প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

৩.১ মহাস্থবির জাতক – তৃতীয় পৰ্ব

মহাস্থবির জাতক – তৃতীয় পৰ্ব

উৎসর্গ

দুর্দিনে দুর্গম পথের সহযাত্রী
বন্ধু
ঊষাকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের স্মরণে

নিবেদন

‘মহাস্থবির জাতক’ লিখতে আরম্ভ করে মনে হয়েছিল, তিন-চার বছরের মধ্যেই কয়েক পর্ব লেখা সম্পূর্ণ করতে পারব। কিন্তু তা হয়নি–অর্থাৎ আর একবার প্রমাণ হয়ে গেল, যা মনে করা যায় সব সময়ে তা হয়ে ওঠে না। দ্বিতীয় পর্ব লেখবার সময়েই আমার দেহ ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়। কিছুকাল পরে একটু সুস্থ হয়েই তৃতীয় পর্ব লিখতে শুরু করি। তৃতীয় পর্ব যখন মাসে মাসে ‘শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন আবার ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সেই সময়েই মাসে মাসে নিয়মিতভাবে ‘জাতকে’র আবির্ভাব হয়তো বন্ধ হয়ে যেত, যদি না স্নেহাস্পদা কবি উমা দেবী তাঁর সাহায্যহস্ত প্রসারিত করতেন। তিনি প্রতি মাসে পাণ্ডুলিপি থেকে আমার দুর্বোধ্য হস্তাক্ষর উদ্ধার করে নিয়মিতভাবে প্রেসকপি তৈরি করে দেওয়ায় ‘জাতক’ প্রকাশের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ ছিল–এজন্যে এখানে তাঁর ঋণ স্বীকার করছি।

“মহাস্থবির”

***

কবি বলেছেন, সুখ-দুখ দুটি ভাই। কিরকম ভাই? মায়ের পেটের ভাই, কি চোরে চোরে মাসতুতো ভাই–সে-বিষয়ে তিনি নীরব। তাই সুখ ও দুঃখ সম্বন্ধে এইখানে তেড়ে একটি ভাষণ ঝাড়বার প্রলোভন হচ্ছে। কিন্তু ভয় নেই, সংযত হচ্ছি। আপনারা শুধু একবার মনশ্চক্ষু উন্মীলন করে দেখুন, স্থবির শর্মা চটিজুতো পায়ে দিয়ে চ্যাটাং চ্যাটাং করতে করতে চলেছে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ফুটপাত দিয়ে ইস্কুলের দিকে। বগলে তার খানকয়েক বই, তাতে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা আছে; কিন্তু যে অভিজ্ঞান তার মাথায় বোঝাই করা রয়েছে তার তুলনায় সেসব জ্ঞান অতি তুচ্ছ। কিন্তু সংসার তা স্বীকার করলে না, তাই আবার এই কৃচ্ছ্রসাধনের অভিনয় :-

বাড়িতে ফিরে আসবার পর বাবা কোনো কথা বললেন না–না বকুনি, না প্রহার। শুধু বললেন–কাল থেকে আবার ইস্কুলে যেতে আরম্ভ কর।

আমি আশঙ্কা করেছিলুম, বাড়ি ফিরলে বাবা মেরে একেবারে পাট বিছিয়ে দেবেন। কিন্তু পাছে আবার পলায়ন করি, এজন্যে তিনি কিছু বললেন না। প্রহারের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে আমিও ভালোমানুষের মতো ইস্কুলে যেতে আরম্ভ করে দিলুম। আমি মনে করলুম, বাবা কি ভালোমানুষ; আর বাবা মনে করলেন, আমার ছেলে কি বাধ্য! কিন্তু আমরা দুজনেই ভুল করলুম, কারণ বাড়ি থেকে পালানো আমার বন্ধ হল না। বাবাকেও দীর্ঘকাল ধরে আপসোস করতে শুনেছি যে, প্রথমবারের পলায়নের পর বেশ উত্তম-মধ্যম পেলে আমি আর কখনও পালাতে সাহস করতুম না। আর আমার দিক দিয়ে আমিও বহুকাল আফশোস করেছি এই ভেবে যে, প্রথমবারেই যদি ইস্কুলে যেতে অস্বীকার করতুম, তা হলে যা হবার তখুনি একটা এপার-ওপার হয়ে যেত, কারণ প্রতিবারই গৃহপ্রত্যাগমনের পর আবার আমায় ইস্কুলে যেতে হয়েছে।

যা হোক, ইস্কুলে যেতে হলেও পড়াশুনোর বালাই আর রইল না। স্বদেশীর বন্যায় সারা বাংলাদেশ তখন টলমল করছে। ইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নামকরণ হয়েছে–গোলামখানা। এই স্বদেশীর কল্যাণে অনেক ছেলে ইস্কুল কলেজের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে গেল, অনেক ধনী-অভিভাবক ব্যাপার সুবিধা নয় বুঝে ছেলেদের বিলেতে পাঠিয়ে দিলেন। বোম্বাইয়ের ‘খলিফারা এই সুযোগে গরিব বাঙালির পয়সায় বড়লোক হতে লাগল। বাঙালিরা বিলিতি মিলের ধুতি বর্জন করে ডবল দাম দিয়ে বোম্বাই মিলের চট কিনতে লাগল। আর তার পরিবর্তে বোম্বাইয়ের মিলওয়ালারা বাংলা ও বিহারের কয়লা বর্জন করে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আমদানি করে বাংলার ঋণ পরিশোধ করতে লাগল।

বাঙালির জাতীয় জীবনে পূজা দোল, দুর্গোৎসব, পরনিন্দা, ঘোঁট, কীর্তন প্রভৃতি উৎসবে উৎসাহ ছিল প্রচুর, কিন্তু এই স্বদেশী আন্দোলন তাদের জীবনে উৎসাহের সঙ্গে নিয়ে এল উত্তেজনা।

স্বদেশী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ আজ চলচ্চিত্রের মতন মনের পর্দায় একে একে ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে বাঙালির সেই উন্মাদনার চিত্র, সেই ভাবের জোয়ার–যাতে একদিন তারা হাত-পা ছেড়ে আপনাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। অদ্ভুত এই বাঙালি-চরিত্র! তারা পূজা করে শক্তির কিন্তু চর্চা করে মাধুর্যরসের–তাই কাটলেট ও মালপোয়ায় তাদের সমান রুচি। এই স্বদেশীর দিনে তারা কীর্তনের সুরে যুদ্ধের গান গেয়ে সকলকে দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত করে বেড়াতে লাগল।

সিপাহী-বিদ্রোহের পর ইংরেজরা কিছুকাল মুসলমান-দমননীতি চালিয়ে ও সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের পিঠে হাত বুলিয়ে কিছুতেই এই মূর্তিপূজকদের বাগে আনতে না পেরে হিন্দু দমন ও মুসলমান-তোষণ নীতি অবলম্বন করলে–যার ফলে হল বঙ্গ-বিভাগ। ইংরেজরা পূর্ববঙ্গকে একটা ছোটখাটো পাকিস্তানে পরিণত করে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ভেদ বাড়িয়ে তোলবার চেষ্টা করতেই বাঙালি নেতারা হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করতে লাগলেন। কয়েকজন মহাপ্রাণ মুসলমানও হিন্দুদের দলে যোগ দিলেন বটে–কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই এই মিলনের শুধু বিপক্ষতা নয়, বিরোধিতা করেছিলেন। মুসলমানদের গ্রন্থাদি যাই বলুক না কেন, তাঁরা কখনও কোনো সময়েই অন্যধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে একত্রে বাস করেছেন–এমন নজির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তাই ইংরেজদের এই চালকে তাঁরা আগ্রহের সঙ্গে বরণ করেছিলেন। ইংরেজদের এই অপচেষ্টা ব্যর্থ করবার জন্য সে-সময় বাংলার নেতারা সমস্ত ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানকে মিলিত করবার চেষ্টা করেছিলেন।

সে-সময় উপযুক্ত স্থানের অভাবে সভা করবার খুবই অসুবিধা ছিল। হয় খোলা মাঠ কিংবা টাউন হল্ ছাড়া সভা করবার বড় জায়গা শহরে ছিল না। কিন্তু গড়ের মাঠ ও টাউন হল দুই-ই ছিল সরকারি আমলাদের কব্‌জায়, কাজেই সরকারের বিরোধী কোনো সভা হওয়া সেখানে একরকম অসম্ভবই ছিল। তাই স্বদেশীযুগের আরম্ভেই নেতারা স্থির করলেন যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলনমন্দির নাম দিয়েই একটা বড় সভা-গৃহ নির্মাণ করতে হবে। অবিশ্যি তাঁরা ঠিক করেছিলেন “এই সভাগৃহের নাম হবে–দি ফেডারেশন হল। মাতৃভাষায় কিছু কল্পনা করা তাঁদের পক্ষে দুরূহ ছিল কিনা!

আচার্য জগদীশচন্দ্রের বাড়ির সম্মুখে ব্রাহ্ম-বালিকা-শিক্ষালয়ের ডান দিকে একটা বড় এবড়ো খেবড়ো খালি জমি পড়ে ছিল। ঠিক হল এই জমির ওপর প্রস্তাবিত মিলন-মন্দির তৈরি করা হবে। তিরিশে আশ্বিন রাখিবন্ধনের দিন এইখানে বিরাট সভা হল। সভায় বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশ হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। আজকাল একটা ফুটবল ম্যাচ দেখতে যেমন হুট বলতে পঞ্চাশ হাজার লোক জমা হয়, তখন তা ছিল না। কোনো সভায় বিশ-পঁচিশ হাজার লোক একত্র হওয়া অদ্ভুত ব্যাপার বলে বিবেচিত হত।

সেদিন বেলা তিনটে বাজতে-না-বাজতে সেই পতিত জমিতে লোক এসে জমা হতে লাগল। নানান পাড়া, সংঘ, সমিতির শোভাযাত্রা আসতে লাগল স্বদেশ-সঙ্গীত গাইতে গাইতে। ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিতে আকাশ কেঁপে উঠতে লাগল। তখনকার দিনে সারকুলার রোডের ওই অঞ্চলটা ছিল বেশ নির্জন, বাড়িঘরও বেশি ছিল না। যা দু-চারখানা নতুন বাড়ি সে-সময় তৈরি হয়েছিল, তারই ছাতে ছাতে লাগল মেয়েদের ভিড়–কলকাতায় সে-দৃশ্য নতুন, এক নতুন ভাবের জোয়ারে নগরবাসী গা ঢেলে দিয়েছে, সে এক নতুন উত্তেজনা!

সভায় সেই কাল্পনিক–মিলন-মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করা হল। কার জমি, কে টাকা দেবে, কোথা থেকে টাকা আসবে- সেসব তুচ্ছ ব্যাপার কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেও আনলে না। স্বর্গীয় ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসু মহাশয় ভিত্তি স্থাপন করলেন। তিনি তখন অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন–এই ব্যাপারের কিছুদিন পরেই তিনি দেহরক্ষা করেন।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয়ের বাড়ি থেকে তাঁকে তোলা-চোয়ারে বহন করে সভাক্ষেত্রে নিয়ে আসা হল। সেই বিরাট জন-কল্লোল মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মধ্যে একতারার মতো ক্ষীণ কণ্ঠে বেজে উঠল বসু মহাশয়ের প্রার্থনা–একখানি করুণ সঙ্গীতের মতো। মুমূর্ষু দেশনায়কের সেই কাতর মর্মবাণী আজ অতীতের গর্ভ থেকে উঠে নতুন সুরে আমার কানে এসে বাজছে : And Thou, Oh God of this ancient land, the Protector and Saviour of Aryavarta and the merciful Father of us all, by whatever name we call upon Thee, be with us on this day, and as a father gathered his children under his arms, do thou gather us under Thy Protecting and sanctifying care.

