ফিলিস্তীনে আসব আমি
খৃস্টানদের চোখে ধূলি দিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী দুর্গ অবরোধ করে ফেললেন। খৃস্টানরা যখন টের পেল, ততক্ষণে সুলতান আইউবী কার্ক অবরোধ করে ফেলেছেন। কিন্তু সেই অবরোধ ছিল অসম্পূর্ণ- ত্রিমুখী। গুপ্তচররা সুলতান আইউবীকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, তিনি আগেভাগেই কার্ক শহরে যে কমান্ডোদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারা ভেতর থেকে দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলবে। কিন্তু অবরোধের চতুর্থ দিন ভেতর থেকে এসে দূত সুলতানকে সংবাদ দিল যে, আপনার প্রেরিত কমান্ডো বাহিনী এবং কয়েকজন স্থানীয় মুসলিম নাগরিক কার্কের প্রাচীর ভাঙ্গতে গিয়ে শহীদ হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন মুসলিম মেয়েও রয়েছে। আছে একটি খৃস্টান মেয়েও। সুলতান আইউবী এ তথ্যও পেলেন যে, কে একজন ঈমান-বিক্রেতা নামধারী মুসলমান আপনবেশে কমান্ডোদের দলে ভিড়ে তথ্য নিয়ে খৃস্টানদের কাছে ফাঁস করে দেয়। ফলে খৃস্টানরা অভিযানের প্রাক্কালে ওঁৎ পেতে দলের সব কজন সদস্যকে হত্যা করে ফেলে। সুলতান আইউবীকে এ সংবাদও প্রদান করা হয় যে, এখন ভেতর থেকে প্রাচীর ভাঙ্গার আর কোন আশা নেই।
খৃস্টানরা দেখতে পেল, প্রাচীর ভাঙ্গার অভিযানে নিহতরা কার্কের-ই মুসলিম যুবক-যুবতী। সেই সূত্র ধরে তারা গণহারে মুসলমানদের ধর-পাকড় শুরু করে দেয়। মুসলিম মহিলারাও তাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়নি। যুবকদেরকে ধরে ধরে বেগার ক্যাম্পে নিক্ষেপ করে। বৃদ্ধদেরকে নিজ নিজ ঘরে এবং যুবতী মেয়েদেরকে দুর্গের সামরিক ব্যারাকে বন্দী করে রাখে। খৃস্টানদের হাতে বন্দী হয়ে কতিপয় মেয়ে আত্মহত্যাও করে ফেলে। কারণ, কাফেররা তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, তা তাদের জানা ছিল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীও ধারণা করলেন যে, এর জন্য কার্কের মুসলমানদের চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হবে। জানবাজদের সংবাদ শুনে তিনি তার নায়েবদের উদ্দেশে বললেন
এটা একজন ঈমান-বিক্রেতার গাদ্দারীর ফল। একজন মাত্র গাদ্দার ইসলামের এত বিশাল একটি বাহিনীকে ব্যর্থ করে দিল। কেউ আল্লাহর নামেনিজের জান কোরবান করছে, আবার কেউ নিজের অমূল্য ঈমানটা কাফেরদের পায়ে উৎসর্গ করছে। গাদ্দাররা ইসলামের ইতিহাসের ধারাই পাল্টে দিচ্ছে…!
বলতে বলতে সুলতান ক্ষুব্ধ হয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ান এবং প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বললেন, অতি শীঘ্রই আমি কার্ক জয় করব এবং ঐ গাদ্দারদের উপযুক্ত শাস্তি দেব।
সুলতান আইউবীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের অফিসার জাহেদান কক্ষে প্রবেশ করেন। সুলতান তখন বলছিলেন
আজ রাতেই অবরোধ সম্পূর্ণ হওয়া চাই। কার্কের পেছন দিকে কোন্ বাহিনীকে পাঠাবে, একটু পরেই আমি তা জানাব।
ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য ক্ষমা চাই মহামান্য আমীরে মেসের- জাহেদান বললেন- বোধ হয় এখন আর আপনি অবরোধ পরিপূর্ণ করতে পারবেন না। আমরা সময় নষ্ট করে ফেলেছি।
তুমি কি নতুন কোন সংবাদ নিয়ে এসেছ? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।
দুশমনকে অসচেতন রেখে যেরূপ সফলতার সাথে অগ্রসর হয়েছিলেন, তার পূর্ণ সাফল্য আপনি উঠাতে পারলেন না- জাহেদান জবাব দেন।
তিনি এমন অবলীলায় কথা বলছিলেন, যেন নিম্নপদস্থ অধীন কাউকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। এমনটা হবেই-বা না কেন। সুলতান তার সব সিনিয়র-জুনিয়র কমান্ডার ও প্রশাসনের সব বিভাগের কর্মকর্তাদের স্পষ্ট বলে রেখেছেন যে, তারা যেন তাকে রাজা ভেবে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম না করে। সাহসিকতা ও পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে পরামর্শ দেয় এবং খোলাখুলি সমালোচনা করে। জাহেদান সুলতানের সেই নির্দেশনার উপরই আমল করছিলেন। তাছাড়া তিনি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানও বটে। তিনি এমন একটি চোখ, যে চোখ অন্ধকারেও দেখে। তিনি এমন একটি কান, যে কান শত শত মাইল দূরের ফিসফিস কানাঘুষাও শুনতে পায়। তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তা সম্পূর্ণ অবগত। সুলতান জানেন, সফল গুপ্তচরবৃত্তি ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। বিশেষত খৃস্টানরা যেখানে সালতানাতে ইসলামিয়ায় গুপ্তচর ও নাশকতাকারীদের জাল বিছিয়ে রেখেছে, সেখানে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অতিশয় উন্নত, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ একটি গোয়েন্দা বাহিনীর একান্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ সফল। তার গোয়েন্দা বিভাগের তিনজন অফিসার আলী বিন সুফিয়ান, তাঁর দুনায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহ ও জাহেদান হলেন জানবাজ গুপ্তচর। বিচক্ষণতার সাথে তারা খৃস্টানদের বহু পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
আপনার তো জানা ছিল যে, খৃস্টানরা কার্কের প্রতিরক্ষা শক্ত করার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সৈন্য কার্ক থেকে খানিক দূরে প্রস্তুত করে রেখেছে জাহেদান বললেন- আপনাকে এ তথ্যও দেয়া হয়েছিল, এই বাহিনীটিকে বাইরে থেকে অবরোধ ভাঙ্গার কাজে ব্যবহার করা হবে। আমার গুপ্তচরদের তথ্যাদি দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, খৃস্টানরা দুর্গের বাইরে লড়াই করবে। তারপরও আপনি সঙ্গে সঙ্গে অবরোধ পরিপূর্ণ করেননি। তা থেকে দুমশন উপকৃত হয়েছে।
তা তারা কি আক্রমণ করে ফেলেছে? বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।
আজ সন্ধ্যা নাগাদ তাদের বাহিনী সেই স্থান পর্যন্ত এসে পৌঁছবে, যেখানে আমাদের কোন সৈন্য নেই- জাহেদান জবাব দেন- আমার গুপ্তচররা যেসব তথ্য নিয়ে এসেছে, তার সারমর্ম হল, খৃস্টান বাহিনী থাকবে অশ্বারোহী ও উজ্জ্বারোহী। এ অভিযানে তাদের পদাতিক বাহিনী থাকবে কম। তারা আমাদের অবরোধের স্থানগুলোতে এসে পৌঁছবে এবং ডানে-বাঁয়ে হামলা করবে। তার ফল এছাড়া আর কী হবে যে, আমাদের অবরোধ ভেঙ্গে যাবে? খৃস্টানরা সংখ্যায় বিপুল বলেও সংবাদ পেয়েছি।
আমি তোমাকে আর তোমার সেইসব গোয়েন্দাদের ধন্যবাদ জানাই, যারা এসব তথ্য সংগ্রহ করে এনেছে- সুলতান আইউবী বললেন- এটা কত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, আমি তা বুঝি। তবে আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, যেসব খৃস্টান সৈন্য আমাদের অবরোধ ভাঙ্গতে এবং শূন্যস্থান পূরণ করতে আসছে, আমি তাদেরকে সেই শূন্যস্থানেই খুইয়ে ফেলব। আল্লাহর সাহায্যের উপর আমার ভরসা আছে। তোমাদের কেউ যদি গাদ্দার না হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়দান করবেন।
এখনো সময় আছে- এক নায়েব বললেন- আপনার আদেশ পেলে আমরা এক্ষুণি তিন-চারটি ইউনিট পাঠিয়ে দিচ্ছি এবং অবরোধের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে ফেলছি। এতে খৃস্টানদের হামলা ব্যর্থ হবে ইনশাআল্লাহ।
সুলতান আইউবীর চেহারায় অস্থিরতার সামান্য ছাপও নেই। তিনি জাহেদানকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার রিপোর্ট যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে কি তুমি বলতে পারবে যে, খৃস্টানরা ঠিক কোন্ সময়টিতে আক্রমণের স্থানে পৌঁছবে?
তাদের অগ্রযাত্রা বেশ দ্রুত- জাহেদান জবাব দেন- তবুও রসদ তাদের সঙ্গে আসছে না; আসছে তাদের পেছনে। এতে বুঝা যাচ্ছে, পথে তারা কোথাও বিরতি দেবে না। যদি তারা এ গতিতেই অবিরাম এগুতে থাকে, তাহলে দুপুররাত নাগাদ তারা হামলার স্থলে পৌঁছে যাবে।
আল্লাহ রহম করুন, যেন তারা পথে কোথাও না থামে- সুলতান আইউবী বললেন- কিন্তু তারা এসেই তো আর ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত উট-ঘোড়া নিয়ে হামলা করবে না। হামলার স্থানে এসে তারা পশুদেরকে দানা-পানি গ্রহণ ও বিশ্রামের সুযোগ দেবে। এই অবসরে তারা দেখে নেবে যে, আমাদের অবরোধে কোন ফাঁক-ফোকড় আছে কিনা। খৃস্টানরা এত নির্বোধ নয় যে, পরিবেশ-পরিস্থিতি না বুঝেই হামলা করে বসবে।
সুলতান আইউবী তার দুতিনজন কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠালেন। তাদেরকে নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে বললেন
খৃস্টানরা আমাদের ফাঁদে এগিয়ে আসছে। দুর্গের পেছন দিকে আমরা যে স্থানটুকু অবরোধের বাইরে রেখেছি, তা আরো সম্প্রসারিত করে দাও। ডান ও বামের বাহিনীকে জানিয়ে দাও যে, তোমাদের পেছন থেকে হামলা আসছে। পার্শ্ব বাহিনীকে আমাদের মধ্যস্থলে এসে পড়ার সুযোগ করে দাও। খবরদার, কোন তীরন্দাজ আদেশ ছাড়া যেন তীর না ছুঁড়ে।
এসব দিক-নির্দেশনা প্রদান করে সুলতান আইউবী নিজের স্পেশাল পদাতিক ও অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনীকে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে সেই স্থানে পৌঁছে যাওয়ার আদেশ দেন, যা খৃস্টানদের সম্ভাব্য আক্রমণের নিকটবর্তী : জায়গা। এলাকাটা না সমতল, না বালুকাময়। এলাকার কোথাও টিলা, কোথাও বড় বড় পাথর খণ্ড, কোথাও গুহা। সুলতান আইউবী কমান্ডো বাহিনীর কমান্ডারকেও ডেকে আনান। তার উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন যে, খৃস্টান ফৌজের পেছনে অমুক পথে তাদের রসদ আসছে। সেই রসদের বহর রাতেই পথে ধ্বংস করতে হবে। এ জাতীয় আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে সুলতান আইউবী তাঁবু থেকে বেরিয়ে যান এবং ঘোড়ায় চড়ে বসেন। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে সঙ্গে করে সুলতান রণাঙ্গন অভিমুখে রওনা হয়ে যান।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আবেগপ্রবণ মানুষ নন। তিনি দূর থেকে অবরোধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন এবং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বললেন, খৃস্টানদের হাত থেকে এই দুর্গ ছিনিয়ে আনা সহজ নয়। অবরোধ দীর্ঘসময় পর্যন্ত বহাল রাখতে হবে। সুলতান দেখলেন যে, দুর্গের সামনের প্রাচীর থেকে বৃষ্টির মত তীরবর্ষণ হচ্ছে। দুর্গের ফটক পর্যন্ত পৌঁছা অসম্ভব। তার বাহিনীর অবস্থান তীরের আওতার বাইরে। কাজেই জবাবী তীরন্দাজী অনর্থক। সুলতান আইউবী দুর্গের সম্মুখ থেকে এক পার্শ্বের দিকে চলে যান। সেখানে তিনি বিস্ময়কর এক দৃশ্য দেখতে পান। তার বাহিনীর একটি ইউনিট বৃষ্টির ন্যায় দুর্গের প্রাচীরের উপর তীর নিক্ষেপ করছে। অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছে ছয়টি মিনজানিক। প্রাচীরের উপর যেখানে তীর ও অগ্নিগোলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, সেখানে কোন খৃস্টান সেনা চোখে পড়ছে না। তারা পেছনে সরে গেছে। সুলতান আইউবী দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা অবলোকন করছেন। এ সময়ে তার বাহিনীর চল্লিশজন সৈনিক হাতে বর্শা ও কোদাল তুলে নিয়ে দ্রুতগতিতে প্রাচীরের দিকে ছুটে যায়। তারা প্রাচীরের সন্নিকটে পৌঁছে যায়। দুর্গের প্রাচীর পাথর ও মাটি দ্বারা নির্মিত। তারা প্রাচীর ভাঙ্গতে শুরু করে। প্রাচীরের উপরে তীর ও আগুনের গোলাবর্ষণ এ জন্যই চলছিল যে, যাতে প্রাচীর ভাঙ্গার সময় দুশমন উপর থেকে তীর ছুঁড়তে না পারে।
সুলতান আইউবীর মুখ থেকে অলক্ষ্যে বেরিয়ে আসে শাবাশ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠেন তিনি। দুর্গের প্রাচীরের উপর হট্টগোলের শব্দ শুনতে পান। সুলতানের জানবাজরা যে স্থানে প্রাচীর ভাঙ্গছিল, ঠিক তার সোজা প্রাচীরের উপর হঠাৎ বেশকিছু খৃস্টান সৈন্যের মাথা ও কাঁধ আত্মপ্রকাশ করে। পরপরই বড় বড় বালতি ও ড্রাম চোখে পড়ে। প্রাচীরের অপর দিক থেকে মাথা জাগিয়েই খৃস্টান সৈন্যরা বালতি ও ড্রামগুলো প্রাচীরের উপর দিয়ে বাইরের দিকে উল্টিয়ে ফেলে দেয়। সেগুলো থেকে জ্বলন্ত কাঠ ও অঙ্গার বেরিয়ে আসে। এগুলো নীচে প্রাচীর ভাঙ্গার কাজে রত মুজাহিদদের উপর নিক্ষিপ্ত হয়। দূরের মুজাহিদরা সামনে এগিয়ে গিয়ে তীর ছুঁড়তে শুরু করে। তাদের তীরের আঘাতে বেশকিছু খৃস্টান সেনা ঘায়েল হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীরের অন্য একদিক থেকে অনেকগুলো তীর মুজাহিদদের দিকে ধেয়ে আসে। তাতে তীরন্দাজ মুজাহিদদের অনেকে আহত হয়, অনেকে শহীদ হয়ে যায়। তারপর উভয় দিক থেকে বৃষ্টির মত এত অধিক তীর আসতে শুরু করে যে, যেন শূন্যে তীরের জাল বোনা হচ্ছে। জানবাজদের প্রাচীর ভাঙ্গার কাজ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু কাজটি বেশ দুরূহ। প্রাচীরের উপর দিক অপেক্ষা নীচের দিকটা বেশী প্রশস্ত। তাদের গায়ে উপর থেকে তীর ছোঁড়া সম্ভব নয় বটে, কিন্তু তাদের উপর জ্বলন্ত কাঠ ও অঙ্গার নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। জ্বলন্ত কয়লাভরা বালতি ও ড্রাম নিক্ষেপকারী খৃস্টান সেনারা কেউ-ই বাহ্যত মুসলিম তীরান্দাজদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারা তীরের আঘাত খেয়ে নীচে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগেই বাইরের দিকে আগুন ফেলে দিচ্ছে।
একদিকে উপর থেকে আগুন পড়ছে, অপরদিকে সুলতান আইউবীর জানবাজরা নিক্ষিপ্ত আগুন উপেক্ষা করে প্রাচীর ভেঙ্গে চলেছে। আরেকদিকে দুপক্ষের মধ্যে চলছে তীর বিনিময়। অবশেষে প্রাচীর ভাঙ্গার কাজে রত মুজাহিদরা আগুনের কাছে ঘায়েল হয়ে যায়। আগুনে অনেকের গা ঝলসে যায়। তাদের কয়েকজন এমন অবস্থায় পেছনে ছুটে যায় যে, তাদের গায়ের কাপড়-চোপড়ে আগুন জ্বলছে। তারা প্রাচীরের সন্নিকট থেকে সরে যাওয়া মাত্র উপর থেকে তীর আসতে শুরু করে। তীর তাদের পিঠে বিদ্ধ হয়। তীরের আঘাত খেয়ে তাদের সব কজনই শাহাদাতবরণ করে।
এবার অপর দশজন জানবাজ মুজাহিদ প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য এগিয়ে আসে। উপর থেকে দুশমনের নিক্ষিপ্ত তীর উপেক্ষা করে তারা প্রাচীরের নিকটে পৌঁছে যায়। তারা প্রাচীর ভাঙ্গার কাজ অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যায়। উপর থেকে তাদের গায়েও আগুনের বালতি ও ড্রাম নিক্ষেপ করা হয়। নিক্ষেপকারীদের কয়েকজন এতো উপরে উঠে আসে যে, তারা বুকে মুজাহিদদের তীর নিয়ে পেছন দিকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে সামনের দিকে প্রাচীরের বাইরে পড়ে যায় এবং নিজেদেরই নিক্ষিপ্ত আগুনে পুড়ে ছটফট করে মরে যায়। তবে প্রাচীর ভাঙ্গার কাজে রত এই মুজাহিদদেরও সবাই শহীদ হয়ে যায়।
সুলতান আইউবী ঘোড়া ছুটান। অপারেশনরত বাহিনীর কমান্ডারের নিকট গিয়ে বললেন, তোমার উপর এবং তোমাদের জানবাজদের উপর আল্লাহ রহম করুন। ইসলামের ইতিহাস তোমার সেই জানবাজদের আজীবন স্মরণ রাখবে, যারা আল্লাহর নামে আগুনে পুড়ে জীবন দিয়েছে। তবে এই পন্থা আপাতত বন্ধ করে দাও। পেছনে সরে যাও। এখনই এত মানুষ ও তীর নষ্ট কর না। খৃস্টানরা এই দুর্গের জন্য এত আয়োজন করে রেখেছে, যা আগে আমি কল্পনাও করিনি।
আর আমরাও এত অধিক কোরবানী দেব, যা খৃস্টানদের কল্পনার অতীত- কমান্ডার বলল- কার্ক দুর্গের প্রাচীর এখান থেকেই ভাঙ্গব এবং আপনাকে আমরা এখান দিয়েই ভেতরে নিয়ে যাব।
আল্লাহ তোমার আকাঙ্খা পূর্ণ করুন- সুলতান আইউবী বললেন- তবে আপাতত তুমি তোমার মুজাহিদদের বাঁচিয়ে রাখ। খৃস্টানরা বাইরে থেকে হামলা করতে যাচ্ছে। তোমাদেরকে সম্ভবত দুর্গের বাইরেই যুদ্ধ করতে হবে। অবরোধ শক্ত রাখ। আমরা খৃস্টানদেরকে দুর্গের ভেতরে না খাইয়ে মারব।
বাহিনীটিকে পেছনে সরিয়ে নেয়া হল। কিন্তু কমান্ডার সুলতান আইউবীকে বলল, সালারে আজমের অনুমতি হলে আমি শহীদদের লাশগুলো তুলে আনতে চাই।
হ্যাঁ, তুলে নিয়ে আস- সুলতান আইউবী বললেন- আমি কোন শহীদের লাশ যেখানে-সেখানে ফেলে রাখতে চাই না।
সুলতান আইউবী সেখান থেকে চলে যান। তার জানবাজ বাহিনীটি সঙ্গীদের লাশগুলো তুলে আনে। সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য। যে কটি লাশ তুলে আনা হল, সে পরিমাণ মুজাহিদ নতুন করে শাহাদতবরণ করল। সুলতান আইউবী ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছেন। যুদ্ধের সময় তিনি তাঁর পতাকা সঙ্গে রাখেন না, যাতে দুশমনরা বুঝতে না পারে যে, তিনি এখন কোথায় আছেন। ফৌজ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়ে সুলতান এক পার্বত্য এলাকায় ঢুকে পড়েন। তিনি ঘোড়া থেকে অবতরণ করেন এবং একটি টিলার উপর উঠে শুয়ে পড়েন, যাতে দুশমন তাকে দেখতে না পায়। এখন তিনি কার্ক দুর্গ ও নগরীর প্রাচীর দেখতে পাচ্ছেন। অন্তত দীর্ঘ এক মাইল এলাকা এখন তার চোখের সামনে। খানিক পর তিনি শয়ন থেকে উঠে দাঁড়ান এবং সাবধানে চারদিক ঘুরে-ফিরে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
সূর্য ডুবে গেছে। সুলতান আইউবী সেখানেই আছেন। কিছুক্ষণ পর সংবাদ এল, তাঁর নির্দেশ মোতাবেক পদাতিক ও অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনী এগিয়ে আসছে। তিনি দূতকে বললেন, কমান্ডারদের ডেকে আন। মুহূর্ত মধ্যে কমান্ডাররা এসে সুলতানের সামনে উপস্থিত হল। কমান্ডো বাহিনীর কমান্ডারও আছে তাদের সঙ্গে। পথ-নির্দেশনা দিয়ে সুলতান আইউবী তাকে অপারেশনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারপর অন্যান্য কমান্ডারদের দিক-নির্দেশনা দিতে শুরু করেন।
***
মধ্যরাত। দূর থেকে ঘোড়ার পদশব্দ কানে আসতে শুরু করেছে, যেন বাঁধভাঙ্গা মহাপ্লাবন ধেয়ে আসছে। জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলোয় ফকফক করছে চারদিক। খৃষ্টানদের বিশাল এক অশ্বারোহী বাহিনী পার্বত্য এলাকার খানিক দূরে এসে পড়েছে। তাদের পেছনে উষ্ট্রারোহী বাহিনী। তাদের সংখ্যার ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অমুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, তিন হাজারের কম। মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে পাঁচ থেকে আট হাজার। তবে তাদের সঠিক সংখ্যা ছিল দশ থেকে বার হাজারের মধ্যে। তাদের কমান্ডার ছিল প্রখ্যাত খৃষ্টান সম্রাট রেমান্ড। দুজন ঐতিহাসিকের মতে কমান্ডারের নাম রেনা। তবে সঠিক তথ্য হল, রেনাল্ট নয়- রেমান্ডই ছিল সেই বাহিনীর কমান্ডার। এই অভিযানের লক্ষ্যে এই বাহিনীটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত দূরবর্তী এক স্থানে তাঁবু গেড়ে অবস্থান করছিল। আজ রাত-ই কিংবা কাল প্রত্যূষে তারা সুলতান আইউবীর কার্ক অবরোধকারী বাহিনীটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
খৃস্টান আরোহীরা ঘোড়া ও উটের পিঠ থেকে অবতরণ করে। প্রতিটি ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা খাবারের থলে। আরোহী সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হল, তারা যেন নিজ নিজ পশুর কাছে থাকে এবং বেশী সময়ের জন্য ঘুমিয়ে না পড়ে। তাদের পশুপালের দানা-পানি পেছনে আসছে। খৃস্টানদের পরিকল্পনা ছিল, মুসলমানদের উপর পেছন থেকে আচানক হামলা করে ঘোড়াগুলোকে দুর্গের ভেতর থেকে পানি পান করিয়ে আনবে। সুলতান আইউবীর গুপ্তচররা খৃস্টান বাহিনীর গতিবিধির প্রতি কড়া নজর রাখছে। খৃস্টান সেনাদের সংখ্যাধিক্য দেখে তারা ঘাবড়ে যায়।
খৃস্টান সৈন্যরা নিজ নিজ বাহনে আরোহন ও তরবারী-বর্শা প্রস্তুত রাখার নির্দেশ পায়। এটি মূলত হামলা করারই নির্দেশ। বিশাল এলাকা জুড়ে সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধভাবে তারা সম্মুখপানে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু যেইমাত্র সামনের সারিটি ঘোড়ার পিঠে কষাঘাত করে ছুটতে উদ্যত হয়, অমনি পেছন থেকে বৃষ্টির মত তীর আসতে শুরু করে। যেসব আরোহী সৈন্যের গায়ে তীর বিদ্ধ হয়, তারা কেউ ঘোড়র উপরই মুখ থুবড়ে পড়ে যায়, কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর যেসব ঘোড়া তীরবিদ্ধ হয়, তারা নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। উটগুলোও যেইমাত্র চলতে শুরু করল, অমনি তাদের মধ্যেও হুলস্থুল শুরু হয়ে যায়। শা শা করে তীর এসে বিদ্ধ হতে থাকে তাদের গায়ে। খৃস্টান কমান্ডার বুঝেই উঠতে পারলেন না যে, হসটা কী? তার সৈন্যবিন্যাস এভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছেই বা কেন? তিনি রাগের মাথায় চীৎকার শুরু করে দেন। দিশেহারা উট-ঘোড়াগুলো পুরো বাহিনীর মধ্যে চরম এক আতংক ছড়িয়ে দেয়। ভোরের আলো ফোঁটার পর রেমান্ড টের পেলেন যে, তিনি সুলতান আইউবীর গ্যাড়াকলে আটকা পড়েছেন। মুসলমানদের সংখ্যা কত, তা তার জানা ছিল না। তার ধারণা, সংখ্যায় মুসলমানরা অনেক। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত নন। তিনি আক্রমণ অভিযান স্থগিত ঘোষণা করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে তার সামনের সারির সৈন্যরা সেই স্থান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেখানে তার পুরো বাহিনীর পৌঁছানোর কথা।
সুলতান আইউবী দুর্গ অবরোধকারী বাহিনীকে পূর্ব থেকেই সতর্ক করে রেখেছেন। তারা এই হামলাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত। শূন্যে ধূলোবালি উড়তে দেখেই তারা পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যায়। একসময় আত্মপ্রকাশ করে একদল অশ্বারোহী খৃস্টান সৈন্য। মুজাহিদরা হামলা প্রতিহত করার পজিশনে চলে যায়। তারা ডানে ও বাঁয়ে প্রস্তুত অবস্থায় ছিল। যেইমাত্র খৃস্টানদের ঘোড়ার বহর তাদের মধ্যখানে এসে পৌঁছায়, অমনি তারা দুদিক থেকে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতক্ষণে খৃস্টানদের এই দলটি টের পেল যে, তারা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং তাদের বাহিনী পূর্বের স্থান ছেড়ে রওনা-ই হয়নি। সুলতান আইউবী নিজেই এই অভিযানের তত্ত্বাবধান করছিলেন। মোকাবেলা করার জন্য খৃস্টানরা পেছনে মোড় ঘুরায়। কিন্তু সুলতান আইউবী তাদের কৌশল আগেই ব্যর্থ করে দিয়েছেন, পেছনে সরে গিয়ে মুখোমুখি সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার জন্য তারা কোন শত্রুই খুঁজে পাচ্ছে না। আইউবীর সৈন্যরা তাদের উপর বেধড়ক তীর ছুঁড়ছে ডান-বাম ও পেছন দিক থেকে। খৃস্টান কমান্ডাররা তাদের রাহিনীটিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে। ফেলে। সুলতান আইউবীর কমান্ডাররা নির্দেশনা মোতাবেক তাদের মুখোমুখি। মোকাবেলা করার সুযোগই দিচ্ছে না। খৃস্টানদের ঘোড়াগুলো পরিশ্রান্ত ও ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর। তারা যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তারা রসদের অপেক্ষা করছে। তাদের রসদ ভোর পর্যন্ত এসে পৌঁছানোর কথা।
বেলা দ্বিপ্রহর। কিন্তু এখনো খৃস্টানদের রসদ এসে পৌঁছায়নি। সংবাদ নেয়ার জন্য কয়েকজন অশ্বারোহী ছুটে যায়। কিন্তু তারা পথে মুসলিম তীরান্দাজদের আক্রমণের শিকার হয়ে নিহত হয়। গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হলেও তারা রসদের সন্ধান পেত না। তাদের রসদের বহর রাতেই সুলতান আইউবীর গেরিলাদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে।
সুলতান আইউবী তার রিজার্ভ বাহিনী থেকে আরো ফোর্স তলব করেন এবং রেমান্ডের বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। মুসলিম সৈন্যদের সংখ্যা যদি খৃস্টানদের সমানও হত, তাহলে তারা হামলা করে খৃস্টানদের সমূলে নিঃশেষ করে দিতে পারত। কিন্তু সংখ্যায় মুসলমানরা নগন্য। তাই সুলতান আইউবী তার এই সামান্য জনশক্তিকে নষ্ট করতে চাইছেন না। তিনি খৃস্টান বাহিনীটিকে ঠেলে ঠেলে পার্বত্য এলাকায় নিয়ে গিয়ে নিজের ঘেরাওয়ে নিয়ে ফেলেন। তিনি জানতেন, সময় যত গড়িয়ে যাবে, খস্টানরা তত হতাশ ও শক্তিহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু খৃস্টানদেরকে ঘেরাওয়ে নিয়ে ফেলে তিনি। নিজেও বেশ বেকায়দায় পড়ে যান। কারণ, ঘেরাও বহাল রাখার জন্য তার বহু সৈন্য এখানে এমনভাবে আটকা পড়ে গেছে যে, তাদের দিয়ে অন্য কোন কাজ করান যাচ্ছে না।
এলাকায় পানি আছে, যা বেশ কিছুদিন পশুদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। আর সৈন্যদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আছে আহত ঘোড়া ও উটের গোশত। সুলতান আইউবী নগরীর অবরোধ পরিপূর্ণ করে ফেলার নির্দেশ দেন। খৃস্টান বাহিনী কোথাও স্থির দাঁড়াতে পারছে না। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আক্রমণের মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাদের। এভাবে দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। সুলতান দুর্গ ও নগরীর চারপাশে ঘুরে-ফিরে দেখছেন, কোন দিক দিয়ে প্রাচীর ভাঙ্গার সুযোগ পাওয়া যায় কিনা।
***
অবরোধের ষোল কিংবা সতেরতম দিন। সন্ধ্যাবেলা। সুলতান আইউবী নিজ তাঁবুতে বসে নায়েব ও অন্যান্যদের সঙ্গে দুর্গের প্রাচীর ভাঙ্গার কৌশল নিয়ে কথা বলছেন। এমন সময় এক রক্ষী ভেতরে প্রবেশ করে সংবাদ দেয়, সুদানের রণাঙ্গন থেকে দূত এসেছেন। সুলতান আইউবী চমকে উঠে বললেন, তাকে এক্ষুণিভেতরে পাঠিয়ে দাও। আল্লাহ করুন, লোকটা ভাল সংবাদ এনে থাকুক।
দূত তাঁবুতে প্রবেশ করে। সুলতান আইউবী দেখেই চিনে ফেললেন, লোকটি দূত নয়- কোন এক সেনাদলের কমান্ডার। সুলতান তাকে অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ভাল সংবাদ নিয়ে এসেছ তো?… বস।
কমান্ডার না সূচক মাথা নেড়ে বলল, মহান সেনাপতি যেমন মনে করেন। আমি যে সংবাদ নিয়ে এসেছি, ইচ্ছে হলে আপনি তাকে ভালও বলতে পারেন, আবার মন্দও বলতে পারেন। ভাল এ জন্য নয় যে, আমরা সুদানে বিজয় অর্জন করতে পারিনি। আর ভাল এ কারণে বলা যায় যে, আমরা পরাজিত কিংবা পিছপা হয়নি।
তার মানে পরাজয় ও পিছুহটার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাই না? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।
সেই লক্ষণ স্পষ্ট- কমান্ডার জবাব দেয়- আমি আপনার আদেশ নেয়ার জন্য এসেছি যে, এখন আমরা কী করব? আমাদের স্পেশাল সৈন্যের একান্ত প্রয়োজন। যদি তার ব্যবস্থা না হয়, তাহলে পেছনে সরে না এসে উপায় নেই।
সুলতান আইউবীর অবর্তমানে তাঁর ভাই তকিউদ্দীন মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি সুদান ও মিসরের সীমান্তবর্তী এলাকায় ফেরাউনী আমলের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে খৃস্টানদের সৃষ্ট ভয়ংকর এক ড্রামা আবিষ্কার করেছিলেন। তারপরই তিনি এই ভেবে সুদান আক্রমণ করেন যে, সেখানে মিসরের উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তার উপদেষ্টাবৃন্দ ও সালারগণ বলেছিলেন, কাজটা সুলতান আইউবীর অনুমতি নিয়ে করা হোক। কিন্তু তকিউদ্দীন তা না করে এই বলে সুদান আক্রমণ করে বসেন যে, তিনি সুলতানকে এর জন্য বিরক্ত করতে চান না। এখন এই কমান্ডার সংবাদ নিয়ে এল, সুদানে তারা পরাজিত হতে চলেছে। সাধারণ দূতের পরিবর্তে তকিউদ্দীন একজন কমান্ডার এ জন্য প্রেরণ করেছেন যে, সে সুলতানকে ময়দানের সঠিক চিত্র সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত করতে পারবে। তার আগে সুলতান শুধু এতটুকু সংবাদ পেয়েছিলেন যে, তকিউদ্দীন সুদান আক্রমণ করেছে।
কমান্ডার সুলতান আইউবীকে যে কাহিনী শোনায়, সংক্ষেপে তা এই
মিসরের বর্তমান অস্থায়ী গভর্নর বাস্তবতার উপর দৃষ্টি রাখার পরিবর্তে আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ও নির্দেশ দেন। বস্তুত তকিউদ্দীনের আবেগ ইচ্ছা সুলতান আইউবীর আবেগ-ইচ্ছারই অনুরূপ। কিন্তু দুভাইয়ের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার মধ্যে বেশ তফাৎ। তকিউদ্দীন যে ফয়সালা নিয়েছিলেন, সৎ উদ্দেশ্য ও ইসলামী চেতনা থেকেই নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এই সত্যটাকে উপেক্ষা করেছেন যে, বিচার-বিবেচনা ছাড়া দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নাম যুদ্ধ-জিহাদ নয়। তিনি সুদানে নিয়োজিত তার গোয়েন্দাদের রিপোর্টও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেননি। তিনি একটি বিষয়ই মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে, খৃস্টান কমান্ডাররা সুদানীদেরকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং সুদানীরা মিসর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তকিউদ্দীন দুশমনকে রণসাজে প্রস্তুত অবস্থায়ই কাবু করে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো বিষয় খুঁটিয়ে দেখেননি যে, সুদানীদের সামরিক শক্তি কতটুকু, আক্রান্ত হলে তারা কি পরিমাণ শক্তি নিয়ে মোকাবেলা করবে, তাদের অস্ত্রের পরিমাণ কি, আরোহী সৈন্য কতজন, পদাতিক কজন ইত্যাদি। সবচে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তিনি ভেবে দেখেননি, তা হল সুদান আক্রমণ করলে পথের দূরত্ব কতটুকু হবে এবং রসদের ব্যবস্থা কিভাবে হবে?
তকিউদ্দীনের এই অপরিপক্ক সিদ্ধান্তের দুটি বিরূপ ফল শুরুতেই সামনে এসে যায়। প্রথমত সুদানীরা- অন্য শব্দে খৃস্টান সৈন্যরা তাকে সীমান্তে প্রতিরোধ করেনি। তারা তকিউদ্দীনকে সুদানের সেই অঞ্চল পর্যন্ত যাওয়ার পথ ছেড়ে দেয়, যেটি পানিহীন বিশাল মরু প্রান্তর। তকিউদ্দীন অবলীলায় সেই এলাকায় পৌঁছে যান। দ্বিতীয়ত তকিউদ্দীনের বাহিনী মূলত সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কৌশল অনুপাতে যুদ্ধ করায় অভ্যস্ত, যারা সংখ্যায় সামান্য হয়েও দুশমনের বিশাল বিশাল বাহিনীকে তছনছ করে দিতে পারঙ্গম। এই বাহিনীকে সুলতান শুধু নিজেই ব্যবহার করতে পারতেন। সুলতান আইউবী সব সময় মুখোমুখি সংঘাত পরিহার করে চলতেন। কিন্তু তকিউদ্দীন ওসবের ধার ধারলেন না। তার এই বাহিনীতে অভিজ্ঞ ও জানবাজ গেরিলা যোদ্ধাও আছে। কিন্তু এদের সঠিক ব্যবহার জানতেন সুলতান আইউবী। এদের নিয়ে সুদান পৌঁছানোর পর অবস্থা এমন হল যে, তকিউদ্দীনের সমস্ত সৈন্য একটি মাত্র বাহিনীতে-ই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। দুশমন তকিউদ্দীনকে তাদের পছন্দনীয় জায়গায় নিয়ে যায় এবং তার বাহিনীর উপর সুলতান আইউবীর-ই ধারায় গেরিলা হামলা শুরু করে দেয়। তকিউদ্দীন তার জানোয়ার ও জওয়ানদের জন্য এক ফোঁটা পানিও পেলেন না। তার গেরিলা বাহিনীর কমান্ডাররা তাকে বলল, আপনি আমাদেরকে ময়দানে স্বাধীন ছেড়ে দিন। আমরা নিজের মত করে অপারেশন চালিয়ে যাই। কিন্তু তকিউদ্দীন তা মানলেন না। তিনি ভাবলেন, এতে বাহিনীর মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দিবে, কেন্দ্রীয় কমান্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে।
যখন রসদের সমস্যা সামনে এল, ততক্ষণে তকিউদ্দীন বুঝতে পারলেন, তিনি অনেক দূর চলে এসেছেন, যেখানে রসদ পৌঁছতে কয়েকদিন সময় লেগেযাবে এবং রসদ বহনের পথও নিরাপদ নয়। আবহাওয়া এতই প্রতিকূল যে, তকিউদ্দীন সংবাদ পেয়ে যান, দুশমন তার রসদ ধ্বংস করার আগেই বাতাসের তোড়ে তার সমস্ত রসদ ও রসদবাহী পশুগুলো উড়ে গেছে।
এই দুর্ঘটনার পর গেরিলা বাহিনীর এক কমান্ডার ও তকিউদ্দীনের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা হয়ে যায়। কমান্ডার বলল, আমি লড়াই করতে এসেছি লড়াই করব; কিন্তু এভাবে নয় যে, দুশমন কমান্ডো হামলা চালাবে, রসদপাতি শেষ হয়ে গেছে আর আমরা কেন্দ্রীয় কমান্ডের পাবন্দ হয়ে বসে বসে মার খাব। তকিউদ্দীন আদেশের সুরে কঠোর ভাষায় জবাব দিলেন। প্রত্যুত্তরে কমান্ডার বলল, আপনার মনে রাখা উচিত যে, আপনি তকিউদ্দীন- সালাহুদ্দীন নন। আমরা সেই প্রত্যয় ও সেই পদ্ধতিতে লড়াই করব, যেভাবে লড়াই করতে আমাদেরকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী শিখিয়েছেন। আমরা গেরিলা সৈনিক। আমরা দুশমনদের রসদ ছিনিয়ে এনে নিজ বাহিনীকে খাওয়াতে অভ্যস্ত।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, কমান্ডারের এ বক্তব্যের পর তকিউদ্দীন চৈতন্য ফিরে পান। তিনি নিজের ভুল উপলব্ধি করতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কমান্ডারের বক্তব্য কত বাস্তবসম্মত এবং মর্মস্পর্শী। তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আমি মহান আল্লাহর আযাবকে ভয় করি। আমি এই জানবাজদেরকে যারা ফিলিস্তিনে লড়াই করে এসেছে- অপমৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাই না।
তা-ই যদি হয়, তাহলে আপনার আক্রমণ করাই উচিত হয়নি- কমান্ডার বললেন- আমাদের মধ্যে একজন সৈনিকও এমন নেই, যে আল্লাহর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত নয়। আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি এসে পৌঁছেছি। আর মুসলমানদের এটাই শান যে, তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে নিজেকে আল্লাহর নিকটবর্তী মনে করে। আপনি আবেগের তাড়নায় তাড়িত হয়ে বের হয়েছেন। আমরা দুশমনের ফাঁদে এসে পৌঁছেছি।
তকিউদ্দিন আনাড়ি নন। সুলতান আইউবীর সেই উক্তিটি তার স্মরণ আছে যে, তিনি বলেছিলেন, নিজেকে রাজা ভেবে অন্যকে আদেশ কর না এবং জিহাদের ময়দানে গিয়ে নিজের ভুল এড়িয়ে যেও না। তাই কমান্ডারের এই কঠোর মন্তব্যকে তিনি গোস্তাখী মনে করেননি এবং তৎক্ষণাৎ ঊর্ধ্বতন সব কমান্ডারকে ডেকে এনে যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা ও আগামী পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত হল, কমান্ডো বাহিনীকে জবাবী আক্রমণ করার জন্য ছড়িয়ে দেয়া হবে। রসদ পরিবহনের রাস্তাও তারা নিজেদের দখলে নিয়ে আসবে। বাহিনী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, তাদেরকে তিন ভাগে বিভক্ত করে দুশমনের উপর তিনদিক থেকে হামলা করা হবে।
এবারকার বন্টনও বিন্যাসে উপকার এই হল যে, তকিউদ্দীনের বাহিনী। সেই এলাকা থেকে বেরিয়ে গেল, যেখানে পানি নেই। আছে শুধু বালি আর টিলা। কিন্তু একটি অসুবিধা হল এই যে, এতে সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত ও বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে তারা নিজ নিজ পজিশনে গিয়ে শত্রুর উপর আঘাত হানার আগেই শত্রুরা তাদের উপর আক্রমণ করে তাদেরকে আরো বিক্ষিপ্ত করে দিল। মুজাহিদদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডাররা নিজ নিজ বাহিনীকে আলাদা করে সুলতান আইউবীর শেখানো পন্থায় যুদ্ধ শুরু করল। কিন্তু তারপরও স্পষ্ট বুঝ হয়ে গেল যে, এই লড়াইয়ে তারা পেরে উঠবে না। তবু তারা ময়দানে অটল থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়। রসদ ও রিজার্ভ বাহিনীর সহযোগিতা পাওয়ার আশা তো সম্পূর্ণই তিরোহিত। কমান্ডো বাহিনী শত্রুর উপর অতর্কিত হামলা করে শত্রুর ক্ষতিসাধন করছে আর খাদ্য খাবার যা পাচ্ছে ছিনিয়ে আনছে। এই ছিনিয়ে আনা খাবার খেয়েই মুজাহিদরা টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
মুজাহিদদের এখন আর কেন্দ্রীয় কমান্ড নেই। তকিউদ্দীন তাঁর কর্মকর্তাদের নিয়ে দৌড়-ঝাঁপে ব্যস্ত। তিনি আগে যতটা আবেগতাড়িত ছিলেন, এখন ততটা শান্ত ও গম্ভীর। অনেকটা আশান্বিতও বটে। এ যাবত তাকে এমন কোন সংবাদ শুনতে হয়নি যে, অমুক দল বা বাহিনী শক্রর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেছে। সংঘাত-সংঘর্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিক্ষিপ্ত হয়ে এখন সুদানের অর্ধেকটায় ছড়িয়ে পড়েছে। মুজাহিদ কমান্ডাররাও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, তারা এভাবে যুদ্ধ চালিয়েই যাবে। তারা সুদান ত্যাগ করবে না। এখন দুমশনেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এক পর্যায়ে দুশমন দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুজাহিদদেরকে কিভাবে সুদান ত্যাগে বাধ্য করা যায়, সেই চিন্তায় তারা অস্থির হয়ে পড়ে। মুসলিম সৈন্যরা মরু ও আবাদী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানদের কি পরিমাণ সৈন্য নিহত হয়েছে, তার কোন পরিসংখ্যান কেন্দ্রের কাছে নেই। তবে এতটুকু অনুমান করা যাচ্ছে যে, শত্রুও অনেকটা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং এখন আর তাদের মিসর আক্রমণের শক্তি-সাহস নেই। কিন্তু এ পদ্ধতির যুদ্ধ স্পষ্ট কোন সুফল বয়ে আনবে না। কোন এলাকা জয় করা যাবে না। মরা আর মারা ছাড়া এ যুদ্ধের কোন ফলাফল নেই।
এমনি পরিস্থিতিতে তকিউদ্দীন তার একজন কমান্ডার মারফত সুলতান আইউবীর নিকট মৌখিক পয়গাম প্রেরণ করেন। তিনি সুলতান আইউবীকে বলার জন্য বলে দেন যে, এখন সুদান অভিযানে সাফল্য অর্জনের একমাত্র উপায়, আপনি সাহায্য প্রেরণ করুন। আমার সমস্ত সৈন্য বিভক্ত হয়ে গেরিলা অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযান দ্বারা সাফল্য অর্জন করতে হলে আরো সৈন্য প্রয়োজন। তকিউদ্দীন কমান্ডারকে সুলতান আইউবীর নিকট থেকে এ প্রশ্নেরও জবাব নিয়ে আসতে বলে দেন যে, সাহায্য না পেলে কি আমি সুদানে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া সৈন্যদেরকে একত্রিত করে মিসর ফিরে যাব? বর্তমানে মিসরে যে ফৌজ আছে, তা মিসরের আভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিরসন এবং সীমান্ত সংরক্ষণের জন্যই যথেষ্ট নয়। কাজেই তাদেরকে ভিন্ন কোন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করার প্রশ্নই আসে না। তবে সুলতান আইউবী পিছুটানে বিশ্বাসী নন। তকিউদ্দীনের সমস্যার সমাধান দেয়া তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান।
***
তকিউদ্দীনের এই দূত সুলতান আইউবীকে যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছিল বটে, কিন্তু খৃস্টান ও সুদানীরা সেখানে আরো যে একটি যুদ্ধক্ষেত্র চালু করে রেখেছিল, সে সম্পর্কে কিছু বলেনি। সম্ভবত সে যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে তার জানা ছিল না। সে তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল অনেক পরে।
তকিউদ্দীনের সৈন্যরা দশ-দশজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুদানের কোন কোন এলাকায় যাযাবরদের ঝুপড়ি এবং তবুও ছিল। কোথাওবা সবুজ-শ্যামল বাগান। অধিকাংশ এলাকা পতিত, অনাবাদী ও বালুকাময়।
একদিন সন্ধ্যায় তিনজন গেরিলা মুজাহিদ ফিরে এসে সিনিয়র এক কমান্ডারের সামনে উপস্থিত হয়। তাদের দুজন আহত। তারা কমান্ডারকে জানায়, আমাদের দৃলে একুশজন মুজাহিদ ছিল। কমান্ডারসহ বাইশজন। আমরা দিনের বেলা একস্থানে লুকিয়ে ছিলাম। কমান্ডার এদিক-ওদিক টহল দিচ্ছিলেন, যেন তিনি পাহারা দিচ্ছেন কিংবা কারো আগমনের অপেক্ষা করছেন। এমন সময় এক সুদানী উজ্জ্বারোহী এদিক দিয়ে পথ অতিক্রম করতে শুরু করে। আমাদের কমান্ডারকে দেখে সে থেমোয়। কমান্ডার তার নিকট এগিয়ে যান এবং তার সঙ্গে কি যেন কথা বলেন। আরোহী চলে গেলে কমান্ডার আমাদেরকে সুসংবাদ শোনান যে, এখান থেকে দুমাইল দূরে একটি গ্রাম আছে, সেখানকার অধিবাসীরা মুসলমান। আরোহী আমাদের আপন। লোক। সে আমাদেরকে সেই এলাকায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিয়ে গেছে। বলেছে, আমরা গেলে রাতে সেখানে আমাদের মেহমানদারী করবে এবং দুশমনের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে হামলার কাজে সহযোগিতাও করবে।
শুনে আমরা খুশী হলাম। কিছু সময় নিরাপদে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি দুশমনের উপর হামলা করারও সুযোগ পাব, এ কম কথা নয়। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরপরই আমরা সেই গ্রাম অভিমুখে রওনা হলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি, তিনটি কুঁড়ে ঘর। আশপাশে গাছ-গাছড়া এবং পানি আছে। আমাদেরকে ঝুঁপড়ির বাইরে ছাউনী ফেলতে বলা হল। কমান্ডার একটি ঝুপড়িতে ঢুকে পড়লেন। বাইরে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়া হল এবং আমাদের সবাইকে খাবার খাওয়ান হল। কমান্ডার বললেন, এবার তোমরা শুয়ে পড়; আক্রমণের সময় হলে জাগিয়ে দেব। আমরা ক্লান্ত সৈনিকরা শুয়ে পড়লাম। আমি শুয়ে পড়লেও ঘুমালাম না। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন খটকা লাগছিল। হঠাৎ একটি ঝুপড়িতে একাধিক নারীর অট্টহাসির শব্দ কানে আসতে লাগল। আমি মাথা তুলে কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলাম। মনে সন্দেহ জাগল। আমি সেদিকে আরো মনোযোগ দিলাম। এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে, আমাদের কমান্ডার ঝুঁপড়িতে দুটি সুন্দরী মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করছে। ও মদপান করছে। মেয়েগুলো গ্রাম্য পোশাক পরিহিত হলেও তাদেরকে গ্রাম্য বলে মনে হল না। কিছুক্ষণ পর একদিকে আমি চাপা পদশব্দ শুনতে পেলাম। একাধিক মানুষের চলার শব্দ। চাঁদের আলোতে দেখতে পেলাম, বেশকিছু মানুষ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে বর্শা ও তরবারী। আমি ঝুঁপড়ির আড়ালে চলে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, এরা কারা। কিছুক্ষণ পর একজন লোক খুঁপড়িতে প্রবেশ করল এবং চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কাজ সেরে ফেলব কি? আমাদের কমান্ডার বললেন, ও তোমরা এসে গেছ? সবাই ঘুমিয়ে আছে, যাও সব কটাকে শেষ করে দাও।
আগত লোকগুলো আমাদের ঘুমন্ত মুজাহিদদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে ঘুমন্ত অবস্থায়ই শহীদ হয়ে যায়। অনেকে জাগ্রত হয়ে মোকাবেলা করে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে থাকি।
কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম, আমার দুজন সঙ্গী পালাচ্ছে। মওকা পেয়ে আমিও পালাতে শুরু করলাম এবং সঙ্গীদ্বয়ের সাথে মিলিত হলাম। তারা দুজন আহত। আমরা সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। কেউ আমাদের পশ্চাদ্ধাবন করল না।
তকিউদ্দীনের এই কমান্ডার উষ্ট্রারোহী দুশমনের প্রদত্ত লোভে পড়ে গিয়েছিল, নাকি পূর্ব থেকেই দুশমনের এজেন্ট ছিল, তা জানা না গেলেও এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, এ যুদ্ধেও দুশমন বিক্ষিপ্ত মুসলিম সেনাদলগুলোকে নিঃশেষ করার জন্য সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করা শুরু করেছে। দুশমন মানবিক দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগাচ্ছিল।
এরূপ আরো একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। গেরিলা বাহিনীর এক কমান্ডার আতা আল-হাশেমী একস্থানে উপবিষ্ট। তার বাহিনী তিন-চারটি দলে বিভক্ত হয়ে আছে। জায়গাটা মিসর থেকে রসদ আসার পথ। আতা আল-হাশেমী যার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা একশরও কম- মিসর থেকে রসদ আসার সমস্ত রাস্তা নিরাপদ করে ফেলেছিল। রসদের উপর গেরিলা আক্রমণকারী দুশমনের তিনি ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছেন। সুদানীরা তাকে ঘায়েল করার জন্য অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু জনাপাঁচেক জানবাজকে হত্যা করা ব্যতীত তারা আর কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
আতা আল-হাশেমী টিলার আড়ালে একস্থানে বসে আছে। তার সঙ্গে ছয় সাতজন গেরিলা। এটি তার হেডকোয়ার্টার। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, মধ্যবয়সী এক পুরুষের সঙ্গে যাযাবরের পোশাকে দুটি রূপসী মেয়ে কোথাও যাচ্ছে। আতা আল-হাশেমীকে দেখে তারা তার কাছে চলে আসে। মেয়েগুলোকে সুদানী বলে মনে হল। কিন্তু পোশাকে তারা ছদ্মবেশী। মুখমণ্ডল ধূলিমলিন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। মেয়ে দুটো পুরুষ লোকটির পেছনে পেছনে হেঁটে আসে, যেন তারা লজ্জায় অবনত।
পুরুষ লোকটি মিসরী ও সুদানী মিশ্রিত ভাষায় বলল, আমি মুসলমান। এরা দুজন আমার কন্যা। এরা ক্ষুধায় মরে যাচ্ছে। এদের খাওয়ার জন্য কিছু দিন।
আতা আল-হাশেমীর সুদানী ভাষা জানা ছিল। তিনি গেরিলা সৈনিক। সুদানী অঞ্চলে কমান্ডো অভিযানে পরিচালনার সুবিধার জন্য তিনি সুদানী ভাষা শিখেছিলেন। তার কাছে খাদ্য-খাবারেরও অভাব নেই। মুজাহিদদের রসদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তার হাতে। এ-পথে এ যাবত দু-তিনবার রসদ অতিক্রম করে। তার থেকে প্রতিবারই তিনি নিজের বাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য-খাবার রেখে দিয়েছিলেন। পানিরও অভাব নেই।
কমান্ডার তিনজনকে খাবার খেতে দেন। তারা আহার করছে। এই ফাঁকে তিনি তাদের ঠিকানা-পরিচয় জেনে নিচ্ছেন। কমান্ডার জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ এবং কোথায় যাচ্ছ? পুরুষ লোকটি একটি গ্রামের নাম উল্লেখ করে বলল, আমরা অমুক এলাকার বাসিন্দা। আমাদের পুরো এলাকা যুদ্ধের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সুদানী-মুসলমান যখন, যারাই এসেছে আমাদের ক্ষতি করেছে, সহায়-সম্পদ খাদ্য-খাবার ছিনিয়ে নিয়েছে। আমি আমার এই মেয়ে দুটোকে সৈন্যদের কবল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে রেখেছি। শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠলাম না। নিরুপায় হয়ে এদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। মেয়ে দুটোর সম রক্ষা করার জন্য আমি এখন ঘরছাড়া। যে কোন প্রকারে যোক আমি মিসর চলে যেতে চাই। কিন্তু কোন পথ দেখছি না। আপনি আমাদেরকে মিসর পৌঁছিয়ে দিন- বলেই লোকটি জিজ্ঞেস করল, তোমরা এখানে কদিন থাকবে?
যে কদিন থাকব, তোমাদের তিনজনকে সঙ্গে রাখব। আতা আল হাশেমী জবাব দেন।
তুমি এই মেয়ে দুটোকে তোমার হেফাজতে নিয়ে নাও- মধ্যবয়সী লোকটি বলল- আমি চলে যাচ্ছি।
আপনার জীবন কত কঠিন, দেখে আমার বিস্ময় লাগছে- কোমল কণ্ঠে এক মেয়ে বলল- আপনার কি স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে পড়ে না?
সবই মনে পড়ে- আতা আল-হাশেমী জবাব দেন। কিন্তু তাই বলে আমি আমার কর্তব্যের কথা তো ভুলতে পারি না।
মনে হচ্ছে, যেন খাবার খেয়ে ও পানি পান করে আগন্তুকদের দেহে নতুন জীবন সঞ্চারিত হয়েছে। দুমেয়ের একজন নিশ্চুপ থাকলেও অপরজনের মুখ খুলে গেছে। মেয়েটি যা বলল, তাতে আতা আল-হাশেমী ও তার জানবাজদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ পায়। মেয়েটি এ-ও বলল যে, আপনারা এতদূর এসে নিজেদের জীবন নষ্ট করছেন কেন?
এ কথা শোনা মাত্র আতা আল-হাশেমী উঠে দাঁড়ান। আগন্তুক তিনজনকেও উঠিয়ে দাঁড় করান এবং সঙ্গীদের ডেকে বললেন, এই সুদানীর পায়ে রশি বেঁধে আমার ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ফেল। হাশেমীর জানবাজরা কমান্ডারের নির্দেশ তামিল করে। তারা রশির এক মাথা লোকটির পায়ে বেঁধে অপর মাথা ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বেঁধে দেয়। আতা আল-হাশেমী এক সিপাহীকে বললেন, তুমি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বস। সিপাহী ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে।
আতা আল-হাশেমী মেয়ে দুটোকে একত্রিত পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দুজন তীরন্দাজকে ডেকে এনে বললেন, আমি ইশারা করা মাত্র মেয়ে দুটোর চোখের ঠিক মধ্যখানে একটি করে তীর ছুঁড়বে এবং অশ্বারোহী ঘোড়া হাঁকিয়ে দেবে। ঘোড়ার পেছনে বেঁধে রাখা সুদানী মাটিতে পড়ে আছে। ঘোড়া ছুটে চললে তার কী পরিণতি হবে, তা তার জানা ছিল। তীরন্দাজরা নিজ নিজ ধনুকে একটি করে তীর স্থাপন করে রাখে এবং অশ্বারোহী ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রস্তুত দাঁড়িয়ে থাকে। আতা আল-হাশেমী সুদানী মেয়ে দুটো এবং মধ্যবয়সী পুরুষটিকে বললেন, আমি তোমাদের তিনজনকে একবারই বলব যে, তোমরা তোমাদের আসল পরিচয় বলে দাও। যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছ, স্বীকার কর। অন্যথায় পরিণতি বরণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।
সবাই নীরব। কারো মুখে রা নেই। মেয়েরা ঘোড়ার পেছনে বাঁধা তাদের সঙ্গীর প্রতি তাকায়। সেও নিশুপ। তারা পরস্পর চোখাচোখি করে মতবিনিময় করে নেয়। সুদানী প্রতিশ্রুতি দেয় যে, আমাদেরকে মুক্ত করে দিন, আসল পরিচয় বলে দেব। আতা আল-হাশেমী তার সম্মুখে বসে যান এবং বলেন, আগে বল তারপর মুক্ত করব। লোকটি বলল, আরে পাষান! তোমার কাছে আমি এত রূপসী দুটি মেয়ে নিয়ে আসলাম, আর তুমি কিনা তাদেরকে তীরের নিশানা বানাচ্ছ। কোন অঘটন না ঘটিয়ে মেয়ে দুটোকে বরণ করে নাও এবং সঙ্গীদের নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। এই মূল্য যদি সামান্য হয়, তাহলে বল সোনা-রূপা যা ইচ্ছা চাও, আমি সিরিয়া থেকে তোমাকে এনে দেব।
আতা আল-হাশেমী উঠে দাঁড়ান এবং ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসা সিপাহীকে বললেন, দুলকি চালে ঘোড়া হাঁকাও, পনের-বিশ কদম চালাও।
ঘোড়া চলতে শুরু করে। কয়েক পা অগ্রসর হওয়া মাত্র সুদানী চীৎকার শুরু করে। আতা আল-হাশেমী চালককে ঘোড়া থামাতে বলেন। ঘোড়া থেমে যায়। হাশেমী লোকটির নিকটে গিয়ে বললেন, এখনো সময় আছে, সোজা করে কথা বল। লোকটি সম্মতি জানায় এবং বলে দেয় যে, আমি সুদানী গুপ্তচর। খৃস্টানরা আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামিয়েছে। মেয়ে দুটো সম্পর্কে বলল, ওরা মিসরী বংশোদ্ভূত। খৃস্টানরা তাদেরকে নাশকতামূলক কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে ছেড়েছে।
আতা আল-হাশেমী লোকটির পায়ের বন্ধন খুলে দেন এবং তাকে নিজের কাছে বসিয়ে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করেন। সে জানায়
আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যে, আমি সুদানে ছড়িয়েপড়া মুসলিম কমান্ডার ও সৈন্যদেরকে সুন্দরী নারী কিংবা সোনা-রূপার চমক দেখিয়ে হত্যা বা গ্রেফতার করিয়ে দেব কিংবা তাদেরকে পক্ষে নিয়ে আসব। লোকটি আরো জানায়, আতা আল-হাশেমী নামক এক মুসলিম কমান্ডার তাদের রসদ পরিবহনের পথকে এত নিরাপদ করে রেখেছে যে, তার তৎপরতায় খৃস্টান ও সুদানী গেরিলাদের অসংখ্য জীবনও নষ্ট হয় এবং মুসলমানদের রসদও গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তাই আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে যে, আমি আতা আল-হাশেমীকে এই মেয়েদের মাধ্যমে অন্ধ করে তাকে হত্যা করব কিংবা ফঁদে নিয়ে গিয়ে হত্যা কিংবা বন্দী করব। আর যদি সে পাক্কা ঈমানদার বলে প্রমাণিত হয়, মেয়েদের দ্বারা ঘায়েল করা না যায়, তাহলে যে কোন কৌশলে আমাদের দলে ভিড়িয়ে নেব।
আতা আল-হাশেমী এই অনিন্দ্যসুন্দর মেয়ে দুটোকে কেন বরণ করল না ভেবে লোকটি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। সে তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি এত রূপসী দুটো মেয়ে এবং সোনা-দানার প্রস্তাব কেন প্রত্যাখ্যান করলেন? জবাবে তিনি বললেন, কারণ, আমার ঈমান কাঁচা নয়।
আতা আল-হাশেমী মেয়েদেরকেও নিজের কাছে ডেকে আনেন। পূর্বে যে মেয়েটি কথা বলেছিল, সে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করবেন? তিনি বললেন, আগামীকাল সকালে আমি তোমাদেরকে আমাদের হেডকোয়ার্টারে সালারে আজম তকিউদ্দীনের কাছে পাঠিয়ে দেব।
তিন গোয়েন্দার তল্লাশি নেয়া হল। তিনজনেরই কাছে খঞ্জর পাওয়া গেল। পুরুষ লোকটির কাছে পাওয়া গেল একটি পুটুলী। ভিতরে হাশীশ।
আতা আল-হাশেমী তার একদল জানবাজকে পাহারাদারির জন্য খানিক দূরে একস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসেছে। এখন সন্ধ্যা। কমান্ডার তাদেরকে আগন্তুক তিনজনের ব্যাপারে অবহিত করেন। বলেন, এরা গুপ্তচর ও নাশকতাকারী সন্ত্রাসী। হতে পারে, এদের সঙ্গীদের জানা আছে যে, এরা আমাদের এখানে আছে এবং তারা এদেরকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য হামলা করবে। কমান্ডার গোয়েন্দাদেরকে তাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়েন। তার চোখে ঘুম এসে যায়।
অল্পক্ষণ পরই কমান্ডারের চোখ খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে মেয়ে দুটোর চেহারা ভেসে উঠে। তিনি ভাবনার জগতে হারিয়ে যান। কী সুশ্রী ও দেখতে নিষ্পাপ দুটো মেয়ে! অথচ তাদের দ্বারা কাজ নেয়া হচ্ছে কত ঘৃণ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। এরা যদি কোন মুসলিম পরিবারে জন্ম নিত, তাহলে এখন এরা। কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ হয়ে সম্মানজনক জীবনযাপন করত।
ভাবতে ভাবতে নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায় আতা আল-হাশেমীর। ভাবেন, আমার স্ত্রীও তো যখন বধূবেশে আমার ঘরে এসেছিল, তখন এদেরই ন্যায় যুবতী ও মনোহারী ছিল। স্ত্রীর স্মরণ আতা আল-হাশেমীকে কল্পনার জগতে নিয়ে যায়।
জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলোয় ফকফক করছে চারদিক। আতা আল হাশেমী শয়ন করেছিলেন একটি টিলার পার্শ্বে। তিনি শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ান। পা টিপে টিপে মেয়ে দুটো যেখানে শুয়ে আছে, সেদিকে এগিয়ে যান, যেন তিনি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছেন।
মেয়ে দুটো শুয়ে আছে একত্রে। তাদের আশপাশে ঘুমিয়ে আছে সিপাহীরা। সুদানী পুরুষটি খানিক দূরে কয়েকজন সৈনিকের বেষ্টনীতে শায়িত।
আতা আল-হাশেমী নিজের পা দ্বারা একটি মেয়ের পায়ে আলতোভাবে আঘাত করেন। কারো পায়ের ছোঁয়া অনুভব করে মেয়েটির চোখ খুলে যায়। চাঁদের আলোতে চিনে ফেলে আতা আল-হাশেমীকে। মেয়েটি উঠে বসে। আতা আল-হাশেমী তাকে তার সঙ্গে আসতে ইশারা করেন। মেয়েটি মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠে যে, অবশেষে তাহলে আমার যৌবনের যাদু এই পাথরসম কমান্ডারকে প্রভাবিত করেছে।
মেয়েটি আতা আল-হাশেমীর পেছনে পেছনে হাঁটা দেয়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বলে কিছুই অন্য সিপাহীরা টের পায়নি।
মেয়েটিকে নিজের জায়গায় নিয়ে যান আতা আল-হাশেমী। মেয়েটির মাথায় এখন ওড়না নেই। চাঁদের আলোয় মাথার বিক্ষিপ্ত চুলগুলো সোনার তারের ন্যায় চিকচিক করছে। কমান্ডার কিছুক্ষণ মেয়েটির প্রতি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটিও. একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে কমান্ডারের প্রতি। তারপর মুখে হাসি টেনে ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আপনি ভয় করছেন দেখে আমার অবাক লাগছে। আমাকে আপনার নিকট আপনারই জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। আপনি কি আমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন না?
আতা আল-হাশেমীর মুখে কথা নেই। তিনি নিশ্চল মূর্তির ন্যায় চুপচাপ মেয়েটির প্রতি তাকিয়েই আছেন। মেয়েটি তার ডান হাতটা ধরে টেনে এনে নিজের ঠোঁটের সঙ্গে লাগায় এবং বলে, আমি জানি, আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন এবং কী ভাবছেন।
মুখ খুললেন কমান্ডার- আমি ভাবছি, তোমার পিতা আমারই মত একজন পুরুষ। মেয়েটির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কমান্ডার বললেন আমিও একজন পিতা। কিন্তু এই দুই পিতার মধ্যে আকাশ-জমিন পার্থক্য। তোমার পিতা কত আত্মমর্যাদাবোধহীন আর আমি আত্মমর্যাদার পাহারাদারি করার লক্ষ্যে নিজের সন্তানদের এতীম বানানোর চেষ্টা করছি।
আমার পিতা নেই- মেয়েটির বলল- হয়ত দেখেছি; কিন্তু স্মরণ নেই।
মারা গেছেন?
তাও মনে নেই।
আর মা?
কিছুই মনে নেই- মেয়েটি বলল- এ-ও মনে নেই যে, আমি কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম, নাকি কোন যাযাবরের তাঁবুতে। কিন্তু এটা তো এমন রসহীন আলাপ করার সময় নয়।
আমরা সৈনিকরা স্মৃতিচারণে স্বাদ পাই- আতা আল-হাশেমী বললেন আমি তোমার মাথায়ও তোমার অতীতের দুচারটি স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
আমি স্বয়ংই একটি সুদর্শন স্মৃতি- মেয়েটি বলল- যার সঙ্গে আমি সামান্য সময়ও অতিবাহিত করি; আজীবনের জন্য আমি তার স্মৃতি হয়ে যাই। আমার নিজের কোন স্মৃতি নেই।
তুমি নিজেকে সুদর্শন নয় একটি ঘৃণ্য স্মৃতি বল- আতা আল-হাশেমী বললেন- তোমার দেহ থেকে আমি পাপের উৎকট গন্ধ পাচ্ছি। তুমি আমার কাছে আসলে আমি মাতাল হয়ে যাব। কোন পুরুষই তোমাকে স্মরণে রাখে না। তোমার মতো মেয়েদের শিকারীরা আজ এখানে কাল ওখানে রাত কাটায়। এক শিকার পেয়ে গেলে পূর্বের শিকারের কথা ভুলে যায়। তোমার এই রূপ দিন কয়েকের মেহমান মাত্র। তুমি এখন আমার হাতে বন্দী। তোমার এই চেহারাটাকে আমি এই মুহূর্তে শাস্তিস্বরূপ আহত করে বিশ্রী বানিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করব না। এই মরুভূমি, মদ, হাশশ আর অপকর্ম তোমাকে অল্পদিনের মধ্যেই শুকিয়ে যাওয়া ফুলে পরিণত করবে। তখন কাছে টেনে নেয়ার পরিবর্তে মানুষ তোমাকে অকেজো ভেবে ছুঁড়ে ফেলবে। এই খৃস্টান আর এই সুদানীরা তোমাকে ভিক্ষা করার জন্য রাস্তায় ঠেলে দেবে।
আতা আল-হাশেমীর দৃঢ়তা ও প্রভাব মেয়েটির মনোজগতে তোলপাড় সৃষ্টি করে দেয়। তকিউদ্দীনের কমান্ডার বলছিলেন
আমার একটি মেয়ে আছে। বয়সে তোমার চেয়ে দুতিন বছরের ছোট হবে। আমি তাকে এমন সম্ভ্রান্ত যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেব, যে আমার ন্যায় কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে উন্নত জাতের ঘোড়ায় চড়ে বেড়াবে। আমার মত, সে-ও রণাঙ্গনের শাহসাওয়ার হবে। আমার কন্যা বধূসাজে সাজবে। স্বামীর ঘরের রাণী হবে। স্বামীর হৃদয়-রাজ্যে রাজত্ব করবে। মানুষ আমার সৌভাগ্যশীল মেয়েটিকে এক নজর দেখতে চাইবে। কিন্তু পারবে না। আমি তাকে নিয়ে গর্ব করব। তার স্বামী তাকে এত বেশী ভালবাসবে যে, বৃদ্ধা হয়ে গেলেও সেই ভালবাসা শেষ হবে না। অপরদিকে তোমাকে দেখার জন্য কেউ অস্থির হয় না। কারণ, তুমি একটি উন্মুক্ত রহস্য। কারো অন্তরে তোমার মর্যাদা নেই। তোমাকে ভালবাসা দেবে এমন কাউকেও তুমি খুঁজে পাবে না।
আপনি আমার সঙ্গে এসব কথাবার্তা কেন বলছেন? মেয়েটি এমনভাবে জিজ্ঞেস করে, যেন কথাগুলো তার ভাল লাগছে না।
আমি তোমাকে বুঝাতে চাই যে, তোমার মত মেয়েরা পবিত্র হয়ে থাকে আতা আল-হাশেমী জবাব দেন- আমরা মুসলমানরা মেয়েদেরকে আল্লাহর নেয়ামত মনে করি। তুমি যদি সতীত্ব-সম্ভ্রম ও ধর্মের অর্থ বুঝে নিতে পার, তাহলে আল্লাহ তোমার উপর রহমত বর্ষণ করবেন। কিন্তু তুমি তা বুঝবে না। কারণ, তুমি সেই ভালবাসা সম্পর্কে অবহিত নও, যা আত্মার গভীর থেকে উত্থিত হয় এবং আত্মার গভীরে গিয়ে স্থান করে নেয়। তুমি বদনসীব। তুমি পুরুষের মোহ দেখেছ, ভালবাসা দেখনি।
আতা আল-হাশেমী ধীরে ধীরে বলে চললেন। তার কথা বলার ভঙ্গী আর প্রভাবই আলাদা। কিন্তু মেয়েটি এই ভেবে বিস্মিত যে, এই লোকটিও তো আর দশজনের ন্যায় পুরুষ। কিন্তু লোকটি আমার এই উপচেপড়া রূপ-যৌবনকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিল না! আতা আল-হাশেমী তো পাষাণও নন। তিনি তো আপাদমস্তক আবেগে নিমজ্জিত একজন সুপুরুষ। মেয়েটি অস্থির হয়ে যায়। বলল, আপনার কথার মধ্যে আমি এমন নেশা ও মাদকতা অনুভব করছি, যা আমার হাশীশে নেই। আপনার একটি কথাও আমি বুঝতে পারিনি। তথাপি প্রতিটি কথাই আমার অন্তরে দাগ কেটেছে।
মেয়েটি বুদ্ধিমতি ও বিচক্ষণ। এ ধরনের নাশকতামূলক কাজের জন্য বিচক্ষণতা অবশ্যকীয় গুণ। পুরুষদেরকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচানোর জন্য ওকে ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই পুরুষটি মেয়েটির সব বিদ্যা-বুদ্ধি অকেজো করে দিয়েছে। মেয়েটি আতা আল-হাশেমীকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করে। ধর্ম বিষয়ক প্রশ্নও করে। তার বলার ভঙ্গিতে এখন পেশাদারী ভাব নেই। এখন কথা বলছে যে স্বাভাবিক গতিতে। মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, আপনি আমাকে কী শাস্তি দেবেন?
তোমাকে আমি কোন শাস্তি দিতে চাই না- আতা আল-হাশেমী বললেন- আগামীকাল সকালে আমি তোমাকে আমার সালারে আজমের হাতে তুলে দেব।
তিনি আমার সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন?
যা আমাদের আইনে লেখা আছে।
আপনি কি আমাকে ঘৃণা করেন?
না।
আমি শুনেছি, মুসলমানরা নাকি একের অধিক স্ত্রী রাখে- মেয়েটি বলল আপনি যদি আমাকে আপনার স্ত্রী বানিয়ে নেন, তাহলে আমি আপনার ধর্ম গ্রহণ করে আজীবন আপনার সেবা করব।
আমি তোমাকে আমার কন্যা বানাতে পারি- স্ত্রী নয়- আতা আল-হাশেমী বললেন- কারণ, তুমি এখন আমার হাতে অসহায়। তুমি আমার আশ্রয়েও আছ, বন্দীতেও। আমি তোমার অসহায়ত্ব থেকে সুযোগ নিতে চাই না।
***
আতা আল-হাশেমী ও গোয়েন্দা মেয়েটি কথা বলছেন। মেয়েটির পুরুষ সঙ্গী তিনজন সৈনিকের বেষ্টনীর মধ্যে শুয়ে আছে। কিন্তু সে জাগ্রত। আতা আল-হাশেমী মেয়েটিকে নিদ্রা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সে দেখেছিল। তাতে সে এই ভেবে আনন্দিত যে, মেয়েটি মুসলিম কমান্ডারকে ফঁদে ফেলে খুন করতে পারবে। শুয়ে শুয়ে সে মেয়েটির ফিরে আসার অপেক্ষা করছে।
দীর্ঘ সময় পর লোকটি ঘুমন্ত মুসলিমের প্রতি চোখ বুলায়। সিপাহীরা অচৈতন্য ঘুমিয়ে আছে। এই সুদানী লোকটি সন্ধ্যার পর তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছিল এবং হাসি-তামাশার মধ্যে তাদেরকে হাশীশ খাইয়ে দিয়েছিল। আতা আল-হাশেমী তল্লাশি চালিয়ে তার থেকে হাশীশের একটি পুটুলী উদ্ধার করলেও সামান্য একটু হাশীশ তার চোগার পকেটে লুকায়িত ছিল, যা আতা আল হাশেমী খুঁজে পাননি। রাতে গল্পের ছলে সেটুকু বের করে তিনজন সিপাহীকে খাইয়ে দেয়। মুসলিম সিপাহীরা নেশাপানে অনভ্যস্ত। তাই সামান্য একটুতেই অচেতন ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবে সুদানী পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল।
সুদানী দেখল যে, তার সঙ্গী এক মেয়ে একটি টিলার পাদদেশে মুসলিম কমান্ডার আতা আল-হাশেমীর কাছে বসে আছে। এভাবে অনেক সময় কেটে গেল, কিন্তু মেয়েটি ফিরে আসছে না। সুদানী মনে করল, বোধ হয় মেয়েটি লোকটাকে খুন করার মওকা পাচ্ছে না।
সুদানী শয়ন থেকে উঠে দাঁড়ায়। অতি সাবধানে ঘুমন্ত সিপাহীদের একটি ধনুক ও নীর থেকে কয়েকটি তীর হাতে তুলে নেয়। মুসলমানদের অস্ত্র দিয়েই মুসলিম কমান্ডারকে খুন করতে চাইছে সে। একপা-দুপা করে অগ্রসর হতে শুরু করে। সামনে কয়েক ফুট উঁচু একটি জায়গা, যার কারণে আতা আল-হাশেমীকে দেখা যাচ্ছে না। পা টিপে টিপে জায়গাটা অতিক্রম করে এগিয়ে যায় লোকটি।
এবার দুজনকেই দেখা যাচ্ছে। কমান্ডারের পিঠটা তার দিকে। তাই কমান্ডার তাকে দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটি চাঁদের আলোতে তীর-ধনুক হাতে একটি লোকের আগমন দেখতে পায়। আগত লোকটিকে চিনে ফেলে সে। আতা আল-হাশেমী নিজের মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন। খঞ্জরটা তার কোষবদ্ধ পড়ে আছে এক পার্শ্বে। মেয়েটি ঝট করে খঞ্জরটা হাতে তুলে নেয়। দেখে আতা আল-হাশেমী খঞ্জর ছিনিয়ে নেয়ার জন্য মেয়েটির প্রতি হাত বাড়ায়। কিন্তু এরই মধ্যে মেয়েটি অতি দ্রুততার সাথে নিজের সঙ্গী পুরুষটির প্রতি খঞ্জর ছুঁড়ে মারে।
দুজনের মাঝে গজ কয়েকের ব্যবধান। অপরদিক থেকে আর্তচিৎকারের শব্দ কানে আসে। খঞ্জরটি সুদানীর ধমনীতে গিয়ে বিদ্ধ হয় এবং আহত হয়েও মেয়েটিকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে। শাঁ করে এসে তীরটি মেয়েটির বুকে বিদ্ধ হয়।
মেয়েটি যেদিকে খঞ্জর ছুঁড়ে মারল এবং যেদিক থেকে তীর আসল, আতা আল-হাশেমী সেদিকে দৌড়ে যান। সুদানী লোকটি ততক্ষণে দেহ থেকে খঞ্জরটি টেনে বের করে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। তার আক্রমণের আশংকায় আতা আল হাশেমী লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ের সর্বশক্তি দিয়ে লোকটির পাজরে; লাথি মারেন। লোকটি দূরে ছিটকে পড়ে। আতা আল-হাশেমী নিজে পড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ান। কিন্তু সুদানী উঠতে পারল না। তার ক্ষতস্থানে ফিকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। তিনি খঞ্জর কুড়িয়ে হাতে নেন এবং মেয়েটির কাছে যান। মেয়েটি নিজেরই সঙ্গী ও দেহরক্ষীর তীর বুকে নিয়ে নির্জীব পড়ে আছে। তবে এখনো সে জীবিত। তীর বের করার কোন ব্যবস্থা নেই।
মেয়েটি আতা আল-হাশেমীর হাত চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমি আপনার জীবন রক্ষা করেছি। বিনিময়ে আপনি আপনার খোদাকে বলুন, যেন তিনি আমার আত্মাকে তার আশ্রয়ে নিয়ে নেন। আমার জীবনটা পাপের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। আপনি আমাকে নিশ্চয়তা দৈন, আল্লাহ এই একটি নেকীর বিনিময়ে আমার গোটা জীবনের পাপ ক্ষমা করবেন কিনা। আপনি আপনার কন্যার মাথায় যেভাবে হাত বুলান, আমার মাথায়ও সেভাবে হাত বুলিয়ে দিন।
আতা আল-হাশেমী মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমার সব পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তুমি নিজে পাপ করনি, তোমাকে দিয়ে পাপ করানো হয়েছে। এতকাল কেউ তোমাকে আলোর পথ দেখায়নি।
প্রচণ্ড ব্যথায় মেয়েটি কুঁকিয়ে উঠে শক্ত করে আতা আল-হাশেমীর ডান হাতটা ধরে বলতে থাকে
এখান থেকে তিন ক্রোশ দূরে সুদানীদের একটি ঘাঁটি আছে। তারা সেখানে আপনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে অবস্থান করছে। আপনার সৈন্যরা এতবেশী ছড়িয়ে পড়েছে যে, তাদের ভাগ্যে এখন মৃত্যু বা বন্দীত্ব ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই। আপনার প্রত্যেক কমান্ডার ও প্রতিটি সেনাদলের পেছনে আমার ন্যায় মেয়েদের লাগিয়ে রাখা হয়েছে। ঐ মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে আমি এ পর্যন্ত আপনার চারজন কমান্ডারকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করেছি। আপনি মিসরের কথা ভাবুন। খৃস্টানরা সেখানে ভয়ানক ও সূক্ষ্ম জাল পেতে রেখেছে। আপনার জাতি ও সৈনিকদের মধ্যে এমন অনেক মুসলিম কর্মকর্তা আছে, যারা খৃষ্টানদের বেতনভোগী গুপ্তচর ও ওফাদার। তারা আমার ন্যায় রূপসী নারী আর অঢেল সম্পদ ভোগ করছে। আপনারা মিসরকে রক্ষা করুন। সুদান ত্যাগ করে চলে যান। গাদ্দারদের চিহ্নিত করে শায়েস্তা করুন। আমি কারো নাম জানি না। যা জানা ছিল বলে দিলাম। আপনিই প্রথম পুরুষ, যিনি আমাকে কন্যা আখ্যায়িত করলেন। আপনি আমাকে পিতার স্নেহ দিয়েছেন।
তারই বিনিময়স্বরূপ আমি আপনাকে এসব তথ্য প্রদান করলাম। আপনি আপনার বিক্ষিপ্ত বাহিনীকে একত্রিত করুন এবং আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আগামী দুতিন দিনের মধ্যেই আপনার উপর আক্রমণ হবে। ফাতেমী ও ফেদায়ীদের থেকে সাবধান থাকুন। তারা মিসরে এমন বহু কর্মকর্তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ও জাতির একান্ত বিশ্বস্ত ও অফাদার।
ক্ষীণ হয়ে আসে মেয়েটির কণ্ঠস্বর। সে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় চিরদিনের জন্য।
রাত কেটে ভোর হল। আতা আল-হাশেমী দুটি লাশ ও জীবিত মেয়েকে নিয়ে তকিউদ্দীনের নিকট চলে যান। তকিউদ্দীনকে ঘটনা শোনা এবং নিহত মেয়েটির শেষ কথাগুলো তার কানে দেন। এসব নিয়ে তকিউলীন পূর্ব থেকেই উদ্বিগ্ন। তিনি আরো বিচলিত হয়ে উঠেন। বললেন, তবে আমি সুলতান আইউবীর অনুমতি ব্যতীত পিছপা হতে চাই না। আমি বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল এক কমান্ডারকে কার্ক পাঠিয়েছি। তোমরা তার ফিরে আসা পর্যন্ত অটল থাক।
***
সুলতান আইউবী দূতের বিবৃত যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনায় পড়ে যান। তিনি তার উপদেষ্টাদের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি বললেন
বিক্ষিপ্ত সৈন্যদের একত্রিত করে পেছনে সরে আসা সহজ কাজ নয়। দুশমন তাদেরকে একত্রিত হতে দেবে না। তাছাড়া পেছনে সরে আসলেই সৈন্যদেরও মনোবল ভেঙ্গে পড়বে, যারা মিসরে অবস্থান করছে। বিষয়টা তাদেরও উপর প্রভাব ফেলবে, যারা আমার সঙ্গে এখানে রয়েছে। জনগণের মনও ভেঙ্গে যাবে। তবে বাস্তবকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। বাস্তবতার দাবী হল, তকিউদ্দীন তার বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসুক। আমরা এ মুহূর্তে তাকে সাহায্য করতে পারছি না। কার্ক অবরোধ প্রত্যাহার করে তাকে সহযোগিতা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ভাই বিরাট ভুল করল। আমার বড় মূল্যবান সৈন্যগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
সুদানের যুদ্ধ থেকে আমাদের হাত গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তই নেয়া উচিত পদস্থ এক কর্মকর্তা বললেন- নেতা ও শাসকবর্গের ভুল পদক্ষেপের কারণে সেনাবাহিনীর দুর্নাম হচ্ছে। দেশবাসীকে আমাদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়া দরকার যে, সুদানে আমাদের পরাজয়ের জন্য সেনাবাহিনী দায়ী নয়।
সন্দেহ নেই যে, এটি আমার ভাইয়ের ভুল- সুলতান আইউবী বললেন আর আমার ভুল হল, আমি তাকে এই অনুমতি দিয়ে রেখেছিলাম যে, কখনো কোন অভিযান পরিচালনা করার প্রয়োজন দেখা দিলে যেন আমাকে কিছু না জানিয়েই করে ফেলে। এখন বেচারা সাত-পাঁচ বিবেচনা না করেই এতবড় অভিযান পরিচালনা করে ফেলল এবং নিজেকে দুশমনের দুয়ার উপর ছেড়ে দিল। কিন্তু আমি আমার ও আমার ভাইয়ের এই বিচ্যুতিকে দেশবাসী ও নূরুদ্দীন জঙ্গী থেকে গোপন রাখব না। আমি ইতিহাসকে ধোকা দেব না। আমি ইতিহাসের পাতায় লিখিয়ে রাখব যে, আমিই এই পরাজয়ের জন্য দায়ী। সেনাবাহিনী নয়। আমি সালতানাতে ইসলামিয়ার অনাগত শাসকদের জন্য এই নমুনা প্রতিষ্ঠিত করে যেতে চাই যে, তারা যেন নিজেদের ক্রটি গোপন রেখে নির্দোষ লোকদেরকে অপদস্থ না করে। নিজের দোষ ঢেকে রেখে নিরপরাধ লোকদের উপর দায়-দায়িত্ব চাপানো এমন এক প্রবণতা ও প্রতারণা, যা বিশ্ব ভূমণ্ডলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
সুলতান আইউবীর চেহারা লাল হয়ে যায়। কণ্ঠস্বর কাঁপতে শুরু করে। মনে হচ্ছিল, যেন তিনি পেছনে সরে আস উচ্চারণ করতে চাইছে না। তিনি কখনো পিছপা হননি। তিনি অনেক কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতে লড়াই করেছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কাছে তিনি অসহায়। তিনি তকিউদ্দীনের প্রেরিত কমান্ডারকে বললেন
তকিউদ্দীনকে গিয়ে বল, সে যেন তার বাহিনীকে গুটিয়ে নেয় এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে পেছনে পাঠিয়ে দেয়। কোথাও দুমশন ধাওয়া করলে মোড় ঘুরিয়ে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করবে এবং এমন ধারায় লড়াই করবে, যেন দুশমন তোমাদেরকে ধাওয়া করতে করতে মিসরে ঢুকে না পড়ে। যখন যে দল মিসরে প্রবেশ করবে, তাদের সংঘবদ্ধ থাকার নির্দেশ দেবে, যাতে দুশমন মিসর আক্রমণ করলে সফলতার সাথে তার মোকাবেলা করা যায়। নিরাপদে সরে আসার জন্য গেরিলা বাহিনীকে ব্যবহার করবে। কোন সেনাদলকে দুশমনের বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ অবস্থায় ফেলে আসবে না। পেছনে সরে আসার এ সিদ্ধান্ত আমি বড় কষ্টে সহ্য করছি। কারণ, আমার এই সংবাদ বরদাশত করা সম্ভব হবে না যে, তোমাদের কোন বাহিনী দুশমনের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছে। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পেছনে সরে আসা সহজ কাজ নয়। অগ্রাভিযানের তুলনায় মান-মর্যাদা বজায় রেখে নিরাপদে সরে আসা অনেক কঠিন কাজ। তোমরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখবে। দ্রুতগামী একদল দূত সঙ্গে রাখবে। আমি লিখিত পয়গাম প্রেরণ করছি না। কারণ, পথে ধরা পড়ে গেলে দুশমন বুঝে ফেলবে যে, তোমরা পেছনে সরে যাচ্ছ।
সুলতান আইউবী জরুরী নির্দেশনা দিয়ে দূত কমান্ডারকে বিদায় জানান। দূত রওনা হয়ে যায়।
দূতের ঘোড়ার পদশব্দ এখনো শোনা যাচ্ছে। এমন সময় জাহেদান কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং বললেন- কায়রো থেকে একজন দূত এসেছে। সুলতান আইউবী তাকে ভেতরে ডেকে পাঠান। লোকটি গোয়েন্দা বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। মিসরের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সংক্রান্ত দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছেন তিনি। তিনি জানান, মিসরে দুশমনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড দিন দিন বেড়েই চলেছে। আলী বিন সুফিয়ান তার পুরো বিভাগ নিয়ে তার মোকাবেলায় দিন-রাত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন নাজুক রূপ ধারণ করেছে যে, সেনা বিদ্রোহেরও আশংকা দেখা দিয়েছে।
সুলতান আইউবীর চেহারার রঙ বিবর্ণ হয়ে যায়। সমস্যা শুধু মিসরের হলে চিন্তার তেমন কারণ ছিল না। মিসরকে তিনি বহু আশংকাজনক সমস্যা থেকে রক্ষা করেছেন। খৃস্টান ও ফাতেমীদের অনেক ভয়ংকর নাশকতামূলক পরিকল্পনা তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন। সমুদ্রের দিক থেকে আসা খৃস্টানদের ভয়াবহ হামলা তিনি সফলতার সাথে প্রতিহত করেছেন। খলীফাকে পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত করে তিনি দেশের পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রেখেছেন। কিন্তু কার্ক অবরোধ করে এখন তিনি সেখানে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে গেছেন। এই ময়দানে তার অনুপস্থিতি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। কার্ক অবরোধ ছাড়াও তিনি দুর্গের বাইরে খৃস্টানদের অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। এই অবরুদ্ধ খৃস্টান বাহিনী অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে সুলতান আইউবী তাঁর দুশমনের জন্য আপদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। এই যুদ্ধ তাঁর তত্ত্বাবধান ছাড়া লড়া সম্ভব নয়।
সুলতান আইউবীর আশংকা, তকিউদ্দীন যদি পলায়নের ধারায় পিছপা হতে শুরু করে, তাহলে শত্রু বাহিনী তাকে ওখানেই খতম করে সোজা মিসরে ঢুকে পড়বে। মিসরে যে পরিমাণ সৈন্য আছে, তারা হামলা প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট নয়।
এদিকে সুলতান আইউবীর কার্ক অবরোধের আশু সাফল্য সংশয়পূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। উভয় রণাঙ্গনের সার্বিক চিত্র মিসরে বিদ্রোহের আশংকা জোরদার করে তুলছে, যার ফলে সুলতান আইউবীর সুদৃঢ় পা টলতে শুরু করেছে। তিনি কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করতে থাকেন। খানিক পর মাথা তুলে বললেন
আমি খৃষ্টানদের সকল সৈন্যের মোকাবেলা করতে পারি। আমি তাদের সেই বাহিনীরও মোকাবেলা করতে পারি, যাদেরকে তারা ইউরোপে সমবেত করে রেখেছে। কিন্তু আমার স্বজাতীয় গুটিকতক গাদ্দার আমাকে পরাজিত করে তুলেছে। কাফেরদের এই সহযোগীরা কেন নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করছে? বোধ হয় তারা জানে, যদি তারা ধর্ম পরিবর্তন করে নতুন পরিচয় ধারণ করে, তাহলে খৃষ্টানরা তাদেরকে এই বলে তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিবে যে, তোমরা ঈমানবেঁচা গাদ্দার। তাই ওরাই এদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে, তোমরা নাম-পরিচয়ে নিজ ধর্মে-ই থাক আর আমাদের থেকে বেতন-ভাতা নিয়ে গাদ্দারী কর।
সুলতান আইউবী নীরব হয়ে যান। তাঁর তাঁবুতে যারা উপস্থিত ছিল, তারাও নীরব। সুলতান তাদের সকলের প্রতি একবার করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন
আল্লাহ আমাদের থেকে কঠিন পরীক্ষা নিতে চাইছেন। আমরা যদি ঈমানের উপর অটল থাকতে পারি, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে কামিয়াব করবেন।
সুলতান আইউবী তার সঙ্গীদের সাহস বাড়ানোর লক্ষ্যে একথা বললেন বটে; কিন্তু তার চেহারা বলছে তিনি শংকিত।
***
সুলতান আইউবীকে শুধু এটুকুই জানানো হয়েছিল যে, মিসরে বিদ্রোহের আশংকা দেখা দিয়েছে এবং খৃষ্টানদের নাশকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বিস্তারিত তাকে জানানো হয়নি। এই সংক্রান্ত রিপোর্টের ব্যাখ্যা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। তার অনুপস্থিতির সুযোগে তিন-চারজন মুসলিম কর্মকর্তা খৃষ্টানদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছে। সুদান আক্রমণ করার দিনকয়েক পর-ই তকিউদ্দীন মিসরে রসদ চেয়ে পাঠান। যত দ্রুত সম্ভব রসদ প্রেরণ করার নির্দেশ পাঠানো হয়। কিন্তু দুদিন পর্যন্ত রসদ পাঠানোর কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে জবাব আসে, একই সময়ে দুটি ময়দান খোলা হয়েছে, এত রসদ আমি কোথা হতে দিব? এক পারি মিসরের বাহিনীকে উপোস রেখে সব খাদ্যসম্ভার ময়দানে পাঠিয়ে দিতে। এত পেট আমি ভরতে পারব না।
এই উক্তিটি যার, তিনি উচ্চপদস্থ একজন মুসলিম কর্মকর্তা এবং সুলতান আইউবীর ঘনিষ্টজনদের একজন। এমন এক ব্যক্তি, যার প্রতি সন্দেহ পোষণ করার প্রশ্নই আসেনা। ফলে তার জবাবের সত্যতা স্বীকার-ই করে নেয়া হল যে, আসলেই খাদ্যসম্ভারের অভাব রয়েছে। তথাপি তাকে অনুরোধ করা হল যে, যেভাবে সম্ভব ময়দানের যোদ্ধাদের জন্য কিছু রসদ পাঠিয়ে দিন। কর্মকর্তা কিছু রসদের ব্যবস্থা করলেন বটে, কিন্তু পাঠালেন আরো দুদিন বিলম্ব করে।
পঞ্চম দিবসে রসদের কাফেলা রওনা হয়। উট ও খচ্চরের দীর্ঘ এক বহর। কাফেলার সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য একদল অশ্বারোহী সৈনিক দেয়ার। পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কর্মকর্তা তাতে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি যুক্তি দেখান, রসদ পরিবহনের সমস্ত পথ-ই নিরাপদ, নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া তিনি মিসরেও পর্যাপ্ত সৈন্যের উপস্থিতির আবশ্যকতাও ব্যক্ত করেন। অবশেষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই রসদবাহী কাফেলা রওনা হয়ে যায়। ছয়দিন পর সংবাদ আসে, রসদ পথে-ই (সুদানের অভ্যন্তরে) দুশমনের কাছে আটকা পড়ে গেছে। সুদানী সৈন্যরা পশুপালসহ সমস্ত রসদ নিয়ে গেছে এবং পশুচালকদের হত্যা করে ফেলেছে।
কায়রোর শীর্ষ কর্মকর্তাগণ অস্থির হয়ে পড়েন। এই রসদ বহর ধ্বংস হওয়া মিসরের জন্য বিরাট এক ক্ষতি। সুদান রণাঙ্গনের বাহিনীর সংকট অনুভূতি কর্মকর্তাদের আরো ভাবিয়ে তোলে। তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বললেন, আপনি অবিলম্বে পুনরায় রসদ পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। কর্মকর্তা বললেন, বাজারে খাদ্যসামগ্রীর তীব্র অভাব। আপনারা ব্যবসায়ীদেরকে বলুন, তারা খাদ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিক। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হল। তারা তাদের খাদ্যগুদাম খুলে দেখায়-সব শূন্য। গোশতের জন্য দুম্বা, বকরী, গরু, মহিষ কিছুই পাওয়া গেল না। আরো খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মিসরে অবস্থানরত সৈন্যরাও পর্যাপ্ত রেশন পাচ্ছে না। তাই তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানায়, গ্রামাঞ্চল থেকে কোন মাল-ই আসছে না। অনুসন্ধানে জানা গেল, বাইরে থেকে মানুষ মফস্বলে এসে তরি-তরকারী, ধান চাল ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী বাজার মূল্যের চেয়ে বেশী দামে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তার অর্থ, মিসরের খাদ্যসামগ্রী পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। এবার সকলের স্মরণ হল, যে, তিন-চার বছর আগে সুলতান আইউবী মিসরের পূর্বেকার সেনাবাহিনীকে- যাদের অধিকাংশ ছিল সুদানী-বিদ্রোহের অপরাধে ভেঙ্গে দিয়ে তার অফিসার সৈন্যদেরকে সীমান্ত লাগোয়া আবাদযোগ্য জমি দিয়ে কৃষিকার্যে জুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারা এখন মিসর সরকার এবং ব্যবসায়ীদেরকে তাদের উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করছে না।
এ হল সুদান আক্রমণের প্রতিক্রিয়া। এই পরিবর্তন সূচিত হয়েছে মাত্র ছয়-সাত দিনের মধ্যে। ফলে মিসর সরকার খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর উপর অর্পণ করে। তারা দিন-রাত খাটা-খাটুনি করে সামান্য যা পেল, নিরাপত্তা হেফাজতে সুদানের রণাঙ্গন অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়া হল।
রসদ সংকটের বিষয়টি মিসরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য প্রচণ্ড মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর আগে এমন খাদ্যসংকট কখনো দেখা যায়নি। তারা এই চিন্তায়ও অস্থির হয়ে পড়েন যে, সুলতান আইউবী নিজে যদি রসদ চেয়ে বসেন, তা হলে কি জবাব দেবেন। মিসরে খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে, একথা সুলতান বিশ্বাসই করবেন না। এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হল। তাদের মধ্যে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সালীম আল-ইদরীসও রয়েছেন। সে সময়কার অপ্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, আল-ইদরীস সেই কমিটির প্রধান ছিলেন। অপর দুজন ছিলেন তার থেকে মাত্র এক স্তর নিম্নপদের বে-সামরিক কর্মকর্তা।
রাতে কমিটির বৈঠক বসে। দুসদস্য আল-ইদরীসকে বললেন, সুলতান—– আইউবী একত্রে দুটি ময়দান খুলে মারাত্মক ভুল করেছেন। আর তকিউদ্দীন তো পরাজয়ের গ্লানি মাথায় না নিয়ে ফিরছেন না।
ফিলিস্তীন মুসলমানদের ভূখণ্ড- আল-ইসরীস বললেন-ওখান থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত করা আবশ্যক। মুসলমানরা ওখানে পশুর মত জীবন যাপন করছে। ওখানকার মুসলিম নারীদের ইজ্জতের কোন নিরাপত্তা নেই। মসজিদসমূহ আস্তাবলে পরিণত হয়েছে।
এ-সবই প্রচারণা- বলল একজন- আপনি কি নিজ চোখে দেখেছেন যে, ফিলিস্তীনে খৃষ্টানরা মুসলমানদের উপর জুলুম করছে?
প্রচারণা নয়-আমি বাস্তব সত্য আপনাদের বলেছি- আল-ইদরীস বললেন।
আমাদের থেকে সত্য গোপন করা হচ্ছে- অপরজন বলল- সালাহুদ্দীন আইউবী শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বটে, কিন্তু সত্য প্রকাশ করতে আমাদের ভয় করা উচিত নয়। দেশ দখলের মোহ আইউবীকে স্থির হয়ে বসতে দিচ্ছে না। আইউবী খান্দানকে তিনি শাহী খান্দানে পরিণত করতে চাইছেন। খৃষ্টান বাহিনী অপ্রতিরোধ্য ঝড়। তাদের মোকাবেলা করার সাধ্য আমাদের নেই। খৃষ্টানরা যদি আমাদের দুশমন হত, তাহলে তারা ফিলিস্তীনের পরিবর্তে মিসর কজা করে নিত। তাদের এত সৈন্য আছে যে, এতদিন তারা আমাদের ক্ষুদ্র বাহিনীকে পিষে ফেলতে পারত। তারা আমাদের নয়- সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন।
আপনার কথাগুলো আমার কাছে অসহ্য লাগছে-আল-ইদরীস বললেন- এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আসুন আমরা আসল কথা বলি।
কথাগুলো আমারও কাছে অসহনীয়-একজন বলল- কিন্তু এক ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ পূরণের জন্য আমাদের গোটা জাতির স্বার্থ ত্যাগ করা উচিত হবে না। আপনি উভয় ময়দানের জন্য রসদ সরবরাহের কথা বলছেন। কিন্তু রসদের অবস্থা তো দেখছেন যে, পাওয়া যাচ্ছে না। সুদানের ময়দান ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি ভাবছি, এই ময়দানের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেব। তকিউদ্দীন পিছনে সরে আসবেন আর সাধারণ সৈন্যরা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে।
এ-ও তো হতে পারে যে, আমরা রসদ না পাঠালে তকিউদ্দীন অপারগতাবশত দুশমনের হাতে ধরা পড়ে যাবে- আল-ইদরীস বললেন এমনও হতে পারে যে, নিরুপায় হয়ে আমাদের সৈন্যরা দুশমনের হাতে আত্মসমর্পণ করবে।
আত্মসমর্পণ করুক, আমরা পরাজয়ের দায় সৈন্যদের উপর চাপিয়ে দেব। লোকটি বলল।
আপনি কেন এমনটি বলছেন? আল-ইদরীস বললেন।
আমার চিন্তা খুবই স্পষ্ট- লোকটি জবাব দেয়- সালাহুদ্দীন আইউবী আমাদের উপর সামরিক শাসন চাপিয়ে দিতে চাইছেন। তিনি খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ করে জাতিকে বুঝাতে চাচ্ছেন যে, জাতির নিরাপত্তার জিম্মাদার শুধু সেনাবাহিনী আর জাতির ভাগ্য সেনাবাহিনীর হাতে। আইউবী যদি সত্যিই শান্তিপ্রিয় মানুষ হতেন, তাহলে তিনি খৃষ্টান ও সুদানীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে শান্তির পথ বেছে নিতেন।
আল-ইদরীস হঠাৎ শিউরে উঠেন। সুলতান আইউবী-বিরোধী ও খৃষ্টানদের পক্ষপাতিত্বমূলক কথাগুলো তার সহ্য হচ্ছে না। বৈঠকে তীব্র বাক বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। কমিটির অপর দুসদস্য আল-ইদরীসকে কথা-ই বলতে দিচ্ছে না। অবশেষে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি বৈঠক সমাপ্ত ঘোষণা করছি। আগামীকালই আমি আপনাদের মতামত ও প্রস্তাবাবলী নিয়ে ময়দানে আমীরে মেসের-এর নিকট পাঠিয়ে দেব।
তিনি রাগের মাথায়-ই উঠে দাঁড়ান।
অপর দুসদস্যের একজন সেখান থেকে চলে যায়। দ্বিতীয়জন-যার নাম আরসালান-আল ইদরীস-এর সঙ্গে থেকে যায়। আরসালান বলল, আপনি আসলে ব্যক্তিপূজারী ও আবেগপ্রবণ মানুষ। আমি সত্য কথা বললাম আর আপনি ক্ষেপে গেলেন। এখন আপনার প্রতি আমার পরামর্শ, আমার বিরুদ্ধে আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছে কিছুই লিখবেন না। এর অন্যথা হলে আপনার জন্য ভাল হবেনা।
লোকটির কণ্ঠস্বর চ্যালেঞ্জ ও হুমকিমিশ্রিত। আল-ইদরীস তার প্রতি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। আরসালান বলল, সুযোগ দিলে আমি আপনার সঙ্গে নির্জনে আরো কিছু কথা বলতে চাই।
এখানেই বলুন। আল-ইদরীস বললেন।
আমার ঘরে চলুন-আরসালান বলল- খাবার আমার ঘরে খাবেন। তবে খেয়াল রাখবেন এই সাক্ষাৎ হবে একেবারে গোপনীয়।
আল-ইদরীস আরসালান-এর সঙ্গে তার ঘরে চলে যান। ভিতরে ঢোকার পর তার মনে হল, যেন তিনি কোন রাজমহলে এসেছেন। অথচ আরসালান তেমন উচ্চপদের কর্মকর্তাও নয়।
দুজন একটি কক্ষে উপবিষ্ট। এমন সময়ে এক অতিশয় রূপসী যুবতী আকর্ষণীয় একটি সোরাহী ও রূপার গোলাকার একটি থালায় করে রূপার দুটি গ্লাস হাতে কক্ষে প্রবেশ করে এবং পাত্রগুলো তাদের সম্মুখে রেখে দেয়। আল ইদরীস ঘ্রাণ থেকে-ই বুঝে ফেললেন, পাত্রের পদার্থগুলো মদ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আরসালান, তুমি মুসলমান হয়ে মদপান করছ?
আরসালান মুচকি হেসে বলল, এক চুমুক পান করুন, তাহলে আপনিও সেই সত্যকে বুঝতে পারবেন, যা আমি আপনাকে বুঝাতে চাচ্ছি।
দুজন সুদানী ভিতরে প্রবেশ করে। তাদের হাতে চকমকে তশতরীতে রকমারী খাবার। আল-ইদরীস বিস্ময়ভরা চোখে আরসালান-এর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। আরসালান বলল, অবাক হবেন না মোহতারাম ইদরীস! এই শান শওকত আপনিও লাভ করতে পারেন। আমিও আপনার ন্যায় একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কিন্তু আজ দেখুন কেমন রূপসী দুটি যুবতী আমার ঘরের শোভা বৃদ্ধি করেছে। আপনি দামেস্ক ও বাগদাদের আমীর-উজীরদের ঘরে গিয়ে দেখুন, তারাও এরূপ রূপসী যুবতী মেয়েদের দিয়ে হেরেম পূর্ণ করেছে। দেখবেন, ওদের হেরেমে মদের বন্যা বইছে।
এই রূপসী মেয়ে, এই ঐশ্বর্য, এই মদ খৃস্টানদের গোলামীর আশির্বাদ-আল-ইদরীস বললেন- নারী আর মদ সালতানাতে ইসলামিয়ারকে ফোল্লা করে দিল।
আপনি দেখছি, সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাষায় কথা বলছেন- আরসালান বলল-এ আপনার দুর্ভাগ্য।
তুমি কী বলতে চাও?- আল-ইদরীস ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন-আমার মনে হচ্ছে তুমি ক্রুসেডারদের জালে আটকা পড়েছ।
আমি সোনবাহিনীর গোলামে পরিণত হতে চাই না-আরসালান বলল-আমি সেনাবাহিনীকে আমার গোলাম বানাতে চাই। তার একমাত্র পন্থা হল, সুদানে তকিউদ্দীনকে রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিন। বিশেষ সাহায্য আসছে বলে তাকে ধোকা দিতে দিতে এবং মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দিয়ে তাকে যুদ্ধে জড়িয়ে রাখতে হবে, যাতে সে সুদানীদের হাতে অস্ত্রসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তকিউদ্দীন সুদানীদের হাতে মারা পড়বে এবং তার বাহিনী চিরদিনের জন্য ওখানেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমরা পরাজয়ের দায়ভার সেনাবাহিনীর উপর চাপিয়ে জাতির সামনে তাদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করব। তারপর জাতি সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীকেও ঘৃণা করতে শুরু করবে। আপনি চেষ্টা করুন, এ পন্থা অবলম্বন করলে আপনি ঠকবেন না। আপনি এর এত প্রতিদান পাবেন, আপনি যার কল্পনা করতেও পারবেন না।
আমি তোমার মতলব বুঝে ফেলেছি- আল-ইদরীস বললেন-তুমি আমাকে দিয়ে ঈমান বিক্রি করাতে চাও। আমার দ্বারা কক্ষনো তা হবে না।
দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর আল-ইদরীস বললেন, আচ্ছা, তুমি এত ভয়ংকর কথা এমন বড় গলায় কিভাবে বলছ? আমি যে তোমাকে গ্রেফতার করে গাদ্দারীর শাস্তি দিতে পারি, সে কি তুমি ভুলে গেছ?
আহা, আমি কি বলতে পারবনা যে, আপনি আমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন?-আরসালান বলল- সালাহুদ্দীন আইউবী আমার বিরুদ্ধে একটি শব্দও শুনবেন না।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান আল-ইদরীস। দেশের এমন পদস্থ একজন কর্মকর্তা কত বড় এক শয়তানে পরিণত হয়ে গেল! লোকটি কেমন অহংকারের সাথে কথা বলছে!!
আল-ইদরীস নিজে একজন পরিপক্ক ঈমানদার মানুষ। তার বুঝেই আসছিল না যে, যারা নীলামে ঈমান বিক্রি করে ফিরে, তারা লাঞ্ছনার কত নিম্ন স্তরে নিক্ষিপ্ত হতে পারে!
আল-ইদরীস পদমর্যাদায় আরসালান-এর সিনিয়র। এই মুহূর্তে আরসালানকে কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা একান্ত প্রয়োজন। আল ইদরীস-এর কাছে তার একটিই পন্থা-ক্ষমতা প্রয়োগ করা। তিনি আরসালানকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি কী বলতে চাও এবং কী করছ, তা আমার আর বুঝতে বাকী নেই। তুমি যে অপরাধে লিপ্ত হয়েছ, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমি তোমাকে এতটুকু খাতির করতে পারি যে, আগামী সাত দিনের মধ্যে যদি তুমি অবস্থান পরিবর্তন করে পথে ফিরে আস এবং দুশমনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমাকে এই নিশ্চয়তা প্রদান কর যে, তুমি বাগদাদের খেলাফত ও স্বজাতির অফাদার, তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি। তবে এই মুহূর্তে আমি তোমাকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলাম। এ দায়িত্ব আপাতত আমি নিজেই পালন করব। আমি তোমাকে সাতদিনের সময় দিলাম। সাতদিন অনেক দীর্ঘ সময়। এ-মুহূর্ত থেকে এ বাড়িতে আমি তোমাকে নজরবন্দী করলাম। এমন যেন না হয় যে, অষ্টম দিনে। এখান থেকে বের করে তোমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে হয়।
আল-ইদরীস বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। তিনি দেখলেন, আরসালান মিটিমিটি হাসছে।
আরসালান বলল, শুনুন মোহতারাম ইদরীস! আপনার দুটি পুত্র আছে এবং দুজনই যুবক।
হা,–আল ইদরীস বললেন-তাতে কী হয়েছে।
না, কিছু-ই নয়- আরসালান বলল-আমি শুধু আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছি যে, আপনার দুটি যুবক পুত্রসন্তান রয়েছে। আর এরা ছাড়া আপনার আর কোন সন্তান নেই।
আরসালান-এর ইংগিতটা বুঝতে পারলেন না আল-ইদরীস। তিনি বললেন, মদ তোমার মস্তিষ্ক নষ্ট করে দিয়েছে।
বলেই তিনি বাইরে বেরিয়ে যান।
***
আরসালানের ঘর থেকে বের হয়ে আল-ইদরীস সোজা আলী বিন সুফিয়ানের কাছে চলে যান এবং তাঁকে আরসালান-এর ঘটনা শোনান। শুনে আলী বিন সুফিয়ান বললেন, আরসালান আমার সন্দেহভাজনদের একজন। তবে এ-যাবত আমি তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাইনি। তথাপি লোকটাকে আমি গোয়েন্দার নজরে রেখেছি।
আল-ইদরীস শুধু অস্থির-ই নন-বিস্মিতও যে, আরসালান এত বীরত্বের সাথে গাদ্দারীতে লিপ্ত হল কি করে! আলী বিন সুফিয়ান তাকে জানালেন, সে একা নয়-গাদ্দারী চলছে সুসংগঠিতভাবে। এর জীবাণু সেনাবাহিনীতেও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ, সুদান রণাঙ্গনের জন্য রসদ প্রেরণ করা। আল-ইদরীস আলী বিন সুফিয়ানকে জানালেন, আমি আরসালানকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছি, রসদের এন্তেজাম এখন আমার নিজের করতে হবে। আলী বিন সুফিয়ান তাকে জানালেন, দেশের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। মফস্বল থেকে তরি-তরকারী, গরু, মহিষ, ভেড়া-বকরী ইত্যাদি সীমান্তের ওপারে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাজারে খাদ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, আমি আমার গুপ্তচর ও তথ্য সংগ্রহকারীদেরকে দায়িত্ব দিয়েছি, তারা যেন রাতে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে এবং কোথাও খাদ্যসম্ভার চোখে পড়লে তুলে নিয়ে আসে। দীর্ঘ আলোচনার পর দুজনে রসদ সংগ্রহের পন্থা ঠিক করে ফেলেন।
আল-ইদরীস জাতীয় কর্তব্য পালনে এতই নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে, তার মাথা থেকে আরসালান-এর এই ইংগিত ছুটে-ই যায় যে, তোমার দুটি যুবক পুত্র আছে এবং ওরাই তোমার সাকুল্য সন্তান। পুত্রদের চরিত্রের ব্যাপারে আল-ইদরীস-এর পূর্ণ আস্থা আছে। কিন্তু মানুষের যৌবন অন্ধ হয়ে থাকে। সুলতান আইউবীর অনুপস্থিতির সুযোগে কায়রোতে অপকর্মের এমন এক ঢেউ সৃষ্টি হয়ে যায়, যা যুব সমাজের চিন্তা-চেতনায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করতে শুরু করে। দু-তিন বছর আগেও এমন এক তুফান উঠেছিল; সুলতান আইউবী, যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবার এই ঢেউ জেগেছে মাটির নীচ থেকে এবং সাফল্য অর্জন করে ফেলেছে। চরিত্রহীনতার এই ঢেউ জেগেছে নানারকম খেলাধুলার নামে।
এক ব্যক্তি তাঁবু খাঁটিয়ে ও শামিয়ানা ঝুলিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করেছে। এই খেলা-তামাশার মধ্যে বাহ্যত আপত্তিকর কিছু ছিল না। কিন্তু শামিয়ানার ভিতরে স্থাপন করা ছোট ছোট তাবুতে আলাদা আলাদাভাবে যুবকদেরকে ইংগিতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের থেকে টাকা নিয়ে কাপড়ের উপর হাতের তৈরী বিভিন্ন প্রকার চিত্র প্রদর্শন করা হয়-অশ্লীল উলঙ্গ নারীর ছবি। ছবি দেখানোর দায়িত্ব পালন করত যুবতী মেয়েরা, যাদের মুচকি হাসি ও অঙ্গভঙ্গিতে থাকত পাপের আবেদন।
সেখানেই এক পর্যায়ে যুবকদেরকে হাশীশ খাওয়ানো হত। এই লজ্জাকর ও ভয়াবহ অভিযান পরিচালিত হত মাটির উপরে। কিন্তু কেউ কুচক্রীদের ধরতে পারতনা। তার কারণ, যে-ই ছবি দেখে কিংবা হাশীশের স্বাদ উপভোগ করে আসত, সে-ই নিজের এই অপরাধপ্রবণতার কথা লুকিয়ে রাখত। সেই পাপে এমন-ই স্বাদ ছিল যে, যে একবার যেত, সে বারবার যেতে বাধ্য হত। তারা বিষয়টা বাইরে এ জন্যেও প্রকাশ করত না যে, সরকার জানতে পারলে তারা এই আনন্দ ও স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। এই অপরাধের শিকার হচ্ছিল সমাজের যুবক শ্রেণী ও সেনাসদস্যরা। তাদের জন্য পর্দার অন্তরালে বেশ্যালয়ও খুলে দেয়া হয়েছিল। মুসলমানের চরিত্র ধ্বংস করার এই অভিযান কিরূপ সফল ছিল? তার জবাব কার্ক দুর্গে খৃস্টানদের ইন্টেলিজেন্স প্রধান ও মনস্তাত্বিক যুদ্ধের লড়াকু জার্মান বংশোদ্ভূত হরমুন তার সম্রাটদের দিয়েছিলেন এভাবে
এসব ছবি অংকন করেছে স্পেনের চিত্রকররা। এ এমন এক অশ্লীল চিত্র, যা পাথরের তৈরী পুরুষদেরকেও মাটির মূর্তিতে পরিণত করে দেয়।
হরমুন একটি নারী-পুরুষের যুগল অশ্লীল চিত্র উপস্থিত সম্রাটদের দেখান। এটি বৃহৎ আকারের একটি ছবি, যা তুলির আঁচড়ে আকর্ষণীয় রং দ্বারা তৈরী করা হয়েছে। খৃস্টান সম্রাটগণ ছবিটি দেখে পরস্পর অশ্লীল ঠাট্টা করতে শুরু করেন। হরমুন বললেন
আমি এমন অসংখ্য ছবি তৈরী করিয়ে মিসরের বড় বড় শহরে সে-সবের গোপন প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছি। ওখান থেকে আমাদের সফলতার সংবাদ আসছে। আমি কায়রোর যুবক শ্রেণীর মধ্যে পাশবিকতা উস্কে দিয়েছি। পাশবিকতা এমন এক শক্তিশালী চেতনা, যা উত্তেজিত হয়ে উঠলে সকল সামরিক চেতনাকে-যার মধ্যে জাতীয় চেতনা অন্যতম-ধ্বংস করে দেয়। আমার তৈরী করান চিত্রসমূহ মিসরে অবস্থানরত মুসলিম সৈন্যদেরকে মানসিক ও চারিত্রিক দিক থেকে অকর্মণ্য করে দিতে শুরু করে দিয়েছে। এসব চিত্রের স্বাদ নেশার আবেদনও সৃষ্টি করে। আমি তারও ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমি অনেকগুলো রূপসী যুবতী মেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কায়রো ও অন্যান্য শহর-গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছি। ওরা উইপোকার ন্যায় সালাহুদ্দীন আইউবীর জাতি ও সেনাবাহিনীকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কায়রোতে আমার যে কয়াট মেয়ে ধরা পড়েছিল, তার কারণ ভিন্ন। এবার আমি যে নতুন পন্থা অবলম্বন করেছি, তা সফল হতে চলেছে। এখন ওখানকার মুসলমানরা নিজেরাই আমার মিশনের রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং তাতে শক্তি জোগাবে। তারা এই মানসিক বিলাসিতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অল্প কদিন পর-ই আমি তাদের মন মানসিকতায় তাদের-ই স্বজাতি ও স্বদেশের বিরুদ্ধে বিষ ঢুকাতে শুরু করব।
সালাহুদ্দীন আইউবী অত্যন্ত সতর্ক মানুষ- উপস্থিত লোকদের একজন বলল-তিনি যখন-ই মিসরে ফিরে আসবেন, সঙ্গে সঙ্গে তোমার সব অভিযান শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলবেন।
যদি তিনি মিসর পৌঁছাতে পারেন, তবে-ই তো ……-হরমুন বললেন এই প্রশ্নের জবাব আপনি-ই দিতে পারেন যে, আপনি তার অবরোধ সফল হতে দিবেন কিনা। তিনি রেমণ্ডের বাহিনীকে দুর্গের বাইরে ঘিরে ফেলেছেন এবং দুর্গ তার হাতে অবরুদ্ধ। কিন্তু এই ঘেরাও ও অবরোধ তার-ই জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। আপনি এখানে চূড়ান্ত লড়াই লড়বেন না। আইউবীকে আমাদের দুর্গ অবরোধ করে রাখতে দিন, যাতে তিনি এখানে-ই আবদ্ধ থাকেন এবং মিসর যেতে না পারেন। সুদানে আমাদের কমাণ্ডারগণ তকিউদ্দীনের বাহিনীকে অত্যন্ত সফলভাবে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। তিনি এখন না পারছেন লড়াই করতে, না পারছেন সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে। মিসরের সব বাজারের এবং ক্ষেত-খামারের সমুদয় খাদ্যসামগ্রী আমি উধাও করে ফেলেছি। আপনার প্রদত্ত অর্থ আপনাকে পূর্ণ ফুল দিচ্ছে। আইউবীর এক অফাদার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরসালান মূলত আপনার-ই অফাদার। লোকটি আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। তার আরো কয়েকজন সহকর্মীও আমাদের সঙ্গে আছে।
আরসালানকে বেতন-ভাতা কত দিচ্ছ?–ফিলিপ আগস্টান জিজ্ঞেস করলেন।
যতটুকু একজন মুসলিম কর্মকর্তার মস্তিস্ক নষ্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজন হরমুন জবাব দেন- নারী, মদ, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার নেশা যে কোন মুসলমানের ঈমান ক্রয় করতে পারে। আমি তা-ই ক্রয় করে নিয়েছি। আমি আপনাকে এ সুসংবাদও দিতে পারি যে, সালাহুদ্দীন আইউবী যদি এই মুহূর্তে মিসর যান, তাহলে তিনি ওখানকার জগত ভিন্ন কিছু দেখতে পাবেন। তিনি যে যুবসমাজের কথা গর্বের সাথে উল্লেখ করেন, তারা মুসলমান হয়েও ইসলামের কোন কাজে আসবে না। তাদের চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রের রশি থাকবে আমাদের হাতে। তার এই প্রজন্ম যৌন উচ্ছঙ্খলরূপে গড়ে উঠেছে। একই দশা তার সেই বাহিনীরও হবে, যাদেরকে তিনি মিসর রেখে এসেছেন। তাদের মধ্যে আমার ঘাতক কর্মীরা এমন অস্থিরতা ও বিশৃংখলা ছড়িয়ে দিয়েছে, প্রয়োজনে যে কোন মুহূর্তে তারা বিদ্রোহ করতেও কুণ্ঠিত হবে না। আজ আমি পূর্ণ আস্থার সাথে এই দাবি করতে পারি যে, আমি আপনারও আগে আমার যুদ্ধের ইতি টানতে সক্ষম হব। প্রতিপক্ষের চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা ধ্বংস করে দিতে পারলে আর সামরিক অভিযানের প্রয়োজন হবে না।
হরমুনের এই উদ্দীপনামূলক রিপোর্ট, শুনে খৃস্টান সম্রাটগণ বেজায় আনন্দিত হন। ফিলিপ অগাস্টাস সেই একই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, যা তিনি আগেও কয়েকবার বলেছিলেন। তিনি বললেন, আমাদের লড়াই সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে নয়-ইসলামের সঙ্গে। একদিন আইউবীর মুত্যু হবে, আমরাও মরে যাব। কিন্তু আমাদের চেতনা ও প্রত্যয় জীবিত থাকতে হবে, যাতে এক সময় ইসলামেরও মৃত্যু ঘটে এবং দুনিয়ার শাসনক্ষমতা ক্রুশের হাতে চলে আসে। তার জন্য আমাদের এমন এক যুদ্ধক্ষেত্র চালু করতে হবে, যদ্বারা মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা ও নৈতিকতার উপর জোরদার হামলা করা যায়। আমি হরমুনকে অভিনন্দন জানাচ্ছি যে, সে এমন যুদ্ধক্ষেত্র শুধু চালু-ই করেনি, বরং অভিযানে এক পর্যায়ে সফলতাও অর্জন করেছে।
***
সালীম আল-ইদরীস-এর দুটি যুবক পুত্র আছে। একজনের বয়স সতের বছর। অপরজনের একুশ। তারাও কায়রোতে খৃস্টানদের পাতা চরিত্র-বিধ্বংসী ফাঁদে পা দিয়েছিল কিনা জানা না গেলেও এতটুকু প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এক সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে বড় পুত্রের গোপন সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করত এবং বে-পর্দায় ঘোরাফেরা করত। মেয়েটি কোন এক সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ খান্দানের সন্তান। দুজনের মিলন হত গোপনে। যেদিন আরসালান আল-ইদরীসকে বলেছিল যে, আপনার দুটি যুবক পুত্র আছে, তার পরদিন মেয়েটি বড়পুত্রকে বলল, অন্য এক যুবক আমাকে খুব বিরক্ত করছে। আমি যেদিকে যাই, যুবকটি আমাকে অনুসরণ করছে এবং আমাকে অপহরণ করার হুমকি দিচ্ছে। বড় পুত্র মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, যুবকটি কে? কিন্তু মেয়ে তা বলেনি। বিষয়টা তালগোল পাকিয়ে যায়। মেয়েটি আমতা আমতা করে বলল, বেশী সমস্যা হলে তোমাকে জানাব।
সেদিন সন্ধ্যায়-ই মেয়েটি তার কাছে এসে বলল, ঐ যুবকটি আমাকে সীমাহীন উত্যক্ত করতে শুরু করেছে। সে তোমার সম্পর্কে বলেছে, তোমাকে নাকি সে এমনভাবে খুন করবে যে, কেউ টেরই পাবে না। কাজেই এখন থেকে তুমি খঞ্জর সঙ্গে রাখ, বলা যায় না কখন কী ঘটে যায়।
পরদিন সন্ধ্যায় মেয়েটি অপর যুবক-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকেও একইভাবে উত্তেজিত করে এবং বলে, এখন থেকে তুমি খঞ্জর সঙ্গে রাখ, বলা যায় না কখন কী ঘটে যায়।
অপর যুবক হল আল-ইদরীস-এর ছোট পুত্র। অর্থাৎ-মেয়েটির দুদিকে দুই সহোদর। কিন্তু তাদের কেউ-ই জানেনা যে, মেয়েটি যে যুবক সম্পর্কে উত্তেজনার রিপোর্ট দিচ্ছে, সে তার-ই ভাই। এ-ও জানত না যে, তারা দুভাই এক-ই মেয়ের জালে আটকা পড়েছে। দুভাই-ই খঞ্জর নিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করেছে। মেয়েটিও উভয়ের সঙ্গে পৃথক পৃথক সাক্ষাৎ করতে থাকে।
মাত্র পাঁচদিনে মেয়েটি দুভাইকে প্রথমে পশুতে, পরে হিংস্র প্রাণীতে পরিণত করেছে। পঞ্চমদিন সন্ধ্যায় মেয়েটি বড় ভাইকে শহরের খানিক দূরে। এক অন্ধকার স্থানে মিলিত হতে বলে। ছোট ভাইকেও একই সময়ে একই স্থানে উপস্থিত থাকতে বলে। মেয়েটি উভয়কে এ কথাও বলে যে, যে যুবকটি আমাকে উত্যক্ত করছে, সে বলে গেছে, আজ সন্ধ্যায় তুমি যেখানে যাবে, সেখানেই আমাকে দেখতে পাবে। আমি তোমার প্রেমনিবেদনকারীকে তোমার-ই চোখের সামনে হত্যা করব। মেয়েটি জানায়, আমি তাকে বলেছি, আচ্ছা, তুমি যদি এতই বীরপুরুষ হয়ে থাক, তাহলে অমুক সময় অমুক জায়গায় এসে পড়। তুমি যদি ওকে খুন করতে পার, তাহলে আমি একান্তভাবে তোমার-ই হয়ে যাব।
দুভাই প্রাণঘাতী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
সন্ধ্যায় বড় ভাই খঞ্জর হাতে মেয়েটির নির্দেশিত স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়। মেয়েটি এতই দক্ষতার পরিচয় দেয় যে, জায়গাটা নির্ধারণ করেছে অন্ধকার দেখে। এ বিষয়ের প্রতিও লক্ষ রেখেছে, যেন দুভাই তার পৌঁছানোর আগেই একত্রিত হয়ে একে অপরকে চিনে না ফেলে।
মেয়েটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে বড় ভাইকে উপস্থিত দেখতে পায়। সে তাকে জানায়, ঐ যুবকটি আমার পিছনে পিছনে আসছে। বড় ভাই খঞ্জর প্রস্তুত করে রাখে। খানিক পরেই ছোট ভাই এসে পৌঁছে। মেয়েটি বড় ভাইকে বলে, ও এসে পড়েছে; তবে আমি চাই না যে, তোমরা খুনাখুনিতে লিপ্ত হও। আমি গিয়ে ওকে বলি, তুমি চলে যাও। বলেই মেয়েটি ছোট ভাইয়ের নিকট ছুটে যায় এবং বলে, তোমার দুশমন পূর্ব থেকেই এখানে এসে উপস্থিত আছে। তার হাতে খঞ্জর। ছোট ভাইয়ের বিবেকের উপর যৌবনের তাজা খুন চেপে বসে আছে। ছেলেটি খঞ্জর হাতে নেয় এবং অন্ধকারের মধ্যেই আপন বড় ভাইয়ের প্রতি ধেয়ে আসে। বড় ভাই আক্রমণোদ্যত প্রতিপক্ষ যুবককে ছুটে আসতে দেখে সে-ও খঞ্জর হাতে দ্রুত এগিয়ে যায়। একজন অপরজনের উপর প্রচণ্ডবেগে আক্রমণ করে বসে। অন্ধকারে দুভাইয়ের সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এক ভাই অপর ভাইকে রক্তাক্ত করে ফেলে। মেয়েটি পার্শ্বে দাঁড়িয়ে উভয়কে উত্তেজিত করতে থাকে।
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা কর্মীরা রাতে টহল দিচ্ছে। হঠাৎ এক অশ্বারোহী গুপ্তচর ঘটনাস্থলে এসে পড়ে। দেখে মেয়েটি পালাতে উদ্যত হয়। আরোহী ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলে। তাকে সঙ্গে করে আবার ঘটনাস্থলে ফিরে যায়। দুভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস গ্রহণ করছে। মেয়েটি এই ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পর্কহীনতার প্রমাণ দিতে জোর চেষ্টা করে। কিন্তু আরোহী তাকে ছাড়ল না। মেয়েটি নানা রকম প্রলোভন দেখালেও আরোহী সেসব প্রত্যাখ্যান করে নীতির উপর অটল থাকে। আরোহী হাঁক দিয়ে তার সহকর্মীদের ডেকে আনে। ততক্ষণে দুভাই মারা গেছে।
মেয়েটিকে তৎক্ষণাৎ আলী বিন সুফিয়ানের নিকট নিয়ে যাওয়া হল। লাশ দুটোও তুলে নেয়া হল। আলো জ্বালিয়ে লাশ দুটি দেখা হল। আল-ইদরীস এর দুপুত্রের লাশ। আল-ইদরীসকে সংবাদ দেয়া হল। দুযুবক পুত্রের দুটি লাশ একত্রে দেখার পর পিতার মানসিক অবস্থা কেমন হল, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মেয়েটি এলোমেলো কথা বলে। তুমি কার মেয়ে, কোথায় থাক-এ প্রশ্নের জবাব দিতে সে অপারগতা প্রকাশ করে। আল-ইদরীস ভীষণ বিমর্ষ বিপর্যস্ত। তিনি ক্ষুব্ধ কম্পিত কণ্ঠে বললেন, মেয়েটাকে পিঞ্জিরায় আটকে রাখ আলী! এভাবে ওর মুখ থেকে কথা বের করা যাবে না।
আমার বলার আছে-ইবা কী? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মেয়েটি বলল। তারপর বড় ভাইয়ের লাশের প্রতি ইংগিত করে বলল, ইনি আমাকে ডেকেছিলেন। আমি তার ডাকে সাড়া দেই। মধ্যখান থেকে ইনি (ছোট ভাইয়ের লাশের প্রতি ইশারা করে) এসে পড়লেন। আমার দখল নিয়ে দুজন খঞ্জর হাতে পুরস্পরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমি ভয়ে পালাতে উদ্যত হই। এমন সময় একজন। অশ্বারোহী এসে আমাকে ধরে নিয়ে আসেন। আমি পিতার নাম বলতে এজন্য ইতস্তত করছি যে, তাতে তার অপমান হবে।
আলী বিন সুফিয়ান বিচক্ষণ, ধীশক্তিসম্পন্ন ও উপস্থিত বৃদ্ধির মানুষ। তার মনে পড়ে যায়, আরসালান ও আল-ইদরীস-এর মাঝে বাক-বিতণ্ডা হয়েছিল। আরসালান তার সন্দেহভাজনদের একজন। তার ঘরে কী সব হচ্ছে, তাও তিনি জানেন। তিনি আল-ইদরীসকে ইশারা করে বললেন, মেয়েটি যে-ই হোক, ঘাতক নয়। একটি মেয়ে দুটি যুবককে খুন করতে পারেনা। মেয়েটি যা বলেছে, সত্যই বলেছে। আমি তার বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশন নিতে পারব না। বলেই তিনি মেয়েটিকে বললেন, যাও, তুমি মুক্ত। আগামীতে কোন বেগানা পুরুষের সঙ্গে এতদূর যেও না; অন্যথায় কখন কার হাতে খুন হও বলা যায় না।
ছাড়া পেয়ে মেয়েটি দ্রুতবেগে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে দুজন গুপ্তচরকে বললেন, তোমরা একজন মেয়েটি কোন্ পথে যায় লক্ষ্য রেখে অরেক পথে আরসালান-এর বাড়ির সদর দরজার সামান্য দূরে চুপচাপ বসে থাক। অপরজন অতি সাবধানে মেয়েটির অনুসরণ করে দেখবে, ও কোথায় যায় এবং যেখানেই গিয়ে পৌঁছুক, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সংবাদ দিবে।
দুজন রওনা হয়ে যায়। মেয়েটি দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং একজন তাকে অনুসরণ করছে। আলী বিন সুফিয়ানের ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হল। মেয়েটি সোজা আরসালানের ঘরে চলে যায়। আলীর নিয়োজিত লোক এসে সংবাদ দেয়। আল-ইদরীস যখন জানতে পারলেন যে, মেয়েটির যোগাযোগ আরসালানের ঘরের সঙ্গে, তৎক্ষণাৎ তার পিছনের ঘটনা মনে পড়ে যায়। তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, আরসালান আমাকে বলেছিল, তোমার দুটি যুবক পুত্র আছে। কিন্তু তখন আমি সেই ইংগিত বুঝতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে, সেই ইংগিত আর এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। আমার স্পষ্ট ধারণা, এই ঘটনা আরসালান-ই ঘটিয়েছে। আমার দুপুত্রকে সে-ই অভিনব এক পন্থায় একজনকে অপরজন দ্বারা খুন করিয়েছে।
আল-ইদরীস পুলিশ প্রধানকে সংবাদ দেন। পুলিশ প্রধান গিয়াস বিলবীস। এসে পৌঁছান। আলী বিন সুফিয়ানেরও ক্ষমতা আছে। তিনি সিদ্ধান্ত দেন যে, আরসালানের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে নজরবন্দী করা হোক।
এবার আমি সালীম আল-ইদরীসকে বুলব, আমি কেন এত সাহসিকতার সাথে কথা বলি- মেয়েটির সাফল্যের কাহিনী শুনে আরসালান বলল- এবার আমি তাকে জানিয়ে দেব, আমি কী করতে পারি। আরসালান মেয়েটিকে মদপান করতে দেয় এবং দুজনে বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠে।
আরসালান-এর উৎসব এখনো শেষ হয়নি। এমন সময় বলা-কওয়া ছাড়াই কে যেন তার ঘরে ঢুকে পড়ে। লোকটি আল-ইদরীস। তিনি আরসালান ও একটি মেয়েকে নেশাগ্রস্থ ও বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পান। মেয়েটিকে তিনি চিনে ফেলেন। আরসালান নেশার ঘোরে-ই বলল, নিজের পুত্রদেরকে খুন করিয়ে তুমি নিজে আমার হাতে খুন হতে এসেছ? ………। দারোয়ান! লোকটি আমার অনুমতি ছাড়া আমার জান্নাতে ঢুকল কেন?
ঢুকেছি তোকে জাহান্নামে পাঠাতে- আল-ইদরীস বললেন- আমি আমার পুত্রদের প্রতিশোধ নিতে আসিনি- এসেছি তোমাকে গাদ্দারীর পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে।
ইতিমধ্যে নগর প্রধান ভিতরে প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে গিয়াস বিলবীস ও আলী বিন সুফিয়ান। তারা মেয়েটিকে গ্রেফতার করে ফেললেন। আরসালান এর সব চাকর-বাকর ও অন্যান্য লোকদেরকে বের করে দিয়ে প্রাসাদোপম ভবনটির ভিতরে-বাইরে প্রহরা বসিয়ে দেয়া হল। অনুসন্ধানে ঘরের মধ্যে প্রশস্ত এক আন্ডারগ্রাউন্ড কক্ষ পাওয়া গেল। সেখান থেকে উদ্ধার করা হল বিপুল পরিমাণ তীর-কামান ও বর্শা। পাওয়া গেল এক গাদা খঞ্জর ও বিস্ফোরক। একটি বাক্স খুলে পাওয়া গেল হাশীশ ও বিষ। অপর এক কক্ষ থেকে উদ্ধার হল, অনেকগুলো সোনার ইট ও স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি বেশ কটি থলে। আরসালান তার পুরাতন দুস্ত্রী ও তাদের সন্তানদেরকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখন ঘরে পাওয়া গেল তিনটি ষোড়শী কন্যা। তাদের একজন অপেক্ষা অপরজন অধিক রূপসী। তিনজনই অমুসলিম। রাতারাতি চাকর-বাকরদের তল্লাশী ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। তাদের তিনজনই খৃস্টানদের গুপ্তচর।
তুমি নিজেই বলে দাও তোমার মিশন কি?- নগর প্রধান আরসালানকে বললেন- এই বিত্ত-বৈভব ও অস্ত্রের ডিপো তোমার মৃত্যুদণ্ডের জন্য যথেষ্ট।
তাহলে মৃত্যুদণ্ড-ই দিয়ে দিন- নেশার ঘোরে বলল আরসালান- জীবন যখন দিতেই হবে, মুখ খুলে লাভ কী?. ..
জীবনের শেষ মুহূর্তে তুমি একটি নেক কাজ করে যাও; ঈমান, ইসলাম ও দেশের শত্রুদের সম্পর্কে তথ্য দাও- নগর প্রধান বললেন- আমি আশা করি, এর উছিলায় আল্লাহ তোমার এতবড় অপরাধও ক্ষমা করে দেবেন।
কিন্তু তোমরা তো ক্ষমা করবে না। আরসালান বলল।
সুলতান আইউবী এর চেয়েও জঘন্য অপরাধ ক্ষমা করে থাকেন- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আপনার জীবনে বেঁচে যাওয়ার পথ খুলতে পারে; এখানে কিরূপ নাশকতা চলছে বলে দিন এবং কিছু লোককে ধরিয়ে দিন।
আরসালান কক্ষে পায়চারী করছে। অন্যরা এদিক-ওদিক উপবিষ্ট। আল ইদরীস-এর কোমরে খঞ্জর সদৃশ একটি তরবারী বাঁধা। আরসালান নিশ্চুপ পায়চারী করতে করতে তার কাছে চলে যায় এবং হঠাৎ কোমর থেকে তরবারীটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের বুকে ও পেটের মধ্যখানে স্থাপন করে। উপস্থিত লোকেরা তার থেকে তরবারীটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু তার আগেই আরসালান হাতটা ধরে পূর্ণ শক্তিতে তরবারীর আগাটা নিজের পেটে ঢুকিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। লোকেরা পেট থেকে তরবারীটা টেনে বের করে আনার চেষ্টা করলে আরসালান বলল, ওটা ওখানেই থাকুক, তোমরা আমার দুতিনটি কথা শুনে রাখ। আমার মৃত্যু হয়ে গেলে তরবারীটা বের করে নিও। আমি নিজেই নিজের শাস্তি দিয়েছি। আমি জীবিত অবস্থায় সালাহুদ্দীন আইউবীর সামনে উপস্থিত হতে চাইনি। কেননা, তিনি আমাকে তার অফাদার বন্ধু বলে বিশ্বাস করতেন। আমি তোমাদের কারুর কাছে কোন প্রশ্নের জবাব দেব না। তরবারী তার কাজ করে ফেলেছে। তোমরা সাবধান হও, মিসর ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। মিসরে যে ফৌজ আছে, তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত। খাদ্যের কৃত্রিম সংকট আমি-ই সৃষ্টি করেছিলাম। সৈন্যরা ঠিকমত খাবার পেত না। খৃস্টান নাশকতাকারীরা। ফৌজের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে যে, দেশের গরু, ভেড়া-বকরী-দুম্বা, তরী-তরকারী, খাদ্যসামগ্রী সব বিভিন্ন রণাঙ্গনে চলে যাচ্ছে আর সেখানকার সৈনিকেরা গনীমতের মালামাল দিয়ে বিলাসিতা করছে। আমার দলে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ছিল। তবে আমি তাদের কারো নাম বলব না। ফাতেমী ও ফেদায়ীরা ধ্বংসযজ্ঞ ও নাশকতার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। তোমরা বিদ্রোহ প্রতিহত করতে পারবে না। নতুন সৈন্য নাও, পরিস্থিতি তোমাদের নিয়ন্ত্রণের…। আরসালান শেষ বাক্যটি আর পূর্ণ করতে পারল না। তার আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল।
আরসালানের ঘর থেকে যে দুটি মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছিল, তারা নিজেদের সম্পর্কে জানায় যে, আমাদেরকে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও পুরুষদেরকে ফাঁদে আটকিয়ে ব্যবহার করার জন্য পাঠান হয়েছিল। তারা জানায়, আরসালান-এর ঘরে প্রতি রাতে বৈঠক হত, যাতে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের অনেক অফিসার আসা-যাওয়া করতেন। তাদের গোপন সাক্ষাৎ ও বৈঠক এই মেয়েদের অনুপস্থিতিতে হত। মেয়েরা স্বীকারোক্তি দেয় যে, মিসরে বিদ্রোহের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। যে মেয়েটি আল-ইদরীস-এর দুপুত্রকে একে অপরের দ্বারা খুন করিয়েছিল, সে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করে। মেয়েটি জানায়, সে আল-ইদরীস-এর বড় পুত্রকে আগেই ভালবাসার জালে আটকিয়ে ফেলেছিল। আরসালান তাকে স্বয়ং আল-ইদরীস-এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন আরসালান পরিকল্পনা পাল্টে দেয় এবং মেয়েটিকে বলে তুমি আল-ইদরীস-এর দুপুত্রকে একজন দ্বারা অপরজনকে খুন করাও।
মাত্র এক রাতের অভিযানের পর প্রায় আড়াইশ উট কেন্দ্রীয় দফতরের সামনে এনে দাঁড় করানো হয়। উটগুলো খাদ্য-সামগ্রীতে বোঝাই। এই উটগুলো তিন-চারটি পয়েন্ট থেকে ধরে আনা হয়েছে। তরী-তরকারী ইত্যাদি যাতে সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে তার জন্য টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটি তাদের প্রথম সাফল্য। ধরে আনা উট কাফেলার সঙ্গে যেসব মানুষ ছিল, তারা শহরের কয়েকজন ব্যাপরীর নাম বলে, যারা দেশের খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে সীমান্তের বাইরে চালান করার কাজে জড়িত। মধ্যরাতের পর তারা এসব পণ্য বিদেশের অপরিচিত ব্যবসায়ীদের হাতে বিক্রি করত। ধৃত লোকগুলো পল্লী এলাকার ও এমন কয়েকটি জায়গার নাম বলে, যেখানে অপরিচিত ব্যবসায়ীরা অবস্থান করত এবং পণ্যদ্রব্য কিনে জমা করে নিয়ে যেত। উষ্ট্ৰচালকরা সীমান্তবর্তী এমন একটি অঞ্চলের কথা জানায়, যেখান থেকে এসব কাফেলা সুদান ঢুকে পড়ত। ওখানে একটি সীমান্তপ্রহরী ইউনিট ছিল। তদন্তে জানা গেল, তার কমাণ্ডার নিয়মিত দুশমনের কাছ থেকে ঘুষ নিত এবং কাফেলার সীমান্ত অতিক্রমের সুযোগ করে দিত। আরো জানা গেল যে, এর সবই হচ্ছিল আরসালান-এর নেতৃত্বে।
***
আল-ইদরীস ও প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাগণ আরসালান-এর গাদ্দারী, আল-ইদরীস-এর শত্রুদের মৃত্যু ও অন্যান্য ঘটনাবলী নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য বৈঠকে বসেন। আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীস অভিমত ব্যক্ত করেন; পরিস্থিতি এত-ই নাজুক রূপ লাভ করেছে যে, এখন তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তারা প্রস্তাব করেন, মিসরে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার এবং ফাতেমী কিংবা ফেদায়ীদের হাতে উচ্চ পর্যায়ের কোন ব্যক্তিত্বের খুন হওয়ার আগেই সুলতান আইউবীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত করা হোক এবং তাঁকে পরামর্শ দেয়া হোক, কার্ক অবরোধ তাঁর নায়েবদের হাতে সোপর্দ করে তিনি কায়রো চলে আসুন। একজন দূত আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল বটে; কিন্তু তাকে বিস্তারিত জানান হয়নি। এখন পরিস্থিতি আরো কঠিন আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, আলী বিন সুফিয়ান ময়দানে গিয়ে সুলতান আইউবীর সঙ্গে মিলিত হবেন।
কার্ক অবরোধের বয়স দুমাস হয়ে গেল। কিন্তু এখনো সফলতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। খৃস্টানরা অস্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করে রেখেছে। তাদের একটি ব্যবস্থাপনা এই যে, তারা শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য-পানীয়র আয়োজন করে রেখেছে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এক গুপ্তচর ভিতর থেকে তীরের সঙ্গে বার্তা বেঁধে বাইরে নিক্ষেপ করে। যাতে লিখা ছিল-ভিতরে খাদ্য-পানীয়র কোন অভাব নেই। মুসলমান অধিবাসীর উপর এমন কঠোর পাবন্দী আরোপ করে রাখা হয়েছে যে, তাদের ঘরের দেয়ালগুলোও তাদের বিরুদ্ধে চরবৃত্তি করছে। ফলে ভিতরে নাশকতামূলক তৎপরতা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যথায় খৃস্টানদের এসব খাদ্যসম্ভার ধ্বংস করে দেয়া যেত।
শহরে সুলতান আইউবীর গুপ্তচরেরও অভাব ছিল না। তারা মাঝে-মধ্যে রাতের বেলা তীরের সঙ্গে পয়গাম বেঁধে সময়-সুযোগমত বাইরে ছুঁড়ে মারত। সেনাদের প্রতি নির্দেশ ছিল এরূপ তীর পেলে যেন তারা কমাণ্ডারদের হাতে পৌঁছিয়ে দেয়। খৃস্টানরা অবরোধ ভাঙ্গার প্রচেষ্টা ত্যাগ করে। তারা সুলতান আইউবীর শক্তি ক্ষয় করার কৌশল অবলম্বন করেছে। সুলতান তাদের কৌশল ধরে ফেলেছেন। তাই জবাবে তিনিও পন্থা পরিবর্তন করেন।
খৃস্টানরা দুর্গের বাইরে থেকে আইউবীর উপর আক্রমণ করার যে কৌশল অবলম্বন করেছিল, সুলতান তা ব্যর্থ করে দেন। এই হামলার জন্য তিনি পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তিনি অতি কৌশলে তাদেরকে ঘিরে ফেলেন।
খৃস্টানদের এই বাহিনীটি সুলতান আইউবীর বেষ্টনীতে আটকা পড়েছে দেড় মাস হয়ে গেছে। বেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তারা চারদিক থেকে হামলাও করতে থাকে। কিন্তু সুলতান তাদের কোন হামলায়-ই কামিয়াব হতে দেননি। অবশ্য তাতে ঘেরাও কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। এলাকাটা ছিল সবুজ-শ্যামল। খৃস্টান সৈন্য ও তাদের পশুদের খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা ছিল। তবে তা তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। হাজার-হাজার উট-ঘোড়ার জন্য সে খাদ্য-পানীয় ছিল অপর্যাপ্ত। পানির জন্য সেখানে কোন নদ-নদী ছিল না। ছিল তিন-চারটি কূপ, যার পানি দেড় মাসেই নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে খৃস্টান সৈন্যদের মাঝে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। খাদ্য ও পানীয়র অভাবে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাতে সুলতান আইউবীর কমাণ্ডো বাহিনী তাদের উপর গেরিলা হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করতে থাকে। দেড় মাসে এই বাহিনী সংখ্যায় অর্ধেকে নেমে আসে। তাদের পশুগুলোরও বেহাল অবস্থা। খৃস্টান সম্রাট রেমাণ্ড এই বাহিনীর কমাণ্ডার। চরম বিপর্যস্ত এক অবস্থার মধ্যে তিনি অপেক্ষা করছেন, কখন বন্ধুরা হামলা করে তাদেরকে আইউবীর কবল থেকে মুক্ত করে নিবে। কিন্তু তার কোন লক্ষ-ই দেখা যাচ্ছে না।
সুলতান আইউবী ইচ্ছে করলে চারদিক থেকে হামলা করে এই বাহিনীকে পরাস্ত করে দিতে পারতেন। কিন্তু তাতে তাদেরও প্রাণহানীর ঘটনা ঘটত প্রচুর। তাছাড়া তাতে যুদ্ধের গতি পাল্টে যাওয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু সুলতান আইউবী নিজের শক্তি ক্ষয় করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি খৃস্টান বাহিনীকে মার দিতে চাচ্ছেন ধীরে ধীরে। সেভাবেই তিনি অগ্রসর হচ্ছেন। অবশ্য তাতে তার এই ক্ষতি হচ্ছিল যে, তার বাহিনীর তৃতীয় যে অংশটি খৃস্টান বাহিনীকে ঘিরে রাখার অভিযানে আবদ্ধ হয়ে আছে তাদেরকে তিনি শহর অবরোধ সফল করে তোলার কাজে ব্যবহার করতে পারছিলেন না। সুলতান আইউবী এখন আর অবরোধ দীর্ঘ করতে চাচ্ছেন না। তিনি ভাবছেন, কিভাবে দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ভিতরে ঢোকা যায়। সে যুগে এক একটি অবরোধ সাধারণত দীর্ঘ-ই হত। এক একটি শহরকে শত্রুরা দুবছর পর্যন্ত অবরোধ করে রাখত। ছয় সাত মাসের অবরোধকে দীর্ঘ ভাবা হত না। কিন্তু সুলতান আইউবী অবরোধ দীর্ঘ করার পক্ষপাতি নন। তিনি ঐসব রাজা-বাদশাদের ন্যায়ও ছিলেন না, যারা কোন দেশের রাজধানী অবরোধ করে ভিতরের লোকদের কাছে বার্তা পাঠাবে যে, এতগুলো সোনা-রূপা, এত হাজার ঘোড়া কিংবা এত পরিমাণ সুন্দরী নারী পাঠিয়ে দাও, আমরা চলে যাব। সুলতান আইউবীর লক্ষ্য আরব ভূখণ্ড থেকে খৃস্টানদের বিতাড়িত করা। তিনি বলতেন, এই ভূখণ্ড ইসলামের ঝর্ণাধারা, যা গোটা পৃথিবীকে পরিতৃপ্ত করবে। তিনি তার আয়ুকে প্রয়োজনের তুলনায় কম মনে করতেন। তিনি বারবার বলতেন, এ-কাজটি আমি আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে সমাপ্ত করে যেতে চাই। অন্যথায় আমি দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলিম শাসকগণ এই পবিত্র ভূমিকে খৃস্টানদের হাতে বিক্রি করতে চলেছে।
এক রাত। সুলতান আইউবী তার তাঁবুতে গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলেন তিনি। এক পর্যায়ে তার মাথায় বুদ্ধি এল যে, দুর্গের আশপাশ থেকে সুড়ঙ্গ খনন করে ভিতরে ঢুকবার চেষ্টা করলে কেমন হয়। আরো কিছু পন্থাও তার মাথায় জাগলো। এখন দিনকয়েকের মধ্যেই তিনি কার্ক দুর্গ দখল করতে চাচ্ছেন।
ঠিক এমনি মুহূর্তে আলী বিন সুফিয়ান তাঁবুতে প্রবেশ করেন। আলীকে দেখে সুলতান আনন্দিত হলেন না। কারণ, তিনি ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছেন যে, মিসরের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। চেহারায় বেদনার ছাপ নিয়েই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং বললেন, নিশ্চয় তুমি আমার জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসনি।
আমীরে মেসের যথার্থ বলেছেন। আপনার জন্য আমি কোন শুভ সংবাদ বয়ে আনতে পারিনি। বলেই আলী বিন সুফিয়ান মিসরের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও ঘটনাবলী বিবৃত করতে শুরু করেন। তার মত একজন দায়িত্বশীল মানুষ সুলতান আইউবীর নিকট থেকে কিছুই গোপন রাখতে পারেন না, পারেন না তিনি তাকে অলীক আশার বাণী শোনাতে। সুলতান আইউবীকে ভোলামেলা সব কথা বলে দেয়াই সময়ের দাবী। আলী বিন সুফিয়ান তকিউদ্দীনের ক্রটি বিচ্যুতি এবং সুলতান আইউবীরও দুএকটি ভুলের কথা খোলাখুলি উল্লেখ করেন। আরসালান-এর গাদ্দারীর কাহিনী এবং আল-ইদরীসের পুত্রদের খুন হওয়ার ঘটনা শুনে সুলতানের চোখে পানি এসে যায়। আরসালান যদি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে না দিত, তাহলে তিনি কখনো বিশ্বাসই করতেন না যে, তার এই কর্মকর্তা- যাকে তিনি নিজের অফাদার বন্ধু মনে করতেন গাদ্দারী করতে পারে।
আরসালান আরো কিছুক্ষণ বেঁচে থাকলে অবশিষ্ট তথ্যও ফাস করে দিত- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- তার সর্বশেষ বাক্য (যা সে পূর্ণ করে যেতে পারেনি) থেকে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মিসরে বিদ্রোহ সংঘটিত হতে যাচ্ছে। মিসরে আমাদের যে বাহিনী আছে, তাদেরকে মানসিকভাবে হীনমন্য করে দেয়া হয়েছে। আমার গুপ্তচরবৃত্তি প্রমাণ করে, আমাদের এক একজন কমান্ডার পর্যন্ত ভুল বুঝাবুঝি ও অস্থিরতার শিকার হয়ে পড়েছে। খাদ্যদ্রব্য ও মাছ-গোশতের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এই সেনাবাহিনীর মাঝে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের সব রেশন ময়দানে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন অপপ্রচারও করা হয়েছে যে, ফৌজের বরাদ্দ কর্মকর্তারা বিক্রি করে খাচ্ছে। মিসরে দুশমনের ষড়যন্ত্র পুরোপুরি সফল হয়েছে।
দুমশনের চক্রান্ত সে দেশেই সফল হয়, যে দেশের কতক মানুষ দুশমনের সঙ্গ দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়- সুলতান আইউবী বললেন আমাদের আপনজনরা যদি দুশমনের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা দুশমনের মোকাবেলা করব কিভাবে? আমি যেভাবে আল্লাহর ঐ সিংহদের চেতনার জোরে এবং তাদের জীবন কোরবান করে খৃস্টানদেরকে রণাঙ্গনে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছি, আমার প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও যদি তেমন পাকা মুসলমান হত, তাহলে প্রথম কেবলা আজ দখলমুক্ত থাকত এবং আমাদের আযানের সুর ইউরোপের গীর্জাগুলোতেও ধ্বনিত হত। কিন্তু আমি আজও মিসরে আটকা পড়ে আছি, আমার চেতনা, আমার প্রত্যয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আছে। সুলতান আইউবী কিছুক্ষণ নীরব রইলেন এবং কি যেন চিন্তা করে আবার বললেন, আমাকে সর্বাগ্রে ঐ গাদ্দারদের খতম করতে হবে; অন্যথায় ওরা দেশ-জাতি-রাষ্ট্রকে উঁইপোকার ন্যায় খেতেই থাকবে।
আমি আপনার সমীপে এই পরামর্শ নিয়ে এসেছি যে, যদি ময়দান আপনাকে অনুমতি দেয়, তাহলে আপনি মিসর চলুন- আলী বিন সুফিয়ান বললেন।
আমি বাস্তবতাকে এড়াতে পারি না আলী- সুলতান বললেন- তবে, আমি তোমাকে এ কথাও না বলে পারছি না যে, যারা আমার হাত থেকে খৃস্টানদের গর্দান আর ফিলিস্তীনকে ছাড়িয়ে নিতে চায়, তারা আমারই ভাই স্বজন শোন আলী! যারা স্বজাতির সঙ্গে গাদ্দারী করে, যারা ইসলামের দুশমনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে, আমি যদি তাদেরকে এখনই খতম না করি, তাহলে তারা কখনোই নিঃশেষ হবে না আর আমাদের ইতিহাসকে এই গোষ্ঠীটি আজীবন কলংকিত করতেই থাকবে। সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করলেন, সুদানের রণাঙ্গনের সংবাদ কী? আমি তকিউদ্দীনের নিকট পয়গাম পাঠিয়েছিলাম, যেন সে ময়দান গুটাতে শুরু করে।
মিসরে কেউ-ই জানে না যে, আপনি এমন নির্দেশ দিয়েছেন। আলী বিন সুফিয়ান বললেন।
আর কারো জানবার প্রয়োজনও নেই। সুলতান আইউবী বললেন।
দারোয়ানকে ডাক দিলেন তিনি। দারোয়ান আসলে তিনি বললেন, কেরানীকে ডেকে আন। কেরানী কাগজ-কলম নিয়ে এসে উপস্থিত হলে সুলতান বললেন, লিখ, মাহামান্য নুরুদ্দীন জঙ্গী…।
***
দ্রুতগতিসম্পন্ন একজন দূতকে পত্রটি দিয়ে নূরুদ্দীন জঙ্গী বরাবর প্রেরণ করা হল। দূত সুলতান আইউবীর এই পয়গাম পরদিন রাতের শেষ প্রহরে বাগদাদে নূরুদ্দীন জঙ্গীর হাতে পৌঁছিয়ে দেয়। সুলতান দূতকে বলে দিয়েছিলেন, পথে প্রতিটি চৌকিতে তুমি তাজাম ঘোড়া পেয়ে যাবে। তবে ঘোড়া বদল করতে যতটুকু সময় লাগবে, ঠিক ততটুকু বিলম্ব করবে, তার। বেশী নয়। যত দ্রুত সম্ভব ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে যাবে। ঘোড়ার গতি শ্লথ হতে দেবে না কোথাও। নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট পৌঁছতে যদি রাত হয়ে যায়, তাহলে দারোয়ানকে বলবে তাকে জাগিয়ে দিতে। ভাই জঙ্গী যদি তাতে বিরক্তি প্রকাশ করেন, তাহলে বলবে, সালাহুদ্দীন বলেছেন, আমরা সকলে জেগে আছি।
সুলতান আইউবীর এই দূত যখন নুরুদ্দীন জঙ্গীর দরজায় গিয়ে উপনীত হয়, রক্ষী বাহিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, পয়গাম পৌঁছানোর জন্য তোমাকে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দূত ঘোড়া তো একাধিকবার বদল করেছিল, কিন্তু নিজে এক ঢোক পানি পান করার সময়ও ব্যয় করেনি। ক্লান্তি, ক্ষুধা, পিপাসা, সর্বোপরি দুরাতের নিদ্রাহীনতায় লোকটির মৃতপ্রায় অবস্থা। পিপাসায় এতই কাতর যে, মুখ দিয়ে কথা সরছে না। দুদিনের না-খাওয়া বলহীন শরীর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তাই শুধু ইঙ্গিতে বলল, অনেক জরুরী পয়গাম।
নুরুদ্দীন জঙ্গীও সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায় বিশিষ্ট আমলা, দারোয়ান ও দেহরক্ষীদের বলে রেখেছিলেন, জরুরী কোন বার্তা আসলে যেন তার নিদ্রা ও বিশ্রামের পরোয়া না করা হয়।
রক্ষী কমান্ডার ভেতরে প্রবেশ করে নুরুদ্দীন জঙ্গীর কক্ষের দরজায় করাঘাত করেন। নুরুদ্দীন জঙ্গী জাগ্রত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং পত্রটি হাতে নিয়ে দূতকে সঙ্গে করে সাক্ষাতের কক্ষে প্রবেশ করেন। টলটলায়মান পায়ে কক্ষে প্রবেশ করেই দূত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নূরুদ্দীন জঙ্গী তার কর্মচারীদের ডাক দেন। তারা এলে দূতকে তুলে নিয়ে সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলার নির্দেশ দেন। সময় নষ্ট না করে তিনি সুলতান আইউবীর পত্রখানা পাঠ করতে শুরু করেন
আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার পয়গাম আপনাকে সন্তুষ্ট করবে না। আপাতত আপনার জন্য সন্তোষজনক সংবাদ শুধু এটুকুই যে, আমি হিম্মত হারাইনি। আমি আপনাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালন করছি। আপনি আমার নিকট চলে আসুন; আমি আপনাকে সব ঘটনা শুনাব। আমি কার্ক অবরোধ করে রেখেছি। এখনো সফল হইনি। শুধু এতটুকু সাফল্য অর্জন করেছি যে, খৃস্টানদের একটি বাহিনী সম্রাট রেমান্ডের নেতৃত্বে আমার উপর হামলা করেছিল; আমি নিরাপদ অবস্থান থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছি। এ যাবত তার অর্ধেক সৈন্য নিঃশেষ হয়ে গেছে। ক্ষুধার্ত খৃস্টান সৈন্যরা তাদের সুদূর এলাকা থেকে যুদ্ধের জন্য নিয়ে আসা উট-ঘোড়াগুলো জবাই করে খাচ্ছে। আমি রেমান্ডকে জীবিত ধরার চেষ্টায় আছি। কিন্তু কার্ক অবরোধ দীর্ঘ হতে চলেছে। খৃস্টানদের মেধা ও যুদ্ধরীতি এখন আগের চেয়ে উন্নত। আমি অবরোধ সফল করার চেষ্টায় আছি। আমি আশাবাদী যে, আমার জানবাজ মুজাহিদরা দুর্গ ভাঙ্গতে সক্ষম হবে। তারা যে চেতনা ও উদ্দীপনার সঙ্গে লড়াই করছে, তা আপনাকে বিস্মিত করবে। কিন্তু সুদানে আমার ভাই তকিউদ্দীন ব্যর্থ হয়েছে। আমি তাকে পিছিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছি। মিসরের সংবাদও ভাল নয়। গাদ্দার ও ঈমান-বিক্রেতারা দুশমনের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে বিদ্রোহ ও ক্রুসেড আক্রমণের পথ সুগম করে দিয়েছে। আপনি আলী বিন সুফিয়ানকে ভাল করে চিনেন। সে আমার কাছে এসেছে। আমি তার পরামর্শকে উপেক্ষা করতে পারি না। সে আমাকে মিসর চলে যেতে বলছে। মুহতারাম! আমি কার্ক দুর্গের অবরোধ প্রত্যাহার করতে পারি না। অন্যথায় খৃস্টানরা বলবে, সালাহুদ্দীন পিছপা হতে পারে। দুশমনের ঘাড় আমার মুঠোয়। আপনি আসুন, এই ঘাড় আপনি নিজের মুঠোয় তুলে নিন। সঙ্গে সৈন্য নিয়ে আসবেন। আপনার বাহিনীকে আমি মিসর নিয়ে যাব। অন্যথায় মিসর বিদ্রোহের শিকার হয়ে পড়বে। আমি আশা করি, আপনি আমার দ্বিতীয় বার্তার অপেক্ষা করবেন না।
সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী এক মুহূর্তও বিলম্ব করলেন না। রাতের পোষাকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের তলব করলেন এবং তাদের জরুরী নির্দেশ প্রদান করেন। দিনের এখনো অর্ধেকও অতিবাহিত হয়নি, তার বাহিনী কার্ক অভিমুখে রওনা হয়ে গেছে। সুলতান জঙ্গী একজন মর্দে মুজাহিদ। তার নাম শুনলে খৃস্টানরা কেঁপে উঠত। তার বক্ষে ছিল ঈমানের প্রদীপ। ছিল যুদ্ধ বিষয়ে পারদর্শিতা। তিনি পথে যথাসম্ভব কম বিরতি দিয়ে এত ময়দানে গিয়ে উপনীত হন যে, দেখে সুলতান আইউবী হতবাক হয়ে যান। দূত যদি আগেভাগেই তাকে অবহিত না করত যে, সুলতান জঙ্গী সৈন্য নিয়ে রওনা হয়েছেন, তাহলে দূর থেকে দেখে সুলতান আইউবী মনে করতেন, খৃস্টান বাহিনী হামলা করতে আসছে। সুলতান আইউবী ঘোড়া হাঁকিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে গেলেন। তাকে দেখে নুরুদ্দীন জঙ্গী ঘোড়া থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইসলামের দুপ্রহরী যখন আলিঙ্গনাবদ্ধ হন, তখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
***
সুলতান আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গীকে সব ঘটনা এবং গাদ্দারদের সবিস্তার কাহিনী শোনান। জঙ্গী বললেন, শোন সালাহুদ্দীন! ইসলামের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, গাদ্দাররা আমাদের জাতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে এবং জাতি তাদের থেকে কখনো মুক্ত হতে পারবে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, এমন একটি সময় আসবে, তখন গাদ্দাররা যথারীতি এ জাতিকে শাসন করবে। তারা দুশমনের বিরুদ্ধে কথা বলবে, বড় বড় দাবি করবে, দুশমনকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করবে, কিন্তু জাতি জানতেই পারবে না যে, তাদের শাসকরা মূলত তাদের ও তাদের দ্বীন-ধর্মের দুশমনের সঙ্গে তলে তলে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে। দুশমন তাদেরকে ঢাল-তরবারীরূপে ব্যবহার করবে এবং তাদের হাতে জাতিকে পিষে মারবে। তুমি অস্থির হয়ো না সালাহুদ্দীন। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব। তুমি মিসর চলে যাও এবং তকিউদ্দীনকে সাহায্য দিয়ে সুদান থেকে বের করে আন। ডানে-বাঁয়ে আক্রমণ করে দুশমনকে অস্থির করে তোল, যাতে তকিউদ্দীনের বাহিনী কোথাও দুশমনের বেষ্টনীতে আটকা না পড়ে। মিসরের সৈন্যদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, আমি তাদের মস্তিষ্ক থেকে বিদ্রোহের পোকা বের করে দেব।
সন্ধ্যার পর নুরুদ্দীন জঙ্গী তার বাহিনীকে কার্ক অবরোধে নিয়োজিত করেন এবং সুলতান আইউবীর বাহিনী পেছনে সরে আসে। তাদেরকে তৎক্ষণাৎ কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
এখানে কিছু ভুল হয়ে যায়। সুলতান আইউবী রেমান্ডের বাহিনীকে ঘিরে রেখেছিলেন। নূরুদ্দীন জঙ্গী যখন জরুরী নির্দেশনা দিয়ে তার বাহিনীকে তথায় প্রেরণ করেন, তখন নির্দেশনার কিছু ভুল বুঝাবুঝির কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে যায়। রেমান্ড অকস্মাৎ সেনাবেষ্টনীর সেই দিকটিতে আক্রমণ করে বসে, যেদিকে সুলতান আইউবীর অবস্থান দুর্বল বলে তার ধারণা। ভুল বুঝাবুঝির কারণে মুসলিম বাহিনী সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল না। রেমান্ড সেদিক থেকে দলবল নিয়ে পালিয়ে যায়। তারপরও কিছু সৈন্য বেষ্টনীতে আটকা পড়ে থাকে। তারা পরদিন জানতে পারে যে, তাদের অধিনায়ক রেমান্ড পালিয়ে গেছেন। তখন তারাও এলোপাতাড়ি পালাবার চেষ্টা শুরু করে দেয়। তারা তাদের জীবন রক্ষা করার জন্য লড়াই করে। ফলে কতিপয় নিহত হয়, বাকীরা ধরা পড়ে। এতে সুলতান আইউবীর এতটুকু ক্ষতি হয় যে, রেমান্ড পালিয়ে গেছে। পাশাপাশি উপকারও হয় যে, নুরুদ্দীন জঙ্গীর বাহিনী কার্ক অবরোধ সফল করে তোলার কাজে নিয়োজিত হওয়ার পূর্ণ সুযোগ পেয়ে গেছে।
সুলতান আইউবী যখন কায়রো রওনা হন, তখন তিনি বেদনাহত চোখে কার্কের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। তিনি জঙ্গীকে বললেন, ইতিহাস একথা বলবে না তো যে, সালাহুদ্দীন আইউবী পিছপা হয়েছিল? আমি অবরোধ প্রত্যাহার করিনি তো?
না, সালাহুদ্দীন!- নুরুদ্দীন জঙ্গী তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- তুমি পরাজিত হওনি। তুমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছ। যুদ্ধ আবেগ দিয়ে লড়া যায় না।
আমার ফিলিস্তীনে আমি আবার আসব- কার্কের প্রতি তাকিয়ে সুলতান আইউবী বললেন- আমি আসব…। বলেই তিনি ঘোড়া হাঁকান, আর পেছনে ফিরে তাকাননি।
নুরুদ্দীন জঙ্গী সুলতান আইউবীর গমনপথে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকেন। একসময় দূর পথে সুলতানের ঘোড়া যখন ধূলো-বালির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন তিনি তার এক নায়েবকে বললেন, ইসলামের প্রতিযুগেই একজন সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রয়োজন হবে। ঘটনাটি ১১৭৩ সালের (৬৫৯ হিজরী) মধ্যভাগের।