৩.১৮ দ্বন্দ্ব
সত্য সরল। তবুও জটিল। সত্য-যে জটিল তার প্রধান কারণ, সত্যের গঠনে থাকে বিপরীতের সমন্বয়। এই সব বিপরীতের প্রতিটিই সরল। এদের সমন্বয় সরল নয়। এর উদাহরণ সর্বত্র ছড়ানো আছে। যেকথাটাকে অকাট্য সত্য বলে মনে হয়, দেখা যায় তার বিপরীত কথাটাও একেবারে মিথ্যা নয়। বিশেষত ভালোমন্দের ____ আমরা বারবারই এইরকম একটা অবস্থার সম্মুখীন হই।
স্বার্থপরতা ও মিথ্যাভাষণ মন্দ। এটা প্রায় অকাট্য সত্য। সবাই যদি মিথ্যা বলতে তবে কারো কথাতেই কেউ বিশ্বাস রাখতে পারতো না। একসঙ্গে কাজ করাই তবে অসম্ভব। সমাজজীবন এভাবে চলতেই পারে না। কিছুটা সন্দেহ ও অবিশ্বাস নিয়ে কাজ করা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ অবিশ্বাস নিয়ে কোনো সামাজিক জীবনই সম্ভব নয়। পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহানুভূতি শুধু প্রশংসনীয়ই নয়। এসব বাদ দিয়ে মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন দাঁড়াতেই পারে না। সত্যই সহযোগিতার আদর্শ ভিত্তি।
সীমাহীন সহানুভূতি কিন্তু অচল এবং অসহ্য। এটাও অস্বীকার করা কঠিন। অন্যের দুঃখকষ্টকে যখন আমরা অনেকটা নিজের দুঃখকষ্টের মতো অনুভব করি তখন তাকেই বলি সহানুভূতি। আপন কোনো মানুষ চোখের সামনে যন্ত্রণা ভোগ করছে এ অবস্থায় আমাদের পক্ষে স্থির থাকা খুবই কঠিন। আমাদের স্নেহাস্পদ কেউ যখন অভুক্ত তখন আমাদের খেতে রুচি হয় না। সর্বজীবে প্রেমের কথা ধর্মে বলা হয়। সব মানুষকে সমান চোখে দেখা আদর্শের কথা। কিন্তু সর্বক্ষণই তো জগতে কেউ অভুক্ত আছে। কিছু মানুষ। যন্ত্রণাভোগ করছে। সকলের প্রতি সমবেদনা যদি আমাদের হৃদয়ে সজীব থাকে তবে কি আমাদের পক্ষে এক মুহূর্তও স্থির থাকা সম্ভব? নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্য কি আমাদের সহানুভূতির সীমা ছোটো করে আনতে হয় না? কলকাতার রাস্তায় প্রতিনিয়তই আমরা দেখছি, কিছু হতদরিদ্র মানুষ নর্দমা থেকে খাদ্য কুড়িয়ে খাচ্ছে। তারপরও কিন্তু আমাদের খাদ্যে রুচি থাকে। হৃদয়কে অনেকখানি কঠিন, নিপ্রেম করে তবেই এটা সম্ভব হয়। হৃদয়ের এতোটা কাঠিন্য ভালো কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু সীমাহীন সহানুভূতি নিয়ে বাঁচা দুঃসাধ্য।
দ্বন্দ্বের আরো একটু জটিল উদাহরণ এবার লক্ষ করা যাক। জ্ঞান ও প্রেম দু’টিকেই সর্বত্র আদর্শ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ আকাঙ্ক্ষা করা মানুষের সহজ ধর্ম। সর্বদেশে সর্বকালে শিল্পসাহিত্যসঙ্গীতের ভিতর দিয়ে মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হয়ে চলেছে। এ থেকে যখন সে একেবারে বঞ্চিত হয় তখন আহত প্রেম হিংসার রূপ ধরে, মানুষের ভিতরে এবং বাইরে বিরোধ ও বিনাশের শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। জ্ঞান নানাবিধ, স্তরভেদে প্রেমের সঙ্গে তার সম্বন্ধ বদলে যায়।
জ্ঞানতৃষ্ণা মনুষ্যত্বের অঙ্গ বলে স্বীকৃত, মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জীবের প্রধান পার্থক্য অনেকে এইখানে খুঁজে পেয়েছেন। অথচ সাংসারিক জ্ঞানের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক অনেক সময়েই সহায়ক বলা যায় না। শৈশবের অনেক স্বপ্ন যেমন বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে দূরে। মিলিয়ে যায়, প্রেমের স্বাভাবিক শক্তিও তেমনি সংসার সম্বন্ধে জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেকের পক্ষেই রক্ষা করা কঠিন হয়ে ওঠে। এযুগে সমস্যাটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কৈশোরে পা রাখতে না রাখতেই সংসারের একটা নগ্ন বীভৎস চেহারা নতুন প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট ও তীব্র হয়ে ওঠে। এই তীব্র বাস্তববোধ বহু তরুণের মনে এমন একটা ঘৃণা আর অশ্রদ্ধার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে যে, সেখানে বিশ্বপ্রেমের কথা হাস্যাস্পদ ভাবালুতা বলেই প্রত্যাখ্যাত হয়। নিবোধেরাই ভালোবাসে, এই জ্ঞানে বহু তরুণ-তরুণী কোনো না কোনো প্রকারে আত্মহননের পথে এগিয়ে যায়। চেতনার এই এক স্তর যেখানে জ্ঞান ও প্রেমের ভিতর বৈর সম্পর্ক এযুগের এক কঠিন সমস্যা। অন্য কোনো স্তরে উত্তরণ অনেকের পক্ষেই অনিশ্চত সম্ভাবনা মাত্র। অনেকেরই অনিবার্য গতি তাই এক অসমম্বিত, আত্মধ্বংসী দ্বন্দ্বে।
এই দ্বন্দ্ব আরো জটিল, আরো বিভ্রান্তকারী হয়ে উঠেছে জীবন সম্বন্ধে ক্রমবর্ধমান এক উদ্দেশ্যহীনতার আক্রমণে। সে কথায় পরে ফিরে আসা যাবে।
.
(খ)
এবার প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক।
মানবপ্রকৃতির সঙ্গে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আছে। মানুষের প্রকৃতি আর ঐ সম্পর্কটা নিয়ে কিন্তু তর্কের অভাব নেই। কেউ বলেছেন, মানুষের ভিতর স্বার্থবুদ্ধিই প্রধান, এটা মেনে নিয়েই সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে আমাদের চিন্তা শুরু করা উচিত; এর বিপরীত চিন্তা অবাস্তব। হল্স কিংবা এডাম স্মিথের কথা এখানে মনে আসে।
স্মিথ বলেছিলেন, কল্পনা করা যাক হঠাৎ একদিন সংবাদ এলো যে চীনদেশটা এক দৈব দুর্বিপাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। তাতে আমাদের ভিতর প্রতিক্রিয়া কী হবে? কিছুক্ষণ আমরা জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে, ভঙ্গুরতা বিষয়ে, কয়েকটি বিষণ্ণ দার্শনিক মন্তব্য করব, তারপর দৈনন্দিন কাজে মন দেব, যেন কিছুই হয়নি। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সামান্য আঁচড় পড়লে কিন্তু আমরা যথার্থই উদ্বিগ্ন হতাম। স্বার্থ মানুষকে যতটা নাড়া দেয় অন্য কিছুই তেমন দেয় না। স্মিথ বলছেন, যে-সব পরস্পরনির্ভর কাজ নিয়ে আর্থিক জীবনের গঠন, সে সবের পিছনে স্থায়ী ও প্রধান পরিচালক শক্তি হচ্ছে স্বার্থ।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বাজারকে ভিত্তি করে যে আর্থিক ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থা, তার সমর্থনে ঐ স্কট অর্থবিজ্ঞানীর মতামত অনেকেই উদ্ধৃত করে থাকেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে দাঁড়িয়ে আত্মোন্নতির আকাঙ্ক্ষা থেকেই মানুষ যথাসাধ্য পরিশ্রম করে, উদ্ভাবনীশক্তি ক্রমাগত প্রয়োগ করে যায় বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, আর এইসবের ভিতর দিয়ে সারা দেশেরই উৎপাদিকা শক্তি বেড়ে চলে।