কিন্তু ওই Thou, যিনি পুরুষের ভাগ্য এবং নারীর চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তিনি যে সবচেয়ে বেশি দুয়ে–সে-কথাটা মানুষ যে জানে না তা ‘নয়, কিন্তু দুর্দিনে পড়ে মানুষ তাঁর কাছে সোনার পাথরবাটি চেয়ে বসে। হাত পাতলেই যদি তাঁর কাছ থেকে জিনিস পাওয়া যেত, তা হলে ঘরে-ঘরেই বিরোধের অন্ত থাকত না। এ-কথা ভুললে কিছুতেই চলবে না যে, আমাদের মঙ্গল সম্বন্ধে এই Thou আমাদের চেয়ে ঢের বেশি সচেতন, এবং বোধ হয় সেইজন্যেই হিন্দুমুসলমানে আজও মিলন হয়নি–মিলন-মন্দির তো দূরের কথা।

সেই কল্পিত মিলন-মন্দিরের মাঠে এখন কতকগুলো বাড়ি তৈরি হয়েছে। এই বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে একটা রাস্তা তৈরি হয়েছে, তার নাম ফেডারেশন স্ট্রিট। যেখানে একদিন উচ্চচূড় মিলন-মন্দিরের সম্ভাবনা হয়েছিল সেখানে আজ সদর রাস্তা হয়েছে–অর্থাৎ মিলনের আশা ধূলিসাৎ হয়েছে।

বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে সমান তালে আমার অন্তরেও তখন বিক্ষোভ, অশান্তি ও উত্তেজনার ঝড় বইতে শুরু করেছিল। স্বদেশীর বন্যায় গা ঢেলে দিয়ে মাঠে মাঠে মিটিঙে যাওয়া, দলবদ্ধ হয়ে গান গাইতে শহরের রাস্তা পরিক্রমণ করা, কনস্টেবলের তাড়া খেয়ে লম্বা দেওয়া, তার ওপরে ফুটবল খেলা ও গড়ের মাঠে ম্যাচ দেখতে যাওয়া–সবই চলছিল বটে; কিন্তু আমার মধ্যে যে একজন চৌকিদার আছে সে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছিল না। আমার খালি মনে হতে লাগল, এর পরে কি হবে! এই উত্তেজনার ঝড় শান্ত হয়ে গেলে–একদিন শান্ত হবেই–তখন আমার কি হবে? কি আমার ভবিষ্যৎ? আমি কি করব? লেখাপড়া শিখে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্যে তৈরি করে নিতে হলে যে বুদ্ধি, অধ্যবসায় ও পারিপার্শ্বিক অনুকূল অবস্থার প্রয়োজন হয়, আমার তা ছিল না। তা ছাড়া কানুনমাফিক নিয়মানুবর্তিতায় পড়াশুনো করবার আগ্রহ বহুদিন আগেই ছুটে গিয়েছিল। তার ওপরে কেন জানি না, সে-সময় স্বদেশী নেতারা–বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ভালো মার্কা যাঁরা অঙ্গে

মার্কা যাঁরা অঙ্গে ধারণ করতেন তাঁরা পর্যন্ত–বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি একটা আক্রোশ পোষণ করতেন এবং বক্তৃতায় ও লেখায় তা প্রকাশ করতেন। আশুতোষ বিল্ডিং বা দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং তখনও তৈরি হয়নি। সেনেট-হলকে লোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি বলে জানত। সেনেট-হলের মোটা থামে শিগিরই ‘To Let’ অথবা ‘বাড়ি ভাড়া’ লেখা ঝুলতে থাকবে–এ-কথাও অনেক নেতাই বলতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল–গোলামখানা। তাঁরা বলতেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্কুল ও কলেজগুলোতে এক গোলামি করতে শেখানো ছাড়া আর কিছুই শেখানো হয় না। ছাত্রেরা যাতে সত্যিকারের শিক্ষা পেতে পারে সেজন্য স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হল। অবিশ্যি এই স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গতিপন্ন কর্তারা নিজেদের ছেলেদের শিক্ষার জন্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফেল্-করা অনেক ছেলে ‘আসল শিক্ষা লাভ করবার জন্যে স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে লাগল। ছেলেরা যাতে হাতে-কলমে ব্যবহারিক কোনো শিক্ষা পায় সেজন্য স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট খোলা হল। সারকুলার রোডে আজ যেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়ান্স কলেজের বিরাট বাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেখানে ছিল সার তারকনাথ পালিত মহাশয়ের বাগানবাড়ি। সেই বাড়িতেই বসেছিল বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। এখানেও দলে দলে ছেলে ভর্তি হতে লাগল। এই বেঙ্গল টেকনিক্যালই পরে যাদবপুর ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে পরিণত হয়েছে।

সে সময় তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে তোলবার খুব একটা হিড়িক পড়েছিল। ভদ্রলোকের ছেলেদের তাঁত চালাতে শেখাবার জন্যে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এইসব জায়গাতেও দলে দলে ছেলে এসে ভর্তি হতে লাগল। মোট কথা, ইস্কুল ও কলেজী শিক্ষা এ-দেশে প্রবর্তিত হবার পর থেকে সেদিন পর্যন্ত এক ধারায় নিরুপদ্রবে চলে আসছিল যে প্রবাহ, তারই ধারাবাহিকতায় লাগল প্রচণ্ড আঘাত। তার ফলে কত ছেলের জীবনতরী যে বানচাল হয়ে গেল, তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

এই উত্তেজনার মধ্যে বাস করেও আমার মনে হতে লাগল, আমার জীবনের ক্ষেত্র এ নয়। আমাকে যদি জীবনে উন্নতি করতে হয়, তবে আমাকে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। বাইরে থেকে একটা প্রবল আকর্ষণ আমাকে দিনরাত্রি টানতে লাগল। সেখানকার বৈচিত্র্য, সেখানকার সুখদুঃখ অপরিচিতের সঙ্গে আত্মীয়তা, নিতান্ত নিশ্চিন্তে জীবন একটানায় চলতে চলতে অপ্রত্যাশিতভাবে বিপদ ও অনিশ্চয়তার আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া–এই জীবনের মধ্যে যে নেশা আছে, সেই নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। গতবারে আমার জীবনে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করলে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পরীক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করলেও তার সঙ্গে তুলনা হয় না। আমি স্থির করলুম, আমি সেই জীবনেই ফিরে যাব। পরীক্ষা পাস করে চাকরি নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করা আমার দ্বারা হবে না।

বাইরে চলে যাব অর্থাৎ এক কথায় যার নাম আবার বাড়ি থেকে পালাব। কিন্তু পালাব বললেই পালানো যায় না। এই পলায়ন ব্যাপারে গতবারে যে কতকগুলো অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার প্রথমটা হচ্ছে–অর্থ কিঞ্চিৎ বেশি চাই। সেবারে প্রথম থেকে অনেকে অযাচিতভাবে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে আমার জীবননদী অন্য খাতে প্রবাহিত হত। কিন্তু যদি কেউ সাহায্য না করে! সেজন্য অন্তত কিছুদিনের জন্যও তৈরি থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। এই অর্থ জোগাড় করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়; কাজেই এমন লোক ‘সঙ্গী চাই যে, সেই প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় সে করতে পারবে। পরিতোষকে সঙ্গে নেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে দেখলুম ইস্কুল-টিস্কুল ছেড়ে দিয়ে তাঁতের ইস্কুলে ঢুকে মনের আনন্দে মাকু চালাচ্ছে এবং স্থির করে ফেলেছে যে, ওই তাঁতের মাধ্যমেই সে জীবনে উন্নতি করবে। যা হোক, সে-দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আমি তক্কে তক্কে ফিরতে লাগলুম–দেখি, কোথা দিয়ে কি হয়!

আমরা যেখানে পড়তুম, সেটা ছিল বোর্ডিং ইস্কুল। নতুন ইস্কুল বলে ছাত্রসংখ্যা ছিল খুবই কম এবং সেজন্য আমরা প্রায় সকলে সকলকে চিনতুম। বোর্ডিঙের বেশির ভাগ ছেলেই মফস্‌সলের, ও তাদের অধিকাংশের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। একদিন বিকেলে খেলার পর মাঠে বসে গল্প হচ্ছে–গল্পের বিষয়বস্তু আমার পলায়নের অভিজ্ঞতা–এমন সময় সুকান্ত বললে, তোমার সঙ্গে আমাদের জনার্দনের দেখছি অনেক মিল আছে।

সুকান্ত ও জনার্দন দুজনেই বোর্ডিঙে থাকত এবং আমার চাইতে নীচের ক্লাসে পড়ত। কিন্তু তা হলেও সুকান্ত ভালো খেলতে পারত বলে আমার সঙ্গে তার খুব ভাব জমে গিয়েছিল।

সে বললে, জনার্দন দু-দু’বার বাড়ি থেকে লম্বা দিয়েছিল। –বল কি! তা হলে তো ভাব করতে হয় তার সঙ্গে। জনার্দনের সঙ্গে আমার মৌখিক আলাপ ছিল মাত্র, এবার ভালো করে ভাব জমল। মাস-দুয়েক আগে সে ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। এর আগে পূর্ববঙ্গের কোনো এক শহরের ইস্কুলে পড়ত। তাকে বাইরে থেকে একটু গম্ভীর-প্রকৃতির ছেলে বলে মনে হত। কিন্তু মিশে দেখলুম, সে দিব্য হাসিখুশি দিলখোলা ছেলে। বাড়ি থেকে সে পালায় কেন–তার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, দূর, এসব কিছু ভালো লাগে না, তাই মাঝে মাঝে চলে যাই।

জিজ্ঞাসা করলুম, কি সব ভালো লাগে না?

–এইসব ইস্কুল, পড়াশুনো, বাড়িঘর, আত্মীয়;. পরিজন–

মোট কথা, জনার্দন কেন যে বাড়ি থেকে পালায় তার কারণ তার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়। বর্তমান জীবন-যাত্রার মধ্যে কোথায় কি একটা খুঁত আছে যা স্পষ্ট না হলেও তাকে খোঁচা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়। আমিও বাড়ি থেকে পালিয়েছিলুম শুনে সে বললে, বেশ হয়েছে, তোমার সঙ্গে আমার মিলবে ভালো।

শুনলুম জনার্দন দু-দু’বার পালিয়ে তিব্বতের দিকে রওনা হয়েছিল। একবার সিকিমের ভেতর দিয়ে খানিকটা অগ্রসর হয়েছিল, আর একবার নৈনিতাল না কোথা দিয়ে ভারতের সীমান্ত অবধি পৌঁছেছিল–সেখান থেকে মানস সরোবর আর দিন-দুয়েকের রাস্তা মাত্র। কিন্তু দু’বারেই তাকে পুলিসে ধরে নিয়ে এসেছে।

জনার্দনকে জিজ্ঞাসা করলুম, এত জায়গা থাকতে তিব্বতের দিকে গেলে কেন?

সে বললে কেন! তিব্বত তো ভালো জায়গা–রাজা রামমোহন রায় গিয়েছিলেন সেখানে বললুম, রামমোহন রায় গিয়েছিলেন তার কারণ আছে। সেখানে ধর্ম সম্বন্ধে অনেক ব‍ই-টই আছে সেইসব বই পড়তে গিয়েছিলেন। তারপর সেখানকার লোকেরা তাঁকে মেরে ফেলতে গিয়েছিল, তিনি কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন।

জনার্দন জিজ্ঞাসা করলে,, কেন, তিব্বত কি তোমার ভালো লাগে না?

বললুম, না ভাই, আমার দুরাশা অত উচ্চ নয়। শেষকালে কি বেঘোরে প্রাণটা দেব? জনার্দন বেশ মুরুব্বির চালে বললে, নাঃ, আজকাল আর তিব্বতে গেলে ওরা কিছু বলে না। তার ওপর সেখানে সব লামারা আছে, তারা খুব ভালো লোক। আমার তো তিব্বত খুবই ভালো লাগে। পয়সা-কড়ির সুবিধে করতে পারলে আবার আমি সেখানে চলে যাব।

কোনো কোনো লোকের বিশেষ কোনো রঙের প্রতি কিংবা খাবারের প্রতি বা বিশেষ কোনো স্থানের প্রতি একটা অহেতুক আকর্ষণ থাকে। দেখলুম আমাদের জর্নাদনেরও তাই। দুনিয়ার এত সমতল ক্ষেত্র থাকতে হিমালয়ের উচ্চতার প্রতি তার এই আকর্ষণ আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হল।

একদিন কথায় কথায় জনার্দন আমাকে বললে, দেখ, যদি টাকার জোগাড় করতে পারি তো আমার সঙ্গে তিব্বত যাবে?

–পাগল হয়েছ! খামকা তিব্বত কেন যাব বল?

-কেন, সেখানে সব লামা আছে।

–লামা-আছে তো আছে, তাতে আমার কি? প্রথমে তিব্বতের পথ অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল, সেখানকার লোকেরা বাইরের লোককে তাদের দেশে ঢুকতে দেয় না, অনেকসময় মেরেই ফেলে। তারপর ভয়ানক শীত সেখানে,–সবার ওপরে সেখানে গিয়ে কি করব বল? বরঞ্চ আমি চলে যাব দিল্লি কি বোম্বাই কিংবা অন্য কোনো শহরে। সেখানে গিয়ে ব্যবসা করব। পয়সা যদি বেশি পাই তো চলে যাব ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়–কোথাও কিছু নেই, তিব্বতে যেতে যাব কেন?

অহো! দিল্লি নামের কি মহিমা! শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সুদূর অতীতেও দূর-দূরান্তের দুর্ধর্ষদের উত্তেজিত করেছে এই নামের মোহ, এই নামের রহস্য। কেউ এসেছে একলা, কেউ-বা এসেছে সদলবলে। কেউ জিতেছে আবার কেউ বা পস্তিয়েছে দিল্লির লাড্ডু আস্বাদন করে। জনার্দন তো ক্ষীণজীবী বাঙালি বালক মাত্র। নাম শুনেই সে তিব্বত থেকে গড়াতে গড়াতে একেবারে সমতল ভূমিতে এসে পড়ল।

জনার্দন বললে, আচ্ছা, কুছ পরোয়া নেই, দিল্লিই যাওয়া যাবে। টাকার জন্যে ভাবনা নেই, টাকার জোগাড় হয়েই যাবে। যে দিন টাকা পাওয়া যাবে সেই দিনই যেতে পারবে তো?

