তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । দেশান্তর
ইতিহাস চলমান। তবে এর পাতায় পাতায় আমরা এমন অনেক তারিখ খুঁজে পাই যা বিরাট কোনো পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে আমাদের মনে গেথে থাকে। এমনই একটি দিন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর বা ১২ রবিউল আউয়াল। এই দিন নবি মুহামদ ইয়াসরিব শহরে পদার্পণ করেন। স্রেফ ধর্মীয় কারণে মুসলমানরা নবির এই দেশান্তরকে (হিজরত) একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখে থাকেন। প্রাচীন আরবীয়রা নির্দিষ্ট কোনো যুগের অন্তর্গত ছিল না। খুব সম্ভবত ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আব্রাহার নেতৃত্বে আবিসিনীয় বাহিনী মক্কা আক্রমণ করে পৌত্তলিকতার তীর্থভূমি কাবাঘর ধ্বংস করে ফেলতে চান। এটি হাতির বছর নামেও পরিচিত”। কারণ আবিসিনীয় বাহিনী এই যুদ্ধে শতাধিক হাতি ব্যবহার করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আবিসিনীয় বাহিনী মক্কাবাসীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়। অনেকে সেদিন হতে নতুন দিনপঞ্জি গণনা করতে শুরু করেন। হিজরতের সময় হতে মুসলমানদের নতুন যুগের সূচনার দাবির পিছনে আরেকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। হিজরতের পর থেকে নবির প্রতি আনুগত্যের কারণে মুসলমানদের সাহস অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাঁরা ক্ষমতা পেয়েছেন এই হিজরতের পর। মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের সদস্যরাও এ-সময় নবিকে নিরাপত্তাদানের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তাদের পরিচিতি হয় ‘আনসার’ হিসেবে।
তবে ইসলামের নতুন যুগের গণনা শুরু রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ থেকে শুরু হয়নি। একই বছরের প্রথম মাস মহরমের প্রথম তারিখ (১৬ জুলাই, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ) থেকে গণনা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে তৎকালীন আরবদের মনে এমন কোনো চিন্তা আসেনি যে, ওই বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখটিই পরবর্তীতে তাদের জীবনধারায় এক বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয়ে দাঁড়াবে। সমসাময়িক বিশ্বেরও কেউ ভাবতে পারেনি যে একদল মরুবাসী, যারা সভ্যতার ইতিহাসে কখনো কোনো অবদান রাখেনি, যারা উন্নততর গোষ্ঠী রোমান রাজা সিজার ও ইরানি বাদশাহ খসরু-১’র অনুগত হয়ে নিজেদের গর্বিত মনে করত, তারা দ্রুতই প্রাচীন সভ্যতার এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ডের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে। (পারস্যের জরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বী এই রাজার নাম খসরু১ আনুশিরুওয়ান’, যার অর্থ ‘অমর আত্মা খসরু। তিনি ৫৩১ থেকে ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাসানিদ রাজবংশের শাসক ছিলেন। তার জন্ম ৫০১ খ্রিস্টাব্দে। পারস্যের ইতিহাসে শিল্পকলার একজন মহান সংস্কারক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচিত হন।)
এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়া আরবদের নিকট নতুন কিছু ছিল না। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে, ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে ইয়েমেনের প্রাচীন মারিব(৪৫) বাঁধ ভাঙার পর দক্ষিণ আরবীয় গোষ্ঠীগুলোর উত্তর সীমান্তের দিকে অভিবাসিত হওয়া। সে তুলনায় মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের এবং কুরাইশ পৌত্তলিকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে কিছু অভিবাসীর মক্কা থেকে ইয়াসরিবে স্থানান্তরকে ইতিহাসের আলোকে অগুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। তবে অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই এক দশকের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। দশ বছরের মাথায় যে সকল ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে মক্কা ত্যাগ করেছিলেন, তারাই মক্কার শাসক হয়ে ওঠেন এবং তাদের প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। প্রতিপক্ষের উপাস্য সকল মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। কুরাইশদের পরিচালিত কাবার চিরাচরিত নিয়মকানুন সব বাদ দেয়া হয়। আবু লাহাব ও আবু জেহেলের উত্তরসূরি আবু সুফিয়ান প্রাণভয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এছাড়া অন্যান্য সকলে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। ছোট ছোট ঘটনার সমন্বয়ে একটি বড় ঘটনার সৃষ্টি হওয়া ইতিহাসে বিরল নয়। উদাহরণ হিসেবে আছে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এবং ইরানে মঙ্গলীয় আগ্রাসন।
মুহাম্মদকে ধর্ম প্রচারকালের শুরু থেকে কুরাইশ প্রধানদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। সম্ভবত তিনি প্রথমে আশা করেননি যে, তার প্রচারিত ধর্ম প্রাথমিকভাবে যৌক্তিক ও অন্যান্য দুই সেমিটিক ধর্মের সাথে সদৃশ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এমন বিরোধের সমূখীন হতে হবে। তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে এটা ভেবে দেখেননি যে, তার দীক্ষা গ্রহণের কারণে কুরাইশদের প্রাধান্য ক্ষমতা, অর্থ, বিত্তকে খাটো করে দেবে। তাদের শত্রুভাবাপন্নতা যখন বেড়ে যায় তখন নবি তা প্রতিরোধ করার উপায় বের করার পরিকল্পনা করতে বাধ্য হন। ইয়াসরিবে চলে যাওয়ার আগে তিনি এ ব্যাপারে আগেই দুটি পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল আবিসিনিয়ায় কিছু মুসলমানকে পর পর দুই দলে বিভক্ত করে পাঠানো। গরিব, অসহায় ও কুরাইশ কর্তৃক নির্যাতিত মুসলমানরা নবির কাছ থেকে আবিসিনিয়ায় যাওয়ার পরামর্শ পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় দলের সদস্যের (যাদের মধ্যে নবির চাচাত ভাই এবং হজরত আলির আপন বড়ভাই জাফর বিন আবু তালেবও ছিলেন) পরিচয় লাভের মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে আসা যায়। নিগাসের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশাও মুহাম্মদের মনে এসেছিল। আবিসিনিয়ার একজন খ্রিস্টান শাসক হিসেবে নিগাস স্বাভাবিকভাবে পৌত্তলিকতার বিরোধী হবেন। যখন তিনি জানতে পারবেন মক্কায় একদল একেশ্বরবাদী জোট হয়ে পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের চেষ্টা করছেন এবং তাঁরা সেখানে নিগৃহীত হচ্ছে, তখন তিনি তাদের সহায়তা করার জন্য একটি বাহিনী হয়তো পাঠিয়ে দিতে পারেন। নিগ্রহের শিকার না হওয়া ও তুলনামূলক সন্ত্রান্ত পরিবার থেকে আসা জাফর বিন আবু তালিবের অংশগ্রহণের কারণ এ থেকে বোঝা যায়। একই সময়ে কুরাইশরা আমর ইবনে আল-আস ও আব্দুল্লাহ বিন আবু রাবিয়াকে আবিসিনিয়ার বাদশাহ নিগাসের কাছে কিছু উপহারসহ পাঠিয়ে দেন। তাদের আশা ছিল এতে করে মুসলমানদের প্রস্তাবিত কোনো বিষয়ে নিগাস যেন রাজি না হন এবং সম্ভব হলে তাদের ঐতিহ্য রক্ষার্থেও তিনি যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি ছিল ৬২০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদের তায়েফের উদ্দেশ্যে যাত্রা। নিজের চাচা ও আশ্রয়দাতা আবু তালিব এবং বিবি খাদিজাকে হারানোর পর তাঁকে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্রভাবাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তিনি তায়েফ-নিবাসী বানু সাকিফ গোষ্ঠীর নিকট থেকে সাহায্য আশা করেছিলেন, যাদের সাথে তার মাতৃবংশীয় সম্পর্ক ছিল। তায়েফে অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে বানু সাকিফদের অবস্থান সমানের দিক থেকে অনেক উচুতে ছিল। তায়েফের জনগণ মক্কার অবস্থান ও বেদুইনদের মাঝে কুরাইশদের সমানকে ঈর্ষার চোখে দেখত। কুরাইশদের আধিপত্য এড়ানোর জন্য তাঁরা স্বাভাবিকভাবে নিজেদের শহরকে আরবীয়দের মিলনমেলায় পরিণত করতে চাইত। এটা কোনো কলপনা নয় বরং প্রমাণিত সত্য। কারণ নবিকে সাকিফ-প্রধানদের সাথে একটি সাক্ষাতের কথা স্মরণ করতে দেখা গেছে। সাকিফ-প্রধানরা বলেছিলেন, তায়েফকে নতুন ধর্মের কেন্দ্র ও পবিত্র ভূমি ঘোষণা করা হয় তবে তায়েফের জনগণ অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করবে। এর আগে তায়েফের আরেকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বানু আমেরও নবির কাছে এরকম একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। তাঁরা অনুরোধ করেছিল তাদের সাহায্যে যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে তবে কুরাইশদের স্থলে তাদেরকেই যেন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী বানিয়ে দেয়া হয়। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে নবির তায়েফ যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের রাস্তা পরিষ্কার করা। তাঁকে সাহায্য করার ইচ্ছা যদি বানু সাকিফদের মধ্যে থাকত তবে কুরাইশদের পরাস্ত করা সম্ভব ছিল। এ-কারণে তিনি গোপনে তার মুক্ত ক্রীতদাস ও পালিত পুত্র জায়েদ বিন হারিসকে নিয়ে অন্য কোনো সঙ্গী ছাড়াই তায়েফ সফরে গিয়েছিলেন। তবে তার আশা অবশ্য ভঙ্গ হয়েছিল, কারণ বানু সাকিফ-প্রধানরা তাঁকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
আরব বেদুইনদের মাঝে আধ্যাত্মিক বিষয়ে কখনো তেমন আগ্রহ ছিল না। এমনকি আজও মুহাম্মদের চৌদ্দ শতক পরেও তারা ধর্মকে পার্থিব অর্জন হিসেবে দেখে। বানু সাকিফরা ভবিষ্যতের মুক্তির কথা ভেবে নিজেদের জীবিকার প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তায়েফ মূলত গ্রীষ্মকালে ব্যস্ত হয়ে উঠত। তায়েফের জনগণ মক্কার পর্যটকদের কাছ থেকে এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে আয়-উপার্জন করতেন। কুরাইশরা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাঁকে কোনোরূপ সাহায্য দিতে দেখলে আরও বেশি শত্রভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। কাজেই নবির অপ্রমাণিত প্রতিশ্রতির তুলনায় তায়েফের জনগণের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের দিকে নজর দেয়াটাকে বানু সাকিফদের যৌক্তিক মন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। লাভ ক্ষতির এমন সমীকরণের সামনে থেকে তায়েফের-প্রধানরা মুহাম্মদকে সাহায্য করতে শুধু অস্বীকৃতিই জানাননি, তার প্রতি বিদ্বেষও সৃষ্টি করেছিল। তাঁরা নবিকে আঘাত করেছিল, অপমানিত করেছিল, এমনকি নবির শেষ অনুরোধটিও পর্যন্ত তাঁরা রাখেননি। যা ছিল তার এই অসফল সফর প্রসঙ্গে কুরাইশদেরকে কিছু না জানানো। কিন্তু কুরাইশরা ঠিকই বার্তা পেলেন। ফলে মক্কায় নবির বিরোধীরা আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠেন। শেষে পৌত্তলিকদের কিছু নেতা মুহাম্মদের নবুওতি ভাবনার (যা তাদের অবস্থান ও বিত্তের প্রতি হুমকি হয়ে উঠেছিল) সমাপ্তি টানার উপায় বের করার জন্য সমাবেশে মিলিত হন। যে তিনটি প্রস্তাব উঠে এসেছিল সেগুলো ছিল নবিকে নির্বাসিত করা, কারাবন্দী করা অথবা হত্যা করা। এক্ষেত্রে তাঁরা শেষ প্রস্তাবটিই বেছে নেন।
তায়েফের পাশাপাশি হেজাজের আরেকটি শহরও অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে মক্কার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছিল। সেটি ছিল ইয়াসরিব, যা মদিনা (স্থানীয় ইহুদিদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ “নগর)(৪৭) নামে পরিচিত। আরবের জনপ্রিয় মূর্তিগুলোর সুসজ্জিত উপাসনালয়গুলোর কারণে মক্কা শহরটি আরবদের কাছে, বিশেষ করে বেদুইন ও কুরাইশদের কাছে ধর্মীয় তীর্থভূমি বলে বিবেচিত হতো। কাবার রক্ষণাবেক্ষণ ও এর পরিদর্শকদের প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্বে নিয়োজিত যা মক্কায় একেবারে ছিল না। সেইসাথে বাণিজ্যিক উন্নয়ন ও তিনটি ইহুদি গোত্রের কারণে অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হারের সন্তোষজনক অবস্থানের ফলে ইয়াসরিবের সাংস্কৃতিক-সামাজিক মান মক্কার তুলনায় উচ্চতর অবস্থায় ছিল। তারপরও হেজাজের শহরগুলোর মধ্যে ইয়াসরিবকে মক্কার পরে দ্বিতীয় স্থানে গণ্য করা হতো।
ইয়াসরিবের অধিবাসীদের মধ্যে কুরাইশদের সাথে শত্রভাবাপন্ন দুটি আরবীয় গোষ্ঠী বসবাস করত। এরা হচ্ছে আউস এবং খাজরাজ। দুই গোষ্ঠীরই আবার ইয়াসরিবের দুই-একটি ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আউস এবং খাজরাজ ছিল কাহতানি আরব, অর্থাৎ ইয়েমেন-বংশোদ্ভূত। আদনানি বা উত্তর আরবীয় বংশোদ্ভূত কুরাইশদের সাথে তাদের বিরোধ বহু প্রাচীন। কৃষি ও বাণিজ্যে অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে আউস এবং খাজরাজ গোত্র তাদের ইহুদি প্রতিবেশীদের মতো অগ্রসর ছিলেন না। তাদের অনেকে ইহুদিদের অধীনে কাজ করতেন। ফলে কিছু নির্দিষ্ট ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে মিত্রতা থাকলেও যেসব ইহুদিদেরকে তাঁরা প্রভু মানতেন, তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকে সহজভাবে নেননি। মক্কায় নবি মুহাম্মদের উত্থান ও ইসলামের প্রচার এবং কুরাইশদের সাথে তার বিরোধের সংবাদ হেজাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ইয়াসরিবের অনেকেই এ-বিষয়ে অত্যন্ত উৎসুক ছিলেন। মক্কা থেকে আগত ইয়াসরিবের পর্যটকদের বর্ণনা শুনে কিছু সংখ্যক আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোক ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কথা ভাবতে থাকেন। নবি মুহামদ ও তার সঙ্গীদের যদি এখানে আনা যায় এবং কোনোভাবে যদি মুহাম্মদের সাথে জোট বাঁধা যায়, তবে হয়তো অনেক সমস্যারই সমাধান হতে পারে। যেহেতু মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরাও কুরাইশ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তাই এতে করে কুরাইশদের সংহতির দেয়ালও ভেঙে ফেলা যেতে পারে। মুহামদ ও তার সঙ্গীদের সাথে গড়ে তোলা জোটের সাহায্যে আউস এবং খাজরাজের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের জাতিগত বিদ্বেষও মিটিয়ে ফেলা যেতে পারে। তাছাড়া মুহাম্মদ একটি নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছেন। এই ধর্ম যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তবে ইহুদিরা আর তাদের উপর অবস্থান করতে পারবে না। মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের সাথে সমঝোতার ফলে ইয়াসরিবের তিন ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে আউস ও খাজরাজের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারে।
৬২০ খ্রিস্টাব্দের হজ মৌসুমে ইয়াসরিবের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে দেখা করেন এবং মুহাম্মদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন। পরের বছর একই সময়ে মক্কার বাইরে আল-আকাবায় বারো সদস্যের একটি দল নবির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা দেখলেন নবির শিক্ষার একটা সুদূরপ্রসার প্রভাব রয়েছে এবং নবির চাওয়াও খুব বেশি কিছু নয়। সবাইকে ব্যাভিচার,
সুদের ব্যবসা, মিথ্যাচার পরিহার করতে হবে এবং মানব নির্মিত মূর্তির পরিবর্তে এক আল্লাহ- তে বিশ্বাস করতে হবে। সেই বারো জন ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ইয়াসরিবে ফিরে আসেন ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের জানান যে, তাঁরা মুসলমান হয়ে গিয়েছেন এবং মুহাম্মদের সাথে তাদের চুক্তিও হয়েছে। তাদের কাজ ও প্রস্তাবনা ইয়াসরিবের অনেক স্থানে স্বীকৃতি লাভ করে। পরের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারীর একটি বড় প্রতিনিধিদল মুহাম্মদের সাথে একই স্থানে দেখা করতে যান এবং দ্বিতীয় চুক্তি সম্পন্ন করেন।
দেশান্তরের বিষয়টি মুহাম্মদের মনে হঠাৎ করে জেগে ওঠেনি। যে-সব মুসলমান আবিসিনিয়ায় গিয়েছিলেন তাদের সূত্রে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। সুরা জুমার’র এই আয়াতে রয়েছে বলো, হে বিশ্বাসী দাসগণ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। যারা এ-পৃথিবীতে ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। (৩৯:১০)। আল-আকাবা চুক্তিতে অবশ্যই মুহাম্মদের আশার প্রতিফলন ঘটেছিল। তের বছর ধরে মক্কায় তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কিছু সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলমান তাদের আরব-চরিত্রের কারণে ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় পূর্বের ধর্মে ফিরে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে যখন তাঁরা দেখলেন মুহাম্মদের আদর্শ খুব একটা বিস্তার লাভ করছে না এবং মুসলমান বলে তাদেরকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে। ধনী ও প্রভাবশালী পৌত্তলিকরা তাদের অনেককে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করেছিল। তায়েফের বানু সাকিফদের সাথে নবির যোগাযোগ শুধু ব্যর্থই হয়নি, এতে করে কুরাইশদের সাথে তার শক্রতা তীব্রতর হয়ে গিয়েছিল। যদিও নিজ গোষ্ঠী বানু হাশেমি তাঁকে রক্ষা করে আসছিল, তবে তাঁরা শুধু শারীরিকভাবে আহত হওয়া থেকে রক্ষা করতেন। তাঁরা কুরাইশদের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নেবে এমনটা আশা করা সম্ভব ছিল না। আউস এবং খাজরাজদের সাথে স্থাপিত মিত্রতা অবশ্য এই আশা পূরণ করতে পারত। তাদের সমর্থন থাকলে কুরাইশদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল। মক্কায় ইসলাম দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি তবে ইয়াসরিবে সেটা সম্ভব ছিল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কুরাইশদের সাথে আউস এবং খাজরাজ গোষ্ঠীর ঈর্ষাকাতরতা। এছাড়া ইয়াসরিবের উন্নত বাণিজ্য ও কৃষিব্যবস্থার কারণে মুসলমানরা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজও খুঁজে নিতে পারবেন।
আল-আকাবায় নবি এবং আউস ও খাজরাজদের মধ্যে আলাপকালে আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেব (তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি, তবে নিজের ভাতিজাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন) হাজির হন। তিনি অন্যদেরকে তাদের অবস্থান ও ইচ্ছার ব্যাপারে স্পষ্ট হতে বলেন। ইয়াসরিবের প্রতিনিধিদের আব্বাস সরাসরি বলেন: তাঁরা এবং মুহাম্মদ কুরাইশদের হামলার শিকার হতে পারে; এবং এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাঁরা মুহাম্মদকে ততটাই প্রতিরক্ষা দিবে যতটা তাঁরা নিজেদের স্ত্রীসন্তানদের দিয়ে থাকে এবং তাঁরা যেন মিথ্যা প্রতিশ্রতি দিয়ে মুহাম্মদকে বিভ্রান্ত না করেন। এ-সময় খাজরাজ গোত্রের প্রতিনিধির মধ্য থেকে আল-বারা বিন আল-মারুর উত্তেজনার বশে বলেন, তাঁরা সবাই নির্ভীক, লড়াকু যোদ্ধা এবং তাঁরা সকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত আছেন। একজন বয়োজ্যষ্ঠ ও অভিজ্ঞ আউস প্রতিনিধি আবুল হাসিম বিন তায়েহান নবিকে বলেন: ইহুদিদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা আপনার ও আপনার সঙ্গীদের সাথে করা চুক্তির কারণে ভেঙে যেতে পারে।
হয়তো আপনার আদর্শ আরও এগিয়ে যাবে। তখন আপনি কি আমাদের ছেড়ে দিয়ে আপনার নিজ গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করে ফেলবেন? প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম (মৃত্যু হিজরি ২১২/২১৮ বা ৮২৮৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) , যিনি ইবনে হিশাম নামে বেশি পরিচিত, তার সম্পাদিত দ্যা লাইফ অব দ্যা প্রফেট গ্রন্থ অনুসারে নবি তখন হেসে উত্তর দিয়েছিলেন: রক্তের জন্য রক্ত, ধ্বংসের জন্য ধ্বংস। আমি আপনাদের সাথে থাকব, আপনারা আমার সাথে থাকবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করবে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব আর যারা আপনাদের সাথে শান্তি বজায় রাখবে আমিও তাদের সাথে শান্তি বজায় রাখব।;
এখানে ‘রক্ত’, ‘ধ্বংস’ শব্দগুলোর উল্লেখ বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লবী জ্যাঁ পল মারাতের উক্তি ‘আমি রক্ত চাই’- এর কথা মনে করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য আবুল হাসিম বিন তায়েহানের প্রশ্নের উত্তরে আরেকটি কথা নবি বলেছিলেন বলে জানা যায়, লাল ও কালোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সম্ভবত এর দ্বারা তিনি সকল বর্ণের সাথে যুদ্ধের কথা বুঝিয়েছিলেন; আরবীয় হোক আর অনারবীয় হোক। এ-বক্তব্য নবি মুহাম্মদের ভবিষ্যত চিন্তা ও গোপন অভীপ্সার কথা জানান দেয়। আবুল হাসিমকে দেয়া উত্তর নির্দেশ করে, এটা ছিল নবি হৃদয় থেকে বের হয়ে আসা আর্তনাদ, দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আউস ও খাজরাজদের সমর্থন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে দিতে পারে। এতে করে নবি ইসলামের প্রসারে আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন, বিরোধী কুরাইশদের বিরোধিতার জবাব দিতে পারবেন এবং দীর্ঘদিনের নিজস্ব চিন্তাও প্রকাশ করতে পারবেন। মক্কায় গত তের বছর ধরে তার প্রচার খুবই ক্ষীণ প্রভাব ফেলেছে, সমগ্র আরবের সামনে এখন ইসলামকে আনা সম্ভব হবে।