আমরা জানি, এই সরল চিত্রটিকে সম্পূর্ণ সত্য বলে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বাজারভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতিতে অসাম্য বাড়ে, ধনসম্পদের অপচয় ঘটে, মানুষের সুখশান্তি নষ্ট হয়। এ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ করতে গেলে অন্য এক প্রবন্ধ দাঁড়িয়ে যাবে। সেটা এখানে অনাবশ্যক।
সত্য আবারও জটিল। মোট কথা, কেবল স্বার্থবুদ্ধিকে অবলম্বন করে কোনো সুষ্ঠু সামাজিক বা আর্থিক ব্যবস্থা দাঁড়াতে পারে না। অথচ স্বার্থবুদ্ধি বর্জন করে কোনো ব্যবস্থা অন্তত এযুগে আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। সাম্যবাদী নামে যেসব দেশ পরিচিত সেখানেও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দূর করা যায়নি। বিশেষত ক্ষমতা নিয়ে সংঘর্ষ সেখানে ভয়াবহ রূপে বারবার দেখা গেছে। স্টালিন-ট্রটস্কির দ্বন্দ্ব বিখ্যাত হয়ে আছে নাটকীয়তার গুণে। কিন্তু ট্রটস্কিই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না স্টালিনের। হত্যাকাণ্ডের অর্ধশতাব্দী পর সম্প্রতি বুখারিনের ‘পুনরুদ্ধার হয়েছে। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এইরকম অসংখ্য হত্যা ঘটিয়েছিলেন সাম্যবাদী সোভিয়েতের রাষ্ট্রনেতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিনিসটা শুধু অর্থনীতিতে নয়, রাজনীতিতেও কত ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে, এযুগে সাম্যবাদী দেশগুলি তার মুখ্য উদাহরণ হয়ে আছে। তবে এদেশে এবং প্রতিবেশী দেশগুলিতেও উদাহরণের অভাব নেই।
সমস্যাটা তা হলে এই ধনই হোক বা ক্ষমতাই হোক, স্বার্থ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ত্যাগ করা কঠিন, আবার ঐ ভিত্তিতে কোনো সুন্দর সমাজ গঠন করাও অসম্ভব। বাস্তবে নানা বিপরীত প্রবৃত্তিকেই সমাজজীবনে স্থান দিতে হয়। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এইসব বিপরীতের ভিতর কোনটাকে প্রাধান্য দিতে হবে, আর কীভাবেই বা সেটা সম্ভব?
এডাম স্থির স্বার্থবুদ্ধির কথা বলেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তিনি সেখানেই আবদ্ধ থাকেননি। সহানুভূতিকেও তিনি মানবপ্রকৃতির এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। স্মিথ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে একথাটা অনেকেই কেন যেন ভুলে যান। সহানুভূতির সবচেয়ে সহজ প্রকাশ পরিবারের ভিতর, প্রতিবেশীর ভিতর, কাছের মানুষদের নিয়ে গঠিত আপন সমাজে। সেখানেও অবশ্য হিংসাদ্বেষ আছে। তবু সহানুভূতির শক্তিকে অস্বীকার করা ভুল, সেই শক্তিতেই ছোটো ছোটো গোষ্ঠী ও সমাজ বহু দৈব দুর্বিপাক এবং ঝড়ঝাঁপটা অতিক্রম করেও টিকে আছে।
স্বার্থবুদ্ধিকে ভিত্তি করে যেমন বাজারের অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে, সহানুভূতিকে কেন্দ্র করে তেমনি এক বিকল্প সমাজব্যবস্থার কথা ভাবা যায়। সহানুভূতির স্বাভাবিক বৃত্তগুলি ছোটো। তারই সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে এক বিকেন্দ্রিত সমাজের রূপরেখা কল্পনা করা যায়। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মতো এদেশের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের অনেকে ঐভাবে চিন্তা করেছেন।
.
এযুগে বৃহৎ সমাজের ওপর ক্ষমতালোভী রাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দুই ব্যবস্থাতেই এই ব্যাপারটা ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে এদের নাম দেওয়া যায় রাষ্ট্রতন্ত্র। রাষ্ট্রতান্ত্রিক দেশের সাধারণ ধর্ম জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্রীয়তাবাদ। রবীন্দ্রনাথ এইরকমের জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন। এর মূলে তিনি দেখেছিলেন ক্ষমতালিপ্সা, প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতি বা আত্মীয়ভাব নয়।
বিকেন্দ্রিত সমাজব্যবস্থার আর্থিক, প্রশাসনিক ও রাজনীতিক সংগঠন নিয়ে গান্ধীজীর চিন্তা উল্লেখযোগ্য। তার বিস্তারিত আলোচনা এখানে করা যাবে না, অন্যত্র করা হয়েছে। কিছুকাল যাবৎ আমরা পঞ্চায়েতীরাজের কথা বেশি করে শুনছি। গান্ধী বলেছিলেন গ্রামস্বরাজের কথা। তিনি জোর দিয়েছিলেন আর্থিক স্বয়ম্ভরতার ওপর। গ্রামস্বরাজকে সার্থক করে তুলতে হলে দলীয় শাসন থেকে দূরে সরতে হবে। রাজনীতিক দলগুলি ক্ষমতার সংগ্রামে মত্ত, ক্ষমতার যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ তাদের সাহায্যে কখনো পূর্ণতা লাভ করবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য গান্ধীর প্রদর্শিত পথ, অহিংস অসহযোগ। দলীয় ক্ষমতালোভী বলেই তাতে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন অন্যায়।
গান্ধীজীর মত ও পথ অনেকের কাছে অবাস্তব মনে হয়েছে। কোনো আদর্শেরই বাস্তবে সম্পূর্ণ রূপায়ণ সম্ভব হয় না। তবু কোন দিকে অগ্রসর হতে হবে সেটাই প্রধান প্রশ্ন। অতিকেন্দ্রিক বৃহৎ সমাজের একটা বিকল্প চিত্ৰ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় পাওয়া যায়। বহুদিন অবধি ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে নিয়েই আমাদের চিন্তা আবর্তিত বিবর্তিত হয়েছে। যখন দেখা গেল যে, আজকের জগতে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নামে যে-দুটি পরিচিত ব্যবস্থা আছে সেই দুটির ভিতর অনেকখানি মিল আছে, দুটি ব্যবস্থাই রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রকারভেদ হয়ে উঠেছে, তখন অন্য এক বিকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন দেখা দিল। সেই চিন্তাভাবনা দেশে-বিদেশে শুরু হয়ে গেছে। তার সবটাই গান্ধীজীর নামের সঙ্গে যুক্ত এমন নয়। তবু গান্ধী চিন্তার সঙ্গে এই নতুন চিন্তার মিল অনেকখানি।
পশ্চিমী ও সোভিয়েত শিবিরের দ্বন্দ্ব, বিপ্লবের সত্তর বছর পর, ক্ষমতার লড়াই হয়ে বেঁচে আছে; তার আদর্শগত ভিত্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। আদর্শের দ্বন্দ্বটা অন্যত্র; তার সমাধান অন্যত্র। সেইখানে গান্ধী নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
.
(গ)
নতুন সংগঠন প্রয়োজন। তবু শুধু প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের জোরে কোনো আদর্শ শেষ অবধি রক্ষা পায় না। এর প্রমাণ ছড়িয়ে আছে পূবে পশ্চিমে সবদেশে। এদেশের অগ্রণী চিন্তকেরা যে স্বদেশীসমাজ বা আত্মীয়সমাজের কল্পনা করেছিলেন তার ক্ষেত্রেও একই কথা। কোনো একটা সাংগঠনিক কৌশলে মানুষ ও সমাজকে দোষমুক্ত করা যায়, আদর্শে পৌঁছে দেওয়া যায়, এ ধারণা ভ্রান্ত।
এযুগের বিজ্ঞান নাগরিক সভ্যতার অবদান। বিজ্ঞানের শক্তি নগরকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস, উচ্চাভিলাষ, কর্তৃত্বের অহংকার। যদিও আত্মীয়সমাজে অন্য এক আদর্শের বীজ আছে তবু বিজ্ঞানের অভাব গ্রামকে দিয়েছে জড়তা, মূঢ়তা, অসহায়তা। এই সংকটের ভিতর থেকেই উঠে আসে এক নতুন সমন্বয়ের কল্পনা। সেই সমম্বয়ে পৌঁছবার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সোজা রাস্তা নেই। ধর্ম নিয়ে যাঁরা একটু তলিয়ে চিন্তা করেছেন তাঁরা একথাটা ভালোভাবেই জেনেছেন যে, ধর্মের সারবস্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের জোরে রক্ষা করা যায় না। সমাজের সারবস্তু সম্বন্ধে একই সিদ্ধান্ত সত্য নয় এমন মনে করবার কারণ নেই, যদিও এবিষয়ে আমাদের মন থেকে মোহ দূর হতে চায় না। সংগঠনের গুরুত্ব অস্বীকার করা অবশ্য ভুল। দুই বিপরীত ভ্রান্তির ভিতর থেকে এখানেও পথ খুঁজে নিতে হবে।
গভীরভাবে বিবেচনা করবার মতো কিছু প্রশ্ন এখানে এসে পড়ে। আমাদের আলোচনার পরিসর অতিসংক্ষিপ্ত। একটি মূল কথার ভিতর দিয়ে আরো নানা কথার ইঙ্গিত দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
মানুষ জীবটির একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, সে তার ব্যবহারিক জীবনে একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে, তা নইলে তার ভিতরে বিশৃঙ্খলা এসে যায়। এ শুধু বাইরের বিশৃঙ্খলা নয়, লক্ষ্যহীনতায় মনের ভিতরই আমরা পথ হারিয়ে ফেলি। অতীতে এই সমস্যা তেমন গুরুতর ছিল না। ইতিহাসের আদিযুগে মানুষকে লক্ষ্য বেছে নিতে হয়নি, প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকেই সেটা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। কোনো প্রকারে প্রাণরক্ষা করাটাই তখন লক্ষ্য। সেদিন প্রাণরক্ষার জন্য নিজেকে প্রাণপণে প্রস্তুত করে তুলতেই মানুষের অধিকাংশ শক্তি নিযুক্ত হত। আজও দারিদ্র্যের চাপে অনেক মানুষের জীবনে অবস্থা এইরকম।
ঐতিহ্যের শক্তিও এইসঙ্গে উল্লেখ্য। প্রাচীন সমাজে লক্ষ্য নির্দিষ্ট হয়ে যায় ঐতিহ্যের দ্বারা। সেই সমাজে অন্যায়ের অভাব নেই, কিন্তু লক্ষ্যহীনতা সেখানে মৌল সমস্যা নয়। ঐতিহ্যের অনুসারী কর্মকাণ্ড জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে চলেছে। অতিদীর্ঘকাল মানুষের জীবন কেটেছে এইভাবে। অন্তত অধিকাংশের জীবনে এটাই হয়ে উঠেছে প্রধান ধারা। আধুনিক যুগে পৌঁছবার পর ঐতিত্বের বন্ধন আজ শিথিল। তবু রাষ্ট্রের শাসনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিয়মে কিছু লক্ষ্য আবারও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে শিল্পপ্রধান সমাজে।
এই যে ব্যবহারিক জীবনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের বন্ধন, এরই ভিতর দিয়ে মানুষের চরিত্রে ও দৃষ্টিভঙ্গীতে কিছু দোষ এবং গুণ গঠিত হয়ে ওঠে। প্রাত্যহিকতার সীমাবদ্ধ উদ্দেশ্য মানুষের কৌতূহল ও সহানুভূতির সীমাকে সংকীর্ণ করে তোলে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মানুষ হয় হৃদয়হীন, সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিমাপটা ক্ৰমে অমানুষিক হয়ে ওঠে। সম্ভবত সেই কারণেই আধুনিক সমাজ যে সমস্ত উদ্দেশ্য স্থির করে দেয়, নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণই সেইসব আর মনেপ্রাণে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিতে পারছে না। অথচ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, একলব্যের যেমন একটা লক্ষ্যের প্রয়োজন ছিল একাগ্রতার জন্য, অনুশীলনের জন্য, আর অনুশীলন ছাড়া অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটে না, আমাদের অধিকাংশের প্রকৃতিতেই তেমনি সুস্থ থাকবার জন্যই একটা লক্ষ্যাভিমুখিতার প্রয়োজন আছে।
দারিদ্র্য বহুকালের সমস্যা। এযুগের বিশেষ সমস্যা, সমৃদ্ধির ভিতরই হতাশা, লক্ষ্যহীনতার হতাশা। নৈরাশ্যকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠেছে এক উত্তেজক তবু জীবনবিমুখ জীবনদর্শন। একদিকে উচ্চাভিলাষী অমানুষিকতা, অন্যদিকে উদ্দেশ্যহীনতার যন্ত্রণা ও ব্যর্থতা, এ-দুয়ের সীমানা অতিক্রম করা যাবে কোন পথে? এই অন্য এক দ্বন্দ্ব, যদিও প্রাচীন তবু বিশেষভাবে এযুগেরই। কর্মে ও অনুশীলনে নিজেকে গভীরভাবে নিযুক্ত করবার শক্তি ও অভ্যাস আমরা অর্জন করব অথচ কর্মই আবার বন্ধন হয়ে আমাদের বেঁধে ফেলবে না, কঠিন এই শর্ত। তবু এছাড়া কি মুক্তির পথ আছে? সেই মুক্তি ব্যক্তিকে লাভ করতে হবে নিজেরই অন্তরে। সমাজ হতে পারে সহায়ক, নয়তো প্রতিবন্ধক। কিন্তু ত্রাণকর্তা হবেন ব্যক্তি স্বয়ং। তা নইলে ত্রাণ নেই।
শাস্ত্রের বাণী গজদন্তেরর মতো বহুমূল্য ও শীতল। কিন্তু আসল কথাটা অন্য ভাষাতেও বলা যায়। বিবেকানন্দ ফুটবল খেলার কথা বলেছিলেন। খেলার প্রথম কথা শরীরচর্চা। শরীরই আদ্য। আমাদের দেশে কমখরচে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে এমন খেলা চাই। ফুটবল এইদিক থেকে উপযোগী। কোনো কোনো খেলায় ব্যক্তির কৌশলটা প্রধান। ফুটবলে দলের ভিতর পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কাজ এগোয় না। শরীরচর্চার সঙ্গে গোষ্ঠীজীবনে সহযোগিতার এই শিক্ষা মূল্যবান। এখানেও কিন্তু কথা শেষ নয়, আরো আছে। খেলোয়াড় মনপ্রাণ দিয়ে খেলবে, তারপর হারজিত যাই। ঘটে হাসিমুখে তাই মেনে নেবে। এটাই তো খেলোয়াড়ী মনোভাব, আর এটাই কর্মযোগ।
মনপ্রাণ দিয়ে অনুশীলনে মানুষ তৈরি হয়, হারজিত সাময়িক ঘটনা। আমাদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জগতে হারজিতের ব্যাপারটাই অতিশয় বড় হয়ে উঠেছে। এতে। সংসারের খেলায় শ্রী থাকে না। যখন দেখা যায় ফুটবল খেলার শেষে মাঠে মারামারি, রাস্তায় দাঙ্গা, তখন বুঝতে হবে, সংকট গভীর। দলবিশেষের নয়, মনুষ্যত্বেরই সেখানে পরাজয়। একটা লক্ষ্যের জন্য নিবিষ্ট হয়ে কাজ করবার শিক্ষা চাই, আর ফলাফলের দুশ্চিন্তা ত্যাগ করেই সেই কাজ করতে হবে। এটাই খেলার মূল শিক্ষা, জীবনেরও। দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯)