। আর্মি অ্যান্ড নেভি বিল্ডিং, দ্বারভাঙ্গা মহারাজের ম্যানসন যার উঁচু মিনারে বিশাল ঘড়ি আটকানো, বিশপস হাউস, ইত্যাদি। আরেক পাশে যতদূর চোখ যায়, নিবিড় ঘাসে ঢাকা গড়ের মাঠ। দুপুরের রোদে সারা ময়দান জুড়ে তীব্র সবুজ আলোর ঝলক। অনেক দূরে মাঠ চিরে যে রাস্তাটা উত্তর-দক্ষিণে কোনাকুনি চলে গেছে সেটার ওপর দিয়ে অগুনতি প্রাইভেট কারের ছোটাছুটি। ট্রামের জানালা দিয়ে মনে হয়, ছোট ছোট খেলনা-গাড়ি। আরও দূরে রেসকোর্সের গ্যালারিগুলো দিগন্তের তলায় সাদা রেখা হয়ে আছে। মাঠের দক্ষিণ দিকে রাজকীয় মহিমায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সেটার চুড়োয় পরী নেচে চলেছে। ক্লান্তিহীন। এই দুপুরবেলায় আগের রাতের কুয়াশার লেশটুকুও নেই, নেই ছিটেফোঁটা লঘু মেঘও। মাথার ওপর অফুরান নীলাকাশ। হালকা মেজাজে ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছ।
চৌরঙ্গির বড় বড় ম্যানসন, গড়ের মাঠ, কোনও কিছুই অচেনা নয়। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে সব বেরিয়ে এসে চোখের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কণামাত্র আগ্রহ বোধ করছে না বিনু। ট্রাম টালিগঞ্জের দিকে যত এগুচ্ছে, ঝিনুকের চিন্তাটা চারদিক থেকে আরও বেশি করে তাকে সাপটে ধরছে।
কন্ডাক্টরটির দায়িত্ববোধ আছে। রেল ব্রিজ পেরুবার পর সঠিক স্টপেজেই বিনুকে নামিয়ে দিল।
শহরের এদিকটা আনন্দদের এলাকার মতো জমকালো নয়। ইটের দেওয়াল আর টিন বা অ্যাসবেস্টসের ছাউনিওলা বাড়িই বেশি। ফাঁকে ফাঁকে দু’চারটে দোতলা তেতলা। উলটো দিকে চাপ বাঁধা বস্তি। সেগুলোর মাথায় খাপরার চাল। সব মিলিয়ে দীন, মলিন।
ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে অন্য একটা রাস্তায় ঢুকে খানিক এগুতেই ডান পাশে জাফর শা নোড। বড় রাস্তার তুলনায় এদিকটা ঢের বেশি জমজমাট। পুরনো বাড়ির পাশাপাশি নতুন নতুন বহু বাড়ি উঠেছে। অনেকগুলোর কাজ চলছে। তবে চারদিকে প্রচুর ফাঁকা জায়গা। ডোবা, পানাপুকুর, বাঁশঝাড়, তালগাছ। বেশ কিছু ফাঁকা মাঠও চোখে পড়ছে।
একটা চায়ের দোকানে খোঁজ করতেই দোকানদার হিরণদের বাড়িটা দেখিয়ে দিল। ছিমছাম দোতলা। নিচু বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনের দিকে কাঠের গেট, এক ফালি ফুলের বাগান। গেট খুলে বাগানের ভেতর দিয়ে ক’পা গেলেই সিমেন্টের তিনটে উঁচু ধাপ। ওপরে উঠে বন্ধ দরজার কড়া নাড়ল বিনু। মায়ের পেটের বোনের কাছে এসেছে। তবু বুকের ভেতরটা ভীষণ কাঁপছে। থরথর।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। সামনে সুধা। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সে। পলক পড়ছে না। স্বচক্ষে বিনুকে দেখেও যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।
বিস্ময়টা থিতোতে কয়েক লহমা লাগল। তারপরই খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল, ও মা, তুই! এ আমি ভাবতেও পারি নি। আয় আয়– বিনুর দু’হাত ধরে টানতে টানতে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে এল সে। নিশ্চয়ই বসার ঘর। ছিমছাম, সাজানো গোছানো। একটা বেতের সোফায় ভাইকে বসিয়ে গা ঘেঁষে বসল। বিনুর হাতটা তার নরম মুঠিতে ধরা রয়েছে।
ভাইয়ের দিক থেকে পলকের জন্য চোখ ফেরায় নি সুধা। গম্ভীর গলায় বলল, কত বছর পর দেখা হল! কত বড় হয়ে গেছিস বিনু!
যুদ্ধ শেষ হবার মুখে মুখে রাজদিয়ায় সুধা সুনীতির বিয়ে হয়েছিল একই দিনে। একই লগ্নে। সুধার বউ-ভাত হয়েছিল রাজদিয়াতেই, কেননা হিরণের ঠাকুরদা আর জেঠিমা তখনও পূর্ব বাংলার ওই শহরেই থাকতেন। সুনীতির বউ-ভাত হয়েছিল বেশ কয়েকদিন পরে, কলকাতায়।
সুধার বউভাতের পর সুনীতি আনন্দ সুধা হিরণ হেমনাথ অবনীমোহন ঝিনুক স্নেহলতা বিনু, সবাই একসঙ্গে কলকাতায় এসে হইহই করে ক’দিন কাটিয়ে গিয়েছিল।
বেয়াল্লিশের শেষাশেষি মহাযুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছে, ডিফেন্সে চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিল হিরণ। তখন সে থাকত মির্জাপুরের এক মেসে। বিয়ের পর পার্ক সার্কাসের এক পাঁচমিশালি পাড়ায় বাড়িভাড়া নিয়েছিল।
সুনীতির বউ-ভাতে এসে সেই বাড়িতে গেছে বিনুরা। সুধা আর হিরণের সঙ্গে তার সেটাই শেষ দেখা।
যুদ্ধের পর একটা বছর কাটতে না কাটতেই সারা ভারতবর্ষ উথলপাথল হয়ে গেল। রাজদিয়ায় খবর পৌঁছেছিল, ছেচল্লিশের ষোলই আগস্ট জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাকে সারা কলকাতা। বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে। চারদিকে শুধু আগুন, নির্বিচার হত্যা আর ধর্ষণ। নরকের লক্ষ দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীতে আলো নেই, বাতাস নেই। সারা কলকাতা সেদিন হননপুরী।
সেই সময় পার্ক সার্কাসের বাড়িতে ভয়ে আতঙ্কে বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যাচ্ছিল সুধাদের। উন্মাদ হত্যাকারীর দঙ্গল বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে। মৃত্যু যখন প্রায় অবধারিত, হঠাৎ দৈবপ্রেরিতের মতো মিলিটারি পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে ভবানীপুরের এক গুরদোয়ারার রিলিফ ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। সেখানে মাসখানেক কাটিয়ে, দাঙ্গার তান্ডব কমে এলে টালিগঞ্জের এই নিরাপদ এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে চলে আসে ওরা। রাজদিয়ায় চিঠি লিখে হিরণ এ বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছিল।
অনেকদিন বাদে সুধাকে দেখল বিনু। নিরবধি কালের মাপে মাঝখানের কটা বছর কী আর এমন! নেহাতই বিন্দুবৎ। তবু মহাযুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সীমান্তের এপারে চলে আসা সব মিলিয়ে মনে হয় হাজার আলোকবর্ষ পার হয়ে গেছে।
সুধাকে দেখে কম খুশি হয় নি বিনু। দুই বোনের মধ্যে ছোটদিই তার বেশি প্রিয়। তারা পিঠোপিঠি, বয়সের তফাতও কম। সুধার বিয়ের আগে পর্যন্ত পরস্পর ছায়ার মতো লেপটে থেকেছে। সারাক্ষণ হিহি হাসি, নইলে মারদাঙ্গা। অতি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে অবিরাম খুনসুটি। এই উদ্দাম ভাব। পরক্ষণে তুলকালাম ঝগড়া। মহাসংগ্রামের পর মহাশান্তি। কেউ কাউকে এক লহমা ছেড়ে থাকতে পারত না। একজন দূরে কোথাও গেলে আরেকজন গন্ধ শুকে শুকে ঠিক হাজির হয়ে যেত।
এত বছর পর সুধা তার পাশে বসে আছে। বুকের ভেতর আবেগের বলক ওঠার কথা। কিন্তু সেই চিন্তাটা অবিরল দংশন করে চলেছে মস্তিষ্কে–ঝিনুক।
সুধার প্রথম দিকের উচ্ছ্বাস থিতিয়ে এসেছিল। ভারী গলায় বলল, তোকে ফের দেখতে পাব, ভাবতে পারি নি। কী দুশ্চিন্তায় যে দিন কাটছিল! হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে, তুই একটু বোস, আমি আসছি– বলেই ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরক্ষণেই ফিরে আসে, সঙ্গে হিরণ।
হিরণের গায়ে চাদর জড়ানো। চোখমুখ টস টস করছে। মনে হয় অসুস্থ। সুধার মতো অপার বিস্ময়ে বিনুকে দেখতে দেখতে তার কাছে বসে পড়ে। ব্যগ্র সুরে জিজ্ঞেস করে, রাজদিয়া থেকে। কবে এলে বিনু?
বিনু বলল, কাল। ঢাকা মেলে—
একমাস ধরে রোজ অফিস ছুটির পর শিয়ালদা যাচ্ছি। রিফিউজি বোঝাই হয়ে যে ট্রেন আসে, সেটার প্রত্যেকটা কামরায় গিয়ে খোঁজ করি। রোজই ভাবি, তোমরা আসবে। পরশু রাতে হিম লেগে জ্বর হল। তাই কাল আর স্টেশনে যাওয়া হয় নি। গেলে দেখা হত। শ্বশুর মশাই তীর্থে গেছেন। ভবানীপুরের বাড়ি তালাবন্ধ। কাল রাতে কোথায় ছিলে?
হিরণ কথা বলছিল ঠিকই, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনুকে লক্ষও করছিল। উদ্বাস্তুদের তো রোজই দেখছে সে। পাকিস্তান থেকে রিফিউজি স্পেশালগুলো শিয়ালদা স্টেশনে ফি সন্ধ্যায় এসে যাদের নামিয়ে দিচ্ছে তাদের চোখেমুখে শুধুই আতঙ্ক, শুধুই উৎকণ্ঠা। একটা নিদারুণ হননপুরী যে তারা পেরিয়ে এসেছে, সর্বাঙ্গে তার ছাপ। তেলহীন রুক্ষ চুলে সাত পুরু ধুলো, ঘোলাটে চোখ এক কড় গর্তে ঢোকানো। ভাঙা গালে কাটার মতো খাড়া খাড়া দাড়ি। পরনে ময়লা চিটচিটে জামাকাপড়। শীর্ণ, সতত ত্রস্ত। সারাক্ষণ ওরা কুঁকড়ে আছে।
বিনু যে ঢাকা মেল থেকে নেমেই এখানে আসে নি, বলে না দিলেও চলে। চুল মোটামুটি আঁচড়ানো, পরিষ্কার কামানো মুখ। পরনে বেখাপ্পা হলেও ইস্তিরি-করা পাজামা পাঞ্জাবি। চোখের কোলে অবশ্য পুরু কালির পোঁচ। একটা রাত যে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছে তা বোঝা যায়।
বিনু বলল, বড়দির বাড়ি।
হিরণ জিজ্ঞেস করে, হেমদাদু, দুই দিদা, ওঁরা কি ওখানেই আছেন?
না। দেশ থেকে কেউ আসেন নি। দাদু রাজদিয়া ছেড়ে আসবেন না। মরতে হলে ওখানেই মরবেন।
বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসতে পারলে না?
ওঁর মতো মানুষকে বোঝানো যায়? একবার যেটা ঠিক করেছেন সেখানে থেকে এক চুলও নড়ানো যাবে না।
এ পাগলামির মানে হয়? ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখায় হিরণকে, দেশ কি আগের মতো আছে? মানুষ উন্মাদ জন্তু হয়ে গেছে।
বিনু উত্তর দেয় না। হেমনাথ স্নেহলতা আর শিবানীকে ছাপিয়ে ঝিনুকের ভাবনাটাই তাকে ক্রমাগত উতলা করে তুলছে। হিরণ বাড়িতে থাকায় একরকম ভালই হয়েছে। ঝিনুককে এ বাড়িতে নিয়ে আসার বিষয়ে দু’জনের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যাবে। সুধার হয়তো আপত্তি হবে না, কিন্তু হিরণের মতামতই আসল। ঝিনুকের কথা কিভাবে বলবে, সব শোনার পর ওদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, ভেবে তল পাওয়া যাচ্ছে না। বলতে গিয়েও বাধা আসছে নিজের ভেতর থেকে। বিনুর ভয়, সুনীতিদের বাড়িতে যা হয়েছে, এখানেও যদি তাই ঘটে? একই অপমানের পুনরাবৃত্তি?
হিরণ বলে যাচ্ছিল, খবরের কাগজ খুললেই ইস্ট পাকিস্তান জুড়ে শুধু খুন, আগুন, লুটপাট, মেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। ট্রেন বোঝাই হয়ে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে আসছে, রোজ তার ছবি বেরোয়। রেডিওতেও একই খবর। সারাক্ষণ আতঙ্কে থেকেছি। অফিস ছুটি হলে দিনের পর দিন শিয়ালদায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছি, তোমরা এলে কিনা। যদি রাজদিয়া কি তার চারপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে কেউ এসে থাকে, চেনাজানা তাদেরও খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছি। ওদের কাছ থেকে হয়তো তোমাদের খবর পাব। কদিন আগে স্টেশনের বাইরের চত্বরে পতিতপাবনকে দেখলাম। ফ্যামিলি নিয়ে কী কষ্টে যে আছে–
বিনু বলল, পতিতপাবনের সঙ্গে কাল আমারও দেখা হয়েছে।
সে বলল, রাজদিয়ার অবস্থা ভাল না। চারদিক গরম হয়ে আছে। দেশ ছেড়ে যখন আসে তখনও কিছু হয় নি, তবে যে কোনও সময় সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটে যাবে। তোমাদের কোনও খবর দিতে পারল না। আমাদের মানসিক অবস্থাটা বোঝে। রোজ শিয়ালদা যাই, আর দু’দিন চারদিন পর পর তোমাদের চিঠি লিখি, কিন্তু উত্তর নেই।
আমরাও তো আপনাকে, বাবাকে আর আনন্দদাকে কত চিঠি লিখেছি। নিশ্চয়ই পান নি?
না, একখানাও না।
পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট কোনও কাজ করছে না।
একটু চুপচাপ।
তারপর গভীর উদ্বেগের সুরে সুধা বলল, শুনেছি, কলকাতায় আসার সময় নদীতে খুনীরা দল বেঁধে হামলা চালাচ্ছে। দাদু দিদারা তোকে একা একা আসতে দিল?
বিনু বলল, না এসে উপায় ছিল না। একাও আমি আসিনি। সঙ্গে ঝিনুক ছিল।
দু’পাশের দুই সোফায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল সুধা আর হিরণ। শ্বাস-আটকানো গলায় সুধা বলল, ঝিনুক, মানে ঢাকায় গিয়ে যার– কথাটা শেষ না করে থেমে যায়।
ধর্ষণের খবরটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারোর আর জানতে বাকি নেই। আস্তে মাথা নাড়ে বিনু, হ্যাঁ। ঢাকা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার পর উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল ঝিনুক। ঘর থেকে বেরুত না, দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকারে এক কোণে বসে দিনরাত কাঁদত। সারাক্ষণ ওর ভয়, এই বুঝি হানাদারেরা তাড়া করে আসছে। ফের তাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাবে। পাকিস্তান ওর কাছে আতঙ্কপুরী। ওখানে থাকলে ঝিনুক বাঁচত না।
কিন্তু—
কী?
ওই বয়েসের একটা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এলি। পথে বিপদে পড়িস নি?
এক-আধবার? সব শুনলে বুঝতে পারবি।
রাজদিয়ায় হেমনাথদের পুকুরঘাটে রাজেকের নৌকোয় ওঠার পর থেকে বর্ডার পর্যন্ত যা যা ঘটে গেছে তার বর্ণনা দিয়ে গেল বিনু। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দিল না। কাল রাত্তিরেও হেমনলিনীদের কাছেও একই বিবরণ দিয়েছে। আরও কতজনকে দিতে হবে, কে জানে।
সীমান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ পথে জলেস্থলে সর্বক্ষণ মরণভয়। কতবার মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, হিসেব নেই। ঝিনুকের জন্য চরম ঝুঁকিটা বিনুকে নিতেই হয়েছিল।
যত শুনছে, চোখের তারা স্থির হয়ে যাচ্ছে সুধার। পলক পড়ে না। বুকের ভেতর বাতাস আটকে যায়। চাপা আতঙ্কে শিউরে শিউরে ওঠে সে। জোরে শ্বাস ফেলে একসময় বলে, এভাবে ঝিনুককে তোর সঙ্গে পাঠানো উচিত হয় নি দাদুর। সাঙ্ঘাতিক কিছু যদি ঘটে যেত? উঃ, আমি ভাবতেই পারছি না।
সুধা চিরকালের ভীতু। অতি তুচ্ছ কারণেও তার ভয়। কিন্তু পাকিস্তান থেকে আসার পথে আজকাল যা ঘটছে তা শুনলে পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষেরও হ্রাসে বুকের ভেতর হিম হয়ে যাবে।
বিনু মলিন হাসে। বলে, কিছুই তো হয় নি। শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে ইণ্ডিয়ায় চলে আসতে পেরেছি।
হিরণ জিজ্ঞেস করে, ঝিনুক কি আনন্দদাদের ওখানে রয়েছে?
মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দেয় বিনু, হ্যাঁ। কিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ ব্যাকুলভাবে বলে ওঠে, হিরণদা, কলকাতায় এসে আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি। সবে কালই এসেছি। দু’চার দিন পরে আপনাদের সঙ্গে দেখা করতাম। কিন্তু আজই ছুটে আসতে হল।
উৎকণ্ঠিত সুধা বিনুর দিকে অনেকখানি ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে রে?
হিরণ নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল। চকিতে কিছু আঁচ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, বিপদটা কি ঝিনুককে নিয়ে?
হ্যাঁ। বিনু বলল, সবটা বলছি, শুনুন–
হঠাৎ হিরণের খেয়াল হয়, মৃত্যুযাতনা ভোগ করতে করতে কলকাতায় পা দিয়েই আজ এখানে চলে এসেছে বিনু। আর সেই থেকেই কথা বলে চলেছে। বিরামহীন। নিশ্চয়ই ভীষণ ক্লান্ত। ওর বিশ্রাম দরকার। সারা মাথায় আতঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার কাহিনী শুনতে শুনতে তারা এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল যে অন্য কোনও দিকে নজর ছিল না।
হিরণ বলল, পরে শুনব। বলে সুধার দিকে ফিরল, ওকে নিয়ে বাথরুম দেখিয়ে দাও। চান খাওয়া সেরে দুপুরটা ঘুমোক। বিকেলে সব শোনা যাবে।
ভাইটার সঙ্গে এত বছর বাদে দেখা। তাকে জলটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ক্রমাগত প্রশ্ন করে করে বকিয়ে মেরেছে। অপরাধী মুখ করে দ্রুত উঠে পড়ে সুধা। বলে, আয় বিনু।
বিনু কিন্তু বসেই থাকে। বলে, বড়দির বাড়িতে চান করে সকালের খাবার খেয়ে এসেছি। এখন আর কিছু খাব না। বেশিক্ষণ থাকতেও পারব না। তোদের সঙ্গে দরকারী কথাটা সেরেই ফিরে যাব। তুই বোস ছোটদি–
তবু হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে সুধা। বলে, এখনই যাবার এত তাড়া কিসের? তুই এখানে এসেছিস, দিদি কি আনন্দদা জানে না?
জানে।
তা হলে আর কী। ওরা নিশ্চয়ই বুঝবে, আমরা তোকে যেতে দিই নি।
বিনু বলল, আমি ওদের কথা ভাবছি না। ঝিনুকের জন্যেই ফিরে যেতে হবে।
সুধা বলল, ও বাড়িতে দিদি আছে, আনন্দদা আছে, মাউইমা আছেন। গন্ডা গন্ডা কাজের লোক। ঝিনুকের আদর যত্নের ত্রুটি হবে না।
বিনু বলে, তোদের বললাম তো, যে ঝিনুককে দেখে এসেছিস, ঢাকা থেকে ফেরার পর সে আর তা নেই। কী কষ্ট করে ওকে আমরা খানিকটা সুস্থ করে তুলেছি, চিন্তা করতে পারবি না। এখানে দাদু নেই, দিদারা নেই, আমাকে বেশিক্ষণ না দেখলে খাবে না, চান করবে না, এমন পাগলামো শুরু করবে যে আর কারোর পক্ষে সামলানো মুশকিল। আমাকে আটকে রাখিস না ছোটদি।
অভিমানের সুরে সুধা কী বলতে যাচ্ছিল, ইশারায় তাকে থামিয়ে সোফা দেখিয়ে দিল হিরণ। সুধা ধীরে ধীরে ফের বসে পড়ে।
হিরণ বিনুর চোখের দিকে তাকায়, ঠিক আছে, ফিরেই যেও। এখন তোমার দরকারী কথাটা বল–
কাল শিয়ালদা স্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে ভবানীপুর গিয়ে অবনীমোহনকে না পেয়ে আনন্দদের বাড়ি যেতে হয়েছিল। রাতটা সেখানে কাটিয়েছে। সুধাদের মাত্র এটুকুই বলেছিল বিনু। কিন্তু দিদির শ্বশুর বাড়িতে ক’টা দিন থাকতে গিয়ে কী জুটল? অপমান। গ্লানি। চরম মানসিক নির্যাতন। ঝিনুকের সঙ্গে হেমনলিনী কী নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন আর বাড়ির প্রতিটি মানুষ নীরবে, বিনা প্রতিবাদে তা সয়ে গেছে, সবিস্তারে জানাল বিনু। একটুও রাখঢাক না করে। ঝিনুকের অপরাধ, সে ধর্ষিত। তাই সে অচ্ছুৎ। কৃমিকীটের মতো নোংরা। তার নিশ্বাসে পৃথিবী অশুচি হয়ে যায়।
বলতে বলতে রাগে, আক্রোশে, তীব্র কষ্টে বিনুর মুখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। চোখ দুটো ফেটে পড়বে। আনন্দদের বাড়িতে মাথা নুইয়ে চুপ করে ছিল। নিরুদ্ধ ক্রোধ আগুনের হলকা হয়ে এখন। বেরিয়ে আসছে।
বিনু বলতে লাগল, আগে যদি জানতাম, ওদের বাড়ি কিছুতেই যেতাম না। শিয়ালদা স্টেশনে রিফিউজিদের ভেতর পড়ে থাকতাম।
হিরণ বিনুর পিঠে নরম করে একখানা হাত রাখে। বলে, ভবানীপুর পর্যন্ত এসেছিলে। সেখান থেকে আমাদের বাড়ি তো খুব দূরে নয়। চলে এলে না কেন?
বিনু বলল, ঠিকানাটা জানি। কিন্তু এদিকে আগে কখনও আসি নি। তার ওপর অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। খিদেয় তেষ্টায় ধকলে আমরা তখন ধুকছি। আনন্দদাদের বাড়িতে আগে গেছি। আবছাভাবে মনেও ছিল। তাই ওখানে চলে গিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম
বিষণ্ণ হিরণ আস্তে মাথা নাড়ে। বিনুর ক্ষোভের দুঃখের অভিযোগের সহস্র কারণ রয়েছে। হেমনলিনী অতটা কঠোর না হলেই পারতেন। সেই ছেলেবেলা থেকে ঝিনুককে চেনে সে। মেয়েটার জন্য বুকের ভেতর চিনচিনে একটা ব্যথা গোপন স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
যে ফুটন্ত উত্তেজনা বিনুর মাথায় টগবগ করছিল, হঠাৎ সেটা জুড়িয়ে যায়। হিরণের একটা হাত আঁকড়ে ধরে সে। ব্যাকুলভাবে বলে, এক মুহূর্তও আর আনন্দদাদের বাড়ি থাকতে চাইছে।
ঝিনুক। জোর করে ওখানে রাখলে মেয়েটা মরে যাবে। বাবা যে কদিন না ফিরছে আপনাদের বাড়িতে আমাদের থাকতে দেবেন?
হিরণ হকচকিয়ে যায়। বলে, এ তুমি কী বলছ বিনু! কদিন কেন, যতদিন ইচ্ছে আমাদের কাছে থাকবে। তোমার ছোটদির বাড়ি তোমার বাড়ি। আবেগে তার গলা কাঁপতে থাকে। জিজ্ঞেস করে, ঝিনুককে কবে নিয়ে আসতে চাইছ?
কতকাল পর ফুসফুস বোঝাই করে সহজভাবে বাতাস টানতে পারল, নিজেই জানে না বিনু। টালিগঞ্জের দিকে পা বাড়ানোর সময় যে দ্বিধা আর সংশয়টুকু ছিল, সব উধাও। বলল, আজই– কৃতজ্ঞতায় তার স্বর বুজে আসে। চোখের কোণদুটো সির সির করছে।
হিরণ বলল, চল, আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।
সুধা ব্যস্তভাবে বলল, জ্বর গায়ে তোমাকে বেরুতে হবে না। ঝিনুককে আনতে আমি ওর সঙ্গে যাব।
কয়েক পলক কী ভেবে নিল বিনু। সুধাকে বলল, না, কারোরই যাবার দরকার নেই। তোরা গেলে মনে করবে, আমি নালিশ করতে এসেছিলাম। তাই ঝিনুককে নিয়ে যেতে এসেছিস। এতে ওরা ভীষণ অপমানিত বোধ করবে।
এক ঘনিষ্ঠ আত্মজনের কাছে যে মেয়ে অবাঞ্ছিত, আরেক আত্মীয় তাকে আশ্রয় দেবার জন্য পড়ি মড়ি করে বাড়ি অব্দি দৌড়ে এসেছে, হেমনলিনী তা ভাল চোখে দেখবেন না। তার অহংবোধে ঘা লাগবে।
বিনু বলতে থাকে, মাঝখান থেকে তোদের সঙ্গে বড়দির শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যাবে।
সুধা বলল, তোরা এখানে এসে থাকবি। সেটা কি ওরা জানতে পারবে না?
জানুক। ভাববে, আমিই ঝিনুককে তোদের কাছে নিয়ে এসেছি। তোরা নিতে আসিস নি।
আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কত রকম জটিলতা, কত রকম টানাপোড়েন! সামান্য এদিক ওদিক হলে সম্পর্কের সুতোগুলো কখন পট পট ছিঁড়ে যাবে, কেউ জানে না। কলকাতায় পা দিয়ে এসব বুঝতে শিখেছে বিনু। এক লহমায় তার বয়স আচমকা অনেকটা বেড়ে গেছে যেন।
হিরণ একদৃষ্টে লক্ষ করছিল। ক’বছর আগে রাজদিয়ায় যে চঞ্চল কিশোরটিকে দেখে এসেছে, কী নিষ্পাপই না ছিল সে। মুখে জগতের সবটুকু সারল্য মাখানো। দু’চোখে অগাধ বিস্ময় নিয়ে এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকত। সে কি এই বিনু যে তার আর সুধার মাঝখানে এখন বসে আছে! কত অল্প সময়ে কত পরিণত হয়ে উঠেছে সে। কত অভিজ্ঞ। সংসারের নানা খুঁটিনাটির দিকে তার এখন তীক্ষ্ণ নজর।
হিরণ বলল, বিনু ঠিকই বলেছে। ও নিজেই ঝিনুককে নিয়ে আসুক।
কত কাল পর কী ভাল যে লাগছে বিনুর! হালকা। ভারমুক্ত। কিন্তু কতক্ষণ? পুরনো সেই দুশ্চিন্তাটা ফের ডালপালা মেলে তার মাথায় চেপে বসে। ভয়ে ভয়ে বলে, কিন্তু হিরণদা–
বিনুর দিক থেকে চোখ সরায় নি হিরণ। জিজ্ঞেস করল, কী বলছ?
বড়দিরা বলছিল, আপনার ঠাকুরদা আর জেঠিমা দেশ থেকে এসে এখানেই থাকেন। এখন পাটনায় বেড়াতে গেছেন। হঠাৎ যদি ওঁরা ফিরে আসেন–
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। হিরণের মুখে চকিতে ছায়া পড়ে। ঝিনুকের লাঞ্ছনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা শুনতে শুনতে সে এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে ঠাকুরদা আর জেঠিমার কথা মনে পড়ে নি। ক’বছরে কত কী ঘটল–মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, গণহত্যা, হাজায় হাজার নারী ধর্ষণ, সীমান্তের ওপার থেকে শরণার্থীর ঢল। বিশ্বসংসার তোলপাড় হয়ে গেল, পুরনো জীবনযাত্রা ছিন্নভিন্ন। কিছুই আগের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সময় কত পালটে গেছে, কিন্তু এতটুকু বদলাননি ঠাকুরদা আর জেঠিমা। হেমনলিনীর মতো ওঁরাও একই ছাঁচে ফেলা। দুই বুড়োবুড়ি কি ঝিনুককে সহজভাবে মেনে নেবেন? মনে হয় না। কিন্তু বিনুকে কথা দেওয়া হয়ে গেছে। এখন আর ফেরানো যাবে না। দ্বিধা কাটিয়ে সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল হিরণ, মাসখানেকের ভেতর ওঁদের আসার সম্ভাবনা নেই। এলে দেখা যাবে।
বিনু বলল, আরেকটা অনুরোধ হিরণদা—
বল।
কেউ ঝিনুকের সামনে ঢাকার কথা, পাকিস্তানের কথা তুলবেন না। ওর পুরনো স্মৃতি একেবারে ভুলিয়ে দিতে হবে।
.
৩.২২
যে কারণে ঊর্ধ্বশ্বাসে টালিগঞ্জে ছুটে আসা, সেটা চুকে যাবার পরও খুব সহজ বেরুনো গেল না। ভাই এতকাল বাদে এসেছে। প্রথম দিন সে কিছুই মুখে না দিয়ে চলে যাবে, সুধা কি তাই যেতে দিতে পারে? শেষ মুহূর্তে কেঁদে কেটে বিনুকে জোর করে হিরণের কাছে বসিয়ে রান্নাঘরে চল গিয়েছিল। ঘরে ভাল মিষ্টি আছে। অল্পবয়সী কাজের মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষিপ্র হাতে লুচি ভেজে থালা বোঝাই করে নিয়ে এল।
এই ভরদুপুরে এত লুচিমিষ্টি খাওয়া যায়? কিন্তু সুধা যা জেদী আর অভিমানী, কোনও কথাই শুনবে না। আপত্তি করলে সময় নষ্ট।
সামনের দেওয়াল ঘড়িতে একটা বেজে সাতাশ। এখান থেকে সুনীতিদের বাড়ি ফিরে যেতে যেতে আড়াইটা বেজে যাবে। এতক্ষণ তাকে না দেখে ঝিনুক কী কান্ড বাধিয়ে বসে আছে, কে জানে। গোগ্রাসে খেতে লাগল বিনু।
খাওয়া যখন প্রায় শেষ, বাইরের বাগানের দিক থেকে কেউ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, ছুটোদিদি, ছুটোদিদি, আমি আইসা গ্যাছি। তলে দুয়ার বন্ধ রইছে।
একটু দাঁড়াও– কণ্ঠস্বর উঁচুতে তুলল সুধা। তাদের বাড়ির কাজের মেয়েটির নাম উমা। তাকে ডেকে, একতলায় গিয়ে সদর দরজা খুলে দিতে বলল।
নিচে থেকে যে ডাকছিল তার গলা চেনা চেনা লাগছিল বিনুর। জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে রে ছোটদি?
সুধা জবাব দেবার আগেই হিরণ বলে উঠল, তোমার খুব জানাশোনা। এলেই দেখতে পাবে। একটু অপেক্ষা কর। তার মুখে মৃদু হাসি। হাসিটা হালকা রহস্যের আবরণে মোড়া।
খানিক পর উমা যাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল, তার সঙ্গে এ জীবনে আর কখনও দেখা হবে, তাও টালিগঞ্জের এই বাড়িতে, কে ভাবতে পেরেছিল! যুগল সামনে দাঁড়িয়ে।
দেশভাগের ঠিক পরে ফের দাঙ্গা বাধলে ভাটির দেশ থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের নিয়ে রাজদিয়ায় এসে এক লহমা বিনুদের সঙ্গে দেখা করেই ইন্ডিয়ায় পালিয়ে এসেছিল যুগল। তারপর নতুন করে পাকিস্তান জুড়ে শুধুই আতঙ্ক। অন্তহীন। নিরবচ্ছিন্ন। যুগলের স্মৃতি কবেই ঝাঁপসা হয়ে গেছে। কিন্তু জীবন এক আশ্চর্য যাদুকর। কখন যে গোপন ঝুলি থেকে কী চমক বার করে আনবে, আগেভাগে টেরও পাওয়া মুশকিল। সময়ের পলি পড়ে পড়ে মন থেকে যে মুছে গিয়েছিল, পৃথিবীর আরেক প্রান্তে সহসাই হয়তো তার সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে যায়।
রাজদিয়ায় হেমনাথের বাড়ি যেদিন প্রথম যুগলকে কামলা খাটতে দেখেছিল বিনু, কী চমৎকারই না ছিল সে। কষ্টিপাথরে কাটা চেহারা। পেটানো সতেজ স্বাস্থ্য, চওড়া বুকের ছাতি। সর্বক্ষণ টগবগ করে ফুটছে।
শক্তপোক্ত কাঠামোটা অটুটই আছে যুগলের। কিন্তু স্বাস্থ্যের অনেকটাই খোয়া গেছে। গাল ভাঙা, মুখে খাপচা খাপচা দাড়ি, কণ্ঠার হাড় গজালের মতো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। চোখ গর্তে ঢোকানো। চুল উঠে উঠে কপালটা মাঠ। পরনে আধময়লা পাজামা আর ডোরাকাটা সবুজ হাফ শার্ট। পায়ে তালিমারা স্যান্ডেল।
পরস্পরের দিকে অপার বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে দুজনে। বিনুকে দেখতে দেখতে যুগলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুৎ খেলে যায়। আনন্দে, উত্তেজনায় সে চেঁচিয়ে ওঠে, আমাগো ছুটোবাবু না!
বিনুও খুব খুশি, খানিক আগে যেমনটা হয়েছিল সুধাকে দেখে। বলল, হ্যাঁ। তোমাকে ছোটদির বাড়ি দেখব, ভাবতেই পারি নি। কাছেই থাকো নাকি?
কথাগুলো কানেই যায় না যুগলের। গভীর আবেগ তার ওপর ভর করে বসেছে। শিশুর মতো দুই হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঝড়ের গতিতে বলে যায়, কত বচ্ছর পর দেখলাম। কী ভালা যে লাগতে আছে! গত বিষুদবারও এই বাড়ি আসছিলাম। ছুটোদিদিরা তো কয় নাই, আপনে পাকিস্থান থিকা ইন্ডিয়ায় চইলা আইছেন–
সুধা বলল, বিনু সবে কালই এসেছে। রাজদিয়া থেকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, আসছে। সে সব চিঠি আমরা পাই নি। তোমাকে খবর দেব কী করে?
যুগল মাথা নাড়ে, হেয়া (তা) ঠিকই। বিনুকে বলে, উই পার থিকা আসনের আগে রাইজদা গিয়া যেই দিন আপনেগো লগে দেখা করলাম তহনই কইছিলাম, পাহিস্থানে থাকন যাইব না। হয় খুন করব, নাইলে বাড়িঘরে আগুন লাগাইয়া বস্যের মাইয়া (যুবতী) উঠাইয়া লইয়া খেদাইয়া দিব। মনে আছে?
যুগল লেখাপড়া শেখে নি, অক্ষরপরিচয়হীন। কিন্তু দূরদর্শী। পাকিস্তানে কী ঘটতে পারে, ভবিষ্যতের সেই চেহারাটা তার কাছে বহুকাল আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
রাজদিয়া থেকে শিয়ালদা পর্যন্ত স্টিমারে আর ট্রেনে গাদাগাদি করে আসার সময় হাজার হাজার ভিটেমাটি খোয়ানো মানুষের মুখে একই কথা শুনেছে বিনু। হুবহু একই অভিযোগ। একই আক্ষেপ। একই সর্বনাশের কাহিনী।
অন্যের কথা শুনতে হবে কেন? ঝিনুককে নিয়ে তার নিদারুণ আতঙ্ক আর অভিজ্ঞতা কি আলাদা কিছু? বিমর্ষ মুখে বিনু বলে, সবই মনে আছে।
যুগল বলল, অনেক আগেই আপনেগো চইলা আসন উচিত আছিল ছুটোবাবু।
বিনু চুপ করে থাকে।
যুগল উৎসুক সুরে এবার বলে, বড়কত্তা, দুই ঠাউরমা–তেনারা কই? ছুটোদিদি, উনাগো ডাইকা আনেন। কত কাল পর দেখা হইব। স্যাবা দিতে (প্রণাম করতে) পারুম। আমারে কী ভালাটাই না বাসতেন!
বিনু বলল, দাদুরা আসেন নি।
যুগল চমকে ওঠে, ক্যান?
হেমনাথদের রাজদিয়া ছেড়ে না আসার কারণটা সংক্ষেপে জানিয়ে দেয় বিনু।
যুগলকে বিচলিত দেখায়। ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত। অধীরভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, এইটা কিলাম (কিন্তু) ঠিক হয় নাই ছুটোবাবু। বড়কত্তায় এত জ্ঞেয়ানী, প্যাটে কত বিদ্যা। অত বুঝমান হইয়াও বোঝলেন না, দিনকাল আর আগের লাখান নাই! দশ বিশজন বাদ দিলে পাকিস্থানের মানুষ অন্য কিসিমের হইয়া গ্যাছে। অহনও সোময় আছে ছুটোবাবু। য্যামন কইরা পারেন, বড়কত্তারে লইয়া আসেন। কুনদিন কী বিপদ যে ঘইটা যাইব! বাকি জমন কাইন্দা কুল পাইবেন না।
হেমনাথ যে কী জেদী, কতখানি একরোখা, বিনুর চেয়ে কে আর ভাল জানে। অনেক বুঝিয়েছে তাকে, কিন্তু অবুঝ গোঁ থেকে তাকে নড়ানো যায় নি। জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে তিনি কিছুতেই আসবেন না। রাজদিয়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবেন। এতে যা ঘটার ঘটুক। যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তিনি প্রস্তুত।
কিন্তু এসব আদৌ বুঝতে চাইবে না যুগল। তার কাছে পাকিস্তান হল নৃশংস এক বধ্যভূমি। কসাইখানা। সেখানে তিলমাত্র নিরাপত্তা নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, যে কোনও উপায়ে সীমান্তের এপারে চলে আসা দরকার। বিনু বলল, দেখি কী করা যায়–হঠাৎ খেয়াল হল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে যুগল। ব্যস্তভাবে তাকে বসতে বলল।
যুগল বাঁ হাঁটু দুমড়ে, ডান পা’টা অনেকখানি ছড়িয়ে, খুব কষ্টেসৃষ্টে মেঝেতে বসে পড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে কী এক যন্ত্রণা সামলাতে চাইছে।
বিনু যুগলের চোখমুখ লক্ষ করে নি। বলল, এ কী, নিচে কেন? সোফায় উঠে বসো।
যুগল বলল, বড়কত্তায় হইল আমার পুরান মুনিব। তেনার নাতি, নাতিন, নাতিন জামাইয়ের সুমখে কি চ্যারে (চেয়ারে) বইতে পারি?
হিরণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার বলল, আমিও কত দিন বলেছি, নিচে বসো না। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ওর মাথায় কী যে ঢুকে আছে! চেয়ারে কি সোফায় বসলে আমাদের সম্মান নাকি নষ্ট হবে!
এ নিয়ে কথা বাড়ানো বৃথা। হঠাৎ বিনুর চোখে পড়ল, ডান পা টান করার জন্য যুগলের পাজামা ঊরুর ওপর উঠে গেছে। গোড়ালি থেকে উরুর আধাআধি অব্দি মস্ত ব্যান্ডেজ। চমকে ওঠে সে, কী হয়েছে তোমার পায়ে?
নিশ্চয়ই মারাত্মক চোট পেয়েছে। যুগল কিন্তু আমলই ছিল না। ব্যথাটা একটু সইয়ে নিয়ে বলল, ত্যামন কিছু না। সুমুন্দির পুতেরা সড়কি চালাইয়া পাওখানেরে এফোড় ওফোড় কইরা ফালাইছিল।
উৎকণ্ঠিত বিনু জিজ্ঞেস করে, কারা? কাদের কথা বলছ?
যুগল জানায়, দেশভাগের পর এপারে এসে বেশ কয়েক মাস তারা শিয়ালদা স্টেশনে ঘাড় গুঁজে পড়ে ছিল। তারপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। খুব মোলায়েম করে সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে শরণার্থী শিবির। কিন্তু ক্যাম্পগুলোর এমন হাল, মানুষ দূরের কথা, পোকামাকড়ও থাকতে পারে না।
যুগল বলতে লাগল, শুনাশুন কানে আসতে লাগল, আমাগো চাইর পাশের কেম্পগুলান থিকা মেলা ‘রিফুজ’ ফাঁকা জমিন বিচরাইয়া (খুঁজে) বাইর কইরা বইসা পড়ছে। তমস্ত (সমস্ত) জনম কি কুত্তা বিলাইয়ের (বেড়ালের) লাখান কেম্পে পইড়া পইড়া মরুম? জান থাকতে না। আমাগো কেম্পের মানুষগুলানও হাত-পাও কোলে কইরা শুইয়া রইল না। ভোরে উইঠা চাউরগা (চাট্টি) মুখে দিয়া বাইর হই, ফিরি সন্ধ্যায় আন্ধার নামলে। ঘুইরা ঘুইরা শ্যাষম্যাষ একখান জমিন পাইয়া গেলাম। লগে লগে দখল কইরা ঘর তুলোম।
কিন্তু নিশ্চিন্ত হবার কি যো আছে? উদ্বাস্তুদের জীবনে নিরঙ্কুশ সুখভোগ বলে কিছু নেই। জমির মালিক তার মালিকানা ছাড়বে কেন? প্রথমে ভালয় ভালয় উঠে যেতে বলল। কাজ না হওয়ায় শুরু হল শাসানি। নিরন্তর হুমকি। কিন্তু যুগলরা অনড়।
জমিদারের হাতে অঢেল টাকা, প্রচুর গুন্ডা, রকমারি মারণাস্ত্র। এবার তারা পাঠাতে লাগল হানাদারের দঙ্গল। রাতের আঁধারে আততায়ীরা মশাল জ্বালিয়ে, রে রে করে দিগদিগন্ত কাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ঝুড়িয়ে, খুন করে, যুগলদের উৎখাত করে দেবে। পাকিস্তানে। যেমনটা চলছে, অবিকল তাই। কিন্তু যুগলরা চায় না আবার ক্যাম্পে ফিরতে, চায় না নতুন করে উদ্বাস্তু হতে। ততদিনে তারা আশেপাশের বাঁশ ঝাড় আর সুপারি বন কেটে বানিয়ে নিয়েছে টেটা সড়কি ল্যাজা লাঠি এবং নানা আদিম অস্ত্রশস্ত্র। গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ বাহিনী। হানাদারদের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে লাগল। তেমনই এক নৈশ যুদ্ধে সড়কির ফলা আমূল তার ঊরু থেকে পায়ের গোছ পর্যন্ত ঢুকে যায়।
এক রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনছিল বিনু। শিহরন জাগানো। তাদের সেই যুগল, যে একদিন রাজদিয়ায় হেমনাথের বাড়ি কামলা খাটতে এসেছিল, পূর্ব বাংলার খাল বিল নদী এমনি অজস্র জলধারা, জলতলের অপার রহস্য, মাছ পাখি শাপলা শালুক, পাট খেত, ধানবন, ভুবনজোড়া বিপুল আকাশ যাকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখত, সে কিনা সীমান্তের এপারে এসে এমন তুমুল, দুঃসাহসিক কান্ড বাধিয়ে বসেছে!
দেওয়াল ঘড়িতে সুরেলা আওয়াজ করে দুটো বাজল। চকিত হয়ে উঠল বিনু। যুগল সম্পর্কে আরও কত কী যে জানতে ইচ্ছা করছিল, কত অফুরান কৌতূহল যে সে উসকে দিয়েছে। কিন্তু এখন আর হাতে সময় নেই, যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। উঠে পড়ার আগে সেই পুরনো প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে ফের করল, তোমাদের সেই জবরদখল জায়গাটা কি খুব কাছে?
যুগল মাথা ঝাঁকায়, না ছুটোবাবু। মেলা (অনেক) দূরে। আগরপাড়ার নাম নি শুনছেন?
বিনু ভাবতে চেষ্টা করে। নামটা অজানা। বলল, না। কোথায় সেটা?
যুগল বুঝিয়ে দিল, শিয়ালদা থিকা রেলে কইরা যাইতে হয়। ইস্টিশানে লাইমা খাড়াখাড়ি মাইল দুই পুব দিকে হাটলে আমাগো জাগাখান (জায়গাটা)। নাম হইল মুকুন্দপুর।
বিনু অবাক, অত দূরে থাকো! ছোটদিদের এই বাড়ি চিনলে কী করে?
এই প্রশ্নটার জবাব দেয় হিরণ। ক্যাম্পবেল হাসপাতালে কিছুদিন আগে তার এক কলিগ ভীষণ অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিল। প্রায়ই সে ভিজিটিং আওয়ার্সে সহকমটিকে দেখতে যেত। হাসপাতালের গেটের কাছে আচমকা যুগলের সঙ্গে দেখা। পায়ের চোট নিয়ে কদিন ধরেই সে ক্যাম্পবেলে আসছে, ডাক্তার নার্স ঝাড়দার থেকে ওয়ার্ড বয় পর্যন্ত সবার হাতে পায়ে ধরছে, কাকুতি মিনতি করছে, কিন্তু কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। এদিকে ক্ষতস্থানটা পেকে দুনিয়ে উঠেছে। পা ফুলে তিন গুণ। যন্ত্রণায়, টাটানিতে প্রাণ বেরিয়ে যাবার যোগাড়।
ঢাকুরিয়া লেকের ধারে মিলিটারি হাসপাতালে হিরণের এক বন্ধু ডাক্তার। সে যুগলকে তার কাছে নিয়ে আসে। বন্ধুটি খুব যত্ন করে যুগলের চিকিৎসা শুরু করে। ফি বেস্পতিবার মুকুন্দপুর থেকে এসে পা দেখিয়ে ড্রেস করায় যুগল। হিরণদের ঠিকানা আগেই জেনে নিয়েছিল। ড্রেসিংয়ের পরসোজা এখানে চলে আসে। সারাটা দুপুর কাটিয়ে বেলা পড়লে ফিরে যায়।
যুগল বলল, এইবার বোঝলেন তো ক্যামন কইরা এই বাড়ির দিশা পাইছি। ছুটো জামাইবাবুর লগে হেইদিন কেমবেলে (ক্যাম্পবেল) দেখা না হইলে নিয্যস (নিশ্চয়ই) মইরা যাইতাম। তার গলার স্বর ভারী হয়ে ওঠে।
ক্ষণিক নীরবতা।
তারপর যুগল জিজ্ঞেস করে, অহন ছুটোদিদির বাড়িতেই তো থাকবেন?
বিনু বলে, কিছুদিন তো আছিই। তারপর দেখা যাক তার মাথায় অবনীমোহনের চিন্তাটা ঘুরে গেল। তীর্থস্থান থেকে ফিরে এলে ঝিনুককে নিয়ে তার কাছে চলে যাবে সে। যুগলকে আপাতত বাবার কথাটা বলল না।
যুগল উৎসাহের সুরে বলে, একদিন আপনেরে আমাগো মুকুন্দপুরে লইয়া যামু। যাইবেন তো ছুটোবাবু?
যুগলদের দখল-করা ভূখন্ডটি দেখার জন্য ভীষণ আগ্রহ বোধ করছিল বিনু। বলল, নিশ্চয়ই যাব।
হেইখানে গ্যালে চিনাজানা মেলা মাইনষের লগে দেখা হইব। আমাগো রাইজদারই দশ ঘর পাইবেন। হেয়া (তা) ছাড়া, রসুইনা তাজপুর গিরিগুঞ্জ ইনামগুঞ্জের মানুষও আছে।
এরা কারা? কী নাম?
যুগল রহস্য করে বলে, অহন কিছু কমু না। মুকুন্দপুরে গ্যালে নিজের চৌখে দেখতে পাইবেন।
বিনু হাসল। এই নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করল না।
যুগল এবার বলে, আমিই খালি ব্যাজর ব্যাজর কইরা যাইতে আছি। আপনের কথা কিছুই তো শুনা হইল না। দ্যাশ থিকা একাই নি আইছেন? নিকি রাইজদার আরও কেও কেও লগে আছিল?
খানিক দ্বিধা হল বিনুর। ঝিনুকের কথা বলা কি ঠিক হবে? তার সেই খবরটা কি যুগল পেয়ে গেছে? সুধাদের বাড়ি যখন তার নিয়মিত যাতায়াত, পেলেও পেতে পারে। যদি নাও পায়, বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবাই যখন জেনে গেছে, তখন বাড়তি একজন জানলে সর্বনাশের মাত্রা নতুন করে কতটা আর বাড়বে?
ঝিনুকের লাঞ্ছনার জন্য বিনু সর্বক্ষণ কুঁকড়ে থাকে। সেটা গোপন রাখতে তার অবিরত প্রয়াস। সহসা বিনুর মনে হয়, এসবের কি প্রয়োজন আছে? তার চেয়ে সারা পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়ানো দরকার। নিজেকে শক্ত করে নিল সে, ঝিনুক আমার সঙ্গে এসেছে।
কই ঝিনুক বইনে? তেনারে লইয়া আসেন। কত বচ্ছর দেখি নাই–যুগলের রুক্ষ মুখ ঝলমলিয়ে ওঠে।
বিনু বলে, ঝিনুক এখানে নেই। কাল বড়দির বাড়ি এসেছিলাম, সেখানেই আছে।
যুগলের কপাল কুঁচকে যায়, বড়দিদি আর বড় জামাইবাবু বড় ভালা। কিন্তুক দিদির শাউড়ির সাই (প্রচন্ড) দেমাক। রোখাচোখা। একবার ছুটোদিদির কাছ থিকা ঠিকানা লইয়া হেইখানে গেছিলাম। রিফুজ বইলা বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দিল না, দুয়ার থিকাই খেদাইয়া দিল। বড়দিদি আর বড় জামাইবাবু মুখ কালা কইরা খাড়ইয়া রইল। সে বলতে থাকে, ঝিনুক বইনেরে উইখানে রাইখেন না। পোলাপান কাল থিকা তো দেখছি, জবর অভিমান–
দুঃসংবাদটা যুগল পেয়েছে কিনা, সঠিক বোঝা গেল না। বিনু বলল, আজই ওকে এখানে নিয়ে আসব। বলতে বলতে সে উঠে পড়ে।
খুব ভালা। পরের বিষুদবার যহন আসুম, ঝিনুক বইনের লগে দেখা হইব। যুগলের চোখে ফের আলোর ছটা।
আস্তে মাথা হেলিয়ে এগিয়ে যায় বিনু। তার পেছন পেছন সুধা হিরণ আর যুগল।
সুধা বলল, বেশি দেরি করিস না।
বিনু বলে, না না, সন্ধের আগেই চলে আসব।
যুগল বলল, আপনেগো পরের বিষুদবারে কিলাম আমাগো মুকুন্দপুরে নিয়া যামু।
বিনু উত্তর দিল না।
একতলার সদর দরজা পর্যন্ত এসে সুধা আর যুগল দাঁড়িয়ে পড়ে। হিরণ কিন্তু বিনুর সঙ্গ ছাড়ে না।
হিরণের উদ্দেশ্যটা আঁচ করে নিয়েছিল বিনু। কুণ্ঠিতভাবে বলে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
হিরণ হাসিমুখে বলে, চলই না—
জ্বর গায়ে আমার সঙ্গে যেতে হবে না। বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকুন।
জবাব না দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে হিরণ। বাড়ি থেকে খানিকটা যাবার পর হঠাৎই একতাড়া নোট বার করে বিনুর পকেটে ঠেসে ঠেসে ভরতে থাকে।
বিনু চমকে ওঠে, না না, দেবেন না। আমার কাছে এখনও সাড়ে ছ শ’র বেশি টাকা আছে।
থাক। এটাও রাখো–
দরকার হলে পরে চেয়ে নেব।
টাকাগুলো ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিল বিনু। তার হাত চেপে ধরে হিরণ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে, বড়রা কিছু দিলে না বলতে নেই।
তার দৃষ্টিতে কত কীই না মেশানো! স্নেহ, আবেগ, চাপা ভর্ৎসনা। বিনুর আর আপত্তি করতে সাহস হয় না। মাথা নিচু করে সে হাঁটতে লাগল।
বড় রাস্তায় এসে বিনুকে ধর্মতলার ট্রামে তুলে দিল হিরণ।
.
৩.২৩
ধর্মতলায় ট্রাম বদলে আনন্দদের বাড়ির কাছাকাছি এসে বিনু যখন নামল, হেমন্তের দিনটা বিকেলের দিকে ঢলতে শুরু করেছে। খানিক আগেও রোদে বেশ ঝাঁঝ ছিল। তপ্ত শহর দ্রুত জুড়িয়ে যাচ্ছে। ঝিরঝিরে হাওয়া এখনও তেমন ঠান্ডা হয় নি, তবু আরামে গা জুড়িয়ে যায়।
চারদিকে যথারীতি ভিড়। প্রচুর মানুষ। প্রচুর গাড়িঘোড়া। নানা ধরনের মিশ্র আওয়াজ। কোনও দিকে দৃকপাত না করে জোরে জোরে পা চালাচ্ছে বিনু। ঢের আগেই ফিরে আসতে পারত। আসা উচিতও ছিল। কিন্তু যুগলের সঙ্গে এত বছর বাদে দেখা। সহজে কি ছাড়ান পাওয়া যায়? কথায়। কথায় কত দেরি হয়ে গেল!
ট্রাম স্টপেজ থেকে বাঁ দিকে একটা চওড়া রাস্তা চলে গেছে। সেটা ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলেই আনন্দদের বাড়ি।
ভেতরে ঢুকতেই একতলায় ঝিনুকের ঘরের সামনে জটলাটা চোখে পড়ল। হেমনলিনী আনন্দ এবং আরও দু’তিনটি কাজের মেয়ে। দুলালী ধারে কাছে নেই। সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কিছুটা উদ্বেগ। আনেকখানি বিরক্তি।
কী হতে পারে? বিনুর বুকের ধকধকটা শতগুণ বেড়ে যায়।
তাকে দেখতে পেয়ে হেমনলিনী হাঁফ ছাড়লেন, মনে হল। এক নিশ্বাসে তার হাজারটা প্রশ্ন। আনন্দর কাছে শুনেছেন, কী দরকারে বিনু একজনের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। একটা, সোয়া একটায় ফিরে আসবে। এখন সাড়ে তিনটে বাজে। কোথায় গিয়েছিল সে? কার কাছে গিয়েছিল? এত দেরি হল কেন?
বোঝা গেল, আনন্দ এবং সুনীতি সুধাদের ব্যাপারটা গোপন রেখেছে। ভালই করেছে।
হেমনলিনীর ঝক ঝক প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অযথা সময় নষ্ট। উঠে আসবে নানা অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ। সব শুনলে তিনি আদৌ খুশি হবেন না।
উৎকণ্ঠায় দমাদ্দম হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির ঘা পড়ছে। বিনু এগিয়ে গিয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মাউইমা?
ক্ষণেক আগে হেমনলিনী যা জানতে চাইছিলেন, এখন আর সে সব নিয়ে কৌতূহল নেই। বললেন, তোমার দেরি দেখে সেই দেড়টা থেকে ঝিনুক পাগলের মতো কেঁদে চলেছে। বিছানা থেকে নামছে না। কিছু মুখে তুলছে না। আমরা বাড়িসুষ্ঠু সবাই কত করে বলছি, শুনছেই না। তুমি একটু বোঝাও বাবা।
বিনু বলল, আমি দেখছি।
অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। পা ধরে গেছে। এখন যাই?
আসুন–
দরজার বাইরে ঝিনুকের ছোঁয়া বাঁচিয়ে কর্তব্য পালন করছিলেন হেমনলিনী। দায়িত্ব হস্তান্তর করে তিনি চলে গেলেন। যে কাজের মেয়েগুলো দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, ধমকে তাদের তাড়ালেন। শুধু আনন্দই দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
বিনু ঘরের ভেতর চলে আসে। আনন্দও। দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে ঝিনুক খাটে বসে আছে। তার পাশে সুনীতি। ম্লান মুখে, নিঃশব্দে ঝিনুকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
নিবিড় ভোলা চুল কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে ছড়িয়ে পড়েছে। পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে ঝিনুকের। অবিরল কান্নার দমকে। অবিকল সকাল বেলার সেই দৃশ্য।
বিনু নিচু গলায় ডাকল, ঝিনুক—
সাড়া নেই। কেঁদেই চলেছে মেয়েটা।
আরও বারকয়েক ডাকাডাকির পর মুখ তোলে ঝিনুক। চোখ রক্তের ডেলা।
কান্নাটা লহমায় উতরোল হয়ে ওঠে। গলা চিরে চিরে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে অপার্থিব কোনও ক্রন্দনের ধ্বনি। করুণ। কাতর। একটানা। তারই মধ্যে জড়িয়ে জড়িয়ে ঝিনুক বলে, দেড়টায় আসবে বলছিলে। কেন তিনটে বাজিয়ে ফিরলে?
বিনু নরম গলায় বলল, শহরের আরেক মাথায় গিয়েছিলাম। এখান থেকে অনেক দূর। ট্রামে বাসে যেতে হয়। আগে থেকে কি বোঝা যায়, সেখানে কতক্ষণ লাগবে? ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।
আমার ভীষণ ভয় করছিল।
বড়দি আছে, আনন্দদা আছে। কিসের ভয়?
জবাব নেই।
ঝিনুক ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। কান্নাটা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে।
বিনু জিজ্ঞেস করে, সবাই এত করে বলেছে, খাও নি কেন?
ঝিনুক সজল চোখে তাকায়, তুমি ফিরছিলে না, তাই—
কোথাও গিয়ে যদি আটকে যাই, তুমি না খেয়ে এমন কান্নাকাটি করবে? কোনও মানে হয়? জানো, তোমার জন্যে এখনও এ বাড়ির কারোর খাওয়া হয় নি?
ঝিনুক লজ্জা পেয়ে মুখ নামায়। হয়তো তার মনে হয়, নিজেকে নিয়েই সে বড় বেশি উতলা হয়ে পড়েছিল। অন্যদের কথা একবারও ভাবে নি।
বিনু বলল, যাও, বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে এস। সকালের জলখাবারের মতো এ ঘরেই ঝিনুকের ভাত পাঠিয়ে দিতে বলল সুনীতিকে।
সুনীতি খাট থেকে নেমে বেরিয়ে গেল। ঝিনুক গেল বাথরুমে।
খানিক পরে খেতে খেতে ঝিনুক মনে করিয়ে দেয়, আমরা কিন্তু আজই এখান থেকে চলে যাব–
বিনু বলে, সেই ব্যবস্থাই তো করতে গিয়েছিলাম। খেয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নাও। সন্ধের আগে বেরিয়ে পড়ব।
বিনু যখন কথা দিয়েছে, অগাধ স্বস্তি। সমস্ত দুর্ভাবনার অবসান। কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, একবারও জানতে চাইল না।
বিনু ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার ওপর কী গভীর বিশ্বাস মেয়েটার! কী অসীম নির্ভরতা! বুকের ভেতর পুরনো মায়া নতুন করে উথলাতে থাকে।
ঝিনুকের খাওয়া হলে সুনীতি বিনু আর আনন্দকে খাওয়ার ঘরে নিয়ে গেল। এ বাড়িতে চিরকালের প্রথা, পুরুষেরা আগে খাবে, তারপর মেয়েরা। সবার শেষে কাজের লোকজন।
আনন্দর ভাই দীপক সাড়ে ন’টায় অফিসে চলে গেছে। পুরুষ বলতে আপাতত দু’জন। আনন্দ আর বিনু। ফুলতোলা আসন পেতে তাদের খেতে বসিয়ে দিল সুনীতি।
রান্নার ঠাকুর মাঝে মাঝে এসে দরকারমতো ভাত ডাল তরকারি মাছ মাংসটাংস দিয়ে যাচ্ছে। কত যে বাটি ঝকঝকে প্রকাণ্ড কাঁসার থালার চারপাশে!
টালিগঞ্জ থেকে আসার সময় এক গাদা লুচিমিষ্টি খাইয়ে দিয়েছিল সুধা। গলা পর্যন্ত ঠাসা। অবেলায় ভাত খেলে সহ্য হয় না বিনুর, সারা শরীর ঢিস টিস করতে থাকে। কাল মাঝরাতে আচমকা এসে পড়ায় সেভাবে খাওয়ানো যায় নি। তাই আজ রান্নাবান্নার বিপুল আয়োজন। শুধু তাদেরই জন্য। না বললে সুনীতি ছাড়বে না, ভীষণ কষ্ট পাবে। হেমনলিনীর কানে গেলে ছুটে আসবেন। আপ্যায়নের এতটুকু ত্রুটি হতে দেবেন না। বিনু খুঁটে খুঁটে একটু আধটু মুখে তুলতে লাগল।
হেমনলিনীদের সামনে কিছুই জিজ্ঞেস করা যায় নি। এমনকি ঝিনুক যখন তার ঘরে একা ছিল তখনও নয়। সুধাদের সঙ্গে কী কথাবার্তা হল, না জানা পর্যন্ত অন্যের সামনে মুখ খোলা ঠিক নয়। ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল সুনীতি আর আনন্দর। সেই সঙ্গে যথেষ্ট উৎকণ্ঠাও।
রাধুনি ঠাকুর রান্নাঘরে ফিরে গেছে। না ডাকলে আপাতত সে আসবে না। সতর্ক চোখে খাওয়ার ঘরের বাইরেটা এক লহমা দেখে নিয়ে সুনীতি ভাইয়ের দিকে ফিরে খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ওখানে কী হল রে? হিরণের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
আস্তে মাথা নাড়ে বিনু, হয়েছে।
কী বললে ওরা? রাজি?
হ্যাঁ।
এত সংক্ষিপ্ত উত্তরে তুষ্ট নয় সুনীতি। সবিস্তার বর্ণনা চায় সে। বলল, কী কী কথা হল বলবি তো।
সেই সাড়ে ন’টায় বেরিয়েছে। হাতিবাগান বাজার ঘুরে টালিগঞ্জ পর্যন্ত ছোটা, ফিরে আসা। সমস্ত দিন প্রায় দৌড়ের মধ্যেই কেটেছে। সারা শরীর জুড়ে অবসাদ। ক্লান্তি। খানিক পরে ফের বেরুতে হবে। কথা বলার মতো যথেষ্ট উদ্যম বা শক্তি তেমন আর অবশিষ্ট নেই। তবু সব জানাতে হল।
নতমুখে ম্রিয়মাণ বসে থাকে সুনীতি। আনন্দর খাওয়া থেমে গিয়েছিল। সেও নিশ্ৰুপ। অনেকক্ষণ পর বিষাদমাখা গলায় সুনীতি বলল, আমরা তো পারলাম না। সুধাদের কাছে গিয়েই থাক।
সুনীতিরা কতটা দুঃখ পেয়েছে, কী নিদারুণ লজ্জা, আবার তা টের পাওয়া যাচ্ছে। গুমোট, ভারী আবহাওয়া হালকা করার জন্য কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা মিশিয়ে বিনু বলল, আজ হিরণদাদের বাড়িতে কার সঙ্গে দেখা হয়েছে জানিস বড়দি?
সুনীতি জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে?
বল না–
কী করে বলব? আমরা কি ওখানে ছিলাম? না এখান থেকে সুধাদের বাড়ির ভেতর পর্যন্ত দেখা যায়?
বিনু বলল, আমাদের সেই রাজদিয়ার যুগল এসেছিল। কত বছর পর দেখা—
সুনীতি নিচু গলায় বলল, শুনেছি, যুগল সুধাদের বাড়ি মাঝে মাঝে আসে।
ওরা মুকুন্দপুর বলে একটা জায়গায় ফাঁকা জমি দখল করে বাড়িঘর তুলেছে। এই নিয়ে জমি মালিকের গুন্ডাদের সঙ্গে রোজ হাঙ্গামা লেগে আছে। সেই সব বলছিল।
জানি। আমাদের এখানেও একদিন যুগল এসেছিল। কিন্তু—
সুনীতি হঠাৎ চুপ করে গেল। তার মুখে মলিন ছায়া পড়েছে।
দিদিকে লক্ষ করছিল বিনু। সুধাদের বাড়িতে যুগলের সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল। হেমনলিনী তাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেন নি, দরজা থেকেই পোকামাকড়ের মতো হাঁকিয়ে দিয়েছেন। যুগলের বলার মধ্যে তীব্র অনুযোগ ছিল। ছিল প্রবল আক্ষেপ। হতাশা। রাগ। হেমনলিনীর রূঢ় আচরণের কথা ভেবেই হয়তো থেমে গেছে সুনীতি। যুগল সুধাদের কাছে আসে, অথচ এ বাড়ির দরজা তার কাছে বন্ধ, এটাই সুনীতিকে নতুন করে পীড়া দিচ্ছে। যুগল আর কখনও আসবে না, বিনুরাও চলে যাবে। প্রিয়জনদের সঙ্গে সম্পর্কের সুতোগুলো একে একে ছিঁড়ে যাচ্ছে।
বিনু ভাবে, তাদের এ বাড়িতে থাকতে দেওয়া গেল না, তাই সুনীতির মন ভীষণ খারাপ। তার ওপর যুগলের প্রসঙ্গটা না তুললেই ভাল হত।
একসময় নিয়মরক্ষার খাওয়া চুকিয়ে উঠে পড়ল বিনু। সঙ্গে আনন্দও। এ ঘরেরই এক কোণে। হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা। জলের কল, বেসিন। আঁচানো হলে সুনীতি বলল, তোর আনন্দদার সঙ্গে ওপরে যা। ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নে। আমি পরে আসছি।
দোতলায় উঠে দক্ষিণের সেই ঘরখানার দিকে যেতে যেতে বিনু বলল, আনন্দদা, আমরা বেশি দেরি করব না। পাঁচটা সোয়া পাঁচটায় বেরিয়ে পড়ব। ঘোড়ার গাড়ি কিভাবে পাওয়া যাবে?
আনন্দ বলে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। যতীনকে দিয়ে ডাকিয়ে আনব। ঘরের দরজা পর্যন্ত এল সে। ভেতরে ঢুকল না। যাও, শুয়ে পড়। আমি থাকলে তোমার বিশ্রাম হবে না।
আনন্দ চলে গেলে ঘরে এসে বিছানায় শরীর ঢেলে দেয় বিনু। কিন্তু ঘুম আসে না।
বাইরে হেমন্তের বিকেল নিস্তেজ হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে আকাশের যে আয়তক্ষেত্র চোখে পড়ে সেখানে মহাশূন্যে কটা চিল অলস ডানায় ভেসে বেড়াচ্ছে। রোদে দুপুরের সেই ঝলমলে ভাবটা নেই। যতদূর নজর যায়, হালকা কালচে ছায়া দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরি থেকে সেই চিন্তাটা ফের বেরিয়ে আসে। আপাতত কয়েকটা দিন সে চাপমুক্ত। ঝিনুককে নিয়ে সুধাদের বাড়িতে অন্তত লজ্জায়, গ্লানিতে কুঁকড়ে থাকতে হবে না।
কিন্তু এ তো সাময়িক বিরতি। রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ফুসফুঁসে বাতাস টেনে নেবার সামান্য অবকাশ। অনন্ত দুর্ভাবনার চিরতরে অবসান তাতে ঘটবে না।
সুধাদের বাড়িতে ক’দিন আর থাকতে পারবে? এক সপ্তাহ, দু’সপ্তাহ। তারপরও রয়েছে শতসহস্র দিন। পারাপারহীন, দীর্ঘ ভবিষ্যৎ কোথায় কতদূরে গিয়ে ঠেকেছে, কে জানে। ঝিনুকের মতো একটি ধর্ষিত মেয়েকে নিয়ে কিভাবে বাকি জীবন কাটবে, ভাবতে ভরসা হয় না বিনুর। মাঝে মাঝে বেপরোয়া হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে। যা ঘটার ঘটুক, যে কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে। কাউকে তোয়াক্কা করবে না। কিন্তু এই পর্যন্তই। পরক্ষণে তার প্রতিজ্ঞা, তার আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে যায়। সামনে হাজারটা বাধা। কত রকম প্রতিবন্ধকতা মাথা উঁচিয়ে আছে। সে সব পেরিয়ে যাওয়া কী যে কঠিন!
হঠাৎ সূক্ষ্মভাবে একটা আক্ষেপ বিনুকে ভেতর থেকে ঝকানি দিতে থাকে। ঝিনুককে পাকিস্তান থেকে না আনলেই বোধহয় ভাল হত। একা, ঝাড়া হাত-পায়ে এলে তার কোনও সমস্যাই থাকত। জীবন হত ভারশূন্য, মুক্ত। সুধা সুনীতি বা অবনীমোহনের কাছে থেকে ধীরেসুস্থে নিজের ভবিষ্যৎ সে তৈরি করে নিতে পারত।
ভাবনার বৃত্তটা পূর্ণ হবার আগেই চাবুকের ঘা পড়ে মুখের ওপর। একের পর এক। অবিরাম।
এ কী ভাবছিল সে! যে মেয়েটা সেই কোন ছেলেবেলা থেকে তার সঙ্গে লক্ষ পাকে জড়িয়ে আছে, মিশে আছে তার স্বাসবায়ুতে, তাকে ফেলে আসার চিন্তা কেমন করে তার মাথায় এল? নিজেকে ধিক্কার দেয় বিনু। আত্মগ্লানিতে মন ভরে ওঠে।
আচমকা কার কলকলানি কানে ভেসে আসে। কোনও মেয়ের কণ্ঠস্বর। গলাটা চেনা চেনা। তবে সুনীতি নয়, মাধুরী নয়। হেমনলিনীও নন। দুলালী বা বাড়ির অন্য কাজের মেয়েও না। কাজের মেয়েদের সাধ্য কী, এমন হইচই বাধায়।
কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। সারা বাড়ি এখন মুখর।
একাই কথা বলছে মেয়েটি। অবিরল। গলার স্বর সতেজ, সুরেলা, তার সঙ্গে ঝংকার মেশানো। মনে হয় কোনও তরুণী। তার সঙ্গীরা মৃদু গলায় কী জবাব দিচ্ছে।
কলধ্বনি এবং পায়ের আওয়াজ অনেক কাছে চলে এসেছে। এবার ডাকটা শোনা গেল, বিনুদা– বিনুদা–
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে বিনু। দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সুনীতি মাধুরী এবং ঝুমা।
আদলটা একই রয়েছে। তবু কত বদলে গেছে ঝুমা। সে এখন পরমাশ্চর্য যুবতী। ভরাট, লম্বাটে মুখ। সুছাঁদ নাক। ডানা-মেলা সরু ভুরু। মসৃণ, স্বর্ণাভ ত্বক। জোড়া বেলের মতো পুষ্ট বুক। ঘন চুল একবেণী করে পিঠের ওপর ঝোলানো। সুগোল হাত সটান কাধ থেকে নেমে এসেছে। পেছন দিকটা অনেক ভারী হয়েছে। দু’চোখে কী এক গাঢ় মাদকতা। পরনে সিল্কের শাড়ি আর ব্লাউজ। বাঁ হাতে সোনার ব্যান্ডে ছোট্ট ঘড়ি, ডান হাতে রুলি। গলায় লকেটওলা হালকা সোনার চেন। সর্বাঙ্গ জুড়ে যৌবনের ইন্দ্রজাল। এমন নারী সেকালে জন্মালে তাকে নিয়ে রাজারাজড়াদের মধ্যে ধুন্ধুমার বেধে যেত। কিংবা দশ দিগন্ত তোলপাড় করে বসত স্বয়ম্বর সভা।
ঝুমার কাঁধ থেকে একটা নকশা করা চামড়ার ব্যাগ ঝুলছে। বাইরে থেকে মনে হয়, বইখাতায় বোঝাই।
চোখের পাতা পড়ছিল না বিনুর। সারা শরীরে শিহরন খেলে যাচ্ছে। পা থেকে মাথা অব্দি তীব্র তড়িৎস্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে যেন।
সেই যুদ্ধের সময় রাজদিয়ায় এক বিজন দুপুরে কিশোরী ঝুমা তার ভেজা ভেজা রক্তাভ ঠোঁট দিয়ে বিনুর ঠোঁট শুষে নিয়েছিল। একটি চুম্বন নরনারীর সম্পর্কের অপার রহস্যের প্রথম দরজা বিনুর সামনে খুলে দিয়েছিল। শিরায়ু সেদিন অবশ হয়ে গেছে। মাথা ঝিমঝিম। কিন্তু তারই মধ্যে টের পাচ্ছিল, বুকের ভেতর ভরা বর্ষার পদ্মা আর মেঘনা যেন সমস্ত কিছু ভেঙে চুরে উথলপাথল করে দিচ্ছে।
যুদ্ধ থামলে ঝুমা আনন্দদের সঙ্গে কলকাতায় চলে এসেছিল। সুনীতির বউ-ভাতে তার সঙ্গে শেষ দেখা। তারপরও মাঝে মাঝে সে চিঠি লিখত। বিনুও উত্তর দিয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই একদিন চিঠি লেখালিখি বন্ধ হয়েছে। চোখের আড়াল হলে অনেক কিছুই তো হারিয়ে যায়।
সেই যে ঝুমার সঙ্গে যোগাযোগের সুতোটা ছিঁড়ে গেল তারপর কত কী-ই না ঘটে গেছে। দাঙ্গা। আগুন। ধর্ষণ। নারীহরণ। ব্যাপক হত্যা। দেশভাগ। সীমান্ত পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর এপারে চলে আসা।
অগ্নিগর্ভ সময়ের উলটোপালটা হাওয়া ঝুমাকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কে জানত, তার বুকের ভেতর কোনও অদৃশ্য প্রান্তে পদ্মা মেঘনা হয়ে লুকিয়ে ছিল মেয়েটা। সঙ্গোপনে। তাকে দেখামাত্র দুই নদী বান ডাকিয়ে পারকূল ভাঙতে ভাঙতে বেরিয়ে এসেছে।
ঝিনুকও যথেষ্ট সুন্দরী। তরুণী। ঝুমারই বয়সী। ঢাকা থেকে উদ্ধার করে আনার পর পাগলামির ঘোরে দু’হাতে মাঝে মাঝেই বিনুকে আঁকড়ে ধরত। রাজদিয়া থেকে বর্ডার পর্যন্ত দুটো দিন তাকে বুকের ভেতর সাপটে নিয়ে আসতে হয়েছে। ঝিনুকের কাঁধ গাল ঠোঁট স্তন পেট উরু তার গায়ে লেপটে থেকেছে। কখনও মনে হয় নি, রক্তে আগুনের ঝিলিক হেনে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। অথচ ঝুমাকে দেখে অস্থির অস্থির লাগছে কেন? কিশোর বয়সের সেই প্রথম চুমুটির তীব্র মধুর অনুভূতি এখনও বুঝিবা তার ঠোঁটে মাখানো রয়েছে।
ঝুমার দু’চোখ থেকে খুশি আর উত্তেজনা উপচে পড়ছিল। গলার স্বর উঁচুতে তুলে বলে, কী দেখছ অমন করে? চিনতে পারছ না? আমি ঝুমা
নেশাগ্রস্ত, আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায় বিনুর। লজ্জা পেয়ে বলল, চিনব না কেন? নিশ্চয়ই চিনেছি।
ঝুমা বলে, দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?
বিব্রত বিনু ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আরে না না। এস—
ঝুমা ঘরে ঢুকে বিনুর খাটের একধারে ঝুপ করে বসে পড়ে। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে পাশে রাখে।
সুনীতি আর মাধুরীও ঝুমার সঙ্গে ভেতরে এসেছিল। দু’টো চেয়ার টেনে তারাও কাছাকাছি বসে।
ঝুমা বলছিল, আজ সকালে খবর পেলাম তুমি পাকিস্তান থেকে চলে এসেছ। কী ভাল যে লাগছে! ওবেলাই দেখা করতে আসতাম। সাড়ে দশটা থেকে দু’টো অনার্স ক্লাস ছিল। তারপর পর পর পাসের। ফাঁকি মারার উপায় নেই। তাই ছুটি হতেই সোজা চলে এসেছি।
বিনু জিজ্ঞেস করে, আমার খবর কে দিল?
দিদা কী দরকারে যতীনদাকে মায়ের কাছে পাঠিয়েছিল। সে-ই বললে—
ঝুমা হেমনলিনীর নাতনী, আনন্দর দিদির মেয়ে। বিনু বলল, কোন কলেজে পড়?
স্কটিশ চার্চ।
কিসে অনার্স?
হিস্ট্রি।
কোন ইয়ার চলছে?
ফাস্ট ইয়ার।
ঝিনুকের মুখ চকিতে বিনুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মন ভারী হয়ে যায়। অল্পবয়সে মা-বাবার গৃহযুদ্ধের কারণে স্কুলে তিনটে বছর নষ্ট হয়েছিল ঝিনুকের। নইলে এতদিনে তারও বি.এ পড়ার কথা। ম্যাট্রিক পাস করার পর ঢাকায় সেই যে বিপর্যয়টা ঘটে গেল, তারপর ওর পড়াশোনার কথা কেউ আর ভাবে নি। ঝিনুক নিজেও না। ভাবার মতো মনের অবস্থা তখন কি ছিল? না, এখনও আছে?
ঝুমা বলল, কলকাতায় যখন চলে এসেছ, আমার সম্বন্ধে সব জানতে পারবে। হেমদাদু আর দুই দিদিমার কথা বল—
কলকাতায় পৌঁছবার পর আত্মীয়পরিজন যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, হেমনাথদের সম্পর্কে বলতে হচ্ছে। ঝুমাকেও না বলে পারা গেল না। তবে অনেক কাটছাঁট করে। সংক্ষেপে। বিশদ করে বলার মতো উদ্যম তার আর অবশিষ্ট নেই।
ঝুমার গোড়ার দিকের উন্মাদনা হঠাৎ ঝিমিয়ে আসে। ঝপ করে গলা নামিয়ে মলিন মুখে বলে, যতীনদা বলছিল, ঝিনুকও তোমার সঙ্গে এসেছে। একতলায় তাকে দেখেও এলাম। ভীষণ খারাপ লাগছিল। ওর সম্বন্ধে আগেই অনেক খবর কানে এসেছিল। অনেক কষ্ট’ শেষ না করে থেমে যায় সে।
কোন খবরের ইঙ্গিত ঝুমা দিয়েছে, বুঝতে বাকি থাকে না। এত বছর বাদে তাকে দেখে বিনুর স্নায়ুমন্ডলীতে যে ঝড় উঠেছিল, মুহূর্তে তা উধাও। সে উত্তর দিল না। ঘন বিষাদে ছেয়ে যায় মন।
দুঃখ, ক্লেশ, মানসিক যাতনা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো নিয়ে বেশিক্ষণ নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছা করে না ঝুমার। শ্বাস আটকে আসে। সে সবের বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে আসার জন্য একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, এখন তো তোমরা এখানেই থাক। আমাদের বাড়ি খুব কাছে। হেদুয়ার সুইমিং পুলের ওধারে। কবে যাবে বল–
একটি যুবককে এমন অসঙ্কোচে আর কোনও মেয়ে কি নিজেদের বাড়ি যাবার কথা বলতে পারত? বিশ্বব্রহ্মান্ডে একমাত্র কুমার পক্ষে বুঝিবা কিছুই অসম্ভব নয়।
বিনু বলল, কবে যেতে পারব, জানি না।
মানে?
আমরা এখানে থাকছি না।
কুমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছিল না। কয়েক পলক হতবাক তাকিয়ে থাকে সে। তারপর বলে, সত্যি?
আস্তে মাথা নাড়ে বিনু। সুনীতির দিকে আঙুলে বাড়িয়ে বলে, তোমার এই মামীকেই জিজ্ঞেস কর না–
ধরা গলায় সুনীতি জানায়, হ্যাঁ। ওরা চলে যাবে।
ঝুমা বিনুকে জিজ্ঞেস করল, কবে যাচ্ছ?
আজই। একটু পরেই বেরুব।
এ বাড়িটা যেন ঝুমার খাস সম্পত্তি। বিনুর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিল না সে। বলল, সবে তো কাল এলে। আজই চলে যাবার কী হল? না না, এখন তোমাদের কোনওভাবেই যাওয়া হবে না। কদিন থেকে যাও।
বিনু নিচু গলায় বলে, থাকার উপায় নেই।
ঝুমা অধীর হয়ে ওঠে, কেন নেই? তোমাকে কি কেউ তাড়িয়ে দিচ্ছে?
না।
তা হলে যাবার জন্যে খেপে উঠেছ কেন?
বিনু চুপ। কী বলবে সে? এ বাড়িতে না থাকার মূল কারণটা আর যাকেই হোক, হেমনলিনীর নাতনীকে কোনওভাবেই জানানো সম্ভব নয়।
ঝুমা ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়ায়, আনন্দমামা, দিদা সবাই বাড়িতে আছে। তাদের ডেকে আনছি। মামীরাও এখানে রয়েছে। কী করে তোমাদের যাওয়া হয় দেখছি–
বিনু হতচকিত। ঝুমা যা মেয়ে, ত্রিভুবন কাঁপিয়ে তুমুল কিছু বাধিয়ে বসার অলৌকিক ক্ষমতা তার আছে। আনন্দদের ডেকে এনে তাদের এখানে রাখার জন্য যদি ঝুমা জেদ ধরে বসে, লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। মুহূর্তে নিজেকে সামলে গম্ভীর মুখে বিনু বলে, বসো।
বিনুর স্বরে এমন এক ঋজুতা রয়েছে যা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নীরবে বসে পড়ে ঝুমা। বিনু বাধা দেওয়ায় মনে ক্ষোভ জমছে। ফর্সা মুখে তা ফুটেও উঠছে। আসলে সে যা চায় সেটি হওয়া চাই। এবং তৎক্ষণাৎ। তার কোনও কাজে, কোনও আচরণে আপত্তি করা চলবে না। তার মর্জিমাফিক চলতে হবে সবাইকে। নতমস্তকে। ঝুমার কাছে এটাই জাগতিক নিয়ম। রাজদিয়ায় থাকতে এ সব লক্ষ করেছে বিনু। বড্ড বেশি অধিকার-বোধ মেয়েটার।
কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে ঝুমা। তারপর জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোথায় যাবে? ভবানীপুরে তোমাদের সেই বাড়িতে?
না।
তবে?
সুধাদের কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা সুনীতি আর আনন্দ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। আপাতত সেটা গোপন রাখতেই হবে। বিনু বলল, যাব এক জায়গায়। তুমি তাদের চেনো না। হাজার গন্ডা জবাবদিহি এড়াবার জন্য মিথ্যেই বলতে হল।
হেমনলিনী ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকলেন। চোখেমুখে শঙ্কা, উত্তেজনা, উদ্বেগ। শ্বাসটানা ত্রস্ত সুরে বিনুকে বললেন, তুমি একবার নিচে যাও বাবা। সন্ধ্যা এসে বললে, ঝিনুক ফের কান্নাকাটি শুরু করেছে। কাজের মেয়েরা সামলাতে পারছে না। দুলালীকে বাদ দিয়ে সন্ধ্যাকে আজ থেকে ঝিনুকের দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
নতুন করে ঝিনুকের কান্নার হেতুটা মোটামুটি আঁচ করে নিল বিনু। লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে সে। ঝুমারা সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, হাতের ইশারায় তাদের থামিয়ে দৌড়ে বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। একতলায় ঝিনুকের ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, উতরোল কান্নায় খান খান হয়ে যাচ্ছে ঝিনুক। মুখটা বিকৃত। দু’চোখ থেকে অবিরল জলের ধারা বইছে।
সন্ধ্যা এবং আরও দুটি কাজের মেয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পার্থিব কোনও শব্দই কানে যাচ্ছে না ঝিনুকের। একেবারে বধির।
সন্ধ্যাদের চলে যেতে বলে ঘর ফাঁকা করল বিনু। ঝিনুকের পাশে বসে নরম গলায় বলল, আবার কী হল? শুধু শুধু কাঁদছ কেন?
কান্নাজড়ানো, ভাঙাচোরা গলায় ঝিনুক বলল, শুধু শুধু? ওই মেয়েটা এসেছে না?
যা অনুমান করা গিয়েছিল, হুবহু তা-ই। হুলটা হৃদয়ের কোন অন্তঃপুরে গিয়ে বিধেছে, টের পাওয়া যাচ্ছে। ঝুমার প্রতি ঝিনুকের হিংসেটা অনেক কালের পুরনো। রাজদিয়ায় থাকতেই সূত্রপাত। এত লাঞ্ছনা, এত বিপর্যয় ঘটে গেছে জীবনে, কিন্তু সেটা স্মৃতির গোপন কক্ষে লুকনোই ছিল। সব দেওয়াল ভেদ করে আবার বেরিয়ে এসেছে।
বিনু বলল, কী আশ্চর্য, এটা ওর মামাবাড়ি। আসবে না?
আসার আর সময় পেল না?, আমরা চলে গেলেই তো আসতে পারত।
অবুঝের মতো কথা বলো না। নিজের মামাবাড়িতে কখন আসবে, কেন আসবে, সেটা সে বুঝবে। তোমার আমার সেখানে কিছু করারও নেই, বলারও নেই। তা ছাড়া–
তা ছাড়া কী?
সে আসায় তোমার আমার কী অসুবিধে হয়েছে?
কান্না থেমে গিয়েছিল ঝিনুকের। শ্লেষে তার গলা রন রন করে ওঠে, ও ও! আমার যা-ই হোক, তোমার সুবিধে তো ষোল আনার জায়গায় আঠার আনা। আমাকে ঝি’দের হাতে তুলে দিয়ে দোতলায় বসে ঝুমার সঙ্গে কত গল্প, কত হাসাহাসি! হা হা, হি হি
রাজদিয়া থেকে বেরুবার পর এই প্রথম একটু কঠোর হল বিনু, কী অদ্ভুত কথা! হ্যাঁ হ্যাঁ, হি হি, গল্প! এসব কী বলছ তুমি!
ঝিনুক নিজের ঝেকেই বলে যায়, মনে করেছ, আমি নিচে আছি বলে কিছুই টের পাই নি! তুমি কী কর, না কর, সব বুঝতে পারি।
বিনু হাল ছেড়ে দেয়। যে প্রতিজ্ঞা করেছে, যুক্তির ধার ধারবে না, তাকে বোঝাতে যাওয়া নেহাতই বৃথা। বলল, এতদিন পর ঝুমার সঙ্গে দেখা। পাকিস্তানের কথা জানতে চাইছিল, দাদু-দিদাদের কথা জিজ্ঞেস করছিল। সে সব বলছিলাম। একে কি গল্প করা বলে? হা হা, হিহি বলে? বড়দি, মাধুরীদি সামনেই বসে ছিল। বিশ্বাস না হলে তাদের জিজ্ঞেস করতে পার।
ঝিনুকের মাথায় অবুঝপনা ভর করেই থাকে। বলে, কোনও সাক্ষীর দরকার নেই। আমাদের যাবার কী হল? এক মিনিটও আমি আর এখানে থাকব না।
ঝুমাকে দেখে খ্যাপামিটা মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে। আর বেশিক্ষণ এ বাড়িতে থাকলে ঝিনুক কী কান্ড যে বাধিয়ে বসবে, কে জানে। বিনু বলল, চোখমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও। আমি ওপর থেকে আসছি।
ঝিনুক বলল, মোটেও দেরি করবে না। কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, তার চোখের আড়ালে বিনু ঝুমার সংস্পর্শে এক লহমাও থাকুক, আদৌ সে তা চায় না।
এতদিন ঝিনুক ছিল সদাস্ত। আতঙ্ক লজ্জা সঙ্কোচ ছিল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সে সবের সঙ্গে নতুন উপসর্গ যোগ হল–ঈর্ষা। জট ক্রমশ বাড়ছে। একই শহরে যখন ঝুমা রয়েছে, সেগুলো আরও বাড়বে। এই মেয়েকে কিভাবে সামলাবে বিনু?
দোতলার সেই দক্ষিণের ঘরে এসে আনন্দকে দেখতে পেল বিনু। হেমনলিনীরা তো ছিলেনই। সে যখন একতলায়, খুব সম্ভব সেই সময় আনন্দ এখানে এসেছে।
সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে। হেমনলিনী জিজ্ঞেস করলেন, ঝিনুক শান্ত হয়েছে?
মাথা সামান্য হেলিয়ে দেয় বিনু, হ্যাঁ—
হেমনলিনী এবার জানতে চাইলেন, কী হয়েছিল?
আসল কারণ কোনওভাবেই বলা যাবে না। এমনকি, ইঙ্গিতেও নয়। বিষয়টা লঘু করার জন্য বিনু বলল, অনেকক্ষণ আমাকে দেখেনি, তাই অস্থির হয়ে পড়েছিল।
হেমনলিনী ভবিষ্যদ্বাণীর সুরে বললেন, এই মেয়েকে নিয়ে তোমার অনেক ভোগান্তি আছে বিনু—
মানসিক দিক থেকে মেয়েটা ভীষণ ধাক্কা খেয়েছে। কলকাতায় কাউকেই চেনে না। বড়দিকেও রাজদিয়ায় অল্প বয়েসে দেখেছে। আমি বেশিক্ষণ কাছে না থাকলে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।
হেমনলিনীর হয়তো আরও কিছু বলার ছিল। কী ভেবে বললেন না।
বিনুও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, মাউইমা, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল–
হেমনলিনী সামান্য উৎসুক হলেন, কী কথা বাবা?
আমরা আজ এখান থেকে চলে যাব।
খবরটা হেমনলিনী হয়তো আগেই পেয়েছেন। অবাক হবার ভান করে বললেন, সে কী! একটি আধো-অপ্রকৃতিস্থ পূর্ণ যুবতাঁকে নিয়ে কোথায় যাবে বিনু, প্রায়-অচেনা এই শহরের কোন প্রান্তে, তা নিয়ে কিন্তু আগ্রহ দেখালেন না।
বেশ জোর দিয়ে বিনু বলল, হ্যাঁ মাউইমা–
হেমনলিনী বললেন, আমি তো বলেছিলাম, তোমার বাবা যতদিন না ফিরে আসছেন, এখানেই থাকো। তাঁরা কণ্ঠস্বরে আবেগ নেই, আন্তরিকতা নেই। কেমন যেমন শুষ্ক। নেহাত ভদ্রতার খাতিরে বলতে হয়, তাই বলা।
না মাউইমা, আমাদের যেতেই হবে।
নিতান্ত নিরুপায় হয়েই যেন হেমনলিনী বললেন, তা হলে আর কী করে আটকাব?
মুখ দেখে বোঝার যো নেই। কিন্তু বিনু টের পায়, বড়দির এই শাশুড়িটি ভেতরে ভেতরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন। এখন তার অপার স্বস্তি।
বিনু সুনীতির দিকে ফেরে, দিদি, ওবেলা আনন্দদা যে নতুন জামাকাপড়গুলো কিনে দিল—
সুনীতি পাথরপ্রতিমা হয়ে বসে ছিল। শিথিল পায়ে উঠে দাঁড়ায়, সব গুছিয়ে রেখেছি। নিয়ে
আসছি। সে চলে যায়।
বিনু এবার আনন্দর দিকে তাকায়, আমাদের ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছিলেন–
হ্যাঁ। যতীনকে পাঠাচ্ছি। আনন্দও বেরিয়ে যায়।
ঘরের ভেতর অন্তহীন নৈঃশব্দ। যে কুমার মুখে সারাক্ষণ খই ফোটে, অন্য কাউকে মুখ খোলার সুযোগই দেয় না, তার কলকলানি পর্যন্ত থেমে গেছে।
দু’তিন মিনিট আগে পরে সুনীতি আর আনন্দ ফিরে এল। সুনীতির হাতে একটা চামড়ার বড় সুটকেস। বলল, এটার ভেতর তোদের ধুতি শাড়িটাড়ি আছে–
আনন্দ জানায়, যতীন ঘোড়ার গাড়ি ডেকে এনেছে। রাস্তায় সেটা দাঁড়িয়ে আছে।
খাট থেকে নেমে হেমনলিনীকে প্রণাম করে বিনু বলল, চলি মাউইমা– সুনীতির হাত থেকে সুটকেসটা নিতে যাচ্ছিল, আনন্দ নিতে দিল না। নিজের হাতেই ঝুলিয়ে নিল।
বিনু ঘরের বাইরে এসে বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে এগোয়। তার পেছনে বাকি সবাই। নিপ্রাণ ক’টি পাথরের পুতুল তাকে অনুসরণ করছে।
এই বাড়িতে বিনুর শেষ আসা সুনীতির বউ-ভাতে। সারা বাড়ি জুড়ে সেদিন উৎসবের মাতন। অজস্র আলো শতধারায় ছড়িয়ে পড়ছিল। অবিরাম বাজছিল সানাই। কত যে ফুল! গোলাপ। রজনীগন্ধা। জুই। রুপোর পিচকিরিতে অতিথিদের গায়ে ছিটনো হচ্ছিল সুগন্ধি গোলাপজল। চারদিক মুখর। হাসি। আনন্দ। কলরব। কিশোরীরা তরুণীরা জলপ্রপাত হয়ে একবার উঠে যাচ্ছিল দোতলায়, যেখানে রানীর মতো সাজিয়ে ভেলভেটের সিংহাসনে বসিয়ে রাখা হয়েছে সুনীতিকে। পরক্ষণে নিচে নেমে সামনের লনের মস্ত শামিয়ানারা তলায়। সেখানে নিমন্ত্রিতরা হাসি-পরিহাসে মাতোয়ারা। আনন্দদের এই বাড়ি সেদিন এক স্বপ্নপুরী।
সেদিন কী আদরযত্ন বিনুদের! কত খাতির। হেমনলিনী মুহুর্মুহু খোঁজ নিচ্ছিলেন, আপ্যায়নে কোনও রকম ত্রুটি ঘটছে কিনা। বউ-ভাতের পর আরও ক’টা দিন থেকে যাবার জন্য কী সনির্বন্ধ অনুরোধ তার। হেমনাথের হাত ধরে কত কাকুতি মিনতি।
আর আজ? ঝিনুককে সঙ্গে না নিয়ে এলে নিশ্চয়ই সব অন্যরকম হত। হেমনলিনী কিছুতেই তাকে এভাবে চলে যেতে দিতেন না। বিষাদময় আবহাওয়ায় এই নিরানন্দ বিদায় বিনুকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে কি? কোনও রকম আক্ষেপ? উত্তরটা সারাক্ষণ নিজের মধ্যেই প্রস্তুত থাকে। না, তিলমাত্রও না। প্রিয় নারীটিকে চূড়ান্ত ঝুঁকি নিয়ে হননকারীদের কাছ থেকে আড়াল করে করে এতদূরে নিয়ে এসেছে। তার জন্য যে কোনও কষ্টভোগ করতে সে তৈরি। যে কোনও পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতেও। ঝিনুকের জন্য বুকের ভেতরটা আবেগে, মায়ায় নতুন করে ফের উতরোল হয়ে ওঠে।
ঝিনুক শাড়ি ঠিকঠাক করে, চুল আঁচড়ে বসে ছিল। তাকে ডেকে নিয়ে এল সুনীতি। কোনও দিকে দৃকপাত না করে, কারও সঙ্গে একটি কথাও না বলে বিনুর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে বসে। উলটো দিকের জানালার বাইরে মুখ ফিরিয়ে থাকে। বিনুও উঠে পড়ে।
আনন্দরা সঙ্গে এসেছিল। সে সুটকেসটা গাড়িতে তুলে দিয়ে কাঠের পলকা দরজা বন্ধ করে দেয়।
হেমনলিনী বললেন, সময় পেলেই চলে এস বিনু। আমন্ত্রণটা শুধু বিকেই। মাত্র কয়েক হাত দূরে ঝিনুককে তিনি দেখতেই পাননি।
ঝুমা বুঝে উঠতে পারছিল না, এভাবে বিনুদের চলে যাবার কী অর্থ? কোথাও বুঝি একটা গোলমাল আছে। যেমনটা হওয়ার কথা তেমনটা ঠিক হচ্ছে না। সব কেমন অস্বাভাবিক। আত্মীয়স্বজন এলে খুশির হাওয়া বয়ে যাবার কথা। তা নয়, পরিবেশটা কেমন দম-চাপা, গুমোট গুমোট। চুলবুলে যে তরুণী সারাক্ষণ বাতাসে উড়তে থাকে, কলরোলে মুখর করে রাখে চতুর্দিক, আচমকা সে হতভম্ব হয়ে গেছে। ঈষৎ ভারী গলায় ঝুমা বলল, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না বিনুদা?
হেমনলিনী নানীর দিকে তাকিয়ে কুটি করলেন। তবে কিছু বললেন না।
ঝুমাকে দেখার পর যে তড়িৎপ্রবাহের সৃষ্টি হয়েছিল, পুরোপুরি তা স্তিমিত হয়ে যায় নি। অল্প হেসে বিনু বলল, একই শহরে থাকব। হয়তো কখনও দেখা হয়ে যাবে।
গোল টুপি-পরা মুসলমান কোচোয়ান গাড়ির মাথায় চাবুক হাতে বসে ছিল। আনন্দ তাকে বলল, বাবুদের ঠিকমতো পৌঁছে দিও।
জি, সাব– কোচোয়ান ঘাড় কাত করে।
ঘোড়ার গাড়ির বাহন অধৈর্য হয়ে পা ঠুকছিল। পিঠে চাবুকের ঘা পড়তে দৌড় শুরু করল।
হেমনলিনীর কাছে আগেই বিদায় নিয়েছিল বিনু। সামান্য হাত নেড়ে বাকিদের বলল, বড়দি আনন্দদা ঝুমা মাধুরীদি, আমরা চলোম
পিচের রাস্তায় অশ্বক্ষুরের ধ্বনি ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে।
.
৩.২৪
ট্রাম রাস্তা ধরলে অনেকখানি ঘুরপথ হয়। সময় লাগে ঢের বেশি। কোচোয়ান সেদিকটায় না গিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ দিয়ে গাড়ি ছোটাচ্ছিল।
হেমন্তের ভরদুপুরে সূর্য যখন সোজা মাথার ওপর, রোদ থাকে তেজীয়ান। বেলা যত ঢলতে থাকে, তার গনগনে কী খাই কী খাই ভাবটা দ্রুত ঝিমিয়ে আসে।
এখন পড়ন্ত বেলায় সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিম দিকে কোথায় যেন নেমে গেছে। দু’ধারের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় যে মরা মরা, হলদে সূর্যরশ্মিটুকু লেপটে আছে, সেটা যেন পা বাড়িয়েই রয়েছে। কিছুক্ষণের ভেতর উধাও হয়ে যাবে।
শহরের তাপাঙ্ক নামছে হু হু করে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে সূক্ষ্ম হিমের রেণু।
মধ্যরাত থেকে ভোর, এই সময়টা বাদ দিলে কলকাতা মানেই কোলাহল। একটানা। নিরবচ্ছিন্ন। সমস্ত শহর জুড়ে একটা চড়া সুরের অর্কেস্ট্রা অবিরল ঝাঁপতালে বেজে যায়।
জানালার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে আছে বিনু। চারপাশে কত রকম শব্দ, কত যানবাহন, মানুষজন। সে সব আবছাভাবে বিনুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। স্পষ্ট করে কিছুই সে দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিল না।
পাশ থেকে পরিচিত ডাক কানে আসে, এই—
চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকায় বিনু। কখন যেন ওধারের জানালা থেকে সরে এসে তার গা ঘেঁষে ঘন হয়ে বসেছে ঝিনুক।
বিনু জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?
হুঁ।
বিনু অপেক্ষা করে থাকে। তার চোখে চোখ স্থির করে ঝিনুক বলে, একটা ঠিক ঠিক জবাব দেবে?
কী? বিনু সতর্ক হল।
তখন ঝুমার সঙ্গে কি শুধু পাকিস্তান আর হেমদাদুদের গল্পই করেছিলে?
তোমাকে তো সবই বলেছি। তারপরও এমন অদ্ভুত প্রশ্ন!
এমনি। কৌতূহল।
কৌতূহল কি মেটে নি?
মিটল আর কই?
ঝুমাকে দেখার পর থেকে অদৃশ্য একটা পোকা মাথায় ঢুকে গেছে ঝিনুকের। যার নাম সন্দেহ। যার নাম সংশয়। বিনু আঁচ করতে পারে, পোকাটা ক্রমাগত হুল ফোঁটাচ্ছে।
রাজদিয়ায় ক’বছর আগে তাকে নিয়ে দুই কিশোরীর মধ্যে এক অঘোষিত মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কখনও প্রকাশ্যে। কখনও গোপনে। বিনুকে দখল করার জন্য কত অস্ত্রই না তারা শানিয়েছে। উদ্ভাবন করেছে নতুন নতুন রণকৌশল।
এক নির্জন দুপুরে ঝুমা অথৈ জলে তাকে নিয়ে শাপলা আর জলপদ্ম তুলতে গিয়েছিল। তারপর কাউফল পাড়তে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে জলে পড়ে যায়। কিন্তু ঝিনুকের চোখে ধূলো দেওয়া যায় নি। এই নিয়ে কম হুজ্জৎ করে নি মেয়েটা। বিনুকে নাকালের একশেষ করে ছেড়েছে।
একদিন রাত্রে বিনুকে নিয়ে দুঃসাহসী ঝুমা লুকিয়ে লুকিয়ে যুগলের সঙ্গে নদী পেরিয়ে সুজনগঞ্জের হাটে যাত্রা শুনতে যাবার নিখুঁত ছক কষে ফেলেছিল। কিন্তু প্রখর অনুমানশক্তি ঝিনুকের। বিনুর দিকে তাকালে লহমায় তার মনের যাবতীয় অন্ধিসন্ধির খোঁজ পায় সে। সেদিনও পেয়েছিল। নৌকোয় উঠতে গিয়ে বিনুদের চক্ষু চড়কগাছ। আগে থেকেই ছইয়ের তলায় বসে আছে ঝিনুক।
এতেই কি নিস্তার ছিল! স্কুল ছুটির পর, কিংবা কোনও কোনও দিন ক্লাস কামাই করে নিশি পাওয়া মানুষের মতো নদীর ধারে ঝুমাদের বাড়ি চলে যেত বিনু। আনন্দদার ভাগনীর মধ্যে চুম্বকের মতো কিছু একটা ছিল। কী তীব্র তার আকর্ষণ! কতদিন বিনু ভেবেছে, যাবে না। কিন্তু প্রতিজ্ঞাটা বজায় রাখা যেত কি? স্কুলে যাবার পরই সেটা খান খান হয়ে যেত। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলত বিনু। আর একটা অদৃশ্য আঁকশি টানতে টানতে তাকে ঝুমার কাছে নিয়ে যেত। ঝিনুকের আড়ালে লুকোচুরি খেলাটা চিরদিন চালিয়ে যাবে, সাধ্য কী। কিভাবে কিভাবে বাতাসে গন্ধ পেয়ে সেও স্কুল ছুটির পর ঝুমাদের বাড়ি হাজির হত। নিজে আগলে আগলে বিনুকে ফিরিয়ে আনত। এমনই কত ঘটনা।
ক’বছর বাদে স্থানকাল পুরোপুরি বদলে গেছে। সেদিনের দুই কিশোরী এখন পূর্ণ যুবতী। পূর্ব বাংলার এক নগণ্য শহর থেকে যুদ্ধক্ষেত্র সরে এসেছে বিশাল মহানগরীতে।
খানিক আগে হেমনলিনী বলেছিলেন, ঝুমাকে নিয়ে ভোগান্তির শেষ থাকবে না বিনুর। ভবিষ্যদ্বাণীটা কি ফলে যাবে? যে মেয়ের মাথায় সন্দেহের কীট ঢুকে গেছে, পরে যদি সেটা নিরন্তর বাতিকে দাঁড়িয়ে যায়, তাকে কিভাবে সামাল দেবে বিনু? পাকিস্তানে থাকতে একরকম সমস্যা ছিল। সীমান্তের এপারে এসে উৎকণ্ঠার মাত্রাটা আরেক দিক থেকে বেড়ে গেল তার।
বিনুর রাগ হচ্ছিল। তবু শান্ত গলায় বলল, তোমাকে তখনই তো বললাম, মাধুরীদিকে আর বড়দিকে জিজ্ঞেস করে দেখ–
ঝিনুক বলল, মাধুরীদিরা সারাক্ষণ তোমাদের পাহারা দিয়েছে, এটা কি সম্ভব?
পাহারা শব্দটা বিনুর মাথায় তীক্ষ্ণ শলা বিঁধিয়ে দেয়। তবু ক্রোধটাকে সে ফেটে বেরিয়ে পড়তে দেয় না। ভুরু কুঁচকে, রুক্ষ চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে।
ঝিনুক নিজের ঝোঁকে বলে যায়, কোনও দরকারে ওরা কি ঘর থেকে দু’একবারও বেরিয়ে যায় নি?
ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। ধৈর্য ভেঙেচুরে যাচ্ছে বিনুর। অসহিষ্ণু গলায় বলল, হ্যাঁ। আমাদের দুজনকে ঘরে রেখে দু’একবার কেন, পঁচিশ তিরিশ বার বেরিয়ে গেছে। খুশি তো?
ঝিনুকের ঠোঁট থরথর কাঁপতে থাকে। দু’চোখ বাষ্পে ভরে যায়। নিজের রূঢ়তায় লজ্জা পেয়ে যায় বিনু। দুঃখী মেয়েটাকে এভাবে আঘাত না করলেই পারত। ঝিনুকের কাঁধে একটা হাত রেখে খুব নরম গলায় বলল, ববাঝে না, তোমার কষ্ট হয়, এমন কিছু কি আমি করতে পারি?
ঝিনুক উত্তর দেয় না। চোখ ফিরিয়ে, জানালার পাশে সরে যায়।
ধর্মতলার ট্রাম লাইন পেরিয়ে কার্জন পার্ক, হোয়াইটওয়ে লেডলো, গ্র্যান্ড হোটেল, ফারপো, লিন্ডসে স্ট্রিটের ফোকর দিয়ে সামান্য দূরে নিউ মার্কেট ইত্যাদি পেছনে ফেলে ঘোড়ার গাড়ি পার্ক স্ট্রিটের মোড় পেরুতে না পেরুতে সন্ধে নেমে এল লম্বা পায়ে। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যে রোদ গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, এখন তার লেশটুকু নেই। শহর এখন অনেক শীতল। হিমমাখানো বাতাস বয়ে যাচ্ছে ঢেউ তুলে তুলে। কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল অনেক আগেই। ময়দানের দিকটা পুরোপুরি ঝাঁপসা। সূর্য নেই। চাঁদ কিন্তু উঠে গেছে। কুয়াশার মায়াবরণের ওপারে হেমন্তের চাঁদ বড় বেশি পান্ডুর। কৃশ। আকাশ জুড়ে লক্ষ তারা ফুটেছে। চাঁদের মতো সেগুলোও নিষ্প্রভ।
চৌরঙ্গি জুড়ে এখন আলোর ঢল। রাস্তায় কর্পোরেশনের আলো, অফিস আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোর আলো। সবচেয়ে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় রঙ্গি নিওন। সব মিলিয়ে অবিরাম বর্ণচ্ছটা। চোখধাঁধানো। স্বপ্নের মতো।
পাশ থেকে আবার সেই গলা, কী অত ভাবছ?
ফের মুখ ফেরাতে হয় বিকে, কী ভাবব?
কিছুই না?
না।
চুপ করে বাইরে তাকিয়ে বসে আছ আর কিছু ভাবছ না, তাই কখনও হয়?
সেই পোকাটা ঝিনুকের মস্তিষ্কে কামড় বসিয়েই চলেছে। এখনই এটা থামানো দরকার। ধমকের সুরে বিনু বলল, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
ঝিনুক থমকে রইল এক মুহূর্ত। পরক্ষণে আরও ঘন হয়ে বসে বলল, ঠিক আছে, বিশ্বাস করছি।
একটু নীরবতা।
তারপর ঝিনুকই আবার শুরু করে, আমরা গাড়িতে ওঠার পর ঝুমা তোমাকে কী বলেছিল, মনে আছে?
বিনু উত্তর দেয় না। বিরক্তিতে তার ভুরু কুঁচকে যায়। ঝিনুক তাকে লক্ষ করছিল। তার চোখে চোখ রেখে আদুরে গলায় বলল, রাগ করো না। আগে আমার কথাটা শুনে নাও।
কী?
ঝুমা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিল।
বিনু উত্তর দিল না। ঝিনুকের চিন্তা কোন সূক্ষ্ম, দুর্গম পথ ধরে চলছিল, সেটা আঁচ করতে চাইছে। ঝিনুক বলতে লাগল, তুমি অবশ্য নিজের থেকে দেখা করবে না। ওই যে বলছিলে, রাস্তাঘাটে হঠাৎ দেখা হয়েও যেতে পারে–
বিনু বলল, তুমিই বল, হতে পারে কিনা—
মাথা হেলিয়ে সায় দেয় দিল ঝিনুক, পুরুষ মানুষ। দিনরাত তো বাড়িতে বসে থাকতে পারবে না। বাইরে বেরুতেই হবে। তখন কোথাও না কোথাও– শেষ না করে চুপ করে গেল সে।
বিনু নিঃশব্দে ঝিনুককে লক্ষ করতে থাকে।
ঝিনুক নতুন উদ্যমে ফের শুরু করে, ধর যদি দেখা হয়েই যায় তখন কী করবে?
তুমি আমাকে কী করতে বল, মুখ ফিরিয়ে চলে যাব?
এবার ধন্দে পড়ে গেল ঝিনুক। কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে রইল। চৌরঙ্গির নানা ধরনের মিশ্র শব্দপুঞ্জ ছাপিয়ে তাদের ঘোড়াটা একনাগাড়ে খট খট আওয়াজ তুলে যাচ্ছে।
একসময় ঝিনুক বলল, সেটা খারাপ দেখাবে। ওরা তোমাদের কুটুম্ব। কথা না বললে ঝুমা চারদিকে রটিয়ে বেড়াবে। তোমার নিন্দে হবে। একটু ভেবে বলে, কথা বলতে পার। তবে
একটা শর্ত জুড়ে দিয়ে চাইছে ঝিনুক। সে জন্য অপেক্ষা করতে লাগল বিনু। সহজভাবে ঝুমার সঙ্গে যে মিশবে, গল্প করবে, তার উপায় নেই।
বলল, ও বলল, আর তুমি নাচতে নাচতে ওদের বাড়ি চলে গেলে, সেটা কিন্তু চলবে না।
আমি কি ওদের বাড়ি কখনও গেছি?
কলকাতায় তো সবে এলে। যাবার সময়টা পেলে কোথায়? ঝুমা যা মেয়ে, ঠিক টেনে নিয়ে যেতে চাইবে।
চাইলেই তো আর হল না।
রাজদিয়ায় থাকতে ঝুমা চাইত, আর তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ওদের বাড়ি চলে যেতে। কি, যাও নি?
বিনু কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কাঁচুমাচু মুখে বলে, দু’একবার গেছি।
দু’একবার! স্বর উঁচুতে তুলে গলা থেকে শ্লেষ ঢেলে দিল ঝিনুক, আমি কতদিন ওদের বাড়ি থেকে তোমাকে ধরে এনেছি। ভুলে গেছ?
প্রসঙ্গটা স্বস্তিকর নয়। ঝিনুক যেভাবে বাঁকা পথে চলেছে, একটু পরেই তুমূল কান্ড বাধিয়ে দেবে। দুই কিশোরীর মাঝখানে সেই টানাপোড়েনের ব্যাপারটা বিনু প্রাণপণে এড়াতে চাইল, কলকাতায় আমি ঝুমাদের বাড়ি যাব না, যাব না, যাব না। হল তো?
ঝিনুকের চোখেমুখে খুশির ঝলক খেলে গেল কি? হয়তো সে খানিক পরিতৃপ্তও। বিনুর কাছ থেকে নতুন করে একটা অঙ্গীকার আদায় করে নিতে পেরেছে। লম্বা বাক্সমতো গাড়ির ভেতর তাকে ঘিরে আলোছায়ার খেলা।
ঘোড়ার গাড়ি ভবানীপুর, হাজরা পেছনে ফেলে এখন রাসবিহারী ক্রসিংয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। এদিকটায় চৌরঙ্গির মতো চাকচিক্য নেই। নেই সহস্র আলোর স্বপ্নমায়া। সব কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে। রাস্তার দু’ধারে উঁচু উঁচু ল্যাম্পপোস্টগুলোর মাথায় মিটমিট করে নির্জীব বাল্ব জ্বলছে। ট্রামরাস্তার গা থেকে ভেতরে ভেতরে যে গলিগুলো চলে গেছে, সেখানে বেশির ভাগই গ্যাসবাতি, কচিৎ বিদ্যুতের আলো।
ঝিনুক হঠাৎ বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি বল তো? সুনীতিদের বাড়ি থেকে চলে যেতে পারবে, এতেই ছিল তার অনন্ত স্বস্তি। বিনু তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, আগে একবারও জিজ্ঞেস করে নি। ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার পরও জানতে চায় নি, তাদের যাত্রাপথ কোথায় গিয়ে শেষ হচ্ছে।
অল্পক্ষণের মধ্যে হিরণদের বাড়ি পৌঁছে যাবে ঘোড়ার গাড়ি। আগে জানালে ঝিনুকের কী প্রতিক্রিয়া হত, তার জানা নেই। এক দিদির বাড়ি থেকে আরেক দিদির বাড়ি গিয়ে ফের লাঞ্ছনার মাত্রাটা বাড়ত কিনা, এক অগ্নিকুন্ড থেকে আরেক বেড়া আগুনে গিয়ে পড়তে হত কিনা, স্বাভাবিকভাবেই এই সব প্রশ্ন তুলে ঝিনুক চেঁচামেচি জুড়ে দিত।
কিন্তু এখন আর লুকোছাপা করে কী হবে? কমিনিট আগে পরে জানলে কী এমন ক্ষতি বৃদ্ধি? বিনু মনস্থির করে ফেলে, আমরা ছোটদির বাড়ি যাচ্ছি।
বুকে শ্বাস আটকে যায় ঝিনুকের। সচকিত হয়ে বলে, তোমার এক দিদির বাড়িতে আমার কী হাল হয়েছে, জানো না? তারপরও আরেক দিদির কাছে নিয়ে যাচ্ছ?
বিনু ঝিনুকের চুলে হাত বুলোতে বুলোতে নরম গলায় বলে, কোনও ভয় নেই। ওখানে তোমার একটুও অসুবিধে হবে না।
ঝিনুক অবুঝ হয়ে ওঠে, এই আশা দিয়ে তুমি আমাকে সুনীতিদির ওখানে নিয়ে গিয়েছিলে। ফের ওরকম হলে আমি কিন্তু আর বাঁচব না।
কিছুই হবে না। আমি ওবেলা এসে ছোটদি আর হিরণদার সঙ্গে কথা বলে গেছি।
তাই তোমার ফিরতে দেরি হয়েছিল?
হ্যাঁ। তুমি তো কেঁদে কেটে একশা।
তুমি সুধাদিদের সঙ্গে দেখা করবে, আমি বুঝব কী করে? বলে আসো নি কেন?
তোমার সম্বন্ধে ওরা কী ভাবে, সেটা আগে বুঝে নিতে হবে না? দেখলাম কোনও সমস্যা নেই। তাই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আর কোনও প্রশ্ন করল না ঝিনুক। এখন পরম আশ্বস্ত। ধীরে ধীরে বিনুর একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের দুই মুঠির ভেতর জড়িয়ে নিল।
.
৩.২৫
সন্ধের পরে পরে সুধাদের বাড়ি পৌঁছে গেল বিরা। দাঙ্গার সময় ঝিনুকের চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়ে গেছে, এ নিয়ে একটি শব্দও কেউ উচ্চারণ করল না। তারা যে সমস্ত জানে, ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিল না। বরং ঝিনুক আসায় তারা কী পরিমাণ খুশি, শতমুখে হইচই করে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। ঝিনুককে নিয়ে তারা কী করবে, কোথায় বসাবে, তাকে কী খাওয়াবে, এই নিয়ে সারাক্ষণ সুধারা শশব্যস্ত।
ঝিনুকের রুক্ষ চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছিল। কতক লেপটে আছে কপালে, কতক গালে। সারা মুখে ধুলোর স্তর। নিজের একখানা সিল্কের শাড়ি, ব্লাউজ আর ভোয়ালে ঝিনুককে দিয়ে স্নানঘরে পাঠিয়ে দিল সুধা। পোশাক পালটে ঝিনুক ফিরে এলে তার ভেজা মুখ মুছে দিয়ে খুব যত্ন করে ক্রিম মাখিয়ে দিল। দুই ভুরুর মাঝখানে পরাল গাঢ় মেরুন রঙের বড় টিপ। চোখে সরু রেখায় টেনে দিল কাজল।
তারপর বাইরের ঘরে ঝিনুককে মাঝখানে বসিয়ে পরোটা আলুর দম মিষ্টি খেতে খেতে কলকল করে শুরু হল কত যে গল্প! বেশির ভাগই রাজদিয়ার। স্মৃতির ঝাপি খুলে বেরিয়ে আসে সেখানকার খাল বিল নদী, ধানের খেত, পাটের খেত, যাত্রাগান, ঢপের গান, সারি গান, পুজোর সময় সারা রাজদিয়ায় টহল দিয়ে সাতখানা প্রতিমা বার বার দেখা, নবমী নিশিতে বিজয়া’ কি ‘মেবার পতন’ নাটক, দশমীর পরদিন নদীতে নৌকো বাইচ, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় বাড়ি বাড়ি প্রসাদ খেয়ে বেড়ানো, বাস্তুপুজোয়, চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় ঘুরে ঘুরে তিলা কদমা চিনির রনি মঠ কেনা, ফানা ফানা সোনার বরণ সবরি কলা কেনা, মাটির হাঁড়ি বোঝাই করে মোহনভোগ কি রসগোল্লা কেনা, বায়োস্কোপের বাক্সে চোখ রেখে দিল্লি দেখা, বম্বে দেখা, বিলাত দেখা। কতবার যে হেমনাথ স্নেহলতা শিবানী। আর অগুনতি রাজদিয়াবাসীর নাম উঠল! কিন্তু হিরণ বা সুধা দাঙ্গার কথা, দেশভাগের কথা কিংবা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সীমান্তের এপারে চলে আসার প্রসঙ্গ একবারও তুলল না। যা কিছু মনোরম, মায়াময় এবং স্বপ্নবৎ, তার বাইরে আর কিছু যেন কখনও রাজদিয়ায় ছিল না, বা কোনও দিন ঘটে নি। রাজদিয়ায় সময় যেন দাঙ্গার আগে পর্যন্ত থমকে গেছে। তারপর আর এগোয় নি।
.
রাত আরেকটু বাড়লে ঝিনুককে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল সুধা। রান্নার লোক আছে তাদের। আজ তাকে ছুটি দিয়ে ঝিনুককে কাছাকাছি একটা মোড়ায় বসিয়ে, গল্প করতে করতে নিজের হাতে একের পর এক তেল কই, বড়ি-বেগুন দিয়ে পাবদা, সোনা মুগের ডাল রাঁধল। বেগুন ভাজল, ঝিরি ঝিরি করে কেটে আলু ভাজল। সব শেষে বসালো সরু চালের ভাত।
সুনীতিদের বাড়িতেও দু’দিন সুখাদ্যের আয়োজন কম ছিল না। কিন্তু কাল রাতে খাওয়াদাওয়া চুকবার পরই ঝিনুককে একতলার এককোণে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। আজ বিকেল পর্যন্ত সেখানে মুখ গুঁজে পড়ে থেকেছে সে। কাল সঙ্গী ছিল দুলালী। ভারি নোংরা মেয়েমানুষ। জঘন্য। মাছির মতো পচা পুঁজরক্ত চেটে খাওয়ার স্বভাব।
খাওয়াদাওয়ার পর সুধা এক ঘরে হিরণ এবং বিনুর শোবার ব্যবস্থা করে দিল। আরেক ঘরে মস্ত খাটে বিছানা পেতে সুধাকে নিয়ে শুল।
ঝিনুক এবাড়িতে আসার পরও এত আন্তরিকতা, এত মায়া, এত যত্নের মধ্যেও নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রেখেছিল। সবার কথায় একটু আধটু হু হা করেছে শুধু। কখনও মৃদু, নির্জীব হাসি ফুটে উঠেছে ঠোঁটে।
কিন্তু সুধা যখন তার পাশে শুল, ভালবাসার উত্তাপ ঝিনুককে যেন তোলপাড় করে দিচ্ছিল। সুধারা তাকে অচ্ছুতের মতো দূরে সরিয়ে রাখে নি। আবেগে গলার কাছটায় লোহার ডেলার মতো শক্ত কিছু আটকে যাচ্ছিল তার। বুকের ভেতর কিসের যেন একটা চাপ। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। ভাঙা ভাঙা, জড়ানো গলায় বলল, সুধাদি তোমার কাছে এসে বেঁচে গেলাম। তুমি নিশ্চয়ই জানো, সুনীতিদির শাশুড়ি কী খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার যে সর্বনাশ হয়েছে, বল তাতে আমার কী দোষ!
সুধা চমকে ওঠে। পাছে তার লাঞ্ছনার কথা ওঠে, সে জন্য দাঙ্গার প্রসঙ্গই কেউ মুখে আনে নি। ওঠে নি সুনীতিদের বাড়ির প্রসঙ্গও। গল্পে গল্পে দমবন্ধ করা, মর্মান্তিক ব্যাপারটা তারা আড়াল করে রাখতে চেয়েছিল। মহাবিশ্বের সবার কাছে তার ধর্ষণের বার্তা পৌঁছে গেছে, আর সুধারাই শুধু জানে না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ঝিনুক জানে, দাঙ্গার পর থেকে সুনীতিদের বাড়িতে একটা দিন কাটানো পর্যন্ত কোনও ঘটনাই সুধাদের অজানা নেই।
সমানে কেঁদে যাচ্ছিল ঝিনুক। তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে আচ্ছন্নের মতো সুধা বলল, ওসব মনে করে রেখো না। এ নিয়ে যত ভাববে, শুধু কষ্টই পাবে–
রাজদিয়ায় রাজেকের নৌকোয় ওঠার পর থেকে কেঁদেই চলেছে ঝিনুক। ব্রাসে। আতঙ্কে। অকারণ গ্লানিবোধ। আজ রাতের কান্নাটা অন্যরকম। বিনু তো পাশে আছেই। কলকাতায় পা রাখার পর। এই প্রথম সে জানলো, নির্ভর করার মতো আরও কেউ কেউ রয়েছে। সুধার গায়ে নিজেকে মিশিয়ে দিতে দিতে তার কান্না উতরোল হয়ে উঠতে লাগল।