–নিশ্চয় পারব।

আমাদের ছেলেবেলায় কলকাতা শহরে গুজব-সম্রাটের আধিপত্য ছিল খুবই বিস্তৃত। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট প্রভৃতি খেলা সে-সময় এখনকার মতো জনপ্রিয় ছিল না। সিনেমা, রাজনৈতিক সভা ও নানা মতের প্রতিষ্ঠান, রেডিও প্রভৃতি আমোদের উপাদানগুলি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এই গুজব-সম্রাটেরাই তখন ছিল একরকম সাধারণ প্রমোদ-পরিবেশক। এরা অদ্ভুত অদ্ভুত সব গুজব আবিষ্কার করে বাজার সরগরম রাখত। ওদিকে বটতলার প্রকাশকেরা মাঝে মাঝে এক ফরমা পাতলা কাগজে মুদ্রিত গুজব-পুস্তিকা বাজারে ছাড়ত। হকারেরা চিৎকার করে হাঁকতে হাঁকতে গলি দিয়ে চলত, ১৮৯৯ সালে–কি জানি কি আছে কপালে–একটি পয়সা খরচ করে, ইত্যাদি।

হু হু করে সেইসব বই বিক্রি হত।

মনে আছে, একবার গুজব রটল–পৃথিবী ধ্বংস হবে। অবিশ্যি পৃথিবী ধ্বংস হবার গুজবটা প্রায়ই রটত, কিন্তু সেগুলো ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। এবারকার গুজবটা রটল খুব জোর। অমুক দিনে রাত্রি একটার সময় এবার পৃথিবী নিশ্চয় ধ্বংস হবে। বাড়িতে-বাড়িতে ইস্কুলে আপিসে ওই একই আলোচনা চলল দিন-রাত্রি ধরে। কি ভাবে ধ্বংস হতে পারে, তা নিয়ে হরেক রকমের গবেষণা হয়। বন্যা, ভূমিকম্প, পৃথিবী ফুঁড়ে অগ্ন্যুৎক্ষেপণ–এর কোনো একটা কিংবা সব ক’টাই একসঙ্গে হতে পারে। মোট কথা, কলির শেষ হয়েছে, এবার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে আবার সত্যযুগ আরম্ভ হবে।

মনে পড়ে, নির্দিষ্ট রাত্রির সন্ধেবেলা অভিভাবকেরা পড়তে বসবার তাগাদা দিলেন না। খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর আমাদের বিছানায় যাবার হুকুম হল। মা বললেন, বারোটা নাগাদ সব ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হবে।

সত্যিই রাত্রি বারোটার সময় আমাদের ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হল। উঠে দেখি, চারিদিকে হৈ-হৈ ব্যাপার চলেছে। বাড়িতে-বাড়িতে ছোটরা কেউ ঘুমোয়নি, সব চেঁচামেচি করছে, কোনো দল বা লুকোচুরি খেলছে। পৃথিবী ধ্বংস হবার উপলক্ষে ছেলেদের উৎসাহ ও ফুর্তি বেড়ে গিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগে বাড়ির পুরুষেরা বাইরের রকে এসে বসলেন, মেয়েরা সদর দরজার ঠিক পেছনেই পান-দোক্তা মুখে ঠেসে কলরব করতে লাগলেন অর্থাৎ বিপদের সূচনা হলেই ‘অ্যাকশন’ শুরু হয়ে যাবে। ভূমিকম্প যদি হয় তবে তাঁরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়বেন, আর যদি জলপ্লাবন হয় তবে পুরুষেরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে ছাতে চড়বেন। কিন্তু ক্রমে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে একটা দেড়টা দুটোর ঘর পেরিয়ে গেল–কিছুই হল না। যে-যার বিছানায় সকলেই ফিরে গেল– –পৃথিবী ধ্বংসও হল না, কলিরও অবসান হল না, অপ্রতিহত প্রভাবে তিনি আজও রাজত্ব করে চলেছেন।

আধুনিকেরা প্রশ্ন করতে পারেন, এইসব গাঁজাখুরি গুজবের মধ্যে কোনো সত্য নেই–এ কথা কি শহরবাসীরা বুঝত না? তার উত্তর হচ্ছে, খুবই বুঝত। বড়দের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, আমরা বালকেরাও তা বুঝতে পারতুম। কিন্তু ব্রহ্ম যেমন নিজের সৃষ্ট মায়ার মধ্যে লীলা করেন, শহরবাসীরাও তেমনই নিজেদের কল্পিত বিপদ নিয়ে দিনকয়েক লীলানন্দ উপভোগ করতেন। তাঁদের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে লীলাসঙ্গিনীদের যে অবস্থা হত, সে-কথা উল্লেখ করে আর কাজ নেই।

সেবার আমাদের পুজোর ছুটি আরম্ভ হবার কিছু আগেই ছেলে-ধরার গুজব উঠল বড় জোর। মারপিটের চোটে শহর সরগরম হয়ে উঠল। শোনা গেল, সারা-তে রেল-কোম্পানি যে নতুন পুল করছে সেখানে ঠিকাদারেরা নাকি এক শো ছেলেকে বলি দেবে বলে ঠিক করেছে। প্রমত্তা পদ্মা মানুষের রক্ত চায়, তা না হলে সে বন্ধনে ধরা দেবে না বলে স্বপ্ন পাওয়া গেছে। ঠিক সেই তালে দু-চারটি খলিফা ছেলে বাড়ি থেকে লম্বা দেখাতে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল। খবরের কাগজওয়ালারা এই নিয়ে আন্দোলন শুরু করে দিল। তখন সবেমাত্র স্বদেশী যুগ আরম্ভ হয়েছে, একটা কিছু পেলেই গভর্মেন্টকে তুড়ে গালাগালি দেওয়া হত। কাগজে পুলিস-বিভাগের অযোগ্যতা সম্বন্ধে খুব লেখালেখি চলতে লাগল। রোজই সত্যমিথ্যা ছেলেধরার গুজব উড়তে লাগল শহরময়। কোনো ব্যক্তির ওপরে কোনো কারণে রাগ থাকলে একবার তাকে রাস্তায় ধরে এই ব্যক্তি ‘ছেলে-ধরা’ বলে চেঁচালেই হল। কোথায় ছেলে, সে-সম্বন্ধে খোঁজের কোনো প্রয়োজন নেই–আগে তাকে প্রহার দাও।

শহরের হালচাল তো এই দাঁড়িয়ে গেল। তখন মোটর-গাড়ির বিশেষ প্রচলন হয়নি। ধনীর ছেলেরা বাড়ির ঘোড়ার গাড়িতেই ইস্কুলে যাতায়াত করত। এরই মধ্যে একদিন একজনদের বাড়ির ছেলেরা ইস্কুল থেকে গাড়ি করে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট দিয়ে বাড়ি ফিরছে, এমন সময় কালীতলার কাছাকাছি ঘোড়াটা কি কারণে ভড়কে গিয়ে মারলে দৌড়। গাড়োয়ান গাড়ি সামলাতে পারে না, ভেতরে ছোট ছোট ছেলে, তারা কাঁদছে, গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে, এমন সময় কে রব তুলে দিলে–ছেলে-ধরারা গাড়ি করে ছেলে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। যাঁহাতক এই কথা শোনা, অমনই রাস্তার লোক হৈ-চৈ করে উঠল। নিজের জান-প্রাণ তুচ্ছ করে সেই উড়ন্ত ঘোড়াকে ধরে ফেলা হল। কোথায় গেল কোচোয়ান আর কোথায় গেল তার সহিস! ছেলেরা বাইরে লাফিয়ে পড়ল। কেউ তাদের জিজ্ঞাসাও করে না–কি হয়েছে? ঘোড়াটা ছাড়া পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে আবার দৌড় মারলে। শেষকালে লোকেরা লাঠি, শাবল, হাতুড়ি এনে দড়াদ্দম মারতে মারতে গাড়িখানাকে ভেঙে একেবারে চুরমার করে ফেললে। এখন কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে যেখানে শ্রীমানী বাজার আছে, আগে সেখানে খোলার চালের বস্তি ছিল। এই বস্তিতে পালেদের মস্ত বড় এক মুদির দোকান ছিল। উন্মত্ত জনসংঘ গাড়িখানাকে চুরচুর করে ভেঙেও নিশ্চিন্ত হতে পারলে না, যদি গাড়ির সেই ভগ্নস্তূপের মধ্যেও কোথাও ছেলেধরার বীজ লুকিয়ে থাকে–এই ভয়ে তারা সামনের সেই মুদির দোকানে ঢুকে ‘কেরোসিন তেলের ক্যানেস্তারা টেনে বার করে সেই চূর্ণ গাড়ির ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে দিলে তাতে আগুন ধরিয়ে। আধ ঘণ্টার মধ্যে হাজার টাকার গাড়িখানা চার আনার কাঠকয়লায় পরিণত হয়ে রাস্তায় পড়ে রইল।

বেশ মনে পড়ে, সেদিন আনন্দমোহন বসুর মৃত্যুদিন। সকালবেলা তাঁর দেহ শোভাযাত্রা করে নিমতলার শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। সেখান থেকে বেলা বারোটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে আহারাদি করে বেরুচ্ছি, এমন সময় দরজার সামনেই দেখি, জনার্দন ও আমার অন্যতম বন্ধু সুকান্ত দাঁড়িয়ে। দেখলুম, জনার্দনের মাথা ন্যাড়া। সে বললে, ছুটির মধ্যে হঠাৎ তার বাবা মারা গিয়েছেন, দিনকতক আগে শ্রাদ্ধশান্তি চুকিয়ে আজ সকালে সে কলকাতায় ফিরেছে। কথা বলতে বলতে আমরা অগ্রসর হতে লাগলুম। সুকান্ত বললে, জনার্দন কাজের ছেলে। বাড়ি থেকে শুধু-হাতে ফেরেনি, কিছু মালও নিয়ে এসেছে।

–তার মানে?

সুকান্ত বললে, চলো না, বোর্ডিঙে গেলেই বুঝতে পারবে।

বোর্ডিঙে গিয়ে দেখা গেল, জনার্দন তিনটি লম্বা ‘জেম’ বিস্কুটের টিন-ভর্তি টাকা নিয়ে এসেছে দেশ থেকে। টাকা বললে ভুল হবে, তিনটি টিন স্রেফ সিকি দোয়ানি ও আধুলিতে ভর্তি–বিশ্বাসঘাতকতা করব না, দু-চারটে টাকাও তাতে ছিল।

ইস্কুলে খুলতে তখনও একদিন দুদিন দেরি ছিল। জনার্দন বললে, টাকা নিয়ে বাড়িতে থাকলে যদি ধরা পড়ে যাই তাই ইস্কুল খোলবার আগেই চলে এসেছি।

তার বুদ্ধির তারিফ করে বললুম, বেশ করেছ বাবা জনার্দন! ভবিষ্যতে এমন বিবেচনাশীল হবে বুঝতে পেরেই বাপে তোমার নাম রেখেছিল–জনার্দন।

তাড়াতাড়ি বোর্ডিঙের একটা ঘরে গিয়ে রেজকিগুলো গুনে ফেলা গেল। সবসুদ্ধ তিনশো টাকার কিছু বেশি হবে–তার মধ্যে আবার টাকা পঁচিশেকের সিকি দোয়ানি ছিল অচল ও কোঁড়ামারা। তার মধ্যে টাকা-দশেক একেবারেই অচল আর বাকিগুলো ‘চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে’–গোছের।

এত সিকি দোয়ানি জুটল কি করে জিজ্ঞাসা করায় জনার্দন আকাশের দিকে মুখ তুলে যুক্তকর বুকে ঠেকিয়ে পরলোকগত পিতার. উদ্দেশে নমস্কার করে বললে, বাবা যাবার সময় দিয়ে গিয়েছেন।

–তোর বাবার সিকি দোয়ানি জমাবার শখ ছিল বুঝি?

জনার্দন ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ কিছুই বললে না। শেষকালে জেরা করতে করতে বেরিয়ে পড়ল যে, বাপের শ্রাদ্ধের সময় তাদের এক এক ভাইয়ের হাতে এক-একটা কাজের ভার পড়েছিল। তার ওপর পড়েছিল ব্রাহ্মণ-বিদায়ের ভার। তা থেকে সে নিজের ভাগে এই টাকাটি ফেলেছে। যা হোক, কি করে অর্থ এসেছে সে-বিষয়ে গবেষণা বন্ধ রেখে এখন কোথায় যাওয়া হবে তাই স্থির করতে মনোনিবেশ করা গেল। বলা বাহুল্য যে, সুকান্তও আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেল। আমরা স্থির করলুম যে, আমরা আগ্রায় যাব, তারপর সেখানে কিছু সুবিধে হলে সেখানেই স্থিতি, নয়তো অন্য কোথাও যাওয়া যাবে। তখনকার দিনে আগ্রা যাবার রেল-ভাড়া ছিল প্রায় আট টাকা, কিছু কম-বেশি হতে পারে। কিন্তু ওই সিকি দোয়ানি নিয়ে তো আর টিকিট কিনতে যাওয়া চলে না। এনটালির এক পোদ্দারের দোকান থেকে একশো টাকার সিকি দোয়ানি দিয়ে নব্বইটা টাকা পাওয়া গেল। তারপর একটা হোটেলে দমভোর খেয়ে রাত্রি প্রায় আটটার সময় দিল্লিযাত্রী একটা এক্সপ্রেস গাড়িতে চড়ে আমরা আগ্রার দিকে রওয়ানা হলুম।

.

