৩.১ শেষযাত্রা

শেষযাত্রা

প্রারম্ভ

বরফে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে ইউক্যালিপ্টাস আর পাইন বনের সারি। সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বইছে। ভারসাম্য ঠিক রাখতে কষ্ট হচ্ছে তিনজনেরই। অন্ধকারে একবার পিছলে গেলে মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না এখানে তারা এসেছিল। তবে মনে কোন খেদ নেই, কাজটা যদি সফল হয় তবে সভ্যতার ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে। সেখানে তাদের নাম হয়তো থাকবে না, তাতে কিছু যায় আসে না। এ বিষয়ে দিনের পর দিন আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তারা। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পথে এগিয়ে এসেছে অনেকটা। এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

পরনে ভারি পোশাক থাকায় নড়াচড়া করতে কষ্ট হচ্ছে, বরফ ঢাকা পথে একটানা উপরে উঠা বেশ শ্রম এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেই কাজটাই খুব দ্রুত সারতে হবে তাদের। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস পরনের ভারি পোশাক ছেদ করে সুইয়ের মতো ভেতরে ঢুকে পড়ছে যেন। বরফে খুব একটা সমস্যা হয় না কার্লের, কিন্তু ফেলিক্স আর এডলফের খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই। শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি আর কৌতূহলের কারনে নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে চলেছে ওরা।

ফেলিক্সকে ইশারা করলো কার্ল, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এডলফ ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখে নিচ্ছে। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই। পা ফেলতে গিয়ে বারবার দেখে নিচ্ছে ফেলিক্স, নরম বরফে পা ফেললে সমুহ বিপদ। এখানে মাঝে মাঝে চোরা গর্ত থাকে, উপরে বরফ জমে থাকে বলে আগে থেকে টের পাওয়া যায় না। ফেলিক্সের উপর ভরসা আছে কার্লের। তাই ওকে সামনে রেখেছে।

আর কতোদূর যেতে হবে সামনে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল এডলফ।

এখনো বুঝতে পারছি না, সামনের ঐ চাতালমতো জায়গায় গিয়ে হিসেব করতে হবে, কার্ল বলল।

আরো প্রায় পঞ্চাশ গজ সামনে জায়গাটা অনেকটা সমতল। ওখানে গিয়ে বিশ্রাম করার পাশাপাশি হাতে তৈরি ম্যাপটা নিয়ে কাজ করতে হবে, ভাবল কার্ল। এরপর হয়তো নামতে হতে পারে নীচের দিকে, কিংবা ডানে বাঁক নিয়ে যেতে হবে খাড়া হয়ে নেমে যাওয়া খাইয়ের পাশে।

এডলফ শেফার, কার্ল হসেনহফ আর ফেলিক্স একহার্ট, তারা তিনজনই হিমলারের খুব প্রিয় বান্দা, এসএস এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ন সদস্য। হিটলারের নাৎসি বাহিনীতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে মোটামুটি ভালো একটা অবস্থান করে নিয়েছে এরমধ্যে। হঠাৎ যখন তিব্বত অভিযানের প্রস্তাব এলো তিনজনই রাজি হয়ে গিয়েছিল সাথে সাথে। এর কারনও অবশ্য আছে। নাৎসি প্রধান হিটলারের খুব ঘনিষ্ঠ জেনারেল হিমলারের তিব্বতের প্রতি খুব আকর্ষন। এই আকর্ষনের কেন্দ্রে আছে সাম্ভালা আর ইয়েতি নামক দুটো মিথ। এছাড়া নিজেদের আর্য প্রমানের জন্য তিব্বতে আসাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। আর্যদের প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্নকে ইতিমধ্যে দলীয় চিহ্ন হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে নাৎসি পার্টি। স্বয়ং হিটলার বিশ্বাস করেন জার্মান জাতির সূত্রপাত আর্য জাতি থেকে, সেই আর্য জাতির শেকড় এই তিব্বতে। অভিযানে যে দলটা পাঠানো হয়েছে সেখানে সৈনিক থেকে বিজ্ঞানী সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আর্যজাতির উৎস থেকে শুরু করে ইয়েতি, সাম্ভালা মিথ নিয়ে কাজ করবেন, সৈনিকরা থাকবে নিরাপত্তার কাজে। তিব্বতের প্রধান দালাইলামা দলটাকে সাদর অভ্যর্থনা

জানিয়েছেন এর মধ্যে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি অভিযাত্রি দল পাঠানো হলেও উল্লেখযোগ্য কিছু এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অকাল্টে বিশ্বাসী হিমলার থেমে থাকার লোক নন, তাই এডলফ, কার্ল এবং ফেলিক্সকে আলাদাভাবে নির্বাচন করেছেন তিনি।

এসব ছাড়াও আরো অদ্ভুত কিছু বিষয় নিয়েও নাৎসি পার্টি দারুন আগ্রহি। এর মধ্যে রয়েছে ফাঁপা পৃথিবী তত্ত্ব, এই তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ ফাঁপা, সেখানে মানুষ বসবাসের উপযোগী পরিবেশ আছে, আছে আলাদা একটা সূৰ্য্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সেই ভূ-গর্ভস্থ মানুষ আরো উন্নত। উত্তর আর দক্ষিন মেরুতে অভিযাত্রী দল পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর ভেতরে যাওয়ার পথ বের করার জন্য। কার্ল নিজে এই তত্ত্বের অনুসারি, নাৎসি পার্টির আগে সে থুল সোসাইটির সাথে জড়িত ছিল। থুল সোসাইটির কিছু কিছু ধারনা পরে নাৎসিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর মধ্যে বিখ্যাত এবং পবিত্র স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভ্রিল নামক এক শক্তির উপর থুল সোসাইটির ছিল অগাধ বিশ্বাস। যারা ভ্রিল নামক মুক্ত শক্তিকে আত্মস্থ করতে পারেন তারাই মহাগুরু। এই ধরনের মহাগুরুর অবস্থান পৃথিবীর অভ্যন্তরের ফাঁপা অংশে। এছাড়া

সম্রাট অশোকের অজানা নয়জন নিয়েও চলছে বিশদ গবেষনা। অজানা নয়জন মিথে বলা হয় যে এটি নয়জন মানুষের একটি সিক্রেট সোসাইটি যারা প্রাচীনকালের কিছু গুপ্তজ্ঞান ধারন করেন, প্রয়োজনের সময় মানবসভ্যতার কাজে এগিয়ে আসেন। সম্রাট অশোক এই নয়জনকে সেইসব জ্ঞান লুকিয়ে রাখতে বলেন, কারন তার ধারনা ছিল অসৎ মানুষের হাতে পড়লে তা মানবসভ্যতার দারুন ক্ষতি করতে পারে। পরবর্তীকালে এই অজানা নয়জন সম্রাট অশোকের পরামর্শমতো অনেক দূরে কোথাও চলে যান। ধারনা করা হয় তারা এখনো বেঁচে আছেন, হিমালয় কিংবা তিব্বতের কোন গহীনে।

কার্লের ইচ্ছে এখানে কাজ শেষ করে দক্ষিন মেরুর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার, তার বর্তমান দুই সঙ্গি অবশ্য এই বিষয়ে অবগত নয়।

তিব্বতে এসে সবার সাথে থাকলেও আলাদাভাবে নিজেদের প্ল্যান করে নিয়েছিল এডলফ, কার্ল আর ফেলিক্স। এরমধ্যে কার্লকে দলনেতা নির্বাচন করা হয়েছে, তার সিদ্ধান্তেই হবে সবকিছু যা একবাক্যে মেনে নেবে বাকি দুজন। গতকাল রাত পর্যন্ত আলাপ হয়েছে আজকের অভিযান নিয়ে। জার্মানীতে ফেরত যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই দেরি না করে কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কার্ল।

চাতাল পর্যন্ত আসতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। হাপিয়ে গিয়েছে তিনজন। পনেরো মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করতে হবে।

এবার কোন দিকে যাবো? জিজ্ঞেস করলো ফেলিক্স।

নেতৃত্ব দিতে ভালো লাগে কার্লের, কিন্তু একঘেয়ে প্রশ্ন শুনলে মেজাজ চড়ে যায় তার। কোনমতে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করলো সে।

পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো ছোঁড়া, বলল কার্ল। ব্যাকপ্যাক থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে আনলো। টর্চের আলোতে দেখার চেষ্টা করছে। তিব্বতি এক লামার বর্ননা শুনে আঁকা হয়েছে একটা ম্যাপ। কাঁচা হাতে কাজটা করেছে ফেলিক্স। ওর এই ম্যাপের উপর খুব একটা ভরসা করতে পারছে না কার্ল। বুড়ো লামা সত্যি কথা বলেছে কি না তারই বা ভরসা কি?

হাতে বাইনোকুলার নিয়ে উঠে দাঁড়াল কার্ল। চারপাশ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ম্যাপ অনুযায়ী জায়গাটা থাকার কথা আরো উত্তরে। কিন্তু উত্তরে কিছু চোখে পড়ছে না। রাতের এই অন্ধকারে চোখে পড়ার কথাও না। এবার একটু ডানে বাইনোকুলার ঘোরাল কার্ল। অদ্ভুত জিনিসটা তখনই চোখে পড়ল। পাইন গাছের সারি ভেদ করে লম্বা হয়ে উঠে গেছে বিশালকায় এক তোরন। তোরনের মাথায় গোলাকার একটা বস্তু।

বাইনোকুলার ফেলিক্সের হাতে দিলো কার্ল, দেখার জন্য। সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলো ফেলিক্স।

কি ব্যাপার, চেঁচাচ্ছ কেন? চাপা গলায় ধমক দিলো কার্ল।

আমরা… দম নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে ফেলিক্সের, আমরা পেয়ে গেছি।

কি পেয়ে গেছি? জিজ্ঞেস করল এডলফ। সে কিছু বুঝতে পারছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কার্ল, ফেলিক্সের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি।

সাম্ভালা!

কি করে বুঝলে সাম্ভালা? ওটা কোন মন্দিরের চূড়াও হতে পারে।

লামা বলেছিলেন সাম্ভালার প্রবেশপথে বিশাল এক তোরন থাকবে, তোরনের মাথায় থাকবে সোনার গোলক।

ওটা কি সোনার? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল কার্লের।

দেখুন আপনি, বলে বাইনোকুলারটা কার্লের হাতে বাড়িয়ে দিলো ফেলিক্স। আকাশ এতোক্ষন মেঘলা ছিল, আলোর ছিটেফোঁটা ছিল না কোথাও। এখন মেঘ সরে গিয়ে বেশ পরিস্কার হয়ে এসেছে চারদিক। তোরনের মাথায় গোলাকার বস্তুটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে কার্ল। সোনালী রঙের বিশাল এক গোলক। গলা শুকিয়ে গেছে তার। সাম্ভালা তাহলে সত্যিই আছে? এখান থেকে কতোদূর জায়গাটা? মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করল। ঐ পাইন বনের দিকে যেতে হলে প্রথমে এই পাহাড় থেকে নামতে হবে, তারপর যেদিক দিয়ে এখানে ঢুকেছিল সেখান থেকে দক্ষিনে যেতে হবে কয়েক মাইল। আকাশে চাঁদের অবস্থান দেখে মনে মনে হিসাব করে নিলো কার্ল। এডলফের দিকে তাকাল বাইনোকুলার নামিয়ে, বেচারা উদগ্রীব হয়ে আছে দেখার জন্য।

হঠাৎ দূরে কোথাও থপথপ শব্দে কেঁপে উঠলো তিনজনই। রাতের এই সময়ে পাহাড়ে কারো থাকার কথা না। ইশারায় সঙ্গি দুজনকে চুপ থাকতে বলল কার্ল। কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করে নিয়ে এসেছে।

উঠে দাঁড়াল। দূরে একটা ঝোঁপ কেঁপে উঠেছে মনে হলো। চোখ কচলাল কার্ল। সাদামতো কিছু একটা চোখে পড়েছে। এডলফ আর ফেলিক্সও উঠে দাঁড়িয়েছে। কার্লের পাশ ঘেষে দাঁড়াল ওরা।

কেউ কি টের পেয়ে গেল আমরা এসেছি? ফিসফিস করে বলল এডলফ।

জানি না। তবে আমাদের অনুসরন করার চরম মূল্য দিতে হবে ওদের, চেপে চেপে বলল কার্ল।

এবার ডান দিকে কিছু একটা নড়াচড়া করছে বলে মনে হলো। সাদা একটা কিছু চোখের নিমিষে এক ঝোঁপ থেকে আরেক ঝোঁপের আড়ালে চলে গেল।

এডলফ আর ফেলিক্স যার যার পিস্তল বের করে এনেছে। তাক করে আছে সামনের অন্ধকারের দিকে, কিছু দেখলেই গুলি করবে।

এবার একটানা হুটোপুটির শব্দ কানে এলো। প্রতিটা ঝোঁপ কাঁপছে, মনে হচ্ছে ঝোঁপের আড়ালে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে কিছু লোক।

আগে গুলি করবে না, আমি না বলা পর্যন্ত, সঙ্গি দুজনের উদ্দেশ্য বলল কার্ল।

একপা এগুলো কার্ল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, জমে গেল যেন। তার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। পেছনের সঙ্গি দুজনেরও এক অবস্থা। পিস্তল হাতে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে তিনজন।

ওদের সামনে কমপক্ষে চারটা সাদা কিছু দাঁড়িয়ে আছে। সাদা ভাল্লুক এবং মানুষের মাঝামাঝি দেখতে, উচ্চতা আটফুটের কম হবে না। এগিয়ে আসছে।

শুট, চেঁচিয়ে বলল কার্ল।

ক্রমাগত গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে চারদিক। গুলিগুলো লক্ষ্যভেদ করছে কি না বুঝতে পারছে না। কারন প্রানীগুলো এগিয়ে আসছে। হঠাৎ অন্য এক বিপদ অনুভব করলো কার্ল। পায়ের নীচে মাটি কাঁপছে, সরে সরে যাচ্ছে। কোনমতে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারছে না। চাতালটা আসলে একটা আলাদা পাথর, শব্দের ধাক্কায় ছুটে গেছে। উপরে টলোমলো তিনজন মানুষ নিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে ডান দিকে, যেখানে কিছুটা দূরেই খাড়া হয়ে পাহাড় নেমে গেছে নীচের দিকে। অন্তত দুই হাজার মিটার গভীর সেখানে।

ওটা কি ইয়েতি? এডলফের হাত ধরতে ধরতে জিজ্ঞেস করল ফেলিক্স, ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার।

জানি না, চেঁচাল এডলফ। সামনের পরিণতি সে দেখতে পাচ্ছে।

কার্ল কোনমতে আটকে আছে, চোখের সামনে অসীম অন্ধকার এগিয়ে আসছে। সঙ্গি দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল সে, বিষণ্ণ হাসি। দেশে তার বৌ, সন্তান-সম্ভবা, কোনদিনই হয়তো সেই প্রিয়মুখ আর দেখা হবে না।

অন্তত একটা জিনিস দেখে যেতে পারলাম, বলল কার্ল।

প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের খন্ডটা, সেখান থেকে লাফ দেয়ার একটা চেষ্টা করল এডলফ, হাত ধরে ফেলল কার্ল। ইশারায় সামনের দিকে তাকাতে বলল।

চিৎকার বেরিয়ে এলো এডলফের বুক চিরে।

এর ঠিক পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে পাথর খন্ডটা তার অসীম সাহসী যাত্রীদের নিয়ে দুই হাজার মিটার গভীর অতল খাদের দিকে যাত্রা করল।

সময়টা ছিল উনিশশো একচল্লিশ সাল, স্থান তিব্বত।

পাহাড়ের উপর বড় বড় পায়ের ছাপ ছিল, যেগুলো সে রাতেই মুছে ফেলা হয়। যারা মুছে ছিল তারা নিজেদের শরীরে আলাদাভাবে লাগানো সাদা ভালুকের চামড়া সরাতে ভুল করেনি। তারপর মন্দিরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল দৈনন্দিন কাজে।

জার্মান দলটা দেশে ফিরেছিল এই তিনজনকে ছাড়াই, সাধারন একটা মিসিং ফাইলে হারিয়ে যাওয়ার কারন বলা হয়েছিল উপযুক্ত ট্রেনিং ছাড়া রাতে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে প্রান হারিয়েছে তিন চৌকস কর্মকর্তা, যাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

*

অধ্যায় ১

ঠিক বারোটা বাজে।

হাতে ঘড়ি না থাকলেও সময় বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। গাদাগাদি করে অনেকগুলো লোকের সাথে বসে আছেন। তিনি বসে আছেন ঠিক মাঝখানে, আশপাশে কেউ নেই। বাকি সবাই একটু দূরত্ব নিয়ে হয় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আছে। উঁচু-নীচু পথে মাঝে মাঝে ঝাঁকি খেতে হচ্ছে, রাস্তার অবস্থা যা তা। যতো সময় যাচ্ছে বিরক্তি ততো বাড়ছে তার। ঠিক বারোটার সময়ই সব শুরু হওয়ার কথা। রাগে দাঁত কড়মড় করে উঠলেন। এটাই শেষ সুযোগ। আবার কখনো এতো মোক্ষম সময় আসবে কি না কে জানে। সব কিছু প্ল্যান করা।

গরমে ঘামে নেয়ে উঠেছেন তিনি। সেদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। সামান্য একটু বাতাসের জন্য খাবি খাচ্ছে ভেতরের লোকগুলো। উপরে ছয় ইঞ্চির মতো খোলা জায়গা দিয়ে বাইরে থেকে রোদ আসছে। সেই খোলা জায়গায় মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন, একটু শীতল বাতাস পাওয়ার আশায়। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। সুৰ্য্য আজ কসম খেয়ে উঠেছে ভেতরের সবাইকে ভাজা ভাজা করে ছাড়বে।

বারোটা পাঁচ।

মনে মনে হিসেব চলছে তার। উঠে দাঁড়ালেন। পায়চারি করবেন। সঙ্গিরা সরে জায়গা করে দিলো হাঁটার জন্য। বুঝতে পারছে ভয়ংকর রেগে আছেন তিনি। দুহাত পেছনে দিয়ে হাঁটছেন। অসমান জায়গার উপর দিয়ে চলছে ভ্যানটা। সবাই হিমশিম খাচ্ছে তাল রাখতে গিয়ে। তার কোন সমস্যা হচ্ছে না।

সব প্ল্যান করা, তবু সময়মতো কিছু হয় না এদেশে। এই ভ্যানটার সামনে একটা জীপ, পেছনেও একটা। পাঁচ মিনিট পরপর সামনে পেছনের জিপের সাথে যোগাযোগ রাখছে ভ্যানটা। এসব কিছুই প্ল্যানে ছিল, কিভাবে কাভার করা হবে, সব। তারপরও সময় মতো হচ্ছে না কিছু। রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার, পরনের কয়েদীর পোশাকটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে ঘামে। দ্রুত হাঁটছেন তিনি, বিড়বিড় করছেন, সহযাত্রীরা ভয়ে ভয়ে আছে, রাগলে এই লোকের মাথার ঠিক থাকে না এরকম অনেক কিছুর স্বাক্ষী হয়েছে তারা এতোদিনে।

খুবই নিরাপত্তার সাথে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সবাইকে। বেশ কয়েকবার পালাবার চেষ্টা করেছে ভ্যানের বিশিষ্ট কয়েদি মি. আকবর আলী মৃধা। সবগুলো চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে তা বলা বাহুল্য। কিন্তু শেষ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে গিয়ে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে কারা কর্তৃপক্ষকে। পুরো একটি সেলের প্রায় সব কয়েদীকে নিজের দলে টেনে আনতে পেরেছিলেন আকবর আলী মৃধা, অদ্ভুত ব্যক্তিত্ত্ব লোকটার, অদ্ভুত হলেও যে কাউকে কাছে টানতে পারে সে, যেন অজানা কোন সম্মোহন শক্তি আছে মানুষটার, নইলে একপাল মানুষকে নিজের ইচ্ছেয় যা খুশি করানো যে কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আকবর আলী মৃধার সংস্পর্শে যারা এসেছিল তারা সবাই যেন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কারা পুলিশের সাথে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও আসতে হয়েছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য। পুরো জেলখানা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল সেদিন আকবর আলী মৃধার অনুসারিদের তান্ডবে। রাবার বুলেট, লাঠিচার্জ, টিয়ার সেল সব কিছু প্রয়োগ করে থামানো হয়েছিল। এরপর সিদ্ধান্ত হয় এই লোককে একনাগাড়ে কোন জেলখানায় একমাসের বেশি রাখা যাবে না। একমাসের বেশি সময় রাখলেই এই মানুষটা বাকিদের নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে দেবে। কিন্তু ওরা জানে না এর মধ্যে কতোটা এগিয়ে গেছেন তিনি।

বারোটা পনেরো যখন বাজল তখন হাল ছেড়ে দিলেন তিনি। চুপচাপ এক কোনায় গিয়ে বসলেন। এভাবে হয় না, হতে পারে না। এতো চমৎকার একটা প্ল্যান! অথচ কোথাও কোন খবর নেই।

প্রথম বিস্ফোরনটা শোনার সাথে সাথে ঘড়ির দিকে তাকালেন তিনি। বারোটা সতেরো বাজে। সতেরো মিনিট লেট। সময় না মেনে চলা পছন্দ করেন না তিনি। সোহেলকে এবার একটা শাস্তি দিতে হবে।

একটার পর একটা বিস্ফোরনের শব্দে কেঁপে উঠছে চারপাশ। ঠান্ডা মাথায় কোনায় চুপচাপ বসে আছেন তিনি। বাকি কয়েদীদের চিৎকার চেঁচামেচিতে নরক গুলজার অবস্থা। একঝাক বুলেট এসে ভ্যানের একপাশটা ঝাঁঝরা করে দিলো এই সময়। বেশ ভারি লোহায় তৈরি হয় এসব ভ্যান। এই লোহা ভেদ করে বুলেট ভেতরে ঢুকবে না।

ভ্যান চলছে এখনো। বোঝাই যাচ্ছে কোনমতে নিয়ন্ত্রন করছে ড্রাইভার। তবে বেশিক্ষন পারার কথা না। যে কোন সময় ভ্যানের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেবে তার দলের লোকেরা। পনেরো জনের একটা দলকে এই অপারেশনের জন্য তৈরি করেছেন তিনি। প্রত্যেকেই দক্ষ। কাজ বোঝে।

বাইরে হৈ চৈ চলছে, গুলি-পাল্টা গুলি, সাধারন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তার দলের লোকদের মোকাবেলা করার সামর্থ্য সাধারন এই পুলিশদের নেই। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো আরেকটা। শব্দে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়, তার মানে খুব কাছেই পড়েছে গ্রেনেডটা। উঠে দাঁড়ালেন তিনি, ভ্যানের দেয়ালে হাত দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছেন কোনমতে। ভ্যানটা চলছে খুবই বিপজ্জনকভাবে, যে কোন সময় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে উলটে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার নিজের আহত হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে।

ভ্যানের গতি বাড়ছে ক্রমাগত, একের পর এক বিস্ফোরন এড়িয়ে একেবেকে এগিয়ে যাচ্ছে ভ্যানটা। মনে মনে ড্রাইভারের প্রশংসা না করে পারলেন না তিনি। বোঝা যাচ্ছে জিপ দুটোকে সরিয়ে দিতে পেরেছে তার লোকেরা। ভ্যানটা উড়িয়ে দিতে পারতো যদি তিনি না থাকতেন। হঠাৎ ভ্যানটা কাত হয়ে গেল একদিকে। চাকায় গুলি লেগেছে। ভেতরের কয়েদীরাও সব কাত হয়ে গেছে একদিকে। এরমধ্যেও গতি কমায়নি ড্রাইভার। টায়ারের রাবার ছিঁড়ে গিয়ে লোহার চাকার উপর ভর দিয়ে চলছে ভ্যানটা। শব্দে অস্থিরতাবোধ করছেন তিনি। কানে হাত দিয়ে রেখেছেন। কয়েদীরা সবাই ডানদিকে কাত হয়ে আছে। যে কোন সময় উলটে যেতে পারে ভ্যানটা, তাই ইশারায় কয়েকজনকে ডানদিকে আসতে বললেন তিনি। দুজন এলো ভয়ে ভয়ে। বাকিরা ভ্যানের গায়ের সাথে প্রায় মিশে আছে।

হঠাৎ মনে হলো একসাথে একহাজারটা বোমা ফেটেছে। ভ্যানটা আর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারলো না। কাত হয়ে রাস্তার সাথে ঘষা খেয়ে খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বহুদূর। রাস্তার অপরপাশ দিয়ে আসা একটা যাত্রীবাহি বাস পাশ কাটাতে গিয়ে রাস্তা ছেড়ে পাশের খাদে পড়ল। শরীরের সাথে ঢালের মতো ধরে রেখেছেন তিনি একজনকে, কোন ধরনের আঘাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য। কয়েদীরা সব পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে। ভ্যান এখনো থামেনি,তারা জানে না ভাগ্যে এরপর কি আছে, ভ্যানটা কোন খাদে পড়ে যেতে পারে, কিংবা কোন নদীতে। তাহলে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো করুন মৃত্যু হবে সবার।

বেশিক্ষন লাগলো না, আরো দশ ফুট দূরে গিয়ে থেমে গেল ভ্যানটা। চুপচাপ সব কিছু বোঝার চেষ্টা করছেন তিনি, বাকি কয়েদীরাও চুপ। চারপাশে কোন শব্দ নেই।

কিছুক্ষনের মধ্যেই ভ্যানের গেটে ওয়েল্ডিং মেশিনের আলো দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। লোহার এই গেট কেটে বের হয়ে যাবেন তিনি।

গোল করে কাটা হচ্ছে গেটটা। কয়েদীদের সবার চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখা যাচ্ছে। একজনের কারনে আজ সবাই ছাড়া পেয়ে যাবে। জোরে চাপ দিয়ে গোলাকার লোহার পাতটা সরিয়ে নিলো কেউ। বাইরের সুৰ্য্যের প্রখর আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে তার। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে তাকালেন তিনি। সোহেল দাঁড়িয়ে আছে, হাসিমুখে। রীতিমতো কোমান্ডো পোশাক পরনে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকে, এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে বের হয়ে এলেন বাইরে। সোহেলকে ইশারা করলেন।

অনেকদিন পর মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের পাশের একটা এলাকা। অনেক দূরে পুলিশের জিপ চোখে পড়ল। এখন আগুনে পুড়ছে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু দেহ পড়ে আছে। হেঁটে ভ্যানের সামনে গেলেন তিনি। ড্রাইভারের চেহারাটা দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছে।

তার চারপাশে চার-পাঁচজন অনুসারী হাঁটছে এখন। ইশারা করলেন তিনি, ধারাল একটা ছুরি চলে এলো তার হাতে। অনুসারিদের একজন দিয়েছে।

ড্রাইভার লোকটা এখনো মরেনি। কোনমতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, বুলেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার বুক। ধারাল ছুরিটা লোকটার গলায় বসিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষন লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটার চোখে বেঁচে থাকার আকুতি দেখতে চান, দেখতে চান তার কাছে জীবন ভিক্ষা চাইছে লোকটা। কিন্তু না, এই মানুষটা অন্যরকম। মুখে ক্রুর হাসি খেলে গেল তার, একটানে গলাটা চিরে ফেললেন তিনি।

একটু দূরে দাঁড়ানো জীপে উঠে বসলেন। ভ্যানের গেটের সামনে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সোহেল। তার দিকে তাকালো শেষ অনুমতির আশায়। বুড়ো আঙুল দেখালেন তিনি। এর অর্থ বুঝে নেবে সোহেল।

জীপ চলতে শুরু করেছে।

পনেরোজনের দলটার সাতজন আছে তার সাথে। সোহেলকে নিয়ে আটজন। বাকিরা জীবন দিয়েছে তার জন্য, শয়তানের দরবারে যোগ্য সম্মান পাবে ওরা, হাসিটা আরো চওড়া হলো পেছনে গ্রেনেডের বিস্ফোরনের শব্দে। ঐ ভ্যানের বাকিরাও এখন নরকের পথে পৌঁছে গেছে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সারাদেশে তাকে খোঁজার জন্য শুরু হবে চিরুনী অভিযান। হোক, সব কিছু প্ল্যান করা আছে। বর্ডার এখান থেকে খুবই কাছে। একবার সেখানে পৌঁছাতে পারলে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

*

অধ্যায় ২

বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। রাত কতো হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না, আকাশে চাঁদ নেই, আজ ঘোর অমাবশ্যা। সবসময় যেভাবে বের হয়ে আসে সেভাবেই গুহা থেকে বের হয়ে এলো সে। তবে আজকের রাতটা একটু অন্যরকম। সাধারনত সন্ধ্যার পরপরই ভেড়ার পাল নিয়ে গ্রামে ফেরে। আজ কি যে হলো, এমন মরনের মতো ঘুম এর আগে কখনোই ঘুমায়নি সে। নামতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেল কিশোর। আরেকটু নামলেই সমতল জায়গাটায় চলে আসবে যেখানে ভেড়ার পাল থাকার কথা। কিন্তু…নাহ, ভেড়ার পাল নেই। উধাও হয়ে গেছে, সম্ভবত তাকে না পেয়ে একাই ফিরে গেছে গ্রামে। এরকম হতে পাওে, অসম্ভব কিছু নয়, নামতে নামতে ভাবছে কিশোর ছেলেটা। উপরে তাকাল, গুহার মুখটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকারে মিশে গেছে।

পাহাড়টা ছোটখাট, এখানে গুহা আছে কেউ কল্পনাই করতে পারবে না। গুহাটা বেশ অদ্ভুত, ছোট এবং বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এখানে সময় কাটাতেই ভালো লাগে কিশোর ছেলেটার। গুহাটা যেন তার জন্যই তৈরি করে রেখে গেছে কেউ। লোকচক্ষুর আড়ালে যখন খুশি এখানে এসে বসে থাকা যায়। ঘন্টার পর ঘন্টা। বাইরের আলো আসে না গুহার ভেতরে। কিন্তু তারপরও কেমন অদ্ভুত এক আলোয় ভরে থাকে গুহার ভেতরটা। বাতাসের অভাবে শ্বাসকষ্ট হওয়ার কথা, কিন্তু তাও হয় না। বরং বাইরের চেয়ে তাপমাত্রা এখানে অনেক কম। ঠান্ডা একটা হাওয়া গুহার ভেতর যেন আটকে থাকে। গুহার অমসৃন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে কিশোর। সেই ঘুম ভাঙ্গে একেবারে সন্ধ্যায়, বাড়ি যাওয়ার সময় হলে। মাঝখানের এতোটা সময় কোন ক্ষুধাববাধ হয় না, কোন ক্লান্তিবোধ হয় না। গুহা থেকে একটু দূরে ভেড়ার পাল রেখে এখানেই পুরোটা সময় কাটায় কিশোর। সন্ধ্যায় যাবার সময় ভেড়ার পাল তাড়িয়ে গ্রামে ফিরে যায় সে। ভেড়ার পালটাও চমৎকার। সারাদিন নিজেদের মতো ঘোরাফেরা করে, সন্ধ্যায় ঠিক গুহার একটু দূরে অপেক্ষা করে তার জন্য, একসাথে বাড়ি যাবার জন্য। হাতে ছোট একটা ছড়ি থাকে সেটা কখনো ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়নি কিশোরের। ভেড়াগুলো এতোটাই শান্ত আর বাধ্য তার।

চারদিকে তাকাল কিশোর, পুরো এলাকাটা কেমন অদ্ভুত নীরবতায় ছেয়ে আছে। সম্ভবত রাত অনেক হয়েছে। দূরে তার গ্রাম থেকে সাধারনত আলো দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়েও কিছু চোখে পড়লো না কিশোরের। মনে হচ্ছে সব ছবির মতো নীরব হয়ে গেছে। ছবিটায় একমাত্র জীবিত ব্যক্তি সে।

এবার দৌড় দিলো কিশোর। অজানা আশংকায় তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিশোর, একটানা দৌড়ে হাপিয়ে গেছে, তবু থামছে না। একবার পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, আবার উঠলো।

গ্রামটায় ঢোকার পথে ছোট একটা সেতু, কাঠের সেতুটা খুব মজবুত করে বানানো। নীচে ছোট একটা খাল বয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে সেতুটা পার হতে হতে নীচে স্রোতের গর্জন কানে এলো। অবাক হলেও থামল না সে।

সারা মুখ টকটকে লাল হয়ে গেছে, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিশোর। চারদিকে কোন শব্দ নেই, শব্দহীন এই জগতে অস্বস্তি লাগছে তার। গ্রামের বাইরে যে ছোট বন আছে সেখান থেকে নানা ধরনের শব্দ পাওয়া যায়, আজ সেই বন যেন পুরো নিথর হয়ে আছে। কিছু একটা হয়েছে গ্রামে, এমন কিছু যা হয়তো সে কল্পনাও করতে পারছে না।

শুধু থেকে থেকে মায়ের মুখটা চোখে ভাসছে। সব ঠিক আছে তো? ছোট দুই ভাই আর এক বোন, ওদের কোন সমস্যা হয়নি তো? কিংবা গ্রামের অন্যান্য লোকজনের?

গ্রামের প্রবেশপথের দিকে তাকাতেই জমে গেল কিশোর। চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইলেও কোন মতে নিজেকে সামলাল।

সারি সারি করে মানুষের লাশ রাখা, মাথাগুলো কেটে বাঁশের আগায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেও পরিচিত সব মুখ চিনতে পারল কিশোর, পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল সে।

হঠাৎ কাঁধে হাত পড়ায় চমকে গেল। মুখ থেকে চিৎকার বেরুনোর আগে সবল একজোড়া হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে তার মুখ। শরীরের সব শক্তি দিয়ে নিজেকে ছোটানোর প্রানপন চেষ্টা করছে সে। কিন্তু যে মানুষটা ধরে আছে সে অসম্ভব বলশালী। একবিন্দু শিথিল করতে পারছে না হাতের বাঁধন, টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে পেছন দিকে। এবার শেষ উপায় হিসেবে এক হাতে কামড় বসিয়ে দিল, কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। বরং অন্য হাতে তার গালে প্রচন্ড শক্তিতে চড় বসিয়েছে লোকটা। হাল ছেড়ে দিলো কিশোর, তাকে আরো অন্ধকারে বনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লোকটা।

ঘুমের মধ্যে গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। এতোক্ষন ধরে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছিলেন, স্বপ্ন বলা ঠিক হবে না। স্বপ্ন এতো নিখুঁত হয় না। কিশোরের ভাগ্যে এরপর কি ঘটেছিল পরিস্কার মনে নেই তার। তবে প্রান হারায়নি কিশোর ছেলেটা এটা পরিস্কার। ছোট তাঁবু ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। হাজার হাজার অথবা লক্ষ বছর আগের কোন ঘটনা দেখেছেন তিনি, নিজের অজান্তেই। এইসব ঘটনা কি সত্যি ঘটেছিল কোনদিন? নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না মাঝে মাঝে।

বাংলাদেশের সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এখন তিনি নেপাল পার হয়ে তিব্বতের পথে। সাম্ভালার খোঁজে, এই খোঁজে বহুবছর আগেই বের হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশের এক অজ পাড়া গায়ে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে তার। আব্দুল মজিদ ব্যাপারি নাম নিয়ে বহুদিন চলেছেন, তার সংসার ছিল, ছেলে-নাতি এখনো আছে। সব ছেড়ে ছুঁড়ে অসমাপ্ত কাজের পেছনে বের হয়েছেন তিনি। বয়স কমিয়ে ফেলেছেন, এখন তাকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না, আব্দুল মজিদ ব্যাপারি নামের সেই বৃদ্ধটি আর কেউ না, তিনি। এখন তার যুবা বয়স। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, সারা শরীরে অবারিত ক্ষমতা। নামও বদলে নিয়েছেন, এখন তাকে সবাই চেনে লখানিয়া সিং নামে। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী এক গ্রামে লখানিয়া সিং নামক সত্যিকারের এক চরিত্রের বুড়ি মা আর নাতি রাশেদ, এই দুজনই তাকে সবচেয়ে বেশি টানে। রাশেদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক, আর যে কয়দিন ছিলেন সেই গ্রামে বুড়ি মা নিজের ছেলের মতো যত্ন করেছে তাকে, যদিও বুড়ির বুঝতে অসুবিধা হয়নি,কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি। সাম্ভালার পথে প্রথমে গিয়েছিলেন ধর্মশালা, সেখান থেকে নেপালের কাঠমুন্ডু, তারপর এখন চলে এসেছেন কোদারি গ্রামের কাছাকাছি। পথে তার সাথে যোগ দিয়েছে যজ্ঞেশ্বর নামক এক সন্ন্যাসী আর বিনোদ চোপড়া নামক এক আন্ডারগ্রাউন্ড আর্টিফ্যাক্ট বিজনেসম্যান। এরা যে কোন সময় পাল্টে যেতে পারে, সেই ধারনা আছে তার। কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। সাথে অন্তত দুএকজন থাকা দরকার সবসময়। যদিও তার গোপন কথা জানবার সময় তাদের কখনোই আসবে না।

অনেক রাত হয়েছে। ভোর হওয়ার দেরি নেই খুব বেশি। একটু দূরে পাশাপাশি তাঁবুতে শুয়ে আছে যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া।

অন্ধকারে ঘন কুয়াশার মাঝে হেঁটে তাঁবু দুটোর সামনে গেলেন তিনি। ছোট ছোট তাঁবু একজনের ব্যবহার উপযোগী করে বানানো। চেইন খুলে ভেতরে ঢুকতে হয়, বেরুতে হয়।

আমরা রওনা দেবো কখন?

চমকে পেছনে তাকালেন তিনি। সজ্ঞেশ্বর দাঁড়িয়ে আছে, কিছুটা দূরে। গায়ে এখনো তেমন কোন কাপড় নেই।

আপনি এতো রাতে!

সূৰ্য্যদেব জাগার আগেই আমাকে জাগতে হয়, বেশ ভারিক্কি গলায় উত্তর দিলো যজ্ঞেশ্বর, অনেক দিনের অভ্যেস।

হু, রওনা দেবো, ভোরের আলো ফুটুক তারপর, বললেন তিনি।

হেঁটে কিছুদুর এগিয়ে গেলেন। এখান থেকে মাইল দশেক দূরে তিব্বত সীমান্ত। সেখানে খুব কড়া পাহারা। বহিরাগতদের এমনিতেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আর ইদানিং বহিরাগতের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। ড. আরেফিন তার দল নিয়ে যে তিব্বত সীমান্তের দিকে গেছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ওদের কাছে পাসপোর্ট, ভিসা সব আছে, নিয়ম মেনে সীমান্ত পার হতে গেলে এগুলো লাগবেই। অথচ এসবের কিছুই তাদের কাছে নেই। কাজেই স্বাভাবিকপথে সীমান্ত পার হবার পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।

আর কিছুদূর গেলেই কোদারি গ্রাম। বহু বছর আগে এখানে এসেই আশ্রয় নিয়েছিলেন এক মন্দিরে। সেই মন্দির এখনো আছে কি না কে জানে? মন্দিরের শেবারনের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন সেই চামড়ার খোপটা, যা এখনো তার সাথে। আছে।

ঠিক কোথায় সেই মন্দিরের অবস্থান এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, তবে অসম্ভব হবার কথা নয়। জায়গাটা এখন তিব্বত সীমান্তের বাইরে পড়েছে জেনে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন তিনি।

আমার কেন জানি খুব অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে যজ্ঞেশ্বর।

যেমন?

সামনে খুব বড় বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ রইলেন তিনি। চোখের সামনে সেই কিশোরের চেহারাটা ভেসে উঠলো যাকে কিছুক্ষন আগে স্বপ্নে দেখছিলেন তিনি। যে লোকটা টেনে হিঁচড়ে কিশোরকে বনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল সে মানুষটার চেহারাও চোখে ভাসছে। বিদঘুঁটে

চেহারা। সারা মুখে রক্তের দাগ। অনেক লম্বা, মুখভর্তি সাদা দাঁড়িগোফ।

ভয় পাবেন না, আমি আছি, বললেন তিনি। ভোরের আলো ফোঁটার এখনো অনেক দেরি।

তার চেহারায় কেমন অদ্ভুত আলোর ছটা দেখতে পেল যজ্ঞেশ্বর। এক পা পিছিয়ে গেল ভয়ে।

*

অধ্যায় ৩

উত্তরায় ফ্ল্যাটের ড্রইং রুমে বসে রাজুর কান্ড দেখছে রাশেদ, কিছুদিন হলো এই ফ্ল্যাটে উঠেছে তিনজন। দুই হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে রাজু। বারবার পড়ে যাচ্ছে, আবার চেষ্টা করছে। সবুজ পড়ার ফাঁকে তাকিয়ে হাসছে। পড়ায় মনোযোগ বসছে না, চোখ চলে আসছে এদিকে। রাজু আর রাশেদের মধ্যে বাজি হয়েছে, রাজু যদি এক মিনিট দুই হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে রাজু যা খেতে চাইবে তাও খাওয়াবে রাশেদ, নইলে রাজু খাওয়াবে। বাজি জেতার জন্য রাজুর প্রানান্ত চেষ্টা দেখে হাসি থামাতে কষ্ট হচ্ছে সবুজের।

মাসখানেক আগে দারুন এক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিল দুজন। বান্দরবানের পাহাড়ে এমন এক জায়গায় আটকা পড়েছিল যেখান থেকে বেরিয়ে আসা ছিল অসম্ভব একটা কাজ। পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো একটা গুহায় আটকা পড়েছিল রাশেদ সেদিন, রাজু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল আগেই। উপর থেকে লরেন্সের ডাক শুনতে পাচ্ছিল রাশেদ, এমনকি লরেন্সের দলের সেই পাহাড়ি সদস্যদের একজনকে দেখতেও পেয়েছিল, কিন্তু লরেন্সকে ডাকার মতো শক্তিও ছিল না গলায়। একটু পর জ্ঞান হারিয়েছিল সে নিজেও।

সেই গুহায় অনেক পুরানো এক কংকাল পেয়েছিল ওরা, হয়তো তিবাওয়ের দলের সদস্য ছিল। সেখানে খুঁজলে হয়তো তিবাওয়ের গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যেতো, কিংবা যেতো না, সেই ঝামেলায় যায়নি রাশেদ। ঐ গুহা থেকে বের হওয়া দরকার ছিল আগে। বৃষ্টি কমে আসলেও আকাশ ছিল মেঘলা, কোনমতে রাজুকে নিয়ে গুহা থেকে বের হয়ে এসেছিল রাশেদ। তারপর টানা দুই দিন হেঁটে লোকালয়ে পৌঁছেছিল তারা। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অস্থির দুজন মানুষ, সারা শরীর কেটে ছড়ে গিয়েছে। স্থানীয় একটা গ্রামে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিল।

লরেন্সের সাথে পরে আর যোগাযোগ হয়নি। মোবাইল নাম্বারের সাথে সাথে ঠিকানাও বদলে ফেলেছে রাশেদ। লরেন্স হয়তো ভেবেছে সে আর রাজু মারা গেছে, এখন পর্যন্ত সেই ধারনা বদল করার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি সে।

সেদিন কি হয়েছিল ভাবার চেষ্টা করেছে রাশেদ। লরেন্স সঞ্জয়ের পাহারাদারদের নিয়ে পাহাড়ের উপরে যাওয়ার পর হয়তো তার পাহাড়ি সঙ্গিদের পেয়ে গিয়েছিল। তারাই হয়তো সঞ্জয়ের লোকদের মেরে অস্ত্র কেড়ে নেয়, পরবর্তীতে লরেন্সের সাথে ওরা নীচে নেমে আসে, গুলি করতে শুরু করে সঞ্জয়ের দলের লোকদের উপর। সঞ্জয়কে নিজের চোখে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখেছে রাশেদ। ভাগ্যভালো সেদিন ঝড় বৃষ্টি ছিল, নইলে কি হতো বলা যায় না।

লরেন্সের পূর্বপুরুষের গুপ্তধনের নক্সা চিরতরে হারিয়ে গেছে, লরেন্সের চোখের সামনেই, সঞ্জয় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিয়েছে বাতাসে। সেই গুপ্তধনের খোঁজ লরেন্স আর কোনদিন পাবে না। গুপ্তধনের খোঁজ কেবল জানে সে আর রাজু। যদিও দুজন প্রতিজ্ঞা করেছে সেই লুকানো সম্পদ লুকানোই থাকবে।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষন আগেই। বাজিতে হেরে রাজু গেছে বাইরে, রাতের মধ্যে ফিরবে। তারপর খাওয়া-দাওয়া হবে। সবুজও থাকবে। একটা বই নিয়ে বসল রাশেদ। দেরিতে ঘুমালেও অসুবিধা নেই, সকালে এমন কোন কাজ নেই। দুপুরের দিকে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে, শাহবাগের দিকে। বন্ধুবান্ধব তেমন কেউ নেই তার, শাহবাগে গিয়ে কিছু বই কিনে আনার ইচ্ছে। এই ফ্ল্যাটে কোন বুক শেলফ নেই, যে হারে বই জমছে তাতে বুক শেলফ না কিনলে আর চলছে না।

সবুজ তার পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। বই পড়তে পড়তে হঠাৎ কেমন অস্থির অস্থির লাগছিল রাশেদের। অনেকদিন লিলির সাথে যোগাযোগ হয় না। গত কিছুদিনে কী সব ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছে তা কিছুই জানানো হয়নি লিলিকে, অযথা টেনশন করবে। লিলির মেইল এসে জমে আছে অনেকগুলো। একটারও উত্তর দেয়া হয়নি। মোবাইলের নতুন নাম্বারটাও জানানো হয়নি,না জানি কি ভাবছে বেচারি।

ফ্ল্যাটে নিজের জন্য আলাদা একটা রুম তৈরি করে নিয়েছে রাশেদ, অনেকটা ড. আরেফিনের রুমের আদলে। সেখানে অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ। নিজের পড়ার বই, কম্পিউটার, মিউজিক সিস্টেম দিয়ে সাজিয়েছে রুমটা। কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগ আছে। চাইলে লিলির সাথে হরদম চ্যাট করা যায়, কিন্তু কেন জানি এসব ভালো লাগে না রাশেদের কাছে। কোন কিছু জানতে হলেই একমাত্র ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এখনো ফেইসবুকে অ্যাকাউন্ট করেনি,এইজন্য রাজু মাঝে মাঝে তার সাথে ঠাট্টা করতে ছাড়ে না।

দশটার দিকে বইটা রেখে উঠে বসল রাশেদ। রাতের খাওয়া হয়নি, কিন্তু মন টানছিল নিজের ব্যক্তিগত রুমটার দিকে। কম্পিউটার খুলে বেশ কিছুক্ষন গান শুনলে রাশেদ। নতুন কিছু ডিভিডি কেনা হয়েছিল কিছুদিন আগে, সেখান থেকে একটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন নেড়েচেড়ে দেখল, কিন্তু মুভি দেখতে ইচ্ছে করছে না। মেইলবক্স ওপেন করলো। কোন মেইল আসার কথা না। কিন্তু দুটো মেইল এসেছে। একটা লিলির কাছ থেকে আরেকটা আফরোজা আরেফিনের কাছ থেকে। লিলির মেইলটা নিয়ে চিন্তিত নয় রাশেদ, আফরোজা আরেফিন নামটা দেখে ভু কুঁচকে গেছে তার। এই মহিলা কে? এই নামের কারো সাথে কখনো তার পরিচয় ছিল বলে মনে পড়ছে না। আচ্ছা, ইনি কি ড. আরেফিনের স্ত্রী? ভদ্রমহিলার নামটাই জানা হয়নি কখনো, আসলে সেভাবে প্রয়োজন পড়েনি। কি এমন দরকার পড়লো এতোদিন পর এই ভদ্রমহিলার? বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে রাশেদ। লিলির মেইলটা পরে পড়লেও চলবে, আগে এই মহিলার মেইলটা দেখা দরকার। ড. আরেফিনের সাথে আদৌ কোন সংযোগ আছে কি না কে জানে?

যা ভেবেছিল তাই, মেইলটা করেছেন ড. আরেফিনের স্ত্রী, তার নাম আফরোজা আরেফিন, সেখানে লেখা :

প্রিয় রাশেদ,

আশা করি ভালো আছে। আমি ড. আরেফিনের স্ত্রী, আফরোজা আরেফিন। আশা করি চিনতে পেরেছে। মাস খানেক আগে তুমি ফোন করেছিলে তখন ড. আরেফিন দেশে ছিলেন না, এখনো নেই। কবে আসবেন তাও বলা যাচ্ছে না।

বিশেষ কারনে তোমাকে লিখছি। আমার স্বামী এখন ভারত, নেপাল পার হয়ে তিব্বতের দিকে রওনা দিয়েছেন। জানি না ঠিক কি উদ্দেশ্য তার, আমার কাছে সব কিছু খোলাসা করে বলেন না। কিন্তু আমি জানি, আমার মন বলছে তিনি বড় কোন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছেন। অদ্ভুত এক রহস্যময় স্থানের খোঁজে তার দল রওনা দিয়েছে দিল্লি থেকে, সম্ভবত তিব্বতের উদ্দেশ্যে, ড. কারসন এই দলের দলনেতা। হয়তো তিনিও তোমার পরিচিত।

যাই হোক, যে কারনে এই মেইল, আমি জানি তিনি কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছেন, হয়তো এরমধ্যে বিপদে পড়েও গেছেন, কারন গত সন্ধ্যার পর থেকে তার সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। এই অবস্থায় তুমি যদি তার খোঁজে যাও তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমি জানি ব্যাপারটা আশা করা খুব বোকামি। কিন্তু আমি অসহায়। নিজেকে এরচেয়ে খারাপ অবস্থায় কখনো আবিষ্কার করিনি। আমার নিজের একটা ছেলে থাকলে সে হয়তো যেতো… সে যাই হোক।

তোমার প্রতি একান্ত অনুরোধ, ড. আরেফিনকে সাহায্য করার মতো তোমার চেয়ে যোগ্য কাউকে আমার চোখে পড়ছে না। জানি এ দাবি অন্যায়, তবু নিজেকে সামলাতে পারলাম না। যদি যেতে চাও আমাকে জানাও। আমি টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে রেখেছি। পাসপোর্ট ভিসা-সহ অন্যান্য কাজের জন্য কয়েকদিন লাগবে।

সবচেয়ে বড় কথা, তুমি না বলতে পারো। আমি মন খারাপ করবো না। আর যদি যেতে চাও, তাহলে জানাও।

তোমার মঙ্গল কামনায়…… আফরোজা আরেফিন।

মেইলটা পড়ে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইল রাশেদ। মাথায় কিছু ঢুকছে না। ভদ্রমহিলা কিসব লিখেছেন এসব! কোথায় যেতে হবে, তিব্বতে? কেন যেতে হবে? ড. আরেফিন কী বিপদে পড়েছেন?

বিপদে না পড়লে ভদ্রমহিলা কখনো মেইল করতেন না, কারো কাছে খুব সহজে নত হওয়ার মানুষ তিনি নন, সেটা মহিলার সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিল রাশেদ। লিলির মেইলটা খুলতে ইচ্ছে করলো না আর। কম্পিউটার টেবিল ছেড়ে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। কোন ধরনের ঝামেলায় জড়াবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কিন্তু ড. আরেফিনের বিপদে না দাঁড়ালে সেটা বেঈমানির পর্যায়ে চলে যাবে। ভদ্রলোক তার জন্য যথেষ্ট করেছেন, সেবার তিনি না থাকলে, আশ্রয় না দিলে আকবর আলী মৃধার খপ্পরে পড়ে জান যেতো। শুধু তার না, সেই সাথে লিলি আর ড. কারসনেরও।

একজন মানুষ সাহায্য চাইছে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে কখনো না বলতে শেখেনি রাশেদ। কাল সকালেই যেতে হবে ড. আরেফিনের বাসায়। সাথে রাজুকে নিতে হবে। রাজু এখনো বাসায় ফেরেনি। ফিরবে যতো রাতই হোক। ওর সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। রাজু উৎসাহী ছেলে এমনও হতে পারে সে যেতে রাজি হতে পারে। রাজু সাথে গেলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এর আগে কখনো বিদেশে যাওয়া হয়নি। পার্সপোর্ট করা নেই, সেগুলোও করাতে হবে।

আরো অনেক চিন্তা আসছিল মাথায়। গত কয়েকদিন বেশ নিশ্চিন্তে কাটছিল দিন, কোন চিন্তাভাবনা ছাড়া। কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকার সৌভাগ্য বোধহয় তার নেই, ভাবল রাশেদ। সামনে ঝড়ের মতো কিছু দিন আসছে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

*

অধ্যায় ৪

নেপাল সীমান্ত পার হয়ে তিব্বতের ঝাংমুতে ঢোকার কথা দলটার। ঝামু নেপাল তিব্বত সীমান্তের শহর। নেপালের শেষভাগের ছোট এলাকাটার নাম কোদারি, জায়গাটা একসময় তিব্বতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিব্বতের বেশ কিছু মন্দির এখনো এখানে অবশিষ্ট আছে। সেই সময় কিছুটা প্রানচাঞ্চল্য থাকলেও এখন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়া এলাকা এই কোদারি। অন্যদিকে ঝাং মোটামুটি ব্যস্ত একটা শহর, এখানে ব্যাংক, হোটেল থেকে শুরু করে পর্যটকদের আরাম-আয়েশের সবধরনের ব্যবস্থা আছে।

ঝাং তিব্বতের শহর হলেও প্রকৃতি এখানে পুরোপুরি তিব্বতের ছোঁয়া পায়নি। চারপাশে সবুজের সমারোহ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তেইশশো মিটার উঁচুতে এর অবস্থান, এর নীচেই কোদারি গ্রাম আর বটেকোশি নদী বয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর যে বিতর্কিত বাঁধ নির্মিত হতে যাচ্ছে তা এখান থেকে খুব কাছেই। আপাতত এই তথ্যগুলো সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালার কাছ থেকে পেয়েছেন ড. আরেফিন।

একটানা জার্নি করে কিছুটা পরিশ্রান্ত দলটা, তাই কোদারি গ্রামে দিন কয়েক কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ড. কারসন। এখানে আসার পর থেকে বেশ চুপচাপ হয়ে আছেন তিনি। পথে ঘটে যাওয়া গোলাগুলির ঘটনায় বেশ আপসেট হয়ে আছেন

ভদ্রলোক বোঝাই যাচ্ছে। সেই সাথে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালার নতুন রুপ হয়তো ঠিকমতো গ্রহন করতে পারছেন না। সাধারন একজন গাইড হিসেবে যাকে জানতেন তার এমন রুপান্তর সহজভাবে গ্রহন করা হয়তো সত্যিই কঠিন, ভাবলেন ড. আরেফিন।

প্রফেসর এবং সন্দীপ আগের মতোই আছে, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কথাও বলতে চায় না সহজে। প্রফেসর সারাক্ষন নিজের মনে বিড়বিড় করেন, যেন কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছেন। তার সাথে কয়েকবার কথা বলতে গিয়ে চলে আসতে হয়েছে ড. আরেফিনকে। অন্যদিকে সন্দীপের কাছে গেলেই অদ্ভুত সব কথা শোনেন। ভিনগ্রহের প্রানী নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব থিওরি শুনতে হয়। লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে কি না বুঝতে পারছেন না। একমাত্র ঠান্ডা মাথায় কাজ করে যাচ্ছে প্রফেসরের সহকারি, রামহরি। এই একজন মানুষকে কোন অবস্থাতেই চিন্তিত হতে দেখেননি তিনি। হয়তো লোকটার স্নায়ু ইস্পাতের মতো, যা অনেক প্রতিভাবান এবং সাহসীদের মাঝেও দেখা যায় না।

নিজেকে নিয়ে চিন্তা করেন না ড. আরেফিন, গত কিছুদিন স্ত্রীর সাথে কথা হয় না বলে কিছুটা চিন্তিত তিনি। এখানে মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক পাওয়া খুব কঠিন।

যেখানে আছেন সে জায়গাটা কোদারি গ্রাম থেকে একটু বাইরে। ছোট ছোট কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। মাঝখানে ক্যাম্পফায়ার করার জায়গা। দুইপাশে উঁচু হয়ে যাওয়ার পাহাড়ের সারি। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য আসলেই মনোমুগ্ধকর। প্রতি কুঁড়েঘরে দুজন করে থাকার ব্যবস্থা। ড. কারসন আর ড. আরেফিন আছেন এক কুঁড়েতে, বাকি দুটোতে আছেন প্রফেসর আর রামহরি, অন্যটিতে সন্দীপ আর সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা। আরো একটি কুঁড়েতে আছে একজন ড্রাইভার, নেপালি, সে কুঁড়েতে যাবতীয় ব্যাগপত্র স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

এখানে বিশ্রাম নেয়ার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি সুরেশের, সে বেশ কয়েকবার আপত্তিও জানিয়েছিল, কিন্তু ড. কারসন অনড়। তার মতো বয়স্ক মানুষের পক্ষে এক নাগাড়ে চলার উপর থাকা সত্যিই একটু কঠিন।

দুপুরে ঘুম ঘুম আসছিল ড. আরেফিনের, এখানকার স্থানীয় বাজার থেকে ইয়াকের মাংস কিনে এনে রান্না করে খাইয়েছে সুরেশ, লোকটার হাতের রান্নার প্রশংসা করতেই হবে। ভালো কোন হোটেলে শেফ হিসেবে চাকরি পেয়ে যাবে ইচ্ছে করলেই, মন্তব্যটা করেছিলেন ড. কারসন। এটা ছাড়া বাকি সময় সুরেশের সাথে তার আচার ব্যবহার অনেক শীতল যা ড. আরেফিনের নজর এড়ায়নি।

বাইরে থেকে মাত্রই ড. আরেফিনের কুড়েতে ঢুকেছেন ড. কারসন, হয়তো জরুরি কোন কথা বলার জন্য। সাথে ল্যাপটপ, ড. আরেফিনের পাশে গিয়ে বসলেন।

আসতে পারি, কুড়ের দরজায় পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেলেন ড. আরেফিন। প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের গলা।

আসুন, ড. কারসন বললেন, হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা দেখছিলেন।

দরজা খুলে ঢুকলেন প্রফেসর। তাকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

বসুন প্রফেসর, একপাশে সরে গিয়ে বসতে দিলেন ড. কারসন।

ছোট দুটো বিছানা পাতা কুঁড়েতে। ডান পাশেরটা ড. কারসনের বিছানা, তার একপাশে বসলেন প্রফেসর। তাকে কেমন লজ্জিত, বিব্রতও মনে হচ্ছিল ড. আরেফিনের কাছে। এমন কিছু বলতে এসেছেন ভদ্রলোক যা বলতে হয়তো অস্বস্তি লাগছে।

ড. কারসন, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতে চাই?

নির্দ্বিধায় বলুন।

আমার মেয়ে লতিকা আসছে এখানে, ড. লতিকা প্রভাকর, আমাদের সাথে যোগ দিতে।

নড়েচড়ে বসলেন ড. কারসন।

লতিকা? লতিকা প্রভাকর!

জি।

সে আপনার মেয়ে? ড. আরেফিন লতিকা প্রভাকরের নাম শোনেননি,তবে ড. কারসন যে শুনেছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

হ্যাঁ।

কই, আগে তো বলেন নি?

আসলে বলার প্রয়োজন হয়নি।

সে কিভাবে এখানে আসছে, আমি তো কিছু বুঝলাম না।

আসলে কাঠমুন্ডুতে থাকার সময় রামহরি ওকে খবর পাঠিয়েছিল।

খবর পাঠালেই চলে আসতে হবে? সত্যি সত্যি অবাক হচ্ছি আমি প্রফেসর সুবামানিয়াম।

আমি না করেছিলাম, কিন্তু জেদি মেয়ে, আসবেই।

ঠিক আছে, আসতে চাচ্ছে যখন আসুক, এখান থেকেই তাকে ফিরে যেতে হবে, আমাদের কাজে নতুন কাউকে নেয়ার অবকাশ নেই।

সে এখান থেকেই ফিরে যাবে। এটুকু কথা দিচ্ছি।

আচ্ছা, কখন আসবে?

রামহরি যাচ্ছে ওকে আনতে, সাথে সুরেশও যাবে।

ঠিক আছে, আজকের মধ্যে যেন আসে। কাল কিন্তু আমরা রওনা দেবো।

ঠিক আছে, বললেন প্রফেসর, উঠে দাঁড়ালেন, তাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল, ড. আরেফিনের দিকে তাকিয়ে দূর্বলভাবে হাসলেন প্রফেসর। তারপর বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

ড. কারসনের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।

ড. লতিকা প্রভাকর যে প্রফেসরের মেয়ে তা কিন্তু আমার জানা ছিল না, ড. আরেফিন। আসলে পৃথিবী অনেক ছোট।

আপনি ড. লতিকাকে চেনেন?

ভালো করে চিনি। এখন হামবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে আছে, সহযোগী অধ্যাপক, পুরাতত্ত্বের শিক্ষক হিসেবে ভালো নাম করেছে। বেশ কিছু এক্সপিডিশনেও অংশ নিয়েছে। আমার সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছে, তাও সেমিনারে।

তাহলে তো আপনার সাথে ভালোই পরিচয় আছে।

তা আছে, কিন্তু মেয়েটা কখনো প্রফেসর সুব্রামানিয়াম প্রভাকরের নাম বলেনি আমার কাছে, ব্যাপারটা অদ্ভুত।

হয়তো প্রয়োজন মনে করেনি।

হুম, তা হতে পারে, উঠে দাঁড়ালেন ড. কারসন। আমি দেখি বাইরে কি অবস্থা, বলে বেরিয়ে গেলেন কুঁড়ে থেকে।

আরো কিছুক্ষন বসে থাকলেন ড. আরেফিন। কেন জানি মনে হচ্ছে লতিকাকে, নিয়ে কোন একটা সমস্যা আছে বাপ-মেয়ের মধ্যে।

উঠে পড়লেন ড. আরেফিন। অনেক ঝামেলা পার হয়ে এখানে ঘাঁটি গেড়েছেন, যারা পথে আক্রমন করেছিল তারা সহজে হাল ছাড়ার কথা না, এরমধ্যে ড. লতিকা প্রভাকরকে আনার জন্য আবার কাঠমুন্ডুতে যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ন ব্যাপার।

কুঁড়ের বাইরে এসে দেখলেন মাঝখানের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সবাই, সুরেশ কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। প্রফেসর গম্ভীর মুখে শুনছেন, সন্দীপও আছে, তবে তার চেহারা দেখে মনের ভাব বোঝা কঠিন। ড. কারসনকেও বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

রামহরি তৈরি যাওয়ার জন্য, সাথে ড্রাইভারও আছে।

এগিয়ে গেলেন তিনি দলটার দিকে।

উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে সুরেশ, বোঝানোর চেষ্টা করছে এখনি ফেরত যেতে হলে অনেক ঝামেলা হবে। শত্রু পথে কোন ফাঁদ পেতে রাখতে পারে, ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না… ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু রামহরি এতো কিছু শোনার জন্য তৈরি না, সে রওনা দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে ঘন্টাখানেকের মধ্যে। বিরক্তমুখে নিজের কুঁড়েতে ফিরে গেল সুরেশ, বের হয়ে এলো সাথে সাথে। হাতে একটা খাম।

কাঠমুন্ডতে গিয়ে এই নাম্বারে ফোন দেবেন, তারপর দেখা করে এই খামটা বুঝিয়ে দেবেন, তাতেই হবে, প্রফেসরের উদ্দেশ্যে বলল সুরেশ। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল।

কি এটা? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

আপনি জানেন না কি ঝামেলায় ফেলেছেন আমাকে! ড. লতিকার জন্য কোন স্পেশাল পাস নেই আমার কাছে, আগে বললে ম্যানেজ করতে পারতাম, এখন সেটা কোনভাবেই সম্ভব না, আপনি ওকে ফোন দেবেন, সেই সবকিছু ব্যবস্থা করে রাখবে, বিরক্ত গলায় বলল সুরেশ।

সমস্যা হবে না তো?

দেখুন, আপনি যাচ্ছেন যান, সমস্যা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, শুধু ফোন করে এই খামটা দিয়ে আসবেন, কাঠমুন্ডুতে পৌঁছেই।

ঠিক আছে, আর কথা বাড়ালেন না প্রফেসর।

বিরক্ত মুখে নিজের কুঁড়েতে ঢুকে পড়ল সুরেশ। ড. কারসনও চলে গেলেন। সন্দীপকে কিছুটা উদাসীন মনে হলো। প্রফেসর সুবামানিয়ামের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ উত্তেজিত তিনি, হয়তো অনেক দিন পর মেয়ের সাথে দেখা হবে ভেবে।

হেঁটে আরো সামনে এগিয়ে গেলেন ড. আরেফিন। নতুন এক চরিত্র যোগ হতে যাচ্ছে, তাও আবার নারী চরিত্র। এই ধরনের অভিযানে একটা নারী পদে পদে শুধু ঝামেলাই তৈরি করে, এটা একটা ধারনা ড. আরেফিনের। লতিকা মেয়েটার বিদেশি এক্সপিডিশনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, সেই অভিজ্ঞতা যেন দলের সবার জন্য সুখকর হয় মনে মনে সেই প্রার্থনা করলেন তিনি।

ফেরার পথে মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই।

একটু আগেও সন্দীপ আর প্রফেসরকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন, এই অল্পসময়ের মধ্যে কিভাবে দুজন উধাও হয়ে গেল বুঝতে পারছেন না ড. আরেফিন। উনারা নিজ নিজ কুঁড়েতে ঢুকতে পারেন, সেটা অসম্ভব না। কিন্তু তারপরও তার মন বলছে কোথাও কোন সমস্যা আছে।

সমস্যাটা কি বোঝার জন্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। কানের পেছনে ঠান্ডা একটা স্পর্শ পেলেন, থপ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখার সময় পাননি কে আঘাত করেছে, তার আগেই জ্ঞান হারালেন।

* * *

নিজের মাঝে দিনদিন বুনোভাব প্রকট হতে দেখছে সে। গত কয়েকমাসে সভ্য জগতের সাথে থেকে অনেক কিছুর সাথে তাল মিলিয়ে চলার একটা চেষ্টা ছিল। অথচ এখানে আসার পর আবার সব আগের মতো হয়ে গেছে।

একটানা হাঁটতে খারাপ লাগছে না তার। এই পথঘাট তার অপরিচিত। সামনের লক্ষ্যও অজানা। শুধুমাত্র একটা বিশ্বাসের উপর ভর করে এগিয়ে চলেছে সে। পরনের কাপড়চোপড় বলতে শুধু একটা প্যান্ট পরনে। গায়ের উপর গেঞ্জিটা ছিঁড়ে গেছে তাই গতরাতেই সেটা ফেলে দিয়েছে মিচনার। লম্বা ধারালো একটা পাথর নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছে। সেটা দিয়ে ছোটখাট একটা হরিন শিকার করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। রান্না করার ঝামেলা বাদ দিয়ে কাঁচা মাংস খাওয়ায় ফিরে যেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি তার।

ভোরে রওনা দিয়েছে মিচনার। হাইওয়ে এড়িয়ে তার এক পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। হাইওয়েতে সবসময় কিছু না কিছু গাড়িঘোড়া থাকবেই, প্রচন্ড শীতল এই অঞ্চলে নগ্নগাত্র একজন মানুষকে দেখলে যে কেউ অবাক হতে বাধ্য। কেউ অবাক হোক তা চায় না মিচনার, কারো চোখে না পড়াই ভালো।

হাইওয়ের পাশ দিয়ে এই পথ ধরে যেতে যেতে একসময় না একসময় কাংখিত গন্তব্যে পৌঁছাবে, এই ধারনা মোটামুটি নিশ্চিত। এখন দরকার শুধু ধৈৰ্য্য।

*

অধ্যায় ৫

ঠিক সন্ধ্যার পর পর এলো রামহরি। লোকটাকে দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। কোনমতে গাড়ি থেকে নেমে এলো হাতে বড় সড় একটা সুটকেস নিয়ে। তার পেছন পেছন লম্বা, শ্যামলা যে অতিথি এলো তাকে দেখে বেশ অবাক হলেন ড. কারসন। প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের সাথে বাহ্যত কোন মিলই নেই ড. লতিকার। বয়স ত্রিশ পার হয়েছে কি না সন্দেহ, সন্ধ্যার এই পরিবেশে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল, বহুদিন এতো চমৎকার কোন মেয়ে চোখে পড়েনি। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটা পূর্বপরিচিত।

মেয়েকে দেখে আবেগে আপ্লুত হলেও তা সামলে নিলেন প্রফেসর। লতিকা এসে সরাসরি তার বাবার পা ছুঁয়ে প্রনাম করলো। দেখে আরো অবাক হলেন ড. কারসন। এরা সংস্কার ত্যাগ করে না কখনো, যেখানেই থাকুক না কেন। ড. কারসনের সাথে হাত মেলাল সাবলীল ভঙ্গিতে। এবার সুরেশের পালা। তার সামনে এসে দুহাত জোড় করে প্রনাম করলো লতিকা। হেসে অভর্থনা জানালো সুরেশ, যদিও রামহরিকে সে থামাবার চেষ্টা করেছে যথেষ্ট।

একটু দূরে সন্দীপ দাঁড়ানো। ওদিকে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না যেন লতিকা। রামহরির দিকে তাকাল।

কাকা, আমার থাকার ব্যবস্থা কি?

তোমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে রেখেছি যাওয়ার আগেই, হেসে বলল রামহরি, আমার পেছন পেছন এসো।

লতিকা রামহরিকে অনুসরন করে সামনে এগুলো। হয়তো বাড়তি কোন কুঁড়ে ব্যবস্থা করে রেখেছে রামহরি। তাই চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

ড. কারসন, এগিয়ে এসে বললেন প্রফেসর, তাকে কিছুটা বিব্রত মনে হচ্ছে।

বলুন।

জানি না, কিভাবে বলবো, একটু চিন্তা করছেন প্রফেসর, আমার এই শরীরে অভিযানটা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আমি তাই বিশ্রাম চাইছি।

বিশ্রাম? তা কি করে সম্ভব? এটা আপনার আগেই ভাবা দরকার ছিল প্রফেসর, যথাসম্ভব কোমল করে বলার চেষ্টা করলেন ড. কারসন, কিন্তু সেভাবে নিজেকে সামলাতে পারলেন না।

জানি আপনি বিরক্ত হবেন, কিন্তু কি করবো?

আপনি এখন কি করতে চাইছেন?

আমি চলে যাচ্ছি, আমার বদলে লতিকা থাকল, আড়চোখে তাকালেন প্রফেসর, যদিও ইচ্ছে ছিল না ওকে একা রেখে যাওয়ার, কিন্তু এমন জেদ ধরেছে যে না করে পারিনি।

আমাদের এই অভিযান সম্পর্কে সবকিছু খুলে বলেছেন আপনার মেয়েকে?

সব খুলে বলিনি,সেটা আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছি। আমার মেয়ে চায়নি তার বাবা এই বয়সে কোন অভিযানে যাক, বরং এই কাজে সে নিজে যথেষ্ট আগ্রহি।

আপনি নিশ্চিত এতে কোন সমস্যা হবে না, ড. কারসন বললেন, তাকে কিছুটা নরম মনে হলো।

আমি জানি কোন সমস্যা হবে না, বেশ দৃঢ় গলায় বললেন প্রফেসর, একটু দূরে দাঁড়ানো সন্দীপের দিকে একটা চাহনি দিলেন, যা ড. কারসনের নজর এড়ালো না।

কাজটা যদিও ঠিক হয়নি,কিন্তু একজন বুদ্ধিমান লোক হিসেবে আপনি যা করেছেন তার উপর আর কথা চলে না, ড. কারসন বললেন।

প্রফেসর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন, তার চেহারায় অপরাধবোধ ফুটে উঠেছে। ড. কারসন এখন ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছেন। লতিকা যেহেতু একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ সে হয়তো প্রফেসরের চেয়ে আরো বেশি কাজে আসবে। কিন্তু সমস্যা একটা থেকেই যাচ্ছে। সন্দীপের সাথে লতিকার সম্পর্কও খুব একটা ভালো বলে মনে হয়নি। দুজন কেউ কারো দিকে তাকায়নি পর্যন্ত, ব্যাপারটা চোখ এড়িয়ে যায়নি ড. কারসনের।

আচ্ছা, আপনি যান, রাতে এই ব্যাপারে কথা বলবো, ড. কারসন বললেন। বেশ ক্লান্ত লাগছিল, প্রফেসর সুব্রামানিয়ামকে দরকার ছিল এই অভিযানে, বেশ অভিজ্ঞ মানুষ, তার বদলে মেয়েটাও হয়তো খুব একটা খারাপ করবে না। প্রফেসরকে নিয়ে একটা সমস্যা অবশ্য ছিল, একটু আরামপ্রিয় মানুষ লোকটা, এইসব অভিযানের সাথে ঠিকঠাক যায় না।

প্রফেসর চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন ড. কারসন। কিছু একটা তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। সুরেশ মনে করিয়ে দিলো ব্যাপারটা।

ড. আরেফিনকে দেখছি না, সুরেশ বলল, উনি কি বের হন নি?

বের তো হবার কথা, চিন্তিত গলায় বললেন ড. কারসন। আমি রুমে যাচ্ছি।

চলুন, আমিও আপনার সাথে যাবো, সুরেশ বলল।

সন্দীপ দেখছিল সবকিছু। কিছু বলেনি এখন পর্যন্ত।

আমিও আসছি, বলে পিছু নিলো সন্দীপ।

কুঁড়েগুলোর অবস্থান কাছাকাছি। ড. আরেফিনের কামরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। দরজার দিকে এগিয়ে গেল সুরেশ।

ড. আরেফিন, দরজায় নক করলো সুরেশ।

কোন সাড়া নেই ভেতর থেকে।

এবার একটু জোরে চাপ দিলো সুরেশ, খুলে গেল দরজাটা। রুমে বাতি জ্বলছে। বিছানা সুন্দর করে সাজানো। বিছানার একপাশের টেবিলে ল্যাপটপটাও দেখা যাচ্ছে।

ভেতরে কেউ নেই।

***

ঠিক কোথায় আছেন বুঝতে পারছেন না, জায়গাটা অন্ধকার, নীরব এবং শীতল। চেয়ারের সাথে হাত-পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। এমনভাবে বেঁধেছে নড়ার কোন উপায় নেই। মুখও আটকানো, টেপ দিয়ে। মাথা ঘুরিয়ে ডানে-বামে তাকানোর চেষ্টা করলেন, ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে বুঝতে পারলেন ঘাড়ের পেছন দিকে ব্যথা। বুঝতে পারছেন পেছনের চুলগুলো জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে আছে, সম্ভবত রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে গেছে। পেছন থেকে কেউ তাকে আঘাত করেছিল। এই ধরনের আঘাতে মৃত্যুও হতে পারে এই ধারনা হয়তো আক্রমনকারির ছিল না।

ঘরটা গুমোট, বাতাস একদম ঢোকে না মনে হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার। ঠিক কতোক্ষন এভাবে বসে আছেন বুঝতে পারছেন না। ঘন্টা খানেক হতে পারে, আবার একদিনও হতে পারে। বাইরে দিন না রাত সেটা বোঝারও কোন উপায় নেই। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলেন। মাথায় কিছু আসছে না। কে আক্রমন করতে পারে? ঐ চায়নীজরা? ওরাই সম্ভবত। এর আগে রাস্তায় রীতিমতো বন্দুক যুদ্ধ হয়েছিল তিব্বত সীমান্তে আসার পথে। সুরেশের কারনে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল সবাই। কিন্তু এখন কি হবে? ড. কারসনরা কি এতোক্ষনে টের পেয়েছে কিছু? ওরা কি তাকে খুঁজবে নাকি তাকে ছাড়াই এগিয়ে যাবে? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরছে। উত্তর পাওয়ার কোন উপায় নেই।

কোথাও কোন শব্দ নেই, অসহ্য লাগছে তার। এমন অসহায় অবস্থায় পড়ার কথা কখনো মাথায় আসেনি। এসব পরিস্থিতিতে কি করতে হবে তাও জানা নেই। তবে মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার।

হঠাৎ মনে হলো খুট করে কোথাও শব্দ হলো। শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়েছেন তিনি। ঘরটা দরজা-জানালাহীন মনে হলেও দরজা আছে, সেই দরজা খুলেছে। দরজার ওপাশে কে আছে বোঝা যাচ্ছে না। হাল্কা আলো আসছে দরজার ফাঁক দিয়ে। এবার শীর্নকায় একটা দেহ দেখতে পেলেন তিনি। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না আলোর বিপরীতে থাকার কারনে। প্রায় নিঃশব্দে তার সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। এতো কাছে লোকটার পরনের জ্যাকেটের দূর্গন্ধ নাকে লাগছে তার। মুখ সরিয়ে নেয়ারও উপায় নেই। বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো কেউ। একশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলে উঠেছে রুমটায়।

এদিক-ওদিক তাকানোর কোন অবস্থা নেই, সামনে দাঁড়ান লোকটার চেহারাও দেখতে পাচ্ছেন না। চেয়ার ঝাঁকিয়ে উঠলেন তিনি। নিজেকে ছাড়াবার প্রানপন চেষ্টা করলেন, যদিও জানেন তাতে বাঁধন একটুও ঢিলে হবে না।

লোকটা এবার দূরে সরে দাঁড়াল। একটা চেয়ার এনে বসল ঠিক তার মুখোমুখি। পরনে জিন্সের প্যান্ট, উপরাধেঁ জ্যাকেট। বাদামী চেহারায় হাজার আঁকিবুকি। মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। চোখ দুটো কোটরাগত, বাদামী চোখের মনি। এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছেন তিনি, মনে করতে পারছেন না।

ড. আরেফিন কামাল? গম্ভীর কণ্ঠে বলল লোকটা, চমৎকার ইংরেজি, একেবারে বৃটিশ একসেন্ট।

উত্তর দেয়ার উপায় নেই। তাকিয়ে দেখছেন শুধু সামনের চেয়ারে বসা মানুষটাকে। এঁকে কোথাও দেখেছেন, খুব বেশি দিন আগের কথা না। কিন্তু কোথায়?

হাত বাড়িয়ে মুখের উপর লাগানো টেপটা একটানে খুলে ফেলল মানুষটা। ব্যথায় ককিয়ে উঠলেন তিনি।

ড. আরেফিন, আবার বলল লোকটা, আমি আপনার পরিচিত, হাসল।

কিছুদিন আগেই আমাদের দেখা হয়েছে।

চোয়াল স্কুলে যাবার অবস্থা ড. আরেফিনের। হ্যাঁ, এই লোকটার সাথে দেখা হয়েছে, তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। সেটা সম্পূর্ন এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে, এখানে এই অবস্থায় আবার দেখা হবে তা কল্পনা করাও কঠিন। তখনকার চেহারা কিংবা বেশভুষার সাথে এখনকার পোশাক-আশাকের অনেক অমিল। সাধারন একজন তিব্বতি লামা কিভাবে অপহরণকারী হয়ে গেল ভাবতেই অবাক হচ্ছেন ড. আরেফিন। এই লোকটার উদ্দেশ্য কি?

হ্যাঁ, মনে পড়েছে, ড. আরেফিন বললেন। সম্পূর্ন ভিন্ন অবস্থায় এবং ভিন্ন পরিস্থিতিতে।

হাসল লোকটা, হাসলে চোখ প্রায় দেখা যায় না বুড়োর, বয়স সত্তুরের কম হবে বলে মনে হলো না ড. আরেফিনের কাছে। এই বয়সেও শরীর যথেষ্ট শক্তিশালী।

হ্যাঁ, বলল লোকটা, অনেক দিন ধরেই খুব শান্তিতে বাস করে আসছিলাম আমরা। হঠাৎ উপদ্রব হয়ে এসেছেন আপনারা।

কাদের শান্তি নষ্ট করেছি আমরা, বুঝলাম না, অবাক হলেন ড. আরেফিন।

ড. আরেফিন, খুব বেশি কিছু বলবো না, গলা একটু নীচু করলেন বুড়ো, আমাদের সংগঠনটার বয়স হাজার বছরের বেশি। অথচ খুব বেশি কাউকে আমাদের সামলাতে হয়নি একটানা। কিন্তু গত কিছুদিন ধরেই হঠাৎ লোকজন খোঁজ করতে শুরু করেছে, আসতে শুরু করেছে, এটা আমাদের পছন্দ না।

আপনারা কারা?

আমরা সাধারন জনগন, তিব্বতি শান্তিপ্রিয় মানুষ।

তিব্বতের শান্তিপ্রিয় মানুষদের আমরা কী ক্ষতি করতে এসেছি? আপনার যদি সেরকম কোন ধারনা থাকে সেটা ভুল।

আপনারা সাম্ভালা খুঁজতে এসেছেন, এতেই আমাদের শান্তি ভঙ্গ হয়েছে, চাপা গলায় বললেন বুড়ো।

এমন একটা জিনিসের অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে তাহলে তা খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি আমি।

আপনি মনে করলেই তো হবে না মি. আরেফিন, এবার গলার স্বর আরো নীচে নামিয়ে আনলেন বুড়ো, প্রায় ফিসফিস করে বললেন, এর পরিণতি যে ভালো হবে না। তা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন।

চুপচাপ শুনলেন ড. আরেফিন, কিছু বলার থাকলেও এখন কথা বাড়ানো ঠিক হবে না।

গত পঞ্চাশ বছরে সাম্ভালা নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি,কেউ নাক গলাতে আসেনি আমাদের গোপন দুনিয়ায়, অথচ এখন কয়েকটা দল এসে হাজির, জার্মান শালাদের নরকে পাঠিয়েছিলাম যেমন, তেমনি আপনাদের সাথেও একই ব্যবহার করা হবে, উঠে দাঁড়ালেন বুড়ো, ঐ জার্মানদের এক বংশধরও হাজির, ওকে আগে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।

জার্মান বংশধর? কে সে? অবাক হয়ে বললেন ড. আরেফিন।

ড. নিকোলাস কারসন, আর কে? বলে বেরিয়ে গেলেন বুড়ো।

পুরো ঘরটা আবার আগের মতো অন্ধকার, শব্দহীন হয়ে এলো। চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলেন ড. আরেফিন। এর আগে জানা ছিল ভদ্রলোক রাশিয়ান বংশোদ্ভুত, বড় একটা তথ্য লুকিয়েছেন ড. কারসন, কিন্তু কেন?

*

অধ্যায় ৬

বাড়িটা পরিচিত, বিপদের মধ্যে এখানেই আশ্রয় পেয়েছিল একসময়। তাই অনেকদিন পর উঠোনে পা দিয়ে কেমন অপরাধবোধ কাজ করছে রাশেদের মনে। ড. আরেফিনের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখা উচিত ছিল তার। তিনি সাহায্য না করলে আজ হয়তো বন্ধু হত্যার দায়ে জেলে পচে মরতে হতো।

সাথে রাজু আছে, বেশ কাঁচুমাচু হয়ে আছে, কেন কে জানে। নিচের ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষা করছে রাশেদ। ড. আরেফিনের স্ত্রীকে খবর দেয়া হয়েছে। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে তাকে নামতে দেখে উঠে দাঁড়াল রাশেদ।

স্যরি, তোমাদের বসিয়ে রাখার জন্য, উল্টোদিকের সোফায় বসতে বসতে বললেন ভদ্রমহিলা।

অসুবিধা হয়নি। আপনি ভালো আছেন? বলল রাশেদ।

আছি। কিন্তু তিনি কেমন আছেন, কোথায় আছেন তাই বুঝতে পারছি না, বেশ নরম গলায় বললেন আফরোজা আরেফিন। রাশেদ তাকাল, গতবার অনেক বিপদের মধ্যেও এই মহিলার মধ্যে একধরনের দৃঢ়তা চোখে পড়েছিল, সহজে ভেঙে পড়ার মানুষ তিনি নন।

কোন খবর, কিংবা শেষ কি কথা হয়েছিল আপনাদের মধ্যে?

শেষ কথা হয়েছিল বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, বলল তিব্বত সীমান্তের দিকে যাচ্ছি, সেখান থেকে যোগাযোগ করা কঠিন হবে, বললেন আফরোজা আরেফিন, কথায় বুঝলাম বেশ ঝামেলায় আছেন।

কি রকম ঝামেলা কিছু আঁচ করতে পারলেন?

না, তিনি আমাকে কখনোই খুলে বলবেন না, কারন তিনি চান না আমি ভয় পাই, এবার ভদ্রমহিলার চোখে পানি দেখতে পেল রাশেদ।

কি উদ্দেশ্যে তিনি সেখানে গিয়েছেন, আপনি কিছু জানেন?

ওরা বের হয়েছে সাম্ভালার খোঁজে?

সাম্ভালা, একসাথে বলে উঠে রাশেদ আর রাজু। রাজু এতোক্ষন চুপচাপ বসে ছিল, এখন নিজেকে সামলাতে পারলো না।

হ্যাঁ, সাম্ভালা, তবে সেটা কী আমি জানি না।

কাউকে চেনেন, কিংবা নাম জানেন, তার সঙ্গিদের?

দলনেতাকে তুমি চিনতে পারো, ড. নিকোলাস কারসন, আফরোজা আরেফিন বললেন, এর আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন, কিডন্যাপ হয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়েছিল একবার, ড. আরেফিন নিয়ে গিয়েছিলেন উনার কাছে।

আমার মন বলছে উনি বিপদে আছেন, নইলে এ কয়দিনে যোগাযোগ হতো আমাদের মধ্যে, আফরোজা বললেন।

উনি ঠিক কোথায় আছেন বলে আপনার ধারনা? জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

নেপালে, তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও, যাওয়ার পথে তাদের গাড়িতে কারা নাকি গুলিও করেছিল।

তাহলে তো কেস সিরিয়াস, রাজু বলল।

হ্যাঁ, আমারও তাই ধারনা, রাশেদ বলল, আমরা এখন কি করতে পারি? আমি কখনো দেশের বাইরে যাইনি,পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই।

সেগুলো নিয়ে চিন্তা করো না, তুমি রাজি থাকলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবো আমি, ইমার্জেন্সি বলে একটা কথা আছে।

আর আমার একজন সঙ্গি দরকার, একেবারে একা যাওয়াটা একটু বিপজ্জনক হয়ে যায় আমার জন্য।

আমার ছোট ভাই যেতে পারে তোমার সঙ্গে, কিংবা তোমার যদি কেউ থাকে তুমি সাথে নিতে পারো, আমার কোন আপত্তি নেই, তার খরচও আমি বহন করবো। আফরোজা আরেফিন বললেন।

রাজু তাকাল রাশেদের দিকে।

ঠিক আছে, আমি আর রাজু যাচ্ছি তাহলে, রাশেদ বলল।

কাল সকালে আমার এক ভাই তোমার সাথে যোগাযোগ করবে, পাসপোর্ট আর ভিসার জন্য কাগজপত্র চাইবে, তোমরা দুজন সব ওর হাতে দিও, বাকিটা সে করে নেবে।

ঠিক আছে, আমরা তাহলে উঠি, রাশেদ বলল।

অনেক দিন পর এসেছো, দুপুরে খেয়ে যাও, আফরোজা আরেফিন বললেন।

আরেকদিন এসে খাবো, আজ যাই, বলল রাশেদ, রাজুকে ইশারা করলো উঠে পড়ার জন্য।

দরজা পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দিলেন আফরোজা আরেফিন। বুকের উপর থেকে দারুন এক ভার নেমে গেছে তার। এখন অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন হবে, কাল সকালে ব্যাংক থেকে তুলে নেবেন। এই দুজনের উপর ভরসা করতে হবে, রাশেদকে বিশ্বাস করা যায় যে কোন মূল্যে, ওর সঙ্গিও নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। এখন সব ঝামেলা শেষ করে ওদের দুজনকে নেপাল পাঠানো দরকার, যতো দ্রুত সম্ভব।

মোবাইল ফোন তুলে পরিচিত একজনের নাম্বার ডায়াল করলেন তিনি।

***

এতো সুন্দর মুখ, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিচনার, চারপাশ কেমন অদ্ভুত সুন্দর, মায়াময়। আলো আধারীতে কেমন মায়াবী লাগছে সবকিছু।

 তুমি কেমন আছো মিচনার? অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসে প্রশ্নটা, প্রায় ফিসফিস করে বলা শব্দগুলো বাতাসে কেমন আলোড়ন তোলে।

আমি…আমি… চারপাশে তাকায় মিচনার, যেন উত্তর আশপাশেই আছে, সে খুঁজে পাচ্ছে না।

তোমার সাথে অনেকদিন পর দেখা, হাল্কা হাসির শব্দে কেঁপে উঠে মিচনার, এতো মোহময় হাসি হতে পারে কারো, এতো স্বচ্ছ, এতে নির্মল!

তুমি কে? কি চাও আমার কাছে?

লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছো তুমি, যখনই মনে হবে আমাকে দরকার, ডাকবে, কানে কানে ফিসফিস করে বলল ছায়ামূর্তিটা।

কি নামে ডাকবো তোমাকে?

খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, যেন এরচেয়ে মজার কথা শোনেনি ছায়ামূর্তি।

কোন নামে ডাকতে হবে না, আমি আসবো, আমরা আসবো।

ছায়াময় মূর্তিটা মিচনারের চারপাশে পাক খেল, পাতলা ফিনফিনে সিল্কের পোশাক পড়া নারীদেহ, মাথাভর্তি কালো চুল, লাল টকটকে ঠোঁট আর বাঁকা চাহনি, তাকে অস্থির করে তুলেছে, দুহাত বাড়িয়ে ধরতে গেল মিচনার। কিন্তু নেই, কিছু নেই। যেন কেউ ছিল না কখনো। সে একাই দাঁড়িয়ে আছে।

এই সুন্দর মুখটাই সে দেখেছিল অনেক অনেক দিন আগে, যখন সে মানুষ ছিল! সাধারন এক নাবিক ছিল, যার তখনো বয়স হয়নি পৃথিবীকে জানার, চেনার। সব যেন দুলছিল, ভাসছিল তার আশপাশে। সে নিজেও ভাসছিল, পানির নীচে না উপরে পরিস্কার মনে নেই। মনে হয়েছিল পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন জগতে চলে গেছে সে। সেই জগতে এই অদ্ভুত সুন্দর মুখশ্রীর মানুষ বাস করে। টানা টানা কালো চোখগুলো তুলনাহীন, ঢেউ খেলানো চুলগুলো দুলছিল সেই সুন্দর মুখশ্রীর চারদিকে। চোখে ইশারা, যেন আরো কিছু বলতে চায়, কিছু দেখাতে চায়।

সুন্দরি মেয়েটার হাতে একটা কিছু ছিল, পরিস্কার মনে পড়ছে, একটা পানপাত্র, স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি, উপরের দিকে কিছুটা বাঁকানো। ইশারায় সেটা নিতে বলেছিল মেয়েটা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আদেশ পালন করেছিল মিচনার, পানপাত্রটা হাতে নিয়ে স্থির হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিল সে। টলটলে স্বচ্ছ এক ধরনের পানীয় ইশারায় পান করতে বলছে মেয়েটা। যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো তা পান করে নিয়েছিল মিচনার, চোখ বন্ধ করে। তখন জানতো না কি হবে সামনে, মৃত্যু! না, মৃত্যু তার হয়নি। বরং অতি দীর্ঘ অমানবিক এক জীবনের অধিকারী হয়েছে সে। ঐ অদ্ভুত পানীয়ের স্বাদ এখনো লেগে আছে মুখে।

চোখ খুলতেই নিজেকে ছোট একটা গাছে হেলান দেয়া অবস্থায় পেল মিচনার। এতোক্ষন যা দেখছিল স্বপ্ন! নাকি সত্যি কিছু? তার এই দীর্ঘ জীবনের রহস্য কী? স্বপ্নে দেখা সেই পানীয় যা এক সুন্দরির হাত থেকে পেয়েছিল, নাকি সেটা কোন স্বপ্ন ছিল না? সেটা ছিল অতি বাস্তব! সেই সুন্দরি কে? কোথায় থাকে? কি উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটার? নাকি এটা সে রকম কোন মিথ যা সত্যি হয়ে গেছে তার বেলায়? ফাউন্টেন অফ ইয়ুথের পানি পান করেছে সে, তাও এক জলকন্যার হাতে! হতে পারে আবার নাও হতে পারে। তবে যাই হোক না কেন কোন এক রহস্যময় কারনে তার এই দীর্ঘ জীবন। সেই জীবনের আবার লক্ষ্যও আছে! হাসল মিচনার। ঠিক তার মতোই একজনকে হারাতে হবে। প্রকৃতি দুজনকে সহ্য করবে না। তাদের একজনকে মরতে হবে, আরেকজনের হাতে। কার হাতে কে মরবে সেটা সময়ই বলে দেবে। হয়তো প্রকৃতিই তাকে বেছে নিয়েছে, মেয়েটা সেই রহস্যময় প্রকৃতির একটা অংশ ছাড়া আর কিছুই না। নিজের উপর পূর্ণ আস্থা আছে মিচনারের, আরো হাজার বছর বাঁচতে তার কোন আপত্তি নেই। জীবন, তা সে যে রকমই হোক, সবসময় আনন্দময়, মৃত্যু এক বিভীষিকার নাম। না, সে মরতে পারে না, মরতে হবে ঐ দ্বিতীয় জনকে।

উঠে দাঁড়াল মিচনার। যতো এগুচ্ছে ততো কাছাকাছি চলে আসছে লক্ষ্যবস্তুর। চোখ বন্ধ করে বাতাসে নাক পাতল মিচনার। বিপদের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। সন্ধে হয়ে এসেছে, রাতটা নিরাপদে কাটানোর ব্যবস্থা করা দরকার। গা ঝাড়া দিয়ে সামনে এগুলো মিচনার। ছোট এই টিলামতো জায়গা থেকে সাপের মতো পেচিয়ে এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটা বেশ সুন্দর দেখা যাচ্ছে। আজ রাতটা এখানেই কাটাবে বলে মনস্থির করলো মিচনার। তার আগে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আগুনের ঝামেলা বাদ দিয়ে এখন পুরো কাঁচা খাওয়ায় বিশ্বাসী সে। চারপাশে তাকাল। তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বিরক্তিতে চোখ কুচকাল মিচনার। আরো একটু দূরে যাযাবর রাখালদের একটা তাঁবু চোখে পড়ল। ওখানে নিশ্চয়ই ছাগল, ভেড়া কিছু একটা পাওয়া যাবে। আশা নিয়ে টিলার ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলো মিনার।

*

অধ্যায় ৭

ড. আরেফিন নেই, কোথায় যেতে পারেন কোন ধারনাই করতে পারছে না কেউ। এই অচেনা জায়গায় কাউকে না বলে কোথাও যাওয়ার কথা নয় ভদ্রলোকের। নিজের কুঁড়েতে ফিরে এসেছেন ড. কারসন। এখানে দেরি করার কোন সুযোগ নেই। এমনিতেই অনেক সময় পার হয়ে গেছে, যতো সময় নষ্ট হবে বিপদের মাত্রা তততা বাড়বে। ড. আরেফিনের আকস্মিক অন্তর্ধান এর প্রমান। ভদ্রলোক একা একা কোথাও যাবেন না, অন্তত ড. কারসনকে না বলে, এটুকু বিশ্বাস তার আছে। এই অভিযানে একমাত্র ড. আরেফিনের উপরই কিছুটা ভরসা ছিল। কিন্তু এখন তিনি না থাকায় কি করবেন, কিভাবে করবেন না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছেন তিনি।

দরজায় নক হলো, সুরেশ দাঁড়িয়ে। তার পেছনে সন্দীপকেও দেখা যাচ্ছে।

ইশারায় দুজনকে ভেতরে ঢুকতে বললেন ড. কারসন।

সন্দীপ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছে, সুরেশ দাঁড়িয়ে আছে, উশখুশ করছে।

কিছু বলবেন, সুরেশ?

ড. আরেফিন, তিনি সম্ভবত কিডন্যাপ হয়েছেন। সুরেশ বলল।

কিভাবে বুঝলেন কিডন্যাপ হয়েছেন? ড. কারসন জিজ্ঞেস করলেন, মনে মনে তিনিও জানেন এটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।

একটা জায়গায় ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন দেখলাম, বেশ কিছু জুতোর ছাপ, যা আমাদের কারো সাথে মেলে না, সুরেশ বলল।

উত্তর দিলেন না ড. কারসন, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে।

আমরা এখন কি করবো? এবার মুখ খুললো সন্দীপ, দলনেতার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।

আমরা রওনা দেবো, কাল সকালেই।

ড. আরেফিনকে ছাড়া?

হ্যাঁ, এছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই।

উনি আমাদের সঙ্গি ছিলেন, এভাবে তাকে আমরা রেখে যেতে পারি না, এবার নিজের অজান্তেই গলা চড়াল সন্দীপ।

হ্যাঁ, সঙ্গি ছিলেন, কিন্তু আমাদের যে উদ্দেশ্য তাতে দেরি করার মতো সময় হাতে নেই। আমার জায়গায় থাকলে তিনিও তাই করতেন।

কিন্তু…

ড. কারসন ঠিকই বলেছেন মি. সন্দীপ, এবার সুরেশ বলল, এখানে বসে থেকে শত্রুপক্ষের সহজ শিকার হওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। এরচেয়ে এগিয়ে যাই। ড. আরেফিনকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা আমি করবো।

ঠিক আছে, আরেকটা কথা…।

ড. কারসন তাকালেন সন্দীপের দিকে, বেশি কথা শুনতে তার এখন ভালো লাগছে। ড. আরেফিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। অপহৃত হয়ে থাকার পরিস্থিতিতে তিনি পড়েছিলেন একবার, নিজেকে কেমন অসহায় লাগে তা ভালোমতোই জানা আছে।

বলে ফেলুন মি. সন্দীপ?

প্রফেসর কি আমাদের সাথে যাচ্ছেন না?

না, তিনি এখান থেকেই ফিরে যাবেন, তার পরিবর্তে যোগ দিচ্ছেন ড. লতিকা, ড. কারসন বললেন।

আচ্ছা, আমি যাই, বলে বেরিয়ে গেল সন্দীপ, যেন যা জানার তা জেনে ফেলেছে।

সুরেশ, আপনি ড. লতিকাকে খবর দিন, ওর সাথে কথা বলা দরকার, ড. কারসন বললেন।

সুরেশও বের হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে প্রফেসর চলে যাচ্ছেন বলে খুব একটা খারাপ লাগছে না ড. কারসনের। এই ধরনের অভিযানের জন্য এখন তার ফিট নন

ভদ্রলোক, এর চেয়ে তার মেয়ে হয়তো ভালো কাজে আসবে।

পায়চারি করতে করতে সামনের করনীয়গুলো ঠিক করতে লাগলেন ড. কারসন, ড. আরেফিনকে ছাড়া সব কিছুই কেমন জটিল হয়ে যাচ্ছে।

***

সকাল সকাল পৌঁছেছেন তিনি কোদারি গ্রামে। সাথে বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বর তো আছেই। যাত্রায় সুবিধার জন্য মালপত্র অনেক কমিয়ে এনেছেন, বিশেষ করে তাঁবুগুলো, ওগুলো নিয়ে চলাফেরা করা সমস্যা, সামনে তিব্বত সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় যতো হাল্কা থাকা যাবে ততোই মঙ্গল। শুধু কিছু গরম কাপড়চোপড় নিয়েছেন, বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরের জন্য।

দূর থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল সবাইকে, বেশ কিছু কুঁড়ে ঘর সারি বেঁধে তৈরি করা হয়েছে, মাঝখানের ফাঁকা অংশটায় দাঁড়িয়ে সবাই। শুধু একজন নেই। গাছের আড়াল থেকে আরো কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন তিনি। কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। একজন নারী সদস্যও দেখা যাচ্ছে, যাকে এই প্রথম দেখলেন তিনি। আধুনিক পোশাক পরনে, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট দৃঢ়চেতা এই মেয়ে।

বোঝার চেষ্টা করছেন কি হচ্ছে, দলটা সম্ভবত তাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। কিন্তু ঐ ভদ্রলোককে ছাড়া? তিনি কি দলত্যাগ করেছেন? এরকম তো হবার কথা নয়। মনে মনে ভাবলেন তিনি।

তবে দুজন দলত্যাগ করছে এটুকু পরিস্কার বুঝলেন, বয়স্ক ভদ্রলোক আর তার সহকারি। এই দুজনের নাম জানেন না তিনি। মেয়েটাকে বেশ কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়েছেন বয়স্ক লোকটা, বাকিদের সাথে সৌজন্যমূলক হাত মিলিয়ে। ওদের নেয়ার জন্য ছোট একটা জিপ অপেক্ষা করছিল। উঠা মাত্রই চলতে শুরু করেছে। জীপটা।

বাকিরা হাত নাড়ল কিছুক্ষন, তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেয়েটা চুপচাপ, হয়তো নতুন এসেছে, এখনো সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। এতো সকালে কোথায় যাচ্ছে দলটা বুঝতে সমস্যা হলো না, তিব্বতী সীমান্তের দিকে যাচ্ছে।

আরো কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে পিছু হটলেন তিনি। কোদারি গ্রামটা এখন অনেক বদলে গেছে। পুরানো সেই বৌদ্ধ মন্দিরটা এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ, সেখানেই আপাতত আশ্রয় গেড়েছেন তিনি। বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরকে সেখানে রেখে এসেছেন।

এই দল আর তার গন্তব্য মনে হচ্ছে একই। আরো দুটো জিপ দাঁড়ানো ছিল, একে একে সবাই উঠে পড়ল জীপগুলোতে। স্টার্ট দেয়ার পর নিজেকে পুরোপুরি গাছের আড়ালে নিয়ে গেলেন তিনি। খুব স্বাভাবিক নিয়মে সীমান্ত পার হবে দলটা, হয়তো সবধরনের অনুমতি নেয়া আছে। কিন্তু তাদের ব্যাপার ভিন্ন। পুরো ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে পার হতে হবে সীমান্ত। নিজেকে নিয়ে তেমন চিন্তা নেই, যে কোন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে অভ্যস্ত তিনি, কিন্তু যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া কিভাবে পার হবে সেটা নিয়ে ভাবছেন তিনি।

জীপগুলো চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষন পর আড়াল থেকে বের হলেন তিনি, হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের কাছে পৌঁছালেন। যজ্ঞেশ্বর ধ্যানে বসেছে, বিনোদ চোপড়া চুপচাপ বসে আছে, তাকিয়ে আছে অনেক দূরের হিমালয় রেঞ্জের দিকে।

কি ভাবছেন? বিনোদ চোপড়ার কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

কিছু না। ভাবছি সত্যিই যেন সাম্ভালা বলে কিছু থাকে!

থাকলে কি হবে?

আমি সেখানে থেকে যাবো, চিরতরে।

কেন? প্যারিস আপনার ভালো লাগে না?

এখন আর ভালো লাগে না। অনেক ধন-সম্পদ করেছি, কিন্তু আপন কেউ নেই আমার, গম্ভীর কণ্ঠে বলল বিনোদ চোপড়া।

আপনার বয়স এখনো বেশি না, চাইলে বিয়ে করে সংসারি হয়ে যেতে পারেন।

তা হয়তো পারি, কিন্তু একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন আমার কখনোই হবে না। আমি একজন স্বীকৃত চোরাচালানি, ভারত আর ফ্রান্স, দুই দেশেই আমার নামে হুলিয়া আছে, আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকি বলে তা এড়িয়ে চলতে পারি। কিন্তু একজন স্বাভাবিক মানুষের জীবন আমি কখনোই পাবো না, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বিনোদ চোপড়ার বুক চিরে।

উঠে দাঁড়ালেন তিনি, আর কথা বলার কোন মানে নেই। ধ্বংসস্তূপের মাঝে চমৎকার একটা বসার জায়গা বেছে নিলেন। সাম্ভালা যদি থেকে থাকে তাহলে বিনোদের ইচ্ছে অপূর্ন রাখবেন না, মনে মনে ভাবলেন তিনি।

যজ্ঞেশ্বরের ধ্যান শেষ হয়েছে।

আমরা রওনা দিচ্ছি কখন? জিজ্ঞেস করল যজ্ঞেশ্বর।

এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই, গুরুজি, হেসে বললেন তিনি।

অস্থির হচ্ছি না, কিন্তু মন বলছে কিছু একটা ঠিক নেই, যজ্ঞেশ্বর বলল।

আমি আপনাকে আগেও বলেছি, চিন্তার কিছু নেই।

দূর থেকে দমকা হাওয়া এলো এই সময়। একটু আগেও আকাশ পরিস্কার ছিল, এখন কেমন মেঘলা হয়ে এসেছে। বাতাসের ঘ্রান নেয়ার চেষ্টা করলেন তিনি, চেহারায় অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা গেল। মুখ কুঁচকে গেছে তার।

আমরা আজ রাতেই রওনা দেবো, নইলে দেরি হয়ে যাবে, বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি, বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

দুপুরে খাবার জন্য কিছু একটা শিকার করতে হবে, এই এলাকায় ফলমূলের আশা করা বৃথা। হাতে ছোট একটা ছোরা আছে তার, অনেক ধারাল। ছোরাটা একহাত থেকে অন্যহাতে নিলেন।

যজ্ঞেশ্বরের বিপদের আশংকা পুরোপুরি অমূলক নয়, তিনি নিজেও বিপদের আশংকা করছেন, যে কোন সময় যে কোন দিক থেকে বিপদ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এখন শিকার করতে বের হয়েছেন তিনি, প্রস্তুত না থাকলে নিজেও শিকারে পরিণত হতে পারেন। এই ধরনের চিন্তাভাবনার যুক্তিযুক্ত কোন কারন নেই। যজ্ঞেশ্বরের গুরুর কথাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি তিনি। তার একজন প্রতিদ্বন্ধী আছে,

সে আসছে, আসছে। যে কোন সময় চলে আসবে।

*

অধ্যায় ৮

খুব তাড়াতাড়িই পাসপোর্ট হয়ে গেল দুজনের। এতো দ্রুত হবে কল্পনাও করতে পারেনি রাশেদ। এ ব্যাপারে তার জানার পরিধি অনেক কম। এর আগে কখনো দেশের বাইরে যায়নি। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। সাথে রাজু থাকছে। একা একা বিদেশে যাওয়াটা কিছুটা ঝুকিপূর্নই হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য। এখন কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে।

গতকাল আবার গিয়েছিল ড. আরেফিনের বাসায়। ড. আরেফিনের নতুন কোন খবর পাওয়া যায় কি না জানতে। নতুন কোন খবর নেই। ড. আরেফিনের মোবাইল বন্ধ। নেপালে বাংলাদেশের দূতাবাসে খবর দেয়া যায়, কিন্তু তাতে কতোটা কাজ হবে তাতে যথেষ্ট সন্দিহান ভদ্রমহিলা। তার একমাত্র ভরসা রাশেদ আর রাজু। গত কদিনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, ফোনে কথা হয়েছে, তাই চমৎকার একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আফরোজা আরেফিনের সাথে। ভদ্রমহিলা এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু একবার মিশে যেতে পারলে বোঝা যায় কি চমঙ্কার একজন মানুষ তিনি।

এই ধরনের মানুষকে বিপদে দেখতে ভালো লাগে না, এছাড়া ড. আরেফিনের প্রতি পূর্ব কৃতজ্ঞতা তো আছেই। এই অভিযানে তাকে যেতেই হতো। আফরোজা আরেফিন টাকা-পয়সার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন আগে থেকেই। রাশেদের যদিও ইচ্ছে ছিল না, তার নিজের কাছে বেশ কিছু টাকা আছে, গ্রামে বাবাকে বললে টাকা পাঠাতে এক মুহূর্ত দেরি করবেন না। কিন্তু ভদ্রমহিলা তাতে রাজি হননি। রাশেদ আর রাজুর পুরো খরচের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। অনেক অনুরোধেও কাজ হয়নি।

বাসায় বসে বসে পত্রিকা পড়ছিল রাশেদ। পেছনের পাতায় খবরটা তার চোখ এড়াল না।

ভয়ংকর কয়েদী পলাতক
নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা কারাগার থেকে চিহ্নিত সাতজন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীকে চট্টগ্রাম কারাগারে স্থানান্তরের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রীতিমতো সিনেমা স্টাইলে কয়েদীদের তুলে নিয়ে গেছে একদল সন্ত্রাসী। ধারনা করা হচ্ছে, এই ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। বৃটিশ নাগরিক ড. নিকোলাস কারসনকে অপহরন এবং শামীম নামে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত কয়েদী আকবর আলী মৃধা পলাতকদের মধ্যে রয়েছেন…

ঘটনার আরো বিস্তারিত বিবরন ছিল, কিন্তু আর পড়তে ইচ্ছে হলো না রাশেদের। ঐ পিশাচ পালিয়েছে! প্রকাশ্য দিবালোকে!

পত্রিকা ফেলে দিয়ে পায়চারি করলো কিছুক্ষন রাশেদ। আকবর আলী মৃধা ছাড়া পেয়েছে, তার মানে পেছনে আবার লোক লাগার সম্ভাবনা আছে। গতবার ওর কারনেই পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিল শয়তানটা। এখন ছাড়া পেয়ে নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দেবে না।

রাজুকে আসতে দেখল এই সময়। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আসছে। বিদেশে যাবে, এই জন্য সবসময় মেজাজ ফুরফুরে। ড. আরেফিনের খোঁজ করতে গিয়ে কি কি ঝামেলায় পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই।

কি দোস্ত, খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে, চেয়ারে বসতে বসতে বলল রাজু।

না, তেমন কিছু না।

প্ল্যান প্রোগ্রাম সব ঠিক আছে তো?

সব ঠিক।

তাহলে কখন রওনা দিচ্ছি আমরা?

কাল ফার্স্ট ফ্লাইটে, এখানে যতো দেরি করবো ড. আরেফিনের জীবনের ঝুঁকি ততো বাড়বে।

উনি জানেন?

হম।

আমি বাড়িতে জানিয়েছি, বললাম ইউনিভার্সিটি থেকে পাঠাচ্ছে, খরচ লাগবে না, শুনে বাবা দারুন খুশি হলো। তুই কি বলবি?

আব্দুল আজিজ ব্যাপারিকে কি বলবে এটা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল, কিন্তু এতো সহজ সমাধানটা তার চোখে পড়েনি। মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো সে।

বাবা, স্লামালেকুম,সালাম দিলো রাশেদ।

বলল, রাশেদ, আছো ক্যামন?

ভালো আছি বাবা, একটা কথা বলার জন্য ফোন দিলাম, আমতা আমতা করে বলে রাশেদ।

বলো।

আমি নেপাল যাচ্ছি, আট-দশদিনের জন্য, ইউনিভার্সিটি থেকে পাঠাচ্ছে, খরচও ওরা দেবে, মিথ্যে বলতে গিয়ে গলা প্রায় আটকে যাচ্ছিল রাশেদের।

কবে যাবা?

আগামীকাল দুপুরের ফ্লাইটে।

কোন সমস্যা নাই তো?

জি না, সমস্যা নাই।

একেবারে খালি হাতে যাওয়া ঠিক না, সকালেই তোমার একাউন্টে কিছু টাকা পাঠাইয়া দিমু।

লাগবে না… আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল রাশেদ।

বেশি কথা বলবা না, সকালে একাউন্টে টাকা যাবে, খালি হাতে যাবা না, বিপদ আপদের কথা বলা যায় না, রাখলাম তাইলে।

চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল রাশেদ। বাবার কাছে মিথ্যে বলতে খারাপ লাগছিল তার। কিন্তু সত্যি কথা বললে তিনি ঝামেলা করতেন।

কি, আমার পথে চললি যে, রাশেদের কাঁধে হাত রেখে বলল রাজু, ঠাট্টা করে।

এই একবারই, বলল রাশেদ।

বিছানার উপর পড়ে থাকা পত্রিকার দিকে তাকাল।

আগামীকাল রওনা দিচ্ছে সে নেপালের পথে, সেখান থেকে যেতে হবে তিব্বত সীমান্তে, যেখানে শেষ কথা হয়েছিল ড. আরেফিন আর তার স্ত্রীর। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো রাশেদ, সে প্রস্তুত।

বহুদিন পর পুরানো পেশায় ফিরে আসতে পেরে ভালোই লাগছিল তার। কাজটায় একঘেয়েমী থাকলেও, উত্তেজনাও আছে। নিজেকে কেমন ইনভেস্টিগেটরের মতো লাগে, অনুসরন করা সহজ কাজ নয়। শুধু অনুসরন করলেই হবে না, যাকে অনুসরন করা হচ্ছে সে কী করছে, কেন করছে সে বিষয়েও ধারনা করতে হয়। যেমন এই ছেলেটাকে আগেও সে অনুসরন করেছে। বেশ কয়েকবার। বোঝাই যাচ্ছে, বস একে কাবু করতে পারেনি, উলটো নিজেই কাবু হয়ে জেলখানায় ঢুকেছে। তবে পরিস্থিতি পাল্টেছে। আবারো তাই আগের কাজে ফিরে আসতে হয়েছে।

উত্তরার এই জায়গাটা তার পরিচিত। আজ বহু ব্যবহৃত নিজের গাড়িটা না এনে একটা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করেছে সে, সারাদিনের চুক্তি। যদিও সারাদিন লাগবে না তার। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই রওনা দেয়ার কথা ওদের।

মোবাইল ফোনে কল এলো এই সময়।

কি খবর? গলার স্বরটা চিকন, অনেকটা মেয়েলী, এমন লোকের কাছ থেকে আদেশ নির্দেশ নিতে ভালো লাগে না, কিন্তু আগে সরাসরি বসের সাথে কথা হলেও এখন সেই সুযোগ নেই।

আমি তৈরি।

ফ্লাইট কয়টায়?

ঘন্টা তিনেক পর।

একদম চোখের আড়াল করবেন না, পৌঁছে আমাকে ফোন দেবেন।

জি, ঠিক আছে।

ফোন রেখে দিয়ে সামনের দিকে তাকাল লোকটা। আরো ঘন্টা তিনেক বাকি আছে। ফ্লাইট ছাড়ার। ওদের বের হতে বেশি সময় লাগবে না। ছেলেটাকে খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছে। কোন আত্মীয়-স্বজন নেই, বন্ধু-বান্ধব নেই। একটা মেয়ে বান্ধবী ছিল, সেও দেশের বাইরে। উপায় না দেখে গ্রামের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে সেখানে গিয়েছিল সে, ছেলেটার মাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে উত্তরার এই ঠিকানা যোগাড় করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি।

তবে আরেকটু দেরি হলেই সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। ওর পিছু নিয়ে একদিনট্রাভেল কোম্পানীতে গিয়েছিল সে, সেখান থেকে খবর পাওয়া গেল নিজের এবং বন্ধুর জন্য নেপালের টিকেট কিনেছে ছেলেটা। সেটা জানানো হলো বসের শিষ্যকে। নেপালের উদ্দেশ্যে তার নিজের জন্যও টিকিট কাটতে হলো।

এর আগে অনুসরনের কাজগুলো সব করতে হয়েছে দেশের মধ্যেই। দেশের বাইরে বলতে নেপালে যাওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকবার, মাথায় তখন ভূত চেপেছিল এভারেস্টে জয় করার, কিন্তু প্রশিক্ষন ছিল না, সেরকম টাকা ছিল না, তাই শুধু ঘুরে ফিরেই চলে আসতে হয়েছিল। বছর কয়েক হলো বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেছে, তাতে কিছুটা হলেও তার মন খারাপ। জীবনে অন্তত একটা রেকর্ড করার ইচ্ছে ছিল তার, এমন কিছু করার ইচ্ছে ছিল যাতে তোক তার নাম মনে রাখে। কিন্তু সে সুযোগ শেষ। এমনিতেই সংসার করা হয়নি,পুত্র-কন্যারা তার নাম বয়ে নিয়ে বেড়াবে সে আশাও নেই। যাই হোক, অনেকদিন পর সুযোগ পাওয়া গেছে দেশের বাইরে যাওয়ার। উড়োজাহাজে চড়া হয় না অনেকদিন।

পাঁচতলা বিল্ডিঙয়ের নীচে রাশেদকে দেখতে পেল। পাশে ব্যাগ নিয়ে ওর বন্ধুও আছে। একটা সিএনজি ডাকল ছেলেটা।

ঐ মিয়া, স্টার্ট দেও, ট্যাক্সিক্যাব চালকের উদ্দেশ্যে বলল লোকটা। সামনের ঐ সিএনজির পিছ পিছ যাবা, ঠিক আছে?

ট্যাক্সিক্যাব চালক হেসে মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।

*

অধ্যায় ৯

পুরো পরিকল্পনা কোথাও একজন গাইডের কোন ভূমিকা ছিল না। ভূমিকা বলতে শুধু পথ দেখানো, যানবাহনের ব্যবস্থা করা এইসব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই লোক ছাড়া এক পা এগুনো যাবে না। দায়-দায়িত্ব সব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে সুরেশ। লোকজনও অনেক কমে এসেছে, এখন আছেন ড. কারসন, সন্দীপ, ড. লতিকা আর সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা। ড. আরেফিন এবং প্রফেসর আর তার সহকারী না থাকাতে দলটা অনেক হাল্কা হয়ে গেছে। ড. আরেফিনের ব্যাগপত্র, ল্যাপটপ সব অবশ্য সাথে আনা হয়েছে।

সকালের দিকে রওনা দিয়েছেন ড. কারসন। ড. লতিকার সাথে পরিচয়ের পর আর বিশেষ কোন কথা হয়নি। যদিও কথা বলাটা খুব দরকার। জিপের একেবারে পেছনের সীটে বসে আছে ড. লতিকা, ড. কারসনের পাশে, মাঝখানের সীটে সন্দীপ।

লতিকা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে, এখানকার প্রকৃতি দেখার মতোই সুন্দর। একেবারে চুপচাপ, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না।

সুরেশ স্বাভাবিকভাবেই ড্রাইভারের পাশের সীটে বসেছে। সতর্ক চোখ রাখছে চারপাশে। সন্দীপ উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকলেও তার চোখ যে মাঝে মাঝে ড. লতিকার দিকে চলে যাচ্ছে না তা নয়। ড. কারসন একমনে ল্যাপটপে কাজ করছেন, গভীর মনোযোগে।

ল্যাপটপ বন্ধ করে লতিকার দিকে তাকালেন ড. কারসন।

ড. লতিকা…

আপনি কিন্তু আমাকে শুধু লতিকা বলে ডাকতেন, মি. কারসন, হেসে বলল লতিকা।

হুম, মনে আছে, তুমিও আমাকে শুধু কারসন বলে ডাকতে পারো, হাসলেন ড. কারসন, বাবার মতো মেয়েটা ততো নিরস নয় মনে হচ্ছে।

কিছু বলতে চাচ্ছিলেন? লতিকা জিজ্ঞেস করলো।

তুমি হামবুর্গে পড়াও, আর্কিওলোজি, এখানে আসার কারন কি বলবে?

আসলে সত্যি কথা বলতে দেশিয় কোন কাজে এখন পর্যন্ত অংশগ্রহন করিনি। আমি। তাই ভাবলাম বাবার জায়গাটা দখল করি। এমনিতে ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি, ওরা জানে না আমি এখানে।

জানলে সমস্যা হবে না?

আমার কৌতূহলের পথে কোন বাঁধাই বাঁধা নয়। সমস্যা হলে হবে, সাম্ভালা রহস্যের সমাধান আমিও চাই।

ব্যক্তিগত কোন কারন, না অন্য কিছু?

অন্য কিছু না, আবার ব্যক্তিগতও না। আমি আসলে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি না, একটু অপ্রতিভ দেখাল লতিকাকে, আপনি কিছু মনে করবেন না।

ইটস ওকে, মাই চাইল্ড। তুমি আমার মেয়ের মতো, ল্যাপটপ খুলে বসলেন আবার ড. কারসন।

সময় হলে আমি আপনাকে বলবো, তবে এটুকু জেনে রাখবেন, আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।

চেকপোস্ট বেশি দূরে নয়। ইশারায় ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল সুরেশ। তার ছোট ব্যাগটা থেকে কিছু কাগজপত্র বের করলো।

এক এক করে সবার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে। এমনকি ড. লতিকার দিকেও।

এগুলো পাস, ড. লতিকারটা নকল, এতে কাজ হবে না, তবু দিয়ে রাখলাম, সুরেশ বলল।

নকল পাস নিয়ে ঝামেলা হবে, কোন ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমি, ড. কারসন বললেন।

মি. কারসন, এখন কোন উপায় নেই আমাদের হাতে, সুযোগ নিতেই হবে, প্রফেসর যদি কাজটা ঠিকমতো করে থাকেন, তাহলে কোন সমস্যা হবে না।

সেটা আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিন গাইডসাহেব, ড. কারসন বললেন।

দুপাশের চেকপোস্টেই আমার লোক আছে, ওরা পার করে দেবে, কিন্তু শিফটিং ডিউটি ওদের, যদি ডিউটি না থাকে তাহলে বিপদের সম্ভাবনা থাকবে।

এতো বড় ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।

এছাড়া আমাদের কোন পথও নেই।

আসল স্পেশাল পাস আনার ব্যবস্থা করুন, খরচ যা লাগে আমি দেবো, এবার লতিকা বলল পেছন থেকে।

খরচের প্রশ্ন আসছে না এখানে, আসল পাসের ব্যবস্থা করতে অন্তত পাঁচদিন সময় দরকার আমার, বলুন, ততোদিন অপেক্ষা করবেন এখানে?

ড. কারসন তাকালেন লতিকার দিকে। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। এতো দিন এখানে অপেক্ষা করার মতো সময় তার হাতে নেই। এরচেয়ে ঝুঁকি নেয়া ভালো।

ঠিক আছে, দেখা যাক কি হয়, ড. কারসন বললেন। সুরেশ দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

আপনি যাচ্ছেন কোথায়? এবার গলা বাড়াল সন্দীপ।

ঐ চেকপোস্ট দিয়ে আমি পার হতে পারবো না, জানালার ভেতরে গলা বাড়িয়ে বলল সুরেশ, নীচুগলায়। কেন সেটা আপনারা ভালো জানেন।

ঠিক আছে, বিরস গলায় বলল সন্দীপ। সুরেশ থাকাতে কিছুটা হলেও মানসিক শক্তি পাচ্ছিল, এখন নিজেকে বেশ অসহায় লাগছিল তার।

সুরেশের ইশারায় গাড়ি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার। ড. কারসন পেছনে তাকিয়ে সুরেশকে দেখলেন। কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। ভরসা করার মতো আরো একজনকে হারালেন।

নেপাল চেকপোস্ট বেশি দূরে নয়। লতিকার দিকে তাকালেন তিনি, টেনশনে আছে বলে মনে হলো না। সন্দীপের দিকে তাকিয়ে কিছুটা হতাশ হলেন, বেচারা একেবারে ঘাবড়ে গেছে। এই দুজনকে সঙ্গি করে রহস্যময় সাম্ভালার খোঁজ কি করে পাবেন তিনি ভেবে হতাশ লাগছিল তার নিজেরও। কিন্তু এতোদূর এসে ভয় পেলে চলবে না।

দেখা যাক, সামনে কি হয়!

***

আকবর আলী মৃধা পায়চারি করছেন তার রুমে, বিকেল গড়িয়ে গেছে। এখানে নতুন আস্তানা গেড়েছেন তিনি কিছুদিন হলো। জায়গাটা বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে বেশ কিছুটা দূরে। আপাতত কিছুদিন এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এরপর অন্য চিন্তা করতে হবে।

গত দুই বছর ধরে জেলে থেকে নিজেকে আরো প্রস্তুত করে নিয়েছেন তিনি। জেলে বসেই অপরাধিদের একটা দলকে নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করেন, যারা সীমান্তে চোরাচালানী, মাদক-ব্যবসা আর অস্ত্র ব্যবসার সাথে জড়িত। অপেক্ষা ছিল কখন জেল থেকে বের হবেন। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছেন। ঢাকা কারাগারের ভেতর থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন উপায়ই নেই। যদি কোনদিন স্থানান্তর করতে যায় কারা কর্তৃপক্ষ, তখনই কেবল সুযোগ আসবে। সেই সুযোগ এলো দুবছর পর, আর সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন তিনি।

ছোটখাট দলটা নিয়ে এখন বাংলাদেশের সীমানার বাইরে রয়েছেন, দেশে তার নামে হুলিয়া জারি করা হয়েছে। তাই খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের খুব বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক, তার থাকার জায়গা যদি কেউ জেনে যায়, তাহলে গ্রেফতার হতে বেশি সময় লাগবে না।

জায়গাটা পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা। আশপাশের গ্রামের লোকেরাও সহজে এদিকে আসে না। তাই এখানে ঢেরা বেঁধেছেন তিনি। ছোট ছোট কুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে, মাঝখানেরটা তার জন্য, বাকিগুলো দলের বাকি লোকেরা থাকে।

দরজায় টোকা শুনে দাঁড়ালেন তিনি।

কে?

বস, আমি সোহেল।

এসো। সোহেল ঢুকল ঘরে। তার দীর্ঘদিনের সহচর। তার ডান হাত।

খবর পেলে কিছু?

জি, খবর পেয়েছি।

বলো।

সে এখন নেপালের পথে।

নেপালের পথে?

জি, একা না, সাথে একজন বন্ধুও আছে।

কবে গেছে?

আজ সকালেই। কিছু একটা চিন্তা করলেন আকবর আলী মৃধা।

নেপাল যাওয়ার ব্যবস্থা করো।

আপনি নেপাল যাচ্ছেন?

বললামই তো, আর ওর পেছনে একজনকে থাকতে বলল।

বলে রেখেছি, কবির ভাই আছে পেছনে।

গুড, এখন যাও।

সোহেল চলে গেলে আবার পায়চারি শুরু করলেন আকবর আলী মৃধা। ঐ ছেলেটার সাথে তার হিসেব বাকি আছে। ওর প্রতারনার কারনেই দুটো প্রয়োজনীয় বছর জীবন থেকে ঝরে গেছে তার। সেই বই, সেই অমরত্বের সন্ধান তিনি পাননি, পেয়েছেন জেলের অন্ধকার গহ্বরে দুটি বছর। এর শোধ তো তাকে নিতেই হবে, কসম মহান লুসিফারের।

এছাড়া নেপালে যাওয়ার পেছনে আরো একটা উদ্দেশ্য আছে, যদিও জানেন শুধুমাত্র শোনা কথার উপর ভরসা করে যাওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ন হয়ে যায়। গুপ্তজ্ঞান। সবসময়ই ভয়ংকর, তার জন্য যোগ্য মূল্য দিতে হয়। বোম্বেতে যে গুরুর শিষ্য ছিলেন, তার খুব ইচ্ছে ছিল তিব্বতে যাওয়ার, বয়স হয়ে যাওয়ার কারনে পারেননি। প্রিয় শিষ্যকে বলেছিলেন যেন একবার হলেও যায়, কী কী করতে হবে সব মনে আছে আকবর আলী মৃধার। কিন্তু দেশে ফিরে আসার পর আর কোথাও যাওয়া হয়নি,এমনকি যে বিশেষ বইটা চুরি করে এনেছিলেন সেটাও নিজের কাছে রাখতে পারেননি,শামীম নামের এক কাছের শিষ্য তা চুরি করে। সে শাস্তি দেয়া হয়ে গেছে, কিন্তু বইটা আর ফেরত পাননি,ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

জেলের ভেতর নিজের এক আলাদা জগত তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। লুসিফারকে একদিনের জন্যও ভোলেননি। লুসিফার তার সব, তার আত্মা, তার পৃথিবী। লুসিফার দীর্ঘদিন তৃষ্ণার্ত। তার তৃষ্ণা মেটাবার সময় হয়েছে। আজ সেই তৃষ্ণা মেটানো হবে গ্রাম থেকে ধরে আনা এক মেয়েকে দিয়ে, তার রক্তে লুসিফার শান্তি পাবে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দরজা খুলে বাইরে এলেন তিনি। একটু পর দলের লোকেরা এসে জড় হবে। আজ অমাবশ্যা। দূরে দলের কয়েকজনকে আসতে দেখলেন তিনি। সাথে ছোট একটা মেয়ে, প্রায় অচেতন অবস্থা। পৈশাচিক একটা হাসি খেলে গেল তার মুখে। অনেকদিন পর একটা কিছু হচ্ছে।

তবে এটুকুতে তৃপ্তি হবে না তার। দরকার রাশেদকে, প্রতিশোধ নিতে হবে, লুসিফারকে শান্ত করতে হবে রাশেদের রক্ত দিয়ে।

*

অধ্যায় ১০

পুরো রাত জঙ্গলে কাটিয়ে ভোরে গ্রামে ফিরে এলো কিশোর। দূর থেকে তাকাল, ভোরের আলোয় কি চমৎকার ঝকঝক করছে গ্রামটা। সেতুটা পার হয়ে গ্রামে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল কিশোর। গ্রামের প্রবেশপথে সারি সারি করে রাখা লাশগুলো দেখা যাচ্ছে। থকথকে রক্তে ভরে আছে চারপাশ। দূর থেকে বেশ কয়েকটা শেয়াল দেখতে পেল, কুকুরও আছে। লাশগুলো ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য এসেছে ওরা। দৌড়ে যাবে তখনই বাঁধা পেল। হাত ধরে আটকেছে পেছন থেকে, অদ্ভুত চেহারার এক বুড়ো। গতরাতে এই বুড়োই তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বনে। আক্রমনকারীরা তখনও গ্রামে ছিল। নইলে ঐ লাশের স্তূপে স্থান তারও।

নিজের আবেগকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছিল না কিশোর। তার বাবা-মা, ভাই-বোনের লাশ ঐ স্তূপে পড়ে আছে। শেয়াল, কুকুর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, অথচ সে কিছু করতে পারছে না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে, আটকানোর চেষ্টা করছে না। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বুড়ো তাকে টেনে নিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে।

আপনি কে?

জোর করে বুড়োর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো কিশোর।

আমি কে তা জানা কি খুব দরকার?

ম্লান স্বরে বলল বুড়ো। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসেছে।

এর আগে বুড়োকে লক্ষ্য করে দেখেনি কিশোর, লোকটা বেশ লম্বা, হাত-পা সরু, মাথায় চোঙামতন টুপি, হাতে লম্বা একটা লাঠি, মুখে সাদা দাড়িগোঁফের জঙ্গল। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করতে পারছে না সে। তবে একশর কাছাকাছি বয়স এটা নিশ্চিত। বুড়োর কাঁধে ছোট একটা ঝোলা, আর কোমরে চামড়ার তৈরি একটা থলে, সেটায় সম্ভবত পানি রাখে।

 আপনি এখানে এলেন কি করে? আগে তো কখনো দেখি নি!

দূর থেকে সুন্দর হাওয়া খেলে গেল পুরো বনে। বুড়োকে চোখ বন্ধ করতে দেখল কিশোর। যেন কিছু একটা অনুমান করার চেষ্টা করছে।

আমি কে সেটা পরে জানলেও চলবে, এখন চলল, উঠে দাঁড়িয়েছে বুড়ো, ব্যস্ত ভঙ্গিতে।

আপনি কে, উদ্দেশ্য কি, এসব না জানলে আমি একচুল নড়বো না।

তুমি যদি এখনই আমার সাথে না আসে, তাহলে নিজের হাতে তোমার হৃদপিন্ড বের করে আনবো, তোমার চোখের সামনে, দেখবে?

বুড়োর কথায় এমন একটা সুর ছিল, ভড়কে গেল কিশোর।

আমার পেছন পেছন এসো, বলে হাঁটা শুরু করলো বুড়ো।

অনেক দূর থেকে বেশ হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে, শব্দটা ক্রমশ জঙ্গলের দিকে এগুচ্ছে। কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পিছু নিলো কিশোর। এই জঙ্গলে আগেও অনেকবার এসেছে সে। গভীরে ঢোকেনি কখনো। এখানে গাছপালা একটার সাথে একটা প্রায় লেগে আছে। সামনের কিছুই প্রায় চোখে পড়ছে না। অনেকটা অন্ধের মতো এগিয়ে চলেছে কিশোর। তার একটু ডানেই বুড়ো লোকটা, দৌড়াচ্ছে। এতো বয়সী একজন মানুষ এভাবে ছুটতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।

প্রায় ঘন্টাখানেক দৌড়ানোর পর দাঁড়িয়ে পড়ল কিশোর। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার, আরেকটু দৌড়ালে সে পড়েই যাবে। তাকে থামতে দেখে বুড়ো মানুষটাও থেমেছে। তার কাছে এসে দাঁড়াল।

এখন আর বিপদ নেই তোমার, হেসে বলল বুড়ো, আমরা অনেকদূর চলে এসেছি।

কিছু বলল না কিশোর। দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার।

এবার আমাদের রাস্তা আলাদা, আমি চলে যাচ্ছি, তুমি তোমার মতো চলে যেও, বুড়ো বলল, উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে থাকল।

আপনি আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছেন? কিশোর বলল। তার চেহারা লাল হয়ে গেছে। আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

আমি একা পথ চলি, আমার কোন সঙ্গি নেই, বাছা।

আমি আপনার সঙ্গি হবে না, শুধু দূর থেকে অনুসরন করবো।

আমি যেখানে যাই সেখানে শুধু বিপদ, ভয় পাবে না তো?

ভয় পাওয়ার মতো আর কী কিছু বাকি আছে? উল্টো প্রশ্ন করলো কিশোর।

ঠিক আছে, এসো, বলে হাঁটতে থাকলো বুড়ো।

অনুসরন করলো কিশোর। বিশাল ঘন জঙ্গল যেন হঠাই শেষ হয়ে গেল। সামনে বড় এক নদী। চমৎকার পরিস্কার পানি। বুড়ো মানুষটা থেমে হাত ইশারায় তাকে ডাকল।

আমার সাথে থাকতে হলে একটা শর্ত মেনে চলতে হবে, বুড়ো বলল।

কি শর্ত?।

আমি যা করতে বলবো, তাই করতে হবে। তোমার বয়স যখন কুড়ি হবে, তারপর তুমি যেখানে খুশি যেতে পারবে।

কি কাজ করতে হবে আমাকে?

ভয়ের কিছু নেই, হেসে বলল বুড়ো।

আমি রাক্ষস নই যে তোমাকে গিলে খেয়ে ফেলবো।

একটা কথা জানা দরকার?

বলো।

আমাদের গ্রামে আসলে কি হয়েছিল?

আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যতোটুকু বুঝেছি তোমাদের গ্রামের কারো সাথে অন্য একটা গ্রামের লোকদের শত্রুতা ছিল। ওরাই আচমকা হামলা করেছে। তোমার তো জানার কথা?

চুপ করে রইল কিশোর। হ্যাঁ, তার গ্রামের লোকদের উপর প্রায়ই আক্রমন করতো পাহাড়ের কিছু লোক। ওরা ডাকাত শ্রেনীর। গ্রামে প্রায়ই ডাকাতি করতে আসতো। কিছুদিন আগে ডাকাত সর্দারের ভাই মারা যায়, তার বাবার হাতে। তার বদলা নিতেই মনে হয় এই নৃশংস কাজ করেছে ডাকাতেরা। পুরো গ্রাম একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।

হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। ঐ ডাকাতকে আমি নিজের হাতে মারবো, কিশোর বলল।

তততদিন পর্যন্ত তুমি বেঁচে থাকতে পারবে কি না সেটা কিভাবে জানো?

আমি বেঁচে থাকবো, আমি জানি।

তোমার নাম কিন্তু জানা হলো না? হাত বাড়িয়ে বলল বুড়ো।

আমি…?

নামটা মনে পড়লো না, এই ঘটনা খৃস্টের জন্মেরও প্রায় তিনহাজার আগের। এতোদিন আগের স্মৃতিগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। ইদানিং অল্প অল্প করে মনে পড়ছে। এই স্মৃতিগুলো মোটেই সুখস্মৃতি না, বরং নিজের অতীতের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা।

সন্ধ্যার পরপর রওনা দেবেন বলে ঠিক করেছেন, এখনো অনেক দেরি। বিনোদ চোপড়া সবসময় সাথে ছোট একটা দাবার বোর্ড রাখে, এখন যজ্ঞেশ্বরের সাথে বাজিতে খেলছে। যজ্ঞেশ্বর যদিও হেরে যাচ্ছে বারবার, কিন্তু খেলা থামায়নি।

অনেক দূর থেকে সুন্দর শীতল হাওয়া তার চুলে খেলে গেল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। অনেকদিন এমন তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়া হয় না। কিন্তু এই সুন্দর বাতাসে কোন একটা গন্ধ মেশানো আছে, যা সে ছাড়া আর কেউ টের পাবে না, যেমন বহু বছর আগে সেই বুড়ো টের পেয়েছিল। গন্ধটা বিপদের।

খেলা বন্ধ করুন আপনারা, বেশ জোরে বললেন তিনি, যাতে একটু দূরে বসে দাবা খেলায় মগ্ন দুজন মানুষ তা শুনতে পায়।

কেন? কি হয়েছে? বোর্ড থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করল বিনোদ চোপড়া।

কিছু হয়নি,উঠুন এখুনি, বললেন তিনি। তার নিজের তৈরি হয়ে নেয়ার তেমন কিছু নেই। অল্প কয়েকটা জিনিস।

কিন্তু বাকি দুজনের একটু হলেও সময় দরকার। কিন্তু সেই সময় এখন দেয়া যাবে। এখানে যতো দেরি হবে বিপদ ততো বাড়বে। সাম্ভালার পথ এখনো অনেক দূর। তার আগে অন্য কোন জায়গায় আটকে যাওয়ার কোন উপায় নেই।

বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বর খুব অল্প সময়েই তৈরি হয়ে নিলো, তারা জানে খুব সমস্যা না হলে এভাবে কখনো কথা বলেন না তিনি।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? প্রশ্ন করে যজ্ঞেশ্বর।

সীমান্ত পার হয়ে তিব্বতে ঢুকবো আমরা, আজ রাতেই।

হঠাৎ এতো তাড়াহুরা?

সে আপনি বুঝবেন না যজ্ঞেশ্বরজী।

আমার বোঝার দরকারও নেই, আমি তৈরি।

বিনোদ চোপড়ার দিকে তাকালেন তিনি। সেও তৈরি।

চারপাশে তাকালেন তিনি। আগুন জ্বালানোর চিহ্ন বাদে আর কোন চিহ্ন রেখে যাননি সেটা নিশ্চিত। কিন্তু তার প্রতিদ্বন্ধী সাধারন কেউ নয়। অনুসরন করে করে এতোদূর যখন চলে আসতে পেরেছে, তাহলে বাকিটা অনুসরন করাও কঠিন হবে না। এই প্রতিদ্বন্ধীকে দুদিন আগে বা পরে মোকাবেলা করতেই হবে। তবে সেটা এখনই না, অন্তত সাম্ভালার খোঁজ না পেয়ে কিছুই করা যাবে না।

বহুদিন পর নিজেকে মনে হলো না অপরাজেয়, মৃত্যুহীন। যে আসছে সে তারই শ্রেনীর, কিন্তু সেই লোকটা আসছে শুধুমাত্র তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য, নিজের স্থানে আর কাউকে অংশীদার রাখা যাবে না। প্রকৃতি ঘন ঘন ব্যতিক্রম পছন্দ করে না। যে কোন একজনকে থাকতে হবে, প্রকৃতির অমোঘ আইনের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই তার। এখন একমাত্র সাম্ভালাতে গিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন তিনি। একবার সেখানে যেতে পারলে মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখানো যেতো। সেটা হয়তো সম্ভব হবে না খুব সহজে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। কোদারি গ্রামটা কাছেই, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করে গভীর রাতে পার হতে হবে সেতুটা। সেই সেতু পার হলেই বহু কাংখিত তিব্বতে পৌঁছতে পারবে সে, পাবে অমরত্বের সন্ধান।

একটানা বেশ কিছুক্ষন দৌড়াল মিচনার। পাহাড়ে চলাচলের অভ্যাস তার আগে থেকেই আছে, কিন্তু অনেকদিন এভাবে দৌড়ানো হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশে থাকাকালীন অনেকটা গৃহবন্দীর মতো থেকেছে সে। বাইরে কোথাও যায়নি,গুরু নিয়ম করে দিয়েছিল। গেটের বাইরে যাওয়া নিষেধ। চাইলে সহজেই বাইরে যেতে পারতো মিচনার, কিন্তু গুরুকে অমান্য করতে চায়নি। এছাড়া গুরু যে তার দিক দেখতো না, তাও নয়। মাঝে মাঝেই তার জন্য উপহার থাকতো, লুফিসারকে খুশি করার সাথে সাথে তাকেও সন্তুষ্ট করতে গুরু। সেই রক্ত দেখার উত্তেজনা, নিজের হাতে কারো প্রান নেয়ার আনন্দ, তার চেয়ে বড় কিছু হয় না। সব ভন্ডুল হয়ে গেল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

দুপুরের পরপর থামল মিচনার, সারা শরীর ঘেমে গেছে, এই ঘাম খুব অল্প সময়ে আবার শুকিয়ে যাবে, একটা পাথরের আড়ালে বসল মিচনার। নীচে কিছুটা সমতলে ভেড়া চড়ছে, আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাখাল হয়তো ঘুমাচ্ছে কোথাও। ক্ষুধা পেয়েছে বেশ, চ্যাপ্টা সাইজের একটা পাথরের টুকরো বেছে নিলো মিচনার। বেশ কিছুক্ষন আরেকটা পাথরে ঘষল মন দিয়ে, ধারাল হওয়া চাই, যাতে একটানেই কাজ হয়ে যায়। আধঘন্টা ঘষার পর মোটামুটি ধারাল হলে উঠে দাঁড়াল জিনিসটা। নীচে শিকার অপেক্ষা করছে তার জন্য।

ধীরে ধীরে নীচে নামছে মিচনার। ভেড়াগুলোর রাখালকে দেখা যাচ্ছে না, ওর চোখ এড়িয়ে কাজ সারতে হবে। আপাতত কারো দৃষ্টি আকর্ষন করার ইচ্ছে নেই তার। আরো নীচে নামতে গিয়ে মনে হলো, সে ভুল পথে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। এই শিকার তার পরে করলেও চলবে, মনের কোথাও যেন কেউ বলে উঠলো। আসল শিকারের অবস্থান তার কাছ থেকে খুব দূরে নয়। আবার ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলো মিচনার। বড় পাথরটার উপরে উঠে দাঁড়াল। এখান থেকে অনেক দূর পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। চারপাশ শান্ত, একেবারে ছবির মতো। দূরে হিমালয়ের পর্বতমালার চুড়াগুলো। একের পর এক দেখা যাচ্ছে। বরফের উপর সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করে উঠছে। পুরো এলাকাটা পর্যবেক্ষন শেষ হলে পাথরটা থেকে নীচে নেমে এলো মিচনার। তাকে যেতে হবে আরো পূবে, শিকার তার কাছ থেকে বেশি দূরে নেই। আচমকা শিকারের সামনে উপস্থিত হতে পারলে ভালো হতো, তবে তার শিকারও যে ভয়ংকর বুদ্ধিমান এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই সাবধানে এগুতে হবে। সামনে হয়তো তার জন্য কোন ফাঁদ অপেক্ষা করে আছে, কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *