তৃতীয় পর্ব
ড্যাডা-ড্যাং–ড্যাডা-ডাং-ড্যাডাং; ড্রার্র্র্র্র্–ড্যাডা-ড্যাং। ড্রার্র্–ড্যাডাং-ড্রার্র্ ড্যাডাং।
বড় বড় ঢাকের পিঠে কাক-চিল-বক পক্ষীর পালক দিয়ে সাজানো ফুঙ্কো-ভঁটির মাথায় চামরের চুল বাজনার সঙ্গে তালে তালে নাচে। কাসি বাজে, শিঙা বাজে, ধূপের ধোঁয়ায় মউ মউ করে বাবা কালারুদূর থান; ‘পাটাগনে’ অর্থাৎ পাট-অঙ্গনে ভক্তরা নাচে হাতে বেতের দণ্ড, গলায় ‘উতুরী’ অর্থাৎ উত্তরীয়, পরনে গেরুয়া কাপড়, কপালে সিঁদুরের ফেঁটা, গঙ্গামাটির ‘তিপুণ্ডক, রুখু চুল, উপবাসে শুকনো মুখ, তবু বাবার মহিমায় ধেই-ধেই করে নাচে। হাড়িডোম-বাউরি-কাহার যার ইচ্ছে বাবার ভক্ত হতে পারে। এবার শিবভক্ত বনওয়ারী। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তাই গোটা কাহারপাড়াটাই গাজনে ‘উতুরী’ পরেছে। শিববা হে, শিবো হে! জয় শিববা কালারুদ্-! বম্ বম্ বম্ বম্ বম্ বম্! ঢাকে বাজে-ড্যাডা-ড্যাং-ড্যাডা-ড্যাং-ডাং!
গজাল-পেটা চড়কপাটার উপর শুয়ে আছে শিবভক্ত বনওয়ারী। ষোলজন ভক্তের কাধের ‘সাঙ’ অর্থাৎ বাঁশের ডাণ্ডার উপর চড়ক চলেছে ঘুরছে ব-ব ব-বন-বন-বন্!
চৈত্র-সংক্রান্তি শেষ হয়ে গেল। বছরের শেষ রাতটি ‘পেভাত’ অর্থাৎ প্রভাত হল, গোটা রাতটি নাচলে কালারুদ্দের ভক্তরা। শিববা হে, কালারুদ্দু হে, বম্ বম্ বম্বম্ববম্ বম্বব বম। চড়কের পাটা পাক দিয়ে ‘চকুর’ অর্থাৎ চক্রের মত ঘুরল বন-বন করে। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনে-বনে আদ্যিকালের অন্ধকার ‘চ’কে চ’কে’ অর্থাৎ চমকে চমকে উঠল। কীটপতঙ্গ-পশু-পক্ষীরা কলকল করে উঠল! সাপেরা গর্তের মধ্যে পাক ঘুরে ফণা তুললে। জন্তুজানোয়ার গা-ঝাড়া দিলে। তারাও জানলে—বছর শেষ হল। তারাও প্রণাম জানাল-শিবো হে, কালারুদ্দু হে!
বছরের প্রথম দিন, গাজন শেষ হল। শিব চললেন জলশয়নে কালীদহের তলায়; গোটা বছরটি থাকবেন সেথায়, আবার উঠবেন বছরের শেষে গাজনে, এক মাস আগে আগামী চৈত্রের শুভদিন অর্থাৎ পয়লা। বলবেন সূর্য হে, চন্দ্ৰ হে, আমি উঠলাম—বছর শেষ কর। শিব জলশয়নে যাচ্ছেন; সেই মিছিল চলেছে–জঙ্গলের কালারুদ্ৰুতলা থেকে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়া হয়ে হাঁসুলী বাঁকের কালীদহে! প্রথম চলেছে ঢাক, কাসি, শিঙে, বাদ্যভাণ্ড; তারপর চলেছে সঙ। সঙ হল-বাবার ভূতপ্রেত দানা-দৈত্যের দল। মানুষেই সেজেছে, নন্দী ভৃঙ্গী ‘তিজট’ ‘দন্তব”—আরও কত ভূত তার নাম কে জানে! যারা সে জছে তারাও জানে না। এবার সঙেও কাহারপাড়ার লোক বেশি। হবে না কেন, এবার বনওয়ারী কাহারপাড়ার মাতব্বর যে শিবভক্ত। সঙের দলের পিছনে চলেছে ভক্তের দল। সারিবদ্ধ হয়ে নাচতে নাচতে চলেছে মাথার উপরে তালে তালে নাচাচ্ছে বেতের দণ্ড, সঙ্গে সঙ্গে পড়ছে পায়ের সারি। তাদের পিছনে চড়কপাটা। ঘুরছে বন্-বন্। চড়কপাটায় গজালের কাটার উপর শুয়ে আছে বনওয়ারী আকাশের দিকে মুখ করে। তার পিছনে বাণগোঁসাই, তার পিছনে বাবার ‘দোলা’ অর্থাৎ চতুর্দল—আসলে একটি ড়ুলি। ড়ুলির আশপাশে ধূপ গুগগুল জ্বলছে। আর খবরদারি করে চলেছেন জাঙলের সদ্গোপ মহাশয়েরা। চৌধুরী-বুড়োকে পর্যন্ত আজ বের হতে হয়েছে। হেদো মণ্ডল, পাকু মণ্ডল, নাকু পাল, এমনকি মাইতো ঘোষও চলেছেন।
না চলে উপায় আছে! সকল দেবতার আদি দেবতা–কালারুদ্দু! দিন বল, রাত বল, মাস বল, বছর বল, আদি বল, অন্ত বল—সব কিছুর মালিক হলেন উনি। শিবো হে, শিবো হে! চড়কের পাটার উপর শুয়ে বনওয়ারী মনে করে কথাগুলো, আর প্রণাম জানায় বাবাকে। প্রাণ নাও বাবা, মান রাখ; আমাকে দণ্ড দাও, কিন্তু কাহারদের মঙ্গল কর—শিবো হে, আসছে জন্মে উচ্চকুলে জন্ম দিয়ে। বাবাঠাকুর তোমারই শিষ্য বাবা, তারও পুজো দিয়েছি, তোমার চড়কের পাটায় লোহার কণ্টকে শুয়ে তোমার চরণে মিনতি করি বাবা, তুমি তাকে প্ৰসন্ন হতে বল, তোমার শিষ্যকে বল—তাঁর বাহন-‘হত্যে’র অর্থাৎ সেই অজগরটিকে পুড়িয়ে মারার অপরাধ যেন তিনি ক্ষমা করেন, যেন হাঁসুলী বাঁকের অমঙ্গল না হয়। ক্ষেত ভরে ধান দাও, ঝড়-ঝাপটা থেকে রক্ষা কর, কোপাই বেটীকে ক্ষ্যাপা বানে ভাসতে বারণ কর।
কাহারপাড়ায় আজ মহাধুম!