পরের দিন দুপুর নাগাদ এলাহাবাদে গিয়ে পৌঁছানো গেল। স্টেশন থেকেই টাঙ্গা করে ছুটলুম সঙ্গম দর্শন করতে। সেখানে গিয়ে নৌকো করে সঙ্গমে গিয়ে মাথায় জল দিয়ে ফিরে কেল্লার মধ্যে অক্ষয়বট ইত্যাদি দেখে বাজারে যাওয়া গেল। আমরা তিনজনেই এক-বস্ত্রে বেরিয়েছিলুম।

জনার্দন বাড়ি থেকে আসবার সময় খানিকটা গাওয়া ঘি এনেছিল। কি জানি কি মনে করে–সেই বোতলটা সে সঙ্গে নিয়েছিল। আর কিছুই আমাদের সঙ্গে ছিল না। বাজার থেকে তিনজনের জন্যে তিনখানা ধুতি ও একখানা লাল কম্বল কেনা গেল।

কাপড়ের দোকানে নানা রকমের কাপড় ও কম্বল দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে, এমন সময় বাজারের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেল–মারো, মারো, পালাও ইত্যাদি। দেখলুম, লোকজন সব ঠিকরে ঠিকরে পালাচ্ছে। কি ব্যাপার! দোকান থেকে বেরিয়ে দেখা গেল, তিনজন গোরা সৈনিকের সঙ্গে মেওয়াওয়ালাদের মারপিট বেধেছে। একপক্ষে তারা তিনজন, আর অন্যপক্ষে বাজারের দোকানদারেরা এবং যারা বাজার করতে এসেছে তাদের মধ্যে অতি সাহসী যারা, তারা। দোকানদারেরা গোরাদের লক্ষ করে ইট-বাটখারা প্রভৃতি ছুঁড়ছে, আর তারা এক-একদিকে তাড়া করে যাচ্ছে, আর হৈ-হৈ করে দিগ্বিদিকে লোক ছুটছে। আমরা যে-দোকানে জিনিসপত্র কিনছিলুম, সেখানেও হুড়মুড় করে লোক ঢুকতে লাগল। দোকানি ছিল ভয়তরাসে লোক, সে ব্যাপার সুবিধের নয় দেখে বাইরের লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে একটা দরজা বন্ধ করে দিলে। এদিকে গোরারা ছুটতে ছুটতে সেই দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের মাথার টুপি উড়ে গেছে, পেন্টুলান জামা ছিঁড়ে ফর্দাফাই। মুখ, মাথা ও দেহের অনেক জায়গা দিয়ে রক্ত ছুটছে–সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! আমরা ভয় পেয়ে দোকানের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছি, এমন সময় দোকানদার আমাদের ঠেলে বার করে দিয়ে দরজায় তালা লাগাতে আরম্ভ করে দিলে। সুকান্তর বগলে সওদা, আমার কাছে ছিল টাকা। পাঁচ টাকা না সাড়ে পাঁচ টাকা জিনিসের দর হয়েছিল। সিকি দোয়ানি গুনছি–এর সঙ্গে দুটো কোঁড়মারা সিকি ভিড়িয়ে দেব কি না ভাবছি, এমন সময় গোরারা একটা চলতি টাঙ্গা থামিয়ে তাতে উঠে পড়ল। টাঙ্গাওয়ালার সঙ্গে তাদের কথাবার্তা চলছে, এমন সময় একটা রোগাপানা লোক পাশের সরু গলি থেকে বেরিয়ে এসে টাঙ্গার পেছনে যে দুজন গোরা বসে ছিল তাদের একজনের পেটে ধাঁ করে ছোরা বসিয়ে দিয়েই কোথায় পালিয়ে গেল–রক্ত একেবারে ফিকি দিয়ে বেরুতে লাগল। বাস্! টাঙ্গাওয়ালাকে আর নির্দেশ দিতে হল না যে, কোথায় যেতে হবে। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলে, খুব সম্ভব হাসপাতালের দিকে।

ব্যাপারটা এতই অভাবনীয় যে, প্রথমটা আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলুম; কিন্তু তখুনি সম্বিৎ ফিরে আসতেই মনে হল, এখানে দাঁড়ানো আর কর্তব্য নয়। চারিদিকে একবার চেয়ে দেখলুম, মুহূর্তকাল পূর্বে যেখানে বাজার ছিল তা এখন মরুভূমির মতন নির্জন। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। আমাদের কাপড়ওয়ালারও কোনো উদ্দেশ নেই। তার অনুসন্ধানে বৃথা কালবিলম্ব না করে জিনিসগুলি সঙ্গম-স্নানের পুণ্যে লাভ হয়েছে মনে করে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে সরে পড়লুম।

স্টেশনের যাত্রীশালায় লাল কম্বল পেতে তারই ওপরে রাত্রি যাপন করা গেল। পরদিন সকালবেলা খসরুবাগ দেখলুম। আমি এর পরেও অনেকবার খসরুবাগে গিয়েছি, কিন্তু সেবারে সেখানে যে ফুলের বাহার দেখেছিলুম তা আর কখনও দেখিনি। সেখানকার সমস্ত জমিতে অসংখ্য রঙের মৌসুমী ফুল ফুটে বাগানটাকে একেবারে আলো করে ছিল। এর পরে এলাহাবাদ গেলেই ফুলের লোভে খসরুবাগ দেখতে গিয়েছি, কিন্তু সে-রকমটি আর দেখিনি। সেই ফুলের রঙ অল্পবয়সে আমার মনে এমন রঙ ধরিয়ে দিয়েছে যে, আজও ট্রেনে করে কোথাও যেতে যদি পথে এলাহাবাদ স্টেশন পড়ে তো ধাঁ করে তার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়ের কথা মনে পড়ে যায়।

যা হোক, সেদিনটা সারাদিনই খসরুবাগে কাটিয়ে দিলুম। কখনও-বা বাগানে শুয়ে, কখনও-বা খসরুর সমাধিতে। সমস্তক্ষণটাই যে ভয়ে ভয়ে কাটল, তা বলাই বাহুল্য। পরোক্ষে ডবল অপরাধী হয়ে আছি –প্রথম, গোরাকে ছুরিমারা দেখা–রাজার জাতকে মারতে দেখাও সে-সময়ে অপরাধ ছিল কি না। দ্বিতীয়ত, দোকানদার দাম না নিয়ে পালিয়েছে, সেও দেখতে পেলে হাঙ্গামা বাধাতে পারে। কিন্তু সঙ্গমস্নান ও অক্ষয়বটবৃক্ষ-দর্শনের পুণ্যে সেসব কিছুই হল না। আমরা নিরাপদে রাত্রি দশটা নাগাদ একখানা দিল্লিযাত্রী ট্রেনে সওয়ার হলুম।

আমার জীবনদেবতা মাঝে মাঝে অসময়ে যবনিকাপাতের ঘণ্টা বাজিয়ে যে রসিকতা করে থাকেন, তার ইঙ্গিত ইতিপূর্বে দিয়েছি। এবারেও কোথাও কিছু না, অতর্কিতে সেই ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি একটু মজা করে নিলেন। আমাদের কাছে আগ্রা ফোর্টের টিকিট ছিল। বেলা সাড়ে ন’টা কি দশটার সময় টুণ্ডলা জংশনে গাড়ি পৌঁছবার কথা। সেখানে নেমে অন্য গাড়ি চড়ে আগ্রায় যেতে হবে। কিন্তু আর একটু হলে তার অনেক আগেই আমাকে আগ্রার চাইতে অনেক দূরে যে পাড়ি জমাতে হত, সেই ঘটনাটা মনের পর্দায় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে।

রাত্রিবেলা এলাহাবাদ স্টেশনে যখন ট্রেনে চড়ি, তখন সে-কামরায় ভিড় মোটেই ছিল না। বড় কামরা, দু-তিনজন লোক এখানে-সেখানে পড়ে আছে দেখেছিলুম। আমি জানলার ধারে একটা লম্বা বেঞ্চিতে শুয়ে পড়েছিলুম। ভোর হয়ে যাবার কিছু পরে, ঘুম ভেঙে গেলেও শুয়ে শুয়ে আলস্যে কাটাচ্ছি, হঠাৎ এক হাত লম্বা ও আধ হাত চওড়া একজোড়া শ্রীচরণ আমার বুকের ওপর এসে পড়ল। জোরে পা-দুখানা বুক থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলুম। দেখি, একটা লোক খুব লম্বা ও চওড়া হাড়ে-মাসে গঠিত দেহ, দেখলেই মনে হয় খুব শক্তিশালী–সামনের বেঞ্চিতে বসে ট্যারা চোখে রাগান্বিত ভাবে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। কে এই ব্যক্তি! আমার প্রতি তার এই উষ্মার কারণই বা কি? এসব ভাবতে বোধ হয় মিনিটখানেক সময় লেগেছিল। ইতিমধ্যে সুকান্ত অন্য জায়গা থেকে উঠে এসে তাকে বলতে লাগল, তুমি তো আচ্ছা লোক! মানুষ শুয়ে আছে তার বুকে পা তুলে দাও!

কামরার মধ্যে তখন অনেক লোক, তাদের মধ্যে অনেকেই সেই লোকটাকে যাচ্ছেতাই করে গালাগালি দিতে লাগল। কিন্তু সে কারুর কথার প্রতিবাদ করলে না, এমনকি কারুর দিকে ফিরে চাইলেও না, শুধু কটমট করে সেই ট্যারা চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ সেইভাবেই কাটাবার পর সে আবার সেই ডোঙার মতন পা-দু’খানা আমার বেঞ্চির ওপর তুলে দিলে, এবারেও তার একখানা পা আমার গায়ে বেশ ভাবে ঠেকে রইল। গাড়িসুদ্ধ লোক হাঁ করে মজা দেখছে, কেউ কেউ রকম-বেরকমের মন্তব্যও করছে, এদিকে বেশ বোঝা যেতে লাগল লোকটা একখানা পা ক্রমেই আমার গায়ের সঙ্গে চেপে লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি নিজেকে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করতে লাগলুম। কিছুক্ষণ এইরকম সহ্য করে আমার দুই পা সোজা একেবারে তার বুকের ওপর চড়িয়ে দিলুম। গাড়িসুদ্ধু নর-নারী হো-হো করে হেসে উঠল। আমাদের সামনেই স্টেশনের দিকে বেঞ্চে একটি লোক সারা বেঞ্চি জুড়ে বিছানা করে শুয়ে ছিল। লোকটিকে বেশ ভদ্র বলেই মনে হল। সে আমার ওই কাণ্ড দেখে উঠে বলতে লাগল, সাবাস বেটা, সাবাস! তারপর অন্যান্য যাত্রীদের দিকে চেয়ে বললে, আমি তখন থেকে এই লোকটার বেহুদাপনা দেখছি। এত বড় বেহুদা যে, ঘুমন্ত লোকের বুকে পা তুলে দেয়! তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, ওটার মুখে মারো তিন লাথি।

নিজের প্রশংসা শুনে মনে-মনে বেশ গর্বিত বোধ করলুমই, উপরন্তু লোকটার মুখে টেনে একটি লাথি ঝাড়ব কি না ভাবছি, এমন সময় সে অদ্ভুত ক্ষিপ্রকারিতার সঙ্গে আমার পায়ের নড়া-দুটো চেপে ধরে আর এক হাতের সাহায্যে খোলা জানলা দিয়ে আমাকে চলন্ত গাড়ি থেকে বাইরে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। কামরার সকলে চিৎকার করতে লাগল, আমার বন্ধুদ্বয় তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করতে লাগল; কিন্তু তাদের সাধ্য কি তাকে ঠেকায়! সে অবলীলাক্রমে আমাকে ঠেলে কোমর অবধি বাইরে বার করে ফেললে। আমার দেহের কোমর অবধি আধখানা বাইরে ঝুলতে লাগল, মাথাটা নীচু দিকে আর আধখানা নিয়ে গাড়ির মধ্যে লড়াই চলতে লাগল। বোধ হয় আধ কি পৌনে এক মিনিট এই অবস্থায় ছিলুম। ঝুলতে ঝুলতে একবার মনে হয়েছিল, সঙ্গমস্নানের পুণ্যফল পেয়ে গেলুম বুঝি! যা হোক্ কামরার মধ্যে আমাকে টেনে নেবার পর দেখলুম, আট-দশজন লোক মিলে লোকটাকে নির্দম পিটছে; কিন্তু সে নির্বিকার। হাত পাও চালাচ্ছে না বা একটা টু শব্দও করছে না। লোকেরাই পিটতে পিটতে ক্লান্ত হয়ে যে যার জায়গায় চলে গেল। বলা বাহুল্য, আমিও আগেকার জায়গা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বসলুম এবং দুর্জনের সঙ্গে একত্রে যাত্রা করা আর উচিত নয় এই স্থির করে কোন স্টেশনে নেমে পড়া যাবে তাই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গভীরভাবে আলোচনা করতে লাগলুম। একটা স্টেশনে এসে গাড়ি থামতেই আমরা নামবার বন্দোবস্ত করছি, এমন সময় আমাদের একজন সহযাত্রী সেই লোকটাকে ডেকে বললে, তুমি এখান থেকে নেমে যাও, নইলে পুলিস ডেকে ধরিয়ে দেওয়া হবে।

বলামাত্র লোকটা টপ্ করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। সে চলে গেলে সকলে বলতে লাগল লোকটা নিশ্চয়ই পাগল। তার হালচাল দেখেও তাই মনে হল।

তিনি কখন যে কি ভাবে কি সেজে আসেন কিছু বলা যায় না।

টুলায় নেমে ট্রেন বদলে আগ্রা ফোর্ট স্টেশনে যখন পৌঁছলুম, তখন বেলা প্রায় বারোটা। স্টেশনেই দলে দলে হোটেলের দালাল ঘুরছে, তাদের মধ্যে একজন আমাদের ধরলে। কাছেই হোটেল, সবরকম সুবিধা আছে সেখানে, ছাতের ওপর চারদিক-খোলা চমৎকার ঘর, তার ওপর যেখানে যে দ্রব্যটি মানায় তাই দিয়ে সাজানো। খাট, টেবিল, চেয়ার, মেঝেয় শতরঞ্চি পাতা–আর কি চাই? ভাড়া দৈনিক দু’আনা, চার আনা, আট আনা,–খাবারের বন্দোবস্ত তোমাদের নিজেদের করতে হবে।

আমরা এই লোকটার হোটেলেই থাকব ঠিক করে তার সঙ্গে স্টেশন থেকে বেরুনো-মাত্র কয়েকজন লোক ‘চুঙ্গী’ ‘চুঙ্গী’ করে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে এসে জনার্দনকে পাকড়াও করলে। আমরা তো ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেলুম। চুঙ্গী কি রে বাবা! শেষকালে হোটেলের সেই দালাল আমাদের বুঝিয়ে দিল যে, ব্যবসার জন্যে কোনো কাম নিয়ে এলে এখানে অকট্রয় ট্যাক্স দিতে হয়। আমরা মনে করলুম, এলাহাবাদ থেকে যে নতুন ধুতি ও কম্বল এনেছি, তার জন্য বোধ হয় ট্যাক্স দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন করে জানা গেল, জনার্দনের হাতে যে ঘিয়ের বোতলটা আছে তার জন্য ট্যাক্স লাগবে। অগত্যা যাওয়া গেল অকট্রয়-অফিসে।

স্টেশন থেকে বেরিয়েই কেল্লার সামনে যে জমি আছে, সেখানে চারটে বাঁশের খুঁটির ওপর শণ না কি দিয়ে কোনোরকমে একটু ছাউনি করা হয়েছে, এই হচ্ছে অকট্রয়-অফিস। অফিসের চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে অফিসারেরও তেমনি মেকদারের চেহারা। আমাদের সেই ঘিয়ের বোতলটা নেড়ে চেড়ে বললে, নাঃ, এর আর ট্যাক্স লাগবে না।

অকট্রয়-অফিস থেকে রেহাই পেয়ে হোটেলে এলুম। স্টেশনের কাছেই বাড়ি। একতলার ঘরগুলো অন্ধকার খুপরি গোছের, ভয়ানক ময়লা। একটা করে দড়ির খাঁটিয়া আছে, ভাড়া দিন-প্রতি দু’আনা। দোতলায় বড় ছাত–ছাতের চার কোণে চারখানা প্রশস্ত ঘর। চারদিকে খোলা। ঘরের মেঝেতে একটা দরি পাতা। দেওয়ালের সঙ্গে একটি টেবিল ও তারই সামনে একখানি চেয়ার। আর এক পাশে একখানা নেয়ারের খাট পড়ে আছে, তাতে বিছানাপত্র কিছুই নেই। এই ঘরের ভাড়া দৈনিক চার আনা। তেতলার ওপরে দুখানা ঘর, তার আসবাবপত্র ওইরকমই, তবে খাট ও চেয়ার দুখানা করে আছে, ভাড়া দৈনিক আট-আনা।

আমরা দোতলায় দৈনিক চার আনাওয়ালা একখানা ঘর নিলুম। খাটের যে অবস্থা দেখা গেল তাতে কেউ শুতে পারবে না–ঠিক হল মেঝেতেই দরির ওপরে শোয়া যাবে। টেবিল-চেয়ারে হাত দেওয়া মাত্র তাঁরা টলে পড়লেন। কি অদ্ভুত উপায়ে যে সেগুলোকে খাড়া রাখা হয়েছিল তা হোটেলওয়ালারাই জানে, কারণ আমরা তিনজনে মিলে দিন-আষ্টেক চেষ্টা করেও তাদের খাড়া করতে পারলুম না।

ঠিক করা গেল, বাজার থেকে খাবার না কিনে তখনকার মতো আলুভাতে ভাত চড়িয়ে দেওয়া যাক, তারপরে ও-বেলা দেখা যাবে’খন

সুকান্ত ও জনার্দন বাজার করতে চলে গেল, আমি ঘর আগলাবার জন্যে রইলুম। ওরা চলে যাবার পর আমি একটু এদিক-ওদিক দেখতে লাগলুম, একতলার যাত্রী আসা-যাওয়ার ও দরদস্তুরের চিৎকার হচ্ছে; আমাদেরই দোতলায় কোণের দিকের ঘরের একজন যাত্রী ছাতে জল তুলিয়ে স্নান করছে, ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, বোম্বাই অঞ্চলে তাঁর বাড়ি। এইরকম এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ পড়ল আমাদের ঘরের একবারে সামনের ঘরে, মাঝখানে লম্বা ছাত–সেই ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে একটি যুবতী আমায় দেখছে। যুবতীর বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে, নিটোল স্বাস্থ্য, রঙ ফরসা, দেখতে বেশ সুন্দরী। জানলা দিয়ে তার কোমর অবধি দেখা যাচ্ছিল, আমার চোখে চোখ পড়বার পরও কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সে জানলা থেকে সরে গেল। একটু পরেই আবার চোখ পড়ল, যুবতী তাদের ঘরের দরজার পাল্লা-দুটো খুলে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ঘর থেকে এবারে তার সম্পূর্ণ চেহারা দেখা যেতে লাগল। বেশ লম্বা চেহারা, কাপড় পরবার ধরন দেখে হিন্দুস্থানী বলেই মনে হল। এবার সে অনেকক্ষণ আমাদের ঘরের দিকে চেয়ে রইল। একবার চোখে চোখ পড়তেই সে যেন একটু হাসলে।

ভাবতে লাগলুম–কিরকম হল! চেনাশোনা নয় তো! কিন্তু কে হতে পারে? ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে মনের মধ্যে আলোচনা করছি, তখনও সে ঠায় সেইভাবে দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে বন্ধুরা বাজার থেকে ফিরতেই তাদের সাড়া পেয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলে।

বন্ধুরা বাজার থেকে হাঁড়ি, উনুন, চাল, কাঠ, আলু, নুন ও আরও কি কি সব এনেছিল। তারা সেসব রেখে বললে, চল, যমুনা থেকে আগে স্নান করে আসি, তার পরে রান্না চড়ানো যাবে।

আমি তখন সেই অপরিচিতার নয়ন-ফাঁদে আবদ্ধ হয়ে ছটফট করছি, স্থান ত্যাগ করবার ক্ষমতা কোথায়? তাদের বললুম, তোরা যা, আমি রান্নার ব্যবস্থা করি, পরে এখানেই স্নান করে নেব।

ওরা স্নান করতে চলে গেল। ছাতের একধারে একটু ছায়া পড়েছিল সেই খানেই রান্না চড়িয়ে দিলুম। রান্না হতে লাগল, কিন্তু আমার চোখ রইল সেই খোলা জানলার দিকে। একটু যেতে-না যেতে সুন্দরী আবার জানলার পশ্চাতে উদিত হলেন। এবার তার মুখে স্পষ্ট হাসি দেখতে পেলুম। আমি হাসতে সেও আর একটু হেসে সরে গেল বটে, কিন্তু তখুনি আবার সেখানে এসে দাঁড়াল।

বন্ধুরা বাজার থেকে করকচ নুন এনেছিল, কিন্তু, সে তো পাড়ে খাওয়া চলবে না। আমার মনে হল, নুন গুঁড়ো করবার কিছু আছে কি না–এই ছুতোয় তার সঙ্গে কথা বলা যাক। যাঁহাতক মনে হওয়া অমনই নুনের মোড়কটা হাতে করে জানলার কাছে গিয়ে তাকে বলে ফেললুম, দেখুন, এই নুন গুঁড়ো করবার কিছু–

এই অবধি শুনেই সুন্দরী ধাঁ করে জানলা থেকে সরে গেল। ব্যাপার দেখে আমার ভয় হল, ভাবতে লাগলুম, সরে পড়ব নাকি! ইতিমধ্যে সে দরজাটা খুলে একটা ছোট পেতলের হামানদিস্তে এগিয়ে দিয়ে বললে, কাজ হয়ে গেলে দিয়ে যেয়ো।

–নিশ্চয়, সে-কথা আর বলতে!

অতি সুমধুর হাসিতে মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কিন্তু সে আর কিছুই বললে না।

হামানদিস্তে নিয়ে নুন গুঁড়ো করতে করতে ভাবতে লাগলুম, আরও কিছু কথা বললুম না কেন! মনের মধ্যে নানারকম প্ল্যান গজিয়ে উঠতে লাগল–এই কথা বলা যেতে পারত, এই করে ভাব আরও বাড়ানো যেতে পারত। সুযোগ যদি বা এল, হেলায় হারালুম, ইত্যাদি।

নুন গুঁড়ো হয়ে গেল। ভাবতে লাগলুম, হামানদিস্তেটা ফেরৎ দেবার সময় হয়েছে কি না! একটু পরেই দেখলুম, সুন্দরী আবার এসে জানলায় দাঁড়িয়েছে। হামানদিস্তেটা ফেরৎ নিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই যুবতী দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে নিলে। এবার সে হেসে উর্দুতে জিজ্ঞাসা করলে, রান্না হচ্ছে বুঝি?

–হ্যাঁ, রান্না করছি। কই, আপনারা রান্না করছেন না?

যুবতী আঁচলের খোঁট মুখে চাপা দিয়ে খানিকটা হেসে নিলে। তার পরে বললে, নাঃ, পরদেশে এসে ওসব হাঙ্গামা আর লাগাইনি। আমরা বাজার থেকে খাবার এনে খাচ্ছি, ঘরওয়ালা খাবার কিনতে গেছে।

আর কি কথা বলব ভাবছি, হঠাৎ যুবতী মুখ তুলে চেয়ে কার দিকে যেন চোখ পড়তেই ঘরের মধ্যে আড়ালে সরে গেল। আমি পেছন ফিরে দেখলুম, বোম্বাইয়ের সেই লোকটি তার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাদের চোখ দিয়ে গিলছে। আর সেখানে না দাঁড়িয়ে ফিরে এসে ভাতে কাঠি দিতে লাগলুম–যুবতীও দেখলুম দরজা-জানলা সব বন্ধ করে দিলে।

একটু পরেই বন্ধুরা যমুনা-স্নান সেরে ফিরে এল। আমি হোটেলেই স্নান সেরে নিলুম। কাঁচা শালপাতায় ভাত ঢেলে জনার্দনের আনা সেই গব্যঘৃত ও আলুভাতে দিয়ে আকণ্ঠ ভোজন করে মেঝেরই দরিতেই পড়ে রইলুম। ঠিক হল, রোদ পড়লে তাজে যাওয়া হবে। দুপুরবেলা আমার যখন ঘুম ভাঙল তখনও বন্ধুরা ওঠেনি, পাশ ফিরছে মাত্র। একবার দেখা পাওয়া যায় কি না দেখবার জন্যে ঘরের বাইরে উঁকি দেওয়া মাত্র দেখলুম, সুন্দরী জানলার ধার থেকে সট করে সরে গেল। পাশের দিকে চেয়ে দেখি, ওদিকের ঘরে সেই বোম্বাইয়ের লোকটি দাঁড়িয়ে–আমাকে দেখে সে ধীরে সুস্থে সরে গেল।

ভিজে ধুতিগুলো ঘরের মধ্যে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো তুলে ভাঁজ করতে লাগলুম আর ওদিকে সুন্দরী আবার এসে জানলায় দাঁড়ায় কি না সেদিকেও নজর রাখলুম। কিন্তু সে আর তো এলই না, উলটে ভেতরে অদৃশ্য থেকে আমাদের দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিলে। আর বাড়িতে বসে সময় নষ্ট করে কি হবে ভেবে বন্ধুদের ডেকে তুললুম। হোটেলওয়ালারাই একটা অদ্ভুতদর্শন তালা দিলে, সেই তালা দরজায় লাগিয়ে তাজ দেখতে যাওয়া হল। বেশ মনে পড়ে, স্টেশনের কাছ থেকে তাজ অবধি এক্কাওয়ালা ভাড়া নিয়েছিল মাত্র দু’-আনা। তাতেও সেদিন সে আমাদের ঠকিয়েছিল, কারণ পরে প্রত্যহই ছ’পয়সা খরচ করে সেখানে গিয়েছি এবং এসেছি পদব্রজে।

তাজমহল দেখলুম যখন তখন তার আধখানায় ছায়া পড়েছে আর আধখানা রোদে ঝকমক করছে। তাজমহল অপূর্ব, অভাবনীয়। অভিধান ঘেঁটে অনেক বিশেষণ তার প্রতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। কিন্তু আমি তা করব না। আমার দেশের রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, সত্যেন্দ্রনাথ ও আরও অনেক কবি তাজমহলের প্রশস্তি গেয়েছেন। তাঁরা ছাড়া দেশবিদেশের আরও অনেক কবি ও মনীষী তাজের রূপস্তুতি করছেন–’সেথা আমি কি গাহিব গান’!

অতি শৈশব থেকে তাজমহলের কথা আমি বাবা-মা’র মুখে শুনেছি। ছোটদের পাঠ্যপুস্তকে তাজের কথা পড়েছি ও তার ছবি দেখেছি, বড় হয়েও ইতিহাসে পড়েছি তাজের কথা। তাজের জন্মের পিছনে পটভূমিস্বরূপ যে প্রেমের করুণ ইতিহাস তার সঙ্গে গাঁথা হয়ে আছে, তাও শুনেছি বহুবার বহুরকম। এইসব শুনে পড়ে ও দেখে আমার মনের মধ্যেও এতদিন ধরে আস্তে আস্তে তাজের একটা রূপ তৈরি হয়ে উঠেছিল। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, কিরকম দেখতে সে রূপ? আমি তার স্পষ্ট জবাব দিতে পারব না। তার খানিকটা বাস্তব, খানিকটা কল্পনা, কতকটা আলো, বেশিরভাগই অন্ধকার। সত্যিকার তাজের সঙ্গে তার কিছু সাদৃশ্য আছে, কিছু নেই। প্রথমে তাজ দেখে মনে হয়েছিল, এর সঙ্গে তো আমার মনের সেই তাজের মিল নেই!–সত্যি বলতে কি, মনে আঘাতই পেয়েছিলুম, নিরাশই হয়েছিলুম, হয়তো আমারই মতন সম্রাট শাজাহান প্রথম যেদিন তাজ দেখেছিলেন সেদিন নিরাশই হয়েছিলেন। হয়তো তাঁর একবার মনে হয়েছিল, যে-প্রেমের স্বপ্নকে রূপ দেবার জন্য এত আয়াস স্বীকার করা হল তা ব্যর্থই হয়েছে। তাঁর স্বপ্নও ঠিক রূপ ধরেনি–কে বলতে পারে! হায়! মানুষের মনের মধ্যে যে রূপ ফুটে ওঠে, অক্ষরের কিংবা প্রস্তরের ইমারত তৈরি করে তাকে হুবহু ফুটিয়ে তোলা যায় না। সে অনির্বচনীয়, অসংবেদনীয়।

তবু তাজ কি সুন্দর নয়? নিশ্চয় সুন্দর। তাজের সৌন্দর্য কিরকমের, সেই কথাটা বলবার চেষ্টা করছি।

আগ্রা শহরে এই আমার প্রথম আগমন, পরে আরও অনেকবার আগ্রায় আসতে হয়েছে এবং এখানে থাকতে হয়েছে কখনও অল্পদিন, কখনও বেশিদিন; কখনও বেকার অবস্থায়, কখনও-বা চাকরি নিয়ে; কখনও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, কখনও-বা একা। কিন্তু তাজকে আমি ভুলিনি। যখন যে অবস্থায় এসেছি–তা সে দু’ঘণ্টার জন্যেই হোক কিংবা ছমাসের জন্যেই হোক, ছুটে গিয়েছি তাজমহলে–কখনও কখনও তাজ আমাকে নেশার মতন পেয়ে বসেছে। এমনও হয়েছে যে, গ্রীষ্মকালে দিনের পর দিন শহর থেকে আগ্রার সেই রোদ মাথায় করে সেখানে গিয়েছি, একলা ঘুরে বেড়িয়েছি তার কত অনধ্যাসিত গোপন কন্দরে। তাজের প্রবেশ-তোরণের অন্ধকারময় অলিন্দে যেসব ঘুলঘুলি আছে তারই ফোকর দিয়ে রোদে জ্বলন্ত তাজের দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে নিদ্রাভিভূত হয়ে তারই স্বপ্ন দেখেছি। পূর্ণিমা প্রতিপদ দ্বিতীয়া, ওদিকে দ্বাদশী-ত্ৰয়োদশী অর্থাৎ চন্দ্রালোকেও দেখেছি তাকে। নীলাকাশ তার পটভূমিকা হলেও স্তিমিত চন্দ্রালোকে তাজকে মনে হয়, যেন নীল সমুদ্রে শ্বেত শতদল ফুটে উঠেছে। চন্দ্রালোকিত রাত্রে চলন্ত মেঘের মাঝে তাজের আর এক রূপ ফুটে ওঠে। এইরকম দেখতে দেখতে হঠাৎ তার আসল রূপ দর্শকের চক্ষে প্রতিভাত হয়। আগেই বলেছি, প্রথম দর্শনে তাজমহলের আসল রূপ চোখে পড়ে না, সে ধীরে ধীরে আপনাকে প্রকাশ করে। তার কায়িক রূপের পেছনে লুকিয়ে আছে সেই রূপ–প্রথম দর্শনের দিনে আমার কাছে তা সংবৃতই ছিল। দুষ্কর কৃচ্ছ্রসাধনের পর আমি তার অবগুণ্ঠন মোচন করে দেখেছি, সে রূপসি।

যাই হোক, রাত্রে তাজ খোলা থাকে কি না জিজ্ঞাসা করায় খাদিমরা বললে যে, সেই রাত্রে প্রথমদিকে চাঁদ উঠবে বলে রাত্রি দশটা অবধি তাজ খোলা থাকবে। শুনলুম যে, পূর্ণিমা-রাতে বারোটা অবধি তাজ খোলা থাকে।

রাত আটটা সাড়ে-আটটা অবধি সেখানে কাটিয়ে হেঁটে শহরে ফেরা গেল। শহরে একটু ঘোরাফেরা করে একটা ময়রার দোকানে ঢুকে বেশ করে কচুরি, জিলিপি ও রাবড়ি আহার করা গেল। কলকাতার হিসাবে সে খাবার দামে সস্তা তো বটেই, খেতেও ভালো। রাবড়ির সের সে-সময় কলকাতায় আট থেকে বারো আনা ছিল, সেখানে তার চেয়ে ঢের ঢের ভালো জিনিস পাওয়া গেল ছ’-আনায়।

আহারাদি শেষ করে পরম পরিতৃপ্ত হয়ে হোটেলে ফিরে এসে নীচে যেখানে ম্যানেজার বসে সেখানে ঘড়িতে দেখা গেল, দশটা বেজে গিয়েছে। হোটেলওয়ালা আমাদের ডেকে বললে,

আজকে রাতে আপনারা দয়া করে কোথাও বেরুবেন না। সরকার থেকে লোক আসবে রেজিস্টারি করতে।

সরকার, রেজিস্টারি প্রভৃতি কথা শুনে তো ভড়কে গেলুম। সে আবার কি রে বাবা!

হোটেলওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারা গেল যে, সেখানে ও প্রত্যেক হোটেলেই যত যাত্রী আসে–পুলিস তাদের নাম, ঠিকানা, কোথা থেকে আসা হচ্ছে, কোথায় যাওয়া হবে ইত্যাদি লিখে নিয়ে যায়–এই নিয়ম আবহমান কাল থেকে চলে আসছে।

আর বেশি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলে যদি হোটেলওয়ালার মনে সন্দেহ জাগে, তাই মনের ভয় মনেই চেপে দোতলায় ওঠা গেল। সেখানে উঠে দেখি, ভীষণ ব্যাপার! অনেক লোকজনের জটলা লেগেছে আমাদের ঘরের সামনের ঘরে–যেখানে দ্বিপ্রহরে সেই রহস্যময়ী সুন্দরীকে দেখেছিলুম।

দেখলুম, দুজন গুণ্ডামতন লোক আমাদের ঘরের সামনে ছাতে বসে আছে, তাদের একজনের হাতে একটা পাকা বাঁশের বড় লাঠি। ঘরের মধ্যে খুব ধমকধামক চলছে দেখে উঁকি দিয়ে দেখি যে, একটা কম্বলের ওপরে, দিনের বেলায় ওদিককার ঘরের বোম্বাইয়ের যে লোকটিকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখেছিলুম, সে বসে রয়েছে। তার মাথার চুল উস্কোখুস্কো, একটা খুব ষণ্ডাগোছের লোক সেই লোকটার কোঁচা বেশ বাগিয়ে ধরে সামনে বসে আছে। আর একটা যণ্ডা লোক ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রীলোকটিকে দেখলুম, কম্বলের এক কোণে সেই দেওয়াল ঘেঁসে বসে আছে–তার মুখের ঘোমটা একেবারে হাঁটু অবধি ঝুলে পড়েছে–লজ্জায় কি চক্ষুলজ্জায় তা বোঝা মুশকিল। যে লোকটা আমাদের স্টেশন থেকে হোটেলে নিয়ে এসেছিল, দেখলুম ঘরের মধ্যে সেও দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে লোকটা বোম্বাইওয়ালার কোঁচা ধরে ছিল সে বিরাট হুঙ্কার ছাড়লে। তার যতটুকু বুঝতে পারলুম তাতে মনে হল, সে অন্য ব্যক্তি হত্যা করে ফাঁসি যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করছে।

কৌতূহল বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তিনজনেই ভিড় করে জানলার আরও কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। ইতিমধ্যে হোটেলের দালালটার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় সে বেরিয়ে এসে আমাদের বললে, বাবু, তোমরা জানলার কাছে দাঁড়িও না, নিজের ঘরে চলে যাও। এসব ঝামেলার মধ্যে কি শরীফ লোকদের থাকতে আছে?

আমরা তাকে আমাদের ঘরে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলুম, কি হয়েছে বলো তো? লোকটা চেষ্টা করে খুব গভীর-রকম গম্ভীর হয়ে বললে, কি আর বলব বলো! বুরা কামকা ইয়েহি নতিজা হোতা হ্যায়।

বললুম, বাপু, হেঁয়ালি ছাড় দিকিন। কোন্ বুরা কামের কি নতিজা হয় তা আমরা ভালোরকম জানি। এখন বলো তো কি হয়েছে।

লোকটা বললে, ওই ঘরে একজনেরা এসেছে কাল বিকেলে। আজ সকালবেলা সে তার স্ত্রীকে রেখে কি কাজে বেরিয়েছিল। রাত্রিবেলা ফিরে এসে দেখে যে, ওই ওদিককার ঘরের যাত্রী তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করছে। বাস্, আর কি! সে তার লোকজন ডেকে এনে এখন ধরেছে তাকে। হয় ওই লোকটা কিছু টাকা দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলুক, আর না-হয় জাহান্নামে যাক।

লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলুম, আসামি এখন কি বলছে?

–বলবে আবার কি! টাকা ওকে দিতেই হবে, নইলে বিদেশে এসে কি জান দেবে! যাকগে, খারাপ কাজের এইরকম ফলই হয়ে থাকে। কিন্তু তোমরা ও-সবের মধ্যে যেও না। ও-দিকে যাবার দরকারই বা কি?

আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় সে নিজেই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেল। সমস্ত ব্যাপারটাই যে যোগ-সাজশে হয়েছে সে-কথা বলাই বাহুল্য। আমাদের বয়েস নেহাত কম, তার, ওপর বাড়ি থেকে পলায়নের অপরাধ কাঁধের ওপরে রয়েছে, নইলে তখুনি পুলিসে খবর দিতুম। আমি সমস্ত দিন ধরে অনেকবার লক্ষ করেছি, ওই ঘরের স্ত্রীলোকটি বোম্বাইয়ের সেই লোকটিকে নানা ভাবে প্রলুব্ধ করবার চেষ্টা করেছে। এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে, সন্ধ্যার সময় দোতলাটা নির্জন দেখে ওই স্ত্রীলোকটি সেই লোকটিকে ডেকে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়েছে। তার লোকগুলো তক্কে তক্কে ফিরছিল, শিকার জালে পড়তেই তারা টপ করে এসে ধরেছে।

একটা ময়লা চিমনি-ভাঙা কেরোসিনের লণ্ঠন মেঝের ওপরে জ্বলছিল, সেটাকে নিবিয়ে দিয়ে মেঝেতেই শুয়ে আমরা লোকটার অবস্থার কথা আলোচনা করতে লাগলুম। পরস্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করার খেসারতস্বরূপ তাকে কত টাকা দিতে হবে তারই একটা আন্দাজ করবার চেষ্টা করছিলুম, এমন সময় জনার্দন বললে, বাবা, প্রেম করেছ কি খেসারত দিতে হয়েছে। “দেখলে না, নিজের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করে সম্রাট শাজাহানকে ন’ কোটি সতেরো লক্ষ টাকা দিতে হয়েছিল, ও-লোকটা সে-তুলনায় আর কতই বা দেবে? যাই দিক, সস্তাতেই সেরেছে বলতে হবে।

রাত্রি বারোটার সময় হোটেলের একজন লোক এসে আমাদের নীচে ডেকে নিয়ে গেল পুলিসের লোক এসেছে বলে। তাদের খাতায় নাম ধাম প্রভৃতি লিখিয়ে ওপরে উঠে একবার উঁকি দিয়ে সেই ঘরখানা দেখলুম–ভোঁ-ভোঁ, কেউ কোথাও নেই। একটু এগিয়ে দেখলুম, ও-ঘরখানাও ফাঁকা–

ভবিষ্যতে আবার কোন্ নাটক সেখানে অভিনীত হবে কে জানে!

.

এইখানে আগ্রা সম্বন্ধে কিছু বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। শুধু আগ্রা নয়, দিল্লি সম্বন্ধেও বলি। আগ্রা শহরে তাজমহল, ইমদউদ্দৌল্লা, সেকেন্দ্রা, কেল্লা এবং আগ্রার কাছেই ফতেপুর-সিক্রি প্রভৃতি দ্রষ্টব্য ঐতিহাসিক স্থানগুলি আছে। দিল্লিতেও কুতকমিনার, হিন্দু পাঠান ও মুগল যুগের কেল্লা, প্রাসাদ, বিখ্যাত ও কুখ্যাত অনেক বাদশার কবর প্রভৃতি দ্রষ্টব্য স্থান আছে। এই দুটি শহরের মাঝামাঝি জায়গায় হিন্দুদের অতি পবিত্র তীর্থ মথুরা ও বৃন্দাবন। এইসবের আকর্ষণে বছরের প্রায় সব সময়েই এই দুই শহরে যাত্রীর ভিড় হয় খুব বেশি। শুধু ভারতবর্ষেরই নানা জায়গা থেকে যে এখানে লোক আসে তা নয়, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে যাত্রী আসে সেইসব দেখতে। এই যাত্রীদের দোহন এবং শোষণ করে এখানে শত শত লোক জীবিকা উপার্জন করে থাকে। একদল লোক আছে, যারা গাইডের কাজ করে। লাইসেন্সধারী গাইড, যারা ঐতিহাসিক স্থানগুলির ইতিহাস, কিংবদন্তি প্রভৃতি বলে–এরা তারা নয়। এরা যাত্রীদের সঙ্গে গায়ে-পড়ে ভিড়ে যায়, তারপরে তাদের গাড়ি ভাড়া করে দেওয়া থেকে আরম্ভ করে জিনিস কেনা, সঙ্গে সঙ্গে ঘোরা ইত্যাদি সব-তাতেই কমিশন মারে। এদের ফী কিছু নির্দিষ্ট নেই–চার আনা থেকে চার-শো টাকা, যার কাছ থেকে যেমন আদায় করা যেতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় যে, কার কতখানি দেবার শক্তি আছে তা লোক দেখলেই তারা ধরতে পারে–এতই বিচক্ষণ তারা। স্টেশনে ও স্টেশনের আশেপাশে এরা ঘোরে। যাত্রী নামলেই গায়ে পড়ে মুটে ঠিক করে দেয়, গাড়ি ঠিক করে দেয়, তারপর সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে আসে। তাজে যাও আর ফতেপুর-সিক্রিতেই যাও, সঙ্গে আঠার মতন লেপটে থাকবে। কোনো জিনিস কেনবার উপায় নেই–ঠিক এসে উপস্থিত। তাড়ালে যায় না, গালাগালি দিলে জবাব দেয় না, শেষকালে যাত্রীরা তাকে মেনেই নেয়। সর্বত্র সে কমিশন তো মারেই, যাবার সময় যাত্রীরা কিছু দিয়ে যায়। প্রায় অধিকাংশ যাত্রীরই এদের সম্বন্ধে কিছু-না-কিছু অভিজ্ঞতা আছে।

আগে যে হোটেলের কথা বলেছি, এইরকম অনেকগুলি হোটেল এইসব যাত্রীদের অবলম্বন করেই তখন বেঁচে ছিল। তা ছাড়া আগ্রায় নরম পাথর ও শ্বেতপাথরের কাজ হয় খুব ভালো। সেখানকার শতরঞ্চিও বিখ্যাত– যাত্রীদের দৌলতেই এইসব শিল্প এখনও টিকে আছে।

আমি যে-সময়ের কথা বলছি, তখন প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধও মানুষের কল্পনার অতীত ছিল। তারপরে অনেক কাল অতীত হয়েছে, ভারতবর্ষও স্বাধীন হয়েছে। আশা করি, সেখানকার অবস্থা এখন অনেক উন্নত হয়েছে।

তারপর, সেইসব হোটেলে মানুষকে ফাঁদে ফেলে বেশ মোটা-রকমের কিছু আদায় করবার যে কত রকমের ব্যবস্থা ছিল তার আর ঠিকানা নেই। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য–মানুষের এই ষড়রিপুকেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উপায়স্বরূপ কাজে লাগিয়ে কিছু উপার্জন করে নেবার যে অসামান্য কৌশল তারা প্রয়োগ করত, তাতে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। হোটেলের মালিকদেরও তার মধ্যে নিশ্চয় যোগসাজশ থাকত, তা ছাড়া ধর্মাধিকরণেরাও কি এ-বিষয়ে কিছুই জানতেন না?

সে-সময় এক শ্রেণীর লোক মাথায় শামলা চড়িয়ে একটা ছোট বাক্স নিয়ে রাস্তায় ও হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়াত। এরা কান দেখতে অর্থাৎ কানের ভেতর থেকে খোল বার করতে ওস্তাদ। রাস্তা দিয়ে হয়তো কোনো নতুন লোক চলেছে–বলা বাহুল্য, নবাগত দেখলেই এরা চিনতে পারে–তাকে ডেকে কোনো কথা বলবার অবকাশ না দিয়ে একেবারে তার কানটা টেনে ধরে ভেতরটা দেখেই শিউরে বলে উঠবে–আর বাস্ রে! কতদিন এরকম হয়েছে?

স্বভাবত লোকের কৌতূহল জাগে। যার জাগে না, সে-ব্যক্তি সে-যাত্রা বেঁচে গেল। নবাগত হয়তো বললে, কেন, কি হয়েছে আমার কানে?

–কি হয়েছে! দেখবে তবে?

তখুনি সে তার বাক্স খুলে নরুনের মতন চ্যাপ্টামুখো একটা যন্ত্র বার করে তার কানের মধ্যে সেটি সেঁধিয়ে দিয়ে এমন একটি তাল খোল বের করবে যা দেখলে যে-কোনো লোকের চক্ষু চড়কগাছে চড়বে। এর পর শুরু হবে দরদস্তুর। দরের কিছু ঠিক নেই, দু আনা থেকে পাঁচ টাকা, যাত্রীর দেবার ক্ষমতা ও লেকচার দিয়ে তার নেবার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে।

একবার আমরা পরীক্ষা করবার জন্যে একই দিনে পাঁচ-ছ’জনকে কান দেখিয়েছিলুম। সকলেই কানের ভেতর থেকে প্রতিবারেই ডেলা-ডেলা খোল বের করেছিল। এমন তাদের হাত-সাফাই, কি করে যে খোল বার করে তা আমরা চেষ্টা করেও ধরতে পারিনি।

আর একবারের কথা বলছি–আমাদের পরিতোষ বেচারির কান ছিল খারাপ। সে বলত, কানের ভেতরে দিনরাত কি-সব খটখট ঝনঝন করে। একবার আগ্রার একজন নাপিতকে ধরে বললুম, এর কানের মধ্যে কি হয়েছে দেখ তো–দিনরাত খটখট করে!

লোকটা অনেক কসরত করে দেখে-শুনে বললে, নল বসাতে হবে।

আমরা মনে করলুম, এদের সবরকমের জোচ্চুরিই ধরে ফেলেছি; কিন্তু কোথায়? এই নল বসাবার কথা ইতিপূর্বে আর শুনিনি। জিজ্ঞাসা করলুম, সেটা কিরকম?

সে বললে, কানের ভেতরে পোকা হয়েছে। নল বসিয়ে সেটাকে বার করে ফেলে দিতে হবে।

কথাটা আমরা বিশ্বাস না করলেও পরিতোষ আগ্রহসহকারে নল বসাতে রাজি হল। লোকটি বাক্স থেকে একটা সরু পেতলের নল তার কানে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ দিয়ে তাতে টান দিতে আরম্ভ করলে। তারপর মাথার পেছনদিকে বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে টিপে দেখে ঠিক কর্ণমূলের কাছে একজায়গায় পোকাটা যেন ধরা পড়েছে এইরকম অভিনয় করতে লাগল। তারপর মাথা টেপার পালা শেষ করে আবার নল মুখে দিয়ে টানতে আরম্ভ করলে। টেনে টেনে শেষকালে নলচে কান থেকে খুলে নিয়ে তার ভেতর থেকে ইয়া বড় একটা পোকা বের করলে। লোকটার হাত-সাফাই দেখে আমরা খুশি হয়ে তাকে আট আনা বখশিশ দিয়ে ফেললুম।

হোটেলে কিরকম যাত্রিবধ করে টাকা আদায় করা হত, তার কিছু নমুনা আগে দিয়েছি। এ ছাড়া আরও কতরকমে যে যাত্রিবধ করা হত, তা লিখতে গেলে শুধু সেই বিষয়েই একখানা বড় বই হয়ে যাবে। এইসব ছাড়া যাত্রীদের আশ্রয় করে সেখান ও আরও কত শিল্প গড়ে উঠেছিল, তার আর ঠিক-ঠিকানা নেই। তার মধ্যেও অনেকগুলি পুরোপুরি জোচ্চুরি না হলেও আধা-জোচ্চুরি বলা যেতে পারে।

দিল্লিকে এ-বিষয়ে আগ্রার দাদা বলা যেতে পারত। সৈয়দ বন্দর ও আলেকজান্দ্রিয়া শহরের এ-বিষয়ে খুব সুনাম আছে। দিল্লি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে কি না বলতে পারি না, তবে ভারতবর্ষের অন্য কোনো শহরই দিল্লির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারত না। এই সম্পর্কে একটা গল্প চলতি আছে-অনেকে উপভোগ করবেন বলে এখানে উল্লেখ করছি।

বোম্বাই শহরের একজন নামজাদা পকেটমার সেখানে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসায়ে সুবিধা হবে ভেবে দিল্লিতে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই তাকে আবার স্বস্থানে ফিরে আসতে দেখে সমব্যবসায়ীরা জিজ্ঞাসা করলে, কি হে, কি হল? ফিরে এলে যে? লোকটি বললে, সেখানে কিছু সুবিধা করতে পারলুম না। আমাদের মতো এলেমের লোক সেখানে পথে ঝাড়ু দেয়। সেখানকার গাঁটকাটা, পকেটমার ও জোচ্চোরদের হাল-চালই আলাদা।

কথাটা শুনে বোম্বাইয়ের একজন বড় পকেটমারের অভিমানে আঘাত লাগল। সংবাদটির যাথার্থ্য পরীক্ষা করবার জন্যে সেইদিনই সে দিল্লি রওনা হল। সেখানে পৌঁছে একদিন সন্ধের সময় সে ট্যাকে একখানা একশো টাকার নোট গুঁজে চাঁদনীচকের অলিগলি, চৌরিবাজারের অন্ধিসন্ধি জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। গাঁটকাটাদের সুবিধা দেবার জন্যে কোনো জায়গায় সে আতর কিনলে, কোথাও বা পান কিনে খেলে, কিন্তু সর্বদা সতর্ক হয়ে রইল গাঁটটি না কাটা যায়। রাত্রি দশটা-এগারোটা অবধি ঘুরে যখন দেখলে ট্যাকের নোট ট্যাকেই আছে তখন তার মনে হল, এই তো দিল্লির গাঁটকাটাদের ক্ষমতা–দূর থেকে অতি নগণ্য জিনিসেরও প্রশংসা শুনতে পাওয়া যায়। যা হোক, বাড়ি ফেরবার মুখে সে একটা বড় পানশরবতের দোকানে বসে শরবত খাচ্ছে এমন সময় পানওয়ালা তাকে জিজ্ঞাসা করলে, কি ভাই, বোম্বাইয়ের খবর কি? সেখানে আজকাল ব্যবসাপত্র কেমন চলে? অমুক খলিফা কি এখনও বেঁচে আছেন, না, দেহরক্ষা করেছেন?

পানওয়ালার কথাবার্তা শুনে বোম্বাইয়ের লোকটি বেশ বুঝতে পারলে যে, সে তারই সমধৰ্মী। তখন বেশ খোলাখুলিভাবেই কথাবার্তা আরম্ভ হল। কিন্তু আলাপ-পরিচয় ও উভয়পক্ষে আপ্যায়নের পর বোম্বাইয়ের লোকটি বলে, ভাইসাহেব, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি–যদি কিছু মনে না কর।

দিল্লিওয়ালা বললে, সে কি! তুমি মেহমান–স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা কর।

বোম্বাইয়ের লোকটি বললে, বোম্বাইয়ে দিল্লির খুব নামডাক শুনেছিলুম। তিন-চার ঘণ্টা ধরে রাস্তায় ঘুরছি, কিন্তু একটা চড়ুইপাখির ঠোকরও তো বুঝতে পারলুম না।

এবার দিল্লিওয়ালা বললে, ভাইসাহেব, কিছু না মনে কর তো বলি।

–হাঁ হাঁ, নিশ্চয় বলবে ভয় কিসের?

দিল্লিওয়ালা বললে, ট্যাকে জাল একশো টাকার নোট নিয়ে ঘুরলে ঠোকর বুঝতে পারবে কি করে?

বোম্বাইয়ের পকেটমার সেই রাত্রেই দিল্লির ওস্তাদের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে।

দিল্লি শহর এখনও সেইরকম আছে–এ কথা যেন কেউ না মনে করেন। এসব আমরা স্বাধীনতা পাবার পূর্বের ইতিহাস। এখন দিল্লি আমাদের ভারতরাষ্ট্রের রাজধানী–সেখানকার চক ও চৌরিবাজার চৌরস হয়ে গেছে। সেখানকার জোচ্চোরেরা কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে রাষ্ট্রের নানা বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে।

কিন্তু এই জোচ্চোরদের ব্যূহ ভেদ করে একটু ঝাড়া-হাত-পা হয়েই বুঝতে পারলুম, আগ্রা নেহাত খারাপ জায়গা নয়। প্রথমত এখানে খুব সস্তায় জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যায়। ইতিপূর্বে কাশীতে জিনিসপত্র খুবই সস্তা মনে হয়েছিল; কিন্তু দেখলুম, আগ্রায় সেখানকার চেয়েও সস্তায় জিনিস পাওয়া যায়। যদিও কাশী অথবা কলকাতার মতন এতরকমের তরি-তরকারি সেখানে পাওয়া যায় না, কিন্তু যা পাওয়া যায় তা জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট এবং তা অত্যন্ত সস্তা। মোট কথা, মাসে দশ-বারো টাকায় একজন লোক বেশ ভদ্রভাবেই সেখানে বাস করতে পারে। তবে এই দশ-বারো টাকা উপায় করবার রাস্তা সেখানে খুবই কম–এমনকি, একরকম নেই বললেই চলে। হয়তো একটা উপায় ভবিষ্যতে হবেই এই আশায় আমরা স্থির করলুম, আগ্রাতেই থেকে যাব। আগ্রাতে আর একটা মস্ত সুবিধা ছিল এই যে, সে-সময় সেখানে অল্পসংখ্যক বাঙালি বাস করতেন। আর কিছু না হোক, দেখা হলেই কোথায় বাড়ি, বয়স কত, কেন বাড়ি থেকে পালালে–ইত্যাদি জেরার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

হোটেলে দিন দশ-বারো কাটাবার পর, সেখানে প্রত্যহ চার আনা করে দেওয়ার চেয়ে একটা বাড়ি ভাড়া করাই ঠিক করা গেল। অনেক খুঁজে-পেতে একটা বাড়ি ঠিক হল। বেশ খোলামেলা, একতলা-দোতলায় সর্বসমেত চার-পাঁচখানা ঘর–মাসিক ভাড়া পাঁচ টাকা। সেখানে আবার শহরের মধ্যে খোলামেলা বাড়ি পাওয়া মুশকিল। সরু সরু গলির মধ্যে খোলা বাড়ি তৈরি করাই যায় না। যা হোক, একদিকে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা চলতে লাগল, অন্য দিকে আমরা বিছানা বালিশ প্রভৃতি তৈরি করাতে লাগলুম।

সেদিন আগ্রায় ছিল জলের উৎসব। এ ধরনের উৎসব বাংলাদেশে তো নেই-ই, অন্য কোথাও আছে কি না জানি না। দলে দলে লোক নানারকমের ভেলা, বড় বড় ধোপার গামলা, কেউ-বা মশককে কি করে ফুলিয়ে তার ওপরে ঘোড়ার মতন চড়ে যমুনার স্রোতে ভেসে যায়। কত লোক নানারকমের অঙ্গভঙ্গি করতে করতে, কেউ-বা সারেঙ্গী বাজাতে বাজাতে অদ্ভুত ভেলায় চড়ে শনশন করে ভেসে চলেছে–দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে সময় কেটে যায়! এই খেলা দেখবার জন্যে যমুনার দুই তীরে অসংখ্য লোকের ভিড় লাগে। বেলা দুটো-আড়াইটে থেকে আরম্ভ করে সন্ধে অবধি খেলা চলতে থাকে।

আমরা তাজমহলের চত্বরে দাঁড়িয়ে এই তামাশা দেখছিলুম। সেখানে আরও অনেক হিন্দু-মুসলমান মেয়ে-পুরুষ দাঁড়িয়ে সেই জলকলি দেখছিল। কেউ হাসছে, কেউ হাততালি দিচ্ছে কেউ কথা বলছে, আমরাও মাতৃভাষায় নানারকম মন্তব্য করেছি। হঠাৎ একটি লোক–এতক্ষণ সে আশপাশের লোকের সঙ্গে খুব কথা বলছিল, হাসি-ঠাট্টা করছিল–বাংলা কথা শুনে হাঁ করে আমাদের দিকে চাইতে লাগল। লোকটির পরনে চু পা-জামা, অঙ্গে সুতির ‘শেরওয়ানি, মাথায় গোল ফেটের টুপি অর্থাৎ হিন্দু-টুপি–বয়স তার পঁচিশের মধ্যে হবে, তবে বেশ হৃষ্টপুষ্ট বলে দু-এক বছর বেশি দেখায়। সরু একজোড়া গোঁফ, বেশ পরিপাটি করে ছাঁটা। ভদ্রলোকই আগে কথা বললেন, তোমার বাঙালি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি?

–আমিও বাঙালি, ব্রাহ্মণ-সন্তান। আমার নাম পরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

বললুম, আপনাকে দেখে তো বাঙালি বলে মনে হয় না! তার ওপরে যা পোশাক পরেছেন- ভদ্রলোক বললেন, বাড়িতে ও অন্য কোথাও যেতে হলে ধুতিই ব্যবহার করি, তবে আপিসের বেলায় এ-দেশের পোশাকই পরতে হয়।

জিজ্ঞাসা করলুম, এখানে চাকরি করেন বুঝি?

–হ্যাঁ, এখানকার আদালতে কাজ করি। আসলে আমার চাকরিস্থল দিল্লি–এখানে একজন ছুটি নেওয়ায় আসতে হয়েছে। তবে ছুটি ফুরিয়ে গেলে আমিও দিল্লি ফিরে যাব।

আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নামটি কি ভাই?

নাম বললুম। একবার বুঝতে পারলেন না, আবার বলতে হল। ভদ্রলোক বললেন, বেড়ে নামটি তো তোমার!

বন্ধুরাও নাম বললে। ভদ্রলোক কোনোরকম ভণিতা না করে একেবারে সোজা প্রশ্ন করলেন, বাড়ি থেকে কতদিন পালিয়েছ?

আমরাও সোজা উত্তর দিলুম, এই দিন-পনেরো হবে।

যমুনার তীর থেকে সরে এসে একটা নির্জন জায়গা দেখে গোল হয়ে বসে যাওয়া গেল। বিড়ি ও সিগারেট আদান-প্রদান হতে লাগল। ভদ্রলোক বললেন, তোমাদের চেয়েও আমি যখন ছোট ছিলুম, তখন একবার ভাই বাড়ি থেকে পালিয়েছিলুম।

সুকান্ত বললে, তা হলে আমরা তো একই গোত্রের লোক বলতে হবে।

পরেশচন্দ্র হেসে বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আর একই গোত্রের যখন, তখন আর আমাকে ‘আপনি’ বলো না।

বললুম, বেশ। আপনি আমাদের দাদা।

পরেশচন্দ্র বললে, বেশ বেশ, খুব ভালো কথা। তারপরে ভাই শোন, পালিয়ে গিয়েছিলুম গয়া, গয়া থেকে রাজগীর। বাস, ওই পর্যন্ত।

–আপনার বাড়ি কোথায়?

–বাড়ি তো বাংলাদেশের চব্বিশ পরগনার কোন এক গ্রামে ছিল। কিন্তু আমার প্রপিতামহ ইংরেজ গভর্মেন্টের কমিশারিয়েটে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন। তারপরে আমরা আম্বালা, সাহারানপুর, মীরাট প্রভৃতি জায়গায় থেকেছি। শুনেছি, আম্বালায় আমাদের বাড়িঘরও ছিল। আমার ঠাকুরদাদা দিল্লিতে বাড়ি করেছিলেন।

জিজ্ঞাসা করলুম, তা হলে দিল্লিতেই বাড়ি?

হ্যাঁ, দিল্লিতে বাড়ি ছিল বলতে পার। সেখানেই জন্মেছি। লেখাপড়া কিছুই শিখিনি তবু এনট্রেন্স ওইখানে থেকেই পাস করেছি। দাদুর দরুন বাড়িখানা ছিল, তা বাবুজী অর্থাৎ বাবা বেচে মেরে দিলেন। তিনি সারাজীবন বসে বসে খেতেন, কোনো কাজকর্ম করতেন না, শেষকালে মরবার সময় বাড়িখানা বেচে দিয়ে আমাকে আর মাকে একেবারে পথে বসিয়ে গেলেন।

এই অবধি বলে পরেশদা মনের দুঃখ হো-হো করে হেসে উড়িয়ে দিলে। তারপর একটালা বেশ জমিয়ে বিড়ি টেনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগল, বাংলাদেশের একরকম কিছুই জানি না বললেই হয়। বাবা মারা যাবার পর মাকে নিয়ে একবার বাড়ির গাঁয়ে গিয়েছিলুম, সে একেবারে অজ পাড়াগাঁ। মামারা কেউ নেই, এক মামি থাকেন সেখানে ছেলেপিলে নিয়ে। তা তিনি নিজেই খেতে পান না তো আমাদের খাওয়াবেন কি! দিনকতক সেখানে থেকে আবার দিল্লিতে ফিরে আসতে হল।

একটু চুপ করে থেকে পরেশদা বললে, তারপর, আমি তো নিজের কথাই বলে যাচ্ছি, এবার তোমাদের কথা শুনি। তোমরা এরকম দল বেঁধে পালালে কেন? কি মতলব তোমাদের? দেশ-দেখা?

বললুম, আমাদের উদ্দেশ্য কাজকর্ম জুটিয়ে নিজেদের উন্নতি করা। বাড়ি ভালো লাগে না, বাড়ির তাঁবেও থাকতে ইচ্ছা করে না, পড়াশুনো করতেও ভালো লাগে না।

আমার কথা শুনে পরেশদা উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন। বললেন, বলো কি ভায়া! বাড়ি ভালো লাগে না, পড়াশুনো করতে ভালো লাগে না তো জীবনে উন্নতি করবে কি করে? বাড়ি ভালো লাগে না কেন?

এ প্রশ্নের আর কি উত্তর দেব–চেপে যাওয়াই সমীচীন বোধ করলুম। পরেশদা বলতে লাগল, আমি কিন্তু ভাই বাড়িকে বড্ড ভালোবাসি। বাড়ি বলতে এক মা–মাকে ছেড়ে এই বুড়ো বয়সেও আমি কোথাও থাকতে পারি না।

বলতে বলতে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললে, এবার বোধ হয় মাকে একেবারেই ছাড়তে হবে।

জিজ্ঞাসা করলুম, কেন দাদা?

–মা’র শরীর খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। আর কাজকর্ম করতে পারেন না বললেই হয়। পরেশদার সঙ্গে আরও অনেক কথা হল। কথায়-বার্তায় একবার বুক ঠুকে জিজ্ঞাসা করে ফেলা গেল, আমাদের কোনো চাকরি-বাকরি জুটিয়ে দিতে পার কি না?

বেশ খানিকক্ষণ ভেবে. পরেশদা বললে, দেখ, আগ্রা তো আমার জানাশোনা জায়গা নয়–তবে তোমরা যদি আমার সঙ্গে দিল্লি যাও তা হলে নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু একসঙ্গেই তিনজনের পারব না–এক-একজন করে। তা মাস ছয়েকের মধ্যে তিনজনেরই হিল্লে করে দিতে পারি বোধ হয়।।

পরেশদাকে বললুম, আমরা তোমার সঙ্গে দিল্লিই যাব।

পরেশদা বলতে লাগল, একটা কথা তোমাদের আগে থাকতেই জানিয়ে রাখা ভালো বলে মনে হচ্ছে। তোমাদের চাকরি জোটবার আগেই মা যদি মারা যান, তা হলে তোমাদের জন্যে কিছু করা বোধ হয় আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। কারণ মা মারা যাবার পর আমাকেই হয়তো সব ছেড়ে-ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে।

পরেশদার কথাগুলো কিছু রহস্যময় শোনালেও ও-বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে তখনকার মতন চেপেই গেলুম। জিজ্ঞাসা করলুম, তিনি আর কতদিন আগ্রায় থাকবেন? পরেশদা বললে ছ’-মাসের প্রায় সাড়ে চার মাস কেটে গেছে–এখনও বুঝতে পারছি না কিছু। শুনছি, সে-লোকটা নাকি ছুটি বাড়াবার জন্যে লিখেছে। দেখা যাক, কয়েকদিনের মধ্যেই টের পেয়ে যাব। আমার মনে হচ্ছে, শীতটা পুরোই এখানে কাটাতে হবে।

সেইখানে বসেই ঠিক করে ফেলা গেল যে, পরেশদা যে-ক’দিন আগ্রাতে থাকবে, আমরাও সে-ক’দিন এখানে থেকে তার পরে তার সঙ্গে দিল্লি চলে যাব।

পরেশদা বললে, চল ভাই, এবার ফেরা যাক, সন্ধে হয়ে এল।

উঠে পড়া গেল। অস্তমান সূর্যের প্রভায় রঞ্জিত পশ্চিম-দিগন্তের মতন আমাদের মানসাকাশেও বিচিত্র রঙের খেলা শুরু হয়ে গেল। পরম উৎসাহে হোটেলের দিকে এগিয়ে চললুম।

পরেশদা আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হোটেলে একেবারে আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত হল। আমরা দৈনিক চার আনা করে ঘর ভাড়া দিচ্ছি শুনে সে বললে, বাবা, এরা তো একেবারে ডাকাত দেখছি!

সে হোটেলের একটা চাকরকে ডেকে বললে, তোমাদের ম্যানেজারকে একবার ডেকে দাও তো।

কিছুক্ষণ পরে হোটেলের একজন লোক আসতেই পরেশদা বললে, দেখ, বাবুরা কতদিন এখানে আছে তার একটা বিল তৈরি করে নিয়ে এস–আমরা এখুনি চলে যাব।

বহুৎ আচ্ছা।–বলে লোকটি চলে যেতেই পরেশদা বললে, চল আমাদের বাড়ি। এখানে এই চোর-জোচ্চর-ডাকাতদের মধ্যে থাকতে আছে! কখন কি ফ্যাসাদে পড়বে আর মারা যাবে। ইতিমধ্যে হোটেলওয়ালা দশ দিনের ঘর-ভাড়ার বিল নিয়ে এসে উপস্থিত হতেই পরেশদা ব্যাগ খুঁলে তাকে টাকা দিতে যাচ্ছিল, আমরা বাধা দিয়ে নিজেদের তবিল থেকে তাদের প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়ে ধুতি কম্বল বালিশ প্রভৃতি নিয়ে পরেশদার বাড়ির দিকে রওনা হলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *