১লা জুলাই ১৯৬৬ ॥ শুক্রবার
ভোরবেলায় খবর পেলাম গত সন্ধ্যায় ১০ সেলে যেখানে মানিক ভাই, শামসুল হক, রফিক, মিজান, মোমিন, ওবায়েদ, হাফেজ মুছা সাহেব, সুলতান, হারুন রশিদ এবং বোধহয় রাশেদ মোশাররফ ও অনেককে রাখা হয়েছে সেখানে গোলমাল হয়েছে তালাবন্ধ করার সময়। মানিক ভাই যেখানে আছেন কোনো গোলমাল সেখানে হতে পারে না, কারণ আমাদের কেহই তাঁর সামনে কোনো অন্যায় করতে যাবে না। সঠিক খবর কিছুই পাই নাই। সিপাহিদের মধ্যে আলোচনা হতেছে। কেহ কেহ বলে ১০ সেলের সাহেবদের কোনো দোষ নাই। আর কেউ বলে, সিপাহিদের সাথে গোলমাল শোভা পায় না নেতাদের। তারা হলো দেশের নেতা, দেশের জন্য জেল খাটছে। সিপাহি যদি বেশি কথা বলেও, তবুও চুপ করে থাকা উচিত।
প্রায় ১০ ঘটিকার সময় খবর পেলাম মিজানুর রহমানের ঘর যখন বন্ধ করতে গিয়াছে তখন মতিউল্লা নামে এক পুরানা সিপাহি তালাবন্ধ করে খটখট শব্দ করতে শুরু করে। টেনে দেখে, তালা ঠিক মতো বন্ধ হয়েছে কিনা। তাতে মিজান নাকি বলেছে, ডিউটি সিপাহিকে বলে দিবেন রাতে যেন আস্তে আস্তে তালা টেনে দেখে, কারণ আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়। দু’ঘণ্টা পর পর রাত্রে পাহারা বদলি হয়। সিপাহি বলেছে জোরে জোরেই টানতে হয়। মিজানের তালাবন্ধ হয়ে গিয়াছে। বাইরে মোমিন সাহেব জিজ্ঞাসা করেছেন বাড়ি কোথায় আপনার’? মোমিন সাহেবের রুম তখনও বন্ধ হয় নাই। এক দুই কথায় খুব ঝগড়া হয়েছে। আমাদের এরা নাকি সিপাহিদের মারতে যায়। মতিউল্লা এসে জেল কর্তৃপক্ষকে কিছু কিছু বাড়াইয়া বলে। আমাদের এরাও ডিআইজির কাছে দরখাস্ত করার জন্য কাগজ চেয়ে পাঠাইয়াছে। মহা গোলমাল! আমি সিকিউরিটি জমাদারকে ডেকে মানিক ভাইয়ের কাছে খবর পাঠাইয়া দিলাম এ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি না করাই উচিত। ভদ্রলোকের কিল খেয়ে কিল হজম করতে হয়। সিপাহিদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন লোকই আমাদের ভক্তি করে, আমাদের প্রতি সহানুভূতি আছে। আমার বিশ্বাস ছিল, মানিক ভাই যখন আছেন এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি হবে না। বিকালে খবর পেলাম চুপচাপই আছে আমাদের এরা। সিপাহিদের সাথে কোনো কথা নিয়ে আলোচনা করা উচিত না। ওরা হুকুম পায়, তামিল করে। আমাদের কিছু বলতে হলে, জেলার সাহেব, ডিপুটি জেলার বা ডিআইজি সাহেবকে বলাই উচিত। এদের সাথে কথা কাটাকাটি করা মোটেই উচিত হয় নাই।
আমাদের মধ্যে এরা অনেকেই নতুন জেলে এসেছে। আমার কাছে রাখলে কোনো কথাই হতো না, কিন্তু সরকার রাখবে না আমার কাছে কাহাকেও। যদি জেলের ভিতর কোনো বিপ্লব করে বসি!
বিকালে মতিউল্লাকে ডেকে আমি বলে দিলাম, মনে কিছু না করতে। কারণ একে আমি জানি বহুদিন থেকে। একটু কথা বেশি বলে, মনটা খারাপ না।
আজ বৃষ্টি না হওয়াতে একটু ভালই লেগেছে। হাঁটাহাঁটি করে শরীরটাকে হালকা করতে চেষ্টা করেছি। রেণুর শরীর খারাপ। আমায় দেখতে আসতে পারে নাই। মনটা খারাপ লাগছিল।
পুরানা ২০ সেলের পাঁচ নম্বর ব্লকে চিত্ত সুতার ও রণেশ মৈত্র থাকেন। তাদের বাইরের দরজা বন্ধ করে রাখা হয়-যদি আমার সাথে দেখা হয়ে যায়! সর্বনাশ, দেখা হলে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে যে! দরজাটা খুলেছে খাবার দিতে, তারাও দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। দেখা হলো, দুই একটা কথাও হলো দূর থেকে কেমন আছেন? ভাল আছি। দরজা বন্ধ করতে হবে কারণ সিপাহির চাকরি থাকবে না, যদি বড় সাহেবরা আমাদের কথা বলতে দেখে।
মোস্তফা সরোয়ারের ভাই গ্রেপ্তার হয়ে এসেছিল নারায়ণগঞ্জ মামলায়। সে পরীক্ষার্থী, বিএ পরীক্ষা দু’টা দিয়েছিল। আবার চার তারিখে পরীক্ষা। ওর নাম হাসু। আমি হাসু বলেই ডাকি। হঠাৎ খবর এল জামিন হয়ে গেছে, এখনি যাবে। আমার সামনে দিয়েই যেতে হবে। দাঁড়িয়ে রইলাম। সে এসে গেল। বললাম, মন দিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিয়ে। তোমার ভাবীকে খবর দিও ইনকাম ট্যাক্স নোটিশের উত্তর আমার সাথে দেখা না করে যেন না দেয়। টেলিফোন করে দিও। আরও দুইটা ছেলে পরীক্ষার্থী পড়ে রইল। একজন পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছে-নাম খাজা মহীউদ্দিন। আর একজন অনুমতি না পেয়ে খুবই মুষড়ে পড়েছে। কি করব? মনুষ্যত্ব যাদের মধ্যে নাই তাদের সম্বন্ধে কি লিখব?
২রা জুলাই ১৯৬৬ ॥ শনিবার
আজ মিলাদুন্নবী। জেলখানায় কয়েদিদের ছুটি। বড় বড় কর্মচারীদেরও ছুটি। বড় সাহেবদের আগমন বার্তা নিয়ে কয়েদিরা আজ আর হৈ চৈ করছে না। কয়েকজন লোক নিয়ে আমার ফুলের বাগানের আগাছাগুলি তুলে ফেলতে শুরু করলাম। দেখলাম মিজানকে নিয়ে হাসপাতালে যেতেছে জমাদার সাহেব-মিজানের দাঁতের ব্যথা দেখাবার জন্য। আজ আমাদের দলের একজনকে দেখলাম বহুদিন পরে। এক জেলে থাকি। বেশি হলে ২০০ হাত দূরে হবে। ওদের দশ সেল, আমার দেওয়ালের মাঝে ২৪ ফিট দেওয়াল। আমার ঘরটা দেওয়াল ঘেঁষে, ওদেরটা একটু দূরে। মধ্যে গরুর ঘর আছে। তবুও দেখা হওয়ার উপায় নাই। একজন আর একজনকে দূর থেকে শুভেচ্ছা জানান ছাড়া আর কিইবা করতে পারি!
আজ আইয়ুব সাহেবের মাস পহেলা বক্তৃতা পড়লাম। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গোলযোগ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট বেতার ভাষণে বলেন যে, মানুষের আবেগ প্রবণতা নিয়া খেলা করতে অভ্যস্থ এইরূপ একটি গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে গোলযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা করিয়াছিল। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়া তাহারা এমন একটি কর্মসূচি চালু করতে প্রয়াসী হইয়াছিল যাহা দেশের বিভিন্ন অংশে কেবলমাত্র ঘৃণা ও বিদ্বেষেরই প্রসার ঘটাইত। সরকার ধৈর্য সহকারেই এই সব লক্ষ্য করিতেছিলেন। কিন্তু তাহাদের কার্যকলাপ সীমা ছাড়াইয়া যাওয়ায় সরকার বাধ্য হইয়া কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত এবং জনগণ ভুল পথে পরিচালিত হওয়া হইতে রক্ষা পাইয়াছে।’ তিনি এইজন্য আল্লাহ তায়ালাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ চিরদিনই যে অবিচ্ছেদ্য থাকবে, তা আমার পক্ষে উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন নাই। উভয় অংশের জনগণের সম্মুখে একই বিশ্বাস, প্রতিজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ রহিয়াছে। এমতাবস্থায় তাহাদের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদের প্রশ্নই উঠিতে পারে না। তিনি আরও অনেক কিছু বলিয়াছেন, দেশের অন্যান্য পরিস্থিতি সম্বন্ধে।
প্রেসিডেন্ট সাহেব গোড়ায়ই গলদ করেছেন। যে কর্মসূচির কথা উনি আলোচনা করেছেন তার মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার কোনো কর্মসূচি নাই। স্বায়ত্তশাসনের দাবি নতুন নয় এবং যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েম করা হয়েছিল তার মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের কথা পরিষ্কার ভাষায় লেখা ছিল। তিনি সে সম্বন্ধে ভাবলেন না। আর যে গোষ্ঠীর কথা বলেছেন, তারা পাকিস্তান কায়েম করার জন্য সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি যাদের নিয়ে শাসন করছেন তারা অনেকেই পাকিস্তানের আন্দোলনে শরীক তো হনই নাই, বৃটিশকে খুশি করার জন্য বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি যদি সময় না পেয়ে থাকেন পড়তে, তাঁকে আমি ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান-দুইটা রাষ্ট্র গঠন হওয়া সম্বন্ধে কিছু ইতিহাস দিতে চাই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যে অবিচ্ছেদ্য সে সম্বন্ধে কাহারও মনে এতটুকু সন্দেহ নাই। তবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক ও শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন চায়, কারণ ১৯ বৎসর পর্যন্ত ছলে বলে কৌশলে এবং মীরজাফরদের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে এমন এক জায়গায় আনা হয়েছে তার থেকে মুক্তি পেতে হলে, শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম করা ছাড়া তাদের উপায় নাই। যখন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়ার কথা হয়েছে, তখনই এই একই কথা একইভাবে সকলের মুখ দিয়েই শুনেছি। তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সাময়িকভাবে অত্যাচার করে বন্ধ করলেও অদূর ভবিষ্যতে এমনভাবে শুরু হতে বাধ্য, যারা ইতিহাস পড়েন তারা তা জানেন। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি শাসকগোষ্ঠী যদি অত্যাচার করে দাবাইয়া দিতে চান তার পরিণতি দেশের জন্য ভয়াবহ হবে।
ভারতের মুসলমানরা যখনই তাদের অধিকারের জন্য দাবি করেছে তখন বর্ণ হিন্দু পরিচালিত কংগ্রেস তার বিরুদ্ধাচরণ করে বলেছে, মুসলমানরা স্বাধীনতা চায় না। মুসলমানরা ফেডারেল ফর্মের সরকার দাবি করেছিল, কিন্তু কংগ্রেস এককেন্দ্রিক সরকার গঠন করার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকল। মুসলমানরা বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হলে এই কয়েকটি প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শাসন চালাতে পারে, এ জন্য ফেডারেল ধরনের শাসনতন্ত্র দাবি করল।
১৯২১ সালে মওলানা হজরত সোহানী যখন মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন, তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “The fear of Hindu majority can be removed, if an Indian Republic was established on federal basis, similar to that of United States of America.’
ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া হলে যে সব প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে সেখানে মুসলমানরা শাসন করতে পারবে। কিন্তু কংগ্রেস এতে রাজি হলো না, যদিও এই বৎসর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটা স্থায়ী শান্তি প্রচেষ্টা খুব ভালভাবে চলছিল।
১৯২৪ সালে মিঃ জিন্নার সভাপতিত্বে লাহোরে মুসলিম লীগের যে সভা হয়। সেখানে মুসলমানদের পক্ষ থেকে এক প্রস্তাব করা হয়েছিল। তা এই, it envisaged that the existing provinces shall be united under a common government on federal basis, so that each province shall have full and complete provincial autonomy, the functions of the central government being confined to such matters only as are of general and common concerns.’
এই প্রস্তাবেও কংগ্রেস রাজি হতে পারলো না। ১৯২৮ সালে সর্বদলীয় কনফারেন্সে মতিলাল নেহেরুকে ভার দেওয়া হলো একটা রিপোর্ট দাখিল করতে, যাতে হিন্দু মুসলমান সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ রিপোর্ট আরও বিভেদ সৃষ্টি করল।
এর পরেই কলিকাতায় সর্বদলীয় সম্মেলন ডাকা হলো নেহেরু রিপোর্ট সম্বন্ধে আলোচনা ও তা গ্রহণ করার জন্য। মি. জিন্না তখন কতকগুলি সংশোধনী প্রস্তাব দিলেন এবং দুনিয়ার বহুদেশের শাসনতন্ত্রও সেখানে উল্লেখ করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার একটি সংশোধনী প্রস্তাবও গ্রহণ করা হল না। তিনি চোখের পানি ফেলে বের হয়ে এসেছিলেন। মি. জিন্নাকে হিন্দু মুসলমানের ‘মিলনের দূত’ বলা হতো। এর পরেই ছোট ছোট যে দলাদলি মুসলমানদের মধ্যে ছিল তা শেষ হয়ে গেল। স্যার মহম্মদ সফি ও মি. জিন্নার দল একতাবদ্ধ হয়ে ১৯২৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স ডাকলেন দিল্লীতে। সেখানে তাঁদের পুরানা দাবি ফেডারেল সরকারের প্রস্তাব দিলেন এবং ভবিষ্যতে মুসলমানদের দাবি কি হবে সেগুলিও গ্রহণ করলেন। সেখানে তারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এরপরেই জিন্না সাহেবের ১৪ দফা বের হলো। এতে ছিল, ‘It pointed out that no constitution would be acceptable to muslims unless and until it is based on federal principles with residuary powers vested in the province.’
১৯৩০-৩১ সালে যে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স বিলাতে হয় তাতে ভারতের মুসলমানদের পক্ষ থেকে এই একই দাবি স্যার সফি করেছিলেন। এমনকি মওলানা মহম্মদ আলি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ডের কাছে ১৯৩১ সালে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে, মুসলমানদের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ফেডারেল শাসনতন্ত্র—যেখানে প্রদেশগুলি পাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।
১৯৩৭ সালে কয়েকটা প্রদেশে কংগ্রেস শাসিত মুসলমানদের উপর ভাল ব্যবহার করা হলো না। আলোচনা হয়েছিল প্রদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হউক। কংগ্রেস রাজি হয় নাই। তার পরেই ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করে। যার ফলে আজ ভারতবর্ষ দুই দেশে ভাগ হয়েছে।
আজ যারা ৬ দফার দাবি যথা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার দাবি বলে উড়াইয়া দিতে চায় বা অত্যাচার করে বন্ধ করতে চায় এই আন্দোলনকে, তারা খুবই ভুল পথে চলছে। ছয় দফা জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচা মরার দাৰি। এটাকে জোর করে দাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল করা হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে। কংগ্রেস যে ভুল করেছিল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ফেডারেল শাসনতন্ত্র না মেনে আমাদের শাসকগোষ্ঠীও সেই ভুল করতে চলেছেন। যখন ভুল বুঝবে তখন আর সময় থাকবে না। আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করি, তবে আমাদের ন্যায্য দাবিও চাই, অন্যকে দিতেও চাই। কলোনি বা বাজার হিসেবে বাস করতে চাই না। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার চাই।
৩রা জুলাই ১৯৬৬ ।। রবিবার
সকালে বৃষ্টি হওয়ার পরে দিনটা একটু ভালই হয়েছে। রৌদ্র উঠেছে। বিছানাগুলি রৌদ্রে দেওয়া দরকার, তাই বের করে রৌদ্রে দিলাম।
মানিক ভাইকে বিজলি পাখা দেওয়ার হুকুম দিয়েছে। বেচারা একটু আরামে ঘুমাতে পারবেন। মানিক ভাই কষ্ট সহ্য করতে পারেন। যে কোনো কষ্টের জন্য যে তিনি প্রস্তুত আছেন, আমি জানি। তবু তাঁর স্বাস্থ্য ভাল না। জীবনে বহু কষ্ট স্বীকার করেছেন। স্বাস্থ্য একবার নষ্ট হলে আর এ বয়সে ভাল হবে না। এই ভাবনাই আমার ছিল। ১০ সেল সম্বন্ধে আলোচনা পূর্বে করেছি, সেখানেই আমার সহকর্মীদের রাখা হয়েছে শুধু কষ্ট দিবার জন্য।
আজ আর খবরের কাগজ আসবে না। মিলাদুন্নবীর জন্য বন্ধ। দিন কাটানো খুবই কষ্টকর হবে। আমি তো একাকী আছি, বই আর কাগজই আমার বন্ধু। এর মধ্যেই আমি নিজকে ডুবাইয়া রাখি। পুরানা কয়েকটা ইত্তেফাক কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলাম।
জেল কর্তৃপক্ষ যে মাছ আমাকে দিয়েছিল তা খাওয়ার অযোগ্য। ফেরত দিয়ে দিলাম। আমার কাছে সামান্য যা ছিল তাই পাক করতে বললাম। কোনোমতে খাওয়া দাওয়া সেরে বই নিয়ে বসলাম। দুপুর বেলা ঘুমের সাথে আমি রীতিমত যুদ্ধ করি। পড়তে পড়তে ঘুম এলে বাইরে যেয়ে একটু ঘোরাঘুরি করতেছিলাম দেখি যে চটকল ফেডারেশনের সেক্রেটারি আবদুল মান্নানকে নিয়ে যায়। শুনলাম বাজার আনতে গেটে নিয়ে যেতেছে। বাইরে গাছের নিচে বসলেই কাক মহারাজরা বদ কর্ম করে মাথা থেকে সমস্ত শরীর নষ্ট করে দেয়। জেলে কাকের উৎপাত একটু বেশি। কয়েকদিন পূর্বে একটা ধনুক বানাইয়াছি। ধনুকটাকে আমি ‘বন্দুক’ বলে থাকি। ইটের গুঁড়া দিয়ে কাক বাহিনীদের আমি আক্রমণ করলেই ওরা পালাতে থাকে। আবার ফিরে আসে। কিছু সময় কাক মেরেও কাটাইয়া থাকি।
বিকালে যখন বেড়াচ্ছিলাম দেখি ঢাকার ন্যাপ কর্মী আবদুল হালিমকে হাসপাতালে নিয়ে চলেছে। দুই দিন থেকে ওর জ্বর। নূতন ২০ সেলের ১ নম্বর ব্লকে হালিম ও আর চারজন থাকেন। খুব নিকটে হলেও দেখা বা কথা বলার উপায় নাই। দরজা অন্য দিক থেকে। আমি এগিয়ে যেয়ে ওর মাথায় হাত দিলাম, খুবই জ্বর। বললাম, হালিম তুমি যে দলই কর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তোমার দান আছে। ১৯৪৯ সালে তুমি আমার সাথে আওয়ামী লীগ করেছ, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছ। তোমার যদি কোনো জিনিসের প্রয়োজন হয় খবর দিও, লজ্জা করো না। তোমার ত্যাগকে আমি শ্রদ্ধা করি।’
সে হাসপাতালে চলে গেল। আমি মনে মনে ওর আরোগ্য কামনা করে বিদায় নিলাম।
একজন জমাদার সাহেব আমার এখানে ডিউটি দেয়। সিপাহির কাছ থেকে শুনলাম জমাদার সাহেব তার এক ছেলেকে এম. এসসি পড়াইতেছে। এবার পরীক্ষা দিবে। আমি তাকে ডেকে বললাম, ভাই খুব ভাল কাজ করেছেন। এত অল্প বেতন পেয়েও ছেলেকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। বলল, ‘স্যার, আমার ছেলেটাও ভাল। প্রাইভেট টিউশনি করে কিছু টাকা উপার্জন করে নিজের পড়ার খরচ চালাইয়া আমাকেও সাহায্য করে। তার কথা শুনে আমার খুব আনন্দ হলো।
সূর্য অস্ত গেল। আমিও আমার নীড়ে ফিরে এলাম। দুই তিন দিন হলো রাতে তিন চার বার ঘুম ভেঙে যায়। আর আজে বাজে স্বপ্ন দেখি। শরীরটা ভাল না, পাইলস ও গ্যাস্ট্রিক কষ্ট দেয়।
৪ঠা জুলাই ১৯৬৬ ॥ সোমবার
রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল, দেখলাম আড়াইটা বাজে। আমি উঠে বসে পাইপ ধরালাম। আপন মনে পাইপ টানতে আরম্ভ করলাম। মশারির বাইরে বসার কি উপায় আছে! মশক শ্ৰেণী সাঁড়াশির মতো আক্রমণ করে। তবে একটা গুণ আছে এই জেলখানার মশক শ্রেণীর, শূল বসিয়ে রক্ত খেতে থাকে চুপচাপ। একদিনের জন্যও বুনু বুনু শব্দ শুনি নাই। তারা ডাকাডাকিতে নাই, নীরবে কাজ সারতেই পছন্দ করে। কয়েদিরা যেমন অত্যাচার সহ্য করে, মার খায়, সেল বন্ধ হয়, ডাণ্ডাবেড়ি পরে, হাতকড়ি লাগায়—প্রতিবাদ করার উপায় নাই, কথা বলার উপায় নাই। নীরবে সহ্য করে যায়। তাই বুঝি মশক বাহিনী বড় সাহেবদের খুশি করার জন্য শব্দ না করেই শূল বসাইয়া দেয়। জেলখানায় কত রক্ত খাবে? যত মশাই হউক, মশারিতো কয়েদিরা পাবে না। বোধ হয় তিন হাজার কয়েদির মধ্যে দুই শত কয়েদি মশারি পায়। রাজবন্দি আর যারা ডিভিশন পায় তারাই মশারি পায়। প্রথম যখন এসেছিলাম মশার আমদানি এত ছিল না।
খবর পেলাম গত রাতে ৬১ জন বিড়ি শ্রমিককে বন্দি করে আনা হয়েছে। তারা কি অন্যায় করেছে জানি না। তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। বিড়ির পাতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে প্রায় তিন চার লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। তারা ও তাদের সংসারের সকলেই না খেয়ে দিন কাটাতেছে। সরকার পাতা বন্ধ করে দিলেন কিন্তু তাদের কাজের বন্দোবস্ত করার কথা চিন্তা করলেন না। সরকারের কোনো দায়িত্বও নাই বলে মনে হয়। আবার তাদের গ্রেপ্তার করাও শুরু হয়েছে। যারা জনগণের কাজের দায়িত্ব নিতে পারে না বেকার করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই তাদের নাই। জুলুম করেই চলেছে। সিরাজগঞ্জের এই সকল শ্রমিক লাট বাহাদুরের কাছে দাবি করে ভাতের পরিবর্তে লাঠির আঘাত ও টিয়ার গ্যাস খেয়েছে। গ্রেপ্তার চলেছে সমানে। বাড়িতে যেয়ে যেয়ে কর্মীদের গ্রেপ্তার করে জেল দিতে শুরু করেছে। আমার মনে হয় পাকিস্তানকে একটা কারাগার ঘোষণা করলেই ভাল হয়, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে। জেলের মধ্যে সকলকে ভাত ও কাপড় দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। দেশটাকে জেলখানা ঘোষণা করে সকলের খাওয়ার ও থাকার বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব নিলেই তো সব গোলমাল থেমে যায়। আর মায়ের সামনে কচি শিশুও না খেয়ে ধুকে ধুকে মরবে না। তোমাদের জুলুম যতই জোরে চলবে, গণআন্দোলনও ততই জোরে শুরু হবে। অত্যাচার চরমে পৌছলে, গণআন্দোলনও চরমে পৌছবে। দেখে খুশি হয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নবাব কালাবাগ সাহেবের আমন্ত্রণক্রমে কয়েকজন সম্পাদক, মালিক এবং পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা তার সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি বলেছেন, যদি ৫ই জুলাই ধর্মঘট বন্ধ রাখা হয় তাহলে জনাব তফাজ্জল হোসেনের গ্রেপ্তার ও নিউনেশন প্রেসের বাজেয়াপ্তের ব্যাপারে একটা সন্তোষজনক মীমাংসার জন্য তিনি চেষ্টা করতে রাজি আছেন, এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথেও আলোচনা করবেন। তাই সাংবাদিকরা ধর্মঘট স্থগিত রেখেছেন আগামী ২০শে জুলাই পর্যন্ত।
আমার মনে হয় একটা কিছু হবে, কারণ নবাব কালাবাগকে আমি জানি, তাঁর সাথে মতের মিল আমার না থাকলেও তিনি যা বলেন, করতে চেষ্টা করেন। নবাব সাহেব ও আমি একসাথে প্রায় সাড়ে তিন বত্সর পার্লামেন্টের সদস্য ছিলাম। তিনি পূর্ব বাংলার গভর্ণর সাহেবের মতো ফালতু কথা বেশি বলেন না।
আজ থেকে ডন কাগজ আমাকে দেওয়া শুরু করেছে। তবে একদিন দেরিতে পাই। এতে আমার দুঃখ নাই, কাগজ যে দেয় এটাইতো ভাগ্যের কথা! যে লোকের পাল্লায় পূর্ব বাংলার লোক পড়েছে, সে কতদূর নিয়ে যায় বলা কষ্টকর।
বিকাল সাড়ে চারটার সময় ডেপুটি জেলার সাহেব এলেন। বললেন, কেমন আছেন? জমাদার সাহেবকে ডেকে যেন কি বললেন, তারপরই বাঁশি বেজে উঠল। পাগলা ঘণ্টা, আর যায় কোথা! দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল। কয়েদিরা যার যার ঘরে চলে গেল। তালাবন্ধ হয়ে গেল। ফৌজ নিয়ে বন্দুক নিয়ে সার্জেন্ট সাহেব ঢুকলেন সেল এরিয়ায়, যেখানে আমি থাকি। বন্দুকের গুলি হতে লাগল, ফাঁকা গুলি। আধ ঘণ্টা পরে আবার ঘন্টা পড়ল, সব ঠিক আছে। একে জেলে ‘মাস কাবারী’ বলে। মাসে একবার করে কয়েদিদের ভয় দেখাবার জন্য এরকম করা হয়। আমরা তো ভয় পেয়ে বসেই আছি। আবার কেন বাবা!
জেলার সাহেব এলেন। তাকে বললাম, আপনার জেলে সাধারণ কয়েদিদের উপর জুলুম চলেছে, খাওয়া-দাওয়াও ভাল হতেছে না। আশা করি আপনি খেয়াল রাখবেন। বদনাম আপনাকেই মানুষ করবে। আর বদ দোয়াও করবে আপনাকে। জেলার সাহেব কয়েদিদের উপর নিজে কোনো অত্যাচার করেন না, সে আমি জানি।
৫ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ মঙ্গলবার
জমাদার ও সিপাহি সাহেবরা মুড়ি খেতে চায়। মুড়ি জেলখানার কয়েদিরা চোখেও দেখে না। মেটকে বললাম, মুড়ি-কাঁচা মরিচ ও পিয়াজ দিয়ে তৈয়ার কর। পূর্বেই আমি দেখাইয়া দিয়েছি কী করে তৈয়ার করতে হয়। নিজেও জানি কিছুটা। সাধারণ কয়েদিরা যারা আমার এখানে কাজ করে তাদের জন্যও বানাও। পাশের সেলে যে কয়জন জেল হতে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি আছে তাদেরও দিতে হবে। খেয়েদেয়ে ‘ডন’ কাগজ পড়তে লাগলাম। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক খবরই পাওয়া যায়।
বৃষ্টি নেমেছে ভীষণভাবে, আর থামতেই চায় না। মশারিটা সকালে ধোপা দফায় পাঠিয়ে দিয়েছি, রৌদ্র দেখে। এখন কী উপায় করি? আজ বোধ হয় মশক বাহিনীর আক্রমণ আমাকে নীরবে সহ্য করতে হবে।
মোনায়েম খান সাহেব আবার হুমকি দিয়েছেন। সাবধান! সত্য কথা কেহ লিখতে ও বলতে পারবা না। চাউলের দাম বেশি বাড়ে নাই-বেড়েছে কিছুটা, তবে ভয়ের কোনো কারণ নাই। অনেক সিপাহি ছুটি ভোগ করে বাড়ি থেকে এসেছে। তাদের কাছেও শুনলাম ৫০ থেকে ৬০ টাকাও দাম উঠেছে চাউলের মন। সত্য কথা চাপা দেওয়ার এই চেষ্টা কেন? আপনার সরকারের কী ক্ষতি হতেছে! চাউল তো আপনার গুদামে যথেষ্ট আছে, আর ভয় কি? ছেড়ে দেন। বাজারে, অথবা রেশনিং প্রথা গ্রামে গ্রামে প্রচলন করুন। খাজনা আদায় বন্ধ করুন। বিনা পয়সায় কিছু চাউল গরিবদের মধ্যে বিলি করুন, কোনো গোলমাল থাকবে না।
কাগজগুলিকেও তিনি হুমকি দিয়াছেন। জনগণ বোধ হয় বেশি ভয় আর করবে না। বেশি বাড়লে ঝড়ে ভেঙে পড়ে। আপনার দিনও ফুরাইয়া এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বাড়ি এই সুযোগে করে রাখুন। সুবিধা হবে, না হলে অনেক বিপদে বোধ হয় পড়তে হবে ভবিষ্যতে।
আজ একজন জেল কর্মচারী আমাকে জেলের দুর্নীতির কথা বলেছিল। কিছুদিন পূর্বে একজন অর্থশালী লোককে এনেছিল জেল দিয়ে। তাদের ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। একজনের বেশি বয়স। আর যায় কোথায়? পানি আনতে হুকুম হলো, বেচারারা পারে না, কাঁদতে থাকে। তখন কয়েদির মধ্য থেকে কিছু দালাল এসে বলে, যদি কিছু টাকা দিতে পারেন, তবে ভাল কাজের বন্দোবস্ত করে দিতে পারি। কোনো কষ্ট হবে না, বসে বসে লেখাপড়া করতে পারবেন বা হাসপাতালে রাখার বন্দোবস্ত করে দেওয়া যাবে। বেচারা বোকার মতো বলে, জেলখানায় টাকা পাব কোথায়? তখন ঐ দালালই বুঝাইয়া দেয়: একখানা কাগজ এনে দিবে, বাইরে তার লোকের কাছে লিখে দিতে হবে অমুকের সাথে দেখা করে টাকা দিয়ে যেতে; নতুবা বাঁচবো না। যাদের টাকা আছে তারা তো কোনোমতে জোগাড় করে এনে দেয়, আর যাদের নাই তাদের কোনো কিছু বিক্রি করে অথবা যেভাবে পারে জোগাড় করে দিতে হবে।
একবার টাকা দিলে আর উপায় নাই। টাকা পেয়ে কয়েকদিন ভালই থাকার বন্দোবস্ত করল। আবার জুলুম। জেল কর্মচারী বেচারা ভাল মানুষ। এসব পথে হাঁটে না। অনেক গল্পই আমার সঙ্গে করল। আমি তো এসব ঘটনা বহু জানি। কারণ কারাগার তো আমার পুরানা সাথী। এমন কি গরিব কয়েদিদেরও টাকা এনে দিতে হয় মহকুমা জেলগুলিতে। সে অনেক ইতিহাস, লেখা কষ্টকর। আবার অনেক ভদ্রলোক আছে সিপাহি জমাদারদের ভিতর, যারা না থাকলে কয়েদিরা জেল খাটতে পারত না। নিজেদের সামান্য বেতন থেকেও কয়েদিদের কিছু কিছু জিনিস এনে দেয়। আবার সাহায্যও করে আদরও করে।
বিকালে বৃষ্টি থামলে বের হলাম ঘর থেকে। ধনুক আছে কাকের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ওদের কিছু তাড়া করে বসে কাগজ পড়তে পড়তে দিন কাটাইয়া দিলাম।
৬ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ বুধবার
নাস্তা খেতে বসে দেখলাম, রুটি দুই টুকরা ছাড়া আর কিছুই নাই। বললাম, খেতে আমার ইচ্ছা নাই। কারণ সকালে চা খেয়েছি। কিন্তু মেট কি শোনে? খেতেই হবে কিছু। এক টুকরা রুটি আর জেলখানার একটা কলা খেয়ে নিলাম। জেলখানার কলা কেন বললাম প্রশ্ন আসতে পারে। কন্ট্রাক্টর কয়েদিদের জন্য আনে বাজারের সবচেয়ে ছোট কলা। কারণ যারা আপত্তি করবে, তারা আপত্তি করা দরকার মনে করে না।
গত কালের কাগজ নিয়ে বসলাম। আবার মেট এসে হাজির, ‘আর কিছু খাবেন না? এতে চলবে কি করে?’ বললাম, বাবা মাফ করো। তোমার জন্য অস্থির হয়ে পড়লাম। শুধু খাই খাই। কিছু সময় পরে মুড়ি নিয়ে এল। যে দুইটা ছেলে পরীক্ষা দিতেছে তাদের মধ্যে একজনের ভোর রাত থেকে বমি ও সকালে পাতলা পায়খানা হয়েছে। আমাকে খবর দিয়েছে একটা ডাবের দরকার। আমার কাছে ডাব ছিল, পাঠাইয়া দিলাম। আর ডাক্তারকে খবর দিতে বললাম। ডাক্তার সাহেব এলেন, ওষুধ দিলেন, বেচারা একটু সুস্থ বোধ করল এবং পরীক্ষা দিতে গেল। ভালভাবে পরীক্ষা দিক এটাই কামনা করলাম।
কাগজ এল। দেখি ইন্দোনেশিয়ার পিপলস কংগ্রেস আজ সুকর্ণকে আজীবন প্রেসিডেন্ট পদ হইতে অপসারিত করিয়াছে, তবে তিনি আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই অন্যতম বিশাল রাষ্ট্রে আজ কমিউনিজম, লেনিনবাদ ও মার্কসবাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছে। পিপলস কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তে-প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ সম্মতি দান করিয়াছেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের বাড়াবাড়ির জন্যই আজ ইন্দোনেশিয়া এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হইয়াছে। তাড়াতাড়ি করে ক্ষমতা দখল করতে যেয়েই এই অঘটন ঘটাল, লক্ষ লক্ষ কম্যুনিস্ট কর্মীদের জীবন দিতে হলো। এখন গ্রেপ্তার ও অত্যাচার সহ্য করতে হতেছে। দুনিয়ার ডিক্টেটরদের চোখ খুলে যাওয়া উচিত। মনে হয় সুকর্ণকে আজ দয়া করে প্রেসিডেন্ট রাখা হয়েছে। কোনো ক্ষমতাই তার নাই। তার নিজের কথাগুলিকে নিজেরই হজম করতে হতেছে। আজ জাতিসংঘ, অর্থনৈতিক ব্যাংক ও অন্যান্য সঙ্গুলির সদস্য হবার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি আজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আজ আবার সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে তাকে পড়তে হবে বলে মনে হয়।
বিকালে চা খাবার সময় সিকিউরিটি জমাদার সাহেবকে আসতে দেখে ভাবলাম বোধহয় বেগম সাহেবা এসেছেন। গত তারিখে আসতে পারেন নাই অসুস্থতার জন্য। চলিয়ে, বেগম সাহেবা আয়া। আমি কি আর দেরি করি? তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। সেই পুরান দৃশ্য। রাসেল হাচিনার কোলে। আমাকে দেখে বলছে, আব্বা! আমি যেতেই কোলে এল। কে কে মেরেছে নালিশ হলো। খরগোস কিভাবে মারা গেছে, কিভাবে দাঁড়াইয়া থাকে দেখালো। রেণুকে জিজ্ঞাসা করলাম, খুব জ্বরে ভুগেছ। এখন কেমন আছ?
‘পায়ে এখনও ব্যথা। তবে জ্বর এখন ভালই।’
বললাম, ‘ঠান্ডা লাগাইও না’।
আমার চারটা ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে এসেছে। ছেলে দুইটাই বাসায় ফিরেছে। মেয়ে দুইটার একজন কলেজ থেকে, আর একজন স্কুল থেকে সোজা এসেছে। ছোট ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়াইয়া থাকে কখন আমি গেটে আসবো।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, মা, আব্বা, ভাইবোনদের খোঁজ-খবর নিলাম। মা ঢাকা আসতে চান না। এতদূর আসতে তার কষ্ট হবে—কারণ অসুস্থ। আবার বয়সও হয়েছে। আব্বা বাড়িতে। তারও কষ্ট হয় সকলের চেয়ে বেশি। একলা আছেন। আজ অনেক সময় কথা বললাম। সবই আমাদের সাংসারিক খবর এবং আমি কিভাবে জেলে থাকি তার বিষয়। বাচ্চারা দেখতে চায় কোথায় থাকি আমি। বললাম, বড় হও, মানুষ হও দেখতে পারবা। সময় হয়ে গেছে, যেতে দিতে হবে। ফিরে এলাম আমার জায়গায়। হরলিক্স ও আম নিয়ে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, আমার জন্য না এনে বাচ্চাদের কিনে দেও তো।
সন্ধ্যা হয়ে এল। ওদের বিদায় দিয়ে আমার স্থানে আমি ফিরে এলাম। মনে মনে বললাম, আমার জন্য চিন্তা করে লাভ কি? তোমরা সুখে থাক। আমি যে পথ বেছে নিয়েছি সেটা কষ্টের পথ।
৭ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ বৃহস্পতিবার
নতুন বিশ সেলের দোতালায় একটা ব্লকে একজন কয়েদিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। একে ‘জাল সেল’ বলা হয়। একে তো সেল, তার উপর আবার জাল দিয়ে সামনেটা ঘেরা। ওকে একদিন আমি দেখেছি। আমার জায়গার কাছ দিয়েই দোতালার সিঁড়ি। চেহারাটা যে একদিন খুব ভাল ছিল সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। লোকটার নাম নেছার খা। আজ ১৭ বৎসর জেলে আছে। যাদের যাবজ্জীবন জেল হয় তাদেরও ১২/১৩ বৎসরের বেশি খাটতে হয় না। একে ১৭ বৎসর রাখা হয়েছে কেন? খবর নিয়ে জানতে পারলাম, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখন জেল-মন্ত্রী এসেছিলেন জেল তদারক করতে। আট সেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল তাকে যাতে সে মন্ত্রী বাহাদুরের কাছে নালিশ করতে না পারে জেলের দুর্নীতি সম্বন্ধে। কারণ লোকটা বড় সাহসী, মুখের উপর সত্য কথা বলে দেয়। যখন মন্ত্রী সাহেব সেই সেলের পাশ দিয়ে যেতেছিলেন সে দেয়ালে উঠে চিল্কার করে বলেছিল, ‘স্যার আমার নালিশ আছে।‘
মন্ত্রী সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে এই লোকটা?’ তাঁকে বলা হয়েছিল লোকটা পাগল। তারপর মন্ত্রী সাহেব চলে যাওয়ার পরে যা ঘটবার তাই ঘটল। তখনকার দিনের বড় সাহেবের হুকুমে জেলখানার পাগলাগারদ ৪০ সেলে এনে বন্দি করা হলো। এবং ঘোষণা করা হলো সে পাগল হয়ে গেছে। পাগলের তো কোনো নির্দিষ্ট সময় নাই। যতদিন ভাল না হবে এবং সিভিল সার্জন সাহেব সার্টিফিকেট দিয়ে সরকারের কাছে না লিখবেন ততদিন ছাড়া পেতে পারে না। এতদিন তাকে পাগল করেই রাখা হয়েছে, যদিও সে পাগল না। এভাবে রাখলে ভাল মানুষও পাগল হয়ে যায়। নতুন সিভিল সার্জন সাহেব এসে ঘোষণা করেছেন, সে পাগল না। তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে লিখেছেন। বোধ হয় শীঘ্রই মুক্তির হুকুম আসবে।
আমার কাছে খুবই খারাপ লাগল। আমাদের সরকারের সময়ই এই অত্যাচার হয়েছিল এজন্য লোকটা এখনও ভুগছে। এর পরেও আমি তিনবার জেলে এসেছি। কেহই এ ঘটনা আমাকে বলে নাই। আর বললেও কি করতে পারতাম? এখন যারা জেল কর্তৃপক্ষ আছেন তারা এদের ছাড়তে দেরি করেছেন। পাগল বলে মুক্তি দেবার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের হাতে নাই। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হতে পারে! যে ভদ্রলোক আমাদের সময় প্রমোশন পেয়েছিলেন, তিনি এই নীচু কাজটা করেছিলেন।
১১টার সময় ডিআইজি জনাব ওবায়দুল্লা দেখতে এসেছেন সেল এরিয়ায়। আমার কাছে আসলে তিনি দুই চার মিনিট বসেন। আজ অনেকক্ষণ বসলেন। হাদিস শরীফ নিয়ে আলোচনা করলেন। খানে দজ্জাল ইমাম মেহেদী আসবেন। ঈসা নবীও আর একবার আসবেন। এজ্জাজ, মাজুজও হাজির হবে। দুনিয়া প্রায়ই ধ্বংস হয়ে যাবে-আরও অনেক কিছু বলেন। আমিও দু’একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি বললেন, রসুলআল্লার জন্মের ১৪ শত বছর পর দুনিয়ায় কি হয় বলা কষ্টকর। তিনি যখন উঠলেন তখন আমি বললাম খানে দজ্জাল তো দুনিয়ায় এসেছে, ইমাম মেহেদীর খবর কি? তিনি বুঝলেন আমি কাকে ইঙ্গিত করলাম। হেসে দিয়ে বিদায় নিলেন, কোনো কথা আর বললেন না।
আমি আমার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম এবং আর একবার চায়ের প্রয়োজন জানালাম। মুড়ি ও চা এসে হাজির হলো। যথারীতি মুড়ি নিধন করিয়া বই নিয়া বসলাম।
মনে মনে ভাবলাম, আজও দুনিয়ায় মানুষ অনেক আজগুবি কথা বিশ্বাস করে? বিশ্বাস না করে উপায় কি? কিল খাওয়ার ভয় আছে। যাক, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
৮ই জুলাই ১৯৬৬ ।। শুক্রবার
প্রাতঃভ্রমণ করছি এমন সময় হাসপাতালের দিকে চেয়ে দেখি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেব তাকাইয়া আছেন। আমাকে হাত ইশারা দিয়ে দেরি করতে বলে হঠাৎ চলে গেলেন ভিতরে। তিনটা ছেলেকে কোলে করে কয়েকজন কয়েদি নিয়ে এল বাইরে। দেখলাম একজনের হাত কেটে ফেলেছে, একজনের বুকের কাছে গুলি লেগেছিল, আর একজন হাঁটতেই পারে না কোলে করেই রেখেছে। বাইরের হাসপাতাল থেকে এদের এনেছে। অত্যাচার করে, মারপিট করে, গুলি করে জখম করেছে। এদের জীবন শেষ করে দিয়েছে, তারপর আবার আসামি করে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে এসেছে। কি নিষ্ঠুর এই দুনিয়া! এরাই তো আমাদের ভাই, চাচা, প্রতিবেশী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায় হলে এদের বংশধররা সুযোগ সুবিধা পাবে। এদেরকে বাদ দিয়ে তো কেউ অধিকার ভোগ করবে না। যারা মৃত্যুবরণ করল আর যারা পঙ্গু হয়ে কারাগারে এসেছে, জীবনভর কষ্ট করবে আমাদের সকলের জন্যই। কেন এই অত্যাচার? কেনই বা এই জুলুম! অত্যাচার কতকাল চলবে!
মনকে শক্ত করতে আমার কিছু সময় লাগল। ভাবলাম সকল সময় ক্ষমা করা উচিত না। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ, কিন্তু জালেমকে ক্ষমা করা দুর্বলতারই লক্ষণ। ইসলামে ঠিক কথাই বলেছে, ক্ষমা করতে পার ভাল না করতে পারলে, হাতের পরিবর্তে হাত, চক্ষুর পরিবর্তে চক্ষু নিতে আপত্তি নাই।
আজ আরও একটা ছেলেকে সাতাশ সেল থেকে নিয়ে এসেছে পুরানা বিশ সেলে। ম্যাট্রিক দেবে। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় বাড়ি। মাথায় আঘাত পেয়েছিল। ধরে নিয়ে ভীষণভাবে মারপিট করেছে। অনেকে জখম নিয়েই কারাগারে এসেছে। খাজা মহীউদ্দিন আমাকে তার পিঠটা দেখালো, এখনও দাগ রয়ে গেছে। তাকে ধরে এনে মেরেছে। শুনলাম ইপিআর-এর লোকগুলি এদের মারধর করে নাই। তারা বেঙ্গল পুলিশকে মিছামিছি গুলি করার জন্য জনসাধারণের সামনেই গালাগালি করেছে। এখনও বহুলোক জেলে আছে। নারায়ণগঞ্জে মামলায় এখনও গ্রেপ্তার চলছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই বাচ্চা ছেলের দল। কি কষ্টেই যে এরা আছে, বলব কি? বলবার ভাষা নাই। একই কাপড় পরে জেলে এসেছে। দিনের পর দিন সেই কাপড় পরেই রয়েছে।
সন্ধ্যার সময় এক সিপাহি আমাকে বলল, দেশের কথা কি বলব স্যার! কয়েকদিন পূর্বে ফরিদপুরের একটা মেয়েলোক আমার এক বন্ধুর কাছে ১৩ দিনের একটা ছেলেকে ১০ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে গিয়াছে। এমনিই দিয়ে যেতে চেয়েছিল, বন্ধু ১০ টাকা দিয়ে দিল। কোনো কথা না বলে ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে সে চলে গেল। একটা কথাও বলল না। শুধু বলল, আমি মাঝে মাঝে দেখতে চাই ছেলেটা ভাল আছে। আরও বলল, অনেক গ্রামের কচু গাছ ও গাছের পাতাও বোধ হয় নাই। বললাম, এইতো আইয়ুব খান সাহেবের উন্নয়ন কাজের নমুনা। মোনায়েম খাঁ সাহেবের ভাষায় চাউলের অভাব হবে না, গুদামে যথেষ্ট আছে। যে দেশের মা ছেলে বিক্রি করে পেটের দায়ে, যে দেশের মেয়েরা ইজ্জত দিয়ে পেট বাঁচায়, সে দেশও স্বাধীন এবং সভ্য দেশ! গুটিকয়েক লোকের সম্পদ বাড়লেই জাতীয় সম্পদ বাড়া হয় বলে যারা গর্ব করে তাদের সম্বন্ধে কি-ইবা বলব!
বাঙালি জাতটা এত নিরীহ, না খেয়ে মরে যায় কিন্তু কেড়ে খেতে আজও শিখে নাই। আর ভবিষ্যতেও খাবে সে আশা করাও ভুল। চুপ করে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম গ্রামের কথা, বস্তির কথা। গ্রামে গ্রামে আনন্দ ছিল, গান বাজনা ছিল, জেয়াফত হতো, লাঠি খেলা হতো, মিলাদ মাহফিল হতো। আজ আর গ্রামের কিছুই নাই। মনে হয় যেন মৃত্যুর করাল ছায়া আস্তে আস্তে গ্রামগুলিকে প্রায় গ্রাস করে নিয়ে চলেছে। অভাবের তাড়নায়, দুঃখের জ্বালায় আদম সন্তান গ্রাম ছেড়ে চলেছে শহরের দিকে। অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ছোটবেলার কত কাহিনীই না মনে পড়ল। কারণ আমি তো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালবাসি।
৯ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ শনিবার
ভিয়েতনামের হ্যানয় ও হাইফং-এ আবারও বোমাবর্ষণ করেছে আমেরিকা। জাতীয় পরিষদে একটা মুলতবি প্রস্তাব হ্যানয় ও হাইয়াং বোমাবর্ষণের ব্যাপার নিয়ে এনেছিল বিরোধী দল। স্পিকার নাকচ করেছেন, অন্য দেশের ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা উচিত না বলে। কিন্তু বিশ্বশান্তি নিয়ে তো আলোচনা করা যায়। পাকিস্তান সরকারের নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির নমুনা!
আইন মন্ত্রী জাফর সাহেব বলেছেন, সরকার উদ্বিগ্ন। চমৎকার কথা। আমি খুশি হয়েছিলাম এই মুলতবি প্রস্তাব এনেছিল বলে। দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখনই অত্যাচার করে, আওয়ামী লীগ তার প্রতিবাদ করে এবং নিজের দেশের সাম্রাজ্যবাদের দালালদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালাইয়া যায়। চীন আজ বহুদিন পর্যন্ত শুধু হুমকি মেরেই চলেছে। কখন সাহায্য করবে? যখন ভিয়েতনামের জনগণ অত্যাচারে, নির্বিচারে গুলির আঘাতে মৃত্যুবরণ করবে তখন বোধ হয় একবার যেতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে তাড়াতে না পারলে জনগণ শান্তির সাথে বাস করতে পারে না। এই সব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেও আজ আমেরিকার অনেক প্রগতিশীল মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে। সুদূর মার্কিন দেশেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তবুও চক্ষু খুলছে না জনসন সরকারের।
আমাদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তিনটা কাগজের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে। একটা সংবাদ, পূর্ব পাকিস্তানের কাগজ, আর দুইটা নওয়াই ওয়াক্ত’ ও ‘কোহিস্তান’-পশ্চিম পাকিস্তানের। প্রায় সকল কাগজকেই সরকার ছলে বলে কৌশলে নিজের সমর্থক করে নিয়েছে। যে দু’চারটা কাগজ এখনও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে জনগণের দাবি দাওয়া তুলে ধরছে তাদের শেষ করার পন্থা অবলম্বন করেছে সরকার। ইত্তেফাক প্রেস তো বাজেয়াপ্ত। ঢাকার কাগজের মধ্যে মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান, পয়গাম, পাসবান সরকারের সমর্থক কাগজ। প্রথমোক্ত দুটাই প্রেস ট্রাস্টের। ইত্তেফাক তালাবন্ধ। সংবাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে শেষ করার অবস্থা। পাকিস্তান অবজারভার তো যখন যেমন, তখন তেমন, হায় হোসেন, হায় হোসেনের দলে। কখন যে আঘাত আসে বলা যায় না।
এক কথায় বাংলাদেশে বিরোধী দলের কোনো কাগজ থাকতে পারবে না। এই সমস্ত থেকে বুঝতে পারা যায় সরকার কোনদিকে চলেছে। এক দলীয় সরকার গঠন করার চেষ্টা করলেই তো ভাল হয়। এই সমস্ত অত্যাচার জুলুম করে লাভ কি? যারা পারবে গোপনে রাজনীতি করবে। আর যারা পারবে না চুপ করে সংসার করবে। দেশকে ধ্বংসের দিকে এরা নিয়ে চলেছে। ফলাফল ভয়াবহ হবে।
আজ সকাল থেকে আমি দূর্বা ঘাস কাটায় নেমে যাই। ঘাস কাটা মেশিন আনা হয়েছে। নতুন ঘাস কাটতে অসুবিধা হয়। আমি তদারক করতে থাকি আর কয়েদিরা কেটে চলেছে। ঝাড়ুদারদের দিয়ে পরিষ্কার করাই। আজ দিনটা কাজের মধ্যে থেকে ভালই লাগছিল। দুপুরে কাগজ পড়ে, আবার বিকালেও এই একই কাজ করে, একটা বাগান সুন্দর করে কেটে তৈরি করেছি। এর পরে যখন ঘাসটা আবার উঠবে তখন আরো সুন্দর হবে।
১০ই জুলাই ১৯৬৬ ॥ রবিবার
আমি যেখানে থাকি তার সাথেই নূতন বিশ সেলের ২ নম্বর ব্লক। রবিবার ছুটির দিন গানের জলসা বসেছে। নূরু ভালই গান গায়।
আমি আরাম কেদারায় বারান্দার পাশে আরামে বসলাম, গান শুনব বলে। জেলের ভিতর আর একজন কয়েদি আছে, নাম বেলাল। ঢাকা শহরেই বাড়ি, ভাল গজল ও কাওয়ালি গান গায়। সে ফুলের বাগানের পাহারা, আমার বাগানে আজ কাজ করতে আসবে। ৯ টায় এসে সেও হাজির হয়। তার কাছ থেকেও কাওয়ালি শুনলাম কয়েকটা। এদের তবলা হলো এ্যালমুনিয়ামের থালা। থালা বাজাইয়া গান করে। বেলালের গলাটা একটু খারাপ হয়েছে কাওয়ালি গাইতে গাইতে। তার সুযোগ আছে, সব জায়গায় যাইতে পারে। তাই যেখানে যায় সিপাহি জমাদাররা ওকে ধরে কাওয়ালি শোনে। নূরুর বাংলা গান শুনলাম। খুবই সুন্দর গলা। তালও ঠিক আছে। ভাবলাম হতভাগাটা জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। জেলে পড়ে নানারকম অত্যাচার সহ্য করে আর জেলের খাওয়া খেয়েও গলাটাকে এখনও কিছুটা ঠিক রেখেছে। ধন্যবাদ দিতে হয়। গাইতে কষ্ট হয় বুঝতে পারি। শক্তি না থাকলে গান আসবে কোথা থেকে? তবুও বড় ভাল লাগল ওর গান শুনে। বিশেষ করে পল্লীগীতি ও চমৎকার গায়।
বেলাল বলে গেল, “স্যার কেবল ‘পাহারা’ হয়েছি। আপনার কাছে এসে কাওয়ালি গেয়েছি শুনলে কি আর রক্ষা আছে?” আমি ওকে রক্ষা করতে পারি? আমিও তো ওর চেয়েও সাংঘাতিক কয়েদি! কেউ আমার সাথে কথা বলতে বা মিশতে পারবে না। একদম সরকারের হুকুম। বাগানে কাজ করতে এসেছিল তাই বোধ হয় একটু সুযোগ পেলাম ওর কাওয়ালি শুনতে।
আইয়ুব সাহেবের সরকারের শুভ সংবাদ, দেশের জন্য শুভ কিনা, বলা কষ্টকর। কনসর্টিয়াম ১৯৬৬-৬৭ সালে পাকিস্তানকে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মনে রাখা দরকার, এই ডলার সবই ঋণ নেওয়া হলো। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কপালে কি আছে আমরা জানি না, তবে সুদ সহ টাকা পূর্ব পাকিস্তানকেই বেশি ফেরত দিতে হবে।
ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বায়ত্তশাসন শেষ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডান্ডা চালাইতে সক্ষম হইবেন। অবস্থা যে কি হবে! বোধ হয় শিক্ষিত সমাজ একটু ঘাবড়াইয়া গিয়াছেন। ভয় নাই, কলম ফেলে দিন। লাঠি, ছোরা চালান শিখুন। আর কিছু তেল কিনুন রাতে ও দিনে যখনই দরকার হবে নিয়ে হাজির হবেন। লেখাপড়ার দরকার নাই। প্রমোশন পাবেন, তারপরে মন্ত্রী হতেও পারবেন।
শুধু ভাবি, ব্যাপারটা কি হলো? কোথায় যেতেছি।