স্বপ্ন, ভয়, প্রতিমামধ্য
প্রথম খণ্ড । ভাগ ৩ – কিংবদন্তি। পরিচ্ছেদ ১
ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে পুরুষেরা সব সময় নিজেদের হাতে ধরে রেখেছে সব বস্তুগত ক্ষমতা; পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদিকাল থেকে তারা নারীকে পরনির্ভর অবস্থায় রাখাকেই মনে করেছে সবেচেয়ে ভালো, তাদের আইনগত বিধিবিধান তৈরি হয়েছে নারীর বিরুদ্ধে; এবং এভাবে তাকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অপররূপে। এ-ব্যবস্থা হয়েছে পুরুষের আর্থিক-স্বার্থের উপযোগী; এবং এটা খাপ খেয়েছে তাদের অস্তিত্বস্বরূপতাত্ত্বিক ও নৈতিক আত্মাভিমানের সাথেও। একবার কর্তা যখন নিজেকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তখন অপর, যে কর্তাকে সীমাবদ্ধ ও অস্বীকার করতে চায়, সেও কর্তার কাছে হয়ে ওঠে আবশ্যক : সে আত্মসিদ্ধি লাভ করে সে-সত্যের মাধ্যমে সে যা নয়, যা তার থেকে ভিন্ন কিছু। এজন্যেই পুরুষের জীবন কখনো প্রাচুর্য ও প্রশান্তি নয়; তা অভাব ও সক্রিয়তা, তা সংগ্রাম। নিজের সামনে, পুরুষ মুখোমুখি হয় প্রকৃতির; তার কিছু ক্ষমতা আছে প্রকৃতির ওপর, সে চায় নিজের বাসনা অনুসারে প্রকৃতিকে রূপ দিতে। তবে প্রকৃতি তার অভাব পূরণ করতে পারে না। হয়তো প্রকৃতি দেখা দেয় এক বিশুদ্ধ নৈর্ব্যক্তিক বিরোধিতারূপে, সে একটি বাধা এবং থেকে যায় আগন্তকরূপে; বা সে অক্রিয়ভাবে পুরুষের ইচ্ছের কাছে ধরা দেয় এবং সম্মত হয় সামঞ্জস্য লাভ করতে, তাই পুরুষ তাকে শুধু গ্রাস করে। অর্থাৎ, তাকে ধ্বংস করে–অধিকার করে। উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষ থেকে যায় নিঃসঙ্গ; সে। নিঃসঙ্গ যখন সে ছোঁয় একটি পাথর, নিঃসঙ্গ যখন সে খায় একটি ফল। অপর-এর উপস্থিতি ঘটতেই পারে না যদি না অপর উপস্থিত থাকে তার ভেতরে এবং তার জন্যে : তাই বলা যায় সত্যিকার বিকল্পতা–অপরত্ব হচ্ছে আমার চেতনার থেকে পৃথক এক চেতনা এবং আমার চেতনার সাথে বস্তুত অভিন্ন এক চেতনা।
প্রত্যেক স্বতন্ত্র সচেতন সত্তা চায় একমাত্র নিজেকে সার্বভৌম কর্তা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রত্যেকেই নিজেকে চরিতার্থ করতে চায় অন্যকে দাসে পরিণত করে। তবে দাস যদিও কাজ করে এবং ভয়পায়, তবু সে একরকমে নিজেকে বোধ করে প্রয়োজনীয়; এবং এক দ্বান্দ্বিক বিপ্রতীপ রীতিতে প্রভুই নিজেকে বোধ করে অপ্রয়োজনীয়। পুরুষ নির্জনতার মধ্যে নিজেকে চরিতার্থ করতে পারে না, তাই পুরুষ তার সহচরদের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে থাকে নিরন্তর বিপদের মধ্যে; তার জীবন এক কঠিন সাহসী উদ্যোগ, যাতে সাফল্য কখনোই নিশ্চিত নয়।
অন্যান্য পুরুষের অস্তিত্ব প্রতিটি পুরুষকে ছিন্ন করে আনে তার সীমাবদ্ধতা থেকে এবং তাকে সমর্থ করে তার সত্তার সত্যতাকে পূর্ণ করে তুলতে, সীমাতিক্ৰমণতার মধ্য দিয়ে, কোনো লক্ষ্যের দিকে যাত্রার মধ্য দিয়ে, কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ করতে। তবে এ-স্বাধীনতা আমার নিজের নয়, আমার স্বাধীনতার আশ্বাস দিয়েও এটি তার বিরোধিতা করে : হতভাগ্য মানব চৈতন্যের ট্র্যাজেডি এখানেই; প্রতিটি সচেতন সত্তা শুধু একলা নিজেকে সার্বভৌম কর্তারূপে প্রতিষ্ঠিত করার অভিকাঙ্খী। অপরকে দাসে পরিণত করে প্রত্যেকে পরিপূর্ণ করতে চায় নিজেকে। কিন্তু দাস, যদিও সে কাজ করে ও ভয় পায়, কোনো-কোনো রকমে নিজেকে বোধ করে অপরিহার্যরূপে; এবং একটা দ্বান্দ্বিক বিপর্যাসের ফলে প্রভুকেই মনে হয় অপ্র্যোজনীয় বলে। যদি প্রতিটি ব্যক্তি খোলাখুলিভাবে অপরকে স্বীকার করে নেয়, যদি প্রত্যেকে যুগপৎ নিজেকে ও অপরকে পারস্পরিক রীতিতে গণ্য করে কর্ম ও কর্তারূপে, তাহলে এবিরোধ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সুতরাং নির্জনতার মধ্যে নিজেকে পরিপূর্ণ করতে অসমর্থ হয়ে পুরুষ তার সহচরদের সাথে সম্পর্কের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বিপদগ্রস্ত : তার জীবন এক দুঃসাধ্য কর্মোদ্যোগ, যাতে সাফল্যলাভ কখনোই নিশ্চিত নয়।
তবে সে বাধাবিপত্তি পছন্দ করে না, ভয় করে বিপদকে। পরস্পরবিরোধী রীতিতে সে অভিকাঙ্খী হয় জীবন ও বিশ্রাম, অস্তিত্ব ও নিতান্ত জীবনধারণ উভয়েরই; সে ভালোভাবেই জানে যে ‘আত্মার ঝঞাট’ হচ্ছে বিকাশের দাম, জানে যে অভীষ্ট বস্তু থেকে দূরত্ব হচ্ছে তার নিজের কাছে নৈকট্যের মূল্য; তবে সে স্বপ্ন দেখে উদ্বেগের মধ্যে শান্তির এবং এক অনচ্ছ পরিপূর্ণতার, যা ভূষিত থাকবে চৈতন্যে। এ-স্বপ্নের সম্যক প্রতিমূর্তি নারী; সে প্রকৃতির সাথে আকাঙ্খিত যোগাযোগের মাধ্যম, পুরুষের কাছে অপরিচিত, এবং সহচর সত্তা, যে অত্যন্ত অভিন্ন। প্রকৃতির বিরূপ নৈঃশব্দ দিয়েও সে পুরুষের বিরোধিতা করে না, আবার পারস্পরিক সম্পর্কের কঠোর আবশ্যকতা দিয়েও বিরোধিতা করে না; এক অনন্য বিশেষাধিকারের মাধ্যমে সে এক চৈতন্যসম্পন্ন সত্তা এবং তবুও মনে হয় যেনো তাকে শারীরিকভাবে অধিকার করা সম্ভব।
আমরা দেখেছি যে প্রথম দিকে ছিলো না মুক্ত নারীরা, পুরুষেরা যাদের পরিণত করেছিলো দাসীতে, এমনকি লিঙ্গভিত্তিক কোনো জাতও ছিলো না। নারীকে শুধু দাসী হিশেবে গণ্য করা ভুল; এটা ঠিক যে দাসদের মধ্যে অনেকে ছিলো নারী, কিন্তু সবসময়ই ছিলো মুক্ত নারী–অর্থাৎ ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন নারী। তারা মেনে নিয়েছিলো পুরুষের সার্বভৌমত্ব এবং পুরুষ এমন কোনো বিদ্রোহের হুমকি বোধ করে নি, যা তাকে কর্মে পরিণত করতে পারতো। এভাবে নারীকে মনে হয় সে অপ্রয়োজনীয়, পারস্পরিকতা ছাড়া যে আবার অপরিহার্য হয়ে ধ্রুব অপর হতে চায় না। এ-বিশ্বাস পুরুষের কাছে প্রিয়, এবং প্রতিটি সৃষ্টিপুরাণ এটা প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে আছে জেনেসিস, যাকে খ্রিস্টধর্মের মধ্য দিয়ে জীবন্ত করে রাখা হয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতায়। হাওয়াকে পুরুষের সাথে একই সময়ে নির্মাণ করা হয় নি; তাকে কোনো ভিন্ন পদার্থেও তৈরি করা হয় নি, আদমকে যে-মাটিতে তৈরি করা হয়েছিলো তাতেও তৈরি করা হয় নি তাকে; তাকে নেয়া হয়েছিলো প্রথম পুরুষের পার্শ্বাঙ্গ থেকে। তার জন্মও স্বাধীন ছিলো না; বিধাতা তাকে তারই জন্যে স্বতস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি করে নি এবং প্রতিদানরূপে সরাসরি তার উপাসনা লাভের জন্যেও সৃষ্টি করে নি। সে তার নিয়তি নির্ধারণ করেছিলো পুরুষের জন্যে; আদমকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত করার জন্যে সে হাওয়াকে দান করেছিলো আদমকে, তার সহচরের মধ্যেই ছিলো তার। উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য; হাওয়া ছিলো অপ্রয়োজনীয়দের বিন্যাসের মধ্যে আদমের পরিপূরক। তাই সে দেখা দেয় সুবিধাপ্রাপ্ত শিকারের বেশে। সে ছিলো চেতনার স্তরে উন্নীত প্রকৃতি; সে সচেতন সত্তা ছিলো, কিন্তু প্রাকৃতিকভাবেই ছিলো অনুগত। এবং এখানেই রয়েছে সে-বিস্ময়কর আশাটি, পুরুষ যা পোষণ করেছে নারীর মধ্যে : সে সত্তা হিশেবে নিজেকে চরিতার্থ করতে চায় অন্য একটি সত্তাকে দৈহিকভাবে দখল করে, এবং একই সময়ে একটি মুক্ত মানুষের বাধ্যতার মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করতে চায় তার স্বাধীনতাবোধ। কোনো পুরুষই কখনো নারী হতে সম্মত হবে না, তবে প্রতিটি পুরুষই চায় নারী থাকুক। ‘নারী সৃষ্টির জন্যে বিধাতাকে ধন্যবাদ’। ‘প্রকৃতি শুভ, কেননা সে পুরুষকে দিয়েছে নারী’। এসব উক্তির মধ্যে পুরুষ পুনরায় স্থূল উগ্রতার সাথে জ্ঞাপন করে যে এ-বিশ্বে তার উপস্থিতি এক অবধারিত ঘটনা ও অধিকার, নারীরটা এক দুর্ঘটনা মাত্র, তবে খুবই সুখকর দুর্ঘটনা। অপররূপে দেখা দিয়ে একই সময়ে নারী দেখা দেয় সত্তার এক প্রাচুর্যরূপে, যা বিপরীত সে-অস্তিত্বের, যার শূন্যতা পুরুষ বোধ করে নিজের মধ্যে; কর্তার চোখে কর্মরূপে গণ্য হয়ে ওই অপর গণ্য হয় আঁ সুওঅ রূপে; সুতরাং একটি সত্তারূপে। পুরুষ যে-অভাব বহন করে তার অন্তরে, তা সদর্থকরূপে প্রতিমূর্তিত হয় নারীতে, এবং তার মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়ে পুরুষ আশা করে আত্মসিদ্ধি অর্জনের।
তবে নারী পুরুষের কাছে শুধু অপর-এর প্রতিমূর্তি উপস্থাপন করে নি, এবং ইতিহাসের যাত্রাপথ ভরে সে সমান গুরুত্ব ধারণ করে নি। অনেক মুহুর্ত এসেছে যখন সে গ্রস্ত হয়েছে অন্যান্য প্রতিমা দিয়ে। যখন নগর বা রাষ্ট্র গিলে খায় নাগরিকদের, তখন পুরুষের পক্ষে ব্যক্তিগত নিয়তি নিয়ে বিভোর থাকা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রের কাছে উৎসর্গিত হয়ে স্পার্টার নারীদের অবস্থা ছিলো গ্রিসের অন্যান্য নারীদের ওপরে। তবে এটা সত্য যে নারী কোনো পুরুষসুলভ স্বপ্নের ফলে রূপান্তরিত হয় নি। নেতাতন্ত্র, তা সে নেপলিয়ন, মুসোলিনি, বা হিটলারই হোক, বর্জন করে অন্য সব তন্ত্র। সামরিক স্বৈরতন্ত্রে, একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, নারী আর সুবিধাপ্রাপ্ত বস্তু থাকে না। এটা বোঝা যায় যে নারীকে দেবীতে উন্নীত করা হয় এমন ধনী দেশে, যেখানে নাগরিকেরা জীবনের অর্থ সম্পর্কে বিশেষ নিশ্চিত নয় : যেমন হয় আমেরিকায়। অন্য দিকে, সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শগুলো, যা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে সব মানুষের সাম্য, সেগুলো এখন ও ভবিষ্যতে কোনো মানবশ্রেণীকে বস্তু বা দেবতা বলে গণ্য করতে অস্বীকার করে : মার্ক্সের ঘোষিত খাঁটি গণতান্ত্রিক সমাজে অপর-এর কোনো স্থান নেই। ফরাসি বেশ্যাদের কাছে লেখা জর্মন সৈন্যদের চিঠি আমি দেখেছি, যাতে, নাটশিবাদ সত্ত্বেও, স্থূলভাবে জ্ঞাপন করা হয়েছে কুমারীর শুদ্ধতার অন্তর্নিহিত ঐতিহ্য। ফ্রান্সে আরাগ, আর ইতালিতে ভিত্তোরিনির মতো সাম্যবাদী লেখকেরা নিজেদের লেখায় নারীদের স্থান দিয়েছেন প্রথম সারিতে, তারা রক্ষিতা বা মাতা যা-ই হোক। হয়তো কোনোদিন নির্বাপিত হবে নারী-কিংবদন্তি, যতো বেশি নারীরা নিজেদের দাবি করবে মানুষ হিশেবে। তবে আজো তা আছে প্রতিটি মানুষের মনে।
প্রতিটি কিংবদন্তি ইঙ্গিত করে একটি কর্তার প্রতি, যে তার আশা ও ভয়গুলোকে বিস্তীর্ণ করে দেয় এক সীমাতিক্ৰমণতার আকাশের দিকে। নারীরা নিজেদের কর্তারূপে প্রতিষ্ঠিত করে না এবং সেজন্যে তারা এমন কোনো পুরুষপুরাণ সৃষ্টি করে নি, যাতে প্রতিফলিত হয়েছে তাদের পরিকল্পনা; তাদের নিজেদের কোনো ধর্ম বা কবিতা নেই : তারা আজো পুরুষের স্বপ্নের ভেতর দিয়ে স্বপ্ন দেখে। পুরুষের তৈরি দেবতারাই তাদের দেবতা, যাদের তারা পুজো করে। পুরুষেরা নিজেদের পরমে উন্নীত করার জন্যে সৃষ্টি করেছে বীরপ্রতিমা : হারকিউলিস, প্রেমিথিউস, পার্সিফাল; এ-বীরদের নিয়তিতে নারীরা পালন করেছে শুধুই গৌণ ভূমিকা। সন্দেহ নেই যে আছে নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িত পুরুষের নানা প্রথাগত প্রতিমা : পিতা, প্রলুব্ধকারী,স্বামী, ঈর্ষাকাতর প্রেমিক, সুবোধ পুত্র, নষ্ট পুত্র; তবে এদের সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করেছে পুরুষেরা, এবং এগুলোর নেই পুরাণের মহিমা, এগুলো শস্তা গতানুগতিকের বেশি কিছু নয়। আর সেখানে নারীকে একান্তভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় পুরুষের সাথে তার সম্পর্ক অনুসার। পুরুষ ও নারী–এ-ধারণা দুটির অপ্রতিসাম্যকে প্রকাশ করা হয়েছে কামপুরাণগুলোর একপাক্ষিক গঠনের মধ্য দিয়ে। আমরা অনেক সময় নারী বোঝানোর জন্যে বলি ‘লিঙ্গ’; নারী হচ্ছে মাংস, মাংসের সুখ ও বিপদ। নারীর জন্যে পুরুষও যে লিঙ্গ ও মাংস, তা কখনো ঘোষিত হয় নি, কেননা ঘোষণা করার কেউ নেই। বিশ্বের উপস্থাপন, বিশ্বের মতোই, পুরুষেরই কাজ; তারা একে বর্ণনা করে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে, যাকে তারা গুলিয়ে ফেলে ধ্রুবসত্যের সাথে।
কোনো একটি পুরাণ বর্ণনা করা সব সময়ই কঠিন; একে ধরা বা বেষ্টন করা যায় না; এটি কোনো স্থির রূপে উপস্থিত না হয়ে মানুষের চেতনায় ঘুরে ফিরে হানা দেয়। পুরাণ এতো বিচিত্র, এতোপরস্পরবিরোধী যে প্রথমে উপলব্ধি করা যায় না এর ঐক্য : ডেলাইলা ও জুডিথ, আস্পাসিয়া ও লুক্ৰেতিয়া, প্যান্ডোরা ও অ্যাথেনা–নারী একই সময়ে হাওয়া ও কুমারী মেরি। সে প্রতিমা, ভৃত্য, জীবনের উৎস, অন্ধকারের শক্তি; সে সত্যের আদি নৈঃশব্দ্য, সে ছল, গুজব, ও মিথ্যাচার; সে শুশ্রুষাকর উপস্থিতি ও মায়াবিনী; সে পুরুষের শিকার, তার পতন, সে সব কিছু পুরুষ যা নয় এবং পুরুষ যা কামনা করে, সে পুরুষের নেতি এবং তার লক্ষ্য ও সত্যতাপ্রতিপাদন।
‘নারী হওয়া,’ স্টেজেজ অন দি রোড অফ লাইফ-এ বলেছেন কিয়ের্কেগার্ড, ‘এমন অদ্ভুত, এতো গোলমেলে, এতো জটিল যে কোনো বিধেয় একে প্রকাশ করার কাছাকাছিও আসে না এবং প্রয়োগ করতে হয় যে-বহুসংখ্যক বিধেয়, সেগুলো এতো পরস্পরবিরোধী যে শুধু নারীর পক্ষেই সেগুলো সহ্য করা সম্ভব’। নারীর নিজেকে নিজের কাছে যেমন মনে হয়, এটা তেমন সদর্থকভাবে গণ্য করা থেকে বেরিয়ে আসে নি, এসেছে নঞর্থকভাবে, তবে একথা সত্য যে নারীকে সব সময় সংজ্ঞায়িত করা হয় অপররূপে। আগেই বলেছি অপর হচ্ছে অশুভ; তবে তা শুভর জন্যে আবশ্যক হয়ে হয়ে ওঠে শুভ। নারী কোনো স্থির ধারণা রূপায়িত করে না, এখানেই রয়েছে তার। কারণটি; তার মাধ্যমে নিরন্তর যাতায়াত চলে আশা থেকে নিরাশায়, ঘৃণা থেকে প্রেমে, শুভ থেকে অশুভে, অশুভ থেকে শুভে। যে-বৈশিষ্ট্যেই নারীকে বিবেচনা করি না কেননা, পরস্পরবিপরীত এ-মূল্যই প্রথম ঘা দেয় আমাদের মনে।
পুরুষ নারীর মধ্যে অপরকে খোঁজে প্রকৃতিরূপে এবং তার সহচর সত্তারূপে। তবে আমরা জানি পুরুষের মধ্যে প্রকৃতি জাগিয়ে তোলে কোন পরস্পরবিপরীত মূল্যসম্পন্ন অনুভূতিরাশি। পুরুষ নারীকে শোষণ করে, নারী পুরুষকে চুরমার করে, পুরুষ নারী থেকে জন্ম নেয় এবং নারীর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে; নারী তার সত্তার উৎস এবং সে-এলাকা, যা সে নিজের ইচ্ছের অধীন করে; প্রকৃতি হচ্ছে অমার্জিত বস্তুর মিশ্রণ, যাতে বন্দী হয়ে আছে আত্মা, আর নারী হচ্ছে পরম বাস্তবতা; নারী আকস্মিকতা ও ভাব, সসীম ও সম্পূর্ণ; সে আত্মার বিপরীত, এবং আত্মা নিজে। এখন মিত্র, পরক্ষণেই শত্রু, সে প্রতিভাত হয় সে-অন্ধকার বিশৃঙ্খলারূপে যেখান থেকে জীবন উৎসারিত হয়, প্রতিভাত হয় এ-জীবনরূপে, এবং ওই সুদূররূপে, যার দিকে ঝুঁকে আছে জীবন। জননী, স্ত্রী, ও ভাবরূপে নারী প্রকাশ করে প্রকৃতির সার; এরূপগুলো কখনোমিলেমিশে যায় এবং কখন্যে সংঘর্ষে আসে, এবং এদের প্রত্যেকে ধারণ করে দ্বৈত মুখাবয়ব।
পুরুষের শেকড় প্রকৃতির ভেতর গভীরভাবে ছড়ানো; তার জনন ঘটেছে পশু ও উদ্ভিদের মতো; সে ভালোভাবেই জান্র সে ততোদিনই অস্তিত্বশীল, যতোদিন সে বেঁচে আছে। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার আগমনের পর থেকে তার চোখে জীবন গ্রহণ করেছে দুটি বৈশিষ্ট্য : জীবন হচ্ছে চেতনা, ইচ্ছা, সীমাতিক্ৰমণতা, এটি চৈতন্য; এবং জীবন হচ্ছে বস্তু, অক্রিয়তা, সীমাবদ্ধতা, এটি মাংস। এস্কিলুস, আরিস্ততল, হিপোক্রেতিস ঘোষণা করেছিলেন অলিম্পাসে যেমন পৃথিবীতেও তেমনি পুরুষ-নীতিই সত্যিকারভাবে সৃষ্টিশীল : এর থেকে এসেছে গঠন, সংখ্যা, গতি; দিমিতারের প্রযত্নে শস্য জন্মে ও সংখ্যায় বাড়ে, কিন্তু শস্যের উদ্ভব ও সত্যিকার অস্তিত্বের মূলে আছে জিউস; নারীর উর্বরতাকে গণ্য করা হয় শুধু এক অক্রিয় গুণ হিশেবে। নারী হচ্ছে মাটি, আর পুরুষ বীজ; নারী জল এবং পুরুষ অগ্নি। সৃষ্টিকে অনেক সময় কল্পনা করা হয়েছে অগ্নি ও জলের বিবাহরূপে; উষ্ণতা ও আর্দ্রতা জন্ম দেয় জীবন্ত বস্তুদের; সূর্য হচ্ছে সমুদ্রের স্বামী; সূর্য, অগ্নি হচ্ছে পুরুষ দেবতা; এবং সমুদ্র মাতৃপ্রতীকগুলোর মধ্যে প্রায়-সর্বজনীন প্রতীকগুলোর একটি। জল অক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে জ্বলন্ত বিকিরণের উর্বরায়ণ ক্রিয়া। একইভাবে তৃণভূমির মাটি চাষীর শ্রমে বিচূর্ণ হয়ে তার হলরেখায় অক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে বীজ। তবে এটা পালন করে এক দরকারি ভূমিকা : এটা বাঁচিয়ে রাখে জীবন্ত জীবাণুটিকে, একে রক্ষা করে এবং এর বিকাশের জন্যে সরবরাহ করে বস্তু। এবং এ-কারণেই মহামাতার সিংহাসনচ্যুতির পরও পুরুষ পুজো করে এসেছে উর্বরতার দেবীর; পুরুষ তার শস্য, পশুপাল, ও তার সমস্ত সমৃদ্ধির জন্যে ঋণী সিবিলের কাছে। এমনকি সে তার জীবনের জন্যেও ঋণী তার কাছে। সে অগ্নির যতোটা স্তব করে, জলের স্তবও তারচেয়ে কম করে না। ‘সমস্ত প্রশংসা সমুদ্রের! সমস্ত প্রশংসা পবিত্র অগ্নিতে পরিবৃত তার তরঙ্গরাশির! সমস্ত প্রশংসা তরঙ্গরাশির! সমস্ত প্রশংসা অগ্নির! সমস্ত প্রশংসা এ-অদ্ভুত অভিযাত্রার,’ ফাউস্ট-এর দ্বিতীয় ভাগে এভাবে চিৎকার করেছেন গ্যেটে। পুরুষ পুজো করে মাটির : যেমন ব্লেক মাটিকে বলেছেন ‘মাতৃকা কর্দম’। ভারতবর্ষের এক ধর্মপ্রবর্তক তার ভক্তদের মাটিতে কোদাল না চালানোর উপদেশ দিয়েছেন, কেননা ‘চাষ করতে গিয়ে আমাদের সকলের জননীকে বিক্ষত করা বা কাটা বা ছিন্ন করা পাপ… আমি কি একটা ছোরা ঢুকিয়ে দেবো আমার জননীর বুকে?… আমি কি তাঁর মাংস টুকরো টুকরো করে ঢুকবো তাঁর অস্থিতে?… আমার কী সাহস যে আমি কাটবো আমার মাতার কেশ?’ মধ্যভারতে ‘মাতা বসুমতীর বুক লাঙল দিয়ে ছিন্নভিন্ন করাকে’ পাপ বলে গণ্য করেন বৈদ্য। উল্টোভাবে, ইদিপাস সম্পর্কে এস্কিলুস বলেছেন সে ‘বীজ বপন করেছিলো সেই পবিত্র হলরেখায়, যেখানে সে গঠিত হয়েছিলো’। সফোক্লিজ বলেছেন ‘পৈতৃক হলরেখা’র কথা এবং ‘সেই কৃষক, দূরের জমির যে প্রভু, যেন সে যায় মাত্র একবার, বীজ বপনের সময়’, তার কথা। একটি মিশরি গানে দয়িতা ঘোষণা করে : ‘আমিই মৃত্তিকা!’ ইসলামি ধর্মীয় রচনায় নারীকে বলা হয় ‘জমি… দ্রাক্ষাক্ষেত্র’। আসিসির সেইন্ট ফ্রান্সিস একটি স্তোত্রে বলেছেন তার কথা, যে ‘আমাদের ভগিনী, মাটি, আমাদের জননী, লালন করছে আমাদের, ফলাচ্ছে সব ধরনের ফল, ফোটাচ্ছে নানান রঙের ফুল ও জন্মাচ্ছে ঘাস’। মিশেলে আঁকুইয়ে কর্দমস্নানের পর, বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন : ‘সকলের প্রিয় জননী! আমরা এক। তোমার থেকে এসেছিলাম আমি, তোমার কাছে আমি ফিরে আসছি ..’ এবং এমনই ঘটে সে-সব পর্বে, যখন দেখা দেয় প্রাণবাদী রোম্যান্টিসিজযম যার কাম্য আত্মার ওপর জীবনের জয়; তখন ভূমির, নারীর ঐন্দ্রজালিক উর্বরতাকে বেশি বিস্ময়কর মনে হয় পুরুষের আবিষ্কৃত কৌশলগুলোর থেকে, তখন পুরুষ মাতৃছায়ায় নিজেকে নতুনভাবে হারিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখে, যাতে সেখানে আবার সে পেতে পারে তার সত্তার সত্যিকার উৎস। মা হচ্ছে মহাবিশ্বের অতলে লুপ্ত সে-শেকড়, যে টানতে পারে এর রস; সে হচ্ছে সেই ফোয়ারা যেখান থেকে ঝরে জীবন্ত জল, সেই জল যা পুষ্টিকর দুগ্ধও, এক উষ্ণ ঝরনাধারা, সঞ্জীবনী গুণাবলিতে সমৃদ্ধ মৃত্তিকা ও জলে তৈরি কর্দম।
তবে অধিকাংশ সময় পুরুষ লিপ্ত থাকে তার দৈহিক অবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহে; সে নিজেকে দেখে এক স্বর্গভ্রষ্ট দেবতা হিশেবে; তার অভিশাপ হচ্ছে এক দীপ্ত ও সুশৃঙ্খল স্বর্গ থেকে তার পতন ঘটেছে মাতৃগর্ভের বিশৃঙ্খল আঁধারে। এই অগ্নি, এই শুদ্ধ ও সক্রিয় নিঃসারণ, যার মধ্যে পুরুষ নিজেকে দেখতে পছন্দ করে, নারীর দ্বারা তা বন্দী হয়ে আছে মৃত্তিকার কর্দমে। বিশুদ্ধ ভাবের মতো, এক-এর মতো, সর্বশ্বের মততা, ধ্রুব আত্মার মতো অবধারিত হওয়ার কথা ছিলো তার; এবং সে দেখতে পায় সে বন্দী হয়ে আছে সীমিত ক্ষমতার একটি দেহের ভেতরে, এমন স্থানে ও কালে যা সে কখনো বেছে নেয় নি, যেখানে সে অনাহুত, অপ্রয়োজনীয়, দুর্বহ, উদ্ভট। তার পরিত্যক্তির মধ্যে, তার অপ্রতিপাদ্য অনাবশ্যকতার মধ্যে তাকেই ভোগ করা হয় সমগ্র শরীরের অনিশ্চয়তা। নারীও তাকে দণ্ডিত করে মৃত্যুতে। এই কম্পমান জেলি যা বিকশিত হয় জরায়ুতে (জরায়, সমাধির মতো সংগোপন ও রুদ্ধ) অতি স্পষ্টভাবে তার স্মৃতিতে জাগিয়ে তোলে পূতিমাংসের কোমল গাঢ় তরলতা, কিন্তু ঘৃণায় তার থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া যাবে না। যেখানেই জীবন প্রস্তুত হতে থাকে-বীজায়ন, গাজন–সেখানেই এটা জাগিয়ে তোলে ঘৃণাবোধ, কেননা ধ্বংসের ভেতর দিয়েই তৈরি হয় এটি; পিচ্ছিল ভ্রূণ শুরু করে সে-চক্র, যা সম্পূর্ণতা লাভ করে মৃত্যুর পচনের ভেতর দিয়ে। যেহেতু সে অনাবশ্যকতা ও মৃত্যুতে বিভীষিকা বোধ করে, তাই পুরুষ জন্মলাভের মধ্যেও বোধ করে বিভীষিকা; সে সানন্দে অস্বীকার করতে চায় তার পাশবিক বন্ধনরাশি; তার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে ঘাতক প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে তাকে।
আদিম জনগণের মধ্যে শিশুর জন্মকে ঘিরে থাকে চরম কঠোর ট্যাবু; বিশেষ করে গর্ভফুলটি পোড়াতে হয় যত্নের সাথে বা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয় সমুদ্রে, কেননা যার হাতেই এটা পড়বে নবজাতকের ভাগ্য থাকবে তারই হাতে। সে-ঝিল্লিময় বস্তুরাশি, যার সাহায্যে বেড়ে ওঠে ভ্রূণটি, তাই হচ্ছে এর পরনির্ভরশীলতার চিহ্ন; যখন এটি ধ্বংস করা হয়, তখন ব্যক্তিটি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আনতে সমর্থ হয় জীবন্ত ম্যাগমা থেকে এবং হয়ে ওঠে স্বায়ত্তশাসিত সত্তা। জন্মের অশুচিতা চাপিয়ে দেয়া হয় মায়ের ওপর। লেভিটিকাস ও সমস্ত প্রাচীন বিধি শুচিতার সমস্ত কৃত্য চাপিয়ে দেয়া তার ওপর, যে জন্ম দিয়েছে; এবং অনেক পল্লী অঞ্চলে গির্জানুষ্ঠানে (শিশুজন্মের পর আশীর্বাদ) এখনো চলছে এ-প্রথা। আমরা জানি যে গর্ভিণীর পেট দেখে স্বতস্ফূর্তভাবে বিব্ৰত বোধ করে শিশুরা, বালিকারা, ও পুরুষেরা, অধিকাংশ সময় প্রকাশ পায়কৌতুকের হাসিতে। সমাজ এর প্রতি যতোই যুক্তি দেখাক না কেনো গর্ভধারণের ব্যাপারটি আজো জাগিয়ে তোলে স্বতর্ফূর্ত ঘেন্নার বোধ। আর ছোটো বালক যদিও শৈশবে ইন্দ্রিয়সুখে জড়িত থাকে মায়ের মাংসের সাথে, কিন্তু যখন সে বড়ো হয়, সামাজিকীকরণ হয় তার, এবং বোধ করে অস্তিত্বের স্বাতন্ত্র, তখন ওই একই মাংস সন্ত্রস্ত করে তাকে; সে এটা অস্বীকার করে এবং মায়ের মধ্যে সে দেখে শুধু এক নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে। সে যে মাকে শুদ্ধ ও সতী বলে বিশ্বাস করার জন্যে উদ্বিগ্ন থাকে, তা যতোটা যৌন ঈর্ষার কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি এ-কারণে যে সে মাকে একটি শরীর হিশেবে দেখতে রাজি নয়। যৌবনে সদ্য পা দেয়া কিশোর বিব্রত বোধ করে, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে যদি সঙ্গীদের সাথে থাকার সময় সে হঠাৎ মুখোমুখি হয় মায়ের, বোনদের, বা কোনো আত্মীয়ার : এর কারণ তাদের উপস্থিতি তাকে মনে করিয়ে দেয় সে-সীমাবদ্ধতার কথা, যার থেকে সে পালিয়ে যেতে চায়, এটা মেলে ধরে সে-শেকড়, যার থেকে সে ছিন্ন করতে চায় নিজেকে। মায়ের চুম্বনে আদরে বালকের বিরক্তিরও একই তাৎপর্য; সে অস্বীকার করে পরিবার, মা, মায়ের বুক। তার ভালো লাগতো পৃথিবীতে হঠাৎ বিকশিত হতে পারলে, অ্যাথেনার মতোপরিপূর্ণগঠিত, সশস্ত্র, অপরাজেয়। মায়ের পেটে বিকশিত হওয়া ও তারপর শিশুরূপে জন্ম নেয়া হচ্ছে সে-অভিশাপ, যা ঝুলে আছে তার নিয়তির ওপর, সে-অশুচিতা, যা দূষিত করে তার সত্তাকে। এবং এটা তার মৃত্যুরও ঘোষণা। বীজায়ন তন্ত্রের সাথে সব সময়ই জড়িত হয়ে আছে মৃত্যুর তন্ত্র। মাতা বসুমতী গ্রাস করে তার সন্তানদের অস্থিপুঞ্জ। যারা বয়ন করে মানবজাতির নিয়তি–পারকেয়ে, মোইরাই–তারা নারী; আবার তারাই ছিড়ে ফেলে সুতো। অধিকাংশ জনপ্রিয় উপস্থাপনে মৃত্যু এক নারী, এবং মৃতের জন্যে বিলাপ নারীর কাজ, কেননা মৃত্যু তাদেরই কর্ম।
তাই নারী-মাতার মুখমণ্ডল ছায়াচ্ছন্ন : সে হচ্ছে সে-বিশৃঙ্খলা, যেখান থেকে সবাই এসেছে এবং একদিন যেখানে সবাইকে ফিরতে হবে; সে হচ্ছে শূন্যতা। রাত্রিতে বিশ্বের বহু রকমের বৈশিষ্ট্য বিভ্রান্তিজাগানো অবস্থায় থাকে, যা উদ্ভাসিত হয় দিনের আলোতে। সমুদ্রের গভীর তলদেশে আছে রাত্রি : নারী মারে তেনেব্রারুম, অন্ধকার সাগর, যাকে ভয় করেছে পুরোনো দিনের নাবিকেরা; পৃথিবীর অন্ত্রে আছে রাত্রি। পুরুষ এ-রাত্রি, যা উর্বরতার বিপরীত, যা তাকে গিলে খেতে চায়, তার ভয়ে ভীত। তার অভিকাঙ্খা হচ্ছে আকাশ, আলোক, রৌদ্রদীপ্ত শিখর, নীলাকাশের বিশুদ্ধ ও স্ফটিক কামশীতলতা; এবং তার পায়ের নিচে আছে এক আর্দ্র, উষ্ণ, ও আঁধারাচ্ছন্ন উপসাগর, যা প্রস্তুত হয়ে আছে তাকে তলদেশে টানার জন্যে; অজস্র উপকথায় আমরা দেখতে পাই নায়ক লুপ্ত হয়ে গেছে মাতৃধর্মী ছায়ায়–গুহায়, রসাতলে, নরকে।
আবার এখানে সে-পরস্পরবিপরীত মূল্যের খেলা : যদি বীজায়ন সব সময় জড়িত মৃত্যুর সাথে, তাহলে মৃত্যুও জড়িত উর্বরতার সাথে। ঘৃণ্য মৃত্যু দেখা দেয় নবজন্ম রূপে, এবং হয়ে ওঠে আশীর্বাদপ্রাপ্ত। মৃত নায়ক, ওসিরিসের মতো, পুনর্জীবিত হয় প্রত্যেক বসন্তে, এবং তাকে পুনর্সৃষ্টি করা হয় একটি নবজন্মের মাধ্যমে। মানুষের উচ্চতম স্বপ্ন, মেটামোরফোসেস অফ দি লিবিডোতে ইয়ুং বলেছেন, ‘হচ্ছে মৃত্যুর অন্ধকার জলরাশি হয়ে উঠুক জীবনের জলরাশি, মৃত্যু ও তার শীতল আলিঙ্গন হোক মায়ের বক্ষ, যা সমুদ্রের মতো সূর্যকে প্লাবিত করেও আবার তাকে জন্ম দেয় নিজের গভীরে’। অসংখ্য পুরাণে পাওয়া যায়একটি সাধারণ বিষয়, সেটি হচ্ছে সমুদ্রের বুকে সূর্যদেবতার সমাহিতি এবং তার প্রোজ্জ্বল পুনরাবির্ভাব। এবং পুরুষ একই সঙ্গে বেঁচে থাকতে চায়, তবে কামনা করে বিশ্রাম ও নিদ্রা ও শূন্যতা। সে অমর হবে এটা সে চায় না, এবং তাই সে মৃত্যুকে ভালোবাসতে শেখে।
সব সভ্যতায় এবং আজো আমাদের কালে পুরুষের বুকে নারী জাগিয়ে তোলে বিভীষিকা; এটা হচ্ছে তার নিজের দৈহিক অনিশ্চিত সম্ভাবনার বিভীষিকা, যা সে প্রক্ষেপ করে নারীর ওপর। ছোটো বালিকা, যে এখনো বয়ঃসন্ধিতে পৌছে নি, কোনো ভীতি প্রদর্শন করে না, তার ওপর কোনো ট্যাবু নেই এবং তার কোনো পবিত্র বৈশিষ্ট্য নেই। অনেক আদিম সমাজে তার লিঙ্গকে মনে করা হয় নিষ্পাপ : শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের অনুমতি দেয়া হয় কামক্রীড়ার। কিন্তু যেদিন নারী ঋতুমতী হয়, সে হয়ে ওঠে অশুচি; এবং ঋতুমতী নারীকে ঘিরে থাকে কঠোর সব ট্যাবু। লেভিটিকাস দিয়েছে এর বিস্তৃত বিধিবিধান, এবং অনেক আদিম সমাজে বিচ্ছিন্নতা ও শুচিতা বিষয়ে আছে একই রকম বিধিবিধান। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ঋতুস্রাবের সঙ্গে জড়িত শক্তিগুলোতে বিদ্যমান ছিলো পরস্পরবিপরীত মূল্য : ঋতুস্রাব বিপর্যস্ত করতে পারতোসামাজিক কর্মকাণ্ড এবং নষ্ট করতে শস্য; তবে এটা প্রণয়োপচার ও ঔষধ তৈরিতেও ব্যবহৃত হতো। এমনকি আজো কোনো কোনো ভারতি গোষ্ঠিতে নদীর দানবদের সাথে সংগ্রামের জন্যে নৌকোর সম্মুখ গলুইয়ে রাখা হয় ঋতুস্রাবে ভেজানো একদলা তন্তু। তবে পিতৃতান্ত্রিক কাল থেকে নারীর ঋতুস্রাবকে জড়ানো হয়েছে শুধু অশুভ শক্তির সাথে। প্লাইনি লিখেছেন যে ঋতুমতী নারী ফসল নষ্ট করে, বাগান ধ্বংস করে, মৌমাছি মেরে ফেলে ইত্যাদি; এবং সে যদি মদ স্পর্শ করে, সেটা ভিনেগারে পরিণত হয়; দুধ পচে যায় ইত্যাদি। এক প্রাচীন ইংরেজ কবি এ-ধারণাকেই ছন্দে বেঁধেছিলেন :
হায়! ঋতুমতী নারী, এক শয়তান তুমি
যার থেকে আড়ালে রাখতে হবে সমগ্র প্রকৃতিভূমি!
এসব বিশ্বাস আজো টিকে আছে বেশ শক্তিশালীরূপেই। ১৮৭৮-এ ব্রিটিশ মেডিক্যল জর্নাল-এ ঘোষণা করা হয়েছিলো ‘এটা নিঃসন্দেহ যে ঋতুমতী নারীর ছোঁয়ায় মাংস পচে’, এবং নানা ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছিলো ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে। এ-শতকের শুরুতে একটি বিধানে উত্তর ফ্রান্সের শোধনাগারগুলোতে ‘অভিশাপ’গ্রস্ত নারীদের ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো, কেননা তাতে চিনি কালো হয়ে যায়। এসব ধারণা আজো গ্রামাঞ্চলে টিকে আছে, যেখানে প্রতিটি পাচক জানে যদি ধারে-কাছে কোনো ঋতুমতী নারী থাকে, তাহলে মেইয়ানেইজ ঠিক হবে না; অনেক গ্রাম্যলোক মনে করে সাইডার গাজিয়ে উঠবে না, অনেকে মনে করে শুয়োরমাংস নোনা করা যাবে না এবং এমন পরিস্থিতিতে তা নষ্ট হয়ে যাবে। হয়তো কিছু অস্পষ্ট বিবরণ আছে এসব বিশ্বাসের পেছনে; তবে এগুলোর গুরুত্ত্ব ও সর্বজনীনতা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এগুলো উদ্ভূত হয়েছে কেবল কুসংস্কার বা অতীন্দ্রিয় বিশ্বাস থেকে। রক্ত পবিত্র, তাই এখানে সাধারণভাবে রক্তের প্রতি প্রতিক্রিয়ার থেকে বেশি কিছু আছে। তবে ঋতুস্রাব বিশেষ অদ্ভুত জিনিশ, এটা নির্দেশ করে নারীর সারসত্তা। তাই এটা ক্ষতি করতে পারে নারীরই যদি অন্য কেউ এর অপব্যবহার করে। সি লেভি-স্ট্রাউসের মতে শাগোদের মধ্যে মেয়েদের সাবধান করে দেয়া হয় যাতে কেউ ঋতুস্রাবের কোনো চিহ্নও দেখতে না পায়; বিপদ এড়ানোর জন্যে পোশাক ইত্যাদি অবশ্যই মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। লেভিটিকাস ঋতুস্রাবকে অভিন্ন করে দেখেছে গনোরিয়ার সাথে, এবং ভিগনি এ-অসুস্থতার সাথে জড়িত দেখেছেন অশুচিতা, যখন তিনি লিখেছেন : ‘নারী, অসুস্থ শিশু এবং বারো গুণ অশুচি’।
নারীর রক্তক্ষরণের চক্রটি সময়ের দিক দিয়ে বিস্ময়করভাবে সঙ্গতিপূর্ণ চাঁদের চক্রের সাথে; এবং এও মনে করা হয় যে চাঁদেরও আছে ভয়ঙ্কর সব চপলতা। নারী সে-ভীতিপ্রদ কৌশলের অংশ, যা গ্রহগুলোকে ও সূর্যকে চালায় তাদের পরিক্রমার পথে, নারী শিকার সে-মহাজাগতিক শক্তিরাশির, যা নিয়ন্ত্রণ করে নক্ষত্ররাশির নিয়তি ও জোয়ারভাটা, এবং পুরুষ ভোগে যার পীড়াদায়ক বিকিরণে। তবে মনে করা হয় যে ঋতুস্রাব বিশেষভাবে ক্রিয়া করে সে-জৈব বস্তুদের ওপর, যা আছে পদার্থ ও জীবনের মাঝামাঝি পথে : মাখন টকায়, মাংস নষ্ট করে, গাজায়, পচায়; এবং এটা রক্ত বলে নয়, বরং এজন্যে যে এটা উৎসারিত হয় যৌনপ্রত্যঙ্গ থেকে। এর যথাযথ কাজ বুঝতে পেরেও মানুষ বুঝেছে এটা জড়িত জীবন সৃষ্টির সাথে : ডিম্বাশয় সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলো প্রাচীন মানুষ, তারা ঋতুস্রাবে এমনকি দেখতে পেয়েছে শুক্রাণুর পরিপূরক। তবে এ-রক্ত নারীকে অশুচি করে না; এটা নারীর অশুচিতার চিহ্ন। এটা জড়িত প্রজননের সাথে, যেখানে ভ্রূণ বিকশিত হয়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এ-রক্ত। নারীর উর্বরতা বহু পুরুষের মনে জাগায় যে-ভয়, তা প্রকাশ পায় ঋতুস্রাবের মাধ্যমে।
অতিশয় কঠোর ট্যাবুগুলোর একটি নিষিদ্ধ করে ঋতুমতী অশুচি নারীর সাথে সব ধরনের যৌনসম্পর্ক। অনেক সমাজে এ-নিষেধভঙ্গকারীদেরই বিশেষ সময়ের জন্যে গণ্য করা হয়েছে অশুচি বলে, বা তাদের বাধ্য করা হয়েছে কঠোর প্রায়শ্চিত্ত করতে; মনে করা হতো যে পুরুষের শক্তি ও প্রাণবন্ততা ধ্বংস হয়ে যাবে, কেননা এ-সময়ে নারী-নীতি থাকে তার চূড়ান্ত ক্ষমতায়। আরো অস্পষ্টভাবে, তার অধিকারে যে-নারী তার মধ্যে মায়ের ভীতিকর সারসত্তার মুখোমুখি হতে ঘেন্না বোধ করে পুরুষ; সে নারীত্বের এ-দু-বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লিষ্ট করার জন্যে বদ্ধপরিকর। তাই অজাচার নিষিদ্ধ। করে বিধিবদ্ধ হয়েছে সর্বজনীন আইন, যার প্রকাশ ঘটেছে গোত্রের বহির্ভূত বিয়ের বিধানে বা আরো আধুনিক নানা রূপে; এজন্যেই পুরুষ নারীর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায় যখন নারী বিশেষভাবে থাকে তার প্রজননগত ভূমিকায় : তার ঋতুস্রাবের সময়, তার গর্ভের সময়, তার স্তন্যদানের সময়। ইদিপাস গূঢ়ৈষা, যাকে নতুনভাবে বর্ণনা করা দরকার, এ-প্রবণতাকে অস্বীকার করে না, বরং এটাই জ্ঞাপন করে। নারী যতোখানি প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বের অস্পষ্ট উৎসের ও অবোধ্য জৈববিকাশের, পুরুষ নারীর বিরুদ্ধে ততোখানি থাকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে।
মহাবিশ্ব ও দেবতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও আজো নারী এ-বেশেই তার গোষ্ঠিকে সামর্থ্য দেয় তাদের সাথে যোগাযোগ রাখার। নারী আজো বেদুইন ও ইরোকুইদের মধ্যে নিশ্চয়তা দেয় জমির উর্বরতার; প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে নারী শুনতে পেতো পাতালের স্বর; সে বুঝতে পারতো বায়ু ও বৃক্ষের ভাষা; সে ছিলো পাইথিয়া, সিবিলে, দৈবজ্ঞা; মৃতরা ও দেবতারা কথা বলতো তার মুখ দিয়ে। সে আজো ধারণ করেভবিষ্যৎবক্তার ক্ষমতা : সে মাধ্যম, হস্তরেখা ও তাস পাঠক, অলোকদ্রষ্টা, অনুপ্রাণিত; সে স্বর শুনতে পায়, দেখতে পায় প্রেতচ্ছায়া। যখন পুরুষ আবার দরকার বোধ করে উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনের ভেতরে মগ্ন হওয়ার যেমন অ্যান্টিউস তার শক্তি নবায়নের জন্যে স্পর্শ করেছিলো মাটি–তারা আবেদন জানায় নারীর কাছে। গ্রিস ও রোমের যুক্তিপরায়ণ সমগ্র সভ্যতা ভরে অস্তিত্বশীল ছিলো গূহ্যধর্ম তন্ত্রগুলো। ওগুলোছিলো সরকারিভাবে স্বীকৃত ধর্মগুলোর থেকে প্রান্তিক অবস্থানে; ওগুলো অবশেষে, যেমন এলুসিসে, রূপ নেয় রহস্যের। পুরুষদের দ্বারা পুনরায় বিজিত এক বিশ্বে দেখা দেয় এক পুরুষ দেবতা, দিউনিসুস, যে দখল করে নেয় ইশতারের, আস্তারতের বন্য ও ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা; তবু তার মূর্তি ঘিরে উন্মত্ত আনন্দোৎসবে যারা মেতে উঠতো, তারা ছিলো নারী : মিনাদ, থাইয়াদ, বাকুসানুসারীরা মানুষদের আমন্ত্রণ জানাতো পবিত্র পানোন্মত্ততায়, পবিত্র উন্মত্ততায়। ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি পালন করতো একই ভূমিকা : এটা ছিলো উর্বরতার শক্তিগুলোকে একযোগে বন্ধনমুক্ত ও প্রবাহিত করে দেয়া। লৌকিক উৎসবগুলোতে আজো দেখা যায়কামের তীব্র বহিঃপ্রকাশ; এতে নারী শুধু প্রমোদের বস্তু হিশেবে উপস্থিত থাকে না, বরং থাকে হাইব্রিস, বন্যতার অবস্থা অর্জনের উপায়রূপে, যাতে ব্যক্তি অতিক্রম করে যায় তার নিজের সীমা। ‘সেই লুপ্ত, বিয়োগান্তক, “অন্ধকারী বিস্ময়”-এর কী ধারণ করে একটি মানুষ তার গভীর ভেতরে, তা শয্যা ছাড়া আবার কোথাও পাওয়া যাবে না,’ লিখেছেন জি বাতাইল।
কামে পুরুষ আলিঙ্গন করে প্রিয়াকে এবং নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায় মাংসের অপার রহস্যে। তবে আমরা দেখেছি যে, উল্টোভাবে, তার স্বাভাবিক কাম মাতাকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় স্ত্রী থেকে। সে জীবনের রহস্যময় রসায়নের প্রতি বোধ করে ঘৃণা, যদিও তার নিজের জীবনই লালিত ও প্রফুল্ল হয় মৃত্তিকার সুস্বাদু ফলে; সে এগুলো অধিকার করে নিতে চায় নিজের জন্যে; সে প্রবলভাবে কামনা করে সদ্য ঢেউ থেকে উঠে আসা ভেনাসকে। নারীকে স্ত্রী হিশেবে প্রথম প্রকাশ করা হয়েছিলো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, যেহেতু পরম সৃষ্টিকর্তাই পুরুষ। মানবজাতির মাতা হওয়ার আগে হাওয়া ছিলো আদমের সঙ্গিনী; তাকে দান করা হয়েছিলো পুরুষের কাছে, যাতে পুরুষ তাকে অধিকার ও উর্বর করতে পারে, যেমন সে অধিকার ও উর্বর করে ভূমি; এবং তার মাধ্যমে পুরুষ সমগ্র প্রকৃতিকে করে তোলে নিজের রাজ্য। পুরুষ যৌন ক্রিয়ায় শুধু ব্যক্তিগত ও ক্ষিপ্র আনন্দ খোঁজে না। সে চায় জয় করতে, দখল করতে, অধিকার করতে; একটি নারী পাওয়া হচ্ছে তাকে জয় করা; লাঙলের ফাল যেমন বিদ্ধ করে হলরেখাকে তেমনি সে বিদ্ধ করে নারীকে; নারীকে সে নিজের করে নেয় যেমন সে নিজের করে নেয় নিজের কর্ষিত জমি; সে চাষ করে, রোপণ করে, বপন করে : এসব চিত্রকল্প সাহিত্যের মতোই প্রাচীন; প্রাচীন কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত উদ্ধৃত করা যায় সহস্র উদাহরণ : ‘নারী ক্ষেত্রের মতো, এবং পুরুষ বীজের মতো,’ বলেছে মনুর বিধান। আঁদ্রে মাসোর একটি রেখাচিত্রে আছে কোদাল হাতে একটি পুরুষ, সে কোদাল দিয়ে কোপাচ্ছে একটি নারীর যোনিদ্বারের উদ্যান। নারী তার স্বামীর শিকার, তার বিষয়সম্পত্তি।
ভয় ও কামনার মাঝে, নিয়ন্ত্রণক অসম্ভব শক্তিরাশিকে অধিকারে রাখার ভয় ও সেগুলোকে জয় করার বাসনার মধ্যে পুরুষের দ্বিধা চমকপ্রদভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কুমারীপুরাণে। পুরুষ একে এই ভয়পাচ্ছে, আবার এই কামনা করছে বা এমনকি দাবি করছে, কুমারী তাই নারীরহস্যের নিখুঁততম পূর্ণাঙ্গ রূপের প্রতীক; তাই সে এর সবচেয়ে পীড়াদায়ক এবং একই সময়ে সবচেয়ে সুখদ রূপ। তাকে ঘিরে ফেলেছে যে-শক্তিরাশি, পুরুষ সেগুলো দিয়ে অভিভূত হচ্ছে বলে বোধ করছে, না কি সে সগর্বে বিশ্বাস করছে সে এসব নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ, সে-অনুসারে সে তার স্ত্রীকে কুমারী রূপে পেতে অস্বীকার করে অথবা দাবি করে। আদিমতম সমাজে, যেখানে নারীর শক্তি অত্যন্ত বেশি, সেখানে ভয়ই নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষকে; তাই বিয়ের রাতের আগেই নারীটির কুমারীত্বমোচন করাই সঙ্গত। মার্কো পোলো তিব্বতিদের সম্বন্ধে বলেছেন ‘তাদের কেউই কুমারী মেয়ে বিয়ে করতে রাজি নয়’। এ-অস্বীকৃতিকে অনেক সময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে যুক্তিসঙ্গত রীতিতে : কোনো পুরুষ এমন স্ত্রী চায় না যে এরই মাঝে পুরুষের কামনা জাগায়নি। আরব ভূগোলবিদ আল বাকরি স্লাভদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন ‘যদি কোনো পুরুষ বিয়ের পর দেখতে পায় তার স্ত্রী কুমারী, তাহলে সে স্ত্রীকে বলে : “যদি তোমার কোনো রূপ থাকতো, তাহলে পুরুষেরা তোমার সাথে শৃঙ্গার করতো এবং কোনো একজন হরণ করতো তোমার কুমারীত্ব।” তারপর সে স্ত্রীকে বের করে দেয় ঘর থেকে এবং তাকে ত্যাগ করে’। এও দাবি করা হয়েছে যে কিছু আদিম জাতির পুরুষ শুধু সে-নারীকেই বিয়ে করতে চায় যে ইতিমধ্যেই মা হয়েছে, এভাবেই সে প্রমাণ দেয় নিজের উর্বরতার।
কিন্তু সতীত্বমোচনের পেছনের ব্যাপকভাবে প্রচলিত এসব প্রথার সত্যিকার প্রেষণাগুলো অতীন্দ্রিয়। কিছু জনগোষ্ঠি কল্পনা করে যে যোনির ভেতরে আছে সাপ, যেটি সতীচ্ছদ ছিন্ন করার সাথে সাথে দংশন করবে স্বামীকে; অনেক জাতি মনে করে কুমারীর রক্তে আছে ভীতিকর শক্তি, যা ঋতুস্রাবের সাথে সম্পর্কিত, তাই একইভাবে তা বিনাশ ঘটাতে পারে পুরুষের বলের। এসব চিত্রকল্পে প্রকাশিত হয় এ-ধারণাটি যে নারী-নীতি তখনই বেশি বলশালী, বেশি হুমকিদায়ক, যখন সেটি থাকে অক্ষত।
অনেক ক্ষেত্রে কুমারীত্বমোচনের প্রশ্নই ওঠে না; উদাহরণস্বরূপ, ম্যালিনোস্কির বর্ণিত ট্রোব্রিয়ান্ড দ্বীপবাসীদের মধ্যে, মেয়েরা কখনোই কুমারী নয়, কেননা শৈশব থেকেই সেখানে কামক্রীড়া অনুমোদিত। কোনো কোনো সংস্কৃতিতে মা, বড়ো বোন, বা কোনো মাতৃকা যথারীতি মোচন করে বালিকার সতীত্ব এবং তার শৈশব ভরে প্রসারিত করে চলে যোনিমুখ। আবার, বয়ঃসন্ধিকালে ছিন্ন করা যেতে পারে সতীচ্ছদ, সেখানে নারীটি ব্যবহার করতে পারে কাঠি, হাড়, বা পাথর, এবং একে মনে করতে পারে শল্যচিকিৎসা। অন্য কিছু গোত্রে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েকে বাধ্য করা হয় এক বর্বর দীক্ষায় : পুরুষেরা তাকে টেনেহেঁচড়েনিয়ে গ্রামের বাইরে এবং ধর্ষণ করে বা কোনো বস্তু দিয়ে তার চ্ছদ ছিন্ন করে। একটি সাধরণ প্রথা হচ্ছে অচেনা পথিকদের কাছে কুমারী দান–হয়তো তারা মনে কর যে ওই অচেনা পথিকেরা মানার বিরূপতার বাইরে, ওই মানা প্রযোজ্য শুধু তাদের গোত্রের পুরুষদের ক্ষেত্রে, বা হয়তো অচেনা পথিকদের বিপদের প্রতি তারা উদাসীন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোহিত, বা কবিরাজ, বা কাশিক বা গোত্রপতি সাধারণত বিয়ের আগের রাতে মোচন করে বধুর সতীত্ব। মালাবার উপকূলে এ-দায়িত্ব পালন করে ব্রাহ্মণেরা, যা তারা কোনো সুখভোগ ছাড়াই সম্পন্ন করে এবং এর জন্যে বেশ ভালো দক্ষিণা দাবি করে। এটা সুবিদিত যে সমস্ত পবিত্র বস্তুই সাধারণের জন্যে ভয়ঙ্কর, তবে পূতপবিত্র ব্যক্তিরা ঝুঁকি ছাড়াই এসব করতে পারে; তাই বোঝা যায় পুরোহিতেরা আর গোত্রপতিরা জয় করতে পারে সে-অমঙ্গলজনক শক্তিগুলো, যাদের ক্ষোভ থেকে রক্ষা করতে হবে স্বামীকে। রোমে এমন প্রথার লেশ হিশেবে টিকে ছিলো শুধু একটি প্রতীকী অনুষ্ঠান : একটি পাথুরে প্রিয়াপাসের লিঙ্গের ওপর বসানো হতো বধুকে, যেটি পূরণ করতো দুটি উদ্দেশ্য যে এটা বাড়াবে তার উর্বরতা এবং শোষণ করে নেবে। তার ভেতরের অতি শক্তিশালী এবং এ-কারণে অশুভ–তরল পদার্থ। স্বামী নিজেকে আরেক উপায়ে রক্ষা করতে পারে : সে নিজে সতীত্বমোচন করতে পারে কুমারীটির, তবে এটা ঘটতে হবে উৎসবের মধ্যে, যা সংকটের মুহূর্তে তাকে করে তোলে অবেধ্য; উদাহরণস্বরূপ, সমগ্র পল্লীবাসীর উপস্থিতিতে সে এ-কাজটি করতে পারে কোনো কাঠি বা হাড় দিয়ে। সামোয়ায়সে ব্যবহার করে শাদা কাপড়ে মুড়ে তার। আঙুল, যে-কাপড় ছিন্নভিন্ন করে বিতরণ করা হয় উপস্থিতদের মধ্যে। বা স্বামীকে অনুমতি দেয়া যেতে পারে স্বাভাবিক রীতিতে স্ত্রীর সতীত্বমোচনের, তবে যাতে প্রজননশীল জীবাণু সতীচ্ছদের রক্তে দূষিত না হয়, তাই সে তিন দিন স্ত্রীর ভেতরে বীর্যপাত করতে পারবে না।
এক ধরনের মূল্যবদলের ফলে কম আদিম সমাজে কুমারীর রক্ত হয়ে ওঠে শুভ প্রতীক। ফ্রান্সে এখনো আছে অনেক গ্রাম, যেখানে বিয়ের পর দিন ভোরে, আত্মীয়স্বজনদের সামনে প্রদর্শন করা হয়রক্তরঞ্জিত বিছানার চাদর। যা ঘটেছে, তা হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষ হয়ে উঠেছে তার নারীর প্রভু; এবং যে-শক্তিরাশি বন্যপশুতে বা অবিজিত বস্তুতে থাকলে হয়ে ওঠে ভীতিকর, সে-একই শক্তিরাশি সেই মালিকের কাছে হয়ে ওঠে মূল্যবান গুণাবলি, যে তাদের পোষ মানাতে পারে। বন্য ঘোড়ার অগ্নি থেকে, বজ্রপাত ও জলপ্রপাতের হিংস্রতা থেকে পুরুষ বের করেছে সম্পদশালী হওয়ার উপায়। এবং তাই সে নারীকে তার সমস্ত সম্পদসহ অক্ষতরূপে আনতে চায় নিজের মালিকানায়। সন্দেহ নেই মেয়েটির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যে-সতীত্ব, সেটা দাবি করতে বেশ ভূমিকা পালন করে যুক্তিপরায়ণ প্রেষণা : স্ত্রীর সতীত্বের মতোই বাগদত্তার নিস্পাপতা প্রয়োজনীয়, যাতে পিতা পরে এমন ঝুঁকিতে না পড়ে যে তার সম্পত্তি দিয়ে যেতে হয় অন্য কারো সন্তানকে। তবে যখন পুরুষ নিজের স্ত্রীকে গণ্য করে ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে, তখন কুমারীত্ব দাবি করা হয় আরো জরুরি কারণে। প্রথমে, মালিকানার ধারণাটিকে সব সময়ই সদর্থকরূপে বোধ করা অসম্ভব; সত্য হচ্ছে, কখনোই কারো থাকে না কোনো জিনিস বা ব্যক্তি; মানুষ মালিকানা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে নঞর্থকভাবে। কোনো কিছু আমার এটা সবচেয়ে নিশ্চিতভাবে জ্ঞাপন করার উপায় হচ্ছে অন্যদের সেটি ব্যবহার করতে না দেয়া। এবং যা কখনোই অন্য পুরুষের অধিকারে ছিলো না, তার থেকে বেশি কাম্য বস্তু পুরুষের কাছে আর কিছু হতে পারে না : তখন ওই বিজয়কে মনে হয় এক অনন্য ও ধ্রুব ঘটনা। অনাবাদী জমি সব সময়ই মুগ্ধ করেছে অভিযাত্রীদের; প্রত্যেক বছরই নিহত হয় পর্বতারোহীরা, কেননা তারা চায় অস্পৃষ্ট কোনো শিখরের হানি ঘটাতে বা এ-কারণে যে তারা চায় এক পাশে একটি নতুন পথ তৈরি করতে; এবং উৎসুক মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নামার চেষ্টা করে মাটির তলদেশের অজানা গুহায়। মানুষেরা যেবস্তু এরই মাঝে ব্যবহার করেছে, সেটি হয়ে উঠেছে একটি হাতিয়ার; প্রাকৃতিক বন্ধন থেকে ছিন্ন হয়ে সেটি হারিয়ে ফেলে তার গভীরতম গুণাবলি : গণফোয়ারার জলের থেকে প্রবল জলধারার অদম্য প্রবাহের মধ্যে আছে অনেক বেশি প্রতিশ্রুতি।
কুমারীর শরীরে আছে গোপন ঝরনাধারার সজীবতা, না-ফোটা ফুলের প্রভাতি আভা, মুক্তোর প্রাচ্য দ্যুতি, যার ওপর কখনো সূর্যের রশ্মি পড়ে নি। কৃত্রিম গুহা, মন্দির, পুণ্যস্থান, গোপন উদ্যান–শিশুর মতো পুরুষও মুগ্ধ হয় বেড়া দেয়া ও ছায়াচ্ছন্ন স্থান দিয়ে, যা কোনো চেতনার দ্বারা সজীব হয়ে ওঠে নি, যা অপেক্ষায় আছে যে তাকে দেয়া হবে একটি আত্মা : পুরুষ যা একা গ্রহণ এবং বিদ্ধ করবে, সত্যিকারভাবে মনে হয় তা যেনো সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। সব কামনার একটি লক্ষ্য হচ্ছে কাম্যবস্তুকে ব্যবহার করে নিঃশেষ করে ফেলা, যা বোঝায় তার ধ্বংস। যে বিদ্ধকরণের পর সতীচ্ছদ অক্ষত থাকে, তার থেকে সতীচ্ছদ ছিন্ন করে পুরুষ নারীদেহ অধিকার করে অনেক বেশি অন্তরঙ্গভাবে; সতীচ্ছদ ছিন্নকরণের উল্টোনোঅসম্ভব কাজটি সম্পন্ন করে পুরুষ দেহটিকে সুস্পষ্টভাবে পরিণত করে একটি অক্রিয় বস্তুতে, সে এটিকে করায়ত্ত করার ব্যাপারটিকে করে প্রতিষ্ঠিত। এভাবনাটি যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়েছে সে-নাইটের উপকথায়, যে বহু বাধা পেরিয়ে এগিয়েছে কাঁটাভরা ঝোপের ভেতর দিয়ে এমন একটি গোলাপ তোলার জন্যে, যার সুগন্ধ আজো অনাঘ্রাত; সে শুধু সেটি পায়ই নি, সে ডাটা ভেঙেছে, এবং এভাবেই সে সেটিকে করেছে নিজের। চিত্রকল্পটি এতো স্পষ্ট যে সাধারণ ভাষায় কোনো নারীর কাছে থেকে তার ফুল ছিড়েনেয়া বোঝায় তার কুমারীত্ব নষ্ট করা; এবং এপ্রকাশরীতি থেকেই উদ্ভূত হয়েছে ‘ডিফ্লোরেশন’ (সতীত্বমোচন) শব্দটি।
তবে সাথে যৌবন থাকলেই শুধু থাকে কুমারীত্বের যৌনাবেদন; নইলে তার রহস্য আবার হয়ে ওঠে পীড়াদায়ক। আজকের অনেক পুরুষ অতিশয় প্রলম্বিত কুমারীত্বের উপস্থিতিতে বোধ করে যৌন দৃণা; এবং শুধু মনস্তাত্ত্বিক কারণেই ‘আইবুড়ো’রা সংকীর্ণমনা ও তিক্ত নারীতে পরিণত হয় না। অভিশাপটি আছে তাদের মাংসের ভেতরেই, যে-মাংস কোনো কর্তার কর্ম নয়, যা কোনো পুরুষের কামনার কাছে হয়েওঠে নি কাম্য, পুরুষের পৃথিবীতে একটুকু জায়গা না পেয়ে যা ফুটে ঝরে গেছে; তার ঠিক গন্তব্য থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যা হয়ে উঠেছে এক অদ্ভুতত্ব, হয়ে উঠেছে উন্মাদের প্রকাশঅসম্ভব চিন্তার মতোপীড়াদায়ক। চল্লিশ বছর বয়স্ক এক নারী, যে তখনো রূপসী, কিন্তু সম্ভবত কুমারী, তার সম্পর্কে আমি একটি পুরুষকে স্থূলভাবে বলতে শুনেছি : ‘এটার ভেতরটা নিশ্চয়ই মাকড়সার জালে ভরা’। এটা সত্য, যে-সব ভূগর্ভস্থ ঘর ও চিলেকোঠায় কেউ ঢোকে না, যেগুলোর ব্যবহার নেই, সেগুলো ভরে ওঠে অশোভন রহস্যে; সেগুলোতে হয়তো প্রেতেরা ঘুরে বেড়ায়; ছাড়াবাড়ি হয়ে ওঠে ভুতপ্রেতের আবাসস্থল। যদি নারীর কুমারীত্ব কোনো দেবতার কাছে উৎসর্গিত না হয়, তাহলে লোকেরা সহজেই বিশ্বাসকরে যে তার এক রকম বিয়ে হয়েছে শয়তানের সাথে। পুরুষের দ্বারা পরাভূত হয় নি যে-নারী, বৃদ্ধা নারীরা যারা মুক্ত থেকেছে পুরুষের অধীনতা থেকে, তাদের অতি সহজেই মনে করা হয় যাদুকরিণী; কারণ নারীর ভাগ্যই হচ্ছে সে কারো দাসত্বে থাকবে, যদি সে পুরুষের জোয়াল থেকে মুক্তি পায়, তাহলে তাকে প্রস্তুত থাকতে হয়শয়তানের জোয়াল মেনে নিতে।
সতীত্বমোচন ব্রতের মধ্য দিয়ে অশুভ প্রেতের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বা তার কুমারীত্বের মধ্য দিয়ে শুদ্ধিলাভ করে, ঘটনা যাই হোক, নববধুকে মনে হয় এক অতিশয় কাম্য শিকার। তাকে আলিঙ্গন করে প্রেমিক লাভ করে জীবনের সমস্ত ঐশ্বর্য। সে পৃথিবীর সব প্রাণী, পৃথিবীর সব উদ্ভিদ; হরিণ ও হরিণী, পদ্ম ও গোলাপ, কোমল জাম, সুগন্ধি বেরি, সে মূল্যবান রত্ন, শুক্তিপুট, গন্ধর্বমণি, মুক্তো, রেশম, আকাশের নীল, ঝরনার সুস্নিগ্ধ জল, বায়ু, অগ্নিশিখা, ভূখণ্ড ও সমুদ্র। পুব ও পশ্চিমের কবিরা নারীর দেহকে রূপান্তরিত করেছেন পুষ্পে, ফলে, পাখিতে। এখানে আবার, প্রাচীন, মধ্য, এবং আধুনিক যুগের লেখা থেকে এতো উদ্ধৃতি দেয়া যায় যে তাতে একটি বিশাল সংকলন তৈরি হয়ে যাবে। কে না জানে পরমগীতের কথা? প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলছে :
কপোতের চোখের মতো তোমার চোখ…
তোমার কেশপাশ ছাগপালের মতো…
তোমার দন্তরাজি মেষপালের মতো ছাঁটা হয়েছে যাদের পশম…
তোমার গাল ডালিমের মতো…
তোমার স্তনযুগল দুটি হরিণশাবকের মতো…
তোমার জিভের নিচে আছে মধু ও দুধ…
রহস্যময় ১৭তে আঁদ্রে ব্রেতো আবার শুরু করেছেন শাশ্বত স্তুতিগীতি : ‘মেলুসিন দ্বিতীয় চিৎকারের সময় : সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছে তার তন্বী নিতম্ব থেকে, তার পেট আগস্টের সমস্ত গম, বাঁকানোকোমর থেকে আতশবাজির মতো জ্বলে ওঠে তার কবন্ধ, চাতকের দুটি ডানার মতো ছাঁচে ঢালা হয়েছে যাদের; তার স্তনযুগল আরমিনের মতো…’
পুরুষ নারীর মধ্যে আবার দেখতে পায় উজ্জ্বল নক্ষত্র ও স্বপ্নাতুর চাঁদ, সূর্যের আলো, কৃত্রিম গুহার ছায়ানিবিড়তা; এবং, বিপরীতভাবে, ঝোপঝাড়ের বন্যফুল, উদ্যানের গর্বিত গোলাপ হচ্ছে নারী। বনদেবীরা, বনপরীরা, সাইরেনরা, পরীরা বিচরণ করে মাঠে ও বনভূমিতে, হ্রদে, সাগরে, পতিত জমিতে। পুরুষের মনের গভীর তলে এ-সর্বপ্রাণবাদ ছাড়া আর কিছু নেই। নাবিকের কাছে সমুদ্র নারী, বিপজ্জনক, বিশ্বাসঘাতক, জয় করা কঠিন, কিন্তু তাকে পরাভূত করার বাসনা পুরুষের প্রবল। যে পর্বতারোহী জীবন বিপন্ন করে জয় করতে চায় গর্বিত, দ্রোহী, কুমারী ও খল পর্বত, তার কাছে পর্বত হচ্ছে নারী। অনেক সময় বলা হয় এসব তুলনা প্রকাশ করে কামের উদ্গতিপ্রাপ্তি; তবে এগুলো প্রকাশ করে নারী ও মৌল উপাদানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, যা কামের মতোই মৌলিক। নারী হচ্ছে সেই সুবিধাপ্রাপ্ত বস্তু, যার মাধ্যমে পুরুষ পরাভূত করে প্রকৃতিকে। তবে অন্যান্য বস্তুও এ-ভূমিকা পালন করতে পারে। কখনো কখনো পুরুষ বালকের দেহে আবার খুঁজে পেতে চায় বালুকাময় উপকূল, মখমল রাত্রি, মধুমতির সুগন্ধ। তবে যৌন বিদ্ধকরণ পৃথিবীকে দৈহিকভাবে অধিকার করার একমাত্র রীতি নয়। স্টেইনবেক তার টু এ গড আননৌন উপন্যাসে রূপায়িত করেছেন এক পুরুষকে, যে একটি শ্যাওলাধরা পাথরকে বেছে নিয়েছে তার ও প্রকৃতির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিশেবে; কলেৎ শাৎ-এ বর্ণনা করেছেন এক তরুণ স্বামীকে, যার প্রেমের কেন্দ্র তার প্রিয় বেড়ালটি, কেননা এ-বন্য ও নিরীহ পশুটির মধ্য দিয়ে সে ধরতে পারে ইন্দ্রিয়কাতর বিশ্বকে, যা তার স্ত্রীর একান্ত মানবিক দেহ তাকে দিতে পারে না। অপর নারীর মতোই চমৎকারভাবে রূপ লাভ করতে পারে সমুদ্ররূপে, পর্বতরূপে। সমুদ্র ও পর্বত যদি হয় নারী, তাহলে নারীও তার প্রেমিকের কাছে সমুদ্র ও পর্বত।
তবে পুরুষ ও বিশ্বের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিশেবে এভাবে কাজ করার জন্যে এটা আকস্মিকভাবে দেয়া হয় নি যে-কোনো নারীকে; পুরুষ শুধু তার সঙ্গিনীর মাঝে তার পরিপূরক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোদেখে সন্তুষ্টি লাভ করে না, নারীকে অবশ্যই হতে হবে জীবনের বিস্ময়কর প্রস্ফুটনের প্রতিমূর্তি এবং একই সময়ে তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে জীবনের অবোধ্য রহস্যগুলো। সব কিছুর আগে, তাই, তার থাকতে হবে যৌবন ও স্বাস্থ্য, কেননা পুরুষ যখন একটি জীবন্ত প্রাণীকে আলিঙ্গনে বাঁধে, সে শুধু তখনই তার মধ্যে পেতে পারে মোহিনীশক্তি যদি সে ভুলে যেতে পারে মৃত্যু বাসা বেঁধে আছে জীবনের মাঝে। এবং সে চায়আরো বেশি কিছু : চায় তার প্রেমিকা হবে সুন্দর। নারীসৌন্দর্যের আদর্শ রূপ পরিবর্তনশীল, তবে কিছু দাবি থাকে অপরিবর্তিত; নারীর নিয়তিই যেহেতু কারো মালিকানায় থাকা, তাই তার দেহের থাকতে হয়বস্তুর জড় ও অক্ৰিয় গুণ। কর্মের জন্যে শারীরিক যোগ্যতার মধ্যে থাকে পৌরুষদীপ্ত সৌন্দর্য, থাকে শক্তিতে, ক্ষিপ্রতায়, নমনীয়তায়; এটা হচ্ছে সে-সীমাতিক্ৰমণতার প্রকাশ, যা সপ্রাণ করে তোলে শরীরকে। নারীর আদর্শ রূপ প্রতিসম শুধু স্পার্টা, ফ্যাশিবাদী ইতালি, ও নাটশি জর্মনির মতো সমাজে, যেগুলো নারীকে তৈরি করে রাষ্ট্রের জন্যে, ব্যক্তির জন্যে নয়, তাকে একান্তভাবে গণ্য করে মাতারূপে এবং তাতে কামের কোনো স্থান নেই।
তবে নারীকে যখন সম্পত্তি হিশেবে দান করা হয় পুরুষের কাছে, তখন পুরুষ দাবি করে নারী হবে মাংসের জন্যে মাংসের প্রতীক। তার শরীরকে উপলব্ধি করা হয় না কোনো কর্ত-ব্যক্তিত্বের বিকিরণ হিশেবে, বরং গণ্য করা হয় আপন সীমাবদ্ধতায় গভীরভাবে বিলুপ্ত এক বস্তু হিশেবে; এমন শরীরের বিশ্বের সাথে কোনো অভিসম্বন্ধ থাকতে পারে না, এটা শুধু নিজের ছাড়া অন্য কিছুর প্রতিশ্রুতি হইতে পারে না : তাকে তৃপ্ত করতে হয় তার জাগানো কামনা। এ-প্রয়োজনীয়তার সবচেয়ে স্থূল রূপ হচ্ছে হটেনটটদের নিতম্বিনী ভেনাসের আদর্শ, কেননা শরীরের মধ্যে নিতম্বেই থাকে সবচেয়ে কম স্নায়ু, যেখানে মাংসকে মনে হয় উদ্দেশ্যহীন। প্রাচ্যদেশীয়দের স্থূলাঙ্গী নারী পছন্দ করাও একই প্রকৃতির; তারা ভালবাসে মেদের এ-নিরর্থক প্রবৃদ্ধি, যার কোনো পরিকল্পনা নেই, শুধু সেখানে থাকা ছাড়া যার আর কোনো অর্থ নেই। এমনকি সে-সব সভ্যতায় যেখানে কামবোধ অধিকতর সূক্ষ্ম, যেখানে পোষণ করা হয় গঠন ও সুষমা সম্পর্কে বিশেষ ধারণা, সেখানেও স্তন ও নিতম্ব থাকে পছন্দের বস্তুরূপে, তাদের অপ্রয়োজনীয়, বিনামূল্যে পাওয়াবিকাশের জন্যে।
পোশাকপরিচ্ছদ ও চালচলনকে অনেক সময় এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়, যাতে নারীদেহ বিচ্ছিন্ন হয় সক্রিয়তা থেকে : পা বাঁধা চিনদেশের নারীরা হাঁটতেই পারতো, হলিউডের তারকার মাজাঘষা নখ তাকে বঞ্চিত করে তার হাত থেকেই; উঁচু খুড়, কর্সেট, প্যানিয়ার, ফার্দিংগেল, ক্রিনোলিনের যতোটা কাজ ছিলো নারীশরীরের বাঁকগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তার চেয়ে বেশি ছিলো দেহকে সামর্থ্যহীন করেতোলা। নারীদেহ যখন মেদভারে নুজ হয়, বা এতে কৃশ হয় যে কাজের কোনো শক্তি থাকে না, অসহায় হয়ে ওঠে অসুবিধাজনক পরিচ্ছদ বা শোভনতা-শালীনতা দিয়ে-তখন নারীদেহকে পুরুষের মনে হয় নিজের সম্পত্তি, তার মাল। প্রসাধন ও অলঙ্কার আরো বাড়িয়ে তোলে মুখমণ্ডল ও শরীরের শিলীভবন। কারুকার্যখচিত বস্ত্রের ভূমিকা খুবই জটিল; কিছু আদিম সমাজে এর রয়েছে ধর্মীয় তাৎপর্য; তবে অধিকাংশ সময়এর লক্ষ্য হচ্ছে নারীকে কোনো মূর্তিতে রূপান্তরিত করা। দ্ব্যর্থবোধক মূর্তি! পুরুষ চায় যে নারী হবে শারীরিক, তার সৌন্দর্য হবে ফল ও ফুলের মতো; তবে সে তাকে আবার চায় নুড়ির মতো মসৃণ, শক্ত ও পরিবর্তনহীন।
নারী তার শরীর দিয়ে হয়ে ওঠে উদ্ভিদ, চিতাবাঘ, মাণিক্য, শুক্তি, আন্দোলিত পুষ্প, পশম, রত্ন, ঝিনুক, পালক; সে নিজেকে সুরভিত করে পদ্ম ও গোলাপের সুগন্ধ ছড়ানোর জন্যে। তবে পালক, রেশম, মুক্তো, ও সুগন্ধি অবশ্য তার মাংসের, গন্ধের পাশব স্থূলতাকে লুকিয়ে রাখার কাজ করে। সে তার মুখ ও চিবুক রঞ্জিত করে সেগুলোকে মুখোশের কঠিন স্থিরতা দেয়ার জন্যে; সে সুরমা ও মাসকারায় গভীরভাবে বন্দী করে তার দৃষ্টিকে, এটা তার চোখের বর্ণাঢ্য অলঙ্কারের থেকে বেশি কিছু নয়; বিনুনিত, কুঞ্চিত, বিন্যস্ত তার কেশপাশ হারিয়ে ফেলে উদ্বেগজাগানো উদ্ভিদ-ধর্মী রহস্য।
বস্ত্রপরিহিত ও অলঙ্কৃত নারীর মধ্যে প্রকৃতি উপস্থিত থাকে, তবে নিয়ন্ত্রিতভাবে, মানুষের ইচ্ছে দিয়ে তাকে ঢালাই করা হয় পুরুষের কামনা অনুসারে। কোনো নারীর মধ্যে প্রকৃতি যততবেশি বিকশিত ও বন্দী হয়, সে ততবেশি হয়ে ওঠে কামনার বস্তু : ‘পরিশীলিত’ নারীই সব সময় থেকেছে আদর্শ কামসামগ্রি। একটু বেশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পছন্দ করা অধিকাংশ সময়ই হচ্ছে পরিশীলনের এক আপাতসত্য রূপ। রেমি দ্য গরমো চেয়েছিলেন নারীদের চুল থাকবে এলানো, থাকবে স্রোতস্বিনীর ও প্রেইরির ঘাসের মতো ঢেউখেলানো। নারী যতো তরুণী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় এবং তার নতুন ও দীপ্ত তনু যতবেশি চিরস্থায়ীসজীবতায় ভূষিত বলে মনে হয়, ছলাকলার প্রয়োজন হয় তার তত কম। পুরুষ যেহেতু ভয় পায় নারীর অনিশ্চিত নিয়তিকে, যেহেতু পুরুষ নারীকে দেখতে পছন্দ করে পরিবর্তনহীন, প্রয়োজনীয়রূপে, তাই পুরুষ নারীর মুখে, নারীর শরীরে, নারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে দেখতে চায় এক আদর্শ রূপের যথাযথ প্রকাশ। আদিম জনগোষ্ঠির মধ্যে এ-আদর্শ হচ্ছে জনপ্রিয় প্রতিরূপের উৎকৃষ্ট রূপ : যে-জাতির ঠোট মোটা ও নাক বোঁচা তার ভেনাসও হয় মোটা ঠোঁটের ও বোচা নাকের; পরে আরো জটিল নান্দনিক বিধি প্রয়োগ করা হয়েছে নারীর ক্ষেত্রে। তারপর আমরা এসে পৌঁছি এক বিসঙ্গতিতে। পুরুষ নারীর মধ্যে প্রকৃতিকে লাভ করতে গিয়েতাকে বাধ্য করে ছলাকলাপূর্ণ হয়ে উঠতে। সে শুধু ফিসিস নয়, বরং সমপরিমাণে প্রতি-ফিসিস, এটা শুধু বৈদ্যুতিক ‘পার্ম’-এর, মোম দিয়ে অতিরিক্ত চুল তোলার, ল্যাটেক্স কোমরবন্ধের সভ্যতায়ই ঘটে না, ঘটে ওষ্ঠ-চাকতির নিগ্রোদের দেশে, চিনে এবং সারা পৃথিবীতে।
সুইফট তাঁর বিখ্যাত অৌড টু সেলিয়ায় নিন্দা করেছিলেন এ-রহস্যীকরণের; ঘেন্নার সাথে তিনি বর্ণনা করেছেন ছেনালের টুকিটাকি জিনিশপত্র এবং ঘেন্নার সাথে স্মরণ করেছেন তার দেহের পাশবিক প্রয়োজনগুলো। ক্রোধে তিনি দু-বার ভুল করেছেন; কেননা পুরুষ চায় নারী একই সাথে হবে পশু ও উদ্ভিদ এবং সে ঢাকা। থাকবে এক কৃত্রিম সম্মুখভাগের আড়ালে; পুরুষ দেখতে ভালোবাসে যে নারী উঠে আসছে সমুদ্র থেকে এবং বেরিয়ে আসছে ফ্যাশনসম্মত বস্ত্রনির্মাতার প্রতিষ্ঠান থেকে, নগ্ন ও বস্ত্রপরিহিত, তার বস্ত্রের নিচে নগ্ন–এভাবেই পুরুষ নারীকে পায় মানবমণ্ডলির বিশ্বে। নগরের পুরুষেরা নারীর ভেতরে খোঁজে পাশবিকতা; তবে সামরিক কাজে নিয়োজিত তরুণ চাষীর কাছে বেশ্যালয়ই হচ্ছে নগরের সমস্ত ইন্দ্রজালের প্রতিমূর্তি। নারী ক্ষেত্র ও চারণভূমি, তবে সে ব্যাবিলনও।
তবে এটাই নারীর প্রথম মিথ্যাচার, তার প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা : এটা জীবনেরই মিথ্যাচার–জীবন যদিও প্রকাশ করে অতিশয় আকর্ষণীয় গঠন, তবু জীবন সব সময়ই উপদ্রুত থাকে বয়স ও মৃত্যুর উত্তেজনা দিয়ে। পুরুষ যেভাবে ব্যবহার করে নারীকে, তাতেই নষ্ট হয় নারীর সবচেয়ে মূল্যবান শক্তিগুলো : গর্ভধারণে ভারাক্রান্ত হয়ে সে হারিয়ে ফেলে তার কামের আবেদন; এমনকি নারী বন্ধ্যা হলেও শুধু কালপ্রবাহই নষ্ট করে দেয় তার মনোহারিত্ব। ক্ষীণবল, সাদামাটা, বৃদ্ধ অবস্থায় নারী আকর্ষণহীন। গাছ সম্পর্কে যেমন বলা হয় তেমনি বলা যেতে পারে সে হয়ে গেছে বিবর্ণ, ম্রিয়মাণ। এটা ঠিক যে পুরুষের জরাগ্রস্ততাও ভীতিকর; তবে পুরুষ সাধারণত বৃদ্ধ পুরুষদের মাংসরূপে দেখে না। নারীর শরীরেই–যে-শরীর সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষেরই জন্যেশুধু পুরুষ মুখোমুখি হয় মাংসের অবনতির। বৃদ্ধা নারী, সাদামাটা নারী আকর্ষণহীন বস্তুই শুধু নয়, তারা জাগায় ভয়মিশ্রিত ঘৃণা। যখন নিঃশেষিত হয়ে যায় স্ত্রীর মনোহারিত্ব, তখন তাদের মধ্যে আবার দেখা দেয় মাতার উদ্বিগ্নকর মূর্তি।
তবুও স্ত্রী এক ভয়ঙ্কর শিকার। সমুদ্রের ঢেউ থেকে উঠে আসে ভেনাসের মধ্যেসজীব ফেনা, উজ্জ্বল ফসল তোলা বেঁচে থাকে দিমিতার; পুরুষ যখন নারীর কাছে থেকে পাওয়া বিনোদের মধ্য দিয়েঅধিকার করে নারীকে, তখন পুরুষ নারীর ভেতরে জাগিয়ে তোলে উর্বরতার সন্দেহজনক শক্তিকেও : যে-প্রত্যঙ্গটিকে সে বিদ্ধ করে, সেটি দিয়েই নারী জন্ম দেয় সন্তান। এ-কারণেই সব সমাজেই নানা ট্যাবু দিয়েপুরুষকে রক্ষা করা হয় স্ত্রীলিঙ্গের বিপদ থেকে। এর বিপরীতটি সত্য নয়, পুরুষের কাছে নারীর ভয় পাওয়ার কিছু নেই; পুরুষের লিঙ্গকে গণ্য করা হয় ইহজাগতিক, লৌকিক বলে। শিশ্নকে উন্নীত করা যেতে পারে দেবতার পর্যায়ে; কিন্তু তার পুজোর মধ্যে নেই ভয়ের কোনো উপাদান, এবং প্রাত্যহিক জীবনে নারীকে পুরুষের থেকে অতীন্দ্রিয়ভাবে রক্ষা করার দরকার পড়ে না, পুরুষ সব সময়ই শুভ। উল্লেখযোগ্য যে বহু মাতৃধারার সমাজে বিরাজ করে খুবই অবাধ যৌনতা; তবে এটা সত্য শুধু নারীর বাল্যকালে, তার কৈশোরে, যখন সঙ্গম প্রজননের ধারণার সাথে জড়িত থাকে না। ম্যালিনোস্কি কিছুটা বিস্ময়ের সাথেই বর্ণনা করেছেন যে তরুণতরুণী যারা অবাধে ঘুমোয় ‘অবিবাহিতদের গৃহ’-এ, তারা তাদের প্রেমলীলার কথা খোলাখুলি প্রকাশ করে দেয়; ঘটনা হচ্ছে তারা মনে করে অবিবাহিত মেয়ের গর্ভ হয় না, এবং তাই সঙ্গমকে মনে করা হয় নিতান্তই এক অনুত্তেজিত ঐহিক প্রমোদ বলে। কিন্তু যেই বিয়ে হয় নারীর, স্বামী প্রকাশ্যে স্ত্রীর প্রতি কোনো অনুরাগও প্রকাশ করতে পারে না, স্ত্রীকে তার ছোঁয়া নিষেধ; এবং নিজেদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের প্রতি কোনো ইঙ্গিত হচ্ছে অধর্মাচরণ : নারী অংশীদার হয়ে উঠেছে মাতার ভীতিকর সারসত্তার, এবং সঙ্গম হয়ে উঠেছে এক পবিত্র কর্ম। তারপর থেকে এটা পরিবৃত থাকে নিষেধ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা দিয়ে। ভূমি চাষের, বীজ বোনার, চারা লাগানোর সময় সঙ্গম নিষিদ্ধ।
পুরুষের মধ্যে নারী যে-ভয় জাগায়, তা কি সাধারণভাবে কাম থেকে উদ্ভূত, না কি ভয় থেকে জাগে কাম, সেটা এক প্রশ্ন। উল্লেখযোগ্য যে, বিশেষ করে লেভিটিকাসে, স্বপ্নদোষকে গণ্য করা হয় দূষণ বলে, যদিও এর সাথে নারীর সম্পর্ক নেই। এবং আমাদের আধুনিক সমাজে হস্তমৈথুনকে সাধারণত মনে করা হয় বিপজ্জনক ও পাপ : অনেক কিশোর ও তরুণ, যারা এর প্রতি আসক্ত, তারা একাজটি করে ভয়াবহ আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্যে। সমাজের এবং বিশেষ করে পিতামাতার হস্তক্ষেপে একটি একান্ত সুখ হয়ে ওঠে পাপ; তবে একাধিক ছেলে স্বতস্ফূর্তভাবে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে তাদের বীর্যপাতে : রক্ত বা বীর্য, তার নিজের যে-কোনো পদার্থের নিঃসরণ তার কাছে মনে হয় উদ্বিগ্নকর। যা বেরিয়ে যাচ্ছে, তা হচ্ছে তার জীবন, তার মানা। তবে পুরুষ কোনো নারীর উপস্থিতি ছাড়াই ব্যক্তিগতভাবে যৌনাভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েগেলেও তার কামের মধ্যে বস্তুগতভাবে জ্ঞাপন করা হয় নারীকে : প্লাতো যেমন উভলিঙ্গদের উপকথায় বলেছেন, পুরুষের সংগঠন ইঙ্গিত করে নারীর সংগঠনের প্রতি। পুরুষ নিজের লিঙ্গ আবিষ্কার করতে গিয়েআবিষ্কার করে নারী, এমনকি নারী রক্তমাংসে এবং চিত্রে উপস্থিত না থাকলেও।
নারীর প্রতি পুরুষের অনুভূতির পরস্পরবিপরীত মূল্য আবার জেগে ওঠে নিজের কামপ্রত্যঙ্গের প্রতি তার মনে ভাবে : সে এর জন্যে গর্বিত, সে এটিকে উপহাস করে, এটির জন্যে লজ্জা পায়। ছোটো ছেলে তার শিশ্নের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে বন্ধুদের সাথে নামে প্রতিযোগিতায় : তার শিশ্নের প্রথম উত্থান তাকে একই সাথে ভরে দেয় গর্বে ও ভীতিতে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তার শিশ্নকে গণ্য করে সীমাতিক্ৰমণতা ও শক্তির প্রতীকরূপে; এটা এক স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত পেশিরূপে এবং একই সময়ে একটি ঐন্দ্রজালিক উপহাররূপে তৃপ্ত করে তার অহমিকাকে : সে এটি দিয়ে মুগ্ধ থাকে, তবে তার মনে সন্দেহ জেগে থাকে যে সে প্রতারিত হতে পারে। যে প্রত্যঙ্গটি দিয়ে সে নিজেকে দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করতে চায়, সেটি তার অনুগত নয়, অতৃপ্ত কামনায় ভারি হয়ে, আকস্মিকভাবে দাঁড়িয়ে, কখনো ঘুমের মধ্যে নিজেকে ভারমুক্ত করে, এটা প্রকাশ করে এক সন্দেহজনক ও খামখেয়ালভরা প্রাণশক্তি। পুরুষ চৈতন্যকে জয়ী করতে চায় জীবনের ওপর, সক্রিয়তাকে অক্রিয়তার ওপর; তার চেতনা প্রকৃতিকে রাখে দূরে, তার ইচ্ছে তাকে রূপ দান করে, কিন্তু তার কামপ্রত্যঙ্গে সে নিজেকে আবার অবরুদ্ধ দেখতে পায় জীবন, প্রকৃতি ও অক্রিয়তা দিয়ে।
‘কামপ্রত্যঙ্গগুলো,’ লিখেছেন শপেনহায়ার, ‘ইচ্ছেশক্তির প্রকৃত পীঠস্থান, যার বিপরীত মেরু হচ্ছে মস্তিষ্ক’। তিনি যাকে ‘ইচ্ছেশক্তি’ বলেছেন, তা হচ্ছে জীবনলগ্নতা, যা হচ্ছে দুঃখভোগ ও মৃত্যু, আর সেখানে ‘মস্তিষ্ক’ হচ্ছে চিন্তা, যা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর মতে যৌন লজ্জা হচ্ছে সে-লজ্জা, যা আমরা বোধ করি শরীরের প্রতি আমাদের নির্বোধ মোহের ফলে। তার তত্ত্বগুলোর হতাশাবাদকে আমরা আপত্তিকর মনে করলেও, যে-বৈপরীত্য তিনি দেখেছেন, তা ঠিক : কাম বনাম মস্তিষ্ক, মানুষের দ্বৈততার প্রকাশ। কর্তা হিশেবে পুরুষ মুখোমুখি হয় বিশ্বের, এবং এ-বিশ্বের বাইরে অবস্থান করে সে নিজেকে করে তোলে এর শাসক; যদি সে নিজেকে দেখে মাংস হিশেবে, কাম হিশেবে, সে আর থাকে না স্বাধীন চেতনা, স্পষ্ট, স্বাধীন সত্তা : সে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায় বিশ্বের সাথে, হয়ে ওঠে এক সীমাবদ্ধ ও বিনাশী বস্তু। সন্দেহ নেই যে প্রজননের কর্ম অতিক্রম করে যায় দেহের সীমা, তবে সে-মুহূর্তেই এটা প্রতিষ্ঠিত করে সীমা। শিশ্ন, প্রজন্মদের পিতা, সঙ্গতিপূর্ণ মায়ের জরায়ুর সাথে; পুরুষ উদ্ভূত হয় একটি জীবাণু থেকে, যে-জীবাণু বাড়েনারীর দেহের ভেতরে, পুরুষ নিজেই আবার জীবাণুর বহনকারী, এবং যা দান করে জীবন, তা বপন করে পুরুষকে পরিত্যাগ করতে হয় তার নিজের জীবনকেই। ‘সন্তানদের জন্ম হচ্ছে,’ হেগেল বলেছেন, ‘পিতামাতার মৃত্যু’। বীর্যপাত হচ্ছে মৃত্যুর প্রতিশ্রুতি, এটা ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রজাতির দৃঢ় ঘোষণা; কামপ্রত্যঙ্গের অস্তিত্ব ও তার কর্মকাও অস্বীকার করে কর্তার গর্বিত বিশিষ্টতা। আত্মার বিরুদ্ধে জীবনের এ-প্রতিদ্বন্দ্বিতাই পুরুষাঙ্গটিকে লজ্জাজনক করে তোলে। পুরুষ যৌনাঙ্গ নিয়ে তখনই গৌরব বোধ করে যখন সে এটিকে মনে করে সীমাতিক্ৰমণ ও সক্রিয়তা, অপরকে অধিকার করার একটি হাতিয়ার; কিন্তু সে একে নিয়ে লজ্জা বোধ করে যখন সে এটিকে দেখে নিতান্ত অক্রিয় মাংসরূপে, যার মাধমে সে হয়ে ওঠে জীবনের অন্ধকার শক্তিরাশির খেলার সামগ্রি।
কিন্তু এখানেই সে বুঝতে পারে–শ্রেষ্ঠ প্রমাণের সাথে তার দৈহিক পরিস্থিতির দ্ব্যর্থবোধকতা। সে তার কামে ততোটাই গর্ব বোধ করে, এটা যতোখানি পরিমাণে অপরকে আত্মসাতের এক রকম উপায়–এবং মালিকানা লাভের এ-স্বপ্ন শেষ হয় শুধু হতাশায়। যথার্থ মালিকানায় অপর বিলুপ্ত হয়ে যায়, একে নিঃশেষ ও ধ্বংস করা হয় : যখন ভোর এসে হাজির হয় তার শয্যা থেকে রক্ষিতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, তখন শুধু আরব্যরজনীর সুলতানেরই আছে তার প্রত্যেক রক্ষিতার মাথা কাটার ক্ষমতা। নারী বেঁচে থাকে পুরুষের আলিঙ্গনের পরেও, এবং এ-ঘটনা দিয়েই সে মুক্তি পায় পুরুষের থেকে; যখনই পুরুষ শিথিল করে বাহু, তার শিকার আবার তার কাছে হয়ে ওঠে অচেনা; সেখানে সে পড়ে থাকে, নতুন, অক্ষত, একই স্বল্পস্থায়ী রীতিতে প্রস্তুত অন্য কোনো প্রেমিকের দ্বারা অধিকৃত হওয়ার জন্যে। পুরুষের এক স্বপ্ন হচ্ছে নারীটিকে এমনভাবে ‘ছাপ মেরে দেয়া,’ যাতে নারীটি চিরকাল তার হয়ে থাকে; তবে সবচেয়ে উদ্ধত পুরুষটিও ভালোভাবেই জানে সে নারীটির কাছে স্মৃতি ছাড়া আর কিছু রেখে যাবে না আর অতিশয় ব্যাকুল স্মৃর্তিচারণও সত্যিকারের, বর্তমান অনুভূতির তুলনায় ঠাণ্ডা। বিপুল পরিমাণ সাহিত্যে সবিস্তারে প্রকাশিত হয়েছে এ-হতাশা। এটা নারীকে করেছে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, তাকে বলা হয়েছে অস্থিরমতী এবং বিশ্বাসঘাতিনী, কেননা তার শরীরই এমন যে তা বিশেষ কোনো পুরুষের কাছে নয়, সাধারণভাবে সব পুরুষের কাছেই উৎসর্গিত হতে পারে।
তবে তার দ্রোহিতা আরো বেশি বিশ্বাসঘাতক : সত্য বলতে কী নারী তার প্রেমিককে পরিণত করে নিজের শিকারে। শুধু একটি দেহই স্পর্শ করতে পারে অন্য একটি দেহকে; পুরুষ তার কাম্য মাংসের প্রভু হয়ে ওঠে শুধু নিজে মাংসে পরিণত হয়ে; হাওয়াকে দেয়া হয়েছিলো আদমের কাছে, যাতে হাওয়ার মাধ্যমে আদম অর্জন করতে পারে তার সীমাতিক্ৰমণতা, এবং হাওয়া আদমকে টেনে নেয় সীমাবদ্ধতার রাত্রির ভেতরে। তার রক্ষিতা, প্রমোদের মাথাঘোরানোর মধ্যে, তাকে আবার বন্দী করে সে-অন্ধকার গর্ভের অনচ্ছ কাদামাটিতে, যা মা তৈরি করেছে তার পুত্রের জন্যে এবং যেখান থেকে সে চায় মুক্তি পেতে। পুরুষ চায় নারীকে অধিকার করতে; সে নিজেই হয় অধিকৃত! গন্ধ, আর্দ্রতা, ক্লান্তি, নির্বেদ–এক গ্রন্থাগারভর্তি বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে মাংসে পরিণত হওয়া চেতনার এ-বিষাদাচ্ছন্ন সংরাগ।
ধারাবাহিক উপন্যাসের অতিব্যবহৃত শব্দভাণ্ডার নারীকে বর্ণনা করেছে অভিচারিণী, সমোহনকারিণী রূপে, যারা পুরুষকে মুগ্ধ করে তার ওপর ছড়িয়ে দেয় সম্মোহন, এবর্ণনায় প্রতিফলিত হয় সবচেয়েপুরোনো ও সর্বজনীন কিংবদন্তিগুলো। নারী উৎসর্গিত যাদুর কাছে। আলাইন বলেছেন যে যাদু হচ্ছে কন্তর মাঝে বেঁকে ভেঙে পড়া প্রেত; কোনো কাজ তখনই ঐন্দ্রজালিক, যখন তা কোনো সংঘটক দ্বারা উৎপন্ন না হয়ে বয়ে আসে অক্রিয় কিছু থেকে। পুরোহিত ও যাদুকরের মধ্যে পার্থক্য সুবিদিত : প্রথমজন দেবতাদের ও বিধান অনুসারে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে শক্তিরাশিকে, সকলের কল্যাণের জন্যে, দলের সব সদস্যের নামে; যাদুকর কাজ করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, দেবতাদের ও বিধানের বিরুদ্ধে, তার নিজের গভীর আগ্রহ অনুসারে। এখন, পুরুষের বিশ্বে নারী সম্পূর্ণরূপে সংহতি লাভ করে নি; অপররূপে, সে তাদের বিরোধী পক্ষ। এটা তার পক্ষে স্বাভাবিক যে তার শক্তিগুলো সে প্রয়োগ করবে, সে বিস্তৃত হবে না পুরুষের সমাজে এবং ভবিষ্যৎ সীমাতিক্ৰমণতার শীতল উদ্যোগের মধ্যে, কিন্তু, যেহেতু সে বিচ্ছিন্ন, বিরোধী, সে পুরুষদের টেনে নেবে বিচ্ছিন্নতার নিঃসঙ্গতায়, সীমাবদ্ধতার তমসায়। নারী হচ্ছে সাইরেন, যার গানে প্রলুব্ধ নাবিকেরা আছড়ে পড়ে শিলার ওপর; সে সির্সে, যে তার প্রেমিকদের রূপান্তরিত করে পশুতে, সে আনডাইন, যে জেলেদের টেনে নেয় খাড়ির গভীরে। নারীর রূপে মুগ্ধ হওয়ার পর পুরুষের আর থাকে না ইচ্ছেশক্তি, কর্মোদ্যোগ, ভবিষ্যৎ; সে আর নাগরিক খাচ্ছে না, হয়ে ওঠে। মাংসের কামনার কাছে দাসত্বে বন্দী মাংস, গোষ্ঠি থেকে বিচ্ছি, সুহুর্তের কাছে বন্দী, পীড়ন ও প্রমোদের মধ্যে অক্রিয়ভাবে আন্দোলিত।
এ-মাংসের নাটকের কোন দিকের ওপর পুরুষ গুরুত্ব দিচ্ছে, সে-অনুসারে পুরুষের থাকতে পারে বহু মনোভাব। যদি কোন পুরুষ জীবনকে অনন্য মনে না করে, যদি সে তার বিশেষ নিয়তি নিয়ে উদ্বিগ্ন না থাকে, যদি সে মৃত্যুকে ভয় না পায়, তাহলে সে আনন্দের সাথে মেনে নেয় তার পাশবিকতা। সমাজের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যে মুসলমানদের মধ্যে নারীকে ধ্বংস করা হয় অতি শোচনীয় অবস্থায়; ওই সমাজ পরিবারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের কাছে আবেদনের অনুমতি দেয় না, এবং ধর্মের কারণে, যে-ধর্ম প্রকাশ করে সভ্যতার যুদ্ধপরায়ণ ভাবাদর্শ, পুরুষকে সরাসরি উৎসর্গ করা হয়েছে মৃত্যুর কাছে এবং নারীকে বঞ্চিত করেছে তার যাদু থেকে। কীসের সে ভয় করবে পৃথিবীতে যে তৈরি হয়ে আছে যে-কোনো মুহূর্তে মুহম্মদীয় স্বর্গের ইন্দ্রিয়পরায়ণ প্রমোদে লিপ্ত হওয়ার জন্যে? এমন ক্ষেত্রে পুরুষ নিজের বা নারীর থেকে আত্মরক্ষার কোনো দরকার ছাড়াই শান্তভাবে উপভোগ করতে পারে নারী। আরব্যরজনীর গল্পগুলো নারীকে উপস্থাপিত করে সুখকর প্রমোদের উৎসরূপে, যেমন উৎস ফল, মোরব্বা, সুস্বাদু পিঠা, ও সুগন্ধি তেল। আজকাল আমরা ওই ইন্দ্রিয়ভারাতুরতা দেখতে পাই ভূমধ্যসাগরীয় জনগণের মধ্যে। ইন সিসিলিতে ভিত্তোরিনি বলেছেন সাত বছর বয়সে প্রশান্ত বিস্ময়ে তিনি দেখেছিলেন এক নারীর নগ্ন দেহ। গ্রিস ও রোমের যুক্তিশীল চিন্তাধারা সমর্থন করে এ-সহজিয়া মনোভাব। তবে যুক্তিশীলতা কখনোই সম্পূর্ণরূপে জয় লাভ করে নি এবং এসব সভ্যতায় কামের অভিজ্ঞতাগুলো রক্ষা করেছে তাদের পরস্পরবিপরীত মূল্যসম্পন্ন চরিত্র : আচারানুষ্ঠান, পুরাণ, সাহিত্য এসবের প্রমাণ। তবে নারীর প্রতি আকর্ষণ ও বিপদ প্রকাশ পেয়েছে দুর্বলতর রূপে।
খ্রিস্টধর্ম আবার নারীকে ভরে তোলে ভীতিকর মর্যাদায় : পুরুষের অস্বস্তিপূর্ণ বিবেকের তীব্র যন্ত্রণা রূপ নেয় অন্য লিঙ্গের প্রতি ভীতি রূপে। একজন খ্রিস্টান নিজের ভেতরে দ্বিধাবিভক্ত; দেহ ও আত্মার, জীবন ও চৈতন্যের স্বাতন্ত্র্য এখানে সম্পূর্ণ; আদিপাপ দেহকে করেছে আত্মার শত্রু; মাংসের সমস্ত বন্ধনকে মনে হয় অশুভ। শুধু খ্রিস্টের দ্বারা ত্রাণ লাভ করে এবং স্বর্গরাজ্যের দিকে চালিত হয়েই রক্ষা পেতে পারে মানুষ; তবে মূলত মানুষ হচ্ছে দূষণ; তার জন্ম তাকে শুধু মৃত্যুদণ্ডিত করে না, নরকদণ্ডিতও করে; শুধু স্বর্গীয় করুণায়ই তার সামনে উন্মুক্ত হতে পারে স্বর্গ, তবে তার পার্থিব অস্তিত্বের সব রূপের ওপরই রয়েছে একটা অভিশাপ। অশুভ হচ্ছে এক ধ্রুব বাস্তবতা; আর দেহ হচ্ছে পাপ। নারী যেহেতু সব সময়ই অপর, তাই এটা বিশ্বাস করা হয় না যে পুরুষ ও নারী উভয়ই পরস্পরের কাছে দেহ : খ্রিস্টানের কাছে দেহ হচ্ছে সেই বৈরী অপর, যা সব সময়ই নারী। খ্রিস্টানের কাছে নারীর মধ্যে রূপ ধারণ করেছে বিশ্বের, মাংসের, ও শয়তানের প্রলোভন। গির্জার সব পিতাই এধারণার ওপর জোর দেন যে নারীই আদমকে প্রলুব্ধ করেছে পাপে। আমাদের আবার উদ্ধৃত করতে হবে তারতুলিয়ানকে : ‘নারী! তুমি শয়তানের প্রবেশদ্বার। তাকে তুমি প্ররোচিত করেছিলে, যাকে শয়তানও সরাসরি আক্রমণের সাহস করে নি। তোমার জন্যেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে ঈশ্বরের পুত্রকে। তুমি সব সময় থাকবে শোকে ও ছিন্নবস্ত্রে’। সমগ্র খ্রিস্টান সাহিত্যের প্রয়াস হচ্ছে নারীর প্রতি পুরুষের ঘৃণা বাড়ানো। তারতুলিয়ান নারীর সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘পয়ঃপ্রণালির ওপর নির্মিত মন্দির’রূপে। সেইন্ট অগাস্টিন বিভীষিকার সাথে কামের ও মলমূত্র ত্যাগের প্রত্যঙ্গগুলোর মেশামেশির দিকে আকর্ষণ করেছেন দৃষ্টি : ‘আমরা জন্ম নিই মলও মূত্রের মধ্যে’। নারীশরীরের প্রতি খ্রিস্টধর্মের বিরূপতা এতো যে যখন এটি তার ঈশ্বরকে ধ্বংস করতে চায় এক কলঙ্কজনক মৃত্যুতে, তখন এটি তাকে অব্যাহতি দেয় জন্ম নেয়ার কালিমা থেকে : প্রাচ্য গির্জার এফিসুসের পরিষদ এবং পাশ্চাত্য গির্জার ল্যাটেরান পরিষদ ঘোষণা করেছে যে খ্রিস্টের জন্ম হয়েছে কুমারী মায়ের গর্ভে। গির্জার আদিপিতারা–অরিগেন, তারতুলিয়ান, ও জেরোমে-মনে করেছিলেন অন্যান্য নারীর মতো মেরিও প্রসব করেছিলো রক্ত ও ময়লার মধ্যেই; কিন্তু সেইন্ট অ্যামব্রোজ ও সেইন্ট অগাস্টিনের মতামতই জয়লাভ করে। কুমারীর দেহ থেকেছিলো রুদ্ধ। মধ্যযুগ থেকেই শরীর থাকা, নারীর বেলা, গণ্য হয়ে এসেছে কলঙ্ক বলে। এমনকি বিজ্ঞানও দীর্ঘকাল বিহ্বল ছিলো এ-ঘৃণায়। লিনাউস তার প্রকৃতি বিষয়ক সন্দর্তে ‘ঘৃণ্য’ বলে নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা এড়িয়ে যান। ফরাশি চিকিৎসক দ্য লরে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এ-মর্মপীড়াদায়ক প্রশ্নটি : ‘এ-স্বর্গীয় প্রাণীটি, যে পরিপূর্ণ যুক্তিশীলতা ও বিচারবুদ্ধিতে, যাকে আমরা বলি পুরুষ, সে কী করে আকৃষ্ট হয় নারীর ওইসব অশ্লীল প্রত্যঙ্গের প্রতি, যা নোংরা হয়ে থাকে তরল পদার্থে এবং লজ্জাকরভাবে অবস্থিত ধড়ের নিম্নতম অংশে?’
আজকাল খ্রিস্টীয় চিন্তাধারার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় আরো নানা প্রভাব; এবং এর রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্য। তবে, পিউরিটান জগতে, শরীরের প্রতি ঘৃণা সমানভাবে বিরাজ করছে; এর প্রকাশ ঘটেছে, উদাহরণস্বরূপ, ফকনারের লাইট ইন আগস্ট-এ; নায়কের প্রথম দিকের যৌন অভিজ্ঞতাগুলো ভয়ঙ্করভাবে আতঙ্কজনক। সাহিত্য ভরেই এটা দেখানো খুবই সাধারণ ঘটনা যে এক তরুণ প্রথম সঙ্গমের পর এভোই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে তার বিবমিষা জাগে; এবং বাস্তবে যদিও এমন প্রতিক্রিয়া খুবই দুর্লভ, তবু এটা যে এতো ঘনঘন বর্ণনা করা হয়, তা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। বিশেষ করে অ্যাংলো-স্যাক্সন দেশগুলোতে, যেগুলো পিউরিটানবাদে বিশেষভাবে সিক্ত, অধিকাংশ তরুণ ও বহু পুরুষের মধ্যে নারী জাগিয়ে তোলে ভয়, যা কমবেশি খোলাখুলি স্বীকার করা হয়। এ-অনুভূতিটা বেশ তীব্রভাবে বিরাজ করে ফ্রান্সে। মিশেল লিরি আজ দঅম-এ লিখেছেন : ‘আজকাল আমি নারীর প্রত্যঙ্গটিকে মনে করি একটি ঘিনঘিনে জিনিশ বা একটা ঘা, কিন্তু এর জন্যে এটা কম আকর্ষণীয় নয়, তবে অন্য সব রক্তাক্ত, শ্লেষ্মল,রোগাক্রান্ত বস্তুর মতোই এটা ভয়ঙ্কর’। একটি সাধারণ বিশ্বাস হচ্ছে সঙ্গমের ফলে পুরুষ হারিয়ে ফেলে তার পেশিশক্তি ও চিন্তাশক্তি, তার ফসফরাস নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং নির্জীব হয়ে পড়ে তার অনুভূতি। এটা সত্য যে হস্তমৈথুনও নির্দেশ করে এসব বিপদ, এবং নৈতিক কারণে সমাজ একে স্বাভাবিক যৌনকর্মের থেকে আরো বেশি ক্ষতিকর মনে করে। কামের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা হচ্ছে বৈধ বিবাহ ও সন্তানকামনা। নারী হচ্ছে ভ্যাম্পায়ার, সে পুরুষ খায় ও পান করে; তার যৌনাঙ্গ বেঁচে থাকে পুরুষের যৌনাঙ্গ খেয়ে খেয়ে। কিছু মনোবিশ্লেষক চেষ্টা করেছেন এসব অলীক কল্পনার বৈজ্ঞানিক প্রমাণযোগানোর, তারা প্রস্তাব করেছেন সঙ্গমে নারী যে-সুখ পায়, তা হয়তো আসে এ-ব্যাপার থেকে যে নারী পুরুষটিকে প্রতীকীরূপে খোজা করে এবং অধিকার করে নেয় শিশ্নটি। তবে মনে হয় মনোবিশ্লেষণ করা দরকার এসব তত্ত্বেরই, এবং এটা সম্ভবপর এসব তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন যে-সব চিকিৎসক, তাঁরা হয়তো লিপ্ত তাদের পূর্বপুরুষের ভীতি প্রক্ষেপণে।
পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে গভীরভাবে পোষ মানানো হয়েছিলো নারীর যাদুকে। তার ভেতরে আছে যে-মহাজাগতিক শক্তিগুলো, নারী সেগুলোকে অঙ্গীভূত করার সুযোগ দেয় সমাজকে। দুমিজেল তাঁর মিত্র-বরুণ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যেমন রোমে তেমনি ভারতে পৌরুষ দেখানোর দুটি রীতি রয়েছে : প্রথমত, বরুণ ও রোমুলুসে, গন্ধর্বদের ও লুপারর্কির মধ্যে, এ-শক্তি হচ্ছে আক্রমণ, ধর্ষণ, বিশৃঙ্খলা, কাণ্ডজ্ঞানহীন হিংস্রতা; এতে নারী দেখা দেয় এমন সত্তারূপে, যাকে করতে হবে ধর্ষণ, বলাৎকার ধর্ষিতা সেবিন নারীদের, যারা স্পষ্টত ছিলো বন্ধ্যা, মারা হয়েছিলো বৃষের চামড়ায় তৈরি চাবুক; এটা করা হয়েছিলো অধিকতর হিংস্রতা দিয়ে অতিশয় হিংস্রতার ক্ষতিপূরণের জন্যে। তবে, দ্বিতীয়ত এবং এর বিপরীতে, মিত্র, নুমা, ব্রাহ্মণরা, ও পুরোহিতেরা ছিলো নগরের আইনশৃঙ্খলার পক্ষে : এক্ষেত্রে নারীকে বিয়ের বিস্তৃত আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করা হয় স্বামীর সাথে, এবং তার সাথে কাজ করতে গিয়ে নারী তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় প্রকৃতির সব নারীশক্তিকে অধীনস্থ করার; রোমে স্ত্রীর মৃত্যু হলে জুপিটারের পুরোহিত ত্যাগ করতে নিজের পদ। একইভাবে মিশরে আইসিস দেবী মহামাতার পরম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পরও থাকে মহানুভব, সুস্মিত, দয়াবতী, ও শুভ, ওসিরিসের জাকজমকপূর্ণ স্ত্রী। কিন্তু নারী যখন পুরুষের সঙ্গী, পরিপূরক, তার ‘অর্ধাঙ্গিনী’, তখন দরকারবশতই নারীর থাকে এক সচেতন অহং, একটি আত্মা। পুরুষ এতো অন্তরঙ্গভাবে এমন কোনো প্রাণীর ওপর নির্ভর করতে পারে না, যে তার সাথে মানুষের সারসত্তার অংশী নয়। আমরা আগেই দেখেছি যে মনুর বিধান বৈধ স্ত্রীকে দিয়েছে স্বামীর সাথে একই স্বর্গের প্রতিশ্রুতি।
খ্রিস্টধর্ম, স্ববিরোধীরূপে, বিশেষ এক স্তরে ঘোষণা করেছে পুরুষ ও নারীর সাম্য। নারীর মধ্যে খ্রিস্টধর্ম ঘৃণা করে দেহ; নারী যদি দেহ অস্বীকার করে, তাহলে সে ঈশ্বরের জীব, ত্রাতা যাকে পাপমুক্ত করেছে, তখন সে পুরুষের থেকে কম নয় : নারী তখন আসন পায় পুরুষের পাশে, স্বর্গের সুখের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে যারা, সে-সব পুণ্যাত্মার মধ্যে। পুরুষ ও নারী উভয়ই বিধাতার দাস, অনেকটা দেবদূতদের মতো অলৈঙ্গিক, এবং একত্রে তারা বিধাতার করুণায় মুক্ত থাকে পার্থিব প্রলোভন থেকে। নারী যদি সম্মত হয় তার পাশবিকতাকে অস্বীকার করতে, তাহলে নারী, যে পাপের প্রতিমূর্তি, সেও তখন হয়ে ওঠে যারা পাপকে জয় করেছে, সেই মনোনীতদের বিজয়ের উজ্জ্বলতম প্রতিমূর্তি। অবশ্য সে-স্বর্গীয় ত্রাতা, যে পাপমুক্ত করে মানুষকে, সে পুরুষ। খ্রিস্ট বিধাতা; কিন্তু মানবমণ্ডলির ওপর রাজত্ব করে এক নারী, কুমারী মেরি। তবে কিছু প্রান্তিক ধর্মগোত্রই নারীর মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে মহাদেবীর প্রাচীন সুযোগসুবিধা ও ক্ষমতা–গির্জা ধারণ ও সেবা করে এক পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার, যাতে পুরুষের উপাঙ্গ হিশেবে থাকাই নারীর জন্যে মানানসই ও বিধেয়। পুরুষের বাধ্য দাসীরূপেই সে হতে পারে আশীর্বাদপ্রাপ্ত সেইন্ট। এভাবে মধ্যযুগের অন্তরে জেগে ওঠে পুরুষের জন্যে শুভ নারীর এক অতিশয় সংস্কৃত ভাবমূর্তি। গৌরবে মণ্ডিত হয়খ্রিস্টের মাতার সুপ্রসন্ন মুখভাব। সে হচ্ছে পাপীয়সী হাওয়ার বিপরীত দিক; সে পায়ের নিচে পিষ্ট করে সাপটিকে; সে পাপমুক্তির মধ্যস্থতাকারিণী, যেমন হাওয়া ছিলো নরকদণ্ডের।
মাতারূপেই ভীতিকর ছিলো নারী; তাই মাতার মধ্যেই তাকে মহিমান্বিত করতে হবে ও পরিণত করতে হবে দাসীতে। সবার ওপরে মেরির কুমারীত্বের আছে এক নঞর্থক মূল্য : এটা যে যেটির মাধ্যমে মাংসকে পাপমুক্তি দেয়া হয়েছে, সেটি দৈহিক নয়; এটিকে স্পর্শ বা অধিকার করা হয় নি। একইভাবে এশীয় মহামাতারও কোনো স্বামী ছিলো না : সে সৃষ্টি করেছিলো বিশ্ব এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাজত্ব করেছিলোএর ওপর; সে তার চপলতায় উচ্ছৃঙ্খল হতে পারে, কিন্তু মহামাতারূপে কোনো স্ত্রীধর্মী আনুগত্য দিয়ে তার মহিমার লাঘব ঘটে নি। একইভাবে মেরির গায়েও লাগে নি কামের দাগ। রণলিপ্সু মিনার্ভার মতো সে একটি গজদন্ত মিনার, নগরদুর্গ, অজেয় প্রধান দুর্গমিনার। প্রাচীন কালের যাজিকারাও, অধিকাংশ খ্রিস্টীয় সেইন্টের মতো, ছিলো কুমারী : শুভর কাছে উৎসর্গিত নারী উৎসর্গিত হতে হবে তার অক্ষত শক্তিরমহিমার মধ্যে; তাকে সংরক্ষিত রাখতে হবে তার নারীত্বের সারসত্তা, তার অপরাজিত সংহতির মধ্যে। স্ত্রী হিশেবে মেরির মর্যাদা যদি অস্বীকার করা হয়, সেটা করা হয়েছে এ-লক্ষ্যে যে তার মধ্যে বিশুদ্ধতররূপে উন্নীত করতে হবে নারী মাতাকে। কিন্তু সে গৌরব পাবে তার জন্যে নির্ধারিত অধস্তন ভূমিকা গ্রহণ করে। ‘আমি প্রভুর দাসী’। মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম মাতা নতজানু হয় তার পুত্রের কাছে; সে তার নিকৃষ্টতা মেনে নেয় সহজে। পুরুষের এটা চরম বিজয়, যা চরিতার্থ হয়েছে কুমারীতন্ত্রে–এটা নারীর পরাজয় সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে নারীর পুনর্বাসন। ইশতার, আস্তারতে, সিবিলে ছিলো নিষ্ঠুর, খামখেয়ালপূর্ণ, কামনাপরায়ণ; তারা ছিলো ক্ষমতাশালী। তারা যেমন ছিলো মৃত্যুর তেমনি জীবনের উৎস, পুরুষ জন্ম দিয়ে তারা পুরুষকে করেছিলো নিজেদের দাস। খ্রিস্টধর্মে জীবন ও মৃত্যু শুধু ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল, এবং পুরুষ একবার মায়ের দেহ থেকে বেরিয়ে চিরকালের জন্যে মুক্তি পেয়ে গেছে দেহ থেকে; মা এখন অপেক্ষায় আছে শুধু তার অস্থিমালার। প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ হিশেবে মাতৃত্ব আর নারীকে কোনো ক্ষমতা দান করে না। তাই নারী যদি তার আদিদোষ থেকে উদ্ধার চায়, তাহলে তার জন্যে আছে শুধু বিধাতার ইচ্ছের কাছে মাথা নত করা, যা তাকে অধীনস্থ করে পুরুষের। এবং এ-বশ্যতাস্বীকারের মধ্য দিয়েই সে পুরুষের পুরাণে পেতে পারে একটি নতুন ভূমিকা। যখন সে আধিপত্য করতে চেয়েছে, তখন তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে দেয়া হয়েছে বিশেষ আকার, করা হয়েছে পদদলিত এবং যতোদিন সে সুস্পষ্টভাবে অধিকার ত্যাগ না করবে, ততোদিন তাকে দেয়া যেতে পারে শুধু অনুগত দাসীর মর্যাদা। সে তার আদিম গুণগুলোর কোনোটিই হারাচ্ছে না, শুধু এগুলো সংকেত হিশেবে উল্টে যাচ্ছে; সেগুলো অশুভ সংকেত থেকে হয়ে ওঠে শুভ সংকেত; কৃষ্ণ যাদু রূপান্তরিত হয় শ্বেততে। দাসী হিশেবে নারীকে দেয়া হয়েছে অতিশয় জমকালো দেবীত্বলাভের অধিকার।
এবং নারীকে যেহেতু বশ মানানো হয়েছে মাতারূপে, তাই সর্বপ্রথম তাকে লালন ও সম্মান করা হয় মাতারূপে। পরিবারে ও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে, বিধিবিধান ও প্রথার সাথে খাপ খাইয়ে, মাতা হয়েউঠেছে শুভর অনন্য প্রতিমূর্তি : যে-প্রকৃতির সে আংশিক অংশীদার, সে-প্রকৃতি হয়ে উঠেছে শুভ, তা আর চেতনার শত্রু নয়; আর যদি সে রহস্যময়ও থাকে, তবে তার রহস্যটা ; লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ম্যাডোনাদের মতো সুস্মিত রহস্য। পুরুষ নারী হতে চায়না, কিন্তু সে স্বপ্ন দেখে অস্তিত্বশীল সব কিছু–এই নারীসহ, সে যা নয়-নিজের মধ্যে জড়িয়ে ধরার; মাতৃপুজোর মধ্য দিয়ে পুরুষ অধিকার করতে চায় তার অদ্ভুত সম্পদরাশি।
পার্কের প্রাচীন পুরাণের মতো জড়িয়ে থাকে মৃত্যুর সাথে; মৃতকে সৎকারের জন্যে প্রস্তুত করার কাজটি করতে হয় তাকেই, মৃতের জন্যে শোকপালনও করতে হয় তাকেই। তবে তার কাজ হচ্ছে জীবনের, সমাজের, সকলের মঙ্গলের সাথে মৃত্যুর সামঞ্জস্য বিধান। এবং তাই সুশৃঙ্খলভাবে উৎসাহিত করা হয় ‘বীরমাতা’তন্ত্র : সমাজ যদি মাতাদের সম্মত করাতে পারে তাদের পুত্রদের মৃত্যুর কাছে সমর্পণ করতে, তাহলে সমাজ বোধ করে যে তাদের হত্যা করার অধিকার তার আছে। মাতার যেহেতু প্রভাব আছে তার পুত্রদের ওপর, তাই মাতাকে হাতে রাখা সমাজের জন্যে বিশেষ সুবিধাজনক : এ-কারণেই মাতাকে ঘিরে দেয়া হয় শ্রদ্ধার অজস্র নিদর্শনে, তাকে ভূষিত করা হয় সমস্ত গুণাবলিতে, তাকে নিয়ে গড়ে ওঠে একটা ধর্ম। তাকে করা হয় নৈতিকতার অভিভাবক; সে পুরুষের দাসী, যারা ক্ষমতাশালী হবে তাদের সে দাসী,সে তার সন্তানদের সুকোমলভাবে পরিচালিত করে বিধিবদ্ধ পথে। যে-সমাজ যতোবেশি দৃঢ় আশাবাদী, সেটি ততো বশমানাভাবে অনুগত হয় এ-অমায়িক কর্তৃত্বের কাছে, আর মাতা ততোবেশি লাভ করে আদর্শায়িত রূপ। মাতাকে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে জন্ম, জীবন, ও মৃত্যুকে একই সময়ে তাদের পাশবিক ও সামাজিক রূপে গ্রহণ করা, এর কাজ প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গতি ঘোষণা। এ-সংশ্লেষণের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে অগাস্ত কোঁৎ নারীকে করেছিলেন ভবিষ্যৎ মানবজাতির দেবী। কিন্তু একই বিবেচনা সব বিপ্লবীকেই উদ্বুদ্ধ করে মাতৃমূর্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে; তাকে অবজ্ঞা করে তারা প্রত্যাখ্যান করে স্টেটাস কৌ, বিধিবিধান ও প্রথার অভিভাবকরূপে মাতার মাধ্যমে সমাজ যা চাপিয়ে দিতে চায় তাদের ওপর।
যে-ভক্তিশ্রদ্ধা জ্যোতিশ্চক্রের মতো ঘিরে থাকে মাতাকে, তাকে ঘিরে থাকে যেনিষেধাবলি, সেগুলো চাপা দিয়ে রাখে সে-শত্রুতাপূর্ণ ঘৃণা, যা স্বতস্ফূর্তভাবে মিশ্রিত থাকে তার জাগানো দৈহিক কোমলতার সাথে। তবে এক ধরনের মাতৃভীতি টিকেই আছে। এটা উল্লেখ করা কৌতূহলজনক হবে যে মধ্যযুগ থেকেই আছে একটি গৌণ কিংবদন্তি, যাতে খোলাখুলিভাবে প্রকাশ পায় এ-ঘৃণা : সেটি হচ্ছে শাশুড়ীর কিংবদন্তি। উপকথা থেকে ভোদভিল পর্যন্ত স্ত্রীর মাতার মধ্য দিয়ে পুরুষ অবজ্ঞা করে মাতৃত্বকে, এবং স্ত্রীর মাতাকে রক্ষা করার জন্যে কোনো ট্যাবু নেই। যে-নারীকে সে ভালোবাসে, তাকে জন্ম লাভ করতে হয়েছে, এটা ভাবতেই অপছন্দ করে পুরুষ : তার শাশুড়ী হচ্ছে সে-জরাগ্রস্ততার দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ, কন্যাকে জন্ম দিয়ে যা সে নির্ধারিত করে রেখেছে নিজের কন্যার জন্যে। তার মেদ ও চামড়ার ভাঁজ জানিয়ে দেয় যে তরুণী নববধুর জন্যেও অপেক্ষা করে আছে এ-মেদ ও ভাঁজ,ভার ভবিষ্যৎ লাভ করে আছে এমন শোকাবহ রূপ।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে তার ঐন্দ্রজালিক অস্ত্রগুলো থেকে বঞ্চিত হয়ে এবং আর্থিক ও সামাজিকভাবে স্বামীর অধীন হয়ে ‘সতী স্ত্রী’ হয়ে ওঠে পুরুষের অতিশয় মূল্যবান সম্পদ। সে এতোগভীরভাবে স্বামীর অধিকারে থাকে যে সে অংশী হয়ে ওঠে স্বামীর একই সারসত্তার; সে পায় স্বামীর নাম, স্বামীর দেবতা, এবং স্বামী নেয় তার দায়দায়িত্ব। স্বামী তাকে বলে তার ‘অর্ধাঙ্গিনী’। স্বামী যেমন তার গৃহ, জমিজমা, পশুপাল, ধনসম্পদ নিয়ে গর্ব বোধ করে, তেমনি সে গর্ব বোধ করে স্ত্রী নিয়েও, এবং কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি; তার মাধ্যমে স্বামী বিশ্বের কাছে দেখায় নিজের ক্ষমতা। সে হচ্ছে স্বামীর আদর্শ পরিমাপ এবং পার্থিব অংশ। প্রাচ্যদেশীয় দৃষ্টিতে নারীকে হতে হয় স্থূলকায় : লোকেরা দেখতে পায় যে সে বেশ পরিপুষ্ট এবং তার প্রভু ও মালিককে সে ভক্তি করে। কোনো মুসলমানের যেতো বেশি স্ত্রী থাকে এবং তারা যতোবেশি হৃষ্টপুষ্ট হয়, তার সম্বন্ধে পোষণ করা হয় তত ভালো ধারণা। বুর্জোয়া সমাজে নারীকে দেয়া হয় একটি ভূমিকা যে তাকে খাসা দেখাতে হবে; তার রূপ, মনোহারিত্ব, বুদ্ধি, মার্জিতভাব হচ্ছে তার স্বামীর ধনসম্পদের বাহ্যিক ও দর্শনীয় চিহ্ন, যেমন চিহ্ন তার গাড়ির ক্রেতা-নির্দেশিত গঠন। যদি স্বামী ধনী হয়, তাহলে সে স্ত্রীকে ঢেকে দেয় পশমে ও রত্নে; যদি ততো ধনী না হয়, তাহলে সে গর্ব করে স্ত্রীর নৈতিকতা ও গৃহিণীপনার। অতিশয় নিঃস্বও যদি তাকে সেবা করার জন্যে পেয়ে থাকে কোনো নারী, তাহলে সেও বিশ্বাস করে যে জগতে সেও কিছুর মালিক : দি টেমিং অফ দি শ্রুর নায়ক সব পাড়াপ্রতিবেশীকে ডেকে আনে সে কতোটা প্রভুত্বের সাথে পরাভূত করতে পারে তার স্ত্রীকে, তা দেখানোর জন্যে। সব পুরুষই স্মরণ করিয়ে দেয় রাজা কাঁদুলেকে : সে তার স্ত্রীকে প্রদর্শন করে, কেননা সে বিশ্বাস করে যে এভাবেই সে প্রচার করছে তার নিজের গুণাবলি।
কিন্তু নারী শুধু পুরুষের সামাজিক শ্লাঘাকে ফুলিয়ে তোলে না; সে পুরুষের আরো আন্তর শ্লাঘার উৎস। নারীর ওপর আধিপত্যে সে আনন্দ পায়; লাঙলের ফাল খুঁড়ছে। হলরেখা এ-বাস্তবসম্মত প্রতীকের ওপর–যখন নারী একজন ব্যক্তি–চাপিয়ে দেয়। আরো আধ্যাত্মিক প্রতীক : স্বামী তার স্ত্রীকে শুধু কামগতভাবে গঠন করে না, করে নৈতিক ও মননগতভাবেও; স্বামী তাকে শিক্ষা দেয়, তার মূল্যায়ন করে, তার ওপর। মারে নিজের ছাপ। যে-সমস্ত স্বপ্নে পুরুষ আনন্দ পায়, তার একটি হচ্ছে তার ইচ্ছেয় জিনিশপত্র রঞ্জিত করা–তাদের গঠনকে বিশেষ রূপ দিতে, তাদের উপাদানকে বিদ্ধ করতে। নারী হচ্ছে সর্বোচ্চ মাত্রায়তার হাতের কর্দম, যার ওপর অক্রিয়ভাবে ক্রিয়া করা যায় এবং যাকে আকৃতি দেয়া যায়; আত্মসমর্পণ করতে করতে নারী বাধা দিতে থাকে, তার ফলে পুরুষের কাজ চলতে থাকে অনির্দিষ্ট কাল ধরে।
খ্রিস্টধর্মের জন্ম থেকে নারীর দেহকে কীভাবে আধ্যাত্মিক করে তোলা হয়েছে, তা দেখা যেতে পারে। পুরুষ নারীর মাধ্যমে উপভোগ করতে চায় যে-সৌন্দর্য, উষ্ণতা, অন্তরঙ্গতা, সেগুলো আর শরীরী গুণাবলি নয়; বস্তুর অব্যবহিত ও উপভোগ্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করার বদলে নারী হয়ে ওঠে তাদের আত্মা; শরীরী রহস্যের থেকে গভীর, তার হৃদয়ে এক গোপন ও বিশুদ্ধ উপস্থিতি প্রতিফলিত করে বিশ্বের সত্য। সে গৃহের, পরিবারের, বাড়ির আত্মা। এবং সে নগর, রাষ্ট্র, জাতির মতো বৃহত্তর সংঘগুলোর আত্মা। ইয়ুং বলেছেন নগরকে সব সময়ই সম্পর্কিত করা হয়েছে মায়ের সাথে, কেননা তারা বক্ষে ধারণ করে নগরবাসীদের, তাই সিবিলেকে রূপায়িত করা হয় সৌধের মুকুটপরা মূর্তিতে। এবং এভাবে বলা হয় ‘মাতৃভূমি’; তবে জীবন লালনকারী মাটিরই শুধু নয়, নারী প্রতীক আরো সূক্ষ্ণ বাস্তবতার। পুরোনো বাইবেল ও আপকালিপসে জেরুজালেম ও ব্যাবিলন শুধু মা নয় : তারা স্ত্রীও। আছে অনেক কুমারী নগর, এবং বাবেল ও টায়ারের মতো বেশ্যাস্বভাবা নগর। এজন্যে ফ্রান্সকে বলা হয়েছে ‘গির্জার জ্যেষ্ঠ কন্যা’; ফ্রান্স ও ইতালি হচ্ছে লাতিন বোন। পুরুষেরা যে বিভিন্ন স্থানকে নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত করে, তা বিশুদ্ধভাবে প্রতীকধর্মী নয় : অনেক পুরুষ আবেগগতভাবেই এটা অনুভব করে। অধিকাংশ সময়ই ভ্রমণকারী তার ভ্রমণের দেশের চাবি খোঁজে নারীর মধ্যে : সে যখন কোনো ইতালীয় বা স্পেনীয় নারীকে আলিঙ্গনে বাঁধে, তার মনে হয় সে অধিকার করেছে ইতালি বা স্পেনের সুগন্ধি সারসত্তা। ‘যখন আমি কোনো নতুন নগরে যাই, সব সময়ই আমি শুরু করি কোনো বেশ্যালয়ে গিয়ে,’ মন্তব্য করেছেন এক সাংবাদিক। যদি একটি দারুচিনি চকোলেট জিদের কাছে মেলে ধরতে পারে সমগ্র স্পেনকে, তাহলে অদ্ভুত মদির ওষ্ঠের চুম্বন প্রেমিককে দেয় তার সমস্ত পশুপাখিউদ্ভিদ, তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিসহ একটি সম্পূর্ণ দেশ। নারী রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান বা আর্থনীতিক সম্পদগুলোর সারাংশ ধারণ করে না; কিন্তু সে যুগপৎ প্রতিমূর্তি তাদের সম্পদের মর্মবস্তু ও অতীন্দ্রিয় মানার। খ্রিস্টান বিশ্ব বনদেবী ও পরীর স্থানে বসিয়েছে অনেক কম শরীরী উপস্থিতিকে; তবে গৃহ, ভূখণ্ড, নগর, এবং ব্যক্তিদের ভেতরে এখনো আনাগোনা করে স্পর্শাতীত নারীত্ব।
এ-সত্য, বস্তুর রাত্রিতে ঢাকা, আকাশেও জ্বলে দীপ্তভাবে; বিশুদ্ধভাবে সীমাবদ্ধ, তবে আত্মা আবার একই সময়ে সীমাতিক্ৰমণতা, ভাববস্তু। শুধু নগর ও জাতিই নয়, প্রতিষ্ঠানের মতো বিমূর্ত ব্যাপারগুলোও নারীত্বের গুণাবলিতে ভূষিত : গির্জা, সিনেগগ, প্রজাতন্ত্র, মানবজাতি নারী; শান্তি, যুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিপ্লব, বিজয়ও তাই। নারী হচ্ছে আত্মা ও ভাব, তবে সে এদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারিণীও : সে হচ্ছে স্বর্গীয় করুণা, খ্রিস্টধর্মীকে যে পথ দেখিয়ে নেয় ঈশ্বরের দিকে, সে বিয়াত্রিসে, যে দান্তেকে পথ দেখিয়ে নেয় দূরান্তরে, সে লরা, যে পেত্রার্ককে ডাকে কবিতার উচ্চতম শিখরের দিকে। যে-সব মতবাদ সমন্বিত করে প্রকৃতি ও চেতনাকে, সেগুলোতে সে দেখা দেয় সঙ্গতি, যুক্তিশীলতা, সত্য রূপে। নস্টিক ধর্মগোত্রগুলো প্রজ্ঞাকে দিয়েছিলো নারীরূপ, সোফিয়া, যার কাজ বিশ্বকে এবং এমনকি তার সৃষ্টিকে পরিত্রাণ করা। এখানে নারীকে আমরা আর মাংসরূপে দেখতে পাই না, দেখি মহিমান্বিত বস্তুরূপে; সে আর অধিকৃত হওয়ার নয়, বরং ভক্তি করতে হবে তাকে তার অক্ষুন্ন গৌরবে; পোর মলিন মৃতরা জল, বায়ু, স্মৃতির মতো তরল; শিভলীয়প্রেমে, লে প্রেসিওতে, এবং রোমান্সের সমগ্র ধারা ভরে, নারী আর কোনো পাশব জীব নয়, বরং সে এক বায়বীয় সত্তা, প্রশ্বাস, শিখাহীন দীপ্তি। এভাবেই নারী নিশীথের অনচ্ছতা রূপান্তরিত হয় স্বচ্ছতায়, এবং খলতা রূপান্তরিত হয় শুদ্ধতায়।
নারীর নিম্নমুখি প্রভাব যায় পাল্টে; সে আর পুরুষকে পৃথিবীর দিকে ডাকে না, ডাকে আকাশের দিকে। ফাউস্ট-এর শেষভাগে এটা ঘোষণা করেন গ্যেটে :
শাশ্বতী নারী
ইশারা করে আমাদের উর্ধ্ব অভিমুখে।
কুমারী মেরি যেহেতু সবচেয়ে সম্পূর্ণরূপে রূপায়িত ও সাধারণভাবে পূজিত নারী ভাবমূর্তি, যে উৎসর্গিত শুভর কাছে, তাই সে কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সাহিত্য ও চিত্রকলায়, সেটা দেখা হবে বেশ আকর্ষণীয়। নিচে উদ্ধৃত হলো মেরির উদ্দেশে নিবেদিত মধ্যযুগের এক ঐকান্তিক খ্রিষ্টধর্মীর প্রার্থনাগীত :
.. অতিশয় মহৎ কুমারী,তুমি উর্বর শিশির, আনন্দের ফোয়ারা, করুণার প্রণালি, প্রাণময় জলের কূপ যা শীতল করে আমাদের অনুভূতির উত্তাপ।
তুমি সেই স্তন যা ঈশ্বর পান করতে দিয়েছে অনাথদের…
তুমি সেই মজ্জা, ক্ষুদ্র কণা, সমস্ত ভালো জিনিশের শাঁস,
তুমি সেই প্রতারণাহীন নারী যার প্রেম কখনো বদলায় না…
তুমি সেই সূক্ষ্ম চিকিৎসক যার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না সালেরনো বা মতপেলিয়েরে…
তুমি নিরাময় হাতের নারী… তুমি হাঁটাও পক্ষাঘাগ্রস্তদের, তুমি সংশোধন করো হীনকে, তুমি বাঁচিয়ে তোলা মৃতকে।
এসব আবাহনে আমরা আবার দেখতে পাই আমাদের আলোচিত নারীর অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য। কুমারী মেরি হচ্ছে উর্বরতা, শিশির, জীবনের নিঝর; বহু ক্ষুদ্র প্রতিমূর্তিতে তাকে দেখা যায় কুয়ো, নিঝর, ফোয়ারার পাশে একটি বহুলব্যবহৃত পদ হচ্ছে ‘জীবনের ফোয়ারা’; সে সৃষ্টিশীল নয়, তবে সে ফলবতী করে, যা মাটির নিচে গুপ্ত ছিলো, সেগুলোকে সে বিকশিত করে দিনের আলোতে। সে হচ্ছে বস্তুর প্রতিভাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীর বাস্তবতা : শাঁস, মজ্জা। তার মাধ্যমে বাসনা প্রশমিত হয় : সে তাই, যা পুরুষের পরিতৃপ্তির জন্যে দেয়া হয়েছে পুরুষকে। সে নিরাময় করে ও বলশালী করে; সে মানুষ ও জীবনের সঞ্চারিকা; জীবন আসে ঈশ্বরের কাছে থেকে, সুতরাং সে মানবজাতি ও ঈশ্বরের সঞ্চারিকা। তারতুলিয়ান তাকে বলেছিলেন ‘শয়তানের প্রবেশদ্বার’; কিন্তু, মহিমান্বিত রূপ লাভ করে, সে হয়ে উঠেছে স্বর্গের প্রবেশদ্বার। চিত্রকলায় আমরা তাকে দেখতে পাই যে সে খুলছে স্বর্গের দিকের কোনো দরোজা বা জানালা, বা মই স্থাপন করছে পৃথিবী ও নভোমণ্ডলের মাঝখানে। তাকে আরো সরাসরি দেখানো হয়প্রবক্তারূপে, যে মানুষের জন্যে ওকালতি করছে তার পুত্রের কাছে, এবং শেষবিচারের দিনে, বক্ষ নগ্ন করে, দীনভাবে কৃতাঞ্জলিপুটে তার গৌরবান্বিত মাতৃত্বের নামে প্রার্থনা করছে খ্রিস্টের কাছে। সে রক্ষা করে শিশুদের, এবং তার করুণাময় প্রেম সব বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে মানুষকে অনুসরণ করে সমুদ্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে। সে স্বর্গীয় ন্যায়বিচারকে দুলিয়ে সুস্মিত হাসিতে ভারি করে তোলে দাঁড়িপাল্লার দয়ার দিক।
এ-করুণা ও কোমলতার ভূমিকা নারীকে দেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলোর একটি। যখন নারী পরিপূর্ণরূপে সংহত হয়ে যায় সমাজের সাথে তখনও সে সূক্ষ্মভাবে প্রসারিত করে তার সীমা, কেননা তার আছে জীবনের বিশ্বাসঘাতক মহানুভবতা। পুরুষ দেবতারা নির্দেশ করে নিয়তি; দেবীদের মধ্যে দেখা যায় স্বেচ্ছাচারী হিতাকাঙ্খা, লীলাময় অনুগ্রহ। খ্রিস্টীয় বিধাতা সুবিচার কঠোরতায় পরিপূর্ণ, কুমারী পরিপূর্ণ দাক্ষিণ্যের বদান্যতায়। পৃথিবীতে পুরুষেরা রক্ষাকারী আইন, যুক্তিশীলতা, প্রয়োজনের। নারী নিরাময় করে পুরুষের ক্ষত, সে লালনপালন করে নবজাত শিশু, এবং সৎকারের জন্যে প্রস্তুত করে মৃতকে। কবিতার কাজ হচ্ছে যা আছে প্রতিদিনের গদ্য পেরিয়ে, তাকে ধরা; এবং নারীং হচ্ছে বিশেষভাবে এক কাব্যিক বাস্তবতা, কেননা পুরুষ তার ওপর প্রক্ষেপ করে সে সব, যা সে হতে চায় না। নারী প্রতিমূর্তিত করে স্বপ্নকে, পুরুষের কাছে যা সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ও সবচেয়ে অদ্ভুত।
নারী যেহেতু পুরুষের কাব্যকর্মের একান্ত বিষয়, তাই বোঝা যায় যে নারী দেখা দেবে পুরুষের প্রেরণারূপে, কাব্যদেবীরা নারী। কাব্যদেবী মধ্যস্থতা করে স্রষ্টা ও তার প্রাকৃতিক নির্ঝরগুলোর মধ্যে, যা থেকে আহরণ করতে হয় তাকে। নারীর চেতনা গভীরভাবে প্রকৃতির ভেতরে মগ্ন, এবং তার মাধ্যমেই পুরুষ জানার চেষ্টা করে নৈঃশব্দ্যের গভীরতার ও রাত্রির উর্বরতার অভিপ্রায়। কাব্যদেবী নিজে কিছুই সৃষ্টি করে; সে এক শান্ত, বিজ্ঞ সিবিলে, যে বশ মেনে নিজেকে সমর্পণ করেছে এক প্রভুর সেবায়। মূর্ত ও বাস্তবিক এলাকায় তার উপদেশ হবে অসার। পুরুষ চায় নারীর ‘বোধি’ যেমন সে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে তারামণ্ডলকে। এ-ধরনের ‘বোধি’কে সঞ্চারিত করা হয় এমনকি ব্যবসা ও রাজনীতিতে; আম্পাসিয়া ও মাদাম দ্য তেনোঁ আজো সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের পেশা।
পুরুষ অন্য যে-একটি এলাকায় দায়িত্ব দেয় নারীকে, সেটি মূল্যায়নের এলাকা; নারী এক বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত বিচারক। পুরুষ অপর-এর স্বপ্ন দেখে শুধু তাকে অধিকার করার জন্যে নয়, তার দ্বারা অনুসমর্থিত হওয়ার জন্যেও; অন্য পুরুষদের দ্বারা, তার সমকক্ষদের দ্বারা অনুসমর্থিত হওয়ার জন্যে পুরুষকে থাকতে হয় স্থায়ী মানসিক চাপের মধ্যে; তাই সে চায় বাইরে থেকে বিবেচনা করে কেউ তার জীবনকে, তার কর্মোদ্যোগকে, এবং তাকে ভূষিত করুক ধ্রুব মূল্যে। বিধাতার বিবেচনা গুপ্ত, বৈরি, দুশ্চিন্তাজনক; এমনকি খুব কম সংখ্যক অতীন্দ্রিয় সাধকই এটা কামনা করেছেন। এ-ঐশ্বরিক ভূমিকা অধিকাংশ সময়ই হস্তান্তরিত হয়ে এসে পড়েছে নারীর ওপর। যেহেতু সে অপর, সে থাকে পুরুষের জগতের বাইরে এবং এটি সে দেখতে পায় বস্তুগতভাবে; এবং পুরুষের কাছে থেকে ও তার অধীনস্থ হয়ে সে পুরুষের বিরোধী কোনো মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করে না। নারী পুরুষের বিগড়ে যাওয়া জগতের বাইরের; তার সমস্ত পরিস্থিতি তার জন্যে নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট দর্শকের। ভূমিকা। নাইট তার নারীর জন্যে নামে অস্ত্রপ্রতিযোগিতায়; কবি চায় নারীর অনুমোদন। প্যারিস জয়ের অভিযাত্রায় বেরোনোর আগে রাস্তিগনায় প্রথমে চায় নারী, তবে সে তাদের শারীরিকভাবে অধিকার করতে বিশেষ চায় নি, সে চেয়েছিলো সেই খ্যাতি, যা শুধু নারীরা দিতে পারে পুরুষকে। বালজাক তাঁর নিজের যৌবনের কাহিনী প্রক্ষিপ্ত করেছেন তাঁর তরুণ নায়কদের মধ্যে : সে নিজেকে শিক্ষিত ও রূপায়িত করতে শুরু করে তার থেকে জ্যেষ্ঠ উপপত্নীদের সংস্পর্শে। নারীকে শিক্ষাদাত্রীর ভূমিকা দেয়া হয়েছে ফ্লুবেরের এদিকাসিয়ে সাঁতিমাতাল-এ, স্তেদালের উপন্যাসে, এবং শিক্ষানবিশির আরো অনেক গল্পে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে নারী হচ্ছে ফিসিস ও অ্যান্টি-ফিসিস : অর্থাৎ সে সমাজের যতোটা প্রতিমূর্তি, প্রকৃতিরও ততোটাই; তার মধ্যেই সাররূপ লাভ করে বিশেষ পর্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতি, যেমন আমরা দেখতে পাই শিভলরির কবিতায়, দেকামেরন-এ, আন্ত্রিতে। সে সূচনা করে নতুন ফ্যাশনের, নেত্রীত্ব করে সলতে, প্রভাবিত ও প্রতিফলিত করে মতামত। খ্যাতি ও গৌরব হচ্ছে নারী; এবং মালার্মে বলেছেন, ‘জনতা হচ্ছে নারী’। তরুণেরা নারীর সাহচর্যের মধ্যে দীক্ষিত হয় ‘সমাজ’-এ, এবং জীবন নামক জটিল বাস্তবতায়। নারী হচ্ছে সেই বিশেষ পুরস্কার, যা অবধারিতভাবে জয় করে নায়কেরা, অভিযাত্রীরা, এবং কর্কশ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা। প্রাচীনকালে আমরা দেখতে পাই পার্সিউস মুক্ত করছে অ্যান্ড্রোমিডাকে, পাতাললোকে অফিউস খুঁজছে ইউরিদিসকে, এবং সুন্দরী হেলেনকে রক্ষার জন্যে যুদ্ধ করছে ট্রয়। শিভলরির উপন্যাসের প্রধান বিষয়ই হচ্ছে বন্দিনী রাজকুমারীদের মুক্ত করার শৌর্যবীর্য। সুন্দর রাজকুমারের কী হতো কাজ যদি সে ঘুম ভাঙাতে নিদ্রিতা রূপসীর? রাজা বিয়ে করছে রাখালকন্যাকে, এ-উপকথা পুরুষকে যতোটা তৃপ্ত করে, ততোটাই করে নারীদের। ধনী পুরুষ দরকার বোধ করে দান করার, নইলে তার নিরর্থক ধন থেকে যায় এক নিষ্কর্ষ : তার কাছাকাছি কারো থাকা দরকার, যাকে সে দিতে পারে। সিন্ডেরেলা উপকথা বিকাশ লাভ করে বিশেষ করে আমেরিকার মতো ধনী দেশে। সেখানে পুরুষেরা তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ নারীর পেছনে ব্যয় না করে কী করবে?
এটা স্পষ্ট যে পুরুষ নিজেকে দাতা, মুক্তিদাতা, ভ্রাতা, পাপমোচনকারীরূপে স্বপ্ন দেখে কামনা করে তার কাছে নারীর অধীনতা; কেননা নিদ্রিতা রূপসীকে জাগানোর জন্যে তাকে আগে ঘুম পাড়ানো দরকার : বন্দিনী রাজকুমারী থাকতে হলে সেখানে থাকতে হবে রাক্ষসখোক্ষস। পুরুষ যতোই কঠিন কর্মোদ্যোগের রুচি অর্জন করে, সে ততোই সুখ বোধ করে নারীকে স্বাধীনতা দিতে। তবে উপহার বা মুক্তি দানের থেকে জয় করা অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর।
তাই গড়পড়তা পশ্চিমি পুরুষের কাছে সে-ই হচ্ছে আদর্শ নারী, যে সানন্দে মেনে নেয় পুরুষের আধিপত্য, যে আলোচনা না করে পুরুষের চিন্তাভাবনা মেনে নেয় না, তবে সে নতি স্বীকার করে পুরুষের যুক্তির কাছে, সে বুদ্ধির সাথে পুরুষকে প্রতিরোধ করে এবং শেষ করে পুরুষের মতে বিশ্বাসী হয়ে। পুরুষের দুঃসাহসিক কাজ যতো বেশি বিপদসঙ্কুল, তার গর্ব ততো বেশি : একটি বশমানা সিন্ডেরেলাকে বিয়েকরার থেকে পেন্থেসিলিয়াকে জয় করা অনেক বেশি তৃপ্তিকর। ‘যোদ্ধা ভালোবাসে বিপদ ও আমোদ,’ বলেছেন নিটশে; ‘তাই সে ভালোবাসে নারী, সব আমোদর মধ্যে যে সবচেয়ে বিপজ্জনক’। যে-পুরুষ বিপদ ও আমোদ পছন্দ করে, সে নারীকে আমাজনে রূপান্তরিত হতে দেখে অসন্তুষ্ট হয় না, যদি তার ভেতরে আশা জেগে থাকে যে সে পরাভূত করতে পারবে নারীটিকে। তার অন্তরের অন্তস্তলে সে যা পোষণ করে, তা। হচ্ছে এ-যুদ্ধ তার জন্যে হবে এক খেলা, আর নারীর জন্যে হবে একান্ত নিয়তি। সে ত্রাতা বা বিজয়ী যাই হোক, পুরুষের প্রকৃত বিজয় হচ্ছে : নারী তাকে সানন্দে স্বীকার করে নেবে নিজের নিয়তি বলে।
নারীকে মাঝেমাঝেই তুলনা করা হয়েছে জলের সাথে; সে হচ্ছ আয়না, যাতে পুরুষ, নার্সিসাসধর্মী, নিবিষ্টভাবে দেখে নিজেকে : সরল বিশ্বাসে বা প্রতারণার জন্যে সে হেলে পড়ে নারীর দিকে। নারী হচ্ছে তার জন্যে পরম ক্ষতিপূরণ, কেননা তার কাছে অচেনা এক আকৃতিতে, যা সে অধিকার করতে পারে নারীর মাংসে, নারী হচ্ছে তার নিজের দেবত্ব-অর্জন। সে আলিঙ্গন করে এ ‘অতুলনীয় দানবী’টিকে, যখন সে নিজের বাহুতে বাঁধে সে-সত্তাটিকে, যে তার কাছে বিশ্বের সারসংক্ষেপ এবং যার ওপর সে চাপিয়ে দিয়েছে তার মূল্যবোধ ও বিধিবিধান। তারপর, সে নিজের করে নিয়েছে যে-অপরকে, তার সাথে মিলিত হতে গিয়ে সে আশা পোষণ করে নিজের মধ্যে পৌঁছোতে। সম্পদ, শিকার, আমোদ ও বিপদ, সেবিকা, পথপ্রদর্শক, বিচারক, মধ্যস্থতাকারিণী, আয়না, নারী হচ্ছে সেই অপর, যার মধ্যে কর্তা সীমাবদ্ধ না থেকে করে নিজের সীমাতিক্রমণ, যে তার বিরোধিতা করে তাকে অস্বীকার না করে; তাই পুরুষের সুখ ও বিজয়ের জন্যে নারী এতো প্রয়োজনীয় যে বলা যেতে পারে যদি নারী থাকতো, তাহলে পুরুষ তাকে আবিষ্কার করতো।
তারা তাকে আবিষ্কার করেছে। ‘পুরুষ সৃষ্টি করেছে নারী, এবং কী দিয়ে? তার দেবতার পাঁজরের, তার আদর্শের একটি অস্থি দিয়ে, ‘দি টুইলাইট অফ দি গডস-এ বলেছেন নিটশে। কিন্তু নারী আছে তাদের আবিষ্কারশক্তি থেকে দূরেও। এবং তাই সে শুধু পুরুষের স্বপ্নের প্রতিমূর্তিই নয়, তার হতাশাও। এমন কোনো অলঙ্কৃত ভাবমূর্তি নেই নারীর, যা সাথে সাথে তার বিপরীত রূপকে স্মরণ করিয়ে দেয় না : সে জীবন ও মৃত্যু, প্রকৃতি ও ছল, দিবালোক ও রাত্রি। যে-বৈশিষ্ট্যেই আমরা তাকে বিবেচনা করি না কেননা, আমরা দেখতে পাই একই এগোনো ও পিছোননা, কেননা পরিহার্য দরকারবশতই ফিরে আসে অপরিহার্যের কাছে। কুমারী মেরি ও বিয়াত্রিসের আদর্শরূপের মধ্যে আজো বেঁচে আছে হাওয়া ও সির্সি।
যেহেতু নারী এক মিথ্যে অসীমতা, সত্যতাহীন এক আদর্শ, তাই সে দেখা দেয় সসীমতা ও মাঝারিত্ব রূপে, এবং একই কারণে, মিথ্যাচারিতারূপে। লাফর্গে সে দেখা দেয় এভাবেই। ওফেলিয়া, সালোমে আসলে নিতান্তই খর্ব নারী। নারী স্বপ্ন দেখায় পুরুষকে; তবু নারী আরামের কথা ভাবে, রাতের খাবারের জন্যে ভাবে স্টিউর কথা; পুরুষ তার কাছে যখন তার আত্মার কথা বলে, তখন সে নিতান্তই এক শরীর।
পুরুষ সফল হয়েছে নারীকে দাসী বানাতে; তবে একই মাত্রায় পুরুষ তাকে বঞ্চিত করেছে সে-জিনিশ থেকে, যার জন্যে তাকে অধিকারে আনা মনে হয়েছে কাম্য। পরিবারে ও সমাজে সংহত হয়ে নারীর যাদু রূপান্তরিত না হয়ে অপচয়িত হয়ে গেছে; যে ছিলো প্রকৃতির সমস্ত সম্পদের প্রতিমূর্তি, দাসীর পর্যায়ে নেমে গিয়ে সে আর আগের সেই অজেয় শিকার থাকে নি। শিভলরীয় প্রেমের উদ্ভব থেকে একটি গতানুগতিক কথা হচ্ছে যে বিয়ে হত্যা করে প্রেম। নিদারুণ অবজ্ঞার পাত্র হয়ে, অতিশয় ভক্তি পেয়ে, অতিশয় দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে, স্ত্রী হারিয়ে ফেলেছে তার কামের আবেদন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মূল লক্ষ্য ছিলো নারীর কবল থেকে পুরুষকে রক্ষা করা; নারী হয়ে ওঠে পুরুষের সম্পত্তি। কিন্তু আমরা যে-সবের মালিক সে-সবও হয়ে ওঠে আমাদের মালিক, এবং বিয়ে পুরুষের জন্যেও এক ধরনের দাসত্ব। সে ধরা পড়ে প্রকৃতির পাতা ফাঁদে : যেহেতু সে চেয়েছে একটি টাটকা তরুণী, তাই তাকে জীবনভর ভরণপোষণ করতে হয় একটি ভারি মেয়েলোককে বা একটি শুটকি বুড়ীকে। তার অস্তিত্বকে অলঙ্কৃত করার সুকুমার রত্নটি হয়ে ওঠে এক ঘৃণ্য বোঝা; জানতিপ্পি ধরনের নারী চিরকালই পুরুষের কাছে ভীতিকর; প্রাচীন গ্রিসে ও মধ্যযুগে সে হয়ে উঠেছিলো বহু বিলাপের বিষয়বস্তু। কিন্তু নারী যখন তরুণী, তখনও বিয়েতে থাকে এক ধোকাবাজি, কেননা কামের সামাজিকীকরণ করতে গিয়ে এটি সফল হয় শুধু কামকে হত্যা করতে।
ঘটনা হচ্ছে যে কাম জানায় সমইয়ের বিরুদ্ধে মুহূর্তের, দলের বিরুদ্ধে ব্যক্তির দাবি; এটা যোগাযোগের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা করে বিচ্ছিন্নতা; এটা সব বিধিবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; এর মধ্যে আছে সমাজের বিরোধী নীতি। প্রথা কখনোই পুরোপুরি নত হয় নি সংস্থা ও বিধিবিধানের কাছে; প্রেম সব সময়ই দেখিয়েছে অবাধ্যতা। গ্রিসে ও রোমে ইন্দ্রিয়াতুর রূপে প্রেম চালিত হয়েছিলো তরুণ ও পতিতাদের দিকে; শিভলরীয় প্রেম, যা ছিলো যুগপৎ শারীরিক ও পাততায়ী, সব সময়ই তার লক্ষ্য ছিলো পরকীয়া। বিস্তান হচ্ছে ব্যভিচারের মহাকাব্য। যে-পর্বে, ১৯০০র দিকে, সৃষ্টি হয়। নারীর নতুন কিংবদন্তি, তখন ব্যভিচার বিষয় হয়ে ওঠে সমস্ত সাহিত্যের। ব্যভিচার লোপ পেতে পারে শুধু বিয়ের সাথে। যেহেতু বিয়ের একটি লক্ষ্য হচ্ছে তার নিজের স্ত্রীর থেকে পুরুষকে অনাক্রম্য করা : কিন্তু অন্য নারীরা স্বামীর জন্যে–ছড়িয়ে রাখে তাদের উচণ্ড আবেদন; এবং তাদের দিকেই সে এগোয়। নারীরা এতে সহযোগী। করে তোলে নিজেদের। এর কারণ বস্তুর এমন বিন্যাসের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করে, যা তাদের বঞ্চিত করতে চায় তাদের অস্ত্র থেকে। নারীকে দেয়া হয়েছে শুধু বন্দিনী হওয়ার স্বাধীনতা; সে শুধুই প্রাকৃতিক বস্তু হিশেবে নিজের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্যে প্রত্যাখ্যান করে এ-মানবিক সুবিধা। দিনভর দুরাচারিণীরূপে সে পালন করে তার। বশমানা দাসীর ভূমিকা, কিন্তু রাতে সে রূপান্তরিত হয় বেড়ালীতে, বা হরিণীতে; সে আবার ঢুকে পড়ে তার সাইরেনের চামড়ার ভেতরে, বা কোনো ঝড়তে চড়ে যাত্রা করে শয়তানের নৃত্যোৎসবের দিকে। কখনোকখনো সে তার নিজের স্বামীর ওপরই প্রয়োগ করে তার নৈশ ইন্দ্রজাল; তবে তার প্রভুর কাছে থেকে তার রূপান্তররাশি লুকিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ; তাই তার নিয়তিই হচ্ছে অসতীত্ব : এটাই তার মুক্তির একান্ত মূর্তরূপ। এমনকি তার কামনা, চিন্তা, সচেতনা পেরিয়ে সে অবিশ্বাসিনী; যেহেতু তাকে গণ্য করা হয় বস্তু হিশেবে, তাই সে নিবেদিত হতে পারে যে তাকে অধিকার করতে সম্মত, এমন যে-কোনো কর্তার কাছে। হারেমে বন্দী থেকে, অবগুণ্ঠনের আড়ালে গুপ্ত থেকেও নিশ্চিত নয় যে সে কারো ভেতরে কামনা জাগিয়ে তুলবে না; এবং কোনো অপরিচিতের মনে কামনা জাগানো হচ্ছে স্বামী ও সমাজকে প্রত্যাখ্যান করা। অধিকাংশ সময়ই সে এ-দুষ্কর্মের আগ্রহী সহযোগী; শুধু প্রতারণা ও ব্যভিচারের মধ্য দিয়েই সে প্রমাণ করতে পারে যে সে কারো অস্থাবর সম্পত্তি নয়। স্বামীর ঈর্ষা কেননা এতো দ্রুত জেগে ওঠে তার কারণ এ-ই; উপকথায় দেখতে পাই অকারণেই সন্দেহ করা হয় নারীদের, তুচ্ছতম সন্দেহে, ব্রাবাতের জেনেভিয়েভ ও দেসদিমোনার মতো, দণ্ডিত করা হয় তাদের। এমনকি যখন কোনো সন্দেহ দেখা দেয় নি, তখনও গ্রিসেলদাকে যেতে হয়েছে কঠোর অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে; একাহিনী হতো উদ্ভট যদি নারীদের আগে থেকেই সন্দেহ করা না হতো; তার অপরাধ প্রমাণের কোনো কথাই ওঠে না; তার সতীত্ব প্রমাণের দায়িত্ব তারই।
ঈর্ষা কেনো চির-অতৃপ্ত, তার কারণ এ-ই। আমরা দেখেছি যে অধিকার কখনোই সদর্থকভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে না; যদি আর সকলকেও সেখানে ডুব দিতে নিষিদ্ধ করা হয়, তবু যে-ঝরনাধারায় তার তৃষ্ণা মেটে সে তার মালিক হয় না : যে ঈর্ষাকাতর, সে এটা জানে ভালোভাবে। সারসত্তায় নারী হচ্ছে অস্থির, জল যেমন তরল; এবং কোনো মানবিক শক্তিই প্রাকৃতিক সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না। সাহিত্য ভরেই, যেমন আরব্যরজনীতে তেমনি দেকামেরন-এ, আমরা দেখতে পাই নারীর ধূর্ততা জয়ী হচ্ছে পুরুষের সাবধানতার ওপর। অধিকন্তু, শুধু একলা নিজের ইচ্ছেয়ই পুরুষ কারারক্ষক হয়ে ওঠে নি : সমাজই তাকে–পিতা, ভ্রাতা, স্বামী রূপেদায়ী করে তার নারীর আচরণের জন্যে। নারীর ওপর সতীত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়। আর্থনীতিক ও ধর্মীয় কারণে, কেননা প্রতিটি নাগরিককে সপ্রমাণিত হতে হয় তার আসল পিতার পুত্ররূপে।
তবে এটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে সমাজ তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে যে-ভূমিকা, তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য করতে হবে নারীকে। পুরুষের রয়েছে এক দ্বিগুণ দাবি, যা নারীকে কপটতার আশ্রয় নিতে বাধ্য করে : পুরুষ চায় নারী হবে তার এবং থাকবে তার সাথে অসম্পর্কিত; পুরুষ স্বপ্ন দেখে তাকে যুগপৎ দাসী ও মোহিনীরূপে পাওয়ার। কিন্তু প্রকাশ্যে সে স্বীকার করে শুধু প্রথমটি; অপরটি এমন প্রতারণাপূর্ণ। বাসনা যে সে তা লুকিয়ে রাখে তার হৃদয় ও মাংসের সংগোপনীয়তার ভেতরে। এটা নৈতিকতা ও সমাজ বিরোধী; এটা অপর-এর মততা, বিদ্রোহপরায়ণ প্রকৃতির মতো, নষ্ট মেয়েলোক-এর মতো খল। পুরুষ যে-শুভকে প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রয়োগ করেছে বলে দাবি করে, তার কাছে পুরুষ নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করে না; সে খারাপের সাথে রক্ষা করে লজ্জাজনক সম্পর্ক। কিন্তু যখনই ওই খারাপ অসতর্ক সাহসে খুলে দেখায় তার মুখ, পুরুষ তার বিরুদ্ধে লিপ্ত হয় যুদ্ধে। রাত্রির ছায়ার তলে পুরুষ নারীকে আমন্ত্রণ জানায় পাপে। কিন্তু পূর্ণ দিবালোকে সে অস্বীকার করে পাপ ও নির্দোষ পাপীকে। এবং নারীরা, শয্যার গোপনীয়তার ভেতরে যারা পাপী, প্রকাশ্যে আরো বেশি সংরক্ত হয়ে ওঠে সতীত্বের পুজোয়।
অন্য দিকে নারী যদি কৌশলে এড়িয়ে যায় সমাজের নিয়ম, তখন সে ফিরে যায় প্রকৃতির কাছে ও শয়তানের কাছে, সে সমষ্টির মধ্যে মুক্ত করে দেয় অদম্য ও অশুভ শক্তিরাশি। নারীর কামুক আচরণের নিন্দার সাথে সব সময়ই জড়িয়ে থাকে ভয়। স্বামী তার স্ত্রীকে সৎপথে রাখতে সফল না হলে সে ভাগী হয় স্ত্রীর দোষের; সমাজের চোখে তার দুর্ভাগ্য হয়ে ওঠে তার মানসম্মানের ওপর একটি কলঙ্ক; অনেক কঠোর। সভ্যতা আছে, যেগুলো স্ত্রীর অপরাধ থেকে নিজেকে বিশ্লিষ্ট করার জন্যে স্বামীকে বাধ্য করে দোষীকে হত্যা করতে। অনেকগুলোতে অপরের সন্তোষ বিধানে আগ্রহী স্বামীকে শাস্তি দেয়া হয় ব্যঙ্গতামাসার মধ্যে, তাকে ন্যাংটো করে দু-পা দু-দিকে ঝুলিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে ঘোরানো হয়। এবং সারা সমাজ কঠোর শাস্তি দেয় অপরাধীকে : স্ত্রী শুধু একলা স্বামীর বিরুদ্ধে অপরাধ করে নি, করেছে সম্পূর্ণ সমাজের বিরুদ্ধে। এসব প্রথা অতিশয় কঠোরভাবে প্রচলিত ছিলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন অতীন্দ্রিয়বাদী স্পেনে, মাংস দিয়ে সন্ত্রস্ত এক ইন্দ্রিয়পরায়ণ দেশে। কালদেরন সর্কা, ভালে ইনক্লান বহু নাটকে ব্যবহার করেছেন এ-বিষয়। লর্কার হাউজ অফ বার্নাদায় গ্রাম্য পরচর্চাকারীরা ধর্ষিত মেয়েটিকে শাস্তি দেয় ‘যে-স্থানে সে পাপ করেছে’ সেখানে জ্বলন্ত কয়লার টুকরো পুড়িয়ে। ভালে ইনক্লানের ডিভাইন ওয়ার্ডস-এ ব্যভিচারিণী নারীটি দেখা দেয় শয়তানের সাথে নৃত্যরত অভিচারিণীরূপে, তার অপরাধ একবার ধরা পড়ার সাথে সাথে সারা গ্রাম জড়ো হয়ে ছিড়েফেড়ে ফেলে তার কাপড়চোপড়, তারপর তাকে জলে ডুবিয়ে মারে। বহু প্রথানুসারে, পাপী নারীকে এভাবে ন্যাংটো করা হতো; তার দিকে ছোঁড়া হতে পাথর, যেমন জানানো হয়েছে বাইবেলে, বা তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো, চুবিয়ে মারা হতো, বা পুড়িয়ে মারা হতো। এসব পীড়নের অর্থ হচ্ছে সামাজিক মর্যাদা বঞ্চিত করে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রকৃতির কাছে; তার পাপ দিয়ে সে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো অশুভর প্রাকৃতিক প্রবাহ।
কুসংস্কার কমতে থাকার সাথে সাথে কমে এ-প্রচণ্ড বর্বরতা এবং দূর হয় ভয়। কিন্তু পল্লী অঞ্চলে আজো নাস্তিক জিন্সিদের গৃহহীন ভবঘুরে হিশেবে দেখা হয় সন্দেহের চোখে। যে-নারী যথেচ্ছ ব্যবহার করে তার আকর্ষণকে–সাহসিকা, ছলনাময়ী, করালী রূপসী–আজো হয়ে আছে উদ্বেগজাগানো নারী। হলিউডের ছায়াছবির নষ্ট নারীর মধ্যে আজো বেঁচে আছে সির্সির ভাবমূর্তি। নারীদের ডাইনিরূপে পুড়িয়ে মারা হয়েছে শুধু এ-কারণে যে তারা ছিলো রূপসী। অনৈতিক জীবনযাপনকারী নারীদের সামনে মফস্বলীয় সতীত্বের বিনয়াভিমানপূর্ণ অসন্তুষ্টির মধ্যে আজো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে প্রাচীন এক ভীতি।
প্রকৃতপক্ষে এসব বিপদই দুঃসাহসিক পুরুষের কাছে নারীকে করে তোলে এক প্রলোভনজাগানো শিকার। বৈবাহিক অধিকারকে অবজ্ঞা করে এবং সমাজের বিধানের সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে, পুরুষ দ্বৈরথে তাকে জয় করার চেষ্টা করে। নারীটি প্রতিরোধ করলেও পুরুষ তাকে অধিকার করতে চায়; পুরুষ নারীটির পেছনে ধাওয়া করে সেই স্বাধীনতার সাথে, যার মাধ্যমে নারীটি এড়িয়ে যায় তাকে। নিস্ফলভাবে। কেউ যখন স্বাধীন থাকে, তখন সে কোনো ভূমিকায় অভিনয় করে না : স্বাধীন নারী মাঝেমাঝেই পুরুষের বিরুদ্ধে করে এমন অভিনয়। এমনকি নিদ্রিতা রূপসীও ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে পারে অসন্তোষের মধ্যে, যে তাকে জাগিয়েছে তাকে সে সুদর্শন রাজকুমার বলে মনে নাও করতে পারে, সে মধুরভাবে হাসতে নাও পারে। বীরের স্ত্রী নিস্পৃহভাবে শোনে তার দুঃসাহসিক কর্মগুলোর উপাখ্যান; কবি স্বপ্ন দেখে যেকাব্যদেবীর, সে হয়তো তার স্তবকরাশি শুনতে শুনতে হাই তোলে। আমাজন অবসাদবশত যুদ্ধে নামতে নাও পারে; এবং সে বিজয়ীও হতে পারে। অবক্ষয়ের যুগের রোমের নারীরা, আজকের বহু নারী, পুরুষের ওপর চাপিয়েদেয় তাদের লীলাচাপল্য বা তাদের নিয়ম। কোথায় সিন্ডেরেলা?
পুরুষ দিতে চায়, এবং এখন এমন নারী আছে, যে নিজের জন্যে নেয়। এটা হয়ে উঠছে আত্মরক্ষার বিষয়, এটা আর খেলা নয়। নারী যখন স্বাধীন সে-মুহূর্ত থেকে সে স্বাধীনভাবে যা সৃষ্টি করে নিজের জন্যে, তা ছাড়া তার আর কোনো নিয়তি নেই। তারপর থেকে দুটি লিঙ্গের সম্পর্ক হচ্ছে সংগ্রামের সম্পর্ক। এক সহচর ব্যক্তি হয়ে নারী এখন হয়ে উঠেছে ততোটা ভীতিকর, যতোটা ছিলো যখন সে পুরুষের মুখোমুখি দাঁড়াতো বৈরী প্রকৃতির অংশ হয়ে। পরিশ্রমী মৌমাছি বা মা মুরগির কিংবদন্তির বদলে দেখা দিয়েছে এখন গোগ্রাসে গেলা স্ত্রী-পতঙ্গের কিংবদন্তি : আরাধনাকারী ম্যান্টিস, মাকড়সা। সে আর সে-নারী নেই যে লালন করতো নবজাত শিশু, বরং সে এমন নারী, যে পুরুষ খায়; ডিম্ব আর প্রাচুর্যের গোলাঘর নয়, বরং এটা এক জড় বস্তুর ফাঁদ, যার ভেতরে শুক্রাণুকে খোজা ও মগ্ন করা হয়। জরায়ু, সেই উষ্ণ, শান্তিময়, ও নিরাপদ নির্জন আশ্রয় হয়ে উঠেছে রসের মণ্ড, এক মাংসাশী উদ্ভিদ, এক অন্ধকার, সংকোচনসক্ষম উপসাগর, যেখানে বাস করে একটি সাপ, যে অশেষ ক্ষুধায় গেলে। পুরুষের শক্তি। একই দ্বান্দ্বিকতা আশ্লেষের বস্তুকে করে তোলে কৃষ্ণ যাদুর অধিকারী, দাসীকে করে বিশ্বাসঘাতকিনী, সিন্ডেরেলাকে রাক্ষসী, এবং সব নারীকে রূপান্তরিত করে শত্রুতে : পুরুষ যে প্রতারণা করে নিজেকে একমাত্র অপরিহার্য বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো, এটা হচ্ছে তার মূল্য পরিশোধ।
তবে এ-বৈরী মুখমণ্ডলই অন্যগুলোর থেকে নারীর অধিকতর চূড়ান্ত মুখাবয়ব নয়। বরং নারীর অন্তরে প্রবর্তিত হয়েছে এক ম্যানিকীয়বাদ। পিথাগোরাস শুভ নীতিগুলোকে সম্পর্কিত করেছিলেন পুরুষের সাথে এবং অশুভগুলোকে নারীর সাথে। পুরুষেরা নারীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে জয় করতে চেয়েছিলো অশুভকে; তারা আংশিক সফল হয়েছে। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম যেমন মুক্তি ও পাপমোচনের ধারণা এনে।নরকদণ্ড শব্দটিকে দিয়েছে তার পূর্ণ অর্থ, ঠিক সেভাবেই পবিত্ৰীকৃত নারীর সাথে তীব্র বৈপরীত্যেই নষ্ট নারী উদ্ভাসিত হয় বিশিষ্ট হয়ে। মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত চলে এসেছে যে ‘নারী নিয়ে ঝগড়া’, তাতে কিছু পুরুষ স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে শুধু তাদের স্বপ্নের আশীর্বাদপ্রাপ্ত নারীকে, অন্যরা শুধু অভিশপ্ত নারীকে, যে ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান করে তাদের স্বপ্নকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পুরুষ যদি সব কিছু পেতে পারে নারীর মধ্যে, তার কারণ হচ্ছে এ-উভয় মুখই আছে তার। জীবন্ত, দৈহিক ধরনে সে ধারণ করে সব মূল্যবোধ ও প্রতি-মূল্যবোধ, যা অর্থপূর্ণ করে জীবনকে। এখানে, বেশ স্পষ্টভাবে, অনুরক্ত মাতা ও বিশ্বাসঘাতকিনী রক্ষিতারূপে পরস্পরের বিপরীতে রয়েছে শুভ ও অশুভ; প্রাচীন ইংরেজি গীতিকা লর্ড র্যান্ডাল, মাই সান-এ এক তরুণ নাইট, রক্ষিতা যাকে বিষ খাইয়েছে, বাড়ি ফিরে আসে মায়ের কোলে মৃত্যুবরণের জন্যে। মাতা, বিশ্বস্ত দয়িতা, ধৈর্যশীলা স্ত্রী–সবাই প্রস্তুত হয়ে থাকে ‘ছলনাময়ীরা’ ও ডাইনিরা পুরুষের হৃদয়ে যে-ক্ষত সৃষ্টি করে, তা পেঁচিয়ে বাঁধার জন্যে। এ-দুই স্পষ্ট স্থির মেরুর মাঝখানে দেখা যায় অসংখ্য দ্ব্যর্থবোধক মূর্তি, শোচনীয়, ঘৃণ্য, পাপিষ্ঠ, উপদ্রুত, ছেনালিপূর্ণ, দুর্বল, দেবদূতপ্রতিম, শয়তানপ্রতিম। নারী এভাবে পুরুষের জীবনকে উদ্দীপ্ত ও সমৃদ্ধ করার জন্যে যোগায় বিচিত্র আচরণ ও ভাবাবেগ।
পুরুষ মুগ্ধ হয় নারীর জটিলতা দিয়েই : এক অপূর্ব দাসী, যে ধাধিয়ে দিতে পারে তার চোখ–এবং খুব বেশি ব্যয়বহুলও নয়। সে কি দেবী না দানবী? এ-অনিশ্চয়তা তাকে পরিণত করে এক স্ফিংক্সে। এখানে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে প্যারিসের প্রসিদ্ধতম বেশ্যালয়গুলোর একটি ব্যবসা চালাতো তার পৃষ্ঠপোষকতায়, স্ফিংক্সের উল্কি ধারণ করে। নারীত্বের মহাপর্বে, কর্সেটের কালে, পল বর্জে, অঁরি বাতাইল ও ফরাশি ক্যান-ক্যানের কালে, নাটক, কবিতা, গানে প্রবলভাবে চলেছিলো স্ফিংক্সের বিষয়বস্তু : ‘কে তুমি, কোথা থেকে আসো তুমি, অদ্ভুত স্ফিংক্স?’ এবং আজো নারীর রহস্য সম্পর্কে স্বপ্নের ও বিতর্কের কোনো শেষ নেই। বস্তুত এ-রহস্য রক্ষা করার জন্যেই পুরুষ বহু কাল ধরে নারীর কাছে আবেদন জানিয়েছে দীর্ঘ স্কার্ট, পেটিকোট, অবগুণ্ঠন, লম্বা গ্লোভ, উঁচু খুড়ের জুতো না ছাড়ার জন্যে : যা কিছু অপরের পার্থক্যকে করে তোলে দৃষ্টিনন্দন, তাই তাকে করে আরো কাম্য, কেননা পুরুষ এভাবেই অধিকার করতে চায় অপরকে। আমরা দেখতে পাই যে পুরুষের মতো করমর্দন করে বলে ইংরেজ নারীদের বকছেন আলা-ফরনিয়ে : তাকে উত্তেজিত করে ফরাশি নারীদের বিনয়ী সংযমশীলতা। সুদূরতমা রাজকুমারীর মতো গভীর ভালোবাসা পেতে হলে নারীকে থাকতে হবে গোপন, অজ্ঞাত। ফরনিয়ে তার জীবনে নারীর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই; তিনি বাল্যকালের, যৌবনের সমস্ত বিস্ময়, হারানো সর্গের জন্যে সমস্ত কাতরতা ভরে দিয়েছিলেন তার নিজের সৃষ্টিকরা এক নারীর মধ্যে, যার প্রথম গুণই ছিলো যে সে অপ্রাপণীয়। তার ইন দ্য গালাইয়ের ছবিটি শাদায় ও সোনায় আঁকা।
তবে পুরুষেরা নারীর ত্রুটিগুলোও মনে সযত্নে লালন করে, যদি সেগুলো রহস্য সৃষ্টি করে। ‘নারীর লীলাচপলতা থাকা দরকার,’ এক পুরুষ কর্তৃত্বব্যঞ্জকভাবে বলেছিলো এক বুদ্ধিমান নারীকে। চপলতা সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যগণী সম্ভব নয়, এটা নারীকে দেয় জলের ওপর ঢেউয়ের শোভা; মিথ্যাচার তাকে সাজায় মনোমুগ্ধকর প্রতিবিম্বে; ছেনালিপনা, এমনকি বিকৃতি, তাকে দেয় উন্মাদক সুগন্ধ। ছলনাময়, পলায়নপর, দুর্বোধ্য, প্রতারণাপূর্ণ–এভাবেই শ্রেষ্ঠরূপে সে ধরা দেয় পুরুষের স্ববিরোধী বাসনার কাছে; অজস্র ছদ্মবেশের আড়ালে সে মায়া। স্ফিংক্সকে তরুণীরূপে রূপায়িত করা এক গতানুগতিক ব্যাপার : কুমারীত্ব হচ্ছে এক গৃঢ়রহস্য, যা সাড়া জাগায় পুরুষের মনে–সেটা হয় ততো বেশি নারী হয় যতো বেশি অসচ্চরিত্র; বালিকার সতীত্ব জাগিয়ে তোলে সব ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার প্রত্যাশা; এবং কেউ জানে না তার নিষ্পপতার ভেতরে লুকিয়ে আছে কী সব বিকার। এখনো পশু ও উদ্ভিদের সন্নিকট, ইতিমধ্যেই সামাজিক নিয়মের অনুগত, সে শিশুও নয় প্রাপ্তবয়স্কও নয়; তার ভীরু নারীত্ব কোনো ভয় জাগায় না, শুধু জাগায় মৃদু উদ্বেগ। আমরা বোধ করি যে সে হচ্ছে নারীরহস্যের অন্যতম বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত উদাহরণ। ‘খাঁটি বালিকা’ যেহেতু লোপ পেয়ে গেছে, তাই তার তন্ত্রও সেকেলে হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে, বেশ্যার প্রতিমা, যাকে মায়ায় বিজয়দৃপ্তভাবে ফরাশি রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপিত করেছেন গতিল, আজো রক্ষা করেছে তার বহু মর্যাদা। ভীরু পিউরিটানের কাছে বেশ্যা হচ্ছে পাপ, লজ্জা, রোগ, নরকদরে প্রতিমূর্তি; সে জাগিয়ে তোলে ভয় ও ঘৃণা; সে কোনো পুরুষের অধিকারে নয়, কিন্তু নিজেকে সে দান করে সকলের কাছে এবং জীবিকা নির্বাহ করে এ-ব্যবসা দিয়ে। সে এভাবে পুনরুদ্ধার করে প্রাচীন কালের বিলাসিনী দেবী মহামাতার ভয়ঙ্কর স্বাধীনতা, এবং সে ধারণ করে নারীত্বের এমন মূর্তি, যা পুরুষের সমাজ পবিত্রিত করে নি এবং সে ভরা থাকে ক্ষতিকর শক্তিতে। যৌনক্রিয়ায় পুরুষ সম্ভবত ভাবতেও পারে না যে সে বেশ্যাটির মূমালিক; সে নিতান্তই নিজেকে সমর্পণ করেছে মাংসের এ-দানবীর কাছে। এটা এমন এক অবমাননা, এমন এক দূষণ, যাতে বিশেষভাবেই তিক্ততা বোধ করে অ্যাংলো-স্যাক্সনরা, যারা দেহকে কমবেশি ঘৃণ্য বলেই মনে করে। অন্য দিকে,যে-পুরুষ দেহকে ভয় পায় না সে উপভোগ করে বেশ্যাকর্তৃক দেহের মহানুভব সৎ ঘোষণাকে; সে তার মধ্যে অনুভব করে নারীত্বের এমন এক উন্নয়ন, কোন নৈতিকতাই যাকে নিষ্প্রাণ করতে পারে নি। সে আবার তার দেহে ফিরে পায় সে-ঐন্দ্রজালিক গুণাবলি, যা অতীতে নারীকে করেছিলো নক্ষত্র ও সমুদ্রের বোন, একজন হেনরি মিলার বেশ্যার সাথে শুয়ে অনুভব করে সে মাপছে জীবন, মৃত্যু ও মহাজগতের গভীরতা; আশুগ্রাহী যোনির গভীর, আর্দ্র ছায়াতলে সে দেখা পায় বিধাতার। বেশ্যা যেহেতু এক ধরনের অস্পৃশ্যজন, যে বাস করে এক সকপট নৈতিক জগতের প্রান্তে, তাই আমরা নষ্ট কন্যাকে গণ্য করতে পারি গৃহীত সতীত্বের এক অকার্যকরকারী হিশেবে; তার দীন অবস্থা তাকে সম্পর্কিত করে খাঁটি সন্তের সাথে; কেননা যাকে পদদলিত করা হয়েছে, সে পাবে উচ্চস্থান। মেরি ম্যাগডালিন ছিলো খ্রিস্টের এক প্রিয়পাত্রী; সকপট সতীত্বের থেকে পাপ স্বর্গের দরোজা খোলে অনেক বেশি তাড়াতাড়ি। সব নারীর মধ্যে বেশ্যারাই পুরুষের বেশি অনুগত, তবু তারাই বেশি সমর্থ পুরুষের থেকে মুক্তি পেতে; এজন্যেই তারা ধারণ করে বিচিত্র অর্থ। তবে এমন কোনো নারী-ধরন নেই–কুমারী, মাতা, স্ত্রী, বোন, দাসী, প্রেমিকা, প্রচণ্ড সতী, সুস্মিত অডালিস্ক–যে পুরুষের ছন্নছাড়া ব্যাকুল কামনাকে এভাবে সংক্ষেপিত করতে সমর্থ নয়।
নারীর কেনো রয়েছে এক দ্বৈত ও প্রতারক মুখাবয়ব, তার কারণ এ-ই : পুরুষ যা কিছু কামনা করে, সে তা এবং পুরুষ যা কিছু অর্জন করতে পারে না, সে তা। সুপ্রসন্ন প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে সে এক ভালো মধ্যস্থতাকারিণী; এবং সে হচ্ছে অজিত প্রকৃতির প্রলোভন, যা সব শুভর বিরোধী। সে সব নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিমূর্তি, শুভ থেকে অশুভর, এবং তাদের বিপরীতের; সে কর্মের এবং যা কিছু তার প্রতিবন্ধক, তার বিষয়, সে পৃথিবীতে পুরুষের আয়ত্তি ও তার হতাশা : সে পুরুষের নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সব চিন্তাভাবনার এবং পুরুষ তা যেভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ, তার সমস্ত কিছুর উৎস ও উদ্ভব; এবং এ-সত্ত্বেও সে কাজ করে পুরুষকে নিজের থেকে অন্য দিকে সরিয়ে নিতে, তাকে নিস্তব্ধতায় ও মৃত্যুতে ডুবে যেতে। সে দাসী ও সঙ্গিনী, কিন্তু পুরুষ আরো প্রত্যাশা করে যে সে হবে পুরুষের শ্রোতা ও সমালোচক এবং তাকে সমর্থন ও অনুমোদন করবে তার সত্তাবোধে; কিন্তু তার নিস্পৃহতা এবং এমনকি তার পরিহাস ও অট্টহাস্য দিয়ে সে বিরোধিতা করে পুরুষের। পুরুষ যা। কামনা করে ও যা ভয় করে, পুরুষ যা ভালোবাসে ও যা ঘৃণা করে, সে-সব পুরুষ প্রক্ষেপ করে নারীর ওপর। এবং নারীর সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলা যদি এতোই কঠিন হয়, তার কারণ হচ্ছে পুরুষ নারীর মধ্যে খোঁজে নিজের পুরোটা এবং একারণে যে নারী হচ্ছে সব। নারী হচ্ছে সব, অর্থাৎ, অপ্রয়োজনীয়র তলে; সে সর্বাঙ্গীন অপর। সব হয়ে, সে কখনো তা নয়, যা তার হওয়া উচিত; যে চিরস্থায়ী ছলনা, সেই অস্তিত্বের একান্ত ছলনা, যা কখনোই সফলভাবে অর্জিত হয় নি সবার পুরোপুরি সামঞ্জস্যও লাভ করে নি অস্তিমানের সমগ্রতার সাথে।