বনওয়ারী এবার শিরভক্ত, চড়কের পাটায় চেপেছে—এবার কালীদহে যাবার পথে ড়ুলি, চড়কের পাটা নামবে কাহারপাড়ায়। এই দুবার নামছে। একবার নেমেছিল অনেক কাল আগে, তখন নীলকুঠির আমল—কাহারপাড়ার মাতব্বর তখন গণ্ডার কাহার। এই দশাশয়ী পেরকাণ্ড চেহারা ছিল বলে নীলকুঠির দেওয়ান জাঙলের চৌধুরী নাম দিয়েছিলেন—গণ্ডার কাহার। গণ্ডার কাহারের বংশ নাই। গণ্ডার সেবার চেপেছিল চড়কের পাটায়। মদ খেয়ে পাটায় চড়েছিল বলে বংশটাই শেষ করে দিয়েছেন বাবাঠাকুর। সেই সেবার কালারুদ্র ড়ুলি নেমেছিল কাহারপাড়ায়। সেও নাকি খুব ধুম হয়েছিল। সাহেবান মহাশয়রা ‘বশকিশ’ করেছিলেন অনেক। এবারও খুব ধুম। এবার দ্বিতীয়বার বাবার ড়ুলি নামবে কাহারপাড়ায়।
ড়ুলি নামবে ওই মজলিস যেখানে বসে, সেইখানে। গোবরজল দিয়ে জায়গাটি পরিপাটি করে নিকানো হয়েছে, বেদি বাধা হয়েছে, গোটা কাহারপাড়াই আজ ঝকঝক তকতক করছে। এটো, কালো হাড়ি সরানো হয়েছে, মুরগি হাঁস আজ ঘরে বন্ধ, ছেলেপিলে সাবধান, বউ-বেটী গিনি-বানি সব কাচা কাপড় পরে চান সেরে, চুল এলিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আসবেন।
হাঁকডাক করে বেড়াচ্ছে করালী।
বনওয়ারী চেপেছে চড়কে। করালী পাড়ায় ঘুরছে চরকির মত। গোটা পাড়াটাকে সেই সাজিয়েছে। সাজিয়েছে, আচ্ছা সাজিয়েছে, বাহাবাহা সাজিয়েছে। এই কথা ছাড়া, প্ৰশংসা প্রকাশের ভাষা কাহারদের নাই। সকলে একবাক্যে বলছে—আচ্ছা ছোকরা, বাহাদুর ছোকরা! বাঁশবাঁদিতে বাঁশের অভাব নাই, গাছপালার অভাব নাই, করালী তার দলবল নিয়ে বাঁশেপাতায় ফটকই করেছে চারটে। মজলিসের ‘থানটি’তে চার কোণে খুঁটি পুঁতে পাতা দিয়ে মুড়ে মাথার উপর টাঙিয়েছে সেই তেরপলখানি। রঙিন কাগজ কিনে এনেছে নিজের পয়সায়, তাই দিয়ে শেকলের মত মালা তৈরি করেছে একরাশ। তাই জড়িয়ে দিয়েছে খুঁটিতে খুঁটিতে, লম্বালম্বি, কোনাকুনি, লালে নীলে সবুজে সদায় রঙ লাগিয়ে দিয়েছে। জাঙলের সদ্গোপ মাশায়দের খাতির করবার জন্যে সিগারেট কিনে এনেছে চন্ননপুর থেকে। এ ছাড়া আর কি দিয়ে খাতির করবে। কাহারদের ছোঁয়া আর তো কিছু খাবেন না—পান পর্যন্ত না। নিজেও সিগারেট টানছে আর ঘুরছে। পাখী ঘুরছে ঘুরঘুর করে, তার পরনে চমৎকার বাহারে ড়ুরে শাড়ি। বউবিটীরা তার দিকে আর করালীর দিকে তাকাচ্ছে। পাখী বুঝছে সব। হাসছে।
বনওয়ারীর স্ত্রী গোপালীবালা জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে আছে মজলিসের বেদির সামনে। ধুনুচিতে মধ্যে মধ্যে ধুনো দিচ্ছে। শান্ত ভালমানুষ, চুপ করে রয়েছে। তার পাশে বসেছে সুচাঁদ। চোখ বড় বড় করে মোটা গলায় গল্প বলছে—বলছে গাজনের গল্প। প্রতিবার গাজনেই বলে, এবারও বলছে। গল্প না বলে চুপচাপ বসে থাকতে হলে সুচাঁদের মনে হয়, সে যেন কত কাঙাল দুঃখী হয়ে গিয়েছে, লোকে তাকে হেনস্তা করছে। তাই লোকে শুনুক না-শুনুক গল্প সে বলে। যায়। বলে—তোরা শুনে আখ, বুড়ি হলে বলবি। গাজন ছেরকাল আছে, গল্প ছিল না। হয়েছে, বলি তাই আছে, না বললে থাকবে না।
পাখী বলে—তবে যে বললে, ছিষ্টি ছিল না তখন। চন্দ না, সুয্যি না, পিথিমী না, মানুষ না, পশু না, পক্ষী না
–হ্যাঁ লো, হা। ছিলই না তো, কিছুই ছিল না। কিছু কিছু না, তারপর কিছু না থাকার ব্যাপকতা এবং গুরুত্ব বোঝাবার জন্য শেষ দীর্ঘ করে টেনে বলে—কিছুই না বলে দু হাত নেড়ে দিলে।
–কি-ছু-ই না?
