তৃতীয় পাঠ
রেনকো, বাসেরিও আর আমি ভিলকাফোরের পরিত্যক্ত মূল সড়ক ধরে হাঁটছি।
চারদিকের নীরবতা বিষণ্ণ করে তুলছে আমাকে। এমন মৌন রেইনফরেস্ট জীবনে কখনো দেখিনি আমি।
রক্তাক্ত একটা মৃতদেহ টপকে এলাম। ধড় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলা হয়েছে মাথাটা।
এরকম আরো অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি আমি। চোখ দুটো বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন ওগুলো থেকে। কিছু মৃতদেহের হাত এবং পা সকেট থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। বেশকিছুর, আমি দেখেছি, তাদের গলা প্রচণ্ড কোনো শক্তি ছিঁড়ে ফেলেছে।
হার্নান্দো? ফিসফিস করে রেনকোকে জিজ্ঞেস করলাম।
অসম্ভব, আমার সাহসী সঙ্গী বলল। আমাদের আগে এখানে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই তার।
রাস্তা ধরে এগোবার সময় দেখলাম বিরাট একটা শুকনো পরিখা গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে। কাঠের দুটো সেতু দিয়ে গ্রামের অপর অংশে যাওয়া যায়, দুর্গসহ একটা গ্রামের সেতু যেমন হয়, প্রয়োজনের সময় দ্রুত সরিয়ে ফেলা যায়। এটা নিশ্চিত যে ভিলকাফোরের আক্রমণ করাটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।
দুর্গে পৌঁছালাম আমরা। দুৰ্গটা দুই-স্তরের পাথরের দালান, পিরামিড আকৃতির, তবে গোলাকার, চৌকো নয়। রেনকো বিশাল পাথরের দরজায় ধাক্কা দিল। দরজায় পৌঁছে ভিলকাফোর নামটা গলা চড়িয়ে বারকয়েক ডেকে বুঝাল যে সে হল রেনকো, আইডলটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। খানিক পর কিছু লোক নিয়ে নিজেই এসে পাথরের স্লাভটা সরিয়ে দিয়ে কয়েকজন সৈন্য বেরিয়ে এলো পেছনে ভিলকাফোর, বুড়োর মাথা ভর্তি ছাই রঙা চুল এবং ঘোলাটে চোখ। লাল কাপড় পরিহিত তবে দেখে মনে হল মাদ্রিদের রাস্তার ফকিরের মতো।
রেনকো! বুড়ো মানুষটা চেঁচিয়ে উঠলেন আমার সঙ্গীকে দেখার সাথে সাথে।
আঙ্কেল, রেনকো বলল।
ঠিক এই সময়টায় ভিলকাফোর আমাকে দেখতে পেল।
আমি ভেবেছিলাম আমি তার চেহারায় অবাক হওয়ার চিহ্ন পাব–একজন স্প্যানিয়ার্ড তার ভাতিজার গুরুত্বপূর্ণ কাজে সঙ্গী হয়েছে–কিন্তু কিছুই হল না। তার বদলে ভিলকাফোর রেনকোর দিকে ঘুরলেন এবং বললেন, এই কি সোনা-খেকো যার কথা আমার ম্যাসেঞ্জার আমাকে বলেছে? যে তোমার পাশেপাশে কুজকোর পথ ধরে এসেছে?
হ্যাঁ, আঙ্কেল, জবাবে রেনকো বলল।
ওরা কুইচুয়ান ভাষায় কথা বলছিল, কিন্তু এর ভেতর অনভিজ্ঞ রেনকো আমার অদ্ভুত ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে এবং আমি বুঝতে পারি বেশিরভাগই ওরা কি কথা বলতে চাইছে।
ভিলকাফোর ঘোঁত ঘোঁত করে উঠলেন। একজন উদার সোনা খেকো…হুম….আমি এ ধরনের প্রাণীর কথা জানি না। তবে সে যদি তোমার বন্ধু হয়ে থাকে, ভাতিজা, এখানে তাকে স্বাগতম।
চিফ ঘুরে দাঁড়ালেন আবার, এবার তিনি ক্রিমিনাল বাসেরিও-র দিকে তাকালেন, দাঁড়িয়ে আছে রেনকোর পেছনে মুখে ছড়ান হাসি নিয়ে, ভিলকাফোর তাকে সাথে সাথে চিনতে পারলেন।
রেনকোর দিকে তাকালেন বিরক্তির দষ্টিতে। ও এখানে কি করছে?
ও আমাদের সাথে এসেছে, আঙ্কেল। একটা কারণ আছে, বলল রেনকো থামল কিছু বলার আগে। আঙ্কেল, এখানে কি ঘটেছে? স্প্যানিয়ার্ডরা কি?
না, ভাতিজা। এটা সোনা খোকোর কাজ নয়। না, এটা শয়তানের কাজ, হাজার গুণ বেশি খারাপ।
কী ঘটেছে এখানে?
ভিলকাফোর মাথা নোয়ালেন। আমার ভাতিজা এই জায়গা এখন আর কারো জন্যে নিরাপদ নয়।
কেন?
না… একদমই নিরাপদ নয়।
আঙ্কেল, তীক্ষ্ণগলায় বলল রেনকো। তুমি কি করেছ?
ভিলকাফোর রেনকোর পাশ দিয়ে পাথুরে মালভূমি ছাড়িয়ে ছোট্ট শহরের দিকে তাকালেন।
ভাতিজা, তাড়াতাড়ি দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়ি! একটু পরেই সন্ধ্যে হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসবে ওগুলো। এসো, দুর্গের ভেতরে আমরা নিরাপদ।
আঙ্কেল, কী ঘটেছে এখানে?
এর জন্যে আমি দায়ী, ভাতিজা। এর জন্য আমি দায়ী।
প্রচণ্ড শব্দ করে আমাদের পেছনে দুর্গের গোলাকার পাথরের দরজাটা বন্ধ হলে গেল।
দুই স্তরের পিরামিডের ভেতরটা অন্ধকার, আলোকিত হয়েছে কয়েকটি হাতে ধরা মশালের সাহায্যে। দেখলাম প্রায় ডজনখানেক ভীত চেহারার মানুষ দাঁড়িয়ে আমার সামনে মেয়েরা বাচ্চাদের চেপে ধরে আছে, পুরুষেরা আহত। বুঝতে পারলাম এরা হল ভিলকাফোরের জ্ঞাতিগুষ্টি, যে সময় বাইরে হত্যাযজ্ঞ চলছিল সৌভাগ্যবানের মতো ওরা ভেতরে ছিল।
পাথরের মেঝেতে একটা চৌকো গর্ত লক্ষ্য করলাম মাঝেমধ্যে দুএকজন লোক উঠে আসছে ওটা থেকে। টানেল কিংবা অন্য কিছু রয়েছে ওটার নিচে।
ওটা হল একটা কোয়েঙ্কো, বাসেরিও ফিসফিস করে আমার কানে বলল।
কি ওটা? জানতে চাইলাম আমি।
একটি গোলকধাঁধা। জটিল। শহরের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গের জাল এঁকেবেঁকে চলে গেছে। একটা বিখ্যাত গোলকধাঁধা আছে কুজকো থেকে বেশি দূরে নয়। আসল, কোয়েঙ্কো বানান হয়েছিল শাসকদের বাছাই করা দলবলের পালানোর সুড়ঙ্গ হিসেবে। শুধুমাত্র রাজকীয় পরিবাররাই জানে এই গোলকধাঁধার সুড়ঙ্গ কিভাবে বের হয়ে যেতে পারবে তার কোড।
আর এখন, কোয়াঙ্কো মূলত খেলাধুলা এবং উৎসবের সময় জুয়া খেলায় ব্যবহার করা হয়। দুজন সাহসী ব্যক্তিকে গোলকধাঁধায় নামিয়ে দেওয়া হয়, সাথে শক্ত সমর্থ পাঁচটি জাগুয়ার। সাহসী ব্যক্তিরা সফলভাবে কোয়াঙ্কো পথ ধরে এগিয়ে যায়, কৌশলে জাগুয়ারদের এড়িয়ে বেরিয়ে আসার পথটা পেয়ে যায় এবং জিতে নেয় পুরস্কার। খুবই জনপ্রিয় খেলা। আমি ধারণা করতে পারি যে এই শহরের কোয়াঙ্কো আসল কাজেই বেশি ব্যবহার করা হয়, এই টানেল ধরে রাজবংশীয় দ্রুত পালাতে পারে।
দুর্গের এক কোণে নিয়ে এলেন ভিলকাফোর, একটা আগুন জ্বলছে। খড়ের গাদায় বসতে বলা হল আমাদেরকে। কাজের লোক আমাদের জন্য পানি নিয়ে এল।
তা রেনকো আইডলটা এখন তোমার কাছে? জানতে চাইলে ভিলকাফোর।
হ্যাঁ। চামড়ার থলে থেকে সিল্ক কাপড়ে মোড়া পুতুলটা বের করল রেনকো। কাপড় তুলে আঙ্কেলকে দেখাল কালো-এবং-রক্ত বেগুনী কাজ করা চকচকে আইডলটা।
এটা যদি সম্ভব হয়ে থাকে, আমি বিশ্বাস করি যে দুর্গের কাঁপুনি দেওয়া কমলা আলো বিড়ালগুলোর দাঁত খিচান অমঙ্গলের পথে পৌঁছে দেয়।
এটা নিয়তির লিখন, ভাতিজা, ভিলকাফোর বললেন। যারা ওটা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়। আইডলটা তুমি রক্ষা করবে। আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত।
আর, আঙ্কেল, রেনকো বলল, যদিও আমি তার গলার স্বর শুনে বুঝতে পেরেছি, তারপরেও। এখানে কী ঘটেছে বলে আমাকে।
মাথা ঝাঁকালেন ভিলকাফোর।
তারপর শুরু করলেন তিনি। খবর পেলাম সোনা-খেকো বিদেশীরা জঙ্গল আর পাহাড় টপকে আমাদের গোপন গ্রামের দিকে ছুটে আসছে। বুঝতে পারছিলাম ওটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দুই চাঁদ আগে নতুন একটা বিশেষ পথ তৈরি করার নির্দেশ দিলাম আমি, যেটা পাহাড়ের গভীরে পৌঁছে দেবে আমাদেরকে। দূরে সরিয়ে রাখবে সোনা খেকো বেজন্মাদের হাত থেকে। তবে পথটা ছিল বিশেষ পথ। একবার ব্যবহার করার পর ধ্বংস করে ফেলা যাবে ওটাকে। তারপর, এই এলাকার বৈশিষ্ট্যের কারণে, পাহাড়ে ঢোকার অন্য কোনো পথ এখান থেকে অন্তত বিশ দিনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিছু নেওয়ার চেষ্টা করলে যে-কোনো লোক কয়েক সপ্তা নষ্ট করবে, ততদিনে গায়েব হয়ে যাব আমরা।
বলে যাও, বলল রেনকো।
আমার ইঞ্জিনিয়াররা এই পথ তৈরি করার জন্যে আদর্শ একটা জায়গা খুঁজে পায়, বিস্ময়কর একটা ক্যানিয়ন, এখান থেকে বেশি দূরে নয়। ক্যানিয়নটা চওড়া, গোল আকৃতির, সেটার মাঝখান থেকে ওপরদিকে উঠে গেছে পাথরের প্রকাণ্ড একটা আঙুল।
দেখা গেল ক্যানিয়নটার পাঁচিল আমাদের নতুন পথের জন্যে খুবই উপযোগী, সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করার নির্দেশ দিই আমি। সব ভালোভাবেই চলল, শেষে একদিন ক্যানিয়নের চূড়ায় পৌঁছাল আমার কারিগররা। ওখানে থেকে নিচে তাকাতে জিনিসটা দেখতে পেল ওরা।
কী দেখতে পেল, আঙ্কেল?
তারা এক ধরনের দালান দেখতে পেল, মানুষের তৈরি একটা কাঠামো, বানান হয়েছে প্রকাণ্ড সেই পাথুরে আঙুলের চূড়ায়।
রেনকো চট করে একবার আমার দিকে তাকাল।
ওটা যাই হোক, ইনকাদের হাতে ওটা তৈরি হয়নি, দেখে মনে হল ধর্মীয় কোনো স্থাপনা, একটা টেম্পল অথবা পবিত্র কিছু হবে, গোটা বনভূমি জুড়ে এ ধরনের ধর্মীয় স্থাপনা আগে যেমন পাওয়া গেছে। টেম্পলগুলো আমাদের সময়ের চেয়ে বহু বছর আগে রহস্যময় কোনো সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি করা হয়।
তবে এই টেম্পলটার আশ্চর্য একটা ব্যাপার হল, বিরাট বোন্ডার দিয়ে ওটার প্রবেশপথ বন্ধ করা। বোল্ডারটার গায়ে নানা ধরনের ছবি আর সংকেত খোদাই করা আছে, আমাদের সবচেয়ে পবিত্র মানুষরাও সেগুলোর অর্থ বের করতে পারেনি।
তারপর কী হল, আঙ্কেল? রেনকো বলল।
চোখ নামালেন ভিলকাফোর। কেউ একজন বলল, ওটা সোলোন-এর টেম্পল, হতে পারে এবং তা যদি হয়, ভেতরে বিপুল পরিমাণে ধন-সম্পদ পাওয়া যাবে।
কী করলে তুমি, আঙ্কেল? চিন্তিত গলায় বলল।
নির্দেশই দিলাম টেম্পল খুলতে হবে, বললেন ভিলকাফোর, মাথাটা নিচু করলেন। আর আমার এই নির্দেশই শয়তানগুলোর লাগাম খুলে দিল, আমি রাপাগুলোকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দিলাম।
.
রাত একটু বাড়তে দুর্গের ছাদে উঠে শহরের ওপর নজর রাখছি রেনকো এবং আমি, রাপা নামের জম্ভগুলোকে দেখতে চাই।
বাসেরিও অবশ্য অন্ধকার ছাদের একটা কোণ বেছে নিয়ে কামরার দিকে পেছন ফিরে বসল, আগের মতোই কী যেন একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
দুর্গের ছাদ থেকে নিচের গ্রামটার দিকে তাকালাম আমি।
এখন, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমাদের আসার পর, আমি রাতের বেলার জঙ্গলের শব্দের ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। দাঁড়কাকের মতো কর্কশ গলায় ব্যাঙের ডাক, পোকামাকড়ের একঘেয়ে গুঞ্জন ধ্বনি, উঁচু গাছের ডালে বানরের চঞ্চল পায়ে ছুটে চলার শব্দ এই সবই শুনেছি।
কিন্তু এখানে কোনো শব্দ নেই। ভিলকাফোরের গ্রামটা ঘিরে থাক একদম নীরব হয়ে আছে।
নেই কোনো প্রাণীর শব্দ। নেই কোনো জীবিত জিনিসের নড়াচড়া।
মূল সড়কে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোর দিকে আমি ভালো করে তাকালাম।
এখানে হয়েছেটা কী? রেনকোকে নরম গলায় প্রশ্ন করলাম আমি।
প্রথমে কিছু বলতে চাইল না। তারপর সে বলল, একটা ভয়ঙ্কর শয়তান ছাড়া পেয়ে গেছে, বন্ধু। ভয়ঙ্কর শয়তান।
তোমার আঙ্কেল যখন বলছিলেন যে তারা যে টেম্পলটা পেয়েছিলেন সেটা হল নিশ্চিত সোলোনের টেম্পল? এই সোলোনটা কে?
রেনকো বলল, বহু হাজার বছর ধরে অনেক সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে এই মার্টিতে। তাদের সম্পর্কে কিছুই আমরা জানি না, শুধু প্রাচীন কিছু স্থাপনা রেখে গেছে তারা, আর স্থানীয় সম্প্রদায়ের লোকগল্পে তাদের গুণগান করা হয়।
এরকম একটা সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন তাকে মানুষ মোক্সে কিংবা মোচে বলে ডাকত। বলা হয়ে থাকে মোক্সের লোকেরা রাপার পুজো করত। অনেকে বলে রাপাকে পোষ মানাত তারা, তবে এটা বিতর্কিত।
তো মোক্সে সাম্রাজ্যের সোলোন নামে একজন ছিলেন। কথিত আছে যে, সোলোন একজন বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন, চিন্তাবিদ এবং তিনি ছিলেন মোক্সের প্রধান উপদেষ্টা।
সোলোন বুড়ো হলে সম্রাট তাঁকে প্রচুর মনিমাণিক্য উপহার হিসেবে দেন এবং বলেন, সাম্রাজ্যের যে-কোনো জায়গায় যে কোনো আকৃতির মন্দির তৈরি করতে পারবেন তিনি। সোলোন যেমনটি চাইবেন, সম্রাটের কারিগররা ঠিক তেমনটি বানিয়ে দেবে।
রেনকো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল।
বলা হয়ে থাকে যে, তারই ফলশ্রুতিতে তৈরি হয় ক্যানিয়নের ভেতর, অতন্ত দুর্গম আর গোপন একটা জায়গায়, সেই টেম্পল বানানোর পর সম্রাটের কাছে এক পাল রাপা চান সোলোন। টেম্পলের ভেতরে এই রাপারা ধন-দৌলত পাহারা দেবে।
সেই কি তাহলে টেম্পলের ভেতর একদল রাপা রাখে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ঠিক তাই, বলল রেনকো। তবে সোলোন কী চেয়েছেন সেটা তোমাকে বুঝতে হবে। টেম্পলটাকে তিনি একটা পরীক্ষা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।
কি বলতে চাইছে?
সোলোন জানত টেম্পলের ভেতর সোনাদানা আছে। এ খবরটা ছড়াতে বেশি সময় লাগবে না। সে জানত লোভ-লালসা অ্যাডভেঞ্চারাসদের সোনার খোঁজে এখানে নিয়ে আসবে আর লুঠ করে বড়লোক হয়ে যাবে।
আর সেই কারণে পরীক্ষার জন্য সে টেম্পলটা বানিয়েছে। পরীক্ষাটা হল প্রচুর ধনসম্পদ এবং সাক্ষাৎ মৃত্যুর মাঝে। পরীক্ষা করে দেখতে চায় মানুষ তার অবাধ্য লোভ কি করে সামাল দেয়।
রেনকো আমার দিকে তাকাল। যে মানুষ তার আকাঙ্ক্ষা এবং পছন্দ জয় করতে পারে সে টেম্পলের দরজা খুলে দিবে না। যে মানুষটার ভেতর লোভ কাজ করে এবং টেম্পলের দরজা খুলে দিবে গুপ্তধনের আশায় আর তার মৃত্যু হবে রাপার আক্রমণে।
আমি নীরবে শুনে গেলাম।
এই টেম্পলটা যার কথা ভিলকাফোর বলেছিলেন, বললাম আমি, একটা বিশাল পাথরের ওপর স্থাপন করা, তুমি কি ভেবেছ এটা সোলোনদের টেম্পল?।
রেনকো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাই যদি হয়, তাহলে এটা আমাকে দুঃখ দিয়েছে।
কেন?
কারণ এর মানে হল আমরা দীর্ঘ পথ ধরে ছুটে এসেছি মৃত্যুর জন্য।
***
আমি রেনকোর সঙ্গে দুর্গের ছাদেই থেকে গেলাম, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে।
এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল।
জঙ্গল থেকে কিছুই বের হয়ে এলো না।
আরো এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কিছুই এলো না।
একটা সময় রেনকো আমাকে বলল দুর্গের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়তে। আমি খুশি মনে তার আদেশ মেনে নিলাম, আমাদের লম্বা জার্নির ফলে প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলাম।
আমি দুর্গের ভেতর ঢুকে শুয়ে পড়লাম এক জায়গায় স্তূপ করা খড়ের ওপর। ঘরের এক কোনে দুটো আগুন জ্বলছিল।
খড়ের ওপর মাথা রাখলাম আমি, কিন্তু চোখ দুটো লেগে আসার পরই আমি আমার কাঁধে টোকা অনুভব করলাম। চোখ খুলে দেখলাম, এমন কুৎসিত চেহারা দেখিনি আমার সারাটা জীবনে।
একজন বুড়ো মতো লোক আমার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁতহীন মাড়ি বের করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ছাই রঙা চুল বেরিয়ে আসছে ভুরু, নাক এবং কান থেকে।
শুভেচ্ছা সোনা-খেকো, বলল বুড়ো। প্রিন্স রেনকোর জন্য তুমি কি করেছ আমি সব শুনেছি, খাঁচা থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেছ, আর আমি আমার, কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি।
দুর্গের চারদিকে একবার তাকালাম। আগুনগুলো এখন আর নেই; যে সব মানুষ ঘরটার জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল তারা তখন নীরব, ঘুমচ্ছে। আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিছু সময়ের জন্য।
ওহ, বললাম আমি। ওয়েল, তোমাকে…তোমাকে স্বাগতম।
আমার বুকে বুড়ো তার হাড্ডিসার আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিল। সোনা-খেকো, সতর্ক হও। শুধু যে রেনকোর ভাগ্য আইডেলটার সাথে নির্ধারণ করা আছে তা ঠিক নয়।
বুঝলাম না।
আমি যা বলতে চাইছি তা হল গার্ডিয়ান অব দ্য স্পিরিট অব দ্য পিপল এই ভূমিকাটা রেনকোর কাছে এসেছে পাচাকামাকের দৈববাণী হিসেবে। দাঁতহীন মাড়ি বের করে বুড়ো হাসল। এবং তোমারও তাই।
আমি পাচাকামাকের দৈববাণীর কথা শুনেছি। সে একজন বৃদ্ধ মহিলা যে টেম্পলের ওপর নজর রাখে। সে একজন স্পিরিট অব পিপল-এর ঐতিহ্যবাহী রক্ষক।
কেন? বললাম আমি। দৈববাণীতে আমাকে নিয়ে কি বলা হয়েছে?
সোনা-খেকো আমাদের নদীর তীরে এসে পৌঁছানোর সাথে সাথে দৈববাণীতে বলা হয়েছে আমাদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপরেও সে বলেছে স্পিরিট অব পিপল দখলকারীর কাছ থেকে দূরে থাকবে, আমাদের আত্মা বেঁচে থাকবে। তবে সে বলেছে শুধুমাত্র একজন মানুষ, একজন মানুষ আইডলটাকে নিরাপদে রাখতে পারবে।
রেনকো।
ঠিক বলেছ। তবে সে কি বলেছে তা হল :
সময় আসবে যখন সে আসবে, একজন মানুষ, একজন বীর, সূর্যের চিহ্নওয়ালা। বিশাল সরীসৃপদের সাথে সে লড়াই করবে সাহসের সাথে, তার কাছে থাকবে জিংগা, সাহসী হৃদয়ের মানুষদের সাহায্য করতে সে আনন্দ পাবে, যে তাদের জীবন দিয়েছে, উদার কোনো কারণে, এবং সে আকাশ থেকে অবতরণ করবে আমাদের স্পিরিটকে বাঁচাতে। সেই-ই হল মনোনীত একজন।
মনোনীত একজন? আমি বললাম।
ঠিক তাই।
অবাক হচ্ছি ভেবে যে আমি সাহসী হৃদয়ের মানুষদের দলে পড়ে গেছি যে তার জীবন দিয়ে দিবে রেনকোকে সাহায্য করার জন্য। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি করব না।
তারপর আমি দৈববাণীর জিংগা শব্দটা নিয়ে ভাবতে বসলাম। আমার মনে পড়ল যে এটা হল ইনকা সংস্কৃতির জ্ঞান। এটা হল মিলিত ভারসাম্য, সমতা এবং গতি, একজন মানুষের বিড়ালের মতো চলাফেরার ক্ষমতা।
কুজকো থেকে সেই সাংঘাতিক মুক্তির কথা মনে পড়ল এবং রেনকো এক ছাদ থেকে আরেক ছাদ হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে দড়ি বেয়ে নেমে এলো আমার ঘোড়ার পিঠে, সে কি বিড়ালের মতো দৃঢ়পায়ে ছুটে চলছিল? কোনো সন্দেহ নেই।
বিশাল সরীসৃপের সাথে সে লড়াই করবে সাহসের সাথে, এর মানে কি? আমি জানতে চাইলাম।
বুড়ো মানুষটা বলল, রেনকোর বয়স যখন তেরো, স্থানীয় এক নদীতে কুমির তার মাকে টেনে নিয়ে যায়। তরুণ রেনকো সে সময় তার সাথে ছিল, যখন সে দেখল কুমির তার মাকে ধরেছে, সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে, যুদ্ধ করে গেল যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মাকে ওই জঘন্য প্রাণীটার কাছ থেকে রক্ষা করতে পারছে। অনেক মানুষই আছে এই নদীতে লড়াই করতে চায় না ভীতিকর ওই প্রাণীগুলোর সাথে। তেরো বছরের কেউ তো নয়ই।
আমি ঢোক গিলোম।
আমি জানতাম না রেনকো ছেলেবেলায় এমনতর প্রচণ্ড সাহসী কাজ করেছে। আমি জানতাম সে সাহসী পুরুষ, কিন্তু এটা? বেশ। আমি এমন কাজ কখনোই করতাম না।
বুড়ো নিশ্চয়ই আমার চিন্তাটা পড়তে পেরেছিল। তার হাড্ডিসাড় আঙুল দিয়ে আমার বুকে টোকা দিল।
তোমার সাহসী হৃদয়কে বাদ দিয়ে দিও না, তরুণ সোনা-খেকো, বলল সে। তুমি তোমার তরুণ প্রিন্সকে যখন স্পেনিশ খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলে তখনই তুমি তোমার বীরত্ব দেখিয়েছ।
আমি মাথা নুয়ালাম।
বুড়ো আমার দিকে আরেকটু ঝুঁকে এলো। আমি বীরত্বপূর্ণ কাজে পুরস্কারহীনভাবে যেতে দিতে বিশ্বাসী নই। না, তোমার সাহসের পুরস্কার হল, আমি তোমাকে এটা দিতে চাই।
সে একটা ব্লাডার ধরল যা নেওয়া হয়েছে ছোট কোনো প্রাণীর শরীর থেকে। ব্লাডারটা পূর্ণ করা আছে তরল কিছু দিয়ে।
আমি ব্লাডারটা নিলাম। ওটার একটা মুখ আছে যে মুখ থেকে তরল পদার্থ বের করে নিয়ে আসা যায়।
কি এটা? আমি জানতে চাইলাম।
বানরের প্রস্রাব, বুড়ো মানুষটা বলল।
বানরের প্রস্রাব, আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম।
রাপার হাত থেকে তোমাকে বাঁচাবে, বুড়ো মানুষটা বলল। মনে রাখবে রাপা হল বিড়াল জাতীয়, এবং অন্যান্য বিড়ালের মতো রাপা হল দাম্ভিক প্রাণী। এই এলাকার আদিবাসীদের মতানুযায়ী, কিছু কিছু তরল পদার্থ আছে যা রাপা ঘৃণা করে। তুমি যদি এই তরল সারা শরীরে মেখে এগিয়ে যাও, রাপা এতে ভয় পাবে।
আমি দুর্বল চিত্তে বুড়োর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। প্রথমবারে আমাকে দেওয়া হল জঙ্গলের প্রাণীর বিষ্ঠা উপলব্ধি নিদর্শনস্বরূপ।
ধন্যবাদ, বললাম আমি। এ ধরনের…চমৎকার একটা…উপহারের জন্যে।
আমাকে খুশি হতে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠল বুড়ো, বলল, তা হলে তোমাকে আরো একটা জিনিস দেব আমি।
ভাবলাম এটাও নিশ্চয়ই অন্য কোনো প্রাণীর বর্জ্য হবে। তবে না, বুডোর দ্বিতীয় উপহার কোনো বস্তু নয়। আমি তোমাকে একটা গোপন তথ্য দেব, বলল সে।
এই শহর থেকে যদি কখনো পালাতে চাও, কোয়াক্কোতে নেমে ডানদিকের তৃতীয় টানেলে ঢুকবে। তারপর থেকে একটা করে বাম টানেল, একটা করে ডান টানেল, এভাবে এগোবে। সবশেষে এই কোয়াঙ্কো তোমাকে একটা জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছে দেবে, যেখান থেকে বিশাল বনভূমি দেখতে পাওয়া যায়। গোলকধাঁধার রহস্যটা সহজই, শুধু যদি জানা থাকে কোত্থেকে শুরু করতে হবে। আমার ওপর আস্থা রেখ, তরুণ সোনা-খেকো, আর উপহারগুলো ব্যবহার করো। ওগুলো হয়তো তোমার প্রাণ বাঁচাবে।
.
একটা ঘুম দিয়ে নতুন করে শরীরে তেজ ফিরে পেয়ে আমি দুর্গের ছাদের দিকে তাকালাম।
সেখানে দেখলাম অভিজাত রেনকো জেগে আছে। সে নিশ্চয়ই চরমভাবে ক্লান্ত, কিন্তু সে ক্লান্তির সঙ্গে কোনো ছলনা করছে না। সড়কে প্রহরীর দিকে তাকাল, বৃষ্টি তার মাথার মুকুটের ওপর হালকাভাবে পড়ছে। আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, গ্রামের যে দিকে তাকিয়ে আছে সে দিকে তাকালাম।
বৃষ্টি ছাড়া কিছু নড়ছে না।
না, কোনো শব্দ নেই।
একটা ভীতিকর নিস্তব্ধতা গ্রামটাকে তাড়া করছে।
কথা বলার সময় রেনকো আমার দিকে তাকাল না। ভিলকাফোর বলেছেন যে তিনি দিনের আলোয় টেম্পলের দরজা খুলেন। তারপর তিনি তার শ্রেষ্ঠ পাঁচ বীর সেনাকে সোলোনের গুপ্তধনের খোঁজে পাঠান। ওরা আর ফিরে আসেনি। শুধুমাত্র রাতের বেলাই রাপাগুলো টেম্পলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে।
এখন কি ওগুলো বাইরে আছে? আমি ভীত গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
তারা যদি বাইরেও থাকে, তারপরেও আমি ওদেরকে দেখতে পাব না।
আমি রেনকোর দিকে তাকালাম। তার চোখ দুটো লাল এবং ও দুটো ফুলে আছে।
বন্ধু, আমি শান্ত গলায় বললাম, তুমি ঘুমোতে যাও। তোমার শক্তি ফিরে পেতে হবে, বিশেষ করে যদি আমার দেশিরা এই শহরটা খুঁজে পায়। ঘুমাও এখন, আমি পাহারায় থাকছি, কিছু চোখে পড়লে তোমাকে ডেকে দিব।
রেনকো মাথা দোলাল। তুমি ঠিক বলেছ, আলবার্তো। ধন্যবাদ।
তারপরই ভেতরে চলে গেলে সে, আর আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম দুর্গের ছাদে, একা একাই রাতের বেলা।
নিচে গ্রামে কিছুই নড়াচড়া করছে না।
ব্যাপারটা শুরু হলো আরো এক ঘণ্টা পর।
চাঁদের আলোয় নদীর রূপালি ঢেউ দেখছিলাম, হঠাৎ ছোট ভেলা চোখে পড়ল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ভেলার ওপর তিনটে ছায়া আইডল দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ধকারে ছায়ার মতো।
আমার রক্ত বরফ হয়ে গেল।
হার্নান্দোর লোক ওরা…
রেনকোকে বলতে হবে যখন কাঠের জেটিতে ভেলাটা ভিড়ল, দেখলাম প্যাসেঞ্জার ভেলা থেকে নেমে পড়ল আর আমি ভালো করে ওদের দিকে তাকালাম।
প্রশান্তি ফিরে এলো শরীরে।
ওরা দখলদার কেউ নয়।
ওরা আসলে ইনকান।
পুরুষটা ঐতিহ্যবাহী যোদ্ধার পোশাক পরে আছে এবং তরুণীর সঙ্গে ছোট একটা বাচ্চা রয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে সবাই মাথায় পরে আছে হুড এবং আলখাল্লা।
শহরের কাদায় মাখা মূল সড়ক ধরে হেঁটে আসছে তিনজন।
আমি তখনই দেখতে পেলাম ওটাকে।
প্রথমে আমি ভেবেছিলাম রাস্তার পাশে কুঁড়েঘরগুলোর একটিতে গাছের ডালের ছায়া নড়ছে। কিন্তু তারপর ডালের ছায়া কুঁড়ের দেয়াল থেকে সরে গেল, সেই জায়গায় আরেকটি ছায়া এসে উপস্থিত হল।
গাঢ় আউটলাইনে বিশাল একটা বিড়াল কুচকুচে কালো, চারপায়ে দাঁড়ান অবস্থায় অন্তত পাঁচ ফুট উঁচু, ওপর দিকে তোলা নাক, কানগুলোর শেষমাথা সরু। খোরাক দেখতে পেয়ে চোয়াল খুলে হাঁ করে আছে।
প্রথমে আমি ওটার আকারে বিশ্বাসী ছিলাম না। যে প্রাণীই হোক না কেন, ওটা প্রকাণ্ড।
হঠাৎ করেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল জন্তুটা।
তিন ইনকান দলটা তখন দুর্গ থেকে মাত্র বিশ কদম দূরে।
চাপা গলায় ওদেরকে আমি কুইচিয়ান ভাষায় বললাম, এদিকে! তাড়াতড়ি এসো! জলদি!
প্রথমে ওরা বুঝতে পারল না আমি কী বলছি।
আর তারপরই লাফ দিয়ে ওদের পেছনের রাস্তায় পড়ল প্রথম জন্তুটা।
দৌড়াও! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। তোমাদের পেছনে ওগুলো!
পুরুষটা ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল এবং দানবটাকে কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে।
জন্তুটা ধীর অথচ দৃঢ় ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো। দেখতে ঠিক যেন একটা প্যান্থার।
একটি বিশাল কালো প্যান্থার। ঠাণ্ডা হলুদ চোখের দৃষ্টি নিচের দিকে, পিটপিট করছে না। এক সেকেন্ড পর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ওটার পাশে চলে এলো আরেকটা এবং দুই রাপা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দলটার দিকে তাকিয়ে আছে।
দুটোই একযোগে নিচু করল মাথা, আঁটো করে জড়ান প্রিয়ের মতো শরীর টান টান করল, অ্যাকশন শুরু করার জন্যে তৈরি।
দৌড়াও! চেঁচাচ্ছি আমি। দৌড়াও!
পুরুষ এবং মহিলা এতক্ষণে দুর্গের দিকে ছুট দিল।
ওদেরকে ধাওয়া করল বিড়াল দুটো।
এক ছুটে খোলা দরজা দিয়ে সিঁড়ির মাথায় চলে এলাম আমি, চিৎকার করে বলছি, রেনকো! কেউঁকি আছে! যে কেউ! মূল গেট খুলে দাও! দরজায় লোকজন এসেছে, খুলে দাও!
আবার ছুটে ছাদের কিনারায় ফিরে এলাম, দেখলাম বাচ্চাটার হাত ধরে দুর্গের গোড়ায় পৌঁছে গেছে মেয়েটি, পুরুষটিও ছুটে আসছে তার পেছনে।
বিড়াল দুটো ঠিক তার পেছনে চলে এসেছে।
কেউ নিচে ছিল না যে, দুর্গের দরজা খুলে দিবে।
চোখে আতঙ্ক নিয়ে আমার দিকে মুখ তুলল মেয়েটা এবং তার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি।
এমন দুর্দান্ত চেহারার মেয়ে খুব কমই দেখেছি আমি–তাড়াতাড়ি গায়ের আলখাল্লা খুলে ফালি ফালি করে ছিঁড়ে গিঁট বাঁধলাম, তারপর ঝুলিয়ে দিলাম নিচে। আমার আলখাল্লাটা ধরো! চিৎকার করে বললাম তাকে। আমি তোমাকে টেনে তুলে নেব।
আলখাল্লার অপর অংশটা ছো দিয়ে ধরল লোকটা, তারপর গুঁজে দিল মেয়েটার হাতে।
যাও! চেঁচিয়ে বলল সে। যাও!
মেয়েটি আমার আলখাল্লার একটা প্রান্ত ধরার পর শরীরের সবটুকু শক্তিতে টানতে শুরু করি। উঠে আসছে মেয়েটি এবং তার বাচ্চাটি দুর্গের ছাদের দিকে। এই সময় মেয়েটার পায়ের নিচে দেখলাম বীরযোদ্ধাটাকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলছে রাপা দুটো। পুরুষটার শরীর দুর্গের দেয়ালে আছড়ে ফেলছে এবং ভৌতিক একটা শব্দের সৃষ্টি করছে। লোকটার চিৎকারের মাঝে রাপা তার খাদ্য খেতে শুরু করল।
আমার সব শক্তি দিয়ে আমি তুলে ধরলাম আলখাল্লাটা, মহিলা এবং বাচ্চাটা তুলে ধরলাম নিরাপদে।
ওরা ছাদের কিনারায় চলে এলো, এবং হালকা বৃষ্টির মধ্যে মহিলা শক্ত করে চেপে ধরল প্রাকার, মাঝেমধ্যে সে তার সন্তানকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ছোট বাচ্চা, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আছে ভয়ে।
আমি একসাথে তিনটি জিনিস নিয়ে লড়ে যাচ্ছি, মহিলা, ছেলেটি, আমার আলখাল্লা, আর আমি আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আরো কয়েকটি রাপা ভিলকাফোরের মূল সড়কে উঠে এসেছে উত্তেজনাকর ঘটনা দেখার জন্য।
ঠিক তারপরই, একটা বিড়ালের নিচের দিকটা কাদা থেকে ওপরের দিকে উঠে গেল এবং মহিলার ঝুলন্ত পা কামড়ে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু মহিলা আরো বেশি সতর্ক। বিড়ালটা বাতাসে কামড় বসাল কারণ শেষ মুহূর্তে মহিলা তার পা-টা তুলে ফেলেছিল।
সাহায্য করুন, মহিলা অনুনয় করে বলল, দৃষ্টিতে উদ্বেগ
করছি, বললাম আমি, বৃষ্টি মুখের ওপর এসে পড়ছে।
মহিলার পায়ের নিচের বিড়ালটা আবার কাদা থেকে লাফ দিল ওপরের দিকে, এবার বিড়ালটা তার বিশাল কাস্তের মতো ধারাল থাবা বাড়িয়ে লাফিয়ে উঠল এবং মহিলার আলখাল্লার প্রান্তটা ধরে ফেলল আর আমি আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম আলখাল্লাটা চেপে বসছে ওটার নিচের সংযোজিত ওজনের জন্য।
না! মহিলা চেঁচিয়ে উঠল, অনুভব করল ওজনটা তাকে নিচের দিকে টানছে।
ওহ, লর্ড, আমি দম নিয়ে বললাম।
যে সময় বিড়ালটা মহিলার আলখাল্লা ধরে নিচের দিকে টানছে ঠিক সেই সময় মহিলা আমার ভেজা হাত চেপে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না, বিশাল বিড়ালটা বেশ ভারী শক্তিশালীও।
শেষ চিৎকারটা দিয়ে মহিলা আমাকে আঁকড়ে ধরা থেকে পিছলে গেল, সাথে তার বাচ্চা, গিয়ে পড়ল ছাদের কিনারে, তারপর দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
আর তারপরেরটা ভাবা আমার পক্ষে অচিন্তনীয়।
আমি ছাদের কিনারে ঝাঁপ দিলাম।
এই সময়, আমি কেন এই কাজ করলাম আমি জানি না।
হয়তো মহিলা তার বাচ্চাটাসহ ছিল বলেই করেছি। কিংবা হয়তো মহিলার সুন্দর চেহারায় ভয়ের স্পষ্ট ছাপ দেখেছি।
অথবা হয়তো তার সুন্দর চেহারার জন্য।
আমি জানি না।
আমি বীরত্বহীনতার মতো দুর্গের সামনে কাদার পুকুরে গিয়ে পড়লাম। আছড়ে পড়ার সাথে সাথে ভেজা বাদামী ছিটে আমার মুখের ওপর এসে পড়ল এবং অন্ধ করে দিল।
চোখের ওপর থেকে কাদা মুছলাম।
এবং সাথে সাথে দৃষ্টিগোচর হল বেশ কিছু নয় মোট সাতটা রাপা অর্ধবৃত্তাকারে আমাকে ঘিরে রেখেছে, তাকিয়ে আছে আমার দিকে ওদের ঠাণ্ডা হলুদ চোখে।
আমার মাথার ভেতর হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে যেন। এখন আমি কি করব, নিশ্চিত আমি কিছুই জানি না।
মহিলা এবং ছেলেটা ঠিক আমার পাশে। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের আড়াল করে আর তীব্রভাবে চিৎকার করে উঠলাম আমাদের সামনে দাঁড়ান সংঘবদ্ধ পিশাচগুলোর দিকে।
চলে যাও, আমি বলছি! চলে যাও!
পিঠে বাধা থেকে আমি টেনে বের করে আনলাম একটা তীর এবং সামনের বিশালাকৃতির বিড়ালের চেহারায় আঘাত করলাম।
রাপাগুলো আমার দুঃখজনক দুঃসাহসিকতার কোনো পাত্তা দিল না।
ওরা আমাদের চারপাশ থেকে কাছে এগিয়ে আসছে।
এখন সত্যি সত্যি এটা বলা যায় যে যদি এই নিষ্ঠুর প্রাণীগুলোকে দুর্গের ছাদ থেকে বড় দেখা যেয়ে থাকে, সামনাসামনি এগুলো আসলেই বিশালাকৃতির। গাঢ়, কালো এবং শক্তিশালী।
তারপর আমার কাছাকাছি দাঁড়ান রাপাটি তার সামনে থাবাটি আমার দিকে আঘাত হানল এবং কামড়ে আমার হাতের তীরের তীক্ষ্ণ অংশটি ভেঙ্গে ফেলল। বিশাল জন্তুটা তার মাথা নোয়াল এবং ঘোঁত ঘোত করল আমার দিকে তাকিয়ে, টানটান হল উড়াল দেওয়ার জন্য এবং তারপর—
কিছু একটা প্রচণ্ড শব্দ করে ঠিক আমার সামনের কাদা পানিতে ঝপাত করে পড়ল।
কি পড়ল সেটা দেখার জন্য তাকালাম। দেখেই আমার ভুরু কুঁচকে গেল।
ওটা আইডল।
রেনকোর আইডল।
উইন্ডমিলের মতো আমার মন ঘুরপাক খেতে লাগল। রেনকোর আইডল এখানে কেন? কেন কেউ এই সময় এই কাদায় ওটাকে ছুঁড়ে ফেলল!
ওপরে তাকাতেই দেখলাম দুর্গের ছাদ থেকে রেনকো ঝুঁকে নিচে তাকিয়ে আছে। ওই-ই আইডলটা আমার কাছে নিচে ফেলেছে।
এবং তারপর ঘটনাটা ঘটল।
আমি জমে গেলাম।
আমি আমার জীবনে এমন শব্দ শুনি নি।
শব্দটা হালকা, কিন্তু শব্দটা ছিল চরম। ছুড়ি দিয়ে বাতাস কাটার মতো, এমনকি বৃষ্টির মধ্যেও শব্দটা তীক্ষ্ণভাবে শোনা যাচ্ছে।
চাইমে আঘাত করলে যেমন শব্দ শোনা যায় ঠিক তেমন। এক ধরনের উচ্চগ্রামে গুন গুন শব্দ।
মমমমমমমম।
রাপাগুলোও শব্দটা শুনেছে। একটু আগে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল সেই জন্তুটা আমাদের সামনে আইডলের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে আমাদের সামনে কাদার মধ্যে অর্ধেকটা ডুবে যাওয়া আইডলটার দিকে।
এরপরেই সবচাইতে অদ্ভুত জিনিসটা ঘটল।
রাপার দল ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগল। আইডলের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল রাপাগুলো।
আলবার্তো, রেনকো ফিসফিস করে বলল, ধীরে ধীরে নড়াচড়া করো, শুনতে পাচ্ছ? খুব ধীরে ধীরে আইডলটা তুলে নাও আর দরজার দিকে এগিয়ে যাও। তোমাদের ভেতরে ঢোকানোর জন্য কাউকে পাঠাচ্ছি।
আমি তার কমান্ড মেনে চলি।
মহিলা এবং বাচ্চাসহ আমি এগিয়ে গিয়ে আইডলটা তুলে নিলাম আর দুর্গের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না দরজাটার কাছে আসে।
রাপাগুলো একটা দূরত্ব রেখে আমাদের অনুসরণ করতে লাগল, ভেজা আইডল থেকে শ্রুতিমধুর শব্দে অভিভূত হয়ে গেল।
তবে কোনো ভাবেই ওরা আক্রমণ করছে না।
তারপরই বিশাল বড় একটা পাথরের স্ল্যাব, যা দুর্গের দরজা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, একপাশে সরে গেল আর আমরা ভেতরে ঢুকে পড়লাম ফুড়ুৎ করে, আমি সবার শেষে ভেতরে ঢোকার পর স্ল্যাবটা আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে এনে দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হল, আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম, দম আটকান, সিক্ত এবং কাঁপুনি সব মিলিয়ে আমি আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে আছি।
.
আমাদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য রেনকো দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলো।
লিনা! মহিলাকে চিনতে পেরে বলল সে। আর মানি! চেঁচিয়ে বলে, কোলে তুলে নিল ছেলেটাকে।
পরিশ্রান্ত হয়ে আমি মেঝেতে প্রায় শুয়ে পড়লাম আর এদিকে সব কিছু ঘটে চলেছে।
লজ্জিত হয়ে আমি বলছি যে আমার বন্ধু রেনকোর প্রতি আমার হিংসে হতে লাগল। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে অসম্ভব সুন্দরী এই মহিলা তার স্ত্রী, আর রেনকোর মতো অকুতোভয় চরিত্রের মানুষ সকলেই প্রত্যাশা করে।
আঙ্কেল রেনকো। রেনকো উঁচু করে ধরতেই বলে উঠল ছেলেটা।
আঙ্কেল?
আমার চোখ ঝট করে খুলে গেল।
ব্রাদার আলবার্তো, এগিয়ে এসে রেনকো বলল। আমি জানি না তুমি বাইরে কি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছিলে, কিন্তু আমার লোকেরা বলছে একটা কথা। এটা এমন কোনো উপহার নয় যে ওই কাজের পেছনে কোনো উদ্দেশ ছিল। ধন্যবাদ তোমাকে। আমার বোন এবং তার ছেলেকে উদ্ধার করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
তোমার বোন? বললাম আমি, তাকালাম মেয়েটার দিকে যে তার পরনের ভেজা আলখাল্লা খুলছিল আর দেখা যাচ্ছিল টিউনিকের মতো দেখতে ভেতরে পরনের কাপড়, চামড়ার সাথে লেগে আছে।
যাই দেখেছি তাতে আমি ঢোক গিলোম।
আগে যেমনটা দেখেছি তার চেয়ে বেশি সুন রী সে, যদি তা হয়ে থাকে তাহলে। সম্ভবত বিশ বছর বয়সী সে, হালকা বাদামী খ, মসৃণ ত্বক, এবং মাথার চুল গাঢ়। হালকা-পাতলা লম্বা লম্বা দুটো পা আর মসৃণ কাঁধ।
উজ্জ্বল মহিলা সে।
একটা শুকনো কম্বল দিয়ে তাকে জড়িয়ে দিল আর মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, হাঁটুর জোর যেন হারিয়ে ফেললাম আমি।
ব্রাদার আলবার্তো সান্টিয়াগো, আনুষ্ঠানিকভাবে বলল। আমার বোনকে তোমার সামনে উপস্থিত করছি, লিনা, ইনকা সাম্রাজ্যের প্রথম রাজকুমারী।
লিনা এগিয়ে এসে আমার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল। আনন্দিত হচ্ছি তোমার সাহায্য পেয়ে, মুখে হাসি নিয়ে বলল সে। আর তোমার সাহসী পদক্ষেপের জন্য ধন্যবাদ।
ওহ, ওটা ছিল… কিছু না, রক্তিম হয়ে আমি বললাম।
আর আমার ভাইকে কয়েদখানা থেকে উদ্ধার করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, বলল মেয়েটি।
আমার অবাক চেহারা দেখে আরো বলল, ওহ, বাকিটা নিশ্চিত, আমার বীর, তোমার কথা আমাদের সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে যাবে।
আমি বো করলাম সম্মান দেখিয়ে। আমার বীর বলাতে আমি খুশি হয়েছি।
তারপর আমার মনে পড়ল এবং আমি রেনকোর দিকে ঘুরে তাকালাম। বল কিভাবে জানলে আইডলের ওই রকম শব্দ রাপাদের ওপর প্রভাব ফেলবে?
রেনকো আমার দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিল।
আসলে আমি জানতামই না ওটা যে ওই কাজ করে।
কি বললে! আমি চেঁচিয়ে বললাম।
রেনকো হাসছে। আলবার্তো, আমি সেই একজন নই যে সঠিকভাবে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে একজন মহিলা এবং একজন বাচ্চাকে বাঁচাব, আমি সেটাও জানি না।
সে একটা হাত রাখল আমার কাঁধে। এটা বলে থাকে যে স্পিরিট অব দ্য পিপল ভয়ঙ্কর প্রাণীদের শান্ত করে রাখার ক্ষমতা রাখে। আমি আগে দেখিনি, তবে আমি শুনেছি পানির সংস্পর্শে এলে আইডল রাগান্বিত প্রাণীকেও শান্ত করে ফেলে। আমি যখন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম তোমার চিৎকার শুনে, দেখলাম তোমাদের তিনজনকে রাপাগুলো ঘিরে রেখেছে, তখন আমি বুঝতে পারলাম এটাই হল উপযুক্ত সময় এই ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখার।
বিস্মিত হয়ে আমি মাথা ঝাঁকালাম।
রেনকো, বলল লিনা, সামনের দিকে এগিয়ে এলো, আমি তোমার আনন্দ উৎসকে বাধা দিতে চাই না, কিন্তু আমি একটা খবর নিয়ে তোমার কাছে এসেছি।
কি সেটা?
স্প্যানিয়ার্ড রোয়া দখল করে নিয়েছে। কিন্তু তারা টোটেমের সংকেত ভাঙ্গতে পারেনি। তাই ওরা যখন একটার কাছে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে, চানকা ট্রাকরা আশেপাশে এলাকা চষে দেখছে যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার ট্রেইলটা ধরছে। স্বর্ণভুকরা পাক্স এবং টুপরাকে খারিজ করল। আমাকে এখানে পাঠান হয়েছে তোমাকে তাদের অগ্রগতি জানানোর জন্য, আমি হলাম অন্যতম যে টোটেম কোডটা সম্পর্কে জানি। আমি জানতে পেরেছি ওরা রোয়া পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। ওরা তোমার গন্ধ পেয়ে গেছে, রেনকো। আর ওরা এই দিকেই আসছে।
কত দূরে আছে? বলল রেনকো।
লিনার চেহারায় আঁধার নেমে এলো।
ওরা দ্রুত এগিয়ে আসছে, ব্রাদার। খুব দ্রুত।
যে দ্রুততার সাথে ওরা এগিয়ে আসছে আমার মনে হয় দিন হওয়ার সাথে সাথে ওরা এখানে পৌঁছে যাবে।
.
কিছু পেলেন? হঠাৎ রেসের পেছন থেকে জানতে চাইল ফ্রাঙ্ক ন্যাশ।
রেস ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে মুখ তুলে ন্যাশের দিকে তাকাল, লরেন, গ্যাবি এবং ক্রাউশ এটিভি-র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। সময়টা শেষ বিকেল। ঘন মেঘ থাকায় ওদের পেছনে আকাশ এরই মধ্যে কালো হয়ে উঠেছে।
হাতঘড়ি দেখল রেস।
সন্ধ্যা ৪.৫৫।
ড্যাম।
খেয়ালই ছিল না এতক্ষণ ধরে পড়ছে সে।
একটু পরেই রাত নামবে। আর রাত হলেই বেরিয়ে আসবে রাপাগুলো।
তো? কোনো উপায় খুঁজে পেলেন? জিজ্ঞেস করল ন্যাশ।
ইই… রেস বলতে শুরু করল। ম্যানুস্ক্রিপ্টটার প্রতি এতটাই আচ্ছন্ন ছিল যে সে প্রায়ই ভুলে গেছে কেন সে এটা পড়েছিল—খুঁজে বের করা রাপাদের কিভাবে পরাজিত করা যায় আর তাদেরকে টেম্পলের ভেতরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এই ছিল তার কাজ।
ওয়েল…? ন্যাশ বলল।
এখানে বলা আছে যে ওগুলো শুধুমাত্র রাতের বেলা বের হয়, কিংবা যখন অস্বাভাবিক অন্ধকার নামে।
ক্রাউশ বলল, পরিষ্কারভাবে বলা আছে ওগুলো কেন গর্তের মুখে তৎপর ছিল। ওখানটায় অসম্ভব অন্ধকার, এমনকি দিনের বেলা, ওগুলো
এমনও দেখা গেছে যে রাপাগুলো বুঝতে পেরেছে এই শহরে তাদের খাবারের ভালো সরবরাহ আছে, রেস বলল, ক্রাউশকে থামিয়ে দিল তার আগের ভুল বিচার করার আগে, যে ভুলের কারণে আগেই তিন সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। ওরা দুবার ম্যানুস্ক্রিপ্টের ওপর আক্রমণ করেছে।
টেম্পলের ভেতরে ওগুলো এলো কি করে তা কি বলা আছে ওটাতে?
হ্যাঁ। একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদের চিন্তার ফসল হিসেবে ওদেরকে টেম্পলের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষের লোভের পরীক্ষা নেওয়া যায় এই টেম্পলের মাধ্যমে। রেস অস্পষ্ট দৃষ্টিও ন্যাশের দিকে তাকাল। মনে হয় আমরা সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারিনি।
সোলোনের টেম্পল… গ্যাবি লোপেজ দম ফেলতে ফেলতে বলল।
ওদের সাথে কি করে যুদ্ধ করব তা কি বলা আছে? ন্যাশ জিজ্ঞেস করল।
কিছুটা বলেছে, দুটো জিনিস আসলে। এক বানরের প্রস্রাব। স্বাভাবিকভাবে সব বিড়াল জাতীয় প্রাণী ওই গন্ধ ঘৃণা করে থাকে। আপনি কি যাবেন ওখানে আর রাপারা আপনাকে ভালো করে দেখতে পাবে।
আর দ্বিতীয় উপায়টা? জানতে চাইল লরেন।
সেটা বেশ অদ্ভুতই বলতে হবে, বলল রেস। কাহিনিটার এক পর্যায়ে, বিড়ালগুলো যখন সান্টিয়াগোকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে, ইনকান প্রিন্স কাদাপানির মধ্যে ছুঁড়ে দেয় আইডলটা। পানির সংস্পর্শে আসামাত্র ওটা থেকে অদ্ভুত গুঞ্জন বেরুতে শুরু করে, আর সেই গুঞ্জন শুনে হিংস্র জানোয়ারগুলো একদম শান্ত হয়ে যায়।
ভুরু কোচকালেন ন্যাশ।
ইনকারা ব্যাপারটা জানত বলে মনে হয়েছে। ম্যানুস্ক্রিপ্টের দুজায়গায় বলা হয়েছে ইনকানরা বিশ্বাস করে তাদের আইডলকে পানিতে ভেজান হলে যে-কোনো বিপজ্জনক হিংস্র জন্তুকেও শান্ত করা যাবে।
লরেনের দিকে তাকাল ন্যাশ।
রেজোন্যান্স হতে পারে, বলল লরেন। পানিতে থাকা কনসেনট্রেটেড অক্সিজেন মলিকিউল-এর সংস্পর্শে এসে থাইরিয়াম রেজোনেট-এর কারণ সৃষ্টি করতে পারে, ঠিক ভাবে অন্যান্য নিউক্লিয়ার পদার্থ বাতাসে থাকা অক্সিজেনের সংস্পর্শে রিয়্যাক্ট করে।
তবে এটা তো মনে হচ্ছে আরো বড় স্কেলে–, বলল ন্যাশ।
সেজন্যেই বোধ হয় মঙ্ক গুঞ্জনটা শুনতে পেয়েছে, বলল লরেন। মানুষের কান কিন্তু রেজোনেট গুঞ্জন ধরতে পারবে না, পুটোনিয়ামের সঙ্গে অক্সিজেনের সংস্পর্শে যে শব্দ হয়, শুনতে পায় না। ফ্রিকোয়েন্সি খুব নিচু। কিন্তু থাইরিয়াম যেহেতু পুটোনিয়ামের চেয়ে অনেক বেশি ঘন, এটা খুবই সম্ভব যে পানির সংস্পর্শে এলে রেজোন্যান্স এত বেশি হয়ে ওঠে যে মানুষও তা শুনতে পায়।
আর সন্ত্রাসী যদি শুনে থাকে, বিড়াল তো আরো অনেক জোরে শুনতে পাবে। সবাই ক্রাউশের দিকে ঘুরে গেল।
ভুলে গেলে চলবে না মানুষের চেয়ে বিড়ালের শ্রবণশক্তি প্রায় দশগুণ বেশি। আমরা শুনতেই পাই না, এমন অনেক শব্দ শোনে ওরা। আর, তা ছাড়া, নিজেদের মধ্যে এমন একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ রক্ষা করে ওরা, আমাদের শ্রবণযন্ত্রের সাধ্য নেই সেটা ধরতে পারে।
ওরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে? আবেগহীনভাবে বললেন ক্রাউশ।
হ্যাঁ, বললেন ক্রাউশ। অনেক বছর আগেই এটা মেনে নেয়া হয়েছে যে অনুমানিক শব্দ আর গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ভাইব্রেশান-এর মাধ্যমে গ্রেট ক্যাটরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মূল পয়েন্ট হল: মঙ্ক যা-ই শুনে থাকুক, বিড়াল যা শুনতে পায় তার দশ ভাগের মাত্র এক ভাগ শুনেছে সে। গুঞ্জনটা নির্ঘাত উদভ্রান্ত করে দেয় ওগুলোকে, তাই তারা পালিয়ে আসার সুযোগ পায়।
ম্যানুস্ক্রিপ্টে আরেকটু বেশি বলা হয়েছে, জানাল রেস। ওটা সবকিছু থামিয়ে দেয় নি। গুঞ্জন শুনে রাপাগুলো শুধু থামেনি, বরং আইডলটাকে অনুসরণ করছিল, যেন ওটা ওগুলোকে সম্মোহিত করেছে।
টেম্পলের ভেতরে আইডলটা এলো কীভাবে, এ-ব্যাপারে ম্যানুস্ক্রিপ্টে কিছু বলা হয়েছে?
না, জানাল রেস। অন্তত এখনো কিছু বলা হয়নি। কে জানে, এমন হতে পারে যে আইডলটাকে ভিজিয়ে রাপাগুলোকে টেম্পলের ঢোকায় রেনকো আর সান্টিয়াগো। তারা যাই করুক, যেভাবেই হোক বিড়ালগুলোকে টেম্পলের ভেতর রেখে আসে এবং আইডলটাও ভেতরে রেখে আসে। রেস থামল। সঠিকভাবে হয়নি কাজটা আসলে। আইডলটাকে টেম্পলের ভেতর রেখে এসে ওরা মানুষের লোভের সোলোন টেস্টের অন্য একটা অংশ শুরু করে।
ওই বিড়ালগুলো, ন্যাশ বলল।
ম্যানুস্ক্রিপ্টে বলা হয়েছে ওগুলো নিশাচর?
বলা হয়েছে ওগুলো যে-কোনো ধরনের অন্ধকার পছন্দ করে, রাত থোক বা অন্য কোনো সময়।
কিন্তু বলা হয়েছে ওগুলো রোজ রাতে খাবারের খোঁজে গ্রামে আসে?
হ্যাঁ।
চোখ সরু করল ন্যাশ, আমরা তাহলে ধরে নিতে পারি প্রতি রাতে খাবারের খোঁজে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে।
ম্যানুস্ক্রিপ্টের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে সেটাই ধরে নিতে হবে।
গুড, বলল ন্যাশ, পেছন ফিরল।
কেন?
কারণ, বলল সে, আজ রাতে বিড়ালগুলো বেরিয়ে এলে টেম্পলের ভেতরে ঢুকে আইডলটা বের করে আনব আমরা।
.
প্রতি মিনিটে দিনের আলো কমে আসছে।
মাথার উপর কালো মেঘের তুমুল আলোড়ন চলছে, সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসের সঙ্গে নেমে এলো ধূসর কুয়াশী। থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি চলছেই।
পাশে বসে লরেনের কাজ দেখছে রেস। রাতে অ্যাকশন শুরু হতে যাচ্ছে, সেটা মাথায় রেখে দুর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু ইকুইপমেন্ট প্যাক করছে সে।
বিয়ে করার পর কেমন কাটছে জীবনটা? স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল রেস।
তার দিকে তাকিয় লরেন হাসল। নির্ভর করছে কোনটার কথা তুমি বলছ।
তাহলে কি একটার বেশি হয়েছে?
আমার প্রথম বিয়েটা টেকেনি। ও আমার ক্যারিয়ারটা পছন্দ করত না। পাঁচ বছরের মাথায় ডিভোর্স নিলাম।
ওহ।
কিন্তু আমি রিসেন্টলি আবার বিয়ে করেছি, লরেন বললেন। এবং এবার ভালো মানুষ পেয়েছি। আসলেই সে ভালো মানুষ। তোমার মতো। যথেষ্ট ক্ষমতাবান।
কত দিন হল?
আঠারো মাস।
খুশি হলাম, শান্ত গলায় বলল রেস। তবে, আসলে আগে দেখা দৃশ্যটার কথা ভাবছে ও। লরেন আর ট্রয় কোপল্যান্ড পরস্পরকে চুমো খাচ্ছিল হিউ হেলিকপ্টারের পেছনে বসে। খেয়াল করেছে কোপল্যান্ডের আঙুলে বিয়ের কোনো আংটি নেই। তা হলে কি তার সঙ্গে লরেনের প্রেম আছে? নাকি কোপল্যান্ড আংটি পরেনি…
তুমি কি বিয়ে করেছ? লরেন জিজ্ঞেস করলেন, চিন্তা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন।
না, রেস বলল ঠাণ্ডা গলায়। না, করিনি।
এস এটি-এসএন রিপোর্ট আসছে, এটিভির দেয়ালে একটা কম্পিউটার টার্মিনাল ফিট করা আছে, সেখান থেকে বলল ভ্যান লিওয়েন।
সে, কোচরেন, রাইকার্ট, ন্যাশ এবং রেস এখন দাঁড়িয়ে আছে দুই জার্মান বিকেএ এজেন্টের সাথে, শ্রোয়েডার এবং সোনালি চুলের মেয়ে রেনে বেকার চার চাকার অল-টেরিয়ান ভেহিকলের ভেতরে।
গাড়িটা নদীর কাছাকাছি পার্ক করা, পশ্চিম লগব্রিজ থেকে বেশি দূরে নয়। ওদের রাতের বেলার টেম্পলের ওপর আক্রমণ থেকে বাধা সৃষ্টি করে রেখেছে।
লরেন ইতোমধ্যে এটিভি ছেড়ে দুর্গের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে, তার পিছু নিয়েছে জোহান ক্রাউশ।
এই সময় এটিভি-তে ফিরে এলো বাজ কোচরেন, তার হাতে খয়েরি রঙের কী একতাল কাদার মতো নরম জিনিস, ভেহিকেলের বদ্ধ জায়গাটা উৎকট দুর্গন্ধে ভরে উঠল।
ওখানে বাঁদর নেই ঠিকই ধরতে পারলে পেশাব করাতে পারতাম, কোচরেন বলল। অন্ধকার নামার আগেই চলে গেছে মনে হয়। হাতের খয়েরি জিনিসটা উঁচু করে দেখাল সে। তবে এটা আনতে পেরেছি, বাদরের মল। আমার মনে হয় এতেও কাজ হবে।
রেসের নাক কুঁচকে গেল দুর্গন্ধে।
ব্যাপারটা খেয়াল করল কোচরেন। কী? গায়ে মাখতে রাজি নন, প্রফেসর? রেনের দিকে তাকিয়ে হাসল। ভাগ্যিস প্রফেসরকে টেম্পলে ঢুকতে হচ্ছে না!
হাতের বিষ্ঠা নিজের ফেটিগের বাইরে মাখতে শুরু করল কোচরেন। রাইকার্ট আর ভ্যান লিওয়েন তাই করছে। সরু ফাটলের মতো দেখতে এটিভি-র জানালার কিনারাতেও লাগান হল জিনিসটা।
রেস যখন ম্যানুস্ক্রিপ্টটা অনুবাদ করছিল, সেই ফাঁকে বাকি সিভিলিয়ানদেরকে নিয়ে দুর্গের ভেতর একটা ছোট ঘটি বানিয়ে নিয়েছেন ন্যাশ। অবশিষ্ট গ্রিন বেরেটরাও বসে ছিল, অচল হয়ে পড়া হিউ হেলিকপ্টারকে মেরামত করার চেষ্টা করছে। তবে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে তারা শুধু কপ্টারের ইগনিশন পোর্ট মেরামত করতে পেরেছে। কোচরেন প্রথমে যেমন ভেবেছিল, ক্ষতিগ্রস্ত টেইল রোটরটা মেরামত করা তারচেয়ে অনেক বেশি কঠিন। নানা রকম জটিলতা দেখা দিয়েছে, ফলে অনেক চেষ্টা করেও সেটাকে ঘোরান সম্ভব হয়নি। টেইল রোটর ছাড়া হিউ উড়বেও না।
তারপর, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে, লয়েড সিদ্ধান্ত নিল সবচেয়ে জরুরি কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইডলটা সংগ্রহ করা। চপার থেকে সরিয়ে গ্রিন বেরেটদের এটিভিতে নিয়ে আসা হল। এখানে তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হল আইডলটা পানি দিয়ে ভেজালে কী ঘটে।
রেস যখন এই কাজে ব্যস্ত, ন্যাশ তখন গ্যাবি, কোপল্যান্ড, ডুগী আর তরুণ জার্মান প্রাইভেট মলকোকে দুর্গের ভেতরে থাকার নির্দেশ দিল।
তার প্ল্যানের প্রয়োজনীয় দিকগুলো হল, বিড়ালগুলো গ্রামে বেরিয়ে আসার সময় টিমের বেশিরভাগ সদস্য দুর্গের ভেতর থাকবে, আর গ্রিন বেরেটদের নিয়ে সে নিজে থাকবেন এটিভি-র ভেতরে, টেম্পলের দিকে চলে যাওয়া নদীর কিনারা ঘেঁষা পথটার কাছাকাছি।
রেস সবে মাত্র গ্রিন বেরেটদের ব্রিফিং শেষ করেছে, দুর্গের ভেতর ঢুকতে হবে ওকেও।
এসএটি-এসএন করছে, কম্পিউটার টার্মিনাল থেকে বলল ভ্যান লিওয়েন। স্যাটেলাইট ছবিও যে কোনো মুহূর্তে আসবে।
কী দেখাচ্ছে? জানতে চাইল ন্যাশ।
দেখুন না, সরে দাঁড়িয়ে বলল ভ্যান লিওয়েন।
এগিয়ে এসে স্ক্রিনের দিকে তাকাল ন্যাশ। দক্ষিণ আমেরিকার অর্ধেক, উত্তর দিকটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে:
ন্যাশনাল রিকোনাইসেন্স অফিস ত্বরান্বিত কাজ নং ০৪০১৯৯-৬৭৫৪ এস এ টি-এস এন প্রাথমিক জরিপ প্যারামিটার : ৮২, ০০°w-৩০.০০° w; ১৫.০০° উ-৩৭.০০ দ তারিখ : জানু ৫ ১৯৯৯ ১৬:৫৯:৫৬ পিএম (স্থানীয়-পেরু)
এটা কি–ভ্রু কোঁচকাল ন্যাশ।
অন্তত আমাদের আশপাশের এলাকা পরিষ্কার আছে… বলল ভ্যান লিওয়েন।
সব মিলিয়ে কী বোঝাচ্ছে? রেস জানতে চাইল।
ভ্যান লিওয়েন বলল, সরলরেখাগুলো দক্ষিণ আমেরিকার পাঁচটা প্রধান কমার্শিয়াল এয়ার করিডর। আসলে, পানামা মহাদেশ থেকে বেরিয়ে যাবার পথ, বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলো সরাসরি যায় লিমা এবং রিও ডি জেনেরিও এবং তারপর বুয়নোস আইরেসের দুটো শহর থেকে। আমাদের কাছাকাছি ধূসর রঙের চৌকো ঘরগুলো রেগুলার কমার্শিয়াল এয়ার করিডোর নয়।
রেস স্ক্রিনের দিকে তাকাল, দেখল উত্তর-পশ্চিম দিকে তিনটি ধূসর রঙের চৌকো ঘর।
সংখ্যা আর হরফগুলোর মানে কি?
ভ্যান লিওয়েন বলল, কুজকোর ঠিক ওপরে ধূসর রঙের বৃত্ত, নিচে এন-১ লেখা মাঝে হল আমরা। অর্থাৎ ন্যাশ-১, গ্রামে আমাদের টিম। এন-২, এন-৩ আর এন-৪ হল আমাদের সাপোর্ট টিম, পানামা থেকে ভিলকাফোরে আসছে। তবে দেখা যাচ্ছে এখনো যথেষ্ট দূরে রয়েছে ওরা।
ধূসর আরো কিছু চৌকো ঘর দেখতে পাচ্ছি?
আর-১, আর-২ এবং আর-৩ হল রোমানোর চপার, জানাল ন্যাশ।
কিন্তু অনেক উত্তরে সরে গেছে ওরা, বলল ভ্যান লিওয়েন, ঘাড় ফেরাল ন্যাশের দিকে। এতটা দূরে কী করে যায়?
ওরা পথ হারিয়ে ফেলেছে, বলল ন্যাশ। নিশ্চয়ই টোটেমগুলোর সংকেত ধরতে পারেনি।
আবার রেসের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল, কে এই রোমানো, জানে উত্তর পাবে না, তাই চুপ করে থাকল।
আর এগুলো? জানতে চাইল রেনে, হাত তুলল স্ক্রিনের একেবারে বাম প্রান্তে সমুদ্রের উপর তিনটে চৌকো ঘর দেখা যাচ্ছে।
এন ওয়াই-১, এন ওয়াই-২ আর এন ওয়াই-৩ ইউএস নেভি সিগনেচার, বলল ভ্যান লিওয়েন।
নিশ্চয়ই ওখানে কোথাও নেভির একটা ক্যারিয়ার আছে।
স্টর্মস্ট্রুপারের কোনো চিহ্ন নেই? জানতে চাইল শ্রোয়েডার।
না। গম্ভীর কণ্ঠে বলল ন্যাশ।
.
রেসের হাতঘড়িতে পাঁচটি বাজল। আকাশ জুড়ে ঘন কালো ঝড়ো মেঘের স্তর জমে। থাকায় শেষ বিকেলটা অস্বাভাবিক অন্ধকার হয়ে উঠেছে। যেন এরইমধ্যে রাত হয়ে গেছে।
ভ্যান লিওয়েনের দিক ফিরল ন্যাশ। ভিশন পাব তো?
ষাট সেকেন্ডের মধ্যে স্যাটেলাইট ইমেজ চলে আসবে।
নাকি আসল সময়ে?
রিয়েল-টাইম ইনফ্রা-রেড
গুড। সন্তুষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকাল ন্যাশ। গর্ত থেকে বেরিয়ে এলেই বিড়ালগুলোকে পরিষ্কার দেখতে পাব আমরা। তোমরা সবাই রেডি?
উঠে দাঁড়াল ভ্যান লওয়েন। তার পাশে, বাজ কোচরেন আর টেক্স রাইকার্ট যে-যার এম-১৬ তুলে বুকের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে চেপে ধরল।
ইয়েস, স্যার, বলল কোচরেন, রেনের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল। ককড়, লকড অ্যান্ড রেডি টু রক।
রেস নত হল।
জার্মান সুন্দরীর দিকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বারবার তাকাচ্ছে কোচরেন। যেন লেজার সাইটসহ তার আগ্নেয়াস্ত্র, এম-২০৩ গ্রেনেড/এ্যাপলিং হুক লাঞ্চার, ব্যারেলে ফিট করা শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট আর কমব্যাট ইউনিফর্ম তাকে যে-কোনো তরুণীর চোখে মিস্টার ইরিজিস্টিবল বানিয়ে দিয়েছে।
এর জন্য রেস তাকে পছন্দ করে না।
স্যাটেলাইট ছবি আসছে, বলল ভ্যান লিওয়েন।
এই সময় এটিভি-র দেয়ালে আরেকটা কম্পিউটার স্ক্রিন আলোকিত হয়ে উঠল।
ওটায় সাদা-কালো ছবি আসছে, প্রথমে রেস কিছুই বলতে পারল না ওটা কি।
স্ক্রিনের একদম বাম দিকটা পুরোপুরি কালো। ডানদিকের এক পাশের অংশ ঝাপসা একটা ঝলকের মতো ধূসর দাগ, ওটার পাশে ঘোড়ার খুরাকৃতির কী যেন, ভেতরে খুদে চৌকো ফোঁটা, আর খুরটার ঠিক মাঝখানে বড় একটা ফোঁটা।
স্ক্রিনের মাঝখানে চওড়া আর গাঢ় একটা ভোরা। তার পাশে বাক্স আকৃতির ছোট কী যেন রয়েছে। দুটো খুদে সাদা বিন্দু হোট বাক্সটা থেকে বেরিয়ে খুরের মাঝখানে বসান বড় ফোঁটাটার দিকে এগোল।
এতক্ষণে তাকে ধাক্কা দিল।
তাকাল ভিলকাফোরের গ্রামটার দিকে।
ঘোড়ার খুর আসলে বিরাট পরিখা, শহরটাকে ঘিরে রেখেছে, ওটার ভেতর চৌকো বিন্দুগুলো কুঁড়ে আর দুর্গ। বাঁদিকের অন্ধকার অংশটা পাথুরে মালভূমি, যে মালভূমিতে টেম্পল রয়েছে ঝাপসা ধূসর রঙটা মালভূমি আর শহরের মাঝখানে রেইনফরেস্ট। আর গাঢ় ধূসর রঙের ডোরাটা হলো নদী।
নদীর পাশে ছোট বাক্সটা, রেস বুঝল, এটিভি, যেখানে বসে রয়েছে ওরা, পশ্চিম লগব্রিজের পাশে। স্ক্রিনে দুটো সচল বিন্দু দেখা যাচ্ছে, এটিভি থেকে দুর্গের দিকে এগোচ্ছে। দ্রুত ঘুরে দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল রেস, দেখল লরেন আর ক্রাউশ কুয়াশার ভেতর দিয়ে দুর্গের দিকে হাঁটছেন।
মাই গড, ভাবল সে।
পৃথিবী থেকে শত শত মাইল ওপর থেকে ভিলকাফোরের ছবি নিয়েছে একটা স্যাটেলাইট।
এখন সেটা আসছে।
থ্রোট মাইকে কথা বলছেন ন্যাশ। লরেন, এখানে আমরা সবাই রেডি। ভেতরে ঢুকেছেন?
এক সেকেন্ড, ওদের ইন্টারকমে লরেনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
ভিউ স্ক্রিনে রেস দেখল সাদা রঙের খুদে বিন্দুগুলো যা লরেন এবং ক্রাউশ গোলাকার ফোঁটার ভেতরে, অর্থাৎ দুর্গে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হ্যাঁ, আমরা ঢুকেছি, লরেন বলল। আপনি কি উইলকে পাঠাচ্ছেন?
হ্যাঁ, এখনই, জানাল ন্যাশ। প্রফেসর রেস এখনই রওনা হয়ে যান, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসার আগে দুর্গে ঢুকে পড়ন।
ঠিক আছে, বলে দরজার দিকে এগোল রেস।
এক সেকেন্ড প্লিজ…হঠাৎ বাধা দিল ভ্যান লিওয়েন
স্থির হয়ে গেল সবাই।
কী ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল ন্যাশ।
আমাদের সঙ্গী জুটেছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে স্ক্রিনের দিকটা দেখাল ভ্যান লিওয়েন।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সাদা-কালো কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকাল রেস। মালভূমি আর ঘোড়ার খুরাকৃতির গ্রামটাকে দেখতে পাচ্ছে।
তারপর সঙ্গী জুটেছে চোখে।
খুরের বাম প্রান্তে, ঝাপসা ঝলকের কাছে–মালভূমি আর গ্রামের মাঝখানে, রেইনফরেস্টে।
সব মিলিয়ে ষোলোটা।
মালভূমির ওদিক থেকেই আসছে সবগুলো।
ষোলোটা সাদা ঝাপসা, প্রত্যেকটির পেছনে একটি করে চঞ্চল লেজ রয়েছে, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চুপিসারে এগিয়ে আসছে গ্রামের দিকে।
রাপার দল।
.
এটিভির ভারী ইস্পাতের দরজা ঠেলে সশব্দে বন্ধ করে দেওয়া হল।
আগেই চলে এসেছে, ন্যাশ বলল।
ঝড়ো মেঘের দল, স্পিকার থেকে ভেসে এলো ক্রাউশের কণ্ঠস্বর। নিশাচর প্রাণীরা ঘড়ি ব্যবহার করে না, ডক্টর ন্যাশ, আশপাশে যথেষ্ট অন্ধকার মনে হলে লুকানোর জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে।
সে যাই হোক, বলল ন্যাশ। বাইরে বেরিয়েছে, এটাই আসল কথা। ঘাড় ফিরিয়ে রেসের দিকে তাকাল। দুঃখিত, প্রফেসর। উপায় নেই, আমাদের সঙ্গেই থাকতে হবে আপনাকে। লরেন, দুর্গ বন্ধ করে দিন।
দুর্গের ছয় ফুটি ডোরস্টোনটা ধরল লরেন আর কোপল্যান্ড, তারপর সেটাকে গড়িয়ে এনে ফেলল দোরগোড়ার মেঝেতে কাটা একটা খাজে।
ডোরস্টোনটার আকৃতি প্রায় চৌকোই বলা যায়, তবে তলার দিকটা পাতিলের মতো গোল করা, ফলে ডোরফ্রেমের ভেতরের খাজে সহজেই ওটাকে ঢোকান আর বের করা যায়। তবে খাজটা দুর্গপ্রাচীরের ভেতর দিকে থাকায় বাইরে থেকে কোনো প্রাণী এত বড় একটা পাথরকে নড়াতে পারবে না।
গড়িয়ে এনে জায়গামতো বসিয়ে দেওয়া হল পাথরটা। তবে লরেন আর কোপল্যান্ড ইচ্ছে করে সামান্য একটু ফাঁক রেখেছে ডোরফ্রেম আর পাথরটার মাঝখানে। দুর্গের ভেতর মানুষ আছে, এটা ওগুলোকে বুঝতে দেওয়াটা জরুরি।
যাই হোক, তারাই তো টোপ।
.
এটিভি-র ভেতরে সবাই ওরা ভিউ স্ক্রিনে লাইভ স্যাটেলাইট ইমেজ দেখছে।
বিড়ালগুলো দুভাগে ভাগ হয়ে গ্রামে ঢুকল, একটা দল এলো সরাসরি পশ্চিম মালভূমির ওদিক থেকে, আরেক দল এল উত্তর দিক থেকে।
ওগুলোর শরীর ইনফ্রারেডে জ্বলজ্বলে সাদা দেখাচ্ছে, লেজগুলো অলসভঙ্গিতে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে আর ছাড়াচ্ছে।
ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর, ভাবল ও। একপাল হিংস্র জন্তুর মধ্যে এ ধরনের সমন্বয় থাকাটা খুবই বিরক্তিকর।
বিড়ালগুলো কয়েক জায়গা দিয়ে পার হয়ে এলো পরিখাটা, কিছু এলো। পশ্চিমের লগব্রিজ ধরে, বাকিগুলো শুকনো পরিখায় পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িগুলোকে লাফিয়ে পার হয়ে এলো।
গ্রামে ঢুকল ওগুলো।
বেশিরভাগ রাপা মানুষের গন্ধ পেয়ে সরাসরি দুর্গের দিকে যাচ্ছে। রেস দেখল।
তবে নিঃসঙ্গ একটা রাপাকে, স্ক্রিনে ছোট্ট একটা সাদা বিন্দু, স্থির দাঁড়িয়ে থাকা এটিভি-র পাশে দেখা যাচ্ছে।
ঝট করে ডানদিকে ঘুরতেই পাশের সরু ফাটল আকৃতির জানালায় বিড়ালটার মুখের কালো লোম দেখতে পেল রেস।
নাক টানল রাপা, বানরের বিষ্ঠার উৎকট গন্ধ পেয়ে ওখানে আর দাঁড়াল না। দুর্গের দিকে এগোল দলে যোগ দেওয়ার জন্য।
ঠিক আছে, বলল ন্যাশ। দেখা যাচ্ছে সব বিড়ালই দুর্গের সামনে জড়ো হচ্ছে। লরেন, রিপোর্ট করুন, কী ঘটছে ওখানে?
দুৰ্গটাকে ঘিরে ফেলেছে ওরা। চেষ্টা করছে ভেতরে ঢোকার, তবে পারছে না। আপাতত এখানে আমরা নিরাপদ। এখন আপনি আপনার টিমকে টেম্পলে পাঠাতে পারেন।
পাশে দাঁড়ান গ্রিন বেরেটদের দিকে তাকাল ন্যাশ। তোমরা রেডি?
সৈন্য তিনজন মাথা ঝাঁকাল।
তা হলে যাও,। এগিয়ে গিয়ে এটিভি-র পেছনের পপ-আপ হ্যাচ ঠেলে খুলে দিল ন্যাশ। কোচরেন, ভ্যান লিওয়েন এবং রাইকটি, তাদের হেলমেট আর পরিচ্ছদে বানরের বিষ্ঠা মাখান, ফাঁকটা গলে বেরিয়ে গেল। তাদের পেছনে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাচ বন্ধ করে দিল লয়েড।
কেনেডি, মাইকে বলল সে। এসএটি-এসএন, কী দেখছেন?
একশো মাইলের মধ্যে কিছু নেই, স্যার, দুর্গ থেকে জানালা ডুগী।
ন্যাশ যখন কথা বলছে, গ্রামের স্যাটেলাইট ইমেজের দিকে তখন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে রেস।
দুর্গের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে রাপার দল, ওগুলোর সতর্ক চলাফেরা, লেজের অলস মোচড় খাওয়া পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তবে শুধু ওগুলো নয়, স্ক্রিনের নিচের দিকে আরো কিছু আছে। তিনটে নতুন দাগ, এটিভি থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, লগব্রিজ পার হয়ে ছাড়ছে। চলে যাচ্ছে গাঢ় মালভূমির দিকে।
কোচরেন, ভ্যান লিওয়েন এবং রাইকার্ট।
আইডলটা আনতে যাচ্ছে।
কুয়াশা ভেদ করে নদী ঘেঁষা পথটায় উঠে ফাটলটার দিকে ছুটছে ওরা। দ্রুত দৌড়াচ্ছে বলে হাপরের মতো শ্বাস নিচ্ছে। প্রত্যেকের হেলমেটে একটা করে ক্যামেরা ফিট করা আছে।
ফাটলটার কাছে পৌঁছাল ওরা।
গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা। ধাপ বেয়ে ওঠার সময় তিন সৈনিকের পা পিছলায়নি। তীরবেগে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।
ন্যাশ, শ্রোয়েডার আর রেনে ভিডিও মনিটরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে, তিন সৈনিকের এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে ওরা।
মনিটরে ওরা দেখতে পেল ফাটলটার দেয়াল সবেগে পিছাচ্ছে। দেয়ালে ঝোলান স্পিকার থেকে বেরিয়ে আসছে তিন সৈনিকের হাঁপানোর আওয়াজ।
ভিডিও মনিটরগুলোর কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেস।
একটু পরেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করল ও, ন্যাশসহ অন্য দুই জার্মান শুধু তিনটে হেলমেট ক্যামেরা থেকে আসা ফটো দেখছে। সৈনিকদের মিশনটাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তারা, ফলে ভুলেও কেউ স্যাটেলাইট ইমেজ স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছে না।
রেস ঘুরে তাকাল স্যাটেলাইট ইমেজের ওপর।
ভুরু কোঁচকাল সাথে সাথে।
হেই, বলল ও। ওগুলো কি?
অলসভাবে রেস আর স্যাটেলাইট মনিটরের দিকে তাকাল ন্যাশ। কিন্তু স্ক্রিনের ইমেজ দেখার সাথে সাথেই ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কী ওগুলো
স্যাটেলাইট ইমেজের ডান প্রান্তে, শহরের পুবদিকটায়, ধূসর রঙের আরো একগুচ্ছ ঝাপসা ঝলক রয়েছে, রেইনফরেস্টের আরো একটা অংশ ওটা, সমমালভূমি ও বিশাল আমাজন অববাহিকার কিনারায় গিয়ে শেষ হয়েছে ওই জঙ্গল।
ওখানে কিছু নেই, তাই ওদিকে তাকায়নি কেউ।
তবে এখন কিছু একটা আছে।
একগাদা খুদে সাদা বিন্দু, গ্রামের ডান দিকে, প্রায় তিরিশটির মতো দ্রুত গ্রামের দিকে এগোচ্ছে।
রেস অনুভব করে তার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
প্রতিটি বিন্দু মানুষ আকৃতির, প্রত্যেকের হাতে কী যেন রয়েছে, দেখে আগ্নেয়াস্ত্র মনে হল ওর।
.
রেইন ফরেস্ট থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো তারা, কাঁধের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আটকান মেশিনগান, গুলি করার জন্য প্রস্তুত।
রেস এবং অন্যরা এটিভি-র সরু জানালা দিয়ে ওদেরকে মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করছিল।
প্রত্যেকে তারা কালো সিরামিক বডি আর্মার পরে আছে, দ্রুত, সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে দলটা, কাভার দিচ্ছে পরস্পরকে, সামনের সারি নিচু হওয়া মাত্র ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে তাদেরকে টপকে আসছে পেছনের সারি, একযোগে আর নিখুঁতভাবে।
দুর্গ ঘিরে রাখা রাপাগুলো নতুন শত্রুর উপস্থিতি টের পেয়ে একসঙ্গে ঘুরল। টান পড়ল পেশিতে হামলার জন্য এবং তারপর।
যে কোনো কারণেই হোক, নতুন আগন্তুকদেরকে হামলা করছে না রাপাগুলো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে শুধু।
এই সময় আগন্তুকদের হাতের একটা অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে ফায়ার শুরু হল। ওটা যেন স্টার ওয়ারস মুভির কোনো অস্ত্র।
চৌকো মাজল থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে অসংখ্য বুলেট বেরুচ্ছে। একটা বিড়ালের মাথা বিস্ফোরিত হল। এক সেকেন্ড আগে যেখানে বিড়ালের মাথা ছিল, পরমূহুর্তে সেখানে রক্ত আর মাংসের মিহি কণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
গুলির আঘাতে দলের আরেকটা প্রাণী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে দেখে বিড়ালগুলো ছড়িয়ে পড়ল।
সরু জানালার দিকে আরেকটু সরে গিয়ে বিড়ালের অস্ত্রগুলো ভালো করে দেখতে চেষ্টা করছে রেস।
দেখতে আকর্ষণীয়, স্পেস এজ-ও।
পুরোপুরি চারকোনা ওগুলো, দেখে মনে হচ্ছে গ্যানব্যারেল বলে কিছু নেই। লম্বা, চৌকো কাঠামোর ভেতরে কোথাও নিশ্চয়ই লুকান আছে ব্যারেলটা।
চিনতে পারল রেস, এ ধরনের অস্ত্র আগে দেখছে, তবে ছবিতে দেখে, সামনা সামনি দেখেনি।
হেকলার অ্যান্ড কচ, জি-১১।
রেসের ভাই মার্টির মতে হেকলার অ্যান্ড কচ জি-১১ রাইফেল হল সবচাইতে আধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল।
১৯৮৯ সালে ডিজাইন করার পরেও দশ বছর এগিয়ে আছে তারপরেও সময়ের চেয়ে এখনো বিশ বছর এগিয়ে আছে অস্ত্রটা। মার্টির মতে এটা হল আগ্নেয়াস্ত্রের হলি গ্রেইল।
আগ্নেয়াস্ত্রের ইতিহাসে এটার মাধ্যমেই প্রথম কেসবিহীন কার্টিজ ব্যবহার করা হচ্ছে। হাতে নিয়ে ব্যবহার করা হয়, এরকম অস্ত্রের মধ্যেও এটাতেই প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বের একমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র খুবই জটিল।
কেসলেস হওয়ায় জি-১১ অবিশ্বাস্য হারে, প্রতি মিনিটে ২৩০০ রাউন্ড বুলেট ছুঁড়তে পারে, অথচ আকারে এম-১৬ অর্ধেক ওটা। এটা এমনকি বডির ভেতর ১৫০ রাউন্ড গুলি স্টোর করে রাখতে পারে, এম-১৬ রাইফেলের তুলনায় ক্লিপে পাঁচগুণ বেশি বুলেট ধরে রাখতে পারে।
সত্যি কথা বলতে কি, জি-১১-র উৎপাদন বন্ধ হওয়ার কারণ হল টাকা। ১৯৮৯ সালে রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে জোরপূর্বক জার্মান সরকার হেকলার অ্যান্ড কচ কোম্পানির সঙ্গে একটা চুক্তি করে জি-১১-র উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
তবে তার আগেই চারশো জি-১১ তৈরি করা হয়ে গিয়েছিল। তবে ব্রিটেনের রয়াল অর্ডিন্যান্স ওই কোম্পানির দায়িত্ব বুঝে নেয়ার সময় একাউন্টস ঘেঁটে দেখা যায় মাত্র দশটা জি-১১ রয়েছে।
বাকি তিনশত নিরানব্বইটি আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো হিসেব নেই।
আমরা এইমাত্র অস্ত্রগুলোর খোঁজ পেয়েছি, রেস ভাবতে ভাবতে ওদিকে তাকিয়ে দেখল রাপাগুলো সুপার-মেশিনগানের গুলির ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
স্টর্মস্ট্রুপার পৌঁছে গেছে, পাশ থেকে বলল শ্রোয়েডার।
বাইরে নরক ভেঙে পড়ছে গুলিবর্ষণের ফলে।
আরো দুটো বিড়াল ছিটকে পড়ল, ব্যথায় কাতরাচ্ছে। দুই স্টর্মস্ট্রুপার বৃষ্টির মতো গুলি করছে গ্রামের সুপার-মেশিনগান দিয়ে।
গ্রামটাকে ঘিরে থাকা রেইনফরেস্টে আশ্রয় নিল বাকি রাপাগুলো। একটু পরেই মূল সড়ক সশস্ত্র স্টর্মস্ট্রুপারদের দখলে চলে গেল।
এসএটি-এমএন ধরা না দিয়ে এখানে ওরা পৌঁছাল কীভাবে? জিজ্ঞেস করল ন্যাশ।
বিড়ালগুলো ওদের ওপর হামলা করেনি কেন? জানতে চাইল রেস।
এখন পর্যন্ত বিড়ালগুলো নির্দয়ভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু কারণে ওরা নতুন সৈন্যদের আক্রমণ করছে না।
এটিভি-র সরু জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকল অ্যামোনিয়ার তীব্র ঝাঁঝ। প্রস্রাবের তীব্র গন্ধ। বানরের প্রস্রাব। নাজিরা ম্যানুস্ক্রিপটা পড়েছে।
হঠাৎ স্পিকার থেকে ভ্যান লিওয়েনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। আমরা রোপ ব্রিজের কাছে পৌঁছাচ্ছি।
রেস আর লয়েড একযোগে মনিটরের দিকে তাকাল, দেখা যাচ্ছে তিন সৈন্যকে।
মনিটরে ভ্যান লিওয়েনের পয়েন্ট অব ভিউ দেখা যাচ্ছে, রশির তৈরি সেতুর উপর দিয়ে ছুটছে সে, যে সেতু ওদেরকে পৌঁছে দেবে টেম্পলে।
কোচরেন, ভ্যান লিওয়েন, জলদি! রেডিওতে বলল ন্যাশ। এখানে আমরা শত্রু
এটিভি-র স্পিকার থেকে তীক্ষ্ণ, কানের পরদা ফাটান আওয়াজ বেরিয়ে এলো, পরক্ষণে নীরব হয়ে গেল ন্যাশের রেডিও।
ইলেকট্রনিক কাউন্টারমেজার এনগেজ করেছে ওরা, বলল শ্রোয়েডার।
মানে? জানতে চাইল রেস।
ওরা আমাদের জ্যাম করে দিয়েছে, বলল ন্যাশ।
এখন কী করব আমরা? আবার প্রশ্ন করল রেনে।
ন্যাশ বলল, ভ্যান লিওয়েন, রাইকার্ট এবং কোচরেনকে জানাতে হবে এখানে ওরা ফিরতে পারবে না। আইডলটা নিয়ে এখান থেকে যত দূরে সম্ভব পালাতে হবে ওদেরকে। তারপর কোনো নানা কোনোভাবে এয়ার সাপোর্ট টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ওরা, একটা চপার ওদেরকে উদ্ধার করে পাহাড়ের কোনো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেবে।
কিন্তু রেডিও জেমিং করা, ওদেরকে জানাবেন কীভাবে? বলল রেস।
আমাদের একজনকে টেম্পলে যেতে হবে, ন্যাশ বলল।
নীরবতা নেমে এল।
এক মুহূর্ত পর শ্রোয়েডার বলল, আমি যাব।
গুড আইডিয়া, রেস ভাবল। গ্রিন বেরেটের পর শ্রোয়েডার হল একজন সৈনিকের মতো।
না, দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল ন্যাশ। আপনি বন্দুক চালাতে পারেন। আপনাকে এখানে আমাদের দরকার হবে। তা ছাড়া, এই নাজিগুলোকে ভালো করে চেনেন আপনি।
তাহলে বাকি রইল ন্যাশ, রেস… কিংবা রেনে।
কিন্তু … শুরু করল শ্রোয়েডার।
কলেজে ফুটবল টিমে আমি ছিলাম সবচাইতে দ্রুততম খেলোয়াড়, রেস বলল। আমি কাজটা করতে পারব।
কিন্তু রাপাদের ব্যাপারে কি হবে? রেনে বলল।
আমি কাজটা করতে পারব।
ঠিক আছে, তাহলে, রেসকে নির্বাচিত করা হল, ন্যাশ বলল, এগিয়ে গেল এটিভি-র সামনের হ্যাচের দিকে।
এটা সঙ্গে রাখুন, বলল ন্যাশ, রেসকে একটা এম-১৬ তুলে দিল, সঙ্গে আরো কিছু। বিড়ালের খাদ্য হওয়া থেকে আপনাকে বিরত করবে। এবার যাত্রা শুরু হোক। শুরু করুন।
হেচের দিকে এগিয়ে গেল রেস, ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস টেনে নিল ভেতরে। ন্যাশ, শ্রোয়েডার এবং রেনের দিকে শেষবারের মতো তাকাল।
তারপর শ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে হ্যাচ থেকে বেরিয়ে এলো।
এবং অন্য এক জগৎ প্রবেশ করল।
সুপার-মেশিন-গানের অগ্নিবর্ষণ তার চারদিকে প্রতিধ্বনি তুলছে, ছিন্নভিন্ন করছে আশপাশের গাছের পাতা, ক্ষত তৈরি করছে ওগুলোর গায়ে। মারাত্মক বিপজ্জনক পরিবেশ।
রেসের হৃদয় যেন তার মাথার ভেতর সশব্দে লাফাচ্ছে।
এই বন্দুকটা হাতে নিয়ে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছি?
তুমি একজন হিরো হওয়ার চেষ্টা করছ, আর তুমি তাই করার চেষ্টা করছ, বোকার হদ্দ কোথাকার।
আবার শ্বাস নিল।
ঠিক আছে…
রেস এটিভিকে পেছনে ফেলে পশ্চিমের লগ ব্রিজের দিকে ছুটছে। ওটা পার হয়ে এসে নদীর কিনারা ঘেঁষা পথটায় উঠল। ঘন কুয়াশা ঘিরে রেখেছে ওকে। তার ছুটে যাওয়া পথে ধোঁয়া যেন লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। গাটওয়ালা গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে পথের উপর।
এম-১৬ তার হাতে বেশ ভারী অনুভব করছে, বুকের ওপর চেপে ধরে দৌড়াচ্ছে সে, প্রতি পদক্ষেপে পানি ছিটাচ্ছে আশেপাশে।
তারপর, একেবারে বিনা নোটিশে, কুয়াশার ভেতর থেকে ওর ডানদিকে পিছলে বেরিয়ে এলো একটা রাপা, ওর সামনে চলে এসে পুরোপুরি উঁচু হয়ে দাঁড়াল
ব্লাম।
বিস্ফোরিত হল রাপার মাথা, বিশাল বড় বিড়ালটা পাথরের মতো দড়াম করে পড়ে গেল, কাদায় পা ছুঁড়ছে।
রেস তার একটাও বিট মিস করছে না, পড়ে থাকা বিড়ালটা টপকে চলে গেল। ওটা পার হতেই সে শ্রোয়েডারের দিকে একবার ঘুরে তাকাল, কাঁধে এম-১৬ চেপে ধরে এটিভি-র হ্যাচ থেকে বেরিয়ে আছে।
রেস দৌড়াচ্ছে।
এক মিনিট পর কুয়াশার ভেতর দেখা গেল পাহাড়ের গায়ের ফাটলটা। মাত্র চোখে পড়েছে, পেছন থেকে ভেসে এলো জার্মানদের চিৎকার করে কথা বলার শব্দ।
আখটুন!
শেনেল! শেনেল!!
হঠাৎ সে ন্যাশের গলা শুনতে পেল কুয়াশার ভেতর কোথাও থেকে : রেস, জলদি! ওরা আপনার পিছু নিয়েছে! ওরা টেম্পলের দিকে যাচ্ছে!
তীরবেগে ফাটলটার ভেতর ঢুকে পড়ল রেস।
দুপাশে ভেজা দেয়াল দ্রুত সরে যাচ্ছে দৌড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ফলে।
তারপর একেবারে হঠাৎ প্রকাণ্ড ক্যানিয়নে বেরিয়ে এলো ও, স্কাইস্ত্রেপারের মতো রক টাওয়ারটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রক টাওয়ারের গোড়াটা ঝাপসা হয়ে আছে কুয়াশায়।
রেস অবশ্য গ্রাহ্য করছে না। বা দিকে প্যাচান পথটা দেখতে পেল ও, লাফ দিয়ে চড়ল ওটায়।
***
এটিভি-র সরু জানালা দিয়ে গ্রামের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রেনে বেকার।
প্রায় ত্রিশজন সশস্ত্র নাজি স্ট্রপ জড়ো হয়েছে গ্রামে। তাদের সবার পরনে স্টেট-অভ-দা-আর্ট কমব্যাট ড্রেস-সিরামিক বডি আর্মার, লাইটওয়েট কেভলার ট্যাকটিকাল, হেলমেট আর কালো স্কি মাস্ক-ওরা এগিয়ে যাচ্ছে ভালো ট্রেনিং প্রাপ্তদের মতে, আক্রমণকারীদের মতো।
রেনে দেখল একজন নাজি পথের মাঝখানে সরে এসে মাথার হেলমেট খুলছে। হেলমেট খোলর পর কালো স্কি মাস্কটাও খুলে ফেলল সে, চারদিকে চোখ বুলিয়ে আশপাশটা দেখছে।
রেনে আরো ভালো করে দেখল লোকটাকে।
মোস্ট ওয়ান্টেড লেখা পোস্টারে বহুবার দেখা সত্ত্বেও এখানে, এখন, রক্ত মাংসের জ্যান্ত লোকটাকে দেখে ভয়ে রেনের চামড়ায় ঢেউ উঠছে।
সামনের দিকে ব্রাশ করা চুল, কুতকুঁতে চোখ, দেখামাত্র চিনতে পারছে সে। বা হাতে মাত্র চারটে আঙুল।
সে তাকিয়ে আছে হেনরিখ অ্যানিসটাজ।
কথা না বলে আঙুল দিয়ে একটি, v সাইন দেখাল অ্যানিসটাজ, তারপর ইঙ্গিত করল এটিভি-র দিকে।
এরই মধ্যে তার বারোজন জি-১১ অস্ত্রধারী লোক এটিভিকে পাশ কাটিয়ে নদীর কিনারা ঘেঁষা পথ ধরে ফাটল আর টেম্পলের গ্রামের দিকে চলে গেছে। তখন ছয়জন এটিভি-র দিকে এগোল, বাকি বারোজন গ্রামের চারদিকে ডিফেন্সিভ পজিশন নিয়ে পাহারায় থাকল।
দুজন লোককে একপাশে সরে দাঁড়াতে দেখা গেল, নাজিদের রেডিও জ্যামিং ডিভাইসটিকে পাহারা দিচ্ছে তারা।
জিনিসটা, ব্যাকপ্যাক সাইজের ছোট একটা ইউনিট, পালস জেনারেটর বলা হয়। নিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস কিংবা ইএমপি পাঠিয়ে শত্রুপক্ষের রেডিও সিগনাল নষ্ট করাই এটার কাজ।
ডিভাইসটা অনন্য। সাধারণত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস একটি সিপিউ-র মাধ্যমে প্রভাবিত করে যে কোনো কিছুতে, কম্পিউটার, টেলিভিশন, কমিউনিকেশন সিস্টেমে। এধরনের পালসকে বলা হয় অনিয়ন্ত্রিত ইএমপি। পালসের মাধ্যমে ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণ করার পর এবং নিজেদের রেডিওর মাধ্যমে ফ্রিকোয়েন্সির ওপর সেট করার নিশ্চিত হওয়ার পর, নাজিরা শত্রুর রেডিও সিস্টেমের ওপর জ্যাম সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, আর নিজেদের কমিউনিকেশন বজায় রেখে যেতে পারে।
যেমনটা এখন তারা করছে।
ছয়জন নাজি এটিভি-র কাছে এসে দেখল প্রতিটি জানালার শাটার ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বোল্ট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি হ্যাচেরও।
বিরাট ভেহিকেলের ভেতর ন্যাশ, শ্রোয়েডার এবং রেনে এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে।
স্টর্মস্ট্রুপাররা সময় নষ্ট করল না।
সাথে সাথে তারা বিশাল বড় আর্মার্ড গাড়িটার তলায় ঢুকে বিস্ফোরক বসাল।
রেস ছুটছে।
উপরে আরো উপরে ঘুরে ঘুরে পাচান পথ বেয়ে, চক্কর খেতে খেতে, ছুটছে।
পায়ের মাংসপেশী লাফাচ্ছে। হৃৎপিণ্ড ধকধক করছে।
রোপ ব্রিজে পৌঁছাল সে। বাউন্স করে এগিয়ে গেল। এগিয়ে গেল পাথরের ধাপের দিকে, টেম্পলে উঠে গেছে।
ফার্ন গাছের ডাল আর পাতার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বেরিয়ে এলো ও, ছোট একটা ফাঁকা জায়গা।
জায়গাটা সম্পূর্ণ নির্জন।
কোনো প্রাণীই নেই, মানুষ কিংবা কোনো বিড়াল নেই, দেখা যাচ্ছে।
টেম্পলের দরজা ওর সামনে খোলা, কুয়াশার ভেতর ঝুলে রয়েছে। ওটার ভেতর থেকে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ির ধাপগুলো গাঢ় ছায়ায় মোড়া।
কোনো অবস্থাতেই ভেতরে ঢুকো না।
মৃত্যু ছুঁয়ে আছে ভেতরে।
এম-১৬ ব্যারেল আটকান ব্যারেল-মাউন্টেড ফ্লাশলাইট অন করল ও, আরো শক্ত করে ধরে সাবধানে পা ফেলে ঢুকে পড়ল খোলা জায়গাটায়। পাথরের দোরগোড়ায় এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল রেস, দেয়ালে রাপা আর ক্ষতবিক্ষত লোকজনের ছবি খোদাই করা ধাপগুলোর নিচে গভীর অন্ধকার।
ভ্যান লিওয়েন! চাপা গলায় ডাকল সে। ভ্যান লিওয়েন, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
সাড়া নেই।
এক ধাপ নামল টেম্পলের ভেতর, বাগিয়ে ধরে আছে তার অস্ত্রটা।
ঠিক এই সময় জবাবটা শুনতে পেল সে।
অনেক দূরে কোথাও মন্দিরের গভীরে ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ শুনতে পেল।
উহ-হু।
আরো এক ধাপ নামল রেস শ্বাস বন্ধ করে। হাতে শক্ত করে ধরে আছে। অস্ত্রটা।
আরো দশটা ধাপ টপকে নেমে এলো সিঁড়ির নিচে। অন্ধকারে, পাথরের প্যাসেজে দাঁড়িয়ে থাকল, প্যাসেজটা ক্রমশ ডানদিকে মোচড় খেয়ে এগিয়েছে।
ফ্ল্যাশলাইটের আলো বেশিদূর যাচ্ছে না, দেয়ালের গায়ে ছোট একটা কুলঙ্গি, তার ভেতরে আলো পড়ল।
একটা কঙ্কালের স্তূপ করা কঙ্কাল ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
খুলির পেছনটা ভেঙে ভেতর দিকে সেঁধিয়ে গেছে, একটা হাতের কোনো অস্তিত্বই নেই, মুখটা এমনভাবে খোলা, যেন আতঙ্কে চিৎকার করার সময় মারা গেছে, চামড়ার তৈরি প্রাচীন একটা বর্ম পরে রয়েছে।
এক পা পিছাল রেস ভীতিকর কঙ্কালটার কাছ থেকে।
এই সময় গলায় জড়ান জিনিসটা ওর দৃষ্টি কেড়ে নিল। নোংরা, পুরানো কঙ্কালের কশেরুকার আড়ালে থাকায় এতক্ষণ দেখতে পায়নি। ভালো করে দেখার জন্য সামনের দিকে একটু ঝুঁকল ও।
চামড়ার তৈরি নেকলেস বলে মনে হল।
ডয়ে ধরল ওটা রেস, একটু টান দিয়ে ঘোরাল ওটাকে। কয়েক সেকেন্ড পর কঙ্কালের গলার পেছন থেকে বেরিয়ে এলো জ্বলজ্বলে সবুজ একটা পান্না, লেদার নেকলেসের সঙ্গে আটকান।
একটা হার্টবিট মিস করল রেস। পান্নার এই লকেটটা ওর পরিচিত। আসলে এটার কথা অতি সম্প্রতি শুনেছে ও।
রেনকোর নেকলেস ওটা।
কুজকো থেকে আইডলটা নিয়ে আসার সময় কোরিকানচার বৃদ্ধা পুরোহিত এটা দিয়েছিল তাকে।
ভীত চোখে কঙ্কালটার দিকে আবার তাকাল রেস।
রেনকো।
কঙ্কালের মাথা থেকে নেকলেসটা ছাড়িয়ে নিল এবং শক্ত করে হাতে ধরে রইল।
রেনকোর কথা ভাবল এবং তারপর হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল মাত্র কিছুক্ষণ আগে ন্যাশকে সে বলেছিল।
টেম্পলে ঢোকার পর রেনকো এবং সান্টিয়াগো বিড়ালগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে দিল তারপর আইডলটাও ভেতরে রেখে আসে।
ঢোক গিলল রেস। রেনকো যখন আইডলটা নিয়ে টেম্পলের ভেতর ঢোকে তখন কি বিড়ালগুলো তার পিছুপিছু ঢুকেছিল?
স্তূপ হয়ে থাকা কঙ্কালের দিকে ভীত চোখে তাকাল ও।
তাহলে রেনকোর এই হাল হল।
একজন হিরোর এই হলো পরিণতি।
মুঠোর নেকলেসটা পরে নিল নিজের গলায়। নিজের দিকে খেয়াল রেখ, রেনকো, বলল উচ্চস্বরে।
ঠিক তখনই চোখ-ধাঁধান আলো পড়ল মুখে, ঝট করে ঘাড় ফেরাল, যেন গাড়ির হেডলাইটের আলোয় একটা পশু ধরা পড়ে গেছে। কোচরেন, ভ্যান লিওয়েন এবং রাইকার্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল সে। টেম্পলের গভীর কোথাও থেকে বেরিয়ে আসছে ওরা।
রাইকার্টের হাতে পার্পেল কাপড়ে জড়ান কি যেন ধরে রেখেছে।
পাশ কাটাবার সময় রেসকে ধাক্কা দিল কোচরেন, এম-১৬ রাইফেলটা এক পাশে সরিয়ে দিল। অস্ত্রটা নিচু করে রাখছেন না কেন কাউকে মেরে ফেলার আগে।
রেসের সামনে থেমে টেক্স রাইকার্ট ঠোঁট বাঁকা করে হাসল, পার্পল কাপড়ে মোড়া জিনিসটা উঁচু করে দেখাল ওকে। পেয়েছি ওটা। বলল সে।
.
রাইকার্ট দ্রুত কাপড়ের পোঁটলাটা খুলল এবং প্রথমবারের মতো রেস দেখতে পেল।
ইনকাদের আইডল।
স্পিরিট অব দ্য পিপল।
আগে রেইনফরেস্টে সে পাথরের টোটেম যেমনটা দেখেছিল, স্পিরিট অব দ্য পিপল দেখতে তার কল্পনার চেয়ে বাস্তবে আরো বেশি অমঙ্গল।
এক ফুটের মতো লম্বা হবে, একটি জুতোর বাক্সের মতো হবে। সামনের অংশটা আয়তক্ষেত্রকার পাথরের, আর রাপার মাথা খোদাই করা, রাগত এবং ভীতিকর রাপার মুখ এর আগে দেখেনি।
দাঁত মুখ খিচান ভয়ঙ্কর চেহারা, চোয়ালটা চওড়া করে খোলা, তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো প্রস্তুত শিকারের অঙ্গচ্ছেদ এবং হত্যা করার জন্য।
রেসের মনে ধরেছে খোদাই করা কাজ, কতটা জীবন্ত দেখতে। দক্ষ কারিগর এবং পাথরের মিশ্রণের ফলে দেখে মনে হচ্ছে রাপাকে যেভাবেই হোক বন্দি করে রাখা হয়েছে কালো এবং বেগুনি-লাল পাথরের মধ্যে এবং এখন চেষ্টা করছে ক্ষিপ্তভাবে বেরিয়ে আসতে।
পাথরটি, রেসের মনে হল সে বেগুনি-লাল লাইনগুলো কাপের মতো নেমে গেছে দাঁত-মুখ খিচানো রাপার চেহারা বেয়ে, যার ফলে ওই চেহারায় রাগ এবং অমঙ্গল প্রকাশ পাচ্ছে।
থাইরিয়াম।
ভাবল সে, ইনকারা যখন আইডিলটা তৈরি করছিল তখন কি সে জানত জিনিসটা কি।
আবার তাড়াতাড়ি কাপড় দিয়ে আইডিলটা মুড়ে ফেলল রাইকার্ট আর চারজন এগিয়ে গেল টেম্পলের বের হবার পথের দিকে।
আপনি এখানে কি করছেন?
টেম্পল থেকে খোলা চত্বরে বেরিয়ে এসেই অকারণ ঝাঁঝের সঙ্গে জানতে চাইল কোচরেন।
ন্যাশ আমাকে পাঠিয়েছে তোমাদেরকে বলার জন্য যে, গ্রামে নাজিরা রয়েছে। ওরা আমাদের রেডিও কমিউনিকেশন জ্যাম করে রেখেছে, তাই আপনাদের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ওরা এদিকে লোক পাঠাচ্ছে। ন্যাশ বলেছে গ্রামে ফিরে না যেতে, তবে অন্য কোনো পথ দিয়ে এই এলাকা ত্যাগ করতে, তারপর এয়ার সাপর্টের জন্যে যোগাযোগ করে রাখছে এবং পাহারের আশেপাশে কোথাও থেকে তুলতে বলেছে–
ঠিক সেই মুহূর্তে, সুপার-মেশিনগানের ফায়ার শুরু হয়ে গেল, ওদের পাশে, প্রবেশপথের পাথুরে দেয়ালগুলো ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। ঝট করে মাথা নিচু করে বোল্ডারটার পেছনে আড়াল নিল ওরা চারজন। নিরেট, পুরু পাথরের তৈরি টেম্পলের প্রবেশপথ ওদের চোখের সামনে এমনভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, ওটা যেন সাধারণ প্লাস্টার।
বোল্ডারের আড়াল থেকে উঁকি দিতেই রেস দেখল গাছপালা আর ঝোঁপের আড়াল থেকে নাজি কমান্ডোরা গুলি করছে জি-১১ থেকে।
কোচরেন খোলা জায়গাটা কাভার করার জন্য পাল্টা গুলি করল। ভ্যান লিওয়েনও তাই করল।
এম-১৬ গর্জন আলট্রা-হাই-টেক জি-১১-র তুলনায় করুণ শোনাল ওদের কানে।
রেসও চেষ্টা করল নাজিদের গোলাগুলির জবাব দিতে, কিন্তু যখন সে এম-১৬-র ট্রিগারটা চেপে ধরল, কিছুই ঘটল না।
কোচরেন তার দিকে তাকাল, কাছে এগিয়ে এলো আর রেসের রাইফেলের টি আকৃতির হাতলটা পেছনের দিকে টেনে দিল।
বেশ্যাবাড়ির যাজকদের মতো ব্যর্থ আপনি, কোচরেন চেঁচিয়ে বলল।
রেস আবার ট্রিগারে চাপ দিল এবং এবার এম-১৬ থেকে গুলির বন্যা বয়ে গেল, বন্দুকের ধাক্কায় প্রায় তার কাঁধ স্থানচ্যুত হয়ে পড়েছিল।
এখন আমরা কি করব? রাইকার্ট চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল গোলাগুলির মাঝে।
আমরা এখানেই থাকব! ভ্যান লিওয়েন চেঁচিয়ে বলল।
দড়িটার কাছে আমাদের যেতেই–।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে মাথার ওপর কোথাও ভুওওওওম করে বিকট এক শব্দ হল।
মুখ তুলে আকাশে তাকাল রেস, কুয়াশার পুরু চাদর ভেদ করে বেরিয়ে এলো কালো এমডি-৫০০ মাসকুইটো লাইট অ্যাটাক হেলিকপ্টার, সগর্জনে রক টাওয়ারের উপর উঠে যাচ্ছে।
অ্যাপাচি কিংবা কোমাঞ্চির চেয়ে মাসকুইটো ছোট আক্রমণাত্মক চপার, ফায়ার পাওয়ারও সেই হারে কম, তবে স্পিড খুব বেশি, আর দ্রুত ওঠানামা করতে পারে।
উপনামটা এসেছে নির্দিষ্ট কোনো পোকার জগতের সাদৃশ্য। ওটা একটা টুকরো টুকরো কাঁচের গোলাকার বুদবুদ যা মৌমাছির গোলাকার চোখের মতো, এবং দুটো লম্বা সরু কোনো বস্তু বৃথা গর্ব করার মতো মাসকুইটোর মতো লম্বা লম্বা পা।
টাওয়ারের মাথায় মাসকুইটোর দুই পাশের কামান থেকে গোলা বের হতে লাগল, টেম্পলের ঠিক সামনে একদলা লম্বা তুলে ফেলা কাদার লাইন দেখা দিল।
খুবই বাজে অবস্থায়! চেঁচিয়ে বলল রেস।
গ্রামে এটিভি-র নিচে বসান নাজিদের এক্সপ্লোসিভ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হল। আট চাকার বিরাট ভেহিকেলের তলায় উন্থলে উঠল গোলাকার একটা অগ্নিকুণ্ড, জমিন থেকে দশ ফুট শূন্যে তুলে দিল ওটাকে, পাক খেল একবার, নিচে পড়ল কাত হয়ে।
ওটার ভেতরে দুনিয়াটা পাগল হয়ে উঠেছে।
নাজিরা ভেহিকেলের তলায় বিস্ফোরক বসাচ্ছে, এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশ, রেনে, আর শ্রোয়েডার নিজেদেরকে কয়েকটা সিটের সঙ্গে স্ট্র্যাপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিয়েছিল, তৈরি ছিল ঝাঁকিটা সামলে নেওয়ার জন্য।
এই মুহূর্তে তিনজন তিনটে লম্বা রেখার মতো ঝুলছে গাড়ির মেঝের উপর, সিটের সঙ্গে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা, তাদের জগৎ ঘুরে পুরোপুরি কাত হয়ে গেছে।
তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এটিভিটা টিকে আছে, বিস্ফোরণে ভেঙে পড়েনি।
মুহূর্তের জন্য।
দুর্গের ছাদ থেকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ডুগী কেনেডি।
গ্রামটা সে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, দেখল ডজনখানেক নাজি কমান্ডার দাঁড়িয়ে আছে ছায়ার মাঝে হাতের জি-১১ তাগ করা।
দেখতে পেল এটিভি বিস্ফোরিত হল এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল এই ভেবে যে নাজিরা বুঝতেই পারেনি যে দুর্গের ভেতর ন্যাশের টিমের একটা দল রয়েছে, এমন মারাত্মক বিস্ফোরণে দেয়ালগুলো টিকে থাকার কথা নয়।
হঠাৎ সে একটা চিৎকারের শব্দ শুনতে পেল, কেউ জার্মানিতে চেঁচিয়ে কাউকে নির্দেশ দিচ্ছে।
ডুগী তেমন একটা জার্মান ভাষা জানে না, তাই বেশিরভাগ শব্দই তার কাছে অর্থহীন। কিন্তু তারপরেও কাকতালীয় ভাবে সে দুটো শব্দের অর্থ জানত, শব্দ দুটো হল : দাস প্রাঙকমান্ডো।
শব্দ দুটো শোনার পর ডুগী ঠাণ্ডায় জমে গেল। তারপর সে দেখতে পেল চার নাজি কমান্ডো নির্দেশ মোতাবেক নদীর দিকে এগিয়ে গেল।
সে জার্মান ভাষা তেমন কিছুই জানে না, তবে হামবুর্গের বাইরে ন্যাটো মিসাইল ফেসিলিটিতে থাকার ফলে বেসিক জার্মান ভাষা এবং জার্মান মিলিটারি টার্মগুলো জানত।
দাস সঙকমান্ডো ওগুলোর মধ্যে একটি টার্ম।
এর মানে হল ডেমোলিশন টিম।
আড়াল থেকে ভ্যান লিওয়েন তার এম-২০৩ লাঞ্চার থেকে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ল। এক সেকেন্ড পর গাছপালার কাছে নাজিদের পজিশনে ফাটল ওটা, চারদিকে প্রচুর কাদা আর পাতার বৃষ্টি হল।
সার্জেন্ট! কোচরেন চেঁচিয়ে বলল।
কী?
এখানে থাকলে মারা পড়ব সবাই। ওদের ফায়ার পাওয়ারের সঙ্গে পারব না আমরা। ওরা আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থাকবে আর আমাদের অ্যামো শেষ হয়ে যাবে তারপর আমরা টেম্পলের ভেতর আটকা পড়ে যাব। এখান থেকে আমাদের বের হতেই হবে!
আমি একটা সাজেশন দিতে চাই, ভ্যান লিওয়েন চেঁচিয়ে বলল।
বল সার্জ, বল, কোচরেন চেঁচিয়ে বলল।
ঠিক আছে, তাহলে, ভ্যান লিওয়েন ভ্রু কুঁচকে বলল। এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, এই টাওয়ার ত্যাগ করার একটাই তো পথ, তা হল রোপ ব্রিজ, ঠিক?
হ্যাঁ, জবাবে রাইকার্ট বলল।
কাজেই প্রথমে আমাদেরকে ওই ব্রিজে পৌঁছাতে হবে, ঠিক?
ঠিক।
ভ্যান লিওয়েন বলল, এবার বলি কীভাবে ওখানে যাব, টেম্পলের পেছন দিয়ে ঘুরে এগোব আমরা, নিচে নেমে টাওয়ার চূড়ার কিনারায় পৌঁছাব। ওখান থেকে ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়াল নিয়ে ফিরব রোপ ব্রিজে। আমরা পার হবার পর নিচে ফেলে দেব ব্রিজ, বেজন্মাদের টাওয়ারে ট্র্যাপ করতে পারব।
প্ল্যানটা ভালো, রাইকার্ট চেঁচিয়ে বলল।
তা হলে দেরি না করে কাজটা করে ফেলি, ভ্যান লিওয়েন বলল।
টেম্পলের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য গ্রিন ব্যারেট প্রস্তুত হল। ওরা যাই করুক না কেন, রেস ওদের কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করছে।
ঠিক আছে, ভ্যান লিওয়েন বলল, এখন!
এবং তারপরই ওরা চারজন ছিটকে বেরিয়ে এলো টেম্পলের দরজা দিয়ে, হাতের বন্দুক গর্জন করতে করতে বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে এলো।
ওদের বন্দুক থেকে গুলিবর্ষিত হচ্ছে।
জঙ্গলের কিনারা থেকে পিছু হটল নাজিরা।
ভ্যান লিওয়েন আর রাইকাট বাঁক ঘুরল প্রথমে, টেম্পলের পেছনে পৌঁছে যাচ্ছে।
কয়েক সেকেন্ড পরেই বাঁকটা ঘুরে গেল, তাই টেম্পলের বাঁক আড়াল দিল ওদেরকে, এখন আর নাজিদের গুলি ওদের লাগবে না। সমতল পাথরের তৈরি পথের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, পিচ্ছিল কাদাময় ঢলের কিনারায়, এই পথটা আগে দেখেছে রেস, যেখানে অস্বাভাবিক বৃত্তাকার পাথরটা রয়েছে।
ওদের নিচের ঢালটা পুরোপুরি কাদায় ভর্তি, প্রায় খাড়াভাবে নেমে গেছে পনেরো মিটার, শেষ হয়েছে ছোট একটা পাথুরে কারনিসে, ওই কারনিসটাই টাওয়ার চুড়ার সর্বশেষ কিনারা। কারনিসের পরে তিনশো ফুট গভীর খাদ। কারনিসের বাঁ দিকে বেশ কিছু গাছপালা আর ঝোঁপ-ঝাড় আছে, ওগুলোর ভেতর দিয়ে রোপ ব্রিজের দিকে যাওয়া যায়।
যেমনটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি কঠিন হবে, কোচরেন বলল ভ্যান লিওয়েনকে।
পরমুহূর্তে, ঠিক যেন সাগরের গভীর থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছে একটা হাঙর, কুয়াশা ভেদ করে কারনিসটার নিচে থেকে উঠে এলো মাসকুইটো অ্যাটাক হেলিকপ্টারটা, তারপর ওদের চারজনের সামনে শূন্যে ঝুলে থাকল স্থির হয়ে, সাইড মাউন্টেড ক্যানন থেকে ফায়ার করছে গানার।
সবাই জমিন লক্ষ্য করে ডাইভ দিল।
টেক্স রাইকার্ট নড়তে দেরি করে ফেলল। একঝাক বুলেট নির্দয়ভাবে ঢুকছে তার শরীরে, মারা যাওয়ার পরেও দাঁড় করিয়ে রেখেছে। প্রতিটি গুলি তার শরীরে ঢোকার সময়, নক্ষত্র আকৃতির রক্তের বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ল তার পেছনের ভিজে দেয়ালে।
বাজ কোচরেন দুটো গুলি খেল পায়ে, ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল সে। কাদার মধ্যে ভারী বস্তার মতো দড়াম করে পড়ল রেস, গুলিবর্ষণের শব্দ না শোনার জন্য কানে হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ভ্যান লিওয়েন ভয় ভীতির উর্ধ্বে উঠে মাসকুইটো লক্ষ্য করে এম-১৬ থেকে গুলি করল। ওর এই হার-না-মানা পাল্টা হামলার সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটল হেলিকপ্টার। মেশিনগানের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ল রাইকার্টের লাশ।
দুভার্গবশত আইডলটা রয়েছে ওই রাইকার্টের হাতে।
লাশটা মার্টিতে আছাড় খেতেই তার হাত থেকে ছুটে গেল আইডলটা। জমিনে ড্রপ খেল, পিছলে গেল কাদাময় জমিনে… ছুটছে কিনারার দিকে।
রেস প্রথমে দেখল ওটাকে।
না! চিৎকার করে, ডাইভ দিল ও, পেট দিয়ে পড়ল নিচে, ওটার পিছু নিয়ে কাদা মোড়া ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে।
ভ্যান লিওয়েন চেঁচিয়ে উঠল, প্রফেসর, থামুন, না!
ইতোমধ্যে রেস দ্রুতবেগে পিছলে যেতে লাগল, এম-১৬ সহ সোজা এগাচ্ছে আইডলটার দিকে।
আট ফুট দূরে।
পাঁচ ফুট।
তিন ফুট।
তারপর হঠাৎ সগর্জনে, বাতাসে তীব্র আলোড়ন তুলে, ফিরে এলো মাসকুইটো, মেশিনগান থেকে গুলি করছে একনাগাড়ে, রেস আর আইডলটার মাঝখানের কাদায় এক লাইনে অসংখ্য গর্ত তৈরি করছে।
দ্রুত রিয়্যাক্ট করল রেস। বুলেটের তৈরি রেখার পথ থেকে সরিয়ে নিল শরীরটাকে, বিস্ফোরিত কাদা থেকে বাঁচার জন্য হাত দিয়ে আড়াল করল চোখ দুটোকে বাদ দিল আইডলটার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা। শরীরের ভার ঘুরিয়ে নিয়েছে ও, ফলে এগিয়ে আসা বুলেটের রেখাকে ফাঁকি দিয়ে নেমে যাচ্ছে ঢালের আরেক দিকে।
ঢালের পর কারনিস, সেটাকে তীরবেগে এগিয়ে আসতে দেখতে পাচ্ছে সে, দেখতে পাচ্ছে ওটার সামনে খাড়া খাদ। আর খাদের উপর মাসকুইটো ঝুলে রয়েছে।
কিন্তু সে খুব দ্রুত পিছলে নিচের দিকে নেমে যেতে লাগল এবং হঠাৎ যখন সে বুঝতে পারল কি ঘটতে যাচ্ছে।
রক টাওয়ারের কিনারা থেকে বেরিয়ে গেল শরীরটা একেবারে শূন্যে ক্যানিয়নের মেঝে থেকে তিনশো ফুট নিচে। শূন্যে বেরিয়ে আসার পর একটা হাত বাড়িয়ে কারনিসের ঠোঁটটা ধরে ফেলল রেস।
ঝাঁকি খেয়ে থামল, কারনিসের কিনারা থেকে এক হাত ঝুলছে, ক্যানিয়নের তলা থেকে তিনশো ফুট উপরে।
সরাসরি রেসের মাথার উপর শূন্যে স্থির হয়ে রয়েছে মাসকুইটোর হেলিকপ্টার, রোটর ব্লেডের প্রচণ্ড বাতাস মাথার ইয়াঙ্কি ক্যাপটাকে খুলির সঙ্গে চেপে রাখছে, বাম হাতে এখনো রেস ধরে রেখেছে এম-১৬ ওটাকে কিনারায় রেখে শরীরটাকে কারনিসে তোলার চেষ্টা করছে ও।
যাই হোক না কেন, নিচে তাকিয়ো না।
তারপরেও নিচে তাকাল।
রক টাওয়ারের খাড়া প্রাচীর লম্বা হয়ে ধূসর কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে এবং ঘন কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
একবার গুঙিয়ে উঠে কনুই দুটো কারনিসে তুলে আনতে পারল রেস, এরপর সহজেই তুলে নিল বাকি শরীর, মুখ তুলতেই ওর ডানদিকে দেখতে পেল ভ্যান লিওয়েন, সঙ্গে কোচরেনকে কাঁধে নিয়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটছে।
নাজিদেরও দেখতে পেল, সব মিলিয়ে বারোজন, সবার হাতে জি-১১, দুদলে ভাগ হয়ে টেম্পলের দুপাশ থেকে একযোগে বেরিয়ে আসছে।
সঙ্গে সঙ্গে আইডলটাকে দেখতে পেল ওরা, কাদা মোড়া খাড়া ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় কাত হয়ে পড়ে রয়েছে।
দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তারা, একজন বাদে সবাই কাভারিং পজিশন নিল, লোকটা অত্যন্ত সাবধানে, এক পা এক পা করে, আড়াআড়ি ভাবে ঢাল বেয়ে আইডলটার দিকে নামছে।
নাজিটা পৌঁছে গেল আইডলটার কাছে। হাত বাড়িয়ে ধরল।
রেসকে ওপরের দিকে উঠতে হবে।
কিন্তু কোনো সুযোগ পাচ্ছিল না। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে একজন নাজি দেখে ফেলল তাকে–কারনিস থেকে অর্ধেক শরীর নিচের দিকে ঝুলছে, সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
নাজিরা সবাই একযোগে জি-১১ তুলল, সবাই তাগ করল রেসের কপালে, ট্রিগারে চেপে বসছে আঙুলগুলো, রেস যা ভেবেছিল সেই কাজটাই করল।
সে নিজেকে নিচের দিকে পড়ে যেতে দিল।
.
রেস নামছে।
তীরবেগে।
রক টাওয়ারের গা ঘেঁষে।
দেখল টাওয়ার প্রাচীরের অসমৃণ গা সবেগে পাশ কাটাচ্ছে ওকে। মুখ তুলে তাকাতে কারনিসটা দেখতে পেল, ধূসর কুয়াশার ভেতরে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
তার মন বিচলিত হচ্ছে।
ভাবতে পারছি না যে আমি এই কাজটা করেছি। শান্ত থাক, শান্ত থাক, ঝাঁপ দিয়েছ, কারণ জানো এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে তুমি।
ঠিক।
নামতে নামতে সে এম-১৬ ঘুরিয়ে নিল রেস।
তুমি মরতে যাচ্ছ না।
তুমি মরতে যাচ্ছ না।
গহ্বরের উপর দিয়ে ভ্যান লিওয়েনকে গ্র্যাপলিং হুক ফায়ার করতে দেখেছে, কাজটা সে কীভাবে করেছিল মনে করতে চেষ্টা করছে ও। হুকটা ফায়ার করার জন্য দ্বিতীয় একটা ট্রিগারে টান দিয়েছিল সেটা থাকার কথা এম-১৬-র ব্যারেলে নিচের দিকে কোথাও।
এখনো নামছে সে।
অস্থিরের মতো অস্ত্রটা চোখের সামনে তুলে ধরল, দ্বিতীয় ট্রিগারটা খুঁজছে—
এই তো!
সঙ্গে সঙ্গে এম-১৬ তুলল রেস, দ্রুত অদৃশ্য হতে শুরু করা টাওয়ার চূড়ায় লক্ষ্যস্থির করল। তারপর দ্বিতীয় ট্রিগারে চাপ দিল।
প্রচণ্ড শব্দ, টায়ার পাংচারের মতো আওয়াজ তুলে ওর গ্রেনেড লঞ্চার থেকে উপর দিকে ছুটল এ্যাপলিং হুক, এঁকেবেঁকে ওটার পিছু নিল নাইলনের রাশি।
সোজা নেমে যাচ্ছে রেস।
এ্যাপলিং হুকটা সোজা ওপরের দিকে উঠে গেল, এঁকেবেঁকে পিছু নিল নাইলনের দড়ি।
এখনো নামছে সে
হুক টাওয়ারের ওপরের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
এখনো নামছে সে।
শক্ত হাতে এম-১৬ টা চেপে ধরে আছে। তারপর সে চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগল, রশির কঁকির অপেক্ষা কিংবা লেকের সারফেসে ধাক্কার অপেক্ষায়, যেটা আগে ঘটবে।
ঝাঁকিটা আগে লাগল।
মুহূর্তের মধ্যে টানটান হল গ্রাপলিং হুকের রশি এবং অকস্মাৎ প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল রেস।
মনে হল হাত দুটো সকেট থেকে এইমাত্র খুলে নেওয়া হয়েছে, তবে যে কোনো ভাবেই এম-১৬ ধরে রাখতে পেরেছে ও।
রেস চোখ খুলল।
টাওয়ারের কিনারা থেকে একশো ফুট নিচে, নাইলন রশির শেষপ্রান্তে ঝুলছে সে।
পুরো তিরিশ সেকেন্ড সে নীরবে ঝুলতে থাকল, হাঁপাল ও, বার কয়েক মাথাটা ঝাঁকাল। কারনিসের কিনারায় নাজিরা নেই। সম্ভবত ওকে খসে পড়তে দেখে ওখান থেকে চলে গেছে তারা।
গভীর শ্বাস ফেলল রেস। তারপর সে নিজেকে প্রস্তুত করল টাওয়ারের ওপর উঠে বসার জন্য।
টাওয়ারের মাথায়, ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে, ছুটছে ভ্যান লিওয়েন হাতের বাওই নাইফটা ম্যাচেটির মতো ব্যবহার করছে।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে, ঢাল থেকে নাজিদেরকে আইডলটা তুলে নিতে দেখেছে সে, কাজেই এখন যেভাবেই হোক তাদের আগে রোপ ব্রিজে পৌঁছাতে হবে তাকে।
রশির সেতু টাওয়ার চূড়ার একেবারে দক্ষিণ কিনারায়, ভেবে অবাক হচ্ছে কোচরেন এই পথ ধরে তাকিয়ে আছে। ঝোঁপ-ঝাড় কেটে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে নতুন একটা পথ তৈরি করে সেদিকে এগোচ্ছে ওরা।
নাজিরা ব্রিজের দিকে যাচ্ছে, সরাসরি পথটা ধরে, প্রথমে ফাঁকা জায়গাটা পেরুবে তারা, তারপর পাথুরে ধাপগুলো টগকাবে।
শেষ কয়েকটা ঝোঁপ কেটে ফেলল ভ্যান লিওয়েন এবং কোচরেন দেখল ওদের সামনে গহবরের উপর ঝুলে রয়েছে রোপ ব্রিজ, টাওয়ার টপ আর আউটার পাথ-এর মাঝখানে।
এই মুহূর্তে দোল খাওয়া ব্রিজটা ওদের কাছ থেকে মাত্র পনেরো গজ দূরে, বারো কিংবা তারও বেশি নাজি পার হচ্ছে সেটা, প্রায় পৌঁছে গেছে অপরপ্রান্তে।
ডেম ইট, ভাবল ভ্যান লিওয়েন, ওরা ওকে হারিয়ে দিয়েছে।
এপার থেকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে একজন নাজি ব্রিজ থেকে নিরেট জমিতে পা দিল, ভাঁজ করা হাত দিয়ে কী যেন একটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে সে, নীল বেগুনি কাপড়ে মোড়া।
আইডল।
সিট!
এরপর ভ্যান লিওয়েন আরেকটা আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিল, সে যেটা করতে চেয়েছিল নাজিরা ঠিক তাই করছে। সে চেয়েছিল নাজিদের আগে রোপ ব্রিজটায় পৌঁছুতে।
গোড়া থেকে প্যাঁচ খুলে রশির ব্রিজটাকে নিচে ফেলে দিল তারা।
বিরাট সেতুটা ঝুলে পড়ল খাদে। গহ্বরের টাওয়ারের দিকটায় এখনো আটকান রয়েছে ওটা, ফলে সবটুকু তলায় খসে পড়ল না। বড় টাওয়ারের পাশে ওটা পড়ে রইল আর ওটার দড়ি দুর্ভেদ্য কুয়াশার ভেতর ঝুলে থাকল।
আইডলটা সঙ্গে নিয়ে কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে নাজিরা। সেদিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ভ্যান লিওয়েন।
আইডলটা ওদের কাছে।
আর ওদিকে রক টাওয়ারে আটকা পড়ে গেছে সে।
হাত দুটো নিতম্বে রেখে ভিলকাফোরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে হেনরিক অ্যানিসটাজ। প্রাচীন গ্রামে তাদের অপারেশন যেভাবে এগোচ্ছে তাতে সে খুশি।
পালস জেনারেটার ঠিকমতো কাজ করছে, বন্ধ করে দিয়েছে শত্রুদের রেডিও কমিউনিকেশন। এটিভি-র ভেতরে লুকিয়ে থাকা আমেরিকানদেরকে সহজেই অচল করে দেওয়া গেছে। আর এইমাত্র খবর পেয়েছে, তার অ্যাসল্ট স্কোয়াড সহজেই কয়েকজন আমেরিকানের কাছ থেকে আইডলটা কেড়ে নিতে পেরেছে।
সব বেশ সুষ্ঠুভাবেই এগোচ্ছে।
একটা চিৎকার ভেসে এলো, ঘাড় ফেরাতেই অ্যানিসটাজ দেখল নদীর কিনারা ঘেঁষা পথটায় বেরিয়ে আসছে টাওয়ার স্কোয়াড।
স্কোয়াডের লিডার সরাসরি তার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর বাড়িয়ে ধরল পুরানো কাপড়ে মোড়া একটা জিনিস।
হের ওবারগ্রুপেন ফুয়েরার, লোকটা আনুষ্ঠানিকভাবে বলল। আইডলটা।
সন্তুষ্টচিত্তে হাসল আনিসটাজ।
গ্রাপলিং হুকের নাইলন রশি বেয়ে রক টাওয়ারে উঠে এলো সে, রেস ছুটে বেরিয়ে গেল, দেখল টেম্পলের পেছনটা ফাঁকা পড়ে রয়েছে, কেউ কোথাও নেই, খুঁজতে লাগল গ্রিন বেরেটদের যদি কেউ বেঁচে থাকে।
রোপ ব্রিজের কারনিসে ভ্যান লিওয়েন আর কোচরেনকে দেখল সে।
শয়তানের বাচ্চারা, ওদের সামনে রোপ ব্রিজ নেই দেখে বলল ও। ব্রিজ কেটে দিয়েছে।
পার হবার আর কোনো উপায় নেই, বলল ভ্যান লিওয়েন। এখানে আমরা আটকা পড়ে গেছি।
তার কথা শেষ হয়েছে মাত্র, কালো মাসকুইটো হেলিকপ্টারটা সগর্জনে পাশ কাটিয়ে গেল ওদেরকে, সাইড মাউন্টেন ক্যানন জ্বলছে যেন। নিশ্চয়ই কাজটা শেষ করার জন্য নাজিরা রেখে গেছে ওটাকে।
রেস এবং অন্য দুজন ডাইভ দিয়ে গাছপালা আর ঝোঁপ-ঝাড়ের নিচে পড়ল। ওদের মাথার উপর বিস্ফোরিত হল রাজ্যের পাতা আর ডালপালা, গাছের কাণ্ডগুলো ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে।
জাহান্নামে যা! গানফায়ারের গর্জনকে ছাপিয়ে উঠল কোচরেনের নিষ্ফল চিৎকার।
উঁকি দিয়ে মাসকুইটো চপারের দিকে তাকাল রেস, গহ্বরের উপর শূন্যে ভেসে রয়েছে ওটা। লম্বা জিহ্বার মতো মেশিনগান থেকে বেরিয়ে আসছে বুলেটগুলো, লম্বা ল্যান্ডিং স্কিড কাঠামোর নিচে ঝুলছে।
ল্যান্ডিং স্কিড…ভাবল সে।
সেই মুহূর্তে, কিছু একটা রেসের ভেতর ক্লিক করল, এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প যা সে ভেতরে ধারণ করে আছে তা সে জানেই না।
হঠাৎ ডাকল ও। ভ্যান লিওয়েন।
কি?
আপনি আমাকে কাভার ফায়ার দিন।
কিসের জন্য?
চপারটাকে আরেকটু ওপরে ওঠার জন্যে, ঠিক আছে? তবে ভয়ে যেন পালিয়ে না যায়।
আপনি কী করতে চান?
এই পাহাড় চড়া থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যেতে চাই!
এতেই যথেষ্ট ভ্যান লিওয়েনের জন্য। এক সেকেন্ড পর ঝোঁপের আড়াল থেকে খানিকটা বেরিয়ে কালো চপারটার দিকে একপশলা গুলি করল সে।
জবাবে একটু উপরে উঠে গেল, আবার ফায়ার শুরু করল।
ইতোমধ্যে, এ্যাপলিং হুক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রেস, প্যাচান নাইলন রশি দ্রুত খুলছে। মুখ তুলে চপারের দিকে তাকাল।
আরেকটু ওপরে তুলতে হবে। চিৎকার করে বলল সে। ওপরে বেশি নিচে হয়ে গেছে!
চপার আর নিজের মাঝখানে দূরত্বটা চোখ দিয়ে মাপল রেস।
এত কাছে ওটা, লাঞ্চার থেকে এ্যাপলিং হুক ফায়ার করা চলে না। হাত দিয়ে চুড়তে হবে ওটা।
আরো খানিকটা রশি খুলল ও, আলগাভাবে ফেলে রাখল যাতে ছোঁড়ার পর জড়িয়ে না যায়।
কোচরেন! চিৎকার করে জানতে চাইল, ভাঙা পা নিয়ে দোল খেতে পারবেন?
আপনি কি মনে করেন, আইনস্টাইন?
তার মানে আপনার অবস্থা ভালো নয়। রেস বলল তীক্ষ্ণ গলায়। আপনি এখানেই থাকছেন। ভ্যান লিওয়েন কাভার দাও!
তারপর, চপারটা লক্ষ্য করে ভ্যান লিওয়েন আরেক পশলা গুলি করতেই, ঝোঁপ-ঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো রেস, হাতে এ্যাপলিং হুক ঝুলছে, ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে মাসকুইটোর বাদিকের স্কিড লক্ষ্য করে জিনিসটা ছুঁড়ল ও।
সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পারল, ছোঁড়াটা নিখুঁত হয়েছে।
বাতাসে ভেসে থাকা হেলিকপ্টারের দিকে ছুটে যাচ্ছে গ্রাপলিং হুক, উত্থানের শেষ সীমায় পৌঁছাল ঠিক যখন মাসকুইটোর বাদিকের স্কিড পাশে চলে এসেছে, ক্লিঙ্ক ক্লিঙ্ক–আওয়াজের সঙ্গে ল্যান্ডিং স্কিডটাকে দুবার প্যাচাল হুকটা, তারপর ঝুলে থাকল।
ঠিক আছে, ভ্যান লিওয়েন, চলুন!
দৌড় শুরু করার আগে চপারের দিকে শেষ আরেক দফা গুলি করল ভ্যান লিওয়েন। তারপর কারনিসের কিনারায় রেসের পাশে পৌঁছাল সে।
ধরুন এটা, নিজের এম-১৬ টা বাড়িয়ে দিল রেস ভ্যান লিওয়েনের দিকে। এ্যাপলিং হুকের রশির শেষপ্রান্ত অস্ত্রটার সঙ্গে বাঁধা।
সেটা নিয়ে রেসের দিকে তাকাল ভ্যান লিওয়েন, আপনি জানেন, আপনি অন্য সবার চেয়ে বেশি সাহসী।
ধন্যবাদ!
কারনিস থেকে একযোগে লাফ দিল রেস এবং ভ্যান লিওয়েন, বড় একটা দোল খেয়ে একশো ফুট চওড়া গহ্বরটা পার হচ্ছে ওরা, ক্রমশ বাঁকা দর্শনীয় একটা পথ তৈরি করে, ঝুলে আছে অ্যাটাক হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা রশি ধরে।
ওরে বাপ…তলাবিহীন খাদের উপর দিয়ে ওদেরকে উড়ে যেতে দেখে বলল বাজ কোচরেন।
ওপারে পৌঁছে পথের উপর নামল রেস এবং ভ্যান লিওয়েন। এম-১৬ থেকে এ্যাপলিং হুকের রশিটা খুলে ছেড়ে দিল রেস।
চপারের ভাব দেখে মনে হল পাইলট জানে না কোথায় গেছে ওরা-খাদের উপর শুধু শুধু পাক খাচ্ছে আর যেদিক খুশি এলোপাথাড়ি গুলি করছে। ওদিকে প্যাচান পথ ধরে ছুটছে রেস আর ভ্যান লিওয়েন, গ্রামের দিকে ফিরছে ওরা।
.
কাপড়ে মোড়া প্যাকেজটা হাতে নিয়ে দম আটকাল হেরনিক অ্যানিসটাজ, ধীরে ধীরে মোড়কটা খুলছে।
হ্যাঁ, চকচকে কালো মৃর্তিটা বেরিয়ে আসতেই বিড়বিড় করল। হ্যাঁ…
তারপর ঘুরল সে, অস্থির পদক্ষেপে পূর্বদিকে লগব্রিজের দিকে হাঁটছে।
ডিমলিশন টিম! জার্মান ভাষায় কথা বলছে। ক্লরিন চার্জগুলো সেট করা হয়েছে?
আর তিন মিনিট, হের ওবারগ্রুপেনফুয়েরার এক লোক জবাব দিল তোবড়ান এটিভি-র কাছ থেকে।
ওই তিন মিনিটই বেশি নিচ্ছ তুমি, গর্জে উঠল অ্যানিসটাজ। ওগুলো তাড়াতাড়ি বসিয়ে নদীতে দেখা করো আমাদের সঙ্গে।
জী, ওবারগ্রুপেনফুয়েরার।
নিচের রেডিও অন করল অ্যানিসটাজ। হের ওবারস্ট্রাগ্রুপেনফুয়েরার? আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? ওবারস্ট্রাগ্রুপেনফুয়েরার হল এসএস র্যাঙ্কে উচ্চ পর্যায় একজন জেনারেল।
হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, জবাব ভেসে এলো।
আমরা ওটা পেয়েছি।
আমার কাছে নিয়ে এস।
জী, ওবারস্ট্রাগ্রুপেনফুয়েরার। এখনই। পুবদিকের লগ ব্রিজ পার হয়ে হন। হন করে এগোল সে, তারপর রেইনফরেস্টে হারিয়ে গেল।
প্যাচান পথ বেয়ে দ্রুত নেমে এলো রেস আর ভ্যান লিওয়েন।
ফাটলের ভেতর ঢুকে পুরোটা পথ পার হল, পৌঁছাল নদীর কিনারা ঘেঁষা পথে, হাতে বাগিয়ে ধরা আগ্নেয়াস্ত্র। চারপাশে ঢাকা কুয়াশায়।
পথটা ধরে ছুটছে রেস, হঠাৎ করে রেডিও এয়ারপিসটা জ্যান্ত হয়ে উঠল।
লিওয়েন, রিপোর্ট। রিপিট। কোচরেন, রাইকার্ট, ভ্যান লিওয়েন, রিপোট–
ন্যাশের কণ্ঠস্বর। ওদের রেডিও আবার কাজ করছে। নাজিরা তাদের জ্যামিং সিস্টেম নিশ্চয়ই অফ করে দিয়েছে, কিংবা অন্তত সরিয়ে নিয়ে গেছে রেঞ্জের বাইরে।
ছোটার গতি ধরে রেখে সাড়া দিল ভ্যান লিওয়েন। কর্নেল ভ্যান লিওয়েন বলছি। রাইকার্টকে হারিয়েছি আমরা, আর কোচরেন আহত হয়েছে। তবে আইডলটা এখন নাজিদের হাতে। রিপিট। আইডলটা এখন নাজিদের হাতে। আমার সঙ্গে প্রফসর রেস রয়েছেন। গ্রামে ফিরছি আমরা।
আইলডলটা ওদের হাতে চলে গেছে?
হ্যাঁ।
ফিরিয়ে আনো ওটা। ন্যাশ বলল।
.
পশ্চিম লগব্রিজে পৌঁছাল রেস আর ভ্যান লিওয়েন। সাবধানে পার হয়ে এলো ওটা। হাতের বন্দুক উদ্ধত।
পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে গ্রামটা। কুয়াশার চাদরে মোড়া। কোনো নাজিকে দেখা যাচ্ছে না। কোনো রাপাও নেই।
ওদের সরাসরি সামনে এটিভি-র গাড়ি কাঠামোটা অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, একদিকে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। বাম দিকে ভিলকাফোরের বিভিন্ন আকৃতির ঘর বাড়ি কুয়াশার ভেতর মাথা তুলে রয়েছে।
এটিভির দিকে এক পা এগোল ভ্যান লিওয়েন।
কর্নেল…? ডাকল সে।
জবাবে গুলির শব্দ শোনা গেল জি-১১ থেকে গুলি ছুঁড়েছে। নাজি ডিমলিশন টিমের তিনজনকে গ্রামে রেখে যাওয়া হয়েছে। অ্যানিসটাজের নির্দেশে ক্লরিন চার্জ বসাচ্ছিল তারা।
ডাইভ দিয়ে বাম দিকে পড়ল রেস, ভ্যান লিওয়েন ডাইভ দিল ডানদিকে, গড়িয়ে স্থির হওয়ার পর উভয়েই গুলি করার জন্য তাদের এম-১৬ তুলল, কিন্তু কোনো লাভ নেই। কুয়াশার ভেতর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ওরা।
নিজের সঙ্গে এক রকম ধস্তাধস্তি করে মাত্র সিধে হয়ে দাঁড়িয়েছে রেস, দেখল একজন নাজি কমান্ডো এটিভি-র পাশ থেকে বেরিয়ে এলো, হাতে উদ্যত জি-১১।
হঠাৎ ব্লাম। জোরাল একটা গুলির আওয়াজ হল রেসের পেছনে কোথাও, নাজি লোকটার মাথা রক্তের ফিনকি ছেড়ে ঝাঁকি খেল পেছন দিকে। বিস্ময়ের ধাক্কায় হতভম্ব হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকল রেস, ওর চোখের সামনে দড়াম করে পড়ে গেল লোকটা, মৃত।
কি ব্যাপার গুলির শব্দের উৎসের দিকে ঘুরে গেল সে।
কুয়াশার ভেতর থেকে ঝট করে ওর সামনে বেরিয়ে এলো একটা রাপা, দাঁত বের করে কোচ্ছে, তারপরই গর্জন ছেড়ে ওর গলা লক্ষ্য করে লাফ দিল–
ব্লাম।
শূন্যে থাকতেই ধাক্কা খেয়ে এক পাশে সরে গেল রাপাটা, আরেকটা রেসের বুলেট ওটার মাথার পাশে লেগেছে, মৃত্যু ঘটেছে তৎক্ষণাৎ। বিরাট জন্তুটার ধড় পিছলে এসে থামল রেসের পায়ের কয়েক ইঞ্চির মধ্যে।
হচ্ছেটা কি এখানে?
প্রফেসর! কুয়াশার ভেতর থেকে ভেসে এলো ডুগীর কণ্ঠস্বর। এদিকে! চলে আসুন! আপনাকে আমি কাভার দিচ্ছি!
চোখ কুঁচকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে তাকাতে দুর্গের ছাদটা অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল রেস। ওখানে, দুর্গের, মাথায়, কাঁধে স্নাইপার রাইফেল চেপে ধরে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ডুগী কেনেডি।
পাথুরে দুর্গের নিরাপদ পাঁচিলে দাঁড়িয়ে গ্রামটার সবটুকুই দেখতে পাচ্ছে ডুগী।
ওর শক্তিশালী স্নাইপার রাইফেল এম৮২৭১এ থারমাল সাইটসহ। কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি জিনিস স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। তার স্কোপে প্রতিটি মুহূর্ত ধরা পড়ছে বহুরঙা লম্বাটে ফোঁটার আকৃতিতে রেস, ভ্যান লিওয়েন অবশিষ্ট দুই জার্মান ডেমলিশন টিমের সদস্যকে খানিকটা মানুষের আদল বিশিষ্ট ফোঁটা বলে মনে হচ্ছে, চারটে দিক বিশিষ্ট আকৃতির মতো দেখাচ্ছে এটিভিকে, তবে উত্তাপবিহীন হওয়ায় কোনো রঙ নেই। আর রাপার ফোঁটাগুলোয় রয়েছে চারটে করে পা।
বিড়ালগুলো।
নাজি ট্রুপ তাদের অস্ত্র নিয়ে চলে যাওয়ার পর ওগুলো আর দেরি করেনি, আবার বেরিয়ে এসেছে, গ্রামে ফিরে এসেছে ওরা।
ওরা ফিরে আসছে। আর ওরা রক্তের খোঁজে বেরিয়েছে ওগুলো।
.
রেস যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে জায়গায়ই ঘুরে দেখল ভ্যান লিওয়েন কাত হওয়া এটিভি-র উপর দাঁড়িয়ে।
প্রফেসর এখান থেকে চলে যান! গ্রিন বেরেট সার্জেন্ট চেঁচিয়ে বলল। ডুগী আপনাকে কভার দিবে। আমি আবার ওটাকে দাঁড়া করাব।
রেসকে একটা ব্যাপারে দুবার বলতে হয় না। সে সাথে সাথে গ্রামের ভেতর চলে গেল, কুয়াশার ভেতর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে কাজটা করল আর সাথে সাথে শুনতে পেল তার পেছনে কাদায় ছুটে আসা পায়ের শব্দ।
এগিয়ে আসছে তার দিকে, নাগালে পৌঁছে যাচ্ছে।
তারপর হঠাৎ বাম-স্ম্যাক-প্ল্যাট।
ডুগীর বন্দুকের গুলির শব্দ বাম–তারপর হল কোনো নাজির গায়ে গুলির আঘাতের শব্দ স্ম্যাক তারপরের শব্দটা হল ওই নাজিটির মার্টিতে আছড়ে পড়ার শব্দ–্যাট।
আরেকটি রাপা তার সামনে পিছলে বেরিয়ে এলো, থাবা মারার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে–বাম!-বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল। রাপার শরীরটা কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠল। বাম! বাম! বাম! বাম! বাম! শরীরটা স্থির হয়ে গেল।
রেস বিশ্বাসই করতে পারছে না।
এটা অনেকটা কুয়াশায় ঢাকা গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে একজন গার্ডিয়ান এঞ্জেলকে নিয়ে যাওয়া। তার কাজ হল শুধু দৌড়ে যাওয়া, সামনের দিকে, আর ডুগীর কাজ হল তার চারপাশের বিপদ মুক্ত করা, যে বিপদগুলো সে নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
শুনতে পেল কাদায় আরো ছুটে আসা পায়ের শব্দ, এবার আরো বেশি ভারি, চার ধরনের পায়ের শব্দ।
বাম।
স্ম্যাক।
স্প্ল্যাট।
****