–কি-ছু-ই না। অন্ধ-কা-র, আঁ-ধা-র, থমথম করছে। চোখ দুটো তার বিস্ফারিত হয়ে উঠল। শরীরে রোম খাড়া হয়ে উঠল, কণ্ঠস্বর হল গভীর থমথমে, বললে-আঁধারের মধ্যে। শুধু কালারুদ্দের চরক ঘুরছিল বন্-বন, ব-বন, ব-ব বলে সে হাতখানি তুলে ধরলে। ইঙ্গিতে সেই আদিকালকে যেন দেখিয়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। সৃষ্টির আদিকাল পর্যন্ত প্রসারিত করে দিলে তার আঙুলের ইঙ্গিতকে।
আদিকাল থেকে এ পর্যন্ত কতকাল, তার সংখ্যা বা পরিমাণ নির্ণয়ের শক্তি ওদের নাই, হয়ত প্রয়োজনও নাই; কিন্তু শক্তিহীন মনের বিস্মিত উদাসীনতার মধ্যে একটা অস্পষ্ট অনুমানের। আভাস ওদের বুকে জেগে উঠেছে। তাই সম্বল করে বাবা কালারুদ্কে অভ্যর্থনা করবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে করজোড় করে।
করালী ছুটতে ছুটতে এল। এসে পড়েছে, এসে পড়েছে।
বাবা এসে নামলেন কাহারপাড়ার নীলবাঁধের পাড়ে মাতব্বরদের মজলিসে পবিত্র করে বাধানো নতুন মাটির বেদিতে।
সুচাঁদ পাখীকে এবং করালীকে টেনে এনে বললে—পেনাম্ কর্। পেনাম্ কর্।
বনওয়ারী একটু হাসলে পাটার উপর শুয়েই। পিসি ঠিক আছে। গোদালড়ি ছদনদড়ি যখন যার কাছে থাকে তখন তারই। পিসির সঙ্গে করালী-পাখীর মিটমাট হয়েছে, এখন আর পিসি ওদের ছাড়া কাউকে জানে না।
করালী-পাখীর সঙ্গে সুচাঁদের মিটমাট হয়েছে এই সেদিন, গাজনের প্রথমেই। চড়কপাটার উপর শুয়েই বনওয়ার কথাগুলি মনে করলে।
সেদিন সুচাঁদের কান্না শুরু হয়েছিল সকালেই। কাঁদছিল বাবার বাহনের জন্য। গাজন আসছে, বাবার বাহনকে মনে পড়ে গিয়েছে। বনওয়ারী বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারে নাই। উপোস করে শুয়ে ছিল—ভাল লাগে নাই বুড়িকে নিয়ে বকাকি করতে; কাঁদুক। দুঃখ এই যে কেঁদে মানুষ মরে যায় না।
আদ্যিকালের বুড়ি ও উপকথার বুড়ির মত ওর ‘কাঁদি-কাঁদি মন করে, কেঁদে না আতি মেটে’, অর্থাৎ আত্মার তৃপ্তি হয় না। ওরা কারণেও কাদে, অকারণেও কাঁদে।
হঠাৎ বাহনের জন্য কান্না বন্ধ করে বুড়ি কাঁদতে লাগল ওর বাপের জন্য। বিনিয়ে বিনিয়ে কাদতে লাগল ওরে বাবা, আমাকে সঙ্গে কর রে! তুমি কোথা গেলে রে! আমি কোথা যাব রে! ওরে আমার কি হবে রে! একেবারে মড়াকান্না।
আর সহ্য হল না বনওয়ারীর। সে উঠল। নীলবাঁধের ঘাটে বুড়ি কাঁদছিল, তার মুখের কাছে হাত নেড়ে চিৎকার করে বললে—বলি সকালবেলা থেকে এমন করে কাঁদছ কেনে?
সুচাঁদ চোখ মুছে মুখের দিকে চেয়ে অভ্যাসমত তার প্রশ্নটার পুনরুক্তি করলে—কাঁদছি কেনে?
–হ্যাঁ, হা। কাঁদছ কেনে?
–আমার মন।
—তা বললে হবে না।
–আমি কাঁদতে পাব না?
–না।
—তবে আমি কোথায় যাব?
—যাবার কথা কে বলেছে?
—তবে?
–বিনি কারণে কাঁদতে পাবা না।
—বিনি কারণে কাঁদতে পাব না?
–হ্যাঁ।
–পাব না?
—না না না।
সুচাঁদ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। উঠে কোমরে কাপড় বেঁধে চন্ননপুরের বাবুদের বাড়ির রাসের উৎসবে বারুদের কারখানার বোম ফাটার মত ফেটে পড়ল।
বিনি কারণে? বিনি কারণে? বিনি কারণে? চিৎকার করতে করতে সে এসে মজলিসের মাঝখানে পা ছড়িয়ে বসে মাটিতে একরাশ ধুলো উড়িয়ে বললে মাতব্বর। পঞ্চায়েত! কই, বিচার করুক পঞ্চায়েত। আমি থাকব কার কাছে! আমাকে খেতে দেবে কে?
উপবাসী বনওয়ারী ঘরে ফিরে যাচ্ছিল। তা ছাড়া কালারুদ্দের শিরভক্ত হয়েছে সে, সন্ন্যাসের সময় সংসারের পুলোমাটি ঝগড়াঝাটি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে তাকে বারণ। তার অভাবে প্রহ্লাদ সকলকে নিয়ে মজলিস করছিল। প্রহ্লাদ সুচাঁদের আস্ফালনে বিস্মিত হল না, কারণ পিসির ধরনই ওই। পিসি হল ‘অরুণ্য’ অর্থাৎ অরণ্যের মত, অরণ্যে যেমন ডাল পড়লে ঢেঁকি হয়, পাতা পড়লে কুলো হয়, অরণ্য যেমন মাতলে ঝড় ওঠে, কাদলে বৰ্ষা নামে, তেমনি পিসি তিলকে করে তাল, উই ঢিপিকে করে পাহাড়, কাদলে গগন ফাটিয়ে চেঁচায়, হা-হা করে হেসে
ধেই ধেই করে নাচে। প্রহ্লাদ হেসে ফেললে।
সুচাঁদ ক্ষেপে গিয়ে কপাল চাপড়াতে আরম্ভ করলে।—আমাকে খেতে দেবে কে? আমাকে খেতে দেবে কে? হাসছিল? তু হাসছিল?
প্ৰহ্লাদ এবার গম্ভীর স্বরে বললে—কেনে, তোমার কন্যে রয়েছে।
—খাব না, আমি কন্যের ভাত খাব না।
—তবে নিজেই খেটে খাবা।
—খেটে খাব?
–হ্যাঁ! তুমি তো এখনও খাটতে পার।
–নিশ্চয় পারি। খুব পারি, তাদের পরিবারদের চেয়ে বেশি পারি। বনওয়ারীর ওই মুখে। ময়দা-নেপা পরিবারের চেয়ে বেশি পারি। হেই পারি। হেই পারি।
সে অঙ্গভঙ্গি করে কত খাটতে পারে বুঝিয়ে দিলে, দেখিয়ে দিলে।
প্ৰহ্লাদ হেসে বললে—তাই তো আমরাও বলছি গো!
—তবে? সেদিন বনওয়ারীর কাছে খাটতে গেলাম, তা বনওয়ারী এক দো-পর খাটিয়ে লটা পয়সা দিয়ে বিয়ে করে দিলে। সারা দোপর পুকুর ডোবার চারিপাশ ঘুরে একটি পাতগুগলি তুলে আনলাম, তা কে আমাকে এঁধে দেয়?
এবার বনওয়ারী বললে—চেঁচিয়ো না, থাম। বনওয়ারী ফিরে এসেছে বাড়ির পথ থেকে।
–আঁ! বনওয়ারীকে দেখে একটু থমকাল সে।
—থাম। আগে থাম।
—থামব?
–হ্যাঁ, থাম।
—থামব, কই, জবাব দে আমার কথার!
বনওয়ারী বললে—তুমি খাটতে গিয়ে হেদো মণ্ডলের সঙ্গে বসে তামুক খাবে, গল্প করবে–
সুচাঁদ তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই যথাসাধ্য সবিনয়ে বলে উঠল—আর করব না, আর তামুক খাব না।
বনওয়ারী গম্ভীরভাবে বললে—তা ছাড়া তুমি ওই মণ্ডলকে কি সব বলছিলে?
—কি বললাম? কিছুই না!
–কিছুই না? বল নাই তুমি? মরা কুকুর বিড়েল ফেলা, নৰ্দমা পরিষ্কারের কথা নিয়ে বল নাই যে, এ ওই বনওয়ারীর মাতব্বরি?
নির্বাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সুচাঁদ বনওয়ারীর মুখের দিকে।
বনওয়ারী বললেবল কেনে, বল নাই তুমি হেদো মণ্ডলকে?
শান্ত কণ্ঠে এবার সুচাঁদ বললো, তা বলেছি বাবা। তা এসব তো পিতিপুরুষে করত, তাই বলেছি। আর সিটি তো তোমারই কীত্তি বাবা।
–হ্যাঁ গো। আমারই কীত্তি বটে। তা অল্যায়টা কোনখানে? আমরা মেথর, না মুদ্দফরাস?
সুচাঁদ চুপ করে রইল। কিন্তু মরা কুকুর বিড়াল ফেলা, মরা গরু কধে বয়ে ফেলার যে অন্যায়টা কোনখানে, সে তাও বুঝতে পারলে না।
প্রহ্লাদ এবার বললে—জাঙলের সদ্গোপ মাশায়রা পিরান গায়ে দিতে শিখলে, বামুনদের মড়া কাঁধে করে গঙ্গাতীরে নিয়ে যেত, তা ছাড়লে। আমরাই বা এ সকল কৰ্ম্ম করব কেনে?
ওসব ছেড়ে দিয়ে সুচাঁদ এবার নিজের কথা বললে তা আমি যাব কোথা তা বল। বসন আমার প্যাটের বিটী, সে খেতে দেবে না। দুটো পাতগুগলি খেতে সাধ, তা
এবার বসন্ত এগিয়ে এল নিজের উঠান থেকে। সে শান্ত মানুষ, শান্ত কণ্ঠেই প্রতিবাদ করে বললে ছাটে’! বলি কবে বলেছি তোকে খেতে দেব না। ভাত বেড়ে তোর ছামনে দিয়েছি—তু ফেলে দিয়েছি।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুচাঁদ বললে—ফেলে দিয়েছি?
–দিয়েছিস কি না আমার মাথায় হাত দিয়ে বল?
সুচাঁদ চিৎকার করে উঠল—বেশ করেছি, খুব করেছি। দোব না? করালীর সঙ্গে পাখীর সাঙা দিলি কেনে? ওর এত বড় বাড়—আমার গায়ে ব্যাঙ দেয়—
বনওয়ারী চিৎকার করে বললে—তার জন্য করালী তোমার পায়ে ধরবে।
—পায়ে ধরবে?
–হ্যাঁ। কই করালী? ডাক করালীকে। সে নিশ্চয় এতক্ষণ চন্নপুর থেকে ফিরেছে।
সুচাঁদ ঘাড় নেড়ে বললে–না। শুধু পায়ে-ধরা লোব কেনে আমি? আমার লাতিনকে সাঙা। করলে, একখান, ভাল কাপড় দিয়েছে আমাকে? বোতল বোতল পাকী মদ খায়, আমাকে দিয়েছে?
করালী এল, বললে—দোব, আমি দোব।
—দে, এখুনি দে। আমি মদ খেয়ে নতুন কাপড় পরে লাচব।
এগিয়ে এল পাখী। সুচাঁদের হাত ধরে টেনে বললে—আয়, এখুনি আয়। এখুনি।
সুচাঁদ অন্য হাতে নিজের পা দেখিয়ে দিয়ে বললে—ধরুক, করালী আমার পায়ে ধরুক, তবে যাব।
করালী শুধু পায়েই ধরলে না, সুচাঁদকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বললে চল, তোকে কোলে করে নিয়ে যাব। চল।
ছোকরার দল সব ছুটল করালীর বাড়ির দিকে।
সেই দিন থেকে সুচাঁদ প্রায় পাখীর বাড়িতেই আড্ডা গেড়েছে। ওইখানেই থাকে, পাকী মদ খায়, সিগারেট খায়, নসুবালার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাচে, শুধু ভাত খাবার সময় বসনের কাছে। আসে। ভাত সে করালীর ঘরে খেতে পারে না। এক, পেটের বেটীর ভাত খায়, তারই লজ্জায় বলে—আমার মরণ নাই, প্যাটের হায়া নাই, বেটীর ভাত খাই সেই লজ্জা। আবার লাতজামাইয়ের ভাত! চড়কের পাটায় শুয়ে সব কথা মনে পড়ল বনওয়ারীর, হাসলে একটু।
কালারুদ্দু কাহারপাড়ায় বসলেন-ধূপে-ধুনোয়, প্রদীপের আলোয়, তেলে-সিঁদুরে পূজা নিলেন কাহারপাড়ায়। আবালবৃদ্ধবনিতা মাটির উপর উপুড় হয়ে গড়িয়ে পড়ল, প্রণাম জানালে। এল না শুধু নয়ান এবং নয়ানের মা। নয়ান বললে—আমি পেনাম করে কি করব? মরার বাড়া গাল নাই। মরবার লেগে বসে আছি। করালীকে পেনাম করতে বগা! কুৎসিত ভাষায় পৃথিবীকে গাল দিতে শুরু করলে, তারপর হাঁপাতে লাগল।
নয়ানের মা ছেলের বুকে হাত বুলাতে লাগল। কথার জবাবই দিলে না। সন্ধ্যার সময় তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কালীদহে স্নান করে ভিজে কাপড়ে এলোচুলে চিলের মত তীক্ষ্ণ স্বরে গাল দিতে দিতে পাড়ায় ফিরল চড়কের পাটায় পাপ করে চেপে যে তোমার মহিমে লষ্ট করলে,
তাকে তুমি ফাটিয়ে মার বাবা। যে বাবাঠাকুরের বাহনকে পুড়িয়ে মারলে, তাকে তুমি ধ্বংস কর। বাবা। কোপাইয়ের বানে ভাসিয়ে দাও বাবা পাপ আজত্বি, ঝড়ে উড়িয়ে দাও বাবা। হে বাবাঠাকুরের মরা বাহন, আকাশে মাথা তুলে ফোঁসযুঁসিয়ে হেলেদুলে তুমি রে-রে করে এস বাবা।
গোটা পাড়াটা শুভদিনে সচকিত শঙ্কিত হয়ে উঠল।
বনওয়ারী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে।